০৬. প্রকাশমান সত্য
ছোটোখাটো অনেক বিষয় তদন্ত করার ছিল তিন গোয়েন্দার। আমি তাই–গ্রাম্য সরাইখানার দীনহীন আস্তানায় একাই ফিরে এলাম। আসার আগে প্রাচীন ভবনসংলগ্ন অদ্ভুতদর্শন পুরোনো আমলের বাগানে একটু পায়চারি করে নিলাম। বাগান ঘিরে সারি সারি অতি প্রাচীন ইউ গাছ–অদ্ভুত সব ডিজাইন কাটা ডালপালা। মাঝখানে সবুজ ঘাস ছাওয়া সুন্দর একফালি। মাঠ… ঠিক মাঝখানে একটা মান্ধাতার আমলের সূর্যঘড়ি। সব মিলিয়ে এমন একটা শান্তির জায়গা যে আমার ক্ষতবিক্ষত স্নায়ু যেন জুড়িয়ে গেল। নিবিড় প্রশান্তিঘেরা এ-জায়গায় এলে অন্ধকার পড়ার ঘরে মেঝের ওপর চিৎপাত রক্তমাখা ওই মূর্তির কথা আর মনে থাকে না–ফ্যানটাসটিক দুঃস্বপ্নর মতোই মনে হয়। তা সত্ত্বেও স্নিগ্ধ পরিবেশে পায়চারি করে আত্মাকে প্রশান্তির মধ্যে নিমগ্ন রাখতে গিয়ে এমন একটা অদ্ভুত ঘটনার মধ্যে গিয়ে পড়লাম যে বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হল ট্র্যাজেডিটার মধ্যে করাল ছায়াপাত ঘটল মনের মধ্যে।
একটু আগেই বলেছি, সুসজ্জিত ইউ-গাছের মালা ঘেরা ছিল বাগানটা। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে ইউ-গাছের সারি যেখানে শেষ হতে চলেছে, গাছগুলো গায়ে গা দিয়ে একটানা ঝোপ হয়ে গিয়েছে। বাড়ির দিক থেকে এই ঝোঁপের দিকে এগোলে দেখা যায় না ঝোঁপের আড়ালে রয়েছে একটা পাথরের বসবার জায়গা। আমি সেইদিকেই যাচ্ছি, এমন সময়ে কানে ভেসে এল কথাবার্তার আওয়াজ। গভীর পুরুষ কণ্ঠের জবাবে ঝরনার মতো মেয়েলি হাসির টুকরো। পরমুহূর্তেই ঝোঁপের কিনারায় এসে দাঁড়ালাম, চোখ গিয়ে পড়ল মিসেস ডগলাস আর বার্কার লোকটার ওপর ওরা কিন্তু তখনও দেখেনি আমাকে। ভদ্রমহিলার চেহারা দেখে আহত হলাম। ডাইনিং রুমে ছিলেন শান্ত, গম্ভীর, সতর্ক। এখন কিন্তু শোকের ভান পুরোপুরি অপসৃত হয়েছে মুখাবয়ব থেকে। প্রাণের আনন্দ জ্বলজ্বল করছে দুই চোখে পুরুষ সঙ্গীর মন্তব্যে কৌতুক উজ্জ্বলিত হয়ে রয়েছে মুখের রেখায় রেখায়–হাসির কাঁপন তখনও মিলোয়নি মুখ থেকে। সামনে ঝুঁকে বসে রয়েছেন বার্কার, দুই করতল একত্রবদ্ধ, হাত হাঁটুর ওপর, প্রত্যুত্তরের হাসি ভাসছে প্রশস্ত, সুশ্রী মুখে। আমাকে দেখার সঙ্গেসঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে কিন্তু সেই একটা মুহূর্তেও দেরি করা ঠিক হয়নি ওঁদের গম্ভীর হয়ে গেল মুখ, ফিরে এল মুখোশ! দ্রুতকণ্ঠে কী যেন বলাবলি করে নিলেন দু-জনে, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বার্কার এগিয়ে এলেন আমার দিকে।
বললেন, মাপ করবেন, আমি কি ডা. ওয়াটসনের সঙ্গে কথা বলছি?
এমন নিরুত্তাপভাবে মাথা হেলিয়ে সায় দিলাম যে স্পষ্ট হয়ে গেল আমার মনের ভাব।
ধরেছি ঠিক। আপনার সঙ্গে মি, শার্লক হোমসের বন্ধুত্বের খবর কে না-জানে বলুন। দয়া করে একবার আসবেন এদিকে, একটু কথা বলবেন মিসেস ডগলাসের সঙ্গে?
কঠোর মুখে গেলাম পেছন পেছন। মনের চোখে তখন স্পষ্ট ভাসছে মেঝের ওপর পড়ে থাকা থেতলানোে বিকৃত সেই মূর্তি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারই বাগানে ঝোঁপের আড়ালে বসে হাসিঠাট্টা করছেন তাঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধ এবং স্ত্রী। ডাইনিংরুমে ভদ্রমহিলার শোকে আমিও শোক পেয়েছিলাম। এখানে কিন্তু সহানুভূতিহীন চোখে তাকালাম তার মিনতি করুণ চোখের পানে।
বললেন, নিশ্চয় খুব হৃদয়হীন ভাবছেন আমাকে?
দু-কাঁধ কঁকালাম আমি।
বললাম, ব্যাপারটা তো আমার নয়।
যদি বুঝতেন তাহলে সুবিচার করতেন।
দুম করে বার্কার বললেন, কেন বুঝতে যাবেন ডক্টর ওয়াটসন? উনি তো বলেই দিলেন এ-ব্যাপার তাঁর নয়।
ঠিক বলেছেন। তাই আর আপনাদের বিরক্ত করব না–বেড়াতে এসেছি, বেড়াতে যাচ্ছি।
ডক্টর ওয়াটসন, এক মিনিট। মিনতিপূর্ণ কণ্ঠে বললেন ভদ্রমহিলা। একটা ব্যাপারে কিন্তু আপনার কথা বলার অধিকার দুনিয়ার যেকোনো লোকের চেয়ে বেশি। ব্যাপারটা আমার কাছে অনেকখানি। মি. শার্লক হোমসকে আপনি যেভাবে জানেন পুলিশের সঙ্গে তার সম্পর্কের খবর যতটা রাখেন, ততটা খবর কেউ রাখে না। ধরুন, কোনো একটা ব্যাপার যদি তাঁকে গোপনে জানানো হয়, তিনি কি তা গোয়েন্দাদের কানে তুলবেন?
সাগ্রহকণ্ঠে বললেন বার্কার, উনি কি স্বাধীন, না সরকারি ডিটেকটিভদের তাবেদার?
এ-প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করা উচিত হবে বলে মনে করি না।
ডক্টর ওয়াটসন আমার অনুরোধ রাখুন–বিশ্বাস করুন এ-ব্যাপারে আমরা যদি আপনার সাহায্য পাই–বিশেষ করে আমি খুবই উপকৃত হব।
এমন আন্তরিকভাবে কথাটা বললেন ভদ্রমহিলা যে সেই মুহূর্তের জন্যে বিস্মৃত হলাম তার চাপল্যে বিচলিত হয়ে ঠিক করলাম ইচ্ছাটা পূরণ করে যাই।
বললাম, মি. হোমস স্বাধীনভাবে তদন্ত করছেন। ওঁর প্রভু উনি নিজে, নিজের বিবেকবুদ্ধি অনুসারে চলেন। তবে এটাও ঠিক যে একসঙ্গে যে-অফিসারদের সঙ্গে কাজে নেমেছেন, তাঁদের প্রতি তার একটা কর্তব্য আছে–যে-খবর পেলে অপরাধীকে আদালতে আনা যায়–তা কখনোই তাদের কাছে গোপন করবেন না। এর বেশি কিছু বলব না। যদি আরও খবর চান, মি. হোমসের সঙ্গেই বরং কথা বলুন।
বলে, টুপি তুলে নিয়ে চলে এলাম। ঝোঁপের আড়ালে ওঁরা ওইভাবেই বসে রইলেন। মোড় ফেরবার সময়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, নিবিষ্টভাবে কথা বলে চলেছেন দুই মূর্তি এবং যেহেতু আমার দিকে তাকিয়েই কথা বলছেন অতএব প্রসঙ্গটা নিশ্চয় আমাকে নিয়েই।
হোমসকে ঘটনাটা বলার পর ও বললে, কারো গোপন কথা শুনতে চাই না। দুই সতীর্থের সঙ্গে পুরো সন্ধ্যাটা ম্যানর হাউসে শলা-পরামর্শ করে কাটিয়েছে সে, ফিরেছে রাক্ষুসে খিদে নিয়ে। হাই-টি অর্থাৎ খাবারদাবার সহ চায়ের অর্ডার দিয়েছি। এখন আর কাউকে বিশ্বাস করে গুপ্ত খবর শুনতে চাই না কেননা খুন আর ষড়যন্ত্রের উৎকণ্ঠায় দু-জনেই টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে।
শেষ পর্যন্ত তাই হবে বলেই তাহলে তোমার মনে হয়?
হোমস সেদিন দারুণ মেজাজে রয়েছে–কৌতুক যেন চোখে-মুখে ফেটে পড়ছে।
বললে, ভায়া ওয়াটসন, চতুর্থ ডিমটা নিকেশ করার পর পুরো ব্যাপারটা তোমাকে জানানোর মতো অবস্থায় আসব। রহস্যর তল পর্যন্ত দেখে ফেলেছি বলাটা ঠিক হবে না–তার ধারেকাছেও যেতে পারিনি। তবে নিখোঁজ ডাম্বেলটার খোঁজ পাওয়ার পর–
ডাম্বেল!
কী বিপদ! কেসটা যে নিখোঁজ ডাম্বেলের উপর ঝুলছে এটা কি তোমার মাথায় আসেনি? যাকগে, যাকগে, মুখখানা অত কালো করার দরকার নেই। তোমাকেই শুধু বলি, ঘটনাটার সাংঘাতিক গুরুত্ব ইনস্পেকটর ম্যাক অথবা দারুণ বুদ্ধিমান স্থানীয় অপরাধ বিশেষজ্ঞের মাথাতেও আসেনি। একটা ডাম্বেল, ওয়াটসন! একখানা ডাম্বেল নিয়ে পাঁয়তারা কষছে এমন কোনো ব্যায়ামবীরকে কল্পনা করতে পারো? ফলাফলটা একটু ভাবতে চেষ্টা করো–একদিকে চাপ পড়ার ফলে মেরুদণ্ড বেঁকে যাবে না? ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। ওয়াটসন, গায়ে কাঁটা দেয়!
দুই চোখে দুষ্টামি নাচিয়ে মুখভরতি টোস্ট চিবুতে চিবুতে আমার ধীশক্তির ধরাশায়ী অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল শার্লক হোমস। ওর এই রাক্ষুসে খিদে দেখে বোঝা যায় তদন্ত সন্তোষজনক হয়েছে এবং ফলাফল মনের মতো হয়েছে। কেননা আমি তো দেখেছি কূট সমস্যায় হালে পানি না-পেলে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত দাঁতে কুটোটি না-কেটে কাটিয়েছে ভাবনা নিয়ে আতীব্র মনঃসংযোগের ফলে চোখ-মুখ আরও ধারালো হয়েছে, আরও শীর্ণ হয়েছে খাবার কথা একদম মনে হয়নি। তাই তারিয়ে তারিয়ে সব খাবার খাওয়ার পর পাইপ ধরিয়ে সেকেলে সরাইখানার চিমনির কোণে বসে যখন হাতের কেস নিয়ে মন্থর কিন্তু প্রাণ খোলা কথা শুরু করল, তখন মনে হল কেস-রির্পোট শোনাচ্ছে না–মশগুল হয়ে রয়েছে গভীর চিন্তায়।
ডাহা মিথ্যে, ওয়াটসন–একটা মস্ত মিথ্যে–এ-মিথ্যের সঙ্গে সমঝোতা চলে না কোনোমতেই। শুরু করা যাক এখান থেকেই। বার্কার যা বলেছে, তার আগাগোড়া নির্ভেজাল মিথ্যে। কিন্তু বার্কারের কথায় নতুন করে বলেছেন মিসেস ডগলাস। সুতরাং মিথ্যেবাদী তিনিও। দু-জনেই চক্রান্ত করে মিথ্যে বলেছেন। সমস্যাটা তাহলে এই মিথ্যে বলছেন কেন? এমন কী কথা যা লুকানোর জন্যে বানিয়ে বানিয়ে ডাহা মিথ্যে বলছেন দু-জনে? এত ঝুঁকি নিচ্ছেন? এত কষ্ট করছেন? ওয়াটসন, দেখা যাক মিথ্যের বাধা পেরিয়ে সত্যকে জোড়াতালি দিয়ে খাড়া করা যায় কিনা।
মিথ্যে যে বলছেন তা জানলাম কি করে? জানলাম কাহিনির এলোমেলো বুনট শুনে যা, এক কথায়, সত্যি হতে পারে না কোনোমতেই। এবার মাথা খেলাও! কাহিনি অনুসারে একটা আংটি খুলে তলা থেকে বিয়ের আংটি সরিয়ে আগের আংটিটা ফের আঙুলে পরাতে আততায়ীর লেগেছে এক মিনিটেরও কম সময় যা কখনোই সম্ভব নয়–তা ছাড়াও একটা আশ্চর্য কার্ড রেখেছে মৃতব্যক্তির পাশে। আমি বলছি এ-জিনিস একেবারেই অসম্ভব। তুমি হয়তো তর্ক করবে, তোমার বিচারবুদ্ধিকে শ্রদ্ধা করি বলেই বিশ্বাস করি ও-পথ তুমি মাড়াবে না–কখনোই তুমি বলবে না যে খুন করার আগে আঙুল থেকে খুলে নেওয়া হয়েছিল আংটিটা। মোমবাতিটা একটু আগেই জ্বালানোর মানেই হল কথাবার্তা বেশিক্ষণের জন্য হয়নি। ডগলাস ভদ্রলোক শুনেছি নির্ভীক পুরুষ ছিলেন। ওঁর মতন ডাকাবুকো মানুষের পক্ষে ওইটুকু সময়ের মধ্যে বিয়ের আংটি খুলে দেওয়া সম্ভব? আংটি খুলে দেবেন, এটাও কি কল্পনা করা সম্ভব? না, ওয়াটসন, লম্ফ না জ্বালিয়ে মৃতব্যক্তির সঙ্গে কিছুক্ষণ একলা ছিল গুপ্তঘাতক। এ-ব্যাপারে তিলমাত্র সন্দেহ আমার নেই। কিন্তু মৃত্যুর কারণ বাহ্যত ওই বন্দুকের গুলি। তাহলে নিশ্চয় আমাদের যে-সময় বলা হয়েছে, বন্দুক ছোড়া হয়েছে তার অনেক আগে। কিন্তু এ-ব্যাপারে তো ভুল হতে পারে না। তাহলে বন্দুকের আওয়াজ যে দু-জন শুনেছে বার্কার আর মিসেস ডগলাস–এই দুজনের মধ্যে একটা পরিষ্কার চক্রান্তের আভাস আমরা পাচ্ছি। গোদের ওপর বিষফোড়া স্বরূপ আরও একটা ঘটনা খেয়াল করিয়ে দিতে চাই তোমাকে পুলিশকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যে জানলার গোবরাটে রক্তের দাগ রেখেছিল এই বার্কার লোকটাই–এবার নিশ্চয়ই মানছ কেসটা ক্রমশ বার্কারের বিরুদ্ধেই যাচ্ছে?
এবার নিজেদেরকে একটা প্রশ্ন করা যাক–খুনটা তাহলে হয়েছে ঠিক ক-টায়? সাড়ে দশটার আগে নিশ্চয় নয়–কেননা ওই সময়ে বাড়িময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল চাকরবাকর। পৌনে এগারোটায় অ্যামিস ছাড়া সবাই গেল শুতে অ্যামিস রইল ভাঁড়ার ঘরে। তুমি চলে আসার পর একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখলাম দরজা-টরজা বন্ধ রেখে পড়ার ঘরে ম্যাকডোনাল্ড যতই আওয়াজ করুক না কেন, ভাঁড়ার ঘরে তা পৌঁছোয় না। হাউসকিপারের ঘরের ব্যাপার অবশ্য আলাদা। এ-ঘর করিডরের শেষের দিকে নয় বলেই পড়ার ঘরে কেউ গলা ফাটিয়ে চেঁচালে অস্পষ্ট শোনা যায়। আমি শুনেছি। খুব কাছ থেকে শটগান ছুড়লে আওয়াজ একটু চাপা হবেই, এক্ষেত্রে যা হয়েছে। আওয়াজটা তেমন জোর না-হলেও নিস্তব্ধ রাতে মিসেস অ্যালেনের ঘরে পৌঁছানো উচিত ছিল। ভদ্রমহিলা নিজেই বলেছে, কানে একটু কম শোনে। তা সত্ত্বেও কিন্তু চেঁচামেচির আগে দড়াম করে দরজা বন্ধ হওয়ার মতো একটা আওয়াজ নাকি শুনেছিল। চেঁচামেচির আধঘণ্টা আগে মানে পৌনে এগারোটা। যে-আওয়াজ সে শুনেছে, তা যে আসলে বন্দুকের আওয়াজ, তাতে একদম সন্দেহ নেই আমার খুনের আসল সময় হল সেটাই। তাই যদি হয়, তাহলে যদি ধরেও নিই যে মিসেস ডগলাস আর মি, বার্কার প্রকৃত হত্যাকারী নন–আমাদের জানতে হবে পৌনে এগারোটায় বন্দুকের আওয়াজ শুনে দু-জনে নেমে আসার পর থেকে সওয়া এগারোটায় ঘন্টা বাজিয়ে চাকরবাকর ডাকার সময় পর্যন্ত ওরা কী করেছিলেন। এর সঙ্গেসঙ্গে কেন ঘণ্টা বাজিয়ে লোক জড়ো করেননি? এ যে প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম এখন, এর জবাব পেলেই জানবে হেঁয়ালির অনেকখানি সমাধান হয়ে যাবে।
বললাম, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই দুজনের মধ্যে একটা বোঝাঁপড়া আছে। স্বামী নিধনের ঘণ্টা কয়েক পরেই হি-হি করে হাসা হৃদয়হীন প্রাণী ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
ঠিক বলেছ। ওঁর নিজের জবানবন্দির মধ্যেও পতিপ্রাণা স্ত্রীর ছাপ রাখতে পারেননি। নারী-প্রশস্তিতে আমার প্রতিটি অণু-পরমাণু উন্মুখ নয় তা তুমি জানো ওয়াটসন। কিন্তু স্বামীর প্রতি এতটুকু শ্রদ্ধা যার আছে, স্বামীর মৃতদেহ সামনে রেখে অন্য পুরুষের মিথ্যে বরদাস্ত করার মতো এমন স্ত্রী যে এ-সংসারে খুব একটা নেই–দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমি তা জেনেছি। বিয়ে যদি কখনো করি ওয়াটসন, বউকে এমন শিক্ষা দিতে চেষ্টা করব যাতে আমার মৃতদেহ মাত্র কয়েক গজ দূরে পড়ে আছে জেনেও হাউসকিপারের সঙ্গে সুড়সুড় করে চলে না-যায়। খুবই যাচ্ছেতাই ভাবে মঞ্চস্থ করা হয়েছে নাটকটা–কেননা অত্যন্ত স্বাভাবিক মেয়েলি বিলাপের এহেন অনুপস্থিতে সন্দেহ হওয়া উচিত আনকোরা তদন্তকারীরও। আর কিছু না-পেলেও শুধু এই ঘটনাই পূর্বপরিকল্পিত চক্রান্তের আভাস এনে দিতে পারত আমার মনে।
তুমি তাহলে নিশ্চিত যে খুনের অপরাধে অপরাধী বার্কার আর মিসেস ডগলাস?
পাইপ তুলে আমার দিকে নাড়তে নাড়তে হোমস বললে, তোমার প্রশ্নগুলো বড় বেশি সোজা। ভয় লাগে। ঠিক বুলেটের মতো তাগ করে ছোড়া আমার দিকে। যদি বলল, খুনের আসল রহস্য জেনেও ষড়যন্ত্র করে গোপন করেছেন মিসেস ডগলাস আর বার্কার–তাহলে জবাব দিতে পারি মন প্রাণ দিয়ে। আমি জানি ঠিক তাই করেছেন দু-জনে। কিন্তু তোমার আরও মারাত্মক উক্তিগুলো তেমন পরিষ্কার নয়। এসো অন্তরায়গুলো নিয়ে বিচার বিবেচনা করা যাক।
ধরে নিচ্ছি এই যুগলমূর্তি যে-ভালোবাসায় বাঁধা পড়েছে তা অপরাধবোধে সমাচ্ছন্ন অবৈধ প্রণয়–মিলনের অন্তরায় পুরুষটিকে সরিয়ে ফেলতে দু-জনেই বদ্ধপরিকর। অনুমানটা কিন্তু একটু বড়োগোছেরই, কেননা চাকরবাকরদের সূক্ষ্মভাবে জেরা করেও এই অনুমানের সমর্থন পাওয়া যায়নি। উলটে এমন অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে যা থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে ডগলাস দম্পতি অত্যন্ত অনুরক্ত ছিল পরস্পরের প্রতি।
নিভৃত বাগানে হাস্যমুখর সুন্দর মুখখানি মনের চোখে ভেসে উঠল। বললাম, আমার দৃঢ় বিশ্বাস তা সত্যি নয়।
সেইরকম ভাবই দেখিয়েছে দু-জনে। যাই হোক, ধরে নিলাম যুগল মূর্তি এই একটি ব্যাপারে বাড়িসুদ্ধ সবাইকে ধোঁকা দিয়ে এসেছে এবং তলায় তলায় পতিদেবতাকে বধ করার ষড়যন্ত্র করেছে। ভদ্রলোকের মাথায় তখন বিপদের খাড়া ঝুলছে
এ-ব্যাপারটা কিন্তু কেবল ওদের মুখেই শোনা।
হোমসকে দেখে মনে হল যেন ভাবনায় পড়েছে।
বটে ওয়াটসন, বটে। তুমি এখন একটা অনুমিতির সন্ধানে আছে যার ফলে বলা যায় ওরা গোড়া থেকে সব বানিয়ে বলেছে। তোমার ধারণা অনুসারে, গুপ্ত সমিতি, ভ্যালি অফ ফিয়ার, সর্দার ম্যাক অথবা কোনো কিছুরই অস্তিত্ব কোনোকালে ছিল না। বিস্তীর্ণ, ব্যাপক অনুমিতি হিসেবে তা মন্দ নয়। এর ফলে কোথায় পৌঁছোচ্ছি এবার দেখা যাক। খুনের আসল উদ্দেশ্য ধামাচাপা দেওয়ার জন্যে গল্পগুলো বানিয়েছে দু-জনে। বাইরের লোক বাড়িতে ঢুকেছিল, এই ধারণা সৃষ্টির জন্যে সাইকেলটা প্রমাণস্বরূপ রেখে দিল বাগানে। জানালায় গোবরাটের রক্ততে সেই ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা। মৃতদেহের পাশে রাখা কার্ডটার উদ্দেশ্যও তাই–ও-কার্ড হয়তো লেখা হয়েছে বাড়ির মধ্যেই! ওয়াটসন, তোমার অনুমিতির সঙ্গে খাপ খেয়ে যাচ্ছে সব কিছুই। এবার আসছে এমন টেড়াবেঁকা যাচ্ছেতাই ব্যাপার যা তুমি খাপ খাওয়াতে পারবে না কিছুতেই। দুনিয়ার এত অস্ত্র থাকতে করাত দিয়ে কাটা শটগান কেন? তাও আমেরিকায় তৈরি? আওয়াজ শুনে কেউ যে ছুটে আসবে না, এ-ব্যাপারে অতটা নিশ্চিত ওরা হল কীভাবে? দড়াম করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনে মিসেস অ্যালেন খোঁজ নিতে আসতে পারত তো? অপরাধী প্রেমে আবদ্ধ যুগলমূর্তি এসব কেন করতে গেল বলতে পারো?
স্বীকার করছি, আমার মাথায় আসছে না।
তারপরেও দেখো, কোনো স্ত্রীলোক আর তার নাগর যদি স্বামী নিধনের চক্রান্ত করে, খুনটুন করার পর আঙুল থেকে বিয়ের আংটি সরিয়ে গোপন চক্রান্তর প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন কখনো দেয়? সম্ভব বলে মনে হয়, ওয়াটসন?
না, একেবারেই নয়।
আরও আছে। সাইকেল লুকিয়ে রাখার মতলবটায় আখেরে কোনো লাভ হচ্ছে কি? অত্যন্ত মাথামোটা ডিটেকটিভও বলবে পুলিশের চোখে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা। চম্পট দেওয়ার প্রথম সহায় ওই সাইকেল–পলাতকরা ফেলে পালাবে কেন?
আমি কোনো ব্যাখ্যা ভাবতে পারছি না।
কিন্তু মানুষের বুদ্ধিতে ব্যাখ্যা হয় না এমন কোনো ঘটনাপরম্পরা থাকতেই পারে না। আমি একটা সম্ভাব্য চিন্তাধারা শোনাচ্ছি শোনো–স্রেফ মনের ব্যায়াম করার জন্যেই বলছিঅক্ষরে সত্যি–এমন কথা কিন্তু বলছি না। নিছক কল্পনা মানছি, কিন্তু অনেক সময়ে পরম সত্যির জননী হয়ে দাঁড়ায় নিছক কল্পনা–তাই নয় কি?
আমরা ধরে নিচ্ছি এই ডগলাস ভদ্রলোকের জীবনে একটা দোষাবহ গুপ্তরহস্য আছেসত্যিকারের লজ্জাকর গোপন অপরাধ। এর ফলেই খুন হতে হয়েছে তাকে ধরে নিচ্ছি, হত্যাকারী খুন করে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছে এবং সে বাইরে থেকে এসেছে। প্রতিহিংসা-পাগল এই লোকটা বিয়ের আংটিটা আঙুল থেকে খুলে নিয়ে গেল কেন নিয়ে গেল স্বীকার করছি তা ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। বিরোধটা হয়তো বংশগত এবং শুরু হয়েছে ডগলাসের প্রথম বিয়ের সময় থেকে তাই কোনো কারণে আংটি সরানো হয়েছে আঙুল থেকে। সরে পড়ার আগেই বার্কার আর ডগলাসের স্ত্রী ঢুকলেন ঘরে। প্রতিহিংসা-পাগল হত্যাকারী দু-জনকেই বুঝিয়ে দিলে তাকে ধরিয়ে দিলে এমন কুৎসিত কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাবে যে টি-ঢি পড়ে যাবে সমাজে। কথাটা মনে ধরেছে দু-জনের যেতে দিয়েছে প্রতিহিংসা পাগলকে। এই কারণেই হয়তো নিজেরাই ড্রব্রিজ নামিয়ে পালানোর পথ করে দিয়েছে। তারপর তুলে রেখেছে। আমি দেখেছি ড্রব্রিজ নিঃশব্দে ওঠানো নামানো যায়। নির্বিঘ্নে পালাল হত্যাকারী। কোনো কারণে সে দেখলে সাইকেল না-নিয়ে হেঁটে পালানোই বরং অনেক নিরাপদ। তাই যন্ত্রটা রেখে গেল এমন জায়গায় যাতে পগারপার হওয়ার আগে কারোর চোখে না-পড়ে। সম্ভাবনার ক্ষেত্র কিন্তু এখনও ছাড়াইনি, তাই না?
রেখে ঢেকে বললাম, এইরকমই হওয়া সম্ভব বলে মনে হচ্ছে বটে।
ওয়াটসন, খেয়াল রাখতে হবে ঘটনা যাই হোক না কেন তা অসাধারণ। এসো আবার শুরু করা যাক অনুমানভিত্তিক তদন্ত। ধরে নেওয়া যাক, হত্যাকারীকে ছেড়ে দেওয়ার পরেই কিন্তু টনক নড়ল দু-জনের খুনটা যে তাদের কীর্তি নয়, কাউকে দিয়ে করায়নি অথবা নিজেরাই করেনি তা প্রমাণ করা মুশকিল হবে যে। তৎক্ষণাৎ একটু গোলমেলে ভাবেই সম্মুখীন হলেন পরিস্থিতির। পলাতক পালিয়েছে কীভাবে বোঝানোর জন্যে বাৰ্কারের রক্তমাখা চটির ছাপ রাখা হল গোবরাটে। বন্দুকের আওয়াজ শুধু এই দু-জনেই শুনেছেন—কাজেই আওয়াজ শোনামাত্র যেভাবে চেঁচামেচি করা উচিত সবই করলেন–তবে ঝড়া আধঘন্টা বাদে।
যা বললে তা প্রমাণ করবে কী করে শুনি?
বাইরের লোক এর মধ্যে থেকে থাকলে পেছন নিয়ে তাকে ধরা হবে। সবচেয়ে মোক্ষম প্রমাণ তখন পাওয়া যাবে। আর তা যদি না হয় বিজ্ঞানের ভাড়ার এখনও ফুরোয়নি। একটা সন্ধ্যা তা নিয়ে ভাবলেই অনেক কাজ দেবে।
মাত্র একটা সন্ধ্যা!
আমি এখুনি ওখানে যাব বলে সব ঠিক করে এসেছি। বার্কারের ওপর খুব একটা সন্তুষ্ট নয় অ্যামিস ব্যবস্থা হয়েছে তার সঙ্গেই। ওই ঘরে গিয়ে বসে দেখব আবহাওয়া থেকে কোনো প্রেরণা পাই কিনা। আমি স্থান মাহাত্মে বিশ্বাসী। হাসছ ওয়াটসন? বেশ, দেখা যাক। ভালো কথা, তোমার সেই বিরাট ছাতটা আছে?
এই তো রয়েছে।
ছাতাটা ধার নেব ভাবছি।
নিশ্চয় কিন্তু অস্ত্র হিসেবে বদখত নয় কি? বিপদ যদি আসে—
গুরুতর কিছু নয়, ভায়া ওয়াটসন; তেমন কিছু হলে তোমার সাহায্য নিতাম। ছাতাটা কিন্তু নিয়ে যাব। এখন বসে আছি সহকর্মীদের ফেরার পথ চেয়ে। ওরা টানব্রিজ ওয়েলস গেছে সাইকেলের মালিকের হদিশ বার করতে।
রাত্তিরের আগে অভিযান থেকে ফিরল না ইনস্পেকটর ম্যাকডোনাল্ড আর হোয়াইট ম্যাসোন। ফিরল বিজয়োল্লাসে, তদন্তে অগ্রগতির বিরাট খবর নিয়ে।
ম্যাকডোনাল্ড বলল, আরে মশাই, এখন স্বীকার করছি বাইরের লোক আদৌ ছিল কিনা তা নিয়ে গোড়া থেকেই সন্দেহ ছিল আমার অবশ্য এখন আর তা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। সাইকেল পেয়েছি, লোকটার চেহারার বর্ণনাও পেয়েছি–ব্যস, এই নিয়েই এগোনো যাবে অনেকদ্দূর।
হোমস বললে, শেষটা এবার শুরু হল বলে মনে হচ্ছে। আপনাদের দুজনকেই অভিনন্দন জানাই অন্তর থেকে।
পরশুদিন টানব্রিজ ওয়েলস থেকে ফেরবার পর মি, ডগলাসকে অস্থির অবস্থায় দেখা গিয়েছিল এই খবর সম্বল করেই তদন্ত শুরু করি আমি। এর মানে এই, টানব্রিজ ওয়েলসেই উনি আঁচ করতে পেরেছিলেন বিপদ ঘনিয়ে আসছে। সুতরাং সাইকেলে করে কেউ যদি এসেই থাকে, নিশ্চয় টানব্রিজ ওয়েলসেই ফেরবার কথা তার। সাইকেলটা তাই সঙ্গে নিয়ে গেলাম। সবক-টা হোটেলে দেখালাম। ইগল কমার্শিয়ালের ম্যানেজার দেখেই চিনতে পারল। দু-দিন আগে হার্থেভ নামে একটা লোক ঘর ভাড়া করেছিল–সাইকেলটা তার। এই সাইকেল আর একটা চামড়ার ছোটো ব্যাগ ছাড়া লোকটার কাছে আর মালপত্র ছিল না। খাতায় নামের পাশে লিখেছিল, লন্ডন থেকে আসছি–কিন্তু ঠিকানা লেখেনি। চামড়ার ব্যাগটা লন্ডনে তৈরি, ভেতরকার জিনিসপত্র ব্রিটিশ–লোকটা কিন্তু নিঃসন্দেহে আমেরিকান।
সহর্ষে হোমস বললে, বাঃ বাঃ! আমি যখন বন্ধুর সঙ্গে বসে থিয়োরি কপচাচ্ছি, আপনারা তখন সত্যিই একটা কাজের কাজ করে এসেছেন। হাতে-কলমে শিক্ষা দিয়ে ছাড়লেন, মি. ম্যাক্স।
হৃষ্টচিত্তে বলল ইনস্পেকটর, তা যা বলেছেন।
কিন্তু এটাও তোমার থিয়োরিতে খাপ খেয়ে যায়, মন্তব্য করলাম আমি।
খাপ খেতেও পারে, নাও পারে। কিন্তু শেষটা শোনা যাক, মি. ম্যাক। লোকটাকে শনাক্ত করার মতো কিছু পাওয়া যায়নি?
এত কম পাওয়া গেছে যে স্পষ্ট বোঝা যায় লোকটা গোড়া থেকেই হুঁশিয়ার হয়ে ছিল যাতে শনাক্তকরণ সম্ভব না হয়। কাগজপত্র নেই, চিঠিপত্র নেই, জামাকাপড়েও কোনো চিহ্ন নেই। শোবার ঘরে টেবিলে পড়ে কেবল এই অঞ্চলের সাইকেল ম্যাপ। গতকাল সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়েছিল সাইকেলে চেপে, আমরা গিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার আগে পর্যন্ত আর কোনো খবর নেই।
হোয়াইট ম্যাসোন বললেন, আমার ধোঁকা লাগছে সেই কারণেই মি. হোমস। লোকটা যদি নিজেকে নিয়ে হট্টগোল সৃষ্টি করতে না-চাইত, তাহলে নিরীহ টুরিস্টের মতো ফিরে এসে হোটেলেই থেকে যেত। কিন্তু এখন তো তার জানা উচিত যে অন্তর্ধান সংবাদ পুলিশকে দেবে ম্যানেজার খুনের সঙ্গেও তাকে জড়িয়ে ফেলা হবে।
সেইরকমই মনে হবে প্রত্যেকেরই। তবে তার বিচারবুদ্ধি এখনও পর্যন্ত ধোপে টিকে রয়েছে একমাত্র প্রমাণ তার ধরা না-পড়া। কিন্তু তার চেহারার কী খবর পাওয়া গেল?
নোটবই দেখল ম্যাকডোনাল্ড।
যদ্দূর বলতে পেরেছে লিখে রেখেছি। লোকটাকে কেউ খুব একটা খুঁটিয়ে দেখে রাখেনি, তবে মুটে, কেরানি আর যে পরিচারিকা শোবার ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তারা যা দেখেছে, আমাদের পক্ষে তাই যথেষ্ট। মাথায় পাঁচ ফুট ন-ইঞ্চি, বয়স বছর পঞ্চাশ, চুল সামান্য কাঁচাপাকা, গোঁফও কাঁচাপাকা, টিকোলো নাক, আর মুখখানা নাকি প্রত্যেকের মতে ভয়ংকর আর বীভৎস।
মুখভাবটুকু বাদ দিলে, ও-রকম চেহারা ডগলাসের নিজেরও, বললে হোমস। তাঁরও বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে, চুল আর গোঁফ কাঁচাপাকা, লম্বায় প্রায় ওইরকমই। আর কিছু পেয়েছেন?
গায়ে ছিল ধূসর রঙের ভারী সুট, আঁটোসাঁটো ডাবল ব্রেস্টেড জ্যাকেট নাবিকরা যেমন পরে, হলদে খাটো ওভারকোট আর একটা নরম ক্যাপ।
শটগান?
শটগানটা তো লম্বায় দু-ফুটেরও কম। সহজেই ভরে নেওয়া যায় চামড়ার ওই থলিতে। অনায়াসে ওভারকোটের তলায় ব্যাগ নিয়ে ঘুরেছে নিশ্চয়।
কেসটার সঙ্গে এসবের সম্পর্কটা বার করলেন কীভাবে?
ম্যাকডোনাল্ড বললে, দেখুন মি. হোমস, লোকটাকে পাকড়াও করার পর সে-বিচার ভালোভাবে করা যাবে। দেখতে কীরকম তা শোনার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই খবরটা টেলিগ্রাম মারফত জানিয়ে দিয়েছি সবাইকে। কিন্তু এই মুহূর্তেও জানবেন এগিয়েছি অনেকটা। আমরা জেনেছি, দু-দিন আগে সাইকেল আর চামড়ার ব্যাগ নিয়ে টানব্রিজ ওয়েলসে এসেছিল হার্থেভ নামে একজন আমেরিকান। চামড়ার থলির মধ্যে লুকিয়ে এনেছিল করাত দিয়ে কাটা একটা শটগান, খুনের অভিসন্ধি অতীব পরিষ্কার। যদ্র জেনেছি, কেউ তাকে পৌঁছোতে দেখেনি–সম্ভবও না, কেননা বাগানের ফটকে পৌঁছতে হলে গ্রামের মধ্য দিয়ে না-এলেও চলে। তা ছাড়া রাস্তায় সাইকেল আরোহীও ছিল বিস্তর। অনুমান করে নিচ্ছি, বাগানে ঢুকেই লরেলের ঝোপে সাইকেল লুকিয়ে রেখে ওত পেতে বসে ছিল বাড়ির দিকে চোখ রেখে মি. ডগলাসের বেরিয়ে আসার প্রতীক্ষায়। সাইকেলটা লরেল ঝোঁপের পাশেই আমরা পেয়েছি। অস্ত্র হিসেবে শটগান জিনিসটা বাড়ির মধ্যে অদ্ভুত ঠিকই, কিন্তু তার মতলব ছিল শটগান ছুড়বে বাগানে আওয়াজ নিয়ে কারো মাথাব্যথাও হবে না কেননা, মৃগয়াভক্ত ইংলন্ডের পল্লি অঞ্চলে অমন বন্দুকের আওয়াজ শোনা যায় যখন-তখন। তা ছাড়া, শটগানের আরও একটা সুবিধে ছিল–লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না।
বাঃ, বেশ পরিষ্কার বোঝা গেল তো! বললে হোমস।
যাই হোক, মি. ডগলাস বেরিয়ে এলেন না। তখন তার কী করা উচিত? গোধূলির আলো-আঁধারিতে গা ঢেকে এগোল বাড়ির দিকে সাইকেল পড়ে রইল ঝোপে। দেখল, ব্রিজ নামানো রয়েছে–ধারেকাছেও কেউ নেই। সুযোগটাকে কাজে লাগাল সে, ঠিক করে নিলে যদি কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, যা হয় একটা অছিলা দেখিয়ে দেবে। কিন্তু কারো সঙ্গে দেখা হল না। প্রথমেই যে-ঘরটা চোখে পড়ল ঢুকল সেই ঘরে, লুকিয়ে রইল পর্দার আড়ালে। সেখান থেকেই দেখল উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে ড্রব্রিজ–বুঝল পালাতে হলে ওই পরিখা টপকে যাওয়া ছাড়া আর পথ নেই। ওত পেতে রইল সওয়া এগারোটা পর্যন্ত রোজকার অভ্যেস মতো নৈশ টহলে বেরিয়ে ঘরে ঢুকলেন মি. ডগলাস। গুলি করে সে পালিয়ে গেল পূর্ব ব্যবস্থা মত। সে জানত সাইকেল নিয়ে পরে হইচই হবে, হোটেলের লোক সাইকেল চিনে ফেলবে এবং তার বিরুদ্ধে সূত্র হিসেবে সাইকেল কাজে লাগানো হবে। তাই সে সাইকেল ফেলেই অন্য কোনোভাবে চলে গেল লন্ডনে অথবা আগে থেকে ব্যবস্থা করে রাখা কোনো লুকোনোর জায়গায়। কীরকম লাগল, মি. হোমস?
চমৎকার বললেন, পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন। এ হল গিয়ে আপনার গল্পের উপসংহার। আমার উপসংহার অন্যরকম–খুনটা যে-সময়ে হয়েছে বলে জানানো হয়েছে, ঘটেছে তার আধ ঘণ্টা আগে। মি. বার্কার আর মিসেস ডগলাস দু-জনেই ষড়যন্ত্র করে কিছু গোপন করছেন, খুনিকে তারা পালাতে সাহায্য করেছেন নিদেনপক্ষে সে পালানোর আগেই ঘরে দু-জনে হাজির হয়েছিলেন,–জানলা গলে পালানোর মিথ্যে কাহিনিটা দু-জনেই সাজিয়েছেন, আসলে খুব সম্ভব নিজেরাই ব্রিজ নামিয়ে হত্যাকারীকে পালাতে দিয়েছেন। এই হল গিয়ে আমার তদন্ত-ফলাফলের প্রথম অর্ধেক।
মাথা নাড়লেন দুই ডিটেকটিভ।
বললে লন্ডন ইনস্পেকটর, তাই যদি, সত্য হয় মি. হোমস, তাহলে আমরা এক হেঁয়ালি থেকে আরেক হেঁয়ালিতে গিয়ে পড়ছি।
ফোড়ন দিলেন হোয়াইট ম্যাসোন, এবং সে-হেঁয়ালিটা আরও বিটকেল। ভদ্রমহিলা জীবনে আমেরিকা যাননি। আমেরিকান গুপ্তঘাতককে আড়াল করার মতো এমন কী সম্পর্ক তার সঙ্গে থাকতে পারে ভদ্রমহিলার বলতে পারেন?
হোমস বললে, অসুবিধে যে আছে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করছি। আজ রাতে নিজে থেকেই , ছোট্ট একটু তদন্ত করে দেখতে চাই–মোদ্দা কারণটা তাতে হয়তো অনেক স্পষ্ট হবে।
আমরা কী সাহায্য করতে পারি, মি. হোমস?
না, না! অন্ধকার আর ডক্টর ওয়াটসনের ছাতা তো রইল। আমার চাহিদা খুব মামুলি। আর রইল অ্যামিস–বিশ্বস্ত অ্যামিস–আমার জন্যে একটা বিষয় সে পরিষ্কার করে দেবে। আমার সব চিন্তাই কিন্তু ছুটছে একটা মূল ধাঁধার সূত্র ধরে একটিমাত্র ডাম্বেলের মতো অস্বাভাবিক যন্ত্র নিয়ে কেন দেহগঠন করতে চায় একজন ব্যায়ামবীর?
একক অভিযান থেকে বেশ রাত করেই সরাইখানায় ফিরল হোমস। দু-বিছানাওলা একটা শোবার ঘরে ছিলাম আমরা দুই বন্ধু পাড়াগাঁয়ের খুদে সরাইখানায় এর চাইতে ভালো ব্যবস্থা আর করা যায়নি। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ও ঘরে ঢুকতেই আধো-জাগরণ ঘটল।
বিড়বিড় করে বললাম, কী হে হোমস? পেলে কিছু?
নীরবে আমার পাশে দাঁড়াল সে, হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি। তারপর দীর্ঘ শীর্ণ মূর্তি ঝুঁকে পড়ল আমার ওপর।
বলল ফিসফিস স্বরে, মগজ যার তলতলে হয়ে গেছে, মন যার শক্তি হারিয়েছে–এমনি এক উন্মাদের সঙ্গে এক ঘরে রাত কাটাতে ভয় করবে না তো?
একদম না, বললাম সবিস্ময়ে।
কপাল ভালো। এর বেশি সে-রাতে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করল না বন্ধুবর।
আগের পর্ব:
০১. হুঁশিয়ারি
০২. আলোচনায় বসলেন মি. শার্লক হোমস
০৩. বির্লস্টোন ট্র্যাজেডি
০৪. অন্ধকার
০৫. নাটকের পাত্রপাত্রী
পরের পর্ব :
০৭. সমাধান
০৮. লোকটা
০৯. বডিমাস্টার
১০. লজ ৩৪১, ভারমিসা
১১. ভ্যালি অফ ফিয়ার
১২. নীরন্ধ্রতম অন্ধকার মুহূর্ত
১৩. বিপদ
১৪. ফাঁদে পড়ল বার্ডি এডোয়ার্ডস
১৫. উপসংহার