রেইগেটের গাঁইয়া জমিদার
[ দ্য রেইগেট স্কোয়ারস ]
১৮৮৭ সালের বসন্তকালে শরীর ভেঙে পড়ে শার্লক হোমসের। শরীরের আর দোষ কী! একটানা ছ-মাস অমানুষিক পরিশ্রম করেছে সে। রোজ পনেরো ঘণ্টা এবং বেশ কয়েকবার একনাগাড়ে পাঁচদিন পর্যন্ত তদন্ত নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। এত ধকল সইবার ক্ষমতা রক্তমাংসের শরীরে থাকে না–হোমসের লৌহকঠিন স্বাস্থ্যও টলে গেছে। যে জন্যে এত পরিশ্রম, সে-কেসে সফল হয়েছে ঠিকই। তিন-তিনটে দেশের পুলিশের ব্যর্থতার পর বিরাট সেই ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়ে সারা ইউরোপে সাড়াও ফেলেছে; অজস্র টেলিগ্রাম-প্রশংসিকায় ঘরের মেঝে ভরে উঠেছে, নিজে কিন্তু বিছানা নিয়েছে ইউরোপের সবচেয়ে ধুরন্ধর জোচ্চোরকে হারিয়ে দেওয়ার বিপুল আনন্দ সত্ত্বেও।
১৪ এপ্রিল লিয় থেকে টেলিগ্রাম পেয়ে ছুটে গেলাম। অসুস্থ হোমসকে তিনদিন পরে নিয়ে এলাম বেকার স্ট্রিটের বাসায়। হাওয়া বদলের দরকার বুঝে ওকে নিয়ে সাতদিন পরে পৌঁছোলাম রেইগেটের আইবুড়ো কর্নেল হেটারের নতুন কেনা বাড়িতে। ভদ্রলোক আমার রুগি ছিলেন আফগানিস্তানে। অনেকদিনের সনির্বন্ধ নিমন্ত্রণ শেষ পর্যন্ত রক্ষে করলাম হোমসকে নিয়ে গিয়ে। ভদ্রলোক আইবুড়ো জেনে হোমসও আপত্তি জানায়নি। পরে দেখা গেল, দুজনেই প্রায় একই ধাতে তৈরি।
যেদিন পৌঁছোলাম, সেইদিন সন্ধেবেলা খাওয়া সেরে কর্নেলের হাতিয়ার-সম্ভার দেখছি আমি, এমন সময়ে কর্নেল বললেন, আজ একটা পিস্তল নিয়ে শুতে হবে দেখছি। বিপদ ঘটতে পারে।
কীসের বিপদ? শুধোই আমি।
চোরের। গত সোমবার এখানকার বুড়ো মোড়ল অ্যাক্টনের বাড়িতে চুরি হয়ে গেছে। চোর ভাগলবা দামি জিনিস চুরি করতে পারেনি।
হোমস এলিয়ে পড়েছিল সোফায়। এখন বললে, সূত্র পাওয়া গেছে?
না। ইন্টারেস্টিং কোনো বৈশিষ্ট্য?
তেমন কিছুই নয়। লাইব্রেরি তছনছ করে ড্রয়ারগুলো টেনে নামিয়েছে চোরের দল। কিন্তু নিয়ে গেছে পোপের লেখা পুরোনো হোমার বইখানা, এক বান্ডিল টোন সুতো, একটা ছোট্ট ওক কাঠের ব্যারোমিটার, একটা হাতির দাঁতের কাগজ-চাপা, দুটো বাতিদান। মানে হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই নিয়েই চম্পট দিয়েছে।
হোমস গজগজ করে বললে, গাঁয়ের পুলিশগুলোও হয়েছে তেমনি—
হোমস, এসেছ জিরোতে, নতুন সমস্যায় মাথা গলালে অনর্থ করব বলে দিলাম, হুঁশিয়ার করে দিলাম আমি।
কিন্তু চেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে, এত করেও আগলাতে পারলাম না বন্ধুবরকে। পরদিন সকাল বেলা প্রাতরাশ খেতে বসে তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।
ছুটতে ছুটতে চলল কর্নেলের বাটলার। নিরুদ্ধ নিশ্বাসে খবর দিলে, কাল রাত বারোটায় চোর পড়েছিল গাঁয়ের জমিদার ক্যানিংহ্যামের বাড়িতে। গুলি করে খুন করে গেছে কোচোয়ান উইলিয়ামকে।
খবর দিয়ে বাটলার বিদেয় হলে কর্নেল বললেন, বুড়ো ক্যানিংহ্যাম কিন্তু লোক ভালো। শেষকালে তার বাড়িতেও চোর পড়ল।
ফের গজগজ করে উঠল হোমস, অ্যাক্টনের বাড়ি থেকে আজব জিনিসপত্র চুরি হবার পর একই গ্রামে ফের হানা দেওয়াটা চোরেদের পক্ষে কিন্তু বেশ অস্বাভাবিক আচরণ। ব্যাপারটা তাই ইন্টারেস্টিং।
এ-অঞ্চলে বর্ধিষ্ণু পরিবার বলতে এই দুটি ফ্যামিলিকেই বোঝায়। তাই চোর হানা দিয়েছে দু-বাড়িতে, বললেন কর্নেল।
টাকাপয়সাও আছে নিশ্চয়? হোমসের প্রশ্ন।
তা তো বটেই। বেশ কয়েক বছর মামলা চলছে দু-পরিবারে। ক্যানিংহ্যামের অর্ধেক সম্পত্তির ওপর দাবি রেখেছে অ্যাক্টন। ফলে পোয়াবারো উকিলদের, দোহন করছে দু-পক্ষকেই।
হাই তুলে হোমস বললে, ভয় নেই ওয়াটসন, আমি নেই এর মধ্যে।
বলতে-না-বলতেই বাটলার এসে খবর দিলে ইনস্পেকটর ফরেস্টার এসেছেন দেখা করতে। পরক্ষণেই ঘরে ঢুকলেন অল্পবয়সি বুদ্ধি-উজ্জ্বল এক পুলিশ অফিসার। ঢুকেই বললেন, সুপ্রভাত কর্নেল। শুনলাম, মি. শার্লক হোমস আপনার এখানে এসেছেন?
হাত তুলে হোমসকে দেখিয়ে দিলেন কর্নেল।
সৌজন্য বিনিময়ের পর ইনস্পেকটর বললেন, মি. হোমস, কেসটা হাতে নেবেন কি?
আমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসল হোমস। বলল, ওয়াটসন, তোমার কপাল খারাপ! বলে এমনভাবে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল যে বেশ বুঝলাম সত্যিই আমার কপাল খারাপ। বলল, খুলে বলুন ইনস্পেকটর।
ইনস্পেকটর বললেন, অ্যাক্টনের বাড়িতে সূত্র পাইনি। কিন্তু ক্যানিংহ্যামের বাড়িতে পেয়েছি। একই লোকের কীর্তি। তাকে দেখা গেছে।
তাই নাকি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। রাত পৌনে বারোটার সময়ে ড্রেসিংগাউন পরে পাইপ খাচ্ছিলেন মি. আলেক ক্যানিংহ্যাম, ছিলেন খিড়কির দরজার কাছে। হঠাৎ চেঁচামেচি শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখেন উইলিয়ামের সঙ্গে ঝটাপটি করছে একটা লোক। ওঁর সামনেই লোকটা উইলিয়ামের বুকে গুলি করে তিরের মতো ছুটে গিয়ে বাগান পেরিয়ে বেড়া টপকে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। শোবার। ঘরের জানলা থেকে মি, ক্যানিংহ্যামও দেখেছেন তাকে নক্ষত্ৰবেগে পালিয়ে যেতে। মি. অ্যালেক ক্যানিংহ্যাম তখন উইলিয়ামকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বলে খুনির পেছন নিতে পারেননি।
অত রাতে উইলিয়াম কী করতে গিয়েছিল ওখানে?
মরবার আগে তা বলে যেতে পারেনি। লোকটা কিন্তু খুব বিশ্বাসী। নিশ্চয় কোনো কাজ ছিল। ঠিক সেই সময়ে তালা ভেঙে দরজা খুলেছিল চোর।
বাড়িতে কিছু বলে এসেছিল উইলিয়াম?
ওর বুড়ি মা এমনিতে কালা, তার ওপর ছেলের শোকে ভেঙে পড়েছে, সে-রকম কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু একটা দরকারি জিনিস পাওয়া গেছে। এই দেখুন।
বলে, নোটবইয়ের একটা ছেড়া পাতা হাঁটুর ওপর বিছিয়ে ধরলেন ইনস্পেকটর, নিহত ব্যক্তির মুঠোর মধ্যে পাওয়া গেছে। কোণটা ছিঁড়ে হাতের মুঠোয় থেকে গেছে। যে সময়ের কথা লেখা আছে, উইলিয়াম মারা গেছে ঠিক সেই সময়ে। মনে হয়, কারুর সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল।
কাগজটা হাতে নিল হোমস। হুবহু প্রতিলিপি দিচ্ছি নীচে :
পৌনে বারোটা নাগাদ
জানতে পারবে যা
হয়তো
ইনস্পেক্টর বললেন, আর একটা সম্ভাবনা থাকছে। উইলিয়াম হয়তো চোর মহাপ্রভুর স্যাঙাৎ। ষড় করে এসেছিল, দরজা ভাঙতে, হাতও লাগিয়েছিল। তারপর কোনো কারণে মারপিট লেগে যায় নিজেদের মধ্যে।
হোমস কিন্তু তন্ময় হয়ে দেখছিল ছেড়া কাগজের কথাগুলো। বললে, যা ভেবেছিলাম, দেখছি তার চাইতেও জটিল ব্যাপার। লেখাটা সত্যিই ইন্টারেস্টিং।
বলে, দুই করতলে মুখ ঢেকে বসে রইল কিছুক্ষণ। বিখ্যাত অপরাধ-বিশেষজ্ঞকে এইভাবে চিন্তিত হতে দেখে হাসি ফুটল ইনস্পেকটরের ঠোঁটে।
কিছুক্ষণ পরেই কিন্তু ছিলে-ছেড়া ধনুকের মতো চেয়ার থেকে ছিটকে গেল হোমস। অবাক হয়ে গেলাম ওর মুখচ্ছবি দেখে। স্বাস্থ্যের আভায় ফের জ্বলজ্বল করছে গাল আর চোখ–প্রাণশক্তি আগের মতোই যেন ফেটে পড়ছে চোখে-মুখে।
বলল সহর্ষে, ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে চাই। ওয়াটসন, কর্নেল আপনারা একটু বসুন। আমি ইনস্পেকটরের সঙ্গে দেখে আসি ব্যাপারটা।
দেড় ঘণ্টা পরে একা ফিরলেন ইনস্পেকটর। বললেন, মি. হোমস মাঠে বেড়াচ্ছেন। ওঁর ইচ্ছে আমরা চারজনেই যাই মি. ক্যানিংহ্যামের বাড়িতে।
কেন বলুন তো?
বলতে পারব না। ওঁর শরীর এখনও ঠিক নেই বুঝতে পারছি। এমন সব অদ্ভুত কাণ্ড করছেন… একটুতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন।
আমি বললাম, ঘাবড়াবেন না। ওর এই খেপামির মধ্যেই জানবেন তদন্তকৌশল প্রচ্ছন্ন থাকে।
অথবা তদন্তকৌশলটার মধ্যেই খেপামি প্রচ্ছন্ন রয়েছে, গজগজ করতে লাগলেন ইনস্পেকটর, যাবার জন্যে আর তর সইছে না। সমানে লাফাচ্ছেন। চলুন।
বাইরে বেরিয়ে দেখি প্যান্টের পকেটে দু-হাত পুরে ঘাড় হেঁট করে মাঠে বেড়াচ্ছে হোমস।
কী মশায়, ঘটনাস্থল দেখে এলেন? শুধোলেন কর্নেল।
লাশটা দেখলাম। ইন্টারেস্টিং।
কিছু আঁচ করেছেন মনে হচ্ছে?
যাচাই না-করে কিছু বলা মুশকিল। তবে কি জানেন চোর যে-বেড়া ভেঙে পালিয়েছে, সে-জায়গাটাও খুব ইন্টারেস্টিং। মি. ক্যানিংহ্যাম আর তার ছেলের সঙ্গেও আলাপ করে এলাম।
তদন্তের ফলটা কী হল?
ফল? খুবই অদ্ভুত। আসল রহস্য কিন্তু হাতের মুঠোয় পাওয়া ওই ছেড়া কাগজের মধ্যে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূত্র।
বাকি অংশটা কোথায়?
নিশ্চয় হত্যাকারীর পকেটে। খুন করে উইলিয়ামের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পকেটে পুরে পালিয়েছে। পকেটটা খুঁজলেই কাগজ পাব–রহস্যও ফর্দাফাঁই হবে।
তা তো হবে। কিন্তু হত্যাকারীকে পাকড়াও না-করে পকেটে হাত ঢোকাবেন কী করে?
তাও তো বটে। খুবই চিন্তার বিষয়!–আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার শুনবেন? পত্রলেখক চিঠিটা নিজে গিয়ে দেয়নি উইলিয়ামকে নিজে গেলে চিঠি লেখার দরকার হত না। চিঠিটা তবে গেল কীভাবে?
ডাকে, জবাব দিলেন ইনস্পেকটর।পিয়োনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কাল বিকেলের দিকে একটা চিঠি পায় উইলিয়াম।
সাব্বাস! সোল্লাসে ইনস্পেকটরের পিঠ চাপড়ে দিল হোমস। আপনার সঙ্গে কাজ করে সুখ আছে। এসে গেছি, এই বাড়িটা।
পুরোনো আমলের একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম আমরা। হোমস আমাদের নিয়ে গেল পেছন দিকে। সেখানে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে একজন চৌকিদার।
হোমস বললে, কর্নেল, এইখানে দাঁড়িয়ে মি. ক্যানিংহ্যামের ছেলে দেখেছিল মারপিট করছে দুজনে। ওই জানলাটায় দাঁড়িয়ে মি. ক্যানিংহ্যাম দেখেছেন ওই ঝোপটা ডিঙিয়ে ছুটে পালাচ্ছে চোর বাপ বেটা দুজনেই দেখেছে ঝোপটা, সুতরাং ভুল হবার জো নেই।
বাড়ির কোণ ঘুরে দুই ব্যক্তি এগিয়ে এল আমাদের দিকে। একজন বয়স্ক। অপরজন তরুণ, আমুদে মুখচ্ছবি, ঝকমকে জামাকাপড়।
কাছে এসেই হোমসকে টিটকিরি দিয়ে ছোকরা বললে, এখনও হাল ছাড়েননি দেখছি। কিন্তু হালে পানি পাবেন বলে মনে হয় না, যা মিটমিটে আপনি। লন্ডনের ডিটেকটিভরা এমন হয় জানতাম না।
তা একটু সময় লাগবে বই কী, বাঁকা সুরে বলল হোমস।
সময় নিয়েও সূত্র পাবেন বলে তো মনে হয় না।
জবাবটা দিলেন ইনস্পেকটর, সূত্র পাওয়া গেছে। হত্যাকারীর, ও কী, মি. হোমস কী হল আপনার?
আচম্বিতে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে ধড়াস করে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল শার্লক হোমস। দারুণ ভয় পেলাম আমি। ধরাধরি করে তুলে এনে শুইয়ে দিলাম একটা বড়ো চেয়ারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সামলে নিয়ে উঠে বসল বন্ধুবর।
লজ্জিত মুখে বললে, কিছু মনে করবেন না। ওয়াটসন মানে আমার শরীর কীরকম ভেঙে পড়েছে। স্নায়ুর জোর কমে গেছে। এমন এক-একটা ধাক্কা আচমকা আসে–সামলাতে পারি না।
গাড়ি করে বাড়ি পাঠিয়ে দেব? বললেন বুড়ো ক্যানিংহ্যাম।
আরে, না, না। এসেছি যখন, একটা ব্যাপার যাচাই করে যাই।
কী ব্যাপার?
আমার বিশ্বাস, চোর চুরি করে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, উইলিয়াম তখন এসে পড়ে–চুরির আগে নয়।
ব্যঙ্গের স্বরে অ্যালেক ক্যানিংহ্যাম বললে, অথচ আমরা জানি কিছু চুরি যায়নি।
চোর কিন্তু অদ্ভুত ধরনের। মামুলি জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। যেমন, অ্যাক্টনের বাড়ি থেকে নিয়েছে কাগজ-চাপা, বাতিদান, টোন সুতো আর বই। তা ছাড়া আর একটা ব্যাপারেও আমার খটকা লাগছে। কী বলুন তো? আপনারা দুজনেই তখন জেগে ছিলেন?
হ্যাঁ।
ঘরে আলো জ্বলছিল?
হ্যাঁ।
কোন ঘরে?
ওই যে পাশাপাশি দুটো ঘরের জানলা দেখছেন–ওই ঘরে।
দেখুন মি. ক্যানিংহ্যাম, বাড়িতে লোক জেগে আছে, চোখে দেখবার পরেও চোর কি চুরি করতে সে-বাড়িতে ঢোকে?
বুকের পাটা বেশি থাকলে ঢোকে বই কী।
যাই হোক, আপনি একটা পুরস্কার ঘোষণা করুন। তাতে হত্যাকারীকে খুঁজে বার করতে উৎসাহ পাবে প্রত্যেকেই। পঞ্চাশ পাউন্ড দিলেই হবে।
আমি পাঁচশো পাউন্ড দিতে রাজি আছি।
তাহলে তো আরও ভালো। এই নিন, একটা খসড়া করে এনেছি আমি। আপনি দয়া করে একটা সই দিয়ে দিন, কাগজ-পেনসিল বাড়িয়ে দিল হোমস।
বৃদ্ধ ক্যানিংহ্যাম ঘোষণাপত্রের বয়ানে চোখ বুলিয়েই বললেন, ভুল লিখেছেন দেখছি। পৌনে এগারোটার সময়ে লিখেছেন কেন? ওটা তো হবে পৌনে বারোটার সময়ে।
ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেল শার্লক হোমস। মনটা আমারও খারাপ হয়ে গেল ওর এই ভুল দেখে। হোমস এত বড়ো ভুল কখনো করে না কিন্তু স্নায়ুর অবস্থা এতই কাহিল যে খুঁটিনাটি ব্যাপারেও গুলিয়ে ফেলছে। ইনস্পেকটরের ভুরু বেঁকে গেল বিষম বিরক্তিতে। আর বিদ্রুপের হাসি হেসে উঠল তরুণ ক্যানিংহ্যাম। যাই হোক, বৃদ্ধ ক্যানিংহ্যাম তৎক্ষণাৎ ভুলটা শুধরে দিয়ে সই করে কাগজ তুলে দিলেন হোমসের হাতে।
পকেট-বুকে কাগজটা রাখতে রাখতে হোমস বললে, এবার চলুন বাড়ির ভেতরটা দেখা যাক। কিছু খোয়া গেছে কি না দেখি।
ভেতরে ঢোকার আগে দরজাটা খুঁটিয়ে দেখল হোমস। উকো বা শক্ত ছুরি দিয়ে তালা ভাঙা হয়েছে কাঠ পর্যন্ত খুবলে গেছে।
দরজায় খিল লাগান না? শুধোয় হোমস।
দরকার হয় না।
কুকুর রাখেন না?
পেছনে বাঁধা থাকে।
চাকরবাকর শুতে যায় কখন?
দশটা নাগাদ।
উইলিয়ামও?
হ্যাঁ।
আশ্চর্য! ঠিক কালকেই ওকে অত রাতে বিছানা ছেড়ে আসতে হল! চলুন, মি. ক্যানিংহ্যাম, বাড়িটা দেখান।
তন্ময় হয়ে বাড়ির স্থাপত্য দেখতে দেখতে এগিয়ে চলল হোমস। কিছুদূর এইভাবে যাওয়ার পর অসহিষ্ণু কণ্ঠে বৃদ্ধ ক্যানিংহ্যাম বললেন, খামোকা সময় নষ্ট করছেন। সিঁড়ির শেষে ওই দেখুন আমার আর ছেলের ঘর; আমি ঘরের মধ্যে বসে থাকতে থাকতেই চোর বাড়ি ঢুকে চুরি করে বেরিয়ে গেল, তা কি হয়?
শ্লেষতীক্ষ্ণ হাসি হেসে পুত্র বললে, নতুন সূত্র ধরুন মশায়, কেঁচে গণ্ডুষ করুন।
ভ্রূক্ষেপ না-করে হোমস বললে, শোবার ঘরের জানলা দিয়ে বাড়ির সামনেটা একটু দেখা দরকার। এইটা বুঝি আপনার ছেলের ঘর? পাশের ঘরের জানলা থেকে দেখি কদ্দূর দেখা যায়। পাইপ খাচ্ছিলেন এই ঘরে বুঝি? বলতে বলতে নিজেই দরজা খুলে উঁকি মেরে সব দেখল হোমস।
বৃদ্ধ ক্যানিংহ্যাম এবার রেগে গেলেন, আপনার দেখা শেষ হয়েছে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব দেখা হয়ে গেছে। মানে, যা দেখতে চাইছিলাম দেখে নিয়েছি। এবার চলুন আপনার ঘরটা দেখা যাক।
বৃদ্ধের পেছন পেছন সবাই ঢুকলাম পাশের ঘরে। জানলার দিকে এগোনোর সময়ে পেছিয়ে পড়ল হোমস, অগত্যা আমিও। আচমকা আমার চক্ষু স্থির করে দিয়ে হোমস ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে টেবিলে বসানো ডিশ ভরতি কমলা আর জলের কুঁজোটা উলটে ফেলে দিল মেঝের ওপর। ঝন ঝন করে ভেঙে গেল কাচের কুঁজো আর ডিশ–কমলা গড়িয়ে গেল ঘরময়।
কী কাণ্ড করলে বল তো ওয়াটসন, ঠান্ডা গলায় আমাকেই ধমকে উঠল হোমস। কার্পেটটার বারোটা বাজিয়ে ছাড়লে।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কমলা কুড়োতে লাগলাম আমি। বেশ বুঝলাম, বিশেষ মতলবে দোষটা আমার ঘাড়ে চাপাচ্ছে বন্ধুবর। আমার সঙ্গে প্রত্যেকেই হাত লাগালেন। কমলা কুড়িয়ে এনে টেবিলটাকে সোজা করে বসালেন। তারপরেই সবিস্ময়ে বললেন ইনস্পেকটর, একী! মি. হোমস কোথায়?
শার্লক হোমস ঘরে নেই! বেমালুম উধাও!
ভদ্রলোকের মাথায় পোকা আছে মনে হচ্ছে। দেখছি আমি। বাবা, এসো, বাপ-বেটায় হনহন করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
দৃষ্টি বিনিময় করলাম আমি, ইনস্পেকটর আর কর্নেল।
ইনস্পেকটর বললেন, মি. অ্যালেক ঠিকই বলেছেন। রোগে ভুগে মাথা বিগড়েছে মি. হোমসের–
মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল। আচমকা তীক্ষ্ণ্ণ আর্তনাদে কেঁপে উঠল সারাবাড়ি, বাঁচাও! বাঁচাও! খুন করে ফেলল!
সারাগায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল সেই চিৎকার শুনে! এ যে হোমসের আর্তনাদ! হোমস চেঁচাচ্ছে! হোমসকে কেউ খুন করতে যাচ্ছে! উন্মত্তের মতো ধেয়ে গেলাম চাতালে। আর্তনাদ তখন বিষম গোঙানিতে এসে ঠেকেছে। চিৎকার লক্ষ করে একটা ঘরের মধ্যে দিয়ে পৌঁছোলাম ড্রেসিং রুমে। মেঝের ওপর চিত হয়ে পড়ে শার্লক হোমস। বুকের ওপর চেপে বসেছে ক্যানিংহ্যাম পিতা পুত্র। ছেলে সর্বশক্তি দিয়ে টুটি টিপছে, বাপ গায়ের জোরে কবজি মোচড়াচ্ছেন। চক্ষের নিমেষে হোমসকে সরিয়ে নিলাম আসুরিক খপ্পর থেকে। টলতে টলতে বিবর্ণ, বেদম মুখে উঠে দাঁড়াল বন্ধুবর।
খাবি খেতে খেতে বললে, গ্রেপ্তার করুন, ইনস্পেকটর, এঁদের গ্রেপ্তার করুন!
কী অপরাধে?
কোচোয়ান উইলিয়ামকে খুন করার অপরাধে।
ইনস্পেকটর তো অবাক, বলেন কী মি. হোমস!
আরে মশাই, ওঁদের মুখের দিকে তাকান না!
সত্যিই তো। মুখের রেখায় এভাবে অপরাধবোধ প্রকট হয়ে উঠতে কখনো তো দেখিনি! বাপ-বেটা দুজনের মুখই চক্ষের নিমেষে পালটে গিয়েছে। বৃদ্ধ যেন ভেঙে পড়েছেন। ক্ষোভে দুঃখে বিবশ হয়ে পড়েছেন। আর ছেলের স্পর্ধিত মুখচ্ছবি অকস্মাৎ ভয়ংকর বন্য জিঘাংসায় ছেয়ে গেছে—কালো চোখে ঝিলিক দিচ্ছে আদিম হিংস্রতা–বিকৃত বিকট হয়ে গেছে সুন্দর মুখখানা। ইনস্পেকটর একটা কথাও না-বলে বাইরে গিয়ে বাঁশি বাজাতেই ছুটে এল দুজন চৌকিদার।
বললেন, মি, ক্যানিংহ্যাম, আমি নিরুপায়।–ওকী! ওকী! ফেলে দিন, ফেলে দিন। বলতে বলতেই এক ঝটকায় অ্যালেক ক্যানিংহ্যামের হাত থেকে সবে টেনে-আনা রিভলভারটা ছিটকে ফেলে দিলেন মেঝেতে।
সঙ্গেসঙ্গে পা দিয়ে রিভলভার চেপে ধরল হোমস।
বলল, ভালো হল। মামলা চলার সময়ে কাজে লাগবে। আর এই দেখুন, এর খোঁজেই এখানে আসা, বলে একটুকরো দলা পাকানো কাগজ নাড়তে লাগল আমাদের সামনে।
কোণ-ছেড়া চিঠির উধাও অংশটা না? লাফিয়ে উঠলেন ইনস্পেকটর।
হ্যাঁ।
পেলেন কোথায়?
যেখানে ছিল জানতাম, সেইখানে। কর্নেল, ওয়াটসনকে নিয়ে দয়া করে বাড়ি যান। একঘণ্টার মধ্যে খাবার টেবিলে দেখা হবে। আপাতত কয়েদিদের সঙ্গে দুটো কথা বলব!
কথা রাখল হোমস। ঠিক একটার সময়ে খর্বকায় এক বয়স্ক ভদ্রলোককে নিয়ে ঢুকল কর্নেলের ঘরে। ভদ্রলোকের নাম মি. অ্যাক্টন। পরিচয় করিয়ে দিল হোমস, এঁর বাড়িতেই চোর অত কষ্ট করে হানা দেওয়ার পর অদ্ভুত কয়েকটা জিনিস নিয়ে পগার পার হয়েছিল।
বলল, কর্নেল, রহস্য ব্যাখ্যা করার সময়ে মি. অ্যাক্টনকে সামনে রাখতে চাই। তার আগে একটু ব্র্যান্ডি দিন, সাংঘাতিক ধকল গেছে শরীরের ওপর দিয়ে।
স্নায়ু খুব চোট খেয়েছে দেখছি।
অট্টহেসে হোমস বললে, ও-ব্যাপারটা যথাসময়ে শুনবেন। একটা কথা আগেই বলে রাখি, সফল গোয়েন্দার উচিত এক ঝুড়ি বাজে আর কাজের তথ্য থেকে ঠিক কাজের তথ্যগুলো বেছে। নিয়ে বাজে তথ্যকে ফেলে দেওয়া–এই ক্ষমতা যে-গোয়েন্দার নেই সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে উপর্যুপরি ঘটনাস্রোতে চিন্তাধারা বয়ে যায় বিপথে। এই কেসে গোড়া থেকেই আমার মন আটকে গিয়েছিল নিহত ব্যক্তির হাতের মুঠোয় পাওয়া চিঠির কোণটার ওপর। বেশ বুঝেছিলাম, রহস্যের চাবিকাঠি রয়েছে ওর মধ্যেই।
বিশদ ব্যাখ্যার আগে অ্যালেক ক্যানিংহ্যাম ছোকরার জবানবন্দির একটা বৈষম্য আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। ছোকরা দেখেছে নাকি চোর ওর সামনেই উইলিয়ামকে বুকে গুলি করেই নক্ষত্রবেগে পালিয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে ধরাশায়ী উইলিয়ামের হাতের মুঠো থেকে চিঠি খাবলে নিয়ে সে যায়নি। কে নিল তাহলে? নিশ্চয় অ্যালেক ছোকরা নিজে–কেননা তার বাবা চাকরবাকর নিয়ে নীচে নামার আগে বেশ খানিকটা সময় সে পেয়েছিল। এই বৈষম্যটুকু ইনস্পেকটরের মাথায় আসেনি। কেননা, উনি প্রথম থেকেই ধরে নিয়েছিলেন সর্ষের মধ্যে ভূত থাকে না–জমিদার কখনো খুনি হয় না। আমি কিন্তু ধরাবাঁধা সিদ্ধান্ত নিয়ে কখনো তদন্তে নামি না–আগে থেকেই অমুকটা অসম্ভব ভেবে বসি না, চোখ কান খোলা থাকে।
যাক, চিঠির কোণটা পরীক্ষা করতে গিয়েই পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল আমার কাছে। সত্যিই অসাধারণ এই ছেড়া কোণটা। বৈশিষ্ট্যটা লক্ষ করেছেন?
লেখার ধাঁচটা একটু অদ্ভুত বটে, বললেন কর্নেল।
আরে মশাই, একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বুঝবেন, লেখাটা দুজনের হাতে লেখা–একজনের হাতে নয়। বারোটা, পারবে আর যা–এই তিনটে শব্দ বাদবাকি সব শব্দের চেয়ে আলাদা। হাতের লেখা বিশ্লেষণ করলেই তো রহস্যটা ধরা যায়।
সত্যিই তো! কর্নেলের চোখ কপালে ওঠার দাখিল হল। কিন্তু কেন মি. হোমস? একই চিঠি দুজনে লিখতে গেল কেন?
উদ্দেশ্য শুভ নয় বলে। দুজনের একজন অপরজনকে বিশ্বাস করে না বলে। তাই সে চেয়েছিল ষড়যন্ত্রের মধ্যে তাকেও জড়িয়ে রাখতে। পৌনে, নাগাদ, জানতে আর হয়তো, এই শব্দগুলো যে লিখেছে, মূল চক্রী সে-ই। নাটের গুরু বলতে পারেন।
কী করে বুঝলেন?
হাতের লেখা থেকে চরিত্র ধরা যায়। এইমাত্র যে-শব্দগুলো বললাম, দেখুন সেগুলো কত শক্ত হাতে স্পষ্ট লেখা। আগে সে জোরালো হাতে লিখে গেছে–মাঝে দু-জায়গায় ফাঁক রেখে গেছে। ফলে জায়গা কম থাকায় বারোটা শব্দটাকে বেশ ঠেসেটুসে লিখতে হয়েছে দু-নম্বর চক্রীকে। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, প্রথম বয়ান রচনা করেছে যে, নাটের গুরু সে–খুনের পরিকল্পনা তারই মাথা থেকে বেরিয়েছে।
চমৎকার বললেন তো! উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন মি. অ্যাক্টন।
তারপর দেখুন, হাতের লেখায় যারা বিশেষজ্ঞ, তারা লেখা দেখে লেখকের বয়স সঠিকভাবে আঁচ করতে পারে। বুড়ো হলে হাতের লেখা কাঁপা-কাঁপা হয় ঠিকই, আবার অসুস্থ শরীরে জোয়ান লোকে লিখলেও তাই হয়। এটা একটা ব্যতিক্রম। কিন্তু এই ক্ষেত্রে দেখুন, একজনের হাতের লেখা স্পষ্ট, জোরদার। অপরজনের লেখা যেন মেরুদণ্ড-ভাঙা অথচ স্পষ্ট। এ থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, প্রথমজন যুবাপুরুষ, দ্বিতীয়জন বৃদ্ধ কিন্তু অশক্ত নয়। টয়ের টিকিটা দেখছেন কত স্পষ্ট?
চমৎকার! আবার চিৎকার করে উঠলেন মি. অ্যাক্টন।
এবার আসছি আরও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে। দুটো হাতের লেখায় বেশ মিল আছে। রক্তের সম্পর্ক থাকলে যা হয়–একই ফ্যামিলিতে একাধিক ব্যক্তির মধ্যে যে মিল দেখা যায়–এই দুই ব্যক্তির হাতের লেখায় সেই মিল অতি সুস্পষ্ট। যেমন জ। এ-রকম আরও তেইশটা বিশ্লেষণ পদ্ধতি আছে, কিন্তু সেসব বিশেষজ্ঞের শুনতে ভালো লাগবে, আপনাদের ভালো লাগবে না। যাই হোক, এইসব যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত থেকে স্পষ্ট বুঝলাম চিঠিটার যুগ্ম লেখক ক্যানিংহ্যাম পিতা পুত্র।
ধারণাটা যাচাই করার জন্যে লাশ দেখতে গিয়ে সন্দেহটা আরও দূর হল। অ্যালেক ছোকরা বলেছে ধস্তাধস্তি করতে করতে উইলিয়ামের বুকে গুলি করে চোর। অত কাছ থেকে গুলি করলে পোশাকে বারুদের দাগ থাকত। কিন্তু নিহত ব্যক্তির বুকে সে-দাগ নেই। তার মানে, কম করে চার ফুট দূর থেকে গুলি করা হয়েছে। সুতরাং অ্যালেক ছোঁড়া কাঁচা মিথ্যে বলেছে। আর একটা ব্যাপারে আবার বাপ-বেটা দুজনেই মিথ্যে বলেছে। চোরকে নাকি দুজনেই দেখেছেন বিশেষ একটা ঝোপ পেরিয়ে পালাতে। সেখানে গিয়ে দেখলাম একটা তলা-ভিজে নালা রয়েছে–অথচ ভেজা কাদায় কারো পায়ের ছাপ নেই। এ থেকেই সন্দেহাতীতভাবে বুঝলাম, ঘটনাস্থলে বাইরের লোক কেউ আসেনি।
এরপর অদ্ভুত এই কাণ্ডকারখানার কারণটা ভাবতে বসলাম। প্রথমেই খটকা লাগল মি. অ্যাক্টনের বাড়ির আজব জিনিসপত্র চুরি যাওয়ার ব্যাপারটায়। কর্নেলের মুখে যখনই শুনলাম মি. অ্যাক্টনের সঙ্গে মি. ক্যানিংহ্যামের মোকদ্দমা চলছে বিষয়সম্পত্তির ব্যাপারে, সঙ্গেসঙ্গে বুঝে নিলাম আসল ব্যাপারটা কী। ক্যানিংহ্যামরা মি. অ্যাক্টনের লাইব্রেরিতে হানা দিয়েছিল দরকারি কোনো দলিল পাচার করার মতলবে।
ধরেছেন ঠিক, সায় দিলেন মি. অ্যাক্টন। কাগজটা কিন্তু সলিসিটরের সিন্দুকে রেখেছিলাম বলেই বেঁচে গেলাম এ-যাত্রা। এ-কাগজ যতক্ষণ আমার কাছে, ততক্ষণ ওদের সম্পত্তির অর্ধেকের ওপর আমার দাবি নস্যাৎ করবার ক্ষমতা কারুর নেই।
মুচকি হেসে হোমস বললে। দলিল না-পেয়ে বেচারিরা হতাশ হয়ে ঠিক করলে যা হয় কিছু চুরি করে নিয়ে যেতে হবে, লোকে যাতে ভাবে ছিঁচকে চোর পড়েছিল বাড়িতে। আমি কিন্তু তাতে ভুললাম না। তাই কোণ-ছেড়া চিঠিখানা উদ্ধার করার জন্যে উঠে পড়ে লাগলাম অ্যালেক ক্যানিংহ্যামেরই ড্রেসিংগাউনের পকেট থেকে, কেননা ড্রেসিংগাউন পরেই ছোকরা খুন করেছে বাটলারকে, মুঠো থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে চিঠিটা, গুঁজে রেখেছে পকেটে। দল বেঁধে বাড়ি গিয়েছিলাম ওই মতলবেই।
বাড়ির বাইরে দেখা হয়ে গেল ক্যানিংহ্যাম বাপ-বেটার সঙ্গে। ঠিক এই সময়ে বোকার মতো মোক্ষম সুত্রটার কথা বলতে গেলেন ইনস্পেকটর। দেখলাম সর্বনাশ হতে চলেছে! ভেঁড়া চিঠির ব্যাপারটা যদি ওদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তৎক্ষণাৎ তা সরিয়ে ফেলবে, নয়তো নষ্ট করে ফেলবে। তাই ইনস্পেকটর কথা শেষ করবার আগেই আমি মূর্ছা গেলাম, কথার মোড় অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিলাম।
বলেন কী মশায়। হাসতে হাসতে বললেন কর্নেল। মূর্ছাটা তাহলে অভিনয়?
তাজ্জব হয়ে আমি বললাম, চমৎকার অভিনয় বলতে হবে। আমি ডাক্তার মানুষ, আমি সুষ্ঠু বোকা বনে গেলাম!
অভিনয় জিনিসটা অনেক সময়ে কাজে লেগে যায়। যাই হোক, সুস্থ হয়ে উঠে বসে আবার একটা চাল চাললাম। কায়দা করে বুড়ো ক্যানিংহ্যামকে বারোটা শব্দ লিখিয়ে নিলাম যাতে চিঠির ছেঁড়া কোণে লেখা বারোটা শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারি।
ইস, কী উজবুক আমি! বললাম ক্ষোভের সঙ্গে।
মুচকি হাসল হোমস। বলল, ভায়া ওয়াটসন, আমার সাংঘাতিক ভুল দেখে তুমি যে মরমে মরে গিয়েছিলে, তা তোমার কালো মুখ দেখেই বুঝেছিলাম। আমি দুঃখিত। যাই হোক, ওপরে গিয়ে ছুতোনাতা করে ঘরে ঢুকে দেখে নিলাম দরজার পাশে ঝুলছে যার খোঁজে আসা, সেই ড্রেসিংগাউন। আপনাদের অন্যমনস্ক করে দেওয়ার জন্যে টেবিল উলটে ফেলে দিয়ে গেলাম ড্রেসিংগাউনের পকেট হাতড়াতে।
ঈপ্সিত বস্তু সবে উদ্ধার করেছি, এমন সময়ে বাঘের মতো আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বাপ-বেটা। আপনারা না-এসে পড়লে নির্ঘাত খুন করে ফেলত আমাকে। এখনও গলা টনটন করছে, কবজি টাটিয়ে রয়েছে। হাতেনাতে ধরা পড়ে যাওয়ায় অতখানি মরিয়া হয়ে উঠেছিল দুই মূর্তিমান।
পরে বুড়ো ক্যানিংহ্যাম পেট থেকে সব কথা টেনে বার করলাম। ছেলেটা খোদ-শয়তান বললেই চলে। হাতে রিভলভার পেলে হয় আত্মহত্যা নয় আর একটা নরহত্যা পর্যন্ত করে বসতে পারে। বুড়োর মুখেই শুনলাম মি. অ্যাক্টনের বাড়িতে ওদের নৈশ অভিযান উইলিয়াম দেখে ফেলেছিল। পেছন পেছন গিয়েছিল এবং পরে এই নিয়ে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করে। সব ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেখিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করে। অ্যালেক ছোকরার গাঁটে গাঁটে বুদ্ধি। সে দেখলে চোরের আতঙ্কে সারা গা তটস্থ। এই সুযোগে আর একটা চুরির নাটক মঞ্চস্থ করে পথের কাঁটা সরানো যাক। তাই চিঠি লিখে বাটলারকে তাতিয়ে এনে খুন করে ফেলল জলজ্যান্ত মানুষটাকে। রাতের অন্ধকারে মুঠোর মধ্যে চিঠির কোণ যে রয়ে গেল, খেয়াল হয়নি। ড্রেসিংগাউনের পকেটটাও বোধ হয় আর দেখেনি। ও-ব্যাপারে আরও একটু হুশিয়ার হলে তিলমাত্র সন্দেহ করা যেত না এদের।
ভায়া, চিঠির রহস্য এবার ভাঙো, বললাম আমি।
শার্লক হোমস তখন দুটো কাগজের টুকরো পাশাপাশি রাখল আমাদের সামনে।
খিড়কির দরজায় এসো, এমন কিছু জানতে পারবে যা তোমাকে দারুণ অবাক করে দেবে এবং হয়তো তোমার আর অ্যানি মরিসনের অনেক কাজে লাগবে। কিন্তু এব্যাপারে কাউকে কিছু বোলো না।
হোমস বললে, ফাঁদটা অতি চমৎকার। কিন্তু অ্যালেক, অ্যানি আর উইলিয়ামের মধ্যেকার সম্পর্কটা এখনও অস্পষ্টই রয়ে গেল। যাই হোক, ভায়া ওয়াটসন, ভাগ্যিস তুমি আমাকে গাঁয়ে টেনে এনেছিলে। কী সুন্দর বিশ্রাম হল বল তো? নতুন এনার্জি নিয়ে কালকেই বেকার স্ট্রিটে ফিরব ভাবছি।
——–
টীকা
১. রেইগেটের গাঁইয়া জমিদার : দ্য রেইগেট স্কোয়ার্স জুন ১৮৯৩-এর স্ট্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয় দ্য রেইগেট স্কোয়ার নামে।স্কোয়ার শব্দটি বহুবচনে পরিবর্তিত হয় মেমোয়ার্স অব শার্লক হোমস গ্রন্থে সংকলন হওয়ার সময়ে। ১৭ জুন ১৮৯৩-এর হার্পার্স উইকলি পত্রিকায় এই গল্প প্রকাশিত হয় দ্য রেইগেট পাজল নামে।
কর্নেলের হাতিয়ার সম্ভার : কোনো গবেষক অনুমান করেছেন, কর্নেল যেহেতু আফগানিস্তানে ছিলেন, সেইহেতু তাঁর হাতিয়ার সম্ভারের মধ্যে একটি জিজেল বন্দুক থাকা সম্ভব।
পোপের লেখা : আলেকজান্ডার পোপ (১৬৮৮-১৭৪৪) হলেন ইংরেজ কবি। ব্যঙ্গাত্মক রচনা লেখাতেও পোপ ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার বিখ্যাত রচনা দ্য রেপ অব দ্য লক, অ্যান এসে অন ম্যান, অ্যান এসে অন ক্রিটিসিজম প্রভৃতি। হোমারের রচনা অনুবাদ করেছিলেন পোপ মোট এগারো খণ্ডে। ইলিয়াড ছ-টি খণ্ডে এবং ওডিসি পাঁচ খণ্ডে।
লেখার ধাঁচটা : এই গল্পর ঘটনাকালে (১৮৮৭) ইউরোপে অন্যত্র হাতের লেখা ধরন বিচার সম্পর্কে কিছু গবেষণা শুরু হলেও, ইংলন্ডে তা হয়েছে অনেক পরে। এই বিষয়ে ফরাসি দেশের জা হিপেলিট মিশের দুই খণ্ডে প্রকাশিত রচনা প্রকাশিত হয় ১৮৭০-এ। কিন্তু আরও বিখ্যাত রচনা ক্রেপপা-জের্মির লেক্রেচার এ লা ক্যারাটেরে প্রকাশিত ১৮৮৮ সালে। অর্থাৎ এই গল্পর ঘটনার পরবর্তী বছরে।