ঘোড়ার নাম সিলভার ব্লেজ
[ সিলভার ব্লেজ ]
সকালবেলা ব্রেকফাস্ট খেতে বসে হোমস হঠাৎ বললে, ওয়াটসন, আমাকেই বোধ হয় যেতে হবে।
যাবে? কোথায়? ডার্টমুরে–কিংস পাইল্যান্ডে।
অবাক হলাম না। যে ঘটনা সারা ইংল্যান্ডকে তাতিয়ে তুলেছে তা নিয়ে হোমস যে কেন এতদিন মেতে ওঠেনি–এইটাই বরং আশ্চর্য।
ঘটনাটা সত্যিই অসাধারণ। ওয়েসেক্স কাপ জিতে নেওয়ার মতো দুর্দান্ত রেসের ঘোড়া সিলভার ব্লেজ হঠাৎ যেন বেমালুম বাতাসে মিলিয়ে গেছে। ট্রেনার ভদ্রলোক খুন হয়েছে নৃশংসভাবে। কাগজে কাগজে এই নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড চলছে। হোমস কিন্তু কাগজগুলোয় শুধু চোখ বুলিয়েই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। ঘনঘন পাইপ খেয়েছে, ঘরময় পায়চারি করেছে, একটা কথাও কানে তোলেনি।
মুখে কথা না-বললেও সিলভার ব্লেজ রহস্য যে ওকে আকর্ষণ করেছে তা বুঝেছিলাম ওর ওই চেহারা দেখে। শার্লক হোমসের ক্ষুরধার বিশ্লেষণী শক্তির নবতম পরীক্ষা এই রহস্য হোমস কি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে?
সত্যিই পারল না। অকুস্থলে যাওয়ার ইচ্ছে মুখ ফুটে বলতেই বুঝলাম আসরে অবতীর্ণ হতে চলেছে বন্ধুবর।
আমি যাচ্ছি নিশ্চয়? বললাম আমি।
অবশ্যই। সঙ্গে তোমার দামি দূরবিনটা নিয়ো।
এক ঘণ্টা পর চলন্ত ট্রেনে বসে আবার খবরের কাগজ নিয়ে তন্ময় রইল হোমস। রীডিং ছাড়িয়ে আসার পর কাগজের উঁই বেঞ্চির নীচে ঠুসে সিগারেট বাড়িয়ে দিল আমাকে।
বলল, ঘণ্টায় সাড়ে তিপ্পান্ন মাইল স্পিডে যাচ্ছি।
সিকি মাইল অন্তর খুঁটিগুলো অবশ্য আমি দেখিনি।
আমি দেখিনি। টেলিগ্রাফ তারের খুঁটিগুলো কিন্তু ষাট গজ অন্তর পোঁতা। সেই হিসেবেই বললাম ঘণ্টায় সাড়ে তিপ্পান্ন মাইল স্পিডে যাচ্ছি। কেসটা পড়েছ?
কাগজে পড়েছি।
অসাধারণ কেস। যুক্তিবিজ্ঞানের চরম পরীক্ষা বলতে পারো। মঙ্গলবার টেলিগ্রাম পেয়েছি ঘোড়ার মালিক কর্নেল রস আর তদন্তকারী ইনস্পেকটর গ্রেগরির কাছ থেকে।
সে কী! আজ বেস্পতিবার! টেলিগ্রাম পেয়েই তো তোমার যাওয়া উচিত ছিল।
ভায়া ওয়াটসন, সেইটাই ভুল হয়েছে আমার। তোমার লেখায় আমাকে যেভাবে আঁকা হয়েছে–আমি যে তা নই, আমিও যে অতি সাধারণ মানুষ, ভুলভ্রান্তি করি–এইটাই তার প্রমাণ। আমি ভেবেছিলাম ডার্টমুরের মতো ফাঁকা জায়গায় নিখোঁজ ঘোড়াকে ঠিকই খুঁজে পাওয়া যাবে।ট্রেনার জন স্ট্রেকারকে খুন করেছে নিশ্চয় ঘোড়া-চোর–তাকেও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। কিন্তু সারাদিনে শুধু ফিজরয় সিম্পসন ছেলেটাকে হাজতে পোরা ছাড়া পুলিশ কিছুই করতে পারেনি দেখে গা-ঝাড়া দিতে বাধ্য হলাম। তবে কী জানেনা, কাল সারাদিনটা একেবারে মাঠে মারা যায়নি।
তার মানে রহস্যের অন্ধকারে আলো দেখতে পেয়েছ?
ঘটনাগুলোকে সাজিয়ে নিতে পেরেছি। বলছি শোনো।
সিলভার ব্লেজ খানদানি ঘোড়া। ভালো বংশ। বয়স পাঁচ। রেসের মাঠে সুনাম হয়েছে। সমস্ত প্রাইজ জিতেছে।ওয়েসেক্স কাপ রেসে বাজি পড়েছিল তিন টাকায় এক টাকা। খুবই বেয়াড়া বাজি–কিন্তু তবুও মোটা বাজি ধরা হয়েছে ঘোড়াটার ওপর কারণ ও কখনো হারেনি কাউকে রাস্তায় বসায়নি। কাজেই সিলভার ব্লেজ মাঠে নামলে যেমন অনেকের লাভ—মাঠে না-নামলেও অনেকের লাভ।
তাই কড়া নজর রাখা হয়েছিল সিলভার ব্লেজের ওপর। কিংস পাইল্যান্ডের আস্তাবলে মোট চারটে ঘোড়ার একটা এই সিলভার ব্লেজ। কর্নেলের জকি জন স্ট্রেকার মুটিয়ে যাওয়ার ফলে ঘোড়া চালানো ছেড়ে ঘোড়া ট্রেনিংয়ের কাজ ধরেছে। তিনটে ছোকরা আস্তাবলের কাজ দেখাশুননা করে। রাতে পালা করে একজন পাহারা দেয়। দুজন ওপরের ঘরে ঘুমোয়। জন স্ট্রেকার নিঃসন্তান। থাকে আস্তাবল থেকে দু-শো গজ দূরে বউ আর একজন ঝি-কে নিয়ে। অবস্থা ভালো। জায়গাটা খুব নিরিবিলি। ফাঁকা। আট মাইল উত্তরে কতকগুলো ভিলা আছে–ডার্টমুরের হাওয়া খেয়ে স্বাস্থ্য ফেরাতে যারা আসে তাদের জন্যে। মাইল দুই পশ্চিমে ট্যাভিসটক গ্রাম। বাদা পেরিয়ে, দু-মাইল দুরে কেপলটনের বড়োসড়ো আস্তাবল–ঘোড়া ট্রেনিংয়ের বিরাট ব্যাপার। আস্তাবলের মালিক লর্ড ব্ল্যাকওয়াটার ম্যানেজার সিলাম ব্রাউন। এ ছাড়া বাদার কোথাও কিছু নেই–মাঝে মাঝে ছন্নছাড়া কিছু ভবঘুরে বেদে। সোমবার রাতে এহেন পরিবেশে ঘটল মর্মান্তিক ঘটনাটা।
যথারীতি ঘোড়াদের চরিয়ে এনে দানাপানি খাইয়ে রাত নটায় তালা দেওয়া হল আস্তাবলে। একজন ছোকরা পাহারায় রইল–দুজন গেল ট্রেনারের বাড়িতে রাতের খাওয়া খেতে। পাহারায় যে রইল, তার নাম নেড হান্টার।
ঝি এডিথ আসছে হান্টারের খাবার নিয়ে হাতে লণ্ঠন ঝুলিয়ে ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে, এমন সময়ে দুম করে একজন ভদ্রলোক অন্ধকার কুঁড়ে হাজির হল তার সামনে। পরনে ধূসর টুইড সুট, মাথায় কাপড়ের টুপি, হাতে গোল মুণ্ডিওয়ালা মোটা ভারী লাঠি। বয়স তিরিশের একটু ওপরে, মুখ ফ্যাকাশে, হাবভাব কেমন যেন অস্থির।
এডিথকে ডেকে বললে, ওহে শোনো, কোথায় এসে পড়েছি বলতে পারো?
