অ্যাডভেঞ্চার অফ দি ইলাসট্রিয়াস ক্লায়েন্ট

অ্যাডভেঞ্চার অফ দি ইলাসট্রিয়াস ক্লায়েন্ট

বিখ্যাত মক্কেলের বিচ্ছিরি বিপদ
[অ্যাডভেঞ্চার অফ দি ইলাসট্রিয়াস ক্লায়েন্ট]

বেশ কয়েক বছরের মধ্যে বার দশেক অনুমতি চেয়েছি শার্লক হোমসের কাছে নীচের এই আশ্চর্য অ্যাডভেঞ্চারের ইতিবৃত্ত লেখবার জন্যে। অনুমতি মিলল দশমবার খোশামোদের পর। বলল, লিখতে পারো, এখন কারো গায়ে লাগবে না।

টার্কিশ বাথ অর্থাৎ বাম্প-স্নান দারুণ ভালো লাগে আমার আর হোমসের। স্নানের পর গা শুকানোর ঘরে পাইপ টানবার সময়ে এমন একটা আমেজ আসে হোমসের মেজাজে তখন, অন্য সময়ের মতো অতটা অমানুষ আর মুখটেপা থাকতে পারে না। এইরকমই একটা দুর্বল মুহূর্তে নর্দামবারল্যান্ড অ্যাভিন্যুর একটা স্নানঘরের ওপরতলায় পাশাপাশি দুটো কোচে চাদর মুড়ি দিয়ে আয়েশ করে বসে থাকার সময়ে শুরু এই অত্যাশ্চর্য কাহিনির। তারিখটা সেপ্টেম্বরের তৃতীয় দিবস, সাল ১৯০২। গা ঢালা অবস্থায় বসে থেকে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম চাঞ্চল্যকর কোনো কেস হাতে আছে কি না। জবাবে কোটের পকেট থেকে একটা খাম টেনে নিয়ে চাদরের বাইরে লম্বা সরু হাতে বাড়িয়ে ধরল হোমস।

বলল, অদ্ভুত ব্যাপার। হয় জীবন মরণের প্রশ্ন, নয় আকাট বোকামি। চিঠিতে যা লেখা আছে, এর বেশি আর কিছুই জানি না।

চিঠি লেখা হয়েছে আগের সন্ধ্যায় কার্লটন ক্লাব থেকে।

মিস্টার শার্লক হোমসকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন স্যার চার্লস ড্যামারি। আগামীকাল বিকেল সাড়ে চারটায় আসছেন দেখা করতে। ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ–বলতেও কুণ্ঠাবোধ হচ্ছে। সেই কারণেই পরামর্শ দরকার মিস্টার হোমসের। তিনি যেন কার্লটন ক্লাবে টেলিফোন করে জানিয়ে দেন দেখা করতে রাজি আছেন।

হোমস বললে, রাজি আমি হয়েছি, ওয়াটসন। ফোনেও জানিয়ে দিয়েছি, ড্যামারি লোকটাকে চেনো?

নাম শুনেছি।

আমি আরও কিছু শুনেছি। যেসব কথা বাইরের লোককে বলা যায় না, সেইসব ব্যাপারে নাক না-গলিয়ে মিটমাট করিয়ে দিতে ইনি সিদ্ধহস্ত। হ্যামার ফোর্ড উইল মামলায় স্যার জর্জ লিউইসের সঙ্গে ইনি যে কথাবার্তা চালিয়েছেন, তা মনে রাখার মতো। সুতরাং ধরে নিতে পারি কেসটা বাজে নয়–ঠেকায় পড়েই উনি চিঠি লিখেছেন–আমাদের সাহায্য চাইছেন।

আমাদের বলছ কেন? চিঠি তো লিখেছেন তোমাকে?

ক্ষমাঘেন্না করে তুমিও থাকছ, নয় কি?

সে তো আমার পক্ষে সম্মানের ব্যাপার হে।

বেশ তো, সম্মানটা না হয় দেওয়াই গেল। সময়টা মনে থাকে যেন সাড়ে চারটে, তার আগে এ নিয়ে আর কথা নয়।

কুইন অ্যানি স্ট্রিটে আলাদা থাকতাম তখন। যথাসময়ে এলাম বেকার স্ট্রিটে হোমসের ডেরায়। কাঁটায় কাটায় সাড়ে চারটের সময়ে এলেন কর্নেল স্যার জেমস ড্যামারি। গম্ভীর মমালায়েম গলা। ফিটফাট পোশাক। পরিষ্কার কামানো গাল। সজ্জন ব্যক্তিত্ব। ধূসর আইরিশ চোখে অসীম সরলতা আর সুমিষ্ট ঠোঁটে নিঃসীম কৌতুকবোধ দেখবার মতো। টপহ্যাট থেকে ভার্নিশ করা জুতো পর্যন্ত সর্বত্র বনেদিয়ানার ছাপ, ঘর যেন আলো হয়ে উঠল তার আবির্ভাবে।

আমাকে দেখে বাতাসে মাথা ঠুকে অভিবাদন করে বললেন, ভালোই হল ডক্টর ওয়াটসনকে পেয়ে। যার সঙ্গে লাগতে যাচ্ছি তার মতো মারকুটে বিপজ্জনক লোক ইউরোপে আর দুটি নেই। কোনো কিছুতেই সে পেছপা নয়।

হাসল হোমস। বলল, পরলোকগত প্রফেসর মরিয়ার্টি অথবা এখনও জীবিত কর্নেল সিবাসটিয়ান মোরানের চাইতেও যদি বিপজ্জনক হয়, তাহলে একহাত নিতে পারলে খুশিই হব। সিগারেট খান? না! বেশ তাহলে আমি ধরাচ্ছি। নাম কী লোকটার?

ব্যারন গ্রানারের নাম শুনেছেন?

অস্ট্রিয়ার সেই মানুষখুনে?

হেসে ফেললেন কর্নেল ড্যামারি, ওয়ান্ডারফুল! কিছুই দেখছি চোখ এড়ায় না আপনার। লোকটাকে এর মধ্যেই খুনি ঠাউরে নিয়েছেন?

কোন মহাদেশে কী ধরনের অপরাধ ঘটছে, সব খবর রাখাটাই যে আমার কাজ কর্নেল। সপ্নজেন গিরিবক্সে দুর্ঘটনায় বউ মারা গেছে বললেই হল? ওভাবে আইনের চোখে ধুলো দেওয়া যেতে পারে। লন্ডনে যখন এসেছে রাসকেল, তখন আমার সঙ্গেও টক্কর লাগবে জানি। কিন্তু এসেছেন কেন? পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটতে?

আজ্ঞে না। নতুন ঘটনা ঘটাতে। মি. হোমস, ব্যাপারটা ভয়ানক, অত্যন্ত ভয়ানক। যে-মক্কেলের হয়ে এসেছি, তার স্বার্থ আপনাকে দেখতেই হবে।

আপনি যে কারো হয়ে এসেছেন বুঝিনি। আসল মক্কেলটি তাহলে কে?

মি. হোমস, নামটা জিজ্ঞেস করবেন না। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

তাহলে আমাকে মাপ করবেন। আমি একমুখো রহস্যের জট খুলতে অভ্যস্ত–দু-মুখো রহস্যের নয়।

মি. হোমস, এ যে শাঁখের করাতে ফেললেন আমাকে। নাম বলতে পারব না কথা দিয়ে এসেছি যে। বেশ তো, ঘটনাটা শুনতে কি আপত্তি আছে?

বলতে পারেন। কিন্তু আমি কোনো কথা দিচ্ছি না।

জেনারেল দ্য মারভিলের নাম শুনেছেন?

খাইবার পাস বিখ্যাত দ্য মারভিল?

হ্যাঁ। ওঁর মেয়ে ভায়োলেট দ্য মারভিল শয়তানটার খপ্পরে পড়েছে। অথচ মেয়েটি যেমন সুন্দরী, তেমনি মার্জিত। কম বয়স, হাতে পয়সা আছে, অপূর্ব মেয়ে বলতে যা বোঝায় তাই।

ভালোবেসে। জানেন তো এ-কবজায় পড়লে কোনো মেয়েই আর বেরোতে পারে না। লোকটা শুনেছি সাংঘাতিক সুন্দর। চালচলন চমকে দেওয়ার মতো, কথাবার্তা মধু ঝরানো। দারুণ রোম্যান্টিক ফিগার দেখলেই মেয়েরা ভালোবেসে ফেলে।

কিন্তু মিস ভায়োলেট দ্য মারভিলের মতো মেয়ের সান্নিধ্যে সে এল কী করে?

