দ্য ভ্যালি অফ ফিয়ার: ০৭. সমাধান

দ্য ভ্যালি অফ ফিয়ার: ০৭. সমাধান

০৭. সমাধান

পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পর স্থানীয় পুলিশ সার্জেন্টের ক্ষুদ্র বৈঠকখানায় গভীর পরামর্শ করতে দেখলাম ইনস্পেকটর ম্যাকডোনাল্ড আর মি. হোয়াইট ম্যাসোনকে। সামনের টেবিলের ওপর ছড়ানো ভূপীকৃত টেলিগ্রাম আর চিঠি সতর্কভাবে বাছাই করে সাজিয়ে রাখছিলেন দু-জনে। একপাশে রয়েছে বাছাই করা চিঠির তিনটে থাক।

প্রফুল্লকণ্ঠে শুধোয় হোমস, ধোঁকাবাজ সাইক্লিস্ট বেচারার পেছনে ছুটছেন দেখছি? কদ্দূর খবর পাওয়া গেল বদমাশটার?

ক্ষোভের সঙ্গে চিঠিপত্রের তাগাড়ের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল ম্যাকডোনাল্ড।

এই মুহূর্তে তার খবর এসেছে লিস্টার, নটিংহ্যাম, সাদামটন, ডাবি, ইস্টহ্যাম, রিচমন্ড এবং আরও চোদ্দোটা জায়গা থেকে। এর মধ্যে তিন জায়গায়–ইস্টহ্যাম, লিসেস্টার আর লিভারপুলে খবর এত পাকা যে তাকে গ্রেপ্তার পর্যন্ত করা হয়েছে। গোটা দেশটা দেখছি হলদে কোট পরা পলাতকে ছেয়ে গেছে।

কী সর্বনাশ। সহানুভূতির সুরে বলে হোমস। মি. ম্যাক, মি. হোয়াইট ম্যাসোন, আপনাদের দু-জনকেই এবার অন্তর থেকে একটা উপদেশ দিতে চাই। মনে আছে নিশ্চয়, আপনাদের সঙ্গে এ-কেসে মাথা গলানোর সময়ে একটা শর্ত আরোপ করা ছিল–অর্ধেক-প্রমাণিত অনুমিতি আপনাদের উপহার দেব না এবং যতক্ষণ না বুঝছি অনুমিতি সত্যি হয়েছে এবং নিজে সন্তুষ্ট হচ্ছি ততক্ষণ আমার ধ্যানধারণা আমার মধ্যেই গোপন রাখব। এই কারণেই এই মুহূর্তে আমার মনের মধ্যে যা রয়েছে তা আপনাদের বলতে পারছি না। আরও একটা কথা বলেছিলাম–তদন্ত আপনারাই করবেন আমি থাকব আড়ালে; সেই কারণেই নিষ্ফল কাজে আপনাদের উৎসাহ উদ্দীপনার অপচয় ঘটুক এ আমি হতে দিতে পারি না। এইসব ভেবেই আজ সকালে এসেছি আপনাদের একটা উপদেশ দিতে এবং আমার এ-উপদেশের সারাংশ নিবেদন করছি মাত্র তিনটে শব্দের মধ্যে–এ-কেস ছাড়ুন।

অবাক হয়ে সুবিখ্যাত সতীর্থটির পানে চেয়ে রইলেন ম্যাকডোনাল্ড এবং হোয়াইট ম্যাসেন।

চিৎকার করে বললে ইনস্পেকটর, আপনি কি তাহলে মনে করেন কোনো আশা নেই এ-কেসে?

আমি মনে করি কোনো আশা নেই আপনাদের কেসে। নিখাদ সত্যে উপনীত হওয়ার মধ্যে আশা নেই–আমি তা মনে করি না।

কিন্তু এই যে সাইক্লিস্ট–এ তো আর কপোল-কল্পনা নয়। তার চেহারার বর্ণনা পেয়েছি, চামড়ার ব্যাগ পেয়েছি, সাইকেল পেয়েছি। কোথাও-না-কোথাও সে আছে। তাকে গ্রেপ্তার করব না কেন?

ঠিক, ঠিক, নিশ্চয় সে কোথাও আছে, এবং নিশ্চয় তাকে আমরা গ্রেপ্তার করব। কিন্তু আমি বলব আপনাদের শক্তিটা ইস্টহ্যাম বা লিভারপুলে নষ্ট করবেন না। আরও সোজা রাস্তা আছে।

কী যেন আপনি চেপে যাচ্ছেন, মি. হোমস। এ কিন্তু আপনার অন্যায়। বিরক্ত হয়েছে ইনস্পেকটর।

আপনি আমার কাজের পদ্ধতি জানেন, মি. ম্যাক। তবে যা বলতে চাই না–তা যদ্র সম্ভব অল্প সময়ের জন্যেই চেপে রাখব। আমি শুধু এককভাবে আমার খুঁটিনাটিগুলো বাজিয়ে দেখতে চাই তা হয়ে যাবে শিগগিরই–তারপর ফলাফল পুরোপুরি আপনাদের হাতে সঁপে দিয়ে নমস্কার ঠুকে ফিরে যাব লন্ডনে। এ ছাড়া আর করণীয় নেই–কেননা এর চাইতে অত্যাশ্চর্য আর কৌতূহলোদ্দীপক প্রহেলিকা আমি দেখিনি।

মি. হোমস, সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না। কাল রাতে টানব্রিজ ওয়েলস থেকে ফিরে আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল, আমাদের ফলাফলের সঙ্গে আপনি মোটামুটি একমত ছিলেন। তারপর এমন কী ঘটল যে কেসটা সম্বন্ধে একেবারে নতুন ধারণা খাড়া করে ফেললেন?

জিজ্ঞাসা যখন করলেন তখন বলি। কাল রাতে কয়েক ঘণ্টা ম্যানর হাউসে কাটিয়েছি। যাবার আগে বলেছিলাম আপনাদের।

তাতে কী হল?

আ! আপাতত এ-প্রশ্নের জবাবে একটা অত্যন্ত মোটামুটি জবাব দেব। ভালো কথা, মান্ধাতা আমলের এই বাড়িটার একটা ছোট্ট কিন্তু স্পষ্ট আর কৌতূহলোদ্দীপক বিবরণ পড়েছিলাম কিনেছি মাত্র এক পেনি দিয়ে স্থানীয় তামাকওলার কাছে। বলতে বলতে ওয়েস্টকোটের পকেট থেকে একটা ক্ষুদ্র পুস্তিকা বার করল হোমস–কাঠের ওপর স্থূলভাবে খোদাই করা সুপ্রাচীন ম্যানর হাউসের ছবিতে সুশোভিত প্রচ্ছদ। ভায়া মি. ম্যাক, অকুস্থলের ঐতিহাসিক পরিবেশের প্রতি সজাগ সহানুভূতি থাকলে তদন্তে আগ্রহ দারুণভাবে বেড়ে যায়। মুখখানা অতটা অসহিষ্ণু করবেন না, কেননা এইরকম একটা নীরস বর্ণনা পড়লেও অতীতের মোটামুটি একটা ছবি মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। যদি অনুমতি করেন তো একটু পড়ে নমুনা শোনাই। প্রথম জেমসের রাজত্বকালে নির্মিত এবং আরও পুরানো একটি বাড়ির জমির ওপর দণ্ডায়মান বির্লস্টোনের ম্যানর হাউস পরিখাবেষ্টিত জ্যাকোবিয়ান আবাসগৃহের অত্যুৎকৃষ্ট নিদর্শন হিসাবে–

মি. হোমস কি আমাদের বাঁদর নাচাচ্ছেন?

