আজ স্কুলে যেতে দেরি হয়ে গেল। গেলে বকা শুনতে হবে। একটু ভয় ভয় লাগছে। মঁশিয়ে আমেল বলেছিলেন পার্টিসিপল না পারলে ক্লাসে কঠোর শাস্তি দেবেন। আমি আসলে বিষয়টা বুঝিই না। এর ভয়ে আমি স্কুল পালিয়ে দৌড়ে মাঠে চলে যাই।
সে দিনটা ছিল কড়া রোদের আর আরামদায়ক গরম। বাগানের কিনারে গাছে গাছে কালো পাখিগুলো গান গাইছিল। করাতকলের পেছনে জার্মান সৈন্যরা মহড়া দিচ্ছিল। সবকিছু ঐ পার্টিসিপলের চেয়ে বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু আমি কেমন করে যেন সেই স্কুলের দিকেই চলে যাচ্ছিলাম।
টাউনহলের পেছন দিয়ে যাবার সময় দেখলাম একদল লোক নোটিশ বোর্ডের সামনে ভিড় করে আছে। গত দু বছর ধরে সেখানে আমরা অনেক দুঃসংবাদ পেয়েছি। যুদ্ধে আমাদের পরাজয়, নানা দাবি-দাওয়া, আদেশ-নির্দেশ ইত্যাদি। না থেমেই ভাবছিলাম, আজ আবার সেখানে কী? যেই মাত্র এড়িয়ে গেছি এ সময় গ্রামের কামার ভাশে আর তার দোকানের কারিগর লোকটা কী যেন দেখছিল। আমাকে দেখে ডেকে বলল, “এত দৌড়ানোর কী আছে? স্কুলে যাওয়ার অনেক সময় পাইবা মিয়া।”
আমাকে বোধ হয় ঠাট্টা করছে, এটা মনে করে আমি দ্রুত স্কুলের দিকে গেলাম। ঊর্ধ্বশ্বাসে আমি মঁশিয়ে আমেলের স্কুলের দিকে দৌড় দিলাম।
সাধারণত, যখন স্কুলে ক্লাস হয় তখন ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ার শব্দ দূর থেকে শোনা যায়। একত্রে তারা কানে আঙুল দিয়ে কোরাস করে পড়ে। প্রচণ্ড শব্দে ডেস্ক খোলে আবার বন্ধ করে। স্যার রুলার দিয়ে কাঠে শব্দ করে বলেন, “এত হইচই হচ্ছে ক্যান চুপ করো।”
আমি ভাবছিলাম আজও তেমন শব্দ শোনা যাবে। কিন্তু দেখতে পাচ্ছি রোববারের মতো একেবারে শান্ত। যেন আজ স্কুল বন্ধ। জানালা দিয়ে আমার ক্লাসরুমের অনেকখানিই দেখতে পাই। বন্ধুরা সবাই যার যার সিটে বসে আছে। স্যার তার ভয়ানক ধাতুর রুলারটি বগলে নিয়ে রুমের এদিক থেকে সেদিকে যাওয়া-আসা করছেন। আমি অত্যন্ত ধীরে দরোজা ঠেলে ভেতরে প্রবশে করে নীরবে বসে পড়লাম। আমি প্রচণ্ড ভয়ে আছি, না জানি আজ কী হয়!
কিন্তু না, মঁশিয়ে আমেল সাধারণভাবেই আমার দিকে তাকালেন এবং শান্তভাবে বললেন, “ফ্রাঞ্জ, দ্রুত তোমার সিটে গিয়ে বসো বাবা। আমরা তোমাকে ছাড়াই ক্লাস শুরু করে দিয়েছি।”
আমি ঝুঁকে পড়ে নিজের সিটে গিয়ে বসলাম। তখন আমাদের চোখে পড়ল আমাদের শিক্ষক মঁশিয়ে আমেল জাঁকজমকপূর্ণ সবুজ কোট পরেছেন। আর কুঁচি দেওয়া শার্ট আর নকশাকরা সিল্কের ক্যাপ পরেছেন। সাধারণত স্কুলে সম্মনজনক কেউ এলে অথবা পুরস্কার বিতরণী উৎসবে তিনি এ পোশাক পরে থাকেন। তবে ক্লাসরুম অস্বাভাবিক রকমের শান্ত। আরও আশ্চর্য লাগল স্কুলের পেছনের বেঞ্চগুলো সাধারণত খালি থাকে, আজ সেখানেও ভিড়। গ্রামের লোকজন বসে আছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রবীণ অসে তার ত্রিকোণাকার হ্যাট পরে। প্রাক্তন মেয়র, প্রাক্তন পোস্টমাস্টার এবং আরো কয়েকজন। সবাইকে কেমন মনমরা লাগছে। অসে তার মলাট লাগানো পুরনো বর্ণবোধ বইটি নিয়ে এসেছেন। হাঁটুতে রেখে চোখে চশমা পরে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছেন।
যখন আমি এসব কিছু দেখছি তখন মঁশিয়ে আমেল তার চেয়ারের পাশে দাঁড়ালেন, আমাদের উদ্দেশ করে স্বাগত বক্তব্যের মতো স্বরে বললেন, “বাচ্চারা, আজ তোমাদের জন্য আমার শেষ ক্লাস। বার্লিন সরকারের আদেশে আলসেক আর লরেইন প্রদেশের স্কুলগুলোতে একমাত্র জার্মান ভাষা শেখানো হবে। আগামীকাল তোমাদের জন্য নতুন শিক্ষক আসবেন। আজ তোমাদের জন্য শেষ ফ্রেঞ্চ ক্লাস। আমি তোমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি, মনোযোগ দিয়ে শোনো।” এ কথা আমার মনে প্রচণ্ড আঘাত করল। ওহ্! পশুগুলো টাউন হলে এসে উঠেছে। আমাদের শেষ ফ্রেঞ্চ ক্লাস!
আমি এখনো ভালো করে জানি না কেমন করে লিখতে হয়। তো কিছুই শিখিনি। আর কিছু শিখতেও পারব না। ইস যদি আগের দিনগুলো ফিরে পেতাম। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে পাখির বাসায় ডিম খুঁজে বেড়ানো, সার-এ স্কেটিং করে কাটানো সময়। যে বইগুলো দেখলেই বিরক্ত লাগত, বোঝা বইতে কষ্ট লাগত, আমার ব্যাকরণ, আমার মহাপুরুষদের ইতিহাস বইগুলো স্কুলে আনা-নেওয়া করতে কষ্ট হতো না আমার কাছে, পুরনো বন্ধুর মতো মনে হতো। মঁশিয়ে আমেলকেও তেমন লাগত। তিনি আমাদের বকাঝকা করতেন, রুলার দিয়ে পেটাতেন, সব কিছু ভুলিয়ে দিল এখনকার নতুন ঘোষণা। শেষ ক্লাস বলেই এর সম্মানে মঁশিয়ে আমেল তার রোববারের পোশাক পরেছেন। এখন বুঝতে পারছি কেন গ্রামের গণ্যমান্য লোকেরা স্কুলের কাছে এসে ভিড় করে আছেন। তাঁরাও তাঁদের স্কুলের প্রতি সর্বশেষ সম্মান জানাতে এসেছেন। কারণ আর কখনো এ স্কুলে তাঁরা আসতে পারবেন না। আজকের দিনটা অবশ্য আমাদের দিক থেকে প্রিয় শিক্ষকের সুদীর্ঘ চল্লিশ বছরের শিক্ষকতার সাফল্যের জন্য ধন্যবাদ জানানোর দিনও। আর যে স্বাধীন দেশটা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তার প্রতিও শেষ শ্রদ্ধা জানানোর সময়।
আমি এ বিষয়গুলো ভাবছিলাম। তখন আমার নামে ডাক পড়ল। এবার আমার পড়ার সময়। পার্টিসিপলের ব্যবহারের নিয়মগুলো জোরে জোরে পড়ার সময়। আমি ডেস্কের সামনে দাঁড়ালাম। কলজে কাঁপছিল ধুকপুক করে। মাথা তুলতে সাহস পাচ্ছি না। তখন শুনলাম মঁশিয়ে আমেল বলছেন, “বাবা ফ্রাঞ্জ, আমি আর কোনোদিন তোমাকে বকা দেব না। তুমি সব সময় আমাকে খারাপ ভাববে।”
ওটা কেমন হবে! আমরা সব সময় বলি, “বাহ, সময় দিলে কাল পড়া শিখে আসব।” এখন সময় এসেছে। আহ এটা এই আলসেক প্রদেশের লোকদের বড় একটা সমস্যা। তারা সব সময় পড়ালেখা পরদিনের জন্য ফেলে রাখে। এখন জনগণ প্রশ্নের মুখে পড়বে, যখন বলা হবে “তোমার নিজের ভাষা পড়তে লেখতে না জেনে কেমন করে নিজেদের ফরাসি বলে অভিনয় করে যাবে।” শুধু তুমি একা দায়ী নও বাবা ফ্রাঞ্জ, আমাদের সবারই নিজেকে দায়ী করার মতো যথেষ্ট কারণ আছে।”
“তোমার মা-বাবা তোমাকে পড়ার জন্য চাপ দেন নাই। তারা তোমাকে ক্ষেত-খামারে অথবা কল-কারখানায় কাজ করে পয়সা কামাই করাতেই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন। আমি নিজেও বেশি ভালো না। আমিও কি তোমারে আমার বাগানে পানি দেওয়ার কাজে লাগাই নাই? যখন আমি মাছ ধরতে গিয়েছি তোমাদের ক্লাস বন্ধ করে কি ছুটি দিয়ে দেই নাই?” তারপর এক চিন্তা থেকে অন্য বিষয়ে চলে যান মঁশিয়ে আমেল। তিনি ফরাসি ভাষা নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। তিনি বলেন, “ফরাসি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ভাষা। অনুভূতিপ্রবণ। এগুলো আমাদের মনে রাখা উচিত। কখনোই ভুলে গেলে চলবে না। কারণ, যে লোক তার মায়ের ভাষাকে ধারণ করে, সে যেন জেলখানার চাবি হাতে পায়।”
এরপরে তিনি ব্যাকরণ ও পাঠ্য নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। খুব সহজেই আমি তা বুঝতে পারি। প্রতিটি বিষয় তিনি পানির মতো সহজ করে বোঝালেন। আমার বিশ্বাস, আগে এগুলো কখনো ভালো করে শুনি নাই। এতো ধৈর্য নিয়েও কখনো বুঝান নাই। একটা হতে পারে যে, তিনি চাইছেন তার সব জ্ঞান একবারেই ঢেলে দেবেন।
ব্যাকরণের পরে তিনি চলে গেলেন লেখায়। আজকে তিনি নতুন নতুন উদাহরণ নিয়ে বেশ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন। বোর্ডে তিনি সুন্দর করে লিখলেন, ‘ফ্রান্স আলসেক, ফ্রান্স আলসেক!’ সবাই দেখল ক্লাসরুম ভরে গেছে ছোট ছোট পতাকায়। সেগুলো পতপত করে উড়ছে। পতাকাগুলো যেন আমাদের হাইবেঞ্চে ও ডেস্কে কাঠি দিয়ে ঝোলানো। আমি দেখি, সবাই যার যার কাজ করছে। পুরো ক্লাস নীরব। শুধু কাগজে কলম ঘষার শব্দ শোনা যায়, আর কিছু না। একবার কতগুলো গুবড়েপোকা ক্ষেতের দিক থেকে জানালা দিয়ে এসে উড়ে গেল কিন্তু কেউ সেদিকে ফিরেও তাকালো না। এমনকি স্কুলের সবচেয়ে ছোট ছেলেটিও না। সে গভীর মনোযোগ দিয়ে ফ্রান্সের ছবি এঁকে যাচ্ছে তার হৃদয়ের মধ্যে।
ছাদের উপরে পায়রাগুলো বাকবাকুম করছিল বেশ শান্তভাবে। যখন আমি ওদের ডাক শুনতে পেলাম তখন নিজে নিজে বললাম, ওদেরও কি জার্মান ভাষার জন্য চাপ দেওয়া হবে? অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরে যখন লেখা থেকে চোখ তুলে তাকালাম, তখন দেখলাম মঁশিয়ে আমেল নিজের চেয়ারে বসে পারপাশে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছেন। যেন তিনি মনে করার চেষ্টা করছেন গ্রামের এই স্কুলে কী কী আছে, আর না আছে।
কল্পনা করা যায়! চল্লিশটা বছর তিনি কাটিয়ে গেলেন একটা জায়গায়, এই স্কুলে! আর সামনের এই উঠানে। সবগুলো ক্লাসরুম তার চোখের সামনে। বেঞ্চ আর ডেস্কগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ওয়ালনাট গাছগুলো বড় হয়ে উঠেছে। এবং হয়তো তিনি নিজেকেই রোপণ করেছেন। এখন জানালা থেকে ছাদে উঠছেন। এটা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক তাঁর কাছে। এই সবকিছু তিনি চির জীবনের জন্য ছেড়ে যাবেন। রুমের উপরে তাঁর বোন সবকিছু গোছগাছ করছে, শব্দ পাওয়া যায়। পরদিনই তাঁদের এদেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে সারাজীবনের জন্য।
একইভাবে তিনি সাহসের সাথে ক্লাস শেষ করে আনলেন। লেখার পরে আমরা ইতিহাসের একটা ক্লাস করলাম। এর পরে ছোটরা একত্রে গাইতে শুরু করল ফরাসি বানান, বিএ-বে, বিই-বি, বিআই-বি, বিও-ব, বিইউ-বু ইত্যাদি। ক্লাসরুমের একেবারে পেছনের এসে প্রবীণ অসে চোখে চশমা পরলেন। প্রাথমিক শিক্ষার বাইটি দুই হাতে নিয়ে শূন্যে তুলে শিশুদের সাথে পড়তে লাগলেন। তাঁর পড়া শুনতে বেশ মজা লাগছিল। শুনতে শুনতে আমরা হাসতে এবং কাঁদতে চাইছিলাম। আহ! আমি এখনো সেই শেষ ক্লাসের কথা মনে করতে পারি।
হঠাৎ গির্জায় দুপুরের ঘণ্টা বেজে উঠল। মেরির বন্দনার ঘণ্টা বাজার মধ্যেই আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম প্রুশিয়ান সৈনিকদের ট্রাম্পেট বাজানোর শব্দ। জানালার নিচে আওয়াজ হচ্ছিল, সেখানে তাদের কুচকাওয়াজ চলছিল। মঁশিয়ে আমেল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল তাঁকে। আগে কখনো স্যারকে এমন বড় দেখা যায় নাই।
“বন্ধুরা, বলো, আমি … আমি…।” কেন যেন তিনি থেমে গেলেন। আর কিছুই বলতে পারলেন না।
তিনি বোর্ডের কাছে গেলেন। এক টুকরা চক হাতে নিলেন। প্রবল শক্তিতে তিনি বোর্ডে যতটা সম্ভব বড় করে লিখলেন,
“ভিভ ল ফ্রঁসে!”
ফ্রান্স দীর্ঘজীবী হোক!
লেখার পরে তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর মাথা পেছনে হেলে দেয়ালে গিয়ে ঠেকল। আমাদের দিকে হাত তুলে বললেন, “হয়ে গেছে! তোমরা যেতে পারো।”
লেখক পরিচিতি: আলফাঁস দুদে একজন ফরাসি গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার এবং কবি। তিনি ১৮৪০ সালের ১৩ মে ফ্রান্সের নিমেসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সাহিত্যের “নিউট্রালিজম” মুভমেন্টের সাথে যুক্ত ছিলেন– যারা সাহিত্যে রোমান্টিকতার বিপরীতে নির্দিষ্টতা, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং সমাজ বাস্তবতার বিষয়বস্তু নিয়ে লেখালিখি করে গেছেন। ১৮৯৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর খ্যাতনামা এই কথাসাহিত্যিক ফ্রান্সের প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন। তার একটি বিখ্যাত গল্প “দ্য লাস্ট ক্লাস” বা “দ্য লাস্ট লেসন”, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা এই গল্পের প্রধান বিষয়বস্তু। গল্পবাজ ম্যাগাজিনের জন্য গল্পটি অনুবাদ করেছেন কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক কাজী মহম্মদ আশরাফ।