দ্য ক্রুকেড ম্যান

দ্য ক্রুকেড ম্যান

বিকলাঙ্গর বিচিত্র উপাখ্যান
[দ্য ক্রুকেড ম্যান]

আমার তখন সবে বিয়ে হয়েছে। গরমকাল। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি গিয়েছে। খাওয়াদাওয়ার পর পাইপ খেতে খেতে উপন্যাস পড়ছি। স্ত্রী শুতে চলে গেছে। চাকরবাকররাও বিদেয় নিয়েছে। এমন সময়ে ঘণ্টাধ্বনি শুনলাম দরজার।

ঘড়িতে তখন বারোটা বাজতে বারো মিনিট বাকি। এত রাতে রুগি ছাড়া আর কেউ আসে। মনটা খিঁচড়ে গেল। সারাদিন ধকলের পর রাতটুকুও কি জিরোতে পারব না?

কিন্তু কর্তব্য আরামের চাইতে বড়ো। তাই উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখলাম দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে শার্লক হোমস।

আমাকে দেখেই বলল সোপ্পাসে, ঠিক জানতাম রাত হলেও তোমাকে পাওয়া যাবে।

কী সৌভাগ্য! ভেতরে এসো!

আইবুড়ো সময়ের অভ্যেস দেখছি এখনও ছাড়তে পারনি, আর্কেডিয়া মিক্সচার না হলে পাইপ খাওয়া হয় না। কোটের ছাইগুলোই অকাট্য প্রমাণ। আর মিলিটারি ধড়াচূড়াও এখনও ছাড়তে পারনি, তাই আস্তিনে রুমাল গুঁজে রাখ এখনও। ভায়া, রাতটা থাকা যাবে এখানে?

স্বচ্ছন্দে।

টুপির আলনায় টুপি ঝুলছে না যখন পুরুষ-অতিথি বাড়িতে নেই।

হোমস, তুমি থাকলে আমি বর্তে যাব।

যাক, ঠাঁই তাহলে পাওয়া গেল। বাড়িতে মিস্ত্রি এসেছিল মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ, গ্যাস বিগড়েছিল। কার্পেটে বুটের ছাপ রেখে গেছে। এবার একটু পাইপ খাওয়া যাক।

মুখোমুখি বসে নীরবে ধূমপান করতে লাগল বন্ধুবর। আমিও কথা বললাম না। জরুরি দরকার না-থাকলে এত রাতে বাড়িতে হানা দেওয়ার পাত্র সে নয়। সুতরাং ধৈর্য ধরতে হবে, একটু পরেই সব বলবে।

আমার দিকে চেয়ে হঠাৎ বললে, পসার খুব জমেছে দেখছি।

কী করে বুঝলে?

তোমার জুতো দেখে। দিব্যি ঝকঝক করছে। তার মানে খুব ঘোড়ার গাড়িতে চাপছ। আমি তো জানি, কাছাকাছি যেতে হলে হাঁটা পছন্দ কর–তুমি গাড়িতে চাপো না।

চমৎকার! প্রশংসামুখর হলাম আমি।

কিন্তু খুবই সামান্য ব্যাপার। নজরটা ঠিকমতো দিতে পারলে শ্রোতাকে এইভাবে বক্তার পক্ষে চমকে দেওয়াটা আশ্চর্য কিছু নয়। আসল জিনিসটা চোখ এড়িয়ে গেলে এইরকমই হয়। ভায়া, একই কথা প্রযোজ্য তোমার ওই গল্পগুলোর ক্ষেত্রেও। নিজের কায়দায় লিখতে গিয়ে সমস্যার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য থেকে বঞ্চিত কর পাঠককে। এই মুহূর্তে আমার হাতে এমনি একটা কেস এসেছে। বড়ো অদ্ভুত কেস-মাথা গুলিয়ে দিচ্ছে। এখনও খেই পাচ্ছি না কিন্তু পাবই, ওয়াটসন, অন্ধকারে আলো আমি দেখতে পাবই। বলতে বলতে দু-চোখ প্রদীপ্ত হয়ে উঠল বন্ধুবরের, পাতলা গালে দেখা দিল রক্তিম আভা। মুহূর্তের জন্যে যেন একটা আবরণ উঠে গেল ওর সুতীব্র, সুতীক্ষ্ণ প্রকৃতির ওপর থেকে। কিন্তু তা পলকের জন্যেই। পরের মুহূর্তেই ফের দেখলাম রেড ইন্ডিয়ানদের মতো ভাবলেশহীন নির্বিকার মুখচ্ছবি–মুখের এই বিচিত্র বিকারবিহীন ভাবের জন্যেই অনেকে ওকে একটা নিছক যন্ত্র ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না।

ওয়াটসন, সমস্যাটা রীতিমতো ইন্টারেস্টিং–অত্যন্ত অসাধারণ বৈশিষ্ট্য-সমৃদ্ধ। ভেবেচিন্তে একটা সমাধান আঁচ করেছি। তোমাকে এর মধ্যে পেতে চাই।

সানন্দে যাব, হোমস।

কালকে অলডারশট যেতে হবে।

যাব।

ওয়াটারলু থেকে দশটা দশের গাড়ি?

ভালোই তো।

ঘুম পেয়েছে কি?

পেয়েছিল–এখন উড়ে গেছে।

তাহলে ঘটনাটা ছোটো করে বলছি, শোনো। অলডারশটে রয়্যাল ম্যালোজের প্রাক্তন কর্নেল বার্কলের খুন সম্পর্কে কিছু শুনেছ?

না।

রয়্যাল ম্যালোজ হল ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সুবিখ্যাত আইরিশ রেজিমেন্ট। ক্রিমিয়ার যুদ্ধ আর সিপাই বিদ্রোহে এদের কৃতিত্ব ভোলবার নয়। জেমস বার্কলে গত সোমবার পর্যন্ত কম্যান্ডার ছিলেন এই রেজিমেন্টের। ঢুকেছিলেন গাদা বন্দুক বইতে–ধাপে ধাপে ওপরে উঠেছেন–সিপাই বিদ্রোহের পর অফিসার হয়ে যান–পরে রেজিমেন্টের সর্বময় কর্তা।

সার্জেন্ট থাকার সময়ে রেজিমেন্টের এক কৃষ্ণকায় সার্জেন্টের মেয়ে ন্যান্সি টিভয়কে উনি বিয়ে করেন। এসব বিয়ে সমাজ চট করে মেনে নেয় না।তাদেরও নেয়নি। পরে ঠিক হয়ে যায়।

মেয়েটা সুন্দরী তিরিশ বছর বিবাহিত জীবনের পরেও।

বিয়ে করে সুখী হয়েছিলেন কর্নেল বার্কলে। প্রাণ দিয়ে ভালাবাসতেন স্ত্রীকে। স্ত্রী-ও ভালোবাসতেন তাকে কিন্তু সে-ভালোবাসায় স্বামীর ভালোবাসার মতো আদিখ্যেতা ছিল না। কাজেই এ-রকম অপূর্ব জুটির এ-ধরনের পরিণতি কল্পনা করা যায় না।

কর্নেল বার্কলে এমনিতে ফুর্তিবাজ, কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ মুখ কালো করে বসে থাকতেন। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে হইচই করতে করতে আচমকা গুম হয়ে যেতেন। দিনকয়েক কাটত এইভাবে। মনে হত যেন ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছেন। ভীষণ ক্লান্তি বোধ করেছেন।ওঁর অফিসার-বন্ধুদের কাছেই শুনেছি এই ব্যাপার।

অলডারশটের ক্যাম্পে বিবাহিত অফিসাররা বাইরে রাত কাটান। আট মাইল দূরে ল্যাচেন বলে একটা বাড়িতে দুজন ঝি আর একজন কোচোয়ান নিয়ে সস্ত্রীক থাকতেন কর্নেল। বাড়িটা খালি জমি ঘেরা, পশ্চিমদিকে তিরিশ গজ দূরে বড়োরাস্তা।

গত সোমবার রাত আটটায় গির্জেতে একটা মিটিংয়ে গিয়েছিলেন মিসেস বার্কলে। তাড়াতাড়ি ডিনার খেয়ে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। মিস মরিসন নামে একটি তরুণীর সঙ্গে মিটিংয়ে যান এবং সওয়া ন-টায় তাকে বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে স্বগৃহে ফিরে আসেন।

রাস্তার দিকে কাচের দরজাওলা এটা ঘর আছে ল্যাচেনে। সকালের দিকে ঘরে বসা হয়, সন্ধের পর খালি থাকে। কাচের দরজায় পর্দা নেই। দরজার সামনে তিরিশ গজ লম্বা সবুজ ঘাস-ছাওয়া লন, তারপর রেলিং-দেওয়া পাঁচিলের পর রাস্তা। মিসেস বার্কলে এই ঘরে এসে এক কাপ চা আনতে বললেন ঝি-কে, অথচ ও সময়ে কখনো তিনি চা খান না। স্ত্রী ফিরেছে শুনে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে হল ঘর পেরিয়ে এই ঘরে ঢোকেন কর্নেল বার্কলে, দেখেছে কোচোয়ান। তারপর আর তাকে জীবিত দেখা যায়নি।

দশ মিনিট পরে চা নিয়ে এসে ঝি দেখল দরজা ভেতর থেকে চাবিবন্ধ এবং অত্যন্ত চড়া গলায় গিন্নি ঝগড়া করছেন কর্তার সঙ্গে। কর্নেল বার্কলে এত আস্তে নরম গলায় জবাব দিচ্ছেন যে কথা শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু গিন্নিমার কথাগুলো শুনে তাজ্জব হয়ে গিয়ে সবাইকে ডেকে আনে সে। মিসেস বার্কলের প্রত্যেকটা কথায় আতীব্র ঘৃণা ঠিকরে পড়ছিল। স্বামীকে তিনি বার বার কাপুরুষ বলে গাল পাড়ছিলেন। তোমার সঙ্গে থাকতেও আমার গা রি-রি করছে! ফিরিয়ে দাও আমার জীবন! আর কি তা পাব? এখানে আর এক মুহূর্ত নয়! কাপুরুষ কোথাকার! কাপুরুষ! কাপুরুষ! আচমকা পুরুষকণ্ঠে শোনা গেল একটা আর্ত চিৎকার! দড়াম করে আছড়ে পড়ার আওয়াজ এবং নারীকণ্ঠে মুহুর্মুহু বুকফাটা হাহাকার। দরজা খুলতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে কোচোয়ান লনের দিক থেকে একটা খোলা জানলা গলে ঢুকে পড়ে ভেতরে। দেখে, সোফায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে মিসেস বার্কলে। আর, চেয়ারের হাতলে দু-পা রেখে ফায়ার প্লেসের ঝাঝরির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে কর্নেল বার্কলে। প্রাণহীন। ঘরে রক্তগঙ্গা বইছে।

ভেতর থেকে দরজা খুলতে গিয়ে মুশকিলে পড়ল কোচোয়ান দরজার চাবি কোথাও পাওয়া গেল না। কাজেই জানলা গলে বাইরে এসে ডেকে আনল পুলিশ আর ডাক্তার। অজ্ঞান অবস্থায় মিসেস বার্কলেকে ঘরের বাইরে আনা হল। এ অবস্থায় সন্দেহটা তার ওপরেই পড়ে এবং তার ব্যতিক্রম হল না। দেখা গেল, মাথার পেছনে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা একটা মারাত্মক চোট পেয়ে মারা গেছেন কর্নেল, একটা ভোতা ভারী অস্ত্র দিয়ে আঘাত হানা হয়েছে খুলিতে। অস্ত্রটাও পাওয়া গেল দেহের পাশে। অদ্ভুত হাতিয়ার। একটা নিরেট গদা, হাতলটা হাড় দিয়ে বাঁধানো। কাঠের ওপর অদ্ভুত সব খোদাইয়ের কাজ। দেশবিদেশে লড়াই করে নানারকম বিচিত্র বস্তু সংগ্রহ করে এনেছিলেন কর্নেল, এই গদাটিও হয়তো তারই সংগ্রহ, অথচ চাকরবাকরেরা এ-জিনিস এর আগে কখনো বাড়িতে দেখেনি। চাবিটা শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল না। অলডারশট থেকে তালা-মিস্ত্রি আনিয়ে দরজা খুলতে হল।

গত মঙ্গলবার পর্যন্ত এই হল ঘটনাপ্রবাহ। কর্নেলের বন্ধু মেজর মর্ফি আমাকে ধরে-বেঁধে নিয়ে গেলেন অলডারশটে পুলিশকে সাহায্য করার জন্যে। যে ঝি-টা কাগিন্নির ঝগড়া বাইরে থেকে শুনেছিল, তাকে জেরা করতে গিয়ে একটা আশ্চর্য খবর শুনলাম। গিন্নিমা নাকি রাগের মাথায় কর্তাকে ডেভিড বলেছিলেন বার কয়েক, অথচ কর্তার নাম জেমস। ব্যাপারটা প্রণিধানযোগ্য। রহস্য সমাধানের প্রথম ধাপ এইটাই হওয়া উচিত।

আরও একটা ব্যাপারে তাক লেগে গেছে চাকরবাকর এবং পুলিশ মহলের। কর্নেলের মুখের পরতে পরতে প্রকট হয়েছে বিষম আতঙ্ক। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে যেন ভূত দেখে চমকে উঠে সিঁটিয়ে গিয়েছেন। পুলিশের বিশ্বাস, প্রাণাধিকা স্ত্রী গদা দিয়ে তাকে মারছে, ভয়ানক এই দৃশ্য দেখেই নাকি তিনি আঁতকে উঠেছিলেন। ভদ্রমহিলা নিজে এখন ব্রেন ফিভারে আক্রান্ত, কোনো কথা তার মুখ থেকে শোনা যাচ্ছে না।

মিসেস বার্কলের সঙ্গে মিস মরিসন ফিরেছিলেন গির্জের মিটিং থেকে, হঠাৎ মিসেস বার্কলে কেন এত খাপ্পা হয়ে গেলেন, এ-প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি মিস মরিসন।

চাবি যখন কোথাও পাওয়া গেল না, ধরে নিলাম বাইরের কেউ ঘরে ঢুকে চাবি নিয়ে ভাগলবা হয়েছে। তাই জানলার বাইরে লন আর রাস্তা পরীক্ষা করতে গিয়ে সবসুদ্ধ পাঁচটা পায়ের ছাপ আমি পেলাম। আততায়ী রাস্তা থেকে পাঁচিল টপকে লনে ঢুকেছে, বেগে লন পেরিয়ে এসেছে, যে কারণে পায়ের পাতা পায়ের গোড়ালির চাইতে মাটিতে বেশি চেপে বসেছে, তারপর জানলা টপকে ঘরে ঢুকেছে। পাঁচটা ছাপের একটা পেলাম রাস্তায়, দুটো লনে, দুটো জানলার গোবরাটে। কিন্তু আততায়ীর সঙ্গে তার একজন যে-এসেছে, আমাকে বেশি তাজ্জব করেছে সে।

খুনের স্যাঙাত?

পকেট থেকে একটা পাতলা ফিনফিনে কাগজ বার করে হাঁটুর ওপর সন্তর্পণে মেলে ধরল হোমস।

বলল, বলো তো ছাপগুলো কীসের?

কাগজভরতি অনেকগুলো কিম্ভুতকিমাকার পদচিহ্ন দেখলাম। বড়ো বড়ো নখ আছে পায়ে এবং নখ-টখ মিলিয়ে পুরো পায়ের ছাপ আইসক্রিম চামচের চেয়ে বড়ো নয়।

কুকুরের পায়ের ছাপ, বললাম আমি।

কুকুর কি পর্দা বেয়ে ওঠে? এ কিন্তু উঠেছিল, পর্দায় ছাপ পেয়েছি।

তাহলে বাঁদর?

বাঁদরের পায়ের ছাপ এ-রকম হয় না।

তবে?

কুকুর, বেড়াল, বাঁদর বা চেনাজানা কোনো জন্তুই নয়। এই দেখ এক জায়গায় ভর দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। সামনের পা আর পেছনের পায়ের মধ্যে ব্যবধান পনেরো ইঞ্চি। এর সঙ্গে গলা আর মাথা জুড়লে লম্বায় সে কম করেও দু-ফুট। ল্যাজ থাকলে তো আরও বেশি। হেঁটেছে কিন্তু তিন ইঞ্চি দীর্ঘ পদক্ষেপে। অর্থাৎ জন্তুটার পা বেঁটে, কিন্তু দেহ লম্বা। লোম-টোম ফেলে গেলে আঁচ করতে সুবিধে হত। আপাতত শুধু বোেঝা যাচ্ছে, বিচিত্র এই প্রাণীটা মাংসাশী, আর পর্দা বেয়ে সরসর করে উঠতে পারে।

মাংসাশী জানলে কী করে?

পর্দা বেয়ে উঠে জানলার ওপরে রাখা একটা পাখির খাঁচার দিকে গিয়েছিল বলে। এই সব দেখেই মনে হয় অদ্ভুত এই জীবকে দেখতে অনেকটা বেজির মতো, কিন্তু বেজিরা যত বড়ো হয়, তার চেয়ে অনেক বিরাট।

বেজির সঙ্গে খুনের কী সম্পর্ক?

এখনও তো ধোঁয়াটে। খবর পেলাম, কর্তাগিন্নির ঝগড়ার সময়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নাকি একটা লোক রগড় দেখছিল। জানলা খোলা ছিল, পর্দা ছিল না, ঘরে আলো জ্বলছিল। তারপর এইসব পায়ের ছাপ দেখে বোঝা যাচ্ছে, পাঁচিল টপকে লন পেরিয়ে তার চার-পেয়ে সঙ্গীকে নিয়ে জানলা গলে ঘরে ঢুকেছিল। তারপর হয় সে কর্নেলের মাথা ফাটিয়েছে, অথবা কর্নেল তাকে দেখে আঁতকে উঠে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে ফায়ারপ্লেসের ঝাঝরিতে নিজের মাথা নিজেই ফাটিয়েছেন। রহস্যময় এই উটকো আততায়ী প্রস্থান করেছে কিন্তু ঘরের চাবিটা পকেটে নিয়ে।

হোমস, রহস্য কিন্তু আরও জট পাকিয়ে গেল।

খাঁটি কথা। মিস মরিসন কিন্তু নিশ্চয় জানেন খোশমেজাজে সাড়ে সাতটার সময়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কেন অত বদমেজাজে ন-টায় বাড়ি ফিরলেন মিসেস বার্কলে। এই দেড় ঘণ্টার মধ্যে নিশ্চয় এমন একটা অঘটন ঘটেছে যে মিসেস বার্কলে বাড়ি ফিরেই নিরালা থাকবার জন্যে বাইরের ঘরে ঢুকেছিলেন। স্ত্রী বাড়ি ফিরেছে শুনে কর্নেল সেই ঘরে ঢুকতেই দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড আরম্ভ হয়ে গেছে। ফেটে পড়েছেন কর্নেল-গৃহিণী। কিন্তু কেন? নিশ্চয় জানেন মিস মরিসন।

তাই মিস মরিসনকে সোজাসুজি বললাম, তিনি যা জানেন, যদি না বলেন, মিসেস বার্কলের ফাঁসি পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে।

ভদ্রমহিলা বেশ সেয়ানা। সব শুনে যা বললেন তা এই :

গিজের মিটিং থেকে বেরোনোর পর জনহীন হাডসন স্ট্রিটের মোড়ে একজন বাক্স কাঁধে বিকলাঙ্গ কুঁজো পা টেনে টেনে যেতে যেতে আচমকা মিসেস বার্কলকে দেখে আরে, ন্যান্সি যে! বলেই ভীষণ চেঁচিয়ে ওঠে। সঙ্গেসঙ্গে মড়ার মতো সাদা হয়ে যায় মিসেস বার্কলের মুখ। এমনভাবে টলে ওঠেন যে মিস মরিসন ধরে না-ফেললে নির্ঘাত পড়ে যেতেন রাস্তায়।

মিস মরিসন পুলিশ ডাকতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বাধা দেন মিসেস বার্কলে। মোলায়েম সুরে বিকৃতদর্শন লোকটিকে বলেন, হেনরি, তুমি! আমি তো জানতাম তুমি মারা গেছ! তিরিশ বছর আমার কাছে তুমি বেঁচে নেই।

সত্যিই কি আমি বেঁচে আছি? আমি তো অতীতের প্রেত! এমন সুরে এমন বিকট মুখভঙ্গি করে কথাগুলো বলল বীভৎস সেই নিশীথ পথচারী যে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল মিস মরিসনের। লোকটার চুল আর জুলপি হাঁসের পালকের মতো সাদা, মুখের চামড়া শুকনো আপেলের মতো অদ্ভুতভাবে কুঁচকানো। দু-চোখে যেন দু-টুকরো অঙ্গার জ্বলছে ধকধক করে রাতে ঘুমের মধ্যেও এই চোখে দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, চেঁচিয়ে কেঁদে উঠেছেন মিস মরিসন।

মিসেস বার্কলে কিন্তু নীরক্ত মুখে কাঁপা ঠোঁটে মিস মরিসনকে এগিয়ে যেতে বলেছেন। ভয়ানক সেই মানুষটার সঙ্গে নাকি তার কথা আছে। কাজেই এগিয়ে গেলেন মিস মরিসন। একটু পরেই পাশে চলে এলেন মিসেস বার্কলে। পেছন ফিরে মিস মরিসন দেখলেন, ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্তের মতো শূন্যে মুষ্টি নিক্ষেপ করছে বিকলাঙ্গ কুজ।

মিসেস বার্কলে নীরবে বাড়ি পর্যন্ত এসে মিস মরিসনকে দিয়ে কথা আদায় করে নিলেন, এই ব্যাপার যেন কাকপক্ষীও না-জানে। লোকটা নাকি তাঁর পূর্ব-পরিচিত, এখন গোল্লায় গেছে।

সব শুনে বুঝলাম মূল রহস্য নিহিত ওই বিকলাঙ্গ লোকটার মধ্যে। বদখত চেহারার লোককে খুঁজে বের করতে খুব একটা অসুবিধে হয় না। হলও না। অলডারশটে মিলিটারি আদমিই বেশি থাকে। বাইরের লোক কম–তার মধ্যে বিকলাঙ্গ একজনই আছে। নাম হেনরি উড। দিন পাঁচেক হল এসেছে–উঠেছে হাডসন স্ট্রিটেরই একটা ভাড়াটে কোঠায়। বাড়িউলি তটস্থ থাকেন লোকটার সঙ্গী-সাথি জন্তুগুলোর জন্যে। এদেরকে নিয়ে সে ভেলকি দেখিয়ে বেড়ায় মিলিটারি ক্যাম্পে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত ভাষায় নিজের সঙ্গেই কথা বলে। দিন দুয়েক নাকি ঘরের মধ্যে থেকে গুঙিয়ে গুঙিয়ে একটানা একঘেয়েমি কান্না কেঁদে চলেছে। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বাড়িউলি। টাকাকড়ির ব্যাপারে লোকটা পরিষ্কার হলে কী হবে–জমা বাবদ একটা অদ্ভুত মুদ্রা রেখেছে বাড়িউলির কাছে। আমি দেখলাম মুদ্রাটা। ভারতবর্ষের টাকা।

ভায়া ওয়াটসন, আমার বিশ্বাস এই লোকটাই সেদিন ঘরে ঢুকেছিল। তারপর কী ঘটেছিল, ওর মুখেই শুনতে চাই। তোমাকে রাখতে চাই সাক্ষী হিসেবে। বেকার স্ট্রিটের উঞ্ছ-বাহিনীর একটা ছোকরাকে বিকট লোকটার ওপর নজর রাখতে বলে এসেছি। বাড়ি ছেড়ে চম্পট দিলেও রেহাই নেই, পেছন নেবে আমার চর।

অলডারশট পৌঁছানোর পরদিন দুপুরে। হাডসন স্ট্রিটে যেতেই একটা উঞ্ছ ছোকরা এসে ফিসফিস করে হোমসকে বলে গেল সব ঠিক আছে।

ছোকড়াকে বিদেয় করে আমাকে নিয়ে বিশেষ একটা বাড়ির সামনে দাঁড়াল হোমস। কার্ড পাঠাল ভেতরে। একটু পরেই ডাক এল ভেতরে।

ঢুকলাম একটা বদ্ধ উত্তপ্ত ঘরের মধ্যে। একে তো গরমকাল, তার ওপরে অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে। ঘরে। ঘরটা তেতে উঠেছে উনুনের মতো। আগুনের সামনে গুটিসুটি মেরে বসে কিম্ভুতকিমাকার একটা লোক। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এমনভাবে দুমড়ে ভাঁজ করে বসে আছে যে এক নজরেই বোঝা যায় সাংঘাতিকভাবে বিকৃত তার প্রতিটি অঙ্গ। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই কিন্তু ময়লা কুচ্ছিত মুখটার মধ্যে কোথায় যেন একটা হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্যের ছোঁয়াচ দেখলাম। এককালে এ-মুখে রূপ ছিল, আকর্ষণ ছিল, এখন বিতৃষ্ণা জাগায় মলিনতা আর শ্রীহীনতার জন্যে।

লোকটা সন্দিগ্ধ আবিল চোখে আমাদের নিরীক্ষণ করে ইঙ্গিতে বসতে বলল দুটো চেয়ারে।

হোমস প্রশান্ত কণ্ঠে বললে, মি. হেনরি উড, আপনি এসেছেন ভারতবর্ষ থেকে। কর্নেল বার্কলের মৃত্যু সম্বন্ধে আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।

কিন্তু আমি তার কী জানি? ব্যাপারটা যদি স্পষ্ট না হয়, আপনার বান্ধবী মিসেস বার্কলের ফাঁসি পর্যন্ত হতে পারে।

চমকে উঠল বিকলাঙ্গ হেনরি উড, কে আপনি? এত খবর আপনি জানলেন কী করে? যা বললেন, তা সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি। জ্ঞান ফিরলেই গ্রেপ্তার হবেন মিসেস বার্কলে।

আপনি কি পুলিশের লোক?

না।

তবে আপনি এ-ব্যাপারে এসেছেন কেন?

সত্যকে জানতে চাই বলে।

মিসেস বার্কলে নিরপরাধ।

তাহলে কি অপরাধটা আপনার?

না।

তাহলে কে খুন করল কর্নেলকে?

নিয়তি। আমি নিজের হাতে খুন করলে প্রাণটা ঠান্ডা হত ঠিকই, বুকজোড়া ধিকিধিকি আগুন কিন্তু নিভত না–যা হারিয়েছে, তা আর ফিরে আসত না। তবে শুনুন আমার অবিশ্বাস্য কাহিনি।

আজকে আমার এই বাঁকাচোরা চেহারা দেখে আপনাদের হাসি পাচ্ছে জানি। পিঠজোড়া কুঁজ আর তেউড়োনো পাঁজরা দেখে অবাক হয়ে ভাবছেন এ-রকম চেহারা নিয়ে আছি কী করে। কিন্তু একদিন ১১৭ নং পদাতিক বাহিনীর সবচেয়ে স্মার্ট মানুষ ছিলাম আমি–কর্পোরাল হেনরি উড। ভারতবর্ষের ভুর্তি অঞ্চলের ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম আমি। সার্জেন্ট বার্কলেও ছিল সেখানে। আর ছিল ন্যান্সি টিভয় কৃষ্ণকায় সার্জেন্ট টিভয়ের পরমাসুন্দরী কন্যা।

ন্যান্সির প্রেমে পাগল হয়েছিল দুটি পুরুষ–বার্কলে আর উড। ন্যান্সি কিন্তু পাগল হয়েছিল আমার জন্যে, কারণ আমার রূপ ছিল। কিন্তু ন্যান্সির বাবার পছন্দ বার্কলেকে–কারণ তার ভবিষ্যৎ ছিল। আমি নাকি একটা মাকাল ফল হইচই করেই দিন কাটাই, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না।

ঠিক এই সময়ে শুরু হল সিপাই বিদ্রোহ। দেশজোড়া অরাজকতার মাঝে নির্বিচারে তুঙ্গে পৌঁছোল আমাদের প্রেম। তারপরেই দশ হাজার বিদ্রোহী ঘিরে ধরল আমাদের। বাচ্চাকাচ্চা মেয়েদের নিয়ে আমরা তখন হাজার জন। জেনারেল নীল এসে যদি উদ্ধার করেন, তাহলেই প্রাণে বাঁচব। নইলে কচুকাটা হতে হবে।

ন্যান্সির মুখ চেয়ে এবং হাজার জনের কথা ভেবে আমি একা গিয়ে জেনারেল নীলকে খবর দিতে চাইলাম। বার্কলে পথঘাটের হদিশ জানত। সে ছক এঁকে দেখিয়ে দিলে কোন পথে যেতে হবে। রাত দশটা নাগাদ সেই পথে যেতে গিয়ে ধরা পড়লাম ছ-জন বিদ্রোহীর হাতে। আগে থেকেই খবর পেয়ে ওরা ওখানে ওত পেতে ছিল আমাকে ধরবার জন্যে। মাথায় চোট পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর খবরটা কে দিয়েছে কানে এল। মন ভেঙে গেল কথাটা শুনে, সার্জেন্ট বার্কলে রাস্তার ছক এঁকে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েই চাকর মারফত গোপনে জানিয়ে দিয়েছিল বিদ্রোহীদের।

এই ঘটনা থেকেই বুঝবেন, জেমস বার্কলের অসাধ্য কিছু ছিল না এ-সংসারে। যাই হোক, জেনারেল নীল পরের দিন উদ্ধার করেন আটক শিবিরবাসীদের। বিদ্রোহীরা আমাকে নিয়ে পিছু হটে গেল। দীর্ঘদিন কাটল ওদের সঙ্গে। ইংরেজের মুখ দেখিনি–শুধু যন্ত্রণা পেয়েছি। অকথ্য কষ্ট দিত। পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়েছি, নিগ্রহ আরও বেড়েছে। বিকলাঙ্গ হয়েছি অবর্ণনীয় অত্যাচারে। তারপর কয়েকজন আমাকে নিয়ে গেল নেপালে। সেখান থেকে দার্জিলিংয়ে। পাহাড়িদের আক্রমণে প্রাণ হারাল পলাতক বিদ্রোহীরা, আমাকে গোলাম বানিয়ে রাখল বেশ কিছুদিন। এবার পালিয়ে উত্তরে গিয়ে পড়লাম আফগানদের হাতে। সেখান থেকে পাঞ্জাবে এসে অনেক রকম লাগ-ভেলকি ম্যাজিক শিখলাম। ইংলন্ডে ফিরে পুরোনো বন্ধুদের কাছে বিকট এই চেহারা দেখাতে মন চাইল না। ঠিক করলাম, ন্যান্সি আর বন্ধুদের কাছে আমি বরং মৃত থাকি। ন্যান্সি যে বার্কলেকে বিয়ে করেছে, সুখে ঘরকন্না করছে, সে-খবর পেয়েছিলাম। তা সত্ত্বেও অতীতকে খুঁচিয়ে জাগাতে চাইনি। ইংলন্ডে ফিরতে চাইনি।

কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গেসঙ্গে দেশের মাটির প্রতি টানও বাড়ে। তাই একদিন ফিরলাম ইংলন্ডে। সৈন্য-শিবিরে ভেলকি দেখিয়ে কোনোমতে দিন গুজরান করতে লাগলাম।

শার্লক হোমস বলল, সত্যিই ইন্টারেস্টিং আপনার কাহিনি। মিসেস বার্কলের সঙ্গে দেখা হল কীভাবে শুনেছি। তারপর নিশ্চয় ওঁর পেছন ধরে বাড়ি পর্যন্ত এসে বাইরের থেকে স্বামী-স্ত্রীর দারুণ ঝগড়া শুনে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি–ভেতরে ঢুকে পড়েছিলেন?

হ্যাঁ। আমাকে দেখামাত্র মুখচোখের চেহারা যেন কীরকম হয়ে গেল বার্কলের। আসলে আচমকা দেখেই নিদারুণ মানসিক আঘাতে মারা গিয়েছিল সঙ্গেসঙ্গে আমার চেহারাটাই যেন বন্দুকের বুলেট হয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছিল ওর পাপজীর্ণ হৃৎপিণ্ড। মৃতদেহটা আছড়ে পড়ে মেঝেতে মাথা ফেটে যায় ফায়ারপ্লেসের ঝাঁঝরিতে লেগে। আর্তনাদ করে উঠে অজ্ঞান হয়ে যায় ন্যান্সি। চাবিটা নিয়ে দরজা খুলতে গিয়ে ভাবলাম, কাজটা ঠিক হবে না। আমাকেই খুনি বলে সাব্যস্ত করা হতে পারে। তাই চাবি পকেটে নিয়ে টেডিকে পর্দার ওপরে ধরতে গিয়ে হাতের লাঠিটা মেঝেতে পড়ে গেল। পালিয়ে এলাম জানলা গলে।

টেডি কে?

হেনরি উড হেঁট হয়ে একটা খাঁচার ঢাকনি খুলে দিতেই ভেতর থেকে সড়াৎ করে বেরিয়ে এল হিলহিলে চেহারার একটা লালচে-বাদামি লোমশ জীব। শক্ত বেঁটে পা, সরু লম্বা নাক, ঝিলমিলে টুকটুকে চোখ।

সবিস্ময়ে বললাম, আরে, এ যে বেজি দেখছি।

আজ্ঞে হ্যাঁ। একে দিয়ে সাপ ধরি আমি। আমার কাছেই বিষদাঁত ভাঙা একটা সাপ আছে। ক্যান্টনমেন্টে রাত্তিরে যাই টেডিকে দিয়ে সাপ ধরার খেলা দেখাতে। আর কিছু জানবার থাকলে বলুন।

মি. হেনরি উড, অতীতকে বর্তমানে টেনে আনতে চাই না। মিসেস বার্কলে বিপদগ্রস্ত না হলে আপনাকে নিয়ে আর টানাটানি করব না। মহাপাপী জেমস বার্কলে ত্রিশ বছর ধরে অনুশোচনায় দগ্ধে মরেছেন তিল তিল করে শেষ মৃত্যু হল নাটকীয়ভাবে আপনার দর্শনের ফলে। চললাম। উঠে পড়ল হোমস।

রাস্তায় বেরিয়ে আসতেই দেখা হয়ে গেল মেজর মর্জির সঙ্গে। হোমসকে দেখেই ভদ্রলোক সোল্লাসে বললেন, এই যে! খবর শুনেছেন? সবই তো পণ্ডশ্রম হল।

কী ব্যাপার বলুন তো?

ডাক্তারের রিপোর্ট এসেছে। জেমস বার্কলে সন্ন্যাস রোগে মারা গেছেন। খুবই সোজা কেস।

সোজাই বটে। ওয়াটসন, চলো, অলডারশটে আমাদের কাজ শেষ হয়েছে।

স্টেশনের দিকে যেতে যেতে বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, একজনের নাম জেমস, আর একজনের হেনরি ডেভিড তাহলে কে? মিসেস বার্কলে কাকে ডেভিড বলছিলেন?

ভায়া ওয়াটসন, তুমি আমাকে যুক্তিবাদী বলে প্রচার করো। সত্যিই যদি তাই হতাম, যুক্তিযুদ্ধি সত্যিই যদি মগজে থাকত–শুধু ডেভিড নামটা শুনেই রহস্য সমাধান করতে পারতাম। ডেভিড বলে কাউকে ডাকা হয়নি, গালাগাল দেওয়া হয়েছে।

গালাগাল দেওয়া হয়েছে?

ইউরিয়া আর বাথসেবার গল্পটা মনে পড়ছে? বাইবেলের কাহিনি? আমার জ্ঞান অতটা স্পষ্ট নয়, প্রথম কি দ্বিতীয় স্যামুয়েল খুলে ঝালিয়ে নিয়ো। সার্জেন্ট জেমস বার্কলের মতোই গর্হিত কাজ করেছিলেন ডেভিড।

————-

টীকা

বিকলাঙ্গর বিচিত্র উপাখ্যান : দ্য ক্রুকেড ম্যান জুলাই ১৮৯৩-এর স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয়। নিউইয়র্কের হার্পার্স উইকলিতে প্রকাশিত হয় ৮ জুলাই ১৮৯৩ সংখ্যায় এবং নিউইয়র্কের স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে অগাস্ট ১৮৯৩ সংখ্যায়।

সবে বিয়ে হয়েছে : হোমস-গবেষকদের মতে ওয়াটসন মেরি মার্সটনের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন ১৮৮৮-র অগাস্ট মাসে।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ : পূর্ববর্তী কাহিনির টিকা দ্রষ্টব্য।

সিপাই বিদ্রোহে : ভারতীয় সিপাই এবং রাজন্যবর্গের একাংশের ইংরেজদের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহের সময়কাল ১৮৫৭-৫৮ সালে। অর্থাৎ গল্পের ঘটনার ঠিক ত্রিশ বা একত্রিশ বছর আগে।

দরজার চাবি কোথাও পাওয়া গেল না : এই ধরনের ঘটনা, বিশেষত্ব হত্যা, সংবলিত কাহিনির সাহিত্যের ভাষায় পোশাকি নাম ক্লোজড বা লকড রুম মিস্ট্রি। এখানে অপরাধ যেখানে অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে আসা বা সেখান থেকে বাইরে যাওয়ার কোনো রাস্তা থাকে না। গোয়েন্দাকে খুঁজে বার করতে অপরাধীর আসা-যাওয়ার পথ। এডগার অ্যালান পো-র মার্ডার্স ইন দ্য রু মর্গ এই ধরনের গল্পের প্রাচীনতম উদাহরণ।

বেকার স্ট্রিটের উঞ্ছ বাহিনীর : বিভিন্ন গল্প উপন্যাসে এই ছেলেদের ব্যবহার করেছেন হোমস। এদের নেতা হিসেবে উইগিন্স-এর নাম শোনা গিয়েছে। এই দলের আর এক সদস্যর নাম সিম্পসন।

ভুর্তি : ভুর্তি কল্পিত অঞ্চল। তবে জেনারেল নীলের কীর্তির বিচারে এটি আগ্রা হওয়া সম্ভব।

জেনারেল নীল : জেনারেল জেমস জর্জ নীল (১৮১০-১৮৫৭) ব্রিটিশ সৈন্যদলকে নিয়ে বিদ্রোহীদের পশ্চাদ্ধাবন করে কানপুর থেকে লক্ষ্ণৌ পৌঁছোন। লক্ষ্ণৌতে বিদ্রোহীদের হাতে নীলের মৃত্যু হয়। ব্রিটিশ রাজপরিবার থেকে মরণোত্তর নাইটহুড লাভ করেন জেনারেল নীল।

নিয়ে গেল নেপালে : সিপাই বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর বিপ্লবীদের একাংশ নেপালে পালিয়ে গিয়ে আত্মগোপন করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত বিপ্লবী নেতা নানাসাহেব।

দার্জিলিংয়ে : নেপাল লাগোয়া দার্জিলিং ১৮৩৫ পর্যন্ত ছিল সিকিম রাজ্যের অন্তর্গত। ওই বছর সিকিম ব্রিটিশদের দার্জিলিং হস্তান্তর করে এবং ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় এই পার্বত্য অঞ্চল।

ইউরিয়া আর বাথসেবার গল্পটা : ইউরিয়ার স্ত্রী বাথসেবা ছিলেন পরমাসুন্দরী। তিনি নজরে পড়েন ইজরায়েলের রাজা ডেভিডের। ডেভিড বাথসেবাকে যুদ্ধে পাঠিয়ে বাথসেবাকে উপভোগ করলে বাথসেবা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। ইউরিয়া ফিরে এসে আবার যুদ্ধে যান এবং সেখানে মৃত্যু হয় তার। তখন বাথসেবাকে বিবাহ করে রানির মর্যাদা দেন ডেভিড। দ্বিতীয় স্যামুয়েলে এই কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত