দি অ্যাডভেঞ্চার অফ শসকোম ওল্ড প্লেস

দি অ্যাডভেঞ্চার অফ শসকোম ওল্ড প্লেস

পাতালের পাপচক্র
[দি অ্যাডভেঞ্চার অফ শসকোম ওল্ড প্লেস]

অনেকক্ষণ ধরে একটা লো-পাওয়ার মাইক্রোস্কোপের ওপর হেঁট হয়ে ছিল শার্লক হোমস। এবার সিধে হয়ে বিজয়গৌরবে তাকাল আমার দিকে।

বলল, জিনিসটা আঠা–কোনো সন্দেহই নেই। ফিল্ডে ছড়ানো বস্তুগুলো দেখলেই বুঝবে।

আই-পিসে চোখ রেখে ফোকাস ঠিক করলাম।

রোঁয়াগুলো টুইড কোটের। ধূসর জিনিসটা ধুলো। বাঁ-দিকের জিনিসটা কোষ থেকে উঠে আসা খোসা। মাঝখানের বাদামি বড়িগুলো আঠা।

হেসে বললাম, মানলাম। কিন্তু তাতে হলটা কী?

সেন্ট প্যানক্র্যাস কেসে মৃত পুলিশের পাশে একটা টুপি পাওয়া গিয়েছিল মনে আছে? যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে বলছে টুপি তার নয়। কিন্তু ছবি বাঁধানো তার পেশা–আঠা নিয়ে তার কারবার।

কেসটা তোমার?

নো, মাই ফ্রেন্ড। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দা মেরিভেলের অনুরোধে একটু নাক গলিয়েছি। কোটের হাতার সেলাইয়ের মধ্যে দস্তা আর তামার গুঁড়ো পেয়ে হাতেনাতে সেবার এক জালিয়াতের টাকা জাল করার কীর্তি ফাঁস করে দেওয়ার পর থেকেই ওদের টনক নড়েছে, মাইক্রোস্কোপের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে। বলতে বলতে অধীরভাবে তাকাল ঘড়ির দিকে—নতুন এক মক্কেলের আসবার সময় হয়ে গেছে। ভালো কথা। ঘোড়দৌড় সম্বন্ধে খবরটবর কিছু রাখ?

আলবাত রাখি। পেনশনের অর্ধেক তো ঘোড়ার পেছনেই ওড়াই।

তাহলে তোমাকেই জিজ্ঞেস করা যাক। স্যার রবার্ট নরবারটন লোকটা কে? কী জান তার সম্পর্কে?

শসকোম ওল্ড প্লেসে থাকেন। গরমের সময়ে কিছুদিন ছিলাম সেখানে। নরবারটন একবার এমন একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসেছিলেন যা তোমার আওতায় আসে।

কীভাবে?

নিউমার্কের হীথের নাম করা কার্জন স্ট্রিট মহাজন স্যাম ড্রয়ারকে ঘোড়ার চাবুক দিয়ে মারতে মারতে প্রায় মেরে এনেছিলেন।

ইন্টারেস্টিং! হামেশাই কি এমনি করেন?

সবাই জানে স্যার নরবারটন বড়ো বিপজ্জনক লোক। সারা ইংলন্ড ছুঁড়ে এলে অমন ডেয়ার ডেভিল ঘোড়সওয়ার আর দুটি পাবে কি না সন্দেহ–বছর কয়েক আগে গ্র্যান্ড ন্যাশনালে সেকেন্ড হয়েছিল। ভালো স্পোর্টসম্যান হতে পারতেন। বক্সিং, ঘোড়দৌড়, খেলাধুলো আর সুন্দরী মেয়ে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন–ওঁর আমলে সবাই যা করেছে। কিন্তু সে-সুযোগ আর ফিরে আসবে না।

চমৎকার! নখদর্পণ বর্ণনা দিলে দেখছি। চোখের সামনে যেন দেখতে পাচ্ছি স্যার নরবারটনকে। শসকোম ওল্ড প্লেস সম্পন্ধে একটু আইডিয়া দিতে পারবে?

জায়গাটা শসকোম পার্কের ঠিক মাঝখানে। ঘোড়া চড়ানোর, পাল ধরানোর আর ট্রেনিং দেওয়ার বিখ্যাত ঘাঁটিটা যেখানে–সেইখানে।

হোমস বললে, হেড ট্রেনার হল জন ম্যাসন। চমকে উঠলে দেখছি। ওয়াটসন, এ-জ্ঞানটুকু অর্জন করলাম এইমাত্র ওই চিঠিখানা থেকে–লিখেছেন জন ম্যাসন স্বয়ং। তার আগে শসকোম সম্পর্কে আরও খবর শোনা যাক। ভালো খোরাক মিলবে মনে হচ্ছে।

শসকোম স্প্যানিয়েলের নাম নিশ্চয় শুনেছ। সাড়া জাগানো কুকুর। ইংলন্ডে অমন স্প্যানিয়েল আর কোথাও হয় না। শসকোম ওল্ড প্লেসের লেডির ভারি জাঁক তাই নিয়ে।

স্যার রবার্ট নরবারটনের স্ত্রী?

স্যার রবার্ট বিয়েই করেননি। বউ পুষতে পারবেন না জেনেই বোধ হয় করেননি। থাকেন বিধবা বোন লেডি বিয়েট্রিস ফালডারের সঙ্গে।

স্যার রবার্টের সঙ্গে থাকেন লেডি বিয়েট্রিস–এই বলতে চাও তো?

আরে, না, না। জায়গাটা লেডি বিয়েট্রিসের স্বর্গত স্বামী স্যার জেমসের। নরবারটনের কোনো দাবিই নেই। যদ্দিন বাঁচবেন, তদ্দিন ভোগ করতে পারবেন লেডি। তারপর পাবে দেওর। বছর বছর ভাড়ার টাকাও ভোগ করেন লেডি।

গুণধর ভ্রাতা রবার্ট নিশ্চয় সেই টাকা ওড়ান?

প্রায় তাই। লোক বড়ো খারাপ। বোনকে জ্বালিয়ে মারছেন সন্দেহ নেই। তবেভাইকে ভালোবাসেন এমন কথাও শুনেছি। কিন্তু শসকোমে এমনি কী কাণ্ড ঘটল যে এত কথা জিজ্ঞেস করছ?

আরে, সেইটা জানবার জন্যেই তো পথ চেয়ে বসে আছি। ভদ্রলোক এসে গেলেন মনে হচ্ছে।

দরজা খুলে গেল। ছোকরা চাকর যাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল তাঁর চোখ-মুখের কাঠিন্য, দৃঢ়তা আর শুষ্কতা দেখলেই বোঝা যায় ঠেটিয়া লোক আর তেড়িয়া ঘোড়া দমন করে রীতিমতো পোক্ত পুরুষ। জন ম্যানসনের এ-সুনাম আছে বই কী। সংযতভাবে মাথা হেলিয়ে অভিবাদন জানিয়ে বসলেন হোমসের দেখিয়ে দেওয়া চেয়ারে।

চিঠি পেয়েছেন, মিস্টার হোমস?

পেয়েছি। কিন্তু বুঝিনি।

ব্যাপারটা এতই ঘরোয়া যে চিঠিতে জানাতে পারিনি। জটিলও বটে। সামনাসামনি বলতে চাই।

বলুন।

প্রথমেই বলতে চাই, আমার অন্নদাতা স্যার রবার্ট পাগল হয়ে গেছেন।

ভুরু তুলে হোমস বললে, এটা বেকার স্ট্রিট, হার্লে স্ট্রিট নয়। কিন্তু কথাটা কেন বললেন?

একটা দুটো অদ্ভুত কাণ্ড করলে উড়িয়ে দেওয়া যায়। পর পর অদ্ভুত ব্যাপার করে গেলে খটকা লাগে। আমার বিশ্বাস, ভদ্রলোকের মাথা বিগড়েছে ডার্বি আর শসকোম প্রিন্সকে নিয়ে।

আনাড়ি বাচ্চা ঘোড়া শসকোম প্রিন্স?

কিন্তু ইংলন্ডে অমন ঘোড়া আর নেই, মিস্টার হোমস তা আর কেউ না-জানুক, আমি জানি। কথাটা আশা করি এ-ঘরের বাইরে যাবে না। এ-ডার্বি জিততেই হবে স্যার রবার্টকে। দেনায় ড়ুবে আছেন–এই তার শেষ সুযোগ। যেখান থেকে যা পেয়েছেন–ধার দেনা করে সর্বস্ব বাজি ধরেছেন। যখন ধরেছিলেন, তখন রেট ছিল প্রায় এক-শো। এখন তা চল্লিশে এসে ঠেকেছে।

কিন্তু ঘোড়া যদি অতই ভালো হবে তো দর পড়বে কেন?

পাবলিক জানে না শসকোম প্রিন্স কত উঁচু জাতের ঘোড়া। স্যার রবার্ট চালাকি করে দালালদের ধোঁকা দিয়ে রেখেছেন। প্রিন্সের মতোই দেখতে একটা ঘোড়াকে তিনি লাফঝাঁপ করাতে মাঠে পাঠান–তফাতটা কেউ ধরতে পারে না। কিন্তু আমি জানি এক ফার্লং১০ দৌড়োলেই দু-ঘোড়ার মাপে তফাত থেকে যায় দুজনের মধ্যে। ঘোড়া আর বাড়ি ছাড়া স্যার রবার্টের মাথায় এখন আর কিছু নেই। জীবনটাই ঝুলছে ডার্বির ওপর। তদ্দিন কোনোমতে ঠেকিয়ে রেখেছেন সুদখোর ইহুদিদের। প্রিন্স হারলে স্যার রবার্টকে ছিঁড়ে খাবে এরা। বড়ো মারাত্মক জুয়োয় নেমেছেন দেখছি। এবার বলুন পাগলামিটা কী দেখলেন? চোখের দেখা দেখলেই বুঝবেন। রাতে ঘুমোন বলে মনে হয় না। সারারাত আস্তাবলে কাটান। চোখ দুটোই দাঁড়িয়েছে পাগলের চোখের মতো। নার্ভ আর সইতে পারছে না। এ ছাড়াও আছে লেডি বিয়েট্রিসের সঙ্গে তাঁর অদ্ভুত ব্যবহার।

কীরকম?

ভাইবোনে দারুণ বন্ধুত্ব। রুচিতেও দারুণ মিল। দুজনেই ঘোড়ার ভক্ত! প্রতিদিন ঘড়ি ধরে ঘোড়া দেখতে লেডি যান গাড়ি চেপে, যান স্যার রবার্টও। প্রিন্সকে দারুণ ভালোবাসেন লেডি নিজেও। এত ভালোবাসেন যে নুড়ির ওপর গাড়ির চাকার কড়মড় আওয়াজ শুনলেই কান খাড়া করে শোনে প্রিন্স দৌড়ে বেরিয়ে যায় লেডির হাত থেকে চিনির ডেলা খেতে। কিন্তু সব এখন শেষ।

কেন?

ঘোড়া নিয়ে আর কোনো মাথাব্যথা নেই লেডির। এক হপ্তা ধরে আস্তাবলের পাশ দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন–গুড মর্নিং বলতেও দাঁড়াচ্ছেন না?

ঝগড়া হয়েছে, এই বলতে চান তো?

সাংঘাতিক ঝগড়া। নইলে যে স্প্যানিয়েলকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন লেডি, –সে-বেচারাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন স্যার রবার্ট? দিনকয়েক হল কুকুরটা দান করেছেন বুড়ো বানেজ, থাকে তিন মাইল দূরে ক্রেনড্যানের গ্রীন ড্রাগনে।

অদ্ভুত ব্যাপার তো!

লেডির শরীর খারাপ। হার্ট দুর্বল, সারাশরীর জলে ভরে উঠেছে ড্রপসি হওয়ায়। দুর্দান্ত ভাইয়ের সঙ্গে পারবেন কেন। আগে কিন্তু এই বোনের সঙ্গেই রোজ সন্ধ্যায় দু-ঘন্টা ঘরে বসে আড্ডা মেরে আসতেন। কিন্তু এখন সব শেষ। বোনের ছায়াও মাড়ান না। লেডির মন ভেঙে গেছে। মদ ধরেছেন। মদে ড়ুবে রয়েছেন।

ঝগড়া হওয়ার আগে মদ খেতেন?

এক আধ গেলাস খেতেন। এখন খান এক-এক সন্ধ্যায় পুরো বোতল। বাটলার স্টিফেন্স তো তাই বলল।

আরও আছে। পুরোনো গির্জের তলায় পাতাল সমাধি ঘরে কী করতে যান স্যার রবার্ট। রোজ একটা লোক এসে দেখা করে–কে সে?

দু-হাত ঘষে হোমস বললে, চালিয়ে যান, মিস্টার ম্যাসন। ক্রমশই জমিয়ে তুলছেন।

লোকটাকে বাটলারই দেখেছে। রাত তখন বারোটা। দারুণ বৃষ্টি হচ্ছিল। শুনে পরের রাতে আমি নিজে গেলাম দেখতে। সত্যিই দেখতে পেলাম না স্যার রবার্টকে বেরিয়ে পড়েছেন অত রাতেও। খোঁজে বেরোলাম আমি আর স্টিফেন্স। ধরা পড়লে মেরে খুন করে ফেলতেন স্যার রবার্ট–তাই কাছাকাছি যেতে ভরসা পেলাম না। দূর থেকে দেখলাম পোড়া পাতালঘরেই ঢুকলেন সেই লোকটাকেও দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে ওর পথ চেয়ে।

পোড়া পাতালঘরটা কী?

পার্কে একটা পুরোনো ভাঙা গির্জে আছে। কত পুরোনো, তা কেউ জানে না। মাটির তলায় আছে একটা সমাধি ঘর–জায়গাটা খারাপ দুর্নাম আছে–লাখ টাকা দিলেও রাত্রে সেখানে কেউ যেতে চায় না। ঠান্ডা, স্যাঁৎসেঁতে অন্ধকার। কিন্তু স্যার রবার্টের ভয়ডর নেই। অত রাতে

কী করতে যান পাতাল গোরস্থানে?

সঙ্গে যে থাকে, সে আস্তাবলের কেউ নয় তো? অথবা বাড়ির কোনো লোক?

সে-রকম কেউ না।

জানছেন কী করে?

লোকটাকে দেখেছি। দ্বিতীয় রাত্রে পেছন পেছন গিয়ে ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে বসে ছিলাম আমি আর স্টিফেন্স। চাঁদের আলোয় পাশ দিয়ে চলে গেলেন স্যার রবার্ট। স্পষ্ট শুনলাম, পেছন পেছন আর একজন আসছে। তাকে অত ভয় কীসের? স্যার রবার্ট চলে যেতেই ঝোপ থেকে বেরিয়ে এলাম। যেন হাওয়া খাচ্ছি এমনিভাবে পেছনে গিয়ে বললাম, আরে! তুমি আবার কে? আমরা যে পেছনে এসেছি, লোকটা তা টের পায়নি। তাই ঘাড় ফিরিয়ে দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। বিকট চেঁচিয়ে পাঁই পাঁই করে পালিয়ে গেল চক্ষের পলকে। কী দৌড়! কোত্থেকে এসেছে, কে সে কিছুই জানা গেল না।

চাঁদের আলোয় মুখটা কিন্তু স্পষ্ট দেখেছিলেন?

হলদেটে মুখ–লেড়ি কুত্তার মতো নোংরা। স্যার রবার্টের সঙ্গে এমন লোকের সম্পর্কটা কী বলতে পারেন?

কিছুক্ষণ চিন্তায় ড়ুবে রইল হোমস।

লেডি বিয়েট্রিসকে সঙ্গ দেন কে? ক্যা

রি ইভ্যান্স–বছর পাঁচেক হল এ-কাজ করছেন মেয়েটা।

লেডি বলতে অজ্ঞান নিশ্চয়?

অজ্ঞান যে কার জন্যে, সে-বিষয়ে সন্দেহ আছে।

বুঝেছি। পরিস্থিতি বিলক্ষণ ঘোরালো দেখছি। ডক্টর ওয়াটসন একটু আগে স্যার রবার্টের যে-বর্ণনা শোনালেন, তা থেকে এটুকু বোঝা গেছে যে ভদ্রলোকের খপ্পর থেকে কোনো মেয়ে। রেহাই পায় না। ভাইবোনে ঝগড়ার সূত্রপাত এই নিয়ে নয় তো?

কিন্তু সে-কেলেঙ্কারি তো আজকের নয়।

লেডি বিয়েট্রিস হয়তো সম্প্রতি জেনেছেন। ধরে নেওয়া যাক, হঠাৎ ব্যাপারটা চোখে পড়েছে। মেয়েটিকে তাই ভাগাতে চান। ভাই রাজি নয়। দুর্বল হৃৎপিণ্ড আর অশক্ত শরীর নিয়ে জোর করতেও পারছেন না লেডি। মেয়েটা চোখের বালি হওয়া সত্ত্বেও কাছছাড়া হচ্ছে না। তাই কথা বন্ধ করে চুপচাপ মদ ধরলেন লেডি। রাগের চোটে বোনের স্প্যানিয়েলকে বাড়ি থেকে

সরিয়ে দিলেন স্যার রবার্ট। কি, সব মিলে যাচ্ছে না?

যতক্ষণ মেলার ততক্ষণ মিলছে।

যা বলেছেন। কিন্তু রাতদুপুরে পাতাল গোরস্থানে স্যার রবার্টের হানা দেওয়ার সঙ্গে কী সম্পর্ক এই ব্যাপারের? এটাকে তো খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না।

আজ্ঞে, না। এমনি আরও অনেক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে যা খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। যেমন, রাতদুপুরে মাটি খুঁড়ে মড়া বার করেন কেন স্যার রবার্ট?

আচমকা সিধে হয়ে বসল হোমস।

আপনাকে চিঠি লেখবার পর ব্যাপারটা জানলাম–গতকাল। লন্ডনে এসেছিলেন স্যার রবার্ট। সেই ফাঁকে পাতাল গোরস্থানে গেছিলাম আমি আর স্টিফেন্স। এককোণে নরদেহের মতো একটা বস্তু দেখলাম।

পুলিশকে খবর দিয়েছেন?

আজ্ঞে, পুলিশের মাথা তাতে ঘামবে বলে মনে হয় না। নরদেহ বলতে একটা মমিদেহের শুধু একটা মাথা আর খানকয়েক হাড়। হয়তো হাজার বছর আগেকার। কিন্তু আগে এ-জিনিস ওখানে ছিল না। স্টিফেন্সও বলল তাই। কোণটা ফাঁকা ছিল চিরকাল। এখন এই হাড়গোড় সেখানে জড়ো করে কাঠ চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।

দেখে কী করলেন?

যেখানকার জিনিস, সেইখানেই রেখে দিলাম।

বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। স্যার রবার্ট গতকাল লন্ডনে এসেছিলেন বললেন। আজ ফিরেছেন?

আশা করছি।

বোনের কুকুর দান করেছেন কবে?

আজ থেকে ঠিক সাতদিন আগে। ভীষণ চেঁচাচ্ছিল বেচারা। সকাল থেকেই মেজাজ তিরিক্ষে হয়েছিল স্যার রবার্টের। এমনভাবে বেচারাকে টেনে আনলেন ভাবলাম বুঝি এবার মেরেই ফেলবেন। জকি স্যান্ডিবেনকে ডেকে বললেন, গ্রিনড্রাগন-এ বার্নেজের কাছে রেখে আসতে–অমন কুকুরের মুখ আর দেখতে চান না।

পাইপ ধরিয়ে ভাবতে বসল হোমস।

তারপর বললে, আমাকে দিয়ে কী করাতে চান, এখনও কিন্তু সেটা স্পষ্ট হয়নি, মিস্টার ম্যাসন।

এই জিনিসটা দেখলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে–বলে, পকেট থেকে কাগজ মোড়া একটা পোড়া হাড় বার করলেন মিস্টার ম্যাসন।

সাগ্রহে দেখল হোমস, কোথায় পেলেন?

লেডি বিয়েট্রিসের ঘরের মাটির তলায় পাতালঘরে ঘর গরম করার ফার্নেস আছে। এতদিন পড়েই ছিল–জ্বালানো হয়নি। হঠাৎ স্যার রবার্ট বললেন, শীতে হাত-পা কালিয়ে যাচ্ছে ফার্নেস জ্বালানো হোক। আজ সকালে ছাই ঘাঁটতে গিয়ে এই হাড়টা ওর চোখে পড়ে। খটকা লাগায় নিয়ে আসে আমার কাছে।

খটকা আমারও লাগছে। ওয়াটসন, তোমার কী মনে হয়?

পুড়ে প্রায় কাঠকয়লার মতো হয়ে গেলেও হাড়ের গড়ন দেখে ভুল হওয়ার কথা নয়।

বললাম, মানুষের ঊরুর হাড়।

ঠিক বলেছ! অত্যন্ত সিরিয়াস হয়ে গেল হোমস।ছোঁড়াটা ফার্নেসে আগুন দেয় কখন?

সকালে।

রাত্রে যে কেউ সেখানে যেতে পারে?

পারে।

বাইরে থেকে এসে?

একটাই দরজা আছে বাইরের দিকে। আর একটা দরজা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে লেডি বিয়েট্রিসের ঘর যেখানে, সেই প্যাসেজে যাওয়া যায়।

ব্যাপারটা গভীর জলের, মিস্টার ম্যাসন। খুবই নোংরা। স্যার রবার্ট কাল রাতে বাড়ি ছিলেন না?

না।

তাহলে হাড় তিনি পোড়াননি।

খাঁটি কথা।

সরাইখানার নামটা কী বললেন?

গ্রিন ড্রাগন।

ও-অঞ্চলে মাছ ধরা যায়?

আরেক পাগলের পাল্লায় পড়েছেন, তা স্পষ্ট হয়ে উঠল ট্রেনারের মুখচ্ছবিতে।

যায়। ট্রাউট আর পাইক। নদীতে ট্রাউট, হল-লেকে পাইক।

চমৎকার! ওয়াটসন আর আমি দুজনেই নাম করা জেলে—তাইনা ওয়াটসন? গ্রিন ড্রাগন-এ এরপর দেখতে পাবেন আমাদের। আজ রাতেই পৌঁছোচ্ছি। নিজে আসবেন না, চিঠি লিখবেন। দরকার পড়লে গিয়ে দেখা করব। কেসটা আগে নাড়াচাড়া করি, তারপর জানাব আমার মতামত।

মে মাসের ঝকঝকে সন্ধ্যায় ফার্স্ট ক্লাস কামরায় চেপে রওনা হলাম শসকোম স্টেশন অভিমুখে। মাথার ওপর মাল রাখার তাকে থরে থরে সাজানো রইল ছিপ, রিল আর বাস্কেট। সরাইখানায় পৌঁছোনোর পর জোসিয়া বানেজ উল্লসিত হল আমাদের মাছ ধরার প্ল্যান শুনে।

হোমস বললে, হল-লেকে পাইক ধরলে কেমন হয়?

অন্ধকার হল বার্নেজের মুখ।

সুবিধে হবে না। ধরা পড়ে যাবেন মাছ ধরার আগেই।

তার মানে?

স্যার রবার্ট দালালদের একদম বরদাস্ত করেন না। ওঁর ট্রেনিং কোয়ার্টারের ধারেকাছে আপনাদের ঘুরঘুর করতে দেখলেই খেপে যাবেন।

ডার্বি রেসে ঘোড়া নামিয়েছেন, তাই না?

আজ্ঞে। ঘোড়াটা আনাড়ি, বাচ্চা। কিন্তু বাজি ধরেছেন সর্বস্ব। বলতে বলতে চিন্তা ঘনিয়ে এল বুড়োর চোখে, আপনারাও রেসের মাঠে যাতায়াত করেন নাকি?

একেবারেই না। এসেছি বার্কশায়ারের হাওয়া খেতে।

সেদিক দিয়ে ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। তবে স্যার রবার্ট সম্বন্ধে যা বললাম, খেয়াল রাখবেন। ভদ্রলোক আগে হাত চালান, পরে কথা বলেন। পার্কের ধারেকাছেও যাবেন না।

তা আর বলতে! হলে একটা স্প্যানিয়েলকে কেঁউ কেঁউ করতে দেখে এলাম। চমৎকার কুকুর কিন্তু।

তা তো হবেই। খাঁটি শসকোম জাতের যে। ইংলন্ডে আর কোথাও এমন স্প্যানিয়েল পাবেন।

কুকুর পুষতে বড়ো ভালোবাসি আমি। কীরকম দাম পড়ে এ-রকম কুকুরের?

এ-কুকুর কেনার টাকা আমার নেই। স্যার রবার্ট দিয়েছেন বলেই রেখেছি। চেন খুলে দিলে এখুনি হলে দৌড় দেবে।

বার্নের্জ চোখের আড়াল হতেই হোমস বললে, ওয়াটসন, অনেক খবর পাওয়া গেল। আরও আসবে দু-একদিনের মধ্যে। স্যার রবার্ট শুনলাম এখনও লন্ডনেই। আজ রাতেই পাতাল গোরস্থানে হানা দেব ভাবছি। কয়েকটা ব্যাপার খতিয়ে নিতে চাই।

কিছু আঁচ করেছ কি?

শুধু একটা ব্যাপার। দিন সাতেক আগে এমন কিছু ঘটেছে যা বেশ নাড়া দিয়ে গেছে শসকোম ফ্যামিলিকে। পরিণামে অনেকগুলো অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে।

যেমন রুগণ বোনের সঙ্গে আর দেখা করছেন না ভাই। বোনের প্রাণপ্রিয় কুকুরকে বিদেয় করেছেন বাড়ি থেকে। ওয়াটসন! খটকা লাগছে না? কিছু বুঝতে পারছ না?

কিছু না–ভাই রেগে কাই–এইটাই কেবল বোঝা যাচ্ছে।

রেগে কাই হতে পারে অন্য কিছুও হতে পারে। ঝগড়া আদৌ হয়েছে কি না জানা নেই–যদিও-বা হয়ে থাকে, তারপর থেকে কী ঘটেছে, এবার তা পর্যালোচনা করা যাক। রোজকার অভ্যেস পালটেছেন লেডি। ঘর থেকে বেরোন না, ঝিকে নিয়ে গাড়ি করে বেরোনোর সময় ছাড়া দেখা যায় না, আস্তাবলে গিয়ে প্রাণাধিক ঘোড়াকেও আর গুড মর্নিং বলেন না এবং শোনা যাচ্ছে মদও ধরেছেন। এই হল পুরো কেস, তাই না?

পাতাল গোরস্থানের ব্যাপারটা বাদ গেল।

সেটা আরেক ব্যাপার। দু-লাইনের চিন্তাধারাকে এক লাইনে মিশোতে যেয়ো না–জট পাকিয়ে যাবে। এক নম্বর লাইনে রয়েছে লেডি বিয়েট্রিসের পাচালো কাণ্ডকারখানা।

কিস্‌সু বুঝছি না।

দু-নম্বর লাইন হল স্যার রবার্টকে নিয়ে। ডার্বি রেস জেতবার জন্যে পাগল হয়েছেন। ইহুদি সুদখোরদের খপ্পরে পড়েছেন। যেকোনো মুহূর্তে আস্তাবল দখল করতে পারে তারা। ভদ্রলোক বেপরোয়া, দুঃসাহসী। যা কিছু আয় বোনের কাছ থেকে। বোনের ঝিকে দিয়ে নিজের কাজ হাসিল করান।

কিন্তু পাতাল গোরস্থান?

ধরা যাক, স্যার রবার্ট বোনকে খুন করে পুড়িয়ে ফেলেছেন।

মাই ডিয়ার হোমস, এ-প্রশ্নই ওঠে না।

স্যার রবার্ট খানদানি মানুষ। কিন্তু জানো তো ইগলদের মাঝেই কখনো-সখনো পচা মাংস খেকো কাক দেখা যায়? কাজেই আপাতত এই লাইনেই ভাবা যাক। শসকোম প্রিন্স রেসে না-জিতলে বড়োলোক হতে পারছেন না এবং বড়োলোক হতে না-পারলে দেশ ছেড়ে লম্বা দিতে পারছেন না স্যার রবার্ট। তদ্দিন ঘাঁটি আগলে বসে থাকতে হবে। থাকতে গেলে বোনের লাশ পাচার করতে হবে এবং বোনের জায়গায় নকল কাউকে দিয়ে সবাইকে ধোঁকা দিয়ে যেতে হবে। ঝি-কে কবজায় রেখেছেন–কাজেই তা অসম্ভব নয়। পাতাল গোরস্থানে কেউ যায় না! কাজেই বোনের লাশ পাচার করা হল সেখানে। পরে পাতাল ফার্নেসে তা পুড়িয়েও ফেলা হল–পড়ে রইল একটাই প্রমাণ–যা আমরা দুজনেই দেখেছি। বলো বন্ধু, কীরকম বুঝলে?

প্রথমেই যে অসম্ভব ভয়ংকর সম্ভাবনাটা ধরে নিয়েছ, সেটা যদি সম্ভব হয় তবেই বাকি সবই সম্ভব।

কাল একটা ছোট্ট এক্সপেরিমেন্ট করলেই এ-ব্যাপারে কিঞ্চিৎ আলোকপাত ঘটবে। ইতিমধ্যে চলো বুড়ো বার্নেজের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়া যাক তারই এক গেলাস মদ খেয়ে, আর মাছ নিয়ে গল্প করে।

সকাল বেলা হোমস বললে, মাছের চারা আনা হয়নি। কাজেই শিকেয় উঠল মাছ ধরা। এগারোটা নাগাদ কালো স্প্যানিয়েলকে নিয়ে হাওয়া খেতে বেরোলাম দুই বন্ধু।

পার্ক গেটের সামনে এসে দেখলাম ফটকের মাথায় কুলচিহ্ন গ্রিফিনের মূর্তি। মাথা আর পাখা ইগল পাখির দেহটা সিংহের। হোমস বললে, মিস্টার বার্নের্জ বলছিলেন, বেলা বারোটা নাগাদ বুড়ি লেডি গাড়ি নিয়ে হাওয়া খেতে বেরোন। গেটের কাছে গাড়ি আস্তে চলে। গেট পেরিয়ে গেলে ফের জোরে চলে। ঠিক তার আগেই কোচোয়ানকে যা হয় কিছু একটা প্রশ্ন করে গাড়ি দাঁড় করাবে, ওয়াটসন। আমার জন্যে ভেবো না। ঝোঁপের আড়ালে বসে দেখি কী করতে পারি।

বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হল না। মিনিট পনেরোর মধ্যেই দেখলাম দু-ঘোড়ায় টানা একটা বড়ো খোলা হলদে গাড়ি এগিয়ে আসছে। কুকুর নিয়ে ঝোঁপের মধ্যে গুড়ি মেরে বসল হোমস। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে বেতের ছড়ি হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম। দৌড়ে এসে একজন খুলে দিল ফটক।

গাড়ি তখন হেঁটে চলার গতিতে গড়াচ্ছে ভেতরে কারা বসে আছে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাঁ-দিকে বসে চড়া রঙে রঙিন এক তরুণী—পট রঙিন চুল–চোখে নির্লজ্জ দৃষ্টি। ডাইনে এক প্রৌঢ়া। শাল দিয়ে ঢাকা মুখ আর কাঁধ। গোলপিঠ। নিঃসন্দেহে রুণা এবং চলৎশক্তিহীন। গাড়ি আবার জোরে চলতে শুরু করেছে দেখে হাত তুলে পথ আটকালাম। জিজ্ঞেস করলাম, শসকোম ওল্ড প্লেসে স্যার রবার্ট আছেন কি না।

ঠিক সেই সময়ে বেরিয়ে এল হোমস, চেন খুলে রাস্তায় নামিয়ে দিল কালো স্প্যানিয়েলকে। উল্লাসে ঘেউ ঘেউ করে চেঁচাতে চেঁচাতে তিরবেগে ছুটে গিয়ে কুকুর লাফিয়ে উঠল পাদানিতে। পরমুহূর্তেই উল্লাসধ্বনি গেল মিলিয়ে জাগ্রত হল ক্রুদ্ধ হুংকার এবং ঘঁাক করে কামড়ে ধরল কালো স্কার্ট।

কর্কশ কন্ঠে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল বিষম আতঙ্কে–চালাও! জোরসে! চাবুক হাঁকড়াল কোচোয়ান—ছিটকে বেরিয়ে গেল গাড়ি রাস্তার মাঝে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।

স্প্যানিয়েল তখন ফুসছে, উত্তেজনায় ভীষণ মূর্তি ধারণ করেছে। ঝটপট গলায় চেন পরিয়ে দিল হোমস।

বলল, কেল্লা ফতে, ওয়াটসন! কুকুর কখনো ভুল করে না। ভেবেছিল লেডি বিয়েট্রিস তাই দৌড়ে গিয়েছিল। গিয়ে দেখল ভুল হয়েছে অন্য কেউ যাকে চেনে না। তাই অত রাগ।

কিন্তু চিৎকারটা বেটাছেলের।

তা তো হবেই। হাতে আর একটা তাস বাড়ল, ওয়াটসন। এবার খেলতে হবে সাবধানে।

সারাদিনে বন্ধুবরের নতুন কোনো প্ল্যান না-থাকায় নদীতে গিয়ে মাছ ধরলাম। রাত্রে খেতে বসে টাটকা পাইকের ঝোল পেলাম সেই কারণেই। খাওয়া শেষ হল–হোমসের উদ্যমও যেন ফিরে এল! ফের নামলাম রাস্তায় এলাম পার্ক গেটের সামনে। জন ম্যাসনের দীর্ঘ কৃষ্ণমূর্তিকে দেখা গেল ফটকের পাশেই আমাদের পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে।

গুড ইভনিং, জেন্টলমেন। আপনার চিঠি পেয়েছি মিস্টার হোমস। স্যার রবার্ট এখনও ফেরেননি। তবে আজ রাতেই ফিরবেন আশা করছি।

পাতাল গোরস্থান বাড়ি থেকে কদ্দূর? হোমসের প্রশ্ন।

প্রায় সিকি মাইল।

তাহলে ওঁকে নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

কিন্তু আমি যে না-ঘামিয়ে পারছি না। বাড়ি ফিরেই তো উনি শসকোম প্রিন্সের খবর জানতে চাইবেন।

তাহলে এক কাজ করুন। আপনার থাকার দরকার নেই। পাতাল কবরখানা দেখিয়ে দিয়ে চলে যান।

আকাশে চাঁদ নেই। নীরন্ধ্র অন্ধকারেও ঘেসোজমির ওপর দিয়ে জন ম্যাসন আমাদের নিয়ে গেলেন একটা জমাট অন্ধকারের সামনে। প্রাচীন গির্জের ভগ্ন্যুপ। এককালে যেখানে গাড়িবারান্দা ছিল, সেইখান দিয়ে ভাঙা ইটকাঠপাথরের ওপর হোঁচট খেতে খেতে পৌঁছোলাম। এক কোণে একটা খাড়াই সিঁড়ি নেমে গেছে পাতাল গোরস্থানের দিকে। দেশলাই জ্বাললেন মিস্টার ম্যাসন। যা তা করে খোদাই করা বিস্তর পাথর, কোণে কোণে জড়ো করা সিসে আর পাথরের কফিন, নীচু ছাদ আলোকিত হয়ে উঠল ম্লান আলোয়–পাতালের অন্ধকারে ক্রমশ হারিয়ে গিয়েছে বিষাদ ঘেরা সুদীর্ঘ সুড়ঙ্গ। লণ্ঠন জ্বালিয়ে নিল হোমস। হলদে আলোয় উদ্ভাসিত হল কফিনের ডালায় গ্রিফিন মূর্তি–এ-বংশের কুলচিহ্ন–মৃত্যুপুরীতে রওনা হওয়ার সময়ে যে-সম্মান নিয়ে যেতে হবে যমের দুয়ার পর্যন্ত।

হাড়গুলো কোথায়, মিস্টার ম্যাসন?

এই তো এই কোণে, কিন্তু পরক্ষণেই চেঁচিয়ে উঠলেন পরম বিস্ময়ে, আরে! গেল কোথায় হাড়গুলো!

কাষ্ঠ হেসে হোমস বললে, জানতাম পাবেন না। ছাইটা পেতে পারেন ফার্নেসে।

কিন্তু হাজার বছর আগেকার কঙ্কাল পুড়িয়ে লাভটা কী বলতে পারেন?

সেইটা জানবার জন্যেই তো এসেছি। সকাল হয়ে যাবে জানতে জানতে। আপনি যান–আর আটকাব না।

জন ম্যাসন যেতে-না-যেতেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কবর পর্যবেক্ষণে মেতে উঠল শার্লক হোমস। হ্যাক্সন আমলের অতি পুরাতন কবর থেকে দেখতে দেখতে নরম্যান হিলগো আর ওড্ডাসদের সুদীর্ঘ কবর দেখে এসে পৌঁছোল অষ্টাদশ শতাব্দীতে সমাহিত স্যার উইলিয়াম আর স্যার ডেনিস ফালডারের কবরের সামনে। ঘন্টাখানেক কি আরও বেশি সময় লাগল সব দেখতে। তারপর এসে দাঁড়ালাম ভটে প্রবেশপথের মুখে একটা সিসের কফিনের সামনে। দেখেই হর্ষধ্বনি করে দৌড়ে গেল হোমস বুঝলাম যা খুঁজছিল এতক্ষণ, এবার তা পেয়েছে। ভারী ডালাটার প্রতি বর্গ ইঞ্চি খুঁটিয়ে দেখল আতশকাচ দিয়ে। তারপর পকেট থেকে ছেনি বার করে ডালার ফাঁকে ঢুকিয়ে চাড় মারতেই ক্ল্যাম্প খসে খুলে গেল ঢাকনা। মড় মড় মচাৎ করে ডালাটা সবে খানিকটা হেলেছে, ভেতরের বস্তু কিছুটা দেখা যাচ্ছে এমন সময়ে বাধা এল অপ্রত্যাশিতভাবে।

মাথার ওপর গির্জেতে কে যেন হাঁটছে। একবারও হোঁচট খাচ্ছে না–থামছে না চেনাজানা পথেই কে যেন দৃঢ় চরণে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। সিঁড়িতে আলোর আভাস দেখা গেল পরমুহূর্তেই পথিক খিলানের ফাঁকে আবির্ভূত হল আলোকধারী ব্যক্তির কৃষ্ণমূর্তি। ভয়ংকর আকৃতি। যেমন লম্বা-চওড়া, তেমনি বিকট চালচলন। হাতে বিরাট আস্তাবল-লণ্ঠন, সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে ইয়া মোটা গোঁফ আর চনমনে ক্রুদ্ধ দুই চোখ। কটমট করে ভল্টের আনাচেকানাচে দেখতে দেখতে দৃষ্টি স্থির হল হোমস আর আমার ওপর।

শোনা গেল বজ্রনাদ, কে আপনারা? আমার জায়গায় কী করতে ঢুকেছেন? হোমস নিরুত্তর দেখে দু-পা এগিয়ে এসে হাতের লাঠি মাথার ওপর তুলল অসুর মূর্তি, কথাটা কানে ঢুকেছে। কে আপনারা? এখানে কী করছেন? লাঠি কাঁপতে লাগল শুন্যে।

হোমস কোথায় পেছিয়ে আসবে, তা না একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

বলল বজ্রকঠিন স্বরে, স্যার রবার্ট, আমি একটা কথা জানতে চাই। এটা কী? এখানে কেন?

বলেই পেছন ফিরে এক ঝটকায় খুলে ফেলল কফিনের ডালা। লন্ডনের জোরালো আলোয় দেখলাম পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাদর ঢাকা একটা লম্বমান দেহ–এক প্রান্তে কেবল বেরিয়ে আছে একটা ভয়াবহ ডাইনি-সদৃশ মুখ–বিরং, সিটিয়ে থাকা মুখ নাক, থুতনি, ঘোলাটে চোখ।

চিৎকার করে উঠলেন ব্যারোনেট। টলতে টলতে পিছিয়ে কোনোমতে একটা পাথরের

শবাধার ধরে সামনে নিলেন নিজেকে।

আপনি জানলেন কী করে?তারপরেই আবার ফিরে এল সেই হিংস্র, বর্বর, উদ্ধত কণ্ঠস্বর, তা নিয়ে আপনার কী?

আমার নাম শার্লক হোমস শুনে থাকতে পারেন। আমার কাজ আইন রক্ষা হচ্ছে কি না দেখা। জবাবদিহির জন্যে প্রস্তুত থাকুন।

জ্বলন্ত চোখে তাকালেন স্যার রবার্ট। কিন্তু ওষুধ ধরল হোমসের নিষ্কম্প কণ্ঠস্বর আর অচঞ্চল আচরণে।

মিস্টার হোমস, দেখে যা ভাবছেন তা নয়। এ ছাড়া আর করার কিছু ছিল না আমার।

যা বলবার পুলিশকে বলবেন।

বৃষস্কন্ধ ঝাঁকিয়ে স্যার রবার্ট বললেন, বলতে তো হবেই। তার আগে আপনি নিজেই শুনে যান সব ব্যাপার।

পনেরো মিনিট পর প্রাচীন প্রাসাদের গানরুমে এসে পৌঁছোলাম সবাই। আমাদের বসিয়ে উধাও হলেন স্যার রবার্ট। ফিরে এলেন প্রায় সঙ্গেসঙ্গে। পেছন পেছন এল দুটি মূর্তি। একজনকে গাড়ির মধ্যে আগেই দেখেছি–চড়া রঙে রঙিন সেই মেয়েটি। অপরজন হঁদুরমুখো এক পুরুষ–চোখে চোরাচাহনি দেখলেই গা পিত্তি জ্বলে যায়। হতভম্ব দুজনেই। স্যার রবার্ট হুটোপুটি করে টেনে এনেছেন নিশ্চয়–খুলে বলার সময় পাননি।

হস্তসঞ্চালনে দুজনকে দেখিয়ে বললেন, মিস্টার আর মিসেস নরলেট এদের নাম। মিসেস নরলেটের ডাক নাম ইভান্স। আমার বোনের পাশে পাশে থাকার কাজ নিয়েছে বছর পাঁচেক আগে। আমি কী করেছি, কেন করেছি–এরা সব জানে। তাই নিয়ে এলাম আপনার সামনে।

তারস্বরে ইভান্স বললে, করছেন কী স্যার রবার্ট?

ইঁদুরমুখো লোকটা সঙ্গেসঙ্গে ধুয়ো ধরল, আমি কিন্তু কোনো দায়িত্ব নিচ্ছি না।

অপ্রসন্ন চোখে তাকিয়ে স্যার রবার্ট বললেন, আমি নিচ্ছি। মিস্টার হোমস, সোজাসুজি সব বলছি–শুনুন।

অনেক ব্যাপার জেনে ফেলেছেন–নইলে আমার আস্তানায় এভাবে ঢুকতেন না। এটাও নিশ্চয় জানেন যে ডার্বি রেসে একটা ঘোড়ার ওপর সর্বস্ব বাজি ধরেছি আমি। যদি জিতি—উতরে যাব। যদি হারি–একেবার তলিয়ে যাব। উফ ভাবাও যায় না।

বুঝতে পারছি, বলল হোমস।

বোন লেড়ি বিয়েট্রিসের ওপর আমি পুরোপুরি নির্ভরশীল। কিন্তু এস্টেট শুধু তাকেই দেখবে আমাকে নয়। আমাকে বাঁচতে হয় ইহুদি মহাজনের টাকায়। বোনের মৃত্যু হলেই ওরা শকুনির মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার আস্তাবল, ঘোড়া–সব কিছুর ওপর–পথে বসিয়ে ছাড়বে আমাকে। মিস্টার হোমস–ঠিক সাতদিন আগে দেহ রেখেছে আমার সেই বোন।

কাউকে তা বলেননি।

বলব কী করে? বললেই তো রাস্তায় বসতাম। কিন্তু হপ্তা তিনেক ঠেকিয়ে রাখলে বেঁচে যাব। এই যে লোকটাকে দেখছেন–ইভান্সের স্বামী–এর জীবিকা অভিনয় করা। ভেবে দেখলাম, একে দিয়ে বোনের ভূমিকা হপ্তা তিনেক অভিনয় করালে ইহুদিদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে। এমন কিছু শক্ত কাজ নয়। রোজ একবার গাড়ি চড়ে হাওয়া খেলেই হল। ঘরে ইভান্স ছাড়া আর কেউ ঢোকে না–কাজেই আর কোনো ঝামেলা নেই। বোন মারা গেছে ড্রপসি রোগে–ভুগছিল অনেক দিন ধরে।

সেটা করোনার দেখবে।

কয়েক মাস পরে ডাক্তারও বলেছিল, মৃত্যু হবে হঠাৎ। সার্টিফিকেট আনিয়ে দেব।

আপনি কী করলেন, তাই বলুন।

ডেডবডি তো রাখা যায় না বাড়ির মধ্যে। তাই সেই রাতেই নরলেট আর আমি লাশ পাচার করলাম বার-বাড়িতে। ওখানে কেউ যায় না। কিন্তু স্প্যানিয়েলটা গেল সঙ্গে সঙ্গে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এত ঘেউ ঘেউ করতে লাগল যে বাধ্য হয়ে ডেডবডি সরিয়ে নিয়ে যেতে হল আরও নিরাপদ জায়গায়। স্প্যানিয়েলকে আগে সরিয়ে দিলাম বাড়ি থেকে। তারপর ডেডবডি নিয়ে গেলাম গির্জের তলায় কবরখানায়। এর মধ্যে কোনো অসম্মান বা অশ্রদ্ধা নেই। লোকান্তরিত আত্মার প্রতি কোনো অন্যায় করেছি বলে আমি মনে করি না।

কিন্তু আমার কাছে তা ক্ষমার অযোগ্য, বললে হোমস। অধীরভাবে মাথা নাড়লেন ব্যারোনেট, জ্ঞান দেওয়া খুব সোজা। আমার অবস্থায় থাকলে হয়তো অন্য বুদ্ধি আপনার মাথায় আসত না। শেষ পর্যন্ত বাড়াভাতে ছাই পড়তে যাচ্ছে দেখলে মাথা ঠিক রাখা যায় না। ঠিক করলাম, সাময়িকভাবে ভগ্নীপতির পূর্বপুরুষদের কোনো শবাধার খালি করে তার মধ্যে বোনকে রাখব–কফিনের কঙ্কাল ফার্নেসে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলব। তাই করেছি আমি নরলেট–দেখতেই পাচ্ছেন!

কিছুক্ষণ নতমস্তকে চিন্তামগ্নভাবে বসে রইল হোমস।

তারপর বলল, যা বললেন, তার মধ্যে একটা ফাঁক কিন্তু রয়ে গেল। রেসে জিতুন আর–জিতুন–পাওনাদাররা তো আপনাকে ছেড়ে দেবে না–এস্টেট লুট করে নিয়ে যাবে!

ঘোড়াটা এস্টেটের সম্পত্তি কিন্তু বাজির টাকার ধার ধারবে না। আমার সবচেয়ে বড়ো পাওনাদার হল স্যামব্রুয়ার। মহাবদমাশ। নিউমার্কেট হীথে হান্টার পেটা করেছিলাম একবার। আপনি কি মনে করেন সে আর আমাকে বাঁচাবে?

উঠে দাঁড়িয়ে হোমস বলল, আপনার ব্যাপার আপনি বুঝবেন। আমার কর্তব্য আমি করব–পুলিশকে খবর দেব। রাত বারোটা বাজল। ওয়াটসন, চলো ফেরা যাক।

সবাই জানেন অত্যাশ্চর্য এই কাহিনির উপসংহারে অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি–যা ঘটা একান্তই সংগত ছিল স্যার রবার্টের অসংগত আচরণের অবশ্যম্ভাবী পরিণামস্বরূপ। শসকোম প্রিন্স ডার্বি জিতেছিল, মালিককে আশি হাজার পাউন্ড পাইয়ে দিয়েছিল। পাওনাদারদের টাকা মিটিয়েও স্যার রবার্টের হাতে এত টাকা থেকে গিয়েছিল বাকি জীবনটা স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। লেডি বিয়েট্রিসের মৃত্যুর খবর দেরিতে নথিভুক্ত করার দরুন ব্যারোনেটকে মৃদু তিরস্কার করে ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ এবং করোনার। পুরো লেনদেনের ব্যাপারটাকে দেখেছিল উদার চোখে। অসম্মানের ছায়া থেকে সরে এসে এখন সসম্মানে বার্ধক্যের দিকে এগিয়ে চললেন স্যার রবার্ট।

————-

টীকা

পাতালের পাপচক্র : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য শসকোম ওল্ড প্লেস স্ট্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় শার্লক হোমস-এর গল্প দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য রিটায়ার্ড কালারম্যান-এর পরে। আমেরিকার লিবার্টি পত্রিকার মার্চ ১৯২৭ এবং স্ট্র্যান্ডের ১৯২৭ সংখ্যায় প্রকাশের আগে ওই পত্রিকার পূর্ববর্তী সংখ্যায় এটি বিজ্ঞাপিত হয়েছিল দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ব্ল্যাক স্প্যানিয়েল নামে। আবার জন মারে প্রকাশিত শার্লক হোমসের গল্প সংকলনে লেখক স্যার আর্থার গল্পটির উল্লেখ করেন দি অ্যাডভেঞ্চার অব শসকোম অ্যাবি নামে।

সেন্ট প্যানক্র্যাস : এই অঞ্চলে চতুর্দশ শতকে নির্মিত সেন্ট প্যানক্র্যাস ওল্ড চার্চকে ইংলন্ডের প্রথম ক্রিস্টান চার্চ বলে অনুমান করা হয়।

টাকা জাল করার কীর্তি : দি গ্রিক ইন্টারপ্রেটার গল্পেও হোমসকে টাকা জাল করার কীর্তি ফাঁস করতে দেখা গিয়েছিল।

পেনশনের অর্ধেক : নিনো সিরোনের প্রবন্ধে জানা যায়, সেই সময়ে ড. ওয়াটসনের পেনশন ছিল সপ্তাহে দু-পাউন্ড। (দ্রষ্টব্য : দ্য ড. জন ওয়াটসন অ্যানুয়াল প্রাইজ এসে কম্পিটিশন ২০০১)।

ঘোড়ার পেছনেই ওড়াই : সিলভার ব্লেজ গল্পে দেখা গিয়েছিল হোমস ঘোড়দৌড় সম্পর্কে বিস্তর খবরাখবর রাখলেও ওয়াটসনের এই ব্যাপারে কোনো ধারণা বা উৎসাহ ছিল না। বিভিন্ন সময়ে ওয়াটসনের শেয়ার বাজারে ফাটকা খেলার উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু রেসের কথা এই প্রথম।

গ্র্যান্ড ন্যাশনাল : লিভারপুলের এইনট্রি রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত বাৎসরিক স্টিপলচেজ প্রতিযোগিতা। স্টিপলচেজ ঘোড়দৌড় শুধু নয়, ঘোড়া এবং ঘোড়সওয়ারের নানাবিধ কসরত প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা। অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ১৮৩৯ থেকে।

হার্লে স্ট্রিট নয় : হার্লে স্ট্রিটে ডাক্তারদের অফিস বা চেম্বার। হোমস বোঝাতে চেয়েছিল, স্যার রবার্টের পাগলামি সারাতে ডাক্তার প্রয়োজন, গোয়েন্দা নয়। আরেকটি হোমসিয় ঠাট্টা।

ডার্বি : সারে-র এপসম ডাউন্স-এ অনুষ্ঠিত উঁচু বাজির বাৎসরিক ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। ১৭৮০ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসা এই প্রতিযোগিতা বর্তমানে বিজ্ঞাপন স্পনসর-এর নাম অনুসারে ভোডাফোন ডার্বি নামে পরিচিত।

চল্লিশে এসে ঠেকেছে : অর্থাৎ, বর্তমান দর হল চল্লিশ।

ফার্লং : এক মাইলের এক অষ্টমাংশ। ডার্বির দৌড় হত দেড় মাইল। অর্থাৎ বারো ফার্লং।

ড্রপসি : শরীরের টিসু এবং শিরায় রস জমে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষত গোড়ালি বা পায়ের নীচের দিকের অন্যান্য অংশ ফুলে ওঠা। বর্তমান নাম ইডিমা।

পাইক : দ্য হাউন্ড অব দ্য বাস্কারভিলস উপন্যাসের টীকা দ্রষ্টব্য।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত