শয়তানের পা
[ দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ডেভিলস ফুট ]
বন্ধুবর শার্লক হোমসের কীর্তিকাহিনি লিখতে গিয়ে সবচেয়ে বড়ো যে অসুবিধের সম্মুখীন হয়েছি তা হল হোমসেরই অনিচ্ছা–নিজের ঢাক নিজে তো পিটবেই না–কাউকে পিটতেও দেবে না। কথা বলে কম, ছিদ্র খোঁজে সব কিছুর মধ্যে। প্রকৃতি কাঠখোট্টা। কাছে গেলে ভয় লাগে। সস্তা বাহবায় তার বিন্দুমাত্র আকর্ষণ নেই। রহস্যের জট সুন্দরভাবে ছাড়িয়ে ঠিক সমাধানে পৌঁছোতে পারলেই অনাবিল তৃপ্তিতে মনটা ভরে ওঠে কানায় কানায়–সেইটাই ওর সবচেয়ে বড়ো আনন্দ, সবচেয়ে বড়ো পুরস্কার। তারপর বাহবার ভাগটুকু তুলে দেয় সরকারি গোয়েন্দার হাতে এবং যখন দেশ জুড়ে ধন্য-ধন্য রব ওঠে সরকারি গোয়েন্দাটির নামে, বিদ্রুপের হাসি হাসে আপন মনে। শুধু এই কারণেই প্রচুর রসদ হাতে থাকা সত্ত্বেও বেশ কয়েক বছর ওর অনেক ভালো ভালো কীর্তিকলাপ জনগণকে উপহার দিতে পারিনি আমি।
তাই গত মঙ্গলবার হোমসের কাছ থেকে টেলিগ্রামটা পেয়ে অবাক হলাম। এ যে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া। এভাবে তো টেলিগ্রাম পাঠিয়ে কখনো ফরমাশ করেনি হোমস। লিখেছে : কর্নিশ-আতঙ্ক নিয়ে এবার কিছু লিখে ফেললা–পাঠকরা চমকে যাবে। অনেক অদ্ভুত কেসের সমাধান করেছি কিন্তু এত অদ্ভুত কোনোটাই নয়। জানি না হঠাৎ এ-খেয়াল ওর মাথায় এল কেন, কেনই-বা মনে পড়ল পুরোনো কাহিনি–আমি কিন্তু আর দেরি করলাম না। মত পালটে যাওয়ার আগেই তড়িঘড়ি কেসটার পুরোনো কাগজপত্র খুঁজে নিয়ে লিখতে বসেছি আশ্চর্য ভয়াল সেই উপাখ্যান।
১৮৯৭ সালের বসন্তকালে শরীর ভেঙে পড়ে শার্লক হোমসের। লোহার কাঠামোতেও ঘুণ ধরার উপক্রম হয় অত্যধিক পরিশ্রম আর স্বাস্থ্যরক্ষায় বিন্দুমাত্র যত্ন না-নেওয়ার দরুন। মার্চ মাসে ধূমকেতুর মতো রীতিমতো নাটকীয়ভাবে হোমসের জীবনে ঢুকে পড়লেন হার্লে স্ট্রিটের বিখ্যাত। ডাক্তার মুর আগার–সে-কাহিনি অন্য সময়ে বলা যাবেখন এবং জানিয়ে দিলেন কর্মক্ষমতা জন্মের মতো চলে যাবে যদি এখুনি সব কাজ ফেলে ঢালাও বিশ্রাম না নেয় হোমস। নিজের শরীর নিয়ে কোনোকালেই ভাবত না হোমস–শরীর থেকে মনকে সরিয়ে আনার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল বলেই ঝুঁদ হয়ে থাকত হাতের কাজ আর চিন্তায়। কিন্তু যখন শুনল জন্মের মতো কাজ করার ক্ষমতা চলে যেতে পারে বিশ্রাম না নিলে, তখন সব কাজ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঠিক করল বায়ু পরিবর্তনে যাবে। এই কারণেই সেই বছর বসন্তের গোড়ায় কর্নিশ অন্তরীপের শেষ প্রান্তে পোলধু উপসাগরের কাছে একটা ছিমছাম ছোট্ট কটেজে আস্তানা নিলাম দুই বন্ধু।
অপূর্ব জায়গা বটে, হোমসের নীরস অন্তর প্রকৃতির উপযুক্ত। ঘাস ছাওয়া উঁচু জমির ওপর আমাদের চুনকাম করা কটেজের জানলা থেকে চোখ পড়ত অর্ধবৃত্তাকারে ক্রূর কুটিল দৃশ্যের পর দৃশ্য, দেখতাম পালতোলা জাহাজের মরণফাঁদ মাউন্টস বে–দেখতাম কীভাবে সারি সারি খোঁচা খোঁচা কালচে এবড়োখেবড়ো পাথর মাথা উঁচিয়ে রয়েছে জলের মধ্যে থেকে। সাগরফেনায় ঢাকা এই চোরা পাথরের ধাক্কায় ড়ুবেছে বহু জাহাজ, মরেছে বহু খালাসি। অথচ উত্তুরে বাতাসে বড়ো শান্ত দেখায় ভয়াল এই মাউন্টস বে–দূর থেকে ঝড়ে উথালিপাথালি জাহাজ ছুটে আসে মরীচিকার টানে–আসে একটু স্থির হতে, ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে।
দক্ষিণ-পশ্চিমের ঝড় এলেই কিন্তু চেহারা পালটে যায় শান্ত সুন্দর এই উপসাগরের। তখন ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে জল ফুঁসে ওঠে, নোঙরে হ্যাচকা টান পড়ে, শুরু হয় পাথরের খোঁচা বাঁচিয়ে জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার শেষ লড়াই। তাই বুদ্ধিমান খালাসি এই শয়তান-অঞ্চলের ধারেকাছেও জাহাজ আনে না।
জলের মতো ডাঙার চেহারাও বুক কাঁপানো। ঢেউ খেলানো বাদার পর বাদা–বালিয়াড়ি রঙের তরঙ্গায়িত জলাভূমির শেষ যেন আর নেই। কাকপক্ষীও বুঝি থাকে না ধু-ধু সেই প্রান্তরে। মাঝে মাঝে মাথা উঁচিয়ে থাকা এক আধটা গির্জের চুড়ো দেখে কেবল বোঝা যায় ছন্নছাড়া সেকেলে গ্রামগুলো রয়েছে কোথায় কোথায়। এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে প্রাগৈতিহাসিক বাসিন্দাদের তৈরি পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ—সুদূর অতীতে তারা যে এই বিজন অঞ্চলে ঘরসংসার করে গিয়েছিল–তার পাথুরে প্রমাণ বিচিত্র থাম আর বিদঘুটে স্কুপের অন্তরালে তাদেরই চিতাভস্ম আর কিম্ভুতকিমাকার মাটির বাসনপত্র। জায়গাটার এই প্রাগৈতিহাসিক মাহাত্ম্য, হারিয়ে-যাওয়া ভুলে-যাওয়া জাতির স্মৃতিচিহ্ন এবং সব মিলিয়ে একটা ভয়াল ভয়ংকর রূপ শার্লক হোমসের বেশ মনে ধরেছে বোঝা গেল। কল্পনায় গা ভাসিয়ে দেওয়ার এমন উপযুক্ত খোরাক পেয়ে অধিকাংশ সময় কাটত নির্জন জলায় একা একা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়িয়ে। সুপ্রাচীন কর্নিশ ভাষাটাও খুব পছন্দ হয়েছে দেখা গেল। এই নিয়ে রীতিমতো চর্চাও আরম্ভ করে দিল। আমাকে বললে, চালডিন ভাষার সঙ্গে নাকি কর্নিশ ভাষার দারুণ মিল আছে। টিনব্যবসায়ী ফিনিশিয়ানদের ভাষা থেকে বেশ কিছু শব্দ ধার করাও হয়েছে। ভাষাতত্ত্বর ওপর এক বাক্স বই আনিয়ে এই সম্পর্কে সবে একটা গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করতে যাচ্ছে, এমন সময়ে আমার সব আশা ধূলিসাৎ করে দিয়ে পাণ্ডববর্জিত অমন একটা বিকট স্বপ্নিল দেশের কোত্থেকে একটা হতকুচ্ছিত কূট সমস্যা এসে হাজির হল একেবারে দোরগোড়ায়–খাস লন্ডন শহরেও এমন রক্ত-জল-করা, এমন প্যাচালো, এমন রহস্যজনক ধাঁধার জট কখনো ছাড়াতে হয়নি। দিব্যি শান্তিতে খেয়েদেয়ে বেড়িয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম, এমন সময়ে মূর্তিমান উৎপাতের মতো এই চক্রান্তে জড়িয়ে যাওয়ায় শান্তিতে দিনযাপন শিকেয় উঠল, অদ্ভুত আশ্চর্য ঘটনার আবর্ত নিদারুণ উত্তেজনা সৃষ্টি করে বিপর্যস্ত করে তুলল আমাদের প্রাত্যহিক জীবন এবং সে-উত্তেজনায় চঞ্চল হল শুধু কর্নওয়াল নয়–সমগ্র পশ্চিম ইংলন্ড। আমার কিছু কিছু পাঠক হয়তো সে সময়ে খবরের কাগজে কর্নিশ-আতঙ্ক সম্বন্ধে দু-এক লাইন খবর পড়ে থাকতে পারেন কিন্তু পুরো খবর কেউ জানেন না। তেরো বছর পরে অকল্পনীয় সেই কাহিনিই সবিস্তারে উপহার দিতে বসেছি সারাদেশকে।
আগেই বলেছি এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে থাকা গির্জের মাথাগুলো দেখেই বোঝা যেত মান্ধাতার আমলের গাঁগুলো রয়েছে কর্নওয়ালের কোথায় কোথায়। সবচেয়ে কাছের গ্রামটার নাম ট্রেডান্নিক ওলাস। শ্যাওলা ধরা সুপ্রাচীন একটা গির্জাকে ঘিরে শ-দুই বাসিন্দার অনেকগুলো কটেজ নিয়ে গড়ে উঠেছে সেই গ্রাম। গাঁয়ের পাদরি মিস্টার রাউন্ড হে ভদ্রলোকের প্রত্নতত্ত্বের বাতিক থাকায় হোমস বেশ খাতির জমিয়ে নিল তার সঙ্গে। ভদ্রলোক মাঝবয়েসি, মোটাসোটা, অমায়িক। স্থানীয় খবরের ডিপো বললেই চলে। চায়ের নেমন্তন্ন রাখতে পারিসাহেবের বাড়ি গিয়ে জেনেছিলাম মর্টিমার ট্রেগেনিস নামে এক ভদ্রলোক পাদরির স্বল্প আয়কে একটু বৃদ্ধি করেছেন তাঁর পেল্লায় বাড়ির খানকয়েক ঘর ভাড়া নিয়ে। ভাড়াটের সঙ্গে পাদরির এমনিতে অনেক অমিল থাকলেও পয়সার দিক দিয়ে কিছুটা সুরাহা হওয়ায় কৃতার্থ হয়েছেন ব্যাচেলর পাদরি। ভাড়াটের চেহারাটা কিন্তু পাতলা, কালচে চোখে চশমা; হাঁটেন একটু ঝুঁকে–যেন বিকৃতি আছে শরীরের কোথাও! চায়ের আসর একাই মাতিয়ে রাখলেন পাদরিসাহেব–কিন্তু ভাড়াটে ভদ্রলোক চুপচাপ বসে রইলেন অন্যদিকে তাকিয়ে। যত রাজ্যের বিষাদ মুখে টেনে এনে অদ্ভুতভাবে মুখে চাবি এঁটে ড়ুবে। রইলেন নিজের মনের ভেতর মনে হল যেন অনেক দুশ্চিন্তায় হাবুড়ুবু খাচ্ছেন। আসলে তার প্রকৃতিই এইরকম মৌন।
ষোলোই মার্চ মঙ্গলবার এহেন দুই ব্যক্তি দুম করে ঢুকে পড়লেন আমাদের ঘরে প্রাতরাশের ঠিক পরেই। আমরা তখন সবে ধূমপান আরম্ভ করেছি–শেষ করেই রোজকার অভ্যেসমতো জলা পরিভ্রমণে বেরোব ভাবছি।
উত্তেজিত কণ্ঠে পাদরি সাহেব বললেন, কাল রাতে অদ্ভুত, অস্বাভাবিক আর অত্যন্ত মর্মান্তিক একটা কাণ্ড ঘটেছে। আমাদের কপাল ভালো, বিধাতা সদয় বলেই অশ্রুতপূর্ব এই ঘটনার মধ্যে আপনাকে আমরা পেয়ে গেছি–ইংলন্ডে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই যিনি এ-রহস্যের সমাধান করতে পারেন।
আমি পাদরিমশায়ের দিকে নির্দয় চোখে কটমট করে তাকালাম। কিন্তু শিকারের গন্ধ পেলে ঝানু হাউন্ড যেভাবে চনমনে হয়ে ওঠে, ঠিক সেইভাবে মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে পিঠ খাড়া করে হোমস সিধে হয়ে বসল আস্তে আস্তে। হাতের ইশারায় বসতে বলল উত্তেজিত দুই অভ্যাগতকে। এঁদের মধ্যে অনেক সংযত দেখলাম মর্টিমার ট্রেগেন্নিসকে। তা সত্ত্বেও যেভাবে ভদ্রলোক অস্থিরভাবে রোগা-রোগা দু-হাত পরস্পর ঘষতে লাগলেন এবং কালো চোখের উজ্জ্বল চাউনি মেলে তাকিয়ে রইলেন, বেশ বুঝলাম, একই আতঙ্কে দুজনেই সমানভাবে অভিভূত হয়ে পড়েছেন।
বললেন পাদরিকে, আপনি বলবেন, না আমি বলব?
হোমস বললে, দেখেছি আপনিই প্রথম ব্যাপারটা আবিষ্কার করেছেন–উনি জেনেছেন পরে–সুতরাং আপনি শুরু করুন।
ভারি সোজা এই অনুমিতি সিদ্ধান্ত অকৃত্রিম বিস্ময়চিহ্ন ফুটিয়ে তুলল দুজনেরই মুখে। ব্যাপারটা আমিও বুঝলাম দুজনের সাজপোশাক দেখে। পুরুতমশায় পোশাক পরেছেন তাড়াহুড়ো করে, কিন্তু ভাড়াটে ভদ্রলোক শ্ৰীঅঙ্গে জামাকাপড় চাপিয়েছেন বেশ পরিপাটি করে।
পাদরি বললেন, আমি বরুং গোড়ায় দু-একটা কথা বলে নিই। শোনবার পর ভেবে দেখবেন মিস্টার ট্রেগেন্নিসের কাছে বিশদ শুনবেন না সোজা ধাওয়া করবেন রহস্যে ঘেরা অকুস্থল অভিমুখে। জলার কাছে মান্ধাতার আমলের পাথরটার কাছেই ট্রেডান্নিক ওয়ার্দা ভবনে গত সন্ধ্যা কাটিয়ে এসেছেন ওঁর দুইভাই আর এক বোনের সঙ্গে, ভাইদের নাম ওয়েন আর জর্জ। বোনের নাম ব্রেন্দা। তাস খেলেছেন রাত দশটা পর্যন্ত দশটার একটু পরেই চলে আসবার সময়ে দেখে এসেছেন তাস নিয়ে খাবার ঘরের গোল টেবিল ঘিরে মশগুল হয়ে বসে তিন ভাইবোন–শরীর বা মনের স্বাস্থ্য যতখানি ভালো থাকা সম্ভব, ততটা ভালো। খুব ভোরে ওঠা ওঁর অভ্যেস। আজ ভোরে বেড়াতে বেরিয়ে দেখা হয়ে গেল ডক্টর রিচার্ডসের সঙ্গে জরুরি কল পেয়ে ছুটছেন ট্রেডান্নিক ওয়ার্দা ভবনে। উদবিগ্ন হলেন মিস্টার মর্টিমার ট্রেগেন্নিস। গেলেন তৎক্ষণাৎ। গিয়ে দেখলেন এক অসাধারণ দৃশ্য। দেখলেন, কাল রাতে ঠিক যেভাবে গোলটেবিল ঘিরে সামনে তাস নিয়ে বসা অবস্থায় ভাইবোন তিনজনকে দেখে গিয়েছিলেন, সেইভাবেই বসে রয়েছে তারা, টেবিলে ছড়ানো রয়েছে তাস, মোমবাতি গোড়া পর্যন্ত পুড়ে নিভে গেছে। চেয়ারে পাথরের মতো শক্ত হয়ে মরে পড়ে আছে বোন আর দু-পাশে বসে দু-ভাই বিকৃত গলায় চেঁচাচ্ছে, পাগলের মতো হাসছে, গান গাইছে, কখনো কাঁদছে–সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো লক্ষণ তাদের নেই। তিন জনেরই মুখে ফুটে উঠেছে অবর্ণনীয় বিভীষিকার প্রতিচ্ছবি–বিকট খেঁচুনি আর প্রবল আক্ষেপে মুখগুলো যেন দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে সীমাহীন আতঙ্কে। অনেক দিনের রাঁধুনি আর হাউসকিপার মিসেস পোর্টার ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। রাত্রে সে মড়ার মতো ঘুমিয়েছে–আওয়াজ-টাওয়াজ পায়নি। চুরিও যায়নি কিছু কোথাও কিছু অগোছালো অবস্থাতেও পাওয়া যায়নি। কিন্তু কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না এমন কী ভয়ংকর কাণ্ড ঘটল যা দেখে কল্পনাতীত আতঙ্কে একটি মেয়ে মরে পাথর হয়ে গিয়েছে, আর দুটি শক্তসমর্থ পুরুষের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। মিস্টার হোমস, সংক্ষেপে এই হল ঘটনা। আপনি যদি মাথা খাটান এ নিয়ে, মস্ত উপকার হয় আমাদের।
মনে মনে ভাবছিলাম, কী করে কয়েকটা বাক্যবাণ ত্যাগ করে বন্ধুবরকে সহজ অবস্থায় ফিরিয়ে আনব–এসেছি ভাঙা স্বাস্থ্য জোড়া লাগাতে রহস্য সমাধান করতে নয়–এইটাই বুঝিয়ে বলব। কিন্তু ওর কেঁচকানো কপালের ভাঁজে আঁকা গভীর চিন্তার রেখা দেখে বুঝলাম বৃথা চেষ্টা। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে অদ্ভুত নাটকটা নিয়ে যেন সমাহিত হয়ে রইল মনে মনে।
তারপর বললে, কথা দিচ্ছি, এ-ব্যাপারে আপনাদের পাশে আমি আছি। সত্যিই খুব জটপাকানো মনে হচ্ছে ব্যাপারটা, খুবই রহস্যময়। আপনি কি সেখানে নিজে গেছিলেন, মিস্টার রাউন্ড হে?
না। মিস্টার ট্রেগেন্নিস ছুটতে ছুটতে এসে খবরটা দিতেই তড়িঘড়ি করে আসছি আপনার সঙ্গে পরামর্শ করার জন্যে।
জায়গাটা এখান থেকে কদ্দূরে?
মাইলখানেক।
তাহলে হেঁটেই যাওয়া যাক। যাওয়ার আগে মিস্টার মর্টিমার ট্রেগেন্নিসকে কয়েকটা প্রশ্ন করব।
এতক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে ছিলেন মিস্টার ট্রেগেন্নিস। লক্ষ করলাম, ওঁর চাপা উত্তেজনা পাদরিমশায়ের ফেটে-পড়া উত্তেজনার চাইতে কোনো অংশে কম তো নয়ই বরং বেশি। ফ্যাকাশে মুখে হোমসের দিকে উদবিগ্ন চোখে তাকিয়ে বসে রয়েছেন ভদ্রলোক। রোগা-রোগা দু-হাত কচলাচ্ছেন বিরামবিহীনভাবে। পারিবারিক বিপর্যয়ের কাহিনি শুনতে শুনতে থর থর করে কাপছে দুই ঠোঁট। কুচকুচে কালো দুই চোখেও যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে বর্ণনার অতীত সেই আতঙ্ক।
বললেন সাগ্রহে, যা ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করুন, মিস্টার হোমস। যদিও বিষয়টা আলোচনা করার মতো নয়। তাহলেও যা জানি সব বলব।
কাল রাতের ঘটনা বলুন।
পাদরিমশায় যা বললেন, গেছিলাম আড্ডা মারতে। ওরা বললে, এক হাত হুইস্ট খেলা যাক। বসে গেলাম তাস নিয়ে। তখন ন-টা। উঠলাম সোয়া দশটা নাগাদ। ওরা তখন দারুণ ফুর্তিতে মশগুল হয়ে বসে টেবিল ঘিরে।
আপনাকে এগিয়ে দিল কে!
মিসেস পোর্টার শুয়ে পড়ায় আমি নিজেই হল ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম–দরজা বন্ধ করলাম নিজেই। খাবার ঘরের জানলা বন্ধ ছিল কিন্তু খড়খড়ি ভোলা ছিল। আজ সকালেও জানলা দরজার অবস্থা দেখলাম সেইরকম। বাড়িতে কেউ ঢুকেছে বলে মনে হল না। তা সত্ত্বেও সাংঘাতিক আতঙ্কে স্রেফ পাগল হয়ে গিয়েছে ভাইরা–আর ভয়ের চোটে মরে কাঠ হয়ে পড়ে রয়েছে বোন–মাথাটা ঝুলে পড়েছে চেয়ারের হাতল পর্যন্ত। মিস্টার হোমস জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ঘরের সেই দৃশ্য মন থেকে আমি মুছতে পারব না।
আশ্চর্য, খুবই আশ্চর্য। আপনার নিজের কোনো ব্যাখ্যা আছে এ-ব্যাপারে?
খোদ শয়তান ঘরে ঢুকেছিল, মিস্টার হোমস! কাঁপতে কাঁপতে বললেন মর্টিমার ট্রেগেন্নিস। শয়তান নিজে এসে দু-দুটো মানুষকে বদ্ধ উন্মাদ করে গিয়েছে আর একজনের প্রাণকে লুঠ করে নিয়ে গিয়েছে! এ-কাজ মানুষের নয়–হতে পারে না!
তাই যদি হয় তো এ-ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। তবে সে-সিদ্ধান্তে আসার আগে স্বাভাবিক ব্যাখ্যা যদি পাওয়া যায়, চেষ্টা করে দেখতে হবে। মিস্টার ট্রেগেন্নিস, আপনি দেখছি ফ্যামিলি থেকে আলাদা ভাইবোনদের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতেন না।
কথাটা ঠিক। আমাদের টিনের খনি ছিল। বিক্রি করে দিয়ে টাকাটা ভাগ বাটোয়ারা করে নিই। সেই সময়ে একটু মন কষাকষি হয়েছিল বটে, এখন সেসব কারো মনে নেই। মানিয়ে নিয়েছি–আলাদা থাকলেও মিলেমিশে আছি।
কাল রাতের ব্যাপারে ফিরে যাওয়া যাক। একসঙ্গে আড্ডা মেরে যাওয়ার সময়ে এমন কিছু নজরে পড়েছিল যার সঙ্গে আজকের এই মর্মান্তিক ব্যাপারের যোগাযোগ আছে? ভালো করে ভেবে দেখুন, মিস্টার ট্রেগেন্নিস। ছোটোখাটো সূত্র পেলেও উপকার হবে আমার!
সে-রকম কিছু মনে পড়ছে না।
চারজনেই কি হইচই করছিলেন? ফুর্তির মেজাজে ছিলেন?
দারুণভাবে।
ভাইবোনেরা কি ভীতু ধাতের? আসন্ন বিপদ সম্পর্কে কোননারকম ভয়-টয় এর আগে দেখিয়েছিল?
একদম না।
কাজে লাগে, এ-রকম কিছুই তাহলে বলার নেই আপনার?
তন্ময় হয়ে মুহূর্তের জন্যে কী যেন ভাবলেন মর্টিমার ট্রেগেন্নিস।
বললেন, একটা ব্যাপার মনে পড়ছে। আমি জানলার দিকে পিঠ ফিরিয়ে টেবিলে বসে ছিলাম। জর্জ বসে ছিল জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে। হঠাৎ আমার কাঁধের ওপর দিয়ে জানলার দিকে কেন তাকাল দেখবার জন্যে ঘাড় ঘুরিয়েছিলাম। ভোলা খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে দেখলাম অন্ধকার বাগানে কালো ছায়ার মতো সাঁৎ করে কী যেন একটা সরে গেল, মানুষ কি জন্তু বোঝ গেল না। জর্জকে জিজ্ঞেস করতে বললে, ওরও মনে হল কী যেন একটা ঝোঁপের মধ্যে মিলিয়ে গেল–ভালোভাবে ঠাহর করা গেল না।
উঠে গিয়ে দেখে এসেছিলেন?
না। সামান্য ব্যাপার বলেই যাইনি। গুরুত্ব দিইনি।
এর মধ্যে আসন্ন বিপদের সংকেত টের পাননি? অমঙ্গলের পূর্বাভাস?
একেবারেই না।
এত সকালে দুঃসংবাদটা কীভাবে শুনলেন?
ভোরে উঠে বেড়াতে বেরোনো আমার বরাবরের অভ্যেস। আজকেও বেরিয়েছি, এমন সময়ে পাশে এসে দাঁড়াল ডক্টর রিচার্ডসনের গাড়ি। মিসেস পোর্টার একটা ছোকরা মারফত ওঁকে এখুনি ডেকে পাঠিয়েছেন। উঠে বসলাম গাড়িতে। বাড়িতে পৌঁছে ঘরের দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মোমবাতি আর ফায়ারপ্লেসের আগুন নিভে গেছে বেশ কয়েক ঘন্টা আগে। অন্ধকার ঘরে বসে থেকেছে ওরা ভোরের আলো না-ফোঁটা পর্যন্ত। ডাক্তার বললেন, ঘন্টা ছয়েক আগে মারা গেছে ব্রেন্দা–জোরজবরদস্তির কোনো চিহ্ন কোথাও নেই! মুখ-চোখের ওইরকম বিকট চেহারা নিয়ে ঘাড় গুঁজে বসে আছে চেয়ারে। বিরাট হনুমানের মতো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইছে জর্জ ওয়েন। সে-দৃশ্য দেখা যায় না! আমি সহ্য করতে পারলাম না–ডাক্তার তো প্রায় অজ্ঞানের মতো এলিয়ে পড়লেন চেয়ারে কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল মুখ। ধরাধরি করে তাকে নিয়ে এলাম বাইরে।
পরমাশ্চর্য হলে যদি কিছু থাকে, তবে তা এই কেস, উঠে দাঁড়িয়ে আলনা থেকে টুপি নামাতে নামাতে বললে হোমস। আর দেরি করা সমীচীন হবে না–চলুন যাওয়া যাক ওয়ার্দায়। উঠন্তি মুলো পত্তনেই চেনা যায় শুরুতেই এ-রকম গোলমেলে সমস্যা এর আগে কক্ষনো হাতে আসেনি আমার।
আমাদের প্রথম দিনের কার্যকলাপ তদন্তের অগ্রগতির পক্ষে খুবই সামান্য। সূত্রপাতেই একটা ঘটনা অদ্ভুত ছাপ রেখে গেল আমার মনে। অকুস্থলে যাওয়ার পথে রাস্তাটা সরু গলির মতো এক জায়গায় বাঁক নিয়েছে। হঠাৎ শুনলাম সামনের দিক থেকে চাকার ঘড়ঘড় আওয়াজ আসছে। সরে দাঁড়ালাম একপাশে। পাশ দিয়ে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল গাড়িটা। পলকের জন্যে বন্ধ জানলার ফাঁক দিয়ে দেখলাম বীভৎসভাবে বিকৃত, বিকট, একটা মুখ জ্বলন্ত চাহনি মেলে কটমট করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। দাঁতে দাঁত ঘষটানি আর নিমেষহীন বিস্ফারিত চাহনি ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো বিদ্যুৎবেগে অতিক্রম করে গেল আমাদের।
ঠোঁট পর্যন্ত সাদা হয়ে গেল মর্টিমার ট্রেগেন্নিসের। আচ্ছন্নকণ্ঠে শুধু বললেন, হেলসটনে নিয়ে যাচ্ছে ভাইদের।
আমাদের ঘোর তখনও কাটেনি। আতঙ্ক বিস্ফারিত চোখে দুঃস্বপ্নের মতো অপস্রিয়মাণ কালো গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলাম ফ্যালফ্যাল করে। তারপর পা চালালাম অভিশপ্ত বাড়িটার দিকে–যে-বাড়ি থেকে এই অদৃষ্ট নিয়ে পাগলাগারদে যাত্রা করেছে দু-দুটো শক্তসমর্থ জোয়ান পুরুষ।
কটেজ ঠিক নয়–বাড়িটাকে ভিলা বলা উচিত। বেশ বড়ো, ঝকঝকে। চারিদিকে বাগান। কর্নিশ বাতাসের দৌলতে এর মধ্যেই ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। বাগানের দিকে খাবার ঘরের জানলাটা দেখা যাচ্ছে। মর্টিমার ট্রেগেন্নিসের বর্ণনা মতে এই জানলা দিয়ে এসেছে অপার্থিব সেই ভয়ংকরটি, যাকে দেখামাত্র বিপুল আতঙ্কে তিন তিনটে মানুষের সুস্থ চেতনায় তুমুল বিস্ফোরণ ঘটেছে নিমেষে বিকৃত হয়েছে মস্তিষ্ক। হোমস চিন্তায় কুঁদ হয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছে ফুলের টবের পাশ দিয়ে বারান্দার দিকে। চিন্তায় সে এমনভাবে ড়ুবে গেছিল যে, জলের ঝারিটার ওপর আচমকা হুমড়ি খেয়ে পড়ায় বাগানের পথ আর আমাদের সকলের পায়ের ওপর দিয়ে ছোটোখাটো একটা বন্যা বয়ে গেল বললেই চলে। বাড়ির ভেতরে দেখা হল প্রৌঢ়া কর্নিশ হাউসকিপার মিসেস পোর্টারের সঙ্গে। একটি বাচ্চা মেয়ের সাহায্য নিয়ে সংসারের কাজ দেখাশুনা করে। হোমসের সমস্ত প্রশ্নের জবাব মুখে মুখে দিয়ে গেল মিসেস পোর্টার। রাত্রে শব্দ-ট কিস্সু কানে আসেনি। গতরাতে মনিবরা যেরকম খোশমেজাজে ছিলেন, সে-রকম সচরাচর থাকেন না। সকালে ঘরে ঢুকেই এই বীভৎস দৃশ্য দেখে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। তারপর সুস্থ হয়ে জানলাটা খুলে দেয় যাতে ভোরের বাতাস ঘরে ঢোকে। তারপর ছুটে বাইরে গিয়ে চাষাদের একটা ছোটো ছেলেকে দিয়ে ডাক্তারকে খবর পাঠায়। বোনের দেহ ওপরের বিছানায় শোয়ানো আছে, ইচ্ছে হলে দেখে আসতে পারি। ভাই দুজনকে পাগলাগারদে নিয়ে যাওয়ার সময় চারজন গাঁটাগোট্টা পালোয়ানকে হিমশিম খেতে হয়েছে। সে নিজে এ-বাড়িতে আর একদণ্ডও থাকবে না–সেন্ট ইভসে আত্মীয়স্বজনের কাছে যাচ্ছে আজকেই বিকেলে।
ওপরে গিয়ে দেখলাম মিস ব্রেন্দা ট্রেগেন্নিসের মৃতদেহ। সত্যিই পরমাসুন্দরী মেয়ে মাঝবয়সি হলেও রূপ যেন ফেটে পড়ছে। নিখুঁত মুখটি প্রকৃত সুন্দর–যদিও সে-মুখ নিঃসীম আতঙ্কে বিকৃত হয়ে রয়েছে। মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে যা দেখে প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে উড়ে গিয়েছে, সেই ভয়ের রেশ এখনও লেগে রয়েছে মুখের পরতে পরতে। শোবার ঘর থেকে নেমে এলাম বসবার ঘরে–যে-ঘরে আশ্চর্য এই ঘটনার সূত্রপাত এবং শেষ। ফায়ার প্লেসে শুধু কাঠকয়লা, টেবিলের ওপর শেষ পর্যন্ত পুড়ে যাওয়া চারটে মোমবাতি আর ছড়ানো তাস। চেয়ারগুলো কেবল সরিয়ে রাখা হয়েছে দেওয়ালের গা ঘেঁষে–এ ছাড়া ঘরের কোনো জিনিস নাড়াচাড়া করা হয়নি। লঘু পায়ে অস্থিরভাবে ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল হোমস। চেয়ারগুলোকে টেনে এনে রাখল টেবিলের পাশে যেখানে থাকা উচিত, সেইখানে। প্রত্যেকটা চেয়ারে বসে দেখলে জানলা দিয়ে বাগানের কতখানি দেখা যায়। খুঁটিয়ে দেখলে মেঝে, কড়িকাঠ আর ফায়ারপ্লেস। কিন্তু ক্ষণেকের জন্যেও চোখ জ্বলে উঠতে দেখলাম না। ঠোঁট শক্ত হতে দেখলাম না–যে-লক্ষণ দেখলেই বুঝতাম নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে আলোর নিশানা পেয়েছে বন্ধু আমার।
একবার কেবল জিজ্ঞেস করল, বসন্তের সন্ধেবেলায় এইটুকু ঘরে আগুন জ্বালানোর কী এমন দরকার পড়ল বলতে পারেন?
মর্টিমার ট্রেগেন্নিস বললেন, বড্ড ঠান্ডা পড়েছিল, স্যাঁ স্যাঁ করছিল–তাই আমি আসবার পরেই হয়েছিল আগুনটা। এখন কী করবেন, মি. হোমস?
হাসল হোমস। আমার বাহু স্পর্শ করে বললে, ওহে ওয়াটসন, তামাক দিয়ে বিষোননা যে উচিত নয়, তা তোমার কাছে বহুবার শুনেছি। এখন কিন্তু সেই তামাক সেবনের একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। ভদ্রমহোদয়গণ, আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি চললাম তামাক খেতে–কেননা এখানে দেখবার মতো আর কিছু নেই। ভেবেচিন্তে যদি কিছু পাই তো আপনাকে জানাব, মিস্টার ট্রেগেন্নিস। পাদরি সাহেবকেও খবর দেব। আপাতত সুপ্রভাত।
পোলধু কটেজে ফিরে না-আসা পর্যন্ত আর একটি কথাও বলল না হোমস। গুটিসুটি মেরে বসে রইল আর্মচেয়ারে। তাম্রকূটের নীলচে ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে অদৃশ্য হয়ে রইল বললেই চলে চিন্তাকুটিল বিশুষ্ক মুখখানা। কালো ভুরু কুঁচকে কপালের রেখায় রেখায় অজস্ব চিন্তার ছাপ ফেলে শূন্য চোখ মেলে তাকিয়ে রইল কোন সুদূরের পানে। অবশেষে এক সময়ে পাইপ নামিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে অট্টহেসে বললে, ভায়া, অযথা ভেবে সুবিধে হবে না। সমুদ্রের ফুরফুরে বাতাস, সূর্যদেবের মিষ্টি রোদ আর ধৈর্য–এই তিনটেই এখন বিশেষ দরকার। চলো, পাহাড়ে বেড়িয়ে বরং চকমকির পাথরের তির খোঁজা যাক। সমস্যার সূত্র খোঁজার চাইতে সেটা সহজ। কয়লা ছাড়া ইঞ্জিন চালাতে গেলে ইঞ্জিন যেমন বিগড়ে যায়, উপযুক্ত রসদ ছাড়া ব্রেন খাটাতে গেলেও ব্রেন তেমনি বিকল হয়। চলো, চলো, হাওয়া আর রোদ খেয়ে আসা যাক।
সমুদ্রের ধারে ধারে পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হোমস বললে, সমস্ত ব্যাপারটা এবার ঠান্ডা মাথায় তলিয়ে দেখা যাক। সবার আগে, এব্যাপারে যা কিছু জেনেছি–তা সে যত তুচ্ছই হোক না কেন–পর-পর সাজিয়ে ফেলা যাক–তাহলে নতুন কোনো ব্যাপার যখন জানব, ঠিকমতো জায়গায় বসিয়ে ঘটনা-পরম্পরা সম্পূর্ণ করা সহজ হবে। ভূত-প্রেত-পিশাচ শয়তানের হাত ঘটনায় নেই–প্রথমেই কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাক, কেমন? মানুষের ব্যাপারে পিশাচ নাক গলিয়েছে, এ-তত্ত্ব মানতে আমি রাজি নই–মন থেকে এ-সম্ভাবনা তাই একেবারেই বাদ দেওয়া গেল। বেশ, বেশ। তাহলে কী পাচ্ছি এখন? কোনো একটা মানবিক উৎপাতের দরুন মারাত্মক চোট পেয়েছে তিন ব্যক্তি একজন মারা গেছে, দুজন উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। উৎপাতটা জ্ঞাতসারে হতে পারে, অজ্ঞাতসারেও হতে পারে। এই হল গিয়ে শক্ত জমি চিন্তার উপযুক্ত ক্ষেত্র–এর ওপর সিদ্ধান্তর ইমারত তৈরি করা যাক। ভয়াবহ এই কাণ্ডটা ঘটল কখন? মি. ট্রেগেন্নিসের কথা মেনে নিলে, তিনি ঘর ছেড়ে চলে আসবার ঠিক পরেই। খুবই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, ধরে নিতে পারি, উনি চলে আসার মিনিট কয়েকের মধ্যেই ঘটনাটা ঘটেছে। কেননা, টেবিলের তাস টেবিলেই পড়ে–জড়ো করা হয়নি। শোয়ার সময় হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও টেবিল ছেড়ে কেউ নড়েনি–চেয়ার পর্যন্ত সরায়নি। তাই ফের বলছি–উনি চলে আসতে-না-আসতেই রহস্যজনক সেই আতঙ্ক এসে উপস্থিত হয়েছে জানলার বাইরে—এবং তা ঘটেছে রাত এগারোটার মধ্যেই পরে নয়।
আচ্ছা এরপর আমাদের করণীয় হল ঘর ছেড়ে চলে আসবার পর মি. ট্রেগেন্নিসের গতিবিধি তার জবানবন্দির সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া। সত্যিই উনি সন্দেহের ঊর্ধ্বে। কেননা, ঝারি উলটে দেওয়ার বদখত কৌশলটা তোমার অজানা নয়। ফলে, ভদ্রলোকের পায়ের স্পষ্ট ছাপ পেলাম ভিজে মাটির ওপর। গতদিনও বৃষ্টি হয়েছিল, মাটি ভিজে ছিল। মি. ট্রেগেন্নিস এবং আরও অনেকের পায়ের ছাপ ভিজে মাটিতে ছিল। তার মধ্য থেকে মি. ট্রেগেন্নিসের পায়ের ছাপ খুঁজে নেওয়া খুব একটা কষ্টকর হল না। ভদ্রলোকের গতিবিধি লক্ষ করে নিশ্চিন্ত হলাম দেখলাম, উনি বাড়ি থেকে বেরিয়েই খুব তাড়াতাড়ি পাদরিমশায়ের বাড়ির দিকে–মানে নিজের বাড়ির দিকে গেছেন।
সন্দেহ-চক্র থেকে তাহলে বাদ গেলেন মি. ট্রেগেন্নিস। তাস খেলা জন্মের মতো পণ্ড হয়ে গেল কার জন্যে, এখনও কিন্তু তা জানা যাচ্ছে না। কার আবির্ভাবে এত আঁতকে উঠল তিন-তিনটে সুস্থ মানুষ–তাও এখনও রহস্য তিমিরে অদৃশ্য। আতঙ্কটা এল কোন পথে কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না। মিসেস পোর্টারকে বাদ দেওয়া যায়। একেবারেই গোবেচারা মেয়েছেলে। এমনও হতে পারে, বাগানের জানলায় গুড়ি মেরে এসে দাঁড়িয়েছিল কেউ এমন বিকট কাণ্ড করেছে যে দেখেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গিয়েছে তিনজনের। ঠিক এই ধরনের সম্ভাবনার আভাস দিয়েছেন একজনই–মি. মর্টিমার ট্রেগেন্নিস! বাগানের অন্ধকারে সাঁৎ করে কী যেন একটা মিলিয়ে গিয়েছিল–দেখেছেন উনি, দেখেছে ওঁর ভাই। খুবই আশ্চর্য ঘটনা। কেননা গতরাতে আকাশ মেঘলা থেকেছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়েছে, ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করেছে। কাজেই এদেরকে ভয় দেখিয়ে পাগল করবার মতলব নিয়ে কেউ এসে থাকলে তাকে শার্সির কাছে মুখ চেপে ধরতেই হবে–নইলে অন্ধকার দেখাই যাবে না। জানলার নীচেই একটা ফুট তিনেক চওড়া ফুলের ঝোপ আছে কিন্তু নরম মাটিতে কই কারো পায়ের ছাপ তো পড়েনি। সেই কারণেই ভেবে পাচ্ছি না বাইরে থেকে এসে কারো পক্ষে মুখ না-দেখিয়ে ভয় দেখানো সম্ভব হয় কী করে–সবচেয়ে বড়ো কথা এত কাঠখড় পুড়িয়ে এত ঝাট করে গোবেচারা তিনটে মানুষকে ভয় দেখানোর কারণটাই-বা কী, তাও তত মাথায় আসছে না। ওয়াটসন, বুঝেছ তো অসুবিধেটা হচ্ছে কোথায়?
হাড়ে হাড়ে বুঝছি, বললাম দৃঢ়স্বরে।
তা সত্ত্বেও জেনো আরও একটু সূত্র-টু পেলে এর মধ্যেও আলোর নিশানা দেখা যাবে। তুমি তো জান, অতীতে এমনি অনেক ঝাঁপসা কেস নিয়ে প্রথম-প্রথম নাকানিচোবানি খেয়েছি–শেষকালে কিন্তু সমস্যার হিমালয়ও একলাফে পেরিয়ে গিয়েছি। কাজেই আমার বুদ্ধি যদি নাও তো, যতক্ষণ ঠিক তত্ত্ব হাতে না-আসছে, ততক্ষণ এ-কেস শিকেয় তুলে রেখে চলো গুহাবাসী মানবের অন্বেষণে সময়টা ব্যয় করা যাক।
যখন খুশি মনটাকে বিষয়ান্তরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল শার্লক হোমসের এ নিয়ে এর আগেও অনেক কথা বলেছি আমি। কিন্তু সেদিন কনওয়ালের সেই বাসন্তী প্রভাতে যেভাবে ঝাড়া দু-ঘণ্টা কেল্ট, তিরের ফলা আর খোলামকুচি নিয়ে সারগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে গেল ও, তেমনটি কখনো দেখিনি। হালকাভাবে কথা বলার ধরন দেখে মনেই হল না যে অত্যন্ত নারকীয় একটা কেস একটু আগেই কুরে কুরে খেয়েছে ওর মস্তিষ্ককে সমাধান না-পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। বিকেল বেলা কটেজে ফিরে দেখলাম একজন দর্শনার্থী বসে রয়েছেন আমাদের ফেরার পথ চেয়ে—ইনিই নিমেষ মধ্যে আমাদের ফিরিয়ে আনলেন ভয়াবহ কেসের আলোচনায়। এক নজরেই দুজনেই চিনলাম ভদ্রলোককে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দরকার হল না। বিরাট চেহারা, এবড়োখেবড়ো সুগভীর বলিরেখা আঁকা মুখ, জ্বলজ্বলে ভয়ানক চোখ আর গরুড় পাখির চঞ্চুর মতো টিকোলো নাক, প্রায়-কড়িকাঠ-ছোঁয়া তেল চটচটে চুল আর চিরন্তর চুরুটের দৌলতে ঠোঁটের কাছে নিকোটিন রাঙানো সোনালি-ঝালরওলা অমন আশ্চর্য সাদাটে দাড়ি গোটা লন্ডন আর আফ্রিকায় শুধু একজনেরই আছে–প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারী বিখ্যাত সিংহশিকারী এবং অজানার অভিযাত্রী–ডক্টর লিয়ন স্টার্নডেল।
উনি যে এ-জেলায় আছেন, সে-খবর পেয়েছিলাম। জলার রাস্তায় বার কয়েক ওঁর তালঢ্যাঙা চেহারাও দেখেছিলাম। উনি আমাদের কাছে ঘেঁষেননি, আমরাও ওঁকে সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছি উনি একলা থাকতে ভালোবাসেন বলে। এই কারণেই পর্যটনের ফাঁকে ফাঁকে বেশির ভাগ সময় কাটান বুচান অ্যারায়েন্সের নির্জন জঙ্গলের গভীরে একটা ছোট্ট বাংলো বাড়িতে। এ-অঞ্চলে এলে বই আর ম্যাপ নিয়ে তন্ময় হয়ে থাকেন নিজের মধ্যে নিজের কাজকর্ম নিজেই করেন, কারো সাহায্য নেন না–কারো সঙ্গে থাকেন না কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে মেশেন না–তাদের ব্যাপারে নাক গলান না। তাই অবাক হয়ে গেলাম ব্যগ্রভাবে যখন হোমসের কাছে জানতে চাইলেন, রহস্যজনক এই উপসংহারে অগ্রগতি কিছু হয়েছে কি না। বললেন, গাঁয়ের পুলিশগুলো এক্কেবারে আকাট আপনার অভিজ্ঞতা তো কম নয়–নিশ্চয় হালে পানি পাবেন। এ-ব্যাপারে আমার এত আগ্রহ কেন জানেন? আমার মা কর্নিশ–সেইদিক দিয়ে ট্রেগেন্নিসরা আমার মাসতুতো ভাইবোন। এদের আমি ভালো করেই চিনি। তাই মন আমার ভেঙে গেছে ওদের এই শোচনীয় পরিণতিতে। প্লিমাউথ পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলাম আজ সকালেই খবরটা পেয়ে, এলাম যদি আপনাদের তদন্তে সাহায্য করতে পারি–এই আশায়।
ভুরু তুলে হোমস বললে, জাহাজ ছেড়ে গেল তো?
পরের জাহাজে যাব।
তাই নাকি! একেই বলে বন্ধুত্ব।
আত্মীয়–আগেই বলেছি।
তা বলেছেন–মায়ের তরফে মাসতুতো ভাইবোন। মালপত্র কোথায়? জাহাজে নাকি?
কিছু কিছু–বেশিরভাগই হোটেলে।
কিন্তু খবরটা নিশ্চয় প্লিমাউথ খবরের কাগজে বেরোয়নি?
আজ্ঞে না। টেলিগ্রামে খবর পেয়েছি।
কে পাঠিয়েছে জানতে পারি?
অভিযাত্রীর বৃহৎ কৃশ বদনের ওপর দিয়ে একটা ছায়া ভেসে গেল যেন।
আপনার কৌতূহলটা একটু বেশি রকমের, মি. হোমস।
আমার ব্যাবসাই যে তাই।
রুক্ষ ভাবটা অতিকষ্টে সামলে নিলেন ডক্টর স্টার্নডেল।
মি. রাউন্ড হে পাঠিয়েছেন টেলিগ্রাম।
ধন্যবাদ। আপনার প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলব, কেসটা সম্পর্কে এখনও মনস্থির করে উঠতে পারিনি। তবে শিগগিরই করব। তার আগে কিন্তু বলাটা সমীচীন হবে না।
আপনার সন্দেহ কোন খাতে বইছে বলতে আপত্তি আছে?
জবাবটা জানা থাকলে তো বলব।
খামোখা খানিকটা সময় নষ্ট করলাম দেখছি। যাক, আর কথা বাড়াতে চাই না, অসভ্যের মতো হনহন করে বেরিয়ে গেলেন বিখ্যাত সিংহ শিকারি। পাঁচ মিনিটও গেল না, পেছন নিল শার্লক হোমস। ফিরল সন্ধেবেলায়! উদ্ভান্ত মুখচ্ছবি আর শ্লথ পদক্ষেপ দেখেই বুঝলাম পণ্ডশ্রম হয়েছে–সুবিধে করে উঠতে পারেনি। একটা টেলিগ্রাম এসে পড়ে ছিল। চোখ বুলিয়ে নিয়েই ছুঁড়ে ফেলে দিলে অগ্নিকুণ্ডে।
বললে, প্লিমাউথ হোটেলের টেলিগ্রাম। মি. রাউন্ড হের কাছে ঠিকানা নিয়ে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে জানতে চেয়েছিলাম ডক্টর স্টার্নডেল যা বলে গেলেন, তা সত্যি কি না। দেখা যাচ্ছে, সব সত্যি। সত্যিই উনি জাহাজে কিছু মাল পাঠিয়েছেন–একরাত হোটেলে কাটিয়েছেন, তারপর ছুটে এসেছেন এখনকার তদন্ত দেখতে। কী বুঝলে ওয়াটসন?
বুঝলাম যে এ-ব্যাপারে ওঁর গভীর আগ্রহ রয়েছে।
খুবই গভীর, বন্ধু খুব গভীর। ওঁর এই সুগভীর আগ্রহের মধ্যেই কিন্তু একটা সুতো রয়েছে–খেইটা ধরতে পারছি না। ঠিকমতো নাগাল পেয়ে গেলেই জানবে জট ছড়িয়ে ফেলা যাবে। অত মুষড়ে পোড় না, ওয়াটসন। ফুর্তি করো। সব সূত্র এখনও হাতে আসেনি–এলে আর অসুবিধে থাকবে না বলে রাখছি।
হোমসের কথার তাৎপর্য যে কতখানি এবং কী ধরনের পৈশাচিক আর অদ্ভুত কর্মকাণ্ডের ফলে তদন্ত নতুন দিকে মোড় নিতে চলেছে, তখন কিন্তু তা একদম বুঝিনি। সকাল বেলা জানলায় দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাচ্ছি, এমন সময়ে দেখলাম একটা এক্কাগাড়ি ঝড়ের মতো আসছে রাস্তা দিয়ে। গাড়ি দাঁড়াল আমাদেরই কটেজের সামনে, লাফিয়ে নামলেন পাদরি মশায় এবং নক্ষত্রবেগে দৌড়ে এলেন ভেতর দিকে। জামাকাপড় পরে তৈরি হয়েছিল হোমস দুজনেই দৌড়ে গেলাম ওঁর দিকে।
সাংঘাতিক উত্তেজিত হয়েছিলেন পাদরি। ভালো করে কথাও বলতে পারছিলেন না। হাঁসফঁস করতে করতে বললেন :
অপদেবতা! অপদেবতায় আমাদের ভিটেমাটি তুলে ছাড়বে মি. হোমস। কারুর নিস্তার নেই–কেউ বাঁচবে না। সবাই মরবে এ-অঞ্চলে।
ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে মুখে, আতঙ্ক বিস্ফারিত চোখে প্রায় নাচতে নাচতে চেঁচাতে লাগলেন ভদ্রলোক। চোখ-মুখের ওইরকম অবস্থা না-দেখলে নির্ঘাত হেসে ফেলতাম : অবশেষে একটু ধাতস্থ হয়ে ব্যক্ত করলেন ভয়াবহ সংবাদটা।
মি. ট্রেগেন্নিস কাল রাতে মারা গেছেন–তিন ভাইবোনের চোখে-মুখে যেসব লক্ষণ দেখা গেছে, তার সমস্ত ওঁর মুখেও ফুটে উঠেছে।
সঙ্গেসঙ্গে যেন এনার্জির বিস্ফোরণ ঘটল শার্লক হোমসের সর্ব অঙ্গে, ছিটকে গেল জ্যামুক্ত তিরের মতো।
আপনার এক্কায় আমাদের জায়গা হবে তো?
হবে।
ওয়াটসন, ব্রেকফার্স্ট পরে খাব। মি. রাউন্ড হে, চলে আসুন, আর দেরি করা যায় না তাড়াতাড়ি চলুন। কে আবার কোথায় হাত দিয়ে ফেলবে, তার আগেই পৌঁছাতে হবে।
পাদরি সাহেবের বাড়িতে ওপর নীচে দুটো ঘর নিয়ে থাকতেন মি. মর্টিমার ট্রেগেন্নিস। নীচে বসবার ঘর, ঠিক ওপরে শোবার ঘর। জানলার ধার পর্যন্ত বাগান। পুলিশ বা ডাক্তার এসে অকুস্থল লাটঘাট করার আগেই পৌঁছে গেলাম আমরা। গিয়ে যা দেখলাম, হুবহু তার বর্ণনা দিচ্ছি। দৃশ্যটা ইহজীবনে তোলবার নয়।
ঘরের আবহাওয়া এমনই ভয়াবহ আর গুমোট যে ঢোকার সঙ্গেসঙ্গে মনটা বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। চাকরটা ঘরে ঢুকেই জানলা খুলে দিয়েছিল তাই রক্ষে, নইলে আরও অসহ্য ঠেকত। এর কারণ বোধ হয় একটা তেলের বাতি–ঘরের ঠিক মাঝখানে। টেবিলের ওপর সেটা তখনও দপদপ করে ধোঁয়া ছাড়ছে। পাশের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মি. মর্টিমার ট্রেগেন্নিস। ছুঁচালো থুতনি ঠেলে এগিয়ে এসেছে সামনের দিকে চশমা জোড়া ঠেলে তোলা কপালের ওপর শীর্ণ মুখটা জানলার দিকে ফেরানো। মরা বোনের মুখে যে বিকট চিহ্ন প্রকট হয়ে উঠতে দেখেছিলাম–অবিকল সেই আতঙ্ক এঁরও মুখের পরতে পরতে ফুটে উঠেছে। হাত-পা মুচড়ে রয়েছে অস্বাভাবিকভাবে প্রচণ্ড একটা আতঙ্ক মুহূর্তের আক্রমণে বেঁকিয়ে আড়ষ্ট করে দিয়ে গিয়েছে হাতের দশ আঙুল। বেশবাস সম্পূর্ণ–কিন্তু তা তাড়াহুড়ো করে পরেছেন। আগেই শুনেছিলাম, রাতে শুয়েছেন–বিছানায় শোয়ার চিহ্ন আছে। খুব ভোরে ঘটেছে এই মর্মান্তিক ঘটনা।
এহেন মৃত্যুমহলে ঢোকার সঙ্গেসঙ্গে হোমসের সর্বাঙ্গে যে কী ধরনের আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল, তা যে না দেখেছে সে কল্পনাই করতে পারবে না যে কী নিদারুণ বিদ্যুৎগতি সুপ্ত থাকে। ওর বাইরের শ্লথ-প্রকৃতির অন্তরালে। মুহূর্তের মতো চনমনে হল যেন প্রতিটি অণুপরমাণু সজাগ, সতর্ক, হুঁশিয়ার। উজ্জ্বল হল দুই চোখ, শক্ত হল পেশি। যেন ব্যগ্র তৎপরতার নব বিদ্যুৎশক্তি সঞ্চারিত হল সারাদেহে। জানলা দিয়ে বাগানে বেরিয়ে গিয়ে ফের ফিরে এল ঘরে। বেশ বার কয়েক ঘরময় চরকিপাক দিয়ে ছুটে গেল ওপরের শোবার ঘরে।
দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল শয়নকক্ষের ওপরে নীচে ডাইনে বাঁয়ে এক ধাক্কায় খুলে দিলে জানলা। সঙ্গেসঙ্গে বুঝলাম মনের মতো কিছু একটা চোখে পড়েছে। কেননা, পাল্লা খুলে যেতেই সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে ঝুঁকে পড়ল নীচে। দুমদুম করে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে, ছিটকে বেরিয়ে গেল জানলা দিয়ে, সটান উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল বাগানের মাটিতে। আবার দাঁড়িয়ে উঠল একলাফে, ফিরে এল ঘরে এবং সব কিছুই এমন একটা প্রচণ্ড উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে করে চলল যেন শিকারের ঠিক পেছনটিতে এসে পড়েছে শিকারি কুকুর। অতি মামুলি তেলের বাতিটাকে অসীম মনোেযোগ নিয়ে দেখল। খোলের মাপ নিল। চিমনির ওপর যে অভ্র-আচ্ছাদন আছে, আতশকাচের মধ্যে দিয়ে সেটা অনেকক্ষণ খুব খুঁটিয়ে দেখল, তারপর ওপর থেকে খানিকটা ছাই চেঁছে নিয়ে রাখল খামের ভেতর। সবশেষে ডাক্তার আর পুলিশ আসতেই মি. রাউন্ড হেঁকে নিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে।
বললে, তদন্ত সার্থক হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে আমার নেই। তবে আপনি দয়া করে বলে দেবেন, যেন ওঁরা শোবার ঘরের জানলা আর বসবার ঘরের তেলের বাতি–এই দুটো জিনিসের ওপর বেশি নজর দেন। প্রত্যেকটাই তদন্তে সাহায্য করবে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে কাজে লাগবে। এর বেশি খবর যদি চায় পুলিশ, আমার কটেজে গিয়ে যেন দেখা করে। ওয়াটসন, চলো এবার অন্য ব্যাপারে মন দেওয়া যাক।
পুলিশি ব্যাপারে শখের গোয়েন্দার নাক গলানো বোধ হয় মনঃপূত হয়নি পুলিশ মহলের, অথবা হয়তো আশাব্যঞ্জক কোনো তদন্তসূত্র পেয়ে সেইদিকেই ছুটেছিল পুলিশ–কারণ যাই হোক না কেন, পরের দুটো দিন কেউ চৌকাঠ মাড়াল না আমাদের। এই দু-দিনের বেশির ভাগ সময় কটেজেই রইল হোমস, পাইপ টানল সমানে আর বিভোর হয়ে রইল দিবাস্বপ্নে। মাঝে মাঝে একাই বেরিয়ে যেত বেড়াতে ফিরত বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বলত না কোথায় গিয়ে কী করে এল। এর মধ্যে একটা এক্সপেরিমেন্ট করে অবশ্য দেখিয়ে দিলে তদন্তের লাইনটা কী। মর্টিমার ট্রেগেন্নিসের মৃত্যুর রাতে তার ঘরে যে তেলের বাতি দেখে এসেছি, হুবহু সেই ডিজাইনের একটা তেলের বাতি কিনে আনল বাজার থেকে। একই তেল দিয়ে ভরল বাতিটা এবং… জ্বালিয়ে রেখে দেখল তেল ফুরোয় কতক্ষণে–হিসেবটা লিখে রাখল কাগজে। আরও একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিল অত্যন্ত অপ্রীতিকর এক্সপেরিমেন্ট–জীবনে ভুলতে পারব কি না সন্দেহ।
একদিন বিকেলের দিকে আমাকে বলল, ওয়াটসন, নিশ্চয় লক্ষ করেছ–বিভিন্ন ঘটনার বিভিন্ন রিপোর্টের মধ্যে একটা বিষয় কিন্তু প্রতিক্ষেত্রেই দেখা গেছে। প্রথমেই ঘরে যে ঢুকেছে, অদ্ভুতভাবে তার উপর প্রভাব বিস্তার করেছে ঘরের আবহাওয়া। মর্টিমার ট্রেগেন্নিসের বর্ণনা মনে করে দেখ। ডাক্তার ঘরে ঢুকেই অজ্ঞানের মতো চেয়ারে পড়ে যান। ভুলে গেছিলে? যাচ্চলে! কিন্তু আমার মনে আছে। হাউসকিপার মিসেস পোর্টারও ঘরে ঢুকে অজ্ঞান হয়ে যায়–পরে জানলা খুলে দেয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মর্টিমার ট্রেগেন্নিসের ঘরে আমরা ঢুকে টের পেয়েছিলাম একটা দম আটকানো আবহাওয়া। জানলা যদিও খোলা ছিল, তবুও ঘরে ঢোকার সঙ্গেসঙ্গে সেই দম আটকানো গুমোট আবহাওয়ার অভিজ্ঞতা চট করে ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না! খোঁজ নিয়ে জেনেছি যে-চাকরটা প্রথমে ঘরে জানলা খুলেছিল, সে বেচারাও এমন অসুস্থ হয়ে পড়েছে যে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। ওয়াটসন, বলো দিকি প্রতিক্ষেত্রে এইভাবে কাহিল হয়ে পড়ার মানেটা কী? কীসের ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন রয়েছে এর মধ্যে? বিষাক্ত আবহাওয়া, তাই নয় কি? আরও আছে–প্রতি ক্ষেত্রে ঘরের মধ্যে কিছু-না-কিছু জ্বলছে। প্রথম ক্ষেত্রে চুল্লির আগুন; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, তেলের বাতি। চুল্লির আগুন না হয় দরকার হয়েছিল কিন্তু তেলের বাতিটা ইচ্ছে করে জ্বালানো হয়েছিল–তেল পুড়তে কতটা সময় লাগে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখেছি, দিনের আলো ফোটবার পরেও জ্বালানো হয়েছিল বাতিটা। এই তিনটে জিনিসের মধ্যে নিশ্চয় একটা নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। আগুন, দম-আটকানো আবহাওয়া, আর সবশেষে উন্মত্ততা অথবা মৃত্যু। পরিষ্কার। হল তো?
মনে তো হচ্ছে।
কাজ শুরু করার মতো একটা অনুমিতি এইভাবে খাড়া করে নিয়ে এগোনো যাক। প্রত্যেকবার ঘরের মধ্যে কিছু একটা পোড়ানো হয়েছে। ফলে এমন একটা নাম-না-জানা বিষময় আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে যার প্রভাব থেকে কেউই রেহাই পায়নি। বেশ, বেশ। প্রথম ক্ষেত্রে, ট্রেগেন্নিস ভাইবোনের বেলায়–জিনিসটা রাখা হয়েছিল চুল্লির আগুনে। জানলা বন্ধ ছিল যদিও, কিন্তু চুল্লির ধোঁয়া বেরিয়ে গিয়েছে চিমনি দিয়ে। বিষটার কাজও হয়েছে দেরিতে। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, মিস্টার মর্টিমার ট্রেগেন্নিসের ঘরে, তেলের বাতির মধ্যে জিনিসটা পোড়ানো হয়েছে বলে ধোঁয়া বেরিয়ে যাওয়ার তেমন সুযোগ পায়নি; তাই বিষের ক্রিয়া হয়েছে খুবই তাড়াতাড়ি, প্রভাবটা হয়েছে প্রচণ্ড। সেইকারণেই প্রথম ক্ষেত্রে একটি মেয়ে বিষের সংস্পর্শে আসতে-না-আসতেই মারা গিয়েছে মেয়েদের দেহযন্ত্র পুরুষদের চাইতে অনেক বেশি অনুভূতি সচেতন বলেই কাজটা হয়েছে দ্রুত কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর বদলে এসেছে সাময়িক অথবা স্থায়ী উন্মত্ততা বিষটার প্রথম কাজ বোধ হয় তাই পাগল করিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ হয়েছে বিষক্রিয়া। এই দুই ঘটনা থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, অন্তরালে কাজ করেছে এমন একটা বিষ যা পুড়ে গিয়ে ধোঁয়ার আকারে প্রথমে নিদারুণ আতঙ্ক সৃষ্টি করে পাগল করে দেয় মানুষকে–তারপরে আনে মৃত্যু।
যুক্তির এই ধারাবাহিকতা মগজের মধ্যে নিয়ে দৌড়ে গেলাম মর্টিমার ট্রেগেন্নিসের ঘরে–আঁতিপাঁতি করে খুঁজলাম মারণদ্রব্যটার অবশিষ্টাংশ। তেলের বাতির অভ্ৰআচ্ছাদনেই এ-জিনিস লেগে থাকার কথা–যেখানে লাগিয়ে রাখলে নিজে পুড়ে ধোঁয়া হয়ে যাবে। সত্যিই দেখলাম স্তরে স্তরে সাজানো কিছু ছাই জমে রয়েছে ধোঁয়া আটকানোর আচ্ছাদনের মধ্যে কিনারা ঘিরে খানিকটা বাদামি পাউডার–তখনও পোড়েনি। তুমি তো দেখলে অর্ধেক পাউডার তুলে রাখলাম খামের মধ্যে।
অর্ধেক কেন?
ভায়া ওয়াটসন, সরকারি পুলিশবাহিনির অন্তরায় হওয়া আমার উচিত নয়। প্রমাণ-টমান যাই পাই না কেন, ওদের জন্যে তা রেখে আসি নিজে সরাই না। অভ্র আচ্ছাদনের কীসের গুঁড়ো এখনও লেগে রয়েছে, ওদের বুদ্ধি থাকে, সংগ্রহ করুক। ওয়াটসন, এবার শুরু হবে আমাদের এক্সপেরিমেন্ট। জানলাটা খোলা থাক–সমাজে আমাদের এখনও দরকার আছে–অকালমৃত্যু ঘটাতে চাই না। তুমি বসবে খোলা জানলার ধারে আর্মচেয়ারে নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে যদি বোঝো এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করার সময়ে এসেছে হস্তক্ষেপ করবে। কী বললে? এক্সপেরিমেন্টে তুমিও অংশ নেবে? আরে আরে ভায়া, তোমাকে আমি চিনি–ঠিক এমনটাই আশা করেছিলাম। ঠিক আছে ভায়া, ঠিক আছে। টেবিলের দু-দিকে পাতলাম দুজনের চেয়ার বিষ থেকে সমান দূরত্বে রইলাম দুজনে–বসব মুখোমুখি। দরজা খোলা থাকুক। দুজনেই কিন্তু বিষের খপ্পরে সমান ভাবে পড়ব, সমান ভাবে টের পাব বিষের ধোঁয়া কাজ করছে কীভাবে এবং সমানভাবে সুযোগ পাব বাড়াবাড়ি হয়ে যাওয়ার আগেই এক্সপেরিমেন্ট ভন্ডুল করে দেওয়ার। পরিষ্কার তো? বেশ, বেশ। খাম থেকে বিষের গুঁড়ো বার করে রাখলাম জ্বলন্ত বাতির আচ্ছাদনে। এইবার! ওয়াটসন, বসে পড়ো, ভায়া বসে পড়ো। দেখো, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়।
বেশি দেরি হল না। ভয়ংকররা এল অত্যন্ত দ্রুত পদক্ষেপে অত্যন্ত অদ্ভুত পদসঞ্চারে। চেয়ারে চেপে বসবার আগেই নাসিকারন্ধ্রে ভেসে এল ঘন মৃগনাভির একটা কটু গুড়-পাক-দেওয়া গন্ধ। উগ্র বিচিত্র সেই গন্ধের প্রথম ঝাঁপটাতেই আমি আর আমার মধ্যে রইলাম না–আমার মস্তিষ্ক, আমার কল্পনাশক্তি যেন বেহাত হয়ে গেল অন্যের হাতে কর্তৃত্ব হারালাম আমারই মগজ আর কল্পনার ওপর। চোখের সামনে দূরন্ত ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরপাক খেতে লাগল নীরন্ধ্র তমিস্রাময় কালো ছায়া। শিউরে উঠল আমার অন্তরাত্মা। অকস্মাৎ একটা নামহীন আতঙ্ক সঞ্চারিত হয়ে গেল আমার অণুতে পরমাণুতে মন বললে, কুণ্ডলী পাকানো ওই বিকট মেঘপুঞ্জের মধ্যে যেন পুঞ্জীভূত হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যত কিছু রক্ত-জল-করা বিভীষিকা। ওরা যেন ওত পেতে রয়েছে পুরু ছায়ার মধ্যে, সময় গুনছে একযোগে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে। বর্ণনাতীত সেই লোমহর্ষক অনুভূতি মুহূর্তের মধ্যে সিটিয়ে তুলল আমার সর্ব অঙ্গ। দুনিয়ার সমস্ত দানবীয় আর ভয়াল শয়তানিকে প্রত্যক্ষ করার ভয়ে আমি যেন পাগল হয়ে গেলাম। মনে হল যেন নিকষ মেঘের মতো ঘুরপাক খাওয়া কৃষ্ণ ছায়ার মধ্যে সরে সরে যাচ্ছে অজস্র আবছা আকৃতি ভাসছে, কাছে আসছে, আবার দূরে সরে যাচ্ছে। তারা কেউ স্পষ্ট নয় কিন্তু তারা হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ করে দেওয়ার মতো ভয়াবহ। প্রতিমুহূর্তেই মনে হল এই বুঝি সিঁড়ির ওপর শুনব ভয়ংকরের পদধ্বনি–যার ছায়া দেখামাত্র নিঃসীম আতঙ্কে অন্তরাত্মা বিদীর্ণ হয়ে যাবে আমার। অথচ সে কে, কীরকম তাকে দেখতে কিছুই জানি না–বুঝতে পারছি না। কিন্তু এই না-বোঝা আতঙ্কের খপ্পরে অসাড় হয়ে এল আমার জ্ঞানবুদ্ধি চেতনা–ক্ষণে ক্ষণে মনে হল অবর্ণনীয় অবিশ্বাস্য অস্বাভাবিক এমন কিছু একটা ঘটতে চলেছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যার তুল্য নজির আর দ্বিতীয় নেই। আমি অনুভব করলাম কল্পনাতীত আতঙ্কে। আমার চুল খাড়া হয়ে যাচ্ছে, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, কোটর থেকে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে, মুখটা হাঁ হয়ে গিয়েছে, জিভটা চামড়ার মতো শক্ত হয়ে বাইরে ঝুলে পড়েছে। এমন একটা তুমুল হট্টগোল, একটা বিকট বিপর্যয় লেগে গেল মস্তিষ্কের কোষে কোষে যে মনে হল যেকোনো মুহূর্তে ছিঁড়েখুঁড়ে দলা পাকিয়ে যাবে মগজের সবকটা স্নায়ু। ভীষণ ভয়ে আর্তগলায় বুকফাটা হাহাকার করতে গেলাম–কিন্তু গলা দিয়ে বীভৎস কর্কশ যে-আওয়াজটা বেরোল–সেটা বুঝি আমার নয়–যেন কাকা করে কেঁদে উঠল একটা দাঁড়কাক। অতিবড়ো দুঃস্বপ্নেও এহেন ডাক যে আমার গলা দিয়ে কখনো বেরোতে পারে ভাবতেও পারিনি। গা হাত পা হিম হয়ে গেল স্বকর্ণে সেই বিকৃত ধ্বনি শুনে। আতঙ্কের এই সর্বনেশে নাগপাশকে ঝেড়ে ফেলে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যেই প্রাণপণে, দেহের আর মনের শেষ শক্তিবিন্দু সঞ্চয় করে, সীমাহীন নৈরাশ্যের পুঞ্জীভূত মেঘের ফাঁক দিয়ে তাকালাম হোমসের পানে। অবশ অক্ষিপটে পলকের জন্যে ভেসে উঠল একটা সাদা কঠিন আতঙ্ক বিকৃত, দুমড়োনো-মুচড়োনো ভয়াল মুখচ্ছবি। ঠিক এই দৃশ্য, এই আতঙ্ক দেখেছি এর আগে দুটি মৃতদেহের মুখে। তৃতীয়বার দেখলাম যার মুখে সে আমার প্রাণাধিক বন্ধু শার্লক হোমস। হোমস! হোমস! হোমস! হোমসের মুখের এই ভয়ানক চেহারাই চাবুক হেনে জড়তা কাটিয়ে দিল আমার। মুহূর্তের মধ্যে আমার চেতনা আসন্নমৃত্যু আর উন্মত্ততার নরককুণ্ড থেকে ঠিকরে বেরিয়ে এল বাইরে ফিরে এল আমার শক্তি আর মস্তিষ্কের সুস্থতা। চেয়ার থেকে লাফিয়ে গেলাম। হোমসকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে টলতে টলতে কাত হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়তে পড়তেও কোনোমতে ছিটকে এলাম দরজা দিয়ে বাইরে এবং আছড়ে পড়লাম ঘাস ছাওয়া জমির ওপর। অবশ্য দেহে প্রায় বিলুপ্ত চেতনা নিয়ে পাশাপাশি পড়ে রইলাম দুই বন্ধু। আঙুল পর্যন্ত নাড়াতে পারলাম না–শুধু টের পেলাম চারদিকে যেন নেচে খেলা করছে প্রাণদায়ী সূর্যরশ্মি আতঙ্কে ঠাসা নারকীয় মেঘ ছিন্নভিন্ন করে উজ্জ্বল হিতকর তপন কিরণ এগিয়ে আসছে যেন আত্মার কাছে শয়তানের মুঠি শিথিল হয়ে যাচ্ছে অরুণ দেবের উষ্ণ স্পর্শে—কুয়াশার গাঢ় অবগুণ্ঠন যেভাবে দিকদিগন্ত থেকে একটু একটু করে উঠে গিয়ে মিলিয়ে যায়, ঠিক সেইভাবে জমাট বাঁধা বর্ণনাতীত সেই আতঙ্ক মেঘও ওপরে উঠে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল–মনের ভেতর থেকেও নিকষ মেঘের তিরোধান ঘটল। মন আর দেহের শক্তি পুরোপুরি ফিরে না-আসা পর্যন্ত ঘামে ভেজা কপাল মুছতে লাগলাম ঘাসে বসে ভয়ার্ত চোখে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে আসন্ন মুত্যুর অপস্রিয়মাণ লক্ষণ দেখে বোঝবার চেষ্টা করতে লাগলাম এইমাত্র কী ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এলাম দুজনে।
অবশেষে ভাঙা ভাঙা গলায় হোমস বললে, ভায়া, আমাকে ক্ষমা করো। এ-এক্সপেরিমেন্টে বন্ধুকে টেনে আনা আমার উচিত হয়নি।
হোমসকে এভাবে বিচলিত হতে কখনো দেখিনি। এভাবে ওর ভেতরের চেহারা কখনো চোখে পড়েনি। তাই আবেগে কেঁপে উঠল আমার গলা।
বললাম, হোমস, তোমার কাজে লাগতে পেরেছি, এইটাই তো আমার সবচেয়ে বড়ো আনন্দ।
মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এল ওর চিরপরিচিত মুখের চেহারা আশেপাশে যারা থাকে। তারাই চেনে হোমসের বাইরের এই খোলস। কিছুটা কৌতুক, কিছুটা ছিদ্রান্বেষী মুখচ্ছবি দিয়ে ঢেকে দেয় কোমল অন্তর-প্রকৃতি। বললে, ভায়া ওয়াটসন, নতুন করে আমাদের পাগল বানানোর আর দরকার ছিল না। পাগল হয়েছিলাম বলেই এ-জাতীয় এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়েছিলাম। বিষের ক্রিয়া যে এত আচমকা আর এত প্রচণ্ড হবে–কল্পনাও করিনি। ঝড়ের মতো কটেজে ঢুকে লম্ফটা ধরে নাকের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে বেরিয়ে এল হোমস ছুঁড়ে ফেলে দিলে কাঁটা ঝোঁপের মধ্যে। ঘরটা একটু পরিষ্কার থোক। ওয়াটসন, আগের ট্র্যাজেড়িগুলো ঘটেছে কীভাবে, এখন নিশ্চয় বুঝেছ?
এক্কেবারে।
উদ্দেশ্য কিন্তু এখনও অস্পষ্ট। এসো, এই কুঞ্জবনে বসে আলোচনা করা যাক। বিশ্রী গ্যাসটা যেন এখনও গলায় আটকে রয়েছে। সবকটা প্রমাণ কিন্তু মর্টিমার ট্রেগেন্নিসকেই ফাঁসিয়ে দিচ্ছে। প্রথম ট্র্যাজেডিতে তিনি খুন করেছেন, দ্বিতীয় ট্র্যাজেডিতে তিনি নিজে খুন হয়েছেন। প্রথমেই একটা ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে। ট্রেগেন্নিস পরিবারে একটা পুরোনো ঝগড়া আছে। পরে অবশ্য তা মিটে গেছে। ঝগড়াটা কতখানি তিক্ততার সৃষ্টি করেছিল–পরে যে সত্যি সত্যিই তা অন্তর থেকে মিটে যায়নি তার বিশদ খবর কোনোদিনই আর জানা যাবে না। মর্টিমার ট্রেগেন্নিসের শেয়ালের মতো ছুঁচোলো মুখ, চশমা ঢাকা পুঁতির মতো ছোটো ধূর্ত চোখ দেখলে মনে হয় না অন্তর থেকে ক্ষমা করার মানুষ উনি। বাগানে কী যেন একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে এই খবরটা শুনে সাময়িকভাবে আমাদের মন অলীক একটা স্তিত্বের দিকে ছুটে গিয়েছিল–খবরটা কিন্তু ওই ভদ্রলোকেরই দেওয়া। গোড়া থেকেই আমাদের ভুল পথে চালিয়ে দেওয়ার পেছনে ওঁর একটা উদ্দেশ্য ছিল–সোজা কথায় যাকে বলব মোটিভ। সবচেয়ে বড়ো কথা, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তেলের বাতিতে উনি গুঁড়োটা না রেখে গেলে আর কে রাখবে বলতে পার? উনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে-না-যেতেই ঘটেছে ঘটমাটা। অন্য কেউ ঘরে ঢুকলে তিন ভাইবোনেরা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াত নিশ্চয় টেবিলের কাছ থেকে সরে আসত। তা ছাড়া, কর্নওয়ালের মতো নিরুপদ্রব অঞ্চলে শান্তিপ্রিয় বাসিন্দারা রাত দশটার পর কারো বাড়িতে সামাজিকতা রাখতে যায় না। কাজেই, সব পয়েন্ট একদিকেই মুখ করে আছে–মর্টিমার ট্রেগেন্নিসের দিকে অপরাধী তিনিই স্বয়ং।
ওঁর নিজের মৃত্যুটা তাহলে আত্মহত্যা?
দেখে সেইরকমই মনে হতে পারে অসম্ভব কিছু নয়। তিন ভাইবোনের এ-হাল যে করেছে, অনুতাপে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে সে যে নিজের হাতে নিজেকে একইভাবে মেরে প্রায়শ্চিত্ত করে গেছে, এইটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। তবে এ-সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কয়েকটা প্রবল যুক্তি আছে। ইংলন্ডে একজনই জানেন। তার নিজের মুখে সব শুনব বলে অ্যাপয়েন্টমেন্টও করে রেখেছি। আরে! একটু আগেই ভদ্রলোক এসে গেছেন দেখছি! এদিকে আসুন, ডক্টর লিয়ন স্টার্নডেল। ঘরে বসে এমন একটা বিতিগিচ্ছিরি কেমিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট করেছি যে আপনার মতো বিশিষ্ট ভদ্রলোককেও ঘরে আর আপ্যায়ন করা যায় না।
কটাং করে গেট খোলার আওয়াজ শুনলাম। বাগানের পথে আবির্ভূত হল সুবিখ্যাত আফ্রিকান অভিযাত্রীর রাজকীয় মূর্তি। সবিস্ময়ে চেয়ে রইলেন আমাদের গাঁইয়া কুঞ্জের দিকে।
ঘণ্টাখানেক আগে আপনার চিঠি পেলাম, মি. হোমস। আসতে বলেছেন বলে এলাম। কিন্তু হঠাৎ শমন পাঠানো হল কেন বুঝলাম না।
আপনার মুখে ব্যাপারটা সবিস্তার শোনবার জন্যে। তারপর আপনি যাবেন আপনার জায়গায়, আমরা যাব আমাদের ডেরায়। যাই হোক, এসে ধন্য করেছেন। এইভাবে ফাঁকা জায়গায় আকাশের নীচে আপনাকে আপ্যায়ন করতে হচ্ছে বলে কিছু মনে করবেন না। এইমাত্র একটা লোমহর্ষক কাহিনির মালমশলা সংগ্রহ করলাম আমি আর আমার এই ডাক্তার বন্ধুটি। কাহিনির নাম দিয়েছি–কনিশ-আতঙ্ক। তা ছাড়া, আপনার সঙ্গে যেসব আলোচনায় বসব এখন, তা আপনাকে ব্যক্তিগত আঘাত হানতে পারে। সেইদিক দিয়ে এখানে আপনি নিরাপদ, আড়ি পাতার কেউ নেই।
মুখ থেকে চুরুটটা নামিয়ে কঠোর চোখে হোমসের পানে চাইলেন সিংহশিকারি অভিযাত্রী।
মশায়, আমাকে ব্যক্তিগত আঘাত হানতে পারে এমন কী ব্যাপার আপনার পেটে আছে আমার মাথায় আসছে না।
মর্টিমার ট্রেগেন্নিসকে খুন করার ব্যাপার। বললে হোমস।
মুহূর্তের জন্যে মনে হল সশস্ত্র থাকলেই বুঝি ভালো করতাম। স্টার্নডেলের প্রবৃত্তি-প্রকটিত ভীষণ মুখটা নিমেষ মধ্যে কালচে-লাল হয়ে গেল, অঙ্গারের মতো জ্বলে উঠল দুই চোখ। দড়ির মতো ফুলে উঠল রগের শিরা–দু-হাত মুঠো করে বাঘের মতো লাফিয়ে গেলেন হোমসের দিকে। থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন পরক্ষণেই প্রবল চেষ্টায় আসুরিক হিংস্র প্রবৃত্তিগুলোর লাগাম টেনে ধরলেন–হঠাৎ এমন ভয়ংকরভাবে ঠান্ডা হয়ে গেলেন যা তাঁর ক্রোধের অকস্মাৎ বিস্ফোরণের চাইতেও বেশি বিপজ্জনক বলে মনে হল।
মি. হোমস, বহুদিন বর্বরদের সঙ্গে ঘর করেছি, আইনকানুনের নাগালের বাইরে জীবন কাটিয়েছি, দরকার হলে আইন আমিই সৃষ্টি করেছি–দণ্ডমুণ্ডের কর্তা আমিই হয়েছি। দয়া করে তা মনে রাখবেন। আপনি জখম হোন, এটা আমি চাই না।
আমিও আপনাকে আহত করতে চাই না, ডক্টর স্টার্নডেল। সেইজন্যেই তো পুলিশ না-ডেকে আপনাকে এনেছি। আমার সদিচ্ছের এইটাই কি স্পষ্ট প্রমাণ নয়?
অ্যাডভেঞ্চার-আকীর্ণ জীবনে এই প্রথম বুঝি ভয় পেলেন ডক্টর স্টার্নডেল। সশব্দে শ্বাস টেনে বসলেন পাশে। হোমসের আচরণে প্রশান্ত অভয়–উদবিগ্ন পুরুষের অন্তরে প্রলেপ দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। বিশাল থাবার মতো দু-হাত বারকয়েক মুঠো করে এবং খুলে বিড়বিড় করে আপন মনে কী যেন বললেন ডক্টর স্টার্নডেল।
তারপর বললেন, কী চান বলুন তো? খুলে বলুন মশায়, চালাকি করতে যাবেন না। আড়ে আড়ে কথা ছাড়ুন–খুলে বলুন। আর যদি ধাপ্পা মেরে বাজিমাত করব ভেবে থাকেন খুব খারাপ জায়গায় চালাকি করতে এসেছেন জেনে রাখবেন।
আমি তো খুলেই বলব–নইলে আপনি মন খুলবেন কী করে। খোলামেলা হাওয়াটা পারস্পরিক ব্যাপার তো। এরপর আমি যা করব, সেটা কিন্তু পুরোপুরি নির্ভর করছে আপনি কীভাবে আত্মসমর্থন করবেন, তার ওপর।
আত্মসমর্থন?
হ্যাঁ, মশাই হ্যাঁ।
কী ব্যাপার?
মর্টিমার ট্রেগেন্নিসকে খুন করার অভিযোগের ব্যাপারে।
রুমাল বার করে কপাল মুছতে মুছতে স্টার্নডেল বললেন, আপনি কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। এইভাবেই কি ধাপ্পা মেরে জেতেন সব কেসে?
শক্ত গলায় হোমস বললে, ডক্টর স্টার্নডেল, ধাপ্পাটা আপনি মারছেন–আমি নয়। প্রমাণ স্বরূপ কয়েকটা ঘটনা বলব–যার ভিত্তিতে পৌঁছেছি এই সিদ্ধান্তে। জাহাজে মালপত্র চাপিয়ে আফ্রিকায় পাচার করে দেওয়ার পর আপনার হঠাৎ ফিরে আসার ঘটনাটা শুনেই বুঝেছিলাম, এই নাটক নতুন করে খাড়া করতে গেলে আপনাকে আমার বিশেষ প্রয়োজন–
আমি ফিরে এলাম–
শুনেছি কেন ফিরে এলেন এবং কারণটা নাকচও করেছি বিশ্বাস করার মতো নয় বলে। যাকগে সে-কথা। আপনি আমার কাছে এলেন শুধু একটা কথা জানতে–কাকে সন্দেহ করেছি আমি। আপনার প্রশ্নের জবাব আমি দিলাম না। আপনি সোজা পাদরিমশায়ের বাড়িতে গিয়ে বাইরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিজের বাড়ি চলে গেলেন।
আপনি জানলেন কী করে?
আপনার পেছন পেছন আমি গিয়েছিলাম বলে।
আমি তো কাউকে দেখিনি।
আমি যখন আপনার পেছন নেব, ঠিক এইরকমটাই দেখবেন সবসময়ে–মানে, আমাকে কখনো দেখতে পাবেন না–আমি কিন্তু আপনাকে দেখতে পাব। সারারাত ছটফটিয়ে কাটালেন নিজের কটেজে, শেষকালে একটা মতলব মাথায় এল। সকাল বেলা বেরিয়ে পড়লেন প্ল্যানমাফিক কাজ হাসিল করার জন্যে। তখন সবে ভোরের আলো ফুটছে! কটেজ থেকে বেরিয়েই দরজার পাশ থেকে তাগাড় করা লালচে নুড়ি কয়েক খামচা তুলে নিয়ে পকেটে পুরলেন।
ভীষণ চমকে উঠলেন স্টার্নডেল, অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন হোমসের দিকে।
হনহন করে এক মাইল হেঁটে পৌঁছোলেন পাদরিমশায়ের বাড়িতে। এখন যে খাঁজকাটা সুখতলাওলা টেনিস জুতো পায়ে দিয়েছেন, তখন এই জুতো পরেই বেরিয়েছিলেন। পাদরিভবনে পৌঁছে ফলের বাগান পেরিয়ে পাশের ঝোপ টপকে পৌঁছোলেন ভাড়াটে ট্রেগেন্নিসের জানলার ঠিক নীচে। তখন দিনের আলো ফুটেছে, কিন্তু বাড়ির কেউ জাগেনি। পকেট থেকে কয়েকটা নুড়ি বার করে আপনি মাথার ওপরকার জানলা টিপ করে ছুঁড়তে আরম্ভ করলেন।
তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন স্টার্নডেল।
সাক্ষাৎ শয়তান নাকি আপনি!
অভিনন্দন শুনে হাসল হোমস। দু-মুঠো, কি তিন মুঠো নুড়ি ছোড়বার পর জানলায় এসে দাঁড়ালেন ভাড়াটে ভদ্রলোক। হাত নেড়ে তাঁকে নীচে আসতে বললেন আপনি। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে নিয়ে নীচের বসবার ঘরে নেমে এলেন ভদ্রলোক। আপনি ঢুকলেন জানলা দিয়ে। কথা বললেন সামান্য কিছুক্ষণের জন্যে আগাগোড়া পায়চারি করলেন ঘরময়। তারপর বেরিয়ে এসে জানলা বন্ধ করে দিলেন। লনে দাঁড়িয়ে চুরুট ধরিয়ে দেখতে লাগলেন কী হয়। ট্রেগেন্নিস মারা যাওয়ার পর যে-পথে এসেছিলেন, সেই পথেই বাড়ি ফিরে গেলেন। ডক্টর স্টার্নডেল, এবার বলুন এ-কাজ করলেন কেন? কী যুক্তিতে করলেন? মোটিভ কী আপনার? ওপরচালাকি করতে গেলে কিন্তু ব্যাপারটা আমার হাত থেকে বেরিয়ে যাবে জেনে রাখবেন।
মুখখানা ছাইয়ের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল ডক্টর স্টার্নডেলের। দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপরেই এক ঝটকায় বুক পকেট থেকে একটা ফোটোগ্রাফ বার করে ছুঁড়ে দিলেন সামনের ঘেসো টেবিলের ওপর।
যা কিছু করেছি, এইজন্যেই করেছি।
পরমাসুন্দরী এক মহিলার আবক্ষ আলোকচিত্র! ঝুঁকে পড়ল হোমস।
বলল, ব্রেন্দা ট্রেগেন্নিস।
হ্যাঁ, ব্রেন্দা ট্রেগেন্নিস।বললেন ডক্টর স্টার্নডেল। আমার ভালোবাসার মানুষ ব্রেন্দা ট্রেগেন্নিস। এ-ভালোবাসা আজকের নয়–বহু বছরের মনপ্রাণ দিয়ে সে ভালোবেসেছে আমাকে, আমি বেসেছি তাকে। কর্নিশ অঞ্চলে কেন মাঝে মাঝে এসে একলা কাটিয়ে যাই–কেউ তা বোঝেনি অবাক হয়েছে–কারণটা আবিষ্কার করতে পারেনি। এই হল সেই রহস্য। শুধু এর জন্যেই সুদূর আফ্রিকা থেকে ছুটে এসেছি বার বার। বছরের পর বছর গিয়েছে ভালোবাসা আরও নিবিড় হয়েছে। সে অপেক্ষা করেছে, আমিও অপেক্ষা করেছি, বিয়ে কিন্তু হয়নি। কেননা, আমি বিবাহিত। বউ অনেকদিন পালিয়েছে। অথচ ইংলন্ডের জঘন্য আইনের জন্যে তাকে ডাইভোর্সও করতে পারিনি। বছরের পর বছর কেবল অপেক্ষাই করে গিয়েছে সে-অপেক্ষা যে এই পরিণতির জন্যে, তা কে জানত বলুন। বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন ডক্টর স্টার্নডেল। থরথরিয়ে কেঁপে উঠল সুবিশাল দেহ। দাড়ির নীচে দু-হাত ঢুকিয়ে নিজেই টিপে ধরলেন নিজের গলা। অতি কষ্টে সামলে নিলেন নিজেকে ফোঁপানি থামিয়ে আত্মস্থ হয়ে ফের বলতে লাগলেন।
পাদরি সাহেব সব জানেন। উনি আমাদের দুজনেরই সব খবর রাখেন। বিশ্বাস করে ওঁর কাছেই কেবল মনের কথা বলেছি আমরা। তাই উনি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন আমাকে। আফ্রিকায় যাওয়া বা মালপত্রের কথা তখন কি আর মনে থাকে? সব ফেলে চলে এলাম। যাকে জীবন দিয়ে ভালোবেসেছি তার এই পরিণতি দিশেহারা করে দিল আমাকে সব ফেলে দৌড়ে এলাম শোধ নেব বলে। মি. হোমস, আপনার হারানো সূত্র এবার নিশ্চয় পেয়েছেন?
বলে যান।
পকেট থেকে একটা কাগজের প্যাকেট বার করে ঘেসো-টেবিলের ওপর রাখলেন ডক্টর স্টার্নডেল। প্যাকেটটার ওপরে লেখা র্যাডিক্স পেডিস ডায়াবোলি। নীচে লাল রঙের বিষের লেবেল সাঁটা। প্যাকেটটা আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, আপনি তো ডাক্তার। এ-জিনিসের নাম কখনো শুনেছেন?
শয়তানের-পা শেকড়! না, কক্ষনো শুনিনি!
তার জন্যে ডাক্তার হিসেবে আপনার সুনাম একটুও ক্ষুণ্ণ হবে না। যদূর জানি, বুড়ার ল্যাবরেটরিতে একটাই নমুনা আছে এই শেকড়ের—ইউরোপের আর কোথাও নেই! বিষবিজ্ঞান বা ভেষজবিজ্ঞানে এখনও ঠাঁই পায়নি এই শেকড়। শেকড়টাকে দেখতে কিছুটা মানুষের পায়ের মতো, কিছুটা ছাগলের পায়ের মতো–তাই উদ্ভিদবিজ্ঞানী অভিযাত্রীরা এর নামকরণ করেছেন শয়তানের পা। পশ্চিম আফ্রিকায় যারা রোগ সারায়, এ-শেকড়ের খবর তারাই কেবল রাখে–আনুষ্ঠানিকভাবে বিষ প্রয়োগের সময় কাজে লাগায়–তাই শেকড়-রহস্য আর কাউকে জানায় না। উবাঙ্গিতে১৪ অদ্ভুত একটা ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ায় এই নমুনাটা হাতে পেয়েছিলাম আমি; বলতে বলতে, প্যাকেট খুলে লালচে বাদামি নস্যির মতো একগাদা গুঁড়ো বার করে দেখালেন ডক্টর স্টার্নডেল।
তারপর? কঠিন কণ্ঠে বললে হোমস।
সবই আপনাকে বলব, মি. হোমস। অনেক কিছুই আপনি জানেন, তাই আমার স্বার্থে আপনার বাকিটুকুও জানা দরকার। ব্রেন্দার জন্যেই ট্রেগেন্নিস ফ্যামিলির সঙ্গে খাতির জমেছিল আমার। বিষয়সম্পত্তি নিয়ে মর্টিমারের সঙ্গে এদের একবার বিবাদ লাগে। পরে তা মিটে যায়। মর্টিমারকে কিন্তু আমি বেশ কয়েকটা ব্যাপারে সন্দেহ করেছিলাম। লোকটা ধূর্ত, চাপা, পঁাচালো–কিন্তু পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাঁধাতে চাইনি সঠিক কোনো কারণ না-থাকায়।
হপ্তা দুয়েক আগে কটেজে এসেছিল মর্টিমার। আফ্রিকায় দুষ্প্রাপ্য কয়েকটা জিনিস দেখিয়ে গল্প করেছিলাম। এই পাউডারটাও দেখিয়েছিলাম। আশ্চর্য গুঁড়োর অদ্ভুত ধর্ম ব্যাখ্যা করেছিলাম। ব্রেনের মধ্যে ভয় পাওয়ার কেন্দ্রকে কীভাবে উদ্দীপ্ত করে, কীভাবে মানুষকে হয় পাগল, নয় একেবারে মেরে ফেলে–তা বলেছিলাম, নিগ্রোদের কাউকে শাস্তি দেওয়ার দরকার হলে গাঁয়ের পুরুত এই গুঁড়ো আগুনে ফেলে তার দফারফা করে ছাড়ে। ইউরোপের বিজ্ঞান আজও এই বিষের সন্ধান পায়নি বিষের ক্রিয়া ধরবার ক্ষমতাও কোনো বিজ্ঞানীর নেই। ঘর ছেড়ে বাইরে যাইনি আমি, তা সত্ত্বেও কীভাবে যে গুঁড়োটা সরিয়েছিল মর্টিমার জানি না। খুব সম্ভব আমি যখন আলমারি খুলে ঝুঁকে পড়ে কৌটো দেখছিলাম, সেই সময়ে শেকড়ের কয়েক চিমটে গুঁড়ো হাতসাফাই করে। বিষটা কতক্ষণে কাজ দেয় পরিমাণ কতখানি লাগে–এই নিয়ে ওর প্রশ্নগুলো কিন্তু বেশ মনে আছে। তখন স্বপ্নেও ভাবিনি ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য আছে বলেই অত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইছে শয়তানের পায়ের শয়তানি বৃত্তান্ত।
প্লিমাউথে পাদরির টেলিগ্রাম পাওয়ার আগে এ-প্রসঙ্গে আর ভাবিনি। কুচক্রী মর্টিমার ভেবেছিল, আমি আফ্রিকায় রওনা হয়ে গিয়েছি বেশ কয়েক বছরের জন্যে কেউ আর আমার খবর পাবে না। কিন্তু আমি ফিরে এলাম সঙ্গেসঙ্গে। সত্যিই আমারই শয়তানের-পা বিষ দিয়ে পৈশাচিক এই কাণ্ডটা করা হয়েছে কি না, আগে তা যাচাই করতে চেয়েছিলাম। আপনার কাছে এলাম আপনি কী ভেবেছেন জানবার জন্যে। কিন্তু দেখলাম, কিছুই জানেন না আপনি। আমি কিন্তু বুঝেছিলাম, দুজনকে পাগল আর একজনকে খুন করেছে মর্টিমার। করেছে বিষয় সম্পত্তির লোভে। তিনজনকেই পথ থেকে সরাতে পারলে সব বিষয় একা পাবে–এই লোভে শয়তানের-পা শেকড় দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে এমন একটি মেয়েকে যাকে আমি সমস্ত সত্তা দিয়ে ভালোবেসেছি–আমাকেও যে ভালোবেসেছে। মহাপাপী এই মর্টিমারকে সাজা দেওয়ার দায়িত্বও আমার। ভাবতে বসলাম সাজাটা কী ধরনের হওয়া উচিত।
আইনের স্মরণ নেব কি? কিন্তু প্রমাণ কই? প্রমাণ ছাড়া অত্যাশ্চর্য এই উপকথা আদালত বিশ্বাস করবে কেন? মর্টিমার অপরাধী–আমিই শুধু জানি ও যা করেছে, তা বর্ণে বর্ণে যে সত্য–কল্পনা নয়, তা দেশের লোককে বিশ্বাস করাব কেমন করে? চেষ্টা করলে হয়তো সাক্ষীসাবুদ প্রমাণ জোগাড় করে বিশ্বাস করাতে পারি নাও পারি! কিন্তু যদি না-পারি? ঝুঁকি নিতে আমি রাজি নই। আমার প্রতিটা রক্তবিন্দু তখন প্রতিহিংসা নেওয়ার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছে। মি. হোমস, এর আগেও আপনাকে বলেছি, বহু বছর আদিম অসভ্যদের সঙ্গে ঘর করেছি আমি–আইনের বাইরে কাটিয়েছি বলেই নিজের আইন নিজেই বানিয়েছি–সাজা নিজেই দিয়েছি। এখনও তাই করব। ঠিক যেভাবে মারা গেছে আমার ভালোবাসার পাত্রী, ঠিক সেইভাবে মরতে হবে মর্টিমারকেও। ব্রেন্দার যে-পরিণতি সে ঘটিয়েছে–সেই একই পরিণতির দিকে তাকে ঠেলে দেব আমি–এই হল আমার প্রতিজ্ঞা।
সবই বললাম আপনাকে। বাকিটুকু আপনিই বলেছেন। সারারাত ছটফট করলাম। ভোর বেলা বেরিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে টেনে তুলতে অসুবিধে আছে অনুমান করেই পকেট বোঝাই করে কয়েকমুঠো নুড়ি নিয়ে গেলাম, জানলা লক্ষ করে ছুঁড়তে লাগলাম। নীচে এসে জানলা খুলে আমাকে ভেতরে ঢোকাল মর্টিমার। ভণিতা না-করে সোজাসুজি আরম্ভ করলাম কাজের কথা বুঝিয়ে দিলাম আর সমস্ত কুকীর্তি আমি ধরে ফেলেছি এবং শাস্তি দেওয়ার জন্যেও তৈরি হয়ে এসেছি। রিভলভার তুলে রাসকেলকে কাঠের পুতুলের মতো বসিয়ে রাখলাম চেয়ারে। ল্যাম্প জ্বেলে খানিকটা গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলাম ওপরে। তারপর রিভলভার নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম জানলার বাইরে পালাবার চেষ্টা করলেই ভয় দেখিয়ে ফের ঘরে ঢোকাব। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই মারা গেল মর্টিমার। অকথ্য যন্ত্রণা পেয়েছিল মরবার আগে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু আমার পাথরের মতো শক্ত মনে কোনো দাগ পড়ল না। ব্রেন্দা যে কষ্ট পেয়েছে, তত কষ্ট ত পেতে হয়নি–কাজেই আমার মন কাদবে কেন? মি. হোমস, সবই তো শুনলেন, এখন বলুন কী করবেন আমাকে নিয়ে। আমি এখন আপনার মুঠোর মধ্যে। যা খুশি করতে পারেন–বাধা দেব না। মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না শুধু এইটুকু জেনে রাখুন জানি না কোনো নারীকে কখনো ভালোবেসেছেন কি না বাসলে আমি যা করেছি, আপনিও তাই করতেন।
কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে রইল হোমস।
তারপর বলল, আপনার প্ল্যান কি এখন?
বাকি জীবনটা মধ্য আফ্রিকায় প্রাণীতত্ত্ব নিয়ে কাটাব। অর্ধেক কাজ এখনও বাকি।
যান, বাকিটুকু শেষ করে ফেলুন। আপনাকে আমি অন্তত আটকাব না।
উঠে দাঁড়াল ডক্টর স্টার্নডেলের দৈত্যমূর্তি। গম্ভীরভাবে বাতাসে মাথা ঠুকে অভিবাদন জানিয়ে মন্থর চরণে বেরিয়ে গেলেন কুঞ্জের বাইরে। পাইপ ধরিয়ে নিয়ে তামাকের থলি আমার দিকে বাড়িয়ে দিল হোমস।
বলল, ভায়া, পৃথিবীতে এমন অনেক ধোঁয়া আছে যা খুব বিষাক্ত নয়, কিন্তু শ্রান্ত মনকে চাঙা করে তুলতে অদ্বিতীয়। আপাতত সেই জাতীয় ধোঁয়া খানিকটা খাও। এ-কেসে আমাদের নাক গলাতে কেউ যখন ডাকেনি তখন আমাদের যা খুশি আমরা করতে পারি। নিজেরা যখন তদন্ত করেছি, কী করব না-করব, সেটাও ঠিক করব নিজেরা। তাই নয় কি? তুমি হলে কী করতে? পুলিশে ধরিয়ে দিতে ভদ্রলোককে?
নিশ্চয় না।
ওয়াটসন, জীবনে কোনো নারীকে ভালোবাসিনি, যদি বাসতাম এবং সে-নারীটির শেষ দশা যদি এইরকম হয়, তাহলে সিংহশিকারি ঠিক যেভাবে আইনের বাইরে গিয়ে সাজা দিয়েছেন, আমিও হয়তো তাই করতাম। যাকগে ভায়া কীভাবে রহস্যভেদ করলাম, তা নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে তোমার বুদ্ধিমত্তাকে খাটো করতে চাই না। জানলার বাইরে নুড়ি দেখেই শুরু করেছিলাম গবেষণা। পাদরির বাগানে এ-রকম নুড়ি কোথাও নেই। ডক্টর স্টার্নডেলের ওপর নজর পড়তেই তাঁর কটেজের বাইরে দেখলাম একই নুড়ি পড়ে রয়েছে পাকার। দিনের আলোয় জ্বলন্ত ল্যাম্প এবং অভ্র-আচ্ছাদনের ওপর গুঁড়ো দেখেই যুক্তির কৌশল মনে মনে বানিয়ে নিয়েছিলাম। যাকগে, এ-প্রসঙ্গ এবার বাদ দাও। কেল্টিক কথাবার্তার চালডিয়ান শেকড় যে এই কর্নিশ অঞ্চলেই রয়েছে তাই নিয়ে গবেষণা শুরু করা যাক।
———
টীকা
শয়তানের পা : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ডেভিলস ফুট স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের ডিসেম্বর ১৯১০ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়।
হার্লে স্ট্রিট : লন্ডনের এই রাস্তায় বহু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অফিস বা চেম্বার অবস্থিত : দ্য রেসিডেন্ট পেশেন্ট গল্পের টীকা দ্রষ্টব্য।
সে কাহিনি অন্য সময়ে বলা যাবেখন : এই গল্প ওয়াটসন কোনোদিনই বলেননি।
কর্নিশ অন্তরীপ : ইংল্যন্ডের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত অঞ্চল।
পোলধু উপসাগর : এই নামে কোনো উপসাগর নেই। কিন্তু মাউন্টস বে-র তীরবর্তী পোলধু কোভ নামে একটি জায়গা আছে। এই পোলধু থেকে ১২ ডিসেম্বর ১৯০১ তারিখে মর্স কোডে প্রথম রেডিয়ো ট্রান্সমিশন প্রেরিত হয়। অতলান্তিকের ওপারে। নিউফান্ডল্যান্ডের সেন্ট জন-এ সেই রেডিয়ো বার্তা গ্রহণ করেন ইতালিয় পদার্থবিদ ওগলিয়েমমা মার্কনি (১৮৭৪-১৯৩৭)।
মাউন্টস বে : ইংলিশ চ্যানেল এবং অতলান্তিক মহাসাগরের ঠিক সংযোগস্থলে এর অবস্থান।
কর্নিশ ভাষা : জুলিয়াস সীজারের সময় থেকে ব্রাইটনদের কথ্য ভাষা কর্নিশ, কেল্টিক উপগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দীতে এই ভাষার প্রচলন থাকার নথীভুক্ত প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। ইংলান্ডের অন্য দুটি ভাষা ব্রেটন এবং ওয়েলশ অদ্যাবধি প্রচলিত থাকলেও কর্নিশ ভাষার ব্যবহার অষ্টাদশ শতকে লুপ্ত হয়।
চালডিন ভাষা : সেমিটিক ভাষা চলে ভিন্ন বা চ্যালডিয়নের অপর প্রচলিত নাম অ্যারামিক। এই ভাষার সঙ্গে হিব্রু, সিরিয়াক এবং ফিনিশীয় ভাষার সাদৃশ্য দেখা যায়।
ফিনিশিয়ান : বর্তমান লেবানন যে অঞ্চলে অবস্থিত, সেখানেই ছিল ফিনিশিয়া। ফিনিশীয়রা ছিল নৌবাণিজ্যে পারদর্শী। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি ফিনিশিয়া পারসিক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। আমি জানলার দিকে পিঠ ফিরিয়ে টেবিলে বসেছিলাম।
জর্জ বসে ছিল জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে : জর্জ যদি হুইস্ট খেলায় মর্টিমারের বিপরীতে বসে, তাহলে ওয়েন আর ব্রেন্দা ছিল মুখোমুখি চেয়ারে। সেক্ষেত্রে মৃত ব্রেন্দার দুই পাশে দুই ভাইয়ের থাকা সম্ভব হয় না।
তারপরে আনে মৃত্যু : একইরকমভাবে বিষাক্ত মোমবাতির ধোঁয়া দিয়ে হত্যা করবার ঘটনা দেখা গিয়েছে এডগার অ্যালান পো-র লেখা একটি গল্পে।
বুড়া : ১৩৬১ সালে হাঙ্গেরী রাজধানীর পত্তন হয় বুড়া শহরে। ১৮৭৩-এ দানিয়ুব নদীর অপর পারে অবস্থিত পেস্ট শহরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে শহরের নতুন নাম হয় বুড়াপেস্ট।
আনুষ্ঠানিকভাবে বিষ প্রয়োগের সময় : আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের বন্য উপজাতির মানুষদের মধ্যে অভিযুক্তকে বিষ খাইয়ে তার অপরাধ নির্ণয়ের প্রথা আছে। বিষ খেয়ে যদি সে বমি করে বিষ উগরে দেয়, তাহলে ধরে নেওয়া হয় লোকটি নিরপরাধ। অন্যথায় তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
উবাঙ্গি : কিংবা উবাংসি বা মুরাংসি মধ্য আফ্রিকার একটি নদী। কঙ্গোর প্রধান শাখানদী ভবাংগি এবং এমবমু (Ambomu) নদী ১৮৯৭ সালে বেলজিয়ান কঙ্গো এবং ফরাসি কঙ্গোর সীমা নির্ধারক রেখা হিসেবে চিহ্নিত হত।
এ-রকম নুড়ি কোথাও নেই : স্টার্নডেল পাদরির বাগানের নুড়ি না কুড়িয়ে নিজের বাগান থেকে নুড়ি নিয়ে এসেছিল কি শার্লক হোমসের অনুসন্ধানের সুবিধার্থে? প্রশ্ন তুলেছেন গবেষক ডি. মার্টিন ডেকিন।