দি অ্যাডভেঞ্চার অব চার্লস অগাস্টাস মিলভারটন

দি অ্যাডভেঞ্চার অব চার্লস অগাস্টাস মিলভারটন

ভাংচি দেওয়ার ভয়ংকর কাহিনি
[দি অ্যাডভেঞ্চার অব চার্লস অগাস্টাস মিলভারটন]

অভ্যাসমতো উদ্দেশ্যবিহীন সান্ধ্য-ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম হোমস আর আমি। কুয়াশা-ঘন, হাড়কাঁপানো শীতের সন্ধ্যা। ছ-টা নাগাদ ঘরে ফিরে হোমস বাতিটা জ্বালতেই আলো গিয়ে পড়ল টেবিলের উপর রাখা একটা ভিজিটিং কার্ডের ওপর। একবারমাত্র চোখ বুলিয়ে নিয়ে কার্ডটাকে সে পরম ঘৃণাভরে কণ্ঠে বিরক্তির স্বর প্রকাশ করে ফেলে দিলে দূরে মেঝের ওপর। কার্ডটা তুলে নিয়ে দেখলাম, তাতে লেখা রয়েছে :

চার্লস অগাস্টাস মিলভারটন,
অ্যাপেলডোর টাওয়ারস,
হ্যাম্পস্টেড।

এজেন্ট।

লোকটা কে হে? জিজ্ঞেস করি আমি।

লন্ডনের জঘন্যতম লোক। আগুনের সামনে বসে পড়ে পা-দুটো ছড়িয়ে দিয়ে জবাব দিল হোমস। কার্ডের পেছনে কিছু লেখা আছে নাকি?

উলটে ধরে পড়লাম, সন্ধ্যা ছটায় আসছি–সি. এ. এম.।

হুম! আসার সময়ও হয়ে এল দেখছি। চিড়িয়াখানার সাপের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে কিলবিলে, হড়হড়ে, পিচ্ছিল, ক্লেদাক্ত প্রাণীগুলোর কালো মৃত্যুর মতো চকচকে চোখ আর কুটিল, চেপটা মুখের দিকে তাকালে তোমার গা শিরশির করে না? আপাদমস্তক রি-রি করে ওঠে না অপরিসীম ঘৃণায়? সারাজীবনে পঞ্চাশজন খুনির সঙ্গে বুদ্ধির পাঞ্জা লড়েছি আমি, কিন্তু ওদের মধ্যে সবচেয়ে বদ লোকটার নাম শুনলেও আমার এতটা ঘৃণা আর বিদ্বেষ জাগে না, যতটা হয় এই লোকটার নাম শুনলে। ওর ছায়া মাড়াবার প্রবৃত্তিও আমার নেই। তবুও ব্যাবসার খাতিরে ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ না-করে আমার উপায় নেই–কেননা, সত্যি বলতে কী, আমার আমন্ত্রণ রাখতেই আজকে সে আসছে এখানে।

কিন্তু লোকটা কে, তা তো বললে না?

বলছি ওয়াটসন বলছি। দুনিয়ার যত ব্ল্যাকমেলারের নাম শুনেছি, তাদের সম্রাট বলা যায় চার্লস অগাস্টাস মিলভারটনকে। যে-পুরুষ এবং যে-নারীর গৃঢ় খবর আর সামাজিক মানসম্মান মিলভারটনের হাতের মুঠোয় এসে পড়ে, ভগবান তাদের রক্ষে করুন। ঠোঁটের কোণে অম্লান হাসি ফুটিয়ে তুলে অথচ মার্বেল পাথরের মতো কঠিন হৃদয় নিয়ে শোষণ শুরু হয়, যতক্ষণ-না শুধু ছিবড়েটুকু অবশিষ্ট থাকে। লোকটার প্রতিভা আছে এবং শোষণ-বিদ্যায় তার একটা পাণ্ডিত্য থাকার ফলে এ-জাতীয় অন্য যেকোনো ব্যাবসায় সে প্রথিতযশা হতে পারত। ওর পদ্ধতি এইরকম : সুকৌশলে সে সবাইকে জানিয়ে দেয়, বিত্ত বা খ্যাতির জীবনে যাঁরা সুপ্রতিষ্ঠিত, তাদের জীবনের গূঢ় তথ্য লেখা কোনো চিঠি অতি উচ্চ মূল্যে কিনতে সে প্রস্তুত। খাসকামরার বিশ্বাসঘাতক চাকর বা ঝিরাই শুধু এ ধরনের চিঠি তার কাছে পাঠায় না, স্নেহ-ভালোবাসার আস্থা অর্জন করে মেয়েদের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, এমন ভদ্রবদমাশরাও অর্থের লোভে ভরিয়ে তোলে মিলভারটনের চিঠির ঝাঁপি। এদিক দিয়ে মোটেই ব্যয়কুণ্ঠ নয় সে। আমি জানি, দুলাইনে লেখা একটা চিরকুটের জন্যে একজন পেয়াদাকে সে সাতশো পাউন্ড দাম দিয়েছিল, আর তার ফলে ধ্বংস হয়ে গেছিল একটা সম্রান্ত পরিবার। বাজারে হেন খবর নেই যা মিলভারটনের কাছে যায় না, তুচ্ছাতিতুচ্ছ খবরও জমা পড়ে তার দপ্তরের খাতায়–তাই এ-শহরের শত শত লোক তার নাম শুনলেও ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কবে কোথায় কীভাবে যে তার মরণ-টিপুনি শুরু হবে, তা কেউ জানে না। কেননা দিন এনে দিন খাওয়ার মতো অবস্থা তার নয়, অর্থের যেমন তার অভাব নেই, তেমন অভাব নেই কূটবুদ্ধিরও ঝোপ বুঝে কোপ মারার জন্যে হাতের তাস হাতেই রেখে বছরের পর বছর শান্তশিষ্ট হয়ে বসে থাকে সে। তারপর যখন বোঝে চড়া বাজি জেতার সময় এসেছে, তখন ছাড়ে তার হাতের তাস। তোমাকে তো বললামই, লন্ডনের জঘন্যতম লোক হল এই মিলভারটন। সাধারণ দুবৃত্তের সঙ্গে এর তুলনা হয় না, কেন জানো? রক্ত গরম হয়ে গেলে মারপিট, খুন-জখম করা এক জিনিস, আর ধীরেসুস্থে হিসেবমতো অবসর সময়ে মানুষের দিবানিশার শান্তি কেড়ে নিয়ে তার স্নায়ুমণ্ডলে বিপর্যয় ডেকে এনে পরিপুষ্ট টাকার থলিকে আরও পুষ্ট করার প্রচেষ্টা আর এক জিনিস।

বন্ধুবরকে এ-রকম তীব্র আবেগ-থর-থর ভাষায় কথা বলতে আমি খুব অল্পই দেখেছি।

বললাম, কিন্তু আইনের আওতায় কি সে পড়ে না?

পড়ে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার কোনো মূল্যই নেই। ধর, এক মহিলার সর্বনাশ আসন্ন। সে সময়ে মিলভারটনকে কয়েক মাসের জন্যে শ্রীঘরে পাঠিয়ে তার কোনো লাভ তো হচ্ছেই না, বরং মিলভারটন জেলে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে তারও সর্বনাশ হচ্ছে সম্পূর্ণ। এইজন্যেই তার শিকাররা পালটা ঘা দিতে সাহস পায় না। নির্দোষ লোককে দোহন করার চেষ্টা করলে অবশ্য ফলাফল হত অন্যরকম। কিন্তু এদিক দিয়ে পাকা শয়তানের মতো ক্ষুরধার বুদ্ধি তার। না হে, না, ওর সঙ্গে লড়তে গেলে অন্য পন্থা ভাবতে হবে আমাদের।

এমন লোককে এখানে ডেকে পাঠিয়েছ কেন?

কারণ, এক স্বনামধন্য মহিলা মক্কেল তার কেস দিয়েছেন আমার হাতে। কেসটা শুনলে সত্যিই করুণা হয়, ওয়াটসন। গত মরসুমে প্রথম আবির্ভাবেই সেরা সুন্দরী হিসাবে যিনি নাম করেছেন, ইনিই সেই লেডি ইভা ব্র্যাকওয়েল। দিন পনেরোর মধ্যেই আর্ল অফ ডোভারকোর্টের সঙ্গে তার বিয়ে। ভদ্রমহিলার অবিবেচকের মতো লেখা কয়েকটি চিঠি এসে পড়েছে এই পিশাচটার খপ্পরে। অবিবেচক ছাড়া কী আর বলব, ওয়াটসন। চিঠিগুলো লেখা হয়েছিল গ্রামাঞ্চলের এক বিত্তহীন সম্রান্ত যুবককে। বিয়ে ভেঙে দেওয়ার পক্ষে চিঠিগুলো যথেষ্ট। মোটা টাকা না-পেলে মিলভারটন ওগুলো পাঠিয়ে দেবে আর্লের কাছে। আমার ওপর ভার পড়েছে তার সঙ্গে দেখা করে যতদূর সম্ভব ভালো শর্তের ভিত্তিতে বিষয়টার ফয়সালা করার।

ঠিক সেই মুহূর্তে খটাখট শব্দের সঙ্গে ঘড়ঘড় আওয়াজ শুনলাম নীচে রাস্তার ওপর। তাকিয়ে দেখি, জমকালো একটা জুড়িগাড়ি দাঁড়িয়ে নীচে। জোরালো বাতি দুটোর আলো ঠিকরে পড়ছিল ঘোড়া দুটোর অপূর্ব সুন্দর গাঢ় লালচে বাদামি রঙের পালিশকরা কাঁধের ওপর থেকে। একজন পেয়াদা দরজা খুলে ধরলে এবং খর্বকায় হৃষ্টপুষ্ট এক পুরুষ নেমে এল নীচে। লোকটার গায়ে রাশিয়ান অ্যাসট্রাখান অঞ্চলের লোমশ চামড়ার ওভারকোট। এক মিনিট পরেই ঘরে ঢুকল সে।

চার্লস অগাস্টাস মিলভারটনের বয়স বছর পঞ্চাশ হবে। ধীমান পুরুষের মতো মস্তবড়ো সুগঠিত মাথা। গোলগাল, মাংসল, শ্মশ্রুবিহীন মুখ। ঠোঁটের কোণে যেন ফ্রেমে বাঁধানো অষ্টপ্রহরের হিমশীতল হাসি। আর চওড়া সোনার চশমার পেছনে একজোড়া তীক্ষ্ণ্ণ ধূসর চোখের উজ্জ্বল দীপ্তি। লোকটার হাবভাবে মি. পিকউইকসুলভ হিতৈষণার ছাপ পাওয়া যায়। কিন্তু এমন ছদ্মবেশেও সামান্য ত্রুটি থেকে গেছে–ফ্রেমে-আঁটা নকল হাসি আর অশান্ত, অন্তর্ভেদী চোখের সুকঠিন ঝিকিমিকির জন্যে। কণ্ঠস্বর মুখের মতোই মসৃণ, পরিচ্ছন্ন। ঘরে ঢুকেই হৃষ্টপুষ্ট হাত বাড়িয়ে বিড়বিড় করে দুঃখ প্রকাশ এগিয়ে এল সে।

হাতটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গ্রানাইট কঠিন মুখে হোমস তাকালে তার দিকে। ছড়িয়ে পড়ল মিলভারটনের হাসি। হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিমায় দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে ওভারকোটটা খুলে ফেলে সে। তারপর পরম যত্নে ভাঁজ করে চেয়ারের পেছনে রেখে আসন গ্রহণ করে।

এ-ভদ্রলোকের সামনে কথাবার্তা বলা যাবে তো? আমার দিকে ইঙ্গিত করে বসে সে।

ডাক্তার ওয়াটসন আমার বন্ধু এবং পার্টনার।

বেশ, বেশ, মিস্টার হোমস। আপনার মক্কেলের স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখেই বললাম এ-কথা। একটা দুরূহ সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা—

ডাক্তার ওয়াটসন এ-সম্বন্ধে আগেই সব শুনেছেন।

তাহলে সরাসরি কাজের কথাই হোক। আপনি বলছেন, লেডি ইভার তরফে আলোচনা করবেন আপনি। আমার শর্ত মেনে নেওয়ার অধিকারও নিশ্চয় তিনি আপনাকে দিয়েছেন?

আপনার শর্ত কী, তাই বলুন।

সাত হাজার পাউন্ড!

আর, যদি তা না-দেওয়া যায়?

মাই ডিয়ার স্যার, আমার পক্ষে সে-আলোচনা বড়োই বেদনাদায়ক। কিন্তু ১৪ তারিখে টাকা–দিলে ১৮ তারিখে যে বিয়ে হবে না এ-বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন। লোকটার অসহ্য হাসি আগের চাইতেও খুশিখুশি হয়ে ওঠে। ক্ষণকাল চিন্তা করে হোমস।

তারপর বলে, এমন অসম্ভব শর্ত আরোপ করছেন আপনি যে, তা মেনে নেওয়া যায় না। চিঠিগুলোর বিষয়বস্তু সম্বন্ধে অবশ্য আমিও ওয়াকিবহাল। আমার পরামর্শ অনুসারে কাজ করতেও দ্বিধা করবেন না লেডি ইভা। কাজেই আমি তাকে বলব ভবিষ্যৎ স্বামীর কাছে অকপটে সব কথা খুলে বলে তার দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করতে।

নিঃশব্দে হেসে উঠল মিলভারটন।

আপনি দেখছি, আর্লকে একেবারেই চেনেন না।

হোমসের মুখে পরাজয়ের চিহ্ন দেখে পরিষ্কার বুঝলাম, আর্লকে চিনতে তারও বাকি নেই।

শুধোয় ও, চিঠিগুলোয় এমন কী ক্ষতিকর কথা আছে?

মিলভারটন জবাব দেয়, বেজায় চনমনে চিঠিগুলো প্রাণরসে ভরপুর। আপনি যদি মনে করেন, এ-পত্রগুচ্ছ আর্লের হাতে সমর্পণ করলেই আপনার মক্কেলের স্বার্থ রক্ষা পাবে, তখন না হয়, তাই করা যাবে এবং সেক্ষেত্রে এই সামান্য লিপিকা ক-টা ফিরিয়ে আনার জন্যে এতগুলো টাকা জলে দেওয়াও আপনাদের পক্ষে বোকামো।বলে দাঁড়িয়ে উঠে ভেড়ার চামড়ার লোমশ কোটে হাত দিল সে।

রাগে অপমানে ছাইয়ের মতো পাঙাশ হয়ে ওঠে হোমসের মুখ।

সবুর। ধীরেসুস্থে কাজ করা দেখছি আপনার ধাতে নেই। এ-রকম ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে কোনোরকম কেলেঙ্কারি যাতে না-ছড়ায়, সে-বন্দোবস্ত যেভাবেই হোক আজ আমাদের করতে হবে।

আবার আসন গ্রহণ করে মিলভারটন। বলে, আমি জানতাম, এদিকটাও ভাববেন আপনি।

হোমস বলে চলে, লেডি ইভা খুব ধনবতী নন। দু-হাজার পাউন্ড দেওয়া মানেই তার স্বল্প বিত্তের প্রায় সবটুকুই দিয়ে দেওয়া আপনার দাবিতে সাত হাজার পাউন্ড দেওয়ার ক্ষমতা তো তার একেবারেই নেই। কাজেই আমার অনুরোধ, আপনি অত চড়া দাম না-হেঁকে ওই দু-হাজারেই চিঠিগুলো ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। বিশ্বাস করুন, দু-হাজারের বেশি একটা কপর্দক দেওয়ার ক্ষমতাও লেডি ইভার নেই।

আর একটু ছড়িয়ে পড়ে মিলভারটনের হাসি–দুই চোখে ঝিকমিক করে ওঠে কৌতূহলের আলো।

লেডি ইভার আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে যা বললেন, তা আমার অজানা নয়। তবে কী জানেন, একটা বিষয় আপনি স্বীকার করবেন যে, যেকোনো মহিলার জীবনে তার বিয়ের লগ্নটিই হল সর্বোত্তম ক্ষণ। এ সময়ে তার প্রতিটি বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন তার জন্যে কিছু-না-কিছু করার আগ্রহ রাখে। মামুলি উপহার দেওয়াটা অনেকেরই মনঃপূত হয় না। তাই বলছিলাম, লন্ডনের সেরা শামাদান আর মাখন-ভরা ডিশ উপহার দিয়ে যতটা আনন্দ পাওয়া যাবে, তার চাইতেও বহুগুণ তৃপ্তি পাওয়া যাবে সামান্য এই পত্রগুচ্ছটি দিলে।

হোমস উত্তর দিলে, যা বললাম, তা সত্য। আপনার দাবিমতো অত টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। তই বলছিলাম, ভদ্রমহিলার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে আপনার যখন কোনো লাভই হবে না, তখন যা পাওয়া যাচ্ছে তাই নেওয়া আপনার পক্ষে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

ভুল করলেন, মিস্টার হোমস, ভুল করলেন। হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলে, আমার লাভ বই লোকসান হবে না। এক্ষেত্রে লাভটা অবশ্য হবে পরোক্ষভাবে এবং তা নিতান্ত সামান্য নয়। বর্তমানে আট-দশটা এই ধরনের কেস হাতে রেখে পাকাচ্ছি–শুধু সুযোগ বুঝে কোপ মারার জন্যে! একগুঁয়েমির কী কঠোর শাস্তি লেডি ইভাকে আমি দিয়েছি, এ-খবর তাদের মধ্যে একবার ছড়িয়ে দিতে পারলেই আমার কাজ অনেকটা সহজ হয়ে আসবে। এ-নজির যে একবার শুনবে, বেয়াড়াপনা করার কল্পনাও মনে স্থান দিতে পারবে না সে। আমার পয়েন্টটা বুঝেছেন তো? পকেট থেকে একটা নোটবই বার করে দেখতে দেখতে বললে মিলভারটন।

বিদ্যুতের মতো চেয়ার থেকে ছিটকে গেল হোমস।

ওর পেছনে যাও, ওয়াটসন। বেরোতে দিয়ো না ঘর থেকে। ঠিক আছে। এবার, মশাই, দেখান তো আপনার ওই নোটবইতে আর কী কী আছে? ইঁদুরের মতো ক্ষিপ্রগতিতে ঘরের ধারে পিছলে গিয়ে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছিল মিলভারটন।

মিস্টার হোমস! মিস্টার হোমস! বলতে বলতে কোটের সামনের দিকটা আমাদের দিকে ফেরাতেই চোখে পড়ল ভেতরের পকেট থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসা একটা বড়ো রিভলভারের কুঁদো। আমিও আশা করেছিলাম, এইরকম ধরনের মৌলিক একটা কিছু না-করে ছাড়বেন না। এ-রকম কাণ্ড প্রায়ই হয় তো, কিন্তু করে কিছু লাভ হয় কি? আরে মশাই, আপনার বোঝা উচিত ছিল সশস্ত্র না-হয়ে কোথাও যাই না আমি। এবং দরকার হলে, গুলি চালাতেও মোটেই দ্বিধা করব না। আইনের সমর্থন যে আমি পাব, তা আপনিও জানেন, আমিও জানি। তা ছাড়া চিঠিসমেত নোটবই এখানে আনব, এ-রকম ভ্রান্ত ধারণা আপনার কী করে হল বুঝছি না। এ-রকম নিরেট মূখের মতো কাজ আমি কখনো করি না। যাই হোক, এবার তো আমায় যেতে। হয়, জেন্টলমেন। আজ রাতেই আরও দু-একটা ছোটোখাটো অ্যাপয়েন্টমেন্ট রয়েছে। হ্যাম্পস্টেডে ফিরে যেতেও অনেকটা সময় লাগবে। এক-পা এগিয়ে এসে কোটটা তুলে নিল মিলভারটন। তারপর রিভলভারের ওপর হাত রেখে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। আমি একটা চেয়ার তুললাম, কিন্তু হোমস মাথা নাড়তে রেখে দিলাম যথাস্থানে। বাতাসে মাথা ঠুকে মৃদু হাসল মিলভারটন, দুই চোখ নেচে উঠল কৌতুকে। তারপরেই বিদায় হল সে। কয়েকমুহূর্তে পরেই দড়াম করে গাড়ির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনলাম এবং পরক্ষণেই গড় গড় শব্দে দূর হতে দূরে উধাও হয়ে গেল তার জুড়ি।

ট্রাউজারের পকেটে দু-হাত ঢুকিয়ে, বুকের ওপর চিবুক ঠেকিয়ে, অপলক চোখে জ্বলন্ত অঙ্গারের পানে তাকিয়ে অনড় দেহে বসে রইল হোমস। পুরো আধঘণ্টা কেটে গেল। নীরব, নিশ্চল হয়ে ড়ুব দিয়ে রইল ও চিন্তার অতলে। তারপরেই, যেন উপায় স্থির হয়ে গেছে, এমনিভাবে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে গেল শোয়ার ঘরে। একটু পরেই ছোকরা বয়েসের এক লম্পট মজুর হেলে-দুলে ফতোবাবুর মতো ঘরে ঢুকল। ছাগল-দাড়ি নেড়ে বাতির শিখায় মাটির পাইপটা ধরিয়ে নিয়ে নেমে গেল রাস্তায়। যাবার আগে বলে গেল, ওয়াটসন, আমার ফিরতে দেরি হবে। রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল তার কৃশ মূর্তি। বুঝলাম, চার্লস অগাস্টাস মিলভারটনের বিরুদ্ধে শুরু হল তার অভিযান। কিন্তু তখন আমি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারিনি অভিযানের অন্তে এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করতে হবে আমাদের।

বেশ কয়েকদিন ধরে এই বেশেই আসা যাওয়া করল হোমস। সে হ্যাম্পস্টেডে যায় এবং সময়টা ভালোই কাটছে সেখানে–এ ছাড়া আর কোনো মন্তব্য শুনলাম না তার মুখে। কাজেই, কী যে করছে ও, তা জানতাম না। তারপর, একদিন এক দূরন্ত ঝড়ের রাতে বাড়িতে ফিরে এল হোমস। হাহাকার শব্দে দরজা-জানলায় মাথা খুঁড়ে ফিরে যাচ্ছিল দূরন্ত হাওয়া। এই তার শেষ অভিযান। ছদ্মবেশ খসিয়ে আগুনের ধারে পা ছড়িয়ে বসে, অভ্যাসমতো আপন মনে নিঃশব্দে প্রাণ খুলে হাসতে লাগল বন্ধুবর।

ওয়াটসন, যদি বলি আমি বিয়ে করতে চলেছি, তাহলে নিশ্চয় তা বিশ্বাস করবে না?

নিশ্চয় না।

শুনে চমকে যাবে ভায়া! আমার বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হয়ে গেছে।

মাই ডিয়ার হোমস! অভিনন্দন…

মিলভারটনের বাড়ির ঝি-এর সঙ্গে।

সর্বনাশ! কী বলছ হোমস?

আরে ভাই, আমার খবরের দরকার হয়ে পড়েছিল।

কিন্তু সেজন্যে তো অনেক দূর গড়িয়েছ দেখছি।

এ ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আমার নাম এসকট। জলের পাইপ, সিসটার্ন ইত্যাদি বসানো এবং মেরামত করাই আমার ব্যাবসা এবং তা দিন-দিন ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। প্রতি সন্ধ্যায় মেয়েটির সঙ্গে আমি হাওয়া খেয়েছি আর কথা বলেছি এন্তার। কী মুশকিল, সেসব কথা তো বলাও যায় না। যাকগে, আমার যা যা দরকার, সবই পেয়ে গেছি। আমার হাতের তালুর সঙ্গে আমার যতখানি পরিচয়, ঠিক ততখানি জেনে গেছি মিলভারটনের বাড়ির খুঁটিনাটি।

কিন্তু হোমস, মেয়েটা?

দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে ও বললে, মাই ডিয়ার ওয়টসন, অত ভাবতে গেলে কি চলে? অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। বাজি যেরকম থাকবে, হাতের তাসও ফেলবে সেইভাবে, তাই নয় কি? ভালো কথা, আরও একটা আনন্দের খবর আছে। অভিসার-পর্ব করতে গিয়ে আমার এক প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বী জুটিয়ে ফেলেছি। পেছন থেকে আমায় পেলেই লোকটা নির্ঘাত গলা কেটে ছাড়বে। ওঃ, কী চমৎকার রাত্রি।

আজকের আবহাওয়া তোমার ভালো লাগছে?

আমার কাজের পক্ষে খুবই উপযোগী আজকের আবহাওয়া। ওয়াটসন, আজ রাতেই মিলভারটনের বাড়িতে সিঁদ দিতে চাই আমি!

সান্ধ্য-পোশাক পরলাম হোমস আর আমি। দেখলে মনে হবে যেন থিয়েটার দর্শনান্তে গৃহে ফিরছেন দুই ভদ্রলোক। অক্সফোর্ড স্ট্রিটে ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে হ্যাম্পস্টেডের একটা ঠিকানায় এসে পৌঁছোলাম। গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিলাম এখানে। দারুণ ঠান্ডা পড়েছিল, কনকনে হাওয়ার ঝাঁপটায় মনে হচ্ছিল যেন বরফের ছুরি কেটে কেটে বসে যাচ্ছেমাংসের মধ্যে। ওভারকোটের বোতাম এঁটে নিলাম! তারপর ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে এগিয়ে চললাম গন্তব্যস্থানের দিকে।

হোমস বললে, আজকের কাজটা একটু বিশেষ রকমের দুরূহ। হিসেবি বা হুঁশিয়ার না হলে সাফল্য অসম্ভব। মিলভারটনের পড়ার ঘরে একটা সিন্দুকের মধ্যে থাকে এই দলিল-দস্তাবেজগুলো। পড়ার ঘরটা আবার তার শোবার ঘরের লাগোয়া একটা ঘর। কিন্তু আমাদের একটা সুবিধে আছে। নাদুসনুদুস খর্বকায় লোকেরা যখন টাকার কুমির হয়, তখন তাদের যে অসুস্থ অভ্যাসটি থাকে, মিলভারটনেরও তা আছে। অর্থাৎ বেজায় ঘুমকাতুরে লোকটা। আমার প্রেমিকা আগাথার কাছে শুনলাম, চাকর মহলে সবাই নাকি এ নিয়ে হাসাহাসি করে। একবার ঘুমোলে হল, সে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙানোর ক্ষমতা আর কারো নেই। মিলভারটনের কাজকর্ম দেখবার জন্যে একান্ত অনুগত একজন সেক্রেটারি আছেন। সে ভদ্রলোকও সারাদিন পড়ার ঘর ছেড়ে এক পাও নড়েন না। আমাদের নৈশ অভিযান সেই কারণেই। এরপর লোকটার একটা বাঘা কুকুর আছে–সারারাত বাগানে টহল দেওয়া তার কাজ। গত দুরাতে আগাথার সঙ্গে দেখা করার সময়ে সে চাবি দিয়ে রেখেছিল কুকুরটাকে কাজেই নির্বিঘ্নে যেতে আসতে পারছি আমি। এই যে, এই বাড়িটা, বাগানওলা এই বড়ো বাড়িটা। ফটক দিয়ে ঢুকে পড়–এবার ডাইনে মোড় নিয়ে দাঁড়ানো যাক লরেল ঝোঁপের মধ্যে। মুখখাশগুলো এখানেই লাগিয়ে নেওয়া যাক, কি বল? লক্ষ করেছ, কোনো জানলা দিয়েই আলোর এতটুকু রশ্মি দেখা যাচ্ছে না। চমৎকার প্ল্যান, যেমনটি আশা করা গেছিল, ঠিক তেমনটিই হচ্ছে দেখছি।

কালো সিল্ক দিয়ে মুখ ঢাকার পর আমাদের দেখতে হল দু-দুটো অতি-ভয়ংকর নিশাচর প্রাণীর মত। মাজারের মতো নিঃশব্দ চরণে নিস্তব্ধ অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝিমিয়ে পড়া বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম দুজনে। একদিকে দেখলাম, টালির ছাউনি দেওয়া একটা বারান্দায় সারি সারি অনেকগুলো জানলা আর দুটো দরজা।

ফিসফিস করে ওঠে হোমস, ওইটাই ওর শোবার ঘর। দরজা খুলতেই পড়ার ঘর। সবচেয়ে ভালো হত এই দরজাটা খুলতে পারলে, কিন্তু দরজার ওদিকে শুধু ছিটকিনি নয়, তালাও লাগানো আছে। কাজেই এদিক দিয়ে ঢুকতে গেলে শব্দ-টব্দ একটু বেশিই হবে! এসো ঘুরে যাওয়া যাক। ওদিকে একটা কাচের তৈরি গাছপালা রাখার গ্রিনহাউস আছে। তার ভেতর দিয়ে বসার ঘরে যাওয়া যায়।

সেখানেও তালা লাগানো। কিন্তু কাচের একটা গোল চাকতি কেটে ফেলে হাত গলিয়ে ভেতর থেকে চাবি ঘুরিয়ে দিলে হোমস। পরমুহূর্তে ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলে সে এবং ঠিক তখন থেকেই আইনের চোখে গুরু অপরাধ করা শুরু হল আমাদের। সংরক্ষণশালার ভারি উষ্ণ বাতাসে আর বিদেশ থেকে আনা রকমারি চারাগাছের দম-আটকানো সৌরভে যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল আমাদের। অন্ধকারের মধ্যে আমার হাত চেপে ধরে দ্রুত এগিয়ে চলল হোমস। গুল্মের কিনারা দিয়ে যাওয়ার সময় পাতাগুলো ঘষটে যেতে লাগল মুখের ওপর। বহুদিনের সযত্ন অভ্যাসে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে দেখবার আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল হোমস। একহাতে আমার হাত আঁকড়ে, অপর হাতে একটা দরজা খুললে সে। মনে হল, যেন একটা মস্ত ঘরে ঢুকেছি; এবং একটু আগেই কেউ সেখানে সিগার খেয়ে গেছে। আসবাবপত্রের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে এগিয়ে গেল হোমস, আর একটা দরজা খুলে আমাকে টেনে নিয়ে গেল ওদিকে। দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর আমি হাত বাড়াতেই দেওয়াল থেকে ঝোলানো কতকগুলো কোটে হাত ঠেকল। বুঝলাম, যাতায়াতের পথে অর্থাৎ প্যাসেজে এসে পড়েছি। প্যাসেজ পেরিয়ে এসে হোমস অতি সন্তর্পণে ডান দিকের একটা দরজা খুলে ধরলে। সঙ্গেসঙ্গে বিদ্যুৎবেগে একটা প্রাণী ধেয়ে এল আমাদের পানে, আর আমার হৃৎপিণ্ডটাও ডিগবাজি খেয়ে এসে ঠেকল গলার কাছে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন বুঝলাম, প্রাণীটা চতুষ্পদ এবং একটা নিরীহ বেড়াল, তখন ইচ্ছে হল জোরে হেসে উঠি। এ-ঘরে আগুন জ্বলছিল চুল্লিতে এবং এখানেও মন্থর বাতাসে ভাসছিল তামাকের ঘন ধোঁয়া। পা টিপে টিপে ভেতরে ঢুকল হোমস। আমি ভেতরে এলে পরে, খুব আলতোভাবে বন্ধ করে দিলে দরজাটা। এইটাই মিলভারটনের পড়ার ঘর। অপর প্রান্তে একটা পর্দা ঝুলতে দেখে বুঝতে কষ্ট হল না যে শোবার ঘরের প্রবেশপথ সেটা।

জোরালো আগুনের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল সমস্ত ঘরটা। দরজার কাছে চক চক করছিল একটা বৈদ্যুতিক সুইচ। আগুনের আলো থাকায় সুইচ টেপার আর দরকার হল না। আগুনের চুল্লির একপাশে দেখলাম একটা ভারী পর্দা, বাড়ির ভেতরে ঢোকার আগে বাইরের দিকে ঠেলে বেরোনো যে-জানলাটা দেখেছিলাম, এ-পর্দা যে সেই জানলাকেই ঢেকে রেখেছে, তা বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না আমার। চুল্লির আর একদিকে ছিল একটা দরজা। বাইরে থেকেই দেখেছি, এ-দরজা খুলেই বারান্দায় পা দিতে হয়। ঘরের ঠিক কেন্দ্রে একটা ডেস্ক আর চকচকে লাল চামড়া-মোড়া ঘুরন্ত চেয়ার। বিপরীত দিকে দেখলাম, মস্তবড়ো একটা বুককেস। ওপরে রয়েছে জ্ঞানের দেবী এনেথের মার্বেল পাথরের আবক্ষ প্রতিমূর্তি। কোণের দিকে বইয়ের আলমারি আর দেওয়ালের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে একটা লম্বা, সবুজ রঙের সিন্দুক। আগুনের আলো ঠিকরে পড়ছিল তার পালিশ করা তামার হাতলের ওপর থেকে। গুড়ি মেরে এগিয়ে গিয়ে একবার দেখে নিলে হোমস। তারপর পা টিপে টিপে শোবার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে ঘাড় কাত করে কান খাড়া করে রইল কিছুক্ষণ। কোনোরকম সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না ভেতর থেকে। ইতিমধ্যে আমি ভাবলাম, বাইরের দিকে দরজা দিয়ে উধাও হওয়ার ব্যবস্থাটাও আগে থেকে সম্পূর্ণ করে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাই দরজাটা পরীক্ষা করতে গেলাম আমি। গিয়ে তো অবাক। দরজায় তালাও নেই–বাইরে থেকে একটু ঠেলা মারলেই খুলে যায়! হোমসের বাহু স্পর্শ করতেই সে মুখোশপরা মুখ ফিরিয়ে তাকালে দরজার দিকে। তাকিয়ে চমকে উঠল, দেখলাম, আমার মতো আশ্চর্য হয়ে গেছে সে।

কানের গোড়ায় মুখ এনে ফিসফিস করে ওঠে হোমস, গতিক সুবিধের মনে হচ্ছে না। বুঝতে পারছি না কী ব্যাপার, চুলোয় যাক, নষ্ট করার মতো সময় আর নেই।

আমার কিছু করার আছে?

আছে। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াও তুমি। কাউকে আসতে শুনলেই ভেতর থেকে ছিটকিনি এঁটে দিয়ে। তখন যে-পথে এসেছি, সেই পথেই সটকান দেব আমরা। যদি উলটো দিক থেকে কেউ আসে, তাহলে কাজ শেষ হয়ে গেলে বারান্দার দরজা দিয়ে সরে পড়ব, আর না হলে, এই পর্দাটার আড়ালে লুকোব। বুঝছ তো?

ঘাড় কাত করে জানালাম, বুঝেছি। তারপর দাঁড়ালাম দরজার সামনে। প্রথম প্রথম একটু ভয়-ভয় করছিল সত্যি, কিন্তু এখন সে-ভয় কেটে গেছিল। বরং সর্ব অঙ্গ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল এক অদ্ভুত তীব্র উল্লাসে। যতদিন আইনের রক্ষক ছিলাম, কোনোদিন উপলব্ধি করতে পারিনি, এ-জাতীয় আনন্দ-শিহরন, সেরাতে সেই প্রথম আইনের ভক্ষক হওয়ার পর আস্বাদ পেলাম তার। অভিযানের মহান উদ্দেশ্য, প্রতিপক্ষের ক্রূর চরিত এবং এ-কাজে যে নিঃস্বার্থ আর রমণীর স্বার্থরক্ষাকল্পে বিরচিত, এই টানটান জ্ঞানের সঙ্গে এসে মিশেছিল অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় স্পোর্টসম্যানসুলভ তীব্র আগ্রহ। অপরাধ-সচেতন হওয়া দূরে থাকুক, বিপদের সম্ভাবনা যতই ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল, ততই অসহ্য আনন্দে শিহরিত হয়ে উঠেছিল আমার প্রতিটি লোমকূপ। যন্ত্রপাতির চামড়ার কেসটা খুলে ফেলল হোমস। তারপর দুরূহ অপারেশন করার আগে সার্জেন যেমন ধীর শান্ত, বিজ্ঞানীসুলভ নিপুণ হাতে একটার পর একটা যন্ত্র বেছে তুলে নেয়, ঠিক তেমনি অভ্যস্ত সতর্কতায় তৎপর হয়ে উঠল সে। সিন্দুক খোলা যে তার বিশেষ শখ, তা জানতাম। তাই এ-রকম একটা দানব-সিন্দুকের সামনাসামনি হয়ে সে যে আনন্দে অধীর হয়ে উঠবে, এতে আশ্চর্য কী; সিন্দুক তো নয়; যেন সোনালি আর সবুজ রঙের একটা ডাগন, যার জঠরে সঞ্চিত রয়েছে কত সুন্দরী মহিলার ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার উপাদান। কোটের হাতা গুটিয়ে নিয়েছিল হোমস ওভারকোটটাকে খুলে রেখেছিল চেয়ারের ওপর। পূর্ণোদ্যমে শুরু হল কাজ। দুটো ছাদা করার ড্রিল, একটা সিধকাঠি আর কয়েকটা খাঁজহীন চাবি বার করে রাখল সে। অতর্কিত বিপদের জন্যে তৈরি থেকে মাঝখানের দরজায় দাঁড়িয়ে আমি তাকাতে লাগলাম, একবার এদিকে আর একবার ওদিকে। অবশ্য কেউ এসে পড়লে আমাদের করণীয় কী, সে-বিষয়ে আমার ধারণা খুব পরিষ্কার ছিল না। প্রায় আধঘণ্টা তন্ময় হয়ে রইল হোমস, নিবিড় উৎসাহ নিয়ে একটার পর একটা যন্ত্র তুলে নিয়ে ট্রেনিং পাওয়া কারিগরের মতো বেশ শক্ত আর নিপুণ হাতে কাজ করে চলল সে। অবশেষে শুনলাম, একটা ক্লিক শব্দ, চওড়া সবুজ দরজা ঘুরে গেল কবজার ওপর, ভেতরে দেখতে পেলাম অনেকগুলি কাগজের প্যাকেট। প্রত্যেকটা প্যাকেট সুতো দিয়ে বাঁধা, সিলমোহর করা এবং ওপরে নাম-ধাম সংখ্যা লেখা। একটা প্যাকেট হোমস তুলে নিলে, কিন্তু আগুনের চঞ্চল আলোয় ওপরের লেখা পড়া সম্ভব হল না। ইলেকট্রিক আলো জ্বালাও বিপজ্জনক, কেননা পাশের ঘরেই ঘুমোচ্ছে মিলভারটন স্বয়ং। তাই, চোরা-লণ্ঠনটা ঢেকে আনল সে। তারপরেই আচম্বিতে থমকে গেল। উৎকর্ণ হয়ে কী যেন শুনল এবং পরমুহূর্তেই সিন্দুকের পাল্লা ঘুরিয়ে বন্ধ করে দিয়ে কেসটা তুলে নিলে। দ্রুতহাতে যন্ত্রপাতি কোটের পকেটে ঠেসে নিয়ে তিরবেগে লুকিয়ে পড়ল জানলার পর্দার পেছনে। যাবার সময়ে আমাকেও সরে আসতে বললে ইঙ্গিতে।

ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর পরেই শব্দ শুনতে পেলাম। তীব্র অনুভূতি দিয়ে অনেক আগেই এ-শব্দ শুনে হুঁশিয়ার হয়ে গেছিল হোমস। বাড়ির মধ্যে কোথায় যেন একটা আওয়াজ শোনা গেল। অনেক দূরে যেন দড়াম করে বন্ধ হল একটা দরজা। তারপর শুনলাম অস্পষ্ট, চাপা গজগজানির পরেই থপ থপ–কে যেন অতি দ্রুত কিন্তু মেপে মেপে পা ফেলে এগিয়ে আসছে এদিকে। ঘরের বাইরের প্যাসেজে এসে গেল থপ থপ শব্দটা।… তারপর থমকে গেল দরজার সামনে। খুলে গেল দরজা। সুইচ টেপার খটাস শব্দ–দপ করে জ্বলে ওঠে ইলেকট্রিক আলো। আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা, কড়া সিগারেটের কটু গন্ধ ভেসে এল নাসারন্ধ্রে। তারপর আমরা, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার কয়েক গজের মধ্যেই পায়ের শব্দ ক্রমাগত আসা-যাওয়া করতে লাগল ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত। এরপর থেমে গেল পদশব্দ, ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ শুনলাম চেয়ারে। তালাতে চাবি লাগানোর ক্লিক শব্দ এবং কাগজপত্র নাড়াচাড়া করার খস খস আওয়াজ। এতক্ষণে উঁকি মারার সাহস আমার হয়নি। এবার বুক ঠুকে পর্দাজোড়া সামান্য ফাঁক করে তাকালাম বাইরে। কাঁধের ওপর হোমসের কাঁধের চাপ পড়ায় বুঝলাম, হোমসও উঁকি মারার লোভ সামলাতে পারেনি। ঠিক সামনে আমাদের নাগালের মধ্যেই একটা চওড়া, গোলাকার পিঠ–আমাদের দিকে পিছন ফিরে বসে আছে স্বয়ং মিলভারটন। বুঝলাম, আগাগোড়া তার গতিবিধির হিসেব করতে ভুল করেছি আমরা। শোবার ঘরে একেবারেই আসেনি সে। ধূমপান করার বা বিলিয়ার্ড খেলার ঘরে এতক্ষণ বসে ছিল, ঘরটা বাড়ির দূরপ্রান্তে হওয়ায় আলোকিত জানলাগুলো আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। চোখের একেবারে সামনেই দেখছিলাম ওর চ্যাটালো, ধূসর মাথা আর চকচকে টাক। দু-পা টান টান করে ছড়িয়ে দিয়ে লাল-চামড়ামোড়া চেয়ারের পেছনে নিজেকে একেবারে ছেড়ে দিয়েছিল ও মুখ থেকে কোণ করে বেরিয়ে ছিল লম্বা কালো একটা সিগার। পরনে ধূমপান করার সময়ে পরার উপযুক্ত কারুকার্য করা আধা-সামরিক স্মোকিং-জ্যাকেট; জ্যাকেটের রং ফরাসি দেশের ক্ল্যারেট মদের মতো লাল, কিন্তু কলারটা কুচকুচে কালো। মখমলের। একহাতে আইন-সংক্রান্ত একটা দীর্ঘ দলিল নিয়ে অলসভাবে পড়ছিল সে, আর ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটার পর একটা ধোঁয়ার বলয় ছুঁড়ে দিচ্ছিল শূন্যে। আয়েশ করে জাঁকিয়ে বসার ভঙ্গিমা দেখে মনে হল না, খুব তাড়াতাড়ি প্রস্থান করার ইচ্ছে আছে তার।

অন্ধকারের মাঝে অনুভব করলাম, আলতো করে আমার হাত ধরে মৃদু আঁকানি দিলে হোমস। পরিস্থিতি যে এখনও তার আয়ত্তের বাইরে যায়নি এবং এখনও নিরুবেগ তার অন্তর, সুতরাং আমারও উচিত সাহসে বুক বাঁধা–এই কথাগুলোই যেন হাত ঝাঁকিয়ে বোঝাতে চাইল ও। কিন্তু আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি যা দেখতে পাচ্ছিলাম, তা নিশ্চয় সে দেখতে পায়নি। সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকে তা দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। তাড়াহুড়ো করে বন্ধ করায়, সিন্দুকের দরজা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি এবং যেকোনো মুহূর্তে তা মিলভারটনের চোখে পড়তে পারে। কাজেই মনে মনে আমি তৈরি হয়ে রইলাম। যে-মুহূর্তে বুঝব মিলভারটন দেখতে পেয়েছে আধ বন্ধ দরজাটা এবং শক্ত হয়ে উঠেছে তার দেহ, সেই মুহূর্তেই গোপন স্থান থেকে একলাফে বেরিয়ে এসে আমার ওভারকোটটা ওর মাথার ওপর ছুঁড়ে দিয়ে জাপটে ধরে কাবু করে ফেলব তাকে, তারপর যা করার সে হোমসই করবে। কিন্তু একবারও চোখ তুলে তাকালে না মিলভারটন। অলস মন্থর ভঙ্গিমায় পাতার পর পাতা উলটে চলল। বুঝলাম, নিবিড় আগ্রহে আইনবিদের যুক্তিস্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে ও। ভেবেছিলাম, দলিলটা পড়া শেষ এবং হাতের সিগার পুড়ে ছাই হলে শোয়ার আয়োজন করবে সে। কিন্তু এ দুটোর একটারও অন্তে পৌঁছোননা হল না। তার আগেই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা এবং আমাদের চিন্তাধারাও আচমকা গতি পরিবর্তন করে ছুটল সম্পূর্ণ ভিন্ন আর এক খাতে!

বেশ কয়েকবার মিলভারটনকে ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখেছিলাম আমি। একবার তো অধীরভাবে উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়ল। রাতদুপুরে যে তার সঙ্গে কারো অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকতে পারে, এ-ধারণা একেবারেই মাথায় আসেনি আমার। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ বাইরের বারান্দা থেকে একটা মৃদু শব্দ ভেসে এল আমার কানে। কাগজপত্র ডেস্কের ওপর ফেলে দিয়ে শক্ত হয়ে বসল মিলভারটন। আবার শোনা গেল শব্দটা, তারপরেই দরজার ওপর আলতোভাবে টোকা মারার আওয়াজ। দাঁড়িয়ে উঠে দরজা খুলে দিলে মিলভারটন।

কেন, আমাদের তা দেখার দরকার নেই। নিয়তির দণ্ড নেমে এসেছে।

তারপর ত্বরিত স্বরে বললে, প্রায় আধঘণ্টার মতো দেরি হয়েছে তোমার।

অর্গল-মুক্ত দরজা আর মিলভারটনের রাত্রি জাগরণের অর্থও সুস্পষ্ট হয়ে গেল নিমেষের মধ্যে। স্ত্রীলোকের বেশভূষার মৃদু খসখস শব্দ শোনা গেল! মিলভারটন আমাদের দিকে ফিরতে পর্দার ফাঁকটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম আমি। এবার সাহস করে আবার ফাঁক করে উঁকি মারলাম বাইরে।

আবার আসন গ্রহণ করেছিল মিলভারটন। আগের মতোই সিগারটাকে আলগোছে ধরে রেখেছিল ঠোঁটের কোণে–ডগাটা মুখ থেকে কোণ করে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। তার ঠিক সামনে, বিদ্যুৎবাতির প্রখর আলোয়, দাঁড়িয়ে ছিল ছিপছিপে লম্বা চেহারার একটি কালোবরণ স্ত্রীলোক। অবগুণ্ঠনে ঢাকা তার মুখ, চিবুক থেকে ঝুলছিল বৈধব্য-সূচক আলখাল্লা। ঘন ঘন এবং দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাস বইছিল তার এবং নমনীয় বরতনুর প্রতিটি ইঞ্চি কেঁপে কেঁপে উঠছিল প্রবল আবেগে।

মিলভারটন বললে, মাই ডিয়ার, রাতের বিশ্রাম তো আমার নষ্ট করে দিলে। যাই হোক, ঘুম–হওয়ার উপযুক্ত মূল্য আশা করি তুমি দিতে পারবে। অন্য কোনো সময়ে তোমার আসা সম্ভব হয় না বুঝি?

ঘাড় নাড়ল স্ত্রীলোকটি।

বেশ বেশ, না আসতে পারলে এসো না। কাউন্টেসের শাসন যদি এতই কড়া বলে মনে কর তো তাকে শায়েস্তা করার এই হল সুযোগ। কী মুশকিল, আরে মেয়েটা, এত কাঁপছে কেন? ঠিক আছে, এই তো চাই। সামলে নাও নিজেকে! এবার এসো কাজের কথা কিছু হোক। ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটা চিরকুট বার করল মিলভারটন, তুমি লিখেছ এমন পাঁচখানা চিঠি তোমার হাতে এসেছে যা কাউন্টেস দ্য আলবার্টকে সংকটে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। চিঠিগুলো। বিক্রি করতে চাও তুমি! আর আমি চাই কিনতে! এ পর্যন্ত কোনো ঝামেলা নেই। এখন শুধু দামটা করে নেওয়া। চিঠিগুলো আমি একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই। নমুনা যদি সত্যি সত্যিই ভালো হয়,–কী সর্বনাশ, আপনি?

একটি কথাও না-বলে অবগুণ্ঠন তুলে ফেলেছিল স্ত্রীলোকটি, চিবুকের ওপর থেকে আলখাল্লাও খসে পড়েছিল বুকের ওপর। মিলভারটনের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম যাঁকে, তাঁর বর্ণ মলিন হলেও তিনি সুশ্রী; সুগঠিত মুখে হুকের মতো কোনো নাক, ঘন কালো ধারালো ভুরু-যুগল, ঝকমকে কিন্তু সুকঠিন একজোড়া চোখ, আর অবঙ্কিম পাতলা অধরোষ্ঠে সর্বনাশা হাসি।

চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিলেন ভদ্রমহিলা, হ্যাঁ, আমি। যার জীবনে আপনি সর্বনাশের আগুন জ্বেলেছেন, আমিই সেই মেয়েটি।

বুকের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন মহিলাটি পাতলা অধরোষ্ঠে খেলা করতে লাগল সেই ভয়ানক বিষাক্ত হাসি।

আমার জীবন যেভাবে ধ্বংস করেছেন, সেভাবে আর কোনো জীবনে আপনি সর্বনাশের আগুন জ্বালাতে পারবেন না। আমার বুক যেভাবে ভেঙেছেন, সেভাবে আর কারো বুকে আপনি আপনার শেল হানতে পারবেন না। পৃথিবীর বুক থেকে আমি মুছে দেব একটা অতি বিষাক্ত বস্তুর অস্তিত্ব। এই নাও কুকুর কোথাকার, আর একটা! –আর একটা!–আর একটা!

বুকের মধ্যে থেকে একটা চকচকে খুদে রিভলভার বার করে মিলভারটনের দেহের ওপর একটার পর একটা ঘর খালি করে চললেন মহিলাটি–নলচেটা রইল মিলভারটনের শার্ট থেকে দু-ফুটের মধ্যেই। কুঁচকে সরে এল সে, উপুড় হয়ে পড়ল টেবিলের ওপর, আর ভীষণভাবে কাশতে লাগল কাগজগুলো আঁকড়ে ধরে। তারপর টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েই আর একটা গুলি খেয়ে গড়িয়ে পড়ল মেঝের ওপর।শেষ করে ফেলল আমায়! আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল সে–পরক্ষণেই নিস্পন্দ হয়ে গেল তার দেহ। নিবিষ্ট চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন মহিলাটি, তারপর চিত হওয়া মুখের ওপর রগড়ালেন জুতোর হিল। আবার তাকালেন, কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। জোরালো খস খস শব্দ শুনলাম, হুহু করে রাতের হাওয়া ঢুকে পড়ল উত্তপ্ত ঘরের মধ্যে, আর উধাও হয়ে গেলেন প্রতিহন্তা বাইরে অন্ধকারে।

আমরা চেষ্টা করলেও লোকটার অদৃষ্টের লিখন খণ্ডাতে পারতাম না। কিন্তু যখন মহিলাটি গুলির পর গুলি ছুঁড়ে যাচ্ছিলেন মিলভারটনের কুঁচকানো দেহের মধ্যে তখন আমি লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে গেছিলাম, কিন্তু হোমস হিমশীতল কঠিন হাতে আমার কবজি চেপে ধরে আটকে রাখলে। ওর ওই দৃঢ় মুঠির অর্থ বুঝলাম আমাকে সংযত রাখার পেছনে তার যুক্তিনির্ভর বিতর্ক। যে অবস্থাই হোক না কুচক্রী শয়তানের, আমাদের আসার উদ্দেশ্য অন্য এবং চোখের সামনে যাই হোক না কেন, কর্তব্য ভুললে চলবে না। মহিলাটি ঘর থেকে ঝড়ের মতো বেগে বেরোতে, হোমস দ্রুত অথচ নিঃশব্দ পদক্ষেপে পৌঁছোল অন্য দরজায়। চাবি ঘুরিয়ে তালা এঁটে দিলে সে। ঠিক সেই মুহূর্তে বাড়ির মধ্যে কণ্ঠস্বর আর ধাবমান পায়ের শব্দ শুনলাম। গুলি ছোড়ার আওয়াজে জেগে উঠেছে বাড়ির প্রত্যেকে। ধীর শান্ত অবিচল হাতে সিন্দুকটা খুলে ফেললে হোমস, দু-হাতে একবোঝা চিঠির তাড়া নিয়ে ফেলে দিলে আগুনে। আবার ফিরে এল সে। আবার নিলে একটা বোঝা ফেলে দিলে আগুনে। কয়েকবারের চেষ্টাতেই শূন্য হয়ে গেল সিন্দুকের উদর। বাইরে থেকে কে দরজার হাতল ঘুরিয়ে চিৎকার করে উঠল। চকিত চোখে চারিদিকে দেখে নিলে হোমস। মিলভারটনের মৃত্যুদূত চিঠিটা রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে ছিল টেবিলের উপর। সেটাও দাউ দাউ আগুনে ফেলে দিয়ে এল হোমস। তারপরেই বাইরের দরজা থেকে চাবিটা খুলে নিয়ে আমার সাথে বেরিয়ে এসে, বাইরে থেকে চাবি ঘুরিয়ে তালা এঁটে দিলে। এদিকে গেলেই বাগানের দেওয়াল টপকাতে পারব।

এত তাড়াতাড়ি যে সমস্ত বাড়ি সজাগ হয়ে উঠবে, তা নিজের চোখে না-দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, আলোয় আলোয় ঝলমল করছে এতবড়ো বাড়িটা। সামনের দরজা খোলা কয়েকজন লোক ছুটছিল বাগানের পথে। বহু লোকের হাঁকডাকে সাড়া পড়ে গেছিল বাগানে। আমরা যেই বারান্দা থেকে বেরিয়েছি, একজন তো পাকড়াও, পাকড়াও করে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এল পিছু পিছু। সমস্ত বাগানটা যেন হোমসের নখদর্পণে। একটা ছোটো চারাগাছের খেতের মধ্যে দিয়ে পথ করে নিয়ে তিরবেগে এগিয়ে চলল সে, আমি আঠার মতো লেগে রইলাম তার পেছনে, আর পেছনে হাঁপাতে হাঁপাতে সমানে ছুটতে লাগল আমাদের অনুসন্ধানকারী। তারপরেই গতি রুদ্ধ হয়ে গেল ছ-ফুট উঁচু একটা পাঁচিলের সামনে। হোমস কিন্তু অবলীলাক্রমে লাফিয়ে উঠে পড়ল ওপরে এবং পরক্ষণেই নেমে পড়ল ওপাশে, আমিও লাফিয়ে উঠে পড়লাম ওপরে এবং পরক্ষণেই নেমে পড়ল ওপাশে, আমিও লাফিয়ে উঠে পড়ার সঙ্গেসঙ্গে পেছন থেকে ছিনেজোঁকের মতো লোকটা সজোরে আঁকড়ে ধরলে আমার গোড়ালি। লাথি মেরে পা ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁকপাঁক করে কোনোরকমে উঠে পড়লাম ঘাসে-ঢাকা ওপরের অংশে, পরক্ষণেই মুখ থুবড়ে পড়লাম ওদিকে একটা ঝোঁপের মধ্যে। পলকের মধ্যে আমাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলে হোমস এবং দুজনে টেনে দৌড়োলাম হ্যাম্পস্টেড হীথ-এর বিস্তীর্ণ ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে। প্রায় মাইল দুয়েক ছোটার পর হোমস দাঁড়িয়ে গিয়ে কানখানা খাড়া করে রইল কিছুক্ষণ। নিথর নিস্তব্ধতায় ঝিমিয়ে ছিল পেছনকার পথ। ছিনেজোঁকের মতো পিছু নেওয়া লোকটার চোখে শেষ পর্যন্ত ধুলো দেওয়া গেছে এবং আবার আমরা নিরাপদ।

এই আশ্চর্য অভিজ্ঞতা লাভের পরের দিন সকালে প্রাতরাশ সমাপনান্তে প্রভাতিক পাইপে ধূমপান করছি, এমন সময়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের মি. লেসট্রেড খুব গম্ভীরভাবে চিন্তামগ্ন মুখে আমাদের বসার ঘরে ঢুকল।

সুপ্রভাত, মিস্টার হোমস, সুপ্রভাত। খুব ব্যস্ত আছেন নাকি?

তোমার কথা শোনার মতো সময় আছে।

হাতে যদি বিশেষ কোনো কাজ না-থাকে, তাহলে একটা অত্যন্ত আশ্চর্য তদন্তে আমাদের সাহায্য করতে পারবেন, এই আশায় এসেছিলাম। গত রাতে হ্যাম্পস্টেডে ঘটেছে এই ঘটনাটা।

সর্বনাশ! কী ব্যাপার শুনি? বলে হোমস।

খুন–অত্যন্ত নাটকীয় এবং আশ্চর্য রকমের খুন। আমি জানি এসব ব্যাপারে কতখানি উৎসুক আপনি। তাই বলছিলাম, দয়া করে যদি অ্যাপলডোর টাওয়ারে আপনার পায়ের ধুলো দিয়ে আপনার মূল্যবান পরামর্শের সুযোগ নিতে দিতেন আমাদের, তাহলে বাস্তবিকই অনুগৃহীত হতাম। খুনটা মোটেই সাধারণ নয়। এই মিলভারটন লোকটার ওপর বেশ কিছুদিন নজর রেখেছিলাম আমরা। আপনাকেই শুধু বলছি, লোকটা একটা আস্ত শয়তান। ব্ল্যাকমেল করার উদ্দেশ্যে অনেক কাগজপত্র নাকি ও রেখে দিত নিজের কাছে। এই ধরনের সব কাগজই পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে গেছে। মূল্যবান কোনো জিনিসই খোয়া যায়নি। সুতরাং আমাদের অনুমান, আততায়ীরা সম্রান্ত ঘরের পুরুষ এবং তাদের মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল এ ধরনের সামাজিক কেলেঙ্কারি বন্ধ করা।

আততায়ীরা! চেঁচিয়ে ওঠে হোমস, বহুবচন?

হ্যাঁ। দুজন এসেছিল। আর একটু হলেই হাতেনাতে ধরাও পড়ত। পায়ের ছাপ পেয়েছি, চেহারার বর্ণনা পেয়েছি এবং পিছু নিয়ে তাদের পাকড়াও করাও খুব অসম্ভব হবে না। প্রথম লোকটা একটু বেশি রকমের চটপটে। দ্বিতীয় লোকটার পায়ের গোড়ালি চেপে ধরেছিল বাগানের মালি–সামান্য ধস্তাধস্তি করেই পগার পার হয়ে যায় সে। মাঝারি আকারের, বেশ শক্তসমর্থ চেহারা লোকটার চৌকো চোয়াল, পুরু ঘাড়, গোঁফ আছে এবং চোখ দুটো ঢাকা ছিল কালো মুখোশে।

শার্লক হোমস বলে ওঠে, খুবই অস্পষ্ট বর্ণনা। আরে, ওয়াটসনের চেহারাও তো ওইরকম!

বেশ কৌতুক অনুভব করে ইনস্পেকটর। বলে, তা অবশ্য ঠিক বলেছেন। বর্ণনার সঙ্গে ডক্টর ওয়াটসনের চেহারাই খাপ খেয়ে যাচ্ছে।

হোমস বললে, লেসট্রেড এযাত্রা তোমাকে সাহায্য করতে পারব বলে মনে হয় না আমার। ব্যাপার কি জান, মিলভারটন লোকটাকে আমিও জানতাম। লন্ডনের সবচেয়ে বিপজ্জনক লোকদের মধ্যেই তাকে স্থান দিয়েছিলাম আমি এবং আমি মনে করি, এমন কতকগুলো অপরাধ আছে সংসারে আইন যাদের স্পর্শ করতে পারে না। কাজেই, প্রকারান্তরে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা অনুমোদন করা যায় এসব ক্ষেত্রে। না, না তর্ক করে লাভ নেই। আমার মন স্থির হয়ে গেছে। নিহতের জন্যে নয়, হত্যাকারীদের জন্যে রইল আমার সহানুভূতি এবং এ-কেসে আমি নাক গলাব না।

যে শোচনীয় দৃশ্য চোখের সামনে দেখলাম, সে-সম্বন্ধে হোমস আমাকে একটা কথা বলেনি। কিন্তু সারাটা সকাল তাকে খুবই চিন্তামগ্ন দেখলাম। শূন্যগর্ভ দৃষ্টি আর নিবিড় তন্ময়তা দেখে মনে হল সে যেন একাগ্র মনে হারিয়ে যাওয়া কিছুকে স্মরণপথে আনবার চেষ্টা করছে। লাঞ্চ খেতে বসে অর্ধেক এগিয়েছি, এমন সময়ে আচমকা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল সে। তারপরই চিৎকার, সর্বনাশ! পেয়েছি! টুপি নাও! এসসা আমার সঙ্গে। লম্বা লম্বা পা ফেলে যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে ও বেকার স্ট্রিট পেরিয়ে এসে অক্সফোর্ড বরাবর গিয়ে পড়ল রিজেন্ট সার্কাসে। এখানে বাঁ-দিকের একটা দোকানের জানলায় সাজানো ছিল ওই সময়কার বহু খ্যাতনামা ব্যক্তি আর সুন্দরীদের ফটোগ্রাফ। হোমসের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল একটা ছবির ওপর। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আমি দেখলাম রানির মতো গরবিনি এক মহিলার ফটোগ্রাফ। পরনে রাজসভার পরিচ্ছদ, সুগঠিত মাথায় মস্ত বড়ো হিরের টায়রা। আভিজাত্য যেন ঠিকরে পড়ছিল তার সর্ব অঙ্গে, হুকের মতো সুচারু বঙ্কিম নাকে, ধারালো ভুরুযুগলে, পাতলা অধরোষ্ঠে, আর ছোটো কিন্তু দৃঢ় থুতনিতে। তারপরেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এল আমার। যুগ যুগ ধরে সম্মানিত সুপ্রাচীন উপাধিটা দেখেই বুঝলাম কার স্ত্রী ছিলেন ইনি। অভিজাতমহলে কুলে-মানে শ্রেষ্ঠ এই সম্রান্ত রাজনীতিবিদের নাম কে-না জানে। হোমসের চোখে চোখ রাখতেই ও ঠোঁটে আঙুল চাপা দিয়ে আমাকে নিয়ে সরে এল জানলার সামনে থেকে।

——–

টীকা

১. ভাংচি দেওয়ার ভয়ঙ্কর কাহিনি : দি অ্যাডভেঞ্চার অব চার্লস অগাস্টাস মিলভারটন ২৬ মার্চ ১৯০৪ সংখ্যার কলিয়ার্স ম্যাগাজিনে এবং এপ্রিল ১৯০৪ সংখ্যার স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯১০-এ রচিত দ্য স্পেকলড ব্যান্ড নাটকে আর্থার কন্যান ডয়াল এই ব্ল্যাকমেলার চরিত্রটিকে রেখেছিলেন।

হ্যাম্পস্টেড : বর্তমানে ক্যামড়েনের অন্তর্গত বসবাসের এলাকা। এখানকার বিখ্যাত বাসিন্দাদের মধ্যে জন কিটস, কার্ল মার্কস প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

চিড়িয়াখানা : বেকার স্ট্রিটের টিউব রেলস্টেশনের এক মাইলের কম দূরত্বে রিজেন্ট পার্কের একাংশে লন্ডনের চিড়িয়াখানা অবস্থিত। জিয়োলজিকাল সোসাইটির উদ্যোগে ১৮২৮ সালে এই চিড়িয়াখানা প্রতিষ্ঠিত হয়।

মি. পিকউইক : চার্লস ডিকেন্স রচিত উপন্যাস, ১৮৩৭-এ প্রকাশিত, দ্য পিকউইক পেপার্স-এর প্রধান চরিত্র, সরল, সাদাসিধে, ধর্মভীরু মানুষ, মি. পিকউইক।

অনেক দূর গড়িয়েছ : কত দূর? একেবারে গভীরতম শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত? আশঙ্কা করেছেন ডেভিড গেলারস্টিন, রিচার্ড আশার, ডি. মার্টিন ডেকিন প্রমুখ গবেষক।

উধাও হয়ে গেলেন প্রতিহন্তা বাইরে অন্ধকারে : বাইরের ওই পথে পালাতে গিয়ে হোমস এবং ওয়াটসনকে পার হতে হয়েছিল ছয় ফুট পাঁচিল। ভিক্টোরীয় যুগের বেশবাসে ওই মহিলা নিশ্চয়ই সে-পথে যাননি। তাহলে কোন পথে পালালেন তিনি? প্রশ্ন তুলেছিলেন হোমস গবেষক ডি. মার্টিন ডেকিন।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত