০৪. জন রান্স যা বললে
তিন নম্বর লরিস্টন গার্ডেন্স ছেড়ে বেরিয়ে এলাম বেলা একটার সময়। নিকটতম টেলিগ্রাফ অফিসে গিয়ে একটা সুদীর্ঘ টেলিগ্রাম পাঠাল শার্লক হোমস। তারপর একটা গাড়ি ডেকে লেসট্রেড প্রদত্ত ঠিকানায় যেতে বললে গাভোয়ানকে।
যেতে যেতে বললে, সাক্ষ্যপ্রমাণ যত টাটকা পাওয়া যায়, ততই ভালো। এ-কেস নিয়ে আমার মনে আর ধোঁকা নেই। তাহলেও আরও খবর যদি পাওয়া যায়, নেওয়া দরকার।
আমি বললাম, হোমস তাজ্জব করলে আমাকে। যা বলে এলে, তা কি সব জেনেই বললে?
ভুল করার মতো কিছু থাকলে তো ভুল করব। অকুস্থলে পৌঁছেই সবার আগে যা যা দেখলাম তা একটা গাড়ির চাকার দাগ ফুটপাত ঘেঁষে চাকার দু-সারি দাগ পড়েছে। বৃষ্টি কাল রাতেই হয়েছে, তার আগের সাতদিনে হয়নি। কাজেই চাকার গভীর দাগটাও কাল রাতেই পড়েছে। ঘোড়ার খুরের ছাপও পড়েছে কাদায় তিনটে অস্পষ্ট, একটা খুব স্পষ্ট তার মানে নতুন নাল। গ্রেগসন বলেছে সকালের দিকে গাড়ি ছিল না বাড়ির সামনে। গাড়িটা কিন্তু এসেছিল বৃষ্টি আরম্ভ হওয়ার পর। সুতরাং ধরে নিলাম, ওই গাড়ি চেপেই গভীর রাতে দু-জনে এসেছিল বাড়িতে!
খুব সোজা তো! কিন্তু হত্যাকারী মাথায় কতখানি ঢ্যাঙা, তা বললে কী করে?
দশজনের মধ্যে ন-জনের ক্ষেত্রেই লম্বা লম্বা পা ফেলার মাপ থেকে বলে দেওয়া যায় মাথায় কতখানি ঢ্যাঙা। হিসেবটা সোজা, কিন্তু অঙ্ক দিয়ে তোমার বিরক্তি উৎপাদন করতে চাই না। লোকটার পায়ের ছাপ দু-জায়গায় পেয়েছি বাইরের কাদায়, ভেতরের ধুলোয়। হিসেবটা যাচাই করার সুযোগও পেয়েছি। দেওয়ালের গায়ে লেখবার সময়ে মানুষমাত্রই চোখের সামনে লেখে–এক লেভেলে। মেঝে থেকে ছ-ফুট উঁচুতে হয়েছে লেখাটা। বাকিটা স্রেফ ছেলেখেলা।
লোকটার বয়স বললে কী করে?
যে-লোক অবলীলাক্রমে সাড়ে চার ফুট পদক্ষেপে হাঁটে, পূর্ণযৌবন কি তার মধ্যে টলমল করছে না? বাগানের রাস্তাটুকু ওইভাবে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে এসেছে হত্যাকারী। ছোটো পদক্ষেপে হেঁটেছে পেটেন্টে চামড়ার বুট–সে-ছাপ ভেঙে দিয়েছে চৌকোনো-মুখ বুট। এর মধ্যে রহস্য নেই, ওয়াটসন। প্রবন্ধটায় পর্যবেক্ষণ আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার যেসব নিয়মকানুন লিখেছি, তারই কিছু কিছু প্রয়োগ করেছি মামুলি জীবনে। বলো, আর কী কী বুঝতে পারনি?
আঙুলের নখ আর ত্রিচিনোপল্লী।
দেওয়ালের লেখাটা একজন পুরুষের আঙুলের রক্তে আঙুল ড়ুবিয়ে লিখেছে। আতশকাচের মধ্যে লক্ষ করলাম, লিখতে গিয়ে প্লাস্টারেও আঁচড় পড়েছে নখ কাটা থাকলে আঁচড় পড়ার কথা নয়। মেঝে থেকে খানিকটা ছাই কুড়িয়ে নিয়েছিলাম মনে আছে? কালচে স্তরে স্তরে সাজানো, একমাত্র ত্রিচিনোপল্লী চুরুটেই এমনি ছাই হয়। চুরুটের ছাই নিয়ে আমার বিশেষ পড়াশুনা আছে, এ-বিষয়ে একটা প্রবন্ধও লিখেছি। বললে অহংকার শোনায়, কিন্তু যেকোনো চুরুট বা তামাকের যেকোনো ছাই দেখে আমি বলে দিতে পারি কোনটা কী ব্র্যান্ডের এবং তফাত কোথায়। লেসট্রেড আর গ্রেগসনের সঙ্গে দক্ষ ডিটেকটিভের তফাত ওইখানেই।
লালচে মুখ?
ওটা একটা আন্দাজি ব্যাপার। তবে আমার বিশ্বাস ভুল হবে না। এই পরিস্থিতিতে এর বেশি জিজ্ঞেস কোরো না।
কপালে হাত চালিয়ে বললাম, মাথা ঘুরছে আমার। যতই ভাবছি, ততই রহস্যজনক ঠেকছে। ফাঁকা বাড়িতে দু-জনে এল কী মতলবে। শুধু দু-জনেই যে এসেছিল, তার কী প্রমাণ? কোচোয়োন গেল কোথায়? একজন কি আর একজনকে বিষ খেতে বাধ্য করতে পারে? অত রক্ত এল কোত্থেকে? হত্যাকারী হত্যা করতে গেল কেন?
ডাকাতির চিহ্ন তো দেখা যায়নি। মেয়ের আংটি-বা এল কোত্থেকে। সবচেয়ে বড়ো রহস্য, সরে পড়ার আগে দ্বিতীয় ব্যক্তি জার্মান শব্দ রাচি লিখতে গেল কেন? কিছুই বুঝছি না, কোনোটার যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছি না।
সম্মতিসূচক হাসি হাসল বন্ধুবর।
বলল, ছোট্টর মধ্যে সবক-টা রহস্য গুছিয়ে বললে। অস্পষ্ট এখনও অনেক কিছুই কিন্তু মূল বিষয়গুলো সুস্পষ্ট আমার মনের মধ্যে। লেসট্রেড বেচারি যে-আবিষ্কার করে তুরুক নাচ নাচছে, ওটা আসলে পুলিশের চোখে ধূলো দেওয়ার ব্যবস্থা পুলিশ যাতে ভুল পথে তদন্ত করে, সমাজবাদ আর গুপ্ত সমিতি নিয়ে ঘুরে মরে। ও-লেখা কোনো জার্মান লেখেনি। A অক্ষরটা জার্মান ছাঁদে লেখা–লক্ষ করেছ নিশ্চয়। কিন্তু খাঁটি জার্মান ল্যাটিন ছাঁদে লেখে। নিশ্চিন্ত মনে তাই বলতে পার, একজন আনাড়ি জার্মান ছাঁদ নকল করতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। স্রেফ ধোঁকা দিয়ে বিপথে চালনা করার প্রয়াস! ডাক্তার, এর বেশি আর তোমায় বলব না। জানো তো, জাদুকর হাত সাফাইয়ের কায়দা যদি বলেই দেয়, তাহলে আর বাহাদুরি পায় না। আমার কাজের পদ্ধতি যদি বেশি বলতে থাকি, তুমি আমাকে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে ফেলবে।
কখনো না অমন কর্ম আমার দ্বারা আর সম্ভব হবে না। এ-পৃথিবীতে গোয়েন্দাগিরিকে পাকাপোক্ত বিজ্ঞানের আসনে তুমিই প্রথম বসালে।
কথাগুলো অন্তর থেকে বলেছিলাম। বন্ধুবর তা লক্ষ করে আনন্দে আরক্ত হয়ে উঠল। গোড়া থেকেই দেখছি, প্রশংসা শুনলে গলে যায় হোমস, সৌন্দর্যের প্রশংসায় মেয়েরা যেমন ডগমগ হয়–শার্লক হোমসও স্বকীয় শিল্পের প্রশংসায় বিচলিত হয় বিলক্ষণ।
তাই ফের বললে, তাহলে আর একটা কথা বলা যাক। পেটেন্ট চামড়ায় বুট আর চৌকোনা-মুখ বুট একই গাড়িতে এসেছে, বাগানের রাস্তা বেয়ে বন্ধুর মতো হাত ধরাধরি করে হেঁটেছে। বাড়ির মধ্যে ঢোকার পর পেটেন্ট চামড়া এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেছে কিন্তু চৌকোনা বুট ঘরময় পায়চারি করেছে। ঘরের ধুলোতেই সে-ছাপ রয়েছে। লোকটা একদণ্ডও থামেনি–ক্রমাগত এদিক-ওদিক করেছে, বকবক করেছে, একটু একটু করে নিজেকে তাতিয়ে খুনের প্রস্তুতি এনেছে। উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে পায়চারি করার সঙ্গেসঙ্গে বুঝলাম ক্রমশ বেশি লম্বা পা ফেলার ছাপ দেখে! শেষকালে ক্রোধ যখন চরমে পৌঁচেছে, খুন করেছে সঙ্গীকে। যা বললাম, তার কিছু জেনেছি, বাকিটা অনুমান করেছি। তদন্ত শুরু করার মতো ভালো বনেদ কিন্তু পেয়েছি। এবার চটপট কাজটা শেষ করা দরকার। কেননা, বিকেলে হ্যালির কনসার্টে যাব নরম্যান নেরুদার বাজনা শুনতে।
এ-কথা যখন হচ্ছে, গাড়ি তখন চলেছে বিবর্ণ নোংরা রাস্তা আর বিষণ্ণ নিরানন্দ অলিগলি দিয়ে। সবচেয়ে নোংরা আর নিরানন্দ গলির মুখে এসে দাঁড়িয়ে গেল গাড়ি। মৃত্যু-রঙিন ইটের দেওয়ালে একটা ফাঁক দেখিয়ে কোচোয়ান বললে–অডলি কোর্ট। এখানেই পাবেন আমাকে। ঘুরে আসুন।
অডলি কোর্ট খুব একটা আকর্ষণীয় অঞ্চল নয়। সরু গলিপথের পর পাথর বাঁধানো একটা চতুর্ভুজ ক্ষেত্র। সারি সারি হীনদর্শন বাড়ি। বিরং পোশাক পরা নোংরা চেহারার বাচ্চাদের মাঝ দিয়ে পৌঁছোলাম ৪৬ নম্বর বাড়ির সামনে। দরজায় তামার পাতে খোদাই করা রান্সের নাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কনস্টেবল মহোদয় এখন শয্যায়। খবর পাঠানোর পর আমাদের বসতে দেওয়া হল সামনের সংকীর্ণ বারান্দায়।
ঘুম থেকে তুলে আনার জন্যে মেজাজ সপ্তমে চড়িয়ে অচিরে এল জন রান্স।
বলল, আমি তো রিপোর্ট দিয়ে এসেছি অফিসে।
পকেট থেকে একটা আধগিনি বার করে চিন্তামগ্ন ভাবে নাচাতে নাচাতে হোমস বললে—আমরা বসেছিলাম তোমার নিজের মুখে ব্যাপারটা শুনতে।
সোনার ছোট্ট চাকতির দিকে চেয়ে থেকে কনস্টেবল বললে, সানন্দে বলব। বলুন কী জানতে চান।
যা-যা ঘটেছিল, বলো তোমার মতো করে।
ঘোড়ার চুল দিয়ে ঠাসা সোফায় বসল রান্স। কপাল কুঁচকে ভেবে নিলে যাতে একটা কথাও না বাদ যায়।
বলল, গোড়া থেকে বলছি। আমার ডিউটি রাত দশটা থেকে ভোর ছটা পর্যন্ত। হোয়াইট হার্টের মদের আড্ডায় এগারোটা নাগাদ একটা মারপিট হয়েছিল–তারপর সব ঠান্ডা। একটার সময় শুরু হল বৃষ্টি। হল্যান্ড গ্রোভ বীটের কনস্টেবল হ্যারি মার্চারের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে হেনরিয়েট্টা স্ট্রিটে গল্প করতে লাগলাম দু-জনে। একটু পরে, দুটো নাগাদ কি তারও একটু পরে, ঠিক করলাম ব্রিক্সটন রোডে সব ঠিকঠাক আছে কিনা টহল দিয়ে দেখে আসা যাক। দারুণ নোংরা আর ফাঁকা রাস্তা। দু-একটা গাড়ি পাশ দিয়ে গেল–তা ছাড়া আর কাউকে দেখলাম না। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দু-জনে ভাবছি এই সময়ে একটু জিন পেলে কি ভালোই না হত, এমন সময়ে হঠাৎ একটা বাড়ির জানালায় আলোর আভা দেখলাম। লরিস্টন গার্ডেন্সের ওই দুটো বাড়িতে কেউ থাকে না আমি জানতাম। কারণ বাড়ির মালিক নর্দমা সাফ করে না–অথচ একজন ভাড়াটে টাইফয়েডে মারা গেছে সেখানে। তাই অবাক হলাম বাড়ির মধ্যে আলো দেখে। সন্দেহ হল নিশ্চয় ব্যাপার সুবিধের নয়। দরজার সামনে আসতেই—
থমকে দাঁড়ালে। ফিরে এলে বাগানের দরজায়। কেন বল তো? বাধা দিয়ে বললে হোমস।
ভীষণ চমকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল রান্স। বিষম বিস্ময়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শার্লক হোমসের মুখপানে।
আরে সর্বনাশ! সত্যিই থমকে গিয়ে ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু আপনি স্যার জানলেন কী করে? ভারি আশ্চর্য তো! ব্যাপারটা কী জানেন, দরজার সামনে পর্যন্ত গিয়ে বাড়ির ভেতরটা এমন খাঁ খাঁ অবস্থায় নিস্তব্ধ দেখলাম যে মনে হল একা যাওয়াটা ঠিক হবে না–সঙ্গে কাউকে রাখি! ভূতের ভয় আমার নেই স্যার। কিন্তু হঠাৎ কেন জানি মনে হল, টাইফয়েডে যে-মরেছে হয়তো সে ফিরে এসেছে নর্দমায় মৃত্যুর কারণটা খুঁজতে। ভাবতেই গা ছমছম করে উঠল। ভাবলাম, ফিরে যাই। মার্চারের লণ্ঠন দেখলে ডেকে নিয়ে আসি। কিন্তু কাউকেই দেখলাম না। না মার্চার, না কেউ।
কেউ ছিল না রাস্তায়?
জ্যান্ত কেউ ছিল না–কুকুর পর্যন্ত নয়। তাই সাহসে বুক বেঁধে ফিরে এলাম। একটা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। কোনো আওয়াজ না-পেয়ে গেলাম যে-ঘরে আলো জ্বলছিল। ম্যান্টল পিসে লাল মোমবাতি জ্বলতে দেখলাম, সেই আলোয় দেখলাম—
জানি কী দেখলে। ঘরময় কয়েকবার চরকিপাক দিয়ে লাশের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লে। তারপর উঠে গিয়ে রান্নাঘরের দরজা খোলার চেষ্টা করলে
ভয়ার্ত মুখে ফের লাফিয়ে উঠে সন্দিগ্ধ চোখে শার্লক হোমসের দিকে চেয়ে রান্স বললে, কোথায় লুকিয়ে ছিলেন বলুন তো? আপনি তো দেখছি আমার চাইতে বেশি জানেন?
হাসতে হাসতে নিজের-নাম-লেখা কার্ডটা টেবিলের উপর দিয়ে কনস্টেবলের দিকে ছুঁড়ে দিল হোমস, দেখো হে, খুনের দায়ে শেষে আমাকেই গ্রেপ্তার করে বোসো না। আমি শিকারীর কুকুর, নেকড়ে নই। মি. গ্রেগসন আর মি. লেসট্রেডকে জিজ্ঞেস করলেই শুনবে খন। আপাতত থেমো না। বলে যাও তারপর কী হল।
রান্স ফের আসন গ্রহণ করল বটে, কিন্তু রহস্যমদিরতা গেল না চোখ-মুখ থেকে। বললে, গেটে এসে বাঁশি বাজালাম। শুনে দৌড়ে এল মার্চার এবং আরও দু-জন।
তখনও কি ফাঁকা ছিল না রাস্তা?
আচ্ছা আমি বলতে কেউ ছিল না।
তার মানে? কী বলতে চাও?
দাঁত বার করে হাসল কনস্টেবল, জীবনে অনেক মাতাল দেখেছি স্যার। কিন্তু কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়া মাতাল দেখিনি। বেরিয়ে এসে দেখি রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে টলছে আর গলা ছেড়ে কলাম্বাইন্স নিউফ্যানগলড ব্যানার জাতীয় একটা গান গাইছে একটা লোক। টলছে ভীষণভাবে পড়ে যায়নি এই যথেষ্ট।
কী ধরনের লোক? শুধোল শার্লক হোমস।
অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় খিটখিটে স্বরে বললে জন রান্স, অসাধারণ মাতাল। হাতে কাজ–থাকলে নির্ঘাত ফাটকে পুরতাম।
মুখটা দেখেছিলে? পোশাক? অসহিষ্ণু স্বর শার্লক হোমসের।
দেখেছিলাম বলেই তো মনে হচ্ছে? আমি আর মার্চার ধরাধরি করে খাড়া করে দিয়েছিলাম বলেই দেখেছিলাম। তালঢ্যাঙা, লালচে মুখ, মুখের নীচের দিক মাফলার দিয়ে–
ওতেই হবে, সজোরে বললে হোমস। কী করলে তাকে নিয়ে?
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললে পুলিশম্যান, তাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় ছিল না। নিজের বাড়িতেই হয়তো গেছে।
জামাকাপড় কী পরেছিল?
ব্রাউন ওভারকোট।
হাতে চাবুক ছিল?
চাবুক–না।
নিশ্চয় রেখে এসেছিল, স্বগতোক্তি করে হোমস। এরপর আর তাকে দেখোনি? গাড়িও চোখে পড়েনি?
না।
এই নাও তোমার আধগিনি, উঠে দাঁড়িয়ে টুপি তুলে নিয়ে বললে হোমস।রান্স, জীবনে তুমি প্রমোশন পাবে না। তোমার ওই মাথাটা গয়নার মতো সাজিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো কাজে লাগবে না। কাল রাতেই তুমি সার্জেন্টের স্ট্রাইপ পেয়ে যেতে। যাকে বগলদাবা করে তুলেছিলে, এ-রহস্যের সূত্র তারই হাতে। তাকেই আমরা এখন খুঁজছি। তর্ক করে লাভ নেই! চলে এসো ডাক্তার!
একইসঙ্গে দুই বন্ধু রওনা হলাম গাড়ি অভিমুখে। অবিশ্বাসভরা চোখে চেয়ে বিষম অস্বস্তির মধ্যে জন রান্স দাঁড়িয়ে রইল পেছনে।
বাড়ির দিকে ছুটে চলল গাড়ি। ভেতরে বসে তিক্ত কণ্ঠে হোমস বললে, বেটা গাধা কোথাকার! একটার পর একটা ভুল করে গেছে! ভাবতে পার এ-রকম একটা অতুলনীয় সুযোগ হাতের মুঠোর মধ্যে আসা সত্ত্বেও ছেড়ে দিতে পারে কেউ?
আমি যে বন্ধু এখনও যে-তিমিরে সেই তিমিরেই রয়েছি। এই রহস্যের দ্বিতীয় ব্যক্তির বর্ণনা তুমি একটু আগে দিয়েছ তার সঙ্গে এই লোকটার চেহারা হুবহু মিলে যায় মানছি। কিন্তু মাথায় ঢুকছে না বাড়ি ছেড়ে চম্পট দেওয়ার পর আবার কেন ফিরে এল সে। ক্রিমিন্যালদের স্বভাব কিন্তু তা নয়।
আংটি… আংটি… আংটির জন্যেই ফিরে আসতে হয়েছে তাকে। আর কোনো পন্থাতেই যদি তার টিকি ধরতে না-পারি–এই আংটির টোপ ফেলেই তাকে ছিপে গাঁথব। ডাক্তার, বাজি ফেলে বলছি, ওকে আমি কবজায় আনবই। কিন্তু ধন্যবাদটা তোমারই প্রাপ্য। কেন জান? তুমি না ঠেলেঠুলে পাঠালে এ-কেসে আমি মাথা গলাতাম না–বঞ্চিত হতাম আমার গবেষক জীবনের শ্রেষ্ঠতম গবেষণা থেকে উজ্জ্বল লাল রঙের খুনের সূত্র–আমাদের কর্তব্য তা আলাদা করে বার করা, রহস্য গ্রন্থিকে সরল করা এবং হাটের মধ্যে প্রহেলিকার হাঁড়ি ভেঙে দেওয়া। আপাতত চলো লাঞ্চ খাই, তারপর শুনব নরম্যান নেরুদার বাজনা। আহা, খাসা হাত ভদ্রমহিলার কায়দাকানুনেরও তুলনা নেই। শোপার সেই সুরটা এত চমৎকার বাজান ট্রা-লা লা-লেরা-লিরা-লে।
গাড়ির কোণে হেলান দিয়ে ভরত পক্ষীর মতো মনের আনন্দে গান গেয়ে চলল শখের রহস্যসন্ধানী–অ্যামেচার ব্লাড হাউন্ড–আর আমি তন্ময় হয়ে রইলাম মানবমনের বহুমুখী রহস্য নিয়ে।
আগের পর্ব :
০২. অবরোহমূলক সিদ্ধান্ত বিজ্ঞান
পরের পর্ব :
০৫. বিজ্ঞাপনের জবাবে সাক্ষাৎপ্রার্থী
০৬. কেরামতি দেখাল টোবিয়াস গ্রেগসন
১০. অবতারের সঙ্গে কথা বলল জন ফেরিয়ার