কিংস পাইল্যান্ড ট্রেনিং আস্তাবলের কাছে।
তাই নাকি! কপাল ভালো বলতে হবে। শুনেছি রোজ রাতে একজন ছোকরা ঘুমোয় ওখানে। খাবারটা বোধ হয় তার জন্যে নিয়ে যাচ্ছ, তাই না? শোনো, শোনো নতুন ড্রেস কেনার কিছু টাকা ফাঁকতালে রোজগার করতে চাও? বলতে বলতে ওয়েস্ট-কোটের পকেট থেকে এক টুকরো সাদা কাগজ টেনে বের করল লোটা।ছোকরাটাকে এই কাগজটা আজ রাতে যদি দাও, কালই একটা চমৎকার ফ্রক কিনে আনতে পারবে বাজার থেকে।
আস্তাবল সেখান থেকে তিরিশ গজ দূরে। লোকটার কথায় ঘাবড়ে গিয়ে, এক দৌড়ে জানলার সামনে পৌঁছোল এডিথ। এই জানলা দিয়ে রোজ রাতে খাবার দিতে হয় তাকে। জানলা খুলে ছোট্ট টেবিলের পাশে বসে ছিল হান্টার। লোকটার কথা সবে বলতে শুরু করেছে এডিথ, এমন সময়ে আগন্তুক নিজেই হাজির হল সেখানে।
বললে, গুড ইভনিং। তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে। এডিথ দেখেছে হাতের মুঠোয় কাগজটা ধরে কথাটা বলেছিল আগন্তুক।
হান্টার বললে, এখানে কী চাই?
তোমার পকেটে দুটো পয়সা যাতে আসে, সেই ব্যবস্থা করতে চাই। ওয়েসেক্স কাপ ঘোড়দৌড়ে তোমাদের দুটো ঘোড়া নামছে–সিলভার ব্লেজ আর বেয়ার্ড–তাই না? ভেতরের খবর একটু জানিয়ে দাও–দেখো তোমার পকেট কীরকম ভরে উঠে। শুনলাম নাকি সিলভার ব্লেজকে পাঁচ ফার্লং দৌড়ে এক-শো গজ পেছনে ফেলে গেছিল বেয়ার্ড? তোমরাও বাজি ধরেছ ওর ওপরেই?
তাই বলুন। ঘোড়ার দালাল! দাঁড়ান, আপনার মজা দেখাচ্ছি, বলেই কুকুর লেলিয়ে দিতে ছুটল হান্টার। বেগতিক দেখে ভোঁ দৌড় দিল এডিথ। যেতে যেতে দেখল, জানলা দিয়ে ঝুঁকে আছে রেসকোর্সের দালাল লোকটা। হান্টার এসে দেখল ভোঁ-ভোঁ–পালিয়েছে সে।
একটা কথা হোমস, জিজ্ঞেস করলাম আমি। কুকুর নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে দরজায় তালা দিয়ে গিয়েছিল হান্টার? না, খোলা ছিল?
এক্সেলেন্ট ওয়াটসন, চমক্কার বলেছ, পয়েন্টটা গুরুত্বপূর্ণ। আমার মাথায় খেলতেই সঙ্গেসঙ্গে ডার্টমুরে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জবাবটা জেনে নিয়েছি। ছোকরা তালা দিয়ে গিয়েছিল দরজায়। জানলাটাও এত ছোটো যে মানুষ গলতে পারে না।
খেয়েদেয়ে অন্য দুই ছোকরা আস্তাবলে আসতে হান্টার সব খুলে বললে। জন ষ্ট্রেকারের কানে যেতেই ভদ্রলোক অস্থির হয়ে পড়ল। রাত একটার সময়ে স্ত্রী দেখল জামাকাপড় পরে স্বামী বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘোড়ার চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না। বাইরে তখন ঝড়জলের মাতামাতি চলছে।
গেল তো গেলই। সকাল সাতটা বাজল–তখনও বাড়ি ফিরল না দেখে মিসেস স্ট্রেকার পাঠাল এডিথকে। এডিথ গিয়ে দেখল, আস্তাবলের দরজা খোলা, ভেতরে একটা চেয়ারে নিঃসাড়ে জবুথবু ভঙ্গিমায় পড়ে আছে হান্টার। সিলভার ব্লেজ নেই, জন স্ট্রেকারও নেই।
অন্য ছেলেদুটোকে টেনে তোলা হল। ওরা ওপরের মাচায় ঘুমোয়। ঘুম তাদের গাঢ়। কোনো আওয়াজ শোনেনি। হান্টার নিজেও ঘুমের ওষুধ খেয়ে মড়ার মতো পড়ে থেকেছে। তখনও ঘোর কাটছে না দেখে অন্য ছেলে দুটো ঝিকে নিয়ে দৌড়োল ঢিবিতে উঠে চারপাশ দেখবে বলে–হয়তো ভোরে উঠে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছে জন স্ট্রেকার।
আস্তাবল থেকে সিকি মাইল দূরে একটা ঝোঁপের পাশে খালের মধ্যে পাওয়া গেল তাকে। দেহে প্রাণ নেই, মাথার খুলি চুরমার খুব ভারী হাতিয়ার দিয়ে যেন বার বার মারা হয়েছে, উরু চিরে গেছে ধারালো অস্ত্রে। ডান হাতে একটা খোলা ছুরি বাঁট পর্যন্ত রক্ত জমে রয়েছেতার মানে আততায়ীদের একজনকে অন্তত জখম করেছে মরবার আগে, বাঁ-হাতে কালো সিল্কের গলাবন্ধ–এডিথ দেখেই চিনেছে–গতরাতে গলায় জড়িয়ে এসেছিল আগন্তুক। ঘোর কাটিয়ে উঠে হান্টারও চিনতে পেরেছে গলাবন্ধটা–তার বিশ্বাস ও যখন কুকুর আনতে দৌড়েছিল, তখনই জানলা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে মাংসে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল অচেনা লোকটা। ঘুমের ওষুধটা যে আফিং–সেটা মাংস পরীক্ষা করে জানা গেছে। নালার মধ্যে কাদার ওপর সিলভার ব্লেজের খুরের দাগও পাওয়া গেছে। ধস্তাধস্তির চিহ্নও আছে।
পুলিশ ইনস্পেকটর গ্রেগরি লোকটা এমনিতে চালাকচতুর হলে কী হবে, কল্পনাকে খেলাতে জানে না–জানলে অনেক উঁচুতে উঠত। সে এলে ভিলা থেকে গলাবন্ধর মালিককে গ্রেপ্তার করেছে। নাম তার ফিজরয় সিম্পসন। একের নম্বরের রেসুড়ে। লেখাপড়া শিখেছে, ভালো বংশে জন্মেছে। কিন্তু টাকাকড়ি সব ফুকে দিয়েছে রেসের মাঠে। এখন লন্ডনে স্পোর্টিং ক্লাবে ঘোড়ার নাম সিলভার ব্লেজ বুকির কাজ করে লুকিয়ে-চুরিয়ে। পাঁচ হাজার পাউন্ড বাজি ধরেছে যে-ঘোড়া জিতবে বলে মনে হয়েছে তার ওপর। ডার্টমুরে এসেছে কিংস পাইল্যান্ড আর কেপলটন আস্তাবলের ঘোড়া সম্বন্ধে খবরাখবর নিতে। গত রাতে সে এইজন্যেই বেরিয়েছিল। এই পর্যন্ত সেসব কথা নিজেই বলেছে–লুকোছাপার ধার দিয়েও যায়নি। কিন্তু গলাবন্ধটা দেখেই মুখ আমসি হয়ে গিয়েছে। লোকটার জামাকাপড়ও বেশ ভিজে রাত্রে ঝড় জলে বেরোনোর চিহ্ন। লাঠিটা সিসে দিয়ে ভারী করা–যার গায়ে মাথার খুলি গুঁড়ো করা সম্ভব।
সিম্পসনের গায়ে কিন্তু ছুরির দাগ দেখা যায়নি। অথচ স্ট্রোরের ছুরিতে রক্ত লেগেছিল–আততায়ীদের নিশ্চয় জখম করেছিল। ওয়াটসন, এই হল গিয়ে সমস্ত ব্যাপার। এবার বলো কী বুঝলে।
ধস্তাধস্তির সময়ে নিজের ছুরিতেই দাবনা চিরে ফেলেনি তো স্ট্রেকার? বললাম আমি।
খুব সম্ভব।
পুলিশ কী বলে?
পুলিশ বলছে, সিম্পসনই হান্টারকে আফিং খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে, দোকড়া চাবি দিয়ে আস্তাবল খুলে সিলভার ব্রেজকে নিয়ে পালিয়েছে। ঘোড়ার সাজও পাওয়া যাচ্ছে না নিশ্চয় পরিয়ে নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময়ে মুখোমুখি হয়েছে জন স্ট্রেকারের সঙ্গে। ধস্তাধস্তির সময়ে স্ট্রেকার নিজেই নিজের ছুরিতে পা কেটেছে। সিম্পসনের লাঠিতে মাথা ভেঙেছে। ঘোড়াটা সেই সময়ে ভোঁ দৌড় দিয়ে জলার কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে অথবা তাকে কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সবই অনুমান। অকুস্থলে না-গেলে বোঝা যাবে না আসল রহস্য।
ট্যাভিস্টক স্টেশনে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন কর্নেল রস আর ইনস্পেকটর গ্রেগরি। প্রথম জন চটপটে, খর্বকায়। দ্বিতীয়জন দীর্ঘকায়, মাথায় লম্বা চুল, নীল চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। বিখ্যাত গোয়েন্দা।
ছাদখোলা ল্যান্ডো গাড়িতে যেতে যেতে গ্রেগরি বলে ওর ধারণা–চুপ করে শুনে গেলেন কর্নেল রস। মাঝে মাঝে এটা ওটা জিজ্ঞেস করতে লাগল হোমস।
গ্রেগরি বললে, সিম্পসনই আসামি।
হোমস বললে, স্ট্রেকারের ছুরির ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়ায়?
নিজের ছুরিতেই চোট খেয়েছে পড়ে যাওয়ার সময়ে।
ওয়াটসনেরও তাই ধারণা। তবে কী জানো, আদালতে এ-কেস গেলে সিম্পসনের বিরুদ্ধে যেসব প্রমাণ তুমি পেয়েছ, সব নস্যাৎ হয়ে যাবে ধুরন্ধর আইনজ্ঞের জেরায়। প্রথমেই ধর না কেন, সিলভার ব্লেজকে বাইরে নিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল কি? ওইখানেই জখম করে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। তা ছাড়া দোকড়া চাবি কি পাওয়া গেছে সিম্পসনের কাছে? আফিং কিনেছিল কোন দোকান থেকে? সবচেয়ে বড়ো কথা, সিম্পসনকে এখানে কেউ চেনে না–কিন্তু সিলভার ব্লেজকে সবাই চেনে–তা সত্ত্বেও কোথায় লুকিয়ে রেখেছে তাকে? এডিথ বলেছে, একটা কাগজ নাকি হান্টারকে দিতে চেয়েছিল সিম্পসন–কীসের কাগজ?
দশ পাউন্ডের নোট–সিম্পসন নিজে বলেছে। মানিব্যাগেও পাওয়া গেছে একটা দশ পাউন্ডের নোট। আপনার অন্য যুক্তিগুলো অকাট্য নয়। চাবির কাজ ফুরিয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, ঘোড়াকে জলার মধ্যে কোনো পুরনো খনিতে লুকিয়ে রেখেছে, আফিং লন্ডন থেকে এনেছে। এ-জায়গাও তার কাছে খুব একটা নতুন নয়। এর আগেও দু-বার গরম কাটিয়ে গেছে।
গলাবন্ধটা?
ভুল করে ফেলে গিয়েছিল। আর ঘোড়া পাচার করে দেওয়া ব্যাপারেও নতুন খবর এনেছে।
কীরকম? উৎকর্ণ হল হোমস।
আস্তাবলের মাইলখানেকের মধ্যে সোমবার একদল জিপসি আড্ডা গেড়েছিল। খুনটা হয়ে যাওয়ার পরেই মঙ্গলবার তারা হাওয়া হয়ে গিয়েছে। ঘোড়াটা তারাই নিশ্চয় নিয়ে গেছে সিম্পসনের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে।
কাছাকাছি আর একটা ট্রেনিং আস্তাবল আছে না?
কেপলটনের আস্তাবল। ওখানকার ঘোড়া ডেসবরোর ওপরেও বাজি ধরা হয়েছে বিস্তর কিন্তু সিলভার ব্লেজের চেয়ে বেশি নয়। ডেসবরোর স্থান সেদিক দিয়ে দ্বিতীয়—সিলভার ব্লেজের প্রথম। কাজেই সিলভার ব্রেজ হারলে ওদের লাভ। স্ট্রেকারের সঙ্গে ওখানকার ট্রেনার সিলাজ ব্রাউনের খুব একটা বনিবনা ছিল না। ওখানেও হানা দিয়েছি কিন্তু সিলাজ ব্রাউনকে এর মধ্যে টেনে আনবার মতো প্রমাণ পাইনি।
একই স্বার্থ নিয়ে সিম্পসন কেপলটন আস্তাবলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে এমন কোনো নজির পাওয়া গেছে?
একদম না।
কথা আর জমল না। গাড়িতে হেলান দিয়ে বসে রইল হোমস। কিছুক্ষণ পরেই পৌঁছোলাম একটা ছিমছাম লাল-ইটের তৈরি ভিলার সামনে। একটু তফাতে ধূসর টালি ছাওয়া বার-বাড়ি। চারদিকে ঢেউ-খেলানো জলাভূমি। অনেকদূরে দিগন্তরেখার কাছে ট্যাভিসটক গ্রামের গির্জার চুড়া, পশ্চিমদিকে কেপলটন আস্তাবল। গাড়ি থামতেই লাফিয়ে নেমে পড়লাম প্রত্যেকেই হোমস বাদে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ধ্যানস্থ হয়ে বসে রইল তো রইলই। আমি বাহুস্পর্শ করতেই ভীষণ চমকে উঠে ধড়মড় করে নেমে এল নীচে।
দুই চোখে নিবিড় বিস্ময় নিয়ে কর্নেল রস তাকিয়ে আছেন দেখে হোমস বললে, দিবাস্বপ্ন দেখছিলাম মশায়, কিছু মনে করবেন না। আমি কিন্তু বন্ধুবরের চোখের দীপ্তি আর হাবভাবের মধ্যে চাপা উত্তেজনা লক্ষ করেই বুঝলাম–দিবাস্বপ্ন নয়, নিশ্চয় জবর সূত্র খুঁজে পেয়েছে সে। কিন্তু সূত্রটা যে কী, তা হাজার ভেবেও মাথায় আনতে পারলাম না।
মি. হোমস, অকুস্থলে যাবেন তো? গ্রেগরির প্রশ্ন।
আগে দু-একটা কথা এখানেই জেনে নেওয়া যাক। স্ট্রেকারের লাশ কোথায়?
ওপরতলায়।
কর্নেল রস, স্ট্রেকার কদ্দিন কাজ করছে আপনার?
বারো বছর। পাঁচ বছর জকি হিসেবে, সাত বছর ট্রেনার হিসেবে। খুবই কাজের লোক।
স্ট্রেকারের পকেটের জিনিসগুলো কোথায়, ইনস্পেকটর?