ছিঃ ছিঃ, মি. ম্যাক! এই প্রথম আপনাকে মেজাজ খারাপ করতে দেখলাম। ঠিক আছে, যেরকম তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠছেন দেখছি এই একটি ব্যাপারে, অক্ষরে অক্ষরে আর পড়ে শোনাব না। কিন্তু যদি বলি, ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে একজন পার্লামেন্টারি কর্নেল এ-বাড়ি দখল করেছিলেন এবং গৃহযুদ্ধের সময়ে বেশ কয়েক দিন চার্লস এখানে লুকিয়েছিলেন, শেষকালে দ্বিতীয় জর্জ এ-বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়ে গিয়েছিলেন তাহলে কিন্তু আপনাকে মানতেই হবে যে কৌতূহল জাগানোর মতো অনেক কিছুই জড়িয়ে আছে সুপ্রাচীন এই সৌধের ইট আর পাথরে।

তাতে কোনো সন্দেহই আমার নেই, মি. হোমস, কিন্তু তা নিয়ে আমাদের কোনো দরকারও নেই।

নেই কি? একেবারেই নেই? ভায়া মি. ম্যাক, আমাদের এ-পেশায় একটা জিনিস একান্তই দরকার–দৃষ্টিশক্তির প্রসারতা। বিবিধ ধারণা নিয়ে খেলা এবং জ্ঞানের পরোক্ষ প্রয়োগ অসাধারণ আগ্রহ জাগায়। এসব মন্তব্যের জন্যে ক্ষমা করবেন। কিন্তু মন্তব্য যিনি করছেন তিনি অপরাধ বস্তুটার নিছক সমঝদার হলেও আপনার চাইতে বয়স্ক এবং হয়তো বেশি অভিজ্ঞও।

আন্তরিকভাবে জবাব দিলে ডিটেকটিভ, সেটা সবার আগে আমি স্বীকার করব। আপনি ঠিক লক্ষ্যবস্তুতে পৌঁছোন মানছি, কিন্তু এমন সাতঘাট ঘুরে আসেন যে মাথায় চক্কর লেগে যায়।

বেশ, বেশ, অতীত ইতিহাসকে বিসর্জন দিয়ে তাহলে বর্তমানের ঘটনা নিয়ে পড়া যাক। আগেই বলেছি, গত রাতে ম্যানর হাউসে গিয়েছিলাম। মি. বার্কার অথবা মিসেস ডগলাসের সঙ্গে দেখাই করিনি। ওঁদের বিরক্ত করার কোনো দরকার আছে বলে মনে করিনি। তবে একটা খবর শুনে খুব খুশি হয়েছি। লোকদেখানো কান্নাকাটি–হুতাশের ধার দিয়েও যাচ্ছেন না ভদ্রমহিলা এবং তারিয়ে তারিয়ে মনের আনন্দে খেয়েছেন রাতের খানা। আমার বিশেষ সাক্ষাৎকারটি ঘটেছিল সচ্চরিত্র অ্যামিসের সঙ্গে। মিষ্টি মিষ্টি দুটো কথা বলতেই কাউকে না-জানিয়ে সে আমায় কিছুক্ষণের জন্যে বসতে দিয়েছিল পড়ার ঘরে।

সে কী! ওই মড়াটার সঙ্গে? আঁতকে উঠলাম আমি।

না, না, এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। মি. ম্যাক, আপনি অনুমতি দিয়েছেন সে-খবর আমি পেয়েছি। ঘর এখন স্বাভাবিক। পনেরো মিনিট সেখানে বসে শিখলাম অনেক জিনিস।

কী করছিলেন বসে বসে?

ব্যাপারটা এত ছোটো যে তা নিয়ে রহস্য করতে চাই না। নিখোঁজ ডাম্বেলটা খুঁজছিলাম। কেসটা সম্বন্ধে আমার আন্দাজি হিসেবে গোড়া থেকেই একটা বিরাট জায়গা জুড়ে রয়েছে এই ডাম্বেল। শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করলাম তাকে।

কোত্থেকে?

আ! তাহলেই তো অজানার অভিযানের শেষে পৌঁছে যাবেন। আমাকে আরও একটু যেতে দিন, সামান্য একটু, প্রতিজ্ঞা করছি তারপর যা জানি তার সমস্ত আপনারাও জানবেন।

ইনস্পেকটর বললে, কী আর করি বলুন, আপনার শর্ত অনুসারেই চলতে হবে আমাদের। কিন্তু কেস ছাড়বার কথা যদি বলেন–কেসটা ছাড়তেই-বা যাব কেন?

খুব সামান্য একটা কারণে। কারণটা এই: কী তদন্ত করছেন, এই প্রথম ধারণাটাই এখনও আপনাদের মাথায় ঢোকেনি বলে।

বির্লস্টোন ম্যানরের মি. জন ডগলাসের মৃত্যুরহস্য তদন্ত করছি।

তা ঠিক, তা ঠিক। কিন্তু কষ্ট করে সাইকেল আরোহী সেই রহস্যজনক ব্যক্তিটিকে খুঁজতে যাবেন না। আমি বলছি তাতে আপনাদের আখেরে লাভ হবে না।

তাহলে কী করতে বলেন আমাদের?

যা বলব ঠিক তাই যদি করেন, তাহলেই বলব কী করতে হবে।

আপনার কাজের পদ্ধতি-টদ্ধতিগুলো সৃষ্টিছাড়া হলেও পেছনে যে একটা কারণ থাকে তা আমাকে মানতেই হবে। বেশ, যা বলবেন তাই করব।

মি. হোয়াইট ম্যাসোন, আপনি?

অসহায়ভাবে প্রত্যেকের মুখ অবলোকন করলেন গ্রাম্য গোয়েন্দা। মি. হোমস আর তার পদ্ধতির সঙ্গে সে পরিচিত নয়।

বললেন শেষকালে, বেশ, ইনস্পেকটরের কাছে যা মঙ্গল, আমার কাছেও তা মঙ্গল!

চমৎকার! বললে হোমস। তাহলে আপনাদের দুজনকেই মনমাতানো চমৎকার পল্লিভ্রমণে বেরোতে বলছি। শুনেছি বির্লস্টোন পর্বতমালা থেকে ওয়েল্ডের দৃশ্য নাকি সত্যিই আশ্চর্য সুন্দর। রাস্তায় দুপুরের খাওয়া নিশ্চয় চটি-টটিতে পাওয়া যাবে–গাঁয়ের পথঘাট অজানা বলেই কোন চটিটা উত্তম হবে, সে-সুপারিশ করতে পারছি না। সন্ধের দিকে ক্লান্ত হলেও তরতাজা মনে

রাগতভাবে চেয়ার চেড়ে উঠতে উঠতে চিৎকার করে বললে ম্যাকডোনাল্ড, ইয়ার্কির মাত্রা কিন্তু ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

খুশি উজ্জ্বল ভঙ্গিমায় কাঁধ চাপড়ে দিয়ে হোমস বললে, বেশ, বেশ, যেভাবে খুশি দিন কাটান। যেখানে খুশি যান, যা খুশি করুন, কিন্তু সন্ধে হওয়ার আগেই আমার সঙ্গে এইখানে দেখা করুন অবশ্যই দেখা করবেন, মি. ম্যাক, অন্যথা যেন না হয়।

এবার তো বেশ স্থিরমস্তিষ্কের মতো কথা বেরোচ্ছে।

প্রত্যেকটা উপদেশই জানবেন খাসা উপদেশ, কিন্তু জোরজবরদস্তি করতে চাই না, যখন দরকার আপনাদের তখন কাছে পেলেই হল। যাওয়ার আগে একটা কাজ করে যান। মি. বার্কারকে একটা চিঠি লিখে যান।

আচ্ছা।

আমি বলছি আপনি লিখে নিন। তৈরি?

প্রিয় মহাশয়,

যদি কিছু পাওয়া যায়, এই আশায় আমাদের মনে হচ্ছে পরিখার জল বার করে দেওয়া আমাদের কর্তব্য–

অসম্ভব, বললে ইনস্পেকটর। আমি খোঁজ নিয়েছি।

ছিঃ, ছিঃ, ভায়া, ছিঃ! যা বলি, তাই করুন।

বেশ, বলুন।

–আমাদের কর্তব্য, কেননা এমন কিছু পাওয়া যেতে পারে যাতে আমাদের তদন্তের সুবিধে হবে। ব্যবস্থা আমি করেছি। লোকজন কাল ভোর থেকেই কাজে লাগবে, জলের ধারাটা অন্য মুখে বইয়ে–

অসম্ভব।

—অন্য মুখে বইয়ে দেওয়া হবে। আগেভাগেই তাই সব খুলে লিখলাম আপনাকে। নিন, এবার সই করুন। চারটে নাগাদ কারো হাতে চিঠিটা পাঠাবেন। চারটের সময়ে এই ঘরেই কিন্তু জমায়েত হব সবাই। ততক্ষণ পর্যন্ত যার যা খুশি করতে পারেন। কেননা আমি জানি এ-তদন্ত একেবারেই থমকে গিয়েছে আর নড়বে না।

সন্ধ্যার আঁধার যখন ঘনায়মান, সবাই জড়ো হলাম ঘরে। হোমসের ভাবভঙ্গি অত্যন্ত সিরিয়াস, আমি কৌতূহলী, ডিটেকটিভ দু-জন স্পষ্টত বিরক্ত এবং সমালোচনা মুখর।

গম্ভীরভাবে বললে বন্ধুবর, ভদ্রমহোদয়গণ, যতরকমভাবে পারেন এখন আমাকে পরীক্ষা করতে পারেন। নিজেরাই বিচার করে দেখুন যা দেখে আমি সিদ্ধান্তে এসেছি, তা যুক্তিযুক্ত কিনা। খুব ঠান্ডা পড়েছে দেখছি, অভিযানটাও কতক্ষণ চলবে জানা নেই। তাই বলব গরম কোট গায়ে দিয়ে নিন। অন্ধকার হওয়ার আগেই যার যার জায়গায় গিয়ে দাঁড়ানোটাই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কাজেই আপনাদের অনুমতি নিয়ে এখুনি রওনা হয়ে পড়তে চাই।

ম্যানর হাউসের পার্কের বাইরের দিকের সীমানা বরাবর হেঁটে যেখানে পৌঁছোলাম সেখানে বেড়ার রেলিংয়ে একটা ফাঁক রয়েছে। ফাঁক দিয়ে গলে ভেতরে ঢুকলাম সবাই। চললাম হোমসের পেছন পেছন। সন্ধের অন্ধকার তখন আরও চেপে বসেছে। পৌঁছোলাম সদর দরজা আর ড্রব্রিজের উলটো দিকে একটা ঝোঁপের সামনে। ড্রব্রিজ তখনও ওঠানো হয়নি। লরেন্স পর্দার আড়ালে গুঁড়ি মেরে বসে পড়ল হোমস, আমরা তিনজন অনুকরণ করলাম তার দৃষ্টান্ত।

একটু রূঢ়ভাবে বললে ম্যাকডোনাল্ড, এবার কী করতে হবে?

ধৈর্য ধরতে হবে এবং যদূর সম্ভব কম আওয়াজ করতে হবে, জবাব দিল হোমস।

এসেছি কী জন্যে? আর একটু খুলে বললে ভালো করতেন।

হেসে ফেলল হোমস। বলল, ওয়াটসন বার বার বলেছি বাস্তব জীবনে আমি নাকি নাট্যকার। ভেতর থেকে একটা শিল্পী মাথা চাড়া দেয়–মঞ্চ সাজিয়ে কাজ শেষ করতে বাধ্য করে। আমাদের এ-পেশাও বৈচিত্রহীন, আদর্শহীন, নীচ হয়ে দাঁড়ায় যদি না ফলাফলকে সাজিয়ে গুছিয়ে বর্ণাঢ্য। দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে মর্যাদাসহকারে উপস্থাপিত করি। দোষীকে সোজাসুজি দোষী বলার মধ্যে বৈচিত্র্য কোথায়? ঘাড় ধরে অপরাধীকে থানায় টেনে নিয়ে যাওয়ার মধ্যে গৌরব আছে কি? কিন্তু তার বদলে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সূক্ষ্ম ফাঁদ পাতা, আসন্ন ঘটনার বুদ্ধিদীপ্ত ভবিষ্যদ্বাণী, বলিষ্ঠ অনুমিতির সফল সমর্থন কি আমাদের সারাজীবনের কাজের পক্ষে যুক্তিযুক্ত নয়? এই মুহূর্তে ধরুন না কেন পরিস্থিতির ইন্দ্রজাল আপনাকে রোমাঞ্চিত করেছে শিকার পাওয়ার নেশায় শিকারীর মতন প্রলুদ্ধ হয়েছেন। টাইম টেবল-এর মতো সব কিছুই ঘড়ি ধরে কাটায় কাটায় ঘটলে কি এত রোমাঞ্চ পেতেন? মি. ম্যাক, তাই শুধু একটু ধৈর্য ধরতে বলছি, তারপর সবই স্পষ্ট হয়ে যাবে।

কৌতুকাভিনেতার মতন হাল ছেড়ে দিয়ে বললে লন্ডন ডিটেকটিভ, বেশ, বেশ, তবে ঠান্ডায় জমে যাওয়ার আগেই যেন গৌরব, যৌক্তিকতা আর বাদবাকিগুলো পাওয়া যায়।

এ-আকাঙ্ক্ষা আমাদের প্রত্যেকেরই কেননা অত্যন্ত কষ্টের সঙ্গে ওত পেতে বসে থাকতে হল অনেকক্ষণ। একটু একটু করে বৃদ্ধ–ভবনের দীর্ঘ, বিষণ্ণ—বদনের ওপর নেমে এল অন্ধকারের ছায়া। পরিখা থেকে একটা কনকনে ঠান্ডা স্যাৎসেতে বাষ্প উঠে হাড় পর্যন্ত কাঁপয়ে ছাড়ল এবং ঠোকাঠুকি লাগল দাঁতে। প্রবেশপথের ওপরে জ্বলছে একটিমাত্র ল্যাম্প এবং মৃত্যু-বিষণ্ণ পড়ার ঘরে জ্বলছে একটা নিষ্কম্প বর্তুলাকার আলো। এ ছাড়া সবই তমিস্রাময় এবং নিস্পন্দ।

আচমকা প্রশ্ন করলেন ইনস্পেকটর, এভাবে আর কতক্ষণ চলবে? প্রতীক্ষাটাই-বা কীসের?

