ঘোমটার ঘোরালো ঘটনা
[ দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ভিইলড লজার ]
তেইশ বছর গোয়েন্দাগিরি করছে শার্লক হোমস। সতেরো বছর আমি তাকে সহযোগিতা করেছি, কীর্তিকাহিনি খাতায় লিখে রেখেছি। কাজেই ওকে নিয়ে গল্প লিখতে বসলে উপাদানের অভাব কখনো হয় না–সমস্যা হয় কেবল বাছাবাছি নিয়ে। বইয়ের তাকে সারি সারি ইয়ার বুক আর তাগাড় করা ডেসপ্যাঁচ-কেস ভরতি কত যে কাহিনি রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অপরাধবিজ্ঞানের ছাত্র তা ঘাঁটলে উপকৃত হবে, সমাজ উপকৃত হবে ভিক্টোরীয় যুগের শেষের দিকে সরকার আর সমাজের নানান গলদ আর কেলেঙ্কারির সন্ধান পেলে। পারিবারিক কেলেঙ্কারি যাঁরা চেপে রাখতে চান, তারা নির্ভয়ে থাকতে পারেন। এব্যাপারে বন্ধুবর হোমস বড়ো সজাগ। যখন প্র্যাকটিস করেছে, তখনও যা বলবার নয়, তা বলেনি–স্মৃতির রোমন্থন করার সময়েও যা গোপনে রাখবার, তা গোপনেই রেখেছে এবং রাখবে। তবে সম্প্রতি এই ধরনের গোপন কাগজপত্র যেভাবে নষ্ট করার একটা চেষ্টা হয়েছিল আমি তার ঘোরতর নিন্দা করছি। এ-চেষ্টা যদি আবার করা হয়, হোমস আমাকে অধিকার দিয়েছে রাজনীতিবিদ, লাইটহাউস এবং প্রশিক্ষিত অতিভোজী দীর্ঘগ্রীব পক্ষী করোমোরান্ট সংক্রান্ত সমস্ত কেচ্ছা পাবলিককে জানিয়ে দেওয়ার। এই হুঁশিয়ারি পড়ে একজনই বুঝতে পারবেন কী বলতে চাইছি আমি।
হোমসের অদ্ভুত পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, যা তার সহজাত প্রতিভা, সব কেসে প্রকাশ পাওয়ার সুযোগ পায়নি। কোনো কেসে হাড়কালি হয়ে গিয়েছে ফল পাড়তে, কোথাও তা টুপ করে খসে পড়েছে কোলের মধ্যে। তাই জীবনযুদ্ধের অনেক ভয়ংকরতম ট্র্যাজেডিতে নিজস্ব প্রতিভা দেখানোর বিশেষ সুযোগ পায়নি। এ-কেসও সেই ধরনের। নামধাম কেবল পালটে দিচ্ছি।
১৮৯৬ সালের শেষাশেষি একদিন দুপুরের ঠিক আগে হোমসের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। আমার সঙ্গ চায়। বেকার স্ট্রিটে পৌঁছে দেখলাম তামাকের ধোঁয়ায় ঘর প্রায়-অন্ধকার। হোমসের চেয়ারে বসে এক প্রৌঢ় মহিলা। বাড়িউলি টাইপের হৃষ্টপুষ্ট মাতৃসুলভ চেহারা।
আলাপ করিয়ে দিয়ে হোমস বললে, ইনি মিসেস মেরিললা, সাউথ ব্রিক্সটনে থাকেন। তামাকের ধোঁয়ায় আপত্তি নেই, তুমিও খেতে পার–যদিও অভ্যেসটি অতিশয় কদর্য। ইনি এসেছেন একটা দারুণ ইন্টারেস্টিং গল্প শোনাতে। গল্পের উপসংহার চমকপ্রদ হতে পারে তুমি হাজির থাকলে।
আমাকে তুমি যা বলবে—
মিসেস মেরিলো, মিসেস রোনডারকে বলে দেবেন, যদি আমি ওর সামনে যাই তো সঙ্গে একজন সাক্ষী রাখব।
ভগবান আপনার ভালো করবেন, মিস্টার হোমস। আপনি আসছেন শুনলে যা বলবেন, ও তাই করবে।
তাহলে বিকেল নাগাদ আসছি দুজনে। তার আগে ডক্টর ওয়াটসনের সামনে ঘটনাগুলো একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। আপনি বলছেন, মিসেস রোনডার আপনার বাড়িতে সাত বছর ভাড়াটে হয়ে রয়েছে, কিন্তু মুখ দেখেছেন মাত্র একবার।
সেটুকুও না দেখতে পারলে বেঁচে যেতাম।
সাংঘাতিকভাবে দুমড়োনো-মুচড়োনো বিকৃত বীভৎস মুখ।
মিস্টার হোমস, তাকে মুখ বলা যায় না। ওপরের জানলায় যে-মুখ এক পলকের জন্যে দেখেই গয়লা দুধের বালতি উলটে ফেলেছিল বাগানে। দেখেছিলাম আমিও মিসেস রোনডার বুঝতে পারেনি যে আমি হঠাৎ এসে যাব। তাড়াতাড়ি মুখ ঢাকা দিয়ে বলেছিল–এখন বুঝলেন তো কেন বারো মাস ঘোমটা দিয়ে থাকি?
মিসেস রোনডারের পূর্ব ইতিহাস জানেন?
একদম না।
ঘর ভাড়া নেওয়ার আগে কারো সুপারিশ হয়নি?
না। তবে নগদ টাকা দিয়েছিল অনেক। তিন মাসের ভাড়া আগাম–সব শর্ত মেনে নিয়েছিল এক কথায়। আমি গরিব মানুষ। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে পারিনি।
আপনার বাড়ি পছন্দ করার কোনো কারণ দর্শিয়েছিল?
বাড়িটা রাস্তা থেকে ভেতর দিকে বলে। ও চায় নিরিবিলিতে একা-একা থাকতে তার জন্যে টাকা ছাড়তেও রাজি।
একবারই শুধু মুখ দেখেছিলেন–তাও আচমকা। তাই তলিয়ে দেখতে চান কী ব্যাপার?
ঠিক তা নয়, মিস্টার হোমস। আমার টাকা নিয়ে দরকার।
তাহলে আজ হঠাৎ এ-ব্যাপার নিয়ে নাড়াচাড়া পড়ল কেন?
শরীর ভেঙে পড়েছে বলে! মিসেস রোনডার যেন মরতে বসেছে। মনটাও যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। খুন! খুন! বলে চেঁচাচ্ছে। একবার শুনলাম বলছে, জানোয়ার! রাক্ষস কোথাকার! তখন নিশুতি রাত। সারাবাড়ি গমগম করে উঠল সেই চিৎকারে। তাই পরদিন গিয়ে বললাম, মনকে কেন খামোখা কষ্ট দিচ্ছেন? পুলিশ অথবা পাদরি–এই দুইয়ের কাকে ডেকে আনলে মন শান্ত হবে বলুন–ডেকে আনছি। বাড়ি মাথায় করে মিসেস রোনডার বললে, না! না! পুলিশ না! পাদরি এসেই-বা কী করবে? যা হয়ে গেছে, তাকে তো আর পালটাতে পারবে না। কিন্তু মরবার আগে সব বলতে পারলে শান্তিতে চোখ মুদতে পারতাম। তখন বললাম, বেসরকারি গোয়েন্দা ডাকলে হবে? মিস্টার শার্লক হোমসকে? শুনেই লাফিয়ে উঠে মিসেস রোনডার বললে, ঠিক বলেছেন! ওঁকেই চাই। আসতে না-চাইলে বলবেন আমি বন্য জন্তু প্রদর্শক রোনডারের বউ। আব্বাস পারভা–এই নামটা বললেই উনি ঠিক আসবেন। এই দেখুন কাগজে লিখে দিয়েছে নামটা।
হোমস বললে, হ্যাঁ, আমি আসছি–ঠিক তিনটের সময়ে।
হাঁসের মতো দুলে দুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা। সঙ্গেসঙ্গে যেন এনার্জির বিস্ফোরণ ঘটল শার্লক হোমসের ভেতরে। ছিটকে গেল ঘরের কোণে পাকার রাখা রাশিরাশি পাঁচমেশালি মামুলি কেতাবের দিকে। মিনিট কয়েক কেবল পাতা উলটে যাওয়ার খসখস আওয়াজ শোনা গেল। তারপরে তৃপ্তিসূচক ধ্বনি শোনা গেল গলার মধ্যে। যা খুঁজছে, তা পেয়েছে। উত্তেজনার চোটে মেঝে থেকে উঠতেও ভুলে গেল। বিচিত্র বুদ্ধমূর্তির মতো বই পরিবৃত অবস্থায় বাবু হয়ে বসে যেন চোখ দিয়ে গিলে গেল পাতার পর পাতা।
কেসটা তখনই ভাবিয়ে তুলেছিল আমাকে, ওয়াটসন ওই দেখো, মার্জিনে, নোটস লিখে রেখেছি। মাথামুণ্ডু অবশ্য তখন বুঝতে পারিনি। শুধু বুঝেছিলাম, করোনার ভুল করছে। আব্বাস পারভা ট্র্যাজেডির ঘটনা মনে পড়ছে?
না, বললাম আমি।
কিন্তু আমার সঙ্গেই তখন ছিলে তুমি। তবে হ্যাঁ, আমি নিজেও তো ধাঁধার জবাব পাইনি। তা ছাড়া, দু-পক্ষের কেউ আমাকে কনসাল্ট করতেও আসেনি। পড়ে শোনাব?
সংক্ষেপে বলো।
রেনডারের নাম তখন ঘরে ঘরে। সার্কাস দুনিয়ার অতবড়ো খেলোয়াড় আর কেউ ছিল। কিন্তু মদের পাল্লায় পড়ে নিজের আর সার্কাসের সুনাম রসাতলে যেতে বসে ট্র্যাজেডিটা ঘটবার সময়ে। বার্কশায়ারে আব্বাস পারভা বলে একটা ছোট্ট গ্রাম আছে। ক্যারাভান সেই গ্রামে পৌঁছোনোর পরে ঘটে বীভৎস ঘটনাটা। যাচ্ছিল অন্যত্র, রাত কাটানোর জন্যে তাঁবু খাঁটিয়েছিল আব্বাস পারভার খেলা দেখাতে নয়–অত ছোটো গ্রামে পয়সা উঠত না খেলা দেখিয়ে।
জস্তুজানোয়ারের মধ্যে ছিল একটা ভারি চমৎকার আফ্রিকান সিংহ। নাম, সাহারা কিং। স্বামী স্ত্রী দুজনেই খাঁচার ভেতরে ঢুকে খেলা দেখাত সাহারা কিংকে নিয়ে। এই দেখো একটা ফটোগ্রাফ। দেখলেই বুঝবে চেহারার দিক দিয়ে রোনডার ছিল বিরাট শুয়োরের মতো। কিন্তু অপূর্ব সুন্দরী ছিল রোনডারের বউ। সাহারা কিং যে সত্যই বিপজ্জনক, সে-লক্ষণ নাকি আগেই দেখা গিয়েছিল। কিন্তু তোয়াক্কা করা হয়নি।
সাহারা কিংকে রাত্রে খাওয়ানো হত। খাওয়াত হয় রোনডার, নয় তার বউ। আর কাউকে কাছে ঘেঁষতে দিত না। কারণ ছিল। যাদের হাতে খাওয়া পাবে, সাহারা কিং তাদেরকেই উপকারী বন্ধু হিসেবে নেবে–থাবা-টাবা মারবে না–এই বিশ্বাস ছিল স্বামী স্ত্রী দুজনের মধ্যেই। সাত বছর আগে এক রাতে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই গেল সিংহের খাবার নিয়ে। তারপর ঘটল সেই ভয়ংকর ট্র্যাজেডি। কিন্তু ঠিক কী ঘটেছিল, আজও জানা যায়নি।
তবুসুদ্ধ লোক জেগে উঠেছিল সিংহের গর্জন আর নারীকণ্ঠের আর্তনাদে। লণ্ঠন নিয়ে লোকজন ছুটে এসে দেখলে, খাঁচার দরজা খোলা। দশ গজ দূরে মুখ থুবড়ে পড়ে রোনডার। মাথার পেছনে সিংহের থাবার গভীর দাগ। খুলি গুঁড়িয়ে গেছে। দরজার সামনেই চিত হয়ে শুয়ে মিসেস রোনডার। সিংহ বসে তার বুকের ওপর! মুখ ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেলেছে। বাঁচবে বলে আর মনে হয় না। সার্কাসের সবচেয়ে স্ট্রংম্যান লিওনার্ডো ক্লাউন গ্রিগসকে নিয়ে দলবল সমেত লম্বা ডান্ডা দিয়ে খুঁচিয়ে ঢুকল সাহারা কিং–তালা পড়ল খাঁচায়। কিন্তু খাঁচা থেকে সে বেরিয়েছিল কীভাবে, সে-রহস্যভেদ আর হল না! স্বামী স্ত্রী দুজনকে সামনে দেখে আর দরজা খোলা হচ্ছে দেখে সাহারা কিং নিশ্চয় নিজেই ধাক্কা মেরে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। মিসেস রোনডারকে আচ্ছন্ন অবস্থায় ধরাধরি করে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময়ে কাপুরুষ! কাওয়ার্ড! বলে বারবার নাকি চেঁচিয়েছিল। ছ-মাস পরে এজাহার দেওয়ার অবস্থায় এসেছিল মিসেস রোনডার, কিন্তু তদন্ত করে শেষ পর্যন্ত এই কথাই বলা হয়েছিল যে নিছক দুর্ঘটনা আর অযথা দুঃসাহস দেখাতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে রোনডার।
এ ছাড়া আর কিছু হতে পারে কি?
তা বলতে পার। কিন্তু বার্কশায়ারের ছোকরা পুলিশ অফিসার এডমন্ডের খটকা লেগেছিল। আমার কাছে এসেওছিল পরামর্শ করতে। এখন সে এলাহাবাদে।
রোগা চেহারা? চুল হলদে?
হ্যাঁ জানতাম তোমার মনে পড়বে।
খটকা লাগল কেন?
খটকা আমারও লেগেছিল। ছাড়া পেয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পলায়মান রোনডারকে পেছন থেকে থাবা মেরে শুইয়ে দিয়ে পালিয়ে গেলেই পারত সাহারা কিং। ফের খাঁচার কাছে ফিরে এসে রোনডারের স্ত্রীকে মাটিতে পেড়ে ফেলে মুখ চিবোতে গেল কেন? তা ছাড়া, ভদ্রমহিলা কাওয়ার্ড বলে চেঁচিয়েছিল কেন? স্বামী এসে সিংহের খপ্পর থেকে বাঁচায়নি বলে? স্বামী নিজেই তো তখন পরলোকে–সে-অবস্থায় কাওয়ার্ড বলে গাল পাড়া হল কেন?
তা ঠিক।
আরও আছে। সিংহ গর্জন আর নারীকণ্ঠের আর্তনাদের মাঝে একটা পুরুষকণ্ঠের চিৎকারও শোনা গিয়েছিল–বিষম আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে যেন চেঁচিয়ে উঠেছিল সিংহ গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে।
রোনডার নিশ্চয়।
মাথা ছাতু হয়ে যাওয়ার পর কেউ চেঁচায়? একাধিক সাক্ষীর মুখে শোনা গেছে একই কথা। নারীকণ্ঠের আর্তনাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল বিশেষ সেই পুরুষকণ্ঠের ভয়ার্ত চিৎকার।
বুর প্রত্যেকেই তখন চেঁচাচ্ছিল। তাই অমন মনে হয়েছে। আসলে স্বামী স্ত্রী দুজনেই যখন খাঁচার দশ গজ দূরে, তখন খাঁচা থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে আসে সাহারা কিং। দেখেই পেছন ফিরে পালাতে গিয়েছিল রোনডার। তাই সিংহের চঁাটা গিয়ে পড়ে তার মাথায়। রোনডারের বউ বেগতিক দেখে খাঁচায় ঢুকে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু খাঁচা পর্যন্ত পৌঁছোবার আগেই সাহারা কিং তার বুকে বসে আরম্ভ করে দেয় সিংহ গর্জন আর আঁচড় কামড়। স্বামী যদি পালাতে না যেত, সিংহ রেগে গিয়ে তেড়ে যেত না–এইজন্যেই কাপুরুষ বলে চেঁচিয়েছিল রোনডারের বউ।
ব্রিলিয়ান্ট! একটা খুঁত কিন্তু রয়ে গেল, ওয়াটসন।
যথা?
খাঁচার দশ গজ দূরেই যদি ছিল দুজনে, দরজা খুলল কে?
কোনো শত্রু নিশ্চয়।
যাদের সঙ্গে খাঁচার ভেতরে খেলা দেখিয়ে অভ্যস্ত, খাঁচার বাইরে তেড়ে গিয়ে তাদের থাবা মারতে গেল কেন সাহারা কিং?
শত্রু ব্যক্তিটি রাগিয়ে দিয়েছিল বলে।
হোমস চুপ করে রইল। চিন্তা করল।
তারপর বলল, রোনডারের শুয়োরের মতো চেহারা তো দেখলে। শুনেছি, মদ খেলে তখন আর কোনো কাণ্ডজ্ঞান থাকত না। একটু আগে ভদ্রমহিলা বলে গেলেন, নিশুতি রাতেজানোয়ার, রাক্ষস কোথাকার! বলে চেঁচায় তার ভাড়াটে। মাতাল স্বামীর অত্যাচারের দৃশ্য স্বপ্নে ফিরে এসেছে বলেই নিশ্চয় অমন চেঁচিয়েছে। যাই হোক, খেয়েদেয়ে চলো বেরিয়ে পড়া যাক।
যথা সময়ে ছ্যাকড়াগাড়ি নিয়ে পৌঁছোলাম মিসেস মেরিলোর বাড়িতে। চৌকাঠ জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্থূলাঙ্গী ভদ্রমহিলা। ভাড়াটে যাতে বাড়ি ছেড়ে সরে না-পড়ে, পইপই করে সে-বিষয়ে আমাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে ছেড়া কার্পেট মোড়া সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে গেলেন দোতালায়–রহস্যময়ী ভদ্রমহিলার ঘরে।
ঘরটা স্যাঁৎসেঁতে। আলো হাওয়া–কম। দীর্ঘকাল যে খাঁচায় আটকে রেখেছিল বনের পশুদের, নিয়তির অঙ্গুলিহেলনে সে যেন নিজেই এখন খাঁচায় আটকে পড়েছে। ছায়াচ্ছন্ন কোণে ভাঙা চেয়ারে বসে ছিল ভদ্রমহিলা। মুখে ঘোমটা শুধু ঠোঁট আর থুতনি বেরিয়ে আছে–নিখুঁত গড়ন দেখেই বোঝা যায় গোটা মুখটি এককালে নিখুঁতই ছিল। শরীরও নিটোল–যদিও দীর্ঘদিন বসে থাকার ফলে একটু ভাজ আর খাঁজ দেখা দিয়েছে শ্রীঅঙ্গে।
কণ্ঠস্বরও মোলায়েম, মিহি। বলল, আমি জানতাম আমাকে চিনবেন, মিস্টার হোমস।
কিন্তু আপনার কেসে আমার আগ্রহ আছে জানলেন কী করে?
কাউন্টি ডিটেকটিভ মিস্টার এডমন্ডের কাছে। ওঁকে মিথ্যে বলেছিলাম ইচ্ছে করেই।
কেন?
একজনকে বাঁচানোর জন্যে। যদিও সে অপদার্থ, তাহলেও সে আমার খুব কাছের মানুষ ছিল–এককালে।
এখন কি সে-বাধা সরে গেছে?
গেছে। যার কথা বলছি, সে আর ইহলোকে নেই।
তাহলে পুলিশকে সব বলছেন না কেন?
নিজের জন্যে বলছি না। আমি শান্তিতে মরতে চাই। পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে কেচ্ছা ছড়িয়ে কেলেঙ্কারি বাড়াতে চাই না। কিন্তু মরবার আগে এমন একজনকে সব কথা বলে যেতে চাই যার নিজস্ব বিচারবুদ্ধি আছে।
আপনার অভিনন্দনের জন্য ধন্যবাদ।
এ-জীবনে এখন বই পড়া ছাড়া আর কিছু করণীয় আমার নেই। পৃথিবীর সব খবর রাখি বলেই আপনারও কীর্তিকলাপ আমার নখদর্পণে। আপনাকে বলে হালকা হতে চাই সেই কারণেই।
বলুন তাহলে।
ভদ্রমহিলা ড্রয়ার খুলে একটা ফটো বার করে বাড়িয়ে দিল সামনে। পেশাদার দড়াবাজিকরের ছবি। অপূর্ব আকৃতি, পেশিবহুল পুষ্ট বুকের ওপর দু-হাত ভাঁজ করে ভারী গোঁফের আড়ালে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলে দাঁড়িয়ে যেন বহু যুদ্ধবিজয়ী আত্মতৃপ্ত পুরুষসিংহ।
এরই নাম লিওনার্ডো, বলল ভদ্রমহিলা।
স্ট্রংম্যান লিওনার্ডো? সাক্ষী হয়েছিল যে?
হ্যাঁ। আর এই আমার স্বামী।
এবার যার ছবি দেখলাম তাকে মানুষের আকারে অতিকায় শুয়োর বলাই সংগত। ভয়াবহ পৈশাচিক মুখের চেহারা। রাগে যেন ফুলছে। গাঁজলা বেরুচ্ছে ঠোঁটের কোণ দিয়ে। খুদে চোখে সে কী জিঘাংসা–দগ্ধ করতে চাইছে যেন জগৎসংসারকে। জানোয়ার, ইতর, নরপিশাচ চওড়া চৌকোনা চোয়ালের পরতে পরতে পরিস্ফুট এই তিনটে এবং আরও অনেক বিশেষণ।
ছবি দুটো দেখলে আমার কাহিনি বুঝতে সুবিধে হবে আপনাদের। সার্কাসের গরিব মেয়ে আমি। মানুষ হয়েছি কাঠের গুঁড়োয় শুয়ে, রিঙের মধ্যে লাফালাফি করে–তখন আমার বয়স দশ বছর। বড়ো হবার পর শুয়োরের মতো এই জানোয়ারটা ভালোবেসে বিয়ে করল আমাকে। পরে বুঝলাম, প্রেম নয়–কামানলে আহুতি দিলাম নিজেকে। শুরু হল নরকযন্ত্রণা। মারধর কিছুই বাদ যায়নি। বেঁধে চাবুক মারত। যন্ত্রণায় কাতরাতাম। সার্কাসের সবাই ওকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত, আমাকে অনুকম্পা করত। তার বেশি কিছু করতে সাহস পেত না। দল ভাঙা শুরু হয়ে গেল তখন থেকেই। সুনাম গোল্লায় গেল। লিওনার্ডো আর জিমি গিস কোনোরকমে চালিয়ে গেল সার্কাস।
এই সময়ে লিওনার্ডোকে ভালোবাসলাম। ওর সুন্দর শরীরের ভেতরে যে একটা ভীতু মানুষ আছে, তখন জানতাম না। তবে রোনডারের তুলনায় সেই মুহূর্তে লিওনার্ডো ছিল আমার কাছে দেবদূতের মতো বরণীয়। রোনডার টের পেয়েছিল আমাদের গোপন ভালোবাসা। শোধ তুলতে আমার ওপর অকথ্য অত্যাচার করে। একদিন আমার কান্না শুনে ভ্যানের দোরগোড়া পর্যন্ত দৌড়ে এসেছিল লিওনার্ডো। সেই রাতেই একটা ভীষণ কাণ্ড ঘটত। ঠিক করলাম, আর নয়। রোনডারকে খুন করতে হবে বাঁচবার জন্যে।
প্ল্যানটা লিওনার্ডোর–এ-ব্যাপারে মাথা ওর সাফ। আমার অত সাহস ছিল না।
একটা কাঠের গদা তৈরি করল লিওনার্ডো–ভেতরে ঠাসা রইল সিসে–বাইরে পাঁচটা লম্বা ইস্পাতের পেরেক। ঠিক যেন সিংহের থাবা। ঠিক হল, এই থাবার ঘায়ে খতম করা হবে রোনডারকে কিন্তু সবাই মনে করবে মরেছে সিংহের থাবায়।
নিশুতি রাতে অভ্যেস মতো দস্তার গামলায় কাঁচা মাংস নিয়ে স্বামী স্ত্রী গেলাম সিংহকে খাওয়াতে। নকল থাবা নিয়ে ভ্যানের আড়ালে ওত পেতে ছিল লিওনার্ডো। পেছন থেকে পা টিপে টিপে এসে মারল স্বামীর মাথায়। আওয়াজ শুনেই নেচে উঠল মনটা। দৌড়ে গিয়ে খুলে দিলাম খাঁচার দরজা।
ভয়ানক ব্যাপারটা ঘটে গেল ঠিক সেই মুহূর্তেই। মানুষের রক্তের গন্ধ এদের নাকে কত তাড়াতাড়ি যায়, নিশ্চয় তা জানেন। চক্ষের পলকে সাহারা কিং আঁপিয়ে পড়ল আমার বুকে। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। চিৎকার করে উঠল লিওনার্ডোও। সেই মুহূর্তে ভয় না-পেয়ে ও যদি গদা দিয়ে মারত সাহারা কিঙের মাথায় বেঁচে যেতাম আমি। কিন্তু তা না-করে প্রাণের ভয়ে দেখলাম ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে লিওনার্ডো। সঙ্গেসঙ্গে সিংহের দাঁত বসে গেল আমার মুখে। বিকট বোঁটকা গন্ধ, মুখের লালার বিষ আর ভয়াল গজরানিতে আমি অজ্ঞানের মতো হয়ে গেলাম। প্রাণপণে দু-হাত দিয়ে সিংহের মুখ সরিয়ে রাখলাম দূরে। কানে ভেসে এল লোকজনের চিৎকার। পুরোপুরি জ্ঞান হারিয়ে ফেলার আগে দেখলাম লিওনার্ডো আর গ্রিগস ডান্ডা দিয়ে খুঁচিয়ে সাহারা কিংকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে বুকের ওপর থেকে। তারপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর আয়নায় মুখের চেহারা দেখে শিউরে উঠলাম। এর চেয়ে মৃত্যুও ভালো ছিল। সেই থেকে মুখ ঢেকে নির্জনে থেকেছি জখম জানোয়ারের মতোই বিবরে ঢুকে মরতে বসেছি–লোকচক্ষে কিন্তু অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে ইউজেনিয়া রোনডার।
কিছুক্ষণ বসে রইলাম নীরবে। তারপর দীর্ঘ শীর্ণ হাত বাড়িয়ে ইউজেনিয়া রোনডারের হাত চাপড়ে দিল শার্লক হোমস। সমবেদনার এহেন অভিব্যক্তি হোমসের চরিত্রে একান্তই দুর্লভ কদাচিৎ দেখেছি আমাদের সুদীর্ঘ সহাবস্থানে।
বেচারা! নিয়তির মার দুনিয়ার বার! লিওনার্ডোর খবর কী?
এ-ঘটনার পর আর দেখিনি। হয়তো ওর ওপর অতটা না-চটলেও পারতাম। পরে আমার রং করা মুখটাই ও ভালোবাসতে পারত। কিন্তু মেয়েদের ভালোবাসা এত তাড়াতাড়ি মরে যায় না। সিংহের মুখে আমাকে ফেলে সে পালিয়েছে, আমার দরকারের সময়ে আমাকে সে ত্যাগ করেছে তবুও তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলাতে চাইনি।
এখন?
মারা গেছে জলে ড়ুবে। গত মাসে মার্গেটে চান করার সময়ে। কাগজে পড়লাম খবরটা।
পাঁচনখী থাবাটা কোথায়?
ঠিক জানি না। ক্যাম্পের পেছনে একটা সবুজ ডোবা ছিল খড়ি-গর্তের তলায়। হয়তো সেখানে।
যাক গে। থাবার আর দরকার নেই। কেস শেষ।
হ্যাঁ, কেস শেষ।
উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু শেষ কথার শেষ সুরটা হোমসের কানে বাজল।
চকিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, জীবনটা আপনার একার নয়। ওর ওপর যেন হাত না-পড়ে।
এ-জীবন আর কারো কাজে লাগবে কি?
জানছেন কী করে? মুখ বুজে সয়ে যে শিক্ষা পাওয়া যায়, অসহ্য এই দুনিয়ায় তার চাইতে বড় সম্পদ আর কিছু আছে কি?
জবাবটা এল ভয়ংকরভাবে। ঘোমটা তুলে আলোর সামনে এসে দাঁড়াল ভদ্রমহিলা।
সহ্য করতে পারবেন?
কী ভয়ংকর! কী বীভস! হাড়ের কাঠামোয় এক সময়ে যে-মুখ ছিল, এখন যা নেই–পৃথিবীর কোনো ভাষায় তার বর্ণনা সম্ভব নয়। অদ্ভুত সুন্দর বিষণ্ণ বাদামি দুটো চোখ কেবল মুখের সেই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল আমাদের পানে। গভীর অনুকম্পায় এবং অপরিসীম প্রতিবাদে দু-হাত তুলে যেন বাধা দিল হোমস এবং আমাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল বাইরে।
দু-দিন পরে হোমসের আস্তানায় যেতেই সগর্বে ম্যান্টলপিসের ওপর রাখা একটা ছোটো নীল শিশির দিকে আঙুল তুলে দেখাল ও। শিশির গায়ে বিষের লাল লেবেল। ছিপি খুলতেই নাকে ভেসে এল বাদামের মিষ্টি গন্ধ।
প্রুসিক অ্যাসিড? প্রশ্ন করলাম।
হা পোস্টে এসেছে। সেইসঙ্গে এই চিঠিটা। প্রলোভন সম্বরণ করলাম। উপদেশ গ্রহণ করলাম। ওয়াটসন, সত্যিই বুকের পাটা আছে মেয়েটার।
————–
টীকা
ঘোমটার ঘোরালো ঘটনা : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ভিইলড লজারআমেরিকার লিবার্টি পত্রিকার ২২ জানুয়ারি ১৯২৭ তারিখের সংখ্যায় এবং ইংলন্ডে স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের ফেব্রুয়ারি ১৯২৭ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়।
করোমোরাস্ট সংক্রান্ত সমস্ত কেচ্ছা : গবেষক ডোনাল্ড রেডমন্ড এই রাজনীতিবিদকে জেমস চেম্বারলেন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
অভ্যেসটি অতিশয় কদর্য : একটি হোমসিয় ঠাট্টা। কারণ ঘরের ধোঁয়া হোমসেরই কীর্তি। কে বলে হোমস গম্ভীর এবং বেরসিক?
সার্কাস দুনিয়ার অতবড়ো খেলোয়াড় : সেকালে সার্কাস জগতের বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন জর্জ উমবোয়েল (১৭৭৮-১৮৫০), এবং জর্জ স্যাংগার (১৮২৭-১৯১১)। এঁরা দুজনেই ছিলেন ভ্রাম্যমাণ সার্কাস দলের প্রতিষ্ঠাতা।
এলাহাবাদে : এলাহাবাদ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে এখানে ব্রিটিশ ফৌজের সঙ্গে সিপাহীদের প্রবল যুদ্ধ হয়েছিল।
জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর : মিসেস রোনডারের জ্ঞান ফিরে এসেছিল। কিন্তু উমবোয়েলের সার্কাসে এলেন ব্রাইট নামে এক সপ্তদশী মারা গিয়েছিল সার্কাসের বাঘের আচমকা আক্রমণে, ১৮৮০ সালে।
প্রসিক অ্যাসিড : বর্ণহীন তীব্র বিষ হাইড্রোজেন সায়ানাইডের আরেক নাম প্রসিক অ্যাসিড। জলে মিশ্রিত অবস্থায় এর নাম হাইড্রোসায়নিক অ্যাসিড। রবার বা প্লাস্টিক তৈরিতে এই রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়।