বসবার ঘরে।
চলো তো দেখি।
সামনের ঘরে ঢুকলাম সবাই। চৌকোনো টিনের বাক্সর তালা খুলে ইনস্পেকটর গ্রেগরি অনেকগুলো জিনিস রাখল টেবিলের ওপর। এক বাক্স মোমের দেশলাই, ছোট্ট একটা চর্বির মোমবাতি, একটা ব্রায়ার পাইপ, চামড়ার ব্যাগে আধ আউন্স ক্যাভেন্ডিস তামাক, সোনার চেনে ঝোলানো রুপোর ঘড়ি, পাঁচটা মোহর, একটা অ্যালুমিনিয়ামের পেনসিল-বাক্স, কিছু কাগজ, কারুকার্য করা হাতির দাঁতের বাঁটওলা একটা অত্যন্ত মূল্যবান সূক্ষ্ম ছুরি–ফলা শক্ত–নোয়ানো যায় না।
উলটেপালটে ছুরিটা দেখে হোমস বললে, অসাধারণ ছুরি দেখছি। ফলায় রক্ত লেগে তার মানে এই ছুরিও পাওয়া গেছে স্ট্রেকারের হাতের মুঠোয়। ওয়াটসন, দেখো তো ছুরিটা তোমাদের ডাক্তারি শাস্ত্রের এক্তিয়ারে পড়ে কি না!
এ তো ছানিকাটা ছুরি।
ঠিক ধরেছ। সূক্ষ্ম অপারেশনের উপযোগী করে ফলাটা এত সরু করা হয়েছে। কিন্তু যে-ছুরি মুড়ে পকেটে রাখা যায় না, সে-ছুরি পকেটে নিয়ে স্ট্রেকার বেরিয়েছিল কেন, এইটাই হল প্রশ্ন। অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না?
গ্রেগরি বললে, খুব অদ্ভুত নয়। তাড়াতাড়িতে হাতের কাছে যা পেয়েছে, তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। টেবিলেই পড়েছিল ক-দিন–মিসেস স্ট্রেকার দেখেছে। ডগায় একটা ছিপি লাগানো ছিল।
কাগজগুলো কীসের?
খড়বিচালির তিনটে রসিদ, একটা কর্নেল রসের নির্দেশলিপি, আর এটা একটা মেয়েদের পোশাকের হিসেব। দাম পঁয়ত্রিশ পাউন্ড পনেরো শিলিং। বিক্রি করেছে বন্ড স্ট্রিটের ম্যাডাম লেসুরিয়ার। কিনেছে উইলিয়াম ডার্বিশায়ার। মিসেস স্ট্রেকারের কাছে শুনেছি এই ভদ্রলোক জন স্ট্রেকারের বিশেষ বন্ধু–চিঠিপত্রও আসত জন স্ট্রোরের ঠিকানায়।
হিসেবটা দেখতে দেখতে হোমস বললে, ডার্বিশায়ার গিন্নির দামি জিনিস ছাড়া মন ওঠে না দেখছি। একটা পোশাক বাবদ বাইশটা গিনি নেহাত কম নয়। চলো, এবার অকুস্থলে যাওয়া যাক।
গলিপথে বেরুতেই একজন স্ত্রীলোক এসে গ্রেগরির বাহুস্পর্শ করল। মুখটা উদবেগ উত্তেজনায় উদ্ৰান্ত, বিশীর্ণ। সাম্প্রতিক বিভীষিকার ছাপ মুখের পরতে পরতে।
বললে হাঁফাতে হাঁফাতে, পেয়েছেন?
এখনও পাইনি, মিসেস স্ট্রেকার। তবে এবার একটা হিল্লে হবে। লন্ডন থেকে মি. হোমস এসে গেছেন।
হোমস বলে উঠল, আরে মিসেস স্টেকার যে, মনে পড়ে কিছুদিন আগে প্লিমাউথের একটা গার্ডেন পার্টিতে আলাপ হয়েছিল আমাদের?
আপনি ভুল করছেন।
সে কী কথা! কিন্তু আমার তো বেশ মনে আছে। অস্ট্রিচ-পালকের ঝালর দেওয়া একটা ভারি সুন্দর সিল্কের ড্রেস পরেছিলেন–রংটা গোলাপি ধূসর?
এ-রকম কোনো ড্রেস আমার নেই, স্যার।
কঁচুমাচু মুখে হোমস আমতা আমতা করে বেরিয়ে এল বাইরে। হাঁটতে হাঁটতে সবাই পৌঁছোলাম অকুস্থলে। গর্তের মতো একটা জায়গা। ধারে হলদে ফুলের একটা ঝোপ। কোট পাওয়া গিয়েছিল এইখানেই। চেয়ে রইল হোমস। বললে, খুনের রাতে হাওয়ার তেমন জোর ছিল না, তাই না?
না। তবে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল।
ওভারকোটটা তাহলে হাওয়ায় উড়ে আসেনি–ঝোঁপের ওপর খুলে রাখা হয়েছিল।
হ্যাঁ তাই ছিল। ঝোঁপের ওপর পাতা ছিল।
কাদায় অনেক পায়ের ছাপ পড়েছে দেখতে পাচ্ছি।
আমরা মাদুর পেতে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
শাবাশ!
এই থলির মধ্যে সিলভার ব্লেজের পায়ের নাল, সিম্পসন আর স্ট্রোরের জুতোর একটা করে পাটিও এনেছি।
সত্যিই গ্রেগরি, তোমার তুলনা হয় না!
থলি নিয়ে গর্তের মতো জায়গাটায় নেমে গেল হোমস। মাদুরটাকে ঠেলে দিল মাঝামাঝি জায়গায়। উপুড় হয়ে শুল মাদুরের ওপর। দু-হাতে চিবুক রেখে তন্ময় হয়ে চেয়ে রইল পদদলিত কাদার দিকে।
আচমকা চেঁচিয়ে উঠল সোল্লাসে, তোবা! তোবা! এ আবার কী?
জিনিসটা একটা মোমের দেশলাই কাঠি। আধপোড়া। এত কাদা লেগেছে যে কাঠের টুকরো বলে মনে হচ্ছে।
মেজাজ খিঁচড়ে গেল গ্রেগরির, আশ্চর্য! আমার চোখ এড়িয়ে গেল!
কাদায় ঢুকে ছিল বলে দেখতে পাওনি। কিন্তু আমি ঠিক এই জিনিসটাই খুঁজছিলাম বলে দেখতে পেয়েছি।
বলেন কী! আপনি জানতেন কাঠি দেখতে পাবেন?
সম্ভাবনা ছিল। বলে থলি থেকে জুতো বার করে ছাপগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখল হোমস। সর্বশেষে গর্তের কিনারায় হাঁচড়পাঁচড় করে উঠে এসে হাত পায়ে হামাগুড়ি মেরে এগিয়ে চলল ঝাউ আর ঝোঁপের মধ্যে দিয়ে।
আর ছাপ পাবেন না, মি. হোমস। চারদিকে এক-শো গজ পর্যন্ত জমি তল্লাশ করেছি আমি, বলল গ্রেগরি।
তাই নাকি? তাহলে নতুন করে খোঁজার ধৃষ্টতা আর দেখাব না। ঘোড়ার নালটা পকেটে নিয়ে অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগে পর্যন্ত জলায় একটু বেড়িয়ে নিই বরং–কপাল খুলে যেতে পারে।
বন্ধুবরের ধীর স্থির পদ্ধতিমাফিক কাজকর্ম দেখতে দেখতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটছিল কর্নেল রসের। ছটফট করছিলেন এতক্ষণ। এবার ঘড়ি দেখলেন।
বললেন, ইনস্পেকটর, আপনি কি আসবেন আমার সঙ্গে? আপনার পরামর্শ দরকার কয়েকটা ব্যাপারে বিশেষ করে ওয়েসেক্স কাপ বাজি জেতার দৌড়ে। সিলভার ব্লেজ যে দৌড়োচ্ছে না–এটা জানিয়ে দেওয়া দরকার পাবলিককে।
কক্ষনো না! জোর গলায় বললে হোমস। সিলভার ব্লেজ দৌড়োবে।
বাতাসে মাথা ঠুকে অভিবাদন জানালেন কর্নেল।
আপনার অভিমতের জন্যে ধন্যবাদ। হাওয়া খাওয়া শেষ হলে স্ট্রেকারের বাড়িতে আসবেন। ওখান থেকেই গাড়িতে ট্যাভিসটক ফিরব।
বলেই, ইনস্পেকটরকে নিয়ে হনহন করে চলে গেলেন ভদ্রলোক। জলার ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগলাম আমি আর হোমস। পড়ন্ত রোদে অপূর্ব লাগছে আশপাশের দৃশ্য। হোমস কিন্তু কোনোদিকে তাকাচ্ছে না। ড়ুবে রয়েছে নিজের চিন্তায়।
অনেকক্ষণ পর হঠাৎ বললে, ওয়াটসন, জন স্ট্রেকারকে কে খুন করেছে আপাতত তা নিয়ে মাথা না-ঘামিয়ে চলো ঘোড়াটার কী হল দেখা যাক। ধর, সিলভার ব্রেজ ছুটে পালিয়েছে। ঘোড়ারা কখনো দলছুট হয়ে একলা থাকে না–দলে ফিরে আসে। সেক্ষেত্রে সিলভার ব্লেজ ফাঁকা জলায় ঘুরে মরতে যাবে কেন? হয় কিংস পাইল্যান্ড না হয় কেপলটনের আস্তাবলে গিয়ে ভিড়বে। বেদেরা কখনোই এ-রকম বিখ্যাত ঘোড়া নিয়ে পুলিশের হামলায় যেতে চাইবে না–ওরা ঝঞ্ঝাট একদম পছন্দ করে না। বুঝলে?