ঈষৎ রুক্ষ স্বরে হোমস বললে, কতক্ষণ চলবে আপনার মতো আমারও জানা নেই। রেলগাড়ির মতো ক্রিমিন্যালরা ঘড়ি ধরে চললে আমাদের সুবিধে হত ঠিকই। প্রতীক্ষাটি কীসের যদি জানতে চান–বাঃ, এই তো–এইজন্যেই তো এতক্ষণ বসে থাকা।

কথার মাঝখানেই পড়ার ঘরের উজ্জ্বল হলুদ আলো আবছা হয়ে এল–কে যেন সামনে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা যে লরেল ঝোপে লুকিয়ে সেটা জানালার ঠিক উলটোদিকে এক-শো গজের মধ্যে। একটু পরেই পাল্লা খুলে গেল সশব্দে–কবজার ক্যাঁচক্যাচানি শোনা গেল স্পষ্ট এবং অন্ধকারের দিকে মুখ বাড়িয়ে থাকতে দেখা গেল একজন পুরুষকে—মুণ্ডু আর কাঁধের রেখাটুকুই কেবল চোখে পড়ল দুর থেকে। মিনিট কয়েক গেল এইভাবে। উঁকি মেরে অন্ধকারের বুকে কী আছে যেন কেউ তাকে দেখতে না-পায়–এমনি সতর্ক, চোরাচাহনি। তারপর সে ঝুঁকে পড়ল সামনে, অখণ্ড নিস্তব্ধতার মধ্যে শুনতে পেলাম বিক্ষুব্ধ জলরাশির ছলছলাৎ শব্দ। মনে হল পরিখার জলে কী ধরে আছে। তারপরেই অনেকটা জেলের হাতের টানে জালের মাছ ডাঙায় উঠে আসার মতো এক হ্যাচকায় একটা মস্ত, গোলমতো বস্তু তুলে আনল ওপরে গরাদহীন খোলা জানালা দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময়ে ঢাকা পড়ল আলো।

সময় হয়েছে! সময় হয়েছে! চাপা চিৎকার করে ওঠে হোমস।

তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম প্রত্যেকেই। হাত-পায়ে খিচ ধরেছে বলে আমরা যখন টলছি, হোমস তখন জ্যামুক্ত তিরের মতো সাঁ করে ধেয়ে গেল সামনে সময়-বিশেষে ওর এই অকস্মাৎ স্নায়বিক শক্তির বিস্ফোরণ একটা বিস্ময়কর ব্যাপার, তখন কিন্তু ওর চাইতে সক্রিয় বা শক্তিমান পুরুষ দুনিয়ার আর কেউ থাকে না। বিপুল এই শক্তিই ওকে উল্কার মতো ছিটকে নিয়ে গেল ঝোঁপের মধ্যে থেকে এবং ঝড়ের মতো ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে ভীষণ জোরে বাজিয়ে দিল ঘণ্টা। দুমদাম খটাংখট শব্দে ছিটকিনি আর খিল খোলার আওয়াজ হল ভেতরে এবং দোরগোড়ায় আবির্ভূত হল অ্যামিসের ভ্যাবাচাকা মূর্তি। তাকে ঠেলে পাশে সরিয়ে দিয়ে নক্ষত্রবেগে আমাদের সবাইকে পেছনে নিয়ে হোমস ঢুকে পড়ল সেই ঘরে যে-ঘরে একটু আগেই ছায়ামূর্তিকে ঢুকতে দেখেছি।

বাইরে থেকে টেবিলের ওপর লম্ফ দেখেছিলাম, তা এখনও জ্বলছে এবং আলো বিকিরণ করছে। কিন্তু এখন আর টেবিলে নেই, রয়েছে সিসিল বার্কারের হাতে–হুড়মুড় করে আমরা ঘরে ঢুকতেই বাড়িয়ে ধরেছেন আমাদের দিকে। আলো ঠিকরে যাচ্ছে তার দৃঢ়, কঠোর, পরিষ্কার কামানো মুখ আর আতঙ্ক-ধরানো চোখ থেকে।

ওকী! এসব কী? কী জন্যে এসেছেন আপনারা?

দ্রুত-মসৃণ চোখে চারদিক দেখে নিয়ে লেখবার টেবিলের তলায় ঠেলে দেওয়া একটা বস্তুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল হোমস। জিনিসটা একটা জল-সপসপে বান্ডিল, দড়ি দিয়ে বাঁধা।

এইজন্যে এসেছি, মি. বার্কার। ডাম্বেল দিয়ে ভারী করা এই যে বান্ডিলটা এইমাত্র আপনি পরিখার তলা থেকে টেনে তুললেন–এর জন্যেই এসেছি।

দুই চোখে বিপুল বিস্ময় নিয়ে হোমসের পানে তাকিয়ে রইলেন বার্কার।

আপনি জানলেন কী করে?

আপনি রেখেছিলেন! আপনি?

পালটাপালটি করে রেখেছিলাম, বলাটাই বোধ হয় ঠিক হবে। ইনস্পেকটর ম্যাকডোনাল্ড আপনার মনে থাকতে পারে, একটা ডাম্বেলের অন্তর্ধানের একটু খটকা লেগেছিল আমার। বিষয়টার প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণও করেছিলাম। কিন্তু আপনি নানান ঘটনার চাপে এই ঘটনাটা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পাননি–এর ভেতর থেকে সিদ্ধান্তকে টেনে বার করতে পারেননি। জল যখন হাতের কাছে এবং একটা ভারী বস্তু যখন নিখোঁজ, তখন নিশ্চয় কিছু জলে ভোবানো হয়েছে–এমন ধারণা করতে কল্পনাকে বেশি কষ্ট করতে হয় না। ধারণাটা বাজিয়ে দেখতে ক্ষতি নেই ভেবে গতরাতে অ্যামিসের কৃপায় এ-ঘরে ঢুকে ডা. ওয়াটসনের ছাতার বেঁকা হাতলের দৌলতে বান্ডিলটাকে, জল থেকে ছিপ দিয়ে টেনে তোলার মতো তুলেছিলাম এবং পর্যবেক্ষণ করে ছিলাম। বস্তুটা ওখানে রাখল কে, সেইটা জানাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার! খুব সহজেই সে-কাজ সারলাম। চিঠি লিখে জানালাম আগামীকাল পরিখার জল বার করে দেওয়া হবে। চিঠি পড়েই টনক পড়বে বান্ডিল যে লুকিয়েছে, তার। রাতের অন্ধকারেই বান্ডিল সরানোর জন্যে সে আসবে। চারজন সাক্ষী দেখেছেন কে সরিয়েছে বান্ডিলটা। মি. বাকার, এবার কিন্তু আপনি দয়ে পড়েছেন।

টেবিলের ওপর লক্ষের পাশে ভিজে বান্ডিলটা উঠিয়ে রাখল হোমস এবং খুলে ফেলল বাঁধনের দড়ি। ভেতর থেকে একটা ডাম্বেল বার করে ছুঁড়ে দিল ঘরের কোণে দাঁড় করানো জুড়িদার ডাম্বেলের দিকে। তারপর বার করল একজোড়া বুটজুততা। পায়ের আঙুল যেদিকে থাকে, সেইদিক দেখিয়ে বললে, দেখতেই পাচ্ছেন, আমেরিকান জুতো। তারপর বার করল খাপে ভরা একটা লম্বা, মারাত্মক ছুরি। তারপর বার করল এক বান্ডিল জামাকাপড়–তার মধ্যে রয়েছে পুরো একপ্রস্থ অন্তর্বাস, মোজা ধূসর রঙের একটা টুইড স্যুট এবং একটা খাটো হলদে ওভারকোট।

হোমস বললে, জামাকাপড়গুলো মামুলি ওভারকোটটা ছাড়া অনেক কিছুর ইঙ্গিত বহন করছে এই কোট।

আলগোছে আলোর সামনে মেলে ধরে ওভারকোটের সর্বত্র দীর্ঘ, শীর্ণ আঙুল বুলোতে বুলোতে বললে, এই দেখুন ভেতরের পকেট–লাইনিং পর্যন্ত লম্বা করাত দিয়ে কাটা মারাত্মক হাতিয়ার রাখার মতো যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। দর্জির লেবেল রয়েছে ঘাড়ের কাছে নিলি, ওস্তাগর, ভারমিসা, যুক্তরাষ্ট্র। অধ্যক্ষর গ্রন্থাগারে পুরো একটা বিকেল কাটিয়ে অনেক জ্ঞান লাভ করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের যে-অঞ্চলে কয়লা আর লৌহ উপত্যকার জন্যে সবচেয়ে বিখ্যাত, তার মাথার দিকে একটা ছোটো সমৃদ্ধ শহরের নাম ভারমিসা।

মি. বার্কার, মি. ডগলাসের প্রথমা স্ত্রীর সঙ্গে কয়লা অঞ্চলের সম্পর্ক আছে, এ-রকম একটা কথা আপনি বলেছিলেন মনে আছে আমার। মৃতদেহের পাশে রাখা কার্ডের V.V. লেখার মানে যে ভারমিসা ভ্যালি–এ-সিদ্ধান্ত নেওয়া নিশ্চয় এখন খুব অন্যায় হবে না। এ হল সেই ভ্যালি যেখান থেকে খুনের সংকল্প নিয়ে আসে গুপ্তঘাতকরা–অথবা ভ্যালি অফ ফিয়ার নামটা আগেই শুনেছি। এই পর্যন্ত বেশ স্পষ্ট। মি. বার্কার, এবার আপনার কী বলার আছে বলুন।

গ্রেট ডিটেকটিভ এইভাবে যখন ফাঁস করছে রহস্য, মি. বার্কারের ভাবব্যঞ্জক মুখখানা তখন সত্যিই দেখবার মতো। ক্রোধ, বিস্ময়, হতবুদ্ধি এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা একে একে ধেয়ে গেল মুখের ওপর দিয়ে। শেষ পর্যন্ত শরণ নিলেন উকট শ্লেষের।

বললেন নাক সিঁটিয়ে, এতই যখন জেনেছেন, তখন বাকিটুকুও না হয় আপনিই বলুন, মি. হোমস।

মি. বার্কার, তার চাইতেও ঢের বেশি বলতে আমি পারি। কিন্তু আমি চাইছি আপনি বলুন–তাতে আপনার মান বাড়বে।

তাই নাকি? তাই নাকি? তাহলে শুধু একটা কথাই বলব–সত্যিই যদি গুপ্তকথা কিছু থাকে এর মধ্যে তাহলে তা আমার নয়–কাজেই আমি তো ফাঁস করব না।

শান্তভাবে ইনস্পেকটর বললে, আপনি যদি এইভাবে বেঁকে বসেন, তাহলে জানবেন ওয়ারেন্ট না-বেরোনো পর্যন্ত আপনাকে নজরবন্দি রাখব, তারপর হাজতে পুরব।

বেপরোয়াভাবে বার্কার বললেন, যা খুশি করতে পারেন।

ভদ্রলোকের গ্রানাইট-কঠিন মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল বিশ্বের কোনো শক্তি তাকে টলাতে পারবে না–ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুখ দিয়ে একটি কথাও বার করতে পারবে না এবং বার্কার সম্পর্কিত আলোচনার ইতিও এইখানে আর এক কদমও এগোবে না। অচলাবস্থার অবসান ঘটল একটি মহিলা কন্ঠে। আধখোলা দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন মিসেস ডগলাস এখন ঢুকলেন ভেতরে।

বললেন, সিসিল, অনেক করেছ আমাদের জন্যে। ভবিষ্যতে যাই ঘটুক না কেন, আমরা জানব তোমার ঋণ শোধ করার নয়।

শুধু অনেক নয়, তার চেয়েও বেশি, গম্ভীর মুখে মন্তব্য করে শার্লক হোমস। ম্যাডাম, আপনার ওপর আমার পূর্ণ সমবেদনা আছে জানবেন। আমার কথা শুনুন। পুলিশকে বিশ্বাস করুন। সব খুলে বলুন। আইনে আস্থা রাখুন। দোষ হয়তো আমারও আছে। বন্ধুবর ডা. ওয়াটসনের মাধ্যমে আপনি যে-ইঙ্গিত পাঠিয়েছিলেন, আমি তা কানে তুলিনি। কিন্তু তখন আমার বিশ্বাস ছিল আপনারা খুনের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এখন জানি তা নয়। শুধু তাই নয়, অনেক কিছুরই এখনও ফয়সালা হয়নি–ব্যাখ্যা শোনা হয়নি তাই বলব আপনি বরং মি. ডগলাসকেই বলুন যেন নিজের মুখে তার কাহিনি বলেন।

হোমসের কথায় সবিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন মিসেস ডগলাস। আমি আর ডিটেকটিভ দু-জনও নিশ্চয় একইভাবে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, কেননা আচমকা যেন দেওয়াল কুঁড়ে বেরিয়ে এল একটা লোক এবং যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরের কোণ থেকে পা ফেলে এগিয়ে এল আমাদের দিকে, ঘুরে দাঁড়ালেন মিসেস ডগলাস–চক্ষের পলকে দু-হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন মূর্তিটিকে। দু-হাত বাড়িয়ে ধরেছিল লোকটা বার্কার আঁকড়ে ধরলেন সেই হাত।

স্ত্রী বললেন স্বামীকে, জ্যাক, সেই বরং ভালো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এর চাইতে ভালো আর কিছু হতে পারে না।

অন্ধকার থেকে আলোয় এলে যেভাবে চোখ ধাঁধিয়ে যায় সেইভাবে চোখ পিটপিট করছিল লোকটা। মুখখানা অসাধারণ বলিষ্ঠ ধূসর চোখ, ছোটো করে ছাঁটা কঁচাপাকা শক্ত গোঁফ, ঠেলে-বার-করা চৌকোনা চোয়াল এবং কৌতুকময় মুখাবয়ব। আমাদের সবাইকে ভালো করে দেখে নিয়ে অবাক করলেন আমাকে সটান আমার দিকে এগিয়ে এসে এক বান্ডিল কাগজ তুলে দিলেন হাতে।

বললেন, আপনার কথা আমি শুনেছি, কণ্ঠস্বর পুরোপুরি ইংরেজের মতো নয়, আমেরিকানের মতোও নয়, কিন্তু বেশ মোলায়েম আর প্রীতিপ্রদ।

