নাচিয়েদের নষ্টামি
[দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ড্যান্সিং মেন]
এই নাও একটা হেঁয়ালি। বলল দিকি এর মাথামুণ্ডু কিছু ধরতে পারছ কি না–একটা কাগজ টেবিলের ওপর ফেলে দিয়ে ঘুরে বসল হোমস তার রাসায়নিক বিশ্লেষণের কাজ নিয়ে।
কাগজটার ওপর আঁকা কিম্ভুতকিমাকার চিত্রাক্ষরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম আমি।
বললাম, আরে, এ তো দেখছি ছেলেমানুষের আঁকিবুকি।
ওহো, তাই বুঝি!
তা ছাড়া আর কী শুনি?
মি. হিলটন কিউবিটও তো তাই জানতে চান। মি. কিউবিট নরফোকে রিডলিং থর্প ম্যানরে থাকেন। ঘণ্টা বাজার শব্দ শুনছি, ওয়াটসন। ভদ্রলোক বোধ হয় এলেন।
সিঁড়িতে ভারী পায়ের শব্দ শুনলাম। পরমুহূর্তেই ঘরে ঢুকলেন লম্বা-চওড়া এক ভদ্রলোক। করমর্দনের পালা সাঙ্গ হলে বসতে যাচ্ছেন, এমন সময়ে তার চোখে পড়ল টেবিলের ওপর রাখা কিম্ভুতকিমাকার ছবি-আঁকা কাগজের টুকরোটা।
উৎসুক কণ্ঠে শুধোন মি. কিউবিট, কীরকম বুঝলেন মি. হোমস? এ-রকম বিদঘুটে ধাঁধা আর দুটি দেখেননি, তাই না মি. হোমস?
হোমস বললে, বিদঘুটে তো বটেই। কিন্তু এই কিম্ভুতকিমাকার জিনিস নিয়ে আপনি এত ভাবিত হয়ে পড়েছেন কেন, তাই তো বুঝছি না।
আমি হইনি মি. হোমস, হয়েছে আমার স্ত্রী। নিদারুণ ভয় পেয়েছে বেচারি। মুখে কিন্তু কোনো কথা নাই। তাই ভাবলাম হেঁয়ালিটার তলা পর্যন্ত না-দেখে আমি ছাড়ছি না।
সূর্যের আলোর সামনে কাগজটা তুলে ধরল হোমস। নোটবই থেকে ছেড়া একটা পাতা। মূর্তিগুলো পেনসিলে আঁকা:-
কিছুক্ষণ পরীক্ষা করার পর সযত্নে কাগজটা ভাজ করে নিজের পকেট বইয়ের মধ্যে রাখল হোমস।
মোটাসোটা গাঁট্টাগোট্টা হাত দুটো কচলাতে কচলাতে নার্ভাসভাবে বললেন মি. কিউবিট, দেখুন, আমি আবার জমিয়ে গল্প বলতে পারি না। কাজেই, বুঝতে অসুবিধে হলে জিজ্ঞেস করে নেবেন। গত বছরে আমার বিয়ের সময় থেকেই শুরু করছি। তার আগে বলে রাখি, আমি ধনবান না হলেও আমার পূর্বপুরুষেরা প্রায় পঁচিশ বছর ধরে বাস করেছেন রিডলিং থর্প-এ। নরফোকে আমাদের বংশের নাম জানে না এমন কেউ নেই; গত বছর জুবিলি উপলক্ষ্যে এসেছিলাম লন্ডনে। গ্রামের যাজক পার্কার রাসেল স্কোয়ারের একটা বোর্ডিং হাউসে উঠেছিল, তাই আমিও ডেরা নিলাম সেখানে। একটি আমেরিকান মেয়ে থাকতেন বোর্ডিং হাউসে। মেয়েটি সুন্দরী এবং যুবতী। নাম, প্যাট্রিক এলসি প্যাট্রিক। ক্রমে ক্রমে আমাদের মেলামেশা বন্ধুত্বের পর্যায়ে পৌঁছোয়। আমার এক মাসের মেয়াদ ফুরোবার আগেই, গভীরভাবে ভালোবেসে ফেললাম তাকে। রেজিস্ট্রি অফিসে বিনা ধুমধামে শেষ হল আমাদের বিয়ে, দু-দিন পর নরফোকে ফিরে এলাম তাকে নিয়ে শুরু হল আমাদের বিবাহিত জীবন। ভাবছেন ডাহা পাগলামি। আমার মতো বংশমর্যাদাসম্পন্ন একজন পুরুষের পক্ষে পাত্রীর অতীত অথবা সামাজিক প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে কোনোরকম খবর না-নিয়েই দুম করে বিয়ে সেরে ফেলা সত্যিই আশ্চর্যের ব্যাপার সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনি যদি তাকে দেখতেন মি. হোমস আর দু-দিন মেলামেশা করতেন, তাহলেই বুঝতেন কেন আমি কিছু না-জেনে, কিছু না-ভেবে সারাজীবনের সঙ্গী করে নিলাম তাকে।
এ-সম্বন্ধে এলসিও কোনো লুকোছাপা করেনি। আমার সঙ্গে কোনোরকম ছলাকলা করা দূরে থাকুক, সরল মনেই বলেছে সে আমাকে তার কথা। সুতরাং ইচ্ছে করলে বিয়ে না-করলেও পারতাম আমি। বিয়ের ঠিক আগের দিন এলসি আমায় বললে, অতীতে কতকগুলো অত্যন্ত বাজে ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলাম আমি। সব কিছুই আমি এখন ভুলে যেতে চাই। অতীত আমার কাছে বড়ো বেদনাদায়ক, তাই সে-সম্বন্ধে আমি কোনোদিনই কোনো কথা বলব না। কিন্তু, হিলটন, আমাকে বিয়ে করলে তুমি জানবে তোমার স্ত্রীর ব্যক্তিগত জীবনে লজ্জা পাওয়ার মতো কিছুই নেই। কিন্তু আমাকে কথা দিতে হবে তোমায়। বিয়ের আগে পর্যন্ত আমার জীবনে যা যা ঘটেছে, সে-সম্বন্ধে কোনোরকম কৌতূহল তুমি প্রকাশ করবে না, আমাকেও কোনো কথা বলতে দেবে না। এ-শর্ত যদি খুব কঠিন বলে মনে হয়, তাহলে ফিরে যাও নরফোকে। দুঃখ কোরো না আমার জন্যে আবার শুরু হোক আমার নিঃসঙ্গ জীবন। সেদিন মেনে নিয়েছিলাম তার শর্ত এবং আজ পর্যন্ত আমার কথা আমি রেখেছি।
যাই হোক, বিয়ের পর একবছর কেটে গেছে। সুখে শান্তিতে ভরে উঠেছিল আমাদের দাম্পত্য জীবন। কিন্তু মাসখানেক আগে জুন মাসের শেষাশেষি সেই প্রথম চোখে পড়ল অশান্তির সূচনা। আমেরিকা থেকে একদিন একটা চিঠি এসে পৌঁছোল আমার স্ত্রীর নামে। আমেরিকান ডাকটিকিটগুলো চোখে পড়েছিল আমার। চিঠি পেয়েই কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল এলসির মুখ। পড়া শেষ হতেই চিঠিখানা সে ছুঁড়ে ফেলে দিলে আগুনের চুল্লিতে। পরেও এ-সম্বন্ধে আর কোনো উচ্চবাচ্য করলে না এলসি। আমিও না। কথা যখন দিয়েছি, তখন তার নড়চড় হবে না। কিন্তু লক্ষ করলাম, সেইদিন থেকেই পুরো একটা ঘণ্টাও সহজভাবে কাটাতে পারেনি বেচারি। সবসময় তার চোখে-মুখে দেখেছি আতঙ্কের ছায়া–সে-আতঙ্ক কীসের তা বুঝিনি। শুধু এইটুকু বুঝেছি যে, যেন দুরু দুরু বুকে সে প্রতীক্ষা করে চলেছে কী-এক আসন্ন বিভীষিকার। কীসের জন্যে এ সভয় পথ-চাওয়া তা জানি না। আমাকে বিশ্বাস করে সব কথা খুলে বললে হয়তো ভালোই করত এলসি। তার সবচেয়ে দরদি বন্ধু হিসেবে নিশ্চয় তার দিবানিদ্রার অশান্তি ঘুচিয়ে দিতে পারতাম আমি। কিন্তু সে আগে না-বললে শর্ত অনুযায়ী আমিও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি না। মি. হোমস, এলসির সততায় আমার কোনো সন্দেহ নেই। অতীতে যাই ঘটুক না কেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সেজন্যে তাকে দায়ী করা চলে না কোনোমতেই। নরফোকের সামান্য লোক আমি। কিন্তু বংশমর্যাদার দিক দিয়ে আমাকে টেক্কা দেওয়ার মতো মানুষ সারাইংল্যান্ডে আর দুটি নেই। এলসি তা ভালো করেই জানে এবং সব জেনে তবে বিয়ে করে আমায়। এ-বংশে কলঙ্কের কালো দাগ লাগে, এমন কিছুই যে সে করবে না–তা আমি জানি।
এবার বলছি আমার কাহিনির সবচেয়ে অদ্ভুত, সবচেয়ে গোলমেলে অংশটা। হপ্তাখানেক আগে গত হপ্তার মঙ্গলবারে একটা জানলার চৌকাঠে আশ্চর্য কতকগুলো নাচিয়ে-মূর্তি দেখলাম। খড়ি দিয়ে আঁকা মূর্তিগুলো। ভাবলাম আস্তাবলের ছোকরাটার কাজ। কিন্তু সে-ছোকরা দিব্য গেলে বললে যে, এ-রকম বদখেয়াল কোনোদিনই আসেনি তার মাথায়। যে-ই করুক, মূর্তিগুলো যে রাত্রে আঁকা হয়েছিল, তা বুঝলাম। জল দিয়ে দাগগুলো মুছে ফেলে পরে স্ত্রীর কাছে গল্প করতে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম এই সামান্য ব্যাপারে তার বিরাট পরিবর্তন দেখে। দারুণ সিরিয়াস হয়ে গিয়ে বার বার মিনতি করতে লাগল এলসি, যেন আবার এ ধরনের মূর্তি চোখে পড়লে তাকে দেখাই আমি। হপ্তাখানেকের মধ্যে নাচিয়েদের আর পাত্তা পাওয়া গেল না। তারপরেই গতকাল সকালে বাগানে সূর্যঘড়ির ওপর পড়ে থাকতে দেখলাম এই কাগজটাকে। এলসিকে দেখাতেই জ্ঞান হারিয়ে সে লুটিয়ে পড়ল মেঝের ওপর। তারপর থেকেই যেন তাকে ভূতে পেয়েছে, চেতনা আছে কি নেই বোঝা মুশকিল। সবসময়ে আচ্ছন্নের মতো যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে স্বপ্নের মধ্যে চোখের তারায় নিঃসীম নিষ্ঠুর আতঙ্কের কালো প্রতিচ্ছবি। তখনই মরিয়া হয়ে চিঠি লিখে কাগজটা পাঠিয়ে দিলাম আপনার কাছে মি. হোমস। এ-জিনিস নিয়ে পুলিশের কাছে যাওয়া মানে তাদের হাসির খোরাক জোগানো। কিন্তু আপনার কাছে আমি নির্ভয়ে আসতে পারি। মি. হোমস, আমার কুলমর্যাদা থাকতে পারে, কিন্তু সে-অনুপাতে টাকা নেই। তবে আমার এলসির জীবনে সত্যিই যদি কোনো বিপদের সম্ভাবনা বয়ে নিয়ে এসে থাকে এই কিম্ভুতকিমাকার নাচিয়েরা, তাহলে আমার শেষ কপর্দকটিও তাকে বিপদমুক্ত করার জন্যে খরচ করতে প্রস্তুত আমি।
তন্ময় হয়ে শুনছিল হোমস। কাহিনি শেষ হলে পর বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাকুটিল মুখে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল সে।
তারপর বললে, মি. কিউবিট, এ-রকম পরিস্থিতিতে আপনার কি মনে হয় না স্ত্রীর কাছে সরাসরি সব কথা জিজ্ঞেস করা উচিত? তাঁকে জানান না কেন যে তার গোপন রহস্যের ভাগীদার হতে চান আপনিও?
মস্তবড়ো মাথা দুলিয়ে বললেন মি. কিউবিট, মি. হোমস, প্রতিজ্ঞা প্রতিজ্ঞাই। এলসির যদি সে-ইচ্ছে হয় তবে সে নিজে থেকেই বলবে! না-বললে আমি নিজে থেকে তার গোপন কথা কোনোদিনই জানতে চাইব না। তবে আপনার কাছে আসা আমার অভিরুচি, তাতে তো আর কথার খেলাপ হচ্ছে না।
বেশ তাহলে আমার আন্তরিক সাহায্য পাবেন আপনি। প্রথমেই একটি প্রশ্ন–আপনার বাড়ির আশেপাশে কোনো আগন্তুককে ঘোরাফেরা করতে কেউ দেখেছে কি?
না।
জায়গাটা নিশ্চয়ই খুব নিরিবিলি। নতুন মুখ দেখলেই কথা উঠত, তাই নয় কি?
বাড়ির একেবারে কাছাকাছি হলে সে-কথা খাটে কিন্তু একটু দূরেই কয়েকটা জলসত্র আছে। বহিরাগতদের থাকার ব্যবস্থাও সেখানে রেখেছে স্থানীয় চাষিরা।
ছবি-অক্ষরগুলোকে একেবারে হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, মি. কিউবিট। প্রত্যেকটা নাচুনের একটা-না-একটা মানে আছে। যদি এলোপাতাড়ি খেয়ালমাফিক আঁকিবুকি হয়, তাহলে অবশ্য এ-প্রহেলিকার জট ছাড়ানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। আর যদি নিয়মমাফিক হয়, তাহলে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এ-ব্যাপারের শেষ না-দেখে আমরা ছাড়ছি না। কিন্তু আপনার আনা নমুনাটা এতই পুঁচকে যে এ থেকে বিশেষ কিছু আলো আমি পাচ্ছি না। তা ছাড়া, আপনার কাহিনি শুনেও বলিষ্ঠ কোনো ইঙ্গিত পেলাম না–কাজেই তদন্ত আরম্ভ করার মতো মালমশলাই নেই হাতে। এই কারণেই আমার অনুরোধ, আপনি নরফোকে ফিরে যান, মি. কিউবিট। কড়া নজর রাখুন চারিদিকে। নতুন কোনো নাচনেওয়ালার ছবি দেখলেই হুবহু কপি পাঠিয়ে দিন আমাকে। জানলার চৌকাঠে খড়ি দিয়ে আঁকা যে-মূর্তিগুলো দেখেছিলেন তার কপি না-পাওয়ার জন্যে যে কী আফশোস হচ্ছে, তা আমি বলে বোঝাতে পারব না আপনাকে। তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখবেন বাড়ির কাছাকাছি অঞ্চলে কোনো আগন্তুকদের আগমন ঘটেছে কি না। টাটকা কোনো প্রমাণ-টমান পেলে বিনা দ্বিধায় চলে আসুন আমার কাছে। এ ছাড়া আপাতত আপনাকে আমার আর কিছু বলার নেই। পরিস্থিতি যদি গুরুতর হয়ে ওঠে, তাহলে আমাকে আপনার নরফোকের বাড়িতেই দেখতে পাবেন।
এই সাক্ষাৎকারের পর থেকে কটা দিন সবসময়ে গভীর চিন্তায় তন্ময় হয়ে থাকতে দেখলাম শার্লক হোমসকে। মাঝে মাঝে পকেট বই থেকে ছবি আঁকা কাগজের টুকরোটা বার করে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ ধরে নিরীক্ষণ করতে দেখলাম আশ্চর্য নাচুনেদের। কিন্তু চিন্তা ছাড়া এ-প্রসঙ্গে একটা কথাও শুনলাম না তার মুখে।
দিন পনেরো কি তারও পরে মি. কিউবিট ফের এলেন।
আর্ম-চেয়ারে অবসন্ন শরীর এলিয়ে দিয়ে বললেন মি. কিউবিট, মি, হোমস, আমার নার্ভ আর সহ্য করতে পারছে না। আপনার সঙ্গে দেখা করে ফিরে যাওয়ার পরের দিন সকালে প্রথমেই যে-জিনিসটা দেখলাম, তা আর একদল নতুন নাচিয়েদের ছবি। টুল-হাউসের কালো কাঠের দরজায় খড়ি দিয়ে আঁকা ছিল মূর্তিগুলো। টুল-হাউসটা লনের পাশেই, সামনের জানলা থেকে পরিষ্কার দেখা যায় হাউসটা। যাই হোক, অবিকল একটা কপি তুলে এনেছি। এই নিন ছবি। বলে একটা কাগজের ভাজ খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন মি. কিউবিট। ছবি-অক্ষরগুলোর হুবহু প্রতিলিপি দিলাম পরের পাতায়:
এক্সেলেন্ট! খুশি ঝরে পড়ে হোমসের কণ্ঠে। এক্সেলেন্ট! তারপর?
কপি করে নেওয়ার পর মূর্তিগুলো মুছে ফেললাম আমি। কিন্তু ঠিক দু-দিন পরেই সকালে উঠে দেখলাম আর একদল নাচিয়েদের। এই দেখুন তার কপি।
হাত ঘষতে ঘষতে খুশির চোটে নিঃশব্দে হাসতে থাকে হোমস।
বলে, মালমশলাগুলো বেশ চটপট পাওয়া যাচ্ছে দেখছি।
তিন দিন পরে সূর্যঘড়ির ওপর নুড়ি চাপা দেওয়া আর এক সারি কাগজে আঁকা মূর্তিদের পাওয়া গেল। এই সেই কাগজ। দেখতেই পাচ্ছেন নাচের ঢংগুলো ঠিক আগের মতো। এরপর ঠিক করলাম ওত পেতে বসে থাকতে হবে। রিভলভার নিয়ে বসলাম স্টাডিতে–এখান থেকে লন আর বাগানটা পুরোপুরি দেখা যায়। রাত প্রায় দুটোর সময়ে জানলার সামনে চুপচাপ বসে আছি, বাইরে চাদের ফুটফুটে আলো ছাড়া সব অন্ধকার, এমন সময়ে ঠিক পেছনে পায়ের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি ড্রেসিং গাউন পরে আমার স্ত্রী। শোয়ার ঘরে ফিরে আসার জন্যে কাকুতিমিনতি করতে লাগল এলসি। আমি খোলাখুলি বললাম, যে-হতভাগা এ-জাতীয় বাঁদরামো করছে আমাদের সঙ্গে, তার শ্রীমুখটি আমার একবার দেখবার দরকার। এলসি বললে, নিছক রসিকতা ছাড়া যখন কিছুই নয়, তখন আমার এ সামান্য বিষয় নিয়ে এত মাথা ঘামানো উচিত নয়।
হিলটন, সত্যিই যদি ছবিগুলোর জন্যে উত্ত্যক্ত মনে কর, তাহলে চল তুমি আর আমি বাইরে কোথাও বেড়িয়ে আসি।
কী, কোথাকার এক ফাজিলের জন্যে নিজের বাড়িঘরদোর ছেড়ে পালাব? লোকে দেখলে টিটকিরি দেবে যে! বললাম আমি।
যাকগে ওসব কথা। আপাতত তো ঘুমোও, কাল সকালে উঠে দেখা যাবে কী করা যায়। বলল এলসি।
কথা বলতে বলতে আচম্বিতে একটা আশ্চর্য জিনিস লক্ষ করলাম। নিমেষে রক্তহীন সাদা হয়ে গেল এলসির মুখ। মনে হল চাঁদের আলো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার মুখের কাছে। শক্ত মুঠিতে আমার কাঁধ চেপে ধরে বিস্ফারিত চোখে সে তাকিয়ে ছিল বাইরে। টুল-হাউসের ছায়ায় কী যেন একটা নড়তে দেখলাম। গুড়িমারা কালো একটা মূর্তি। হামাগুড়ি দিয়ে মূর্তিটা কোণ থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটু পেতে বসল দরজার সামনে। পিস্তল বার করে ছুটে বেরোতে যাচ্ছি, কিন্তু বাধা পেলাম স্ত্রীর কাছে। প্রাণপণ শক্তিতে আমাকে জাপটে ধরে আটকে রাখল এলসি। ঠেলে বেরোবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মরিয়া হয়ে আমাকে জাপটে ধরে রইল সে। অনেক কষ্টে ছাড়ান পাওয়ার পর দরজা খুলে টুল-হাউসে পৌঁছে আর দেখতে পেলাম না কৃষ্ণবর্ণ প্রাণীটাকে। উধাও হওয়ার আগে সে তার চিহ্ন রেখে গেছিল দরজার ওপর। আগের দু-বারের মতোই দেখলাম বিভিন্ন ঢঙে নাচতে নাচতে এগিয়ে চলেছে একদল মূর্তি। তখুনি কাগজটার হুবহু কপি করে নিলাম ছবিটার। চারদিকে দৌড়াদৌড়ি করেও রাসকেলটার আর টিকি দেখতে পেলাম না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, লোকটা পালায়নি মোটেই–কোথাও-না-কোথাও ঘাপটি মেরে ছিল। কেননা, পরের দিন সকালে কালো কাঠের দরজার ওপর দেখলাম আরও কয়েকটা নতুন মূর্তি আঁকা হয়েছে গত রাত্রে দেখা মূর্তিগুলোর নীচে।
নতুন মূর্তিগুলোও কপি করেছেন? হ্যাঁ। যদিও মাত্র কয়েকটি মূর্তি, তবুও কপি করতে ভুলিনি। এই দেখুন। আবার একটা কাগজ বার করলেন মি. কিউবিট। নতুন নাচের ধরনটা এইরকম :
হোমসের চোখ দেখে মনে হল ভেতরে ভেতরে দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে সে। কাগজটা নামিয়ে রেখে শুধোল, এ-মূর্তিগুলো প্রথম সারির মূর্তিগুলোর অংশ হিসাবে আঁকা হয়েছিল, না একেবারে আলাদাভাবে দেখানো হয়েছিল, তা লক্ষ করেছিলেন কি?
দরজার অন্য পাল্লায় ছিল ছবিগুলি।
এক্সেলেন্ট! এতক্ষণে দারুণ একটা পয়েন্ট পাওয়া গেছে। শুনে আমার আশা জাগছে, মি. কিউবিট। তারপর? থামবেন না, আপনার রীতিমতো ইন্টারেস্টিং রিপোর্টের বাকিটুকুও বলে ফেলুন।
আমার আর বিশেষ কিছু বলার নেই, মি. হোমস। সে-রাত্রে আমি স্ত্রীর ওপর বাস্তবিকই রেগে গেছিলাম আমাকে এ-রকম বেমক্কাভাবে আটকে রেখে রাসকেলটাকে পগার পার হতে দেওয়ার জন্যে! আমাকে ওভাবে জাপটে না-ধরলে আমি স্কাউন্ট্রেলটাকে জন্মের মতো শিক্ষা দিয়ে দিতাম। এলসি শুধু কাঁদো কাঁদো ভাবে বললে, পাছে আমি বিপদে পড়ি, তাই আমাকে সে আটকেছে। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল, আসল ব্যাপারটা ঠিক তার উলটো। আমি নয়, এলসির ভয়, লোকটা পাছে বিপদে পড়ে। কেননা, এলসি যে নিশাচর মূর্তিটাকে চেনে আর বিদঘুটে নিশানগুলোর মানে জানে সে-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ওর স্বরে এমন এক সুর আছে, ওর চোখে এমন এক দৃষ্টি আছে যে, এ-রকম সন্দেহ মনে এলেও তা টেকে না! আমার বিশ্বাস, এলসি সত্য কথাই বলেছে। আমার মঙ্গলের জন্যই আমাকে ওভাবে আটকে রেখেছিল বেচারি। আমার রিপোর্ট শেষ হয়েছে, মি. হোমস। এখন প্রয়োজন আপনার পরামর্শের। আমার ইচ্ছে, খামারের জনা ছয়েক ছোকরাকে পাহারা বসাই। রাসকেলটাকে ধরে বেশ করে, উত্তম-মধ্যম দিলেই স্বপ্নেও আর এমুখো হবে না হতভাগা।
অত সোজা দাওয়াইয়ে এ-কেসের কোনো সুরাহা হবে না, মি. কিউবিট। বলল হোমস। কাগজগুলো রেখে যান। খুব শিগগিরই আসছি আপনার ওখানে। তখনই আপনার কৌতূহল খানিকটা মেটাতে পারব বলে মনে হয় আমার।
মি. হিলটনের চওড়া পিঠ দরজার আড়ালে যাওয়ামাত্র হোমস ছিলেছেড়া ধনুকের মতো লাফিয়ে উঠে টেবিলের সামনে বসে মেলে ধরল কাগজগুলো। তারপর শুরু হল অত্যন্ত জটিল এবং সূক্ষ্ম গণনার পালা।
পুরো দু-ঘণ্টা ধরে রাশি রাশি অঙ্ক আর অক্ষর নিয়ে তন্ময় হয়ে কাগজের পর কাগজ ভরিয়ে চলল হোমস। তারপর খস খস করে লেখা হল সুদীর্ঘ একটা টেলিগ্রাম। আমার দিকে ফিরে বলল, ওয়াটসন, টেলিগ্রামের উত্তর যদি আমার আশানুরূপ হয়, তাহলে একটা তোফা কেসের বিবরণ লেখার জন্য তৈরি থেকো।
কিন্তু দুটো দিন কেটে গেল অধীর প্রতীক্ষায় টেলিগ্রামের উত্তর এসে পৌঁছোল না। এই দু-দিন দরজায় সামান্য শব্দ শুনলেই কান খাড়া করে বসে থাকত হোমস। দ্বিতীয় দিনের সন্ধ্যায়। একটা চিঠি এসে পৌঁছোল হিলটন কিউবিটের কাছ থেকে। খবর সব ভালো। সেদিনই সকালে সূর্যঘড়ির নীচে মস্ত লম্বা একটা নাচিয়েদের সারি পাওয়া গেছে। কপিটা চিঠির সঙ্গেই এসেছিল :
বেশ কয়েক মিনিট আবোল-তাবোল বিদকুটে মূর্তিগুলোর ওপর ঝুঁকে রইল হোমস, তারপরেই আচম্বিতে তড়াক করে লাফিয়ে উঠেই এক চিৎকার। শুনেই বুঝলুম, যেমন অবাক হয়েছে, তেমনই হতাশ হয়েছে সে। দারুণ উদবেগে চোখ-মুখের ভাবও পালটে গেল নিমেষের মধ্যে।
ওয়াটসন, খামোখা দেরি করে অনেক দূর গড়িয়ে এনেছি ব্যাপারটাকে। আজ রাতেই নর্থ ওয়ালস্যামের দিকে কোনো ট্রেন আছে?
টাইমটেবিল উলটে দেখলাম লাস্ট ট্রেন ছেড়ে গেল এইমাত্র।
হোমস বললে, তাহলে কাল ভোরে উঠে ব্রেকফার্স্ট খেয়েই ছুটতে হবে স্টেশনের দিকে। যেভাবেই হোক প্রথম ট্রেন ধরে যত তাড়াতাড়ি পারি নরফোকে পৌঁছাতে হবে আমাদের, ওয়াটসন। এই তো এসে গেছে টেলিগ্রামটা। এক সেকেন্ড, মিসেস হাডসন–উত্তর থাকলে নিয়ে যাবেন। না, ঠিকই আছে দেখছি, যা ভেবেছিলাম তাই। খবরটা পাওয়ার পর উদবেগ আরও বাড়ল। আমাদের উচিত, এখন আর একটু দেরি না-করে মি. হিলটন কিউবিটকে সব জানানো। ব্যাপারটা উনি যতটা সহজ ভেবেছেন ততটা সহজ নয়। অত্যন্ত সাংঘাতিক বিপদের জালে জড়িয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক।
নর্থ ওয়ালস্যামে সবে নেমে জিজ্ঞাসাবাদ করছি আমাদের গন্তব্যস্থান সম্বন্ধে, এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে শুধোলেন স্টেশন মাস্টার আপনারা নিশ্চয় ডিটেকটিভ? লন্ডন থেকে আসছেন, তাই না?
বিরক্তির ছায়া ভেসে যায় হোমসের মুখের ওপর দিয়ে।
এ-রকম ধারণা কী করে হল আপনার?
কেননা, নরউইচ থেকে এইমাত্র এসে পৌঁছোলেন ইনস্পেকটর মার্টিন। আপনারা সার্জনও হতে পারেন। মেয়েটি মরেনি–মানে, একটু আগে পর্যন্ত শুনলাম সে বেঁচে আছে। আপনারা তাড়াতাড়ি গেলে হয়তো প্রাণটা রক্ষা পাবে। কিন্তু তাতে লাভই-বা কী–শেষ পর্যন্ত ফাঁসিকাঠে তো ঝুলতে হবেই।
উদ্বেগে কালো হয়ে উঠল হোমসের মুখ।
আমরা রিডলিং থর্প ম্যানরে যাব বলেই এসেছি। কিন্তু কী ব্যাপার বলুন তো? সিরিয়াস কিছু ঘটেছে নাকি?
ব্যাপার শুধু সিরিয়াস নয়, অতি ভয়ানক। একই রিভলভার দিয়ে পর পর গুলি করা হয়েছে দুজনকে। গুলি চালিয়েছেন মিসেস কিউবিট নিজে। প্রথমে স্বামীর ওপর, পরে নিজের ওপর। মি. কিউবিট মারা গেছেন। মিসেসের অবস্থা খুবই খারাপ! কী সর্বনাশ। নরফোকের এত বড়ো একটা নামকরা বনেদি বংশের এ কী হাল হল!
আর দ্বিতীয় শব্দটি উচ্চারণ না-করে একটা ভাড়াটে গাড়িতে চেপে বসল হোমস। দীর্ঘ সাত মাইল পথে একবারও মুখ খুলতে দেখলাম না তাকে। অনেকক্ষণ পর জেগে উঠল নরফোক উপকূলের সবুজ কিনারার ওপর জার্মান সমুদ্রের বেগুনি বলয়-রেখা। একধারে গাছপালার মাথার ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল পুরোনো আমলের ইটকাঠে তৈরি দুটো বড়ো বড়ো খিলেন। চাবুক তুলে খিলেন দুটি দেখিয়ে হেঁকে উঠল গাড়োয়ান, রিডলিং থর্প ম্যানর—।
গাড়িবারান্দার দিকে যেতে টেনিস-লনের পাশে লক্ষ করলাম অদ্ভুত এই কাহিনির সঙ্গে বিজড়িত কালো রঙের টুল-হাউস আর বেদিওলা সূর্যঘড়িটা! দু-চাকার একটা উঁচু ঘোড়ার গাড়ি থেকে সবেমাত্র চালাকচতুর চেহারার চটপটে খর্বকায় একটি পুরুষ নেমে দাঁড়িয়েছিলেন। মোম দিয়ে পাকানো গোপ নেড়ে নিজের পরিচয় দিলেন ভদ্রলোক—নরফোক কন্সট্যাবুলারির ইনস্পেকটর মার্টিন। বন্ধুবরের নাম শুনে কিন্তু রীতিমতো আশ্চর্য হয়ে গেলেন ইনস্পেকটর?
অবাক কাণ্ড দেখছি! খুনটা হয়েছে রাত প্রায় তিনটের সময়ে। কিন্তু লন্ডনে বসে এত তাড়াতাড়ি খবর পেয়ে আমার সঙ্গেসঙ্গেই এসে পৌঁছোলেন কেমন করে, তা বুঝলাম না তো মি. হোমস?
আমি আগে থেকেই অনুমান করেছিলাম খুন-জখম যা হয় একটা কিছু হবে। এবং তা রোধ করতেই আমার নরফোকে আসা।
তাহলে আমার চাইতে অনেক খবরই রাখেন আপনি। আমি তো মশাই ভেবেই পাচ্ছি না কী করে শুরু করা যায় তদন্ত–মি. এবং মিসেস কিউবিটের দাম্পত্য-প্রেমের কথা কে-না জানে বলুন?
হোমস বললে, প্রমাণ শুধু একটাই পেয়েছি আমি এবং তা হচ্ছে নাচিয়েদের মূর্তি। সব কথা আমি পরে খুলে বলবখন।
ইনস্পেকটর মার্টিন বুদ্ধিমান পুরুষ। হোমসকে তার খুশিমতো কাজ করতে দিয়ে নিজে শুধু ফলাফলগুলো সযত্নে নোট করে নিতে লাগলেন। মিসেস হিলটন কিউবিটের ঘর থেকে একজন সাদা চুল প্রবীণ ভদ্রলোক এসে খবর দিলেন, ভদ্রমহিলার আঘাত সিরিয়াস তো বটেই, কিন্তু মারাত্মক নয়। শুনলাম, ভদ্রলোক এ-অঞ্চলের সার্জন। আরও বললেন, বুলেটটা গেছে মগজের সামনের দিক দিয়ে এবং খুব তাড়াতাড়ি জ্ঞান ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। মিসেস কিউবিট নিজেই নিজেকে গুলি করেছেন, না, অন্য কেউ তাকে গুলি করেছে এ-প্রশ্নের উত্তরে কোনো মতামত প্রকাশ করতে রাজি হলেন না ভদ্রলোক। বুলেটটি অবশ্য ছোড়া হয়েছে খুবই কাছ থেকে। ঘরের মধ্যে পাওয়া গেছে শুধু একটা পিস্তল–দুটো ব্যারেল তার খালি। মি. হিলটন কিউবিটের হৃৎপিণ্ড এফেঁড়-ওফোড় হয়ে গেছে গুলিতে। এমনও হতে পারে যে, আগে মি. কিউবিট মিসেসকে গুলি করার পর আত্মহত্যা করেছেন। অথবা, মিসেস কিউবিট স্বামীকে খুন করার পর আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছেন। রিভলভারটা দুজনের মাঝখানেই মেঝের ওপর পড়ে থাকতে দেখা গেছে তাই সন্দেহ দুজনের ওপরেই পড়েছে।
আপনি অত্যন্ত বিচক্ষণ পুরুষ ডক্টর। আপনাকে খবর পাঠিয়েছিল কে? শুধোল হোমস।
সন্ডার্স–এ-বাড়ির ঘরকন্নার কাজ দেখাশুনা করে সে।
সে-ই কি সবাইকে ডেকে তোলে?
সে আর রাঁধুনি–মিসেস কিং।
কোথায় তারা?
খুব সম্ভব রান্নাঘরে।
তাহলে এখুনি তাদের ডেকে আনা যাক। আদ্যোপান্ত ব্যাপারটা ওদের মুখেই শুনতে চাই আমি।
জেরার উত্তরে দুজন স্ত্রীলোকই একই কথা বলে গেল গড়গড় করে। ফায়ারিংয়ের দারুণ শব্দে একই সাথে ঘুম ভেঙে যায় দুজনের এবং এক মিনিট যেতে-না-যেতেই শোনা যায় আর একবার গুলি ছোড়ার আওয়াজ। পাশাপাশি ঘরে ঘুমোয় দুজন। তাই ঘুম ভাঙতেই আগে মিসেস কিং ছুটে যায় সন্ডার্সের ঘরে। তারপর দুজন মিলে দুড় দুড় করে নীচে নেমে এসে দেখে দু-হাট করে খোলা স্টাডির দরজা; আর টেবিলের ওপর জ্বলছে একটা মোমবাতি। ঘরের মাঝখানে মুখ থুবড়ে পড়ে ছিলেন মি. কিউবিট।
খুব সম্ভব দেহে তখন প্রাণ ছিল না। জানলার সামনের দেওয়ালে মাথা হেলিয়ে গুড়ি দিচ্ছিলেন মিসেস কিউবিট। বীভৎসভাবে জখম হয়েছিলেন তিনি; কেননা মুখের একটা পাশ রক্তে একেবারে ভেসে গেছিল। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন উনি, কিন্তু কথা বলার ক্ষমতা তার ছিল না। জানলার ছিটকিনি তোলা ছিল ভেতর থেকে। এ-বিষয়ে দুজনের মধ্যে বিরোধ দেখা গেল না। দেরি না-কবে তখুনি দুজনে ডাক্তার আর কনস্টেবল ডাকতে লোক পাঠায়। তারপর, সহিস আর আস্তাবলের ছোকরাটাকে ডেকে এনে ধরাধরি করে মিসেস কিউবিটকে তুলে নিয়ে যায় তার শোবার ঘরে। কা-গিন্নি দুজনেই শুয়ে ছিলেন শয্যায়। সাধারণ পোশাক পরেছিলেন মিসেস, কিন্তু মিস্টার কিউবিট রাত্রিবাসের ওপর ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে নিয়েছিলেন। স্টাডির আর কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া হয়নি। যতদূর তারা জানে, স্বামী-স্ত্রীতে কোনোদিন ঝগড়া করতে দেখা যায়নি। দুজনেই দুজনকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন এবং বাস্তবিকই বড়ো সুখী দম্পতি ছিলেন।
চাকরবাকরদের জেরা করার ফলে প্রধান পয়েন্ট পাওয়া গেল এই ক-টাই। ইনস্পেকটর মার্টিনের প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল প্রত্যেকটা দরজা ভেতর থেকে বন্ধ থাকায় কারো পক্ষেই বাড়ি থেকে সরে পড়া সম্ভব নয়। হোমসের প্রশ্নের জবাবে বললে, ফায়ারিংয়ের শব্দ শুনে ওপরের তলার ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসবামাত্র বারুদের বিশ্রী গন্ধ ভেসে আসে দুইজনের নাকেই। শুনে হোমস ইনস্পেকটর মার্টিনকে বললে, এ-পয়েন্টটা একটু ভালো করে ভেবে দেখবেন ইনস্পেকটর। আচ্ছা, এবার তো মনে হয় অনায়াসেই আমরা ঘরটাকে পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
স্টাডি-রুমটা বিশেষ বড়ো নয়। তিনদিকে সাজানো বই, আর বাগানের দিকে মুখ করা সাদাসিদে জানলার সামনে লেখবার টেবিল। ঘরের মাঝেই লম্বা হয়ে পড়ে ছিল হতভাগ্য মি. কিউবিটের বিশাল দেহ। প্রথমেই আমরা ঝুঁকে পড়লাম তার ওপর। বিস্বস্ত জামাকাপড় দেখে মনে হল ঘুম ভাঙতেই খুব চটপট বেরিয়ে পড়তে হয়েছে তাকে। গুলিটা ছোড়া হয়েছে সামনের দিক থেকে এবং হৃৎপিণ্ড এফেঁড়-ওফোঁড় করেও তখনও দেহের মধ্যে থেকে গেছে বুলেটটা। মৃত্যু খুবই আকস্মিক এবং যন্ত্রণাবিহীন। হাতে অথবা ড্রেসিং গাউনে বারুদের কোনো দাগ দেখা গেল না। ডাক্তার বললেন, মিসেস কিউবিটের মুখে বারুদের চিহ্ন পাওয়া গেছে কিন্তু দুটো হাতই একদম পরিষ্কার।
হোমস বললে, হাতে বারুদের দাগ নেই অর্থাৎ কোনো ঘোরপ্যাঁচ মানেও নেই। থাকলেই কিন্তু যত গোলমেলে সম্ভাবনার কথা এসে পড়ে। খারাপভাবে লাগানো কার্তুজ থেকে পেছন দিকে বারুদ না-ছিটকোলে হাতে কোনো দাগ না-ফেলে এন্তার ফায়ার করা চলে। তাহলে, ইনস্পেকটর, এবার মি. কিউবিটের লাশ সরানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ভালো কথা, ডক্টর, মিসেস কিউবিটের দেহ থেকে বুলেটটা বার করেছেন নাকি?
বুলেট বার করতে গেলে এখন বড়ো রকমের অপারেশনের দরকার। কিন্তু রিভলভারে তো এখনও চারটে কার্তুজ রয়েছে দেখছি। ছোড়া হয়েছে মাত্র দুটো এবং হতাহতের সংখ্যাও দুজন। সুতরাং–
সেইরকমই মনে হয় বটে। জানলার ধারে যে-বুলেটটা লেগেছিল, আমার তো মনে হয় তার হিসেবটাও আপনি দিয়ে দিতে পারবেন।
বলেই, আচম্বিতে সবাইকে চমকে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল হোমস। দীর্ঘ, শীর্ণ আঙুল তুলে দেখাল জানলার পাল্লায় নীচের দিক থেকে ইঞ্চিখানেক ওপরে একটা পরিষ্কার ফুটো।
বাই জর্জ! এ-জিনিস আপনার চোখে পড়ল কী করে? সোল্লাসে চিৎকার করে ওঠেন ইনস্পেকটর মার্টিন!
কেননা, আমি এ-ঘরে ঢুকে খুঁজছিলাম ফুটোটাকে।
ওয়ান্ডারফুল। এবার ডাক্তারের উচ্ছ্বসিত হওয়ার পালা। আপনার অনুমান নির্ভুল, স্যার। দুবার নয়, ফায়ার করা হয়েছে মোট তিনবার এবং দুজন নয়, সবসুদ্ধ তিনজন হাজির ছিল খুনের দৃশ্যে। কিন্তু কে সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি? আর কী করেই-বা উধাও হল দরজা-জানলা বন্ধ বাড়ির ভেতর থেকে?
সেই সমস্যাই এবার আমাদের সমাধান করতে হবে, বললে শার্লক হোমস! ইনস্পেকটর মার্টিন, আপনাকে একটা পয়েন্ট বিশেষ করে স্মরণে রাখতে বলেছিলাম, আশা করি তা ভুলে যাননি। মনে পড়ছে না? চাকরবাকদের জবানবন্দিতে শুনলেন না, ওপরতলার ঘর থেকে বেরোনোমাত্র বারুদের গন্ধ ভেসে এসেছিল তাদের নাকে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিন্তু, স্যার, বিনা দ্বিধায় স্বীকার করছি–এ-পয়েন্ট মনে রেখে আমার লাভটা কী, তা আমি একেবারেই বুঝতে পারছি না।
আশা করি এবার পারবেন। ওপরতলায় বারুদের গন্ধ পাওয়ার অর্থ শুধু একটাই–গুলি ছোড়ার সময়ে ঘরের দরজা জানলা দুটোই ভোলা ছিল। তা না-হলে পোড়া বারুদের গন্ধ এত তাড়াতাড়ি বাড়ির মধ্যে ঢুকে যেতে পারত না। দমকা হাওয়ার ঝাঁপটা থাকায় ধোঁয়া একেবারে ওপরতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। অবশ্য খুব অল্পক্ষণের জন্যই ভোলা ছিল দরজা জানলা দুটো।
এ-ধারণার প্রমাণ?
তা না-হলে মোমবাতিটা নিভে যেত।
ক্যাপিটাল? রীতিমতো চেঁচিয়ে ওঠেন ইনস্পেকটর। ক্যাপিটাল!
খুনের সময়ে জানলা খোলা ছিল। এ-বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর ভাবলাম তাহলে নিশ্চয় কোনো তৃতীয় ব্যক্তি হাজির ছিল সে সময়ে। খোলা জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে গুলি চালিয়েছে সে-ই। কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে তার ওপর গুলি চালালে জানলার পাল্লায় তা লাগলেও লাগতে পারে। তাই খুঁজছিলাম যদি কোনো ফুটো-টুটো পাই এবং দেখতেই তো পাচ্ছেন–আমার খোজা বৃথা যায়নি–এই সেই বুলেটের দাগ!
কিন্তু জানলাটা ভেতর থেকে বন্ধই-বা হল কি কেমন করে, ছিটকিনিই-বা পড়ল কেমন করে?
গুলি ছোড়াছুড়ির সঙ্গেসঙ্গে ছুটে এসে জানলা টেনে বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দেওয়াই তো মিসেস কিউবিটের পক্ষে স্বাভাবিক, তাই নয় কি? আরে, এ কী দেখছি?
জিনিসটা একটা লেডিজ হ্যান্ডব্যাগ। কুমিরের চামড়ার ওপর রুপোর কারুকার্য করা রুচি-সুন্দর ছোট্ট ব্যাগটা পড়ে ছিল স্টাডির টেবিলের ওপর। হোমস ব্যাগটা উপুড় করে ধরলে টেবিলের ওপর; রবার ব্যান্ড লাগানো কুড়িটা পঞ্চাশ পাউন্ডের ব্যাঙ্ক অফ ইংলন্ডের নোট ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না ভেতর থেকে।
নোট সমেত ব্যাগটা ইনস্পেকটরের হাতে তুলে দিয়ে হোমস বললে, জিনিসটা সাবধানে রেখে দিন–মোকদ্দমা চলার সময়ে কাজে আসবে। এবার তিন নম্বর বুলেটের রহস্য নিয়ে একটু মাথা ঘামানো যাক। কাঠের টুকরোটা যেভাবে উড়ে গেছে আর চোচগুলো যেদিকে মুখ করে রয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে গুলিটা ছোড়া হয়েছে ঘরের ভেতর থেকে। এ-সম্পর্কে মিসেস কিংয়ের সঙ্গে আর এক প্রস্থ আলোচনা দরকার।… এই যে মিসেস কিং, তখন বলছিলে ফায়ারিংয়ের দারুণ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেছিল তোমার? এ-কথা বলার মানে কী? তোমার কি মনে হয়, দ্বিতীয় শব্দের চেয়ে অনেক জোরালো হয়েছিল প্রথমটা?
শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেছিল ঠিকই, কিন্তু কোন আওয়াজটা বেশি আর কোনটা কম, তা বলা কঠিন। তবে স্যার, আওয়াজটা খুব জোরে বলেই মনে হয়েছিল।
দুটো রিভলভার থেকে একসঙ্গে গুলি ছোড়া হয়েছিল মনে হয়?
আজ্ঞে, তা তো বলা মুশকিল।
হ্যাঁ, তাই হয়েছিল। এ-বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ইনস্পেকটর মার্টিন, আমার তো মনে হচ্ছে–এ-ঘরে আর কিছু করার নেই আমাদের। এবার চলুন, বাগানটা ঘুরে দেখা যাক যদি নতুন কিছু প্রমাণ-টমান পাওয়া যায়।
স্টাডির জানলার ঠিক নীচেই ফুলের চওড়া ঝোপটার কাছাকাছি এসেই আমরা প্রত্যেকেই চিল্কার করে উঠলাম মহা উল্লাসে। ঝরাফুলগুলোকে কে যেন নির্দয়ভাবে মাড়িয়েছে, নরম মাটির ওপর তারই অগুনতি পায়ের ছাপ। ছাপগুলো পুরুষের পায়ের। অদ্ভুত রকমের লম্বা, আঙুলগুলো ছুঁচলো। ঘাসপাতা নেড়ে উলটে ফুঁ দিয়ে এমন কাণ্ড জুড়ে দিলে হোমস যেন মুখ দিয়ে লালা ঝরিয়ে শিকারি কুকুর হয়ে খুঁজছে গুলি-খাওয়া পাখিকে। তারপরেই দারুণ খুশির চিৎকার ছেড়ে তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠল সে–হাতে তার পেতলের তৈরি ছোট্ট একটা সিলিন্ডার।
যা ভেবেছিলাম, তাই। রিভলভারটায় ইজেক্টর ছিল, তাই খালি খোলটা ছিটকে পড়েছে এখানে।ইনস্পেকটর মার্টিন, এই হল আপনার তিন নম্বর কার্তুজ এবং আমার কেসও প্রায় সম্পূর্ণ।
হোমসের তদন্ত ধারার দ্রুত কর্তৃত্বময় অথচ নির্ভুল কার্যপরম্পরা দেখে রীতিমতো তাজ্জব বনে গেছিলেন বেচারি ইনস্পেকটর মার্টিন। প্রথম প্রথম দু-একটা কথা বলে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এখন এমনই অভিভূত হয়ে পড়লেন যে বাঙনিস্পত্তি না-করে হোমসের প্রতিটি নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই বোধ হয় বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ বলে মনে করলেন তিনি।
শুধোলেন, কাকে সন্দেহ হয় আপনার?
সে-প্রসঙ্গে পরে আসছি। প্রথম থেকেই তো কেসটার অনেক পয়েন্ট অপরিষ্কার থেকে গেছে আপনার কাছে, এটাও না হয় থাকুক। পরে একসাথে সব কিছু খোলসা করা যাবে, কি বলেন?
যা অভিরুচি আপনার। আমার শুধু খুনিটাকে পেলেই হল।
মিছিমিছি সাসপেন্স বানাবার কোনো অভিলাষ আমার নেই, ইনস্পেকট্টর মার্টিন! কিন্তু এই মুহূর্তে লম্বা-চওড়া জটিল বক্তৃতা দিয়ে রহস্য কী করে সমাধান করলাম, তা বলবার সময়ও নেই। এ-ব্যাপারের সবকটি গুটি আমার হাতে। এখন যদি মিসেস কিউবিটের জ্ঞান নাও ফিরে আসে, তাহলেও জানবেন, গত রাতে এ-বাড়িতে যেসব কাণ্ড ঘটেছে, তার প্রতিটি আপনাদের শোনাবার মতো ক্ষমতা আমার আছে। আমার লক্ষ্য শুধু একটি এবং তা যেনতেনপ্রকারেণ অপরাধীর সমুচিত শাস্তি-বিধান। প্রথমেই আমি জানতে চাই, এ-অঞ্চলে এলরিজি নামে কোনো সরাইখানা আছে কি না?
চাকরবাকরেরা সবাই একবাক্যে জানালে যে এ-নামের কোনো সরাইখানা ধারেকাছে কোথাও আছে বলে তাদের জানা নেই। তবে আস্তাবলের ছোকরাটা একটু কিন্তু কিন্তু করে বললে, সরাইখানা নেই বটে, তবে এলরিজি নামে এক চাষা মাইল কয়েক দূরে ইস্ট রাস্টনের দিকে থাকে।
খামারবাড়িটা খুব নিরালা নাকি?
আজ্ঞে হ্যাঁ, দারুণ নিরালা।
এ-বাড়িতে রাত্রে যেসব কাণ্ডকারখানা ঘটেছে, নিশ্চয় এখনও পর্যন্ত সেসব খবর ওদের কানে পৌঁছোয়নি।
আজ্ঞে, খুব সম্ভব না।
কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে চিন্তা করল হোমস, তারপর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক বিচিত্র হাসি।
বললে, চটপট একটা ঘোড়ার জিন চাপিয়ে তৈরি হয়ে নাও। একটা চিঠি দিচ্ছি–এক্ষুনি দিয়ে এসো এলরিজির খামারবাড়িতে।
পকেট থেকে নাচিয়েদের ছবি আঁকা কাগজের টুকরোগুলো বার করল হোমস। তারপর স্টাডির টেবিলে বসে, কাগজগুলো সামনে মেলে ধরে বেশ কিছুক্ষণ ব্যস্ত হয়ে রইল। ইতিমধ্যে ছোকরাটা তৈরি হয়ে আসতে ছোট্ট একটা চিরকুট তার হাতে দিয়ে কড়া নির্দেশ দিয়ে দিলে হোমস, ওপরে যার নাম লেখা, শুধু তারই হাতে চিরকুটটা দিয়ে এবং কোনো প্রশ্নের জবাব না-দিয়ে যেন সিধে ফিরে আসে সে এখানে। হোমসের হাতের লেখা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মুক্তোর মতো গোটা গোটা। কিন্তু চিরকুটের ওপর দেখলাম আঁকাবাঁকা হোঁচট-খাওয়া কায়দায় লেখা : মি. অ্যাবি স্ল্যানে, এলরিজির খামারবাড়ি, ইস্ট, নরফোক।
ইনস্পেকটর মার্টিনকে হোমস বললে, আমার অনুমানই যদি সত্য হয়, আমার গণনা যদি নির্ভুল হয়, তাহলে অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রকৃতির একটা লোককে আপনাকে হাতকড়া লাগিয়ে হাজতে ঢোকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সুতরাং, আমার মনে হয় আপনি এখুনি একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিন আরও পাহারাদারের জন্যে। এই ছোকরাই আগে টেলিগ্রামটা পৌঁছে দিয়ে তারপর চিঠি নিয়ে রওনা হবে এলরিজির খামারবাড়িতে। ওয়াটসন, বিকেলের দিকে লন্ডনের কোনো ট্রেন থাকলে আমরা তাতেই ফিরে যাব। কেননা, এখানকার ঝামেলা তো প্রায় চুকে গেল। তা ছাড়া, আমাকে আবার একটা ইন্টারেস্টিং কেমিক্যাল অ্যানালিসিস আজকেই শেষ করতে হবে।
চিরকুট নিয়ে ছোকরাটা রওনা হয়ে যাওয়ার পর, হোমস চাকরবাকরদের ডেকে কড়া হুকুম দিয়ে দিলে, যদি আগন্তুক এসে মিসেস কিউবিট-এর সঙ্গে দেখা করতে চায়, তাহলে তাকে তার অবস্থা সম্বন্ধে কোনো খবর না-জানিয়ে যেন সিধে নিয়ে আসা হয় ড্রয়িং রুমে। বার বার এই ক-টা পয়েন্টেই এমনভাবে জোর দিয়ে বোঝাতে লাগল হোমস যে, দেখেশুনে মনে হল অনেক কিছুই নির্ভর করছে এর উপর। তালিম দেওয়া শেষ হলে পর হোমস এবার পড়ল আমাদের নিয়ে। হাতের তির যতক্ষণ-না লক্ষ্যে গিয়ে বিধছে ততক্ষণ ড্রয়িং রুমে বসে নির্ভেজাল গুলতানি দেওয়া যাক–এই বলে সবাইকে নিয়ে এসে বসল বসবার ঘরে। রোগী দেখার দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে আগেই ডাক্তার বিদায় নিয়েছিলেন। কাজেই আসর জমিয়ে বসলাম আমি, হোমস আর ইনস্পেকটর মার্টিন।
টেবিলের কাছে চেয়ারটা টেনে নিয়ে পকেট হাতড়ে নাচুনেদের বিদঘুটে মূর্তি আঁকা কাগজগুলো বার করল হোমস। তারপর, টেবিলের ওপর মেলে ধরে বললে, ঘণ্টাখানেক সময় যাতে ভালোভাবেই কাটে, সে-ব্যবস্থা করছি। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, এ-জাতীয় হেঁয়ালি আমার কাছে একেবারে নতুন। এ-পদ্ধতির আবিষ্কর্তা যে-ই হোক না, তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মূর্তিগুলো যে আসলে ছদ্মবেশী অক্ষর, তা যেন কেউ ধরতে না-পারে এবং বাচ্চাকাচ্চার এলোপাতাড়ি নকশা ভেবে উড়িয়ে দেয়।
মূর্তিগুলো যে আসলে অক্ষরের প্রতীক, তা জানার পর সব সাংকেতিক লিপির মূল নিয়মটি খাটাতেই জলের মতো সরল হয়ে এল হেঁয়ালির অর্থ। প্রথম বার্তাটি আমার হাতে আসার পর দেখলাম খবরটা অত্যন্ত ছোটো। যদিও এত ছোটো খবর থেকে বিশেষ কিছু জানা সম্ভব নয়। তবুও ওদের মধ্যে একটা প্রতীকের অর্থ যে E, সে-সম্বন্ধে আমার খুব বেশি সন্দেহ ছিল না। জানেন তো, ইংলিশ বর্ণমালার E-র ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। এমনকী একটা ছোটো বাক্যের মধ্যেও বেশ কয়েকবার দেখতে হয় E-র শ্রীমুখ। প্রথম খবরটায় পনেরোটা প্রতীকের মধ্যে চারটে প্রতীক হুবহু এক। সুতরাং এ-প্রতীকের অর্থ যে E, তা ধরে নিলে খুব বেশি অযৌক্তিক হয় না। অবশ্য মাঝে মাঝে প্রতীকটার হাতে নিশান দেখা গেছে। কিন্তু নিশানওলা মূর্তিগুলো পাশাপাশি নেই–ছড়িয়ে আছে সমস্ত খবরটার মধ্যে। সুতরাং আমরা যদি অনুমান করি, নিশানমূর্তি দিয়ে আসলে এক একটা বাক্যের সমাপ্তি চিহ্নিত করা হয়েছে, তাহলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে না। মাথায় অনুমানটা আসার পরেই দেখলাম, E অক্ষরের প্রতীক হল এই মূর্তিটা।
এ পর্যন্ত হল বেশ। কিন্তু আসল ঝামেলা শুরু হল এর পরেই। E-র পরেই কোন ইংলিশ অক্ষরটির জোর বেশি এ-সম্বন্ধে কেউই কোনো পাকাঁপাকি সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। আপনি হয়তো দেখলেন, একটা পাতার মধ্যে E-র পরেই অমুক অক্ষর গড়ে সবচেয়ে শক্তিশালী। তারপরেই আবার দেখলেন, একটা ছোটো বাক্যের মধ্যেই সে-অক্ষরটিকে দাবিয়ে দিয়েছে আরও কয়েকটা অক্ষর ঘন ঘন তাদের শ্রীমুখ দেখিয়ে। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে T, A, 0, ।, N, s, H, R, D আর L-কে সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক দিয়ে এইভাবে পর পর সাজানো যায়। এদের মধ্যে আবার T, A, 0 আর 1 এত ঘেঁষাঘেঁষি যে কে বেশি পাওয়ারফুল তা বলা বড়ো মুশকিল। তাই নতুন খবরের অপেক্ষায় রইলাম। মি. হিলটন কিউবিটের সাথে আমার দ্বিতীয়বার মোলাকাত হওয়ার পর পেলাম দুটো ছোটো সেনটেন্স আর একটা খবর। খবরটায় কোনো নিশান না-থাকায় একটা গোটা শব্দ বলেই মনে হল। এই দেখুন প্রতীকগুলো। যেটাকে একটা শব্দ বলে মনে হয়েছে, তার মধ্যে E এসেছে দু-বার দ্বিতীয় স্থানে আর চতুর্থ স্থানে শব্দটার মোট অক্ষর সংখ্যা পাঁচ। ফলে SEVER, LEVER অথবা NEVER শব্দটা ব্যবহার করা যেতে পারে কোনো কাকুতিমিনতির উত্তরে। এবং এক্ষেত্রে এই অনুমানটাই স্বাভাবিক এই কারণে, এর আগে মি. কিউবিটের মুখে যা সব শুনেছি, তাতে মনে হয়, মিসেস কিউবিটের কোনো চিঠির উত্তরে NEVER শব্দটা লিখে গেছে আততায়ী। ধরে নিলাম এইটাই ঠিক, তাহলে N, V আর R প্রতীক দাঁড়াচ্ছে, যথাক্রমে :
তখনও কিন্তু আমার মুশকিল আসান হয়নি, কাটেনি অন্ধকারের ঘোর। ঠিক এমনি সময় একটা কথা মাথায় আসতেই খানিকটা আলোর মুখ দেখলাম। হাতে তখন বেশ কয়েকটা চিঠি রয়েছে। ভাবলাম, আততায়ী যদি মিসেস কিউবিটের পূর্বপরিচিত হয় এবং অতীত-জীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকে, তাহলে যে পাঁচ অক্ষরওলা শব্দের মধ্যে দুটো অক্ষরই E, সেগুলো দিয়ে নিশ্চয় লেখা হয়েছে ELS।E নামটাকে। পরীক্ষা করে দেখলাম, তিন তিনবার খবরের উপসংহারে এমন প্রতীক-শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কাজেই, খবরগুলো যে ELS।E-র উদ্দেশে, সে-বিষয়ে আর সন্দেহ না-থাকাই ভালো। এমনি করে পেলাম L, S আর ।-কে। কিন্তু এ কী ধরনের খবর? এ কি আকুতি, না শুধুই আদেশ? ELS।E-র ঠিক আগেই চার অক্ষরওলা শব্দটার শেষে দেখলাম E। মনে হল, শব্দটা COME হওয়াই উচিত। যতগুলো চার-অক্ষরওলা শব্দের শেষে E আছে, সবকটাতেই চোখ বুলোলাম, কিন্তু বিশেষ সুবিধে হল না। কাজেই, C, 0, M হাতের মুঠোয় আসায় আবার পড়লাম প্রথম খবরটাকে নিয়ে। ছোটো ছোটো শব্দে ভাগ করে ফেললাম খবরটাকে, যে যে অক্ষর বুঝিনি, তাদের জায়গায় ফুটকি বসালাম। এইভাবে পেলাম :
. M. ERF. .ESL. NE.
এখন প্রথম অক্ষরটা A না-হয়ে যায় না, এইটুকু বাক্যের মধ্যেই তিন তিনবার ব্যবহার করা হয়েছে একই প্রতীককে। দ্বিতীয় শব্দে H-কে অনুমান করে নেওয়া চলে। তাহলে বাক্যটা দাঁড়াল এই রকম :
AM HERE A. E SLANE
নামের ফাঁকটায় Y বসাই স্বাভাবিক। তাহলে পাচ্ছি–
AM HERE A. E SLANEY
হাতে অনেকগুলো অক্ষর এসে যাওয়ায় অকুতোভয়ে এবার পড়লাম দু-নম্বর খবরটাকে নিয়ে। প্রতীক-ছদ্মবেশে খসিয়ে দেখা গেল খবরটা দাঁড়াচ্ছে এইরকম :
A ELR।, ES.
ভেবেচিন্তে দেখলাম, ফঁকগুলোয় T আর G বসানো যায়, তাহলেই মোটামুটি একটা মানে পাওয়া যায় খবরটার। ELR।GES নামটা নিশ্চয় কোনো বাড়ি বা সরাইখানার নাম লোকটা আস্তানা গেড়েছে এইখানেই।
প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে শুনছিলাম বন্ধুবর হোমসের হেঁয়ালি উদ্ধারের তাক লাগানো গল্প। জলের মতো পরিষ্কার করে এতবড়ো কঠিন সমস্যাকে বুঝিয়ে দিলে হোমস। সামান্য কতকগুলি নাচুনে মূর্তি, কিন্তু তাদের অঙ্গভঙ্গিরও এত অর্থ?
তারপর, স্যার, কী করলেন তাই বলুন। বললেন ইনস্পেকটর।
ABE SLANEY যে আমেরিকান সে-সম্বন্ধে আমার বিশেষ সন্দেহ ছিল না দুটি কারণে। প্রথমত ABE নামটার চলন আমেরিকাতেই আছে। দ্বিতীয়ত আমেরিকা থেকে আসা একটা চিঠি মিসেস কিউবিটের হাতে পড়তেই যত গোলমালের সূত্রপাত। তা ছাড়া এ-ব্যাপারে গোপন-রহস্যটাও যে আইনানুগ নয় এবং অপরাধ-সংক্রান্ত, আমার এমন বিশ্বাস হওয়ারও যথেষ্ট কারণ ছিল। অতীতের উল্লেখ এবং স্বামীর কাছে সব কথা চেপে যাওয়া শুধু এই দুটো প্রমাণই কি এজন্যে যথেষ্ট নয়? কাজেই টেলিগ্রাম পাঠালাম উইলসন হারগ্রিয়েভকে। উইলসন আমার বন্ধু। নিউইয়র্ক পুলিশ ব্যুরোর একজন হোমরাচোমরা। লন্ডনের অপরাধজীবন সম্বন্ধে আমার সামান্য জ্ঞানকে বহুবার উইলসন কাজে লাগিয়েছে। উইলসনকে জিজ্ঞেস করলাম, অ্যাবি স্ল্যানি নামটা ওর চেনা কি না। উত্তরে উইলসন লিখেছে :শিকাগোর সবচেয়ে বিপজ্জনক খুনে বদমাশ।এ-খবর যেদিন পেলাম, সেদিন সন্ধ্যায় হিলটন কিউবিটের কাছ থেকে পেলাম তার শেষ বার্তা। অক্ষর-পরিচয় আগেই ঘটেছে, তাই ধাঁধার জট ছাড়াতেই খবরটা দাঁড়াল এইরকম :
ELS।E. RE. ARE. TO MEET THY CO.
P আর D বসাতেই সম্পূর্ণ হল খবরটা। পড়ে আঁতকে ওঠার যথেষ্ট কারণ ছিল। প্রথমত, এইটুকু বুঝলাম যে কাকুতিমিনতি ছেড়ে ভয় দেখানো শুরু করেছে আমাদের নিশাচর আততায়ী। দ্বিতীয়ত শিকাগোর নীচুতলায় জাঁহাবাজদের প্রকৃতি সম্বন্ধে আমি একটু আধটু খবর রাখি। তাই, লোকটা যে আর অনর্থক দেরি না-করে চটপট কথামতো কাজ শুরু করে দেবে–তা বুঝলাম। তৎক্ষণাৎ সহকর্মী-বন্ধু ওয়াটসনকে নিয়ে চলে এলাম নরফোকে। কিন্তু এত করেও শেষরক্ষা করতে পারলাম না–প্ল্যাটফর্মে পা দিয়েই শুনলাম যা হবার তা হয়ে গেছে গত রাতেই।
জানলা দিয়ে দেখলাম, লম্বা লম্বা পা ফেলে দরজার দিকে আসছেন এক দীর্ঘকায় পুরুষ। গায়ের রং ময়লা হলেও ভদ্রলোক সুদর্শন, পরনে ধোঁয়াটে ফ্ল্যানেলের সুট, মাথায় পানামা হ্যাট। মস্তবড়ো উদ্ধত নাকটা সামনের দিকে একটু বেঁকানো, গালে-চিবুকে চাপদাড়ি, হাতে চকচকে ছড়ি। স্বচ্ছন্দভাবে ছড়ি ঘুরোতে ঘুরোতে তার হাঁটার ভঙ্গিমা দেখে মনে হল যেন এ-বাড়ির মালিক সে-ই। তারপরেই শুনলাম জোর ঘণ্টাধ্বনি–যেন এক মুহূর্তও আর দেরি সইছে না তার।
শান্তভাবে বলল হোমস, এবার আমাদের দরজার পেছনে দাঁড়াবার সময় হয়েছে। এই ধরনের বিপজ্জনক লোককে বাগে আনতে হলে একটু সাবধান হওয়া ভালো। ইনস্পেকটর হাতকড়া বার করে রাখুন। কথা যা বলার আমিই বলব।
পুরো একটা মিনিট নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম তিনজনে। তুচ্ছ একটা মিনিট, কিন্তু তবুও তো কোনোদিনই ভোলা যায় না। তারপরেই খুলে গেল দরজা–ঘরে ঢুকল ঢ্যাঙা লোকটা। পলকের মধ্যে হোমস পিস্তল ঠেকালে তার মাথায়। আর মার্টিন কবজিতে এঁটে দিলেন হাতকড়া। সমস্ত জিনিসটা এত তাড়াতাড়ি, এত নিপুণভাবে শেষ হয়ে গেল যে, আক্রান্ত হয়েছে এ-কথা বোঝবার আগেই অসহায় হয়ে পড়ল তার অবস্থা। জ্বলন্ত কালো চোখে একে একে আমাদের ওপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিলে সে। তারপরেই এক অট্টহাসি। তিক্ত হাসিতে ব্যর্থতার জ্বালা।
শাবাশ, জেন্টলমেন। এবার দেখছি আপনারাই একহাত নিলেন আমার ওপর। বড়ো কঠিন ঠাঁই মনে হচ্ছে। যাইহোক, মিসেস হিলটন কিউবিটের একটা চিঠি পেয়ে আমি এসেছি। উনি বাড়ি নেই, এ-কথা যেন আবার বলে বসবেন না। ফাঁদটা যে তারই পাতা, এ-খবরও নিশ্চয় শুনতে হবে না আপনাদের কাছে।
মিসেস হিলটন কিউবিট মারাত্মকভাবে জখম হয়েছেন, বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই।
ভাঙা গলায় বিকট চিৎকার করে উঠল লোকটা–সমস্ত বাড়ি গম গম করে উঠল সে চিকারে!
কী আবোল-তাবোল বকছেন আপনি। তীব্রস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে সে। ওর গায়ে কোনো আঁচড়ই লাগেনি–লেগেছে ওই লোকটার বুকে। এলসিকে কেন জখম করতে যাব আমি? ভয় দেখাতে পারি। কিন্তু ওর ওই রেশম-হালকা চুলের একটা গাছিও স্পর্শ করার দুঃসাহস আমার নেই। ফিরিয়ে নিন ফিরিয়ে নিন এসব বাজে কথা। বলুন তার কোনো আঘাত লাগেনি।
মৃত স্বামীর পাশে অত্যন্ত মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায় দেখা গেছে মিসেস কিউবিটকে।
গুঙিয়ে উঠে হাতকড়া লাগানো দু-হাতে মুখ ঢেকে সেটির ওপর এলিয়ে পড়ল সে। পুরো পাঁচ মিনিট সব চুপ। এতটুকু স্পন্দন শব্দ শুনতে পেলাম না তার দিক থেকে। তারপর, মুখ থেকে হাত নামিয়ে চোখ তুলল সে। মুখ দেখে মনে হল যেন চকিতে কোনো অমিতবিক্রমশালী প্রভঞ্জনের বিপুল ফুৎকারে নিমেষে নিভে গেছে তার যত কিছু সাহস, শক্তি আর আত্মবিশ্বাসের দীপশিখা, হারিয়ে গেছে নিচ্ছিদ্র নিরাশার তমিস্রায়।
নিরুত্তাপ স্বরে কথা বলল সে, জেন্টলমেন, কিছুই আর লুকোব না। আমি যদি তাকে গুলি করে থাকি, তবে সে-ও পালটা গুলি করেছিল আমাকে। সুতরাং এতে খুন-টুন কিছু নেই। কিন্তু যদি ভেবে থাকেন এলসিকেও জখম করেছি আমি, তাহলে বলব আমার সম্বন্ধে কিছুই জানেন না আপনারা। এ-দুনিয়ায় আমার চাইতে তাকে বেশি ভালোবেসেছে, এমন কোনো পুরুষ কোনোদিনই ছিল না, এখনও নেই। তার ওপর আমার দাবি অসীম। অনেক বছর আগে আমার বাগদত্তা হয়েছিল সে। আপনারাই বলুন, আমাদের মধ্যে এই ইংলিশম্যানটার আসার কি অধিকার আছে? আবার বলছি, সে আমার। আমি এসেছিলাম আমার সেই দাবিকেই আবার তুলতে।
আপনার স্বরূপ প্রকাশ পেতেই গা ঢাকা দিয়েছিলেন আপনার বাগদত্তা, কঠিন কণ্ঠে বললে হোমস। আপনার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যেই আমেরিকা থেকে পালিয়ে ইংলন্ডে এসে একজন অনারেবল ভদ্রলোককে বিয়ে করেছিলেন তিনি। আপনার সঙ্গে উধাও হতে রাজি হননি তিনি–তাই শেষ পর্যন্ত হিলটন কিউবিটের মতো অভিজাত পুরুষকে বিদায় নিতে হয়েছে এ-দুনিয়া থেকে। আর স্ত্রীকে করতে হয়েছে আত্মহত্যা। মি. অ্যাবি স্ল্যানি, আপনার হাত এসব কিছুর পেছনেই আছে এবং এ-রেকর্ডের উত্তর আপনাকে দিতে হবে আইনের কর্তাদের কাছে।
এলসি যদি মারা যায়, আমি জাহান্নামে যেতেও আর পরোয়া করি না, হাতের মুঠোয় দলা পাকানো একটা চিরকুটে চোখ পড়তেই বাঘের মতো ধারালো চোখে সন্দেহের ঝিলিক হেনে বললে অ্যাবি স্ল্যানি–মিস্টার, এ-সম্পর্কেও গালগল্প ছাড়বেন নাকি? এদিকে তো বলছেন মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে এলসি, তাই যদি হয় তবে এ-চিরকুট কার লেখা শুনি? কাগজের দলাটাকে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিল সে।
আপনাকে আনার জন্যে আমিই লিখেছি।
আপনি লিখেছেন? জয়েন্টের বাইরে তামাম আশমান দুনিয়ার আর কারো পক্ষেই নাচিয়ে মূর্তিদের রহস্য জানা সম্ভব নয়। আপনি লিখলেন কী করে?
হোমস বললে, আজকের যা প্রথম আবিষ্কার কালকে তা পুনরাবিষ্কার–পৃথিবীর ইতিহাসে এনজিরের তো অভাব নেই, মি. স্ল্যানি। যাই হোক, আপনার এখন করণীয় শুধু একটি। সারা দুনিয়াকে আপনি জানিয়ে দিন যে কোনোমতেই কোনো দিক দিয়েই কিউবিট পরিবারের এই শোচনীয় পরিণতির জন্যে মিসেস হিলটন কিউবিটকে দায়ী করা চলে না।
খুব ভালো কথা বলেছেন। আমার এখন উচিত বিনা দ্বিধায় নগ্ন সত্যকে স্বীকার করা এবং আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন মিস্টার, আমি তা করব।
হুঁশিয়ার কিন্তু, আমি আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছি, আপনার প্রতিটি কথা আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহার করব আমরা। ঝটিতি চেঁচিয়ে ওঠেন ইনস্পেকটর মার্টিন। ব্রিটিশ ক্রিমিন্যাল ল-র চমকদার সরলতার যেন একটি মূর্ত প্রতীক।
দু-কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললে স্ল্যানি, সেটুকু ঝুঁকি না হয় নিলামই! জেন্টলম্যান, প্রথমেই আপনাদের জানিয়ে রাখি, এলসি যখন শিশু, তখন থেকেই আমি তাকে চিনি। শিকাগোর একটা দলে সবসুদ্ধ সাতজন ছিলাম আমরা। এলসির বাবা ছিল জয়েন্ট-এর মাথা। ধুরন্ধর লোক এই বুড়ো প্যাট্রিক। নাচিয়েদের বিদঘুটে মূর্তি দিয়ে চিঠি লেখার কায়দা আবিষ্কার করে সে-ই! হেঁয়ালির চাবিকাঠিটা জানা না-থাকলে ছেলেমানুষি আঁকিবুকি বলে উড়িয়ে দেওয়াই স্বাভাবিক এবং এতদিন তাই হয়েছেও। যাক, এলসি আমাদের কাজকর্ম কিছু কিছু শিখে নিয়েছিল। কিন্তু এসব সহ্য না-হওয়ায় নিজের সঞ্চিত কিছু টাকা নিয়ে একদিন সে আমাদের সবার চোখে ধুলো দিয়ে সরে পড়ল লন্ডনে। এলসি আমার বাগদত্তা : যদি এ-পেশা ছেড়ে সৎপথে রোজগার করতাম, তাহলে নিশ্চয় সে বিয়ে করত আমায়। ইংলিশম্যানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তার ঠিকানা পৌঁছোল আমার হাতে। চিঠি লিখলাম কিন্তু উত্তর এল না। বাধ্য হয়ে আসতে হল নিজেকে। চিঠি লিখে কোনো ফল হত না–তাই যাতে তার চোখে পড়ে এমনি জায়গায় সাংকেতিক ভাষায় খবর পাঠাতে শুরু করলাম।
প্রায় মাসখানেক হল এসেছি এখানে। এলরিজির খামারবাড়িতে ডেরা নিয়েছিলাম প্রথম থেকেই। নীচের ঘরে থাকতাম, রাতের অন্ধকারে গা ঢেকে যখন খুশি বেরোতাম–কাকপক্ষীও কোনোদিন টের পায়নি। এলসিকে বার করে আনার সবরকম চেষ্টাই করেছিলাম আমি। খবরগুলো যে তার নজর এড়াচ্ছে না, তা বুঝলাম একদিন যেদিন আমার খবরের নীচেই দেখলাম তার হাতে লেখা একটা লাইন। তখনই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার শুরু হল ভয় দেখানোর পালা। এবার একটা চিঠি পেলাম ওর কাছ থেকে। চিঠিতে এলসি কাকুতিমিনতি করে তার আশা ছেড়ে আমায় চলে যেতে বলেছে। কেননা, স্বামীর মানসম্মানের হানিকর এমন কোনো কেলেঙ্কারি ঘটলে লজ্জায় দুঃখে আত্মঘাতী হতে হবে তাকে। আরও লিখলে, স্বামী ঘুমিয়ে পড়লে রাত তিনটের সময়ে জানলার কাছে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে সে। কিন্তু শর্ত রইল–তারপর আর অশান্তি না-করে এদেশ ছেড়ে চলে যাব আমি অনেক টাকা নিয়ে। নেমে এল এলসি ঘুস দিয়ে চেষ্টা করলে হটিয়ে দেওয়ার! এইতেই খেপে গেলাম আমি। খপ করে হাত ধরে এক হ্যাচকা টানে জানলা দিয়ে বাইরে টেনে আনার চেষ্টা করতেই হাতে রিভলভার নিয়ে তিরবেগে ঘরে ঢুকল তার স্বামী। এলসি মেঝেতে বসে পড়েছিল–মুখোমুখি দাঁড়ালাম দুজনে। আমার উদ্দেশ্য ছিল রিভলভার বার করে ভয় দেখিয়ে সরে পড়া। কিন্তু সেই মুহূর্তে গুলি চালাল লোকটা, আমিও পলক ফেলার আগেই ঘোড়া টিপে পেড়ে ফেললাম তাকে মেঝেতে। বাগানের ওপর দিয়ে সরে পড়ার সময় পেছন থেকে জানলা বন্ধ করার শব্দ শুনলাম। ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলছি জেন্টলমেন, যা বললাম, তার প্রতিটি অক্ষর সত্য। ছোকরাটার হাতে চিরকুটটা পাওয়ার আগে পর্যন্ত কিছুই শুনিনি আমি। খুশিতে ডগমগ হয়ে এসেছিলাম এলসির সাথে দেখা করতে। কিন্তু বদলে পেলাম আপনাদের, আর একজোড়া হাতকড়া।
জানলায় দাঁড়িয়ে পুলিশের গাড়িটাকে কয়েদিসহ টগবগিয়ে চোখের আড়ালে উধাও হয়ে যেতে দেখলাম। তারপর, ফিরে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল টেবিলে রাখা তালগোল পাকানো চিরকুটটাকে। সামান্য এই কাগজটা দিয়ে হোমস অতবড়ো দুর্ধর্ষ লোকটাকে ভুলিয়ে এনেছে। নিজের খপ্পরে।
মুচকে হেসে হোমস বললে, দেখ হে ওয়াটসন, যদি পঙ্কোদ্ধার করতে পার লেখাটার। বিচিত্র চিঠি। অক্ষরের বালাই নেই, শুধু নেচে-কুঁদে এগিয়ে যাওয়া এক সারি মূর্তি :
হোমস বললে, এইমাত্র যে-পদ্ধতি বোঝালাম, তাই দিয়ে চিঠিটার সাদা অর্থ দাঁড়ায় এই এখুনি চলে এস। আমি জানতাম, এ-আমন্ত্রণ এড়ানোর সাধ্য তার নেই, কেননা এ-সাংকেতিক লিপি যে মিসেস কিউবিট ছাড়া আর কারো কাছ থেকে আসতে পারে, তা সে কল্পনাতেও আনতে পারবে না। এতদিন ধরে যে নাচিয়েদের ছবি অশুভ বার্তাই বহন করে এনেছে, নতুন অপরাধ সৃষ্টি করেছে, নির্মম পরিণতির সূচনা করেছে–এই প্রথম সেই নাচিয়েদের শুভ কাজে লাগালাম আমি, কল্যাণ এবং মঙ্গলময় পরিণতির মধ্য দিয়ে মহা কেলেঙ্কারির সম্ভাবনা থেকে দূরে সরিয়ে আনলাম পতিব্রতা মিসেস হিলটন কিউবিটের নামকে। আমি তোমায় কথা দিয়েছিলাম, নতুন লেখার চাঞ্চল্যের উপকরণ দেব। সে-প্রতিশ্রুতিও রইল।
———-
টীকা
নাচিয়েদের নষ্টামি : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ডান্সিং মেন ডিসেম্বর ১৯০৩ সংখ্যার স্ট্যান্ড ম্যাগাজিনে ইংলন্ডে এবং ৫ ডিসেম্মর ১৯০৩-এর কলিয়ার্স উইকলি পত্রিকায় আমেরিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়।
রিডলিং থর্প ম্যানর : স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রকাশিত গল্পে নাম ছিল রিডিং বা রাইডিং (R।d।ng) থর্প ম্যানর। বিশেষজ্ঞরা এটিকে বানান ভুল মনে করেন।
গত বছর জুবিলি উপলক্ষ্যে : রানি ভিক্টোরিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৮৩৭-এ। ১৮৮৭ তার রানি হওয়ার স্বর্ণজয়ন্তী বা গোল্ডেন জুবিলি এবং ১৮৯৭-এ হীরক জয়ন্তী বা ডায়মন্ড জুবিলি উৎসব পালিত হয়। জানা যায়, ওই উৎসবের অঙ্গ হিসেবে রানির প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে পঞ্চাশ হাজার গোখা, ক্যানাডিয়ান এবং জ্যামাইকান সৈনিক কুচকাওয়াজ করে। তা ছাড়া অন্যান্য অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হয়।
সূর্যঘড়ি : প্রথম খণ্ডর টীকা দ্রষ্টব্য।
জার্মান সমুদ্র : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত নর্থ সি বা উত্তর সাগরকে জার্মান সমুদ্রও বলা হত।
নিউ ইয়র্ক পুলিশ ব্যুরো : সঠিক নাম নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট কিংবা নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিটেকটিভ ব্যুরো।
হোমরাচোমরা : কাছাকাছি সময়ে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন টমাস বায়ার্নস। ১৮৮২ থেকে ১৮৯২ পর্যন্ত তিনি ওই পদে কাজ করেন। কিন্তু তারপর দুর্নীতির অভিযোগে চাকরি ছাড়তে হয়। অবশ্য তার বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো অভিযোগ কেউ তোলেনি। পুলিশ চাকরি চলে যেতে একটি বিমা কোম্পানির চাকরিতে যোগ দেন বায়ার্নস।
শিকাগো : গুন্ডামি এবং নানা অসামাজিক কাজে শিকাগোর বদনামের জন্য আল কাপোনেকে দায়ী করা হলেও, কাপোনের সংঘবদ্ধ অপরাধ শুরুর দুই দশক আগে থাকতেই এই শিল্প শহর অপরাধের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করে।
অনেক টাকা : এলসির ব্যাগে পঞ্চাশ পাউন্ডের কুড়িখানা নোট পাওয়া গিয়েছিল। এই হাজার পাউন্ড সে কোথা থেকে পেল, তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
জানলা বন্ধ করার শব্দ : এলসি আত্মহত্যা করার আগে জানলা বন্ধ করতে গেল কেন? তার কোনো দরকার ছিল না।
যে-পদ্ধতি বোঝালাম : বিখ্যাত হোমস-গবেষক উইলিয়ম এস, বেরিং গোল্ড দেখিয়েছেন যে সংকেতে লেখা NEVER-এর V এবং PREPARE-এর P-তে একই মূর্তি ব্যবহার করা হয়েছে। আবার হোমসের সংকেতের C এবং অন্য লেখার M-ও একইভাবে লেখা হয়েছে। অবশ্য এই ভুল ওয়াটসনের কপি করার সময়ে হয়েছে নাকি নিছক ছাপাখানার ভুল সে-সম্পর্কে মন্তব্য করেননি বেরিং-গোল্ড।