ভূমধ্যসাগরে জাহাজে বেড়ানোর সময়ে। দুজনের দেখা সেইখানেই, আলাপটা এমন ভালোবাসায় এসে ঠেকেছে যে বিয়ে হতে চলেছে সামনের মাসে। কিছুতেই টলানো যায়নি মিস মারভিলকে। ব্যারন ছাড়া ওর কাছে দুনিয়া এখন অন্ধকার।

ব্যারনের কুকীর্তি শোনবার পরেও?

ব্যারন নিজেই নিজের কুৎসা শুনিয়েছে মেয়েটিকে এমনভাবে শুনিয়েছে যেন সবই মিথ্যে অপবাদ। ফলে মেয়েটিকে কোনো কুৎসাকাহিনিই আর টলাতে পারছে না।

আপনি কিন্তু অজান্তে মক্কেলের নাম বলে ফেলেছেন, কর্নেল। জেনারেল দ্য মারভিলের হয়ে এসেছেন, তাই না?

আজ্ঞে না। জেনারেল এই ব্যাপারে এক্কেবারে ভেঙে পড়েছেন। আমি এসেছি এমন একজনের তরফে যিনি মেয়েটিকে ফ্ৰকপরা অবস্থা থেকে দেখে এসেছেন, নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন। কথা দিয়েছি, তার নাম ফাঁস করব না। মি. হোমস, দয়া করে পীড়াপিড়ি করবেন না।

বেশ, কথা দিলাম। কেসটাও হাতে নিলাম–বেশ ইন্টারেস্ট লাগছে। যোগাযোগ করব কীভাবে?

কার্লটন হোটেলে। খুব জরুরি দরকার থাকলে XX.31 এই প্রাইভেট নাম্বারে ফোন করবেন!

ব্যারনের ঠিকানা?

কেনসিটংনের ভারনন লজে। বেশ বড়ো বাড়ি। অবস্থাপন্ন লোক। সেই কারণেই আরও বেশি বিপজ্জনক।

এখন বাড়িতেই আছে তো?

আছে।

ব্যারন সম্বন্ধে আর কোনো খবর দিতে পারেন?

লোকটার রুচি আছে–দেদার টাকা ওড়ায় বই আর ছবি কিনতে। বদমাশ হলেও শিল্পী-সত্তা আছে। চৈনিক বাসন-কোসনের অনেক খবর রাখে। এই নিয়ে একটা বইও লিখেছে। হার্লিংটনে এক সময়ে পোলা খেলত। প্রাহার কেলেঙ্কারির জন্যে চলে আসে।

পৃথিবীর বড়ো বড়ো বদমাশরা এই ধরনেরই জটিল চরিত্রের অধিকারী হয়, কর্নেল। চার্লি পিস বেহালায় তুখোড় ছিল, ওয়েনরাইটমস্ত আর্টিস্ট ছিল। এবার পড়া যাক ব্যারন গ্রানারকে নিয়ে।

কর্নেল তো গেলেন, মুখ গোমড়া করে অনেকক্ষণ বসে রইল হোমস–আমার অস্তিত্বই যেন ভুলে গেল। তারপরেই আচমকা ফিরে এল চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তব জগতে।

ওয়াটসন, কী মনে হয় তোমার?

মেয়েটির সঙ্গে তোমার দেখা করা দরকার।

ভায়া ওয়াটসন, ভগ্নহৃদয় পিতৃদেব নিজে যেখানে ব্যর্থ, সেখানে আমার মতো উটকো লোক কিছু করতে পারবে? অন্যদিক থেকে চেষ্টা করতে হবে। শিনওয়েল জনসনকে দিয়ে কাজ হতে পারে।

হোমসের কর্মজীবনের শেষের দিকে আবির্ভাব ঘটেছিল এই শিনওয়েল জনসনের। সেই কারণেই তার সম্বন্ধে কোনো কথা আগের কাহিনিতে লেখা হয়নি। লোকটা মহা দুবৃত্ত। পার্কস্টে দু-বার জেল পর্যন্ত খেটেছে। তারপর অনুতাপের আগুনে পুড়ে পালটে যায় এবং হোমসের শাগরেদি করে এই শতাব্দীর প্রথম কয়েক বছরে। লন্ডনের সুবিশাল অপরাধী মহলের নাড়িনক্ষত্র তার নখদর্পণে। হোমসের এজেন্ট হিসেবে এনে দিত সেইসব খবরাখবর। পুলিশের তাঁবেদারি করলে কোনকালে কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যেত শিনওয়েলের। কিন্তু হোমসের কাছ থেকে কোনো খবর বেরোত না শিনওয়েলের স্যাঙাতরাও জানতে পারত না খবর চালান করেছে কে। দু-বার জেলখাটার ফলে দাগি আসামি হিসেবে শহরের সমস্ত খারাপ জায়গায় অবাধ গতিবিধি ছিল শিনওয়েলের। লোকটার ব্রেন ছিল, চোখ ছিল। ফলে যা দেখত ঝটপট তা থেকে খবর বার করে এনে উপহার দিত হোমসকে। শার্লক হোমস ঠিক করল এই শিনওয়েল জনসনকেই এবার কাজে লাগবে।

হাতে অন্য কাজ ছিল বলে হোমসের সঙ্গে লেগে থাকতে পারিনি–কী করল, কোথায় গেল সে-খবরও রাখিনি। দেখা হল সন্ধ্যায়—সিম্পসনে। রাস্তার দিকের জানলার ধারে ছোট্ট টেবিলে বসলাম দুই বন্ধু। স্ট্যান্ডের চলমান জলপ্রবাহের দিকে তাকিয়ে হোমস বললে সারাদিনের ঘটনা। জনসন বেরিয়ে পড়েছে খবরের খোঁজে। লন্ডনের চোরডাকাত মহলেই পাওয়া যাবে বদমাশটার গোপন কুকীর্তির যাবতীয় সংবাদ।

কিন্তু যে-মেয়ে কোনোরকম কুকীর্তি শুনেই টলেনি৷ সে তোমার জানা নতুন কুকীর্তি শুনে টলবে কি?

বলা যায় না। মেয়েদের মন বোঝা ভার। খুন-টুনকেও মানিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু ছোটোখাটো ব্যাপার মন বিষিয়ে দিতে পারে। ব্যারন গ্রানারই তো বলছিল—

বলছিল! তোমাকে!

লোকটার সঙ্গে মুখোমুখি বসে চোখাচোখি চেয়ে দেখতে চেয়েছিলাম দৌড় কতখানি। জনসনকে খবর আনতে পাঠিয়ে নিজেই গেছিলাম কেনসিংটনে। বেশ তোফা মুডে পেলাম ব্যারনকে।

চিনে ফেলেনি তো?

না ফেলার কোনো কারণ ছিল না–কেননা নিজের ভিজিটিং কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এ-লোকের সঙ্গে টক্কর দিয়েও সুখ। বরফের মতো ঠান্ডা মেজাজ, কথাবার্তা সিল্কের মতো মসৃণ, রীতিমতো ফ্যাশন দুরস্ত, কেউটের মতো বিষধর। উঁচু জাতের ক্রিমিনাল। অভিজাত অপরাধী। মুখে মধু ভেতরে ছুরি।

তোফা মুডে পেলে?

ইঁদুর দেখলে বেড়ালের মুড় যেরকম হয়–সেইরকম আর কি। কিছু লোক যখন মুড়ে থাকে, তখন তারা মারদাঙ্গা লোকদের চাইতেও বিপজ্জনক। আমাকে দেখেই মহা খাতির করে বললে, মিস্টার হোমস, আমি জানতাম আজ হোক কাল হোক আপনি আসবেনই। ভায়োলেটের সঙ্গে আমার বিয়েটা ভন্ডুল করার জন্যেই নিশ্চয় আপনাকে পাঠিয়েছেন জেনারেল দ্য মারভিল?

আমি বললাম, কথাটা ঠিক।

মশায়, মিছিমিছি সময় নষ্ট করছেন। এতদিনের সুনাম খোয়াবেন। দুর্নামের শেষ থাকবে না। মাঝখান থেকে বিপদ ডেকে আনবেন। আমার কথা শুনুন। এ-কেস ছেড়ে দিন।

আমি বললাম, মশায়, ঠিক ওই উপদেশটা আপনাকেও দিতে চাই। আপনার ব্রেনকে খাতির করি বলেই বলছি। এতদিনের নামডাক ধুলোয় লুটোবে যদি পত্রপাঠ সরে না-পড়েন। মেয়েটাকে ছাড়ুন। নইলে ইংলন্ডের এমন সব বাঘা বাঘা ব্রেন আপনার পেছনে লাগবে যে তিষ্ঠোতে পারবেন না! অতীতে অনেক কাণ্ড করেছেন—এখন যদি সেসব ভায়োলেটের কানে তোলা যায়, পরিণামটা সুখের হবে কি?

ব্যারনের নাকের নীচে পোকামাকড়ের কুঁড়ের মতো মোম মাখানো কয়েক গাছি গোঁফের চুল বিষম মজায় থিরথির করে কাঁপতে লাগল আমার কথায়। শেষকালে খুক খুক করে হেসেও ফেলল রাসকেলটা।

বলল, মিসটার হোমস, হাতে রঙের তাস একটাও নেই কিন্তু বেশ তড়পে যাচ্ছেন দেখছি। আমার হাতে কিন্তু তুরুপের তাস আছে–দরকার হলে দেখাতে দ্বিধা করব না।

ওই জেনেই বসে থাকুন।

বসেই তো আছি। মিস্টার হোমস, বহাল তবিয়তে আছি। আমার সব কুকীর্তিই ভায়োলেটকে বলেছি। সেইসঙ্গে বলে রেখেছি বেশ কিছু বদলোক সেইসব কাহিনি বলে মন ভাঙাতে আসতে পারে–আপনিও কিন্তু তাদের একজন মিস্টার হোমস। সম্মোহন করে যা হুকুম দেওয়া যায়, সম্মোহিত মানুষ সেই হুকুম হুবহু মেনে চলে২ জানেন তো? এক্ষেত্রে আমার ব্যক্তিত্ব দিয়ে সম্মোহন করেছি ভায়োলেটকে বলে রেখেছি মন ভাঙাতে যারা আসবে, তাদের যেন উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়। কাজেই আপনি স্বচ্ছন্দে দেখা করতে পারেন ভায়োলেটের সঙ্গে, সে দেখাও করবে–ফলটা হাতে হাতে পেয়ে যাবেন।

ওয়াটসন, এরপর আর কথা চলে না। মানে মানে সরে পড়াই ভালো। খুবই গম্ভীরভাবে দরজার হাতলে হাত রাখলাম দরজা খুলব বলে, এমন সময়ে ডাক এল পেছন থেকে।

মিস্টার হোমস, ফ্রেঞ্চ এজেন্ট লাবার্নের নাম শুনেছেন?

হ্যাঁ।

লাবার্নের পরিণামটা কী হয়েছিল জানেন?

মারের চোটে পঙ্গু হয়ে গেছে।

কী অদ্ভুত যোগাযোগ দেখুন, তার ঠিক আগেই সে ঘাঁটাতে এসেছিল আমাকে, আরও অনেকের একই হাল হয়েছে বেশি বাড়াবাড়ি করায়। মিস্টার হোমস, সরে পড়ুন, সরে পড়ুন, নিজের চরকায় তেল দিন।

ওয়াটসন, এই হল গিয়ে আজকের রিপোর্ট।

লোকটা বিপজ্জনক।

অত্যন্ত বিপজ্জনক। এ ধরনের লোকরা যা করে, বলে তার চাইতে কম।

তোমার নাক গলানো কি ঠিক হবে? ভায়োলেটকে ব্যারন বিয়ে করলে তোমার কী?

যেহেতু নিজের বউকে সে খুন করেছে, তাই ব্যাপারটা মোটেই তুচ্ছ নয়। ও-কথা থাক, ওয়াটসন। কফিটা শেষ করো, বাড়ি চলো। শিনওয়েল খবর নিয়ে আসছে ওখানে।

বেকার স্ট্রিটের ডেরায় গিয়ে দেখলাম শিনওয়েলকে। বিরাট লালমুখো ধ্যাবড়া চেহারা। গায়ে স্কার্ভি১৩ চর্মরোগের ছাপ। চোখ দুটোই যা কেবল রীতিমতো কালো আর চকচকে–অপরিসীম ধূর্ততা মাখানো। সঙ্গে এনেছে ছিপছিপে চেহারার অগ্নিশিখার মতো এক তরুণীকে। মুখে লাবণ্য, কিন্তু পাপবোধ আর অনুতাপে পুড়ে কালো। বহু বছরের দহন যেন কুষ্ঠরোগের কুৎসিত দাগ রেখে গিয়েছে সুন্দর মুখটিতে।

মিস্টার হোমস, ইনি মিস কিটি উইন্টার।

মিস্টার হোমস, সঙ্গেসঙ্গে বলে উঠল রূপসি, লন্ডন নরকে আমাকে খুঁজে বার করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। কিন্তু তার চাইতেও বড়ো নরকে একজনের ঠাঁই হোক। আপনি তার পেছনেই লেগেছেন শুনলাম।

আপনার ইচ্ছে যেন ফলে যায়, মৃদু হেসে বলল হোমস।

বিষম আবেগে সাদা মুখখানাকে আরও সাদা করে দু-হাতে বাতাসখানাকে ধরে তীব্র গলায় বললে রূপসি, যে-নরকে সে আমাকে নামিয়েছে, আমার মতো আরও অনেককে পাঠিয়েছে–আমি চাই তাকে তারও নীচে নামাতে। বলতে বলতে দু-চোখ ধকধক করে জ্বলতে লাগল মেয়েটার। মেয়েদের চোখে এ-আগুন বড় একটা দেখা যায় না।

জল কন্দুরে গড়িয়েছে শুনেছেন?

শিনওয়েল বলেছে। আর একটা আহাম্মক মেয়ে ফাঁদে পা দিয়েছে বিয়েটা বন্ধ করতে চান আপনি।

হ্যাঁ। মেয়েটা অন্ধের মতো ভালোবাসে ব্যারনকে। সব শুনেও কর্ণপাত করছে না।

বউকে খুন করার ঘটনাটা বলেছেন?

হ্যাঁ।

মেয়েটার সাহস তো কম নয়!

ওর মতে এ সবই মিথ্যে রটনা।

প্রমাণ তুলে ধরেছেন?

আপনি জোগাড় করতে পারবেন?

প্রমাণ তত আমি নিজে।

সামনে গিয়ে বলতে পারবেন?

কেন নয়?

ব্যারনের সব কুকীর্তি শোনার পর ভায়োলেট তাকে ক্ষমা করেছে। এ-প্রসঙ্গ নতুন করে আলোচনা নাও করতে পারে।

ওসব কথা আমিও শুনেছি। আপনারা যে খুনের কথা শুনেছেন। এ ছাড়াও অনেক খুন সে করেছে। সব কথাই আমাকে শুনিয়েছে। বলেছে, অমুক ঘটনার এক মাসের মধ্যেই অমুক লোকটা মারা যায়। আমি তখন পাগলের মতো ভালোবাসতাম। তাই কিছুই গ্রাহ্য করিনি যেসব এখন করছে ভায়োলেট। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার ভেতর পর্যন্ত নাড়া দিয়ে যায়। সেদিন মদ খেয়ে বেহুশ ছিল বলেই জিনিসটা আমাকে দেখিয়ে ফেলেছিল গ্রানার। একটা বাদামি চামড়া বাঁধানো বই–মলাটে ওর প্রতীক চিহ্ন আর তালা লাগানো।

কীসের বই?

পাপের বই। সারাজীবনে যত মেয়ের সর্বনাশ করেছে, তাদের প্রত্যেকের ছবি, নামধাম সমস্ত সেই বইতে আছে। লোকে যেমন প্রজাপতি আর মথপোকা সংগ্রহ করে, এই শয়তান তেমনি মেয়েমানুষ সংগ্রহ করে।

বইটা কোথায়?

এখন কোথায় তা বলতে পারব না। এক বছর হল আমাকে ছেড়ে দিয়েছে শয়তানটা। তবে প্রথমবার দেখেছিলাম ভেতরের পড়ার ঘরে পুরোনো আলমারির খুপরিতে। এখনও থাকতে পারে সেইখানেই লোকটা এমনিতে খুব গুছোনো জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখার অভ্যেস নেই।

বাড়িতে আমি গেছিলাম।

বলেন কী! আজ সকালেই কেস হাতে নিয়ে অনেকদ্দূর এগিয়ে গেছেন দেখছি। অ্যাদ্দিনে ঠিক লোকের পাল্লায় পড়েছে রাসকেল। ভেতরের পড়ার ঘরটা ছোটো–দরকারি কাগজ আর জিনিস থাকে।

চোরের ভয় নেই?

অ্যাডেলবার্ট আর যাই হোক, কাওয়ার্ড নয়। বাড়িতে লুকোনো ঘন্টা আছে–চোর ঢুকলেই বেজে ওঠে। চোর এসে দামি দামি বাসন-কোসন নেবে–কাগজ নিতে যাবে কেন?

হক কথা, সায় দিল শিনওয়েল।

হোমস বললে, মিস উইন্টার, আপনি কাল বিকেল পাঁচটায় আসুন এখানে। দেখি ভায়োলেটের সঙ্গে দেখা করানো যায় কি না। আমার মক্কেল কিন্তু আপনাকে মোটা পারিশ্রমিক দিতে রাজি।

টাকার জন্যে আমি আসিনি। যে-কাদায় আমি নেমেছি সেই কাদা পায়ে করে তার মুখে মাখাতে পারলেই আমার মেহনতের দাম আমি পাব।

পরের দিন স্ট্যান্ড রেস্তোরাঁয় ফের দেখা হল হোমসের সঙ্গে। রুক্ষ রসকষহীন কথায় যা বললে, তা এই :

ভায়োলেট সহজেই দেখা করতে চেয়েছিল। জেনারেলের ফোন পেয়ে ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময়ে মিস উইন্টারকে নিয়ে গাড়ি করে পৌঁছোলাম ১০৪ নম্বর বার্কলে স্কোয়ারে। পুরানো কেল্লাবাড়িজাঁকালো চেহারা–বিরাট গির্জেও সে তুলনায় কিছু নয়। হলদে পর্দা ঝোলানো বসবার ঘরে দেখা হল ভায়োলেটের সঙ্গে। শান্ত সংযত, বরফচূড়ার মতো! অনমনীয় এবং উদাসীন।

ওয়াটসন, মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী। সে-সৌন্দর্য ভাষায় বলবার নয়। পুরোনো তৈলচিত্রে এমনি রূপ আমি দেখেছি। এমন মেয়েকে কী করে যে ফাঁদে ফেলল ভেবে পেলাম না। তবে কি জানো, কার কোথায় মজে মন, কিবা হাড়ি কিবা ডোম কথাটা যুগে যুগে সত্যি হয়েছে।

শয়তান ব্যারন যে আগে থেকেই ভায়োলেটের মন বিষিয়ে তুলেছে, তা বুঝলাম আমাদের অভ্যর্থনার ধরন থেকেই। কুষ্ঠরোগীদের যেন চেয়ারে বসতে বলছে গির্জের পুরুষ–অনেকটা এইরকম ভাব দেখাল মেয়েটা।

তারপর বলল বরফঠান্ডা গলায়, আপনার নাম আমি শুনেছি। আপনি এসেছেন ভাঙচি দিতে, আমি যাকে ভালোবাসি তার নিন্দে করে বিয়েটা ভাঙাতে। বাবা বলেছেন বলেই দেখা করছি মনে রাখবেন। কিন্তু নিন্দে করে লাভ কিছু হবে না।

ওয়াটসন, দুঃখ হল মেয়েটার জন্য; সেই মুহূর্তে তাকে আমি আমার নিজের মেয়ের মতোই দেখেছিলাম। বুঝিয়েওছিলাম। তুমি তো জান আমি মাথার যুক্তিতে চলি—হৃদয়াবেগে নয়। সব সময়ে গুছিয়ে কথা বলতেও পারি না। কিন্তু সেসময়ে যতরকমভাবে বোঝানো যায়, বুঝিয়েছিলাম। তবুও মুখে রং ফোঁটাতে পারিনি। ধ্যানস্থ চোখে আবেগের আলো জাগাতে পারিনি। সত্যিই যেন ব্যারনের সম্মোহনের প্রভাবে আচ্ছন্ন মেয়েটা যেন মর্তে থেকেও স্বর্গস্বপ্নে মশগুল।

শেষকালে বললে, মিস্টার হোমস, আপনি ভাড়াটে এজেন্ট। আমার মন ভাঙাতে এসেছেন–টাকা খেলে ব্যারনের হয়েও অন্যের মন ভাঙাতে পা বাড়াবেন। কাজেই আমার মন আপনি ভাঙাতে পারবেন না। আপনাদের কথা জানলার ওই চড়ুইদের কিচিরমিচিরের শামিল আমার কাছে। ব্যারন মহৎ। অতীতে যদি তার পদস্থলন হয়েই থাকে, আমি এসেছি তাকে মহত্তর জীবনে নিয়ে যেতে। ইনি কে? বলে ফিরে তাকাল মিস উইন্টারের দিকে।

আমি কথা বলার আগেই ঘূর্ণি বাতাসের মতো ভেঙে পড়ল মিস উইন্টার। বরফ আর আগুন মুখোমুখি কখনো দেখেছ? আমি দেখলাম সেই মুহূর্তে।

তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে ভীষণ আবেগে চোখ-মুখ বিকৃত করে বললে মিস উইন্টার উজবুক মেয়ে কোথাকার। এখনও বুঝছেন না কোন নরকে আপনাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে শয়তান ব্যারন। আমার যা দশা হয়েছে, অনেকের সে-হাল হয়েছে আপনারও তাই হবে–তার চাইতেও বেশি হবে। আমিও তাকে ভালোবাসতাম। এখন তাকে ঘৃণা করি। আমার মতোই একদিন সে আপনার হয় বুক নয় ঘাড় ভাঙবে।

ঠান্ডা গলায় বললে মিস দ্য মারভিল, এসব অবান্তর প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। আমি জানি অতীতে মতলববাজ তিনটে মেয়ের পাল্লায় পড়েছিল ব্যারন।

তিনটে মেয়ে! বলছেন কী আপনি! আপনার মতো নিরেট বোকা আমি আর দেখিনি!

মিস্টার হোমস, বাবার কথায় আপনার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছি, এই জীবটির হাত পা ছোড়া দেখতে নয়। আজ এখানেই থাক।

আমি চেপে না-ধরলে মিস উইন্টার রাগে ফুলতে ফুলতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত মিস দ্য মারভিলের ওপর। কোনোরকমে টেনে হিচড়েনিয়ে গিয়ে তুললাম ছ্যাকড়াগাড়িতে। একটা পাবলিক কেলেঙ্কারি এড়ানো গেল। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, আমারও মেজাজ ঠিক ছিল না। মিস দ্য মারভিলের নির্বিকার মুখচ্ছবি আর বরফ ঠান্ডা মেজাজে কারো মেজাজ ঠিক থাকতে পারে না। যাকে বাঁচাতে চাই, তার এই ব্যবহার অসহ্য। এ-পথে হবেনা, ওয়াটসন। অন্য দাওয়াই দিতে হবে। তোমাকেও দরকার হতে পারে। তবে এবার ওরাই হয়তো দাওয়াই ছাড়বে আমার ওপর।

ঘটলও তাই! তবে সে-দাওয়াই শুধু সেই রাসকেলের–এর মধ্যে ভায়েলেটকে টেনে আনতে মন সায় দিচ্ছে না। দু-দিন পরে রাস্তায় থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম দেয়ালে লটকানো একটা খবরের কাগজের শিরোনাম দেখে :

শার্লক হোমসকে খুনের চেষ্টা

কিছুক্ষণ সম্বিৎ ছিল না হলদে কাগজের ওপর কালো হরফে ছাপা ভয়ংকর সংবাদটা পড়বার পর। তারপর হকারের কাছ থেকে একটা কাগজ ছিনিয়ে নিয়ে একটা দোকানের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে চক্ষের নিমেষে পড়ে ফেললাম শার্লক হোমসকে ধরাধাম থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল কীভাবে :

সুবিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ শার্লক হোমসের প্রাণ নিয়ে টানাটানি চলেছে আজ সকালে তার ওপর হত্যাকারী চড়াও হওয়ার পর থেকে। বিস্তারিত বিবরণ এখনও পাওয়া যায়নি! ঘটনার সুত্রপাত সম্ভবত বেলা বারোটার সময় কাফে রয়ালের সামনে রিজেন্ট স্ট্রিটের ওপর। দুজন হানাদার লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিটোয় শার্লক হোমসকে। মাথা এবং দেহের ক্ষত দেখে ডাক্তার বলেছেন অবস্থা ভালো নয়। হাসপাতাল থেকে তাঁকে বেকার স্ট্রিটের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাঁরই জেদে। যারা পিটিয়েছে, বেশভূষায় তারা রীতিমতো ভদ্রলোক।

কাগজ পড়েই ছুটলাম বেকার স্ট্রিটে। গাড়ি থেকে নেমেই দেখলাম বাইরে দাঁড়িয়ে একটা ব্রহাম গাড়ি, ভেতরে সুবিখ্যাত সার্জন স্যার লেসলি ওকশট। আমাকে বললেন, এখুনি কোনো বিপদ ঘটবে না। মাথায় দুটো বড় রকমের চোট লেগেছে সারা গা ঘেঁতলে গেছে। বেশ কয়েকটা সেলাই দরকার হল সেইজন্যেই। মরফিন দিয়েছে একটু শান্তিতে থাকা দরকার। তবে মিনিট কয়েক দেখা করা যেতে পারে।

প্রায়ান্ধকার ঘরে ঢুকে দেখলাম খড়খড়ি নামাননা জানলার ফাঁক দিয়ে সামান্য একটু রোদ আসছে। মাথায় রক্ত ছুঁয়ে-বেরিয়ে-আসা ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় বিছানায় এলিয়ে রয়েছে হোমস! আমাকে দেখেই ভাঙা-ভাঙা গলায় বললে, ভালোই আছি, ওয়াটসন। ঘাবড়ে যেয়ো না।

ভগবান বাঁচিয়েছেন!

জানই তো আমি নিজেও লেঠেল। একজনকে সামাল দিয়েছিলাম–আরেকজনকে পারলাম।

সেই রাসকেলের কাজ। এখুনি যাচ্ছি–ছাল ছাড়িয়ে নিচ্ছি।

খবরদার, ওটি কোরো না! আমার প্ল্যানটা শোনো, ওরা তোমার কাছেই আসবে আমার অবস্থা কীরকম জানতে। বাড়িয়ে বলবে। মাথায় চোট–প্রলাপ–তুমিই ভালো পারবে।

কিন্তু স্যার লেসলি ওকশট তো আসল কথা বলে দেবেন।

ওঁকে সামলানোর ভার আমার।

আর কিছু?

শিনওয়েলকে বল মিস উইন্টারকে এখুনি সরিয়ে নিয়ে যেতে। এভাবে যারা পথের কাঁটা সরায়, আমাকে খুন করতে চেষ্টা করে তারা ও-মেয়েকে ছাড়বে না। আজ রাতের মধ্যেই মেয়েটাকে সরিয়ে ফেলা দরকার।

এখুনি যাচ্ছি। আর কিছু?

পাইপ আর তামাক টেবিলে রেখে যাও। রোজ সকালে একবার এসো–ফন্দি আঁটা যাবে।

জনসনকে দিয়ে সেই রাতেই মিস উইন্টারকে শহরতলিতে চালান করে দিলাম–বিপদ–কাটা পর্যন্ত গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে বললাম।

এর পরের ছ-দিন জনসাধারণ জানল, শার্লক হোমসের অবস্থা অতীব শোচনীয়। যমে মানুষে টানাটানি চলছে। বুলেটিন আর খবরের কাগজে বেরোতে লাগল অতি যাচ্ছেতাই সংবাদ। আমি কিন্তু রোজ যেতাম বলেই জানতাম অবস্থা তার সে-রকম নয় মোটেই। দ্রুত সেরে উঠছে। বরং সন্দেহ হত, আমার কাছেও যেন দ্রুত সেরে ওঠার খবর চেপে যাচ্ছে। ওর মনের জোর আর লৌহ কাঠামোর দৌলতে ভেতরে ভেতরে ফিরে আসছে লুপ্ত শক্তি। কিন্তু নিকটতম বন্ধুর কাছেও চেপে যাচ্ছে, এরপর ওর প্ল্যান কী। যে চক্রান্তকারী একা-একা চক্রান্ত করে কারো সাহায্য নেয় না–সেরা চক্রী সে-ই–এই আপ্তবাক্য অনুসারে ও কাউকেই মনের মধ্যে টেনে আনে না। কাছে থেকেও তাই বুঝতাম বেশ দূরে আছি আমি।

সপ্তম দিনে সেলাই খোলা হলেও কাগজে বেরোল মৃগীরোগে পুঁকছে হোমস। সেইদিনই একটা খবর পেয়ে অসুস্থ বন্ধুবরকে না-জানিয়ে পারলাম না। রুরিটানিয়া জাহাজে ব্যারন অ্যাডেলবার্ট গ্রানার লিভারপুল থেকে সামনের শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র রওনা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে বিয়েটা হবে তারপর। গুম হয়ে খবরটা শুনে গেল হোমস বুঝলাম নড়বড় করে

উঠেছে ভেতরটা।

বললে চাপা গলায়, রাসকেল কোথাকার! পালিয়ে বাঁচতে চায়! আর মাত্র তিন দিন! ওয়াটসন, পালাতে ওকে দোব না। একটা কাজ করতে পারবে?

সেইজন্যেই তো এসেছি।

তাহলে সামনের চব্বিশ ঘণ্টা চীনেমাটির বাসন-কোসন নিয়ে বেশ কিছু পড়াশুনো করো।

এর বেশি হোমস একটা কথাও বলল না, আমিও জিজ্ঞেস করলাম না। সোজা গেলাম লন্ডন লাইব্রেরিতে১৬। একগাদা বই আগলে ফিরলাম বাড়ি।

সারাসন্ধে, গভীর রাত পর্যন্ত, পরের দিন সকালেও শুধু জিরোনোনার সময় ছাড়া একটানা পড়ে গেলাম বইয়ের পর বই। চৈনিক পটারি সম্বন্ধে এত খবর সংগ্রহ করলাম যে বলবার নয়। হাং-ও১৭, আং-লো৮, তাং-ইং১৯, সাং২০ আর উয়াংদের আশ্চর্য, রহস্যময়, বিস্ময়কর, গৌরবময় কীর্তিকলাপ মাস তারিখ সমেত মুখস্থ করে ফেলে পরের দিন সন্ধে নাগাদ বেকার স্ট্রিটে গিয়ে দেখলাম মাথায় পেল্লায় ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় গালে হাত দিয়ে আর্মচেয়ারে বসে রয়েছে শার্লক হোমস।

বললাম, ভায়া, লোকে কিন্তু জানে তুমি মরতে বসেছ।

সেইরকম জানাতেই তো চাই। পড়া হয়েছে?

চেষ্টা করেছি।

এ-প্রসঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারবে?

পারব।

তাহলে ম্যান্টলপিস থেকে ওই কৌটোটা পেড়ে দাও।

ঢাকনা খুলে সূক্ষ্ম মসলিনে মোড়া একটা ভারি সুন্দর লাল-নীল রঙের প্লেট বার করল হোমস।

ওয়াটসন, মিং রাজবংশের২২ আসল ডিমের খোলার বাসন এটি। পিকিংয়ের রাজপ্রাসাদের বাইরে পুরো সেটটা আজও বেরিয়েছে কি না সন্দেহ। যেকোনো সমঝদার এ-জিনিসের জন্যে রাজত্ব বিলিয়ে দিতেও রাজি।

এ নিয়ে আমি কী করব?

ডক্টর হিল বার্টন, ৩৬৯ হাফমুন স্ট্রিট ঠিকানা ছাপানো একটা কার্ড আমার হাতে দিয়ে হোমস বললে, এই হল তোমার ছদ্মনামী ঠিকানা। তুমি ডাক্তার বলেই ডাক্তারের ভূমিকা অভিনয় করতে হবে। সাড়ে আটটা নাগাদ ব্যারনের সঙ্গে দেখা করবে। আগেই জানিয়ে আসবে মিং চায়নার একটা নমুনা তোমার হাতে দৈবাৎ এসে গেছে–সমঝদারের হাতে তুলে দিতে চাও। তুমি নিজেও একজন সংগ্রাহক।

কী দামে? চমৎকার প্রশ্ন করেছ, ওয়াটসন। এ জিনিসের দাম জানা না-থাকলে বোকা বনে যাবে। জিনিসটা জোগাড় করেছি স্যার জেমসের কাছ থেকে। তুমি বলবে এর জুড়ি নেই পৃথিবীতে–

বলব যেকোনো বিশেষজ্ঞকে দিয়ে দাম ঠিক করাই সংগত।

চমৎকার! চমৎকার!! দারুণ বুদ্ধির ঝিলিক দেখাচ্ছ আজ! সোদবি-র ক্রিস্টির নাম করবে। নিজে দাম হাঁকতে চাইবে না।

কিন্তু যদি দেখা না করে?

দেখা করবেই। চীনেমাটির বাসন সংগ্রহের দারুণ বাতিক আছে বলেই দেখা করবে। এ-ব্যাপারে ও নিজেও একজন বিশারদ। বোসসা। চিঠিখানা বলছি, লিখে নাও। জবাব দরকার নেই। শুধু জানাবে–তুমি আসছ এবং কেন আসছ।

লোক মারফত ছোট্ট কিন্তু কৌতূহল জাগানো পত্র পাঠিয়ে দিলাম। তারপর ডক্টর হিলবার্টনের কার্ড পকেটে নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করতে রওনা হলাম।

ব্যারনের বাড়ি তো নয়–পেল্লায় প্রাসাদ। আফ্রিকায় সোনা খুঁজে পেয়ে আঙুল-ফুলে কলাগাছ এক ভদ্রলোক বিরাট জমির ওপর তৈরি করেছিলেন আশ্চর্য এই ইমারত।

ব্যারন দাঁড়িয়ে ছিল দুই জানলার মাঝে রাখা চৈনিক বাসন বোঝাই আলমারির সামনে। আমি ঘরে ঢুকতেই হাতে একটা বাদামি ফুলদানি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

বসুন। আমার নিজের জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। এই যে তার নমুনাটা দেখছেন। এর সৃষ্টি সপ্তম শতাব্দীতে। এমন পালিশ কখনো দেখেছেন? মিং প্লেটটা এনেছেন?

সন্তর্পণে মোড়ক খুলে এগিয়ে দিলাম ঠুনকো বস্তুটা। ল্যাম্প টেনে নিয়ে টেবিলে বসে তন্ময় হয়ে দেখতে লাগল গ্রানার সেই ফাঁকে ল্যাম্পের হলদে আলোয় আমি দেখলাম ওর মুখ।

সত্যিই সুশ্রী চেহারা। দেখলেই মেয়েদের পছন্দ হয় এই কারণেই। বিশেষ করে কুচকুচে কালো চোখের আকর্ষণ এড়ানো বড়ো সহজ নয়। চুল আর গোঁফও দাঁড়কাকের পালকের মতো মিশমিশে, কালো গোঁফ ছুঁচোলো–মোম দিয়ে পাকানো।

ঠোঁট পাতলা–প্রীতিকর মুখের মধ্যে ওই একটি জায়গাতে কেবল খুনি অন্তরের ছাপ ফুটে বেরিয়েছে–ভয়ংকর, নির্মম, কঠিন। কথাবার্তা মোলায়েম–মন ভুলানো। গোঁফ জোড়াই কেবল বিপদ সংকেতের মতো উঁচিয়ে আছে কাটা দাগের মতো মুখবিবরের ঠিক ওপরে। বয়স মনে হয়েছিল তিরিশ–পরে শুনলাম বিয়াল্লিশ।

চমৎকার–সত্যিই চমৎকার! আপনি বলছেন আরও ছ-টা প্লেট আছে আপনার কাছে। গোলমাল লাগছে কেবল এই একটা ব্যাপারে। আমি জানি এ-জিনিস একটাই আছে ইংলন্ডে একজনের কাছে। এতগুলো যে পাওয়া যাচ্ছে, আগে কখনো শুনিনি। আপনি পেলেন কোত্থেকে?

জিনিসটা খাঁটি। বিশেষজ্ঞ দিয়ে যাচাই করেও নিতে পারেন। কোত্থেকে পেয়েছি জেনে কী করবেন?

কালো চোখে সন্দেহের বিদ্যুৎ ঝলকিয়ে ব্যারন বললে, ভারি রহস্যজনক ব্যাপার দেখছি। জিনিসটা খাঁটি সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনার বিক্রি করার আদৌ কোনো অধিকার আছে কি না জানা দরকার তো।

সে-দায়িত্ব আমার… গ্যারান্টি দিচ্ছি আর কেউ এসে নিজের বলে দাবি করবে না।

কী ধরনের গ্যারান্টি?

ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি।

তা সত্ত্বেও পুরো ব্যাপারটাই গোলমেলে লাগছে।

নেওয়া না-নেওয়া আপনার ইচ্ছে। আপনি সমঝদার শুনেই এসেছি–না নেন অন্যত্র যাব।

আমি সমঝদার আপনাকে কে বলল?

একটা বই লিখেছেন এ-ব্যাপারে।

আপনি পড়েছেন?

না।

রহস্য আরও বাড়ল। যে-বই পড়লে এ-জিনিসের মর্ম বুঝতেন, সেই বইখানা না-পড়েই এ-জিনিস আপনি সংগ্রহ করেছেন?

আমি ডাক্তার মানুষ ভীষণ ব্যস্ত।

ওটা জবাব হল না। শখের খাতিরে মানুষ সব করে জীবিকা যাই হোক না কেন। আপনি নিজে সমঝদার চিঠিতে লিখেছেন।

তা তো বটেই।

তাহলে আপনার বিদ্যেবুদ্ধির দৌড় একটু যাচাই করা যাক। ডাক্তার জানি না আপনি সত্যিই ডাক্তার কিনা–বলুন তো সম্রাট শোমু২৩ সম্বন্ধে কী জানেন? নারা২৪-র শোশোর সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? ভড়কে গেলেন দেখছি! উঙ্গ রাজবংশ সম্বন্ধে কিছু জানেন? চৈনিক বাসন-কোসনের সঙ্গে তাঁদের কী সম্পর্ক জানেন?

রেগেমেগে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম আমি।

অসহ্য! আমি এসেছি আপনার উপকার করতে পরীক্ষা দিতে নয়। এ-ব্যাপারে আমার জ্ঞান আপনার চেয়ে কম সন্দেহ নেই কিন্তু আপনার কোনো প্রশ্নের জবাব আমি দেব না।

পলকহীন চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল ব্যারন। চাউনিতে আর কৌতুক নেই–আগুন ঝলসাচ্ছে। হঠাৎ নিষ্ঠুর চাপা দুই ঠোঁটের আড়ালে ঝিলিক দিল সাদা দাঁতের মাড়ি।

স্পাই কোথাকার! হোমসের গুপ্তচর! নিজে মরতে বসেছে, তাই স্পাই পাঠিয়ে আমার সঙ্গে চালাকি হচ্ছে! ঢুকেছেন যত সহজে বেরোনো কিন্তু তত সহজ হবে না।

বলেই লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল গ্রানার। আমিও ছিটকে গেলাম পেছনে। গোড়া থেকেই আমাকে সন্দেহ করেছে বলেই এত জেরা করে এসেছে। এখন পাগলের মতো হাতড়াতে লাগল। ড্রয়ারের ভেতরে। আচমকা স্তব্ধ হয়ে কান খাড়া করে কী যেন শুনতে লাগল।

পরমুহূর্তেই অস্ফুট শব্দে চেঁচিয়ে তিরবেগে ধেয়ে গেল পেছনের ঘরে।

চক্ষের পলকে আমিও পৌঁছোলাম দোরগোড়ায়। দেখলাম বাগানের দিকে খোলা জানলার সামনে অপচ্ছায়ার মতো মাথায় রক্তমাখা ব্যান্ডেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে শার্লক হোমস। নীরক্ত মুখে জানলা দিয়ে বেগে ছিটকে গেল ওর বিকট ভূতের মতো দীর্ঘ শীর্ণ মূর্তি নীচের লরেল ঝোপে আছড়ে পড়ল হুড়মুড় করে। ব্যারন গ্রানারও রাগে হুংকার ছেড়ে ধেয়ে গেল জানলার দিকে।

তারপরের ঘটনাটা ঘটল চোখের পলক ফেলবার আগেই। স্পষ্ট দেখলাম একটা নারী-হস্ত বেরিয়ে এল পাতার আড়াল থেকে। পরমুহূর্তেই বীভৎস চিৎকার ছেড়ে দু-হাতে মুখ খামচে ধরে পাগলের মতো ঘরময় ছুটতে ছুটতে দেওয়ালে মাথা ঠুকতে ঠুকতে মেঝের ওপর পড়ে বিষম যন্ত্রণায় চেঁচাতে লাগল ব্যারন।

জল! জল! জল!

পাশের টেবিল থেকে কাচের কুঁজো ভরতি জল নিয়ে দৌড়ে গেলাম। ততক্ষণে দুজন চাকর দৌড়ে এসেছে ঘরের মধ্যে। একজন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল ব্যারনের মুখখানা ল্যাম্পের দিকে আমি ঘুরিয়ে ধরতেই। একটু আগেই যে-মুখ দেখে আমি তারিফ করেছি, সে-মুখ এখন বীভৎস, কদাকার। অমানবিক, বর্ণবিহীন আর্টিস্ট যেন ছবির ওপর দিয়ে ভিজে স্পঞ্জ বুলিয়ে এইমাত্র ধেবড়ে দিয়ে গেল সুন্দর মুখখানা। তরল অ্যাসিড তখনও গড়িয়ে পড়ছে কান আর চিবুক বেয়ে। মুখের সর্বত্র প্রবেশ করছে ভয়ংকর অ্যাসিড। একটা চোখ সাদা হয়ে এসেছে–আর একটা চোখ লাল হয়ে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে।

কিটি উইন্টার! কিটি উইন্টার! আমার সর্বনাশ করে গেল শয়তানি কিটি উইন্টার! উঃ বড়ো যন্ত্রণা… আর সইতে পারছি না… বড়ো যন্ত্রণা!

জানলা গলে বৃষ্টি ঝরা অন্ধকার বাগানে লাফিয়ে পড়ল চাকরবাকর। আমি মুখে তেল মাখিয়ে কাঁচা মাংসের ওপর তুলো লেপে দিলাম, মরফিন ইঞ্জেকশন দিলাম। আমার ওপর থেকে সব সন্দেহ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে পাগলের মতো দু-হাতে আমাকে খামচে রইল গ্রানার–মরা মাছের মতো চোখ মেলে চেয়ে রইল এমনভাবে যেন ও-চোখের দৃষ্টিও ফিরিয়ে দিতে পারি আমি। কদাকার সেই মুখ দেখে কেঁদেই ফেলতাম যদি-না—শয়তানটার পুরোনো পাপ কাহিনি মনের মধ্যে ভিড় করে আসত। বাড়ির ডাক্তার এসে যেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সেইসঙ্গে এল পুলিশ। আমার আসল কার্ড তাদের হাতে দিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম বেকার স্ট্রিটে।

শ্রান্ত-ক্লান্ত ফ্যাকাশে মুখে চেয়ারে বসে ছিল হোমস। এমনিতেই জখম দেহ। তার ওপর একটু আগের ওই ভয়াবহ ঘটনা প্রচণ্ড শক পেয়েছে দেখলাম। আমার মুখে সভয়ে শুনল কী ভয়ংকরভাবে পালটে গিয়েছে ব্যারনের মুখের চেহারা।

বলল, পাপের সাজা এইভাবেই পেতে হয়, ওয়াটসন। টেবিল থেকে একটা বই তুলে নিয়ে এই সেই বই যার দৌলতে বিয়ের দফারফা করে ছাড়ব–মিস উইন্টার এই বইটার কথাই বলছিল। যে-মেয়ের ভেতরে এতটুকু আত্মসম্মান আছে, এই বই পড়বার পর সে আর ব্যারনকে স্বামী বলে কল্পনাও করতে পারবে না।

ব্যারনের প্রেমের ডাইরি?

প্রেমের নয় ওয়াটসন, কামের ডাইরি। মিস উইন্টারের কাছে ডাইরির কথা শুনেই বুঝেছিলাম এই সেই মোক্ষম অস্ত্র যা দিয়ে বিয়ে ভাঙা সম্ভব হবে। কী করব ভেবেও নিয়েছিলাম কিন্তু মেয়েটাকে বলিনি পাছে ফাঁস করে দেয়। তারপরেই আমার এই অবস্থা করে গেল ব্যারনের লোক। ভালোই হল। আমি শয্যাশায়ী মুমূর্ষু জেনে আমার দিকে নজর দেওয়া ছেড়ে দিল ও। আমি তক্কে তক্কে রইলাম। আরও দিনকয়েক সবুর করতাম। কিন্তু রাসকেলটা আমেরিকা যাচ্ছে শুনে আর দেরি করতে পারলাম না। এ-রকম একটা মূল্যবান দলিল ফেলে রেখে যাবার পাত্র সে নয়–সঙ্গে নেবেই। তাই তৎক্ষণাৎ চড়াও হওয়ার প্ল্যান করলাম। তোমাকে চাইনিজ পটারি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করিয়ে দিয়ে নীল পিরিচ সমেত পাঠালাম। হাতে সময় খুবই কম পাব জানতাম–অল্প বিদ্যার ফলে পটারি প্রসঙ্গ নিয়ে কতক্ষণই-বা আর আটকে রাখতে পারবে। ব্যারনকে ওর মধ্যেই যাতে ডাইরি উদ্ধার করতে পারি, তাই সঙ্গে নিলাম মিস উইন্টারকে। কিন্তু ও যে আমার কাজ করতেই শুধু যাচ্ছে না–নিজের কাজ সারতেও যাচ্ছে তা বুঝিনি। পোশাকের তলায় ছোট্ট প্যাকেটটা কেন অত সযত্নে নিয়ে যাচ্ছে একদম মাথায় আসেনি।

ব্যারন কিন্তু আঁচ করে নিয়েছিল যে তুমিই আমাকে পাঠিয়েছ।

আমি জানতাম ও করবেই। ডাইরিটা পকেটস্থ করার সময়টুকুই কেবল দিয়েছিলে তুমি–আর একটু সময় পেলে কাকপক্ষীও টের পেত না-লম্বা দিতাম। এই যে স্যার জেমস, আসুন!

সান্ধ্য অ্যাডভেঞ্চার শোনবার পর ভদ্রলোক উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, চমৎকার! মুখের চেহারা যদি ওইরকম হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে এই ডাইরি না-দেখলেও বিয়ে ভেঙে যাবে।

মাথা নেড়ে হোমস বললে, মিস দ্য মারভিলের মতো মেয়েরা মুখ দেখে টলে না। বরং আরও বেশি করে পছন্দ করে বসবে ব্যারনকে। ওর শারীরিক দোষ নয়, চরিত্রের দোষটাই মারভিলের সামনে তুলে ধরতে হবে। এ-ডাইরি ব্যারনের নিজের হাতে লেখা অবিশ্বাস করতে পারবে না।

পিরিচ আর ডাইরি নিয়ে আনন্দে আটখানা হয়ে রাস্তায় নেমে গেলেন স্যার জেমস। আমারও বাড়ি যাওয়ার সময় হয়েছে বলে নেমে এলাম পেছনে পেছনে। ব্রহাম গাড়িতে লাফিয়ে উঠে পড়লেন স্যার জেমস। আলখাল্লা দিয়ে প্যানেলের ওপর বর্ণ-চিহ্ন চাপা দিতে গেলেন বটে, কিন্তু তার আগেই যা দেখবার আমি দেখে নিয়েছিলাম। সঘন নিশ্বাস টেনে দৌড়ে উঠে এলাম হোমসের ঘরে। হাঁপাতে হাঁপাতে বিষম উত্তেজিত হয়ে বললাম, হোমস, তোমার আসল মক্কেলের নাম জানতে পেরেছি। ইনি–

হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে হোমস বললে, খুবই খানদানি মানুষ তিনি। এইটুকুই শুধু জানা থাক, কেমন?

ডাইরিটাকে বিয়ে ভাঙার কাজে লাগানো হল কীভাবে আমি জানি না। স্যার জেমস নিজে হয়তো ঝুঁকি নেননি মিস মারভিলের বাবার হাতে ভারটা দিয়েছিলেন। তিন দিন পরে মর্নিং পোস্ট-এ একটা খবর বেরোল। গ্রানারের সঙ্গে ভায়োলেটের বিয়ে আর হবে না। সেইসঙ্গে বেরোল আর একটা খবর। ব্যারনের মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে দেওয়ার অপরাধে মিস কিটি উইন্টারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু বিচার চলার সময়ে এমন সব ভয়ানক ভয়ানক খবর ফাঁস হয়ে গেল যে মানবতার খাতিরে নামমাত্র সাজা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল মিস উইন্টারকে। শার্লক হোমসের বিরুদ্ধেও ডাইরি চুরির অভিযোগ এসেছিল। কিন্তু উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, কঠোর ব্রিটিশ আইনও তখন নুয়ে পড়ে। ফলে, বন্ধুবরকে আজও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।

———–

টীকা

বিখ্যাত মক্কেলের বিচ্ছিরি বিপদ : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দি ইলাসট্রিয়াস ক্লায়েন্ট স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ ১৯২৫ সংখ্যায় দুই কিস্তিতে এবং আমেরিকার কলিয়ার্স উইকলির ৮ নভেম্বর ১৯২৪-এর সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়।

টার্কিশ বাথ : ডেভিড উকহার্ট ইস্তাম্বুল-এর ব্রিটিশ দূতাবাসে কাজ করবার সময়ে টার্কিশ বাথ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করে পরে পার্লামেন্টের সদস্য থাকাকালীন ইংলন্ডে তা প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রথমে নিজের বাড়ি তুর্কি ঘরানায় সাজিয়ে। তারই লেখা বই পিলারস অব হারকিউলিস-এর বিবরণ অনুসারে আয়ারল্যান্ডে প্রথম টার্কিশ বাথ প্রচলন করেন ড. রিচার্ড বার্টার নামক এক চিকিৎসক, ১৮৫৬ সালে।

কার্লটন ক্লাব : ৯৪, পলমল ঠিকানায় অবস্থিত কার্লটন ক্লাবের সদস্য সংখ্যা ১৮৯৬-এ ছিল প্রায় আঠারোশো।

স্যার জর্জ লিউইস : লিউইস অ্যান্ড লিউইস ফার্মের স্যার জর্জ লিউইস (১৮৩৩-১৯১১) ছিলেন তৎকালীন ব্রিটেনের একজন বিখ্যাত সলিসিটর।

কুইন অ্যানি স্ট্রিট : ক্যাভেন্ডিশ স্কোয়ারে, ডাক্তারদের পিজ হার্লে স্ট্রিট থেকে কুইন অ্যানি স্ট্রিট বেশি দূরে নয়। বেকার স্ট্রিট থেকেও এই রাস্তার দূরত্ব সামান্য।

সপ্লুজেন গিরিবর্ত্ম্য : প্রাহা বা প্রাগ ছিল চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী। কিন্তু সপ্লুজেন গিরিবর্ত্ম্যের অবস্থান সুইজারল্যান্ড এবং ইতালির সীমান্তে।

খাইবার পাস : দ্বিতীয় আফগান যুদ্ধে, খাইবার পাসের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৭৮-৭৯ সালে।

হার্লিংটনে : ফুলহ্যামের হার্লিংটন ক্লাব ছিল ইংলন্ডে পোলো খেলার প্রধান ঘাঁটি। পোলো খেলার উৎপত্তি সম্ভবত পারস্যে অথবা ভারতবর্ষে ছ-শো খ্রি. পূ. থেকে খ্রিস্টিয় প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো সময়ে বলে মনে করা হয়।

চার্লি পিস : শেফিল্ডের বাসিন্দা চার্লস পিস ছিলেন আবিষ্কারক, নামি বেহালাবাদক, অভিনেতা এবং সেইসঙ্গে সিঁধেল চোর এবং খুনি।

ওয়েনরাইট : থমাস গ্রিফিথ ওয়েনরাইট (১৭৯৪-১৮৫২) ছিলেন চিত্রকর এবং শিল্প সমালোচক। তিনি বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন ইগোমেট বনমট এবং জানুস ওয়েদারকুক ছদ্মনামে। শোনা যায় তিনি একটি হত্যার মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন।

পার্কহার্স্ট : ১৮৩৮-এ আইল অব ওয়েটে প্রতিষ্ঠিত অতীব সুরক্ষা সংবলিত কারাগার। সম্মোহিত মানুষ সেই হুকুম হুবহু মেনে চলে : ভিয়েনার চিকিৎসক ফ্রানজ আন্তন মেসমার (১৭৩৪-১৮১৫) সম্মোহন বিদ্যা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ব্যবহারের প্রচলন করেন। উনবিংশ শতকের শেষে ইউরোপে সম্মোহন ছিল একটি জনপ্রিয় বিষয়।

স্কার্ভি : ভিটামিন সি-এর অভাবে ঘটিত চর্মরোগ।

কুষ্ঠরোগ : কুষ্ঠরোগের জীবাণু মাইক্রোব্যাকটিরিয়াম ল্যাপরে প্রথম চিহ্নিত করেন নরউইজিয় চিকিৎসক জি, আরমোয়ার হ্যানসেন। সেকালে এই রোগ ছিল দুরারোগ্য এবং সংক্রামক মনে করা হত কুষ্ঠরোগকে।

সামনের শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্র রওনা হচ্ছে : গবেষক লেসলি ক্লিংগার জানিয়েছেন রুরিটানিয়া জাহাজের কর্তৃপক্ষ কুনাৰ্ড লাইনারের জাহাজ লিভারপুল থেকে সেই সময়ে শুধুমাত্র মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার এবং শনিবার রওনা হত।

লন্ডন লাইব্রেরি : সেন্ট জেমস স্কোয়ারে অবস্থিত লন্ডন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪১-এ। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য টমাস কার্লাইল এবং জন স্টুয়ার্ট মিল-এর নাম।

হাং ও : দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা হাং ও (১৩২৮-১৩৯৮)-র আসল নাম চু উয়ান চ্যাং। ইনি মিং রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।

আং লো : আং লো (১৩৬০-১৪২৮) ছিলেন মিং বংশের তৃতীয় সম্রাট।

তাং ইং : মিং যুগের এক বিখ্যাত কবি এবং শিল্পী ছিলেন তাং ইং বা তান ইন (১৪৭০-১৫২৩)।

সাং : চৈনিক রাজবংশ সাং-এর শাসনকাল ছিল খ্রিস্টিয় ৯৬০ থেকে ১২৫৯ পর্যন্ত।

উয়াং : বা উয়ান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মোঙ্গল বীর চেঙ্গিস খানের নাতি কুবলাই খান (১২১৫-১২৯৪)। সাং বংশীয় শাসকদের সিংহাসনচ্যুত করে কুবলাই খান এই রাজবংশের সূচনা করেন ১২৭১ সালে। উয়াল রাজবংশ রাজত্ব করে ১৩৬৮ পর্যন্ত।

মিং রাজবংশ : উয়ান রাজবংশের পতনে মিং রাজবংশের সূচনা হয় চিনদেশে ১৩৬৮ সালে। এর শাসনকালের সমাপ্তি ঘটে ১৬৪৪-এ।

সম্রাট শোমু : জাপানের সম্রাট শোমু (৭০১-৭৫৬) সিংহাসনে অভিষিক্ত হন ৭১৫ সালে মাত্র চোদ্দো বছর বয়সে। শোমু ছিলেন বুদ্ধদেবের প্রবর্তিত ধর্মের অনুগামী এবং বৌদ্ধশিল্পের পৃষ্ঠপোষক।

নারা : জাপানের প্রথম রাজধানী নারা। সেখানে ৭৫২ সালে সম্রাট শোমু টোডাই-জি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। শোশো-ইন হল টোডাই-জি মন্দিরের একটি হর্মের নাম। শোশো-ইন এখন শোমুর ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সংগ্রহশালা।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত