এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস

এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস

গিজার বিশাল পিরামিড
০১.

গিজার বিশাল পিরামিডের উপরের ধাপে উঠে গিয়ে এক তরুণী মেয়ে তাকে ডাকে, নিচের দিকে তাকিয়ে। তাড়াতাড়ি কর, রবার্ট! আমি জানতাম, আরো কম বয়েসি কাউকে বিয়ে করা উচিৎ ছিল। হাসিতে তার জাদু ঝরে।

শ্রাগ করে সে, গতি বাড়াতে চায়। কিন্তু পা যেন গেঁথে গেছে পাথরের মত। সবুর কর! বলে সে, মিনতি করে, প্লিজ…।

যত উপরে উঠছে ততই আচ্ছন্ন হয়ে আসছে দৃষ্টি। কানে বজ্রপাতের শব্দ। আমাকে অবশ্যই মেয়েটার কাছে পৌঁছতে হবে। কিন্তু আবার যখন সে উপরে তাকায়, স্রেফ ভোজবাজির মত উবে যায় মেয়েটা। তার স্থলে দাড়িয়ে আছে দন্তহীন এক বুড়ো। লোকটা তাকিয়ে আছে নিচের দিকে, ঠোঁট ভাঁজ করে। সাথে সাথে চিৎকার করে ওঠে ল্যাঙডন, নিরব মরুর বুকে সেই আওয়াজের প্রতিধ্বণি বাজে।

দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠল রবার্ট ল্যাঙডন। বিছানার পাশের ফোন কর্কশ কন্ঠে চেঁচামেচি করছে। মোহাবিষ্ট হয়ে রিসিভারটা তুলে নেয় সে।

হ্যালো?

আমি রবার্ট ল্যাঙডনের খোঁজ করছিলাম, এক লোকের কণ্ঠ বলল।

খালি বিছানায় উঠে বসল ল্যাঙডন, চেষ্টা করল মনটাকে পরিষ্কার করার। দিস… ইজ রবার্ট ল্যাঙডন। তাকাল সে ঘড়ির দিকে। ডিজিটাল ঘড়িটায় সকাল পাঁচটা আঠারো উঠে আছে।

আপনার সাথে জরুরি ভিত্তিতে দেখা হওয়া দরকার।

কে বলছেন?

আমার নাম ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার। আমি ডিসক্রিট পার্টিকল ফিজিসিস্ট।

আপনি… কী? কথা কি বুঝতে পারছে না ল্যাঙডন? আপনি কি নিশ্চিত যে ল্যাঙডনের খোঁজ করছেন আপনি আমিই সেই লোক?।

আপনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিলিজিয়াস আইকোনলজির প্রফেসর। আপনি সিম্বলজির উপর বই লিখেছেন এবং—

আপনি কি জানেন কটা বাজে এখন?

ক্ষমা চাচ্ছি। আমার কাছে এমন কিছু আছে যেটা আপনি দেখতে চাইতে পারেন। কথাটা ফোনে বলা সম্ভব নয়।

একটা বাঁকা হাসি উঠে এল ল্যাঙডনের ঠোঁটে। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিছুদিন আগেও তার লেখা বইয়ের এক পাঠক তাদের দলের পক্ষ থেকে ফোন করেছিল, ঈশ্বর তাদের কাছে যে প্রমাণ পাঠিয়েছেন সেটা দেখানোর জন্য। আরেক মেয়েলোক তাকে ওকলাহোমা থেকে ফোন করে সেরা সেক্স অফার করেছিল যদি সে দয়া করে উড়ে গিয়ে সেখানে তার বেডশিটের উপরে লেখা ওঠা দৈবাবণী দেখে।

আমার নাম্বার পেলেন কোত্থেকে? এই সময়টাতেও ল্যাঙডন চেষ্টা করল একটু নরম হয়ে কথা বলার।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে। আপনার বইয়ের ওয়েবসাইটে।

এবার গুঙিয়ে উঠল ল্যাঙডন। সে নিশ্চিত, তার ওয়েবসাইটে আর যাই থাক বাসার ফোন নাম্বার থাকবে না কশ্মিনকালেও। লোকটা অবশ্যই মিথ্যা কথা বলছে।

আপনার সাথে দেখা হওয়া দরকার, চাপ দিল কলার, আমি আপনাকে যথেষ্ট পে করব।

এবার পাগল হবার দশা ল্যাঙড়নের, দুঃখিত। কিন্তু আমি আসলেই বুঝে উঠতে পারছি না…

এখনি যদি আপনি রওনা দেন তাহলে এখানে পৌঁছতে পারবেন।

কোথাও যাচ্ছি না আমি। এখন সকাল পাঁচটা বাজে! তুলে রাখল রিসিভারটা ল্যাঙডন, ফিরে গেল বিছানায়। বন্ধ করল চোখ, চেষ্টা করল আবার ঘুমের রাজ্যে ফিরে যেতে। কোন কাজে লাগল না চেষ্টাটা। স্বপ্নটা মনে গাঁথা হয়ে গেছে। না পেরে অবশেষে সে রোবটা চাপাল গায়ে, তারপর নেমে গেল নিচে।

রবার্ট ল্যাঙডন খালিপায়ে পায়চারি করে বেড়াতে লাগল তার ম্যাসাচুসেটস ভিট্টোরিয়ান বাসায়। এখন ইনসমনিয়া থেকে বেঁচে যাবার আশায় এক মগ ধূমায়িত কফি হাতে তুলে নিল। এপ্রিলের চাদ বাইরে থেকে আলো পাঠাচ্ছে, ওরিয়েন্টাল কার্পেটের উপর আকা হচ্ছে বিচিত্র সব নকশা। কলিগরা প্রায়ই ঠাট্টা করে, তার বাসা নাকি বসতবাড়ি নয়, একটা পুরাকীর্তির আখড়া। জাদুঘর। তার বাসা আসলেই ঠাসা হয়ে আছে নানা জায়গা থেকে আসা ধর্মীয় আর্টিফ্যাক্টে। ঘানা থেকে একটা ইকুয়াবা, স্বর্ণের তৈরি ক্রস এসেছে স্পেন থেকে এমনকি বোনিওর একটা বোক্কাসও আছে, একজন তরুণ যোদ্ধার চির তারুণ্যের প্রতীক।

মহাঋষির চেয়ারে বসে সে চকলেটের স্বাদ নিতে নিতে টের পেল বাইরের বে উইন্ডো দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ইমেজটা ম্লান… যেন কোন ভূত। বয়েসি কোন ভূত, ভাবল সে। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল, আসলে তার এই তারুণ্য আর বেশিদিন থাকছে না। এই শরীরটা একটা বাসা বৈ কিছু নয়।

যদিও এই চল্লিশ বছর বয়সে সে একেবারে ওভার স্মার্ট নয়, তবু তার মহিলা সহকর্মীরা তাকে আড়ালে আবডালে প্রাচীণ এ্যাপিল যুক্ত বলে থাকে–তার ধূসর, ঢেউ খেলানো চুল, তীক্ষ্ণ নীল চোখ, দৃষ্টি কেড়ে নেয়া গভীর কণ্ঠস্বর এবং শক্তিমান, বেপরোয়া মুচকি হাসি যে কারো মনোযোগ আকৃষ্ট করবে, কোন সন্দেহ নেই। স্কুল, আর কলেজ থেকেই ডাইভার হিসাবে সুনাম কুড়িয়ে আসছে আর এই বয়সে শত কাজের মাঝেও অভ্যাসটা ধরে রেখেছে ঠিক ঠিক। তাই শরীর এখনো নিখুঁত, এখনো, সাঁতারুর চিহ্ন সারা গায়ে, এখনো অবিরাম পঞ্চাশ ল্যাপ করে সাঁতরায় সে ইউনিভার্সিটির সুইমিং পুলে।

ল্যাঙডন তার বন্ধুদের কাছে সব সময় বিবেচিত হয় একটা কিংবদন্তী হিসাবে। এমন এক লোক যে শতাব্দিগুলোর মাঝে ধরা পড়ে গেছে। উইকএন্ডে তাকে নীল জিন্স পরা অবস্থায় দেখা যাবে ঠিকই, কাজ করছে সে, কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সাথে সাথে লেকচার দিচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে, রিলিজিয়াস আর্টের বিষয়ে। কিন্তু আর সব সময় দেখা যাবে হ্যারিস টুইড আর ভেস্ট পরা অবস্থায়। ছবি আসে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়, যেখানে সেই বিখ্যাত পপাশাক আর সেই সাথে কোন জাদুঘরের উদ্বোধনে বক্তৃতা দিচ্ছে পটু কণ্ঠে।

একজন কঠিন শিক্ষক আর কড়া শৃঙ্খলার লোক হলেও ছাত্রমহলে তুমুল জনপ্রিয়তা আছে তার। দ্য লস্ট আর্ট অব গুড ক্লিন ফান এর ব্যাপারে সব সময় সে কঠিন। ক্যাম্পাসে তার ডাকনাম দ্য ডলফিন এটা শুধু সাঁতারে অবিশ্বাস্য দক্ষতার জন্য আসেনি, এসেছে ওয়াটার পোলো খেলায় প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করার কারণেও।

একা একা বসে আছে ল্যাঙডন, রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙছে না মোটেও। এবার ঘাপলা বাঁধাল তার ফ্যাক্স মেশিনের রিংটোন। বিরক্ত হতে গিয়েও হল না সে। হাসল কোনক্রমে।

ঈশ্বরের লোকজন! ভাবল সে, দু হাজার বছর ধরে মেসিয়াহর জন্য প্রতীক্ষা! কিন্তু আজও তাদের আশা ফুরায় না।

ওক প্যানেলের স্টাড়ির দিকে সে আলসে ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়, হাতের খালি মগটা রেখে। ফ্যাক্সের ছবিটা পড়ে আছে ট্রে তে।

সাথে সাথে একটা ধাক্কা খেল সে।

এখানে একটা নগ্ন লাশের ছবি দেখা যাচ্ছে। লোকটার ঘাড় পুরোপুরি পিছনে ফিরাননা। তার বুকে একটা চিহ্ন আকা। লোকটার বুকের এই ব্র্যান্ডটা… একটা মাত্র শব্দ। এই শব্দটাকে ল্যাঙডন জানে। ভাল করেই জানে। অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকে সে লেখাটার দিকে কিছুক্ষণ।

ইলুমিনেটি, বলল সে জোরে জোরে। ধ্বক ধ্বক করছে বুক। এ হতে পারে না…

ফ্যাক্সটাকে ভয়ে ভয়ে সে একশো আশি ডিগ্রি ঘোরায়। দেখল পাতাটার উপর দিক নিচে চলে এসেছে।

ঠিক সে মুহূর্তে, চলে গেল শ্বাস প্রশ্বাস। আবার সে অবিশ্বাস নিয়ে ঘুরিয়ে যায় পাতাটাকে।

ইলুমিনেটি! ফিসফিস করে সে।

উপর এবং নিচ থেকে একই লেখা দেখা যাচ্ছে। স্থাণুর মত পড়ে গেল ল্যাঙডন চেয়ারের উপরে। তারপর ফ্যাক্স মেশিনের জ্বলতে নিভতে থাকা লাইটের দিকে চোখ যায়। এখনো যে পত্রটা পাঠিয়েছে অপেক্ষা করছে ফোন লাইনে।

ল্যাঙডন তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ, তারপর তুলল রিসিভার।

০২.

আমরা এবার আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছি কি? লাইনের জবাব দেয়ার সাথে সাথে লোকটার কণ্ঠ শোনা গেল।

ইয়েস, স্যার। আপনি খুব ভাল করেই পেরেছেন। নিজের কথা ব্যাখ্যা করতে চান নাকি?

আগেই আপনাকে বলার চেষ্টা করেছিলাম। আমি একজন ফিজিসিস্ট। একটা রিসার্চ ফ্যাসিলিটি চালাই। একটা খুন হয়েছে এখানে। মরদেহটা ভাল করেই দেখেছেন বোধ করি।

কী করে আমাকে পেলেন?

এরিমধ্যে বলেছি আপনাকে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। দ্য আর্ট অব দ্য ইলুমিনেটি বইটার সাইটে।

ভাল করেই জানে সে, সাহিত্যের মূল ধারায় তার বইটা কল্কে পায়নি ঠিক, কিন্তু মোটামুটি সাড়া জাগাতে পেরেছে। কিন্তু তাতেও ব্যাপারটা স্পষ্ট হচ্ছে না। পেজে কোন কন্টাক্ট নাম্বার ছিল না। আমি নিশ্চিত।

ওয়েব থেকে তথ্য নিয়ে চমকে দেয়া লোজনের কোন অভাব নেই আমার ল্যাবগুলোয়।

মনে হচ্ছে আপনার ল্যাবগুলো ওয়েবের ব্যাপারে অনেক বেশি জানে?

আমাদের জানা উচিৎ, বলল লোকটা, কারণ এটা আমাদেরই আবিষ্কার।

লোকটার কন্ঠে এমন কিছু ছিল যাতে ঠিক ঠিক বোঝা যায় ঠাট্টা করছে না সে–আর যাই করুক।

আপনার সাথে আমার এক্ষুণি দেখা হওয়া দরকার। মিনতি ঝরে পড়ল লোকটার কণ্ঠে, বোস্টন থেকে ল্যাবের দূরত্ব বেশি নয়, এক ঘণ্টার পথ।

তাকিয়ে আছে ল্যাঙডন একাধারে, হাতের ফ্যাক্সটার দিকে খুব জরুরি, চাপ দিল লাইনে থাকা কণ্ঠ।

ইলুমিনেটি! তাকিয়ে আছে সে একদৃষ্টে। প্রাচীণ চিহ্ন আর প্রতীক নিয়েই তার কায়কারবার। আর বিশেষ করে ইলুমিনেটি নিয়ে। কিন্তু যে কোন ভূতত্ত্ববিদ যদি জলজ্যান্ত ডায়নোসরের সামনাসামনি হয় তাহলে যেমন ভড়কে যাবে তেমনি ভড়কাচ্ছে সে আজকের দিনে ইলুমিনেটির ছাপ দেখে।

আমি আপনাকে না-জানিয়েই একটা প্লেন পাঠিয়ে দিয়েছি। আর বিশ মিনিটের মধ্যে সেটা বোস্টনের মাটি কামড়ে ধরবে।

ল্যাঙডন এখনো যেন স্বপ্ন দেখছে। কোথায় হতে পারে? উড়ে যেতে এক ঘন্ট সাগবে…

আমার ধৃষ্টতা ক্ষমার চোখে দেখবেন প্লিজ, বলছে কণ্ঠটা, আর কোন উপায় ছিল। আপনাকে এখানে চাই-ই চাই।

একবার তাকাল ল্যাঙডন হাতের ফ্যাক্সটার দিকে। তাকাল বাইরের কোমল প্রকৃতির দিকে। না, আর দেরি করা যায় না। তার প্রাচীণ সাধনার নূতন নমুনা দেখা দিয়েছে।

আপনিই জিতলেন, বলল সে, বলুন কোথায় আপনার প্লেনের সাথে দেখা করতে হবে।

০৩.

হাজার হাজার মাইল দূরে, দুজন মানুষ দেখা করছিল। চেম্বারটা অন্ধকারাচ্ছন্ন, পুরনোদিনের, মধ্যযুগীয়।

বেনভেনিউটো, দায়িত্বে থাকা লোকটা বলল, দেখা যাচ্ছে না তাকে। ইচ্ছা করেই সে আড়ালে থাকছে। তোমার কাজ কি ভালমত শেষ হয়েছে?

সি, বলল অপরজন, পারফেট্টামেন্টে। কণ্ঠ তার পাথরের মতই নিখাদ।

আর কোন সন্দেহ থাকবে না কে দায়ী সে বিষয়ে?

না।

সুপার্ব। তোমার কাছে কি আমার চাওয়ার জিনিসটা আছে?

খুনির চোখ চকচক করে উঠল। তেলের মত কালো। একটা ভারি ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস সে টেনে তুলল। তারপর রেখে দিল টেবিলের উপরে, সশব্দে।

ছায়ার লোকটাকে যেন তুষ্ট মনে হল, ভাল কাজ করেছ।

ব্রাদারহুডের কাজে লাগা এক সম্মান বৈ কিছু নয়। বলল খুনি।

পরের ধাপ শুরু হতে যাচ্ছে অচিরেই। একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। আজ রাতে আমরা দুনিয়ার খোল নলচে পাল্টে দিতে যাচ্ছি।

০৪.

রবার্ট ল্যাঙডনের সাব নাইন হান্ড্রেড এস কালাহান সুরঙ্গ থেকে তীরবেগে বেরিয়ে এল। বোস্টন হারবার সামনেই, তার পরই লোগান এয়ারপোর্ট। তিনশ গজ সামনে যেতেই একটা আলোকিত হ্যাঙ্গার পাওয়া গেল। একটা বিশাল চার জ্বলজ্বল করছে এটার উপর। বেরিয়ে এল সে।

ভবনের পিছন থেকে গোলগাল চেহারার এক লোক এগিয়ে এল। পরনে তার নীল ইউনিফর্ম। রবার্ট ল্যাঙডন?

দ্যাটস মি, বন্ধুসুলভ কণ্ঠের জবাবে বলল সে গাড়িটার চাবি লাগাতে লাগাতে।

পারফেক্ট টাইমিং, বলল পাইলট লোকটা, আমার পিছনে পিছনে আসুন, প্লিজ।

বিল্ডিং পেরিয়ে যেতে যেতে একটু দ্বিধান্বিত হয়ে ওঠে ল্যাঙডন। এমন সব ব্যাপারের সাথে সে মোটেও পরিচিত নয়। একজোড়া চিননা, একটা টার্টলনেক আর হ্যারিস টুইডের স্যুট জ্যাকেট নিয়ে সে ঘর ছেড়েছে কোথায় যেতে হবে তা না জেনেই। পকেটের ছবিটার ব্যাপার এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।

ল্যাঙডন যে একটু অস্থির সেটা টের পেল পাইলট, ওড়াটা আপনার জন্য কোন সমস্যা নয়, তাই না স্যার?

আসলেই। বলল সে, ব্র্যান্ড বসানো মরদেহ আমার জন্য সমস্যা। উড়ে চলা? সেটাকে ঠিক সামলে নিতে পারব।

লোকটা হ্যাঁ ঙ্গারের কোণা ঘুরে গিয়ে একটা রানওয়ের দিতে তাকাল।

আবার স্থবির হয়ে গেল ল্যাঙন, সামনের দৃশ্য দেখে, আমরা ঐ জিনিসটায় চেপে বসতে যাচ্ছি?

একটা আকর্ণবিস্তৃত হাসি দিল লোকটা, পছন্দ হয়?

পছন্দ হয়? কোন্ চুলা থেকে উঠে এসেছে এটা?

তাদের সামনের ক্র্যাফটটা আকারে আকৃতিতে বিশালবপু। দেখে এক পলে মনে পড়ে যায় যে কোন স্পেস শাটলের কথা। শুধু পার্থক্য একটাই, সামনের দিকটা চেছে দেয়া হয়েছে, করা হয়েছে সমান।

ল্যাঙডন প্রথমেই যা ভাবল, নিশ্চই স্বপ্ন দেখছে সে। যানটাকে বরং বুইক বলে ভুল হয়। কোন আকাশ রথ নয়। অবশ্য ফিউজিলাজের গোড়ায় দুটা ছোট ছোট ডানা দেখা যাচ্ছে। ঐ পর্যন্তই। বাকিটার পুরোটাই খোলস। পিছনের জায়গা থেকে একেবারে সামনে পর্যন্ত নিরেট খোলস। কোন জানালা নেই, নেই কোন চিহ্ন।

আড়াই লাখ কিলো পুরোপুরি ভরা আছে, বলল পাইলট, যেমন করে কোন বাবা। তার নতুন জন্মানো শিশুর জন্য মায়া নিয়ে কথা বলে, স্ন্যাস হাইড্রোজেনে চলে। সিলিকন কার্বাইড ফাইবারে মোড়া, বিশ অনুপাত এক হল এটার থ্রাস্ট/ওয়েট রেশিও। বেশিরভাগ জেই চলে সাত অনুপাত একে। ডিরেক্টর নিশ্চই আপনাকে দেখার জন্য প্রাণ পাত করছে। প্রয়োজন বিশেষ না হলে কখনো বিগ বয়কে বাইরে পাঠানো হয় না।

এই জিনিসটা উড়ে চলতে জানে? এখনো বিস্ময় কাটেনি ল্যাঙডনের।

হাসল পাইলট, ওহ্ ইয়া! দেখতে একটু জবুথবু, কিন্তু আপনার জেনে রাখা ভাল, যত তাড়াতাড়ি এতে অভ্যস্ত হবেন ততই মঙ্গল। আজ থেকে পাঁচ বছর পর আপনি যত বিমান দেখবেন তার সবই এ রকম। এইচ এস সি টি–হাই স্পিড সিভিল ট্রান্সপোর্ট। আমাদের ল্যাব এ জিনিস কিনেছে একেবারে প্রথমবারেই।

নিশ্চই নরক গুলজার করা ল্যাব তাদেরটা! ভাবল ল্যাঙডন।

এ হল বোয়িং এক্স থার্টি থ্রির প্রোটোটাইপ। বলেই যাচ্ছে পাইলট, কিন্তু এমন, আরো ডজন ডজন আছে এরিমধ্যে, দ্য ন্যাশনাল এ্যারো স্পেস প্লেন, রাশিয়ানদের আছে স্ক্যাম জেট, ব্রিটিশদের আছে হোটেল। এখানেই গুমরে মরছে ভবিষ্যত। শুধু পাবলিক সেক্টরে আসার আগে একটু স্বস্তিতে দিন গুজরান করছে এই বিভিন্ন মডেলের প্লেনগুলো। এগুলোর জাত আলাদা হলেও তাল ঠিক। প্রচলিত জেটগুলোকে আপনি বিনা বিদায় চুম্বন দিতে পারেন অনায়াসে।

আমার মনে হয় প্রচলিত জেটগুলোতেই অনেক বেশি স্বস্তি বোধ করব।

এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পাইলট, এদিক দিয়ে, মিস্টার ল্যাঙডন, সাবধানে পা ফেলুন, প্লিজ।

কয়েক মিনিট বাদে, খালি কেবিনের ভিতরে জেকে বসেছে ল্যাঙডন। পাইলট তাকে সামনের দিকের একটা সিটে অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দিয়ে সামনের দিকে উধাও হয়ে গেল।

ভিতরের সমস্ত দৃশ্য প্রচলিত বাণিজ্যিক এয়ারলাইনের মত, শুধু পার্থক্য এক জায়গায়, এখানে কোন জানালা নেই। ভাবনাটা মোটেও স্বস্তি দিল না ল্যাঙডনকে। একটু ক্ল্যাস্ট্রোফোবিয়া তার সারা জীবন ধরে তাড়িয়ে ফিরছে। বাল্যকালের অযাচিত এক ঘটনার পর থেকে কোন পরিস্থিতিতেই সে আবদ্ধ জায়গায় থাকতে পারে না।

আবদ্ধ জায়গা থেকে দূরে থাকার জন্য যথাসম্ভব সব করে সে, বদ্ধ জায়গার খেলাগুলোকে এড়িয়ে চলে, যখন তখন ভোলা জায়গার জন্য আইঢাই করে তার প্রাণ। এমনকি এই বিশাল ভিট্টোরিয়ান বাসাটাও সেজন্যেই এত খোলামেলা।

ইঞ্জিন গর্জে উঠছে তার নিচে। জ্যান্ত হয়ে উঠছে তাবৎ প্লেন। সে কোনমতে গলাধঃকরণ করল ব্যাপারটাকে। টের পেল সে ঠিক ঠিক, ট্যাক্সিইং করে এগিয়ে যাচ্ছে আজব প্লেনটা। উপরে হালকা কান্ট্রি মিউজিক বাজছে।

সিটের পাশের একটা ফোন বিপবিপ করে উঠল। হাত বাড়াল ল্যাঙডন।

হ্যালো?

আরামদায়ক, মিস্টার ল্যাঙডন?

মোটেও নয়।

রিলাক্স করুন। এক ঘণ্টার মধ্যে জায়গামত পৌঁছে যাচ্ছি।

আর সেখানটা কোথায়? কোথায় যাচ্ছে তার বিন্দুবিসর্গ জানা নেই দেখে আশ্চর্যান্বিত হল সে।

জেনেভা। ইঞ্জিন চালু করতে করতে জবাব দিল পাইলট, ল্যাবটা জেনেভায়।

জেনেভা! একটু যেন স্বস্তি পেল ল্যাঙডন, নিউ ইয়র্কের উপরদিকটায়? সেনেকা লৈকের কাছে আমার পরিবার আছে। জানতাম নাতো জেনেভায় একটা ফিজিক্স ল্যাব আছে!

হাসল পাইলট, নিউ ইয়র্কের জেনেভা নয়, মিস্টার ল্যাঙডন, জেনেভা, সুইজারল্যান্ড।

কথাটা কানে প্রবেশ করতে যেন অনেকটা সময় নিল।

সুইজারল্যান্ড? মনে হয় আপনি বলেছিলেন জায়গাটা মাত্র এক ঘণ্টার দূরত্বে,

ঠিক তাই, মিস্টার ল্যাঙডন, মুচকে হাসছে পাইলট, এই প্লেন ম্যাক ফিফটিনে চলে। শব্দেরচে পনেরগুণ গতিতে।

০৫.

ব্যস্ত ইউরোপিয়ান পথে খুনি সাপের মত একেবেকে এগিয়ে যায় হাজার মানুষের ভিতর দিয়ে। সে শক্তিশালী, কালো এবং নিষ্ঠুর। এখনো তার মাংসপেশী আড়ষ্ট। হয়ে আছে সেই দেখা হবার পর থেকেই।

ভালভাবেই এগিয়ে গেল ব্যাপারটা, ভাবল সে আপন মনে, যদিও কখনো তার চাকরিদাতা মুখ উন্মোচিত করেনি, তবু খুনি মনে মনে আহ্লাদে আটখানা হয় তার উপস্থিতির কথা ভেবে, মাত্র পনেরদিন ধরে কি তার চাকরিদাতা তার সাথে যোগাযোগ করছে?

সেই কলের প্রত্যেকটা কথা তার এখনো অক্ষরে অক্ষরে মনে পড়ে…

আমার নাম জানাস, বলেছিল কলার, আমরা একই পথের পথিক। আমাদের দুজনেরই অভিন্ন এক শত্রু আছে। শুনেছি তোমার দক্ষতা ভাড়া করা যায়।

নির্ভর করে আপনি কার পক্ষ থেকে কথা বলছেন তার উপর, সাথে সাথে চট করে জবাব দেয় সে।

জবাব দেয় কলারও।

আমি ঠাট্টা তামাশা তেমন পছন্দ করি না।

তুমি আমাদের নাম শুনেছ, আমি খুশি। বলল কলার।

অবশ্যই, ভাতৃসংঘ এক ঐতিহাসিক ব্যাপার।

আর এখনো তুমি নিশ্চিত হতে পারছ না আমি সত্যি বলছি নাকি মিথ্যা।

সবাই জানে যে ব্রাদাররা ধূলিতে মিশে গেছে।

একটা চাতুরি। অজানা শত্রুই সবচে বড় শত্রু।

একটা ছোটমত ধাক্কা খেল খুনি, এখনো টিকে আছে ব্রাদারহুড?

চিরকালের চেয়ে অনেক বেশি গোপনে। যা তুমি দেখতে পাও, তার সবখানেই আমাদের মূল প্রবেশ করেছে সংগোপনে… এমনকি আমাদের সবচে বড় শত্রুর অজেয় কেল্লাতেও।

অসম্ভব। তাদের কোন ছিদ্র নেই।

আমাদের হাত অনেক লম্বা।

কারো হাত এত লম্বা নয়।

খুব দ্রুত তুমি বিশ্বাস করবে। ব্রাদারহুডের অপ্রতিরোধ্য এক মহড়া খুব দ্রুত অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এমন এক মহড়া যাতে সারা দুনিয়ার লোক কেঁপে উঠবে, সত্যিটা জানতে পারলে।

কী করেছেন আপনারা?

বলল সে।

বড় বড় হয়ে গেল খুনির চোখ। অসম্ভব!

পরদিন সারা দুনিয়ার সংবাদপত্রে একই খবর বেরুল।

বিশ্বাস করল খুনি।

আর এখন, পনেরদিন পর, তার বিশ্বাসের ভিত্তিমূল প্রোথিত হয়ে আছে অনেক অনেক গভীরে। ভাতৃসঘ এখনো টিকে আছে, ভাবে সে। আজ রাতে তারা মাথা উঁচু করে তাদের লক্ষ্য সম্পূর্ণ করবে।

সে গর্বিত বোধ করে, তারা তাকে নির্বাচিত করে। একই সাথে এ-ও জানে, সে ছাড়া নির্বাচিত করার মত দক্ষ লোক খুব কমই আছে।

এ পর্যন্ত ঠিক ঠিক সব কাজ করেছে সে। খুন করেছে, জ্যানাসের হাতে তুলে দিয়েছে জিনিসটা। এখন জায়গামত বসানো বাকি।

জায়গামত…

কিন্তু কীভাবে? ভিতরে খুব শক্ত সমর্থন থাকতে হবে। আসলেই, ব্রাদারহুডের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত।

জ্যানাস, ভাবে খুনি, একটা কোড নেম।

সে জানে, রোমান এই দুই মুখের দেবতার নাম নিয়ে ভুল করেনি তার চাকরিদাতা। নাকি শনির চাঁদের নামে নাম নিয়েছে? যে জন্যই নামটা নেয়া হোক না কেন, তাতে আর কোন পার্থক্য নেই। লোকটার ক্ষমতা যে অসীম তা ঠিক ঠিক বোঝা হয়ে গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে খুনি তার পূর্বপুরুষদের কথা কল্পনা করল। তারা নিশ্চই তার প্রতি স্নেহাশীষ পাঠাচ্ছে। আজ সে তাদের যুদ্ধে নেমেছে। সেই একাদশ শতাব্দি থেকে। একটা শত্রুর বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর ঘৃণা পুষে রেখেছে তারা… যখন থেকে ক্রুসেডাররা তাদের ভূমিতে পা রাখে, খুন আর ধর্ষণের বন্যা বইয়ে দেয়, তাদের অপবিত্র ঘোষণা করে, বিলুপ্ত করে দেয় তাদের মন্দির আর ঈশ্বরের চিহ্ন, তখন থেকে।

নিজেদের রক্ষার জন্য তার পূর্বপুরুষরা একটা ছোট কিন্তু ভয়ানক বাহিনী গড়ে তোলে। সারা ভূমি জুড়ে তাদের নাম ছিল রক্ষক–তারা থাকত গোপনে। সংগোপনে। কিন্তু খুন করতে দ্বিধা করত না মোটেও। সামনে যে শক্রই পড়ক খুন হয়ে যেতে বিন্দুমাত্র সময় নিত না। হত্যাকান্ডের জন্যই তারা শুধু বিখ্যাত ছিল না, খ্যাতনামা ছিল অবসর সময় কাটানোর পদ্ধতির জন্যও। তাদের ড্রাগটা ছিল অনেক বেশি বিষাক্ত, নাম ছিল তার হাসিস।

আস্তে আস্তে তাদের বিস্তৃতি যখন ঘটে, নামটাও মুখে মুখে রটে যায়–হ্যাসাসি ন–হাসিসের অনুসরণকারী। আস্তে আস্তে হ্যাসাসিনের সাথে মৃত্যুর একটা যোগসূত্র তৈরি হয়। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা ভাষায় হ্যাসাসিন মৃত্যুর অপর নাম। এ নামটা আজো পৃথিবীতে প্রচলিত, এমনকি আধুনিক ইংরেজিতেও… কিন্তু খুনের পদ্ধতির সাথে সাথে নামটাও পাল্টে গেছে অনেকটা।

এখন সেটাকে বলা হয় এ্যাসাসিন।

০৬.

চৌষট্টি মিনিট পরে সূর্যের আলোয় বিধৌত রানওয়ের উপর আছড়ে পড়ে জেটটা। বাইরের খোলা আবহাওয়া একেবারে লা জওয়াব। চারপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ আর কালচে পাহাড়, মাথায় তাদের শুভ্র বরফের টোপর।

স্বপ্ন দেখছি আমি, বলল রবার্ট ল্যাঙডন নিজেকে শুনিয়ে, যে কোন মুহূর্তে জেগে উঠব।

সুইজারল্যান্ডে স্বাগতম, বলল পাইলট।

হাতের ঘড়ি দেখে নিল ল্যাঙডন, এখানে সাতটা সাত দেখাচ্ছে।

আপনি ছটা টাইম জোন পেরিয়ে এসেছেন। এখানে এখন মাত্র একটা বেজেছে। দুপুর একটা।

সাথে সাথে ঘড়ি রিসেট করল ল্যাঙডন।

কেমন বোধ করছেন আপনি?

পাকস্থলি চেপে ধরল ল্যাঙডন, যেন আমি এইমাত্র এত্তোগুলো স্টিরোফোম খেয়ে উঠেছি।

নড করল পাইলট, উচ্চতা-অসুখ। আমরা ষাট হাজার ফিট উপরে ছিলাম। সেখানে ওজন কমে যায় ত্রিশভাগ। কপাল ভাল, আমরা কম দূরত্ব পেরিয়ে এসেছি। : যদি টোকিওতে যেতে হত তাহলে আর কোন কথাই নেই। শত মাইল উপরে উঠতে হত।

একটা উষ্ণ নড় করে ল্যাঙডন নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করল টোকিও না যেতে হওয়ায়। টেক অফের সময় হাড়ভাঙা ত্বরণের কথা বাদ দিলে এ যাত্রা যাত্রাটা খারাপ হয়নি। কিন্তু একটা কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে, এগারো হাজার মাইল প্রতি ঘণ্টা বেগে ঘুরে এসেছে তারা এইমাত্র।

এক্স থার্টি থ্রির যত্ন আত্তি করার জন্য কয়েকজন এগিয়ে গেল রানওয়ের দিকে। পার্কিঙয়ে রাখা একটা কালো পিউগট সিডানে নিয়ে গেল পাইলট তাকে। ভ্যালির ভিতর দিয়ে একটা আকাবাকা পথে চলে গেল তারা। মাঝে মধ্যে একটু দুটা বিল্ডিং দেখা যায়, বাকিটা সবুজ ঘাসে মোড়া।

অবিশ্বাসের সাথে সে দেখল, পাইলট বিনা দ্বিধায় গাড়ির গতি ঘণ্টায় একশো শত্ত্বর কিলোমিটার তুলে ফেলল।

এই লোকটার সাথে গতির কী সম্বন্ধ? ভেবে পায় না সে।

ল্যাব থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে আছি। সেখানে নিয়ে যাব আপনাকে দু মিনিটের মধ্যে।

সাথে সাথে সিটবেল্টে নিজেকে আরো শক্ত করে গুটিয়ে নেয় সে।

কেন, সময়টাকে তিন মিনিট বানিয়ে নিয়ে আমাদের দুজনকেই সেখানে জ্যান্ত পৌঁছানো যায় না?

গতি বাড়িয়েই চলল গাড়িটা।

টেপ ডেকে একটা ক্যাসেট ঢোকাতে ঢোকাতে জিজ্ঞাসা করল পাইলট, আপনি কি রেবা পছন্দ করেন?

এক মহিলা গাওয়া শুরু করল, এ হল একা থাকার ভয়…

এখানে কোন ভয় নেই, অন্যমনস্কভাবে ভাবে ল্যাঙডন, তার মেয়ে সহকর্মীরা নিশ্চিন্তে বলে বেড়ায় যে বাসার সারাটা জায়গাকে একেবারে জাদুঘর বানিয়ে রাখাটা আসলে একটা ছলনা। যেন খালি খালি না লাগে সে চেষ্টা।

হেসে উড়িয়ে দিত ল্যাঙডন সেসব কথা। তার জীবনে এরই মধ্যে তিনটা ভালবাসা দানা বেঁধেছে, সিম্বলজি, ওয়াটারপোলো আর কৌমার্য।

তার জীবনে ফিরে এসেছে আনন্দ, সে চাইলেই দুনিয়া চষে বেড়াতে পারে, করতে পারে যা খুশি। রাতের নিস্তব্ধতায় চাওয়া মাত্র একটা বই হাতে নিয়ে এক গ্লাস ব্র্যান্ডি তুলে নিতে পারে বিনা দ্বিধায়।

আমরা আসলে একটা ছোটখাট মহানগরী, বলল পাইলট, শুধু ল্যাব নয়, আমাদের আছে সুপারমার্কেট, একটা হাসপাতাল এমনকি পুরোদস্তুর একটা সিনেমা।

নড করল ল্যাঙডন। তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।

সত্যি বলতে গেলে, আমাদের হাতে আছে এ দুনিয়ার সবচে বড় যন্ত্র।

তাই নাকি?

ঠিক তাই। এটা মাটির নিচে, ছতলা নিচে বসানো।

কোন কথা না বলে তাকিয়ে রইল ল্যাঙডন এবারো।

হঠাৎ ঘ্যাচ করে থামিয়ে দিল পাইলট গাড়িটাকে। সামনে লেখা, সিকুরিটে, এ্যারেন্টেজ। এবার হঠাৎ করে সে টের পায় কোথায় আছে এখন।

মাই গড! আমি পাসপোর্ট আনিনি!

পাসপোর্ট একটা বাহুল্য। আমাদের সাথে সুইস সরকারের একটা সমঝোতা আছে।

দেখল ল্যাঙডন, একটা কার্ড এগিয়ে দিল পাইলট। সেন্টি সেটাকে নিয়ে ঢোকায় অথোরাইজেশন ডিভাইসের ভিতর। জ্বলে উঠল সবুজ বাতি।

যাত্রির নাম?

রবার্ট ল্যাঙডন। বলল পাইলট।

কার অতিথি?

ডিরেক্টরের।

ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেল সেন্ট্রির। সে তাকাল সামনের দিকে, একবার তাকাল হাতের লিস্টে, আরেকবার কম্পিউটার স্ক্রিনে। তারপর এগিয়ে এল জানালার কাছে, এঞ্জয় ইউর স্টে, মিস্টার ল্যাঙডন।

এগিয়ে গেল গাড়ি আরো দুশ গজ। সামনে একটা চতুষ্কোণ, অতি আধুনিক স্থাপত্য চোখে পড়ে, কাচ আর স্টিল দিয়ে গড়া। ভবনটার অসাধারণ স্বচ্ছতা,দেখে সে যার পর নেই আমোদিত হল। সব সময় ল্যাঙডন স্থাপত্যশৈলির সমঝদার।

দ্য গ্লাস ক্যাথেড্রাল। বলল লোকটা।

গির্জা?

আরে না! এখানে একটা জিনিসই নেই। গির্জা। এখানকার ধর্মের নাম ফিজিক্স। পদার্থবিদ্যাই এখানকার চালিকা শক্তি। যত খুশি ঈশ্বর নাম মুখে আনুন, শুধু কোয়ার্ক আর মেসন সম্পর্কে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখালেই হল।

কোয়ার্ক আর মেসন? কোন বর্ডার সিকিউরিটি নেই? ম্যাক ফিফটিক জেট? কোন নরক থেকে উঠে এসেছে এই লোকগুলো?

সামনের একটা বিশাল কাচের ভবন। সেখানে থেমে জবাব পেয়ে গেল সে।

(সার্ন)
কাউন্সেল ইউরোপিন পুর লা
রিসার্চে নিউক্লিয়ারে

নিউক্লিয়ার রিসার্চ? পুরোপুরি নিশ্চিত সে, অনুবাদ ঠিক ঠিক হয়েছে।

কোন জবাব দিল না ড্রাইভার। এখানেই নামতে হচ্ছে আপনাকে। ডিরেক্টর এখানেই দেখা করছেন।

একজন লোককে হুইল চেয়ারে বসে বেরিয়ে আসতে দেখল ল্যাঙডন। লোকটা এগিয়ে আসছে, চোখে মুখে প্রৌঢ়ত্বের ছাপ, বয়স হবে ষাটের কোঠার প্রথমদিকে। এখনো শক্ত চোয়াল। এত দূর থেকেও তার চোখ দুটাকে একেবারে নিপ্রাণ বলে মনে হয়। যেন পাথরের টুকরা।

তিনিই সেই লোক?

যাক, আমিও একদিন হব। বলল পাইলট, নির্মল একটা হাসি দিয়ে, শয়তানের কথা আরকী!

এগিয়ে গেল সে লোকটার দিকে। বাড়িয়ে দিল লোকটা কৃশ একটা হাত।

মিস্টার ল্যাঙডন? আমি ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার। ফোনে কথা হয়েছে আমাদের।

০৭.

ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার, ডিরেক্টর জেনারেল অব সার্ন, পিছন থেকে তাকে ডাকা হয় কোনিং-কিং। একটা হুইল চেয়ারের সিংহাসনে থেকে সে শক্ত হাতে চালায় সার্নকে।

মাত্র কয়েক মুহূর্ত ধরে লোকটার সান্নিধ্যে থেকেও ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে ল্যাঙডন, দূরত্ব বজায় রাখতে ওস্তাদ এই প্রবীণ বিজ্ঞানী।

হুইল চেয়ারের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে রীতিমত ঘেমে নেয়ে উঠতে হচ্ছে ল্যাঙডনকে। এমন চেয়ার সে কস্মিনকালেও দেখেনি। হাজারটা বিদঘুটে যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। একটা মাল্টি লাইন ফোন সেট আছে, আছে পেজিং সিস্টেম, কম্পিউটার স্ক্রিন, এমনকি একটা ছোট, ডিটাচেবল ভিডিও ক্যামেরা।

এ হল কিং কোহলারের মোবাইল কমান্ড সেন্টার।

সার্নের বিরাটাকায় মূল লবিতে প্রবেশ করল ল্যাঙডন একটা যান্ত্রিক দরজা পেরিয়ে।

দ্য গ্লাস ক্যাথেড্রাল, মনে মনে আউড়ে গেল সে, উপরের দিকে তাকিয়ে।

উপর থেকে নীলচে কাচে পড়ছে পড়ন্ত সূর্যের রশ্মি, এগিয়ে আছে একটা অনির্বচনীয় আবহ। বাতাসে পরিচ্ছন্নতার গন্ধ, কয়েকজন বিজ্ঞানী এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের পদশব্দ পাওয়া যায় সব সময়।

এ পথে, প্লিজ, মিস্টার ল্যাঙডন। বলল কোহলারের কণ্ঠস্বর। একেবারে কম্পিউটারাইজড। দ্রুত করুন প্লিজ, মরা চোখ তুলে তাকাল সে ল্যাঙডনের দিকে।

মূল আর্টিয়াম থেকে অযুত হলওয়ে চলে গেছে চারদিকে। প্রতিটায় জীবনের উৎসব।

যে-ই দেখছে কোহলারকে, থমকে যাচ্ছে। তারপর চোখ তুলে তাকাচ্ছে ল্যাঙডনের দিকে। কে লোকটা, যে ডিরেক্টরকে খাচা থেকে বের করে আনল!

আমি বলতে লজ্জা পাচ্ছি যে কখনো সার্নের নামটা পর্যন্ত শুনিনি।

স্বাভাবিক। বেশিরভাগ আমেরিকান মনে করে বিজ্ঞানের আধুনিক সূতিকাগার তাদের দেশ। ইউরোপ নয়। তারা আমাদের এলাকাকে শুধু মাত্র একটা শপিং ডিস্ট্রিক্ট মনে করে। তারা ভুলেই যায়, এখানেই জন্মেছিলেন আইনস্টাইন, গ্যালিলিও, নিউটন।

পকেট থেকে ছবিটা বের করে কাজের কথায় চলে এল ল্যাঙডন, ছবির লোকটা, আপনি কি-

প্লিজ। এখানে নয়। আমি আপনাকে তার কাছেই নিয়ে যাচ্ছি। হাত বাড়াল সে, মনে হয় জিনিসটা হাতে নিয়ে নেয়াই ভাল।

বিনা বাক্যব্যায়ে ল্যাঙডন তার হাতের ছবিটা তুলে দিল ডিরেক্টরের হাতে।

হঠাৎ বাঁয়ে মোড় নিয়ে কোহলার একটা চওড়া হলওয়েতে ঢুকল যেটা ছেয়ে আছে নানা আকার আর প্রকারের বিচিত্র সব এ্যাওয়ার্ডে। বড় একটার সামনে দিয়ে যেতে যেতে লেখাটা পড়ল ল্যাঙডন।

আর্স ইলেক্ট্রনিকা এ্যাওয়ার্ড
ডিজিটাল যুগে কালচারাল আবিষ্কারের জন্য
পুরস্কারটা যাচ্ছে টিম বার্নার্ড লি এবং সার্নের কাছে
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব,
আবিষ্কারের কারণে

সব সময় ল্যাঙডন ভেবে এসেছে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আমেরিকার কীর্তি।

ওয়েবটা, বলছে কোহলার, মুখে রুমাল চাপা দিয়ে একটু কেশে নিয়ে, এখানে প্রথম তৈরি করা হয় ভিতরের কম্পিউটারের যোগাযোগ যন্ত্র হিসাবে। যাতে যে কোন বিজ্ঞানী সার্নের যে কোন তথ্য পেতে পারে সহজেই। কিন্তু দুনিয়া মনে করে এটা আমেরিকার আবিষ্কার।

কেন সঠিক তথ্যটা জানানো হয় না?

সাধারণ একটা ভুল শোধারাবার গরজ সার্নের নেই। কম্পিউটারের পৃথিবীব্যাপি কানেকশনের তুলনায় সার্ন অনেক বেশি বড়। আমাদের বিজ্ঞানীরা প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন জাদু দেখায়।

জাদু?

আপনাকে অন্যরকম মনে হচ্ছে। আমার ধারণা ছিল আপনি রিলিজিয়াস সিম্বলজিস্ট। আপনি কি জাদুমন্ত্রে বিশ্বাস করেন না? অলৌকিকে?

আমি অলৌকিকে ঠিক ভরসা রাখি না। এ ব্যাপারে কোন স্থির বিশ্বাস নেই আমার।

সম্ভবত অলৌকিক ভুল শব্দ। আমি আপনার ভাষায় কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

আমার ভাষায়? একটু তেতে উঠল ল্যাঙডন, আপনাকে দুঃখ দেয়ার জন্য বলছি, স্যার। আমি রিলিজিয়াস সিম্বলজি স্টাডি করি-আমি একজন এ্যাকাডেমিক, কোন যাজক নই।

একটু যেন লজ্জা পেল সার্নের ডিরেক্টর, অবশ্যই, কী বোকা আমি! ক্যান্সারের লক্ষণ বিচারের জন্য ডাক্তারের ক্যান্সার রোগি হতে হবে এমন কোন কথা নেই।

এত স্পষ্টভাবে আগে ভাবেনি ল্যাঙডন ব্যাপারটা নিয়ে।

এগিয়ে যেতে যেতে একটা হলওয়ে ধরে কোহলার বলল, আশা করি আমি আর আপনি পরস্পরকে ঠিক ঠিক বুঝতে পারব।

কেন যেন কথাটা সত্যি বলে মনে হল না ল্যাঙডনের।

এগিয়ে যেতে যেতে সে টের পেল, সামনে থেকে তাদের পায়ের প্রতিধ্বনি উঠছে। বুঝতে পারল, টানেলের শেষ মাতা চলে এল। তারপর এমন কিছু দেখল যেটার সাথে। অভিজ্ঞতা খাপ খায় না।

এটা আবার কী?

ফ্রি ফল টিউব। মুক্ত পতন টিউব। এটুকুই বলল কোহলার। যেন আর কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।

আর কোন আগ্রহ দেখাল না ল্যাঙডন। কিন্তু মনে মনে একটু তেতে উঠল। কোহলার লোকটা আর যে পুরষ্কারই পাক না কেন, আতিথেয়তার জন্য কোন উপহার সে পাবে না।

আমার কী! ভাবে সে। আমি এখানে এসেছি অন্য কোন কারণে। ইলুমিনেটি।

এখানেই কোথাও একটা খুন হয়ে যাওয়া দেহ পড়ে আছে। এটা চোখের নজরে দেখার জন্য সে পেরিয়ে এসেছে তিন হাজার মাইল।

প্রফেসর রবার্ট ল্যাঙডন এক জীবনে কম বস্তু দেখেনি। কম বিস্মিত হয়নি। কিন্তু এখন যা দেখতে পেল তার কোন ব্যাখ্যা আপাতত নেই। একটা কাচের ঘরের চারধারে দর্শকদের সারি। ভিতরে কয়েকজন লোক ওজনশূণ্যভাবে ভেসে আছে। তিনজন। একজন হাত নাড়ল ভিতর থেকে।

মাই গড! ভাবে সে, আমি রূপকথার রাজ্যে চলে এসেছি।

রুমের ফ্লোরটা একেবারে নিখুঁত। সেখানে পাতলা একটা আবরণ আছে যেন পড়লেও খুব বেশি আঘাত না পায় লোকে। তার নিচে আছে একটা দানবীয় প্রোপেলার।

ফ্রি ফল টিউব, বলল কোহলার আবার। ইনডোর স্কাই ডাইভিং। ক্লান্তির হাত থেকে বেঁচে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জন্য ব্যবস্থাটা করা হয়েছে। নিচে আছে কৃত্রিম উইন্ড টানেল।

একজন মহিলা ভিতর থেকে হাসি দিল। এগিয়ে আনল তার বুড়ো আঙুল। দেখাল। সেটা। ভেবে পায় না ল্যাঙডন, এই মহিলা কি জানে এ এ প্রতীক ছিল আসলে প্রাচীণ ফ্যালিক ঐতিহ্যে এবং এ দিয়ে পুরুষের কদর্যতা প্রকাশ করা হয়।

মহিলাটা একটু মোটাসোটা। তাই ঘরের আর সবাই প্যারাস্যুট ছাড়াই ভাসলেও সে একটা পিচ্চি স্যুট পরে আছে। মোটা মানুষের জন্য এগুলো দরকার ফ্রি ফল ডাইভে। বোঝাই যায়।

ব্যাপারটা যে এই রাতেই, শত শত কিলোমিটার দূরের কোন এক দেশে তার জীবন রক্ষা করবে তা সে এখন বুঝতেও পারছে না।

০৮.

যখন কোহলার সার্নের মূল কমপ্লেক্সের পিছন দিয়ে বেরিয়ে এল, তাদের চোখে আঘাত করল সুইজারল্যান্ডের সূর্যের আলো। চারধারে সবুজ ঘাসের ভিতর দিয়ে পায়চলা পথ। সুন্দর সুন্দর লন। দুজন হিপ্পি ফ্রিসবি ছোড়াছুড়ি করছিল একে অপরের দিকে। শুনছিল মাহলারের ফোর্থ সিম্ফনি।

এখানে চারটা রেসিডেন্সিয়াল ডর্ম আছে, এগিয়ে যেতে যেতে বলল কোহলার, এখানে তিন হাজারেরও বেশি ফিজিসিস্ট আছেন। সার্ন একাই পৃথিবীর বেশিরভাগ পার্টিকেল ফিজিসিস্টকে চাকরি দেয়। পৃথিবীর বুকের সবচে মেধাবী মুখগুলোকে–জার্মান, জাপানি, ইতালিয়, ডাচ, নানা ভাষার, নানা দেশের মানুষ পাঁচশতাধিক ইউনিভার্সিটি আর ষাটটার উপর দেশ থেকে আমাদের পদার্থবিদরা এসেছেন।

আপনারা সবাই যোগাযোগ করেন কী করে?

ইংরেজি, অবশ্যই, বিজ্ঞানের সর্বগামি ভাষা।

ল্যাঙডন জানত গণিত হল বিজ্ঞানের সর্বগামি ভাষা। কিন্তু যুক্তি দেখানোর মত এনার্জি নেই তার। এগিয়ে গেল সে ডিরেক্টরের পিছন পিছন।

নিচে এক লোক জগিং করছিল। তার গেঞ্জিতে লেখা, নো গাট, নো গ্লোরি।

গাট?

জি ইউ টি। জেনারেল ইউনিফাইড থিওরি। জাগতিক, এবং অজাগতিক সব ব্যাপারকে এক সূত্রে গাঁথার তত্ত্ব।

আই সি সবজান্তার ভাব নিল ল্যাঙডন, বুঝল না কিছুই।

আপনি কি পার্টিকেল ফিজিক্স সম্পর্কে জানেন, মিস্টার ল্যাঙডন?

আমি জেনারেল ফিজিক্স সম্পর্কে একটু একটু জানি। পড়ন্ত বস্তু আরও কী সব যেন… সে সব সময় পানিতে হাই জাম্প করে। গতি বাড়ার হার বা তৃরণ দেখে দেখে। সে পদার্থবিদ্যাকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছে। কণা-পদার্থবিদ্যা হল আণবিক বিদ্যা, তাই নয় কি?

মাথা নাড়াল কোহলার, আমরা যা নিয়ে কায় কারবার করি তার কাছে একটা পরমাণু হল একেবারে গ্রহের সমান। আমাদের আগ্রহ পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ব্যাপারে। কেন্দ্রবিন্দু। পুরো পরমাণুর দশ হাজার ভাগের একভাগ এলাকা। সার্নের হাজার হাজার মেধাবী মুখ এখানে একত্র হয়েছে সেই প্রশ্নের জবাব পাবার জন্য যেটার, পিছনে ছুটছে তারা অনন্তকাল ধরে। যে রহস্যের কিনারা করতে গিয়ে মানুষ নিয়েছে নানা সংস্কার আর ধর্মের আশ্রয়। আমরা কী দিয়ে গড়া?

এই সব প্রশ্নের উত্তর একটা পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাগারে পাওয়া যাবে?

মনে হয় অবাক হলেন?

আমি তাই হয়েছি। উত্তরটা আত্মিক নয় কি?

মিস্টার ল্যাঙডন, এককালে সব প্রশ্নের উত্তরই ছিল আধ্যাত্মিক। বিজ্ঞান যেটাকে বুঝতে পারেনি,সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি সে প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য এগিয়ে এসেছে ধর্ম আদ্যিকাল থেকে। সূর্য আর চন্দ্রের ওঠানামা এককালে দেবতা হেলিওসের অগ্নিরথের সাথে যুক্ত ছিল। পোসাইডনের জন্যই হত ভূমিকম্প আর জলোচ্ছ্বাস। বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, সেসব ঈশ্বরের কোন অস্তিত্ব নেই। আস্তে আস্তে প্রমাণিত হবে কোন ঈশ্বরের কোন অস্তিত্ব কোনকালে ছিল না। বিজ্ঞান এর মধ্যে মানুষের করার মত প্রতিটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে বসেছে। আর মাত্র কয়েকটা প্রশ্ন বাকি। এবং এগুলোই সবচে বেশি অবাক করা। কোত্থেকে এলাম আমরা? কী করছি এখানে? জীবন আর এ সৃষ্টিজগতের মানে কী?

বিস্ময় লুকানোর চেষ্টা করল না ল্যাঙন, আর এসব প্রশ্নের জবাবই দেয়ার চেষ্টা করছে সান?

ঠিক করে নিতে হবে কথাটা। চেষ্টা করছি না শুধু, জবাব দিচ্ছিও।

এগিয়ে যেতে যেতে দুজন লোককে ফ্রিসবি খেলতে দেখল তারা। তাদের একজন ফ্রিসবি ছুড়ে মারলে সেটা সোজা এসে পড়ে তাদের সামনে। কোহলার না দেখার ভাণ করল।

আওয়াজ উঠল সেদিক থেকে, সিল ভৌস প্লেট! এস

তাকাল ল্যাঙডন সেদিকে। একজন শুভ্র কেশের বুড়ো লোক পরে আছে সোয়েট শার্ট, হাত নাড়ছে তার দিকে। ছুড়ে মারল সে ফ্রিসবিটা। কৃতজ্ঞতায় আঙুল দেখাল লোকটা। চিৎকার করে বলল, মার্সি! এই

অভিনন্দন! বলল কোহলার, আপনি এইমাত্র একজন নোবেল বিজয়ীর দেখা পেলেন। জর্জ চারপ্যাক। তিনি মাল্টিওয়্যার প্রোপোর্সনাল চেম্বারের আবিষ্কারক।

নড করল ল্যাঙডন। আজ দিনটাই আমার জন্য শুভ।

জায়গামত পৌঁছতে আরো তিন মিনিট লেগে গেল। সেখানে একটা বিলাসবহুল ডর্মিটরি দেখা যাচ্ছে। আর বাকিগুলোর তুলনায় সুন্দর। লেখা, বিল্ডিং সি।

এর স্থাপত্য রক্ষণশীল এবং কঠিন।

একজোড়া মার্বেলের কলামের পাশ দিয়ে যাবার সময় তারা দেখতে পায় কেউ একজন লিখেছে কী যেন।

এই কলামগুলো আয়নিক

আমি দেখে অত্যন্ত আনন্দিত যে বড় বড় মেধাবী ফিজিসিস্টরাও ভুল করে।

কী বলতে চান আপনি?

এই নোটটা যেই লিখে থাক না কেন, একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছে। এ কলামটা আয়নিক নয়। আয়নিক কলামগুলোর আকৃতি একেবারে এক রকম। এটা ডোরিক–গ্লিক ঐতিহ্য। এ ভুলটা অনেকেই করে।

হাসল না কোহলার, কথাটা ঠাট্টা করে লিখেছে যেই লিখে থাকুক। আয়নিক মানে আয়ন সম্পন্ন। বেশিরভাগ পদার্থেই আয়ন থাকে। ধনাত্বক বা ঋণাত্বক আয়ন থাকতেই পারে।

সাথে সাথে পিছনের কলামটার দিকে চোখ তুলে আরেকবার তাকাশ ল্যাঙডন।

***

একটা লিফট বেয়ে উঠে এসে পায়চলা পথে এসেও সে মনে মনে নিজেকে বেকুব ঠাউরে রেখেছে। সামনের সাজসজ্জা চমকে দিল তাকে। ফ্রান্সের কলোনিয়াল যুগের আদল। একটা ফ্লাওয়ার ভাস আছে, আছে চেরি ডিভান।

আমরা আমাদের বিজ্ঞানীদের একটু আরামে রাখতে ভালবাসি। ব্যাখ্যা করল কোহলার।

তার মানে ছবির লোকটা এখানেই থাকে? আপনার আপার লেভেল এমপ্লয়ি?

অনেকটাই। আজ সকালে আমার সাথে একটা মিটিং ছিল, সেটাকে মিস করে সে। তারপর আমার পেজেরও কোন জবাব দেয় না। আমি নিজে উঠে আসি এখানে, তারপর তার লিভিঙরুমে মরদেহ দেখতে পাই।

একটা লাশ দেখবে ভেবেই ভিতরে পাক দিয়ে উঠল ল্যাঙডনের কী করে যে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি লাশ কাটাছেঁড়া করে তারপর মানুষের দেহ আকত আল্লা মালুম।

এগিয়ে গেল তারা তারপর দেখতে পেল একটা লেখা!

লিওনার্দো ভেট্রা

লিওনার্দো ভেট্রা! বলল কোহলার, আগামি সপ্তাহে তার আটান্ন হবার কথা ছিল। আমাদের কালের সবচে মেধাবী বিজ্ঞানীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। তার মৃত্যু বিজ্ঞানের জন্য এক অপুরণীয় ক্ষতি।

এক মুহূর্তের জন্য মনে হল কোহলারের মুখাবয়বে ব্যাথার একটা চিহ্ন দেখা যাচ্ছে যত দ্রুত ব্যাপারটা এসেছিল তত দ্রুতই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। পকেটে হাত ডুবিয়ে একটা বড় চাবির রিঙ বের করল লোকটা।

একটা চিন্তা হঠাৎ পাক খেয়ে উঠল ল্যাঙডনের মনে। এ বিল্ডিংটায় আর কেউ নেই। কোথায় গেল সবাই?

ল্যাবে।

আমি বলছি, পুলিশ… তারা কি এরমধ্যেই চলে গেছে?

পুলিশ?।

অবশ্যই। পুলিশ। আপনি আমাকে একটা হত্যাকান্ডের ছবি পাঠিয়েছেন। অবশ্যই পুলিশকে ডাকার কথা।

আমি অবশ্যই তেমন কিছু করিনি।

কী?

কোহলারের ধূসর চোখ একটু সূক্ষ্ম হয়ে উঠল, পরিস্থিতি অনেক জটিল, মিস্টার ল্যাঙডন।

কিন্তু অবশ্যই কেউ না কেউ এ ব্যাপারটা সম্পর্কে জানে…

জানে। লিওনার্দোর পালক কন্যা। সেও সার্নের একজন পদার্থবিজ্ঞানী। সে আর তার বাবা একটা ল্যাব শেয়ার করে। তারা পার্টনার। ফিল্ড রিসার্চের জন্য মিস ট্রো এ সপ্তাহে বাইরে আছে। আমি তার বাবার মৃত্যুসংবাদ দিয়েছি। আসছে সে যথা সম্ভব তাড়াতাড়ি। কথা বলতে বলতেই এসে হাজির হবে।

কিন্তু একজন মানুষ খুন হয়ে–

একটা ফরমাল ইনভেস্টিগেশন ঠিকই নেয়া হবে। আর একই আঁথে লিওনার্দো আর তার মেয়ের ল্যাবে যাব আমরা। এই একটা ব্যাপারকে সবার থেকে আলাদা করে রেখেছে তারা। এজন্যই মিস ভেট্রা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করব আমি।

কোহলার চাবি ঘোরাল।

ল্যাঙডনের মুখে সাথে সাথে একটা বরফ শিতল বাতাস লাগল।সে যেন ফিরে গেছে। সারা ঘর ছেয়ে আছে থিকথিকে কুয়াশায়। আর কী ঠান্ডা!

কী ব্যাপার… বলতে পারল না বাকি কথাটা ল্যাঙডন।

ফ্রিয়ন কুলিং সিস্টেম। জবাব দিল কোহলার, মৃতদেহটা রক্ষা করার জন্য পুরো ঘরকে শিতল করতে হয়েছে।

কী ধাঁধায় পড়লাম আমি! ভেবে পায় না ল্যাঙডন।

০৯.

নীলচে কালো হয়ে আছে লিওনার্দো স্ট্রোর মরদেহ। সারা গায়ে কোন আবরণ নেই। মাথাটা একেবারে পিছনদিকে ফিরানো। নিজের জমে যাওয়া প্রস্রাবের মধ্যে পড়ে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এক বিজ্ঞানী। তার যৌনাঙ্গের রোমগুলো পর্যন্ত শক্ত হয়ে আছে।

বিভ্রান্ত হয়ে ল্যাঙডন দৃষ্টি দেয় লোকটার বুকের দিকে। যদিও কয়েক ডজন বার সে ছবিটা দেখেছে, তবু কেমন যেন করে উঠল বুকের পোড় চিস্টা দেখে ল্যাঙডনের নি। একটা নিখুন সিল জুড়ে আছে তার বুক।

চারপাশে একবার ঘুরে এল ল্যাঙডন। না, অন্যদিক থেকেও লেখাটা একই রকম।

মিস্টার ল্যাঙডন?

শুনতে পায়নি ল্যাঙড। অন্য কোন এক জগতে চলে গেছে সে… তার জগৎ তার কন, যেখানে ইতিহাস, মিথ, পুরাণ, আর সত্যি মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।

মিস্টার ল্যাঙডন?

চোখ তুলে এবারও তাকাল না সে। আপনারা কতটুকু জানতে পারলেন এ পর্যন্ত।

আমি আপনার ওয়েবসাইট পড়ে যেটুকু জানতে পারলাম, ব্যস, এটুকুই। এমিনেটি শব্দের মানে আলোকিত ব্যাক্তি। এটা কোন এক প্রাচীণ ব্রাদারহুডের নাম।

আপনি কি আগে নামটা শুনেছেন?

মিস্টার ভেট্রার বুকে দেখার আগে নয়।

তার মানে আপনি এর উপর একটা ওয়েব সার্চ চালালেন?

হ্যাঁ।

সাথে সাথে শব্দটার শত শত রেফারেন্স চলে এল, তাই না?

হাজার হাজার।বলল কোহলার, আপনারটায় হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড আর পরিচিত টারের নাম ছিল। আপনারটাই সবচে বেশি তথ্যবহুল বলে মনে হল।

এখনো ল্যাঙডন চোখ ফিরাতে পারছে না মৃতদেহটা থেকে।

এরচে বেশি কিছুই বলল না কোহলার। যেন অপেক্ষা করছে ল্যাংডন আরো কিছু কবে এর উপর। একটা সুরাহা হবে রহস্যের।

কোন উষ্ণতর জায়গায় বসে এ নিয়ে কথা বললে কেমন হয়? জিজ্ঞাসা করল নন।

এ ঘরটা মন্দ নয়। এখানেই কথা বলছি আমরা।

ভেবে পায় না সে, কোথা থেকে শুরু করে। ইলুমিনেটির কাহিনী সরল নয়। এতে যজারটা বাঁক আছে, আছে অনেক মোড়। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমি ঘেমে নেয়ে উঠব।

ইলুমিনেটির সেই বিখ্যাত সিম্বলের কথা সব সিম্বলজিস্ট জানলেও কেউ আসলে স্বচক্ষে দেখেনি এটাকে। আদ্যিকালের বইগুলোয় এটাকে এ্যাম্বিগ্রাম হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এ্যাম্বি মানে উভয়, বোঝা যায়, এটাকে উপর নিচ দু দিক দিয়ে একই ভাবে পড়া যাবে।

স্বস্তিকা, যিন ইয়াঙ, ইহুদিদের তারকা, সরল ক্রস–সবই এক একটা এ্যাগ্রিাম। আধুনিক কালের সিম্বলজিস্টর এই ইলুমিনেটি শব্দটাকে এ্যাম্বিগ্রামে বসাতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়েছে। কেউ পারেনি। ফলে আধুনিক সিম্বলজিস্টরা মনে করে এটা আসলে একটা মিথ।

তাহলে? ইলুমিনেটি কারা?
তাইতো! কারা?
শুরু করল ল্যাঙডন তার গল্প।

ইতিহাসের শুরু থেকে, ব্যাখ্যা করছে ল্যাঙডন, বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে একটা গভীর রেষারেষি ছিল। কোপার্নিকাসের মত বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা

খুন হয়ে গিয়েছিলেন। নাক গলাল কোহলার, সায়েন্টিফিক টুথ উদ্ধারের দায়ে চার্চের কোপানলে পড়েছিলেন। ধর্ম সব সময় বিজ্ঞানের পিছু ধাওয়া করে চলে।

ঠিক তাই। কিন্তু যোড়শ শতকে একদল লোক গির্জার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়। ইতালির সবচে আলোকিত লোকগুলো–পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, এ্যাস্ট্রোনোমার সবাই একত্রে গোপনে দেখা করতে শুরু করেন। চার্চের একমাত্র সত্যি সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানকে অবলীলায় পদদলিত করছে। বিজ্ঞান সত্যিকার সত্যিকে তুলে আনতে পারছিল না। তারা পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানমনস্ক ব্যাক্তি, যা একত্র হয়, নাম নেয় আলোকিত।

দ্য ইলুমিনেটি।

তাই। ইউরোপের সবচে জ্ঞানী গুণী লোকগুলো… একত্র হয় বৈজ্ঞানিক সূত্র রক্ষার কাজে, বিজ্ঞানকে ধর্মের নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে।

একেবারে চুপ মেরে গেল কোহলার।

অবশ্যই, হন্যে হয়ে তাদের খুঁজে বেড়ায় চার্চ। যেখানে যেভাবে পায়, হত্যা করে। অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে বিজ্ঞানীরা নিজেদের রক্ষা করে। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ইলুমিনেটি। ইউরোপ তার সূতিকাগার। সেখানকার সবচে ডাকসাইটে জ্ঞানী লোকগুলো একত্র হয়। এক অতি গোপনীয় এলাকায় তারা একত্র হয়। রোমের কোথাও। নাম তার চার্চ অব ইলুমিনেশন।

এখনো চুপ করে আছে ডিরেক্টর।

ইলুমিনেটির বেশিরভাগ চায় গির্জার বিরুদ্ধে লড়তে। কিন্তু তারা ছিল মধ্যমপন্থী। আর তাদের বাধা দেয় একজন। বিশ্বের সবচে দামি মানুষগুলোর একজন।

ল্যাঙডন আশা করে এবার নামটা না বলতেই বুঝে ফেলবে কোহলার। এ এমন এক মানুষ, যাকে নিয়ে মিথের অন্ত নেই, যার আবিষ্কারের কোন তুলনা নেই। যিনি বড়াই করে ভোলা মনে প্রথমবার বলতে পেরেছিলেন, পৃথিবী নয়, আমাদের চেনা সৃষ্টি জগতের কেন্দ্র সূর্য। যদিও তিনি সোজা বলে দিতে পারতেন, তবু একটু ঘুরিয়ে বলেন। বলেন, ঈশ্বর তার সৃষ্টি জগতের কেন্দ্রে না রেখে মানুষকে একটু দূরে স্থাপন করেছেন।

নাম তার গ্যালিলিও গ্যালিলি। বলল ল্যাঙডন অবশেষে। চোখ তুলে তাকাল কোহলার, গ্যালিলিও?

হু। গ্যালিলিও ছিলেন একজন ইলুমিনেটাস। বলা ভাল ইলুমিনেটির জ্ঞানগুরু। তিনি একই সাথে ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ ক্যাথলিক। তিনি বিজ্ঞানের উপর থেকে ধর্মের, বিশেষ করে খ্রিস্টবাদের রোষ কষায়িত দৃষ্টি সরানোর জন্য বললেন, বিজ্ঞান ঈশ্বরের উপস্থিতি অস্বীকার করে না।

এমনকি সবার মনকে বুঝ দেয়ার জন্য বলেছেন, টেলিস্কোপে করে বিভিন্ন গ্রহ দেখার সময় শুনতে পেয়েছেন ঈশ্বরের জয়গান। বলতেন, বিজ্ঞান আর ধর্ম শত্রু নয়, বরং পরস্পরের বন্ধু। বিজ্ঞান আর ধর্ম একই কথা দু পথে বলে। সমতার গল্প…

স্বর্গ আর নরক, রাত আর দিন, উষ্ণতা আর শিতলতা, ঈশ্বর আর শয়তান। বিজ্ঞান আর ধর্ম একই কথার জয়জয়কার করে যায়, ঈশ্বর আর খারাপের পার্থক্য, আলো আর আঁধারের পার্থক্য…

হুইল চেয়ারে বসে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে কোহলার।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, চার্চ কখনো চায়নি ধর্মের সাথে বিজ্ঞান মিশে যাক।

অবশ্যই নয়, এবার বলে উঠল কোহলার, তা হয়নি বলে কল্যাণ হয়েছে। বিজ্ঞান ধর্মের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেয়েছে। এর সাথে খ্রিস্টবাদ মিলে যেতে পারেনি। কিন্তু তেতে উঠল চার্চ। গ্যালিলিওকে বিচারের সম্মুখীন করল, সাব্যস্ত করল দোষী, বন্দি করে রাখল বাসায়। সায়েন্টিফিক হিস্টোরি সম্পর্কে ভালই জানি, মিস্টার ল্যাঙডন। কিন্তু এ সবই মধ্যযুগের কথা। কয়েক শতাব্দি আগের কথা। এর সাথে লিওনার্দো ট্রোর কী সম্বন্ধ?

মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।

গ্যালিলিওর আটকে থাকাতে তেতে উঠল ইলুমিনেটি। ছোট কোন ভুল হয়ে গেল। চার্চ পেয়ে গেল চার ইলুমিনেটি বিজ্ঞানীকে। ধরে আনল তাদের, করল জিজ্ঞাসাবাদ। এমনকি সেই চারজন কোন কথাই বলল না–সয়ে গেল নরক যন্ত্রণা।

নরক যন্ত্রণা?

নড করল ল্যাঙডন, জীবিত অবস্থায় তাদের বুকে ছাপ মেরে দেয়া হয়। একটা ক্রসের সিম্বল।

বড় বড় হয়ে গেল কোহলারের চোখ।

তারপর সে বিজ্ঞানীদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। তাদের মৃতদেহ ফেলে রাখা হয় রোমের পথে পথে। যারা ইলুমিনেটিতে যোগ দিতে চায় তাদের সামনে পরিবেশন করা হয় হুমকি। চার্চের অব্যাহত চাপের মুখে ইতালি থেকে প্রায় লুপ্ত হয়ে যায় ইলুমিনেটি।

ইলুমিনেটি চলে যায় একেবারে আন্ডারগ্রাউন্ডে। ক্যাথলিকদের হাতে হেনস্থা হওয়া অন্য গ্রুপগুলোর সাথে তাদের মিশে যাবার প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন থেকেই। মিস্টিক, এ্যালকেমিস্ট, অকাল্টিস্ট, মুসলিম, ইহুদি। বছরের পর বছর ধরে ইলুমিনেটি দল ভারি হতে থাকে।

এক নূতন ইলুমিনেটির উদয় হয়। অ ইলুমিনেটি। এক গতী, হিস্ত্র ইলুমিনেটি, খ্রিস্টবাদ বিরোধী ইলুমিনেটি। তারা অপেক্ষা করতে থাকে, শক্তি জড়ো করতে থাকে, এগিয়ে যাবার প্রেরণী একত্র করতে থাকে, ক্যাথলিক চার্চের উপর প্রতিশোধ নেয়ার বাসনা তাদের অন্তরে। একদিন উঠে আসবে তারা। তাদের শক্তি এত বেড়ে যায় যে গির্জা তাদেরকে পৃথিবীর একক, সর্ববৃহৎ এন্টি-ক্রিশ্চিয়ান দল হিসাবে বিবেচনা করতে শুরু করে। ভ্যাটিকান এবার ঘোষণা করে ইলুমিনেটিতে একটা শাইতোয়ান হিসাবে।

শাইতোয়ান?

শব্দটা ইসলামি। এর মানে শত্রু। ঈশ্বরের শত্রু। অমান্যকারী চার্চ ইসলামকেই বেছে নিল কারণ এ ধর্মের ভাষা আর সব ব্যাপারকেই তারা চরম নোংরা বলে মনে করত। শাইতোয়ান হল ইংরেজি শব্দ স্যাটানের মূল।

কোহলারের চেহারায় ফুটে উঠল অস্বস্তি।

আরো বেড়ে যাচ্ছে ল্যাঙনের কণ্ঠের তেজ, মিস্টার কোহলার, আমি জানি না কী করে এই চিহ্ন এ লোকে বুকে এল। কিমা কেন এল। কিন্তু আপনি তাকিয়ে আছেন পৃথিবীর সবচে বড় আর ক্ষমতাবান আন্ডারগ্রাউন্ড শয়তানি সংঘের প্রতীকের দিকে।

১০.

গলিটা একেবারে চিকন। জনশূণ্য। দাঁড়িয়ে আছে হ্যাসাসিন। তার কালো চোখ চকচক করছে কী এক অজানা লালসায়। সে জায়গা মত এগুনোর সাথে সাথে জ্যানাসের শেষ কথাগুলো কানে বেজে ওঠে। পরের ধাপ শুরু হতে যাচ্ছে। একটু আয়েশ করে নাও।

ঘুমের অভাব আছে হ্যাসাসিনের চোখে। কিন্তু তার পূর্বপুরুষরা একবার কোন যুদ্ধে নেমে পড়লে ঘুম কাকে বলে বুঝত না। এ যুদ্ধ ঠিক ঠিক শুরু হয়ে গেছে। আর সে প্রথম রক্তপাতের কাজটা করতে পারছে। এখন কাজে ফিরে যাবার আগে হাতে মৌজ করার মত দুটা ঘণ্টা সময় থাকছে।

ঘুম? রিল্যাক্স করার মত আরো ভাল কত পথ আছে…

হাসিস? না। পূর্বপুরুষের মত কোন ড্রাগ নিবে না সে। তারচে অনেক আনন্দদায়ক উৎস আছে আশপাশে। নিজের শরীর নিয়ে গর্বিত সে। গর্বিত খুন করার ক্ষমতা নিয়ে।

গলির পথ ধরে একটা দরজায় হাজির হয় সে। সেখানে ডোরবেল বাজিয়ে ভিতরে ঢোকে।

স্বাগতম! সুন্দর পোশাক পরা রমণী তাকে অভ্যর্থনা জানায়।

একটা ছবির এ্যালবাম তুলে দেয় আধো আলো ছায়াতে মহিলা বলে, মন স্থির হলে আমাকে রিঙ কবুলেই চলবে।

হাসল হ্যাসাসিন।

যদিও তাদের জানি ক্রিসমাস উপভোগ করে না, কিন্তু সে আশা করে এখানে কোন এক খ্রিস্টান বালিকা অপেক্ষা করবে তার জন্য। ভিতরের ছবিগুলো দেখতে দেখতে তার শরীর জেগে ওঠে। এক জীবনে উপভোগ করার মত ছবি ভেসে ওঠে সামনে।

মারিসা, ইতালিয় দেবী।

ফিয়েরি, তরুণী সোফিয়া লরেন।

সাকহিকো, জাপানি পুতুল।

লিথ, কোন সন্দেহ নেই, পাকা।

কানারা, সুন্দর, পেশীবহুল, আদিরসাত্বক।

দুবার পুরো এ্যালবাম চষে দেখল সে। তারপর টেবিলের পাশের বোতামে চাপ দিল। এগিয়ে এল সেই মহিলা, বলল, ফলো মি।

এগিয়ে গেল সে। চাহিদা মত সব ব্যাপার ঠিকঠাক করতে করতে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হল তাকে। তারপর এগিয়ে গেল সামনের দিকে। একটা সুন্দর হলওয়ে। শেষের সোনালি দরজা। তোমার স্বাদ দামি।

উচিৎ।

একটা চিতা যেভাবে বুভুক্ষু থেকে থেকে অবশেষে শিকারের সন্ধান পায়, যেভাবে এগিয়ে যায়, সেভাবে এগোয় সে।

দরজায় ধাক্কা দেয়। খুলে যায় সেটা।

যখন সে তার সিলেকশন দেখতে পায়, চোখের সামনে খুলে যায় চিন্তার ভাঁজ।, ভুল হয়নি। তার অনুরোধ মত সাজানো আছে মেয়েটা… নগ্ন, উপুর হয়ে শুয়ে আছে, পুরু ভেলভেটের কর্ড দিয়ে স্ট্যান্ডের সাথে বাঁধা দু হাত।

ঘরটা কোনক্রমে পেরিয়ে যায় সে। তারপর হাত রাখে নগ্ন, উত্তেজক নিম্নাঙ্গে, পিছন থেকে। আমি কাল রাতে খুন করেছি একটা। আর তুমি আমার পুরস্কার।

০২. ভেবে পায় না কোহলার কী বলবে
১১.

শয়তানি? ভেবে পায় না কোহলার কী বলবে, এটা কোন শয়তানি সংঘের প্রতীক?

এতক্ষণে ঘরটাকে একটু উষ্ণ মনে হয় ল্যাঙড়নের। ইলুমিনেটি শয়তানি সংঘ ছিল ঠিকই। কিন্তু এখনকার বিবেচনায় নয়, আমরা শয়তানি সংঘ বলতে যা বুঝি তেমন নয়।

মানুষ শয়তানি সংঘ বলতে বোঝে কিম্ভুত সাজ-পোশাকের কিছু মানুষকে যারা শয়তানের পূজা করে আর বিচিত্র জীবন যাপন করে। কিন্তু ব্যাপারটা তেমন নয়। চার্চ যাকে শয়তানি সংঘ বলে ঘোষণা করে তা তেমন হবে এমন কথা নেই। এ সম্পর্কে একটা ভীতি জুড়ে দেয়াই গির্জার আসল উদ্দেশ্য। শাইতোয়ান।

শয়তানি সংঘগুলো শয়তানের পূজা করে, আরাধনা করে, পশু বলি দেয়, রক্তপান করে, নেশা করে, ব্ল্যাক ম্যাজিক করে, পেন্টাগ্রাম ধারণ করে, এসবই চার্চের প্রচারণা। কিছু সত্যি যে নেই তা নয়। কিন্তু এসব খাটে না ইলুমিনেটির ব্যাপারে।

মানুষ চার্চের কথা আস্তে আস্তে বিশ্বাস করতে থাকে। ত্যাগ করতে থাকে। ইলুমিনেটিকে এবং এমন সব সংঘকে। সফল হয় চার্চের উদ্দেশ্য।

এ সবই পুরনো কাহিনী। আমি জানতে চাই এখানে কী করে এই সিম্বলটা এল!

একটা গভীর শ্বাস নিল ল্যাঙডন, গ্যালিলিও সমতা ভালবাসতেন। যে কোন ক্ষেত্রে। তার সেই অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েই ইলুমিনেটির কোন এক অজানা কিন্তু বিখ্যাত শিল্পী এই প্রতীকটা আবিষ্কার করেন। এই ডিজাইনটাকে ইলুমিনেটি গুপ্ত রেখেছে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে। তাদের একটা আশা ছিল, একদিন তারা শক্তি অর্জন করবে, সেদিন সগর্জনে বেরিয়ে আসবে। সেদিনই প্রথম দেখা যাবে তাদের সিম্বল। অর্জন করবে ফাইনাল গোল।

তার মানে, এই প্রতীকটা বলছে যে ইলুমিনেটি ব্রাদারহুড এবার বেরিয়ে আসবে?

ব্যাপারটা এক কথায় অসম্ভব। ইলুমিনেটির আরো একটা অধ্যায় থেকে যাচ্ছে যার ব্যাখ্যা আমি করিনি।

আলোকিত করুন আমাকে।

হাতের তালু একত্র করল ল্যাঙডন, মনে মনে শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছে, যা লিখেছে এবং যা জানে, একত্র করছে সে, ইলুমিনেটি টিকে গিয়েছিল, রোমের বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়ে তারা সারা ইউরোপ চষে বেরিয়েছে। একটা নিরাপদ স্থানের খোঁজে। কালক্রমে তারা আরো একটা সিক্রেট সোসাইটির সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে। নাম তার। ফ্রিমেসন।

দ্য মেসনস?

মেসনদের সদস্য আধকোটিরও বেশি সারা পৃথিবীতে। অর্ধেক আছে আমেরিকায়, আর এক মিলিয়ন ইউরোপে।

মেসনরা আর যাই হোক, শয়তানি সংঘ নয়। বলল কোহলার।

অবশ্যই নয়। বিজ্ঞানীদের তাদের দলে যুক্ত করে নিয়ে মেসনরা একটা ছদ্ম আবরণ এনে দিল ইলুমিনেটির জন্য। এটাই প্রয়োজন ছিল। আস্তে আস্তে পরজীবীর মত একে একে এর বড় বড় পোস্টগুলো দখল করে নেয় ইলুমিনেটি। সবার অজান্তে। সেই সতেরশ সাল থেকে। একটা সোসাইটির ভিতরে গজিয়ে ওঠে অন্য। সিক্রেট সোসাইটি। মূল আদর্শে তারা একই রকম। শুধু ইলুমিনেটির লক্ষ্য ধ্বংস বয়ে আনা। তাদের আদর্শ আস্তে আস্তে ভর করে মেসনের উপর।

আস্তে আস্তে মেসনকে বোঝানো হয়, চার্চ যে খড়গহস্ত হয়ে আছে সেটা সবার জন্য খারাপ। বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রা থেমে যাবে, থমকে যাবে মানবজাতির পথচলা। পিছিয়ে পড়বে একটা অবৈজ্ঞানিক পথে! শুরু হবে ধর্মযুদ্ধ।

ঠিক যেমনটা আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি।

মানল ল্যাঙডন। কথা সত্যি, আজো ক্রুসেড হচ্ছে। আজো সেই আদর্শ বয়ে চলছে ধর্ম থেকে ধর্মে। আমার ঈশ্বর তোমারটার চেয়ে বড়।

বলে যান। বলল কোহলার।

ভাবনাগুলোকে আবার গুছিয়ে নিল ল্যাঙডন, ইলুমিনেটি আস্তে আস্তে ইউরোপে বিস্তৃত হয়ে ওঠে। তারপর দৃষ্টি দেয় আমেরিকার উপর। এমন এক দেশ, যেখানে অনেক হর্তাকর্তারাই ছিল মেসনিক–জর্জ ওয়াশিংটন, বেন ফ্র্যাঙ্কলিন। সৎ, ধর্মভীরু মানুষগুলো, যারা জানে না মেসনদের উপর ছায়া পড়েছে ইলুমিনেটির। শেষ লক্ষ্য অর্জন করার জন্য জাঁকিয়ে বসে ইলুমিনেটি। সামরিক পথে নয়, ব্যাঙ্ক, ইউনিভার্সিটি, ইন্ডাস্ট্রি দখলের মাধ্যমে। তাদের লক্ষ্য একটাই, এক, অভিন্ন দুনিয়া সৃষ্টি করা। এক ভুবন, এক রাষ্ট্র, এক আদর্শ, ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মহীন পৃথিবী। এ নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার।

নড়ছে না কোহলার।

এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা, যার পিছনে আলো দিবে একটা মাত্র ব্যাপার। বিজ্ঞান। তারা তাদের লুসিফারিয় আদর্শে, লুসিফারিয়ান ডকট্রিনে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। গির্জা বলে, লুসিফার শয়তানের নাম। কিন্তু ইলুমিনেটি গোড়ার দিকে তাকায়। লুসিফার মানে শয়তান নয়, লুসিফার মানে আলোক আনয়নকারী। দ্য ইলুমিনেটর।

শ্বাস গোপন করল না কোহলার। মিস্টার ল্যাঙডন, প্লিজ সিট ডাউন।

পাতলা তুষারের পরত দেয়া চেয়ারে বসে পড়ে ল্যাঙডন।

আমি নিশ্চিত নই আপনার বলা প্রতিটা কথা বুঝতে পারছি কিনা। কিন্তু একটা ব্যাপার ঠিক ঠিক বুঝতে পারছি। লিওনার্দো ভেট্রা ছিলেন সার্নের সবচে মূল্যবান লোকদের একজন। তিনি আমার এক বন্ধুও ছিলেন। আমি চাই আপনি ইলুমিনেটিকে খুঁজে বের করার কাজে আমাকে সহায়তা করবেন।

ইলুমিনেটিকে খুঁজে বের করা?

বাচ্চাদের মত কথা বলছে নাকি লোকটা?

আমি দুঃখিত স্যার। এ কাজটা করা একেবারে অসম্ভব।

ভাঁজ পড়ল কোহলারের প্রতে, কী বলতে চান আপনি? আপনি নিশ্চই

মিস্টার কোহলার, ভেবে পায় না সে কী করে যা ভাবছে তা বলবে, আমার কাহিনী এখনো শেষ হয়নি। এখানে, এ লোকটার বুকে একটা চিহ্ন আছে। এই তো? গত আধ শতাব্দি ধরে ইলুমিনেটির মাথার টিকিটারও খোঁজ নেই। আর বেশিরভাগ স্কলার একমত যে ইলুমিনেটি অনেক বছর আগেই অবলুপ্ত হয়ে গেছে।

কী করে আপনি এ কথা বলেন? যেখানে এই লোকটার বুকে তাদের দেয়া পোড়া ছাপ মারা আছে!

এই একই প্রশ্ন ল্যাঙডনকেও জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারছে গত ঘণ্টাখানেক ধরে।

সিম্বল থাকলেই বোঝা সম্ভব নয় যে তাদের আসল স্রষ্টারা এখনো টিকে আছে।

এ কথার কী মানে হবার কথা?

আমি বলতে চাই, যদি ইলুমিনেটির তরী ডুবে গিয়েও থাকে, তাদের প্রতীকটা ঠিকই থাকবে… অন্য গ্রুপগুলো সেটা তুলে নিতে পারবে সহজেই। এর নাম ট্রান্সফারেন্স। সিম্বলজিতে এমন নজিরের কোন অভাব নেই। নাজিরা স্বস্তিকা নিয়েছে হিন্দুদের কাছ থেকে। খ্রিস্টানরা ক্রুসিফর্ম নিয়েছে মিশরিয়দের কাছ খেকে আর–

এই সকালে, আজ, আমি যখন ইলুমিনেটি টাইপ করছিলাম, বর্তমানের সাথে সম্পর্কযুক্ত হাজার হাজার ব্যাপারের সাথে এটার যোগসূত্র পাওয়া যায়। অনেক মানুষ মনে করে সেই গ্রুপটা আজো বিদ্যমান।

ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা।

মানুষ এখনো আশায় আছে, এখনো ভয়ে আছে, একদিন ঠিক ঠিক ইলুমিনেটি উঠে আসবে। ঝাপিয়ে পড়বে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার উপর। তৈরি করবে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার।

কিছুদিন আগেও নিউ ইয়র্ক টাইমস অনেক বিখ্যাত মেসনিক দিকপালের কথা বলেছে–স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, ডিউক অব কেন্ট, পিটার সেলার্স, আরভিউ বার্লিন, প্রিন্স ফিলিপ, লুইস আর্মস্ট্রঙ! সেই সাথে আছে আধুনিক লোকজন। ব্যাঙ্কার, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট।

তাকাল কোহলার মরদেহটার দিকে, তারপর একটু দম নিয়ে বলল, এ প্রতীক দেখে আমার মনে হচ্ছে ষড়যন্ত্রের কথা ভুল নয়।

আমি বুঝতেই পারছি ব্যাপারটা কীভাবে আসছে আপনার কাছে, যথা সম্ভব কূটনৈতিকভাবে বলল কথাটা, তবু এ কথাটাও ফেলে দেয়া যায় না যে অন্য কোন সংস্থা ইলুমিনেটির দখল নিয়ে নিয়েছে এবং তাদের মত করে ব্যাপারটাকে ব্যবহার করছে।

কোন লক্ষ্য? এই খুনটার কী মানে হয়?

ভাল প্রশ্ন।

চারশো বছর আগের সংস্থা কী করে একজন বিজ্ঞানীকে বিজ্ঞানের নাম নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলবে সেটা ভেবে পাচ্ছে না ল্যাঙডনও।

আমি আপনাকে একটা কথা বলতে পারি, ইলুমিনেটি যদি আজো সক্রিয় থাকে, আমি যা মনে করি, তারা সক্রিয় নেই, তবু, যদি থাকে, তারা কখনোই লিওনার্দো ভুেট্টার খুনের সাথে জড়িত হবে না।

না?

না। ইলুমিনেটি ক্রিশ্চিয়ানিটির বিলুপ্তিতে বিশ্বাস করলেও তাদের ক্ষমতা বেড়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর শিক্ষাগত দিকে, সামরিক দিক দিয়ে নয়। তার উপর, ইলুমিনেটির কঠিন একটা আদর্শ ছিল, কী করে তারা শত্রুদের দেখবে সে সম্পর্কিত একটা আদর্শ ছিল। তাদের কাছে ম্যান অব সায়েন্স হল সবচে উঁচু পদ। লিওনার্দো ভেট্রার মত একজন বিজ্ঞানীকে খুন করার কোন উপায় নেই তাদের হাতে।

কোহলারের চোখ বন্ধ হয়ে গেল। একটু থেমে সে বলল, আমার হয়ত আরো একটা ব্যাপার দেখাতে হবে আপনাকে।

মিস্টার কোহলার, আমি মানি, লিওনার্দো ট্রোর নানামুখী দক্ষতা থাকতে পারে, কিন্তু তাকে খুন করবে না ইলুমিনেটি কখনোই

কোনরকম আভাস না দিয়েই কোহলার হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে ঝট করে বেরিয়ে গেল লিভিঙরুম থেকে। এগিয়ে গেল একটা হলওয়ে ধরে।

ফর দ্য লাভ অফ গড, ভাবল ল্যাঙডন। হলওয়ের শেষ প্রান্তে তার জন্য অপেক্ষা রছিল কোহলার।

এ হল লিওনার্দোর স্টাডি। বলল ডিরেক্টর। আপনি ভিতরটা দেখার পর পরিস্থিতি সম্পর্কে ভিন্নভাবে ভাববেন।

এগিয়ে গেল ল্যাঙডন। তারপর ভিতরটা দেখেই পাক খেয়ে উঠল তার ভিতর। হোলি মাদার অব জেসাস! বলল সে আপন মনে।

১২.

এক অন্য দেশে, ভরুণ এক গার্ড বসে আছে ঘরভর্তি মনিটরের সামনে। ভেসে যাচ্ছে ইমেজ, তাকিয়ে আছে সেদিকে নিশ্চিন্তে। বিচিত্র আর জটিল ভবনগুলোর ভিতরে রাখা শত শত ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে সে। অশেষ মহড়া চালাচ্ছে ছবিগুলো।

এক হলওয়ে।

একটা অফিস ঘর।

বিশালবপু কিচেন।

হবিগুলো চলে যাচ্ছে। কোনক্রমে দিবান্দ্রিা ঠেকিয়ে রেখেছে গার্ড ধৈর্য ধরে। শিফট শেষ হবার সময়টাতেও বসে আছে সে। এখানে কাজ করতে পারাই এক প্রকার সম্মানের ব্যাপার। একদিন এজন্য সে পুরস্কার পাবে। অনেক দামি পুরস্কার।

একটা ছবির সামনে তার চোখ ঠেকে গেল। আর ঠেকে যাবার সাথে সাথে লাফিয়ে উঠল সে। চাপ দিল একটা বাটনে। ছবিটা স্থির হল সাথে সাথে। ধ্বক ধ্বক করে উঠল তার ভিতরটা। বুকে এল সামনে। সামনের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ক্যামেরা নাম্বার ছিয়াশি থেকে আসছে সেটা। এটার কোন এক হলওয়ের উপর নজর রাখার কথা।

কিন্তু সামনে যে ছবি ভেসে উঠেছে সেটা আর যেখানকারই হোক না কেন, কোন হলওয়ের নয়।

১৩.

সামনের স্টাডির দিকে বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে আছে ল্যাঙন। এ আবার কেমন জায়গা!

কোন জবাব দিল না কোহলার।

ঘরের দিকে বিমূঢ় দৃষ্টি ফেলে লাঙডন। মুখে কিছুই বলে না। এখানে তার জীবনে দেখা সবচে বিচিত্র আর্টিফ্যাক্ট ঠাসা। সামনে, বিশাল কাঠের কুসিফর্ম, দেখেই তার অভিজ্ঞ চোখ বলে দেয় জিনিসটা প্রাচীণ স্প্যানিশ। চতুর্দশ শতকের। কুসিফর্মের উপরে ছাদ থেকে ঝুলছে একটা বিশাল মডেল। সৌর জগতের মডেল। ডানে কিশোরি। মেরির শুয়েল পেইন্টিং।

অন্যপ্রান্তে দুটা ক্রুশ ঝুলছে, মাঝখানে আইনস্টাইনের ছবি, ছবির নিচে সেই বিখ্যাত উক্তি। ঈশ্বর সৃষ্টি জগৎ নিয়ে ছেলেখেলা খেলেন না।

ঘরের ভিতরে চলে এল সে। তাকাল চারধারে, সবিস্ময়ে। ডেস্কের উপর চামড়ায় মোড়া মূল্যবান একটা বাইবেল, বাইবেলের পাশে বোরের পরমাণু মডেলের প্লস্টিক সংস্করণ এবং সেইসাথে মাইকেলেঞ্জেলোর সেই বিখ্যাত কীর্তির রেপ্লিকা। মোজেস। মুসা।

ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল সে ঘরের উষ্ণতা থাকা সত্ত্বেও। এ কী! দিক-দর্শনের দু বিপরীত মেরু এক হয়ে গেছে লোকটার ঘরে। বুকসেলফের বইয়ের নামের দিকে চোখ ফেরাল সে।

দ্য গড পার্টিকেল
দ্য টাও অব ফিজিক্স
গডঃ দ্য এভিডেন্স

এক জায়গায় বইয়ের তালিকার সাথে লেখা :

সত্যিকার বিজ্ঞান ঈশ্বরকে আবিষ্কার করে
যিনি প্রতিটা দরজার পিছনে অপেক্ষা করছেন
–পোপ দ্বাদশ পিউস

লিওনার্দো একজন ক্যাথলিক যাজক ছিল… বলল কোহলার।

সাথে সাথে চমকে গেল ল্যাঙডন, বলল, একজন যাজক? আমার মনে হয় আপনি বলছিলেন তিনি একজন পদার্থবিদ।

সে দুটাই ছিল। ইতিহাসে বিজ্ঞান আর ধর্মের লোক অনেক পাওয়া যায়। লিওনার্দো তাদের একজন। সে পদার্থবিজ্ঞানকে ঈশ্বরের প্রাকৃতিক আইন বলে মনে করত। সব সময় একটা কথা বলত সে, আমাদের চারপাশের প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরের হাতের লেখা পাওয়া যাবে। বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে সে ঈশ্বরের উপস্থিতির কথা শতমুখে প্রচার করতে চাইত। এখানে থেকে তার অস্তিত্বের কথা প্রকাশ করতে চাইত। নিজেকে মনে করত একজন থিয়ো-ফিজিসিস্ট।

পার্টিকেল ফিজিক্সের ভূমিতে, বলছে কোহলার, সম্প্রতি কিছু চমকে দেয়া আবিষ্কার এসেছে। এমন সব আবিষ্কার যা পিলে চমকে দেয়। মানুষকে ধর্মের সামনে নতজানু করে তোলে। তেমন অনেক আবিষ্কারের দায় ছিল লিওনার্দোর।

স্পিরিচুয়ালিটি আর ফিজিক্স? জানে ল্যাঙডন, এরই নাম তেল-জুল। কখনো একে অন্যের সাথে মিশে যাবে না। কশ্মিন কালেও না।

পার্টিকেল ফিজিক্সের একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল ভেট্রা। ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে মেলবন্ধন গডতে যাচ্ছিল আর একটু হলেই। একেবারে অপ্রত্যাশিত পথে এ দু জগৎ একে অন্যকে জাপ্টে ধরে আছে, সেটাই দেখাতে চাচ্ছিল সে। এই ক্ষেত্রকে ডাকত নিউ ফিজিক্স।

একটা বই বের করল কোহলার। এগিয়ে দিল ল্যাঙডনের দিকে, গড, মিরাকল এ্যান্ড নিউ ফিজিক্স-লিওনার্দো ট্রো।

ফিল্ডটা এখনে তেমন বাড়েনি। বলল কোহলার, কিন্তু এর মধ্যে এমন কিছু আছে যার উত্তর আমরা খুঁজে চলেছি প্রথম থেকেই। সৃষ্টিজগতের শুরু আর আমাদের সবাইকে এক করে রাখা শক্তির ব্যাপারে এখানে পিলে চমকে দেয়া কয়েকটা তথ্য আছে। লাখ লাখ লোককে ধর্মের দিকে নিয়ে আসবে তার আবিষ্কার, এমনি বিশ্বাস ছিল। লিওনার্দো ভেট্রার। গত বছরই সে এমন এক আবিষ্কার করে যা বলছে যে একটা অচেনা শক্তি আছে যা আমাদের সবাইকে ধরে রাখে। রাখে একত্র করে… আপনার। শরীরের পরমাণুগুলো আমার শরীরের অণু-পরমাণুর সাথে যুক্ত… ফলে, একটা অবিচ্ছিন্ন শক্তি বয়ে চলছে আমাদের সবার ভিতরে।

চমকে উঠল কথাটা শুনে ল্যাঙডন, আর ঈশ্বরের শক্তিই আমাদের সবাইকে একত্র করবে! মিস্টার ট্রো প্রমাণ করতে যাচ্ছিলেন যে আমাদের সবাই, সব বস্তু একে অন্যের সাথে জড়িত?

প্রমাণ সহ। সায়েন্টিফিক আমেরিকানের এক নতুন সংখ্যায় নিউ ফিজিক্সকে আখ্যায়িত করা হয় ধর্মের পথে নয়, ঈশ্বরের পথে পথচলা হিসাবে।

থেমে গেল কোহলার। থমকে গেল ল্যাঙডন। আর ধর্মবিরুদ্ধ ইলুমিনেটি এমন কিছু ঘটতে দিবে না। এই স্বাভাবিক। কিন্তু অতি চিন্তা হয়ে যাচ্ছে কি? ইলুমিনেটি এখানে হাত লাগাবে! সম্ভব! ইলুমিনেটির স্থান এখন শুধুই বই পত্রে। এর কোন অস্তি ত্ব নেই মোটেও। সব এ্যাকাডেমিকই তা জানে!

বৈজ্ঞানিক জগতে ট্রোর শক্রর কোন অভাব নেই। বলল কোহলার, অনেক বৈজ্ঞানিক বিশুদ্ধতাবাদী তাকে উপড়ে ফেলতে চায়। এমনকি এই সার্নেও। এ্যানালিটিক্যাল ফিজিক্সকে ব্যবহার করে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানকে মিশিয়ে ফেলার বিরোধী তারা।

কিন্তু আজকের দিনে বিজ্ঞানীরা কি চার্চ থেকে অনেক বেশি প্রভাবমুক্ত নয়? তারা কি আর ধর্মের ব্যাপারগুলোকে ভয় করে?

কেন পাব আমরা? এখন আর চার্চ বিজ্ঞানীদের জ্যান্ত ধরে ধরে পোড়ায় না ঠিক, কিন্তু বিজ্ঞানের ভিতরে হাত ঢোকানের চেষ্টায় তাদের কোন অন্ত নেই। বলুনতো দেখি, আপনার দেশের অর্ধেক বিদ্যালয়ে কেন আজো বিবর্তনবাদ পড়ানো নিষেধ? কেন আপনাদের দেশের ক্যাথলিক লবি পৃথিবীতে বিজ্ঞানের জয়যাত্রাকে থমকে দেয়? বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে যুদ্ধ এখনো চলছে পুরোদমে, মিস্টার ল্যাওড়ন। এখন আর এসব নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র বেঁধে যায় না, বেঁধে যায় না কুরুক্ষেত্র, কিন্তু তা এখনো চলছে।

টের পেল ল্যাঙডন, লোকটার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। গ্রাজুয়েট প্রোগ্রামে কেন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং চলছে তা জানার জন্য এই সেদিনও যুক্তরাষ্ট্রে হাভার্ড স্কুল অব ডিভাইনিটি থেকে বায়োলজি বিল্ডিংয়ের দিকে মিছিল ছুটে গিয়েছিল। বায়ো ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান বিখ্যাত অর্নিথোলজিস্ট রিচার্ড এ্যারোনিয়ান তার ঘরের ভিতর থেকে একটা বিশাল ব্যানার ঝুলিয়ে দেন আমেরিকান লাঙফিল যেভাবে মাটিতে উঠে এসেছে, যেভাবে তার পা গজিয়েছে, তেমন একটা ছবি। সেইসাথে সেখানে জিসাস না লেখা থেকে লেখা ছিল ডারউইন।

একটা তীক্ষ্ণ বিপবিপ শব্দে কান ঝালাপালা হবার আগেই মেসেজটা পড়তে শুরু করুল কোইলার।

ভাল। আসছে লিওনার্দো ভেট্রার মেয়ে। এখনি সে হেলিপ্যাডে ল্যান্ড করবে। সেখানেই তার সাথে দেখা করব আমরা। এটাই ভাল হয়। এখানে উঠে এসে তার বাবাকে এ অবস্থায় দেখার চেয়ে অনেক ভাল হয়।

রাজি হল ল্যাঙডন। এ এমন এক আঘাত যা কোন মেয়ের পক্ষে সহ্য কর অসম্ভব।

আমি মিস ভেট্রাকে চাপ দিব সে আর তার বাবা মিলে কী প্রজেক্ট করছিল সেটা খুলে বলার জন্য। হয়ত খুনের ব্যাপারটার উপর একটু আলোকপাত হবে।

আপনি কি মনে করেন কাজের জন্য ট্রো খুন হয়েছেন?

অবশ্যই। লিওনার্দো বলেছিল যে সে কাজ করছে দুনিয়া কাঁপানো একটা ব্যাপারে। এরচে বেশি কিছু তার মুখ দিয়ে বেরোয়নি। প্রজেক্টের ব্যাপারে কাক পক্ষীকেও জানতে দিতে নারাজ সে। সে একটা প্রাইভেট ল্যাব আর সিকিউরিটি ব্যবস্থা। চেয়েছিল। আমি খুশি মনেই তা দিয়েছি তার মেধার কথা মনে করে। শেষের দিকে তার কাজে অনেক অনেক ইলেক্ট্রিক পাওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আমি ভুলেও জিজ্ঞাসা করিনি কী করছে সে এত পাওয়ার দিয়ে। স্টাডি ডোরের দিকে এগিয়ে গেল। কোহলার, এখানে আরো একটা ব্যাপার আছে যা আপনার জানা প্রয়োজন।

আর কী শুনতে হবে ভেবে পায় না ল্যাঙডন।

ভো মারা যাবার পর একটা জিনিস চুরি গেছে।

একটা জিনিস?

ফলো মি।

কুয়াশায় মোড়া লিভিঙরুমে ঢুকল কোহলার হুইলচেয়ার নিয়ে। পিছন পিছন এ আড়ষ্ট হয়ে ওঠা ল্যাঙডন। আর কী দেখতে হবে একদিনে! স্ট্রোর শরীরের কাছাকাছি এসে সে থামল। সামনে আসবে ল্যাঙডন, এমন প্রত্যাশা দেখা গেল তার চোখেমুখে। প্রত্যাশা পূরণ কবল সে। খুন হয়ে যাওয়া বিজ্ঞানীর কাছে বুকে এলে জমে যাওয়া ইউরিনের গন্ধ পেল ল্যাঙডন।

তার চেহারার দিকে চোখ তুলে তাকান। বলল কোহলার।

তার চেহারার দিকে তাকান? বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল ল্যাওডন। আমার মনে হয় আপনি বলছিলেন যে কিছু একটা চুরি গেছে!

একটু ইতস্তত করে হাটু গেড়ে বসল ল্যাংডন। চেষ্টা করল লিওনার্দো স্ট্রোর চেহারা দেখার কিন্তু সেটা একেবারে একশো আশি ডিগ্রি ঘোরানো ও কার্পেটের দিকে ফিরানো।

শারীরিকভাবে অক্ষম কোহলার কষ্ট করে এগিয়ে এল সামনে। তারপর ঘোরাল ভেট্রার মাথা। শব্দ করে লাশটার মাথা ঘুরে এল সামনে। এক মুহূর্ত ধরে রাখল সে মাথাটাকে। তারপর ছেড়ে দিল।

সুইট জিসাস! চিৎকার করে উঠল ল্যাঙডন। আতঙ্কে। ট্রোর সারা মুখ ভরে গেছে রক্তে। একটা চোখ তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। অন্য চোখটার কোটর শূণ্য।

তারা লোকটার চোখ চুরি করে নিয়ে গেছে?

১৪.

লাঙডন বিল্ডিং সি থেকে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে এল খোলা বাতাসে। মনের ভিতরে বসত করা খালি চোখের মর্মান্তিক দৃশ্য চলে যাচ্ছে খোলা সূর্যের রশ্মিতে।

এ পথে, প্লিজ। বলল কোহলার, এগিয়ে যেতে যেতে, মিস ট্রেী যে কোন সময় চলে আসতে পারে।

গতি ধরে রাখার জন্য তারাহুড়া করতে হল ল্যাঙডনকে।

তাহলে? বলল কোহলার, এখনো আপনার মনে কোন সন্দেহ আছে যে এটার সাথে ইলুমিনেটি যুক্ত?

চুপ করে থেকে আবার ইলুমিনেটির কথা ভাবল সে। আমার মনে হয়, এখনো মনে হয়, ইলুমিনেটি এর সাথে যুক্ত নয়। খোয়া যাওয়া চোখই তার প্রমাণ।

কী?

অপ্রয়োজনীয় ক্ষতি, বলল সে কোনক্রমে, ইলুমিনেটির স্বভাব নয়। সত্যিকার শয়তানি সংঘগুলো এসব করতে পারে, কিন্তু ইলুমিনেটির মত একটা দল এমন পৈশাচিকতা করতে পারবে না।

পৈশাচিকতা? একটা লোকের চোখ তুলে নেয়ার চেয়ে বড় পৈশাচিকতার জন্য অপেক্ষা করতে হবে?

এ দিয়ে একটা ব্যাপারই বলা চলে। কোন বিকৃত মনের মানুষ এ কাজ করেছে। ইলুমিনেটির মত সংস্থা নয়।

কোহলারের হুইলচেয়ার পাহাড়ের উপরে উঠে থামল। মিস্টার ল্যাঙডন, বিশ্বাস করুন, সেই হারানো চোখটা আরো বড় একটা লক্ষ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। অনেক বড়।

দুজন এগিয়ে গেছে হেলিপ্যাডের দিকে। এগিয়ে আসছে একটা চপার দূর থেকে। উপত্যকাটাকে চিরে দিয়ে।

নামার সাথে সাথে বেরিয়ে এল পাইলট। শুরু করল আনলোডিং গিয়ার। অনেক কিছু বেরিয়ে আসছে ভিতর থেকে। স্কুবা ডাইভিঙয়ের সাজ সরঞ্জাম এবং সমুদ্র সম্পর্কিত আরো অনেক যন্ত্রপাতি। দেখে মনে হয় হাইটেক ডাইভিং ইকুইপমেন্ট।

বিভ্রান্ত দেখাল এবারো ল্যাঙডনকে। এগুলো কি মিস ভেট্রার জিনিসপত্র।

সে ব্যালিয়ারিক সিতে বায়োলজিক্যাল রিসার্চ চালাচ্ছিল।

আপনি বলেছিলেন যে সে একজন ফিজিসিস্ট!

সে তাই। সে একজন বায়ো এন্টাঙ্গলমেন্ট ফিজিসিস্ট। লাইফ সিস্টেমের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে রিসার্চ করছিল। এ কাজের সাথে তার বাবার পার্টিকেল ফিজিক্সের কাজ ওতপ্রেতভাবে জড়িত। টুনা ফিসের একটা ঝাকের উপর কাজ করে সে সম্প্রতি আইনস্টাইনের একটা ফান্ডামেন্টাল থিওরিকে ভুল প্রমাণিত করেছে।

ঠাট্টা করছে কিনা লোকটা তা বোঝার চেষ্টা করছে ল্যাঙডন। আইনস্টাইনের সাথে টুনা মাছ? ভেবে পায় না সে, এক্স থার্টি থ্রি প্লেন তাকে ভুল করে অন্য কোন দুনিয়ায় নামিয়ে দিয়ে যায়নিতো?

ফিউজিলাজ থেকে এক মুহূর্ত পরে বেরিয়ে এল ভিট্টোরিয়া! ল্যাওডন বুঝতে শুরু করল আজকের দিনটা হাজার সারপ্রাইজ নিয়ে আসবে। সাদা স্লিভলেস টপ আর ছোট খাকি শর্টস পরে নেমে আসছে মেয়েটা। যেমন বইপোকা চশমা পরা ফিজিসিস্টের কথা তার মনে পড়ে তার সাথে এ মেয়ের কোন মিল নেই। চেস্টনার্টের মত গায়ের রঙ তার, চুলের রঙ একেবারে কালো। সেগুলো উড়ছে পিছনে পিছনে। রোটোরের বাতাসে। কোন ভুল নেই, তার চেহারা একেবারে ইতালিয়। কোন বাড়তি চটক নেই, কিন্তু শতভাগ সৌন্দর্য উপচে পড়ছে। কেমন একটা খাঁটি, কাচা সৌন্দর্য, তার সাথে বন্যতা মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে। বাতাসের প্রভাবে তার শরীরের সমস্ত পোশাক নড়ছিল, দেখা যাচ্ছিল চিকণ কোমর, ছোট স্তন।

মিস ভেট্রার শক্তির কোন শেষ নেই। ভয়ানক বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে মাসের পর মাস ধারে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারে সে। পারে যে কোন কাজে পড়ে থাকতে। একই সাথে সে সার্নের আবাসিক গুরু। হাত যোগব্যায়ামের গুরু। নিরামিষাশী।

হাত যোগ? ভেবে পায় না ল্যাঙডন। একজন ক্যাথলিক যাজকের মেয়ে, পদার্থবিদ, কাজ করছে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র নিয়ে, সার্নে থাকার সময় সে হয়ে যায় প্রাচীণ বৌদ্ধদের ব্যায়ামের শিক্ষক!

রোদপোড়া চামড়া মেয়েটার। চোখগুলো ফোলা ফোলা। এখনো কাঁদছে সে।

ভিট্টোরিয়া, মেয়েটা এগিয়ে এলে বলল কোহলার, আমার গভীরতম বেদনা… এখানে, সার্নের ক্ষতি হয়েছে, ক্ষতি হয়েছে পুরো পৃথিবীর বিজ্ঞানের… আমি…

নড করল মেয়েটা। তারপর যখন কথা বলল, ব্যক্তিত্ব আর শক্তিমত্তা ফুটে উঠল তার কণ্ঠে, কে দায়ী তা কি জানা গেছে?

এখনো এ নিয়ে কাজ করছি।

ফিরল সে ল্যাঙডনের দিকে, আমার নাম ভিট্টোরিয়া ভেট্রা, হাত বাড়িয়ে দিল, মনে হয় আপনি ইন্টারপোল থেকে এসেছেন?

হাতটা তুলে নিল সে হাতে। বলল, রবার্ট ল্যাঙডন। আর কী বলবে ভেবে পেল না।

মিস্টার ল্যাঙডন অথরিটির সাথে যুক্ত নন, বলল কোহলার, ব্যাখ্যা করল, তিনি আমেরিকা থেকে আসছেন। একজন স্পেশালিস্ট। কে দায়ী সে ব্যাপারে সাহায্য করবেন তিনি আমাদের।

আর পুলিশ?

চুপ করে থাকল কোহলার।

বডি কোথায়? দাবি করল মেয়েটা।

কাজ চলছে। বলল কোহলার।

সাদা নির্জলা মিথ্যা শুনে ভড়কে গেল ল্যাঙডন।

আমি তাকে দেখতে চাই, সোজা দাবি করল মেয়েটা আবারো।

ভিট্টোরিয়া, বলল অবশেষে কোহলার, তোমার বাবা নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। যেমন স্মৃতি তোমার মনে আছে তেমনটা মনে রাখাই ভাল।

কথা শুরু করল ডিট্টোরিয়া কিন্তু তা থেমে গেল একটা শব্দে।

হেই! ভিট্টোরিয়া! দূর থেকে একজন বলে উঠল, ওয়েলকাম হোম!

হেলিপ্যাডের কাছ দিয়ে যেতে থাকা একদল বিজ্ঞানী উৎফুল্লভাবে হাত নাড়ল।

আইনস্টাইনের আর কোন তত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়ে এলে নাকি? বলল একজন।

আরেক জন কথা বলে উঠল সাথে সাথে, তোমার ড্যাড অনেক খুশি হবেন। গর্বিত হবেন তিনি।

কোনমতে একটু হাসির মত দিতে পারল ভিট্টোরিয়া লোকটার দিকে তাকিয়ে। অনেক কষ্টে। তারপর ফিরল ডিরেক্টরের দিকে। এখনো কেউ জানে না?

আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা এখনি না জানানো ভাল।

আপনি স্টাফদের জানাননি যে আমার বাবা খুন হয়ে গেছেন?

হয়ত ভুলে যাচ্ছ মিস ভেট্রা, আমি যখনি তোমার বাবার খুনের ব্যাপারে একটা ঘোষণা দিব সাথে সাথে সার্নে একটা তদন্ত হবে। তার ল্যাবের ব্যাপারটাও বাদ পড়বে না। তোমার বাবার প্রাইভেসির ব্যাপারটায় আমি সব সময় প্রাধান্য দিয়েছি। তোমাদের বর্তমান প্রজেক্ট নিয়ে তিনি আমাকে মাত্র দুটা ব্যাপার জানিয়েছেন। এক, এর এত গুরুত্ব আছে যে সার্ন অসম্ভব পরিমাণের আর্থিক লাভের সম্মুখীন হবে। পরের দশকে এর টাকা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবতে হবে না। আর দুই, তিনি সেটাকে সবার সামনে প্রকাশ করতে চান না কারণ প্রযুক্তিটা এখনো অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এ দুটা ব্যাপার নিয়ে আমি ভাবছি। ভাবছি, যদি লোকজন তার ল্যাবের ভিতরে ঘোরে আর কিছু সরিয়ে ফেলে অথবা অসাবধানে চুন থেকে পান খসে যায় তাহলে সার্ন দায়ী থাকবে। মারাও পড়তে পারে তারা। আমি কি ভুল কিছু বলছি? পরিষ্কার করতে পারছি নিজেকে তোমার সামনে?

কিছু বলল না ভিট্টোরিয়া। ল্যাঙডনও মনে মনে তারিফ করল কোহলারের যুক্তির।

কোন অথরিটির কাছে ধণা দেয়ার আগে আমি জানতে চাই তোমরা দুজন কী নিয়ে কাজ করছিলে। যেতে চাই তোমাদের ল্যাবে।

ল্যাবের সাথে এর সম্পর্ক থাকার কথা নয়। আমি আর বাবা মিলে কী করছিলাম সেটার খবর আর কেউ জানে না।

প্রমাণে অন্য কথা মনে হয়।

প্রমাণ? কী প্রমাণ?

একই কথা গুমরে মরছে ল্যাঙউনের ভিতরেও।

তোমার আমাকে শুধু বিশ্বাস করতে হবে। কথা বলার প্রয়োজন নেই।

ভিট্টোরিয়ার চোখের দৃষ্টি দেখে ঠিক ঠিক বোঝা যায় এখন সে কাউকে বিশ্বাস করে না।

১৫.

ল্যাঙডন চুপচাপ তাদের দুজনের পিছনে পিছনে যাচ্ছে। মেয়েটা আশ্চর্য শান্ত। যোগব্যায়ামের ফল কিনা কে জানে! কিন্তু একটু পর পর ফোঁপানোর শব্দ যে আসছে না তা নয়।

কিছু একটা বলতে চায় ল্যাঙডন মেয়েটাকে একটু সহানুভূতি। বাবা বা মাকে হারানো কতটা বেদনার সেটা সে ঠিক ঠিক জানে।

তার বারোতম জন্মদিনের দুদিন পরে। মনে পড়ে শেষকৃত্যানুষ্ঠানটার কথা। বৃষ্টি পড়ছে। চারদিক ধূসর। এসেছিল অনেকেই। আন্তরিক ভঙ্গিতে তার হাত ঝাঁকিয়ে দিচ্ছিল। কার্ডিয়াক, স্ট্রেস ধরনের কয়েকটা কথা বারবার তারা বলছিল। তার মা তাকিয়ে ছিল অশ্রুতে ভরা চোখ নিয়ে।

একবার, যখন তার বাবা জীবিত ছিল, মাকে বলতে শুনেছিল, থাম, আর গোলাপের সুগন্ধ নাও।

এক ক্রিসমাসে সে বাবার জন্য একটা গোলাপ কিনে আনে। বাবা চুমু দেয় তার কপালে, তারপর সেটাকে রেখে দেয় ঘরের অন্ধকারতম কোণায়, ধূলিভরা একটা শেলফে। দুদিন পরে সে কৃত্রিম গোলাপটাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসে স্টোরে। টের পায়নি বাবা কখনো।

একটা লিফটের সামনে এসে বাস্তবে ফিরে এল ল্যাঙডন। ভিতরে চলে গেছে কোহলার আর ভিট্টোরিয়া। বাইরে ইতস্তত করছে সে।

কোন সমস্যা? প্রশ্ন করল কোহলার। সে সমস্যার কথা জানতে রাজি নয়। এমনি ভাব।

নট এট অল। বলল সে অবশেষে, ছোট খুপরিটার দিকে নিজেকে ঠেলে দিতে দিতে। কখনো সে পারতপক্ষে যায় না লিফটের দিকে। তারচে বরং খোলা প্রশস্ত সিঁড়িই ভাল।

ডক্টর ভেট্রার ল্যাব মাটির নিচে। বলল কোহলার।

ভিতরে আসতে আসতে মনে মনে ভাবল ল্যাঙডন, চমৎকার। ঢোকার সাথে সাথে কারটা নামতে শুরু করল নিচে।

ছতলা।

দেখল এলিভেটরের মার্কারে দিকে। সেখানে মাত্র দুটা তলার কথা লেখা আছে। গ্রাউন্ড লেভেল আর এল এইচ সি।

এল এইচ সি কী?

লার্জ হ্যাড্রন লিডার বলল কোহলার, একটা পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটর।

পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটর? এ শব্দটার সাথে খুব একটা পরিচিত নয় ল্যাঙডন। এ রাতে তার এক ফিজিসিস্ট বন্ধু তাদের পার্টিতে এসেছিল।

বেজন্মার দল ব্যাপারটা ক্যানসেল করে দিল। গাল ঝাড়ছিল ব্রাউনওয়েল।

ক্যানসেল করল কী? জিজ্ঞেস করল তারা।

এস এস সি।

কী?

সুপারকন্ডাক্টিং সুপার কলিডার।

একজন শ্রাগ করল। আমি জানতামই না যে হার্ভার্ড এমন কিছু বানাচ্ছে।

হার্ভার্ড নয়! বলল সে তেতে উঠে, আমেরিকা। এটা পৃথিবীর সবচে বড় পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটর হতে পারত! দেশের সবচে বড় সায়েন্টিফিক প্রজেক্ট। দু বিলিয়ন ডলার নিয়ে বসে ছিল তারা এমন সময় সিনেট বাতিল করে দিল। মরার বাইবেল-বেল্ট লবিয়িস্টদের কাজ?

শান্ত হয়ে আসার পর ব্রাউনওয়েল আস্তে আস্তে বলল, যে পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটর হল এমন এক যন্ত্র যেটা গোলাকার, একেবারে সুবিশাল। এর ভিতর দিয়ে পরমাণুর একেবারে ক্ষুদ্রতম কণাগুলো ছুটে চলে অকল্পনীয় গতিতে। কয়েলের চারদিকের চুম্বকগুলো এই গতি বাড়ায়। বাড়তে বাড়তে সেকেন্ডে এক লক্ষ আশি হাজার মাইলে চলে যায়।

এ গতিতে আলোর গতির কাছাকাছি! বলল এক প্রফেসর।

ড্যাম রাইট! ব্রাউনওয়েল বলল সাথে সাথে। ব্যাখ্যা করল, কী করে দুটা পার্টিকেলকে দুদিকে ঘোরানো হয়। ঘোরানো চলতে চলতে গতি বাড়ে। চরম গতিতে তাদের সংঘর্ষ করানো হয়। তখন যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাতে জানা যাবে সৃষ্টির পূঢ় রহস্য।

পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটরগুলো, বলেছিল ব্রাউনওয়েল, বিজ্ঞানের আগামী নির্দেশ করে। এ থেকেই ইউনিভার্সের বিল্ডিং ব্লকের খোঁজ পাওয়া যাবে।

হার্ভার্ডের পয়েট ইন রেসিডেন্স, শান্ত লোক, নাম তার চার্লস ভ্যাট, খুব বেশি উফুল্ল মনে হল না তাকে, এটা আমার কাছে বিদঘুটে লাগে, বলেছিল সে, বিজ্ঞানের পথে এগিয়ে আসার চেয়ে প্রাচীণযুগে ফিরে যাবার মত… ঘড়িগুলোকে একটার সাথে আরেকটাকে ঠুকে দিয়ে ভেঙে তারপর সেটার ভিতরের কলকজা দেখে বোঝার চেষ্টা করা সময় কী করে চলে।

ব্রাউনওয়েল সাথে সাথে তার কাঁটাচামচ ফেলে দেয়, ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

তার মানে সার্নের একটা পার্টিকেল এক্সিলারেটর আছে? ভাবল ল্যাঙডন, বস্তুকণা গুড়িয়ে দেয়ার মত গোলাকার একটা যন্ত্র! ভেবে পায় না সে কী কারণে তারা সেটাকে একেবারে মাটির নিচে কবর দিল।

যখন লিফটটা নামছে, পায়ের নিচে একটা কম্পন টের পেল সে। তারপর আবার তলায় গিয়ে হতাশ হয় সে। আবারো দাড়িয়ে আছে একটা একেবারে অচেনা এলাকায়। অচেনা দুনিয়ায়।

ডানে-বামে অসীম হয়ে মিশে গেছে করিডোরটা। এটা একেবারে নিখুঁত সিমেন্টের পথ। এখানে একটা আঠারো চাকার যান বিনা দ্বিধায় চলতে পারবে, এতটাই প্রশস্ত। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তারা, সে জায়গাটা ভালভাবেই আলোকিত। তারপর দুদিকে শেষ বিন্দুতে একেবারে পিচকালো অন্ধকার। একটা বদ্ধ বাতাস মনে করিয়ে দেয় তাদের যে তারা এখন মাটির নিচে। মাথার উপরে নিই মাটির অনেক পরত আছে। আছে নুড়ি আর পাথর। হঠাৎ করেই সে আবার ফিরে গেল ন বছর বয়সে। চারধারে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার… অন্ধকারে থাকার সেই পাঁচটা ঘণ্টার কথা এখনো তার ভিতরে গুমরে মরে।

এগিয়ে গেল ভিট্টোরিয়া তাদের ছেড়ে। সামনের দিকে। যত এগিয়ে গেল সে, তত আলোকিত হয়ে উঠল টানেল। তারপর নিভে গেল মাঝখানের বাতিগুলো। ল্যাঙডনের মনে হল সুড়ঙ্গটা জীবিত।

পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটর, আমতা আমতা করে বলল ল্যাঙডন, এটা কি নিচে, এই সুড়ঙ্গ ধরে কোথাও?

এটাই পার্টিকেল এ্যাক্সিলারেটর। দেখাল কোহলার পিছনদিকে। ভিতরদিকের দেয়ালে।

ল্যাঙডনের চোখ কুঁচকে উঠল। দেয়ালের দিকে দেখাচ্ছে কেন লোকটা! এটাই এ্যাক্সিলারেটর? অবাক হয়ে দুদিকে তাকাল সে, আমি মনে করেছিলাম জিনিসটা গোলাকার।

এই এ্যাক্সিলারেটরও গোলাকার। বলল কোহলার, দেখতে সোজা। কিন্তু একেই বলে চোখের ধাঁধা। মোটেও সোজা নয়। এর গোলাকৃতিটা এত কম মাত্রায় বেড়েছে যে তা দেখে গোল হবার কথাটা মনে পড়ে না। অনেকটা পৃথিবীর মত।

এটা এক বৃত্ত! কী বলে! কত বড় হবার কথা, এই সোজা লাইন যদি একটা বৃত্ত হয়…

এল এইচ সি পৃথিবীর সবচে বড় মেশিন।

সার্ন ড্রাইভার বলেছিল যে মাটির নিচে পৃথিবীর সবচে বড় মেশিনটা লুকানো আছে, কিন্তু–

ব্যাসে এটা আট মাইল। আর পরিধিতে সাতাশ কিলোমিটার।

কী! সাতাশ কিলোমিটার? এই টানেলটা সাতাশ কিলোমিটার লম্বা? এতো… এতো ষোল মাইলের চেয়েও বেশি!

নড করল কোহলার। একে একেবার নিখুঁত বৃত্তাকারে খোড়া হয়েছিল। এখানে ফিরে আসার আগে ফ্রান্সের সীমান্তে ঢু মারে এটা। একত্র হয়ে যাবার আগে, পরিপূর্ণ গতিপ্রাপ্ত পার্টিকেল সেকেন্ডে দশ হাজার বারেরও বেশিবার ঘুরবে এটাকে কেন্দ্র করে।

আপনি বলছেন যে সার্ন কোটি টন মাটি খুড়েছে শুধু ছোট্ট পার্টিকেল গুঁড়া করার জন্য?

কখনো কখনো সত্যি বের করার জন্য মানুষকে পাহাড় ডিঙাতে হয়।

১৬.

শত শত মাইল দূরে, একজন বলল, ওয়াকিটকিতে, ওকে, আমি হলওয়েতে।

টেকনিশিয়ান বলল অন্য প্রান্ত থেকে, আপনি ক্যামেরা নম্বর ছিয়াশির খোঁজে গিয়েছেন। এটার শেষ প্রান্তে থাকার কথা।

রেডিওতে অনেকক্ষণ নিরবতা উঠল। ঘাম মুছল টেকনিশিয়ান। কেন যেন দরদর করে ঘামছে সে। তারপর সচল হল তার রেডিও।

ক্যামেরা এখানে নেই। বলল কটা, যেখানে আটকানো ছিল সে জায়গাটা দেখা যায়। কেউ না কেউ জিনিসটাকে সরিয়ে নিয়েছে।

বড় করে শ্বাস নিল টেকনিশিয়ান, ভাল, এক সেকেন্ড থাকুন।

সামনের স্ক্রিনের দঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আবার ঘামতে শুরু করল লোকটা। এর আগেও ক্যামেরা খোয়া গেছে। বিচিত্র কিছু নয়। পাওয়া গেছে অহরহ। কিন্তু এবার কিছু একটা অমঙ্গলের ব্যাপার টের পাওয়া যায় এখানে। যখনি ক্যামেরাটা কমপ্লেক্স ছেড়ে বেরুবে, চলে যাবে রেঞ্জের বাইরে, সাথে সাথে সেই স্ক্রিনটা কালো হয়ে যাবে। মনিটরের দিকে আরো একবার তাকায় টেকনিশিয়ান। ক্যামেরা নং ছিয়াশি থেকে এখনো ছবি আসছে স্পষ্ট।

বোঝাই যাচ্ছে, ক্যামেরাটা কমপ্লেক্সের ভিতরেই আছে। এবং কেউ একজন সেটাকে চুরি করে হাপিস হয়ে গেছে। কে? এবং কেন?

সিঁড়ির কাছে কি কোন অন্ধকার কোণ আছে? কোন খুপরি বা এমন কোন জায়গা যেখানটায় একটা ক্যামেরা লুকানো সম্ভব?

না। কেন?

নেভার মাইন্ড। সহায়তার জন্য ধন্যবাদ।

বন্ধ করে দিল সে ওয়াকিটকি। তারপর চেপে ধরল ঠোঁট।

এই সুরক্ষিত এলাকার ভিতরেই কোথাও ঘাপটি মেরে আছে ক্যামেরাটা। এখানেই কোথাও। নিশ্চিত। আধমাইল ব্যাসের বিশাল এলাকার বত্রিশটা ভুবনের কোথাও। একটা মাত্র ক্লু আছে, ক্যামেরাটা এমন কোথাও বসানো আলো যায় না যেখানে। এই কমপ্লেক্সে অন্ধকার এলাকার কোন অভাব নেই। মেইনটেন্যান্স ক্লজেট, হিটিং ডাক্ট, গার্ডেনিং শেড, বেডরুম ওয়ার্ডরোব, আর আছে মাটির নিচের সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধা। কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে ক্যামেরা নাম্বার ছিয়াশি বের করতে।

কিন্তু এটা আমার মাথাব্যাথা নয়। ভাবল সে।

এখনো হারানো ঝামেরাটা ট্রান্সমিট করছে। তাকাল সে সেদিকে। একটা আধুনিক গডনের কিছু দেখা যাচ্ছে সেখানে যেটার সাথে মোটেও পরিচিত নয় টেকনিশিয়ান। এবং এ ব্যাপারটাই ঘামাচ্ছে তাকে। এর গোড়ায় বসানো ইলেক্ট্রনিক ডিসপ্লে দেখল সে।

যদিও গার্ডরা তাকে চরম মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রাখার নানা কৌশল শিখিয়েছে, তবু, দরদর করে ঘামছে সে। নিজেকে শান্ত থাকতে বলল সে। কোন না কোন ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে। জিনিসটা এত বড় নয় যে তা নিয়ে ঘাবড়াতে হবে। তবু, কমপ্লেক্সের ভিতর এটার অস্তিত্ব ঠিক ঠিক সমস্যায় ফেলে দেয় তাকে। খুব সমস্যায়, অবশ্যই।

সব বাদ দিয়ে আজকের দিনে… ভাবে সে।

তার চাকরিদাতার কাছে সিকিউরিটিই সবচে বড় ব্যাপার। কিন্তু আজকের দিনে…। গত বারো বছরের যে কোন দিন থেকে আজকের দিনটা গুরুত্বপূর্ণ। আজ এখানকার নিরাপত্তাই সবচে বড় ব্যাপার। আবার তাকাল সে জিনিসটার দিকে। দেখতে নিরীহ। কিন্তু, কোথায় বসানো আছে তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করতে পারে।

সিদ্ধান্ত নিল সে, ডাকবে উপরের কাউকে।

১৭.

খুব বেশি বাচ্চা মনে করতে পারবে না সে কখন প্রথম তার বাবার সাথে দেখা করেছিল কিন্তু ভিট্টোরিয়া ভেট্রা ঠিকঠিক মনে করতে পারে।

বয়স ছিল আট বছর। ছিল সে সেখানেই, যেখানে সব সময় ছিল। অরফ্যানোট্রোফিও ডি সিয়েনা। ফ্লোরেন্সের কাছে একটা ক্যাথলিক এতিমখানায়। মা বাবা তাকে ছেড়ে গিয়েছিল কিনা সে জানে না। মা-বাবা আছে কিনা জানত না তাও।

সেদিন বৃষ্টি ছিল সেখানে। নার্স দুবার তাকে ডেকেছে খাবার খেয়ে যেতে। কিন্তু বরাবরের মত শুনেও না শোনার ভাণ করেছে সে। বসে আছে বাইরে… বৃষ্টির ফেঁটাগুলোকে পড়তে দিচ্ছে গায়ে… চেষ্টা করছে পরের ফোঁটাটা কোথায় পড়বে তা বোঝার।

আবার ডাকল নার্স। বারবার বলছিল, প্রকৃতি নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় যে বাচ্চারা, বৃষ্টিতে ভেজে, তাদের কপালে নিউমোনিয়ার দুঃখ আছে।

তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি না… ভাবল ভিট্টোরিয়া।

যখন তরুন প্রিস্ট তার জন্য এসেছিল, ভিজে একসা হয়ে গিয়েছিল সে। চেনে না লোকটাকে। নতুন এসেছে এখানে। ভিট্টোরিয়া অপেক্ষা করল। কখন লোকটা ধৈর্য হারিয়ে তাকে খপ করে ধরবে, তারপর হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে ভিতরে, কিন্তু এমন কিছুই করল না লোকটা। অবাক করে দিয়ে সেও শুয়ে পড়ল মেয়েটার পাশে। তার বোব ছড়িয়ে আছে ঘাসের উপর।

তারা বলল তুমি নাকি প্রশ্ন করতে করতে তাদের নাস্তানাবুদ করে দাও? বলল লোকটা, খাতির জমানোর মত করে।

সাথে সাথে ফুঁসে উঠল ভিট্টোরিয়া, প্রশ্ন করা কি দোষের?

হাসল লোকটা সাথে সাথে। প্রাণখোলা হাসি। মন উজাড় করা হাসি। মনে হয়। তাদের কথাই ঠিক।

কী করছ তুমি এখানে, বৃষ্টির মধ্যে?

যা তুমি করছ… ভাবছি, ভেবে মরছি বৃষ্টি কেন পড়ে!

আমি এ কথা চিন্তা করছি না। আমি জানি ঠিক ঠিক কীজন্যে বৃষ্টি পড়ে।

সাথে সাথে অবাক চোখে তার দিকে তাকাল প্রিস্ট, তুমি জান?

সিস্টার এ্যাঞ্জেলিনা বলে বৃষ্টির ফোঁটা হল ফেরেশতাদের কান্না। আমাদের পা বুয়ে মুছে দেয়ার জন্য নামে।

ওয়াও! এই তাহলে ব্যাখ্যা?

না, এতে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না! বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে কারণ সবই পড়ে। সব পড়ে ধু বৃষ্টির ফোঁটা নয়!

জান, ইয়ং লেডি, তোমার কথাই ঠিক। সব পড়ে। এরই নাম গ্রাভিটি।

এরই নাম কী?

তুমি মাধ্যাকর্ষণের কথা শোননি?

না।

খুব খারাপ কথা। গ্রাভিটি অনেক প্রশ্নের জবাব দেয়।

সাথে সাথে আগ্রহে অত্যুজ্বল হয়ে উঠল ভিট্টোরিয়ার চোখমুখ, গ্রাভিটি কী? বোঝাও আমাকে!

যাই জিজ্ঞেস কর না কেন, সব প্রশ্নের জবাব দিব ডিনারের পর।

তরুণ প্রিস্টের নাম লিওনার্দো স্ট্রো। নানদের নিঃসঙ্গ ভুবনে মেয়েটা আকড়ে ধরে তাকে। লিওনার্দোকে হাসায় ভিট্টোরিয়ার উজ্জ্বলতা, ভিট্টোরিয়াকে সে জানায় নানা রহস্য। রঙধনুর রহস্য, নদী আর ঝর্ণার রহস্য।

আলো, গ্রহ, তারকারাজি, আকাশ, সবকিছুর ব্যাখ্যা দেয় সে ঐশ্বরিক আবহে, বৈজ্ঞানিক ভাবধারায়।

আনন্দিত ভিট্টোরিয়াও। বাবা থাকার কী যে মজা তা সে আগে জানত না। তারপর তার সবচে বড় দুঃস্বপ্ন চলে এল। যাবার সময় হয়েছে লিওনার্দোর।

সুইজারল্যান্ডে যাচ্ছি। জেনেভা ইউনিভার্সিটি থেকে একটা স্টাইপেন্ড পেয়েছি। ফিজিক্স পড়ব।

ফিজিক্স? আমি মনে করেছিলাম তুমি ঈশ্বরকে ভালবাস!

অবশ্যই! তাইত তার স্বর্গীয় আইনগুলো জানতে চাই।

থামল সে। মুষড়ে পড়েছে ভিট্টোরিয়া!

আমি তোমাকে পালিত কন্যা হিসাবে নিলে তুমি খুশি হবেতো?

পালিত মানে কী?

বলল ফাদার লিওনার্দো।

কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরল তাকে ছোট্ট মেয়েটা, ওহ্! ইয়েস! ইয়েস!

জেনেভায় চলে গেল তারা। ছমাস আগে গেছে লিওনার্দো এবার গেল ভিট্টোরিয়াও। সেখানে জেনেভা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে যোগ দিল। রাতে শিখতে লাগল বাবার কাছ থেকে।

তিন বছর পরেই লিওনার্দো ভেট্রাকে সার্ন নিয়ে নেয়।

ব্যালেরিক আইল্যান্ডে কাজ করছিল ভিট্টোরিয়া! এমন সময় ম্যাসেজ এল।

তোমার বাবা খুন হয়েছেন। তাড়াতাড়ি ফিরে এস।

ডাইভ বোটের ডেকে বসে বসে তরঙ্গের দোলায় একেবারে কাঠ হয়ে বসে থাকল ভিট্টোরিয়া।

বাড়ি ফিরে এল সে। কিন্তু এখানে আর বাড়ি বাড়ি ভাব নেই। যে লোকটার জন্য ফিরে আসা সেই নেই।

কে তার বাবাকে খুন করেছে? কেন? আর কে এই আমেরিকান স্পেশালিস্ট? ল্যাব দেখার জন্য পীড়াপীড়ি করছে কেন কোহলার সব বাদ দিয়ে?

কোন্ প্রমাণ আছে? কেউ জানত না কী কাজ করছি আমরা। আর কেউ যদি জেনেও ফেলে, তাকে খুন করার মত কী হল?

এগিয়ে যাচ্ছে ভিট্টোরিয়া। তার বাবার সবচে বড় কীর্তি উন্মোচিত করতে। যে কাজটা বাবাকে নিয়ে করার কথা ছিল তার। সাথে থাকত ডাকসাইটে সব বিজ্ঞানী। বিস্ময়ে ঝুলে পড়ত তাদের চোয়াল।

এখন, মানুষের সামনে তাদের কীর্তি ঠিক ঠিক প্রকাশিত হচ্ছে যখন তার বাবা নেই।

সাথে আছে ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার। ডের কোনিং। আর আছে একজন অপরিচিত আমেরিকান।

কোহলারকে একেবারে বাল্যকাল থেকেই দুচোখে দেখতে পারে না সে। আস্তে আস্তে বুঝতে শিখে যায় যে লোকটা কাজের। কিন্তু তার শিতল চোখের সামনে লিওনার্দো ভেট্রার উষ্ণতা, তার নিছক গাণিতিক বিজ্ঞানের সামনে বাবার আত্মিকতার

কোন তুলনা নেই।

এগিয়ে গেল তারা একটা টাইল বাধানো পথের দিকে। সেখানে সারা দেয়াল জুড়ে বিচিত্র সব ছবি আটকানো। কোনটারই কোন মানে বোঝা যাচ্ছে না। মডার্ন আর্ট? হতে পারে।

স্ক্যাটার প্লট, বলল ভিট্টোরিয়া, পার্টিকেলের সংঘর্ষের ছবি। কম্পিউটারের। এটা জেড পার্টিকেল। পাঁচ বছর আগে বাবা এটাকে আবিষ্কার করেন। পিওর এনার্জি। কোন ভর নেই।

বস্তু এনার্জি?

বিষম খেল ল্যাঙডন।

ভিট্টোরিয়া, বলছে কোহলার, আমার বলা দরকার যে তোমার বাবার খোঁজে এসেছিলাম আজ সকালে।

এসেছিলেন?

আর তারপর আমার বিস্ময়ের কথাটা একবার ভাব। তিনি সার্নের স্ট্যান্ডার্ড কিপ্যাড সিকিউরিটি সিস্টেম বাদ দিয়ে অন্য কাজ করেছেন।

আমি ক্ষমা চাইছি। আপনি ভাল করেই জানেন নিরাপত্তার ব্যাপারে বাবা কত খুতখুতে। তিনি আমাদের দুজন ছাড়া আর কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিতে চাননি।

ভাল। দরজা খোল।

এরপর কী হবে সে ব্যাপারে ল্যাঙডনের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

এগিয়ে গেল ভিট্টোরিয়া।

একটা টেলিস্কোপের দৃষ্টি দেয়ার অংশের মত জায়গায় সে ডান চোখ রাখল। তারপর চেপে দিল একটা বাটন। ফটোকপি মেশিনের মত আলো উপর নিচ, উপর নিচ করে স্ক্যান করে নিল তার রেটিনা।

এটা রেটিনা স্ক্যান। আমার আর বাবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

সাথে সাথে জমে গেল রবার্ট ল্যাঙডন। সব পরিষ্কার হয়ে গেল মুহূর্তে।

তাকাল সে সাদা টাইলের উপর। দেখতে পেল একটা জমাট বিন্দু। রক্ত।

ভাগ্য ভাল, ভিট্টোরিয়া দেখেনি।

খুলে গেল দরজা। ভিতরে যাবার সময় বোঝা গেল, কোহলারের দৃষ্টিতে। সে যেন বলছেঃ।

যা বলেছিলাম… হারানো চোখের আরো বড় উদ্দেশ্য আছে।

১৮.

মেয়েটার হাত বাঁধা। তার মেহগনি রঙা চামড়া দেখে মনে আগুন ধরে যায় হ্যাসাসিনের।

সে কিছুই কেয়ার করে না। পাপ-পুণ্যের কথা ভাবার সময় নেই। তাকায় সে।

তার দেশে, মহিলারা সম্পদ। দুর্বল। ভোগের বস্তু। কিন্তু এখানে, ইউরোপে, মেয়েরা তেজস্বী। ব্যাপারটা তাকে আনন্দ দেয়।

আজ রাতে হ্যাসাসিন খুন করেছে। আর তার বদলে উপভোগ করবে তার পুরস্কার।

অনেকক্ষণ পরে! শুয়ে আছে হ্যাসাসিন তার পুরষ্কারের কাছে। হাত চালাচ্ছে। ঘুমন্ত মেয়েটার গলায়। মেরে ফেললে কী? ও তো একটা উপমানব ভোগের বস্তু। অসাড়।

আরো অনেক কাজ পড়ে আছে। তার নিজের কামনার চেয়ে বড় ব্যাপার নিয়ে কাজ করতে হবে।

বিছানায় উঠে বসে সে। তারপর ভেবে পায় না, সেই জ্যাসান লোকটার প্রভাব কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। বুঝতে পারে না কী করে ইলুমিনেটি তার খোঁজ পেল। যতই ভাবে সে, ততই সশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। তাদের মূল অনেক অনেক গভীরে প্রোথিত!

এখন, তারা তাকে নির্বাচিত করেছে। সেই তাদের কণ্ঠ, তাদের হাত। এ এক অনির্বচনীয় সুসংবাদ। সম্মান। তাদের লোক এ প্রতিনিধিকে বলে মালাক-আল-হক। দ্য এ্যাঞ্জেল অব ট্রুথ।

১৯.

ভেট্রার ল্যাব একেবারেই ভবিষ্যৎমুখী।

কম্পিউটার আর অন্যান্য যন্ত্রপাতিতে ঠাসা। দেখতে অনেকটা অপারেশন রুমের মত। এখানে কী এমন থাকতে পারে যার জন্য একজন মানুষের চোখ তুলে ফেলতে হবে।

একটু থমকে গেল কোহলার। তাকাল চারপাশে। ভিট্টোরিয়ার চলনও অনেক ধীর। যেন বাবাকে ছাড়া এখানে এসে সে বিরাট কোন পাপ করে বসেছে।

ঘরের মধ্যখানে চলে গেল ল্যাঙডনের চোখ। একদল ছোট পিলার উঠেছে মেঝে থেকৈ। একটা ছোট স্টোনহেঞ্জের ডজনখানেক পালিশ করা কলাম উঠে আছে উপরে। ফুট তিনেক লম্বা। প্রতিটায় একটা করে লম্বা ক্যানিস্টার বসানো আছে। টেনিসবল ক্যানের মত। ভিতরটা খালি।

সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টি দিল কোহলার, চুরি যায়নিতো কিছু?

চুরি যাবে কী করে? বলল ভিট্টোরিয়া, এখানে ঢুকতে হলে রেটিনা স্ক্যান করতে হবে।

একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নাও।

সবই ঠিক মনে হচ্ছে। ঠিক যেভাবে বাবা রেখে যেত।

ভাবিত হল কোহলার। যেন ভাবছে কতটা বলবে ভিট্টোরিয়াকে। তারপর যেন ছেড়ে দিল হাল।

চলে এল সে ঘরের ভিতরে।

গোপনীয়তা, বলছে ডিরেক্টর, এমন এক বিলাস যা করা আমাদের আর সাজে না।

নড করল ভিট্টোরিয়া। যেন আবার কেঁদে ফেলবে।

এক মিনিট সময় দাও মেয়েটাকে! ভাবছে ল্যাঙডন।

যেন কী শুনবে সে কথা ভাবতে না পেরে চোখ বুজল ভিট্টোরিয়া ও শ্বাস নিল পরপর।

ঠিক আছে তো মেয়েটা?

তাকাল ল্যাঙডন কোহলারের দিকে। ডিরেক্টর নির্ভাবনার অভয় দিল চোখের ইশারায়।

তারপর, ঝাড়া দশ সেকেন্ড বন্ধ রেখে, খুলল চোখ সে।

যে ভিট্টোরিয়া ট্রোকে সে দেখল, তাতে বিষম খেতে হল ল্যাঙডনের। এক নতুন মানুষ। শরীরের প্রতিটা পেশীকে ভবিতব্য মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত করে নিয়েছে।

কোত্থেকে শুরু করব… বলল মেয়েটা।

প্রথমে তোমার বাবার পরীক্ষা সম্পর্কে বল।

বিজ্ঞানকে ধর্মের আলোয় অত্যুজ্জ্বল করা আমার বাবার সারা জীবনের স্বপ্ন। তিনি সব সময় প্রমাণ করতে চাইতেন যে ধর্ম আর বিজ্ঞান পরস্পরের পরিপূরক। আর সম্প্রতি… তিনি তা প্রমাণ করার একটা উপায় খুঁজে পেয়েছেন।

কিছুই বলল না কোহলার।

তিনি এমন এক এক্সপেরিমেন্ট করেছেন যেটা থেকে বিজ্ঞান আর ধর্মকে একত্রিত করা সম্ভব। ইতিহাসে প্রথমবারের মত।

কোন কোন প্রতিদ্বন্দ্বীতার সুরাহা করে? নিজেকেই প্রশ্ন করে ল্যাওড়ন।

ক্রিয়েশনিজম! কীভাবে সৃষ্টি জগৎ তৈরি হল সে রহস্যের দুয়ারে করাঘাত করেন।

ও! সেই বিতর্ক!

বাইবেল বলে, ঈশ্বর এই ইউনিভার্সকে তুলে এনেছেন মহা শূণ্যতা থেকে। বলেছেন, লেট দেয়ার বি লাইট। দুঃখজনক হলেও সত্যি, পদার্থবিদ্যা বলে, বস্তু কখনোই একেবারে শূণ্য থেকে উঠে আসতে পারে না।

একেবারে শূণ্যতা থেকে উঠে আসা সমর্থন করে না বিজ্ঞান।

মিস্টার ল্যাঙডন, বলছে ভিট্টোরিয়া, মনে হয় আপনি বিগ ব্যাঙ থিওরির সাথে পরিচিত।

মোটামুটি।

ল্যাঙডন জানে, বিগ ব্যাঙ হল এই ইউনিভার্সের সৃষ্টির তত্ত্ব। কোন এক ঘনবিন্দুতে সন্নিবিষ্ট হওয়া শক্তির বিস্ফোরণ। বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে সেটা। এই হল ইউনিভার্সের গল্প।

বলে চলেছে ভিট্টোরিয়া, ক্যাথলিক উনিশো সাতাশে প্রথম বিগব্যাঙ থিওরি প্রস্তাব করে

আই এ্যাম স্যরি! বলল ল্যাঙডন, আপনি বলছেন যে বিগ ব্যাঙ থিওরি ক্যাথলিক চার্চের অবদান!

অবশ্যই। একজন ক্যাথলিক, জর্জ লেমিত্রে, উনিশো সাতাশে।

কিন্তু আমি মনে করেছিলাম… বিগ ব্যাঙ তত্ত্বটা কি হার্ভার্ডের এডউইন হাবলের প্রস্তাবনা নয়?

কোহলার এবার কথা বলে উঠল, আবারো, আমেরিকানদের ভুল ধারণা। হাবলের প্রস্তাবনাটা ওঠে উনিশো উনত্রিশে। লেমিত্রের দু বছর পর।

কিন্তু এর নাম হাবল টেলিস্কোপ। আমি কোন লেমিত্রে টেলিস্কোপের কথা শুনিনি কশ্মিন কালেও!

মিস্টার কোহলারের কথাই সত্যি। প্রস্তাব করেছিলেন লেমিত্রে। হাবল পরে প্রমাণ সংগ্রহ করেন।

ওহ।

ভেবে পায় না ল্যাঙডন, হার্ভার্ডের হাবল-পাগলা লেকচারাররা কি কখনো ভুলেও লেমিত্রের কথা তুলেছে?

লেমিত্রে যখন প্রথম বিগ ব্যাঙ থিওরির কথা প্রকাশ করলেন, বলছে ভিট্টোরিয়া, তখন সমস্বরে ভেঙচি কাটলেন বিজ্ঞানীরা। বস্তু, বললেন তারা, কখনোই তৈরি হতে পারে না শূণ্যতা থেকে। তারপর যখন প্রমাণ হাজির করলেন হাবল, শতকণ্ঠে গির্জা বিজয় দাবি করল। প্রমাণিত হয়ে গেল বাইবেলের কথা বৈজ্ঞানিক।

নড করল ল্যাঙডন, ব্যাপারটার উপর এতোক্ষণে তার নজর পড়ল।

অবশ্যই, বিজ্ঞানীরা তাদের আবিষ্কারকে ধর্ম প্রচারের ঝান্ডা হিসাবে ব্যবহার করতে দিতে চাইলেন না। সুতরাং তারা সাথে সাথে বিগ ব্যাঙ থিওরিকে গাণিতিক রূপ দিলেন। এখনো, সেই গাণিতিক হিসাবের পরও, চার্চ উপরে আছে একটা দিক দিয়ে।

মাথা নাড়ল কোহলারও, দ্য সিঙ্গুলারিটি।

ইয়েস, দ্য সিঙ্গুলারিটি। বলছে ভিট্টোরিয়া, টাইম জিরো। সে সময়টাকে ব্যাখ্যা করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াল বিজ্ঞানীদের জন্য। গণিত এগিয়ে যায় টাইম জিরো পর্যন্ত। তার পরই খেই হারিয়ে পড়ে।

ঠিক, বলল কোহলার, সেখানে একটা প্রভাবকের প্রয়োজন পড়ে।

বিগ ব্যাঙের সাথে ঈশ্বরের সম্পৃক্ততার কথা বলেন আমার বাবা। বিজ্ঞান আজ বোঝ না সে মুহূর্তটাকে। একদিন বুঝতে পারবে, এটাই তার আশা ছিল।

মেসেজটা পড়ল ল্যাঙডন :

বিজ্ঞান আর ধর্ম বিপবীত নয়।
বিজ্ঞান এত নবীন যে সে বুঝতে পারে না।

বাবা বিজ্ঞানকে আরো উচ্চতর একটা স্তরে পৌঁছে দিতে চান, যেখানে বিজ্ঞান মেনে নিবে ঈশ্বরকে। তিনি সে প্রমাণ আনার জন্য এমন এক পথ বেছে নিলেন যেটার কথা কোন বিজ্ঞানী ভাবেনি। নেই তাদের সেই টেকনোলজি। তিনি এমন এক পরীক্ষা করার কথা ভাবলেন যা মানুষকে জানাবে যে জেনেসিস সম্ভব।

জেনেসিস প্রমাণ করা? লেট দেয়ার বি লাইট শূণ্য থেকে বস্তু?

ঘরের উপর আলসে দৃষ্টি পড়ল কোহলারের, মাফ করবে!

আমার বাবা একটা সৃষ্টি জগত তৈরি করেছেন… শূণ্যতা থেকে।

কী!

বলা ভাল, তিনি বিগ ব্যাঙ তৈরি করেছিলেন। অবশ্য একেবারে ছোট পরিমাণে… পদ্ধতিটা একেবারেই সরল। এ্যাক্সিলারেটর টিউবের ভিতর থেকে পার্টিকেলের দুটা অতি পাতলা প্রবাহ বইয়ে দিলেন। প্রবাহর একে অন্যের উপর ঝাপিয়ে পড়ল অবিশ্বাস্য গতিতে। তাদের সমস্ত ক্ষমতা একত্র করল একটা মাত্র বিন্দুতে। সেখানে অত্যন্ত শক্তিশালী এ্যানার্জি তৈরি হল।

ফলাফল খুব বেশি বিস্ময়কর নয়। তার কাছে। কিন্তু যখন সেটা প্রকাশিত হবে, কেঁপে যাবে আধুনিক ফিজিক্সের ভিত্তিমূল। এ অবস্থায়, বস্তুর কণা জন্মাতে শুরু করল শূণ্য থেকে।

বলল না কিছু কোহলার। তাকিয়ে থাকল ফাঁকা দৃষ্টিতে।

বস্তু প্রস্ফুটিত হল একেবারে শূণ্য থেকে। সাব এটমিক ফুলঝুরির এক অসাধারণ প্রদর্শনী। শুধু তাই নয়, তিনি প্রমাণ করলেন, এই সবই ঘটেছে এক অবিশ্বাস্য শক্তির সান্নিধ্যে।

তার মানে ঈশ্বর? দাবি করল কোহলার।

গড, ঈশ্বর, বুদ্ধ, দ্য ফোর্স, ইয়াহওয়েহ, দ্য সিঙ্গুলারিটি, একীভুত বিন্দু–যে নামেই ডাকুন না কেন, ফলাফল একই–বিজ্ঞান আর ধর্ম একই কথা বলে, পিওর এনার্জিই সৃষ্টির মূল।

প্রমাণ?

এ ক্যানিস্টারগুলো। সেগুলোর স্পেসিমেন তিনিই তৈরি করেছেন।

কীভাবে প্রমাণ করবে? যে কোন স্থান থেকে সেগুলো সংগ্রহ করা সম্ভব।

সম্ভব নয়। এই পার্টিকেলগুলো ইউনিক। তারা এমন এক বস্তু যা পৃথিবীর বুকে কোথাও পাওয়া যাবে না।

কোহলার বলল, ভিট্টোরিয়া, কী করে তুমি বল যে বিশেষ ধরনের পদার্থ? পদার্থ সবই–

আপনি এর মধ্যেই এ বিষয়ে কথা বলে ফেলেছেন, ডিরেক্টর। সৃষ্টি জগতে দু ধরনের পদার্থ আছে। বৈজ্ঞানিক তথ্য।

মিস্টার ল্যাঙডন, বাইবেল সৃষ্টির ব্যাপারে কী বলে?

বলে… ঈশ্বর তৈরি করলেন আলো এবং অন্ধকার, স্বর্গ এবং নরক।

ঠিক তাই। তিনি সবকিছুই জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করলেন।

ডিরেক্টর, বিজ্ঞানও একই কথা বলে, এই ইউনিভার্সেরও বৈপরীত্য আছে…

বস্তুর ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য… ফিসফিস করল কোহলার।

তাই, বাবা তার পরীক্ষা চালানোর সাথে সাথে দু প্রকারের বস্তু তৈরি হল।

যে বস্তুর কথা তুমি বলছ সেটা ইউনিভার্সের অন্য কোন প্রান্তে আছে। নেই আমাদের সৌর জগতে। সম্ভবত আমাদের গ্যালাক্সিতেও নেই।

তাতেই প্রমান হয়ে যাচ্ছে যে, ঐ ক্যানিস্টারের জিনিসগুলো আনা হয়েছে শূণ্য থেকে।

তুমি নিশ্চই বলবে না যে ঐ স্পেসিমেনগুলো–

তাই বলব, ডিরেক্টর! আপনি পৃথিবীর প্রথম এন্টিম্যাটার স্পেসিমেনের দিতে তাকিয়ে আছেন।

২০.

দ্বিতীয় ধাপ, ভাবল ত্যাসাসিন, অন্ধকারাচ্ছন্ন সুড়ঙ্গের মুখে দাঁড়িয়ে।

তার হাতের মশালটা নিভু নিভু হয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে সময়। ভয়, তার আজীবনের সঙ্গি, পিছু ছাড়ছে না। যে কোন যুদ্ধের চেয়ে ভয় এগিয়ে থাকবে সব সময়।

সামনের আয়নাটা জানাচ্ছে তাকে যে সে একেবারে নিখুঁত। ছদ্মবেশে কোন ভুল নেই। রোব আকড়ে ধরল সে।

দু সপ্তাহ আগে হলেও বলা যেত এর অপর নাম মরণ। বলা যেত নাঙা দেহে সিংহের খাঁচায় চলে যাওয়া আর এখানে আসা সমান।

কিন্তু সব ব্যাপারকে পাল্টে দিয়েছে জ্যানাস।

এখন একটা চিন্তাই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, জ্যানাসের কথামত তারা শান্তি থাকবে তো? নিশ্চিন্তে সারা যাবে তো কাজ?

যাবে।

ভিতর থেকে সাহায্য আসছে, বলেছিল জ্যানাস।

ভিতর থেকে? অসম্ভব। অবিশ্বাস্য।

যত ভিতরে যাচ্ছে সে ততই বুঝতে পারছে, এ যেন ছেলেখেলা।

ওয়াহাদ… তিন্তাইন… সালাসা… আরবাআ… শেষপ্রান্তে চলে যাবার আগে আরবিতে বলল।

এক… দুই… তিন… চার…

০৩. এন্টিম্যাটারের কথা
২১.

মনে হয় আপনি এন্টিম্যাটারের কথা আগে থেকেই জানেন, তাই না মিস্টার

ল্যাঙডন? জিজ্ঞাসা করল ভিট্টোরিয়া।

জানতাম… একটু।

আপনি স্টার ট্রেক দেখেন, তাই না?

আমার ছাত্র ছাত্রীরা দেখে। ইউ এস এস এন্টারপ্রাইজকে চালায় না এন্টিম্যাটার?

ভাল সায়েন্স ফিকশন ভাল সায়েন্সের উপর ভর করে তৈরি।

তাহলে এন্টিম্যাটারের কাহিনী সত্যি?

প্রকৃতির গৃঢ় ব্যাপার। সব কিছুর বিপরীত ব্যাপার আছে। প্রোটনের বিপরীত ইলেক্ট্রন, আপ কোয়ার্কের ক্ষেত্রে ডাউন কোয়ার্ক। প্রতিবস্তু সব হিসাবের মধ্যে একটা পূর্ণতা এনে দেয়।

এখনো বিশ্বাস হতে চায় না ব্যাপারটা।

উনিশো আঠারো থেকেই বিজ্ঞানীরা জানে যে সব ব্যাপারের বিপরীত আছে। বিগ ব্যাঙে এন্টিম্যাটার তৈরি হয়েছিল।

এক ধরনের বস্তু আমরা। আমাদের পৃথিবী, শরীর, বৃক্ষ, সব। আর এর বিপরীতের সব একই রকম, শুধু এর চার্জের ক্ষেত্রটা উল্টো।

কোহলারের ঝালিয়ে নেয়ার সময় এসেছে, কিন্তু এ কাজের পথে বিরাট বাঁধা আছে। স্টোর করবে কী করে? আলাদা করে রাখবে কীভাবে?

প্রতিবস্তুর পজিট্রনগুলো আসার সাথে সাথে সেগুলোকে আকৃষ্ট করে আলাদা করার ব্যবস্থা করেছিলেন বাবা।

ভ্যাকুয়াম?

হ্যাঁ।

কিন্তু একটা ভ্যাকুয়াম ম্যাটার এন্টিম্যাটার দুটাকেই শুষে নিবে।

বাবা একটা ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করলেন। ফলে, চুম্বকের প্রভাবে, ম্যাটার চলে গেল বামে আর এন্টিম্যাটার চলে গেল ডানে। বেঁকে গেল তারা বিপরীত দিকে।

এত যুক্তির ভিতরে একটু একটু করে প্রবেশ করছে কোহলার। অ… বিশ্বাস্য! বলল সে, এখনো হার মেনে নেয়নি, তাহলে সেটাকে স্টোর করবে কী করে? এই ক্যানিস্টারে ভ্যাকুয়াম থাক, কিন্তু এগুলো তো ম্যাটারের তৈরি। বস্তুর সংস্পর্শে আসার সাথে সাথে প্রতিবস্তু-

স্পেসিমেন কখনোই ক্যানিস্টারের গায়ে লেগে যাবে না, বলছে ভিট্টোরিয়া, এ ক্যানিস্টারগুলোর নাম দিয়েছি এন্টিম্যাটার ট্র্যাপ। স্পেসিমেটুকু আর যাই করুক, ক্যানিস্টারের গায়ে লাগবে না কস্মিনকালেও।

কীভাবে?

দুটা ভিন্ন চৌম্বক ক্ষেত্রের কারণে। এদিকে, তাকান।

তাকাল কোহলার একটা কালো, বন্দুকের মত নলের ভিতর দিয়ে।

তোমরা দেখার মত এ্যামাউন্ট তৈরি করেছ?

দেখা যাচ্ছে টলটলে একটা তরল বিন্দুকে। ভাসছে।

পাঁচ হাজার ন্যানোগ্রাম। মিলিয়ন পজিট্রনের একটা লিকুইড প্লাজমা।

লক্ষ লক্ষ ! কিন্তু কেউ কখনো একত্রে মাত্র কয়েকটার বেশি এন্টিম্যাটার তৈরি করতে পারেনি।

তিনি জেননকে কাজে লাগিয়েছিলেন। জেননের জেটে পার্টিকেল বিম প্রবাহিত করেন। এগুলো ইলেক্ট্রন থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। কাচা ইলেক্ট্রনও কাজে লাগে এক্সিলারেটরে।

ল্যাঙডন ভেবে পায় না এখনো তারা ইংরেজিতে কথা বলছে কিনা।

টেকনিক্যালি, তা থেকে—

ঠিক তাই! অনেক অনেক পাওয়া যাবে।

আবার তাকাল কোহলার আইপিস দিয়ে। তাকিয়েই থাকল। তারপর চোখ তুলে, কপালের রেখাকে গভীরতর করে বলল, মাই গড… তোমরা সত্যি সত্যি কাজটা করেছ!

আমার বাবা করেছেন।

কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।

ল্যাওডনের দিকে তাকাল ভিট্টোরিয়া, আপনি একবার চোখ রাখবেন?

চোখ রাখল সে।

এবং দেখতে পেল।

তার প্রত্যাশা অনুযায়ী জিনিসটাকে ক্যানিস্টারের তলায় পাওয়া গেল না। পারদের মত চকচকে একটা তরল ভেসে আছে উপরে। এর উপরিতলে সর্বক্ষণ কাঁপন উঠে আসছে। একবার শূণ্যতায় পানির ফোটার কাজ দেখেছিল সে। এ ব্যাপারটাও তেম্নি।

এটা… ভাসছে এটা!

এমন থাকাই তার সাজে, বলল ভিট্টোরিয়া, এন্টিম্যাটার চরম অস্থিতিশীল। এন্টিম্যাটার আর ম্যাটার যদি একত্র হয় তাহলে তুলকালাম কান্ড ঘটে যাবে। বাতাসের সংস্পর্শ এলেও ফুসে উঠবে তারা।

আবার হতবাক হয়ে যায় ল্যাঙডন।

ভ্যাকুয়ামে কাজ করার কথা বলছে!

এন্টিম্যাটার ট্র্যাপগুলোও কি, বলছে কোহলার, তোমার বাবার কাজ?

আসলে,.. সেটার ভার আমার।

চোখ তুলে তাকাল কোহলার।

আমিই তাকে পথ বাৎলে দিই। বলি এমন একটা পথ বের করার কথা।

তাকিয়ে থাকল ল্যাঙডন। কোহলারের কথাই সত্যি। এ অসাধারণ।

চুম্বকের পাওয়ার সোর্স কোনটা?

ট্র্যাপের নিচের একটা পিলার। অবাক হলেও সত্যি, ফাদের ব্যাপারটা অসম্ভব ভাল। .

সে ঠিক কথাই বলেছে। কিন্তু যদি কারেন্ট চলে গেল?

হতেই পারে। বোতলের এ অংশটায় তরল চলে আসে, আমরা একটা বিস্ফোরণ ঘটাব। দেখব এ্যানিহিলেশস।

এ্যানিহিলেশন? ভেবে পায় না এ কথার মানে।

যদি একবার এখানে, আমাদের কাছাকাছি, পৃথিবীর বুকে একটা প্রতিবস্তুর কণা পড়ে, বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছি আমরা। এন্টিম্যাটার আর ম্যাটার মিললে এ পরিণতি হবেই।

ওহ!

এটা একেবারে সহজ। একটা বস্তু আর প্রতিবস্তু পরস্পরের সাথে মিলিত হলে নতুন একটা কণা বেরোয়। ফোটন। আলোর কণা।

ল্যাঙডন ফোটনের কথা পড়েছে। বলা চলে আলোর একক। শক্তির প্যাকেট। ক্লিঙ্গনদের বিরুদ্ধে ক্যাপ্টেন কার্ক কীভাবে ফোনট ব্যবহার করে তা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সে। তার মানে, এন্টিম্যাটার পড়লে আমরা আলোর একটা ছোট্ট রেখা দেখতে পাব?

শ্রাগ করল ভিট্টোরিয়া, নির্ভর করছে কোনটাকে আপনি ছোট্ট বলেন। এখানে, আমাকে দেখাতে দিন।

একটা ক্যানিস্টারকে প্রস্তুত করল সে।

সাথে সাথে যেন পাগল হয়ে গেল কোহলার।

ভিট্টোরিয়া! পাগল হয়ে গেলে নাকি তুমি?

২১.

কোহলার, অবিশ্বাস্যভাবে, তার দু পায়ের উপর, কাঠির মত দু পায়ের উপর ভর দেয়। তার চেহারা কাগজের মত ফ্যাকাশে হয়ে গেছে আতঙ্কে। ডিরেক্টরের হঠাৎ আসা আতঙ্কের কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না ল্যাঙডন।

পাঁচশ ন্যানোগ্রাম! তুমি যদি চৌম্বক্ষেত্রটা ভাঙ…।

ডিরেক্টর! এটা একেবারে নিরাপদ। প্রত্যেকটা ট্র্যাপের ফেইল সেফ আছে। রিচার্জার থেকে সরিয়ে আনলে একটা ব্যাটারি তাকে ব্যাক আপ দিবে। ভয় নেই।

ব্যাটারিগুলো অটোম্যাটিক এ্যাকটিভেটেড হয়। চব্বিশ ঘণ্টা। লাগাতার।

প্রতিবস্তুর একটা বিচিত্র ব্যবহার আছে, মিস্টার ল্যাঙডন। একটা দশ মিলিগ্রামের প্রতিবস্তু, বালির কণার সমান যার আয়তন, দুশ মেট্রিকটন প্রচলিত রকেট ফুয়েলের চেয়েও বেশি কাজ করে।

আবার চক্কর দিতে শুরু করল ল্যাঙড়নের মাথা।

এই আগামী দিনের শক্তির উৎস। নিউক্লিয়ার এ্যানার্জির চেয়ে হাজার গুণ বেশি ক্ষমতাবান। একশোভাগ কর্মক্ষম। কোন বাই প্রোডাক্ট নেই। নেই তেজস্ক্রিয়তা। নেই দূষণ। মাত্র কয়েক গ্রাম বেশ কয়েকদিনের জন্য একটা বড় মহানগরীর চাহিদা মিটাতে পারবে।

গ্রাম?

দুঃখ পাবেন না। আমাদের পরীক্ষার পরিমাণ লাখ লাখ ভাগের এক ভাগ, সেই ভরের। অনেক কম ক্ষতিকর।

তুলে ফেলল ভিট্টোরিয়া একটা ক্যানিস্টার। সেখানে লেডের আলো কাউন্ট ডাউন শুরু করে দিয়েছে।

২৪:০০:০০…

২৩:৫৯:৫৯…

২৩:৫৯:৫৮…

এতো টাইম বোমা!

ব্যাটারিটা, ব্যাখ্যা করছে ভিট্টোরিয়া, মরে যাবার আগে পুরোদস্তুর চব্বিশ ঘণ্টা জুড়ে কাজ করবে। আবার পোডিয়ামে ফিরিয়ে দিলে চার্জ হতে থাকবে। যেন বহন করা যায়, সেজন্যেই এ ব্যবস্থা।

পরিবহন? আৎকে উঠল কোহলার, তুমি এ জিনিসকে বাইরে নেয়ার মতলব আঁটছ?

অবশ্যই না। কিন্তু এতে করে আমরা কাজ আরো ভাল করে করতে পারি।

একটা দরজা খুলল ভিট্টোরিয়া। তার পিছনে আগাগোড়া ধাতুতে মোড়া একটা ঘর। মনে পড়ে গেল ল্যাঙডনের, হেনতাই কীর্তি দেখার জন্য পাপুয়া নিউ গিনিতে গিয়ে এমন ব্যাপারটা দেখেছিল সে।

এটা এ্যানিহিলেশন ট্যাঙ্ক। ঘোষণা করল ভিট্টোরিয়া।

চোখ তুলে তাকাল কোহলার, তোমরা সত্যি সত্যি এ্যানিহিলেশন কর?

বাবা। বলল ছোট্ট করে ভিট্টোরিয়া, একটা ধাতব ড্রয়ার টেনে বের করতে করতে। সাথে সাথে ট্রাপটা চলে গেল ঘরের মাঝামাঝি। …

একটা শক্ত হাসি দিল ভিট্টোরিয়া, আপনারা এখন প্রথম দেখতে পাবেন ম্যাটার আর এন্টিম্যাটারের সংঘর্ষ। অতি কম। এক গ্রামের লাখ লাখ ভাগের এক ভাগ।

বাকি দুজন বোকাটে দৃষ্টি নিয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা ক্যানিস্টারটার দিকে তাকাল।

সাধারণত চব্বিশ ঘণ্টা প্রতীক্ষা করার কথা। কিন্তু এই চেম্বারটার ভিতরে, নিচে আরো শক্তিশালী ক্ষেত্র আছে। সেটা পরাস্ত করবে ক্যানিস্টারের শক্তিকে। আপনারা দেখতে পাবেন…।

এ্যানিহিলেশন? বলল কোহলার।

আরো একটা ব্যাপার। এন্টিম্যাটার একেবারে খাঁটি শক্তি নির্গত করে। ভরকে শতভাগ ফোটনে রূপান্তরিত করে। তাই সরাসরি স্যাম্পলের দিকে তাকাবেন না। শিল্ড ইউর আইস।

বেশি বেশি করছে কি ভিট্টোরিয়া? ত্রিশগজ দূরে তারা। বিশেষ কাঁচের জানালা দিয়ে আলো আসবে। ভিতরের এন্টিম্যাটারটা দেখা যাবে না।

বাটন চাপল ভিট্টোরিয়া।

একটা আলোর বিন্দু বেরিয়ে এল।

ছড়িয়ে গেল সারা এলাকায়। আলোর শকওয়েভ ঠিক ঠিক টের পেল. তারা। ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল চোখ কোটর ছেড়ে।

একটা মুহূর্ত, মুহূর্তেরও ভগ্নাংশ।

তারপর আলোটা ফিরে গেল আগের উৎসতে। তারপর থেমে গেল। একটা বিন্দুতে একটু জুলে থেকে গেল নিভে।

চোখ পিটপিট করল ল্যাঙডন…

গ… গড!

ঠিক এ কথাটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন আমার বাবা।

২৩.

কোহলার আরো বেশি বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে চেম্বারের দিকে।

আমি আমার বাবাকে এবার দেখতে চাই। ল্যাব দেখিয়েছি, এবার দেখতে চাই বাবাকে।

এত দেরি কেন করলে, ভিট্টোরিয়া? তোমার আর তোমার বাবার উচিৎ ছিল এ প্রজেক্ট সম্পর্কে আগেভাগে আমাকে জানানো।

কত কারণ চাও তুমি?

ডিরেক্টর, এ নিয়ে বচসা করার অনেক সময় হাতে পাব আমরা। ঠিক এখন, আমি আমার বাবাকে দেখতে চাই।

তুমি কি জান এ টেকনোলজির কত মূল্য?

শিওর, সার্নের জন্য টাকা। অসীম টাকা। এবার আমি বাবাকে দেখতে চাই।

কেন তোমরা লুকিয়ে রাখলে? আমি রেজিস্টার করে ফেলব এ ভয়ে? শুধু টাকা নয় ভিট্টোরিয়া, বিজ্ঞান একেবারে আনকোরা নূতন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল। মানবজাতি পৌঁছে যেতে চলেছিল সৃষ্টি জগতের প্রান্তে প্রান্তে। সব সায়েন্স ফিকশনের কল্পনাও চলে যাচ্ছিল পুরনো হয়ে।

এটাকে লাইসেন্সড করাও প্রয়োজন। বলল ভিট্টোরিয়া, এর গুরুত্ব আমরা ভাল করেই জানতাম। জানতাম, এ নিয়ে বিপদের সম্ভাবনাও কম নয়। আমরা সময় নিচ্ছিলাম একে আরো আরো নিরাপদ করার কাজের জন্য।

অন্য কথায়, তোমরা বোর্ড অব ডিরেক্টরসকে তোয়াক্কা করনি।

আরো কারণ আছে। বাবা এন্টিম্যাটারকে আরো আলোকিত অবস্থায় সবার সামনে উপস্থাপন করার কাজ করছিলেন।

মানে?

জেনেসিস। ঈশ্বরের উপস্থিতি।

তার মানে তিনি চাচ্ছিলেন না কেউ নাক গলাক?

অনেকটা তাই।

এবং তিনি বাণিজ্যিকতায় যেতে চাচ্ছিলেন না শুরুতেই?

অনেকটা তাই।

আর তুমি?

নিশ্চুপ ভিট্টোরিয়া। এ প্রযুক্তির জন্য রাতদিন ঘুম হারাম করেছিল তারা। গাস্টিকের আধার বানিয়েছে। প্লাস্টিকের ব্যাটারি বানিয়েছে। নিরাপদ করেছে আরো আরো।

আমার আগ্রহ, বলল ভিট্টোরিয়া, বিজ্ঞান আর ধর্মকে এক করে দেয়ার চেয়ে বেশি ছিল অন্য ব্যাপারের উপর।

পরিবেশ?

এ প্রযুক্তি পুরো দুনিয়াকে বাঁচিয়ে তুলতে পারত। এক ধাক্কায় গোটা পৃথিবীকে তুলে আনতে পারত প্রথম বিশ্বের সারিতে।

অথবা এটাকে ধ্বসিয়ে দেয়া। কে ব্যবহার করছে তার উপর নির্ভর করবে অনেক কিছু।

অন্য কেউ না। বলেছি আমি সেকথা।

তাহলে কী কারণে তোমার বাবা খুন হলেন?

কোন ধারণাই নেই। সার্নে তার শত্রুর কোন অভাব ছিল না। কিন্তু এর সাথে এন্টিম্যাটারের কোন গোল নেই। আর কাউকে বলবেন না, এ ওয়াদা করা ছিল আমাদের মধ্যে।

তোমাদের প্রস্তুতি শেষ হওয়া পর্যন্ত?

হ্যাঁ।

আর তুমি নিশ্চিত বাবা সে ওয়াদা রক্ষা করেছিলেন?

এরচে অনেক বড় বড় প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছেন তিনি!

আর তুমিও বলনি কাউকে?

অবশ্যই বলিনি!

ধরে নেয়া যাক, স্রেফ ধরে নেয়া যাক, কেউ জানতে পারল, কেউ আসতে পারল, কী মনে হয়, কীসের খোঁজ করবে সে? এখানে তোমার বাবার কোন নোট কি আছে? ডকুমেন্ট?

ডিরেক্টর, অনেক ধৈর্য ধরেছি। এবার কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে আমাকেও। আপনি বারবার এখানে প্রবেশের কথা বলছেন–

কথার জবাব দাও। কী খোয়া যেতে পারে?

আমার কোন ধারণা নেই। আসেনি কেউ। সবই ঠিকঠাক গোছানো উপরে।

উপরে?

হ্যাঁ, এখানে, আপার ল্যাবে।

তোমরা লোয়ার ল্যাবটাও কাজে লাগাচ্ছ?

স্টোর হিসাবে।

তোমরা হাজ-মাত চেম্বার ব্যবহার করছ? কীসের স্টোর হিসাবে?

আর কীসের!

উত্তেজনায় বিষম খেল কোহলার। আরো স্পেসিমেন আছে? আগে বলনি কেন?

আমি কোন সুযোগ পাইনি বলার।

আমাদের সেসব চেক করতে হবে। এখনি!

সেটা। সিকুলার। আর কেউ সেটার টিকিটারও খোঁজ পাবে না।

মাত্র একটা? উপরে নেই কেন?

বাবা জিনিসটাকে নিরাপত্তার খাতিরে নিচে রেখেছেন। এটা আর সবগুলোর চেয়ে বড়।

তোমরা পাঁচশ ন্যানোগ্রামের চেয়ে বড় স্পেসিমেন তৈরি করেছ?

প্রয়োজনে। আমাদের প্রমাণ করতে হত যে ইনপুট করার সময় বেশি পরিমাণ নিলেও ভয় নেই।

তেলের ট্যাঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান জ্বালানিটাকে তারা উপরে না রেখে নিচে রেখেছে শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল নাকি ভয়ে কুকড়ে গেল তারা বোঝা যাচ্ছে না।

বাবা চাননি বড় স্পেসিমেন তৈরি করতে। ভিট্টোরিয়াই চাপ দিত সব সময়। দুটা ব্যাপার প্রমাণ করতে হত তাদের। আরো দুটা ব্যাপার। প্রথমত, বিশাল পরিমাণে সেগুলো জমানো যায়। দ্বিতীয়ত, সেগুলো স্টোর করা যায় নিরাপদে।

হাজ-মাতে, গ্রানাইটের একটা ছোট্ট খুপরিতে, আরো পঁচাত্তর ফুট নিচে, বসানো ছিল সেটা।

সেখানেও, শুধু তারা দুজনে যেতে পারবে।

ভিট্টোরিয়া! এবার মিনতি ঝরে পড়ল কোহলারের কন্ঠে, কত বড় স্পেসিমেন তুমি আর তোমার বাবা মিলে তৈরি করেছ?

অবিশ্বাস্য বিস্ময় দেখা দিবে এখন গ্রেট ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলারে চোখে। ভেবে তৃপ্ত হয় ভিট্টোরিয়া।

এক গ্রামের পুরো চার ভাগের একভাগ।

কোহলারের চোখমুখ থেকে সরে গেল সমস্ত রক্ত, কী! একগ্রামের চার ভাগের এক ভাগ? এর শক্তি… প্রায় পাঁচ কিলোটনের সমান!

কিলোটন! শব্দটাকে ঘৃণা করে ভিট্টোরিয়া। এক কিলোটন হল এক হাজার মেট্রিকটন টি এন টির সমতুল্য।

এটা বিস্ফোরকের হিসাব। অকল্যাণের হিসাব।

সে আর বাবা মিলে সব সময় ইলেক্ট্রন-ভোল্টে মাপত শক্তিটাকে। নয়ত জোল্টে।

এই পরিমাণ বিস্ফোরক আধমাইল ব্যাসের জায়গাকে ধূলার সাথে মিশিয়ে দিবে এক পলকে!

যদি পুরোটাকে একেবারে জ্বালানো হয়। কেউ তা করতে পারবে না।

যদি কেউ ভুল করে বসে… যদি তোমার পাওয়ার সোর্স নষ্ট হয়ে যায়… –

সেজন্যেই বাবা সেটাকে হাজ-মাতে, নিরাপদ দূরত্বে, ফেইল সেফ সহ- সিয়ে রেখেছেন।

হাজ-মাতেও তোমাদের বাড়তি নিরাপত্তা আছে?

দ্বিতীয় রেটিনা স্ক্যান।

নিচের দিকে! এখনি!

ফ্লাইট এলিভেটর একটা পাথরের মত পড়ে গেল।

আরো পঁচাত্তর ফুট নিচে।

দুজনের চোখে কেন ভয় দেখতে পাচ্ছে ভেবে পায় না ভিট্টোরিয়া।

একেবারে তলায় পৌঁছে গেল তারা।

একটা করিডোর। তার শেষ প্রান্তে লোহার গেটে লেখা, হাজ-মাত। স্ক্যান করাল সে নিজের চোখ।

চোখ তুলে ফেলল সে সাথে সাথে। সেখানে কিছু একটা আছে… রক্ত?

ফিরল সে দুজনের দিকে। তাদের মুখও ফ্যাকাশে। তাকিয়ে আছে ভিট্টোরিয়ার পায়ের দিকে।

ভিট্টোরিয়া তাদের চোখকে অনুসরণ করে তাকাল নিচে।

না! দৌড়ে গেল ল্যাঙড়ন। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।

মেঝেয় পড়ে থাকা জিনিসটার দিকে আটকে গেল তার চোখ৷ এটা একই সাথে একেবারে অপরিচিত এবং সুপরিচিত।

একটা মাত্র পল লাগল।

বুঝল সে ঠিক ঠিক। চিনতে ভুল হল না চোখের গালটাকে

২৪.

সিকিউরিটি টেকনিশিয়ান তার কাঁধে কমান্ডারের শ্বাস টের পায়। তাকিয়ে আছে সে শক্ত ঘাড়ে, স্ক্রিনের দিকে।

কমান্ডারের নিরবতার কারণ আছে। বোঝায় সে নিজেকে। তিনি একজন প্রটোকল মানা লোক। তিনি কখনোই আগে বলে এবং পরে চিন্তা করে কিছু করেন না। পৃথিবীর সবচে এলিট বাহিনীগুলো সেসব নিয়ম মানে।

কিন্তু সে কী ভাবছে?

একটা স্বচ্ছ ক্যানিস্টারের দিকে তাদের চোখ।

কীভাবে যেন সেটার ভিতরে একটা ফোঁটা ভেসে আছে।

সেইসাখে আছে রোববাটিক ব্লিঙ্ক। লেডের লাল আলোয় কাউন্ট ডাউন।

ক্যানিস্টারকে আরো একটু আলো দেয়া কি সম্ভব? জিজ্ঞেস করল কমান্ডার।

চেষ্টা চরিত্র করল টেকনিশিয়ান লোকটা। একটু আলো এল।

সামনের দিকে ঝুঁকে এল কমান্ডার। কন্টেইনারের একেবারে ভিত্তিতে একটা কিছু দেখা যাচ্ছে।

টেকনিশিয়ানের দৃষ্টি তার কমান্ডারকে অনুসরণ করুল। চারটা বড় হাতের অক্ষর আছে সেখানে।

এখানেই থাক, বলল কমান্ডার, কিছু বলোনা। আমি পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছি।

২৫.

হাজ-মাত।

ভিট্টোরিয়া ভেট্রা পড়ে যাচ্ছে জ্ঞান হারাতে হারাতে। রবার্ট ল্যাঙডন এগিয়ে এল। তারা চোখ উপড়ে নিয়েছে!

দুমড়ে মুচড়ে গেল তার পৃথিবী। যেন এ এক স্বপ্ন। চোখ খুললেই সব মিথ্যা সরে যাবে।

খুলে গেল দরজা।

ভিতরে ঢুকতে ঢুকতেই সে প্রস্তুতি নিল যে কোন কিছু দেখার জন্য এবং তার আশঙ্কাই সত্যি বলে প্রমাণিত হল।

ক্যানিস্টারটা নেই।

কেউ একজন এটাকে তুলে নিয়েছে। আর কল্যাণের অগ্রদূত পরিণকুহয়েছে সবচে বীভৎস অস্ত্রে। নিয়ে নেয়ার সাথে সাথে।

মারা গেছে বাবা। তার মেধার জন্যই।

আরো একটা আবেগ এগিয়ে এল। নিজেকে দোষী ভাবার আবেগ। এ কাজটা সেই করতে বলেছিল। বলেছিল বড় একটা স্পেসিমেন গডতে। তৈরি করেছিল ব্যাক আপ সিস্টেম এবং ব্যাটারি।

এক গ্রামের এক চতুর্থাংশ…

আর সব টেকনোলজির মতই- আগুন, গান পাউডার, কমবাশন ইঞ্জিন এবং ভুল হাতে পড়লে এন্টিম্যাটারও, হতে পারে প্রাণঘাতী।

আর সময়টা বয়ে গেলে…

একটা অন্ধ করে দেয়া আলো। বজ্রপাতের শব্দ। একটা বিস্ফোরণ, শুধু আলোর একটা ঝলক। বিশাল, খালি একটা জ্বালামুখ তৈরি হয়ে যাবে। এক বিশাল, খালি জ্বালামুখ।

এর কোন ধাতব আবরণ নেই যে মেটাল ডিটেক্টরে ধরা পড়বে। নেই কোন কেমিক্যাল যে কুকুর ধরে ফেলবে। এটাকে বসানোর মত কোন চার্জারও নেই যে চার্জ করবে তারা।

ভিট্টোরিয়া তাকিয়ে আছে বোবার মত। স্থাণুর মত। তার চোখ থেকে আড়াল করার জন্য ল্যাঙডন তাকায় নিচে। রুমাল দিয়ে ঢেকে দেয় অক্ষিগোলকটাকে।

মিস্টার ল্যাঙডন! আপনি স্পেশালিস্ট, বলল কোহলার, আমি জানতে চাই এই ইলুমিনেটি বাস্টার্ডরা কী করবে ক্যানিস্টারটা দিয়ে।

ইলুমিনেটির কথা আমার এখনো অপ্রযোজ্য মনে হচ্ছে, মিস্টার কোহলার। হয়ত সার্নের ভিতর থেকেই কেউ স্যাবোটাজ করছে। কে, জানি না। কিন্তু ইলুমিনেটি বলতে এখনো কোন সংস্থার অস্তিত্ব আছে তা মনে হয় না।

এখনো আপনার কাছে অস্পষ্ট লাগছে মিস্টার ল্যাঙডন? যারাই খুনটা করে থাক না কেন- করেছে এই ক্যানিস্টার চুরি করার উদ্দেশ্যে। আর এ নিয়ে তাদের পরিকল্পনা আছে। নিশ্চিত।

সন্ত্রাসবাদ?

সোজা।

কিন্তু ইলুমিনেটি সন্ত্রাসী নয়।

কথাটা লিওনার্দো ভেট্রাকে বলুন।

ধাক্কা খেল ল্যাঙডন এবার। ইলুমিনেটির অপ্রকাশিত সিম্বল আকা আছে তার বুকে। কোন না কোন ব্যাখ্যা থাকবেই।

আবার ভাবে সে।

ইলুমিনেটি যদি এখনো টিকে থাকে, কী করবে তারা এন্টিম্যাটারটা নিয়ে তাদের টার্গেট কী হতে পারে?

না। মিলছে না। ইলুমিনেটির এক শত্রু আছে ঠিকই। সেটা এখনো টিকে আছে। তাই বলে এত বছর পর, সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে, মাস ডেস্ট্রাকশনের মাধ্যমে সে লক্ষ্য হাসিল করবে তারা এমন কোন সম্ভাবনা নেই।

এখনো, সন্ত্রাসবাদের চেয়ে বড় কোন ব্যাখ্যা আছে…

কোহলার তাকাল। অপেক্ষা করছে।

বলা হয় ইলুমিনেটি ক্ষমতা চায়। কিন্তু সেটা অন্য কোন ক্ষেত্র থেকে। আর্থিক ক্ষেত্র, শিক্ষা ক্ষেত্র। তাদের হাতে আছে পৃথিবীর সবচে দামি জিনিস, দ্য ইলুমিনেটি ডায়মন্ড, আছে সোনার খনি।

টাকা। বলল সে অবশেষে, টাকার জন্য কেউ এটাকে নিয়ে থাকতে পারে।

আর্থিক সুবিধা? কোথায় তারা এক ফোঁটা এন্টিম্যাটার বেচবে?

স্পেসিমেন নয়, বলল সে, টেকনোলজিটা। হয়ত কেউ চুরি করেছে প্রযুক্তিটা বোঝার জন্য।

ইন্ডাস্ট্রিয়াল এসপিওনাজ? কিন্তু এর ঘড়ি টিক টিক করছে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এর রফা দফা হয়ে যাবে।

তারা রিচার্জ করতে পারে। এমন একটা চার্জার তৈরি করতে পারে।

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে? তারা যদি এটাকে নিয়ে গিয়ে সার্চে বসে যায় তবু চার্জার বানাতে ইঞ্জিনিয়ারদের গলদঘর্ম হতে হবে মাসের পর মাস ধরে। কয়েক ঘণ্টায়? অসম্ভব।

মৃদু কণ্ঠ শোনা গেল ভিট্টোরিয়ার দিক থেকে, তার কথা ঠিক।

দুজনেই তাকাল তার দিকে।

তার কথা ঠিক। ফ্লাক্স ফিল্টার, সার্ভো কয়েল, পাওয়ার কন্ডিশনিং এ্যালয়, এসব। ঠিক করতে করতে অনেক সময় পেরিয়ে যাবে।

বুঝল ল্যাওড়নও, একটা সকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে সেটাকে চার্জ করার চেষ্টা বাতুলতা মাত্র।

একটা অস্বস্তি ঝুলে রইল বাতাসে।

আমাদের ইন্টারপোলকে ডাকতে হবে, বিড়বিড় করল আঘাত পাওয়া ভিট্টোরিয়া,

সময়মত ডাকতে হবে সঠিক অথরিটিকে।

কোহলার তাকাল তার দিকে, এ্যাবসোলিউটলি নট!

না? কী বলতে চান আপনি?

তুমি আর তোমার বাবা মিলে আমাকে একটা গ্যাড়াকলে ফেলে দিয়েছ।

ডিরেক্টর, আমাদের সহায়তা প্রয়োজন! আমাদের সময় মত ক্যানিস্টারটাকে ফিরে পেয়ে রিচার্জ করতে হবে। নাহলে

নাহলে আমাদের চিন্তা করতে হবে। এই পরিস্থিতি সার্নের জন্য কতটা নাজুক ইতে পারে একবার ভেবেছ?।

আপনি সার্নের সুনাম নিয়ে চিন্তিত? একটা শহুরে এলাকায় সেই ক্যানিস্টার কী করতে পারে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা আছে আপনার? এর ব্লাস্ট রেডিল্লাস আধ মাইলের। নয়টা সিটি ব্লকের সমান!

হয়ত বানানোর সময় কথাটা মাথায় রাখা উচিৎ ছিল তোমাদের।

কিন্তু আমরা সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করেছি।

দেখাই যাচ্ছে, কাজ হয়নি তাতে!

কিন্তু কেউ জানেনি এ সম্পর্কে।

আর হাওয়া থেকে, না জেনে, কেউ এসে এটাকে নিয়ে গেছে।

ভিট্টোরিয়া কাউকে বলেনি। ঘুণাক্ষরেও না। তার বাবা কি বলেছে? তাও কি সম্ভব? আর যদি বলেও থাকে, তা আর জানার কোন উপায় নেই। তিনি এখন মৃত।

শর্টস পকেট থেকে একটা সেলফোন বের করল সে।

কোহলার ফেটে পড়ল রাগে, কাকে ফোন করছ?

সার্নের সুইচবোর্ডে। তারা আমাদেরকে ইন্টারপোলের সাথে যুক্ত করবে।

ভাব! তুমি কি এতই বোকা? ক্যানিস্টারটা এতক্ষণে দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে থাকতে পারে। কোন ইন্টেলিজেন্স তা পাবে না সময়মত।

আর তাই আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকি?

আমরা তাই করব, যা স্মার্ট। না ভেবে সার্নের সুনাম ভূলুণ্ঠিত করতে পারি না।

কোহলারের কন্ঠে যুক্তি আছে। আবার মানুষের জীবন রক্ষার শেষ চেষ্টা করাটাও সবচে বড় যুক্তির কাজ।

তুমি কাজটা করতে পার না। সাবধান করে দিল ভিট্টোরিয়াকে কোহলার।

শুধু চেষ্টা করুন আমাকে থামানোর।

নড়ল না কোহলার।

এক মুহূর্ত পরেই টের পেল ভিট্টোরিয়া, কেন। সেলফোনে ডায়াল নেই মাটির এত নিচে।

সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিল ভিট্টোরিয়া।

শুরু করল ছোটা।

২৬.

পাথুরে সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে হ্যাসাসিন। টানেলের বদ্ধ বাতাসে তার নিভু নিভু লণ্ঠন থেকে কালো ধোঁয়া মিশে গিয়ে আরো সমস্যা সৃষ্টি করছে। সামনের লোহার দরজা দেখতে এই টানেলের মতই পুরনো। এবং শক্ত।

চলে এসেছে সময়।

ভিতর থেকে কেউ একজন সহায়তা করবে। কেউ একজন ভিতর থেকে বিশ্বাস ভাঙরে। সারা রাত সে দাড়িয়ে থাকতে পারে এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করার সুবাদে।

কয়েক মিনিট পরে, একেবারে সময়মত একে একে ভারি চাবি দিয়ে দরজার তালাগুলো খোলার শব্দ উঠল। বোঝাই আয়, এটাকে অনেক শতাব্দি ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে না।

তারপর নিরবতা।

ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে হাসানি। পাঁচ মিনিট। ঠিক যা বলাছিল তাকে। তারপর, শক্ত হাতে সে ধাক্কা দেয়। খুলে যায় বিখ্যাত দরজায় পাল্লা।

২৭.

ভিট্টোরিয়া! আমি এ কাজ অনুমোদন করব না!

এখন কেন যেন এ জায়গাটাকে অচেনা মনে হয়। কেন যেন গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে কান্না।

একটা ফোনের কাছে চলে যাও…

রবার্ট ল্যাঙডন এখনো চুপ করে আছে।

কীসের স্পেশালিস্ট সে? কীভাবে সহায়তা করবে? তারা দুজনেই কিছু না কিছু লুকাচ্ছে তার কাছ থেকে। কী সেটা?

সার্নের ডিরেক্টর হিসাবে বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ, সার্নের ভবিতব্যের কথা আমাকে ভাবতে হয়–

বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ? আপনি কি সোজা নির্জলা মিথ্যা বলবেন? কাউকে জানাবেন না যে সেটা সার্ন থেকে পাওয়া গেছে? আপনি কি বিনা দ্বিধায় এত মানুষের জীবন। সংশয় নিয়ে ছেলেখেলা খেলবেন?

আমি না। তোমরা। তুমি আর তোমার বাবা।

দূরে তাকাল ভিট্টোরিয়া।

আর যতই জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলব আমরা, বলল কোহলার, এবার একটু নিচু লয়ে, জীবন হল এমন এক ব্যাপার যা নিয়ে এখন কথা বলা যায়। কিন্তু মানবজাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সার্নের মত প্রতিষ্ঠানের উপর। তুমি আর তোমার বাবার মত বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সমস্যা মিটানোর জন্য এখানে অহর্নিশি কাজ করছে।

থামল সে। তারপর আবার বলতে শুরু করল, বিজ্ঞান এই পৃথিবীর অর্ধেক সমস্যা এনেছে। আর স্পেস প্রোগ্রাম, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিসিন–সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞানের জয় জয়কারের সাথে সাথে তার ভুলগুলোকেও শুধরে নেয়ার সময় এসেছে।

ভিট্টোরিয়া সাথে সাথে বলল, আপনি মনে করেন সার্ন পৃথিবীর ভবিষ্যতের সাথে এমন জটিলভাবে সম্পর্কিত যে আমাদের নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকেও দূরে থাকতে হবে?

আমার সাথে নৈতিকতা নিয়ে যুক্তি দেখাবে না। স্পেসিমেনটা তৈরির সময়ই নৈতিকতার দ্বার পেরিয়ে গেছ তোমরা। আমি শুধু এখানটার তিন হাজার বিজ্ঞানীর চাকরি রক্ষার চেষ্টা করছি না। চেষ্টা করছি তোমার বাবার সুনামও অক্ষুন্ন রাখতে। ব্যাপক বিদ্ধংসী অস্ত্রের আবিষ্কতা হিসাবে তার নাম যাওয়া কোন দিক দিয়েই ভাল নয়।

আমিই বাবাকে স্পেসিমেন তৈরি করতে বলেছি। যা ভুল সব আমার।

যখন দরজা খুলে গেল, তখনো কথা বলছিল কোহলার। থামল ভিট্টোরিয়া, তারপর আবার খুলল ফোন।

এখনো নেটওয়ার্ক নেই। ড্যাম! সে দরজার দিকে যেতে শুরু করল।

ভিট্টোরিয়া! থাম! কথা বলতে হবে আমাদের।

বাস্তা ডি পার্লারে!

বাবার কথা ভাব! কী করতেন তিনি?

যাচ্ছে মেয়েটা।

ভিট্টোরিয়া! তোমাকে সব বলা হয়নি?

এবার টের পেল ভিট্টোরিয়া, তার পা স্থবির হয়ে আসছে।

জানি না কী ভাবছিলাম আমি। শুধু তোমাকে রক্ষার কথাই ভাবছিলাম। শুধু বল আমাকে, কী চাও তুমি। একত্রে কাজ করতে হবে আমাদের।

আমি শুধু এন্টিম্যাটারটা পেতে চাই। আর জানতে চাই কে আমার বাবাকে খুন করল।

ভিট্টোরিয়া, এরমধ্যেই আমরা জানি কে তোমার বাবাকে খুন করেছে। আই এ্যাম স্যরি।

কী?

ব্যাপারটা জটিল—

আপনি আগে থেকেই জানেন কে আমার বাবাকে খুন করেছে?

একটা স্পষ্ট ধারণা আছে। খুনি চিহ্ন রেখে গেছে। এজনন্যই আমি মিস্টার ল্যাঙডনকে ডাকি। গ্রুপটা

গ্রুপ? টেররিস্ট গ্রুপ?

ভিট্টোরিয়া, তারা এক কোয়ার্টার গ্রাম এন্টিম্যাটার চুরি করেছে।

নতুন করে ভাবতে শুরু করল ভিট্টোরিয়া। তাকাল আমেরিকান লোকটার দিকে।

মিস্টার ল্যাঙডন, আমি জানতে চাই কে বাবাকে খুন করেছে। আর আপনার এজেন্সির সহায়তাও চাই।

আমার এজেন্সি?

আপনি ইউ এস ইন্টেলিজেন্সের সাথে যুক্ত, তাই না?

আসলে… না!

কোহলার নাক গলাল, মিস্টার ল্যাঙডন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর। আর্ট হিস্টোরির প্রফেসর।

একজন আর্ট টিচার?

তিনি কাল্ট সিম্বলজির বিশেষজ্ঞ। ভিট্টোরিয়া, আমরা মকেছি তোমার বাবা কোন শয়তানি সংঘের কারণে নিহত হয়েছেন।

শয়তানি সংঘ?

দায়িত্ব স্বীকার করা গ্রুপের নাম ইলুমিনেটি।

ইলুমিনেটি? দ্য ব্যাভারিয়ান ইলুমিনেটি?

তাদের কথা জানতে?

স্টিভ জ্যাকসনের কম্পিউটার গেম আছে এর উপর। ব্যাভারিয়ান ইলুমিনেটিঃ দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার। ইন্টারনেটে বেশিরভাগ লোক খেলে। কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারছি না…

ল্যাঙডনের দিকে একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কোহলার।

নড করল ল্যাঙডন, জনপ্রিয় গেম। প্রাচীণ ব্রাদারহুড পৃথিবীর দখল নিয়ে নেয়। আধা-ঐতিহাসিক। আমি জানতাম না এটা ইউরোপেও আছে।

কী বলছেন আপনি? দ্য ইলুমিনেটি? এ এক কম্পিউটার গেম।

ভিট্টোরিয়া, বলল কোহলার, তারাই তোমার বাবার হত্যার কথা স্বীকার করছে।

পুরো পরিস্থিতিটার উপর একবার নজর বুলিয়ে তীক্ষ্ণধীর ভিট্টোরিয়া বুঝে ফেলল, সে একেবারে একা। এগিয়ে যেতে নিল ভিট্টোরিয়া, থামাল তাকে কোহলার। তারপর একটা ফ্যাক্স বের করল পকেট থেকে।

তারা তাকে ব্র্যান্ডেড করেছে, বলল সে, ব্র্যান্ডেড করেছে বুকে।

২৮.

এখন একটা আতঙ্কে পড়ে গেছে সিলভিয়া বডেলক। তাকাল সে ডিরেক্টরের খালি অফিসে।

কোন নরকে গেল সে? কী করব এখন আমি?

আজকের দিনটাই গোলমেলে। অবশ্যই, কোহলারের সাথে যে কোন দিন গুজরান করা কষ্টকর। কিন্তু আজ তার মাথার টিকিটারও দেখা পাওয়া ভার।

আমাকে লিওনার্দো ট্রোর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দাও। বলেছিল সে আজ সকালে।

পেজ করল সিলভিয়া। ফোন করল, তারপর পাঠাল ই-মেইল।

লা জওয়াব।

তার পরই বেরিয়ে গেল সে। কয়েক ঘণ্টা পরে যখন ফিরে এল, একেবারে অসুস্থ দেখাচ্ছিল তাকে… তার পরই মডেমে ঢোকা। ফোন। ফ্যাক্স। কম্পিউটার ঘাঁটাঘাঁটি।

এরপর যখন বেরিয়ে গেল সে, এখনো ফিরেনি।

এটাকেও কোহলারের নাটকীয়তা বলে ধরে নিয়েছিল সে। কিন্তু যখন ফিরে এল না ইঞ্জেকশন নিতে, চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে পড়ল প্রাইভেট সেক্রেটারি। মাঝে মাঝে সিলভিয়ার মনে হয় ডিরেক্টরের মনে সুপ্ত আছে মরার চেষ্টা।

গত সপ্তাহে যখন ভিজিটিং বিজ্ঞানীর দল তার পায়ের কথা তুলে আফসোস করছিল তখন সে উঠে দাঁড়িয়ে একটা পেপার ক্লিপবোর্ড ছুড়ে মেরেছিল তাদের একজনের মাথা লক্ষ্য করে।

এখন ডিরেক্টরের স্বাস্থ্য বাদ দিয়ে অন্য চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মিনিট পাঁচেক আগে সার্নে একটা বিদেশি ফোন আসে।

তারপর অপারেটর বলল, কে কল করেছে।

আপনি ঠাট্টা করছেন, তাইতো? আর আপনার কলার আইডি বলছে যে–আচ্ছা, ঠিক আছে, আপনি কি জিজ্ঞেস করতে পারবেন কেন না ঠিক আছে। হোল্ড করতে বলুন। এখনি ডিরেক্টরের সাথে যোগাযোগ করছি। হু। বুঝলাম। আমি দ্রুত করব।

কিন্তু পেল না সিলভিয়া তাকে।

যে মোবাইল কাস্টমারকে চাচ্ছেন আপনি তিনি রেঞ্জের বাইরে।

রেঞ্জের বাইরে? কতদূর যেতে পারে সে?

এবার সে চেষ্টা করল বিপারে, দুবার। কোন জবাব নেই। নেই সাড়া ইমেইল করল মোবাইল কম্পিউটারে।

যেন লোকটা হাওয়া হয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে!

কী করব আমি?

একটা লম্বা শ্বাস নিল সে। শেষ চেষ্টা। কী ভাববে,ডিরের তী, আর ভয় অবকাশ নেই।

মাইক্রোফোনটা তুলে নিল সিলভিয়া।

২৯.

এক সময় বুঝতে পারল ভিট্টোরিয়া, তার বাবার কথা মনে পড়ছে। উঠে এসেছে তারা উপরের এলিভেটরে। কখন বলতে পারবে না।

পাপা!

মনে পড়ছে তার বাবার কথা। চট করে চলে গেল ভিট্টোরিয়া ন বছর বয়সে।

পাপা! পাপা!

কী, এ্যাঞ্জেল?

পাপা জিজ্ঞেস কর হোয়াট দ্য ম্যাটার?

কিন্তু তোমাকে খুশি খুশি দেখাচ্ছে, মিষ্টি মেয়ে! কেন তোমাকে জিঞ্জেস করব হোয়াট দ্য ম্যাটার?

জিজ্ঞেস কর না!

শ্রাগ করল ট্রো, হোয়াটস্ দ্য ম্যাটার?

এভরিথিং ইজ দ্য ম্যাটার। পাথর! গাছ! পরমাণু! সবই ম্যাটার।

হাসল লিওনার্দো, কথাটা কি নিজে নিজে বের করেছ?

স্মার্ট না?

আমার ছোট্ট আইনস্টাইন!

তার চুলের কোন ছিরি নেই। আমি ছবি দেখেছি।

কিন্তু তার মাথার শ্রী আছে। কী প্রমাণ করেছেন তিনি বলেছি না তোমাকে?

ড্যাড! না! তুমি প্রমিজ করেছিলে!

ই ইজ ইকুয়াল টু এম সি স্কয়ার! বলল লিওনার্দো হাসতে হাসতে, ই ইজ ইকুয়াল টু এম সি স্কয়ার!

কোন ম্যাথ নয়। আমি বলেছি না তোমাকে? ঘৃণা করি।

আমি খুশি হয়েছি যে তুমি অঙ্ক ঘৃণা কর। মেয়েদের অঙ্ক কষা নিষেধ।

আসলেই?

অবশ্যই। সবাই জানে। মেয়েরা পুতুলের সাথে খেলবে। ছেলেরা করবে গণিত। মেয়েদের জন্য অঙ্ক নয়। আমি ছোট মেয়েদের সাথে অঙ্ক নিয়ে কথা বলার অনুমতি পাইনি!

কেন! কিন্তু এতে অন্যায়!

নিয়ম নিয়মই। বাচ্চা মেয়েদের জন্য গণিত নয়।

কিন্তু পুতুল নিয়ে খেলা বিরক্তিকর।

স্যরি। আমি তোমার কাছে অঙ্কের অনেক মজার মজার খা বলতাম কি.. একবার যদি ধরা পড়ে যাই… তাকাল সে দুর্বলচিত্তে। চারপাশে।

ওকে! আমাকে আস্তে আস্তে বল!

***

এলিভেটরের দৃশ্য তাকে বাস্তবে টেনে আনল। চোখ খুলল ভিট্টোরিয়া। চলে গেছেন তিনি।

রাজ্যের চিন্তা এসে ভর করল তার মনের কুঠুরিতে।

কোথায় এন্টিম্যাটার?

কোত্থেকে যেন সুড়সুড় করে এগিয়ে এল একটা আতঙ্কের অনুভূতি।

৩০.

মাক্সিমিলিয়ান কোহলার, দয়া করে আপনার অফিসের সাথে যোগাযোগ করুন! মাথার উপর থেকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়ার আওয়াজ হাওয়াতে মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে চিৎকার জুড়ে দিল কোলারের সব যোগাযোগ যন্ত্র। তার পেজার। ফোন। ই-মেইল।

ডিরেক্টর কোহলার, দয়া করে অফিসের সাথে যোগাযোগ করুন!

তাকাল সে উপরে। এবং তারপর জমে গেল তারা সবাই।

হাতলের উপর থাকা সেলফোনটা তুলে নিল কোহলার।

দিস ইজ… ডিরেক্টর কোহলার। ইয়েস? আমি মাটির নিচে ছিলাম। কে? ইয়েস, পাখ ইট থ্রে। হ্যালো? দিস ইজ ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার। আমিই সানের ডিরেক্টর। কার সাথে কথা বলছি?

ভিট্টোরিয়া আর ল্যাঙডন তাকিয়ে আছে তার দিকে।

কাজটা ঠিক হবে না। বলল সে অবশেষে, ফোনে কথা বলাটা ঠিক হবে না। চলে আসছি দ্রুত। কাশছে আবার কোহলার, ক্যানিস্টারের লোকেশন বের করুন। দ্রুত। আসছি আমি। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এয়ারপোর্টে আমার সাথে দেখা করুন।

কথাটা বাজল দুজনের কানেই।

সব পরিষ্কার হয়ে এল ল্যাঙডনের সামনে। এম্বিগ্রাম, খুন হয়ে যাওয়া যাজক বিজ্ঞানী এবং এবার, টার্গেটটা…

পাঁচ কিলোটন! লেট দেয়ার বি লাইট।

দুজন প্যারামেডিক এগিয়ে এল। তুলে দিল অক্সিজেন মাস্ক কোহলারের মুখে।

মাস্কের মধ্যে মুখ দিয়ে বার দুয়েক দম নিয়ে তাকাল কোহলার তাদের দিকে। মুখোশটাকে সরিয়ে নিয়ে।

রোম!

রোম? দাবি করল ভিট্টোরিয়া, এন্টিম্যাটার রোমে চলে গেছে? কে ফোন করেছিল?

সুইস…

আর বলতে পারল না কোহলার। ঢলে পড়ল। সে প্রচন্ড অসুস্থ এবং সময় মত ইঞ্জেকশন নেয়নি।

নড করল ল্যাওড়ন। বুঝতে পারছে কী বলে ডিরেক্টর।

যান… মাস্কের নিচে খাবি খাচ্ছে ডিরেক্টর, যান… গিয়ে আমাকে কল করুন।

তাকাল ভিট্টোরিয়া, রোম? কিন্তু সুইস আবার কী?

সুইস গার্ড। বলল ল্যাঙডন, দ্য সুইস গার্ড। ভ্যাটিকান সিটির অতন্দ্র, বাহিনী।

০৪. এক্স থার্টি থ্রি
৩১.

এক্স থার্টি থ্রি আবার উঠে এল। রোমের আকাশে।

গত পনের মিনিট ধরে পরিস্থিতি ব্যাখ্য করে এসেছে ল্যাঙডন ভিট্টোরিয়ার কাছে।

কী করছি আমি? একই সাথে ভাবে সে, সুযোগ পাবার সাথে সাথে চাট্টিবাট্টি গোল করে আমার ঘরে ফিরে যাবার কথা।

কিন্তু একই সাথে টের পায় সে, কাজটা আদৌ সম্ভব নয়। অজান্তেই জড়িয়ে গেছে সে। বোস্টনে ফিরে যাবার চেষ্টা এখন পুরোদস্তুর স্বার্থপরতা। ইলুমিনেটির কাজের ধারা বোঝা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, পাশে বসা মেয়েটার সঙ্গ দরকার। এ পরিস্থিতিতেও দরকার তাকে।

আরো একটা ব্যাপার তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। ভ্যাটিকান সিটিতে এন্টিম্যাটারের উপস্থিতি শুধু মানুষের জন্য ক্ষতি বয়ে আনবে না। ধ্বংস করে দিবে পৃথিবীর মূল্যবান কিছু জিনিসকে।

আর্ট।

পৃথিবীর সবচে বড় আর্ট কালেকশন এখন এক বিধ্বংসী টাইম বোমার উপর বসে আছে। ভ্যাটিকান মিউজিয়ামে ষাট হাজারেরও বেশি শিল্পকর্ম আছে। আছে এক হাজার চারশো সাতটা রুমে।

মাইকেলেঞ্জেলো, দা ভিঞ্চি, বার্নিনি, বত্তিচেল্লি।

বারবার তার মনে একটা ব্যাপার ব্যাথা দিচ্ছে। প্রয়োজনে সবটাকে কি বের করে আনা সম্ভব? অসম্ভব।

তার উপর দেয়ালকর্মও কম নেই পুরো ভ্যাটিকান জুড়ে। সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা, সিস্টিন চ্যাপেল, মাইকেলেঞ্জেলোর ফ্রেম করা কাজ, মুসিয়ো ভ্যাটিকানো…

মানুষের সৃষ্টিশীলতার নিদর্শন। বহুমূল্য নয়, অমূল্য।

আসার জন্যে ধন্যবাদ। বলল ভিট্টোরিয়া।

দিবানিদ্রা ভেঙে গেল ল্যাঙডনের। তাকাল সে সুন্দর মেয়েটার দিকে। গভীরভাবে শ্বাস নিচ্ছে, আবেগ থামিয়ে রাখার চেষ্টা হিসাবে। মেয়ের ভালবাসা দেখা যাচ্ছে তার চোখে।

শর্টস বদলানোর কোন সুযোগ ছিল না ভিট্টোরিয়ার। এখনো পরে আছে স্লিভলেস টপ। শীতে কাঁপছে মেয়েটা।

সাথে সাথে জ্যাকেট খুলে এগিয়ে দিল ল্যাঙডন।

আমেরিকান ভদ্রতা? বলল কটাক্ষ করে ভিট্টোরিয়া, তার চোখে ধন্যবাদ।

ঝাঁকি খেল প্লেন, সাথে সাথে ল্যাঙডন কল্পনা করার চেষ্টা করল, কোন বদ্ধ কেবিনে নেই সে। আছে খোলা মাঠে।

যখন ব্যাপারটা ঘটে, সে ঠিকই খোলা মাঠে ছিল। তারপর অন্ধকার… প্রাচীণত্ব…

আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, মিস্টার ল্যাঙডন?

আমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি?

বেকায়দায় ফেলে দিল মেয়েটা প্রশ্ন করে।

বছরের পর বছর ধরে ধর্ম নিয়ে ইতিউতি কাজ করেও ল্যাঙডন কোন ধার্মিকে পরিণত হতে পারেনি।

আমি বিশ্বাস করতে চাই।

তাহলে, কেন নয়?

এবার হাসল ল্যাঙডন, মুচকে, আসলে ব্যাপারটা তত সরল নয়। বিশ্বাসের সাথে আরো বেশ কিছু ব্যাপার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মিরাকল, স্বর্গ, নরক, অদৃষ্টবাদ, ভাগ্য… বাইবেল, কোরান, বৌদ্ধ গ্রন্থগুলো… সবগুলোতেই একই কথা, একই সুর প্রতিভাত হয়। সবখানে বলা আছে, না মানলে আমার কপালে নরক যন্ত্রণা। এমনভাবে শাসন করা কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাসে আসে না আমার।

এমন নির্লজ্জভাবে নিশ্চই ছাত্রদেরও বলেন না আপনি?

কী?

মিস্টার ল্যাঙডন, আমি সাধারণ মানুষ ঈশ্বর বলতে যা বোঝায় সেটায় বিশ্বাসের কথা বলছি না। আপনি আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে অপার্থিবকে দেখতে পান কি? অনুভব করেন কি, তার সাথে আছেন আপনি?

অনেকক্ষণ ধরে বুঝল ব্যাপারটা ল্যাঙডন।

আমি সীমা ছাড়িয়ে গেছি। বলল ভিট্টোরিয়া।

না। আমি আসলে…

ক্লাসে নিশ্চই আপনি বিশ্বাস নিয়ে শোরগোল পাকান?

অশেষ।

আর আপনি সেখানে শয়তানের ঝান্ডা বহন করেন। যদ্দূর মনে হয়।

হাসল ল্যাঙডন, আপনিও নিশ্চই একজন শিক্ষক!

না। কিন্তু আমি একজন শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছি। মুক্ত মানুষ।

হাসল ল্যঙডন আবারো। একটা প্রশ্ন করতে পারি, মিস ভেট্রা?

ভিট্টোরিয়া ডাকুন আমাকে। মিসেস ট্রো বুড়ি বুড়ি শোনায়।

ভিট্টোরিয়া, আমি রবার্ট।

তোমার একটা প্রশ্ন ছিল।

হ্যাঁ। একজন সায়েন্টিস্ট আর প্রিস্টের কন্যা হিসাবে ধর্ম সম্পর্কে তোমার মনোভাব কী?

ধর্মটা ভাষা বা পোশাকের মত। মূল ব্যাপার হল, যেখান থেকে জন্মেছি, সেই জড়তেই ফিরে যাব আমরা। শুধু যিনি সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।

তুমি বলতে চাও যে খ্রিস্টান হও আর মুসলিম, কোথায় জন্মাচ্ছ তার উপর নির্ভর করছে?

এটাই কি হবার কথা নয়? পৃথিবীর দিতে তাকাও।

তারমানে বিশ্বাস একটা গড পড়তা ব্যাপার?

মোটামুটি। বিশ্বাস সার্বজনীন। আমাদের কেউ কেউ যিশুর কাছে প্রার্থনা করে, কেউ যায় মক্কায়, কেউ কেউ স্টাডি করে সাব এটমিক পার্টিকেল। সবশেষে দেখা যায় আমাদের সবাই একটা ব্যাপারের জন্য ঘুরে ফিরছি। বিশ্বাস। সত্য।

বিষম খেল ল্যাঙডন এত সুন্দরভাবে সে কেন নিজেকে উপস্থাপিত করতে পারল না?

আর ঈশ্বর? তুমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস কর?

বিজ্ঞান বলে ঈশ্বর অবশ্যই আছেন। আমার মন বলে আমি ঈশ্বরকে বুঝতে পারি। আর হৃদয় বলে, এসব ভাবার কথা নয়।

তার মানে তুমি বিশ্বাস কর ঈশ্বর বাস্তব, কিন্তু তাকে, সেই পুরুষকে, আমরা কখনো বুঝতে পারব না?

সেই মহিলাকে, হেসে বলল ভিট্টোরিয়া, তোমাদের নেটিভ আমেরিকানরা ভালই মনে করে।

মাদার আর্থ!

গায়া। পুরো গ্রহটা এক জ্যান্ত প্রাণী। আর আমরা সবাই আলাদা আলাদা কাজে লাগা কোষ। আর তার পরও, আমরা একে অপরের সাথে যুক্ত। সেবা করছি পুরোটার।

যে পরিশুদ্ধতা দেখতে পাচ্ছে ল্যাঙডন তা বলার নয়।

মিস্টার ল্যাঙডন, আরো একটা প্রশ্ন করতে দাও…

রবার্ট।

মিস্টার ল্যাঙডন বুড়োটে শোনায়। আমি বুড়ো।

যদি কিছু মনে না কর, রবার্ট, কী করে তুমি ইলুমিনেটির ব্যাপারে আকৃষ্ট হলে?

আসলে, টাকা।

টাকা? কনসাল্টিং?

না। টাকা। আমি প্রথম কাল্টটার ব্যাপারে উৎসুক হয়ে উঠি এ কথা জানতে পারার পর যে আমেরিকান ডলারে এই ভাতৃসঙ্রে প্রতীক আছে।

ঠাট্টা করছে নাতো লোকটা?

একটা এক ডলারের নোট বের করল ল্যাঙডন। পিছনে তাকাও। বামের গ্রেট সিলটা দেখতে পাচ্ছ? পিরামিডটা?

পিরামিড। তুমি কি জান, আমেরিকান ইতিহাসের সাথে শিরামিডের কী সম্পর্ক আছে?

শ্রাগ করল ভিট্টোরিয়া।

কোন সম্পর্ক নেই।

তাহলে আপনাদের গ্রেট সিলের কেন্দ্রে কেন এটা?।

এর সাথে ইলুমিনেটির সম্পর্ক আছে। পিরামিড চূড়ায় পৌঁছার প্রতীক। আর এর উপরের চিহ্নটা দেখতে পাচ্ছ কি?

একটা ত্রিকোণের ভিতরে রাখা চোখ।

এর নাম ট্রিক্রিয়া। আর কোথাও সেই ত্রিকোণাবৃত চোখ দেখেছ তুমি?

আসলে… হ্যাঁ। কিন্তু আমি মনে করতে পারছি না…

সারা দুনিয়ার মেসনিক প্রতীক এটা।

সিম্বলটা মেসনিক?

আসলে, না। এটা ইলুমিনেটির। একে তারা দৈব ডেল্টা নামে ডাকে। এই ত্রিকোণটা আলোময়তার প্রতিনিধিত্ব করছে। আর এই ত্রিকোণটা গ্লিক অক্ষর ডেল্টা যা প্রতিনিধিত্ব করে–

পরিবর্তনের।

হাসল ল্যাঙডন, ভুলেই গিয়েছিলাম, কথা বলছি একজন বিজ্ঞানীর সাথে।

জিজ্ঞাসা করল ভিট্টোরিয়া, তার মানে তুমি বলতে চাও যে যুক্তরাষ্ট্রের সিলটা আসলে সর্বব্যাপী আলোকিত করার আহ্বান?

একে কেউ কেউ নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার নামে অভিহিত করে।

পিরামিডের নিচে লেখা আছে… নোভাস অর্ডো…

নোভাস অর্ডো সেক্লোরাম। বলল ল্যাঙডন, এর মানে নূতন ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা।

ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা?

অধার্মিক। এতে ইলুমিনেটি অবজেকটিভ শুধু প্রকাশিত হয় না। একই সাথে এর ভিতরের লেখাটাকে সন্দেহে ফেলে দেয়।

ইন গড উই ট্রাস্ট?

ঠিক সেটাই।

কিন্তু এই সিম্বলজি কী করে পৃথিবীর সবচে প্রভাবশালী টাকার উপর অঙ্কিত হল?

ভাইস প্রেসিডেন্ট হেনরি ওয়ালেসের কারসাজি মনে করে বেশিরভাগ মানুষ। তিনি মেসনের উপরের ধাপের লোক ছিলেন। কোন সন্দেহ নেই, ইলুমিনেটির সাথেও ছিল তার দহরম মহরম। কীভাবে প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছেছিল তাও একটা রহস্য।

কী করে? কেন প্রেসিডেন্ট–

প্রেসিডেন্টের নাম ছিল ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। ওয়ালেস তাকে বলেছিলেন যে নোভাস অর্ডো সেক্লোরাম মানে নতুন কাজ।

আর রুজভেল্ট কাউকে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে বলেনি?

কোন প্রয়োজন নেই। সে আর ওয়ালেস যেন ভাই ভাই।

ভাই ভাই?

হিস্টোরির বই দেখ। ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট ছিল পুরোদস্তুর একজন মেসন।

৩২.

রোমের বাতাসে যখন শীষ কেটে নেমে আসছে এক্স থার্টি থ্রি, শ্বাস বন্ধ করল ল্যাঙডন। ক্র্যাফট নামল নিচে। ট্যাক্সিইং করে চলে গেল একটা প্রাইভেট হ্যাঙ্গারে।

ধীর ফ্লাইটের জন্য দুঃখিত। বলল পাইলট, জনপ্রিয় এলাকাগুলোর উপর দিয়ে আস্তে উড়ে যেতে হয়।

মাত্র তেত্রিশ মিনিট তারা আকাশে ছিল।

হাতের কাগজ সরাল পাইলট, কেউ কি আমাকে বলবে কী হচ্ছে এখানে?

কেউ জবাব দিল না। ফা

ইন। আমি ককপিটে মিউজিক নিয়ে বসে থাকব।

আকাশের দিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস নিল ভিট্টোরিয়া।

ঘামতে ঘামতে ভাবল ল্যাঙডন, মেডিটেরানিয়ান্স!

কার্টুনের তুলনায় একটু বেশি বয়স হয়ে গেছে, তাই না? জিজ্ঞেস করল ভিট্টেরিয়া।

মানে?

তোমার রিস্টওয়াচ। প্লেনে দেখেছিলাম।

কালেক্টরস এডিশন মিকি মাউসের ঘড়িটা সে পেয়েছিল ছেলেবেলায়। ঘড়িটা আর নষ্ট হয়নি। তারও গরজ হয়নি এটাকে ছেড়ে দেয়ার। ওয়াটারপ্রুফ, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। আর কী চাই!

ছটা বাজে। বলল ল্যাঙডন।

মাথা নাড়ল ভিট্টোরিয়া। বলল, আমাদের নিতে এসে পড়েছে।

ঠিকই, দূরে দেখা যাচ্চে হেলিকপ্টার। পাপাল হেলিকপ্টার। সাদা। ভ্যাটিকানের সিল লাগানো। তারা মনে করেছিল ভ্যাটিকান, একটা কার পাঠাবে।

তা নয়।

সোজা মাথার উপর একটু ভেসে থেকে, পাপাল ক্রাউনের সিল সহ নেমে এল চপার তাদের সামনে।

হোলি চপার!

ভাবল ল্যাঙডন।

পোপের যাতায়তের জন্য একটা চপার তাদের আছে, আগে জানত না ল্যাঙডন। থাকাই অস্বাভাবিক। একটা গাড়ি হলেই বরং ভাল লাগত তার।

এবার ধাক্কা খাবার পালা ভিট্টোরিয়ার, এই আমাদের পাইলট?

উদ্বেগটা শেয়ার করে নিল ল্যাঙডনও, উড়ব কি উড়ব না ভাবতে হবে এখনি।

যেন শেক্সপিয়রিয় নাটকের জন্য পোশাক পরেছে পাইলট। অত্যুজ্জ্বল নীল আর সোনালি দিয়ে স্ট্রাইপ করা তার পোশাক। তার সাথে আছে ম্যাট করা প্যান্টলুন। সবার উপরে, একটা কালো ফেল্ট ব্যারেট লাগিয়েছে সে মাথায়।

সুইস গার্ডের ঐতিহ্যবাহী পোশাক, বলল ল্যাঙডন। ডিজাইন করেছিলেন স্বয়ং মাইকেলেঞ্জেলো। আমি মনে করি এটা মাইকেলেঞ্জেলোর কীর্তিগুলোর মধ্যে জায়গা পাবার যোগ্যতা রাখে না।

ইউ এস মেরিনের মত চালে এবং কায়দায় এগিয়ে আসছে সুইস গার্ড পাইলট। এলিট সুইস গার্ড হবার জন্য যে কষ্টকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেটার কথা অনেকবার পড়েছে ল্যাঙউন। সুইজারল্যান্ডের চার ক্যাথলিক ক্যান্টনের কাছে সুইস গার্ড হবার জন্য প্রার্থীকে অবশ্যই উনিশ থেকে ত্রিশ বছর বয়সী পুরুষ হতে হবে। কমপক্ষে পাঁচফুট ছ ইঞ্চি। সুইস আর্মির সবচে সাবধানী পরীক্ষায় উতরে যেতে হবে। নিতে হবে কঠিন প্রশিক্ষণ। সারা দুনিয়ার তাবৎ এলিট বাহিনী এই দলটাকে হিংসা করে।

আপনারা সার্ন থেকে এসেছেন? পাথুরে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল গার্ড।

ইয়েস। স্যার। বলল ল্যাঙডন।

আপনারা অনেক আগে চলে এসেছেন, এক্স থার্টি থ্রির দিকে ভাবলেশহীন চোখে তাকাল সে। যেন এমন যান সব সময় দেখে আসছে।

ম্যাম, আপনার আর কোন বস্ত্র নেই?

বেগ ইউর পারডন?

ভ্যাটিকান সিটির ভিতরে শর্ট প্যান্ট অনুমোদিত নয়।

এই আছে আমার। আমরা সময় পাইনি পোশাক বদলে নেয়ার।

আপনারা কোন অস্ত্র বহন করছেন কি?

অস্ত্র? বিষম খেল ল্যাঙডন। এই একটা জিনিস সে মোটেও পছন্দ করে না।

না।

এগিয়ে এল অফিসার। নির্লিপ্ত তার চোখ। পা থেকে শুরু করল সার্চ। মোজা, প্যান্ট, কুঁচকি, পেট, বুক, পিঠ, কাঁধ।

ফিরল সে ভিট্টোরিয়ার দিকে।

একথা কল্পনাও করবেন না। বলল সে।

তাকিয়ে থাকল গার্ড। তার কোন ইচ্ছা নেই এ মহিলাকে সার্চ করার।

তাক করল আঙুল ভিট্টোরিয়ার প্যান্টের পকেটে। কী ওটা?

সেলফোন।

বের করতে হল জিনিসটাকে। তারপর দেখা হলে আবার পাথুরে কষ্ঠ বলে উঠল, ঘুরে দাঁড়ান, প্লিজ।

গার্ড তারপর ভাল করে দেখল।

থ্যাঙ্ক ইউ। এপথে, প্লিজ!

প্রথমে উঠল ভিট্টোরিয়া। ল্যাঙডনের দেরি হয় একটু।

একটা গাড়ি পাবার কোন সুযোগ নেই? হাঁকল ল্যাঙডন জোরেসোরে।

জবাব দেয় না পাইলট।

রোমের ম্যানিয়াকরা যেভাবে পথে পথে গাড়ি হাঁকায় তাতে আকাশপথে ভ্রমণ করা অনেক ভাল মনে করে ল্যাঙডন উঠে বসল চপারে।

আপনারা কি ক্যানিস্টারটাকে চিহ্নিত করেছেন?

কী চিহ্নিত করব?

ক্যানিস্টার। আপনারা সার্নকে একটা ক্যানিস্টারের জন্য কল করেছেন না?

জানি না কী বলছেন আপনি। আজকে আমরা মহাব্যস্ত। কমান্ডার আপনাদের তুলে আনতে বলেছে। হুকুম তামিল করছি আমি। ব্যস।

একটু বীতশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল ভিট্টোরিয়া ল্যাঙডনের দিকে।

বাকল আপ প্লিজ। বলল পাইলট।

নিচে রোম। মোহময়ী নোম। রোম ইজ নট বিল্ড ইন এ ডে। একদিনে রোম তৈরি হয়নি। কত উত্থান, কত পতন! আধুনিক যে সভ্যতা বয়ে চলেছে সারা দুনিয়ায়, তার সূতিকাগার এই রোম। এককালে সিজার এখানে দাপড়ে বেরিয়েছে। এখানেই যিশুর বড় সহচর সেন্ট পিটারকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। আর এর গভীরে, একটা বোমা টিকটিক করছে।

৩৩.

আকাশ থেকে রোম দেখতে একেবারে অকল্পনীয় গোলকধাঁধা। পুরনো রোমের গলি ঘুপচি, ছোটবড় বিল্ডিং, সব উপর থেকে বিচিত্র দেখা যায়।

নিচে তাকিয়ে আছে ল্যাংডন, চপারটা নিচু হয়ে উড়ে যাবার সময়। সেখানে সাইটসিয়িং এরিয়া, বড় বড় চত্বর, তাতে প্রাচীণ রোমান দেবদেবীর মূর্তি, খ্রিস্টবাদের কীর্তি, ভিড়, ফিয়াট-সেডানের চারদিকে ছুটে চলা।

সাম্য থেকে জীবন।

কিছু বলল না ভিট্টোরিয়া।

জোরে ঝাঁকি খেল উড়ন্ত ঘাসফড়িঙটা।

সামনে দেখা যাচ্ছে রোমান কলোসিয়াম। দ্য কলোসিয়াম। যেটা মানব ইতিহাসের সবচে বড় একটা নিদর্শন বলা চলে। মানব সভ্যতার দোলনা এই এলাকা, আর এর কেন্দ্রবিন্দু এ স্টেডিয়াম! কিন্তু এখানে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে মানুষ কুর আর অসভ্য কাজগুলো করেছে। হয়েছে বীভৎসভাবে মানুষ খুন।

উত্তরের পথ ধরার পর তারা রোমান ফোরাম দেখতে পেল। খ্রিস্টপূর্ব রোমের প্রাণকেন্দ্র। ক্ষয়ে যেতে থাকা কলামগুলো পুরনোদিনের ঐতিহ্যকে সগর্বে প্রকাশ করে।

পশ্চিমে টাইবার নদীর চওড়া বেসিন দেখা যায়। দেখা যায় তার কাকচক্ষু পানি। বুঝতে পারে ল্যাঙডন, এর গভীরতা ভয় দেখিয়ে দেয়ার মত।

সরাসরি সামনে। চপার নিয়ে উঠে আসতে আসতে বলল পাইলট।

সাথে সাথে তাকাল ভিট্টোরিয়া আর ল্যাঙডন। মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়া পর্বতের মত হঠাৎ করে উদিত হল সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার শ্বেত শুভ্র, অনিন্দ্যসুন্দর, কাপন তোলা, ঐতিহাসিক গম্বুজ। এখানে, ইতিহাস ঝলসে ওঠে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতকে আকড়ে ধরে।

এখন, সেটা, বলল ল্যাঙডন ভিট্টোরিয়ার দিকে ফিরে, হল এমন এক কাজ, যার জন্য মাইকেলেঞ্জেলোকে স্মরণ করা যায়।

সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকাকে আকাশ থেকে কখনো দেখেনি ল্যাঙডন। বিকালের পড়ন্ত আলোয় ঝলসে উঠছে তার গা। দুটা ফুটবল মাঠের মত চওড়া এবং ছটার মত লম্বা এই বিশাল ভবনে একশো চল্লিশজন প্রেরিতপুরুষ, এ্যাঞ্জেল, শহীদের মূর্তি আছে। আছে ষাট হাজারেরও অধিক প্রার্থনাকারীর জন্য স্থান। ভ্যাটিকান সিটির মোট জনসংখ্যার একশো গুণ।

এগিয়ে আসছে ভ্যাটিকান সিটি, পৃথিবীর সবচে ছোট রাষ্ট্র।

সামনে আছে সেন্ট পিটার্স স্কয়ার। ব্যাসিলিকার চেয়েও বড় এলাকা। ভোলা। সেখানে, বিশালত্বের মধ্যে শতাধিক উঁচু স্তম্ভ এক অনির্বচনীয় উচ্চতার অনুভূতি এনে, দেয়।

এখন যদি মাথা নিচের দিকে আর পা উপরের দিকে দিয়ে ক্রুশবিদ্ধ করে মারা সেন্ট পিটার এই বিশালত্ব দেখতে পেতেন, কী ভাবতেন তিনি? এই ডোমের ঠিক নিচে, এই জায়গাতেই, ভ্যাটিকান হিলে, তিনি ক্রুশবিদ্ধ হন। আর এখানেই, মাটির পাঁচতলা নিচে, পৃথিবীর সবচে জটিল আর রহস্যময়, গোপনীয় গোলকধাঁধায় ভরা কবরখানায় তার সমাধি রয়ে গেছে।

ভ্যাটিকান সিটি। খুব একটা উষ্ণতা ঝরল না পাইলটের কণ্ঠে।

ক্ষমতা আর রহস্যে আবৃত এক প্রাচীণ নগরী দেখতে দেখতে বিভোর ল্যাঙডন।

দেখ! বলল ভিট্টোরিয়া।

তাকাল ল্যাঙডন নিচে।

এদিকে! বলল মেয়েটা।

তাকাল ল্যাঙডন। কিন্তু বুঝে উঠতে পারল না। সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের একপালে, ছায়াতে অনেকগুলো ভ্যান। সম্ভবত মিডিয়াভ্যান। ছাদে তাদের লেখা:

টেলিভিজর ইউরোপিয়া
ভিডিও ইতালিয়া
বিবিসি
ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল

সাথে সাথে বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল ল্যাভন। এখনি খবরটা চাউর করে দিয়ে ভাল করল কি ভ্যাটিকান?

প্রেস এখানে কেন? কী হচ্ছে?

কী হচ্ছে? আপনারা জানেন না কী হচ্ছে?

না।

এল কনক্লেভ। এক ঘণ্টার মধ্যে সারা দুনিয়া দেখবে, বন্ধ হয়ে যারে কনক্লেডের দুয়ার।

***

এল কনক্লেভ

কথাটা অনেকক্ষণ ল্যাঙডনের পেটের ভিতর পাক খেল।

এল কনক্লেভ! দ্য ভ্যাটিকান কনক্লেভ।

কীভাবে সে ভুলে গেল? এতো সাম্প্রতিক ঘটনা।

পনের দিন আগে, পোপ, অসম্ভব জনপ্রিয়তার বারো বছর কাটিয়ে, মারা গেছেন। এক রাতে, হঠাৎ করে ঘুমের মধ্যেই প্রচন্ড স্ট্রোকে তিনি মারা যান। ব্যাপারটাকে কেউ কেউ সন্দেহের চোখেও দেখে। সারা পৃথিবীর সংবাদপত্রে সেদিন একই হেডলাইন এসেছিল।

এখন ঐতিহ্য অনুযায়ী, পোপের মৃত্যুর পনেরদিন পরে, ভ্যাটিকান সিটিতে এল কনক্লেভ বসছে। সারা পৃথিবীর একশো পয়ষট্টিজন কার্ডিনাল গোপন সভায় বসবেন। তাবৎ দুনিয়ার খ্রিস্টবাদের লোকগুলো তাদের গোপন শলা পরামর্শ আর ভোটাভুটির পর নির্বাচিত করবেন নতুন পোপ।

এখন এখানে সারা পৃথিবীর সব কার্ডিনাল আছেন… ভাবল ল্যাঙডন; আর তারা বেরুতে পারবেন না নতুন পোপ নির্বাচিত করার আগে। বাইরে থেকে তাদের তালা দিয়ে দেয়া হবে। পুরো রোমান ক্যাথলিক চার্চ, শুধু ভ্যাটিকান সিটি নয়, বসে আছে একটা টাইম বোমার উপর।

৩৪.

কার্ডিনাল মাটি সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদের দিতে তাকিয়ে আছে। চারদিক থেকে আসা কার্ডিনালদের গুঞ্জনে ভরে আছে ভিতরটা। কথা বলছেন তারা ইংরেজিতে, ইতালিয়ানে, স্প্যানিশে।

তাকাল মর্টাটি ছাদের দিকে। সেখানে মাইকেলেঞ্জেলোর ফ্রেস্কো শোভা পাচ্ছে।

সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরে স্বর্গীয় আবহে আসে আলো। যেন স্বর্গ থেকেই আসে পাটে বসতে যাওয়া সূর্যের বাঁকা রশ্মি। সিস্টিনের উঁচু ঘরের কাচঘেরা ছিদ্রগুলো দিয়ে।

কিন্তু আজ তেমন কিছু হচ্ছে না।

নিয়মানুযায়ী, কার্লো ভেলভেট দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে সব জানালা। কেউ যেন। বাইরে থেকে ভিতরে উঁকি দিতে না পারে। যেন ভিতর থেকেও বাইরে তাকাতে না পারে।

আলো আসছে ভিতর থেকেই। মোমের নরম আলো।

আশি বছরের বেশি বয়সী কার্ডিনালরা এখানে আসতে পারেন না তাদের বার্ধক্যের সীমার জন্য। এখানটায় মর্টাটিই সবচে প্রবীণ। উনআশি বছর বয়স তার।

সন্ধ্যা সাতটার আলাপচরিতা শেষ করে কনক্লেভের দু ঘণ্টা আগেই এখানে হাজির হয় কার্ডিনালরা।

মৃত পোপের চ্যাম্বারলেইন এখানে আসবে। প্রার্থনা করবে। উদ্বোধিত হবে কনক্লেভ। তারপর সারা চ্যাপেলের সব দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিবে সুইস গার্ড। প্রহরায় থাকবে। কার্ডিনালরা একটা সিদ্ধান্তে আসার আগ পর্যন্ত এখানেই থাকবে। সবাই।

কনক্লেভ আসলে এসেছে কন ক্লেভ থেকে। এর অর্থ চাবির ভিতরে আটকানো। ফোনকল আসতে পারবে না। পারবে না মেসেজ আসতে। দরজায় দাড়িয়ে কেউ। ফিসফিস করতে পারবে না। তাদের চোখের সামনে থাকবেন কেবল মহান স্রষ্টা।

সারা দুনিয়ার একশো কোটিরও বেশি রোমান ক্যাথলিকের নেতা নির্বাচিত হবেন একেবারে গোপনীয়তায়। এই দেয়ালের ভিতরের কাহিনী সব সময় মহিমান্বিত হয় না। কখনো কখনো বচসা বেঁধে যায়। এমনকি হত্যাকান্ডও ঘটে এখানে।

এসবই পুরনোদিনের কাহিনী। এ কনক্লেভ হবে শান্ত, আশীর্বাদপ্রাপ্ত, নির্বিঘ্ন। অনেককাল ধরে এমনটাই হয়ে আসছে।

এখনো একটা চিন্তা পীড়া দিচ্ছেন কার্ডিনাল মর্টাটিকে। চারজন কার্ডিনাল এখানে গড হাজির। কিন্তু আর এক ঘণ্টাও নেই শুরু হতে। তারা এসে পড়বে। হয়ত কোন কাজে আটকে পড়েছে। বাইরে যাবার উপায় নেই। ভ্যাটিকান সুরক্ষিত।

তাদের ছাড়া কনক্লেভ হতেও পারবে না। তারা সেই কার্ডিনাল। দ্য চুজেন ফোর।

কার্ডিনালদের অনুপস্থিতির কথা মর্টাটি পৌঁছে দিয়েছেন সুইস গার্ডের কাছে। এরই মধ্যে একটু কানাকানি শোনা যাচ্ছে। অস্থির হয়ে পড়ছে কার্ডিনালরা। তাদের ছাড়া কনক্লেভ শুরুও হবে না। আবার দেরিও করা যাবে না।

কী করবে বুঝতে পারছে না মাটি।

৩৫.

ভ্যাটিকানের হেলিপ্যাড।

টেরা ফার্মা। বলল পাইলট।

ল্যাঙডন নেমে এল। নেমে এল ভিট্টোরিয়া।

বিশালাকায় এক কার্ট আছে হেলিপ্যাডের পাশে। আর তার পাশেই এক পঞ্চাশ ফুট উঁচু, ট্যাঙ্কের আঘাত সয়ে যাবার মত শক্ত দেয়াল। এটাই ঘিরে রেখেছে ভ্যাটিকানকে।

পঞ্চাশ মিটার দূরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে একজন করে সুইস গার্ড। একেবারে সাবধান। এ্যাটেনশন ভঙ্গিতে।

কার্ট চলতে শুরু করল।

চারপাশে নানা দিক নির্দেশক।

পালাজ্জো গভরেন্টারাটো
কলেজ্জো ইথিওপিয়ানা
ব্যালিসিকা স্যান পিয়েত্রো
চ্যাপেলা সিস্টিনা

রেডিও ভ্যাটিকানা লেখা ভবনের পাশ দিয়ে তাদের গতি বেড়ে গেল। এখানেই পৃথিবীতে সবচে বেশি শোনা রেডিও স্টেশনটা। রেডিও ভ্যাটিকানা।

এ্যাটেঞ্জিয়োনে বলে একটা তীক্ষ্ণ বাক নিল তাদের পাইলট। গাড়িটা চলে এল জিয়ার্দিনি ভ্যাটিকানিতে। ভ্যাটিকান সিটির হৃদপিন্ড। সোজা সামনে উদিত হল সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার পশ্চাৎপট। এ দৃশ্য সাধারণ মানুষ দেখতে পায় না। বামে আছে প্যালেস অব দ্য ট্রিবুনাল। আছে বিশালবপু গভর্নমেন্ট বিল্ডিং। সামনে আছে ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের চারকোণা অবয়ব। এ যাত্রা মিউজিয়ামে যে যাওয়া যাবে না তা ল্যাঙডন ভাল করেই জানে।

কোথায় সবাই? অবশেষে জিজ্ঞেস করল ভিট্টোরিয়া।

একটা মিলিটারি সুলভ দৃষ্টি হানল পাইলট। বিরক্ত।

কার্ডিনালদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে সিস্টিন চ্যাপেলে। এক ঘণ্টাও বাকি নেই কনক্লেভের।

তার আগে কার্ডিনালরা তাদের পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করে। মেতে ওঠে আড়ায়। মত বিনিময় করে।

কিন্তু রেসিডেন্টরা?

নিরাপত্তার জন্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কনক্লেভ শেষ হলে তারা ফিরবে।

কখন শেষ হবে?

একমাত্র ঈশ্বর জানেন।

সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ঠিক পিছনে থামল কার্ট। ত্রিকোণ একটা কান্ট্রিইয়ার্ড পেরিয়ে তারা এগিয়ে গেল। ভায়া বেলভেড্রে পেরিয়ে ঘন সন্নিবিষ্ট ইমারতগুলোর কাছে গেল তারা। এখানেই আছে ভ্যাটিকান প্রিন্টিং অফিস, ট্যাপেস্ট্রি স্টোরেশন ল্যাব, পোস্ট অফিস, চার্চ অব সেন্ট এ্যান।

তারা আরো একটা মোড় ঘুরল। তারপর হাজির হল গন্তব্যে।

সুইস গার্ডের অফিসের সামনে।

পাথুরে ভবনটার সামনে পাথুরে মুখ করে পাথুরে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে দুজন গার্ড।

কোনক্রমে নিজেকে বোঝাল ল্যাঙডন, তাদের হাস্যকর দেখাচ্ছে না। হাতে তাদের ঐতিহ্যবাহী লঙ সোর্ড। যে বর্শা দিয়ে অনেক অনেক মুসলিম ধর্মযোদ্ধার প্রাণনাশ করা হয়েছিল ক্রুসেডের সময়।

কোথায় যাবেন?

কমান্ডান্টের মেহমান।

সরে দাঁড়াল গার্ডরা। থেমে গেল পাইলট সেখানেই।

ভিতরের বাতাস শিতল। এটা দেখতে কোন বাহিনীর অফিসের মত নয়। ভিতরে অনেক অনেক পেইন্টিং শোভা পাচ্ছে। দেয়ালে দেয়ালে। যে কোন মিউজিয়াম এগুলোকে পেলে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাবে।

নেমে গেল তারা নিচে।

সামনে অনেক অনেক মূর্তি। পাথরে কুঁদে দেয়া। অথবা শুধু পাথুরে। সব মূর্তির লজ্জাস্থান একটা করে পাতায় মোড়া। পাতাগুলো একই রঙের হলেও বোঝা যায়, কৃত্রিম।

আঠারোশ সাতান্নতে পোপ পিউস নাইন সিদ্ধান্ত নেন, ভ্যাটিকানের মত পবিত্র জায়গায় কোন নগ্ন দেহ থাকবে না। দেখা যাবে না যৌনাঙ্গ। সুতরাং, ভেঙে ফেলা হল হাজার মূর্তির লিঙ্গ।সরিয়ে দেয়া হল চোখের সামনে থেকে। তারপর একই রঙের পাতা দিয়ে ঢেকে দেয়া হল।

এ ভ্যাটিকানের কোন না কোন কোণায় লিঙ্গের একটা স্তুপ পাওয়া যাবে। জানে ল্যাঙডন।

মাইকেলেঞ্জেলো, ব্রামান্তে আর বার্নিনির মত যুগশ্রেষ্ঠ, সর্বকালের মেধাবী শিল্পীর কর্ম নষ্ট হয়ে যায়।

এখানে। বলল সাথে আসা গার্ড।

একটা কোড ঢোকায় গার্ড। তারপর খুলে যায় সামনের লোহার দরজা।

ভিতরে পুরো অন্য জগত।

৩৬.

সুইস গার্ডের অফিস।

এখানে প্রাচীণত্ব আর নূতনত্ব একত্র হয়ে গেছে। শেলফ ভর্তি বই, ওরিয়েন্টাল কার্পেট, দেয়ালচিত্র, হাইটেক গিয়ার, কম্পিউটার, টেলিভিশন সেট, আছে সবই।

এখানে অপেক্ষা করুন। বলল গার্ড।

গভীর নীল সামরিক ইউনিফর্ম পরা একজন অনেক লম্বা লোকের দেখা পেল তারা ভিতরে। সেলফোনে কথা বলতে বলতে দাঁড়িয়ে আছে। পিছনে ফিরে।

এগিয়ে গেল গার্ড। বলল কিছু। ফিরল লোকটা। তারপর একটা নড় করেই আবার ফিরে গেল আগের অবস্থানে। কথায়।

এক মিনিটের মধ্যেই কমান্ডার ওলিভেট্টি আপনাদের সাথে যোগ দিচ্ছেন। থ্যাঙ্ক ইউ। ফিরে গেল গার্ড তার আগের জায়গায়। সিঁড়ির ধাপে।

সারা ঘরে একটা সাজ সাজ রব। ইউনিফর্ম পরা লোকজন চিৎকার করে আদেশ দিচ্ছে। কাজ চলছে কম্পিউটারে।

লক্ষ্য করল ল্যাঙডন কমান্ডার ওলিভেটিকে। এ লোক একটা দেশের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ।

কথা চলছে সারা ঘরে।

কন্টিনিউয়া এ সার্চে!

হা প্রোভোতে হাল মিউসো?

খুব বেশি ইতালিয় জানতে হয় না, এখান থেকে যে একটা সার্চ চালানো হচ্ছে তা বোঝার জন্য। বুঝল ল্যাঙডন। একটু তৃপ্ত হল সে।

তুমি ঠিক আছতো? জিজ্ঞাসা করল সে ভিট্টোরিয়াকে।

শ্রাগ করল ভিট্টোরিয়া। চেষ্টা করল একটা কষ্টার্জিত হাসি দেয়ার।

এগিয়ে আসছে কমান্ডার ওলিভেট্টি ফোনকল শেষ করে। প্রতি ধাপে তাকে আরো আরো উঁচু মনে হয়। চেহারা তার কঠিন। চোয়াল শক্ত। বছরের পর বছর ধরে সামরিক কায়দায় চলতে চলতে এ হাল হয় লোকের।

চমৎকার ইংরেজিতে তাদের সম্ভাষণ জানাল কমান্ডার।

গুড আফটারনুন। আমি কমান্ডার ওলিভেট্টি-সুইস গার্ডের কমান্ডান্টে প্রিন্সিপালে। আপনাদের ডিরেক্টরকে আমিই ফোন করেছিলাম।

ভিট্টোরিয়া ধন্যবাদ জানাল, থ্যাঙ্ক ইউ ফর সিয়িং আস, স্যার।

এগিয়ে গেল সে তাদের সঙ্গে নিয়ে। একটা কাচের দরজার গায়ে ঠেস দিয়ে বলল, ঢুকুন।

একটা অন্ধকার রুমে প্রবেশ করল তারা যেখানে সাদাকালো ক্যামেরায় সারা ভ্যাটিকানের চারদিক দেখা যাচ্ছে। অনেক স্ক্রিন।

ফিউরি! বলল কমান্ডার গার্ডের দিকে তাকিয়ে।

গার্ড গুছিয়ে নিয়ে উঠে গেল।

এ ছবিটা, দেখাল সে একটা চিত্র, ভ্যাটিকানের কোন এক গোপন ক্যামেরা থেকে আসছে। রিমোট ক্যামেরা থেকে। আমি একটা ব্যাখ্যা চাই।

কোন সন্দেহ নেই সার্নের ক্যানিস্টার। এর লেড দেখাচ্ছে কাউন্ট ডাউন। সার্ন লেখা ক্যানিস্টারটার গায়ে। আর স্ক্রিনে লেখা: লাইভ ফিড-ক্যামেরা নাম্বার ছিয়াশি।

তাকাল ভিট্টোরিয়া ক্যামেরার দিকে, ছ ঘণ্টাও নেই!

হিসাব কষল ল্যাঙডন, তার মানে আমাদের হাতে সময় আছে–

মাঝরাত পর্যন্ত।

ওলিভেট্টির কথা ফুটল, এ ক্যানিস্টার কি আপনাদের ফ্যাসিলিটির?

নড করল ভিট্টোরিয়া, অস্থির হয়ে আছে সে, হ্যাঁ। চুরি গেছে। এর ভিতরে এক অত্যন্ত বিস্ফোরণোন্মুখ পদার্থ আছে। নাম প্রতিবস্তু।

আমি বিস্ফোরকের ব্যাপারে ভাল করেই জানি, মিস স্ট্রো, কখনো এন্টিম্যাটারের নাম শুনিনি।

টেকনোলজিটা নূতন। এটাকে তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করে ভ্যাটিকান সিটিকে খালি করতে হবে আমাদের। যত দ্রুত সম্ভব।

খালি করা? আপনার কি কোন ধারণা আছে আজ রাতে কী হচ্ছে এখানে?

ইয়েস, স্যার। আর আপনাদের কার্ডিনালরা প্রচন্ড হুমকির মুখে বাস করছে।

হাতে ছ ঘণ্টা সময়ও নেই। ক্যানিস্টারের লোকেশনের জন্য কোন কিছু কি করেছেন। আপনি?

খোঁজা শুরু করিনি।

কী? আমরা তো শুনলাম আপনার গার্ডরা সার্চ করছে—

সার্চ করছে, সত্যি। আপনাদের ক্যানিস্টারের জন্য নয়। আমরা অন্য কিছুর খোঁজ করছি। আপনার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।

আপনারা এখনো ক্যানিস্টারের খোঁজ শুরু করেননি!

অনেক ভাল ব্যবহার করেছে ওলিভেট্টি, তাই নাকি, মিস ভেট্রা? একটা ব্যাপার ব্যাখ্যা করতে দিন। আপনাদের ডিরেক্টর ফোনে কোন কথা বলেননি। শুধু বলেছেন যে এটাকে খুঁজে বের করতে হবে খুব দ্রুত। আর আমরা ব্যস্ত। আপনাদের সাথে ভালমত কথা না বলে কাজে নামিয়ে দিতে পারি না, সেই বিলাসের সুযোগ নেই আমার কাছে।

হাতে ছ ঘণ্টাও সময় নেই। এ ক্যানিস্টারটা পুরো কমপ্লেক্স বাষ্পের মত উবিয়ে দিবে।

মিস ভেট্রা, আপনাকে জানানোর মত কিছু ব্যাপার আছে। ভ্যাটিকান সিটিতে, প্রতিটা প্রবেশপথে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে, প্রত্যেককে চেক করে ঢোকানো হয়েছে। যে কোন বিস্ফোরককে আমরা মুহূর্তে চিনে ফেলব। রেডিও এ্যাকটিভ আইসোটোপ স্ক্যানার আছে, অলফ্যাক্টরি ফিল্টার আছে, কেমিক্যালের বিন্দুমাত্র ছোয়া বুঝে ফেলার যন্ত্র আছে, আছে সর্বাধুনিক মেটাল ডিটেক্টর, আছে এক্স রে স্ক্যানার।

খুব ভাল। কিন্তু দুর্ভাগ্য বলতে হয়, প্রতিবস্তুর তেজস্ক্রিয়তা নেই, নেই কেমিক্যাল পরিচয়, ভিতরে যা আছে তা খাঁটি হাইড্রোজেনের প্রতিনিধিত্ব করে। উল্টো। ক্যানিস্টারটা প্লাস্টিকের। আপনার কোন ডিভাইস সেটাকে ধরতে পারবে না।

কিন্তু ডিভাইসের একটা এনার্জি সোর্স আছে। নিকেল-ক্যাডমিয়ামের ক্ষীণতর চিহ্ন–

ব্যাটারিগুলোও প্লাস্টিকের।

প্লাস্টিক ব্যাটারি?

পলিমার জেল ইলেক্ট্রোলাইট উইথ টেফলন।

সিনা, ভ্যাটিকান প্রতি মাসে কয়েক ডজন বোমা হামলার হুমকি পায়। ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রত্যেক সুইস গার্ডকে অত্যাধুনিক বিস্ফোরকের ব্যাপারে ট্রেনিং দিই। আমি ভাল করেই জানি যে পৃথিবীতে এমন কোন পাওয়ার নেই যা আপনি বলছেন তা করার মত। যে পর্যন্ত না একটা বেসবলের সমান ওয়্যারহেড সহ নিউক্লিয়ার বোম্ব থাকছে।

প্রকৃতির এখনো অনেক অজানা রহস্য রয়ে গেছে।

আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি আপনি সার্নে কোন পজিশনে আছেন?

আমি রিসার্চ স্টাফের একজন সিনিয়র মেম্বার। এবং ভ্যাটিকানে এই ক্রাইসিস মোকাবিলা করার জন্য পাঠানো প্রতিনিধি।

কঠিন হওয়ায় আমাকে ক্ষমা করবেন। যদি সত্যি সত্যি এটা ক্রাইসিস হয়, আমি কেন আপনার ডিরেক্টরের সাথে কথা বলছি না? আর আপনি কী করে ভ্যাটিকান সিটিতে একটা শর্ট প্যান্ট পরে আসার মত ধৃষ্টতা দেখান?

কমান্ডার ওলিভেট্টি, আমি রবার্ট ল্যাঙডন। আমি আমেরিকার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিলিজিয়াস স্টাডির অধ্যাপক। আমি এন্টিম্যাটার এক্সপ্লোশন দেখেছি। এবং মিস ট্রো যা বলছেন তা যে সত্যি তা দাবি করছি। আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট–কারণ আছে যে বোমাটা কোন এক গুপ্ত সংস্থা ভ্যাটিকানকে গুড়িয়ে দেয়ার জন্য কনক্লেভের সময়ে এখানে স্থাপন করেছে।

আমার সামনে শর্ট প্যান্ট পরা এক মহিলা বলছেন যে এক ফোঁটা বস্তু পুরো ভ্যাটিকান সিটিকে উড়িয়ে দিবে। আর একজন আমেরিকান প্রফেসরকে পেয়েছি যিনি বলছেন যে কোন এক ধর্মদ্বেষী সংস্থা ভ্যাটিকানকে শেষ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে।

ক্যানিস্টারটা খুঁজে বের করুন। বলল ভিট্টোরিয়া, ধৈর্য হারিয়ে, এখুনি।

অসম্ভব! জিনিসটা যে কোন জায়গায় থাকতে পারে। ভ্যাটিকান সিটি কোন খুপরি নয়।

আপনাদের ক্যামেরায় জিপিএস লোকেটর নেই?

সাধারণত তারা চুরি যায় না। এই হারানো ক্যামেরা খুঁজে বের করতে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যাবে।

আমাদের হাতে দিনের হিসাবে সময় নেই। বলছে ভিট্টোরিয়া, হাতে আছে কয়েক ঘণ্টা।

কী হতে কয়েক ঘণ্টা, মিস ট্রো? উচ্চ থেকে উচ্চগ্রামে উঠে গেল হঠাৎ ওলিভেট্টির কণ্ঠ, এই লেড কাউন্ট ডাউন শেষ হতে? ভ্যাটিকান সিটি হাওয়ায় উবে যেতে? বিশ্বাস করুন, আমার সিকিউরিটি সিস্টেমের উপর একহাত নেয়া লোকদের ভাল চোখে দেখি না কখনো। আমি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়াটাই আমার কাজ। কিন্তু যা আপনি বলছেন, মেনে নেয়া দুষ্কর।

ল্যাঙউন কথা বলে উঠল, আপনি কি কখনো ইলুমিনেটির নাম শুনেছেন?

এসব বাজে বকার সময় আমার হাতে নেই, সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাদের।

তার মানে আপনি ইলুমিনেটির কথা জানেন?

আমি ক্যাথলিক চার্চের একজন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ রক্ষক। দ্য ইলুমিনেটির কথা আমি ভাল ভাবেই শুনেছি। অনেক দশক ধরে তাদের মাথার টিকিটারও সন্ধান নেই।

লিওনার্দো ট্রোর সেই ছবিটা চলে গেল ওলিভেট্টির হাতে।

আমি একজন ইলুমিনেটি স্কলার। তারা এখনো টিকে আছে, কথাটা মেনে নিতে আমার কম কষ্ট হয়নি। কিন্তু এই পরিস্থিতি দেখে বিশ্বাস না করে পারছি না।

কম্পিউটারে করা কারসাজি।

কারসাজি? একবার মিলের দিকে তাকিয়ে দেখুন। দেখুন এর এ্যাম্বিগ্রামটার উপর, চোখ বুলিয়ে নিন।

হয়ত মিস ট্রো বলেননি আপনাকে, কিন্তু সার্ন বছরের পর বছর ধরে ভ্যাটিকানের নাক নিয়ে টানাটানি করছে। মনে হয় কী? গ্যালিলিও আর কোপার্নিকাসের জন্য চার্চকে তিতিবিরক্ত করে ছাড়ছে তারা। এখন এ চাল চেলেছে, পাঠিয়েছে প্রথমে একটা ক্যানিস্টার। তারপর আপনাদের।

ঐ ছবিটা আমার বাবার। আমার খুন হয়ে যাওয়া বাবার। কী মনে হয়, আমি তাকে নিয়ে তামাশা করছি আপনার সাথে?

আমি জানি না মিস ট্রো। শুধু এটুকু জানি, আগে আমার হাতে শক্ত প্রমাণ আসতে হবে। এটুকু দেখে আমার পক্ষে কোন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব নয়। এখানকার ধর্মীয় কাজগুলো যেন ঠিকমত হয় সেটা জানাই আমার কাজ। সেটা দেখাই আমার কাজ।

ল্যাঙডনের কথায় এবার মিনতি ঝরে পড়ল, অন্তত ব্যাপারটা নিয়ে ভাবুন। বিবেচনায় নিন!

বিবেচনায় নেয়া? কনক্লেভ মোটেও আমেরিকান বেসবল খেলা নয় যে চাইলেই বৃষ্টির ছুতোয় বন্ধ করে দেয়া যাবে। এর কঠিন নিয়ম কানুন আছে। এক বিলিয়ন ক্যাথলিক তাদের নতুন নেতার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই প্রটোকল পবিত্র। অপরিবর্তনীয়। এগারোশো উনআশি থেকে কনক্লেভ টিকে গেছে ভূমিকম্প, আগুন এমনকি প্লেগের হাত থেকেও। বিশ্বাস করুন, একজন খুন হয়ে যাওয়া বিজ্ঞানী আর এক ফোঁটা ঈশ্বর জানে কীর জন্য কখনোই কনক্লেভ বন্ধ করা যাবে না।

ইন চার্জে যিনি আছেন তার কাছে নিয়ে চলুন আমাকে। বলল ভিট্টোরিয়া।

আপনি এরই মধ্যে তাকে পেয়ে গেছেন।

না। যাজকদের একজন।

যাজক চলে গেছেন। সুইস গার্ড ব্যতীত ভ্যাটিকানে আছেন শুধু কার্ডিনালরা। আর কলেজ অব কার্ডিনাল চলে গেছেন কনক্লেভে। সিস্টিন চ্যাপেলে।

চ্যাম্বারলেইনের ব্যাপারে কী বলবেন? জিজ্ঞাসা করল ল্যাঙডন।

কে?

বিগত পোপের চ্যাম্বারলেইন। আশা করছে ল্যাংডন, তার জানা ভুল নয়। পোপের মৃত্যুর পর তার চ্যাম্বারলেইন সমস্ত দায়িত্ব পায়। পোপের ব্যক্তিগত সহকারি চালায় ভ্যাটিকানকে, তার মৃত্যুর পর। আমার বিশ্বাস চ্যাম্বারলেইন এখানকার দায়িত্বে আছেন।

এল ক্যামারলেনগো? ক্যামারলেনগো এখানে একজন প্রিস্ট। সামান্য প্রিস্ট। সে পোপের হাতের কাছের সার্ভেন্ট।

কিন্তু সে এখানে আছে। আর আপনি তার কাছেই জবাবদিহি করেন।

কথা সত্যি, মিস্টার ল্যাঙডন, পোপের মৃত্যুর পর ভ্যাটিকানের কনক্লেভের দায়িত্ব তার ক্যামারলেনগার হাতেই বর্তায়। ব্যাপারটা এমন, আপনাদের প্রেসিডেন্ট অক্কা পেলেন আর তার ব্যক্তিগত সহকারি ওভাল অফিস জুড়ে বসল। ক্যামারলেনগো তরুণ, আর সিকিউরিটি বা অন্য যে কোন ব্যাপারে তার জ্ঞান একেবারে সামান্য। এ ব্যাপারে, এখানে আমিই ইন চার্জ।

তার কাছে নিয়ে চলুন আমাদের। বলল জেদের সুরে ভিট্টোরিয়া।

অসম্ভব। চল্লিশ মিনিটের মধ্যে কনক্লেভ শুরু হতে যাচ্ছে। পোপের অফিসে প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্যামারলেনগো। নিরাপত্তার ব্যাপারে তার মনোযোগ আকর্ষণ করার কোন ইচ্ছা নেই আমার।

কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিল ভিট্টোরিয়া এমন সময় একজন প্রহরী এগিয়ে এল।

ইলোরা, কমান্টে!

হাতের ঘড়ি চেক করল ওলিভেট্টি। নড করল।

আমার সাথে সাথে আসুন… এটা আমার অফিস… আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি, ততক্ষণে আপনারা সিদ্ধান্ত নিন কীভাবে কী করবেন।

চরকির মত ঘুরল ভিট্টোরিয়া, আপনি চলে যেতে পারেন না! ক্যানিস্টারটা

আমার হাতে কথা বলার মত সময় নেই। কনক্লেভ শেষ হওয়া পর্যন্ত আপনারা এখানেই থাকছেন। তারপর কথা বলব।

সিনর! যুক্তি দেখাল গার্ড, স্প্যাজ্জারে লা ক্যাপেলা।

আপনি চ্যাপেল ঝাড় দিতে যাচ্ছেন? তেতে উঠল ভিট্টোরিয়া।

আমরা ঝাড় দেই ইলেক্ট্রনিক বাগের আশায়। ব্যাপারটা আপনি বুঝবেন না মিস।

মোটা কাচের দরজার ওপাশে চলে গেল সে। লাগিয়ে দিল তালা।

আবার চিৎকার করল ভিট্টোরিয়া, ইডিয়ট! আপনি আমাদের এখানে বন্দি করে রাখতে পারবেন না।

কিছু একটা বলল ওলিভেট্টি গার্ডকে।

নড করল গার্ড। তারপর তাদের দিকে ফিরে দাঁড়াল। বুকে হাত দুট ক্রস করা। * পা ফাঁক করে দাঁড়ানো।

পারফেক্ট! ভাবল ল্যাঙডন, একেবারে পারফেক্ট!

৩৭.

একদৃষ্টে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে গার্ড। তার পরনে সুইস গার্ডের ঐতিহ্যবাহী পোশাক।

পাজামা পরা এক লোকের হাতে গান দিয়ে জিম্মি করে রাখা! ভাল!

ভাবল ভিট্টোরিয়া।

ল্যাঙডন একেবারে চুপসে গেছে। আর ভিট্টোরিয়া আশা করছে তার হার্ভার্ড ব্রেন দিয়ে এখান থেকে বেরুনোর কোন না কোন উপায় বের হবে।

কিন্তু বেচারার চোখের দৃষ্টি দেখে করুণা হল তার। আহারে! বেচারাকে শুধু শুধু এখানে আনা হল টেনে।

প্রথমেই মনে হল সেলফোন বের করে সবটা জানায় কোহলারকে। তাতে লাভের লাভ কিছু হবে না। গার্ড সোজা ভিতরে ঢুকে ফোনটা কেড়ে নিতে পারে। আর যদি তা নাও করে, কোহলারের অসুস্থতা কাটেনি, কাটার কথা নয় এত দ্রুত।

ভেবে বের কর! এ নরক থেকে বেরুনোর পথ ভেবে বের কর!

বৌদ্ধ ফিলোসফারদের পদ্ধতি হল এই ভেবে বের করাটা। সে ধর্মে বলা হয়, প্রত্যেকে সব জানে। সুতরাং সেটাকে ভেবে বের কারাটাই বাকি থাকে।

ফল হল না বেশ কিছুক্ষণের চেষ্টায়।

তার এখন কাউকে জানাতে হবে। এখানকার দায়িত্বে থাকা কাউকে। কীভাবে? কাকে? ক্যামারলেনগো পদের মানুষটাকে? কীভাবে? তারা এখন একটা গ্লাসবক্সে আটকে আছে যেখান থেকে কোন মুক্তি নেই।

যন্ত্রপাতি! ভাবল সে, সব সময় আশপাশ যন্ত্রপাতি থাকে। এখানেও আছে। খুঁজে বের কর।

চোখ বন্ধ করল সে। ঝুলিয়ে দিল কাঁধ। মাথা থেকে সমস্ত চিন্তাকে সরিয়ে দিল। এখানে কিছু না কিছু পজিটিভ আছেই! কী সেটা?

আরো মনোনিবেশ করল সে। আরো। তারপর টের পেল কী করতে পারে।

আমি একটা ফোনকল করছি।

আমি তোমাকে বলতাম কোহলারকে ফোন করার কথা। কিন্তু—

কোহলারকে না। অন্য কাউকে।

কাকে?

ক্যামারলেনগো।

তুমি চ্যাম্বারলেইনকে কল করবে? কীভাবে?

ওলিভেট্টি বলেছিল ক্যামারলেনগো পোপের অফিসে আছে।

ওকে। তুমি পোপের প্রাইভেট নাম্বার জান?

না। কিন্তু আমি আমার ফোন থেকে কল করছি না। সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা লোকটার নিশ্চই পোপের সাথে সরাসরি কথা বলার একটা পথ আছে।

তার একজন ভারোত্তোলকও আছে, ছফিট সামনে। হাতে গান।

আর আমরা ভিতরে ইদুরের মত বন্দি হয়ে আছি।

আমি ভাল করেই তা জানতাম।

আমি বলছি, গার্ড আসলে বাইরে তালাবদ্ধ হয়ে আছে। এটা ওলিভেট্টির প্রাইভেট অফিস। আর আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, অন্যদের হাতে আর একটা চাবি নাও থাকতে পারে।

এটা একেবারেই পাতলা গ্লাস। আর তার হাতে একেবারেই বড় একটা গান আছে।

কী করবে সে? ফোন ব্যবহার করার অপরাধে গুলি করে বসবে?

কে জানে? এ জায়গা বড়ই অদ্ভুত। আর পরিস্থিতি যা-

তাতে বোঝা যায় সব এভাবেই চলবে এবং আমি বাকি পাঁচ ঘণ্টা বেয়াল্লিশ মিনিট এখানে তালাবদ্ধ হয়ে থাকব তোমার সাথে। যখন প্রতিবস্তু বিস্ফোরিত হবে, আমরা বসে থাকব সামনের সারিতে।

কিন্তু গার্ড তোমার ফোন তোলার সাথে সাথে ওলিভেট্টির সাথে যোগাযোগ করবে। সবগুলো ফোন নিয়ে চেষ্টা করবে তুমি?

নোপ! মাত্র একবার! বলল ভিট্টোরিয়া। তারপর তুলল ফোনটা। ডায়াল করল সবার উপরের বাটনটায়।

বাইরে উশখুশ করে উঠল গার্ড। তাকাল অগ্নিচুতে।

পরিস্থিতি সুবিধার মনে হেছ না। ভাবল ল্যাঙডন।

না! এতে রেকর্ডিং!

রেকর্ডিং? পোপের আনস্যরিং মেশিন আছে?

পোপের অফিস নয়। ভ্যাটিকান কমিশারির মেনু।

ল্যাঙডন কোনক্রমে একটা ম্লান, মিইয়ে পড়া হাসি দিল যখন বাইরের গার্ড অস্ত্র কক করেও সেটাকে নামিয়ে রেখে ওয়াকিটকি বের করে ওলিভেট্টির সাথে যোগাযোগ করল।

৩৮.

ভ্যাটিকান সুইচবোর্ড অবস্থিত উফিসিও ডি কমিউনিকেঞ্জিয়োতে। ভ্যাটিকান পোস্ট অফিসের পিছনে। একশো একচল্লিশটা সুইচবোর্ড বসানো এ ঘরটা তুলনামূলকভাবে ছোট। অফিসে দিনে দু হাজারের বেশি কল আসে। তার বেশিরভাগই রেকর্ড করা জবাব শুনতে পায়।

ক্যাফেইন সমৃদ্ধ এককাপ চা নিয়ে বসে ছিল কমিউনিকেশন্স অপারেটর। চুমুক দিচ্ছিল আয়েশ করে ধূমায়িত কাপে।

গত কয়েক বছর ধরে ভ্যাটিকানে আসা কলের মাত্রা অনেক কমে গেছে। এমনকি মিডিয়ার লোকজন আর ফ্যানরাও আগের মত এত জ্বালাতন করে না।

ভ্যাটিকানের প্রতি আগ্রহ কমে এসেছে দুনিয়ার। স্বাভাবিক। আধুনিক জীবনযাত্রা আস্তে আস্তে ধর্মীয় ভাব থেকে সরিয়ে আনছে মানুষকে। যদিও বাইরের স্কয়ার মিডিয়া ভ্যানে পূর্ণ, সেখানে বেশিরভাগই ইতালিয়। খুব বেশি ইন্টারন্যাশনাল সংস্থা আসেনি কনক্লেভ কাভার করতে।

হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে ভাবে অপারেটর, আর কতক্ষণ লাগবে আজ রাতটা পেরিয়ে যেতে।

কনক্লেভ আর আগের মত নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলে না। আঠারোশো একত্রিশ সালের কনক্লেভ তিপ্পান্ন দিন ধরে চলেছিল। এবার আর তা হবার যো নেই।

মাত্র একটা ধোয়াশার মত কেটে যাবে কনক্লেভের সময়।

একটা বোর্ডে আলো দেখে অবাক হল সে।

ভিতরে থেকে, লাইন জিরো থেকে কে অপারেটরের সাহায্য চাইতে পারে? আজকের দিনে ভিতরে আছেইবা কে?

সিটা ডেল ভ্যাটিকানো, প্রেগো? তুলল অপারেটর ফোন।

দ্রুতলয়ে বলে গেল ওপাশের কণ্ঠ। ইতালিয়তে। এ আর যেই হোক, সুইস গার্ড নয়।

মহিলা কণ্ঠ শুনে ভড়কে গেল অপারেটর। তার চা ছলকে পড়ল সাথে সাথে।

ভিতর থেকে? এই রাতে? মহিলার কন্ঠ?

মহিলা ঝড়ের গতিতে কথা বলে যাচ্ছে। অপারেটর কম সময় কাটায়নি এখানে। সে ভাল করেই জানে কারা ভুল করছে, ফাজলামি করছে, আর কারা সত্যি কথা বলছে। মহিলা উত্তেজিত, কিন্তু কণ্ঠে তার ছোয়া আছে সামান্য। কণ্ঠে ঝরে পড়ছে মিনতি।

এল ক্যামারলেনগো? আমি হয়ত পারব না লাইন দিতে… হ্যাঁ, আমি জানি তিনি পোপের অফিসে আছেন, কিন্তু… কে বলছিলেন? আবার বলুন প্লিজ… আর আপনি তাকে সাবধান করে দিতে চান… সে শুনল। আরো আরো মনোযোগ দিয়ে। সবাই বিপদে আছে… কীভাবে? আমার হয়ত সুইস গার্ডের সাথে… আপনি বললেন কোথায় আছেন? কোথায়?

শুনল অপারেটর। তারপর বলল, হোল্ড প্লিজ।

তুলল সে কমান্ডার ওলিভেট্টির নাম্বার।

ওপাশ থেকে সেই কণ্ঠই বলে উঠল, ঈশ্বরের নামে বলছি, প্লিজ, কলটা!

কমান্ডার ওলিভেট্রি আরো কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এল। তাকাল ফোন ধরে রাখা মহিলার দিকে। সে কথা বলছে কমান্ডারের প্রাইভেট লাইনে।

এগিয়ে এল কমান্ডার।

কী করছেন আপনি?

হ্যাঁ… আর আমার আরো সতর্ক করে দিতে হচ্ছে যে…

কেড়ে নিল ওলিভেট্টি, কোন চুলা থেকে কে বলছে?

তারপর থেমে গেল সে। দমে গেল একদম। মিইয়ে গেল ভিজানো মুড়ির মত। ইয়েস, ক্যামারলেনগো, বলছে সে, সত্যি, সিনর, কিন্তু নিরাপত্তার ব্যাপারটা… অবশ্যই নয়… আমি তাকে এখানে ধরে রেখেছি কারণ… অবশ্যই, কিন্তু… একটু অস্বস্তিতে পড়ল ওলিভেট্টি, ইয়েস, স্যার! বলল সে, আমি তাদের নিয়ে এখনি আসছি।

৩৯.

এ্যাপোস্টোলিক প্রাসাদ বিভিন্ন ভবনের জটলার মধ্যে, সিস্টিন চ্যাপেলের পিছনে। সেন্ট পিটার্স স্কয়ার থেকে বেশ ভাল একটা ভিউ পাওয়া যায়। এ ইমারতেই পোপের অফিস আর এ্যাপার্টমেন্ট।

লম্বা রোকোকো করিডোর ধরে তাদের নিয়ে যাচ্ছে কমান্ডার ওলিভেট্টি। রাগে তার ঘাড়ের পেশিগুলো আড়ষ্ট হয়ে আছে। সিঁড়ির ধাপ পড়ল সামনে। তার পরই একটা হাল্কা আলোয় ভরা হলওয়ে। চওড়া।

দেয়ালের শিল্পকর্মগুলোর দিকে তাকিয়ে স্রেফ আঁৎকে উঠল ল্যাঙডন। লাখ লাখ ডলার মূল্য এগুলোর।

এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল কমান্ডার।

উফিসিও ডেল পাপা! ঘোষণা করল সে। তাকিয়ে রইল ভিট্টোরিয়ার দিকে। কটমট করে। পাত্তা দিল না ভিট্টোরিয়া মোটেও। দরজায় জোরে করাঘাত করল সে।

অফিস অব দ্য পোপ! আবার শিউরে উঠল ল্যাঙডন। বিশ্বের ধর্মগুলোর মধ্যে সবচে ক্ষমাতবান লোকটার কার্যালয়।

আভান্তি! ভিতর থেকে কেউ একজন বলে উঠল।

দরজা খুলে যাবার সাথে সাথে ল্যাঙডনের চোখ ঢেকে ফেলতে ইচ্ছা হল। সূর্যের আলো পড়ছে সরাসরি চোখে। আস্তে আস্তে তার সামনের ইমেজ স্পষ্ট হয়ে এল।

অফিসটা অফিসের মত লাগছে না। লাগছে বলরুমের মত। লাল মার্বেলের মেঝে, চারদেয়ালে বিচিত্র দেয়ালচিত্র। অসাধারণ। সামনে সূর্যের আলোয় ভেসে যাওয়া সেন্ট পিটার্স স্কয়ার।

মাই গড! এ ঘরটায় জানালা আছে।

সামনের বিশাল ডেস্কের পিছনে একজন বসে আছে। আভান্তি! বলল সে। হাতের কলম নামিয়ে রেখে।

সামনে এগিয়ে গেল ওলিভেটি। তার হাবভাব সামরিক। সিনর, ক্ষমা প্রার্থনার সুরে, নন হো পটেউটো

লোকটা তার কথা মাঝপথে থামিয়ে দিল।

ভ্যাটিকানে ঘুরতে ঘুরতে যে রকম মানুষের কথা মনে আসে ল্যাঙডনের, ক্যামারলেনগো মোটেও তেমন নয়। তার গলায় কোন পেন্টেন্ট নেই। নেই বাড়তি কোন সাজসজ্জা। নেই যোব। একটা সাধারণ ক্যাসক তার পরনে। তা থেকেই ভিতরের মানুষটার পরিচয় পাওয়া যায়।

বয়স তার ত্রিশের কোটার শেষদিকে। ভ্যাটিকানের হিসাবে দুগ্ধপোষ্য শিশু। ধূসর চুল তার। মুখ অত্যন্ত সুন্দর। এগিয়ে যেতে যেতে তার মধ্যে ক্লান্তি দেখতে পায় ল্যাঙডন। পনের দিনের ঝড় শেষ হয়েছে তার। এখন বিশ্রামের সময় এগিয়ে আসবে।

আমি কার্লো ভেন্ট্রেস্কা। বলল সে, ইংরেজি একেবারে পাকা, বিগত পোপের ক্যামারলেনগো। তার কণ্ঠ দয়ার্দ্র।

ভিট্টোরিয়া ভেট্রা, এগিয়ে গেল মেয়েটা, বাড়িয়ে দিল হাত। আমাদের দেখা দেয়ায় আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

ক্যামারলেনগো হ্যান্ডশেক করাতে হতবাক হয়ে গেল ওলিভেট্টি।

ইনি রবার্ট ল্যাঙডন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রিলিজিয়াস হিস্টোরির প্রফেসর।

পাদ্রে! যথা সম্ভব ইতালিয় টানে বলার চেষ্টা করল ল্যাঙডন। হাত বাড়াল। বাড়িয়ে দেয়া হাতের সামনে নিচু করল মাথা।

না-না! বলল ক্যামারলেনগো, হিজ হোলিনেসের অফিস আমাকে পবিত্র করেনি। আমি সামান্য এক প্রিস্ট। একজন ক্যামারলেনগো যে সময় মত সার্ভিস দেয়।

দাঁড়িয়ে রইল ল্যাঙডন।

প্লিজ! বলল ক্যামারলেনগো, প্রত্যেকে বসুন। ডেস্কের সামনে কয়েকটা চেয়ার একত্র করার চেষ্টা করল।

ওলিভেট্টি দাঁড়িয়ে থাকাকেই শ্রেয় বলে মনে করল।

ক্যামারলেনগো বসল তার ডেস্কে। হাত ভাঁজ করল। ছোট্ট করে ফেলল একটা শ্বাস। তারপর তাকাল ভিজিটরদের দিকে।

সিনর! বলল ওলিভেষ্টি, মহিলার ধৃষ্টতা আমার ভুল। আমি-

তার ধৃষ্টতা আমাকে ভাবিত করছে না। জবাব দিল ক্যামারলেনগো সাথে সাথে, যখন অপারেটর আমাকে কনক্লেভের আধঘণ্টা আগে ফোন করে জানায় যে একজন মহিলা আপনার অফিস থেকে ফোন করে আমাকে চাচ্ছে কোন এক বড় দুর্ঘটনার ব্যাপার জানাতে যার কথা আমি জানি না সেটাই ভাবিত করছে আমাকে।

একেবারে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল ওলিভেট্টি।

ক্যামারলেনগোর উপস্থিতিতে মোহাবিষ্ট অনুভব করল ল্যাঙডন। তরুণ, উদ্দীপিত, অনেকটা পুরাণের মহানায়কের মত।

সিনর! বলল অবশেষে ওলিভেট্টি, এখনো তার কণ্ঠে তা, সেই সাথে একটু ঔদ্ধত্য, সিকিউরিটির ব্যাপারে আপনাকে চিন্তিত না হলেও চলবে। অন্য অনেক কাজের চাপ আপনাকে সামলে নিতে হয়।

কাজের চাপ সম্পর্কে আমি পুরোপুরি ওয়াকিফহাল। আমি আরো জানি যে ডিরেট্রেলরা ইন্টারমিডিয়াররা অনুসারে, আমার উপর কনক্লেভ যেন নিরাপদে ঘটে সেটা নিয়েও দায়িত্ব বর্তায়। কী হচ্ছে এখানে?

পরিস্থিতি আমার আয়ত্তে।

দেখাই যাচ্ছে, তা নয়।

ফাদার, এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল ওলিভেট্টির, প্লিজ!

এগিয়ে গেল ওলিভেট্টি, ফাদার। এ নিয়ে আপনি ভাববেন না। এসব ব্যাপার।

ক্যামারলেনগো ফ্যাক্সটা হাতে নিল। ওলিভেট্টিকে অনেক সময় ধরে অবজ্ঞা করে। সেখানে মৃত বিজ্ঞানীর ছবি। সেখানে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকে সে বলল, এ কী!

তিনি আমার বাবা। বলল আগ বাড়িয়ে ভিট্টোরিয়া, কষ্টে তার আবেগ, তিনি ছিলেন একজন প্রিস্ট। একই সাথে বিজ্ঞানের লোক। গত রাতে তিনি খুন হন।

সাথে সাথে নরম হয়ে গেল ক্যামারলেনগোর মুখাবয়ব। চোখ তুলে তাকাল সে মেয়েটার দিকে। মাই ডিয়ার চাইল্ড, আই এ্যাম সো স্যরি!

ক্রস করল নিজেকে ক্যামারলেনগো। তারপর তাকাল ফ্যাক্সের দিকে। তার চোখের কোণায় টলটল করছে অশ্রু। কে… আর তার বুকের এই পোড়া চিহ্ন…।

এখানে লেখা আছে ইলুমিনেটি, ব্যাখ্যা করল ল্যাঙডন, আপনি যে নামটা চেনেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

একটা বিচিত্র ভাব খেলে গেল ক্যামারলেনগোর চোখে। কী যেন মিলছে না। আমি নামটার সাথে ভালভাবেই পরিচিত, কিন্তু…

ইলুমিনেটি লিওনার্দো ভেট্রাকে খুন করে কারণ তিনি এমন এক নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিলেন যা

সিনর! বাধা দিল ওলিভেট্টি, এর কোন মানে হয় না। ইলুমিনেটি? তারা অনেক আগেই গাপ হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে–

কথা শুনছে না ক্যামারলেনগো। তাকিয়ে রইল সে ফ্যাক্সের দিকে বেশ কিছুক্ষণ। মিস্টার ল্যাঙডন, আমি ক্যাথলিক চার্চের জন্য আমার সারা জীবন ব্যায় করেছি। ইলুমিনেটির ব্যাপারে আমি পুরোপুরি সজাগ। তাদের ব্র্যান্ডিং করার ঐতিহ্য সম্পর্কেও। কিন্তু আমি বর্তমান কালের লোক। খ্রিস্টবাদের অনেক বর্তমান শত্রু আছে, ভূতরা ছাড়াও…

এই চিহ্নটা একেবারে নিখুঁত। বলল সে। এগিয়ে গেল ফ্যাক্সটা ক্যামারলেনগোর হাত থেকে নেয়ার জন্য।

ক্যামারলেনগো অবাহ হয়ে গেল দ্বিমুখীতা দেখে।

এমনকি আধুনিক কম্পিউটারও, বলছে সে, এমন একটা এ্যাম্বিগ্রাম তৈরি করতে পারে না।

অনেকক্ষণ ধরে চুপ থাকল ক্যামারলেনগো। তারপর বলল, এখন ইলুমিনেটির কোন অস্তিত্ব নেই। অনেক আগেই তারা হাপিস হয়ে গেছে।

নড করল ল্যাঙডন, গতকালও আমি আপনার সাথে একমত হতাম।

গতকাল?

আজকের ঘটনাক্রমের আগে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইলুমিনেটি ফিরে এসেছে। তাদের অপূর্ণ স্বাদ পূর্ণ করার জন্য। পথ পূর্ণ করার জন্য।

মাফ করবেন। আমি ঠিক জানি না। কোন পথ?

ভ্যাটিকান সিটির ধ্বংস এবং এর পথ।

ভ্যাটিকান সিটি ধ্বংস? ভয়েরচে বিস্ময় বেশি উঁকি দিচ্ছে ক্যামারলেনগোর কণ্ঠে। কিন্তু তা অসম্ভব হবার কথা।

মাথা নাড়ল, ভিট্টোরিয়া, আসলে আমাদের হাতে আরো বড় কিছু দুঃসংবাদ আছে।

৪০.

এ কথা কি সত্যি? বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেছে ক্যামারলেনগো। তাকাচ্ছে ওলিভেটির দিকে।

সিনর, আশ্বস্ত করে ওলিভেট্টি, আমি মানছি যে এখানে কোন প্রকারের ডিভাইস আছে। সিকিউরিটি মনিটরে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মিস ভেট্রার দাবি অনুযায়ী, এর ক্ষমতা অকল্পনীয়। এমন কোন সম্ভাবনা

এক মিনিট, তেতে উঠছে এবার ক্যামারলেনগো, আপনারা সেটাকে দেখতে পাচ্ছেন?

জ্বি, সিনর, ক্যামেরা নম্বর ছিয়াশিতে।

তাহলে সেটাকে উদ্ধার করেননি কেন? এবার ক্যামারলেনগোর কণ্ঠে ধরা দিল উত্তেজনা।

খুবই কঠিন, সিনর। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, ওলিভেট্রি। বর্ণনা করল পরিস্থিতি।

ক্যামারলেনগো শুনল মন দিয়ে। তারপর তাকাল সবার দিকে। আপনারা কি নিশ্চিত এটা ভ্যাটিকানের ভিতরেই আছে? কেউ হয়ত সেটাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে ট্রান্সমিট করছে।

অসম্ভব। বলল ওলিভেট্টি, আমাদের বাইরের দেয়ালগুলো ইলেক্ট্রিক্যালি প্রতিহত করে বাইরের সিগন্যাল, যেন ভিতরের সম্প্রচার বিষয়ক কোন ব্যাপারে অসুবিধা না হয়।

তাহলে আমার মনে হয় আপনি এখন মিসিং ক্যামেরাটার জন্য নেমে পড়েছেন?

মাথা নাড়ল ওলিভেট্টি, না, সিনর। সেটাকে বের করতে শত শত মানব-ঘণ্টা লেগে যাবে। আমাদের কাজ এখন সবচে বেশি। লোকবলের পুরোটাকেই নানা কাজে লাগিয়ে দিতে হয়েছে। আর মিস স্ট্রোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই জানাতে চাই সেই বিন্দুটা খুবই ছোট।

এবারও সতেজে বলল ভিট্টোরিয়া, সেই ফোঁটাই ভ্যাটিকানকে বাস্প করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আমি যা বলছি তার প্রতি একবারও কি কান দিয়েছেন আপনি?

ম্যাম, বিস্ফোরকের ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা অনেক।

এখানে আপনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে না। আমি পৃথিবীর সবচে বড় সাব এটমিক রিসার্চ ফ্যাসিলিটির একজন সিনিয়র সদস্য। ব্যক্তিগতভাবে আমিই সেই জিনিটার ধারকের ডিজাইন করেছি। এমনকি অনেকবার অতি ক্ষুদ্র পরিমাণ নিয়ে বিস্ফোরণের মহড়া দিয়েছি। সতর্ক করে দিচ্ছি আপনাকে, আগামী ছ ঘণ্টার মধ্যে সেটাকে বের করতে না পারলে অনর্থ ঘটে যাবে। আপনার গার্ডরা আর কিছুকেই রক্ষা করার জন্য পাহারা দিবে না। শুধু থাকবে মাটিতে একটা বড় গর্ত।

এবার রগচটা ওলিভেট্টি তাকাল ক্যামারলেনগোর দিকে ঝট করে, সিনর, এই কথোপকথন আমি আর চালাতে চাচ্ছি না। আপনার সময় নষ্ট হচ্ছে পাঙ্কস্টারদের কারণে। ইলুমিনেটি? এমন একটা ফোঁটা যা আমাদের সবাইকে ধ্বসিয়ে দিবে?

বাস্তা! ঘোষণা করল ক্যামারলেনগে। সে স্পষ্ট শব্দটী উচ্চারণ করেছে এবং তা। ঘরের ভিতরে ধ্বণিত প্রতিধ্বণিত হচ্ছে। ধ্বংসাত্মক হোক আর না হোক, ইলুমিনেটি থাক আর না থাক… ব্যাপারটা ঘটছে ভ্যাটিকান সিটির ভিতরে। কনক্লেভের সময়। আমি এটাকে পাওয়া অবস্থায় দেখতে চাই। নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পেতে চাই। খুব দ্রুত একটা সার্চের ব্যবস্থা করুন।

সিনর, আমরা যদি এখন আমাদের পুরো লোকবল দিয়েও সার্চ চালাই, তবু ক্যামেরাটা পেতে কয়েক দিন লেগে যাবে। মিস ট্রোর কথা শোনার পর আমি আমাদের একজনকে এই এন্টিম্যাটার বিষয়ে আলোচনা পাবার জন্য আমাদের সবচে। অগ্রসর ব্যালিস্টিক গাইড ঘাটতে পাঠিয়েছি। আমি কোথাও এর কোন বর্ণনা দেখিনি। কোথাও না।

বোকার হদ্দ! ভাবছে ভিট্টোরিয়া, ব্যালিস্টিক গাইড! তুমি কি কোন এনসাইক্লোপিডিয়া ঘেঁটেছ? এ শব্দের উপর?

কথা বলছিল ওলিভেট্টি, সিনর, যদি আপনি ভোলা চোখে পুরো ভ্যাটিকান সিটি চষে ফেলতে বলেন তাহলে আমাকে অবশ্যই সে কথার প্রতিবাদ করতে হবে।

কমান্ডার, তীক্ষ্ণতর হল এবার ক্যামারলেনগোর স্বর, একটা কথা কি আপনাকে মনে করিয়ে দিতে হবে যে যখন আপনি আমাকে এ্যাড্রেস করছেন, আপনি এ্যাড্রেস করছেন এই অফিসকে? আমি টের পাচ্ছি আপনি আমার পদটাকে ঠিকভাবে নিচ্ছেন না। আমি আছি ভ্যাটিকানের দায়িত্বে। আমার কোন ভুল না হয়ে থাকলে, কার্ডিনালরা এর মধ্যেই সিস্টিন চ্যাপেলে চলে গেছেন। আর কনক্লেভ ভাঙা পর্যন্ত আপনার নিরাপত্তা বলয়ের এলাকা অনেক কমে যাচ্ছে। ভেবে পাচ্ছি না আপনি কেন এই ডিভাইসটার খোঁজ করতে গড়িমসি করছেন। আমার ভুল না হয়ে থাকলে বলতে হয়, আপনি এ কনক্লেভকে আন্তর্জাতিক দুর্ঘটনার মুখে পতিত হতে দিচ্ছেন।

এবার যেন ফুলকি ছুটল ওলিভেট্টির মুখ দিয়ে, কত বড় সাহস তোমার! আমি তোমার পোপকে বারো বছর ধরে সেবা দিয়েছি। তার আগের পোপকে চৌদ্দ বছর! চৌদ্দশ আটত্রিশ থেকে সুইস গার্ড

এমন সময় তার ওয়াকিটকি সজিব হয়ে উঠল, কমান্ডান্টে?

মুখের কাছে তুলল ওলিভেট্টি জিনিসটাকে, সোনো অকুপাটো! কোসা ভুওই!

স্কোসি, রেডিওর সুইস গার্ড বলল, কমিউনিকেশন্স হিয়ার। আমি মনে করেছি আপনি জানেন যে আমরা একটা বোমা হামলার হুমকির মুখে পড়েছি।

তাহলে ব্যাপারটাকে হ্যান্ডেল কর! স্বাভাবিক ট্রেস চালাও। সমূলে বের করে দাও ব্যাটাকে।

আমরা করেছি, স্যার। কিন্তু কলার… থামল গার্ড একটু, আমি আপনাকে বিরক্ত করব না বেশি কথা বলে। কলার যা বলল সেটা আপনার একটু আগে বলা শব্দ।

এন্টিম্যাটার!

সারা ঘরে নেমে এল পিনপতন নিরবতা। তাকিয়ে আছে সবাই।

সে কী বলেছে?

এন্টিম্যাটার, স্যার। কলের ট্রেস বের করার চেষ্টা যখন করছি আমরা তখন তার দাবির উপরে আরো কিছু কাজ করি আমি। এন্টিম্যাটার নিয়ে যে তথ্য আছে… সেটা… আসলেই খুব সমস্যার। বড় সমস্যার।

আমি মনে করেছি তুমি বলেছ যে ব্যালিস্টিক গাইডে সেটার নাম-নিশানাও নেই।

অন লাইনে পেয়েছি ব্যাপারটা।

এ্যালিলুইয়া! ভাবল ভিট্টোরিয়া।

জিনিসটা খুবই বিস্ফোরক। কথাটা কতটা সত্যি তা জানি না, তবে সেখানে লেখা আছে যে এন্টিম্যাটারের এক পাউন্ড পে লোড সে পরিমাণ পারমাণবিক ওয়্যারহেডের চেয়ে শতগুণ বেশি কর্মক্ষম!–থমকে গেল ওলিভেট্টি। যেন কোন পাহাড় দেখতে পাচ্ছে সে গোড়ায় বসে থেকে।

ক্যামারলেনগোর চেহারায় আতঙ্ক দেখে ভিট্টোরিয়ার উল্লাস হাপিস হয়ে গেল।

তুমি কি কলটা ট্রেস করেছ? জিজ্ঞাসা করল ওলিভেট্টি।

ভাগ্য মন্দ। ভারি এলাকা থেকে সেলুলারে কল এসেছে। স্যাট লাইনগুলো জ্যাম, একের উপর আরেকটা পড়ে যাচ্ছে। আই এফ সিগন্যাল এটুকু জানাচ্ছে যে সে রোমেই কোথাও আছে। কিন্তু তাকে আবার পাবার কোন উপায় নেই।

সে কি কোন দাবি করেছে? শান্ত কণ্ঠে বলল ওলিভেট্টি।

না, স্যার। শুধু আমাদের জানিয়েছে যে কমপ্লেক্সের ভিতরে এন্টিম্যাটার লুকানো আছে। তাকে কেন যেন সারপ্রাইজড বলে মনে হল। জিজ্ঞাসা করল এখনো আমি সেটাকে দেখেছি কিনা। আপনি আমাতে এন্টিম্যাটার বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারেন, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, সব জেনে তারপর আপনাকে জানাব।

ঠিক কাজই করেছ। নেমে আসছি এক মিনিটের মধ্যে। আবার কল করলে আমাকে জানিও।

একটু সময় ধরে নিরবতা দেখা দিল লাইনে। সে এখনো লাইনে আছে, স্যার।

যেন ধাক্কা খেল ওলিভেন্তি, সে এখনো লাইনে আছে?

জি, স্যার। দশ মিনিট ধরে তাকে ট্রেস করার চেষ্টা করছি। সে জানে তাকে পাব না আমরা। তাই নাছোড়বান্দার মত ক্যামারলেনগোর সাথে কথা না বলা পর্যন্ত লাইন কাটতে রাজি হচ্ছে না।

পাঠিয়ে দাও তার লাইন! বলল ক্যামারলেনগো, এখনি।

ফাদার! না! ওলিভেট্টি বাধা দিল ট্রেইল্ড সুইস গার্ড নেগোশিয়েটর অনেক বেশি দক্ষ, তাকে দিয়ে অনেক সুবিধা আদায় করা সম্ভব।

এখনি!

ওলিভেট্টি আদেশ দিল।

এক মুহূর্ত পরেই ক্যামারলেনগোর একটা ফোন বেজে উঠল। ক্যামারলেনগো আঙুল এগিয়ে দিল স্পিকার-ফোন বাটনে, ঈশ্বরের নামে জিজ্ঞেস করছি, নিজেকে কে মনে করছেন আপনি?

০৫. শব্দটা যান্ত্রিক এবং ঠান্ডা
৪১.

শব্দটা যান্ত্রিক এবং ঠান্ডা। ধাতব। রুমের প্রত্যেকে শুনছে।

উচ্চারণটা ধরার চেষ্টা করল ল্যাঙডন। মধ্যপ্রাচ্যের, তাই না?

আমি এক প্রাচীণ ব্রাদারহুডের প্রতিনিধি। অপরিচিত, অপার্থিব আত্মবিশ্বাস লোকটার সুরে, এমন এক ভাতসংঘ যেটাকে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে আপনারা দমন করে এসেছেন। আমি দ্য ইলুমিনেটির একজন সংবাদবাহক।

ল্যাঙডনের মনে পড়ে গেল আজ সকালে প্রথম দেখা এ্যাম্বিগ্রামটার কথা।

কী চান আপনি? জিজ্ঞাসা করল ক্যামারলেনগা।

আমি বিজ্ঞানের লোকদের শ্রদ্ধা করি। মানুষ, যারা আপনাদের মতই সত্যের সন্ধানে আছে, কিন্তু আরো বেশি ভাল পদ্ধতিতে, আরো বিশুদ্ধ পথে। যারা মানুষের গন্তব্য, তার উদ্দেশ্য, তার স্রষ্টার বিষয়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে চায়।

আপনি যেই হন না কেন, বলছে ক্যামারলেনগো, আমি।

সাইলেঞ্জিও! আপনার কথাগুলো শুনে নেয়াই ভাল। দু হাজার বছর ধরে সত্যের সন্ধানে আপনার চার্চই অগ্রবর্তী ছিল। আপনারা বিনা দ্বিধায় আপনাদের শত্রুদের মূলোৎপাটিত করেছেন। আপনারা সত্যের আরাধনার নামে আখের গুছিয়েছেন। যারা অন্য পথে সত্যের সন্ধানে ছিল তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন বিনা দ্বিধায়। আপনারা কী করে অবাক হন এ কথা শুনে যে সারা পৃথিবীর আলোকিত মানুষের টার্গেট এখন আপনাদের ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠান?

আলোকিত মানুষরা ব্ল্যাকমেইল করে না।

ব্ল্যাকমেইল? হাসল কলার, এটা কোন ব্ল্যাকমেইল নয়। আমাদের কোন দাবি নেই। ভ্যাটিকানের ধ্বংস অপ্রতিরোধ্য। আজকের দিনের জন্য আমরা শত শত বছর ধরে প্রতীক্ষা করেছি। মাঝরাতে আপনাদের মহানগরী গুঁড়িয়ে যাবে। আপনাদের করার কিছু নেই।

ফোনের কাছে এগিয়ে গেল ওলিভেট্টি, এ সিটিতে ঢোকা অসম্ভব! আপনাদের পক্ষে এখানে বোমা রাখা সম্ভব নয়!

আপনার কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে সুইস গার্ডের প্রতিনিধিত্ব করছেন। কোন অফিসার? আপনার জানার কথা যে বছরের পর বছর ধরে আমরা সারা পৃথিবীর সব এলিট বাহি নীর সাথে টক্কর দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছি। আপনি কি মনে করেন যে ভ্যাটিকান সিটি একেবারে নিরেট?

জিসাস! ভাবল ল্যাঙডন, তারা ভিতরের সাহায্য নিচ্ছে।

এতেই ইলুমিনেটির প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া যায়। তারা মেসনদের ভিতরে বেড়ে উঠেছে, দখল করেছে পৃথিবীর ব্যাঙ্কিং পাওয়ার, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। একবার চার্চিল বলেছিলেন যে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস জানতে পেরেছে, পার্লামেন্টের ভিতরে নাজি আছে, আছে ইলুমিনেটি। একমাসে যুদ্ধ শেষ হয়ে যেতে পারত।

স্পষ্ট ধাপ্পা! আবার বলল ওলিভেট্টি, আপনাদের ক্ষমতা এতদূরে যেতে পারে না!

কেন? কারণ আপনাদের সুইস গার্ড অত্যন্ত ক্ষমতাবান? কারণ তারা আপনাদের প্রাইভেট ওয়ার্ল্ডের সব কোণা আর গলি-ঘুপচি রক্ষা করে? সুইস গার্ডের নিজেদের সম্পর্কে কী বলবেন? তারা কি মানুষ নয়? আপনি কি সত্যি সত্যি মনে করেন তারা সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে বিনা দ্বিধায় কাজ করছে যে কোন এক কালে কেউ একজন পানির উপর হেঁটেছিল? নিজেকেই প্রশ্ন করুন কীভাবে ভ্যাটিকান সিটির ভিতরে ক্যানিস্টারটা ঢুকল। বা কীভাবে আপনাদের সবচে দামি চার সম্পদ স্বয়ং ভ্যাটিকানের ভিতর থেকে উবে গেল?

আমাদের সম্পদ? অবাক হল ওলিভেট্টি, কী বলতে চান?

এক, দুই, তিন, চার। আপনারা এখনো তাদের হারানোর কথা জানেন না?

কোন চুলার কথা বলছেন আপনি- থমকে গেল ওলিভেটি। কথা ফুঠছে না তার কণ্ঠে এবার।

আমি কি তাদের নাম বলব?

হচ্ছেটা কী? তাড়া দিল ক্যামারলেনগো।

হাসল কলার, আপনার অফিসার এখনো জানায়নি? কী পাপের কথা! অবাক হবার মত কিছু নয়। এতবড় গর্ব! আমি কল্পনা করতে পারি আসল সত্যিটা আপনাকে না জানানোর ব্যাপারটা… যে চার কার্ডিনালকে সে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা করেছিল তারা উধাও হয়ে গেছে…

এ তথ্য কোথায় পেলেন আপনি? ওলিভেট্টি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

ক্যামারলেনগে, বলল কলার একটু শান্ত কণ্ঠে, আপনার কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করুন সব কার্ডিনাল এর মধ্যে সিস্টিন চ্যাপেলে গেছে কিনা।

ওলিভেট্টির দিকে চকিতে তাকাল ক্যামারলেনগো, তার সবুজ চোখে ব্যাখ্য চাওয়ার ভাব।

সিনর, ওলিভেট্টি ফিসফিস করল ক্যামারলেনগোর কানে কানে, কথা সত্যি যে আমাদের চারজন কার্ডিনাল এখনো সিস্টিন চ্যাপেলে যাননি। কিন্তু সেজন্য সতর্কবাণীর কোন প্রয়োজন নেই। আজ সকালে সবাই রেসিডেন্ট হলে চেক ইন করেছেন। তাই আমরা ভাল করেই জানি যে তারা সবাই ভ্যাটিকান সিটির ভিতরে নিরাপদে আছেন। ঘণ্টাকয়েক আগে আপনি নিজে তাদের সাথে চা চক্রে যোগ দিয়েছেন। কনক্লেভের ফেলোশিপের জন্য তারা হয়ত কোন জায়গায় শলা পরামর্শ করছেন। আমাদের সার্চ চলছে পূর্ণ উদ্যমে। আমি নিশ্চিত তারা সময়ের কথা ভুলে গিয়ে ভ্যাটিকানের কোন না কোন অসাধারণ ব্যাপার উপভোগ করছেন। হয়ত বাগানে।

বাগানে উপভোগ করছেন? ক্যামারলেনগোর কণ্ঠ বরফ শিতল হয়ে গেল, চ্যাপেলে তাদের চলে যাবার কথা আরো ঘণ্টাখানেক আগেই।

ল্যাঙডন চকিতে দৃষ্টি ফেলল ভিট্টোরিয়ার উপর। কার্ডিনালরা হারিয়ে গেছে? তাহলে এর খোঁজেই তারা আশপাশ চষে ফেলছিল?

আমাদের কাজে আপনারা বেশ তুষ্ট হবেন। নামগুলো বলছি। কার্ডিনাল ল্যামাসে, প্যারিস থেকে; কার্ডিনাল গাইডেরা, বার্সিলোনা থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে কার্ডিনাল ইবনার…

প্রতিটা নাম পড়ার সাথে আরো আরো যেন কুঁকড়ে যাচ্ছিল ওলিভেট্টি।

আর ইতালি থেকে… কার্ডিনাল ব্যাজ্জিয়া।

যেন এইমাত্র ডুবে গেল ক্যামারলেনগোর ভরসার জাহাজ। বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকল ফোনের দিকে। এই প্রেফারিটি! ফিসফিস করল সে, চার ফেভারিট… ব্যাঞ্জিয়া সহ… সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে যাওয়া চার কার্ডিনাল… কী করে সম্ভব?

ল্যাঙডন আধুনিক পাপাল ইলেকশনের ব্যাপারে অনেক পড়েছে। নির্বাচনের আগে কয়েকজন কার্ডিনালের প্রস্তাব করা হয়। তাদের নিয়েই ভোট হবে। তাদের থেকেই একজন নির্বাচিত হবে পরবর্তী পোপ!

ক্যামারলেনগোর ভ্রূ থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরে পড়ছে। তুমি এ লোকদের নিয়ে কী করবে?

আপনার কী মনে হয়, কী করব? আমি হ্যাসাসিনদের সরাসরি বংশধর।

একটা ধাক্কা খেল ল্যাঙডন। নামটাকে সে ভালভাবেই চেনে। চার্চ বছরের পর বছর ধরে একে একে অনেক শক্রর জন্ম দিয়েছে হ্যাসাসিন, নাইট টেম্পলার, আরো নানা জাতের সৈন্যদল-যারা হয় গির্জার দ্বারা প্রতারিত হয়েছে নাহয় তাদের দাবড়ে বেড়িয়েছে চার্চ। খুন করেছে নৃশংসভাবে।

ছেড়ে দাও কার্ডিনালদের, অবশেষে রা ফুটল ক্যামারলেনগোর ঠোঁটে, ঈশ্বরের মহানগরী ধ্বংসের হুমকিই কি যথেষ্ট নয়?

আপনাদের চার কার্ডিনালের কথা স্রেফ ভুলে যান। আপনাদের কাছে তাদের আর কোন নাম-নিশানা নেই। একটা ব্যাপার ঠিক ঠিক মনে রাখুন, তাদের মৃত্যু স্মরণীয় হয়ে থাকবে… লাখ লাখ লোকের কাছে। প্রত্যেক শহীদের মৃত্যুর মত। আমি তাদের মিডিয়া-খ্যাতি পাইয়ে দিব ঠিক ঠিক। একের পর এক। মাঝরাতের মধ্যে ইলুমিনেটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। কেন শুধু শুধু পৃথিবীকে বদলে দেয়া যদি পৃথিবী না-ই জানল? লাখ লাখ লোকের কাছে আজো আতঙ্ক হয়ে আছেন আপনারা। অনেক অনেক আগেই তার প্রমাণ দিয়েছেন… হত্যাকান্ড, নাইট টেম্পলারদের উপর করা অত্যাচার, ক্রুসেডার… একটু থামে সে, আর, অবশ্যই, লা পাৰ্জা।

একেবারে নিরব হয়ে গেল ক্যামারলেগো।

আপনার কি আসলেই লা পাৰ্জার কথা মনে নেই? শাসানোর ভঙ্গিতে জিগ্যেস করল কলার, অবশ্যই, মনে থাকার কথা নয়, আপনি একজন দুগ্ধপোষ্য শিশু ছাড়া অন্য কিছুই নন। ঠুনকো একজন প্রিস্ট। প্রিস্টদের ইতিহাস জ্ঞান তথৈবচ। নাকি, এ ইতিহাস মনে রাখতে নেই কারণ এটা তাদের মনে লজ্জার কারণ হয়ে দেখা দেয়?

লা পাৰ্জা। হঠাৎ টের পায় ল্যাঙডন, সে কথা বলছে, মোলশো আটষট্টি, চার্চ চারজন ইলুমিনেটি বিজ্ঞানীকে হত্যা করে বুকে ক্রসের আগুন-ছাপ বসিয়ে দেয়। তাদের পাপ স্খলনের জন্য।

কে কথা বলছে? কণ্ঠটা যেন দাবি করল, যেন সে প্রশ্ন করলে সব প্রশ্নের জবাব দিতে সবাই বাধ্য, একপায়ে খাড়া, এখানে আর কে কে আছে?

আবার একটু ধাক্কা খায় ল্যাঙছন, আমার নাম কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। বলল সে, চেষ্টা করল সে কণ্ঠ ঠিক রাখতে। ব্যাপারটা এখনো ঠিক স্বস্তিকর লাগছে না। একজন জীবন্ত ইলুমিনেটাসের সাথে সে কথা বলছে… ব্যাপারটা তার কছে জর্জ ওয়াশিংটনের সাথে কথা বলার সমতুল্য। আমি একজন এ্যাকাডেমিক যে আপনাদের ব্রাদারহুডের উপর গবেষণা করেছে।

চমৎকার! সাথে সাথে জবাব দেয় কণ্ঠটা, আমি ব্যাপারটা ভেবে অত্যন্ত আনন্দিত হচ্ছি যে আমাদের সাথে করা তুলনাহীন অন্যায়ের ব্যাপারটা কেউ না কেউ মনে রেখেছে। আজো তা নিয়ে স্টাডি করছে।

আমাদের বেশিরভাগই মনে করে আপনারা বিলুপ্ত।

এমন এক ভ্রান্তি যা অনেক কষ্টে চাউর করেছে ব্রাদারহুড। লা পাৰ্জার ব্যাপারে আর কী জানেন আপনি?

একটু দ্বিধায় পড়ে যায় ল্যাঙডন। আর কী জানি আমি! এই পুরো পরিস্থিতি অত্যন্ত ঘোলাটে আর জটিল হয়ে উঠছে, ব্যস, এটুকুই জানি। চিহ্ন একে দেয়ার পর চার বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়। তারপর রোমের জনবহুল এলাকাগুলোয় সে লাশ ফেলে রাখা হয়, যেন আর কোন বিজ্ঞানী ইলুমিনেটিতে যোগ না দেয়।

ঠিক তাই। আর সেজন্যেই আমরা একই কাজ করব। কুইড প্রো কিউ। একে ধরে নিন আমাদের ব্রাদারহুডের প্রতিশোধ। আমরা ঠিক তাই করব আপনাদের কার্ডিনালদের নিয়ে যা করা হয়েছিল আমাদের সাথে। আটটা থেকে পালা শুরু হবে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় একে একে তারা মারা যাবে। মাঝরাতে ঘটনা চাউর হয়ে যাবে সারা দুনিয়ায়।

ল্যাঙডন ঝুঁকে এল ফোনের কাছে, আপনারা আসলেই সেই চারজনকে ইলুমিনেটির ছাপ দিয়ে রাস্তায় নিক্ষেপ করবেন?

হিস্টোরি রিপিটস ইটসেলফ, তাই নয় কি? অবশ্যই, গির্জা যতটা নিষ্ঠুর ছিল তারচে বেশি করব আমরা। তারা নির্জনে হত্যা করেছে, তারপর ফেলে দিয়েছে এমন সব সময় যখন মানুষ দেখতে পাবে না। ব্যাপারটা কি কাপুরুষ কাপুরুষ নয়?

কী বলছেন আপনি? চিৎকার করে ওঠে ল্যাঙডন, আপনারা মানুষের সামনে তাদের ব্র্যান্ডেড করে হত্যা করবেন?

খুব ভাল। অবশ্য ব্যাপারটা এমন, আপনারা মানুষের সামনে বলতে কী বোঝেন তার উপর নির্ভর করছে। আমার যদ্দূর মনে হয় আজকাল খুব বেশি লোক গির্জায় যায় না।

সাথে সাথে প্রশ্ন করে ল্যাঙডন, আপনারা তাদের চার্চে খুন করবেন?

দয়া করে। তাদের আত্মা যেন স্বর্গে খুব সহজেই তুলে নিতে পারেন ঈশ্বর। ব্যাপারটা এখানেই। অবশ্যই, সংবাদপত্রের লোকজনও থাকবে সেখানে।

ব্লাফ দিচ্ছেন আপনি, ওলিভেট্টি বলল, তার সেই চির শীতল কণ্ঠস্বরে। আপনারা কোন চার্চে একজন মানুষকে হত্যা করে পাততাড়ি গুটাতে পারবেন না মোটেও।

ব্লাফ দিচ্ছি? আপনার সুইস গার্ডের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রক্ত প্রবাহের মত আমাদের চলাফেরা। আপনারা দয়া করে মন থেকে ঐ চারজন কার্ডিনালকে সরিয়ে দিলাম, আপনাদের পবিত্রতম জায়গার হৃদপিন্ডে সবচে ভয়ঙ্কর বোমা পেতে দিলাম আর আপনারা ব্যাপারটাকে ব্লাফ মনে করছেন? খুনটা হয়ে যাবার পর মিডিয়া যখন হামলে পড়বে তখন বুঝবেন ব্লাফ কাকে বলে। মাঝরাতের মধ্যে পুরো দুনিয়া জেনে যাবে ইলুমিনেটির কথা।

আর আমরা যদি প্রত্যেক চার্চে গার্ড বসাই? প্রশ্ন তুলল ওলিভেট্টি। হাসল কলার। আমি জানি আপনাদের মান্ধাতার আমলের ধর্ম-মন্দিরে এমন কিছু করার চেষ্টা আপনারা করবেন। আমি ভাল করেই ব্যাপারটা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। আপনি যখন কথাটা বলছেন তখন কি ভাল করে ভাবেননি? রোমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারশ গির্জা। ক্যাথলিক গির্জার সাথে সাথে আরো আছে ক্যাথেড্রাল, চ্যাপেল, ট্যাবারনেল, এ্যাবে, মনাস্টারি, কনভেন্ট, প্যারোসিয়াল স্কুল…।

আরো শক্ত হয়ে গেল ওলিভেট্রির চোয়াল।

নব্বই মিনিটের মধ্যে খেলা শুরু হয়ে যাবে। একটু যেন ব্যস্ত কলার, এক ঘণ্টা অন্তর অন্তর। মরণের একটা গাণিতিক হার। এবার আমার যেতেই হচ্ছে।

দাঁড়ান! বলল ল্যাঙডন, আপনি তাদের গায়ে যে চিহ্ন একে দিতে চান সে সম্পর্কে কিছু বলুন।

যেন বেশ মজা পেয়েছে লোকটা, মনে হচ্ছে আগেভাগেই ব্যাপারটা সম্পর্কে। জেনে গেছেন আপনি! নাকি আপনি কোন স্কেপটিক? আর বেশি দেরি নেই, তাড়াতাড়িই দেখতে পাবেন সেগুলোকে। পুরনোদিনের কথাগুলো যে সত্যি তার প্রমাণ হিসেবেই দেখা যাবে সেগুলোকে।

মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ল্যাঙডনের। সে ঠিক ঠিক জানে লোকটা কী বলতে চায়। লিওনার্দো ট্রোর বুকের সেই চিহ্নটার কথা তার মনে পড়ে যায়। ইলুমিনেটির গল্পগাঁথায় পাঁচটা চিহ্ন একে দেয়ার কথা ছিল। আর চারটা ব্র্যান্ড বাকি, ভাবল সে, এবং চারজন কার্ডিনাল স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে।

আমার একটা প্রতিজ্ঞা ছিল, বলল ক্যামারলেনগো, প্রতিজ্ঞা ছিল ঈশ্বরের কাছে। আজ রাতেই আমি একজন নতুন পোপ আনব।

ক্যামারলেনগো, বলল কলার, দুনিয়ার নতুন একজন পোপের কোন প্রয়োজন নেই। আজ মাঝরাতের পর পৃথিবীর উপর ছড়ি ঘোরানোর মানুষগুলো থাকবে না। মিশে যাবে ইট পাথরের গুঁড়ার সাথে। ক্যাথলিক চার্চ শেষ। পৃথিবীতে আপনাদের রাজত্বের অবসান চলে এসেছে। খুব কাছে।

একটা নিরবতা ঝুলে আছে পুরো ঘর জুড়ে।

ক্যামারলেনগার চোখ একেবারে দ্বিধাবিভক্ত। আপনি ভ্রান্ত পথে আছেন। ভুল পথ দেখানো হয়েছে আপনাকে। একটা চার্চ শুধুই ইট পাথরের কোন গাঁথুনি নয়। আপনি দু হাজার বছরের বিশ্বাসকে এক লহমায় খুঁড়িয়ে দিতে পারেন না… কোন বিশ্বাসকেই নয়। কোন বিশ্বাসকে তার দুনিয়াবী সম্পদ ধ্বংস করে শেষ করে দেয়া যায়। ক্যাথলিক চার্চের ধারা চলতেই থাকবে। ভ্যাটিকান সিটি থাক আর নাই থাক।

কী মহৎ মিথ্যাচার! আমরা দুজনেই আসল সত্যিটা জানি। বলুন তো দেখি, ভ্যাটিকান দেয়ালঘেরা দুনিয়া কেন?

ঈশ্বরের মানুষেরা একটা ঝুঁকিপূর্ণ জগতে বসবাস করেন। চটপট বলল ক্যামারলেনগো।

আপনি কতটা তরুণ? ভ্যাটিকান সিটি একটা দেয়ালঘেরা বিশ্ব কারণ ক্যাথলিক গির্জার অর্ধেক সম্পদ এর ভিতরে। দুর্লভ পেইন্টিং, স্কাল্পচার, দামি গহনা, দুর্লভ বই… আর ভ্যাটিকান ব্যাঙ্কের ভিতরে দুনিয়ার তাবৎ গির্জার কাগজপত্র আর সোনার ঢিবি পড়ে আছে। সাড়ে আটচল্লিশ বিলিয়ন ডলার মূল্যের জিনিসপত্র ঐ একটা ব্যাঙ্কে সাজানো আছে। আপনারা একটা ডিম্বাকার ঘরে বসে আছেন, নিরাপদে, নিরুপদ্রব। আর কালকে এই সমস্ত সম্পদ স্রেফ ধ্বংসস্তুপ… বলা ভাল ছাইয়ে পরিণত হবে। এমনকি পোশাকী বাহিনী পাঠিয়েও কোন ফায়দা লুটে নেয়া যাবে না।

কথার সত্যতা সহজেই অনুমেয়। সাথে সাথে ছাইবর্ণ হয়ে গেছে ওলিভেট্টির মুখ আর ক্যামারলেনগোর চেহারা। কোনটা নিয়ে অবাক হতে হবে তা ভেবে পায় না ল্যাঙডন। ক্যাথলিক চার্চের অত সম্পদ আছে সেটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাবে, নাকি কী করে ইলুমিনেটি এই গোপন খবর পেল সেটা ভেবে হয়রান হবে।

ক্যামারলেনগো আবার শক্ত করে ফেলতে পারল মুখাবয়ব, বিশ্বাস এই গির্জার ভিত্তি। অর্থ নয়।

আবার মিথ্যা কথা! বলল কলার, যেন বেশ মজা পেয়েছে, গত বছর আপনারা একশো তিরাশি মিলিয়ন ডলার ব্যায় করেছেন আপনাদের মেরুদন্ড আরো পোক্ত করার কাজে। সারা দুনিয়া জুড়ে। চার্চে হাজির হওয়ার হার গত বছর ইতিহাসে সবচে নিচে নেমে এসেছে। ছিচল্লিশ ভাগ। দানের হারও সাত বছরে সবচে নিচে নেমে এসেছে। সেমিনারিতে মানুষের আসার হার কমছে তো কমছেই। আপনারা বলেন আর নাই বলেন, চার্চের মরণ ঘনিয়ে এসেছে এম্নিতেই, তার উপর আমরা একটু প্রভাবক যোগ করে দিলাম। আরেকটু দ্রুত হোক হাটা। এই আরকী!

এক পা এগিয়ে গেল ওলিভেট্টি, এখন আর তাকে আগের মত যুদ্ধংদেহী মনে হচ্ছে না। বরং যেন একটু বিদ্ধস্ত। যেন একটু নুয়ে পড়া। সত্যকে যেন সে মেনে নিচ্ছে। তার দৃষ্টি একজন কোণঠাসা মানুষের মত যে পালাবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। আর যদি এমন হয় যে আপনাদের ফান্ডে সেই ক বিলিয়নের কিয়দংশ আপনাদের গাঁটে জায়গা করে নেয়?

আমাদের দু পক্ষকেই অপমান করার কোন মানে হয় না।

আমাদের অনেক অনেক টাকা আছে।

ঠিক আমাদের মতই। আপনারা তার কোন তল খুঁজে পাবেন না।

ইলুমিনেটির অর্থ সম্পদের কথা একবার মনে করার চেষ্টা করল ল্যাঙডন। সেই আদ্যিকাল থেকে তারা সামরিক দিক দিয়ে শক্তিমান হবার বদলে সমস্ত মনোযোগ দিয়েছে অর্থনীতি আর রাজনীতির দিকে। সেই কবেকার মেসনদের সম্পদও তাদের করতলে। প্রথমদিকের ব্যাভারিয়ান মেসনদের সম্পদ, রথসচাইল্ডের টাকার কাড়ি, বিল্ডার বার্গার আর ইলুমিনেটির সেই হীরা।

আই প্রেফেরিতি! প্রসঙ্গ বদল করল ক্যামারলেনগো, অনুনয় ঝরে পড়ল তার ঠান্ডা কণ্ঠে ছেড়ে দিন তাদের। তারা বয়স্ক। তারা

তারা চিরকুমার… হাসল কলার, গা জ্বালানো হাসি, আপনি কি সত্যি সত্যি মনে করেন তাদের কৌমার্য অক্ষত আছে? তাদের মরণের সময় সত্যি কি তাদের জন্য কেঁপে উঠবে ঈশ্বরের সিংহাসন? স্যাক্রিফিসি ভার্জিনি নেল অল্টেয়ার ডি সিয়েঞ্জা।

অনেক অনেক সময় ধরে চুপ করে থাকল ক্যামারলেনগো, তারপর বলল, তারা বিশ্বাসের মানুষ। আর অবশেষে সাহস ভর করল তার কণ্ঠে, তারা মরণকে ভয় পান না।

হাসল কলার। লিওনার্দো ভেট্রাও বিশ্বাসের মানুষ ছিল। গতরাতে তাকে যখন আমি হত্যা করি তখন তার চেহারায় রাজ্যের ভয় ভর করেছিল। এমন একটা ভয় যেটাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম আমি।

এতোক্ষণ চুপ করে ছিল যে, সেই ভিট্টোরিয়া এবার সাথে সাথে জুলে উঠল তেলে বেগুনে। এ্যাসিনো! সে ছিল আমার বাবা।

একটা মৃদু হাসি শোনা গেল ফোনের অপর প্রান্ত থেকে, আপনার বাবা? কী শুনছি আমি! ট্রোর একটা মেয়েও আছে নাকি? আপনার জানা উচিৎ, শেষ বেলায় আপনার বাবা হাল ছেড়ে দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছিল। বাচ্চা ছেলের মত। আফসোস। কিন্তু যে

সত্যি তাই বলছি আমি।

কথাগুলো যেন কোণঠাসা করে ফেলল ভিট্টোরিয়াকে! একেবারে পড়ে যেতে নিয়েও দাঁড়িয়ে রইল সে কোনমতে। সাহায্য করার জন্য ল্যাঙডন এগিয়ে যেতেই আবার সামলে নিল। তার গহীন চোখদুটা স্থির হল ফোনের দিকে, আমি আমার প্রাণ হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, আজ রাতটা কেটে যাবার আগেই আমি তোমার টুটি চেপে ধরব। তার কণ্ঠ আরো আরো চিকণ হয়ে যাচ্ছে, আর একবার তোমাকে পেলে…

আবার হাসল লোকটা, তেজ আছে মেয়েটার। আমি স্তম্ভিত! হয়ত আজ রাত পেরিয়ে যাবার আগেই আমি তোমাকে খুঁজে পাব, আর একবার তোমাকে পেলে…

কথাটুকু ভেসে থাকল বাতাসে কিছুক্ষণ। তারপর সে চলে গেল।

৪২.

কার্ডিনাল মর্টাটি কালো রোব গায়ে দেয়া অবস্থায় ঘেমে একসা হচ্ছেন। সিস্টিন চ্যাপেলের কী অবস্থা তা ঈশ্বরই ভাল জানেন। এটা যেন কোন শোনা বাথের ঘর। আর বিশ মিনিটের মধ্যে কনক্লেভ শুরু হয়ে যাবে। এখনো কোন পাত্তা নেই সেই চার কার্ডিনালের। তাদের অনুপস্থিতিতে অন্য কার্ডিনালদের কথোপকথন এখন অস্থিরতার রসে জারিত হচ্ছে।

ভেবে পান না কোন চুলায় যেতে পারেন ঐ চার কার্ডিনাল। ক্যামারলেনগার সাথে নেই তো? ভাবেন তিনি। তার ভালই জানা আছে, ক্যামারলেনগো আজ বিকালে বেছে নেয়া চারজনের সাথে চা-চক্রে বসেছিলেন। কিন্তু সেটী কয়েক ঘণ্টা আগের কথা। তারা কি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? খাবারের সাথে বেখাপ্পা কিছু গিলিয়ে দেয়া হয়নি তো? এ নিয়েও সংশয় কম নেই। মৃত্যুশয্যায় থাকলেও তারা এখানে হাজির হতেন সময় মত। একটা জীবনে এমন সুযোগ আর আসে না। সুপ্রিম পন্টিফ হিসেবে নির্বাচিত হতে হলে অবশ্যই সেই কার্ডিনালকে এই সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরে থাকতে হবে নির্বাচনের সময়। এ নিয়মের কোন ব্যয় নেই।

চারজন প্রেফারিতি থাকলেও কার্ডিনালদের মধ্যে দ্বিধা আছে, কে হতে পারেন সেই সোনার মুকুটধারী। গত পনেরটা দিন একের পর এক ফোন আর ফ্যাক্স এসেছে, কে হতে পারেন পরবর্তী পোপ। কথামত চারজনকে প্রেফারিতি হিসেবে ধরা হয়। পোপ হবার সমস্ত গুণাবলী তাদের মধ্যে বিদ্যমান।

ইতালিয়, স্প্যানিয়, ইংরেজিতে দক্ষতা,
ক্লজিটের ভিতরে কোন কঙ্কাল থাকতে পারবে না, বয়স হতে হবে পঁয়ষট্টি থেকে আশির মধ্যে।

প্রথমত, একজন প্রেফারিতিকে আর সবার সামনে কলেজ অব কার্ডিনালরা প্রস্ত বিনা করবেন। আজরাতের সেই মানুষের নাম কার্ডিনাল অলডো ব্যাজ্জিয়া, এসেছেন মিলান থেকে। ব্যাজ্জিয়ার কাজের অতুলনীয় রেকর্ড, অসাধারণ ভাষাজ্ঞান আর আত্মিক যোগাযোগে দক্ষতার কারণে তাকেই সবাই সবচে সম্ভাবনাময় বলে ধরে নিয়েছেন।

আর এখন সেই দানব কোথায়? প্রশ্ন ছোঁড়েন মর্টাটি।

এই কনক্লেভ পরিচালনা বা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তার ঘাড়ে পড়েছে দেখে মর্টাটি যুর পর নাই উদ্বিগ্ন হন। এক সপ্তাহ আগে থেকেই কলেজ অব কার্ডিনালস মর্টাটিকে দ্য গ্রেট ইলেক্টর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল-কনক্লেভের অভ্যন্তরীণ নেতা। ক্যামারলেনগো আসলে প্রথা অনুযায়ী প্রশাসনের প্রধান হলেও সে সামান্য একজন প্রিস্ট। আর নির্বাচনের জটিলতা বা পদ্ধতি কোনটা সম্পর্কেই তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তাই সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরে এই পুরো প্রক্রিয়া তদারকির জন্য কার্ডিনালদের মধ্যে একজনকে বেছে নেয়া হয়।

কার্ডিনালরা প্রায়ই বলাবলি করেন যে গ্রেট ইলেক্টর নির্বাচিত হওয়া এক প্রকারের নিষ্ঠুর তামাশার নামান্তর। নির্বাচন যেন সুষ্ঠুভাবে হয় তা দেখার দায়িত্ব তার, আবার তিনি সাধারণত বয়োজ্যেষ্ঠ হন, তার ভিতরে পোপ হবার গুণাবলী থাকে, তবু তিনি অন্য কাউকে নির্বাচিত করার পথে সহায়তা করতে পারেন, ব্যস, এটুকুই। তার নিজের পক্ষে নির্বাচিত হবার কোন সুযোগ থাকে না।

কিন্তু এ নিয়ে মাটির মনে কোন আফসোস নেই। বরং দায়িত্ব পেয়ে তিনি খুশীই। তিনি যে সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরের কার্ডিনালদের মধ্যে সবচে বয়সী তাই শুধু নয়, তিনি ছিলেন বিগত পোপের খুব কাছের মানুষ। যদিও তিনি প্রার্থি হবার যোগ্যতা রাখেন, উনআশি বছর বয়স্ক হিসাবে, তবু পোপ হিসেবে নির্বাচিত করায় কিছু সমস্যা আছে। এখন আর তিনি তেমন শক্তপোক্ত নন। কার্ডিনালদের কলেজ তাঁকে আর এই জীবনের এত লম্বা সময় পেরিয়ে এসে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় পোপত্বের মত বড় একটা খাটুনির কাজে নিয়োগ দিতে ঠিক রাজি নয়। একজন পোপ গড়ে দিনে চৌদ্দ ঘণ্টা, সপ্তাহে সাতদিন এবং জীবনে ছয় দশমিক তিন বছর কাটান প্রচন্ড ব্যস্ততায়। তারপর ত্যাগ করেন শেষ নিঃশ্বাস। নিষ্ঠুর রসিকতাটা হল, পোপত্ব মেনে নেয়া আর স্বর্গের দিকে দ্রুত ধাবিত হওয়া একই মুদ্রার আরেক পিঠ।

অনেকেই মনে করেন, মর্টটি তার আরো তরুণ বয়সে পোপত্ব পেতে পারতেন যখন তিনি ছিলেন শক্ত-সমর্থ এবং একই সাথে একটু কট্টর। যখন এ পোপত্ব আসে তখন তিনটা পবিত্র বৈশিষ্ট থাকতে হয়

রক্ষণশীলতা, রক্ষণশীলতা, রক্ষণশীলতা।

একটা ব্যাপার মৰ্টিটি বেশ খেয়াল করেছেন, বিগত পোপ, ঈশ্বর তাঁর আত্মাকে শান্তিতে রাখুন, ছিলেন অনেক বেশি উদারপন্থী, অবশ্যই পোপতৃ পাবার পরে। তিনি বুঝতে পারছিলেন, পৃথিবীর গতি এখন অনেক বেশি। মানুষ গির্জার গন্ডি অনেক আগেই পিছনে ফেলে এসেছে, এই হার আরো আরো বাড়ছে, গাণিতিক হারে। তাই তিনি চার্চকে অনেক বেশি উদারপন্থি হিসেবে জাহির করলেন। এমনকি কিছু নির্বাচিত গবেষণার জন্য অর্থও বরাদ্দ করলেন। কিন্তু আসলে এটা রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। রক্ষণশীল ক্যাথলিকরা তার উপর ভ্রান্তির কলঙ্ক চাপিয়ে দিল তাৎক্ষণাৎ। তারা শতমুখে বলতে লাগল, পোপ চার্চকে এমন সব ক্ষেত্রে নিয়ে যাচ্ছেন যেখানে এর আওতা নেই।

তো, তারা কোথায়?

ঘুরে গেলেন মাটি।

একজন কার্ডিনাল অনেকটা অনিশ্চয়তা নিয়ে তার কাঁধে টোকা দিচ্ছিলেন। আপনি জানেন তারা কোথায়, তাই না?

মর্টাটি খুব একটা উদ্বিগ্নতা না দেখিয়েই বললেন, সম্ভবত ক্যামারলেনগোর সাথে।

এই সময়ে? এটা একেবারে নিয়ম বহির্ভুত। ক্যামারলেনগো সময়ের কথা ভুলে যাননি তো?

এ কথায় মাটি ঠিক রাজি হতে পারলেন না। কিন্তু চুপ করে থাকাকেই শ্রেয় মনে করলেন। একটা কথা বেশিরভাগ কার্ডিনাল মনে করেন, ক্যামারলেনগোর কোন মূল্য। নেই। এই লোক পোপকে কাছ থেকে দেখাশোনা করার হিসেবে একেবারে বাচ্চা। মর্টাটি জানেন, এদের বেশিরভাগের এই মনোভাবের পিছনে কাজ করে হিংসা। কিন্তু মনে মনে তারিফ করেন মাটি এই কমবয়েসি ক্যামারলেনগোর। পোপ ভুল করেননি এমন একজন চেম্বারলিনকে নিয়োগ দিয়ে। আর একটা ব্যাপার বলার মত, ক্যামারলেনগোর চোখ-মুখে একটা অন্যরকম দীপ্তি আছে। আর অনেক কার্ডিনাল যেটা পারেননি সেটা করে দেখিয়েছেন এই ক্যামারলেনগো। রাজনীতি আর স্বার্থ থেকে চার্চকে সুন্দরভাবেই দূরে রাখতে সমর্থ হয়েছেন। ব্যাপারটা দুর্লভ। আসলেই, এ লোক ঈশ্বরের মানুষ।

তবু এই ক্যামারলেনগোর থলেতে যে কিছুই নেই সেটা বলা যাবে না। বরং অনেক বেশি অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপার আছে তাকে ঘিরে, তার ছেলেবেলায়… এমন একটা ব্যাপার ঘটেছিল যার কোন তুলনা নেই। সব মানুষের মনেই একটা স্থির বিশ্বাসের জন্ম। দেয় ব্যাপারগুলো। মনে মনে একটু আফসোসও করেন মর্টাটি। তার কৈশোরে এমন। মিরাকল ঘটলেও ঘটতে পারত।

চার্চের দুর্ভাগ্য, ভাবলেন তিনি, পরিণত বয়সেও কখনোই ক্যামারলেনগো পোপ হতে পারবে না। পোপ হবার জন্য প্রচন্ড রাজনৈতিক জেদ থাকা দরকার যা এই অপেক্ষাকৃত তরুণ লোকটার ভিতরে নেই। বারবার সে পোপের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে, সে খুব বেশি কিছু হতে চায় না। আর দশজনের মত থেকে চার্চের সেবা করাই তার ইচ্ছা।

এরপর কী হবে? আবার কার্ডিনাল তার কাঁধে টোকা দিলেন।

চোখ তুলে তাকালেন মাটি, আই এ্যাম স্যরি?

দেরি হয়ে যাচ্ছে তাদের। কী করব আমরা?।

আমরা আর কী করতে পারি? সতেজে জবাব ঝাড়লেন মাটি, আমরা অপেক্ষা করব। বিশ্বাস রাখব অটুট।

পুরোপুরি অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেলেন কার্ডিনাল ছায়ায়।

একটা দীর্ঘ মুহূর্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন মর্টাটি। আসলেই, কী করব আমরা? তিনি ফাঁকা চোখে তাকালেন মাইকেলেঞ্জেলোর করা সেই ভুবনখ্যাত দেয়ালচিত্রের দিকে। দ্য লাস্ট জাজমেন্ট। তার ব্যকুলতা একটু কমাতে পারল না ছবিটা। এটা পঞ্চাশ ফুট লম্বা বিশাল এক ছবি। সেখানে যিশুখ্রিস্ট মানুষের বিশাল এক দলকে দেখাচ্ছেন পথ। পাপীরা চলে যাচ্ছে নরকের দিকে, নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। আর পথপ্রাপ্তরা। অপেক্ষা করছে। মাইকেলেঞ্জেলোর শত্রুদের একজন বসে আছে নরকে, তার পরনে গাধার কান। জা দি মপসাঁ একবার বলেছিলেন যে ছবিটা দেখে মনে হয় কোন নিচু স্তরের কয়লা-আকিয়ে কোন রেসলিং বুথের জন্য ছবি একে রেখেছে।

একমত হলেন কার্ডিনাল মাটি।

৪৩.

ল্যাঙডন তাকিয়ে আছে নিচের মিডিয়ার লোকজনের দিকে, তাদের ট্রাকগুলোর দিকে, পোপের বুলেটপ্রুফ অফিসে দাঁড়িয়ে থেকে। বিচ্ছিরি ফোনকলের কথাগুলো তার মনে বারবার আঘাত করছে… কেন যেন তেতে উঠছে মন। তার নিজের প্রতি নয়, অবশ্যই।

ইলুমিনেটি, পুরনো দিনের একটা বিশাল সাপের মত বেরিয়ে এসেছে গর্ত থেকে, আর এসেই সোজা জড়িয়ে ধরেছে তাদের অষ্টেপৃষ্ঠে। কোন দাবি নেই। নেই কোন হাত মেলানো। শুধুই শোধ। শয়তানির মতই সরল। শুষে ফেলা। এমন এক প্রতিশোধ, যার জন্য চারশো বছর অপেক্ষা করতে হল। শতবর্ষের খোলস ছেড়ে বিজ্ঞান এবার তেড়েফুড়ে আসছে প্রচন্ড প্রলয় হাতে নিয়ে।

ক্যামারলেনগো সোজা বসে আছে তার আসনে। ফাঁকা দৃষ্টি ফেলছে ফোনের উপর। ওলিভেটিই প্রথমে নিরবতা ভাঙল, কালো, বলল সে, ক্যামারলেনগোর প্রথম নাম ধরে, তার কণ্ঠে অফিসারসুলভ কোন ভঙ্গিমা নেই, তার বদলে ভয়ে জবুথবু এক বন্ধুর চিহ্ন পাওয়া যায়। ছাব্বিশ বছর ধরে আমি এই অফিসের নিরাপত্তার জন্য প্রাণপাত করেছি। আজ রাতে আমার মনে হচ্ছে আমার যথাযথ সম্মানটুকু পাচ্ছি না।

ক্যামারলেনগো সাথে সাথে বলল, আমি আর আপনি দুজনেই দু পথে ঈশ্বরের সেবা করে গেছি। আর সেবা সব সময় সম্মান বয়ে আনে।

এই ব্যাপারগুলো… আমি কল্পনাও করতে পারি না কী করে… এই পরিস্থিতি… ওলিভেট্টি যেন একেবারে মিইয়ে গেছে।

আপনি জানেন, আমাদের সামনে একটা মাত্র পথ খোলা আছে। কলেজ অব কার্ডিনালের নিরাপত্তার জন্য আমার ঘাড়েও একটা দায়িত্ব বর্তায়।

আমার ভয় হচ্ছে, দায়িত্বটা আসলে পুরোদস্তুর আমার, সিনর।

তার মানে আপনার লোকজন খুব দ্রুত এ জায়গা খালি করার কাজে নেমে পড়বে।

সিনর?

পরের কাজটার জন্য পরে উঠেপড়ে লেগে গেলেও চলবে। ডিভাইসটার খোঁজ পরে করলেও আমাদের চলবে। খোঁজ করতে হবে হারানো কার্ডিনালদেরও। কিন্তু সবার আগে এখানে হাজির কার্ডিনালদের নিরাপত্তার দিকটা দেখতে হবে আমাদের। মানুষের মূল্য আর সবকিছুর উপরে। ঐ লোকগুলো এ গির্জার ভিত।

আপনি বলছেন এখন আমরা কনক্লেভ বাদ দিয়ে দিব?

আর কোন উপায় কি আছে আমার?

নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য আপনার উপর যে দায়িত্ব ছিল তার কী হবে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তরুণ চ্যাম্বারলিন ফিরে দাঁড়াল জানালার দিকে। নিচে, রোমের দিকে তার দৃষ্টি ঘুরছে ফিরছে। হিজ হলিনেস একবার আমাকে বলেছিলেন যে পোপ হলেন এমন এক মানব যিনি দুটা জগতের মাঝখানে পড়ে যান… বাস্তব ভুবন আর ঐশ্বরিক দুনিয়া। তিনি সব সময় আমাকে মনে করিয়ে দিতেন যে, কোন চার্চ যখনি বাস্তবতাকে মেনে না নিয়ে কাজ করবে সে-ই বঞ্চিত হবে ঐশ্বরিক জগতে। হঠাৎ তার কণ্ঠে ঝরে পড়ল বাস্তবতা, আমাদের উপর আজ রাতে বাস্তব দুনিয়া ভেঙে পড়ছে। আমরা সেটাকে অবহেলা করার কোন উপায় দেখতে পাচ্ছি না। ঐতিহ্য আর গর্ব কখনোই কারণকে অবজ্ঞা করতে পারে না।

নড করল ওলিভেট্টি, তার চোখেমুখে সত্যিকার বন্ধুত্ব, আমি আপনাকে ছোট করে দেখেছি, সিনর।

কথাটা যেন শুনতে পায়নি ক্যামারলেনগো, তার চোখ ঘুরে ফিরছে রোমের উপরে।

খোলাখুলিই বলব আমি, সিনর। বাস্তব দুনিয়া হল আমার দুনিয়া। আমি প্রতিদিন এত বেশি বার এ নোংরা দুনিয়ার মুখোমুখি হই, এত বেশিবার পৃথিবীর খারাপ দিকগুলোর মোকাবিলা করি, একটা মাত্র কারণে, অন্যরা যেন একটা পরিষ্কার জগৎ উপহার পায়। আমাকে আজ বলতে দিন। এ পরিস্থিতির জন্যই আমাকে বারবার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে… আপনার সিদ্ধান্ত ভয়ংকর হতে পারে।

ঘুরে দাঁড়াল ক্যামারলেনগো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ওলিভেট্টো। এখন আপনার পক্ষে সবচে বেশি জটিল হবে

যে কাজটা, তা হল, কলেজ অব কার্ডিনালসকে সিস্টিন চ্যাপেল থেকে বের করে আনা।

ক্যামারলেনগো যেন খুব একটা দ্বিমত পোষণ করছে না। আপনি কী বলেন?

কার্ডিনালদের কিছু না বলা। তাদের কনক্লেভ সিল করে দেয়া। সেই সাথে সময় বুঝে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া। আমাদের হাতে যেটা সবচে বেশি প্রয়োজন, তা হল, সময়।

দ্বিধায় পড়ে গেছে যেন ক্যামারলেনগো, আপনি কি বলতে চান যে টাইম বোমার উপরে রেখে কলেজ অব কার্ডিনালসকে কনক্লেভে বন্দি করে ফেলব?

জ্বি, সিনর। এখনকার জন্য। পরে, যদি প্রয়োজন পড়েই যায়, আমরা দ্রুত তাদের সরিয়ে নিতে পারব।

মাথা নাড়ল ক্যামারলেনগো, দরজা বন্ধ হয়ে যাবার আগে যা করার করতে হবে। একবার কনক্লেভ বন্ধ হয়ে গেলে সেটাকে আর কোনমতেই সরানো যাবে না। নিয়ম অনুযায়ী…

বাস্তব ভুবন, সিনর। আজ রাতে আপনি এখানেই আছেন। মন দিয়ে শুনুন। এবার ওলিভেট্টির জবানি শুনতে কোন ফিল্ড অফিসারের সুরের মতই শোনাচ্ছে, একশো পয়ষট্টিজন কার্ডিনালকে রোমে তুলে আনা একই সাথে অনিরাপদ এবং ঝামেলার কাজ। তাদের সর্বাই বয়স্ক। সবাই শারীরিকভাবে একটু হলেও অক্ষম। তাদের এই বয়সে এতখানি সরিয়ে আনা একেবারে অবিবেচকের মত কাজ হবে। এ মাসে একটা চরম স্ট্রোকই যথেষ্ট।

একটা চরম স্ট্রোক। কথাটা মনে করিয়ে দিল ল্যাঙডনের অতীত স্মৃতি। সে হার্ভার্ডে থাকার সময় পত্রিকায় দেখেছিলঃ পোপ স্ট্রোকে ভুগেছেন। ঘুমন্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

এ ছাড়াও, বলছে ওলিভেট্টি, সিস্টিন চ্যাপেল আসলে একটা দুর্গ। আমরা কথাটা বলে বেড়াই না। কিন্তু এর ভিত যে কোন ধাক্কা সয়ে যাবার মত করে তৈরি করা। আমরা আজ বিকালে পুরো চ্যাপেল খুঁটিয়ে দেখেছি। কোন ছারপোকা বা অন্য কোন ধরনের আড়ি পাতার যন্ত্রের খোঁজেই আমাদের এ কাজ করতে হয়। চ্যাপেল একেবারে পরিচ্ছন্ন। আর আমি নিশ্চিত এন্টিম্যাটারটা আর যেখানেই থাক না কেন, চ্যাপেলের ভিতরে নেই। এখন এমন কোন নিরাপদ জায়গা নেই যেখানে এ মানুষদের থাকতে দেয়া যায়। আমরা পরে অবশ্যই জরুরি নির্গমন করাতে পারব। তাই ব্যাপারটা বাদ দিয়ে দেয়া হচ্ছে না।

আবার চমৎকৃত হল ল্যাঙডন। ওলিভেট্টির এই শীতল যুক্তি আর ধারালো কথা মনে করিয়ে দিল কোহলারের নাম।

কমান্ডার, বলল ভিট্টোরিয়া, তার কণ্ঠ ভয় পাওয়া, আরো চিন্তার বিষয় আছে। এত বেশি পরিমাণে এন্টিম্যাটার আর কেউ বানায়নি। বিস্ফোরণের এলাকা, আমি শুধু হিসাব করতে পারি। আশপাশের রোমের কিছু অংশও ঝুঁকির মধ্যে আছে। ক্যানিস্টারটা যদি আপনাদের ভিতরের মাঝামাঝিতে থাকা কোন ভবনে লুকানো থাকে, যদি আন্ডারগ্রাউন্ডেও থাকে, তবু তার প্রভাব এই দেয়ালের বাইরে খুব একটা ক্ষতিকর নাও হতে পারে… এ বিল্ডিংয়ে, উদাহরনের জন্য বলছি… সে একটা দৃষ্টি বুলিয়ে নেয় সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারের দিকে।

বাইরের দুনিয়ার দিকে আমার কী কাজ আছে সে ব্যাপারে আমি ভাল করেই জানি। বলল ওলিভেট্টি, আর তাতে এই পরিস্থিতির কোন উন্নতি হবে না, আর যাই হোক না কেন। দু দশকেরও বেশি সময় ধরে আমার আত্মার ধ্যান-ধারণা এই ভবনগুলোর নিরাপত্তার সাথে জড়িত। আমার কোন ইচ্ছা নেই, এমন কোন ইচ্ছা। নেই… জিনিসটা বিস্ফোরিত হোক এমনটা আমি কখনোই চাইনি।

ক্যামারলেনগো এবার আশা নিয়ে একটা দৃষ্টি দিল, আপনি মনে করেন এটাকে খুঁজে বের করতে পারবেন?

সার্ভেল্যান্স স্পেশালিস্টদের ব্যাপারে কিছু কথা বলতে দিন আমাকে। আমরা যদি ভ্যাটিকানের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিই। যদি এখান থেকে বিদ্যুতের সমস্ত কর্মকান্ড বন্ধ করে দিই তাহলে সহজেই বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের পরীক্ষা করে বের করে ফেলতে পারব এন্টিম্যাটারটুকু।

যেন অবাক হল ভিট্টোরিয়া, আপনি ভ্যাটিকান সিটিকে ব্লাক আউট করে ফেলতে চান?

সম্ভবত। আমি বলব না যে ব্যাপারটা খুব একটা সহজ হবে। কিন্তু একটা চেষ্টা চালিয়ে দেখা যায়।

কার্ডিনালরা তখন বোঝার চেষ্টা করবেন কী ঘটছে এখানে। বলল ভিট্টোরিয়া।

ওলিভেট্টি সাথে সাথে জবাব দিল, কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয় মোমবাতির আলোয়। কার্ডিনালরা জানতেই পারবেন না। একবার কনক্লেভ সিল হয়ে গেলেই আমার সব প্রহরী নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে পারব, মাত্র কয়েকজনকে পাহারায় রাখলেই চলবে। একশো মানুষ খুব তাড়াতাড়ি বিশাল এলাকা চষে ফেলতে পারবে। পাঁচ ঘণ্টা অনেক সময়।

চার ঘণ্টা। বলল ভিট্টোরিয়া, ক্যানিস্টারটাকে আমার উড়িয়ে নিতে হবে সার্নে। ব্যাটারি রিচার্জ না করলে বিস্ফোরণ অবশ্যম্ভাবী।

এখানে রিচার্জ করার কোন উপায় নেই?

মাথা ঝাঁকাল ভিট্টোরিয়া, ইন্টারফেসটা খুব জটিল। আমি পারলে সেটা তুলে আনতাম।

তাহলে চার ঘণ্টাই সই। বলল ওলিভেট্টি, এখনো সময় আছে হাতে। আতঙ্ক আর যাই হোক, কোন কাজে আসবে না। সিনর, আপনার হাতে দশ মিনিট সময় আছে। সোজা চলে যান কনক্লেভের দিকে, সিল করে দিন। আমার লোকজনকে কাজ করার জন্য কিছুটা সময় দিন। আমরা যত ঝুঁকিপূর্ণ সময়ের কাছে যাব তত ঝুঁকিহীন সিদ্ধান্ত নিব।

ল্যাঙডন ভেবে পেল না আর কত ঝুঁকিপূর্ণ সময়ের দিকে এগুতে চাচ্ছে লোকটা।

ফাঁকা দৃষ্টি ক্যামারলেনগোর চোখে, কিন্তু কলেজ সাথে সাথে প্রেফারিতিদের ব্যাপারে প্রশ্ন করবে… বিশেষত ব্যাজ্জিয়ার ব্যাপারে… তারা কোথায়।

তাহলে সাথে সাথে আপনার অন্য কোন ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে, সিনর। বলুন, তাদেরকে চায়ের সাথে এমন কিছু খাইয়েছেন যার কারণে এখন তারা আসতে সমর্থ নন।

ক্ষেপে উঠল ক্যামারলেনগো, সিস্টিন চ্যাপেলের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কলেজ অব কার্ডিনালসের সামনে কনক্লেভের আগের মুহূর্তে মিথ্যা কথা বলব?।

তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই। উনা ব্যাগিয়া ভেনিয়ালে। একটা শুভ্র মিথ্যা কথা। আপনার কাজ শান্তি বজায় রাখা। দরজার দিকে তাকাল ওলিভেটি, এখন আপনি যদি আমাকে ক্ষমা করেন তো কাজ শুরু করতে পারি।

কমান্ডান্টে, বলল ক্যামারলেনগো, যুক্তি দেখিয়ে, হারিয়ে যাওয়া কার্ডিনালদের ব্যাপারে আমরা পিছন ফিরে থাকতে পারি না।

ওলিভেট্টি সাথে সাথে দরজা থেকে ফিরে তাকাল, ব্যাজ্জিয়া এবং অন্যেরা এখন আমাদের ক্ষমতার বাইরে। আওতায় নেই তারা। এখন অবশ্যই তাদের যেতে দিতে, হবে… সবার কল্যাণের জন্য। সামরিক দৃষ্টিতে এটাকে ট্রায়াজ বলা হয়।

আপনি কি ছেড়ে আসা বোঝাতে চাচ্ছেন না?

তার কণ্ঠ এবার শক্ত হয়ে উঠল, যদি কোন উপায় থাকত, সিনর… স্বর্গে যদি ঐ কার্ডিনালদের চিহ্নিত করার কোন উপায় থাকত, আমি আমার জীবন নষ্ট করে দিতাম তাদের খুঁজে বের করার কাজে। আর এখনো… সে হাত তুলল ডুবে যেতে বসা সূর্যের দিকে, তার রক্তিম আভায় রোমের বিশাল ছাদ-সমুদ্র ঝকঝক করছে, পঞ্চাশ লাখ লোকের সিটিতে সার্চ চালানো আমার আওতার বাইরে। একটা নিস্ফল কাজের জন্য এ মুহূর্তে এক পল সময়ও আমি ব্যয় করতে রাজি নই। আমি দুঃখিত।

কিন্তু হাল ছাড়ার মানুষ নয় ভিট্টোরিয়া, কিন্তু আমরা যদি খুনীকে ধরে ফেলি? আপনি কি তাকে কথা বলাতে পারবেন না?

সাথে সাথে অগ্নিদৃষ্টি হানল ওলিভেট্টি তার দিকে, সৈন্যরা কখনোই সাধু সাজার চেষ্টা করে না, মিস ভেট্রা। বিশ্বাস করুন, আমি আপনার ব্যক্তিগত দুঃখটার ব্যাপারে একমত। এ লোককে ধরার ব্যাপারে আমার মনে কম ক্ষোভ নেই।

শুধু ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কথা বলছি না আমি, সাথে সাথে ইটের বদলে পাটকেল ছুঁড়ে দেয় ভিট্টোরিয়া, খুনী জানে এন্টিম্যাটারটা কোথায় আছে… জানে কোথায় আছেন হারানো কার্ডিনালরা… যদি কোনক্রমে তাকে একবার বগলদাবা করা যায়…

বিশ্বাস করুন আমার কথা, যে কথা আপনি বলছেন তেমন কিছু করা আদৌ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের সীমিত জনবল নিয়ে রোমের শত শত গির্জা চষে ফেলতে অনেক সময় লাগবে এবং সেজন্য পুরো ভ্যাটিকান সিটিকে খালি করে ফেলতে হবে… কোন প্রহরী থাকবে না… তার পরও, সেই ইলুমিনেটি লোকটাকে কুপোকাৎ করা কোন সহজ কম্ম হবে না। বাকী যে কার্ডিনালরা আছেন তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে মুখে কুলুপ এটে রাখাই শ্রেয়।

ব্যাপারটা সবাইকে নতুন করে ভাবাল।

রোমান পুলিশের সাহায্য নেয়ার ব্যাপারে কী বলেন আপনি? ক্যামারলেনগো সাথে সাথে বলল। আমরা তাদের সহায়তায় পুরো মহানগরী চষে ফেলতে পারি। অপহরণ করা কার্ডিনালদের খুঁজে বের করার জন্য এরচে ভাল আর কোন উপায় নেই।

আরেকটা ভুল। বলল ওলিভেট্টি, আপনি ভাল করেই জানেন রোমান। কারাবিনিয়েরি আমাদের সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করে। আমরা সারা দুনিয়ার সামনে আমাদের ক্রাইসিসটার কথা প্রচার করার বদলে সামান্য একটু লোক দেখানো সহায়তা পাব। ব্যস। এই ব্যাপারটাই চাচ্ছে আমাদের শক্ররা। দ্রুত মুখোমুখি হতে হবে মিডিয়ার। তাতেই তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।

আমি আপনাদের কার্ডিনালদের মিডিয়ার সামনে তুলে ধরব, খুনীর কথাটা মনে পড়ে যায় ল্যাঙডনের, রাত আটটায় প্রথম কার্ডিনালের মরদেহ পড়ে থাকবে। তারপর প্রতি ঘণ্টায় একটা করে। প্রেস ব্যাপারটাকে ভালবাসবে।

আবার কথা বলছে ক্যামারলেনগো, তার কণ্ঠে রাগের একটু আভাস, কমান্ডার, আমরা হারানো কার্ডিনালদের ব্যাপারে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।

চোখে মরা মানুষের দৃষ্টি নিয়ে ক্যামারলেনগোর দিকে তাকায় ওলিভেট্টি, সেন্ট ফ্রান্সিসের জন্য যে প্রার্থনা করা হয়, সিনর। আপনার কি কথাটা মনে আছে?

ক্যামারলেনগোর কণ্ঠে ধ্বণিত হয় বেদনার করুণ সুর, হে ঈশ্বর, আমাকে শক্তি দিন এমন ব্যাপার মেনে নিতে যাকে আমি বদলাতে পারি না।

বিশ্বাস করুন আমাকে, বলেছিল ওলিভেট্টি, এটা তেমনি এক পরিস্থিতি। তারপর সে পিছন ফিরে চলে গেল।

৪৪.

লন্ডনের পিকাডেলি সার্কাসের পাশেই ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি)

সেন্ট্রাল অফিস। সুইচবোর্ডের ফোন বেজে উঠল, সাথে সাথে একজন জুনিয়র কন্টেন্ট এডিটর তুলে ধরল ফোনটা।

বিবিসি। বলল মেয়েটা, মুখ থেকে ডানহিল সিগারেট সরিয়ে।

ফোনের অপর প্রান্তের কণ্ঠটা একটু ঘষটানে ঘষটানো। মধ্যপ্রাচ্যের সুর আছে। সেখানে। আমার কাছে একটা ব্রেকিং স্টোরি আছে যেটা আপনাদের কর্পোরেশন লুফে নিবে।

সাথে সাথে এডিটর তুলে নিল খাতা আর কলম। বিষয়?

পোপ সিলেকশন।

সে একটু বিরক্ত হল। বিবিসি সেখানে থেকেই নিউজ কাভার করছে। আজকাল মানুষের এ ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ নেই। ঐশ্বরিক খবরটা কী?

রোমে কি ঘটনা কাভার করার জন্য কোন লোক পাঠিয়েছেন আপনারা?

আমি তেমনি মনে করি।

আমি সরাসরি তার সাথে কথা বলতে চাই।

আই এ্যাম স্যরি। কিছু আইডিয়া না পেলে আমি আপনাকে সেই নাম্বারটা দিতে পারব না–

কনক্লেভের উপরে একটা হুমকি এসেছে। এরচে বেশি কিছু বলতে চাই না আমি।

সাথে সাথে আরো ঝুঁকে এল সম্পাদক, আপনার নাম?

আমার নাম ইস্মেটারিয়াল।

একটুও অবাক হয়নি এডিটর। আপনার কাছে এই দাবির প্রমাণ আছে?

আছে।

আমি আপনার কাছ থেকে তথ্যটুকু পেলেই বরং খুশি হই। আমাদের পলিসির মধ্যে এমন কোন ফাঁক নেই যে সরাসরি রিপোর্টারের কাছে…

বুঝতে পারছি আমি। আমি নাহয় অন্য কোন নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ করব। সময় দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। শুড়…

এক মিনিট, বলল এডিটর, একটু ধরে থাকতে পারবেন?

কলারকে লাইনে রেখে সম্পাদক গলা লম্বা করল। কলারদের ফোন ট্রেস করার কোন না কোন উপায় থাকে তাদের কাছে। কিন্তু এরই মধ্যে কলার দুটো পরীক্ষায় উৎরে গেছে। সে তার নাম জানানোর জন্য মোটেও উদগ্রীব নয় এবং সে ফোনটা রেখে দিতে চাচ্ছে। মানুষ সাধারণত এমন সব কলে নিজের নামটা প্রচার করতে চায়।

রিপোর্টারদের হাতে মিস করার মত খবর সহজে আসে না। যদি কোনক্রমে একটা সত্যিকার খবর মিস হয়ে যায় তাহলে এডিটরের অবস্থা আর দেখতে হবে না। তাই পাগলদের দেয়া খবরও যত্ন নিয়ে শুনতে হয়। রিপোর্টারের পাঁচটা মিনিট হারিয়ে যেতে দেয়া যায়। তাতে খুব একটা পাপ হয় না। কিন্তু যদি খবরটা মিস হয়ে যায়, যদি খবরটা হেডলাইন হয়, তাহলে আর দেখতে হবে না।

হাই তুলতে তুলতে মেয়েটা তার কম্পিউটারের দিকে তাকাল, তারপর লিখল, ভ্যাটিকান সিটি। তারপর পাপাল সিলেকশনে থাকা ফিল্ড অপারেটরের নাম দেখে মুখ বাঁকিয়ে হাসল সে। বিবিসি তাকে লন্ডনের একটা ট্যাবলয়েড থেকে তুলে এনেছে সাধারণ ফিল্ড রিপোটি কাভার করার জন্য। এডিটররা তাকে একেবারে নিচের স্তরের রিপোর্টার মনে করে।

সে সারা রাত সেখানে এক পায়ে খাড়া হয়ে থাকবে। তারপর তার দশ সেন্ডের লাইভ রিপোর্ট নিয়ে কম্ম সারা করবে। অন্তত বিরক্তিকর কাজগুলো থেকে একটু মুক্তি পেয়ে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

ভ্যাটিকান সিটিতে থাকা রিপোের্টারের স্যাটেলাইট এক্সটেনশন বের করল এডিটর। তারপর আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে নাম্বারটা জানিয়ে দিল কলারকে।

৪৫.

এ তে কোন কাজ হবে না। বলল ভিট্টোরিয়া। পোপর অফিসে সারাক্ষণ পায়চারি করছে সে। চোখ তুলে তাকাল ক্যামারলেনগোর দিকে। যদি সুইস গার্ড পুরো সিটি ব্লাক আউট করতেও পারে, যদি তারা ক্যানিস্টারটার খোঁজ পায়, তাহলে তাদেরকে সেটার ঠিক উপরে থাকতে হবে। এর সিগন্যাল নির্ঘাৎ দুর্বল হবে। যদি সেটা পাওয়াও যায়, তার ফল শুভ নাও হতে পারে। যদি আপনাদের গ্রাউন্ডের কোথাও সেটা লোহার বাক্সে ভরে মাটি চাপা দেয়া থাকে তাহলে? কিম্বা উপরে, ধাতব কোন ভেন্টিলেটিং ডাক্টে থাকে? তাহলে আর তা পাবার কোন উপায় থাকবে না। আর কে বলতে পারে যে আপনাদের সুইস গার্ড গুপ্তচরহীন? কে বলতে পারে তারা ঠিকমত সার্চ করবে?

একেবারে বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে ক্যামারলেনগোর চেহারা, আপনি কী করতে বলেন, মিস ভেট্রা?

এবার বেশ স্বস্তিতে পড়ল ভিট্টোরিয়া। এ কথাটা আসতই, তাই নয় কি? আমি বলি স্যার, আপনারা দ্রুত অন্য কোন প্রস্তুতি নিন। আমরা আর সব আশা বাদ দিয়ে আশা করতে পারি কমান্ডারের সার্চ ঠিকমত শেষ হবে। তারপর? একই সাথে জানালার বাইরে তাকান। ঐ মানুষগুলোকে কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন? পিয়াজ্জার বাইরে ঐ বাড়িগুলোকে? মিডিয়া ভ্যানগুলো? ট্যুরিস্টদের? তারা অবশ্যই বিস্ফোরণ এলাকার ভিতরে আছে। আপনাদের যা করার এখনি করতে হবে।

আবারও ফাঁকা একটা নড করল ক্যামারলেনগো।

হতাশ হল ভিট্টোরিয়া। ওলিভেট্টি সফল। সবাইকে সে বুঝিয়ে বসতে পেরেছে যে। হাতে প্রচুর সময় আছে। কিন্তু সে জানে, যদি একবার, কোন না কোন ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে খবরটা বাইরের দুনিয়ায় জানাজানি হয়ে যায় তাহলে আর দেখতে হবে না। চোখের সামনে ভরে যাবে সামনের এলাকাটা। সুইস পার্লামেন্ট বিল্ডিংয়ের বাইরে এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছে সে। ভিতরে বোমা সহ লোকজনকে আটকে রাখায় চারপাশে মানুষের ভিড় উপচে পড়ছিল। সবাই দেখতে চাচ্ছিল কী ঘটবে। যদিও পুলিশ বারবার তাদের বলছিল যে তারা বিপদে আছে তবু মানুষ প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে এসেছিল। মানুষের মনে মানুষের জীবন সংশয়ের মত আগ্রহোদ্দীপক আর কোন ব্যাপার ঘটে না।

সিনর, ভিট্টোরিয়া আবার কথা তুলল, আমার বাবার হন্তা লোকটা বাইরেই কোথাও আছে। এই শরীরের প্রতিটা কোষ প্রাণপণে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে তাকে ধরে টুকরা টুকরা করে ফেলতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি আপনার অফিসে দাঁড়িয়ে আছি… কারণ একটাই, আমার কিছু দায়বদ্ধতা আছে আপনাদের প্রতি। আপনার প্রতি এবং আর সবার প্রতি। জীবন এখন সংশয়ে আছে। আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছেন সিনর?

এবারো কোন জবাব দিল না ক্যামারলেনাগো।

ভিট্টোরিয়া তার নিজের হৃদয়কে ধুকতে দেখল। সুইস গার্ড কেন লোকটাকে চিহ্নিত করতে পারল না? ইলুমিনেটি এ্যাসাসিনইতো সব কাজের চাবিকাঠি। সে জানে কোথায় রাখা হয়েছে ক্যানিস্টারটা… হেল! সে জানে কোথায় আছে কার্ডিনালরা। শুধু খুনিটাকে ধরে আন। বাকি সব আপসে শেষ হয়ে যাবে।

টের পাচ্ছে ভিট্টোরিয়া, অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে সে। একটা মানসিক বিকার। ব্যাপারটা ঘটত এতিমখানায় থাকার সময়। এমন হতাশা যেখানে করার মত কিছুই নেই। তোমার হাতে কাজ করার মত চাবিকাঠি আছে। বলল সে নিজেকে, সব সময় তোমার হাতে কাজ করার মত চাবিকাঠি থাকে। কিন্তু এ কথা ভেবেও কোন কাজ হল না তার। তার মনের ভিতরে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে সারাক্ষণ। সে একজন রিসার্চার। একজন প্রব্লেম সলভার। কিন্তু এ এমন এক সমস্যা যার কোন সমাধান চোখে দেখে বের করা যাচ্ছে না। কোন ডাটা তোমার দরকার? কী তথ্য তুমি চাও? সে নিজেকে বলল, শ্বাস নাও বড় করে, সমাধান তোমার হাতে কাছেই আছে। এবং অবাক হয়ে দেখল, জীবনে এই প্রথম তার সামনে কোন সমাধান নেই। এই প্রথম, সব কিছুর বদলে সে দেখল, ফোঁপাচ্ছে সে।

মাথা ব্যথা করছে ল্যাঙডনের। সেও কোন কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। সেও অসহায়ভাবে একবার তাকায় ক্যামারলেনগোর দিকে, আরেকবার তাকায় ভিক্টোরিয়ার দিকে। কিন্তু তার চিন্তা ভাবনা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আসছে। বারবার মনে পড়ছে কয়েকটা চিত্র। বিস্ফোরণ, সাংবাদিকদের উপচে পড়া ভিড়, ক্যামেরার চলাচল, চারজন চিহ্ন আকা মানুষের লাশ।

শাইত্বোয়ান… লুসিফার… আলোক আনয়নকারী… স্যাটান…

মন থেকে দৃশ্যগুলো তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করল সে। পরিকল্পিত সন্ত্রাস, বলল সে নিজেকে, হিসাব কষা ধ্বংস। এক সেমিনারের কথা তার মনে পড়ে যায়। সন্ত্রাসি এ্যালেস এন্ড ডেনস কর্মকান্ডে সিম্বলের ব্যবহারের উপর তাকে একটা বক্তব্য দিতে হয়েছিল। এর পর আর কখনো সে এমন করে সন্ত্রাসের কথা ভাবেনি।

সন্ত্রাসের, বলেছিল এক প্রফেসর, একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। কী সেটা?

নিস্পাপ মানুষকে হত্যা করা? সাথে সাথে বোকার মত জবাব দিয়েছিল এক ছাত্র।

ভুল। হত্যাকান্ডটা সন্ত্রাসের একটা পথ মাত্র, এরচে বেশি কিছুই নয়।

শক্তিমত্তার প্রমাণ?

না। ক্ষীণতর পথপরিক্রমা নয়।

আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া?

এতোক্ষণে মূল কথায় এসেছ। সন্ত্রাসের একটা মাত্র লক্ষ্য আছে। ভীতি আর আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া। সন্ত্রাস সব সময়ই একটু হলেও দুর্বল… তারা তাদের দুর্বলতা ঢাকতে চায় সন্ত্রাস দিয়ে। যে কোন একটা মেসেজ জানিয়ে দেয়া তাদের লক্ষ্য। কথাটা টুকে রাখ। সন্ত্রাস মোটেও শক্তিমত্তার পাগলাটে প্রদর্শনী নয়। এটা একটা রাজনৈতিক হাতিয়ার। সরকারের অকর্মণ্যতা প্রমাণ করে তুমি পরে মানুষের মন জয় করে নাও, এমনও হতে পারে।

মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা…

এই একটা ব্যাপারেই কি সব রহস্য লুকিয়ে আছে? সারা দুনিয়ার খ্রিস্টানেরা ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখবে? পাগলা কুকুরের সময়টায় কুকুরদের মেরে যেভাবে রাস্ত য় ফেলে রাখা হত সেভাবে তাদের কার্ডিনালদের সেখানে পড়ে থাকতে দেখে তাদের মনে কী প্রতিক্রিয়া হবে? যদি একজন কার্ডিনালের মত সৰ্বোচ্চ ক্ষমতার মানুষ শয়তানের হাত থেকে না বাঁচতে পারে, যদি ভ্যাটিকান সিটির মত পবিত্রতম শহর মাটির সাথে মিশে যায় তাহলে সাধারণ খ্রিস্টানদের মনে তার কী প্রভাব পড়বে? ল্যাঙডনের মন আরো দ্রুত কাজ করছে এখন… মনের ভিতরে কোথায় যেন দুটা অস্তি ত্ব লড়াই করছে। একটা সুতা নিয়ে টানাহেঁচড়া করছে।

বিশ্বাস তোমাকে রক্ষা করে না… রক্ষা করে ওষুধ আর এয়ারব্যাগ… ঈশ্বর বলতে কেউ নেই… আর যদিও থেকেও থাকে, তার কোন দায় পড়েনি যে সে তোমাকে রক্ষা করবে… তোমাকে যা রক্ষা করে তার নাম বুদ্ধিমত্তা। আলোই রক্ষা করে তোমাকে। আলোকিত হও। বিজ্ঞানের আলোতে। এমন কিছুর উপর ভরসা রাখ যে তোমাকে রক্ষা করবে। কেউ একজন পানির উপর দিয়ে হেটে গেছে, তারপর কত যুগ পেরিয়ে গেল? আর কেউ কি কাজটা করতে পেরেছে? আধুনিক মিরাকলগুলোর স্রষ্টা হল বিজ্ঞান… কম্পিউটার, ভ্যাকসিন, স্পেস স্টেশন… এমনকি সৃষ্টির আদি দিকগুলোও হাপিস হয়ে গেছে। বিজ্ঞান, জিনতত্ত্ব হাতে তুলে নিয়েছে সে দায়িত্ব। এমনকি সৃষ্টির সবচে বড় যে তত্ত্ব, শূণ্য থেকে জন্ম নেয়া, সেটাও হচ্ছে এখন ল্যাবে। কার আর ঈশ্বরের প্রয়োজন আছে? না! সায়েন্স ইজ গড!

হন্তার কথাগুলো ধ্বণিত প্রতিদ্ধণিত হচ্ছে ল্যাঙড়নের মনে, মস্তিষ্কে। মধ্যরাত… খুনের ধারাবাহিক পথ পরিক্রমা… স্যাক্রিফিসি ভার্জিনি নেল অল্টারে ডি সিয়েঞ্জা।

তারপর হঠাৎ করেই, যেভাবে কোন বন্দুকের গুলি হাপিস হয়ে যায়, সেভাবে মাথা থেকে সমস্ত চিন্তা উধাও হয়ে গেল।

সিট ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল রবার্ট ল্যাঙডন। তার পিছনে পড়ে গেল চেয়ারটা, মার্বেলের মেঝের উপর।

ভিট্টোরিয়া আর ক্যামারলেনগো সাথে সাথে চমকে গেল।

আমি আসল ব্যাপারটা ধরতে পারিনি। যেন মোহগ্রস্থ ল্যাঙডন কথা বলছে। আমার সামনেই ছিল। ধরতে পারিনি আমি।

কী মিস করেছ? দাবি করল ভিট্টোরিয়া। প্রিস্টের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল ল্যাঙডন, ফাদার, তিন বছর ধরে আমি ভ্যাটিকানের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছি। যেতে চাই আপনাদের আর্কাইভে। সাতবার আমাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

মিস্টার ল্যাঙডন, আমি দুঃখিত, কিন্তু এ সময়ে এমন একটা ব্যাপার নিয়ে অভিযোগ তোলাটা আমার কাছে বিচিত্র বলে মনে হচ্ছে।

ল্যাঙডন সাথে সাথে বলল, আমি এখনি এখানে প্রবেশাধিকার চাই। চারজন কার্ডিনাল হারিয়ে গেছেন। আমি ভেবে বের করতে চাই কোথায় তাদের হত্যা করা

ভিট্টোরিয়া এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

ক্যামারলেনগোর দৃষ্টিও ফাকা। যেন তাকে নিয়ে কোন নিষ্ঠুর কৌতুক করা হচ্ছে। আপনি বলতে চান যে এই তথ্যটা আমাদের আর্কাইভে আছে?

আমি প্রতিজ্ঞা করতে পারছি না যে ঠিক ঠিক বের করতে পারব তবে আশা করতে কোন দোষ নেই। আমি আশাবাদী…।

মিস্টার ল্যাঙডন, আমি আর চার মিনিটের মধ্যে সিস্টিন চ্যাপেলে থাকব। আর্কাইভটা ভ্যাটিকান সিটির অপর প্রান্তে।

তুমি সিরিয়াস, তাই না? চোখের দিকে তীব্র দৃষ্টি হানল ভিট্টোরিয়া, জানতে চায় কতটুকু সিরিয়াস সে।

মশকরা করার মত সময় নয় এটা। সাথে সাথে জবাব দিল ল্যাঙডন।

ফাদার, ভিট্টোরিয়া বলল ক্যামারলেনগার দিকে তাকিয়ে, যদি কোন সুযোগ থাকেই… যদি বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকে তারা কোথায় মারা যাবেন তা জানার, তাহলে আমরা অন্তত লোকেশনগুলো বের করতে পারব।

কিন্তু আর্কাইভে? অনুনয় ঝরে পড়ল ক্যামারলেনগোর কষ্ঠে, কী করে সেখানে কোন কু লুকিয়ে থাকতে পারে?

ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা, বলল ল্যাঙডন, অনেক সময় নিবে, অন্তত চার মিনিটে সুরাহা করা যাবে না। কিন্তু আমি যদি সত্যি সত্যি ব্লু টা পেয়ে যাই, তাহলে হ্যাসাসিনকে ধরার একটা সুযোগ থেকে যাচ্ছে।

এমনভাবে ক্যামারলেনগো তাকাল যেন সে এ কথাতে ভরসা রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু কী করে যেন তার বিশ্বাসটা ঠিক খাপ খেল না। খ্রিস্টানত্বের সবচে গোপনীয় ডকুমেন্টগুলো সেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এমন সব সম্পদ সেখানে লুকানো যেগুলোর দিকে চোখ রাখার অনুমতি আমি নিজেও পাইনি।

আমি সে সম্পর্কে ভাল ভাবেই জানি।

ক্যামারলেনগো বলল, ভিতরে ঢোকার একটা মাত্র রাস্তা আছে। কিউরেটর আর বোর্ড অব ভ্যাটিকান লাইব্রেরিয়ানসের লিখিত অনুমতি নিতে হবে।

অথবা, বলল ক্যামারলেনগোকে ল্যাঙড়ন, পাপার পদে আসীন কারো অনুমতি। আপনার কিউরেটর যতবার আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে ততবার চিঠিতে আমি এ কথাটা পেয়েছি।

নড করল ক্যামারলেনগা।

কঠিন হয়ে কথাটা বলছি না, বলল ল্যাঙডন, আমার যদি কোন ভুল হয়ে না থাকে তো পাপাল ম্যান্ডেট আসে এই অফিস থেকেই। আর আমি আরো যতটুকু জানি, আজ রাতে এ অফিসে আসীন আছেন আপনি নিজে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলা যায়…

পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করে এক পলক তাকিয়ে নিল ক্যামারলেনগো। মিস্টার ল্যাঙডন, আজ রাতে এই চার্চের সুরক্ষার জন্য আক্ষরিক অর্থেই আমার জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত।

ল্যাঙড়ন তাকাল লোকটার চোখের দিকে। সেখানে সত্যের ঝলক দেখা যাচ্ছে।

এই ডকুমেন্ট, জিজ্ঞেস করল ক্যামারলেনগো, আপনি কি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেন যে পেলে আপনি ঠিক ঠিক চারজন চার্চকে খুঁজে বের করতে পারবেন?

আমি ভিতরে ঢুকে হাজারটা ডকুমেন্ট ধরে একটা হ-য-ব-র-ল লাগিয়ে দিব না। আপনারা যখন কোন শিক্ষককে বেতন দেন তখন ইতালি আপনাদের মাথায় ভেঙে পড়ে না। আপনাদের হাতে যে ডকুমেন্ট আছে তা একই সাথে পুরনো এবং–

প্লিজ, বলল ক্যামারলেনগো, ক্ষমা করুন আমাকে। আমার মনে এরচে বেশি কোন কথা আসছে না এ মুহূর্তে। আপনি কি জানেন কোথায় সেই গোপন ডকুমেন্ট লুকানো আছে?

উল্লাসের একটা ঝলক খেলে গেল ল্যাঙডনের চোখেমুখে, সান্তা এনার গেটের ঠিক পিছনে।

চমৎকার! বেশিরভাগ স্কলার মনে করেন এটা সেন্ট পিটারের পবিত্র সিংহাসনের পিছনে আছে।

না। এটা নিয়ে বেশিরভাগ মানুষই গোল পাকিয়ে বসে। আর্কাভিয়ো দেলা রেভারেন্দা দ্য ফ্যাব্রিকা ডি সন্ত পিতেরো। একটা কমন মিসটেক।

একজন লাইব্রেরিয়ান সব প্রবেশপথে নজর রাখতে পারে না। তাকে সাথে থাকতে হয়। আজ রাতে আমরা কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। একজন কার্ডিনাল ঢোকার সময়েও সাথে একজন না একজন থাকেই।

আমি আপনাদের সম্পদকে অত্যন্ত যত্নের সাথে নিরীক্ষণ করব। আপনাদের লাইব্রেরিয়ান আমার সেখানে থাকার কোন প্রমাণ পাবে না।

মাথার উপর সেন্ট পিটারের ঘণ্টা বাজতে শুরু করল। পকেট থেকে বের করে আবার ঘড়িটা দেখল ক্যামারলেনগগা। আমার যেতেই হচ্ছে। আমি আর্কাইভে আপনার জন্য একজন সুইস গার্ড পাঠিয়ে দিব। আপনার উপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম, মিস্টার ল্যাঙড়ন। এগিয়ে যান এবার।

মুখে কোন রা সরল না ল্যাঙড়নের।

ফিরে গেল কমবয়েসি প্রিস্ট। যাবার আগে আর একবার ফিরে এল সে। হাত রাখল ল্যাঙডনের কাধে, তারপর সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরল তাকে। পিছন থেকে। আপনি যা-ই খুজছেন, আশা করি তা পেয়ে যাবেন। আর বের করুন এটাকে। দ্রুত।

৪৬.

এ কটা পাহাড়ের উপরে, বর্জিয়া কান্ট্রিইয়ার্ডের পরে, সান্তা এ্যানের শেষপ্রান্তে

ভ্যাটিকানের গোপনীয় আর্কাইভ অবস্থিত। সেখানে বিশ হাজারের বেশি পুরনো বই আর দলিল-দস্তাবেজ আছে। বলা হয় এখানে এমন অনেক বস্তু আছে যার দু একটা বাইরে প্রকাশ পেলেই উল্টে যাবে ইতিহাসের পাশার ছক। আছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির গোপন ডায়েরি, আছে বাইবেলের না-ছাপা হওয়া কপি।

এখনো ল্যাঙডন তার মনকে বিশ্বাস করাতে পারছে না যে সে পৃথিবীর সবচে গোপনীয় একটা অঞ্চলে প্রবেশ করছে। তার পাশে পাশেই আসছে ভিট্টোরিয়া। কষ্ট করে তার পায়ের সাথে তাল মিলাচ্ছে। তার খোলা চুলে খেলে যাচ্ছে হাওয়া। বাতাসের সেই প্রবাহ থেকে আসছে অচেনা একটা সুগন্ধ, সেটুকু নির্দ্বিধায় টেনে নিচ্ছে ল্যাঙড়ন।

ভিট্টোরিয়া সাথে সাথে তাকে পেয়ে বসল, তুমি কি আমাকে বলবে কী খুঁজছি আমরা?

একটা ছোট্ট বই। গ্যালিলিও নামের এক লোকের লেখা।

অবাক হয়ে গেল সে। তুমি আর কোন গোল পাকিও না। এর ভিতরে কী লেখা আছে?

এর ভিতরে এমন কিছু থাকার কথা যাকে লোকে এল সাইনো বলে।

দ্য সাইন?

সাইন, ক্লু, সিগন্যাল… নির্ভর করবে তুমি এটাকে কীভাবে অনুবাদ করছ তার উপর।

কীসের সাইন?

ল্যাঙডন আরো বাড়িয়ে দিল চলার গতি, একটা গুপ্ত অবস্থান। গ্যালিলিওর ইলুমিনেটি তাদের দলকে চার্চের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য গোপন বিভিন্ন আস্তানা বেছে বের করত। তাই তারা ভ্যাটিকানের হাত থেকে বাঁচার জন্য এখানে, এই রোমেই একটা অতি গোপনীয় আস্তানা বের করে। এটাকে তারা দ্য চার্চ অব ইলুমিনেটি নামে ডাকত।

বাহ্! একটা শয়তানি আড্ডাকে চার্চ নামে ডাকা!

মাথা নাড়ল ল্যাঙড়ন, গ্যালিলিওর ইলুমিনেটি মোটেও শয়তানি সংঘ ছিল না। তারা ছিলেন আলোকবর্তিকা হাতে এক একজন সম্মানিত বিজ্ঞানী। তাদের আড্ডাখানা। কোন শয়তানি কাজে লাগত না। বরং তাদের আড্ডাতে কথা হত এমন সব বৈজ্ঞানিক ব্যাপার নিয়ে যা চার্চ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমরা সবাই জানি গোপন আড্ডাটা আছে। এ পর্যন্তই। কেউ জানে না সেটা কোথায়।

শুনে মনে হচ্ছে ইলুমিনেটি ভাল করেই জানে কী করে একটা ব্যাপারকে গোপন রাখতে হয়।

অবশ্যই। ইন ফ্যাক্ট, ব্রাদারহুডের বাইরে কেউ কখনো কোনক্রমে তাদের সেই গুপ্ত সংঘের কথা বলেনি। এর ফলে তাদের গোপনীয়তা রক্ষা পায়। একই সাথে আর একটা সমস্যার উদয় হয়। নতুন রিক্রুট করার সময় খুব সাবধান হতে হয় তাদের।

তারা বেড়ে উঠতে পারত না যদি তারা প্রচার না করত। পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে মেয়েটার মস্তিষ্ক !

ঠিক তাই। মোলশ ত্রিশের দশকে গ্যালিলিওর দুনিয়া বিস্তৃত হতে শুরু করে। এমনকি এ সময়টায় গোপনে গোপনে মানুষ এমনভাবে রোমে আসত যেভাবে কোন মানুষ তীর্থ দেখতে যায়। তারা আসত ইলুমিনেটিতে যোগ দিতে… গ্যালিলিওর টেলিস্কোপে একটা বার চোখ রাখার লিপ্সা তাদের এখানে নিয়ে আসত। মহান শিক্ষকের মুখের একটা কথা শোনার জন্য তারা উদগ্রীব হয়ে থাকত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, জ্ঞানলিন্দু বিজ্ঞানীর দল জানত না কোথায় মিলিত হতে হবে সেই প্রবাদ পুরুষের সাথে, কীভাবে দেখা করতে হবে ইলুমিনেটির সাথে। তারা বৃথাই ঘুরে মত রোম জুড়ে। ইলুমিনেটি নতুন রক্ত চায়, চায় তরুণ মেধা, কিন্তু একই সাথে তাদের মাথায় রাখতে হয় যে তাদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।

বলল ভিট্টোরিয়া, অনেকটা সিচুয়েজিওনে সেঞ্জা সলিউজিওনের মত শোনাচ্ছে।

ঠিক তাই। একটা ক্যাচ-২২, বর্তমানে আমরা যা বলতে পারি।

তাহলে তারা কী করত?

তারা বৈজ্ঞানিক। পুরো সমস্যা খতিয়ে দেখে একটা করে উপায় বের করে তারা। সত্যি সত্যি খুব মেধাবী কাজ ছিল সেটা। তাদের জন্য আসা বিজ্ঞানীদের জন্য একটা মানচিত্রের ব্যবস্থা করে।

ম্যাপ? শুনতে বোকামি বোকামি ঠেকছে না? একবার যদি কোন ভুল হাতে গিয়ে পড়ে…

কখনোই পড়তে পারবে না। বলল ল্যাঙডন, এর কোন কপি ছিল না কোথাও। কাগজে বসানো কোন ম্যাপ ছিল না সেটা। সারা মহানগরী জুড়ে সেই ম্যাপ আকা ছিল। কেউ সেটা থেকে ভালমন্দ বুঝতে পারবে না।

ওয়াকওয়ের পাশে তীরচিহ্ন দেয়া?

এক কথায়, তাই বলা চলে। কিন্তু তা আরো অনেক বেশি জটিল ছিল। সাধারণ মানুষের পথেই ছড়ানো ছিল সেগুলো, কিন্তু তার প্রক্রিয়া ছিল ভিন্ন। বিভিন্ন চিহ্ন ছড়ানো ছিটানো, সারা রোম জুড়ে। পরের জায়গা… তার পরের জায়গা… একটা পথ… আর সবশেষে ইলুমিনেটির আসল আড্ডা।

ভিট্টোরিয়ার চোখ চকচক করে উঠল, মনে হচ্ছে কোন গুপ্তধন বের করার সন্ধানে নামা ছাড়া উপায় ছিল না কোন।

মুখ ভেঙুচে হাসল একটু ল্যাঙডন, এক কথায়, তাও বলা চলে। এটাকে ইলুমিনেটি বলত, দ্য পাথ অব ইলুমিনেশন। যে কেউ, যে চায় ইলুমিনেটিকে খুঁজে বের করতে, সেখানে যোগ দিতে, তাকে এ পথ ধরেই আসতে হবে। একই সাথে ব্যাপারটা এক ধরনের পরীক্ষা।

কিন্তু ভ্যাটিকান যদি ইলুমিনেটিকে খুঁজে বের করতে চায়? বাদ সাধল ভিট্টোরিয়া, তারা কি সোজাসাপ্টা পাথওয়ে অনুসরণ করে করে পৌছে যেতে পারবে না?

না। পথটা ছিল গুপ্ত। একটা পাজল। শুধু অনুমোদিত মানুষজনই এ পথ দেখে বুঝতে পারবে। আর কেউ নয়। ইলুমিনেটি চার্চ কোথায় লুকিয়ে আছে তা শুধু তারাই বের করতে পারবে। এটাকে শুধু এজন্যই জটিল করে তোলা হয়নি। একই সাথে তারা সবচে মেধাবী বিজ্ঞানীদের হেঁকে তুলতে চেয়েছিল। তাদের দরজায় যেন আর কোন মানুষ কড়া না নাড়তে পারে সে ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছিল।

কিন্তু আমি কিছুতেই একমত হতে পারছি না। ষােলশো শতকের রোম ছিল সারা দুনিয়ার সবচে মেধাবী মুখের তীর্থস্থান। চার্চের কেউ না কেউ নিশ্চিত খুঁজে বের করতে পারত জায়গাটা। ভ্যাটিকানে শুধু মূর্খরাই থাকবে এমন মনে করার কোন কারণ নেই।

অবশ্যই। বলল ল্যাঙডন, যদি তারা চিহ্নগুলো সম্পর্কে কিছু জানত। কিন্তু সব ঘটেছিল তাদের অগোচরে। ইলুমিনেটি সেগুলোকে এমন পথে নির্দেশ করেছিল শুধু জানা লোকজনই এগিয়ে যেতে পারবে। তারা যে প্রক্রিয়া ধরে এগিয়েছিল সিম্বলজিতে তাদের বলা হয় ডিসিমিউলেশন।

ক্যামোফ্লেজ।

বেশ আশ্চর্য হল ল্যাঙডন, তুমি অর্থটা জান?

ডিসিমিউল্যাজিওনে, সে বলল, প্রকৃতির সবচে সেরা প্রতিরক্ষা। সাগরের আগাছায় ভেসে থাকা একটা ছোট মাছকে খুঁজে বের করার মত কষ্টকর একটা প্রক্রিয়া।

ওকে। বলল ল্যাঙডন, ইলুমিনেটি একই পদ্ধতি ধরে এগিয়েছে। তারা চাচ্ছিল রোমের ভিতরে যেন হারিয়ে যায় এই প্রতীকগুলো। যেন সেগুলোকে দেখেও না দেখে সাধারণ মানুষ। তারা বৈজ্ঞানিক চিহ্ন ব্যবহার করতে পারত না। ব্যবহার করতে পারত না সাধারণ ভাষা। ব্যবহার করতে পারেনি তাদের প্রচলিত এ্যাম্বিগ্রাম। তাই তারা ডাক দিল তাদের মেধাবী এক আর্টিস্টকে। তিনিই ইলুমিনেটির এ্যাম্বিগ্রামটা তৈরি করেছিলেন। তারা চারটা চিহ্ন বের করল।

ইলুমিনেটি স্কাল্পচার?

ঠিক তাই। এমন স্কাল্পচার যা দিয়ে মাত্র দুটা অর্থ বোঝাবে। প্রথমেই, সেগুলোকে এমন হতে হল যা রোমের সাধারণ আর্টের সাথে মিশে যায়… এমন সব আর্টওয়ার্ক যেগুলোকে ভ্যাটিকান মোটেও সন্দেহ করবে না।

ধর্মীয় চিত্রাঙ্কন!

নড করল ল্যাঙডন, একটু উত্তেজিত হয়ে উঠছে সে। তার কথার বেগ বেড়ে গেছে অনেক গুণ। আর দ্বিতীয় ব্যাপার হল, চারটা চিত্র খুব সুনির্দিষ্ট থিম বহন করবে। প্রত্যেক খন্ড বিজ্ঞানের চার বন্ধুকে নির্দেশ করবে।

চার বস্তু? ভিক্টোরিয়া বলল, কিন্তু প্রকৃতিতে শতাধিক যত আছে।

ষােড়শ শতকে নয়। মনে করিয়ে দিল ল্যাঙডন তাকে, বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, পুরো ইউনিভার্স মাত্র চারটা বস্তু দিয়ে গঠিত। মাটি, পানি, বাতাস, আগুন।

প্রথম দিককার ক্রস। ল্যাঙডন ভাল করেই জানে, এ দিয়ে সহজেই চারটাকে বোঝানো যায়। চার হাত দিয়ে আগুন, পানি, বাতাস আর মাটি। যদিও পৃথিবীতে এই চারকে বোঝানোর জন্য ডজন ডজন প্রতীক ছিল পৃথিবীতে- পিথাগরিয়ান সাইকেল অব লাইফ, চাইনিজ হঙ-ফান, জাঙ্গিয়ান পুরুষ এবং মহিলা, জোডিয়াক প্রতীক, এমনকি মুসলিমরাও এই চিহ্ন চতুষ্টয় তুলে ধরে… ইসলামে সেটার নাম ছিল স্কোয়ারস, মেঘমালা, বজ্রপাত আর ঢেউ। তবু একটা ব্যাপার এখনো জ্বালাতন করে লাঙডনকে, মেসনরা আজো চার চিহ্নের বেড়াজালে আটকা পড়ে আছে মাটি, বাতাস, আগুন, পানি।

যেন মোহাবিষ্ট হয়ে গেছে মেয়েটা, তার মানে ইলুমিনেটি এমন প্রতীক বানাল যেটা আসলে দেখতে হবে ধর্মীয়, আদপে ভিতরে ভিতরে তা মাটি পানি, আগুন, বাতাসের প্রতিনিধিত্ব করবে?

ঠিক তাই। বলল ল্যাঙড়ন, ভায়া সেন্টিয়ানেল থেকে আর্কাইভের দিকে ঘুরতে ঘুরতে, রোম জুড়ে থাকা ধর্মীয় আর্টওয়ার্কের সমুদ্রে প্রতীকগুলো মিশে গেল। আগেই এগুলো চার্চে চার্চে সওয়ার হল। তারপর প্রতিটা গির্জার বাইরে একে দেয়া হল এসব চিহ্ন। এতোক্ষণে এগুলো ধর্মের গন্ডিতে পার পেয়ে গেছে। তারপর এল আর সব জায়গায় এগুলো এঁটে দেয়ার কাজ। একটা গির্জায় এঁকে দেয়া হল… দেখিয়ে দেয়া হল পরের গির্জার পথ… সেখানে প্রতীক্ষা করছে পরের চিহ্নটা। তাদের প্রতীক ধর্মচিত র রূপ নিয়ে অপেক্ষা করছে পরের স্টপেজে। কোন চার্চে যদি কোন ইলুমিনেটি-প্রেমী মাটির চিহ্ন পায়, তাহলে সে পরের চার্চে খুজবে বাতাস… এরপর আগুন… সবশেষে পানি… আর তারপরই আসছে চার্চ অব ইলুমিনেশনের কথা।

আরো আরো ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে ভিট্টোরিয়ার মাথা। আর এর সাথে হ্যাসাসিনকে খুঁজে বের করার কোন না কোন সম্পর্ক আছে?

হাসল ল্যাঙডন সুন্দর করে। দৃকপাত করল মেয়েটার দিকে, ওহ! ইয়েস! ইলুমিনেটিরা এই চার চার্চকে অন্য একটা নাম দিয়েছে, দ্য অল্টার্স অব সায়েন্স।

আবার হাসল ল্যাঙডন। চারজন কার্ডিনাল, চারটা চার্চ, চারটা অল্টার, অব সায়েন্স!

কিন্তু খুব একটা তুষ্ট মনে হচ্ছে না ভিট্টোরিয়াকে, তুমি বলতে চাও কার্ডিনাল চারজন যে চার গির্জার ভিতরে স্যাক্রিফাইজড় হবে সে গির্জাগুলোই অল্টার অব সায়েন্স? ইলুমিনেটিকে খুঁজে পাওয়ার পথ?

আমি এমনি মনে করি। ঠিক এমন।

কিন্তু খুনী কোন দুঃখে আমাদের হাতে সূত্র ধরিয়ে দিবে?

কেন নয়? ঠাটপাট জবাব দেয় ভিট্টোরিয়াকে, ল্যাঙডন, খুব কম ইতিহাসবেত্তা এই চার চার্চের খবর জানে। আর অনেক কম জন বিশ্বাস করে তার অস্তিত্ব আছে। আর তাদের সিক্রেটটা চার শতক ধরে গোপনই আছে। কোন সন্দেহ নেই, আর মাত্র পাঁচ ঘণ্টা এই রহস্যটা রহস্যই থাক তা মনেপ্রাণে চাইবে ইলুমিনেটি। আর এখন ইলুমিনেটির প্রয়োজন নেই পাথ অব ইলুমিনেশনের। তাদের গোপন আস্তানা এতোদিনে দূরে কোথাও চলে গেছে। কোন সন্দেহ নেই। তারা এখনকার উন্নততর পৃথিবীতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। তারা এখন প্রাইভেট ব্যাঙ্কের ঘরে ঘরে আসন পেতে বসে, বসে পাবলিক প্লেসে, বসে খাবার জায়গায়, বসে গলফ ক্লাবে। আজ রাতে তারা চায় তাদের গোপনীয়তা প্রকাশ পেয়ে যাক। এটাই তাদের মহান মুহূর্ত, যার জন্য চারশো বছর ধরে তারা ওৎ পেতে ছিল, যার জন্য তাদের অনেক অনেক বিজ্ঞানী প্রাণপাত করেছে, যার জন্য পুরো দুনিয়ার অর্থনীতি তারা কজা করে রেখেছে, যার জন্য পৃথিবীর বেশিরভাগ উঁচু সারির রাজনীতিকদের তারা নিজেদের দলে টেনেছে, যে মুহূর্তের স্বপ্ন দেখত গ্যালিলিও, পৃথিবী থেকে ক্যাথলিক চার্চের বিদায়, স্রষ্টার নামে বিজ্ঞানকে পদদলিত করার দিনের বিদায়, শ্রেণিহীন-বিজ্ঞান নির্ভর একক বিশ্বের উদয়,

তাদের গ্র্যান্ড আনভেইলিং।

আরো একটা কথা ভেবে মনে মনে ভয় পাচ্ছে ল্যাঙডন। মিলে যাচ্ছে সব। একে একে। সেই চারটা প্রতীকের ছাপ কি থাকবে পোড়া চামড়ায়? কে জানে! সেই খুনি বলেছে, তাদের চারজনের কাছে চারটা প্রতীক থাকবে। বলেছিল সে, প্রমাণ করব আগের দিনের কিংবদন্তীগুলো ভুল নয়। চার পুরনো দিনের এ্যাম্বিগ্রামের চিহ্ন! সেই চারটা চিহ্ন! ইলুমিনেটিরই মত বয়স হয়েছে যেগুলোরঃ আর্থ-এয়ার-ফায়ার-ওয়াটার! মাটি-বাতাস-আগুন-পানি! চারটা শব্দ, পরিপূর্ণ অবস্থা সহ। দ্বিমুখী চিহ্ন। ঠিক ইলুমিনেটির মত। সে নামটা এরই মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে আরেক প্রিস্টের বুকে। প্রত্যেক কার্ডিনালের জন্য অপেক্ষা করছে বিজ্ঞানের প্রাচীণতম প্রতীক। ইতিহাসবেত্তাদের মধ্যে এ নিয়ে আরো একটা বিতর্ক চালু আছে। ইলুমিনেটির চার প্রতীক সহ ইলুমিনেটির নামটাও দ্বিমুখী। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আর একটা ব্যাপার বাকি থেকে যাচ্ছে। নামগুলো ইতালিয় নয়, ইংরেজিতে লেখা। ইংরেজিতে রাখাটা তাদের পাইকারি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। আর তাদের মধ্যে কোন কাজেই পাইকারি নয়… খুব গোছানো।

আর্কাইভ ইমারতের সামনে থেমে দাঁড়ায় ল্যাঙডন। প্রশস্ত সিড়িতে। শত শত ছবি ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে। কীভাবে ইলুমিনেটি মার খেয়ে গেল একের পর এক, কীভাবে তারা জীবনগুলো হারাল, তারপর কীভাবে ডুব মারল ইতিহাসের পাতা থেকে, কীভাবে ভিতরে ভিতরে শক্তি সঞ্চয় করল, আবার কীভাবে দিনের আলোয় বুক পেতে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। তারা এবার উঠে আসবে, তাদের ইতিহাসখ্যাত ষড়যন্ত্রের সত্যতা তুলে আনবে। কিন্তু এখানে কি তারা থামবে, নাকি পুরো বিশ্ব দখলের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে? যারা এমন গোপন জায়গা থেকে এমন গোপন একটা অস্ত্র ততোধিক গুপ্ত একটা এলাকায় এনে তা আবার ফলাও করে প্রচার করতে পারে তাদের পক্ষে কোন কাজই অসম্ভব নয়। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টাকাতে তাদের ছাপ শোভা পায়। মানুষের সামনে তাদের কথা প্রচার করার একটা সুযোগ চলে আসছে।

ভিট্টোরিয়া বলল, এইতো এগিয়ে আসছে আমাদের এসকর্ট। সামনের লন থেকে হন্তদন্ত হয়ে এগুতে থাকা সুইস গার্ডের দিকে চোখ তুলে তাকাল ল্যাঙড়ন।

তাদেরকে দেখার সাথে সাথে গার্ড জায়গাতেই থেমে গেল। তাদের দিতে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লোকটা। যেন ভুল দেখছে চোখের সামনে। আর এক বিন্দু অপেক্ষা না করে সে সেখানেই জমে গেল, পকেট থেকে তুলে আনল ওয়াকি টকি। তড়িঘড়ি করে লোকটা কথা বলে গেল লাইনের অপর প্রান্তে থাকা লোকটার সাথে। যেন সে মেনে নিতে পারছে না ব্যাপারটা। কিন্তু ঠিকঠিক বুঝতে পারল ল্যাঙডন, অপর প্রান্ত থেকে ভাল চোট পেয়েছে লোকটা। অসন্তুষ্ট একটা দৃষ্টি হানল সে।

গার্ড তাদেরকে বিল্ডিংয়ের দিকে গাইডিং করে নিয়ে যাবার সময় কোন কথা হল তাদের মধ্যে। তারা চারটা স্টিলের দরজা পেরিয়ে নেমে এল নিচে। সেখানে আরো দুটা কি প্যাড আছে, সেগুলোতে সঠিক পাসওয়ার্ড দেবার পরই সামনে আরো অনেকগুলো হাইটেক গেট পড়ল। তারপর হাজির হল ওকের তৈরি ভারি পাল্লা। এবার থামল প্রহরী, তাদের দিকে রোষ-কষায়িত নেত্রে একটু তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করতে করতে দেয়ালের একটা ধাতব বাক্সের দিকে এগিয়ে গেল। আনলক করল সেটাকে, ঢুকল ভিতরে, তারপর আরো একটা কোড প্রেস করল। অবশেষে তাদের সামনের দরজার ভারি পাল্লা আস্তে করে খুলে গেল। প্রশস্ত হল তাদের পথ।

গার্ড ঘুরে দাঁড়াল, কথা বলল প্রথম বারের মত। এ দরজার শেষ প্রান্তেই আর্কাইভ। এ পর্যন্ত আসার কথা আমার, তার পরই ফিরে গিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত হতে হবে।

চলে যাচ্ছেন আপনি? প্রশ্ন তুলল ভিট্টোরিয়া।

এই পবিত্র আর্কাইভে সুইস গার্ডদের প্রবেশাধিকার নেই। আপনারা এখানে তার একমাত্র কারণ আমাদের কমান্ডার ক্যামারলেনগোর কাছ থেকে একটা সরাসরি আদেশ পেয়েছেন।

তাহলে আমরা বাইরে বের হব কী করে?

মনোডিরেকশনাল সিকিউরিটি। একপথে যাবার সময় এ নিরাপত্তা নিয়ে ভাবা হয়। বেরুনোর পথে আপনাদের কোন সমস্যায় পড়তে হবে না। কথার এখানেই ইতি টেনে মার্চ করে বেরিয়ে গেল প্রহরী।

কিছু কথা বলল ভিট্টোরিয়া, কিন্তু কান দিতে পারল না ল্যাঙডন। তার চোখ সামনের দুই দুয়ারী ঘরের দিকে। কে জানে তার ভিতরে কী রহস্য লুকিয়ে আছে।

৪৭.

যদিও সে জানে, হাতে সময় বেশি নেই, তবু ক্যামারলেনগো কার্লো ভেন্ট্রেস্কা আস্তে আস্তে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। ওপেনিং প্রেয়ারের আগে তার মনটাকে গুছিয়ে নেয়া জরুরী। অনেক বেশি কান্ড ঘটে যাচ্ছে অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে। সে সামনে। এগিয়ে যেতে যেতে টের পায় গত পনের বছরের গুরুভার এবার তার কাধে এসে বর্তাবে।

তার পবিত্র দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে সে। সারা জীবন।

ঐতিহ্য অনুযায়ী পোপের মৃত্যুর পর ক্যামারলেনগো ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে যাবে পোপের দিকে। চেষ্টা করবে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনার। হাত রাখবে পোপের ক্যারোটিড আর্টারিতে, তারপর তিনবার পোপের নাম নিয়ে ডাকবে। নিয়ম অনুযায়ী আর কোন উপায় নেই। সাথে সাথে সে সিল করে দিবে পোপের বেডরুম, ধ্বংস করে দিবে পাপাল ফিসারমেন্স রিং, লাশের রক্ষণাবেক্ষনের ব্যবস্থা করে শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করবে। এ পাট চুকলে পরের ধাক্কা আসবে ক্যামারলেনগোর উপরে, কনক্লেভের জন্য প্রস্তুতি।

কনক্লেভ। ভাবল সে, শেষ ঝক্কি-ঝামেলার কাজ। খ্রিস্টানত্বের সবচে পুরনো ঐতিহ্যের একটা এই ব্যাপার। এর পিছনেও অনেক কথা আছে। এটা খ্রিস্টানত্বের প্রতীক হলেও সমালোচনা হয়েছে এ নিয়ে। ভিতরে কী ঘটে সেটা ভিতরের কার্ডিনালরাই ভাল বলতে পারবে। ক্যামারলেনগো জানে, এটা ভুল বোঝাবুঝি ছাড়া আর কিছুই নয়। কনক্লেভ মোটেও ভোটাভুটির মাধ্যমে পাপা নির্বাচন নয়। এটা প্রাচীণ এক পদ্ধতি। ঐশ্বরিক ক্ষমতা বন্টনের পথ। এই ঐতিহ্যের যেন কোন শেষ নেই… গোপনীয়তা, কাগজের ভাঁজ করা দলা, ব্যালটগুলো পুড়িয়ে ফেলা, পুরনো রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণ, ধোঁয়ার সিগন্যাল…।

অষ্টম জর্জের এলাকা পেরুতে পেরুতে চিন্তায় পড়ে যায় ক্যামারলেনগো। কী করছেন এখন কার্ডিনাল মাটি? এখনো ধৈর্য ধরে রাখতে পারছেন কি? নিশ্চই মাটি দেখেছেন প্রেফারিতিরা এখনো হাজির হননি। তারা হাজির না থাকলে সারা রাত ধরে ভোটিং চলবে। মাটিকে গ্রেট ইলেক্টর পদে আসীন করাটা বিজ্ঞোচিত কাজ হয়েছে, নিজেকে একটু আশ্বস্ত করে ক্যামারলেনগো। লোকটা মুক্তচিন্তার মানুষ। ভাল সিদ্ধান্ত নিতে জানেন। আজ রাতের মত নেতা আর কোনদিন কনক্লেভের প্রয়োজন পড়েনি।

রাজকীয় সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ক্যামারলেনগোর মনে হল সে শেষ বিচারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই উচ্চতা থেকেও সে স্পষ্ট টের পেল একশো পঁয়ষট্টি কার্ডিনালের অস্বস্তি মাখা আলোচনা।

একশো একষট্টি জন কার্ডিনাল। শুধরে নিল সে।

এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলল ক্যামারলেনগো। সে পড়ে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে নরকের পাকে, চিৎকার করছে লোকজন, আগুনের লেলিহান শিখা উঠে আসছে তার দিকে, আকাশ থেকে পাথর আর রক্ত বর্ষাচ্ছে।

আর তারপর, নিথর দুনিয়া।

***

যখন শিশু জেগে উঠল, সে স্বর্গে বাস করছিল। তার চারপাশের সব বস্তু শ্বেত বর্ণের। খাঁটি আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়, যদিও সবাই বলে দশ বছরের কিশোর কখনোই স্বর্গের স্বর্গীয়তা বুঝতে পারবে না। কিন্তু দশ বছরের কার্লো ভেট্রো ঠিক ঠিক চিনে নিতে পারল স্বৰ্গকে। সে এখন ঠিক ঠিক স্বর্গে আছে, আর কোথায় সে থাকতে পারে? তার দশ বছরের ছোট্ট জীবনটায় কালো ঠিক ঠিক ঈশ্বরকে চিনে নিতে পেরেছিল। পাইপ অর্গানের বজ্রনিনাদ, উঁচু উঁচু গম্বুজ, সুরের মূৰ্ছনায় পরিবেশিত সঙ্গীত, আলো করা কাঁচ আর ব্রোঞ্জ ও স্বর্ণের ছড়াছড়ি। কার্লোর মা, মারিয়া তাকে প্রতিদিন সাধারণ্যে নিয়ে আসতেন। গির্জাই কার্লোর আবাসভূমি।

প্রতিদিন আমরা মানুষের সামনে আসি কেন? একটুও রাগ না করে প্রশ্ন করেছিল কার্লো।

কারণ আমি ঈশ্বরের কাছে ওয়াদা করেছিলাম এমনটাই করব। বলতেন মা,, আর ঈশ্বরের কাছে করা প্রতিজ্ঞা আর সব কাজেরচে দামি। স্রষ্টার কাছে দেয়া কোন কথা কখনো ভঙ্গ করবে না।

কার্লো মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল, কখনো স্রষ্টাকে দেয়া কোন প্রতিশ্রুতি সে ভাঙবে না। এই পৃথিবীর আর সবকিছুর চেয়ে সে তার মাকে ভালবাসত। তিনি তার কাছে পবিত্র ফেরেশতী। সে তাকে মাঝে মাঝে ডাকত মারিয়া বেন্ডেট্রা-আশীর্বাদপুষ্ট মেরি–নামে, যদিও তিনি তা ঠিক পছন্দ করতেন না। তিনি যখন প্রার্থনায় বসতেন তখন কালো মায়ের সুগন্ধ নিত, আবেশিত হত তার প্রার্থনার সুর লহরীতে। হেইল মেরি, মাদার অব গড… আমাদের পাতকদের জন্য প্রার্থনা করুন… এখন এবং আমাদের শেষ নিঃশ্বাসের সময়টায়…

আমার বাবা কোথায়? প্রশ্ন করত কার্লো। যদিও সে জানে তার বাবা তার জন্মের আগেই মারা গেছে।

ঈশ্বরই এখন তোমার পিতা। সাথে সাথে তিনি জবাব দিতেন নির্দ্বিধায়। কথাটা মনে রেখ, এখন থেকে তোমার বাবা হলেন ঈশ্বর। তিনি তোমার ভালমন্দ দেখবেন, রক্ষা করবেন সব বিপদ থেকে। ঈশ্বরের কাছে তোমাকে নিয়ে অনেক বড় পরিকল্পনা অপেক্ষা করছে, কার্লো। শিশু জানত তার মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। সে তখনি অনুভব করত, ঈশ্বর মিশে আছেন তার শোণিত ধারায়।

রক্তে,…
আকাশ থেকে রক্তের বর্ষণ!
নিরবতা। তারপরই স্বর্গ।

তার স্বর্গ, যতটা মনে পড়ে কার্লোর, ছিল সান্তা ক্লারা হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট। পালারমোর বাইরে। সে তখন ছিল একটা চ্যাপেলে, সেটা ভেঙে পড়ে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায়। সেখানে সে ছিল, ছিল তার মা, তারা মানুষের সামনে বেরিয়ে এসে ঈশ্বরের মহিমা নিয়ে গুণকীর্তন করছিল। সাইত্রিশজন মারা পড়ে সাথে সাথে। তাদের মধ্যে তার মা-ও ছিলেন। কার্লোর বেঁচে যাওয়াটাকে পত্রিকারা ডাকে দ্য মিরাকল অব সেন্ট ফ্রান্সিস নামে। কার্লো সৌভাগ্যক্রমে ঠিক বিস্ফোরণের আগ মুহূর্তটায় ছিল একটু নিরাপদ কক্ষে। সেখানে সে সেন্ট ফ্রান্সিসের গল্প নিয়ে মেতে ছিল।

ঈশ্বর আমাকে সেখানে ডেকে নিয়েছিলেন, বলত সে নিজেকে, তিনি চাইতেন আমি টিকে থাকি।

ব্যথায় জর্জরিত ছিল কালো। সে এখনো তার মায়ের কথা ঠিক ঠিক মনে করতে পারে। তার মা, একটা মিষ্টি চুমু ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন তার দিকে। তারপরই একটা বিস্ফোরণ, শতছিন্ন হয়ে গেল তার মিষ্টি গন্ধ ভরা শরীর। সে আজো মানুষের কদর্য দিকটার কথা মনে করতে পারে। এখনো তার সামনে রক্তের হোলি খেলার দৃশ্য ভেসে বেড়ায়। তার মায়ের শোণিত উপর থেকে পড়ে তার গায়ে! আশীর্বাদপুষ্ট মারিয়ার রক্ত!

ঈশ্বর তোমাকে সব সময় চোখে চোখে রাখবে। সব সময় রক্ষা করবে তোমাকে। বলত মা।

কিন্তু এখন কোথায় সেই ঈশ্বর?

তারপর, মায়ের কথামত এক লোক এল তার কাছে, হাসপাতালে। সে সামান্য কোন মানুষ ছিল না, ছিল একজন বিশপ। সে তাকে নিয়ে প্রার্থনা করল। প্রার্থনা করল তারা জন্য। সেন্ট ফ্রান্সিসের অলৌকিক মহিমার জন্য। তারপর যখন সে সুস্থ হল, সেই বিশপের আওতায় তাকে একটা মনাস্টারিতে জায়গা করে দেয়া হল। আর সবার সাথে শিক্ষা নেয় কালো। তাকে পাবলিক স্কুলে ভর্তি হতে বলল সেই বিশপ, কিন্তু রাজি নয়

কার্লো। এখন সে সত্যি সত্যি তুষ্ট। সে এখন আসলেই বাস করছে ঈশ্বরের ঘরে।

প্রতি রাতে কালো মায়ের জন্য নতজানু হয়ে প্রার্থনা করত।

ঈশ্বর কোন এক উদ্দেশ্য সামনে রেখে আমাকে রক্ষা করেছেন, সব সময় তার ছিল এই এক ভাবনা। কিন্তু কী সেই কারণ?

কার্লোর যখন ষোল বছর বয়স তখন সে ইতালির বাধ্যতামূলক সামরিক ট্রেনিংয়ে অংশ নেয়। সেটা ছিল রিজার্ভ মিলিটারি। এই কাজ থেকে দূরে থাকতে হলে তাকে সেমিনারিতে ভর্তি হতে হবে, বলেছিল তাকে বিশপ। সাথে সাথে বিজ্ঞোচিত জবাব দিয়েছিল সে, তার প্রিস্ট হবার ইচ্ছায় কোন খাদ নেই, কিন্তু সে খারাপকে চেখে

দেখতে চায়।

কিন্তু কথাটার মর্ম বুঝতে পারল না বিশপ।

সে খুলে বলল, যদি সে চার্চে থেকে সারা জীবন মন্দের হাত থেকে দূরে থাকার কাজ করে তবে আগে তাকে অবশ্যই মন্দ কী তা বুঝতে হবে, জানতে হবে। সে বুঝতে পারছিল, সামরিকতা ছাড়া মন্দকে খুব দ্রুত আর কোথাও চিনতে পারা যাবে না। সেনাবাহিনী গোলা বারুদ নিয়ে কায়-কারবার করে। একটা বোমার আঘাতেই আমার আশীর্বাদপ্রাপ্ত মা ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন।

বিশপ তাকে সামরিক বাহিনী থেকে যথা সম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু মন স্থির করে ফেলেছে কার্লো।

কিন্তু সাবধান, আমার পুত্র! বলেছিল বিশপ, আর মনে রেখ, চার্চ তোমার, প্রত্যাবর্তনের আশায় দিন গুণবে।

কার্লোর দু বছরের সামরিক চাকুরি আসলেই নরকে কেটেছিল। কার্লোর মত মেঘমন্দ্র, তার ভাবনা সুচিন্তিত, তার ধী স্থির, কিন্তু সামরিক বাহিনীতে এসবের কোন মূল্য নেই। এখানে নিরবতার কোন স্থান নেই। অষ্টপ্রহর শব্দ আর শব্দ। চারধারে অতিকায় যন্ত্র, শান্তির জন্য বরাদ্দ নেই একটা ঘণ্টাও। যদিও সৈন্যরা সপ্তাহে একদিন ছুটি পায়, কেউ কেউ চার্চেও যায়, তবু কালো তার সহকর্মীদের মধ্যে ঈশ্বরের ছায়া দেখতে পায়নি। তাদের মনে-মগজে ধ্বংস সব সময় দামামা বাজায়। ঝংকার তোলে ইন্দ্রিয় কাঁপিয়ে। প্রকম্পিত করে তোলে মনোজগত।

নতুন জীবনকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতে শেখে কালো। ফিরে যেতে চায় শান্তির বসতে। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নয় সে। এখনো মন্দকে চেখে দেখতে হবে তাকে। সে অস্ত্র তুলে নিতে অস্বীকার করল, তাই সামরিক বাহিনী তাকে মেডিক্যাল হেলিকপ্টার চালানো শিখাতে চায়। সে শব্দকে ঘৃণা করে, ঘৃণা করে এই যান্ত্রিকতা, কিন্তু সেই হেলিকপ্টারই তাকে নিয়ে যায় মাটির পৃথিবী থেকে উপরে, তার মায়ের কাছাকাছি। যখন কার্লো জানতে পারল এ ট্রেনিংয়ের সাথে আরো আছে প্যারাস্যুটের কারসাজি, সে ব্যাপারটাকে ঠিক মেনে নিতে পারল না। কিন্তু পা বাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আর কোন উপায় নেই।

ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করবেন। বলে সে নিজেকে।

কার্লোর প্রথম প্যারাস্যুট ট্রেনিং ছিল তার জীবনে সবচে কষ্টকর অভিজ্ঞতার একটা। একই সাথে দামি। যেন ঈশ্বরকে পুঁজি করে সে উড়ছে, উড়ছে তার সাথে। ব্যাপারটার সাথে তাল মিলিয়ে নিতে পারল না কার্লো… সেই নৈঃশব্দ… সেই ভেসে থাকা… সে মেঘের সাদা এলাকা পেরিয়ে নিচের ভূমিতে ফিরে আসতে আসতে দেখতে পায় মায়ের মুখ, মেঘমালাতে। তোমাকে নিয়ে ঈশ্বরের পরিকল্পনা আছে, কালো। মিলিটারি থেকে ক্ষান্ত দিয়ে ফিরে এসে কার্লো যোগ দেয় সেমিনারিতে।

সেটা তেত্রিশ বছর আগের কথা।

রাজকীয় সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ক্যামারলেনগো কার্লো ভেন্ট্রেস্কা, সে মনে করার চেষ্টা করে সেই সময়টার কথা। বেরিয়ে আসতে চায় তারপর। আসতে চায় বর্তমানে।

দূর করে দাও সব ভীতি, বলল সে, আর আজকের রাতটাকে ছেড়ে দাও ঈশ্বরের হাতে।

সিস্টিন চ্যাপেলের বিশালবপু ব্রোঞ্জ গেটটা সে দেখতে পাচ্ছে এখন স্পষ্ট। চারজন সুইস গার্ড আড়াল করে রেখেছে পথটাকে। গার্ডরা পাল্লা খুলে দেয়ার জন্য বিশাল ছিটকিনি খুলল। ভিতরের প্রত্যেক চেহারা ঘুরে গেছে এদিকে। ক্যামারলেনগো তার সামনের কালো রোব আর লাল কাপড়ের ঢাকনার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ। হঠাৎ সে বুঝে যায় তার জন্য ঈশ্বরের কী পরিকল্পনা ছিল।

নিজেকে ক্রস করে নিয়ে পা ফেলে ক্যামারলেনগো সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরে।

৪৮.

বিবিসি সাংবাদিক গুন্টার গ্লিক সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে বিবিসির ভ্যানে বসে দরদর করে ঘামতে ঘামতে গালি দিয়ে একসা করছে তার এডিটরকে। কেন এই মরার কাজে তাকে টেনে আনা। যদিও তার প্রথম মাসের কাজের পর অনেক বা জুটেছে কপালে–মেধাবী, দক্ষ, নির্ভরতার পাত্র-তবু এই এখানে বসে বসে শুধু শুধু মাছি মারাটা তার মোটেও ভাল লাগছে না। যদিও বিবিসি তাকে শাবাস জানাতে দ্বিধা। করেনি, তবু এভাবে রিপোর্ট করাটা তার আইডিয়া ছিল না।

গ্লিকের এ্যাসাইনমেন্টটা একেবারে সরল। সে এখানে বসে বসে মাছি তাড়াবে আর তারপর, বুড়োদের দল তাদের নূতন বুড়োকে নির্বাচিত করলে সে পনের সেকেন্ডের লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার করবে, আর কিছু নয়। পিছনে থাকবে ভ্যাটিকান সিটির অবয়ব।

ব্রিলিয়ান্ট!

গ্লিক ভেবে পায় না কী করে বিবিসি এখানে রিপোর্টার পাঠায় আরো। তোমরা কি চোখে ঠুলি পরিয়েছ? আমেরিকান নেটওয়ার্ক এখানে ঢু মারছে সে ব্যাপারটা কি চোখে পড়ে না? এখানে পড়ে আছে সিএনএন। তারাও ওৎ পেতে বসে আছে। বসে আছে এমএসএনবিসি। তাদের প্রস্তুতি আরো ঝকমারি। কৃত্রিম বর্ষার ব্যবস্থা করাই আছে। লোকে আর খবর শুনতে চায় না, চায় বিনোদন।

উইন্ডশিল্ড দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আরো আরো বিরক্ত হয়ে পড়ে গ্লিক। সামনেই ভ্যাটিকানের রাজকীয় পাহাড়ে বসে আছে গোটা ভ্যাটিকান সিটি। লোকে এখানে মনোযোগ দেয়ার মত কী পায় ঈশ্বরই জানে।

আমি আমার জীবনে কী পেলাম? নিজেকেই সে প্রশ্ন করে সশব্দে, কিস্যু নয়। একেবারে ফাঁকা।

তাহলে হাল ছেড়ে দাও, সাথে সাথে তার পিছন থেকে একটা মেয়ে কন্ঠ বলে উঠল।

লাফ দিয়ে উঠল গ্লিক। সে যে একা নয় এ কথাটাই বেমালুম ভুলে বসেছিল। ফিরে তাকায় যেখানে তার ক্যামেরা ওমান চিনিতা মার্চি বসে বসে তার চশমার কাঁচ পরিষ্কার করছে। এই মেয়েটা সর্বক্ষণ কাঁচ ঘষতে ঘষতে পার করে দেয়। চিনি কালো। এম্নিতে আফ্রিকান আমেরিকানদের প্রতি তার ভাল সহমর্মিতা আছে, কিন্তু আদপে চিনি বিশাল। সে কখনোই কাউকে ভুলে যেতে দিবে না যে সে একজন কালো মানিক। আর গ্লিক তাকে ভালই পছন্দ করে। এখন এই সঙ্গটুকু উপভোগ করতে বাকি।

সমস্যা কী, গান্থ? জিজ্ঞেস করে চিনি।

কী করছি আমরা এখানে?

এক অসাধারণ ব্যাপার দেখছি। এখনো মনোযোগ দিয়ে গ্লাস পরিষ্কার করছে সে।

বুড়ো মানুষগুলো কালিগোলা অন্ধকারে ডুবে আছে এটা খুব বেশি দর্শনীয় ব্যাপার হল?

তুমি ভাল করেই যান যে তোমার শেষ গন্তব্য নরক, জান না?

এখন তাহলে কোথায় আছি?

আমার সাথে কথা বল, যেন শাসাচ্ছে মা কোন দস্যি ছেলেকে।

আমি শুধু অনু করছি, আমার মাথা থেকে সব প্রশংসা উবে যাচ্ছে।

তুমি ব্রিটিশ ট্যাটলারের জন্য আবেদন করেছ?

হুঁ। কিন্তু এতে কোন বদ নিয়ত নেই।

কাম অন! আমি মনে করেছি তুমি একটা দুনিয়া কাঁপানো আর্টিকেল লিখেছ পত্রিকায়, রাণীর সাথে এলিয়েনদের যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে।

থ্যাঙ্কস।

হেই, বিধাতা চোখ তুলে তাকিয়েছে। আজ রাতে তুমি জীবনে প্রথমবারের মত পনের সেন্ডের শট নিতে যাচ্ছ, তাও আবার লাইভ।

ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল গ্লিক। সে এখনি বাহবাটার কথা বলে দিতে পারে, থ্যাঙ্কস গুর, গ্রেট রিপোর্ট। তারপর তার দিক থেকে চোখ চলে যাবে প্রকৃতির দিকে, আমার

একটা স্থির অবস্থান দরকার।

হাসল মাক্রি, এই অভিজ্ঞতার ঝোলা আর মুখটাকা দাড়ি নিয়ে?

হাত বোলাল গ্লিক তার জঙ্গুলে দাড়িতে, আমি মনে করেছিলাম এগুলো থাকলে আমাকে আরো বুদ্ধিমান বুদ্ধিমান লাগে।

কপাল ভাল। গ্লিক আরো একবার হেরে বসার আগে ভ্যানের সেল ফোনটা বেজে উঠল। মনে হয় এডিটর। বলল সে। আশায় চকচক করছে তার চোখে। কী মনে হয়, কোন লাইভ আপডেট জানতে চাইবে কি তারা?

এই কাহিনীর উপর? হাসল ম্যাক্রি আবারও, স্বপ্ন দেখতে থাক। দোষ নেই কোন এ কাজে।

যথা সম্ভব ভারিক্কি চালে গ্লিক তুলে নিল ফোনটা। গুন্টার গ্লিক, বিবিসি, ভ্যাটিকান সিটি থেকে সরাসরি।

লাইনের লোকটার স্বরে আরবি টানের সুস্পষ্ট চিহ্ন, মনোযোগ দিয়ে শুনুন। বলল সে, আমি আপনার জীবনটা বদলে দিতে যাচ্ছি।

৪৯.

ল্যাঙডন আর ভিট্টোরিয়া এখন একা একা দাঁড়িয়ে আছে গোপন আর্কাইভের দুই দুয়ারের সামনে। সামনে দেয়াল থেকে দেয়ালে চলে যাওয়া গালিচা, নিচে মর্মরের মেঝে, উপরে সিকিউরিটির ওয়্যারলেস ক্যামেরা। ভেবে পায় না ল্যাঙডন, এটা কোন বিশোধিত রেনেসাঁ নয়ত? সামনে ছোট্ট একটা ব্রোঞ্জের প্লেট, তাতে লেখা :

আর্কিভিও ভ্যাটিকানো
কিউরেটরে, পাদ্রে জ্যাকুই টমাসো

ফাদার জ্যাকুই টমাসো। ল্যাঙডন তার ঘরে রাখা ফিরিয়ে দেয়ার চিঠিগুলোতে লেখা নামটা মনে করতে পারছে ভালভাবেই। প্রিয় জনাব ল্যাঙডন, আমি অতীব দুঃখের সহিত জানাইতেছি যে, ভ্যাটিকানের আর্কাইভে আপনার প্রবেশাধিকার দিতে পুনর্বার। অপারগতা প্রকাশ করিতে হইতেছে…

দুঃখের সহিত জানানো। গোবর! জ্যাকুই টমাসোর রাজত্ব শুরু হবার সময় থেকে কোন নন ক্যাথলিক আমেরিকানকে দেখতে পায়নি যে ভ্যাটিকান আর্কাইভে প্রবেশ করতে পেরেছে। এল গার্ডিয়ানো, তাকে ব্যঙ্গ করে ডাকত ইতিহাসবেত্তারা। জ্যাকুই টমাসসা ইহধামের সবচে রক্ষণশীল কিউরেটর, সবচে কর্কষ লাইব্রেরিয়ান। ভিতরে প্রবেশ করার সময়ই মনে মনে একবার দেখে নেয় ল্যাঙডন কিউরেটরকে। সে পরিপূর্ণ সামরিক সাজে সজ্জিত, তার পাশে বাজুকা হাতে একজন সৈনিক। কিন্তু না। ব্যাপারটা তেমন নয়। পুরো এলাকা জনশূণ্য। খাঁ খাঁ করছে।

নিরবতা আর নিবু নিবু আলো।

আর্কিভিও ভ্যাটিকানো। তার জীবনের সবচে মূল্যবান মুহূর্তগুলোর একটা। ভিতরে চোখ রেখেই মৃদু একটা ধাক্কা খেল ল্যাঙডন। কল্পনার চোখে কী বিচিত্ৰই ছিল ভ্যাটিকান সিটির আর্কাইভ। তার সাথে মোটেও মিলছে না আসল চিত্র। সে কল্পনায় দেখেছিল ধূলিপড়া অতিকায় বুকশেলফগুলো দাঁড়িয়ে থাকবে, সেখানে শোভা পাবে সোনার জলে আকা, চামড়ার মলাটে বাঁধানো বিরাট বিরাট সব বই। সামনে থাকবে আলো-আঁধারি, থাকবে ধর্মনেতাদের উপস্থিতি। নিবিষ্টচিত্তে তারা পড়ালেখা করবে ভিতরে…। কল্পনার ধারকাছ দিয়েও বাস্তব যাচ্ছে না।

প্রথম দৃষ্টিতে যা মনে হল, সামনের এলাকাটা বিশাল কোন হ্যাঙ্গার, আর তার ভিতরে বিরাট বিরাট নাড়াতে পারা মাঠ। এমন প্রতিরক্ষাই থাকার কথা। ভিতরে থাকবে বই, বাইরে কাঁচ। তার মাঝখানে বায়ুশূণ্য স্থান। বাতাসের জলীয়বাষ্প আর ভেসে বেড়ানো এসিড খুব সহজেই ক্ষয়িষ্ণু ভলিউমগুলোকে তুবড়ে ফেলতে পারে। নষ্ট করে ফেলতে পারে বইগুলোকে। তাই তাদের এভাবেই সংরক্ষণ করতে হবে। আর কোন উপায় নেই। সংরক্ষিত ভল্টে ভিট্টোরিয়া কখনো না গেলেও ল্যাঙডন বহুবার গিয়েছে। তাও এ পরিস্থিতির কোন তুলনা নেই… এমন কোন একটা বদ্ধ কন্টেইনারে আটকে পড়া যেখানে লাইব্রেরিয়ানের ইচ্ছানুসারে অক্সিজেন সরবরাহ আসবে।

ভল্টগুলো কালো, ভল্টগুলোর শেষপ্রান্তে আলোর ক্ষীণ একটা রেখা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। এখানে লুকিয়ে আছে অযুত রহস্য, যা আর সবার সামনে প্রকাশ করা যাবে না। যেন পুরনোদিনের ইতিহাস মুখ ব্যাদান করে আছে। এ সঞ্চয়ের কোন তুলনা নেই।

ভিট্টোরিয়াও যেন মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছে। বিশাল আকারের স্বচ্ছ কাচের দিকে তাকিয়ে সেও পাশে পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

হাতে সময় বেশি-নেই। একটুও দেরি করতে রাজি নয় ল্যাঙডন, তার দরকার একটা বিশাল বপু এনসাইক্লোপিডিয়া যেটায় নজর বুলিয়ে জানতে পারা যাবে কোন কোন বই আছে এখানে। তারপর যা দেখা গেল, ঘরের প্রান্তে প্রান্তে কম্পিউটার সাজানো। দেখেশুনে মনে হচ্ছে তারা সমস্ত বইয়ের ক্যাটালগ কম্পিউটারাইজড করে ফেলেছে।

আশান্বিত দেখাচ্ছে ভিট্টোরিয়াকে, এমন হয়ে থাকলে কাজ হয়ে যাবে আলোর গতিতে।

ল্যাঙডন আশা করে তার উচ্ছ্বাসটা ভাল। কিন্তু আসলে সে বেশ দ্বিধায় পড়ে গেছে। কম্পিউটারাইজড করা হলে শাপে বরের বদলে বরে শাপ হতে পারে। একটা টার্মিনালের দিকে এগিয়ে গিয়ে সে টাইপ করা শুরু করল। তার মনে সন্দেহ দানা বঁধছে। পুরনো নিয়মই ভাল ছিল।

কেন?

কারণ সত্যিকার বইগুলোতে পাসওয়ার্ড প্রটেকশন নেই। মনে হয় না ফিজিসিস্টরা স্বভাবসুলভ হ্যাকার।

মাথা ঝাঁকাল ভিট্টোরিয়া, আমি এক-আধটু চেষ্টা করে দেখতে পারি। এই যা।

লম্বা করে একটা দম নিয়ে ল্যাঙডন ফিরে তাকাল ভল্টগুলোর দিকে। সবচে কাছেরটার দিকে এগিয়ে গিয়ে সে চোখ ফেলল ভিতরে। ভিতরে থরে বিথরে বই সাজানো। বুক শেলফ, পার্চমেন্ট বিন আর একজামিনেশন ট্যাবলেট। প্রত্যেক বইয়ের সারির শেষ মাথায় জ্বলজ্বলে ট্যাব আছে। এই সারিতে কী কী বই আছে সেটা লেখা সেখানে। স্বচ্ছ বাধার সামনে সারিবদ্ধ নামগুলো সে দেখতে থাকে।

পিয়েট্রো লেরেমিটা… লা ক্রসিয়াটে… আরবানো টু… লেভান্ট…

লেবেল এঁটে দিয়েছে বইগুলোর গায়ে। বলল সে, হাঁটছে এখননা, কিন্তু এখানে লেখকদের নাম অনুসারে বর্ণক্রমে সাজানো নেই। অবাক হয়নি সে। পুরনো দিনের লাইব্রেরিগুলোতে লেখকের নাম অনুসারে বইয়ের তালিকা দেয়া থাকে না কারণ অনেক অনেক বইয়ের লেখকের নাম অজানা। আর অনেক অনেক ঐতিহাসিক বইয়ের বদলে চিঠিপত্র আর হেঁড়াখোরা পাতা, পার্চমেন্টও থাকে। যাই হোক, এই ক্রমবিন্যাস কোন কাজে লাগবে না।

ভিট্টোরিয়ার দিকে তাকাল ল্যাঙডন, তার চোখে হতাশা, মনে হচ্ছে ভ্যাটিকান আর্কাইভের নিজস্ব রীতি আছে।

আসলেই, চমক বলা চলে।

আবার সে লেবেলগুলো একবার পরখ করে দেখে। বইগুলোর নামে ক্রম ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সে অনুভব করছে, কোন না কোন সূত্রে সেগুলোকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মনে হয় কোন গাণিতিক নিয়ম রক্ষা করে বইয়ের তালিকা রাখা আছে।

গাণিতিক? বলল ভিট্টোরিয়া, তার চোখে হতাশা, খুব একটা কার্যকর বলে মনে হচ্ছে না।

আসলে… ভাবল ল্যাঙডন, আরো কাছ থেকে ব্যাপারটা নিরীক্ষণ করছে সে, এ হয়ত আমার দেখা সবচে কিম্ভুত ক্যাটালগিং সিস্টেম। সে সব সময় তার ছাত্রদের বলে এসেছে, পুরো ব্যাপার বুঝে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। যেখানে যে সুর ধ্বণিত হয় সেটাই বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এখন মনে হচ্ছে এই ভ্যাটিকান আর্কাইভের রীতিও তেমন কিছু, বেসুরো কোন সুর,

এই ভল্টের সবগুলো ব্যাপারকে দেখে মনে হচ্ছে, বলল সে, অবশেষে, এখানকার সব বই ক্রুসেড বিষয়ক… শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মযুদ্ধের উপরে লেখাগুলো জায়গা পেয়েছে। সব আছে এখানে, অনুভব করল সে। ঐতিহাসিক ব্যাপার, চিঠিপত্র, আর্টওয়ার্ক, রাজনৈতিক-সামাজিক তথ্য, আধুনিক বিশ্লেষণ। এক জায়গায় সব মিলেমিশে গুবলেট হয়ে গেছে… যে কোন একটা বিষয়ে গভীর মনোেযোগ দেয়া সম্ভব। ব্রিলিয়ান্ট।

তেতে উঠল ভিট্টোরিয়া, কিন্তু ডাটাকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সাজানো যায়।

আর তাই তারা বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে ব্যাপারটাকে সাজিয়েছে… একটা সেকেন্ডারি ইন্ডিকেটরের দিকে হাত নির্দেশ করল ল্যাঙডন, এগুলো দিয়ে আরো অন্য বিষয়ের সাথে যুক্ত হওয়া যায়।

অবশ্যই, বলল মেয়েটা, কোমরে হাতদুটা রেখে সে সারা আর্কাইভের বিশাল ঘরের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। তারপর তাকাল ল্যাঙডনের দিকে, তো, প্রফেসর, আমরা যা খুজছি, এই গ্যালিলিও-লেখাটার নাম কী?

হাসা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই ল্যাঙডনের। তাকাল সে ঘরটার চারদিকে, তারপর নিজেকে শুনিয়ে বলল, আছে, এখানেই কোথাও আছে। অপেক্ষা করছে আমার জন্য, মৃদু আলোর কোন কোণে…

ফলো মি। বলল ল্যাঙডন, তাকাল ইন্ডিকেটরগুলোর দিকে। মনে মনে একটু হিসাব কষে নিয়ে বলল, মনে আছে তো? ইলুমিনেটি কীভাবে পথ বের করত? বলেছিলাম না নতুন সদস্যরা কীভাবে চিনে নিত?

গুপ্তধন উদ্ধার করা। বলল ভিট্টোরিয়া, কাছ থেকে দেখতে দেখতে।

চিহ্নগুলো ঠিক মত বসানোর পর তাদের আরো একটা কাজ করা বাকি থেকে যায়। জানানো। জানাতে হয় নতুন বিজ্ঞানীদের, কী করে প্রতীকগুলো চিনে নিবে।

লজিক্যাল। বলল ভিট্টোরিয়া, নাহলে কেউ কশ্মিন কালেও চিহ্নের ব্যাপারটা জানতে পারবে না।

ঠিক তাই। এমনকি যদি তারা জানতেও পারত যে চিহ্নগুলো আছে, তবু বিজ্ঞানীরা জানতেও পারত না কোথা থেকে পথটা শুরু হবে। আদ্যিকাল থেকেই রোম অনেক বড় এক মহানগরী।

ওকে।

পরের সারির দিকে চোখ রেখে ল্যাঙডন বলে চলল। বছর পনের আগে এক বিজ্ঞানী সূত্র আবিষ্কার করে। ইলুমিনেটির সূত্র। দ্য সাইনো।

সাইন। পথটা কোথা থেকে শুরু হল তার হদিস।

ঠিক তাই। এবং তার পর থেকে অনেক অনেক ইলুমিনেটি এ্যাকাডেমিক, আমি সহ, সাইনোর ব্যাপারটা বের করতে পারি। আজ এটা স্বীকৃত সত্যি যে সাইনো বলে কিছু একটা ছিল এবং গ্যালিলিয় বিজ্ঞানীদের কাছে যুগযুগ ধরে ইলুমিনেটির পথে এই চিহ্নগুলো কাজ করে এসেছে। বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেনি ভ্যাটিকান।

কীভাবে?

তিনি অনেক অনেক বই লিখেছেন। ছাপিয়েছেন সেগুলোকে। বছরের পর বছর ধরে।

নিশ্চই ভ্যাটিকান ঠিক ঠিক দেখেছিল? দেখেশুনে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।

ঠিক তাই। সাইনো প্রচার করা হয়েছে।

কিন্তু কেউ কোনদিন সেটা জানতে পারেনি?

না। ব্যাপারটা বেখাপ্পা হলেও, সাইনোর চিহ্ন যাই হোক না কেন–মেসনিক ডায়েরিগুলোয়, আগের দিনের সায়েন্টিফিক জার্নালে, ইলুমিনেটির চিঠিগুলোতে একটা নাম্বার দিয়ে ব্যাপারটাকে মাঝে মাঝে প্রকাশ করা হত।

সিক্স সিক্স সিক্স?

হাসল ল্যাঙডন, না। আসলে ছিল ফাইভ ও থ্রি।

অর্থ?

আমাদের কেউ এখনো অর্থটা বের করতে পারিনি। ফাইভ ও প্রি নিয়ে আমি আমি কম গলদঘর্ম হইনি। সংখ্যাতত্ত্ব, মানচিত্র চিহ্ন, ভূতাত্ত্বিক অবস্থান–নানাভাবে ব্যাপারটাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি আমরা। সারির শেষ মাথায় চলে গিয়ে ল্যাঙডন পরের সারির দিকে চোখ বুলাতে বুলাতে বলে গেল। অনেক বছর ধরে ফাইভ ও থ্রির একমাত্র যে সূত্রটা আমরা বের করতে পারলাম তা হল, ব্যাপারটা শুরু হচ্ছে ফাইভ দিয়ে। এ সংখ্যাটা ইলুমিনেটির গোপনীয় নাম্বারের মধ্যে একটা। থামল সে একটু।

আমার মন কেন যেন বলছে সম্প্রতি তুমি ফাইভ ও থ্রির একটা সুরাহা করতে পেরেছ এবং সেজন্যই আমরা আজ এখানে।

ঠিক কথা। বলল ল্যাঙডন। একটা মুহূর্তের জন্য তার গর্বকে সমুন্নত করে রাখল সে। তুমি কি গ্যালিলিওর একটা বইয়ের নামের সাথে পরিচিত? নাম ডায়াললাগো?

অবশ্যই। বিজ্ঞানীদের মধ্যে অত্যন্ত পরিচিত। বৈজ্ঞানিক কর্মধারার এক ঐশীবাণী বলা চলে বইটাকে।

ষোলশো ত্রিশের প্রথমদিকে গ্যালিলিও একটা বই প্রকাশ করতে চান। তিনি কোপার্নিকাসের সূর্য কেন্দ্রীক সৌরজগতের মডেল নিয়ে আলোচনা করতে চান সেটায়। কিন্তু ভ্যাটিকান সিটি বইটাকে প্রকাশ করতে দিবে না যে পর্যন্ত না গ্যালিলিও চার্চের পৃথিবীকেন্দ্রীক মডেলের ব্যাপারে যথাযথ যুক্তি দেখিয়ে সেটাকেও সমুন্নত না করছেন। এমন এক মডেলকে সত্যি বলে প্রমাণ করতে হবে যেটাতে গ্যালিলিওর মোটেও বিশ্বাস। নেই। তাই আর কোন পথ থাকল না তার। তিনি দু মডেলেরই পক্ষে বিপক্ষে বিস্তর কাহিনী রেখে লিখলেন বইটাকে।

যদ্দূর মনে হয়, বলল ল্যাঙডন, তুমি জান যে এ বইটার জন্যে আজো বিতর্ক দানা বাঁধে মানুষের মনে। এটার জন্যই ভ্যাটিকান গ্যালিলিওকে বন্দী করে ফেলে।

কোন ভাল কাজই শাস্তি ছাড়া করা যায় না।

হাসল ল্যাঙডন, একেবারে সত্যি কথা। গৃহবন্দি হয়ে থাকার সময়টায় তিনি আরো একটা বই লেখেন। অনেক স্কলারই এটাকেও ডায়ালোগোর সাথে গুলিয়ে ফেলে। আসলে তার নাম ডিসকর্সি।

নড করল ভিট্টোরিয়া, আমি এটার কথাও জানি। ডিসকোর্সেস অন দ্য টাইড।

অবাক হয়ে গেল ল্যাঙডন মেয়েটার কথা শুনে। সে কিনা জোয়ার ভাটার উপর গ্রহগুলোর প্রভাব বিষয়ক বইটার কথাও জানে!

হেই! বলল মেয়েটা, তুমি একজন ইতালিয় মেরিন ফিজিসিস্টের সাথে কথা বলছ যার বাবা গ্যালিলিওর আরাধনা করতেন।

হাসল ল্যাঙডন। তারা ডিসকর্সির খোঁজে জান জেরবার করছে না। ল্যাঙডন ব্যাখ্যা করল, ডিসকর্সিই গ্যালিলিওর গৃহবন্দি হয়ে থাকার সময় একমাত্র লেখা বই নয়। ইতিহাসবিদরা মনে করে তিনি সেই সময়টায় আরো একটা বই লিখেছিলেন। ডায়াগ্রামা।

ডায়াগ্রামা ডেলা ভেরিটা, বলল ল্যাঙডন, ডায়াগ্রাম অব টুথ।

এ নাম কখনো শুনিনি।

অবাক হইনি মোটেও। ডায়াগ্রামা গ্যালিলিওর সবচে গোপনীয় কাজগুলোর মধ্যে একটা। বলা উচিৎ এককভাবে সবচে গোপনীয়। তিনি এমন সব বৈজ্ঞানিক ব্যাপার সেখানে আলোচনা করেছেন যেগুলোকে তিনি সত্যি বলে জানতেন কিন্তু প্রকাশ্যে বলতে পারতেন না। তার আর অনেক লেখার মত এটাও গোপনে রোম থেকে তার এক বন্ধুর মাধ্যমে বাইরে চালান করে দিয়ে হল্যান্ড থেকে সেটাকে প্রকাশ করা হয়। ইউরোপিয় গুপ্ত বৈজ্ঞানিক সমাজের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয় লেখাটা। ভ্যাটিকান এটার গন্ধ টের পেয়ে বই পোড়ানোর উৎসব শুরু করে।

চোখ তুলে তাকাল আবার মেয়েটা, বলল, আর তুমি মনে কর ডায়াগ্রামাতেই সেই সত্যের সন্ধান আছে? সেটা আসলে শুধু কোন মামুলি বই নয়, বরং তার ভিতরেই লুকিয়ে ছিল সংকেতটা, যেটা ইউরোপের সমস্ত বিজ্ঞানীকে আকৃষ্ট করে ইলুমিনেটির দিকে, যেটা থেকে তারা জানতে পারে কীভাবে ইলুমিনেটির সন্ধান পাওয়া যাবে? দ্য সাইনো? দ্য পাথ অব ইলুমিনেশন?

ডায়াগ্রামাতেই আসলে গ্যালিলিও পথটার সন্ধান ভরে রেখেছিলেন। আমি নিশ্চিত। ল্যাঙডন চলে গেল তৃতীয় সারির দিকে, ট্যাবগুলো দেখতে দেখতে বলে গেল এক সুরে, আর্কাইভিস্টরা ডায়াগ্রামার একটা কপি পাবার জন্য প্রাণপাত করতে প্রস্তুত। অনেক বছর ধরে। কিন্তু ভ্যাটিকানের বই পোড়ানোর উৎসব আর পুস্তিকাটার গোপনীয়তার কারণে পারমানেন্স রেটিংয়ের জন্য পৃথিবীর মুখ থেকে হাপিস হয়ে যায় বইটা।

পারমানেন্স রেটিং?

টিকে থাকার কাল। আর্কাইভিস্টরা বইকে দশের মধ্যে একটা রেটিং দেয়, যেটা বইয়ের কাগজ টিকে থাকার সময়কাল উল্লেখ করে। ডায়াগ্রামা প্রিন্ট হয়েছিল সিজ প্যাপিরাসে। জিনিসটার সাথে টিস্যু পেপারের সাথে তুলনা চলে শুধু। এর জীবদ্দশা এক শতাব্দির বেশি হবে না।

এরচে শক্ত পোক্ত কোন কাগজ নয় কেন?

এটাও গ্যালিলিওর চালাকি। তার অনুসারীদের টিকিয়ে রাখার কৌশল। যদি কোন বিজ্ঞানী একটা বই সহ ধরা পড়ে যায় তাহলে সোজা সে বইটাকে পানিতে ছেড়ে দিবে। হাপিস হয়ে যেতে বেশি সময় নিবে না সেটা প্রমাণ লুকিয়ে ফেলার চমৎকার কৌশল। কিন্তু আর্কাইভিস্টদের জন্য ব্যাপারটা দুঃখজনক। বলা হয়ে থাকে, অষ্টাদশ শতাব্দির পর একটা মাত্র ডায়াগ্রামার কপি টিকে ছিল।

একটা? আর এখানেই আছে সেটা? কপালে চোখ উঠে গেল মেয়েটার। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার।

গ্যালিলিওর মৃত্যুর পরপর ভ্যাটিকান সেটাকে উদ্ধার করে নেদারল্যান্ড থেকে। আমি এটাকে খুঁজে পাবার আশায় হন্যে হয়ে গেছি যখন থেকে জানতে পারলাম এটার ভিতরে কী আছে।

ল্যাঙডনের মনের লেখা পড়তে পেরে সাথে সাথে ভিট্টোরিয়া চলে গেল অন্য প্রান্তে। বইটা খোঁজার চেষ্টার গতি দ্বিগুণ করার জন্য।

থ্যাঙ্কস, বলল সে, খুজছি এমন কোন রেফারেন্স ট্যাব যেটাতে গ্যালিলিওর কোন

কোন সূত্র আছে, একটু-আধটু নামটা থাকলেও চলবে। সায়েন্স, সায়েন্টিস্ট পেলেও চলে। দেখলেই তুমি বুঝতে পারবে।

ঠিক আছে। কিন্তু এখনো বললানি ঠিক কীভাবে বুঝে উঠতে পারব যে এখানে গ্যালিলিওর কু আছে। ইলুমিনেটির চিঠিগুলোতে যে লেখাগুলো আছে তার সাথে কোন সম্পর্ক নেইতো? কিম্বা ফাইভ ও থ্রির সাথে?

হাসল ল্যাঙডন, আসলেই। আমি প্রথমে যোগ-সাজসটা টের পাইনি। কিন্তু এই ফাইভ ও থ্রির সাথে ভাল যোগ আছে অন্যান্য সূত্রের। আছে সরল একটা ব্যাখ্যা। এটার সাথে সরাসরি ডায়াগ্রামার যোগসূত্র আছে।

এক মুহূর্তের জন্য ল্যাঙডন চলে গেল দু বছর আগের ষোলই আগস্টে। তার এক কলিগের ছেলের বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে সে হ্রদের ধারে দাড়িয়ে ছিল। তারপর সেই লেকে ভেসে বেড়াতে লাগল একটা ফুলে ফুলে ছাওয়া প্রমোদতরী। অবাক হয়ে ল্যাঙডন জিজ্ঞেস করল কনের বাবাকে, সিক্স ও টুর সাথে কী সম্পর্ক?

সিক্স ও টু?

ডি সি আই আইর অর্থ রোমান অক্ষরে সিক্স ও টু।

হাসল লোকটা, এটা কোন রোমান অংক নয়। বরং ভাসতে থাকা বার্জটার নাম। ডিসি টু।

দ্য ডিসি টু?

নড করল লোকটা, দ্য ডিক এ্যান্ড কনি টু।

বোকার মত তাকিয়ে থাকল ল্যাঙডন। মাঝে মাঝে সে এমন বোকামি করে ফেলে। নাম দুটা বর আর কনের। অবশ্যই, তাদের প্রতি সম্মান জানাতে বার্জটায় এমন নাম দেয়া হয়েছে। ডিসি ওয়ানের কী খবর?

দুঃখ ভেসে উঠল লোকটার কণ্ঠে, গতকাল সেটা ডুবে গিয়েছিল, লানের সময়।

হাসল ল্যাওড়ন, কথাটা শুনে আমি দুঃখিত। তাকাল সে ডিসি টুর দিকে। মনে পড়ে গেল তার কিউ ই টুর কথা। ব্যাপারটা তাকে স্থবির করে দিল কিছুক্ষণের জন্য।

এবার ল্যাঙডন ফিরে দাঁড়াল ভিট্টোরিয়ার দিকে। ফাইড ও থ্রি, বলল সে, আগেই বলেছি, এটা একটা কোড। এটা ইলুমিনেটির এক ধরনের চালাকি। তারা এটাকে রোমান সংখ্যার সাথে মিলিয়ে নিয়েছে। রোমানে ফাইভ ও থ্রির প্রকাশ হচ্ছে,..

ডি আই আই আই।

চোখ তুলে তাকাল ল্যাঙডন, এত দ্রুত কী করে বললে! আবার বলে বসো না আমাকে যে তুমি একজন ইলুমিনেটা।

হাসল মেয়েটা, আমি রোমান অক্ষর ব্যবহার করি কোনকিছুকে নির্দেশ করার কাজে।

ঠিক তাই, মনে মনে বলল ল্যাঙ৬ন, আমরা সবাই কি একই কাজ করি না? চোখ তুলে তাকাল ভিট্টোরিয়া, তো, ডি আই আই আইর অর্থ কী?

ডি আই আর ডি আই আই এবং ডি আই আই আই অনেক আদ্যিকালের শব্দ সংক্ষেপণ। আগের দিনের বিজ্ঞানীরা গ্যালিলিওর পুরনো দিনের তিনটা বইকে নির্দেশ করত এ তিন নামে। এর আরেক মানে হল…।

আরো একটা শ্বাস নিল ভিট্টোরিয়া, ডায়ালোগো… ডিসকর্সি… ডায়াগ্রামা।

ডি-ওয়ান, ডি-টু, ডি-থ্রি। প্রতিটাই বৈজ্ঞানিক। প্রতিটাই বিতর্কিত। আর ফাইভ ও থ্রির অর্থ হল, ডি-থ্রি। ডায়াগ্রামা। তার বইগুলোর মধ্যে তৃতীয়টা।

এখনো ঠিক মিলে যাচ্ছে না ভিট্টোরিয়ার হিসাব-কিতাব, কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার নয়। এই এত পথ, এই এত গোপনীয়তা, তারপরও কেন ভ্যাটিকান সিটি আসল ব্যাপারটা উদ্ধার করতে পারল না? খুব সহজ। তাহলে বই পোড়ানোর উৎসবে কিম্বা পরে আর্কাইভে সারিবদ্ধ করে রাখার সময় কেন তারা টের পেল না মোটেও?

তারা দেখেছে ঠিকই, বুঝতে পারেনি। ইলুমিনেটির দ্বিমাত্রিকের মধ্যে নামটাকে লুকিয়ে রাখার কারসাজি দেখেছ না তুমি? না জানলে কীভাবে বুঝতে পারতে কোন ছাতমাথা আকা আছে সেখানে? পারতে না। একই ভাবে, যারা সেটা খুজছে না তারা কশিন কালেও বুঝে উঠতে পারবে না।

মানে?

মানে, গ্যালিলিও জিনিসটাকে ভালভাবেই লুকাতে পেরেছিলেন। ইতিহাসবিদরা বলে, সাইনোটা একটা প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে এসে ইলুমিনেটির সাথে গাটছড়া বাঁধে। তাকে বলা হয় লিঙ্গুইয়া পিউরা।

দ্য পিওর ল্যাঙ্গুয়েজ?

জ্বি। ম্যাথমেটিক্স?

আমিও তাই ভাবছিলাম। দেখেশুনে মনে হচ্ছে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যাওয়া মোটেও রহস্যময় নয়। গ্যালিলিও আসলেই একজন বিজ্ঞানী। আর তিনি লিখছিলেন শুধুমাত্র বিজ্ঞানীদের জন্য। স্বভাবতই, গণিতই পথ, যেটা দিয়ে এক বিজ্ঞানী আরেক বিজ্ঞানীকে ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারবে। ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না বাকীরা। পুস্তি কাটার নাম ডায়াগ্রামা। তার মানে গাণিতিক ডায়াগ্রামগুলোও আরেকটা উৎস হতে পারে।

আরো যেন বিভ্রান্ত হয়ে উঠছে মেয়েটা, আশা করি কোনমতে গ্যালিলিও বিজ্ঞানীদের বোধগম্য করে লেখাটা লিখেছিলেন।

তোমার সুর শুনে মনে হচ্ছে হাল ছেড়ে দিচ্ছ? সারির শেষদিকে সরে যেতে যেতে বলল ল্যাঙডন আস্তে করে।

আমি ছেড়ে দিচ্ছি না। আসলে হাল ছাড়ছি না কারণ তুমি এখনো আশা ধরে রেখেছ। তুমি যদি ডি-থ্রির ব্যাপারে এতই নিশ্চিত হয়ে থাক তাহলে কেন এ কথাটা প্রচার করনি? তাহলে এখানে, ভ্যাটিকান আর্কাইভে যারা আসত বা আসার অনুমতি পেত তারা এখানে এসে ডায়াগ্রামাকে নিয়ে বেশ ভালভাবেই ব্যাপারটার সুরাহা করতে পারত।

আমি কথাটা চাউর করে দিতে চাইনি। বলল ল্যাঙডন, তথ্যটা বের করার জন্য গাধার খাটুনি খাটতে হয়েছে আমাকে। বের করতে হয়েছে অনেক অনেক তথ্য আর নিজেকে থামিয়ে দিল সে। একটু অপ্রস্তুত হয়ে নিজেকে থামিয়ে দিল।

তুমি সুনাম চেয়েছিলে।

কথা বলল ল্যাঙডন, বলতে গেলে… আসলে-

অপ্রস্তুত হবার কোন কারণ নেই, বলল সাথে সাথে ভিট্টোরিয়া, তুমি একজন সায়েন্টিস্টের সাথে কথা বলছ। সার্নে এই ব্যাপারটার একটা চলতি নামও আছে।

আমি শুধু প্রথম হবার চেষ্টায় এমন করেছি তা কিন্তু না। এমন চিন্তাও ছিল, কোন ভুল লোকের হাতে প্রমাণটা পৌঁছলে ডায়াগ্রামা হাপিস হয়ে যেতে পারে।

ভুল লোক মানে ভ্যাটিকান?

তাদের কাজ যে ভুল এমন কোন কথা আমি বলছি না। কিন্তু তাই বলে ভ্যাটিকান যে ইলুমিনেটির হুমকিকে কখনো ছোট করে দেখেছে তাও না। এমনকি উনিশো সালের দিকে চার্চ ইলুমিনেটিকে অতিকথনের দোষে দুষ্ট করে। সবচে বড় যে ব্যাপারটা তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা হল, তাদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে দাঁড়াল দুনিয়ার খ্রিস্টানত্বের বিরোধী দলগুলো মোটামুটি এক কাতারে। দখল করল অর্থনৈতিক ক্ষেত্র, সামাজিক ক্ষেত্র, রাজনৈতিক মাঠ দখল করল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কথাটা কি ঠিক হল? এখনো এমন এক শক্তি আছে যা দখল করে আছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র, সামাজিক ক্ষেত্র, রাজনৈতিক মাঠ; দখল করে আছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

আরো একটা প্রশ্ন আছে আমার। ভিট্টোরিয়া তাকে থামিয়ে দিল, তারপর অদ্ভুত চোখে তাকাল তার দিকে, তুমি কি সিরিয়াস?

একটু ধাক্কা খেল ল্যাঙডন, কী বলতে চাও তুমি?

মানে, আজকের দিনটাকে রা করাই কি তোমার সত্যিকার পরিকল্পনা?

ল্যাঙডন ঠিক ঠিক বলতে পারবে না মেয়েটার আতঙ্কে ভর্তি চোখে করুণা দেখতে পেয়েছে কিনা, তুমি কি ডায়াগ্রামাকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে বলছ?

আমি বলতে চাই, তুমি ডায়াগ্রামাকে খুঁজে বের করবে, চারশ বছর আগের সাইনো বের করবে, ভাঙবে কিছু গাণিতিক কোড, তারপর এমন কিছু প্রাচীণ শিল্পকর্মের পিছনে ছুটবে যেটার অর্থ বের করতে গলদঘর্ম হতে হয়েছে ইতিহাসের সবচে বিখ্যাত আর মেধাবী বিজ্ঞানীদেরও, তারপর সেই লোকটার গোড়াসুদ্ধ উপড়ে এনে বাকি সমস্যাগুলোর সমাধান করবে… আর এ সবই শেষ হবে আগামী চার ঘণ্টার মধ্যে?

শ্রাগ করল ল্যাঙডন, আমি অন্য যে কোন পরামর্শ নিতে রাজি আছি।

৫০.

রবার্ট ল্যাঙডন আর্কাইভ ভল্ট নাইনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গাদা করে রাখা বইয়ের সাথের লেবেলগুলো খুটিয়ে পড়ছে।

ব্রাহে… ক্ল্যাভিয়াস… কোপার্নিকাস… কেপলার… নিউটন…

আরেকবার তালিকাটা পড়ে কেমন একটু অস্বস্তি জেঁকে বসতে দেখল সে নিজের মনে, এখানে সব বিজ্ঞানীর কথা উল্লেখ করা আছে, কিন্তু কোথায় গেল গ্যালিলিও?

সাথের আরেকটা ভল্টের লেখা চেক করতে থাকা ভিট্টোরিয়ার দিকে তাকাল সে, আমি পথটা পেয়ে গেছি, কিন্তু গ্যালিলিওর নাম-গন্ধও নেই কোথাও।

না, তিনি নিখোঁজ নন, বলল সে, তাকিয়ে আছে তার সামনের ভল্টটার দিকে, তিনি এখানে। তবে আশা করি তুমি একটা ভাল লুকিং গ্লাস এনেছ, কারণ এ পুরো ভল্টটায় তার নাম, পুরোটাই তার।

দৌড়ে চলে এল ল্যাঙডন, ঠিক কথাই বলেছে ভিট্টোরিয়া, এই ভল্টের প্রতিটা ইন্ডিকেটরে একটা নামই ফুটে উঠছেঃ

এল প্রসেসে গ্যালিলিয়ানো

এবার হঠাৎ করে ল্যাঙডন বুঝে ফেলল কেন গ্যালিলিওর নিজের জন্য মস্ত একটা ভল্ট বরাদ্দ করা হয়েছে। দ্য গ্যালিলিও এ্যাফেয়ার্স, বলল সে সামনে ঝুকে এসে, ভ্যাটিকানের ইতিহাসে সবচে বড় আইনি ধাক্কা। চোদ্দ বছরে কত শত কাজ! সবই এখানে গুটিয়ে রাখা।

কয়েকটা লিগ্যাল ডকুমেন্টও আছে।

আশা করি গত কয়েক শতাব্দিতে খুব বেশি বাগিয়ে নিতে পারেনি আইনজীবিরা।

হাঙররাও খুব বেশি খাবার পায়নি গত কয়েক শতাব্দিতে।

ল্যাঙডন ভল্টটার পাশের বিশাল হলুদ একটা বাটনে চাপ দিল। এটায় চাপ দিতেই উপর থেকে আলোর বন্যা এসে ভাসিয়ে দিল চারপাশ। আলোর রঙ লাল চুনীর মত। ঝকঝকে, ভল্টটাকে রক্তে ভেসে যাওয়া একটা জীবন্ত কোষের মত দেখাচ্ছে, ভিতরের বইয়ের উঁচু উঁচু তাক আরো গভীরতা এনে দেয়।

মাই গড! চিৎকার করে উঠল ভিট্টোরিয়া, তুমি কি এখানে কাজ করার কথা ভাবছ?

পার্চমেন্ট আর ছেঁড়াখোড়া কাগজ খুজতে হবে।

খোঁজাখুজি করতে করতে পাগল না হয়ে যাও!

অথবা আরো খারাপ অবস্থা… ভাবে ল্যাঙডন। ভল্টের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে, একটা কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি, অক্সিজেন কিন্তু অক্সিডেন্ট, আর ভল্টগুলোতে এ জিনিসটার তেমন উপস্থিতি নেই। ভিতরটা অনেক অংশে ভ্যাকুয়াম। তোমার শ্বাস কিন্তু ক্ষতিকর হতে পারে তোমার জন্য।

হেই, বৃদ্ধ কার্ডিনালরা যদি এখানে উৎরে যেতে পারে তাহলে আমার ভুলটা কোথায়?

হয়ত, ভাবল ল্যাঙডন, আশা করি আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন।

ভল্টগুলোতে একটা করে রিভলভিং ডোর আছে, সেগুলো বাইরের পরিবেশের সাথে খুব দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে, এক মুহূর্তে এমনভাবে দরজাটা খুলে যায় যে বাইরে থেকে খুব বেশি বাতাস ভিতরে ঢুকতে পারে না। ভিতরটাকে সংরক্ষিত রাখার একটা উপায় বলা চলে।

আমি ভিতরে ঢুকে যাবার পর, বলল ল্যাঙডন, তুমি বাটনটা টিপে দিয়ে আমার মত করবে, ব্যস। ভিতরের বাতাসে জলীয় বাষ্পের হার আট পার্সেন্ট। সুতরাং একটা খটখটে শুকনো মুখের জন্য প্রস্তুত হও।

ল্যাঙডন ঘুরতে থাকা কম্পার্টমেন্টের বাটন চেপে ধরল। দরজা জোরে শব্দ করে ঘুরতে শুরু করেছে। ভিতরে প্রবেশ করেই সে একটা থাক্কা খেল, বেশ বড়সড় ধাক্কা। কোন মানুষকে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা থেকে যদি এক মুহূর্তে বিশ হাজার ফুট উপরে তুলে নেয়া হয় তাহলে লোকটার হাল যেমন হবে, ল্যাঙডনের অবস্থাও ঠিক তেমনি। মাথা ঘোরানো আর ফাঁকা ফাঁকা লাগার রোগটা নতুন নয়। এখানে অবাক হবার কিছু নেই। এমন হবেই। ডাবল ভিশন, ডাবল ওভার, মনে মনে আর্কাইভিস্টের শ্যেণদৃষ্টির মন্ত্র আউড়ে গেল সে। ল্যাঙডন টের পেল তার কানের পর্দায় চাপ নেই, টের পেল, পিছনে দরজাটা খুলে গেছে।

ভিতরে চলে এসেছে সে।

প্রথমেই যে কথাটা ল্যাঙডনের মনে পড়ল, তার আশারচে বেশি পাতলা ভিতরের বাতাস। দেখে মনে হচ্ছে ভ্যাটিকান সৰ্বোচ্চরও কিছু বেশি যত্ন-আত্তি করছে ভল্টগুলোয় লুকিয়ে থাকা সম্পদগুলোর। ল্যাঙডন জোর করে শান্ত থাকল যখন তার শিরা-উপশিরা প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। কিন্তু এখানেই তার পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগল। দিনে পঞ্চাশ ল্যাপ সাঁতারের সুফল পাওয়া যাবে এখন। ভিতরে ঢোকো, ডলফিন, বলল ল্যাঙডন নিজেকেই। অনেকটা ঠিকমত শ্বাস নিতে নিতে সে তাকাল চারদিকে, চোখ বোলাল। চারপাশে বইয়ের দিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ করে তার মনে পড়ে গেল পুরনো ভয়টার কথা, মাথাচাড়া দিয়ে উঠল বিরক্তিকর অনুভূতি, আমি একটা বাক্সে বন্দি! ভাবল সে, আমি একটা রক্তলাল স্বচ্ছ প্রায় বায়ুহীন বাক্সে বন্দি!

তার পিছনে দরজা শব্দ করে উঠতেই পিছন ফিরে তাকাল ল্যাঙডন, ভিট্টোরিয়া প্রবেশ করছে। সাথে সাথে বড়বড় হয়ে গেল মেয়েটার চোখ, ভরে উঠল জলে। শ্বাস নিতে শুরু করল সে জোরে জোরে।

এক মিনিট সময় দাও, উপদেশ ঝাড়ল ল্যাঙডন, যদি মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাহলে উবু হও একটু।

আমার… মনে হচ্ছে…খাবি খাচ্ছে ভিট্টোরিয়া, ডাঙায় তোলা মাছের মত, আমি যেন কোন… স্কুবা ডাইভিংয়ে… ভুল মিশ্রণ সহ…

মেয়েটার সয়ে নেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল ল্যাঙডন। সে জানে, সয়ে নিতে পারবে যোগ ব্যায়ামের ওস্তাদ মেয়েটা। কী চমৎকার গডন ওর! অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রশংসার দৃষ্টি চলে যায়, টলে যায় মন। সে এমন একটা মেয়েকে দেখেছিল আরেক আদ্যিকালের লাইব্রেরিতে। সেখানে পরে তার ভাগ্যে যে ভদ্রমহিলা জোটে তাকে এক কথায় বুড়ি বললেও কম বলা হবে। ল্যাঙডন নিশ্চিত তার দাঁতগুলোও কৃত্রিম, বাঁধানো।

এখন একটু ভাল লাগছে? প্রশ্ন করল সে।

নড করল ভিট্টোরিয়া।

আমি তোমাদের মরার প্লেনে চড়েছি, তাই আমি মনে করি তোমার মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে না।

এ কথায় একটা হাসি উপচে পড়ল মেয়েটার ঠোঁট বেয়ে, উসে!

দরজার পাশের বাক্সের কাছে চলে গেল ল্যাঙডন, সেখান থেকে তুলে আনল কিছু কটন গ্লাভ।

এমনটাই করা উচিৎ? জিজ্ঞেস করল ভিট্টোরিয়া।

আঙুলের এসিড। এগুলো ছাড়া ডকুমেন্ট ধরা অনুচিৎ। তোমারও একজোড়া দরকার।

ভিট্টোরিয়াও নিয়ে নিল একজোড়া, হাতে কতটা সময় আছে?

ল্যাঙডন তার হাতের মিকি মাউস ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়, সাতটা বেজেছে একটু আগে।

এ ঘণ্টার মধ্যেই জিনিসটা পেতে হবে আমাদের।

আসলে, বলল ল্যাঙডন, আমাদের হাতে সেটুকু সময়ও নেই। হাত তুলে দেখাল সে উপরে, সাধারণত কিউরেটর ঐ ডাক্টে করে বাড়তি অক্সিজেন পাঠায় ভিতরে কেউ থাকলে। আমরা এ অবস্থায় তার সহায়তা পাব বলে তো মনে হচ্ছে না। লোকটা ভ্যাটিকানে নেই। বিশ মিনিট। আর দেখতে হবে না। বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করবে ফুসফুস।

কথার ধাক্কা কোনমতে সয়ে নিল মেয়েটা।

একটু হেসে উঠল ল্যাঙডন, হোক বা না হোক, মিসটে মিকি টিকটিক করছে।

০৬. বিবিসি অপারেটর গুন্থার গ্লিক
৫১.

বিবিসি অপারেটর গুন্থার গ্লিক সেলফোনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। তুলে দেয়ার আগে ঝাড়া দশটা সেকেন্ড সে তাকিয়ে থাকল।

এদিকে ভ্যানের পিছন থেকে ক্রিস্টিনা ম্যাক্রি তাকিয়ে আছে তার দিকে, কে?

ঘুরে দাঁড়াল প্লিক, তার দৃষ্টি অনেকটা বাচ্চা ছেলের মত যে আশাও করেনি এমন মহা মূল্যবান ক্রিস্টমাস গিফট পাবে। আমি শুধু একটু সূত্র পেয়েছি, ভ্যাটিকানে কিছু একটা ঘটছে।

এর নাম কনক্লেভ, বলল মেয়েটা, সবজান্তার ভঙ্গিতে, হ্যালুভা টিপ।

না। এটুকু আমিও জানি। এরচে বেশি কিছু আছে। বড় কিছু। সে এখনো খাবি খাচ্ছে, কলার যে কথাটা বলল সেটা সত্যি হবার সম্ভাবনা কতটুকু! বেশ লজ্জা পেল গ্লিক উপলব্ধি করে যে সে কথাটার সত্যি হবার পক্ষে প্রার্থনা করছিল। আমি যদি তোমাকে বলি যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ চারজন কার্ডিনাল আজ রাতে অপহৃত হয়েছে এবং মারা যেতে যাচ্ছে চারটা ভিন্ন চার্চে, তুমি কী বলবে?

আমি বলব যে তোমাকে নিয়ে অফিস থেকে কেউ বিশ্রী মানসিকতা নিয়ে মশকরা করছে।

যদি আমি বলি প্রথম কোথায় হত্যাকান্ডটা ঘটছে সেটাও বলে দেয়া হয়েছে আমাকে?

আমি জানতে চাই কোন চুলার কার সাথে তুমি এতক্ষণ কথা বললে।

নাম বলেনি সে।

কারণ হয়ত সে গোবর ভরা মাথা নিয়ে কথা বলেছে।

সাথে সাথে সত্যের একটু ধাক্কা খেল গ্লিক। তার মনে পড়ে গেল একটা দশক জুড়ে সে ব্রিটিশ টেটলার-এ পাগলাটে মানুষের ফোন কল এবং সরাসরি যোগাযোগে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল তার জীবন। কিন্তু এ কলারও যে তেমন তা ঠিক ভেবে উঠতে পারছে না সে। এই লোক তেমন কোন মোহগ্রস্থ কলার নয়। পূর্ণ সচেতন, ঠান্ডা, যুক্তিনির্ভর। আমি আপনাকে আটটার ঠিক আগে কল করব, বলেছিল সে, আর বলব ঠিক কোথায় প্রথম হত্যাকান্ডটা ঘটবে। যে ছবি তুলবেন আপনি সেগুলো আপনাকে এক মুহূর্তে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। যখন গ্লিক জিজ্ঞেস করেছিল কেন তাকে এগুলো বলা হচ্ছে তখন লোকটা বলে, তার মধ্যপ্রাচ্যের টান সহ, বরফ-শীতল কণ্ঠে, সাফল্যের ডানহাত হল মিডিয়া।

সে আমাকে আরো একটা কথা বলেছে, বলল সে।

কী? এলভিস প্রিসলি এইমাত্র পোপ নির্বাচিত হয়েছেন?

বিবিসি ডাটাবেসে ডায়াল কর, করবে কি তুমি? বলল গ্লিক, তেতে উঠছে সে মেয়েটার কথায়, এই লোকদের সম্পর্কে আর কী জানি আমরা সেটা জানতে হবে আমাকে।

কোন লোকদের সম্পর্কে?

আর কোন কথা জিজ্ঞেস করোনা আমাকে।

ম্যাক্রি সাথে সাথে বিবিসি ডাটাবেসে সংযোগ দিতে দিতে বলল, এক মিনিট সময় লাগবে।

গ্লিক ভাসছে কল্পনার জগতে, কলার আমাকে প্রশ্ন করেছিল আমার সাথে কোন ক্যামেরাম্যান আছে কি-না।

ভিডিওগ্রাফার।

আর আমরা সরাসরি সম্প্রচার করতে পারব কিনা।

এক দশমিক পাঁচ তিন সাত মেগাহার্টজ। কী নিয়ে এত ভোলপাড় পড়ে গেল? বিপ করল ডাটাবেজ, ওকে, ঢুকে গেছি আমরা, কার খোঁজ করছ তুমি?

একটা কি-ওয়ার্ড দিল গ্লিক তাকে।

সাথে সাথে চোখ বড় বড় করে ম্যাক্রি তার দিকে তাকাল, আশা করি তুমিও তামাশায় মেতে যাওনি!

৫২.

আর্কাইভাল ভল্টের ভিতরকার স্থান চিহ্ন ল্যাঙডন যেমনটা আশা করেছিল তেমন নয়। তার উপর ডায়াগ্রামাকে গ্যালিলিওর আর সব রচনার সাথে এক কাতারে বসিয়ে রাখা হয়নি। বাইবেলিয় কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ঢুকে এখান থেকে বের না করে আর কোন উপায় দেখছে না তারা দুজন। চোখে দেখছে স্রেফ সর্ষে ফুল।

তুমি শিওর ডায়াগ্রামা এখানেই আছে? অবশেষে প্রশ্ন না করে পারল না মেয়েটা।

হ্যাঁ-বোধক। এখানে একটা জায়গা আছে যেখানে উফিসিও ডেলা প্রোপাগান্ডা ডেলা ফ্রেডে নামে একটা তালিকা আছে–

চমৎকার। যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার কাছে ব্যাপারটার প্রমাণ থাকছে ততক্ষণ অব্দি।

ল্যাঙডন এবার ডানের পথ ধরল। চলছে তার ম্যানুয়াল সার্চ। তাকে গতি বজায় রাখতে হবে, তাকাতে হবে তার চোখের সামনে পড়া সব লেখার দিকে, আর এই ভন্টের ঐশ্বর্যের কোন তুলনা নেই। হেন জিনিস নেই যা এখানে নেই। দ্য এ্যাসেয়ার… নাক্ষত্রিক সংবাদবাহী… সানস্পট বিষয়ক চিঠিপত্র… গ্র্যান্ড ডাচেস ক্রিস্টিনার কাছে পাঠানো পত্র… এ্যাপোলোজিয়া প্রো গ্যালিলিও… আরো এবং আরো।

অবশেষে সফল হল ভিট্টোরিয়াই, একপাশ থেকে হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠল, ডায়াগ্রামা ডেলা ভেরিটা!

সাথে সাথে লাল আলোয় সামনে আসতে শুরু করল ল্যাঙডন, কোথায়?

ভিট্টোরিয়া আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল। সাথে সাথে বুঝতে পারল ল্যাঙডন জিনিসটাকে বের করতে এত পরিশ্রম হবার কার। জিনিসটা শেলফে ছিল না, ছিল একটা ফোলিও বিনে। না বাধা কাগজপত্র রাখার জন্য ব্যবহার করা হয় ফোলিও বিন। কন্টেইনারটার গায়ে আটা লেবেল দেখে খুব সহজেই বলে দেয়া চলে কোন ভুল হয়নি।

ডায়মা ডেলা ভেরিটা
গ্যালিলিও গ্যালিলি, ১৬৩৯

ল্যাঙডন নিচু করে ফেলল তার কনুই। ধ্বক ধ্বক করছে তার হৃদপিন্ড। ডায়াগ্রামা! কোনমতে একটা দুর্বল হাসি ম্যানেজ করতে পারল সে, এ বিন থেকে কাগজগুলো তুলে আনতে সাহায্য কর আমাকে।

ভিট্টোরিয়া নুয়ে এল তার কাছাকাছি। সামনেই বিনটার মধ্যে সাজানো আছে লেখাগুলো।

কোন লক নেই? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ভিট্টোরিয়া।

নেভার। ডকুমেন্টগুলোকে মাঝেমধ্যে হঠাৎ করে সরিয়ে আনতে হয়। আগুন লাগার সম্ভাবনা থাকে, সম্ভাবনা থাকে বা হবার।

তাহলে এটাকে খোলা যাক।

ল্যাঙডনের মোটেও প্রয়োজন নেই বাড়তি কোন উৎসাহ-উদ্দীপনার। এম্নিতেই সে টইটম্বুর। তার সারা ক্যারিয়ার জোড়া কাজের, স্বপ্নের সাকারত্ব দেখতে পাচ্ছে সে, অনুভব করছে, চোখের সামনে পাতলা হয়ে আসছে বাতাস। সেখানে, পাকানো কাগজের দলার ভিতরে এক ধরনের প্রিজার্ভেটিভ। কাগজটুকুকে বের করে আনল সে। পড়ে থাকল কালো প্রিজার্ভেটিভের বাক্সটা।

আমি বরং কোন রত্নের কৌটা আশা করেছিলাম এখানে। বলল ভিট্টোরিয়া।

ফলো মি! বলল ল্যাঙডন, তার হাতে ধরা ব্যাগটা, যেন অত্যন্ত প্রিয় কোন উপহার, অত্যন্ত পবিত্র, সংরক্ষিত, সে চলে গেল ভল্টের ঠিক মাঝখানটায়, যেখানে রাখা আছে আর্কাইভাল এক্সাম টেবিল। এটার কেন্দ্র থেকে চারদিক দিয়ে কাচ চলে গেছে। ছোট করেছে ভল্টের আয়তন। এতে অনেক সুবিধা, এক পাশের ডকুমেন্ট অন্য পাশে যেতে পারবে না, একপাশে ক্ষতিকর কোন কিছু হলে অন্যপাশে তার আছর পড়বে না। সবচে বড় কথা, আবিষ্কারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কোন স্কলারই চায় না তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ আড়চোখে দেখে ফেলুক তার কাজ।

ল্যাঙডন পাউচটাকে বসিয়ে দেয় টেবিলের গায়ে। পাশে পাশে আছে ভিট্টোরিয়া সর্বক্ষণ। এগিয়ে গেল সে। খুলে ধরল ব্যাগের মুখ। কাঁপছে তার আঙুল, সুতি গ্লাভের ভিতরেই।

রিল্যাক্স, ফোড়ন কাটল ভিট্টোরিয়া, এটা কাগজের থলি, পুটোনিয়াম নয়।

কিন্তু তার কথায় দমে যাবার পাত্র নয় ল্যাঙডন, সে সম পরিমাণ সাবধানতা এবং দক্ষতার সাথে স্পর্শ করল ভিতরের কাগজগুলোকে, আলতো করে ধরল, যেন ভেঙে যায় একটুও। একজন আর্কাইভিস্টের দক্ষতায় সে কাগজটাকে ধরল। তারপর সেটাকে তুলে না এনে ব্যাগটাকেই নামিয়ে দিল নিচে। এ-ও আর্কাইভিস্টের কায়দায়। তারপর কাজটা শেষ করতে না করতেই হাঁপাতে শুরু করল সে।

কাগজগুলোকে খতিয়ে দেখার জন্য স্থাপন করল সে এক্সাম টেবিলে। তার পাশ থেকে এবার ভিট্টোরিয়া কথা বলে উঠল, ছোট ছোট কাগজের দলা।

নড করল ল্যাঙডন। তাদের সামনের কাগজের দলাটাকে দেখে মনে হতে পারে কোন পেপারব্যাক থেকে ছিড়েখুড়ে আনা হয়েছে ভঙ্গুর কয়েকটা পাতা। সে দেখতে পেল সেখানে কাগজ আর কলমের চিহ্ন আছে, আছে গ্যালিলিওর নিজের হাতে করা স্বাক্ষর।

এক মুহূর্তেই ল্যাঙডন যেন অন্য ভুবনে চলে গেল, ভুলে গেল যে তারা এখন জীবন-মরণের ঠিক মাঝখানে বসবাস করছে, ভুলে গেল স্থান-কাল-পাত্রের কথা। নির্জলা বিস্ময় নিয়ে সে শুধু চেয়ে আছে কাগজগুলোর দিকে। মোনা লিসায় ব্রাশের টানের ক্ষেত্রে কোন বিশেষজ্ঞ যেমন সাবধানতা অবলম্বন করবে তেমন যত্ন এখন ল্যাঙডনের হাতে…।

হাতে ধরা বিবর্ণ হলদে প্যাপিরাসগুলোর আসল হবার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সবচে বড় কথা, পাতাগুলোর হাল একেবারে সুন্দর। রঙে একটু বিচ্যুতি আছে, সূর্যে নেয়ে ওঠা কাগজের একটা ভাব আছে, তারপরও, এত ভাল অবস্থা আশাও করা যায় না।

তার মুখমন্ডল একটু ঘেমে উঠছে, কেঁপে উঠছে কিছুটা। আর বোরা দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে ভিট্টোরিয়া।

একটা স্পাটুলা এগিয়ে দাও, প্লিজ। বলল ল্যাঙডন। সাথে সাথে পাশে থাকা স্টেইনলেস স্টিল আর্কাইভাল টুল থেকে একটা তুলে আনল ভিট্টোরিয়া। দিল তার, হাতে। সে খুব সাবধানতার সাথে সেটা দিয়ে খুলল কাগজের ভজ, তার আগে হাত দিয়ে টুলটার গা থেকে সম্ভাব্য ময়লা ঝেড়ে নিয়েছে।

একটু অবাক হয়েই সে টানা টানা লেখার প্রথম পৃষ্ঠার দিকে নজর দিল। সেখানে ছোট ছোট ক্যালিগ্রাফিক লেখাও আছে যেগুলো দেখে কোন মানে বোঝা যায় না। এখানে কোন গাণিতিক হিসাব নেই, নেই কোন ডায়াগ্রাম, এটা নির্জলা একটা রচনা।

হেলিওসেন্ট্রিসিটি, সূর্যকেন্দ্রিকতা। বলল ভিট্টোরিয়া, ফোলিও ওয়ানের হেডলাইনটাকে অনুবাদ করে। দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবী কেন্দ্রিকতার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন এখানে গ্যালিলিও। পুরনোদিনের ইতালিয়ান, পড়া কষ্টকর। অনুবাদ করা আরো গলদঘর্ম হয়ে যাবার মত কাজ।

ভুলে যাও, যেন কিছুই এসে যায় না ল্যাঙডনের, আমরা গণিতের খোঁজ করছি। দ্য পিওর ল্যাঙ্গুয়েজ। পরের পাতাটা খোলার জন্য সে টুলটাকে ব্যবহার করল। আরো এক রচনা। নেই কোন অঙ্ক, নেই কোন নকশা। দস্তানার ভিতরে ঘেমে নেয়ে উঠছে ল্যাঙডনের হাত।

গ্রহগুলোর গতিবিধি, এবারও অনুবাদ করে দিল ভিট্টোরিয়া।

আর যে কোন দিন হলে প্রাণপাত করে হলেও ল্যাঙডন খুঁটিয়ে পড়ত পুরো বইটা, এতোদিন পরে নাসার গ্রহ-অবস্থিতি বিষয়ক চূড়ান্ত গবেষণায় যে কথা উঠে আসছে সেটার শুরু এখান থেকেই। কিন্তু আজ সময় নেই হাতে।

নো ম্যাথ। অবশেষে বলল ভিট্টোরিয়া, তিনি কথা বলছেন গ্রহগতিবিদ্যা আর ডিম্বাকার কক্ষপথ টাইপের বিষয় নিয়ে।

ডিম্বাকার কক্ষপথ! মনে আছে ল্যাঙডনের, গ্যালিলিও মহা বিপাকে পড়ে যান গ্রহের ডিম্বাকার পরিভ্রমণ পথ বাৎলে দেবার পরই। উঁহু, ভ্যাটিকান সায় দিচ্ছে না। ভ্যাটিকান বলছে, গ্রহগুলোর পথ একেবারে নিখুঁত, গোলাকার। ডিম্বাকার হতেই পারে না। কিন্তু গ্যালিলিওর ইলুমিনেটি তার কথা মেনে নিয়েছে। অক্ষরে অক্ষরে। ইলুমিনেটির ডিম্বাকার পথ আজো বিখ্যাত। আজকের মেসনিক লেখাগুলোতে, প্যাডে বা চিহ্নে সেই ডিম্বাকার পথের প্রমাণ মিলে যায়।

পরেরটা। বলল ভিট্টোরিয়া।

সাথে সাথে উল্টে দিল ল্যাঙডন।

চন্দ্রকলা ও জোয়ার-ভাটা। বলল সে, কোন সংখ্যা নেই। নেই কোন ডায়াগ্রাম।

আবার উল্টাল ল্যাঙডন। কিছুই নেই। আরো প্রায় ডজনখানেক পাতা উল্টে গেল সে সাথে সাথে। নেই। নেই। নেই।

আমি মনে করেছিলাম এ লোক গণিতবিদ ছিলেন,হতাশ সুরে বলল ভিট্টোরিয়া, এখানে অঙ্কের কোন নাম-নিশানাও নেই।

টের পাচ্ছে ল্যাঙডন, তার ভিতরের বাতাস আস্তে ধীরে পাতলা হয়ে আসছে। পাতলা হয়ে আসছে আশা। চিড় ধরছে বিশ্বাসের গায়ে।

এখানে কি নেই। অবশেষে সিদ্ধান্ত দেয়ার সুরে বলল ভিট্টোরিয়া, কোন গণিত নেই। কয়েকটা তারিখ, কয়েকটা স্ট্যান্ডার্ড ফিগার, কিন্তু কোনটা দেখেই মনে হয় না যে সেখানে কোন স্কু আছে।

পরের পাতা উল্টে নিল ল্যাঙডন। ছাড়ল একটা দীর্ঘশ্বাস। এটাও রচনা। শেষ। পাতা।

একেবারে ছোট বই। বলল ভিট্টোরিয়া।

নড করল ল্যাঙডন।

মার্ডা, আমরা রোমে এ নামেই এগুলোকে ডাকি।

হাবিজাবি বলল ল্যাঙডন মনে মনে। তাকিয়ে আছে কাঁচের দিকে। তারক্ষন মেনে নিতে পারছে না। কোন না কোন সূত্র থাকবেই থাকবে, বলল সে অবশেষে। এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে সেই সাইনো। আমি নিশ্চিত।

হয়ত ডি আই আই আই এর ব্যাপারে তোমার কোন ভুল হয়েছে নাকি?

লিঙ্গুয়া পিউরা। আর কী হতে পারে এর মানে?

আর্ট?

এখানে তো কোন ডায়াগ্রাম বা ছবি নেই।

যদ্দূর বোঝা যাচ্ছে, লিঙ্গুয়া পিউরা বলতে ইতালিয় বাদে অন্য কোন ভাষা বোঝানো হচ্ছে। এটুকু বোঝা যায় সহজেই।

আমিও তোমার সাথে একমত।

কিন্তু সহজে মেনে নেবার পাত্র নয় ল্যাঙডন, নাম্বারগুলো অবশ্যই লেখা আছে। গণিত নিশ্চই ইকুয়েশনের বদলে শব্দে লেখা আছে। আমি নিশ্চিত।

সাথে সাথে বলল ভিট্টোরিয়া, সবগুলো পাতা খুটিয়ে দেখতে অনেক সময় লাগবে। অন্তত আমাদের হাতে থাকা সময়ের তুলনায় অনেক।

এই সময়টারই অভাব আছে আমাদের। কাজ ভাগ করে নিতে হবে। আর কোন গত্যান্তর নেই। সাথে সাথে উল্টে নিল ল্যাঙডন পাতাগুলো, সংখ্যা খুঁজে বের করার মত ইতালিয় আমার জানা আছে। কার্ডের মত করে সে দু ভাগ করে ফেলল পাতাগুলোকে, তারপর এগিয়ে দিল ভিট্টোরিয়ার দিকে অর্ধেকটা। আমি নিশ্চিত, এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে আমাদের লক্ষ্য।

ভিট্টোরিয়া হাত বাড়িয়ে নিল তার পাতা। তারপর সেটায় দৃষ্টি দিল।

স্প্যাটুলা! চিৎকার করে উঠল ল্যাঙডন সাথে সাথে, হাতে ধরো না। স্প্যাটুলা ব্যবহার কর।

আমার হাতে গ্লাভ পরা আছে। সতেজে জবাব দিল ভিট্টোরিয়া, কতটা ক্ষতি করতে পারব আমি?

যা বললাম কর। অবশেষে মেয়েটা তুলে নিল স্প্যাটুলা, তুমিও কি আমার মত অনুভব করছ? টেনশন?

না। দমের অভাব।

অবশ্যই, ল্যাঙডন অতিমানব নয় যে দমের অভাব বোধ করবে না। তার কল্পনার চেয়েও দ্রুত পাতলা হয়ে যাচ্ছে বাতাস। তারা জানে তাদের তড়িঘড়ি করতে হবে। আর্কাইভের এই হালের সাথে সে মোটেও অপরিচিত নয়। কিন্তু এ অবস্থা অনাকাক্ষিত। আর একটুও বাক্যব্যয় না করে সে কাজে ঝাপিয়ে পড়ল বুভুক্ষুর মত।

দেখা দাও! ড্যাম ইট! দেখা দাও!

৫৩.

আণ্ডারগ্রাউন্ড টানেলে, রোমের কোন এক জায়গায় একটা কালো অবয়ব হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছে। আদ্যিকালের প্যাসেজওয়ের গুমোট বাতাস হাপ ধরিয়ে দেয়। টর্চের আলোয় যেন আরো ভারি হয়ে যাচ্ছে। উপরে, ভয় পাওয়া কণ্ঠস্বরের কথা ধ্বণিত প্রতিদ্ধণিত হচ্ছে। বৃথাই।

কোণা ঘুরে সে তাদের দেখতে পায়। ঠিক যেভাবে ফেলে রেখে গিয়েছিল সেভাবেই। চারজন বুড়ো লোক, একটা পুরনো পাথরের গায়ে শিকল দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে তাদের।

কুই এ্যাটেস ভোয়াস? তাদের একজন ফ্রেঞ্চে দাবি করল, আমাদের নিয়ে কী করতে চাও তুমি?

হিলফে! আরেক কণ্ঠ বলল, যেতে দাও আমাদের!

আমরা কারা সে সম্পর্কে তোমার কি বিন্দুমাত্র জ্ঞান আছে? আরেকজন স্প্যানিশ টান সহ ইংরেজিতে বলল।

নিরবতা! ভারি কণ্ঠ একটা মাত্র শব্দ উচ্চারণ করল। এর উপরে আর কোন শব্দের গুঞ্জন নেই।

চার বন্দির একজন, ইতালিয়, গভীর চোখে তাদের অপহরণকারীর দিকে তাকাল, তার সারা গা শিরশির করে উঠল, কী যেন দেখতে পেল সে সেখানে। গড হেল্প আস। বলল সে মনে মনে।

হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল লোকটা, তারপর চোখ ফেলল তার বন্দিদের দিকে। সময় চলে এসেছে, বলল সে, কে আগে যাবে?

৫৪.

আর্কাইভাল ভল্টের ভিতরে সামনের ক্যালিগ্রাফির দিকে তাকিয়ে রবার্ট ল্যাঙডন

বুঝতে পারলে সেখানে সংখ্যা আছে। মিল… সেন্টি… উন, দিয়ে, ত্রে… সিঙ্কোয়ান্তা। আমার একটা গাণিতিক রেফারেন্স দরকার, যে রকমই হোক না কেন, একটা গানিতিক রেফারেন্স!

একের পর এক পাতা পড়ে যেতে শুরু করেছে সে। হাতে ধরা স্প্যাটুলার সাথে সাথে হাতও কাপছে তার, থরথর করে। একটু পরে সে টের পায়, স্পাটুলাটা সরিয়ে রেখেছে সে। উল্টাচ্ছে পাতা হাত দিয়েই। উপস! ভাবল সে। অক্সিজেনের অভাব কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার। বোধবুদ্ধির লয় আসে যে কোন সময়। দেখে মনে হচ্ছে আমি আর্কাইভিস্টদের দোজখে জ্বলেপুড়ে মরব।

সময় বয়ে যাচ্ছে? বলল ভিট্টোরিয়া, তারপর তাকাল ল্যাঙডনের হাতের দিকে। মহোৎসাহে সেও সমান তালে হাত দিয়ে পাতা উল্টানো শুরু করল সাথে সাথে।

ভাগ্যের দেখা?

মাথা নাড়ল ভিট্টোরিয়া, কোন লেখা দেখে বোঝার উপায় নেই ম্যাথমেটিকাল কোন ক্লু আছে কিনা।

বাড়তে থাকা জটিলতার সাথে হাতের পাতাগুলো উল্টে যাচ্ছে ল্যাঙডন। এম্নিতেই ল্যাঙডনের ইতালিয় জ্ঞান আধপোড়া, তার উপর প্রাচীণ ভাষা আরো বেশি তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। ল্যাঙডনের অনেক আগেই ভিট্টোরিয়া তার ভাগের পাতাগুলো উল্টে পাল্টে দেখা শেষ করেছে। এবার সে একটা হতাশা ভরা দৃষ্টি দিল ল্যাঙডনের দিকে। তারপর আবার দেখা শুরু করল আগের পাতাগুলোই।

শেষ পাতা শেষ করে ল্যাঙডন কষে একটা গালি ঝেড়ে তাকাল ভিট্টোরিয়ার দিকে। বেচারি তার পাতার দিকে একটু অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

কী? জিজ্ঞেস করল ল্যাঙডন।

জবাব দিল না ভিট্টোরিয়া, বরং প্রশ্ন করল, তোমার পাতায় কোন ফুটনোট পেয়েছ নাকি?

মনে হয় না। কেন?

এ পাতায় একটা পাদটিকা আছে। দেখে একটু খটকা লাগে।

সাথে সাথে এগিয়ে এল ল্যাঙডন, ভিট্টোরিয়ার ঘাড়ের উপর দিয়ে তাকাল সামনে। প্রথম প্রথম সে কিছুই দেখতে পায় না, দেখল শুধু পাতা নং-৫, তারপর আরো খেয়াল দিতে দিয়ে সে একটু ভিড়মি খেল। ফোলিও ফাইভ, ফাইভ, পিথাগোরাস, পেন্টাগ্রাম, ইলুমিনেটি। ভেবে পায় না ল্যাঙডন, ইলুমিনেটি কি পাঁচ নম্বর পাতাকে তাদের লুকিয়ে থাকার সূত্র হিসাবে উপস্থাপিত করেছে? আশপাশের লালচে ধোঁয়াশায় একটু আশার আলো দেখতে পায় সে। ফুটনোট কি গাণিতিক?।

মাথা নাড়ল ভিট্টোরিয়া, টেক্সট। এক লাইন। খুবই ছোট প্রিন্টিং, দেখে প্রায় বোঝাই যায় না।

আশা আরো মিইয়ে গেল, কিন্তু এটা গাণিতিকভাবে থাকার কথা। লিঙ্গুয়া পিউরা।

জানি, আমি জানি। বলল মেয়েটা, তবু আমার মনে হয় কথাটার অর্থ তুমি জানতে চাবে। কী একটা আভাস যেন তার কণ্ঠে।

পড়ে যাও।

সাথে সাথে ভিট্টোরিয়া পড়ে ফেলল লাইনটাকে, আলোক-পথ পড়ে আছে, পবিত্র পরীক্ষা।

কথাগুলোর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝে উঠতে পারল না যেন ল্যাঙডন, আই এ্যাম স্যরি?

আলোক-পথ পড়ে আছে, পবিত্র পরীক্ষা।

আলোক-পথ?

ঠিক তাই, আলোক-পথ।

এক মুহূর্তে যেন ডুবে গেল ল্যাঙডন কোন অতলে, আলোক-পথ পড়ে আছে, পবিত্র পরী! সে বুঝে উঠতে পারে না কীভাবে ব্যাপারটাকে নিবে, কিন্তু এটুকু বুঝতে পারে, এখানে সরাসরি ইলুমিনেটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আলোক-পথ পড়ে আছে, পবিত্র পরী! মাথাটা যেন ভুল জ্বালানি দেয়া কোন ইঞ্জিন। তুমি নিশ্চিত, অনুবাদে কোন ভুল হয়নি?

একটু ইতস্তত করে ভিট্টোরিয়া, আসলে… একটা অদ্ভুত নজর দিয়ে তাকায় সে ল্যাঙড়নের দিকে, টেকনিক্যালি বলতে গেলে, এটা ঠিক ভাষান্তর নয়। লাইনটা লেখা আছে ইংরেজিতে!

সাথে সাথে ঠান্ডা হয়ে এল ল্যাঙডনের ভিতরটা। কেঁপে গেল অন্তরাত্মা, ইংরেজি?

ঠেলে দিল ভিট্টোরিয়া লেখাটা তার দিকে। আর সাথে সাথে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ল্যাঙডন সেটার উপরে। আলোক-পথ পড়ে আছে, পবিত্র পরীা। ইংরেজি! কিন্তু একটা ইতালিয় বইতে ইংরেজি আসছে কোন দুঃখে?

শ্রাগ করল ভিট্টোরিয়া। তার চোখমুখেও দ্বিধা। হয়ত কাদের জবানিতে ইংরেজিই লিঙ্গুয়া পিউরা! আজকের দিনে আমরা এ ভাষাটাকেই বিজ্ঞানের আন-র্জাতিক ভাষা হিসাবে অভিহিত করি। অন্তত সার্নে।

কিন্তু এটা কোন কথা হল, বল? যুক্তি দেখাচ্ছে ভিট্টোরিয়া, আলোক-পথ পড়ে আছে, পবিত্র পরীক্ষা! এই মরার কথা কোন মানে দেখায় বল?

তার কথা ঠিক, ভাবল ল্যাঙডন। কোন মানে এখন আপাতত বোঝা যাচ্ছে না। তারপরও, তোলপাড় চলছে তার মনে। ব্যাপারটা বেখাপ্পা, ভাবছে সে, এ কথা দিয়ে কী বোঝা যাবে?

আমাদের এখান থেকে পাততাড়ি গুটাতে হবে। বলল ভিট্টোরিয়া, তাড়াতাড়ি!

কান দিল না তার কথায় ল্যাঙডন। তার তনুমন এখন একটা চিন্তায় মশগুল, আলোক-পথ পড়ে আছে, পবিত্র পরীক্ষা। এটা ইম্বিক পেন্টামিটারের লাইন নয়তো? সে বলল হঠাৎ করে, তারপর বলতেই থাকল, সিলেবল নিয়ে খেলা। একবার একভাবে পড়া তো আরেকবার আরেকভাবে পড়া।

জিজ্ঞেস করল ভিট্টোরিয়া, কী বলছ?

ফিলিপ এক্সটারের একাডেমি অব ইংলিশের কথা এক মুহূর্তে মনে পড়ে গেল ল্যাঙডনের। শেক্সপিয়রের লিম্বিক পেন্টামিটারের একটা লাইন নিয়ে হাবুডুবু খাওয়া স্কুল বেসবলের তারকা পিটার গ্রির সারাক্ষণ নাকাল হত। তাদের প্রফেসর, একজন পটে আকা আদর্শ স্কুলমাস্টার, বলতেন, পেন্টা-মিটার, গির! বাসার প্লেটের কথা একবার ভাব। একটা পেন্টাগন। পাঁচটা পাশ, পেন্টা! পেন্টা! পেন্টা! পেন্টা! হায় খোদা!

পাঁচটা কুপলেট, আর প্রতিটায় দুটা করে সিলেবল। সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে সে তার পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে এমন সব ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করে কাটিয়েছে। লিম্বিক পেন্টামিটারের সাথে ইলুমিনেটির মিল আছে। ইলুমিনেটির বেসও পাঁচ আর দুই!

এইতো, হচ্ছে! জোরে জোরে ভাবা শুরু করল ল্যাঙডন, সরিয়ে দিতে চাচ্ছে মন থেকে। কী যেন খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। পাঁচ, পিথাগোরাস আর পেন্টাথলনের চিহ্ন দুই, জগতের সব কিছুর বৈপরীত্যের, জোড়ার চিহ্ন।

আর এক মুহূর্তে বাকি কথাটাও তার ভিতরে উদিত হল। পিওর ভার্স, পিওর ল্যাঙ্গুয়েজ, লা লিঙ্গুয়া পিউরা। এই কথাটাই কি বোঝাতে চায় ইলুমিনেটি? আলোক পথ পড়ে আছে, পবিত্র পরীক্ষা…

ওহ! না! বলল ভিট্টোরিয়া।

না। এটার দ্বিমুখী লেখা হবার কোন সম্ভাবনা নেই। এ্যাম্বিগ্রাম নয় এটা।

না। একটা এ্যাম্বিগ্রাম নয়, কিন্তু, এটা… কথা শেষ না করেই লেখাঁটিকে ঘোরাতে শুরু করে নব্বই ডিগ্রি করে।

এটা কী?

চোখ তুলে তাকাল ভিট্টোরিয়া, এটাই একমাত্র লাইন নয়।

আরো একটা আছে?

প্রত্যেক মার্জিনে একটা করে লাইন আছে। উপরে, নিচে, বামে, ডানে। আমার মনে হয় এটা কোন কবিতা।

চার লাইনের? বিষম খেল ল্যাঙডন, আমাকে দেখতে দাও, গ্যালিলিও কবি ছিলেন!

কিন্তু তার দিকে এগিয়ে দিল না ভিট্টোরিয়া পাতাগুলো। আমি লেখাগুলো আগে দেখিনি কারণ এগুলো মার্জিনের কাছে বসে আছে। আর এগুলোর আকার একেবারে ক্ষুদে। একটা কথা জান? গ্যালিলিও কথাগুলো লেখেননি।

কী?

এখানে যে কবির স্বাক্ষর আছে নাম তার জন মিল্টন।

জন মিল্টন? সেই বিখ্যাত ইংরেজ কবি, যিনি প্যারাডাইস লস্টের মত বিখ্যাত লেখার রচয়িতা। তিনিও গ্যালিলিওর সমসাময়িক, তিনিও গ্যালিলিওর সাথে দেখা করেছেন, তাদের মধ্যে কোন প্রকার আঁতাত থাকা বিচিত্র কিছু নয়। সবাই জানে, জন মিল্টন ষোলশ আটত্রিশে রোমে একটা তীর্থযাত্রা করেন, আলোকিত মানুষদের সাথে দেখা করার জন্য। তিনি এই প্রখ্যাত বিজ্ঞানীর বাসায় দেখা করেন, তার গৃহবন্দি থাকার সময়টায়। সেখানে তারা আলো নিয়ে আলোচনা করেন, আলোচনা করেন জ্ঞান নিয়ে, পৃথিবীর রেনেসার দুই দিকপাল। তাদের এ দেখা করা নিয়েও অনেক শিল্পকর্মের জন্ম হয়েছে। এ্যানিব্যাল গ্যাটির গ্যালিলিও গ্র্যান্ড মিল্টন এমনি এক বিখ্যাত চিত্র। ফ্লোরেন্সের আই এম এস এস জাদুঘরে আজো সেই ছবি শোভা পায়।

মিল্টন গ্যালিলিওকে চিনতেন, তাই না? বলল ভিট্টোরিয়া, হয়ত তিনি গ্যালিলিওর খাতিরে কবিতাটা লিখে দিয়েছেন।

এবার হাতে তুলে নিল ভিট্টোরিয়ার হাত থেকে কাগজটাকে সে, তারপর দেখল সবচে আগের লাইনটা, তারপর একবার ঘুরিয়ে নিয়ে আরেকপাশের লেখা, তারপর আবার, তারপর আবার। চক্র পূর্ণ হয়েছে। প্রথম লাইনটা ভিট্টোরিয়া পড়ল, আসলে সেটা কবিতার তৃতীয় লাইন। এবার ল্যাঙডন আবার লেখাটা পড়তে শুরু করল। ঘড়ির কাঁটার দিকে। উপর-ডান-নিচ-বাম। যখন সে পড়াটা শেষ করল, দম বন্ধ হয়ে এল তার। আপনি পেরেছেন, মিস ভেট্রা।

হাসল মেয়েটা, প্রাণখোলা হাসি, দারুণ, এবার কি আমরা এই নরক থেকে বেরুতে পারি?

আমার এই লাইনগুলো কপি করতে হবে। একটা পেন্সিল আর কাগজ পেতে

মাথা নাড়ল ভিট্টোরিয়া, ভুলে যাও, প্রফেসর। খেলার মত কোন সময় হাতে নেই। মিকি টিকটিক করছে। তার হাত থেকে ছোঁ মেরে কাগজটুকু তুলে নিয়েই সে রওনা হল দরজার দিকে।

দাঁড়িয়ে থাকল ল্যাঙডন, তুমি এটাকে বাইরে নিয়ে যেতে পার না। এটা—

কিন্তু বেরিয়ে গেল ভিট্টোরিয়া।

৫৫.

ল্যাঙডন আর ভিট্টোরিয়া পবিত্র আর্কাইভের বাইরে বেরিয়ে এল। ল্যাঙডনের ফুসফুস ভরে দিচ্ছে পরিচ্ছন্ন বাতাস। নির্মল বাতাসের যেন কোন তুলনা নেই। সে পৃথিবীর সবচে গোপনীয় ভল্ট থেকে বেরিয়ে এল। ক্যামারলেনগো বলেছিল, আমি আপনাকে আমার বিশ্বাস দিয়ে দিচ্ছি।

তাড়াতাড়ি, বলল ভিট্টোরিয়া, ওলিভেট্টির অফিসের দিকে তার দৃষ্টি।

যদি এক বিন্দু পানি ঐ প্যাপিরাসে পড়ে

শান্ত হও। আমরা এর ব্যবচ্ছেদ করে ফেললে তারপর যত্ন-আত্তি করে তাদের পবিত্র ফোলিও পাঁচ ফিরিয়ে দিতে পারব।

গতি বাড়িয়ে দিল ল্যাঙডন। তার চলায় আসল আরো দ্রুতি। কিন্তু একটা ব্যাপার সে মোটেও ভুলতে পারছে না। জন মিল্টন একজন ইলুমিনেটি ছিলেন। তিনি ফোলিও পাঁচ প্রকাশ করার জন্য একটা কবিতা লিখেছেন… ভ্যাটিকানের চোখের আড়ালে।

বাইরে বেরিয়েই ভিট্টোরিয়া ফোড়ন কাটল, তুমি কি মনে কর এটা ডিসাইফার করার তোমার কম্ম? নাকি এতটা সময় আমরা উলুবনে মুক্তা চূড়ালাম?

ল্যাঙডন যত্ন করে কাগজটা তুলে নিল ভিট্টোরিয়ার হাত থেকে। তারপর সেটাকে নির্দ্বিধায় পুরে ফেলল টুইড জ্যাকেটের পকেটে, সূর্যের আলো আর আর্দ্রতা থেকে রক্ষা করতে। আমি এরই মধ্যে এটাকে ডিসাইফার করে ফেলেছি।

সাথে সাথে থমকে গেল ভিট্টোরিয়া, তুমি কী করেছ?

কিন্তু থামল না ল্যাঙডন।

হাল ছাড়ার পাত্রী নয় ভিট্টোরিয়া, তুমি মাত্র একবার পড়েছ এটা। আর তাতেই হয়ে গেল? এটার জটিল হবার কথা।

ল্যাঙডন জানে, মেয়েটার কথাই সত্যি হবার কথা। কিন্তু তার পরও, সে কীভাবে কীভাবে যেন একবার পড়েই এটার কোড ভেঙে ফেলেছে। এখনো তার মনে পড়ে যায় পুরনোদিনের একটা কথাঃ যদি সমাধানটা যন্ত্রণাদায়ক ও কঠিন না হয়, তাহলে বুঝতে হবে তুমি ভুল করেছ।

আমি ডিসাইফার করেছি এটাকে। চলার গতি বাড়িয়ে দিয়ে সে বলল, আমি জানি প্রথম হত্যাকান্ডটা কোথায় হবে। ওলিভেট্টির কাছে পৌঁছতে হবে যে করেই হোক।

আরো কাছে চলে এল ভিট্টোরিয়া, তুমি এরই মধ্যে জেনে গেলে কী করে? আরেকবার জিনিসটাকে দেখতে দাও। বক্সারের দক্ষতায় মেয়েটা তার জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল কাগজটাকে।

সাবধান, বলল ল্যাঙডন, তুমি…

ওর কথার ঘোড়াই পরোয়া করে ভিট্টোরিয়া। ফোলিওটাকে হাতে নিয়ে সে যেন ল্যাঙডনের পাশে পাশে উড়ছে, আলতো হাতে ধরে রেখেছে সেটাকে, বিকালের সূর্যের শেষ আলোয়। তাকিয়ে আছে মার্জিনগুলোর দিকে। মেয়েটা জোরে জোরে পড়া শুরু করতেই ল্যাঙডন তার দিকে হাত বাড়িয়ে ছোঁ মারল। কিন্তু তার বদলে একটা মুখ ঝামটা দিয়ে ফিরিয়ে দিল তাকে ভিট্টোরিয়া। তার কণ্ঠ চিরে শব্দগুলো এখন বিমূর্ত হয়ে উঠছে।

এক মুহূর্তের জন্য, শব্দগুলো শুনতে পেয়ে বিবশ হয়ে পড়ে ল্যাঙডন, যেন সময়ের ভিতর দিয়ে ভ্রমণ করা শুরু হল… যেন সেও গ্যালিলিওর গুপ্ত সভার সভ্য, প্রথমবারের মত ঐশীবাণীর মত এই কবিতা শুনতে পাচ্ছে… যেন সে জানে, এটা একটা সূত্র, একটা ম্যাপ, বিজ্ঞানের চার প্রতীকের চিহ্ন, চিহ্ন চতুষ্টয়… এই চারটা প্রতীক রোমে ছড়িয়ে আছে, বাৎলে দিচ্ছে রোমের ভিতর থেকে ইলুমিনেটিতে যাবার গুপ্ত দ্বারের কথা। ভিট্টোরিয়ার ঠোঁট থেকে গানের সুরে বেরিয়ে আসতে লাগল কথাগুলোঃ

ফ্রম শান্তি স আর্থি টম্ব উইথ ডেমনস হোল,
ক্রস রোম দ্য মিস্টিক এলিমেন্টস আনফোল্ড।
দ্য পাথ অব লাইট ইজ লেইড, দ্য সেক্রেড টেস্ট,
লেট এ্যাঞ্জেলস গাইড ইউ অন ইউর লফটি কোয়েস্ট।

ভিট্টোরিয়া পরপর দুবার লেখাগুলো পড়ে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল।

মনে মনে আউড়ে নিল ল্যাঙডন, ফ্রম শান্তিস আর্থি টম্ব উইথ ডেমন হোল, এ একটা ব্যাপারে কবিতা স্ফটিক-স্বচ্ছ। পাথ অব ইলুমিনেশনের শুরু হয়েছে শান্তির মাজারে। সেখান থেকে, এ্যাক্রস রোম, পথ বলে দিতে দ্বিধা করেননি মিল্টন।

ফ্রম শান্তি স আর্থি টম্ব উইথ ডেমনস্ হোল,
ক্রস রোম দ্য মিস্টিক এলিমেন্টস আনফোল্ড।

রহস্যময় এলিমেন্ট। তারপরও, পরিষ্কার ও আর্থ-এয়ার-ফায়ার-ওয়াটার। বিজ্ঞানের চার এলিমেন্ট। প্রাচীণ বিজ্ঞানের চার মূলমন্ত্র। চার মৌলিক পদার্থ। ধর্মের ছদ্মাবরণে ইলুমিনেটির চার প্রতীক প্রায় প্রকাশ্যেই লুকিয়ে আছে।

প্রথম মার্কারটা, বলল ভিট্টোরিয়া, দেখে মনে হচ্ছে এটা শান্তিস টম্বে আছে।

হাসল ল্যাঙডন, বলেছি না আমি তোমাকে? ব্যাপারটা তেমন জটিল নয়।

তো? শান্তিটা কে? ভিট্টোরিয়া জিজ্ঞেস করল, যেন ল্যাঙডন সবজান্তা, আর তার মাজারটাই বা কোথায়?

নিজে নিজে মুচকে হাসল ল্যাঙডন। সে ভেবে বেশ পুলকিত হয়, সাধারণ মানুষ শান্তি বলতে কাউকে চেনে না। অথচ এটা রেনেসার আমলের সবচে দামি শিল্পীদের মধ্যে একজনের নামের দ্বিতীয় অংশ… এমন এক লোক যিনি মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের জন্য কাজ করা শুরু করেছিলেন। আর আটত্রিশ বছর বয়সে যখন তিনি মারা যান, তার কাজের মধ্যে ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফ্রোস্কোগুলো। আর প্রথম নাম দিয়ে পরিচিতি পাওয়া খুবই দুর্লভ একটা ব্যাপার, তার অধিকারী হয়েছিলেন নেপোলিয়ান, গ্যালিলিও আর যিশুর মত ব্যক্তিত্বরা। এ লোকের চিহ্ন, যাকে টাও ক্রস বলা হয়, সেটাও কম বিখ্যাত নয়। SHAPE * MERGEFORMAT

টাও ক্রস। এর সাথে কৌতুহলোদ্দীপক চিহ্নও আছে।

শান্তি, বলল সে অবশেষে, হল মহান রেনেসাঁ আর্টিস্ট রাফায়েলের শেষ নাম।

চোখ তুলে তাকাল দ্বিধান্বিত ভিট্টোরিয়া, শান্তি? রাফায়েল? সেই রাফায়েল?।

ওয়ান এ্যান্ড ওনলি রাফায়েল। প্রায় উড়ে চলেছে ল্যাঙডন সুইস গার্ডের অফিসের দিকে।

তার মানে রাফায়েলের কবর থেকেই পাথ অব ইলুমিনেশন শুরু হচ্ছে?

এমনটাইতো মনে হয়। তড়িঘড়ি করে যেতে যেত বলল ল্যাঙডন, ইলুমিনেটি বড় বড় আকিয়ে আর শিল্পীদের মাঝেমধ্যে অনারারি ব্রাদার হিসাবে নেয়। হয়ত শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই ইলুমিনেটি রাফায়েলের কবর বেছে নিয়েছে। আবার এ-ও জানত ল্যাঙডন, আরো অনেক ধর্মীয় শিল্পীর মত রাফায়েলও তোপের মুখে পড়া ব্যক্তিত্ব।

যত্ন করে কাগজটা ফিরিয়ে দিল ভিট্টোরিয়া, তো, কোথায় লুকিয়ে আছে রাফায়েল?

বিশ্বাস কর আর নাই কর, তার কবর প্যান্থিয়নে।

প্যান্থিয়নে?

দ্য রাফায়েল এট দ্য প্যান্থিয়ন। প্যান্থিয়ন এমন এক জায়গা যেখানে আকিয়েরা সমাহিত হন। বলতেই হল ল্যাঙডনকে, আর যাই হোক, প্যান্থিয়নকে তারা আশা করেনি। এখানে প্রথম মার্কারটা থাকবে সেটা কে ভেবেছিল! তার মনে হয়েছিল প্রথম চিহ্নটা থাকবে কোন অখ্যাত, দুর্গম জায়গার নিভৃত কোন চার্চে, যেখানে মানুষের আনাগোনা তেমন নেই। সেই মোলশ সালেও, রোমের মধ্যে সবচে দর্শনীয় জায়গার একটা ছিল এই প্যান্থিয়ন, এর বি-শা-ল, শতছিদ্রযুক্ত গম্বুজটা দেখার মত জায়গা ছিল।

প্যান্থিয়ন কি কোন গির্জা? প্রশ্ন করল মেয়েটা।

রোমের প্রাচীনতম ক্যাথলিক চার্চ।

কিন্তু তুমি কি মনে কর প্রথম কার্ডিনালকে কতল করা হবে প্যান্থিয়নে? এটাতো রোমের সবচে ব্যস্ত টুরিস্ট স্পটের মধ্যে একটা। লোকে লোকারণ্য।

শ্রাগ করল ল্যাঙডন, ইলুমিনেটির দাবি অনুযায়ী, তারা এমন কিছু করতে চায় যেটা সারা দুনিয়া দেখবে। প্যান্থিয়নের মত একটা জায়গায় একজন সম্ভাব্য পোপকে মারা যেতে দেখলে কিছু লোকের চোখতো ঠিক ঠিক খুলে যাবে।

কিন্তু কী করে এ লোকগুলো আশা করে যে প্যান্থিয়নের মত একটা জায়গায় প্রকাশ্যে খুন করে তারা ঠিক ঠিক বেঁচেবর্তে চলে যেতে পারবে? এ তো একেবারে অসম্ভব।

ভ্যাটিকান সিটি থেকে চারজন সম্ভাব্য পোপকে তুলে আনার মতই অসম্ভব, কী বল? কবিতাটা স্পষ্ট পথ দেখাচ্ছে।

আর তুমি নিশ্চিত যে রাফায়েল ঐ মরার প্যান্থিয়নের মধ্যেই শুয়ে আছে?

আমি তার কবর অনেকবার দেখেছি।

নড করল ভিট্টোরিয়া, কটা বাজে?

সাড়ে সাত।

প্যান্থিয়ন কি এখান থেকে দূরে?

মাইলখানেক হবে। আমাদের হাতে সময় আছে।

কবিতায় লেখা আছে শান্তি স আর্থি টম্ব। এর কোন সুরাহা করতে পারছ? আসলে রোমে এরচে আৰ্থি আর কোন জায়গা নেই। একটা কথা বলে রাখি, প্যান্থিয়ন মানে যেমন আকিয়েদের কবরস্থান, একই ভাবে এ শব্দের আরো একটা অর্থ আছে, সব দেবতাদের আরাধনাস্থল। প্যাস্থেসিজম থেকে এ শব্দটা এসেছে। পাগন দেবতাদের জন্য এটা নির্ধারিত। মাদার আর্থ তাদের আরাধ্য।

আর্কিটেকচারের ছাত্র হিসাবে ল্যাঙডন একবার ভিড়মি খেয়েছিল একটা ব্যাপার জানতে পেরে, প্যান্থিয়নের মূল চেম্বারটার ডাইমেনশন নাকি গায়ার প্রতি উৎসর্গীকৃত ছিল! গায়া-দ্য গডেস অব আর্থ।

ওকে! বলল ভিট্টোরিয়া, এখনো হাল ছাড়তে নারাজ সে, আর ডেমনস হোল? ফ্রম শান্তিস আর্থি টম্ব উইথ ডেমনস্ হোল?

এ একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে না ল্যাঙডন, নিশ্চই সেটা ওকুলাসকে নির্দেশ করে। বলল সে, কোনমতে নিজেকে জড়ো করে নিয়ে, প্যান্থিয়নের ছাদে যে বিশাল আকৃতির গর্ত রয়েছে সেটার কথা বোঝানো হয়ে থাকতে পারে ডেমনস হোল দিয়ে।

কিন্তু এটা একটা গির্জা। বলল ভিট্টোরিয়া, তার পাশে পাশে হাটতে হাটতে, তারা কেন ঐ খোলা জায়গাটাকে ডেমনস্ হোল বলবে? শয়তানের গর্ত বলার কোন কারণতো দেখা যাচ্ছে না।

এই একটা ব্যাপার নিয়েই নাকানি-চুবানি খাচ্ছিল ভিতরে ভিতরে ল্যাঙডনও। সে কখনো শয়তানের গর্ত-কথাটা শোনেনি। কিন্তু একজন বিখ্যাত সমালোচকের কথা তার মনে পড়ে যায়, তিনি বলেছিলেন, ষষ্ঠ বোনিফেসের দ্বারা নির্মিত হবার সময় প্যান্থিয়ন থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য শয়তানরা এ গর্তটা করেছিল।

আর কেন, বলল ভিট্টোরিয়া, কেন তারা শান্তি নামটা ব্যবহার করবে যেখানে তার আসল নাম রাফায়েল। অন্তত এ নামে সবাই চেনে তাকে।

তুমি অনেক প্রশ্ন কর।

আমার বাবা এ কথাটাই বলতেন।

দুটা সম্ভাব্য কারণ আছে। প্রথমত, রাফায়েল শব্দটায় অনেক বেশি সিলেবল আছে। এটা হয়ত কবিতার মাত্রা আর ছন্দকে বিদ্ধস্ত করে দিত।

খুব একটা ধোপে টিকছে না।

ঠিক আছে। আর শান্তি নামটা দিয়ে রাফায়েলের ব্যাপারটাকে আরো একটু ঘোলাটে করে নেয়া হল, যেন সহজে কেউ বুঝে উঠতে না পারে।

ভিট্টোরিয়া এখনো তার কথা মেনে নিতে পারছে না। আমি নিশ্চিত রাফায়েল যখন জীবিত ছিলেন সে সময়টায় তার দু নামই যথেষ্ট বিখ্যাত ছিল।

অবাক হলেও, কথাটা মোটেও সত্যি নয়। সে সময়কার একটা ঐতিহ্য ছিল, এক শব্দের নামের মধ্যে মাহাত্ম ছিল একটু হলেও বেশি। আজকালের পপ স্টাররা যেমন করে, তেমনি করেছিলেন রাফায়েল। ম্যাডোনার কথাই ধর। সে কিন্তু তার নামের সাথে সিন্ধোনে ব্যবহার করে না কখনো।

বেশ মজা পেল যেন ভিট্টোরিয়া, তুমি ম্যাড়োনার শেষ নাম জান?

একটু মজা পেল ল্যাঙডনও। কোন কথা বলল না সে। সোজা হেঁটে গেল সুইস গার্ডের অফিসের দিকে।

তাদের পিছন থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠল, ফার্মাতেভি!

ভিট্টোরিয়া আর ল্যাঙডন সাথে সাথে তাদেরকে একটা বন্দুকের মুখে দেখার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।

এ্যাটেন্টো! চিৎকার করে উঠল ভিট্টোরিয়া, পড়ে গেল এক পাশে, দেখ, দেখ…

নন স্পেসটাটোভি! চিৎকার করল গার্ডও, কক করছে তার আগ্নেয়াস্ত্র।

সোলডেটো! মাঠের অপর প্রান্ত থেকে ভোজবাজির মত উদয় হল ওলিভেট্টি, যেতে দাও ওদের!

আমতা আমতা করছে সৈন্যটা, মা, সিনর, ই উনা ডোনা—

ভিতরে!

সিনর, নন পোসে–

এখনি! আমাদের উপর নূতন আদেশ এসেছে। ক্যাপ্টেন রোচার কোরকে বিফ করবে। দু মিনিটের মধ্যে। আমরা একটা সার্চের কাজে নেমে পড়ব।

চোখে বিস্ময় নিয়ে গার্ড তড়িঘড়ি করে ঢুকে গেল সিকিউরিটি সেন্টারের দিকে। তাদের দিকে মার্চ করে এগিয়ে এল ওলিভেট্টি, আমাদের সবচে গোপনীয় আর্কাইভে? আমি একটা ব্যাখ্যা চাই।

আমাদের কাছে সুসংবাদ আছে। বলল ল্যাঙডন। সরু হয়ে গেল ওলিভেট্টির চোখ, আশা করি খবরটা আসলেই সু হবে।

৫৬.

চার অচিহ্নিত আলফা রোমিও ১৫৫ টি-স্পার্ক ভায়া ডেই করোনারি ধরে ফাইটার প্লেনের মত ছুটে চলল। চার্চি-পার্দিনি সেমি অটোমেটিক সহ বারোজন সাদা পোশাকের সুইস গার্ড আছে সেগুলোতে। আছে লোকাল রেডিয়াস নার্ভ গ্যাস ক্যানিস্টার, আর লঙ রেঞ্জ শটগান। তিনজন শার্প শুটার হাতে নিয়েছে লেজার সাইটেড রাইফেল।

সবচে সামনে থাকা গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটে বসা ওলিভেট্টি ফিরে তাকাল পিছনে বসা ভিট্টোরিয়া আর ল্যাঙডনের দিকে। আমাকে আপনারা নিশ্চয়তা দিয়েছেন। ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এখন আমি বেরিয়ে এলাম।

ছোট গাড়িতে একটু হাসফাস করে উঠল ল্যাঙডন, আমি আপনার সমস্যা বুঝতে পারছি–

না, আপনি বুঝতে পারছেন না! কখনো চড়ে না ওলিভেট্টির গলা, আমি এইমাত্র ভ্যাটিকান থেকে আমার সেরা এক ডজন লোককে সরিয়ে নিলাম। কনক্লেভের ঠিক আগে। আমি বেরিয়ে এলাম একজন আমেরিকানের কথায় যে কিনা আগে কখনো আমার চোখে পড়েনি এবং যার কাছে একটা চারশো বছর আগের কবিতা আছে প্রমাণস্বরূপ। আর এন্টিম্যাটার খুঁজে বের করার মত গুরুভার দিয়ে এলাম জুনিয়র অফিসারদের হাতে।

পকেট থেকে প্যাপিরাসটা বের করে এবার কথা বলে উঠল ল্যাঙডন, আমি যতটুকু জানি তা হল, চিহ্নটা আছে রাফায়েলের কবরে, আর রাফায়েলের কবর আছে। প্যান্থিয়নে।

সাথে সাথে কমান্ডারের পাশে বসা অফিসার বলে উঠল, তার কথা ঠিক, কমান্ডার। আমি আর আমার স্ত্রী–

ড্রাইভ! যেন চড় বসিয়ে দিল ওলিভেট্টি। আবার ফিরে এল ল্যাঙডনের দিকে।

কীভাবে এমন একটা জনাকীর্ণ জায়গায় হত্যাকান্ড ঘটিয়ে আপসে আপ সটকে পড়বে?

আমি জানি না। বলল ল্যাঙডন, কিন্তু ইলুমিনেটির কায়কারবার যে অনেক উচ্চ স্তরের সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তারা সার্ন আর ভ্যাটিকানের মত দুর্গগুলোয় খুব সহজেই কেল্লা ফতে করেছে। এটা বলা চলে একেবারেই ভাগ্যের ব্যাপার যে আমরা জানি হত্যাকান্ডটা কোথায় হবে। প্যান্থিয়নই আপনার একমাত্র সুযোগ, পাকড়াও করে নিন লোকটাকে সেখানেই।

আরো বৈপরীত্য। বলল ওলিভেট্টি, একমাত্র সুযোগ? আমার মনে হয় আপনারা বললেন আরো কী সব পথওয়ে আছে। মার্কারের সিরিজ। প্যান্থিয়নই সে জায়গা যেখান থেকে আর সব পথের সন্ধান আমরা পাব। লোকটাকে ধরার চারটা সুযোগ থাকছে আমাদের সামনে।

আমি তেমনি আশা করেছি, হার মানার পাত্র নয় ল্যাঙডনও, সুযোগ থাকত আরো এক শতাব্দি আগে।

ল্যাঙডন জানে, প্যান্থিয়ন প্রথম জায়গা। কিন্তু পরেরগুলো যে কোথায় তা ভেবে কুল পায়না সে। যে কোন জায়গায় হতে পারে। সময় তাদের সাথে গাদ্দারি করতে পারে। প্রতারিত হতে পারে তারা। এই এত বছর পরেও পাথ অব ইলুমিনেশন যে অক্ষত থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু আশা ছাড়ছে না সে। ইলুমিনেটি লেয়ার পর্যন্ত যাবার আশা রাখা যায়। হায়! এমনটা না হবার সম্ভাবনাই বেশি।

ভ্যাটিকান প্যান্থিয়নের সব মূর্তি ধ্বংস আর স্থানান্তর করেছে আঠারোশ সালের শতকে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ভিট্টোরিয়া, কেন?

স্ট্যাচুগুলো পাগান অলিম্পিয়ান দেবতাদের। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, প্রথম নিদর্শন হাপিস হয়ে গেছে। আর সেই সাথে

আর কোন আশা? বলল ভিট্টোরিয়া, ইলুমিনেটির পথ খুঁজে পাবার?

মাথা নাড়ল ল্যাঙডন, আমাদের হাতে একটা গুলি আছে। দ্য প্যান্থিয়ন, তারপর উধাও হয়ে যাবে পথ।

তাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে চিল্কার করে উঠল ওলিভেটি, পুল ওভার! সাথে সাথে ব্রেক কষে ধরল ড্রাইভার, তীক্ষ্ণ একটা ক্যাচ-ক্যাচে শব্দে থেমে গেল গাড়িটা, সেই সাথে পিছনের তিনটা আলফা রোমিও। থেমে গেল ভ্যাটিকানের গাড়ি বহর।

কী করছেন আপনি! চিৎকার করে উঠল ভিট্টোরিয়াও।

আমার কাজ। ঠান্ডা সুরে বলল ওলিভেট্টি, মিস্টার ল্যাঙডন, আপনি যখন আমাকে বললেন যে প্যান্থিয়নে আসার পথে আপনি ব্যাপারটা ব্যখ্যা করবেন তখন আমার একটা ক্ষুদে আশা ছিল আমি জানতে পারব কেন আমার লোকেরা এখানে আসছে। আমি এ পর্যন্ত আশা রাখতে পারছিলাম, কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। আপনার রূপকথার গালগল্প অনেক শুনলাম, এবং আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। এখুনি সরিয়ে নিচ্ছি আমি এই মিশন। বের করল সে তার ওয়াকিটকি, কথা বলতে শুরু করল।

পিছন থেকে এগিয়ে এসে ভিট্টোরিয়া তার হাত জাপ্টে ধরল, আপনি পারেন না…

সাথে সাথে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে তাকাল ভিট্টোরিয়ার দিকে, আপনি কখনো প্যান্থিয়নে গেছেন?

না। কিন্তু আমি—

আমাকে এ সম্পর্কে একটু বলতে দিন। প্যান্থিয়ন একটা ঘর। পাথর আর সিমেন্টে গাঁথা একটা বিশাল গোলাকৃতি ঘর। এর প্রবেশপথ মাত্র একটা, কোন জানালা নেই, নেই কোন সরু গলিপথ। সে প্রবেশপথ আগলে রাখে কমপক্ষে চারজন রোমান পুলিশ, সশস্ত্র পুলিশ, জায়গাটাকে আগলে রাখে শিল্পকর্ম চোরদের, এন্টি ক্রিশ্চিয়ান টেররিস্টদের, ভবঘুরে আর জিপসিদের কাছ থেকে।

আপনার পয়েন্ট? ঠান্ডা স্বরে বলল মেয়েটা।

আমার পয়েন্ট? হাত ঝাঁকাল ওলিভেট্টি, আঁকড়ে ধরেছে গাড়ির সিটটা সে। আমার পয়েন্ট হল, আপনারা এইমাত্র আমাকে যা হবার কথা বললেন সেটা হওয়া একেবারে অসম্ভব। একবার দৃশ্যটা মনশ্চক্ষে কল্পনা করুন, প্যান্থিয়নের ভিতরে কী করে একজন কার্ডিনালকে হত্যা করা সম্ভব? আর গোড়ার কথা ধরতে গেলে, কী করে একজন মানুষ সাথে বন্দি নিয়ে পুলিশের চোখ এড়িয়ে এগিয়ে যাবে? আর পরের কথাতো আরো স্বাভাবিক, কী করে তাকে সেখানে খুন করে আবার সাততাড়াতাড়ি পাততাড়ি গোটাবে? শরীর এলিয়ে দিল ওলিভেটি, তার ঠান্ডা চোখ এখন ল্যাঙডনের মুখের দিকে তাকিয়ে, কীভাবে, মিস্টার ল্যাঙডন? একটা বিশ্বাসযোগ্য দৃশ্য গড়ে নিন।

আরো যেন এগিয়ে আসছে ল্যাঙডনের চারপাশের এলাকা, আরো যেন সংকুচিত হয়ে পড়ছে সে। আমার কোন ধারণাই নেই। আমি কোন এ্যাসাসিন নই! সে কোন মরার পন্থা অনুসরণ করবে তার থোড়াই আমি জানি! আমি শুধু জানি যে

একটা মাত্র দৃশ্য বানিয়ে নিন। বলল ভিট্টোরিয়া, চাপ দেয়ার ভঙ্গীতে, তার কণ্ঠ আস্তে আস্তে সরু হয়ে উঠছে, কীভাবে? ঘরটার ছিদ্র ওয়ালা ছাদের উপরে একটা হেলিকপ্টার নিয়ে হত্যাকারী এগিয়ে আসবে, তারপর ছুড়ে দিবে একজন ব্র্যান্ডেড কার্ডিনালকে? কার্ডিনাল মার্বেলের টাইলের উপর আছড়ে পড়বেন এবং সাথে সাথে বেমক্কা পটল তুলবেন!

সাথে সাথে সবাই ভিট্টোরিয়ার দিকে চোখ মেলে তাকাল। তোমার কল্পনা, মেয়ে, ভাবল ল্যাঙডন, খুবই অসুস্থ এবং খুবই ত্বড়িৎ গতির।

কথাটাকে হেসে উড়িয়ে দিতে পারল না ওলিভেট্টি, সম্ভব,.. আমি মানছি… কিন্তু–

কিম্বা হন্তারক কার্ডিনালকে একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে ঠেলে নিয়ে যাবে প্যান্থিয়নের দিকে, তারপর ভিতরে নিয়ে গলা টিপে তাকে সেখানেই বসিয়ে রেখে সটকে পড়বে।

কথাগুলো যেন ভালই প্রভাব ফেলল ওলিভেট্টির উপর।

নট ব্যাড! খুশি হয়ে উঠছে ল্যাঙডনও।

অথবা, মেয়েটার বলা যেন ফুরাতে চায় না, কিলার অন্য পথে–

আমি আপনার কথা শুনেছি, বলল অধৈর্য ভঙ্গিমায় ওলিভেট্টি, যথেষ্ট! বড় করে আরেকটা দম নিল কমান্ডার। বাইরের দিকে তাকাল সে। সেখানে আরেক কার থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল একজন সোলজার। তার পরনে সাদামাটা সাহেবি পোশাক।

সব ঠিক আছেতো, কমান্ডার? জামার হাতা গুটিয়ে মিলিটারি কায়দায় দাঁড়াল সে, সাতটা চল্লিশ, কমান্ডার, আমাদের পজিশন নিতে সময় লাগবে।

অনেকটা দিশেহারা ভঙ্গীমায় নড করল ওলিভেট্টি, কিন্তু অনেক সময় ধরে টু শব্দটাও করল না। ড্যাশবোর্ডের উপর, হালকা ধূলার পরতে হাত দিয়ে সে একটা রেখা তৈরি করল অনেক সময় ধরে। সাইডভিউ মিররে সে অনেকণ ধরে ল্যাঙডনকে পর্যবেণ করল, ল্যাঙডনও অনুভব করছে তার শ্যেন দৃষ্টি। অবশেষে সে ফিরে তাকাল গার্ডের দিকে। তার কণ্ঠে প্রতিদ্ধণিত হল কর্তৃত্বের সুর, আমি ভিন্ন ভিন্ন পথ ধরে যাওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করছি। পিয়াজ্জা ডেলা রাউন্ড ধরে গাড়ি যাবে, যাবে ভায়া ডিগ্রি অরফ্যানি ধরে, পিয়াজ্জা সেন্টারনিও আর সেন্ট ইউস্টাচিও ধরে। একটা অন্যটার ত্রিসীমানায় যেন না যায়, ছায়াও যেন না মাড়ায় দু ব্লকের মধ্যে। একবার কোনমতে পার্ক করতে পারলেই তোমরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিয়ে অপো করবে আমার অর্ডারের জন্য। তিন মিনিট।

ভেরি গুড, স্যার। সৈন্যটা ফিরে গেল তার গাড়িতে।

সাথে সাথে খুশিতে ঝলমল করে উঠল ভিট্টোরিয়ার ম্লান মুখ, উদ্ভাসিত হল ল্যাঙডনের ভাবভঙ্গিও। একই সাথে তারা দুজন অনুভব করল একটা ক্ষীণ সুতা যেন তাদের মধ্যে আছে। যেন তারা এরই মধ্যে বাঁধা পড়ে গেছে।

কমান্ডার ঘাড় ঘোরাল ল্যাঙডনের দিকে, কটমটে দৃষ্টি হেনে বলল, মিস্টার ল্যাঙডন, আমাদের দেখে গায়েপড়ে না হাসাটাই ভাল হয়।

সাথে সাথে কষ্টেসৃষ্টে একটু হাসি জড়ো করতে পারল সে। কীভাবে আমি এমন কাজ করতে পারি?

৫৭.

সার্নের ডিরেক্টর ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার চোখ খুলল নাস্তানাবুদ অবস্থায়, তার গায়ের বিভিন্ন জায়গায় নানা কিম্ভুত বস্তু জুড়ে দেয়া হয়েছে। হাজারটা মেডিক্যাল এ্যাপারেটাস। সে নিজেকে সার্নের একটা গুরুত্বপূর্ণ মেডিক্যাল রুমে শোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করল। বিছানার পাশেই আছে হুইলচেয়ারটা। সবচে ভাল সংবাদ, সে এখন খুব সহজেই শ্বাস নিতে পারছে।

সে দেখতে পায় চেয়ারে ঝোলানো আছে জামাকাপড়। বাইরে একজন নার্সের কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। সে আলগোছে, একটুও শব্দ না করে গা তুলল, হাত বাড়াল খুলে রাখা জামা-কাপড়ের জন্য। মরে যাওয়া পা দুটার সাথে অনেকক্ষণ যুদ্ধ করে সে গা-টা তুলে দেয় হুইলচেয়ারে, কোনমতে।

একটু কেশে নিয়ে সে চেয়ার চালালো দরজার দিকে। সে চলছে হাতে হাতে। তারপর একটুও শব্দ না করে যখন সে দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল তখন দেখতে পেল সামনের বারান্দায় কেউ নেই।

একেবারে চোরের মত নিঃশব্দে ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার বেরিয়ে এল মেডিক্যাল এরিয়া থেকে।

৫৮.

সাত-চল্লিশ-ছয় এবং ত্রিশ… মার্ক! ওয়াকি-টকিতে কথা বলা সত্ত্বেও ওলিভেষ্টির গলার স্বর উঁচুতে উঠল না একটুও। একেবারে ফিসফিসিয়ে বলা হল কথাটুকু।

আলফা রোমিওর ব্যাকসিটে বসা ল্যাঙডন বেশ বুঝতে পারছে, ঘামছে সে ভিতরে ভিতরে, হ্যারিস টুইড এবার ক্যারিশমা দেখাবে। প্যান্থিয়ন এখান থেকে তিন ব্লক দূরে। তার পাশে বসে আছে ভিট্টোরিয়া, বেচারির দৃষ্টি ওলিভেট্টির দিকে। কমান্ডার শেষ মুহূর্তের অর্ডার দিচ্ছে ওয়াকি-টকিতে।

ডিপ্লয়মেন্টটা হবে আট পয়েন্টে। আট দিক থেকে এগিয়ে যাবে তোমরা। তোমাদের যেন শেষ মুহূর্তের আগে দেখা না যায়। খেয়াল রাখতে হবে, হামলা হবে নন-লিথাল। ছাদটাকে স্পট করার জন্য আমাদের কিছু লোক প্রয়োজন পড়বে। প্রাইমারি হচ্ছে টার্গেট, আর আমাদের পরের লক্ষ্য সেকেন্ডারি, এ্যাসেট।

হায় খোদা! ভাবল ল্যাঙডন, এইমাত্র যে কথাটা ওলিভেট্টি তার দলকে বলল, সেটার ধাক্কায় বোবা হয়ে গেছে সে, কার্ডিনালকে বাঁচাননা মূল লক্ষ্য নয়। সেকেন্ডারি, এ্যাসেট।

আবার বলছি, সাধারণ নিয়ম, টার্গেটকে অবশ্যই জীবিত পেতে হবে। গো! ওয়াকি-টকি অফ করে দিল ওলিভেট্টি।

ভিট্টোরিয়ার চোখমুখ এখনো শক্ত হয়ে আছে, কমান্ডার, ভিতরে কেউ কি যাচ্ছে?

ভিতরে?

প্যান্থিয়নের ভিতরে। যেখানে ঘটনাটা ঘটার কথা, সেখানে?

এ্যাটেন্টো! আরো বেশি শক্ত হয়ে গেছে কমান্ডারের কন্ঠ, আমার ব্যাঙ্ক এর ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে কি? আমার লোকজন একবার দেখেই বেশ বুঝে ফেলতে পারবে করণীয়। আপনার সহকর্মী এইমাত্র আমাকে বললেন যে এটাই খুনিকে ধরার একমাত্র সুযোগ। সেটা ভেস্তে দেয়ার কোন ইচ্ছা আমার নেই ভিতরে কোন সৈন্যদলকে মার্চ করিয়ে দিয়ে।

কিন্তু যদি এরই মধ্যে খুনি ভিতরে ঢুকে গিয়ে থাকে?

হাতের ঘড়ি আরেকবার পরীক্ষা করে নিল ওলিভেটি সাথে সাথে, টার্গেটের ভিতরে যাবার কথা আটটায়। এখনো পনের মিনিট বাকি আছে।

সে বলেছে শিকারকে হত্যা করা হবে আটটায়। তার মানে এই নয় যে সে পনের মিনিট আগে ভিতরে যেতে পারবে না তাকে নিয়ে। আর আপনার লোেকরা যদি টার্গেটকে বেরিয়ে আসতে দেখে এবং জানতে না পারে কে সে, তাহলে? কারো না কারো জানাতেই হবে যে ভিতরে কোন সমস্যা নেই।

এ মুহূর্তে কোন ঝুঁকি নেয়া যাবে না।

যদি লোকটাকে চেনাই না গেল তবুও না?

ভোল পাল্টে যাবার মত সময় নেই আমাদের হাতে। ছদ্মবেশ নেয়ার জন্য প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে–

আমি আসলে আমার কথা বলছিলাম। বলল ভিট্টোরিয়া।

সাথে সাথে ফিরে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে থাকল ল্যাঙডন।

মাথা নাড়ল ওলিভেট্টি, অবশ্যই নয়।

সে আমার বাবাকে হত্যা করেছে।

ঠিক তাই, এজন্যেই সে জানতে পারে কে আপনি।

ফোনে তার কথা আপনি ঠিকই শুনতে পেয়েছেন। তার কোন ধারণাই ছিল না যে লিওনার্দো ট্রোর একটা মেয়ে আছে। আর এ-ও ঠিক, সে আমি দেখতে কেমন তার কচুটাও জানে না। একজন টুরিস্টের মত আমি ভিতরে ঢুকে যেতে পারব অবলীলায়। আমি যদি সন্দেহজনক কোন কিছু দেখি সাথে সাথে ইশারায় আপনার লোকদের আসতে বলতে পারি।

স্যরি। এমন কিছু করতে দিতে পারি না আমি।

কমান্ডান্টে! ওলিভেট্টির রিসিভার কঁকিয়ে উঠল, উত্তর পয়েন্টের দিকে উই হ্যাভ এ সিচুয়েশন। আমাদের দৃষ্টির পথ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে সামনের ফোয়ারার জন্য। পিয়াজ্জার সমভূমির দিকে না এগিয়ে গেলে আমরা কিছুই দেখতে পাব না। অন্তত প্রবেশপথটা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যাবে। আপনার কী মত? আমরা দৃষ্টিহীন হয়ে থাকব, নাকি ধরা পড়ে যাব চোখে?

ভিট্টোরিয়ার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেছে, এইতো! এবার যাচ্ছি আমি! বলেই সে খুলে ফেলল তার পাশের দরজা। বেরিয়ে এল সাথে সাথে।

সাথে সাথে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল ওলিভেট্টিও। হাতে ধরা ওয়াকি-টকি। চক্কর দিল সে একটা, ভিট্টোরিয়াকে ঘিরে।

বেরিয়ে এল ল্যাঙডনও, কী করছে মেয়েটা!

পথরোধ করে দাঁড়াল ওলিভেট্টি, মিস ট্টো, আপনার অনুভূতি খুবই ভাল, কিন্তু আমি কোন সিভিলিয়ানকে নাক গলাতে দিতে পারি না।

নাক গলাতে দেয়া! আপনি চোখ বেঁধে উড়ছেন। আমাকে সহায়তা করতে দিন।

ভিতরে একজন মার্কার থাকলে আমার বরং ভাল হয়। কিন্তু…

কিন্তু কী? তেতে উঠল ভিট্টোরিয়া, আমি একটা মেয়ে, এইতো?

চুপ করে থাকল ওলিভেউি।

আপনি ভাল করেই জানেন, কমান্ডার, এখানে মেয়ে হওয়াটা মোটেও খারাপ কোন ব্যাপার না। বরং সেখানে সবাইকেই সন্দেহ করা হতে পারে, কোন মেয়েকে হাফ প্যান্ট পরা অবস্থায় ভ্যাটিকান পাঠিয়েছে এ ব্যাপারটা খুনি কল্পনাও করতে পারবে না। এরচে বড় কোন সুযোগ হয় না।

আমাদেরকে আমাদের কাজ করতে দিন।

আমাকে সাহায্য করতে দিন।

খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আপনার সাথে যোগাযোগ রাখার কোন পথ থাকবে না হাতে। আমি আপনার হাতে আর যাই হোক, একটা ওয়াকি-টকি তুলে দিতে পারছি না। আবার না দিলেও দূরে সরে যাচ্ছেন।

শার্টের পকেটে হাত ডুবিয়ে ভিট্টোরিয়া তার সেলুলার ফোনটা তুলে আনল, অনেক অনেক টুরিস্ট সেলফোন ব্যবহার করে।

ওলিভেন্ট্রি কোনমতে দাঁত কামড়ে রইল।

ভিট্টোরিয়া ফোনের ভঁজ খুলল, তারপর উল্লসিত কণ্ঠে বলর, হাই হানি! আমি দাঁড়িয়ে আছি প্যান্থিয়নে। চমক্কার জায়গা। তোমার দেখা উচিৎ! আবার সে ভাঁজটা বন্ধ করল সে, কে জানবে কীভাবে? একেই বলে নো রিস্ক সিচুয়েশন। আমাকে আপনার চোখ হতে দিন। বলল সে হড়বড় করে, আপনার নাম্বার কত?

কোন জবাব দিল না ওলিভেট্টি।

ড্রাইভারকে দেখে মনে হচ্ছে তার মনেও কিছু কিছু কথা ঘোরাঘুরি করছে। বেরিয়ে এল সেও। টেনে নিয়ে গেল কমান্ডারকে একপাশে, তারপর বেশ কিছুক্ষণ গুজগুজ করল ইতালিয়ানে। এরপর ফিরে এল সে। বলল, এ নাম্বারগুলো প্রোগ্রাম করুন। সে ডিজিট বলা শুরু করল।

ভিট্টোরিয়া তার ফোন প্রোগ্রাম করল।

এবার নাম্বারটা কল করুন।

অটো ডায়াল প্রেস করল ভিট্টোরিয়া। ওলিভেট্টির বেল্টের ফোন বাজতে শুরু করল। সে তুলে আনল ফোনটা, তারপর বলল, ভিতরে চলে যান, মিস ভেট্রা খোলা রাখুন চোখ। বেরিয়ে আসুন, তারপর সব খুলে বলুন আমাকে।

বন্ধ করে ফেলল ভিট্টোরিয়া ফোনটা, থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।

এবার একটু সচকিত হয়ে উঠল ল্যাঙডন, এক মিনিট, বলল সে, আপনি তাকে একা একা ভিতরে পাঠাচ্ছেন?

রবার্ট, আমি ভালই থাকব। বিশ্বাস রাখতে পার অবলীলায়। প্লিজ।

আবার সুইস গার্ড ড্রাইভার কথা বলতে শুরু করল ওলিভেট্টির সাথে।

ব্যাপারটা বিপজ্জনক। ভিট্টোরিয়াকে বলল ল্যাঙডন।

তার কথা কিন্তু একদম ঠিক, বলল ওলিভেটি, আমাদের সেরা লোকজনও কোনদিন একা একা কাজ করে না। আর আমার লেফটেন্যান্ট বলল তাদের মতামত। তারা চায় আপনারা দুজনেই ভিতরে যাবেন।

আমাদের দুজনেই! মনে মনে দ্বিধায় পড়ে গেল ল্যাঙডন, আসলে আমি ভাবছি—

আপনাদের দুজনেই যাচ্ছেন, একত্রে, ফরমান জারি করল ওলিভেট্টি, আপনাদের দেখতে একেবারে ট্যুরিস্ট জুটির মত লাগবে, প্রয়োজনে একে অন্যকে ব্যাক-আপও দিতে পারবেন। এ ফরম্যাটটায়ই আমি সবচে বেশি তৃপ্তি পাব।

শ্রাগ করল ভিট্টোরিয়া, ফাইন। আমি দ্রুত যেতে চাচ্ছি।

মনে মনে গজগজ করল ল্যাঙডন, নাইস মুভ, কাউবয়!

সামনে, রাস্তার দিকে আঙুল তাক করল ওলিভেট্টি, ভায়া ডেলগি অরফ্যানি আপনাদের প্রথম রাস্তা। বামে যান। সোজা প্যান্থিয়নে গিয়ে হাজির হবেন। দু মিনিট হাটতে হবে, ব্যস। তারপর আমি আমার লোকদের নির্দেশনা দিব এখানে বসে। অপেক্ষা করব আপনাদের কলের জন্য। সে খুলে আনল পিস্তলটা, আপনাদের কেউ কি জানেন কী করে একটা আগ্নেয়াস্ত্রকে সামলাতে হয়?

একটা বিট মিস করল ল্যাঙডনের হার্ট, আমাদের আদৌ কোন আগ্নেয়াস্ত্রের দরকার নেই!

হাত বাড়িয়ে দিল ভিট্টোরিয়া, আমি চল্লিশ মিটার দূর থেকে ধেয়ে যাওয়া কোন শিপের বো তে রাখা যে কোন বস্তুকে চোখের পলকে ঝেড়ে ফেলতে পারি।

গুড! উফুল্ল কন্ঠে বলল কমান্ডার, আপনাকে ব্যাপারটা প্রমাণ করতে হবে।

ভিট্টোরিয়া তার শর্টসের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ মেলল ল্যাঙডনের দিকে।

ও, না? তুমি এমন কাজ করতে পার না! চোখের ভাষায় বলল ল্যাঙডন, কিন্তু মেয়েটা এত চটপটে যে ধরা পড়ে গেল সে। সোজাসাপ্টা হাত বাড়াল সে, খুলে ফেলল জ্যাকেটের একপাশ, তারপর সেধিয়ে দিল পিস্তলটাকে, তার বুক পকেটে। যেন কোন পাথর সোজা ধেয়ে আসছে তার পকেটে। তার একমাত্র শান্তির খবর হল, ভায়াগ্রামা এই পকেটে নেই। আছে অন্য একটায়।

দেখতে আমাদের দুগ্ধপোষ্য লাগছে, বলল ভিট্টোরিয়া, তারপর আকড়ে ধরল ল্যাঙডনের হাত, ঠিক প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া জুটির মত, তারপর নেমে পড়ল পথে।

ড্রাইভার আহ্লাদে আটখানা হয়ে গিয়ে বলল, কথাটা মগজে ঢুকিয়ে নিন, আপনারা প্রেমে চুর হয়ে যাওয়া একটা জুটি। হাতে হাত রাখা, তারপর ঘনিষ্ঠভাবে চলাচল করাটা তাই দেখতে অত্যন্ত প্রীতিকর লাগবে। আপনারা কিন্তু নববিবাহিত দম্পতি।

ল্যাঙডন এখনো ঠিক মানিয়ে নিতে পারছে না ব্যাপারটার সাথে। সে কি ভুল দেখল? ভিট্টোরিয়ার ঠোঁটের কোণে একটা হাসির মৃদু রেখা দেখা দিয়েছিল কি?

৫৯.

কর্পো ডি ভিজিল্যাঞ্জায় সুইস গার্ডের বাইরের ঘাঁটি, এটায় তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে, ভ্যাটিকানের বাহ্যিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, পাপাল এরিয়ায় কোন অনুষ্ঠান হলে সবচে বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আজকে, যাই হোক, সেটা অন্য কোন কাজের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।

সুইস গার্ডের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আজ এখানে আস্তানা গেড়েছে। হম্বিতম্বি করে বেড়াচ্ছে বুক ফুলিয়ে। ক্যাপ্টেন এলিয়াস রোচার। ক্যাপ্টেনের বুকের ছাতি দেখলে যে কারো অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে। তার পরনে প্রচলিত ক্যাপ্টেনের পোশাক। মাথায় একটা লাল রঙের ব্যারেট, তেরছা করে পরে আছে সে সেটাকে, খুব কায়দা করা সৈনিকের মত। এত বিশালদেহী মানুষটার কষ্ঠ ঠিক মানায় না। রিনঝিনে। যেন কোন চিকণ সুরের যন্ত্র বেজে যাচ্ছে। তার লোকজন তাকে আড়ালে-আবডালে অর্সো বলে ডাকে। গ্রিজলি ভালুক। অনেকে আবার তাকে ভাইপার সাপের ছায়ায় চলা ভালুক নামেও ডাকে। কমান্ডার ওলিভেট্টি হল সেই ভাইপার। রোচার ভাইপারের চেয়ে কোন অংশে কম ভয়াল নয়, কিন্তু অন্ততপক্ষে তাকে আসতে দেখা যাবে।

রোচারের লোকজন একেবারে নিখুঁত এ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। কোন নড়াচড়া নেই। এইমাত্র যে খবর তারা পেয়েছে তাতে তাদের রক্তচাপ বেড়ে গেছে কয়েক গুণ।

আরেক লেফটেন্যান্ট চার্ট্রান্ড মনেপ্রাণে আফসোস করছিল এখানে আসতে চাওয়া আর নিরানব্বই ভাগ ব্যর্থ অফিসারের সাথে সে কেন ছিল না। বিশ বছর বয়সে চার্ট্রান্ড ফোর্সের সবচে নবীন গার্ড। সে ভ্যাটিকানে আছে মোটামুটি মাস তিনেক ধরে। আর সবার মত চার্ট্রান্ডও সুইস আর্মির কাছ থেকে ট্রেনিং পেয়েছে আর দু বছর কাটিয়েছে। অসবিল্ডাঙ এ। রোমের বাইরে সুইস গার্ডের গুপ্ত ব্যারাকেও তার সময় কেটেছে অনেক। তবু, তার ট্রেনিংয়ের কোন অংশই তাকে এ অবস্থা মোকাবিলা করার মত দক্ষ করে তোলেনি।

প্রথমে চার্ট্রান্ড মনে করেছিল যে এই ব্রিফিঙটা আসলে কোন বিদঘুটে ট্রেনিংয়ের অংশ। ভবিষ্যতের অস্ত্র? প্রাচীণ গুপ্ত সংঘ? অপহৃত কার্ডিনালরা? তারপরই নোচার তাদের এর উপর ভিডিও দেখাল। সাথে সাথে চার্ট্রান্ড বুঝে ফেলল, এটা কোন প্রশিক্ষণ নয়, নয় কোন পরীক্ষা।

আমরা নির্বাচিত জায়গার পাওয়ার অফ করে দিব, বলছে রেচার, যাতে বোমাটার চৌম্বক ক্ষেত্রের দেখা পাই। আমরা চারজন চারজন করে ময়দানে নেমে যাব। প্রত্যেকের সাথে থাকবে ইনফ্রারেড গগলস। প্রচলিত বাগ-ফাইন্ডার দিয়েও কাজ সারব আমরা। সাব ওম থ্রি থাকলেই সেখানটা সার্চ করতে হবে। কোন প্রশ্ন?

নেই।

চার্ট্রান্ড একটু আগ বাড়িয়ে বলল, যদি জিনিসটাকে খুঁজে না পাই তো? আর প্রশ্নটা করেই মনেপ্রাণে সে কামনা করতে থাকে, এটা যেন শুনতে না পায় ক্যাপ্টেন।

লাল ব্যারেটের নিচ থেকে গ্রিজলি ভালুক তার দিকে আগুন ঝরানো দৃষ্টি হানল। তারপর একটা স্যাটুল ঠুকে দিয়ে ব্রিফিংয়ের ইতি টানল।

ঈশ্বরের গতি, ছেলেরা!

৬০.

প্যান্থিয়ন থেকে দু ব্লক দূরে, ভিট্টোরিয়া ও ল্যাঙডন একটা ট্যাক্সির সারি পেরিয়ে গেল। ড্রাইভাররা ফ্রন্ট সিটে বসে ঝিমাচ্ছে।

নিজের সমস্ত চিন্তা ভাবনা গুটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল ল্যাঙডন, কিন্তু পরিস্থিতি একেবারেই প্রতিকূল। মাত্র দু ঘণ্টা আগে সে কেম্বুিজের আরামদায়ক বাসায় শুয়ে ছিল।

আর এখন সে ইউরোপে, আদ্যিকালের দানবদের মধ্যকার লড়াই চাক্ষুস করছে। হ্যারিস টুইডের দু পকেটে দুটা বিপরীত ধারা এখন, আর সেই সাথে বাহুলগ্ন হয়ে আছে এক অনিন্দ্যসুন্দর মেয়ে।

সে আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখে ভিট্টোরিয়ার দিকে। মেয়েটার দৃষ্টি একেবারে সামনে। তার ধরে থাকার মধ্যে এক ধরনের শক্তিমত্তা আছে; স্বাধীন, ড্যামকেয়ার মেয়ের শক্তিমত্তা। তার আঙুলগুলো আলতো করে আদর করছে তাকে, সত্যিকার প্রেমিক-যুগলের মত। একটুও জড়তা নেই। একটু যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল ল্যাঙডন। বাস্তবে ফিরে আস! বলল সে নিজেকেই।

তার জড়তা টের পাচ্ছে ভিট্টোরিয়াও, রিল্যাক্স! বলল সে, আমাদের দেখতে নববিবাহিত দম্পতির মত লাগার কথা।

আমি রিল্যাক্সড।

তুমি আমার হাতটা গুঁড়া করে ফেলছ। সাথে সাথে হাতটায় ঢিল দিল ল্যাঙডন।

চোখ দিয়ে দম নাও। বলল ভিট্টোরিয়া।

কী?

এটা মাসলগুলোকে রিল্যাক্স করে। নাম প্রণায়ামা।

পিরানহা?

মাছ না। প্রণায়ামা। নেভার মাইন্ড।

তারা মোড় ঘোরার সাথে সাথে সামনে ভোজবাজির মত উদিত হল প্যান্থিয়ন। ল্যাঙডন সাথে সাথে প্রশংসার দৃষ্টি হানল এটার দিকে। চোখেমুখে তার ঠিকরে বেরুচ্ছে প্রশংসা। দ্য প্যান্থিয়ন! সব দেবতার মন্দির। পাগান দেবতাদের। প্রকৃতি আর পৃথিবীর দেবতাগণ। অবাক চোখে সে তাকায় সামনে। তাকিয়েই থাকে। এখান থেকে দেখতে অনেকটা চৌকোণা মনে হলেও সে জানে আসলে সেটা ভিতরে গোলাকার। তারা যে ভুল করেনি তা বোঝা গেল এম এ্যাগ্রিপ্পা এল এফ কোস টার্টিয়াম ফেসিট দেখে। সাথে সাথে মনে মনে অনুবাদ করে নিল লেখাটাকে ল্যাঙডন। মার্কাস এ্যাগ্রিপ্পা, কনসাল ফর দ্য থার্ড টাইম, বিল্ট দিস।

চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে সে। হাতে ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে একদল টুরিস্ট সেখানে আনাগোনা করছে। লা টাজা ডিওরোর আউটডোর ক্যাফেতে অনেকে আবার রোমের সেরা আইস কফি চেখে দেখছে। আর প্যান্থিয়নের বাইরে, ঠিক যেমনটা বলেছিল ওলিভেট্টি, চারজন সশস্ত্র রোমান পুলিশ এ্যাটেনশন হয়ে দাড়িয়ে আছে।

দেখতে বেশ শান্তই লাগে। বলল ভিট্টোরিয়া।

নড করল ল্যাঙডন। সে এখানে বাহুলগ্না করে একটা মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অপেক্ষা করছে ইতিহাসের সবচে ভয়াল ঘটনাগুলোর মধ্যে একটার জন্য, কল্পনাটা মোটেও স্বস্তিদায়ক নয় তার জন্য। ভিট্টোরিয়া তার পাশে পাশে আছে ঠিকই, তারপরও, একটা ব্যাপার ভেবে সে বিষম খায়, সে-ই সবাইকে এখানে দাঁড় করিয়েছে, প্রতিটা কু দিয়েছে। চিনিয়েছে ইলুমিনেটি পয়েমের অর্থ। সে জানে, এই সেই স্থান। এটাই শান্তিস টম্ব। এখানে, রাফায়েলের কবরের পাশে, উপরের বিশাল ছিদ্রটার নিচে, সে অনেকবার এসেছে।

বাজে কটা? প্রশ্ন ছুড়ল ভিট্টোরিয়া।

সাতটা পঞ্চাশ। আর দশ মিনিট।

আশা করি ব্যাটারা ভাল হবে। বলল ভিট্টোরিয়া, ভিতরে যদি কিছু ঘটেই যায়, বলল সে আফসোসের সুরে, আমরা সবাই ক্রসফায়ারে পড়ে যাব।

বড় করে একটা দম নিয়ে ল্যাঙডন এগিয়ে গেল সামনের দিকে। পকেটের গানটা যেন আরো ভারি হয়ে আসছে। তার মনে একটা চিন্তা বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। একবার যদি চোখ দেয় পুলিশেরা, তাহলে কেল্লা ফতে। সোজা হাজতের ভাত জুটবে কপালে। কিন্তু অফিসার তার দিকে একবারের বেশি দৃষ্টি দিল না। না, ছদ্মবেশ ভালই হয়েছে।

প্রশ্ন করল সে ভিট্টোরিয়ার দিকে লক্ষ্য করে, ট্রাঙ্কুইলাইজার গানের বাইরে আর কিছু দিয়ে কখনো গুলি করেছ?

তুমি কি আমাকে ঠিক বিশ্বাস কর না?

বিশ্বাস করা? আমি তোমাকে আদৌ এখন পর্যন্ত ভাল করে চিনতেই পারলাম না! বিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে কী করে?

আর আমি কিনা ভেবে বসে আছি আমরা নববিবাহিত দম্পতি!

০৭. প্যান্থিয়নের ভিতরে বাতাস শীতল
৬১.

প্যান্থিয়নের ভিতরে বাতাস শীতল, একটু ভারি। চারদিকে ইতিহাসের সব দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একশো চল্লিশ ফুট উঁচু গম্বুজের ভিতরে ঢুকে আবারও ঠান্ডা হয়ে আসে ল্যাঙডনের ভিতরটা। সেন্ট পিটার্সও হার মেনে যাবে এটার সামনে। এখানে একই সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং আর আর্টের অসাধারণ মিশেল দেখা যাচ্ছে। তাদের মাথার উপরে বিশাল গোলাকার ছিদ্রটা দিয়ে বিকালের রোদ আলস্য ভরে এলিয়ে পড়ছে। দ্য অকুলাস! ভাবল সে, দ্য ডেমনস্ হোল!

এসে পড়েছে তারা।

তাদের পায়ের কাছে, পলিশ করা মার্বেলের মেঝের দিকে নেমে এসেছে এই সুউচ্চ ভবনটা। দর্শনার্থীদের পায়ের মৃদু শব্দই ভিতরে শব্দের একটা ইন্দ্রজাল তৈরি করে দিচ্ছে। দেখতে পেল ল্যাঙডন, ডজনখানেক পর্যটক এলোমেলো পা ফেলে যাচ্ছে। তুমি কি এখানেই আছ?

দেখে বেশ শান্ত মনে হচ্ছে। বলল ভিট্টোরিয়া। এখনো তার হাত ধরে আছে। নড করল ল্যাঙডন।

রাফায়েলের মাজার কোথায়?

একটু সময় নিল ল্যাঙডন। দম ফিরে পাবার চেষ্টা করছে। রুমটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। কবর। পিলার। ভাস্কর্য। শিল্পকর্ম। সে ঠিক নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারছে না। তারপর অবশেষে সে বলল, আমার মনে হয় রাফায়েলেরটা ঐদিকে।

পুরো রুমের বাকি জায়গাটুকু একটু দেখে নিল ভিট্টোরিয়া। আমি এমন কাউকে দেখছি না যাকে তাকিয়ে খুনি বলে মনে হবে এবং যে এখানে এসেছে একজন প্রেফারিতি কার্ডিনালকে হত্যা করতে। আমরা কি আরেকটু চোখ বুলিয়ে নিব?

নড করল ল্যাঙডন, এখানে মাত্র একটা জায়গাই আছে যেখানে কেউ গা ঢাকা দিতে পারবে। আমাদের বরং রিইন্ট্রাঞ্জে চেক করে দেখা ভাল।

দ্য রিএ্যাক্সেস?

হ্যাঁ। দ্য রিএ্যাক্সেস ইন দ্য ওয়াল।

কবর আর শিল্পকর্মের সারির বাইরে আরো একটা জিনিস আছে এখানে। দেয়াল থেকে বাঁকা হয়ে একটু করে অংশ বেরিয়ে আছে। এগুলো খুব একটা যে বড় তা না। কিন্তু অন্ধকারে গা ঢাকা দেয়ার জন্য এরচে ভাল জায়গা এখানে নেই। মনের দুঃখ সহ সে কল্পনা করে, প্যান্থিয়নের এখানটায় পাগন দেবতাদের মূর্তি রাখা হত। তারপর দিন পাল্টে গেল। ভ্যাটিকান দখল করে নিল জায়গাটাকে। বানাল চার্চ। হারিয়ে গেল অলিম্পিয়ান গডরা। একটা কথা ভেবে কুল পায় না সে। সে বিজ্ঞানের প্রথম দিককার এক অনন্য সৃষ্টির ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু এর নির্মাতারা কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। তাদের সংস্কৃতি আর তাদের ধর্ম আজ শুধুই গবেষণার বিষয়। বিলুপ্তির অতলে হারিয়ে গেছে তারা। তার কল্পনায় এখন ইলুমিনেটির দিকে নির্দেশ করা একটা মৃর্তির কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। এর স্রষ্টা কে? কোথায় আছে এখন সেটা? টিকে আছেতো? পাথ অব ইলুমিনেশন কি খুঁজে পাওয়া যাবে এখান থেকে এ যুগেও?

আমি বামের পথ ধরছি, বলল ভিট্টোরিয়া, আর তুমি যাচ্ছ ডানে। চেক করতে করতে একশো আশি ডিগ্রিতে আবার দেখা হচ্ছে।

আড়ষ্ট একটা হাসি দিল ল্যাঙডন।

তারপর এগিয়ে গেল পথ ধরে। তার মন এখনো আগের কথাগুলো আউড়ে যাচ্ছে। খুনির কথা প্রতিধ্বণিত হচ্ছে। আটটার সময়। বিজ্ঞানের বেদীতে কুমারি মেয়ের বলিদান। মৃত্যুবরণের একটা গাণিতিক হার… আট, নয়, দশ, এগারো… একেবারে মধ্যরাতে।

হাতের ঘড়ি আরো একবার পরীক্ষা করে নিল সে। সাতটা বায়ান্ন। আর মাত্র আট মিনিট।

ল্যাঙডন সামনে এগিয়ে যাবার সময় একজন ইতালিয় ক্যাথলিক রাজার কবর পেরিয়ে গেল। লোকটার কবর একটু বিচিত্রভাবে বসানো। দর্শনার্থীদের একটা জটলা ব্যাপারটা নিয়ে ধাঁধায় পড়ে গেছে। কিন্তু ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য থামল না ল্যাঙডন। পূর্বে মুখ দিয়ে কবর দেয়া নিয়ে একটু ঝামেলা আছে। সিম্বলজি দুশো বারো ক্লাসে এ নিয়ে একটা হট্টগোল বেঁধে গিয়েছিল। এই গত মাসেই।

অসম্ভব! এমন কিছু হতেই পারে না। বলেছিল একটা মেয়ে। পূর্বমুখী খ্রিস্টান মাজারগুলোর মূল কথা বোঝানোর পর সে চেঁচিয়ে উঠেছিল। কেন শুধু শুধু খ্রিস্টানরা তাদের টম্বগুলোকে উঠতি সূর্যের দিকে মুখ দিয়ে রাখবে? আমরা খ্রিস্টানত্বের ব্যাপারে কথা বলছি… সূর্য পূজার ব্যাপারে নয়।

সাথে সাথে আপেল চিবাতে চিবাতে সে ডাকল, মিস্টার হিজরট! চিৎকার করল সেও।

পিছনের সারিতে বসে ঝিমাতে থাকা একটা ছেলে হড়বড় করে বলল, জ্বি? আমি?

ল্যাঙডন দেয়ালে ঠাসা একটা রেনেসাঁর আর্টের পোশাকের দিকে নির্দেশ করল। ঈশ্বরের সামনে নতজানু হয়ে আছে লোকটা, কে সে?

উম… কোন সন্ত?

ব্রিলিয়ান্ট! আর কী করে তুমি বুঝলে যে সেটা কোন সন্তের ছবি?

তার পরনে একটা হ্যালো আছে?

এ্যাক্সিলেন্ট! আর এই সোনালি হ্যালো কি তোমাকে অন্য কোন কথা মনে করিয়ে দেয়?

সাথে সাথে হিজরটের মুখের স্নান ভাব উধাও হয়ে যায়। হাসিতে ভেসে ওঠে সে। ইয়াহু! গত টার্মে আমরা যে ইজিলিয়ান জিনিসগুলো নিয়ে পড়ালেখা করেছিলাম। সেই… উম্… সানডিস্ক…।

ঠিক তাই, মিশরিয় সৌর চাকতি, থ্যাঙ্ক ইউ, হিজরট। আবার ঘুমিয়ে পড়। ফিরে তাকাল ল্যাঙডন ক্লাসের দিকে, হ্যালোস, আর বেশিরভাগ ক্রিশ্চিয়ান সিম্বলজির মত, এটাকেও ইজিপ্সিয়ান সূর্য-আরাধনা থেকে ধার করা হয়েছে। খ্রিস্টবাদে সূর্যপূজার উদাহরণের কোন শেষ নেই।

এক্সকিউজ মি? তেতে উঠল প্রথমদিকে বসা সেই মেয়েটা, আমি সব সময় চার্চে যাই। সেখানে সূর্য পূজার মত কোন ব্যাপার আমার চোখে পড়েনি কখননা!

আসলেই? পঁচিশে ডিসেম্বর তোমরা কী সেলিব্রেট কর?

ক্রিসমাস। জেসাস ক্রাইস্টের জন্মজয়ন্তি।

অথচ, বাইবেলের কথানুসারে, যীশু খ্রিস্ট জন্ম নেন মার্চে। তাহলে আমরা ডিসেম্বরের শেষ দিকটায় কী উদযাপন করছি?

নিরবতা।

হাসল ল্যাঙডন, ডিসেম্বর পঁচিশ, আমার প্রিয় ছাত্রছাত্রীবৃন্দ, হল গিয়ে প্রাচীণ পাগান ছুটির দিন। সোল ইনভিক্টাস। অজেয় সূর্য। এটা কিন্তু অবাক হলেও সত্যি কথা, সূর্যের ফিরে আসার দিন। তার আগ পর্যন্ত দিন শুধু ছোটই হত। তারপর এ দিনটা এলে আবার তা বড় হতে থাকে। তার মানে সূর্যের অজেয়তার পূজা করা হচ্ছে।

আরো এক কামড় আপেল মুখে নিল ল্যাঙডন।

বিজয়ী ধর্মগুলো, সে বলে চলছে, মাঝে মাঝে পুরনো ধর্মের দু-একটা ব্যাপার ইচ্ছা করেই তাদের ভিতরে ঢুকিয়ে নেয়, যেন ধর্ম পাল্টানোটা খুব বেশি আঘাত হয়ে দেখা না দেয়। এর একটা সুন্দর নাম আছে। ট্রান্সমিউটেশন। এর ফলে মানুষ নতুন ধর্মের উপর কিছুটা আস্থা রাখতে শেখে। ফলে বদলে যাওয়া লোকগুলো সেই একই অনুষ্ঠান পালন করে, একই ভাবে সূর্য পূজা করে, শুধু তাদের পরনে থাকে নতুন ধর্মের খোলস… ফলে অন্য আরো কোন ঈশ্বরের আরাধনা চলে আসে তাদের কর্মে।

সামনের মেয়েটা ফোস ফোস করছে যেন, আপনি বলতে চান খ্রিস্টবাদ আসলে সূর্য পূজার নূতন রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়?।

অবশ্যই না। খ্রিস্টান শুধু সূর্য পূজা থেকে ধার করেনি, ঐতিহ্য ধার করেছে আরো অনেক কিছু থেকে। ক্রিস্টিয়ান ক্যানোনাইজেশন আসলে আগের দিনের দেব সৃষ্টির কাজ থেকে নেয়া। গড-ইটিংয়ের ব্যাপারটা এসেছে প্রাচীণ এ্যাজটেকদের কাছ থেকে। সেই হলি কষ্যনিয়ন! এমনকি আমাদের পাপ মোচনের জন্য যীশুর আত্মাহুতিও আমাদের মৌলিক কোন ব্যাপার নয়। এটাও ধার করা। কোয়েঞ্জালকোটের প্রাচীণ পুরাণে দেখা যায় জনপদের পাপ স্খলন করতে তরুণ যুবার দল জীবনপাত করছে।

এবার আরো কঠিন হয়ে গেল মেয়েটার কণ্ঠ, তাহলে, এমন কিছু কি আছে খ্রিস্টানত্বে যা দিয়ে ব্যাপারটার কিছু দিককে মৌলিক বলা চলে?

যে কোন মূল বিশ্বাসের বেশিরভাগই আসলে মোটামুটি খাদ মিশানো। ধর্ম কখনোই এককভাবে শুরু হয়নি। বরং তাদের একটার উপর ভিত্তি করে আরেকটা গজিয়ে উঠছে হরদম। আধুনিক ধর্ম আর কিছুই নয়… মানুষ শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে অচেনাকে চেনার, অব্যাখ্যাতকে ব্যাখ্যা করার জন্য যা করে আসছে সেগুলোর একটা সম্মিলিত রূপই এই ধর্ম।

উম… হোল্ড অন! হিজরট বলল, বোঝা যাচ্ছে এতোক্ষণে তার চোখের ঘুম পালিয়েছে, আমি ক্রিশ্চিয়ানিজমের এমন কিছুর কথা জানি যা একেবারে মৌলিক। আমাদের গড়ের ব্যাপারে কী হবে? খ্রিস্টানরা কখনোই ঈশ্বরকে অন্যের আদলে আকেনি। তারা এ্যাজটেক আর সৌর-পূজারীদের মত তাকে কোন অবয়ব দেয়নি। তার অবয়ব শ্বেত-শুভ্র, তার দাড়ি লম্বা এবং পাকা। এর সাথে নিশ্চই আর সব ধর্মের মিল নেই। আমাদের ঈশ্বর মৌলিক, ঠিক না?

আবারো হাসল ল্যাঙডন। যখন প্রথমদিকের খ্রিস্টানরা তাদের আদিকালের দেবতাদের ছেড়ে এসেছে–পাগান দেবতা, রোমান দেবতা, গ্লিক, সান, মিথ্রাইক, যাই হোক–তারা চার্চকে সর্বক্ষণ প্রশ্ন করে তিতি বিরক্ত করেছে, তাদের নতুন ঈশ্বর দেখতে কেমন? বিজ্ঞের মতই জবাব দিয়েছে গির্জা। সবচে ক্ষমতাবান, সবচে ভয় পাওয়া জনকেই বেছে নিয়েছে তারা… সব ইতিহাস-সচেতন মানুষের কাছেই তার পরিচিতি আছে।

এখনো ঠিক যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না ছাত্রটা। একজন বৃদ্ধলোক, যার শ্বেত-শুভ্র দাঁড়ি আছে?

দেয়ালে রাখা প্রাচীণকালের দেবতাদের চার্টের দিকে আঙুল তাক করল ল্যাঙডন। সেখানেও বড় বড় সাদা দাড়ির সাথে মানিয়ে গেছেন দেবতা।

জিউসের সাথে মিল পাওয়া যায় না কি?

সেদিন ক্লান্টা এভাবেই শেষ হয়েছিল।

গুড ইভিনিং. এক লোকের কণ্ঠ বলল।

সাথে সাথে লাফ দিল ল্যাঙডন। ফিরে এসেছে সে প্যান্থিয়নে। নীল ক্যাপ পরা এক বয়েসি লোকের সাথে সে আরেকটু হলে ধাক্কা খেয়েছিল। তার বুকে একটা লাল ক্রস। তার হলদে দাঁতে ঝিকিয়ে উঠল হাসি।

আপনি ইংরেজ, ঠিক না? লোকটার উচ্চারণ পুরোপুরি টাসকান।

পিটপিট করল ল্যাঙডন চোখ, তারপর বলল, আসলে তা নয়, আমি আমেরিকান।

লোকটা যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, ওহ্, হ্যাভেন! মাফ করবেন, প্লিজ। আপনার পোশাক এত ভালভাবে সাজানো ছিল… আমি মনে করে বসলাম… ক্ষমা করবেন।

আমি কি আপনার কোন কাজে লাগতে পারি? বলল ল্যাঙডম অবশেষে। তার হৃদপিন্ড এখনো ধ্বক ধ্বক করছে।

না, আসলে আমি ভাবছিলাম আমিই হয়ত আপনাকে সাহায্য করতে পারি। আমিই এখানকার সিসেরোন।

লোকটা তার সিটি ইস্যু করা ব্যাজের দিকে সগর্বে নির্দেশ করল। আপনার রোম ভ্রমণ আরো চিত্তাকর্ষক করার দায়িত্ব বর্তেছে আমার মত মানুষদের কাঁধে।

আরো চিত্তাকর্ষক! ল্যাঙডন জানে, এরচে বেশি চিত্তাকর্ষক রোম ভ্রমণ গত কয়েক শতকে কোন মানুষ করেনি।

আপনাকে দেখে মনে হয় উঁচু কোন কাজে নিয়োজিত আছেন বলল গাইড, মনে হচ্ছে আপনি ইতিহাস সম্পর্কে আর সবার চেয়ে বেশি আগ্রহী। অন্তত গডপড়তার চেয়ে বেশি। আপনাকে এই অত্যন্ত সুন্দর এলাকা সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।

হাসল সে সাথে সাথে, অনেক ধনাবাদ আপনাকে, কিন্তু আমি নিজেই একজন আর্ট হিস্টোরিয়ান আর

অসাধারণ! যেন কোন জুয়ায় এইমাত্র লোকটা একটা বিশাল দান জিতে নিয়েছে, এমন সুরে বলল, তাহলে আপনার মত আগ্রহ আর কার হবে এসব বিষয়ে?

না। আসলে আমি আশা করি। দ্য প্যান্থিয়ন… লোকটা বলা শুরু করল তার ধূসর স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে, মার্কাস এ্যাগ্রিপ্পা এটা বানিয়েছিলেন খ্রিস্টপূর্বাব্দ সাতাশ সালে।

হ্যাঁ। এবং একশো উনিশ খ্রিস্টাব্দে সেটাকে আবার বানানো হয়। এবার স্থপতি ছিলেন হ্যাড্রিয়ন।

নিউ অর্লিন্সে উনিশো ষাট সালে সুপারডোম গড়ার আগে এটাই ছিল পৃথিবীর সবচে বড় ফ্রি স্ট্যান্ডিং ডোম!

মনে মনে গজগজ করল ল্যাওড়ন। লোকটাকে কোনমতে থামানো যাচ্ছে না।

আর পঞ্চম শতাব্দির এক লোক প্যান্থিয়নকে তুলনা করেছিল শয়তানের আস্তানার সাথে। তার মতে, উপরের দিককার ঐ ছিদ্রটা দিয়ে শয়তানরা অনুপ্রবেশ করবে। এন্ট্রান্স ফর দ্য ডেমনস।

লোকটা এখনো ভাগছে না। কী করা যায়। সে এবার কথা বলতে বলতে মুখ তুলে তাকাল ওকুলাসের দিকে। তার মনে বিভীষিকার সৃষ্টি করল একটা চিন্তা। ভিট্টোরিয়ার কথা যদি ঠিক হয়? একটা অসাড় করা চিন্তা এলোমেলোভাবে চলছে তার মনোজগতে… একজন ব্র্যান্ডেড কার্ডিনাল ঐ গর্ত ধরে পড়ছে! পড়ছে মর্মরের বাঁধানো মেঝেতে। এটা দেখার মত একটা ব্যাপার হবে, অন্তত মিডিয়ার কাছে। ল্যাঙডন এরই মধ্যে জরিপ শুরু করে দিয়েছে। ভিতরে কোন সাংবাদিক আছে কি? নেই।

রুমের অন্যপ্রান্তে, ভিট্টোরিয়া চষে চলেছে চারধার। তার স্বভাবসুলভ তীক্ষ্ণ চোখ দিয়ে। বাবার মৃত্যুর পর, এই প্রথম সে একা হতে পেরে যেন নিজের কষ্টটাকে উঠে আসতে দিল। গত আটটা ঘণ্টা কীভাবে কীভাবে পেরিয়ে গেল কে জানে! খুন হয়ে গেছে তার বাবা–নিষ্ঠুরভাবে, নির্মমভাবে। একই ব্যথা উথলে ওঠে তার বাবার আবিষ্কারকে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রে রূপান্তরিত হতে দেখে। এন্টিম্যাটারটা বহনযোগ্যতা পেয়েছে তার দোষে। তারই আবিস্কৃত পন্থায়। ব্যাপারটা আরো যন্ত্রণা বয়ে আনে তার কাছে… তার বাবার সত্যানুসন্ধান আজ পড়ে আছে ভ্যাটিকানে, খোদ আরাধ্য স্থানে, ধ্বংসদূত হয়ে।

তার জীবনে আরেক বিস্ময় এই একেবারে অপরিচিত লোকটা। রবার্ট ল্যাঙডন। লোকটার চোখে কোন আকর্ষণ নেই… নিরুত্তাপ। একটা মেয়ে যে তার সাথে আছে, সুন্দর একটা মেয়ে, তা যেন সে টেরই পাচ্ছে না। ঠিক যেন কোনকিছুকে বিন্দুমাত্র মূল্য না দেয়া সমুদ্রের উর্মিমালা… বেপরোয়া, কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক। আজও সে সেই সমুদ্রের কাছেই ছিল। তারপরই খবরটা… সে আসলেই সন্তুষ্ট ল্যাঙডনের মত একজন সঙ্গী পেয়ে। শুধু উষ্ণ সঙ্গই নয়, নয় শক্তির একটা উৎস হিসাবে, ল্যাঙডনের ত্বড়িৎ বুদ্ধিমত্তা তার বাবার খুনিকে ধরে ফেলার একটা সুযোগ এনে দিয়েছে।

বিশাল গোলার্ধ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে বড় করে শ্বাস নেয় একটা ভিট্টোরিয়া। সে ভাবতেও পারে না সমস্ত প্রাণীর প্রতি অদ্ভুত মায়া মাখানো লোকটা, নিতান্তই ধার্মিক লোকটাকে এমন বিকৃত মানসিকতায় খুন করা যায়। সে খুনিকে মৃত অবস্থায় দেখতে চায়। মৃত। সে দেখতে পায় কী এক অব্যাখ্যাত ক্রোধ তার ইতালিয় রক্তে টগবগ করে ফুটছে… এ জীবনে প্রথমবারের মত। তার সিসিলিয়ান পূর্বপুরুষরা পরিবারের অমোচনীয় তিতে ফিসফিস করে যেন প্রতিশোধের কথা মনে করিয়ে দিেছ প্রতিনিয়ত। ভেট্টো! ভাবল মেয়েটা, এবং প্রথমবারের মত তার মূল অর্থ অনুধাবন করতে পারল।

এগিয়ে গেল সে সামনে, সেখানটায় রাফায়েল শান্তির কবর আছে। শায়িত আছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এক দেয়ালচিত্র আকিয়ে।

রাফায়েল শান্তি, ১৪৮৩-১৫২০

সে মনোযোগ দিয়ে পড়ল কবরফলকটা। দেখল সেখানকার লেখা।

তারপর… সে আবার পড়ল।

এরপর পড়ল আর।

এক মুহূর্ত পরে, সে ঘরের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ছুটে যেতে লাগল, রবার্ট। রবার্ট!

৬২.

ল্যাঙডন গায়েপড়া গাইডের জ্বালা যন্ত্রণায় হন্যে হয়ে গেছে, কিন্তু লাভ হচ্ছে না কিছুমাত্র। তার কাজ আটকে গেছে অনেকাংশে, আটকে গেছে শেষটা। সে ফিরে তাকাল লোকটার দিকে। এখনো একমনে বকবক করছে বয়েসি লোকটা। ল্যাঙডন এগিয়ে গেল সামনের এ্যালকোভের দিকে।

দেখে মনে হচ্ছে বেশ উপভোগ করছেন আপনি এ ব্যাপারটা,বেহায়ার মত কথা বলেই যাচ্ছে লোকটা। আপনি কি জানেন, দেয়ালের এই পুরুত্বের জন্যই ডোমটা প্রায় ভরশূণ্য হয়ে আছে?

নড করল ল্যাঙডন, একবিন্দুও শুনছে না সে লোকটার কথা। হঠাৎ পিছন থেকে কে একজন তাকে ধরে ফেলল। ভিট্টোরিয়া। তার চোখমুখে ঠিকরে পড়ছে আতঙ্ক। সাথে সাথে ল্যাঙডনের মনে হল একটা কথা। সে নিশ্চই কোন মৃতদেহ দেখতে পেয়েছে। আৎকে উঠল ল্যাঙডন।

আহ্! আপনার স্ত্রী। গাইড লোকটা যেন সত্যি সত্যি উৎফুল্ল হয়েছে, আরো একজন মেহমান পেয়ে যেন আহ্লাদে আটখানা। সে তার শর্ট প্যান্ট আর উঁচু হয়ে ওঠা বুটের দিকে চোখ রেখে বলল, এবার আমি হলপ করে বলতে পারি, আপনি একজন আমেরিকান।

আমি একজন ইতালিয়। ওহ! ডিয়ার!

রবার্ট! ফিসফিস করল ভিট্টোরিয়া, পিছনটা দিল গাইডের দিকে, গ্যালিলিওর ডায়াগ্রামা। আমি দেখতে চাই ওটাকে।

ডায়াগ্রামা! নির্দ্বিধায় নাক গলাল সেই বেহায়া গাইড, মাই! আপনারা নিশ্চই অনেক কিছু জানেন। কপাল মন্দ, ডকুমেন্টটা দেখতে পাবেন না। সেটা ভ্যাটিকান সিটির গোপন আর্কাইভে।

আপনি কি আমাদের মাফ করতে পারবেন? একটু কষ্ট হয়ে যেন বলল ল্যাঙডন। ভিট্টোরিয়ার আতঙ্ক দেখে সে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। যত্ন করে সে ডায়াগ্রামার ফোলিওটা বের করল। হচ্ছেটা কী?

এখানে কোন ডেট দেয়া আছে।

খুঁটিয়ে দেখল ল্যাঙ৬ন, কোন তারিখ তো…

ট্যুরিস্ট রিপ্রোডাকশন, বলল ল্যাঙডন, দাঁতের ফাঁক দিয়ে, আপনার সহায়তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি আর আমার স্ত্রী একটু একান্ত সময় কাটাতে চাই।

লোকটা পিছিয়ে গেল। তার চোখ পড়ে আছে কাগজটার উপর।

তারিখ… আবার বলল ভিট্টোরিয়া, কবে এটা প্রকাশ পায়?

রোমান অক্ষরে লেখা আছে। সমস্যাটা কোথায়?

ষোলশ উনচল্লিশ?

হু। সমস্যা কোথায়?

চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল মেয়েটার, আমরা সমস্যায় আছি, রবার্ট, মহা সমস্যায়। তারিখ মিলছে না।

কোন তারিখ মিলছে না?

রাফায়েলের টম্বের তারিখ। সতেরশো উনষাটের আগ পর্যন্ত তিনি এখানে শায়িত হননি। ডায়াগ্রামা ছাপা হবার এক শতক পরে।

ল্যাঙডন একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চেষ্টা করছে কথার মর্ম বোঝার। না। রাফায়েল মারা গেছেন পনেরশ বিশে। ডায়াগ্রামার অনেক অনেক আগে।

ঠিক তাই। কিন্তু অনেকদিন পর্যন্ত তিনি এখানে ছিলেন না। অনেক অনেক পরে। তাকে এখানে কবর দেয়া হয়।

কী যা-তা বলছ?

আমি এইমাত্র সেটা পড়ে এলাম। শতেরশ আটান্ন সালে রাফায়েলের দেহাবশেষ এখানে কবর দেয়া হয়। ইতিহাসের বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে তাকে এখানে দাফন করা। হয় আবার।

কথাগুলোর ধাক্কা মোটেও সামলে উঠতে পারছে না সে। কী আবোল তাবোল কথাবার্তা হচ্ছে এসব!

কবিতাটা যখন লেখা হয়, ঘোষণার সুরে বলে ভিট্টোরিয়া, তখন রাফায়েলের কবর অন্য কোথাও ছিল। এখানে নয়। সে সময়টায় প্যান্থিয়নের সাথে এ লোকের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিল না।

কিন্তু… এর মানে…

তাই আমি বলছি। আমরা ভুল জায়গায় এসে বসে আছি।

অসম্ভব… আমি নিশ্চিত ছিলাম… ভাবছে ল্যাঙডন।

সাথে সাথে এগিয়ে গেল ভিট্টোরিয়া ল্যাঙডনকে টেনে নিয়ে, সিনর, মাফ করবেন আমাদের। ষোলশ সালের আগে রাফায়েলের দেহাবশেষ কোথায় ছিল?

আর্ব… আর্বিনো। তার জন্মস্থানে।

অসম্ভব! বলল ল্যাঙডন, মাথা নাড়তে নাড়তে। ইলুমিনেটির আস্তানা এই রোমেই ছিল। আর তাদের সমস্ত কর্মকান্ডও সীমিত ছিল এখানে। রাফায়েলের জন্মস্থানের সাথে এটার পথের কোন সম্পর্ক গড়ানো অসম্ভব।

ইলুমিনেটি? সাথে সাথে রসগোল্লার মত বড় বড় হয়ে গেল গাইডের চোখজোড়া, আপনারা কারা বলুন তো?

সাথে সাথে দায়িত্ব নিয়ে নিল ভিট্টোরিয়া, আমরা এমন এক জায়গার সন্ধানে বেরিয়েছি যেটাকে শান্তিস আর্থি টম্ব বলা হয়। রোমের ভিতরেই কোথাও। আপনি কি আমাদের বলতে পারেন কোথায় হতে পারে জায়গাটা?

রোমে এটাই রাফায়েলের একমাত্র কবর।

ল্যাঙডন চেষ্টা করছে ভাবার। কিন্তু তার মন মানতে রাজি নয়।

ষোলশ পঞ্চান্নতে রাফায়েলের টম্ব যদি রোমে না-ই থেকে থাকে তাহলে কী উদ্দেশ্যে কবিতাটা লেখা হয়? শান্তিস আর্থি টম্ব উইথ দ্য ডেমনস হোল? কোন চুলার কথা এটা? ভাব!

শান্তি নামে আর কোন আর্টিস্ট কি ছিলেন? যথা সম্ভব কথা আদায় করে নিচ্ছে মেয়েটা।

আমি তো জানি না।

আর কোন কোন পেশায় এমন বিখ্যাত কেউ থাকতে পারেন? বিজ্ঞানী, কবি বা এ্যাস্ট্রোনোমার? শান্তি নামে?

এবার যাবার পাঁয়তাড়া কষছে গাইড লোকটা, না, ম্যাডাম, আমি একমাত্র শান্তি র কথা জানি। রাফায়েল দ্য আর্কিটেক্ট।

আর্কিটেক্ট? আমিতো জানতাম তিনি একজন পেইন্টার।

তিনি উভয়ই ছিলেন। তাদের সবাই। মাইকেলেঞ্জেলো, দা ভিঞ্চি, রাফায়েল।

ল্যাঙডন চারপাশের কবরগুলোর অবস্থিতি দেখে এখন আর কোন কথা তার মনে জায়গা করে নিতে পারছে না। শান্তি একজন স্থপতি ছিলেন। তখনকার আর্কিটেক্টরা দু ধরনের কাজই করত। এক-বিশাল বিশাল ধর্মীয় মূর্তি বানাত, অথবা বিভিন্ন দর্শনীয় কবরের এলাকায় ভবন তৈরি করত। শন্তিস টম্ব। এমনটা কি হতে পারে? তার কল্পনা

এবার খুব দ্রুত পাখা মেলতে শুরু করল…

দা ভিঞ্চির মোনালিসা

মনেটের ওয়াটারলিলি

মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিড

শান্তির আর্থি টম্ব…

শান্তি টটার ডিজাইন করেছেন। বলল ল্যাঙডন অবশেষে।

ঘুরে দাঁড়াল ভিট্টোরিয়া, কী?

রাফায়েলের টম্ব বলতে রাফায়েল যেখানে শায়িত আছেন সেকথা বলা হয়নি, তিনি যে টম্ব ডিজাইন করেছেন সেটার কথা বলা হচ্ছে।

কী আবোল তাবোল বকছ?

আমরা ভুল পথে হাঁটছি, আসলে শান্তি যেখানে শুয়ে আছেন সেখানকার কথা বলা হয়নি। তিনি যে টটার ডিজাইন করেছিলেন অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে সেটার কথাই বলা হয়েছে। রেনেসাঁর সময়টায় যত জ্ঞানী-গুণী মারা যেত তাদের কবর দেয়া হত রোমে। আর সে সময়টার লোক ছিলেন রাফায়েল। রাফায়েলের টম্ব বলতে শত শত কবরখানাকে বোঝানো হতে পারে। নিশ্চই তিনি অনেক ডিজাইন করেছেন।

শত শত?

ঠিক তাই।

আর তার মধ্যে কোন না কোনটা আর্থি, প্রফেসর।

সাথে সাথে একটা ধাক্কা খেল ল্যাঙডন। সে রাফায়েলের কাজ সম্পর্কে খুব বেশি জানে না। যা জানে তা দিয়ে মোটামুটি কাজ চালিয়ে নেয়া যায়। তাই বলে… এখানে মাইকেলেঞ্জেলো হলে সে তেড়েফুঁড়ে সব বলতে পারত। সে বড়জোর আরো খান-দুই বিখ্যাত টম্বের কথা বলতে পারবে কিন্তু সেগুলো দেখতে কেমনতরো তার বিন্দু বিসর্গও বলতে পারবে না।

একটু একটু করে পিছিয়ে যেতে থাকা গাইডের দিকে তাকাল ভিট্টোরিয়া, কারণ ল্যাঙডন কোন খেই পাচ্ছে না। সে খপ করে ধরে ফেলল লোকটার হাত, আমরা একটা টম্বের হদিস চাই। এমন এক টম্ব যেটা রাফায়েলের ডিজাইন করা এবং যাকে আর্থি বলা চলে।

এবার যেন গাইডের অবস্থা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। রাফায়েলের টম্ব? আমি জানি না। তিনি অনেক অনেক ডিজাইন করেছেন। আর আপনারা হয়ত রাফায়েলের ডিজাইন করা কোন চ্যাপেলের কথা বলছেন, টম্ব নয়। স্থপতিরা সব সময় টম্বের সাথে চ্যাপেলের গডন গুলিয়ে ফেলেন। এটা করে তারা মজা পান।

হঠাৎ টের পায় ল্যাঙডন, লোকটার কথা কত সত্যি!

রাফায়েলের টম্ব বা চ্যাপেলগুলোর কোনটা কি মেটে হিসাবে বিবেচিত?

শ্রাগ করল লোকটা। আমি দুঃখিত। আপনি কী বলতে চান তার কিছুই আমি বুঝে উঠতে পারছি না। মেটে দিয়ে কী বোঝাচ্ছেন তা আপনিই ভাল বলতে পারবেন। আমার এবার যেতে হয় যে!

এবার নাচার হয়ে যাওয়া গাইডের দিকে তাকিয়ে ডায়াগ্রামা থেকে পড়তে শুরু করল ভিট্টোরিয়া, ফ্রম শান্তিস আর্থি টম্ব উইথ ডেমনস হোল। এর কোন মানে কি আপনি ধরতে পারছেন?

একটুও নয়।

এবার হঠাৎ করে যেই ধরে ফেলল ল্যাঙডন, উল্লসিত হয়ে উঠল সে, ডেমনস হোল! আরে, মরার শব্দগুলো আগে কেন মনে পড়ল না!

রাফায়েলের টম্ব বা চ্যাপেলের কোনটায় কি ওকুলাস আছে? মানে উপরে কোন ছিদ্র আছে?

আমার জানা মতে, প্যান্থিয়ন ইউনিক। কিন্তু…।

দুজনে একই সাথে চিল্কার করে উঠল, কিন্তু কী?

একটা ডেমনস হোল? কিন্তু… বুকো ডিয়াভোলো?

নড করল ভিট্টোরিয়া, অর্থ করলে, ঠিক তাই।

হাসল লোকটা। এই একটা ব্যাপার আছে যেটার সাথে আমি তেমন একটা পরিচিত নই। আমার ভুল না হলে বুকো ডিয়াভেলো দিয়ে আন্ডারক্রফট বোঝানো হয়।

আন্ডারক্রফট? জিজ্ঞেস করল ল্যাঙডন, ক্রিপ্ট?

ঠিক তাই। চার্চের নিচে, মাটির তলায় লাশ মাটি দেয়ার জায়গা। কিন্তু এটা দিয়ে শুধু ক্রিপ্ট বোঝানো হয় না। বোঝানো হয় বিশেষ ধরনের ক্রিপ্ট। আমি যদ্দূর জানি, কবর দেয়ার এক বিশাল এলাকা, যেটা কোন চ্যাপেলে থাকে… অন্য কোন টম্বের নিচে…

অসুয়ারি এ্যানেক্স? জবাব দাবি করল ল্যাঙডন, সাথে সাথে উবে গেল তার ভিতরের হতাশা।

আরে… এই শব্দটাই আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

ব্যাপারটাকে মাথায় সেঁধিয়ে নিল ল্যাঙড়ন। অসুয়ারি এ্যানেক্স হল এক প্রকারের চ্যাপেল। মাঝে মাঝে চার্চ যখন তাদের প্রিয় সদস্যদের কবর দেয় তখন মাঝে মাঝে পরিবারের লোকজন দাবি করে যেন তাদের একত্রে কবর দেয়া হয়… তাদের আশা থাকে গির্জার ভিতরেই কোথাও তারা দুজনেই বা সবাই সমাহিত হবে। যখন একটা চার্চের যথেষ্ট টাকা বা জায়গা থাকে না একটা পরিবারের জন্য জায়গা ছেড়ে দেয়ার মত তখন বিকল্প ব্যবস্থা দেখা হয়। তখনি তারা মাঝে মাঝে অসুয়ারি এ্যানেক্স খোঁড়ে। টম্বের পাশে মেঝেতে একটা গর্ত খোদাই করে। ডেমনস হোল। কালক্রমে এটা বেশ জনপ্রিয় একটা পদ্ধতিতে রূপান্তরিত হয়।

এবার ল্যাঙডনের হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে। ফ্রম শান্তিস আর্থি টম্ব উইথ ডেমনস হোল। যেন কোন প্রশ্নের উত্তর মিলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। রাফায়েল কি এমন কোন টম্ব ডিজাইন করেছিলেন যেটায় তেমন ডেমনস হোল ছিল?

আসলে… আমি দুঃখিত, এখন একটার কথা মাত্র মনে পড়ছে।

মাত্র একটা! হতাশ হল ল্যাঙডন। সে আরো বেশি আশা করেছিল।

কোথায়? প্রায় চিক্কার করে উঠল ভিট্টোরিয়া।

তাদের দিকে অবাক করা চোখে তাকাল লোকটা, এটাকে চিগি চ্যাপেল নামে ডাকা হয়। অগাস্টিনো চিগি আর তার ভাইয়ের টম্ব। শিল্প আর বিজ্ঞানের বড় বড় মহারথী তারা।

বিজ্ঞানের? ভিট্টোরিয়ার দিকে চকিত দৃষ্টি বুলিয়ে ল্যাঙডন তাকাল লোটার দিকে।

কোথায়? আবার প্রশ্ন করল মেয়েটা।

আমি বলতে পারি না টম্বটা আর্থি কিনা… কিন্তু এটুকু নির্দ্বিধায় বলতে পারি… এটা ডিফারেন্টে।

ডিফারেন্ট? ল্যাঙডন বলল, কীভাবে?

স্থাপত্যের দিক দিয়ে। রাফায়েল শুধু আর্কিটেক্ট ছিলেন। ভিতরের কারুকাজ আর অন্যান্য ব্যাপার করেছে বাকীরা। আমার মনে পড়ছে না কারা।

ল্যাঙডন এবার যেন তীরের কাছে চলে এসেছে। সেই বিখ্যাত ইলুমিনেটি আর্টিস্ট, মাস্টার, আর কে?

কবরটা আর যেমনি হোক না কেন.. বলছে গাইড, সেটা দেখে মনে তৃপ্তি আসবে না। কেন আসবে না? আমার ঈশ্বর জানেন। কে পিরামিদেসের নিচে শায়িত হতে চায়?

নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না ল্যাঙডন, পিরামিড? একটা চ্যাপেলের ভিতরে পিরামিড আছে? এখান থেকে কতদূরে?

মাইলখানেক উত্তরে। সান্তা মারিয়া ডেল প্রোপোলোতে।

সাথে সাথে ধন্যবাদ দিয়ে হিসাব চুকিয়ে দিতে চাইল ভিক্টোরিয়া, ধন্যবাদ আপনাকে, চল-

হেই! সাথে সাথে বাধা দিল বয়েসি গাইড লোকটা, আমি ভেবে পাই না কী বোকা আমি!

ভিট্টোরিয়া সাথে সাথে তার দিকে তাকাল, বলবেন না প্লিজ, আপনার কোন ভুল হয়েছে।

না, ভুল হয়নি। বরং একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম আসি। চিগি চ্যাপেল সব সময় চিগি নামে পরিচিতি পায় না। এর আরো একটা নাম আছে। চ্যাপেলা ডেলা টেরা।

চ্যাপেল অব দ্য ল্যান্ড? অনুবাদ করেই জানতে চাইল ল্যাঙডন।

না। শুধরে দিল ভিট্টোরিয়া, চ্যাপেল অব দ্য আর্থ।

ভিট্টোরিয়া ভেট্রা তার সেলফোনে যোগাযোগ করল কমান্ডারের সাথে। কমান্ড ওলিভেট্টি! বলল সে, আমরা ভুল জায়গায় মাথা কুটে মরছি।

ভুল? কী বলতে চান আপনি?

সায়েন্সের প্রথম অল্টার হল চিগি চ্যাপেল।

কোথায়? কিন্তু মিস্টার ল্যাঙডন বলেছিলেন…

সান্তা মারিয়া ডেল পোপোলো। এক মাইল উত্তরে। আপনার লোকজনকে সেখানে সরিয়ে নিন। দ্রুত। আমাদের হাতে মাত্র চার মিনিট সময় আছে।

কিন্তু আমার লোকজন এখানে পজিশনে আছে। আমি সম্ভবত সময়ের মধ্যে…

মুভ! বন্ধ করে দিল ভিট্টোরিয়া তার সেলফোনটা।

তার পিছনে পিছনে প্যাভিয়ন থেকে বেরিয়ে এল ল্যাঙডন।

এখন আর সুইস গার্ডের গাড়িতে আরামে আয়েশে ফিরে যাবার সময় নেই। ভিট্টোরিয়া খামচে ধরল ল্যাঙডনের হাত। সোজাসাপ্টা নিয়ে চলল সামনের দিকে। তারপর যেখানে ট্যাক্সির লাইন জটলা বাধিয়ে রেখেছে সেখানে প্রথম ক্যাবটাকে খালি পেয়েই ঝটকা দিয়ে খুলে ফেলল সেটার দরজা। ধরফড় করে জেগে উঠল ড্রাইভার।

সে কিছু বোঝার আগেই ভিতরে ঠেলে দিল সে ল্যাঙডনকে, তারপর কিছু বুঝতে দিয়ে ড্রাইভারকে বলল, সান্তা মারিয়া ডেল পোপোলো। চিত্তার করল সে, প্রেসতো!

ঘুমভাঙা চোখে তাকিয়ে কী বুঝল ড্রাইভারই বলতে পারবে। সোজা এ্যাক্সিলারেটরে পা দাবিয়ে দিল সে।

৬৩.

গুন্থার গ্লিক চিনিতা ম্যাক্রির কাছ থেকে কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল নিজের তহাতে।

আমি তোমাকে আরো আগেই বলেছিলাম, বলল গ্লিক, আরো কিছু কি চাপ দিয়ে, ব্রিটিশ টেটলার একমাত্র পত্রিকা নয় যেটা সর্বক্ষণ এসব নিয়ে মেতে থাকে।

ম্যাক্রি আরো কাছে এসে চোখ বুলিয়ে নেয়। গ্লিকের কোথাও ভুল হয়নি। গত দশ বছরে বিবিসির ডাটাবেসে ইলুমিনেটি নামক সংস্থাটা নিয়ে ছবার খবর বেরিয়েছে। আমাকে লালচে রঙে রাঙিয়ে নাও। মনে মনে বলল ম্যাক্রি। কে এই কাহিনীর জনক? কোন সাংবাদিক? সে রসিকতা ভালই করতে জানে।

নোংরা রসিকতা বিবিসি করে না।

তারা তোমাকে ভাড়া করেছে কোন দুঃখে?

আমি বুঝতে পারছি না কেন তুমি এমন করল। ইলুমিনেটি একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার।

একই রকম ঐতিহাসিক ব্যাপার ডাইনি বুড়িরা, ইউ এফ ও এবং নোচ নেস দানবেরা।

ঘটনার পরম্পরা পড়ছে গ্লিক। উইনস্টন চার্চিল নামে কোন লোকের কথা কি কখনো তুমি শুনেছ?

মনের ঘন্টি বাজিয়ে দেয়।

তুমি কি জান, উনিশো বিশের দশকে এই চার্চিল ইলুমিনেটির অনৈতিক কাজের জন্য সারা দুনিয়াকে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন?

কোথায় এ নিয়ে লেখা এসেছিল? ব্রিটিশ টেটলারে?

লন্ডন হেরাল্ডে। আটই ফেব্রুয়ারি, উনিশো বিশ।

অসম্ভব।

নিজের চোখে দেখ।

ক্লিপটার দিকে আরো তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় ম্যাক্রি। ঠিকই তো! যাক। চার্চিল একজন প্যারানয়েড ছিল।

সে একা হলেও কথা ছিল। উড্রো উইলসন উনিশো একুশে আরো একটা তথ্য জানান। রেডিও ব্রডকাস্টে তিনি ঘোষণা করেন, আমেরিকান অর্থনীতির উপর ক্রমাগত ইলুমিনেটির প্রভাব বাড়ছে। তুমি কি রেডিও ট্রান্সক্রিপ্টটা দেখতে চাও?

আসলে না।

তিনি বলেছিলেন, খুব ভালভাবে সংগঠিত, খুব তীক্ষ্ণ মেধা সম্পন্ন, খুব পরিপূর্ণ, খুব লক্ষ্যস্থির করা এমন এক শক্তি আছে যারা যখন কোন কথা বলে তার উপর কোন কথা বলার মত শক্তি আর কেউ পায় না।

আমি কখনো এ সম্পর্কে কিছু শুনিনি!

হয়ত এজন্যে যে উনিশো একুশের দিকে তুমি একেবারে দুগ্ধপোষ্য শিশু ছিলে।

ভাল, ভাল! ম্যাক্রি মনে মনে একটু ধাক্কা পেলেও সেটাকে কোনমতে সামলে নেয়। তার বয়স এখন তেতাল্লিশ। কম নয়। তার চুলের ঢল এখন একটু ধূসর হয়ে উঠছে। তার মা, একজন ব্যাপ্টিস্ট, তাকে শিক্ষা দিয়েছিল।

যখন তুমি একজন কালো মহিলা, তার মা বলতেন, কখনো সত্যটা লুকানোর চেষ্টা করবে না। যেদিন তুমি তেমন কোন চেষ্টা করবে সেদিনই তোমার আত্মিক মৃত্যু হবে। আর তাই, সক সময় তুমি হাসবে। তারা ভেবে মরবে কোন দুঃখে তুমি হাসছ।

কখনো সিসিল রোডসের নাম শুনেছ? জিজ্ঞেস করল গ্লিক।

ব্রিটিশ প্রযোজক?

জি। রোডস স্কলারশিপ যিনি শুরু করেন।

আমাকে বলো না–

ইলুমিনেটাস।

বিএস?

বিবিসি, আসলে। নভেম্বর মোল, উনিশো চুরাশি।

আমরা লিখেছি যে সিসিল রোডস ইলুমিনেটি?

আর আমরা আরো জানি যে রোডস স্কলারশিপ আর কিছু নয়। তরুণ ইলুমিনেটিদের পড়ালেখা চালানোর জন্য একটা সহায়তার বৈতরণী।

অসম্ভব! আমার চাচা একজন রোডস স্কলার ছিলেন।

বিল ক্লিনটনও।

এবার তেতে উঠল ম্যাক্রি। সে গুজবে খবরে মোটেও বিশ্বাস করে না বরং ব্যাপারটাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। তবু সে জানে, বিবিসির মত কোন প্রতিষ্ঠানই এত ছেকে, এত ভেবে চিন্তে খবর প্রকাশ করে না।

আরো একটা ব্যাপার আছে ম্যাক্রি, কথাটা তোমার জন্য ভালই হবে। উনিশো আটানব্বইয়ের পাঁচ মার্চ। পার্লামেন্ট কমিটি চেয়ার, ক্রিস মুলিন। ডাকলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সবাইকে, যারা মেসন ছিলেন। তাদের সাথে মতামতের বিনিময় হল

তার।

মনে আছে ম্যাক্রির। ভুলে যায়নি সে। কেন এটা হয়েছিল? আরেকবার বলবে?

পড়ল গ্লিক, … মেসনদের ভিতরেই দানা বেঁধে উঠছে আর একটা গুপ্ত সংস্থা। সেটা আগা-পাশ-তলা এক সর্বগ্রাসী সংঘ যেটা রাজনৈতিক আর আর্থিক সুবিধাগুলো একে একে দখল করে নিচ্ছে।

কথা সত্যি।

কিন্তু তাতে করে সমস্যা আরো বেড়ে যায়। পার্লামেন্টের মেসনরা সাথে সাথে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এমনটাই হবার কথা। বেশিরভাগই ছিল একেবারে গোবেচারা। তারা মেসনে যোগ দিয়েছে রাজনৈতিক সুবিধা পাবার জন্য। মানুষের সেবা, সমাজসেবা, চ্যারিটি… ইত্যাদি ইত্যাদি। তাদের দরকার সুবিধা।

দরকার ছিল সুবিধা।

যাই হোক। বলল গ্লিক, মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে, এটার দিকে তাকাও একবার। এখানে ইলুমিনেটির গোড়ার দিকে আসা হচ্ছে। গ্যালিলিওর সময়টা। ফ্রান্সের গুয়েরেনেট, স্পেনের এ্যালুম্বাডােস, এমনকি কার্ল মার্ক্স এবং রাশিয়ান বিপ্লব।

ইতিহাসের একটা নিজস্ব পন্থা আছে। নিজেকে সে বারবার নিজের মত করে লিখে নেয়।

দারুণ! তুমি সাম্প্রতিক কালের কোন তথ্য পেতে চাও? এদিকে চোখ মেলে তাকাও। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে এখানে একটা নতুন খবর আছে।

জার্নালে?

তুমি কি জানো আমেরিকায় বর্তমানে সবচে জনপ্রিয় কম্পিউটার গেম কোনটা?

পিন দ্য টেইল অন পামেলা এন্ডারসন।

কাছাকাছি। এর নামঃ ইলুমিনেটি: নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার।

ম্যাক্রি এবার এগিয়ে এসে পড়তে শুরু করল, স্টিভ জ্যাকসনের গেম সব সময়েই দারুণ বাজার পায়… এক পরা-ঐতিহাসিক এ্যাডভেঞ্চার যেখানে বাভারিয়া থেকে প্রাচীণ শয়তানি সংঘের দ্বারা পুরো পৃথিবীতে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়। আপনি এগুলোকে অন-লাইনেও পেতে পারেন…।

এবার টনক নড়ল ম্যাক্রির, এই ইলুমিনেটির সাথে ক্রিশ্চিয়ানিটির কী প্রতিদ্বন্দ্বীতা?

শুধু খ্রিস্টবাদ নয়। এক কথায় ধর্ম। আমি যে লোকটার কথ এইমাত্র শুনলাম সে আর যাই হোক না কেন, এমন কোন সংঘ থেকে আসতেও পারে।

ওহ্! কাম অন! তুমি নিশ্চই আশা কর না যে এ লোকদের সাথে সত্যি সত্যি সেই প্রাচীণ ইলুমিনেটির যোগাযোগ আছে এবং তারা ভ্যাটিকান সিটি থেকে চারজন কার্ডিনালকে গাপ করে দিয়েছে। নাকি?

ইলুমিনেটির সেই বার্তাবাহকের কথা? অবশ্যই বিশ্বাস করি।

৬৪.

ল্যাঙডন আর ভিট্টোরিয়ার ট্যাক্সি এক মিনিটের মধ্যে ভায়া ডেলা স্লোফা ধরে এক টানে চলে এল এক মাইল পথ। ঠিক যেন কোন ড্রাগ গেম, কিম্বা বলা ভাল প্রিন্ট। আটটার ঠিক আগে আগে তারা সেখানে পৌঁছল। কোন সমস্যা না হওয়াতে ল্যাঙডন ট্যাক্সিওয়ালা লোকটাকে ডলারে পে করল। অনেক বেশি। সাথে সাথে বাইরে বেরিয়ে এল তারা দুজন। জনপ্রিয় রোসাতি ক্যাফেতে এলাকার কয়েকজন লোকের হৈ হল্লা ছাড়া এলাকাটাকে একেবারে নিরব বলা চলে। বাতাসে পেস্ট্রির চনমনে গন্ধ।

এখনো ল্যাঙডন প্যান্থিয়নের ব্যাপারটা ভুল হবার ধাক্কা সামলে উঠতে পারছে না। চোখ পড়ে আছে মিকির দিকে, তার মন পড়ে আছে রাত আটটার দিকে। এখনি টিকটিক শুরু করে দিয়েছে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। পিয়াজ্জা যেন ইলুমিনেটির নানা বর্ণের প্রতীকে ভরপুর। শুধু আকৃতিগত মিল নয়। দেখা যাচ্ছে ডলারে থাকা পিরামিড। উচ্চতার প্রতীক। এখানে এটা একটু অন্যরকম। পাথুরে গডন, বিশাল উচ্চতা, বিপুল বপু। এখানে সবাই এটাকে এক নামে চেনে।

মনোলিথটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ল্যাঙডন টের পায় যে আরো বেশি উল্লেখ্য কিছু দেখা যাচ্ছে এখানে।

আমরা ঠিক জায়গাতেই এসেছি, বলল সে শান্ত স্বরে, একবার আশপাশে তাকিয়ে দেখ। শিউরে উঠছে সে মনে মনে প্রকাশ করছে না।

সামনে একটা পাথুরে পথ। সেদিক থেকে আরো একটা ব্যাপার চোখে পড়ে। দেখে পরিচিত মনে হচ্ছে কি?

ত্রিকোণ পাথরের স্তুপের উপরে জ্বলজ্বলে একটা তারকা?

পিরামিডের উপরে আলোক বর্তিকার উৎস।

নড়েচড়ে দাঁড়াল ভিট্টোরিয়া, ঠিক যেন… ঠিক যেন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট সিল?

ঠিক তাই। মেসনিক এক ডলারের নোট।

সাথে সাথে গভীর ভাবে একটা দম নিল ভিট্টোরিয়া, তারপর একটা মুহূর্ত চুপ থেকে সে বলল, তাহলে কোথায় সেই মরার চার্চ?

সান্তা মারিয়া ডেল পোপোল গির্জা দাঁড়িয়ে আছে একটা ভুল জায়গায় বসানো যুদ্ধজাহাজের মত। পিয়াজ্জার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে। একাদশ শতকের স্থাপত্য সগর্বে মাথা উঁচু করে রেখেছে।

এগিয়ে গেল ল্যাঙডনও। ভিতরে কি সত্যি সত্যি কোন হত্যাকান্ড হতে যাচ্ছে? কে জানে! শিউরে উঠল সে আবার। তার মনে একটাই আশা। ওলিভেট্টি যদি কোনমতে তাড়াতাড়ি করতে পারে! আবারও তার পকেটের পিস্তলটা ভারি ভারি ঠেকছে।

গির্জার প্রথমদিকের সিঁড়িগুলো হল ভেন্টাগ্নিও- স্বাগত জানানো, বাঁকানো পথ কিন্তু এ পথ বাঁধা পড়ে আছে। নির্মাণ সামগ্রীতে ঠাসা জায়গাটা। সেই সাথে এটা সতর্কবাণীও লটকে দেয়া আছেঃ

কন্সট্রাজিওন। নন এন্টারে।

ব্যাপারটা লক্ষ্য করে আরেকবার বিষম খেল তারা দুজনেই। একটা নির্মীয়মান চার্চ মানে খুনির খুন করার জন্য একেবারে অভয়ারণ্য। প্যান্থিয়নের মত না। কোন চালাকির দরকার নেই, নেই কোন পরিকল্পনা বা ছদ্মবেশের। শুধু ঢোকার জন্য একটা পথ বের করে নাও, ব্যস।

বিনা দ্বিধায় ভিট্টোরিয়া সেগুলোর ভিতর দিয়ে পথ করে নিয়ে এগিয়ে গেল।। তাকে বাধা দিল ল্যাঙডন, ভিট্টোরিয়া! বলল সে, এখনো যদি লোকটা ভিতরে থেকে থাকে

কিন্তু থোড়াই পরোয়া করে ভিট্টোরিয়া। সে গটগট করে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। চার্চের মূল দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তড়িঘড়ি করে তার পিছন পিছন এগিয়ে এল ল্যাঙডন। প্রাণান্ত চেষ্টা করল তাকে বাধা দেয়ার। কিন্তু যা করার করে বসেছে ভিট্টোরিয়া। চার্চের মূল হলরুমের কাঠের দরজার হাতল ধরে টেনে নিয়েছে নিজের দিকে। কিন্তু দরজা খুলছে না।

নিশ্চই অন্য কোন প্রবেশপথ আছে। বলল ভিট্টোরিয়া

সম্ভবত। শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল ল্যাঙডন, কিন্তু ওলিভেট্টি এক মিনিটের মধ্যে এখানে হাজির হচ্ছে। কিন্তু ভিতরে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সবচে ভাল হয় আমরা যদি বাইরেই থাকি আর অপেক্ষা করি মূল সময়ের জন্য। যেন কেউ বাইরে বেরুতে না পারে–

সাথে সাথে চট করে তার দিকে ফিরল ভিট্টোরিয়া। চোখ তার আগুন বর্ষাচ্ছে, যদি ঢোকার মত অন্য কোন পথ থেকেই থাকে, বেরুবার পথও থাকবে। লোকটা যদি একবার হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, আমাদের প্রাণপাখিও উড়ে যাবে। আমরা হয়ে যাব ফ্রিগেটি।

মেয়েটার কথা যে ঠিক সেটা বোঝার মত ইতালিয় ল্যাঙডন জানে।

চার্চের মূল পথটা অন্ধকার। দু পাশেই উঁচু দেয়াল। সেখানে আরো একটা গন্ধ টের পাওয়া যাচ্ছে। আর সব মহান সিটির মতই এটা, যেখানে বার আছে অগুণতি কিন্তু রেস্ট রুমের সংখ্যা একেবারে হাতেগোণা। বিশটার অনুপাতে একটা। তাই ইউরিনের গন্ধ তাকে বিরক্ত করছে।

এই অন্ধকারের দিকেই তারা দুজনে এগিয়ে গেল যেখানে অবশেষে ভিট্টোরিয়া আকড়ে ধরল ল্যাঙডনের বাহু। নির্দেশ করল সামনে।

ভিট্টোরিয়ার দেখানো দিকে চোখ পড়েছে ল্যাঙডনেরও। সামনের কাঠের দরজাটায় ভারি পাল্লা ঠাসা। বোঝাই যাচ্ছে এটা ক্লার্জিদের জন্য একটা প্রাইভেট এন্ট্রান্স।

বেশ কয়েক বছর ধরেই এগুলো একেবারে অকেজো হয়ে আছে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা আর বাড়ি-ঘর তুলে নেয় যারা সেসব লোকজন গলি-তস্য গলি আর পথ বানিয়ে বানিয়ে একেবারে অকেজো করে দিয়েছে গির্জাটার অন্য প্রবেশপথটাকে।

দ্রুত এগিয়ে গেল ভিট্টোরিয়া, এগিয়ে গেল ল্যাঙডনও। যেখানে ভোরনব থাকার কথা সেখানে একটা কিস্তুত কিমার্কার জিনিস ঝুলছে।

এ্যানুলাস, ফিসফিস করল ল্যাঙড়ন। কাছে এগিয়ে গেছে সে। আলতো করে টেনে ধরেছে সে রিঙটাকে। সে টেনে ধরল রিঙটাকে তার দিকে। ফলে ভিতর থেকে একটু ক্লিক করে শব্দ হল। এগিয়ে গেল ভিট্টোরিয়া, একটু অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে তাকে। রিঙটাকে এবার ল্যাঙডন সেটাকে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘোরাল। তিনশো ষাট ডিগ্রি ঠিকভাবেই এটা ঘুরে গেল। অন্যদিকেও ল্যাঙডন একই ভাবে ঘোরাল সে জিনিসটাকে এবং একই ফল পেল।

সামনের গলির দিকে চোখ ফেলল ভিট্টোরিয়া, তুমি কি মনে কর সেখানে আরো পথ আছে?

সন্দেহ করছে ল্যাঙড়নও। রেনেসাঁর যুগের স্থাপত্যকর্মগুলোর আরো কিছু বৈশিষ্ট আছে। সেগুলোকে নিরাপদ করার একটা তাগিদ থাকত সবার। তাই যথা সম্ভব কম প্রবেশপথ রাখা হত সে যুগে। সেখানে যদি আর কোন পথ থেকেই থাকে, থাকবে পিছনে। অবশেষে বলল সে, তবে সেটা আছে বেরিয়ে আসার পথ হিসাবে। ঢোকার পথ নয়।

কথা শোনার সময় নেই ভিট্টোরিয়ার। সে কথা শেষ হয়ে যাবার আগেই ছোটা শুরু করল।

সামনে এগিয়ে গেল ল্যাঙডন। তার দুপাশে দেয়াল আকাশ ছুঁয়ে দিচ্ছে। আশপাশে কোথাও একটা বেল বেজে উঠল। আটটা বাজে।

প্রথম ডাকটা শুনতে পায়নি রবার্ট ল্যাঙডন। ভিট্টোরিয়া ডাকছে তাকে। সে একটা কাচের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চার্চের ভিতরটা দেখার প্রাণান্ত চেষ্টায় মেতে ছিল।

রবার্ট! আবার ডাক আসলে সে সচকিত হয়। একটু জোরে এই ফিসফিসে শব্দটা আসে এবার।

মাথা তুলে তাকাল ল্যাঙডন। পথের শেষপ্রান্তে আছে ভিট্টোরিয়া। সে গির্জার পিছনদিকটা নির্দেশ করে তার দিকে ফিরে হাত নাড়ছিল। ল্যাঙডন ধীরে জগিং করার ভঙ্গিতে তার দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে একটা সরু পথ। সোজা নেমে গেছে গির্জার তলার দিকে।

প্রবেশপথ? জিজ্ঞেস করল ভিক্টোরিয়া।

নড় করল ল্যাঙডন। আসলে একটা বহির্গমন পথ। কিন্তু এখন আমরা প্রবেশ বাহির নিয়ে বিবাদ না করি।

ভিট্টোরিয়ার কর্মোদ্যমে কোন ঢিল নেই। সে সাথে সাথে বলল, দরজাটা চেক করে নিই। যদি ভোলা পাওয়া যায়!

ল্যাঙডন মুখ খুলতে নিয়েছিল। মানা করবে। তার আগেই কাজে নেমে পড়ল ভিট্টোরিয়া।

দাঁড়াও! বলল ল্যাঙডন তাকে।

অধৈর্য ভঙ্গিতে তার দিকে তাকাল মেয়েটা।

বাগড়া দিল ল্যাঙডন, আমি আগে যাচ্ছি।

কেন? বীরত্ব দেখানো?

সৌন্দর্যের আগে এগিয়ে যাবে বয়স।

এটা কি কোন রকমের প্রশংসার মধ্যে পড়ছে?

হাসল একটু ল্যাঙডন। ভাগ্যিস আলো কম ছিল, তার অপ্রস্তুত ভাবটা ধরা পড়ে যাচ্ছে না। সিড়ির ব্যাপারে সাবধান।

দেয়ালে এক হাত রেখে সে খুব ধীরে ধীরে প্রবেশ করে ভিতরে। হাতের তালুতে খোচা দিচ্ছে পাথুরে এবড়োথেবড়ো দেয়াল। মিনোটারের গোলকধাধায় কীভাবে তরুণ ডেডেলাস আঁধারে হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গিয়েছিল সে কথাটা তার মনে পড়ে। একটা বিশ্বাস তার দৃঢ় ছিল, একবারো দেয়াল থেকে সরে না গেলে সে ঠিক ঠিক আসল জায়গায় গিয়ে হাজির হবে। বেরুতে পারবে গোলকধাধা থেকে। দেয়ালে হাত রেখে ল্যাঙডন এগিয়ে যাচ্ছে, সে জানে না ঠিক পথটা শেষ করতে চায় কিনা।

সুড়ঙ্গটা আরো আরো সরু হয়ে আসছে। গতি কমাল ল্যাঙডন। তার ঠিক পিছনেই এগিয়ে আসছে ভিট্টোরিয়া। দেয়াল ঘুরে যাবার পর একটা অর্ধ-গোলাকৃতির এ্যালকেভে গিয়ে হাজির হল তারা। অবাক হলেও সত্যি, এখানে আলোর একটা ক্ষীণতম আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আলোর আড়ালে দেখতে পেল সে, একটা বড় কাঠের দরজা আছে।

ওহ্! বলল সে।

লক করা?

ছিল।

ছিল? এবার এগিয়ে এল মেয়েটা।

হাতের ইশারায় দেখাল ল্যাঙডন। ভিতর থেকে আলোর একটা ক্ষীণ রেখা এগিয়ে আসছে। দরজা ভাসছে আলোয়। এটার পাল্লা খোলা হয়েছে যে টুল দিয়ে সেটা এখনো লাগানো আছে।

নিরবতায় তারা একটা মুহূর্ত চুপ করে বসে থাকে। তারপর, আঁধারে ভিট্টোরিয়ার হাত টের পায় ল্যাঙডন। তার বুকে হাতড়ে বেড়াচ্ছে মেয়েটা।

রিল্যাক্স, প্রফেসর। বলল সে, আমি শুধু গানটা খুঁজে পাবার চেষ্টা করছি।

সেই মুহূর্তেই, ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের ভিতরে চারদিক থেকে সুইস গার্ডের একটা টাস্ক ফোর্স এগিয়ে এল। জাদুঘর অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং গার্ডরা ইউ এস মেরিনদের জন্য বরাদ্দকৃত নাইট ভিশন গগলস পরে আছে , সবুজের শেডে প্রতিটা জিনিস দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। প্রত্যেকের সাথে একটা করে হেডফোন আছে, সেটার সাথে আছে একটা করে ছোট এ্যান্টেনার মত ডিভাইস। এগুলো তারা ব্যবহার করে সপ্তাহে দুবার। ইলেক্ট্রনিক ছারপোকা খুঁজে বের করার কাজে। তাদের দক্ষ হাতের কাজ এগিয়ে চলেছে প্রতি পলে। সামনে চৌম্বক ক্ষেত্রের বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখা গেলেও সেটা ধরা পড়ে যাবে।

আজ রাতে, যাই হোক, তারা কোন ঝুঁকি নিচ্ছে না।

৬৫.

সান্তা মারিয়া ডেল পোপোলোর ভিতরটা মৃদু আলোয় নেয়ে উঠছে। দেখতে মোটেও ক্যাথেড্রালের মত নয়। বরং দেখে মনে হতে পারে কোন অর্ধ সমাপ্ত সাবওয়ে ট্রেনের স্টেশন এটা। মূল মঞ্চটাও খালি নেই। চারধারে ঠাসা জিনিসপত্র। নির্মাণ সামগ্রী। অতিকায় থাম উঠে গেছে অনেক উপরে, ছাদ পর্যন্ত। সামনে একটা দেয়ালচিত্র দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে যায় ল্যাঙডন সেটার দিকে একটু।

কিছু নড়ছে না ভিতরে। একেবারে স্থির।

দু হাত একত্র করে ভিট্টোরিয়া পিস্তলটা বের করে আনে। ঘড়ি চেক করে দেখে ল্যাঙডন, আটটা বেজে চার। আমরা ভিতরে ঢোকার সাহস করে ঠিক ভাল করিনি। ভাবছে সে, এখানে থাকাটা বেশি সাহসের কাজ। আর এমন খুনে সাহসের কোন দরকার নেই। সে জানে, খুনি যদি এখানে থেকেও থাকে, সে চাইলেই যে কোন দরজা। দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে পারে। কোন সমস্যা হবে না তার। আর লোকটা নিশ্চই খুনোখুনীতে সিদ্ধহস্ত। তাই এত কষ্ট করে ভিতরে ঢোকার কোন মানেই দাঁড়াবে না। ভিতরে তাকে পাকড়াও করে ফেলার পথটাই সবচে ভাল হত… আর যদি সে ভিতরে থেকে থাকত তাহলে না একটা কথা ছিল। ল্যাঙডন প্যান্থিয়নে সে চেষ্টা করে দেখেছে এবং লাভের লাভ কিছু এখানেও হবে বলে মনে হয় না। সে আর এখন যাই বলুক না কেন, সতর্ক থাকতে বলতে পারে না। এই পর্যায়ে সে-ই সবাইকে টেনে এনেছে।

ভিতরটা খুটিয়ে দেখল মেয়েটা… তো, কোথায় তোমার চিগি চ্যাপেল?

চারদিকে তাকাল সে। বিশাল কামরা, কামরার লাগোয়া দেয়াল, দেয়ালের ফ্রেস্কো, স্তুপ করে রাখা রাশি রাশি নির্মাণ সামগ্রী… সবই আছে ঠিকঠাক। কিন্তু একটা ব্যাপার হঠাৎ করে তার মনে পড়ে গেল। রেনেসাঁর যুগে মাঝেমধ্যেই গির্জার মধ্যে একাধিক চ্যাপেল বানানোর রেওয়াজ ছিল। নটরডেমের মত বড় বড় ক্যাথেড্রালগুলোয়। ডজন ডজন আছে। চ্যাপেলগুলো ঠিক ঘর নয়, বরং যেন একটা শূণ্যতা। অর্ধ গোলাকার এলাকা… একটা গির্জার বাইরের এলাকা জুড়ে থাকে।

চার দেয়ালে চারটা ছবি দেখে মনে মনে ভাবল ল্যাঙডন, দুঃসংবাদ। এখানে মোট আটটা চাপেল আছে। যদিও আট সংখ্যাটা বুক কাঁপিয়ে দেয়ার মত কিছু নয় তবু এখন এই আটটাকে দেখে ফেলা মুখের কথা নয়। সবগুলোই এখন নির্মাণকালীন সতর্কতার মধ্যে পড়ছে। সবগুলোতেই পলিথিন দিয়ে প্রবেশপথ ঢেকে রাখা।

এই সবগুলোতে প্রবেশ করার কথা চিন্তাও করা যায় না। বলল ভিট্টোরিয়াকে ল্যাঙডন, তারচে মনে হয় কোনটা চিগি সেটা বোঝার জন্য বরং ভিতরে যাওয়া অনেক ভাল। কিন্তু সেটা নিজের পায়ে কুড়াল মারার মত ব্যাপার হবে না কি? আমি চিন্তা করছিলাম ওলি-

কোথায় সেকেন্ডারি লেফট এপস্?

আর্কিটেকচারাল কথাবার্তা শুনে একটু দমে গেছে ল্যাঙডন মনে মনে, সেকেন্ডারি লেফট এপস?

তার পিছনের দেয়ালের দিকে নির্দেশ করল ভিট্টোরিয়া! সেখানকার পাথরে একটা টাইল বসানো। তারা বাইরে যে সিম্বল দেখেছে এখানেও সেটা আছে। একটা পিরামিডের উপরে এক জ্বলজ্বলে তারকা। এর পাশে লেখা আছে আরো কিছু

কোট অব আর্মস অব আলেক্সান্দার চিগি
হুজ টম্ব ইজ লোকেটেড ইন দি
সেকেন্ডারি লেফট এপস্ অব দ্য ক্যাথেড্রাল

নড করল ল্যাঙডন। চিগির কোর্ট অব আর্মস কি পিরামিড আর তারা? হঠাৎ তার মাথায় আরো একটা চিন্তা খেলে গেল। এই চিগি লোকটাও ইলুমিনেটাস নয়ত? নড করল সে ভিট্টোরিয়ার দিকে তাকিয়ে, নাইস ওয়ার্ক, ন্যান্সি ড্রিউ।

কী?

নেভার মাইন্ড। আমি–

একটা ধাতব জিনিস পড়ল তাদের সামনে। সেটা থেকে ঝনঝন শব্দে সারা হল ভরে গেল। শব্দের দিতে তাক করে ধরেই রেখেছে ভিট্টোরিয়া তার হাতের গানটাকে। তাকে পাশ থেকে আশ্বাসের ভঙ্গিতে ধরল ল্যাঙডন। নিরবতা। আবার শব্দ এল। এবার শ্বাস আটকে ধরল ল্যাঙডন, আমাদের এখানে আসাটা মোটেও উচিৎ হয়নি! শব্দটা তাদের ভড়কে দিয়েছে। এবার তারা এগিয়ে এল। দেখা যাচ্ছে কী যেন। পিলারের দিকে।

ফিগলিও ডি পুট্টানা! পিছনে পড়ে যেতে যেতে বিড়বিড় করল ভিট্টোরিয়া। ল্যাঙডন তার সাথে এলিয়ে পড়ল।

সামনে ছিল একটা আধ খাওয়া স্যান্ডউইচ মুখে বিশাল বপু এক ইদুর। সেটা বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল তাদের দিকে। নির্নিমেষ। তাকিয়ে থাকল ভিট্টোরিয়ার হাতের গানটার দিকে। যেন ব্যারেল নিরীক্ষণ করছে। তারপর বিরক্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল সামনে।

সন অব এ… কোনমতে নিজেকে সামলে নিল ল্যাঙডন। মুখ ফসকে বেমক্কা গালিটা আর একটু হলেই বেরিয়ে যাচ্ছিল।

নিচু করল ভিট্টোরিয়া গানটাকে। ছন্দ ফিরে পেতে কয়েকটা মুহূর্ত নষ্ট করল। সামনে এক মহিলার আধ খাওয়া লাঞ্চবক্স দেখা যাচ্ছে। লিপস্টিক লেগে আছে সেটায়।

ভিট্টোরিয়ার দিকে রোষ কষায়িত নেত্রে তাকিয়ে ল্যাঙডন বলল, মরার লোকটা যদি এখানে থেকেই থাকে তাহলে তোমার কথা ঠিক ঠিক শুনতে পেয়েছে, তুমি কি শিওর এখনো ওলিভেট্টির জন্য অপেক্ষা করবে না?

সেকেন্ডারি লেফট অপস, যেন তার কোন কথাই শুনতে পায়নি ভিট্টোরিয়া, এমন সুরে বলল, কোথায় হতে পারে জায়গাটা?

অনেক চেষ্টা চরিত্র করে ল্যাঙডন বুঝে নিল কোথায় আছে চিগি চ্যাপেল। তারপর সেদিকে ফিরে সন্ত্রস্ত হয়ে দেখল, তাদের হিসাব ঠিকই আছে, এটা ভাল খবর। খারাপ খবর হল, তারা একেবারে প্রান্তে বসে আছে। যেতে হলে চিগির চ্যাপেলের মত আরো তিনটাকে পেরিয়ে যেতে হবে।

দাঁড়াও, বলল ল্যাঙডন, আমি আগে যাচ্ছি। ভুলে যাও। আমিই কিন্তু প্যান্থিয়নে আগে গিয়েছিলাম।

সাথে সাথে তার দিকে ঘুরে দাঁড়াল ভিট্টোরিয়া, পুরোপুরি মারমুখী, কিন্তু অস্ত্র আছে আমার কাছে।

তার চোখে আসলে অন্য কথা দেখতে পাচ্ছে ল্যাঙডন, … আমিই সে জন যার বাবা মারা গেছে। গণবিদ্ধংসী অস্ত্র তৈরির ইন্ধন যে যুগিয়েছিল সে জন আমিই। এই লোকটার উপর প্রতিশোধ নেয়ার অধিকার শুধু…

মেনে নিল ল্যাঙডন। এগিয়ে যেতে দিল তাকে। ভিট্টোরিয়ার পাশে পাশে এগিয়ে আসছে সে। যেন পাগলাটে, অন্য গ্রহের আতঙ্কে ভরা কোন খেলা খেলছে তারা।

ভিতরে ভিতরে গির্জাটা একেবারে নিশ্ৰুপ। বাইরের হট্টগোলের এক কণাও আসছে না পাথুরে দেয়াল ভেদ করে। একের পর এক চ্যাপেল পেরিয়ে যাবার সময় যেন মৃত অতৃপ্ত আত্মাগুলো তাদের দিকে মুখ ভেঙচে দিচ্ছে। প্রাস্টিকের আড়াল সরালেই যেন তাদের দেখা পাওয়া যাবে।

সময় যাচ্ছে বয়ে। ভেবে কূল পায় না ল্যাঙডন, এখন বাজে আটটা ছ। এতোক্ষণে খুনির নকশাও উবে যাবার কথা। হত্যাকারি কি যথেষ্ট সময় সচেতন? সে কি ভিট্টোরিয়া আর ল্যাঙডন সেখানে যাবার আগেই পাততাড়ি গুটাবে? সে এসেছে কিনা তাও এখন এক প্রশ্ন। যদি সে এসেই থাকে, যদি কাজ সারতে থাকে তাহলে ঈশ্বর তাদের রক্ষা করুন। সামনে কোন দৃশ্য দেখতে পাবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় ল্যাঙডন।

দ্বিতীয় এপস্টা পেরিয়ে এল তারা। আস্তে আস্তে আলো নিভে আসছে ভিতরে। বাইরের দরজা দিয়ে আলো আসছে না। আসছে জানালা দিয়ে। সেদিকে তাকিয়ে বেশ বলে দেয়া যায় সূর্য অস্ত নেয়ার পায়তাড়া কষছে খুব দ্রুত। তারা চলে যাবার সময় পাশে প্লাস্টিক একটু নড়ে উঠল। ঘরের বাতাসের চাপে তারতম্য হলে এমন হয়। এখন কোন ফ্যানও চলছে না। কোন দরজা খুললেই এমনটা হতে পারে।

সামনে এগিয়ে গিয়েই হাতের পিস্তল প্রস্তুত করল ভিট্টোরিয়া, এখানেই গ্রানাইটের গায়ে খোদিত হয়ে আছে দুটা শব্দঃ

চ্যাপেল চিগি

নড করল ল্যাঙডন অন্ধকারেই। একটা মোটা থামের পিছনে তারা দুজনই সামরিক কায়দায় অবস্থান নিল। তারপর ভিট্টোরিয়া ইশারা করল। সে বসে আছে পিস্তল তাক কর।

প্রার্থনা করার এইতো সময়! ভাবল ল্যাঙডন। তারপর অতি যত্নে সরাল প্লাস্টিকের আবরণ। একটু একটু করে। একটু সরল জিনিসটা তারপর একেবারে বিশ্রী আওয়াজ উঠল সেখান থেকে। কাঠ হয়ে গেল দুজনেই। সতর্কতা। নিরবতা। একটা মিনিট কেটে যাবার আগেই ভিট্টোরিয়া এগিয়ে এল একটু ক্রল করে। চোখ রাখল ফাঁকা দিয়ে। তার ঠিক পিছনেই আছে ল্যাঙডন। কাঁধের উপর দিয়ে তাকাচ্ছে।

শ্বাস চেপে রাখল তারা দুজনেই।

খালি! অবশেষে বলল ভিট্টোরিয়া, গানটা নিচু করতে করতে, আমরা বেশি দেরি করে ফেলেছি।

কথা শুনল না ল্যাঙডন। এখন সে অন্য কোন এক ভুবনে বিচরণ করছে। তার জীবনে কখনো এমন একটা চ্যাপেলের কথা চিন্তা করেনি। পুরোটাই চেস্টনাট মার্বেলে বাধাই করা। শ্বাসরোধ করে ফেলে চিগি চ্যাপেল। দেখে খুব সহজেই বলা চলে এটা। যথা সম্ভব আর্থি। দেখে মনে হয় গ্যালিলিও আর তার ইলুমিনেটি সযত্নে এ ডিজাইন করেছে।

মাথার উপরে, গম্বুজের ভিতরপৃষ্টে জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্রলোক, জ্যোতির্বিদ্যার সাত গ্রহ। নিচে রাশির বারো চিহ্ন। পাগান আর্থি প্রতীকগুলো আস্তে আস্তে এ্যাস্ট্রোনমিতে জায়গা করে নিয়েছে। রাশিও সরাসরি নির্দেশ করে মাটি, বাতাস, আগুন, পানি… আর্থ ইজ ফর পাওয়ার কথাটা মনে মনে আউড়ে নেয় ল্যাঙডন।

দেয়ালের অনেক নিচের দিকে দেখল পৃথিবীর চারটী কাল নিয়ে কথা–প্রিমাভেরা, এস্টাটে, অটান্নো, ইনভেরননা! দূরে আরো একটা জিনিস দেখে থমকে গেল ল্যাঙডন। বিড়বিড় করল, হতে পারে না! এ হতে পারে না! কিন্তু চোখের দেখাকে অবিশ্বাস করার বিন্দুমাত্র যো নেই। দূরে দেখা যাচ্ছে দুটা দশফুট উঁচু মার্বেলের পিরামিড! একেবারে নিখুঁত।

আমি কোন কার্ডিনালকে দেখতে পাচ্ছি না। বলল ফিসফিসিয়ে ভিট্টোরিয়া, কিম্বা কোন খুনিকে। সে সরাল প্লাস্টিকটা তারপর চলে গেল ভিতরে।

কিন্তু ল্যাঙডনের মন-মগজে ঢুকে গেছে পিরামিড, একটা খ্রিস্টানদের চ্যাপেলে মরার পিরামিড আছে কী করতে? আর অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সেখানে আরো বিস্ময় লুকিয়ে আছে। প্রতিটা পিরামিডের চূড়ায় বসিয়ে দেয়া আছে একটা করে স্বর্ণের মেডেলিয়ান… এমন জিনিস জীবনে খুব কমই দেখেছে ল্যাঙউন… একেবারে নিখুঁত গোলাকৃতি। বাইরে থেকে আলো আসায় চকচক করছে পালিশ করা সোনার চাকতি। গ্যালিলিওর নিখুঁত বৃত্ত? পিরামিড? তারকা খচিত ছাদ? এই ঘরটায় ইলুমিনেটির চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ল্যাঙডনের কল্পনার চেয়েও অনেক বেশি হারে।

রবার্ট, দেখ!

ভিট্টোরিয়ার কথা শুনে তাকল সে দেখানো দিকটায়। ব্লাডি হেল! চিৎকার করেই সে ঝাঁপ দিল একদিকে।

সামনে তেমনি একটা পিরামিডের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে তারকার প্রতীক, ঠিক যেমনটা তারা বাইরে দেখে এসেছে। আছে একটা খুলির চিহ্ন আর সবচে বড় কথা, মেঝে থেকে পিরামিড হয়ে ওঠা একটা অংশের উপরটায় নিখুঁত বৃত্ত আছে। সেটা দেখতে ম্যানহোলের মত।

ডেমনস হোল! খাবি খেতে খেতে বলল ল্যাঙডন। সাথে সাথে সে গর্তটার দিকে যাওয়া শুরু করল। ভিতর থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ উঠে আসছে।

মুখের উপর একটা হাত রাখল ভিট্টোরিয়া, চি পুৎজা।

ক্ষয় হতে থাকা হাড় থেকে বাষ্প উঠে আসছে। ব্যখ্যা করল ল্যাঙডন। এগিয়ে গেল সামনের দিকে। মুখে জামার হাতা চাপা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিল ভিতরে। কালিগোলা অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আমি।

তোমার কী মনে হয়? নিচে কেউ আছে?

জানার কোন উপায় নেই।

গর্তটার দূরপ্রান্তে ভিট্টোরিয়া নজর দিল। একটা পচতে থাকা পুরনো নড়বড়ে সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে। নেমে গেছে অতলে।

মাথা নাড়ল ল্যাঙডন, ঠিক নরকের মত।

হয়ত নিচে কোন ফ্লাশলাইট আছে। আমি একটু নজর বুলিয়ে নিতে চাই। বলল ভিট্টোরিয়া।

সাবধান! আমরা কিন্তু নিশ্চিত জানি না হ্যাসাসিন এখানে আছে কিনা।

তাই কিন্তু এরই মধ্যে হাপিস হয়ে গেছে ভিট্টোরিয়া।

কী কঠিন ব্রতের মেয়েরে বাবা! মনে মনে আউড়ে নিল ল্যাঙডন কথাটুকু।

গর্তের কাছাকাছি যেতেই সে গন্ধে মাথা ফাঁকা ফাঁকা অনুভব করল। বড় করে একটা শ্বাস নেয়ার পর সে উঁকি দিল, বলা ভাল মাথা ঢুকিয়ে দিল গর্তের ভিতরে। আস্তে আস্তে চোখ মানিয়ে নিতে শুরু করায় এবার ছায়ার মধ্যেই একটু একটু করে দেখতে পেল সে নানা অবয়ব। বোঝা যাচ্ছে গর্তটা একটা ছোট চেম্বারে গিয়ে উন্মুক্ত হয়েছে। ডেমনস হোল! আবার ভাবল সে। কে জানে, চিগিদের কত প্রজন্ম এখানে শায়িত আছে! চোখ বন্ধ করল ল্যাঙডন, তার চোখের তারাকে আরো তীক্ষ্ণ করার চেষ্টা করল যেন অন্ধকারেও দেখা যায়। আবার যখন সে চোখ খুলল, একটা বিচিত্র ব্যাপার দেখতে পেল। ভিতরে যেন একটা শরীর ভাসছে। আমি কি কোন মরদেহ দেখছি? ভেবে কূল পায় না ল্যাঙডন। আবার চোখ বন্ধ করল সে। আবার খুলল, যেন আলোর ক্ষীণতম রেখাও স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়।

ভিতরটাকে এবার একটু দেখা যাচ্ছে।

এমন সময় পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, দেখ!

সাথে সাথে সে উঠে বসার চেষ্টা করছে, কিন্তু ঘাড়ের দিকে টের পেল একটা শীতল স্পর্শ। জমে গেল সে সেখানেই।

তারপর বুঝতে পারল মানুষটা আর কেউ নয়, স্বয়ং ভিট্টোরিয়া।

কী করছ তুমি! রাগে গজগজ করছে ল্যাঙডন।

তোমার জন্য একটা আলোর উৎস খুঁজে এনেছি। বলল ভিট্টোরিয়া সমান তালে, ব্রো টর্চ।

ভিট্টোরিয়ার হাতের টর্চটার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে দম ফেলল ল্যাঙডন।

এরচে ভাল কিছু পাওয়া দুষ্কর। কলল ভিট্টোরিয়া, এটাকেই কষ্টে সৃষ্টে তুলে এনেছি। কোন ফ্লাশলাইট নেই।

ঘাড়ের দিকে হাত রেখে বলল ল্যাঙডন, আমি তোমার আসার আওয়াজ পাইনি! শব্দ করার কথা ছিল কি আমার?

টর্চটা তুলে নিয়ে সে এগিয়ে যেতে থাকে গর্তটার দিকে। ভিতরে আলো ফেলল সে। দেয়ালে। আলোর বন্যায় ভেসে গেল ভিতরটা। ছোট একটা ঘর। গোলাকৃতি। পাশে বিশ ফুট হবে কোনক্রমে। গভীরতা হবে ফুট ত্রিশেক। আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। মেঝে থেকে। মেঝেটা মাটির সোঁদা গন্ধ তাহলে কিছুটা মাটি থেকেও আসছিল।

তারপর ল্যাঙডন শরীরটা দেখতে পেল।

সাথে সাথে তার সহজাত ক্ষিপ্রতা জানিয়ে দিল কী দেখতে পাচ্ছে সে।

সে এখানে, বলল ল্যাঙডন, চেষ্টা করছে যেন তার দৃষ্টি ঘুরে না যায়। দেহটা পড়ে আছে মাটির উপরে। আমার মনে হয় তাকে উলঙ্গ করে খুন করা হয়েছে গলায় রশি দিয়ে।

কল্পনার চোখে সে দেখে নিল লিওনার্দো ভেট্রার মরদেহ।

কার্ডিনাল?

জানে না কী বলবে ল্যাঙডন। কিন্তু সে ভেবে পায় না আর কে হবে! সে তাকাল নিচে। স্থির একটা দেহের দিকে। অনড়। প্রাণহীন। আর এখনো ইতস্তত করছে ল্যাঙডন। দেহটা যেভাবে পড়ে আছে সেখানে একটা দেখার মত ব্যাপার আছে। মনে হচ্ছে যেন…

অবশেষে শব্দ করল ল্যাঙডন, হালো

তোমার কী মনে হয়। সে জীবিত?

নিচ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না।

নড়ছে না লোকটা, ভিট্টোরিয়াকে জানাল সে, কিন্তু তার পড়ে থাকার মধ্যে, না, অসম্ভব!

তার পড়ে থাকার মধ্যে কী? এবার ভিট্টোরিয়াও উঁকি দিল তার কাঁধের উপর দিয়ে।

ল্যাঙডন অন্ধকারে দেখল। দেখে মনে হচ্ছে তিনি উঠে দাঁড়াচ্ছেন।

শ্বাসরোধ করে ভিট্টোরিয়া তাকাল নিচের দিকে। তার চেহারায় বিহ্বল ভাব। এক মুহূর্ত পরে পিছিয়ে এল সে।

তোমার কথাই ঠিক। উঠে দাঁড়াচ্ছেন তিনি। হয়ত তার সহায়তা দরকার। আবার ভিতরের দিকে তাকাল মেয়েটা, বলল, হ্যালো?! মি পুয়ো সেন্টিরে?

ভিতর থেকে কোন প্রতিদ্ধনি উঠে এল না। শুধুই নিরবতা।

আমি নিচে যাচ্ছি। বলল অবশেষে ভিট্টোরিয়া।

তার হাত জাপ্টে ধরল ল্যাঙডন, না, ঝুঁকি আছে। যাচ্ছি আমি।

এবার আর কোন বাদ-অনুবাদ করল না মেয়েটা।

৬৬.

চিনিতা ম্যাক্রি একেবারে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। ভায়া টোমাসেলিতে আলস্যে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে বিবিসির ভ্যানটা, সেটার প্যাসেঞ্জার সিটে গা এলিয়ে দিয়েছে সে। গুন্থার গ্লিক রোমের মানচিত্র খুটিয়ে দেখছে। যেন এই দুনিয়ায় নেই সে। তার এখন মহা ব্যস্ত কাটবে সময়। কারণ এবার লোকটা কিছু তথ্য সহ ফোন করেছে।

পিয়াজ্জা ডেল পোপোলো, গ্লিক অনুরোধ করল, এ জায়গার খোঁজই আমরা করছি। সেখানে একটা গির্জা আছে। আর ভিতরে আছে কবরস্থান। আর সেখানেই আছে একটা প্রমাণ।

প্রমাণ? শব্দ নিয়ে খেলা করতে বেশ ভাল লাগচে চিনি ম্যাক্রির, প্রমাণ আছে যে একজন কার্ডিনাল লাশ হয়ে গেছে?

এই কথাটাই সে বলেছিল।

তুমি যা শোন তাতেই কান দিয়ে বস, না? আশা করছে চিনিতা, যেমনটা সে প্রায়ই করে, যদি সে এখানে ইন-চার্জ থাকত! ভিডিওগ্রাফাররা, যাই হোক, ক্যামেরার সামনে থাকা রিপোর্টারের অধীনে থাকে। এটাই নিয়ম। তা হোক সে পাগল-ছাগল। এই এখন যদি গুন্থর গ্লিক ঠিক করে যে সে যাবে ফোন কলটার সত্যতা খতিয়ে দেখতে, চিনিতা আর বেল্টে বাঁধা একটা কুকুরের মধ্যে কোন ফারাক থাকবে না।

সে আবার তাকাল গ্লিকের দিকে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে বসেছে। লোকটার বাবা মা নিশ্চই ভাঁড়, না হলে এ লোকের এমন একটা নাম দেয়! গুন্থার গ্লিক! তার প্রাণান্ত চেষ্টার কথা বাদ দিলে, উঠে আসার জন্য বিচিত্র কসরতের কথাকে গোণায় না ধরলে, ওছার গ্লিক একেবারে ভাল একজন মানুষ…

আমাদের কি সেন্ট পিটার্সে ফিরে যাওয়া উচিৎ নয়? যথা সম্ভব কোমল সুরে বলল মাক্রি, আমরা এই রহস্যময় চার্চের ব্যাপার পরেও খতিয়ে দেখতে পারি। আরো ঘণ্টাখানেক আগেই কনক্লেভ শুরু হয়ে গেছে। আমরা ফিরে আসার আগে কার্ডিনালরা যদি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায় তাহলে ব্যাপারটাকে কি ভাল দেখাবে? নাকি আম আর ছালা দুটাই হারিয়ে আমাদের দেউলিয়া হতে হবে?

গ্লিক তার কথাকে খোড়াই পরোয়া করে। সোজা সে এগিয়ে নিয়ে গেল গাড়িকে। ম্যাপের দিকে তার নজর। বিড়বিড় করল, আমার মনে হয় এবার ডানে যাওয়া দরকার। ঠিক তাই। ডানে। তার পরের বামের মোড়টাতেই জায়গামত হাজির হব। সামনের চিকণ গলি দিয়েও সে একই গতিতে চালানো শুরু করল ভ্যানটাকে।

দেখ! বলল ম্যাক্রি। সে একজন ভিডিও টেকনিশিয়ান। তার মত তীক্ষ্ণ চোখ আর কার আছে। কপাল ভাল, গ্লিকও বেশ করিৎকর্মা। সাথে সাথে চেপে ধরল সে ব্রেক। আর সেই ফাকে চারটা একই রকমের আলফা রোমিও সই করে বেরিয়ে গেল। তারপর সেগুলো থামল একটা ব্লক পরে। যেখানে থামার কথা গ্লিকের।

পাগল নাকি! চিৎকার করে উঠল ম্যাক্রি।

ব্যাপারটাকে লক্ষ্য করেছ?

হ্যাঁ। লক্ষ্য করেছি। আর একটু হলেই আমাদের তারা যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল।

না। আমি বলতে চাচ্ছি, গাড়িগুলো, সবগুলো গাড়ি একই রকম।

তার মানে তারা বদ্ধ উন্মাদ, কোন বোধ-বুদ্ধি তাদের নেই।

গাড়িগুলো লোকে ঠাসা।

তো কী এসে যায়?

চারটা গাড়ি। প্রতিটায় চারজন করে যাত্রি?

তুমি কি কখনো কারপুলিংয়ের কথা শুনেছ?

ইতালিতে? কড়া করেই জবাব দিল গ্লিক, তাদের এখানে এমন কিছু করার কথা নয়।

এ্যাক্সিলারেটরে পা দাবিয়ে দিল সে। সোজা আরো এগিয়ে গেল সামনে।

নিজের সিটে সেঁধিয়ে গেল ম্যাক্রি, কী করছ তুমি?

আমার হঠাৎ করে মনে হচ্ছে আজ, এ সময়টায়, আমি আর তুমিই শুধু গির্জার দর্শনার্থী নই। তার নজর গিয়ে রয়েছে আলফা রোমিওগুলোর দিকে।

৬৭.

নেমে আসাটা ধীর হল।

একের পর এক ধাপ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে নেমে এল ল্যাঙডন… চিগি চ্যাপেলের মেঝের নিচে, আরো আরো নিচে। ডেমনস হোলের ভিতরে… ভাবল সে। তার সামনের দিকটা দেয়ালের দিকে পিছনটা চেম্বারের দিকে। আঁধারে হাতড়ে হাতড়ে নেমে যেতে যেতে সে মনে মনে প্রমাদ গুণল। এই একদিনে আর কত ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হবে আল্লা মালুম। প্রতি পদে আরো একটু একটু করে আলগা হয়ে। যাচ্ছে সিড়িটা। যে কোন মুহূর্তে সে প্রপাত ভূতল হতে পারে।

গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত নাকে এসে হামলে পড়ছে পচা মাংসের উৎকট গন্ধ। কোন চুলায় বসে আছে ওলিভেট্টি কে জানে!

উপরে ভিট্টোরিয়ার অবয়ব এখনো দেখা যাচ্ছে। ল্যাঙডনের পথটাকে আলোকিত করার জন্য সে ধরে রেখেছে ব্লো টর্চটা। যত নিচে নেমে যাচ্ছে সে ততই ফিকে হয়ে আসছে উপরের আলোর নীলচে রেখা। একমাত্র যে ব্যাপারটা শক্তিমান হয়ে উঠছে ক্রমাগত তা হল-আশঙ্কা।

বারো ধাপ পেরিয়ে যাবার পর ঘটনা ঘটল। ল্যাঙডনের পা-টা এগিয়ে এল একটা ধাপের দিকে, যেখান থেকে পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে ধাপগুলো। তার উপর গিয়েছে ক্ষয়ে। কোনমতে তাল সামলে নিল সে। তারপর মনে মনে একটা গালি কষে নিয়ে আবার নামা শুরু করল। এবার আরো সন্তপর্ণে, আরো সযত্নে।

তিন ধাপ নামার পর আবারো আর একটু হলেই পড়ে যেতে বসেছিল সে। এবার ধাপের কোন দোষ নেই। দোষ ভয়ের। সে নেমেই দেখতে পেল খুলির একটা সংগ্রহের সামনে সে নেমে আসছে একটু একটু করে। সে দেখতে পায় ভিতরটা বিচিত্র হয়ে উঠেছে। চারধারে কঙ্কালের ছড়াছড়ি, আছে অনেক অনেক কফিনও। আধো আলো ছায়াতে, এটা আরো বেশি ভৌতিক হয়ে উঠল।

চোখের সামনে খালি অক্ষিকোটর মুখব্যাদান করে আছে। কী অবাক ব্যাপার। মাসখানেক আগেও সে এমনি এক সন্ধ্যায় কঙ্কালের সামনে মৃদু আলোয় বসেছিল। সেবার অবশ্য ইলেক্ট্রিক লাইট ছিল না। ছিল মোমের বাতি। আর ছিল দাওয়াত। নিউ ইয়র্কের একটা আর্কিওলজিক্যাল জাদুঘরের নিমন্ত্রণে সে যোগ দিয়েছিল ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে। তাদের পাশে ছিল আদ্যিকালের ডায়নোসরের কঙ্কাল। রেবেকা স্ট্রসও ছিল সেখানে এক কালের ফ্যাশন মডেল, এখন টাইমসের আর্ট ক্রিটিক। রেবেকা স্ট্রসের চুলের ঢল এখনো কালো, এখনো একটু আধটু ঝিলিক দেয় তার সৌন্দর্য, এখনো তার স্তনের সৌন্দর্য বিহ্বল করে দেয় যে কাউকে। কাবু করে দেয়। কিন্তু সেদিন ল্যাঙডন নিশ্চিত ছিল। পাত্তা দিবে না। করেছিলও ঠিক তাই। দুবার ডাকে তাকে মহিলা। একবারও উত্তর দেয়নি সে, নিতান্তই অভদ্রলোকের মত। তার মনে একটা কথাই বারবার ঘোরাঘুরি করছিল, রেবেকা স্ট্রসের মত মহিলা আর কতকাল টিকে থাকবে!

নামতে নামতে আরো আতঙ্কিত হয়ে উঠছিল সে। ভেবে কূল পাচ্ছিল না কী করবে। এখন যদি একবার পা ফসকে যায় তাহলেই চিৎপটাং। না, শেষ বেলায় কুপোকাত হওয়া চলবে না। তার মনে সাহস রাখতে হবে। দেয়াল তো আর ভেঙে পড়ছে না তার উপর। কিন্তু একই সাথে জুতার তলাটাও পিচ্ছিল হয়ে আসছিল আস্তে ধীরে।

বোটকা গন্ধটা আরো জাঁকিয়ে বসতেই সে আরো শক্ত করে আকড়ে ধরে তার জামার হাতা, নাকের উপর। নিচের দিকে তাকাল সে। মাংসের একটা শুভ্র তাল যে। পড়ে আছে। অচল। অন্যদিকে ফেরানো।

তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায়, লোকটা উঠার চেষ্টা করছিল।

হ্যালো? শব্দ করেই এগিয়ে যেতে থাকে ল্যাঙডন লোকটার আরো কাছে। দেখল সে, লোকটাকে অত্যন্ত খর্বাকৃতি দেখাচ্ছে। একটু বেশিই খাটো লাগছে মনে হয়…

হচ্ছেটা কী? উপর থেকে চিল্কার করল ভিট্টোরিয়া, আলো আরো একটু তুলে নিল সে।

জবাব দিল না ল্যাঙডন। সবটা দেখার মত কাছে চলে গেছে সে। তারপর হঠাৎ করেই একটা ধাক্কা খেয়ে সে ব্যাপারটা বুঝে ফেলল। চেম্বারটা যেন তার চারপাশে শ্বাসরোধ করার জন্য এগিয়ে আসছে। মাটির মেঝে থেকে এগিয়ে আসা একটা দুষ্ট আত্মার মত মানুষটা আসলে একজন বৃদ্ধ… না হলেও অন্তত তার অর্ধেক।

মাটিতে তাকে অর্ধেকটা পুঁতে দেয়া হয়েছে।

কার্ডিনালের লাল শাস দিয়ে তাকে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে। গায়ে কোন পোশাক নেই। উপরের দিকে ফিরে লোকটা পিছন ফিরে আছে। যেন কোন পাঞ্চিং ব্যাগ। লোকটার চোখদুটা এখনো ভোলা। ঠিক উপরে, আকাশের দিকে তোলা। যেন ঈশ্বরের কাছে অনুযোগ করছে অন্তরের অন্তস্থল থেকে।

তিনি কি মৃত? উপর থেকে জিজ্ঞেস করল ভিট্টোরিয়া।

শরীরটার দিকে এগিয়ে গেল ল্যাঙডন। আশা করি মারা যাবার সৌভাগ্য হয়েছে তার… এগিয়ে গেল সে। তাকাল লোকটার উপর দিকে তাক করে রাখা চোখের দিকে। এগিয়ে গেল সে এবং আরো একটা ধাক্কা খেল।

না! খোদার কসম! না!

কী?

কোনমতে নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করছে ল্যাঙডন। তিনি মারা গেছেন। আরো আগে। আমি তার মারা যাবার কারণটা দেখছি। সে দেখল, লোকটার মুখ ভর্তি হয়ে আছে মাটিতে।

কেউ একজন তার গলা বেয়ে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে মাটি।

মাটি? ভিট্টোরিয়া সাথে সাথে তাকাল আরো নিচে, তার মানে… আর্থ?

আরো একটা ধাক্কা লাগল ল্যাঙডনের বুকে। আর্থ! সে প্রায় ভুলে বসেছিল, চিহ্ন চতুষ্টয়! আর্থ, এয়ার, ফায়ার, ওয়াটার। খুনিটা সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেছে, প্রত্যেক কার্ডিনালকে প্রাচীণ বিজ্ঞানের চার মৌলিক পদার্থে হত্যা করবে।

প্রথম বিষয় ছিল আর্থ। ফ্রম শান্তিস আর্থি টম্ব।

চারপাশে ঘুরে বেড়াতে লাগল সে। আর সেই সাথে তার ভিতরের সিম্বলজিস্ট জেগে উঠল আরো। আর্থ! এটার এ্যাম্বিগ্রাম কীরকম হবে? কেমন হবার কথা? এর কোন এ্যাম্বিগ্রাম কি বানানো সম্ভব?

আর মুহূর্তকাল পরেই সে সেটাকে দেখতে পেল।

ইলুমিনেটির কাহিনীর শতাব্দি-পুরনো ব্যাপারগুলো একে একে আসতে শুরু করল তার মনে। কার্ডিনালের বুকের চামড়া পুড়ে গেছে। সেখানে খোদিত হয়ে আছে একটা লেখা। দ্য লিঙ্গুয়া পিউরা…।

চারপাশের ঘর ঘুরতে শুরু করার সাথে সাথে ল্যাঙডন চোখ মেলে তাকাল এম্বিগ্রামটার দিকে।

আর্থ!

আর্থ! ফিসফিস করল সে, আর্থ! যেন এ কথাটার কোন মানে জানে না রবার্ট ল্যাওডম।

এবং সাথে সাথে আরো একটা ব্যাপার তার মাথা ঘুরিয়ে দিল, আরো তিনটা চিহ্ন বাকি আছে।

চিহ্ন চতুষ্টয়!

৬৮.

সিস্টিন চ্যাপেলের নরম মোমের আলোয় কার্ডিনাল মাটি ঘেমে নেয়ে একসা হচ্ছেন। অফিসিয়ালি কনক্লেভ শুরু হয়ে গেছে। আর এই শুরুটার মত বিচিত্র আর কোন ব্যাপার নেই।

আধঘণ্টা আগে, সময়মত, ক্যামারলেনগো কার্লো ভেন্ট্রেস্কা চ্যাপেলে ঢুকেছিল। সামনে এগিয়ে গিয়ে সে সরাসরি ওপেনিং প্রেয়ার শুরু করে। সিস্টিনে আর কখনো এমন নিষ্ঠুর কথা শোনেননি প্রায় অশীতিপর কার্ডিনাল মাটি।

আপনারা ভালভাবেই জানেন, বলেছিল ক্যামারলেনগো, যে আমাদের চারজন প্রেফারিতি এখন কনক্লেভে হাজির নন। আমি, বিগত হিজ হোলিনেসের দিব্যি দিয়ে আপনাদের অনুরোধ করছি… আপনারা শুরু করে দিন কাজ, যা হবার কথা। আশা করি আপনাদের চোখের সামনে শুধু ঈশ্বর থাকবেন। তারপর সে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।

কিন্তু, সাথে সাথে একজন কার্ডিনাল বলল, কোথায় তারা?

থামল ক্যামারলেনগো, সত্যি সত্যি এ কথার জবাব আমার কাছে নেই।

ফিরে আসবেন কখন?

সত্যি সত্যি এ কথার জবাব আমার কাছে নেই।

তারা ঠিক আছেন তো?

সত্যি সত্যি এ কথার জবাব আমার কাছে নেই।

তারা কি ফিরবেন?

একটা লম্বা বিরতি নিল ক্যামারলেনগো।

বিশ্বাস রাখুন। বলল সে।

তারপর চলে গেল কামরা ছেড়ে।

নিয়ম অনুযায়ী সিস্টিন চ্যাপেলের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে বাইরে থেকে, দুটা ভারি চেইন সহ। পিছনের হলওয়েতে চোখ রাখছে চারজন সুইস গার্ড। মাটি জানে, এখন আর সেই দরজা দুটা ভোলা যাবে না। খোলা যাবে শুধু একজন পোপকে নির্বাচিত করলে, কোন কার্ডিনাল মরণাপন্ন হলে অথবা প্রেফারিতিদের কেউ ফিরে এলে।

শেষের ব্যাপারটাই যেন সত্যি হয় সে আশায় মনে মনে প্রার্থনা করলেন মাটি। কিন্তু তার পেটের ভিতরে যে অনুভূতি গুলিয়ে উঠছে সেটার সাথে আর কিছুর তুলনা নেই। এরই নাম অস্বস্তি।

চালাব, যেমনটা করা উচিৎ আমাদের, ভাবলেন মাটি। আর কী করতে পারি? ক্যামারলেনগো চলে যাবার সাথে সাথে ভাবা শুরু করলেন তিনি।

আরো মিনিট ত্রিশেক চলে গেল এসব নিয়ে অন্যান্য প্রস্তুতিমূলক কাজ করতে করতে। প্রত্যেক কার্ডিনাল এগিয়ে এসে একে একে ব্যাটিংয়ের কাজ সম্পন্ন করতে শুরু করলেন।

অবশেষে শেষ কার্ডিনাল এগিয়ে এলেন। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন।

আমি বলি আমার দেখা থেকে যে, তার সামনে বলা শুরু করলেন আগন্তুক কার্ডিনাল, ক্রাইস্ট দ্য লর্ড, যিনি আমার বিচারক হবেন, তার কথায় আমি বলি এমন। একজনের জন্য আমার ভোট যাবে যিনি প্রভুর সামনে নতজানু, এবং যোগ্য।

উঠে দাঁড়ালেন তিনি, তারপর ব্যালটটাকে মাথার উপরে তুলে ধরলেন যেন সবাই দেখতে পায়। সেখানে একটা প্লেট সাজানো আছে। সেটার উপর তিনি রেখে দিলেন কাগজটা। তারপর সেটাকে তুলে ধরলেন তিনি, নিচের পাত্রে ফেলে দিলেন কাগজটা। প্লেটটায় রাখতে হয় যেন কেউ একাধিক ব্যালট ফেলে না দেয় গোপনে, সেটা নিশ্চিত করার জন্য।

তিনি তার ব্যালট হাজির করার পর, আবার বসিয়ে দিলেন প্লেটটাকে পাত্রের উপর। ক্রসের সামনে নিচু হয়ে একটু সম্মান প্রদর্শন করে ফিরে গেলেন নিজের আসনে।

শেষ ব্যালটও বসিয়ে দেয়া হয়েছে।

এবার মাটির কাজে যাবার পালা।

উপরের প্লেটটাকে সরিয়ে নিয়ে তিনি দু ইঞ্চি পুরু হয়ে পড়া ব্যালট পড়ে শোনানো শুরু করলেন।

এলিগো ইন সুম্মুন পন্টিফিসেম… ঘোষণা দিলেন তিনি, প্রতিটা ব্যালটের উপরে যে লেখাটা আছে সেটা পড়তে শুরু করলেন, সুপ্রিম পন্টিফ হিসাবে আমি নির্বাচিত করছি… তারপর তিনি ঘোষণা করলেন বিবেচিত প্রার্থির নাম। এলিগো লেখাটার উপর একটা সুই চালিয়ে ছিদ্র করলেন। তারপর একটা লগবুকে সেটা টুকে রাখলেন।

একই কাজ করলেন আবারো। উঠে দাঁড়ালেন। ব্যালট তুললেন একটা। জোরে সেটার নির্বাচিত প্রার্থির নাম বললেন। তারপর সেটাকে ছিদ্র করে অন্য পাশে সরিয়ে রাখলেন। টুকে রাখলেন লগবুকে। বুঝতে পারলেন প্রথম থেকেই, একটা হট্টগোল লেগে যাচ্ছে সামনে।

দ্বিতীয় ব্যালট পর্যন্ত যাবার সময়েই বুঝলেন তার ব্যালটও বৃথা যাবে।

পর পর সাতটা ব্যালটে উঠে আসল সাতজন কার্ডিনালের নাম।

এখানকার লেখাগুলো দেখে সহজেই বোঝা যায় কে কাকে ভোট করছে। একটা বিশৃঙ্খলা লেগে গেছে কনক্লেভে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বোঝা যাচ্ছে চার প্রেফারিতি না থাকায় এবং তাদের কোন বিকল্পের কথা কেউ ভেবে না রাখায় একটা চরম অনিয়ম মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সঠিক যোগ্য লোকের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত না হওয়াতে সবাই ইচ্ছামত নিজেকে বা নিজের পছন্দসই কাউকে ভোট দিয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু মাটি জানেন, এটা আসলে নিজেকে উঠিয়ে আনার চেষ্টা শুধু নয়, বরং কনক্লেভকে আরো দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা। এর মধ্যে যদি কোন কার্ডিনাল যথেষ্ট ভোট না পান তো আবার ভোটাভুটি শুরু হবে…

কার্ডিনালদের আসলে মিথ্যাই এ ভোটাভুটি,.. আসলে চলছে অপেক্ষা… প্রেফারিতিরা চলে আসেন।

যখন শেষ ভোর্টটা গণনা করা হল তখন মাটি ঘোষণা করলেন, ব্যর্থ!

তিনি সবগুলো ব্যালট একত্র করলেন। তারপর সেটাকে একটা মালার মত করে নিয়ে শুইয়ে দিলেন একটা প্লেটের উপর, রূপালি প্লেটটার উপর দিতে বললেন কিছু রাসায়নিক দ্রব্য, তারপর সেগুলো সহ সেটাকে তিনি একটা ফায়ার প্লেসের মত

জায়গায় স্থাপন করলেন। ধরিয়ে দিলেন আগুন।

রাসায়নিক পদার্থের কল্যাণে অনেক ধোঁয়া উঠল, কিন্তু সেটা ছড়াল না। কালো পাক দিয়ে উঠে গেল চিমনির দিকে।

সরু চিমনি বেয়ে প্রকাশ্যে, সবার কাছে ধোঁয়াটুকু একটা বার্তা বয়ে নিয়ে গেল।

একবার ভোট দেয়া শেষ হয়ে গেছে।

কোন পোপ নির্বাচিত হয়নি।

৬৯.

একটু কষ্ট করে উপরের দিকে চোখ ফেলল ল্যাঙডন। তার মাথা ঘুরছে, অপার্থিব মনে হচ্ছে চারপাশটাকে। কোনমতে উপরে চোখ তুলে তাকাল সে। তারপরও কাটছে না মন থেকে চিন্তাটা…

আর্থ…

আর্থ…

উপরে উঠতে উঠতে তার মাথায় আবার স্লিপ কেটে পড়ে যাবার ভয় কাজ করতে শুরু করল। উপরে উঠে আসার দু ধাপ আগেই তার পা আবার ফসকে গেল। কোনমতে সে ধরার চেষ্টা করল মইটাকে আকড়ে, পারল না। পড়ে যেতে শুরু করল হঠাৎ করে। বাড়িয়ে দিয়েছিল সে হাত, ভিট্টোরিয়ার দিকে। তাতেও কাজ হয়নি। হঠাৎ সে টের পেল সে এখন সাধারণ অবস্থায় নেই। পড়ে যাচ্ছে।

তারপর কী হল সে কথা মনে নেই তার।

অনেকক্ষণ পরে, দুজন সুইস গার্ড তাকে টেনে তুলল একটা কপিকলের উপর, সে টের পেল ডেমনস হোল থেকে বেরিয়ে আসছে তার মাথা। হাসফাস করছে সে বাতাসের জন্য। তাকে ঠান্ডা পাথুরে মেঝেতে নামিয়ে দিল গার্ডরা।

মুহূর্তখানেক ঠিক বুঝতে পারল না ল্যাঙডন কোথায় আছে সে। মাথার উপর দেখতে পাচ্ছে তারা… ঘুরতে থাকা গ্রহ। তার চোখের সামনে থেকে আস্তে আস্তে সরে গেল বিচিত্র দৃশ্যগুলো। লোকজন চিৎকার করছে। উঠে বসার চেষ্টা করল সে। একটা পিরামিডের মেঝেতে পড়ে আছে এবং একটা পরিচিত রাগি কণ্ঠ চিৎকার-চেচামেচি করছে, তারপরই একে একে সবগুলো ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে উঠল তার কাছে।

চিৎকার করে আকাশ মাথায় তুলছে ওলিভেট্টি, আগে কেন আপনারা এ ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি?

কথাগুলো বলা হচ্ছে ভিট্টোরিয়াকে উদ্দেশ্য করে। পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বোঝনোর চেষ্টা করছে মেয়েটা।

তার কথাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ওলিভেট্টি চেঁচিয়ে আদেশ-নির্দেশ দিতে শুরু করল তার লোকজনে, বডিটা এখান থেকে তুলে আন। সারা ইমারত তন্ন তন্ন করে খোঁজ!

উঠে বসার চেষ্টা করল ল্যাঙডন। সুইস গার্ডে গিজগিজ করছে চিগি চ্যাপেল। চ্যাপেলের প্রবেশপথে রাখা পলিথিন ছিড়ে ফেলা হয়েছে। তাজা বাতাস এসে ভরে দিচ্ছে তার বুক। এগিয়ে আসছে তার দিকে ভিট্টোরিয়া, তার চোখমুখে পরীর আভা।

ঠিক আছতো তুমি? জিজ্ঞেস করতে করতে কোমল হাতে তুলে নিল সে ল্যাঙডনের হাত দুটা। পরীক্ষা করল তার হাতের পালস রেট।

থ্যাঙ্কস! বলেই উঠে বসল ল্যাঙডন। ওলিভেট্টি পুরো পাগল হয়ে গেছে!

নড করল ভিট্টোরিয়া। তার পাগল হয়ে যাবার কারণ আছে। আমরা ভুল করেছিলাম।

আমরা মানে? আমি পাকিয়েছি ঝামেলাটা।

তাহলে নিজেকে ফিরে পাও। পরের বার ধরা চাই লোকটাকে।

পরের বার? ভেবে পাচ্ছে না এমন একটা নিষ্ঠুর কথা কী করে বলতে পারল ভিট্টোরিয়া! পরের বার বলে আর কিছু নেই। আমরা খেলায় আসল দানে হেরে বসে আছি!

হাতের ঘড়িটা পরীক্ষা করল ভিট্টোরিয়া। মিকি বলছে আমাদের হাতে আরো চল্লিশ মিনিট সময় আছে। তোমার মন-মস্তিষ্ক ঠিক করে নাও। পরের বার তাকে আমরা পাকড়াও করছি।

আমি তোমাকে বলেছি ভাল করেই, ভিট্টোরিয়া, আমরা সুযোগ হারিয়ে বসে আছি। পাথ অব ইলুমিনেশন- মাঝপথে থেমে গেল ল্যাঙডন।

নরম করে হাসল ভিট্টোরিয়া।

কষ্টেসৃষ্টে উঠে দাঁড়াল ল্যাঙডন। চোখ বোলাল চারদিকে। পিরামিড, নক্ষত্র, গ্রহ, অর্ধবৃত্ত… হঠাৎ পুরো ব্যাপারটা তার মাথায় চলে এল।

একটা ব্যাপার এবার তার মাথায় খেলা শুরু করেছে। কী নিখুঁতভাবেই না এই পাথ অব ইলুমিনেশন বের করা হয়েছে! ভুবনখ্যাত প্যান্থিয়নকে আড়াল করেও কী চমৎকার ভাবে ঠিক রাখা হয়েছে তাদের উদ্দেশ্য। এখানে আক্ষরিক অর্থেই ডেমনস হোল আছে, আছে মাটির সব ধরনের চিহ্ন। কোন ভুল-ভ্রান্তির বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। পারফেক্ট।

বড় পিরামিডটা ধরে নিজেকে সোজা করল ল্যাঙডন। ভিট্টোরিয়ার কথাই ঠিক। এটাই যদি বিজ্ঞানের প্রথম মাইল ফলক হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই পরের জায়গাটার ইশারা নিহিত আছে এখানে। এখনো একটা ক্ষীণ সুযোগ আছে, কথাটা ভাবতে না ভাবতেই একেবারে আড়মোড়া ভেঙে শিরদাঁড়া খাড়া করল ল্যাঙডন। সুযোগ এখনো আছে। আছেই। যদি পথটার রহস্য খানিকটা সরে যায় তাহলেই পরের স্টপেজে খুনিকে হাতেনাতে ধরে ফেলার একটা সুযোগ থেকে যাবে।

এগিয়ে এল ভিট্টোরিয়া, আমি বের করে ফেলেছি কে গোপন ইলুমিনেটি শিল্পী ছিল।

তুমি কী করেছ?

এখন আমাদের বের করতে হবে এখানে থাকা কোন নকশা থেকে—

এক মিনিট! তুমি জান ইলুমিনেটির শিল্পী কে?

হাসল ভিট্টোরিয়া, বার্নিনি। বলল সে, দ্য বার্নিনি।

সাথে সাথে বুঝতে পারল ল্যাঙডন। কোথাও কোন ভুল হয়ে গেছে মেয়েটার। বার্নিনি? অসম্ভব। জিয়ানলরেঞ্জো বার্নিনি সর্বকালের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ স্কাল্পটর। তার খ্যাতির উপরে আর একজনই আছেন। স্বয়ং মাইকেলেঞ্জেলো। সপ্তদশ শতকে আর সবার চেয়ে বেশি কাজ করেছেন বার্নিনি। আর তারা এমন একজনের পিছনে লেগেছে যার কোন হদিস ইতিহাসে নেই।

মাথা নাড়ল ভিট্টোরিয়া, তোমাকে দেখে খুব একটা খুশি বলে মনে হচ্ছে না।

বার্নিনি? অসম্ভব।

কেন? বার্নিনি ছিলেন গ্যালিলিওর সহচর। তিনি ছিলেন এক বিখ্যাত শিল্পী।

তিনি ছিলেন এক অতি বিখ্যাত মানুষ। এবং একজন ক্যাথলিক।

ঠিক তাই, বলল ভিট্টোরিয়া, ঠিক গ্যালিলিওর মত।

না। একমত নয় ল্যাঙডন, কোন দিক দিয়েই এক রকম নয় ব্যাপারটা। ভ্যাটিকানের দৃষ্টিতে গ্যালিলিও ছিলেন একজন বিদ্রোহী। অন্যদিকে চার্চের প্রিয়পাত্র ছিলেন বার্নিনি। ভ্যাটিকানের সার্বিক শিল্পের দায়িত্ব দিয়ে দেয়া হয়েছিল তার হাতে।

ভ্যাটিকান সিটির ভিতরে তিনি তার সারা জীবন কাটিয়েছেন।

এক চমৎকার কভার। ইলুমিনেটির গুপ্তচর। বিরক্ত বোধ করছে ল্যাঙডন, ইলুমিনেটির সদস্যরা তাদের শিল্পীকে কী নামে ডাকত জান? এল মায়েস্ট্রো ইগনোটো–দ্য আননোন মাস্টার।

ঠিক তাই। তাদের কাছে অচেনা। ম্যাসনদের গোপনীয়তার কথা একবার ভাব। একেবারে উপরের দিকে যিনি আছেন তিনিই শুধু পুরোটা জানবেন। আর কেউ নয়। বেশিরভাগ সদস্যের কাছে বার্নিনির পরিচয় গোপন রেখেছিলেন গ্যালিলিও। বার্নিনির নিজের নিরাপত্তার জন্যই। ফলে ভ্যাটিকান কখনোই সত্যিকারের তথ্যটা জানতে পারবে না।

এখনো সব এলোমেলো লাগছে ল্যাঙডনের। কিন্তু এটুকু সে বুঝতে পারছে, ভুল নেই মেয়েটার কথায়। যুক্তি আছে। গোপন ব্যাপারগুলোকে গুপ্ত রাখার কাজে সিদ্ধহস্ত ছিল ইলুমিনেটি। প্রত্যেকে উপরের জনের কাছে তথ্য দিত। আর কারো কাছে নয়। ফলে তাদের গোপনীয়তায় কোন ফাঁক ফোঁকড় থাকত না। পুরো ব্যাপারটা খুব কম। মানুষের কাছেই ফাঁস হয়েছিল।

আর বার্নিনির ইলুমিনেটির সাথে যোগাযোগের ব্যাপারটাই প্রমাণ করে যে তাদের দুটা পিরামিড বানাতে হয়েছিল। মৃদু একটা হাসি ঝুলে আছে ভিট্টোরিয়ার ঠোঁটে।

বড় আকারের পিরামিডে হাত রেখে উঠতে উঠতে কথাটুকুর গূঢ় তত্ত্ব বুঝতে পারছে ল্যাঙডন একটু একটু করে। বার্নিনি একজন ধর্মীয় শিল্পী। এই পিরামিড তার গড়ার কথা নয়।

ত্যাগ করল ভিট্টোরিয়া, তোমার পিছনের লেখাটাকে সে কথা খুলে বল।

সাথে সাথে পিছনে ফিরল ল্যাঙডন, দেখতে পেলঃ

চিগি চ্যাপেলের শিল্পকর্ম
যেখানে গতি ছিলেন রাফায়েল,
ভিতরের সব নকশার কারুকার জিয়ানলরেজো বার্নিনি

দুবার লেখাটা পড়ল ল্যাঙডন। এখনো সে কথাটা ঠিক হজম করতে পারছে না। এখনো তাকে তেমন বিশ্বাসী করে তুলতে পারেনি ব্যাপারটা। জিয়ানলরেঞ্জো বার্নিনি তার বিভিন্ন কাজের জন্য বিখ্যাত। কুমারী মেরি, এ্যাঞ্জেল, প্রফেট, পোপ… এসবই ছিল তার শিল্পকর্মের বিষয়। পিরামিড নিয়ে তিনি কী করছিলেন?

উপরের দিকে তাকিয়ে আরো বোবা হয়ে গেল ল্যাঙডন। দুটা পিরামিড। সেগুলোর উপরে ঝকঝকে মেডেল। এরচে বেশি অখ্রিস্ট কাজ আর কী হতে পারে! পিরামিড, সেগুলোর উপরে তারকা, আশপাশে রাশি। ভিতরের সব নকশার কারুকার জিয়ানলরেঞ্জো বার্নিনি। যদি কথা সত্যি হয়ে থাকে, ভাবল ল্যাঙডন, তাহলে ভিট্টোরিয়ার কোন দোষ নেই।

যদি বার্নিনি সত্যি সত্যি ইলুমিনেটির সেই চির অচেনা শিল্পী হয়ে থাকেন… এ চ্যাপেলের শিল্পকর্মে আর কোন পটুয়ার হাত পড়েনি! তথ্যগুলো এত বেশি দ্রুত এসে। ঝাপিয়ে পড়ল তার উপর যে ল্যাঙডন খেই খুঁজে পাচ্ছিল না।

বার্নিনি একজন ইলুমিনেটাস। বা

র্নিনি ডিজাইন করেছেন ইলুমিনেটি এ্যাম্বিগ্রামগুলো।

বার্নিনি তৈরি করেছেন পাথ অব ইলুমিনেশন।

রা ফুটছে না ল্যাঙডনের কন্ঠে। তাহলে এই ছোট্ট চিগি চ্যাপেলেই কি বসে আছে সেই চিহ্ন যেটা ধরে রোমের অন্য কোন প্রান্তে গিয়ে উপনীত হয়ে পাথ অব ইলুমিনেশনের নকশা পাওয়া যাবে। সামনেই পড়ে আছে অল্টার অব সায়েন্স?

বার্নিনি, বলল সে অবশেষে, আমি কখনোই কল্পনা করতে পারি না।

ভেবে বের কর, ভ্যাটিকানের একজন সম্রান্ত আকিয়ে ছাড়া আর কার কলিজায় এত শক্তি আছে যে রোম জুড়ে বিখ্যাত সব চ্যাপেলে পাথ অব ইলুমিনেশন তৈরি করতে পারবে? অচেনা কেউ? অসম্ভব।

কথাটাকে বিবেচনায় নিল ল্যাঙডন। পিরামিডগুলোর দিকে চোখ তুলে তাকাল সে। এর কোনটা সেই মাৰ্কার নয়তো? নাকি দুটাই?

পিরামিডগুলো দুটা ভিন্ন দিক নির্দেশ করছে, অবশেষে বলল ল্যাঙডন। তারা চিহ্নিত নয়। সুতরাং আমি বলতে পারব না কোনটায় সূত্র বসানো আছে…।

আমার মনে হয় না যে জিনিসের খোঁজে আমরা আতিপাতি করছি সেটা কোন পিরামিড।

কিন্তু এখানে এগুলোই একমাত্র স্কাল্পচার।

ওলিভেটির দিকে আঙুল তাক করে ভিট্টোরিয়া তাকে থামিয়ে দিল। সেখানে আরো কয়েকজন প্রহরী ভিড় করেছে ডেমনস হোলে।

ল্যাঙডন মেয়েটার হাত অনুসরণ করে তাকাল সামনে। কিছুই নেই। তারপর আস্তে আস্তে নজরে এল ব্যাপারগুলো। একটা সাদা মার্বেল। একটা হাত। একটা মুখাবয়ব। দুটা মানব-অবয়ব। ল্যাঙডনের শ্বাস থেমে গেল। সে পিরামিড আর ডেমনস হোল নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে আর কিছুর দিকে তার চোখই যাচ্ছিল না।

সোজা সে এগিয়ে গেল সামনে। সেখানে যে কী লুকিয়ে আছে এতক্ষণ তা খেয়াল করেনি। সাদা মার্বেলে খোদাই করা কারুকাজ। বাতাসে উড়ছে খোদাই করা মানুষগুলোর জামা। খাঁটি বার্নিনি-কাজ। ভ্যাটিকানের অঢেল সম্পদই পারে এমন বস্তু তৈরি করাতে। একেবারে কাছে আসার আগে সে কিছুই টের পেল না।

এরা কারা? প্রশ্ন করল ভিট্টোরিয়া, যেন সব সওয়ালের জবাব আছে ল্যাঙডনের কাছে।

বাক্যব্যয় করার কোন শক্তিই যেন নেই তার। অনেক কষ্টে বলল, হাবাক্কাক এ্যান্ড দি এ্যাঞ্জেল। একেবারে মিইয়ে পড়া কন্ঠে বলল সে। এই কাজটা এতোই বিখ্যাত যে কোন কোন আর্টের বইতেও জায়গা করে নিয়েছে। ভুলেই গিয়েছিল সে, এটা আছে এখানেই।

হাবাক্কাক?

ঠিক তাই। সেই প্রফেট যিনি পৃথিবী ধ্বংসের কথা বলেছিলেন।

অপ্রস্তুত লাগছে ভিট্টোরিয়ার, তোমার কী মনে হয়? এটাই সেই মার্কার?

এখনো স্থাণুর মত মাথা নাড়ল ল্যাঙডন। জীবনে আর কখনো কোন ব্যাপারে এত নিশ্চিত হয়নি সে। এটাই প্রথম ইলুমিনেটি মার্কার। কোন সন্দেহ নেই। যদিও ল্যাঙডন আশা করেছিল যে এটা দিয়ে কোন একটা দিক দেখানো হবে, তবু তা ঠিক উৎরে যাচ্ছে। এটা যে এত স্পষ্টভাবে দেখানো থাকবে সে কথা সে ভাবতেও পারেনি। প্রফেট আর এ্যাঞ্জেল, দুজনের হাতই দূরে এক দিক নির্দেশ করছে।

হঠাৎ টের পেল ল্যাঙডন, হাসছে সে, খুব বেশি কষ্টকর নয়, কী বল?

একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছে ভিট্টোরিয়া, তবু তার চোখ থেকে উবে যায়নি বিভ্রান্তি। আমি তাদের দিকনির্দেশ করতে দেখছি, কিন্তু তারা তো বিভ্রান্তিকর দিক নির্দেশ করছে। এ্যাঞ্জেল দেখাচ্ছে একদিক তো আরেকদিক দেখাচ্ছে প্রফেট।

মুখ ভেঙচে হাসল ল্যাঙডন। কথা সত্যি। যদিও দুজনেই দূরে দেখাচ্ছিল, তবু তাদের দিক একে অপরের সাথে মিলে যায় না। এরই মধ্যে সমস্যার সমাধান বের করে ফেলেছে ল্যাঙডন। হঠাৎ করে সে দৌড় শুরু করল দরজার দিকে।

কোথায় যাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল ভিট্টোরিয়া।

বিল্ডিংয়ের বাইরে। দরজার দিকে ছুটে যেতে যেতে বেশ ভারমুক্ত অনুভব করল ল্যাঙডন। আমি দেখতে চাই স্কাল্পচারটা কোনদিক নির্দেশ করছে!

থাম! কী করে তুমি জানলে কোন আঙুল ফলো করতে হবে?

কবিতা। শেষ লাইনটা।

লেট এ্যাঞ্জেল গাইড ইউ অন ইউর লফটি কোয়েস্ট? হতভম্বের মত ছেয়ে থাকল মেয়েটা।

৭০.

গুন্থার গ্লিক আর চিনিতা ম্যাক্রি বিবিসি ভ্যানটাকে পার্ক করিয়ে পিয়াজ্জা ডেল প্রোপোলোর দিকে এগিয়ে গেল। চার আলফা রোমিওর একটু পরেই তারা এসে হাজির হয়েছে। বিচিত্র ঘটনার পরম্পরা দেখতে তারা উদগ্রীব। চিনিতা এখনো জানে কী হচ্ছে এসব। শুধু একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত। ক্যামেরা রোল করাতে হবে।

আসার সাথে সাথে চিনি আর গ্লিক দেখতে পেল কম বয়েসি লোকজনের একটা সৈন্যদল বেরিয়ে এল আলফা রোমিও থেকে। চার্চের চারধারে। তাদের কেউ কেউ অস্ত্র বের করে ফেলেছে। একজন অপেক্ষাকৃত বেশি বয়েসি লোক কয়েকজনকে নিয়ে গটগট করে উঠে গেল ভিতরের দিকে। ম্যাক্রি কিছুই শুনতে পায়নি। শুধু একটা ব্যাপার দেখতে পেল। সবাই ঠিকঠাক করে নিচ্ছে তাদের সাইলেন্সর। তারপরই সোজা ঢুকে গেল ভিতরে।

চিনি ঠিক করল তারা দূরেই থাকবে, আর ছায়া থেকে ভিডিও করবে সবকিছু। হাজার হলেও, অস্ত্র হল অস্ত্র। আর তারা ভ্যানের ভিতর থেকে বেশ পরিষ্কার চিত্র পাচ্ছে। কোন আপত্তি জানায়নি গ্লিক। তারা এখন দেখতে পাচ্ছে ভিতর থেকে বাইরে, বাইরে থেকে ভিতরে লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গেছে। একদল আরেক দলের সাথে উচ্চস্বরে বাদানুবাদ করছে। একটা দল বাইরের দিকটা সার্চ করতে শুরু করল। বিবিসির ক্যামেরা অনুসরণ করল তাদের। তাদের সবাই যদিও বেসামরিক পোশাক পরে আছে তবু ঠিক ঠিক বলা যায় কায়-কারবারে তারা একেবারে মিলিটারি। কী মনে হয়, কারা ওরা? জানতে চাইল চিনিতা।

জানলে এতক্ষণে দোজখে থাকতাম। বলল সে, সমান তেজে, তোমার ক্যামেরা তাদের ধরতে পারছে তো?

প্রত্যেকটা ফ্রেম।

যেন সুযোগ পেল প্লিক, এখনো তুমি পোপ-ওয়াচে বেরিয়ে পড়তে চাইছ?

কী বলতে হবে তা ঠিক ঠিক জানে না চিনিতা। অনেকদিন ধরে সাংবাদিকতার সাথে যোগ-সাজস আছে তার। সে ভাল করেই জানে, আপাতত বেশ আগ্রহোদ্দীপক ঘটনার পিছনেও একেবারে নির্জলা নিরস কারণ থাকে।

এর কোন মানে নাও থাকতে পারে, বলল সে অবশেষে, এই লোকেরাও হয়ত তোমার মতই একটা উড়ো খবর পেয়েছে। হামলে পড়েছে সত্যতা উদ্ধারের কাজে। ফলস এ্যালার্ম হবার সম্ভাবনা কম নয়।

গ্লিক তার হাত খামচে ধরল। ঐদিকে তাকাও। ফোকাস কর! চার্চের দিক নির্দেশ করল সে।

সাথে সাথে ক্যামেরা ঘুরিয়ে ফেলল চিনিতা। সোজা তাক করল গির্জার প্রবেশপথের দিকে। হ্যালো দেয়ার! বলল সে। যেন স্বাগত জানাল সিঁড়ির লোকটাকে।

উটকো লোকটা কে?

ক্লোজ-আপ নিল চিনিতা। আগে তাকে দেখিনি। বলল সে, কিন্তু তাকে আবার দেখতে কোন আপত্তি নেই আমার।

রবার্ট ল্যাঙডন গির্জা থেকে গুলির মত ছিটকে বেরিয়ে এল। চলে এল পিয়াজ্জার মাঝামাঝি পর্যন্ত। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দক্ষিণ রোমের আশপাশে টপ করে ডুবে যেতে বসেছে সূর্য। আশপাশের ভবন থেকে ছায়া এসে গিলে নিচ্ছে স্কয়ারটাকে।

ওকে, বার্নিনি! বলল সে জোরে জোরে, কোথায় তোমার এ্যাঞ্জেল দিক নির্দেশ করছে?

ফিরে তাকাল সে গির্জাটার দিকে, যেটা থেকে এইমাত্র বেরিয়ে এসেছে সে। সে ভিতরের চিগি চ্যাপেলের কথা ভাবল। ভাবল সেটার ভিতরে থাকা এ্যাঞ্জেলের নির্দেশিত দিকের কথা। কোন প্রকার অস্বস্তি ছাড়াই সে ফিরে তাকাল পশ্চিমে। সূর্য নামছে পাটে। টিকটিক করে কেটে যাচ্ছে সেকেন্ডের কাঁটা।

দক্ষিণ-পশ্চিম, বলল সে, পরের মার্কারটা সেখানেই।

মনের বারোটা বাজিয়ে পাতার পর পাতা পড়ে যাওয়া ইতালিয় আর্টের বর্ণনা মনে মনে পড়ে নিচ্ছে। বার্নিনি এত বেশি কাজ করেছেন যে কোন স্পেশালিস্ট ছাড়া পুরো ব্যাপারটাকে মানিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। প্রথম কাজটা যেহেতু তার পরিচিত, আশা করছে সে, পরেরটাও পাওয়া যাবে স্মৃতি ঘটলেই। সেটাও বিখ্যাত কোন কাজ হবে।

আর্থ, এয়ার, ফায়ার, ওয়াটার… ভাবল সে। প্রথমটায় সে আর্থ পেয়েছে। হাবাক্কাক, সেই প্রফেট যিনি পৃথিবীর লয়ের কথা বলেছিলেন।

পরেরটা হল এয়ার। মাথাকে ঘামিয়ে বারোটা বাজাচ্ছে সে। বার্নিনির এমন কোন কাজ যেটায় এয়ার আছে… নিজেকে আরো ঝালিয়ে নিল সে। আরো সতেজ হল। আমি পাথ অব ইলুমিনেশনে আছি। আমাকে দেখাবে পথ, পাথ অব ইলুমিনেশন… এখনো এটা অক্ষ…।

দক্ষিণ-পশ্চিম রোমের দিকে তাকিয়ে কোন একটা টাওয়ারকে খুজছে সে যাতে মনে পড়ে যায় বিখ্যাত কোন শিল্পকর্মের কথা। মনে পড়ে যায় কোন প্রখ্যাত গির্জার। কথা। একটা ম্যাপ প্রয়োজন। এমন একটা ম্যাপ যেটা দিক দেখিয়ে দেবে। যেটা থেকে ঠিক ঠিক বোঝা যাবে দক্ষিণ-পশ্চিম রোমে কোন কোন প্রাচীণ চার্চ আছে। সেগুলোর নামের উপর একবার করে চোখ বুলিয়ে নিলেই আসল সমস্যাটার সমাধান। চলে আসবে। মনে পড়ে যাবে সেটার কথা।

এয়ার! সে চাপ দিল। বায়ু। বার্নিনি। স্কাল্পচার। এয়ার। ভাবো। ভেবে বের কর।

ঘুরে দাঁড়াল ল্যাঙডন। ফিরে চলল চ্যাপেলের ভিতরে। সেখানে প্রবেশমুখেই দেখা হয়ে গেল ওলিভেট্টি আর ভিট্টোরিয়ার সাথে।

দক্ষিণ-পশ্চিম। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সে, পরের গির্জাটা এখান থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে।

ওলিভেটির ফিসফিসানি আগের চেয়েও শীতল। এবার আপনি নিশ্চিত?

কামড়টা অনুভব করতে পারল না ল্যাঙডন। সে উত্তেজিত। আমাদের একটা ম্যাপ লাগবে। এমন এক মানচিত্র যেটায় পুরো রোমের প্রাচীণ চার্চগুলোর খতিয়ান দেয়া আছে।

একই ভঙ্গিতে তাকে খুটিয়ে দেখল। এখনো তার হাবভাবে কোন উত্তেজনা নেই।

হাতের ঘড়ি পরীক্ষা করে দেখল ল্যাওড়ন। আমাদের হাতে মাত্র আধঘণ্টা সময় আছে।

ওলিভেট্টি সোজা তাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল তার গাড়ির দিকে। গাড়িটা সোজা চ্যাপেলের সামনে পার্ক করা। মনে মনে আশা জাগল ল্যাঙডনের একটু। আশা করা যায় লোকটা ম্যাপ আনতে গেছে।

ভিট্টোরিয়া এখনো উদ্যমী, তার মানে এ্যাঞ্জেল দক্ষিণ-পশ্চিমে দিক নির্দেশ করছে? সেদিকে কোন কোন চার্চ আছে সে বিষয়ে কোন ধারণা নেই?

আমি মরার বিল্ডিং ভেদ করে দেখতে পাই না। সখেদে বলল ল্যাঙডন, আর আমি রোমের হাজারটা গির্জার ব্যাপারেও যে সব জানি সে কথা-থেমে গেল সে।

আরো তীক্ষ্ণ মনে হচ্ছে ভিট্টোরিয়াকে, কী?

পিয়াজ্জার দিকে আরেকবার দৃষ্টি ফেলল ল্যাঙডন। চার্চের সিঁড়িগুলো মাড়িয়ে আসায় এবার সে আরো একটু উঁচু হয়ে গেছে। আরো একটু বেশি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বাইরের দৃশ্যগুলো। এখনো সে খুব একটা বেশি কিছু দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু এ কথাটা নিশ্চিত, একটু নির্দেশনা পাচ্ছে এখান থেকে। সামনে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে লম্বা লম্বা ভবন। অনেকগুলোই গির্জাটার চেয়ে উঁচু। তারপরও সে ঠিক ঠিক বুঝে ফেলল কোনদিকে তার দৃষ্টি।

বিবিসি ভ্যানের ভিতরে, পিয়াজ্জার অপর প্রান্তে, বসে আছে গ্লিক আর চিনি। একেবারে আঠার মত লেগে আছে সিটের সাথে। আর তাদের শকুন দৃষ্টি আটকে আছে গির্জাটাকে ঘিরে গজিয়ে ওঠা বিচিত্র ঘটনার দিকে।

পাচ্ছ এগুলো? প্রশ্ন করল গুন্থার গ্লিক।

ম্যাক্রি তার নজর ধরে রেখেছে বাইরে থেকে ছাদের দিকে উঠতে থাকা লোকটার দিকে। স্পাইডার ম্যান-স্পাইডার ম্যান খেলার তুলনায় লোকটার সাজ-পোশাক একটু বেশি ভদ্র বলা চলে।

আর মিস স্পাইডিটা কে?

চিনিতা তাকাল নিচের অপরূপ মেয়েটার দিকে। আমি নিশ্চিত তুমি বের করার ব্যাপারে খুবই উৎসাহী।

কী মনে হয়? এডিটোরিয়ালকে কল করব?

এখনো না। আরো একটু খতিয়ে দেখতে দাও। এখনো ঝোলাতে আরো কিছু রতে হবে যদি জানাতে হয় যে কনক্লেভের সময়টা পার করছি আমরা এখানে বসে বসে এ্যাডভেঞ্চার দেখতে দেখতে।

তোমার কী মনে হয়? আসলেই কেউ ওই হদ্দ বুড়োদের একজনকে এখানে পটল তুলিয়ে দিয়েছে?

হাসল চিনি, তুমি নিশ্চিত দোজখে যাবে।

কিন্তু সাথে করে পুলিৎজার পুরস্কারটাও বগলদাবা করে নিয়ে যাব।

০৮. যত উপরে উঠছে ল্যাঙডন
৭১.

যত উপরে উঠছে ল্যাঙডন, ততই স্পষ্ট হচ্ছে বাইরের দৃশ্য। উপরে ওঠা তার থামছে না।

উপরের দিকে চলে যাবার পর সে আশার চেয়েও বেশি হারে হাঁপাচ্ছিল। শেষ ধাপে উঠে সে নিজেকে কোনমতে টেনে তুলল। তারপর ঝাড়ল গায়ে লাগা ধুলি ময়লা। এই উচ্চতা তাকে মোটেও ভীত করছে না। বরং ভালই লাগছে।

সামনের দৃশ্যের কোন তুলনা নেই। যেন কোন সাগরে আগুন লেগে গেছে। আগুন লেগে গেছে বাড়িগুলোর ছাদে ছাদে। শেষ বিকালের সূর্য কৃপণভাবে কীরণ পাঠাচ্ছে সাত পাহাড়ের শহরের উপর। জীবনে প্রথমবার সে দেখতে পেল দূষণমুক্ত, স্বর্গীয় সিটা ডি ডিওকে–দ্য সিটি অব গড।

এই ভবন সমুদ্রে ল্যাঙডন খুঁজে বের করার চেষ্টা করল ঘন্টি বাধা গির্জাগুলোকে। কিন্তু সে যতই দূরে… আরো দূরে দেখতে লাগল, ততই তার দৃষ্টি হতবিহ্বল হয়ে উঠল। চার্চের এত অভাব রোম শহরে! এখানে শত শত গির্জা আছে। ভাবছে সে। আর দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে দু-একটা থেকে পারে না। চাৰ্চটাকে এখনো দেখা যাবে, যদি সেটা এখনো দাঁড়িয়ে থেকে থাকে।

চোখকে একবিন্দু বিশ্রাম না দিয়ে সে আবার খতিয়ে দেখতে শুরু করল পুরনো দৃশ্যগুলো। সে জানে, অবশ্যই, সব চার্চের বাইরে যে দৃম্যমান মিনার থাকবে এমন কোন কথা নেই। বিশেষত ছোট স্যাঙচুয়ারিগুলোতে তা আশা করা যায় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, সপ্তদশ শতকে সাঁই সাঁই করে রোমের আকৃতি বড় হয়ে যায় কারণ

নিয়মানুযায়ী, গির্জার চেয়ে উঁচু করে কোন বাসা বানানো যেত না। কিন্তু অনেক আগেই সে কাল চলে গেছে। এখন যখন ল্যাঙডন তাকায় সেদিকে, দেখতে পায় অনেক অনেক এ্যাপার্টমেন্ট, হাই-রাইজ, টিভি টাওয়ার।

আরো একবার দূরতম প্রান্তে ল্যাঙডনের দৃষ্টি কিছু একটা খুঁজে ফিরল। দূরে দেখা যাচ্ছে মাইকেলেঞ্জেলোর কীর্তি। সেদিকেই কোথাও আছে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা, আছে ভ্যাটিকান সিটি। ভেবে সে কূল পায় না কী অবস্থায় আছে কনক্লেভের ভিতরের মানুষগুলো, পাওয়া গেছে কি এ্যান্টিম্যাটারের ক্যানিস্টারটা? যদ্দূর মনে হয়, পাওয়া যায়নি… যাবেও না।

তার মাথায় আবার চক্কর কাটতে শুরু করল কবিতাটা। মন্ত্রের মত আউড়ে গেল সে। একের পর এক লাইন। অতি সাবধানে। ফ্রম শান্তিস আর্থি টম্ব উইথ ডেমনস হোল। তারা শান্তির টম্ব খুঁজে পেয়েছে। ক্রস রোম দ্য মিস্টিক এলিমেন্টস আনফোল্ড। মিস্টিক এলিমেন্ট হল আর্থ, এয়ার, ফায়ার, ওয়াটার। দ্য পাথ অব লাইট ইজ লেইড, দ্য সেক্রেড টেস্ট। পাথ অব ইলুমিনেশন তৈরি হয়েছে বার্নিনির স্কাল্পচার থেকে। লেট এ্যাঞ্জেল গাইড ইউ অন ইউর লফটি কোয়েস্ট।

এই এ্যাঞ্জেল দিক নির্দেশ করছে ঠিকই।

দক্ষিণ-পশ্চিমে।

সামনের সিঁড়ির দিকে, বলল গ্লিক চড়া গলায়। কিছু একটা হচ্ছে সেখানে!

মূল এন্ট্রান্স থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ম্যাক্রি তাকাল সেদিকে। অবশ্যই, কিছু একটা হচ্ছে সেখানে। একদল মিলিটারি সদৃশ লোক একটা আলফা রোমিওকে এগিয়ে এনেছে একেবারে সিড়ির কাছে। খুলে ফেলেছে ট্রাঙ্ক।

একজন চোখ বুলাচ্ছে চারদিকে। প্রথমে ম্যাক্রির মনে হয়েছিল লোকটা তাকে দেখছে। তারপর দেখল, না, ঘুরে গেছে দৃষ্টি। আশপাশে কেউ নেই এ ভাবনাটা পাকা হবার পর সে একটা ওয়াকি-টকি বের করে কথা বলতে শুরু করল।

এমন সময় সত্যি সত্যি একটা সৈন্যদলকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। ঠিক যেভাবে আমেরিকান ফুটবল খেলায় প্লেয়াররা দেয়াল তৈরি করে এগিয়ে আসে সেভাবে। সিঁড়ির একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত।

একটা মানবপ্রাচীরের মত এগিয়ে আসছে তারা। তাদের পিছনে, একেবারে অদৃশ্য কিছু একটাকে তুলে আনছে চারজন সৈনিক। ভারি কিছু। ভেবে পাচ্ছে না গ্লিক কী হতে পারে ওটা।

পিছনে তাকাল সে, তারা কি গির্জা থেকে কিছু চুরি করছে?

জবাব দেয়ার ধাত নেই ম্যাক্রির। সে তার জুম ক্যামেরায় দৃশ্যগুলো ভালভাবেই দেখতে পাচ্ছে। তার মনে এখন অন্য চিন্তা। একটা ফাঁক-ফোঁকড়! একটা মাত্র ফ্রেম! তাতেই কেল্লা ফতে হয়ে যাবে। লোকজন একটা প্রাণীর মত এগিয়ে আসছে। অবিচ্ছিন্ন। কাম অন! লেগে আছে ম্যাক্রি, কিন্তু তাতে কিছুই-গিয়ে আসছে না। তারপর, অবশেষে, সৈন্যরা যখন কিছু একটা তোলার চেষ্টা করছে ট্রাঙ্কে, তখনি সুযোগটা মিলে গেল ম্যাক্রির।

অবশেষে, পাওয়া গেল ফ্রেম। আহ্লাদে আটখানা হয়ে যাবার মত সুযোগ। তারপও তেমনি পাথর পাথর ভাব ধরে বসে আছে ভিডিওগ্রাফার। একটা নয়, মোটামুটি খান দশেক ফ্রেম ঠিক ঠিক তুলে আনা গেছে।

এডিটোরিয়ালকে কল কর! অবশেষে বলল সে, আমরা একটা ডেডবডি পেয়ে গেছি।

অনেক দূরে, সার্নে, ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার এগিয়ে গেল লিওনার্দো ট্রোর স্টাডিতে। হুইল চেয়ারে ভর করে। দক্ষ হ্যাকারের মত সে দেখতে লাগল প্রতিটা ফাইল-পত্র। যা পাবার চেষ্টা করছে তা না মিলে যাওয়াতে সে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেল ট্রোর বেডরুমে। তার পাশের টেবিলটার উপরের ড্রয়ার তালা আটা। কিচেন থেকে একটা চাকু তুলে এনে সে সহজেই সেটার রহস্য উন্মোচন করল।

ভিতরে, কোহলার ঠিক সেটাই খুঁজে পেল যেটার জন্য তন্ন তন্ন করছিল লিওনার্দো ডেট্রার স্টাডি।

৭২.

ল্যাঙডন নেমে পড়েই ধুলাবালি ঝাড়ার কাজে লেগে পড়ল।

কপাল মন্দ? জিজ্ঞেস করল ভিট্টোরিয়া।

মাথা নাড়ল ল্যাঙডন।

তারা কার্ডিনালকে ট্র্যাঙ্কে পুরে দিয়েছে।

তারপর তাকাল সে ওলিভেটি আর তার সৈন্যদলের দিকে। তারা একটা ম্যাপ মাটিতে বিছিয়ে কাজে লেগে পড়েছে।

দক্ষিণ-পশ্চিমের খোঁজ করছে নাকি?

নড করল মেয়েটা। কোন চার্চ নেই। এখান থেকে সোজা সেদিকে গেলে তুমি ধাক্কা খাবে সেন্ট পিটার্সের সাথে।

গজগজ করল ল্যাঙডন। সে এগিয়ে গেল ওলিভেষ্টির দিকে। সৈন্যরা তাকে পথ ছেড়ে দিল।

তাকাল ওলিভেট্টি, চোখ তুলে, কিছু নেই। এটা দিয়ে সব চার্চ অবশ্য দেখা যায়। শুধু বড়গুলো। মোটামুটি পঞ্চাশটা।

আমরা কোথায়? জিজ্ঞেস করল ল্যাঙডন।

ওলিভেট্টি পিয়াজ্জা ডেল প্রোপোলোর দিকে আঙুল রেখে সোজা দক্ষিণ-পশ্চিমে দিক নির্দেশ করল। সেদিকে রোমের অনেকগুলো বড় বড় গির্জা আছে। কালো স্তম্ভ দিয়ে সেগুলোকে নির্দেশ করার হয়। কপাল মন্দ, রোমের বড় চার্চ বলতে রোমের

প্রাচীণ চার্চগুলোকেই বোঝানো হয়। সবই ষোলশো সালের দিকে বানানো।

আমার কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, বলল ওলিভেট্টি, আপনি কি দিকের ব্যাপারে নিশ্চিত?

ল্যাঙডন আবার মনে মনে দেখে নিল এ্যাঞ্জেলের নির্দেশিত দিকটার কথা। ইয়েস, স্যার। পজিটিভ।

শ্রাগ করল ওলিভেট্টি, তারপর এর উপর দিয়ে আরো একবার সোজা দাগ কেটে গেল। পথে পড়ল মার্গারিটা ব্রিজ, ভিয়া কোলা ডি রিয়েজো আর পাশ কাটিয়ে গেল পিয়াজ্জা ডেল রিসোর্জিমেন্টোকে। কিন্তু সোজা পথে তা কোন দিকেই আক্রমণ করল না।

কোনটার গায়েই লাগল না। শেষ পর্যন্ত তা গিয়ে ঠেকল সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে।

সেন্ট পিটার্সের দোষ কোথায়? বলল এক সাহসি সৈন্য, তার বা চোখের নিচে গভীর ক্ষত, এটাও একটা চার্চ।

মাথা নাড়ল সাথে সাথে ল্যাঙডন, না-না। একটা পাবলিক প্লেস হতে হবে। পিটার্স তেমন কোন সর্ব সাধারণের জন্য উন্মুক্ত জায়গা নয়।

কিন্তু সেটা সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের ভিতর দিয়েও গিয়েছে। সেটা পাবলিক প্লেস। বলল ভিট্টোরিয়া, এরই মধ্যে সে চলে এসেছে।

এরই মধ্যে ল্যাঙডন এটাকে বিবেচনায় এনেছে, কোন স্ট্যাচু নেই।

ঠিক মাঝখানে একটা মনোলিথ আছে না?

মেয়েটার কথা ঠিক। সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে একটা মিশরিয় একশিলাস্তম্ভ আছে। ল্যাঙডন সেটাকে দেখেছিল। মাথায় নানা চিন্তা এসে এসে বাতিল হয়ে যাচ্ছে।

না। ভ্যাটিকান মনোলিথটা বার্নিনির কীর্তি নয়। ক্যালিগুলা এটাকে এনেছিলেন। আর এর সাথে এয়ারের কোন সম্পর্ক নেই। আরো একটা কথা আছে। কবিতায় বলা হয়েছে নিশানাগুলো ছড়িয়ে আছে রোমে। ভ্যাটিকান সিটির কথা নেই সেখানে।

নির্ভর করছে আপনি কাকে জিজ্ঞেস করছেন তার উপর। নাক গলাল একজন গার্ড।

কী? চোখ তুলে তাকাল ল্যাঙডন।

সব সময়ই কাবাবের ভিতর হাড্ডি। বেশিরভাগ ম্যাপেই সেন্ট পিটার্স স্কয়ারকে ভ্যাটিকান সিটির ভিতরে দেখানো হয়। কিন্তু এখানে আরো একটা ব্যাপার আছে। বেশিরভাগ রোমান প্রশাসক মনে করে এটা যেহেতু ভ্যাটিকানের আর সব জায়গার মত দেয়াল ঘেরা নয়, তাই এটা রোমের অভ্যন্তরীণ এলাকা।

আপনি বাচ্চাদের মত কথা বলছেন। বলল ল্যাঙডন। এমন কথা সে কখনো শোনেনি।

আমি এটার কথা বলেছি একটামাত্র কারণে, তেতে উঠেছে গার্ড, কারণ মিস ভেট্রা আর কমান্ডার ওলিভেট্টি এয়ারের সাথে সম্পর্কের কথা বলছিলেন।

চোখ বড় বড় হয়ে গেল ল্যাঙডনের, আর আপনি জানেন সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে বায়ুর সাথে সম্পর্কযুক্ত কিছু আছে?

ঠিক তা নয়। এটা কোন স্কাল্পচার না। হয়ত এর সাথে আদৌ কোন সম্বন্ধ নেই। শোনা যাক তোমার কথা। চাপ দিল ওলিভেটি।

শ্রাগ করল গার্ড। আমি এ সম্পর্কে জানি তার একমাত্র কারণ আমি পিয়াজ্জায় ডিউটিতে থাকি প্রায়ই। সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের প্রতিটা কোণা আমার নখদর্পণে।

স্কাল্পচার, খোদিত শিল্প, বলছে যুক্তি দেখানোর ভঙ্গিতে ল্যাঙডন, দেখতে কেমন?

এখনো ভেবে কূল পায় না ল্যাঙডন, এত বড় সাহস কি হবে তাদের? ইলুমিনেটি কি সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ঠিক বাইরে তাদের দ্বিতীয় চিহ্ন রাখার সাহস পাবে!

এটার পাশ দিয়ে প্রতিদিন আমি ধর্ণা দেই। বলছে সোলজার, এটা একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত। ঠিক যেদিকে লাইনটা গেছে। এটাই আমাকে সে জিনিসটার কথা মনে করিয়ে দিল। যা বলেছিলাম, এটা আসলে কোন স্কাল্পচার নয়। বরং যেন কোন… ব্লক।

পাগলাটে দেখাচ্ছে ওলিভেট্টিকে, একটা ব্লক?

ইয়েস, স্যার। স্কয়ারে বসানো একটা মার্বেল ব্লক। মনোলিথের ভিত্তি স্বরূপ। কিন্তু ব্লকটা কোন চতুষ্কোণ নয়, বরং অর্ধচন্দ্রাকার। আর এটা নিচু হয়ে গেছে বায়ু প্রবাহের মত। বাতাস… আমার মনে হয়, যদি আপনারা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে চান।

অত্যাশ্চর্য চোখ নিয়ে তাকাল ল্যাঙডন সৈন্যটার দিকে। রিলিফ! বলল সে হঠাৎ করে।

সবাই তাকাল তার দিকে। রিলিফ, বলল ল্যাঙডন, স্কাল্পচারের অন্য পাশটা!

স্কাল্পচার ইজ দ্য আর্ট অব শেপিং ফিগার্স ইন দ্য রাউন্ড গ্র্যান্ড অলসো ইন রিলিফ। চকবোর্ডে এই সংজ্ঞা লিখে আসছে সে অনেক বছর ধরে। রিলিফ হল দ্বিমাত্রিক স্কাল্পচার। পেনিতে যেভাবে আব্রাহাম লিঙ্কনের প্রোফাইল দেয়া আছে, সেভাবে। বার্নিীনির চিগি চ্যাপেলের মেডেলগুলোও তেমনি উদাহরণ।

বাসোরেলিইভো? ইতালিয় শিল্প-কথা ব্যবহার করে গার্ড জানতে চাইল।

হু। বাস-রিলিফ! ল্যাঙডন আরো এগিয়ে গেল সামনে। আমি ঐ টার্মগুলো নিয়ে চিন্তা করছিলাম না। যে জিনিসটা নিয়ে আপনারা কথা বলছেন সেটার নাম আসলে ওয়েস্ট পোনেন্তে–দ্য ওয়েস্ট উইন্ড। এর আরো একটা নাম আছে। রেসপিরো ডি ডিও।

ব্রিথ অব গড?

ঠিক তাই। এয়ার! আর একটাকে সেখানে বসানো হয়েছে সত্যিকার আর্কিটেক্টের দ্বারা!

ল্যাঙডন দেখল, ভিট্টোরিয়ার চোখেমুখে অনিশ্চয়তা, আমি ভেবেছিলাম মাইকেলেঞ্জেলো সেন্ট পিটার্সের নির্মাতা।

তোমার কথায় ভুল নেই। ব্যাসিলিকা গড়েছেন তিনি। কিন্তু সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের ডিজাইনার ছিলেন বার্নিনি!

যখন আলফা রোমিওর গাড়ির বহর এগিয়ে যাচ্ছে মহা ব্যস্ততায়, তখন প্রত্যেকে এত উত্তেজিত আর চিন্তিত ছিল যে কেউ খেয়াল করেনি তাদের পিছনে পিছনে পাততাড়ি গোটাচ্ছে বিবিসি ভ্যান।

৭৩.

গুন্থার গ্লিক হন্তদন্ত হয়ে চালাচ্ছে তার পেটমোটা ভ্যানটাকে। দ্রুত যেতে থাকা আলফা রোমিওর সারিকে অনুসরণ করতে করতে গলদঘর্ম হচ্ছে সে। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র সে নয়। টাইবার নদীর তীর ধরে তারা ছুটছে তীরবেগে। পন্টা মার্গারিটা ধরে তারা পেরিয়ে গেল টাইবার।

সাধারণত গ্লিক অনুসরণ করার ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে চলে। ধরি মাছ ছুই পানি ধরনের দূরত্ব, যেন যাকে ফলো করা হচ্ছে সে ঠাহর না করতে পারে। কিন্তু আজকে তার ভিতরে সেসবের বালাই নেই। এই লোকগুলো উড়ালপঙ্কিতে চড়ে যাচ্ছে যেন!

লন্ডনের সাথে একটা ফোনকল শেষ করে পিছনের সিটে, নিজের কর্মক্ষেত্রে ম্যাক্রি আবার এ্যাকশনে নামার পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার সিরিয়াসনেস এতোক্ষণে উঠে এসেছে উপরে। ফিরে তাকাল সে গ্লিকের দিকে।

কোন খবরটা চাও? গুড নিউজ নাকি ব্যাড নিউজ?

ব্যাড নিউজ।

সম্পাদকীয় তেতে আছে, আমরা কাজ ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছি।

সারপ্রাইজ।

তারা আরো মনে করছে তোমার সংবাদদাতা একটা প্রতারক।

অবশ্যই।

আর বস এইমাত্র আমাকে বললেন যে তুমি হলে এমন এক লোক যাকে ক্ষণে ক্ষণে চা খেয়ে তরতাজা থাকতে হয় নাহলে একেবারে স্বপ্নে ডুবে থাক।

গ্রেট। আর সুসংবাদ?

তারা রাজি হয়েছে আমাদের এইমাত্র তোলা ফুটেজ দেখতে।

সাথে সাথে একটা আলাভোলা হাসি ছড়িয়ে পড়ল গ্লিকের সারা মুখ জুড়ে, এবার দেখা যাবে কোন ঘুমকাতুরে কুম্ভকর্ণের নিদ্রা তাড়ানোর জন্য চায়ের প্রয়োজন আছে, তাহলে? উড়িয়ে দাও তোমার চিঠি।

ট্রান্সমিট করতে পারব না যে পর্যন্ত না একটা স্থির জায়গায় বসছি।

ভিয়া কোলা ডি রিয়েঙ্গোতে উঠে এল গ্লিক, এখন থামা অসম্ভব। সে আবারও আলফা রোমিও গুলোর তেলেসমাতি দেখে হয়রান হয়ে যাচ্ছে। একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে সেগুলো ঢুকে পড়েছে পিয়াজ্জা রিসোর্জিমেন্টোতে।

ম্যাক্রি সোজাসাপ্টা তার কম্পিউটারের কাজে নেমে পড়ল। আমার ট্রান্সমিটারটা একবার ভেঙে ফেল… বলল সে, সখেদে, আর তারপর আমি ফুটেজটুকু লন্ডন পর্যন্ত পায়ে হেঁটে পৌঁছে দিয়ে আসব।

শক্ত হয়ে বস, আমার ভালবাসা, কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি।

ম্যাক্রি সত্যি সত্যি কাঠ কাঠ হয়ে বসে পড়েছে, কোথায়?

সামনে ভোজবাজির মত হাজির হওয়া বিশাল গম্বুজের দিকে তাকিয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত কেলিয়ে হাসল গ্লিক, প্রাণখোলা হাসি, যেখান থেকে আমাদের ভানুমতির খেল শুরু হয়েছিল সেখানেই।

সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে জড়ো হওয়া অনেক যন বাহনের মধ্যে মুহূর্তে জায়গা করে নিল আলফা রোমিও চারটা। তারা বিভক্ত হয়ে গিয়ে পিয়াজ্জার চারদিকে ঘিরে ফেলল। ঠান্ডা মাথায় সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসছে লোকজন। গার্ডরা সাথে সাথে সেখানে ভিড় করা ট্যুরিস্ট আর সাংবাদিকদের ভিতরে হারিয়ে গেল। কোন কোন গার্ড ঢুকে পড়ল পিলারের জঙ্গলের ভিতরে। সেখানেও মিশে গেল তারা মুহূর্তের মধ্যে। উইন্ড শিল্ডের ভিতরে বসে ল্যাঙডন দেখতে শুরু করল সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের কান্ড কারখানা।

নেমেই কাজে ঝাপিয়ে পড়েছে ওলিভেট্টি। আরো লোক আনার জন্য খবর পাঠিয়েছে ভিতরে। কয়েকজনকে পাঠিয়ে দিয়েছে সেই মনোলিথের গোড়ায়। ল্যাঙডন সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের ছড়ানো চত্বরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে যুদ্ধ করল। কী করে একজন ইলুমিনেটি এ্যাসাসিন এই দঙ্গলের মধ্যে ঢুকে একজন কার্ডিনালকে বেমক্কা মেরে ফেলে সদর্পে পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করে! কী করে সে লোকটাকে তুলে অনিবে এখানে, তারপর সর্বসমক্ষে হত্যা করবে?

মিকি মাউসকে চেক করে দেখল আরেকবার ল্যাঙডন। আটটা চুয়ান্ন। আর মাত্র ছ মিনিট।

এগিয়ে এল আবার গাড়ির দিকে ওলিভেট্টি, বলল ল্যাঙডন আর ভিট্টোরিয়াকে, আপনারা দুজনে এখন বার্নিনি ইটের বা ব্লকের বা কোন্ জাহান্নামের জায়গা সেটা… সেখানে হাজির থাকবেন। একই কাজ। আপনারা ট্যুরিস্ট। আর ফোন ব্যবহার করবেন বেখাপ্পা কিছু দেখামাত্র।

ল্যাঙডন কিছু বলার বা বোঝার আগেই দেখতে পেল ভিট্টোরিয়া তার হাত চেপে ধরে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।

সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার শেষ প্রান্তে আর একটু হলেই ডুবে যাবে শরতের সূর্য। পিয়াজ্জাকে আড়াল করে একটা বোবা করে দেয়া আকারের ছায়া এলিয়ে পড়ছে। ল্যাঙডন একটা হিম শীতলতা অনুভব করে যখন সে আর ভিট্টোরিয়া যাচ্ছে ঠান্ডা পথ ধরে। মানুষের সমুদ্রে ডুবে যেতে যেতে ল্যাঙডন বারবার চোখ বুলিয়ে যায় প্রত্যেক দর্শনার্থীর মুখে। এর মধ্যে খুনিটা নেই তো! ভিট্টোরিয়ার হাত খুব উষ্ণ লাগছে তার কাছে।

সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের খোলা এলাকা পেরিয়ে যেতে যেতে ল্যাঙডন টের পেল একটা বিশালত্বের অনুভূতি তার মনকে দখল করে রাখছে। কী অবাক ব্যাপার, বার্নিনি সারা জীবন ভ্যাটিকানে কাটিয়েও চারশো বছর ধরে একেবারে অপরিচিত রয়ে গেছেন। বাইরের দুনিয়ার কাছে, ইলুমিনেটির গোপন মাস্টার হিসাবে।

ওবেলিস্কের দিকে? একশিলাস্তম্ভাটার কাছে?

পিয়াজ্জার বামদিক ধরে যাবার সময় নড করল ল্যাঙডন।

সময়? জিজ্ঞেস করল ভিট্টোরিয়া। দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে, সতর্কভাবে।

পাঁচ।

কিছু বলল না ভিট্টোরিয়া। কিন্তু টের পেল ল্যাঙডন, হাতের উপর ঠিক ঠিক চেপে বসেছে মেয়েটার হাত, আরো শক্ত হয়ে। সে এখনো অস্ত্রটা বহন করছে।এখনো সে দুরু দুরু বুকে আশা করে ভিট্টোরিয়া জিনিসটাকে আবার ফেরৎ চাবে না। সে চায় না সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে, সর্বসমক্ষে ভিট্টোরিয়া গানটা ব্যবহার করে কোন খুনির হাঁটুর হাড়ি উড়িয়ে দিয়ে খবরের পাতায় চলে আসুক। আবার এ কথাটা মনে পড়লেও তার অস্থির লাগে। একজন কার্ডিনালকে এখানে ব্র্যান্ডেড অবস্থায় পাওয়া যাবার কথা।

এয়ার… ভাবছে ল্যাঙডন, বিজ্ঞানের দ্বিতীয় বস্তু… সে ব্র্যান্ডটার চিহ্ন বোঝার চেষ্টা করছে। কেমন হবে এ্যাম্বিগ্রামটা! কথা ভেবে এখনো কোন কূল কিনারা পাচ্ছে না সে। একটা বিশাল মরুভূমির উপরে বসানো গ্রানাইটের পাথরে যেন সে দাড়িয়ে আছে। চারধার ঘিরে আছে সুইস গার্ড। যদি হ্যাসাসিন ঠিক ঠিক চেষ্টাটা করে, তবু সে কীভাবে বেঁচেবর্তে যাবে তাই ভেবে পায় না সে।

পিয়াজ্জা গোলাপের একেবারে কেন্দ্রে কালিগুলার সাড়ে তিনশ টন ওজনের মিশ রিয় ওবেলিস্কটা দাঁড়িয়ে আছে এক ঠায়। এটা একাশি ফুট উপরে উঠে গেছে, সেখানে একটা ফাপা ধাতব ক্রস মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন বলছে, শির দেগা, নাহি দেগা আমামা। এটা এত উঁচুতে যে চারদিক আঁধারে ভরে গেলেও এটার মাথাকে ছুয়ে দিতে পারেনি বিকালের ছায়া।

চারদিকে ছায়া, তার মধ্যে একটু রোদের সামনে অপার্থিব মাহাত্মে ঝকঝক করছে সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের ধাতব ক্রস, যে ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে যিশু প্রাণপাত করেছিলেন সেটারই এক অনুকরণ।

চির উন্নত মম শির। একেবারে নিখুঁত দূরত্ব থেকে দুটা ঝর্ণা শোভিত করছে ওবেলিস্কটাকে। সাধারণের কাছে দেখে মনে হবে এটা দেখতে সুন্দর, ব্যস। কিন্তু এর মধ্যে আরো গুপ্ত রহস্য রয়েছে যেগুলোর কিছু কিছু জানে চিহ্নবিদরা, আর যতটা জানে ল্যাঙডন, বর্তমানে তারচে বেশি মনে হয় কোন বিশেষজ্ঞ জানে না।

পুরো রোম জুড়ে মিশরিয় চিহ্ন ছড়িয়ে আছে। পিরামিড, অর্ধচন্দ্র, অদ্ভুত জ্যামিতি… এর অর্থ পুরোটা জানতে পারবে না বিশেষজ্ঞরা যে পর্যন্ত না বার্নিনির পুরো রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে।

ওবেলিস্কের কাছাকাছি পৌঁছেই আরো ধীর হয়ে গেল ভিট্টোরিয়া। সে এমনভাবে থামল, যেন ল্যাঙডন অসুস্থ, তাকে একটু সুযোগ দিতে হবে আস্তে ধীরে একটু বিশ্রাম করার। সাথে সাথে বুঝে ফেলল ল্যাঙডন, সেও একটু কাশির মত শব্দ করে চোয়াল ঝুলিয়ে দিল। পৃথিবীর সবচে বড় গির্জার বাইরে কোথাও… ওবেলিস্কের আশপাশেই সেকেন্ড অল্টার অব সায়েন্স লুকিয়ে আছে–বার্নিনির ওয়েস্ট পনেন্টে–সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের একটা ডিম্বাকার ব্লক।

গুন্থার গ্লিক সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের চারপাশে ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের দিকে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে। একটু যেন উদাস। অন্য যে কোন দিনে, টুইড জ্যাকেট পরা বাবু সাজা লোকটা আর তার সাথের সুন্দর, খাকি শর্টস পরা মেয়েটা তার নজর মোটেও কাড়ত না।

দেখে মনে হচ্ছে তারা সুখি দম্পতি অথবা বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড, রোম চষে ফেলার কাজে বেরিয়েছে পর্যটক হয়ে। কিন্তু আজকের দিনের সাথে আর কোন দিনের সম্পর্ক স্থাপন করা চলে না। আজ অচেনা ফোনকলের দিন, মরদেহ বের করার দিন, বোম জুড়ে তান্ডব তোলা কার রেসিংয়ের দিন, টুইড জ্যাকেট পরা ফুটবাবু সেজে থাকা লোকের তরতর করে প্রাচীণ গির্জার কার্নিশ ধরে ছাদে উঠে গিয়ে আল্লা মালুম কী যেন খোঁজার দিন, সর্বোপরি, নতুন পোপ নির্বাচনের দিন।

পিছু ছাড়ার পাত্র নয় গ্লিক।

সে স্কয়ারের অন্য প্রান্তে দেখতে পেল ম্যাক্ৰিকে। সে ঠিক সেখানেই গেছে যেখানে যেতে বলেছিল গ্লিক। অদ্ভুত সেই জুটির লেজ ধরে। সে প্রেস লেখা জ্যাকেট পরে আছে। আলতো হাতে ধরে রেখেছে ক্যামেরা। জায়গা করে নিচ্ছে ভিড়ের মধ্যে। আশপাশে আর কোন সাংবাদিক নেই। তাই অনেক পর্যটকের দৃষ্টি কাড়ল বিবিসি লেখা ওয়ালা ম্যাক্রির পোশাক।

আলফা রোমিওর ট্রাঙ্কে ভরে দেয়া যে নাঙা লাশটার ফুটেজ ধরেছিল সে সেটা এখন সম্প্রচারিত হচ্ছে ভ্যানের ভি সি আর ট্রান্সমিটারে। গ্লিক জানে এই মুহূর্তে ছবিগুলো উড়ে চলেছে লন্ডনের উদ্দেশ্যে, তার মাথার উপর দিয়ে। সম্পাদকীয় কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না সে।

তার একটা কামনা ছিল। ম্যাক্রিকে নিয়ে কোনমতে যদি লাশটার কাছাকাছি ঘেঁষা যেত। কিন্তু কাবাবে হাড়ি হয়ে বসে ছিল সাদা পোশাকের সৈন্যদল।

সে জানে, এই মুহূর্তে সেই সৈন্যদলই মিশে গেছে ভিড়ের সাথে। বড়সড় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে আজ।

প্রচারণার ডান হাত হল মিডিয়া, বলেছিল খুনি। সে আরেকবার চোখ ফেলল দূরপ্রান্তে পার্ক করা অন্যান্য মিডিয়া ভ্যানের দিকে। আবার তাকাল ম্যাক্রির দিকে। পিছন পিছন যাচ্ছে সে। রহস্যময় জুটির পিছনে।

৭৪.

ল্যাঙডন দেখল তার চোখ পড়ে আছে দশ কদম সামনে। ট্যুরিস্টদের ভিড়ের ফাঁক থেকে উঁকি দিচ্ছে বার্নিনির ওয়েস্ট পনেন্টে। দেখেছে ভিট্টোরিয়াও, তার হাত আরো শক্ত করে বসে গেল ল্যাঙডনের বাহুতে।

রিল্যাক্স! বলল ভিট্টোরিয়ার দিকে ফিরে ল্যাঙডন, ফিসফিস করে, তোমার ঐ পিরানহা না কী যেন… সেটা কর।

হাতের উপর চাপ কমিয়ে দিল ভিট্টোরিয়া সাথে সাথে।

তারা যত কাছে যাচ্ছে ততই যেন প্রতিটা ব্যাপার একেবারে নির্দোষ দেখাচ্ছে। সব স্বাভাবিক। ভ্রমণপিয়াসীরা দল বেঁধে হাল্কা হল্লা করছে। অপেক্ষা করছে ভক্তরা নতুন পোপের জন্য। একটা বাচ্চা মেয়ে মনোলিথের গোড়ায় খাবার দিচ্ছে কবুতরের ঝাঁককে।

হাতঘড়ি আর একবার চেক করা থেকে কোনক্রমে বিরত করল নিজেকে ল্যাঙডন। সে জানে।

দ্য টাইম হ্যাথ কাম।

সময় চলে এসেছে।

পায়ের তলায় চলে এল ডিম্বাকার এলাকা। ভিট্টোরিয়া আর ল্যাঙডন একটা টেনশন ফ্রি মুডে থামতে শুরু করল। যেন কোন ট্যুরিস্ট-জোড়া সামনের জিনিসটা দেখার জন্য থেমেছে।

ওয়েস্ট পনেন্টে, বলল ভিট্টোরিয়া, পাথরের উপরে খোদাই করে দেয়া লেখাটা পড়তে পড়তে।

কতবার এখানে এসেছে ল্যাঙডন, কতবার রোমে এসেছে, কত বইতে এসব নিয়ে নিযুত লেখাজোকা পড়েছে সে সতৃষ্ণ চোখে। কিন্তু এখনো এর পুরো ব্যাপারটা ধরা পড়ে যায়নি।

বড়জোর ফুট তিনেক হবে আকার-আকৃতিতে। পশ্চিম-বাতাসের জন্য মুখিয়ে আছে যেন পাথরটা। বার্নিনি পুরো রোমের দিকে একটা বাতাস বইয়ে দিয়েছেন..কত সূক্ষভাবে! কোথায় ব্রিদ অব গড আর কোথায় সেকেন্ড এলিমেন্ট অব সায়েন্স! এয়ার… বার্নিনি বাতাসকে পাঁচটা দমকা হাওয়ায় বিভক্ত করেছেন। পাঁচ… ল্যাঙডনের বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে গ্যালিলিওর কথা। দুটা তারকা, পাঁচটা ঝাপ্টা, ডিম্বাকৃতি, সাযুজ্য… খালি খালি লাগছে তার। ফাঁকা লাগছে ভিতরটা।

ভিট্টোরিয়া তাকে সরিয়ে নিল দূরে। আস্তে করে নিজে যেতে থাকায় সরে এল ল্যাঙডনও। বলল মেয়েটা ফিসফিসিয়ে, মনে হয় আমাদের কেউ ফলো করছে।

ঝট করে তাকাল ল্যাঙডন, কোথায়?

কথা না বলে আরো ত্রিশ কদম এগিয়ে গেল ভিট্টোরিয়া। সে ভ্যাটিকানের দিকে আঙুল নির্দেশ করল, যেন কিছু দেখাচ্ছে ল্যাঙডনকে গম্বুজের চূড়ায়। স্কয়ারের শুরু থেকে যে আমাদের অষ্টপ্রহর অনুসরণ করে আসছে সে-ই। বলেই আলতো করে সে তাকাল পিছনে, এখনো লেগে আছে টিকটিকিটা। চলতে থাক। কী

কী মনে হয়? এ-ই হ্যাসাসিন?

মাথা নাড়াল ভিট্টোরিয়া, মনে হয় না ইলুমিনেটি বিবিসির কোন ক্যামেরাসুদ্ধ সাংবাদিককে ভাড়া করবে।

সেন্ট পিটার্সের ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে ঝাপিয়ে পড়ল ভিট্টোরিয়া আর ল্যাঙডন দুজনেই। সময় চলে এসেছে। সময় চলে এসেছে। তারা এড়িয়ে চলছে ওয়েস্ট পনেন্টেকে, খসানোর চেষ্টা করছে রিপোর্টারকে। কিন্তু বিধি বাম। আঠার মত লেগে, আছে সংবাদদাতা।

ঘণ্টার শব্দ ছাড়া পুরো স্কয়ার একেবারে নিরেট, ঠান্ডা। শান্ত পর্যটকের দল ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অপেক্ষা করছে নতুন পোপের জন্য। ওবেলিস্কের গোড়ায় ধাক্কা খেল এক মাতাল, পিচ্চি এক মেয়ে খাবার দিচ্ছে কবুতরের ঝাককে। ভেবে পাচ্ছে না এই ফেউ কী করে পিছনে পিছনে জুটল। অবশ্যই, মনে পড়ে গেল তার। আমি আপনাদের কার্ডিনালদের ভুবনজোড়া খ্যাতি এনে দিব, বলেছিল খুনি, মিডিয়ার মাধ্যমে।

নবম ঘণ্টার শব্দ মিলিয়ে যেতে না যেতেই একটা শান্তিময় নিরবতা নেমে এল পুরো স্কয়ার জুড়ে।

আর তার পর পরই, চিৎকার জুড়ে দিল ছোট্ট মেয়েটা।

৭৫.

ল্যা ডন সবার আগে চিৎকার করতে থাকা মেয়েটার দিকে এগিয়ে যায় বিনা দ্বিধায়।

আতঙ্কিত মেয়েটা তাকিয়ে আছে ওবেলিস্কের গোড়ার দিকে, যেখানে এক মাতাল পড়ে আছে। বোঝাই যায় নেশায় চুর হয়ে আছে সে। পাঁড় মাতাল। এমন দৃশ্য দেখলে কার না করুণা জাগে… রোমের বাস্তুহারাদের কেউ হবে। তার মাথা জুড়ে এলোমেলো চুল, সারা গা নোংরা একটা চাদরে আবৃত। মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যেতে যেতে মেয়েটা চিৎকার করতে থাকে।

এরপর জমে গেল ল্যাঙডনও। সে এমন দৃশ্য কল্পনা করেনি। সামনের সিঁড়ির ধাপ থেকে কালচে কী এক তরল বেরিয়ে আসছে। নিশ্চিত। রক্ত। খাঁটি রক্ত।

তার পরই, এক মুহূর্তে সব যেন ঘটে গেল।

বয়স্ক লোকটা আস্তে আস্তে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন, তার পরই পড়ে গেলেন সিঁড়ি বেয়ে সামনের দিকে। উবু হয়ে, মুখ নিচের দিকে দিয়ে।

এগিয়ে গেল ল্যাঙডন প্রথমেই, চেষ্টা করল ধরতে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে অনেক।

পড়ে আছে শরীরটা, অনড়।

হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল ল্যাঙডন, পাশে চলে এল ভিট্টোরিয়া। জমে যাচ্ছে ভিড়।

পিছন থেকে লোকটার গলায় আঙুল চেপে ধরল ভিট্টোরিয়া, তারপর বলল, এখনো পালস আছে। সোজা কর।

এরই মধ্যে কাজে নেমে পড়েছে ল্যাঙডন। কাঁধ আকড়ে ধরে সে সোজা করল লোকটাকে। কিন্তু এখন আর তেমন কোন সুযোগ নেই। লোকটা যেন নরম মাংসের একটা তাল। যেভাবে সোজা করল ল্যাঙডন সেভাবেই নেতিয়ে পড়ল শরীর।

তার বুকের অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা ক্ষত ফুটে উঠেছে। পোড়া মাংসের গন্ধ নাকে এসে লাগছে।

ভিট্টোরিয়া আরো সোজা করল।

বোধশক্তিহীন লাগছে ল্যাঙডনের। সিম্বলটা একেবারে সরল।

এয়ার! কোনক্রমে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল ভিট্টোরিয়া, এই সেই লোক…।

সাজ সাজ রব পড়ে গেছে সুইস গার্ডদের মধ্যে। তারা এরই মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি আর আদেশ-নির্দেশের হল্লা বাঁধিয়ে ফেলে অদৃশ্য খুনির পিছনে উঠেপড়ে লেগে গেছে।

একজন টুরিস্ট বলল যে এই গরিব লোকটার পাশে বসেছিল এক কালো চামড়ার লোক, মিনিট কয়েক আগেও। এমনকি সে এই ভবঘুরে লোকটার পাশেও বসেছিল, সিঁড়িতে। তারপর হারিয়ে গেছে ভিড়ের মধ্যে।

কাজে লেগে পড়ল ভিট্টোরিয়া। লোকটার বুকে আঘাত দিয়ে সবটুকু বাতাস বের করে আনল। অবশ্যই, চিহ্নটাকে এড়িয়ে গিয়ে। তারপর মুখে মুখে শ্বাস দেয়া শুরু করল। এরপর কী ঘটবে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না ল্যাঙডনের। একদিকে মুখে মুখে বাতাস দিচ্ছে ভিট্টোরিয়া আর অন্যদিকে রক্তের একটা ফোয়ারা ঠিক তিমির পানি উগড়ে দেয়ার মত করে ছিটকে এসে ল্যাঙডনের চোখে-মুখে এসে পড়ল।

আৎকে উঠল ভিট্টোরিয়া, লোকটার লাঙস… বলল সে, ছিদ্র করে ফেলা হয়েছে।

সাথে সাথে চোখ বুজিয়ে দিল ল্যাঙডন। আর কিছু করার নেই। কার্ডিনালের ফুসফুস ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলা হয়েছে। আর বেঁচে নেই লোকটা।

সুইস গার্ড এসে পড়তে পড়তে ভিট্টোরিয়া শরীরটাকে ঢেকে দিল।

তারপর অসহায় দৃষ্টি মেলে ল্যাঙডন দেখতে পেল বিবিসি ক্যামেরা নিয়ে তাদের পিছনে পিছনে ফেউয়ের মত ঠিক ঠিক হাজির হয়েছে রিপোর্টার মূর্তীমতী আতঙ্কের মত। এখনো তার ক্যামেরা রোল করছে। তার চোখমুখ ঠিক ঠিক ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। তারপর শিকারি বিড়ালের মত অলক্ষ্যে ঝাপিয়ে পড়ল ভিডিওগ্রাফার।

৭৬.

চিনিতা ম্যাক্রি এগিয়ে চলছে। তার জীবনেও অনেক কথা আছে।

সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে জড়ো হওয়া মানুষজনকে পাশ কাটিয়ে তার ক্যামেরা ঠিক একটা নোঙরের মত এগিয়ে গেছে উদ্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে।

কিছু একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে, টের পেল সে। সাংবাদিকতায় থাকতে থাকতে যে কারো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় খুব দ্রুত সচল হয়ে যায়। সেও টের পাচ্ছে, টুইড। জ্যাকেট পরা লোকটা দেখতে পায় তাকে আরো আগেই। ঘোড়াই পরোয়া করত সে, কিন্তু বাড়াভাতে ছাইয়ের মত আশপাশ থেকে আরো অনেক পাথরমুখো মানুষ ঘিরে ধরল তাকে।

ভেবে পাচ্ছে না এতক্ষণ যা সে রেকর্ড করল সেগুলো যদি সত্যি হয়। খুন হয়ে যাওয়া লোকটা যদি তেমন কেউ হয় যাকে সন্দেহ করা হচ্ছিল, তাহলে প্লিকের কাছে আসা ভূতুড়ে কলের একটু হলেও সুরাহা হবে।

সে ঠিক ঠিক বাতাসে বিপদের গন্ধ পেয়ে গেছে। টের পাচ্ছে, সামনে কিছু একটা খারাপি আছে তার কপালে। সাত তাড়াতাড়ি পাততাড়ি গুটিয়ে নিতে নিতে এগিয়ে যেতে থাকে বিবিসি ভ্যানের দিকে। কিন্তু বিধি বাম। হাওয়া থেকে উদয় হল একটা কমবয়েসি লোক, যার হাবভাবে-মুখভঙ্গিতে সামরিক কায়দা ফুটে উঠছে। তাদের চোখে চোখে কী যেন কথা হয়ে গেল। থেমে গেল দুজনেই।

বজ্রপাতের মত এক ঝলকে লোকটা পকেট থেকে ওয়াকিটকি বের করে কথা বলল। তারপর এগিয়ে আসতে লাগল তার দিকে। ম্যাক্রি সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। ঘুরে দাঁড়াল, তারপর সোজা মিশে গেল জনারণ্যে। ধ্বক ধ্বক করছে তার হৃদপিন্ড।

আরো কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে এ মুহূর্তে। বাতাসে বারুদের গন্ধ। হারিয়ে গিয়েই সে বাকী কাজটা সেরে ফেলার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল। বাঁচাতে হবে ফিল্মটাকে। কী করে? খুলে ফেলল সে। তারপর আলতো হাতে সেটাকে পিছনদিকে কোমরে গুজে দিয়