রহস্য নিকেতন কপার-বীচেস
[দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য কপার-বীচেস]
শার্লক হোমস ছুঁড়ে ফেলে দিল ডেইলি টেলিগ্রাফের বিজ্ঞাপনের পাতাটা।
বললে, ওয়াটসন, আমারকীর্তি নিয়ে তুমি যখনই গল্প লিখেছ, সেগুলো গল্পইহয়ে দাঁড়িয়েছে–রং চড়ানোর দিকে নজর না-দিয়ে যুক্তিবিজ্ঞানের দিকে বেশি নিষ্ঠা দেখালে ভালো করতে।
কথা বলতে বলতে চেরি কাঠের পাইপটা ধরিয়ে নিল হোমস। তর্ক করার দরকার হলে এই পাইপ খায় ও, ধ্যানস্থ থাকার সময়ে ক্রে পাইপ।
কথা হচ্ছে বেকার স্ট্রিটের বাসায়। বাইরে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। আগুনের দু-পাশে বসে আছি আমরা দুই বন্ধু। ব্রেকফাস্ট এইমাত্র শেষ হয়েছে। খবরের কাগজ খুলে এতক্ষণ বিজ্ঞাপন পড়ছিল হোমস, এখন তা নিক্ষেপ করে পেছনে লেগেছে আমার।
পাইপে টান মেরে বললে, একটা ব্যাপারে অবশ্য তোমার নিষ্ঠা আছে। চাঞ্চল্যকর ঘটনা না-বেছে এমন সব কেস নিয়ে লিখছ যার মধ্যে যুক্তিবিদ্যার বিশ্লেষণী ক্ষমতা ভালোভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। তবে কী জানো, রং চড়াতে গিয়ে সেগুলো গল্পই হয়ে গেছে, নইলে যুক্তিবিজ্ঞানের প্রবন্ধ হয়ে দাঁড়াত।
হোমসের চরিত্রের এই অহমিকা এর আগেও লক্ষ করেছি। তাই মুখ গোঁজ করে বললাম, সামান্য ঘটনাগুলোই কিন্তু অসামান্য হয়ে উঠেছে তোমার যুক্তিবিদ্যার জোরে।
ভায়া, যুক্তিবিদ্যার কদর কি আর আছে? সাধারণ মানুষ আজকাল অন্ধ চোখ খুলে দেখেও। দাঁত দেখে তাতিকে চেনা অথবা বাঁ-হাতের আঙুল দেখে ছাপাখানার কম্পােজিটর কিনা বলে দেওয়ার মতো বিশ্লেষণ বা অনুমিতি-সিদ্ধান্তর যুগ চলে গেছে। তোমার আর দোষ কী বল। আজকালকার অপরাধীরাও আর তেমন মৌলিক অপরাধ করতে পারছে না! আমার কাজটা এখন কারো পেনসিল হারালে খুঁজে দেওয়া, নয়তো স্কুলের মেয়েদের জ্ঞান দেওয়া। দুর! দুর! এই চিঠিটাই দেখ না কেন। নাও, পড়ো! দলা-পাকানো একটা কাগজ আমার দিকে ছুঁড়ে দিল হোমস।
কাগজটা একটা চিঠি। লেখা হয়েছে মন্টেগু প্লেস থেকে গত সন্ধ্যায়।
প্রিয় মি. হোমস,
আপনার সঙ্গে পরামর্শকতে চাই একটা চাকরি নেওয়ার ব্যাপারে। চাকরিটা গৃহশিক্ষয়িত্রীর। নেওয়াটা উচিত হবে কি না আপনি বলে দেবেন। কাল সকাল সাড়ে দশটায় আসছি।
আপনার বিশ্বস্ত
ভায়োলেট হান্টার
ভদ্রমহিলাকে চেনো? আমার প্রশ্ন।
না।
সাড়ে দশটা তো বাজল।
দরজার ঘণ্টাও বোধ হয় বাজল।
একটু পরেই ঘরে ঢুকল একজন তরুণী। চটপটে চেহারা। চোখে-মুখে বুদ্ধির ছাপ। বেশবাস সাদাসিধে, কিন্তু পরিচ্ছন্ন। মুখটিতে টিটিভ পাখির ডিমের মতো মেচেতার দাগ।
অভিবাদন বিনিময়ের পর হোমসের হৃষ্ট মুখ দেখে বুঝলাম মেয়েটিকে তার খারাপ লাগেনি। আপাদমস্তক সন্ধানী চোখ বুলিয়ে নিয়ে অর্ধনিমীলিত চোখে আঙুলের ডগায় ডগায় চুইয়ে বললে, বলুন আপনার কী সমস্যা।
মেয়েটি বললে, গত পাঁচ বছর যেখানে গৃহশিক্ষয়িত্রীর কাজ করছিলাম, তারা আমেরিকায় চলে যাবার পর আমি এখন বেকার। তাই চাকরি জোটানোর একটা সংস্থায় প্রায় ফ্রি-হপ্তায় যাই। মিস স্টোপার সেখানকার কাজ দেখেন।
গত হপ্তায় গিয়ে দেখলাম মিস স্টোপারের সঙ্গে বসে রয়েছেন অসুরবিশেষ এক ভদ্রলোক। থুতনির নীচে চর্বির ভাঁজ, চোখে চশমা। মুখে দেখন-হাসি। আমাকে দেখেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন।
বাঃ এই তো পাওয়া গেছে! পরমোৎসাহ হাত ঘষতে ঘষতে বললেন মিস স্টোপারকে এঁকে দিয়েই কাজ হবে।
আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মিস, চাকরি চাই, তাই না?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
গৃহশিক্ষয়িত্রীর?
হ্যাঁ।
কত মাইনে চাও। কর্নেল মনরো দিতেন মাসে চার পাউন্ড।
অ্যাঁ! মাসে চার পাউন্ড! কী অন্যায়! কী অন্যায়! সুন্দরী শিক্ষিতা একটা মেয়েকে এত কম মাইনেও কেউ দেয়?বলতে বলতে হাত ছুঁড়ে চেঁচিয়ে ভীষণ রাগে যেন ফেটে পড়লেন ভদ্রলোক।
কিন্তু আমি খুব একটা লেখাপড়া শিখিনি। ফরাসি আর জার্মান ভাষাটা একটু-আধটু জানি। সামান্য গান-বাজনা আর ছবি আঁকা—
আরে দুর। লেখাপড়ার চেয়ে বড়ো হল সহবত। সেইটা না-থাকলে ঘরের ছেলেকে যার তার হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় কি? এ জিনিস যার মধ্যে আছে, তার মাইনে কখনো বছরে এক-শশা পাউন্ডের কম হতে পারে না। তোমার মাইনেও তাই হবে। কি, রাজি?
মি. হোমস, আমার তখন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা বলতে পারেন। পকেট গড়ের মাঠ, দেনাও করে ফেলেছি। তা সত্ত্বেও এত টাকা মাইনের প্রস্তাব শুনে যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারলাম না।
ভদ্রলোক তখন হাসতে হাসতে পকেট থেকে একটা নোট বার করে বললেন, আমার অভ্যেস হল মাইনের অর্ধেক টাকা আগাম দিয়ে দেওয়া। খরচপত্র আছে তো?চর্বির ভঁজের মধ্যে কুতকুতে চোখ দুটো প্রায় অদৃশ্য হয়ে এল হাসির ধাক্কায়। চোখ তো নয় যেন দুটো আলোকবিন্দু।
এমন চমৎকার ভদ্রলোক জীবনে দেখিনি। তবুও কীরকম অদ্ভুত মনে হচ্ছিল। ভাবলাম একটু বাজিয়ে নিই, আরও খবরাখবর নিয়ে।
জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলাম ভদ্রলোক থাকেন হ্যাম্পশায়ারে। মাইল পাঁচেক ভেতরে একটা গ্রামে। বাড়ি নাম কপার-বীচেস। তার দু-বছরের ছেলেকে সামলাতে হবে। ভারি দুষ্টু ছেলে।
কুতকুতে চোখে হাসতে হাসতে বললেন, কী বজ্জাত! কী বজ্জাত! চটি দিয়ে চটাচট আরশুলা মারাটা যদি দেখ।
বজ্জাতির ধরন শুনে আমার চক্ষু স্থির হয়ে এল। তারপরে চোখ কপালে উঠল ভদ্রলোকের বায়নাক্কা শুনে।
আমাকে তার স্ত্রী-র ফাইফরমাশ খাটতে হবে। তাতে আপত্তি করিনি। বড় খেয়ালি তাঁরা। তাই আমার খুশিমতো পোশাক পরা চলবে না—তাদের পছন্দমতো পোশাক পরতে হবে। অবাক হলেও তাও মেনে নিলাম। তারপর নাকি তাদের কথামতো এখন সেখানে বসতে হবে। এ-প্রস্তাবেও আপত্তির কিছু দেখলাম না। কিন্তু যখন বললেন স্ত্রী-র ইচ্ছেমতো আমার এই সুন্দর চুলের বোঝা ছেটে ফেলতে হবে, তখন বেঁকে বসলাম।
বললাম, তা কি হয়? আমার এই চুল দেখে শিল্পীরাও মুগ্ধ হয়ে যায়। এ-চুল তো ছাঁটতে পারব না।
ভদ্রলোক পলকহীন চোখে আমার দিকে চেয়ে ছিলেন। মুখখানা কালো হয়ে গেল আমার মাথানাড়া দেখে।
বললেন, মিস, ওইটাই কিন্তু আসল ব্যাপার। আমার গিন্নি গোঁ ধরেছে, ছোটো চুল রাখতে হবে গভর্নেসকে।
না, চুল ছাঁটতে আমি পারব না, বললাম শক্ত গলায়।
তাহলে আর হল না। সব পছন্দ হয়েছিল, তোমার মতো মেয়েই চাইছিলাম। যাক গে, মিস স্টোপার, দেখুন আর কাউকে পাওয়া যায় কি না।
এতক্ষণ মিস স্টোপার চুপ করে কথা শুনছিলেন। এবার বিরক্ত সুরে বললেন, আমি আর তোমার জন্যে চাকরি খুঁজতে পারব না। আসতে পার।
বাড়ি ফিরে এলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সংসারে সবকিছুই বাড়ন্ত দেখলাম। ভাবলাম, দুর ছাই, চাকরিটা নিলেই হত। কী হবে চুল রেখে? চুল ছোটো করলে অনেককে বরং ভালোই লাগে। বছরে এক-শো পাউন্ড কি সোজা কথা! ঠিক করে ফেললাম, পরের দিন ফের ধরনা দেব মিস স্টোপারের কাছে।
তার আর দরকার হল না। পরের দিন একটা চিঠি এল সেই ভদ্রলোকের কাছ থেকে।
চিঠিখানা সঙ্গে এনেছি। শুনুন, পড়ছি।
কপার-বীচেস।
প্রিয় মিস হান্টার,
মিস স্টোপার তোমার ঠিকানা দিলেন। তুমি আর একবার ভেবে দেখ আমার চাকরি নেবে কি না। আমার খেয়াল মেটাতে গিয়ে তোমার চুল কাটতে হবে ঠিকই তার খেসারতও পাবে। বছরে এক-শো বিশ পাউন্ড দেব। বিদ্যুৎ-নীল রঙের পোশাক আমার স্ত্রীর খুব পছন্দ। খামোেকা কিনে টাকা খরচ করবার দরকার নেই। আমার মেয়ে অ্যালিস এখন ফিলাডেলফিয়ায় গেছে–তার পোশাকটা তোমাকে ফিট করবে। সকাল বেলা পরবে এই পোশাক। মাঝে মাঝে এখানে সেখানে বসবে কোনো অসুবিধে তোমার হবে না। ছেলের সম্বন্ধে খুব একটা ভাবতে হবে না। খুব হালকা কাজ, উইনচেস্টারে এক-ঘোড়ায় টানা গাড়ি নিয়ে হাজির থাকব। কোন ট্রেনে আসছ, জানাও।
তোমার বিশ্বস্ত
জেফ্রো রুকাসল
মি. হোমস, চিঠিটা পেয়ে ভাবছি, চাকরিটা নেব। কিন্তু তার আগে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে চাই।
মিস হান্টার, বলল শার্লক হোমস, আমার কোনো বোনকে বলব না এই পরিবেশে চাকরি নিতে। পরিবেশটা আর যাই হোক, কোনো তরুণীর পক্ষে অনুকুল নয়। বিপদ আছে।
কীসের বিপদ?
তা তো এখুনি বলতে পারব না। ভদ্রলোকের বউ পাগল নন তো? উদ্ভট খেয়াল মেটানোর জন্যে আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন না তো?
হতে পারে। আমি শুধু ভাবছি বছরে চল্লিশ পাউন্ড দিলেই যখন গভর্নেস পাওয়া যায়, তার তিনগুণ টাকা খরচ করা হচ্ছে কেন। নিশ্চয় কোনো মতলব আছে।
সেইরকম যদি কিছু বুঝি, আপনাকে চিঠি লিখলে আপনার সাহায্য পাব?
এক-শো বার। আপনার কেসটা সত্যিই ইন্টারেস্টিং। যখনই আপনার টেলিগ্রাম পাব, দৌড়ে যাব, কথা দিলাম।
মিস হান্টারের মুখ থেকে মেঘের ভার সরে গেল। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আজ রাতে আমি চুল ছেটে ফেলছি। কাল রওনা হব উইনচেস্টার। চললাম।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল চটপটে পদশব্দ। আমি বললাম, চালাক মেয়ে। নিজেকে সামলাতে জানে।
তা ঠিক, গম্ভীর মুখে হোমস বললে, তবে ওর টেলিগ্রাম শিগগিরই আসবে। বিপদ আসন্ন।
বিপদটা যে কী, তা হোমস মেয়েটির কাছে ভাঙেনি, আমার কাছেও বলল না। তবে সেইদিন থেকেই প্রায়ই দেখতাম ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবছে! ভাবনাটা আমার মনেও যে আনাগোনা করেনি, তা নয়। যার খপ্পরে গিয়েছে মিস হান্টার, সে শয়তান না সাধু কিছুই আঁচ করতে পারতাম না। মনটা কিন্তু অস্থির হয়ে থাকত। হোমসকে জিজ্ঞেস করলে অস্থির হয়ে হাত ছুঁড়ে বলত, দুর! ঘটনা ছাড়া সিদ্ধান্ত খাড়া করা যায় নাকি? তবে কী জানো, আমার বোনকেও আমি যেতে দিতাম না।
হোমসের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল পনেরো দিন পর। গভীর রাতে টেলিগ্রাম এল হোমসের নামে।ও তখন ওর নৈশ গবেষণার জন্যে তৈরি হচ্ছে। বকযন্ত্র আর টেস্টটিউব সাজাচ্ছে রাসায়নিক বিশ্লেষণ নিয়ে রাত কাটিয়ে দেবে বলে। এমন সময়ে এল টেলিগ্রামটা।
হোমস চোখ বুলিয়ে নিয়ে গবেষণার সরঞ্জাম সরিয়ে রেখে বললে, আজ রাতে ঘুম চাই–কাল অনেক ঝামেলা আছে। ওয়াটসন, উইঞ্চেস্টারের ট্রেন ক-টায়?
টাইমটেবল দেখে বললাম, সকাল সাড়ে নটায়।
টেলিগ্রামটা পড়লাম। লেখা আছে : কাল দুপুরে উইঞ্চেস্টারের ব্ল্যাক সোয়ান হোটেল-এ আসবেন। সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে আমার। হান্টার।
পরদিন সকাল এগারোটায় চলে এলাম প্রাচীন ইংলন্ডের রাজধানীতে ট্রেনে খবরের কাগজে নাক ড়ুবিয়ে বসে ছিল হোমস। হ্যাম্পশায়ার পেরিয়ে আসার পর কাগজের ভাঁই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিসর্গ দৃশ্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হল। বসন্তের সাজে প্রকৃতি সেজেছেও চমৎকার। নীল আকাশ, সাদা মেঘ, মিষ্টি রোদ। চারিদিকে কেবল সবুজ পাতার সমারোহ—ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে খামার বাড়ির ছাদ।
বেকার স্ট্রিটের দম আটকানো কুয়াশা থেকে এই মন মাতানো পরিবেশে পড়ে পুলক জাগল আমারও চিত্তে। সোল্লাসে বললাম, হোমস, কী সুন্দর বল তো? সব টাটকা, তাজা, নতুন।
গম্ভীর হয়ে গেল হোমস। মাথা নেড়ে বললে, ভায়া, শহরে ক্লেদ আছে, কিন্তু আইন ভাঙা সেখানে কঠিন। এখানে প্রকৃতির উদারতার মধ্যে নৃশংস কাণ্ড ঘটে গেলেও কেউ টের পাবে না। মেয়েটা উইঞ্চেস্টারে থাকলে এতটা ভাবনা হত না–পাঁচ মাইল ভেতরে গ্রামের মধ্যে অনেক কাণ্ড ঘটতে পারে।
কী ঘটতে পারে বলে মনে হয় তোমার?
মোট সাতটা সম্ভাবনা ভেবে রেখেছি। দেখা যাক কোনটা সত্যি।
ব্ল্যাক সোয়ান সরাইখানাটা হাইস্ট্রিটের ওপরে–স্টেশনের কাছেই। মিস হান্টার আমাদের জন্যে লাঞ্চ সাজিয়ে বসে ছিল।
আমরা যেতেই বললে, আঃ, বাঁচলাম আপনাদের দেখে। মি. রুকাসলকে বলে এসেছি তিনটের মধ্যে ফিরব। উনি অবশ্য জানেন না কেন এসেছি।
আগুনের সামনে লম্বা ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে হোমস বললে, বলুন কী দেখলেন?
মি. হোমস, প্রথমেই বলে রাখি মি. রুকাসল আমার সঙ্গে মোটেই খারাপ ব্যবহার করেননি। কিন্তু ওঁদের মতিগতি মাথায় ঢুকছে না।
খুলে বলুন।
মি. রুকাসল নিজে গাড়ি হাঁকিয়ে কপার-বীচেস-এ নিয়ে গেলেন আমাকে। বাড়িটা চৌকোনা পুরোনো। তিন দিকের জঙ্গল লর্ড সাদাম্পটনের সম্পত্তি। একদিকের জমি ঢালু হয়ে নেমে গেছে সাদাম্পটন রোেড বড়োরাস্তা পর্যন্ত রাস্তাটা কিছুদূর গিয়ে বাঁক নিয়েছে।
বাড়িতে গিয়ে ছেলে বউয়ের সঙ্গে আলাপ করার পর বুঝলাম, যা ভেবেছিলাম তা নয়–মিসেস রুকাসল মোটেই পাগল নন। তবে যেন মনে চাপা দুঃখ আছে। চুপচাপ থাকেন। কখনো কখনো গালে হাত দিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবেন। সবসময়ে চোখে চোখে রাখেন স্বামী আর ছেলেকে। দুজনেই যেন নয়নের মণি। মাঝে মাঝে কঁদতেও দেখেছি। স্বামী ভদ্রলোক একটু রুক্ষ হলেও স্ত্রীকে যত্নে রাখেন। গিন্নির এত ভাবনা বোধ হয় ছেলেটার জন্যে। ভারি বদ ছেলে। নিষ্ঠুর। হেঁড়ে মাথা, বেঁটে, গোঁয়ার। ইতর প্রাণীকে কষ্ট দিয়ে বিকট উল্লাস পায়। আদর দিয়ে বাঁদর করা ছেলে।
ভদ্রলোক বিপত্নীক ভদ্রমহিলা তার দ্বিতীয় পক্ষ। দুজনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান পনেরো বছর পঁয়তাল্লিশ আর তিরিশ। প্রথম পক্ষের একমাত্র মেয়ে ফিলাডেলফিয়ায় চলে গেছে সম্মা-র সঙ্গে বনিবনা হয়নি বলে। বয়সের ব্যবধান খুবই তো কম। মেয়েটির বয়স কুড়ি। খবরটা মি. রুকাসলই আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলেছেন। দ্বিতীয় পক্ষ সংসারে এসেছে বছর সাতেক। খুব শান্ত মহিলা।
বাড়িতে ঝি-চাকরের পাট প্রায় নেই বললেই চলে। প্রথম থেকেই খটকা লেগেছে এই নিয়ে। আছে কেবল দুজন—টলার আর তার বউ। টলার লোকটা চোয়াড়ে, চুলদাড়ি খোঁচা খোঁচা, অষ্টপ্রহর মাতাল। বউটা মদ্দা টাইপের কিন্তু মুখটা সবসময়ে নিমতেতো। বাড়ির গিন্নির মতোই চুপচাপ থাকা স্বভাব। এদের সান্নিধ্য মোটেই সুখের নয়।
বাড়িতে এসে দু-দিন ভালোই কাটল। তৃতীয় দিন ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পর কর্তার কানে কানে কী যেন বললেন গিন্নি।
হাসিমুখে আমার দিকে ফিরে কর্তা বললেন, মিস হান্টার, তুমি আমাদের কথা রেখেছ–চুল ঘেঁটে ফেলেছ। চমৎকার দেখাচ্ছে কিন্তু। এবার আর একটা কথা রাখো। তোমার বিছানায় ইলেকট্রিক ব্লু কালারের একটা ড্রেস দেখতে পাবে। যাও, পরে এসো।
ঘরে গিয়ে দেখলাম সত্যিই অদ্ভুত সুন্দর একটা পোশাক রয়েছে খাটে। গায়ে দিতে চমৎকার ফিট করে গেল–যেন আমার মাপেই তৈরি।
এলাম বসবার ঘরে।এ-ঘরটা বাড়ির সামনের দিকে। পাশাপাশি তিনটে মেঝে পর্যন্ত নামানো বিরাট কাচের জানলা আছে সাদাম্পটন রোডের দিকে! মাঝের জানলাটার সামনে পেছন করে বসানো চেয়ারে বসতে বলা হল আমাকে। আমার সামনে দিয়ে পায়চারি করতে করতে মজার মজার হাসির গল্প বলতে লাগলেন মি. রুকাসল। হাসতে হাসতে পেটে খিল লেগে যাবার উপক্রম হল। গিন্নি কিন্তু রামগরুড়ের ছানার মতো চুপচাপ বসে রইলেন চেয়ারে। ভাবগতিক দেখে মনে হল যেন উদবেগে ভুগছেন।
ঘণ্টাখানেক পরে উঠিয়ে দেওয়া হল আমাকে। ড্রেস পালটে ছেলে দেখাশুনা করতে গেলাম।
দু-দিন পরে আবার হুকুম হল নীলবসনা হয়ে জানলার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসবার। এবারও হাসির গল্প শুনিয়ে হাসিয়ে ছাড়লেন মি. রুকাসল। শেষকালে একটা হলদে মলাটের বই হাতে দিয়ে মাঝখান থেকে কয়েক পাতা পড়ে শোনাতে বললেন। একটু পড়বার পরেই উনি আমাকে উঠিয়ে দিলেন–পোশাক পালটে নিতে বললেন।
লক্ষ করেছি, কিছুতেই জানলার দিকে মুখ ফেরাতে দেওয়া হয় না আমাকে পেছনে কী ঘটছে দেখতে দেওয়া হয় না। তাই বিষম কৌতূহল হল। অদ্ভুত ব্যাপারটার মানে জানবার জন্য ভেতরটা আকুলিবিকুলি করতে লাগল। পরের বার নীলবসনা হয়ে বসবার সময়ে রুমালের মধ্যে লুকিয়ে রাখলাম ভাঙা আয়নার একটা টুকরো। কথার ফাঁকে ফাঁকে রুমাল তুলে ধরলাম চোখের সামনে। প্রথমটা কিছু দেখিনি। দ্বিতীয়বার দেখলাম, বাড়ির জমির রেলিংয়ে ভর দিয়ে সাদাম্পটন রোডে একজন দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় কত লোক যাচ্ছে—এ কিন্তু চলে যাচ্ছে না–ঠায় তাকিয়ে আছে এদিকে। গায়ে ছাই রঙের পোশাক, আকারে ছোটোখাটো।
মিসেস রুকাসল খরখরে চোখে চেয়েছিলেন আমার দিকে। মনে হল রুমালের মধ্যে লুকোনো আয়না উনি দেখে ফেলেছেন। কর্তাকে বললেন, দেখ দেখ, রাস্তার একটা লোক প্যাট প্যাট করে চেয়ে আছে মিস হান্টারের দিকে।
তাই নাকি? মিস হান্টারের বন্ধু নয় তো?
আজ্ঞে না। এখানকার কাউকেই চিনি না আমি।
তাহলে বাজে লোক। তুমি এইভাবে হাত নেড়ে বিদেয় করো ওকে।
রাস্তায় কে দাঁড়িয়ে আছে, তা নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর দরকার কী? উনি কিন্তু পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। উনি যেভাবে দেখালেন, সেইভাবে হাত নাড়ালাম। সঙ্গেসঙ্গে জানলার পরদা টেনে দিলেন গিন্নি ঠাকরুন। এই গেল সাতদিন আগেকার ঘটনা। এরপর আর জানলায় নীল ড্রেস পরে বসতে হয়নি।
ইন্টারেস্টিং কেস, বলল হোমস। তারপর?
প্রথম যেদিন কপার-বীচেস-এ গেলাম, সেদিন মি. রুকাসল আমাকে বারবাড়ির রান্নাঘরের পাশে একটা ছোটো ঘরের সামনে নিয়ে গেছিলেন। ভেতর থেকে শেকল নাড়ার ঝনঝন শব্দ শুনলাম, সেইসঙ্গে একটা জন্তুর চলাফেরার খচমচ শব্দ।
তক্তার ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকাতে বললেন মি. রুকাসল। তাকিয়েই রক্ত হিম হয়ে গেল। অন্ধকারের মধ্যে জ্বলছে যেন দু-টুকরো আগুন–একজোড়া চোখ।
মিষ্টি করে হাসতে হাসতে মি. রুকাসল বললেন, ওই হল আমার আদরের ডালকুত্তা–কার্লো। একবেলা খাইয়ে রাখা হয়–পেটে সবসময়ে খিদে থাকে মানুষ পেলেই যাতে ছিঁড়ে খেতে পারে। রাত্রে টলার ওকে ছেড়ে দেয়। তাই বলে রাখি, সন্ধের পর বাড়ির বাইরে পা দিয়ো না। টলার ছাড়া ওকে সামাল দিতে পারে না কেউ।
কথাটা যে মিথ্যে নয়, দু-দিন পরে চাদের আলোয় রাত দুটোর সময়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে তার প্রমাণ পেলাম। দাঁড়িয়ে ছিলাম জানলার সামনে। এ-বাড়ির কপার বীচেস নাম হয়েছে তামাটে পাতাওলা কপার বীচেস গাছের জন্যে গাছটা আছে বাড়ির একদম সামনে। তারই ছায়ায় বাছুরের মতো বড়ো কী যেন একটা নড়তে দেখলাম। তারপরেই চাদের আলো পড়ল কালো ছায়াটার ওপর। একটা দানব কুকুর। ঝুলন্ত চোয়াল, কালচে নাক, কপিশ বর্ণ। প্রকাণ্ড হাড়গুলো যেন ঠেলে বেরিয়ে আছে। ভয়ংকর সেই আকৃতি দেখে রাতে ভালো করে ঘুমোতেও পারলাম না।
এরপর আর একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আগের চাইতেও আশ্চর্য। লন্ডনে চুল হেঁটে ফেলে কাটা চুলগুলো আমার ট্রাঙ্কের তলায় রেখে দিয়েছিলাম।একদিন সন্ধেবেলা ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়লে আমার ঘরের জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে দেওয়ালের একটা দেরাজে তালা দেওয়া দেখলাম। অন্য দুটো দেরাজ খোলা ছিল। তাতে আমার জামাকাপড় রাখার জায়গা কুলোত না। তাই ভাবলাম এ-দেরাজটা যদি ভোলা যায় বাড়তি জামাকাপড় রাখা যাবে। চাবির গোছার একটা চাবি লেগেও গেল। ভেতর থেকে পেলাম সেই কাটা চুলের বোঝা।
আমি তো অবাক। বেশ মনে আছে আমার চুল আছে আমারই ট্রাঙ্কে–এখানে এল কী করে?
খুললাম আমার তোরঙ্গ। আমার চুল যথাস্থানেই আছে। বার করে এনে রাখলাম দেরাজে পাওয়া চুলের পাশে। মি. হোমস, বললে বিশ্বাস করবেন না–দুটো চুলই একরকম। একরকম বেণী, একইরকম রং।
এ কী রহস্য! হাত কাঁপতে লাগল আমার। বেশ বুঝলাম, এ-রহস্য যাতে আমি টের না-পাই, তাই দেরাজে ছিল। খোলাটা অন্যায় হয়েছে। কাউকে বলাটাও ঠিক হবে না।
এর পরের ঘটনাও কম অদ্ভুত নয়। আমি যা দেখি, ভালো করেই দেখি। দেখার ব্যাপারে চোখ আমার ধারালো। কপার-বীচেস বাড়িটার একপাশে একটা অংশে কেউ থাকে না গোড়া থেকেই লক্ষ করেছি। টলার-দম্পতি যেখানে থাকে, তার পাশ দিয়ে সেদিকে যেতে হয়। সবসময়ে তালা ঝোলে অংশটায়। একদিন এই দরজা দিয়েই রাগে থমথমে মুখে মি. রুকাসলকে বেরিয়ে আসতে দেখলাম–হাতে চাবি। দরজায় তালা দিয়ে আমার পাশ দিয়ে হনহন করে চলে গেলেন কথাও বললেন না।
কৌতূহল হল। সেইদিকের অংশটা ঘুরে দেখতে গিয়ে খটকা লাগল। পেছনে চারটে জানলা। তিনটেতে ধুলোবালি জমে প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে আর একটায় কেবল খড়খড়ি দেওয়া। পায়চারি করছি আর জানলা দেখছি, এমন সময়ে হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন মি. রুকাসল–কিছুক্ষণ আগেকার সেই গনগনে রাগের চিহ্নমাত্র নেই মুখে।
বললেন, তখন তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারিনি, কিছু মনে করনি তো?
আমি বললাম, না না। মনে করব কেন? কিন্তু এইদিকে কতকগুলো ঘর খালি পড়ে রয়েছে দেখছি–একটাতে আবার খড়খড়ি তোলা।
ভদ্রলোক চমকে উঠলেন আমার কথা শুনে।তৎক্ষণাৎ অবশ্য সামলে নিলেন। বললেন, ফটো তোলার শখ আছে তো। ওই হল ডার্করুম। কিন্তু তোমার তো দেখছি সবদিকেই চোখ। আশ্চর্য। খুবই আশ্চর্য! কথার স্বরে স্পষ্ট সন্দেহ আর বিরক্তি চোখে কপট হাসি।
বেশ বুঝলাম উনি চান না তালা দেওয়া অংশ নিয়ে মাথা ঘামাই। ফলে, কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। দেখতেই হবে কী আছে ও-ঘরে। শুধু মি. রুকাসল নন, তার স্ত্রীকেও ভেতরে ঢুকতে দেখেছি–একদিন টলারকেও দেখেছি থলি হাতে চৌকাঠ পেরোতে।
সুযোগ পেলাম হঠাৎ গতকাল। মাতাল টলার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তালা দিতে ভুলে গেছিল। কর্তা গিন্নি আর ছেলেটাও নীচে। ধাঁ করে ঢুকে পড়লাম ভেতরে।
সামনে একটা লম্বা করিডর। শেষের দিকে বাঁক নিয়েছে। সেখানে পাশাপাশি তিনটে ঘর। দু-পাশের ঘর দুটোর দরজা খোলা–ভেতরে অন্ধকার আর ধুলো। মাঝের দরজাটা লোহার খিল দিয়ে বন্ধ করা এবং কড়ায় তালা দেওয়া! পাল্লার নীচে আলো দেখা যাচ্ছে। এটাই সেই ঘর যার খড়খড়ি তোলা থাকে। আলোটা আসছে বোধ হয় স্কাইলাইট দিয়ে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ঘরের রহস্য নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছি, এমন সময় স্পষ্ট পায়ের আওয়াজ শুনলাম ঘরের ভেতরে। পাল্লার নীচে আলোয় যেন কার ছায়াও পড়ল।
সাংঘাতিক ভয়ে দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এলাম বাইরে—আছড়ে পড়লাম মি. রুকাসলের দু-বাহুর মধ্যে।
মিষ্টি হেসে বললেন, ধরেছি ঠিক। দরজা খোলা দেখেই ভেতরে ঢুকে পড়েছ?
উঃ ভীষণ ভয় পেয়েছি।
কীসের ভয় মিস হান্টার?ভাবতে পারবেন না কী আশ্চর্যনরম সুরে বললেন মি. রুকাসল–আদর আর ভালোবাসা যেন ঝরে পড়ল প্রতিটি শব্দ থেকে।
শুনেই আমি হুঁশিয়ার হলাম। বেশি মোলায়েম হাত গিয়ে ন্যাকামিটা নিজেই ধরিয়ে দিয়েছেন মি. রুকাসল। মেকি আদর–সাচ্চা নয়।
বললাম, বড্ড অন্ধকার। গা শিরশির করে উঠেছিল! এই দেখুন না কেন এখনও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
ব্যস? শুধু এই? ধারালো চোখে আমার মুখ দেখতে দেখতে বললেন মি. রুকাসল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আবার কী?
দরজা বন্ধ রাখি কেন জান?
না তো।
পরের ব্যাপারে যারা নাক গলায় তাদের জন্যে।
আমি তো জানতাম না—
এখন জেনেছ। ফের যদি দেখি এদিকে এসেছ–বলতে বলতে মুখটা পিশাচের মতো হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত পিষে ভীষণ চোখে তাকিয়ে বললেন, ওই ডালকুত্তার সামনে তোমাকে ফেলে দেব।
এমন ভয় পেলাম যে বলে বোঝাতে পারব না আপনাকে। দৌড়ে এসে অজ্ঞানের মতো পড়ে গেলাম বিছানায়। অনেকক্ষণ পরে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে আপনার কথা মনে পড়ল। এই শত্ৰুপুরীতে কেউ আমার আপন নয়–এমনকী দু-বছরের বাচ্চাটাও আমার অমঙ্গল চায়। আমাকে বাঁচাতে পারেন কেবল আপনি। তাই তক্ষুনি চুপি চুপি চলে গেলাম আধ মাইল দূরে পোস্টাপিসে–টেলিগ্রাম পাঠালাম আপনাকে। টলার মদের ঝেকে তখন অজ্ঞান বললেই চলে–সেইজন্যে যাওয়ার সাহস পেলাম–ও ছাড়া ডালকুত্তাকে ছেড়ে দেওয়ার ক্ষমতা কারোর নেই। বাড়ি ফিরে রাতটা প্রায় না-ঘুমিয়েই কাটালাম। আজ ছুটি নিয়ে এসেছি তিনটে পর্যন্ত। সন্ধ্যায় কর্তা গিন্নি কোথায় যাবেন–বাড়ি থাকবেন না। বাচ্চাটাকে আমি একাই দেখব। মি. হোমস, সব তো শুনলেন, এবার বলুন এই অদ্ভুত কাণ্ডকারখানার মানে কী?
এই বিচিত্র কাহিনি শুনলাম আমি আর হোমস মন্ত্রমুগ্ধের মতো। তারপর পকেটে হাত পুরে গম্ভীর মুখে পায়চারি করতে করতে বন্ধুবর শুধোল, টলার এখনও মদে বেঁহুশ?
হ্যাঁ।
মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রুকাসল? সন্ধের পর বাড়ি থাকছেন না?
না।
তাহলে একটা কাজ করুন। মিসেস টলারকে কোনো একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শেকল তুলে দিন। কুকুরটাও ছাড়া থাকছে না। সেই ফাঁকে আমরা দুই বন্ধু গিয়ে খানাতল্লাশ করে দেখি রহস্যটা কদ্দূর দানা বেঁধেছে। মিস হান্টার, আমি এই মুহূর্তে যা বুঝেছি, তা এই : আপনি এসেছেন অ্যালিস মেয়েটার ভূমিকায় অভিনয় করতে। অ্যালিসকে দেখতে মোটামুটি আপনার মতো চুল একরকম। নাছোড়বান্দা কাউকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যে আপনাকে তারই পোশাক পরিয়ে বসানো হয় জানলার সামনে পিঠ ফিরিয়ে। ছিনেজোঁক এই লোকটা হয় অ্যাসিসের বন্ধু নয় তা হবু-বর। অ্যালিস আমেরিকায় গেছে, এই কথা রটানো রয়েছে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে। আপনার ইশারা দেখে ছিনেজোঁকটি যাতে নিশ্চিন্ত থাকে এই হল অ্যালিসের বাবার মতলব। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে দু-বছরের বাচ্চাটা সম্বন্ধে যা শুনলাম।
বাচ্চাটা আবার কী করল? আমি তো অবাক।
ভায়া, বাচ্চাটা কিছু করেনি–কিন্তু বাচ্চার চরিত্র বিচার করে বাপ-মায়ের চরিত্র আঁচ করা যায়। সন্দেশ দেখে যেমন ছাঁচ কীরকম জানা যায়—এও সেইরকম। ওইরকম উৎকট বিকট নিষ্ঠুরতা যার চরিত্রে জন্মসূত্রে বাসা নিয়েছে তার বাপ অথবা মা নিশ্চয় দয়ালু যিশু নয়। মাকে বাদ দিলাম–বাপ সম্বন্ধে যা শুনলাম, তাতে মনে হয় লোকটা অমানুষিক নৃশংস। একটি মেয়েকে তিনি যন্ত্রণা দিচ্ছেন–তাকে বাঁচাতে হবে।
সন্ধ্যা সাতটার সময়ে হাজির হলাম কপার-বীচেস ভবনে। সামনেই সেই গাছ। তামাটে পাতা চকচক করছে পড়ন্ত সূর্যের আলোয়। মিস হান্টার সদর দরজা থেকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে আমাদের নিয়ে গেল ভেতরে।
বলল, দুমদাম আওয়াজ শুনছেন? মিসেস টলারকে ভাড়ার ঘরে আটকে রেখেছি। বুড়ো টলার এখনও বেহুঁশ। এই নিন মি. রুকাসলের চাবির নকল।
হোমস বললে, ভালোই হল। চলুন কোথায় যেতে হবে।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দরজা খুললাম। অন্ধকার করিডর বেয়ে বন্ধ দরজার সামনে পৌঁছোলাম। লোহার পাতটা দরজার সামনে থেকে সরিয়ে নিল হোমস, কিন্তু চাবি ঘুরিয়েও তালা খুলতে পারল না। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সব নিস্তব্ধ।
মুখটা কালো হয়ে গেল হোমসের। বিড়বিড় করে বললে, দেরি করে ফেললাম নাকি! ওয়াটসন, কঁধ লাগাও।
দুই বন্ধু মিলে চাপ মারলাম জীর্ণ দরজায়। মচ মচাৎ শব্দে কবজা থেকে ঠিকরে গেল পাল্লা। হুড়মুড় করে ঢুকলাম ভেতরে। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। একটা টেবিল আর বাক্সভরতি কিছু পোশাক ছাড়া কিচ্ছু নেই ঘরে। স্কাইলাইট খোলা।
লাফ দিয়ে কড়িকাঠের কাছে উঠে স্কাইলাইট ধরে ঝুলতে ঝুলতে হোমস বললে, বাইরে একটা দড়ির মই ঝুলছে দেখছি। পিশাচ বাপ মেয়েকে এদিক দিয়েই সরিয়েছে মনে হচ্ছে। বাইরে যাওয়ার নাম করে বাইরে থেকেই সেরেছে কাজ। ধড়িবাজ শয়তান কোথাকার, ঠিক এই সময়ে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল সিঁড়িতে।
চাপা গলায় হোমস বললে, ওয়াটসন, মি. রুকাসল আসছেন মনে হচ্ছে। পিস্তলটা হাতে রাখো। লোক কিন্তু খুব খারাপ।কথা শেষ হতে-না-হতেই দরজায় আবির্ভূত হল ভীষণ মোটা বিশালদেহী এক পুরুষ, হাতে একটা মোটা লাঠি। দেখেই আর্ত চিৎকার করে উঠে দেওয়ালে সিটিয়ে গেল মিস হান্টার। এক লাফে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কিন্তু স্বয়ং শার্লক হোমস।
জানোয়ার কোথাকার! কোথায় আপনার মেয়ে?
ঘরময় চোখ বুলিয়ে নিয়ে স্কাইলাইটের দিকে তাকাল মোটকা লোকটা।
বলল বজ্র হুংকারে, তবে রে! ওপরচালাকি হচ্ছে! আমাকেই আবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। চোর কোথাকার। কোথায় সরিয়েছিস ওকে? দাঁড়া, দেখাচ্ছি তোদের মজা! বলেই করিডর দিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নীচে।
কুকুর আনতে গেল যে! ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন মিস হান্টার।
আসুক না, আমার রিভলভার তো রয়েছে, অভয় দিলাম আমি।
সামনের দরজাটা বন্ধ করে দিই চলো, বলেই ঘর থেকে ছিটকে গেল হোমস। তিনজনেই সিঁড়ি বেয়ে ঝড়ের মতো নেমে এলাম নীচে। হল ঘরে পৌঁছোতে-না-পৌঁছোতেই শুনলাম কুকুরের গুরুগম্ভীর গর্জন–পরমুহূর্তেই একটা তীব্র যন্ত্রণাময় আর্ত চিৎকার—রক্ত-জল-করা সেই ভয়ংকর চিৎকার কান পেতে শোনাও যায় না। একজন লাল মুখখা বয়স্ক পুরুষ টলতে টলতে বেরিয়ে এল পাশের একটা দরজা দিয়ে।
সর্বনাশ। কে ছাড়ল কুকুরটাকে। দু-দিন খাওয়ানো হয়নি যে! তাড়াতাড়ি চলুন, তাড়াতাড়ি।
হোমস আর আমি তিরবেগে বেরিয়ে এলাম বাইরে, বাড়ির কোণ ঘুরে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োলাম শব্দ লক্ষ করে পেছন পেছন ছুটে এল টলার। দূর থেকেই দেখতে পেলাম ভয়ংকরদর্শন উপপাসি দানব কুকুরটাকে কালো নাক ঠেকে রয়েছে রুকাসলের গলার ওপর মাটিতে পড়ে যন্ত্রণায় পাকসাট দিচ্ছেন–রুকাসল–বিকট চিৎকারে খানখান হয়ে যাচ্ছে রাত্রি। কাছে গিয়েই নির্ভুল লক্ষ্যে ঘিলু বার করে দিলাম ডালকুত্তার–সাদা দাঁত তখনও কামড়ে রইল ঘাড়ের থাক থাক চর্বি। অতি কষ্টে চোয়াল ছাড়িয়ে মুমূর্মুকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে এলাম বাড়ির মধ্যে। প্রাণটা পুরোপুরি বেরোয়নি কিন্তু কাঁধের অবস্থা চোখ মেলে দেখা যায় না–এমনি ভয়াবহ। সোফায় শুইয়ে সেবাশুশ্রুষায় মন দিলাম আমি–টলারকে পাঠালাম বউকে খবর দিতে।
ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল লম্বা, অস্থিসর্বস্ব শুকনো চেহারার একজন স্ত্রীলোক।
মিসেস টলার! অস্ফুট কণ্ঠে বললে মিস হান্টার।
হ্যাঁ, মিস। মি. রুকাসল আপনার সন্ধানে যাওয়ার আগে ঘর থেকে বের করে দিয়ে গেছিলেন আমাকে। আরে মিস, আমাকে বললেই তো হত আপনাদের আসল মতলব। এত ঝামেলার মধ্যে তাহলে আর যেতে হত না।
তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে শার্লক হোমস বললে, তাই বল। মিসেস টলার দেখছি কেউ যা জানে , তাও জানে।
আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি সবই জানি। বলতেও এক পায়ে খাড়া আছি।
তাহলে বসে পড়ো। কয়েকটা জায়গা ভালো বুঝিনি–খোলসা করে দাও দিকি বাপু।
নিশ্চয় দেব। ঘরে ঢুকিয়ে শেকল তুলে দেওয়ার আগে যদি জিজ্ঞেস করতেন, সব বলতাম। আদালত পর্যন্ত যদি গড়ায় ব্যাপারটা, খেয়াল রাখবেন আপনাদের এই বান্ধবীটির সত্যিকারের বন্ধু আমি–মিস অ্যালিসও কিন্তু আমার বড়ো বন্ধু।
দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকেই এ-বাড়িতে সুখে থাকতে পারেনি অ্যালিস। লাঞ্ছনা মুখ বুজে সয়ে গেছে! অত্যাচার চরমে উঠল মি. ফাউলারের সঙ্গে তার আলাপ হওয়ার পর। উইল অনুসারে অ্যালিসও বেশ কিছু টাকাকড়ি পায় কিন্তু অ্যাদ্দিন কোনো কথা বলেনি–সব ছেড়ে দিয়েছিল মি. রুকাসলের হাতে। কিন্তু বিয়ের কথা উঠতেই বাপ দেখলেন মহা মুশকিল–এবার সম্পত্তির ভাগ চেয়ে বসবে জামাই–তাই উঠে পড়ে লাগলেন যাতে সব সম্পত্তির মালিক হওয়া যায়। জোর করে অ্যালিসকে দিয়ে একটা কাগজে সই করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, বিয়ে হলেও যাতে টাকার ওপর দখল থাকে মি. রুকাসলের। অ্যালিস বেঁকে বসল। শুরু হল অমানুষিক পীড়ন। ব্রেন-ফিভারে শয্যাশায়ী হল অ্যালিস ছ-মাস লড়াই চলল যমে মানুষে। প্রাণে বেঁচে গেলেও শরীর একেবারে আধখানা হয়ে গেল–অমন সুন্দর চুলের বোঝাও কেটে ফেলতে হল। তাতে মন টলল না মি. ফাউলারের ধনুর্ভঙ্গ পণ করে রইল অ্যালিসকেই বিয়ে করবে।
হোমস বললে, এবার বুঝেছি। বাকিটা আমি বলছি। মি. রুকাসল তখন থেকেই মেয়েকে সেইভাবে বন্দিনী করে রাখতে লাগলেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
লন্ডন থেকে মিস হান্টারকে নিয়ে এলেন ছিনেৰ্জোক মি, ফাউলারকে ঘাড় থেকে নামানোর জন্যে?
মি. ফাউলারের জেদ তাতে চিড় খেল না। অসমি অধ্যবসায় তার। বাড়ি অবরোধ করে বসে রইলেন। তোমার সঙ্গেও তার একটা বোঝাঁপড়া হয়ে গেল বুঝিয়ে দিলেন তার স্বার্থের সঙ্গে তোমার স্বার্থের কোনো সংঘাত নেই!
মি. ফাউলারের কথাবার্তাই শুধু মিষ্টি নয়, হাতটিও দরাজ।
তাই তোমার পতিদেবতার যাতে মদের অভাবনা-ঘটে, সে-ব্যবস্থা করে তোমাকে দিয়েই দড়ির মই জোগাড় করে রাখল যাতে মনিব বেরিয়ে গেলেই ভাবী বউকে নিয়ে চম্পট দেওয়া যায়?
আপনি তো দেখছি ঠিক ঠিক সব বলে যাচ্ছেন?
ডাক্তার এসে গেছেন দেখছি। মিসেস টলার, অনেক উপকার করলেন, অনেক ধাঁধা কাটিয়ে দিলেন। মিস হান্টারকে নিয়ে আমরা চললাম উইঞ্চেস্টারে।
তামাটে বৃক্ষ কপার-বীচেসওলা রহস্য-নিকেতনের রহস্য এইভাবেই ফর্দাফাই করে ছাড়ল সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ডিটেকটিভ শার্লক হোমস। মি. রুকাসল প্রাণে বেঁচে গেলেও খুব সুখে তার দিন কাটেনি স্ত্রী-র আন্তরিক সেবায় দিন চলে গেছে কোনোরকমে। ঝি-চাকরকে তাড়ানোর সাহস হয়নি ভদ্রলোকের। ওঁর কুকীর্তি এত বেশি জেনে ফেলেছে টলার-দম্পতি যে বাড়িতেই তাদের থাকতে দিতে হয়েছে–এখনও আছে। বাড়ি থেকে পালানোর পরের দিনই সাদাম্পটনে গিয়ে বিশেষ লাইসেন্সের জোরে মি. ফাউলারের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় অ্যালিসের। এখন তিনি সরকারি চাকরি নিয়ে মরিশাসে আছেন। মিস হান্টার একটা প্রাইভেট স্কুলের ভার নিয়ে ওয়ালসালে–তার সম্বন্ধে শার্লক হোমসের আর কোনো আগ্রহই নেই–যা দেখে খুবই হতাশ হয়েছি আমি।
————-
টীকা
১. রহস্য নিকেতন কপার-বীচেস: দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য কপার-বীচেস ১৮৯২-এর জুন মাসের স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয়।
২. ডেইলি টেলিগ্রাফ : এই সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠাতা কর্নেল স্নে। প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৫৫-র ২৯ জুন। সানডে টাইমসের মুদ্ৰক যোসেফ মোজেস লেভি ছাপতেন ডেইলি টেলিগ্রাফ। পরে কর্নেল ম্লে-র কাছ থেকে মালিকানা আসে লেভির হাতে। তার ক-দিন পরেই এই খবরের কাগজের বিক্রি অন্য সব দৈনিক কাগজের বিক্রিকে ছাড়িয়ে যায়।
৩. সেগুলো গল্পই হয়ে গেছে : দ্য ব্ল্যাঞ্চড সোলজার গল্পটি শার্লক হোমস বর্ণিত। তখন কিন্তু হোমস স্বীকার করেন গল্পের বর্ণনা তেমনই হওয়া উচিত, যা পড়তে পাঠকের ভালো লাগে।
৪. চুল তো ছাঁটতে পারব না : ভিক্টোরীয়-যুগে ইংরেজ মহিলারা লম্বা চুল পছন্দ করলেও, চুল ছোটো করে ছাঁটারও চল ছিল।
৫. আমার কোনো বোনকে : হোমসের কোনো বোন থাকবার কথা আর্থার কন্যান ডয়াল লেখেননি। কিন্তু কোনো। কোনো গবেষক তার এক বা একাধিক বোন থাকার সম্ভাবনা অনুমান করেন।
৬. প্রাচীন ইংলন্ডের রাজধানীতে : উইনচেস্টার ছিল ৫১৯ খ্রিস্টাব্দে ওয়েসেক্সের স্যাক্সন রাজ্যের রাজধানী। ইংলন্ডের রাজা অ্যালফ্রেড দ্য গ্রেটের সময়ে, ৪২৭ সালে, উইনচেস্টার ইংলন্ডের রাজধানী হয়। ক্যানিউট দ্য ডেন, উইলিয়ম দ্য কনকারার প্রভৃতি রাজাও রাজত্ব করেছেন এই শহর থেকে। ১১৪১-এ ঘটিত এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর এই শহর গুরুত্ব হারায়।
৭. মোট সাতটা সম্ভাবনা : সাতটা সম্ভাবনার কথা হোমস বলেছেন দ্য মিসিং থ্রি কোয়ার্টার্স গল্পে। দ্য নাভাল ট্রিটি গল্পে বলেছিলেন সাতটা সূত্রর কথা।
৮. ব্ল্যাক সোয়ান সরাইখানাটা : উইনচেস্টার এই নামে সত্যিই একটি হোটেল ছিল।
৯. কার্লো : দ্য সাসেক্স ভ্যাম্পায়ার গল্পে এই নামের একটি স্প্যানিয়েল কুকুর দেখা যায়।
১০. তোমাকে দিয়েই দড়ির মই জোগাড় করে রাখল : অল্প সময় আগেই কিন্তু হোমস ভেবেছিল ওই দড়ির মই দিয়েই রুকাসল সরিয়ে দিয়েছে অ্যালিসকে।
১১. মরিশাসে মরিশাসে ১৮১০ সাল থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশ পত্তন হয়। সেই সময়ে এই দ্বীপ ছিল জলপথে ভারতবর্ষে পৌঁছোনোর রাস্তায় একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ১৯৬৮ সালে মরিশাস স্বাধীন হয়।