প্রশ্নপত্রের পলায়ন
[দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য থ্রি স্টুডেন্টস]
১৮৯৫ সাল। একসঙ্গে অনেকগুলো ঘটনার চাপে পড়ে মি. শার্লক হোমস এবং আমাকে কয়েক হপ্তা একটি বিশ্ববিদ্যালয় শহরে থাকতে হয়েছিল। এইখানেই এক সন্ধ্যায় এক পরিচিত ভদ্রলোক দেখা করতে এলেন আমাদের সঙ্গে। ভদ্রলোকের নাম মি. হিলটন সোমস, কলেজ অফ সেন্ট লিউকস-এর শিক্ষক এবং লেকচারার। রোগাটে লম্বা। নার্ভাস প্রকৃতির এবং একটুতেই উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু সেদিন তার মধ্যে এমনই অদম্য উত্তেজনার লক্ষণ দেখলাম যে, বুঝতে অসুবিধে হল না বেজায় অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে।
মি. হোমস, আমার বিশ্বাস আপনার মূল্যবান সময়ের কয়েকটি ঘণ্টা আমার জন্য ব্যয় করবেন। সেন্ট লিউকস-এ একটা বড়ো বিশ্রী কাণ্ড ঘটেছে। সৌভাগ্যক্রমে এ-শহরে আপনি এখন উপস্থিত রয়েছেন। তা না হলে আমি তো ভেবেই পেতাম না যে, এ-পরিস্থিতিতে কী করা উচিত আমার।
আগেই একটা জিনিস খোলসা করে রাখি আপনার কাছে। আগামীকালই ফর্টেক্স স্কলারশিপ পরীক্ষার প্রথম দিন। পরীক্ষকদের মধ্যে আমিও আছি। আমার বিষয় গ্রিক। ফার্স্ট পেপারে ছাত্রদের অদেখা একটি মস্তবড়ো প্যাসেজ থাকে গ্রিক থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের জন্য। পরীক্ষার খাতাতেই ছাপা থাকে এই প্যাসেজটা। কাজেই কোনো পরীক্ষার্থী যদি আগে থেকেই প্যাসেজটা তৈরি করে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে স্বভাবতই বিলক্ষণ সুবিধে হয় তার। এই কারণেই কাগজটাকে গোপন রাখার জন্য দারুণ সাবধানতা অবলম্বন করা হয়।
আজকে প্রায় তিনটের সময়ে কাগজটারপ্রুফ এসে পৌঁছোয় ছাপাখানা থেকে। থিউসিডাইডিজ-এর আধখানা পরিচ্ছেদ তুলে দেওয়া হয়েছে তরজমার জন্যে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্যাসেজটা পড়তে হয় আমায়, কেননা তা অক্ষরে অক্ষরে নির্ভুল থাকা দরকার। সাড়ে চারটার সময়েও শেষ হল না আমার কাজ। এক বন্ধুর বাড়িতে চা-পানের কথা ছিল। তাই প্রুফটা টেবিলের ওপর রেখে বেরিয়ে গেলাম। আমি। ঘন্টাখানেকেরও বেশি হবে বাইরে ছিলাম। আপনি তো জানেন, মি. হোমস, আমদের কলেজের দরজাগুলো ভেতর বাইরে দু-রকম হয়। ভেতর দিকে থাকে সবুজ রঙের পুরু পশমি কাপড়ের আবরণ। আর বাইরের দিকে ভারী ওক কাঠের পাল্লা। বাইরের দরজার দিকে এগুতেই অবাক হয়ে গেলাম চাবির গর্ত থেকে একটা চাবি ঝুলতে দেখে। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তোবা ভুলে ফেলে গেছি আমি। কিন্তু পকেটে হাত দিয়ে দেখি, তা তো নয়। যতদূর আমি জানি, ঘরের দোসরা চাবি থাকে শুধু একজনের কাছেই এবং সে আমার পরিচারক ব্যানিস্টার। আজ দশ বছর হল ব্যানিস্টার আমার সব কিছু দেখাশুনা করে আসছে এবং তার সততা সম্বন্ধে তিলমাত্র সন্দেহ আমার জাগে না। দেখলাম, চাবিটা তারই বটে। আমি চা পান করব কি না, তা জিজ্ঞেস করার জন্যেই ঘরে ঢুকেছিল ও। তারপর বেরিয়ে আসার সময়ে ভুল করে চাবিটা রেখে এসেছে দরজায়। অত্যন্ত অসাবধানীর মতো কাজ। আমি বেরিয়ে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিশ্চয় এসেছিল ও ঘরের মধ্যে। চাবি সম্বন্ধে ওর এতটা ভুল হওয়াটা অন্য সময় হলে কোনোরকম ক্ষতিকর ছিল
এবং তাতে এমন কিছু যেত আসত না। কিন্তু আজকের দিনে এই সামান্য ভুলের পরিণাম কী নিদারুণ শোচনীয়, তা কহতব্য নয়।
টেবিলের দিকে চোখ পড়তেই বুঝলাম কে যেন আমার কাগজপত্র হাতড়ে গেছে তাড়াহুড়ো করে। লম্বা লম্বা তিনটে স্লিপ কাগজে প্রুফটা এসেছিল। তিনটে কাগজই একসঙ্গে রেখে গেছিলাম আমি। কিন্তু এখন দেখলাম, একটা কাগজ পড়ে মেঝের ওপর, একটা জানলার পাশে রাখা সাইড-টেবিলের ওপর, আর তৃতীয়টা আমি যেখানে রেখে গেছিলাম ঠিক সেখানেই!
এই প্রথম নড়েচড়ে বসল হোমস।
প্রথম পাতাটা মেঝের ওপর, দ্বিতীয়টা জানলার কাছে, আর তৃতীয়টা যেখানে রেখে গেছিলেন সেখানেই? বলল সে।
এগজ্যাক্টলি, মি. হোমস। তাজ্জব ব্যাপার। আপনি কী করে জানলেন?
দয়া করে আপনার রীতিমতো ইন্টারেস্টিং কাহিনির বাকিটুকু বলে ফেলুন।
ক্ষণিকের জন্য ভেবেছিলাম, বুঝি-বা ব্যানিস্টারই এই ক্ষমাহীন অপরাধটি করেছে। আমার অবর্তমানে খুশিমতো নাড়াচাড়া করে দেখেছে আমার কাগজপত্র। কিন্তু সে তা অস্বীকার করলে। তার সুগভীর ঐকান্তিকতা দেখে বুঝলাম, সত্য বই মিথ্যে বলেনি সে। তাহলে বিকল্প অনুমান দাঁড়াচ্ছে এই এদিক দিয়ে কেউ যেতে যেতে দরজায় চাবি ঝুলতে দেখেছিল। সে জানত আমি ঘরে নেই। তাই ভেতরে ঢুকেছিল আমার কাগজপত্রে চোখ বুলিয়ে নিতে। বিপুল অঙ্কের অর্থ জলে যেতে বসেছে মি. হোমস। স্কলারশিপটা বাস্তবিকই ভারি মূল্যবান। কাজে কাজেই, ন্যায় অন্যায় যে বোঝে না, অধর্ম-ভয়ে যে ঘাবড়ায় না, সে যদি অন্যান্য ছাত্রদের ওপর টেক্কা মারার বদ মতলবে এ-ঝুঁকি নেয় তো আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
এ-ঘটনায় দারুণ বিচলিত হয়ে পড়েছে ব্যানিস্টার। যখন দেখলাম সত্যি সত্যিই আমার কাগজপত্র সে ঘাঁটাঘাঁটি করে গেছে এবং এ-সম্বন্ধে যখন কোনো সন্দেহই আর রইল না, তখন তো ব্যানিস্টার প্রায় অজ্ঞান হয় হয় এমনি অবস্থা। খানিকটা ব্র্যান্ডি দিলাম ওকে। আধমরার মতো ও জবুথবু হয়ে বসে রইল একটা চেয়ারে। আর আমি আবার বেশ তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করলাম ঘরটাকে। তখনই দেখলাম, এদিকে সেদিকে ছড়ানো কাগজ ছাড়াও আগন্তুক তার অনধিকার প্রবেশের আরও কিছু চিহ্ন রেখে গেছে ঘরের মধ্যে। জানলার কাছে টেবিলের ওপর পেনসিলের কাটা কাঠের কুটো দেখে বুঝলাম একটা পেনসিল ছুঁচোলো করা হয়েছিল সেখানে। একটা ভাঙা শিসও পড়ে ছিল টেবিলের ওপর। অর্থাৎ, রাসকেলটা বেজায় তাড়াহুড়ো করে কাগজটাকে নকল করতে গিয়ে পেনসিলের শিস ভেঙে ফেলে। কাজেই বাধ্য হয়ে পেনসিল ছুলে আবার নতুন শিস বার করে নিতে হয় তাকে।
এক্সেলেন্ট। বলে ওঠে হোমস। কেসটার বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে যতই তন্ময় হয়ে যাচ্ছিল ও, ততই শরিফ হয়ে উঠেছিল বিগড়োনো মেজাজ। ভাগ্য আপনার সহায়।
এই সব নয়, মি. হোমস, আরও আছে। আমার লেখার টেবিলটা নতুন। পাতলা মসৃণ লাল চামড়া দিয়ে ঢাকা ওপরটা। শুধু আমি নয়। ব্যানিস্টারও আমার সুরে সুর মিলিয়ে শপথ করে বলতে রাজি আছে যে মোলায়েম চামড়ার ওপরে এতটুকু আঁচড় বা দাগ কোনোদিনই ছিল না। কিন্তু এখনও দেখলাম, প্রায় ইঞ্চি তিনেকের মতো লম্বা একটা পরিষ্কার কাটা। নিছক আঁচড়ের দাগ নয়, সত্যিকারের কাটা। শুধু তাই নয়। টেবিলের ওপর কাদা মাটি, খমির বা অন্য কোনো নরম পদার্থের একটা ছোট্ট বলও পেলাম। বলটার গায়ে ফুটকি দাগ দেখে করাতচেরা কাঠের গুঁড়ো বলে মনে হল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে-লোকটা আমার কাগজপত্র ঘেঁটে গেছে, এসব চিহ্ন তারই। পায়ের ছাপ বা লোকটাকে শনাক্তকরণের অন্য কোনো প্রমাণাদি পেলাম না ঘরে। দেখেশুনে আমার বুদ্ধিশুদ্ধি তত বেবাক গুলিয়ে গেল। কিন্তু আপনি যে এই শহরেই এখন রয়েছেন, তা আচমকা মনে পড়তেই আশার আলো দেখলাম। তাই সিধে চলে এসেছি এ-কেস আপনার হাতে তুলে দিতে।
দাঁড়িয়ে উঠে ওভারকোটটা গায়ে চাপিয়ে নিয়ে হোমস বললে, এ-ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে পারলে সত্যিই খুশি হব আমি। আমার সাধ্যমতো পরামর্শও আমি দেব আপনাকে। কেসটা একেবারেই নিরেস নয়। ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট কিছু আছে। পেপারগুলো আপনার হাতে আসার পর আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে আপনার ঘরে কেউ এসেছিল কি?
হ্যাঁ, এসেছিল। ওই একই তলায় তরুণ ভারতীয় ছাত্র দৌলতরাম থাকে। পরীক্ষা সম্বন্ধে কয়েকটি খুঁটিনাটি খবরাখবর জানতে এসেছিল ও।
পরীক্ষায় সে-ও বসছে?
হ্যাঁ।
পেপারগুলো টেবিলের ওপরেই ছিল, তাই না?
আমার যতদূর বিশ্বাস, গোল করে পাকানো ছিল কাগজগুলো।
কিন্তু প্রুফ বলে চেনা তো যেত?
খুব সম্ভব।
আর কেউ আসেনি?
না।
আর কেউ জানত কি যে আপনার ঘরে প্রুফগুলো আসবে?
ছাপাখানার লোক ছাড়া আর কেউ না।
ব্যানিস্টার জানত কি?
না, না, নিশ্চয় না। কেউ জানত না। বেচারি! খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়ার পর ওই অবস্থাতেই তাকে রেখে পড়ি কি মরি করে ছুটে এসেছি আপনার কাছে।
দরজা খোলা রেখে এসেছেন?
পেপারগুলো আগে তালাচাবি দিয়ে রেখেছি ভেতরে।
তাহলে মি. হোমস ব্যাপারটা মোটামুটি দাঁড়াচ্ছে এই–ভারতীয় ছাত্র দৌলতরাম যদি পাকানো কাগজগুলোকে প্রুফ বলে চিনে না-থাকে, তাহলে যে-লোকটা কাগজগুলো ঘেঁটেছে সে কিন্তু কাগজগুলো যে ওখানে আছে তা না-জেনেই দৈবাৎ ঢুকে পড়েছিল ঘরের ভেতর।
আমারও তাই মনে হয়।
প্রহেলিকা-আবিল দুর্বোধ্য হাসি হাসল হোমস।
বলল, চলুন, ঘুরে আসা যাক এক চক্কর। এ কিন্তু তোমার কেস নয়, ওয়াটসন–মানসিক ব্যাপার, শরীর ঘটিত নয়। বেশ, বেশ, ইচ্ছে হলে চলে এসো। মি. সোমস–আমরা প্রস্তুত!
আমাদের মক্কেল ভদ্রলোকের বসার ঘরের লম্বা, কিন্তু নীচু জাফরিকাটা জানলার পরেই প্রবীণ কলেজের গাছ-শ্যাওলার ছোপ ছোপ দাগ কলঙ্কিত সুপ্রাচীন প্রাঙ্গণটা। গথিক প্যাটার্নের খিলানওলা দরজার পরেই ক্ষয়ে আসা পাথরের সিঁড়ির সারি। একতলায় মি. সোমসের ঘর। আর ওপরের তিনতলায় এক এক তলায় এক একজন ছাত্রের ঘর। এহেন হেঁয়ালি-দৃশ্যে যখন পৌঁছোলাম, তখন গোধূলির ম্লান আলো ছড়িয়ে পড়েছে ধরিত্রীর বুকে। তারপর আরও কাছে এগিয়ে গিয়ে পায়ের আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে উঠে সারস পাখির মতো গলা লম্বা করে তাকাল ঘরের ভেতর।
আমাদের পণ্ডিত পথপ্রদর্শক ভদ্রলোক বললেন, নিশ্চয় দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিল লোকটা। কেননা কাচের শার্সিতে একটিমাত্র কাচ, তা ছাড়া আর প্রবেশপথ নেই।
কী বিপদ? বলে ওঠে হোমস। তারপর মি. সোমসের পানে তাকিয়ে কীরকম যেন আশ্চর্যভাবে হেসে ওঠে।বেশ, বেশ, এখানে যদি কিছু না পাওয়া যায় তো চলুন, আমরা বরং ভেতরে যাই।
চাবি ঘুরিয়ে বাইরের দরজাটা খুলে ফেললেন লেকচারার, তারপর সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন ভেতরে। প্রবেশপথেই দাঁড়িয়ে গেলাম আমরা। আর কার্পেটটা পরীক্ষা করতে শুরু করলে হোমস।
বললে, উঁহু, এখানে কোনো চিহ্ন দেখছি না। এ-রকম শুকনো খটখটে দিনে আশা করাও অন্যায়। আপনার পরিচারক মনে হচ্ছে বেশ সামলে নিয়েছে। ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে আপনি বেরিয়ে পড়েছিলেন বললেন। কোন চেয়ারটা বলুন তো?
জানলার পাশেরটা।
বটে। ছোট্ট এই টেবিলের কাছে, এখন ভেতরে আসতে পারেন আপনারা। কার্পেট দেখা সাঙ্গ হয়েছে আমার। এবার সবার আগে এই ছোটো টেবিলটা নিয়ে পড়া যাক। ঘটনা পরম্পরাগুলো কিন্তু জলের মতোই দিব্যি পরিষ্কার। লোকটা ঘরে ঢুকে মাঝখানের টেবিল থেকে কাগজগুলো তুলে নেয়। একেবারেই সবগুলো নয়–প্রতিবারে একটি তাড়া। কাগজগুলো নিয়ে যায় সে জানলার ধারে টেবিলটার কাছে এই উদ্দেশ্যে যে, উঠোনের মাঝ দিয়ে আপনাকে আসতে দেখলেই সে সটকান দিতে পারবে অনায়াসে।
সোমস বললেন, প্রকৃতপক্ষে সে তা পারত না। কেননা, আমি পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলাম।
আ, তা বেশ! সে যাই হোক, এই অভিসন্ধিই ছিল তার মনে। এবার দেখা যাক স্লিপ কাগজগুলো। আঙুলের ছাপ নেই—নাঃ! আচ্ছা, এইটাই সে প্রথমে নিয়ে যায় জানলার কাছে, নকলও করে ফেলে। সবরকমের সম্ভাবনা অল্পীকরণ পন্থা কাজে লাগিয়েও এটা কপি করতে তার কতক্ষণ লাগা উচিত? মিনিট পনেরো তো বটেই, তার কম নয় কিছুতেই। প্রথমটা হয়ে যেতেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তুলে নিলে পরেরটা। এই নিয়েই যখন সে ব্যস্ত, ঠিক তখনই এসে পড়লেন আপনি। বেজায় ত্বরিতগতিতে বিদ্যুতের মতো গা ঢাকা দিতে হল তাকে। মনে রাখবেন, খুব তাড়াতাড়ি, অতি দ্রুতবেগে তাকে অন্তর্হিত হতে হয়েছে। কেননা, কাগজগুলো ছড়ানো অবস্থায় পড়ে থাকা মানেই যে তার উপস্থিতি আপনাকে জানিয়ে দেওয়া–তা সত্ত্বেও সে পেপারগুলো টেবিলের ওপর যথাস্থানে রেখে যেতে পারেনি, রাখার সময় পায়নি। দরজার সামনে পৌঁছে সিঁড়ির ওপর খুব দ্রুত পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন কি?
না। এ-বিষয়ে বিশেষ সজাগ ছিলাম না আমি।
যাই হোক, ঝড়ের মতো লিখতে গিয়ে পেনসিলের শিস ভেঙে ফেলে সে। আপনি তো লক্ষ করেছেন, আবার পেনসিল ছুলে ছুঁচোলো করতে হয়েছে তাকে। পয়েন্টটা কিন্তু ভারি চিত্তাকর্ষক, ওয়াটসন। পেনসিলটা সাধারণ পেনসিল নয়। আর পাঁচটা পেনসিলের মতোই এর সাইজ। নরম শিস। বাইরের রংটা গাঢ় নীল। রুপোলি অক্ষরে লেখা নির্মাতার নাম। অনেক ব্যবহারের পর, তার এখনকার দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে দেড় ইঞ্চি। মি. সোমস, এইরকম একটা পেনসিলের সন্ধানে থাকুন, তাহলেই যাকে খুঁজছেন তার হদিশ আপনি পেয়ে যাবেন। এইসঙ্গে আরও একটু জুড়ে দিই–বড়ো সাইজের বেজায় ভোতা, একটা ছুরিও পাবেন লোকটার কাছে। আপনার আরও সুবিধে হয়ে গেল, মি. সোমস।
মি. সোমস তখন তথ্যের এহেন বন্যায় বেশ খানিকটা অভিভূত হয়ে পড়েছেন। অন্যান্য পয়েন্টগুলো না হয় বুঝলাম। কিন্তু দৈর্ঘ্য সম্পর্কে যা বললেন—
ছোট্ট একটা কুচো তুলে নিলে হোমস। কুচোটার ওপর NN অক্ষর দুটি লেখা এবং তারপরে খানিকটা কাঠ একদম ফাঁকা।
দেখছেন তো?
না, দেখছি না, এখনও আমি বুঝতে পারছি না—
ওয়াটসন, চিরকালই তোমার ওপর অবিচার করে এসেছি আমি। এদিক দিয়ে তুমি একলা নও, আরও অনেকে আছেন। এই NN অক্ষর দুটো কী হতে পারে বলো তো? একটা শব্দের শেষের দুটো অক্ষর। তুমি তো জান JOHANN FABER হচ্ছে সবচেয়ে নামকরা পেনসিলনিৰ্মাতার নাম। JOHANN শব্দটার পর সাধারণত পেনসিলের কতখানি অংশ অবশিষ্ট থাকে, তা অনুমান করা কি খুব কঠিন? ছোটো টেবিলটাকে কাত করে বৈদ্যুতিক বাতির দিকে ফিরিয়ে ধরলে হোমস। ভেবেছিলাম, যে-কাগজে সে লিখেছে, তা যদি পাতলা হত, তাহলে পেনসিলের চাপে কিছু কিছু চিহ্ন ফুটে উঠত পালিশ করা চকচকে টেবিলের ওপর। নাঃ, তেমন কিছুই দেখছি না। এখানে আর কিছু জানা যাবে বলে তো মনে হয় না আমার। এবারে মাঝখানের টেবিলটা। কাদামাটি বা নরম পদার্থের এই ছিটে গুলির মতো বলটার কথাই আপনি বলছিলেন, তাই না? আকারে মোটামুটি পিরামিডের মতো। হুঁ, ভেতরটা প্রায় পা। ঠিকই বলছেন, মি. সোমস, করাত চেরা কাঠের গুঁড়োর মতোই কয়েকটা কণা দেখা যাচ্ছে বটে। সর্বনাশ এ তো দেখছি দারুণ ইন্টারেস্টিং জিনিস। আর এই কাটাটা–বটে, দেখছি সত্যি সত্যিই ছিঁড়ে দু-ভাগ হয়ে গেছে চামড়াটা। শুরু হয়েছে পাতলা আঁচড় দিয়ে, শেষ হয়েছে খাঁজকাটা গর্তে। এ-কেসে আমার মনোেযোগ আকর্ষণ করার জন্যে আপনার কাছে আমি বিশেষ কৃতজ্ঞ, মি. সোমস। এ-দরজা দিয়ে যাওয়া যায় কোথায়?
আমার শোবার ঘরে।
আপনার অ্যাডভেঞ্চারের পর ও-ঘরে আর গিয়েছিলেন?
না। সিধে চলে গেছি আপনার কাছে।
ভেতরটা একবার চোখ বুলিয়ে নিতে চাই। বাঃ, ভারি সুন্দর ঘর তো! দিব্যি সেকেলে কায়দায় সাজানো! মেঝে পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মিনিটখানেকের জন্য সবুর করবেন নিশ্চয়। এ-পর্দাটা কীসের? পেছনে পোশাক-টোশাক বুঝি? এ-ঘরে যদি কেউ লুকোতে চায়, তাহলে তার আদর্শ স্থান হল এইখানটা। কেননা বিছানাটা দারুণ নীচু, পোশাক রাখার আলমারিটাও বেজায় পাতলা। কেউ নেই বলেই তো মনে হয়, তাই না?
পর্দাটা টেনে সরিয়ে দিলে হোমস। আমি কিন্তু ওর সামান্য শক্ত হয়ে ওঠা আর ভাবভঙ্গির সজাগ সতর্কতা দেখেই বুঝেছিলাম আচমকা কারো বেরিয়ে আসার জন্যে প্রস্তুত হয়েই তবে পর্দায় হাত দিয়েছে ও। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, পর্দা সরানোর পর আলনা থেকে ঝোলানো তিন-চারটে সুট ছাড়া আর কারো টিকিটিও দেখা গেল না ওই স্বল্প পরিসরের মধ্যে। ঘুরে দাঁড়াল হোমস। তার পরেই হঠাৎ ঝুঁকে পড়ল মেঝের ওপর। আরে! আরে! এটা কী? বলে ওঠে ও।
জিনিসটা একটা ছোট্ট পিরামিড। কালো রঙের পুটিন জাতীয় উপাদানে তৈরি। পড়াশুনা করার ঘরে টেবিলের ওপর যে পিরামিডটি পাওয়া গেছে, হুবহু সেইরকম। হাতের তালুর ওপর জিনিসটা রেখে প্রখর বিদ্যুৎ বাতির নীচে ধরল হোমস।
আগন্তুক শুধু আপনার বসবার ঘরেই নয়, মি. সোমস, শোবার ঘরেও তার আগমনের চিহ্ন রেখে গেছে দেখছি।
কিন্তু এখানে তার কী দরকার?
আমার তো মনে হয় তা অনুমান করা মোটেই কঠিন নয়। অপ্রত্যাশিত পথে দুম করে ফিরে এলেন আপনি। কাজে কাজেই আপনি একেবারে দোরগোড়ায় না-এসে পৌঁছানো পর্যন্ত হুঁশিয়ার হওয়ার মতো কোনো নিশানাই পেল না সে। এক্ষেত্রে কী করা উচিত তার? যে যে জিনিসগুলো তাকে ধরিয়ে দেবে, সেইগুলোই দু-হাতে তুলে নিয়ে তিরবেগে ঢুকে পড়ল সে আপনার শোবার ঘরে গা-ঢাকা দেওয়ার অভিপ্রায়ে।
হে ভগবান! মি. হোমস, আপনি কি তাহলে বলেন, যতক্ষণ ব্যানিস্টারের সঙ্গে ও-ঘরে আমি কথা বলছিলাম, ততক্ষণ আসল লোকটা ঘাপটি মেরে ছিল এ-ঘরে, আর আমি তার কিছুই
জানতে পারিনি?
তাই তো দেখছি।
নিশ্চয় আর একটা বিকল্প আছে, মি. হোমস? আমার শোবার ঘরের জানলাটা লক্ষ করেছেন কি?
জাফরিকাটা, কাচের শার্সিওলা, সিসের ফ্রেম, তিনটে আলাদা আলাদা জানলা, একটায় কবজা লাগানো এবং এত বড়ো যে অনায়াসেই একজন মানুষ ঢুকতে পারে।
এগজ্যাক্টলি। উঠোনের দিকে কোণ করে থাকায় জানলার খানিকটা প্রায় অদৃশ্য থাকে বললেই চলে। ওই দিক দিয়েই লোকটা ঢুকেছিল ভেতরে। শোবার ঘরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময়ে কিছু কিছু চিহ্ন রেখে যায় ঘরের মধ্যে। সবশেষে, দরজাটা খোলা পেয়ে লম্বা দেয় সেই পথেই।
অসহিষ্ণুভাবে মাথা নাড়তে লাগল হোমস।
বললে, এবার একটু প্র্যাকটিক্যাল হওয়া যাক। আপনি তো বললেন না, তিনজন ছাত্রই এ-সিঁড়ি ব্যবহার করে বলে প্রায় তাদের যাতায়াত করতে হয় আপনাদের দরজার সামনে দিয়ে, তাই তো?
হ্যাঁ, তাই।
তিনজনেই পরীক্ষায় বসছে?
হ্যাঁ।
তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাউকে সন্দেহ করার কোনো কারণ আপনার আছে কি?
ইতস্তত করতে লাগল সোমস।
তারপর বললে, এ বড়ো জবর প্রশ্ন করলেন, মি. হোমস মহা পরে ফেললেন আমায়। প্রমাণাদির বালাই যেখানে নেই, সেখানে চট করে কেউ কি কাউকে সন্দেহ করতে চায়?
সন্দেহই শোনা যাক। প্রমাণ খোঁজার ভার আমার।
তাই যদি হয় তো সংক্ষেপে কয়েকটি কথায় তিন ঘরের তিন বাসিন্দার চরিত্র বর্ণনা করেছি। নীচের তলায় থাকে গিলক্রাইস্ট, ছাত্র হিসাবে ভালো। খেলোয়াড় হিসাবেও সুনাম আছে। কলেজের রাগবি আর ক্রিকেট টিমে খেলে। হার্ডলস অর লং জাম্পে ব্লু হয়েছে। চমৎকার ছেলে সে, সব দিক দিয়ে পুরুষের মতো। রেসকোর্সে যিনি সর্বস্বান্ত হয়েছেন, সেই কুখ্যাত স্যার জাবেজ গিলক্রাইস্ট ওর বাবা। ছেলে কিন্তু খুবই গরিব। তাহলেও সে কঠোর পরিশ্রমী আর অধ্যবসায়ী। পরীক্ষায় ওর ফলাফল ভালোই হবে।
দোতলায় থাকে ভারতীয় ছাত্র দৌলতরাম। ছেলেটি শান্তশিষ্ট দুর্বোধ্য এবং আগাগোড়া রহস্যময়। সব ভারতীয়ই যা হয়, তাই আর কি। পড়াশুনায় সে ভালোই, যদিও সব সাবজেক্টের মধ্যে গ্রিকেই সে কাঁচা। অটল তার চরিত্র এবং কাজকর্মও বেশ পদ্ধতিমাফিক।
ওপরের তলাটা মাইলস ম্যাকলারেনের। কোনো কাজ যদি করবে বলে মনে করে তো ধীশক্তির দিক দিয়ে তার জুড়ি মেলা ভার। এই ইউনিভার্সিটির উজ্জ্বলতম প্রতিভাদের অন্যতম সে। কিন্তু সে চঞ্চলচিত্ত, উচ্ছঙ্খল আর নীতিহীন। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময়ে তাস খেলা নিয়ে একটি কেলেঙ্কারি হওয়ায় কলেজ থেকে নাম কাটিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এবারের পুরো পাঠক্রমটা সে ফাকি দিয়েছে। কাজেই নিশ্চয় এ-পরীক্ষা একটা বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কাছে।
তাহলে একেই আপনি সন্দেহ করেন বলুন?
অতদূর যাওয়ার সাহস আমার নেই! তবে তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে কম সন্দেহ যদি কাউকে করতে হয়, তাহলে সে হয়তো মাইলস ম্যাকলারেন নয়।
এগজ্যাক্টলি। মি. সোমস এবার আপনার পরিচারক ব্যানিস্টারকে একটু দেখতে চাই।
লোকটা আকারে ছোটোখাটো। সাদাটে, পরিষ্কার কামানো মুখ। ধোঁয়াটে রঙের কঁচাপাকা চুল। বছর পঞ্চাশ বয়স। রোজকার অচঞ্চল জীবনধারায় এই আকস্মিক উৎপাতের যন্ত্রণায় তখনও কষ্ট পাচ্ছিল সে। স্নায়বীয় দুর্বলতার জন্যে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছিল তার গোলগাল মুখ। হাতের আঙুলগুলো পর্যন্ত স্থির রাখতে পারছিল না বেচারি।
মি. সোমস বললেন, এই যাচ্ছেতাই ব্যাপারটার একটা বিহিত করা দরকার, তাই আমরা তদন্ত শুরু করেছি, ব্যানিস্টার।
ইয়েস, স্যার।
হোমস বললে, শুনলাম দরজায় চাবি ফেলে গেছিলে তুমি?
ইয়েস, স্যার।
যেদিন পেপারগুলো ঘরের মধ্যে এল, ঠিক সেইদিনই চাবি খুলে নিতে ভুলে গেলে তুমি যোগাযোগটা কি খুব অসাধারণ ঠেকছে না?
আমার কপাল মন্দ, স্যার। কিন্তু এর আগেও মাঝে মাঝে এমন ভুল আমার হয়েছে।
ঘরে ঢুকেছিলে কখন?
সাড়ে চারটা নাগাদ। মি. সোমসের চা-পানের সময় তখন।
কতক্ষণ ছিলে ঘরের ভেতর?
উনি ঘরে নেই দেখে তখুনি বেরিয়ে যাই আমি।
টেবিলের ওপর রাখা পেপারগুলো লক্ষ করেছিলে?
না, স্যার, মোটেই করিনি।
দরজা থেকে চাবি খুলে নিতে ভুলে গেলে কেমন করে?
আমার হাতে চায়ের ট্রে ছিল। ভাবলাম, ফিরে এসে নিয়ে যাব চাবিটা। তারপর ভুলে গেছি।
বাইরের দরজায় কি স্প্রিংয়ের তালা লাগানো আছে?
না, স্যার।
তাহলে সর্বক্ষণই খোলা ছিল দরজাটা?
ইয়েস, স্যার।
মি. সোমস ফিরে এসে তোমাকে যখন ডেকে পাঠান, তখন তুমি বিচলিত হয়ে পড়েছিলে?
ইয়েস, স্যার। এত বছর এখানে আছি। কিন্তু এরকম ঘটনা তো কোনোদিন ঘটেনি। প্রায় জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা হয়েছিল আমার।
তা তো বটেই। যখন বুঝলে শরীর খারাপ লাগছে, তখন কোনখানটায় ছিলে তুমি?
কোনখানে ছিলাম স্যার? কেন এইখানে দরজার পাশেই।
ভারি আশ্চর্য ব্যাপার তো! এতটা পথ গিয়ে দূরের কোণে ওই চেয়ারটায় বসেছিলে কিনা, তাই বললাম। মাঝের এ-চেয়ারে বসলে কেন শুনি?
জানি না স্যার। বসার জায়গা নিয়ে তখন আমি এত ভাবিনি।
এ-ব্যাপারে ও যে বিশেষ কিছু জানে, তা আমার সত্যি সত্যিই মনে হয় না, মি. হোমস। খুব অসুস্থ দেখাচ্ছিল ওকে–ছাইয়ের মতো একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল।
মি. সোমস চলে যাওয়ার পর এ-ঘরে ছিলে তুমি?
মিনিটখানেকের জন্যে ছিলাম। তারপর দরজায় তালা দিয়ে নিজের ঘরে চলে যাই আমি।
কাকে সন্দেহ হয় তোমার?
কারো নাম করার আমার সাহস হয় না স্যার। এ ধরনের নোংরা কাজ করে লাভবান হওয়ার মতো প্রবৃত্তি এ-ইউনিভার্সিটিতে কোনো ভদ্রলোকের আছে বলে মনে হয় না আমার। না, স্যার, আমার তা বিশ্বাস হয় না।
ধন্যবাদ। ওতেই হবে। বললে হোমস। ওহো, আরও একটা কথা। এই যে তিনজন ভদ্রলোকের দেখাশুনা কর তুমি, ওদের কাউকে বলনি তো এখান থেকে কিছু খোয়া গেছে?
না, স্যার, একটা অক্ষরও বলিনি।
ওদের কারো সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না, স্যার।
বেশ, বেশ। এবার অনুমতি করেন তো চত্বরটা এক পাক ঘুরে আসা যাক।
সন্ধ্যার বিষণ্ণ আঁধার গাঢ় হয়ে আসছিল। তারই মাঝে তিনটে হলুদ রঙের চৌকোনা আলো ঝকমক করছিল আমাদের মাথার ওপরে।
ওপরে তাকিয়ে হোমস বললে, আপনার তিনটে পাখিই দেখছি নিজের নিজের বাসায় রয়েছে। আরে! আরে! ও কী! ওদের একজন তো দারুণ অশান্তিতে ছটফট করছে মনে হচ্ছে?
পর্দার ওপর আচমকা ভেসে উঠল ভারতীয় ছাত্রের কুচকুচে কালো ছায়া। দ্রুত পদক্ষেপে ঘরের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত পায়চারি জুড়েছিল সে।
হোমস বললে, ওদের প্রত্যেকের ঘরে একবার ঝাঁকি দর্শন দিয়ে আসতে চাই! সম্ভব হবে কি?
সোমস জবাব দিলেন, কোনো অসুবিধে নেই। এ ঘর তিনটে কলেজের সবচেয়ে পুরানো ঘর বলে দর্শনেচ্ছুর আগমনটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। আসুন, আমি নিজেই নিয়ে যাচ্ছি আপনাদের।
গিলক্রাইস্টের দরজায় টোকা মারার সঙ্গেসঙ্গে হোমস বলে উঠল, নাম বলবেন না, প্লিজ! ছিপছিপে চেহারার দীর্ঘতনু একটি যুবাপুরুষ দরজা খুলে দিলে৷ সোনালি রেশমের মতো একমাথা হালকা চুল। আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য শুনে সাদরে অভ্যর্থনা জানালে ভেতরে। মধ্যযুগীয় গার্হস্থ্য স্থাপত্যের কতকগুলি বিচিত্র নিদর্শন ছিল ঘরের মধ্যে। সত্যি সত্যি দেখবার মতো! একটা দেখে হোমস তো এমনই বিমুগ্ধ হয়ে গেল যে তা আঁকতে শুরু করে দিলে নিজের নোটবইয়ের পাতায়। পেনসিলের শিস ভেঙে যাওয়ায় গিলক্রাইস্টের কাছ থেকে একটা পেনসিল ধার চেয়ে নিলে; সবশেষে, একটা ছুরি চেয়ে নিয়ে শানিয়ে নিলে নিজের পেনসিলটা! এই আশ্চর্য দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল ভারতীয়ের ঘরেও। ছেলেটি স্বল্পভাষী, খর্বকায়। হুকের মতো বেঁকানো নাক। আড়চোখে আমাদের কার্যকলাপ লক্ষ করতে লাগল সে। হোমসের স্থাপত্য সম্পর্কিত অধ্যয়ন সমাপ্ত হলে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল! বেশ বুঝলাম, আমাদের বিদায় দিয়ে খুশি হল সে। কিন্তু উভয়ক্ষেত্রেই হোমস যে তার অভীপ্সিত সূত্রের সন্ধান পায়নি, তা পবিষ্কার বুঝতে পারলাম ওর মুখ দেখে। তৃতীয়বার নিষ্ফল হল আমাদের অভিযান। টোকা মারা সত্ত্বেও দরজা খোলা দূরে থাকুক, ভেতর থেকে এমন এক পশলা কদর্য ভাষার বর্ষণ ভেসে এল যে কহতব্য নয়। তুমি যে-ই হও না কেন, পরোয়া করি না। গোল্লায় যাও! গর্জে ওঠে ক্রুদ্ধ কণ্ঠ। কাল আমার পরীক্ষা। আজকে কারো ক্ষমতা নেই আমায় বাইরে বার করে।
অত্যন্ত রুক্ষ ছোকরা, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রাগের চোটে লাল হয়ে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন আমাদের পথপ্রদর্শক। ও অবশ্য জানত না যে আমিই টোকা মেরেছি দরজায়। তাহলে ওর স্বভাবটাই ওইরকম অভব্য, অভদ্র আর এ-রকম অবস্থায় তো বাস্তবিকই সন্দেহজনক।
প্রত্যুত্তরে হোমস যা শুধাল, তা সত্যিই বিচিত্র।
ওর সঠিক উচ্চতাটা বলতে পারেন?
মি. হোমস, তা বলা মুশকিল। ভারতীয় ছাত্রের চেয়ে ও লম্বা বটে, তবে গিলক্রাইস্টের মতো অতটা নয়। আমার তো মনে হয় পাঁচ ফুট ছ-ইঞ্চির ধারেকাছে হবে।
দারুণ দরকারি পয়েন্ট, বললে হোমস। গুড নাইট, মি. সোমস।
বিস্ময়ে হতাশায় সজোরে চেঁচিয়ে ওঠেন আমাদের পথপ্রদর্শক।
হায় ভগবান, মি. হোমস, এভাবে আমাকে অকূল পাথারে ফেলে সত্যি সত্যিই কি আপনি দুম করে চললেন? পরিস্থিতিটা এখনও উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে তো মনে হচ্ছে না। আগামীকাল পরীক্ষা। আজ রাতেই পাকাঁপাকি কিছু ব্যবস্থা আমায় করতেই হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার পরে তো পরীক্ষায় বসতে দিতে পারি না। যেভাবেই হোক এ-পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে আমায়।
যেমন আছে, তেমনি চলুক। কিছু রদবদল করবেন না। কাল ভোরের দিকে এখানে আসছি। তখনই এ-প্রসঙ্গে কথা বলবখন। আমার তো মনে হয়, তখনই কী ধরনের ব্যবস্থা অবলম্বন করা উচিত, সে-সম্পর্কে কিছু শলাপরামর্শ দিতে পারব। ইতিমধ্যে কোনো কিছুরই পরিবর্তন করবেন না–সামান্য পরিবর্তনও নয়।
বেশ, তাই হবে, মি. হোমস।
আপনি নিরঙ্কুশ নিশ্চিন্ত মনে থাকতে পারেন। এ উটকো উৎপাত থেকে বেরিয়ে পড়ার একটা-না-একটা পথ নিশ্চয় আবিষ্কার করতে পারব আমরা। কালো কাদামাটির পিরামিড আর পেনসিলের কুচোগুলো নিয়ে চললাম। গুড বাই।
চত্বরে অন্ধকারে বেরিয়ে এসে আবার ওপরদিকে তাকালাম জানলাগুলোর পানে। ভারতীয় ছাত্রটি তখনও পায়চারি করছিল ঘরময়! বাকি দুজনে ছিল দৃষ্টির অন্তরালে।
বড়োরাস্তায় এসে পড়ার পর হোমস শুধোলে, কীহে ওয়াটসন, কী মনে হয় তোমার? এ যেন একটা ছোটোখাটো টেবিলে বসা খেলা–অনেকটা তিন তাসের হাত সাফাইয়ের মতো তাই নয় কি? তিনজন লোক রয়েছে এ-হেঁয়ালিতে। এদের মধ্যেই একজন করেছে এ-কাজ। তোমার পছন্দসই লোকটি কে শুনি?
ওপরের তলার আঁস্তাকুড়-মুখখা ছোকরাটা। ওরই রেকর্ড সব চাইতে খারাপ। ইন্ডিয়ান ছোকরাটাও কিন্তু ভারি ধড়িবাজ। সারাক্ষণ ঘরময় পায়চারি করার মানেটা কী শুনি?
তাতে কোনো দোষ নেই। প্রাণপণে কিছু মুখস্থ করার চেষ্টা করলে অনেকেই এ-রকম করে থাকে।
কীরকম অদ্ভুতভাবে বাঁকাচোখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল, তা দেখেছ তো?
তুমিও অমনিভাবে তাকাতে যদি পরীক্ষার আগের রাতের প্রস্তুতির মাঝে অনাহূত এক দঙ্গল লোক এসে ঢুকত তোমার ঘরে। না, না, ওতে কোনো গলতি দেখি না আমি। পেনসিল, ছুরি–সবই সন্তোষজনক। কিন্তু তবুও ওই লোকটাই যে গোলমাল করে দিচ্ছে সব।
কে?
কেন, ব্যানিস্টার, সোমসের পরিচারক? এ-ব্যাপারে তার ভূমিকাটা কী বলো তো?
রকমসকম দেখে তাকে বিলকুল খাঁটি মানুষ বলেই বিশ্বাস হয় আমার।
আমারও তাই বিশ্বাস। গোলমাল করে দিচ্ছে এই জায়গাটাই। কীসের জন্য একজন বিলকুল খাঁটি মানুষ বেশ, বেশ, এই তো দেখছি একটা বড়োসড়ো মনিহারি দোকান। এসো, আমাদের গবেষণা শুরু হোক এখান থেকেই।
মাত্র চারটে মনিহারি দোকান ছিল শহরে। বৃথাই সবকটায় ছুঁ মারলাম। প্রতিবারই পেনসিলের কুচোগুলো বার করে চড়া দাম দিতে চাইলে হোমস। কিন্তু সবাই একবাক্যে জানালে যে সাধারণ পেনসিল নয় বলে এ-জিনিস স্টকে রাখা হয় না বললেই চলে, তবে অর্ডার দিলে আনিয়ে দেওয়া যাবে। ব্যর্থতা সত্ত্বেও বন্ধুবর খুব দমে গেছে বলে মনে হল না। কৌতুকছলে দুই কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাল ছেড়ে দিলে সে। তবে সে-কৌতুক পুরোপুরি নয়, আধাআধি।
লাভ নেই মাই ডিয়ার ওয়াটসন। সবচেয়ে জোরালো আর চুড়ান্ত সুত্র ছিল এইটাই–কিন্তু ফলাফল তো দেখছি ফক্কা। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, এ-সূত্র ছাড়াই যে কেসটা খাড়া করতে পারি আমি, সে-সম্বন্ধে তিলমাত্র সন্দেহ আমার নেই। সর্বনাশ! আরে ভায়া, ন-টা বাজতে চলল যে! আসবার সময়ে আধো-আধো গলায় ল্যান্ডলেডি বলে দিয়েছিল কড়াইশুটি তৈরি থাকবে সাড়ে সাতটায়। আরে ভাই ওয়াটসন, তোমার এই বারোমেসে তামাক আর অসময়ে খাওয়াদাওয়ার জন্যে আশা করছি শিগগিরই বাড়ি ছাড়ার নোটিশ পাবে। আর, তোমার অধঃপতনের অংশ আমাকেও নিতে হবে। কিন্তু নার্ভাস শিক্ষক, অসাবধানী পরিচারক আর তিনজন সমুবাহী ছাত্রের রহস্যভেদ করার আগে তো তা করা যাবে না।
সেদিন আর এ-প্রসঙ্গ নিয়ে উচ্চবাচ্য করল না হোমস। যদিও দেরি করে ডিনার খাওয়ার পর বহুক্ষণ চিন্তামগ্ন হয়ে বসে রইল ও। সকাল আটটায় সবে প্রাতঃকৃত্য শেষ করেছি, এমন সময়ে আমার ঘরে ঢুকল ও।
বলল, ওহে ওয়াটসন, সেন্ট লিউকস-এ যাওয়ার সময় হয়েছে। প্রাতরাশ না-সেরে আসতে পারবে?