এই যে কাগজের তাড়া দিলাম আপনাকে, এর ইতিহাস আপনিই লিখুন। ডক্টর ওয়াটসন, জীবনে আপনার হাতে এমন কাহিনি আর আসেনি–সর্বস্ব বাজি ফেলে বলতে পারি। নিজের মতো করে বলুন, ঘটনা তো হাতেই রইল জনগণ লুফে নেবে। ইঁদুরের গর্তের মতো ওই গর্তে দিনের আলো যেটুকু ঢোকে, সেই আলোয় দু-দিন বসে বসে লিখেছি এই কাহিনি। ভ্যালি

অফ ফিয়ারের এ-কাহিনি এখন আপনার নিজে পড়ুন, পড়ান আপনার পাঠককে।

শার্লক হোমস, শান্তভাবে বলেন, মি. ডগলাস, ওটা তো আপনার অতীতের কাহিনি। আমরা চাই আপনার বর্তমানের কাহিনি।

শুনবেন বই কী, তাও শুনবেন, বললেন ডগলাস। কথার সঙ্গে ধুমপান চালাতে পারি? ধন্যবাদ, মি. হোমস, যদূর মনে পড়ছে আপনি নিজেও ধূমপায়ী। আপনিই কেবল বুঝবেন পাছে গন্ধ খুঁকে ধরে ফেলে ওই ভয়ে পকেটে ধূমপানের সরঞ্জাম নিয়ে দুটো দিন ঠায় বসে থাকা কী কষ্টকর। হোমসের হাত থেকে চুরুট নিয়ে ম্যান্টলপিসে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চুরুট চুষতে চুষতে বললেন ডগলাস। আপনার কথা আমি শুনেছি মি. হোমস, দেখা যে হবে কখনো ভাবিনি। আমার হাতের কাগজের তাড়ার দিকে তাকিয়ে, ওগুলো পড়ার আগেই আরও টাটকা খবর দিচ্ছি আপনাকে।

সুবিপুল বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে নবাগতের পানে তাকিয়েছিল ইনস্পেকটর ম্যাকডোনাল্ড।

শেষকালে আর থাকতে না-পেরে বললেন চিৎকার করে, আমার মাথায় কিছুই তো ঢুকছে! আপনিই যদি বির্লস্টোন ম্যানরের মি. জন ডগলাস হন তো এই দু-দিন কার মৃত্যুরহস্যের তদন্ত আমরা করছিলাম? আপনিই-বা কোত্থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলেন? মনে তো হল পাতাল কুঁড়ে উঠে এলেন।

মি. ম্যাক, ভৎসনাসূচক তর্জনী হেলনে বললে শার্লক হোমস।রাজা চার্লসের লুকিয়ে থাকার কাহিনি যে-বইতে ছিল, আপনি তা পড়তে চাননি। লুকোনোর ভালো জায়গা না-থাকলে সেকালে কেউ লুকোতে যেত না। আর, যে-জায়গা একবার লুকোনোর কাজে লেগেছে, আবার তা সেই কাজেই লাগতে পারে। আমিও নিজেকে সেইভাবে লুকিয়ে ভেবে দেখেছি এই বাড়িতেই নিশ্চয় আছেন মি. ডগলাস।

ভীষণ রেগে বললে ইনস্পেকটর, চালাকিটা কদিন ধরে চালাচ্ছিলেন আমাদের ওপর জানতে পারি কি মি. হোমস? যে-তদন্ত উদ্ভট বলে আপনি নিজে জানতেন, সেই তদন্তে আমাদের শক্তির অপচয় ঘটতে দিচ্ছিলেন কদ্দিন ধরে?

এক মুহূর্তের জন্যেও নয়, ভায়া মি. ম্যাক। কেসটা সম্পর্কে আমার মতামত তৈরি করলাম মাত্র কাল রাতে। যেহেতু আজ রাতের আগে তা প্রমাণ করা যাবে না, তাই আপনার সহকর্মীকে বলেছিলাম একদিন উপভোগ করতে। বলুন দিকি ভায়া এর বেশি আর কী করতে পারি আমি? পরিখার জলে জামাকাপড়ের বোঝা দেখেই বুঝেছি, যে-মৃতদেহ আমরা দেখছি, তা মোটেই মি. জন ডগলাসের নয়–টানব্রিজ ওয়েলস থেকে সাইকেল চেপে যে-লোকটা এসেছিল, নিশ্চয় তার মৃতদেহ। এ ছাড়া আর কোনো সিদ্ধান্তই সম্ভব নয়। তখন ঠিক করতে হল কোথায় থাকতে পারেন মি. জন ডগলাস স্বয়ং। সব সম্ভাবনা দাঁড়িপাল্লায় ওজন করলে দেখা যাচ্ছে লুকোনো জায়গা যে-বাড়িতে থাকা সম্ভব, নিশ্চয় সেই বাড়িতেই তিনি আছেনস্ত্রী এবং বন্ধুও যোগসাজশ করে তাঁকে লুকিয়ে রেখেছেন–হইচই থেমে গেলেই একেবারেই পালাবেন বলে।

সায় দিলেন মি. ডগলাস। বললেন, ধরেছেন ঠিক! ব্রিটিশ আইন আমাকে কী চোখে দেখবে, সে-বিষয়ে ধাঁধায় ছিলাম বলেই ঠিক করেছিলাম ফাঁকি দেব ব্রিটিশ কানুনকে। সেই সঙ্গে এ-জীবনে যাতে কুত্তাগুলো আর পেছন না-নেয়, সে-ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। খেয়াল রাখবেন, গোড়া থেকে আমি যা করেছি তার জন্যে তিলমাত্র লজ্জিত আমি নই–একই কাণ্ড ফের যদি করতে হয়, তখনও লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে বলে মনে করব না। আমার কাহিনি আগে শুনুন, বিচার পরে করবেন। সাবধান করার দরকার নেই১১, ইনস্পেকটর। সত্যি বলতে আমি ডরাই না।

শুরু থেকে শুরু করব না। সে সবই ওর মধ্যে আছে–আমার হাতের কাগজের বান্ডিল দেখিয়ে দারুণ অদ্ভুত গল্পের উপাদান পাবেন ওর মধ্যে। সংক্ষেপে ব্যাপারটা এই, কিছু লোক আমাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে, ঘৃণা করার যথেষ্ট কারণও আছে এবং তারা পণ করেছে কপর্দকশূন্যও যদি হতে হয়, তাহলেও আমাকে নিকেশ করবেই করবে। যদ্দিন আমি বেঁচে থাকব আর তারাও বেঁচে থাকবে, এই দুনিয়ায় নিরাপত্তা বলে আমার কিছু নেই। শিকাগো থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় ওরা আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে, শেষকালে তাড়া খেয়ে পালিয়েছি আমেরিকা থেকেই, কিন্তু বিয়ে করার পর এই নিরিবিলি শান্তির জায়গায় সংসার পাতবার পর ভেবেছিলাম বাকি জীবনটা নিঝঞাটে কাটবে। বউকে কোনোদিনও বলিনি কাদের তাড়া খেয়ে পালিয়েছি আমেরিকা থেকে। এর মধ্যে ওকে টেনে লাভ কী বলুন? শান্তিতে আর একটা মুহূর্তও কাটাতে পারবে না, প্রতি মুহূর্তে মনে করবে ওই বুঝি এল চরম বিপদ। তবে আমার মনে হয়, আমার দু-চারটে মুখ ফসকে বেরিয়ে-পড়া কথা থেকে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল; গতকাল আপনারা ওর সঙ্গে দেখা করে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আসল ব্যাপার কিছু জানিনি। আপনাদের বলেছে ও সব জানত, বার্কারও বলেছে তাই, যেদিন এ-কাণ্ড ঘটে সেদিন এত কম সময় পেয়েছিলাম যে কিছুই খুলে বলতে পারিনি। এখন ও সবই জেনেছে এবং অনেক ভালো করতাম যদি আগেই সব খুলে বলতাম। কিন্তু বড়ো কঠিন সমস্যায় পড়েছিলাম–মুহূর্তের জন্যে স্ত্রীর হাত নিজের হাতে তুলে নিলেন ডগলাস–তাই যা কিছু করেছি তোমার ভালোর জন্যই করেছি।

জেন্টেলমেন, এই ঘটনার আগের দিন আমি টানব্রিজ ওয়েলস গিয়ে রাস্তায় একটা লোককে এক পলকের জন্যে দেখেছিলাম। যাকে বলে ঝুঁকিদর্শন–এক লহমার জন্যে দেখা–কিন্তু আমার চোখ বড়ো শানানো কিছুই নজর এড়ায় না তাই দেখেই বুঝেছিলাম সে কে। ওদের মধ্যে আমার ওপর সবচেয়ে বেশি যে খাপ্পা, উত্তর আমেরিকার বন্ধু হরিণের পেছনে ধাবমান উপপাসি নেকড়ের মতো যে আমাকে এত বছর হন্যে হয়ে খুঁজছে–এ হল সেই লোক। আমার পরম শত্রু। বিপদ আসন্ন বুঝতে পেরে বাড়ি ফিরে এসে তৈরি হলাম। ঠিক করলাম শেষ পর্যন্ত একাই লড়ব। আমার সৌভাগ্য নিয়ে একদিন সারাযুক্তরাষ্ট্রে লোক কথা বলত, সেই সৌভাগ্য যে আবার আমার সহায় হবে এ-বিষয়ে এতটুকু সন্দেহ ছিল না আমার মনে।

পরের দিন সারাদিন হুঁশিয়ার রইলাম, পার্কে একদম বেরোলাম না। ভালোই করেছিলাম। কেননা, পার্কের মধ্যে আমি ওকে পেড়ে ফেলার আগেই ও আমাকে বাকশট গান দিয়ে শেষ করে দিত। সন্ধের সময়ে ড্রব্রিজ ভোলা হয়ে গেলেই কিন্তু বরাবরই মন আমার অনেক স্থির হয়ে আসে। সেদিনও ব্রিজ ওঠানোর পর ও-ব্যাপার মন থেকে সরিয়ে দিলাম। ও যে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে এবং আমার জন্যে ওত পেতে থাকবে বিপদের এই দিকটা একবারও খতিয়ে ভাবিনি। কিন্তু রোজকার অভ্যেসমতো ড্রেসিং গাউন পরে বাড়ি টহল দিতে বেরিয়ে পড়ার ঘরে ঢোকবার সঙ্গেসঙ্গে বিপদের গন্ধ পেলাম। এ-রকম ঘটনা অনেকবার আমার জীবনে ঘটেছে। আমার মনে হয়, বিপদ এলে মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় লাল নিশান উড়িয়ে ঠিক জানিয়ে দেয়–হুঁশিয়ার! সংকেতটা আমি স্পষ্ট টের পেলাম, কিন্তু কেন যে আমার প্রতিটি দেহকোষ বিপদের গন্ধে সজাগ হয়ে উঠল, তা বুঝলাম না। পরের মুহূর্তেই জানলার পর্দার নীচে দেখলাম একটা বুট–স্পষ্ট বুঝলাম কী ব্যাপার।

আমার হাতে তখন একটামাত্র মোমবাতি, কিন্তু হল ঘরের খোলা দরজা দিয়ে ল্যাম্পের বেশ খানিকটা আলো ঘরে আসছিল। মোমবাতি রেখেই লাফ দিয়ে ম্যান্টলপিসের ওপর থেকে হাতুড়ি তুলতে গেলাম। একই সঙ্গে সে-ও লাফ দিল আমার দিকে। ছুরির ঝিলিক দেখেই হাতুড়ি মারলাম। নিশ্চয় গায়ে লেগেছিল, কেননা ছুরিখানা ঝনঝনিয়ে ছিটকে গেল মেঝের ওপর। বান মাছের মতো স্যাৎ করে টেবিলের ওদিকে গিয়ে গা বাঁচাল সে এবং তারপরেই কোটের পকেট টেনে বার করল বন্দুক। ট্রিগার ঠেলে তোলার আওয়াজ পেলাম, কিন্তু গুলি করবার আগেই বন্দুক চেপে ধরলাম আমি। ধরেছিলাম নলটা, ধস্তাধস্তি চলল মিনিট খানেকের মতো। যার হাত ফসকাবে, মৃত্যু তার অনিবার্য। ওর হাত মুহূর্তের জন্যেও ফসকায়নি, কিন্তু হাতলটা বোধকরি একটু বেশিক্ষণের জন্যে নীচের দিকে রেখেছিল। ট্রিগার বোধ হয় আমিই টিপেছিলাম। অথবা টানাটানিতে দু-জনেই টিপে ফেলেছিলাম। যেই টিপুক না কেন, দুটো নল থেকেই জোড়াগুলি উড়িয়ে দিল ওর মুণ্ডু –ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম টেড বলড়ুইনের দেহাবশেষের দিকে। শহরে দেখেই ওকে চিনেছিলাম, পর্দার আড়াল থেকে তেড়ে বেরিয়ে আসার সময়েও চিনেছিলাম, কিন্তু ওই অবস্থায় ওর মা-ও ওকে চিনতে পারত কিনা সন্দেহ। জীবনে অনেক ভয়ানক কাজ নিয়ে আমি দিন কাটিয়েছি, বীভৎস দৃশ্য আমার গা সওয়া হয়ে গিয়েছে কিন্তু টেড বলড়ুইনের ছাতু-হয়ে-যাওয়া মাথা দেখে সেদিন পেটের নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল।

টেবিলের কিনারায় ভর দিয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময়ে ছুটতে ছুটতে নেমে এল বার্কার। স্ত্রীকেও নামতে শুনলাম, দৌড়ে বেরিয়ে গিয়ে ঘরে ঢুকতে বারণ করলাম। এ-দৃশ্য মেয়েরা সইতে পারে না। কথা দিলাম এখুনি আসছি। বার্কারকে দু-একটা কথা বলতেই ও বুঝে নিলে, দু-জনে মিলে দাঁড়িয়ে রইলাম আর কে আসে দেখবার জন্যে। কিন্তু কারো চিহ্ন দেখলাম না, তখন বুঝলাম ওরা কিছুই শুনতে পায়নি। এ-ঘটনা জানি কেবল আমরা।১৩

ঠিক সেই সময়ে আইডিয়াটা এল মাথায়। মগজ যেন ঝলসে উঠল আইডয়াটার অত্যন্ত উজ্জ্বলতায়। লোকটার হাতা সরে যাওয়ায় বাহুর ওপর লজ-এর দাগানো চিহ্নটা বেরিয়ে পড়েছিল। এই দেখুন।

ডগলাস বলে যাকে চিনেছি, সেই ভদ্রলোক এবার কোট খুলে জামার হাতা গুটোতেই দেখলাম বাহুর ওপর সেই চিহ্ন–বৃত্তের মধ্যে একটা ত্রিভুজ–যা দেখেছি মৃতব্যক্তির বাহুতে।

এই দাগটা দেখেই মতলবটা এল মাথায়। চক্ষের নিমেষে গোটা প্ল্যানটা ছকা হয়ে গেল মাথার মধ্যে। ওর উচ্চতা, চুল, আকার হুবহু আমার মতন। মুখ দেখে চেনবার জো-টি আর নেই। বেচারা! আমি আমার এই জামাকাপড় নিয়ে এলাম ওপর থেকে। মিনিট পনেরো লাগল আমার ড্রেসিংগাউন পরতে–দু-জনে মিলে শুইয়ে রাখলাম যেভাবে আপনারা দেখছেন সেইভাবে। ওর যাবতীয় জিনিসপত্র বান্ডিল বাঁধল মা। হাতের কাছে যে-ওজনটা পেলাম তাই দিয়ে ভারী করলাম, জানলা গলিয়ে ছুঁড়ে জলে ফেলে দিলাম। যে-কার্ডটা আমার মৃতদেহের পাশে রাখবে বলে এনেছিল, সেটা রাখলাম ওরই মৃতদেহের পাশে। আমার আংটি পরালাম ওর আঙুলে, কিন্তু বিয়ের আংটিটা টানতে গিয়ে–পেশিময় হাত বাড়িয়ে ধরলেন ডগলাস, এই দেখুন কোথায় গিয়ে আটকে রয়েছে। বিয়ের পর থেকে একটা দিনের জন্যেও এ-আংটি আমি আঙুল থেকে খুলিনি–এখন খুলতে হলে উকো দিয়ে কাটতে হবে। তা ছাড়া এ-আংটি কাছছাড়া করতে পারব কিনা সেটাও একটা ব্যাপার বটে; তবে এক্ষেত্রে আমি চাইলেও আঙুল থেকে আংটি বার করা সম্ভব নয়। কাজেই আংটির ব্যাপার ওই অবস্থায় ফেলে রাখা ছাড়া আর উপায় ছিল না–তাতে যে যা মনে করে করুক। উলটে আর একটা কাজ আমি করলাম। একটুখানি স্টিকিং প্লাস্টার এনে ওর গালে লাগিয়ে দিলাম ঠিক যেভাবে আমার গালে লাগানো দেখছেন, ওইভাবে। মি. হোমস এই একটা ব্যাপার আপনার নজর এড়িয়েছে। যত ধূর্তই আপনি হোন না কেন, ঠকিয়েছি আপনাকে। প্লাস্টারটা টেনে তুললেই দেখতেন তলায় কাটা-ফাটা কিচ্ছু নেই।

এই হল গিয়ে পরিস্থিতি। কিছুদিন ঘাপটি মেরে থাকবার পর যদি বাড়ি ছেড়ে পালাই এমন এক জায়গায় যেখানে স্ত্রী-ও যাবে পরে, বাকি জীবনটা অন্তত কাটাতে পারব নির্ভাবনায় নির্ভেজাল শান্তিতে। মাটির ওপর যদ্দিন বিচরণ করব, শয়তানগুলো তদ্দিন শান্তিতে থাকতে দেবে না, কিন্তু খবরের কাগজে যখন দেখবে বলড়ুইন খতম করেছে শিকারকে, শান্তি পাব আমি। বার্কার স্ত্রীকে এতকথা বুঝিয়ে বলবার সময় না-পেলেও ওরা বুঝেছিল, সাহায্য করতে রাজিও হয়েছিল। লুকোনোর এই জায়গায় খবর আমি যেমন রাখি, অ্যামিসও তেমনি রাখে–কিন্তু খুনের সঙ্গে জায়গাটার যে একটা সম্পর্ক থাকতে পারে, তা তার মাথায় আসেনি। এই খুপরিতেই ঢুকে বসলাম আমি। বাকি যা করবার করল বার্কার।

কী করেছে তা নিশ্চয় আপনারা অনুমান করে নিয়েছেন। জানলা খুলে গোবরাটে রক্তের দাগ লাগলে যাতে মনে হয় খুনি এদিক দিয়েই পালিয়েছে। পালানোটা একটু মুশকিল ঠিকই, কিন্তু ব্রিজ ওদিকেই রয়েছে আর কোনো পথ নেই। সাজানোর ব্যাপারটা শেষ হলে পর ঘণ্টা বাজল এবং যা করার সবই করে গেল। পরে কী হয়েছে আপনারা জানেন। এখন আপনারা যা ভালো মনে করেন করতে পারেন। কিন্তু জানবেন আমি যা বললাম তা বর্ণে বর্ণে সত্য–ঈশ্বর তাই আমার সহায়। এখন শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। ইংরেজ আইন আমাকে কী চোখে দেখবে?

কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ করলে শার্লক হোমস।

ইংরেজ আইন শুধু একটা আইন। এ থেকে আপনি খুব একটা ভালো কিছু আশা করতে পারেন না। কিন্তু আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই, লোকটা জানল কী করে যে আপনি এখানে আছেন, কী করে বাড়ি ঢুকতে হবে, ঠিক কোথায় লুকোলে আপনাকে চক্ষের পলকে খতম করা যাবে?

কিছুই জানি না।

ভীষণ সাদা আর গম্ভীর হয়ে গেল হোমসের মুখ।

বললে, গল্প এখনও ফুরোয়নি। ইংরেজ আইনের চেয়েও জঘন্য বিপদ শিগগিরই আপনার জীবনে আসতে পারে–আমেরিকার শত্রুদের চেয়েও এ-বিপদ আরও করাল। মি. ডগলাস, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সাংঘাতিক বিপদ ওত পেতে রয়েছে আপনার জন্যে। আমার কথা যদি শোনেন, গা-আলগা দেবেন না, হুঁশিয়ার থাকুন।

হে পাঠক-পাঠিকা, অনেক ধৈর্য ধরেছেন সুদীর্ঘ এই উপাখ্যান পড়তে। এবার আপনাদের আহ্বান জানাব অন্যত্র। কিছুক্ষণের জন্যে চলে আসুন আমার সঙ্গে। জায়গাটা বির্লস্টোনের সাসেক্স ম্যানর হাউস থেকে অনেক দূরে, সময়টাও মর্যাদাময়। সে-বছর থেকে অনেক দূরে

যে-বছরে আমাদের বিচিত্র অভিযান জন ডগলাস নামক এক ব্যাক্তির আশ্চর্য কাহিনিতে শেষ হয়েছিল। আমার অনুরোধ মতো সময়-পথে যদি কুড়িটা বছর পেছিয়ে যান এবং শূন্যপথে কয়েক হাজার মাইল চলে আসেন, তাহলে আপনার সামনে মেলে ধরব একটা অত্যন্ত অসাধারণ আর ভয়ংকর উপাখ্যান–এতই অসাধারণ আর ভয়ংকর যে বিশ্বাস করতেও মন চাইবে না আপনাদের মনে হবে সব মিথ্যে। কোনোকালেই এমন ঘটনা ঘটেনি। একটা কাহিনি শেষ করার আগেই আর একটা কাহিনি ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছি ভাববেন না যেন। পড়তে পড়তেই বুঝবেন মোটেই তা নয়। দূরস্থিত ঘটনাবলির ঘটনা শুনে অতীতের রহস্য উন্মোচন করার পর আবার ফিরে আসুন বেকার স্ট্রিটের ঘরে, যে-ঘরে আরও অনেক চমকপ্রদ ঘটনার মতো এ-কাহিনিরও পরিসমাপ্তি ঘটবে শেষ পর্যন্ত।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত