দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য লায়নস মেন

দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য লায়নস মেন

সিংহ-কেশরের সংহার মূর্তি
[দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য লায়নস মেন]

গোয়েন্দাগিরি যতদিন করেছি, ততদিন ভাগ্যে এ-রকম অসাধারণ কেস জোটেনি। এমনই কপাল যে কেসটা ঘরের কাছেই ঘটল গোয়েন্দাজীবন থেকে বিদায় নিয়ে লন্ডনের ধোঁয়াটে পরিবেশ ত্যাগ করে সাসেক্সের গ্রামাঞ্চলে প্রকৃতির লীলানিকেতনে পরম শান্তিতে শেষ জীবন কাটাতে আসার পর। ওয়াটসন এখন দৃষ্টিসীমার বাইরে বললেই চলে। মাঝেমাঝে হপ্তাশেষে একবার দেখা করে যায়। কাজেই কাহিনিটা নিজেই লিখছি। সিংহকেশরের রহস্যভেদ করে সমাধানে পৌঁছোনোর আগে ঠিক যেরকমটি দেখেছিলাম শুনেছিলাম–সেইভাবেই প্রতিটি কথা, দৃশ্য এবং ঘটনা লিখে যাব সহজ সরলভাবে আমার ভঙ্গিমায়।

ডাউনসের দক্ষিণ ঢালে আমার ছোট্ট ভিলা থেকে ইংলিশ চ্যানেল দেখা যায়। উপকূলের এদিকে কেবল খড়িপাথরের খাড়াই টিলা। একটিমাত্র পিচ্ছিল পথ বেয়ে অতি সাবধানে পা টিপে টিপে নামতে হয় জলের দিকে। পথের শেষে প্রায় এক-শো গজ চওড়া বেলাভূমিতে ছড়ানো কেবল নুড়ি আর জলে ক্ষয়ে যাওয়া ছোটো ছোটো পাথর। জোয়ার এলেও বেলাভূমির পাথর আর নুড়ি দেখা যায়। মাঝে মাঝে কতকগুলো গভীর গর্তে প্রতিবাত জোয়ারের টাটকা জল জমে ছোটো ছোটো সন্তরণকুণ্ড তৈরি হয়ে যায়। ডাইনে বাঁয়ে যেদিকে দু-চোখ যায় আশ্চর্য এই বেলাভূমির ছেদ নেই কোথাও–শুধু এক জায়গায় ছাড়া… ফুলওয়ার্থ গ্রাম আর ছোট্ট উপসাগর রয়েছে যেখানে।

আমার বাড়িতে আমি, মৌমাছি আর ঘরের কাজকর্ম দেখাশুনা করার জন্যে একটা লোক আর কেউ থাকে না। আধ মাইল দূরে হ্যারোল্ড স্ট্যাকস্টের কোচিং হাউস। নানা ধরনের বৃত্তি শিক্ষা দেওয়া হয় এখানে। স্ট্যাকহাস্ট নিজে এককালে ভালো খেলোয়াড় এবং ভালো ছাত্র ছিল। এখন অনেক মাস্টার রেখে কোচিং হাউস চালাচ্ছে। আমার সঙ্গে খুব জমেছে। বিনা নেমন্তন্নে দুজনেই দুজনের বাড়ি গিয়ে সন্ধে কাটিয়ে আসি যখন-তখন। ওর কোচিং হাউসের নাম গেবলস।

১৯০৭ সালের জুলাই মাসের শেষাশেষি প্রচণ্ড ঝড়ে উবেল ইংলিশ চ্যানেলের জল খাড়াই। খড়িপাহাড় ভাসিয়ে দিল–ঝড় থেমে গিয়ে জল নেমে যাওয়ার পর দেখা গেল বেশ একটা উপহ্রদের মতো সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। এমন মনোরম প্রভাতে হাওয়া খেয়ে আসার লোভ সামলাতে পারলাম না। পিচ্ছিল পথটা বেয়ে খাড়াই খড়িপাহাড়ের দিকে যাচ্ছি, এমন সময়ে . পেছন থেকে চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখি হ্যারোল্ড স্ট্যাকহাস্ট–সোল্লাসে হাত নাড়ছে।

কী সুন্দর সকাল দেখেছেন! আমি জানতাম আপনি বেরিয়ে পড়বেন। সাঁতার কাটতে চলেছেন দেখছি।

সেই পুরোনো কায়দা, হাসতে হাসতে ঠেলে-ওঠা পকেটে হাত দিল স্ট্যাকহাস্ট। ম্যাকফারসন আগেই বেরিয়েছে–আমি যাচ্ছি এখন।

ফিজরয় ম্যাকফারসন কোচিং হাউসের সায়েন্স-মাস্টার। বাতজ্বরে বেচারার হার্টের বারোটা বেজে গিয়েছে। পঙ্গু হয়ে পড়েছে। খেলাধুলা এখনও করে এবং কেউ ওর সঙ্গে টক্কর দিতেও পারে না। তবে যে-খেলায় বেশি ধকল পড়ে, তা এড়িয়ে যায়। শীতগ্রীষ্মে সাঁতার কাটা ওর প্রিয় অভ্যেস। সাঁতারু আমি নিজেও। একসঙ্গে সাঁতারও কেটেছি অনেকবার।

ঠিক এই সময়ে দেখতে পেলাম ফিজরয়কে। রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে খাড়াই খড়িপাহাড়ের ওপর প্রথমে দেখা গেল দুটো হাত, তারপর সারাদেহ। টলছে ম্যাকফারসন। যেন মদ খেয়েছে। পরমুহূর্তেই দু-হাত শূন্যে ছুঁড়ে অব্যক্ত যন্ত্রণায় বিষমভাবে ককিয়ে উঠে পড়ে গেল মুখ থুবড়ে। দৌড়ে গেলাম আমরা। চিত করে শুইয়ে সভয়ে দেখলাম ম্যাকফারসন মরতে চলেছে। চোখে আলো নেই, গালে রং নেই। ক্ষণিকের জন্যে প্রাণের স্পন্দন দেখা গেল চোখে-মুখে–সমস্ত শক্তি দিয়ে কী যেন বলতে চাইল। শেষ কথাটা কেবল আমার কানে ধরা পড়ল।লায়নস মেন! যেন শেষ মুহূর্তেও সাবধান করে দিতে চাইছে সিংহকেশর সম্পর্কে। খুব অস্পষ্ট আর দুর্বোধ্য হলেও অর্থহীন শব্দ দুটো কিন্তু কানে লেগে রইল আমার। তারপরেই আধখানা শরীর মাটি থেকে তুলে দু-হাত শূন্যে নিক্ষেপ করে কাত হয়ে পড়ে গেল নিষ্প্রাণ দেহে।

পা থেকে মাথা পর্যন্ত চনমন করে উঠল ভয়ংকর এই মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে। ম্যাকফারসনের গায়ে বারবেরি ওভারকোট, ট্রাউজার্স আর পায়ে ফিতে বাঁধা ক্যানভাস জুতো। কাত হয়ে আছড়ে পড়ার সময় পিঠ থেকে সরে গেল ওভারকোট। শিউরে উঠলাম পিঠময় সরু তারের মতো চাবুকের ঘা দেখে। বিন্দু বিন্দু ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ছুঁয়ে বেরুচ্ছে। রক্ত ঝরছে নীচের ঠোঁট থেকেও মৃত্যুযন্ত্রণা সইতে না-পেরে কামড়ে রক্ত বার করে ফেলেছে ঠোঁট থেকে। সে-যন্ত্রণা যে কী নিদারুণ, তা বিকৃত বীভৎস মুখচ্ছবি দেখলেই মালুম হয়।

খোলা পিঠের দগদগে কশাঘাতের দিকে বিহুল চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় পেছন থেকে কার ছায়া পড়ল সামনে। ফিরে দেখি আয়ান মুরডক। কোচিং হাউসের অঙ্কের মাস্টার। কালো চোখ, লম্বা পাতলা কঠোর চেহারা! কারো সঙ্গে মেলামেশা তেমন নেই। ছাত্রের সঙ্গে তেমন প্রাণের সম্পর্ক নেই। সবসময়ে নিজস্ব জগতে কুঁদ হয়ে তাকে। রেগে গেলে মাথায় তখন খুন চাপে। তখন আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। ম্যাকফারসনের কুকুরের বেয়াদবি সইতে না-পেরে কাচের জানলার মধ্যে দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল একবার। স্ট্যাকহার্স্ট তখনই চাকরি থেকে জবাব দেবে ঠিক করেছিল মুরডককে–কিন্তু অমন মাস্টার আর দুটি পাওয়া যায়

বলেই সয়ে গিয়েছিল। ম্যাকফারসনের প্রাণহীন দেহের দিকে পলকহীন চোখে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম এহেন আয়ান মুরডককে। কুকুরের ঘটনাটা মনে পড়ার জন্যেই বোধ হয় চোখে-মুখে খুব একটা সহানুভূতির ছায়াপাত দেখলাম না। যদিও মনে হল যেন খুবই বিচলিত হয়েছে সতীর্থের মৃত্যুতে।

আহা রে!

সঙ্গে ছিলেন নাকি?

না, না। আমি তো ঘুম থেকে উঠেছি দেরিতে। সমুদ্রের ধারেই যাইনি। সোজা আসছি গেবলস থেকে। কী করি বলুন তো?

ফুলওয়ার্থে গিয়ে এখুনি পুলিশে খবর দিন।

মুখ থেকে আর একটা কথাও না-খসিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে উধাও হল মুরডক। স্ট্যাকহাস্ট আচ্ছন্নের মতো বসে রইল মৃতদেহের পাশে। আমি উঠে পড়লাম ধারেকাছে আর কেউ আছে কি না দেখবার জন্যে। ওপরে উঠতেই অনেকদ্দূর পর্যন্ত চোখে পড়ল। খাঁ-খাঁ করছে চারদিক। অনেক দূরে গোটা দুই আবছা মূর্তি ফিরছে ফুলওয়ার্থ গ্রামের দিকে। রাস্তা বেয়ে নামতে নামতে দেখলাম একই পায়ের ছাপ নেমেছে এবং উঠে এসেছে। ম্যাকফারসন একাই ছিল–কেউ আসেনি এদিকে আজ সকালে। এক জায়গায় পাঞ্জার ছাপ–আঙুলগুলো ঢালের দিকে ছড়ানো। ঢাল বেয়ে উঠতে গিয়ে আছড়ে পড়েছিল ম্যাকফারসন। গোল গর্তও দেখলাম মাটি বসে গিয়েছে–খড়িমাটি আর সার মেশানো কাদার ওপর যেন হাঁটু গেড়ে বার বার বসে পড়েছে। ম্যাকফারসন ঢাল বেয়ে উঠতে গিয়ে। পথের নীচে বেশ একটা উপহ্রদ দাঁড়িয়ে গেছে ঝড়ের পর জল সরে যাওয়ার পরেও। এইখানে এক জায়গায় ম্যাকফারসনের তোয়ালে পড়ে–পোশাক খুলেছিল নিশ্চয় জলে নামবে বলে। কিন্তু নামেনি। কেননা তোতায়ালে দিব্যি খটখটে শুকনো এবং পরিপাটিভাবে ভাজ করা। বালির ওপর এখানে সেখানে ওর খালি পা। অথবা ক্যানভাসে জুতোর ছাপ পড়েছে। জুতো খুলেছিল জলে নামবে বলেই। কিন্তু শুকনো তোয়ালে দেখে বোঝা যাচ্ছে নামা আর হয়ে ওঠেনি।

এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল ম্যাকফারসনের মৃত্যু-প্রহেলিকা। বিজন সৈকতে ও একা ছিল বড়োজোর পনেরো মিনিট–কেননা গেবলস থেকে রওনা হওয়ার পর স্ট্যাকহাও রওনা হয়েছে। মাঝে পনেরো মিনিটে কারো নির্মম কশাঘাতে প্রাণ হারিয়েছে হার্টের রুগি ম্যাকফারসন। জলে সে নামেনি অথবা গা মুছবার সময় পায়নি–ধড়ফড় করে কোনোমতে জামাজুতো পরে নিয়েছে–তাই জুতোর ফিতে বাঁধা হয়নি–ওভারকোট কোনোমতে গায়ে গলিয়েছে। কাছাকাছি কেউ ছিল না। খাড়াই খড়িপাহাড়ের গায়ে বিস্তর গর্ত আর গুহা আছে ঠিকই কিন্তু দিগন্তরেখায় উদীয়মান সূর্যের আলো সোজাসুজি সেসব গর্তে পড়ায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কেউ সেখানে লুকিয়ে নেই। অনেক দূরে যে আবছা ছায়ামূর্তিগুলোকে দেখলাম, এই স্বল্প সময়ে এখান থেকে অতদূরে চলে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়–বিশেষ করে মাঝখানে যখন উপহ্রদ রয়েছে যার জলে ম্যাকফারসন সাঁতরাবে মনস্থ করেছিল। সমুদ্রে দু-একটা মাছধরা নৌকা ভাসছে বটে, সে-নৌকোয় কারা আছে তা পরে অবসরমতো তদন্ত করে জানা যাবেখন। তদন্ত করার পথ একাধিক কিন্তু কোনোটাই প্রহেলিকা সমাধানের পথ বলে মনে হল না।

মৃতদেহের কাছে ফিরে এসে দেখলাম লোক জড়ো হয়েছে। গাঁয়ের কনস্টেবলকে নিয়ে ফিরে এসেছে আয়ান মুরডক। সব কথা শোনবার পর সে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে বললে, মিস্টার হোমস, এ-কেস ফয়সালা করা আমার সাধ্য নয়। আপনি সাহায্য না-করলে ওপরওয়ালা আমায় দাঁতে পিষবে।

আমি বললাম ওপরওলাকে যেন এখুনি খবর দেওয়া হয়। একজন ডাক্তার দরকার এখুনি। নতুন কোনো পায়ের ছাপ যেন না পড়ে। কোনো জিনিস যেন সরানোনা হয়। মৃতদেহের পকেট সার্চ করে পেলাম একটা রুমাল। একটা বড়ো ছুরি, আর একটা কার্ড কেস। কার্ড কেসের ভেতর থেকে বেরুল মেয়েলি হাতের লেখা একটা চিরকুট–তুমি এসো, আমি থাকব। মডি। প্রেম-ট্রেম চলছিল মনে হল। কিন্তু দেখাসাক্ষাৎ হবে কোথায় তা লেখা নেই। কনস্টেবলও দেখল চিরকুটটা রেখে দিল কার্ড কেসে। বললাম, খাড়াই কড়িপাহাড়ের তলদেশ যেন তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখা হয়। এরপর বাড়ি ফিরে ব্রেকফার্স্ট খেয়ে নিলাম।

দু-এক ঘণ্টার মধ্যে স্ট্যাকহাস্ট এল জবর খবর নিয়ে। ডেডবডি গেবলস-এ নিয়ে গেছে পুলিশ। ম্যাকফারসনের ডেস্ক থেকে কয়েকটা প্রেমপত্র পাওয়া গেছে। লিখেছে ফুলওয়ার্থের মিস মড বেলামি।

প্রেমে হাবুড়ুবু খাচ্ছিল ম্যাকফারসন। কিন্তু তার সঙ্গে ওর মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না আমার। তবে হ্যাঁ, ম্যাকফারসনের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিল মেয়েটা।

পাঁচজনে যেখানে যায় চান করতে, ঠিক সেইখানে? বললাম আমি।

ভাগ্য ভালো ছাত্ররা গিয়ে পড়েনি।

সবটাই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেবেন?

চিন্তায় কপাল কুঁচকে গেল স্ট্যাকহারে।

মুরডক অ্যালজেব্রার অংশ শেখানোর জন্যে আটকে রেখেছিল ছাত্রদের।

দুজনের মধ্যে কিন্তু বন্ধুত্ব ছিল না।

এককালে ছিল না–পরে হয়েছিল। বছরখানেক ওদের মধ্যে মেলামেশা ছিল। আর পাঁচজনের সঙ্গে মুরডকের মেলামেশা যতখানি–ঠিক ততখানি। সহানুভূতি বস্তুটার অভাব আছে মুরডকের স্বভাব-চরিত্রে।

সেটা আমিও বুঝেছি। কুকুর নিয়ে দুজনের মধ্যে একবার টক্কর লেগেছিল না?

সে কোনকালে মিটে গেছে।

তিক্ততা থেকে যায়নি?

না, না। সত্যিকারের বন্ধুত্ব ফিরে এসেছিল তারপরে।

তাহলে মেয়েটাকে নিয়ে ভাবা যাক। চেনেন আপনি?

কে-না চেনে। এ-অঞ্চলের একমাত্র রূপসি বলতে সে-ই সত্যিকারের ডানাকাটা পরি। দেখলেই ফিরে তাকাতে ইচ্ছে যায়। ম্যাকফারসনের মনে ধরেছিল জানতাম, কিন্তু জল যে এতদূর গড়িয়েছে জানা ছিল না।

মেয়েটা কে?

টম বেলামির মেয়ে। মাছ ধরা কারবার শুরু করে বুড়ো টম বেলামি। এখন এ-তল্লাটের সমস্ত বোট আর চান করার কটেজের মালিক। ছেলে উইলিয়ামকে নিয়ে ব্যাবসা চালায় টম বেলামি।

ফুলওয়ার্থে গিয়ে চলুন আলাপ করে আসা যাক।

কী অছিলায়?

ম্যাকফারসনের মৃত্যুটা সত্যিই চাবুকের ঘায়ে হয়েছে কি না ঈশ্বর জানেন। কিন্তু মানুষের হাতে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তার চেনাজানা লোকের সংখ্যা যখন কম, তখন একটা ছুতোনাতায় টম বেলামিদের সঙ্গে দেখা করতে অসুবিধে হবে না। মোটিভ পাওয়া গেলে ক্রিমিনালকেও পাওয়া যাবে।

সুগন্ধিত ডাউনস বেয়ে হাঁটতে অন্য সময়ে ভালো লাগত, কিন্তু সে সময়ে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে থাকায় প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারলাম না। ফুলওয়ার্থ গ্রামটা উপসাগর ঘিরে আধখানা চাঁদের আকারে গড়ে উঠেছে। সেকেলে কুঁড়ের সারির পেছনে খানকয়েক আধুনিক বাড়ি। এইদিকেই যেতে যেতে স্ট্যাকহার্স্ট বললে, ওই যে স্লেট ছাওয়া কর্নার-টাওয়ার বাড়িটা দেখছেন, ওই হল টম বেলামির বাড়ি। পকেটে কানাকড়িও ছিল না এক সময়ে এখন দেখেছেন অবস্থাটা। আরে–! ও কে?

বাগানের গেট খুলে বেরিয়ে এল দীর্ঘ এক মূর্তি? আয়ান মুরডক।

রাস্তার মুখোমুখি হতেই আড়চোখে আমাদের দেখে নিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে গেল মুরডক, কিন্তু ধরে ফেলল স্ট্যাকহাস্ট।

বললে, এখানে কেন?

রাগে মুখ লাল হয়ে গেল মুরডকের, কৈফিয়ত দেব যখন আপনার বাড়িতে আপনার কাজে থাকব রাস্তায় ব্যক্তিগত ব্যাপারে নয়।

অন্য সময়ে হলে স্ট্যাকস্টের প্রতিক্রিয়া হত অন্যরকম–দুম করে ফেটে না-পড়ে সরে যেত। কিন্তু তখন ওরও নার্ভের অবস্থা শোচনীয়। কাজেই মাথায় রক্ত চড়ে গেল চক্ষের নিমেষে।

মিস্টার মুরডক, জবাবটা অত্যন্ত উদ্ধত হয়ে গেল।

আপনার প্রশ্নটাও তাই।

আপনার ঔদ্ধত্য এর আগে ক্ষমা করেছি অনেকবার। এবার আর নয়। আপনাকে আর আমার কাজ করতে হবে না।

আমিও তাই ঠিক করেছি। গেবলস-এ থাকবার মতো পরিবেশ একজনই তৈরি করে রেখেছিল–আজ সে চলে গেল।

দুমদাম করে বেরিয়ে গেল মুরডক। রাগত চোখে স্ট্যাকহাস্ট বললে, অসহ্য! বরদাস্ত করা যায় না!

আমার কিন্তু চোখ খুলে গেল এ-ঘটনায়। স্পষ্ট বুঝলাম, আয়ান মুরড়ক ছুতোনাতা করে অকুস্থল ছেড়ে চম্পট দেবার ফিকিরে আছে। সন্দেহ দানা বাঁধল মনের মধ্যে। বেলামি পরিবারের সঙ্গে দেখা করলে হয়তো অন্ধকারে আলো দেখা যেতে পারে। স্ট্যাকহার্স্ট সামলে নিল নিজেকে। এগোলাম বাড়ির দিকে।

টম বেলামি মাঝবয়েসি পুরুষ। দাড়ির রং আগুনের মতো লাল। মেজাজ খুব তিরিক্ষে মনে হল। আমাদের কথা শোনবার পর দাড়ির মতোই লাল হয়ে গেল মুখ।

খেঁকিয়ে উঠে বললে, অত খুঁটিনাটি শোনবার দরকার দেখছি না। ওই আমার ছেলে উইলিয়াম। ঘরের কোণে বিষণ্ণবদন ভারীমুখ এক জোয়ানকে দেখিয়ে, আমরা দুজনেই এ-ব্যাপারে একমত। ম্যাকফারসন আমার মেয়েকে বিয়ে করবে এ-কথা একবারও বলেনি কিন্তু চিঠিপত্র দেখা সাক্ষাৎ চলছিল। আমরা তা চাইনি। মেয়েটির মা নেই। আমরাই তার অভিভাবক। তাই ঠিক করেছি—

কথা আটকে গেল স্বয়ং মড বেলামির আবির্ভাবে। সত্যিই সুন্দরী। যেকোনো যুবাপুরুষের মুণ্ডু ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। বিস্ফারিত চোখে স্ট্যাকহার্স্টের সামনে এসে বললে, ফিজরয় মারা গেছে আমি শুনেছি। সব খুলে বলুন।

টম বেলামি বললে, আরেকজন এসে সব বলে গেছে।

উইলিয়াম গজগজ করে উঠল, উইলিয়াম, ব্যাপারটা আমার–আমাকে সামলাতে দাও। খুনিকে ধরতে গেলে আমার সাহায্যের দরকার আছে–ফিজরয়ের আত্মার শান্তির জন্যে।

মেয়েটির শুধু রূপই নেই, চরিত্রে দৃঢ়তাও আছে। স্ট্যাকহাস্ট গুছিয়ে বলল সব কথা। শোনবার পর আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল মড, মিস্টার হোমস, খুন যারা করেছে, তাদের পুলিশে ধরিয়ে দিন আমি সাহায্য করব! বলতে বলতে অপাঙ্গে চেয়ে নিল বাপ আর।

আমি বললাম, যারা, বলছেন কেন? আপনি তাহলে মনে করেন খুনটা একজন করেনি?

ম্যাকফারসনের গায়ে জোর ছিল, মনে সাহস ছিল। ওর মতো পুরুষকে একা ঘায়েল করা সম্ভব নয় বিশেষ করে ওইভাবে।

আপনাকে একা কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠল টম বেলামি, খবরদার, মড!

অসহায়ভাবে মড বললে, কী করি বলুন তো!

আমি বললাম, তাহলে সবার সামনেই বলছি–দু-দিন বাদে দেশসুদ্ধ লোক তো জেনেই যাবে। বাবা আর ভাইয়ের সামনে প্রসঙ্গটা পাড়তে চাইনি। ম্যাকফারসনের পকেটে একটা চিঠি পাওয়া গেছে। চিঠির বয়ানটাও বললাম। তদন্ত শুরু হলে এ-চিঠির প্রসঙ্গও উঠবে। আপনি কিছু জানেন এ-সম্পর্কে?

খামোখা রহস্য সৃষ্টি করতে চাই না। ম্যাকফারসনের সঙ্গে আমার বিয়ের ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তা পাঁচকান করা হয়নি ওর কাকার জন্যে। তাঁর অনিচ্ছায় বিয়ে করলে সম্পত্তি পাওয়া যাবে না বলে রেখেছেন। ভদ্রলোক এখন মৃত্যুশয্যায়।

কথাটা আমাদের বললে পারতে, গজগজ করে বললে টম বেলামি।

বলতাম যদি একটু সহানুভূতি দেখাতে।

আমি চাই না যাকে তাকে বিয়ে করুক আমার একমাত্র মেয়ে।

ম্যাকফারসন সম্পর্কে তোমার এই গাজোয়ারি কথাবার্তার জন্যেই কিছুই বলিনি। চিঠিটা লিখেছিলাম আমি এই চিঠির জবাবে। বলে একটা তালগোল পাকানো চিরকুট বার করে দিল মড।

তাতে লেখা—

প্রিয়তমা,

মঙ্গলবার সূর্য ডোবার সময়ে সৈকতে পুরোনো জায়গায়। আর সময় হবে না বেরোনোর।– এফ.এম!

আজ মঙ্গলবার। সন্ধের সময়ে যাব ঠিক করেছিলাম।

চিরকুটটা উলটেপালটে দেখে বললাম, এ-চিঠি তো পোস্টে আসেনি। কী করে পেলেন?

যা নিয়ে তদন্ত করছেন, তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই বলেই জবাব দোব না। এ ছাড়া অন্য সব ব্যাপারে আমার সহযোগিতা পাবেন।

কথার নড়চড় হল না। সব কথার জবাব দিয়ে গেল মড়–চিঠি এনেছে কে, এ-প্রশ্নটি বাদে। ফিজরয়ের কোনো শত্রু আছে বলে তার জানা নেই। স্বীকার করল, অনেকেই তার রূপে মুগ্ধ।

মিস্টার আয়ান মুরডক কি তাদের একজন?

বললে, এক সময়ে ছিল। পরে যখন জানল আমার সঙ্গে ফিজরয়ের মন দেওয়া নেওয়া হয়েছে, তখন অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিল মুরডক।

আয়ান মুরড়ককে ঘিরে সন্দেহের ছায়া নতুন করে ঘনীভূত হল আমার মনের মধ্যে। একই মনোভাব দেখা গেল স্ট্যাকহারেও। লোকটার ঘর সার্চ করা দরকার গোপনে। কাগজপত্র দেখা দরকার। স্ট্যাকহার্স্ট সাহায্য করতে চাইল নিজে থেকেই। টম বেলামির বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম মনের মধ্যে সেই ভরসা নিয়ে রহস্য সূত্রের একটা প্রান্ত হয়তো হাতের মুঠোয় পাওয়া গেছে।

দিন সাতেক বৃথাই গেল পুলিশ তদন্তে অশ্বডিম্ব প্রসবই সার হল। আমিও আকাশ-পাতাল ভেবে কূলকিনারা পেলাম না। তার পরেই ঘটল কুকুরের ঘটনা।

আমার বাড়ির কাজকর্ম যে দেখে একদিন সে বললে, শুনেছেন, মিস্টার ম্যাকফারসনের কুকুরটাও এবার মনিবের কাছে গেল।

সে কী! কীভাবে?

একই জায়গায় যেখানে–মনিব খুন হয়েছে–ঠিক সেই জায়গায়।

তোমাকে কে বলল?

সবাই জেনে গেছে। সাতদিন মনের দুঃখে না-খেয়ে ছিল বেচারা। আজকে দুজন ছাত্র গিয়েছিল জলের ধারে দেখলে মরে কাঠ হয়ে পড়ে আছে। আহা রে!

একটা কথা কানে লেগে রইল। মনিব যেখানে খুন হয়েছে ঠিক সেই জায়গাতেই পাওয়া গেছে প্রভুভক্ত কুকুরকেও। এ কি নিছক কাকতালীয়? না, বিশেষ ওই জায়গাটিতে চিরবৈরীর অদৃশ্য অনল জ্বলছে লেলিহান প্রতিহিংসারূপে? তবে কি… একটা আবছা সন্দেহ দেখা দিল মনের দিগন্তে। চটপট পা চালিয়ে পৌঁছে গেলাম কোচিং হাউসে। স্ট্যাক ডেকে পাঠাল ছাত্র দুজনকে।

একজন বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ, মিস্টার ম্যাকফারসনের পায়ের ছাপ ফলো করেই যেন জলের ধার পর্যন্ত গিয়েছিল বেচারা ঠিক একই জায়গায় শেষ নিশ্বাস ফেলতে।

হল ঘরে মাদুরের ওপর শোয়ানো কুকুরটিকেও দেখলাম। সর্বাঙ্গ আড়ষ্ট, অঙ্গ বিকৃত, চোখ ঠেলে বার করা, নিদারুণ যন্ত্রণার অভিব্যক্তি দেহের সর্বত্র।

গেবলস থেকে সোজা গেলাম অভিশপ্ত সেই জায়গাটিতে। সূর্য ড়ুব দিয়েছে তখন নিথর জলের ওপর আসন্ন অন্ধকারে ছায়া সিসের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। চারদিক খাঁ খাঁ করছেমাথার ওপর কর্কশ শব্দে উড়ে গেল গোটা দুই সামুদ্রিক পাখি। হেঁট হয়ে মগ্ন রইলাম নিজের মধ্যে। অনেকরকম চিন্তায় ভরে রইল মনটা সমাধান সূত্র যেন ঠাহর করেও ধরতে পারছি না এমনি একটা আবছা দুঃসহ অনুভূতি ছটফটিয়ে তুলল আমাকে। বুঝি বুঝি করেও কী যেন বুঝে উঠতে পারছি না–মাথায় এসেও আসছে না। অবশেষে পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে।

আর ঠিক তখনই বিদ্যুৎচমকের মতো মাথার মধ্যে ঝলসে উঠল আবছা ধারণাটা। ওয়াটসন বহুবার আপনাদের লিখে জানিয়েছে–আমার পড়াশুনা বহু বিষয় নিয়ে। মাথার মধ্যে বিস্তর জ্ঞান জড়ো করা থাকে–অগোছালো অবস্থায়। যেন অনেকরকম খবরের প্যাকেট তাগাড় করা থাকে মস্তিষ্ক নামক মাচার মধ্যে। তাই দরকার মতো ঝট করে কোন খবরটা কোথায় আছে খুঁজে পাই না কিন্তু জানা থাকে খবরটা আমার মাথাতেই আছে–খুঁজে বার করতে হবে। আবছা সেই মনে পড়াটাকেই এবার টেনেটুনে বার করতে হবে তথ্যবহুল–মস্তিষ্ক থেকে। অবিশ্বাস্য দানবিক হলেও যা সন্দেহ করছি তা সম্ভবপর। খুবই সম্ভবপর। দেখা যাক যাচাই করে।

আমার ছোট্ট ভিলায় একটা মস্ত চিলেকোঠা আছে। রাজ্যের বই ঠাসা আছে সেখানে। ঝাড়া এক ঘণ্টা বই ঘাঁটলাম সেই ঘরে বসে। রুপোলি চকোলেট রঙের একটা মোটা বই বার করে আবছাভাবে মনে পড়া একটা অধ্যায় খুলে গ্রোগ্রাসে গিললাম বিষয়বস্তু। যা পেলাম, এ-কেসে ঠিক তা ঘটেছে ভাবতেও কল্পনাকে কষ্ট করতে হল–সম্ভাবনা তেমন আছে বলেও মনে হল না। কিন্তু বাজিয়ে দেখে নিশ্চিত না-হওয়া পর্যন্ত স্থির হতেও পারলাম না। মনটা উদগ্রীব হয়ে রইল সেই প্রতীক্ষায়।

কিন্তু তার আগেই বাগড়া পড়ল বিরক্তিকরভাবে। পরের দিন ভোরবেলা চা খেয়ে সৈকত অভিমুখে রওনা হতে যাচ্ছি, এমন সময়ে এলেন ইনস্পেকটর বর্ডিল। নিরেট চেহারা চোখে দুশ্চিন্তা।

বললেন, মিস্টার হোমস, মিস্টার ম্যাকফারসনের খুনের অপরাধে এবার গ্রেপ্তারটা করে ফেলব কি না ভাবছি।

কাকে করবেন? মিস্টার আয়ান মুরডককে?

তিনি ছাড়া এ-কাজ আর কে করতে পারে বলুন?

প্রমাণ?

ইনস্পেকটর যা বলে গেলেন, সে-লাইনে চিন্তা আমিও করেছিলাম। আয়ান মুরডকের স্বভাব চরিত্র, তাকে ঘিরে দানা বেঁধে ওঠা রহস্য, হঠাৎ খেপে গিয়ে ম্যাকফারসনের কুকুরকে জানলা গলিয়ে ফেলে দেওয়া, ম্যাকফারসনের সঙ্গে অতীতে ঝগড়া, মড় বেলামির প্রতি ম্যাকফারসনের অনুরাগকে কেন্দ্র করে ঈর্ষা–সবই আমার পয়েন্ট। শুধু একটা পয়েন্ট বাদে মুরডক যে চম্পট দেওয়ার আয়োজন করছে, সে-খবর রাখে না ইনস্পেকটর।

শোনবার পর আমি বললাম, আপনার যুক্তির মধ্যে তিনটে ফাঁক আছে। প্রথম, মুরডকের অন্যত্র স্থিতি জোরদার? সে দেখিয়ে দেবে ম্যাকফারসন যখন খুন হয়েছে, তখন সে ছাত্রদের অঙ্ক বোঝাচ্ছিল। সৈকতে এসেছে ম্যাকফারসন আসার পর আগে নয়। দ্বিতীয় ফাঁক–একা হাতে এভাবে চাবকে মানুষ খুন তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। তৃতীয় ফাঁক–এ-রকম ক্ষত সৃষ্টি করার মতো হাতিয়ার কি পাওয়া গেছে?

নমনীয় চাবুক দিয়ে মারলে এ-রকম দগদগে ঘা দেখা যায়।

দাগগুলো আপনি দেখেছেন?

দেখেছি। ডাক্তারও দেখেছে।

আমি দেখেছি আতশকাচের মধ্যে দিয়ে। দাগগুলো অদ্ভুত।

কীরকম অদ্ভুত?

উঠে গিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা এনলার্জ করা ফটো নিয়ে এলাম, এসব কেস এইভাবেই আমি তদন্ত করি।

কিছুই বাদ দেন না দেখছি।

ডান কাঁধের ওপর এই টানা লম্বা দাগটা দেখুন, আশ্চর্য একটা ব্যাপার লক্ষ করছেন?

আজ্ঞে না।

দগদগে ভাবটা সব জায়গায় সমান জোরালো নয়। এই দেখুন রক্ত চুয়ে পড়ছে খুব বেশি এই পয়েন্টে–তারপর এই এখানে আর একটা পয়েন্ট। এপাশের টানা লম্বা দাগেও দেখুন সেই অসমান দগদগে ভাব। এর মানে কী বলুন তো?

আমি জানি না। আপনি জানেন?

বোধ হয় জানি। বোধ হয় জানি না। তবে শিগগিরই জানব। তারপর ধরতে পারব অপরাধীকে।

আচ্ছা আগুনে পোড়ানো টকটকে রাঙা কোনো তারের জাল পিঠে ছড়িয়ে দিলে জালের দুটো তার যেখানে মিশেছে, গাঁটের ঠিক সেই জায়গায় এ-রকম বেশি রক্তওলা দাগ হতে পারে নাকি?

অথবা খুব শক্ত গাঁটওলা কোনো চাবুক দিয়ে মারলেও এমনি দাগ পড়তে পারে।

মিস্টার হোমস! ঠিক ধরেছেন মনে হচ্ছে!

অন্য ব্যাপারও হতে পারে। তাই বলছিলাম, এখুনি গ্রেপ্তার করতে যাবেন না। তা ছাড়া ম্যাকফারসন মরবার ঠিক আগে বলেছিল–লায়নস মেন।

আয়ান নামটার সঙ্গে কিন্তু মিল রয়েছে না?

তাও ভেবেছি। কিন্তু আমি স্পষ্ট শুনেছি মেন–আয়ান নয়।

তাহলে কী হতে পারে?

হাতে আরও মালমশলা না-আসা পর্যন্ত সেটা বলা সংগত হবে না।

কখন আসবে?

ঘন্টাখানেকের মধ্যে।

অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে চিবুক চুলকোলেন ইনস্পেকটর বার্ডল।

জেলে নৌকোর কথা ভাবছেন নাকি?

আরে না। অদ্দূর যেতে হবে না।

তাহলে কি বেলামি বাপ বেটাকে সন্দেহ করেছেন? ম্যাকফারসনের নাম শুনলেই তো জ্বলে উঠত দুজনে।

না, না। যাক গে, দুপুরে আসুন–তখন তৈরি থাকব আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যে। এখন–

এই পর্যন্ত বলার সঙ্গেসঙ্গে প্রচণ্ড বাধা পড়ল কথায় এবং শুরু হয়ে গেল শেষ পর্ব। দড়াম করে খুলে গেল দরজা। স্থলিত পায়ের আওয়াজ শুনলাম প্যাসেজে। পরক্ষণেই টলতে টলতে এলোমেলো বসনে উশকোখুশকোভাবে ঘরে ঢুকল আয়ান মুরডক। মুখ যন্ত্রণাবিকৃত, চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে, হাতের সামনে আসবাবপত্র যা পাচ্ছে খামচে ধরে সিধে থাকবার চেষ্টা করছে।

ব্র্যান্ডি! ব্র্যান্ডি! বিকট গলায় গুঙিয়ে উঠে ধড়াম করে পড়ে গেল সোফায়। পেছন পেছন এল স্ট্যাকহাস্ট। হাঁপাচ্ছে, মাথায় টুপি নেই! মুরডকের মতোই প্রায় তার চেহারা—উদ্ভান্ত।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ব্র্যান্ডি দিন। দম নিতে পারছে না–দু-বার অজ্ঞান হয়েছে আসবার পথে!

আধ গেলাস ব্র্যান্ডিতে ম্যাজিক ঘটে গেল। এক হাতে ভর দিয়ে দেহটা অর্ধেক তুলে আরেক হাতে কোটটা টান মেরে ফেলে দিয়ে ককিয়ে উঠল মুরডক, তেল! আফিং! মরফিয়া! যা থাকে দিন–এ-যন্ত্রণা আর সইতে পারছি না!

খোলা পিঠের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম আমি আর ইনস্পেকটর। ম্যাকফারসনের পিঠে চাবুক মারার রক্তঝরা যে বীভৎস দাগ দেখেছি, হুবহু সেই রকমের এলোপাতাড়ি চাবুকের ঘা সারাপিঠ জুড়ে রয়েছে।

অসহ্য সে-যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বেশ কয়েকবার দম আটকে মুখ কালো হয়ে এল মুরডকের প্রতিবারেই প্রবল চেষ্টায় অনেকক্ষণ পরে হু-উ-উ-স করে নিশ্বেস নিয়ে হার্ট চালু রাখল কোনোমতে। ঘামে ভিজে গেল কপাল। বেশ বুঝলাম, যেকোনো মুহূর্তে মারা যেতে পারে বেচারা। গলায় ব্র্যান্ডি ঢালতে লাগলাম ক্রমাগত, প্রতি ঢোক গেলার সঙ্গেসঙ্গে একটু একটু করে ফিরে আসতে লাগল প্রাণশক্তি। সেইসঙ্গে স্যালাড অয়েলে তুলে ভিজিয়ে বিচিত্র ক্ষতস্থানে চেপে ধরায় যন্ত্রণাও কমে এল অনেকটা। শেষকালে বেদম হয়ে আচ্ছন্নের মতো পড়ে রইল সোফায়–অর্ধচৈতন্য অর্ধনিদ্রিত অবস্থায়।

এ-অবস্থায় প্রশ্ন করা সম্ভব নয়।

স্ট্যাকহার্স্ট আতঙ্ক বিকৃত কণ্ঠে বলল, হোেমস! হোমস! এ কী! এসব কী হচ্ছে!

এ-অবস্থায় একে পেলেন কোথায়?

জলের ধারে, ঠিক যে-জায়গায় দেখেছিলাম ম্যাকফারসনকে। আসবার পথেই মারা যেত যদি ম্যাকফারসনের মতো হার্টের রুগি হত। গেবলস পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারব না বলেই এখানে ঢুকে পড়লাম।

সমুদ্রের ধারে দেখলেন?

পাহাড়ের ওপর বেড়াচ্ছিলাম–এমন সময়ে শুনলাম চিৎকার। জলের ধারে পড়ে মাতালের মতো পাকসাট খাচ্ছিল। ছুটে গিয়ে জামাকাপড় জড়িয়ে টানতে টানতে নিয়ে এসেছি! হোমস! এ কী অভিশাপ লেগেছে এ জায়গায়! যা পারেন করুন! বাঁচান আমাদের।

করব। আসুন আমার সঙ্গে। ইনস্পেকটর, আপনিও আসুন। দেখি মার্ডারারকে তুলে দেওয়া যায় কি না আপনার হাতে।

হাউসকিপারের হেফাজতে অজ্ঞান মুরডককে রেখে তিনজনে গেলাম মৃত্যু-ভয়াল উপহ্রদে। জলে ক্ষয়ে যাওয়া নুড়ির ওপর তোয়ালে আর জামাকাপড়ের স্তুপ চোখে পড়ল। আহত মুরডক রেখে গেছে। জলের কিনারা বরাবর হাঁটতে লাগলাম আস্তে আস্তে, সার বেঁধে পেছন পেছন এল দুই সঙ্গী। বেশির ভাগ অঞ্চলই অগভীর–কেবল এক জায়গায় জল চার পাঁচ ফুটের মতো গভীর। জল এখানে ক্রিস্টালস্বচ্ছ–অদ্ভুত সুন্দর সবুজ রঙের সাঁতারুর পক্ষে লোভ সামলানো কঠিন। খাড়াই পাহাড়ের নীচের দিকে তাকের মতো বেরিয়ে থাকা পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগলাম জলের দিকে চোখ রেখে! জল যেখানে সবচেয়ে গভীর আর স্থির, সেখানে পৌঁছোতেই দেখতে পেলাম এতক্ষণ চোখ যা দেখতে চাইছিল। বিপুল উল্লাসে বললাম নিস্তব্ধ সৈকত কাঁপিয়ে, সায়ানিয়া! সায়ানিয়া! সিংহ কেশর সায়ানিয়া!

আঙুল তুলে বিচিত্র যে-বস্তুটার দিকে দুই সঙ্গীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম, বাস্তবিকই তা দেখতে সিংহের কেশর থেকে ছিঁড়ে আনা একতাল জটার মতো। ফুট তিনেক গভীরে জলের মধ্যে পাথুরে তাকের ওপর অদ্ভুত দর্শন লোমশ প্রাণীদেহটা স্পন্দিত হচ্ছে, দুলে দুলে উঠছে বিচিত্র ভঙ্গিমায় হলুদ বেণিগুচ্ছের মধ্যে দেখা যাচ্ছে রুপোলি আভাস! দুলছে, গুটিয়ে ছোটো হয়ে গিয়ে ফের বড়ো হয়ে যাচ্ছে নিয়মিত ছন্দে।

স্ট্যাকহার্স্ট, অনেক খুন করেছে এই শয়তান! এবার খেল খতমের পালা! হাত লাগাও!

হাতের কাছেই একটা বড়োসড়ো গোলমত পাথর ছিল। ঠেলাঠেলি করে ফেলে দিলাম জলের ওপর। প্রচণ্ড শব্দে ঝপাস করে জলে পড়ল লোমশ হত্যাকারীর ঠিক ওপরেই। জল স্থির হওয়ার পর দেখলাম নীচের তাকে গিয়ে আটকে গেছে পাথরটা। একদিকে উঁকি দিচ্ছে প্রাণীটার কম্পমান খুঁড়গুলো। তেলতেলে পুরু গাঁজলা পাথরের চারপাশ থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে ভেসে উঠছে জলের ওপরে।

অবাক হয়ে ইনস্পেকটর বললেন, মিস্টার হোমস, কী এটা? সাসেক্সে জন্মেছি আমি কিন্তু একে তো কখনো দেখিনি!

ঝড় এনে তুলেছে সাসেক্সে, বললাম আমি। চলুন, বাড়ি ফেরা যাক। সমুদ্রের আতঙ্কের সর্বশেষ শিকারের মুখেই শোনা যাক তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার লোমহর্ষক কাহিনি।

বাড়ি ফিরে দেখলাম মুরডকের জ্ঞান ফিরেছে, উঠে বসতে পারছে। তবে আচ্ছন্ন ভাবটা পুরোপুরি কাটেনি। যন্ত্রণার দমকে মাঝে মাঝে সমস্ত শরীরটাকে মোচড় দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ভাঙা ভাঙা কথায় যা বললে তা থেকে এইটুকুই বোঝা গেল যে কী যে হয়েছে তা সে নিজেই জানে না। আচম্বিতে সমস্ত শরীরের মধ্যে দিয়ে অনেকগুলো গরম শিক কুঁড়ে দেওয়ার মতো একটা ভয়াবহ যন্ত্রণায় সে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। কোনোরকমে তীরে এসে উঠেছিল।

চিলেকোঠা থেকে বার করা সেই কেতাবখানা তুলে নিয়ে বললাম, রহস্যভেদ করবে এই বই। নাম আউট অফ ডোরস লিখেছেন জে. জি. উড। উড নিজেই শেষ হয়ে যেতেন এই পিশাচ প্রাণীর খপ্পরে পড়ে আয়ু ছিল বলেই বেঁচে যান। এর পুরো নাম সায়ানিয়া ক্যাপিলাটা। কেউটে কামড়ালে যে-যন্ত্রণা, তার চাইতে বহুগুণ বেশি যন্ত্রণা-এর ছোবলে। জীবনহানির সম্ভাবনাও বেশি। একটু পড়ে শোনাছি, শুনুন।

চান করতে নেমে কেউ যদি সিংহের কেশর থেকে খামচে আনা একতাল পিঙ্গলবর্ণ চুল আর চামড়ার মতো কিছু দেখেন–যার ভেতরে রুপোলি আভাস–তাহলে যেন হুঁশিয়ার হন। নিরীহ দর্শন এই প্রাণীর হুল ফোঁটানোয় জীবন বেরিয়ে যেতে পারে। এর নাম সায়ানিয়া ক্যাপিলাটা। মূর্তিমান আতঙ্ক। এর চাইতে ভালো বর্ণনা কি আর সম্ভব?

মিস্টার উড কেন্টের উপকূলে সাঁতার কাটছিলেন। দেখলেন প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূর পর্যন্ত প্রায় অদৃশ্য শুড় বাড়িয়ে কিলবিল করছে সিংহ-কেশর সায়ানিয়া। অতদূর থেকেও শুড়ের ছোঁয়ায় উড প্রাণে মরতে বসেছিলেন। লিখেছেন, অসংখ্য সুতোর ছোঁয়ায় রক্তলাল দাগ ফুটে ওঠে চামড়ার ওপর। খুব কাছ থেকে দেখলে মনে হবে যেন সারি সারি ফুসকুড়ির লাইন–প্রত্যেকটা ফুসকুড়ি দিয়ে আগুনে তাতানো ছুঁচ ফুটিয়ে দেওয়া হয়েছে নার্ভের মধ্যে।

বলেছেন, হুল ফোঁটানোর জায়গায় যে-যন্ত্রণা, শরীরময় তীব্র যন্ত্রণার তুলনায় তা সামান্যই। বুকের মধ্যে যন্ত্রণার শলাকা গেঁথে যায় যেন যেন তপ্ত বুলেটে এফোঁড়-ওফোড় হয়ে যায় হৃৎপিণ্ড আছড়ে পড়েছিলাম হার্টের সেই অকথ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না-পেরে। হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যায়–তারপরেই এমনভাবে ছ-সাতবার সাংঘাতিকভাবে লাফিয়ে ওঠে। হৃৎপিণ্ড যেন বুকের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে বাইরে।

সিংহ-কেশরের দংশন ওঁকে ঘায়েল করেছিল সমুদ্রের উদবেল জলের মধ্যে স্নান করার শান্ত নিস্তরঙ্গ জলের মধ্যে নয়। লিখেছেন, পরে নিজেকে দেখে নিজেই চিনতে পারেননি এমন সাদা হয়ে গিয়েছিল মুখখানা অজস্র বলিরেখায় কুঁচকে ভাঁজ খেয়ে গিয়েছিল মুখের চামড়া। পুরো এক বোতল ব্র্যান্ডি ঢকঢক করে খেয়ে কোনোমতে প্রাণটাকে আটকে রেখেছিলেন দেহপিঞ্জরে। ইনস্পেকটর, এই সেই বই। রাখুন আপনার কাছে। ম্যাকফারসন বেচারা যে কী যন্ত্রণা পেয়ে মারা গেছে, তার নিখুঁত বর্ণনা পাবেন এর মধ্যে।

ক্লান্ত বিষণ্ণ হেসে আয়ান মুরডক বললে, সেইসঙ্গে বন্ধু হত্যার দায় থেকেও অব্যাহতি দিতে পারবেন আমাকে। আপনাদের কারোরই দোষ নেই ইনস্পেকটর। মিস্টার হোমস, আপনাকেও আমি দোষারোপ করছি না আমাকে সন্দেহ করার জন্যে! নিজেকে প্রায় মেরে এনেছিলাম একই পন্থায়–তাই আজ বেঁচে গেলাম ফাঁসির দড়ি থেকে।

হোমস বললে, কথাটা ঠিক নয়, মিস্টার মুরডক। আপনি যে নির্দোষ, আমি তা জেনেছিলাম। আর একটু আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লে এহেন ভয়াল অভিজ্ঞতার মধ্যেও আপনাকে পড়তে দিতাম না।

আপনি জেনেছিলেন? কীভাবে মিস্টার হোমস? কীভাবে?

রাজ্যের জ্ঞান সংগ্রহ করা আমার বাতিক। যা পাই, তাই পড়ি। স্মৃতির মন্দিরে ফেলনা জিনিসও জমিয়ে রাখি। জানেন তো যাকে রাখা যায়, সে-ই আপনাকে পরে রেখে দেয়। লায়নস মেন শব্দ দুটো সেই কারণেই প্রচণ্ড উৎপীড়ন সৃষ্টি করেছিল মাথার মধ্যে। কোথায় যেন পড়েছিলাম–পড়ব বলে পড়িনি–চোখে পড়ে গিয়েছিল কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। এখন শুনলেন তো কীভাবে জলচর আতঙ্কের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন মিস্টার উড। জলে নেমে তালগোল পাকানো লোমশ এই প্রাণীকেই দেখেছিলেন মিস্টার ম্যাকফারসন। তাই মরবার আগেও শরীরের শেষ শক্তিবিন্দু দিয়ে বোঝাতে চেয়েছে–হুঁশিয়ার করতে চেয়েছে–সাবধান! জলে নেমেমা না! সিংহ-কেশর ওত পেতে আছে সেখানে অসংখ্য শুড়ের হুল বাড়িয়ে।

অতি কষ্টে দাঁড়িয়ে মুরডক বললে, আমি তাহলে খালাস পেলাম সন্দেহের আওতা থেকে। আপনাদের তদন্ত কোন পথে যাচ্ছিল জানি বলেই দু-একটা ব্যাপার খোলসা করে যেতে চাই। মড বেলামিকে আমি ভালোবাসতাম ঠিকই, কিন্তু যেদিন জানলাম প্রিয় বন্ধু ম্যাকফারসনকে সে মন দিয়েছে, সেইদিন থেকেই মন প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে গেছি যাতে মড সুখী হয়। ওদের মধ্যে খবর দেওয়া নেওয়ার কাজ করেছি। সেই কারণেই ওদের সমস্ত গোপন কথা আমি জানতাম। ম্যাকফারসনের শোচনীয় মৃত্যুর খবরটা অন্য কেউ ফেনিয়ে অন্যরকমভাবে মড়কে জানিয়ে পাছে ওর মন ভেঙে দেয় তাই নিজে থেকেই গিয়েছিলাম ওকে সব কথা জানাতে। গিয়েছিলাম ওকে মন থেকে ভালোবাসি বলে। আমাদের মধ্যে সম্পর্ক কীরকম ছিল, মড আপনাকে বলেনি পাছে আপনারা ভুল ধারণা করেন, আর আমি অকারণ ভোগান্তির মধ্যে পড়ি। আর নয়। এবার যাই। একটু না-শুলেই নয়।

হাত বাড়িয়ে দিয়ে স্ট্যাকহাস্ট বললে, নার্ভের অবস্থা কারোরই ভালো ছিল না বলে যা ঘটে গেছে, তা ভুলে যেয়ো। মুরডক, ভবিষ্যতে যেন আমাদের মধ্যে মধুর সম্পর্ক বজায় থাকে। হাতে হাত দিয়ে বন্ধুর মতোই বেরিয়ে গেল দুজনে। বলদের মতো চোখ মেলে ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে ইনস্পেকটর বললেন, আবার কিস্তিমাৎ করলেন মিস্টার হোমস! অনেক সুনাম শুনছি আপনার–এবার দেখলাম নিজের চোখে! ওয়ান্ডারফুল! না-দেখলে বিশ্বাসই করতাম না!

এ-প্রশংসা হজম করা মানেই নিজেকে খাটো করা। তাই মাথা না-নেড়ে পারলাম না।

বললাম, প্রথম দিকে যাচ্ছেতাইভাবে দেরি করেছি। মৃতদেহ জলের মধ্যে পাওয়া গেলে এত দেরি হত না–সঙ্গেসঙ্গে ধরে ফেলতাম মৃত্যুর কারণ। তোয়ালেটাই বিপথে চালিয়েছে আমাকে। ম্যাকফারসন গা মোছবার কথাও ভাবেনি–ভঁজ করা শুকনো তোয়ালে দেখে আমিও তাই ভেবেছি ও বুঝেছি যে জলে ও নামেনি। তাই জলচর জীরের আক্রমণের সম্ভাবনাও মাথায় আসেনি। ভুল করেছি সেইখানেই। ইনস্পেকটর, পুলিশদের আমি বিদ্রপ করেছি বহুবার, এবার দেখছি খোদ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকেও এক হাত নিয়ে গেল সায়ানিয়া ক্যাপিলাটা।

———-

টীকা

সিংহকেশরের সংহার মূর্তি : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য লায়ন্স মেন ইংলন্ডে স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের ডিসেম্বর ১৯২৬ সংখ্যায় এবং আমেরিকার লিবার্টি পত্রিকার ২৭ নভেম্বর ১৯২৬ তারিখের সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৯২-এ ওয়েস্টমিনস্টার লাইব্রেরিজ এবং লন্ডনের শার্লক হোমস সোসাইটি এই গল্পটির পাণ্ডুলিপি সংস্করণ প্রকাশ করে।

একটা লোক : ইনি কি হিজ লাস্ট বাও গল্পে উল্লিখিত মার্থা? মিসেস হাডসন নিশ্চয়ই নন।

বারবেরি ওভারকোট : গ্যাবার্ডিন কাপড়ের আবিষ্কর্তা টমাস বারবেরির ডিজাইন করা, আজকালকার ট্রেঞ্চ-কোটের মতো লম্বা ওভারকোট।

চান করার কটেজের : স্নানের পোশাকে জনসমক্ষে আসা এড়াতে সেকালে বেশ কিছু মানুষ সমুদ্রে স্নান করতেন সবদিক ঢাকা চাকা লাগানো ঠেলাগাড়িতে বসে। গাড়ির ভেতর স্নানার্থীকে বসিয়ে ঠেলে নামিয়ে দেওয়া হত জলে। স্নান হলে ভেতরে থাকা স্নানার্থীর ইশারায় গাড়ি উঠিয়ে আনা হত এবং গাড়ি কোনো ঘরের ভেতরে নিয়ে এসে তাকে নামানোর ব্যবস্থা থাকত। এগুলির প্রচলিত নাম বেদিংকট। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পুরোেনো দিনে বহু হিন্দু পর্দানশিন মহিলাকে পালকি শুদ্ধ গঙ্গায় ড়ুবিয়ে আবার উঠিয়ে নিয়ে বেহারারা গঙ্গাস্নান করাতেন।

সত্যিই সুন্দরী : জুলিয়া সি, রোসেনব্লাট প্রশ্ন তুলেছিলেন, মড় বেলামির সৌন্দর্যে অভিভূত হয়েই কি শার্লক হোমস এই ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন?

জে. জি. উড : রেভারেন্ড জন জর্ড উড (১৮২৭-১৮৮৯) প্রকৃতিবিদ্যা এবং অন্যান্য নানা বিষয়ে প্রায় ষাটখানি গ্রন্থের রচয়িতা। নিজে বিজ্ঞানী বা দক্ষ সাহিত্যিক ছিলেন না, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল এই বইগুলি।

সায়ানিয়া ক্যাপিলাটা : ইংরেজি নাম লায়ন্সমেন জেলিফিশ, বঙ্গানুবাদে সিংহকেশর জেলিফিশ। এযাবৎ পাওয়া সর্ববৃহৎ প্রকারের জেলিফিশ। এর মাথা তিন ফুট পর্যন্ত চওড়া হয়ে থাকে, আর শুড় কখনো ত্রিশ ফুটও লম্বা হতে দেখা গিয়েছে।

স্মৃতির মন্দিরে ফ্যালনা জিনিসও জমিয়ে রাখি : আ স্টাডি ইন স্কারলেট উপন্যাসে হোমসকে বলতে শোনা যায় ফালতু জ্ঞান ব্রেন-কুঠরিতে ঢোকাতে নারাজ।… বাজে জিনিস ঠাসতে গিয়ে কাজের জিনিসগুলো মানুষ ভুলে যায় এই কারণেই…।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত