অনেক অনেক দিন আগে এক প্রাসাদে স্নো হোয়াইট নামে এক রাজকুমারী বাস করতো। তুষারের মতো ধবধবে সাদা মুখশ্রী তার। কয়লার মতো কালো চুল, গোলাপের পাপড়ির মতো লালচে ঠোঁট তার। যে কেউ তাকে প্রথম দেখলে বলে উঠবে, এ কি বিধাতার সৃষ্টি!
সেই অপরূপা সুন্দরী স্নো হোয়াইটের সৎ মা ছিলো সেই রাজ্যের রাণী। রাণী হলে কী হবে, সে ছিলো এক কুটনি মহিলা। স্নো হোয়াইট জন্মের পর পরই তার মা মারা যান, একারণে রাজা সুন্দরী কুটনি মহিলাটিকে বিয়ে করেন। রাণী শুধু কুটনি ছিলো তাই নয়। সে ছিলো কালো জাদুর উপাসক। তার কাছে ছিলো বিখ্যাত কালু জাদুর আয়না।
কুটনি রাণী তার চেয়ে সুন্দরী সবাইকে ঘৃণা করতো। একারণে সে স্নো হোয়াইটকে দাসীর মতো খাটাতো। তাকে দিয়ে বিভিন্ন কাজকর্ম করাতো। স্নো হোয়াইট খুব কর্মঠ মেয়ে। সে রাণীর সকল অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতো। স্নো হোয়াইট মনে মনে স্বপ্ন দেখতো, একদিন সে এই জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। এক সুন্দর রাজকুমার এসে তাকে তার রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাবে।
একদিন স্নো হোয়াইট গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে কুয়া থেকে পানি তুলছিলো। এমন সময় এক সুদর্শন যুবক তার সামনে এসে হাজির। স্নো হোয়াইটের গানে মুগ্ধ হয়েই তার আগমন। স্নো হোয়াইট যুবককে দেখে বেজায় লজ্জা পেল। সে যুবকের সাথে কোনো কথা না বলেই দৌড়ে প্রাসাদে ঢুকে গেলো।
প্রাসাদের ভেতর রাণী প্রতিদিন তার জাদুর আয়নাকে জিজ্ঞাসা করতো,
“আয়না! আয়না!
দেয়ালের আয়না ,
কে বেশি সুন্দরী,
আমাকে বলো না?”
জাদুর আয়না প্রতিদিন উত্তর দিতো,
“সে আবার বলতে!
তুমি ছাড়া আবার কে!”
রাণী জাদুর আয়নার উত্তর শুনে সন্তুষ্ট মনে ঘুমাতো।
কিন্তু স্নো হোয়াইট যত বড় হতে লাগলো, সে আরও সুন্দরী হয়ে উঠতে থাকলো। এমনকি সে রাণীর চেয়েও সুন্দরী হয়ে উঠলো। রাণী এটা নিয়ে স্নো হোয়াইটকে খুব হিংসা করতো।
এরপর একদিন রাণী তার জাদুর আয়নাকে জিজ্ঞাসা করলো,
“আয়না! আয়না!
দেয়ালের আয়না!
কে বেশি সুন্দরী
আমাকে বলো না?”
জাদুর আয়না বললো,
“যে হোক সে হোক
তুমি না, তুমি না।”
দুষ্টু রাণী রেগে আয়নাকে জিজ্ঞাসা করলো,
“কে সে? কে সে?
বল তুই আমাকে?”
জাদুর আয়না বললো,
“সে হলো অপরূপা
স্নো হোয়াইট!”
শয়তান অহংকারী রাণী আর্তনাদ করে উঠলো। সে রাজশিকারীকে ডেকে বললো, “স্নো হোয়াইটকে ধরে আনো। তাকে বনের গভীরে নিয়ে যাও। তারপর তাকে মেরে ফেলো। আর প্রমাণস্বরূপ তার হৃদপিণ্ড আমার কাছে নিয়ে আসো।”
হৃদপিণ্ড আনার জন্য সে শিকারীকে একটা সুন্দর বাক্স দিলো। শিকারী তাকে বনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বললো, “অভাগা স্নো হোয়াইট! আমি তোমাকে মারতে পারবো না। তুমি দৌড়ে পালিয়ে যাও। রাণীর কাছ থেকে দূরে থাকো।”
স্নো হোয়াইট খুব ভয় পেয়ে অন্ধকার বনের ভিতর দিয়ে দৌড়াতে লাগলো। এদিকে শিকারী একটা অন্য প্রাণী হত্যা করে তার হৃদপিণ্ড রাণীর কাছে নিয়ে গেলো। রাণী বুঝতেই পারলো না স্নো হোয়াইট বেঁচে আছে। রাণী ওই প্রাণীর হৃদপিণ্ড চিবিয়ে খেয়ে নিলো মনের সুখে। সে ভাবলো, সে বুঝি স্নো হোয়াইটের হৃদপিণ্ডই খাচ্ছে।
অন্যদিকে স্নো হোয়াইট দৌড়াতে দৌড়াতে বনের ভেতর একটা সুন্দর বাড়ির কাছে এসে পৌঁছালো। স্নো হোয়াইট অবাক হয়ে গেলো, সে ভাবলো, “কে এই জঙ্গলের মাঝে বসবাস করে?”
একটু পরেই সে গানের শব্দ শুনতে পেলো। ওই সুন্দর বাড়িতে আসলে থাকতো সাত বামুন। তারা হীরার খনিতে কাজ করে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছিলো।
স্নো হোয়াইটকে দেখে তারাও অবাক হলো। বামুনেরা তার সাথে পরিচিত হলো। তাদের নাম ছিলো স্লিপি, গ্রাম্পি, হ্যাপি, ডক, ডোপি, স্নিজি আর বাশফুল। তারা স্নো হোয়াইটকে রাতের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানালো। স্নো হোয়াইট সাদরে তাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করলো। সে বামুনদের সব কথা খুলে বলতেই বামুনরা দুঃখ প্রকাশ করলো। স্নো হোয়াইট বামুনদের কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে করলো। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো, সে তাদের কাছেই থেকে যাবে।
কিন্তু স্নো হোয়াইট সুখে থাকতে পারলো না। রাণী খুব দ্রুতই জানতে পারলো— স্নো হোয়াইট জীবিত। জাদুর আয়নাই তাকে বিষয়টা জানতে সাহায্য করলো।
রাণী তার জাদুর আয়নাকে আবার জিজ্ঞাসা করলো,
“আয়না! আয়না!
দেয়ালের আয়না!
কে বেশি সুন্দরী
আমাকে বলো না?”
জাদুর আয়না বললো,
“সে তুমি জানো না?
সে হলো অপরূপা
স্নো হোয়াইট!”
দুষ্টু রাণী বুঝতে পারলো শিকারী তার সাথে জোচ্চুরি করেছে। সে সিদ্ধান্ত নিলো, এবার সে নিজের হাতে স্নো হোয়াইটকে হত্যা করবে।
বদমাইশ রাণী তার প্রাসাদের নীচের এক গোপন অন্ধকার কক্ষে গেলো। সেখানে সে কালো জাদুর চর্চা করতো। সেই ঘরে গিয়ে, সে এমন একটা জাদুর পোশন (জাদুর মিশ্রণ) তৈরি করলো যেটা দিয়ে সে নিজেকে বুড়ি বানিয়ে ফেলতে পারবে। তারপর সে একটা আপেল আরেকটা পোশনে ডুবিয়ে দিলো। তারপর শয়তানী হাসি দিয়ে বলে উঠলো, “স্নো হোয়াইট! তুই আপেলে এক কামড় দিবি, তারপর আর কোনোদিন তোর চোখ খুলবে না। হা! হা! হা! আমিই হবো সবচেয়ে সুন্দরী!”
এরপর রাণী বুড়ি সেজে বামুনের বাড়িতে গেলো। স্নো হোয়াইটের জানালার কাছে গিয়ে বললো, “হে আমার প্রিয়। আমার একটা আপেল খেয়ে দেখো। এই আপেল খেলে তোমার মুখ রসে ভরে উঠবে। বড্ড সুমিষ্ট এই আপেল।” তারপর সে বিষাক্ত আপেলটি স্নো হোয়াইটকে দেবার জন্য বের করলো।
এ কাণ্ড দেখে, বনের পাখিরা অস্থির হয়ে উঠলো। তারা স্নোয়াইটকে বিষাক্ত আপেল সম্পর্কে সতর্ক করতে চেষ্টা করলো। তারা বুড়ি ডাইনির চারপাশে ঘুরতে লাগলো আর আপেলটা বুড়ির হাত থেকে ফেলে দেবার চেষ্টা করতে লাগলো।
“এসব বন্ধ করো! বন্ধ করো!” স্নো হোয়াইট চিৎকার করে বলতে লাগলো। স্নো হোয়াইটের কথা শুনে পাখিরা মন খারাপ করে উড়ে গেলো। তারপর বনের প্রাণীরা দৌড়ে বামুনদের সতর্ক করতে গেলো। তারা বামুনদের বুঝাতে লাগলো— খারাপ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, তাদের বাড়ি ফেরা উচিৎ।
সাত বামুন দৌড়ে তাদের বাড়িতে ফিরে এসে দেখলো দুষ্টু বুড়ি নিথর স্নো হোয়াইটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সাত বামুন ডাইনিকে তাড়া করলো। এমন সময় ঝড় শুরু হওয়াতে বজ্জাত বুড়ি দৌড়ে পালালো। তারপর হঠাৎ দুষ্টু বুড়ি একটা খাড়া পাহাড়ের উপর নিজেকে আবিষ্কার করলো। পাহাড় বেয়ে বামুনেরা পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করছিলো।
দুষ্টু বুড়ি একটি বিরাট পাথর নিচের গড়িয়ে দিতে চাইলো, যাতে করে বামুনগুলো পাথরের চক্করে পড়ে মরে যায়। গ্রাম্পি অন্যদের উদ্দেশ্যে চিতকার করে বললো, “ওদিকে দেখো!” এমন সময় একটা বাজ পড়লো। দুষ্টু রাণী তার শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাহাড় থেকে পড়ে গেলো।
ছোট্ট বামুনেরা তাদের বাড়িতে ফিরে গেলো। তারা স্নো হোয়াইটের জন্য স্বর্ণ ও কাঁচ দিয়ে একটা সুন্দর বিছানা বানালো। তাকে দিনরাত চোখে চোখে রাখতে লাগলো সাত বামুন।
তারপর একদিন এক সুদর্শন রাজপুত্র ঘোড়ায় চেপে সেই জঙ্গলে আসলো। রাজপুত্র স্নো হোয়াইটের সৌন্দর্য দেখে চমকে উঠলো। রাজপুত্র স্নো হোয়াইটের পাশে হাঁটু মুড়িয়ে বসে তার গোলাপের মতো লালচে ঠোঁটে চুম্বন দিলো। রাজকুমারের চুম্বনে স্নো হোয়াইট জেগে উঠলো। রাজপুত্র স্নো হোয়াইটকে নিয়ে তার নিজের রাজ্যে চলে গেলো। সেখানে তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।