রূপান্তর / দ্য মেটামরফসিস

রূপান্তর / দ্য মেটামরফসিস

দ্য মেটামরফসিস-এর ভূমিকা

আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম ব্যতিক্রমী শিল্পী ফ্রানজ কাফকা জন্মগ্রহণ করেন ১৮৮৩ সালে, প্রাগে, এক সচ্ছল মধ্যবিত্ত ইহুদি ব্যবসায়ী পরিবারে। প্ৰাগ তখন ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রাগের জর্মন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের পাঠ সমাপ্ত করে ১৯০৬ সালে তিনি ডিগ্রি লাভ করেন এবং পরবর্তী কয়েক বছর একটি বীমা কোম্পানিতে চাকরি করেন। কাফকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। জীবনের অনিশ্চয়তা, অর্থহীন বিষাদমাখা অযৌক্তিক কাণ্ডকারখানা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিঃসঙ্গতা তাঁকে পীড়িত করে। তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। মানসিক দিক থেকেও তিনি বিধ্বস্ত বোধ করলেন। তাঁর মনে হল এই জীবনের জন্য তিনি যথেষ্ট উপযুক্ত ও সক্ষম নন। তবে তাঁর হ্রস্ব জীবনের শেষ দিকে কাফকা এই বোধ বহুলাংশে কাটিয়ে উঠেছিলেন। ১৯২৩ সালে ডোরা ডাইমন্ট নামী এক প্রতিভাময়ী ইহুদি অভিনেত্রীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। তিনি প্রাগ ত্যাগ করে ডোরাকে নিয়ে বার্লিনে বাস করতে শুরু করলেন। এই পর্বে তার অস্থিরতা ও মানসিক অশান্তি প্রায় অপসৃত। কিন্তু ততদিনে তার স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়েছে। দুরারোগ্য যক্ষ্মা শেষপর্যন্ত কাফকার জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে দেয়। অনেক কষ্ট ও যন্ত্রণা ভোগের পর ১৯২৪ সালের মাঝামাঝি মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে ফ্রানজ কাফকা মৃত্যুবরণ। করলেন। কিন্তু তার পূর্বেই তিনি রচনা করে ফেলেছেন অসাধারণ কয়েকটি উপন্যাস ও ছোটগল্প।

কাফকার শ্রেষ্ঠ রচনাবলির মধ্যে রয়েছে তিনটি উপন্যাস : দি ট্রায়াল, দি কাসল এবং আমেরিকা। এগুলো প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯২৫, ১৯২৬ ও ১৯২৭ সালে। উপন্যাস ছাড়াও কাফকা বেশ কয়েকটি অত্যন্ত উন্নতমানের, শিল্পগুণসম্পন্ন, গভীর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ-সমৃদ্ধ, আবেদনময় ছোটগল্প রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মেটামরফোসিস, এ হাঙ্গার আর্টিস্ট, এ্যান ওল্ড পেজ এবং দি হান্টার এ্যাকাস।মেটামরফোসিস অথবা রূপান্তরকে অবশ্য ছোটগল্প না বলে উপন্যাসিকাও বলা চলে। বিশ্বজুড়ে সাধারণ পাঠকের মনে ফ্রানজ কাফকার নামের সঙ্গে এই রচনাটি প্রায় অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। কেউ কেউ এর প্রারম্ভিক বাক্যটি সম্পর্কে বলেছেন যে এটা হল আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের সবচাইতে চমক-জাগানো অবিস্মরণীয় বাক্য।

রূপান্তর যথার্থই একটি অত্যাশ্চর্য গল্প, সেই সঙ্গে সঙ্গে কাফকার প্রতিনিধিত্বমূলক রচনাও বটে। কাফকা-সাহিত্যের সবগুলো প্রধান লক্ষণ এর মধ্যে বিদ্যমান। মানুষের জীবন, কর্ম ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা দুঃস্বপ্ন; মানুষের নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা ও অপরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে ব্যর্থতা; নিজেকে অপরের কাছে স্পষ্ট করে তোলার অক্ষমতা; নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভয়-ভাবনার কথা অন্যকে কিছুতেই বোঝাতে না-পারা; মানুষের চরম ঔদাসীন্য ও নিস্পৃহতা; বর্তমানের বিরাজমান পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে অতীতের স্নেহ-মমতা-সহানুভূতির অবলুপ্তি; তারুণ্যের কাছে তাৎক্ষণিক জীবনের অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ এবং তার ফলে জীর্ণ-অসুস্থ-মৃতকে দ্রুত বিস্মৃত হওয়া—এই সবই কাফকা তার রূপান্তর গল্পে তুলে ধরেছেন। গল্পটি কাফকার অন্যান্য রচনার মতোই একাধিক স্তরে উপভোগ্য, বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় ঋদ্ধ; এর মধ্যে ফ্যান্টাসি আছে, রূপক-প্রতীক আছে, আর তার আড়ালে আছে নির্মম সত্যের উদ্ভাসন। এখানে নাটকীয়তা আছে, নিখুঁত চরিত্র-চিত্রণ আছে, সর্বোপরি আছে বিশদ বাস্তববাদী বর্ণনার ঐশ্বর্য।

মেটামরফোসিস-এর কাহিনী সংক্ষেপে এই রকম। যুবক গ্রেগর সামসা এক মধ্যবিত্ত ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান। কঠিন তার জীবন-সংগ্রাম। বৃদ্ধ মা-বাবা আর তরুণী ছোটবোনকে নিয়ে সে থাকে। সংসারের সব দায়-দায়িত্ব তার কাঁধে। নানা দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা, আনন্দহীন ক্লান্তিকর কাজের বোঝা, চাকরি-ক্ষেত্রে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ঔদাসীন্য প্রভৃতিতে সে বিপর্যস্ত। তবু এর মধ্যেও তার মনে একটা গোপন গর্ববোধও আছে। সে-ই সংসারটা চালাচ্ছে। ছোটবোনকে সে ভালোবাসে। তাকে সংগীতবিদ হবার সুযোগ করে দিতে সে দৃঢ়সংকল্প। এসব কথা অবশ্য আমরা গল্পের শুরুতেই জানতে পারি না। গল্পের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নানা তথ্য আমাদের চেতনায় ধরা পড়ে। কাহিনী শুরু হয় অবিশ্বাস্য অদ্ভুত চরম নাটকীয় একটি বাক্য দ্বারা : একদিন নানা দুঃস্বপ্ন দেখার পর ভোরবেলা গ্রেগর সামসা যখন ঘুম ভেঙে জেগে উঠল তখন সে দেখল যে সে একটা বিশাল পতঙ্গে পরিণত হয়ে তার বিছানায় শুয়ে আছে। প্রথমে গ্রেগর ভেবেছিল যে এটা বোধহয় তার ঘুমের মধ্যে দেখা কোনো স্বপ্নেরই সম্প্রসারণ, কিন্তু না, এ কোনো স্বপ্ন নয়। সত্যিই সে বিরাট একটা আরশোলায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এই অবিশ্বাস্য ঘটনার পটভূমিতে কাফকা তার কাহিনীতে এক বিস্ময়কর বাস্তববাদী অনুপুঙ্খ বর্ণনার সমারোহ নিয়ে আসেন। আরশোলা হয়ে যাবার পর গ্রেগর। কীভাবে বিছানা থেকে উঠল, নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়া করার কৌশল ও রীতিনীতি কীভাবে আয়ত্ত করল, কীভাবে চলাফেরা করল, কী আহার করল ও কেমন করে—এসবের এমন বিশদ বর্ণনা কাফকা দিয়েছেন যে কাহিনীটি। পাঠকচিত্তে অবাস্তববাদীর পাশাপাশি একটা বাস্তববাদী মাত্রিকতাও গড়ে তোলে। এ-প্রসঙ্গে কারো কারো হয়ত মনে পড়তে পারে কোলরিজের দুঃস্বপ্নের স্মৃতিতাড়িত অদ্ভুত এক কাহিনী বর্ণনা-করা বৃদ্ধ নাবিকের কথা।

মেটামরফোসিস গল্পটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দিক থেকেও উল্লেখযোগ্য। আরশোলায় রূপান্তরিত গ্রেগর সামসা ধীরে ধীরে অনিবার্যভাবে তার চেনা জগৎ থেকে, তার স্নেহশীল পারিবারিক বন্ধন থেকে, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই ট্র্যাজেডি আরও বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে এই কারণে যে গ্রেগর নিজে সব বুঝতে পারে, অন্যের প্রতিটি ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তীক্ষ্ণ্ণ হয়ে তার চেতনায় ধরা পড়ে, কিন্তু প্রবল ইচ্ছা ও চেষ্টা সত্ত্বেও সে তার নিজের মনোভাব, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও আবেগ-অনুভূতি কাউকে বোঝাতে সক্ষম হয় না।

কাহিনীর মধ্যে গ্রেগরের মা, বাবা, ভাই-বোন, পরিচারিকা প্রভৃতি বিভিন্ন চরিত্র এসেছে। তাদের প্রতিক্রিয়া চিত্রায়নে এবং সেইসব প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেগরের মনোজগতে যে ঘাত-প্রতিঘাতের সৃষ্টি হয় তার রূপায়ণে কাফকা অসামান্য পর্যবেক্ষণ-শক্তি, মনোবিশ্লেষণ-দক্ষতা ও শৈল্পিক নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ করে ছোটবোনের আচার-আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির যে ক্রম-বিবর্তন কাফকা পরিবেশন করেছেন তার মধ্য দিয়ে গ্রেগরের ট্র্যাজেডি তীব্রভাবে ফুটে উঠেছে।

কাহিনীর গঠন-কাঠামোও লক্ষ করবার মতো। এর মধ্যে তিনটি সুস্পষ্ট বিভাগ আমাদের চোখে পড়ে। প্রতিটি বিভাগের শেষে ক্লাইম্যাক্স আছে। সব মিলিয়ে একটা প্যাটার্ন ও ছন্দ আমরা লক্ষ করি। গ্রেগর সামসা কাহিনীর শেষ পর্বে মারা যায়। কিন্তু তার মৃত্যু-পরবর্তী কিছু তথ্যও কাফকা পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। গ্রেগর মারা যাবার পর পরিবারের সবাই যে তাকে স্বল্পকালের মধ্যেই। বিস্মৃত হবে, একটা অসম্ভব ও অসহনীয় অবস্থার অবসানে তার মা-বাবা-বোনের জীবন যে আবার নতুনভাবে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে তার নির্ভুল ইঙ্গিত আমরা পাই কাহিনীর সর্বশেষ অনুচ্ছেদে।

একটি স্তরে গল্পটি অবিশ্বাস্য। কোনো মানুষই বাস্তব অর্থে আরশোলায় রূপান্তরিত হতে পারে না। সেদিক থেকে মেটামরফোসিস বাস্তবতাবিরোধী গল্প। কিন্তু আক্ষরিক বাস্তবতাকে অতিক্রম করে আমরা কি ভিন্ন ধরনের কোনো বাস্তবতার কথা ভাবতে পারি না? যদি পারি, তাহলে আমরা দেখব যে মেটামরফোসিস বা রূপান্তর আমাদের জন্য বিচিত্র ও ভয়ঙ্কর-সব অর্থে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই গল্প আমাদের জন্য এমন একটা জগতের ছবি তুলে আনে যা

পারম্পর্যহীন চরম নৈরাজ্যের, যেখানে মানুষ পরস্পরের সঙ্গে কিছুতেই অর্থবহ যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না, শুধু সীমাহীন নিঃসঙ্গতা ও চরম শূন্যতার মধ্যে হাবুডুবু খায়। সম্ভবত আধুনিক পাঠককুল মেটামরফোসিসসহ কাফকার সামগ্রিক সাহিত্যকর্মে এক নতুন আঙ্গিকে সমকালীন বিপর্যস্ত সমাজের নির্ভুল চিত্রকে প্রতিফলিত হতে দেখে বলেই, এর আপাত-উদ্ভটতা সত্ত্বেও, এর প্রতি প্রবল আকর্ষণ বোধ করে।

কবীর চৌধুরী
২৮ ফেব্রুয়ারি ৯০
ঝরোকা
বাড়ি নং ৫৬, সড়ক নং ২৮
গুলশান, ঢাকা

১. নানা আজেবাজে স্বপ্ন দেখার পর

নানা আজেবাজে স্বপ্ন দেখার পর একদিন সকালে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে গ্রেগর সামসা দেখল যে এক বিশাল পতঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে সে তার বিছানায় শুয়ে আছে। চিৎ হয়ে নিজের শক্ত পিঠের উপর সে শায়িত, পিঠটা যেন বর্মে মোড়া, আর মাথা একটু উঁচু করতেই তার চোখে পড়ল গম্বুজের মতো নিজের বাদামি পেট, শক্ত বাঁকানো অংশে বিভক্ত, তার উপরে, লেপটা ঠিকমতো রাখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল, পিছনে প্রায় সম্পূর্ণ পড়ে যাচ্ছিল সেটা। তার অসংখ্য পাগুলো শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় পীড়াদায়ক রকম সরু, আর তার চোখের সামনে সেই পাগুলো এখন অসহায়ভাবে নড়ছে।

সে ভাবল, কী হয়েছে আমার? এ কোনো স্বপ্ন নয়। সুপরিচিত চার দেয়ালের মধ্যে এই তো তার ঘর স্থির হয়ে পড়ে রয়েছে, একটা স্বাভাবিক মানবিক শয়নকক্ষ, একটু বেশি ছোট এই যা। টেবিলের উপর কাপড়ের নমুনার সংগ্রহ খোলা, কাপড়গুলো খুলে বিছানো—সামসা একজন ভ্রাম্যমাণ কর্মজীবী, ঘুরে ঘুরে কাপড়ের নমুনা দেখিয়ে বেড়ায়—একটু উপরে একটা ছবি ঝুলছে, অল্প কদিন আগে একটা সচিত্র পত্রিকা থেকে কেটে সুন্দর গিল্টি-করা ফ্রেমে বাঁধিয়ে ওখানে ঝুলিয়ে দিয়েছে সে। এক মহিলার ছবি, মাথায় ফারের টুপি, গায়ে ফারের কোট, সোজা বসে দর্শকের দিকে একটা বিরাট ফারের দস্তানা বাড়িয়ে ধরেছেন, যার মধ্যে তার বাহুর প্রায় গোটাটা ঢুকে গেছে!

এরপর গ্রেগরের চোখ পড়ল জানালার উপর, আর মেঘে ঢাকা আকাশের উপর-জানালার পাশের নর্দমায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল—গ্রেগরের মন রীতিমতো বিষণ্ণ হয়ে উঠল। সে ভাবল, এই আজেবাজে ব্যাপারটা ভুলে গিয়ে আরও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকলে কেমন হয়, কিন্তু সেটা পারা গেল না, কারণ ও ডান পাশে শুয়ে ঘুমুতে অভ্যস্ত, অথচ তার বর্তমান অবস্থায় সে পাশ ফিরতে পারছিল না। যত জোরেই সে ডান দিকে ফিরতে চেষ্টা করল, প্রত্যেকবারই সে গড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে যেতে লাগল। অন্তত একশোবার সে চেষ্টা করল, নিজের অস্থির চঞ্চল পাগুলো যেন দেখতে না হয় সেজন্য সে চোখ বন্ধ করে তার প্রয়াস চালিয়ে গেল, এবং ইতিপূর্বে কখনও অনুভব করেনি, পাশের দিকে সে ধরনের একটা ভোতা বেদনা অনুভব করার পরই শুধু সে তার প্রয়াসে ক্ষান্ত দিল।

হেই ভগবান, সে ভাবল, কী প্রচণ্ড অবসাদ জাগানো কাজই আমি বেছে নিয়েছি! দিনের পর দিন ঘুরে বেড়ানো! দপ্তরে বসে আসল কাজ করার চাইতে এটা অনেক বেশি বিরক্তিকর, তাছাড়া এখানে রয়েছে নিরন্তর ভ্রমণের ঝামেলা, ঠিকমতো ট্রেন-কানেকশন পাওয়া যাবে কিনা সে সম্পর্কে দুশ্চিন্তা, থাকা আর অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার নিয়ে দুর্ভাবনা, নিত্যি-নতুন লোকজনের সঙ্গে ক্ষণিক পরিচিতি, যারা কখনও অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে উঠতে পারে না। জাহান্নামে যাক এইসব! পেটের কাছটায় সে সামান্য একটু চুলকানি অনুভব করল; ধীরে ধীরে চিৎ হয়ে শুয়ে সে খাটের উপরের দিকটায় নিজেকে একটু ঠেলে দিল যেন তার মাথা আরেকটু সহজে তুলতে পারে; চুলকানির জায়গাটা সে দেখল, তার চারপাশে সাদা ছোট ছোট কয়েকটা দাগ, যার প্রকৃতি সে বুঝতে পারল না; একটা পা দিয়ে সে ওই জায়গাটা স্পর্শ করতে চেষ্টা করল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে পা টেনে নিল, কারণ ওখানে পা লাগতেই তার সারা শরীর দিয়ে একটা ঠাণ্ডা কাঁপুনি বয়ে গেল।

একটু পিছলে নেমে সে আবার তার পূর্বতন অবস্থায় ফিরে গেল। এই রকম ভোরে ওঠা, সে ভাবল, মানুষকে বুন্ধু বানিয়ে দেয়। মানুষের ঘুম দরকার। অন্য বাণিজ্যিক প্রতিনিধিরা হেরেমের মেয়েদের মতো ন্দ্রিা দেয়। যেমন, আমি যে। সব অর্ডার সংগ্রহ করেছি সেগুলো লিখে ফেলার জন্য সকালবেলায় যখন কোনো হোটেলে ফিরে আসি তখন দেখি যে আর সবাই সবেমাত্র নাশতার টেবিলে এসে বসছে। আমি যদি সেরকম কিছু করতাম তাহলে বড়কর্তা তক্ষুনি আমার চাকরি খেয়ে দিতেন। অবশ্য কে বলতে পারে, সেটা হয়ত আমার জন্য ভালোই হত। বাবা-মার কথা ভেবে আমি যদি চুপ করে না থাকতাম তাহলে বহু আগে আমি নিজেই চাকরি ছাড়ার নোটিশ দিতাম, সোজা বড়কর্তার কাছে গিয়ে তার সম্পর্কে আমি কী ভাবি সেটা ওর মুখের ওপর শুনিয়ে দিতাম। ডেস্কের উপরেই তাহলে তিনি ঢলে পড়ে যেতেন! এমনিতেই ব্যাপারটা অদ্ভুত, তিনি একটা ডেস্কের ওপাশে উঁচুতে বসে কর্মচারীদের দিকে ঝুঁকে নিচু হয়ে কথা বলেন, তার উপর তিনি কানে কম শোনেন, তাই কর্মচারীদেরকে তার খুব কাছে এগিয়ে যেতে হয়। তবে এখনও আশা আছে। ওর কাছে বাবা-মার যে ঋণ আছে সেটা পরিশোধ করার মতো টাকা জমাবার পর—আর পাঁচ-ছ বছরের মধ্যেই তা হয়ে যাবে—আমি অবশ্যই এ কাজটা করব। নিজেকে আমি তখন সব বাধা-বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে নেব। কিন্তু তার আগে, এখনকার মতো আমি বরং উঠে পড়ি, সকাল পাঁচটায় আমার ট্রেন ছেড়ে যাবে। সিন্দুকের উপর টিকটিক-করা এলার্ম ঘড়িটার দিকে তাকাল সে। উরেঃ বাবা! সাড়ে ছটা বেজে গেছে, ঘড়ির কাঁটা ধীরভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, অর্ধ-ঘণ্টার বিন্দুটা ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে, এগিয়ে যাচ্ছে পৌনে সাতটার দাগের দিকে। এলার্মটা কি তাহলে বাজেনি? খাট থেকেই সে দেখতে পাচ্ছে যে এলার্ম চারটাতেই ঠিকমতো দেয়া ছিল; নিশ্চয়ই সেটা যথাসময়ে বেজে উঠেছিল। হা। কিন্তু ওই কান-ফাটানো শব্দ উপেক্ষা করে তারপরেও নির্বিবাদে ঘুমানো কি সম্ভব? অবশ্য সে মোটেই নির্বিবাদে ঘুমায়নি, যদিও মনে হচ্ছিল ঠিক তার উল্টোটা। কিন্তু এখন কী করবে সে? পরের ট্রেন ছাড়ে সাতটায়। ওই ট্রেন ধরতে হলে তাকে পাগলের মতো তাড়াহুড়া করতে হবে, আর এদিকে তার নমুনাগুলো এখনও প্যাক করা হয়নি, নিজেকেও তেমন সতেজ ও সকর্মক মনে হচ্ছে না। আর ট্রেন ধরতে পারলেও বড়কর্তার সঙ্গে ঝগড়া সে এড়াতে পারবে না, কারণ ফার্মের দারোয়ান পাঁচটার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে থেকে, তাকে সেই ট্রেনে না-আসতে দেখে, নিশ্চয়ই সে কথা বড়কর্তাকে অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছে। দারোয়ান হল বড়কর্তার নিজের লোক, মেরুদণ্ড হীন ও নির্বোধ। আচ্ছা, গ্রেগর যদি বলে যে তার অসুখ করেছে। সেটা খুব অপ্রীতিকর হবে, দেখাবেও সন্দেহজনক, কারণ এই পাঁচ বছরের চাকরিকালে সে একদিনের জন্যও অসুস্থ হয়নি। বড়কর্তা নিঃসন্দেহে নিজেই রোগ-বীমার ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসবেন, তার বাবা-মাকে পুত্রের আলসেমির জন্য তিরস্কার করবেন, বীমা-ডাক্তারের মতামতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার সব অজুহাত নাকচ করে দেবেন, আর বীমা-ডাক্তার তো সমস্ত মানবজাতিকেই মনে করেন রীতিমত সুস্থ, ফাঁকিবাজ একটা গোষ্ঠী। আর এক্ষেত্রে কি তার সিদ্ধান্ত খুব ভুল হবে? আসলে গ্রেগরের শরীর তো বেশ ভালোই আছে, শুধু একটু ঘুম-ঘুম পাচ্ছে, অত দীর্ঘ দ্রিার পর যার কোনো মানে হয় না। আর তার অস্বাভাবিক রকম ক্ষুধাও পেয়েছে।

সে বিছানা ছেড়ে-উঠবে-কি উঠবে না এ-সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে অসমর্থ অবস্থায় উপরোক্ত চিন্তাগুলো যখন তার মনে প্রচণ্ড দ্রুতবেগে ছুটে চলেছে—ঘড়িতে এইমাত্র পৌনে সাতটা বাজার ঘণ্টাধ্বনি হল—তখন খাটের মাথার ওপাশে দরজার ওপর একটা সতর্ক টোকা পড়ল। গ্রেগর—তার মায়ের গলা শোনা গেল—পৌনে সাতটা বাজে। তোমার ট্রেন ধরতে হবে না? সেই স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর! গ্রেগর জবাব দিতে গিয়ে নিজের গলার আওয়াজ শুনে অসম্ভব চমকে গেল। তার নিজেরই গলার আওয়াজ, সে-কথা সত্য, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরের আড়ালে ভয়ঙ্কর নিচুগ্রামের একটানা একটা কিচকিচ শব্দ হল, যার ফলে শুধু প্রথম এক মুহূর্তের জন্য কথাগুলো স্পষ্ট আকৃতি পেল, তারপরই গমগম করে উঁচু লয়ে উঠে সেই ধ্বনির আড়ালে কথাগুলোর সমস্ত অর্থ নস্যাৎ হয়ে গেল, ফলে কারো পক্ষে সে যে যথার্থ কি শুনল তা বোঝা আর সম্ভবপর হল না। গ্রেগরের ইচ্ছা হল সমস্ত ব্যাপারটা সে বিশদ ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলে, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনা করে সে শুধু বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ধন্যবাদ, মা। আমি এখুনি উঠে পড়ছি। তাদের দুজনের মধ্যবর্তী কাঠের দরজার জন্য নিশ্চয়ই তার কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন বোঝা যায়নি, কারণ তার মা ওই কথা শুনে সন্তুষ্ট হয়ে পা টেনে টেনে সরে গেলেন। তবু ওই সামান্য সংলাপের ফলেই পরিবারের অন্যরা বুঝতে পারল যে গ্রেগর এখনও বাড়িতে আছে, এটা তারা আশা করেনি, আর তাই তার বাবা ইতোমধ্যে পাশের দিকের একটা দরজায় হাতের মুঠি দিয়ে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিতে শুরু করেছেন। তিনি ডাক দিলেন, গ্রেগর, গ্রেগর, তোমার কী হয়েছে? একটু পরে তিনি আবার ডাকলেন, এবার আগের চাইতে ভারী গলায়। পাশের দিকের অন্য দরজার কাছ থেকে তার বোন নিচু করুণ গলায় জিজ্ঞাসা করল, গ্রেগর, তোমার কি শরীর খারাপ? কিছু লাগবে তোমার? গ্রেগর একই সঙ্গে দুজনকে উত্তর দিল, প্রতিটি শব্দ আস্তে আস্তে, সুস্পষ্টভাবে, দুশব্দের মধ্যে অনেকখানি বিরতি দিয়ে, ভেঙে ভেঙে, সে বলল, যেন তার কণ্ঠস্বর যতটা সম্ভব স্বাভাবিক শোনায়, এই আমি তৈরি হয়ে গেলাম বলে। ওর বাবা তখন আবার নাশতার টেবিলে ফিরে গেলেন কিন্তু বোন ফিসফিস করে বলল, গ্রেগর দরজা খোল। খোল! কিন্তু দরজা খোলার কথা গ্রেগর মোটেই ভাবল না, আর বাইরে ভ্রমণ করার সময় রাত্রিতে ঘরের দরজায় তালা দিয়ে শোবার যে প্রাজ্ঞ অভ্যাস সে রপ্ত করেছিল, বাড়িতেও যা সে বজায় রেখেছিল, তার জন্য এখন নিজেকে সে ধন্যবাদ জানাল।

তার তাৎক্ষণিক ভাবনা হল কোনোরকম বাধা-বিপত্তি ছাড়া চুপচাপ বিছানা ছেড়ে ওঠা, কাপড়-জামা পরা, সর্বোপরি সকালের নাশতাটা খাওয়া, এবং তারপর আর কী করা যায় সেটা ঠিক করা, কারণ সে বেশ বুঝতে পারছিল যে বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাজার ভাবনা-চিন্তা করলেও কোনো তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্তে সে পৌঁছুতে পারবে না। তার মনে পড়ল যে অনেক সময় বিছানায় শোয়া অবস্থায় সে শরীরের নানা স্থানে বহু ছোটখাটো ব্যথা-বেদনা অনুভব করেছে, সম্ভবত বেকায়দায় শোয়ার জন্য, তারপর বিছানা ছেড়ে ওঠার পর দেখা গেছে যে সেসব ব্যথা-বেদনা সবই কাল্পনিক। গভীর প্রত্যাশা নিয়ে সে ভাবল যে আজকের সকালের এই দুঃস্বপ্ন-বিভ্রান্তিও আস্তে আস্তে কেটে যাবে। তার কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন আর কিছু নয়, একটা কঠিন ঠাণ্ডার আক্রমণের পূর্বাভাস মাত্র, তার মতো ভ্রাম্যমাণ বাণিজ্যিক কর্মচারীদের নিত্যদিনের অসুখ, এ বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না।

লেপটা সে খুব সহজে সরিয়ে দিতে পারল; নিজেকে একটু ফোলাতেই সেটা আপনা থেকে পিছলে পড়ে গেল। কিন্তু এর পরবর্তী কাজটা বেশ কঠিন হল, বিশেষ করে তার অস্বাভাবিক প্রশস্ততার কারণে। নিজেকে উঁচু করে তুলে ধরার জন্য তার দরকার ছিল হাত আর বাহুর; সে জায়গায় তার আছে শুধু অজস্র ছোট ছোট পা, যেগুলো একটুও স্থির না-থেকে সারাক্ষণ শুধু এদিক-ওদিক নড়ছে আর যার নড়াচড়া সে কিছুমাত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সে একটা পা বাঁকাতে চেষ্টা করল, কিন্তু ওটা সঙ্গে সঙ্গে আবার সোজা হয়ে গেল। একটা পা যখন সে শেষপর্যন্ত বাঁকাল তখন দেখা গেল যে অন্য পাগুলো ভয়ঙ্কর বিরক্ত ও অস্থির হয়ে পাগলের মতো নড়ছে। গ্রেগর আপন মনে বলল, কিন্তু এই রকম অলসভাবে বিছানায় শুয়ে থাকলেই-বা কী লাভ হবে?