নিশ্চয়।
আমরা গিয়ে নিশ্চিত কিছু না-বলা পর্যন্ত তো হাঁকপাঁক করে মরবেন সোমস। আর, ভয়ংকর সে ছটফটানি, নাকি বল?
ওঁকে নিশ্চিত কিছু বলার মতো উপাদান পেয়েছ?
মনে তো হয় পেয়েছি।
সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে পেরেছ?
পেরেছি, মাই ডিয়ার ওয়াটসন। এ-রহস্যের সমাধান আমি করেছি।
কিন্তু টাটকা সাক্ষ্যপ্রমাণ তুমি পেলে কী করে শুনি? আর পেলেই-বা কী?
আহা! ভোর ছ-টার মতো অসময়ে তো আর স্রেফ হাওয়া খাওয়ার জন্যে শয্যাত্যাগ করিনি আমি। ঝাড়া দুটো ঘণ্টা বেদম খাটতে হয়েছে আমাকে। আর কম করে পাঁচ মাইল হাঁটতে হয়েছে। তবেই না কিছু দেখাতে পারছি। এই দেখ।
হাত বাড়িয়ে ধরল ও। হাতের তালুতে দেখলাম কালো রঙের মণ্ডের মতো কাদামাটির তৈরি ছোটো ছোটো তিনটে পিরামিড।
আরে, হোমস, কাল তো মোটে দুটো পেয়েছিলে! আর একটা পেয়েছি আজ সকালে। খুব সাধাসিধে বিতর্কের ব্যাপার হে। তিন নম্বরটার আগমন যে-অঞ্চল থেকে, এক নম্বর আর দুনম্বরের উৎপত্তিও সেইখানে। তাই, না, ওয়াটসন? বেশ, বেশ, চলে এসো চটপট। বন্ধুবর সোমসের যন্ত্রণা লাঘব করে আসা যাক এবার।
বাস্তবিকই রীতিমতো উত্তেজিত অবস্থায় দেখলাম দুর্ভাগা শিক্ষক বেচারিকে তার চেম্বারে পৌঁছানোর পর। সে-উত্তেজনা দেখলে সত্যিই বড় করুণা হয়। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুরু হবে পরীক্ষা। অথচ তখনও তার উভয় সংকটের যন্ত্রণা ঘোচেনি। তখনও ভাবছেন, এ-কাণ্ড সর্বসমক্ষে হাজির করবেন, না বদমাশ নচ্ছারটাকেও মূল্যবান স্কলারশিপের পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করতে দেবেন! এমনই উদগ্র তার মানসিক উদবেগ যে চুপ করে দাঁড়িয়েও থাকতে পারছিলেন উনি। হোমসকে দেখেই দু-হাত সামনে প্রসারিত করে ব্যাকুলভাবে ছুটে গেলেন তার পানে।
জয় ভগবান, আপনি তাহলে এসেছেন! আমার ভয় হয়েছিল হয়তো নিরাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন আপনি। কী করি বলুন তো? পরীক্ষা শুরু করব?
হ্যাঁ। শুরু করুন–কোনো বাধা দেবেন না পরীক্ষায়।
কিন্তু বদমাশটা—
সে পরীক্ষা দেবে না।
তার নাম জানতে পেরেছেন?
মনে হয় পেরেছি। এব্যাপারে যদি পাঁচ-কান না করতে চান তো আমাদের নিজের নিজের কিছু ক্ষমতা লাভ করা দরকার। সামরিক বিচারালয়ের মতো ছোটোখাটো একটা কোর্ট মার্শালের আয়োজন করে আমরাই নিস্পত্তি করে ফেলব এ-ব্যাপারের। সোমস, আপনি থাকুন ওইখানে–যদি কিছু মনে না করেন। ওয়াটসন, তুমি এখানে। আর্মচেয়ার নিয়ে মাঝখানে বসব আমি। অপরাধবোধে দুরু দুরু যার হৃৎপিণ্ড, তার বুকে আতঙ্কের শেল হানবার মতো পোজ আমরা নিতে পেরেছি বলেই তো মনে হয় আমার। দয়া করে ঘণ্টাটা বাজিয়ে দিন।
ব্যানিস্টার ঘরে ঢুকল। ঢুকেই কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে পিছিয়ে গেল এক পা। বেশ বুঝলাম, আমাদের ধর্মাবতারসুলভ ভাবভঙ্গিমা আর ধর্মাধিকরণ দৃশ্য দেখে ভয়ে বিস্ময়ে কেঁপে উঠেছে ওর বুক।
হোমস বললে, দয়া করে দরজাটা বন্ধ করে দাও। ব্যানিস্টার, গতকালের ঘটনায় যে-সত্যটুকু লুকানো আছে, তা কি এবার বলবে?
লোকটার চুলের গোড়া পর্যন্ত বোধ হয় ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
আমি তো আপনাকে সবই বলেছি স্যার!
আর কিছু বলার নেই?
আর কিছুই নেই, স্যার।
বেশ, তাহলে কয়েকটা সম্ভাবনার কথা শোনাই তোমায়। গতকাল চেয়ারটায় গিয়ে যখন বসেছিলে, তখন কি তুমি কোনো জিনিস গোপন করার অভিপ্রায় নিয়েই গেছিলে ওখানে? যে জিনিসটা দেখামাত্র বোঝা যেত যে ঘরের মধ্যে কারো আবির্ভাব ঘটেছিল?
পাঙাশপানা বীভৎস হয়ে ওঠে ব্যানিস্টারের মুখ।
না, স্যার, নিশ্চয় না।
এটা কিন্তু একটা নিছক সম্ভাবনা, মোলায়েম মিষ্টি গলায় বললে হোমস। আমি অকপটে স্বীকার করছি, এ-সম্ভাবনা প্রমাণ করতে আমি অপারগ। তবে আর একটি জিনিস খুবই সম্ভব বলে মনে হচ্ছে আমার। মি. সোমস পিছু ফেরামাত্র সেই মুহূর্তে শোবার ঘরে যে-লোকটা লুকিয়ে ছিল তাকে তুমিই ছেড়ে দিয়েছিলে।
শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে নিলে ব্যানিস্টার।
ওখানে কেউ ছিল না, স্যার।
আহা, সেইটাই তো পরিতাপের বিষয়, ব্যানিস্টার। এতক্ষণ পর্যন্ত সত্য বললেও বলে থাকতে পার। কিন্তু এবার তো আমি জানি যে ডাহা মিথ্যে বলছ তুমি।
ওখানে কেউ ছিল না, স্যার।
ধীরে, ব্যানিস্টার, ধীরে।
না, স্যার, কেউ ছিল না।
তাই যদি হয় তো আর কোনো খবরাখবর তুমি আমাদের দিতে পারবে না। দয়া করে এ-ঘরেই থাকবে কি তুমি? শোবার ঘরের দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াও। সোমস, একটা অনুরোধ আছে। অনুগ্রহ করে গিলক্রাইস্টের ঘরে গিয়ে তাকে একবার এখানে আসতে বলবেন কি?
ক্ষণেক পরেই গিলক্রাইস্টকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন সোমস। ভারি চমৎকার চেহারা ছেলেটির। ছিপছিপে লম্বা নমনীয় তনু। লাফিয়ে লাফিয়ে চলাফেরার ধরন দেখলেই বোঝা যায় কতখানি বিদ্যুৎশক্তি লুকিয়ে আছে তার প্রতি পদক্ষেপের মধ্যে। চটপটে ক্ষিপ্রতায় মজবুত দেহখানি। মুখশ্রী সুন্দর আর অকপট! উদবেগঘন নীল নীল দুই চোখের দৃষ্টি বুলিয়ে নিলে সে আমাদের প্রত্যেকের ওপর। তারপর তা স্থির হয়ে গেল দূরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যানিস্টারের মুখের ওপর। এবার তার চোখের তারায় দেখলাম নিরাবয়ব নৈরাশ্যের প্রতিচ্ছবি।
হোমস বললে, দরজাটা বন্ধ করে দিন। মি. গিলক্রাইস্ট, এখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই এবং আমাদের কথোপকথনের একটি অক্ষরও বাইরে কেউ কোনোদিনই জানতে পারবে না। কাজে কাজেই, অনায়াসেই মনের অর্গল খুলে দিয়ে অকপট কথা কইতে পারি আমরা। মি. গিলক্রাইস্ট, আমরা জানতে চাই আপনার মতো এ-রকম মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ গতকালের এই গর্হিত কাজটা করলেন কী করে?
টলমলিয়ে উঠে পিছু হটে গেল দুর্ভাগা তরুণ গিলক্রাইস্ট। তারপরেই বড়ো বড়ো চোখে তাকালে ব্যানিস্টারের পানে। সে-চোখে পাশাপাশি ফুটে উঠল আতঙ্ক আর তিরস্কার।
না, না, মি. গিলক্রাইস্ট! একটা কথাও আমি বলিনি একটা কথাও না। আকুল কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে ব্যানিস্টার!
হোমস বললে, না বলনি। কিন্তু এবার তা বললে। মি. গিলক্রাইস্ট, এবার বুঝতে পেরেছেন। তো ব্যানিস্টারের একটি কথার পর আর কোনো আশা নেই আপনার। এখন আপনার একমাত্র পথ হচ্ছে অকপটে সব কিছু স্বীকার করা।
মুহূর্তের জন্যে দু-হাত তুলে দারুণ আক্ষেপে থর থর করে কেঁপে ওঠা দেহটাকে সামলে নেওয়ার প্রয়াস পেলে গিলক্রাইস্ট। পরের মুহূর্তেই সে জানু পেতে বসে পড়ল টেবিলের পাশে এবং দুই করতলে মুখ ঢেকে নিঃশেষে ভেঙে পড়ল আবেগঘন কান্নায়। ওঃ, সে কী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না।
নরম গলায় হোমস বললে, আস্তে, আস্তে। মানুষমাত্রেরই ভুল হয়। আর, তা ছাড়া আপনাকে দাগি ক্রিমিনাল হওয়ার অপবাদ তো কেউ দিচ্ছে না। আপনার বদলে যদি সমস্ত ঘটনাটা বলি মি. সসামসকে তাহলে হয়তো আমার ভুল-টুল হলে শুধরে দেওয়াটাই সহজতর হবে আপনার পক্ষে। তাই করব নাকি? বেশ, বেশ, কষ্ট করে আর উত্তর দিতে হবে না! শুধু শুনে যান। লক্ষ রাখুন যাতে আপনার ওপর কোনোরকম অবিচার না করে বসি।
মি. সোমস, যে-মুহূর্তে আপনি আমায় বললেন যে আর কেউ তো নয়ই, এমনকী ব্যানিস্টারের পক্ষেও জানা সম্ভব ছিল না আপনার ঘরে পেপারগুলোর আবির্ভাব-তত্ত্ব, ঠিক তখন থেকেই কেসটা একটা স্পষ্ট রূপ নিতে শুরু করলে আমার মনের মধ্যে। অবশ্য ছাপাখানার লোকে জানত কিন্তু সে-সম্ভাবনা নাকচ করে দিলাম। কেননা, সে তো অফিসেই পরীক্ষা করতে পারত কাগজগুলো। ভারতীয় ছাত্রের সম্বন্ধেও কিছু ভাবিনি আমি। প্রুফগুলো পাকানো অবস্থায় থাকলে কাগজগুলো আসলে কীসের, তা তো আর তার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সুতরাং তাও বাদ দিলাম। ঘরে যে ঢুকেছিল সে জানত পেপারগুলো টেবিলের ওপর আছে। কিন্তু কী করে জানল সে?
আপনার ঘুরে আসার সময়ে জানলাটা পরীক্ষা করেছিলাম। তখন আপনার একটা একটা মজাদার ধারণা শুনে হাসি পেয়েছিল আমার। খটখটে দিনের আলোয় বিপরীত দিকের ঘরগুলোর বাসিন্দাদের চোখের ওপর দিয়ে আগন্তুক মহাপ্রভু ঠেলেঠুলে জানলা দিয়ে ভেতরে ঢুকছেএমনি একটা সম্ভাবনা আমি নাকি চিন্তা করছিলাম। রীতিমতো উদ্ভট এই ধারণা। আসলে আমি মেপে দেখছিলাম, কতখানি লম্বা হলে তবে একজনের পক্ষে জানলার সামনে দিয়ে যেতে যেতে মাঝখানের টেবিলের ওপর রাখা কাগজগুলো দেখতে পাওয়া সম্ভব। আমি ছ-ফুট লম্বা। কিন্তু আপনাকেও কসরত করে তবে দেখতে হয়েছে মাঝখানের টেবিলটা। ওই উচ্চতার কমে কারো পক্ষেই এ-সুযোগ পাওয়া সম্ভব নয়। আপনি তো জানেন, তিনজন ছাত্রের মধ্যে যে অস্বাভাবিক রকমের লম্বা ত্রয়ীর মধ্যে তার ওপরেই নজর রাখলে লাভ হবে সবচেয়ে বেশি–এমন কথা ভাববার মতো যুক্তি এসে গেছিল আমার মাথার মধ্যে।
ঘরে ঢুকলাম। সাইড-টেবিল সম্পর্কিত খুঁটিনাটি আপনাকে জানালাম। গিলক্রাইস্ট যে লংজাম্পে দক্ষ, এ-তথ্য আপনি আমায় না-বলা পর্যন্ত মাঝখানের টেবিল সম্বন্ধে বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারিনি আমি।তখনই সমস্ত জিনিসটা চকিতের মধ্যে ভেসে উঠল আমার মনের পর্দায়। বাকি রইল শুধু থিয়োরিকে বলবৎ করার জন্যে কয়েকটি প্রামাণ সংগ্রহের। এবং তা-ও আমি পেলাম অচিরেই।
যা ঘটেছিল, তা শুনুন। সারাবিকেলটা খেলার মাঠে লংজাম্প প্র্যাকটিস করে কাটিয়েছে এই তরুণটি। লাফাবার জুতো কাঁধে ঝুলিয়ে ফিরে আসে সে। জানেন তো, এ ধরনের জুতার তলায় প্রচুর কাঁটা লাগানো থাকে। জানলার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে রেজায় লম্বা হওয়ার দরুন টেবিলের ওপর রাখা প্রফগুলো সে দেখতে পায়। সঙ্গেসঙ্গে বুঝে নেয় জিনিসগুলো কী। কোনো ক্ষতিই হত না যদি-না দরজার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে আপনার অসাবধানী পরিচারকের ফেলে যাওয়া চাবিটা দেখতে পেত সে। আচম্বিতে একটা ঝোক চেপে বসে ওর মনে। ভেতরে ঢুকে দেখতে হবে কাগজগুলো সত্যিই প্রুফ কিনা। কাজটা দুঃসাহসের। কিন্তু বিপজ্জনক নয়। কেননা, ধরা পড়ে গেলেই সাফাই গেয়ে দিত সে যে নিছক একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার জন্যেই তার এহেন প্রবেশ।
কিন্তু যখনই দেখলে যে কাগজগুলো বাস্তবিকই প্রশ্নপত্রের প্রুফ, তখন আর প্রলোভনের খপ্পর থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারলে না সে। জুতো দুটো নামিয়ে রাখলে টেবিলের ওপর। জানলার কাছে ওই চেয়ারটায় কী রেখেছিলেন বলুন তো?
দস্তানা। বললে তরুণ গিলক্রাইস্ট।
বিজয়গৌরবে ব্যানিস্টারের পানে তাকাল হোমস।
দস্তানাগুলো চেয়ারের ওপর রেখে প্রফগুলো তুলে নিলে সে। একসঙ্গে সবগুলো নয়। এক একটা করে নিলে নকল করার জন্যে। ও ভেবেছিল মাস্টারমশাই নিশ্চয় প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকবেন এবং জানলা থেকেই আপনাকে দেখতে পাবে সে। কিন্তু আমরা তো জানি, মাস্টারমশাই ফিরে এলেন পাশের ফটক দিয়ে। হঠাৎ তারা পায়ের শব্দ পাওয়া গেল দরজার সামনেই। পালানোর সম্ভাব্য পথ আর নেই। দস্তানার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে জুতোজোড়া তুলে নিয়ে তিরবেগে সে ঢুকে পড়ল শোবার ঘরে। আপনি আগেই লক্ষ করেছেন, টেবিলের ওপর ওই আঁচড়টা একদিকে খুব ক্ষীণ, কিন্তু শোবার ঘরের দরজার দিকে যতই গেছে দাগটা, ততই তা গভীরভাবে কেটে গিয়ে দু-ভাগ করে দিয়েছে চামড়া। শুধু এই দেখলেই তো বোঝা যায় জুতোগুলো টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওইদিকেই এবং আসামি আশ্রয় নিয়েছে ওই ঘরে। কাঁটার চারপাশে লেগে থাকা মাটি পড়ে রইল টেবিলের ওপর। দ্বিতীয় নমুনা আলগা হয়ে পড়ল শোবার ঘরে। আরও বলি, আজ সকালেই হাঁটতে হাঁটতে খেলার মাঠে গিয়েছিলাম আমি। গিয়ে দেখতে পেলাম এই কালো রঙের আঠালো কাদামাটির উৎস। লাফাবার গর্তে এ ধরনের মাটির ব্যবহার দেখা যায়। তা ছাড়াও করাত চেরা কাঠের গুঁড়ো বা গাছের সূক্ষ্ম ছালচুর্ণ ছড়িয়ে দেওয়া হয় ওপরে যাতে করে লাফাবার পর অ্যাথলিট পিছলে না যায়। গুঁড়ো সমেত কাদামাটির নমুনা খানিকটা নিয়ে এসেছি সাথে। যা বললাম,তা সত্য, মি. গিলক্রাইস্ট?
সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছিল তরুণ ছাত্র গিলক্রাইস্ট।
এখন বললে, হ্যাঁ, স্যার, সত্য।
হায় ভগবান, এ ছাড়া আর কিছুই কি তোমার বলার নেই? চেঁচিয়ে ওঠেন হোমস।
আছে, স্যার। কিন্তু এই লজ্জাকর ব্যাপার প্রকাশ পাওয়ার আঘাতে হতবুদ্ধি হয়ে গেছি আমি। সারারাত ছটফটিয়ে কাটানোর পর ভোরের দিকে এ-চিঠি লিখেছিলাম আপনার কাছে। আমার পাপকাজ যে আর ঢাকা নেই, এ-খবর জানার আগেই লিখেছিলাম চিঠিটা। নিন, স্যার। চিঠিখানা খুললেই দেখবেন আমি লিখেছি, আমি মনস্থ করেছি এ-পরীক্ষা দেব না এবং এ-বিষয়ে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রোডেশিয়ান পুলিশ একটি অফিসারের পদ অফার করেছে আমায় এবং আমি অবিলম্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় রওনা হচ্ছি।
সোমস বললেন, বাস্তবিকই খুব খুশি হলাম যে শেষ পর্যন্ত তুমি অসৎ পথে পাওয়া সুযোগ নিয়ে লাভবান হওয়ার প্রচেষ্টা থেকে বিরত হয়েছ। কিন্তু মত পরিবর্তন করলে কেন শুনি?
আঙুল তুলে ব্যানিস্টারকে দেখালে গিলক্রাইস্ট।
বলল, ওই সেই মানুষটি, যে আমায় ঠিক পথে চালনা করেছে।
হোমস বললে, এবার পথে এসো ব্যানিস্টার। আমি যা বললাম, তা থেকে নিশ্চয় একটু পরিষ্কার বুঝেছ যে একমাত্র তুমিই এই তরুণ ছাত্রটিকে ঘরের বাইরে যেতে দিতে পারতে। কেননা, ঘরে ছিলে তুমি এবং ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে নিশ্চয় তালা দিয়ে গেছিলে দরজায়। জানলা দিয়ে পালানোর সম্ভাবনা একেবারেই অবিশ্বাস্য। আচ্ছা, এ-রহস্যের শেষ পয়েন্টটা খোলসা করে বলবে কি? তোমার এ-রকম আচরণের অর্থটা কী, তা তো বুঝলাম না?
আপনি যদি আগাগোড়া সব জানতেন, স্যার, তাহলে দেখতেন জলের মতোই পরিষ্কার আমার আচরণের অর্থটুকু। কিন্তু আপনি যতই চতুর হন না কেন, শত চেষ্টা করলেও এ-তথ্য জানা আপনার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এক সময়ে আমি এই তরুণ ভদ্রলোকটির বাবা বুড়ো স্যার জ্যাবেজ গিলক্রাইস্টের বাটলার ছিলাম। উনি সর্বস্বান্ত হলে পরে এ-কলেজের পরিচারক হিসাবে এলাম এখানে। কিন্তু ভুলতে পারলাম না আমার পুরোনো মনিবকে ভুলতে পারলাম না দুনিয়ার চোখে তার এ পতনের জন্যে, তার দুর্দৈবের জন্যে। পুরোনো দিনের কথা স্মরণ করে তার ছেলেকে যতখানি পারলাম চোখে চোখে রাখলাম আমি। গতকাল চেঁচামেচি শুনে এ-ঘরে আসামাত্র প্রথমেই যে জিনিসগুলি দেখলাম , তা হল ওদিককার চেয়ারের ওপর পড়ে থাকা মি. গিলক্রাইস্টের দস্তানা দুটি। এ-দস্তানা আমি ভালোভাবেই চিনি এবং তাই চকিতে বুঝলাম এখানে তাদের আগমনের রহস্যটুকু। মি. সোমসের চোখে পড়লেই ফাঁস হয়ে পড়বে সব কিছু। তাই ঝপ করে বসে পড়লাম চেয়ারটায়। আপনাকে ডেকে আনার জন্যে মি. সোমস ঘরের বাইরে না-যাওয়া পর্যন্ত আর চেয়ার ছেড়ে একচুলও নড়লাম না। তারপরেই আমার তরুণ মনিব, যাকে আমি হাঁটুতে শুইয়ে দোলনা দিয়েছি, বেরিয়ে এল পাশের ঘর থেকে এবং তখুনি সব স্বীকার করলে আমার কাছে। স্যার, এরপর কি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করাটা আমার পক্ষে স্বাভাবিক নয়? স্বাভাবিক নয় কি তার বাবা যা করতেন ঠিক সেইভাবে ওকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করা যে এ-পথে তার কোনো লাভই হবে না? এজন্যে কি আমায় আপনি দোষ দেন, স্যার?
নিশ্চয় না। জ্যামুক্ত ধনুকের মতো টক করে দাঁড়িয়ে উঠে আন্তরিক সুরে বলল হোমস, সোমস, আপনার ছোট্ট সমস্যার সমাধান করতে পেরেছি বলেই তো মনে হচ্ছে। এদিকে বাড়িতে ঠান্ডা হচ্ছে আমাদের প্রাতরাশ। এসো হে, ওয়াটসন। মি. গিলক্রাইস্ট, আমার বিশ্বাস, রোডেশিয়ায় আপনার উজ্জ্বল ভবিষষ্যৎ রয়েছে। জীবনে শুধু একবার আপনি নীচে নামলেন। এবার দেখা যাক, ভবিষ্যতে কত উঁচুতে আপনি উঠতে পারেন।
———–
টীকা
প্রশ্নপত্রের পলায়ন : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য থ্রি স্টুডেন্টস জুন ১৯০৪ সংখ্যার স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে ইংলন্ডে এবং কলিয়ার্স উইকলির ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় শহরে : ইংলন্ডে বিশ্ববিদ্যালয় শহর বলতে অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজকেই বোঝানো হয়। হোমসের গল্প বা উপন্যাস থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য বা বক্তব্য সাপেক্ষে গবেষকরা মনে করেন হোমস অক্সফোর্ডেরই ছাত্র ছিলেন। এই গল্পের শহরটির সঙ্গে হোমসের পরিচয় দেখে তারা অনুমান করেন এখানেও অক্সফোর্ডের কথা বলা হয়েছে।
থিউসিডাইডিজ : আনুমানিক ৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের গ্রিক ইতিহাসবিদ, থিউসিডাইডিজ ছিলেন এথেন্সের বাসিন্দা। পেলোপোনেসিয়ার যুদ্ধে অংশ নেন কিন্তু স্পার্টার সঙ্গে যুদ্ধে আপিপালিস শহরকে রক্ষা করতে না-পারায় এথেন্স থেকে নির্বাসিত হন। এর পরবর্তী কুড়ি বছরে তিনি এথেন্স এবং স্পার্টার রাজনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক গ্রন্থ হিস্ট্রি অব দ্য পলিপোনেসিয়ান ওয়ার রচনা করেন।
তিনটে স্লিপ কাগজে প্রুফটা এসেছিল : অ্যান্ড্রু ল্যাং এবং অন্যান্য কয়েকজন গবেষক জানিয়েছেন, থিউসিডাইডিজের একটি সম্পূর্ণ পরিচ্ছেদের প্রুফের জনাও তিনটি স্লিপ লাগতে পারে না।
JOHANNEABER: জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে কাসপার ফ্যাবার-এর প্রতিষ্ঠা করা পেনসিল তৈরির ব্যাবসা তার প্রণাতি জোহান লুথার ভন ফ্যাবার (১৮১৭-১৮৯৬) এবং জন এবারহার্ড ফ্যাবার (১৮২২-১৮৭৯) বড়ো করে ছড়িয়ে দেন প্রায় সমগ্র ইউরোপ এবং আমেরিকায়।
ব্লু হয়েছে : অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজের ছাত্রদের ক্রীড়ায় পারদর্শিতার শংসাপত্র হত ব্লু হলে। লেখাপড়ায় লেটার পাওয়ার সমকক্ষ ব্লু নামটির উদ্ভব অক্সফোর্ডে সফল ক্রীড়াবিদদের দেওয়া গাঢ় নীল এবং কেমব্রিজে হালকা নীল রঙের টুপির থেকে।
ছোটোখাটো একটা কোর্ট মার্শালের আয়োজন করে : দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য অ্যাবি গ্র্যাঞ্জ গল্পে ঠিক এই ধরনের একটি দৃশ্য দেখা যায়।
রোডেশিয়ান : আফ্রিকার দক্ষিণ অংশে রোডেশিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় সিসিল রোডস-এর উদ্যোগে ১৮৮৯-এর সনদের ভিত্তিতে। রোডস পরে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনির প্রধানমন্ত্রী হন। রোডেশিয়ার বর্তমান পরিচিতি জিম্বাবুয়ে নামে।