একদা একটি দ্বীপে এক জীর্ণ কুঁড়েঘরে এক বৃদ্ধ জেলে তার স্ত্রীর সাথে বসবাস করতো। তারা ছিলো খুবই দরিদ্র। বৃদ্ধ লোকটি প্রতিদিন জাল ফেলে কিছু মাছ ধরার চেষ্টা করতো। কিন্তু সে যে পরিমাণ মাছ ধরতো, তা দিয়ে তার সংসার চলতো না। একদিন সকালে সে মাছ ধরার জন্য জাল ফেললো। তারপর সে জালটা টানা শুরু করলো। জালটা উপরে উঠতেই সে ভিতরে একটি সোনার মাছ দেখতে পেলো। কিন্তু মাছটি সাধারণ মাছের মতো ছিলো না, মাছটি খাঁটি স্বর্ণের মতো জ্বলজ্বল করছিলো। হঠাৎ মাছটি মানুষের কন্ঠস্বরের মতো করে কথা বলে উঠলো, “দয়ালু বৃদ্ধ আমাকে মুক্ত করে দাও! আমাকে ঐ গভীর নীল সমুদ্রে ফিরে যেতে দাও। তোমার প্রয়োজনে আমি তোমাকে সাহায্য করবো। আমি তোমার সব ইচ্ছা পূর্ণ করে দেবো।” বৃদ্ধ জেলে মাছের কাছ থেকে এটা শুনে আশ্চর্য হলো এবং মাছটিকে বললো, “তোমার কাছ থেকে আমার কিছু দরকার নেই, তুমি সমুদ্রে ফিরে যাও, মুক্ত ভাবে সাঁতার কাটো।” সে স্বর্ণমৎস্যটিকে সমুদ্রে ছুঁড়ে দিয়ে বাড়ি চলে আসলো।
এদিকে জেলের স্ত্রী তার ফিরে আসার জন্য প্রতীক্ষা করছিলো। জেলে ফিরে আসতেই তার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা করলো আজকে সে কতটুকু মাছ ধরেছে। বৃদ্ধ জেলে উত্তর দিলো, “একটিও না। একটা সোনার মাছ ধরেছিলাম, কিন্তু ওটাকে আবার আমি সমুদ্রে ছেড়ে দিয়েছি। মাছটি মানুষের কন্ঠস্বরের মতো করে বলছিলো, আমাকে গভীর নীল সমুদ্রে যেতে দাও। তুমি যা চাবে আমি তোমার জন্য তাই করবো।”
বৃদ্ধ বলতে থাকলো, “আমি তার প্রতি দয়া অনুভব করলাম। কিন্তু মনে হলো তার কাছে চাইবার মতো কিছু নেই। তাই তাকে সমুদ্রে মুক্ত ভাবে সাঁতার কাটার জন্য ছেড়ে দিলাম।” জেলের স্ত্রী বললো, “তুমি একটা মুর্খ!” সে বললো, “সোনার মাছ ধরেছিলে ঠিক আছে। কিন্তু মাছটি ধরে রাখার মতো সাধারণ বুদ্ধিও তোমার মাথায় নেই।” আসলে জেলে স্ত্রী তার স্বামীর কার্যকলাপে মাঝে মাঝেই রাগান্বিত হতো। সে তার স্বামীকে বললো, “তুমি অন্ততপক্ষে একটি নতুন গামলা চাইতে পারতে। আমাদের যেটা আছে, সেটাতে ফাটল ধরেছে।”
স্ত্রীর জ্বালায় সে অস্থির হয়ে উঠলো। তার হাতে অন্য উপায় ছিলো না। তাই সে স্বর্ণমৎসের কাছে একটা নতুন গামলা চাওয়ার জন্য সমুদ্রের তীরে ফিরে গেলো। সে সমুদ্রের তীরে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, “স্বর্ণমৎস্য, স্বর্ণমৎস্য, তুমি তোমার লম্বা লেজ উঁচিয়ে এসো, মুখটি তোমার দেখাও।” মাছটি হাজির হলো এবং বললো, “হে বৃদ্ধ জেলে, তুমি কি চাও?” বৃদ্ধ বললো, “আমার স্ত্রী আমার প্রতি খুবই রাগান্বিত, সে আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে একটি নতুন গামলার জন্য।” মাছটি বললো, “তুমি উদ্বিগ্ন হইও না, তুমি বাড়িতে যাও, ইতোমধ্যে তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হয়ে গেছে।” এটা বলে মাছটি চলে গেলো।
খুব দ্রুতই বৃদ্ধ বাড়িতে ফিরে এলো। বৃদ্ধ দেখতে পেলো তার স্ত্রী নতুন গামলা ব্যবহার করছে। সে বাড়িতে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তার স্ত্রী চিৎকার করে বললো, “তুমি আসলেই একজন মুর্খ বৃদ্ধ, তুমি সাধারণ একটি গামলা চেয়েছো, তোমার এতটুকু বুদ্ধি হয়নি যে তুমি একটি নতুন ঘর চাইবে।” বৃদ্ধের স্ত্রী আবার বললো, “ফিরে যাও তোমার স্বর্ণমৎস্যের কাছে। তার কাছে একটি নতুন ঘর চাও। আমি এখানে আর একমুহূর্ত থাকতে পারবো না, এই ঘরের চাল যে কোন সময় ভেঙ্গে পড়বে।” বৃদ্ধ জেলে আবার সমুদ্রের তীরের গেলো এবং মাছটিকে ডাকতে লাগল, “স্বর্ণমৎস্য, স্বর্ণমৎস্য, তুমি তোমার লেজে উঁচিয়ে এসো, মুখটি তোমার দেখাও।” মাছটি সাঁতার কেটে এসে জানতে চাইলো, “আবার কি হয়েছে বৃদ্ধ?” বৃদ্ধ মাছটিকে বললো, “আমার স্ত্রীর চাওয়া অনেক বেশি, সে আমাদের পুরাতন ঘর নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না। সে একটি নতুন ঘর চাইছে।” মাছটি বললো, ” শান্ত হও আমার বৃদ্ধ বন্ধু, যেহেতু সে একটা নতুন ঘর চেয়েছে, সুতরাং এটিও পূর্ণ হবে।”
স্বর্ণমৎস্যের কথা শুনে বৃদ্ধ বাড়িতে ফিরে আসলো। সে তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। ঠিক যেখানে তার পুরাতন ঘর ছিলো, সেখানে একটি নতুন ঘর। বৃদ্ধের স্ত্রী ঘরের ভিতরে ছিলো। জেলে ঘরে ঢোকার সাথে সাথে তার স্ত্রী আগের চেয়ে বেশি ক্ষেপে উঠলো। সে তাকে চিৎকার করে গালি-গালাজ করতে করতে বললো, “তুমি সত্যিই একটি বুড়ো ভাম! তুমি অন্যকিছু চিন্তা করতে পারতে, নতুন বাড়ির চাইতে ভালো কিছু চাইতে পারতে। তুমি আাবার স্বর্ণমৎস্যের কাছে ফিরে যাও এবং আমার নতুন ইচ্ছার কথা বলো। আমি ছোটলোক হয়ে থাকতে চাই না, আমি চাই একজন সম্মানীয় নারী হতে, যাতে অন্যেরা আমাকে প্রণাম করে এবং তাদের যা করতে বলবো তাই করে।” জেলে আবার সাগরে ফিরে গেলো এবং স্বর্ণমৎস্যকে বললো, “স্বর্ণমৎস্যে, স্বর্ণমৎস্য, তুমি তোমার লেজ উঁচিয়ে উঠে এসো, মুখটি তোমার দেখাও!” মাছটি সাঁতার কেটে আসলো এবং জিজ্ঞাসা করলো, “তুমি তোমার ইচ্ছার কথা বলো?” জেলে উত্তর দিলো, “আমার স্ত্রী আমাকে ত্যাগ করেছে। আমার মনের শান্তি কেড়ে নিয়েছে।” সে আরও বললো, “সে বন্য হয়ে গেছে, সে শুধু বর্তমানকে চায় না, সে চায় সম্মানিত নারী হতে।” স্বর্ণমৎস্য বলে, “তুমি ভেঙে পড়ো না। তোমার ইচ্ছাই আমার আদেশ।”
তাই বৃদ্ধ আবার বাড়িতে ফিরে গেলো এবং তিন তলাবিশিষ্ট পাথরের বাড়ি দেখে চমকে উঠলো। অসংখ্য চাকর তার বাড়ির প্রাঙ্গণে ঘোরাফেরা করছিলো। জেলের বৃদ্ধ স্ত্রী উঁচু চেয়ারে মকমলের পোশাক পরিধান করে বসে চাকরদের আদেশ দিচ্ছিলো। বৃদ্ধ বললো, “তোমাকে অভিবাদন।” কিন্তু বৃদ্ধ মহিলা উত্তর দিলো, “কি সাহস তোমার! তুমি বোকা বৃদ্ধ হয়ে আমাকে ডাকার সাহস পাও কিভাবে, তুমি জানো না তোমার স্ত্রী এখন একজন সম্মানীয় নারী।” তার স্ত্রী খুবই রাগান্বিত হলো এবং তার চাকরদের আদেশ করলো তাকে যেন তার চোখের সামনে থেকে বের করে দেয়।
কয়েকদিন পর এক সকালে বৃদ্ধা মহিলা বৃদ্ধকে ডেকে পাঠিয়ে আদেশ করলো, “তুমি আবার স্বর্ণমৎস্যের কাছে যাও। তাকে আমার নতুন ইচ্ছার কথা জানাও, আমি রুশ সাম্রাজ্যের রাণী হতে চাই।” তাই বৃদ্ধ জেলে আবার সমুুুদ্রে গেলো এবং স্বর্ণমৎস্যকে ডাকলো, “স্বর্ণমৎস্য, স্বর্ণমৎস্য, তুমি লেজ উঁচিয়ে এসো, মুখটি তোমার দেখাও!” স্বর্ণমৎস্য জিজ্ঞাসা করলো, “তোমার পরবর্তী ইচ্ছা কী বলো বন্ধু।” বৃদ্ধ বললো আমার স্ত্রী পূর্বের মতোই খুশি নয়, সে সম্মানীয় নারী হয়ে থাকতে চায় না, সে রুশ রাণী হতে চায়।” স্বর্ণমৎস্য বললো, “চিন্তা করো না। বাড়িতে চলে যাও, তোমার স্ত্রীর সকল ইচ্ছাই পূর্ণ হয়েছে।” যখন বৃদ্ধ বাড়ি ফিরলো, সে দেখতে পেলো একটি সুউচ্চ দালান। দালানের ছাদ সোনা দিয়ে তৈরি। সিঁড়িতে অগণিত সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে। প্রাসাদটির পিছনে বাগান। বাগানে পাখিরা কিচিরমিচির করছিলো। বৃদ্ধ মহিলা একটি লাল রং-এর মকমলের সিল্কের কাপড় পরে ছিলো। সে বারান্দায় তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো।
কিছুদিন যাবার পর, বৃদ্ধ মহিলা তার রাণীত্ব নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। সে তার কর্মকর্তাদের তার স্বামীকে খুঁজে নিয়ে আসতে বললো। জেলে আসতেই সে তার নতুন ইচ্ছা সম্পর্কে বলে, “আমার ইচ্ছা মনোযোগ সহকারে শোনো। তুমি স্বর্ণমৎস্যের কাছে যাও এবং বলো, আমি রুশ রাণী হয়ে থাকতে চাই না, আমি সমুদ্রের রাণী হতে চাই। সে যেনো আমার ইচ্ছা গুলো পূর্ণ করে।” বৃদ্ধের কিছু বলার ছিলো না, কারণ সে যদি যেতে অস্বীকার করে তবে তার মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে। সে আবার সমুদ্রের তীরে গেলো এবং স্বর্ণমৎস্যকে ডাকতে লাগল, “স্বর্ণমৎস্য, স্বর্ণমৎস্য, তুমি লেজ উঁচিয়ে এসো, মুখটি তোমার দেখাও!” কিন্তু এবার কোনো স্বর্ণমৎস্য হাজির হলো না। বৃদ্ধলোক আবার ডাকতে লাগল। সে তৃতীয় বারের মতো স্বর্ণমৎস্যকে ডাকলো, তখন সমুদ্রে ঝড় শুরু হয়ে গেলো। ঝড় থেমে যাবার পর মাছটি সাঁতার কাটতে কাটতে আসলো এবং বললো, “বৃদ্ধ এবার তোমার কি ইচ্ছা?” বৃদ্ধ বললো, “লোভী বৃদ্ধা তার রাজত্ব চায় না। সে রুশ সাম্রাজ্য নিয়ে খুশী নয়, সে সমুদ্রের রাণী হতে চায়, সে চায় তুমি তার অধীনে যাও।” মাছটি বৃদ্ধকে কিছুই বললো না, সে তার লেজ ঘুরিয়ে গভীর সমুদ্রে চলে গেলো। বৃদ্ধ আবারও ফিরেআসলো এবং তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না। সে প্রাসাদের জায়গায় কুঁড়েঘর দেখতে পেলো। তার স্ত্রী নোংরা পোষাকে সেই পুরাতন ভাঙ্গা গামলার পাশে বসে আছে।