তার মনে হল প্রথমে শরীরের নিচের অংশটার সাহায্যে সে বোধ হয় বিছানা থেকে নামতে পারবে, কিন্তু এই নিচের অংশটা সে এখনও দেখেনি, এ সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার ধারণাই তার হল না, আর ওই অংশ নাড়ানও, দেখা গেল, দুঃসাধ্য। খুব আস্তে আস্তে সেটা নড়ল, তারপর বিরক্তিতে প্রায় ক্ষেপে গিয়ে সে যখন শেষপর্যন্ত নিজের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে বেপরোয়াভাবে একটা ধাক্কা দিল, তখন দেখা গেল যে সে দিকের হিসেবে ভুল করেছে, খাটের পায়ের দিকে গিয়ে তার দেহ ধাক্কা খেয়েছে, আর তক্ষুনি একটা প্রচণ্ড জ্বালাময় ব্যথা তাকে জানিয়ে দিল যে এই মুহূর্তে সম্ভবত তার দেহের নিম্নাংশই সবচাইতে বেশি স্পর্শকাতর।

কাজেই সে তার শরীরের ঊর্ধ্বাংশ প্রথমে বাইরে নামিয়ে আনতে সচেষ্ট হল। খুব সতর্কতার সঙ্গে সে নিজের মাথা খাটের কিনারার দিকে নিয়ে গেল। এটা বেশ সহজেই করা গেল এবং তার দেহের প্রশস্ততা ও ঘনত্ব সত্ত্বেও অবশেষে সেটা তার মাথার গতিধারা অনুসরণ করতে সক্ষম হল। তবু, যখন সে তার মাথা শেষপর্যন্ত খাটের কিনারার ওপাশে নিয়ে যেতে সক্ষম হল, তখন সে আর অগ্রসর হতে সাহস করল না, কারণ এইভাবে যদি সে নিজেকে নিচে পড়তে দেয় তাহলে কোনো অলৌকিক কাণ্ড ছাড়া নিজের মাথাকে সে আঘাতের হাত থেকে কিছুতেই বাঁচাতে পারবে না। আর, যে করেই হোক, এখন তার সংজ্ঞা হারান চলবে না, ঠিক এই মুহূর্তে। তার চাইতে সে বরং বিছানাতেই শুয়ে থাকবে।

কিন্তু আরেকবার সেই একই রকম চেষ্টার পুনরাবৃত্তির পর সে যখন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে পূর্বতন অবস্থায় শুয়ে পড়ল আর তার পাগুলোকে, সম্ভব হলে আগের চাইতেও বেশি অস্থির হয়ে, পরস্পরের সঙ্গে জড়াজড়ি করে নড়তে দেখল, এবং ওই স্বতঃস্ফুর্ত অসম্বন্ধ বিভ্রান্তির মধ্যে শৃঙ্খলা আনবার কোনো উপায়ই সে খুঁজে পেল না, তখন সে আপন মনে আবার বলল যে বিছানায় শুয়ে থাকা অসম্ভব। এখন বিছানা থেকে উঠে পড়তে পারার ক্ষীণতম সম্ভাবনার জন্য সর্বস্ব পণ করে ঝুঁকি নেয়াই হবে তার পক্ষে সবচাইতে বেশি বুদ্ধিমানের কাজ। একইসঙ্গে সে ইত্যবসরে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে ভুলল না যে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা, যতটা সম্ভব ঠাণ্ডা মাথায়, ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্তের চাইতে বহুগুণ ভালো। এইরকম মুহূর্তে সে যথাসম্ভব তীক্ষ্ণ্ণ চোখে জানালার দিকে তাকাল, কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত, ভোরের কুয়াশার একটা সম্ভাবনা তখন সরু রাস্তার ওপাশ পর্যন্ত ঝাঁপসা করে তুলেছে, ফলে ওই দৃশ্য তার জন্য কোনো উৎসাহ বা সান্ত্বনা আনয়ন করল না। এলার্ম ঘড়িটা আবার বেজে উঠতেই সে মনে মনে বলল, সাতটা হয়ে গেল এর মধ্যে, সকাল সাতটা, অথচ এখনও এত ঘন কুয়াশা। সামান্য কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থাকল সে, শ্বাস-প্রশ্বাস নিল হাল্কাভাবে, যেন এইরকম পরিপূর্ণ প্রশান্তির ফলে, সে আশা করছে, সবকিছু আবার বাস্তব ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে।

কিন্তু তখনই সে আবার মনে মনে বলল, সোয়া সাতটা বাজবার আগে আমাকে যে করে তোক পুরোপুরি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তেই হবে। এর মধ্যে আপিস থেকে কেউ-না-কেউ আমার খোঁজ করতে এসে পড়বে, কারণ সাতটার আগেই তো আপিস খুলে যায়। এবার সে তার সারাশরীর একই তালে একটু করে দোলাতে শুরু করল, বাইরে পরিকল্পনা ছিল এইভাবে দুলতে দুলতে সে একবার বিছানার বাইরে চলে আসতে পারবে। ওইভাবে যদি সে নিজেকে তুলে আনতে পারে তাহলে ঠিক পড়ার মুহূর্তে সে মাথাটাকে সম্পূর্ণ একপাশে বাকিয়ে জখমের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে। পিঠটা বেশ শক্তই মনে হচ্ছে, কার্পেটের উপর পড়লে তেমন ক্ষতি হবে না। তার সবচাইতে বেশি দুশ্চিন্তা হল এই ভেবে যে পড়ার সময় ধপাস করে যে জোর একটা শব্দ হবে সেটা সে কিছুতেই রোধ করতে পারবে না, এবং সেটা শুনে দরজার ওপাশের সবাই আতঙ্কিত না হলেও সম্ভবত খুবই চিন্তিত হয়ে পড়বে। কিন্তু, তবু, ওই ঝুঁকি তাকে নিতে হবে।

যখন সে খাট থেকে প্রায় অর্ধেক বার হয়ে এসেছে—এই নতুন পদ্ধতিটা বিশেষ একটা প্রয়াসের চাইতে তার কাছে অনেকটা খেলার মতোই বেশি মনে হল, কারণ এখন শুধু দুলতে দুলতে নিজের দেহটা একটু একটু করে সরিয়ে নিয়ে আসা—তখন তার হঠাৎ মনে পড়ল সে যদি একটু সাহায্য পেত তাহলে ব্যাপারটা কত সহজ হয়ে যেত। দুজন শক্তিশালী মানুষ—বাবা আর কাজের মেয়েটির কথা মনে পড়ল তার—থাকলেই যথেষ্ট হত। তার পিঠের নিচ দিয়ে ওদের বাহু ঢুকিয়ে তাকে খাট থেকে তুলে নিচে নামিয়ে দিলেই হবে, তারপর ওরা একটু ধৈর্য ধরে থাকলে সে নিজেই মেঝের উপর তার শরীরটাকে উল্টে নিতে পারবে, তার আশা আছে যে ততক্ষণে ওর পাগুলো নিজেদের স্বাভাবিক। কর্মক্ষমতা ফিরে পাবে। তাহলে, তালাবন্ধ দরজাকে উপেক্ষা করে ওর কি সাহায্যের জন্য চেঁচিয়ে ওঠা উচিত? নিজের দুর্দশা সত্ত্বেও এ-কথা ভেবে সে হাসি চাপতে পারল না।

এখন ও এতখানি এগিয়ে গেছে যে দেহের ভারসাম্য আর প্রায় রাখতে পারছিল, সে সজোরে নিজেকে একটা দোলা দিল, শিগগিরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য তার স্নায়ুকে শক্ত করে নিতে হবে, কারণ আর পাঁচ মিনিট পরেই সোয়া সাতটা বেজে যাবে—আর ঠিক তক্ষুনি সামনের দরজায় ঘণ্টি বেজে উঠল। আপন মনে সে বলল, ওই যে আপিস থেকে লোক এসেছে; তার শরীর শক্ত টানটান হল, শুধু তার ছোট ছোট পাগুলো আগের চাইতেও দ্রুতবেগে নড়তে লাগল। একটুখানি সময়ের জন্য পূর্ণ নীরবতা বিরাজ করল। একটা যুক্তিহীন আশায় বুক বেঁধে গ্রেগর মনে মনে বলল, ওরা দরজা খুলবে না। কিন্তু না, কাজের মেয়েটি তার স্বভাবসিদ্ধ ভারী পা ফেলে বাইরের দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে সেটা খুলে দিল। দর্শনার্থীর প্রথম সুপ্রভাত কথাটি শোনামাত্র গ্রেগর বুঝতে পারল কে এসেছে—মুখ্য কেরানি স্বয়ং। কী ভাগ্য! সামান্যতম বিচ্যুতি যেখানে গভীরতম সন্দেহের জন্ম দেয়। সেইরকম একটি ফার্মে তাকে কাজ করতে হচ্ছে! সকল কর্মচারীই কি হাড় বজ্জাত? তাদের মধ্যে কি এমন একজনও বিশ্বস্ত নিবেদিতচিত্ত মানুষ থাকতে পারে না যে ফার্মের ঘণ্টাখানেক সময় অপচয় করার জন্য বিবেকের দংশনে প্রায় পাগল। হয়ে যেতে পারে, যে সত্যি সত্যি তার শয্যা ত্যাগ করতে অক্ষম? যদি খোঁজ নেয়ার দরকারই হয় তাহলে কি একজন শিক্ষানবিশকে পাঠালেই চলত না? স্বয়ং মুখ্য কেরানিকেই আসতে হবে, যেন সমস্ত পরিবারের সামনে, একটি নিরপরাধ পরিবারের সামনে, এই ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়া যায় যে এই রকম সন্দেহজনক পরিস্থিতিতে তার চাইতে কম অভিজ্ঞ কাউকে খোঁজ নেবার জন্য পাঠানো যায় না? এবং অন্য কোনো সক্রিয় ইচ্ছার চাইতে এইসব ভাবনাপ্রসূত। উত্তেজনার ফলেই সে তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে বিছানার বাইরে ঠেলে ফেলতে সক্ষম হল। ধপ করে একটা শব্দ হল, বেশ জোরেই, কিন্তু চুরমার করার মতো প্রচণ্ড জোরে নয়। কার্পেটটা তার পতনের বেগ কমিয়ে দিল, আর তার পিঠও যে যতটা ভেবেছিল ততটা টানটান মনে হল না। ফলে একটা স্থূল ধপাস শব্দ হল শুধু, তেমন চমকাবার মতো কিছু নয়। কেবল সে যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে তার মাথা উঁচু করে ধরতে পারেনি, তাই সেখানে একটু চোট পেয়েছে। সে মাথাটা ঘুরিয়ে ব্যথা আর বিরক্তিতে কার্পেটের উপর ঘষল সেটা।

মুখ্য কেরানি বাঁ পাশের ঘর থেকে বলে উঠল, ওখানে কী একটা পড়ার শব্দ হল। গ্রেগর মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করল আজ তার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা যেন কোনো-একদিন মুখ্য কেরানির ভাগ্যে ঘটে। এমন-যে ঘটতে পারে তা কারো পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই অনুমানের কড়া প্রতিবাদরূপেই যেন পাশের ঘর থেকে মুখ্য কেরানির দৃঢ় পদক্ষেপের শব্দ শোনা গেল, তার পেটেন্ট চামড়ার বুটজুতোর মচমচ আওয়াজ উঠল। ডান পাশের ঘরের দিক থেকে তার। বোন তাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য ফিসফিস করে বলল, গ্রেগর, মুখ্য কেরানি এসেছেন। গ্রেগর আপনমনে অস্ফুট কণ্ঠে বলল, জানি; কিন্তু সে গলা উঁচু করতে সাহস পেল না আর তাই তার বোন ওর কথা শুনল না।

এবার তার বাবা বাঁ পাশের ঘর থেকে বললেন, গ্রেগর, মুখ্য কেরানি সাহেব এসেছেন, তিনি জানতে চান তুমি ভোরের ট্রেনটা ধরনি কেন? আমরা তাকে কী। বলব জানি না। তাছাড়া তিনি মুখোমুখি নিজে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। দয়া করে দরজা খোল। তোমার ঘরের অগোছালো অবস্থার জন্য তিনি কিছু মনে করবেন না। ইতোমধ্যে মুখ্য কেরানি অমায়িক কণ্ঠে সম্ভাষণ জানালেন, সুপ্রভাত, মি. সামসা। বাবা তখনও দরজার ওপাশ থেকে তাকে লক্ষ করে কথা বলছেন, আর একইসঙ্গে তার মা মুখ্য কেরানিকে উদ্দেশ করে বললেন, ওর শরীর ভালো নেই। বিশ্বাস করুন, ও অসুস্থ। তা না হলে ও কী জন্য ট্রেন মিস করবে? কাজ ছাড়া ওর মাথায় আর কোনো ভাবনা নেই। সন্ধ্যায় কোথাও বেড়াতে বেরোয় না; মাঝে মাঝে আমি তো চটে যাই। গত আট দিনের মধ্যে ও একদিন বিকেলেও বাইরে যায়নি। চুপচাপ টেবিলে বসে সে হয় খবরের কাগজ পড়ে, নয়তো রেলওয়ে টাইমটেবিলের পাতা উল্টেপাল্টে দেখে। একমাত্র টুকটাক হাতের কাজ করে সে যা আনন্দ পায়। এই-তো, দুতিন দিন ধরে বিকেলে কাজ করে সে ছোট্ট একটা ছবির ফ্রেম তৈরি করেছে, কী চমৎকার যে হয়েছে আপনি দেখলে বুঝবেন। এক্ষুনি গ্রেগর দরজা খুললেই দেখতে পারেন; ওর ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছে। আপনি আসায় আমি সত্যি খুশি হয়েছি, স্যার। আমাদের কথায় ও কিছুতেই দরজা খুলত না, ভীষণ একরোখা ও। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে ও অসুস্থ, কিন্তু আজ সকালে ও সে-কথা মানতেই চাইছে না।  গ্রেগর ধীরে ধীরে খুব সাবধানে বলল, আমি এক্ষুনি আসছি। পাছে ওদের কথাবার্তা শুনতে না-পায় সেই ভয়ে ও দরজার কাছ থেকে এক ইঞ্চি নড়ল না। মুখ্য কেরানি বললেন, আমি-তো, ম্যাডাম, আর অন্য কোনো কারণের কথা ভাবতে পারছি না। আশা করি সিরিয়াস কিছু নয়। অবশ্য, অন্য দিক থেকে, আমাকে এ-কথাও বলতে হবে যে আমাদের ব্যবসায়ীদের, সৌভাগ্যবশতই বলুন কিংবা দুর্ভাগ্যবশতই বলুন, ছোটখাটো অসুস্থতা উপেক্ষা করতে হয়, কারণ ব্যবসা-সংক্রান্ত কাজকর্ম তো আর ফেলে রাখা যায় না। গ্রেগরের বাবা অধৈর্য হয়ে দরজায় আবার ধাক্কা দিয়ে বললেন, তো, মুখ্য কেরানি সাহেব কি এখন ঢুকতে পারবেন? গ্রেগর বলল, না। এই অস্বীকৃতির কথা শুনে বাঁ-দিকের ঘরে একটা বেদনাদায়ক নীরবতা নেমে এল আর ডান দিকের ঘরে তার বোন ডুকরে কাঁদতে শুরু করল।

তার বোন অন্যদের সঙ্গে যোগ দেয়নি কেন? হয়ত এইমাত্র সে বিছানা ছেড়ে উঠেছে, এখনও হয়ত কাপড়জামা পরতেই আরম্ভ করেনি। তো, সে কাঁদছে কেন? সে যে উঠে মুখ্য কেরানিকে ঘরে ঢুকতে দিতে পারছে না সেজন্য, নাকি তার চাকরি খোয়াবার সম্ভাবনা আছে সেজন্য? নাকি মুখ্য কেরানি আবার সেই পুরনো ঋণের জন্য তার মা-বাবাকে অস্থির করে তুলবেন সেজন্য? এই মুহূর্তে ওসব জিনিস নিয়ে নিশ্চয়ই মাথা ঘামাবার দরকার নেই। গ্রেগর এখনও বাড়িতে আছে, আর তার পরিবারকে ত্যাগ করার কথা সে একটুও ভাবছে না। সত্য বটে, এই মুহূর্তে, সে কার্পেটের উপর শুয়ে আছে এবং তার বর্তমান অবস্থার কথা জানা থাকলে কেউ নিশ্চয়ই আশা করতে পারত না যে গ্রেগর এখন দরজা খুলে মুখ্য কেরানিকে ঘরে ঢুকতে দেবে। কিন্তু এই রকম সামান্য অসৌজন্যের জন্য, যার কারণ কি-না, পরে কোনো-একসময় পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়া যাবে, গ্রেগরকে নিশ্চয়ই তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করা চলে না? গ্রেগরের মনে হল এখন কান্নাকাটি আর অনুরোধ-উপরোধ না করে তাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিলেই সেটা সঙ্গত হত। অবশ্য নিজেদের অনিশ্চয়তা তাদেরকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল এবং সেজন্য তাদের আচরণ অবশ্য ক্ষমার্হ।

এবার মুখ্য কেরানি আরেকটু গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, মি. সামসা, আপনার কী হয়েছে? ঘরের মধ্যে আছেন আপনি, দরজা বন্ধ করে রেখেছেন, শুধু হাঁ কিংবা না বলে প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন, মা-বাবাকে অনর্থক কষ্ট দিচ্ছেন। আর, এটা অবশ্য এমনি প্রসঙ্গক্রমে বলছি, অবিশ্বাস্যভাবে আপনি আপনার ব্যবসায়িক দায়িত্ব অবহেলা করছেন। আমি আপনার মা-বাবার নামে, আপনার কর্মাধ্যক্ষের নামে, জিজ্ঞাসা করছি, আমি মিনতি করছি, আপনি এক্ষুনি আপনার আচরণের। একটা পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিন। আপনি আমাকে অবাক করছেন, সত্যি অবাক করছেন। আমি আপনাকে ভেবেছিলাম একজন চুপচাপ নির্ভরযোগ্য মানুষ, আর। এখন আপনি হুট করে এই ধরনের একটা বিশ্রী আচরণ করতে শুরু করে দিলেন? আপনার হাওয়া হয়ে-যাওয়ার একটা সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে অবশ্য কর্মাধ্যক্ষ আজ সকালে আমাকে একটা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন—সম্প্রতি ক্যাশ পেমেন্টের জন্য আপনার জিম্মায় যে টাকা দেয়া হয়েছে তার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন তিনি—কিন্তু আমি এরকম জোর দিয়ে বলেছি যে এটা হতেই পারে না। কিন্তু এখন, আপনার অবিশ্বাস্য গোয়ার্তুমি প্রত্যক্ষ করার পর, আপনার। পক্ষাবলম্বনের আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। আর ফার্মে আপনার অবস্থানও তেমন সুদৃঢ় নয়। আমি গোপনে আপনাকে এ-কথা বলার ইচ্ছা নিয়ে এখানে এসেছিলাম; কিন্তু আপনি যখন এইভাবে অনর্থক আমার সময় নষ্ট করছেন তখন আপনার মা-বাবাও সব কথা শুনুক। কিছুদিন যাবৎ আপনার কাজকর্ম খুবই অসন্তোষজনক হচ্ছিল। স্বীকার করি যে বর্তমান মৌসুম খুব একটা চুটিয়ে ব্যবসা করার সময় নয়, তবু কোনো ব্যবসাই করা যাবে না তা তো হতে পারে না। তা হতে পারে না, মি. সামসা। এবার উত্তেজনায় আত্মবিস্মৃত হয়ে, সব। কিছু ভুলে গিয়ে, গ্রেগর বলে উঠল, কিন্তু স্যার, আমি তো এক্ষুনি দরজা খুলে দিচ্ছি। সামান্য একটু অসুস্থতা, হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেল, তাই আমি বিছানা থেকে উঠতে পারিনি। এখনও আমি বিছানায় শুয়ে আছি। কিন্তু এখন ভালো লাগছে শরীর। উঠে পড়ছি এক্ষুনি। আর দুএক মিনিট সময় দিন আমাকে! নাহ্, যতটা ভালো ভেবেছিলাম ততটা ভালো নেই আমি। কিন্তু আসলে ঠিকই আছি। কিন্তু ওই রকম সামান্য একটা জিনিস কীভাবে একজনকে এমন কাবু করে ফেলতে পারে! কাল রাতেই তো আমি সম্পূর্ণ ঠিক ছিলাম, আমার মা-বাবা আপনাকে সে-কথা বলতে পারবেন, অবশ্য কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে তার একটু আভাস পেয়েছিলাম ঠিকই। তার কিছু লক্ষণ নিশ্চয়ই আমার আচরণে ফুটে উঠেছিল। এ-কথা আমি আপিসে রিপোর্ট করিনি কেন? কারণ মানুষ সবসময়ই ভাবে যে বাড়িতে বসে না-থেকেও অসুস্থতা সারিয়ে তোলা যায়। স্যার, আমার বাবা-মাকে রেহাই দিন। আমাকে যে-কথা বলে আপনি তিরস্কার করছেন তার কোনো ভিত্তি নেই। আমাকে কেউ এর বিন্দুবিসর্গও আগে বলেনি। সম্ভবত আমি যে সর্বশেষ অর্ডারগুলো জোগাড় করেছি তাও আপনি দেখেননি। যাই হোক, আমি এখনও আটটার ট্রেন ধরতে পারব। এই কয়েক ঘণ্টার বিশ্রামে আমার উপকারই হল। আপনাকে, স্যার, আমি আর আটকে রাখতে চাই না। আমি শিগগিরই কাজে লেগে পড়ব, আপনি দয়া করে সেকথা কর্মাধ্যক্ষের কাছে। গিয়ে বলুন, এবং আমার ক্ষমা প্রার্থনার কথা তাকে জানান।

হুড়মুড় করে গ্রেগর কথাগুলো বলল, কী যে বলছে তার সঠিক জ্ঞানও নেই, আর বলতে বলতে সে বেশ সহজে সিন্দুকটার কাছে পৌঁছে গেল। শুয়ে শুয়ে যে অভ্যাস করেছিল, বোধহয় সেজন্যই এটা সম্ভব হল। এখন সে তার সাহায্যে নিজেকে উপরে তুলতে চেষ্টা করল। সে সত্যি সত্যি দরজা খুলে দিতে চাইল, নিজেকে দেখাতে ও মুখ্য কেরানির সঙ্গে কথা বলতে চাইল। তাদের ওই রকম পীড়াপীড়ির পর তাকে দেখে ওদের কী প্রতিক্রিয়া হয় সেটা জানতে চাইল ও। তারা যদি ভয়ে। শিউরে ওঠে তাহলে তার আর দায়দায়িত্ব থাকবে না, তখন সে চুপচাপ পড়ে থাকতে পারবে। কিন্তু তারা যদি শান্তভাবে ব্যাপারটা মেনে নেয় তাহলে তার অস্থির হবার কোনোই কারণ থাকবে না। তখন তাড়াহুড়া করলে সে সত্যি সত্যি স্টেশনে গিয়ে আটটার ট্রেনটা ধরতে পারবে। প্রথমদিকে সে কয়েকবার সিন্দুকের মসৃণ গা বেয়ে পিছলে পড়ে গেল, কিন্তু অবশেষে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সোজা দাঁড়াতে সক্ষম হল। শরীরের নিমাংশের যন্ত্রণাকে সে আর আমল দিল না, যদিও তা খুব জ্বালা করছিল। এরপর সে নিজেকে নিকটবর্তী একটা চেয়ারের পেছন দিকে নামিয়ে এনে তার ছোট ছোট পাগুলো দিয়ে তার কিনারা আঁকড়ে ধরল। এর ফলে সে আবার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল, এবং নিজে কথা বলা বন্ধ করল, কারণ এখন সে মুখ্য কেরানির কথা শুনতে পাচ্ছে।

মুখ্য কেরানি বলছিলেন, আপনারা ওর কথা কিছু বুঝতে পেরেছেন? ও নিশ্চয়ই আমাদের সবাইকে বোকা বানাবার চেষ্টা করছে না? তার মা কাঁদতে-কাঁদতে বললেন, উহ, ভগবান, ও হয়ত ভীষণ অসুস্থ আর আমরা ওকে এইভাবে কষ্ট দিচ্ছি! গ্রেটা! গ্রেটা! ওপাশ থেকে তার বোন জবাব দিল, কী, মা? গ্রেগরের ঘরের দুদিক থেকে তারা চিৎকার করে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছে। তোমাকে এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। গ্রেগরের শরীর খারাপ। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডেকে আনে। ও কীভাবে কথা বলছিল শুনেছ? মায়ের তীক্ষ্ণ্ণ স্বরের পাশে, চোখে পড়ার মতো নিচু গলায়, মুখ্য কেরানি বললেন, ওটা কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর নয়। আর বাবা হাততালি দিয়ে, হলঘরের মধ্য দিয়ে রান্নাঘরের উদ্দেশে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন, আনা! আনা! এক্ষুনি একটা তালা খোলার লোক নিয়ে এস! তরুণী দুটি স্কার্টের হুশহুশ শব্দ তুলে ইতোমধ্যে হলঘরের ভেতর দিয়ে ছুটতে শুরু করেছে—তার বোন এত তাড়াতাড়ি পোশাক পরতে পারল কীভাবে?—সামনের দরজা সশব্দে খুলে ওরা বেরিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ করার কোনো শব্দ হল না? স্পষ্টতই, কোনো বাড়িতে বিরাট একটা দুর্যোগ ঘটার পর যেমন হয় তেমনিভাবে ওরা দরজা খোলা রেখে চলে গেছে।

কিন্তু গ্রেগর এখন অনেক বেশি সুস্থির। তার কথা, আপাতদৃষ্টিতে, এখনও বোঝা যাচ্ছে না, যদিও তার নিজের কাছে তা বেশ স্পষ্ট মনে হচ্ছে, এমনকি আগের চাইতেও বেশি স্পষ্ট, সম্ভবত ওই ধ্বনির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার জন্যই। যাই হোক, ওরা এখন বিশ্বাস করেছে যে তার একটা কিছু বিপর্যয় ঘটেছে এবং ওরা তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। সেই উদ্দেশ্যে ওরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার সুস্পষ্ট নিশ্চয়তা তাকে আশ্বস্ত করল। তার মনে হল আবার তাকে মানুষের বৃত্তের মধ্যে টেনে নেয়া হয়েছে। ডাক্তার আর তালাঅলা উভয়েই বিরাট ও তাৎপর্যপূর্ণ কিছু করতে পারবে বলে তার আশা হল, যদিও ওই দুজনের মধ্যে যথার্থ পার্থক্য যে কী তা সে বুঝে উঠতে পারছিল না। অত্যাসন্ন চূড়ান্ত সংলাপের জন্য তার কণ্ঠস্বরকে যতটা সম্ভব স্পষ্ট করার লক্ষ্যে সে একটু গলা-ঝেড়ে নিল, অবশ্য যথাসম্ভব আস্তে, কারণ, সে যা বুঝতে পারছে, তাতে তার ওই গলা ঝাড়ার শব্দও কোনো মানুষের গলা-ঝাড়ার মতো শোনাল না। ইত্যবসরে পাশের ঘরে বিরাজ করতে শুরু করেছিল সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা। হয়ত তার মা-বাবা মুখ্য কেরানিকে নিয়ে টেবিলে বসে আছেন, ফিসফিস করে কথা বলছেন, হয়ত তারা সবাই দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, কান পেতে শুনছেন।

গ্রেগর ধীরে ধীরে চেয়ারটা দরজার কাছে ঠেলে নিয়ে গেল, তারপর সেটা ছেড়ে দরজাটা ধরল, যেন পড়ে না যায়—তার ছোট ছোট পায়ের তলা কেমন আঠাল হয়ে গেছে—তারপর এতখানি পরিশ্রম করার পর দরজার গায়ে হেলান দিয়ে সে এক মুহূর্ত বিশ্রাম করল, এবং তারপর নিজের মুখ দিয়ে দরজার চাবিটা ঘোরাবার কাজে মনোনিবেশ করল। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত মনে হল তার কোনো দাঁত নেই—তাহলে সে কী করে চাবিটা শক্ত করে ধরবে?—পক্ষান্তরে তার চোয়াল খুবই শক্তিশালী; তার সাহায্যে সে চাবিটা নাড়াতে সক্ষম হল, অবশ্য সেটা করতে গিয়ে সে তার চোয়ালকে কোনো এক জায়গায় নিঃসন্দেহে জখম করল, বাদামি একটা রস সেখান থেকে বেরিয়ে চাবির উপর দিয়ে গড়িয়ে টিপটিপ করে মেঝেতে পড়ল, কিন্তু সেদিকে কোনো নজর দিল না সে। মুখ্য কেরানি পাশের ঘর থেকে বললেন, ওই শুনুন, ও চাবি ঘোরাচ্ছে। কথাগুলো গ্রেগরকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করল। কিন্তু ওদের সবারই উচিত ছিল তাকে উৎসাহ দেয়া, তার বাবা আর মায়েরও। ওদের বলতে হত, চেষ্টা করতে থাক, গ্রেগর। চেষ্টা করতে থাক, চাবিটা শক্ত করে আঁকড়ে থাক। ওরা তার সকল প্রয়াস মন দিয়ে অনুসরণ করছে এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে সে তার সর্বশক্তি দিয়ে মরিয়া হয়ে তার চোয়ালের সাহায্যে চাবিটা চেপে ধরল। চাবির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সে তালার চারদিকে বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগল, এখন শুধু মুখ দিয়ে ধরে আছে, প্রয়োজন অনুযায়ী কখনও চাবিটা ঠেলছে, কখনও শরীরের সমস্ত ভার দিয়ে নিচে টেনে নামাচ্ছে। তালা খুলে যাবার অপেক্ষাকৃত বড় আওয়াজটা পাবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেগর আক্ষরিকভাবে প্রবল উত্তেজনা অনুভব করল। স্বস্তির একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সে মনে মনে বলল, তো, তালাঅলা আর আনার দরকার হল না। তারপর দরজাটা হাট করে খুলে দেবার উদ্দেশ্যে সে তার হাতলের উপর নিজের মাথা স্থাপন করল।

দরজাটা তাকে ভেতর দিকে টেনে খুলতে হল তাই সেটা সম্পূর্ণ খোলার পর সে দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেল। জোড়া-দরজার কাছের দিকটার পাশ দিয়ে তাকে ধীরে ধীরে, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ঘুরে, সামনে আসতে হল, যেন চৌকাঠে ধাক্কা লেগে চিৎ হয়ে পড়ে না যায়। এই কঠিন কাজটা করতে সে এত ব্যস্ত থাকল যে আর কোনো দিকে নজর দেবার সময় পেল না। হঠাৎ সে মুখ্য কেরানিকে উচ্চকণ্ঠে একটা ওহ! ধ্বনি করে উঠতে শুনল—মনে হল যেন একটা দমকা হাওয়ার শব্দ হল। এবার সে তাকে দেখতে পেল, দরজার সবচাইতে কাছে ছিলেন তিনি, হাঁ-হয়ে যাওয়া, মুখের উপর তিনি একটা হাত চাপা দিয়েছেন, তারপর আস্তে আস্তে পেছনে সরে যাচ্ছেন যেন কোনো অদৃশ্য চাপ তাঁকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। তার মা-মুখ্য কেরানির উপস্থিতি সত্ত্বেও তার চুল তখনও বাঁধা হয়নি, চারদিকে এলোমেলো উঁচু হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে—প্রথমে নিজের মুখে। হাত-চাপা দিয়ে ওর বাবার দিকে তাকালেন, তারপর গ্রেগরের দিকে দুপা এগিয়েই মেঝের উপর পড়ে গেলেন। বুকের উপর ঝুলেপড়া তার মুখ এখন প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। বাবা একটা ভয়ঙ্কর মুখভঙ্গি করে নিজের হাত মুষ্ঠিবদ্ধ। করলেন, যেন গ্রেগরকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের মধ্যে পাঠিয়ে দেবেন, তারপর তিনি। বিমূঢ়ভাবে বসবার ঘরের দিকে তাকিয়ে দু-হাত দিয়ে চোখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর বিশাল বক্ষ ফুলে ফুলে উঠল।

গ্রেগর তখন আর বসবার ঘরে গেল না। দরজার শক্ত করে বন্ধ-করা অংশটার ভেতর দিকে হেলান দিয়ে দাঁড়াল সে। তার দেহের শুধু অর্ধেকটা এখন দেখা যাচ্ছে। দরজার ওপর দিয়ে মাথাটা একপাশে নিচু করে সে অন্যদের দেখছে। ইতোমধ্যে আলো আরও জোরাল হয়েছে। রাস্তার ওপারে, ঠিক উল্টো দিকে, দীর্ঘ নিরানন্দ ধূসর অফুরন্ত দালানটার একটা অংশ এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওটা একটা হাসপাতাল—নিয়মিত ছেদ দিয়ে সারি সারি জানালা বসানো রয়েছে সেখানে। তখনও বৃষ্টি পড়ছে, বড় বড় ফোঁটায়, আলাদা আলাদা করে লক্ষ করা যায়, আক্ষরিকভাবে একটা একটা করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে। টেবিলের উপর নাশতার বিপুল আয়োজন করা রয়েছে। গ্রেগরের বাবার জন্য সকালের নাশতাই হল দিনের প্রধান আহারপর্ব। অনেকগুলো খবরের কাগজ হাতে নিয়ে তিনি নাশতার টেবিলে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেন। গ্রেগরের ঠিক উল্টো দিকের দেয়ালে সামরিক পোশাক পরিহিত তার একটা ফটো ঝুলছে, লেফটেনান্টের পোশাক, তরবারির উপর হাত রাখা, মুখে নিরুদ্বিগ্ন হাসি, যেন তার ইউনিফর্ম আর সামরিক ভাবভঙ্গিকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য সে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। হলঘরের দিকের দরজাটা খোলা। সামনে প্রবেশ-পথের দরজাও খোলা, তার ভেতর দিয়ে বাইরে নিচে রাস্তায় নেমে-যাবার সিঁড়ির প্রথম ধাপগুলো চোখে পড়ছে।

গ্রেগর বুঝতে পারল যে একমাত্র তারই মানসিক স্থৈর্য অক্ষুণ্ণ আছে। সেটা ভালোভাবে জেনেই সে বলল, আমি এক্ষুনি কাপড়জামা পরে স্যাম্পলগুলো প্যাক করে, রওনা হব। আপনারা শুধু আমাকে যেতে দেবেন তো? দেখুন, স্যার, আমি মোটেই একগুঁয়ে নই, আমি কাজ করতে ইচ্ছুক, ঘোরাঘুরির জীবন বেশ কঠিন, কিন্তু সেটা ছাড়া আমি বাঁচব না। আপনি কোথায় যাচ্ছেন, স্যার? অফিসে? হ্যা? আপনি আমার ঘটনাটার সত্যি বর্ণনা দেবেন তো? কেউ সাময়িকভাবে অক্ষম হয়ে পড়তে পারে, কিন্তু তখনই তো তার পুরনো দিনের কর্তব্যপালনের কথা স্মরণ করা দরকার, এবং পরে, আবার সক্ষম হয়ে ওঠার পর সে-যে আরও মন দিয়ে আরও অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাজ করবে, সে-কথা মনে রাখা উচিত। বড়কর্তার প্রতি অনুগত থেকে দায়িত্বপালন করতে আমি বাধ্য, এ-কথা আপনি বেশ ভালো করে জানেন। আমাকে আমার মা-বাবা ও বোনের ভরণ-পোষণ করতে হবে। আমি মহা অসুবিধায় আছি, কিন্তু এটা আমি কাটিয়ে উঠব। পরিস্থিতি এমনিতেই কঠিন, একে আপনি আরও খারাপ করে তুলবেন না। ফার্মে আপনি আমার সপক্ষে কথা বলবেন। আমি জানি যে আমার মতো ভ্রাম্যমাণ কর্মচারীরা সেখানে জনপ্রিয় নয়। লোকে ভাবে যে তারা গাদাগাদা টাকা কামাই করে, আর ফুর্তি করে বেড়ায়। এ দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবার বিশেষ কোনো কারণ অবশ্য নেই। কিন্তু আপনি, স্যার, স্টাফের অন্যদের চাইতে ব্যাপকতর দৃষ্টিকোণ থেকে জিনিসটা দেখতে পারেন, হ্যাঁ, আপনাকে গোপনে বলছি যে স্বয়ং বড়কর্তার চাইতেও পূর্ণতর ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী আপনি। মালিক হবার কারণে বড়কর্তা সহজেই তার কর্মচারীদের কোনো একজনের বিরুদ্ধে ভ্রান্ত মতামত পোষণ করতে পারেন। আর আপনি তো ভালো করেই জানেন, বাইরে বাইরে ঘুরতে হয় বলে ভ্রাম্যমাণ কর্মচারীকে আপিসে প্রায় সারা বছর ধরে দেখাই যায় না; নানারকম গুজব, অসমর্থিত অভিযোগ আর দুর্ভাগ্যের সহজ শিকারে পরিণত হয় সে, যার প্রায় কিছুই সে জানতে পারে না; এবং তখন এর কুফল ভোগ করতে হয় তাকে, অথচ সমস্ত ব্যাপারটার; মূল ও প্রাথমিক কারণগুলোর হদিশ সে আর পায় না। স্যার, স্যার, আপনি-যে মনে করেন যে আমি ঠিক কথা বলছি অন্তত কিছু পরিমাণে, সেটা বোঝাবার জন্য একটা কিছু না-বলে চলে যাবেন না!

কিন্তু গ্রেগর মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে মুখ্য কেরানি পিছু হটে গিয়েছিলেন। আঁকুপাঁকু করা কাঁধের উপর দিয়ে তিনি বিস্ফারিত মুখে চোখ বড় বড় করে তাকে লক্ষ করলেন। যতক্ষণ গ্রেগর কথা বলছিল ততক্ষণ তিনি এক মুহূর্তের জন্যও এক জায়গায় স্থির হয়ে না-দাঁড়িয়ে, চুপি চুপি গ্রেগরের উপর থেকে চোখ না তুলে, ইঞ্চি ইঞ্চি করে, বাইরের দরজার দিকে সরে যেতে থাকেন, যেন এই ঘর ছেড়ে চলে যাবার কোনো একটা গোপন নির্দেশ পালন করছেন তিনি। ইতোমধ্যে তিনি হলকক্ষে পৌঁছে গেছেন। তারপর যে রকম দ্রুত আকস্মিকতার সঙ্গে তিনি বসবার ঘর থেকে তাঁর শেষ পদক্ষেপটি নিলেন তাতে মনে হতে পারত যে তাঁর পায়ের তলা বুঝি পুড়ে যাচ্ছে। হলকক্ষে পৌঁছে তিনি তাঁর সামনের সিঁড়ির দিকে নিজের ডান বাহু প্রসারিত করে দিলেন, যেন কোনো দৈবশক্তি তাঁকে মুক্তি দেবার জন্য সেখানে অপেক্ষা করছে।

গ্রেগর উপলব্ধি করল যে মুখ্য কেরানিকে তার মনের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কিছুতেই এখান থেকে চলে যেতে দেয়া যাবে না, তাহলে ফার্মে গ্রেগরের অবস্থান ভীষণ বিপদের সম্মুখীন হবে। তার বাবা-মা এ-কথা তেমনভাবে বুঝতে পারছেন না। তাঁদের ধারণা গ্রেগর ওই ফার্মে সারাজীবনের জন্য পাকাঁপাকিভাবে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। তাছাড়া নিজেদের তাৎক্ষণিক বহু ঝামেলা নিয়ে তাঁরা এত ব্যস্ত থাকতেন যে ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি দেবার মতো অবস্থা তাদের ছিলই না। কিন্তু গ্রেগরের সে ভবিষ্যদৃষ্টি ছিল। মুখ্য কেরানিকে আটকে রাখতেই হবে, তাকে শান্ত করে ব্যাপারটা ভালো করে বোঝাতে হবে, এবং শেষপর্যন্ত তাকে তার নিজের দলে আনতে হবে। গ্রেগর আর তার পরিবারের সমস্ত ভবিষ্যৎ এটার ওপর নির্ভর করছে। শুধু তার বোন যদি এখানে থাকত! গ্রেগর যখন চুপ করে চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে ছিল তখন তার বোন কাঁদতে আরম্ভ করে। আর মুখ্য কেরানি, মেয়েদের প্রতি সবসময় যার পক্ষপাতিত্বের কথা সর্বজনবিদিত, নিঃসন্দেহে তার বোনের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হত। তার বোন ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দিয়ে মুখ্য কেরানির সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাকে আতঙ্কমুক্ত করত। কিন্তু সে এখানে নেই, এখন গ্রেগরকেই পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে, এককভাবে এবং এখনও নড়েচড়ে বেড়াবার কতটুকু ক্ষমতা তার আছে সে সম্পর্কে অসচেতন থাকা সত্ত্বেও, এমনকি তার কথাবার্তা আগের মতো এখনও হয়ত, হয়ত কেন প্রায় নিশ্চিতভাবে বোধের অগম্য হবে এ-কথা স্মরণ না-করেই, সে দরজার পাল্লাটা ছেড়ে দিয়ে তার ফাঁক দিয়ে নিজেকে সামনে ঠেলে দিল, হাঁটতে শুরু করল মুখ্য কেরানির দিকে, যিনি ইতোমধ্যে সিঁড়ির রেলিংয়ের উপর দুহাত দিয়ে হাস্যকরভাবে ঝুলতে আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু, তক্ষুনি, যখন ভর দেবার জন্য সে কিছু একটা খুঁজছে, ঠিক সেই সময়, ছোট্ট একটা চিৎকার করে গ্রেগর মাটিতে তার পাগুলোর উপর পড়ে গেল। নিচে পড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু সে আজ সকালে এই প্রথমবারের মতো একটা শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের ভাব অনুভব করল; তার পায়ের নিচে মাটি মনে হল শক্ত; পাগুলো যে এখন তার সম্পূর্ণ অনুগত এই উপলব্ধি তাকে আনন্দিত করল। যেদিকে ইচ্ছা এখন তাকে সেই দিকে নিয়ে যেতে পর্যন্ত তার পাগুলো চেষ্টা করছে। তার মনে হল তার যাবতীয় কষ্টের বুঝি, শেষপর্যন্ত, উপশম হতে যাচ্ছে। কিন্তু সে ঠিক যে মুহূর্তে দেখল যে সে মেঝের উপর পড়ে গেছে, এগিয়ে যাবার অবরুদ্ধ উত্তেজনায় দুলছে একটু একটু করে, ঠিক তক্ষুনি, তার খুব কাছে, বস্তুতপক্ষে একেবারে সামনে দাঁড়ানো তার মা, যাকে দেখে এতক্ষণ মনে হচ্ছিল যে তিনি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছেন, মুহূর্তের মধ্যে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, এবং দুহাত বাড়িয়ে আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ঈশ্বরের দোহাই, বাঁচাও বাঁচাও! তারপর তিনি নিজের মাথা একটু নিচু করলেন, যেন গ্রেগরকে ভালো করে লক্ষ করতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে দুর্বোধ্যভাবে, তিনি পিছু হটে যেতে থাকলেন। পেছনে যে খাবার ভর্তি টেবিল আছে তার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে তিনি যেন বেখেয়ালে, ঝট করে টেবিলের উপর বসে পড়লেন। এবং যখন ঝাঁকুনি খেলেন, তাঁর পাশের বড় কফির পাত্রটা উল্টে গিয়ে মেঝেতে কার্পেটের উপর কফি পড়ে জায়গাটা ভিজিয়ে দিল, তখনও যেন তাঁর চেতনায় এসব কিছু ধরা পড়ল না।

গ্রেগর নিচু গলায় ডাকল, মা! মা! মায়ের মুখের পানে তাকাল সে। মুখ্য কেরানির কথা মুহূর্তের জন্য সে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিল। তার বদলে, কফির স্রোতধারা দেখার সঙ্গে সঙ্গে সে তার চোয়ালের ওঠানামা কিছুতেই বন্ধ করতে পারল না। এটা দেখে মা আবার চিৎকার করে উঠলেন, টেবিলের কাছ থেকে ছুটে পালাতে গিয়ে তিনি গ্রেগরের বাবার প্রসারিত বাহুর মধ্যে ধরা পড়লেন। ইতোমধ্যে বাবা তাকে ধরবার জন্য দ্রুত ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু গ্রেগরের তখন মা-বাবার কথা ভাববার সময় নেই; মুখ্য কেরানি ততক্ষণে সিঁড়িতে পৌঁছে গেছেন; সিঁড়ির রেলিং-এ চিবুক ঠেকিয়ে তিনি শেষবারের মতো পিছনে ফিরে সমস্ত দৃশ্যটা দেখে নিতে চাইলেন। তাঁর সামনে গিয়ে পড়ে তাঁকে আটকাবার উদ্দেশ্যে গ্রেগর একটা লাফ দিল; কিন্তু মুখ্য কেরানি নিশ্চয়ই ওর মতলব বুঝে ফেলেছিলেন, কারণ তিনিও লাফ দিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি টপকে চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তখনো তিনি আহ্ আহ্! করে চেঁচাচ্ছিলেন, আর সিঁড়ি জুড়ে তার চিৎকারের প্রতিধ্বনি উঠছিল।

দুর্ভাগ্যবশত, মুখ্য কেরানির পলায়নের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেগরের বাবা ভয়ানক অস্থির হয়ে পড়লেন। এতক্ষণ তিনি মোটামুটি শান্ত ছিলেন; কিন্তু এখন, লোকটার পিছনে নিজে ছুটে না-গিয়ে, অন্তত গ্রেগরকে তার প্রয়াসে বাধা না-দিয়ে, তার পরিবর্তে, তিনি চেয়ারের উপর ফেলে যাওয়া মুখ্য কেরানির বেড়াবার লাঠিটা নিজের ডান হাতে তুলে নিলেন—মুখ্য কেরানি তার টুপি আর ওভারকোটও ফেলে রেখে গিয়েছিলেন—আর বাঁ হাত দিয়ে তিনি টেবিলের উপর থেকে একটা বৃহদাকার খবরের কাগজ তুলে নিয়ে, মেঝেতে পা ঠুকতে ঠুকতে, লাঠি আর কাগজটা উঁচিয়ে ধরে, নাড়তে নাড়তে, গ্রেগরকে তার নিজের ঘরে ঠেলে পাঠিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন। গ্রেগরের কোনো কাকুতি-মিনতিতে কাজ হল না, বস্তুতপক্ষে তার কোনো কাকুতি-মিনতি কারো বোধগম্যই হল না, কারণ সে যত নরম হয়ে তার মাথা নিচু করুক না কেন, তার বাবা মেঝেতে ততই আরো জোরে জোরে পা ঠুকতে লাগলেন। বাবার পেছনে দাঁড়ানো তার মা ঠাণ্ডা আবহাওয়া সত্ত্বেও একটা জানালা হাট করে খুলে দিয়ে দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে মাথাটা অনেক দূর অবধি বার করে দিলেন। রাস্তা থেকে সিঁড়ি বেয়ে একটা জোর দমকা হাওয়া বয়ে এল, জানালার পর্দাগুলো ফুলে উঠল, টেবিলের উপরকার খবরের কাগজের পাতাগুলো ফরফর করে শব্দ করল, আলগা পাতাগুলো মেঝের উপর ছড়িয়ে পড়ল ইতস্তত। নির্মমভাবে গ্রেগরের বাবা তাকে হুশ। হুশ। হুশ। শব্দ করতে করতে একটা বুনো প্রাণীর মতো ঠেলে পিছনে হটিয়ে দিলেন। কিন্তু গ্রেগর যেহেতু পেছনে হাঁটায় একটুও অভ্যস্ত ছিল না তাই ব্যাপারটা করতে অনেক সময় নিল। যদি সে একবার তার দেহটা ঘোরাবার সুযোগ পেত, তা হলে সে তৎক্ষণাৎ নিজের ঘরে ফেরত চলে যেতে পারত, কিন্তু ওইভাবে ধীরে ধীরে ঘুরতে অনেকখানি সময় নেবে এবং অত সময় নিতে তার সাহস হল না, বাবা ক্ষেপে যাবেন, আর তার বাবার হাতের লাঠি এখন যে কোনো মুহূর্তে তার পিঠে কিংবা মাথায় মারাত্মক আঘাত হানতে পারে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাই করা ছাড়া তার গত্যন্তর থাকল না, কারণ চরম আতঙ্কের সঙ্গে সে আবিষ্কার করল যে পেছনে চলতে গিয়ে সে তার পাগুলোকে কোনো নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করতে পারছে না, গতিধারার উপর কোনো নিয়ন্ত্রণই আর তার নেই; অতএব, নিজের কাঁধের উপর দিয়ে বাবার মুখের উপর সারাক্ষণ সন্ত্রস্ত চোখ রেখে, সে যতটা সম্ভব দ্রুত গতিতে ঘুরতে শুরু করল, যদিও সেই গতি আসলে ছিল ভীষণ ধীর। বাবা হয়তো তার সদিচ্ছা উপলব্ধি করলেন, কারণ এই প্রক্রিয়ায় তিনি বাধা দিলেন না, বরং মাঝে মাঝে দূর থেকে তার লাঠির মাথা দিয়ে তাকে একটু-আধটু সাহায্য করলেন। শুধু যদি তিনি তার ওই ভয়ঙ্কর হুশ হুশ শব্দটা থামাতেন! ওই শব্দটা গ্রেগরকে দিশাহারা করে দিচ্ছে। সে যখন প্রায় সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়িয়েছে ঠিক তক্ষুনি ওই শব্দটা তাকে এমন বিভ্রান্ত করে দিল যে সে আবার অল্প একটু ভুল দিকে ঘুরে গেল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সে যখন তার মাথাটা শেষপর্যন্ত দরজার ঠিক সামনে নিয়ে আসতে সক্ষম হল তখন দেখা গেল যে তার শরীর এত চওড়া যে ওই ফাঁকটুকু দিয়ে সেটা ঢুকবে না। তার বাবা অবশ্য নিজের বর্তমান মানসিক অবস্থায় গ্রেগরকে আরেকটু জায়গা করে দেবার জন্য দরজার অপর অর্ধাংশ খুলে দেবার কথা ভাবতেই পারছিলেন না। তাঁর মনে তখন একটাই চিন্তা, গ্রেগরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঠেলে নিজের ঘরে ফেরত পাঠিয়ে দিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে গ্রেগর যে পায়ের উপর ভর দিয়ে কোনো। রকমে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে ঢুকে যাবার চেষ্টা করবে তার বাবা সে সময়টুকুও তাকে দিতে আদৌ রাজি নন। হয়তো গ্রেগরকে তাড়া দেবার। আগ্রহে, তার সামনে যেন কোনো বাধা নেই এই ভেবে, তিনি আগের চাইতেও বেশি শব্দ করছিলেন। গ্রেগরের কাছে ওই শব্দ এখন আর কোনো একক পিতার কণ্ঠস্বর বলে মনে হল না। পরিস্থিতি সত্যিই অত্যন্ত সংকটময়। যা হবার তাই হবে, মরিয়া হয়ে গ্রেগর দরজা দিয়ে নিজেকে সজোরে ঠেলে দিল। তার শরীরের একটা দিক উঁচু হলদরজাপথে তার দেহ কাত হয়ে থাকল, একটা পাশ রীতিমতো ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে, সাদা দরজার গায়ে বিশ্রী দাগ পড়ল, শিগগিরই সে ফোকরের মধ্যে শক্ত হয়ে আটকা পড়ল, নিজের চেষ্টায় সে আর নড়তেই পারল না, এক ধারে তার পাগুলো বাতাসে থরথর করে কাঁপছে, অন্য ধারে মেঝের উপর অন্য পাগুলো প্রায় দুমড়ে মুচড়ে গেছে, ভীষণ যন্ত্রণা সেখানে—আর ঠিক তখুনি তার বাবা তাকে একটা জোর ধাক্কা দিলেন, আক্ষরিক অর্থেই সেটা তাকে মুক্তি দিল। সে রক্তাক্ত দেহ নিয়ে ঘরের মধ্যে অনেক দূরে ছিটকে পড়ল। লাঠির আঘাতে তার পেছনে সশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে। গেল। আর তারপর, অবশেষে, নামল নীরবতা।

২. সন্ধ্যার সময় গ্রেগর ঘুম থেকে জেগে উঠল

সন্ধ্যার সময় গ্রেগর ঘুম থেকে জেগে উঠল। ঘুম নয়, বরং মূৰ্ছার মতো। নিজে থেকে সে, নিশ্চয়ই আর বেশি দেরি না করেই জেগে উঠত, কারণ বেশ ভালো ঘুম আর বিশ্রাম হয়েছে তার, কিন্তু তার মনে হল কে যেন লঘু পায়ে এগিয়ে এসেছিল, তারপর সতর্কভাবে হলঘরে যাবার দরজা বন্ধ করেছে, আর ওই শব্দ তাকে জাগিয়ে দিয়েছে। রাস্তার বিজলি বাতি ঘরের ছাদ আর আসবাবপত্রের উপরের দিকটায়, এখানে ওখানে আলোর ঝলক ফেলেছে। কিন্তু নিচে, যেখানে সে শুয়ে আছে, সেখানে অন্ধকার। ধীরে ধীরে, ব্রিতকরভাবে, সে তার শুড়গুলো নেড়েচেড়ে দেখল, এই প্রথমবার সে সানন্দে এর তাৎপর্য উপলব্ধি করল, তারপর ওদিকে কী হচ্ছে দেখার জন্য দরজার দিকে নিজেকে ঠেলে নিয়ে গেল। সমস্ত বাঁ দিকটা টন টন করছে, একটা টানা দীর্ঘ আঘাতের দাগ সেখানে, বস্তুতপক্ষে তার দুসারি পায়ের উপর তাকে রীতিমতো খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছে। তার উপর আজকের সকালের ঘটনায় একটা পা প্রচণ্ড জখম হয়েছে—শুধু একটা পা-ই যে জখম হয়েছে সে এক অলৌকিক ব্যাপার—আর সেই পা-টা এখন অকেজো হয়ে তার পেছনে পেছনে লটর-পটর করছে।

সত্যি সত্যি কিসের আকর্ষণে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেছে সেটা আবিষ্কার করার আগেই সে দরজার কাছে পৌঁছে গেল। খাবারের গন্ধ। এক পাত্রভর্তি তাজা দুধ, তার মধ্যে ছোট ছোট সাদা রুটির টুকরো ভাসছে। আনন্দে সে প্রায় হেসে উঠতে যাচ্ছিল; সকালের চাইতেও এখন সে বেশি ক্ষুধার্ত দুধের বাটিতে সে প্রায় চোখ অবধি তার মাথা ডুবিয়ে দিল। কিন্তু তাড়াতাড়ি, হতাশ হয়ে, সে মাথা তুলে নিল। একে তো তার আহত কোমল বাঁ দিকের জন্য তার খেতে কষ্ট হচ্ছিল—নিজের গোটা শরীরের কম্পমান সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া তার পক্ষে খাদ্য গ্রহণ কিছুতেই সম্ভব নয়—তার উপর দুধটা খেতে তার একটুও ভালো লাগল না, অথচ এই দুধ ছিল তার প্রিয় পানীয়, এবং নিশ্চয়ই সেজন্যই তার বোন তার জন্য এখানে দুধভর্তি এই পাত্র রেখে গেছে। কিন্তু এখন প্রায় ঘৃণাভরে সে ওই পাত্রের কাছ থেকে সরে এসে হামাগুড়ি দিতে দিতে ঘরের মাঝখানে ফিরে গেল।

দরজার ফাঁক দিয়ে সে দেখল যে বসবার ঘরে গ্যাসের আলো জ্বালানো হয়েছে, কিন্তু এই সময়ে তার বাবা সাধারণত জোরে জোরে তার মাকে, এবং অনেক সময় তার বোনকেও, যে দ্বিপ্রহরিক খবরের কাগজ পড়ে শোনাতেন, তার জায়গায় এখন সেখানে টু শব্দটিও শোনা যাচ্ছে না। তবে, তার বোন আলাপ-আলোচনায়। এবং চিঠিপত্রে প্রায়ই যার উল্লেখ করেছে, বাবা হয়তো এখন জোরে জোরে কাগজ পড়ার সেই অভ্যাসটা ত্যাগ করেছেন। কিন্তু ফ্ল্যাটজুড়ে সর্বত্র একই নীরবতা বিরাজ করছে, অথচ ফ্ল্যাটটি মোটেই অধিবাসীশূন্য নয়। গ্রেগর আপন মনে বলল, আমার পরিবারের লোকজনরা কী প্রশান্ত জীবনই না যাপন করছে! মা-বাবা আর বোনের জন্য সে কী সুন্দর ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে, নিশ্চল হয়ে বসে অন্ধকারে দুচোখ মেলে দিয়ে গ্রেগর বেশ অহংকারের সঙ্গে সেকথা ভাবল। কিন্তু এই প্রশান্তি, এই আরাম, এই তৃপ্তি যদি এখন একটা ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে নিঃশেষ হয় তা হলে কী হবে? এই দুশ্চিন্তার কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য গ্রেগর নড়াচড়ায় মনোনিবেশ করল। সে ঘরময় হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরতে লাগল।

দীর্ঘ বিকেলের মধ্যে একবার মাত্র এক পাশের দরজা একটু খুলেই আবার দ্রুত বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, পরে অন্য পাশের দরজার ক্ষেত্রেও তাই করা হয়। স্পষ্টতই কেউ-একজন ভেতরে আসতে চেয়েও পরে মত পাল্টায়। গ্রেগর এবার বসবার ঘরের দরজার ঠিক মুখের সামনে এসে অবস্থান নিল, যে কোনো দ্বিধান্বিত দর্শনার্থীকে সে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ভিতরে ঢোকাতে বদ্ধপরিকর হল, অন্তত লোকটি যে কে সেটা সে দেখবে। কিন্তু দরজা আর খুলল না; বৃথাই সে অপেক্ষা করল। ভোরবেলা, দরজা যখন তালাবন্ধ ছিল, তখন তারা সবাই ভেতরে ঢোকার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, আর এখন, যখন সে একটা দরজা খুলে দিয়েছে, অন্যটাও স্পষ্টতই দিনের কোনো-একসময় খুলে দেয়া হয়েছিল, এখন আর কেউ ভেতরে ঢুকছে না, এমনকি চাবিগুলো পর্যন্ত এখন দরজার অন্য পাশে লাগানো রয়েছে।

তখন অনেক রাত, বসবার ঘরে তখনও আলো নেভানো হয়নি। গ্রেগর সহজেই বুঝতে পারল যে তার বাবা-মা ও বোন তখন পর্যন্ত জেগে আছে। সে স্পষ্ট তাদের পা টিপে টিপে হাঁটার শব্দ শুনতে পেল। এখন আর কেউ তাকে দেখতে আসবে না, অন্তত সকাল পর্যন্ত, এ বিষয়ে সে সুনিশ্চিত। কাজেই ভবিষ্যতের জন্য সে নিজের জীবনকে কীভাবে গুছিয়ে নেবে সেটা ধীরেসুস্থে ভাবার মতো তার হাতে এখন যথেষ্ট সময় আছে। কিন্তু এই উঁচু শূন্য ঘর, যার মেঝেতে এখন তাকে সটান শুয়ে থাকতে হচ্ছে, এটা তাকে ভীত করে তুলল, যার কারণ সে বুঝতে পারছে না। গত পাঁচ বছর ধরে এটাই তো ছিল তার একান্ত নিজস্ব ঘর। অর্ধ-সচেতনভাবে, তার সঙ্গে যে সামান্য লজ্জার ভাব মিশে ছিল না এমন নয়, সে সুড়সুড় করে সোফার নিচে ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার বেশ ভালো লাগল, যদিও পিঠটা একটু চাপাচাপি হল, মাথাটাও উঁচু করতে পারছে না, তবু। তার আসল দুঃখের কারণ হল এই যে তার শরীরটা বড় বেশি চওড়া হবার জন্য দেহের সবটুকু সে সোফার নিচে ঢোকাতে পারল না।

গোটা রাতটা সে ওখানে কাটিয়ে দিল। খানিকক্ষণ তন্দ্রার মধ্যে ঝিমাল, ক্ষুধার জ্বালায় সে মাঝে মাঝেই চমকে জেগে উঠছিল; খানিকক্ষণ সে নানা দুশ্চিন্তায় এবং ভবিষ্যৎ আশার ছবি এঁকে কাটিয়ে দিল। শেষপর্যন্ত একটি সিদ্ধান্তেই সে উপনীত হল : আপাতত তাকে চুপচাপ থাকতে হবে। তার বর্তমান অবস্থায় নিজের পরিবারকে যে অসুবিধার মধ্যে সে ফেলেছে তার জন্য ধৈর্য ও পরম বিবেচনার সঙ্গে তাকে তার পরিবারকে যথাযোগ্য সাহায্য করতে হবে, যেন তারা সেটা সহ্য করতে পারেন।

পরদিন খুব সকালে, তখনো প্রায় রাত, গ্রেগর তার নতুন সিদ্ধান্তগুলো কত দৃঢ় সেটা পরীক্ষা করবার সুযোগ পেল, কারণ তার বোেন, প্রায় পুরোপুরি পোশাক পরে, হলঘরের দিক থেকে দরজাটা খুলে ভেতরে একবার উঁকি দিল। ওকে তার বোন সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেল না, কিন্তু সোফার নিচে যখন তাকে দেখল—তো, তাকে তো কোথাও থাকতে হবে, সে তো উড়ে চলে যেতে পারে না, নাকি?—তখন তার বোন এমন চমকে গেল যে সে নিজের অজান্তেই দরজাটা আবার সশব্দে বন্ধ করে দিল। কিন্তু পরক্ষণেই, যেন এই ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত হয়ে, সে পা টিপে টিপে আবার দরজার কাছে ফিরে এল, মনে হল সে যেন কোনো রোগী, এমনকি কোনো-একজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে আসছে। গ্রেগর তার মাথা সোফার একেবারে ধার পর্যন্ত ঠেলে দিয়ে তাকে লক্ষ করছিল। ও কি লক্ষ করবে যে গ্রেগর দুধ স্পর্শও করেনি, এবং সেটা ক্ষুধার অভাবের জন্য নয়। ও কি তার পক্ষে আরেকটু রুচিকর অন্য কোনো খাবার নিয়ে আসবে? নিজে থেকে যদি না করে, তবে উপোস করে মরে গেলেও সে এ বিষয়ে বোনের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না, যদিও তার ভীষণ ইচ্ছা করছিল যে সোফার তলা থেকে বেরিয়ে এসে ওর পায়ের উপর পড়ে তাকে কিছু খেতে দেবার জন্য মিনতি জানায়। কিন্তু তার বোন তৎক্ষণাৎ সবিস্ময়ে লক্ষ করল যে পাত্রটা তখনো ভর্তি, সামান্য একটু দুধ ছলকে পড়ে চারপাশে শুধু লেগে আছে, সে সঙ্গে পাত্রটা তুলে নিল, অবশ্য খালি হাতে নয়, একটা কাপড়ে জড়িয়ে সে ওটা নিয়ে গেল। তার বদলে এবার সে কী আনবে সেটা জানবার জন্য গ্রেগরের অদম্য কৌতূহল হল এ নিয়ে সে নানা জল্পনা-কল্পনা করল। কিন্তু অতঃপর তার বোন নিজের হৃদয়ের উদারতা থেকে যা করল সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। তার কী রকম খাবার পছন্দ সেটা বুঝবার জন্য ও একটা পুরনো খবরের কাগজের উপর নানা ধরনের এক গাদা খাবার নিয়ে এসেছে। সেখানে রয়েছে বাসি অর্ধেক-পচা শাক-সবজি, গত রাতের খাবারের উচ্ছিষ্ট হাড়-গোড় যার উপর পুরু হয়ে সস্ জমে আছে; কিছু কিসমিস ও বাদাম; এক টুকরা পনির যা দুদিন আগেও গ্রেগর অখাদ্য। বিবেচনা করত, একটা শুকনো রুটি, একটা মাখন-মাখানো রুটি এবং একটা রুটি যাতে মাখন ও লবণ দুই-ই মাখানো আছে। এসব ছাড়াও সে ওই আগের পাত্রটাই একপাশে নামিয়ে রাখল, এখন তার মধ্যে সে কিছু পানি ঢেলে দিয়েছে, বোঝা গেল যে এখন থেকে ওই পাত্রটাই তার একক ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এবং তীক্ষ্ণ্ণ বিবেচনার সঙ্গে, গ্রেগর যে, তার উপস্থিতিতে খাবে না এটা বুঝতে পেরে, সে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে গেল। শুধু তাই নয়, সে চাবিও লাগিয়ে দিল, গ্রেগর যেন বুঝতে পারে যে সে তার ইচ্ছামতো সময় নিয়ে খেতে পারবে। গ্রেগরের পাগুলো সরসর করে খাবারের দিকে ছুটে গেল। তার আঘাতগুলো নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ সেরে গিয়েছিল, কারণ এখন আর সে কোনো রকম অক্ষমতা অনুভব করছে না। ভীষণ অবাক হয়ে গেল সে, সে ভাবতে লাগল যে এক মাসেরও বেশি আগে ছুরি দিয়ে তার একটা আঙুল সামান্য কেটে গিয়েছিল এবং এই গত পরশুদিন পর্যন্ত তার আঙুলটা ব্যথা করছিল। আমি কি তাহলে আগের চাইতে কম স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছি? এ কথা ভাবতে ভাবতে সে লোভীর মতো পনিরটা চুষতে লাগল। অন্য সব খাবারের চাইতে এটাই তাকে তাৎক্ষণিক এবং সবচাইতে প্রবলভাবে আকর্ষণ করল। চোখ দিয়ে তৃপ্তির অশ্রু ফেলতে ফেলতে সে একের-পর-এক পনির, শাকসবজি আর সস খেয়ে ফেলল। পক্ষান্তরে, তাজা খাবারগুলোর প্রতি সে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দিল না, তার গন্ধ পর্যন্ত ওর সহ্য হল না, প্রকৃতপক্ষে সে তার না-খাওয়া খাবারগুলো একটু দূরে টেনে সরিয়ে রাখল। খাওয়া শেষ করবার বেশ খানিকক্ষণ পরে, সে যখন ওই জায়গাতেই অলসভাবে শুয়ে ছিল তখন, তার বোন খুব ধীরে ধীরে চাবিটা ঘোরাল, তাকে ইঙ্গিতে জানাল যে এবার তার লুকিয়ে পড়বার সময় হয়েছে। প্রায় ঘুমিয়ে পড়লেও, এই শব্দটা পেয়ে তৎক্ষণাৎ জেগে উঠে সে দ্রুত সোফার নিচে চলে গেল। যে অল্প সময়টুকু তার বোন ওই ঘরে রইল সে সময়টুকুও সোফার নিচে পড়ে থাকার জন্য তাকে প্রচুর আত্মসংযমের পরিচয় দিতে হল, কারণ খাওয়া-দাওয়ার পর তার দেহ খানিকটা ফুলে উঠেছিল, আর সোফার নিচে তার এমন চাপাচাপি হচ্ছিল যে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হল। মাঝে মাঝে মনে হল যেন তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন তার বোন, একটা ঝাটা দিয়ে, তার খাবারের অবশিষ্ট ছিটেফোঁটাগুলোই শুধু নয়, যা সে স্পর্শও করেনি সেগুলোও, যেন তা আর অন্য-কারো কোনো ব্যবহারেই আসতে পারবে না, পরিষ্কার করে, তাড়াতাড়ি একটা বালতিতে তুলে তার উপর একটা কাঠের ঢাকনা চাপিয়ে বাইরে নিয়ে গেল, আর এ দৃশ্য দেখতে দেখতে গ্রেগরের মনে হল তার মাথার ভেতর থেকে বুঝি তার চোখ দুটি ঠেলে বেরিয়ে আসবে। তার বোন পিছনে ফিরতে-না-ফিরতে গ্রেগর সোফার নিচ থেকে বেরিয়ে এসে হাত-পা ছড়িয়ে একটু স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলল।

এইভাবে গ্রেগরকে খাওয়ানো হতে লাগল, একবার খুব ভোরে, যখন তার বাবা-মা ও পরিচারিকা মেয়েটি ঘুমিয়ে থাকে, আর দ্বিতীয়বার সবার দুপুরের খাওয়ার পর, যখন বাবা-মা একটু ঘুমিয়ে নেয় আর কাজের মেয়েটিকে তার বোন কোনো একটা ফাই-ফরমাশ দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। অবশ্য ও যে না খেয়ে মরুক এটা তারা কেউ চাইত না, কিন্তু তারা হয়তো শোনা-কথার চাইতে আরও প্রত্যক্ষভাবে তার খাবার ব্যাপারটার কথা জানার বেদনা সহ্য করতে পারত না, হয়তো তার বোনই তাদেরকে ওই যন্ত্রণা থেকে যতটা সম্ভব রক্ষা করতে চেয়েছিল, কারণ এমনিতেই তো তাদের কম কষ্ট সইতে হচ্ছিল না।

সেই প্রথমদিনে কী অজুহাতে ডাক্তার আর তালাওয়ালাকে বিদায় দেয়া হয়েছিল গ্রেগর তা আবিষ্কার করতে পারেনি, কারণ যেহেতু তার কথা অন্য কারো বোধগম্য হয়নি, সেই হেতু সে যে তাদের কথা বুঝতে সক্ষম তা ওদের কারো মাথায়, এমনকি তার বোনের মাথায়ও ঢোকেনি। আর তাই ওর বোন ওর ঘরে এসে কখনো কখনো শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলত, কখনো কখনো সন্তদের কাছে প্রার্থনা করত, আর গ্রেগরকে এটা শুনেই তৃপ্ত থাকতে হত। পরে যখন তার বোন বর্তমান পরিস্থিতিতে কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে—পুরোপুরি অভ্যস্ত সে কখনোই হয়ে উঠতে পারেনি–তখন মাঝে মাঝে তার মুখ থেকে কিছু সহৃদয় মন্তব্য, অন্তত সহৃদয় বলে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এমন মন্তব্য, শোনা যেতে লাগল। গ্রেগর যখন ভাল করে, চেটে পুটে সব খাবার খেয়ে নিত তখন সে বলত, তো, আজকে ওর খাবারটা বেশ পছন্দ হয়েছে, আর যখন সে ভাল করে খেত না, এবং ইদানীং ঘন ঘনই তা হচ্ছিল, তখন সে বিমর্ষভাবে বলত, সবই তো আবার যেমন ছিল তেমনি পড়ে রয়েছে।

কিন্তু যদিও গ্রেগর সরাসরি কোনো খবর পেত না তবু পাশের ঘরের অনেক কথাবার্তা তার কানে এসে পৌঁছুত। আর তাই ওখানে কোনো কণ্ঠস্বর শোনা গেলেই সে সংশ্লিষ্ট দরজার কাছে ছুটে গিয়ে তার গায়ে গা-সেঁটে দাঁড়িয়ে থাকত। প্রথম কয়েকদিন তার সম্পর্কে ছাড়া, অন্তত পরোক্ষভাবে তার সম্পর্কে নয়, এমন কোনো কথাবার্তাই হয়নি। গোটা দুদিন ধরে, প্রত্যেক বেলা খাওয়ার সময়, এখন কী করণীয় তা নিয়ে পারিবারিক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। শুধু তাই নয়, খাওয়ার মধ্যবর্তী সময়েও বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। সর্বক্ষণ বাড়িতে পরিবারের অন্তত দুজন সদস্য থেকেছে, কারণ কেউ একা ফ্ল্যাটে থাকতে রাজি হয়নি আর বাড়ি একদম খালি রাখা তো ছিল অচিন্ত্যনীয় ব্যাপার। আর একেবারে প্রথমদিনই বাড়ির রাঁধুনি মহিলা—সে ব্যাপারটা কী এবং কতটুকু জেনেছে তা পরিষ্কার বোঝা গেল না—তার মায়ের পায়ের কাছে নতজানু হয়ে কাজ ছেড়ে চলে যাবার অনুমতি ভিক্ষা করে; এবং মিনিট পনের পর চলে যাবার সময় তাকে ছেড়ে দেবার জন্য অশ্রুভরা চোখে এমন অজস্র ধন্যবাদ দেয় যেন তার ভীষণ উপকার করা হয়েছে, আর কোনোরকম। উৎসাহ-ইঙ্গিত ছাড়াই সে দিব্যি গেলে বলে উঠল যে, যা ঘটেছে সে-সম্পর্কে একটি কথাও সে কক্ষনো কাউকে বলবে না।

এখন গ্রেগরের বোনকেও রান্নার কাজে মাকে সাহায্য করতে হয়, যদিও সত্যি বলতে, রান্না তেমন করতে হত না, কারণ ওরা প্রায় কিছুই খাওয়া-দাওয়া করত না। গ্রেগর প্রায় সারাক্ষণ শুনত যে পরিবারের একজন আরেকজনকে খাবার জন্য ব্যর্থ অনুরোধ করছে, কিন্তু ধন্যবাদ, যথেষ্ট খেয়েছি ছাড়া আর কোনো উত্তর পাওয়া যেত না, কিংবা ওই জাতীয় অন্যকোনো কথা। ওরা হয়তো পানীয়ও গ্রহণ করত না। প্রায়ই তার বোন বাবাকে জিজ্ঞাসা করত তিনি একটু বিয়ার খাবেন কিনা, তাহলে সে নিজে গিয়ে নিয়ে আসবে, আর তার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সে বলত যে সে দারোয়ানকে গিয়ে বিয়ার নিয়ে আসতে বলতে পারে, এবং তখন বাবা সুস্পষ্টভাবে না বলতেন এবং সমস্ত প্রসঙ্গটা সেখানেই চাপা পড়ত।

এই ঘটনার একেবারে প্রথমদিকেই গ্রেগরের বাবা তার মা ও বোনের কাছে পরিবারের আর্থিক অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথা বুঝিয়ে বলেছিলেন। পাঁচ বছর আগে তার ব্যবসায় লাটে ওঠার পর তিনি সামান্য কিছু ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখন, মাঝে মাঝে টেবিল থেকে উঠে গিয়ে, ছোট সিন্দুকটা খুলে তিনি তার মধ্য থেকে কোনো ভাউচার বা মেমোরান্ডাম নিয়ে এলেন। সিন্দুকের জটিল তালাটি খোলার, কাগজপত্র নাড়াচাড়া করার, এবং আবার সিন্দুক বন্ধ করার শব্দ স্পষ্ট শোনা গেল। গ্রেগরের বন্দিজীবন শুরু হবার পর থেকে তার বাবার সেই উক্তিই তাকে প্রথমবারের মতো একটা আনন্দের সংবাদ দিল। তার ধারণা হয়েছিল বাবার ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের পর আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না, অন্তত তার বাবা এই ধারণা ঘুচিয়ে দেবার মতো বিপরীত কথা কখনো বলেননি, অবশ্য সেও কোনোদিন সরাসরি এ-সম্পর্কে তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। সে সময় গ্রেগরের একমাত্র বাসনা ছিল ওই ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের কথা যত শীঘ্র সম্ভব ভুলে গিয়ে তারা যেন চরম হতাশার হাত থেকে মুক্তি পায় সেজন্য পরিবারকে তার দিক থেকে যথাসাধ্য সাহায্য করা। সে-উদ্দেশ্যে সে অস্বাভাবিক উদ্যমের সঙ্গে কাজ শুরু করে দেয়, এবং প্রায় রাতারাতি একটি ক্ষুদ্র কেরানির পরিবর্তে একজন বাণিজ্যিক ভ্রাম্যমাণ চাকুরে হয়ে ওঠে, ওই পথেই আছে বেশি অর্থ রোজগারের সুযোগ, এবং তার সাফল্য সঙ্গে সঙ্গে সুডৌল মুদ্রায় রূপান্তরিত হল, আর সে সক্ষম হল তার পরিবারের বিস্মিত ও আনন্দিত সদস্যদের সামনে ওই মুদ্রা টেবিলের উপর সাজিয়ে দিতে। চমৎকার ছিল ওই দিনগুলো, অবশ্য আর তার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি, অন্তত ওই রকম গৌরবদীপ্তভাবে, যদিও পরবর্তী সময়ে গ্রেগর এত অর্থ উপার্জন করে যে তা দিয়ে পরিবারের সকল খরচপাতি বহন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়, এবং সে তা করেও বটে। আর কিছু নয়, ওরা ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল মাত্র, পরিবারের। সদস্য এবং গ্রেগর নিজেও। অর্থটা গৃহীত হত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে, প্রদত্ত হত। আনন্দের সঙ্গে, কিন্তু তার মধ্যে কোনো বিশেষ উষ্ণ আবেগ-অনুভূতির উচ্ছ্বাস মিশে থাকত না। শুধু বোনের সঙ্গে তার একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বজায় ছিল। তার একটা গোপন পরিকল্পনা ছিল যে তার বোন, যে সংগীত ভীষণ ভালোবাসে, গ্রেগরের মতো নয় ও, যে চমৎকার বেহালা বাজাতে পারে, তাকে সে সামনের বছর, প্রচুর খরচের ব্যাপার হলেও কনসার্ভেটোরিয়ামে পাঠাবে, অর্থের ব্যাপারটা সে অন্য কোনোভাবে সমাধা করে নেবে। ভ্রাম্যমাণ জীবনের ফাঁকে সে যখন স্বল্প সময়ের জন্য বাড়ি আসতো তখন বোনের সঙ্গে কথাবার্তার সময় ওই সংগীত শিক্ষা নিকেতনের কথা প্রায়ই উচ্চারিত হত, কিন্তু সবসময়ই একটা সুন্দর স্বপ্ন। হিসাবে, যা বাস্তবে কৃদাচ রূপায়িত হবে না, আর তার বাবা-মা ওই নির্দোষ কথাবার্তাকেও সবসময় নিরুৎসাহিত করতেন। কিন্তু গ্রেগর নিজে বিষয়টি সম্বন্ধে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল এবং বড় দিনের সময় যথাযোগ্য গাম্ভীর্যের সঙ্গে সে কথাটা সবাইকে জানাবে বলে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল।

দরজার গায়ে সোজা হয়ে ঝুলতে ঝুলতে পাশের ঘরের কথাবার্তা কান পেতে শোনার সময় নিজের বর্তমান সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় তার মাথার মধ্যে ওইসব ভাবনা খেলে গেল। কখনো কখনো, নিছক ক্লান্তির ভারে, সে ওদের কথাবার্তা না শুনে নিজের মাথাটাকে আলস্যের সঙ্গে দরজার উপর ঢলে পড়তে দিত, কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সে সতর্ক হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াত, কারণ ওই সামান্য শব্দও পাশের ঘরে শোনা যেত, আর সঙ্গে সঙ্গে ওরা তাদের কথাবার্তা থামিয়ে ফেলত। একটু পরে ওর বাবা জিজ্ঞাসা করতেন, এখন কী করছে ও?, স্পষ্টতই দরজার দিকে তাকিয়ে তিনি এ প্রশ্ন করতেন, এবং শুধু তারপরই আবার তাদের বাধা পড়া কথাবার্তা নতুন করে শুরু হত।

গ্রেগর এখন পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট অবিহিত হতে সক্ষম হল। কারণ তার বাবা বারবার পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করলেন, কিছুটা এই জন্য যে দীর্ঘদিন তিনি এসব ব্যাপার নিয়ে নাড়াচাড়া করেননি, আর কিছুটা এই জন্য যে তার মা ব্যাপারটা চট করে ধরতে পারছিল না। তাদের টাকা-পয়সা মারা যাবার পরও লগ্নীর একটা অঙ্ক, সত্য বটে খুবই সামান্য অঙ্ক, এখনও টিকে আছে, এমনকি ডিভিডেন্ডগুলো ইতোমধ্যে স্পর্শ করা হয়নি বলে সেই অঙ্ক সামান্য পরিমাণে বৃদ্ধিও পেয়েছে। তাছাড়া প্রতি মাসে গ্রেগর যে টাকা বাড়িতে নিয়ে আসত—নিজের জন্য সে মাত্র সামান্য কয়েক ডলার রাখত—তা সম্পূর্ণ খরচ হত না। এখন সেটা জমতে জমতে ছোট্ট একটা মূলধনে পরিণত হয়েছে। এই অপ্রত্যাশিত মিতব্যয়িতা এবং দূরদৃষ্টির প্রমাণ পেয়ে গ্রেগর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সোৎসাহে তার মাথা নাড়ল। সত্য বটে, তার বাড়তি টাকা দিয়ে সে বড়কর্তার কাছে তার বাবার ঋণ আরও কিছুটা শোধ করে দিতে পারত এবং নিজের দিক থেকে তার চাকরি ছেড়ে দেবার তারিখটা হয়তো আরেকটু নিকটে আনতে সক্ষম হত কিন্তু নিঃসন্দেহে তার বাবা যে ব্যবস্থা করেছেন সেটাই ও বেশি ভালো হয়েছে।

তবু গোটা পরিবারের পক্ষে শুধু সুদের উপর বেঁচে থাকার মতো ওই মূলধন যথেষ্ট ছিল না। মূলের ওপর নির্ভর করে ওরা হয়তো এক বছর, বড়জোর দুবছর বেঁচে থাকতে পারবে, বৎস, ওই পর্যন্তই। কিন্তু ওই মূলধন তো স্পর্শ করা উচিত নয়, দুর্দিনের জন্য সেটা তুলে রাখা দরকার। দৈনন্দিন ভরণ-পোষণের টাকাটা রোজগার করতে হবে। তার বাবা অবশ্য এখনও সুস্থ সমর্থ, কিন্তু তার বয়স হয়ে গেছে, গত পাঁচ বছর ধরে তিনি কোনো কাজকর্ম করেননি এবং এখন খুব বেশি কিছু করতে পারবেন এমন আশাও করা যায় না। এই পাঁচ বছরে, তাঁর পরিশ্রমী, যদিও অসফল, জীবনের প্রথম বিশ্রামের দিনগুলোতে, তিনি বেশ মোটা এবং কিছুটা অলস ও ধীরগতি হয়ে পড়েছেন। আর গ্রেগরের বৃদ্ধা মা, তার হাঁপানি নিয়ে তিনি কীভাবে জীবিকার জন্য অর্থ রোজগার করবেন, হাঁপানির জন্য ফ্ল্যাটের মধ্যে হাঁটাচলা করতেই যার কষ্ট হয়, মাঝে মাঝেই যাকে খোলা জানালার পাশে সোফায় শুয়ে পড়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে হয়? আর তার বোন, এখনও মাত্র সতেরো বছরের এক বালিকা যার জীবন এ-পর্যন্ত সুখে কেটেছে, সুন্দর কাপড়জামা পরে যে শুধু মিষ্টি করে সেজেছে, দীর্ঘ ঘুম দিয়েছে, সংসারের কাজে টুকটাক সাহায্য করেছে, মাঝে মাঝে ছোটখাটো আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে, সবার উপরে বেহালা বাজিয়েছে, তাকে কি এখন তার নিজের রুটি নিজে রোজগার করতে হবে? প্রথমদিকে টাকা রোজগারের প্রয়োজনীয়তার কথা উঠলেই প্রচণ্ড লজ্জা ও ক্ষোভে গ্রেগর এমন অস্থির হয়ে উঠত যে সে দরজা ছেড়ে দিয়ে সোফার ঠাণ্ডা চামড়ার মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকত।

প্রায়ই সে দীর্ঘ রাতগুলো দ্রিাহীন অবস্থায় কাটাতে লাগল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোফার চামড়ার গায়ে আঁচড় কাটল। কিংবা স্নায়ুগুলো শক্ত করে, প্রচণ্ড প্রয়াসে, একটা আরামকেদারা জানালার পাশে ঠেলে নিয়ে গিয়ে তার গা বেয়ে জানালার কার্নিশে গিয়ে উঠত, তারপর জানালার শার্সিতে হেলান দিয়ে দাঁড়াত। স্পষ্টতই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকালে সর্বদা সে যে একটা মুক্তির স্বাদ অনুভব করত তার স্মৃতিই তাকে এটা করতে উদ্বুদ্ধ করছিল। কারণ বাস্তবে কিন্তু দিনের-পর-দিন তার দৃষ্টির সামনে সামান্য দূরের জিনিসও একটু একটু করে ক্রমেই বেশি ঝাঁপসা হয়ে উঠছিল। সারাক্ষণ চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বলে যে হাসপাতালকে সে চিরকাল গাল দিয়ে এসেছে এখন তা আর তার দৃষ্টির সীমানার মধ্যে মোটেই ধরা পড়ছে না। আর সে যদি না জানত যে সে শার্লট স্ট্রিটে বাস করছে, নিঃসন্দেহে একটা শান্ত চুপচাপ রাস্তা, কিন্তু শহরের রাস্তা তো। বটে, তা হলে তার নিশ্চিত মনে হত যে তার জানালার বাইরেই রয়েছে একটা মরুভূমির শূন্যতা, যেখানে ধূসর আকাশ আর ধূসর ভূমি পরস্পরের মধ্যে লীন হয়ে গেছে। তার তীক্ষ্ণ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন বোনকে মাত্র দুবার লক্ষ করতে হয় যে আরামকেদারাটা জানালার পাশে রাখা আছে; এরপর থেকে ওর ঘর পরিষ্কার। করার পর সে সবসময় চেয়ারটা আবার জানালার পাশে সেই একই জায়গায় ঠেলে নিয়ে গিয়ে রাখত, এমনকি জানালার ভেতরদিকের শার্সিটাও খুলে রেখে যেত।

গর যদি তার সঙ্গে কথা বলতে পারত, ওর জন্য সে যা করছে সেজন্য। তাকে ধন্যবাদ দিতে পারত, তাহলে তার সেবাযত্ন সে আরেকটু ভালোভাবে সহ্য করতে পারত। বর্তমান অবস্থায় সেটা তাকে রীতিমত পীড়িত করতে শুরু করল। তার বোন অবশ্য এই অরুচিকর কাজটা হাল্কাভাবে নেবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল, এবং সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেক্ষেত্রে ক্রমশ অধিকতর সাফল্যও অর্জন করছিল, কিন্তু কালপ্রবাহ গ্রেগরের দৃষ্টিশক্তিকেও স্বচ্ছতর করে তুলেছিল। যেভাবে সে তার ঘরে এসে ঢুকত সেটাই তাকে ভীষণ পীড়া দিত। ঘরে ঢুকেই সে সোজা জানালার কাছে ছুটে যেত, দরজাটা বন্ধ করার তর সইত না তার, সাধারণত গ্রেগরের ঘরকে অন্যদের চোখের আড়ালে রাখার জন্য সর্বপ্রকার সতর্কতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও সে একাজটা করত, তারপর, যেন তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমনিভাবে, দ্রুত আঙুল চালিয়ে জানালার শার্সিগুলো সে। হুড়মুড় করে খুলে দিত। এবং ভীষণ ঠাণ্ডার মধ্যেও খোলা দমকা হাওয়ায় সে ওখানে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিত। তার ওই সশব্দ দ্রুত পদচারণা গ্রেগরকে দিনে দুবার করে ভয়ানক অস্বস্তিতে ফেলত; পুরো ওই সময়টুকু সে সোফার নিচে গুটিসুটি হয়ে থরথর করে কাপত, যদিও গ্রেগর নিশ্চিত জানত যে তার বোন যদি তার সঙ্গে একঘরে জানালা না খুলে কোনরকমে থাকতে পারত তাহলে তাকে কিছুতেই এই কষ্টটা সে দিত না।

গ্রেগরের রূপান্তরের প্রায় মাসখানেক পর একদিন, যখন তার চেহারা দেখে ওর চমকে ওঠার কোনোই কারণ ছিল না, তার বোন সাধারণ সময়ের চাইতে একটু আগে তার ঘরে এসে উপস্থিত হয়ে তাকে জানালার সামনে একেবারে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখল। তাকে নিশ্চয়ই ভূতের মতো দেখাচ্ছিল। সে যদি মোটেই ঘরে না ঢুকত তাহলেও গ্রেগর খুব আশ্চর্য হত না, গ্রেগর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তার পক্ষে জানালা খোলাই সম্ভব ছিল না, কিন্তু তার বোন যে শুধু পিছিয়ে গেল তাই নয়, সে এক লাফে, যেন ভীষণ ভয় পেয়ে, বেরিয়ে গিয়ে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল। অপরিচিত কেউ হলে ঠিক ভাবত যে সে বুঝি ওখানে তার জন্য ঘাপটি মেরে বসে আছে, সুযোগ পেলেই তার গায়ে কামড় বসিয়ে দেবে। গ্রেগরকে অবশ্য তৎক্ষণাৎ সোফার নিচে গিয়ে আত্মগোপন করতে হয়, দুপুর পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হয়, দুপুরের আগে আর তার বোন আসেনি, এবং যখন এল তখনো মনে হল সে যেন আগের তুলনায় অনেক বেশি ব্ৰিত। তার দৃষ্টিতে সে যে এখনও কত কুৎসিত এটা সে স্পষ্ট বুঝল, এবং এটা অব্যাহত থাকবে। সোফার তলা থেকে তার শরীরের যে সামান্য অংশ বেরিয়ে আছে সেটা চোখে পড়ার পর এখান থেকে ছুটে পালিয়ে না যাবার জন্য তার বোনকে যে কী ভীষণ কষ্ট করতে হচ্ছে তাও সে উপলব্ধি করল। তাই, তাকে এই কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দেবার জন্য সে একদিন পিঠে করে একটা চাদর সোফার কাছে নিয়ে এল—এ কাজটা করতে তাকে চার ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হয়—তারপর চাদরটা এমনভাবে সাজাল যেন সে সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে, এমনকি তখন নিচু হয়ে তাকালেও তার বোন তাকে দেখতে পাবে না। চাদরটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করলে সে নিশ্চয়ই সেটা সোফার উপর থেকে সরিয়ে ফেলত, কারণ এইভাবে পর্দা-ঢাকা বন্দি অবস্থা যে গ্রেগরের কাছে তৃপ্তিকর নয় সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল, কিন্তু তার বোন চাদরটা যেমন ছিল তেমনি রেখে দিল, এমনকি গ্রেগর যখন চাদরটা অতি সামান্য একটুখানি তুলে মাথা বার করে এই নতুন ব্যবস্থা তার বোনের কেমন লাগছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করল তখন সে যেন তার চোখে একটা সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিও দেখতে পেল।

প্রথম এক পক্ষকাল তার মা-বাবা গ্রেগরের ঘরে ঢুকবার মতো অবস্থায় নিজেদের মনকে তৈরি করে উঠতে পারেননি। তবে, ইতিপূর্বে যেখানে তাঁরা প্রায়ই তার বোনকে কিছু কাজের নয় বলে, তিরস্কার করতেন, এখন সেখানে তার কার্যাবলির জন্য তাঁরা প্রশংসাসূচক কথাবার্তা বললেন এবং সেসব কথা তার কানে এসে পৌঁছুতে লাগল। এখন তার মা-বাবা উভয়েই প্রায়ই দরজার বাইরে অপেক্ষা করে থাকতেন, এবং তার ঘরদোর সাফ করে বাইরে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তার বোনকে তার মা-বাবার কাছে সবকিছু খুঁটিয়ে বলতে হত—ঘরের অবস্থা কী রকম, গ্রেগর কী খেয়েছে, তার অবস্থার সামান্য একটুও উন্নতি ঘটেছে কি-না ইত্যাদি। তার মা-ও অল্পদিনের মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা করতে চাইতে আরম্ভ করলেন, কিন্তু তার বাবা আর বোন নানা যুক্তি দেখিয়ে মাকে নিরস্ত করল। গ্রেগর খুব মন দিয়ে সেসব যুক্তি শুনল এবং মোটের উপর তার সারবত্তাও সে অনুমোদন করল। কিন্তু, পরবর্তী সময়ে, যখন তিনি চিৎকার করে বলতে লাগলেন, আমাকে গ্রেগরের কাছে যেতে দাও! ও আমার দুর্ভাগা ছেলে! কেন বুঝতে পারছে না যে আমাকে ওর কাছে যেতেই হবে! এবং যখন তাঁকে রীতিমতো বল প্রয়োগ করে আটকে রাখতে হত, তখন গ্রেগরের মনে হল যে তাকে বোধ হয় ঢুকতে দেয়াই ভালো হবে, অবশ্য রোজ নয়, কিন্তু ধরো সপ্তাহে। একবার; নিঃসন্দেহে তিনি সবকিছু তার বোনের চাইতে ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। ও অবশ্য যথেষ্ট চেষ্টা করছে এবং হয়তো একটা ছেলেমানুষি অবিমৃষ্যকারিতার বোধ থেকেই এই রকম একটা কঠিন কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে; কিন্তু আসলে তো সে নিতান্ত ছেলেমানুষ ছাড়া আর কিছু নয়।

গ্রেগরের মাকে দেখার সাধ শিগগিরই পূর্ণ হল। মা-বাবার প্রতি বিবেচনাবোধ থেকে গ্রেগর দিনের বেলায় জানালার সামনে দাঁড়াতে চাইত না, কিন্তু মেঝের এই সামান্য কয়েক বর্গগজ জায়গার মধ্যে তো তার পক্ষে বেশি ঘুরে বেড়ান সম্ভব ছিল না, অথচ সারারাত চুপচাপ শুয়ে থাকাও তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল। অন্যদিকে খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কে তার যে উৎসাহ দেখা দিয়েছিল তাও দ্রুত স্তিমিত হতে আরম্ভ করে। অগত্যা একটু বিনোদনের জন্য সে দেয়ালে আর ছাদের গায়ে আড়াআড়িভাবে চলে বেড়াবার অভ্যাস করে ফেলল। বিশেষ করে। ছাদের বুক থেকে ঝুলে থাকাটা সে বেশ উপভোগ করতে শুরু করল, মেঝেতে শুয়ে থাকার চাইতে এটা অনেক ভালো, অনেক সহজে এখানে নিঃশ্বাস নেয়া যায়, তার দেহ এই অবস্থায় মৃদুমন্দ গতিতে দোল খেত; আর ওই পরম তৃপ্তিকর। দোদুল্যমান অবস্থায় আত্মবিস্মৃত হয়ে সে হয়তো কখনো কখনো নিজের হাত পা ছেড়ে দিত, এবং তখন অবাক হয়ে দেখত যে সে ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেছে। তবু তার শরীর এখন নিঃসন্দেহে আগের চাইতে বেশি স্বনিয়ন্ত্রণে আছে, এবং অত উঁচু থেকে পড়ার জন্যও তার তেমন ক্ষতি হল না। গ্রেগর যে নিজেকে ভোলাবার জন্য একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করেছে তার বোন সেটা সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ করল। যেখান দিয়েই সে গুটগুট করে যেত সেখানেই কিছু কিছু চিহ্ন পড়ে থাকত। তার বোনের মনে হল চলে-ফিরে বেড়াবার জন্য গ্রেগরকে যত বেশি জায়গা সম্ভব তা ছেড়ে দেয়া দরকার, আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলা প্রয়োজন, বিশেষভাবে আলমারি আর লেখার টেবিলটা। কিন্তু তার একার পক্ষে একাজ করা সম্ভব নয়; বাবাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে বলার সাহস সে পেল না; আর কাজের মেয়েটিকে, ষোল বছরের এক বাচ্চা মেয়ে, রাঁধুনি মহিলা চলে যাবার পরও মেয়েটি সাহস করে থেকে গিয়েছে, তাকে সাহায্য করতে বলা যাবে না, কারণ সে ইতোমধ্যে একটা বিশেষ অনুরোধ করে রেখেছিল, রান্নাঘরের দরজা সে তালা বন্ধ করে রাখবে, এবং একমাত্র সুনির্দিষ্ট ডাক পড়লেই শুধু সে ওই দরজা খুলবে। অতএব মাত্র একটা পথই খোলা আছে, বাবা যখন বাইরে থাকবেন তখন সে মাকে সাহায্য করতে বলবে। আর ওই বৃদ্ধা রমণী সঙ্গে সঙ্গে অধীরভাবে সানন্দ ধ্বনি করতে করতে এগিয়ে এলেন, তবে গ্রেগরের ঘরের দরজার সামনে আসতে আসতেই তার আনন্দ যেন উবে গেল। গ্রেগরের বোন, অবশ্য, আগে ঘরে ঢুকল, মাকে ঢুকতে দেবার আগে সবকিছু ঠিকঠাক আছে। কিনা দেখে নিল। গ্রেগর তাড়াতাড়ি করে চাদরটা আরও নিচে টেনে নামাল, এমনভাবে সেটা সাজাল যেন মনে হয় আকস্মিকভাবে তা সোফার উপর পড়ে গেছে। আর এবার সে তার তলা থেকে উঁকি মেরে তাকাল না। এবার সে মাকে দেখার আনন্দ থেকে নিজেকে স্বেচ্ছায় বঞ্চিত করল, তিনি যে এসেছেন এতেই সে খুশি হল। এস, ওকে দেখা যাচ্ছে না, এ-কথা বলে তার বোন, স্পষ্ট বোঝা গেল, হাত ধরে মাকে ঘরের ভেতর টেনে আনল। গ্রেগর এবার শুনতে পেল ওই দুই মহিলা ভারী আলমারিটা ধস্তাধস্তি করে সরাবার চেষ্টা করছেন, তার বোন বেশি পরিশ্রমের কাজটা নিজে করতে চাইছে, আর তার মা তাকে বারণ করছেন, বলছেন যে ওর কষ্ট হবে, ক্ষতি হবে। কাজটা করতে অনেকক্ষণ লাগল। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা টানাটানি করার পর মা বললেন যে আলমারিটা যেখানে আছে। সেখানে থাকাই ভালো, কারণ প্রথমত, ওটা বড় বেশি ভারী, তার বাবা বাড়ি ফিরে আসার আগে ওটাকে কিছুতেই সরানো যাবে না, আর ঘরের ঠিক মাঝখানে পড়ে থাকলে গ্রেগরের চলাফেরার আরও অসুবিধাই হবে, দ্বিতীয়ত, আসবাবপত্রগুলো সরালে তাতে যে গ্রেগরের সত্যি সত্যি কোনো উপকার হবে তাও সুনিশ্চিত নয়। মায়ের ধারণা বরং উল্টো। নিরাভরণ শূন্য দেয়ালের চেহারা তার নিজের মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে; গ্রেগরের কোনো অনুরূপ অনুভূতি হবে না? বিশেষত এইসব জিনিস তার কত দিনের পরিচিত। এগুলো না থাকলেই হয়তো তার একা একা লাগবে। তাছাড়া মা নিচু গলায় বললেন, বস্তুতপক্ষে সারাটা সময় তিনি ফিসফিস করে কথা বলছিলেন, তিনি যেন গ্রেগরকে, সে যে ঠিক কোথায় আছে তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না, তাঁর কথার সুরটুকুও শোনাতে চাননি, কারণ গ্রেগর যে তার কথাবার্তা একটুও বুঝতে পারছে না সে বিষয়ে তার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না, তাছাড়া, ওর আসবাবপত্রগুলো সরিয়ে নিলে ও কি ভাববে না যে আমরা ওর ভালো হবার আশা বিসর্জন দিয়ে তাকে ঠাণ্ডা মাথায় সম্পূর্ণ তার নিজের উপর ছেড়ে দিচ্ছি? আমার মনে হয় ওর ঘর সর্বদা যেমন ছিল ঠিক সেই রকম অবস্থায় রেখে দেওয়াই ভালো, যাতে সে আবার আমাদের মাঝে ফিরে এলে সবকিছু অপরিবর্তিত দেখতে পায় এবং তখন মধ্যবর্তী সময়ে যা কিছু ঘটেছে তার কথা সে সহজেই ভুলে যেতে পারবে।

মায়ের মুখ থেকে এই কথাগুলো শোনার পর গ্রেগর বুঝতে পারল যে বিগত দু-মাস ধরে সর্বপ্রকার প্রত্যক্ষ মানবিক সংলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে এবং পারিবারিক জীবনের একঘেয়েমির দরুন তার চিত্ত বিকল ও বিভ্রান্ত হয়ে গেছে, তা না হলে সে যে সত্যিই নিজের ঘরকে সম্পূর্ণ আসবাবপত্রহীন দেখার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিল কী করে তার কারণ ব্যাখ্যা করা যাবে? সুনিশ্চিতভাবে যে দিকে খুশি সেদিকে অবাধে ঘুরে বেড়াবার সুবিধার জন্য, সে কি সত্যি সত্যি তার মানবিক পটভূমির সকল স্মৃতিকে বিসর্জন দেবার মূল্যেও চেয়েছিল যে প্রাচীন পারিবারিক আসবাবপত্রে আরামদায়কভাবে সুসজ্জিত তার এই উষ্ণ মনোরম ঘরটি একটা নিরাভরণ আস্তানায় রূপান্তরিত হোক? প্রকৃতই সে বিস্মৃতির অতল খাদের এত কিনারে এসে পৌঁছেছিল যে একমাত্র তার মায়ের কণ্ঠস্বর, যা সে কতকাল শোনেনি, তাকে সেখান থেকে টেনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তার ঘর থেকে কিছু সরানো যাবে না; যেমন ছিল সবকিছু হুবহু সেই রকম থাকবে; নিজের মনের উপর আসবাবপত্রগুলোর সুপ্রভাব সে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেবে; যদি চক্রাকার তার অর্থহীন ঘুরে বেড়ানোর ক্ষেত্রে আসবাবগুলো কিছু বাধার সৃষ্টি করে তবুও সেটা কোনো ক্ষতি নয়, বরং একটা লাভের ব্যাপার।

দুর্ভাগ্যবশত তার বোনের মত ছিল উল্টোটা। গ্রেগরের ব্যাপারে সে তার মা-বাবার তুলনায় নিজেকে, অবশ্য সংগত কারণেই, একজন বিশেষজ্ঞ ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, তাই মায়ের পরামর্শ শোনার পর নিজের সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করতে সে আরও দৃঢ়সংকল্প হল। প্রথমে সে ভেবেছিল যে শুধু আলমারি আর লেখার টেবিলটা সরাবে, এখন ঠিক করল অপরিহার্য সোফাটি ছাড়া সব আসবাবপত্রই সে সরিয়ে ফেলবে। শুধু ছেলেমানুষি অবাধ্যতা কিংবা এত মূল্যে এবং এরকম অপ্রত্যাশিতভাবে তার নবাৰ্জিত আত্মবিশ্বাসের জন্যই সে এ-ব্যাপারে অত দৃঢ়সংকল্প হয়ে ওঠেনি। সে সত্যি সত্যি দেখেছিল যে গুটি গুটি করে ঘুরে বেড়াবার জন্য গ্রেগরের যথার্থই অনেকখানি জায়গা দরকার হয়; পক্ষান্তরে, যতটা বোঝা যাচ্ছিল, ওর আসবাবপত্রগুলো সে কখনই ব্যবহার করত না। এর পেছনে আরেকটা জিনিসও কাজ করে থাকতে পারে, সেটা হল একটি কিশোরী মেয়ের উৎসাহ-উদ্দীপনাময় স্বভাব, যা সুযোগ পেলেই পরিতৃপ্তি খুঁজে বেড়ায়, এবং সেজন্যই গ্রেটা এখন তার ভাইয়ের বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে ইচ্ছা করে বাড়িয়ে তুলতে প্রলুব্ধ হল, যেন তার জন্য সে আরও বেশি করে কাজ করতে পারে। একটা ঘর, যার নিরাভরণ শূন্য দেয়ালে গ্রেগর একাধিপত্য করে বেড়াবে, যেখানে একমাত্র সে ছাড়া আর কারো পা দেবার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।

আর তাই তার মায়ের কথাবার্তা তাকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারল না। তার উপর গ্রেগরের ঘরে মার বেশ অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল এবং সেজন্য তাঁর। মতামতের ক্ষেত্রেও একটা অনিশ্চিত ভাব দেখা দিল। শিগগিরই তিনি চুপ করে গেলেন। আর যতটুকু সম্ভব মেয়েকে আলমারিটা ঠেলে বাইরে সরাবার কাজে সাহায্য করতে লাগলেন। তা, প্রয়োজন হলে, আলমারিটা ছাড়া গ্রেগর চালিয়ে নিতে পারবে, কিন্তু লেখার টেবিলটা তাকে রাখতেই হবে। রমণী দুজন হাঁসফাঁস করতে করতে আলমারিটা ঠেলে ঘরের বাইরে নিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেগর সোফার নিচ থেকে তার মাথা বার করল। সে দেখতে চাইল কীভাবে সে, যথাসম্ভব সতর্কতা ও সহৃদয়তার সঙ্গে, ওদের এই কাজে বাধা দিতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার মা-ই ঘরের মধ্যে প্রথম ফিরে এলেন। গ্রেটা তখন পাশের ঘরে একাই সমস্ত শক্তি দিয়ে আলমারিটাকে দু-হাতে ধরে সরাবার চেষ্টা করছে, যদিও নিজের জায়গা থেকে সে ওটাকে একটুও সরাতে পারল না। মা তো গ্রেগরের চেহারা দেখতে এখনও অভ্যস্ত হননি, তাই পাছে তার ভীষণ খারাপ লাগে এই ভয়ে গ্রেগর তাড়াতাড়ি সোফার অন্য প্রান্তে সরে গেল, কিন্তু এটা করতে গিয়ে সামনের দিকে চাদরটা একটু দুলে উঠল, সেটা সে বন্ধ করতে পারল না। এতেই কিন্তু তার মা সতর্ক হয়ে গেলেন। তিনি এক মুহূর্ত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর গ্রেটার কাছে ফিরে গেলেন।

গ্রেগর নিজেকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করল যে অস্বাভাবিক কিছুই ঘটছে না, শুধু কিছু আসবাবপত্র পাল্টানো হচ্ছে, কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে তাকে স্বীকার করতে হল যে তার মনের মধ্যে একটা ভয়ানক অস্থিরতা চলছে। এই যে দুজন মহিলা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছেন, উহ্ আহ্ করে উঠছেন, মেঝের উপর দিয়ে আসবাবপত্র টানাহেঁচড়ার শব্দ হচ্ছে, এইসব একসঙ্গে চারদিক থেকে ছুটে আসা একটা বিশাল বিপর্যয়ের মতো তাকে আঘাত করল। যতই সে তার মাথা আর পাগুলো গুটিয়ে নিয়ে একেবারে মেঝের ভেতরে সেঁধিয়ে যেতে চেষ্টা করল ততই তাকে স্বীকার করতে হল যে এই অবস্থা সে আর বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারবে না। ওরা তার ঘর থেকে তার সব জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছে; সে যা কিছু ভালোবাসে সব তারা নিয়ে যাচ্ছে; ওই আলমারিটায় সে চিরকাল তার করাত ও অন্যান্য কাজের টুকিটাকি হাতিয়ার রাখত, সেটা তারা ইতোমধ্যে নিয়ে গেছে; এখন ওরা, প্রায় মেঝের মধ্যে বসে-যাওয়া, তার লেখার টেবিলটা টেনে আলগা করছে, ও যখন কমার্শিয়াল একাডেমিতে পড়ত তখন সে ওই টেবিলে তার সব হোমওয়ার্ক করেছে, তারও আগে গ্রামার স্কুলে পড়ার সময়, এমনকি, হ্যাঁ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়েও তাই করেছেনা, ওই দুই মহিলার শুভ ইচ্ছার দিকটা পরিমাপ করে নষ্ট করার মতো সময় আর তার হাতে এখন নেই, ইতিমধ্যে সে ওদের অস্তিত্বের কথা প্রায় ভুলে যেতে বসেছিল, কারণ ওরা এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে এই পর্যায়ে ওরা নীরবে কাজ করে যাচ্ছিল, শুধু তাদের পায়ের টেনে টেনে চলার ভারী শব্দ হচ্ছিল।

ওরা তখন পাশের ঘরে লেখার টেবিলটার গায়ে হেলান দিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। গ্রেগর তার জায়গা থেকে ছুটে বেরিয়ে এল, চারবার সে তার গতি পরিবর্তন করল, কারণ কোন জিনিসটা প্রথম বাঁচাবে তা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না, তারপর তার চোখ পড়ল ঠিক উল্টো দিকের দেয়ালে, সে-দেয়াল। ইতোমধ্যে প্রায় পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে, শুধু ফার দিয়ে সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত ওই মহিলার ছবিটি তখনো সেখানে ঝুলছে। গ্রেগর দ্রুত ছবিটির গা বেয়ে উঠে কাচের উপর নিজেকে চেপে ধরল, বেশ ভালোভাবে নিজেকে আটকে রাখার মতো সুন্দর সমতল একটা জায়গা, তার তেতে ওঠা পেটটা ভারি আরাম পেল। তার নিচে ছবিটা এখন প্রায় সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেছে : অন্তত এই ছবিটা সে। কাউকে এখান থেকে সরাতে দেবে না। ওরা দুজন ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে যেন তাদের লক্ষ করতে পারে সেজন্য সে বসবার ঘরের দরজার দিকে নিজের মাথা ঘুরিয়ে রাখল।

ওরা অবশ্য খুব অল্পক্ষণই বিশ্রাম নিল, ইতোমধ্যে ওরা এদিকে চলে আসতে শুরু করেছে। গ্রেটা তার মাকে জড়িয়ে ধরে আছে, তাকে একরকম বয়ে নিয়ে আসছে সে। চারদিকে নজর ফেলে সে বলল, এবার কী নেব আমরা? তার চোখ গিয়ে পড়ল দেয়ালের গায়ে গ্রেগরের চোখের উপর। সে মাথা ঠিক রেখে স্থির থাকল, স্পষ্টতই তার মায়ের কথা ভেবে, তারপর মাকে উপর দিকে তাকানো থেকে নিবৃত্ত রাখার উদ্দেশ্যে নিজের মাথা নিচু করে হড়বড় করে, কিছু না। ভেবেচিন্তেই, মাকে বলে বসল, আমরা বরং খানিকক্ষণের জন্য বসবার ঘরে থাকি, কী বল, মা? গ্রেগর বোনের উদ্দেশ্য পরিষ্কার বুঝতে পারল। সে মাকে নিরাপদ জায়গায় রেখে এসে তাকে দেয়াল থেকে তাড়িয়ে নামাবে। ঠিক আছে, একবার চেষ্টা করে দেখুক! সে সোজা উড়ে গিয়ে গ্রেটার মুখের উপর পড়বে।

কিন্তু গ্রেটার কথা মাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। তিনি একপাশে একটু সরে। গেলেন, আর তখনই ফুলের নকশা-আঁকা ওয়াল-পেপারের গায়ে বসে থাকা বিরাট বাদামি বস্তুটির উপর তার চোখ পড়ল। যা তিনি দেখছেন সেটা যে গ্রেগর সে সম্পর্কে যথার্থ সচেতন হবার আগেই তিনি ভাঙা গলায় সজোরে চিৎকার করে উঠলেন, হা ভগবান! হা ভগবান! চিৎকার করেই সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে, তিনি দুবাহু প্রসারিত করে সোফার উপর লুটিয়ে নিশ্চল হয়ে গেলেন। তার বোন নিজের হাত দুটি মুঠি করে নাড়তে নাড়তে তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, গ্রেগর! তার রূপান্তরের পর এই প্রথমবার সে সরাসরি গ্রেগরকে উদ্দেশ্য করে কথা বলল। মায়ের মূৰ্ছা ভাঙাবার জন্য গন্ধযুক্ত তরল কিছু একটা ওষুধ আনতে সে পাশের ঘরে ছুটে গেল। গ্রেগরও চাইল সাহায্য করতে—ছবিটা বাঁচাবার এখনও সময় আছে—কিন্তু কাচের গায়ে তার শরীর শক্ত হয়ে সেঁটে গেছে, বেশ জোর করে তার নিজেকে সরিয়ে আনতে হল। তারপর সে তার বোনের পেছন পেছন পাশের ঘরে ছুটে গেল, চিরকাল তাকে যেমন পরামর্শ দিয়েছে এখনও যেন সেইরকম নির্দেশ আর পরামর্শ দেবে; কিন্তু এখন তাকে তার বোনের পেছনে গিয়ে অসহায়ভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে হল? ইতোমধ্যে তার বোন এক গাদা ছোট ছোট বোতল হাতড়ে বেড়াচ্ছে; একবার মুখ ঘুরিয়ে। ওকে দেখতে পেয়েই সে ভয়ে চমকে উঠল; একটা বোতল মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেল; একটুকরা কাচের আঘাতে গ্রেগরের মুখ কেটে গেল, আর কি একটা ঝাঁঝাল ওষুধ ছলকে পড়ে তাকে ভিজিয়ে দিল। আর এক মুহূর্ত না থেমে গ্রেটা চোখের পলকে সবগুলো বোতল তুলে নিয়ে তার মায়ের কাছে ছুটে গেল, তারপর পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল। গ্রেগর এখন মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন; তার মা হয়তো তারই জন্য প্রায় মরতে বসেছেন। পাছে বোন ভয়। পায় সেই আশঙ্কায় সে দরজা খুলতে ভরসা পেল না, বোনকে এখন মায়ের কাছে থাকতেই হবে; অপেক্ষা করা ছাড়া তার আর এখন কিছুই করবার নেই; দুশ্চিন্তায় আর আত্মধিক্কারে অস্থির হয়ে সে দেয়াল, আসবাবপত্র, ছাদ, সবকিছুর গা বেয়ে ঘুরতে আরম্ভ করল, এবং অবশেষে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে, যখন তার মনে হল যে গোটা ঘরটা তার চারধারে বন বন করে ঘুরছে, সে ধপ করে বড় টেবিলটার ঠিক মাঝখানে পড়ে গেল।

কিছু সময় কেটে গেল; গ্রেগর তখন দুর্বলভাবে পড়ে রয়েছে, চারদিকে সব চুপচাপ, এটা হয়তো একটা সুলক্ষণ। এমন সময় দরজার ঘণ্টি বেজে উঠল। কাজের মেয়েটি তো রান্নাঘরে তালা বন্ধ করে বসে আছে, কাজেই গ্রেটাকেই দরজা খুলে দিতে হবে। বাবা এসেছেন। ঢুকেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে? গ্রেটার মুখ দেখেই তিনি নিশ্চয় সবকিছু বুঝে ফেলেছিলেন। গ্রেটা অবরুদ্ধ গলায় বলল, বোঝা গেল যে সে বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে কথা বলছে, মা মূৰ্ছা গিয়েছিলেন, কিন্তু এখন অনেকটা ভালো। গ্রেগর বেরিয়ে পড়েছে। বাবা বললেন, আমি জানতাম ঠিক এরকম কিছু একটা ঘটবে। তোমাদের তো বারবার এ-কথা বলেছি আমি, কিন্তু তোমরা মা-মেয়ে আমার কথায় কান দাওনি। গ্রেগর স্পষ্ট বুঝল যে গ্রেটার অতিরিক্ত সংক্ষিপ্ত উক্তির সবচাইতে খারাপ ব্যাখ্যা করে নিয়েছেন তার বাবা। তিনি ধরে নিয়েছেন যে গ্রেগর নিশ্চয়ই হিংসাত্মক কিছু একটা কাজ করেছে। অতএব গ্রেগরকে এখন তার বাবাকে ঠাণ্ডা করতে হবে, এখন তাকে সবকিছু ভালোভাবে বোঝাবার সময় বা উপায় নেই। তাই সে দ্রুত নিজের ঘরের দরজার কাছে ছুটে গিয়ে সেখানে গুটিসুটি হয়ে লেগে থাকল যেন বাবা হলঘর থেকে এদিকে আসলেই তাকে দেখতে পান এবং বুঝতে পারেন যে তার ছেলের মনে এই মুহূর্তে নিজের ঘরে ঢুকে যাবার সদিচ্ছা রয়েছে, কাজেই তাকে সেখানে তাড়িয়ে ঢোকাবার কোনো আবশ্যকতা নেই, শুধু দরজাটা খুলে দিলেই সে তার ঘরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু নিজের বর্তমান মানসিক অবস্থায় বাবা ওই সূক্ষ্ম তারতম্য লক্ষ করলেন। গ্রেগরকে দেখেই তিনি আহ! বলে চিৎকার করে উঠলেন। তাঁর গলার স্বর শোনাল একইসঙ্গে ক্রুদ্ধ ও উল্লসিত। গ্রেগর দরজার কাছ থেকে তার মাথা টেনে নিল, তারপর মাথা উঁচু করে বাবার দিকে তাকাল। সত্যি, মনে মনে সে বাবাকে যেরকম কল্পনা করেছিল ইনি তো সেরকম নন; অবশ্য এটা স্বীকার্য যে ইদানীং সে ছাদের গা বেয়ে ঘুরে বেড়াবার নতুন খেলায় এমন মেতে উঠেছিল যে বাড়ির অন্যত্র কিসব ঘটছে তা আর আগের মতো ঔৎসুক্য নিয়ে লক্ষ করতে পারেনি। সত্যি, সত্যি, কিছু পরিবর্তনের জন্য তো তার প্রস্তুত থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তবু, তবু, এই কি তার বাবা? যখনই গ্রেগর ব্যবসায়ের কাজে ভ্রমণে বেরুত তখন যে মানুষটি বিছানায় ক্লান্তভাবে এলিয়ে পড়ে থাকতেন, রাত্তিরে ঘরে ফিরে এলে যিনি ড্রেসিং গাউন পরে লম্বা একটা আরাম কেদারায় শুয়ে শুয়ে গ্রেগরকে স্বাগত জানাতেন; তিনি যথার্থভাবে উঠে পর্যন্ত দাঁড়াতে পারতেন না, শুধু হাত তুলে তাকে শুভ সম্ভাষণ জানাতেন; বিরল কয়েকটি সময়ে, বছরে দু-এক রবিবারে কিংবা বিশেষ ছুটির দিনে, যখন পরিবারের অন্যদের সঙ্গে বেড়াতে বেরুলে যিনি গ্রেগর আর তার মায়ের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে হাঁটতেন, যারা এমনিতেই আস্তে আস্তে হাঁটত, আর যিনি তাদের চাইতেও ধীর গতিতে হাঁটতেন, তার পুরনো ওভার-কোটটায় নিজেকে ভালোভাবে ঢেকে-ঢুকে যিনি বেশ কষ্ট করে, প্রতি পদক্ষেপের সময় তার হাতের মাথা-বাকানো লাঠিটা সতর্কতার সঙ্গে ঠুকতে ঠুকতে তার সাহায্যে, ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতেন, এবং কিছু-একটা বলতে চাইলে প্রায় একদম দাঁড়িয়ে পড়ে তার সঙ্গীদের কাছে ডেকে আনতেন, ইনি কি সেই ব্যক্তি? ওই-তো এখন তিনি ওখানে চমৎকারভাবে দাঁড়িয়ে আছেন; তাঁর পরনে একটা কেতাদুরস্ত নীল ইউনিফর্ম, সোনালি বোতাম-আঁটা তাতে, ব্যাঙ্কের বার্তাবাহকরা যে রকম পোশাক পরে সেই রকম; তার কোটের উঁচু শক্ত কলারের উপর দিয়ে। তার বলিষ্ঠ দ্বিত্ব চিবুক ফুলে ঝুলে পড়েছে; ঘন ভ্রুযুগলের নিচ থেকে তার কালো দুচোখ তীক্ষ্ণ্ণ সতেজ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে; তার একদা এলোমেলো সাদা চুল এখন চকচকে, সযত্নে ভাগ করা, সিথির দুপাশে পাট করে আঁচড়ানো। তাঁর টুপির গায়ে সোনালি মনোগ্রাম আঁকা, সম্ভবত কোনো ব্যাঙ্কের প্রতীকচিহ্ন; টুপিটা তিনি ছুঁড়ে দিলেন, বাঁকা হয়ে ঘুরে, ঘরের গোটা দৈর্ঘ্য পেরিয়ে, সেটা গিয়ে একটা সোফার উপরে পড়ল; কোটের প্রান্তদেশ পেছনে ঠেলে দিয়ে, দু-হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে কঠোর মুখভঙ্গি করে তিনি গ্রেগরের দিকে এগিয়ে গেলেন। সম্ভবত নিজের উদ্দেশ্য তিনি নিজেও ঠিকমতো জানতেন না; কিন্তু তিনি তার পা অস্বাভাবিক রকম উঁচু করে তুলেছিলেন, আর গ্রেগর তার জুতার তলার সুবিশাল আকৃতি দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। কিন্তু গ্রেগর কোনো প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়ে তাঁর মুখোমুখি হবার ঝুঁকি নিতে চাইল না, কারণ নিজের নতুন জীবনের একেবারে প্রথম দিন থেকেই সে লক্ষ করেছিল যে তার সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাবা। কঠোরতম প্রক্রিয়াকেই সবচাইতে উপযোগী বলে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিলেন। আর তাই সে তার বাবার আগে আগে ছুটল, তিনি থামলে সেও থামল, এবং বাবা একটু নড়লেই সেও আবার শুটশুট করে সামনে এগিয়ে গেল। এইভাবে ওরা কয়েকবার ঘরটির মধ্যে চক্রাকারে ঘুরল, কোনো কিছুই চূড়ান্তভাবে ঘটল না। সত্যি বলতে কী সমস্ত কাণ্ডটা পশ্চাদ্ধাবনের মতোও দেখাল না, কারণ এই ছোটাছুটিটা পরিচালিত হল অত্যন্ত ধীর গতিতে। আর তাই গ্রেগর মেঝে ছেড়ে অন্যত্র গেল না; তার ভয় হল সে যদি দেয়াল বা ছাদ বেয়ে ওঠে তাহলে বাবা নিশ্চয়ই তার ওই অভিযানকে একটা অস্বাভাবিক শয়তানি বলে মনে করবেন। তবু এই অবস্থা সে আর বেশিক্ষণ চালিয়ে যেতে পারবে না, কারণ তার বাবা যেখানে একটিমাত্র পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন সেখানে তাকে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অনেকগুলো অংশকে একসঙ্গে নাড়াতে হচ্ছিল। পূর্বতন জীবনে যেমন তার ফুসফুস খুব নির্ভরযোগ্য ছিল না, এখনও ঠিক তেমনিভাবে সে এরই মধ্যে হাঁপাতে শুরু করেছিল। সে টলমল পায়ে এগিয়ে গেল, দৌড়ানোর উপর তার সমস্ত শক্তি কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করল, চোখ দুটি কোনোরকমে একটু খোলা রাখল শুধু; নিজের বিভ্রান্ত অবস্থায় সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া পলায়নের আর কোনো পথের কথা সে একবারও চিন্তা করল না; সে-যে সহজেই দেয়াল বেয়ে উঠে যেতে পারে একথা সে প্রায় ভুলে গেল, আর এই ঘরের দেয়াল তো নানা জিনিসের চমৎকার কাজ করা হাতল, দণ্ড এবং খাজে সুসজ্জিত—এই সময় হঠাৎ তার পেছনে, খুব কাছে, হালকাভাবে ছুঁড়ে দেয়া কী একটা জিনিস এসে পড়ল, তারপর সেটা গড়িয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল। একটা আপেল; তারপর প্রায় তক্ষুনি আরেকটা আপেল এসে পড়ল তার পাশে। গ্রেগর ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়াল। আর দৌড়াবার কোনো মানে হয় না, কারণ বাবা এখন তার উপর বোমাবর্ষণ করতে বদ্ধপরিকর। সাইডবোর্ডের উপরে-রাখা একটি পাত্র থেকে তিনি অনেকগুলো ফল তুলে তার পকেটভর্তি করেছেন, এবং এখন এই মুহূর্তে, খুব ভালো রকম নিশানা না-করেই। তাকে লক্ষ করে একটার-পর-একটা আপেল ছুঁড়ে মারছেন। ছোট ছোট লাল আপেলগুলো যেন চুম্বকের আকর্ষণে গড়িয়ে গড়িয়ে একটার গায়ে আরেকটা সশব্দে আঘাত হানছে। হালকা জোরের সঙ্গে ছোড়া একটা আপেল গ্রেগরের পিঠ ছুঁয়ে, কোনো বিপদ না ঘটিয়েই, পিছলে পড়ে গেল। কিন্তু ঠিক পরের মুহূর্তে আরেকটা আপেল সোজা তার পিঠে পড়ে তাকে ঠেসে ধরল। গ্রেগর নিজেকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করল, যেন এই অবিশ্বাস্য চমক জাগানো বেদনা সে পিছনে ফেলে রেখে যেতে পারে, কিন্তু তার মনে হল তাকে যেন কেউ পেরেক দিয়ে ওই জায়গায় গেঁথে দিয়েছে, আর তখনই তার সকল ইন্দ্রিয়ানুভূতির চরম ওলট-পালটের মধ্যে সে নিজেকে মেঝের উপর যতটা সম্ভব ছড়িয়ে দিল। তার শেষ সজ্ঞান দৃষ্টি দিয়ে সে তার ঘরের দরজাকে প্রচণ্ড বেগে খুলে যেতে দেখল, তার বোন চিৎকার করছে, আর তার বোনের আগে আগে ছুটে বেরিয়ে আসছেন, মায়ের উর্ধ্বাঙ্গে শুধু অন্তর্বাস, কারণ মা যেন সহজে নিঃশ্বাস নিতে পারেন, তাড়াতাড়ি যেন তার মূৰ্ছা ভাঙে, সেজন্য মেয়ে তার কাপড় ঢিলা করে দিয়েছিল। সে দেখল ছুটে যাচ্ছেন বাবার দিকে, যেতে যেতে তাঁর ঢিলা করে দেয়া পেটিকোটগুলো একটার পর একটা মেঝেতে ছেড়ে যাচ্ছেন, এবং সেগুলোর উপর দিয়ে হুমড়ি খেয়ে তিনি সোজা তার বাবার বুকে পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন—তাঁর সঙ্গে যুক্ত হলেন পরিপূর্ণ মিলনে—কিন্তু এই পর্যায়ে গ্রেগরের চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসতে শুরু করেছিল- মা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে পুত্রের প্রাণভিক্ষা করলেন।

৩. গ্রেগর বেশ কঠিন আঘাত পেয়েছিল

গ্রেগর বেশ কঠিন আঘাত পেয়েছিল; একমাসের বেশি সময় তাকে অক্ষম হয়ে পড়ে থাকতে হয়। একটা চাক্ষুষ স্মারকের মতো আপেলটা তখন তার পিঠে বিধে রয়েছে, কেউ সেটা সরাতে সাহস করল না, আর এই অবস্থা তার বাবাকে পর্যন্ত স্মরণ করিয়ে দিল যে গ্রেগর, তার দুর্ভাগ্যজনক ও বিতৃষ্ণা জাগানো আকৃতি সত্ত্বেও, এই পরিবারের একজন সদস্য, তার সঙ্গে শত্রুর মতো আচরণ করা উচিত নয়, বরং পারিবারিক কর্তব্য বোধ দাবি করে যে সর্বপ্রকার বিতৃষ্ণা দমন করে তার সঙ্গে ধৈর্যের সাথে আচরণ করতে হবে; ধৈর্য, আর কিছু নয়।

যদিও তার আঘাত হয়তো চিরদিনের জন্য তার চলাফেরার ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিল, আপাতত তার ঘরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে যেতে অনেক অনেকক্ষণ সময় লাগছে, একজন অথর্ব বৃদ্ধের মতো, দেয়াল বেয়ে ওঠানামার কোনো প্রশ্নই এখন ওঠে না, তবু তার নিজের কাছে মনে হল যে তার অবস্থা আগের চাইতে খারাপ হলেও এর বদলে সে যা পেয়েছে তা যথেষ্ট মূল্যবান। এখন সন্ধ্যার দিকে বসবার ঘরের দরজা খোলা থাকে; আগে তাকে দু-এক ঘণ্টা ধরে সেদিকে হাপিত্যেস করে তাকিয়ে থাকতে হত; এখন দরজাটা খোলা থাকার ফলে নিজের ঘরের অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে, পরিবারের আর সবার চোখের আড়ালে থেকে, সে ওদের সবাইকে আলোকোজ্জ্বল টেবিলের চারপাশে উপবিষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ওদের কথাবার্তা শুনছে, সবার একটা সাধারণ সম্মতি নিয়েই যেন শুনছে, আগের মতো আড়ি পেতে চুপি চুপি শোনার চাইতে যা একেবারে ভিন্ন।

সত্য বটে, ওদের কথাবার্তার মধ্যে আগের দিনের সেই প্রাণবন্ত উচ্ছলতা ছিল। তার ভ্রাম্যমাণ জীবনে হোটেলের ছোট্ট ঘরে ঠাণ্ডা বিছানায় ক্লান্ত হয়ে গা এলিয়ে দিয়ে সে সতৃষ্ণভাবে ওদের যে উচ্ছল আলাপচারিতার কথা মনে মনে ভাবত সে রকম সে আর এখন শুনছে না। বেশিরভাগ সময় এখন ওরা চুপ করে থাকে। রাত্তিরে খাবার অল্প পরেই বাবা তার আরামকেদারায় ঘুমিয়ে পড়তেন; মা আর বোন পরস্পরকে নীরব থাকতে উপদেশ দিত; মা, বাতির খুব কাছে ঝুঁকে পড়ে, একা, অন্তর্বাস-নির্মাতা সংস্থার জন্য খুব সূক্ষ্ম সেলাইর কাজ করতেন; আর তার বোন, যে বিক্রেতা-মেয়ের কাজ নিয়েছিল, এখন রাতের বেলায় শর্টহ্যান্ড আর ফ্রেঞ্চ শিখতে শুরু করেছে, এইভাবেই সে নিজের অবস্থার উন্নতি করবে। মাঝে মাঝে তার বাবা ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠতেন, তিনি যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সে সম্পর্কে একেবারে অচেতন থেকে মাকে উদ্দেশ করে বলতেন, আজ যে অনেকক্ষণ ধরে সেলাই করছো! এবং বলেই তক্ষুনি আবার ঘুমিয়ে পড়তেন, আর মহিলা দুজন তখন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত হাসি বিনিময় করতেন।

একটা অর্থহীন একগুঁয়েমি নিয়ে বাবা বাড়িতেও সারাক্ষণ তার ইউনিফর্ম পরে থাকতে শুরু করলেন; তার ড্রেসিংগাউন এখন অকেজো হয়ে দেয়ালে আটকানো একটা পেরেকে ঝুলছে; তিনি পুরো ধরা-চূড়া পরা অবস্থায় যেখানে বসে থাকতেন সেখানেই ঘুমাতেন, যেন ডাক আসামাত্র কাজে বেরিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত, যেন। এখানেও তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তার দাস। এর ফলে তার ইউনিফর্মটা, যা গোড়াতেই সম্পূর্ণ নতুন ছিল না, নোংরা দেখাতে আরম্ভ করল, তার মা ও বোন সযত্নে সেটা পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করা সত্ত্বেও তা মলিন ও অপরিচ্ছন্ন হয়ে উঠল। গ্রেগর প্রায়ই তার পোশাকের গায়ে তেল চিটচিটে দাগগুলোর দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত, দেখত তার চকচকে পলিশ করা সোনালি বোতামগুলো, লক্ষ করত ওই রকম অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেও কি গভীর প্রশান্তির সঙ্গে তিনি ঘুমাচ্ছেন।

দশটার ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে মা কোমল কণ্ঠে বাবাকে জাগিয়ে বিছানায় নিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করতেন, কারণ বসে বসে এই অবস্থায় যথার্থভাবে ঘুমানো মোটেই সম্ভব ছিল না, অথচ এখন তার পক্ষে ঘুমই ছিল সবচাইতে প্রয়োজনীয়, কারণ ঠিক সকাল ৬টায় তাকে কাজে যেতে হবে। কিন্তু ব্যাংকের বার্তাবহ হবার পর থেকে একগুঁয়েমি তাঁকে এমনই অধিকার করে বসেছে যে নিয়মিতভাবে টেবিলের পাশে ঘুমিয়ে পড়লেও তিনি ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর সময় সেখানেই বসে থাকার জন্য জেদ করতেন। শেষে প্রচুর কষ্ট করে তাঁকে তাঁর আরাম কেদারা থেকে তুলে নিয়ে তার বিছানায় শুইয়ে দিতে হত। গ্রেগরের মা আর বোন যতই সস্নেহে তাঁকে ঘুমুতে যাবার কথা মনে করিয়ে দিত, তিনি ততই, প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে, চোখ বন্ধ রেখে ধীরে ধীরে তার মাথা নাড়তেন, কিছুতেই উঠে দাঁড়াতেন না। মা তার জামার হাত ধরে টানতেন, কানে কানে ফিসফিস করে মধুর সম্ভাষণ করতেন, বোন নিজের পড়া ছেড়ে উঠে এসে মাকে সাহায্য করত, কিন্তু গ্রেগরের বাবা টলবার নয়। তিনি তার চেয়ারের মধ্যে আরো বেশি তলিয়ে যেতেন। অবশেষে মহিলা দুজন যখন বগলের নিচে হাত দিয়ে তাঁকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিত শুধু তখনই তিনি চোখ খুলে, একজনের পর একজন করে তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে, সচরাচর এই ছোট্ট মন্তব্যটি করতেন, এই হচ্ছে জীবন। আমার বৃদ্ধ বয়সে এই হচ্ছে সুখ আর শান্তি। তারপর ওদের দুজনের উপর ভর দিয়ে, অনেক কষ্টে, যেন তিনি একটা দুর্বহ বোঝা, ওদের দুজনকে তিনি দরজা পর্যন্ত তাঁকে নিয়ে আসতে দিতেন, আর তারপরই হাত নেড়ে ওদের ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে একা একা এগিয়ে যেতেন, আর তার মা নিজের সেলাই আর তার বোন নিজের কলম ফেলে দিয়ে আবার তাঁকে আরেকটু সাহায্য করবার জন্য তার দিকে ছুটে যেত।

অতিরিক্ত কর্মভার-পীড়িত ও ক্লান্তিতে জর্জরিত এই পরিবারে গ্রেগরকে নিয়ে, ন্যূনতম প্রয়োজনের বাইরে চিন্তা-ভাবনা করার সময় কার ছিল? ক্রমেই বাড়ির কাজের লোক কমতে লাগল; পরিচারিকা মেয়েটিকে ছাড়িয়ে দেয়া হল; একটি বিশালদেহী ঢ্যাঙা ঝি সকালে বিকালে এসে ভারী কাজগুলো করে দিয়ে যেত, তার সাদা চুল উড়তে থাকত মাথা ঘিরে; গাদা গাদা সেলাই করা ছাড়াও বাকি সব কাজ করতে হত গ্রেগরের মাকে। তার মা আর বোন নানা উৎসব অনুষ্ঠান ও পার্টিতে পারিবারিক যেসব অলঙ্কার সগর্বে পরতেন সেগুলো পর্যন্ত বিক্রি করতে হল। বিক্রি করে কত দাম পাওয়া গেছে একদিন সন্ধ্যায় তারা সে সম্পর্কে কথাবার্তা বলার সময় গ্রেগর ব্যাপারটা জানতে পারে। কিন্তু যার জন্য তারা সব চাইতে বেশি দুঃখ প্রকাশ করল তা এই যে, তাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বাড়িটা বড় বেশি বড়, অথচ গ্রেগরকে কীভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরিয়ে নেয়া যাবে তা তারা কিছুতেই ভেবে উঠতে পারল না। তবু, তার প্রতি বিবেচনা বোধই যে ওদের বাড়ি বদলের পথে প্রধান বাধা নয় এটা গ্রেগর স্পষ্ট বুঝতে পারল; কারণ তাকে স্থানান্তরিত করার জন্য ওরা সহজেই বাতাসের জন্য কয়েকটা ছিদ্র রেখে একটা উপযুক্ত বাক্স বানিয়ে নিতে পারত; আসলে তারা নিজেরাই এমন পরিপূর্ণ হতাশায় ডুবে গিয়েছিল, এমন একটা বিশ্বাসে ভারাক্রান্ত হয়েছিল, যে তাদের মনে হল তারাই বুঝি এই ধরনের দুর্ভাগ্যের জন্য বিশেষভাবে নির্বাচিত হয়েছে, যেরকম দুর্ভাগ্যের শিকার তাদের কোনো আত্মীয় পরিজন অথবা চেনাজানা মানুষ কখনো হয়নি, আর এই জন্যই তাদের বর্তমান বাড়ি ছেড়ে তারা অন্যত্র উঠে যেতে পারছিল না। এই দুনিয়া গরিব মানুষদের কাছ থেকে যা দাবি করে এরা তার সবকিছু কড়ায়-গণ্ডায় মিটিয়ে দিচ্ছিল; বাবা ব্যাংকের নিম কেরানিদের জন্য সকালের নাস্তা বহন করে এনে দিতেন; মা অচেনা অজানা মানুষদের অন্তর্বাস তৈরির কাজে নিজের সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন; বোন কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়িয়ে ছুটে ছুটে খদ্দেরদের ফরমাস তামিল করত, কিন্তু এর চাইতে আর বেশি কিছু করার শক্তি তাদের ছিল না। আর যখন তার মা আর বোন, বাবাকে বিছানায় শুইয়ে আবার ফিরে আসত, নিজেদের কাজ ফেলে দিয়ে দুজন দুজনের গালে গাল ঠেকিয়ে কাছাকাছি বসত, গ্রেগরের পিঠের ক্ষতটা নতুন করে তাকে যন্ত্রণা দিতে শুরু করত। মা তখন তার দরজার দিকে অঙুলি নির্দেশ করে বলতেন, গ্রেটা, ওই দরজাটা এখন বন্ধ করে দাও, আর গ্রেগর তখন আবার একা অন্ধকারের মধ্যে পরিত্যক্ত হত, আর পাশের ঘরে ওরা দুজন তখন কান্নায় ভেঙে পড়ত কিংবা হয়তো শুকনো চোখে এক দৃষ্টিতে টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকত।

রাতে কিংবা দিনে গ্রেগর প্রায় একটুও ঘুমাত না। একটা ধারণা তার মাথায় চেপে বসল; পরেরবার দরজাটা খুললেই আবার সে আগের মতো সংসারের যাবতীয় কাজকর্মের ভার নিজের মাথায় তুলে নেবে। দীর্ঘ বিরতির পর আবার তার চিন্তাভাবনার মধ্যে ফিরে এল বড়কর্তা আর মুখ্য কেরানি ভ্রাম্যমাণ বাণিজ্যিক কর্মচারীবৃন্দ, শিক্ষানবিস, আর সেই মোটামাথা দারোয়ানের ছবি; তার মনে পড়ল অন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত দুতিনজন বন্ধুর কথা, গ্রামাঞ্চলের এক হোটেলের একটি পরিচারিকা তরুণীর কথা, দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া একটি মধুর স্মৃতি, মহিলাদের টুপির দোকানে কাজ-করা একটি মেয়ের কথা, যাকে সে আন্তরিকভাবে প্রেম নিবেদন করেছিল কিন্তু বড় বেশি মন্থর গতিতে—তারা সব একসঙ্গে এসে উপস্থিত হল, এদের সঙ্গে সঙ্গে আরও এল অপরিচিত অথবা ভুলে যাওয়া কিছু মানুষ, কিন্তু তাকে বা তার পরিবারকে সাহায্য করার পরিবর্তে ওদের সবাইকে, ব্যতিক্রমহীনভাবে, দেখা গেল অনধিগম্য। ওদের কারো কাছে এগুনো যায় না, এবং ওরা যখন অদৃশ্য হয়ে গেল গ্রেগর তখন খুশিই হল। অন্য সময় হলে সে তার পরিবারের লোকজনকে নিয়ে এত মাথা ঘামাত না, ওরা যে তাকে এতটা অবহেলা করছে এজন্য তার চিত্ত ক্রোধে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। এবং কী খাবার তার পছন্দ সে সম্পর্কে তখন পর্যন্ত তার কোনো স্পষ্ট ধারণা না-গড়ে উঠলেও, ভাড়ার ঘরে গিয়ে, ক্ষুধার্ত না হলেও, যে খাবারের উপর তার ন্যায্য দাবি রয়েছে সে তা নিজেই সংগ্রহ করবার মতলব আঁটতে আরম্ভ করল। তার বোন আর আগের মতো, যে রকম খাবার তাকে বিশেষভাবে তৃপ্তি দিতে পারত সেরকম খাবার তার জন্য নিয়ে আসত না। ভোরবেলায় কিংবা দুপুরে, নিজের কাজে বেরিয়ে যাবার আগে, সে তাড়াহুড়া করে হাতের কাছে সহজে যা খাবার মিলত তাই পা দিয়ে তার ঘরের মধ্যে ঠেলে দিত, আর তারপর সন্ধ্যার সময় ঝাটার এক বাড়িতে সব পরিষ্কার করে নিয়ে যেত, গ্রেগর শুধু একটু চেখে দেখেছে নাকি কিছুই খায়নি—যা ক্রমেই বেশি বেশি করে ঘটতে লাগল—সে বিষয়ে তার বোন কোনো দৃষ্টিই আর। দিত না। এখন রাত্তিরে তার ঘরও সে পরিষ্কার করত কোনোরকমে, অত্যন্ত তাড়াহুড়া করে। দেয়ালের গায়ে ময়লার রেখা পড়ে থাকত, এখানে ওখানে পড়ে থাকত ধুলো আর নোংরা বস্তুর গোল্লা। প্রথমদিকে তার বোন ঘরে ঢুকতেই গ্রেগর বিশেষভাবে অপরিষ্কার কোনো একটা কোণায় গিয়ে নিজের অবস্থান নিত, যেন এর মাধ্যমে সে তার বোনকে তিরস্কার করছে। কিন্তু দেখা গেল, ওখানে এক সপ্তাহ বসে থাকলেও তার বোনকে দিয়ে অবস্থার উন্নতি-বিধানে সে কিছুই করাতে পারবে না। ময়লাগুলো ঠিক তার বোনের চোখে পড়ত, ওর নিজের মতই, কিন্তু সে মন স্থির করে ফেলেছিল যে ওগুলো সে সরাবে না। অথচ, অদ্ভুত এক স্পর্শকাতরতা নিয়ে, যার দ্বারা পরিবারের সকলেই আক্রান্ত মনে হল, সে গ্রেগরকে দেখাশোনার কাজে তার একক অধিকারকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে রক্ষা করে যেতে লাগল। তার মা একবার তার ঘরটা আগাগোড়া খুব ভালো করে পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন, এজন্য বালতি বালতি জল ঢালতে হয়েছিল; ঘরটা সঁতসেঁতে হয়ে যাওয়ায় অবশ্য গ্রেগরের খুব অস্বস্তি বোধ হয়েছিল, সে মুখ গোমড়া করে নিশ্চল হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে সোফার উপর শুয়েছিল, কিন্তু এজন্য তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হয়। সেদিন সন্ধ্যায় তার ঘরের পরিবর্তিত রূপ দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার বোন রাগে আগুন হয়ে বসবার ঘরে ছুটে যায়, আর তার মা ওপর দিকে দুহাত তুলে অনুনয় করা সত্ত্বেও সে কেঁদে ভাসিয়ে দেয়, আর তার বাবা-মা—অবশ্যই বাবা ইতোমধ্যে, চমকে, চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে। দাঁড়িয়েছিলেন প্রথমে অসহায় বিস্ময়ে তাকে লক্ষ করলেন, আর তারপরই ওরা সবাই প্রচণ্ড হৈ চৈ শুরু করে দিল। তার ডান দিকে দাঁড়ানো মাকে বাবা তিরস্কার করলেন, গ্রেগরের ঘর পরিষ্কার করার দায়িত্ব কেন তিনি গ্রেগরের বোনের উপর ছেড়ে দেননি, আর তার বাঁ দিকে দাঁড়ানো গ্রেগরের বোনের দিকে তাকিয়ে তিনি চিৎকার করে বললেন, সে যেন আর কক্ষনো গ্রেগরের ঘর পরিষ্কার করতে না যায়; ওদিকে তার মা, বাবাকে উত্তেজনায় প্রায় সম্বিতহারা হয়ে যেতে দেখে, হাত ধরে তাঁকে তাঁর নিজের ঘরে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন; আর তার বোন ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে তার ছোট মুষ্টিবদ্ধ দুহাত দিয়ে ক্রমাগত টেবিলে আঘাত করতে থাকল; আর গ্রেগর ভীষণ চটে গিয়ে সজোরে হিসহিস করে উঠল, কারণ তাকে এই দৃশ্য আর এত গোলমালের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য ওদের কেউ দরজাটা বন্ধ করে দেবার কথা পর্যন্ত ভাবেনি।

তবুও দৈনন্দিন কাজের চাপে অবসাদগ্রস্ত হয়ে তার বোন আগের মতো গ্রেগরকে দেখাশোনার ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করলেও এই কাজে মার নাক না গলালেও চলত, আর গ্রেগরকে অবহেলা করারও কোনো দরকার ছিল না। সেই ঠিকা-কাজের মহিলা তো ছিল। তার শক্তসমর্থ ঢ্যাঙা শরীরের ওপর দিয়ে এই দীর্ঘ জীবনে অনেক ঝড়ঝাঁপ্টা বয়ে গেছে, সব সে সহ্য করতে পেরেছে, গ্রেগরকে দেখে তার ভয় বা বিতৃষ্ণা হত না। একদিন সে হঠাৎ, কোনোরকম কৌতূহল ছাড়াই, তার ঘরের দরজা খুলে ফেলেছিল। গ্রেগর চমকে গিয়ে ঘরময় ছোটাছুটি করতে শুরু করে দিয়েছিল, যদিও কেউ তাকে তাড়া করেনি। ওই মহিলা তাকে দেখে দুহাত বুকের উপর জড়ো করে শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর থেকে রোজ সকাল-সন্ধ্যায় সে এক মুহূর্তের জন্য দরজাটা একটু ফাঁক। করে তাকে এক নজর দেখে নিতে কক্ষনো ভুল করত না। প্রথমদিকে সে, তার ধারণায় বন্ধুর মতো ভঙ্গিতে, তাকে নিজের কাছে আসার জন্য ডাকত, যেমন বলত, এই যে গুবরে পোকা মশাই, আসুন এদিকে। কিংবা দেখ, দেখ, বদমাশ গুবরে পোকাটাকে দেখ! গ্রেগর এইসব আহ্বানে কোনো সাড়া দিত না, নিজের জায়গায় নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, এমন ভাব দেখাত যেন তার ঘরের দরজা খোলাই হয়নি। ওর খেয়াল খুশিমতো এরকম অর্থহীনভাবে তাকে বিরক্ত করার পরিবর্তে ওদের উচিত ছিল তাকে, ওই মহিলাকে, ওর ঘরটা রোজ পরিষ্কার করার নির্দেশ দেওয়া। একদিন, খুব ভোরে—জানালার শার্সির উপর তখন জোর বৃষ্টির ঝাঁপটা এসে পড়ছিল, বোধ হয় বসন্ত আগতপ্রায় তার সংকেত—ওই মহিলা। তাকে উদ্দেশ করে কথা বলতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেগর ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে তার দিকে ছুটে গেল, যেন তাকে সে আক্রমণ করবে, অবশ্য সে অগ্রসর হল। অত্যন্ত ধীরে ধীরে, এবং খুব দুর্বলভাবে। তাকে দেখতে পেয়ে ঠিকা মেয়েলোকটি কিন্তু একটুও ভয় না পেয়ে, দরজার পাশেই রক্ষিত একটা চেয়ার উঁচু করে ধরে, নিজের মুখ ব্যাদান করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, পরিষ্কার বোঝা গেল যে হাতের চেয়ারটা গ্রেগরের পিঠের উপর সজোরে নামিয়ে দেবার পরই সে তার মুখ বন্ধ করবে। গ্রেগর ঘুরে দাঁড়াতেই ও বলল, তাহলে আর তুমি কাছে এগুচ্ছ না?, বলেই সে আবার নীরবে চেয়ারটা যথাস্থানে এক কোণায় রেখে দিল।

ইদানীং গ্রেগর প্রায় কিছুই খেত না। যে জায়গায় তার জন্য খাবার মেলে রাখা হত শুধু তার সামনে দিয়ে কখনো যেতে হলে সে খেলাচ্ছলে কিছু একটা মুখে তুলে, ঘণ্টাখানেক সেটা মুখের মধ্যে রেখে, সাধারণত আবার সেটা থু করে ফেলে দিত। প্রথমে সে ভেবেছিল যে তার ঘরের অবস্থা দেখে মন খারাপ হয়ে যাওয়ায় সে খেতে পারছে না, কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই সে ঘরের বহুল পরিবর্তিত অবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে গেল। ইতোমধ্যে পরিবারের সবার একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল; যখনই কোনো জিনিসের অন্যত্র স্থান সংকুলান হত না তখনই তারা সেসব জিনিস গ্রেগরের ঘরে ঠেলে ঢুকিয়ে দিত, বিশেষ করে যখন একটা ঘর। তিন ভদ্রলোকের কাছে ভাড়া দেয়া হল তারপর থেকে। এই ভারিক্কি ভদ্রলোকদের, এদের তিনজনই ছিল ঘন শ্মশ্রুমণ্ডিত, গ্রেগর একদিন দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছে, এরা ছিল শৃঙ্খলার ব্যাপারে প্রচণ্ড উৎসাহী, শুধু তাদের নিজেদের ঘরের জিনিসপত্রের ক্ষেত্রে নয়, বরং, যেহেতু তারা এখন এই বাড়িরই সদস্য, সমস্ত জিনিসপত্রের ক্ষেত্রেই, বিশেষ করে রান্নাঘরের। নোংরা তো বটেই, কোনো রকম ফালতু জিনিসই তারা বরদাস্ত করতে পারত না। এই জন্য দেখা গেল যে অনেক কিছুই বাদ দেয়া যায়, অথচ সেসব বিক্রি করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ নেই, আবার সেগুলো ফেলেও দেয়া যায় না। সেইসব জিনিস গ্রেগরের ঘরে ঠাই পেল। ছাই-র হাঁড়ি, রান্নাঘরের ময়লার ঝুড়িও। তাৎক্ষণিকভাবে কোনো জিনিসের প্রয়োজন না থাকলেই ওই কাজের মহিলা তা গ্রেগরের ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিত, আর সে তার সব কাজই করত তাড়াহুড়া করে। সৌভাগ্যবশত গ্রেগর শুধু বস্তুটা দেখত, সেটা যাই হোক না কেন, আর বস্তুটা ধরে থাকা হাতটি। হয়তো মহিলার ইচ্ছা ছিল সুযোগ-সুবিধা মতো সে জিনিসগুলো এখান থেকে আবার সরিয়ে নিয়ে যাবে, কিংবা সব জড়ো করে একসঙ্গে বাইরে ফেলে দেবে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে সে জিনিসগুলো যেখানে ছুঁড়ে ফেলল সেখানেই পড়ে থাকল। মাঝে মাঝে শুধু একটা ব্যতিক্রম ঘটত, যখন গ্রেগর আবর্জনার স্তুপ ভেদ করে, ঠেলে, সামনে এগুতো তখন জিনিসগুলো কিছুটা নড়েচড়ে যেত; প্রথমে তাকে একাজটা করতে হয় প্রয়োজনের তাগিদে, কারণ নড়ে বেড়াবার মতো যথেষ্ট জায়গা তার ছিল না, কিন্তু পরে এর মধ্যে সে ক্রমবর্ধমান আনন্দ পেতে শুরু করল, কিন্তু এই জাতীয় প্রতিটি অভিযানের পর ক্লান্তি ও বিষণ্ণতায় মৃতপ্রায় হয়ে তাকে কয়েক ঘণ্টা নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকতে হত। ভাড়াটে ভদ্রলোকেরা প্রায়ই বাড়ির সবার ব্যবহৃত বসবার ঘরে রাত্রির খাবার খেতেন, তখন অনেক রাত্রিতেই বসবার ঘরের দরজাটা বন্ধ থাকত, গ্রেগর কিন্তু এই দরজা বন্ধ থাকার ব্যাপারটার সঙ্গে সহজেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিল, কারণ মাঝে মাঝে কোনো রাত্তিরে দরজা খুলে দিলেও গ্রেগর তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নিজের ঘরের সবচাইতে অন্ধকার কোণটিতে, পরিবারের সবার দৃষ্টির আড়ালে, চুপচাপ পড়ে থাকত। কিন্তু একদিন কাজের মহিলা দরজাটা একটু খোলা রেখে দিয়েছিল, এবং ভাড়াটেরা নৈশাহারের জন্য ঘরে ঢোকার পরও বাতি-জ্বালিয়ে দেবার পরও, দরজাটা খোলা পড়ে রইল। ওরা টেবিলের মাথার দিকে আসন নিল, যেখানে আগে গ্রেগর এবং তার মা-বাবা বসে আহার করতেন; এখন ওরা সেখানে বসে ন্যাপকিনের ভাঁজ খুলল, হাতে তুলে নিল ছুরি আর কাঁটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অন্য দরজা দিয়ে, হাতে মাংসের পাত্র নিয়ে, তার মা ঘরে ঢুকলেন এবং তার প্রায় পেছনে পেছনে হাতে উঁচু-করে বোঝাই আলুর ডিশ নিয়ে ঢুকল তার বোন। ভাড়াটে তিনজন মুখে দেবার আগেই তাদের সামনে স্থাপিত খাবার মাথা নিচু করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। বস্তুতপক্ষে মাঝে বসা লোকটি, যাকে এই বিষয়ে অন্য দুজন চূড়ান্ত কর্তাব্যক্তি রূপে বিবেচনা করে বলে মনে হল, তার প্লেটে রাখা এক টুকরা মাংস কেটে দেখল, স্পষ্টতই সেটা নরম, না শক্ত, নাকি আবার রান্নাঘরে ফেরত পাঠাতে হবে তা পরীক্ষা করে দেখল। সে সন্তোষ প্রকাশ করতেই, তার মা আর বোন, যারা এতক্ষণ চিন্তাকুল মুখে লোকটির দিকে তাকিয়েছিল, সহজভাবে নিঃশ্বাস ফেলে হাসতে শুরু করল।

পরিবারের সদস্যরা এখন রান্নাঘরে আহার করে। তা হলেও, রান্নাঘরে যাবার আগে গ্রেগরের বাবা টুপি হাতে নিয়ে, মাথা নিচু করে দীর্ঘ অভিবাদন জানিয়ে, এই ঘরের টেবিলটা একবার প্রদক্ষিণ করতেন। ভাড়াটে তিনজন তখন উঠে দাঁড়িয়ে তাদের দাড়ি-গোঁফের আড়াল থেকে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলত। তারপর আবার একা হলেই প্রায় সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যে তারা তাদের আহারপর্ব সমাধা করত। গ্রেগরের একটা ব্যাপার খুব আশ্চর্য মনে হল; টেবিলের ওখান থেকে নানা ধরনের যেসব শব্দ আসছিল তার মধ্যে সে সর্বদা ওদের দাঁত দিয়ে খাবার চিবানোর শব্দটা স্পষ্ট আলাদা করে বুঝতে পারত। এটা যেন গ্রেগরকে সংকেতে বলে দিচ্ছে যে খাবার জন্য একজনের দাঁত প্রয়োজন, এবং দন্তহীন মাড়ি নিয়ে, তা সেটা যত নিপুণই হোক-না-কেন, কেউ কিছু করতে পারে না। গ্রেগর বিমর্ষভাবে আপন মনে বলল, আমি বেশ ক্ষুধার্ত, কিন্তু ওই রকম খাবারের জন্য নয়। এহ্, ওই ভাড়াটেগুলো কী রকম গোগ্রাসে গিলছে, আর আমি এদিকে উপোস করে মরছি।

সেদিন রাতেই—এতদিনের মধ্যে একবারও বেহালার শব্দ শুনেছে বলে গ্রেগরের মনে পড়ল না—রান্নাঘর থেকে বেহালা বাজাবার শব্দ ভেসে এল। ভাড়াটেদের খাওয়া ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছিল; মাঝের ভদ্রলোক একটা খবরের কাগজ বার করে, তার মধ্য থেকে একটি পাতা নিয়ে অপর দুজনের একজনকে, এবং আরেকটি পাতা নিয়ে অন্যজনকে দিল, আর তারপর তারা আরাম করে আসনে পিঠ হেলিয়ে কাগজ পড়তে এবং ধূমপান করতে লাগল। বেহালা বাজানো শুরু হতেই তারা কান খাড়া করে শুনল, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর পা টিপে টিপে হলঘরের দরজার সামনে গিয়ে জড়ো হল। ওদের নড়াচড়ার শব্দ নিশ্চয়ই রান্নাঘরের ভেতরে গিয়ে পৌঁছেছিল, কারণ গ্রেগরের বাবা ভিতর থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, বেহালা বাজানোতে আপনাদের কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে ভদ্রমহোদয়গণ? এক্ষুনি বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে কিন্তু। মাঝের ভাড়াটিয়াটি বলল, ঠিক তার উল্টো। আচ্ছা, কুমারী সামসা কি এই ঘরে, আমাদের মাঝখানে এসে বাজাতে পারেন না? এখানটা তো অনেক বেশি আরামের, অনেক বেশি সুবিধাজনক। গ্রেগরের বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, যেন তিনিই বেহালা-বাদক, নিশ্চয়ই। ভাড়াটিয়ারা বসবার ঘরে এসে অপেক্ষা। করতে লাগল। দেখতে দেখতে গ্রেগরের বাবা মিউজিক স্ট্যান্ড হাতে নিয়ে উপস্থিত হলেন, মা এলেন স্বরলিপির খাতা হাতে নিয়ে, আর তার বোন বেহালা নিয়ে। তার বোন ধীরভাবে বাজাবার জন্য প্রস্তুত হল; ওর মা-বাবা কখনো এর আগে ঘর ভাড়া দেয়নি, তাই ভাড়াটিয়া সম্পর্কে তার মনে ছিল মাত্রাতিরিক্ত রকম সৌজন্যবোধ; সেই বোধের কারণে তাঁরা নিজেদের চেয়ারে আসন গ্রহণ করলেন না; বাবা, আনুষ্ঠানিকভাবে বোতাম-আঁটা তাঁর ইউনিফর্মের কোটের দুই বোতামের মধ্য দিয়ে ডান হাত ঢুকিয়ে দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন; ভাড়াটেদের একজন অবশ্য তার মাকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল, লোকটি চেয়ারটা যেখানে রাখল মা সেটাকে সেখান থেকে একটুও সরালেন না, ফলে তিনি আসন গ্রহণ করলেন এক পাশে, ঘরের এক কোণায়।

গ্রেগরের বোন বাজাতে শুরু করল, তার বাবা-মা, দুজন দুদিক থেকে, গভীর মনোযোগের সঙ্গে তার হাতের গতিভঙ্গি লক্ষ করতে লাগলেন। বাজনার সুরে আকৃষ্ট হয়ে গ্রেগর সাহস করে একটু সামনে এগিয়ে গেল, প্রকৃতপক্ষে এখন তার মাথা বসবার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। অন্যদের সম্পর্কে নিজের বিবেচনা বোধের অভাবে সে একটুও অবাক হল না, যদিও একসময় সে তার বিবেচনা বোধের জন্য রীতিমত গর্ব অনুভব করত। ঠিক এই মুহূর্তে তার আত্মগোপন করে থাকার বিশেষ কারণ ছিল, ওর ঘর ছিল ধুলোভর্তি, সামান্য একটু নড়াচড়া করলেই চারদিকে ভীষণভাবে ধুলো উড়ত, ওর নিজের সারা শরীর এখন ধুলোয় ভরা। তার শরীরে রোয়া, চুল আর খাবারের ধ্বংসাবশেষ লেগে রয়েছে, তার পিঠের উপর আর তার পার্শ্বদেশে সেগুলো আটকে রয়েছে। একসময় সে দিনে কয়েকবার উল্টেপাল্টে কার্পেটের উপর ঘষে ঘষে নিজের শরীরটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে নিত, কিন্তু এখন তার ঔদাসীন্য এমন একটা স্তরে পৌঁছেছিল যে সে এ-বিষয়ে বিন্দুমাত্র মনোযোগ দিল না। তার বর্তমান অবস্থা সত্ত্বেও বসবার ঘরের তকতকে ঝকঝকে মেঝের উপর দিয়ে আরেকটু এগিয়ে যেতে কোনোরকম লজ্জাবোধ তাকে কিছুমাত্র বাধা দিল না।

অবশ্য, এ-কথা ঠিক, কেউ তার উপস্থিতি টের পায়নি। পরিবারের সবাই বাজনার ভেতর গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিল। ভাড়াটেদের ক্ষেত্রে কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্নতর দেখা গেল। প্রথমে তারা দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে মিউজিক স্ট্যান্ডের পেছনে, খুব কাছে, অবস্থান নিল, যেন স্বরলিপি নিজেরা পড়তে পারে। এতে তার বোন নিশ্চয়ই বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল; কিন্তু একটু পরেই ওরা জানালার কাছে। গিয়ে মাথা নিচু করে ফিসফিস করে কী সব বলাবলি করল। গ্রেগরের বাবা। চিন্তিতমুখে ওদের দিকে তাকালেন; ওরা কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকল। প্রকৃতপক্ষে, ভালো কিংবা উপভোগ্য বেহালাবাদন শুনবার তাদের প্রত্যাশা যে পূর্ণ হয়নি, এক্ষেত্রে যে তারা হতাশ হয়েছে, সেটা তারা বেশ স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিল। বস্তুতপক্ষে তাদের যেন যথেষ্ট বেহালা শোনা হয়ে গেছে, এখন শুধু সৌজন্যের খাতিরে ওরা তাদের শান্তির উপর এই অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে। যেভাবে তারা সবাই মুখ উঁচু করে নাক-মুখ দিয়ে তাদের সিগারের ধোঁয়া ছাড়ছিল তাতে তাদের বিরক্তিটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। অথচ গ্রেগরের বোন ভারি সুন্দর বাজাচ্ছিল। তার বোনের মুখ একপাশে সামান্য হেলানো, তার বিষণ্ণ চোখ দুটি নিবিষ্ট স্বরলিপির পাতার উপর। গ্রেগর সুড়সুড় করে আরেকটু এগিয়ে গেল, তারপর তার মাথা মাটির কাছে নামিয়ে আনল, যেন বোনের চোখের উপর চোখ রাখা সম্ভব হয়। সংগীত তার উপর এমন প্রভাব বিস্তার করছে কেন? সে কি একটা পশু সেই জন্য? তার মনে হল যে অজ্ঞাত মানসিক পুষ্টির জন্য সে এত দিন হাপিত্যেস করে বসেছিল সেই পথ যেন এবার তার জন্য খুলে যাচ্ছে। সে স্থির করল তার বোনের আরও কাছে এগিয়ে যাবে, তার কাপড় ধরে টানবে, তাকে বেহালা নিয়ে ওর ঘরে আসতে বলবে, কারণ সে যেভাবে তার বাজনার মর্যাদা দেবে, সেটা উপভোগ করবে, এখানে কেউ তেমন করছে না। সে কক্ষনো তার বোনকে তার ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে দেবে না, অন্তত যত দিন সে বাঁচবে। তার বীভৎস চেহারা, এই প্রথমবারের মতো, তার কাজে আসবে। সে তার ঘরের সবগুলো দরজার উপর সর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখবে, জোর করে, কেউ ঢুকতে চেষ্টা করলেই তার গায়ে থুতু ছিটাবে; তবে তার বোনের উপর কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না; সে স্বেচ্ছায় তার সঙ্গে থাকবে; সোফাতে তার পাশে বসে সে তার মুখের কাছে কান নামিয়ে আনবে, তার দৃঢ় সংকল্পের কথা শুনবে, সে যে ওকে। কনসার্ভেক্টোরিয়ামে পাঠাবে বলে ঠিক করে রেখেছিল সে কথা ওকে বলবে, গত বড়দিনের সময়ই—নিশ্চয়ই বড়দিন অনেক আগে পার হয়ে গেছে—সে এ-কথা সকলের সামনে ঘোষণা করত, কারো কোনো আপত্তিতে কান দিত না। তার বোন এ-কথা শুনে অভিভূত হয়ে নিশ্চয়ই কান্নায় ভেঙে পড়বে, আর তখন গ্রেগর। নিজেকে ওর কাঁধ অবধি উঁচু করে তুলে ওর ঘাড়ে চুমু খাবে; আর তার বোন এখন বাইরে কাজে যায় বলে সেখানে কোনো রিবন বা কলারের বালাইও নেই।

মধ্যবর্তী ভাড়াটে, মি. সামসা! বলে চেঁচিয়ে গ্রেগরের বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল, তারপর আর কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে অগ্রসরমাণ গ্রেগরের দিকে অঙুলি নির্দেশ করল। সঙ্গে সঙ্গে বেহালা বাজানো থেমে গেল, আর ওই ভদ্রলোক প্রথমে তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, পরে আবার গ্রেগরের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। ভাড়াটেদের মোটেই সন্ত্রস্ত দেখাল না, বরং মনে হল বেহালা শোনার চাইতে গ্রেগরকে দেখেই যেন তারা বেশি আমোদ পাচ্ছে; কিন্তু তবু গ্রেগরের বাবা তাকে ওর ঘরে তাড়িয়ে দেবার পরিবর্তে ভাড়াটেদের আশ্বস্ত করার জন্যই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি দু-হাত প্রসারিত করে দ্রুত তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন, তাদেরকে নিজেদের ঘরে চলে যেতে ইঙ্গিত করলেন, আর সেই সাথে সাথে গ্রেগরকে তাদের চোখের আড়ালে রাখতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু এবার ওরা সত্যি সত্যি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে আরম্ভ করল, বুড়ো বাবার আচরণে, নাকি পাশের ঘরে যে গ্রেগরের মতো একজন প্রতিবেশী আছে হঠাৎ সেটা আবিষ্কার করে ফেলার জন্য, সেটা স্পষ্ট বোঝা গেল না। ওরা বাবার কাছে সমস্ত ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দাবি করল, তারই মতো হাত নাড়ল, নিজেদের দাড়ি ধরে টানল, এবং অবশেষে নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে তাদের ঘরের দিকে পা বাড়াল। ইতোমধ্যে গ্রেগরের বোন, হঠাৎ যার বাজানোতে বাধা পড়ার জন্য যে এতক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল, তখনও যার অবশ হাতে বেহালা আর ছড়িটা ধরা, নিষ্পলক চোখে যে তাকিয়ে ছিল তার স্বরলিপির পাতার দিকে, এবার মায়ের কোলে বেহালাটা গুঁজে দিল। মা তখন নিজের চেয়ারে বসে তার হাঁপানির সঙ্গে যুদ্ধ করে নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করছেন, আর বাবা ভাড়াটেদের, আগের চাইতেও দ্রুততার সঙ্গে, তাদের ঘরের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন। তার বোন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে ভাড়াটেদের ঘরে গিয়ে ঢুকল। তখন দেখা গেল যে তার অভ্যস্ত হাতে সে ভাড়াটেদের ঘরে বালিশ আর কম্বল সুশৃঙ্খলভাবে বিছানায় সাজিয়ে দিচ্ছে। ভাড়াটেরা ঘরে ভালো করে ঢুকবার আগেই তার বোন বিছানা করার কাজ শেষ। করে নিঃশব্দে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

বাবার নিজের ইচ্ছা অন্যের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবার একগুঁয়েমি মনোভাবটা আবার ভয়ানক প্রবল হয়ে উঠেছে বলে মনে হল। ভাড়াটেদের প্রতি যে কিছু শ্রদ্ধা-সৌজন্য দেখানো উচিত তা তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন। তিনি তাদেরকে ক্রমাগত ওদের ঘরের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে চললেন, শেষে প্রায় যখন ওদের শোবার ঘরের দোরগোড়ায় ঠেলে নিয়ে গিয়েছেন তখন মধ্যবর্তী ভাড়াটিয়াটি মেঝের উপর প্রচণ্ড জোরে পা ঠুকল। এবার বাবা থমকে দাঁড়ালেন। লোকটি একটা হাত উঁচু করে গ্রেগরের বাবা-মার দিকে তাকিয়ে বলল, এই বাড়িতে, এই পরিবারে, যে জঘন্য অবস্থা বিরাজ করছে, এখানে সে সজোরে মেঝেতে থুতু ফেলল, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি এই মুহূর্তে আপনাদের নোটিশ দিচ্ছি। স্বভাবতই যে সময়টা আমি এখানে বাস করেছি। তার জন্য আমি এক পয়সাও দেব না, উল্টো আপনাদের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের অভিযোগ আনার কথা আমি বিবেচনা করছি, এবং—বিশ্বাস করুন—সে দাবি সহজেই প্রমাণ করা যাবে। লোকটি কথা বলা থামিয়ে সোজা সামনের দিকে তাকাল, যেন কিছু-একটা প্রত্যাশা করছে। বস্তুতপক্ষে তার বন্ধু দুজন এই বিরতির সুযোগ নিয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমরাও এই মুহূর্তে নোটিশ দিচ্ছি। এই কথা বলেই মাঝের ভাড়াটিয়া দরজার হাতল টেনে সশব্দে তাদের ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।

গ্রেগরের বাবা হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গিয়ে ধপ করে নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন : একবার মনে হল তিনি বোধ হয় তার স্বাভাবিক সান্ধ্যকালীন স্বল্পন্দ্রিার জন্য গা এলিয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু তার মাথার সুস্পষ্ট নড়াচড়া, মনে হল এই নড়াচড়াটা এখন চলছে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, বুঝিয়ে দিল যে তিনি মোটেই ঘুমাচ্ছেন না। গ্রেগর এতক্ষণ ভাড়াটিয়া তাকে যেখানে দেখেছিল ঠিক সেই এক জায়গায় চুপ করে অবস্থান করছিল। নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না করতে পারার হতাশায় এবং ভীষণ ক্ষুধার কারণে দুর্বলতার জন্য, সে একটুও নড়তে পারল না। তার আশঙ্কা হল, এ বিষয়ে সে প্রায় সুনিশ্চিত হল যে, যে-কোনো মুহূর্তে পরিস্থিতির অস্থিরতা-উত্তেজনা এমন স্তরে পৌঁছে যাবে যে সবাই তখন সম্মিলিতভাবে তাকে। আক্রমণ করার জন্য তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সে চুপ করে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। এমনকি বেহালাটা যখন তার মায়ের কোল থেকে, তাঁর কাঁপা কাঁপা আঙুলের বাঁধন ছিন্ন করে, সশব্দে মাটিতে পড়ে গিয়ে একটা সুরেলা আওয়াজ তুলল তখনও তার ভাবভঙ্গিতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

তার বোন ভূমিকা স্বরূপ টেবিলে হাতের চাপড় মেরে বলল, বাবা-মা, এরকম ভাবে আর চলতে পারে না। আপনারা হয়তো এটা বুঝতে পারছেন না, কিন্তু আমি পারছি। এই প্রাণীটার সামনে আমি আমার ভাইয়ের নাম উচ্চারণ করব না : তাই আমি শুধু এটুকু বলছি যে এটাকে আমাদের তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা করতে হবে। আমরা এর যত্ন নেবার চেষ্টা করেছি, মানুষের পক্ষে যতটা সম্ভব আমরা ততটা সহ্য করেছি, আমার মনে হয় না কেউ আমাদের দোষ দিতে পারবে।

গ্রেগরের বাবা আপন মনে বললেন, ওর কথা একদম ঠিক। আর তার মা, এখনও ভালোভাবে নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে তাঁর দম আটকে আসছে, মুখে হাত চাপা দিয়ে কেশে উঠলেন, তার চোখে ফুটে উঠল উদ্ৰান্ত দৃষ্টি।

বোন ছুটে গিয়ে মায়ের কপালে হাত রাখল। গ্রেটার কথা শুনে বাবার ভাবনারাজি যেন অস্পষ্টতার কুয়াশা ছিঁড়ে বেরিয়ে এল; তিনি তাঁর চেয়ারে পিঠটান করে বসলেন, খাবার টেবিলে এখনো পড়ে থাকা তার টুপিটা আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করলেন, আর মাঝে মাঝে গ্রেগরের নিশ্চল মূর্তির দিকে চোখ তুলে তাকালেন।

মা তখনো এত কাশছিলেন যে গ্রেটার কোনো কথা তার কানে যাচ্ছিল না। তাই গ্রেটা এবার সরাসরি বাবাকে লক্ষ করে বলল, এটাকে তাড়িয়ে দিতে আমাদের চেষ্টা করতেই হবে, নইলে আপনারা দুজনেই মারা পড়বেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সেটা। আমাদের এখন কী ভীষণ পরিশ্রম করতে হচ্ছে, আমাদের সবাইকে, এর উপর বাড়িতে এই রকম নিরন্তর অত্যাচার আর সহ্য করা যায় না। অন্তত আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বলতে বলতে সে উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়ল, টপ টপ করে তার চোখের জল পড়ল মায়ের মুখের উপর, আর যন্ত্রের মতো সে ওই অশ্রু মুছে ফেলতে লাগল।

বৃদ্ধ বাবা স্পষ্টতই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সহানুভূতির সঙ্গে বললেন, কিন্তু, মা, আমরা কী করতে পারি?

গ্রেগরের বোন অসহায়ভাবে শুধু কাঁধ কোঁচকাল। তার আগেকার আত্মবিশ্বাস ততক্ষণে কান্নার দমকে ধুয়েমুছে নিঃশেষ হয়ে গেছে।

বাবা কতকটা প্রশ্ন তোলার ভঙ্গিতে বললেন, ও যদি আমাদের কথা বুঝতে পারত। গ্রেটা তখনো কাঁদছিল, সেই অবস্থাতেই সে সজোরে হাত তুলে সেটা যে অচিন্ত্যনীয় তা ইঙ্গিতে জানিয়ে দিল।

গ্রেগরের পক্ষে বোঝা যে অসম্ভব, কন্যার এই প্রত্যয়কে খতিয়ে দেখার। উদ্দেশ্যে বাবা চোখ বন্ধ করে আবার বললেন, সে যদি আমাদের কথা বুঝতে পারত তাহলে আমরা হয়তো তার সঙ্গে কোনো একটা চুক্তিতে উপনীত হতে পারতাম, কিন্তু এই অবস্থায়—

গ্রেগরের বোন চিৎকার করে বলল, ওকে যেতেই হবে, এইটেই একমাত্র সমাধান, বাবা। এই জিনিসটা যে গ্রেগর আপনাকে সে-ধারণা ত্যাগ করার চেষ্টা করতে হবে। আমরা যে এতকাল এটা বিশ্বাস করে এসেছি সেটাই আমাদের সকল দুঃখ-দুর্দশার মূলে। কিন্তু এটা কেমন করে গ্রেগর হতে পারে? এটা যদি গ্রেগর হত তাহলে সে বহু আগেই বুঝতে পারত যে এরকম একটি প্রাণীর সঙ্গে কোনো মানুষ বাস করতে পারে না, তখন নিজের ইচ্ছাতেই সে এখান থেকে চলে যেত। তাহলে আমাদেরও কোনো হাঙ্গামা পোহাতে হত না, আমরা তার স্মৃতিকে সসম্মানে লালন করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই প্রাণীটা আমাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, আমাদের ভাড়াটিয়াদের হাঁকিয়ে দিচ্ছে, গোটা বাড়িটা নিজের অধিকারে রাখতে চাইছে; পারলে সে যেন আমাদের সবাইকে ঘুমোবার জন্য নর্দমায় পাঠিয়ে দিত। দেখুন, বাবা, গ্রেটা হঠাৎ তীক্ষ্ণ্ণ চিৎকার করে উঠল, আবার শুরু করেছে ও! ভয়ে দিশাহারা হয়ে গেল সে; ব্যাপারটা গ্রেগরের কাছে মোটেই বোধগম্য হল না; তার বোন মাকে ত্যাগ করে, তার কাছ থেকে ঠেলে চেয়ারটা সরিয়ে দিয়ে, অন্যদিকে ছুটে সরে গেল, যেন গ্রেগরের অত কাছে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব; সে গিয়ে বাবার পিছনে অবস্থান নিল, আর তার বাবাও ওর অস্থিরতায় বিমূঢ় হয়ে, ওকে যেন আশ্রয় দেবার জন্য, দু-হাত অর্ধপ্রসারিত করে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

অথচ কাউকে ভয় পাইয়ে দেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা গ্রেগরের ছিল না, তার বোনকে তো নয়-ই। সে শুধু হামাগুড়ি দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে যাবার জন্য ঘুরতে শুরু করেছিল, কিন্তু ব্যাপারটা ছিল সত্যিই দেখে চমকে যাবার মতো, কারণ তার বর্তমান অবস্থায় শরীর ঘোরাবার মতো কঠিন কাজ করার জন্য তাকে নিজের মাথাটা তুলে বারবার সেটা মেঝেতে ঠেকিয়ে শক্তি আর গতিবেগ সংগ্রহ করে নিতে হচ্ছিল। সে একটু থেমে চারদিকে তাকিয়ে দেখল। মনে হল তার সদিচ্ছা এখন সবাই উপলব্ধি করেছে, ওদের আতঙ্কটা ছিল তাৎক্ষণিক। এখন ওরা সবাই নীরবে বিষণ্ণভাবে তাকে লক্ষ করছে। মা তার চেয়ারে শুয়ে আছেন, পা দুটো জড়ো করে শক্তভাবে সামনে মেলে দিয়েছেন, ক্লান্তিতে তার দুচোখ প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে এসেছে; বাবা আর বোন পাশাপাশি বসে আছে, তার বোনের বাহু বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আছে।

গ্রেগর ভাবল এবার বোধ হয় আমি আবার ঘুরে দাঁড়াবার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারি। সে পুনরায় পরিশ্রম করতে শুরু করল। কিন্তু সশব্দে হাপাতে হাঁপাতে নিঃশ্বাস নেয়াটা সে বন্ধ করতে পারল না; মাঝে মাঝে তাকে তার সকল প্রয়াস থামিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে হল। তবে কেউ তাকে কোনো কষ্ট দিল না, তাকে বিন্দুমাত্র ব্ৰিত করল না, তাকে নির্বিবাদে নিজের কাজ চালিয়ে যেতে দিল। সম্পূর্ণ ঘোরার কাজটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সুড়সুড় করে সোজা নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। তার বর্তমান অবস্থান থেকে তার ঘরের দূরত্ব দেখে সে অবাক হয়ে গেল, নিজের দুর্বল অবস্থায়, অল্প একটু আগে, সে কীভাবে এই দূরত্বটুকু অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল তা সে বুঝতে পারল না। তখন যেন সে এটা লক্ষই করেনি। যত দ্রুত গতিতে সম্ভব সে গুটিগুটি পায়ে একাগ্রচিত্তে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল, ওরা সবাই যে একটি শব্দও উচ্চারণ করল না, কোনোরকম বিস্ময়সূচক ধ্বনি পর্যন্ত করল না, এটা সে লক্ষও করল না। কেউ তার অগ্রগতিতে বাধা দিল না। একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে সে তার মাথা ঘুরাল, পুরোপুরি নয়, কারণ তার ঘাড়ের মাংসপেশি শক্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, কিন্তু যতটুকু ঘোরাতে পারল তাতেই সে দেখল যে সবকিছু যেমন ছিল তেমনি আছে, শুধু তার বোন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার শেষ দৃষ্টি গিয়ে পড়ল মায়ের ওপর, যিনি তখনো পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়েননি।

সে ভালো করে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই তার দরজাটা ঠেলে, বল্ট লাগিয়ে, তালা বন্ধ করে দেয়া হল। পিছনের দিকে হঠাৎ ওই রকম শব্দ শুনে সে এমন চমকে গেল যে তার ছোট ছোট পাগুলো অবশ হয়ে পড়ল। এই প্রচণ্ড তাড়াহুড়াটা করল তার বোন। সে এর জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, ঠিক সময়ে এক লাফে সে সামনে ছুটে আসে, গ্রেগর টেরও পায়নি সে কখন এসেছে। এবার দরজার তালায় চাবি লাগাতে লাগাতে তার বোন বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলল, এতক্ষণে!

অন্ধকারে চারপাশে তাকাতে তাকাতে গ্রেগর নিজেকে প্রশ্ন করল, এখন কী হবে? অল্পক্ষণের মধ্যেই সে আবিষ্কার করল যে এখন সে আর তার একটি অঙ্গও নাড়াতে পারছে না। এতে সে অবাক হল না, বরং তার ওই দুর্বল ছোট ছোট পা নিয়ে সে যে সত্যি সত্যি নড়ে বেড়াতে পেরেছিল সেটাই তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হল। এছাড়া তুলনামূলক তার ভালই লাগছিল। সত্য বটে, তার সারা শরীর ব্যথা করছিল, কিন্তু ব্যথাটা মনে হল ক্রমেই কমে আসছে, এবং অবশেষে হয়তো একদম বন্ধ হয়ে যাবে। পিঠের উপর আটকে-থাকা পচা আপেলটা ও তার পাশের লাল হয়ে-ওঠা অংশ ইতোমধ্যেই তাকে আর বিশেষ যন্ত্রণা দিচ্ছিল না। সে সমতার সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে, নিজের পরিবারের লোকজনদের কথা ভাবল। তাকে যে চলে যেতে হবে এই সিদ্ধান্ত সে দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করল, সম্ভব হলে তার বোনের চাইতেও বেশি দৃঢ়তার সঙ্গে। এইভাবে নির্ভার ও প্রশান্ত ধ্যানে সে অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিল। অবশেষে টাওয়ারের ঘড়িতে যখন সকাল তিনটা বাজবার ঘণ্টাধ্বনি হল তখন তার আত্মসমাহিত ভাবটা কাটল। তখন জানালার বাইরে এই ধরণীতে ক্রমসম্প্রসারমাণ আলোর প্রথম ছটা আরেকবার তার চেতনায় ধরা পড়ল। তার মাথা আপনা থেকে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ল আর তার নাক থেকে নির্গত হল তার শেষ নিঃশ্বাসের মৃদু মন্থর বায়ু।

পরদিন খুব ভোরে যখন ঠিকা-কাজের মহিলাটি এল—তার গায়ের জোর আর অসহিষ্ণুতা এই দুই মিলে সে বাড়ির দরজাগুলো খুলত আর লাগাত ভীষণ শব্দ করে—তাকে হাজার বার এরকম করতে নিষেধ করেও কোনো লাভ হয়নি, ফলে সে বাড়িতে ঢুকবার পর পুরো এপার্টমেন্টে কারো পক্ষে আর শান্তিতে ঘুমোবার উপায় ছিল না-তখন গ্রেগরের ঘরে তার স্বাভাবিক উঁকি দিয়ে সে অস্বাভাবিক কিছুই লক্ষ করল না। সে ভাবল গ্রেগর ইচ্ছা করে নিশ্চল হয়ে পড়ে রয়েছে, ভান করছে যেন তার মন-মেজাজ খুব খারাপ। যেহেতু তখন তার হাতে ছিল লম্বা দণ্ডবিশিষ্ট আঁটাটা, তাই তার সাহায্যে সুড়সুড়ি দিয়ে সে ওকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করল। কিন্তু যখন তাতেও গ্রেগরের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না তখন মহিলা চটে উঠে ঝাঁটাটা দিয়ে তাকে আরেকটু জোরে ধাক্কা দিল, এবং যখন তাকে মেঝের উপর দিয়ে ঠেলে সরিয়ে নিয়ে যাবার সময়ও সে কোনো রকম প্রতিরোধের সম্মুখীন হল না শুধু তখনই তার কৌতূহল জাগ্রত হল। ব্যাপারটা যে সত্যি সত্যি কী সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে অবশ্য তার খুব বেশিক্ষণ লাগল না, আর তখন তার চোখ দুটি বিস্ফারিত হল, সে শিস দিয়ে উঠল, কিন্তু এ নিয়ে বিশেষ সময় নষ্ট না করে সে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সামসাদের শোবার ঘরের দরজা খুলে, অন্ধকারের মধ্যে, তার গলায় যতটা জোর আছে ততটা জোর। দিয়ে চিৎকার করে উঠল, এই যে, এসে দেখুন, মরে গেছে ওটা। ওইখানে মরে। পড়ে রয়েছে, অক্কা পেয়েছে একদম!

মি. এবং মিসেস সামসা তাঁদের জোড়া খাটে চমকে উঠে বসলেন। ওই মহিলার আকস্মিক ঘোষণায় ওরা এমন চমকে গিয়েছিলেন যে তার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে তাদের কিছুটা সময় নিল। কিন্তু তারপরই ওঁরা দ্রুত খাট ছেড়ে উঠে পড়লেন, দুজন দুদিক দিয়ে, মি. সামসা গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে নিলেন, মিসেস সামসার পরনে শুধু তাঁর রাত্রিবাস, ওই ভাবেই তারা গ্রেগরের ঘরে ঢুকলেন। ইতোমধ্যে বসবার ঘরের দরজাও খুলে গেল; ভাড়াটিয়ারা আসার পর থেকে গ্রেটা ওখানেই ঘুমাত; সে পুরো পোশাক পরে আছে, মনে হল সে শুতেই যায়নি, তার মুখের পাণ্ডুরতাও সে অনুমান সমর্থন করল। মিসেস সামসা ঠিকা ঝির দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, মরে গেছে?, যদিও তিনি নিজেই সেটা তদন্ত করে দেখতে পারতেন, অবশ্য কোনোরকম তদন্ত ছাড়াই বিষয়টা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। ঝি জবাব দিল, আমার তো তাই মনে হয়, এবং ওর কথা যে সত্য তার প্রমাণ হিসেবে হাতের লম্বা ঝাঁটাটা দিয়ে গ্রেগরের মৃতদেহ একপাশে ঠেলে অনেক দূর পর্যন্ত সরিয়ে দিল। মিসেস সামসা যেন তাকে বাধা দেবার জন্য একটু নড়ে উঠলেন, কিন্তু তারপরই নিজেকে তিনি সামলে নিলেন। মি. সামসা বললেন, যাক্, ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ। তিনি ক্রুশের চিহ্ন স্পর্শ করলেন, মহিলা তিনজনও তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করল। গ্রেটার চোখ এক মুহূর্তের জন্যও গ্রেগরের মৃতদেহের উপর থেকে সরেনি। সে বলল, দেখুন, কি রকম শুকিয়ে গিয়েছিল ও। অনেক দিন ধরেই কিছুই খাচ্ছিল না। যেভাবে খাবার দেয়া হত সেভাবেই তা ফিরে আসত। সত্যিই গ্রেগরের শরীরটা এখন দেখাচ্ছিল সম্পূর্ণ সমতল এবং শুষ্ক, তার পায়ের উপর তার শরীর আর এখন দাঁড়িয়ে ছিল না, আর তাই তাকে খুঁটিয়ে ভালো করে দেখার পথে কোনো বাধা ছিল না।

মিসেস সামসা ঈষৎ কাঁপা হাসি হেসে বললেন, গ্রেটা, তুমি একটু আমাদের সঙ্গে চল, আর গ্রেটাও, মুখ ফিরিয়ে মৃতদেহটার দিকে একবার তাকিয়ে, মা-বাবার পেছন পেছন নিজেদের শোবার ঘরে চলে গেল। কাজের মহিলা এবার দরজাটা বন্ধ করে, ঘরের জানালা হাট করে খুলে দিল। এখনও খুব ভোর, কিন্তু তবু বাতাসের মধ্যে পরিষ্কার একটা কোমলতার স্পর্শ পাওয়া গেল। হাজার হোক, মার্চ মাস তো প্রায় শেষ হয়ে এল।

এই সময় ভাড়াটিয়া তিনজন তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে প্রাতরাশের কোনো আয়োজন না দেখে অবাক হল। তাদের কথা ওরা ভুলে গিয়েছিল। মাঝের ভাড়াটিয়া বিরক্ত মুখে ঝিকে জিজ্ঞাসা করল, আমাদের নাশতা কোথায়? কিন্তু সে তার ঠোঁটের উপর আঙুল-চাপা দিয়ে, কোনো কথা না বলে, ভাবভঙ্গি দ্বারা, ইঙ্গিতে তাদেরকে গ্রেগরের ঘরে যেতে বলল। তারা তাই করল; নিজেদের কিছুটা পুরনো ও অনুজ্জ্বল কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তারা গ্রেগরের ঘরে গিয়ে তার মৃতদেহের চারপাশ ঘিরে দাঁড়াল। ওই ঘর তখন আলোয় আলোময়।

এই সময় সামসাদের শয়নকক্ষের দরজা খুলে গেল : মি. সামসা তাঁর ইউনিফর্ম গায়ে চড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, একদিকে তার স্ত্রী একটি বাহু ধরে আছেন, অন্যদিকে তাঁর কন্যা। দেখে মনে হল তারা সবাই একটু কেঁদেছেন : মাঝে মাঝে গ্রেটা তার বাবার বাহুর মধ্যে নিজের মুখ গুঁজে দিচ্ছিল।

নিজেকে মহিলা দুজনের মাঝখান থেকে মুক্ত করে নিয়ে সোজা দরজার দিকে অঙুলি নির্দেশ করে, মি. সামসা বললেন, আপনারা এই মুহূর্তে আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যান। খানিকটা অবাক হয়ে মুখে একটা দুর্বল হাসি ফুটিয়ে মাঝের ভাড়াটিয়া বলল, কী বলতে চাইছেন আপনি? অন্য দুজন পেছনে হাত নিয়ে হাতে হাত ঘষতে লাগল, যেন সানন্দে একটা প্রচণ্ড বিতণ্ডার জন্য অপেক্ষা করছে, যার মধ্য থেকে তারা নিঃসন্দেহে বিজয়ী হয়ে বেরিয়ে আসবে। মি, সামসা জবাব দিলেন, যা বলেছি ঠিক তাই বলতে চেয়েছি আমি বলেই তিনি কন্যা ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে লোকটির দিকে সোজা এগিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক প্রথমটায় মেঝের দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল, যেন তার চিন্তাভাবনাকে নতুনভাবে গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। তারপর সে মি. সামসার দিকে চোখ তুলে বলে উঠল, ঠিক আছে, তাহলে আমরা চলেই যাব। মনে হল হঠাৎ বিনয়ের বন্যায় সিক্ত হয়ে সে নতুন কোনো ব্যবস্থা প্রত্যাশা করছে। কিন্তু মি. সামসা তার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিপাত করে শুধু সংক্ষেপে দু-একবার নিজের মাথা নাড়লেন। এবার ভাড়াটিয়াটি সত্যিই লম্বা লম্বা পা ফেলে হলঘরের দিকে এগিয়ে গেল। তার দুই সঙ্গী এতক্ষণ কান খাড়া করে সব শুনছিল, কিছুক্ষণ ধরে তাদের হাত ঘষা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এখন তারা সুটসুট করে তার পশ্চাদধাবন করল, যেন ভয় পেয়েছে, মি. সামসা হয়ত তাদের আগেই হলঘরে পৌঁছে গিয়ে ওদেরকে ওদের নেতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবেন। হলঘরে গিয়ে ওদের তিনজনই র্যাক থেকে তাদের টুপি তুলে নিল, ছাতার স্ট্যান্ড থেকে তুলে নিল তাদের লাঠি, তারপর নিঃশব্দে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট ত্যাগ করল। সন্দিগ্ধচিত্তে, যে সন্দেহ অবশ্য সম্পূর্ণ তিত্তিহীন প্রমাণিত হল, মি. সামসা ও রমণী দুজন তাদের অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন, সিঁড়ির থামের উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে তারা দেখলেন যে লোক তিনটি ধীরে ধীরে কিন্তু নির্ভুলভাবে দীর্ঘ সোপান বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে, ঘোরানো সিঁড়ির একটি বাঁকে প্রতিটি তলায় তারা দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে, দু-এক মুহূর্ত পরেই আবার তাদের দেখা যাচ্ছে, ক্রমেই তারা ক্ষীয়মাণ হতে থাকল, আর সেই সঙ্গে সঙ্গে তাদের সম্পর্কে সামসা পরিবারের উৎসাহও ক্ষীয়মাণ হতে থাকল। এবং শেষে যখন কসাইর ছেলেকে দেখা গেল, মাথায় মাংসের ট্রে নিয়ে তাদের পাশ কাটিয়ে সগর্বে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে, শুধু তখনই মি. সামসা ও রমণী দুজন নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে গেলেন; মনে হল তাদের মাথা থেকে একটা বোঝা নেমে গেছে।

ওঁরা স্থির করলেন, আজকের দিনটা তারা বিশ্রাম নেবেন, একটু হাঁটতে বেরুবেন। কাজ থেকে এই অবসরটুকু নেবার অধিকার যে তারা শুধু অর্জন করছিলেন তাই নয়, এটা তাদের দরকারও হয়ে পড়েছিল। অতএব তারা তিনজন টেবিলে বসে তিনটা ছুটির দরখাস্ত লিখে ফেললেন, মি. সামসা তাঁর ব্যবস্থাপনা পরিষদের কাছে, মিসেস সামসা তার নিয়োগকর্তার কাছে আর গ্রেটা তার ফার্মের প্রধানের কাছে। তারা যখন লিখছিলেন সেই সময় কাজের মহিলাটি এসে জানাল যে তার সকালের কাজ শেষ হয়েছে এবং এখন সে যাচ্ছে। প্রথমে চোখ না তুলে ওরা মাথা নাড়ল, কিন্তু মহিলাটি যখন বিদায় না নিয়ে ওখানেই ঘুরঘুর করতে থাকল তখন বিরক্তভাবে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করে মি. সামসা জিজ্ঞাসা করলেন, কী? ও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁত বার করে হাসল, যেন সবাইকে একটা সুখবর দেবার আছে, কিন্তু ভালোভাবে তাকে প্রশ্ন না করলে সে কিছুই ভাঙবে না। তার মাথায় খাড়া হয়ে চাপানো ছিল উট পাখির পালকের ছোট একটা টুপি, তাকে কাজে নিয়োগ করার প্রথম দিন থেকেই যেটা দেখে মি. সামসা বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন, সেই টুপির পালকগুলো এখন সোল্লাসে চতুর্দিকে দোল খাচ্ছিল। মিসেস সামসা, যাকে মেয়েলোকটি অন্যদের চাইতে খানিকটা বেশি সম্মান করত, জিজ্ঞাসা করলেন, তো, ব্যাপারটা কী? ওহ, সে এমন খিলখিল করে হেসে উঠল যে তক্ষনি কিছুই বলতে পারল না, তারপর জানাল, শুধু এই যে, পাশের ঘরের ওই জিনিসটাকে নিয়ে কী করবেন তা নিয়ে আপনাদের আর ভাবতে হবে না, যা করবার আমি করে ফেলেছি। মিসেস সামসা এবং গ্রেটা যেন খুব ব্যস্ত এমনিভাবে তাদের চিঠির উপর আরও ঝুঁকে পড়লেন; মি. সামসা যখন দেখলেন যে ঠিকা-ঝি ব্যাপারটা সবিস্তারে বর্ণনা করার জন্য বিশেষ উদগ্রীব তখন তিনি দৃঢ়ভাবে হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন। কিন্তু ঝিকে যখন তার গল্পটা বলতে দেয়াই হল না, যখন তার মনে পড়ল যে তার খুব তাড়া আছে, এবং স্পষ্টতই মনোক্ষুণ্ণ হয়ে সে বলল, ঠিক আছে, চলি, বলেই সে প্রায় হিংস্রভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে সাংঘাতিক জোরে দরজা বন্ধ করে প্রস্থান করল।

মি. সামসা বললেন, ওকে আজ রাত্রেই নোটিশ দেব, কিন্তু তাঁর স্ত্রী বা কন্যা কেউ কিছু বলল না; মনে হল, যে-প্রশান্তিটুকু তারা সবেমাত্র অর্জন করেছিলেন তা ওই মেয়েলোকটি খান খান করে ভেঙে দিয়ে গেছে। ওঁরা উঠে জানালার কাছে গিয়ে দুজন দুজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। মি. সামসা নিজের চেয়ারে ঘুরে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে ওদের দেখলেন, তারপর ওদেরকে ডাক দিলেন, এই, এদিকে এস। অতীতকে অতীতের মধ্যেই থাকতে দাও। তাছাড়া, আমার প্রতি তো কিছু বিবেচনাবোধ দেখাতে পার। ওরা দুজন সঙ্গে সঙ্গে তার কথা শুনল, তাড়াতাড়ি তার কাছে এসে সস্নেহে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিল, এবং তারপর তারা দ্রুত তাদের চিঠি শেষ করে ফেলল।

এরপর তারা তিনজন একসঙ্গে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরোলেন, বিগত কয়েকমাসের মধ্যে যা তারা একবারও করতে পারেননি। তাঁরা ট্রামে চড়ে শহরের বাইরে গ্রামাঞ্চলের পথে যাত্রা করলেন। ট্রামটা, যার মধ্যে তারাই ছিলেন একমাত্র যাত্রী, উষ্ণ সূর্যালোকে ভরে গিয়েছে। নিজেদের আসনে আরাম করে হেলান দিয়ে বসে ওঁরা ওঁদের ভবিষ্যতের কথা আলোচনা করলেন। একটু খুঁটিয়ে দেখতেই দেখা গেল যে তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা মোটেই খারাপ নয়, কারণ যে চাকরি তারা পেয়েছেন, এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে তাঁরা কেউ ভালোভাবে পরস্পরের সঙ্গে কোনোরকম আলাপ-আলোচনাই করেননি, সে চাকরি-তিনটিই বেশ ভালো, এবং পরে আরও ভালো হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁদের অবস্থার ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় উন্নতি যেটা হবে সেটা হবে অন্য একটা বাসায়। উঠে যাবার জন্য। গ্রেগর যে বাসা পছন্দ করেছিল এটা হবে তার চাইতে ছোট ও সস্তা, তবে তার চাইতে ভালো জায়গায় অবস্থিত, এবং পরিচালনার দিক থেকে সহজতর। ওঁরা যখন এসব কথা বলছিলেন তখন হঠাৎ মি. আর মিসেস সামসা একটু যেন অবাক হয়েই লক্ষ করলেন, দুজনে প্রায় একইসঙ্গে, যে তাদের মেয়ের উৎসাহ-উদ্দীপনা বেশ বেড়েছে, সাম্প্রতিককালের দুঃখ-বেদনা সত্ত্বেও, যার জন্য তার গাল দুটি পাণ্ডুর হয়ে গিয়েছিল, সে এখন একটি সুন্দরী মেয়ে হয়ে ফুলের মতো ফুটে উঠেছে, তার দেহসৌষ্ঠবও হয়েছে চমৎকার। ওরা একটু চুপ করে পুরোপুরি ঐকমত্যের মধ্য দিয়ে, পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল; তারা ঠিক করলেন যে কিছুদিনের মধ্যেই ওর জন্য একটি ভালো বর খোঁজার সময় হয়ে যাবে। এবং তাদের এই নতুন স্বপ্ন এবং চমৎকার উদ্দেশ্যের সমর্থনেই যেন। তাঁদের কন্যা, ওদের ভ্রমণ যাত্রার সমাপ্তিতে, সকলের আগে লাফ দিয়ে উঠে তার তরুণ শরীরটা টানটান করে দাঁড়াল।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত