০৪. স্যার হেনরি বাস্কারভিল
সকাল-সকাল সাফ হয়ে গেল ব্রেকফাস্ট টেবিল, পূর্বব্যবস্থা অনুযায়ী সাক্ষাৎকারীদের অপেক্ষায় ড্রেসিংগাউন পরে বসে রইল হোমস। মক্কেলরা দেখলাম ঘড়ি ধরে চলেন। কাঁটায় কাঁটায় দশটায় এলেন। ঘড়িতে দশটা বাজবার সঙ্গেসঙ্গে ডক্টর মর্টিমারকে নিয়ে আসা হল ওপরে, পেছনে পেছনে এলেন তরুণ ব্যারনেট। ভদ্রলোকের বয়স বছর তিরিশ, ছোটোখাটো মানুষ, সতর্ক, চোখ কালো, অত্যন্ত বলিষ্ঠ গঠন–যেন পেটাই লোহা, পুরু কালো ভুরু এবং দৃঢ়, যুদ্ধপ্রিয় মুখাবয়ব। পরনে লালচে টুইডসুট, চেহারায় রোদ জলের স্বাক্ষর যেন জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন খোলা হাওয়ায়, তা সত্ত্বেও কিন্তু স্থির চোখ আর শান্ত আচরণের মধ্যে উচ্চবংশের সুপষ্ট ছাপ।
ইনিই স্যার হেনরি বাস্কারভিল, বললেন ডক্টর মর্টিমার।
কী কাণ্ড দেখুন দিকি, বললেন স্যার হেনরি, অদ্ভুত ব্যাপার মি. শার্লক হোমস, এই বন্ধুটি যদি আজ সকালে আপনার এখানে আসবার কথা না-বলতেন, আমি নিজেই আসতাম। ছোটোখাটো ধাঁধার সমাধান আপনি করেন জানি। আজ সকালেই এমনি একটা ধাঁধায় আমি পড়েছি। একটু বেশি চিন্তার দরকার আমার সে সময় নেই।
বসুন স্যার হেনরি। লন্ডনে পোঁছে আশ্চর্য অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন মনে হচ্ছে?
গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, মি. হোমস। ঠাট্টা বলেই মনে হয়। আজ সকালে এই চিঠিটা পেয়েছি জানি না একে চিঠি বলবেন কি না।
টেবিলের ওপর একটা লেফাফা রাখলেন স্যার হেনরি, আমরা প্রত্যেকেই ঝুঁকে পড়লাম খামটার ওপর। মামুলি কাগজের খাম, রংটা ধূসর। অসমান ছাঁদে লেখা ঠিকানা স্যার হেনরি বাস্কারভিল, নরদামবারল্যান্ড হোটেল। ডাকঘরের ছাপ শেরিংক্রস, চিঠি ডাকে ফেলার তারিখ গতকাল সন্ধ্যা।
তীক্ষ্ম চোখে তরুণ ব্যারনেটের পানে তাকিয়ে শার্লক হোমস, আপনি যে নর্দামবারল্যান্ড হোটেলে উঠেছেন, কে তা জানত?
কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। ডক্টর মর্টিমারের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ঠিক করেছিলাম দু-জনে।
কিন্তু ডক্টর মর্টিমার নিশ্চয় আগেই উঠেছিলেন ওখানে?
না, আমি উঠেছি এক বন্ধুর বাড়িতে বললেন ডক্টর মর্টিমার, এ-হোটেলে আসব, এ-রকম কোনো আভাস আগে প্রকাশ পায়নি।
হুম! আপনার গতিবিধির ব্যাপারে কোনো একজনের গভীর আগ্রহ রয়েছে দেখা যাচ্ছে।
খামের মধ্যে থেকে চার ভাঁজ করা এক তাড়া ফুলক্যাপ কাগজ বার করে হোমস। ভাজ খুলে মেলে ধরে টেবিলের ওপর। কাগজ থেকে কাটা কতকগুলো ছাপা শব্দ মাঝখানে আঠা দিয়ে লাগিয়ে একটা বাক্য সৃষ্টি করা হয়েছে। কথাটা এই: প্রাণের মায়া আর বুদ্ধি থাকলে জলার ত্রিসীমানায় ঘেঁষবেন না। জলার শব্দটা লেখা কালি দিয়ে।
স্যার হেনরি বাস্কারভিল বললেন, এবার বলুন মি. হোমস, মানে কী এসবের? আমার ব্যাপারেই-বা এত আগ্রহ কার?
ডক্টর মর্টিমার, আপনার কী মনে হয়? মানছেন নিশ্চয় এর মধ্যে অতিপ্রাকৃত কিছুই নেই?
তা নেই। তবে এ-চিঠি যে লিখেছে তার দৃঢ় বিশ্বাস পুরো ব্যাপারটা অতিপ্রাকৃত।
কী ব্যাপার? ঝটিতে জিজ্ঞেস করেন স্যার হেনরি। আমার নিজের ব্যাপারে আমি যা জানি, মনে হচ্ছে তার চাইতে ঢের বেশি খবর রাখেন আমার?
স্যার হেনরি, এ-ঘর ছেড়ে বেরোনোর আগেই আমরা যা জানি, আপনিও তা জানবেন। কথা দিচ্ছি আমি, বললে শার্লক হোমস। অতঃপর যদি অনুমতি দেন, অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক এই দলিলটায় মন দিতে পারি। নিশ্চয় কাল সন্ধ্যায় এ-চিঠি জোড়াতালি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, তারপর ডাকে ফেলা হয়েছে। গতকালের টাইমস কাগজ আছে?
এই তো কোণে রয়েছে।
একটু কষ্ট করে মাঝের কাগজটা দেবে–যাতে সম্পাদকীয় প্রবন্ধটা আছে। একটার পর একটা স্তম্ভের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত দ্রুত চোখ বুলিয়ে গেল হোমস। মুক্ত বাণিজ্যের ওপর শীর্ষস্থানীয় প্রবন্ধ। কিছুটা পড়ে শোনাচ্ছি। কেউ কেউ বুদ্ধি দিচ্ছেন, একটা বাড়তি শুল্কের আড়াল থাকলে ব্যবসার সমৃদ্ধি ঘটবে, স্বদেশি জিনিসের ওপর মায়া বাড়বে, কিন্তু বুঝছেন না এ ধরনের আইনের ফলে শেষকালে বিদেশের অর্থ এদেশের ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না, আমদানির পরিমাণ কমে যাবে, আর এ-দ্বীপের লোকের প্রাণধারণের মানও কমে যাবে। কীরকম বুঝছ, ওয়াটসন? দারুণ উৎফুল্ল হয়ে পরম পরিতৃপ্তির স্বরে হাত ঘষতে ঘষতে বললে হোমস। প্রশংসনীয় সেন্টিমেন্ট, তাই না?
পেশাদারি আগ্রহ ফুটে ওঠে ডক্টর মর্টিমারের চোখে-মুখে নির্নিমেষে তাকালেন হোমসের পানে। স্যার হেনরি বাস্কারভিল কিন্তু বিভ্রান্ত দুই কৃষ্ণ চক্ষু নিবদ্ধ করলেন আমার ওপর।
বললেন, বাণিজ্য আর শুল্কের অত খবর আমি রাখি না। তবে বোধ হয় চিঠির প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি।
ঠিক উলটো, স্যার হেনরি, সূত্র ধরে দিব্যি এগিয়ে চলেছি। ওয়াটসন আমার পদ্ধতির খবর রাখে। কিন্তু দেখছি সে-ও কথাটার তাৎপর্য ধরতে পারেনি।
সত্যিই পারিনি। দুটোর মধ্যে কোনো সম্পর্ক দেখছি না।
ভায়া ওয়াটসন, সম্পর্কটা এতই নিবিড় যে একটাকে আর একটা থেকে টেনে বার করা হয়েছে। প্রাণের, মায়া, আর, বুদ্ধি, থাকলে, ত্রিসীমানায় ঘেঁষবেন না। বুঝতে পারছ। না কোত্থেকে নেওয়া হয়েছে শব্দগুলো?
কী আশ্চর্য! ঠিক ধরেছেন তো! দারুণ স্মার্ট দেখছি। আপনি! সবিস্ময়ে বললেন স্যার হেনরি!
সম্ভাব্য সন্দেহ যদিও-বা কিছু থাকে, ত্রিসীমানায় ঘেঁষবেন না শব্দগুলো দেখলেই তা ঘুচে যাবে।ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না একসঙ্গে কেটে নেওয়া হচ্ছে একটা ন অন্য জায়গা থেকে কেটে এনে ঘেঁষবের পাশে লাগিয়ে ঘেষবেন করা হয়েছে।
তাই তো বটে!
ডক্টর মর্টিমার অবাক চোখে আমার বন্ধুর পানে তাকিয়ে বললেন—মি. হোমস, এ যে আমি ভাবতেই পারছি না! খবরের কাগজ থেকে কেটে নিয়ে শব্দগুলো আঠা দিয়ে লাগানো হয়েছে, যে কেউ তা বলতে পারে। কিন্তু খবরের কাগজের নাম বলে দেওয়া, এমনকী সম্পাদকীয় প্রবন্ধ থেকেই যে তা নেওয়া–এ যে রীতিমতো আশ্চর্য ব্যাপার! এ-রকম কাণ্ড
কখনো শুনিনি আমি। কী করে বললেন বলুন তো?
ডক্টর, নিগ্রো আর এস্কিমোর করোটি দেখলেই আপনি চিনতে পারবেন?
নিশ্চয় পারব।
কীভাবে?
আরে, সেটাই তো আমার বিশেষ শখ। তফাতগুলো সুস্পষ্ট। চোখের কোটরের ওপর দিককার হাড়ের উঁচু গড়ন, মুখাবয়বের কোণ, চোয়ালের বাঁক—
এটাও আমার বিশেষ শখ, তফাতগুলো এক্ষেত্রেও সমানভাবে সুস্পষ্ট! আপনার ওই এক্সিমোর খুলি আর নিগ্রোর খুলির মধ্যে যে তফাত, আধপেনি দামের অগোছালো সান্ধ্য-দৈনিক ছাপা আর টাইমস প্রবন্ধের ছোটো ছোটো বরজয়িস হরফের মধ্যে সেই একই তফাত ধরা পড়ে যায় আমার চোখে। অপরাধ বিষয়ে বিশেষ বিশেষজ্ঞ হতে গেলে হরফ দেখেই চিনতে পারার বিদ্যে একটা রীতিমতো অসাধারণ জ্ঞানের পর্যায়ে পড়ে; যদিও স্বীকার করছি, খুব অল্প বয়সে লিডস মার্কারি আর ওয়েস্টার্ন মর্নিং ক্রনিকল-এর হরফ দেখে গুলিয়ে ফেলেছিলাম। তবে কি জানেন, টাইমস কাগজের প্রধান সম্পাদকীর একেবারেই আলাদা জাতের, এ-শব্দগুলো অন্য কোনো কাগজে নেওয়া হয়নি কখনোই নয়। যেহেতু কাজটা সারা হয়েছে গতকাল, তাই গতকালের টাইমস থেকে নেওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি করে দেখা দিয়েছিল।
স্যার হেনরি বাস্কারভিল বললেন, আপনার কথা শুনে যদূর বুঝছি, এই চিঠির শব্দগুলো কেউ কাঁচি দিয়ে কেটে
নখ কাটা কাঁচি দিয়ে, বললে হোমস। কাচির ফলা দুটো খুবই ছোটো। ত্রিসীমানায় ঘেঁষবে না কাটতে গিয়ে দু-বার কঁচি চালাতে হয়েছে।
ঠিক। ছোটো ফলাওলা কঁচি দিয়ে শব্দগুলো কেউ কেটেছে, তারপর ময়দার আঠা দিয়ে—
গঁদের আঠা দিয়ে, বললে হোমস।
গঁদের আঠা দিয়ে কাগজে লাগিয়েছে। কিন্তু জলার শব্দটা হাতে লেখা হল কেন জানতে পারলে খুশি হতাম।
কারণ ছাপার অক্ষরে শব্দটা পাওয়া যায়নি। অন্য শব্দগুলো সোজা, যেকোনো দিনের সংখ্যাতেই পাওয়া যায়, কিন্তু জলার শব্দটা চট করে চোখে পড়ে না।
ঠিক বলেছেন, বুঝলাম ব্যাপারটা। চিঠির বয়ানে আর কিছু চোখে পড়ল, মি. হোমস?
দু-একটা ইঙ্গিত চোখে পড়েছে, তবে অত্যন্ত যত্নসহকারে যাবতীয় সূত্র মুছে ফেলা হয়েছে। লক্ষ করেছেন নিশ্চয়, ঠিকানাটা লেখা হয়েছে অসমান ছাঁদে। কিন্তু টাইমস এমনই একটা কাগজ যা উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ছাড়া কারু হাতে সচরাচর যায় না। তাহলেই ধরে নিচ্ছি, ঠিকানা যে লিখেছে, সে লেখাপড়া জানা মানুষ কিন্তু অশিক্ষিত সেজে থাকতে চাইছে। হাতের লেখা লুকোনোর এই চেষ্টা, এ থেকে বোঝা যাচ্ছে হয় তার হাতের লেখা আপনি চেনেন অথবা চিনে ফেলতে পারেন। তারপর দেখুন, শব্দগুলো সঠিক লাইনে গদ দিয়ে সাঁটা হয়নি। যেমন, এই প্রাণের শব্দটা লাইনের যেখানে থাকার কথা, সেখান থেকে ঠেলে উঠে পড়েছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে শব্দ যে কেটেছে, হয় সে তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে উত্তেজনার চোটে মেপেজুপে লাগায়নি, অথবা সে অসতর্ক পুরুষ। আমি কিন্তু প্রথম মতবাদের পক্ষপাতী। কেননা বিষয়টা অতীব গুরুত্বপূর্ণ এবং এ-চিঠি যে সৃষ্টি করেছে, সে অসতর্ক পুরুষ, ভাবতে পারছি না। তাড়াতাড়িই যদি করে থাকে, কেন তাড়াতাড়ি করেছিল সেটাই হবে একটা ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন। কেননা, মাঝরাত পর্যন্ত যেকোনো সময়ে চিঠি ডাকে ফেললে হোটেল ছেড়ে বেরোনোর আগে স্যার হেনরির হাতে পৌঁছে যেত। তবে কি বাধা পাওয়ার আশঙ্কা করেছিল পত্রলেখক? কে বাধা দিত?
ডক্টর মর্টিমার বললেন, আমরা কিন্তু এবার অনুমানের রাজ্যে ঢুকে পড়েছি।
বরং বলুন এমন একটা রাজ্যে ঢুকেছি যেখানে বিভিন্ন সম্ভাবনা পাল্লায় চাপিয়ে দেখি কোনটা বেশি ভারী, বেছে নিই যেটা সবচেয়ে বেশি সম্ভবপর। এ হল কল্পনার বিজ্ঞানসম্মত প্রয়োগপদ্ধতি, দূর কল্পনা শুরু করতে হবে কিন্তু বস্তুজগতের বনেদের ওপর। আপনি বলবেন অনুমান, আমি কিন্তু প্রায় নিশ্চিত যে এ-ঠিকানা লেখা হয়েছে কোনো একটা হোটেল থেকে।
কী করে তা জানছেন?
খুঁটিয়ে দেখলেই চোখে পড়বে কলম আর কালি দুটোই ভুগিয়েছে লেখককে। একটিমাত্র শব্দ লিখতে গিয়ে দু-বার কালি ছিটিয়েছে কলম এবং ছোট্ট একটা ঠিকানা লিখতে গিয়ে কালি ফুরিয়েছে তিন বার। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, দোয়াতে নামমাত্র কালি ছিল। বাড়ির দোয়াত বা কলম কদাচিৎ এ-রকম দুরবস্থায় থাকে–একই সাথে দুটোর এ-রকম হাল বিরল ঘটনা বললেই চলে। কিন্তু হোটেলের দোয়াত আর কলমের ছিরি কীরকম হয়, আপনি তা জানেন, এর চেয়ে ভালো জিনিস সেখানে আশা করা যায় না। শেরিংসের আশপাশের হোটেলগুলোয় ছেড়া কাগজের ঝুড়ি হাঁটকালে কাটা-ছেড়া টাইমস সম্পাদকীয় পাওয়া যে যাবে, এ-কথা বলতে খুব একটা দ্বিধা আমার নেই। অত্যাশ্চর্য এই পত্র যে রচনা করেছে, তাকেও ধরে ফেলা যাবে অনায়াসে। আরে! আরে! আরে! এ আবার কী?
খবরের কাগজের শব্দগুলো যে ফুলক্যাপ কাগজে গদ দিয়ে লাগানো হয়েছে, দেখলাম, হোমস সেই কাগজখানা চোখের সামনে এক ইঞ্চি কি দু-ইঞ্চি তফাতে রেখে কী যেন দেখছে।
কী হল?
কিছু না, কাগজটা প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললে হোমস।জলছাপের দাগ পর্যন্ত নেইবেবাক ফাঁকা আধখানা একটা কাগজ। অদ্ভুত এই চিঠি থেকে অনেক কিছুই লাভ করা গেল। স্যার হেনরি, এবার বলুন, লন্ডনে পৌঁছোনোর পর কৌতূহলোদ্দীপক আর কোনো ঘটনা ঘটেছে আপনাকে নিয়ে?
না, মি. হোমস, মনে তো হয় না।
আপনার পিছু নিচ্ছে বা আপনার ওপর নজর রাখছে, এমন কাউকে লক্ষ করেননি?
সস্তার রোমাঞ্চ উপন্যাসের নায়ক হয়ে পড়েছি মনে হচ্ছে? আরে মশাই, আমার পেছন নিয়ে বা আমার ওপর নজর রেখে কার কী লাভ বলতে পারেন?
বলছি সে-কথা। সে-প্রসঙ্গ শুরু করার আগে বলবার মতো আর কোনো খবরই কি নেই?
বলবার মতো কিনা, সেটা আপনার মনে করার ওপর নির্ভর করছে।
দৈনন্দিন জীবনের বাইরে যা কিছু, সবই বলবার মতো ঘটনা বলে জানবেন।
মৃদু হাসলেন স্যার হেনরি, ইংরেজদের দৈনন্দিন জীবনের খবর আমি খুব একটা রাখি না। জীবনের বেশির ভাগ কাটিয়েছি কানাডা আর যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলব এক পাটি বুট জুতো হারানোটা নিশ্চয় এখানকার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মধ্যে পড়ে না।
এক পাটি বুট জুতো হারিয়েছেন? উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন ডক্টর মর্টিমার। হোটেলে ফিরে গিয়েই দেখবেন আপনার জুতো আপনার কাছেই আবার ফিরে এসেছে। সামান্য এই বিষয় নিয়ে মি. হোমসকে উত্ত্যক্ত করে লাভ কী বলতে পারেন?
উনি কিন্তু বলেছেন দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বাইরে যা কিছু ঘটেছে, সব বলতে হবে।
ঠিকই তো, বললে হোমস। যত উদ্ভটই হোক না কেন, তবুও তা শুনতে হবে। একপাটি বুট হারিয়েছে আপনার?
নিশ্চয় কোথাও পড়ে-উড়ে আছে। কাল রাত্রে দরজার সামনে দু-পাটি রেখেছিলাম, আজ সকালে উঠে দেখি এক পাটি রয়েছে। বুটপালিশ ছোকরার পেট থেকে কথা বার করতে পারলাম না। সবচেয়ে যাচ্ছেতাই হল, বুটজোড়া কালকেই রাত্রে কিনেছিলাম স্ট্যান্ড থেকে, একবারও পায়ে দিয়ে হাঁটা হয়নি।
যদি পায়ে দিয়েই না-থাকেন তো পরিষ্কার করার জন্যে বাইরে রেখেছিলেন কেন?
কষ লাগিয়ে পাকা করা কাঁচা চামড়ার বুট তো, ভার্নিশ ছিল না। তাই রেখে ছিলাম বাইরে।
আপনি তাহলে গতকাল লন্ডনে পা দিয়েই বেরিয়েছিলেন? জুতো কিনে হোটেলে ফিরেছিলেন?
বেশ কিছু কেনাকাটাও করেছিলাম। ডক্টর মর্টিমার আমার সঙ্গে ছিলেন। ব্যারনেট হয়ে থাকতে গেলে সাজপোশাক সেইরকম হওয়া দরকার। পশ্চিমে অত হিসেব করে চলিনি। অন্যান্য জিনিসপত্রের মধ্যে ছিল বাদামি বুটজোড়া ছডলার দিয়ে কিনেছিলাম–পায়ে দেওয়ার আগেই চুরি হয়ে গেল এক পাটি।
শার্লক হোমস বললেন, চুরি করার মতো জিনিসই নয় এটা কোনো কাজেই লাগবে না। ডক্টর মর্টিমারের সঙ্গে আমিও একমত। শিগগিরই যথাস্থানে ফিরে আসবে নিখোঁজ বুটের পার্টি।
সংকল্প দৃঢ় স্বরে ব্যারনেট বললেন, জেন্টলমেন, আমি যেটুকু জানি, সবই বললাম। এবার আপনাদের কথা রাখুন। বলুন কী নিয়ে এত গোলমাল।
আপনার অনুরোধ খুবই যুক্তিযুক্ত, জবাব দিলেন হোমস। ডক্টর মর্টিমার, গল্পটা আমাদের যেভাবে শুনিয়েছিলেন, সেইভাবেই বললে একটা কাজের কাজ করবেন।
উৎসাহ পেয়ে পকেট থেকে পাণ্ডুলিপির তাড়া টেনে বার করলেন বৈজ্ঞানিকবন্ধু এবং গতকাল সকালে যেভাবে বলেছেন, সেইভাবেই নিবেদন করলেন সম্পূর্ণ কেসটা। অত্যন্ত তন্ময়ভাবে শুনলেন স্যার হেনরি বাস্কারভিল মাঝে মাঝে কেবল চেঁচিয়ে উঠলেন বিস্ময়ে।
সুদীর্ঘ বিবৃতি সমাপ্ত হলে পর বললেন, উত্তরাধিকার সূত্রে শুধু সম্পত্তি নয়, তার মানে একটা অভিশাপ আর প্রতিশোধও পেয়েছি দেখছি। ধাইমা-র ঘরে যখন থাকতাম, তখন থেকেই অবশ্য এই কুকুরের গল্প শুনেছি। পরিবারের প্রিয় কাহিনি। আমি কিন্তু খুব একটা পাত্তা দিইনি কোনোদিনই। কাকার মৃত্যুটা অবশ্য ব্যাপারটা এখনও ধোঁয়াটে আমার কাছে, মাথার মধ্যে যেন ফুটছে। কেসটি পুলিশের না পুরুতঠাকুরের সেইটাই ঠিক করা যাচ্ছে না।
খাঁটি বলেছেন।
তারপরেই ধরুন হোটেলে পাঠানো এই চিঠির ব্যাপারটা। বেশ খাপ খেয়ে যাচ্ছে।
ডক্টর মর্টিমার বললেন, জলার কাণ্ডকারখানার খবরাখবর আমাদের চাইতে বেশি কেউ জানে, এই চিঠি পড়ে তা মনে হচ্ছে।
হোমস বললে, এবং সেই ব্যক্তি আপনার প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন নয়–তাই বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ারি পাঠাচ্ছে।
অথবা নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যেই আমাকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইছে।
তাও সম্ভব। ডক্টর মর্টিমার, আপনার কাছে আমি সবিশেষ কৃতজ্ঞ। এমন একটা সমস্যায় আমাকে টেনে এনেছেন যার অনেকগুলো কৌতূহলোদ্দীপক বিকল্প। কিন্তু একটা কার্যকর বিষয় এখুনি ঠিক করতে হবে আমাদের। স্যার হেনরি, বিষয়টা এই বাস্কারভিল হলে আপনার এখন যাওয়াটা সমীচীন হবে কিনা।
কেন যাব না শুনি? বিপদটা কীসের বলে মনে হয় আপনার? ভয়টা কাকে? পারিবারিক শত্রু সেই শয়তানকে? না, মানুষকে?
সেইটাই তো বার করতে হবে।
বিপদ যে ধরনেরই হোক না কেন, আমার জবাবের নড়চড় হবে না। আমার বাপপিতামহের ভিটেয় যাওয়া রোধ করতে পারে, এমন শয়তান নরকে নেই, এমন মানুষও মর্তে নেই। মি. হোমস এই আমার শেষ জবাব। কথা বলতে বলতে কালচে লাল হয়ে গেল স্যার হেনরির মুখ, গ্রন্থিল হল কালো ভুরু। বেশ বোঝা গেল, বাস্কারভিল বংশের প্রচণ্ড মেজাজ শেষ বংশধরটির মধ্যেও লোপ পায়নি। বললেন, ইতিমধ্যে যা বললেন, তা নিয়ে ভাববার সময় আমার নেই। একবারেই সব বুঝে নিয়ে মন ঠিক করে ফেলাটা যেকোনো মানুষের কাছেই একটা বিরাট ব্যাপার। মনস্থির করতে আমাকে নির্জনে ঘণ্টাখানেক বসতে হবে। মি. হোমস, আপনার বন্ধুকে নিয়ে দুটো নাগাদ আসবেন? একসঙ্গে লাঞ্চ খাওয়া যাবে? তখন আরও স্পষ্টভাবে বলতে পারব এ-ব্যাপারে আমার মনের অবস্থা।
তাহলে আসছি জানবেন।
গাড়ি ডেকে দেব?
আমি বরং হেঁটেই ফিরব। একটু চঞ্চল হয়েছি এ-ব্যাপারে।
ডক্টর মর্টিমার বললেন, আমিও সানন্দে হাঁটব আপনার সঙ্গে।
তাহলে ফের দুটোয় দেখা হবে। আসুন, সুপ্রভাত।
সাক্ষাৎপ্রার্থী দু-জনের পায়ের আওয়াজ সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল, তারপরেই দড়াম করে বন্ধ হল সামনের দরজা। পরমুহূর্তে উধাও হল হোমসের অবসন্ন স্বপ্নাচ্ছন্নতা বিদ্যুৎ খেলে গেল হাতে পায়ে।
টুপি আর বুট পরে নাও, ওয়াটসন, তাড়াতাড়ি! একটা মুহূর্তও নষ্ট করা চলবে না। ড্রেসিং গাউন পরেই ঘর থেকে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল হোমস, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফিরে এল গায়ে ফ্ৰককোট চাপিয়ে। তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে নেমে এসে পড়লাম। রাস্তায়। প্রায় দু-শশা গজ সামনে তখনও দেখা যাচ্ছে ডক্টর মর্টিমার আর বাস্কারভিলকে–চলেছেন অক্সফোর্ড স্ট্রিটের দিকে।
দৌড়ে গিয়ে দাঁড় করাব?
ভায়া ওয়াটসন, ও-কাজটি কোরো না। তোমার সঙ্গ পেয়েই আমি বিলক্ষণ সস্তুষ্ট–অবশ্য আমার সঙ্গ যদি পছন্দ হয় তোমার। আমাদের নতুন বন্ধু দু-জন দেখছি বুদ্ধিমান পুরুষ সকালটা সত্যিই অতি চমৎকার–হাঁটবার উপযুক্ত।
মাঝের ব্যবধান অর্ধেক কমিয়ে না-আনা পর্যন্ত দ্রুত পা চালাল হোমস। এক-শো গজ ব্যবধান বজায় রেখে পেছন পেছনে এলাম অক্সফোর্ড স্ট্রিটে, সেখান থেকে রিজেন্ট স্ট্রিটে। সামনের দুই একবার একটা দোকানের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে শো-কেসের দিকে তাকিয়ে রইলেন, হুবহু তাই করল শার্লক হোমসও। পরমুহূর্তেই চেঁচিয়ে উঠল হৃষ্টকণ্ঠে। অনুসরণ করলাম ওর সাগ্রহ দৃষ্টি। দেখলাম, রাস্তার উলটোদিকে দাঁড়িয়ে একটা দু-চাকার ঘোড়ার গাড়ি, ভেতরে একজন পুরুষ আরোহী। আমি তাকাতে-না-তাকাতেই গাড়িটা আবার আস্তে আস্তে এগোল সামনের দিকে।
ওয়াটসন! ওয়াটসন! ওই সেই লোক! চলে এসো, আর কিছু না-পারি, চেহারাটা ভালো করে দেখে রাখি।
তৎক্ষণাৎ গাড়ির পাশের জানলা দিয়ে আমাদের দিকে তাকাল অন্তর্ভেদী একজোড়া চক্ষু ঝোঁপের মতো কালো দাড়িতে আচ্ছন্ন একখানা মুখ। সঙ্গেসঙ্গে ছিটকে উঠে গেল গাড়ির ছাদের ঠেলে-তোলা দরজা–আতীক্ষ্ণ কণ্ঠে কী যেন বলা হল কোচোয়ানকে–অমনি রিজেন্ট স্ট্রিটের ওপর দিয়ে উন্মত্ত বেগে যেন উড়ে চলল গাড়িখানা। বিপুল আগ্রহে আর একটা ভাড়াটে গাড়ির আশায় আশপাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল হোমস, কিন্তু কোনো গাড়িই চোখে পড়ল না। তখন পাগলের মতো ধেয়ে চলল ধাবমান গাড়ির পেছন পেছন গাড়িঘোড়ার স্রোতের মধ্যে দিয়ে, কিন্তু পাল্লা দেওয়া গেল না দেখতে দেখতে চোখের আড়ালে অদৃশ্য হল সামনের গাড়ি।
পালাল! যানবাহন বন্যার মধ্যে থেকে বিষম বিরক্তিতে নীরক্ত মুখে হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে এসে তিক্তকণ্ঠে বললে হোমস। এ-রকম যাচ্ছেতাই বরাত আর যাচ্ছেতাই কাজ কখনো দেখেছ? ওয়াটসন! ওয়াটসন! সততা বলে যদি কিছু থাকে তোমার মধ্যে, আমার সাফল্যের পাশে চরম এই ব্যর্থতার কাহিনিও লিখে রাখ হে!
লোকটা কে?
কিস্সু জানি না।
চর?
হতে পারে, শহরে পা দেওয়া ইস্তক ছায়ার মতো লোক ঘুরছে বাস্কারভিলের পেছন পেছন। তা না-হলে উনি নর্দামবারল্যান্ড হোটেলে উঠবেন ঠিক করেছেন, এত তাড়াতাড়ি লোকটা জানল কী করে? প্রথম দিন যারা ছায়ার মতো পেছন পেছন ঘুরেছে, মনকে বোঝালাম দ্বিতীয় দিনেই নিশ্চয় তারা পেছন ছাড়বে না। ডক্টর মর্টিমার যখন কিংবদন্তি পড়ে শোনাচ্ছিলেন, মনে থাকতে
পারে তোমার দু-বার জানলার সামনে দিয়ে ঘুরে এসেছিলাম।
হ্যাঁ মনে আছে।
রাস্তায় কেউ পায়চারি করছে কিনা দেখতে গিয়েছিলাম, কিন্তু কেউ ছিল না। ওয়াটসন, যার সঙ্গে টক্কর লেগেছে আমাদের, সে কিন্তু মহা ধড়িবাজ। জল ক্রমশ গভীর হচ্ছে। আড়ালে থেকে যে আমাদের ওপর নজর রেখেছে, সে আমাদের ইষ্ট চায়, না, অনিষ্ট চায় এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। তবে তার কাজকর্মের মধ্যে শক্তির চমক আর নিখুঁত পরিকল্পনার আভাস দেখেছি। বন্ধ দু-জন রাস্তায় পা দিতেই পেছন পেছন আমি নেমে এসেছিলাম ওঁদের অদৃশ্য সহচরকে দেখবার মতলবে। লোকটা এতই ধূর্ত যে নিজের পা জোড়ার ওপর ভরসা না-রেখে ভাড়াটে গাড়ির শরণ নিয়েছে, যাতে দরকার মতো পেছন পেছন যাওয়া যাবে, নয়তো পাশ দিয়ে বেগে বেরিয়ে যাওয়া যাবে–চোখ এড়িয়ে পালানো যাবে। ব্যবস্থাটার আর একটা সুবিধে ছিল। বন্ধু দু-জন যদি ভাড়াটে গাড়িতে চাপে, গাড়ির জন্যে আর ছুটোছুটি করতে হবে না–অনায়াসে যাবে পেছন পেছন। একটা অসুবিধে অবশ্য থেকে যাচ্ছে এ ব্যবস্থায়!
কোচোয়ানের অধীন থাকতে হচ্ছে।
ঠিক।
ইস, গাড়ির নাম্বারটা যদি লিখে নিতাম।
ভায়া ওয়াটসন, কাজটা খুবই খারাপ করেছি সন্দেহ নেই, তাই বলে, নম্বরটা দেখে রাখিনি, সত্যিই মনে কারো নাকি? নম্বরটা ২৭০৪। এই মুহূর্তে অবশ্য ও-নম্বর কোনো কাজে আসছে না।
এর বেশি আর কী করণীয় ছিল আমার মাথায় আসছে না।
গাড়িটা চোখে পড়ার সঙ্গেসঙ্গে অন্যদিকে ফিরে হাঁটা উচিত ছিল। তাহলে ধীরেসুস্থে আর একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে বেশ খানিকটা তফাতে থেকে সামনের গাড়িকে ফলো করতে পারতাম, তার চাইতেও ভালো করতাম নরদামবারল্যান্ড হোটেলে গিয়ে যদি অপেক্ষা করতাম। অজ্ঞাত এই ব্যক্তি যখন বাস্কারভিলের পেছন ছাড়বে না বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করবেই তখন ওর চালেই ওকে ধরতাম যেখানে চলেছে সেখানে গিয়েই ওত পেতে থাকতাম। কিন্তু অবিবেচকের মতো আগ্রহ দেখিয়ে ফেলে সব মাটি করেছি। অসাধারণ ক্ষিপ্রতা আর উদ্যম দেখিয়ে সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে প্রতিপক্ষ নিজেদের ধরা দিয়েছি, প্রতিপক্ষকে হারিয়েছি।
কথা বলতে বলতে অলসভাবে হাঁটছি রিজেন্ট স্ট্রিট বরাবর, সঙ্গীসহ ডক্টর মর্টিমার বহু আগেই অদৃশ্য হয়েছেন দৃষ্টিপথ থেকে।
হোমস বললে, ওঁদের পেছন পেছন গিয়ে লাভ নেই। ছায়া উধাও হয়েছে, আর ফিরবে না। দেখা যাক হাতে এবার কী তাস আসে, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে। গাড়ির ভেতরকার লোকটার মুখ কীরকম, হলফ করে বলতে পারবে?
শুধু দাড়িটার কথাই হলফ করে বলতে পারব।
আমারও সেই কথা–এই থেকেই ধরে নেব, দাড়িটা নিশ্চয় নকল। এ ধরনের সূক্ষ্ম কাজে ধড়িবাজরা যখন নামে, তখন দাড়ি জিনিসটা কোনো কাজেই আসে না চেহারা গোপন করা ছাড়া। এদিকে এসো, ওয়াটসন!
আঞ্চলিক বার্তাবাহকদের একটা অফিসে ঢুকে পড়েছে হোমস। ওকে দেখেই সাদর অভ্যর্থনা জানায় ম্যানেজার।
উইলসন যে! ছোট্ট সেই কেসটার কথা এখনও ভোলোনি দেখছি। আমার কপাল ভালো, তাই তোমাকে সাহায্য করতে পেরেছিলাম।
কিছুই ভুলিনি, স্যার। আমার সুনাম শুধু নয়, জীবনটাও রক্ষে করেছিলেন আপনি।
আরে ভায়া, বড্ড বাড়িয়ে বলছ। উইলসন, বন্ধুর মনে পড়ছে কার্টরাইট নামে একটা ছোকরা তোমার এখানে কাজ করত। গতবারের তদন্তে সে বেশ দক্ষতা দেখিয়েছিল।
আজ্ঞে হ্যাঁ, এখনও কাজ করে এখানে।
ঘণ্টা বাজিয়ে একটু ডেকে পাঠাবে? ধন্যবাদ! পাঁচ পাউন্ডের এই নোটটা ভাঙিয়ে দিয়ো।
ম্যানেজারের তলব পেয়ে চোদ্দো বছরের এক কিশোর এসে দাঁড়াল সামনে। উজ্জ্বল, শানিত মুখ। সুবিখ্যাত গোয়েন্দাপ্রবরের দিকে চেয়ে রইল অপরিসীম শ্রদ্ধায়।
হোমস বললে, হোটেল ডিরেক্টরিটা দেখি। ধন্যবাদ। কার্টরাইট, তেইশটা হোটেলের নাম দেখছি এখানে–সবই শেরিংক্রসের ধারেকাছে। দেখেছ?
আজ্ঞে, হ্যাঁ।
প্রত্যেকটা হোটেলে তুমি যাবে।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
গিয়েই আগে বাইরের দারোয়ানকে একটা শিলিং দেবে। এই নাও তেইশটা শিলিং।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
বলবে, গতকালের ছেড়া কাগজের ঝুড়িগুলো দেখতে চাই। বলবে, একটা গুরুত্বপূর্ণ টেলিগ্রাম অন্য ঠিকানায় চলে গেছে–খুঁজে বার করতে হবে, বুঝেছ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আসলে কিন্তু খুঁজবে গতকালের টাইমস কাগজের মাঝের পাতা দেখবে কাঁচি দিয়ে কতকগুলো ফুটো করা রয়েছে কাগজের মাঝখানে। এই পাতাটা। দেখলেই চিনতে পারবে তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
প্রত্যেক হোটেলেই বাইরের দারোয়ান হল ঘরের দারোয়ানকে ডেকে পাঠাবে, তাকেও একটা শিলিং দেবে। এই নাও তেইশটার মধ্যে খুব সম্ভব কুড়িটা হোটেলে শুনবে, গতকালের ছেড়া কাগজ ফেলে দেওয়া হয়েছে, অথবা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। বাকি তিনটে হোটেলে তাগাড় করা কাগজ দেখিয়ে দেওয়া হবে তোমাকে টাইমস-এর এই পাতাখানা তার মধ্যে তুমি খুঁজবে। না-পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। জরুরি দরকারের জন্যে এই নাও আরও দশ শিলিং। সন্ধের আগেই বেকার স্ট্রিটে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দেবে কী পাওয়া গেল। ওয়াটসন, এবার একটা কাজই বাকি রইল। টেলিগ্রাম মারফত ২৭০৪ নম্বর ছ্যাকড়াগাড়ির কোচোয়ানকে শনাক্ত করতে হবে। তারপর বন্ড স্ট্রিট ললিতকলা প্রদর্শনীর ঘরে গিয়ে ছবি দেখব হোটেলে যাওয়ার সময় না-হওয়া পর্যন্ত।
পরের পর্ব :
০১. শার্লক হোমস
০২. বাস্কারভিল বংশের অভিশাপ
০৩. প্রহেলিকা
০৪. স্যার হেনরি বাস্কারভিল
০৫. তিনটে ছিন্নসূত্র
০৬. বাস্কারভিল হল
০৭. মেরিপিট হাউসের স্টেপলটনরা
০৮. ডক্টর ওয়াটসনের প্রথম রিপোর্ট
০৯. ডক্টর ওয়াটসনের দ্বিতীয় রিপোর্ট : জলায় আলো
১০. ডক্টর ওয়াটসনের ডায়ারি থেকে উদ্ধৃতি
১১. পাহাড়চুড়োর মানব
১২. বাদায় মৃত্যু
১৩. জাল বিস্তার
১৪. বাস্কারভিলস হাউন্ড
১৫. স্মৃতিমন্থন