নীলকান্ত পদ্মরাগের আশ্চর্য অ্যাডভেঞ্চার
[দি অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ব্লু কারবাঙ্কল]
বড়োদিনের দু-দিন পরে মঙ্গল কামনা করতে গিয়েছিলাম বন্ধুবর শার্লক হোমসের আস্তানায়। ঘরে ঢুকে দেখলাম আরামকেদারায় শুয়ে আছে সে। গায়ে বেগনি ড্রেসিং গাউন, হাতের কাছে তাক ভরতি তাম্রকূট সেবনের পাইপ, সদ্যপড়া খবরের কাগজের উঁই, একটা বিতিগিচ্ছিরি থেঁতলানো শতচ্ছিদ্র পশমের গোল টুপি, আতশকাচ আর ফরসেপস, মানে সন্না। অর্থাৎ টুপি পরীক্ষায় ব্যস্ত ছিল এতক্ষণ।
বললাম, কাজে বাগড়া দিলাম মনে হচ্ছে?
আরে বোসো। টুপি দেখিয়ে–ব্যাপারটা সামান্য, কিন্তু সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলি অসামান্য।
সাংঘাতিক অপরাধ নাকি?
না, না অপরাধ-টপরাধের ব্যাপার এটা নয়–কিন্তু বেশ বিদঘুটে।
তার মানে আইন ভাঙা হয়নি, কিন্তু রহস্যময়? এ-রকম তিনটে কেস এর আগেও লিখেছি।
সেইরকমই বটে। পিটারসনকে চেনো তো?
ইউনিফর্ম পরা দারোয়ান?
হ্যাঁ। টুপিটা তারই আবিষ্কার! মালিক কে, কোথায় থাকে জানা যায়নি। বড়োদিনের দিন ভোর চারটে নাগাদ টটেনহ্যাম কোর্ট রোড দিয়ে ফেরবার সময়ে ও দেখে সাদা রাজহংসী কাঁধে তালঢ্যাঙা একটা লোক টলতে টলতে যাচ্ছে। আচমকা কতকগুলো গুন্ডার সঙ্গে লাগল কথা কাটাকাটি, শেষে মারামারি। ঢ্যাঙা লোকটার টুপি লাঠির ঘায়ে ছিটকে যেতেই সে লাঠি তুলল মারবার জন্যে লাঠি লাগল পেছনে দোকানে জানলার কাচে ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল কাচ। গুন্ডাদের হাত থেকে তাকে বাঁচানোর জন্যে পিটারসন তখন সেদিকেই দৌড়েছে। লোকটা কিন্তু কাচ ভাঙার জন্যে হকচকিয়ে গেছিল। এমন সময়ে ইউনিফর্ম পরা পিটারসনকে দৌড়ে আসতে দেখে পুলিশ ভেবে ভোঁ দৌড় দিল সেখান থেকে রাজহাঁসটা ফেলে গেল রাস্তায়।
পিটারসন বেচারা পড়ল মহা ফাঁপরে। রাজহাঁসের বাঁ-পায়ে ছোট্ট একটা কার্ডে কেবল লেখা : মিসেস হেনরি বেকারের জন্যে। টুপির লাইনিংয়েও H.B. অক্ষর দুটি সুতো দিয়ে লেখা। কাকে ফিরিয়ে দেবে রাজহাঁস বুঝতে না-পেরে পিটারসন এল আমার কাছে। ও তো জানে সমস্যা যত সাধারণই হোক না কেন, আমি কখনো নারাজ হই না। এই দু-দিন বহাল তবিয়তেই ছিল রাজহাঁস… এখন নিয়ে গেছে পিটারসন–এতক্ষণে রান্নাও বোধ হয় আরম্ভ হয়ে গেছে। যার হাঁস তার ভোগে লাগল না, এইটাই যা দুঃখ। টুপিটা কেবল রেখেছি মালিককে ফেরত দেওয়ার জন্যে।
ঠিকানা তো জান না, ফেরত দেবে কী করে?
ঠিকানা এই টুপি থেকেই উদ্ধার করব।
কী যে বল!
বিশ্বাস হল না? বেশ, এই নাও তোমার আতশকাচ। আমার পরীক্ষা পদ্ধতি তুমি জান। দেখি, টুপি দেখে টুপির মালিককে কীরকম আঁচ করতে পার।
উলটেপালটে দেখলাম জীর্ণ, বিধ্বস্ত, শ্রীহীন টুপিটা। অত্যন্ত মামুলি ফেল্ট টুপি, রং কালো, আকারে গোল, বেশ শক্ত, লাল লাইনিং একপাশে লেখা দুটো অক্ষর–H.B. আলনায় ঝুলিয়ে রাখতে গিয়ে কয়েক জায়গায় ছাদা হয়ে গেছে, ধুলো যে কোথায় লাগেনি বলা মুশকিল, অনেক রকমের দাগও লেগেছে–কালি বুলিয়ে সে-দাগ ঢাকবার চেষ্টাও হয়েছে। ছিরিছাঁদ একেবারেই নেই–তার ওপর বহু ব্যবহারের ফলে অবস্থা বেশ কাহিল। একটা ঢাকনা পরানো হয়েছে টুপি যাতে বেশি নষ্ট না হয়। ইলাস্টিক ছিঁড়ে গেছে।
ফিরিয়ে দিলাম টুপি। বললাম, কিছুই দেখছি না।
উঁহু, একেবারে উলটো বললে। সবই দেখেছ। কিন্তু চোখের দেখাকে মনের যুক্তি দিয়ে সাজাতে পারছ না। সিদ্ধান্ত নিতে গেলেই ঘাবড়ে যাও বড্ড।
বেশ তো, তোমার সিদ্ধান্তটাই শোনা যাক না।
নিবিড় চোখে, টুপির দিকে তাকিয়ে রইল হোমস। চাহনির মধ্যে ফুটে উঠল সেই অন্তর্মুখিতা–যা ওর বৈশিষ্ট্য।
বলল আত্মনিমগ্ন কণ্ঠে, লোকটা মাথা খাঁটিয়ে খায়। এখন একটু টানাটানি চলছে—বছর তিনেক আগে অবস্থা সচ্ছল ছিল। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করতে পারত এককালে এখন সে-গুণ গোল্লায় গেছে–ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনা বা দূরদৃষ্টি আর নেই। নৈতিক অধঃপতন থেকেই তা সম্ভব হয়েছে খুব সম্ভব মদ ধরেছে–বউয়ের ভালোবাসা হারিয়েছে সেই কারণেই। সম্পত্তি খুইয়েছে নেশা করতে গিয়েই।
ভায়া হোমস! বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!
ইদানীং লোকটা আত্মসম্মান কিছুটা রাখতে পারছে। কুঁড়ে, ঘরকুনো, হাতের কাজে আনাড়ি, লাইম-ক্রিম মাখে, চুলের রং ধূসর। চুল কেটেছে এই সেদিন, মাঝবয়েসি, বাড়িতে গ্যাসের ব্যবস্থা বোধ হয় নেই।
খুব ঠাট্টা জুড়েছ দেখছি!
এত স্পষ্ট করে বলার পরেও কিছু ধরতে পারছ না।
মানছি আমার মাথায় ঘিলু কম। কিন্তু বুঝলে কী করে যে টুপির মালিক মাথা খাঁটিয়ে খায়?
টুপিটা নিজের মাথায় দিল হোমস–কপাল ছাড়িয়ে এল নাক পর্যন্ত। বলল, দেখলে? এত বড়ো যার মাথার সাইজ, সে মাথা খাঁটিয়ে খাবে না তো কি গতর খাঁটিয়ে খাবে?
সম্পত্তি খুইয়েছে বুঝলে কী করে?
এই ফ্যাশনের টুপি বছর তিনেক আগে চালু ছিল, দামও খুব বেশি। সুতরাং তিন বছর আগে এত দামি টুপি কেনার যার ক্ষমতা ছিল, তিন বছরেও আরও একটা টুপি কিনতে পারেনি দেখে কি মনে হয় না তার অবস্থা পড়ে গেছে?
দূরদৃষ্টি হারিয়েছে বললে কেন? নৈতিক অধঃপতনের খবরই-বা জানলে কী করে?
আগে দূরদৃষ্টি ছিল বলেই ধুলো হাওয়া থেকে টুপি রক্ষে করার জন্যে ঢাকনা পরিয়েছিল! এখন দূরদৃষ্টি নেই বলেই ইলাস্টিক ছিঁড়ে যাওয়া সত্ত্বেও নতুন করে লাগায়নি! স্বভাব প্রকৃতিও যে কমজোরি হয়ে আসছে–এটাও তার প্রমাণ। তবে আত্মসম্মান সম্বন্ধে সজাগ বলেই কালি বুলিয়ে দাগ ঢাকবার চেষ্টা করা হয়েছে।
সদ্য চুল ছেঁটেছে বলেই কাঁচিতে কাটা কুচো চুল লেগে ভেতরে, লাইমক্রিমের গন্ধও বেশ নাকে আসছে, বাদামি ধুলোটা রাস্তার ধুলোবালি নয়–ভেতরকার, অর্থাৎ ঘরকুনো মানুষ। ভেতরটা ভিজে ভিজে চটচটে, মানে চট করে মাথা ঘেমে যাওয়ার অভ্যেস আছে। যারা বেশি মাথা খাটায় হাতে কম কাজ করে–তাদের মাথাই টুপির ভেতরে এইভাবে ঘামে।
স্ত্রী আগের মতো ভালোবাসেন না তুমি জানলে কী করে?
ভালোবাসলে রোজ বুরুশ দিয়ে টুপির ধুলো ঝেড়ে দিতেন। কিন্তু এ-টুপিতে ধুলো চামাটি ধরে গেছে।
হয়তো বিয়েই করেনি।
দুর! বউকে তোয়াজ করার জন্যেই তো হাঁসের ডান পায়ে চিরকুট ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ঘাড়ে করে।
বাড়িতে গ্যাস নেই কে বলল তোমাকে?
পাঁচ জায়গায় চর্বি মোমের দাগ রয়েছে। এক হাতে টুপি আর এক হাতে জ্বলন্ত মোম নিয়ে ওপর তলায় উঠেছেন বলেই এমন হয়েছে। বাড়িতে গ্যাসের আলো থাকলে কি চর্বি-মোমের ফেঁটা পড়ত তা থেকে?
হোমসের বুদ্ধির তারিফ করলাম। হোমস জবাব দিতে যাচ্ছে এমন সময়ে দড়াম করে খুলে গেল দরজা, ঝড়ের মতো ঢুকল পিটারসন। চোখ-মুখ লাল উত্তেজনায় অস্থির।
বললে রুদ্ধশ্বাসে, স্যার, স্যার, সেই রাজহাঁসটা।
সে কী! জ্যান্ত হয়ে রান্নাঘরের জানলা দিয়ে উড়ে গেল নাকি?
এই দেখুন। হাঁসের গলার থলিতে আটকে ছিল! আমার বউ তো হতভম্ব! বলে হাতের তেলোয় একটা মটরের দানার মতো আশ্চর্য উজ্জ্বল নীলচে মণি দেখাল পিটারসন। যেন লক্ষ রোশনাই ছিটকে গেল হাত নাড়াতেই। সোজা হয়ে বসল শার্লক হোমস আঁতকে উঠে আমি বললাম, আরে সর্বনাশ! এই কি সেই নিখোঁজ রত্ন? কাউন্টেস অফ মোরকারের নীলকান্ত পদ্মরাগ?
ধরেছ ঠিক। ক-দিন ধরেই টাইমস কাগজে বিজ্ঞাপন বেরুচ্ছে। শুধু পুরস্কারই দেওয়া হবে হাজার পাউন্ড–যা ওর আসল দামের বিশ ভাগের এক ভাগও নয়।
মাথা ঘুরে গেল পিটারসনের। ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে।
হোমস বললে, কাউন্টেস তো শুনছি তাঁর আধখানা সম্পত্তিও দিতে রাজি এই মণির বিনিময়ে ব্যাপারটা সেন্টিমেন্টাল।
মণি তো হারিয়েছিল কসমোপলিটান হোটেলে? বললাম আমি।
হ্যাঁ। পাঁচ দিন আগে জন হার্নার নামে এক পাইপ সারানোর মিস্ত্রি নাকি রত্নটা লোপাট করে গয়নার বাক্স থেকে। খবরের কাগজে বেরিয়েছিল পুরো ব্যাপারটা।
কাগজের ডাঁই থেকে একখানা কাগজ তুলে নিয়ে পড়ে শোনাল হোমস :
হোটেল কসমোপলিটানে মণি লুঠ! ছাব্বিশ বছর বয়স্ক প্লাম্বার জন হর্নারকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে কাউন্টেস অফ মোরকারের নীলকান্ত পদ্মরাগ মণি চুরির অপরাধে। ঘটনাটা ঘটে এ-মাসের বাইশ তারিখে কসমোপলিটান হোটেলে। চুল্লির একটা শিক হঠাৎ ঢিলে হয়ে গিয়েছিল বলে হোটেল পরিচালক জেমস রাইডার ডেকে আনেন হর্নারকে। কিছুক্ষণ হর্নারের সঙ্গেই ছিলেন তিনি, তারপর অন্যত্র যান কাজের তাড়ায়। ফিরে এসে দেখেন হর্নার অদৃশ্য, আলমারির কপাট ভাঙা, আর একটা গয়নার বাক্স ডালা খোলা অবস্থায় পড়ে টেবিলে। এই দেখেই আতঙ্কে চেঁচিয়ে ওঠেন রাইডার, ছুটে আসে কাউন্টেসের পরিচারিকা ক্যাথরিন কুশাক। ইনস্পেকটর ব্র্যাডস্ট্রিট হর্নারকে যখন গ্রেপ্তার করতে যান, তখন সে ভীষণ চেঁচামেচি করে, আর ধস্তাধস্তি করে। বিনা দোষে তাকে নাকি গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কিন্তু আগেও একবার চুরির দায়ে হর্নার জেল খেটেছে শুনে বিচারপতি তাকে উচ্চতর আদালতে সোপর্দ করেছেন। বিচারের সময়ে তার চোখে অনুতাপের যন্ত্রণা ফুটে উঠতে দেখা যায় এবং অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
পড়া শেষ করে হোমস বললে, হুম! এ তো গেল আদালতের খবর। কিন্তু নীলকান্ত পদ্মরাগ হাঁসের পেটে গেল কী করে এবং হেনরি বেকার মশায় ওইরকম শ্রীহীন টুপি মাথায় দিয়ে সেই রাজহাঁস ঘাড়ে করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন কেন, এবার তা জানতে হবে। বেশ রহস্যজনক ব্যাপার, তাই না ওয়াটসন? সান্ধ্য কাগজগুলোয় বিজ্ঞাপন দিতে হবে দেখছি।
কী বলবে বিজ্ঞাপনে?
পেনসিল আর কাগজ দাও, লেখা যাক। এবার শোনো :
গুজ স্ট্রিটের মোড়ে একটা রাজহংসী আর একটা কালো পশমের টুপি পাওয়া গেছে। আজ সন্ধে সাড়ে ছটায় ২২১বি বেকার স্ট্রিটে এসে মিস্টার হেনরি বেকার নিয়ে যেতে পারেন।
কিন্তু হেনরি বেকারের চোখে পড়বে তো?
বন্ধুবান্ধবের চোখেও তো পড়তে পারে মিস্টার হেনরি বেকারের নাম দেখলেই তাকে খবরটা জানিয়ে দেবে। সবকটা সান্ধ্য দৈনিকে বেরুবে বিজ্ঞাপনটা।
মণিটা?
আমার কাছেই থাক। পিটারসন, একটা ভালো দেখে বদলি রাজহাঁস কিনে দিয়ে যেয়ো–ফেরত দিতে হবে তো।
পিটারসন বিদেয় হতেই ঝলমলে মণিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে হোমস বললে, সামান্য একটা কার্বনের ডেলাবই তো নয়—বয়স এখনও কুড়ি বছরও হয়নি—ওজনও মাত্র চল্লিশ গ্রেন পাওয়া গিয়েছিল দক্ষিণ চীনের অ্যাময় নদীর তীরে পদ্মরাগ মণি চুনির মতো লাল হয়, এ হল নীলকান্ত। এইটেই এর বৈশিষ্ট্য। তাই এত কম বয়সেই এর জন্যে দুটো খুন, একবার অ্যাসিড নিক্ষেপ, একটা আত্মহত্যা এবং বেশ কয়েকবার ডাকাতি হয়ে গেছে। বড়োই কুটিল অতীত। কাজেই আপাতত থাকুক আমার সিন্দুকে। কাউন্টেসকে খবর পাঠাব পরে।
হর্নার কি নির্দোষ?
বলা মুশকিল। তবে হেনরি বেকার নির্দোষ বলেই মনে হয়। গরিব মানুষ, ভাবতে পারেননি যাকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন, তার দাম নিরেট সোনার হাঁসের চাইতেও বেশি। আসুক বিজ্ঞাপনের জবাব, তখন বোঝা যাবে।
তাহলে আমি রুগি দেখতে চললাম, আসব সন্ধের সময়ে। ব্যাপারটার রহস্যমোচন ঘটে কী করে দেখতে হবে।
যথাসময়ে বেকার স্ট্রিটের বাসাবাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি লম্বা মতো এক ভদ্রলোক গলা পর্যন্ত বোতাম আঁটা কোট গায়ে দিয়ে মাথায় স্কচ টুপি১৩ পরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি আসতেই দরজা খুলে গেল। দুজনেই উঠে গেলাম হোমসের ঘরে।
সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হোমস বললে, বসুন, মি. হেনরি বেকার। এত ঠান্ডায় বড্ড পাতলা কোট পরে বেরিয়েছেন–বসুন আগুনের সামনে। এই টুপি আপনার তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমারই।
ভদ্রলোকের বেশ দোহারা চেহারা, গোল কাধ, বিরাট মাথা, প্রশস্ত বুদ্ধিদীপ্ত মুখ, তলার দিকটা সরু হয়ে এসে ঠেকেছে ছুঁচোলো ধূসর-বাদামি দাড়িতে। নাক থুতনি ঈষৎ লালচে, হাত কাঁপছে থির থির করে। দেখে মনে পড়ে গেল হোমসের আন্দাজি কথাগুলো। শার্ট পরেননি–কোটের কলার তুলে দিয়ে গলা পর্যন্ত এঁটেছেন। কবজি খুবই সরু। কথা বলেন কাটাকাটা স্বরে–শব্দ বাছাইয়ের যেন বেশ বাছবিচার আছে, যেন ভাগ্যের হাতে মার খেয়েছেন শিক্ষিত খানদানি এক পুরুষ।
হোমস বললে, ভেবেছিলাম কাগজে বিজ্ঞাপন দেবেন।
কাষ্ঠ হেসে ভদ্রলোক বললেন, পয়সা কোথায় যে বিজ্ঞাপন দেব? আগে ছিল–এখন অযথা খরচ করতে মন চায় না। আমি ভেবেছিলাম গুন্ডার দল টুপি আর হাঁস নিয়ে পালিয়েছে।
হাঁসটা কিন্তু আমাদের পেটে চলে গেছে।
অ্যাঁ! লাফিয়ে উঠলেন হেনরি বেকার।
বদলি হাঁস একটা রেখেছি–ওই দেখুন। ওজনে একই।
আঃ, বাঁচালেন!
আপনার হাঁসের পালক, পা, গলার থলি অবশ্য রেখেছি। যদি চান তো—
অট্টহেসে হেনরি বেকার বললেন, কী যে বলেন! মরা পাখির পালক নিয়ে আমি কী করব? টাটকা পাখিটাকে দিন, বিদেয় হই।
আড়চোখে আমার দিকে চেয়ে নিল হোমস।
বলল, এই নিন আপনার জিনিস। আচ্ছা, হাঁসটা কিনলেন কোখেকে দয়া করে বলবেন? এ-রকম প্রথম শ্রেণির রাজহাঁস বড়ো একটা দেখা যায় না।
উঠে দাঁড়িয়ে হেনরি বেকার ততক্ষণে হাঁস আর টুপি বগলদাবা করে ফেলেছেন। বললেন, মিউজিয়ামের কাছে আলফা-ইনের মালিক উইন্ডিগেট একটা রাজহংসী ক্লাব খুলেছিল। ফি হপ্তায় কয়েক পেনি জমা রাখলেই বড়োদিনে পাওয়া যাবে একটা হাঁসপাখি। আমিও চাদা দিয়েছিলাম তাই পেয়েছিলাম ওই হাঁস। চললাম। বিদেয় হলেন হেনরি বেকার। হোমস বললে, দেখলে তো ভদ্রলোক নির্দোষ। মণির খবর রাখেন না। তোমার যদি খুব খিদে না-পেয়ে থাকে, চলো একটু খোঁজখবর নিয়ে আসা যাক।
চলো।
বেরিয়ে পড়লাম শীতের রাতে। ডাক্তার-পাড়ার মধ্যে দিয়ে অনেক রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছোলাম আলফা-ইন সরাইখানায়১৫। দু-গেলাস বিয়ারের হুকুম দিয়ে মালিককে হোমস বললে, তোমার হাঁসের মতো বিয়ারটাও আশা করি অতি উত্তম হবে।
আমার হাঁস! আকাশ থেকে পড়ল সরাইওলা।
আরে হ্যাঁ। এইমাত্র হেনরি বেকারের কাছে তোমার সুখ্যাতি শুনে এলাম।
তাই বলুন। ও হাঁস তো আমি কিনেছি অন্য দোকান থেকে।
কোত্থেকে?
কভেন্ট গার্ডেনের ব্রেকিনরিজের কাছ থেকে। দু-ডজন হাঁস কিনেছিলাম।
আর কথা না-বাড়িয়ে বিয়ারে চুমুক দিল হোমস। শেষ করে বেরিয়ে এলাম বাইরে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছোলাম কভেন্ট গার্ডেন মার্কেটে।
ব্রেকিনরিজ লোকটাকে খুঁজে বার করতে অসুবিধে হল না। বেশ বড়ো দোকানের মালিক। ঘোড়ার মতো চেহারা, মুখটায় যেন শান দেওয়া, পরিপাটি করে ছাঁটা জুলপি। একটা ছোকরা চাকরকে নিয়ে খড়খড়ি বন্ধ করছে।
গুড ইভনিং, বললে হোমস। হাঁস সব বিক্রি হয়ে গেছে দেখছি।
কাল সকালে আসুন, পাঁচশো দেব।
উঁহু, তাতে হবে না।
তাহলে পাশের দোকানে চলে যান।
কিন্তু সুপারিশ করা হয়েছে তোমাকেই।
কে করেছে?
আলফা-ইনের মালিক।
ও হ্যাঁ, দু-ডজন হাঁস কিনেছে বটে।
চমৎকার জাতের হাঁস। কোত্থেকে জোগাড় করেছিলে বল তো?
ভালো জ্বালা দেখছি! রেগে গেল দোকানদার।কোথেকে হাঁস পেয়েছি তা নিয়ে আপনার কী দরকার?
কিন্তু এত ছোট্ট ব্যাপারে এ-রকম রেগে উঠছ কেন বুঝছি না।
আরে মশাই এই একই কথা আজ কতবার শুনলাম জানেন? যান, সরে পড়ুন।
কারা তোমাকে জ্বালিয়েছে জানি না কিন্তু আমি এসেছিলাম বাজি জিততে।
বাজি জিততে! উৎসুক দেখা গেল দোকানদারকে।
আরে হ্যাঁ, হাঁসটা পাড়াগাঁয়ের, না শহরের–এই নিয়ে বাজি ধরেছে একজন। আমি বলছি গাঁইয়া পাখি–সে বলছে শহুরে।
তাহলে তো মশাই আপনিই হেরেছেন। এটা খাস লন্ডন শহরের হাঁস।
মোটেই না। এক গিনি বাজি ধরছি!
ধরেছেন? তবে দেখুন।
ঝপাঝপ অনেকগুলো খাতা খুলে ফেলল চোয়াড়ে দোকানদার। দেখিয়ে দিল ২২ ডিসেম্বর ১১৭ নম্বর ব্রিক্সটন রোডের মিসেস ওকশটের কাছ থেকে সাড়ে সাত শিলিং দিয়ে কিনেছিল দু-ডজন হাঁস–সেই হাঁসই বেচেছে উইন্ডিগেটকে বারো শিলিংয়ে।
অকাট্য প্রমাণ। নিজের চোখে ঠিকানা দেখল হোমস। মুখখানা ব্যাজার করে এক গিনি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে পেট ফাটা হাসি হাসল অনেকক্ষণ।
বললে, যখনই কারো জুলপি দেখবে ওইভাবে ছাঁটা আর পকেটে দেখবে গোলাপি রুমালের কোণ বুঝবে তাকে বাজির নেশায় কিস্তিমাত করা যাবে। এক-শো পাউন্ড ঘুস দিতে চাইলেও ওকে নোয়াতে পারতাম না। যাক গে এবার যাওয়ার দরকার মিসেস ওকশটের কাছে। যা শুনলাম, তাতে তো দেখছি আমি ছাড়াও আরও অনেকে হাঁসের ঠিকানা জানতে উঠে-পড়ে লেগেছে। কাজেই
আচমকা ভীষণ চেঁচামেচি শুনলাম। ঘুরে দেখি, দোকানের বাইরে বেরিয়ে এসেছে ব্রেকিরিজ। ঘুসি তুলে ষাঁড়ের মতো গাঁক গাঁক করে গলাবাজি করছে যাকে লক্ষ করে চেহারার দিক দিয়ে সে নেহাতই ভিজে বেড়াল। মুখটা ইঁদুরের মতো। খর্বকায়। ভয়ে সিটিয়ে গেছে।
ফের যদি ঘ্যান ঘ্যান করতে আসেন তো কুকুর লেলিয়ে দেব। হাঁস কি আপনার কাছ থেকে কিনেছি? মিসেস ওকশটকে নিয়ে আসুন–যা বলবার তাঁকেই বলব।
গুঙিয়ে উঠল খুদে লোকটা, কিন্তু হাঁসের চালানে আমার হাঁসটাও যে মিশে গিয়েছিল।
সেটা মিসেস ওকশটকে গিয়ে বলুন।
মিসেস ওকশট তোমাকেই জিজ্ঞেস করতে বললে।
তাহলে প্রুশিয়ার রাজাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। বেল্লিক কোথাকার! বলে মারমুখো ভঙ্গিমায় তেড়ে গেল ব্রেকিরিজ। চম্পট দিল খর্বকায় লোকটা।
হোমস কানে কানে বললে, আঃ বাঁচা গেল। ব্রিক্সটন রোডে আর কষ্ট করে যেতে হবে না, বলেই পেছন নিল লোকটার। লম্বা লম্বা পা ফেলে ধরে ফেলল একটু পরেই। কাঁধে হাত রাখতেই আঁতকে উঠে লাফিয়ে গিয়ে সে ঘুরে দাঁড়াল আমাদের দিকে। গ্যাসবাতির আলোয় দেখা গেল নীরক্ত হয়ে গিয়েছে ইঁদুরের মতো মুখখানা।
নরম সুরে হোমস বললে, ব্রেকিরিজকে যা বলছিলেন, আমি তা শুনে ফেলেছি।
কে আপনি?
আমার নাম শার্লক হোমস। যে-খবর প্রাণপাত করেও কেউ জানতে পারে না–আমি তা জেনে ফেলি এবং সেইটাই আমার পেশা।
আমার ব্যাপার আপনি জানেন?
জানি বই কী। আলফা ইন থেকে মি. হেনরি বেকার যে-রাজহাঁসটি এনেছিলেন, সেটি সরাইওলা উইন্ডিগেট কিনেছিল ব্রেকিনরিজের কাছ থেকে।
আঃ কী উপকারই করলেন আমার! চলুন আমার বাড়ি, একটা চলন্ত ঘোড়ার গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল হোমস, কিন্তু কথা বলছি কার সঙ্গে এখনও জানলাম না।
সামান্য দ্বিধা করল লোকটা। তারপর বলল, আমার নাম জন রবিনসন।
উঁহু, মধুক্ষরা স্বর হোমসের, আসল নামটা বলুন।
মুখ লাল হয়ে গেল খর্বকায় ব্যক্তির, জেমস রাইডার।
ঠিক, ঠিক, হোটেল কসমোপলিটানের পরিচারক। উঠুন গাড়িতে। যা জানতে চান, সব বলব।
জেমস রাইডার গাড়িতে উঠল বটে, কিন্তু মুখ দেখে বোঝা গেল মহা ধাঁধায় পড়েছে। এক চোখে আশা, আর এক চোখে ভয় নিয়ে পর্যায়ক্রমে চাইতে লাগল আমাদের মুখের দিকে। সঘন নিশ্বাস আর হাত কচলানোর মধ্যে ফুটে উঠল নার্ভাসনেস।
আধ ঘণ্টা লাগল বেকার স্ট্রিট পৌঁছোতে। ঘরে ঢুকে আসন গ্রহণ করার পর সোল্লাসে বলল হোমস, আপনি একটা সাদা হাঁসের পেছনে ধাওয়া করেছেন, তার ল্যাজের দিকে কালো ডোরা কাটা। ঠিক তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, লাফিয়ে উঠল জেমস রাইডার।
এই ঘরেই ছিল। খানদানি পাখি। মারবার পরেও একটা রত্ন পেড়ে গেছে। নীল ডিম!
আর একটু হলেই টলে পড়ে যেত রাইডার ম্যান্টলপিস আঁকড়ে ধরে সামলে নিল কোনোমতে। রীতিমতো টলছে তখনও। সিন্দুক খুলে অত্যাশ্চর্য নীলকান্ত পদ্মরাগ তুলে দেখাল হোমস। যেন লক্ষ রোশনাই ঠিকরে গেল পাথর থেকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইল রাইডার।
শান্ত কণ্ঠে হোমস বললে, জেমস রাইডার, খেল খতম। আহা পড়ে যাবেন যে! ওয়াটসন, তুমি বরং ওঁকে একটু ব্র্যান্ডি গিলিয়ে দাও। এই ধাত নিয়ে এসব পথে আসা কেন বাপু?
ব্র্যান্ডিতে কাজ হল। ভয়ার্ত চোখে হোমসের দিকে চেয়ে রইল রাইডার।
গম্ভীর গলায় হোমস বললে, রাইডার, কাউন্টেসের নীলকান্ত পদ্মরাগের কথা আপনি জানলেন কী করে?
ক্যাথরিন কুশাক বলেছিল।
কাউন্টেসের সেই পরিচারিকা? পাক্কা শয়তান হওয়ার মতো সব উপাদানই আপনার মধ্যে আছে, জেমস রাইডার। হর্নারের অতীত দুষ্কর্ম আপনি জানতেন। তাই ইচ্ছে করেই কাউন্টেসের ঘরের চুল্লির একটা শিক আলগা করে ডেকে এনেছিলেন এই হর্নারকেই যাতে সন্দেহ তার ঘাড়েই পড়ে। সে বেরিয়ে যেতেই গয়নার বাক্স ভেঙে মণি সরিয়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করেছিলেন।
দড়াম করে আছড়ে পড়ে খপাত করে বন্ধুবরের দু-পা আঁকড়ে ধরল জেমস রাইডার, আমাকে বাঁচান স্যার। আমি দেশ ছেড়ে চলে যাব। আর কক্ষনো এমন কাজ করব না।
দেখা যাবে কী করা যায়, বজ্রকণ্ঠে বললে হোমস। মণিটা হাঁসের পেটে গেল কী করে? হাঁসটাই-বা দোকানে চালান হল কীভাবে?
বলছি, স্যার, সব বলছি। মণি পকেটে নিয়ে মহা অশান্তিতে পড়েছিলাম। পুলিশ আমার বাড়ি পর্যন্ত সার্চ করতে পারে। কী করি? কোথায় রাখি? শুকনো মুখে গেলাম ব্রিক্সটন রোডে বোনের বাড়ি–ওকশটকে বিয়ে করেছিল সে। হাঁস-মুরগি পালে, বড়ো করে বিক্রি করে। বসে বসে পাইপ খাচ্ছি আর ভাবছি কী করা যায়, এমন সময়ে পায়ের কাছে হাঁস চলতে দেখে একটা জবর বুদ্ধি মাথায় এল। অনেকদিন ধরেই বোন বলছিল, এবার বড়োদিনে সবচেয়ে মোটা একটা হাঁস আমাকে এমনিই দেবে। মণিটা সেইরকম একটা হাঁসকে খাইয়ে দিলেই তো হয়। তারপর হাঁস নিয়ে বাড়ি ফেরা যাবেখন! যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। ল্যাজে কালো ডোরাকাটা একটা হাঁসকে চেপে ধরে মণিটা ঠেলে দিলাম গলায় গিলেও ফেলল কেঁৎ করে কিন্তু এমন প্যাক প্যাক করতে লাগল যে দৌড়ে এল আমার বোন। হাঁসটা সেই ফাঁকে আমার হাত ফসকে মিশে গেল অন্য হাঁসের মধ্যে। বোনকে বললাম, তুই যে একটা হাঁস দিবি বলেছিলি, এবার দে। ও বলল–বেশ তো নাও যেটা খুশি। আমি হাঁসটাকে ধরে এনে মেরে নিয়ে গেলাম বাড়ি। পেট কাটবার পর যখন পাথর খুঁজে পেলাম না–তখন বুঝলাম সর্বনাশ হয়েছে। ভুল করে অন্য হাঁস মেরে এনেছি–আসলটা বোনের বাড়িতেই রয়ে গেছে। তক্ষুনি গেলাম। দেখি, কোনো হাঁসই নেই। বোনকে জিজ্ঞেস করলাম। ও বললে, সব হাঁস চালান হয়ে গেছে কভেন্ট গার্ডেন মার্কেটের ব্রেকিনরিজের দোকানে।
চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলাম, ল্যাজে কালো ডোরাকাটা একটা হাঁস ছিল তার মধ্যে?
ছিল। ও-রকম দুটো হাঁস ছিল–হুবহু একরকম।
শুনে আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল আমার। বুঝলাম কী কাণ্ড ঘটেছে। ছুটলাম কভেন্ট গার্ডেনে। ব্রেকিনরিজ হাঁস বেচে দিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই বলছে না কাকে বেচেছে। সারাদিন কত জিজ্ঞেস করেছি–বার বার হাঁকিয়ে দিয়েছে। আপনারাও শুনলেন কীরকম ব্যবহার করল আমার সঙ্গে। যে-জিনিসের জন্যে এতবড়ো পাপ করলাম ভালো করে তা দেখতে পর্যন্ত পেলাম না।
বলতে বলতে দু-হাতে মুখ ঢেকে ড়ুকরে উঠল জেমস রাইডার।
তারপর বেশ কিছুক্ষণ নৈঃশব্দ্য চেপে বসল ঘরে। টেবিলের কোণে আঙুল ঠুকে বাজনা বাজিয়ে চলল শার্লক হোমস।
তারপর উঠে গিয়ে দরজা খুলে বলল, দূর হও।
বাঁচালেন! ভগবান আপনার মঙ্গল করবেন!
আবার কথা! বেরোও বলছি।
দুমদাম করে সিঁড়িতে আওয়াজ শুনলাম, দড়াম করে খুলেই বন্ধ হয়ে গেল সদর দরজা, পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেল রাস্তায়।
মাটির পাইপটা তুলে নিয়ে হোমস বললে, ওয়াটসন, দৈবাৎ এ-কেসে নাক গলিয়ে ফেলেছি কাজেই কর্তব্য করে গেলাম। এত ভয় পেয়েছে লোকটা যে হারের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আর যাবে না–সে বেচারিও খালাস পেয়ে যাবে। পুলিশের মাইনে-করা চাকর আমি নই তাই ক্ষমা করলাম আসল চোরকে। যদি না-করি, যদি জেলে পাঠাই, তাহলে দেখবে সমাজে আর একটা দাগি চোরের সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু এখন যা করলাম, এর ফলে আর কোনোদিন এ-পথ ও মাড়াবে না। এবার ঘণ্টা বাজাও। বুনো মুরগির মাংস দিয়ে তদন্ত শুরু করা যাক।
————–
টীকা
১. নীলকান্ত পদ্মরাগের আশ্চর্য অ্যাডভেঞ্চার : প্রথম প্রকাশ স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিন জানুয়ারি ১৮৯২ এবং নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের ১৮৯২-এর ফেব্রুয়ারি সংখ্যায়। এ ছাড়া ওই সময়েই ফিলাডেলফিয়া এনকোয়ারার এবং অন্য কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় দ্য ক্রিসমাস গুজ দ্যাট সোয়ালোড আ ডায়মন্ড নামে। স্ট্র্যান্ডে প্রকাশিত হয়েছিল দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ব্লু কার্বাঙ্কল নামে।
২. রাজহাঁসটা :ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংলন্ডে ক্রিসমাসের ডিনারে রাজহাঁসের রোস্ট খাওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। পরবর্তী সময়ে আমেরিকার প্রভাবে হাঁসের জায়গা নেয় টার্কি। পাখির রোস্টের সঙ্গে খাওয়া হত প্লাম-পুডিং এবং মাংসর পিঠে বা পাই।
৩. H.B.: অনেক হোমস-গবেষক লক্ষ করেছেন H.B. আদ্যক্ষর-বিশিষ্ট নামের চরিত্র দেখা গিয়েছে দ্য নোল
ব্যাচেলর এবং ব্ল্যাক পিটার গল্পে।
৪. লাইম-ক্রিম : মাথার চুলের এই জনপ্রিয় ক্রিমে লেবুর গন্ধ ব্যবহার করা হত।
৫. এত বড়ো যার মাথার সাইজ : ভিক্টোরীয় যুগের প্রচলিত ধারণা, যার মাথার আকার বড়, তার বুদ্ধি বেশি। এই ধারণা যে ভুল তা প্রথম বলেন ভিয়েনার অধিবাসী, চিকিৎসক ফ্রানজ যোসেফ গল।
৬. হাঁসের গলার থলি : হাঁসের গলার থলিতে এভাবে কিছু আটকে থাকার সম্ভাবনার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন জীববিদ্যা-বিশারদ।
৭. নীলকান্ত পদ্মরাগ : পদ্মরাগ বা গানেট সাদা, লাল, সবুজ, হলুদ, কমলা, বাদামি বা হালকা বেগুনি রঙের হলেও নীল কখনো দেখা যায় না।
৮. টাইমস : ১৭৮৫-র পয়লা জানুয়ারি প্রথম প্রকাশিত সংবাদপত্র ডেইলি ইউনিভার্সাল রেজিস্টারের নাম ১৭৮৮ থেকে দ্য টাইমস হয়।
৯. আসল দামের বিশভাগের একভাগও নয় : পুরস্কারের বিশগুণ অর্থাৎ কুড়ি হাজার পাউন্ড যদি বারো ক্যারাটের দাম হয়, তাতে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কয়েকজন সমালোচক। সেই সময়ে, অর্থাৎ ১৮৯১-এ রাশিয়ার রাজদণ্ডে লাগানো ১৯৪ ক্যারাটের অরলফ ডায়মন্ডের দাম ধার্য হয়েছিল নব্বই হাজার পাউন্ড, হোপ ডায়মন্ডের দাম ধরা হয়েছিল ত্রিশ হাজার পাউন্ড।
১০. কসমোপলিটান হোটেলে : সেই সময়ে বিদেশ থেকে আসা রাজন্য-সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষজন উঠতেন লন্ডনের ক্লারিজস হোটেলে। ফরাসি সম্রাজ্ঞী ইউজিনের সঙ্গে ১৮৬০-এ এই হোটেলেই সাক্ষাৎ করেন রানি ভিক্টোরিয়া। ১৮৮৯-এর অগাস্ট মাসে স্যাভয় হোটেল খোলা হওয়ার পর সেখানেও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ থাকতে শুরু করেন।
১১. কার্বনের ডেলা : হিরে হল কার্বনের ডেলা। কিন্তু গানেট বা পদ্মরাগ গঠিত হয় ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতির সংমিশ্রণে।
১২. অ্যাময় নদী : অ্যাময় কোনো নদী নয়, দক্ষিণ চিনের একটি শহর। বর্তমান নাম জিয়ামেন (Xiamen)। প্রথম আফিম-যুদ্ধের পর ব্রিটিশদের দখলে আসে অ্যাময়। এই শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীটির নাম জিউ-লুঙ।
১৩. স্কচ টুপি : উলের তৈরি গোল, নরম টুপি।
১৪. মিউজিয়ামের কাছে : লন্ডন শহরে একাধিক নামি মিউজিয়াম থাকলেও মিউজিয়াম বলতে প্রথমেই মনে আসে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের নাম। বিখ্যাত পদার্থবিদ স্যার হান্স স্লোন-এর (১৬৬০-১৭৫৩) ব্যক্তিগত সংগ্রহ এবং আরও কিছু জিনিস নিয়ে এই মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৫৩ সালে। মন্টেগু হাউসে এটি স্থানান্তরিত হয় ১৭৫৯-এর ১৫ জানুয়ারি।
১৫. আলফা-ইন সরাইখানা : আলফা-ইন নামটি কল্পিত হলেও ক্রিস্টোফার মর্লের মতে এটি মিউজিয়ম ট্যাভার্ন কিংবা
ব্রিটিশ মিউজিয়াম এবং লিটল রাসেল স্ট্রিটের সংযোগস্থলে অবস্থিত প্লাও-এর সঙ্গে তুলনীয়।
১৬. কভেন্ট গার্ডেন : কভেন্ট গার্ডেন মার্কেট ছিল সেকালের সবজি, ফল এবং ফুলের এক বিশাল বাজার। এ ছাড়া মাংস, পোলট্রি এবং মুদিখানার জিনিসপত্রের বাজারও ছিল এখানে।
১৭. প্রুশিয়া : জার্মানির অন্তর্গত সর্ববৃহৎ রাজ্য প্রশিয়ার রাজধানী ছিল বার্লিন। ১৮৬১-তে প্রুশিয়ার সিংহাসনে আরোহণ করেন প্রথম উইলিয়ম। অস্ট্রো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ এবং ফ্রাঙ্কো প্রুশিয়ান যুদ্ধে জয়ের পর প্রথম উইলিয়ম জার্মান সাম্রাজ্যের কাইজার হন ১৮৭১-এ।
১৮. ক্ষমা করলাম আসল চোরকে : হোমস-বিশেষজ্ঞ রবার্ট কিথ লেভিট হিসেব কষেছেন, চোদ্দোটি কেস-এ হোমস অপরাধীকে ছেড়ে দিয়েছেন।