০৭. পিপে উপাখ্যান
সঙ্গে একটা ছ্যাকড়াগাড়ি এনেছিল পুলিশ। সেই গাড়িতে মিস মসঁঠানকে বাড়ি নিয়ে গেলাম। মেয়েরা একদিক দিয়ে সত্যিই দেবী। নিজের চাইতে দুর্বল মেয়ের সামনে ভেঙে তো পড়েই না, উলটে প্রবোধ দিয়ে যায়। ভয়াতুরা হাউসকিপারের সামনে শান্ত সমুজ্জ্বল মুখে সব ঝক্কিই সয়ে গেছে মিস মর্সটান–প্রশান্ত আচরণ দেখে বোঝাই যায়নি ভেতরে তার কী চলছে, গাড়িতে উঠে কিন্তু ভেঙে পড়লেন। প্রথমে মূৰ্ছা গেলেন, তারপর সে কী কান্না! এত রাতে এত অ্যাডভেঞ্চার সইতে পারবেন কেন? পরে আমাকে বলেছিলেন, সে-রাতে আমি নাকি সারাপথ নির্লিপ্তভাবে বসেছিলাম যেন দূরের মানুষ! বেচারা! ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি কী তুমুল তুফান উঠেছিল আমার ছোট্ট বুকের খাঁচায় এবং কী অপরিসীম সংযমবলে ভাবোচ্ছ্বাসকে চেপে রেখে বসেছিলাম গাড়িতে। আমার প্রেম, আমার সমবেদনা কিন্তু স্পর্শ করেছিল বই কী তাঁকে–যে-মুহূর্তে বাগানের পথে হাতে হাত দিয়েছিলাম–উজাড় করে দিয়েছিলাম আমার বুকভরা ভালোবাসা। বহু বছরের গতানুগতিক অভিজ্ঞতায় যা সম্ভব হত না–এক রাতের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তা সম্ভব হয়েছিল। মিস মটানের সুমিষ্ট, অকুতোভয় প্রকৃতিকে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলাম। তা সত্ত্বেও মুখ দিয়ে ভালোবাসার কথা বার করতে পারিনি। শুধু দুটো চিন্তার জন্যে। অসহায় দুর্বল মুহূর্তে ভালোবাসার কথা চাপিয়ে দেওয়া অশোভনদেহে মনে, যিনি ভেঙে পড়েছেন তাকে এসব কথা বলা যায় না। তার চাইতেও যাচ্ছেতাই যা, তা হল আমাদের দুজনের অসম আর্থিক অবস্থা। উনি এই মুহূর্তে সাংঘাতিক ধনবতী। হোমসের গবেষণা যদি সফল হয়, তাহলে পাঁচ লক্ষ পাউন্ডের স্বত্বভোগী হবেন উনি একা। এমতাবস্থায় দৈব আমাদের পাশাপাশি এনেছে বলে আমার মতো একজন আধা মাইনের রিটায়ার্ড ডাক্তারের কি উচিত সেই সুযোগ নেওয়া? যদি একটা খারাপ ধারণা করে বসে আমার সম্পর্কে? যদি ভাবেন আমার আসল মতলব ভাগ্য ফেরানো এবং প্রকৃতি অত্যন্ত নীচ? পাছে এমন একটা কিছু ভেবে বসেন, তাই ঝুঁকি নিতে পারলাম না কোনোমতেই। দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরের মতোই আমাদের মাঝে খাড়া রইল মণিমুক্তো।
দুটো নাগাদ পৌঁছোলাম মিসেস সিসিল ফরেস্টারের বাড়ি। চাকরবাকর সব শুয়ে পড়েছিল কিন্তু জেগে বসেছিলেন মিসেস ফরেস্টার। মিস মর্সটান সেই অদ্ভুত চিঠিটা পাওয়ার পর উনিও খুব উদবিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। দরজা খুললেন নিজেই। মধ্যবয়সি সম্রান্ত মহিলা। মিস মটানের কোমর মায়ের মতো জড়িয়ে ধরলেন, মায়ের মতো স্নেহ কোমল কণ্ঠে সম্বোধন করলেন। দেখে মনটা ভরে উঠল আনন্দে। মিস মর্সটান এ-বাড়ির মাইনে-করা কেউ নয় যেন পরম বন্ধু। সম্মান সেইরকমই। আলাপ পরিচয় হওয়ার পর মিসেস ফরেস্টার ভেতরে এসে অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি শোনাতে অনুরোধ করলেন আন্তরিকভাবে। তখন বললাম কী গুরুত্বপূর্ণ কাজ হাতে নিয়ে বেরিয়েছি আমি। কথা দিলাম, পরে আসব। যখন যা ঘটবে জানিয়ে যাব। চলে আসতে ঘাড় ফিরিয়ে আবার দেখলাম মন-ভরানো সেই দৃশ্য। অশান্তিপূর্ণ ভয়ঙ্কর রাতে এমন একটা শান্তির নীড় দেখেও মনটা হালকা হয়। খাঁটি ইংলিশ গেরস্থালি–শান্তিতে টইটম্বুর। আধখোলা দরজার সামনে সিঁড়ির ধাপে আলিঙ্গনাবদ্ধ দু-টি সম্ভ্রান্ত মহিলা রঙিন কাচের মধ্যে দিয়ে বাইরে ঠিকরে আসছে হলঘরের আলো, দেখা যাচ্ছে ব্যারোমিটার আর সিঁড়ির চকচকে রড।
কুচুটে কেসটা মহা গোলমাল শুরু করে দিল মাথার মধ্যে। যতই ভাবি ততই যেন আরও করাল, আরও কালো মনে হতে থাকে। গ্যাসের আলোয় আলোকিত নিস্তব্ধ পথের ওপর গড়গড়িয়ে ছুটছে গাড়ি। ভেতরে বসে অসাধারণ কেসটার গোড়া থেকে ফের চিন্তা করছি নতুন করে। মূল সমস্যাটার জট অবশ্য খুলে এসেছে : ক্যাপ্টেন মর্সটানের মৃত্যু, মুক্তো পাঠানো, বিজ্ঞাপন এবং চিঠি–সবই এখন দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট। কিন্তু এই থেকেই এসে পড়েছি আরও গভীর, আরও শোচনীয় রহস্যে। ভারতবর্ষের রত্নবাক্সে, মটানের মালপত্রের মধ্যে পাওয়া একটাই অদ্ভুত নকশা, মেজর শোল্টোর মৃত্যুকালীন বিচিত্র দৃশ্য, রত্নবাক্সের পুনরুদ্ধারের ক্ষণপরে উদ্ধারকারীকে হত্যা। অপরাধসংলগ্ন অতি-অদ্ভুত ঘটনাপরম্পরা, পায়ের ছাপ, আশ্চর্য অস্ত্র, কার্ডে লেখা কথাগুলো–যা ক্যাপ্টেন মস্টানের নকশায় লেখা কথার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়–সত্যি বড়ো জবর গোলকধাঁধা। আমার রুমমেটটির চাইতে কম বুদ্ধিধর কারো পক্ষে এ-রহস্যের ক্ষীণতম সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টাও দুরাশা মাত্র।
ল্যামবেথের নিম্নমহলের একটা অতি নোংরা রাস্তা হল পিনচিন লেন। দু-পাশে সারি সারি দোতলা বাড়ি। তিন নম্বর বাড়িটার দরজায় বেশ কিছুক্ষণ ধাক্কা মারার পর তবে সাড়া পাওয়া গেল। আলোর আভা ফুটল খড়খড়ির ফাঁকে। একটা মুখ বেরিয়ে এল ওপরের জানলায়।
বলল, দূর হ মাতাল কোথাকার! আর বেশি গোলমাল করলে কুকুর লেলিয়ে দেব তেতাল্লিশটা কুকুর তোকে ছিঁড়ে খাবে।
আমি বললাম, একটা ছেড়ে দাও–সেইজন্যেই আসা।
দূর হয় তবে রে! দাঁড়া আপদ তাড়ানোর মশলা আমার এই ব্যাগেই আছে। এক ফোঁটা মাথায় পড়লেই ঠেলা বুঝবি!
আরে গেল যা! আমি আপদ হতে যাব কেন? এসেছি একটা কুকুর নিতে।
আবার মুখের ওপর কথা! তিন পর্যন্ত গুনব। তারপরে তোর মাথায় গিয়ে পড়বে গরমমশলার একটা ফোঁটা!
মি. শার্লক হোমস–এই বলে শুরু করেছিলাম কিন্তু শেষ করতে হল না। জাদুমন্ত্রের মতো কাজ দিল শুধু ওই নামখানা। মুহূর্তের মধ্যে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল ওপরের জানলা, এক মিনিট যেতে-না-যেতেই ধড়াম করে খুলে গেল সদর দরজা এবং দরজা জুড়ে সবিনয় মুখে আবির্ভূত হল মি. শেরম্যান–দীর্ঘ, কৃশ, শুষ্ক বৃদ্ধ; ঘাড়টা মোটা দড়ির মতো, কাঁধ ঈষৎ নোয়ানো এবং চোখ নীলচে কাচের চশমায় ঢাকা।
আসুন, স্যার। ভেতরে আসুন–মি: শার্লক হোমসের বন্ধুর জন্যে এ-বাড়ির দরজা সব সময়ে অবারিত। হুশিয়ার! ব্যাজারটার কাছ দিয়েও যাবেন না, বড় কামড়ে দেয়। কী দুষ্টু! কী দুষ্টু! ভদ্রলোককে খামচাতে শখ হয়েছে বুঝি? এ-কথাটা বলা হল একটা স্টোট বেজিকে। খাঁচার গরাদের ফাঁক দিয়ে ক্রুর মাথা আর লাল চোখ বাড়িয়ে চেয়ে ছিল আমার দিকে। ঘাবড়াবেন না স্যার। ওর দাঁত নেই–ভেঙে দিয়েছি। ঘরময় ছোটে, গুবরে পোকা খতম করে। প্রথম দিকে ব্যবহারটা খারাপ করে ফেলেছি। গায়ে মাখবেন না। ছোঁড়াগুলো বড় জ্বালায়, যখন-তখন কত লোক যে এসে কড়া নাড়ে। এবার বলুন কী চান মি. শার্লক হোমস?
তোমার একটা কুকুর।
আ! টোবিকে নিশ্চয়?
হ্যাঁ। নামটা টোবি-ই বটে।
বাঁ-দিকের সাত নম্বরে থাকে টোবি।
চারপাশের অদ্ভুত প্রাণীদের মাঝখান দিয়ে মন্থর চরণে মোমবাতি হাতে এগুলো বৃদ্ধ। ছায়াময়, অনিশ্চিত আলোয় কেবল চোখে পড়তে লাগল চকচকে ঝকঝকে স্ফুলিঙ্গর মতো বহু চক্ষু নানা কোণ থেকে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। এমনকী মাথার ওপরকার মাচা থেকেও সারিবদ্ধ মোরগ নির্বাকমুখে ঘুমভাঙা মেজাজে একবার এ-পা আর একবার সে-পায়ে ভর দিয়ে চেয়ে রইল আমাদের পানে।
টোবি কুকুরটা দেখলাম অতি কদাকার প্রাণী। ঝোলা কান, লম্বা চুল। গায়ের রং সাদায় আর বাদামিতে মিশোনো, হাঁটে দুলেদুলে হাঁসের মতো অতি বিতিগিচ্ছিরিভাবে। জাত অর্ধেক স্প্যানিয়েল অর্ধেক লার্চার। বৃদ্ধ প্রাণীতত্ত্ববিদ এক ডেলা চিনি দিল আমার হাতে। একটু দ্বিধা করে ডেলাটা আমার হাত থেকে মুখে নিল টোবি–বন্ধুত্ব গড়ে উঠতেই পেছন পেছন এল আমার। উঠে বসল গাড়িতে, নির্বিঘ্নে এল সঙ্গে। প্রাসাদ ঘড়িতে ঢং ঢং করে যখন তিনটে বাজছে, আমি ফিরে এলাম পণ্ডিচেরি লজে। শুনলাম প্রাক্তন বাজি জিতিয়ে লড়াকু ম্যাকমুর্ডোকেও গ্রেপ্তার করে মি. শোন্টোর সঙ্গে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে থানায়। ফটক পাহারায় ছিল দু-জন কনস্টেবল। ডিটেকটিভের নাম বলতেই ভেতরে যেতে দিল আমাকে কুকুরসমেত।
পকেটে হাত পুরে দাঁতে পাইপ কামড়ে ধরে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েছিল হোমস।
আ! এই তো এসে গেছে আমার টোবি। গুড ডগ! তুমি যাওয়ার পর অনেক কেরানি দেখাল আথেলনি জোন্স। শুধু থেডিয়াসকেই নয়, হাউসকিপার ইন্ডিয়ান চাকর, এমনকী ফটকের দারোয়ানকে পর্যন্ত ধরে নিয়ে গেছে খুনির শাগরেদ বলে। বাড়ি এখন খালি–ওপর তলায় মোতায়েন আছে কেবল একজন সার্জেন্ট। কুকুর এখানে রেখে চলো ওপরে যাই।
হল ঘরের টেবিলের পায়ায় টোবিকে বেঁধে আমরা উঠে এলাম ওপরতলায়। ঘর যেমন তেমনি আছে। মাঝের চেয়ারে আসীন নিষ্প্রাণ মূর্তিটিকে কেবল একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া আছে। এককোণে বসে একজন পুলিশ সার্জেন্ট।
সার্জেন্ট, তোমার লণ্ঠনটা ধার দাও তো, বলল হোমস। এবার কর্ডটা বাঁধো আমার গলায় যাতে সামনে ঝোলে। ধন্যবাদ। জুতো মোজা খুললাম। ওয়াটসন, নীচে নিয়ে যাও। পাইপ বেয়ে ওঠানামা করতে হবে কিনা। রুমালটা ক্রিয়োসোটে ড়ুবিয়ে দাও। ওতেই হবে। এবার চিলেকোঠায় এসো আমার সঙ্গে।
ফুটো দিয়ে গেলাম ওপরে। ধুলোয় আঁকা পায়ের ছাপগুলোয় আবার লণ্ঠনের আলো ফেলল হোমস।
বলল, বিশেষভাবে লক্ষ করো ছাপগুলো। বৈশিষ্ট্য কিছু দেখছ?
এ-ছাপ হয় বাচ্চা ছেলের, নয় বেঁটে মেয়েছেলের।
সাইজ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে?
অন্যান্য পায়ের ছাপের মতোই মনে হচ্ছে।
মোটেই না। এই দ্যাখো। ডান পায়ের এই ছাপটা দ্যাখো ধুলোর ওপর। আমার খালি পায়ের ছাপ পাশে ফেললাম। সবচেয়ে বড়ো তফাতটা কোথায় বলো তো?
তোমার পায়ের আঙুলগুলো গায়ে গায়ে লেগে আছে। অন্যান্য ছাপটায় বেশ ফাঁক ফাঁক।
ঠিক ধরেছ। এটাই আসল পয়েন্ট। মনে রেখো পয়েন্টটা। এবার একটা কাজ করো। ঠেলা জানলাটার সামনে যাও–কাঠের ফ্রেমটা শোঁকো। রুমাল নিয়ে আমি আর যাব না–এখানে দাঁড়াচ্ছি।
হুকুম মতো শুকলাম কাঠের ফ্রেম। সঙ্গেসঙ্গে নাকে ভেসে এল আলকাতরাজাতীয় একটা কড়া গন্ধ।
বেরোনোর সময়ে ওইখানেই প্রথম পা দিয়ে দিয়েছিল আততায়ী। গন্ধ যখন তোমার নাকে এসেছে টোবির নাকেও আসবে। যাও এবার নীচে গিয়ে কুকুরটাকে ছেড়ে দাও।
দৌড়ে বাইরে নেমে এলাম–ততক্ষণে শার্লক হোমস ছাদে উঠে পড়েছে। আলসের ওপর দিকে একটা অতিকায় জোনাকি পোকার মতো আস্তে আস্তে হাঁটছে। একসারি চিমনির আড়ালে ঢুকল হোমস, বেরিয়ে এল অপর দিক দিয়ে, আবার অদৃশ্য হয়ে গেল উলটোদিকে। আমি ঘুরে গিয়ে দেখলাম চালের প্রান্তভাগে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।
ওয়াটসন নাকি?
হ্যাঁ।
এইখান থেকেই নেমেছিল। নীচে ওই কালোমতো জিনিসটা কী?
জলের পাইপ।
খাড়া করে বসানো?
হ্যাঁ।
ধারেকাছে মই দেখতে পাচ্ছ?
না।
কী সর্বনাশ! পড়লে যে ছাতু হয়ে যেতে হবে। তবে সে যখন উঠেছে, আমিও নামতে পারব। জলের পাইপ মজবুত বলে মনে হচ্ছে! নামছি।
খসখস আওয়াজ শুনলাম। ধীর স্থিরভাবে নেমে এল লণ্ঠনের আলো। লাফ দিয়ে পিপের ওপর নামল হোমস, সেখান থেকে মাটিতে।
জুতো মোজা পরতে পরতে বললে, খুব মুশকিল হয়নি পিছু নিতে। যেখানে যেখানে পা ফেলেছে, টালি আলগা করে গেছে। তাড়াহুড়োয় এই জিনিসটাও ফেলে গেছে। ডাক্তার তোমাদের ভাষাতেই বলি, আমার ডায়াগ্নোসিস যে নির্ভুল–এই জিনিসটাই তার প্রমাণ।
বলে যে-জিনিসটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে, তা একটা রঙিন ঘাসের ছোট্ট থলি বা বটুয়া। গায়ে বসানো চটকদার পুঁতি। সাইজে বা চেহারায় সিগারেট কেসের চেয়ে বড়ো নয়। ভেতরে আধ ডজন কালো কাঠের কাটা। একদিকে ছুঁচোলো, আর একদিক চেঁছে গোল করা। বার্থোলোমিউ শোন্টোর কানের ওপর যা বেঁধা অবস্থায় দেখেছি হুবহু তাই।
হোমস বললে, খুব খারাপ জিনিস কিন্তু–শয়তানের অস্ত্রও বলতে পার। সাবধান, গায়ে ফুটিয়ে ফেলো না যেন। খুব সম্ভব এই ক-টা ছাড়া আর কাটা নেই। কাজেই আমি বেঁচে গেলাম। নইলে কে জানে কখন নিজের চামড়াতেই এসে ফুটত একটা। মার্টিনি বুলেটকে বুক পেতে নিতে পারি–এই কাঁটাকে নয়। মাইল ছয়েক হাঁটার মতো মেজাজ আছে ওয়াটসন?
নিশ্চয় আছে, বললাম আমি।
তোমার পা পারবে তো?
আরে, হ্যাঁ খুব পারবে।
গুড ওল্ড টোবি! আয় টোবি কাছে আয়, নে, গন্ধ শোঁক, ভালো করে শোক! ক্রিয়োসোট রুমালটা টোবির নাকের সামনে নাড়তে লাগল হোমস। সঙ্গেসঙ্গে চার পা ফাঁক করে ঘাড় কাত করে এমন একটা হাস্যকর ভঙ্গিমায় দাঁড়াল চতুষ্পদ প্রাণীটা যেন ক্রিয়োসোট রুমাল নয়, বিখ্যাত দ্রাক্ষা-মদিরার আঘ্রাণ নিচ্ছে খুঁতখুঁতে গন্ধ বিশেষজ্ঞ। দূরে রুমাল ছুঁড়ে দিল হোমস। দো-আঁশলার কলারে একটা মোটা দড়ি বেঁধে নিয়ে গেল পিপের গোড়ায়। জমির কাছে নাক নামিয়ে, ল্যাজটা শূন্যে তুলে হিড়হিড় করে নিয়ে চলল আমাদের। টান টান হয়ে গেল হাতের দড়ি এবং পাল্লা দিয়ে প্রায় দৌড়েই চলতে হল আমাদের।
পুবে আলো ফুটছে। ধূসর শীতল আভায় বেশ কিছুদূর দেখা যাচ্ছে। পেছনে বিষণ্ণ বদনে একাকী দাঁড়িয়ে অতিকায় চৌকোনো পিণ্ডবৎ বাড়িটা। খাঁ-খাঁ করছে জানালাগুলো। বেজায় উঁচু ন্যাড়া, কালো দেওয়ালগুলোও বিষাদগ্রস্ত। জমিতে অনেক গর্ত, অনেক পরিখা। খোঁড়াখুঁড়ির জ্বালায় একটুকু জমিও আস্ত নেই। এইসব খানাখন্দ পাশ কাটিয়ে চলেছি তো চলেইছি। রাবিশ, আর্বজনাপ, আগাছা ঝোপ এবং সর্বোপরি একটা অশুভ ছায়াপাতে পুরো জায়গাটা যেন কুটিল ট্র্যাজেডির উপর্যুক্ত অকুস্থল হয়ে উঠেছে।
বাগানের প্রান্তে পৌঁছে পাঁচিল বরাবর দৌড়তে লাগল টোবি। নিজের লম্বা ছায়ায় নাক ড়ুবিয়ে গর গর করে গর্জেই চলেছে সমানে। তারপরেই থেমে গেল এক কোণে–সামনে একটা তরুণ বীচ গাছ। দুটো দেওয়াল যেখানে মিশেছে, কয়েকটা ইট সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে। ফাঁকে ফাঁকে পা দিয়ে মইয়ের মতো ওঠানামার দরুন ক্ষয়ে গোল হয়ে এসেছে। ইটগুলো। ইটের ফাঁকে পা দিয়ে হোমস উঠে পড়ল পাচিলের মাথায়, হাত বাড়িয়ে কুকুরটাকে কোলে দিয়ে নামিয়ে দিল পাশে।
আমি উঠে বসলাম পাঁচিলে। হোমস বললে–কেঠো-পাঅলার হাতের ছাপ পড়েছে পাঁচিলে। সাদা চুনবালির ওপর রক্ত লেগেছে দেখেছ? কপাল ভালো, কাল থেকে তেমন ভারী বৃষ্টি হয়নি। আটাশ ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও রাস্তায় গন্ধ আছে এখনও।
স্বীকার করছি, আমি কিন্তু যানবাহনবহুল লন্ডন রাজপথের দিকে তাকিয়ে মোটেই ভরসা রাখতে পারিনি বন্ধুবরের কথায়। আটাশ ঘণ্টা কম নয়। এর মধ্যে কত গাড়িই-না গিয়েছে। পথ বেয়ে। তবে আমার ভয় যে অমূলক সে-প্রমাণ মিলল অচিরে। মুহূর্তের জন্যেও টোবিকে দ্বিধাগ্রস্ত বা বেকুব হতে দেখলাম না। অতশত গন্ধের মধ্যে থেকে ক্রিয়োসোটের গন্ধটি ঠিক আলাদা করে নিয়ে একইভাবে অদ্ভুতভাবে হেলেদুলে এগিয়ে চলল রাস্তার মাঝ দিয়ে। যেতে যেতে হোমস বললে, ওয়াটসন, ভেবো না যেন দৈবাৎ আততায়ীদের একজন ক্রিয়োসোটে পা ড়ুবিয়ে ফেলেছে বলে কেসটার সাফল্য নির্ভর করছে কেবল সেই সুযোগের ওপর। অনেক খবরই জানা গিয়েছে–কাজেই ও-সুযোগ ছাড়াও আরও অনেকভাবে আততায়ীদের টিকি ধরবার উপায় আমার জানা আছে। এই সুযোগটা অবশ্য একেবারে নাগালের মধ্যে এসে গেছে। এবং হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলাও একটা অপরাধ। অবশ্য কেসটাকে যেমন বুদ্ধিদীপ্ত মনে হয়েছিল এই সুযোগের ফলে তা আর মনে হচ্ছে না। সূত্রটা এতই মামুলি যে কৃতিত্ব নেওয়ার মতো নয়।
বল কী? কৃতিত্ব আছে বই কী! জেফারসন হোপের মার্ডার কেসে তুমি যে বিশ্লেষণী ক্ষমতা দেখিয়েছিলে, আমার তো মনে হয় এ-কেসে এর মধ্যেই তুমি তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষমতা দেখিয়ে ফেলেছ। এ-কেস যেন আরও জটিল, আরও দুর্বোধ্য। উদাহরণস্বরূপ, কেঠো-পাঅলা লোকটার নিখুঁত বিবরণ দিলে কী করে? যা বললে, তা তো বেশ জোরের সঙ্গেই বললে, বিশ্বাস কর বলেই বললে।
আরে ছ্যাঃ মাই ডিয়ার বয়? এ তো জলের মতো সোজা। নাটক করতে চাই না। একজন কয়েদি প্রহরীর কাছ থেকে দু-জন অফিসার গুপ্তধন সংক্রান্ত খবর পায়। জোনাথন স্মল নামে একজন ইংরাজ গুপ্তধনের একটা নকশা এঁকে অফিসারের হাতে তুলে দেয়! ক্যাপ্টেন মর্সটানের জিনিসপত্রের মধ্যে এ-নাম দেখেছ মনে পড়ছে? ক্যাপ্টেন নিজের এবং স্যাঙাতদের তরফে সই দিয়েছিলেন নকশায়–নাটকীয়ভাবে এই সইকেই বলা হয়েছে চারের সংকেত। অফিসাররা অথবা অফিসারদের একজন–এই নকশার দৌলতে মাটি খুঁজে উদ্ধার করে গুপ্তধন এবং নিয়ে আসে ইংলন্ডে। যে-শর্তে এনেছিল, ধরে নিচ্ছি সে-শর্ত সে রাখেনি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে জোনাথন স্মল নিজে গুপ্তধন উদ্ধার করেনি কেন? উত্তর হাতের কাছেই রয়েছে। নকশায় যে-তারিখ বসানো, সে-তারিখে কয়েদিদের সংস্পর্শে ছিলেন ক্যাপ্টেন মর্সটান। কয়েদিদের মধ্যে শাকরেদসহ জোনাথন স্মল ছিল বলেই নিজে গিয়ে তুলে আনতে পারেনি গুপ্তধনের বাক্স।
কিন্তু ভায়া। এ তো তোমার নিছক অনুমান, বললাম আমি।
তার চাইতেও বেশি। একমাত্র এই অনুমান দিয়েই সবক-টা ঘটনার যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। উপসংহারকে এই অনুমানের ভিত্তিতে পর্যালোচনা করলেই বুঝবে। গুপ্তধন আগলে বেশ কয়েক বছর পরম শান্তিতে কাটালেন মেজর শোল্টো। তারপরেই ভারতবর্ষ থেকে একটি চিঠি পেলেন। এক চিঠিতে ধাত ছেড়ে গেল তার বিষম ভয় পেলেন। বলল তো চিঠিতে কী ছিল?
যাঁদের ঠকিয়েছেন তাদের ছাড়া পাওয়ার খবর।
অথবা জেল থেকে তাদের পালানোর খবর। সেইটাই বেশি সম্ভব, কেননা উনি জানতেন নিশ্চয় জেলের মেয়াদ ওদের ক-দিন। অস্বাভাবিকভাবে ছাড়া পাওয়ার খবর হলে এ-রকম আঁতকে উঠতেন না। তারপর কী করলেন? কেঠো-পাঅলা এক ব্যক্তির হঠাৎ হামলা থেকে বাঁচবার ব্যবস্থা করলেন। লোকটা কিন্তু ইউরোপের মানুষ পয়েন্টটা মনে রেখো। তাই ইংরেজ ফেরিওলা দেখেই ভুল করে প্রাণের ভয়ে গুলি পর্যন্ত করে বসেছিলেন বেচারাকে। নকশায় সাদা চামড়া নাম একটাই আছে। আর সবাই হয় হিন্দু নয় মুসলমান। সাদা চামড়া আর কেউ নেই। বিনা দ্বিধায় দৃঢ়ভাবে তাই বলা যায় কেঠো-পাঅলা লোকটা আর জোনাথন স্মল। এক এবং অভিন্ন ব্যক্তি। কী? যুক্তির মধ্যে ফঁক আছে?
না। পরিচ্ছন্ন, সংক্ষিপ্ত।
বেশ, আবার তাহলে জোনাথন স্মলের জায়গায় নিজেদের বসানো যাক। তার দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যাপারটা দেখা যাক। সে ইংলন্ডে এল এক ঢিলে দু-পাখি মারবার মতলব নিয়ে। গুপ্তধন পুনরুদ্ধার এবং বেইমানের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া। শোল্টো কোথায় থাকেন তা জানবার পর খুব সম্ভব বাড়ির কারুর সঙ্গে যোগাযোগ করে। লাল রাও নামে একজন খাস চাকর আছে শুনেছি, চেহারা এখনও দেখিনি। লোকটা যে মোটেই সুবিধের নয়, এ-রকম কথা শুনেছি মিসেস বার্নস্টোনের মুখে। কিছুতেই গুপ্তধনের হদিশ পেল না স্মল। কেউ জানে না কোথায় আছে বাক্সটা–দু-জন ছাড়া। মেজর স্বয়ং এবং একজন পরম বিশ্বাসী অনুচর যে মারা গেছে অনেক আগেই। হঠাৎ খবর পেল স্মল, মেজর মৃত্যুশয্যায়, ক্ষিপ্তের মতো পাহারাদারদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে সে ছুটে এল ভেতর-বাড়িতে পাছে গুপ্তধনের গুপ্ত ঠিকানা নিয়েই পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হন মেজর এই ভয়ে। মেজরের শোবার ঘরের জানলার বাইরে এসেও ভেতরে ঢুকতে পারল না কেবল দুই ছেলে হাজির থাকার ফলে। জিঘাংসায়। উন্মত্ত অবস্থায় কিন্তু সেই রাতেই হানা দিল, ঘরের মধ্যে তছনছ করে গেল জিনিসপত্র গুপ্তধনের ঠিকানা কিন্তু পেল না। যাবার সময়ে কার্ডের গায়ে চারের সংকেত লিখে জানান দিয়ে গেল কে এসেছিল। মেজরকে খুন করে বুকের ওপর চারের সংকেত লেখা কার্ড রেখে যাওয়ার পরিকল্পনা নিশ্চয় আগে থেকেই ছিল। তার মাথার মধ্যে যাতে খুনটা স্বাভাবিক খুন বলে মনে না হয় এবং বোঝানো যায় যে চার শাকরেদের তরফ থেকে দণ্ড দিয়ে গেল একজন। অপরাধ ইতিহাসে এ ধরনের উদ্ভট আচরণ বা খামখেয়ালির নজির অনেক আছে। এ থেকে সাধারণত অপরাধী সম্বন্ধে অনেক মূল্যবান তথ্য এসে যায় অপরাধ বিশেষজ্ঞের হাতে। যা বলছি তা বুঝছ তো?
পরিষ্কার বুঝছি।
জোনাথন স্মল এখন করে কী? গুপ্তধন উদ্ধারের আশায় গোপনে নজর রেখে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। মাঝে মাঝে ইংলন্ড ছেড়ে চলেও যায়, ফিরে আসে কিছুদিন পরে। এর পরেই আবিষ্কৃত হল গোপন চিলেকুঠরির হদিশ–সঙ্গেসঙ্গে খবর চলে গেল স্মলের কানে। তাহলেই দ্যাখ, বাড়ির মধ্যেই যে স্মলের স্যাঙাত আছে, সে-প্রমাণ পাচ্ছি। আবার। কাঠের পা দিয়ে বার্থোলোমিউ শোন্টোর অত উঁচু ঘরে ওঠবার ক্ষমতা নেই স্মলের। তাই সঙ্গে নিল এমন একজন অদ্ভুত চোস্ত শাকরেদকে যে এই দুস্তর বাধা অক্লেশে টপকে গেলেও খালি পা ড়ুবিয়ে বসল ক্রিয়োসোটে–ফলে এল টোবি এবং আধা মাইনের একজন অফিসার তার জখম টেন্ডো অ্যাকিলিস নিয়ে খুঁড়িয়ে এল পাক্কা ছ-টি মাইল।
কিন্তু খুনটা তো জোনাথন করেনি–স্যাঙাত করেছে।
খুব সত্যি। তাতে খুবই চটেছে জোনাথন–ঘরে ঢুকেই দুমদাম করে পা ফেলে ঘরময় পায়চারি করা দেখেই বুঝেছি। বার্থোলোমিউ শোন্টোর ওপর তিলমাত্র রাগ নেই তার মুখে কাপড় ঠেসে হাত পা বেঁধে রাখলেই খুশি হত। ঝামেলায় মাথা গলাতে নারাজ। কিন্তু আর কিছু করার ছিল না–স্যাঙাতের বর্বর প্রবৃত্তি ষোলোকলায় প্রকাশ পেয়েছে বিষ-মাখানো কাটার কাজ ভালোভাবেই শেষ হয়েছে–কাজেই চারের সংকেত লেখা কার্ড ফেলে জানান দিয়ে গেল স্মল রত্নবাক্স নামিয়ে দিলে নীচে–সব শেষে নামল নিজে। এই পর্যন্ত ঘটনা পরম্পরা ছাড়া করতে পেরেছি সূত্র আর সংকেতের রহস্যভেদ করে। সে যে মধ্যবয়সি আর আন্দামানের মতো জ্বলন্ত উনুনে অত বছর থাকার ফলে ঝলসানো চেহারার হবে সেটা বলা খুব কঠিন নয়। লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরময় পায়চারি করেছিল সে। দু-পায়ের মাঝে ব্যবধান দেখে আঁচ করেছি উচ্চতা কতখানি। গালে দাড়ি যে আছে, তাও জানি। জানলায় তার মুখ দেখে আঁতকে উঠেছিল থেডিয়াস শোল্টো কেবল ওই দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলের জন্যেই। আর কিছু বলবার তো দেখছি না।
স্যাঙাতটা সম্বন্ধে বল।
ও-ব্যাপারে খুব একটা রহস্য নেই। শিগগিরই সব জানবে। কী মিষ্টি সকাল দেখেছ? ছোট্ট ওই মেঘটা কীরকম উড়ে যাচ্ছে দেখ–ঠিক যেন একটা দানব ফ্ল্যামিঙ্গোর গা থেকে খসে-পড়া গোলাপি পালক। লন্ডনের ওপরকার মেঘ ঠেলে মাথা তুলেছে সূর্যের লাল রং। উষার রাঙা আলোয় অনেকেই এখন নেয়ে উঠেছে। আমরা দু-জন ছাড়া অদ্ভুত পথের পথিক হয়েছি বলে! প্রকৃতির পঞ্চভূতের এই মহান শক্তির সামনে নিজেদের ক্ষুদ্র উচ্চাশা আর প্রচেষ্টা কত তুচ্ছ বল তো? জাঁ পল পড়েছ তো?
মোটামুটি। কারলাইল পড়তে পড়তে জাঁ পলে পৌঁছেছি।
লেক থেকে ছোটোখাটো যেসব নদী বেরোয়, তাদের যেকোনো একটাকে ধরে এগোলে লেকেই পৌছানো যায়। তোমার ব্যাপারটাও হয়েছে তাই। অদ্ভুত কিন্তু ভাববার মতো একটা কথা বলেছেন উনি। কোনো মানুষ কত মহান তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মেলে তার নিজেদের ক্ষুদ্রতার সম্যক উপলব্ধিতে অর্থাৎ তুলনামূলক বিচার আর উপলব্ধি দিয়েই নিজেই নিজের মহত্ত্ব প্রমাণ করেন। রিচটারের কথায় এমনি অনেক চিন্তার খোরাক আছে। তোমার তো পিস্তল নেই, না?
ছড়ি আছে।
বিবরে পৌঁছোনোর পর হয়তো হাতাহাতি হতে পারে। জোনাথনকে তুমি সামলাবে। কিন্তু স্যাঙাতটা যদি বেগড়বাই করে তো গুলি করে মারব।
বলতে বলতে রিভলবার বার করে হোমস। দুটো চেম্বারে গুলি ভরে রেখে দিল কোটের ডান-হাতি পকেটে।
টোবির পেছন পেছন এসে পড়েছি বিশাল নগরীর উপান্তে আধা-গ্রামের মতো পল্লিতে দুপাশে সারি সারি ভিলা। রাস্তার পর রাস্তায় শুরু হয়েছে ভোরের তৎপরতা। খালাসি মেহনতি মানুষরা উঠেছে ঘুম থেকে। নোংরা মেয়েমানুষেরা খড়খড়ি খুলে দিয়ে বুরুশ দিয়ে পরিষ্কার করছে চৌকাঠ। কোণের চৌকোনা-ছাদ পাবলিক হাউসগুলোর কাজকর্ম সবে শুরু হয়েছে। চোখ-মুখ ধুয়ে রুক্ষ চেহারার পুরুষরা বেরিয়ে এসে জামার হাতা দিয়ে দাড়ি ঘষছে। রাস্তার কুকুরগুলো টহল দিচ্ছে আনাচেকানাচে। অবাক চোখে দেখছে আমাদের। কিন্তু তুলনা নেই টোবির। রাস্তা ছাড়া হুঁশ নেই কোনোদিকে। একভাবে ঘাড় বেঁকিয়ে গন্ধ শুকে এগিয়ে চলেছে। আর মাঝে মাঝে গরগর করে উঠে জানান দিচ্ছে যে গন্ধ এখনও বেশ উগ্র।
স্ট্রেটহাম, ব্রিক্সটন, ক্যামবারওয়েল পেরিয়ে এলাম। ঢুকলাম কেনিংটন লেনে। গলিঘুজির মধ্য দিয়ে পৌঁছোলাম ওভালের পুবদিকে। যাদের পেছন নিয়েছি, তারা যেন ইচ্ছে করেই সোজা সড়ক ছেড়ে গলিঘুজির মধ্যে এঁকেবেঁকে চলেছে–যাতে পেছন নিয়েও নাগাল ধরা
-যায়। মূল সড়কের সরু গলি থাকলে সেই গলি দিয়েই হেঁটেছে–মূল সড়ক মাড়ায়নি। কেনিংটন লেনের শেষে পৌঁছে বাঁ-দিকে বেঁকে বন্ড স্ট্রিট আর মাইলস স্ট্রিট ধরেছে। মাইলস স্ট্রিট যেখানে নাইটস প্লেসে মোড় নিয়েছে, ঠিক সেইখানে গিয়ে আর এগোল না টোবি। এক কান খাড়া করে, আর এক কান ঝুলিয়ে অস্থিরভাবে একবার যার সামনে, আবার পেছিয়ে আসে পেছনে। দোটানায় পড়লে কুকুরমহল যা করে–হুবহু সেই চিত্র। তারপর গোল হয়ে ঘুরতে লাগল হেলেদুলে ঘনঘন তাকাতে লাগল আমাদের দুজনের দিকে গোলমালে পড়ে যেন সহানুভূতি প্রার্থনা করছে।
হল কী কুকুরটার? গর গর করে ওঠে হোমস। বেলুনে চেপে নিশ্চয় উড়ে যায়নি। ছ্যাকড়াগাড়িও নেয়নি দুশমন দু-জন।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল বোধ হয়। বললাম আমি।
আ! এই তো আবার এগোচ্ছে। স্বস্তির নিশ্বেস ফেলে বললে বন্ধুবর।
সত্যিই আবার এগোচ্ছে টোবি। গন্ধ শুকতে শুকতে হঠাৎ মনস্থির করে ফেলে এমন বেগে একদিকে ধেয়ে গেল তাক লেগে গেল আমার। এত উৎসাহ এত প্রত্যয় তো আগে দেখিনি। গন্ধ নিশ্চয় আরও উৎকট এখানে, কেননা রাস্তায় নাক নামানোর আর দরকারও হচ্ছে না–দড়িতে প্রবল টান মেরে ছুটছে সামনে ছুটতে হচ্ছে আমাদেরকেও। হোমসের প্রদীপ্ত চোখ দেখে বুঝলাম যাত্রাপথের শেষ ঘনিয়ে এসেছে।
নাইন এমস বরাবর প্রায় ছুটতে ছুটতে হোয়াইট ইগল পানশালার-২ পাশ দিয়ে এলাম ব্রোডরিক অ্যান্ড নেলসনের কাঠের গোলায়। ক্ষিপ্তের মতো পাশের গেট দিয়ে ভেতরের চত্বরে ঢুকে পড়ল টোবি–লোকজন তখন কাজ নিয়ে ব্যস্ত সেখানে। করাত দিয়ে ঘস ঘস করে কাঠ কাটা চলছে। টোবি কিন্তু আমাদের হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল কাঠের গুড়ো আর কাঠের কুচোর মাঝখান দিয়ে একটা গলির মধ্যে। সেখান থেকে একটা চওড়া পথ পেরিয়ে, দু-দিকে কাঠের স্কুপের মাঝখান দিয়ে একটা ঠেলাগাড়ির সামনে। ঠেলাগাড়ির ওপরে বসানো একটা মস্ত পিপের ওপরে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বিজয়গর্বে ডেকে উঠল ঘেউ ঘেউ করে। সে কী উল্লাস। জ্বলজ্বলে চোখে ঘন ঘন চোখের পাতা ফেলতে ফেলতে এবং লকলকে জিব বার করে লালা ফেলতে ফেলতে পিপের ওপর পিঠটান করে দাঁড়িয়ে বাহবার আশায় পর্যায়ক্রমে চাইতে লাগল আমার আর হোমসের মুখের দিকে। ঠেলাগাড়ির চাকা আর পিপের তক্তায় লেগে একটা কালচে তরল পদার্থ এবং বাতাস ভারী রয়েছে ক্রিয়োসোটের কটু গন্ধে।
শূন্য দৃষ্টি বিনিময় করলাম আমি আর শার্লক হোমস, পরক্ষণেই পেট ফাটা হাসির দমকে যুগপৎ ভেঙে পড়লাম দুজনে।
* ব্যাজার–বেজি আর ভালুকের মাঝামাঝি চতুষ্পদ জন্তু বিশেষ।
আগের পর্ব :
০১. অবরোহমূলক সিদ্ধান্ত বিজ্ঞান
০২. কেস বৃত্তান্ত
০৩. সমাধানের সন্ধানে
০৪. টেকো লোকটির কাহিনি
০৫. পণ্ডিচেরি লজের বিয়োগান্তক কাহিনি
০৬. হাতেনাতে দেখাল শার্লক হোমস
পরের পর্ব :
০৮. বেকার-স্ট্রিটের ছন্নছাড়া বাহিনী
০৯. শৃঙ্খলে যেখানে ফাঁক রয়েছে
১০. দ্বীপবাসীর শেষদিন
১১. আগ্রা সম্পদ
১২. জোনাথন স্মলের বিচিত্র কাহিনি