সিলভার ব্লেজ তাহলে এখন কোথায়?
কিংস পাইল্যান্ড অথবা কেপলটন–এই দুটো আস্তাবলের একটায় তার ফেরা উচিত। প্রথমটায় সে যায়নি–তাহলে নিশ্চয় দ্বিতীয়টায় গিয়েছে। অনুমতিটা বাজিয়ে নেওয়া যাক। গ্রেগরি যেদিকে পায়ের ছাপ খুঁজেছে–সেদিকটা শুকনো খটখটে। কিন্তু কেপলটনের দিকে জমি ঢালু হয়ে গেছে, বৃষ্টির জলে কাদাও নিশ্চয় আছে। সিলভার ব্লেজ যদি ওইদিকেই গিয়ে থাকে, পায়ের ছাপ নিশ্চয় পাওয়া যাবে।
একটু খোঁজাখুঁজির পর সত্যিই দেখা গেল একসারি অশ্বখুর-চিহ্ন এগিয়ে গিয়েছে কাদাজমা গর্তের মতো একটা জায়গা দিয়ে। পকেট থেকে সিলভার ব্লেজের নাল বার করে মিলিয়ে দেখল হোমস একই নালের ছাপ।
সোল্লাসে বললে হোমস, দেখলে তো? একেই বলে কল্পনার পুরস্কার। এই একটি ঘাটতি আছে গ্রেগরির ভেতরে! চলো, এগিয়ে দেখা যাক।
কাদাটে গর্ত পেরিয়ে আবার সিকি মাইলটাক পথ শুকনো খটখটে মাটি মাড়িয়ে এলাম। আবার জমি ঢালু হয়েছে দেখা গেল। আবার কাদার ওপর পাওয়া গেল অশ্বখুর-চিহ্ন। তারপর আধ মাইল রাস্তায় কোনো চিহ্নই নেই। ফের পাওয়া গেল কেপলটনের আস্তাবলের কাছে। বিজয়োল্লাস দেখলাম হোমসের দুই চোখে। সিলভার ব্লেজ এবার একা নয়–পাশে একটা মানুষের পায়ের ছাপও পড়েছে।
সে কী! এতক্ষণ তো একাই হেঁটেছে সিলভার ব্লেজ! সবিস্ময়ে বললাম আমি।
ঠিক কথা, ঠিক কথা! এতক্ষণ একা হেঁটেছে সিলভার ব্লেজ। আরে! আরে! এ আবার কী!
যুগ্ম পদচিহ্ন সহসা মোড় ঘুরে কিংস পাইল্যান্ডের দিকে গিয়েছে। শিস দিয়ে উঠল হোমস। চললাম দুজনে মানুষ আর ঘোড়ার পায়ের ছাপ অনুসরণ করে। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম যুগল পদচিহ্নকে ফের উলটোদিকে চলতে দেখে।
চললাম সেইদিকে। একটু পরেই এসে পড়লাম পিচ বাঁধানো রাস্তায়। সামনেই কেপলটন আস্তাবলের ফটক। ভেতর থেকে হাঁ-হাঁ করে দৌড়ে এল একজন, সহিস।
কী চাই? কী চাই? ফালতু লোকের ঘোরাফেরা এখানে চলবে না।
তোমার মনিবের সঙ্গে দেখা করতে চাই। কাল ভোর পাঁচটায় এলে মি. সিলাজ ব্রাউনকে পাওয়া যাবে?
ভোরেই তো ওঠেন উনি। কিন্তু তার দরকার হবে না। ওই উনি আসছেন।
সাঁই-সাঁই শব্দে চাবুক নাড়তে নাড়তে হনহন করে ফটক পেরিয়ে বেরিয়ে এল ভীষণদর্শন এক বয়স্ক পুরুষ।
ডসন, কীসের আড্ডা হচ্ছে? যাও, নিজের কাজে যাও! আপনারা এখানে কেন?
আপনার সঙ্গে মিনিট দশেক হাওয়া খেতে। যেন মিছরি ঝরে পড়ল হোমসের বচনে।
বাজে লোকের সঙ্গে কথা বলবার সময় আমার নেই। ভাগুন বলছি। নইলে কুকুর লেলিয়ে দেব।
গলা বাড়িয়ে ট্রেনারের কানে কানে কী যেন বলল হোমস। সঙ্গেসঙ্গে আঁতকে উঠল সিলাজ ব্রাউন–টকটকে লাল হয়ে গেল মুখখানা।
মিথ্যে কথা! ডাহা মিথ্যে কথা।
বেশ তো, মিথ্যেই যদি হয় তো তা নিয়ে খোলা জায়গায় তর্ক না-করে ভেতরে গেলে হয় না?
আসুন! আসুন!
মুচকি হেসে হোমস বললে, ওয়াটসন, মিনিট কয়েক দাঁড়াও এখানে চলুন মি. ব্রাউন। ঠিক দশ মিনিট পরে বেরিয়ে এল দুজনে। এইটুকু সময়ের মধ্যে সিলাজ ব্রাউনের মুখচ্ছবি আশ্চর্যভাবে পালটে গিয়েছে। ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে মুখ, ফেঁটা ফোঁটা ঘাম দাঁড়িয়ে গিয়েছে কপালে। হাতের চাবুক থর থর করে কাঁপছে হাওয়া-আন্দোলিত বৃক্ষশাখার মতো। চোয়াড়ে মারকুটে চেহারা যেন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে, প্রভুভক্ত কুত্তার মতো ল্যাজ গুটিয়ে হাঁটছে হোমসের পাশে পাশে।
বললে কেঁউ কেঁউ করে, যা বললেন, ঠিক তাই হবে, স্যার।
ভুল যেন না হয়। চোখে চোখ রেখে বললে হোমস। ইস্পাত-কঠিন চোখের সেই দৃষ্টি দেখে সিটিয়ে গেল বেচারি ব্রাউন।
না, না, কোনো ভুল হবে না। সময়মতো হাজির থাকবে। পালটাব কখন? আগে, না পরে?
ভেবে নিল হোমস। অট্টহেসে বললে, না। এখন কোনো পালটাপালটি নয়। চিঠি লিখে জানাব। কিন্তু যদি দেখি ওপরচালাকির তালে আছেন—
না, না। বিশ্বাস করুন আমি কথা দিচ্ছি।
ঠিক নিজের মতন যত্নআত্তি করা চাই।
নিশ্চয়, নিশ্চয়।
বলে, করমর্দনের জন্যে কম্পিত হাত বাড়িয়ে দিল সিলাজ ব্রাউন। হোমস কিন্তু হাত ছুঁলো না পেছন ফিরে পা বাড়াল কিংস পাইল্যান্ডের দিকে।
যেতে যেতে বললে, এ-রকম একটা কাপুরুষ, চোয়াড়ে আর ছিঁচকে আর দেখিনি।
ঘোড়া-চোর তাহলে সে?
মানতে কি আর চায়। কিন্তু নিশীথ রাতের কাণ্ডকারখানা যখন হুবহু বলে গেলাম, তখন ভাবল ওর সমস্ত কীর্তি আমি আড়াল থেকে দেখেছি। কাদার মধ্যে অদ্ভুত-মাথা চৌকোনা বুটের ছাপ তুমিও দেখেছ। ব্রাউনের বুটের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় সেই বুট। এ-রকম একটা কুকাজের ভার কেউ অধস্তন লোকের ওপর দেয় না নিজেই সারে। সাক্ষী রাখে না। খুঁটিয়ে বললাম সে-রাতে কী ঘটেছিল। রাত থাকতে যার ঘুম থেকে ওঠা অভ্যেস, সে নিশ্চয় সেদিনও বিছানা ছেড়ে বেরিয়েছিল জলায়–এমন সময়ে দেখলে সিলভার ব্লেজ আপন মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রথমে ঠিক করল, যেখানকার ঘোড়া সেখানেই রেখে আসবে। তাই লাগাম ধরে এগোল কিংস পাইল্যান্ডের দিকে। কিন্তু একটু যেতেই মাথায় ভূত চাপল। ঠিক করলে, ঘোড়দৌড়টা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত কোথাও লুকিয়ে রাখা যাক। তাই লুকিয়ে রাখল কেপলটনেই।
কিন্তু আস্তাবল তো দেখে গেছে গ্রেগরি।
আরে ভায়া, ঘোড়ার জালিয়াতিতে যারা হাত পাকিয়েছে, তারা জানে ঘোড়া কী করে লুকোতে হয়।
কিন্তু ওর কাছে এখন ঘোড়া রেখে দেওয়া কি ঠিক হল?
নিজের মাথা বাঁচাবার জন্যে ও এখন দরকার হলে ঘোড়াটাকেই মাথায় তুলে রাখবে।
কিন্তু কর্নেল রস ওর মাথা আস্ত রাখবে বলে মনে হয় না।
কর্নেল রস জানলে তো। আমি সরকারের নুন খাই না যে সব কথা বলতে হবে। তা ছাড়া কর্নেল লোকটা আমার সঙ্গে খুব একটা ভালো ব্যবহার করেনি। কাজেই ওঁকে নিয়ে একটু মজা করব। ঘোড়া পাওয়া গেছে বলে ফেলো না যেন।
পাগল! এবার তাহলে কোরের খুনিকে ধরবে তো?
আরে না। আজ রাতের ট্রেনেই লন্ডন ফিরব।
মাথায় বাজ পড়লেও এতটা অবাক হতাম না। মাত্র কয়েক ঘণ্টা হল এসেছে ও ডেভনশায়ারে। এর মধ্যে তদন্ত ছেড়ে সরে পড়ার মতো কী এমন কারণ ঘটল মাথায় এল না। হোমসের মুখ থেকেও একটি কথাও আর বার করতে পারলাম না।
জন স্ট্রেকারের বাড়ির বারান্দায় দেখা গেল কর্নেল আর ইনস্পেকটরের সঙ্গে।
হোমস বললে, ডার্টমুরের চমৎকার বাতাস খুবই ভালো লাগল। মাঝরাতের এক্সপ্রেসে লন্ডন ফিরছি।
দু-চোখ পরো খুলে গেল ইনস্পেকটরের অবজ্ঞায় ঠোঁট বেঁকে গেল কর্নেলের।
বললেন, স্ট্রেকারের খুনিকে ধরবার আশা তাহলে ছাড়লেন?
কাঁধ ঝাঁকিয়ে হোমস বললে, একটু অসুবিধে হচ্ছে। আপনার জকি কিন্তু তৈরি রাখবেন–বৃহস্পতিবার মাঠে নামছে সিলভার ব্লেজ। জন স্ট্রেকারের একটা ফটো পেতে পারি?
পকেট থেকে একটা খাম বার করে এগিয়ে দিল ইনস্পেকটর।
মাই ডিয়ার গ্রেগরি তোমার দুরদৃষ্টি দেখে তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি। আমি কী চাই তা আগে থেকেই আঁচ করে রাখ। একটু দাঁড়াও, ঝি-টাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করে আসি।
ঘর থেকে হোমস বেরিয়ে যেতেই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কর্নেল বললেন, লন্ডন থেকে ডিটেকটিভ আনিয়ে পণ্ডশ্রম হল দেখছি।
ঘোড়া তো ফিরে পাচ্ছেন, প্রতিবাদের সুরে বললাম আমি।
আগে তো পাই, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন কর্নেল।
মুখের মতো জবাব দিতে যাচ্ছি, এমন সময়ে আচমকা ঝুঁকে পড়ে আস্তাবলের ছোকরাটাকে হোমস জিজ্ঞেস করল, ভেড়াগুলোর দেখাশুননা করে কে?
আমি।
সম্প্রতি অদ্ভুত কিছু লক্ষ করেছ?
তিনটে ভেড়া খোঁড়া হয়ে গেছে।
ভেড়াদের খোঁড়া হওয়ার ঘটনায় খুশি যেন উপচে পড়ল হোমসের চোখে-মুখে। খুকখুক। করে শুকনো হেসে দু-হাত ঘষতে ঘষতে চিমটি কেটে বসল আমার হাতে।
বলল, দেখলে তো! অন্ধকারে ঢিল ছুড়লাম, ঠিক লাগল গায়ে! মাই ডিয়ার গ্রেগরি, ভেড়াদের এই অত্যাশ্চর্য মড়ক নিয়ে তুমি একটু তলিয়ে ভেবো৷ কোচোয়ান, চালাও জোরসে!
বন্ধুবর সম্পর্কে কর্নেল রসের ধারণা যে কতখানি নেমে গেল এই উচ্ছ্বাসে, তা উৎকটভাবে প্রকট হল তার চোখে-মুখে। কিন্তু গ্রেগরির চোখে যেন হিরের ঝিকিমিকি দেখলাম। নিঃসীম আগ্রহ আতশবাজির মতো ফেটে পড়ল চোখে-মুখে।
বলল, ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ?
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আর কোনো ব্যাপারে আমাকে তলিয়ে ভেবে দেখতে হবে কি?
গভীর রাতে কুকুরটার কাণ্ডটা নিয়ে একটু ভেবো–সত্যিই অদ্ভুত।
কুকুর তো কিছু করেনি।
সেইটাই তো অদ্ভুত ব্যাপার হে।
চারদিন পর হোমসসহ গেলাম উইঞ্চেস্টার। সেখান থেকে কর্নেলের গাড়িতে রেসকোর্সে। ভদ্রলোক দেখলাম সাংঘাতিক গম্ভীর। ব্যবহারটাও রসকষহীন।
বললেন, ঘোড়ার ল্যাজ পর্যন্ত এখনও দেখলাম না।
দেখলে চিনতে পারবেন তো? হোমসের প্রশ্ন।
ভীষণ রেগে গেলেন কর্নেল, বিশ বছর রেসকোর্সে আছি–আজ পর্যন্ত এ-কথা কেউ জিজ্ঞেস করেনি আমাকে। সিলভার ব্লেজের সাদা কপাল আর তার পায়ের দাগ দেখলে বাচ্চা ছেলেও চিনতে পারে।
কীরকম বাজি চলছে?
সেটাও একটা অদ্ভুত ব্যাপার। গতকাল ও ছিল পনেরোতে এক। কমতে কমতে আজ দাঁড়িয়েছে তিনে এক।
হুম! তার মানে ভেতরের খবর কেউ রাখে মনে হচ্ছে!
রেসকোর্সে ঘোড়ার নাম লেখা রয়েছে। চোখ বুলিয়ে দেখলাম ছ-টা ঘোড়ার মধ্যে সিলভার ব্লেজের নামও রয়েছে। জকির মাথায় কালা টুপি, গায়ে লাল জ্যাকেট।
বললাম, ওই তো আপনার ঘোড়া দৌড়োচ্ছে।
কোথায়? দেখছি না তো? আকাশ থেকে পড়লেন কর্নেল।
নাম যখন আছে, ঘোড়াও আছে। পাঁচটা ঘোড়া গেল–এবারেরটা নিশ্চয় আপনার।
মুখের কথা খসতে-না-খসতেই ওজন নেওয়ার ঘেরা জায়গা থেকে টগবগিয়ে বেরিয়ে এল। একটা তেজি ঘোড়া সামনে দিয়েই গেল–পিঠে কর্নেলের বহু পরিচিত লাল-কালো চিহ্ন।
কক্ষনো না, এ-ঘোড়া আমার নয়,তারস্বরে চেঁচাতে লাগলেন কর্নেল, এ কী করলেন মি. হোমস? এর গায়ের একটা লোমও তো দেখছি সাদা নয়।
নির্বিকার কণ্ঠে হোমস বললে, দেখাই যাক না। আমার দূরবিন টেনে নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল দূরের দিকে। তারপর বলল, চমৎকার! শুরুটা চমৎকার হয়েছে! আসছে! আসছে! মোড় ঘুরে আসছে!
গাড়িতে বসেই স্পষ্ট দেখতে পেলাম কক্ষচ্যুত উল্কার মতো ছটা ঘোড়া প্রায় গায়ে গা
গয়ে সোজা ধেয়ে আসছে। কেপলটনের ঘোড়াটা এগিয়ে ছিল কিন্তু মাঝামাঝি এসেই। হঠাৎ দমক মেরে কর্নেলের লাল-কালো ঘোড়া সবাইকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল সামনে।
এতক্ষণ দমবন্ধ করে বসে ছিলেন কর্নেল। এবার বিরাট নিশ্বাস ফেলে বললেন, আঃ! বাঁচলাম! আমার ঘোড়াই বাজিমাত করল শেষ পর্যন্ত। কিন্তু মাথামুণ্ডু কিছুই যে বুঝতে পারছি না, মি. হোমস? রহস্য যে আর সইতে পারছি না?
এখুনি সব জানবেন, কর্নেল। চলুন, যাওয়া যাক আপনার ঘোড়ার কাছে, ওজন নেওয়ার ঘেরা অঞ্চলে ঢুকলাম আমরা। মদ দিয়ে মুখ আর পা ধুইয়ে দিন, কর্নেল সিলভার ব্লেজকে দেখতে পাবেন।
বলেন কী!
ঘোড়া জালিয়াতের পাল্লায় পড়েছিল সিলভার ব্লেজ–ওই অবস্থাতেই মাঠে নামিয়েছি।
মাই ডিয়ার স্যার, ঘোড়া ফিরিয়ে দিয়ে অশেষ উপকার করলেন আমার। এবার ধরিয়ে দিন জন স্ট্রোরের খুনিকে।
ধরিয়ে তো দিয়েছি। শান্তকণ্ঠ হোমসের।
আমি আর কর্নেল দুজনেই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। সমস্বরে বললাম, কোথায় সে?
এখানেই।
এইখানে? কোথায়?
আমাদের সঙ্গে।
রেগে গেলেন কর্নেল, দেখুন মশায়, উপকার করেছেন ঠিকই, কিন্তু গাড়োয়ানি ইয়ার্কির সময় এটা নয়। যথেষ্ট অপমানিত বোধ করছি আমি।
হাসতে লাগল শার্লক হোমস।
বললে, কর্নেল, আপনাকে খুনি ঠাউরেছি এটা কেন ভাবছেন? আসল খুনি দাঁড়িয়ে আপনার ঠিক পেছনে?
বলে হাত বুলোতে লাগল সিলভার ব্লেজের চকচকে ঘাড়ে।
সিলভার ব্লেজ!
যুগপৎ চিৎকার করে উঠলাম আমি আর কর্নেল।
হ্যাঁ, সিলভার ব্লেজ। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে গিয়েই ট্রেনারকে খুন করতে হয়েছে তাকে। জন স্ট্রেকার লোকটা পয়লা নম্বর নেমকহারাম। যাক গে, ঘণ্টা বেজে গেল। পরের ঘোড়াগুলির দৌড় আগে দেখি, ব্যাখ্যানা পরে হবেখন।
লন্ডন ফেরার পথে চলন্ত পুলম্যান গাড়ির কোনায় বসে হোমসের মুখে আমি আর কর্নেল শুনলাম রহস্য উদঘাটনের বিচিত্র কাহিনি। সময় যে কীভাবে কেটে গেল, বুঝতেও পারলাম না।
খবরের কাগজ পড়ে যা ভেবেছিলাম, এখানে পৌঁছানোর পর দেখলাম, তা ভুল। ভেবেছিলাম, ফিজরয় সিম্পসন নাটের গুরু। পরে দেখলাম তার বিপক্ষে প্রমাণ নেই। জন স্ট্রেকারের বাড়ি যাওয়ার সময়ে হঠাৎ চোখ খুলে গেল আমার। মনে আছে নিশ্চয় এমন তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম যে তোমরা সবাই নেমে পড়েছিলে গাড়ি থেকে আমার একদম খেয়াল ছিল না–বসেই ছিলাম। আসলে কী হয়েছে জান, মাটনকারির অত্যন্ত ইঙ্গিতপূর্ণ, অথচ অত্যন্ত সহজ সূত্রটা কেন যে আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল অবাক হয়ে তাই ভাবছিলাম।
কর্নেল সোৎসাহে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি যেন কীরকম হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু মাটনকারির সঙ্গে এ-ব্যাপারের কী সম্পর্ক, বুঝতে পারছি না তো।
আমার যুক্তি-শৃঙ্খলের পয়লা-নম্বর আংটা হল মাটনকারি। গুঁড়ো আফিম স্বাদহীন হয় না কখনোই। গন্ধটা যাচ্ছেতাই না-হলেও, ধরা যায়। মামুলি খাবারে মেশালে জিভে ধরা পড়বেই, যাকে খেতে দেওয়া হয়েছে, সে আর নাও খেতে পারে। কিন্তু মাটনকারিতে মেশালে ধরা যায় না, আফিম মেশানোর আদর্শ রান্না হল মাংসের ঝোল। স্বাদ একেবারই ঢাকা পড়ে যায়। স্ট্রেকার পরিবারে মাংসের ঝোল পরিবেশন করা ফিজরয় সিম্পসনের মতো আগন্তুকের পক্ষে সম্ভব নয় কোনোমতেই। ঠিক যে-রাতে মাংস রান্না হয়েছে, সেই রাতেই সে লন্ডন থেকে আফিমের গুঁড়ো পকেটে করে নিয়ে আসবে, এটা একটা অসম্ভব কাকতালীয়, হতেই পারে না। বাকি রইল তাহলে দুজন–স্ট্রেকার আর তার স্ত্রী ছাড়া মাটনকারির আয়োজন করা আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আস্তাবলের ছেলেটার খাবারেই কেবল আফিম মেশানো হয়েছে, বাড়ির লোকের মাংসে নয়। এডিথ দেখেনি কে মিশিয়েছে। তাহলে সে কে?
আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল কুকুরটার চুপ করে থাকাটা। রাতদুপুরে আস্তাবলে ঢুকে সিলভার ব্লেজকে বার করে আনা হয়েছে অথচ কুকুরের কাজ কুকুর করেনি, একদম হাঁকডাক করেনি। তার মানে কি এই নয় যে ঘোড়া নিয়ে গেছে, কুকুর তাকে চেনে?
সেইজন্যেই অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, মাঝরাতের নিশিকুটুম্বটি আসলে জন স্ট্রেকার স্বয়ং। মাটনকারিতে আফিম সে-ই মিশিয়েছে। ঘোড়াও সে বার করেছে। কিন্তু কেন? অনেক সময়ে দেখা গেছে, ট্রেনাররা টাকার লোভে ভালো ঘোড়াকে খুব সূক্ষ্মভাবে খারাপ করে দেয়। কখনো কখনো জকির হাতও থাকে এই ষড়যন্ত্রে। এমনভাবে এই কাজ করা হয় যে ধরা মুশকিল। তাই কী-কী জিনিস পকেটে নিয়ে নিশীথ অভিযানে বেরিয়েছিল জন স্ট্রেকার, দেখতে চেয়েছিলাম।
পকেটে পেলাম আশ্চর্য সেই ছুরি, যা ভাঁজ করে পকেটে রাখা যায় না, মারপিটের সম্ভাবনায় যে ছুরি পকেটে নিয়ে কেউ বেরোয় না। ওয়াটসন ডাক্তার মানুষ, সে বলল এ-ছুরি চোখের ছানিকাটার মতো সূক্ষ্ম কাজে লাগে। কর্নেল রস, আপনি নিশ্চয় জানেন, ঘোড়ার পেছনের পায়ের টেন্ডন সামান্য একটু চিরে দিলে ঘোড়া খোঁড়া হয়ে যায়। মনে হয় যেন বেশি প্র্যাকটিস করেছে বা বাত হয়েছে বলে খোঁড়াচ্ছে, কুকীর্তিটা কখনোই ধরা পড়ে না।
এই পর্যন্ত শুনেই স্কাউন্ট্রেল, ভিলেন বলে চিৎকার করে উঠলেন কর্নেল।
হোমস বললে, এই কারণেই ঘোড়া নিয়ে ফাঁকা জায়গায় গিয়েছিল স্ট্রেকার। আস্তাবলের ভেতরে খোঁচাখুঁচি করতে গেলে দাপাদাপির ঠেলায় ঘুম ভেঙে যেত প্রত্যেকের।
মোমবাতি আর দেশলাই সঙ্গে নিয়েছিল সেই কারণেই, রাগে আগুন হয়ে বললেন কর্নেল।
হ্যাঁ। পকেটে পাওয়া কাগজপত্র পরীক্ষা করেই বোঝা গেল যে কতখানি নীচে সে নেমেছে। অন্যের রসিদ কেউ পকেটে নিয়ে বেড়ায় না। একটা দামি মেয়েদের ড্রেসের রসিদ তার পকেটে দেখলাম। দেখেই বুঝলাম, এর ভেতরে বাইরের মেয়ে আছে। তার পেছনে টাকা ওড়াতে হচ্ছে। স্ট্রেকারকে। বিশ গিনির ড্রেস স্ট্রেকার-গৃহিণী পরে কি না, কায়দা করে জেনে নিলাম। সে বেচারি চোখেও কখনো দেখেনি এত দামি ড্রেস। অর্থাৎ মি. ডার্বিশায়ার নামক লোকটা স্ট্রেকারের বন্ধু নয়, সে নিজে। স্ট্রোরের ছবি নিয়ে পোশাক যে-দোকানে বিক্রি হয়েছে গেলাম সেখানে, তারাও বললে এই হল মি. ডার্বিশায়ার।
এবার সব স্পষ্ট হয়ে গেল। তাড়াতাড়িতে পালাতে গিয়ে সিম্পসন বেচারি গলাবন্ধ ফেলে গিয়েছিল। সেইটা কুড়িয়ে পায় স্ট্রেকার। ভেবেছিল তাই দিয়ে সিলভার ব্লেজের পেছনের পা জোড়া বেঁধে ছুরি চালাবে। কিন্তু ঘোড়াদের অদ্ভুত সহজাত অনুভূতি থাকে–আসন্ন বিপদ ওরা আঁচ করতে পারে। অথবা হয়তো হঠাৎ আলোর ঝলক দেখে চমকে উঠে লাথি মারে জোড়া পায়েসজোরে লাগে স্ট্রোরের কপালে লোহার নাল লাগানো তেজিয়ান ঘোড়ার চাট বড়ো সোজা কথা নয়–গুঁড়িয়ে যায় স্ট্রোরের খুলি। ওভারকোট খুলে ঝোপে রেখেছিল কাজের সুবিধের জন্যে–ফলে আচমকা চাট খেয়ে হাতের ছুরি গিয়ে লাগল নিজের উরুতে।
তারপর একটু আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে সিদ্ধান্তটা যাচাই করে নিলাম। ঘোড়ার টেন্ডন চেরবার আগে নিশ্চয় হাত পাকিয়েছে স্ট্রেকার। ভেড়াগুলো দেখে মনে হল এদের ওপর প্র্যাকটিস করেনি তো? জিজ্ঞেস করতেই সন্দেহ আর সন্দেহ রইল না। সত্যিই হঠাৎ তিনটে ভেড়া খোঁড়া হয়ে গেছে।
কর্নেল বললেন, কিন্তু সিলভার ব্লেজকে পেলেন কোত্থেকে?
আরে মশাই, ছিল কোনো প্রতিবেশীর কাছে। ভালোই ছিল। এই তো ক্ল্যাপহ্যাম জংশন এসে গেল। ভিক্টোরিয়া পৌঁছোব দশ মিনিটেই। কর্নেল, গরিবের বাড়িতে যদি পায়ের ধুলো দেন, তাহলে চুরুট খেতে খেতে না হয় আরও কিছু শুনে যাবেন।
———-
টীকা
১. ঘোড়ার নাম সিলভার ব্লেজ : সিলভার ব্লেজ লন্ডনের স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের ডিসেম্বর ১৮৯২ সংখ্যায়, নিউইয়র্কে মুদ্রিত স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় জানুয়ারি ১৮৯৩ সংখ্যায়।
২. ডার্টমুরে : দক্ষিণ-পশ্চিম ইংলন্ডের ডেভনশায়ারের অন্তর্গত ডার্টমুর প্রধানত গঠিত জলাভূমি এবং টর নামে পরিচিত গ্রানাইট পাথরের ছোটো বড়ো বিস্তর টিলা নিয়ে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এখানে লৌহযুগ এবং ব্রোঞ্জযুগে মানুষের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া গিয়েছে। শার্লক হোমসের বিখ্যাত উপন্যাস দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস-এর পটভূমিও ডার্টমুরে। স্যাক্সনদের রাজত্বকালে ডার্টমুর ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। ঊনবিংশ শতকের প্রাক্কালে এখানে একটি কারাগার নির্মিত হয়। ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধে বন্দিদের রাখা হত সেই কারাগারে।
৩. ঘোড়ার দালাল : এদের কাজ হল রেসের ঘোড়ার হাল হকিকত সম্পর্কে আগাম খবর জোগাড় করে, তা অর্থের বিনিময়ে রেসুড়ে জুয়াড়িদের জানিয়ে বাজি ধরতে সাহায্য করা।
৪. ট্যাভিসটক : ডার্টমুরের পশ্চিমতম প্রান্তে ট্যাভিসটকের অবস্থান।
৫. ল্যান্ডো : চারটি চাকাযুক্ত ঘোড়ায় টানা গাড়ি। এই গাড়ির ছাদ প্রয়োজনমতো বন্ধ করা বা খুলে রাখা যেত। আবারসওয়ারির ইচ্ছে হলে আধখোলাও রাখা যেত।
৬. ক্যাভেন্ডিস তামাক : ক্যাভেন্ডিস নামক কোম্পানি এই তামাক বিক্রি করত ডেলাকৃত টুকরো অবস্থায়।
৭. বন্ড স্ট্রিটের : দুটি বন্ড স্ট্রিটের উল্লেখ পাওয়া যায়। ওল্ড বন্ড স্ট্রিট এবং নিউ বন্ড স্ট্রিট। হাল ফ্যাশনের পোশাক এবং ছবির গ্যালারির জন্য বিখ্যাত নিউ বন্ড স্ট্রিট।
৮. পুলম্যান গাড়ি : রাত্রে শুয়ে ভ্রমণ করবার উপর্যুক্ত রেল-কামরার নাম পুলম্যান কোচ হয়েছিল যিনি এই গাড়ির নকশা করেন। সেই আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার জর্জ মর্টিমার পুলম্যানের (১৮৩১-১৮৯৭) নামে।
৯. এ-ছুরি চোখের ছানি কাটার মতো সূক্ষ্ম কাজে লাগে : বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ছানি কাটার ছুরি এতই পাতলা যে তা দিয়ে ঘোড়ার পায়ের টেন্ডন বা অন্য যেকোনো পেশিতে কোনো ক্ষত সৃষ্টি করা অসম্ভব।
১০. ভিক্টোরিয়া পৌঁছোব : এই গল্পর ঘটনার সময়ে কোনো ট্রেন উইনচেস্টার থেকে ভিক্টোরিয়া স্টেশনে আসত না। আসত ওয়াটারলু স্টেশনে।