প্রস্তরের প্রহেলিকা
[ দ্য প্রব্লেম অফ থর ব্রিজ ]
শেরিং ক্রসে কক্স অ্যান্ড কোম্পানির ব্যাঙ্কের ভল্টে একটা তোবড়ানো টিনের বাক্স আছে। ডালায় লেখা আছে আমার নাম–জন এইচ ওয়াটসন, এম. ডি.। এককালের ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর ডাক্তার। বহু দেশ পাড়ি দেওয়ার ফলে টোল খেয়ে বাক্সের অবস্থা শোচনীয়। ভেতরে ঠাসা শার্লক হোমসের বহুবিধ কেসের বৃত্তান্ত লেখা রাশি রাশি কাগজ। কতকগুলো কেস নিষ্ফল তদন্তেই শেষ হয়েছে। শার্লক হোমস হালে পানি পায়নি। সেসব নিয়ে গল্প লেখা আর হবে না–পাঠক মজা পাবে না। যেমন, জেমস ফিলিমোরের অসমাপ্ত কাহিনি। ভদ্রলোক ছাতা নেওয়ার জন্যে বাড়ি ফিরলেন–তারপর থেকেই বেমালুম যেন উবে গেলেন ধরাতল থেকে। বিচিত্র কাহিনি হিসেবে অ্যালিসিয়া জাহাজের অদ্ভুত রহস্যও কম যায় না। কুয়াশার মধ্যে ঢুকে জাহাজখানা যেন অদৃশ্যই হয়ে গেল লোকজন সমেত। ইসাদোরা পারসানোর উপাখ্যানও চক্ষু কপালে তুলে দেবার মতো বিস্ময়কর। ইনি একাধারে পুঁদে দ্বন্দযযাদ্ধা এবং সাংবাদিক। কিন্তু এহেন ব্যক্তিকেই একদিন দেখা গেল বদ্ধ উন্মাদ অবস্থায় সামনে একটা দেশলাইয়ের বাক্স নিয়ে বসে আছেন–বাক্সের মধ্যে একটা আশ্চর্য পোকা, যে-পোকার নাম বিজ্ঞান এখনও শোনেনি। এ ছাড়াও এমন সব গোপন কাহিনি নিয়ে তদন্ত করেছে হোমস যা নিয়ে এখন গল্প লিখলে হইচই পড়ে যাবে। বাকি কেসগুলো কম বেশি কৌতূহলোদ্দীপক হলেও এতদিন গল্প লেখায় হাত লাগাইনি পাছে সর্বজনশ্রদ্ধেয় বন্ধুবরের সুনামে আঁচড় পড়ে–এই ভয়ে। এই ধরনের কিছু কেসে আমি নিজে থেকেছি, কিছু শুনেছি। আজ যে-কেসটা লিখতে বসেছি, তার মধ্যে আমি নিজে ছিলাম।
অক্টোবরের সকাল। বাড়ির পেছনে একমাত্র গাছটার শেষ পাতা ক-টাও হাওয়ায় ঝরে পড়ছে মাটিতে। শয্যাত্যাগ করে ব্রেকফার্স্ট খাওয়ার জন্যে নামতে নামতে ভাবলাম, নিশ্চয় বিষণ্ণ মেজাজে দেখব হোমসকে। পরিবেশের প্রভাব ওর ওপর বড্ড বেশি পড়ে তো৷ কিন্তু দেখলাম তার বিপরীত। হালকা মুডে থাকলে যা তাই। দুষ্ট প্রসন্নতা ভাসছে চোখে-মুখে। খুশি যেন উপচে পড়ছে। খাওয়া প্রায় শেষ করে এনেছে।
বললাম, কী হে, হাতে কেস এসেছে মনে হচ্ছে?
ও বলল, গোয়েন্দাগিরি জিনিসটা দেখছি ছোঁয়াচে রোগ। ঠিক ধরে ফেলেছ। মাসখানেক ছ্যাচড়া কাজ নিয়ে উপপসি থাকার ফলে আজ জবর কেস এসেছে হাতে।
ভাগ পাব তো?
ভাগ দেওয়ার মতো তেমন কিছু যদিও নেই, তাহলেও তোমার পাতের ওই কড়া সেদ্ধ ডিম দুটো সাবাড় করার পর এ নিয়ে কথা বলা যাবেখন।
পনেরো মিনিটেই শেষ হল প্রাতরাশ–সাফ হয়ে গেল টেবিল। পকেট থেকে একটা চিঠি বার করে হোমস বললে, সোনার রাজা নীল গিবসনের নাম নিশ্চয় শুনেছ?
সে তো কিছুদিনের জন্যে ছিলেন। আসলে ওঁর খ্যাতি অন্য কারণে। সোনার খনিওয়ালাদের মধ্যে ওঁর চেয়ে বড়ো আর কেউ নেই পৃথিবীতে।
এখন আছেন ইংলন্ডে।
বছর পাঁচেক আগে হ্যাম্পশায়ারে বাড়ি কিনেছেন। ওঁর স্ত্রীর শোচনীয় মৃত্যুর খবরটা নিশ্চয় শুনেছ?
এখন মনে পড়েছে। নামটা ওইজন্যেই অত চেনা চেনা লাগছে।
চেয়ারে গাদা করা একরাশ কাগজ দেখিয়ে হোমস বললে কেসটা যে শেষ পর্যন্ত আমার হাতে আসবে ভাবিনি। ঘটনাটা সাংঘাতিক চাঞ্চল্যকর। কিন্তু দারুণ সোজা–কোনো সমস্যাই নেই যেন। করোনারের জুরি যাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেছে, তার অদ্ভুত ব্যক্তিত্বও দোষের মাত্রা লাঘব করতে পারেনি–ঘটনা ঘটনাই থেকে গিয়েছে এবং নতুন কোনো ঘটনা না-জানা পর্যন্ত মক্কেল। ভদ্রলোকের খুব একটা উপকার করতে পারব বলেও মনে হয় না।
তোমার মক্কেল?
এই দেখো! তোমার সঙ্গে থেকে থেকে পেছন থেকে গল্প বলা অভ্যেস করে ফেলেছি। আসল ব্যাপারটাই ভুলে মেরে বসে আছি। এই নাও, পড়ো। বলে চিঠিখানা এগিয়ে দিল হোমস। বেশ কড়া হাতে লেখা চিঠির ভাবটা এইরকম :
ক্ল্যারিজস হোটেল
তেসরা অক্টোবর
প্রিয় মিস্টার শালক হোমস,
ঈশ্বর যে-মেয়েটিকে সব মেয়ের সেরারূপে সৃষ্টি করেছেন, এইভাবেই কি তার মৃত্যু হবে? তাকে বাঁচানোর জন্যে কোনো চেষ্টাই কি হবে না? বুঝিয়ে বলার ক্ষমতা আমার নেই, কিছু বুঝতেও পারছি না। শুধু বলব, মিস ডানবার নিরপরাধিনী। দেশসুদ্ধ লোক জেনে গেছে যে-ব্যাপার, আপনিও তা জানেন। গুজবের অন্ত নেই, প্রতিবাদে কেউ কিন্তু সোচ্চার হচ্ছে না। এতবড়ো অন্যায় আমি আর সইতে পারছি না–মাথা খারাপ হতে বসেছে। মাছি পর্যন্ত মারতে পারে না যে-মেয়ে, সে করবে মানুষ খুন? কাল ঠিক এগারোটায় আমি আসছি। দেখুন, অন্ধকারে আলো আবিষ্কার করতে পারেন কি না। সূত্র হয়তো আমার কাছে, কিন্তু আমিই জানি না তা কী। আমার সর্বস্ব আপনার যদি তাকে বাঁচাতে পারেন। আপনার ক্ষমতার প্রকৃত প্রয়োগ করুন এই কেসে।
আপনার বিশ্বস্ত
।জে নীল গিবসন
ব্রেকফার্স্ট পাইপ থেকে ছাই ফেলে দিয়ে ফের তামাক ঠাসতে ঠাসতে হোমস বললে, বসে আছি এঁর জন্যেই। কেসটা সব কাগজেই বেরিয়েছে। সমস্ত পড়বার হয়তো সময় পাওনি। আমি ছোটো করে বলছি। যিনি আসছেন, পৃথিবীতে এর টাকার দাপট প্রচণ্ড। মানুষ হিসেবেও অতি ভয়ংকর, অতি প্রচণ্ড। যাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি এখন যৌবননাত্তীর্ণা। দুই সন্তানের ভার দেওয়া ছিল পরমাসুন্দরী এক গভর্নেসের হাতে। তিন জনের মধ্যে থেকে একজন, মানে, ভদ্রলোকের স্ত্রী, সোজাসুজি খুন হয়ে গেলেন একটা ঐতিহাসিক খামারবাড়িতে। মাথায় বুলেট, গায়ে শাল, পরনে ডিনার ড্রেস। বাড়ি থেকে আধ মাইল দূরে গভীর রাতে পাওয়া গেল তার দেহ। খুনের অস্ত্র ডেডবডির কাছে পাওয়া যায়নি–খুনের কোনো পত্রও পাওয়া যায়নি। ওয়াটসন, পয়েন্টটা খেয়াল রেখো–ডেডবডির ধারেকাছে হত্যার হাতিয়ার পাওয়া যায়নি। খুনটা হয়েছে সন্ধে নাগাদ, ডেডবডি চোখে পড়েছে রাত এগারোটা নাগাদ, পুলিশ আর ডাক্তার তন্নতন্ন করে লাশ পরীক্ষা করে তবে বাড়ির মধ্যে এনেছে। খুব ছোটো হয়ে গেল না তো? স্পষ্ট হল?
খু-উব। কিন্তু সন্দেহটা গভর্নেসের ওপর কেন?
স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে। একই বুলেটের ক্যালিবারের পিস্তল পাওয়া গেছে। ভদ্রমহিলার ওয়ার্ডরোবের নীচের তাকে একটা চেম্বার খালি। বলতে বলতে চোখের তারা স্থির হয়ে গেল হোমসের ছাড়া ছাড়া ভাবে বললে নিজের মনে, পাওয়া গেছে ভদ্রমহিলার ওয়ার্ডরোবের–নীচের তাকে। এ-লক্ষণ আমি চিনি। চিন্তার ট্রেন ছুটছে মাথায়। বাগড়া দেওয়া ঠিক হবে না। ঝাঁকি মেরে ফের প্রাণবন্ত হল সেকেন্ড কয়েক পরেই। বলল, হ্যাঁ, পাওয়া গেছে ওয়ার্ডরোবের নীচের তাকে। খুবই খারাপ। তার চাইতেও খারাপ হল একটা চিরকুট। লিখেছেন গভর্নেস। অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছেন গিবসনের স্ত্রীর সঙ্গে। চিরকুট মুঠোর মধ্যে নিয়েই অ্যাপয়েন্টমেন্টের জায়গায় খুন হয়েছেন তিনি। কী বুঝলে? চূড়ান্ত প্রমাণ হল মোটিভ। সিনেটর গিবসন বিপত্নীক হলে গভর্নেসের পোয়াবারো। প্রেম, ঐশ্বর্য, ক্ষমতা এসে যাবে গিবসনের প্রসাদে। ওয়াটসন, কেস অতি কদর্য!
খুবই।
গভর্নেস নিজেও তাঁর অন্যত্রস্থিতি বলতে পারেননি। উলটে তিনি যে ওই সময়ে ওই জায়গায় ছিলেন–তা বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী দেখেছে।
তাহলে তো হয়েই গেল।
উঁহু, তাহলেও…সব হয়েও… যাকগে! লাশ পাওয়া গেছে থর ব্রিজের মুখে। পাথরের ব্রিজ। থর জলা যেখানে সরু হয়ে গিয়েছে, তার ওপর তৈরি পাথরের ব্রিজটার নাম থর ব্রিজ। আরে, মক্কেল ভদ্রলোক দেখছি একটু আগেই এসে গেলেন।
বলতে-না-বলতেই দরজা খুলে বিলি যাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল এবং নামটা তার আগেই বলে গেল–তিনি নীল গিবসন নন। মার্লো বেটস। নার্ভাস, রোগা, ভয়ার্ত চক্ষু। দুজনের কেউই চিনি না ভদ্রলোককে। কম্পিত কলেবর দেখে আমার ডাক্তারি মন বলল, লোকটা স্নায়ুপীড়নের ধকল সইতে না-পেরে ভেঙে পড়ার মুখে এসে পৌঁছেছেন।
হোমস বলল, বড় উত্তেজিত দেখছি আপনাকে। বসুন। যা বলবার তাড়াতাড়ি বলুন। এগারোটায় একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
জানি কার সঙ্গে আছে। হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন মার্লো বেটস যেন দম আটকে এল প্রত্যেকটা শব্দ উচ্চারণের সঙ্গেসঙ্গে, নীল গিবসন আমার মনিব–আমি তার এস্টেট ম্যানেজার। শয়তান, পিশাচ জানোয়ার কোথাকার!
বড্ড শক্ত শক্ত কথা বলছেন কিন্তু।
মনের কথা চট করে বোঝাতে চাই বলেই বলছি। সময় খুব কম। এখানে আমাকে দেখতে পেলে আর রক্ষে নেই। আজ সকালে সেক্রেটারি ফার্গুসনের কাছে শুনলাম উনি আসছেন এখানে। তাই ছুটতে ছুটতে আসছি।
আপনি না তাঁর ম্যানেজার?
ছিলাম–চাকরিতে জবাব দিয়েছি। পিশাচ নীল গিবসন দানধ্যান করে শুধু কুকীর্তি ধামাচাপা দেওয়ার জন্যে। সবচেয়ে জঘন্য ব্যবহার করেছে নিজের বউয়ের সঙ্গে। জানোয়ার কোথাকার! কী করে মারা গেলেন মিসেস গিবসন বলতে পারব না—তবে ওঁর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল এই শয়তান। মিসেস গিবসনের জন্ম গরমের দেশে–ব্রেজিলে। জানেন তো?
এই শুনলাম।
স্বভাবটাও তাই গরম। সূর্যের দেশের মেয়ে–আবেগে ফুটতেন সবসময়ে। স্বামীকে ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে, কিন্তু যেই রূপ যৌবন গেল, এককালে খুবই রূপবতী ছিলেন–আরম্ভ হয়ে গেল শয়তানির শয়তানি। অসম্ভব ধূর্ত, অসম্ভব বদমাশ। মুখের কথায় ভুলবেন না। যা বলবে, ঢাকবে তার বেশি। আমি চলি। না, না, আটকাবেন না–এসে গেল বলে নীল গিবসন!
ঘড়ির দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল বিচিত্র আগন্তুক।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর হোমস বললে, নীল গিবসনের কর্মচারীরা মনিবের প্রতি খুব একটা অনুগত নন দেখছি। ভালোই হল। হুঁশিয়ারিটা কাজে লাগবে!
ঠিক এগারোটার সময়ে সিঁড়িতে ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল। ঘরে ঢুকলেন স্বনামধন্য কোটিপতি। এক নজরেই হাড়ে হাড়ে বুঝলাম কেন ম্যানেজার ভদ্রলোক যমের মতো ভয় পান মনিবকে এবং কেনই-বা প্রতিদ্বন্দ্বী কারবারিরা অভিশাপের পাহাড় জমিয়েছে এঁর মাথায়। যদি ভাস্কর হতাম, চামসিটে বিবেকসম্পন্ন লৌহকঠিন স্নায়ুতে গড়া মূর্তি গড়ার বায়না যদি পেতাম, মডেল হিসেবে বেছে নিতাম নীল গিবসনকে। এবড়োখেবড়ো পাথরের মতো বিরাট দীর্ঘ চেহারায় আগাগোড়া প্রচণ্ড লালসা আর অপরিমেয় ক্ষুধা যেন ফুটে বেরোচ্ছে। আব্রাহাম লিঙ্কনকে যদি সৎ কাজ থেকে হেঁটে এনে বদকাজে লাগানো হয় তাহলে যা দাঁড়ায়, নীল গিবসন তাই। মুখখানা যেন গ্রানাইট কুঁদে তৈরি। কঠিন। অনুতাপবিহীন। অজস্র কঠিন রেখায় অসংখ্য সংকট পেরিয়ে যাওয়ার চিহ্ন। ধূসর শীতল চোখ দিয়ে পর্যায়ক্রমে দুজনকে মেপে নিলেন প্রথমেই। আমার পরিচয় দিল হোমস। অভিবাদন সেরে নিয়ে কর্তৃত্বব্যঞ্জক ভঙ্গিমায় চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন হোমসের একদম সামনে।
বললেন, টাকার অভাব হবে না মিস্টার হোমস। টাকা ছড়ান–কিন্তু প্রমাণ করে দিন ভদ্রমহিলা নির্দোষ। বলুন, কত নেবেন?
ঠান্ডা গলায় হোমস বললে, আমি যা নিই, তার বেশি কখনোই নিই না। অথবা একদম পয়সাই নিই না।
বেশ, টাকার দরকার না-থাকলে নামডাকের প্রয়োজন তো আছে। সারাইংলন্ডে হইচই পড়ে যাবে এ-কেস যদি ঠিকমতো সাজিয়ে দিতে পারেন।
ধন্যবাদ। নামডাকের প্রয়োজন আমার নেই। আমি আড়ালে থেকে কাজ করতেই ভালোবাসি। সমস্যাটাই আমার কাছে একমাত্র আকর্ষণ। বাজে সময় নষ্ট না-করে কাজের কথায় বরং আসা যাক।
খবরের কাগজেই নিশ্চয় সব জেনেছেন?
একটা খবর বাদে।
কোনটা?
আপনার সঙ্গে মিস ডানবারের আসল সম্পর্কটা কী?
দারুণ চমকে উঠলেন স্বর্ণ নৃপতি। চেয়ার থেকে উঠতে গিয়েও ফের বসে পড়লেন–সামলে নিলেন নিজেকে।
মিস্টার হোমস, সীমা রেখে ডিউটি করবেন আশা করি?
অবশ্যই।
মিস ডানবারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক মনিবের সঙ্গে কর্মচারীর সম্পর্কের মতোই–ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে যখন থাকে, দেখাশুনা হয় শুধু তখন।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হোমস বললে, তাহলে আপনি আসতে পারেন। আমি ব্যস্ত মানুষ। বাজে কথায় সময় নষ্ট করতে চাই না।
ভীষণ রাগে মুখ লাল হয়ে গেল নীল গিবসনের। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে হোমসের ওপর প্রায় ঝুঁকে পড়ে বললেন বজ্রকণ্ঠে, তার মানে?
কেস ছেড়ে দিলাম।
কারণটা কী? দাম বাড়াচ্ছেন? না, ভয় পাচ্ছেন? সোজা জবাব দিন।
সোজাই বলছি। কেসটা জটিল, ভুল খবরে আরও জটিল হবে।
তার মানে বলতে চান আমি মিথ্যে বলছি?
ভদ্রভাবে বলতে চেয়েছি–কিন্তু আপনি যখন সোজাভাবে জানতে চাইছেন–প্রতিবাদ করব না।
তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম কোটিপতির মুখে পৈশাচিক ভাবের বিস্ফোরণ আর উদ্যত মুষ্টি দেখে। হোমস কিন্তু ক্লান্তভাবে হেসে হাত বাড়াল পাইপের দিকে।
বললে, মিস্টার গিবসন, গোলমাল করবেন না। ব্রেকফাস্টের পর চেঁচামেচি ভালো লাগে না। রাস্তায় গিয়ে হাওয়া খান–মাথা ঠান্ডা হবে।
নীল গিবসনের প্রশংসা না-করে পারছি না। অসীম মনোবলে মুহূর্তের মধ্যে শান্ত করে নিলেন নিজেকে।
বললেন, কাজটা ভালো করলেন না। আমাকে ঘাঁটিয়ে কেউ পার পায় না।
অনেকেই অমন বলে আমাকে, এখনও আছি বহাল তবিয়তে। হেসে হেসেই বলল হোমস। আচ্ছা আসুন, সংসারে এখনও অনেক শিক্ষার বাকি আপনার।
দুমদাম করে বেরিয়ে গেলেন নীল গিবসন। পাইপ টানতে টানতে স্বপ্নাচ্ছন্ন চোখে নীরবে কিছুক্ষণ কড়িকাঠ নিরীক্ষণ করল হোমস।
তারপর বললে, কী বুঝলে হে?
পথের কাঁটা যে-লোক এভাবে সরাতে চায়, তার পক্ষে রূপযৌবনহীনা স্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। মিস্টার বেটস ঠিকই বলেছেন।
আমারও তাই মনে হয়।
কিন্তু গভর্নেসের সঙ্গে ওঁর সম্পর্কটা কী? তুমি জানলে কী করে?
ধাপ্পা মেরে। চিঠির ভাষা আবেগে কাঁপছে–সংযত গুছোনো মোটেই নয়। কিন্তু সামনাসামনি কথা বলছে রেখে ঢেকে নিশ্চয় শুধু কর্মচারীকে বাঁচানোর জন্যে এ-রকম কাণ্ড কেউ করে না–ভেতরে আরও ব্যাপার আছে। তাই সরাসরি ঘা মারতেই ফেটে বেরিয়ে এল আসল মূর্তি। কিছুই জানি না শুধু আঁচ করেছি।
ফিরে আসবেন নিশ্চয়।
আলবত আসবেন। এভাবে কেস ফেলে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ওই তো ঘণ্টার আওয়াজ, সিঁড়ি দিয়ে সেই পায়ের মালিক আসছে না? আসুন মিস্টার গিবসন এইমাত্র বলছিলাম ওয়াটসনকে, আপনি এলেন বলে।
অনেকটা মার্জিত চরণে ঘরে প্রবেশ করলেন কোটিপতি! হোমসের দাওয়াইতে কাজ হয়েছে কিন্তু অপমানের জ্বালা চোখ থেকে এখনও যায়নি। কমনসেন্স দিয়ে বুঝেছেন কাজ উদ্ধার করতে হলে নতিস্বীকার করতেই হবে।
বললেন, ভেবে দেখলাম আপনি প্রশ্ন করেছেন সংগত কারণেই। কিন্তু আমার সঙ্গে মিস ডানবারের সম্পর্ক এ-কেসে আসছে না।
সেটা আমি বুঝব।
অর্থাৎ ডাক্তারের মতোই রুগির সব খবর আপনি জানতে চান?
হ্যাঁ! রুগির পক্ষে তা গোপন করা কি ঠিক?
দুম করে যদি একজন মহিলার সঙ্গে আসল সম্পর্ক কী জিজ্ঞেস করেন, স্পষ্ট কথা কি বলা যায়? প্রত্যেক মানুষেরই গোপন কথা থাকে অন্যের প্রবেশ সেখানে নিষেধ। যাক কী জানতে চান বলুন।
যা সত্যি, তাই।
মনে মনে কথাটা সাজিয়ে নিলেন কাঞ্চনসম্রাট। আরও ভারী, আরও গম্ভীর, আরও বিষণ্ণ হয়ে উঠল মুখটা।
সংক্ষেপে বলছি। আমার স্ত্রী মেরিয়া পিন্টোকে বিয়ে করেছিলাম ব্রেজিলে কুড়ি বছর আগে সোনা খোঁজার সময়ে। পরমাসুন্দরী বলতে যা বোঝায়, মেরিয়া ছিল তাই। বিয়ের পর আবেগ যখন থিতিয়ে এল, তখন দেখলাম ওর সঙ্গে আমার মনের মিল কোথাও নেই। আমার ভালোবাসায় ভাটা পড়ল কিন্তু ওর ভালোবাসা যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেল। লোকে বলে আমি নাকি নিষ্ঠুর হয়েছি স্ত্রীর প্রতি। হয়েছি ইচ্ছে করেই। যাতে আমাকে ও ঘৃণা করতে পারে। কিন্তু এত করেও ভালোবাসায় এতটুকু চিড় ধরাতে পারিনি।
এরপর আমাদের বিজ্ঞাপনের জবাবে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার ভার নিতে এল মিস গ্রেস ডানবার। কাগজে নিশ্চয় তার ছবি দেখেছেন। দুনিয়া জানে সে সুন্দরী। একই বাড়িতে তার মতো মেয়ের প্রতি দুর্বলতা না-নিয়ে থাকা যায় না–আমিও পারিনি। সেটা কি দোষের?
দোষের হবে তখনই যখন আপনার মনোভাব ব্যক্ত করে ফেলবেন ভদ্রমহিলার কাছে। কেননা, উনি এসেছেন আপনার আশ্রয়ে চাকরি করতে।
হয়তো তাই, মুখে বললেন বটে, কিন্তু মুহূর্তের জন্য তিরস্কারের ধাক্কায় স্ফুলিঙ্গ দেখা দিল দুই চোখে। আমি যা নই তা বলতে চাই না নিজেকে। জীবনে যা চেয়েছি মিস ডানবারকেও আমি চাই, চাই তার ভালোবাসা। সে-কথা বলাও হয়ে গেছে।
তাই নাকি? ভীষণ দেখাল হোমসকে।
বলেছি উপায় থাকলে এখুনি বিয়ে করতাম। টাকা যত লাগে দিতে রাজি–তার সুখের জন্যে সর্বস্ব দিতেও প্রস্তুত।
অসীম করুণা আপনার। অবজ্ঞা শানিত স্বর হোমসের।
মিস্টার হোমস, আমি নীতিজ্ঞান শুনতে আসিনি।
অসহায় যে-মেয়েটির সর্বনাশ করার জন্যে আপনি উঠে পড়ে লেগেছেন, তাকে আইনের চোখে নিরপরাধ প্রমাণ করার জন্যে এ-কেস আমি হাতে নিয়েছি। আপনাদের মতো বড়ো লোকদের জানা দরকার দুনিয়ায় ঘুস দিয়ে সব জিনিস কেনা যায় না।
অবাক হয়ে গেলাম এতবড়ো একটা ভৎসনা কাঞ্চন সম্রাট বেমালুম হজম করে গেলেন দেখে।
বললেন, এখন তা বুঝছি। ঈশ্বর যা করেন, ভালোর জন্যেই করেন। মিস ডানবার আমার কোনো কথাই রাখেনি–সেই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল।
গেল না কেন?
দুটো কারণে। প্রথমত, আমি কথা দিয়েছিলাম, আর গায়ে হাত দেব না। এই কথাতেই সে থেকে যায়। কিন্তু আমি জানি কারণ আর একটা আছে। আমার ওপর তার প্রভাবটাকে সে ভালো কাজে লাগাতে চেয়েছিল।
কীভাবে?
মিস্টার হোমস, মিস ডানবার আমার অনেক খবর রাখে। সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে যে ক্ষমতা আমার তা আছে। আমি ইচ্ছে করলে ভাঙতে পারি, গড়তে পারি। ব্যক্তিবিশেষও নয়–সমাজ।
শহর এমনকী একটা জাতকেও। ব্যাবসা বড়ো কঠিন খেলা–এ-খেলায় দুর্বলের ঠাঁই নেই। আমি নিজে হেরে কাঁদিনি অন্যের কান্নায় গলে যাইনি। কিন্তু মিস ডানবারের দৃষ্টিভঙ্গি অন্য রকম। সে বলে একজন মানুষের যেটুকু দরকার, তার বেশি তার থাকার প্রয়োজন নেই এবং দশ হাজার রিক্ত মানুষকে ধ্বংস করে একজনের বিত্ত বাড়ানোও পাপ। ডলার চিরকাল থাকে না–যা চিরন্তন, মিস ডানবার ডলারের পাহাড় পেরিয়ে সেইদিকেই নিয়ে যেতে চেয়েছিল আমাকে সারাদুনিয়ার মঙ্গল এইভাবেই করছিল আমার কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই উদ্দেশ্যেই ও থেকে যায়। তারপরেই ঘটল এই ঘটনা।
ঘটনাটা সম্বন্ধে আপনার কী অভিমত?
দু-হাতে মাথা চেপে ধরে মিনিট কয়েক কী যেন চিন্তা করে নিলেন স্বর্ণ সম্রাট।
বললেন, কেস খুবই খারাপ। মেয়েদের মন বোঝা ভার–বাইরে এক, ভেতরে আর এক। প্রথমে তাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তবে কী জানেন, মিস ডানবারের বাইরেটাই অ্যাদ্দিন দেখেছি। তারপর ভেবে দেখলাম, তা নয়। ঈর্ষা জিনিসটা শুধু দেহ নয়–মনকে নিয়েও গড়ে ওঠে। মিস ডানবারের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা যে কেবল মনের–আমার স্ত্রী তা টের পেয়েছিল। ডানবারের মনের প্রভাব যে আমার ওপর প্রচণ্ড–যে-প্রভাব আমার স্ত্রীও সৃষ্টি করতে পারেনি তা সে বুঝতে পেরেই নিশ্চয় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল। হাজার হোক রক্তের মধ্যে আমাজনের হলকা রয়েছে তো। পিস্তল নিয়ে তাই খুন করতে গিয়েছিল মিস ডানবারকে কিন্তু ধস্তাধস্তিতে গুলি নিজের মাথাতেই লেগেছে।
হোমস বললে, সম্ভাবনাটা আমিও ভেবেছি। ঠান্ডা মাথায় খুন করার বিকল্প সিদ্ধান্ত হিসেবে শুধু এইটাই সম্ভব।
কিন্তু মিস ডানবার তো তা মানছে না।
তারপরেও ধরুন আচ্ছন্ন অবস্থায় কোনো মেয়েমানুষের পক্ষে রিভলভার সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে জামাকাপড়ের আলমারিতে রেখে দেওয়া বিচিত্র নয়–কী করছে সে-হুঁশ হয়তো তখন ছিল না। পরে যখন পিস্তল পাওয়া গেল, তখন মিথ্যে বলা বা অস্বীকার করাটাও স্বাভাবিক। এই যে সিদ্ধান্ত, এর বিপক্ষে কী পয়েন্ট থাকতে পারে বলুন?
মিস ডানবার নিজে।
হয়তো।
ঘড়ির দিকে তাকাল হোমস, সকালটা যাবে পারমিট বার করতে, সন্ধের ট্রেনে পৌঁছে যাব উইনচেস্টার। ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা না-করা পর্যন্ত এ নিয়ে স্পষ্ট কিছু বলা বা আপনার সঙ্গে একমত হওয়া সম্ভব নয়।
সরকারি অনুমতি বার করতে একটু দেরি হল। উইনচেস্টারে না-গিয়ে সেদিন আমরা গেলাম নীল গিবসনের এস্টেট থর প্লেসে। নীল গিবসন নিজে এলেন না–সার্জেন্ট কভেন্ট্রির ঠিকানা দিয়ে দিলেন। কেসটা প্রথমে ইনিই তদন্ত করেছেন। রোগা লম্বা বিবর্ণ চেহারার মানুষ। যা জানেন, যেন তার চাইতে ঢের কম বলেন–এমনি একটা রহস্য আর গোপনীয়তা জাগিয়ে রাখেন হাবভাবের মধ্যে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ গলার স্বর ফিসফিসানিতে নামিয়ে এনে এমন একটা ভাব করেন যেন খবরটা দারুণ কিছু আসলে তা নেহাতই মামুলি। এইসব কায়দা-টায়দার আড়ালে লোকটা অতি সজ্জন এবং ভালো মানুষ। এ-রহস্যের কিনারা করার মতো বুদ্ধি যে তার ঘটে নেই, যেকোনো সাহায্য পেলে বর্তে যাবেন–তা স্বীকার করে বসলেন অকপটে–যদিও মুখখানা গোমড়া করে।
মিস্টার হোমস, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাহায্য নিয়ে মুশকিল আছে। কেস ফয়সালা করে কৃতিত্বটা তারাই নিয়ে যাবে আমাকে দুর্নামে ড়ুবিয়ে যাবে। সেদিক দিয়ে আপনি অনেক ভালো। সোজা লোক আপনি। অনেক সুনাম শুনেছি।
কারো সাতেপাঁচে থাকি না। শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন বিষণ্ণবদন অফিসার, কেস ফয়সালা করলেও নিজের নাম কোনো ব্যাপারে জড়াই না।
আপনার উপযুক্ত কথাই বলেছেন, মিস্টার হোমস। ডক্টর ওয়াটসনকে নিশ্চয় বিশ্বাস করা যায়। চলুন, অকুস্থলে যাওয়া যাক। তার আগে একটা কথা শুধু আপনাদের বলতে চাই, বলে এমনভাবে জুল জুল করে চারদিক দেখে নিলেন সার্জেন্ট যেন কথাটা মুখ দিয়ে বলতে ভরসা পাচ্ছেন না, মিস্টার নীল গিবসন নিজেই খুন করেননি তো?
আমিও ভেবেছি সেইরকম।
মিস ডানবারকে দেখলে বুঝবেন অমন মেয়ে ত্রিভুবনে নেই। পথের কাঁটা বউকে সরিয়ে দিয়েছেন নীল গিবসন নিজেই। আমেরিকানরা সব পারে। কথায় কথায় বন্দুক চালায়। পিস্তলটাও তো তার।
প্রমাণ পেয়েছেন?
এক জোড়া পিস্তলের একটায় খুন হয়েছেন মিসেস গিবসন।
জোড়া পিস্তল? আরেকটা কোথায়?
বাড়িময় তো পিস্তল ছড়ানো। মিলিয়ে দেখা এখনও সম্ভব হয়নি। তবে বাক্সের মধ্যে দুটো পিস্তলের জায়গা আছে দেখছি।
কিন্তু মিলিয়ে না-দেখলে নিঃসন্দেহ হবেন কী করে?
চলুন না, গিয়ে দেখবেনখন। সাজিয়ে রেখেছি সব।
পরে দেখব। এখন চলুন অকুস্থলে।
সার্জেন্ট কভেন্ট্রির সাদাসিদে কটেজটাই স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি। এখান থেকে হেঁটে গেলাম প্রায় আধ মাইল পথ। ঝরা ফার্নের সোনালি আর ব্রোঞ্জ পাতায় ছাওয়া, হাওয়ায় দামাল অনুর্বর গুল্ম সমাকীর্ণ প্রান্তর পেরিয়ে পৌঁছোলাম থর প্লেস এস্টেটে ঢোকবার সাইড-গেটের সামনে। দূরে রাস্তার শেষে দেখলাম পাহাড়ের গায়ে একটা আধা-জর্জিয়ান আধা-টিউডর বিশাল বাড়ি অর্ধেক তৈরি গাছের গুড়ি দিয়ে। আমাদের পাশেই নলবনে আকীর্ণ জলা। জলা যেখানে সংকীর্ণ, ঠিক সেই জায়গায় গাড়িতে যাওয়ার পাথুরে ব্রিজ। দু-পাশে জলা বিস্তৃত হয়ে লেকের আকার নিয়েছে। ব্রিজে ওঠবার মুখে সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে গেলেন।
জমির দিকে আঙুল তুলে বললেন, এইখানে পাওয়া গেছে মিসেস গিবসনের দেহ।
লাশ সরানোর আগে আপনি এসেছিলেন তো?
নিশ্চয়। সঙ্গেসঙ্গে খবর পাঠিয়েছিল আমাকে।
কে খবর পাঠিয়েছিল?
মিস্টার গিবসন নিজে লোকমুখে খবর শুনেই সবাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে ছুটে আসেন এখানে–পইপই করে প্রত্যেককে বলে দেন পুলিশ না-আসা পর্যন্ত যেন কিছু সরানোনা হয়।
বুদ্ধিমানের কাজ করেছিলেন। খবরের কাগজে লিখেছে, খুব কাছ থেকে নাকি গুলি করা হয়েছে?
খুবই কাছ থেকে।
ডান রগে?
একটু পেছনে।
লাশ কীভাবে পড়ে ছিল?
চিত হয়ে। ধস্তাধস্তির কোনো চিহ্ন পাইনি। বাঁ-মুঠোয় আঁকড়ে ধরা ছিল মিস ডানবারের লেখা চিরকুটটা।
আঁকড়ে ধরেছিলেন?
আস্তে। আঙুল খুলতে হিমশিম খেয়ে গেছি।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। এ থেকে বোঝা যায়, মিথ্যে সূত্র হিসেবে চিরকুটটা খুনের পর হাতে গুঁজে দেওয়া সম্ভব ছিল না। চিরকুটের বয়ানও তো খুব ছোট্ট, রাত নটায় থর ব্রিজে থাকব।–জি, ডানবার। তাই?
আজ্ঞে।
মিস ডানবার স্বীকার করেছেন চিরকুট তাঁরই লেখা?
করেছেন।
কেন দেখা করতে এসেছিলেন, বলেছেন?
যা বলবার জেলা আদালতে বলবেন, বলেছেন।
ইন্টারেস্টিং সমস্যা। বিশেষ করে চিঠির ব্যাপারটা।
আজ্ঞে হ্যাঁ, একমাত্র অকাট্য প্রমাণ।
মাথা নেড়ে হোমস বললে, কিন্তু চিঠিখানা হাতের মুঠোয় নিয়ে দেখা করলেন কেন গিবসন? চিঠি পেয়েছিলেন রাত নটার বেশ আগে ঘণ্টাখানেক আগে তো বটেই। অতক্ষণ পরেও চিঠি ধরে রইলেন কেন? চিঠি নিয়ে নিশ্চয় কথা হচ্ছিল না? অদ্ভুত নয় কি?
সেইরকমই তো দেখছি।
বসে বসে ভাবা যাক, বলে পাথরের পাঁচিলে বসে তীক্ষ্ণ্ণ চোখে এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দৌড়ে গেল ব্রিজের উলটোদিকের পাঁচিলের সামনে। পকেট থেকে আতশকাচ বার করে পাথরের কারুকাজ দেখতে দেখতে বললে–অদ্ভুত তো?
আমিও দেখেছি, স্যার। পাথরে চটা উঠে গেছে। অনেক লোক যায় তো ব্রিজ পেরিয়ে, তাদেরই কারুর কীর্তি।
পাথরটা ধূসর, কিন্তু এক জায়গা সাদা দেখাচ্ছে চটা উঠে যাওয়ায়। ছ-পেনি মুদ্রার সাইজে খানিকটা জায়গা ভেঙে গেছে। যেন একটা জোরালো চোট লেগেছিল ঠিক ওই জায়গাতেই।
চিন্তামগ্ন চোখে হোমস বললে, বেশ জোরে ঘা মেরে ভাঙা হয়েছে দেখছি। হাতের ছড়ি দিয়ে গায়ের জোরে মারল পাঁচিলে, কিন্তু পাথর চটাতে পারল না। বেশ কড়া মার। লেগেছে বড়ো অদ্ভুত জায়গায়। ওপর থেকে নয়, নীচ থেকে। পাঁচিলের তলার কিনারায় দেখছেন?
কিন্তু লাশ পড়েছিল এখান থেকে কম করেও পনেরো ফুট দূরে।
তা ঠিক। তাহলেও ব্যাপারটা তুচ্ছ নয়। পায়ের ছাপ-টাপ পেয়েছেন?
মাটি লোহার মতো শক্ত। কোনো ছাপ নেই।
তাহলে যাওয়া যাক। আগে বাড়ির ভেতরে অস্ত্রগুলো দেখব। তারপর উইনচেস্টারে–মিস ডানবারের সঙ্গে কথা বলব।
নীল গিবসন তখন ফেরেননি শহর থেকে। ম্যানেজার মিস্টার বেটস ছিলেন নিউরোটিক চেহারা নিয়ে তিনিই আমাদের মনিব সংগৃহীত রকমারি সাইজের বন্দুক পিস্তল দেখিয়ে মনে মনে যেন বিরাট তৃপ্তি পেলেন।
বললেন, মাথার কাছেও গুলি ভরা পিস্তল নিয়ে ঘুমোন মিস্টার গিবসন। শত্রুর শেষ নেই—যা ব্যাভার, হবেই-বা না কেন। আমাদের সঙ্গেও মাঝে মাঝে এমন কাণ্ড করে বসেন যে ভয়ে সিটিয়ে থাকি। মিসেস গিবসনও নিশ্চয় আতঙ্কে থেকেছেন যে কটা দিন বেঁচেছিলেন।
মারধর করতে কখনো দেখেছেন?
না। তবে কথা শুনেছি। চাকরবাকরদের সামনেই স্ত্রীকে যা মুখে আসে তাই বলে গেছেন।
স্টেশনের দিকে যেতে যেতে হোমস বললে, কোটিপতির প্রাইভেট লাইফ খুব উজ্জ্বল নয় দেখা যাচ্ছে। মিস্টার বেটস ভদ্রলোক সম্বন্ধে যত মন্দ কথাই বলুন না কেন, শহর থেকে বিকেল পাঁচটা নাগাদ ফেরার পর চৌকাঠ পেরোননি খুনের খবর পাওয়ার আগে পর্যন্ত। সাড়ে আটটার সময়ে তো ডিনার ঘরে ছিলেন। পক্ষান্তরে, মিস ডানবার খুনের ঠিক আগেই মিসেস গিবসনের কাছে ছিলেন মুখে স্বীকার করছেন তার বেশি কিছু বললেন না উকিল বারণ করেছে বলে। এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা না-করা পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। শুধু একটা ব্যাপারের জন্যেই একে খুনি বলে ধরে নিচ্ছি না।
কী ব্যাপার হোমস?
ওঁরই জামাকাপড়ের আলমারিতে পিস্তল খুঁজে পাওয়াটা।
বল কী। সেইটাই ওঁর বিপক্ষে সবচেয়ে অকাট্য প্রমাণ!
খুব অকাট্য নয়। কাগজ পড়েই খটকা লেগেছিল। কাছে এসে অসংগতিটা আরও চোখে পড়ছে। সংগতি যতক্ষণ না পাচ্ছি, ধরে নেব কোথাও একটা চোখে ধূলো দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
বুঝলাম না কী বলতে চাও।
ওয়াটসন, ধরো তুমি একজন মহিলা। খুব ঠান্ডা মাথায় পূর্ব পরিকল্পিত পন্থায় প্রতিদ্বন্দ্বীকে হনন করতে চাও। প্ল্যান ঠিক করে ফেললে। একটা চিরকুটও লেখা হল। খুন যে হবে, সে এল। হাতে তোমার অস্ত্রও আছে। খুন করলে। ভারি নিখুঁত কাজ–কোথাও কোনো ফাঁক রইল না। এরপর কি বলতে চাও অপরাধী হিসেবে তোমার এত সুনাম নষ্ট করবে পাশের নলবনে অস্ত্রটা ছুঁড়ে না ফেলে দিয়ে সেটাকে ধরে এনে নিজেরই ওয়ার্ডরোবে সযত্নে রেখে দিয়ে? নলবন হাতের কাছেই, ছুঁড়ে ফেলে দিলে জীবনে কেউ খুঁজে পাবে না। কিন্তু এমন একটা জায়গায় রাখলে সবার আগে যেখানে সার্চ করা হবে। ওয়াটসন, তুমি যে ধুরন্ধর চক্রী, এ-অপবাদ তোমার প্রাণের বন্ধুও তোমাকে দেবে না–তা সত্ত্বেও বলব এ-রকম আহামুকি তোমার দ্বারাও জীবনে সম্ভব নয়।
উত্তেজনার মুহূর্তে—
কক্ষনো না। এত ঠান্ডা মাথায় যে-খুন করা হয়–ঠান্ডা মাথায় খুনের প্রমাণ লুকিয়ে রাখাও সেক্ষেত্রে করা হয়। না হে, মারাত্মক ভুল ধারণার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে আমাদের।
কিন্তু অনেক কিছুই তাহলে অস্পষ্ট থেকে যায়। স্প
ষ্ট করার চেষ্টা করা যাক। দৃষ্টিকোণ পালটে গেলেই আগে যা ধোঁয়াটে পরে তা সূত্র হয়ে ওঠে। যেমন ধরো, এখানে ধোঁয়াটে ব্যাপার হচ্ছে রিভলভার। মিস ডানবার বার বার বলছেন রিভলভার তিনি রাখেননি। নতুন থিয়োরি অনুসারে তিনি সত্যি বলছেন যদি ধরে নিই, তাহলে কেউ এই বস্তুটি তার ওয়ার্ডরোবে রেখেছে। কে রেখেছে? এমন কেউ যে তাকে দোষী সাব্যস্ত করাতে চায়। এই ব্যক্তিই কি প্রকৃত অপরাধী নয়? দেখলে, কীভাবে সঠিক তদন্ত লাইন ধরে ফেললাম।
উইনচেস্টারে রাত কাটাতে বাধ্য হলাম সরকারি অনুমতি পেতে দেরি হল বলে। পরের দিন সকালে মিস ডানবারের আইনবিদ উঠতি ব্যারিস্টার কামিংসকে নিয়ে গেলাম ভদ্রমহিলার কারাকক্ষে। পরমাসুন্দরী কাউকে দেখব আশা করেই গিয়েছিলাম কিন্তু এ-রকম আশ্চর্য রূপ দেখব ভাবতেও পারিনি। দাপুটে কোটিপতিও যে কেন এঁর কথায় ওঠবোস করেন, তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলাম। ভদ্রমহিলা কৃষ্ণাঙ্গী, চুলও কালো। ধারালো চোখে-মুখে এমন একটা ভাব বিচ্ছুরিত হচ্ছে যা দেখে বোঝা যায় এঁর দ্বারা কোনোরকম অপকর্মই সম্ভব নয়–মহৎ কাজ ছাড়া আর কিছুতেই সায় নেই। জালে জড়িয়ে পড়া অসহায় প্রাণীর মতো কালো চোখ দুটিতে ভাসছে আকুলতা আর আর্তি–বেরোবার পথ যে আর নেই তা অন্তর দিয়ে যেন বুঝতে পেরেছেন। এই অবস্থায় যখন দেখলেন বিখ্যাত গোয়েন্দা এসেছে তাকে বাঁচাতে, তখন রং ফুটল দুই গালে, আলো জাগল দুই চোখে।
খাটো গলায় উত্তেজনা ভাসিয়ে বললেন, মিস্টার নীল গিবসনের কাছে শুনেছেন তো আমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক?
শুনেছি। কিন্তু কোর্টে সব কথা খুলে বলেননি কেন? শুধোয় হোমস।
ভেবেছিলাম একদিন সত্য প্রকাশ পাবে। ঘরোয়া কেলেঙ্কারি পাবলিককে জানাতে চাইনি। এখন দেখছি সত্য প্রকাশ পাচ্ছে না–আরও তলিয়ে যাচ্ছে।
তা ঠিক। আপনার অবস্থা এখন খুব সঙিন। কাজেই আমার অনুরোধ কিছু লুকোবেন না।
না, কিছুই লুকোব না।
তাহলে বলুন মিসেস গিবসনের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক আসলে কীরকম ছিল।
ঘৃণার, বিদ্বেষের, ঈর্ষার। আমাকে দু-চক্ষে দেখতে পারতেন না। গরমের দেশের মেয়ে স্বভাবও তাই। আধাআধি কিছু করেন না–যা করেন পুরোপুরি। আমাকে ঘেন্না করার ব্যাপারেও তাই। ওঁর স্বামীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আত্মিক, সম্পূর্ণ মানসিক এবং তার মঙ্গলের জন্যেই ও-বাড়িতে আমি থেকে গিয়েছিলাম তা বুঝতে পারেননি। এখন দেখছি, আমি না-থাকলেও ও-বাড়িতে সুখ কোনোদিন ফিরে আসত না।
ঠিক কী-কী ঘটেছিল সেই রাতে পর পর বলে যান।
বলব, কিন্তু কতকগুলো ব্যাপারের অর্থ বুঝিয়ে বলতে পারব না।
আপনি না-পারলেও অন্যে পারবে। আপনি খালি ঘটনাগুলো বলে যান।
থর ব্রিজে গিয়েছিলাম মিসেস গিবসনের চিঠি পেয়ে। সকাল বেলা স্কুলরুমে বোধ হয় নিজের হাতেই চিঠিখানা রেখে গিয়েছিলেন। ডিনারের পর যেন দেখা করি, খুব জরুরি দরকার, কথা আছে। আমার জবাব যেন বাগানের সূর্যঘড়ির ওপর রেখে আসি। ওঁর চিঠিখানা যেন। পড়বার পর পুড়িয়ে ফেলি। অবাক হইনি। স্বামীকে যমের মতো ভয় করতেন। স্ত্রীর সঙ্গে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ব্যবহার করতেন মিস্টার গিবসন। এ নিয়ে অনেকবার বকাবকি করেছি ওঁকে।
মিসেস কিন্তু আপনার চিঠি পোড়াননি–খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। মৃত্যুর সময়ে চিঠি মুঠোয় ছিল শুনে খুবই অবাক হয়েছি।
তারপর কী হল?
কথা দিয়েছিলাম বলেই গেলাম। যাওয়ার পর বুঝলাম কীভাবে মনেপ্রাণে আমাকে উনি ঘেন্না করতেন। এক বাড়িতে এতদিন থেকেছি, অথচ একবারের জন্যেও বুঝতে দেননি আমি ওঁর দু-চক্ষের বিষ। বুঝিয়ে দিলেন সেইদিন। যা মুখে এল বলে গেলেন। সেসব কথা শোনাও পাপ। কানে হাত চাপা দিয়ে পালিয়ে আসতে আসতে শুনলাম চিলের মতো চেঁচিয়ে আমার মুণ্ডপাত করছেন। দাঁড়িয়ে ছিলেন থর ব্রিজের মুখের কাছে।
মৃতদেহ পরে কোথায় পাওয়া গেল?
যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তার কয়েক গজ দূরে।
ফেরার পথে গুলি ছোড়ার শব্দ শোনেননি?
না। ভীষণ উত্তেজিত ছিলাম। শোনবার বা দেখবার মতো মনের অবস্থা ছিল না। সোজা নিজের ঘরে গেছিলাম।
ঘর থেকে আবার বেরিয়েছিলেন সকালের আগে?
হ্যাঁ। মিসেস গিবসন খুন হয়েছেন শুনেই সবার সঙ্গে দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
মিস্টার গিবসনকে তখন দেখেছিলেন?
হ্যাঁ। ব্রিজ থেকে ফিরে ডাক্তার আর পুলিশকে খবর পাঠাচ্ছিলেন।
খুব বিচলিত মনে হয়েছিল?
মিস্টার গিবসন শক্ত মানুষ। ভেতরের আবেগ বাইরে ফোঁটান না। তা সত্ত্বেও মনে হয়েছিল। ভেতরে ভেতরে খুব নাড়া খেয়েছেন।
এবার আসল পয়েন্টে আসা যাক। পিস্তলটা আগে দেখেছিলেন?
জীবনে না।
পাওয়া গেল কখন?
পরের দিন সকালে পুলিশ এসে যখন সার্চ করল।
আপনার জামাকাপড়ের মধ্যে?
হ্যাঁ, নীচের তাকে।
কতক্ষণ ছিল সেখানে বলে মনে হয়?
তার আগের সকালেও ছিল না।
কী করে জানলেন?
ওয়ার্ডরোব গুছিয়েছিলাম বলে।
তাহলে ঘরে ঢুকে কেউ পিস্তল রেখে গেছে আপনাকে ফাঁসানোর জন্যে।
নিশ্চয় তাই।
কিন্তু কখন?
খাবার সময়ে অথবা যখন ছেলে-মেয়েদের নিয়ে স্কুলঘরে ছিলাম তখন! চিঠি পাওয়ার পর ওই ঘরেই ছিলেন? সমস্ত সকালটা ছিলাম।
পাথরের ব্রিজে এক জায়গায় চটা উঠে গেছে। সদ্য পাথর ভেঙেছে। লাশ যেখানে পড়ে ছিল–ঠিক তার উলটোদিকে। কেন বলতে পারেন?
নিছক কাকতালীয়।
খুবই অদ্ভুত কাকতালীয়, মিস ডানবার। ঠিক যেখানে যে সময়ে খুন হল, পাথরের চটা উঠল কেন ঠিক সেই জায়গায় সেই সময়ে?
উঠবেই-বা কী করে? গায়ের জোরে পাথরে ঘা না-মারলে ওভাবে চটা ওঠানো যায় না।
জবাব দিল না হোমস। আচমকা টানটান হয়ে গেল পাণ্ডুর মুখখানা–ধূসর দুই চোখে ভেসে উঠল দূরায়ত দৃষ্টি। এ-দৃষ্টি আমি চিনি। রহস্যকূপের নিতলে তলিয়ে সূত্র অন্বেষণে ধ্যানস্থ এখন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রহস্যসন্ধানী। ধ্যানমগ্ন সেই মূর্তির সামনে কথা বলারও সাহস হল না আমার, ব্যারিস্টারের বা মিস ডানবারের। আচমকা তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে প্রচণ্ড স্নায়বিক শক্তিতে থরথরিয়ে কেঁপে উঠে যেন ফেটে পড়ল আত্যন্তিক আবেগ, ওয়াটসন, চলো!
কী হল, মিস্টার হোমস?
মাই ডিয়ার লেডি, অন্ধকারে আলো দেখা যাচ্ছে, রহস্যের মেঘ উঠে যাচ্ছে। মিস্টার কামিংস, শিগগিরই সারাইংলন্ড কাপিয়ে দেওয়ার মতো একখানা কেস আপনাকে দেব। মিস ডানবার, খবর পাবেন কাল সকালেই।
উইনচেস্টার থেকে থর প্লেস খুব একটা লম্বা পথ নয় কিন্তু ট্রেনে বসে ছটফট করতে লাগল শার্লক হোমস পথ যেন আর ফুরোচ্ছে না। থর প্লেসের কাছাকাছি আসতেই আচমকা আমার মুখোমুখি বসে দু-হাত আমার হাঁটুর ওপর রেখে দুই চোখে বিষম কৌতুক আর প্রচণ্ড নষ্টামি নাচিয়ে বললে, ওয়াটসন, অভিযানে বেরোলেই সঙ্গে পিস্তল রাখ তুমি, তাই না?
রাখি ওর জন্যেই। সমস্যায় ড়ুবে গেলে আত্মরক্ষার খাতিরে পিস্তল নেওয়ার কথাও খেয়াল থাকে না হোমসের–তাই বহুবার প্রয়োজনের মুহূর্তে আমার পিস্তল বাঁচিয়ে দিয়েছে ওর অমূল্য জীবন। কথাটা মনে করিয়ে দিলাম।
ও বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি আবার একটু অন্যমনস্ক এসব ব্যাপারে। পিস্তলটা এবারেও এনেছ আশা করি?
হিপ-পকেট থেকে বার করে দিলাম হাতিয়ার। ক্যাচ খুলে বুলেটগুলো হাতে নিয়ে হোমস বললে, বড্ড ভারী দেখছি।
নিরেট বলেই ভারী।
মিনিটখানেক কী যেন ভাবল হোমস।
বলল, ভায়া, এ-তদন্তে তোমার এই পিস্তল একটা বড়ো ভূমিকা নিতে যাচ্ছে।
মাই ডিয়ার হোমস, ইয়ার্কি মেরো না।
আমি কিন্তু সিরিয়াস। একটা টেস্ট করব–টেস্টে তোমার পিস্তল যদি পাশ করে যায়–তাহলেই কেল্লা ফতে। একটা বুলেট বাইরে রাখলাম–পাঁচটা ভেতরে রাখলাম আরও ওজন বাড়ল। চমৎকার।
ওর মাথায় যে কীসের খেলা চলছে, বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারলাম না। বসে রইলাম চুপচাপ। হ্যাম্পশায়ার স্টেশনে পৌঁছে একটা ছ্যাকড়াগাড়ি নিয়ে হাজির হলাম সার্জেন্টের আস্তানায়।
সূত্র পেয়েছেন নাকি, মিস্টার হোমস?
সেটা নির্ভর করছে ডক্টর ওয়াটসনের পিস্তল কীরকম ব্যবহার করে আমাদের সঙ্গে তার ওপর। এই নিন পিস্তলটা। দশগজ সরু দড়ি দিতে পারেন?
টোয়াইন সুতোর একটা গোলা পাওয়া গেল গাঁয়ের দোকান থেকে।
এতেই হবে, বলল হোমস। চলো এবার অভিযানের শেষ পর্ব শুরু করা যাক।
তখন সূর্য ড়ুবেছে। হ্যাম্পশায়ারের দিগন্তবিস্তৃত তরঙ্গায়িত জলাভূমি অপূর্ব সুন্দর লাগছে পড়ন্ত আলোয়। হোমসের মস্তিষ্ক আদৌ সুস্থ আছে কি না, সে-সন্দেহ হরেকরকমভাবে প্রকাশ পাচ্ছে সার্জেন্টের বক্র চাহনির মধ্যে। অকুস্থলে গিয়ে বুঝলাম বাইরে যতই স্থির থাকতে চেষ্টা করুক না কেন, ভেতরে ভেতরে দারুণ উত্তেজিত হয়েছে শার্লক হোমস।
আমার টিপ্পনীর জবাবে বললে, আগে বেশ কয়েকবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছি তুমি জান। আমি সহজাত অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পারি লক্ষ্যটা কোথায়–তা সত্ত্বেও অনেক সময়ে হেদিয়ে মরেছি। এ-কেসেও উইনচেস্টার জেলে বসেই বিদ্যুৎচমকের মতো সম্ভাবনাটা খেলে গেছে মাথার মধ্যে দেখা যাক তা কতদূর সত্যি।
হাঁটতে হাঁটতেই টোয়াইন সুতোয় একদিক শক্ত করে বেঁধে নিয়েছিল রিভলভারের হ্যান্ডেলে। অকুস্থলে পৌঁছে সার্জেন্টের মুখে শোনে ঠিক কোন জায়গায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে মিসেস গিবসনের মৃতদেহ। তারপর খুঁজেপেতে একটা বড়োসড়ো পাথর এনে সুতোর আর একদিক বাঁধল পাথরে। ঝুলিয়ে দিল পাথরের পাঁচিলের অন্য দিকে। পাথর ঝুলতে লাগল জলের ঠিক ওপরে। তারপর লাশ যেখানে পড়েছিল, ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে টান টান সুতোয় বাঁধা আমার পিস্তলটা হাতে নিয়ে বলল সোল্লাসে, এইবার।
বলেই, পিস্তল ঠুসে ধরল নিজের রগে এবং মুঠি আলগা করল পর মুহূর্তেই। চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতে ঝুলন্ত পাথরের ওজন পিস্তলটাকে সাঁৎ করে টেনে নিয়ে গেল ব্রিজের ওপর দিয়ে, ঠকাং করে লাগল উলটোদিকের পাঁচিলে এবং চোখের নিমেষে পাঁচিল টপকে অদৃশ্য হয়ে গেল জলের তলায়। একলাফে পাথুরে পাঁচিলের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বিষম উল্লাসে যেন ফেটে পড়ল শার্লক হোমস।
পেয়েছি! পেয়েছি! এর চাইতে অকাট্য হাতেনাতে প্রমাণ আর হয় না! দেখলে তো ওয়াটসন, সমস্যার সমাধান করল তোমার রিভলভার! দেখলাম, পাঁচিলের তলার দিকে চটা উঠে গেছে পিস্তলের ঘায়ে আগের চটার ঠিক পাশে–সাইজ এবং আকার হুবহু এক।
বিমূঢ় বিস্মিত সার্জেন্টের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হোমস বললে, আজ রাতটা সরাইখানায় কাটাব। আঁকশি-হুক এনে আমার বন্ধুর রিভলভারটা উদ্ধার করে দিন। পাশেই পাবেন সুতো আর পাথর বাঁধা আর একটা রিভলভার মিস্টার গিবসনের জুড়িদার রিভলভার–যা দিয়ে হিংসেয় জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে গিয়ে নিজের অপরাধ গোপন করে নিরপরাধিনীকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে চেয়েছিলেন মিসেস গিবসন। মিস্টারকে জানিয়ে দেবেন কাল সকালে আমি যাব ওঁর কাছে, তারপর মিস ডানবারকে খালাস করার ব্যবস্থা করা যাবেখন।
সেইদিনই রাত্রে সরাইখানায় বসে পাইপ টানতে টানতে হোমস বললে, ওয়াটসন, থর ব্রিজ রহস্য নিয়ে তুমি গল্প নিশ্চয় লিখবে, কিন্তু আমার সুনাম খুব একটা বাড়বে না। আমার গোয়েন্দাগিরি আর্টের মূল ভিত হল কল্পনা আর বাস্তবের সহাবস্থান। এ-কেসে আমি তার কথা ব্যবহার করতে পারিনি। পাথরের চটা চোখের সামনেই ছিল কিন্তু অতবড়ো সূত্রটা দেখেও কল্পনাকে কাজে লাগাতে দেরি করেছি।
মিসেস গিবসনের মনে যে-খেলা চলছিল, তা এত গভীর যে ওপর ওপর বোঝার সাধ্যি কারোরই ছিল না। ভালোবাসা বিকৃত হলে যে অঘটন ঘটাতে পারে, আমাদের এতদিনকার অ্যাডভেঞ্চারময় জীবনে তা কখনো ঘটেনি। স্বামীর ওপর মিস ডানবারের আত্মিক অথবা মানসিক প্রভাবের কদৰ্থ উনি করেছিলেন। ভেবেছিলেন স্বামী তার সঙ্গে যে গহিত আচরণ করছে, তার ইন্ধন জুগিয়ে চলেছেন মিস ডানবার। তাই প্রথমে নিজেকে হনন করে মিস ডানবারকে এমন দণ্ড দিতে চেয়েছিলেন যা আকস্মিক মৃত্যুর চাইতে অনেক বেশি ভয়াবহ।
প্লট তৈরি করলেন খুব ভেবেচিন্তে নিখুঁতভাবে। কায়দা করে চিঠি লিখিয়ে নিলেন মিস ডানবারকে দিয়ে দেখে মনে হবে যেন তিনি নিজেই দেখা করতে গিয়েছিলেন থর ব্রিজে। শেষ মুহূর্তে একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলেছিলেন চিরকুটটা মুঠোয় ধরে রেখে–এই একটা বিসদৃশ ব্যাপার দেখেই যেকোনো সন্দিগ্ধ মানুষের সজাগ হওয়া উচিত ছিল।
বাড়িতে সিন্দুকে অনেক পিস্তল ছিল। একটা নিলেন কাজ সারার জন্যে! জোড়া পিস্তলটা নিয়ে জঙ্গলে গিয়ে একটা গুলি ছুঁড়ে এনে সকালের দিকে লুকিয়ে রাখলেন মিস ডানবারের ওয়ার্ডরোবের জামাকাপড়ের মধ্যে। তারপর গেলেন থর ব্রিজে অত্যন্ত মৌলিক পন্থায় হাতিয়ার উধাও করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। মিস ডানবার এলেন। আশ মিটিয়ে তাকে গালাগাল দিলেন। মিস ডানবার পালিয়ে যেতেই চক্রান্ত যবনিকা ফেললেন নিজের জীবনে যবনিকা টেনে। রহস্য-শৃঙ্খলে এখন আর কোথাও কোনো ফাঁক নেই–পাশাপাশি সাজানো হয়ে গেল সবকটা আংটা। খবরের কাগজগুলো অবশ্য এরপর চেঁচিয়ে আকাশ ফাটাবে আগেভাগে জলায় জাল ফেলা কেন হয়নি বলে, কিন্তু এতবড়ো জলায় ঠিক কোথায় জাল ফেলা দরকার হয় সেটা জানা না-থাকলে সে-প্রশ্ন ওঠে না। যাই হোক ওয়াটসন, এক আশ্চর্য মহিলা আর এক ভয়াবহ পুরুষকে যুগপৎ সাহায্য করে গেলাম আমরা। এবার দেখা যাক দুজনের বিপুল শক্তি একত্র হয়ে আর্থিক দুনিয়ার কতখানি মঙ্গলসাধন করে। মিলিত ওঁরা হবেনই এবং সারাদুনিয়া জানবে দুঃখের যে পাঠশালায় আমরা সবাই শিক্ষালাভ করি–নীল গিবসন সেই পাঠশালা থেকে কী শিক্ষা শিখে এলেন।
———-
টীকা
প্রস্তরের প্রহেলিকা : দ্য প্রবলেম অব থর ব্রিজ প্রকাশিত হয় স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের ১৯২২-এর ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ সংখ্যায় দুই কিস্তিতে। আমেরিকার হার্স্ট ইন্টারন্যাশনাল ম্যাগাজিনেও দুই কিস্তিতে এই গল্প প্রকাশিত হয়েছিল ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ ১৯২২ সংখ্যায়।
কক্স অ্যান্ড কোম্পানি : লয়েডস টি. এস. বি. ব্যাঙ্কের শেরিংক্রস শাখার অবস্থান ছিল স্ট্র্যান্ডে। প্রবেশপথের ওপর কক্স অ্যান্ড কোম্পানির বোর্ড টাঙানো আছে।
এইচ : ওয়াটসনের মধ্যনামের এই আদ্যক্ষর জানানো হয়েছিল আ স্টাডি ইন স্কারলেট উপন্যাসে। তবে পুরো নামটি কোথাও বলা হয়নি।
ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর : ওয়াটসন ছিলেন বার্কশায়ার অ্যান্ড নাম্বারল্যান্ড ফুসিলিয়ার্স-এর সদস্য। এই গোলন্দাজ বাহিনী ভারতীয় নয়, ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত।
অ্যালিসিয়া জাহাজ : এক গবেষক জানিয়েছেন, ১৮৯১-৯২-এর লয়েডস-এর তালিকায় অ্যাসিলিয়া নামের একটি জাহাজের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই জাহাজ ১৮৭৭-এ নির্মিত হয় এবং ১৮৯১ পর্যন্ত চালু ছিল।
বিলি : বিলি-র উল্লেখ পাওয়া যায় দ্য মাজারিন স্টোন এবং এই গল্পে, এ ছাড়া দ্য ভ্যালি অব ফিয়ার উপন্যাসে।
সোনা খোঁজার সময়ে : ব্রেজিলে গোল্ড-রাশ হয়েছিল ১৬৯৫ সাল থেকে, যখন মিনাস গেরাইস-এ সোনা আবিষ্কৃত হয়।
নিজের জীবনে যবনিকা টেনে : ইংলন্ডের আইনে আত্মহত্যা অপরাধ। ১৮৭০ পর্যন্ত কেউ আত্মহত্যা করলে তার সম্পত্তি রাজা বাজেয়াপ্ত করত। তা সত্ত্বেও ইউরোপে সর্বাধিক আত্মহত্যার ঘটনা ইংলন্ডেই ঘটত বলে জানা যায়।