দ্য দা ভিঞ্চি কোড

দ্য দা ভিঞ্চি কোড

০১. রবার্ট ল্যাংডন ঘুম থেকে জেগে উঠলো

অধ্যায় ১

রবার্ট ল্যাংডন খুব ধীরে ধীরে ঘুম থেকে জেগে উঠলো।

অন্ধকারে ফোন বাজছে ছোট্ট একটা অপরিচিত রিংয়ের শব্দ, যেনো বহু দূর থেকে ভেসে আসছে। সে বিছানার পাশে রাখা ল্যাম্পটার সুইচ হারে জ্বালিয়ে দিয়ে আড়চোখে চারপাশটা দেখে নিলো। একটা রেনেসা শোবার ঘর, ঘোড়শ সুইয়ের আমলের আসবাবপত্রে সাজানো, হাতে নক্সা করা দেয়াল আর সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত মেহগনি কাঠের বিছানা।

আরে, কোথায় আমি?

বিছানার পাশেই একটা বাথরোবের মনোগ্রামে লেখা : হোটেল রিজ প্যারিস।

আস্তে আস্তে ধোয়াটে ভাবটা কাটতে শুরু করলে ল্যাংডন রিসিভারটা তুলে নিলো। হ্যালো?

মঁসিয়ে ল্যাংডন? একটা পুরুষ কণ্ঠ বললো, আশা করি আপনার ঘুম ভাঙিনি আমি?

বিরক্ত হয়ে ল্যাংডন বিছানার পাশে রাখা ঘড়িটার দিকে তাকালো। রাত ১২টা বেজে ৩২ মিনিট। মাত্র এক ঘণ্টা হলো সে ঘুমিয়েছে, কিন্তু তার মনে হলো অনেকক্ষণ ধরে মরে পড়েছিলো।

আমি হোটেলের দ্বাররক্ষী বলছি, মঁসিয়ে। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চাই, কিন্তু আপনার কাছে একজন অতিথি এসেছেন। তিনি চাপাচাপি করছেন, ব্যাপারটা নাকি খুব জরুরি।

ল্যাংডনের তখনও ঘুম ঘুম ভাবটা ছিলো। একজন অতিথি? বিছানার পাশে রাখা টেবিলের ওপরে অনেকগুলো কাগজ-পত্রের সাথে দোমড়ানো-মোচড়ানো একটা ফ্লাইয়ারের দিকে তার চোখ গেলো।

আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব প্যারিস

গর্বের সাথে উপস্থাপন করছে

রবার্ট ল্যাংডন-এর সাথে একটি সন্ধ্যা

প্রফেসর, ধর্মীয় প্রতীক বিদ্যা

হারভার্ড ইউনিভার্সিটি

ল্যাংডন একটা গভীর আর্তনাদ করলো। আজ রাতের বক্তৃতাটা–শাত্রের ক্যাথেড্রালে লুকানো পাথরের মধ্যে প্যাগান প্রতীকগুলোর ওপর একটা স্লাইড শো–বোধহয় কোন রক্ষণশীল শ্রোতাকে বিক্ষুব্ধ করেছে। তাদের মধ্যে কোন কোন ধর্মীয় পণ্ডিত তার পিছু পিছু বাড়ি পর্যন্ত এসে এ নিয়ে একচোট ঝগড়াও করে গেছে।

আমি দুঃখিত, ল্যাংডন বললো, আমি খুবই ক্লান্ত আর–

মেই, মঁসিয়ে, দ্বাররক্ষীটি একটু নিচু স্বরে খুব তাড়া দিয়ে বললো, তার কণ্ঠে জরুরি একটা ভাব আছে। আপনার অতিথি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

ল্যাংডনের খুব কমই সন্দেহ ছিলো। ধর্মীয় চিত্রকর্ম এবং কাল্ট প্রতীকের ওপর রচিত তার বইয়ের জন্য সে খুব অপ্রত্যাশিতভাবেই শিল্পজগতে একজন সেলিবৃটি হয়ে গেছে, আর গত বছরের ল্যাংডনের পরিচিতিটা শত সহস্রগুণ বেড়ে গেছে ভ্যাটিকানের সাথে বহুল আলোচিত একটি ঘটনায় জড়িয়ে পড়াতে। ব্যাপারটা মিডিয়াতে বেশ প্রচার পেয়েছিলো। তারপর থেকে, স্বঘোষিত ইতিহাসবিদ আর শিল্পবিশারদদের স্রোতধারা তার ঘরের দরজায় আছড়ে পড়তে শুরু করেছে বিরামহীনভাবে।

আপনি যদি একটু দয়া করেন, ল্যাংডন বললো, ভদ্র থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো সে, আপনি কি তার নাম আর ফোন নাম্বারটা নিয়ে রাখতে পারবেন, তাকে বলবেন, আমি বুধবার প্যারিস ছাড়ার আগেই ফোন করে তার সাথে যোগাযোগ করবো। ধন্যবাদ, আপনাকে। দ্বাররক্ষী কোন কিছু বলার আগেই সে ফোনটা রেখে দিলো।

এবার উঠে বসে ল্যাংডন তার পাশে রাখা গেস্ট রিলেশনস হ্যান্ড বুকএর দিকে ভূরু তুলে তাকালো, সেটার কভারে লেখা আছে : আলো ঝলমলে শহরে ঘুমান শিশুদের মতো। প্যারিস রিজ-এ ঘুমান। ঘরের এক পাশে রাখা প্রমাণ সাইজের আয়নার দিকে ক্লান্তভাবে সে তাকালো। যে লোকটা আয়না থেকে তার দিকে চেয়ে আছে তাকে তার অচেনা মনে হলো এলোমেলো আর পরিশ্রান্ত।

তোমার একটু ছুটির দরকার, রবার্ট।

বিগত দশ বছর তার ওপর দিয়ে বেশ খাটুনি গেছে। কিন্তু সে আয়নার অবয়বটাকে সাধুবাদ দিতে নারাজ। তার তীক্ষ্ণ নীল চোখ জোড়া আজ রাতে ঘোলাটে আর কুয়াশাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। খোঁচা খোচা দাড়িতে শক্ত চোয়াল আর টোল পড়া গালটা ঢেকে গেছে। মাথার চুল ধূসর হয়ে যাচ্ছে, আর সেটা হালকা পাতলা কালো চুলকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। যদিও তার নারী সহকর্মীরা এটাকে তার পাণ্ডিত্যের প্রকাশভঙ্গী হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকে, তবে ল্যাংডন ভালো করেই জানে সত্যিকারে কারণটি।

বোস্টন ম্যাগাজিন যদি এখন আমাকে দেখতে পেতো। গত মাসে, ল্যাংডন সবচাইতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলো যখন বোস্টন ম্যাগাজিন শহরের সবচাইতে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যক্তি হিসেবে টপ টেনের তালিকায় তাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলো— একটা সন্দেহজনক সম্মানের ফলে সে তার হারভার্ডের সহকর্মীদের কাছ থেকে সীমাহীন টিটকারি আর টিপ্পনির শিকার হয়েছিলো। আজ রাতে, তার নিজ দেশ থেকে

তিন হাজার মাইল দূরে এই ব্যাপারটা এখানে এসে পৌঁছেছে। তার বক্তৃতার অনুষ্ঠানেও সেটা উঠে এসেছে। এখানেও সে এটার শিকার হলো।

ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রমহোদয়গণ… উপস্থাপিকা প্যারিসের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাভিলিয়ন ডওফিন-এর হলভর্তি লোকজনের উপস্থিতিতে ঘোষণা দিলো, আজ রাতের আমাদের অতিথিকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কোন দরকার নেই। তিনি অসংখ্য বইয়ের লেখক। দ্য সিম্বোলজি অব সিক্রেট সেক্ট, দ্য আর্ট অব দি ইলুমিনাতি, দ্য লস্ট ল্যাংগুয়েজ অব ইডিওগ্রামস, আর আমি যখন কথা বলছি তখন তিনি লিখছেন দ্য রিলিজিয়াস আইকোনোলজির ওপর একটি বই। আপনাদের অনেকেই তার লেখা পাঠ্য বই হিসেবে শ্রেণী কক্ষে পড়েছেন।

উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে ছাত্ররা সানন্দে মাথা নেড়ে সায় দিলো। আমার একটা পরিকল্পনা ছিলো, আজ রাতে তাকে তার অসাধারণ পেশাগত পরিচয়টা তুলে ধরে আপনাদের কাছে উপস্থাপন করবো, কিন্তু যেভাবেই হোক… মেয়েটা ল্যাংডনের দিকে সকৌতুক দৃষ্টিতে তাকালো। একজন শ্রোতা কিছুক্ষণ আগে আমার হাতে একটা জিনিস দিয়ে গেছে, বলা যায়… কৌতূহলোদ্দীপক একটি পরিচয়।

বোস্টন ম্যাগাজিনর একটা কপি তুলে ধরলো মেয়েটা।

ল্যাংডন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। এটা সে পেলো কোথেকে?

উপস্থাপিকা প্রবন্ধটির নির্বাচিত কিছু অংশ পড়ে শোনাতে লাগলো। ল্যাংডনের মনে হলো সে তার চেয়ারের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। ত্রিশ সেকেন্ড পরে, দর্শক-শ্রোতারা প্রবল করতালি দিতে শুরু করলো। মেয়েটার মধ্যে এই ব্যাপারটা শেষ করার কোন চিহ্নই দেখা গেলো না। আর গতবছর মি. ল্যাংডনের সাথে ভ্যাটিকানের ওরকম ভূমিকার ব্যাপারে জনসমক্ষে কোন কিছু বলতে অস্বীকার করার কারণেই আমাদের কৌতূহলোদ্দীক মিটারের পয়েন্টে তিনি জয়ী হয়েছেন। উপস্থাপিকা শ্রোতাদের কাছে জিজ্ঞেস করলো, আপনারা কি আরো কিছু শুনতে চান?

মেয়েটাকে কেউ থামাচ্ছে না কেন, সে আবার পড়তে শুরু করতেই ল্যাংডন আপন মনে বললো।

যদিও প্রফেসর ল্যাংডন এখানে পুরস্কারপ্রাপ্ত তরুণদের মতো কেতাদূরস্ত হ্যান্ডসাম নন, কিন্তু চল্লিশোর্ধ এই পণ্ডিত ব্যক্তির পাণ্ডিত্য নির্ঘাত আবেদন সৃষ্টি করে।

তার আকর্ষণীয় উপস্থিতি, নিচু স্বরের স্পষ্ট উচ্চারণের মাধুর্যময় কণ্ঠের কারণে আরো বাঙময় হয়ে ওঠে যা তার ছাত্রীরা বর্ণনা করে কানের চকোলেট হিসেবে। পুরো হলটা হাসিতে ফেটে পড়লো।

ল্যাংডন জোড় করে একটা কাষ্ঠ হাসি দিলো। সে জানতো এর পরে কী হবে হ্যারিস টুইড পরিহিত হ্যারিসন ফোর্ড জাতীয় কিছু হাস্যকর লাইন কারণ আজকের সন্ধ্যায় সে পরে আছে হ্যারিস টুইড আর বারবেরি টার্টেলনেক টাই। সে ঠিক করলো একটা কিছু করতেই হবে।

ধন্যবাদ তোমাকে, মনিকা, ল্যাংডন আগেভাগেই উঠে দাঁড়িয়ে পোডিয়ামে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে এগোতে এগোতে বললো, বোস্টন ম্যাগাজিন নিশ্চিত ভাবেই গল্প বানাবার রসদ পেয়ে গেলো। সে শ্রোতাদের দিকে ঘুরে বিব্রত হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আমি যদি খুঁজে পাই আপনাদের মধ্যে কে এই প্রবন্ধটি এখানে এনেছেন, তবে দূতাবাসে গিয়ে আমি তাকে তার দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেবো।

শ্রোতারা সবাই হেসে উঠলো।

তো, শ্রোতারা, আপনারা সবাই জানেন, আজ এখানে এসেছি প্রতীক বা সিম্বলের ক্ষমতা কী, সেটা বলতে…

ল্যাংডনের হোটেলের ফোনটা নিরবতা ভেঙে আরেকবার বেজে উঠলো।

অবিশ্বাসে গোঙাতে গোঙাতে সে ফোনটা তুলে নিলো। হ্যাঁ? যা ভেবেছে তা-ই, আবারো সেই হোটেলের দ্বাররক্ষী।

মি. ল্যাংডন, আমি আবারো ক্ষমা চাচ্ছি। আমি আপনাকে ফোন করেছি এটা জানাতে যে, আপনার অতিথি আপনার কাছেই আসছে। আমার মনে হলো, এটা আপনাকে জানানো দরকার।

ল্যাংডন কথাটা শুনেই পুরোপুরি ঘুম ছেড়ে উঠে গেলো। আপনি আমার ঘরে একজন লোককে পাঠিয়ে দিয়েছেন?

আমি এজন্যে ক্ষমা চাইছি, মঁসিয়ে, কিন্তু এরকম একজন মানুষকে…থামানোর ক্ষমতা আমি রাখি না।

ঠিক করে বলুন তো, লোকটা আসলে কে?

কিন্তু ফোনের অপর প্রান্তে দ্বাররক্ষী ফোনটা ততক্ষণে রেখে দিয়েছে।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ল্যাংডনের দরজায় জোড়ে জোড়ে ধাক্কা দেবার শব্দ হলো।

কী করবে ঠিক ভেবে না পেয়ে ল্যাংডন বিছানা থেকে নেমে এলো, স্যালোয় কার্পেটে তার পা-দুটো ডুবে যাচ্ছে বলে মনে হলো। তড়িঘড়ি দরজার দিকে এগিয়ে গেলো সে। কে?

মি. ল্যাংডন? আপনার সাথে একটু কথা বলার দরকার। লোকটার ইংরেজি উচ্চারণ একটু অন্যরকম, খুব পরিষ্কার, কিন্তু কর্তত্বপূর্ণ। আমার নাম লেফটেনান্ট জেরোমে কোলেত। পুলিশ জুডিশিয়ারের ডিরেকশন সেন্ট্রেইল থেকে এসেছি।

ল্যাংডন একটু থেমে গেলো। জুডিশিয়াল পুলিশ? ডিসিপিজে হলো আমেরিকার এফবিআইর সমতুল্য।

সিকিউরিটি চেইনটা লাগিয়ে ল্যাংডন দরজাটা একটু ফাঁক করলো। যে চেহারাটা তার দিকে চেয়ে আছে সেটা হাল্কা-পাতলা এবং ভাবলেশহীন, লোকটা সাংঘাতিক রকমের মেহদীন, নীল রঙের অফিশিয়াল পোশাক পরে আছে।

ভেতরে আসতে পারি কি? লোকটা বললো।

ল্যাংডন একটু ইতস্তত করলো, আগন্তুক তাকে নিরীক্ষণ করতে থাকলে সে একটু দ্বিধাগ্রস্তও হলো। হয়েছে কি?

আমার ক্যাপ্টেনের একটু আপনার সাহায্যের দরকার, ব্যক্তিগত একটা ব্যাপারে।

এখন? ল্যাংডন স্বাভাবিক হলো। মধ্যরাত তো পেরিয়ে গেছে।

আজ রাতে লুভর মিউজিয়ামের কিউরেটরের সাথে আপনার সাক্ষাত করার কথা ছিলো, আমি কি ঠিক বলেছি?

হঠাৎ করেই ল্যাংডনের খুব অস্বস্তি হতে লাগলো। বক্তৃতার শেষে আজ রাতে তার সাথে কিউরেটর জ্যাক সনিয়ের একটা সাক্ষাতের কথা ছিলো, কিন্তু সনিয়ে আর সেই সাক্ষাতের জন্য আসেননি। হ্যাঁ, আপনি সেটা জানলেন কি করে?

আমরা আপনার নাম উনার দৈনিক পরিকল্পনার নোটবুকে পেয়েছি।

আমার বিশ্বাস, খারাপ কিছু ঘটেনি?

লোকটা একটা করুণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজার ফাঁক দিয়ে পোলারয়েডে তোলা একটি ছবি তার দিকে বাড়িয়ে দিলো। ছবিটা দেখেই ল্যাংডনের পুরো শরীরটা কাটা দিয়ে উঠলো।

ছবিটা একঘণ্টা আগে ভোলা হয়েছে। লুভরের ভেতরেই।

অদ্ভুত এই ছবিটা দেখে ল্যাংডন আতৃকে উঠে রেগে গেলো। কে এরকম করলো!

আমরা আশা করছি এই প্রশ্নের উত্তর পেতে আপনার সাহায্যের দরকার রয়েছে। বিশেষ করে প্রতীকবিদ্যার ওপরে আপনার জ্ঞান এবং উনার সাথে সাক্ষাতের পরিকল্পনার কথাটা যদি বিবেচনা করেন।

ল্যাংডন ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো, এবার তার বিস্ময় কমে গিয়ে ভীতিতে রূপান্তরিত হলো। ছবিটা খুবই অদ্ভুত আর জঘন্য। ছবিটাতে এমন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে যা তার কাছে একেবারেই অভাবনীয় বলে মনে হচ্ছে। এরকম দৃশ্য সে এর আগে একবারই দেখেছে, কিন্তু সেটা কাউকে বলে বোেঝাবার মতো নয়। একবছর আগে ল্যাংডন এ রকম একটি লাশের ছবি পেয়েছিলো আর তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য অনুরোধও করা হয়েছিলো। চব্বিশ ঘণ্টা পরে, সে ভ্যাটিকানের ভেতরে নিজের জীবনটা প্রায় খুইয়ে ফেলতে যাচ্ছিলো। এই ছবিটা একেবারেই অন্যরকম। তারপরেও দৃশ্যগত দিক থেকে কিছুটা মিলও রয়েছে বলে তার মনে হলো। লোকটা তার ঘড়িটা দেখে নিলো। আমার ক্যাপিতেন অপেক্ষা করছে, স্যার।

মনে হলো ল্যাংডন তার কথা শুনতেই পায়নি। তার চোখ ছবিটার দিকে, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।

এখানের এই প্রতীকটা, তার শরীরটা যেরকম অদ্ভুতভাবে …

অবস্থানটা? লোকটা তাকে বললো।

ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো, লোকটার দিকে তাকাতেই তার কী রকম শীতল অনুভব হলো। আমি ভাবতেও পরছি না, কোন মানুষের সাথে কেউ এরকম করতে পারে।

লোকটা চোখ কুচকে বললো, আপনি বুঝতে পারছেন না, মি. ল্যাংডন। ছবিতে আপনি যা দেখছেন… সে একটু বিরতি দিলো। মঁসিয়ে সনিয়ে নিজেই এমনটি করেছেন।

০২.

এক মাইল দূরে, সাইলাস নামের প্রকাণ্ড শরীরের শ্বেতি লোকটা রুই লা ব্রুইয়ার বিলাসবহুল ব্রাউনস্টোনের অট্টালিকার সদর দরজা দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঢুকলো। কাঁটাযুক্ত সিলিস বেল্টটা সে তার ঊরুতে বেঁধে রেখেছে। সেটা তার ঊরুর মাংস কেঁটে ভেতরে ঢুকে গেছে, তারপরেও তার মন-প্রাণ ঈশ্বরের জন্য কাজ করতে পেরে সন্তুষ্ট হয়ে গান গাইছে।

কষ্ট ভালো।

তার লাল চোখ দুটো ঢোকার সময় বাড়ির লবির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একটু দেখে নিলো। কিছু নেই। নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো সে। তার সহযোগী কোন সদস্যকে ঘুম থেকে ওঠাতে চাচ্ছিলো না সাইলাস। তার শোবার ঘরের দরজাটা খোলাই রয়েছে। এখানে তালা লাগানো নিষিদ্ধ। ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো সে।

 

ঘরটা একেবারে সাদামাটা শক্ত কাঠের জমিন, পাইন কাঠের একটা টেবিল আর একটা ক্যানভাস ম্যাট ঘরের এক কোণে, এটা সে বিছানা হিসেবে ব্যবহার করে। এই সপ্তাহটা এখানে সে একজন মেহমান হিসেবে এসেছে। এ ধরনের পরিবেশে দীর্ঘদিন ধরেই সে অভ্যস্ত, সেটা অবশ্য নিউইয়র্কে।

 

ঈশ্বর আমাকে আশ্রয় দিয়েছে, আমার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে।

 

আজ রাতে, শেষপর্যন্ত সাইলাসের মনে হলো, সে তার ঋণশোধ করতে শুরু করেছে। টেবিলের ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখা সেল ফোনটা হাতে নিয়ে একটা ফোন করলো।

 

হ্যাঁ? একটা পুরুষ কণ্ঠ জবাব দিলো।

 

টিচার, আমি ফিরে এসেছি।

 

বলো, কণ্ঠটা আদেশ করলো, এই কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে আনন্দিত হলো সাইলাস।

 

চার জনের সবাই শেষ। তিন জন সেনেক্য … আর গ্র্যান্ডমাস্টার।

 

একটু বিরতি নেমে এলো, যেনো প্রার্থনা করছেন। তাহলে আমি অনুমান করতে পারি তোমার কাছে তথ্যটা আছে?

 

চার জনের সবার কাছ থেকেই নিয়েছি। আলাদা আলাদাভাবে।

 

তুমি তাদের কথা বিশ্বাস করেছো?

 

তাদের সবার কথা এক হওয়াটা কাকতালীয় কোন ব্যাপার না। উত্তেজনাপূর্ণ একটা নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো ওপর পাশ থেকে। চমক্কার। আমার ভয় ছিলো ভ্রাতৃসংঘের গোপনীয়তা রক্ষার সুনামটি বোধ হয় এবারেও টিকে যাবে।

 

মৃত্যুর দৃশ্যটা ছিলো খুবই অনুপ্রেরণামূলক।

 

তো, আমার শিষ্য, সেই কথাটা বলো, যা শোনার জন্য আমি ব্যাকুল হয়ে আছি।

 

সাইলাস জানতে সে তার শিকারদের কাছ থেকে যে তথ্যটা পেয়েছে সেটা আশংকাজনক। টিচার, চার জনের সবাই ঐতিহাসিক কি-স্টোন ক্লেফ দ্য ভূত-এর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত করেছে।

 

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে নিঃশ্বাস নেবার যে শব্দটা শুনতে পেলো সেটা তার টিচারের উত্তেজনারই বহিঃপ্রকাশ। কি-স্টোন, ঠিক যেমনটি আমরা সন্দেহ করেছিলাম।

 

লোককাহিনী মতে, ভ্রাতৃসংঘ পাথরের চোঙার ভেতরে একটা মানচিত্র তৈরি করেছে—একটা ক্লেফ দ্য ভূত… আথবা কি-স্টোন—খোঁদাই করা একটা চাকতি যা ভ্রাতৃসংঘের সেই অসাধারণ গোপনীয়তাকে, চূড়ান্ত শায়িত স্থানকে উন্মোচিত করে…তথ্যটা এতো বেশি শক্তিশালী যে, এটা রক্ষা করার কারণেই সৃষ্টি করা হয়েছে। ভ্রাতৃসংঘ।

 

আমরা কখন কি-স্টোনটা হাতে পাবো, টিচার বললেন, আমরা আর মাত্র একধাপ দূরে আছি।

 

আপনার ধারণার চেয়েও আমরা কাছাকাছি এসে পড়েছি। কি-স্টোনটা এখানেই আছে, এই প্যারিসে।

 

প্যারিসে? অবিশ্বাস্য। তাহলে তো খুব বেশিই সহজ হয়ে গেলো।

 

সাইলাস আজকের রাতের সমস্ত ঘটনাই বর্ণনা করলো…কীভাবে চারজন হতভাগ্য ব্যক্তি তাদের ঈশ্বরবিহীন জীবনটাকে শেষ মুহূর্তে রক্ষা করার জন্য তার বিনিময়ে সেই গুপ্ত ব্যাপারটি তার কাছে বলে গেছে। প্রত্যেকেই সাইলাসের কাছে ঠিক একই বর্ণনা দিয়েছে কি-স্টোনটা প্যারিসেরই কোন প্রাচীন গীর্জায়, নির্দিষ্ট কোন স্থানে অত্যন্ত সঙ্গোপনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এগুলি দ্য সেন্ট সালপিচ গীর্জায়।

 

প্রভুর নিজের ঘরের ভেতরেই, টিচার বিস্ময়ে বললেন। তারা আমাদের সাথে কীভাবে ফাজলামি করেছে দ্যাখো।

 

যেমনটা তারা শতশত বছর ধরে করে আসছে।

 

টিচার একটু চুপ হয়ে গেলেন। যেনো এই মুহূর্তের বিজয়টাকে নিজের বিজয় হিসেবে পরিগণিত হবার সুযোগ করে দিচ্ছেন। শেষে তিনি বললেন, তুমি ঈশ্বরের জন্য একটি মহান কাজ করেছে। আমরা এজন্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অপেক্ষা করেছি। তুমি অবশ্যই আমার জন্য কি-স্টোনটা উদ্ধার করে দেবে। আজ রাতেই। বিপদটা সম্পকে তো তোমার সম্যক ধারণা আছেই।

 

সাইলাস জানতো বেশুমার বিপদ রয়েছে এতে, আর টিচার এখন যে আদেশ দিয়েছেন সেটা মনে হচ্ছে খুবই অসম্ভব একটি ব্যাপার। কিন্তু গীর্জাটা তো একটা দূর্গ। বিশেষ করে রাতের বেলায়। আমি কিভাবে ভেতরে ঢুকবো?

 

টিচার একজন অসামান্য প্রভাবশালী মানুষ, আত্মবিশ্বাসী কষ্ঠে তাকে সবিস্তারে বলে দিলো কি করতে হবে।

 

সাইলাস ফোনটা নামিয়ে রাখতেই উত্তেজনায় তার চামড়া টান টান হয়ে গেলো।

 

আর একঘন্টা। মনে মনে বললো। সে খুব কৃতজ্ঞ যে, টিচার ঈশ্বরের ঘরে ঢোকার আগে কী কী করতে হবে তার জন্য সময় দিয়েছেন। আজকের পাপের জন্য আমি অবশ্যই আমার আত্মাকে বিশুদ্ধ করে নেবো।

 

আজকে যে পাপ করা হয়েছে সেটার উদ্দেশ্য ছিলো খুবই পবিত্র। ঈশ্বরের শত্রুদের বিরুদ্ধে শতাব্দী ধরেই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ক্ষমা পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে।

 

তারপরও, সাইলাস জানতো, ধর্মের জন্য বলি দিতেই হয়।

 

কাপড়চোপড় খুলে ফেলে সাইলাস ঘরের মাঝখানে হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো। তার ঊরুতে বাঁধা সিলিস বেল্টটার দিকে তাকালো। দ্য ওয়ের সত্যিকারের সব অনুসারীই এই জিনিসটা পরে থাকে একটা চামড়ার বেল্ট তাতে লোহার কাঁটা লাগানো থাকে যা মাংসপেশীকে কেঁটে ভেদ করে যিশুর যন্ত্রণাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

 

যদিও সাইলাস নিয়মানুযায়ী দুঘণ্টার চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরেই আজ এটা পরে আছে, কারণ দিনটা কোন সাধারণ দিন নয়। বেল্টটা আরো আঁটোসাঁটো করে বেঁধে নিলো সে, যাতে মাংসপেশীতে সেটা আরো বেশি বেঁধে যায়। আস্তে আস্তে তার প্রার্থনা শুরু করলো সে। যন্ত্রণা ভালো। সাইলাস বিড়বিড় করে বললো। বারবার সব গুরু গুরু ফাদার হোসে মারিয়া এসক্রিভার পবিত্র মন্ত্রটা আওড়াতে লাগলো সে।

 

যদিও এসক্রিভা ১৯৭৫ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন, তার প্রজ্ঞা আজো বেঁচে আছে, তাঁর শব্দ আজো সারা পৃথিবীর হাজার হাজার বিশ্বাসীরা হাটু গেঁড়ে প্রার্থনা করার সময় ব্যবহার করে থাকে। এই প্রার্থনাটি সবার কাছে কোরপোরাল মর্টিফিকেশন বা শারীরিক শাস্তি হিসেবে পরিচিত।

 

সাইলাস এবার তার পাশে রাখা গিট পাকানো মোটা দড়িটার দিকে তাকালো। গিটগুলোতে ওকননা রক্ত লেগে আছে। নিজের যন্ত্রণাকে বিশুদ্ধ করার জন্য দ্রুত একটা প্রার্থনা সেরে নিলো। তারপর, দড়িটার এক মাথা মুঠোতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘাড়ের উপর দিয়ে পিঠে আঘাত করতে শুরু করলো। সে টের পেলো গিটগুলো তার পিঠে লাগছে। সে বার বার এটা করতে লাগলো। মাংসগুলো ফালা ফালা করে ফেললো। বার বার।

 

কাঙিগো কোরপাস মেয়োম। অবশেষে, সে বুঝতে পারলো রক্ত ঝড়তে শুরু করেছে।

 

 

 

০৩.

 

সিতরোঁ গাড়িটা দক্ষিণ প্রান্তের অপেরা হাউস অতিক্রম করে প্লেস ভোদোয়ায় এসে পড়তেই এপ্রিলের নির্মল বাতাসের ঝাঁপটা জানালা দিয়ে ভেতরে এসে লাগলো। গাড়িতে বসা রবার্ট ল্যাংডনের মনে হলো তার চিন্তাভাবনাগুলো পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। তড়িঘড়ি করে গোসল ও শেভ করার জন্য তাকে দেখতে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও এটা তার উদ্বেগটাকে একটুও কমাতে পারেনি। কিউরেটরের ভয়ংকর ছবিটা তার মনে আঁটকে আছে।

 

জ্যাক সনিয়ে মারা গেছেন।

 

কিউরেটরের মৃত্যু ল্যাংডনের কাছে একটা বিরাট ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই না। পর্দার অন্তরালে থাকা সত্ত্বেও সনিয়ে একজন শিল্পবোদ্ধা এবং শিল্পের জন্য তাঁর অবদানের যে সুনাম আছে, সেটার জন্য একজন বিখ্যাত ব্যক্তিই হয়ে উঠেছিলেন। পুশিয়ান এবং তেনিয়ারের শিল্পকর্মের মধ্যে যে লুক্কায়িত কোড বা সংকেত রয়েছে সেটার ওপর রচিত তার বই ল্যাংডনের খুবই প্রিয় এবং সে এগুলো শ্রেণীকক্ষে পাঠ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। আজকের সাক্ষাতের জন্য ল্যাংডন অধীর আগ্রহে ছিলো, কিন্তু কিউরেটর যখন কথা মতো আসতে পারলেন না তখন সে যারপর নাই হতাশ হয়েছিলো।

 

আবার কিউরেটরের ছবিটা তার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। জ্যাক সনিয়ে নিজেই এরকম করেছেন? ছবিটা মন থেকে তাড়ানোর জন্য ল্যাংডন জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। বাইরে, শহরটা বাতাসের ঝাঁপটায় ফুরফুর করছে রাস্তার হকাররা তাদের টং গাড়িগুলো ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, ময়লা ফেলার লোকগুলো ময়লার ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে ডাস্টবিনের দিকে, একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা এই মধ্যরাতেও ঠাণ্ডা বাতাসের বিরুদ্ধে জড়াজড়ি করে উষ্ণতা খুঁজছে, বাতাসে জেসমিন ফুলের গন্ধ। সিতরোটা বেশ কর্তপূর্ণভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে, এটার দুই টোনের সাইরেনের আওয়াজ রাস্তার যানবাহনগুলোকে ছুরির ফলার মতো কেটে কুটে গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

 

আজ রাতে আপনি প্যারিসে আছেন দেখে লো ক্যাপিতেইন খুব খুশি হবেন, পুলিশের লোকটা হোটেল ছাড়ার পর এই প্রথম কথা বললো। কাকতালীয়ভাবেই এটা সৌভাগ্যের।

 

ল্যাংডন সৌভাগ্য ছাড়া আর সবকিছুই ভাবছে। আর কাকতালীয় ব্যাপারটাকে সে পুরোপুরি বিশ্বাসও করতে পারে না, এরকম কোন ধারণায় সে বিশ্বাস করে না। যে কিনা সারা জীবন ব্যয় করেছে লুকানো প্রতীক, সংকেত আর বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস নিয়ে, সেই ল্যাংডন মনে করে পৃথিবীটা ইতিহাস আর ঘটনাসমূহের একটা জাল ছাড়া আর কিছুই না। সংযোগটা হতে পারে অদৃশ্য, সে প্রায়শই তার হারভার্ডের ক্লাসের ছাত্র ছাত্রিদের কাছে কথাটা বলে, কিন্তু সয়ময়ই সেগুলো থাকে মাটির নিচে।

 

আমার অনুমান, ল্যাংডন বললো, প্যারিসের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি আপনাদেরকে বলেছে আমি কোথায় আছি?

 

গাড়ির চালক মাথা নাড়লো। ইন্টারপোল।

 

ইন্টারপোল, ল্যাংডন ভাবলো। অবশ্যই। সে ভুলে গিয়েছিলো ইউরোপের সবগুলো হোটেলই তাদের অতিথির তালিকা ইন্টারপোলের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সরবরাহ করে থাকে—এটাই নিয়ম। একটা নির্দিষ্ট রাতে সমগ্র ইউরোপে, কে কোথায় ঘুমাচ্ছে, সে সম্পর্কে একেবারে নিখুঁত তথ্য ইন্টারপোলের কাছে থাকে। রিজ হোটেলে যে ল্যাংডন অবস্থান করছে, সেটা ইন্টারপোলের জানতে পাঁচ সেকেন্ড সময় লেগেছে।

 

সিতরোটা শহরের দক্ষিণ দিকে দ্রুতবেগে ছুটতেই আইফেল টাওয়ারটা দেখা গেলো। আকাশের দিকে তাক করে আছে, যেনো খোচা দিবে আকাশটাকে। এটা দেখেই ল্যাংডন ভাবলো ভিত্তোরিয়ার কথা, মনে পড়ে গেলো এক বছর আগে করা প্রতীজ্ঞাটা, ছমাস অন্তর অন্তর তারা দেখা করবে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন রোমান্টিক জায়গায়। ল্যাংডনের মনে হলো আইফেল টাওয়ারটা তাদের তালিকায় অবশ্যই থাকতো। দুঃখের কথা, সে ভিত্তোরিয়াকে বিদায়ী চুম্বন দিয়েছিলো একবছর আগে রোমের এক কোলাহলপূর্ণ বিমানবন্দরে।

 

আপনি কি তার ওপরে উঠেছেন? পুলিশের লোকটা জিজ্ঞেস করলে ল্যাংডন তার দিকে তাকালো, নিশ্চিতভাবে সে ভুল বুঝেছে।

 

কি বললেন, বুঝতে পারলাম না।

 

খুব সুন্দর, না? লোকটা আইফেল টাওয়ারের দিকে ঈশারা করে বললো। আপনি কখনও ওটার ওপরে উঠেছেন?

 

ল্যাংডন তার দিকে চেয়ে বললো, না, আমি টাওয়ারে কখনও উঠিনি।

 

এটা ফ্রান্সের প্রতীক। আমার মনে হয় সেটা ঠিকই আছে।

 

ল্যাংডন উদাসভাবে মাথা নেড়ে সায় দিলো। সিম্বোলজিস্টরা প্রায়শই ফ্রান্সকে উল্লেখ করে মাচিসমো, মেয়েলীপনা এবং খর্বাকৃতির রাষ্ট্রনায়ক নেপোলিয়ন আর বামন পেপিনদের দেশ হিসেবে তারা হাজার ফুট উঁচু জাতীয় প্রতীক ছাড়া অন্যকিছু বেছে নিতে পারেনি।

 

রুই দ্য রিভোলিতে এসে পড়তেই ট্রাফিক সিগনালের বাতিটা জ্বলে উঠলো, কিন্তু সিতরোটার গতি কমলো না। পুলিশের লোকটা গাড়িটা আরো জোড়ে চালিয়ে তুইলেরি

 

গার্ডেনের উত্তর দিকের প্রবেশ পথ দিয়ে রুই কাস্তিলিওর দিকে চলে গেলো। এটা প্যারিসের সেন্ট্রাল পার্কের নিজস্ব সংস্করণ। বেশির ভাগ পর্যটকই এটাকে ভুল করে জারদিন দে তুইলেরি বলে ডাকে। তাদের ধারণা এখানে হাজার হাজার টিউলিপ ফোটে বলে এরকম নাম। কিন্তু তুইলেরি নামটা সত্যিকারের যে জিনিস থেকে এসেছে, সেটা অনেক কম রোমান্টিক। এই পার্কটা আগে প্যারিসীয় ঠিকাদারদের একটা ইট বানাবার কারখানা ছিলো। খনি থেকে পিট আর মাটি দিয়ে এখানে এক ধরনের লাল টাইলস বানানো হোতো, যা বাড়ি ঘরের ছাদে ব্যাপকহারে ব্যবহারে করা হতো—সেই টাইলসকেই ফরাসিরা বলে তুইলে।

 

ফাঁকা পার্কটাতে ঢোকামাত্রই পুলিশের লোকটা সাইরেন বন্ধ করে দিলো। আচমকা নিরবতা নেমে আসাতে ল্যাংডন স্বস্তিবোধ করলো।

 

ল্যাংডন সবসময়ই তুইলেরিকে পবিত্রস্থান বলে বিবেচনা করে। এইসব বাগানে বসেই ক্লদ মনে ফর্ম এবং রঙ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন, আর এই জায়গাটিই ইপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের জন্ম দিতে প্রেরণা দিয়েছে। আজ রাতে, এই জায়গাটিই অদ্ভুত এক অশরীরী অনূভূতির জন্ম দিচ্ছে।

 

সিতরোটা বাম দিকে মোড় নিয়ে পার্কের সেন্ট্রাল বুলেভার্ডের পশ্চিম দিকে চলে গেলো। একটা গোল পুকুর পাড় ঘুরে ড্রাইভার ফাঁকা এভিনুতে এসে পড়লো। ল্যাংডন দেখতে পেলো তুইলেরি গার্ডেনের শেষ প্রান্তটি, একটা বিশাল পাথরের পথ দিয়ে সেটা শেষ হয়েছে।

 

আর্ক দু কারুজেল।

 

যদিও আর্ক দু কারুজেলে হৈ চৈ পূর্ণ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, তারপরও চিত্রমোদীরা এই স্থানটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে উল্লেখ করে থাকে। তুইলেরির শেষপ্রান্তে অবস্থিত বিশাল চত্বরটির চারদিকে পৃথিবীর চারটি সেরা জাদুঘর দেখতে পাওয়া যাবে… কম্পাসের প্রতিটি দিকে একটি করে অবস্থিত।

 

ডানদিকের জানালা দিয়ে দক্ষিণ দিকে সিন নদী এবং কুয়ে ভলতেয়ার দেখা যায়। ল্যাংডন আড়ম্বরপূর্ণ আলোকজ্জল পুরাতন স্টেশনের চত্বরটি দেখতে পেলো—এটা এখন মিউজি দরসে। বাম দিকে তাকালে দেখা যাবে অত্যাধুনিক পশিদু সেন্টার, যা আধুনিক চিত্রকলার জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তার পেছনে, পশ্চিম দিকে, ল্যাংডন জানতো রামেসিসের প্রাচীন অবিলিস্কটা গাছপালার ওপর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই জায়গাটাতেই জো দ্য পমের জাদুঘর অবস্থিত।

 

কিন্তু ঠিক সোজা, সামনের পূর্ব দিকে, ল্যাংডন দেখতে পেলো কারুকার্যময় রেনেসা প্রাসাদটিকে যা এখন বিশ্বের সবচাইতে বিখ্যাত জাদুঘর হিসেবে পরিচিত।

 

মিউজি দু লুভর।

 

ল্যাংডনের চোখ যখন বিশাল চত্বরটি দেখলো তখন অতি পরিচিত বিস্ময়ের আভা তার সমস্ত অনুভূতিতে ছড়িয়ে পড়লো। একটা বাড়তি বিশাল খোলা চত্বর সামনে, লুভরের সুবিশাল দূর্গ সদৃশ্য এলাকাটি প্যারিসের সবচাইতে মনোরম দৃশ্য। এটার আকৃতি বিশাল একটি অশ্বক্ষুরের মতো, লুভর ইউরোপের সবচাইতে দীর্ঘ ভবন। দৈর্যের দিক থেকে পাশাপাশি তিনটি আইফেল টাওয়ারের সম্মিলিত দৈর্ঘের সমান। এমনকি খোলা চত্বরের কয়েক মিলিয়ন স্কয়ার ফিটের রাজকীয় জায়গাটিও তার চেয়ে বেশি বড় নয়। ল্যাংডন একবার লুভরের পুরো এলাকাটি হেটে খুবই অবাক হয়েছিলো, তিন মাইলের মতো ছিলো ভ্রমণটা।

 

এই দালানের ভেতরে রাখা ৬৫৩০০টি শিল্পকর্ম ভালো মতো দেখতে হলে পাঁচ সপ্তাহ লাগার কথা থাকলেও বেশিরভাগ পর্যটকই সংক্ষিপ্ত সফর বেছে নেয়, ল্যাংডন যাকে লুভর লাইট হিসেবে উল্লেখ করে তিনটি বিখ্যাত বস্তু দেখার মধ্য দিয়ে লুভর পরিক্রমা শেষ করা : মোনালিসা, ভেনাস দ্য মিলো, এবং উইংগ ভিক্টোরি। আর্ট বুচওয়াল্ড একবার বলেছিলেন যে, এই তিনটি মাস্টারপিস দেখতে তাঁর পাঁচ মিনিট পঞ্চান্ন সেকেন্ড লেগেছিলো।

 

ড্রাইভার একটা ওয়াকিটকি হাতে নিয়ে ক্রমাগতভাবে ফরাসিতে কথা বলে যেতে লাগলো। মঁসিয়ে ল্যাংডন এ এরাইভ। দু মিনিত্‌স।

 

ওয়াকি-টকিতে একটা নির্দেশ দেয়া হলো তাকে। যন্ত্রটা সরিয়ে রেখে পুলিশের লোকটা ল্যাংডনের দিকে ফিরলো। আপনি সদর দরজায় ক্যাপিতেনের সাথে দেখা করবেন।

 

প্লাজার ট্রাফিক সিগনালের নিষেধাজ্ঞা বাতিটা অগ্রাহ্য করে ড্রাইভার গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে সিতরোটাকে প্লাজার পাথরের চত্বরে তুলে নিলে লুভরের মূল প্রবেশ পথটি দৃষ্টিগোচর হলো। দূর থেকে সেটাকে খুব উদ্যতভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। একটা বিশালাকৃতির ত্রিভুজ। জ্বলজ্বল করছে সেটা।

 

লা পিরামিদ।

 

প্যারিসের লুভরের নতুন প্রবেশ পথ, জাদুঘরটির মতোই বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। বির্তকিত, অতি-আধুনিক কাঁচের পিরামিডটি চায়নিজ বংশোদ্ভূত আমেরিকান স্থপতি আই এম পেইর নক্সা করা, আজো সেটা ঐতিহ্যবাদীদের দ্বারা সমালোচিত হয়ে আসছে, যারা মনে করে এটা বেঁনেসা ভবনের প্রাঙ্গণটির মর্যাদা নষ্ট করে ফেলেছে। গ্যোতে স্থাপত্যকলাকে জমে যাওয়া সঙ্গীত হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। আর পেইর সমালোচকরা এই পিরামিডকে ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর ভাঙা নখ বলে উল্লেখ করে থাকে। প্রগতিশীল ভক্তরা অবশ্য পেইর একাত্তর ফুট উঁচু স্বচ্ছ এই পিরামিডকে প্রাচীন স্থাপনা এবং আধুনিক পদ্ধতির অসাধারণ সম্মিলন বলে মনে করে—পুরাতন এবং নতুনের মধ্যে একটা প্রতীকি যোগসূত্র লুভরকে নতুন সহস্রাব্দে প্রবেশ করতে সাহায্য করেছে।

 

আপনি কি আমাদের পিরামিডটি পছন্দ করেন? পুলিশের লোকটি জিজ্ঞেস করলো।

 

ল্যাংডন ভূরু কুকালো। মনে হয়, ফরাসিরা আমেরিকানদের এই কথাটা জিজ্ঞেস করতে পছন্দ করে। এটা একটা উভয় সংকটের প্রশ্ন, অবশ্যই পিরামিডটাকে ভালো লাগছে বলে মেনে নিলে আপনাকে একজন রুচিহীন আমেরিকান হিসেবে দেখা হবে, আর অপছন্দের কথা প্রকাশ করলে সেটা ফরাসিদেরকে অপমান করা হবে।

 

মিতের একজন সাহসী মানুষ ছিলেন, ল্যাংডন জবাব দিলো, ভিন্ন পথে এগোলো সে। প্রয়াত ফরাসি প্রেসিডেন্ট যিনি পিরামিডটি স্থাপনে সম্মতি দিয়েছিলেন, বলা হয়ে থাকে তিনি ফেরাউনের জটিলতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। মিশরীয় অবিলিস্ক, চিত্র আর শিল্পকলায় প্যারিস ভরে ফেলার জন্য তাকে দায়ী করা হয়, সেই ফ্রাসোয়া মিতেরর মিশরীয় সংস্কৃতির ব্যাপারে দারুণ আগ্রহ এবং শ্রদ্ধা থাকার দরুণ তাঁকে এখনও স্ফিংস হিসেবে অভিহিত করা হয়।

 

ক্যাপ্টেনের নাম কি? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো। আলোচনাটা বদলে ফেললো সে।

 

বেজু ফশে, পিরামিডের মূল প্রবেশ পথের দিকে এগোতে এগোতে ড্রাইভার বললো। আমরা তাকে বলি লো তাঊরু।

 

ল্যাংডন তার দিকে তাকালো, ভাবলো, সব ফরাসিরই কি একটা করে জম্ভ জানোয়ারের নামে ডাক নাম রয়েছে কিনা।

 

আপনারা আপনাদের ক্যাপ্টেনকে বৃষল, মানে ষাড় বলে ডাকেন?

 

লোকটা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালো। আপনার ফরাসি খুব ভালো, যতোটা আপনি স্বীকার করেন, তারচেয়েও বেশি ভালো, মঁসিয়ে ল্যাংডন।

 

আমার ফরাসি খুব ভালো নয়, ল্যাংডন ভাবলো, কিন্তু আমার রাশিফলের প্রতীক সংক্রান্ত জ্ঞান বেশ ভালোই বলা যায়। তাউরাস মানে বৃষ, অর্থাৎ ষাড়। জ্যোতিষ বিজ্ঞানের প্রতীকগুলো সারা পৃথিবীতে প্রায় একই রকম।

 

পুলিশের লোকটা গাড়িটাকে একটা জায়গায় থামিয়ে পিরামিডের পাশে একটা বড় দরজার দিকে ইঙ্গিত করলো।

 

এটা হলো প্রবেশ পথ। গুডলাক, মঁসিয়ে।

 

আপনারা আসছেন না?

 

আপনাকে এই পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার নির্দেশই ছিলো আমার কাছে। আমার অন্য খানে কাজ রয়েছে।

 

ল্যাংডন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো। এটা আপনার সার্কাস।

 

পুলিশের লোকটা গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে চলে গেলো।

 

গাড়িটা চলে যাওয়ার পর ল্যাংডের মনে হলো, ইচ্ছে করলে সে এখান থেকে খুব সহজেই উল্টো পথে চলে যেতে পারে। প্রাঙ্গন থেকে বেড় হয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে ঘুমাতে পারে। কিন্তু তার এও মনে হলো এই আইডিয়াটা সম্ভবত খুব বাজে একটা ব্যাপার হবে।

 

ভেতরে ঢুকেই ল্যাংডনের মনে হলো একটা কাল্পনিক জগতে ঢুকে পড়ছে সে, অস্বস্তিকর লাগছে তার। রাতের পরিবেশটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। বিশ মিনিট আগে সে হোটেলে ঘুমিয়ে ছিলো। এখন দাঁড়িয়ে আছে একটা স্বচ্ছ পিরামিডের সামনে যেটা তৈরি করেছে একজন স্ফিংস আর সে অপেক্ষা করছে এক পুলিশের জন্য, যাকে সবাই ডাকে ষাড় বলে।

 

আমি সালভাদোর দালির চিত্রকর্মের মধ্যে আঁটকা পড়ে গেছি। সে ভাবলো।

 

ল্যাংডন মূল প্রবেশ পথের দিকে এগোতে লাগলো—একটা বিশাল ঘূর্ণায়মান দরজা। ভেতরের ফয়ারটা পেরিয়ে গেলে দেখা গেলো জায়গাটা আঁধো আলো অন্ধকার আর একেবারেই ফাঁকা। আমি নক করবো?

 

ল্যাংডন অবাক হয়ে ভাবলো হারভার্ডের কোন ইজিপ্টোলজিস্ট কি কখনও কোন পিরামিডের দরজায় নক করে কোন জবাবের আশা করেছিলো কিনা। সে কাঁচের ওপর টোকা মারার জন্য হাত ওঠাতেই নিচের অন্ধকার থেকে একজন মানুষের অবয়ব আসতে দেখলো। লোকটা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে। দেখতে শক্তসামর্থ্য আর কালো, প্রায় নিয়ানডারথাল মানুষের মতো, পরে আছে কালো ডাবল ব্রেস্টের সুট যা তার চওড়া কাঁধটাকে ঢেকে রেখেছে। সে অগ্রসর হচ্ছে অভ্রান্ত কর্তৃত্বসহকারে, দৃঢ় পদক্ষেপে। লোকটা ফোনে কথা বলছে কিন্তু তার সামনে আসতেই ফোনটা ছেড়ে দিয়ে ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে।

 

আমি বেজু ফশে, ল্যাংডন ঘূর্ণায়মান দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সে ঘোষণা দিলো। সেন্ট্রাল জুডিশিয়াল পুলিশের ক্যাপটেন। তার কণ্ঠ খুবই স্পষ্ট—গম গম করছে … যেনো আকাশে মেঘের গর্জন।

 

ল্যাংডন হাত মেলাবার জন্য নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো। রবার্ট ল্যাংডন।

 

ফশের বড়সড় হাতের পাঞ্জাটি ল্যাংডনের হাতটি সজোড়ে ধরে প্রচণ্ড জোড়ে চাপ দিলো।

 

ছবিটা আমি দেখেছি। ল্যাংডন বললো, আপনার লোক আমাকে বলেছে জ্যাক সনিয়ে নিজেই এটি করেছেন–

 

মি. ল্যাংডন, ফশের কঠিন কালো চোখ তার ওপর আঁটকে আছে। আপনি ছবিতে যা দেখেছেন তা সনিয়ে যা করেছে তার গুরু মাত্র।

 

 

 

০৪.

 

ক্যাপ্টেন বেজু ফশে ক্রুব্ধ ষাড়ের মতো ফুঁসছে। তার চওড়া কাঁধটা একটু পেছনের দিকে হেলে থুতনিটা বুকের কাছে আঁটকে আছে। তেল দেবার জন্য কালো চুলগুলো চক্ করছে। কপালের সম্মুখভাগটি তীরের মতো উচিয়ে আছে, আর ভূরু দুটো যেনো সেটা বিভক্ত করে রেখেছে। কাছে আসতেই তার কালো চোখ দুটো আরো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। জ্বল জ্বল করা চোখ দুটো তার সুনামকে আরো বেশি প্রকট করে তুলেছে।

 

কাঁচের পিরামিডের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া বিখ্যাত মার্বেল সিঁড়ি দিয়ে আর্টিয়ামের ভেতরে ল্যাংডন ফশের পিছু পিছু চললো। তারা এগোতেই দুজন অস্ত্রধারী জুডিশিয়াল পুলিশের দেখা পেলো। তাদের হাতে রয়েছে মেশিনগান। ব্যাপারটা খুব পরিষ্কার : আজরাতে কেউ এখান থেকে ক্যাপ্টেন ফশের আশীর্বাদ ছাড়া ঢুকতে এবং বের হতে পারবে না।

 

গ্রাউন্ড লেবেলের নিচে যেতে যেতে ল্যাংডন ক্রমাগত একটা কাঁপুনি থেকে নিজেকে বাঁচাতে লড়াই করলো। ফশের উপস্থিতি সুখকর নয়, আর লুকেও এই সময়টাতে প্রায় জীবন্ত কবর দেয়ার ভূগর্ভস্থ কবরখানা বলেই মনে হচ্ছে। সিঁড়িটা অন্ধকার সিনেমা হলের মতো। ল্যাংডন তার নিজের পায়ের শব্দ শুনতে পেলো। শব্দটা উপরের কাছে প্রতিফলিত হচ্ছে। সেখানে তাকাতেই ল্যাংডন দেখলো স্বচ্ছ কাঁচের ছাদটা। বাইরের আলো সেখানে মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

 

আপনি কি এটা পছন্দ করেন? ফশে জিজ্ঞেস করলো, থুতনিটা একটু উপরের দিকে তুলে মাথা নাড়লো সে।

 

ল্যাংডন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো, সে এসব খেলার জন্য খুব বেশিই ক্লান্ত। হ্যাঁ, আপনাদের পিরামিডটা সত্যি বিস্ময়কর।

 

ফশে ঘোৎঘোৎ করে উঠলো। প্যারিসের চেহারায় এটা একটা কলঙ্কের দাগ।

 

লেগেছে। ল্যাংডন বুঝতে পারলো তার সামনের লোকটাকে খুশি করা মোটেই সহজ কাজ নয়। সে ভাবলো, ফশের কি কোন ধারণা আছে যে, এই পিরামিডটা যা প্রেসিডেন্ট মিতেরর প্রচণ্ড দাবি ছিলো, সেটা নির্মিত হয়েছে একেবারে কাটায় কাটায় ৬৬৬টা স্প্যান দিয়ে একটা অদ্ভুত অনুরোধ ছিলো সেটা, যা সব সময়ই সমালোচক ও নিন্দুকদের কাছে গরম আলোচনার বিষয় হয়ে আছে, যারা দাবি করে ৬৬৬টি হলো শয়তানের সংখ্যা। ত

 

ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিলো এই প্রসঙ্গটি তুলবে না।

 

তারা যখন আরো নিচে নামতে লাগলো তখন অন্ধকার ভেদ করে জায়গাটা দৃষ্টির গোচরে চলে এলো। মাটি থেকে সাতান্ন ফিট নিচে তৈরি করা লুভরের নতুন স্থাপনা ৭০০০০ বর্গফুটের লবিটাকে মনে হবে অন্তহীন এক গুহা। উপরে লুভরের জমিন যে রকম মধু-রঙের পাথর দিয়ে তৈরি তার সাথে মিল রেখেই এ জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে উষ্ণতা নিরোধক মার্বেল পাথর। নিচের এই জায়গাটি সাধারণত সূর্যের আলো এবং পর্যটকদের পদভারে কম্পিত হয়। আজরাতে, অবশ্য লবিটা অন্ধকার আর ফাঁকা মনে হচ্ছে। আর এতে করে পুরো জায়গাটিতে এক ধরনের হিমশীতল পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

 

মিউজিয়ামের নিয়মিত নিরাপত্তারক্ষীরা কোথায়? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

 

এঁ কোরাতোঁয়া, ফশে এমনভাবে জবাব দিলো যেনো ল্যাংডন ফশের দলটির কর্তব্যনিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। নিশ্চিতভাবেই, আজরাতে এখানে কেউ প্রবেশ করেছিলো যার এভাবে প্রবেশ করাটা ঠিক হয়নি। রাতের বেলায় লুভরের দায়িত্বে থাকা সব ধরনের লোককেই এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আমার লোকজন আজ রাতের জন্য লুভরের নিরাপত্তার ভার নিয়ে নিয়েছে।

 

ল্যাংডন মাথা নেড়ে ফশের সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে চললো।

 

জ্যাক সনিয়েকে আপনি কি রকম চেনেন? ক্যাপ্টেন জিজ্ঞেস করলো।

 

সত্যি বলতে কী একদমই না। আমরা কখনও দেখা করিনি।

 

ফশেকে দেখে মনে হলো খুব অবাক হয়েছে। আপনাদের প্রথম সাক্ষাতটি সম্ভবত আজরাতে হবার কথা ছিলো?

 

হ্যাঁ। আমরা ঠিক করেছিলাম আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে আমার বক্তৃতা শেষ হবার পরপরই সেখানে মিলিত হবো। কিন্তু উনি আসেন নি।

 

ফশে একটা নোটবইয়ে কিছু টুকে নিলো। তারা এগোতেই ল্যাংডনের চোখ পড়লো লুভরের লেজার হিসেবে পরিচিত পিরামিডের দিকে—লা পিরামিদ ইনভার্সি—একটা বিশাল উল্টো পিরামিড আকৃতির স্কাইলাইট, যা সিলিং থেকে ঝুলে আছে। প্রবেশ পথের টানেল দিয়ে যাবার জন্য ফশে ল্যাংডনকে ছোট্ট একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে গেলো। সেই টানেলের প্রবেশ মুখের উপরে সাইনবোর্ডে লেখা আছে: ডেনন।

 

ডেনন উইং হলো লুভরের প্রধান তিনটি সেশনে মধ্যে সবচাইতে বিখ্যাত।

 

আজকের সাক্ষাতের জন্য কে অনুরোধ করেছিলো? ফশে আচমকা জিজ্ঞেস করলো। আপনি, নাকি উনি?

 

প্রশ্নটিকে একটু অদ্ভুত মনে হলো। মি. সনিয়ে, ল্যাংডন টানেলে ঢুকতে ঢুকতে কথাটা বললো। উনার সেক্রেটারি ই-মেইলের মাধ্যমে আমার সাথে কয়েক সপ্তাহ আগে যোগাযোগ করেছিলেন। সে-ই আমাকে বলেছিলো যে কিউরেটর জানতে পেরেছেন আমি এ মাসে প্যারিসে একটা বক্তৃতা দেবো আর তখন তিনি আমার সাথে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন।

 

কিসের আলোচনা?

 

আমি জানি না। মনে হয় চিত্রকলা সম্পকে। আমাদের আগ্রহ একই ধরনের বিষয়ে।

 

ফশেকে দেখে মনে হলো সন্দেহপ্রবণ। সাক্ষাতের বিষয় সম্পর্কে আপনার কোন ধারণাই নেই?

 

ল্যাংডনের কোন ধারণাই ছিলো না। সেই সময়ে সে খুব বেশি কৌতূহলী ছিলো এবং নির্দিষ্ট কোন বিষয়ে আলোচনা হবে সেটা জিজ্ঞেস করাটা তার কাছে সংগত মনে হয়নি। শ্রদ্ধেয় জ্যাক সনিয়ে নিজের একান্ত বিষয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য সুপরিচিত ছিলেন এবং খুব কম সাক্ষাতই অনুমোদন করতেন তাই ল্যাংডন তার সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়ে কৃতজ্ঞই ছিলো।

 

মি. ল্যাংডন, আপনি কি অনুমান করতে পারেন, আমাদের খুন হওয়া ব্যক্তিটি আসলে কী বিষয় নিয়ে আপনার সাথে আজরাতে দেখা করতে চেয়েছিলেন? এটা জানা খুবই দরকারী।

 

প্রশ্নটির ইঙ্গিত ল্যাংডনকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলো।

 

আমি আসলেই অনুমান করতে পারছি না। আমি জিজ্ঞেস করিনি। উনার সাথে যোগাযোগ হবে এই ভেবে আমি খুব সম্মানিত বোধ করেছিলাম। আমি মি. সনিয়ের কাজকে খুব শ্রদ্ধা করি। তার ভক্ত ছিলাম। উনার লিখিত বইপত্র প্রায়শই শ্রেণী কক্ষে ব্যবহার করতাম।

 

ফশে তার নোট বইয়ে এইসব টুকে নিলো।

 

দুজন লোক তখন ডেনন উইংসর প্রবেশ পথের টানেলের অর্ধেক পথে এসে পড়েছে। ল্যাংডন দেখতে পেলো পথের শেষ মাথায় এক জোড়া এসকেলেটর। দুটোই। থেমে আছে। ততা, আপনারা একই বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন? ফশে জিজ্ঞেস করলো।

 

হ্যাঁ। সত্যি বলতে কী, গতবছরের বেশিরভাগ সময়ই আমি এমন একটি বিষয়ে বই লিখতে ব্যস্ত ছিলাম যে বিষয়ে মি. সনিয়ের বেশ দক্ষতা ছিলো। আমি উনার মাথা থেকে আরো কিছু জিনিস নিতে চাচ্ছিলাম।

 

কথাটা বোধ হয় ফশে ঠিক বুঝতে পারলো না।

 

আমি উনার চিন্তাভাবনা সমূহ সম্পর্কে জানতে চাইছিলাম আর কী।

 

আচ্ছা। বিষয়টা কি ছিলো?

 

ল্যাংডন দ্বিধান্বিত হলো, কীভাবে বলবে ঠিক বুঝতে পারছিলো না। লেখার বিষয় বস্তু ছিলো দেবীদের আইকনোগ্রাফি সম্পর্কিত-পবিত্র নারী, পূজা এবং তার সাথে চিত্রকলা আর প্রতীকের সংযোগ।

 

ফশে তার চুলে আলতো করে আঙ্গুল চালালো। সনিয়ের এ ব্যাপারে খুব জানালোনা ছিলো?

 

তাঁর চেয়ে বেশি কেউ জানতো না।

 

বুঝেছি।

 

ল্যাংডন বুঝতে পারলো ফশে আসলে কিছুই বোঝেনি। জ্যাক সনিয়েকে দেবী আইকনোগ্রাফির ব্যাপারে এ বিশ্বে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শুধুমাত্র পূরাকীর্তি সংক্রান্ত দেবী পূজা, স্ত্রী পূজা, উইকা এবং পবিত্র নারী সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণেই নয়, বরং লুভরে বিশ বছর ধরে কিউরেটর হিসেবে থাকাকালীন সময়ে সনিয়ে লুভরে সারা পৃথিবীর দেবীদের চিত্রকলার এক বিশাল সংগ্রহ তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন লাবরিজ এর কুড়াল থেকে প্রাচীন গৃকের ডেলফির মন্দিরের নারী যাজকদের চিত্রকলা, স্বর্ণ কাচি ওয়ান্ডস, শত শত ইয়েত আখ, প্রাচীন মিশরে শয়তানের ক্ষমতা রহিতকরণের জন্য ব্যবহার করা এক ধরনের গোখরা সাপ এবং আইসিস দেবীর সেবায় রত হোরাসের বিস্ময়কর ভাস্কর্য।

 

সম্ভবত জ্যাক সনিয়ে আপনার পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে জানতো?  ফশে বললো, তিনি আপনার বইয়ের জন্য তাঁর সাহায্যের ব্যাপরে সাক্ষাতের প্রস্তাব করেছিলেন।

 

ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো। আসলে, এখন পর্যন্ত আমার পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। সেটা এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। আমি ওটা আমার সম্পাদক ছাড়া আর কাউকে দেখাইনি।

 

ফশে চুপ মেরে গেলো।

 

ল্যাংডন পাণ্ডুলিপিটা কেন অন্য কাউকে দেখায়নি সেটা অবশ্য বললো না। তিনশ পৃষ্ঠার খসড়া আকর্ষনীয় শিরোনাম সিম্বলস অব দি লস্ট স্যাকরেড ফেমিনিন–সমকালীন প্রতিষ্ঠিত ধর্মমতগুলোর আইকনোগ্রাফি সম্পর্কে কিছু নতুন ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে যা নিশ্চিত ভাবেই বির্তকিত হবে।

 

এখন, থেমে থাকা এসকেলেটরের কাছে এগোতেই ল্যাংডনের মনে হলো ফশে তার পাশে নেই। লাংডন ঘুরে দেখে ফশে একটা লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

 

আমরা লিফটে যাবো, লিফটের দরজাটা খুলতেই ফশে বললো। আমি নিশ্চিত, আপনি জানেন, গ্যালারিটি পায়ে হেটে যাওয়ার জন্য একটু বেশিই হয়ে যায়।

 

যদিও ল্যাংডন জানতো যে লিফটে মাত্র দুতলা গেলেই ডেনন উইংস। সে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

 

কিছু হয়েছে কি? ফশে দরজায় হাত দিয়ে অধৈর্যের সাথে বললো।

 

ল্যাংডন ক্লান্ত ভঙ্গীতে থেমে থাকা এসকেলেটরের দিকে তাকালো। কিছুই হয়নি, সে নিজের সাথে মিথ্যে বললো। লিফটের দিকে পেছন ফিরে রইলো সে। ছেলেবেলায় ল্যাংডন একটা পরিত্যাক্ত কুয়ায় পড়ে গিয়ে পানিতে ডুবে মরতে বসেছিলো—সেখানে একঘণ্টা আটকে ছিলো। তারপর মরে যাওয়ার আগেই তাকে উদ্ধার করা হয়েছিলো। এরপর থেকেই বদ্ধ কোন জায়গায় ঢুকলেই তার প্রচণ্ড ভয় করে—লিফট, ভূগর্ভস্থ পথ, স্কোয়াশ কোর্ট সসব জায়গায়। লিফট খুবই নিরাপদ একটা জায়গা, ল্যাংডন ক্রমাগত নিজেকে বলে চললো। অবশ্য এ কথা সে কখনও বিশ্বাস করে না। এটা একটা ছোট্ট লোহার বাক্স, বদ্ধ একটা জায়গায় ঝুলে আছে! বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে সে লিফটের ভেতরে প্রবেশ করলো। অতি পরিচিত শিড়দাঁড়া বেয়ে শীতল একটা অনুভূতি টের পেলো সে।

 

দুই তলা। দশ সেকেন্ড মাত্র।

 

আপনি এবং মি. সনিয়ে, লিফটা চলতে শুরু করলে ফশে বলতে শুরু করলো, কখনও কথা বলেন নি? ই-মেইল আদান প্রদান করেননি?

 

আরেকটা অদ্ভুত প্রশ্ন। ল্যাংডন মাথা নাড়লো। না, কখনও না।

 

ফশে মাথাটা দোলাতে লাগলো যেনো এই কথাটা সে মনে মনে টুকে নিচ্ছে কিন্তু কিছুই বললো না, ঠিক সামনের ক্রোম দরজাটার দিকে চেয়ে রইলো। লিফটা চলতে শুরু করলে ল্যাংডন অন্য কিছুর দিকে না তাকিয়ে চার দেয়ালের দিকে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। লিফটের চঞ্চকে দরজার দিকে চেয়ে দেখলো সেখানে ক্যাপ্টেনের টাই বাঁধা দৃশ্যটা প্রতিফলিত হচ্ছে—একটা সিলভার ক্রুশ, সেই তেরোটি কালো অকীক মণির কারুকাজ খচিত। ল্যাংডনের কাছে এটা খুবই বিস্ময়কর বলে মনে হলো। সে অবাকই হলো বলা যায়। প্রতীকটি কুক্স জেমাতা হিসেবেই পরিচিত একটা ক্রুশ যাতে রয়েছে তেরোটি জেম বা পাথর বসানো—একটি বৃস্টিয় আদর্শ প্রতীক, যিশু এবং তার বারোজন শিষ্য। যাহোক, ল্যাংডন কোনভাবেই এটা আশা করেনি যে, ফরাসি পুলিশের কোন ক্যাপ্টেন তার ধর্মকে এরকম খোলাখুলিভাবে প্রচার করবে। তারপরও বলতে হয়, এটা ফ্রান্স; খৃস্টান ধর্ম এখানে জন্ম অধিকার হিসেবে খুব একটা স্বীকৃত নয়।

 

এটা ক্রুক্স জেমমাতা, ফশে আচমকা কথাটা বললো। ল্যাংডন চমকে চেয়ে দেখে ফশের চোখ তার উপর। লিফটা থেমে গেলে দরজাটা খুলে গেলো।

 

ল্যাংডন খুব দ্রুতই ভেতর থেকে বের হয়ে এলো, খোলামেলা বিশাল কোন স্থানের জন্য উদগ্রীব ছিলো সে। লুভরের বিখ্যাত গ্যালারির উঁচু সিলিংয়ের নিচে এসে হাফ ছেড়ে বাচলো। যে জায়গায় সে এসে পড়লো, সেটা আর যাই হোক তার কাছে প্রত্যাশিত ছিলো না।

 

বিস্মিত ল্যাংডন থেমে দাঁড়ালো।

 

ফশে তার দিকে তাকিয়ে বললো, মনে হয় মি. ল্যাংডন, আপনি কখনও বন্ধ হয়ে যাবার পর লুভর দেখেননি।

 

মনে হয় না দেখেছি? ল্যাংডন ভাবলো, অন্যমনস্কতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করলো।

 

যে লুভর সবসময় আলো ঝলমলে চোখ ধাঁধানো অবস্থায় থাকে সেই জায়গাটা আজরাতে কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে। উপর থেকে সাদা ফ্লাড লাইট জ্বলা সত্ত্বেও একটা ছোট লালবাতির আভাই বেশি চোখে পড়ছে—লাল আলোর ছটা টাইলসের ফ্লোরে পড়াতে জায়াগাটাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে।

 

ল্যাংডন অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডোরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এই দৃশ্যটা প্রত্যাশা করাই উচিত ছিলো তার। বলতে গেলে প্রায় সব প্রধান প্রধান গ্যালারিতেই রাতের বেলায় লাল বাতি জ্বলিয়ে রাখা হয় বিশেষ বিশেষ জায়গায় এমন ভাবে এগুলো রাখা হয় যাতে এইসব নরম আর হালকা আলোতে কর্মচারীরা চলাফেরা করতে পারে। চিত্রকর্মগুলো তার চেয়েও বেশি অন্ধকারে রাখা হয়, কড়া আলোয় ছবিগুলোর ক্ষয় দ্রুত হয় সেজন্যে। আজরাতে মিউজিয়ামটি খুব বেশি অস্বস্তিকর বলে মনে হচ্ছে। সব জায়গায় দীর্ঘ ছায়া ছড়িয়ে আছে আর উঁচু উঁচু ছাদগুলো অন্ধকারে খুব বেশি নিচু লাগছে।

 

এদিক দিয়ে আসুন, ফাশ বললো, ডানদিকে ঘুরে একাধিক গ্যালারির সংযোগস্থলের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। ল্যাংডন তাকে অনুসরণ করলো, অন্ধকারে আস্তে আস্তে তার চোখ মানিয়ে নিতে শুরু করেছে। তার মনে হলো চারদিকের তৈলচিত্রগুলে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, অনেকটা ছবি তৈরির ডার্ক রুমে যেভাবে ছবিগুলো আস্তে আস্তে ফুটে ওঠে…সে সব চিত্রকর্মগুলো যেনো তাদেরকে চেয়ে চেয়ে দেখছে। সে জাদুঘরের চিরচেনা বাতাসের গন্ধটা টের পেলো সে—একটা শুষ্ক, হাল্কা কার্বনের গন্ধ-শিল্প-কারখানার মতো কোলফিল্টারটা সারাদিনের আগত দর্শনার্থীদের ত্যাগ করা কার্বন-ডাই-ওক্সইডকে শুষে নিচ্ছে।

 

দেয়ালের খুব উঁচুতে, নিরাপত্তা ক্যামেরাগুলো দৃষ্টির গোচরে এলো। সেগুলো যেনো দর্শনার্থীদের কাছে একটা পরিষ্কার বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে : আমরা তোমাদের দেখছি। কোন কিছু স্পর্শ কোরো না।

 

সবগুলোই কি আসল? ক্যামেরাগুলোর দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

 

ফশে মাথা নাড়লো। অবশ্যই না।

 

ল্যাংডন একটুও অবাক হলো না। এ রকম একটা বিশাল জাদুঘরে ভিডিও সার্ভিলেন্স করাটা অসম্ভব ব্যয়বহুল আর অকার্যকর। কয়েক একরের গ্যালারিতে নজর দারি করতে হলে শুধুমাত্র ক্যামেরার ছবি মনিটরিং করার জন্যই লুভরের দরকার হবে শত শত টেকনিশিয়ান। বড় বড় জাদুঘরগুলো বর্তমানে কনটেইনমেন্ট সিকিউরিটি ব্যবহার করে থাকে। চোরদেরকে বাইরে রাখার কথা ভুলে যাও। তাদেরকে ভেতরেই রাখো। অবরুদ্ধ করা, মানে কনটেইনমেন্ট সিস্টেমটা জাদুঘর বন্ধ হবার সাথে সাথেই চালু করা হয়। আর এখন যদি কোন অনুপ্রবেশকারী কোন একটা শিল্পকর্ম সরিয়ে ফেলে, তবে পুরো গ্যালারিটির বের হবার পথ সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে। চোর তখন পশিল আসার আগেই জেলখানার.গারদের ভেতরে নিজেকে আবিষ্কার করবে।

 

মার্বেল পাথরের করিডোর থেকে মানুষের কণ্ঠস্বরের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়ে আসতে লাগলো। শব্দগুলো সম্ভবত ডানদিকের নিচতলার কোন প্রকোষ্ঠ থেকে আসছে। হলওয়ের ওপর উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে আছে।

 

এটা কিউরেটরের অফিস। ক্যাপ্টেন বললো।

 

বারান্দা দিয়ে যাবার সময় ল্যাংডন হলওয়ের নিচের দিকে একটু তাকিয়ে দেখলো, সনিয়ের অভিজাত পড়ার ঘরটা উষ্ণ কাঠের তৈরি, পুরনো তৈলচিত্র আর বড়সড় একটা পুরনো আমলের ডেস্ক, যার ওপর দুই ফুট লম্বা বর্ম পরিহিত একটা নাইটের মূর্তি রাখা। ঘরটার ভেতরে কয়েকজন পুলিশ অফিসার, ফোনে কথা বলছে, নোট নিচ্ছে। তাদের একজন সনিয়ের ডেস্কে বসে ল্যাপটপে টাইপ করছে। প্রকারন্তরে কিউরেটরের ব্যক্তিগত কক্ষটি ডিসিপিজের আজ রাতের কমান্ড-পোস্ট হয়ে উঠেছে।

 

মেঁসিয়ে, ফশে ডাক দিলে লোকটা তার দিকে ঘুরে তাকালো। নিনো দোরাঁগেজ পাস সু আঁক প্রিতেক্স। এঁতেদু?

 

অফিসের সবাই কথাটা বুঝতে পেরে মাথা নাড়লো।

 

ল্যাংডন নো পাস দোরাঁগেজ চিহ্নসম্বলিত কার্ড হোটেলের ঘরের বাইরে ঝুলিয়ে রাখে, সে ক্যাপ্টেনের কথার সারমর্মটা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারলো। ফশে আর ল্যাংডনকে কোন কারণে যেনো বিরক্ত করা না হয়।

 

পুলিশের দলটাকে পেছনে রেখে ফশে ল্যাংডনকে নিয়ে আরো বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন হলওয়ের দিকে এগিয়ে গেলো। লুভরের সবচাইতে জনপ্রিয় গ্যালারিটা আর মাত্র ত্রিশ ফুট দূরে–লা গ্রঁ গ্যালারি—প্রায় এক অন্তহীন দীর্ঘ করিডোর, যেখানে রয়েছে লুভরের সবচাইতে মূল্যবান ইতালিয় মাস্টারপিসগুলো। ল্যাংডন এতোক্ষণে বুঝে গিয়েছে, সনিয়ের মৃত দেহটা এখানেই পড়ে আছে; গ্র্যান্ড গ্যালারির বিখ্যাত কাঠের নক্সা করা জমিনটা পোলারয়েড ক্যামেরায় অভ্রান্তভাবেই ফুটে উঠেছিলো।

 

তারা এগোতেই ল্যাংডন দেখতে পেলো প্রবেশ পথটি বড় একটা লোহার গেট দিয়ে আঁটকানো আছে ; যেনো মধ্যযুগের রাজপ্রাসাদগুলো মারাউদিং সৈন্যদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য এসব ব্যবহার করছে।

 

কনটেইনমেন্ট সিকিউরিটি, গেটের সামনে পৌঁছাতেই ফশে বললো।

 

এমনকি অন্ধকারেও ঐ গেটটা দেখে মনে হলো সেটা একটা ট্যাংককেও আটকে দিতে পারবে। বাইরে থেকেই ল্যাংডন লোহার গৃলের ভেতর দিয়ে স্বল্প আলোর গ্র্যান্ড গ্যালারিটা দেখতে পেলো।

 

আপনার সামনেই, মি. ল্যাংডন, ফশে বললো।

 

ল্যাংডন ফিরে দেখলো। আমার সামনে, কোথায়?

 

ফশে স্থির হয়ে গৃলের নিচে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। ল্যাংডনও নিচে তাকালো। অন্ধকারে সে খেয়াল করেনি। গৃলটা দুফুটের মতো উপরে উঠানো। তাতে করে নিচে কি আছে সেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

 

এই জায়গাটা এখনও লুভরের নিরাপত্তার বাইরে রয়েছে, ফশে বললো। আমার পুলিশ তেকনিক এ সাইস্তিফিক-এর দলটি একটু আগেই তাদের তদন্ত শেষ করেছে। সে গৃলের দিকে এগিয়ে গেলো। প্লিজ, নিচ দিয়ে আসুন।

 

ল্যাংডন সেই সরু জায়গাটার দিকে তাকিয়ে বিশাল লোহার গৃলটার উপরের দিকে তাকালো। ঠাট্টা করছে, তাই না? লোহার গৃলের ব্যারিকেডটা দেখে মনে হচ্ছে একটা গিলোটিন, অনুপ্রকেশকারীর গলা কাটার জন্য অপেক্ষা করছে।

 

ফশে ফরাসিতে বিড়বিড় করে কিছু বলে ঘড়ির দিকে তাকালো, তারপর হাটু গেঁড়ে গৃলের নিচ দিয়ে গড়িয়ে ভেতরে চলে গেলো। অন্যপ্রান্তে গিয়ে গৃলের ভেতর দিয়ে ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে।

 

ল্যাংডন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হাতের তালু পালিশ করা কাঠের জমিনে রেখে শুইয়ে পড়ে নিচ দিয়ে গড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। নিচ দিয়ে যাবার সময় তাঁর হ্যারিস টুইড টাইটা আঁটকে গেলে ল্যাংডনের মাথাটা একটু পেছনের দিকে টান লাগলো। মাথাটা টুক করে লোহার গৃলের সাথে লাগলে ব্যথা পেলো সে।

 

খুবই ভালো, রবার্ট, সে ভাবলো। একটু হোচট খেয়ে শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়ালো। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই ল্যাংডনের এই আশংকা হতে শুরু করলো যে, আজকের রাতটা খুব দীর্ঘ হবে।

 

 

 

০৫.

 

মুরে হিল–ওপাস দাইর নতুন বিশ্ব সদর দফতর এবং কনফারেন্স সেন্টার নিউইয়র্ক শহরের ২৪৩ লেক্সিংটন এভিনুতে অবস্থিত। ৪৭ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি টাকা ব্যয়ে নির্মিত, ১৩৩০০০ বর্গফুটের টাওয়ারটা লাল ইট আর ইন্ডিয়ানা লাইমস্টোন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। মে এন্ড পিংসার নক্সায় করা এই দালানটাতে রয়েছে একশরও বেশি শোবার ঘর, ছয়টা ডাইনিং-রুম, লাইব্রেরি, বৈঠকখানা, মিটিং-রুম এবং অফিস ঘর। তৃতীয় অষ্টম এবং ঘোড়শ তলাগুলো গীর্জা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেগুলো মিলওয়ার্ক এবং মার্বেল দিয়ে সাজানো। সতেরো তলাটি পুরোপুরি আবাসিক কাজে ব্যবহার করা হয়। পুরুষেরা এই ভবনে লেক্সিংটন এভিনুর দিকের প্রধান দরজাটা দিয়ে প্রবেশ করে আর মহিলারা প্রবেশ করে পাশের রাস্তা বরাবর একটা আলাদা দরজা দিয়ে। তাদেরকে এই ভবনে শাব্দিক এবং দৃশ্যগত। উভয় দিক থেকে সবসময়ই পৃথক করে রাখা হয়।

 

আজকের রাতের প্রথম দিকে, নিজের এপার্টমেন্টের পবিত্র আবহাওয়ার মধ্যে বিশপ ম্যানুয়েল আরিজারোসা ছোট্ট একটা ট্রাভেলব্যাগ গোছগাছ করে ঐতিহ্যবাহী কালো পোশাক পরে তৈরি হয়ে গেলেন। সাধারণত তিনি কোমরে বেগুনি রঙের একটা সিনচুয়ার জড়িয়ে নেন, কিন্তু আজ রাতে তিনি জনসাধারনের মধ্যে যাতায়াত করবেন। তাই ঠিক করলেন কারোর মনোযোগ যাতে আকর্ষিত না হয় যে, তিনি একজন বিশপ। শুধুমাত্র অভিজ্ঞ চোখই তার হাতের ১৪ ক্যারেটের সোনার আংটিটা দেখে তাঁকে চিনতে পারবে। যাতে রয়েছে পার্পল অ্যামেথিস্ট, বড় একটা হীরা এবং হ্যান্ডটুল মিরে ক্রোজিয়ের এপলিক পাথর। ট্রাভেল ব্যাগটা কাঁধে ফেলে তিনি নিরবে একটা প্রার্থনা। সেরে নিয়ে নিজের এপার্টমেন্ট ত্যাগ করলেন। লবিতে তার ড্রাইভার তাকে বিমান। বন্দরে নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।

 

এখন, রোমের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়া একটা বাণিজ্যিক বিমানে বসে আরিঙ্গারোসা জানালা দিয়ে ঘন কালো আটলান্টিকের দিকে তাকালেন। সূর্য ইতিমধ্যে উদয় হয়েছে, কিন্তু অরিঙ্গাবোসা জানতেন তাঁর নিজের আকাশের তারা উঠে গেছে। আজ রাতে যুদ্ধ জয় হবে, ভাবলেন তিনি, বিস্ময়কর ব্যাপার যে, মাত্র এক মাস আগেও তার সাম্রাজ্য ধ্বংস হবার হুমকিটার বিরুদ্ধে তিনি খুব অসহায়বোধ করছিলেন।

 

ওপাস দাইর প্রেসিডেন্ট-জেনারেল হিসেবে বিশপ আরিঙ্গাবোসা বিগত দশ বছর ধরে নিজের জীবন ব্যয় করেছেন ওপাস দাইর মাধ্যমে ঈশ্বরের কর্মীর বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। সংস্থাটি ১৯২৮ সালে স্পেনিয় যাজক হোসে মারিয়া এসক্রিভা গঠন করেছিলেন। রক্ষণশীল ক্যাথলিক মূল্যবোধে ফিরে যাওয়া আর সেটার পৃষ্ঠাপোষকতা করা এবং এর সদস্যদেরকে ঈশ্বরের কর্ম সম্পাদন করার জন্য আত্মত্যাগে উৎসাহ দেবার জন্য কাজ করে সংগঠনটি।

 

ওপাস দাইর ঐতিহ্যবাহী দর্শনটি ফ্রাংকোর শাসনামলেরও আগে স্পেনে এর শিকড় প্রােথিত ছিলো। কিন্তু ১৯৩৪ সালে হোসে মারিয়া এসক্রিভার আধ্যাত্মিক বই দ্য ওয়ে প্রকাশ হবার পর থেকে এসক্রিভার বার্তা বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে দ্য ওয়ের চল্লিশ লক্ষেরও বেশি কপি বিয়াল্লিশটি ভাষায় অনূদিত আছে। ওপাস দাই বিশ্বব্যাপী একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর আবাসিক হল, শিক্ষাকেন্দ্র এবং এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ পৃথিবীর প্রায় সব বড় বড় শহরগুলোতেই পাওয়া যাবে। ওপাস দাই সারা বিশ্বের ক্যাথলিক সংস্থাসমূহের মধ্যে সবচাইতে দ্রুত বর্ধনশীল এবং আর্থিকভাবে সুসংহত সংগঠন। দূভার্গ্যবশত, আরিঙ্গাবোসা বুঝতে শিখেছিলেন যে, ধর্মীয় সিনিসিজমের এই যুগে, ওপাস দাইর ক্রমবর্ধমান সম্পদ এবং ক্ষমতা বৃদ্ধি সম্পর্কে সন্দেহকে চুম্বকের মতোই টানবে।

 

অনেকেই ওপাস দাইকে মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের কারখানা বলে থাকে, সাংবাদিকরা প্রায়শই এমন চ্যালেঞ্জ করে থাকে। অনেকেই আপনাদেরকে অতিরক্ষণশীল একটি বৃস্টিয় গুপ্ত সমাজ বলে অভিহিত করে থাকে। আপনারা আসলে কোনটা?

 

ওপাস দাই এসব কোনটাই না, বিশপ খুব ধৈর্যসহকারে জবাব দিতেন, এটি একটি ক্যাথলিক চার্চ। আমরা এমন একটি ক্যাথলিক সংগঠন যারা সত্যিকারের ক্যাথলিক বিশ্বাস নিজেদের দৈনন্দিন জীবনাচরণে পালন করা জন্য অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি।

 

ঈশ্বরের কর্ম করার জন্য কি কুমার থাকার বা কৌমার্য ব্রত পালন করার সত্যি কোন দরকার আছে, নিজের শরীরকে কষ্ট দেয়া এবং সিলিসের মাধ্যমে তীব্র যন্ত্রণা পাওয়ার কি সংগত কোন কারণ আছে?

 

আপনারা শুধুমাত্র ওপাস দাইর ক্ষুদ্র একটি অংশের বর্ণনা দিলেন, অরিঙ্গাবোসা বলেছিলেন। আমাদের এখানে অনেক ধরনের অংশগ্রহণ রয়েছে। হাজার হাজার ওপাস দাইর সদস্য বিবাহিত, তাদের পরিবার আছে এবং তারা নিজেদের সমাজে ঈশ্বরের কর্ম সম্পাদন করে থাকে। অন্যেরা আমাদের আবাসিক স্থানগুলোতে অধ্যাত্মবাদের জীবন বেছে নিয়েছে। এসব তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ। কিন্তু ওপাস দাইর সবাই একই উদ্দেশ্য পোষণ করে থাকে, ঈশ্বরের কর্মীর মাধ্যমে বিশ্বের আরো বেশি মঙ্গল সাধন করা। নিশ্চিতভাবেই এটি একটি প্রসংশনীয় প্রচেষ্টা।

 

প্রচার মাধ্যম সবসময়ই কেলেংকারীর উপরই বেশি গুরুত্ব দেয়। আর ওপাস দাইরও অন্যসব বৃহৎ সংগঠনের মতোই, নিজেদের ভেতরে কিছু বিপথগামী সদস্য রয়েছে যাদের জন্য সংগঠনের সব সদস্যই বদনামের ভাগীদার হয়।

 

দুমাস আগে, ওপাস দাইর মিডওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির একটি দল নতুন যোগ দেয়া সদস্যদেরকে দীক্ষিত করার জন্য এবং ধর্মীয় অনুভূতির আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা লাভের আশায় মাদক সেবনরত অবস্থায় হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়। আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাঁটা তারের সিলিস বেল্টটা নিয়মানুযায়ী দিনে দুঘণ্টা ব্যবহার না করে বেশি সময় ব্যবহার করে মারাত্মক ইনফেকশনের শিকার হয়ে প্রায় মরতে বসেছিলো। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, বোস্টনের এক মোহগ্রস্ত তরুণ ব্যাংকার তার নিজের সমস্ত ধন-সম্পত্তি ওপাস দাইর নামে লিখে দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলো।

 

বিপথগামী ভেড়া, আরিঙ্গাবোসা ভাবলেন, তাদের জন্য তাঁর হৃদয়ে কোন সহানুভূতি নেই।

 

সন্দেহাতীতভাবেই সবচাইতে বিব্রতকর ব্যাপার ছিলো বহুল আলোচিত এবং ব্যাপক প্রচারণা পাওয়া এফবিআইর গুপ্তচর রবার্ট হানসেনের মামলাটি। সে ছিলো ওপাস দাইর খুবই নাম করা একজন সদস্য। দেখা গেলো সে আসলে যৌনবিকৃত ব্যক্তি, যে নিজের শোবার ঘরে একটা ক্যামেরা লুকিয়ে রেখে দিতো যাতে তার বন্ধু বান্ধবরা তার বউয়ের সাথে যৌনকর্মের দৃশ্য দেখতে পারে। এজন আত্ম উৎসর্গীকৃত ক্যাথলিকের জন্য সময়টা সত্যিই কঠিন, বিচারক মামলা চলাকালীন সময়ে মন্তব্যটি করেছিলেন।

 

দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এইসব ঘটনা নতুন একটি পর্যবেক্ষক দল, যাদের নাম দি ওপাস দাই এওয়্যারনেস নেটওয়ার্ক (ওডিএএন), গঠনে সাহায্য করলো। দলটির জনপ্রিয় ওয়েবসাইট www.odan.org-ওপাস দাইর সাবেক সদস্যদের কাহিনী সম্প্রচার করতে শুরু করে, যেনো কেউ এই বিপজ্জনক সংগঠনে যোগ না দেয়। প্রচার মাধ্যমগুলো এরপর থেকে ওপাস দাইকে ঈশ্বরের মাফিয়া এবং যিশুর পূজারী বলে অভিহিত করতে থাকে।

 

আমরা যা বুঝি না সেটাকে ভয় পাই, আরিঙ্গাবোসা ভাবলেন, তাঁর আক্ষেপ, এইসব সমালোচক যদি জানতো কতো লোককে ওপাস দাই নতুন জীবন দিয়েছে। দলটি ভ্যাটিকানের পুরোপুরি সমর্থন এবং আশীবাদপুষ্ট। ওপাস দাই স্বয়ং পোপেরই একটি মনোনীত সংস্থা।

 

সাম্প্রতিক কালে, ওপাস দাই প্রচারমাধ্যমের চেয়েও বেশি শক্তিশালী একটি শক্তির হুমকির সম্মুখীন হয়েছে …একটি আচমকা শত্রুতা যা আরিঙ্গাবোসা কোনভাবেই লুকাতে পারেন না। পাঁচমাস আগে, ক্ষমতার অকেন্দ্রটি ঝাঁকুনি খেয়েছিলো, আর আরিগারোসা এখনও সেই আঘাতটি সামলে উঠতে পারেননি।

 

তারা জানে না, তারা কোন্ যুদ্ধ শুরু করেছে, আরিজারোসা মনে মনে বললেন। বিমানের জানালা দিয়ে তিনি নিচের অন্ধকার সমুদ্রের দিকে তাকালেন। তখনই তাঁর চোব জানালার কাঁচে প্রতিফলিত হওয়া নিজের মুখের দিকে আঁটকে গেলো কালচে এবং পরিশ্রান্ত, লম্বা বাঁকানো নাক আধিপত্য করছে সেখানে, তরুণ মিশনারি হিসেবে স্পেনে থাকার সময় নাকটা একটা ঘুষিতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছিলো। সেই চিহ্নটা এখনও রয়ে গেছে তাঁর শরীরে। আরিঙ্গাবোসা আত্মার বিশ্বের মানুষ, রক্তমাংসের নয়।

 

পর্তুগালের উপকূল দিয়ে জেট প্লেনটা অতিক্রম করতেই, পকেটে রাখা সেল ফোনটা কাঁপতে শুরু করলো। ফোনটার রিংটোন বন্ধ করে রাখা ছিলো। যদিও বিমান চলাকালীন সময়ে সেলফোন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ, তারপরও আরিঙ্গাবোসা জানেন এই কলটা তিনি ছেড়ে দিতে পারেন না। এই ফোন নাম্বারটা শুধুমাত্র একজনের কাছেই আছে। সেই লোকই তাঁকে ফোন করেছে।

 

উত্তেজিত বিশপ খুব শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন। হ্যাঁ?

 

সাইলাস কি-স্টোনটার অবস্থান জানতে পেরেছে, লোকটা বললো। সেটা প্যারিসেই রয়েছে। সেন্ট সালপিচ চার্চের ভেতরে।

 

বিশপ আরিঙ্গারোসা মুচকি হাসলেন। তাহলে আমরা খুব কাছাকাছি এসে গেছি।

 

আমরা খুব দ্রুতই সেটা নিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু আমাদের দরকার আপনার সাহায্যের।

 

অবশ্যই। বলুন আমাকে, কি করতে হবে?

 

আরিঙ্গাবোসা যখন ফোনটা বন্ধ করলেন তখন তার হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছে। তিনি আবার বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকালেন। যা ঘটেছে তাতে তাঁর দারুণ এক সুখকর অনুভূতি হতে লাগলো।

 

* * *

 

পাঁচশো মাইল দূরে, সাইলাস নামের ধবল লোকটি একটা ছোট্ট পানির বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার পিঠের রক্ত পরিষ্কার করছে আর পানিতে লাল রক্তটা দেখতে কী রকম হয় সেটা পরখ করে দেখেছে। আমাকে শুদ্ধ করো, আমি শুদ্ধ হবো, সে বাইবেলের একটা প্রার্থনা সঙ্গীত আওড়ালো। আমাকে সাফ করো, আমি তুষারের চেয়েও বেশি সাদা হবো।

 

সাইলাসের এমন এক অনুভূতি হচ্ছে যা তার আগে কখনও হয়নি। এটা বিদ্যুতায়িত এবং বিস্ময়কর, দুটোই মনে হচ্ছে তার কাছে। বিগত দশ বছর ধরে, দ্য ওয়ে অনুসরণ করে আসছে। নিজেকে পাপ থেকে পরিষ্কৃত করা…নিজের জীবনকে পুণঃনির্মাণ করা…আর অতীতের সহিংসতা মুছে ফেলা। আজ রাতে এসব কিছু আবার ফিরে এসেছে তার মধ্যে। সে খুব অবাক হলো এই ভেবে যে, কতো দ্রুত তার অতীত আবার উঠে আসছে। সেটা কাজ করবার জন্য বেশ উপযোগীই হবে।

 

যিশুর বার্তা হলো শান্তির…অহিংসার…ভালবাসার। শুরুতে এইসব কথাই সাইলাস শিখেছিলো, সেসব কথা সে হৃদয়ে ধারণ করে আছে। আর এসবই যিশুর শত্রুরা ধ্বংস করার হুমকি দিচ্ছে। যারা ঈশ্বরকে শক্তির হুমকি দেয় তারা শক্তির মুখোমুখি হবে। অনড় এবং প্রচণ্ড দ্রুততার সাথে।

 

দুহাজার বছর ধরে, খৃস্টিয় সৈনিকরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে যারা তাদের বিশ্বাসকে ধ্বংস করতে চায়। আজরাতে, সাইলাস একটা যুদ্ধের ডাক দিয়েছে।

 

নিজের ক্ষত শুকিয়ে সে তার গোড়ালী সমান লম্বা আলখেল্লাটা পরে নিলো। সেটা এক রঙা উলের তৈরি, তার গায়ের এবং চুলের রঙের সাথে মিলিয়ে শাদা রঙের। কোমরে দড়িটা শক্ত করে বেঁধে নিয়ে সে তার মাথাটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিলো। চাকাটা ঘুরছে।

 

 

 

০৬.

 

নিরাপত্তা দরজার নিচে চাপা খেয়ে ল্যাংডন এ্যান্ড গ্যালারির ভেতরে উঠে দাঁড়ালো। একটা গভীর গিরিখাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। গ্যালারির দুদিকের দেয়ালই ত্রিশ ফিট উচ্চতা সম্পন্ন, অন্ধকারের মধ্যেও সেটা বোঝা যায়। লাল আলোর সার্ভিস লাইটগুলো দেয়ালের ওপরের দিকে লাগানো, সেগুলোর অতিপ্রাকৃত আলোতে দা ভিঞ্চি, তিতিয়ান এবং কারাজ্জিওর দূর্লভ সংগ্রহগুলো উদ্ভাসিত হয়ে আছে। ছবিগুলো ছাদের সাথে তার লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। স্টিল লাইফ, ধর্মীয় দৃশ্য। এবং ল্যান্ডস্কেপের সাথে সঙ্গী হয়েছে খ্যাতনামা ব্যক্তি আর রাজনীতিবিদদের ছবি। যদিও গ্র্যান্ড গ্যালারি হলো লুভরের সবচাইতে বিখ্যাত ইতালিয় শিল্পকলার কক্ষ, তবে অনেক দর্শনার্থী মনে করে এখানকার সবচাইতে চিত্তাকর্ষক জিনিসটা হলো কাঠের নক্সা করা ফ্লোরটা। ওক গাছের বাকলের উপর অসাধারণ জ্যামিতিক নক্সার ফ্লোরটা এক ধরণের ক্ষণস্থায়ী দৃষ্টি বিভ্রম সৃষ্টি করে দর্শনার্থীদের মধ্যে এমন অনুভূতি তৈরি করে। যাতে তাদের মনে হয় তারা গ্যালারির ওপরে ভাসছে আর প্রতিটি পদক্ষেপে দৃশ্যসমূহ বদলে যাচ্ছে।

 

জমিনের ওপর তাকাতেই ল্যাংডনের চোখ একটা অপ্রত্যাশিত জিনিসের দিকে আঁটকে গেলো। জিনিসটা কয়েক গজ দূরে মাটিতে পড়ে আছে, সেটার চারদিক পুলিশের ফিতা দিয়ে ঘেরাও করা। সে ফশের দিকে তাকালো। এটা কি… কারাজ্জিওর ছবি মাটিতে পড়ে আছে?

 

ফশে তার দিকে না তাকিয়েই মাথা নেড়ে সায় দিলো। চিত্রকর্মটি, ল্যাংডন অনুমান করলো, দুই মিলিয়ন ডলারেরও বেশি দামের, আর সেটা কিনা একটা দোমড়ানো মোচরানো পোস্টারের মতো মাটিতে পড়ে আছে। এটা এভাবে মাটির ওপর পড়ে আছে!

 

ফশে একটুও না নড়েচড়ে তার দিকে চোখ বড়বড় করে তাকালো। এটা অপরাধ সংঘঠিত স্থান, মি. ল্যাংডন। আমরা এখানকার কোন কিছুই স্পর্শ করিনি। ছবিটা কিউরেটর নিজেই দেয়াল থেকে টেনে ফেলেছেন। এভাবেই নিরাপত্তা। সিস্টেমটাকে সচল করেছেন তিনি।

 

ল্যাংডন গেটের দিকে তাকালো, কী ঘটেছিলো তার একটা ছবি মনে মনে আঁকার চেষ্টা করলো।

 

কিউরেটর তার অফিসেই আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। সেখান থেকে গ্র্যান্ড গ্যালারির দিকে দৌড়ে এসেছেন। আর সিকিউরিটি সিস্টেমটা সচল করেছেন দেয়াল থেকে এই ছবিটা টেনে ফেলে দিয়ে। সাথে সাথে লোহার গেটটা পড়ে সবগুলো প্রবেশ পথ বন্ধ করে দিয়েছে। এই গ্যালারিতে ঢোকা এবং বের হবার জন্য এটাই একমাত্র প্রবেশ পথ।

 

ল্যাংডনকে খুব দ্বিধান্বিত দেখালো। তবে তো, কিউরেটর তাঁর আক্রমণকারীকে গ্র্যান্ড গ্যালারির ভেতরে আঁটকে ফেলতে পেরেছিলেন?

 

ফশে মাথা নাড়লো, সিকিউরিটি গেটটা সনিয়ে এবং তার আক্রমণকারীকে পৃথক করে রেখেছিলো। খুনি গেটের বাইরে থেকে গৃলের ভেতর দিয়ে গুলি করেছে। যে লোহার গেটের নিচ দিয়ে তারা এইমাত্র এখানে এসেছে ফশে তার একটি শিকে কমলা রঙের ট্যাগের দিকে নির্দেশ করলো। পিটিএস দলটি বন্দুকের গুলি লাগার জায়গাটি খুঁজে পেয়েছে। খুনি গলের ভেতর দিয়েই গুলি করেছে। জ্যাক সনিয়ে এখানে একা একাই মৃত্যু বরণ করেছেন।

 

ল্যাংডন সনিয়ের শরীরের ছবিটা কল্পনা করলো। তারা বলছে, তিনি নিজেই এরকম করেছেন। ল্যাংডন তাদের সামনের বিশাল করিডোরটার দিকে তাকালো। তো উনার মৃত দেহটা কোথায়?

 

ফশে তার টাইপিনটা একটু ঠিক করে নিয়ে হাটতে শুরু করলো। সম্ভবত আপনি জানেন, গ্র্যান্ড গ্যালারিটা অনেক দীর্ঘ।

 

ল্যাংডন খুব ভালো করেই এটার একদম সত্যিকারের দৈর্ঘের কথাটা মনে করতে পারলো, সেটা প্রায় পনেরো শ ফুট দীর্ঘ, তিন তিনটা ওয়াশিংটন মনুমেন্টের দৈর্যের সমান। করিডোরটির প্রশস্ততাও অবিশ্বাস্য রকমের, সেখানে খুব সহজেই পাশাপাশি দুটো প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলাচল করতে পারবে।

 

ফশে চুপ মেরে গেলো, হনহন করে করিডোরের বাম দিক দিয়ে ছুটে চললো। তার দৃষ্টি একেবারে সোজা সামনের দিকে। বিখ্যাত বিখ্যাত সব মাস্টার পিসগুলোর সামনে দিয়ে যাবার সময় কোন ধরনের বিরতি না দিয়ে, সেগুলোর দিকে না তাকিয়ে এভাবে হেটে যাওয়ায় ল্যাংডনের কাছে মনে হলো ছবিগুলোকে অসম্মান করা হচ্ছে।

 

এরকম আলোতে কিছুই দেখতে পারবো না, সে ভাবলো।

 

এরকম স্বল্প আলো দুভার্গ্যজনকভাবেই তাকে স্বল্প আলোর ভ্যাটিকানের গোপন আকাইভে ঘটনাটার কথা স্মরণ করিয়ে দিলো। সেটা আজকের রাতের মতোই রোমে তার প্রায় মরতে বসার ঘটনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আবার ভিত্তোরিয়ার কথা মনের পর্দায় ভেসে এলো। গত এক মাস ধরে মেয়েটা তার স্বপ্নে অনুপস্থিত ছিলো। ল্যাংডন একদমই বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে, রোমের ঘটনাটি এক বছর আগের ; তার মনে হচ্ছে কয়েক যুগ আগে সেটা ঘটেছে। অন্য আরেকটি জীবনে। ভিত্তোরিয়ার সাথে তার শেষ যোগাযোগ হয়েছিলো গত ডিসেম্বরে—একটা পোস্টকার্ডে এই কথা লেখা ছিলো যে, সে জাভা সাগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে তার এনটেঙ্গেলমেন্ট পদার্থ বিদ্যার গবেষণার জন্য…উপগ্রহ ব্যবহার করে মান্তা রশ্মির সন্ধান করার মতো একটা ব্যাপারে। ল্যাংডন কখনও এমন ভ্রান্ত মোহে আচ্ছন্ন ছিলো না যে, ভিত্তোরিয়ার মতো একজন মেয়ে তার সাথে কলেজ ক্যাম্পাসে থেকে সুখি হবে, কিন্তু রোমে তাদের মুখোমুখি দেখা হওয়াটা তার মনে এমনভাবে গেঁথে আছে যে, সে এমনটি কখনও কল্পনাও করতে পারেনি। তার চিরজীবন অবিবাহিত থাকার বাসনা আর সহজ সরল স্বাধীনতা যেভাবেই হোক প্রচণ্ড একটা ঝাকি খেয়েছিলো ….

 

একটা অপ্রত্যাশিত একাকীত্ব মনে হচ্ছে সেই জায়গাটা দখল করেছে আর বিগত একবছর ধরে সেটা ক্রমাগত বেড়েই চলছে।

 

তারা হনহন করে হাটতে লাগলো, এতোদূর এসেও ল্যাংডন কোন মৃতদেহ দেখতে পেলো না। জ্যাক সনিয়ে এতোদূর পর্যন্ত এসেছিলেন?

 

মি. সনিয়ে পেটে গুলি খেয়েছিলেন। তিনি খুব ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করেছেন। সম্ভবত পনেরো কিংবা বিশ মিনিট পরে। নিশ্চিতভাবেই তিনি ছিলেন একজন শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের মানুষ।

 

ল্যাংডন অবাক হয়ে তাকালো। নিরাপত্তারক্ষীদের এখানে আসতে পনেরো মিনিট লেগেছে?

 

অবশ্যই না। লুভরের নিরাপত্তা রক্ষীরা এলার্ম শুনেই সাথে সাথে এখানে চলে এসেছিলো, এসে দেখে গ্র্যান্ড গ্যালারির গেট বন্ধ। গৃলের ভেতর থেকে তারা করিডোরের শেষ প্রান্তের দিকে কারোর পায়ের শব্দ শুনতে পেয়েছিলো, কিন্তু লোকটাকে দেখতে পায়নি। তারা চিৎকার করে ডেকেও কোন উত্তর পায়নি। ধারণা করেছিলো, সেটা অপরাধীই হবে। তাই তারা প্রটোকল অনুযায়ী জুডিশিয়াল পুলিশকে ঘটনাটা জানিয়ে দেয়। আমরা পনেরো মিনিটের মধ্যে এখানে এসে অবস্থান নিয়ে নেই। এখানে পৌঁছেই ব্যারিকেডটা একটু তুলে দিয়ে ভেতরে ডজনখানেক অস্ত্রধারী সৈনিক পাঠিয়ে দেই। তারা গ্যালারির ভেতরে অনুপ্রবেশকারীকে তন্নতন্ন করে খোঁজে।

 

তারপর?

 

ভেতরে কাউকেই পাওয়া যায়নি। শুধুমাত্র … হলের একটু দূরে ইঙ্গিত করলো সে। তাঁকে ছাড়া।

 

ল্যাংডন ফশের আঙ্গুলের দিকে তাকালো। প্রথমে সে ভেবেছিলো ফুশে হলওয়ের মাঝখানে রাখা বিশাল একটা পাথরের মূর্তির দিকে ইঙ্গিত করছে। আরেকটু সামনে যেতেই ল্যাংডন মূর্তিটা অতিক্রম করে দেখতে পেলো ত্রিশ গজ দূরে, একটা স্ট্যান্ডের উপর স্পট লাইটটা জ্বলছে, সেটার আলো অন্ধকার গ্যালারির জমিনে পড়ে একটা আলোর বৃত্ত তৈরি করেছে। আলোর বৃত্তের মাঝখানে, অনেকটা মাইক্রোস্কোপের নিচে থাকা পোকা-মাকড়ের মতো কিউরেটরের মৃতদেহটা কাঠের নক্সা করা জমিনের ওপর সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

 

আপনি ছবিটা দেখেছেন, ফশে বললো, তাহলে তো, খুব বেশি অবাক হবার কথা নয়।

 

মৃতদেহটার কাছে যেতেই ল্যাংডনের খুব হিমশীতল একটা অনুভূতি হলো। তার সামনে এমন অদ্ভুত ছবি ভাসছে, যা সে জীবনেও দেখেনি।

 

জ্যাক সনিয়ের বিবর্ণ মৃতদেহটা কাঠের জমিনে এমনভাবে পড়ে আছে ঠিক যেমনটি সে ছবিতে দেখেছে। ল্যাংডন তীব্র আলোর মধ্যে মৃতদেহটার সামনে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে ভাবতে লাগলো সনিয়ে তাঁর শেষ কয়েকটি মুহূর্ত নিজের শরীরটাকে কত অদ্ভুতভাবেই না সাজিয়েছেন।

 

সনিয়ে তাঁর বয়সের তুলনায় অসাধারণ সুস্থ আর সতেজ ছিলেন …তাঁর শরীরের পেশীগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি তার ব্যবহার্য সব ধরনের পোশাকই খুলে সেগুলো সুন্দর করে পাশে রেখে দিয়েছেন। চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন করিডোরের মাঝখানের জমিনে। নিখুঁতভাবেই ঘরের অক্ষের সমান্তরালে দেহটা রেখেছেন। তার হাত-পা ঈগল পাখির ডানার মতো ছড়িয়ে আছে, অনেকটা শিশুদের তৈরি বরফের পরীর মতো অথবা, খুব স্পষ্ট করে বললে, কোন অদৃশ্য শক্তি কর্তৃক একজন মানুষকে আঁকা হলে যেমনটি হয়, সেরকম।

 

সনিয়ের পাঁজরের হাড়ের নিচে একটা রক্তে আঁকা চিহ্ন, যেখানে বুলেটটা বিদ্ধ হয়েছিলো ঠিক সেখানেই। আঘাতটার ফলে খুবই ছোট্ট একটা ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, সেটা বিস্ময়করই বটে। শুধুমাত্র এক ফোঁটা কালচে রক্তের ছোট্ট একটা বৃত্ত।

 

সনিয়ের বাম হাতের তর্জনীটাও রক্তাক্ত। নিজের রক্তকে কলমের কালি হিসেবে ব্যবহার করে আর নিজের পেটকে ক্যানভাস বানিয়ে সনিয়ে ছোট্ট একটা প্রতীক এঁকেছেন—পাঁচটা সরল রেখা দিয়ে একটা পাঁচ কোনা তারা।

 

পেনটাকল।

 

সনিয়ের নাভির মাঝখানে রক্তাক্ত তারাটা মৃতদেহটাকে একধরনের ভৌতিক রূপ দিয়েছে। যে ছবিটা ল্যাংডন দেখেছিলো সেটাও যথেষ্ট ভীতিকর ছিলো, কিন্তু এখন,

 

স্বচক্ষে দৃশ্যটা দেখে ল্যাংডনের খুব গভীর অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি তৈরি হলো।

 

তিনি নিজেই এটা করেছেন।

 

মি. ল্যাংডন? ফশের গভীর কালো চোখ আবার তার ওপর স্থির হলো।

 

এটা একটা পেনটাকল, ল্যাংডন বললো, তার কথাটা বিশাল ফাঁকা জায়গায় প্রতিধ্বনিত হলো। পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন একটা প্রতীক। যিশুর জন্মের চার হাজার বছর আগেও এটা ব্যবহার করা হোত।

 

এর মানে কি?

 

এ ধরনের প্রশ্ন করা হলে ল্যাংডন সবসময়ই দ্বিধাগ্রস্ত হয়। একটা প্রতীকের মানে কি, এটা বলা মানে, একটা সঙ্গীত কেমন অনুভবের সৃষ্টি করবে সেই কথা বলা—এটা একেকজনের কাছে একেক রকম। সাদা রঙের একটা কু ক্লাক্স ক্লান মুখোশের ছবি যুক্তরাষ্ট্রে ঘৃণা এবং বর্ণবাদের প্রতীক, আর সেই একই জিনিস স্পেনে ধর্মীয় বিশ্বাসের অর্থ বহন করে।

 

একেক জায়গায় প্রতীকের অর্থ একেক রকম হয়ে থাকে, ল্যাংডন বললো। সাধারণ অর্থে, পেনটাকল হলো একটি প্যাগান ধর্মীয় প্রতীক।

 

ফশে মাথা নাড়লো। শয়তানের পূজা।

 

না, ল্যাংডন শুধরিয়ে দিলো, পরক্ষণেই বুঝতে পারলো তার আরো পরিষ্কার করে বলা দরকার। তার শব্দ চয়ন আরো বেশি পরিষ্কার হওয়া উচিত।

 

আজকাল প্যাগান শব্দটি শয়তান পূজার সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে—একটা জনপ্রিয় ভুল ধারণা। শব্দটির মূল এসেছে ল্যাটিন শব্দ প্যাগানাস থেকে, যার অর্থ গ্রামীন অধিবাসী। আভিধানিক অর্থে প্যাগান মানে অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকজন, যারা প্রাচীন গ্রামীন প্রকৃতি পূজার অনুসারী। আসলে, যারা ভিলেজ, মানে গ্রামে বাস করে তাদের সম্পর্কে চার্চের অনেক ভীতি ছিলো, সেই গ্রামবাসী তথা ভিলেজার শব্দটি থেকেই ভিলেইন অর্থাৎ খল-এই নেতিবাচক অর্থটি আরোপিত হয়েছে।

 

পেনটাকল, ল্যাংডন খুলে বললো, একটি প্রাক খৃস্টিয় প্রতীক যা প্রকৃতি পূজার সাথে সম্পর্কিত। প্রাচীন কালের মানুষেরা তাদের পৃথিবীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দেখতো-নারী আর পুরুষ। তাদের দেব-দেবীরা শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করতো। ইন। এবং ইয়াং। যখন নারী এবং পুরুষ ভারসাম্যপূর্ণ থাকতো, পৃথিবীতে তখন সম্প্রীতি বিরাজ করতো। আর যখন তারা ভারসাম্যহীন থাকতো, তখন নৈরাজ্য নেমে আসতো। ল্যাংডন সনিয়ের পেটের দিকে ইঙ্গিত করলো।এই পেনটাকলটা নারীর প্রতিনিধিত্ব করে, যারা পৃথিবীর সব কিছুরই অর্ধেক—এটা ধর্মীয় ইতিহাসবিদদের ধারণা, পবিত্র নারী অথবা স্বর্গীয় দেবী বলে ডাকা হয়। সনিয়ে সেটা জানতেন।

 

সনিয়ে তার পেটে একটি দেবীর প্রতীক এঁকেছেন?

 

ল্যাংডনকে স্বীকার করতেই হলো, যদিও এটা খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে। একেবারে নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, পেনটাকল ভেনাসেরই প্রতীক-যৌনতা, ভালোবাসা আর সুন্দরের দেবী।

 

ফশে নগ্ন দেহটার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করতে লাগলো।

 

প্রথম দিকে ধর্মগুলো ছিলো প্রকৃতির স্বর্গীয় শৃঙ্খলার উপর ভিত্তি করে। দেবী ভেনাস এবং ভেনাস গ্রহ একই জিনিস। রাতের আকাশে দেবীর একটা অবস্থান আছে আর এটা অনেক নামেই পরিচিত ভেনাস, পূর্ব-তারা, ইস্টার, আস্টার্তে সবগুলো শক্তিশালী নারীর প্রতিভূ যা মাতৃদেবী পৃথিবীর সাথে সম্পর্কিত।

 

ফশেকে আরো বেশি চিন্তিত মনে হলো এবার, যেনো সে প্রকৃতি পূজার ধারণাটিই বেশি পছন্দ করেছিলো।

 

ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিলো পেনটাকল সম্পর্কিত সবচাইতে বিস্ময়কর তথ্যটি সে জানাবে না—ভেনাসের চিত্রের সত্যিকারের ঘটনাটি। একজন তরুণ জ্যোর্তিবিদ্যার ছাত্র হিসেবে ল্যাংডন এই তথ্যটি জেনে অবাক হয়েছিলো যে, ভেনাস গ্রহ প্রতি আট বছরে আকাশে যে অবস্থান বদল করে সেটা একটা নিখুঁত পেনটাকলরই আকৃতিতে। এই ঘটনাটা প্রাচীন মানুষকেও এতোটা বিস্মিত করেছিলো যে, তারা ভেনাস এবং পেনটাকলকে সুন্দর, নিখুঁত এবং যৌনজ ভালবাসার প্রতীক হিসেবে পরিণত করে ফেললো। ভেনাসের এই যাদুময়তাকে সম্মান প্রদর্শন করার জন্যই গৃকরা প্রতি আট বছর পরপর অলিম্পিক খেলার প্রচলন করে। আজকাল খুব কম সংখ্যক লোকই বুঝতে পারবে যে, বর্তমানের চার বছর অন্তর অন্তর অলিম্পিকটি আসলে ভেনাসের পরিক্রমার অর্ধ চক্র। এমনকি খুব অল্পসংখক লোক জানে অলিম্পিকের অফিশিয়াল প্রতীক হয়ে ওঠা পাঁচটা বৃত্ত আসলে শেষ মুহুর্তে পাঁচটা তারাকে বদলেই করা হয়েছে-ভেনাসের পাঁচটা তারাকে বদলে পাঁচটা বৃত্ত দিয়ে আধুনিক অলিম্পিকের সত্যিকারের চেতনা ও সম্প্রীতির একটি প্রতীক তৈরি করা হয়েছে।

 

মি. ল্যাংডন, ফশে হরবর করে বললো। অবশ্যই পেনটাকল শয়তান সম্পর্কিত। আপনাদের আমেরিকান ভৌতিক চলচ্চিত্রগুলো এটা খুব স্পষ্ট করেই দেখায়।

 

ল্যাংডন ভুরু তুললো। ধন্যবাদ হলিউড, তোমাকে। পেনটাকল, মানে পাঁচ মুখের তারা বর্তমানে চলচ্চিত্রে শয়তান ও সিরিয়াল খুনির প্রতীক হয়ে উঠেছে। কোন শয়তান বা পিশাচের ঘরের দেয়ালে সাধারণত অন্যান্য পিশাচ প্রতীকের সাথে এটা আঁকা থাকে। ল্যাংডন এই প্রতীকটাকে এরকমভাবে ব্যবহার করতে দেখলে খুবই মর্মাহত হয়; পেনটাকলর সত্যিকারের উৎস কিন্তু পুরোপুরি দেবতা সম্পৰ্কীয়।

 

আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি, ল্যাংডন বললো, ছবিতে আপনি যা-ই দেখেছেন, পেনটাকলর এই রকম পিশাচ প্রতীকীকরণের ব্যাপারটা ঐতিহাসিকভাবেই ভুল। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে পেনটাকলর প্রতীকটি বিকৃত করে তুলে ধরা হচ্ছে। আর আজকের ঘটনায়, এটা একেবারে রক্তপাতের মধ্য দিয়ে করা হয়েছে।

 

আমি নিশ্চিত হতে পারছি না।

 

ল্যাংডন ফশের ক্রুশর দিকে তাকালো, মনস্থির করতে পারছিলো না কীভাবে পরের কথাটা বলবে। চার্চ করেছে, স্যার। সব প্রতীকই দ্ব্যর্থবোধক, কিন্তু পেনটাকল বৃস্টিয় যুগের সূচনাতেই রোমান ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক পরিবর্তিত হয়ে যায়। ভ্যাটিকানের প্যাগান ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচারণা এবং সেই ধর্মমত অনুসারীদেকে খৃস্ট ধর্মে দীক্ষা দেবার অংশ হিসেবে চার্চ প্যাগান দেব-দেবীদের বিরুদ্ধে একটি সর্বগ্রাসী অভিযান পরিচালনা করেছিলো। সেই সূত্রে তারা স্বর্গীয় প্রতীকগুলোকে শয়তানের চিহ্ন হিসেবে আখ্যায়িত করে।

 

বলে যান।

 

এরকম ঘটনা ঐ রকম অরাজক সময়ে খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার, ল্যাংডন আবারো বলতে শুরু করলো। একটি উদীয়মান নতুন শক্তি বিদ্যমান প্রতীকগুলো আত্মসাৎ করে নেয়, সেগুলোকে হেয় প্রতিপন্ন করে যাতে ধীরে ধীরে সেসব জিনিসের সত্যিকারের অর্থ মুছে যায়, বিস্মৃত হয়ে যায়। প্যাগান প্রতীক এবং খৃস্টিয় প্রতীকের মধ্যে লড়াইয়ে প্যাগানরা হেরে যায় ; পসাইডন দেবতার ত্রিশূল হয়ে ওঠে শয়তানের লাঠি, জ্ঞানী ক্রোনের লম্বা টুপিটা ডাইনীর প্রতীকে আর ভেনাসের পেনটাকল হয়ে যায় শয়তানের চিহ্ন। ল্যাংডন একটু বিরতি দিলো। দূর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীও পেনটাকলকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে; এটা এখন আমাদের বেশির ভাগের কাছেই যুদ্ধের একটা প্রতীকে পরিণত হয়েছে। আমরা এটাকে আমাদের সবগুলো যুদ্ধ বিমানে এঁকে রাখি আর সব জেনারেলের কাঁধে লাগিয়ে রেখেছি।

 

ভালোবাসা এবং সৌন্দর্যের দেবীদের জন্য একটু বেশিই হয়ে গেছে।

 

মজার তো। ফশে হাত পা ছড়ানো মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললো, আর এই দেহটার এই রকম অবস্থানের কারণ? এটার ব্যাপারে কি বলবেন?

 

ল্যাংডন কাঁধ ঝাঁকালো। এই অবস্থাটা খুব সহজ করে বলতে গেলে পেনটাকল এবং পবিত্র নারীকেই ইঙ্গিত করছে।

 

ফশের মুখভঙ্গী ছায়ায় পেঁকে গেলো। ক্ষমা করবেন, বুঝতে পারছি না?

 

অনুকরণ। প্রতীকটা অনুকরণ করা হয়েছে যাতে দেখামাত্রই বোঝা যায়। জ্যাক সনিয়ে নিজেকে পেনটাকলর পাঁচটি মুখের আদলে নিজের শরীরটাকে সাজিয়েছেন। যদি একটা পেনটাকল ভালো হয়, তবে দুটো পেনটাকল অবশ্যই আরো ভালো।

 

ফশে সনিয়ের দেহের পাঁচটি অংশ, হাত-পা, মাথার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে আবার নিজের তৈলাক্ত চুলে আঙুল চালালো। মজার বিশ্লেষণ। সে একটু থামলো। আর নগ্নতা? সে শব্দটা উচ্চারণ করার সময় একটু বিড়বিড় করলো। একজন বয়স্ক মানুষের নগ্ন দেহের দিকে তাকিয়ে এ কথাটা একটু অশ্লীলই শোনালো। তিনি কেন নিজের সমস্ত জামা-কাপড় খুলে ফেললেন?

 

একেবারে মোক্ষম প্রশ্ন, ল্যাংডন ভাবলো। পোলারয়েড ক্যামেরার ছবিটা প্রথমবার দেখার পর থেকেই সে অবাক হয়ে এই কথাটি ভাবছিলো। তার সবচাইতে বেশি যে ব্যাখ্যাটি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে, সেটা হলো, নগ্ন মানুষের দেহ যৌনতার দেবী ভেনাসের প্রতিমূর্তিকেই ইঙ্গিত করে। যদিও আধুনিক কালে ভেনাসের স্ত্রী-পুরুষ মিলন সম্পর্কিত শাব্দিক অর্থটি মুছে ফেলা হয়েছে, তারপরও শব্দজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে যে, ভেনাসের উৎপত্তি হয়েছে Venereal শব্দ থেকে, যার অর্থ যৌনসঙ্গম। ল্যাংডন ঠিক করলো এই প্রসঙ্গটি তুলবে না।

 

মি. ফশে, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারবো না, কেন মি. সনিয়ে এই প্রতীকটি এঁকেছেন অথবা এভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন, কিন্তু আমি আপনাকে বলতে পারি সনিয়ের মতো একজন মানুষ পেনটাকল প্রতীকটিকে নারী দেবীর মূর্তি হিসেবেই বোঝাতে চেয়েছেন। এই প্রতীকটি এবং পবিত্র নারীর ধারণাটি শিল্পকলা বিষয়ক ইতিহাসবিদ এবং সিম্বোলজিস্টদের কাছে খুবই সুপরিচিত।

 

চমৎকার। আর নিজের রক্তকে কালি হিসেবে ব্যবহার করাটা?

 

অবশ্যই এ ছাড়া তাঁর কাছে লেখার জন্য অন্য কিছু ছিলো না।

 

ফশে কিছুক্ষণ চুপ রইলো। আসলে, আমি বিশ্বাস করি তিনি লেখার জন্য রক্তের ব্যবহার করেছেন ফরেনসিক প্রমাণের সুবিধার্থে।

 

বুঝলাম না?

 

তার বাম হাতের দিকে তাকিয়ে দেখুন।

 

ল্যাংডন কিউরেটরের অসাড় হাতটার আঙ্গুলের দিকে চাইলো, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না। সে মৃতদেহটা চারপাশ দিয়ে ঘুরে দেখলো, নিচু হয়ে তাকালো, অবাক হবার মতো কোন কিছু দেখতে পেলো না। শুধু দেখতে পেলো কিউরেটরের দেহের নিচে একটা মার্কার কলম চাপা পড়ে আছে।

 

আমরা যখন এখানে আসি তখন সনিয়ে এটা হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছিলেন, ফশে বললো, একটু সরে গিয়ে কয়েক গজ দূরে রাখা একটা পোর্টেবল টেবিলের কাছে গিয়ে তদন্তকার্যে ব্যবহার্য কিছু যন্ত্রপাতি, তার এবং ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করলো। আপনাকে তো আগেই বলেছি, সে বললো, আমরা কিছুই স্পর্শ করিনি। আপনি কি এ ধরনের কলমের সাথে পরিচিত?

 

ল্যাংডন হাটু গেঁড়ে বসে কলমটা আরো ভালো করে পরখ করে দেখলো।

 

স্টাইলো দ্য লুমিয়ে নোয়ে

 

সে অবাক হয়ে তাকালো।

 

ব্ল্যাক লাইট কলম অথবা ওয়াটার মার্ক স্টাইলাস এমন এক ধরনের বিশেষ কলম, পুলিশ এবং জাদুঘরের ক্ষতিগ্রস্ত ছবি ঠিক করে যারা, তারা এই কলম ব্যবহার করে থাকে জালিয়াতি ধরতে মালপত্রের গায়ে অদৃশ্য দাগ দেবার জন্য। স্টাইলাস কলমে কালি হিসেবে ব্যবহার করা হয় এলকোহল জাতীয় ফুরোসেন্ট কালি, যা কেবলমাত্র ব্ল্যাক লাইটের প্রভাবেই এর কালির দাগ দৃষ্টিগোচর হয়। আজকাল, জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কর্মচারীরা এটা ব্যবহার করে থাকে প্রতিদিনকার টহলের সময় মেরামত করার জন্য বিবেচিত হওয়া ছবিকে চিহ্নিত করার কাজে।

 

ল্যাংডন উঠে দাঁড়ালে, ফশে স্পটলাইটটার কাছে গিয়ে সেটা বন্ধ করে দিলে সাথে সাথে গ্যালারিটা আচমকা অন্ধকারে ডুবে গেলো।

 

সাময়িক অন্ধকার হয়ে গেলে ল্যাংডনের মনে হলো তার ভেতরে অনিশ্চয়তার উত্থান ঘটছে। ফশে একটা বহনযোগ্য লাইট নিয়ে এলো, যেটা থেকে বেগুনি আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। আপনি হয়তো জানেন, ফশে বললো, তার চোখে বেগুনি আলোর ঝলকানি, পুলিশ অপরাধ সংগঠিত স্থানে ব্ল্যাক লাইট ব্যবহার করে রক্ত এবং অন্যান্য ফরেনসিক এভিডেন্স খুঁজে পেতে। সুতরাং আপনি আমাদের অবাক হবার ব্যাপারটা কল্পনা করতে পারেন… সাথে সাথেই সে লাইটটা মৃতদেহের উপর নিক্ষেপ করলো।

 

ল্যাংডন দৃশ্যটা দেখেই চমকে গেলো।

 

কাঠের ফ্লোরের ওপর এই আজব দৃশ্যটা দেখ তার হৃদপিণ্ড লাফাতে শুরু করলো। একটা হাতের লেখা জ্বলজ্বল করছে। কিউরেটরের শেষ কিছু কথা তাঁর মৃতদেহটার পাশেই লেখা আছে। সেই জ্বলজ্বল করতে থাকা লেখাটার দিকে তাকিয়ে ল্যাংডনের মনে হলো কুয়াশার যে চাদর সারাটা রাত জুড়ে ছিলো, সেটা ক্রমশ হালকা হয়ে উঠছে।

 

ল্যাংডন লেখাটি পড়ে ফশের দিকে তাকালো, এই লোকটা করেছে কী!

 

ফশের চোখ কেমন সাদা দেখাচ্ছে। মঁসিয়ে, এই কথার উত্তর দিতেই আপনাকে এখানে ডেকে আনা হয়েছে।

 

* * *

 

খুব বেশি দূরে নয়, সনিয়ের অফিসের অভ্যন্তরে, লেফটেনান্ট কোলেত লুভর থেকে ফিরে এসে একটা অডিও কনসোল নিয়ে সনিয়ের ডেস্কে বসে কাজ করছে একটা ভূতুরে পরিবেশে, যেখানে কিউরেটরের ডেস্কের উপর একটা নাইট-এর মূর্তি রাখা আছে আর সেটা যেনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপরও কোলেত খুব স্বাচ্ছন্দেই কাজ করে যাচ্ছে। সে তার একেজি হেডফোনটা ঠিক করে নিয়ে রেকর্ডিং সিস্টেমটা চেক্ করে দেখলো। সবকিছু ঠিক আছে। শব্দ শোনা যাচ্ছে খুবই পরিষ্কার।

 

লো মোমেস্ত দ্য ভারিত, সে বিড়বিড় করে বললো। মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে বাকি কথপোকথন শুনতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। এইসব কথাবার্তা গ্র্যান্ড গ্যালারি থেকে ধারণ করে রেকর্ড করা হচ্ছে।

 

 

 

০৭.

 

সেন্ট সালপিচ চার্চের ভেতরেই একটি ছিমছাম আবাস রয়েছে, সেটা চার্চের তিন তলায় কয়্যার বেলকনির বাম দিকে অবস্থিত। পাথরের ফ্লোর আর কম সাজসজ্জা সম্পন্ন দুই ঘরের এই সুটটা বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সিস্টার সানড়ন বাইলের আবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পাশের কনভেন্টটি তার আগের আবাস ছিলো। কেউ যদি তাঁকে প্রশ্ন করে তবে তিনি চার্চের ঘরটিই বেশি পছন্দ করেন বলে জানান। সেখানেই তিনি একটা বিছানা, টেলিফোন আর হট প্লেট নিয়ে বেশ নিরবে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করেন।

 

চার্চের কনজারভারিস ডি এফেয়ার্স হিসেবে সিস্টার সানড়নই চার্চের সবধরনের ধর্মীয় বহির্ভূত কার্যকলাপের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ ব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ, কর্মচারী নিযুক্ত করা ও ভাড়া করার নির্দেশনা দেয়া, পুরো বিল্ডিংয়ের নিরাপত্তা দেখাশোনা করা, বিশেষ করে চার্চ বন্ধ হবার পর, এবং কমিনিউন-এর জন্য প্রয়োজনীয় মদ ও পোশাক সরবরাহ করা তাঁর কাজের মধ্যে পড়ে।

 

আজরাতে তিনি নিজের ছোট্ট খাটে ঘুমিয়ে ছিলেন, জেগে উঠলেন টেলিফোনের ঝংকারে। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সিস্টার ফোনটা তুলে নিলেন,সোয়ের সানড়ন। এগলিস সেন-সালপিচ।

 

হ্যালো সিস্টার, লোকটা ফাসিতে বললো।

 

সিস্টার সানড্রন উঠে বসলেন। ছয়টা বাজে? যদিও তিনি তাঁর বসের কণ্ঠটা ভালো করেই চেনেন, তবুও পনেরো বছরে কখনই তাঁর বস তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠাননি। আব্বে একজন ঘুম কাতুরে লোক, যিনি মাস্ এর পরপরই বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।

 

আমি যদি আপনাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে থাকি তার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, সিস্টার, আব্বে বললেন, তাঁর কণ্ঠটা খুব কাটা কাটা শোনাচ্ছে। আপনাকে একটা কথা বলতে হচ্ছে। এই মাত্র আমি একজন প্রভাবশালী আমেরিকান বিশপের ফোন পেয়েছি। সম্ভবত আপনি তাকে চেনেন? ম্যানুয়েল আরিঙ্গাবোসা?

 

ওপাস দাইর প্রধান? অবশ্যই তাকে আমি চিনি। এই চার্চের কে না তাঁকে চেনে? আরিঙ্গারোসার রক্ষণশীল সংগঠনটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুব দ্রুত বর্ধনশীল করে অঙ্গসংগঠন, আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন

 

হচ্ছে। সংগঠনটি হঠাৎ করেই শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যখন ১৯৮২ সালে পোপ জন পল দ্বিতীয় অপ্রত্যাশিতভাবে ঘোষণা দেন যে, তারা হলো পোপের ব্যক্তিগত অঙ্গসংগঠন, আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সবধরনের কার্য কলাপই অনুমোদন করে দেয়া হয়। সন্দেহজনকভাবে ঐ একই বছরে সম্পদশালী ধর্মীয় সংগঠনটি প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ভ্যাটিকানের ধর্মীয় ইনস্টিটিউটে হস্তান্তর করে যা সর্বসাধারণের কাছে ভ্যাটিকান ব্যাংক হিসেবে পরিচিত বিব্রতকর দেউলিয়ার হাত থেকে ব্যাংকটিকে এভাবে রক্ষা করা হয়। এর পরবর্তী পদক্ষেপটি অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দেখা দেয়, পোপ ওপাস দাইর প্রতিষ্ঠাতাকে সেন্ট হবার তালিকায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন বলে। প্রায়শই যেটা একশ বছরের দীর্ঘ একটি ব্যাপার, সেটা খুব দ্রুত কমিয়ে বিশ বছরের আনুষ্ঠানিকতায় টেনে আনা হয়েছিলো। সিস্টার সানন এটা না ভেবে পারলেন না যে, রোমে ওপাস দাইর এতো ভালো অবস্থানের ব্যাপারটি অবশ্যই সন্দেহজনক, তবে তাদের ধর্মীয় আনুগত্যের ব্যাপারে কোন তর্ক চলে না।

 

বিশপ আরিঙ্গাবোসা আমার কাছে একটা সাহায্য চেয়েছেন, আব্বে তাঁকে বললেন, তাঁর কণ্ঠটা খুবই নার্ভাস শোনা যাচ্ছে। উনার একজন শিষ্য আজ রাতে প্যারিসে আছেন …।

 

সিস্টার সানন একটা অদ্ভুত অনুরোধ শুনে দোটানায় পড়ে গেলেন। আমি দুঃখিত, আপনি বলছেন ওপাস দাইর এই সদস্যটি আগামীকাল সকালে আসতে পারবেন না?

 

হ্যাঁ, তা-ই। তার প্লেন খুব সকালেই ছাড়বে। তিনি সবসময়ই সেন্ট সালপিচ চার্চ দেখার স্বপ্ন দেখতেন।

 

কিন্তু দেখার জন্য চার্চটা তো দিনের বেলায়ই বেশি আকর্ষণীয়। ছাদের কাঁচের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো, আলো-আঁধারির ছায়া, এগুলোই তো চার্চের অনন্য বৈশিষ্ট্য।

 

সিস্টার, আমি আপনার সাথে একমত, তারপরও আমি আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করছি উনাকে আজ রাতে চার্চে প্রবেশ করার অনুমতি দিন। তিনি আপনার এখানে ঠিক…একটা বাজে? তার মানে বিশ মিনিটের মধ্যে।

 

সিস্টার সানভৃনের চোখ কপালে উঠলো। অবশ্যই। এটা আমার জন্য খুবই আনন্দের ব্যাপার।

 

আব্বে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোনটা রেখে দিলেন। হতভম্ব হয়ে সিস্টার সানভৃন নিজের উষ্ণ খাটে কিছুক্ষণ বসে থেকে ঘুম ঘুম ভাবটা কাটাবার চেষ্টা করলেন। তাঁর পয়ষট্টি বছরের শরীরটা খুব দ্রুত ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারে না। যদিও আজরাতের ফোনটা তাঁকে জেগে তুলেছে, তার সম্বিত ফিরেছিলো খুব দ্রুত। ওপাস দাই সব সময়ই তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তাদের শরীরে কষ্ট দেয়ার অনুশীলটা বাদ দিলেও, নারীদের সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী খুবই আগ্রাসী। তিনি এটা জেনে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন যে, ওখানকার মেয়ে সদস্যদেরকে জোর করে কোন রকম পারিশ্রমিক ছাড়াই পুরুষ সদস্যদের বাসস্থান পরিষ্কার করানো হয়। মেয়েরা শক্ত, খসখসে কাঠের পাটাতনে ঘুমায় আর পুরুষেরা ঘুমায় নরম ম্যাটে; মেয়েদেরকে শারিরীক কষ্টের অনুশীলনে একটু বাড়তি কিছু করানো হয় এবং সেটা করানো হয় জোর করে…এসবই করা হয় আদি পাপের শাস্তি ভোগের জন্য। মনে হয় ইভের আপেল খাওয়াটা নারী জাতির জন্য এক পারলৌকিক শাস্তি। দুঃখের বিষয় হলো, যেখানে বেশিরভাগ ক্যাথলিক চার্চ নারীদের বিষয়ে সঠিক পথে এগোচ্ছে, নারীদের অধিকারকে সম্মান করছে উত্তরোত্তর, সেখানে ওপাস দাই পুরো ব্যাপারটিকে উল্টো পথে চালানোর হুমকি দিচ্ছে। যাই হোক, সিস্টার সানড়ন একটা আদেশ পেয়েছেন।

 

আস্তে আস্তে তিনি নিজের বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর খালি পায়ে ঠাণ্ডা জমিনের শীতলতা লাগলো। ঠাণ্ডাটা সমস্ত শরীর জুড়ে বয়ে গেলে তার একটা অপ্রত্যাশিত অনুভূতির সৃষ্টি হলো।

 

নারীদের স্বজ্ঞা?

 

ঈশ্বরের একজন অনুসারী হিসেবে, সিস্টার সানড়ন শিখেছেন নিজের আত্মার শান্ত কণ্ঠের মধ্যেই শাস্তি নিহিত থাকে। আজরাতে, সেইসব কণ্ঠস্বর, তাকে ঘিরে থাকা নিরব, ফাঁকা চার্চের মতোই নিশ্চুপ।

 

 

 

০৮.

 

কাঠের ফ্লোরের জ্বলজ্বলে লেখাটির তীব্র আলোতে ল্যাংডনের চোখে পানি এসে গেলো। জ্যাক সনিয়ের শেষ বার্তাটি বিদায়ী বার্তা হিসেবে এতোটাই বেখাপ্পা যে, সে এটা কল্পনাও করতে পারেনি।

 

বার্তাটি হলো :

 

13-3-2-21-1-1-8-5

Oh, Draconian devil!

O’ Lame saint!

 

যদিও ল্যাংডনের একটুও ধারনা ছিলো না এটার মানে কী, তবুও ফশে কেন এমন ধারণা করলো যে, পেনটাকল হলো শয়তান পূজার সাথে সংশ্লিষ্ট, সেটা সে বুঝতে পারলো।

 

ও, ড্রাকোনিয়ান শয়তান।

 

সনিয়ে শয়তানের উল্লেখ করে একটা লিখিত বক্তব্য দিয়ে গেছেন। সংখ্যাগুলোও লেখার মতোই সমান কিম্ভুতকিমাকার, দেখে মনে হচ্ছে একটা সংকেতের অংশ।

 

হ্যাঁ, ফশে বললো। আমাদের ক্রিপটোগ্রাফাররা এ নিয়ে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, কে তাঁকে খুন করেছে সেটা জানার জন্য এই সংখ্যাগুলোই মূল চাবিকাঠি হবে। হয়তো কোন ফোন নাম্বার, অথবা কোন সোশাল আইডি নাম্বার। এই সংখ্যাগুলো কি আপনার কাছে কোন প্রতীকি অর্থ বহন করে?

 

ল্যাংডন সংখ্যাগুলোর দিকে আবারো তাকালো, বুঝতে পারলো এগুলোর ঠিক মতো প্রতীকি অর্থ বের করতে হলে কম পক্ষে এক ঘণ্টা সময় লেগে যাবে। অবশ্য, এ দিয়ে সনিয়ে যদি কিছু বুঝিয়ে থাকেন তো। ল্যাংডনের কাছে সংখ্যাগুলো একেবারেই এলোমেলো লাগছে। সে প্রতীকি ক্রমের ব্যাপারে জ্ঞাত, যা দিয়ে কিছু বোঝা যায়, কিন্তু এখানকার সবটাইপেনটাকল, লেখাগুলো, সংখ্যাগুলো মনে হচ্ছে মূলগত দিক থেকে একটার সাথে আরেকটার কোন মিলই নেই।

 

আপনি শুরুতে বলেছিলেন, ফশে বললো, সনিয়ের এখানকার কাজকর্মগুলো এক ধরনের বার্তা দেয়ার চেষ্টা বলে মনে হচ্ছে…দেবী পূজা অথবা সেই রকম কিছু? এই বার্তাটি সেগুলোর সাথে কীভাবে খাপ খায়?

 

ল্যাংডন জানতো প্রশ্নটা শুধুই বাগাড়ম্বরপূর্ণ। এই অদ্ভুত সব জিনিস নিশ্চিতভাবেই ল্যাংডনের বলা দেবী পূজার সাথে মোটেও খাপ খায় না।

 

ওহ্, ড্রাকোনিয়ান শয়তান? ও ল্যাংড়া সেন্ট?

 

ফশে বললো, এইসব লেখা-ঝোকা দেখে মনে হচ্ছে এগুলো একধরনের অভিযোগ। আপনি কি একমত নন?

 

ল্যাংডন কল্পনা করতে চেষ্টা করলো গ্র্যান্ড গ্যালারির ভেতরে একা আঁটকে পড়া কিউরেটরের শেষ কয়েক মিনিটের সময়টার কথা, তিনি জানতেন মারা যাচ্ছেন। এটা যুক্তিপূর্ণই মনে হচ্ছে। নিজের খুনির বিরুদ্ধে অভিযোগ করাটা খুবই স্বাভাবিক, আমারও তাই মনে হয়।

 

আমার কাজ হলো, লোকটার নাম বের করা। আপনাকে একটি প্রশ্ন করি মি. ল্যাংডন। আপনার চোখে এই সংখ্যাগুলো বাদে, এই বার্তাটিতে সবচাইতে অদ্ভুত জিনিসটা কি?

 

সবচাইতে অদ্ভুত? একজন মরতে বসা লোক নিজেকে গ্যালারির অভ্যন্তরে আঁটকে রাখলেন, নিজে নিজে একটা পেনটাকল আঁকলেন এবং কাঠের ফ্লোরে একটি রহস্যময়, দূর্বোধ্য কিছু আঁকিবুকি করলেন। এসবের কোনটা অদ্ভুত নয়?

 

ড্রাকোনীয় শব্দটি? সে একটু ঝুঁকি নিলো। ল্যাংডন একদম নিশ্চিত ছিলো যে, সেটা ড্রাকোকেই নির্দেশ করে—খৃস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী নিষ্ঠুর এক রাজনীতিক। ড্রাকোনীয় শয়তান মনে হচ্ছে একটা অদ্ভুত শব্দের ব্যবহার।

 

ড্রাকোনীয়? ফশের কণ্ঠে একধরনের অধৈর্যের প্রকাশ দেখা গেলো। সনিয়ের শব্দ ব্যবহার করাটা এখানে তেমন বড় কোন বিষয় নয়।

 

ল্যাংডন নিশ্চিত ছিলো না, ফশের মনে ঠিক কোন্ বিষয়টা ঘুরপাক খাচ্ছে।

 

সনিয়ে একজন ফরাসি, ফশে উত্তাপহীন কণ্ঠে বললো। তিনি প্যারিসে থাকতেন। তারপরও তিনি এরকম একটি বার্তা বেছে নিলেন লেখার জন্য…

 

ইংরেজিতে, ল্যাংডন বললো, বুঝতে পারলো ক্যাপ্টেনের কথার অর্থটি। ফশে মাথা নাড়লো, যথাযর্থই। কোন ধারণা আছে, কেন?

 

ল্যাংডন জানতো সনিয়ে খুব নিখুঁত ইংরেজি বলতেন, তারপরও শেষ কথা হিসেবে লিখিত বার্তাটি লিখতে গিয়ে ইংরেজি ব্যবহার করাটা ল্যাংডন খেয়ালই করেনি। সে কাধ ঝাঁকালো।

 

ফশে সনিয়ের পেটে আঁকা পেনটাকলের দিকে ঘুরলো। শয়তানের পূজার সাথে কোন সম্পর্ক নেই? আপনি কি এখনও নিশ্চিত?

 

ল্যাংডন কোন কিছুর ব্যাপারেই নিশ্চিত নয়। প্রতীক বিদ্যা আর লিখিত কিছু মনে হচ্ছে কাকতালীয় নয়। আমি দুঃখিত, আমি এর চেয়ে বেশি সাহায্যে আসতে পারছি না।

 

সম্ভবত এটা আরো পরিষ্কার করে দেবে, ফশে মৃতদেহটা থেকে সরে এসে ব্ল্যাক-লাইটটা আবার তুলে ধরলো, আলোটা আরেকটু বাড়িয়ে নিয়ে নিক্ষেপ করলো। এখন?

 

ল্যাংডনের কাছে খুব বিস্ময়কর মনে হলো, কিউরেটরের শরীরের চারপাশে একটা বৃত্ত জ্বলজ্বল করছে। সনিয়ে আরো একটা চিহ্ন একেঁছেন। একটা বৃত্তের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করেছেন। এক ঝলকেই অর্থটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠলো।

 

ভিটরুভিয়ান ম্যান, ল্যাংডন সখেদে বললো। সনিয়ে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত ছবির একটা প্রমাণ সাইজের অনুলিপি তৈরি করেছেন।

 

এটাকে সেই সময়ে এনাটমিক্যালি দিক থেকে সবচাইতে শুদ্ধ ছবি হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ভিঞ্চির ভিটরুভিয়ান ম্যান আধুনিক কালের একটি সাংস্কৃতিক আইকন হয়ে উঠেছে। পোস্টার, কম্পিউটারের মাউস প্যাড, টি-শার্ট, ইত্যাদিতে এই ছবি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ছবিটাতে দেখা যাবে একটা নিখুঁত বৃত্তের মধ্যে একজন নগ্ন পুরুষ… ডানা ছড়ানো ঈগল পাখির মতো তার হাত পা ছড়ানো।

 

দা ভিঞ্চি। ল্যাংডনের ভেতরে একটা রোমাঞ্চ খেলে গেলো। সনিয়ের অভিপ্রায় খুবই স্পষ্ট, সেটা অস্বীকার করা যায় না। জীবনের শেষ মুহূর্তটায় কিউরেটর পরনের কাপড় চোপড় খুলে দা ভিঞ্চির ভিটরুবিয়ান ম্যানর অনুকরণে নিজেকে তুলে ধরেছেন।

 

বৃত্তটা একটি অব্যাখ্যাত উপাদান। নারীত্বের রক্ষার প্রতীক, নগ্ন লোকটাকে ঘিরে থাকা বৃত্তটা দা ভিঞ্চির একটি ইঙ্গিতের অভিপ্রায় নারী পুরুষের সম্প্রীতি। এখন প্রশ্ন হলো, সনিয়ে কেন এ রকম বিখ্যাত একটি ছবিকে অনুকরণ করলেন।

 

মি. ল্যাংডন, ফশে বললো, আপনার মতো একজন মানুষ নিশ্চিত করেই জানে যে, লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ডার্ক-আর্টের ব্যাপারে এক ধরনের ঝোঁক ছিলো।

 

দা ভিঞ্চি সম্পর্কে ফশের জানাশোনা দেখে ল্যাংডন খুবই অবাক হলো। কিন্তু ক্যাপ্টেনকে এ ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা তেমন সুবিধার হবে না। তাকে বোঝানো যাবে না শয়তান পূজা সম্পর্কে তার সন্দেহের নিশ্চিত কোন ভিত্তি নেই। দা ভিঞ্চি সবসময়ই ইতিহাসবিদদের কাছে একটি জটিল চরিত্র। বিশেষ করে খৃস্টিয় ঐহিত্যে। এই দূরকল্পনাকারীর অসাধারণত্ব বাদ দিলেও তিনি ছিলেন একজন সমকামী এবং প্রকৃতির স্বর্গীয় শৃঙ্খলার পূজারী। এই দুইয়ের কারণেই তাকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপাচারের দোষে অভিযুক্ত করা হয়। তাছাড়া শিল্পীর অন্যান্য কাজকর্ম তাকে শয়তান সংশ্লিষ্ট রহস্যময়তায় বিবেচনা করা হয় : দা ভিঞ্চি এনাটমি করার জন্য মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করতেন; তিনি কিছু রহস্যময় এবং উল্টো করে লেখা পাণ্ডুলিপি রেখে গেছেন; তিনি বিশ্বাস করতেন তাঁর আয়ত্তে রয়েছে সেই এলকেমি শক্তি যা দিয়ে সীসাকে সোনায় রূপান্তর করা যায়। এমনকি ঈশ্বরকে ফাঁকি দিয়ে মৃত্যুকেও থামিয়ে দেয়া যাবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন; তার এমন কিছু ভৌতিক আর কল্পিত চিত্র রয়েছে যা তখন ছিলো একেবারেই অকল্পনীয়, পরে অবশ্য সেগুলোর বেশিরভাগই বাস্তবায়িত হয়েছে।

 

ভুল বোঝাবুঝি অবিশ্বাসের জন্ম দেয়, ল্যাংডন ভাবলো। এমনকি দা ভিঞ্চির বিশাল খৃস্টিয় শিল্পকর্মের ভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও সেটা তাঁর আধ্যাত্মিক ভণ্ডামি হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। ভ্যাটিকান থেকে শত শত শিল্পকর্ম তৈরির জন্য লোনীয় সুযোগ পেলেও, দা ভিঞ্চি বৃস্টিয় ছবিগুলো নিজের বিশ্বাসের প্রকাশ হিসেবে না নিয়ে বরং সেগুলোকে বাণিজ্যিক ব্যাপার হিসেবেই নিয়েছিলেন–বিলাস বহুল জীবন যাপন করার তহবিল তৈরির উদ্দেশ্যে। দা ভিঞ্চি ছিলেন একজন খামখেয়ালি মানুষ। তিনি তার হাতে আঁকা অনেক খৃস্টিয় শিল্পকর্মে এমন কিছু সিম্বল বা প্রতীক লুকিয়ে রাখতেন যা আর যাইহোক খৃস্টিয় কিছু নয়। ল্যাংডন এ সম্পর্কে লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে একটি বক্তৃতাও দিয়েছিলো, যার শিরোনাম ছিলো : লিওনার্দোর গুপ্তজীবন্ত স্টিয় চিত্রকর্মে প্যাগান প্রতীক।

 

আমি আপনার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি, ল্যাংডন বললো, কিন্তু দা ভিঞ্চি কখনোই ব্ল্যাক আর্ট চর্চা করেননি। তিনি ছিলেন খুবই আধ্যাত্মিক একজন মানুষ, যার সাথে চার্চের সব সময়ই দ্বন্দ্ব লেগে থাকতো। কথাটা বলার সময় ল্যাংডনের মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা খেলে গেলো। সে ফ্লোরের লেখাটার দিকে আরেকবার তাকালো। ওহ্, ড্রাকোনীয় শয়তান! ও, ল্যাংড়া সেন্ট।

 

হ্যাঁ? ফশে বললো।

 

ল্যাংডন খুব সর্তকভাবে বলতে শুরু করলো। এইমাত্র আমি ভাবছিলাম যে, সনিয়ে দা ভিঞ্চির সাথে অনেক আধ্যাত্মিক দর্শনই শেয়ার করতেন, তাঁর মধ্যে, আধুনিক ধর্মমতগুলো থেকে চার্চের পবিত্র নারী নির্মূল করার ব্যাপারটাও রয়েছে। হয়তো দা ভিঞ্চির বিখ্যাত ড্রইংটা অনুকরণ করে সনিয়ে, আধুনিক চার্চ কর্তৃক দেবীদেরকে ডাইনী বানাবার ব্যাপারে তাঁদের উভয়ের হতাশার কথাটাই বলতে চেয়েছেন।

 

ফশের চোখ দুটো শক্ত হয়ে উঠলো। আপনার ধারণা সনিয়ে চার্চকে ল্যাংড়া সেন্ট এবং ড্রাকোনীয় শয়তান বলে অভিহিত করছেন?

 

ল্যাংডনকে মানতেই হলো এটা অনেক বেশি দূরকল্পনা, তারপরও মনে হচ্ছে পেনটাকল এ ধরনের আইডিয়াকে কিছুটা হলেও অনুমোদন করে। আমি যা বলতে চাচ্ছি, সেটা হলো, মি. সনিয়ে তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন দেবীদের ইতিহাস গবেষণায়, আর ক্যাথলিক চার্চের চেয়ে অন্য আর কেউ এতো বেশি ইতিহাস মুছে ফেলেনি। এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে যে, সনিয়ে হয়তো তার বিদায়ী সময়টাতে নিজের হতাশা আর অনুযোগের কথা বলাটাই বেছে নিয়েছিলেন।

 

হতাশা? ফলে জিজ্ঞেস করলো, তাকে এখন শত্রু বলে মনে হচ্ছে। এইসব লেখা হতাশার চেয়ে রাগ-গোস্বা বলেই বেশি প্রতীয়মান হচ্ছে, আপনি কি তাই বলবেন না?

 

ল্যাংডন তার ধৈর্যের শেষ সীমায় চলে এলো। ক্যাপ্টেন, আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন সনিয়ে কী বলতে চেয়েছেন সে সম্পর্কে আমার মতামতটা কি, আর আমি সেটাই আপনাকে বলছি।

 

এটা চার্চের বিরুদ্ধে বিষোদগার? ফশের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো, দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বললো সে। মি. ল্যাংডন, আমি আমার কর্মজীবনে অনেক হত্যা-খুন দেখেছি, আমার কথাটা শুনুন। যখন একজন লোক আরেকজন লোক কর্তৃক খুন হয়, আমি বিশ্বাস করি না, তখন সেই লোকটা তার চূড়ান্ত কথা হিসেবে প্রহেলিকাময় ও অস্পষ্ট আধ্যাত্মিক কিছু কথা লিখে যাবে যা কেউই বুঝতে পারবে না। আমি বিশ্বাস করি তিনি একুটাই চিন্তা করছিলেন। ফশের ফিস্ ফিস্ কথাবার্তা বাতাসে বিশ্লিষ্ট হয়ে গেলো।

 

লা ভেনজিনেস। আমার বিশ্বাস সনিয়ে এই লেখাটা লিখেছেন এটা বলার জন্য যে, কে তাকে খুন করেছে।

 

ল্যাংডন চেয়ে রইলো। কিন্তু এসব দেখে তো তেমন কিছু একদমই মনে হচ্ছে।

 

না?

 

না, ক্লান্ত এবং বিমর্ষ হয়ে সেও পাল্টা বললো। আপনি আমাকে বলেছেন, সনিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন তাঁর নিজের অফিসে, এমন একজন লোকের দ্বারা, যাঁকে তিনি নিজেই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

 

হ্যাঁ।

 

তাহলে, স্পষ্টই মনে হচ্ছে, কিউরেটর তার আক্রমণকারীকে চিনতেন।

 

ফশে মাথা নাড়লো। বলে যান।

 

তো, সনিয়ে যদি জানতেন কে তাকে খুন করেছে, তাহলে এসবের মানে কি? সে ফ্লোরের দিকে ইঙ্গিত করলো। সংখ্যার কোড? ল্যাংড়া সেন্ট? ড্রাকোনীয় শয়তান? তার পেটে আঁকা পেনটাকলটা? এগুলোর সবটাই খুব বেশি রহস্যজনক বলে মনে হচ্ছে।

 

ফশে এমনভাবে ভুরু তুললো যেনো এ ধারণাটি তার কখনোই মনে আসেনি। আপনার কথায় যুক্তি আছে।

 

সবকিছু বিবেচনা করুন, ল্যাংডন বললো, আমার ধারণা, সনিয়ে যদি বলতে চাইতেন তাঁকে কে খুন করেছে, তবে তিনি কারোর নামই লিখতেন।

 

ল্যাংডন এই কথাটা বলতেই এই প্রথমবারের মতো ফশের ঠোঁটে একটা মুচকী হাসি দেখা দিলো। যথার্থই, ফশে বললো। যথার্থই।

 

 

 

আমি একজন ওস্তাদের কাজ প্রত্যক্ষ করছি, লেফটেনান্ট কোলেত কানে হেডফোন লাগিয়ে ফশের কথাবার্তা শুনতে শুনতে ভাবছিলো।

 

ফশে এমন কিছু করবে, যা কেউ করতে সাহসও করবে না।

 

কাজোলের সূক্ষ্ম শিল্পের দক্ষতা আধুনিক কালের আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এতে একজনকে প্রচণ্ড চাপের সময় অসাধারণ ভারসাম্য ধরে রাখতে হয়। খুব কম লোকেরই এই ধরনের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক শক্তি থাকে। কিন্তু মনে হচ্ছে, এর জন্যই ফশের জন্ম হয়েছে। তার ধৈর্য আর মানসিক শক্তি রোবটের সমপর্যায়ের।

 

আজ রাতে ফশের মূল আবেগটি মনে হচ্ছে, যেনো এই গ্রেফতারটি তার একান্তই ব্যক্তিগত একটি ব্যাপার। এক ঘণ্টা আগে ফশে তার এজেন্টকে যে বৃফিংটা দিয়েছে, তাতে মনে হয় সে একেবারেই নিশ্চিত, সাধারণত এমনটি কখনোই সে করে না। আমি জানি কে জ্যাক সনিয়েকে হত্যা করেছে, ফশে বলেছিলো। তুমি জানো কি করতে হবে। আজরাতে কোন ভুল করা যাবে না।

 

আর এখন পর্যন্ত, কোন ভুলই করা হয়নি। কোলেতের কাছে এখনও এমন কোন প্রমাণ কিংবা ইঙ্গিত যথেষ্ট বলে মনে হচ্ছে না, যাতে অপরাধীর ব্যাপারে ফশের নিশ্চিত জানাটাতে বিশ্বাস রাখা যায়। কিন্তু সে জানতো, খুবভালো করেই জানতো, এই বৃষলকে জিজ্ঞেস করার কোন দরকার নেই। ফশের অনুমান, অনেক সময়ই মনে হয় প্রায় আধ্যাত্মিক কিছু থেকে উৎসারিত হয়। ঈশ্বর তার কানে কথা বলে, একজন।

 

এজেন্ট তার ইন্দ্রিয়ের ক্ষমতার প্রমাণ পাওয়ার পর একথাটা বলেছিলো। কোলেতও  সেটা মেনে নিয়েছিলো, যদি কোন ঈশ্বর থেকে থাকে, তবে বেজু ফশে সেই ঈশ্বরের তালিকায় প্রথম দিকেই থাকবে। ক্যাপ্টেন মাস্ এবং কনফেশনে নিয়মিতই উপস্থিত থাকে—অন্যসব অফিসাররা যেমনটি করে থাকে শুধুমাত্র ভালো গণসংযোগের আশায়, মোটেও তেমনভাবে নয়। কয়েক বছর আগে পোপ যখন প্যারিসে এসেছিলেন, ফশে তখন সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাঁর একজন শ্রোতার সম্মান অর্জন করতে পেরেছিলো। পোপের সাথে ফশের একটা ছবি বর্তমানে তার অফিসে টাঙানো আছে। পাপালের ষাড়, লোকজন আড়ালে আবডালে তাকে এ নামে ডাকে।

 

কিন্তু কোলেতের কাছে এটা খুবই পরিহাসপূর্ণ বলে মনে হলো, যখন সে দেখতে পেলো ফশে আজকাল ক্যাথলিক চার্চের শিশু-যৌন-নির্যাতন কেলেংকারী সম্পর্কে বেশ প্রকাশ্যেই সমালোচনা করা শুরু করেছে। এইসব পাদ্রীদেরকে একবার নয়, দুবার ফাঁসিতে ঝোলানো উচিত। ফশে বেশ জোড়েশোরেই কথাটা বলে থাকে। একবার বাচ্চাদের সাথে এই অপরাধ করার জন্য, এবং আরেকবার ক্যাথলিক চার্চের সুনামকে হেয় করবার জন্য। কোলেতের অদ্ভুত ধারণা তৈরি হয়েছিলো যে, দ্বিতীয় কারণটার জন্যই ফশে বেশি রেগে আছে।

 

তার ল্যাপটপ কম্পিউটারের দিকে ঘুরে কোলেত তার দ্বিতীয় কাজটি করতে লেগে গেলো জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম। কম্পিউটারে লুভরের পুরো এলাকাটির একটা স্ট্রাকচারাল ডিজাইন ভেসে এলো। গ্যালারি এবং হলওয়ের দিকে তার চোখ কী যেনো খুঁজতে লাগলো। অবশেষে কোলেত সেটা পেয়ে গেলো।

 

গ্র্যান্ড গ্যালারির অভ্যন্তরে ছোট্ট একটা লাল বিন্দু জ্বলছে আর নিভছে।

 

লা মার্ক।

 

ফশে আজরাতে তার শিকারকে খুব শক্ত করেই ধরেছে। রবার্ট ল্যাংডন এ পর্যন্ত নিজেকে খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছে।

 

 

 

০৯.

 

মি. ল্যাংডনের সাথে কথাবার্তায় যেনো বিঘ্ন না ঘটে সেটা নিশ্চিত করতে বেজু ফশে নিজের সেল ফোনটা বন্ধ করে রেখেছিলো। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, সেটা ছিলো খুবই ব্যয়বহুল একটা যন্ত্র যেটার রয়েছে দ্বিমুখী রেডিও সুবিধা। তার নিষেধ সত্ত্বেও এখন যন্ত্রটা বেজে উঠছে, তার এক এজেন্টের করা কলে।

 

ক্যাপিতেইন? ফোনটা সশব্দ হয়ে উঠলো ওয়াকি-টকির মতো। ফশে দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো প্রচণ্ড রাগে। সে কোনমতেই ভাবতে পারছে না, কোলেতের সার্ভিলেন্স করার কাজের চেয়ে আর কোন জরুরি বিষয় আছে কিনা বিশেষ করে এরকম একটি জটিল মুহূর্তে।

 

সে ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলো। ক্ষমা করবেন, এক মিনিট। বেল্ট থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে রেডিও ট্রান্সমিশনেরর সুইচটা চাপ দিলো।

 

উই?

 

ক্যাপিতেই, উঁ এজেন্ট দু দিপার্তমেস্ত দ্য ক্রিপ্টোগ্রাফি এস এরাইভ।

 

ফশের রাগটা কিছুক্ষণের জন্য কমে গেলো। কিটোগ্রাফার? এই অসময়ে ফোন করলেও, সম্ভবত খবরটা ভালো। ফশে সনিয়ের ক্রিপটিক অর্থাৎ রহস্যময় লেখাগুলো খুঁজে পাবার পর, সেগুলোর সব ছবিই তুলে ক্রিপ্টোলজি ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিয়েছিলো এই আশায় যে, কেউ হয়তো বলতে পারবে সনিয়ে আসলে কী বলতে চেয়েছেন। যদি এখন কোন কোড ব্রেকার এসে থাকে, তার মানে, কেউ না কেউ সনিয়ের লেখার পাঠোদ্ধার করতে পেরেছে।

 

এই মুহূর্তে আমি খুব ব্যস্ত আছি, ফশে ফোনে জবাব দিলো, ক্রিপ্টোগ্রাফারকে কমান্ড পোস্টে অপেক্ষা করতে বলো। আমার কাজ শেষ হলে লোকটার সাথে কথা বলবো।

 

মহিলা, স্যার, কণ্ঠটা শুধরিয়ে দিলো, এজেন্ট নেভু।

 

এই ফোনটা আসার পর থেকেই ফশের আশা একটু একটু করে দূরাশায় পরিণত হচ্ছে। সোফি নেভু ডিসিপিজের একটি মস্ত বড় ভুল। একজন প্যারিসবাসী তরুণী, যে ক্রিপ্টোগ্রাফি নিয়ে লেখাপড়া করেছে ইংল্যান্ডের রয়্যাল হলো ওয়েতে, দুই বছর আগে যখন নারীদেরকে পুলিশে আরো বেশি অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তার মন্ত্রণালয় সোফিকে নিয়োগ দেয় তখন থেকে মেয়েটা ফশের কাঁধে চেপে বসেছে। এ ব্যাপারে ফশে আপত্তি করেছিলো এই বলে যে, এতে ডিপার্টমেন্টটা দুর্বল হয়ে যাবে।  শুধুমাত্র শারীরিক সক্ষমতার অভাবের জন্যই নয়, নারীদের উপস্থিতি পুলিশের মাঠ পর্যায়ের পুরুষ সহকর্মীদের মনোযোগের বিচ্যুতি ঘটাবে। এটা হবে খুবই বিপজ্জনক। ফশে যতোটা আশংকা করেছিলো সোফি নেভু তার চেয়েও বেশি মনোযোগের বিচ্যুতি ঘটিয়েছে।

 

বত্রিশ বছর বয়সের মেয়েটার দৃঢ়তা তার একগুয়েমীপনাকে পরিমিত করে রেখেছে। তার বৃটেনের নতুন ক্রিপ্টোলজিক পদ্ধতির ব্যবহার ক্রমাগতভাবে প্রখ্যাত ফরাসি ক্রিপ্টোগ্রাফারদেরকে ক্ষুব্ধ করে যাচ্ছে। তারচেয়েও বড় কথা, ফশের জন্য সবচাইতে বড় সমস্যা হলো সেই চিরন্তন সত্য কথাটি যা থেকে সে নিজেও বাচতে পারেনি, সেটা হলো, একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ মানুষের অফিসে, সুন্দরী, আকর্ষণীয় কোন তরুণী চোখের সামনে থাকলে, চোখ সারাক্ষণ সেদিকেই ঘোরে, হাতের কাজের দিকে নয়।

 

ফোনে লোকটা বললো, এজেন্ট নেভু এই মুহূর্তেই আপনার সাথে কথা বলার জন্য চাপচাপি করছে, ক্যাপ্টেন। আমি তাকে থামাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে গ্যালারির দিকে রওনা দিয়ে দিয়েছে।

 

ফশে অবিশ্বাসে চিৎকার করে উঠলো প্রায়। এটা কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি খুব ভালো করেই বলেছিলাম

 

কিছুক্ষণের জন্য ল্যাংডনের মনে হয়েছিলো বেজু ফশের স্ট্রোক করেছে বোধ হয়। কথার মাঝপথে ক্যাপ্টেনের চোয়াল শক্ত হয়ে চোখ দুটো ঠিকরে বের হয়ে যাচ্ছিলো। তার রক্তচক্ষু ল্যাংডনের কাঁধের পাশে কোথাও স্থির হয়ে গেলো। ল্যাংডন ঘুরে দেখার আগেই, শুনতে পেলো একটি নারী কণ্ঠ, তার পেছন থেকে রিনিঝিনি করে বলে উঠলো।

 

এক্সুইজেজ মোয়ে, মেঁসিয়ে।

 

ল্যাংডন ঘুরে দেখে একজন তরুণী এগিয়ে আসছে। করিডোর দিয়ে লম্বা-লম্বা পা ফেলে তাদের দিকেই আসছে সে…তার হাটার ধরণে নির্ঘাত শিকারের একটি ব্যাপার রয়েছে। হাটু পর্যন্ত ক্যাজুয়াল পোশাক পরিহিত, ঘিয়ে রঙের সোয়েটার, কালো রঙের পা-মোজা, দেখতে খুব আকর্ষণীয় আর বয়স ত্রিশের কোঠায় বলে মনে হচ্ছে। তার পাতলা এলোমেলো চুলগুলো কাঁধের উপর অবিন্যস্তভাবে পড়ে আছে। সেজন্যে মুখটার চারপাশ একটু ঢেকে গেছে। এই মেয়েটার রঙ-চঙহীন সৌন্দর্য আর অকৃত্রিমতা এক ধরনের দৃঢ় চরিত্রের দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

 

ল্যাংডনের কাছে খুব অবাক করার ব্যাপার হলো যে, মেয়েটা সরাসরি তার কাছে এসে বেশ ভাবেই হাতে বাড়িয়ে দিলো। মঁসিয়ে ল্যাংডন, আমি ডিসিপিজের ক্রিপ্টোগ্রাফার ডিপার্টমেন্টের এজেন্ট নেভু। তার উচ্চারণে এ্যাংলো-স্যাক্সন টান বেশ স্পষ্ট।

 

আপনার সাথে পরিচিত হওয়া খুব আনন্দের ব্যাপার। তার নরম হাত ধরে ক্ষণিকের জন্য ল্যাংডনের মনে হলো তার চোখ মেয়েটার ওপর স্থির হয়ে আছে। মেয়েটার চোখ জলপাই সবুজ—প্রখর এবং স্পষ্ট।

 

ফশের ভাবসাবে বিরক্তি ফুটে উঠলো।

 

ক্যাপ্টেন, মেয়েটা বললো, খুব দ্রুত তার দিকে ফিরে একটা আক্রমণাত্মক কথা বললো, এজন্যে আমাকে ক্ষমা করবেন, কিন্তু সে নেস্ত পাস লো মোমেন্ত! ফশে খুব কাটা কাটাভাবে বললো।

 

আমি আপনাকে ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম, সোফি ইংরেজিতেই চালিয়ে গেলো ল্যাংডনের প্রতি সৌজন্যবশতায়। কিন্তু আপনার সেল ফোনটা বন্ধ।

 

ফোনটা একটা কারণে বন্ধ করে রেখেছিলাম, ফশে গজ গজ করতে করতে বললো। আমি মি. ল্যাংডনের সাথে কথা বলছিলাম।

 

আমি সংখ্যা-কোডটা উদঘাটন করতে পেরেছি, সে খুব সাদামাটাভাবেই কথাটা বললো।

 

ল্যাংডনের মধ্যে একধরনের স্নায়ুবিক উত্তেজনা দেখা দিলো। সে কোডটার মমোৰ্দ্ধার করতে পেরেছে?

 

ফশে কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে ব্যাপারে একটু দ্বিধাগ্রস্ত বলে মনে হলো।

 

এটা ব্যাখ্যা করার আগে, সোফি বললো, মি. ল্যাংডনের জন্য আমার কাছে একটা জরুরি মেসেজ আছে সেটা বলে নেই।

 

ফশে খুবই অবাক হলো বলে মনে হচ্ছে। মি. ল্যাংডনের জন্য?

 

মেয়েটা মাথা নেড়ে ল্যাংডনের দিকে ফিরলো, আপনার এখনই ইউএস এ্যামবাসিতে যোগাযোগ করা দরকার, মি. ল্যাংডন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আপনার জন্য আসা একটা মেসেজ তাদের কাছে রয়েছে।

 

ল্যাংডনও অবাক হলো, কোড-এর অর্থ জানার জন্য যে উত্তেজনাটা তার মধ্যে ছিলো, সেটা যেনো হঠাৎ করেই অন্য একটা বিস্ময়ে প্রতিস্থাপিত হলো। যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটা মেসেজ? সে অনুমান করতে চেষ্টা করলো, কে তাকে সেটা পাঠাতে পারে। তার সহকর্মীদের খুব কম সংখ্যকই জানে বর্তমানে সে প্যারিসে আছে।

 

খবরটা শুনে ফশের চওড়া চোয়ালটা খুব শক্ত হয়ে গেলো। ইউএস এ্যামবাসি? সে প্রশ্ন করলো, তার কথায় সন্দেহের আভাস। তারা কীভাবে জানতে পারলো মি. ল্যাংডন এখানে আছেন?

 

সোফি কাঁধ ঝাঁকালো। আসলে তারা মি. ল্যাংডনের হোটেলে ফোন করেছিলো, সেখান থেকে জানতে পেরেছে যে, মি. ল্যাংডনকে ডিসিপিজে তুলে নিয়ে গেছে।

 

ফশেকে দেখে মনে হলো সে বিপদে পড়েছে। আর এ্যামবাসি তারপর ডিসিপিজের ক্রিপ্টোগ্রাফিতে যোগযোগ করেছে?

 

না, স্যার, সোফি বললো, তার কণ্ঠ খুব দৃঢ়। আমি যখন ডিসিপিজের সুইচ বোর্ড থেকে আপনার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম তখন তারা আমায় বললো যে, মি. ল্যাংডনের কাছে একটা মেসেজ এসেছে, যদি আমি আপনাকে পেয়ে যাই তবে সেটা আমাকে পৌঁছে দিতে বললো তারা।

 

ফশেকে খুব চিন্তিত দেখালো। সে কিছু বলার আগেই সোফি ল্যাংডনের দিকে ঘুরলো।

 

মি. ল্যাংডন, সে তার পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাগজ বের করে বললো, এটা আপনার এ্যামবাসির মেসেজ সার্ভিসের নাম্বার। তারা আপনাকে যতো দ্রুত সম্ভব ফোন করতে বলেছে। কাগজটা তার হাতে তুলে দেবার সময় সে চোখের একটু ইশারা করলো। আমি যখন মি. ফশেকে কোডের অর্থটা ব্যাখ্যা করতে থাকবো তখন আপনি ফোন করে নেবেন।

 

ল্যাংডন কাগজটা দেখলো। এটাতে প্যারিসের ফোন নাম্বার এবং একটা এক্সটেনশন নাম্বার দেয়া আছে। ধন্যবাদ আপনাকে, সে বললো, তার খুব উদ্বিগ্ন বোধ হচ্ছে এখন। একটা ফোন কোথায় পেতে পারি?।

 

সোফি তার সোয়টারের পকেট থেকে একটা ফোন বের করতে যেতেই ফশে তাকে ইশারা করে থামিয়ে দিলো। তাকে এখন মাউন্ট ভিসুভিয়াস মনে হচ্ছে, এক্ষুণি বোধ হয় অগ্নৎপাত হবে। সোফির দিক থেকে চোখ না সরিয়েই সে নিজের সেল ফোনটা বের করলো। এই লাইনটা ব্যবহার করাই বেশি নিরাপদ, মি. ল্যাংডন। আপনি এটা ব্যবহার করতে পারেন।

 

ফশে কেন এই মেয়েটার উপর এত ক্ষেপে আছে সেটা ল্যাংডনের কাছে খুবই রহস্যময় মনে হচ্ছে। খুব অস্বস্তি লাগলেও সে ক্যাপ্টেনের ফোনটা গ্রহণ করলো। ফশে ফোনটা দিয়েই একটু দূরে দাঁড়ানো সোফির কাছে চলে গিয়ে চাপা গলায় কী যেনো বলতে শুরু করলো। ল্যাংডন ক্যাপ্টেনকে অপছন্দ করতে শুরু করেছে, তাদের এই অদ্ভুত কথাবার্তা থেকে নিজেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে সে ফোনটার সুইচ টিপলো। কাগজটা দেখে দেখে ল্যাংডন একটা নাম্বারে ফোন করলো।

 

রিং বাজতে শুরু করেছে। একবার… দুবার….তিনবার… শেষে কলটা লাইন পেলো।

 

ল্যাংডন এ্যামবাসির একজন অপারেটরকে আশা করেছিলো। কিন্তু তার পরিবর্তে সে একটা এন্সারিং মেশিনের আওয়াজ শুনতে পেলো। সবচাইতে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, টেপের কণ্ঠটা খুব পরিচিত। এটা সোফি নেভুরই।

 

বজুঁখ, ভু এতে বুশেজ সোফি নেভু, নারী কণ্ঠটা বললো, জো সুই এবসেনতে পোটর লো মোমেন্ত, সেই…..

 

কিছু বুঝে উঠতে না পেরে, ল্যাংডন সোফির দিকে তাকালো। আমি দুঃখিত, মিস্ নেভু? আমার মনে হয় আপনি আমাকে।

 

না, এটাই ঠিক নাম্বার, সোফি খুব দ্রুতই মাঝপথে বাধা দিয়ে বললো। এ্যামবাসির একটা স্বয়ংক্রিয় এন্সারিং মেশিন আছে। মেসেজটা পেতে হলে আপনাকে আরেকটা এক্সটেনশন নাম্বার ডায়াল করতে হবে।

 

ল্যাংডন চেয়ে রইলো। কিন্তু—

 

আমি আপনাকে তিন সংখ্যার একটা কোড দিয়েছি, কাগজে।

 

ল্যাংডন কিছু একটা বলতে যাবে, তখনই সোফি নিঃশব্দে চোখের ইশারা করলো। সেটা খুব অল্প সময়ের জন্য। তার সবুজ চোখ দুটো স্পষ্টতই একটা বার্তা দিয়ে দিয়েছে।

 

কোন প্রশ্ন করবেন না। শুধু যা বলেছি তাই করুন। ল্যাংডন এক্সটেনশন নাম্বারটা চাপলো : ৪৫৪।

 

সোফির মেসেজটা সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেলো, আর তারপরই ল্যাংডন শুনতে পেলো একটা ইলেক্ট্রনিক কণ্ঠ, ফরাসিতে : আপনার জন্য একটা নতুন মেসেজ আছে। আসলে, ৪৫৪ নম্বরটি সোফিরই, সে যখন বাড়িতে না থাকে তখন তার মেসেজ পেতে এটি ব্যবহার করা হয়।

 

আমি এই মেয়েটারই মেসেজ নিতে যাচ্ছি।

 

ল্যাংডন এবার টেপটা শুনতে পেলো। আবারো, যে কণ্ঠটি কথা বলছে, সেটা সোফির নিজের।

 

মি. ল্যাংডন, মেসেজটা একটা ভীতিকর ফিসফিস্ কণ্ঠে বলতে শুরু করলো। এই মেসেজটা পড়ে কোন ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে শুনে যান। আপনি এখন খুব বিপদে আছেন। মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনুন।

 

 

 

১০.

 

সাইলাস কালো অদি গাড়িটার পেছনের সিটে বসে আছে, টিচার তার জন্য এই গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন। সে বসে থেকে বাইরে বিখ্যাত চার্চ সেন্ট-সালপিচের দিকে তাকিয়ে আছে। নিচ থেকে ফ্লাড লাইটের আলোতে চার্চের দুটো টাওয়ারকে মনে হচ্ছে লম্বা দালানটার দুদিকে দুটো পাহাড়াদার।

 

শয়তানের দল তাদের কি-স্টোনটা লুকানোর জন্য ঈশ্বরের ঘরকে ব্যবহার করেছে। আবারো ভ্রাতৃসংঘ তাদের রহস্য-প্রহেলিকা আর শঠতার ঐতিহাসিক সুনামটি বজায় রাখতে পেরেছে। সাইলাস কি-স্টোনটা খুঁজে পেলেই সেটা তার টিচারকে দিয়ে দেবে, যাতে ভ্রাতৃসংঘ যে জিনিসটা বিশ্বাসীদের কাছ থেকে চুরি করেছিলো সেটা তাঁরা ফিরে পায়।

 

সেটা ওপাস দাইকে কত শক্তিশালীই না করবে।

 

সেন্ট সালপিচের এক ফাঁকা জায়গায় অদিটাকে পার্ক করে সাইলাস বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো, নিজেকে সুধালো এই মুহূর্তের কাজের জন্য মাথাটা পরিষ্কার রাখতে হবে। তার প্রশস্ত পিঠটা আজ সকালের কোরপোরাল মরটিফিকেশন নামক শারিরীক শাস্তির একটি অনুশীলনের জন্য এখনও ব্যাথা করছে। এই যন্ত্রণাটা তার আগেরকার জীবনের যন্ত্রণার সাথেই তুলনীয়, ওপাস দাই তাকে তখনও সেই জীবন থেকে তুলে আনেনি।

 

এখনও সেইসব স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

 

তোমার ঘৃণাকে ছেড়ে দাও, সাইলাস নিজেকে আদেশ করলো। তোমার বিরুদ্ধে যারা এসে যাবে, তাদেরকে মাফ করে দিও।

 

সেন্ট সালপিচের পাথরের টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে, সাইলাসের মনে পড়ে গেলো অতিপরিত একটা দৃশ্যের কথা … যে আচরণের কারণে অনেক অনেক আগে তাকে জেলখানায় বন্দী করা হয়েছিলো, সেটা ছিলো তার তরুণ বয়সে। আত্মশুদ্ধির স্মৃতিটা তার মনে একটা ঝড় বয়ে আসার মতো করে আসলো…পচা, সোঁদা-সোঁদা গন্ধ, মৃত্যুর বিভীষিকা, মানুষের প্রস্রাবের। হতাশার কান্না, আছুঁড়ে পড়তো পিরেনিজর বাতাসের ওপর।

 

এনদোরা, সে ভাবলো, অনুভব করলো তার পেশীগুলো আড়ষ্ট হয়ে আছে।

 

অবিশ্বাস্যভাবে, সেটা ছিলো স্পেন আর ফ্রান্সের মাঝখানে নিষিদ্ধ একটা এলাকাতে, পাথরের নির্জন সেলে বসে কান্নাকাটি করতে করতে মরে যেতে চাইতো শুধু, সেই সাইলাসকে রক্ষা করা হয়েছিলো।

 

সেই সময়ে সে এটা বুঝতে পারে নাই।

 

বজ্রপাতের পরপরই আলোটা এসেছিলো।

 

তখন তার নাম সাইলাস ছিলো না, যদিও সে তার বাবা-মার দেয়া নামেও নিজেকে পরিচয় দিতো না। সাত বছর বয়সে বাড়ি ছেড়েছিলো সে। তার মদ্যপ বাবা, জাহাজঘাটার একজন নগন্য শ্রমিক ছিল, ধবল একটি সন্তানকে দুনিয়ার আলো দেখানোর দায়ে তার মাকে প্রায় প্রতিদিনই রেগেমেগে নির্যাতন করতো। সন্তানের এরকম অবস্থার জন্য তাকে দায়ী করতো। যখন ছোট্ট সাইলাস মাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতো, তখন তাকেও বেদম মারা হতো। একরাতে, ভয়ংঙ্কর মারপিট হলো। মারের চোটে তার মা আর উঠে দাঁড়াতে পারলো না। ছোট্ট ছেলেটা নিথর-নিস্তব্ধ মার পাশে দাড়িয়ে মার এই অবস্থার জন্য নিজেকে দায়ী মনে করলো।

 

এটা আমারই দোষ

 

যেনো এক ধরণের অশুভ শক্তি তার শরীরটা নিয়ন্ত্রণ করছিলো। ছেলেটা রান্নাঘরে গিয়ে একটা কসাইর ছুরি হাতে তুলে নিলো। সম্মােহিতভাবে সোজা চলে গেলো। শোবার ঘরে, যেখানে তার বাবা মাতাল হয়ে পড়ে আছে। কোন কথা না বলেই, ছেলেটা বাবার পিঠে কোপ বসালো। তার বাবা চিৎকার দিয়ে গুটি গুটি মেরে গড়াগড়ি খেতে লাগলো, কিন্তু ছেলে আবারো কোপ মারলো। বারবার মারলো, যতোক্ষণ পর্যন্ত না ঘরটা নিথর-নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।

 

ছেলেটা বাড়ি ছাড়লো কিন্তু মার্সেইর পথঘাটকেও একই রকম শত্রুভাবাপন্ন হিসেবে পেলো সে। রাস্তাঘাটের অন্যান্য ঘর পালানো ছেলের দল তার অদ্ভুত চেহারার জন্য তাকে একঘরে করে রাখতো। তখন বাধ্য হয়েই একটা ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার ভূগর্ভস্থ ঘরে আশ্রয় নিলো সে, জাহাজঘাটার ফেলে দেয়া ফলমূল আর কাঁচা মাছ খেতো। তার একমাত্র সঙ্গী ছিলো আবর্জনায় ফেলে দেয়া পরিত্যাক্ত ম্যাগাজিন। নিজে নিজেই সে ওগুলো পড়তে শিখেছিলো। পরে খুব শক্ত-সামর্থ্য এক মানুষে পরিণত হলো সে। যখন তার বয়স বারো তখন আরেকজন ঘরপালানো ভবঘুরে—তার দ্বিগুণ বয়সের একটা মেয়ে-পথে-ঘাটে তাকে পরিহাস করতো শুধু আর তার খাবার চুরি করার চেষ্টা করতো। একদিন মেয়েটা নিজেকে আবিষ্কার করলো। ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায়। কর্তৃপক্ষ যখন ছেলেটাকে মেয়েটার উপর থেকে টেনে তুললো, তখন তারা তাকে আলটিমেটাম দিয়ে দিলো–মার্সেই ছাড়ো নয়তো কিশোর জেলখানায় যেতে হবে।

 

ছেলেটা তুইলোর উপকূলের দিকে চলে গেলো। সময়ের পরিবর্তনে, যে ছেলেটা পথঘাটের করুণার পাত্র ছিলো, সে-ই হয়ে উঠলো ভীতিকর এক চরিত্রে। ছেলেটা প্রচণ্ড শক্তির এক যুবক হিসেবে বেড়ে উঠলো। যখন লোকজন তার পাশ দিয়ে যেতো, সে শুনতে পেতো, তারা একে অন্যকে ফিস্ ফিস্ করে বলছে, একটা ভূত, তার শাদা চামড়ার দিকে তাকিয়ে তাদের চোখ ভয়ে গোল গোল হয়ে যেতো। একটা ভূত, শয়তানের মতো চোখ!

 

আর সেও নিজেকে ভূত মনে করতে শুরু করলো…স্বচ্ছ…সমুদ্রতীর থেকে সমুদ্রতীরে ভেসে বেড়ানো।

 

মনে হতো মানুষজন তার শরীরের ভেতর দিয়ে সব কিছু দেখতে পেতো।

 

আঠারো বছর বয়সে, এক বন্দর শহরে, একটা কার্গো থেকে শূয়োরের মাংসের টিনের কৌটা চুরি করবার চেষ্টা করলে দুজন খালাসি তাকে ধরে ফেললো। যে দুজন খালাসি তাকে মারতে শুরু করলো তাদের মুখ থেকে সে বিয়ারের গন্ধ পেয়েছিলো, যেমনটা তার বাবার মুখ থেকে পেতো। ঘৃণা এবং ভয়ের স্মৃতি তার ভেতর থেকে এমনভাবে উঠে এলো যেমন করে সুপ্ত অবস্থায় থেকে কোন দানব জেগে ওঠে। সেই যুবকটা একজন খালাসির ঘাড় মটকে দিলো খালি হাতেই, আর একই পরিণতি থেকে অন্য খালাসিটাকে পুলিশ এসে বাঁচাতে পেরেছিলো কোনমতে।

 

দুমাস পরে, শেকল পড়া অবস্থায়, সে এনডোরার একটা বন্দীশালায় এসে পৌঁছালো।

 

তুমি ভূতের মতোই শাদা, প্রহরীরা যখন তাকে পাহাড়া দিতো তখন তার সঙ্গীরা ঠাট্টাচ্ছলে এ কথা বলতো। তাকে ন্যাংটো করে ঠাণ্ডা শীতে রাখা হতো। মিরা এন এসপেত্রো! সম্ভবত ভূতটা এই দেয়াল ভেদ করে যেতে পারবে।

 

বারো বছর বয়স থেকেই সে তার আত্মা এবং শরীরকে ভূতুরেই মনে করতে শুরু করেছিলো। ভাবতে শুরু করেছিলো সে স্বচ্ছ কাঁচে মতো হয়ে গেছে।

 

আমি ভূত।

 

আমি ওজনহীন।

 

ইয়ো সোয় এসপেকত্রো…পালিদো কোমো উন ফ্যানতাসমা…কামিনাদো এতে মুন্দো এ সালাম, এক রাতে ভূতটা তার সহ-বন্দীদের চিৎকারে ঘুম থেকে উঠে গেলো। সে জানতো না, সে যে ফ্লোরে ঘুমিয়ে আছে, সেটা কোন অদৃশ্য শক্তিতে থর থর করে কাঁপছে। কোন মহা শক্তিশালী হাত পাথরের সেলটাকে কাঁপাচ্ছে। কিন্তু লাফ। দিয়ে দাঁড়াতেই যে জায়গাটাতে সে ঘুমিয়ে ছিলো সেখানে একটা বিশাল শৈলখণ্ড এসে আছড়ে পড়লো। সে দেখতে পেলো দেয়ালটাতে একটা বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে, আর সেই গর্ত দিয়ে সে দৃশ্যটা দেখতে পেলো, সেটা বিগত দশ বছর ধরে সে দেখেনি। একটা চাদ। মাটিটা যখন কাঁপছিলো, তখন ভূতটা একটা সরু টানেলের গিরিখাদে এসে পড়লো। জায়গাটা ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত। সারাটা রাত ধরে সে ছুটে চললো নিচের দিকে, প্রচণ্ড ক্ষুধার আর ক্লান্তিকর ছিলো ব্যাপারটা।

 

সম্বিত ফিরে পেতেই সে নিজেকে আবিষ্কার করলো বনের মধ্যে বুক চিড়ে চলে যাওয়া রেললাইনের পাশে। রেললাইন ধরে সে ছুটে চললো যেনো সে স্বপ্ন দেখছে। একটা খালি মালবাহি গাড়ি দেখতে পেলে হামগুড়ি দিয়ে সেটার কাছে গেলো, ওটার ভেতরে আশ্রয় নিলো একটু বিশ্রামের জন্য। জেগে উঠে দেখতে পেলো ট্রেনটা চলছে। কততক্ষণ? কতো দূরে? তীব্র যন্ত্রণা বোধ হলো তার। আমি মারা যাচ্ছি? সে আবারো। ঘুমিয়ে পড়লো। এবার তার ঘুম ভাঙলো অন্য কারোর ডাকাডাকিতে, চড় থাপড়ে, তাকে তুলে মালবাহি গাড়ি থেকে ফেলে দেয়া হলো। ক্ষতবিক্ষত অবস্থায়, রক্তমাখা শরীরটা নিয়ে সে একটা ছোট্ট গ্রামের বাইরে খাবারের আশায় ঘুর ঘুর করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত তার শরীরটা এভোটা দুর্বল হয়ে গেলো যে, আর এক পা-ও এগোতে পারলো না। পথের পাশে অচেতন হয়ে পড়ে গেলো সে।

 

আলোটা এসেছিলো ধীরে ধীরে। ভূতটা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো কততক্ষণ ধরে সে মরে পড়ে আছে। একদিন? তিনদিন? তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। তার বিছানাটা এতো নরম ছিলো যেনো সেটা মেঘের মতো কিছু। তার চার পাশের বাতাসটা ছিলো খুবই মিষ্টি আর মোমবাতিতে ভরা ছিলো পুরো ঘরটা। যিশুও সেখানে ছিলেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে। আমি এখানে আছি, যিশু বললেন। পাথর গড়িয়ে পড়ে তোমার নতুন এক জন্ম দিয়ে গেছে।

 

সে জেগে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। তার চিন্তাভাবনা ধোয়াচ্ছন্ন হয়ে রইলো। সে কখনও স্বর্গে বিশ্বাস করতো না, তারপরও যিশু তার দিকে চেয়ে আছে। তাকে দেখাশোনা করছে। তার বিছানার পাশে খাবার রাখা ছিলো। ভূত সেটা উদর পূর্তি করলো। তার মনে হলো খাবারগুলো তার শরীরে পুষ্ট হয়ে হাড়ে হাড়ে মাংস তৈরি করছে। সে বার বার ঘুমিয়ে পড়তো। যখন সে জেগে উঠলো, তখনও যিশুর মুখে হাসি লেগেই আছে। তিনি কথা বললেন। তুমি বেঁচে গেছে, বাছা। যে আমার পথ অনুসরণ করে সে-ই আশীর্বাদ পায়।

 

আবারো সে ঘুমিয়ে পড়লো।

 

একটা যন্ত্রণাকাতর চিৎকারে ভুতটা তার ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে এলো। চিৎকারটা যেখান থেকে এসেছিলো সেখানে ছুটে গেলো সে। একটা রান্নাঘরে ঢুকে দেখতে পেলো বিশাল দেহের এক লোক ছোটোখাটো একজনকে প্রহার করছে। কোন কিছু না জেনেই ভুতটা বিশালদেহী লোকটাকে জাপটে ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। লোকটা তার হাত থেকে ছুটে পালালো। ভুতটা দাড়িয়ে রইলো পাদ্রীর দড়ি পড়া একজন যুবকের নিথর দেহের পাশে। পাদ্রীর নাকটা একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। ভূতটা তাকে তুলে নিয়ে একটা সোফায় শোয়ালো।

 

ধন্যবাদ তোমাকে, আমার বন্ধু, পাদ্রী ভাঙাভাঙা ফরাসিতে তাকে বললো। দানের টাকা-পয়সা চোর-বাটপারের কাছে বেশি লোভনীয়। তুমি ঘুমের মধ্যে ফরাসিতে কথা বলছিলে। তুমি কি স্পেনিশে কথা বলতে জাননা?

 

ভূতটা মাথা নাড়ালো।

 

তোমার নাম কি? ভাঙা ভাঙা ফরাসিতেই বললেন।

 

ভূতটা তার বাবা-মার দেয়া নামটা কোনভাবেই মনে করতে পারলো না। সে শুধু জেলের প্রহরীরা তাকে যে নামে ডাকতো তা-ই শুনেছে।

 

পাদ্রী মুচকি হাসলেন। নো হেই প্রবলেমা। আমার নাম ম্যানুয়েল আরিঙ্গাবোসা। আমি মাদ্রিদের একজন মিশনারি। আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে ওরা দ্য ডিওর জন্য একটা গীর্জা বানাতে।

 

আমি কোথায় আছি? তার কণ্ঠটা ভীতিকর শোনালো।

 

অভিদোতে। স্পেনের উত্তরে।

 

এখানে আমি কিভাবে এলাম?

 

তোমাকে কেউ একজন আমার দরজার সামনে ফেলে রেখে গিয়েছিলো। তুমি খুব অসুস্থ ছিলে। আমি তোমাকে খাইয়েছি। তুমি এখানে অনেকদিন ধরেই আছে।

 

ভূতটা তার যুবক রক্ষাকর্তার দিকে তাকালো। অনেক বছর যাবত কেউ তার প্রতি এরকম দয়া দেখায়নি। ধন্যবাদ, ফাদার।

 

পাদ্রী তার রক্তাক্ত ঠোঁটটা স্পর্শ করলো। আমিই তোমাকে ধন্যবাদ দেই, বন্ধু আমার।

 

যখন ভূতটা সকালে ঘুম থেকে উঠলো, তখন তার দুনিয়াটা স্পষ্ট হয়ে গেলো। সে তার বিছানার উপর থাকা কুশটার দিকে তাকালো। যদিও এটা তার সাথে কোন কথাই বলেনি তবুও তার মনে হলো এটার উপস্থিতিতে তার এক ধরনের আরাম বোধ হচ্ছে। উঠে বসে দেখে তার বিছানার পাশে একটা দৈনিক সংবাদপত্র রাখা আছে, সে খুব। অবাক হলো। লেখাটা ফরাসিতে ছিলো, এক সপ্তাহের পুরনো। যখন সে গল্পটা পড়লো, শিউরে উঠলো। এতে বলা আছে, একটা প্রচণ্ড ভূমিকম্পে পাহাড়ের পাদদেশের বন্দীশালা ধবংস হয়ে গেছে আর অনেক বিপজ্জনক কয়েদী পালিয়েছে। তার বুক ধরফর করতে লাগলো।পাদ্রী জানে আমি কে? তার যে ধরনের আবেগের সৃষ্টি হলো, সেটা এর আগে আর হয়নি। লজ্জা। অপরাধবোধ। তার সাথে ধরা পড়ার ভয়। সে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠলো। কোথায় পালাবো আমি?

 

বুক অব এক্টস্, দরজার দিক থেকে কণ্ঠটা বললো। ভূতটা ঘুরে দেখে ভয় পেয়ে গেলো।

 

তরুণ পাদ্রীটি ঘরে ঢুকলো হাসতে হাসতে। তাঁর নাক খুব বাজেভাবে ব্যান্ডেজ করা। তাঁর হাতে একটা পুরনো বাইবেল। আমি ফরাসিতে একটা বাইবেল খুঁজে পেয়েছি, তোমার জন্য। অধ্যায়গুলোতে দাগ দেয়া আছে।

 

অনিশ্চয়তা বোধ থেকেই ভূতটা বাইবেল হাতে তুলে নিয়ে পাদ্রীর দাগ দেয়া অধ্যায়গুলোর দিকে তাকালো।

 

এক্টস ১৬।

 

পংক্তিটাতে বলা আছে সাইলাস নামের এক বন্দীর কথা যাকে নগ্ন করে সেলের ভেতরে ফেলে নির্যাতন করা হয়েছিলো। সে ঈশ্বরের স্তবক গাইছিলো। যখন ভূতটা ২৬ নাম্বার পংক্তিতে পৌঁছালো, সে আতকে উঠলো।

 

…আর হঠাৎ করেই, সেখানে একটা প্রবল ভূমিকম্প হলো, তাতে বন্দীশালার ভিতটা কেঁপে উঠলো আর ভেঙ্গে পড়লো সবগুলো দরজা।

 

তার চোখ পাদ্রীর দিকে নিক্ষিপ্ত হলো।

 

পাদ্রী একটা উষ্ণ হাসি দিলেন। এখন থেকে, বন্ধু, যদি তোমার অন্য কোন নাম থেকে থাকে, আমি তোমাকে সাইলাস নামেই ডাকবো।

 

ভূতটা মাথা নাড়লো। সাইলাস। তাকে রক্ত-মাংসের শরীর দেয়া হলো। আমার নাম সাইলাস।

 

নাস্তা খাবার সময় হয়ে গেছে, পাদ্রী বললেন, যদি তুমি আমাকে এই গীর্জাটা বানাতে সাহায্য করো তবে তোমার খুব শক্তির দরকার রয়েছে।

 

 

 

ভূমধ্য সাগর থেকে বিশ হাজার ফুট উঁচুতে, আলিতালিয়ার ১৬১৮ বিমানটা, শূন্যে একটু ঝাকি খেলে যাত্রীরা ঘাবড়ে গেলো। বিশপ আরিঙ্গাবোসা এগুলো লক্ষ্যই করলেন না। তার চিন্তাভাবনা ছিলো ওপাস দাইর ভবিষ্যত নিয়ে। তিনি জানতে উদগ্রীব ছিলেন প্যারিসের কাজটা কতোটুকু হলো, তার ইচ্ছে হলো সাইলাসকে একটা ফোন করতে। কিন্তু তিনি তা করলেন না। টিচার নিজে সেটা দেখছেন।

 

এটা তোমার নিজের নিরাপত্তার জন্য, টিচার ব্যাখ্যা করেছিলেন। ফরাসি টানে ইংরেজিতে বলেছিলেন, আমি বেশ ভালো করেই জানি কীভাবে ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগের যন্ত্রগুলো ইন্টারসেপ্ট করা হয়। ফলাফলটা তোমার জন্য খুবই ধ্বংসাত্মক হতে পারে।

 

আরিঙ্গাবোসা জানতেন তিনি ঠিকই বলেছেন। টিচার হলেন খুবই সর্তক একজন মানুষ। তিনি আরিঙ্গারোসার কাছে নিজের পরিচয় দেননি, আর তিনি নিজেও প্রমাণ করেছেন যে, তিনি একজন বিশ্বস্ত লোক। হাজার হোক, তিনি খুবই গোপন একটা জিনিস জানেন। ভ্রাতৃ সংঘের শীর্ষ চার ব্যক্তির নাম! এজন্যেই বিশপের কাছে টিচারের এতো সমাদর।

 

বিশপ, টিচার তাঁকে বলেছিলেন, আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। আমার পরিকল্পনা সফল করার জন্য আপনি অবশ্যই সাইলাসকে কয়েক দিনের জন্য আমার সাথে যোগাযোগ করার অনুমতি দেবেন। সে যেনো আমার কাছেই জবাবদিহি করে। আপনারা দুজন সেই সময়টাতে কোন কথা বলবেন না। আমি তার সাথে খুবই নিরাপদ চ্যানেল ব্যবহার করে যোগাযোগ করবো।

 

আপনি তার সঙ্গে সম্মানের সাথে ব্যবহার করবেন?

 

একজন বিশ্বাসী মানুষ তো সর্বোচ্চ সম্মানই আশা করে।

 

চমৎকার। বুঝতে পেরেছি। এটা শেষ হওয়ার আগে সাইলাস এবং আমি কথা বলবো না।

 

এটা আমি করবো আপনার পরিচয়টা রক্ষা করার জন্য। সাইলাসের পরিচয় এবং আমার বিনিয়োগ রক্ষা করতেও এর প্রয়োজন রয়েছে।

 

আপনার বিনিয়োগ?

 

বিশপ, যদি আপনার অতিরিক্ত কৌতূহল আপনাকে জেলে ভরে ফেলে তবে তো, আপনি আর আমার পারিশ্রমিকটা দিতে পারবেন না।

 

বিশপ হাসলেন। চমৎকার যুক্তি। আমাদের দুজনের আকাঙ্খ একই, ঈশ্বরের জন্যই আমরা কাজ করি।

 

বিশ মিলিয়ন ইউরো, বিশপ ভাবলেন, প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। অঙ্কটা ইউএস ডলারের প্রায় সমপরিমাণ। খুব শক্তিশালী হবার জন্য যথার্থই বটে।

 

তাঁর মনে হলো সাইলাস এবং টিচার ব্যর্থ হবে না। টাকা এবং বিশ্বাস খুবই শক্তিশালী জিনিস।

 

 

 

 

 

০২. উঁয়ে প্লাঁসোইতোরি নিউমেরিক

উঁয়ে প্লাঁসোইতোরি নিউমেরিক? বিবর্ণ মুখে ফশে অবিশ্বাসে সোফির দিকে চেয়ে আছে। একটা ঠাট্টা? সনিয়ের কোডের ব্যাপারে আপনার পেশাগত মূল্যায়ন হলো, এটা একধরনের গাণিতিক ঠাট্টা?

 

ফশে এই মেয়েটার ধৃষ্টতায় বিস্মিত। তার অনুমতি ছাড়া সে এইমাত্র এখানে এসে যা করছে শুধু সেটাই নয়, বরং মেয়েটা এখন তাকে এই বলে বিশ্বাস করতে বলছে যে, সনিয়ে তার অন্তিম মুহূর্তে একটা গাণিতিক প্রহেলিকা রেখে গেছেন?

 

এই কোডটা, সোফি ফরাসিতে দ্রুত বলে গেলো, একেবারেই অর্থহীন একটা জিনিস। জ্যাক সনিয়ে অবশ্যই জেনে থাকবেন যে, আমরা খুব দ্রুতই এখানে এসে এটা এভাবেই দেখবো। সে সোয়েটারের পকেট থেকে একটা দোমড়ানো কাগজ বের করে ফশের হাতে তুলে দিলো। এখানেই এটার পাঠোদ্ধারের বিষয়টা আছে।

 

ফশে লেখাটার দিকে তাকালো।

 

১-১-২-৩-৫-৮-১৩-২১

 

এই? সে ফুঁসে উঠলো। আপনি কেবল সংখ্যাগুলো ছোট থেকে বড়তে সাজিয়েছেন।

 

সোফির নার্ভ খুব শক্ত, সে একটা সম্ভষ্ট হবার হাসি দিলো। একদম ঠিক। ফশে বিড়বিড় করে আপন মনে বকতে শুরু করলো।

 

এজেন্ট নেভু, আপনি এসব নিয়ে কতদূর যাবেন, সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণাই নেই, তবে আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি, ওখানে খুব দ্রুত যান। সে ল্যাংডনের দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। সে কানে ফোনটা চেপে অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে। ল্যাংডনের ফ্যাঁকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে, ফশে আঁচ করতে পারলো খবরটা খারাপই হবে।

 

ক্যাপ্টেইন, সোফি বললো, তার কণ্ঠ বিপজ্জনকভাবেই উদ্ধত। আপনার হাতে যে সংখ্যাগুলো আছে সেটা খুবই বিখ্যাত আর ঐতিহাসিক একটা সখ্যক্রম।

 

ফশে এ ব্যাপারে সচেতন ছিলো না যে, পৃথিবীতে কোন সংখ্যাক্রম বিখ্যাত হয়ে থাকতে পারে। সে সোফির কথাটা পাত্তাই দিলো না।

 

এটা ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রম, সোফি জানালো, ফশের হাতে ধরে থাকা কাগজটার দিকে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করলো সে। এটা এমন একটি সংখ্যাক্রম, যার পূর্বের দুটি সংখ্যার যোগ ফল হলো তৃতীয় সংখ্যাটির সমান।

 

ফশে সংখ্যাগুলো ভালো করে দেখে নিলো। কথাটা সত্যি। তারপরেও সে বুঝতে পারলো না, এর সাথে সনিয়ের মৃত্যুর সম্পর্ক কী।

 

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে গণিতশাস্ত্রবিদ লিওনার্দো ফিবোনাচ্চি এই সংখ্যাক্রম তৈরি করেছিলেন। নিশ্চিতভাবে সনিয়ের লেখা সংখ্যাগুলোর সবটাই ফিবোনাচ্চি সংখ্যা হওয়টা কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয়।

 

ফশে তরুণীর দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো। চমক্কার, যদি এটা কাকতালীয় ব্যাপার না-ই হয়ে থাকে, তাহলে আপনি কি আমায় বলবেন, কেন জ্যাক সনিয়ে এটা বেছে নিলেন। তিনি কি বলতে চাচ্ছেন? এটার মানেই বা কি?

 

মেয়েটা কাঁধ ঝাঁকালো। একেবারে কিছুই না। এটাই হলো আসল কথা। এটা খুব সরল একটা ক্রিপটোগ্রাফিক জোক। অনেকটা বিখ্যাত কোন কবিতার কিছু শব্দ নিয়ে, সেগুলো এলোমেলো করে মিশিয়ে, কাউকে খুঁজে বের করতে বলা।

 

ফশে খুবই আক্রমনাত্মকভাবে কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেলো। সোফির চেহারা থেকে তার মুখটা মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। আমি নিশ্চিত করেই আশা করি যে, এসবের চেয়ে আরো ভালো ব্যাখ্যা আপনি আমাকে দেবেন।

 

ক্যাপ্টেনের এভাবে সামনে ঝুকে আসাতে সোফির নরম চেহারাটা বিস্ময়ে হতবাক হলো। ক্যাপটেন, আজরাতের এখানকার যে বিপদ সেটা বিবেচনা করুন, আমার মনে হচ্ছে, আপনি এটা জেনে বিশ্বাস করবেন যে, জ্যাক সনিয়ে আপনার সাথে হয়তো খেলা খেলছেন। আসলে তা নয়। আমি ক্রিপটোগ্রাফির পরিচালককে জানিয়ে দেবো, আপনার আর আমাদেরকে প্রয়োজন নেই।

 

এটা বলেই সে যে পথ দিয়ে এসেছিলো সেদিকে ঘুরে চলে গেলো।

 

হতবাক হয়ে ফুশে চেয়ে চেয়ে দেখে মেয়েটা অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলো। মেয়েটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো? সোফি নেভু এইমাত্র যা করলো তা আর কিছু না, স্রেফ লো সুইসাইড প্রফেশনাল।

 

ফশে ল্যাংডনের দিকে ঘুরে দেখলো সে এখনও ফোনে কথা শুনেই যাচ্ছে, আগের চেয়েও বেশি মনোযোগী আর চিন্তিত মনে হলো তাকে। খুব মনোযোগ দিয়েই সে ফোনের মেসেজটা শুনে যাচ্ছে। ইউ এস এ্যামবাসি। বেজু ফশে অনেক কিছুই ঘৃণা করে…কিন্তু ইউএস এ্যামবাসির ওপর তার যতোটা রাগ ততোটা খুব কম জিনিসের ওপরই।

 

ফশে এবং এ্যামবাসেডর নিয়মিতই একে অপরকে মোকাবেলা করে থাকে পররাষ্ট্রবিষয়ক কিছু বিষয় নিয়ে তাদের সবচাইতে সাধারণ যুদ্ধটা বাঁধে ফ্রান্সে আগত আমেরিকানদের সাথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আচরণ নিয়ে। প্রায় প্রতিদিনই, ডিসিপিজে আমেরিকান ছাত্রদেরকে মাদকসহ গ্রেফতার করে থাকে। আমেরিকান ব্যবসায়ীরা অল্পবয়স্কা পতিতাসহ এবং আমেরিকান পর্যটকরা দোকান থেকে চুরির দায়ে অথবা ভাঙচুরের জন্য গ্রেফতার হয়ে থাকে। বৈধভাবেই ইউএস এ্যামবাসি অভিযুক্ত নাগরিকদেরকে নিজের দেশে বিচারের জন্য পাঠিয়ে দেয়, যেখানে তাদেরকে একটা থাপ্পর মারা ছাড়া আর কিছুই করা হয় না।

 

আর এই কাজটা এ্যামবাসি বিরামহীনভাবেই করে থাকে।

 

লো মাসকুলেশন দ্য লা পুলিশ জুডিশিয়ার, ফশে একে এভাবেই অভিহিত করে থাকে। প্যারিস ম্যাচ সম্প্রতি একটা কার্টুন ছেপেছে, যাতে ফশেকে পুলিশের কুত্তা হিসেবে দেখানো হয়েছে, কুত্তাটা এক আমেরিকানকে কামড়াতে চেষ্টা করছে, কিন্তু তার শেকল ইউএস এ্যামবাসিতে বাধা, তাই সে কামড়াতে পারছে না।

 

আজ রাতে আর সেটা হচ্ছে না, ফশে মনে মনে বললো। অনেক বড় বিপদে পড়েছে আজকে।

 

রবার্ট ল্যাংডন ফোনটা রেখে দিলো। তাকে খুব অসুস্থ দেখাচ্ছে।

 

সবকিছু কি ঠিক আছে? ফলে জিজ্ঞেস করলো।

 

ক্লান্ত ভঙ্গীতে ল্যাংডন মাথা নাড়লো।

 

দেশ থেকে খারাপ খবর এসেছে, ফশে অনুমান করলো, খেয়াল করে দেখলো ল্যাংডন ঘামছে।

 

একটা দুর্ঘটনা, ল্যাংডন ফশের দিকে অদ্ভুত ভঙ্গীতে তাকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললো, এক বন্ধু… সে একটু ইতস্তত করলো। সকালের প্রথমই দিকেই আমাকে দেশের ফ্লাইটটা ধরতে হবে।

 

ল্যাংডনের চেহারায় যে অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছে সেটা যে সত্যি, সে ব্যাপারে ফশের কোন সন্দেহ ছিলো না। তার পরও, তার কাছে মনে হলো ল্যাংডনের মনে অন্য কিছুও আছে, যেনো একটা দূরবর্তী ভয় আমেরিকানটার চোখে মুখে জেঁকে বসেছে। খবরটা শুনে আমি দুঃখিত, ল্যাংডনকে খুব ভালো করে দেখে কশে বললো। আপনি কি একটু বসবেন? সে গ্যালারির একটা ভিউয়িং বেঞ্চের দিকে ইঙ্গিত করে বললো।

 

ল্যাংডন উদাসভাবে মাথা নেড়ে কয়েক ফিট দূরের একটা বেঞ্চের কাছে গিয়ে একটু থামলো। প্রতিটি মুহূর্তে তাকে আরো বেশি দ্বিধাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। আসলে, আমার মনে হচ্ছে বিশ্রামঘরটা একটু ব্যবহার করি।

 

ফশে ভুরু তুললো একটু। বিশ্রাম ঘর। অবশ্যই। ঠিক আছে, কয়েক মিনিটের বিরতি নেয়া যাক তবে। সে বিশ্রাম ঘরটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিলো। বিশ্রাম ঘটা কিউরেটরের অফিসের ঠিক পেছন দিকেই।

 

ল্যাংডন একটু ইতস্তত করলো। অন্যদিকে ইঙ্গিত করে দেখালো, গ্যালারির করি ডোরের দিকে। আমার মনে হয় আরো কাছ একটা বিশ্রামঘর আছে, ওখানে।

 

ফশে বুঝতে পারলো ল্যাংডন ঠিকই বলছে। গ্র্যান্ড গ্যালারির শেষ মাথায় দুটো বিশ্রামঘর আছে। আমি কি আপনার সাথে আসবো?

 

ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিয়ে রওনা দিতে উদ্যত হলো। না, তার আর দরকার নেই। আমার মনে হয়, আমার কয়েক মিনিট একা থাকা দরকার।

 

ল্যাংডনের একা চলে যাওয়াতে ফশে তেমন চিন্তিত হলো না। কারণ, সে জানে ল্যাংডন এখান থেকে কোনভাবেই বের হতে পারবে না সবগুলো ফটকেই পাহাড়া বসানো আছে। এমনকি ফায়ার-স্কেপ সিঁড়িগুলোও নজরে রাখা আছে। ডিসিপিজের এজেন্টরা ভেতরে, বাইরে, চারদিকেই আছে। ল্যাংডন ফশেকে ফাঁকি দিয়ে কোথাও যেতে পারবে না। এটা একেবারেই অসম্ভব।

 

আমাকে মি. সনিয়ের অফিসে ফিরে যেতে হচ্ছে কিছুক্ষণের জন্য। ফশে বললো। দয়া করে সেখানেই সোজা চলে আসুন, মি. ল্যাংডন। আমাদের আরো অনেক ব্যাপারে কথা বলার দরকার রয়েছে।

 

ল্যাংডন নিরবে চলে গেলো অন্ধকারের মধ্যেই।

 

ল্যাংডন চলে যেতেই ফশে রেগে ফেটে পড়লো। গ্র্যান্ড গ্যালারির সনিয়ের অফিসটা এখন কমান্ডসেন্টার, সেখানে ধুম করে ঢুকে পড়লো সে।

 

সোফি নেভুকে এই বিল্ডিংয়ে ঢোকার অনুমতি কে দিয়েছে! ফশে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।

 

কোলেই প্রথমে জবাব দিলো, সে বাইরের গার্ডদের বলেছিলো যে, সে কোডটার অর্থ বের করে ফেলেছে।

 

ফশে চারপাশটা এক ঝলক তাকিয়ে দেখলো। সে কি চলে গেছে?

 

সে আপনার সাথে নেই?

 

না, সে চলে গেছে। ফশে অন্ধকার হলওয়ের দিকে তাকালো। সোফির এমন কোন স্বভাব নেই যে, যাবার পথে অন্য অফিসারদের সাথে গল্পগুজব কবে, কথা বলবে। তার ইচ্ছে হচ্ছিলো নিচের গর্দভদের ওয়্যারলেস করে বলবে সোফিকে আটকাতে। কিন্তু এই চিন্তাটা বাদ দিলো ফশে। আজরাতে ইতিমধ্যেই সে অনেক উল্টাপাল্টা করে ফেলেছে।

 

এজেন্ট নেভুর সাথে পরে খেলা যাবে, মনে মনে বললো সে। মেয়েটাকে গুলি করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো তার।

 

সোফিকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে, ফশে কয়েক মুহূর্ত সনিয়ের ডেস্কে রাখা নাইট মূর্তিটার দিকে তাকালো, তারপর কোলেতের দিকে ফিরলো। তাকে পেয়েছো?

 

কোলেত একটা ইতিবাচক ভঙ্গী করে ল্যাপটপ কম্পিউটারটা তার দিকে ঘুরিয়ে দিলো। লাল বিন্দুটা এই ভবনের মানচিত্রের একটা জায়গায় পরিষ্কার বিপ করছে। যে ঘরটাতে সেটা জ্বলছে সেটাতে পাবলিক টয়লেট লেখা।

 

বেশ, একটা সিগারেট ধরিয়ে ফশে বললো, আমাকে একটা ফোন করতে হবে। আর ল্যাংডন যেনো শুধুমাত্র বিশ্রাম ঘরেই যেতে পারে সেটা একদম নিশ্চিত করে রেখো। অন্য কোথাও যেনো সে না যেতে পারে।

 

 

 

১২.

 

গ্র্যান্ড গ্যালারির শেষ মাথায় পৌঁছে রবার্ট ল্যাংডনের মনে হলো তার মাথাটা, একেবারে হালকা হয়ে গেছে। সোফির ফোন মেসেজটা তার মাথায় বার বার বাজতে লাগলো। করিডোরের শেষ মাথায়, জ্বলজ্বলে একটা সাইনে বিশ্রামঘরের আন্তর্জাতিক একটা প্রতীক আঁকা আছে, সে একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলো সেটার দিকে। বিশ্রামঘরটা ইতালিয়ান চিত্রের সারি সারি ক্যানভাসের এক ফাঁকে যেনো লুকিয়ে আছে।

 

পুরুষের চিহ্ন দেয়া দরজাটা খুঁজে ল্যাংডন ভেতরে প্রবেশ করেই বাতি জ্বালালো।

 

ঘরটা খালি।

 

সিঙ্কের কাছে গিয়ে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে সে মুখে ঝাঁপটা দিলো। ঘোরটা কাটাতে চেষ্টা করলো। কড়া ফুরোসেন্টের আলো চচ্চকে টাইলসে জ্বলজ্বল করছে। ঘরটাতে এমোনিয়ার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তোয়ালে দিয়ে মুখটা মুছতেই ঘরের দরজাটা খট করে খুলে গেলে খুব চমকে গেলো সে।

 

সোফি নেভু ঢুকলো। তার সবুজ চোখে ভয়ের আভা। ধন্যবাদ ঈশ্বরকে, আপনি এসেছেন। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।

 

ল্যাংডন সিঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে ডিসিপিজের ক্রিপ্টোগ্রাফার সোফি নেভুর দিকে বিস্ময়ে চেয়ে আছে।

 

মাত্র মিনিটখানেক আগে ল্যাংডন ফোনে তার মেসেজাটা শুনেছে। ভাবছিলো এই ক্রিপ্টোগ্রাফার ভদ্রমহিলা নির্ঘাত পাগল। তারপর যতোই সোফি নেভুর কথা সে শুনছে, ততোই তার মনে হচ্ছে মেয়েটা সততার সাথেই কথা বলছে। এই মেসেজটা শুনে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। ঠাণ্ডা মাথায় গুধ গুনে যান। আপনি এখন বিপদে আছেন। আমার কথা মনোেযোগ দিয়ে শুনুন।

 

অনিশ্চয়তা বোধ করলেও, ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিলো সোফি যা বলবে ঠিক তা-ই করবে। সে ফশেকে বলেছে যে, ফোনের মেসেজটা তার নিজের দেশের একজন আহত বন্ধুর পাঠানো। তাকে দেশে ফিরে যেতে বলা হয়েছে। তারপর সে বিশ্রামঘর ব্যবহার করার কথা বলেছে, যেটা গ্যালারির শেষ প্রান্তে অবস্থিত।

 

সোফি এখন তার সামনে দাড়িয়ে আছে, তার শ্বাস প্রশ্বাস এখনও দ্রুত চলছে। অনেকটা পথ ঘুরে এখানে আসতে হয়েছে তাকে। ফুরোসেন্ট লাইটে ল্যাংডন দেখলো সোফির মুখটা বেশ নরম। সে অবাকই হলো বলা যায়। শুধুমাত্র তার চোখটা তীক্ষ্ম। আর সেটা যেনো রেনোয়র একাধিক লেয়ারে আঁকা ঐন্দ্রজালিক একটা মুখচ্ছবি… আড়াল করা কিন্তু স্বতন্ত্র এক ধরনের ঢেকে থাকা রহস্য আর সাহসিকতাপূর্ণ।

 

আমি আপনাকে সাবধান করে দিতে চাই, মি. ল্যাংডন… সোফি বলতে শুরু করলো, এখনও তার নিঃশ্বাস দ্রুত পড়ছে, আপনি এখন সু সারভিলেন্স ক্যাচির অধীনে আছেন। কথাগুলো যখন বলছিলো তখন তার উচ্চারিত শব্দগুলো প্রতিধ্বনি হলো।

 

কিন্তু…কেন? ল্যাংডন জানতে চাইলো। সোফি ইতিমধ্যেই তাকে ফোনে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছে। কিন্তু কথাটা সে সোফির মুখ থেকেই শুনতে চায়।

 

কারণ, কয়েক পা সামনে এগিয়ে এসে সে বললো। এই হত্যাকাণ্ডে ফশের প্রাথমিক সন্দেহভাঁজন হলেন আপনি।

 

ল্যাংডন কথাটা শুনে অবিশ্বাসে তাকালো, তারপরও কথাটা তার কাছে খুব হাস্যকর শোনালো। সোফির মতে, ল্যাংডনকে আজ রাতে লুভরে ডেকে আনা হয়েছে একজন সিম্বোলজিস্ট হিসেবে নয়, বরং একজন সন্দেহভাঁজন হিসেবে। তাকে বর্তমানে ডিসিপিজের কাছে জনপ্রিয় পদ্ধতি সারভিলেন্স ক্যাচির আওতায় রাখা হয়েছে এক ধরনের ধোকাবাজি, পুলিশ এই পদ্ধতিটা ব্যবহার করে সন্দেহভাঁজনকে অপরাধ সংঘটিত স্থানে নিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, যাতে সন্দেহভাঁজন ব্যক্তি নার্ভাস হয়ে ভুলবশত কিছু করে ফেলে, আর জালে আঁটকা পড়ে যায়।

 

আপনার জ্যাকেটের বাম দিকের পকেটে দেখুন, সোফি বললো। আপনি প্রমাণ পাবেন, তারা আপনাকে নজরে রেখেছে।

 

ল্যাংডন বুঝতে পারলো তার উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। আমার পকেটে দেখবো? শুনে মনে হচ্ছে এক ধরনের সত্তা যাদুর কৌশল।

 

একটু দেখুন।

 

অনিচ্ছা সত্ত্বেও, ল্যাংডন তার জ্যাকেটের পকেটে হাত দিলো—এই পকেটটা সে কখনই ব্যবহার করে না। ভেতরে কিছুই খুঁজে পেলো না। কি আর আশা করতে পারো তুমি? সে একটু ভাবলো, হয়তো সোফি পাগলই হয়ে গেছে। কিন্তু পরক্ষণেই হাতে একটা কিছুর নাগাল পেলো, একেবারেই অপ্রত্যাশিত। জিনিসটা ছোট্ট আর শক্ত। তার আঙ্গুলে ওটার স্পর্শ লাগলো। ল্যাংডন সেটা বের করে এনে দেখলো, দারুণ বিস্মিত হলো সে। একটা ধাতব জিনিস। বোতামের মতো কিছু, অনেকটা হাতঘড়ির ব্যাটারির মতো দেখতে। আগে কখনও দেখেনি সে। এটা কি….?

 

জিপিএস ট্র্যাকিং ডট, সোফি বললো, বিরামহীনভাবেই এটা নিজের অবস্থান সম্পর্কে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তথ্য দিয়ে থাকে, আর ডিসিপিজে সেটা মনিটরিংও করতে পারে। আমরা এটা লোকজনের অবস্থান জানার কাজে ব্যবহার করে থাকি। এই পৃথিবীর যে কোন জায়গা, এমনকি দুই ফিটের মতো জায়গাও এটা চিহ্নিত করতে পারে। এ দিয়ে তারা আপনাকে নজরদাড়ি করছে। যে এজেন্ট লোকটা আপনাকে হোটেল থেকে তুলে এনেছে, সে-ই এই জিনিসটা আপনার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

 

ল্যাংডন হোটেল ঘরের কথাটা স্মরণ করলো…তার দ্রুত গোসল করা, পোশাক পরা, ডিসিপিজের এজেন্ট ঘর থেকে বের হবার সময় তার টুইড জ্যাকেটটা হাতে নিয়ে ছিলো। বাইরে খুব ঠাণ্ডা, মি. ল্যাংডন, এজেন্ট লোকটা তাকে বলেছিলো। প্যারিসের বসন্ত শুধু গানেরই হয় না। ল্যাংডন তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জ্যাকেটটা পরে নিয়েছিলো।

 

সোফির অলিভ রঙের চোখের চাহনীটা খুবই প্রখর। আমি আপনাকে এই জিনিসটার ব্যাপারে আগে সতর্ক করিনি, কারণ আমি চাইনি আপনি ফশের সামনেই আপনার পকেট হাতড়ে বেড়ান। আপনি যে এটা খুঁজে পেয়েছেন সেটা যেনো সে না জানে।

 

ল্যাংডন কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে সে সম্পর্কে কোন ধারণাই তার ছিলো না।

 

তারা আপনার সাথে জিপিএস লাগিয়ে দিয়েছে, কারণ তারা ভেবেছে, আপনি পালাতে পারেন। সোফি একটু থামলো। সত্যি বলতে কী, তারা আশা করছে আপনি পালাবেন ; এতে তাদের কেটা খুব শক্ত হবে।

 

আমি পালাবো কেন! ল্যাংডন জানতে চাইলো। আমি নির্দোষ!

 

ফশে কিন্তু অন্য কিছু মনে করছে।

 

রেগে মেগে ল্যাংডন ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ডটটা ফেলতে উদ্যত হলো।

 

না! সোফি তার হাতটা টেনে ধরে তাকে থামালো।

 

পকেটেই রাখুন। এটা ফেলে দিলে সিগনালটা থেমে যাবে, তখন তারা বুঝতে পারবে আপনি জিনিসটা খুঁজে পেয়েছেন। ফশে আপনাকে একা ছেড়েছে, তার কাণ সে আপনার অবস্থানটা মনিটরিং করতে পারছে। যদি সে জেনে যায় যে, আপনি এটা ধরে ফেলেছেন, তবে যা করবে… সোফি কথাটা শেষ করলো না। জিনিসটা তার পকেটেই আবার ঢুকিয়ে দিলো। এটা আপনার সাথেই থাকুক। অন্তত পক্ষে কিছুক্ষণের জন্য।

 

ল্যাংডন আশাহত হলো। ফশে কী করে বিশ্বাস করতে পারলো যে, আমি জ্যাক সনিয়েকে খুন করেছি!

 

আপনাকে সন্দেহ করার কিছু সঙ্গত কারণও রয়েছে, কিছু জোড়ালো প্রমাণ আছে তার কাছে। সোফির মুখে একটা চিন্তার ছাপ দেখা গেলো। এখানে একটা ছোটখাটো প্রমাণ রয়েছে যা আপনি দেখেননি। ফশে সেটা খুব যত্ন সহকারে আপনার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে।

 

ল্যাংডন শুধু চেয়ে রইলো।

 

আপনি কি সনিয়ের লেখা তিনটি লাইন মনে করতে পারবেন, ফ্লোরের লেখাটা?

 

ল্যাংডন মাথা নাড়লো। সংখ্যা আর লেখাটা তার মনে ছাপা হয়ে গেছে।

 

সোফির কণ্ঠটা নিচুতে নেমে ফিসফিসানিতে পরিণত হলো। দূভাগ্যজনক কথা হলো, আপনি মেসেজটার পুরোটা দেখেননি। সেখানে চতুর্থ একটা লাইন ছিলো যা আপনি আসার আগেই ফশে ছবি তুলে রেখে মুছে ফেলেছে।

 

যদিও ল্যাংডন জানতো যে ওয়াটার-মার্কের কালি খুব সহজেই মুছে ফেলা যায় তবুও সে কল্পনাও করতে পারলো না, ফশে কেন সেটা করতে যাবে।

 

মেসেজটার শেষ লাইন, সোফি বললো, এমন কিছু ছিলো যা সে চায়নি আপনি দেখে ফেলেন। সে একটু থামলো। অন্তত পক্ষে, আপনার সাথে একটা মীমাংসা করার আগে তো নয়ই।

 

সোফি তার পকেট থেকে একটা কম্পিউটার প্রিন্টের ছবি বের করে সেটার ভাঁজ খুললো। ফশে এটা ক্রিপ্টোলজি ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়েছিলো যাতে সনিয়ের মেসেজটার মর্মোদ্ধার করা যায়। এটা হলো মেসেজটার পূর্ণাঙ্গ ছবি। সে ছবিটা ল্যাংডনকে দিলো।

 

অবাক চোখে, ল্যাংডন ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ফ্লোরের মেসেজটার একটা ক্লোজ-আপ ছবি। শেষ লাইনটা ল্যাংডনকে এমনভাবে আঘাত করলো যেনো তার মাথায় কেউ প্রচণ্ড জোরে লাথি মেরেছে।

 

১৩-৩-২-২১-১-১-৮-৫

 

ওহ্, ড্রাকোনীয় শয়তান!

 

ও, ল্যাংড়া সেন্ট!

পি,এস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো।

 

 

 

১৩.

 

কয়েক সেকেন্ড ধরে ল্যাংডন অবাক দৃষ্টিতে সনিয়ের লেখার ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো। পি এস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো। তার মনে হলো তার পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠছে। সনিয়ে আমার নাম উল্লেখ করে একটা মেসেজ রেখে গেছেন? সে দুঃস্বপ্নেও এটা ভাবে নাই, এরকমটি কেন হলো সেটা বুঝে উঠতেও পারছে না।

 

এখন আপনি বুঝতে পারছেন, সোফি বললো, তার চোখে তাড়া, কেন ফলে আপনাকে এখানে এনেছে, আর কেনইবা আপনি তার প্রাথমিক সন্দেহে আছেন?

 

ল্যাংডন এবার বুঝতে পারলো, যখন সে বলেছিলো সনিয়ে তাঁর খুনির নাম রেখে যেতে পারেন তখন কেন ফশে ওরকম আচরণ করেছিলো তার সাথে।

 

রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো।

 

সনিয়ে কেন এটা লিখবেন? ল্যাংডন জানতে চাইলো, তার হতাশা এখন রাগে পরিণত হলো। আমি কেন সনিয়েকে খুন করতে যাবো?

 

ফশে এখনও মোটিভটা ধরতে পারেনি, কিন্তু সে আজরাতে আপনার সাথে তার সমস্ত কথাবার্তা রেকর্ড করে ফেলেছে এই আশায়, যাতে আপনি কিছু উন্মোচিত করে ফেলেন।

 

ল্যাংডনের মুখ হা হয়ে গেলো, কোন কথা বললো না।

 

সে ছোট্ট একটা মাইক্রোফোন ফিট করেছে, সোফি ব্যাখ্যা করলো, তার পকেটে থাকা একটা ট্রান্সমিটারের সাথে সেটা সংযুক্ত, সেখান থেকে সমস্ত কথাবার্তা কমান্ড পোস্টে ট্রান্সমিট হয়েছে।

 

এটা অসম্ভব, ল্যাংডন চিৎকার করে উঠলো। আমার একজন এলিবাই আছে। আমি বক্তৃতা শেষ করে সরাসরি আমার হোটেলে ফিরে এসেছিলাম। আপনি হোটেলের ডেস্কে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।

 

ফশে ইতিমধ্যেই সেটা করেছে। তার রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, আপনি হোটেলের চাবি নিয়েছেন দশটা ত্রিশে, দূর্ভাগ্যজনকভাবে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয় এগারোটার দিকে। আপনি খুব সহজেই, কাউকে না জানিয়ে, সবার নজর এড়িয়ে, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারতেন।

 

এটা পাগালামী! ফশের কাছে কোন প্রমাণ নেই!

 

সোফির চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেলো যেননা সে বলতে চাচ্ছে : কোনো প্রমাণ নেই? মি. ল্যাংডন, আপনার নাম ফ্লোরে লেখা ছিলো, মৃতদেহের পাশেই। আর সনিয়ের ডেটবুকে লেখা ছিলো আপনি তার সাথে দেখা করবেন, ঠিক যে সময়টাতে তিনি খুন হয়েছেন সে সময়। সে একটু থামলো। আপনাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ফশের কাছে খুব বেশিই প্রমাণ আছে।

 

ল্যাংডনের হঠাৎ করেই মনে হলো যে, তার একজন আইজীবির দরকার। আমি একাজ করিনি।

 

সোফি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো। এটা আমেরিকান টেলিভিশন নয়, মি. ল্যাংডন। ফ্রান্সের আইন পুলিশকে রক্ষা করে, অপরাধীকে নয়। দূভাগ্যজনক হলেও এটা সত্যি যে, এই কেসের ব্যাপারে মিডিয়াও বেশ আগ্রহী থাকবে। জ্যাক সনিয়ে প্যারিসে খুবই সম্মানিত এবং শ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তি। তার হত্যার খবরটি প্রতিটি মিডিয়ায় সকালেই চাউড় হয়ে যাবে। ফশের ওপর খুব জলদিই একটা বিবৃতি দেবার জন্য চাপ থাকবে। আর সেক্ষেত্রে, তিনি তো একজন সন্দেহভাঁজনকে গ্রেফতার করতেই বেশি পছন্দ করবেন। সেটাইতো তার জন্য সবচাইতে ভালো হবে। আপনি অপরাধী হন বা না হন, ডিসিপিজে আপনাকে তাদের হেফাজতে রাখতে চাইবে ততোক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না তারা জানতে পারবে সত্যি কী ঘটেছিলো।

 

ল্যাংডনের মনে হলো সে খাঁচায় বন্দী একটা পশু। আপনি আমায় কেন এসব বলছেন?

 

কারণ, মি. ল্যাংডন, আমি বিশ্বাস করি আপনি নির্দোষ। সোফি তার চোখটা একটু নামিয়ে আবারো তার দিকে তাকালো। আর, আরেকটি কারণ হলো, আপনার এই বিপদের জন্য অংশত আমিও দায়ি।

 

কি বললেন? আপনি দায়ী?

 

সনিয়ে আপনাকে জড়াতে চাননি, ফাঁসাতেও চাননি। এটা একটা ভুল হয়ে গেছে। ফ্লোরের মেসেজটা আসলে আমার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে!

 

ল্যাংডন কথাটা বুঝতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিলো, আমায় মাফ করবেন, কি বললেন?

 

মেসেজটা পুলিশের জন্য ছিলো না। তিনি ওটা আমার জন্য লিখেছেন। আমার মনে হয় কোন এক কারণে তিনি পুরো কাজটা খুব দ্রুত করেছেন, আর সেজন্যেই পুলিশের কাছে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে সেটা হয়তো তিনি খেয়াল করেননি। সে একটু থামলো। সংখ্যার কোডটা একেবারেই অর্থহীন। সনিয়ে এটা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন যে, এই কেসটায় যেনো একজন ক্রিপ্টোগ্রাফারকে জড়ানো হয়, আর সেই সূত্রে যাতে আমি জানতে পারি তাঁর কী হয়েছিলো।

 

ল্যাংডনের মাথায় কিছুই ঢুকলো না। তবে এটা সে বুঝতে পারলো যে, সোফি কেন তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে। পি এস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো। সোফি বুঝতে পারছে, কিউরেটর যে লেখাটা রেখে গেছেন সেটা বুঝতে হলে ল্যাংডনের সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু আপনি এটা কেন ভাবলেন যে, মেসেজটা আপনার জন্যই লেখা হয়েছে?

 

ভিটরুভিয়ান ম্যান, সোফি নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললো। লিওনার্দোর এই স্কেচটা সবসময়ই আমার খুব প্রিয়। তিনি এটা করেছেন আমার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য।

 

রাখেন, রাখেন। আপনি বলছেন কিউরেটর সাহেব জানতেন আপনার প্রিয় ছবি কী?

 

সোফি মাথা নেড়ে সায় দিলো। আমি দুঃখিত। জ্যাক সনিয়ে এবং আমি …।

 

সোফির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেলো। ল্যাংডন আঁচ করতে পারলো, সোফি এবং সনিয়ে একটা বিশেষ সম্পর্কে জড়িত। তার সামনে দাঁড়ানো যুবতীটাকে সে ভালো করে দেখলো। খুবই সুন্দরী, আর সে এ ব্যাপারে বেশ জ্ঞাত ছিলো যে, ফ্রান্সে বয়স্ক লোকেরা প্রায়শই অল্পবয়স্কা তরুণী রক্ষিতা হিসেবে রেখে থাকে। তারপরও, সোফি নেভুকে এজন রক্ষিতা হিসেবে একদমই মনে হচ্ছে না।

 

দশ বছর ধরে আমাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই, সোফি বললো। তার কণ্ঠ এখন বেশ নিচু হয়ে গেছে। তারপর থেকে আমাদের মধ্যে খুব কমই কথা হয়েছে। আজরাতে ক্রিপ্টোগ্রাফি ডিপার্টমেন্ট থেকে আমি তাঁর ছবিটা দেখে বুঝতে পেরেছি, আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা তিনি করেছিলেন। আমার কাছে একটা মেসেজ পাঠানোর চেষ্টাও করেছেন তিনি।

 

ভিটাভিয়ান ম্যানের কারণেই?

 

হ্যাঁ। আর পি, এস অক্ষর দুটো।

 

পোস্ট স্ক্রিপ্ট?

 

সে মাথা ঝাঁকালো। পিএস আমার নামের আদ্যাক্ষর।

 

কিন্তু আপনার নাম তো সোফি নেভু।

 

তিনি আমাকে ডাকতেন প্রিন্সেস সোফি বলে। তার চেহারাটায় লাল একটা আভা দেখা গেলো। পি এস মানে প্রিন্সেস সোফি।

 

ল্যাংডন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

 

খুব ছেলেমানুষী শোনাচ্ছে, আমি জানি, সে বললো, কিন্তু অনেক বছর আগের কথা সেটা। তখন আমি খুব ছোট ছিলাম।

 

আপনি তাকে চিনতেন যখন আপনি খুব ছোট ছিলেন?

 

একদম তাই সোফি বললো, তার চোখ ছল-ছল করে উঠলো আবেগে। জ্যাক সনিয়ে আমার দাদু হোন।

 

 

 

১৪.

 

ল্যাংডন কোথায়? কমান্ড-পোস্টের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে ফশে জিজ্ঞেস করলো।

 

এখনও পুরুষ টয়লেটে আছে, স্যার। লেফটেনান্ট কোলেত প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

 

ফশে বেশ বিরক্ত হলো, সময় নিচ্ছে সে, বুঝেছি।

 

কোলেতের ঘাড়ের উপর দিয়ে ফশে ল্যাপটপের পর্দায় ডটটার ছবি দেখলো। সে ল্যাংডনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে ওখানে যাবার জন্য চাপাচাপি করতে চাইলো। এরকম কাজে কাউকে বুঝতে দেয়া চলে না যে, তাকে চোখে চোখে রাখা হচ্ছে। ল্যাংডন নিজের ইচেয়ই ফিরে আসবে। ইতিমধ্যে দশমিনিট পার হয়ে গেছে।

 

খুব বেশি সময় নিচ্ছে।

 

ল্যাংডনের কি আমাদের চালাকিটা ধরে ফেলার কোন সম্ভাবনা আছে? ফশে জিজ্ঞেস করলো।

 

কোলে মাথা ঝাঁকালো। এখনও পুরুষ টয়লেটের ভেতরে নড়াচড়া করার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। তার মানে জিপিএস ডটটা নিশ্চিতভাবেই তার সাথে আছে। হয়তো সে খুব অসুস্থবোধ করছে। যদি ডটটা সে খুঁজে পেতো, তবে সেটা ফেলে দিয়ে পালাতে চেষ্টা করতো।

 

ফশে তার হাতঘড়িটা দেখে নিলো। চমৎকার। এখনও তাকে দেখে অস্থির মনে হচ্ছে। সারাটা সন্ধ্যা, কোলেত আঁচ করতে পেরেছে, তার ক্যাপ্টেনের মধ্যে এক ধরনের অদ্ভুত দুঃশ্চিন্তা। সচরাচর নির্লিপ্ত আর দারুণ চাপের মধ্যেও ঠাণ্ডা মাথার ফশেকে আজ রাতে দেখে মনে হচ্ছে আবেগ তাড়িত, যেনো এই ব্যাপারটা যে কোনভাবেই হোক, তার ব্যক্তিগত একটি ব্যাপার। অবাক করার কিছু নেই, কোলেত ভাবলো। ফশের এই গ্রেফতারটি খুবই দরকার, দারুণভাবেই দরকার। সামপ্রতিক সময়ে বোর্ড অব মিনিস্টার এবং মিডিয়া ফশের আগ্রাসী কৌশলের জন্য সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে। তার সাথে বেশ কিছু শক্তিশালী এ্যামবাসির দ্বন্দ্ব আর নিজের ডিপার্টমেন্টে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে বাজেটও খুব বাড়িয়ে ফেলেছে। আজ রাতে, একটি অতি উচ্চ প্রযুক্তি ব্যবহার করে, স্বনামধন্য একজন আমেরিকানকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে ফশে তার সমালোচকদেরকে কিছু দিনের জন্য মুখ বন্ধ করে রাখতে পারবে, যা তার চাকরিটাকে বাঁচিয়ে দেবে। আর মাত্র কয়েক বছর পরই সে অবসরে চলে যাবে, সেই সাথে পাবে অবসরের আকর্ষণীয় ভাতা। সবটাই সে এই কাজের মধ্য দিয়ে সুরক্ষা করতে পারবে। ঈশ্বর জানেন, তার পেনশনটার খুবই দরকার, কোলেত ভাবলো। প্রযুক্তির ব্যাপারে ফশের অতি আগ্রহ পেশাগত এবং ব্যক্তিগতভাবে তার মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে। আজরাতে, এখনও বেশ সময় হাতে রয়েছে। সোফি নেভুর অদ্ভুতভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করাটা যদিও দুঃখজনক, তবে সেটা খুব সামান্য ব্যাপারই। সে এখন চলে গেছে। আর ফশের কাছে খেলার জন্য এখনও কার্ড রয়েছে। সে এখনও ল্যাংডনকে জানায়নি যে, ফ্লোরের লেখার মধ্যে ল্যাংডনের নামও ছিলো। ভিকটিম নিজে সেটা লিখে গেছেন। পি, এস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো।

 

ক্যাপ্টেন? ডিসিপিজের এক এজেন্ট অফিস থেকে কল করলো। আমার মনে হয়, এই ফোনটা আপনার নেয়া দরকার। সে একটা ফোন হাতে ধরে রেখেছে। তাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে।

 

কে করেছে? ফশে জিজ্ঞেস করলো।

 

এজেন্ট চোখ কপালে তুলে বললো, ক্রিপ্টোলজি ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর।

 

কি?

 

সোফির ব্যাপারে, স্যার। মনে হচ্ছে একটা কিছু হয়েছে।

 

 

 

১৫.

 

সময় হয়ে গেছে।

 

কালো অদি গাড়িটা থেকে নামতেই নিজেকে সাইলাসের খুব শক্তিশালী মনে হলো। রাতের বাতাসে তার কোমরে আলগা করে বাঁধা দড়িটা নড়ছে। পরিবর্তনের বাতাস বইছে। সে জানে, তার সামনে যে কাজটি আছে তার জন্যে শক্তির চেয়ে বেশি চাতুর্যের প্রয়োজন। তাই তার পিস্তলটা গাড়িতেই রেখে এসেছে। থার্টিন রাউন্ড হেলার এবং কচ ইউএসপি ৪০ পিস্তলটা টিচার তাকে দিয়েছে।

 

ঈশ্বরের ঘরে কোন মারণাস্ত্রের স্থান নেই। বিশাল গীর্জাটার সামনের পাজাটা এই সময়ে একেবারেই ফাঁকা, সেন্ট সালপিচের দূরে, দৃশ্যত যে প্রাণীর চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, তা হলো একজোড়া অল্প বয়স্কা পতিতা। পথঘাটের পর্যটকদেরকে নিজেদের সম্পদ দেখাচ্ছে। তাদের প্রাপ্তবয়স্ক শরীরটা সাইলাসের কাছে অতি চেনা মনে হলো। তার নিজের পাছার কথা মনে পড়ে গেলো। তার ঊরুতে বাধা কাটা তারের সিলিস বেল্টটা মাংস কেটে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে, আর তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।

 

আচমকা তার শারীরিক কামনা উথিত হলো। দশ বছর ধরে সাইলাস সব ধরনের যৌনকর্ম থেকে নিজেকে বিশ্বস্ততার সাথেই বিরত রেখেছে। এমনকি স্বমেহনও করেনি। দ্য ওয়ের জন্য। সে জানতো ওপাস দাইকে অনুসরণ করতে হলে তাকে আরো বড় আত্মত্যাগ করতে হবে। বিনিময়ে সে পাবে তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু। ব্যক্তিগত সমস্ত সম্পদ আর ভোগকে বাদ দেয়ার একটা প্রতীজ্ঞা করেছে সে, এটাই তো আত্মত্যাগ। যে দারিদ্র থেকে সে উঠে এসেছে, আর যে যৌনতার শিকার সে জেলখানার ভেতরে হয়েছে, সেটা থেকে মুক্তি পেয়েছে সে।

 

এবার, গ্রেফতার হয়ে ফ্রান্সের এনডোরায় বন্দী হবার পর, এই প্রথম সে ফ্রান্সে আসলো। সাইলাসের মনে হলো, তার স্বদেশ তাকে পরীক্ষা করছে। তার আত্মা অতীত হিংস্রতার স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হলো। তুমি নতুন জন্ম লাভ করেছে, সে নিজেকে আবারো সুধালো। ঈশ্বরের জন্য আজকে তার যে কাজ, তার জন্য একটি হত্যার প্রয়োজন রয়েছে। এটাও আত্মত্যাগ, সাইলাস জানতো সেটা।

 

যন্ত্রণা সহ্য করার পরিমাণই হলো তোমার বিশ্বাসের গভীরতা, টিচার তাকে এই কথাটা বলেছিলেন। যন্ত্রণার ব্যাপারে সাইলাস কোন আনাড়ি লোক না, আর সে এটা টিচারের কাছে প্রমাণ করবার জন্য মুখিয়ে ছিলো।

 

হাগো লা ওরা দি দিয়োস, চার্চের মূল প্রবেশদ্বারের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সাইলাস ফিসফিস করে বললো।

 

বিশাল দরজাটার সামনে এসে সাইলাস খুব গভীর একটা নিঃশ্বাস নিলো।

 

কি-স্টোনটা। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাবে। সে তার ভূতুরে সাদা হাতটা দিয়ে দরজায় তিনটা আঘাত করলো।

 

কিছুক্ষণ পর, বিশাল দরজাটার বোল্ট খুলতে শুরু করলো।

 

 

 

১৬.

 

সোফি ভাবতে লাগলো, সে যে এখান থেকে চলে যায়নি, সেটা বুঝতে ফশের কতোক্ষণ লাগতে পারে। ল্যাংডনকে খুব বেশি মাত্রায় ঘাবড়ে যেতে দেখে সোফি নিজেকে প্রশ্ন করলো, সে ল্যাংডনকে এই পুরুষ টয়লেটে নিয়ে এসে ভুল করেছে কিনা।

 

এছাড়া আমি আর কী-বা করতে পারতাম।

 

সোফি তার দাদুর মৃতদেহটার দৃশ্য কল্পনা করলো, নগ্ন এবং ঈগল পাখির মতো হাত-পা ছড়ানো। একটা সময় ছিলো, যখন তার দাদাই তার কাছে এই দুনিয়া ছিলো। তারপরও, সোফি খুব অবাক হলো যে, এই লোকটার জন্য তার কোন দুঃখবোধ হচ্ছে। না। জ্যাক সনিয়ে এখন তার কাছে একজন আগন্তুক। তাদের সম্পর্কটা মার্চের একরাতে, একটি মাত্র ঘটনায় আচমকাই উবে গিয়েছিলো। তখন সোফির বয়স ছিলো মাত্র বাইশ। দশ বছর আগের কথা। ইংল্যান্ডের গ্র্যাজুয়েট ইউনির্ভাসিটি থেকে কয়েক দিন আগেই বাড়ি ফিরে সোফি তার দাদুকে এমন কিছুতে জড়িত অবস্থায় দেখতে পায় যা তার কখনও দেখার কথা ছিলো না।

 

হায়, আমি যদি নিজ চোখে সেটা না দেখতাম…

 

লজ্জায় ঘৃণায় বিস্মিত হয়ে সোফি তার দাদুকে ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছিলো। নিজের জমাকৃত টাকা পয়সা নিয়ে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ঠিক করে একজন বান্ধবীর সাথে বসবাস করতে শুরু করে দিলো। সোফি প্রতীজ্ঞা করেছিলো, যে দৃশ্য সে দেখেছে, সে সম্পর্কে কাউকে কোনদিন কিছুই বলবে না। তার দাদু তার সাথে যোগাযোগ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। চিঠিপত্র আর কার্ড পাঠিয়ে বার বার অনুরোধ করে বলেছিলেন, সোফি যেনো একবার দেখা করে, যাতে তার কাছে ব্যাপারটা খুলে বলা যায়। কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? একবারই কেবল সোফি জবাব দিয়েছিলো তার সাথে কখনও কোন জায়গাতে যেননা তিনি দেখা না করেন, ফোন না করেন। সোফি বেশ ভীত ছিলো যে, ঘটনাটার ব্যাখ্যা ঘটনাটার চেয়েও বেশি ভয়ংকর হবে।

 

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সনিয়ে কখনও সোফির ব্যাপারে হাল ছেড়ে দেননি। সোফি একটা বন্ধ করা ড্রয়ার নিয়ে দশ বছর কাটিয়ে দিয়েছে। তার দাদু তার অনুরোধ ঠিকই রক্ষা করেছিলেন, তাকে কখনও ফোন করেননি কিংবা চিঠিও লেখেননি।

 

কেবল আজকের সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত।

 

সোফি? সোফির এনসারিং মেশিনে তাঁর কণ্ঠস্বরটি অনেক বেশি বয়স্ক বলে মনে হয়েছিলো। আমি তোমার কথামতো দীর্ঘদিন যোগাযোগ করিনি, মেনে চলেছি তোমার নিষেধ, কিন্তু আজ তোমার সাথে আমার কথা বলতেই হবে। একটা ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে।

 

তার প্যারিসের ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে সোফি এতোগুলো বছর পর তার কণ্ঠটা শুনে খুব শীতল অনুভব করলো। তার নম্র কণ্ঠস্বরটা শুনে সোফির ছেলেবেলাকার ভক্তির স্মৃতিটা ফিরে এলো।

 

সোফি, দয়া করে আমার কথা শোনো। তিনি সোফির সাথে ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। সে যখন ছোট ছিলো তখন ঠিক এভাবেই তিনি কথা বলতেন। স্কুলে ফরাসি চর্চা করবে। বাড়িতে ইংরেজি। তুমি চিরতরের জন্য পাগল হতে পারো না। তুমি কি সেইসব চিঠিগুলো পড়ে দ্যাখোনি, যা আমি বিগত বছরগুলো ধরে লিখেছি? তুমি কি এখনও বুঝতে পারোনি? তিনি একটু থামলেন। এক্ষুনি আমাদেরকে কথা বলতে হবে। দয়া করে এবারের মতো তোমার দাদুর কথাটি রাখো। এক্ষুণি লুভরে ফোন করো আমায়। এক্ষুণি। আমার মনে হচ্ছে, তুমি আর আমি ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি।

 

সোফি এনসারিং মেশিনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। বিপদ? তিনি এসব কি বলছেন?

 

প্রিন্সেস… তার দাদুর কণ্ঠটা আবেগমথিত ছিলো, সোফি আর অটল থাকতে পারেনি। আমি জানি, আমি তোমার কাছ থেকে কিছু লুকিয়ে রেখেছি আর সেজন্যে আমি তোমার ভালবাসা হারিয়েছি। কিন্তু সেটা তোমার নিরাপত্তার জন্যই। এখন তুমি অবশ্যই সত্যটা জানতে পারবে। আমি তোমার পরিবার সম্পর্কে সত্য কথাটা বলবো।

 

সোফি হঠাৎ করেই তার নিজের মনের কথাটা শুনতে পেলো। আমার পরিবার? সোফির যখন চার বছর বয়স তখন তার বাবা-মা মারা গিয়েছিলো। তাদের গাড়িটা একটা সেতুর রেলিং ভেঙে খরস্রোতা নদীতে পড়ে গিয়েছিলো। তার দাদী এবং ছোট, ভাইটিও গাড়িতে ছিলো, হঠাৎ করেই সোফির পুরো পরিবারটা বিলীন হয়ে গেলো। সংবাদ পত্রের কিছু ক্লিপিংস সে রেখে দিয়েছে নিশ্চিত হবার জন্য।

 

তাঁর কথাগুলো সোফির হাড়ে অপ্রত্যাশিতভাবে কাঁপুনি লাগিয়ে দিয়েছিলো। আমার পরিবার! সোফির মনে পড়ে গেলো, ছোটবেলায় সে স্বপ্নে অসংখ্যবার একটা জিনিস দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠতো : আমার পরিবার জীবিত আছে। তারা বাড়িতে ফিরে আসছে। কিন্তু মুহূর্তেই এই ভাবনাটা উবে যেতো।

 

তোমার পরিবার মারা গেছে সোফি। তারা আর ফিরে আসবে না।

 

সোফি… এন্সারিং মেশিনে তার দাদুর কণ্ঠটা বলছিলো। অনেক বছর ধরে আমি এই কথাটা তোমাকে বলার জন্য অপেক্ষা করে আছি। ঠিক মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু এখন সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমাকে লুভরে ফোন করো। যত দ্রুত সম্ভব। আমি এখানে সারা রাত অপেক্ষা করবো। আমার আশংকা, আমরা দুজনেই চরম বিপদে রয়েছি। তোমার অনেক কিছুই জানার দরকার।

 

মেসেজটা এইখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো।

 

নিরবে, সোফি নিশ্চল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলো। তার দাদুর মেসেজটার মর্মার্থ সে অনুমান করার চেষ্টা করলো। একটাই সম্ভাবনা আছে, তার মনে হচ্ছিলো, এটা একটা, টোপ।

 

অবশ্যই, তার দাদু তাকে দেখার জন্য ব্যকুল হয়ে আছেন। আর সেজন্য তিনি সবকিছুই করতে পারেন। লোকটার ব্যাপারে তার ঘৃণা খুবই গভীর। সোফি ভাবলো, হয়তো তিনি মারাত্মক কোন অসুখে পড়েছেন, একেবারেই অন্তিম অবস্থা, আর ঠিক করেছেন যেভাবেই হোক একটা বুদ্ধি খাটিয়ে তিনি সোফিকে তার কাছে নিয়ে আসবেন, এক নজর দেখার জন্যে। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে তিনি বুদ্ধিমানের মতোই কাজ করেছেন।

 

আমার পরিবার।

 

এখন, লুভরের পুরুষ টয়লেটের আঘো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সোফি সন্ধ্যাবেলার মেসেজটার প্রতিধ্বনি যেনো শুনতে পেলো। সোফি, আমরা হয়তো দুজনেই খুব বিপদে আছি। আমাকে ফোন করো।

 

সোফি ফোন করেনি। এমনকি সেটা করার কোন পরিকল্পনাও করেনি। এখন, তার সন্দেহটা খুব বড়সড় একটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তার দাদু নিজের জাদুঘরে পড়ে আছেন। ফ্লোরে তিনি একটা কোডও লিখে গেছেন।

 

তার জন্য একটা কোড। এ ব্যাপারে, সে একদমই নিশ্চিত। যদিও মেসেজটার অর্থ সে বুঝতে পারছে না, তবুও সে নিশ্চিত, কথাগুলো তার জন্যই। সোফির ক্রিপ্টোগ্রাফি সম্পর্কে ছোটবেলা থেকে যে আগ্রহ ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছিলো সেটা কার্যত জ্যাক সনিয়ের জন্য—কোডের ব্যাপারে তাঁর নিজে মারাত্মক রকমের আসক্তি ছিলো। বিশেষ করে ওয়ার্ডস গেমস এবং পাজল। কত রোববার আমরা সংবাদ পত্রের ক্রিপ্টোগ্রামস্ আর ক্রসওয়ার্ডস নিয়ে পার করে দিয়েছি?

 

বারো বছর বয়সে সোফি লা মদে পত্রিকার ক্রসওয়ার্ডস কারো সাহায্য ছাড়াই মেলাতে পারতো। তবে দাদু তাকে ইংরেজিতে ক্রসওয়ার্ডস, গাণিতিক পাজল আর সাবস্টিটিউশন সিফারে দক্ষ করে তুলেছিলেন। সোফি সবগুলোই ভালো পারতো। প্রকারান্তরে সোফি তার নেশাটাকে পেশায় রূপান্তর করে নিলো পুলিশ জুডিশিয়ারে একজন কোডব্রেকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার মধ্য দিয়ে।

 

আজরাতে, সোফির ক্রিপ্টোগ্রাফার সত্ত্বা তাকে বাধ্য করছে তার দাদুর সহজ সরল কোডটা দুজন আগন্তুককে এক সঙ্গে জুড়ে দেবার জন্য সোফি নেভু এবং রবার্ট ল্যাংডন।

 

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন?

 

দুঃখের কথা হলো, ল্যাংডনের হতবাক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সোফির মনে হলো এই আমেরিকানটাও তার চেয়ে বেশি কিছু জানে না, কেন তার দাদু তাদের দুজনকে একসঙ্গে, এরকম একটি ঘটনায় নিক্ষেপ করেছেন।

 

সে আবার বলতে শুরু করলো। আপনার সাথে আমার দাদুর আজ রাতে দেখা করার কথা ছিলো। কিসের জন্য?

 

ল্যাংডনকে সত্যি খুব কিংকর্তব্যবিমূঢ় মনে হলো। তার ব্যক্তিগত সচিব সাক্ষাতের ব্যবস্থাটা করেছিলো, আর এ ব্যাপারে সে কোন কারণও বলেনি। আমিও জিজ্ঞেস করিনি। আমার ধারণা, তিনি হয়তো শুনেছেন যে, আমি ফরাসি ক্যাথেড্রালের প্যাগান আইকনোগ্রাফি নিয়ে বক্তৃতা দেবো, সে ব্যাপারে হয়তো উনার আগ্রহ রয়েছে। আমি মনে করলাম, বক্তৃতার পর তার সাথে গল্পগুজব আর একটু পানাহার করাটা খুবই আনন্দদায়ক হবে।

 

সোফি এ কথাটা একদমই মানতে পারলো না। সংযোগটা একেবারেই যুক্তিহীন বলে মনে হচ্ছে। তার দাদু প্যাগান আইকননাগ্রাফি সম্পর্কে এ পৃথিবীর যে কোন লোকের চেয়ে বেশিই জানতেন। তার চেয়েও বড় কথা, তিনি একজন অসম্ভব রকমের অন্তর্মুখী ব্যক্তি ছিলেন, কোন গুরুত্বপূর্ণ কারণ না থাকলে, একজন আমেরিকানকে ডেকে এনে আড্ডা জুড়ে দেবেন, সেটা একেবারেই অসম্ভব।

 

সোফি একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে আবারো জানতে চাইলো। আমার দাদু আজ বিকেলে ফোন করে আমাকে বলেছিলেন যে, আমরা দুজনেই খুব বড় রকমের একটা বিপদে আছি। এটা কি আপনার কাছে কোন অর্থ বহন করে?

 

ল্যাংডনের নীল চোখ দুটো চিন্তার মেঘে ঢেকে গেলো। না, কিন্তু যা ঘটেছে সেটা বিবেচনা করলে…

 

সোফি মাথা নেড়ে সায় দিলো। আজরাতে যা ঘটেছে সেটা বিবেচনায় না নিলে সে খুব বোকা হিসেবেই প্রতীয়মান হবে। অন্যমনস্কভাবে হেটে বাথরুমের ছোট্ট একটা কাঁচের জানালার কাছে গেলো। সেখান থেকে বাইরে তাকালো, দেখলো জানালার কাঁচে এলার্ম টেপ লাগানো আছে। তারা অনেক উপরে আছেচল্লিশ ফুট উপরে।

 

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে প্যারিসের চমৎকার নৈসর্গিক দৃশ্যের দিকে তাকালো। বাম দিকে, সাইন নদীর ওপারে, জ্বলজ্বল করছে আইফেল টাওয়ার। আর ঠিক সোজাসুজি তাকালে, আর্ক দ্য ট্রায়াম্ফ। ডান দিকে ঢালু আর সুউচ্চ মতোয়ামাত্রে, গর্বিত সা কোয়েরের এরাবেস্কডাম-এর পালিশ করা সাদা পাথর দ্যুতি ছড়াচ্ছে পবিত্র আলোর মতো। এখানে ডেনন উইং-এর পশ্চিম মাথাটার কাছে প্লেস দু কারুজেল। লুভরের বাইরের দেয়ালটা শুধুমাত্র সরু একটা ফুটপাত দিয়ে সেই জায়গা থেকে পৃথক করা হয়েছে। নিচে, যথারীতি রাত্রিকালীন ট্রাকের সারি অলসভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সিগনালের অপেক্ষায় আছে তারা। তাদের বাতিগুলো মনে হচ্ছে টিপটিপ করে সোফির দিকে ঠাট্টাচ্ছলে তাকাচ্ছে।

 

আমি জানি না কী বলবো, ল্যাংডন বললো। সোফির পাশে এসে দাঁড়ালো সে। আপনার দাদু নিশ্চিতভাবেই আমাদেরকে কিছু বলতে চেষ্টা করেছেন। আমি দুঃখিত, আমি খুব কম সাহায্যেই আসতে পারছি।

 

সোফি জানালা থেকে ঘুরে দাঁড়ালো। বুঝতে পারলো ল্যাংডনের কণ্ঠে গভীর অনুশোচনাটা একেবারেই নিখাদ। তাকে নিয়ে এতো সমস্যা হবার পরও সে নিশ্চিতভাবেই চায় তাকে সাহায্য করতে। ডিসিপিজের সন্দেহের তালিকায় নিজের নামটি দেখেও এই শিক্ষাবিদ ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝতে পারছে না।

 

আমাদের দুজনের অবস্থাই একরকম, সে ভাবলো।

 

একজন কোডব্রেকার হিসেবে সোফি তার জীবিকা অর্জন করে আপাত অর্থহীন তথ্যের অর্থ বের করে। আজরাতে রবার্ট ল্যাংডনকে নিয়ে তার সবচাইতে ভালো অনুমান হলো, লোকটা জানুক আর না-ই জানুক, সে এমন কিছু জানে, যা সোফির খুবই জানা দরকার। প্রিন্সেস সোফিয়া, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো।

 

তার দাদুর মেসেজটা এর চেয়ে আর কতোটা পরিষ্কার হতে পারতো? ল্যাংডনের সাথে সোফির আরো বেশি সময় দরকার ভাবার জন্য। এক সাথে এই রহস্যের ভেদ করতে সময় লাগবে। কিন্তু দুঃখজনক, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

 

ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে সোফি একটা জিনিসের কথাই শুধু ভাবতে পারলো। বেজু ফশে আপনাকে যেকোন সময়ে তার কাস্টডিতে নিয়ে নেবে। আমি আপনাকে এই জাদুঘর থেকে বের করতে পারি। কিন্তু আমাদের এখন একটু অভিনয় করতে হবে।

 

ল্যাংডনের চোখ দুটো বড় হয়ে গেলো। আপনি চাচ্ছেন আমি পালাই?

 

এটাই হবে আপনার জন্য সবচাইতে স্মার্ট কাজ। আপনি যদি ফশের কাছে ধরা দেন, তবে সে এক্ষুণি আপনাকে তার কাস্টডিতে নিয়ে নেবে। আপনাকে তখন কয়েক সপ্তাহ ফ্রান্সের জেলে কাটাতে হবে আর সেই সময়টাতে ডিসিপিজে এবং ইউএস এ্যামবাসি আপনার মামলাটা কোন্ কোর্টে হবে, সেটা নিয়ে লড়াই শুরু করে দেবে। কিন্তু, আপনি যদি এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে আপনার এ্যামবাসিতে চলে যেতে পারেন, তবে আপনার সরকার আপনার অধিকার রক্ষা করতে পারবে। তখন আপনি আর আমি প্রমাণ করতে পারবো যে, এই হত্যাকাণ্ডের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই।

 

ল্যাংডনকে দেখে মনে হলো না, সে পুরোপুরি একমত হতে পেরেছে। ভুলে যান এটা! সবগুলো বের হবার দরজায় ফুশে সশস্ত্র পাহাড়া বসিয়েছে। তারপরও যদি আমরা কোন গুলি না খেয়ে পালিয়ে যেতে পারি, তবে আমরা অপরাধী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবো। আপনি ফশেকে বলুন যে, ফ্লোরের লেখা মেসেজটা আপনার জন্যই লেখা হয়েছে। আমার নামটা অভিযুক্তকারীর নাম হিসেবে লেখা হয়নি।

 

আমি সেটা করবো, সোফি বললো, খুব দ্রুত কথা বলছে সে, তবে সেটা তখনই, যখন আপনি ইউএস এ্যামবাসির ভেতরে নিরাপদে থাকবেন। সেটা এখান থেকে মাত্র এক মাইল দূরে। জাদুঘরের বাইরে আমার গাড়িটা পার্ক করা আছে। এখানে ফশের সাথে দেনদরবার করাটা খুব বেশি জুয়া খেলা হয়ে যাবে। আপনি কি সেটা বুঝতে পারছেন না? ফশে আজরাতে তার মিশন ঠিক করে ফেলেছে, আপনাকে অপরাধী প্রমাণ করবেই সে। আপনি যদি কিছু করে বসেন তবে তার কেসটা আরো শক্তিশালী হবে, এই আশাই সে করছে।

 

একদম ঠিক। যেমন পালিয়ে যাওয়া!

 

সোফির সোয়েটারের পকেটে থাকা সেলফোনটা হঠাৎ করে বেজে উঠলো। সম্ভবত ফশে। সে পকেটে হাত দিয়ে ফোনটা বন্ধ করে দিলো।

 

মি. ল্যাংডন, সে খুব হরবর করে বললো, আপনাকে আমি একটা শেষ প্রশ্ন করতে চাই। আর আপনার পুরো ভবিষ্যতটাই তার উপর নির্ভর করছে। ফ্লোরের লেখাটা একদম নিশ্চিত করে আপনার অপরাধের প্রমাণ নয়, তারপরও ফলে আমাদের পুরো টিমকে বলেছে যে, সে নিশ্চিত, আপনিই হলেন আসামী। আপনি কি এ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেন, যা আপনাকে তার কাছে অপরাধী করতে পারে?

 

ল্যাংডন কয়েক সেকেন্ড নিরব রইলো।তেমন কিছুই তো মনে হচ্ছে না।

 

সোফি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এর অর্থ, ফশে মিথ্যে বলছে। কেন, সোফি সেটা ভাবতে পারলো না। সত্য হলো এই, বেজু ফশে আজ রাতে রবার্ট ল্যাংডনকে চৌদ্দ শিকে ভরবেই, যে করেই হোক। সোফির নিজের জন্যেও ল্যাংডনকে প্রয়োজন। আর এ জন্যেই তার কাছে একমাত্র যে যৌক্তিক ব্যাপারটা মনে আসছে, সেটা আরো বেশি প্রহেলিকাময়। ল্যাংডনকে ইউএস এ্যামবাসিতে পৌঁছে দেয়ার দরকার।

 

জানালার দিকে ঘুরে, সোফি কাঁচে লাগানো এলার্ম টেপটার দিকে তাকালো। সেখান থেকে নিচে তাকালো, চল্লিশ ফুট উচ্চতা হবে। এখান থেকে লাফ দেয়ার অর্থ ল্যাংডনের পা কয়েকটা জায়গায় ভেঙে যাওয়া। যাইহোক, সোফি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। রবার্ট ল্যাংডন লুভর থেকে পালাবেই, সে চাক আর না চাক।

 

 

 

১৭.

 

কোন জবাব দিচ্ছে না মানে? ফশেকে খুব সন্দেহপ্রবণ দেখাচ্ছে। তুমি তার সেল ফোনে ফোন করেছে, ঠিক? আমি জানি ওটা তার সাথেই আছে।

 

কোলে কয়েক মিনিট ধরেই সোফির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছে। হয়তো তার ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেছে। অথবা রিংটোন বন্ধ করে রেখেছে।

 

ক্রিপ্টোলজির পরিচালকের সাথে ফোনে কথা বলার পর থেকেই ফলশকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। ফোনটা রেখেই সে কোলেতের কাছে এসে এজেন্ট নেভুকে ফোন করে তাকে দিতে বললো কিন্তু কোলেত লাইন দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফশেকে দেখে মনে হলো খাঁচায় বন্দী একটা সিংহ পায়চারী করছে।

 

ক্রিপ্টো থেকে কেন ফোন করা হয়েছিলো? কোলেত এবার জানতে চাইলো।

 

ফশে তার দিকে তাকালো। এটা বলতে যে, ড্রাকোনীয় শয়তান আর ল্যাংড়া সেন্ট-এর ব্যাপারে তারা কিছু খুঁজে পায়নি।

 

এই?

 

না, তারা আরো বলেছে, এইমাত্র সংখ্যাগুলোকে তারা ফিবোনাচ্চি সংখ্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছে। কিন্তু তাদের সন্দেহ এটা একেবারেই অর্থহীন একটা জিনিস।

 

কোলেতকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখালো। কিন্তু তারা তো ইতিমধ্যে এজেন্ট নেভুকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছে।

 

ফশে মাথা নাড়লো। তারা নেভুকে পাঠায়নি। কি?

 

ডিরেক্টরের মতে, আমার নির্দেশে তিনি তার পুরো দলটিকে আমার পাঠানো ছবিগুলো বিশ্লেষণে লাগিয়ে দেন। এজেন্ট নেভু ওখানে আসার পর সনিয়ের একটা ছবি আর কোডটা নিয়ে কোন কথা না বলেই অফিস থেকে বেড়িয়ে যায়। ডিরেক্টর বলেছেন, তিনি সোফিকে তার আচরণের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করেননি, কারণ ছবিগুলো দেখে সোফি সঙ্গত কারণেই ভেঙে পড়েছিলো।

 

ভেঙে পড়েছিলো? সে কি কখনও মৃতদেহের ছবি দেখেনি?

 

ফশে কিছুক্ষণ নিরব রইলো, এ ব্যাপারটা কেউই জানতো না, যতক্ষণ না সহকর্মীদের একজন ডিরেক্টরকে জানিয়েছিলো যে, আসলে জ্যাক সনিয়ে সোফি নেভুর দাদা হোন।

 

কোলেত বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।

 

ডিরেক্টর বলেছেন, সোফি একবারও বলেনি যে জ্যাক সনিয়ে তার দাদা হোন, আর তাঁর মতে এটা এজন্যে যে, সোফি তার বিখ্যাত দাদার কথা বলে কোন ধরনের বাড়তি সুবিধা পেতে চায়নি।

 

ছবি দেখে ভেঙে পড়েছিলো তাতে অবাক হবার কিছু নেই। কোলেত কখনও কল্পনাও করতে পারেনি যে, কাউকে একদিন একটা কোডের মর্মোদ্ধার করতে বলা হবে তারই নিকট আত্মীয়ের হত্যাকাণ্ডের পর, ভিকটিমের নিজের লেখা সেই কোড। তারপরও সোফির আচরণ বেখাপ্পা মনে হচ্ছে। কিন্তু সে তো নিশ্চিতভাবেই সংখ্যাগুলো ফিবোনাচ্চি সংখ্যা হিসেবে চিহ্নিত করে আমাদের কাছে এসে বলে গেছে। আমি বুঝতে পারছি না, কেন সে অফিসের কাউকে সেই কথাটা না বলে অফিস থেকে বের হয়ে গেলো।

 

কোলেত এই রকম ঘটনার একটা ব্যাখ্যার কথাই ভাবতে পারছে আর তা হলো, সনিয়ে এই আশায় ফ্লোরে একটা সংখ্যাগত কোড লিখেছেন যাতে ফশে একজন ক্রিপ্টোগ্রাফারকে এই ঘটনায় যুক্ত করে, আর এভাবেই তার নিজের নাতনী জড়িত হয়ে যাবে। আর বাকী লেখাগুলো তার নাতনীর কাছে দেয়া এক ধরনের মেসেজ ছাড়া আর কী? কিন্তু এতে ল্যাংডনকে কিভাবে মেলানো যায়?

 

কোলেত এর চেয়ে বেশি ভাবোর আগেই, ফাঁকা জাদুঘরটা এলামের আওয়াজে কেঁপে উঠলো। মনে হলো এলার্মটা গ্র্যান্ড গ্যালারির ভেতর থেকে আসছে।

 

এলার্মে! একজন এজেন্ট চিৎকার করে বললো। তার চোখ ভরের সিকিউরিটি সেন্টারের দিকে। গ্যালারি তয়লেত, মেঁসিয়ে!

 

ফশে কোলেতের দিকে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। ল্যাংডন কোথায়?

 

এখনও পুরুষ টয়লেটেই আছে! কোলেত ল্যাপটপের পর্দায় লাল বিন্দুটার অবস্থানে দিকে ইঙ্গিত করে বললো, সে জানালার কাঁচ ভেঙেছে, নিশ্চিত! কোলেত জানতো ল্যাংডন বেশি দূরে যেতে পারবে না। যদিও প্যারিসের ফায়ার কোড অনুযায়ী পনেরো মিটার উঁচুতে অবস্থিত জানালার কাঁচ আগুন লাগলে ভাঙা যেতে পারে, তবে লুভরের দোতলা থেকে মই অথবা হুক ছাড়া নামার অর্থ হলো নির্ঘাত আত্মহত্যা করা। আরেকটি ব্যাপার, ডেনন উইংয়ের পশ্চিম দিকে কোন গাছ-পালা নেই এমনকি মাটিতে কোন ঘাসও নেই যে, পড়ে গেলে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যাবে। বিশ্রাম ঘরের জানালার নিচে দুই লেইন বিশিষ্ট প্লেস দু কারুজেল অবস্থিত।

 

হায় ঈশ্বর, পর্দার দিকে তাকিয়ে কোলেত চিৎকার করে বললো। ল্যাংডন জানালা দিয়ে লাফ দিয়েছে!

 

কিন্তু ফশে ইতিমধ্যেই তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। তার ম্যানুরিন এম আর-৯৩ রিভলবারটা হাতে নিয়ে অফিস থেকে বেড়িয়ে গেছে।

 

কোলেত পর্দার দিকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চেয়ে আছে, তার চোখে বিস্ময়। লাল বিন্দুটা এই ভবনের বাইরে চলে গেছে। হচ্ছেটা কি? সে অবাক হলো। ল্যাংডন কি জানালা দিয়ে, নাকি–

 

হায় যিশু। লাল বিন্দটা লাফিয়ে লাফিয়ে দেয়াল অতিক্রম করে ফেললে কোলেত উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলো। সিগনালটা একটু থামলো, তারপর বিন্দুটা ভবনের বাইরে, প্রায় দশ গজ দূরে চলে গেলো।

 

তড়িঘড়ি করে কোলেত প্যারিসের রাস্তা-ঘাটের মানচিত্রটার জন্য কম্পিউটারে সার্চ করে জিপিএস সিস্টেমটা ঠিক করে নিলো। দৃশ্যটা একটু বড় করে সে বিন্দুটার একেবারে নিখুঁত অবস্থান দেখতে পেলো।

 

এটা আর নড়ছে না।

 

এটা এখন প্লেস দু কারুজেল-এর মাঝখানে থেমে আছে। ল্যাংডন ঝাঁপ দিয়ে…

 

 

 

১৮.

 

ফশে ঊর্ধ্বশ্বাসে গ্র্যান্ড গ্যালারির দিকে ছুটে চললো, কোলেতের রেডিওটা ঘরঘর করছে, কিন্তু এলার্মের শব্দে সেটা শোনা যাচ্ছে না।

 

সে ঝাঁপ দিয়েছে! কোলেত চিৎকার করে বলছে। আমি সিগনালটাকে প্লেস দু কারুজেলে দেখতে পাচ্ছি। বাথরুমের জানালার বাইরে! এটা একদমই নড়ছে না! হায় যিশু, আমার মনে হচ্ছে ল্যাংডন আত্মহত্যা করেছে, আর কিছু না।

 

ফশে কথাটা শুনতে পেলো, কিন্তু তার কাছে এগুলো কোন অর্থই বহন করছে না। সে দৌড়াতেই লাগলো। হলওয়েটা মনে হচ্ছে কখনও শেষ হবে না। সনিয়ের মৃতদেহটা দৌড়ে অতিক্রম করার সময় সে ডেনন উইংয়ের পার্টিশনের দিকে তাকালো। এলার্মটা আরো জোরে শোনা যাচ্ছে।

 

দাঁড়ান! রেডিওতে কোলেতের কণ্ঠটা চিৎকার করে বললো, সে নড়ছে! হায় ঈশ্বর, সে বেঁচে আছে। ল্যাংডন পালাচ্ছে!

 

ফশে দৌড়াতেই লাগলো, প্রতিটি পদক্ষেপে হলওয়ের দৈর্ঘ্যটা কমিয়ে আনছে সে।

 

ল্যাংডন খুব দ্রুত দৌড়াচ্ছে। কোলেত রেডিওতে চিৎকার করেই যাচ্ছে। সে কারুজেল দিয়ে দৌড়াচ্ছে। দাঁড়ান… সে খুব জোরে দৌড় শুরু করেছে। সে তো দেখি প্রচণ্ড দ্রুত দৌড়াচ্ছে।

 

পার্টিশনের দিকে আসতেই ফশে দেখতে পেলো বিশ্রাম ঘরের দরজাটা, সে ওদিকেই দৌড়ে গেলো।

 

এলার্মের শব্দে ওয়াকি-টকির কথা আর শোনা গেলো না। সে কোনও গাড়িতে চড়ে থাকবে! আমার মনে হয় সে গাড়িতেই আছে! আমি বলতে পারছি না–

 

ফশে প্রবল বেগে পুরুষ টয়লেটের ভেতরে অস্ত্র হাতে ঢুকতেই কোলেতের কথাগুলো এলামের আওয়াজ গিলে ফেললো। পুরো ঘরটা ভালো করে দেখে নিলো সে। ঘরটা একেবারেই ফাঁকা। বাথরুমও খালি। ফশের চোখ ঘরের ভাঙাচোরা জানালাটার দিকে গেলো। সে দৌড়ে জানালার কাছে গিয়ে নিচের দিকে তাকালো। ল্যাংডনকে কোথাও দেখা গেলো না। ফলে কোনভাবেই ভাবতে পারলো না, এ রকম ঝুঁকি কেউ নিয়ে থাকবে। নিশ্চিতভাবেই, কেউ যদি এখান থেকে লাফ দেয়, তবে মারাত্মকভাবে আহত হবে।

 

এলার্মটা বন্ধ করে দেয়া হলে ওয়াকিটকিতে কোলেতের কণ্ঠটা আবারো শোনা গেলো।

 

…দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে … খুব দ্রুত … পন দু কারুজেল দিয়ে সিন নদীটা পার হচ্ছে!

 

ফশে তার বাম দিকে ঘুরলো। পন দু কারুজেলের রাস্তায় একমাত্র যে যানবাহনটা আছে, সেটা হলো বিশাল বড় একটা টুইনবেড ডেলিভারি ট্রাক, লুভর থেকে দক্ষিণ দিকে চলে যাচ্ছে সেটা। ট্রাকের পেছনের খোলা ডালাটা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা, একটা বিশাল হ্যামোক আছে সেখানে। ফশে খুব দ্রুতই বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। এই ট্রাকটা কিছুক্ষণ আগে বিশ্রামঘরের নিচে ট্রাফিক সিগনালের জন্য থেমে ছিলো।

 

একটা উন্মাদগ্রস্ত ঝুঁকি, ফশে আপন মনে বললো। ল্যাংডনের কোনভাবেই জানতে পারা কথা নয়, ত্রিপলের নিচে কী আছে। ট্রাকটা যদি স্টিল বহন করে থাকে তবে কি হবে? অথবা সিমেন্ট? কিংবা ময়লা আবর্জনা? চল্লিশ ফুট উঁচু থেকে ঝাঁপ দেয়া? একেবারেই পাগলামী।

 

ডটটা ঘুরে যাচ্ছে! কোলেত জানালো, পন দে সেন-পেরেজর দিকে যাচ্ছে!

 

ঠিক তা-ই, ট্রাকটা বৃজ অতিক্রম করে ধীরে ধীরে পন দে সেন-পেরেজর দিকে যাচ্ছে। তাই হোক, ফশে ভাবলো। কোলেত ইতিমধ্যেই ওয়্যারলেসের মাধ্যমে কয়েকজন এজেন্টকে লুভর থেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাদেরকে প্যাট্রল গাড়িতে করে রাস্তায় টহল দিতে বলে দিয়েছে সে। এরই মধ্যে ট্রাকটার অবস্থান পরিবর্তিত হলো, যেনো ব্যাপারটা অদ্ভুত একটি চোর-পুলিশ খেলা।

 

খেলা শেষ হয়ে গেছে, ফশে জানতো। তার লোকজন মিনিট খানেকের মধ্যেই ট্রাকটা আঁটকে ফেলতে পারবে। ল্যাংডন কোথাও যেতে পারবে না।

 

অস্ত্রটা জায়গামতো রেখে ফশে বিশ্রামঘর থেকে বের হয়ে কোলেতকে ওয়্যারলেস করলো। আমার গাড়িটা নিয়ে আসতে বলো। গ্রেফতারের সময়টাতে আমি ওখানে থাকতে চাই।

 

ফশে গ্র্যান্ড গ্যালারি থেকে বের হতে হতে ভাবছিলো, ল্যাংডন যদি এখান থেকে লাফ দেয়ার পরও বেঁচে থাকে, তবে সেটা অবাক হবার মতোই ব্যাপার হবে।

 

এটা অবশ্য কোন ব্যাপার না।

 

ল্যাংডন পালিয়েছে, অভিযুক্ত হয়ে।

 

***

 

বিশ্রাম-ঘর থেকে মাত্র পনেরো গজ দূরেই ল্যাংডন আর সোফি গ্র্যান্ড গ্যালারির ছায়া ঢাকা জায়গাটাতে দাঁড়িয়েছিলো। ফশে বাথরুম থেকে বের হবার সময় তারা নিজেদেরকে খুব কষ্ট করে দৃষ্টির আড়ালে রাখতে পেরেছিলো। তার হাতে অস্ত্র ছিলো। হুরমুর করে বাথরুমে ঢুকেছিলো সে। শেষ ষাট সেকেন্ড সময়টা ছিলো ঘোরের মতো।

 

ল্যাংডন পুরুষ টয়লেটের ভেতরে দাঁড়িয়ে বার বার পালাতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলো। যে অপরাধ সে করেনি, সেই অপরাধ থেকে কেন সে পালাবে। যখন সোফি জানালার এলার্মটা পরীক্ষা করে নিচের দিকে তাকালো, তার ভাবসাব দেখে মনে হলো উপর থেকে লাফ দেবার হিসাব কষছে সে।

 

ছোট্ট একটা নিশানার সাহায্যে এখান থেকে আপনি বের হয়ে যেতে পারেন, সে বলেছিলো।

 

নিশানা? অস্বস্তি নিয়ে বিশ্রাম ঘরের জানালার দিকে তাকিয়েছিলো সে।

 

রাস্তায়, একটা বিশাল আকারের আঠারো চাকার ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে।

 

ট্রাকটার ডালায় বিশাল একটা ত্রিপল দিয়ে মালপত্রগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে। ল্যাংডন আশা করলো সোফিকে দেখে যা মনে হচ্ছে সে যেনো তা না ভাবে। সোফি, আমি কোনভাবেই লাফ দিচ্ছি না–

 

ট্র্যাকিং ডটটা বের করুন।

 

হতবুদ্ধিকর ল্যাংডন তার পকেট হাতরাতে লাগলো। হাতরাতে হাতরাতে পেয়ে গেলো ছোট্ট ধাতব জিনিসটা। সোফি সেটা হাতে নিয়ে সিংকে রেখে দিলো। একটা টয়লেট সাবান নিয়ে সেটার মধ্যে ধাতব বস্তুটি চেপে ধরে রাখলো যতোক্ষণ না সেটা দেবে গিয়ে আঁটকে না গেলো।

 

সাবানটা ল্যাংডনের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সোফি একটা ময়লা ফেলার ভারি ড্রাম টেনে এনে জানালার কাছে নিয়ে এলো। ল্যাংডন কোন কিছু বলার আগেই সেই ড্রামটা দিয়ে জানালায় আঘাত করে জানালার কাঁচ ভেঙে ফেললো।

 

এলার্মটা মাথার উপর প্রচণ্ড শব্দে বাজতে শুরু করলো।

 

সাবানটা আমার হাতে দিন। সোফি চিৎকার করে বললো, এলার্মের আওয়াজে কিছু শোনা যাচ্ছিলো না।

 

ল্যাংডন সাবানটা তার হাতে তুলে দিলো।

 

সাবানটা হাতে নিয়ে, সোফি ভাঙা জানালা দিয়ে নিচে দাড়িয়ে থাকা আঠারো চাকার গাড়িটার দিকে তাকালো। টার্গেটটা খুব বেশি বড় আকাড়ের আর সেটা বিল্ডিংটা থেকে দশ ফুটেরও কম দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাফিক বাতিটা পরিবর্তন হবার আগেই, সোফি গভীর একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সাবানটা ছুঁড়ে মারলো।

 

সাবানটা ট্রাকের উপর গিয়ে পড়ে সেটা ত্রিপলের মধ্যে আঁটকে রইলো। আর ট্রাফিক সিগনালের বাতিটা সবুজ রঙে আসতেই ট্রাকটা সাঁই করে চলে গেলো।

 

কগ্রাচুলেশনস্, দরজার দিকে তাকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে সোফি বললো। আপনি লুভর থেকে পালিয়ে গেলেন আর কী।

 

পুরুষ টয়লেট থেকে বের হয়েই তারা অন্ধকারে সরে পড়লো। ফশে খুব দ্রুতই এসে পড়েছিলো। এবার ফায়ার এলার্মটা বন্ধ হতেই ল্যাংডন শুনতে পেলো ডিসিপিজের সাইরেন লুভর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। পুলিশের হিজরত হচ্ছে। ফশেও খুব দ্রুতই গ্র্যান্ড গ্যালারি থেকে বের হয়ে গেলে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেলো।

 

গ্র্যান্ড গ্যালারির পেছনে, আনুমানিক পঞ্চাশ মিটার দূরে, একটা জরুরি সিঁড়ি আছে, সোফি বললো।

 

এখন প্রহরীরা এই এলাকা ছেড়ে চলে গেলেই আমরা এখান থেকে বের হয়ে যেতে পারবো।

 

ল্যাংডন ঠিক করলো আজ রাতে আর কিছু বলবে না। সোফি নেভুকে এখন তার চেয়েও অনেক বেশি বুদ্ধিমান বলেই মনে হচ্ছে।

 

 

 

১৯.

 

সেন্ট-সালপিচ গীর্জা, বলা হয়ে থাকে প্যারিসের অন্য যেকোন দালানের চেয়ে এর ইতিহাস একটু ভিন্ন ধরনের। মিশরীয় দেবী আইসিসের একটা ভগ্নপ্রায় মন্দিরের উপর এটি নির্মাণ করা হয়েছিলো। গীর্জাটাতে একটা স্থাপত্যিক পদচিহ্ন আছে যেটা নটরডেমের পদচিহ্নের সাথে একেবারে মিলে যায়। এই গীর্জাটাতেই মারকুইস দ্য সাদ এবং বোদলেয়ারের ব্যাপটিজম অনুষ্ঠিত হয়েছিলো, সেই সাথে ভিক্টর হুগোর বিয়েটাও। গীর্জা সংলগ্ন সেমিনার কক্ষটি অপ্রচলিত ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী, এক সময় গুপ্ত সভা কক্ষটি অসংখ্য গুপ্ত সংঘের আখড়া ছিলো।

 

আজরাতে সেন্ট-সালপিচ গীর্জাটা কবরের মতোই নিরব-নিথর। সাইলাস আঁচ করতে পারলো সিস্টার সানড়ন তাকে ভেতরে নিয়ে যাবার সময় একটু অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। এতে অবশ্য সে খুব একটা অবাক হয়নি। তার উপস্থিতিতে লোকজন যে অস্বস্তিবোধ করে থাকে, সাইলাস তাতে অভ্যস্ত ছিলো।

 

আপনি একজন আমেরিকান, সিস্টার বললেন।

 

জন্মসূত্রে ফরাসি, সাইলাস জবাব দিলো। স্পেনেও আমি ছিলাম, আর এখন যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করছি।

 

সিস্টার সানন মাথা নেড়ে সায় দিলেন। তিনি ছোটোখাটো একজন মহিলা, শান্ত শিষ্ট চোখের অধিকারিনী। আপনি কখনও সেন্ট-সালপিচ দেখেননি?

 

আমি বুঝতে পারছি, এটা না দেখাটা এক ধরনের পাপই।

 

দিনের বেলায় এটা আরো বেশি সুন্দর দেখায়।

 

এ ব্যাপারে আমিও নিশ্চিত। তাসত্ত্বেও, আজরাতে আমাকে এখানে আসার সুযোগ করে দেয়ার জন্য আপনার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ।

 

আব্বে এজন্য আমাকে অনুরোধ করেছিলেন। আপনার তো দেখছি অনেক ক্ষমতাবান বন্ধ রয়েছে।

 

আপনার কোন ধারণাই নেই, সাইলাস ভাবলো।

 

সিস্টার সানভৃনের পেছনে পেছনে ভেতরে যাওয়ার সময় সাইলাস গীর্জার ভেতরটা দেখে অবাক হলো। রঙ-বেরঙের ফ্রেসকো, ছাদের নক্সা এবং উষ্ণ কাঠের জন্য সেন্ট-সালপিচ গীর্জাটাকে নটরডেমের মতো মনে হয় না। নিরব-নিথর আর ভেতরের পরিবেশ শীতল, অনেকটা স্পেনের ক্যাথেড্রালের মতো। সাজসজ্জার কমতির কারণে ভেতরটা আরো বেশি অভিজাত বলে মনে হয়। ছাদের দিকে তাকাতেই তার মনে হলো, সে কোন উল্টো করে রাখা বিশাল জাহাজের নিচে দাঁড়িয়ে আছে।

 

খাপ খেয়ে যাওয়া দৃশ্য, সে ভাবলো। ভ্রাতৃসংঘের জাহাজটা চিরতরের জন্যই উল্টে যাবে। কাজে নেমে যাবার জন্য উদগ্রীব সাইলাস সিস্টার সানভৃনকে অনুরোধ করলো যাতে তাকে একটু একা থাকতে দেয়া হয়। তিনি খুবই ছোটোখাটো আকৃতির একজন মহিলা, যাকে সাইলাস খুব সহজেই কাবু করতে পারবে, কিন্তু সে প্রতীজ্ঞা করেছে, একেবারে প্রয়োজন না হলে শক্তি প্রয়োগ করবে না। তিনি একজন নারী, আর ভ্রাতৃসংঘের লোকেরা তাঁর চার্চকে নিজেদের কি-স্টোনটা লুকানোর কাজে ব্যবহার করার জন্য তো তাকে দায়ী করা যায় না। অন্যের পাপের জন্য তাকে শাস্তি দেয়াটা ঠিক হবে না।

 

আমি খুবই বিব্রতবোধ করছি, সিস্টার। আমার জন্য আপনাকে ঘুম থেকে উঠতে হয়েছে।

 

না, তা নয়। আপনি প্যারিসে খুব অল্প সময়ের জন্য আছেন। সেন্ট-সালপিচ না দেখাটা ঠিক হবে না। আপনি কি চার্চের স্থাপত্য দিক নাকি ঐতিহাসিক দিকের প্রতি বেশি আগ্রহী?

 

আসলে, সিস্টার, আমার আগ্রহটা আধ্যাত্মিক ব্যাপারেই।

 

সিস্টার একটা প্রশান্তির হাসি হাসলেন। তাহলে তো কোন কথাই নেই। আমি ভাবছিলাম, আপনি কোথা থেকে আপনার পরিদর্শনটা শুরু করবেন।

 

সাইলাস বুঝতে পারলো তার চোখ বেদীর দিকে। পরিদর্শনের কোন প্রয়োজন নেই। আপনার দয়া সিস্টার। আমি নিজেই ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবো।

 

আমার কোন সমস্যা হবে না। তিনি বললেন। হাজার হোক আমিতো জেগেই গেছি।

 

সাইলাস হাটা থামিয়ে দিলো। তারা বেদী থেকে মাত্র পনেরো গজ দূরে এসে পড়েছে। সে তার বিশাল দেহটা ছোটোখাটো মহিলার দিকে ঘুরালো। মহিলার চোখের দিকে তাকিয়ে তার পিছু হটার কারণটা বুঝতে পারলো। তার লাল চোখের দিকে সিস্টার তাকিয়ে ছিলো। যদি আপনার কাছে এটা খুব বেশি অভদ্র মনে না হয় সিস্টার, আমি ঈশ্বরের ঘরে শুধুমাত্র এমনিতে ঘোরাঘুরি করার ব্যাপারে অভ্যস্ত নই। প্রার্থনা করার আগে আমি একা একা জায়গাটা ঘুরে দেখলে আপনি কি কিছু মনে করবেন?

 

সিস্টার সানড়ন একটু দ্বিধাগ্রস্ত হলেন। ওহ্, অবশ্যই। আমি চার্চের বেলকনিতে আপনার জন্য অপেক্ষা করবো।

 

সাইলাস আলতো করে তার ভারি হাতটা সিস্টারের কাঁধে রেখে তার দিকে তাকালো। সিস্টার, আপনাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে আমি বেশ অপরাধ বোধ করছি।

 

আর আপনাকে জেগে থাকতে বলাটা খুব বেশি হয়ে যাবে। দয়া করে আপনি আপনার বিছানায় ফিরে যান। আমি আপনার চার্চে একা একা ভালোই থাকবো, তারপর একাই চলে যেতে পারবো।

 

সিস্টার খুব অস্বস্তি বোধ করলেন। আপনি কি নিশ্চিত, এখানে আপনার একা একা খারাপ লাগবে না?

 

মোটেই না। একা একা প্রার্থনা করাই সবচেয়ে বেশি আনন্দের।

 

আপনার যেমন ইচ্ছে।

 

সাইলাস তার হাতটা সিস্টারের কাঁধ থেকে সরিয়ে নিলো। ভালো ঘুম হোক, সিস্টার। ঈশ্বরের শান্তি আপনার সাথেই থাকুক।

 

আপনার সাথেও। সিস্টার সানড়ন সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। বেড়িয়ে যাবার সময় দয়া করে দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে যাবেন।

 

ঠিক আছে। সাইলাস দেখলো তিনি চলে যাচ্ছেন। পুরোপুরি অপসৃত হবার পর সে ঘুরে হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো, সিলিস বেল্টটার চাপ অনুভব করলো।

 

হে ঈশ্বর, আজ যে কাজটি আমি করবো, সেটা তোমাকে নিবেদন করছি।

 

কয়্যার বেলকনির ছায়া ঢাকা অংশ থেকে সিস্টার বেদীর সামনে হাটু গেঁড়ে বসা যাজকের দিকে আড়াল থেকে তাকালেন। তার মনে আচমকা একটা ভয় চেপে বসাতে ভাবতে শুরু করলেন, এই রহস্যময় অতিথি হতে পারে শত্রুপক্ষের কেউ, তারা তাকে আগেই এ ব্যাপারে সর্তক করে দিয়েছিলো। আজ রাতে হয়তো সে রকমই কিছু হবে, আর এজন্য সে অনেক বছর ধরে আদেশ বহন করে চলছে। সিস্টার ঠিক করলেন, তিনি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন লোকটার প্রতিটি চলাফেরা।

 

 

 

২০.

 

ছায়া ঢাকা জায়গা থেকে বের হয়ে ল্যাংডন আর সোফি চুপিসারে ফাঁকা গ্র্যান্ড গ্যালারির করিডোরে এসে উপস্থিত হলো। তারা জরুরি বহিগমনের সিঁড়িটার দিকে এগিয়ে গেলো।

 

চলতে চলতে ল্যাংডনের মনে হলো সে অন্ধকারের মধ্যে জিগশ পাজল মেলাবার চেষ্টা করছে। এই রহস্যের নতুন মাত্রাটা হলো খুবই সমস্যা সংকুল আর কঠিন একটি অবস্থা।

 

জুডিশিয়াল পুলিশের ক্যাপ্টেন আমাকে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।

 

আপনি কি মনে করেন, সে ফিসফিস করে বললো, ফশে নিজেই মেসেজটা ফ্লোরে লিখেছে?

 

সোফি এমন কি তার দিকে ঘুরেও তাকালো না। অসম্ভব।

 

ল্যাংডন অবশ্য খুব নিশ্চিত ছিলো না। সে আমাকে অপরাধী বানাতে সচেষ্ট বলে আমার মনে হচ্ছে। হয়তো সে ভেবেছে, ফ্লোরে আমার নাম লিখে দিলে তার মামলায় সাহায্য হবে?

 

ফিবোনাচ্চি সংখ্যক্রমটা? পি,এস? দা ভিঞ্চি আর দেবীদের সবগুলো প্রতীকের ব্যাপারটা? এটা আমার দাদুই করেছেন।

 

ল্যাংডন জানে সোফি ঠিকই বলছে। প্রতীকগুলোর সবই নিখুঁতভাবে জালের বুননের মতো—পেনটাকল, ভিটরুবিয়ান ম্যান, দা ভিঞ্চি, দেবী, এমন কি ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রমটা। এক সেট সঙ্গতিপূর্ণ প্রতীকসমূহ, আইকনোগ্রাফাররা এটাকে এ নামেই ডাকবে। সবগুলোই একটার সাথে আরেকটা সংযুক্ত।

 

আজ বিকেলে তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন, সোফি যোগ করলো। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, আমাকে তার কিছু বলার আছে। আমি নিশ্চিত ভরে রেখে যাওয়া মেসেজটার মধ্য দিয়ে তিনি আমাকে কিছু বলতে চেয়েছেন, কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা, এমন কিছু যা তিনি ভেবেছেন যে, আপনি সেটা আমাকে বুঝতে সাহায্য করতে পারবেন।

 

ল্যাংডনের চোখ ছানাবড়া হলো। Oh, Draconian devil! ০, laine saint! ও, ড্রাকোনীয় শয়তান! ওহ, ল্যাংড়া সেন্ট! তার ইচ্ছে করলো মেসেজটা আবার উচ্চারণ করবে, সোফি এবং তার নিজের জন্য। ব্যাপারটা সেই প্রথম থেকে, যখন ল্যাংডন ক্রিপটিক শব্দগুলো দেখেছিলো, শুধুই খারাপের দিকেই যাচ্ছে। বাথরুমের জানালা দিয়ে ভূয়া লাফ দেয়াতে ল্যাংডনের জনপ্রিয়তায় কোন সাহায্যে আসবে না। সে সন্দেহ করলো, ফরাসি পুলিশের ক্যাপ্টেন পিছু নিয়ে সাবানের বারটা খুঁজে পেয়ে একটা কৌতুককর দৃশ্যই দেখবে।

 

দরজাটা খুব বেশি দূরে নয়, সোফি বললো।

 

আপনি কি মনে করেন, আপনার দাদুর মেসেজটাতে যে সংখ্যাগুলো আছে সেগুলো দিয়ে বাকি লাইনগুলো বোেঝার কোন সম্ভাবনা আছে? ল্যাংডন একবার বাকোনিয়ান ম্যানুস্ক্রিপ্টের ওপর কাজ করেছিলো, যেখানে শিলালিপিতে সাংকেতিক লিপি দেয়া ছিলো, যাতে করে নির্দিষ্ট একটা কোডের মাধ্যমে সংকেত উদ্ধার করা যায়।

 

সারা রাত ধরে আমি সংখ্যাগুলো নিয়ে ভেবেছি। কিছুই পাইনি। গাণিতিক দিক থেকে এগুলো খুব এলোমেলোভাবে বিস্তৃত হয়ে আছে। একটা ক্রিপ্টোগ্রাফীয় প্রহেলিকা।

 

তারপরও সেগুলোর সবটাই ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রম। এটাতো কাকতালীয় হতে পারে না।

 

তা না। ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রম ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে আমার দাদু আমার দৃষ্টি আকর্ষণই করতে চেয়েছেন যেমন, মেসেজটা তিনি ইংরেজিতে লিখেছেন, অথবা আমার প্রিয় চিত্রকর্মের অনুকরণে নিজেকে মেলে ধরেছেন। কিংবা নিজের শরীরে পেনটাকল আঁকা। সবটাই, আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য।

 

পেনটাকল কি আপনার কাছে কোন অর্থবহন করে?

 

হ্যাঁ। আমি সেটা আপনাকে বলার সুযোগ পাইনি, আমার দাদু এবং আমার মধ্যে পেনটাকল একটা বিশেষ প্রতীক ছিলো সেই ছোট বেলা থেকেই। আমরা আনন্দ পাওয়ার জন্য টারোট কার্ড খেলতাম। আর আমার ইন্ডিকেটর কার্ডটা সবসময়ই হতো পেনটাকল।

 

ল্যাংডন শীতল অনুভব করলো। তারা টারোট খেলতো? মধ্যযুগের ইতালিয় কার্ড খেলাটাতে ঐতিহ্যবাহী প্রতীকের এতো বেশি প্রাচুর্য ছিলো যে, ল্যাংডন তার নতুন লেখাটার একটা পুরো অধ্যায়ই টারোট-এর নামে উৎসর্গ করেছে। বাইশ কার্ডের এই খেলাটায় মহিলা পোপ, তারকা ইত্যাদি নামও রয়েছে। উৎসের দিক থেকে, টারোট এমন একটি আদর্শিক অর্থ বহন করে যা চার্চ কর্তৃক নিষিদ্ধ। বর্তমানে, টারোটর রহস্যময় গুণাবলীর জন্য এই বিদ্যাটা আধুনিক জ্যোতিষীদের কাছে চলে গেছে।

 

টারোটর ইঙ্গিতপূর্ণ পবিত্র নারীর পোশাকটা হলো পেনটাকল, ল্যাংডন ভাবলো। বুঝতে পারলো, সনিয়ে যদি তার নাতনীর সাথে আনন্দঘন সময় কাটানোর জন্য। খেলাটা খেলে থাকে, তবে পেনটাকল জোক হিসেবে যথার্থই ছিলো।

 

তারা জরুরি সিঁড়ির কাছে এসে পড়লে সোফি খুব সাবধানে দরজাটা খুললো। কোন এলার্ম বাজলো না। শুধুমাত্র বাইরের দরজার সাথে একটা তার সংযুক্ত আছে। সোফি ল্যাংডনকে সরু সিঁড়িটা দিয়ে নিচে নামার জন্য পথ দেখিয়ে আগে আগে নামতে শুরু করলো। কিছু দূর নামার পর গতি একটু বাড়িয়ে দিলো।

 

আপনার দাদু, দ্রুত তার পেছনে নামতে নামতে ল্যাংডন বললো, কখন আপনাকে পেনটাকলের ব্যাপারে বলেছিলেন, তিনি কি কোন দেবীপূজা অথবা ক্যাথলিক চার্চের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন কিছুর উল্লেখ করেছিলেন?

 

সোফি মাথা ঝাঁকালো। আমি আসলে এটার গাণিতিক ব্যাপারটার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী ছিলাম—স্বর্গীয় অনুপাতের ব্যাপার অর্থাৎ PHI, ফিবোনাচ্চি সংখ্যক্রম, এরকম কিছু জিনিস।

 

ল্যাংডন খুব অবাক হলো। আপনার দাদু আপনাকে PHI সংখ্যা সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছেন?

 

অবশ্যই। স্বর্গীয় অনুপাত। তার চেহারায় লাজুক একটা ভাব দেখা গেলো। সত্যি বলতে কী, তিনি ঠাট্টা করে বলতেন আমি হলাম অর্ধেক স্বর্গীয়…বুঝতেই পারছেন, আমার নামের অক্ষরগুলোর কারণে।

 

ল্যাংডন কথাটা একটু সময় নিয়ে ভেবে আপন মনে বলে উঠলো। S – O – PHI -e

 

অন্যমনস্কভাবে ল্যাংডন PHI নিয়ে ভাবতে লাগলো। সে বুঝতে পারলো সনিয়ের কু-গুলো প্রথম দিকে সে যতোটা আন্দাজ করতে পেরেছিলো তার চেয়েও বেশি সুসংহত।

 

দা ভিঞ্চি… ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রম … পেনটাকল।

 

অবিশ্বাস্যভাবে এইসবগুলো জিনিস একটা ধারণার সাথেই সংযুক্ত, সেটা হলো চিত্র কলার ইতিহাস, যা ল্যাংডন প্রায়শই তার শ্রেণী কক্ষে টপিক হিসেবে বলে থাকে।

 

PHI

 

ল্যাংডন আচমকাই অনুভব করলো সে হারভার্ডে ফিরে গেছে, দাঁড়িয়ে আছে তার চিত্রকলায় সিম্বোলিজম ক্লাসের সামনে। তার প্রিয় সংখ্যাটা ব্ল্যাকবোর্ডে লিখছে।

 

১.৬১৮

 

ল্যাংডন তার উদগ্রীব হয়ে চেয়ে থাকা ছাত্র-ছাত্রিদের সমুদ্রের দিকে ফিরলো। কে আমায় বলতে পারবে এই সংখ্যাগুলো কি?

 

পেছনে বসা এক লম্বা পায়ের গণিতের মেজর, হাত তুললো। এটা PHI-র সংখ্যা। সে এটা উচ্চার করলো ফি বলে।

 

চমৎকার বলেছেন, স্টেটনার, ল্যাংডন বললো। সবাই পরিচিত হোন PHI-র সাথে।

 

PI-এর সাথে গুলিয়ে ফেলবেন না, স্টেট্রার আরো বললো, দাঁত বের করে হাসতে লাগলো সে। আমরা গণিতবিদরা যেরকমটি বলতে পছন্দ করি : PHIর একটা H আসলে PI-এর চেয়ে অনেক বেশি ঠাণ্ডা!

 

ল্যাংডন উচ্চস্বরে হাসলো, কিন্তু অন্য কেউ এই ঠাট্টাটা বুঝতে পারলো বলে মনে হলো না।

 

এই PHI সংখ্যাটা, ল্যাংডন বলতে শুরু করলো, এক দশমিক ছয়-এক-আট, শিল্পকলায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কে আমাকে বলতে পারে, কেন?

 

স্টেটনার নিজেকে আবারো প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলো। কারণ, এটা খুবই সুন্দর?

 

সবাই হেসে উঠলো।

 

আসলে, ল্যাংডন বললো, স্টেট্রার আবারো ঠিক বলেছে। PHI-কে সাধারণত এই মহাবিশ্বের সবচাইতে সুন্দর সংখ্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

 

হাসিটা থেমে গেলে স্টেটনারের মুখে তৃপ্তির একটা হাসি দেখা গেলো।

 

ল্যাংডন তার স্লাইড প্রজেক্টরটাতে ফিল্ম ভরতে ভরতে ব্যাখ্যা করলো যে, PHI সংখ্যাটি ফিবোনাচ্চি সংখ্যক্রম থেকেই উদ্ভূত হয়েছে—সংখ্যাক্রমটি শুধুমাত্র এজন্যে বিখ্যাত নয় যে, প্রথম দুটি সংখ্যার যোগফল পরবর্তী সংখ্যার সমান, বরং সন্নিহিত সংখ্যার ভাগফলে বিস্ময়কর সংখ্যা ১.৬১৮ রয়েছে–অর্থাৎ PHI.

 

PHI-এর রহস্যময় গাণিতিক উৎপত্তিটা ছাড়াও, ল্যাংডন ব্যাখ্যা করলো যে, PHI এর সত্যিকারের হতবুদ্ধিকর জিনিসটা হলো প্রকৃতির গঠনের ক্ষেত্রে তার মৌলিকতু। গাছপালা, জীবজম্বু এবং এমনকি মানুষের ক্ষেত্রেও, সবকিছুতেই মাত্রাগত দিক থেকে একেবারে ঠিক ঠিকই PHI-এর সাথে ১-এর সমানুপাতে আছে।

 

PHI প্রকৃতির সর্বত্রই রয়েছে, ল্যাংডন বললো, বাতিটা নিভিয়ে দিলো সে, যা : পরিষ্কারভাবেই কাকতালীয় ব্যাপারটাকে অতিক্রম করে, আর তাই প্রাচীন কালের মানুষেরা PHI সংখ্যাটিকে মনে করতো বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা এটা আগে থেকেই ঠিক করে দিয়েছেন। প্রাচীন কালের বিজ্ঞানীরা এক দশমিক-ছয়-এক-আটকে স্বর্গীয় অনুপাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলো।

 

দাঁড়ান, সামনের সারিতে বসা এক তরুণী বললো, আমি বায়োলজির ছাত্রী, আমিতো কখনও প্রকৃতিতে এই স্বর্গীয় অনুপাতটা দেখিনি।

 

দেখেননি? ল্যাংডন দাঁত বের করে হাসলো। কখনও কি মৌচাকের পুরুষ এবং স্ত্রী মৌমাছির সম্পর্কটা খতিয়ে দেখেছেন?

 

অবশ্যই। স্ত্রী মৌমাছি সবসময়ই পুরুষ মৌমাছির তুলানায় সংখ্যায় বেশি থাকে।

 

একদম ঠিক। আর আপনি কি এটা জানেন, যদি পুরুষ মৌমাছির সংখ্যা দিয়ে স্ত্রী মৌমাছির সংখ্যাকে ভাগ করা হয় তবে সবসময়ই একই সংখ্যা পাওয়া যাবে?,

 

আপনি জানেন?

 

আজ্ঞে। PHI।

 

মেয়েটা খেদোক্তি করলো। একদমই না!

 

একদমই! ল্যাংডন পাল্টা বললো, হাসতে হাসতে প্রজেক্টরে একটা ছবি প্রক্ষেপন করলো। চিনতে পেরেছেন এটা?

 

এটা একটা সামুদ্রিক শামুক, এক বায়ো মেজর বললো। একটা শামুকের মাথার ভেতরের অংশ যা গ্যাস পাম্প করে ভেতরে নিয়ে যায় ভেসে থাকার জন্য।

 

ঠিক বলেছেন। আপনি কি আন্দাজ করতে পারেন প্রতিটা স্পাইরালের ডায়ামিটার পরেরটার সাথে কি সুনপাতে রয়েছে?

 

মেয়েটা অনিশ্চিত ভঙ্গীতে শামুকের স্পাইরালের দিকে তাকালো।

 

ল্যাংডন মাথা নাড়লো। PHI। স্বর্গীয় অনুপাত। এক দশমিক ছয়-আট-এক। মেয়েটাকে বিস্মিত হতে দেখা গেলো।

 

ল্যাংডন পরবর্তী স্নাইডটাতে গেলোসূর্যমুখী ফুলের বীজের মাথার একটা বিশাল ছবি। সূর্যমুখী ফুলের বীজ বিপরীত চক্রাকারে বেড়ে ওঠে। আপনারা কি অনুমান করতে পারেন, প্রতিটি ক্রোকারের ব্যস পরেরটার সাথে কত অনুপাতে আছে?

 

PHI? সবাই বললো।

 

বিঙ্গো। ল্যাংডন স্লাইডগুলো নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে গেলো—পদ্ম ফুল, গাছপালার পাতার বিন্যাস, পোকা-মাকড়ের বিভাঁজন সবগুলো বিস্ময়করভাবেই স্বর্গীয় অনুপাত মেনে চলেছে।

 

দারুণ! কেউ একজন চিৎকার করে বললো।

 

হ্যাঁ, আরেকজন বললো, কিন্তু এর সাথে চিত্রকলার সম্পর্ক কি?

 

আ-হা! ল্যাংডন বললো। আপনি জিজ্ঞেস করাতে খুশি হয়েছি। সে আরেকটা স্লাইড চড়ালো–বিবর্ণ হলুদ রঙের পার্চমেন্ট কাগজে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ভিরুভিয়ান ম্যান–প্রতিভাবান রোমান স্থপতি মার্কাস ভিরুভিয়ানের নামানুসারে করা হয়েছিলো, যিনি স্বর্গীয় অনুপাতকে তাঁর লেখায় প্রশংসা করে বলেছিলেন দ্য আর্কিটেকচুরা।

 

মানুষের শরীরের স্বর্গীয় গঠনের ব্যাপারটা দা ভিঞ্চির চেয়ে বেশি কেউ বুঝতে। আসলে দা ভিঞ্চি শবদেহ ব্যবচ্ছেদ করে মানুষের শরীরে হাড়ের গঠনের যথার্থ অনুপাতটি মেপে ছিলেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি দেখিয়েছিলেন যে, মানুষের শরীর গঠনে সবময়ই PHI-র হিসাবে থাকে।

 

শ্রেণীকক্ষের সবাই সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালো।

 

আমাকে বিশ্বাস করছেন না? ল্যাংডন চ্যালেঞ্জ করলো। এরপর গোসল করার সময় একটা মাপজোখ করার ফিতা নিয়ে যাবেন।

 

কথাটা শুনে কয়েকজন ফুটবল খেলোয়াড় নাক সিঁটকালো।

 

ল্যাংডন বললো, আপনাদের সবাই। ছেলে এবং মেয়ে। চেষ্টা করে দেখবেন এটা। আপনাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত মেপে দেখবেন। তারপর মাটি থেকে আপনাদের নাভি পর্যন্ত যে মাপ হয় তা দিয়ে সেটাকে ভাগ করে দেখবেন। কোন্ সংখ্যাটা আপনারা পাবেন, জানেন?

 

PHI নয়! একজন সৈনিক অবিশ্বাসে কথাটা বললো।

 

হ্যাঁ, PHI, ল্যাংডন জবাব দিলো, এক-দশমিক-ছয়-এক-আট। আরেকটা উদাহরণ চান? আপনাদের কাঁধ থেকে হাতের আঙুল পর্যন্ত মাপ নিন, আর সেটাকে আপনাদের বাহু থেকে আঙুল পর্যন্ত যে মাপ হয়, সেটা দিয়ে ভাগ করুন। আবারো PHI। আরেকটা চান? পা থেকে হিপর মাপকে পা থেকে হাটু দিয়ে ভাগ করুন। আবারো PHI। আঙুলের গিট, পায়ের পাতা। মেরুদণ্ডের বিভাঁজন। PHI, PHI, PHI। বন্ধুরা, আপনারা প্রত্যেকেই স্বর্গীয় অনুপাতের কল্যাণে হাটছেন।

 

এমনকি অন্ধকারেও ল্যাংডন দেখতে পারলো তারা সবাই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আছে। সে ভেতরে ভেতরে অতিপরিচিত একটা আবেগ অনুভব করলো। এজন্যেই সে শিক্ষাদান করে থাকে। বন্ধুরা, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, এই পৃথিবীর বিশৃঙ্খল সবকিছুই আসলে সুপ্ত একটা শৃঙ্খলায় চলছে। যখন প্রাচীনকালের মানুষেরা প্রথম PHI আবিষ্কার করলো, তখন তারা নিশ্চিত হয়েছিলো যে, তারা ঈশ্বরের বিশ্ব নির্মানের একটা হিসাবের সন্ধান পেয়েছে। আর এজন্যেই তারা প্রকৃতি পূজা করে থাকে। যে কেউই ব্যাপারটা বুঝতে পারবে, কেন। প্রকৃতিতে ঈশ্বরের হাতের প্রমাণ রয়েছে, এমনকি আজকের দিনেও প্যাগানদের অস্তিত্ব রয়েছে। আমাদের অনেকেই, আজও প্যাগানদের মতো প্রকৃতি উৎসব করে থাকি। আর তারা এটা জানেও না। মে-ডে হলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, বসন্ত উৎসব উদযাপন…পৃথিবী তার উর্বরা শক্তি ফিরে পায়। স্বর্গীয় অনুপাতের মধ্যে যে রহস্যময় জাদুশক্তি আছে, সেটা মানব সভ্যতার শুরুর দিকেই লিখিত হয়েছিলো। মানুষ প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা শাসিত, আর যেহেতু শিল্পকলা হলো ঈশ্বরের হাতকে অনুকরণ করার একটা প্রচেষ্টা, সেজন্যে আপনারা এই সেমিস্টারে শিল্পকলায় স্বর্গীয় অনুপাতের ছড়াছড়ি দেখতে পাবেন।

 

পরবর্তী আধঘণ্টা ধরে ল্যাংডন স্লাইডশোর মাধ্যমে একের পর এক মাইকেল এঞ্জেলো, আলব্রেখট দ্রার, দা ভিঞ্চি এবং অন্য অনেকের চিত্রকর্ম দেখালেন। প্রতিটাতেই শিল্পী ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের কম্পােজিশনে স্বর্গীয় অনুপাত ব্যবহার করেছেন। ল্যাংডন গৃক পার্থিনোন, মিশরের পিরামিড, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত জাতিসংঘের ভবনের স্থাপত্যে PHI-এর বিষয়টি উন্মোচিত করলো। PHI মোজার্টের সোনাটার গঠনেও আছে, বিঠোফেনের পঞ্চম সিম্ফোনি এবং বার্তোক, ডেবুসি আর শুবার্টের কর্মেও সেটা বিদ্যমান। ল্যাংডন তাদেরকে বললো, PHI সংখ্যাটি, এমনকি স্ট্রাডিভ্যারিয়াসও ব্যবহার করেছেন তার বেহালার হোল-এর সঠিক অবস্থানের জন্য।

 

অবশেষে, ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে এগিয়ে গিয়ে ল্যাংডন বললো, আমরা আবার প্রতীকেই ফিরে আসবো। সে পাঁচটি বিন্দুর সাহায্যে একটা তারা আঁকলো। এই প্রতীকটা সবচাইতে শক্তিশালী একটা ইমেজ যা আপনারা এই টার্মে দেখতে পারবেন। সাধারণত এটাকে বলা হয় পেনটাগ্রাম অথবা পেনটাকল, যেমনটি প্রাচীন কালের মানুষেরা বলতো—এই প্রতীকটা বিভিন্ন সংস্কৃতিতে স্বর্গীয় আর জাদুকরী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেউ কি বলতে পারবে, কেন?

 

স্টেটনার, গণিতের মেজ, আবারো হাত তুললো। কারণ, আপনি যদি পেনটাগ্রাম আঁকেন তবে আপনা আপনিই সেটা স্বর্গীয় অনুপাতে বিভাজিত হয়ে যাবে।

 

ল্যাংডন ছেলেটাকে মাথা নেড়ে সাধুবাদ জানালো। চমৎকার। হ্যাঁ, পেনটাকলর রেখার বিভিন্ন অংশের সবগুলোর অনুপাতই PHIর সমান। এজন্যেই, এই প্রতীকটা স্বর্গীয় অনুপাতের একটি অনিবার্য প্রকাশ হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। এই কারণেই পাঁচ বিন্দুর এই তারকাটা সবসময়ই দেবী এবং পবিত্র নারীর সাথে সংশ্লিষ্ট সৌন্দর্য আর নিখুতের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

 

শ্রেনী কক্ষের মেয়েরা ভুরু কুঁচকালো।

 

একটা কথা। আজকে আমরা শুধু দা ভিঞ্চিকে স্পর্শ করেছি। কিন্তু আমরা এই সেমিস্টারে তার আরো অনেক কিছুই দেখতে পাবো। লিওনার্দো প্রাচীন দেবীদের প্রতি খুবই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, এর যথেষ্ট প্রমাণও আছে। আগামীকাল, আমি আপনাদেরকে তার দ্য লাস্ট সাপার ফ্রেসকোটি দেখাবো, এতে পবিত্র নারীর একটি বিস্ময়কর প্রমাণ রয়েছে, যা আপনারা কখনও দেখেননি।

 

আপনি ঠাট্টা করছেন, তাই না? কেউ একজন বললো।

 

আমরা তো জানতাম দ্য লাস্ট সাপার যিশু খৃস্টের উপর!

 

ল্যাংডন মুচুকি হাসলো। আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না, প্রতীকগুলো কীভাবে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে আছে।

 

 

 

আসুন, নিচু স্বরে সোফি বললো। কি হয়েছে আপনার? আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি। জলদি করুন!

 

ল্যাংডন চোখ তুলে তাকালো, দূরের চিন্তাভাবনা থেকে ফিরে আসলো। বুঝতে পারলে তারা সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে পড়েছে। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলো সে।

 

O, Draconian devil! Oh, lame saint!

 

সোফি তার পেছনে থাকা ল্যাংডনের দিকে ঘুরে তাকালো।

 

এটা এতোটা সহজ-সরল হতে পারে না, ল্যাংডন ভাবলো।

 

কিন্তু সে জানে, অবশ্যই এটা।

 

লুভরের এই গহ্বরের ভেতরে … PHI এবং দা ভিঞ্চি তার মনে ঘুরপাক খেতে লাগলো। রবার্ট ল্যাংডন আচমকা, অপ্রত্যাশিতভাবে সনিয়ের কোডটার মর্মোদ্ধার করে ফেললো।

 

O, Draconian devil! সে বললো, Oh, lame saint! এটাতো খুব সহজ সরল ধরনের একটা কোড!

 

সোফি থেমে তার দিকে দ্বিধাগ্রস্তভাবে তাকালো। এটা একটা কোড? সে সারারাত ধরে শব্দগুলো নিয়ে ভেবেছে কিন্তু কিছুই খুঁজে পায়নি, বিশেষ করে সহজ সরল ধরনের কোড।

 

আপনি নিজেই এটা বলেছিলেন। ল্যাংডনের কণ্ঠে আবার উত্তেজনা ফিরে এলো। ফিবোনাচ্চি সংখ্যাগুলো শুধুমাত্র যথার্থ নিয়মে থাকলেই কোন অর্থ বহন করে। তা না হলে ওগুলো গাণিতিক প্রহেলিকা ছাড়া আর কিছুই না।

 

সে কী বলছে সে সম্পর্কে সোফির কোন ধারণাই ছিলো না। ফিবোনাচ্চি সংখ্যা? সে এ ব্যাপারে খুব নিশ্চিত যে, এটা শুধুমাত্র ক্রিপ্টোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টকে জড়িত করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। ওগুলোর আরেকটা উদ্দেশ্যও আছে? সে তার হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে প্রিন্ট-আউটটা বের করলো, তার দাদুর মেসেজটা আবার খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো।

 

13-3-2-21-1-1-8-5

 

O, Draconian devil!

Oh, lame saint!

 

সংখ্যাগুলোর ব্যাপারটা কি?

 

এলোমেলোভাবে ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রমটা আসলে একটা ক্লু, প্রিন্ট-আউটটা হাতে নিয়ে ল্যাংডন বললো। সংখ্যাগুলো আসলে বাকি মেসেজগুলোর মর্মোদ্ধার করার একটা ইঙ্গিত। তিনি সংখ্যামটা এলোমেলোভাবে লিখেছেন আমাদেরকে এটা বলার জন্য যে, একই কাণ্ড করা হয়েছে লিখিত মেসেজেটাতেও। O, Draconian devil? oh, lame saint? এই লাইনগুলোর কোন অর্থ নেই। এগুলো এলোমেলোভাবে লেখা অক্ষর ছাড়া আর কিছুই না।

 

আপনার মতে এই মেসেজটা…উনে এনাগ্রাম?  সে তার দিকে চেয়ে রইলো। অনেকটা সংবাদপত্র থেকে শব্দের দঙ্গল বানানো?

 

ল্যাংডন সোফির চেহারায় সন্দেহ দেখতে পেলো, সঙ্গত কারণেই বুঝতে পারলো সেটা। খুব কম লোকই এনাগ্রাম জিনিসটা বুঝতে পারে। কোন শব্দ বা বাক্যাংশের বর্ণগুলো দিয়ে স্থান পরিবর্তনের সাহায্যে ভিন্ন-ভিন্ন শব্দ বা বাক্য তৈরি করাকে এনাগ্রাম বলে।

 

কাবালার রহস্যময় শিক্ষা খুব বেশি রকমেরই এনাগ্রাম ভিত্তিক—এতে হিব্রু অক্ষরগুলো নতুন ভাবে সাজিয়ে নতুন অর্থ বের করে আনা হয়। রেনেসাঁর সময়কার ফরাসি রাজারা এনাগ্রামের ব্যাপারে এতোটাই মুগ্ধ ছিলো যে, তারা বিশ্বাস করতো এতে জাদুকরী শক্তি আছে। তারা রাজকীয় এনাগ্রাম বিশারদ পর্যন্ত নিয়োগ দিয়েছিলো যাতে করে গুরুত্বপূর্ণ দলিল-দস্তাবেজ বিশ্লেষণে সাহায্য করা যায়। রোমানরা সত্যিকার অর্থে এনাগ্রাম বিদ্যাকে আক্বস ম্যাগনা অর্থাৎ মহান চিত্র বলে অভিহিত করেছিলো।

 

ল্যাংডন সোফির দিকে তাকালো, তার চোখে চোখ স্থির করলো। আপনার দাদুর অর্থটা আমাদের সামনেই রয়েছে, আর তিনি আমাদের কাছে এটা দেখানোর জন্য যথেষ্ট কু-ই রেখে গেছেন।

 

আর কোন কথা না বলেই ল্যাংডন তার জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা কলম বের করে প্রতিটা লাইনের অক্ষরগুলো নতুন করে সাজালো।

 

0, Draconian devil!

Oh, lame saint!

 

এর একটি নিখুঁত এনাগ্রাম হলো …

 

Leonardo Da vinci!

The Mona Lisa!

 

 

 

 

 

০৩. মোনালিসা

২১.

 

মোনালিসা।

 

হঠাৎ করেই সোফি বের হওয়ার সিঁড়িটার সামনে থম্‌কে দাঁড়ালো, ভুলে গেলো লুভর থেকে চলে যাবার কথাটা। তার এজন্যে দুঃখ হতে লাগলো যে, এনাগ্রামটার মর্মোদ্ধার সে নিজে করতে পারেনি। সোফির দক্ষতা জটিল জটিল সব ক্রিপ্টো বিশ্লেষণের উপর, তাই তার চোখ সহজ সরল শব্দের খেলাটা এড়িয়ে গেছে। তারপরও তার মনে হলো, তার উচিত ছিলো এটা বের করার। হাজার হলেও, তার কাছে এনাগ্রাম কোন অপরিচিত কিছু ছিলো না, বিশেষ করে ইংরেজিতে।

 

যখন সে খুব ছোট ছিলো, তার দাদু প্রায়ই তার ইংরেজি বানানের দক্ষতা পরীক্ষা করার জন্য এই এনাগ্রাম খেলাটা ব্যবহার করতেন। একবার তিনি ইংরেজি শব্দ Planets লিখে এর অক্ষরগুলো দিয়ে সোফিকে বিরানব্বইটি অন্য ইংরেজি শব্দ লিখতে বললেন। এই অক্ষরগুলো দিয়ে আসলেই, বিস্ময়করভাবে এতোগুলো শব্দ লেখা যায়। সোফি তিন দিন ব্যয় করে, ডিকশনারি ঘেঁটে সবগুলো শব্দ বের করতে পেরেছিলো।

 

আমি কল্পনাও করতে পারছি না, লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন বললো, কীভাবে আপনার দাদু মারা যাবার আগে মিনিটখানেকের ভেতরে এরকম একটি এনাগ্রাম তৈরি করতে পারলেন!

 

সোফি ব্যাখাটা জানতো, আর এটা বুঝতে পেরে তার খুব খারাপ লাগলো। আমার এটা দেখা উচিত ছিলো! সে তার দাদুর কথা স্মরণ করলো—একজন শব্দ খেলার আসক্ত ব্যক্তি এবং শিল্পকলাপ্রিয় মানুষ তরুণ বয়সে বিখ্যাত সব চিত্রকর্ম দিয়ে এনাগ্রাম তৈরি করে খুব আনন্দ পেতেন। সত্যি বলতে কী, একবার তাঁর তৈরী একটা এনাগ্রাম তাঁকে বেশ সমস্যায় ফেলে দিয়েছিলো, তখন সোফি একটা বাচ্চা মেয়ে। আমেরিকান এক আর্ট ম্যাগাজিনের সাথে সাক্ষাতের সময়, সনিয়ে আধুনিক কিউবিজম আন্দোলনের প্রতি তার অপছন্দের কথা প্রকাশ করেছিলেন পিকাসোর মাস্টারপিস les Demoiselles d ‘Avignor-কে Vile meaningless doodles-এর যথার্থ  এনাগ্রাম হিসেবে বর্ণনা করে। পিকাসোর ভক্তরা এতে খুশি হতে পারেনি।

 

আমার দাদু এই Monalisa এনাগ্রামটি সম্ভবত অনেক আগেই তৈরি করেছিলেন, ল্যাংডনের দিকে চেয়ে সোফি বললো। আর আজরাতে তিনি এটা বাধ্য হয়েই একটা কোড হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সে তার দাদুর শীতল কণ্ঠটা শুনতে পেলো।

 

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি!

 

মোনালিসা!

 

কেন তিনি তাঁর চুড়ান্ত মুহূর্তের কথায় এই বিখ্যাত চিত্রকর্মটির উল্লেখ করে গেছেন, সে ব্যাপারে সোফির কোন ধারণাই ছিলো না। কিন্তু একটা সম্ভাবনার কথাই কেবল ভাবতে পারলো সে। বিব্রতকর একটা কিছু।

 

এগুলো তাঁর অন্তিম কথা নয় …

 

সে কি মোনালিসা দেখতে যাবে? তাঁর দাদু কি সেখানে কোন মেসেজ রেখে গেছেন? আইডিয়াটা মনে হচ্ছে যথার্থই ন্যায়সঙ্গত। হাজার হোক, বিখ্যাত চিত্রকর্মটি ঝুলে আছে সল দে এতা-এ-একটা আলাদা কক্ষে, কেবলমাত্র গ্র্যান্ড গ্যালারির ভেতর দিয়েই সেখানে প্রবেশ করা যায়। সোফি টের পেলো, যে ঘরটির দরজা খোলা রয়েছে সেটা থেকে কেবল বিশ মিটার দূরে তার দাদুর মৃতদেহটা পড়ে আছে।

 

তিনি মারা যাবার আগে খুব সহজেই মোনালিসাকে দেখে যেতে পারতেন।

 

সোফি ইমার্জেন্সি সিঁড়িটার দিকে ফিরে তাকালো, সিদ্ধান্তহীনভাবে। সে জানে তার উচিত ল্যাংডনকে এক্ষুণি জাদুঘর থেকে বের করে নেয়া। তারপরও তার মনে হতে লাগলো বিপরীত কিছু করার। সোফি তার শৈশবে দাদুর সাথে লুভরের ডেনন উইংয়ে বেড়াতে আসার কথাটি মনে করতেই বুঝতে পারলো, তার দাদু যদি তার কাছে গোপন কিছু বলার থেকেই থাকে, তবে সেটা দা ভিঞ্চির মোনালিসার চেয়ে খুব কম জায়গাই রয়েছে এই পৃথিবতে।

 

সে এখান থেকে অল্প দূরেই আছে, তার দাদু সোফির নরম হাতটা ধরে ফিস ফিস্ করে কথাটা বলেছিলো। তখন জাদুঘরটা সবার জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো,

 

ফাঁকা জাদুঘরটা তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন তিনি।

 

সোফির বয়স তখন মাত্র ছয়। বিশাল বড় ছাদ আর চমঙ্কার ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয়েছিলো, সে খুব ছোট আর নগন্য। ফাঁকা জাদুঘরটা তাকে ভীত করে তুলেছিলো। যদিও সেটা দাদুকে বুঝতে দেয়নি সে।

 

সামনেই সল দে এতা, লুভরের সবচাইতে বিখ্যাত ঘটাতে প্রবেশ করতেই তার দাদু তাকে বলেছিলেন। দাদুর দারুণ উত্তেজনা থাকা সত্ত্বেও সোফি চাইছিলো বাড়ি ফিরে যেতে। সে বইতে মোনালিসার ছবি দেখেছিলো, তার একদম পছন্দ হয়নি। সে বুঝতেই পারতো না, কেন সবাই তাকে নিয়ে এতো মাতামাতি করে।

 

সেস্ত, এনুয়ে, সোফি গজ গজ করে ফরাসিতে বলেছিলো।

 

বোরিং, দাদু ইংরেজি শব্দটা বলে শুধরিয়ে দিয়েছিলেন, স্কুলে ফরাসি, বাড়িতে ইংরেজি।

 

লো লুভর, সেস্তু পা শেজ মেয়ে! সে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলো।

 

তিনি ক্লান্ত একটা হাসি দিয়েছিলেন। ঠিক বলেছো তুমি। তাহলে মজা করার জন্য ইংরেজি বলা হোক।

 

সোফি ঠোঁট উল্টিয়ে হাটতে শুরু করেছিলো। সল দে এতা-এ ঢোকা মাত্রই তার চোখ সংকীর্ণ একটা ঘর নিরীক্ষণ করে খুঁজে পেলো সেই সম্মানজনক স্থানটি ডান দিকের দেয়ালের ঠিক মাঝখানটা। সেখানে বুলেটপ্রুফ গ্লাসের পেছনে একটা ছবি টাঙানো ছিলো। তার দাদু দরজার দিকে এসেই একটু থেমে গিয়ে ছবিটার দিকে ঘুরে বলেছিলেন, যাও, সোফি। খুব বেশি মানুষ তাকে একা দেখার এই দূর্লভ সুযোগটা পায় না।

 

সোফি আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়েছিলো। মোনালিসা সম্পর্কে এতো কিছু শোনার পর, তার মনে হচ্ছিলো, সে যেনো রাজকীয় কোনো কিছুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বুলেট প্রুফ গ্লাসটার সামনে এসে দাঁড়াতেই সোফি নিঃশ্বাস নিয়ে সোজা ছবিটার দিকে তাকিয়েছিলো।

 

সোফি নিশ্চিত ছিলো না, তার কী রকম অনুভূতি হবে, কিন্তু তার তেমন কিছুই হয়নি। কোন বিস্ময় না। তৎক্ষণাৎ কোন উত্তেজনাও বোধ করেনি। বিখ্যাত চেহারাটা, বইতে যেমন দেখেছে, তেমনি দেখাচ্ছিলো সেটা। নিরবে দাঁড়িয়ে ছিলো সে যা তার কাছে অনন্ত কালের অপেক্ষা করার মতো মনে হয়েছিলো। সে কিছু একটা ঘটার প্রতীক্ষা করছিলো।

 

তো, তোমার কি মনে হচ্ছে? তার দাদু তার পেছনে এসে ফিসফিস্ করে বলেছিলেন। সুন্দর, চোখটা?

 

সে তো দেখি খুবই ছোট।

 

সনিয়ে হেসে ছিলেন। তুমিও তো ছোট, কিন্তু সুন্দর।

 

আমি সুন্দর নই, সে মনে মনে ভেবে ছিলো। সোফি তার লাল চুল আর চেহারায় ছিট-ছিট দাগগুলো ঘৃণা করতো। তার ক্লাসের সব ছেলেদের চেয়েও সে বড়সড় ছিলো। সে মোনালিসার দিকে আবার ফিরে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ছিলো। বইতে তাকে যেমন দেখায়, দেখতে তার চেয়েও বেশি খারাপ। তার চেহারাটা …ব্রুমোয়া।

 

কুয়াশাচ্ছন্ন, তার দাদু বলেছিলেন।

 

কুয়াশাচ্ছন্ন, সোফিও কথাটা আবার বলে ছিলো।

 

এটাকে বলে পেইন্টিংয়ের ফুমেতো স্টাইল। তিনি সোফিকে বলেছিলেন। আর এভাবে আঁকা খুবই কঠিন কাজ। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি অন্য যে কারোর চেয়ে এক্ষেত্রে সেরা ছিলেন।

 

তারপরও সোফি ছবিটা পছন্দ করেনি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে কিছু একটা জানে… যেমন স্কুলের বাচ্চারা গোপন কিছু জানে, সেরকম।

 

তার দাদু জোরে জোরে হেসে ছিলেন, অনেকটা, এজন্যেই সে এতো বিখ্যাত। লোকজন অনুমান করতে পছন্দ করে, কেন সে হাসছে।

 

তুমি কি জানো, কেন সে হাসছে?

 

হয়তো। তার দাদু মিটিমিটি হেসে বলেছিলেন। একদিন আমি এসবের সবটাই তোমাকে বলবো।

 

সোফি তার পাটা মাটিতে সজোরে আঘাত করেছিলো। আমি তো তোমাকে বলেছিই, রহস্য আমার ভালো লাগে না!

 

প্রিন্সেস, তিনি হেসে বলেছিলেন। এ জীবন রহস্যে পরিপূর্ণ। তুমি একবারে এগুলোর সবটা জানতে পারবে না। আমি উপরে ফিরে যাচ্ছি, সোফি ল্যাংডনকে বললো, তার কণ্ঠটা সিঁড়ি ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো।

 

মোনালিসার কাছে? ল্যাংডন ভুরু কুচকে বললো। এখনই?

 

সোফি ঝুঁকিটা বিবেচনা করলো। আমি সন্দেহভাঁজন খুনি নই। আমি আমার সুযোগটা নেবোই। আমার দাদু আমাকে কী বলতে চাচ্ছেন, সেটা আমার জানা দরকার।

 

এ্যামবাসির ব্যাপারটা কি হবে?

 

ল্যাংডনকে একজন ফেরারি বানিয়ে এখন আবার তাকে পরিত্যাগ করার কথাটা ভেবে সোফির খুব অপরাধবোধ হতে লাগলো, কিন্তু তার অন্য কোন উপায়ও ছিলো না। সে নিচের সিঁড়ির কাছে একটা লোহার দরজার দিকে ইঙ্গিত করলো।

 

এই দরজাটা দিয়ে বেড়িয়ে যান, আর জ্বলজ্বলে বহির্গমনের সাইনগুলো অনুসরণ করুন। আমার দাদু আমাকে এখানে নিয়ে আসতেন। আমি এ জায়গাটা চিনি। বাইরে বের হবার জন্য এই একটাই পথ আছে। সোফি তার গাড়ির চাবিটা ল্যাংডনের কাছে হাতে দিয়ে দিলো। আমারটা লাল রঙের, কর্মচারীদের লটে পার্ক করা আছে। আপনি কি জানেন এ্যামবাসিতে কীভাবে যাওয়া যায়?

 

হাতের চাবিটার দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন মাথা নাড়লো।

 

শুনুন, সোফি বললো, তার কণ্ঠটা খুব নরম শোনাচ্ছে। আমার মনে হয়, আমার দাদু মোনালিসাতে আমার জন্য একটা মেসেজ রেখে গেছেন—তাঁকে কে খুন করেছে, হয়তো সেই ব্যাপারে কোন কু আছে। অথবা, কেন আমি বিপদে আছি সেটা বলা আছে। অথবা আমার পরিবারের কী হয়েছিলো। আমাকে সেটা দেখতেই হবে।

 

কিন্তু তিনি যদি আপনার বিপদের কথাটা বলতেই চাইতেন, তবে তিনি মারা যাবার আগে সেটা ফ্লোরে লিখে গেলেন না কেন? কেন এই জটিল শব্দ-শব্দ খেলা?

 

আমার দাদু আমাকে যা-ই বলতে চাইছেন, আমার মনে হয় না, তিনি চান সেটা অন্য কেউ জানুক। এমন কি পুলিশও না। স্পষ্টতই, তার দাদু নিজের সমস্ত শক্তি দিয়েই তার কাছে একটা মেসেজ পৌঁছাতে চাইছিলেন। তিনি সেটা কোডের আকাড়ে লিখে গেছেন। সোফির গোপন আদ্যক্ষরও সংযুক্ত করে দিয়েছেন। আর শেষে তাকে বলে গেছেন রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করতে একটি প্রজ্ঞাময় আদেশ। আমেরিকান সিম্বোলজিস্ট এই কোডটার মর্মোদ্ধার করতে পারবে এই ধারণায়। খুবই অদ্ভুত শোনাচ্ছে, সোফি বললো, আমার মনে হয়, তিনি চেয়েছেন অন্য কেউ পৌঁছানোর আগেই আমি মোনালিসার কাছে যাই।

 

আমিও আসছি আপনার সাথে।

 

না! আমরা জানি না গ্র্যান্ড গ্যালারি কততক্ষণ খালি থাকবে। আপনাকে যেতেই হবে।

 

ল্যাংডনকে মনে হলো দ্বিধাগ্রস্ত, যেনো তার একাডেমিক কৌতূহলটা এখন হুমকির সম্মুখীন।

 

এক্ষুণি যান। সোফি তার দিকে চেয়ে একটা বিদায়ী হাসি দিলো। আমি এ্যামবাসিতে গিয়ে আপনার সাথে দেখা করবো, মি. ল্যাংডন।

 

ল্যাংডনকে দেখে মনে হলো খুশি হয়নি। আমি আপনার সাথে সেখানে দেখা করতে পারি একটা শর্তে, সে জবাব দিলো, তার কণ্ঠ কাঁপছে।

 

সোফি একটু থেমে চোখ তুলে তাকালো। সেটা কি?

 

আপনি আমাকে ল্যাংডন বলা বন্ধ করবেন।

 

সোফি মিষ্টি হেসে ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে বললো, গুড লাক, রবার্ট।

 

 

 

ল্যাংডন সিঁড়ির একেবারে শেষ ধাপে নেমে আসলো। সেখানে তেল আর পাস্টারের ঝাঝালো গন্ধটা তার নাকে এসে লাগলো। সামনে এগোতেই চোখ পড়লো SORTIE/ EXIT লেখা একটা সাইন। সেটা সঙ্কীর্ণ একটা করিডোরের দিকে ইঙ্গিত করছে। ল্যাংডন সেদিকেই পা বাড়ালো।

 

হলওয়ে দিয়ে যেতে যেতে ল্যাংডন ভাবতে লাগলো, যদি এই মুহূর্তে ক্যামবৃজের বিছানা থেকে জেগে উঠতো সে আর আজকের পুরো ঘটনাটাই হতো অদ্ভুত একটা স্বপ্ন! আমি লুভর থেকে চুপিসারে বেড়িয়ে যাচ্ছি… একজন ফেরারী হয়ে।

 

সনিয়ের চাতুর্যপূর্ণ এনাগ্রামটি এখনও তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ল্যাংডন অবাক হয়ে ভাবলো, সোফি মোনালিসাতে কী এমন খুঁজে পাবে…অবশ্য যদি কিছু পায়। সে একদম নিশ্চিত যে, তার দাদু তাকে বিখ্যাত চিত্রকর্মটি আরেকবার পরিদর্শন করার জন্য ইঙ্গিত করে গেছেন। কিন্তু ল্যাংডনের কাছে এটা হেঁয়ালী বলেই মনে হলো।

 

পি,এস, রর্বাট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো।

 

সনিয়ে ল্যাংডনের নাম ফ্লোরে লিখে সোফিকে আদেশ করে গেছেন তাকে খুঁজে বের করতে। কিন্তু কেন? এজন্যে কি, যাতে ল্যাংডন এনাগ্রামটার মর্মোদ্ধার করতে তাকে সাহায্য করতে পারে?

 

এটা একেবারেই মনে হচ্ছে না।

 

হাজার হোক, সনিয়ের এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে, ল্যাংডন একজন দক্ষ এনাগ্রাম বিশেষজ্ঞ। আমরা এমনকি কখনও দেখাও করিনি। তাছাড়া, সোফি ইতিমধ্যেই ফিবোনাচ্চি সংখ্যামটা বের করতে পেরেছে, আরেকটু সময় পেলে বাকী মেসেজটার মর্মোদ্ধারও সে করতে পারবে। এগুলোর জন্য তো তার ল্যাংডনের কোন সাহায্যের দরকার নেই।

 

সোফি এনাগ্রামটা নিজে নিজেই বের করতে পারতো। হঠাৎ করেই ল্যাংডন এ ব্যাপারে একদম নিশ্চিত হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারলো, সনিয়ের এরকম করার কারণটা কী।

 

আমি কেন? ল্যাংডন অবাক হয়ে হলের দিকে এগোলো। কেন সনিয়ের মৃত্যুকালীন ইচ্ছা হলো তাঁর বিচ্ছিন্ন হওয়া নাতনী আমাকে খুঁজে বের করুক?

 

হঠাৎ অন্য একটা ভাবনা খেলে গেলো ল্যাংডনের মনে। সে একটু থেমে পকেট হাতড়ে কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটটা বের করলো। সনিয়ের মেসেজটার শেষ লাইনটার দিকে তাকালো সে।

 

পি,এস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো।

 

দুটো অক্ষরের দিকে সে চোখ স্থির করলো।

 

পি, এস।

 

হুট করেই ল্যাংডনের মনে হলো, সে সনিয়ের উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারছে। অনেকটা বজ্রপাতের মতো সিমোলজি আর ইতিহাস তার উপর পতিত হলো। আজ রাতে সনিয়ে যা যা করেছেন, তার সবটাই এখন স্পষ্ট বলেই তার কাছে মনে হচ্ছে। ল্যাংডনের চিন্তাভাবনাগুলো খুব দ্রুত সবকিছু মিলিয়ে একটা অর্থ দাঁড় করাতে শুরু করলো। ঘুরে, যেখান থেকে সে এসেছিলো, সেখানে আবার তাকালো।

 

সময় আছে কি?

 

সে জানতো, এতে অবশ্য কিছু যায় আসে না।

 

কোন রকম ইতস্তত না করেই, ল্যাংডন সিঁড়ি ভেঙে দ্রুত উপরে উঠতে শুরু করলো।

 

 

 

২২.

 

বেদীর দিকটা ভালো করে দেখে নিয়ে সাইলাস হাটু গেঁড়ে প্রার্থনা করার ভান করলো। সেন্ট-সালপিচ, বেশির ভাগ চার্চের মতোই বিশালাকার রোমান ক্রসের আকাড়ে নির্মাণ করা হয়েছে। এটার লম্বা কেন্দ্রীয় অংশটি মূল অংশ সরাসরি বেদীর দিকে চলে গেছে। সেখান থেকে ট্রানসেপ্ট নামের আরেকটা ছোট অংশ আড়া আড়ি চলে গেছে। মূল অংশটি এবং এর সাথে আড়াআড়ি ছোট অংশটাকে চার্চের প্রাণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় …সবচাইতে পবিত্র এবং আধ্যাত্মিক স্থান।

 

আজ রাতে নয়, সাইলাস ভাবলো। সেন্ট সালপিচ তার সিক্রেটটা অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছে।

 

ডান দিকে চেয়ে সে দক্ষিণ দিকের ক্রুশাকৃতির অংশটার দিকে তাকালো। তার শিকাররা যে বস্তুটার কথা তাকে বলেছিলো, পদ্রীর আসনের ওপাশে খোলা জায়গাটার দিকে সেটা দেখতে পেলো সাইলাস।

 

এইতো এটা।

 

ধূসর গ্রানাইট ফ্লোরের পাথরের মধ্যে শক্ত করে লাগিয়ে রাখা পালিশ করা পিতলের একটা ডোরা কাটা দাগ চক্ করছে…সোনালী রেখাটা চার্চের ফ্লোরটাকে আড়াআড়িভাবে বিরক্ত করে আছে। দাগটার মধ্যে কিছু চিহ্ন দেয়া আছে, অনেকটা রুলার-স্কেলের মতো। এটা সূর্য ঘড়ির কাঁটা। সাইলাসকে বলা হয়েছিলো যে, এটা একটা প্যাগান জ্যোর্তিবিদ্যার যন্ত্র, অনেকটা সূর্যঘড়ির মতো দেখতে। পর্যটক, বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ এবং প্যাগানরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে সেন্ট সালপিচের এই বিখ্যাত রেখাটি দেখতে আসতো।

 

রোজ লাইন।

 

আস্তে আস্তে সাইলাস দাগটা লক্ষ্য করে ঘরের ডান থেকে বাম দিকে তাকালো। তার সামনে বেঢপ আকৃতির একটা কোণ, চার্চের সাথে একেবারেই অসামঞ্জস্যভাবে স্থাপিত। মূল বেদীটা এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত দাগ কাটা, যেনো সুন্দর কোন চেহারায় কাটা দাগের মতো। দাগটা চার্চের প্রস্তুটাকে এপাশ-ওপাশ ভাগ করে ফেলেছে। অবশেষে, উত্তর দিকের কোণায় পাদ্রীর আসনের কাছে গিয়ে থেমেছে। সেখানে এটা সবচাইতে অপ্রত্যাশিত একটা স্থাপত্যের গোড়ায় গিয়ে মিলেছে।

 

একটা বিশাল মিশরীয় অবিলিস্ক।

 

এখান থেকে, চকে রোজ লাইনটা নব্বই ডিগ্রি বাঁক নিয়ে সোজা অবিলিস্কের দিকে চলে গেছে। তেত্রিশ ফুট দূরে গিয়ে অবশেষে থেমেছে।

 

রোজ লাইন, সাইলাস ভাবলো। ভ্রাতৃসংঘ কি-স্টোনটা রোজ লাইনে লুকিয়ে রেখেছে।

 

আজ রাতে প্রথম দিকে সাইলাস যখন তার টিচারকে বলেছিলো যে, প্রায়োরি কি স্টোনটা সেন্ট সালচিপের অভ্যন্তরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে, টিচার তখন সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু সাইলাস যখন খুলে বললো যে, ভ্রাতৃসংঘের সবাই তাকে ঠিক একই কথা বলেছে, ঠিক একই জায়গার বর্ণনা দিয়েছে, টিচারের কণ্ঠে তখন আতিশয্যের বহিপ্রকাশ পাওয়া গিয়েছিলো। তুমি রোজ লাইনর কথা বলছো!

 

টিচার সাথে সাথেই সাইলাসকে সেন্ট সালপিচের অদ্ভুত স্থাপত্যের খ্যাতি সম্পর্কে বলেছিলেন—একটা পিতলের ডোরা কাটা দাগ চার্চের ভেতরের জায়গাটাকে নিখুঁতভাবে উত্তর-দক্ষিণ অক্ষে বিভক্ত করেছে। এটা এক ধরনের প্রাচীন সূর্য ঘড়ি, যা প্যাগান মন্দিরের অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট, আর ঠিক এই জায়গাটাতেই এক সময় একটা প্যাগান মন্দির অবস্থিত ছিলো। সূর্যের রশ্মি, দক্ষিণ দিকের চচকে দেয়াল থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে দাগ ধরে এগিয়ে যায়, যা সময়ের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

 

উত্তর-দক্ষিণ ডোরা কাটা দাগটাই রোজ লাইন নামে পরিচিত। শত শত বছর ধরে রোজ বা গোলাপের প্রতীকটা মানচিত্রের দিক নির্দেশনার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলো। কম্পাস রোজপ্রায় সব মানচিত্রেই আঁকা থাকে যা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমকে নির্দেশ করে। আগে এটা উইন্ড-রোজ হিসেবে পরিচিত ছিলো। এটা বত্রিশটা বায়ু প্রবাহের দিক নির্দেশ করতে যা আটটা অর্ধেক বায়ু প্রবাহ আর ষোলোটা এক চতুর্থাংশ বায়ু প্রবাহ থেকে উদ্ভুত। যখন বৃত্তের মধ্যে এটা আঁকা থাকে তখন কম্পাসের এই বত্রিশটা বিন্দু ঐতিহ্যবাহী বত্রিশটা গোলাপের পাপড়ির সাথে মিলে যায়। আজকের দিনেও নেভিগেশনের মূল যন্ত্রপাতিকে বলা হয় কম্পাস রোজ। এটার দক্ষিণ দিকের নির্দেশনাটা এখনও একটা তীরের মাথা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়…খুব সাধারণভাবে সেটা ফ্লার-দ্য-লিস প্রতীক হিসেবেই পরিচিত।

 

একটি ভূ-গোলকে রোজ লাইনকে মধ্য রেখা অথবা দ্রাঘিমাংশ হিসেবেও ডাকা হয়দক্ষিণ-মেরু থেকে উত্তর-মেরু পর্যন্ত যে কোন কাল্পনিক রেখাকেই দ্রাঘিমাংশ বলা হয়। অবশ্য, ভূ-গোলকে সীমাহীন সংখ্যক দ্রাঘিমা রেখা রয়েছে, কারণ ভূ-গোলকের উত্তর দক্ষিণ দিকে কল্পনা করা যে কোন বিন্দু থেকেই দ্রাঘিমা রেখা টানা যায়। প্রাচীন। কালে এই রেখাগুলোকেই রোজলাইন হিসেবে ডাকা হতো শূন্য দ্রাঘিমা রেখা—যে রেখা থেকে অন্য দ্রাঘিমা রেখাগুলো মাপা হয়।

 

আজকের দিনে এই লাইনটাই হলো ইংল্যান্ডের গৃনিচ।

 

কিন্তু সবসময় এটা এখানে ছিলো না।

 

প্রধান মধ্যরেখা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার অনেক আগে শূন্য দ্রাঘিমা রেখাটি প্যারিসে অবস্থিত ছিলো, আর সেটা ছিলো সেন্ট সালপিচেই। সেন্ট সালপিচের পিতলের ডোরা কাটা দাগটাই পৃথিবীর প্রথম প্রাইম মেরিডিয়ান বা প্রধান মধ্যরেখার স্মৃতি বহন করে আছে। আর যদিও গৃনিচ ১৮৮৮ সালে প্যারিস থেকে এই সম্মানটা ছিনিয়ে নেয়, তারপরও, আসল রোজ লাইন এখনও এখানে দেখা যায়।

 

আর এজন্যেই বিংবদন্তীটা সত্যি, টিচার সাইলাসকে বলেছিলেন। বলা হয়ে থাকে প্রায়োরি কি-স্টোনটা রোজ লাইন চিহ্নের নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

 

সাইলাস, হাটু গেঁড়েই চার্চের চারপাশটা একটু দেখে নিলো, নিশ্চিত হলো, কেউ নেই। পরক্ষণেই, তার মনে হলো, কয়্যার বেলকনি থেকে নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। সে ওদিকটায় কয়েক মুহূর্ত ভালো করে লক্ষ্য করলো কিন্তু কিছুই দেখতে পেলো না।

 

আমি একা।

 

এবার সে বেদীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ক্রুশ এঁকে বাম দিকে ঘুরে পিতলের ভোরা কাটা দাগটা অনুসরণ করে অবিলিস্কের উত্তর দিকে চলে গেলো।

 

 

 

ঠিক এই সময়ে রোমের লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের রানওয়েতে টায়ারের ঘর্ষণ হলে বিশপ আরিঙ্গারোসার অন্যমনস্কভাবটা কেটে গেলো।

 

আমি এসে গেছি, তিনি ভাবলেন, যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দে আছেন ভেবে খুশি হলেন।

 

বেনভেনুতে এ রোমা, ইন্টারকমে ঘোষণাটা এলো। নড়েচড়ে বসে আরিঙ্গাবোসা তার কালো আলখেল্লাটা একটু শক্ত করে বেঁধে নিয়ে বিরল একটা হাসি হাসলেন। এই সফরটা করতে পেরে তিনি খুব সুখী অনুভব করছেন।

 

আমি অনেকদিন ধরেই রক্ষণাত্মক ছিলাম। আজ রাতে, এই নিয়মটা বদলে গেছে। মাত্র পাঁচ মাস আগে, আরিঙ্গারোসা তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসের ভবিষ্যতটা নিয়ে বেশ ভীত ছিলেন। এখন, যেনো অনেকটা ঈশ্বরের ইচ্ছায়, সমাধানটা নিজেই উপস্থিত হয়েছে।

 

স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ।

 

যদি প্যারিসের সব কিছুই পরিকল্পনা মাফিক এগোয়, আরিঙ্গাবোসা খুব জলদিই এমন কিছুর অধিকারী হয়ে উঠবেন, যা তাঁকে খৃস্টান বিশ্বে সবচাইতে শক্তিশালী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।

 

 

 

২৩.

 

সোফি সলদে এতা-এর বিশাল কাঠের দরজার বাইরে এক দমে এসে পড়লো—এই ঘরেই মোনালিসা থাকে। ভেতরে ঢোকার আগে, হলের দিকে সে আনমনে তাকালো। বিশ গজ অথবা এরকমই হবে, যেখানে তার দাদুর মৃতদেহটা এখনও স্পট-লাইটের নিচে পড়ে রয়েছে। যে সুতীব্র অনুশোচনা তাকে আঁকড়ে ধরেছে, সেটা খুবই শক্তিশালী আর হঠাৎ করেই এসেছে। গভীর দুঃখবোধের সাথে সাথে তার অপরাধবোধও হলো। লোকটা এই দশ বছরে তার কাছে অসংখ্যবার আসতে চেয়েছে। তারপরও সোফি ছিলো অনড়—তাঁর দেয়া চিঠি-পত্র আর প্যাকেটগুলো না খুলেই ড্রয়ারে রেখে দিতো। সাক্ষাৎ করার ব্যাপারে একদমই রাজি হতো না। তিনি আমার সাথে মিথ্যে বলেছেন। ক্রমাগতভাবে গোপন করে গেছেন। আমার কীইবা করার ছিলো? তাই সোফি তাঁর কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতো।

 

আজ তার দাদু মৃত। এখন সোফির সাথে তিনি কবর থেকে কথা বলছেন।

 

মোনালিসা।

 

সে বিশাল কাঠের দরজাটার কাছে পৌঁছে সেটা ধাক্কা দিলে খুলে গেলো। সোফি একটু থমকে দাঁড়ালো। বিশাল আয়তক্ষেত্র কক্ষটি তাকিয়ে দেখলো, এটাও নরম লাল আলোতে স্নাত হয়ে আছে। সল-দে এতা হলো জাদুঘরের অন্যতম বিরল কস-দ্য সেক্—একেবারে শেষ মাথায় আর গ্র্যান্ড গ্যালারির মাঝামাঝিতে অবস্থিত। এই দরজাটাই এখানে ঢোকার একমাত্র প্রবেশ পথ। এটার মুখোমুখি, দূরের দেয়ালটাতে, বত্তিচেল্লির পনেরো ফুটের একটি চিত্রকর্ম আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। এটার নিচে, কাঠের ফ্লোরটার মাঝখানে, একটা বিশাল আটকোনা পালঙ্ক সদৃশ্য বেঞ্চিটা দর্শকদের বিশ্রামের আকাঙ্খ মিটিয়ে থাকে, তাদের ক্লান্ত পা দুটোকে বিশ্রাম দেয়, সেই সাথে লুভরের মূল্যবান সম্পদসমূহ অবলোকন করার সুযোগও তৈরি করে।

 

ভেতরে ঢোকার আগেই সোফি জানতো, কিছু একটা ফেলে এসেছে। ব্ল্যাক লাইটটা। সে হলের দিকে তাকালো, সেখানে তার দাদু স্পট-লাইটের নিচে পড়ে আছেন, চারিদিকে ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি ভরা। যদি সেখানে তিনি কিছু লিখে থাকেন, তবে সেটা নিশ্চিতভাবেই ওয়াটারমার্ক স্টাইলাস দিয়ে লিখেছেন তিনি।

 

একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে সোফি দ্রুত সেই জায়গাটাতে চলে গেলো। তার দাদুর দিকে না তাকিয়েই সে পিটিএস যন্ত্রপাতিগুলোর দিকে নজর দিলো। একটা ছোট আলট্রাভায়োলেট পেন-লাইট খুঁজে পেলো সে। পেন-লাইটটা সোয়েটারের পকেটে ভরে সল দে এতা-এর খোলা দরজার দিকে চলে গেলো।

 

সোফি ঢুকতেই অপ্রত্যাশিত একটা শব্দ শুনতে পেলো, কারোর পায়ের আওয়াজ। সেটা তার দিকেই আসছে। এখানে অন্য কেউ আছে! লাল আলো থেকে আচমকাই একটা ভূতুরে অবয়ব আবির্ভূত হলো। সোফি লাফিয়ে পেছনে সরে গেলো।

 

এইতো তুমি! ল্যাংডন সোফির কাছে এসে চাপা কণ্ঠে বললো।

 

সোফির স্বস্তিটা ছিলো ক্ষণস্থায়ী। রবার্ট, আমি তোমাকে এখান থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিলাম! ফশে যদি—

 

তুমি কোথায় ছিলে?

 

আমি ব্ল্যাক লাইট আনতে গিয়েছিলাম, নিচু স্বরে বললো। জিনিসটা পকেট থেকে বের করে আনলো সে। যদি আমার দাদু আমার জন্যে কোন মেসেজ রেখে যান-–

 

সোফি, শোনো। ল্যাংডন নিঃশ্বাস নিতে নিতে সোফির নীল চোখের দিকে চোখ স্থির করে বললো, পি,এস অক্ষর দুটো…তোমার কাছে কি অন্য কোন অর্থ বহন করে? অন্য কোন মানে আর কি?।

 

তাদের কথাবার্তা প্রতিধ্বনিত হয়ে নিচের হলে চলে যেতে পারে এই ভয়ে সোফি তাকে টেনে সল দে তা-এর ভেতরে নিয়ে এসে বিশাল দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করে দিলো। আমি তোমাকে বলেছি তো, আদ্যক্ষরটির অর্থ প্রিন্সেস সোফি।

 

আমি জানি, কিন্তু তুমি কি এই অক্ষরগুলো অন্য কিছুতে দেখেছো? তোমার দাদু কি পি,এস অক্ষর দুটো অন্য কিছুতে ব্যবহার করেছিলেন, অন্য কোনভাবে? মনোগ্রাম হিসেবে, অথবা ব্যক্তিগত কোন জিনিসে?

 

প্রশ্নটা তাকে ভাবিয়ে তুললো। রবার্ট কিভাবে এটা জানতে পারলোর সোফি পিএস অক্ষর দুটো অবশ্যই আরো একবার দেখেছিলো। এক ধরনের মনোগ্রাম হিসেবে। সেটা ছিলো তার নবম জন্ম দিনের ঠিক আগে। সে গোপনে তার পুরো ঘরটা তল্লাসী চালিয়েছিলো জন্ম দিনের লুকানো উপহারের খোঁজে। এরপর থেকে, সোফি তার কাছ থেকে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখাটা সহ্য করতে পারতো না। এই বছর আমার দাদ আমার জন্যে কি উপহার এনেছেন? সে কাপবোর্ড ও ড্রয়ার খুঁজে দেখে ছিলো। আমি যা চাচ্ছি সেই পুতুলটা কি তিনি এনেছেন? কোথায় সেটা রেখেছেন?

 

সারা বাড়িতে কিছু না পেয়ে সোফি তার দাদুর শোবার ঘরে তল্লাশী চালাবার সাহসও অর্জন করেছিলো। ঘরটা তার খুব কাছেই ছিলো, কিন্তু দাদু নিচের ঘরের সোফায় শুয়ে ছিলেন।

 

আমি খুব দ্রুতই কাজটা করে নেবো!

 

পায়ের পাতা উঁচু করে কাঠের ফ্লোরটা পেরিয়ে চুপি চুপি দাদুর ক্লোসেটের কাপড় সরিয়ে দেখেছিলো সে। কিছুই ছিলো না। তারপর, বিছানার নিচে দেখে ছিলো। তাঁর দাদুর ব্যুরোর দিকে এগিয়ে একের পর এক ড্রয়ার খুলে সেগুলো তন্নতন্ন করে দেখে ছিলো। আমার জন্যে কিছু একটা আছেই! নিচের ড্রয়ারটাতেও সে কোন পুতুলের চিহ্ন খুঁজে পায়নি। রেগেমেগে শেষ ড্রয়ারটা খুলে সে দেখতে পেয়ে ছিলো কতগুলো কালো রঙের পোশাক, যা কখনও তার দাদুকে পরতে দেখেনি। ড্রয়ারটা বন্ধ করার সময় ড্রয়ারের পেছনে একটা কিছু চমকাতে দেখে ছিলো সে। দেখতে ছিলো পকেট ঘড়ির চেইনের মতো। কিন্তু সে জানতো তিনি ওসব পরেন না। জিনিসটা কি সেটা বুঝতে পেরে তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়ে ছিলো।

 

একটা নেকলেস!

 

সোফি খুব সযত্নে চেইনটা ড্রয়ার থেকে বের করে এনে ছিলো। তার বিস্ময় বেড়ে গেলো যখন সে দেখতে পেলো চেইনটার শেষ মাথায় একটা সোনার চাবি। ভারি এবং চৰ্চকে। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে ওটা হাতে তুলে নিলো। সে জীবনে কখনও এরকম চাবি দেখেনি। বেশির ভাগ চাবিই সমতল, উঁচু-নিচু দাঁত বিশিষ্ট। কি এটার কলামটা ত্রিভূজাকৃতির আর সেটার উপর অনেকগুলো ছোট-ছোট দাগ। এটার বড় সড় সোনার মাথাটি ক্রুশ আকৃতির। কিন্তু সেগুলো সাধারণ ক্রুশের মতো নয়। সবগুলো বাহুই সমান, অনেকটা যোগ চিহ্নের মতো। ক্রুশটার মাঝখানে একটা অদ্ভুত প্রতীকদুটো অক্ষর এমনভাবে একটার সাথে আরেকটা লেগে আছে যেনো কোনো ফুলের ছবি।

 

পি এস, সোফি ফিসৃফিস্ করে বলেছিলো। এটা কি হতে পারে?

 

সোফি? তার দাদু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন। চমকে গিয়ে চাবিটা হাত থেকে ফেলে দিয়েছিলো সে। সোফি চাবিটার দিকেই চেয়ে ছিলো, তার দাদুর দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছিলো। আমি…আমার জন্মদিনের উপহার খুঁজছিলাম, সে বলেছিলো। সে জানতো, তাঁর বিশ্বাসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ফেলেছে সে।

 

তার দাদুর নিরবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটা তার কাছে অনন্ত কালের মতো মনে হচ্ছিলো। শেষে তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ছিলেন। চাবিটা তুলে নাও, সোফি।

 

সোফি চাবিটা তুলে নিয়ে ছিলো।

 

তার দাদু সামনে এগিয়ে এসে বলেছিলেন, সোফি, অন্য লোকদের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার-স্যাপারগুলো তোমার সম্মান করার দরকার রয়েছে। খুব ধীরে তিনি হাট গেঁড়ে মাটি থেকে চাবিটা তুলে নিয়ে ছিলেন। এই চাবিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি তুমি এটা হারিয়ে ফেলো … তার দাদুর শান্ত কণ্ঠটা সোফিকে আরো বেশি ঘাবড়ে দিয়ে ছিলো।

 

আমি দুঃখিত গ্র্যঁ-পেয়া। সত্যি আমি দুঃখিত। সে একটু থেমে বলে ছিলো, আমি ভেবেছিলাম এটা আমার জন্মদিনের একটা নেকলেস।

 

তিনি তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে ছিলেন। আমি এটা আবারো বলছি, সোফি, কারণ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য লোকের ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলোকে তোমার সম্মান করা শিখতে হবে।

 

হ্যাঁ, গ্র্যঁ পেয়া।

 

এ ব্যাপারে আমরা পরে কথা বলবো। এখন, বাগানে আগাছা সাফ করতে হবে।

 

সোফি দ্রুত ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে গিয়েছিলো গৃহস্থালীর কাজ করার জন্যে।

 

পরের দিন সকালে, সোফি তার দাদুর কাছ থেকে জন্ম দিনের কোন উপহার পায়নি। যা সে করেছে, তারপর সে এমন কিছু প্রত্যাশাও করেনি। কিন্তু তিনি সারাটা দিন তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছাও জানাননি। রাতে, দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে সোফি শুতে গিয়ে ছিলো। বিছানার বালিশের নিচে একটা কার্ড খুঁজে পেয়ে ছিলো সে। কার্ডে একটা সহজ সরল ধাঁধা ছিলো। ধাঁধাটা সমাধান করার আগেই সে মুচকি হেসে ছিলো। এটা কি, আমি তা জানি! তার দাদু গত ক্রিসমাসের সকালেও এটা করেছিলেন। গুপ্তধন খোজা!

 

সোৎসাহে সে ধাঁধাটা সমাধান করার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়েলো। সমাধানটা তাকে বাড়ির আরেকটা জায়গার ইঙ্গিত দিলো, সেখানে সে অন্য আরেকটা ধাঁধার কার্ড খুঁজে পেলোলা। এটাও সোফি সমাধান করে ফেলে আরেকটা কার্ডের পেছনে ছুটলো। এভাবে। সে ঘরের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলো। একটা ক্লু থেকে আরেকটা কুতে। সোফি সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে এসে থমকে দাঁড়ালো। ঘরের মাঝখানে একটা লাল রঙের বাইসাইকেল রাখা। সাইকেলটার হাতলে একটা ফিতে বাধা। সোফি আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিলো।

 

আমি জানি তুমি পুতুল চেয়েছিলে, তার দাদু বলে ছিলেন। এক কোণে দাঁড়িয়ে হাসছিলেন তিনি। আমার মনে হলো, এটা তার চেয়েও ভালো কিছু হবে।

 

পরের দিন, তাঁর দাদু তাকে সাইকেল চালানো শিখালেন। তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাহায্য করলেন। যখন লনে সাইকেল চালাতে গিয়ে সোফি ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে দাদুসহ ঘাসের উপর চিৎপটাং হয়ে পড়ে গিয়েছিলো তখন তারা দুজনেই খুব হেসেছিলো।

 

গ্র্যঁ পেয়া, সোফি এই বলে তার দাদুকে জড়িয়ে ধরেছিলো। ঐ ঘটনার জন্য আমি সত্যি দুঃখিত।

 

আমি জানি, সুইটি। তোমাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। তোমার ওপর আমি বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারি না। দাদু আর নাতনী সব সময়ই একে অন্যকে মাফ করে দেয়।

 

সোফি জানতো তার জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না, কিন্তু জিজ্ঞেস না করে থাকতেই পারলো না সে। এটা দিয়ে কি ভোলা হয়? এরকম চাবি আমি কখন দেখিনি। ওটা দেখতে খুব সুন্দর ছিলো।

 

তার দাদু কিছুক্ষণ নিরব ছিলেন; আর সোফি ভেবে পাচ্ছিলো না তিনি কী বলবেন। দাদু কখনও মিথ্যা বলেন না।

 

এটা দিয়ে একটা বাক্স খোলা হয়, অবশেষে তিনি বলে ছিলেন। সেখানে আমি অনেক গোপন কিছু লুকিয়ে রেখেছি।

 

সোফি কপট অভিমানের সুরে বলে ছিলো, আমি গোপনীয়তাকে ঘৃণা করি!

 

সেটা আমি জানি, কিন্তু এসব গোপনীয়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একদিন তুমি আমার মতোই এটা সংরক্ষণ করবে।

 

আমি চাবির ওপরের অক্ষরগুলো দেখেছি, একটা ফুলও।

 

হ্যাঁ, আমার প্রিয় ফুল। এটাকে ফ্লার-দ্য-লিস বলা হয়। আমাদের বাগানে এগুলো আছে। সাদা রঙেরগুলো। ইংরেজিতে এ ধরনের ফুলকে আমরা বলি লিলি।

 

এগুলো আমি চিনি। এগুলো আমার প্রিয় ফুল!

 

তাহলে আমি তোমার সাথে একটা চুক্তি করি। তার দাদুর চোখ দুটো কপালে উঠে গিয়ে ছিলো, যেমনটি তিনি করে থাকেন তাকে একটা চ্যালেঞ্জ দেয়ার সময়। তুমি যদি আমার চাবিটার কথা গোপন রাখো, এবং এ ব্যাপারে কারো সাথে, এমনকি আমার সাথেও আর কখনও আলোচনা না করো, তবে একদিন তোমাকে আমি এটা দিয়ে দেবো।

 

সোফি তার নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলো না।

 

সত্যি?

 

আমি প্রতীজ্ঞা করছি। সময় এলে, চাবিটা তোমার হয়ে যাবে। এটাতে তোমার নাম লেখা আছে।

 

সোফি অবিশ্বাসে তাকালো। না, তাতে নেই। এটাতে পি এস লেখা আছে। আমার নাম তো পি এস নয়!

 

তার দাদু কণ্ঠটা নিচে নামিয়ে নিয়ে ছিলেন, যেনো অন্য কেউ কথাটা শুনতে না পায়। ঠিক আছে, সোফি, যদি তুমি জানতেই চাও তো শোনো, পিএস হলো একটা কোড। এটা তোমার গোপন নামেরই আদ্যক্ষর।

 

তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গিয়ে ছিলো। আমার গোপন নাম আছে?

 

অবশ্যই। নাতনীদের সবসময়ই একটা গোপন নাম থাকে, যা তাদের দাদুরাই কেবল জানে।

 

পি এস?

 

তিনি সোফিকে আলতো করে টোকা দিলেন। প্রিন্সেস সোফি।

 

সে মাথা দোলালো। আমি তো প্রিন্সেস নই!

 

তিনি আশ্বস্ত করে বলেছিলেন। আমার কাছে তুমি তা-ই।

 

সেদিন থেকে তারা আর চাবিটা নিয়ে কোন কথা বলেনি। আর সেও হয়ে উঠলো প্রিন্সেস সোফি।

 

 

 

সলদে এতাত্-এর ভেতরে সোফি নিরবে দাঁড়িয়ে হারানোর সুতীব্র বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো।

 

আদ্যক্ষরটা, তার চোখের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ল্যাংডন ফিসফিস্ করে বললো। তুমি কি ওগুলো দেখেছো?

 

সোফির মনে হলো, তার দাদুর কণ্ঠস্বরটা জাদুঘরের করিডোর থেকে ভেসে আসছে। এই চাবিটা সম্পর্কে কখনও কিছু বলবে না, সোফি। আমার সাথে কিংবা অন্য কারোর সাথে। তার মনে পড়ে গেলো, পিএস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো। তার দাদু ল্যাংডনের কাছে সাহায্য চেয়েছেন। সোফি মাথা নাড়লো। তা, আমি পিএস অক্ষরটা একবার দেখেছি। তখন আমি খুব ছোট ছিলাম।

 

কোথায়?

 

সোফি দ্বিধাগ্রস্ত হলো। তাঁর কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এমন কোন কিছুতে।

 

ল্যাংডন তার চোখে চোখ রাখলো।

 

সোফি, এটা খুবই জরুরি। তুমি কি আমাকে বলতে পারো, আদ্যক্ষরটা একটা প্রতীকে ছিলো কিনা? একটা ফ্লার-দ্য লিস-এ?

 

সোফি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। কিন্তু…তুমি সেটা কীভাবে জানতে পারলে।

 

ল্যাংডন নিঃশ্বাস ছেড়ে নিচু কণ্ঠে বললো, আমি খুবই নিশ্চিত যে, তোমার দাদু একটি গোপন সংগঠনের সদস্য ছিলেন। খুবই পুরাতন, একটা গোপন ভ্রাতৃসংঘ।

 

সোফির মনে হলো তার পেটের ভেতরে কোন কিছু গিট দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। সেও এ ব্যাপারে খুব নিশ্চিত ছিলো। বিগত দশ বছর ধরে সে ঐ দুঃসহ ঘটনাটা ভুলতে চেষ্টা করেছে। সে অচিন্তনীয় কিছু একটা দেখে ফেলেছিলো। ক্ষমার অযোগ্য।

 

ফ্লার-দ্য-লিস, ল্যাংডন বললো, পি এস অক্ষর সংবলিত, এটা ভ্রাতৃসংঘের নিজস্ব প্রতীক। তাদের লোগো।

 

তুমি এটা কীভাবে জানো? সোফি মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো যেনো ল্যাংডন আবার না বলে বসে যে, সে নিজেও ঐ সংগঠনের সদস্য।

 

আমি এই দলটির সম্পর্কে লিখেছি, সে বললো, তার কণ্ঠ উত্তেজনায় কাঁপছে। গোপন সংগঠনের প্রতীক নিয়ে গবেষণা করাই আমার বিশেষত্ব। তারা নিজেদেরকে ডাকে প্রায়োরি দ্য সাইওন বলে অর্থাৎ প্রায়োরি অব সাইওন। তারা ফ্রান্স ভিত্তিক হলেও, সারা ইউরোপ থেকে শক্তিশালী সদস্য আকর্ষিত করে থাকে। সত্যি বলতে কী, তারা এই পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন গোপন সংগঠন।

 

সোফি তাদের ব্যাপারে কখনও কিছু শোনেনি।

 

ল্যাংডন এবার ক্রমাগতভাবে এ ব্যাপারে বলতে শুরু করলো।

 

প্রায়োরি অব সাইন ইতিহাসের অনেক বিখ্যাত সংস্কৃত ব্যক্তিত্বকে অর্ন্তভূক্ত করেছিলো : বত্তিচেল্লি, স্যার আইজাক নিউটন, ভিক্টর হুগোর মতো মানুষদেরকে। সে একটু থামলো। তার কণ্ঠটা এখন শিক্ষকের মতো শোনাচ্ছে। এবং লিওনার্দো দা ভিঞ্চি।

 

সোফি তার দিকে চেয়ে রইলো। দা ভিঞ্চি গোপন সংগঠনে ছিলেন?

 

দা ভিঞ্চি প্রায়োরিতে ১৫১০ থেকে ১৫১৯ সাল পর্যন্ত গ্র্যান্ড মাস্টার হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এতে তোমার দাদুর লিওনার্দো প্রীতি সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে। দুজনেই ঐতিহাসিক একটা দলিলে চুক্তিবদ্ধ ছিলেন। আর এটা তাদের দুজনেরই দেবীদের আইকননালজি, প্যাগান মতবাদ, নারীত্ব এবং চার্চবিরোধী কৌতূহলের সাথে খাপ খেয়ে যায়। পবিত্র নারী সম্পর্কে প্রায়োরিদের কাছে যথেষ্ট দলিল-দস্তাবেজ রয়েছে।

 

তুমি বলছো এই দলটি প্যাগান দেবীদের পূজক?

 

প্যাগান দেবীদের পূজকের চেয়েও বেশি কিছু। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, তারা একটি প্রাচীন সিক্রেট অর্থাৎ গুপ্ত ব্যাপারের অভিবাবক হিসেবেই বেশি পরিচিত। এটা এমন একটা জিনিস, যা তাদেরকে সীমাহীন শক্তিশালী করে তুলেছিলো।

 

ল্যাংডনের কথাবার্তা সোফির কাছে অবিশ্বাস্য শোনালো। গোপন প্যাগান পূজক। এক সময় লিওনার্দো দা ভিঞ্চি তার প্রধান ছিলেন? এস কথা শুনতে একদম অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে। তারপরও, এসব বাতিল করে দিলেও, তার মন ফিরে গেলো দশ বছর আগে রাতে, সে ভুলক্রমে তার দাদুকে দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছিলো। এমন কিছু দেখে ফেলেছিলো সে যা কখনও মেনে নিতে পারেনি। এটাকে কি ব্যাখ্যা করা যায়–?

 

প্রায়োরিদের জীবন্ত সদস্যদের পরিচিতি খুবই গোপনীয় একটি ব্যাপার, ল্যাংডন বললো, কিন্তু তুমি ছোটবেলায় যে পিএস এবং ফ্লার-দ্য-লিস দেখেছিলে, সেটাই প্রমাণ করে, এটা কেবল প্রায়োরিদের সাথেই সংশ্লিষ্ট।

 

সোফি এখন বুঝতে পারলো যে, ল্যাংডন তার দাদু সম্পর্কে তার চেয়েও অনেক বেশি জানে। এই আমেরিকানটার অবশ্যই অনেক কিছু আছে যা তার সাথে ভাগ করা উচিত। কিন্তু এটা সেই জায়গা নয়। আমি তোমাকে তাদের হাতে ধরা পড়তে দিতে পারি না। রবাট, আমাদের অনেক কিছু নিয়েই কথা বলতে হবে। তোমাকে যেতে হবে!

 

ল্যাংডন কেবলমাত্র সোফির বিড়বিড় করাটাই শুনতে পেলো। সে কোথাও যাচ্ছে। অন্য আরেকটা জায়গায় সে হারিয়ে গেছে এখন। এমন এক জায়গায় যেখানে প্রাচীন গুপ্ত গোলাপটি উদয় হয়েছে। এমন এক জায়গায়, যেখানে বিস্মৃত ইতিহাস অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে আসছে, ধীরে ধীরে।

 

ধীরে, যেনো পানির নিচে নড়ছে; ল্যাংডন তার মাথাটা ঘুরিয়ে লাল আলোর ঘোলাটে পরিবেশে থাকা মোনালিসার দিকে তাকালো।

 

ফ্লার-দ্য-লিস…দ্য ফ্লাওয়ার অব লিসা…মোনালিসা।

 

একটা আরেকটার সাথে সংশ্লিষ্ট। একটা নিঃশব্দ সিম্ফোনি প্রায়োরি অব সাইন আর লিওনার্দো দা ভিঞ্চির গহীন গোপনীয়তাকে প্রতিধ্বনিত করতে লাগলো।

 

 

 

কয়েক মাইল দূরে, লে ইনভ্যালিদ পেরিয়ে, একটা নদীর তীরে, হতভম্ব এক ট্রাক ড্রাইভার অস্ত্রমুখে দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ জুডিশিয়ারের ক্যাপ্টেন ট্রাকের পেছন থেকে একটা সাবানের টুকরো পেয়ে রাগে ফুঁসে ওঠে সিন নদীতে সাবানটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

 

 

 

২৪.

 

সাইলাস সেন্ট-সালপিচের অবিলিস্কটার দিকে তাকালো, বিশাল আর দীর্ঘ মার্বেলের গাঁথুনীটা দেখে হতাশ হলো। তার মাংসপেশী উত্তেজনায় আড়ষ্ট হয়ে আছে। সে চার্চের চারপাশটা আবার তাকিয়ে দেখলো নিশ্চিত হবার জন্য যে, সে একাই আছে এখানে। তারপর হাঁটু গেঁড়ে ওটার নিচে বসে পড়লো, শ্রদ্ধা বোধ থেকে নয়, প্রয়োজনে।

 

কি-স্টোনটা রোজ লাইনর নিচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। সালপিচের অবিলিস্কটার গাঁথুনীর নিচে।

 

ভ্রাতৃসংঘের সবাই একই কথা বলেছিলো।

 

হাটু গেঁড়েই সাইলাস পাথরের জমিনে হাত দিয়ে খুঁজে ফিরলো আগা টাইলসের কোন ফাঁটল অথবা দাগ আছে কি না, যাতে সে বুঝতে পারে কোন টাইলসটা সরানো যাবে। মুষ্টিবদ্ধ হাতটা আলতো করে জমিনে আঘাত করতে লাগলো। সবগুলো টাইলসই পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো সে। শেষ পর্যন্ত, একটা টাইলস থেকে অদ্ভুত প্রতিধ্বনি শোনা গেলো।

 

সাইলাসের ঠোঁটে হাসি দেখা গেলো, আর সেই সাথে বেলকনি থেকে সিস্টার সানভৃনের দীর্ঘ নিঃশ্বাসটাও বাতাসে ভেসে এলো। তাঁর গভীর অন্ধকার ভীতিটা এইমাত্র নিশ্চিত হলো। এই অতিথি সেরকম কেউ নয়, যে রকমটা তিনি মনে করেছিলেন। ওপাস দাইর রহস্যময় সন্ন্যাসীটা সেন্ট সালপিচে অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে।

 

একটা গোপন উদ্দেশ্য।

 

গোপনীয় কিছুর তুমিই একমাত্র ব্যক্তি নও, তিনি ভাবলেন। সিস্টার সানড়ন এই চার্চের একজন তত্ত্বাবধায়কের চেয়েও বেশি কিছু। তিনি একজন প্রহরীও বটে। আর আজ রাতে, সেই পুরনো চাকাটা আবার ঘুরতে শুরু করেছে। এই আগষুকের অবিলিস্কের গাঁথুনীর নিচে এসে কিছু খোঁজাটা ভ্রাতৃসংঘের একটা সংকেত।

 

এটা একটা নিরব যন্ত্রণার ডাক।

 

 

 

২৫.

 

প্যারিসের ইউএস এ্যামবাসি শাম্প এলিসির দক্ষিণের গ্যাবৃয়েল এভিনুর একটা ছোটখাটো কমপ্লেক্সে অবস্থিত। এই তিন একরের জায়গাটিকে যুক্তরাষ্ট্রের মাটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার অর্থ, যে এখানে এসে পড়বে, সে-ই যুক্তরাষ্ট্রের আইন আর আশ্রয়ের অনুরূপ, একই রকম অধিকার ভোগ করবে।

 

এ্যামবাসির রাত্রিকালীন অপারেটর টাইম ম্যাগাজিনের আন্তর্জাতিক সংস্করণটা হাতে নিয়ে পড়ছিলো। ফোনটা বেজে ওঠায় সে বিরক্ত হলো।

 

ইউএস এ্যামবাসি, মেয়েটা বললো।

 

শুভ সন্ধ্যা। ফোনের অপর পাশ থেকে ফরাসি টানে ইংরেজিতে বললো। আমার একটু সাহায্যের দরকার। লোকটার কথাবার্তায় ভদ্রতা আর মার্জিতভাব থাকা সত্ত্বেও, তার কণ্ঠটা কট্রটে আর খুব বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ শশানাচ্ছিলো। আমাকে বলা হয়েছিলো যে, আপনাদের কাছে আমার একটা মেসেজ রয়েছে, অটোমেটেড সিস্টেমে। নাম ল্যাংডন। দুঃখের বিষয়, আমি আমার তিন ডিজিটের কোডটা ভুলে গেছি। আপনি যদি সাহায্য করতে পারেন, তবে আমি খুবই কৃতজ্ঞ থাকবো।

 

অপারেটর একটু চুপ মেরে গেলো, দ্বিধাগ্রস্ত মনে হলো। আমি দুঃখিত স্যার, আপনার মেসেজটা অনেক দিন আগের হয়ে থাকবে। এই সিস্টেমটা দুবছর আগে নিরাপত্তাজনিত কারণে বদলে ফেলা হয়েছে। এখন সবগুলো একসেস কোড হলো পাঁচ ডিজিটের। আপনাকে কে বলেছে, আমাদের কাছে আপনার মেসেজ রয়েছে?

 

আপনাদের কাছে কোন অটোমেটেড ফোন সিস্টেম নেই?

 

না, স্যার। আপনার কোন মেসেজ আমাদের সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে থাকলে সেটা হাতে লেখায় হতে হবে। আপনার নামটা যেনো কী বললেন?

 

ইতিমধ্যেই ওপাশের লোকটা ফোন রেখে দিলো।

 

সিন নদীর তীরে পায়চারি করতে থাকা বেজু ফশের মনে হলো, সে বধির হয়ে গেছে। সে একেবারেই নিশ্চিত, ল্যাংডনকে সে লোকাল নাম্বারে ডায়াল করতে দেখেছে তিন সংখ্যার কোডটা দিয়ে। তারপর রেকর্ডিং করা মেসেজও সে শুনেছে। কিন্তু ল্যাংডন যদি এ্যামবাসিতেই ফোন না করে থাকে, তবে সে করলো কার কাছে? সাথে সাথেই তার চোখ গেলো সেলুলার ফোনের দিকে। ফশে বুঝতে পারলো উত্তরটা তার হাতের মুঠোয়ই আছে। ফোনটা করার জন্য ল্যাংডন আমার ফোনই ব্যবহার করেছিলো।

 

ফোনের মেনু বাটনটা চেপে সাম্প্রতিক করা ফোন কলের নাম্বারগুলো চেক্ করে ল্যাংডনের করা নাম্বারটা খুঁজে পেলো সে।

 

প্যারিসের একটা নাম্বার, তারপর সেটা তিন সংখ্যার কোড নাম্বার ৪৫৪-তে ডায়াল করা।

 

সেই নাম্বারটা পুণরায় ডায়াল করে ফশে লাইনটা পাবার জন্যে অপেক্ষা করলো।

 

অবশেষে, একটা নারী কন্ঠের জবাব এলো। বজুঁখ, ভু ইতে ব্যুঁ শেজ সোফি নেভু, রেকর্ড করা কণ্ঠটা বললো। জো সুই এবসেস্তে পুর লো মেমোয়া, মেই…

 

৪…৫…৪, সংখ্যাটা ডায়াল করার সময় ফশের রক্ত বলক দিয়ে উঠলো।

 

 

 

২৬.

 

সুবিশাল খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও, মোনালিসা মাত্র একত্রিশ ইঞ্চি লম্বা আর একুশ ইঞ্চি চওড়া—এমনকি লুভরের গিফট শপে বিক্রি হওয়া পোস্টারের চেয়েও এটা আকারে ছোট। সল দে এতা-এর উত্তর-পশ্চিম দেয়ালে, দুই ইঞ্চি পুরু বুলেট প্রুফ গ্লাসের পেছনে এটা টাঙানো রয়েছে। এটা আঁকা হয়েছে পপুলার কাঠের ওপর। তার ধোঁয়াটে, কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশটা লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ফুমাতো স্টাইলের অনন্য সাধারণ কীর্তির স্বাক্ষর বহন করছে। এই স্টাইলে ফর্মগুলো একটার উপর আরেকটা ঘোয়াটে হয়ে আর্বিভূত হয়। লুভরে স্থান পাওয়ার পর থেকে মোনালিসা অথবা লা জকোন্দো, যেমনটি তাকে ফ্রান্সে ডাকা হয় দু দুবার চুরি হয়েছিলো। সাম্প্রতিক কালেরটা হয়েছিলো ১৯১১ সালে, যখন সে লুভরের সল ইমপেনেট্রেবল থেকে উধাও হয়েছিলো। প্যারিসবাসী রাস্তা-ঘাটে কান্নাকাটি করে, সংবাদপত্রে কলাম লিখে, চোরের কাছে ছবিটা ফিরে পাবার আবেদন জানিয়েছিলো। দুবছর বাদে, মোনালিসা ফ্লোরেলের একটা হোটেল কক্ষের ট্রাঙ্কের গোপন কুঠুরি থেকে উদ্ঘাটিত হয়েছিলো।

 

ল্যাংডন, এখন সোফিকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো যে, তার চলে যাবার কোন ইচ্ছেই নেই। সোফির সাথেই সে সল দে এতা-এ ঢুকলো। সোফি ব্ল্যাক লাইটটা যখন জ্বালালো তখনও মোনালিসা বিশ গজ দূরে। হালকা নীল ক্রিসেন্ট আলোটা ফ্লোরের উপর গিয়ে পড়লো। সোফি আলোটা ফ্লোরে এমনভাবে নিক্ষেপ করলো যেনো ফ্লোরটা ঝাড়া মোছা করছে। লুমিনিসেন্ট কালি আছে কি না খুঁজে দেখলো সে।

 

তার পাশে হাটতে হাটতে ল্যাংডনের মনে হলো, বিখ্যাত চিত্রকর্মগুলো মুখোমুখি দেখার সুযোগটা আবারো আসলো। তার বাম দিকে, ঘরের মাঝখানে কাঠের ফ্লোরে রাখা আটকোনা বেঞ্চিটাকে অন্ধকারে মনে হচ্ছিলো একটা ফাঁকা কাঠের সমুদ্রে ভেসে থাকা দ্বীপ।

 

ল্যাংডন এবার দেয়ালের কালো গ্লাসের প্যানেলটা দেখতে পেলো। সে জানতো, এটার পেছনেই, নিজের ঘরে বন্দী হয়ে আছে বিশ্বের সবচাইতে খ্যাতিমান চিত্রকর্মটি।

 

ল্যাংডন জানে, বিশ্বের সবচাইতে বিখ্যাত চিত্রকর্ম হিসেবে মোনালিসার যে অবস্থান তার সাথে রহস্যময় হাসির কোন সম্পর্ক নেই। অনেক চিত্রসমালোচক আর ষড়যন্ত্র খুঁজে বেড়ানো ভক্তের রহস্যময় ব্যাখ্যার জন্যেও নয়। খুব সহজেই বলা যায়, মোনালিসা বিখ্যাত, কারণ লিওনার্দো দা ভিঞ্চি দাবি করেছিলেন যে, এটা তার সবচাইতে সেরা কাজ। তিনি যেখানেই যেতেন, ছবিটা সঙ্গে নিয়ে নিতেন। যদি জিজ্ঞেস করা হয় কেন, জবাবটা হলো, তিনি এতে তার নারী সৌন্দর্যের সূক্ষ্মপ্রকাশ ঘটাতে পেরেছিলেন।

 

তারপরও, চিত্রকলার ইতিহাসবিদদের অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, দা ভিঞ্চি মোনালিসাকে শ্রদ্ধা করেছেন তার শৈল্পিক রহস্যের জন্য নয়। সত্যি বলতে কী, ছবিটা বিস্ময়করভাবেই ফুমাতে পোট্রেটের একটি সাধারণ কাজ। এই কাজের জন্য দা। ভিঞ্চির প্রশংসা, অনেকেই দাবি করে, এর অন্তর্নিহিত কিছুর জন্যেই : ছবিটার পরতে পরতে লুকায়িত কোন মেসেজের জন্য। মোনালিসা, সত্যি বলতে কী, পৃথিবীর সবচাইতে নথিবদ্ধ বিখ্যাত অর্ন্তনিহিত একটি জোক। সাম্প্রতিক সময়ে এই ছবিটির দ্ব্যর্থবোধকতা আর ঐন্দ্রজালিক ব্যাপারটি উন্মোচিত হলেও, অবিশ্বাস্যভাবেই, এটা এখনও তার হাসির জন্যেই বিশাল রহস্য হয়ে আছে।

 

কোন রহস্যই নেই, ল্যাংডন ভাবলো। সে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো সোফির পাশাপাশি। কোন রহস্যই নেই।

 

অতিসম্প্রতি, ল্যাংডন মোনালিসার রহস্যময়তা আর গুপ্তব্যাপারটি নিয়ে একদল অদ্ভুত লোকের চিন্তাভাবনার সাথে পরিচিত হয়েছিলো—এসেক্সের কাউন্টি জেলের একদল কয়েদী। ল্যাংডনের এই জেল সেমিনারটা ছিলো হারভার্ডের জেলখানায় শিক্ষা দীক্ষার প্রকল্পের একটি অংশ বিশেষ অপরাধীদের জন্য সংস্কৃতি, ল্যাংডনের সহকর্মীরা এটাকে এই নামেই উল্লেখ করেছিলো।

 

জেলখানার লাইব্রেরির অন্ধকার একটি কক্ষে, মাথার ওপর একটা প্রজেক্টর নিয়ে ল্যাংডন কয়েদীদের সাথে মোনালিসার রহস্য আর গুপ্ত ব্যাপারটা আলোচনা করেছিলো। ওখানে সে দেখতে পেয়েছিলো, লোকগুলো বিস্ময়করভাবেই খুব। মনোযোগী রাফ এন্ড টাফ, কিন্তু প্রখর বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। আপনারা হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, প্রজেক্টর থেকে মোনালিসার ছবিটা লাইব্রেরির দেয়ালে প্রক্ষেপন করে সেখানে হেটে গিয়ে ল্যাংডন তাদের বলেছিলো, তার পেছনের দৃশ্যপটটা অসমান। ল্যাংডন তাদের দিকে ঘুরে বললো, দা ভিঞ্চি বাম দিকের আনুভূমিক রেখাটা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই ডান দিকের চেয়ে একটু নিচু করে এঁকেছেন।

 

দা ভিঞ্চি এটাকে টাল করে ফেলেছেন? কেউ একজন বলেছিলো।

 

ল্যাংডন কথাটাতে খুব মজা পেয়ে ছিলো। না, দা ভিঞ্চি এরকমটা হরহামেশা করতেন না। আসলে এটা দা ভিঞ্চির একটা ছোটখাটো চালাকি। বাম দিকের নৈসর্গিক দৃশ্যটা একটু নিচু করে দেয়ায়, মোনালিসাকে ডান দিকের তুলনায়, বাম দিক থেকে একটু বড় দেখা যায়। এটা দা ভিঞ্চির একটা ছোট্ট অর্ন্তনিহিত জোক। ঐতিহাসিকভাবে নারী আর পুরুষের অবস্থানগত হিসাবটা হলো বাম দিক নারীর। ডান দিক পুরুষের। যেহেতু দা ভিঞ্চি নারীবাদের একজন বড় ভক্ত ছিলেন, তাই তিনি মোনালিসাকে এমনভাবে একেছেন যেনো, ডান দিকের তুলনায় বাম দিক থেকে তাকে বেশি অভিজাত আর বড় দেখায়।

 

আমি শুনেছি, তিনি একজন সমকামী ছিলেন, ছোটখাটো ছাগলা দাড়িওয়ালা এক লোক বললো।

 

ল্যাংডন চোখ কুচকে বললো, ঐতিহাসিকরা সাধারণত ব্যাপারটাকে এভাবে দেখেন না, কিন্তু এটা সত্যি, দা ভিঞ্চি একজন সমকামী ছিলেন।

 

একজন্যেই কি তিনি এইসব নারী সংক্রান্ত বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন?

 

আসলে, দা ভিঞ্চি ছিলেন নারী এবং পুরুষের মধ্যেকার ভারসাম্যপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মধ্যে যততক্ষণ না, নারীপুরুষ উভয়ের উপাদান থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার আত্মা আলোকিত হবে না।

 

তার মানে, বলতে চাচ্ছেন, পুরুষের মধ্যে মেয়েলীপনা থাকতে হবে? কেউ একজন বললো।

 

কথাটা শুনে ঘরের মধ্যে একটা হাসির রোল পড়ে গেলো। ল্যাংডন ভাবলো Hermaphrodite শব্দটির শাব্দিক ব্যাখ্যাটা আলোচন করবে, যা Hermes আর Aphrodite শব্দের সম্মিলনে তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার কাছে মনে হলো, এটা হয়তো এই হৈহল্লার মধ্যে হারিয়েই যাবে।

 

এই, মি. ল্যাংফোর্ড, শক্তপেশীর এক লোক বললো, এটা কি সত্য যে, মমানালিসা দা ভিঞ্চির নিজের ছবিরই অনুকরণ? আমি শুনেছি, এটা সত্যি।

 

এটা খুবই সম্ভব, ল্যাংডন বললো, দা ভিঞ্চি একজ খেয়ালি মানুষ ছিলেন। কম্পিউটারের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোনালিসা এবং দা ভিঞ্চির আত্ম-প্রতিকৃতির সাথে অদ্ভুত রকমের সাদৃশ্য রয়েছে। দা ভিঞ্চি যা-ই করে থাকুক, ল্যাংডন বললো, তার মোনালিসা না পুরুষ, না নারী। এটা আসলে দুটোরই মিলিত রূপ।

 

আপনি নিশ্চিত, এটা হরাভার্ডের সেই হাজামজা জিনিস না, যারা বলে, এটা হলো এক কুৎসিত ছুক্‌রি।

 

ল্যাংডন হেসে ফেললো। আপনি হয়তো ঠিক বলেছেন। কিন্তু দা ভিঞ্চি আসলে যথেষ্ট কু রেখে গেছেন যে, ছবিটা উভয়লিঙ্গের। এখানে কেউ কি মিশরীয় দেবী আমন এর নাম শুনেছেন?

 

হ্যাঁ-হ্যাঁ। বিশালাকৃতির লোকটা বললো। পুরুষ উর্বরতার দেবতা!

 

ল্যাংডন দারুণ অবাক হলো।

 

এটা আমন কনডমের প্রতিটি প্যাকেটেই বলা আছে। পেশীবহুল লোকটা চওড়া একটা হাসি দিলো। এটাতে একটা ভেড়া-মাথার পুরুষ রয়েছে আর বলা হয়েছে, সে হলো মিশরীয় উর্বরতার দেবতা।

 

ল্যাংডন অবশ্য এই কনডম কোম্পানির নামটার সাথে পরিচিত ছিলো না। তার পরও সে খুব খুশি হলো যে, প্রস্তুতকারকরা তাদের সঠিক হায়ারোগ্লিফস ঠিকই ধরতে পেরেছে। খুব ভালো। আমন সত্যি ভেড়া মাথাওয়ালা পুরুষকেই প্রতিনিধিত্ব করে আর তার বাঁকানো শিং দুটো আমাদের আধুনিক যৌন স্ল্যাং Hornyর সাথে সংশ্লিষ্ট।

 

কী!

 

কী, ল্যাংডনও পাল্টা বললো। আপনারা কি জানেন, আমনের সঙ্গী কে ছিলো? মিশরীয় উর্বরতার দেবী? প্রশ্নটা কয়েক মুহূর্তের নিরবতার আবহ তৈরি করলো।

 

আইসিস, ল্যাংডন তাদের বললো। একটা কলম হাতে তুলে নিলো সে। তো, আমরা পুরুষ দেবতা আমনকে পেলাম। সে নামটা লিখে ফেললো। আর নারী দেবী আইসিস, যার প্রাচীন প্রতীকটাকে ডাকা হতো LISA বলে। ল্যাংডন লেখা শেষ করে প্রজেক্টরের সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো।

 

AMONLISA

 

কিছু বোঝা যাচ্ছে? সে জিজ্ঞেস করলো।

 

Mona Lisa … পবিত্র জঞ্জাল, কেউ একজন ফোঁস করে উঠলো।

 

ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো। ন্দ্রমহোদয়গণ, মোনালিসার চেহারাটা শুধুমাত্র উভলিঙ্গেরই নয়, তার নামটাও নারী-পুরুষের স্বর্গীয় ঐক্যের একটি এনাগ্রাম। আর এটাই, আমার বন্ধুগণ, দা ভিঞ্চির ছোটখাটো রহস্য আর মোনালিসা যে হাসছে তার কারণ।

 

 

 

আমার দাদু এখানেই ছিলেন, সোফি বললো, হঠাৎ করেই মোনালিসা থেকে মাত্র দশ ফিট দূরে হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো। সে ব্ল্যাক লাইটের আলোটা কাঠের ফ্লোরে ফেলে খুঁজতে লাগলো কিছু।

 

প্রথমে ল্যাংডন কিছুই দেখতে পেলো না। তারপর, সেও হাটু গেঁড়ে তার পাশে বসে পড়তেই, দেখতে পেলো ছোট্ট এক ফোটা শুকিয়ে যাওয়া তরল, যা আসলে লুমিনেসিং। কালি? হুট করেই সে বুঝে গেলো ব্ল্যাক লাইটটা যার জন্যে আসলে ব্যবহার করা হয়। রক্ত। তার চিন্তা ভাবনা একটু ধাক্কা খেলো। সোফি ঠিকই বলেছে। জ্যাক সনিয়ে মারা যাবার আগে মোনালিসা দেখতে এসেছিলেন।

 

তিনি এখানে কোন কারণ ছাড়া আসেননি, সোফি উঠে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বললো। আমি জানি, তিনি এখানে আমার জন্যে একটা মেসেজ রেখে গেছেন। সে সোজা চলে এলো মোনালিসার ঠিক সামনে। ছবিটার সামনের ফ্লোরে ব্ল্যাক লাইটটা দিয়ে কিছু খুঁজে চললো সে।

 

এখানে কিছু নেই!

 

ঠিক সেই মুহূর্তেই, ল্যাংডন মোনালিসার বুলেটপ্রুফ কাঁচের ওপর হালকা বেগুনী রঙের কিছু একটা দেখতে পেলো। সামনে এসে সে সোফির হাতটা ধরে ধীরে ধীরে ব্ল্যাক লাইটটা ছবিটার দিকে নিক্ষেপ করলো।

 

দুজনেই বরফের মতো জমে গেলো।

 

কাঁচের ওপর, বেগুনী রঙের ছয়টা শব্দ জ্বল জ্বল করছে। সরাসরি মোনালিসার চেহারা বরাবর।

 

 

 

২৭.

 

সনিয়ের ডেস্কে বসে, লেফটেনান্ট কোলেত অবিশ্বাসে তার কানে ফোনটা ধরলো। আমি ফশের কথা ঠিক ঠিক শুনতে পারছি? একটা সাবানের টুকরো? কিন্তু ল্যাংডন কীভাবে জিপিএস ডটটার কথা জানতে পারলো?

 

সোফি নেভু, ফশে জবাব দিলো। সে-ই ওকে বলেছে।

 

কী! কেন?

 

খুব ভালো প্রশ্ন করেছে, আমি এইমাত্র একটা রেকর্ড করা মেসেজ শুনে বুঝতে পেরেছি সোফিই ওকে সর্তক করে দিয়েছে।

 

কোলেত বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। নেভু কি ভাবছে? ফশের কাছে প্রমাণ রয়েছে, সোফি নেভু ডিসিপিজের অপারেশনে নাক গলিয়েছে? সোফি নেভূকে শুধু বরখাস্তই করা হবে না, জেলেও যেতে হবে। কিন্তু, ক্যাপ্টেন…তাহলে ল্যাংডন এখন কোথায় আছে?

 

এখানকার কোন ফায়ার এলার্ম কি বেজেছে?

 

না, স্যার।

 

আর গ্র্যান্ড গ্যালারির সদর দরজা দিয়ে কেউ কি বের হয়েছে?

 

না। সদর দরজায় আমাদের নিরাপত্তা অফিসাররা রয়েছে। আপনার অনুরোধেই তাদের রাখা হয়েছে।

 

ঠিক আছে, ল্যাংডন অবশ্যই গ্র্যান্ড গ্যালারির ভেতরে আছে।

 

ভেতরে? কিন্তু, সে করছেটা কি?

 

লুভরের নিরাপত্তা প্রহরী কি সশস্ত্র অবস্থায় রয়েছে?

 

হ্যাঁ, স্যার। সে একজন সিনিয়র ওয়ার্ডেন।

 

তাকে ভেতরে পাঠাও, ফশে আদেশ করলো।আমি আমার লোকদেরকে কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে ফিরে আনতে পারবো না, আর আমি চাই না ল্যাংডন ওখান থেকে বের হয়ে যাক। ফশে একটু থামলো। তুমি প্রহরীকে বলে দাও, এজেন্ট সোফি নেভুও তার সাথেই আছে।

 

আমার মনে হয়,এজেন্ট নেভু চলে গেছে।

 

তুমি কি তাকে চলে যেতে দেখেছো?

 

না, স্যার কিন্তু–

 

ওখানকার কেউই তাকে চলে যেতে দেখেনি। তারা শুধু তাকে ঢুকতে দেখেছে।

 

কোলেত সোফি নেভুর সাহসিকতায় দারুণ অবাক হলো। সে এখনও ভেতরেই আছে?

 

এদিকটা একটু সামলাও, ফশে নির্দেশ দিলো। আমি চাই, ফিরে এসেই যেনো দেখি ল্যাংডন আর সোফি অস্ত্রের মুখে বন্দী হয়ে আছে।

 

ট্রাকটা চলে যেতেই ক্যাপ্টেন ফশে তার লোকদের জড়ো করলো। রবার্ট ল্যাংডন আজ রাতে একটা লুকোচুরি খেলা শুরু করেছে। আর এখন এজেন্ট নেভু তাকে সাহায্য করছে। ধারণার চেয়েও তাকে বেশি কঠিন বলে মনে হচ্ছে।

 

ফশে ঠিক করলো, সে কোন সুযোগই দেবে না ওদের। তার লোকদের অর্ধেককে লুভরে ফিরে যেতে বললো সে। বাকি অর্ধেক লোককে প্যারিসের একমাত্র যে স্থানে ল্যাংডন নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারে, সেখানে গিয়ে পাহাড়া দিতে বললো।

 

 

 

২৮.

 

সল দে এতাত-এর ভেতরে ল্যাংডন বুলেট প্রুফ কাঁচের ওপর লেখা ছয়টা শব্দের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে রইলো। লেখাগুলো দেখে মনে হচ্ছে বাতাসে ভাসছে। সেগুলোর ছায়া মোনালিসার রহস্যময় হাসির উপরে গিয়ে পড়েছে।

 

তোমার দাদু, ল্যাংডন নিচু স্বরে বললো।  প্রায়োরিদের একজন সদস্য ছিলেন, এটা তারই প্রমাণ!

 

সোফি তার দিকে দ্বিধাগ্রস্তভারে তাকালো। তুমি এটা বুঝতে পেরেছো?

 

এটা খুবই নিখুঁত, ল্যাংডন মাথা নেড়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বললো। এটা প্রায়োরিদের একটি মূল দর্শনকেই ব্যক্ত করছে! মোনালিসার চেহারায় ভেসে থাকা মেসেজটার দিকে হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো সে।

 

SO DARK THE CON OF MAN

 

সোফি, ল্যাংডন বললো। দেবী পূজার ব্যাপারে প্রায়োরিদের বিশ্বাসের মূলে যে প্রেক্ষাপট রয়েছে সেটা তোমাকে জানতে হবে। খৃস্টিয় চার্চের শুরুর দিকে, ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে পৃথিবীকে নারীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিলো, যাতে করে পুরো ব্যাপারটা পুরুষতন্ত্রের পক্ষে যায়।

 

লেখাগুলোর দিকে চেয়ে সোফি নিচুপ রইলো।

 

প্ৰায়োরিরা বিশ্বাস করে, কনস্টানটিন এবং তার পুরুষ-বংশধরেরা সাফল্যজনকভাবেই মাতৃতান্ত্রিক প্যাগান সমাজকে পিতৃতান্ত্রিক খৃস্টিয় সমাজে রূপান্তরিত করেছিলেন পবিত্র নারীকে ডাইনীকরণের মধ্য দিয়ে, আধুনিক ধর্ম থেকে তাদেরকে চিরতরের জন্য নির্বাসিত করে।

 

সোফি নির্বাক হয়ে রইলো। আমার দাদু আমাকে এসব জিনিস খুঁজে বের করার জন্য এখানে পাঠিয়েছেন। তিনি অবশ্যই এর চেয়ে বেশি কিছু বলার চেষ্টা করেছেন।

 

ল্যাংডন বুঝতে পারলো সে কি বোঝাতে চাইছে। সে মনে করছে এটা একটা কোড! এখানে কোন লুকানো অর্থ আছে কী না সেটা ল্যাংডন তৎক্ষণিকভাবে বলতে পারলো না। তার মন সনিয়ের লেখা মেসেজটার কথা ভেবে ভেতরে ভেতরে দারুণ উত্তেজিত বোধ করছিলো।

 

So dark The con of man অর্থাৎ অন্ধকার মানুষের বিরুদ্ধে, সে ভাবলো। খুবই অন্ধকার। আজকের সমস্যা সংকুল বিশ্বে আধুনিক চার্চ যে, বিশাল জনকল্যাণ মূলক কাজ করেছে সে ব্যাপারটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, তারপরও বলতে হয়, চার্চের রয়েছে খুবই জঘন্য আর হিংসাত্মক এক ইতিহাস। তাদের বর্বর ক্রুসেড তিন শতাব্দী ধরে প্যাগান আর নারী পূজারীদের পুণঃদীক্ষা করেছে। আর এসব করতে গিয়ে তারা এমন সব পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলো, যা এতোটাই বিভীষিকাময় ছিলো যে তারা আরো বেশি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন।

 

ক্যাথলিক ইনকুইজিশন একটা বই প্রকাশ করেছে যাকে মানব ইতিহাসের সবচাইতে রক্তাক্ত-ঘামের প্রকাশনা হিসেবে বলা যেতেই পারে। মালিয়াস মেল ফিকারাম অথবা ডাইনী শায়েস্তাকরণ—এমন একটি মতবাদ, যাতে বলা হয়েছে মুক্তচিন্তার নারীরা বিপজ্জনক। আর পুরোহিতদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কীভাবে তাদেরকে খুঁজে বের করে অত্যাচার করে ধ্বংস করা যেতে পারে। চার্চ যাদেরকে ডাইনী বলে মনে করেছিলো তাদের মধ্যে জ্ঞানী, নারী যাজক, জিপসি, আধ্যাত্মিক নারী ব্যক্তিত্ব, প্রকৃতি প্রেমী, লতাপাতা সংগ্রহকারী এবং প্রাকৃতিক বিশ্বের সাথে মিলে যায় এমন যে কোন নারী। ধাত্রীদেরকেও হত্যা করা হয়েছিলো তাদের উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া বাচ্চা প্রসবের সময় প্রসূতির বেদনা লাঘবের কৌশলের জন্য প্রসব বেদনাটা, চার্চের দাবি অনুসারে, হাওয়া স্বর্গ থেকে জ্ঞানের গন্ধম ফল খাওয়ার জন্য ঈশ্বর প্রদত্ত একটি ন্যায়সঙ্গত শাস্তি। এভাবেই তারা প্রসব বেদনার মধ্য দিয়ে আদি পাপের শাস্তি বহন করে। তিন শত বছর ধরে ডাইনী শিকারের সময়ে চার্চ অবিশ্বাস্য সংখ্যক পঞ্চাশ লক্ষ নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিলো।

 

প্রচারণা আর রক্তপাত বেশ ভালোই কাজে লেগেছিলো। সফল হয়েছিলো তারা। আজকের এই পৃথিবীই তার সব চেয়ে বড় প্রমাণ।

 

এক সময় আধ্যাত্মিক উজ্জীবনের অর্ধেক হিসেবে যে নারী গণ্য হতো, তারা এই পৃথিবীর ধর্মশালা থেকে একেবারেই উৎখাত হয়ে গেছে। বর্তমান বিশ্বে কোন নারী অর্থোডক্স রাব্বি নেই, কোন নারী ক্যাথলিক যাজক নেই, এমন কি ইসলামী দুনিয়ায় কোন নারী ধর্মীয় নেতাও নেই। এক সময় যে হায়ারোস গামোস অর্থাৎ নারী পুরুষের স্বাভাবিক সঙ্গমের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার পূর্ণতায় পৌঁছানো কাজটাকে ভক্তি করা হতো, সেটাই হয়ে উঠলো লজ্জাজনক একটি কাজ। সাধুপুরুষরা এক সময় ঈশ্বরের সাথে মিলিত হবার জন্যে তাদের নারী সঙ্গীদের সাথে যৌন মিলনে লিপ্ত হতেন। সেই তাঁরাই তাঁদের স্বাভাবিক যৌন তাড়নাকে শয়তানের কাজ বলে মনে করতে শুরু করলেন। নারীদের সাথে মিলিত হওয়াটা শয়তানি কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হলো।

 

নারীদের সাথে সংশ্লিষ্ট, বাম দিকটাও চার্চের হাত থেকে রেহাই পায়নি। ফ্রান্স এবং ইতালিতে, বাম শব্দটার অর্থ গশে এবং সিনিস্ত্রা—এটা এসেছে খুবই নেতিবাচক অর্থ থেকে। যেখানে ডান দিকের সঙ্গী হলো সততা নিরপেক্ষতা আর বিশুদ্ধতার প্রতীক, সেখানে আজকের দিনেও, উগ্রবাদী চিন্তাসমূহকে বলা হয় বামপন্থী, অযৌক্তিক চিন্তাকে বলা হয় বাম মস্তিস্ক, আর শয়তানী ব্যাপারকে বলা হয় সিনিস্তার।

 

দেবীদের দিন শেষ হয়ে গেছে। পেন্ডুলামটা ঝুলছে। ধরিত্রী জননী হয়ে উঠেছে পুরুষের বিশ্ব। আর তাই ধ্বংসের দেবতা এবং যুদ্ধ ব্যাপক প্রাণহানি ঘটাচ্ছে এই বিশ্বে। পুরুষ অহংবোধটা তাদের নারী সঙ্গীদের অলক্ষ্যে দুই হাজার বছর কাটিয়ে দিয়েছে। প্রায়োরি অব সাইওন বিশ্বাস করে, পবিত্র নারীকে এভাবে দমন করার জন্য আমাদের আধুনিক জীবন হয়ে গেছে আমেরিকান আদিবাসিরা যাকে বলে কয়ানিস কোয়াসি অর্থাৎ ভারসাম্যহীন জীবন—একটা অস্থিতিশীল অবস্থা, যা নারী বিদ্বেষী সমাজের আধিক্য আর পুরুষতান্ত্রিকতার যুদ্ধংদেহীভাবকেই চিহ্নিত করে আর সেই সাথে ধরিত্রী মাতাকে ক্রমবর্ধমানভাবে অসম্মান করা হয়।

 

রবার্ট! সোফি বললো, তার কণ্ঠ অস্ফুট। কেউ আসছে!

 

সে হলওয়ে থেকে একটা পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো।

 

এখানে! সোফি তার ব্ল্যাক লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে ল্যাংডনের সামনে থেকে যেনো উধাও হয়ে গেলো।

 

মূহূর্তের জন্য ল্যাংডনের মনে হলো, সে একদম অন্ধ হয়ে গেছে। এখানে! তার দৃষ্টিটা পরিষ্কার হতেই সে দেখতে পেলো সোফির অবয়বটা ঘরের মাঝখানে আটকোনা বেঞ্চিটার আড়ালে চলে যাচ্ছে। যখন একটা কণ্ঠ তাকে থামতে বললো, সেও সোফিকে অনুসরণ করতে লাগলো।

 

আরেতেজ! দরজা থেকে একটা কণ্ঠ বললো। লুভরের নিরাপত্তারক্ষী সল দে এতার ভেতরে প্রবেশ করে তার পিস্তলটা ল্যাংডনের বুকের কাছে তা করলো।

 

ন্যাংডন তার দুহাত উপরে তুলে ধরলো।

 

কুশেজ—ভূ! রক্ষীটা আদেশ করলো। শুয়ে পড়ো!

 

ল্যাংডন মুহূর্তেই ফ্লোরের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লে রক্ষীটা দ্রুত কাছে এসে তার পায়ে লাথি মারলো।

 

মভোয়া আইদি, মঁসিয়ে ল্যাংডন, সে ল্যাংডনের পিঠে অস্ত্রটা ঠেকিয়ে বললো,মভোয়া আইদি।

 

কাঠের ফ্লোরে হাত-পা ছড়িয়ে এভাবে শুয়ে থাকাটা ল্যাংডনের কাছে নিয়তির নির্মম পরিহাস বলে মনে হলো। উপুড় হয়ে থাকা ভিটাভিয়ান ম্যান, সে ভাবলো।

 

 

 

২৯.

 

সেন্ট-সালপিচের অভ্যন্তরে, সাইলাস বেদীর পাশে রাখা ভারি লোহার মোমবাতির স্ট্যান্ডটা নিয়ে অবিলিস্কের কাছে ফিরে আসলো। এটা দিয়ে অনায়াসেই হাতুড়ির কাজ করা যাবে। ধূসর মার্বেল প্যানেল, যেটার নিচটা ফাঁপা, সেটার দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারলো, কোন ধরনের শব্দ ছাড়া এটা ভাঙতে পারবে না।

 

মার্বেলের উপর লোহার আঘাতের শব্দটা ঘরের ছাদে প্রতিধ্বনিত হবে।

 

এটা কি নান শুনতে পারবে? এই সময়ের মধ্যে উনি নিশ্চিত ঘুমিয়ে যাবেন। তারপরও, সাইলাস কোন ঝুঁকি নিতে চাইলো না। লোহার স্ট্যান্ডটার মাথা একটা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে নেবার দরকার, কিন্তু সে বেদীর লিনেন কাপড় ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না। ওটাকে অসম্মান করতে চাইলো না সাইলাস। আমার আলখেল্লাটা, সে ভাবলো। সে জানে, বিশাল এই চার্চে সে একাই আছে। সাইলাস শরীর থেকে আলখেল্লাটা খুলে ফেললো।

 

ওটা খুলতে গিয়ে কাপড়ের আঁশ সাইলাসের পিঠের ক্ষতে লেগে যাওয়াতে একটু ব্যথা করলো।

 

নিমাঙ্গের অর্ন্তবাসটা ছাড়া সে এখন নগ্নই বলা চলে। সাইলাস তার আলখেল্লাটা লোহার স্ট্যান্ডের মাথায় পেঁচিয়ে নিলো, তারপর ফ্লোরের টাইলসের মাঝ বরাবর নিশানা করে সজোড়ে আঘাত করলো। একটা ভেঁতা শব্দ হলো। কিন্তু পাথরটা ভাঙলো না। আবারো আঘাত করলে একটা ভোতা আওয়াজটা হলো, কিন্তু সেই সাথে ভেঙে যাবার শব্দও শোনা গেলো। তৃতীয় আঘাতে টাইলসটা পুরোপুরি ভেঙে গেলে ফ্লোরের নিচে গহ্বরটা দেখা গেলো।

 

একটা কক্ষ।

 

খুব দ্রুত আরো কিছু টাইলস্ খুলে সাইলাস ফোকরটা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখলো। হাটু গেঁড়ে বসার সময় তার রক্ত টগবগ করছিলো। বিবর্ণ ফ্যাঁকাশে হাত দুটোয় ভর করে সে ভেতরে ঢুকে পড়লো।

 

প্রথমে তার কিছুই মনে হলো না। ভেতরের কক্ষটার জমিন মসৃন পাথরের আর সেটা একেবারেই খালি। তারপর রোজলাইন রেখাটা ধরে কয়েক হাত এগোতেই, একটা কিছুর স্পর্শ পেলো। পাতলা একটা পাথরের তক্তা। সেটার কোণা দুটো হাত দিয়ে ধরে তুলে ফেললো। সাইলাস দেখতে পেলো একটা অমসৃণ পাথরের ফলক, তাতে কিছু লেখা খোঁদাই করা আছে। কিছুক্ষণের জন্য তার নিজেকে মনে হলো আধুনিক কালের মুসা পয়গম্বর বলে।

 

ফলকটার লেখাগুলো পড়ে সাইলাস দারুণ অবাক হলো। সে আশা করেছিলো কিস্টোন একটা মানচিত্র হবে, অথবা একটা জটিল নির্দেশনা, কিংবা হয়তো কোন কোড। কি-স্টোনটা, দেখা যাচ্ছে, আসলে সহজ সরল একটা প্রস্তর ফলক।

 

জব ৩৮:১১

 

বাইবেলর একটা পংক্তি? সাইলাস এমন সহজ সরল জিনিস দেখে হতবাক হয়ে গেলো। তারা যে গোপন জায়গাটা খুঁজে ফিরছে, সেটা বাইবেলের একটা পংক্তিতে প্রকাশ করা হয়েছে? ভ্রাতৃসংঘ কি শেষ পর্যন্ত ঠাট্টা করলো!

 

জব। অধ্যায় আটত্রিশ। পংক্তি এগারো।

 

যদিও সাইলাসের এগারো নাম্বার পংক্তিটা হুবহু মুখস্ত নেই, তারপরও, সে জানতো, জব পুস্তকে এমন একজন লোকের গল্প বলা হয়েছে, যার ঈশ্বরের বিশ্বাসটা পরীক্ষা করবার পরেও টিকে ছিলো। যথার্থই, সে ভাবলো, তার উত্তেজনার সাথে মিলে যাচ্ছে।

 

মাথার ওপর তাকিয়ে সাইলাস না হেসে পারলো না। প্রধান বেদীর উপরে রাখা বই রাখার বড় একটা স্ট্যান্ড, তার উপড়ে চামড়ায় মোড়ানো বিশাল একটা বাইবেল রাখা।

 

বেলকনির ওপরে দাঁড়িয়ে সিস্টার সানডৃন কাঁপছিলেন। লোকটা যখন তার আলখেল্লাটা আচমকা খুলে ফেললো, তখন চলে যেতে উদ্যত হয়েছিলেন তিনি। তার প্রতি যে নির্দেশ ছিলো, সেটা পালন করতে চাইছিলেন। লোকটার ফ্যাঁকাশে সাদা চামড়া দেখে তিনি ভয় পেলেন। তার চওড়া বিবর্ণ পিঠটা রক্তে ভিজে আছে। এমন কি এখান থেকে তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন টাকা ক্ষত চিহ্নগুলো।

 

লোকটাকে নির্দয়ভাবে চাবুক মারা হয়েছে।

 

তিনি তার ঊরুতে রক্তাক্ত সিলিস্ বেল্টটাও দেখতে পেলেন। সেখান থেকে রক্ত ঝড়ছে। কোন ধরনের ঈশ্বর এ রকম শারিরীক শান্তি কামনা করে? ওপাস দাইর নিয়ম-নিষ্ঠা সিস্টার সানড্রন কখনও বুঝতে পারেননি। তবে এই ব্যাপারটা তার কাছে এখন আর তেমন বিবেচ্য বিষয় নয়। ওপাস দাই কি-স্টোনটার খোঁজ করছে। তারা এ সম্পর্কে কীভাবে জানতে পারলো, সিস্টার সানন সেটা কোনোভাবেই ভেবে পেলো না। অবশ্য, তিনি জানতেন, ভাবার মতো সময় তাঁর এখন নেই।

 

রক্তাক্ত সন্ন্যাসিটি এবার নিরবে তার আলখেল্লাটা পরে নিলো। এরপর, সে বেদীতে রাখা বাইবেলের দিকে গেলো।

 

শ্বাসরুদ্ধকর নিরবতায় সিস্টার সানন বেলকনি ছেড়ে দ্রুত নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। হাটু গেঁড়ে বসে তার কাঠের খাটটার নিচ থেকে সিলগালা করা একটা খাম বের করলেন। তিন বছর আগে এটা তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন।

 

খামটা ছিঁড়ে, খুলে দেখতে পেলেন, প্যারিসের চারটা ফোন নাম্বার।

 

কাঁপতে কাঁপতে তিনি ডায়াল করলেন।

 

নিচে, পাথরের ফলকটি সাইলাস তুলে নিয়ে আসলো বেদীর সামনে। অন্য হাতে চামড়ার বাইবেলটা তুলে নিলো সে। তার লম্বা-লম্বা সাদা আঙ্গুল দিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করলো। ওল্ড টেস্টামেন্টটা ঘেঁটে-ঘেঁটে বুক অব জব খুঁজে পেলো সে। আটত্রিশতম অধ্যায়টা বের করলো। যে শব্দগুলো সে খুঁজছে, সেই শব্দগুলো পেয়ে গেলো এখানে।

 

তারাই পথ দেখাবে।

 

এগারো নাম্বার পংক্তিটা খুঁজে পেয়ে সাইলাস সেটা পড়ে দেখলো। এতে মাত্র সাতটা শব্দ রয়েছে। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে, সে ওটা আবার পড়তে লাগলো। তার মনে হচ্ছিলো, বিশাল একটা ভুল হয়ে গেছে। পংক্তিটা একেবারেই সহজ সরল।

 

এ পর্যন্তই তোর আসা উচিত, এর চেয়ে বেশি না।

 

 

 

৩০.

 

সিকিউরিটি ওয়ার্ডেন ক্লদ গ্রুয়াদ মোনালিসার সামনে অবনত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, তার বন্দীর সামনে অস্ত্র তাক করে রেখে দারুণ উত্তেজনা অনুভব করলো। এই বানচোতটা জ্যাক সনিয়েকে হত্যা করেছে। সনিয়ে ছিলেন গ্রুয়ার্দ এবং তার টিমের কাছে একজন স্নেহপরায়ণ পিতার মতোন।

 

গ্রুয়ার্দ টৃগারটা টিপে রবার্ট ল্যাংডনের পিঠে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেয়া ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছিলো না। একজন সিনিয়র ওয়ার্ডেন হিসেবে গ্রুয়ার্দ হলো সেই সব স্বল্প সংখ্যক লোকদের একজন, যে সঙ্গে করে অস্ত্র বহন করে। সে নিজেকে প্রবোধ। দিলো যে, ল্যাংডনকে খুন করা মানে, ফরাসি জেলখানায় যাওয়া আর বেজু ফশের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া।

 

গ্রুয়ার্দ তার কোমরের বেল্ট থেকে ওয়াকি-টকিটা নিয়ে ব্যাক-আপের জন্য সাহায্য চাইলো। কিন্তু সে কেবল ঘঘ শব্দই শুনতে পেলো। এই কক্ষের বাড়তি ইলেক্ট্রনিক সিকিউরিটির জন্য সবসময়ই রক্ষীদের যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়ে থাকে। আমাকে দরজার কাছে যেতে হবে। ল্যাংডনের দিকে অস্ত্রটা তা করে রেখেই গ্রুয়ার্স আস্তে আস্তে পিছু হটে দরজার বাইরে দিকে যেতে লাগলো। তার তৃতীয় পদক্ষেপেই, সে কিছু একটা বুঝতে পেরে একটু থামলো।

 

এটা আবার কি?

 

ঘরটার মাঝখানে কিছু একটা নড়ে-চড়ে উঠছে। একটা ছায়ার অবয়ব। এই ঘরে তাহলে আরেক জন আছে? দূরের অন্ধকারে একটা মেয়েকে নড়তে দেখা যাচ্ছে। তার সামনে একটা বেগুনী আলোর রেখা ফ্লোরের এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। যেনো রঙ্গীন ফ্লাশ লাইটটা দিয়ে কেউ কিছু খুঁজছে।

 

কুয়ে এস্ত লা? গ্রুয়ার্দ গর্জন করে বললো, শেষ ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে দ্বিতীয় বারের মতো শিড়দাঁড়া দিয়ে শীতল অনুভূতিটা অনুভব করলো। আচমকাই সে খেই হারিয়ে ফেললো। অস্ত্রের নিশানাটা কোথায় তা করবে আর কোন দিকেই বা সে যাবে।

 

পিটিএস, মেয়েটা শীতল কণ্ঠে জবাব দিলো, এখনও লাইটটা দিয়ে সে খোঁজাখুঁজি করে যাচ্ছে।

 

পুলিশ তেকনিক এ সাইন্তিফিক। গ্রুয়ার্দ এবার ঘামে ভিজতে শুরু করলো। আমি ভেবেছিলাম সব এজেন্টই এখান থেকে চলে গেছে। সে বেগুনী আলোটা চিনতে পারলো, আন্ট্রাভায়োলেট রশ্মি। পিটিএস দলের কাছে এগুলো থাকে। তারপরও সে বুঝতে পারলো না, কেন ডিসিপিজে এখানে প্রমাণ বা আলামতের জন্য খোঁজাখুঁজি করছে।

 

ভোতার নম! গ্রুয়ার্দ চিৎকার করে বললো। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বললো কিছু একটা অসঙ্গতি রয়েছে। রিপোদে!

 

সে সোয়ে, কণ্ঠটা খুব শান্ত, ফরাসিতে বললো। সোফি নেভু।

 

গ্রুয়ার্দের মনের কোণে কোথাও এই নামটা আছে, সোফি নেভু? এই নামটাতো সনিয়ের নাতনীর নাম, তাই না? ছোটবেলায় সে এখানে আসতো, কিন্তু সেটাতো অনেক বছর আগের কথা। এই মেয়েটা সম্ভবত সে নয়। আর যদি সে সোফি নেভূই হয়ে থাকে তারপরও তাকে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই, গ্রুয়ার্দ সনিয়ে এবং তার নাতনীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের গুজবটা শুনেছিলো।

 

আপনি আমাকে চেনেন, মেয়েটা বললো। রবার্ট ল্যাংডন আমার দাদুকে খুন করেনি। বিশ্বাস করুন।

 

ওয়ার্ডেন গ্রুয়ার্দ এই কথাটা আমলেই নিলো না। আমার দরকার ব্যাক-আপের। তার ওয়াকি-টকিতে আবারো চেষ্টা করলো, সাড়াশব্দ কিছুই পেলো না। প্রবেশ দ্বারটা এখান থেকে আরো বিশ গজ পেছনে। গ্রুয়াদ আস্তে আস্তে পিছু হটতে লাগলো। সে ঠিক করলো, ফ্লোরে শুয়ে থাকা লোকটার দিকেই অস্ত্রটা তাক করে রাখবে। পিছু হটতেই গ্রুয়ার্দ দেখতে পেলো মেয়েটা ঘরের অন্য পাশ থেকে তার ইউভি লাইটটা দিয়ে সল দে এতাত এর দেয়ালে মোনালিসার ঠিক বিপরীতে টাঙানো বিশাল একটা

 

ছবির দিকে আলো ফেলে কি যেনো খুঁজছে।

 

গ্রুয়ার্দ ভাবলো, বুঝতে চেষ্টা করলো, কোন্ পেইন্টিং সেটা।

 

ঈশ্বরের দোহাই, মেয়েটা করছে কি?

 

সোফি নেভুর মনে হলো, তার কপালটা ঠাণ্ডা ঘামে ভিজে গেছে। ল্যাংডন মাটিতে ডানা ছড়ানো ঈগলের মতোই পড়ে আছে। একটু, রবার্ট, এইতো। জানতো তাদের প্রহরী কাউকেই গুলি করবে না। সোফি তার নিজের কাজেই মনোেযোগ দেবার মনস্থির করলো। একটা মাস্টার পিসের পুরোটাই খুঁজে দেখলো, বিশেষ করে আরেকটা দা ভিঞ্চি। কিন্তু ইউভি লাইটে কিছুই ধরা পড়লো না। ফ্লোরেও না, দেয়ালেও না, এমনকি ক্যানভাসেও না।

 

এখানে কিছু একটাতো আছেই।

 

সোফির মনে হলো সে তার দাদুর সংকেতের পুরোটাই ঠিক ঠিকভাবে মর্মোদ্ধার করতে পেরেছে।

 

এ ছাড়া আর কীইবা তিনি বোঝাতে চাইবেন?

 

যে মাস্টার পিসটা সে পরীক্ষা করলো, সেটা পাঁচ ফুট লম্বা একটা ক্যানভাস। দা ভিঞ্চি একটা অদ্ভুত দৃশ্য এঁকেছিলেন, যাতে জবুথুবুভাবে কুমারী মেরি শিশু যিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন, পাশে জন দ্য ব্যাপটিস্ট এবং ইউরিয়েল এনজেল একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সোফি যখন ছোট ছিলো তখন তার দাদু এই ছবিটার কাছে তাকে জোর করে ধরে না নিয়ে এসে মোনালিসা দর্শন শেষ করতেন না।

 

গ্র্যঁ-পেয়া, আমি এখানে! কিন্তু সেটা দেখতে পাচ্ছি না! তার পেছনে, সে শুনতে পেলো, রক্ষীটা আবার সাহায্যের জন্য রেডিওতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

 

ভাবো!

 

সে মোনালিসার বুলেট প্রুফ কাঁচের ওপরে লেখা মেসেজটা আবার দেখলো। So dark the con of man। তার সামনের পেইটিংটার কোনো কাঁচ নেই, যাতে কোন মেসেজ লেখা থাকতে পারে। সোফি জানে, তার দাদু বিখ্যাত কোনো মাস্টার পিসের উপরে কিছু লিখে সেটা নষ্ট করবেন না। সে একটু থামলো। সামনে তো কোনোভাবেই নয়। তার চোখ ওপরের দিকে গেলো। ক্যানভাসটা সিলিংয়ের থেকে যে তারটা দিয়ে ঝোলানো রয়েছে, সেটা লাফিয়ে ধরলো। এটাই কি তবে সেই জিনিস? ক্যানভাসটার বাম দিকটা ধরে তার কাছে টেনে আনলো সেটা। ছবিটা বেশ বড়, তাই দুলতে লাগলো। সোফি কোনোমতে তার মাথাটা ক্যানভাসের পেছনে ঢুকিয়ে উঁকি মারলো। ব্ল্যাক লাইটটা দিয়ে পেছনে খুঁজে দেখতে চেষ্টা করলো।

 

মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগলো বুঝতে যে, তার ধারণাটা ভুল। ছবিটার পেছন দিক কালো আর বিবর্ণ, সেখানে কোন বর্ণালি রঙের লেখা নেই, শুধুমাত্র পুরনো ক্যানভাসের পেছনকার কালো ধূসর চিটচিটে রঙ আর–

 

আরে।

 

সোফির চোখ কাঠের ফ্রেমের নিচের দিকের খাজের মধ্যে একটা ধাতব, চঞ্চকে বস্তুর দিকে আঁটকে গেলো। জিনিসটা ছোট, সেটাতে আঁটকে আছে জ্বলজ্বলে একটা সোনার চেইন।

 

সোফি যারপরনাই বিস্মিত হলো। চেইনটার সাথে লাগনো আছে অতিপরিচিত সোনার চাবিটা। চাবিটার চওড়া মাথাটা ক্ৰশ আকৃতির, আর তাতে আছে একটা খোঁদাই করা সিল, যা সে নয় বছর বয়সের পর আর কখনও দেখেনি। একটা ফ্লার-দ্য লিস তার সাথে আছে পিএস অক্ষরটা। সোফির মনে হলো, তার দাদুর অশরীরি কণ্ঠস্বরটা তার কানে ফিস্ ফিস করে বলছে। যখন সময় আসবে, চাবিটা তোমার হবে। তার দাদু মারা গেলেও নিজের প্রতিশ্রুতি ঠিকই রক্ষা করেছেন, এটা বুঝতে পেরে তার গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। এই চাবিটা দিয়ে একটা বাক্স খোলা যায়, তাঁর কণ্ঠটা বলছে, সেখানে আমি অনেক গোপনীয় জিনিস রাখি।

 

সোফি এবার বুঝতে পারলো, আজকের রাতের পুরো শব্দখেলার সত্যিকারের উদ্দেশ্য ছিলো এই চাবিটা। তার দাদু যখন মারা যাচ্ছিলেন, তখন চাবিটা তার কাছেই ছিলো। তিনি চাননি এটা পুলিশের হাতে গিয়ে পড়ক। তাই ছবিটার পেছনে সেটা রেখে দিয়েছিলেন। তারপর একটা অতিপরিচিত গুপ্তধন খোজা খেলাটা খেলালেন, যাতে কেবলমাত্র সোফিই এটা খুঁজে পায়।

 

অ্যা সিকোর! রক্ষীটা জোরে বলে উঠলো। সোফি চাবিটা ফ্রেমের পেছন থেকে এক ঝটকায় নিয়ে ইউডি লাইটটা সহ তার পকেটে ঢুকিয়ে ফেললো। ক্যানভাসের পেছনে থেকেই সে উঁকি মেরে দেখলো রক্ষীটা তখনও ওয়াকি-টকিতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে পিছু হঁটে-হঁটে প্রবেশ দ্বারের দিকে যাচ্ছে, আর হাতে ধরা অস্ত্রটা ল্যাংডনের দিকেই তাক্ করে রাখা।

 

অ্যা সিকোর! সে আবারো রেডিওতে চিৎকার করে বললো।

 

কোন সাড়া শব্দ নেই।

 

লোকটা যোগাযোগ করতে পারছে না, সোফি বুঝতে পারলো। তার মনে পড়ে গেলো, প্রায়শই দশনার্থী পর্যটকরা মোনালিসা দেখে অভিভূত হয়ে তাদের সেল ফোনে কথা বলতে গিয়ে দেখে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। এখানের দেয়ালে এক্সট্রা সার্ভিলেন্স যন্ত্রের জন্য কোন ধরনের বেতার যোগাযোগ একরকম অসম্ভবই হয়েই পড়ে, যদি না দরজার বাইরে না গিয়ে সেটা করা হয়। রক্ষীটাও এখন খুব দ্রুত দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। সোফি জানে, তাকে এক্ষুণি কিছু একটা করতে হবে। বড় ছবিটার পেছন থেকে সোফি তাকিয়ে দেখছিলো আর ভাবছিলো যে, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি আজ রাতে দ্বিতীয় বারের মতো সাহায্যে আসতে পারে কিনা।

 

আর মাত্র কয়েক মিটার দূরেই, গ্রুয়ার্দ মনে মনে বললো, অস্ত্রটা তা করেই রাখলো।

 

আরেতেজ! ওউ জো লা দেই। মেয়েটা ঘরের একপাশ থেকে বলে উঠলো। গ্রুয়ার্দ তাকিয়ে দেখেই পিছু হটা থামিয়ে দিলো। মদিউ, নো!

 

ঘোলাটে লাল আলোর মধ্য দিয়ে সে দেখতে পেলো, মেয়েটা ঝুলে থাকা তারটা ছিঁড়ে ফেলে একটা বিশাল চিত্রকর্ম তার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। পাঁচ ফুট লম্বা ছবিটা মেয়েটাকে প্রায় ঢেকেই ফেলেছে। গ্রুয়ার্দ প্রথমে অবাক হয়ে ভাবলো, ছবিটা তার থেকে ছিঁড়ে ফেলার সময় এলার্ম কেন বাজলো না, অবশ্য, পরক্ষণেই, সে বুঝতে পারলো তারগুলোর সাথে এলার্মের সেন্সরটা এখনও নতুন করে সেট করা হয়নি। মেয়েটা করছে কি?

 

দৃশ্যটা দেখে তার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।

 

ক্যানভাসটার মাঝখান ফুলে উঠেছে। কুমারি ম্যারি, শিশু যিশু, জন ব্যাপটিস্ট এর নাজুক জায়গাটা ছিঁড়ে যাবার উপক্রম হলো।

 

নোঁ! গ্রুয়ার্দ চিৎকার করে বললো। দা ভিঞ্চির অমূল্য চিত্রকর্মটির এ অবস্থা দেখে সে ভয়ে জমে গেলো। মেয়েটা ক্যানভাসের পেছন থেকে হাটু দিয়ে ছবিটার মাঝখানে চাপ দিচ্ছে!

 

নোঁ।

 

গ্রুয়ার্দ তার পিস্তলটা ল্যাংডনের থেকে সরিয়ে মেয়েটার দিকে তাক্ করেই বুঝলো এটা একটা অসাড় হুমকি। ক্যানভাসটা কাপড়ের হলেও, সেটা একেবারেই অভেদ্য–ছয় মিলিয়ন ডলার দামের একটা বর্ম।

 

আমি দা ভিঞ্চিকে গুলি করতে পারি না!

 

আপনার ওয়াকি-টকি আর অস্ত্রটা নামিয়ে রাখুন, মেয়েটা ফরাসিতে শীতল কণ্ঠে বললো, তা-না হলে, আমি এই ছবিটা ছিঁড়ে ফেলবো। আমার মনে হয় আপনি জানেন, আমার দাদু এতে কী রকম কষ্ট পেতো।

 

গ্রুয়ার্দ একটা হতবুদ্ধিকর অবস্থায় পড়ে গেলো। দয়া করে…না। এটা ম্যাড়োনা অব দি রস! সে তার ওয়াকি-টকি আর অস্ত্রটা ফেলে দিয়ে মাথার উপর দু হাত তুলে ধরলো।

 

ধন্যবাদ আপনাকে, মেয়েটা বললো। এখন, আমি যা বলি তা-ই করুন, তাহলে সবকিছুই ঠিকঠাক হয়ে যাবে।

 

কিছুক্ষণ বাদে, ল্যাংডন যখন সোফির পাশাপাশি জরুরি বর্হিগমনের সিঁড়িটা দিয়ে বের হতে লাগলো, তখন তার নাড়িস্পন্দনটা লাফাচ্ছিলো। লুভরের সল দে এতা-এ রক্ষীটাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে, ওখান থেকে বের হবার সময় থেকে তারা একটা কথাও বলেনি। রক্ষীর পিস্তলটা এখন ল্যাংডনের হাতে। আর এই জিনিসটা পরিত্যাগ করার জন্য একটুও অপেক্ষা করতে চাইলো না। অস্ত্রটা তার কাছে খুবই ভারি আর অচেনা মনে হচ্ছিলো। একসাথে দুটো করে সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে ল্যাংডন অবাক হয়ে ভাবছিলো, সোফি কি জানে, যে ছবিটা সে প্রায় নষ্ট করে ফেলতে যাচ্ছিলো, সেটা কত দামী। আজ রাতে, এই এ্যাডভেঞ্চারের জন্য মেয়েটা ভালো একটা ছবিই বেছে নিয়েছিলো। দা ভিঞ্চির যে ছবিটা সে নিয়েছিলো, সেটা অনেকটা মোনালিসার মতোই, শিল্প ইতিহাসবেত্তাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে প্যাগান প্রতীক লুকিয়ে থাকার জন্য সমালোচিত ও আলোচিত।

 

তুমি খুব দামি জিম্মি বেছে নিয়েছিলে, দৌড়াতে দৌড়াতে ল্যাংডন তাকে বললো।

 

ম্যাড়োনা অব দি রস, সে জবাব দিলো। কিন্তু আমি এটা বেছে নেইনি, আমার দাদুই বেছে নিয়েছেন। তিনি ওটার পেছনে আমার জন্যে ছোট্ট একটা জিনিস রেখে গিয়েছেন।

 

ল্যাংডন মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকালো। কী! কিন্তু তুমি কি করে জানলে কোন্ ছবিটাতে সেটা আছে? ম্যাডোনা অব দি রক্স কেন?

 

So dark the con of man। সে একটা বিজয়ীর হাসি হাসলো। আমি প্রথম দুটো এনাগ্রাম ধরতে পারিনি, রবার্ট। তৃতীয়টা ঠিকই ধরতে পেরেছি।

 

 

 

 

 

 

 

০৪. সিস্টার সানডন

৩১.

 

তাঁরা মরে গেছে।

 

সিস্টার সানডন সেন্ট সালপিচ-এর নিজের ঘরে বসে ফোনটা হাতে নিয়ে ভয়ে কাঠ হয়ে আছেন। তিনি এনসারিং মেশিনে একটা মেসেজ রেখে দিয়েছেন। দয়া করে ফোনটা তুলুন! তাঁরা সবাই মরে গেছে।

 

প্রথম তিনটি টেলিফোন নাম্বারে ফোন করে ভয়াবহ ফল পাওয়া গেলো—একজন হিস্টিরিয়াগ্রস্ত বিধবা, এক গোয়েন্দা হত্যা হবার পর ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছেছেন আর একজন বিষণ্ণ পাদ্রী শোক-সন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তিনটা নাম্বারের সবগুলোই অকেজো। আর এখন, তিনি শেষ, অর্থাৎ চতুর্থ নাম্বারটা ফোন করতেই বাকি তিনটা নাম্বার ফোন করে না পেলেই কেবল এই নাম্বারটা তিনি করতে পারবেন—একটা এনসারিং মেশিনের কণ্ঠ শুনতে পেলেন। রেকর্ড করা কণ্ঠটা নিজের কোন নাম বা পরিচয় না দিয়ে সোজা বলে দিলো মেসেজটা ছেড়ে যেতে।

 

ফ্লোরের প্যানেলটা ভেঙে ফেলা হয়েছে! মেসেজটাতে বললেন। বাকি তিনজন মারা গেছেন!

 

সিস্টার সানডুন যে চারজনকে রক্ষা করছেন তাদের পরিচয় তিনি জানতেন না। কিন্তু তার বিছানার নিচে সযত্নে রাখা চারটা ব্যক্তিগত ফোন নাম্বার কেবল একটা ক্ষেত্রেই ব্যবহার করার কথা।

 

যদি কখনও ফ্লোর প্যানেলটা ভাঙা হয়, অদেখা মেসেন্জার তাকে বলেছিলেন, তার মানে, আমাদের মধ্যে কেউ, জীবননাশের হুমকির মুখে একটা মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়েছেন। নাম্বারগুলোতে ফোন করুন। বাকিদের সর্তক করে দিন। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হবেন না।

 

সেটা ছিলো একটা নিঃশব্দ এলার্ম। এটার সহজ সরলতা বোকাও বুঝতে পারবে। এই পরিকল্পনাটার কথা যখন তিনি প্রথম শুনেছিলেন, অবাকই হয়েছিলেন। যদি একজন ভাইয়ের পরিচয় উন্মোচিত হয়ে যায়, তবে একটা মিথ্যা বলবেন তিনি, যা ঘুরেফিরে বাকিদের কাছে পৌঁছে যাবে সতর্ক হবার জন্য। আজ রাতে, মনে হচ্ছে, কমপক্ষে একজন তো ধরা পড়ে গেছেই।

 

দয়া করে উত্তর দিন, তিনি ভয়ে ফিসফিস করে বললেন। কোথায় আপনি?

 

ফোনটা রাখুন, দরজা থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠ বললো। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সিস্টার তাকিয়ে দেখতে পেলেন বিশাল সন্ন্যাসীটাকে। তার হাতে ভারি মোমবাতি স্ট্যান্ডটা ধরা।

 

কাঁপতে কাঁপতে তিনি ফোনটা নামিয়ে রাখলেন।

 

তারা সবাই মারা গেছে, সন্ন্যাসীটা বললো। চার জনের সবাই। আর তারা আমার সাথে চালাকি করেছে। এবার আপনি বলুন, কি-স্টোনটা কোথায় আছে।

 

আমি জানি না! সিস্টার সানভৃন সত্যি করেই বললেন। এই গুপ্ত ব্যাপারটা অন্যেরা জানে। অন্যরা, যারা মারা গেছেন।

 

লোকটা সামনের দিকে এগিয়ে আসলো, তার সাদা হাতে লোহার স্ট্যান্ডটা শক্ত করে ধরা। আপনি এই চার্চের একজন সিস্টার। তারপরও আপনি তাদের হয়ে কাজ করেন?

 

যিত্র একটা সত্য-বাণী আছে, সিস্টার সানড়ন দৃঢ়ভাবে বললেন। আমি ওপাস দাইর মধ্যে সেটা দেখতে পাইনি।

 

লোকটার চোখে আচমকা একটা ক্রোধের ছায়া দেখা গেলো। সে শক্ত হাতে স্ট্যান্ডটা তুলে ধরলো। সিস্টার সানড়ন পড়ে যাবার সময় শেষ যে জিনিসটা তাঁর মনে হচ্ছিলো, সেটা হলো এক ধরনের স্বতস্ফুর্ত পূর্বাভাস।

 

চার জনের সবাই মারা গেছেন।

 

দূর্লভ সত্যটা চিরতরের জন্যই হারিয়ে গেলো।

 

 

 

৩২.

 

ল্যাংডন আর সোফি প্যারিসের গভীর রাতে প্রবেশ করতেই ডেনন উইং-এর পশ্চিম প্রান্তের সিকিউরিটি এলার্মটা সশব্দে বেজে ওঠে আশপাশের তুইলেরি গার্ডেনের কবুতরগুলোকে এদিক ওদিক ছড়িয়ে দিলো। প্লাজায় রাখা সোফির গাড়ির কাছে যেতেই ল্যাংডন দূর থেকে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনতে পেলো।

 

।এইতো, এটা এখানে, সোফি বললো, প্রাজায় রাখা নাক বোচা দুই সিটের লাল গাড়িটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে।

 

সে ঠাট্টা করছে, তাই না? গাড়িটা ল্যাংডনের দেখা সবচাইতে ছোটখাটো একটা গাড়ি।

 

স্মার্ট গাড়ি, সোফি বললো, লিটারে একশো মাইল চলে।

 

সোফি গাড়িটার ইজিন চালু করতেই ল্যাংডন কোনমতে ওটার ভেতরে গিয়ে বসে পড়লো। গাড়িটা ঝাকি খেয়ে ফুটপাতের ওপরে উঠে যেতেই ল্যাংডন দুহাতে গাড়ির ড্যাশ বোর্ডটা ধরে রাখলো। লাফাতে লাফাতে সেটা কারুজেল দু লুভরের ছোট্ট একটা গলি দিয়ে ছুটতে লাগলো।

 

সঙ্গে সঙ্গেই, সোফির মনে পড়ে গেলো শর্টকাট পথটার কথা। গলিটা দিয়ে সোজা চলে গেলেই হবে। মেরিডিয়ান চতুরটার ভেতর দিয়ে তারা গোল ঘাসের চত্বরটা সোজা মাড়িয়ে গেলো।

 

না! ল্যাংডন চিৎকার করে বললো, সে জানতো কারুজেল দু লুভর-এর একেবারে মাঝখানে একটা গহ্বর আছেলা পিরামিদ ইনভার্সি উল্টো পিরামিড স্কাই-লাইটটা সে জাদুঘরের ভেতরে আগেই দেখেছিলো। ওটা তাদের ছোট্ট স্মার্ট গাড়িটাকে খুব সহজেই গিলে ফেলতে পারার মতোই বিশাল। সৌভাগ্যক্রমে, সোফি সচরাচর রাস্তাটি ব্যবহার করারই সিদ্ধান্ত নিলো। ডান দিকে এক ঝট্কায় বাঁক নিয়ে একটা গোল চক্কর দিয়ে, বাম দিকে মোড় নিয়ে, উত্তর দিকের রুই দ্য রিভোলির পথে এগোলো।

 

দুই টোনের পুলিশের সাইরেনটা তাদের পেছনে চিৎকার করতে করতে তাড়া করে আসছে। ল্যাংডন দরজার পাশের আয়না দিয়ে গাড়ির লাইটটা দেখতে পারলো। সোফি লুভর থেকে বের হয়ে যাবার জন্য গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলে স্মার্ট গাড়িটার ইনজিন একটা আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলো। পঞ্চাশ গজ সামনে, রিভোলির ট্রাফিক লাইটটার লালবাতি জ্বলে উঠলো। সোফি দম নিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়েই যাচ্ছে। ল্যাংডন অনুভব করলো তার পেশীগুলো আড়ষ্ট হয়ে গেছে।

 

সোফি?

 

চৌরাস্তার মোড়ের কাছে এসে একটু ধীর গতি করলো সোফি। গাড়ির হেডলাইটটা জ্বালিয়ে, চোরা চোখে দুপাশটা দেখে নিয়ে, গাড়িটা আবার দ্রুত গতিতে বাম দিকে মোড় নিয়ে সোজা চলে গেলো রিভোলির ফাঁকা রাস্তায়। এরপর তারা শাম্প এলিসির প্রশস্ত এভিনুতে চলে এলো।

 

গাড়িটা সোজা চলতেই ল্যাংডন নিজের আসন থেকে ঘুরে, ঘাড় বেঁকিয়ে রিয়ার উইন্ডো দিয়ে লুভরের দিকে তাকালো। সে দেখতে পেলো পুলিশ আর তাদেরকে তাড়া করছে না। নীল আলোর সমুদ্রে জাদুঘরটা আলোকিত হয়ে আছে।

 

তার হৃদস্পন্দন অবশেষে ধীর-স্থির হলো। ল্যাংডন সোফির দিকে তাকিয়ে বললো, খুব মজার ব্যাপার ছিলো এটা।

 

মনে হলো না কথাটা সোফি শুনতে পেয়েছে। তার চোখ সামনের সুদীর্ঘ শাম্প এলিসির দিকে স্থির হয়ে আছে। দুই মাইল দীর্ঘ অভিজাত প্রান্তরটাকে প্রায়শই প্যারিসের পঞ্চম এভিনু হিসেবে ডাকা হয়। এ্যামবাসিটা এখান থেকে মাত্র এক মাইল দূরে অবস্থিত। ল্যাংডন তার সিটে ঠিক করে বসে পড়লো।

 

So dark the con of man.

 

সোফির চটজলদি চিন্তাটা ছিলো খুব ইমপ্রেসিভ।

 

Modonna of the Rocks.

 

সোফি বলেছে, তার দাদু ছবিটার পেছনে তার জন্যে কিছু একটা রেখে গেছেন। একটা চুড়ান্ত মেসেজ? সনিয়ের অসাধারণ লুকানোর জায়গাটার কথা না ভেবে ল্যাংডন পারলো না; Madonna of the Rocks আজ রাতে ব্যবহৃত প্রতীকগুলোর সাথে একেবারেই সংগতিপূর্ণ আর সামঞ্জস্যপূর্ণ। মনে হচ্ছে, সনিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রেই লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অজানা কালো-অধ্যায় সম্পর্কে বেশ ভক্তির স্বাক্ষর রেখে গেছেন। দা ভিঞ্চির ম্যাডোনা অব দি রকস্ ছবিটা আসলে ইমাকুলেট কনসেপশন নামে পরিচিত একটা ধর্মীয় দলের কাছ থেকে ফরমায়েশ পেয়ে আঁকা হয়েছিলো, যাদের দরকার ছিলো মিলানে অবস্থিত সেন্ট ফ্রান্সেকোর চার্চের বেদীর ঠিক মাঝ বরাবর জায়গায় একটা চিত্রকর্মের। নান লিওনার্দোকে নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন কোন থিমের ওপর ছবিটা হবে কুমারি মেরি, শিশু জন দ্য ব্যাপটিস্ট, ইউরিয়েল এবং শিশু যিশুখৃস্ট একটা গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। যদিও দা ভিঞ্চি অনুরোধক্রমেই ছবিটা এঁকেছিলেন, তারপরও ছবিটা সমাপ্ত করে তাদের কাছে হস্তান্তর করার সময় ঐ দলটি ভয়ে আঁতকে উঠেছিলো কেনো ছবিটাতে তিনি বিস্ফোরণােন্মুখ আর বিব্রতকর জিনিসে ভরে রেখেছিলেন।

 

ছবিটাতে দেখানো হয়েছে, কুমারি মেরি নীল রঙের একটা গাউন পরে কোলে একটা শিশু নিয়ে বসে আছেন, শিশুটা হলো নবজাতক যিশু। মেরির বিপরীতে ইউরিয়েল, সেও আরেকটা নবজাতক নিয়ে বসে আছে, সেই শিশুটা হলো জন দ্য ব্যাপটিস্ট। বিষদৃশ্য ব্যাপারটা হলো, যিশু আর্শীবাদ করছেন জনকে, প্রচলিত এই দৃশ্যটা না রেখে বরং শিশু জনই যিশুকে আর্শীবাদ করছে এমন দৃশ্য দেখানো হয়েছে …আর যিশু সেই ব্যাপারটা অনুমোদন করছেন! আরো সমস্যা আছে, মেরির এক হাত শিশু জনের মাথার ওপর, আর সেটা খুবই ভয় দেখানো ইঙ্গিত করছে তার আঙ্গুলগুলো অনেকটা ঈগল পাখির বাঁকা নখের মতো, একটা অদৃশ্য মাথা ধরে আছে যেনো। চূড়ান্ত যে ভীতিকর জিনিস ছবিটাতে রয়েছে : মেরির কোঁকড়ানো আঙ্গুলগুলোর নিচে ইউরিয়েল হাত দিয়ে একটা আঘাত করার ভঙ্গী করছে—যেনো মেরির থাবা সদৃশ্য হাতে ধরা অদৃশ্য ঘাড়টাকে কেঁটে ফেলবে।

 

ল্যাংডনের ছাত্ররা সব সময়ই এটা জানতে পেরে বিস্মিত হয় যে, দা ভিঞ্চি ধর্মীয় দলটাকে দ্বিতীয় আরেকটা ছবি একে দিয়ে তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করেছিলেন। ওয়াটার ডাউন সংস্করণে মাড়োনা অব দি রকস-এ সবাইকে অনেক বেশি প্রচলিত ভঙ্গীতে দেখানো হয়েছিলো। দ্বিতীয় সংস্করণটা এখন লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে ভার্জিন অব দি রক নামে টাঙানো রয়েছে। অবশ্য ল্যাংডন এখনও লুভরে রাখা প্রথম ছবিটাই পছন্দ করে থাকে।

 

শাম্প এলিসির দিকে যেতেই, সোফি গাড়িটার গতি আরো বাড়িয়ে দিলে ল্যাংডন বললো, চিত্রকর্মটার পেছনে, কি ছিলো?

 

সোফির চোখ ছিলো রাস্তার দিকে। জিনিসটা আমি আপনাকে এ্যামবাসির ভেতরে, নিরাপদে পৌঁছাবার পরেই দেখাবো।

 

তুমি ওটা আমাকে দেখাবে? ল্যাংডন খুব অবাক হয়ে বললো, তিনি তোমার কাছে একটা জিনিস রেখে গেছেন?

 

সোফি হ্যাঁ-সূচক ইঙ্গিত করলো। ফ্লার-দ্য-লিস খোঁদাই করা, সেই সাথে পি,এস অক্ষর সংবলিত।

 

ল্যাংডন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না।

 

 

 

আমরা প্রায় এসে গেছি, স্মার্ট গাড়িটা ডান দিকে মোড় ঘোরাতেই সোফি ভাবলো। বিলাসবহুল হোটেল দ্য সলোয় অতিক্রম করে সারি সারি বৃক্ষের কূটনৈতিক এলাকাটাতে প্রবেশ করলো। এ্যামবাসিটার দূরত্ব এখান থেকে একমাইলেরও কম। সোফির শেষ পর্যন্ত মনে হলো, সে এখন স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে পারছে আবার।

 

গাড়ি চালানোর সময়ও সোফির চিন্তা-ভাবনা আঁটকে ছিলো পকেটে রাখা চাবিটার মধ্যে। অনেক দিন আগের দেখা সেই সোনার চাবিটা, পিএস অক্ষর দুটো আর ফ্লার-দ্য-লিস, সবগুলোই তার মনে পড়ে গেলো।

 

যদিও এতোগুলো বছর ধরে চাবিটা সম্পর্কে সোফি খুব কমই ভেবেছে, তারপরও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ কর্ম করতে করতে সোফি নিরাপত্তাসম্পর্কিত অনেক কিছুই শিখেছিলো। তাই এই অদ্ভুত চাবিটা তার কাছে আর কোন রহস্যময় জিনিস বলে মনে হলো না। একটা লেজার মেট্রিক্স যন্ত্রপাতির মতো। এটা নকল করা অসম্ভব। অন্য চাবির মতো এর কোন দাত নেই, আর প্রচলিত চাবির মধ্যেও এটা কাজ করে না। একটা ইলেকট্রক চক্ষু দ্বারা এটা পরীক্ষিত হলেই কেবল চাবিটা কাজ করবে, অত্যাধুনিক কোন তালা খুলতে। একেবারেই সূক্ষ্ম একটা পদ্ধতি, একটু এদিক ওদিক হলেই কাজ করবে না। তাই এটা নকল করা একেবারেই অসম্ভব।

 

সোফি ভাবতেই পারলো না, এরকম একটা চাবি দিয়ে কোন্ ধরনের জিনিস খোলা যায়। তবে তার মনে হলো রবার্ট এ ব্যাপারে সাহায্য তাকে করতে পারবে। হাজার হোক, জিনিসটা না দেখেই সে এটার খোঁদাই করা প্রতীকটার কথা বলতে পেরেছে। চাবিটার মাথায় আঁকা ক্রশের চিত্রটা কোন বৃস্টিয় সংগঠনের বলে মনে হলেও, সোফি জানতো, কোন চার্চই লেজার চাবি ব্যবহার করে না।

 

তাছাড়া, আমার দাদু খৃস্টান ছিলেন না…

 

এর প্রমাণটা সোফি দশ বছর আগেই প্রত্যক্ষ করেছে। পরিহাসের ব্যাপার হলো, সেটা ছিলো আরেকটা চাবি–অনেক বেশি স্বাভাবিক চাবি যা সোফির কাছে তার সত্যিকারের স্বভাবটা উন্মোচিত করেছিলো।

 

সেই বিকেলটা ছিলো খুবই গরম যখন সোফি শার্ল দ্য গল বিমান বন্দরে নেমেই একটা ট্যাক্সি ধরেছিলো বাড়ি যাওয়ার জন্য। গ্র্যঁ পেয়া আমাকে দেখে খুবই অবাক হবেন। সে ভেবেছিলো। বৃটেনের গ্রাজুয়েট স্কুল থেকে বসন্তের ছুটি কাটাতে একটু আগেই দেশে ফিরেছিলো সে। এনক্রিপশন পদ্ধতি সম্পর্কিত শিক্ষাটা গ্রহণ করে সোফি তার দাদুকে সে সম্পর্কে বলার জন্য আর অপেক্ষা করতে চাইছিলো না।

 

যখন প্যারিসের নিজ বাড়িতে এসে পৌঁছালো, দেখলো তার দাদু বাসায় নেই। হতাশ হলেও সে বুঝতে পারলো, তিনি তো আর জানতেন না সোফি আসবে। অবশ্যই তিনি ভরেই কাজ করছেন। কিন্তু আজতো শনিবার, সে বুঝতে পারলো। তিনি সপ্তাহান্তে কাজ কর্ম থেকে বিরত থাকেন। সপ্তাহান্তে, তিনি সাধারণত হেসে, সোফি গ্যারাজের দিকে ছুটলো। নিশ্চিত ছিলো দাদুর গাড়িটা থাকবে না। সপ্তাহান্তে জ্যাক সনিয়ে একটা গাড়ি নিয়ে একটি জায়গাতেই চলে যান নরম্যান্ডিতে তার অবকাশ যাপনের জন্য তৈরি করা শ্যাতুতে। সেটা প্যারিসের উত্তরে অবস্থিত। লন্ডনে কয়েক মাস কাটিয়ে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে ছুটি কাটাবার জন্য উদগ্রীব ছিলো সোফি। সময়টা তখন ছিলো মাত্র সন্ধ্যা, তাই সে ঠিক করলো, সেখানে গিয়ে দাদুকে চম্‌কে দিবে। এক বন্ধুর কাছ থেকে একটা গাড়ি ধার করে নিয়ে সোফি রওনা দিলো। ঠিক দশটায় পৌঁছালো সেখানে। তাঁর দাদুর শ্যাতুর এলাকায় প্রবেশের পথটা একমাইলেরও বেশি, আর অর্ধেক রাস্তায় আসতেই সে গাছ-পালার ফাঁক দিয়ে বাড়িটা দেখতে পেলো—একটা বিশালাকৃতির পাথরের তৈরি শ্যাতু, পাহাড়ের পাশেই।

 

সোফি আশা করেছিলো এসময়টাতে তার দাদু ঘুমিয়ে থাকবে, কিন্তু বাড়িটাতে বাতি জ্বলতে দেখে সে একটু উত্তেজিত বোধ করলো। তার আনন্দ বিস্ময়ে রূপান্তরিত হলো, যখন সে দেখতে পেলো বাড়ির প্রাঙ্গণটাতে অনেকগুলো গাড়ি পার্ক করা মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, অদি আর রোলস-রয়েস। সোফি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হাসিতে ফেঁটে পড়লো। আমার দাদু, প্রখ্যাত সন্নাসী, জ্যাক সনিয়ে, দেখে মনে হচ্ছে, তিনি নিজেকে যতোটা সন্নাসী হিসেবে দাবি করেন, আসলে তিনি ততোটা নন। সোফির অনুপস্থিতিতে তিনি একটা পার্টির আয়োজন করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। আর পার্ক করা গাড়িগুলো দেখে বোঝাই যাচ্ছে প্যারিসের প্রভাবশালী লোকেরা এখানে উপস্থিত আছেন।

 

তাঁকে চমকে দেবার আশায়, সোফি সামনের দরজার দিকে দ্রুত ছুটে গেলো। কিন্তু দেখতে পেলো দরজাটা বন্ধ। কড়া নেড়ে কোন সাড়া-শব্দ পেলো না। হতভম্ব হয়ে সে পেছনের দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করলো। সেটাও বন্ধ। কোন সাড়া-শব্দ নেই। হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সে কিছু একটা শুনতে পেলো। নরম্যান্ডির উপকূল থেকে ভেসে আসা ঠাণ্ডা বাতাসের ঝিঝির শব্দই কেবল শুনতে পেলো।

 

না কোন সংগীত।

 

না কোন কণ্ঠ।

 

কিছুই না।

 

বনের নির্জনতায়, সোফি দ্রুত বাড়িটার পাশে স্তুপ করা কাঠের উপর উঠে বসার ঘরের জানালা দিয়ে ভেতরে তাকালো। সে যা দেখতে পেলো, তাতে আরো বেশি হতভম্ব হয়ে গেলো।

 

এখানেও কেউ নেই!

 

পুরো ঘরটাতে কেউ নেই, একেবারে ফাঁকা।

 

লোকজন সব কোথায় গেলো?

 

তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো, ছুটে গেলো একটা বক্সের কাছে, যেখানে তার দাদু বাড়তি একটা চাবি লুকিয়ে রাখতেন। সে দৌড়ে সামনের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। অভ্যর্থনা কক্ষে ঢোকামাত্রই সিকিউরিটি সিস্টেমটার লাল বাতি জ্বলতে শুরু করলো—একটা সতর্কতা, প্রবেশকারী দশ সেকেন্ডের মধ্যে সঠিক কোডটা টাইপ না করতে পারলে নিরাপত্তা এলার্মটা বাজতে শুরু করবে।

 

পার্টির সময়টাতে তিনি এলার্ম দিয়ে রাখেন?

 

সোফি দ্রুত কোডটা টাইপ করে এলার্মটা থামালো।

 

ভেতরে ঢুকে সোফি পুরো ঘরটাকে জন-মানবশূন্য দেখতে পেলো। উপরের তলায়ও এরকমই। সে আবারো ফাঁকা অভ্যর্থনা কক্ষে এসে ভাবতে লাগলো, সম্ভাব্য কী ঘটতে পারে।

 

এরপরই সোফি সেটা শুনতে পেয়েছিলো।

 

চাপা একটা কণ্ঠস্বর। আর সেগুলো মনে হচ্ছে নিচ থেকে ভেসে আসছে। সোফি কল্পনাও করতে পারলো না। হামাগুড়ি দিয়ে সে মাটিতে কান পাতলো। হ্যাঁ, শব্দটা নিশ্চিত নিচ থেকেই আসছে। কণ্ঠগুলো মনে হচ্ছে গান করছে, অথবা…ফিসফাস্ করছে? সোফি ভয় পেয়ে গেলো। এই বাড়িতে যে একটা বেসমেন্ট রয়েছে সেটা সোফি জানতো না।

 

এবার অভ্যর্থনা কক্ষের চারপাশটা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো সোফি। পুরো ঘরটাতে সে শুধু একটা জিনিসই খুঁজে পেলো, যা একটু সরে ছিলো তার দাদুর প্রিয় এন্টিক। একটা চওড়া টেপেস্ট, যেটা পূর্ব দিকের দেয়ালে, ফায়ার প্লেসের পাশে সাধারণত টাঙানো থাকে। কিন্তু সেদিন সেটা একটু দূরে সরে ছিলো। যেনো জিনিসটা কেউ ইচ্ছে করেই সরিয়ে রেখেছে। এতে করে ওটার পেছনের দেয়ালটা দেখা যাচ্ছে।

 

কাঠের দেয়ালটার কাছে যেতেই, সোফি শুনতে পেলো আওয়াজটা বেড়ে যাচ্ছে। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে সে কাঠের উপর কান চেপে শুনতে চাইলো। আওয়াজটা এবার খুব পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। লোকগুলো নিশ্চিত সুর করে গাইছে…গানের কথাগুলো সোফি ধরতে পারলো না।

 

এই দেয়ালটার পেছনে ফাঁকা জায়গা আছে!

 

প্যানেলের কোনায়, সোফি টের পেলো একটা ছিদ্র আছে।একটা স্লাইডিং দরজা। তার হৃদস্পন্দন আবারো বেড়ে গেলো। ছিদ্রটার মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে টান দিলো সে। কোন রকম শব্দ ছাড়াই ভারি দরজাটা সরতে লাগলো। ভেতরের অন্ধকার থেকে কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

 

দরজাটা দিয়ে সোফি ভেতরে ঢুকেই দেখতে পেলো খড়খড়ে পাথরের তৈরি একটা সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। সে ছোট বেলা থেকেই এবাড়িতে নিয়মিত আসততা, তারপরও এ ধরনের সিঁড়ির অস্তিত্ব সম্পর্কে তার কোন ধারণাই ছিলো না।

 

ভেতরে ঢুকতেই বাতাসটা ঠাণ্ডা অনুভূত হলো। কণ্ঠস্বরগুলো আরো পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে। এখন সে নারী-পুরুষের কণ্ঠ শুনতে পেলো। সিঁড়ির একেবারে নিচের ধাপে নেমে সে দেখতে পেলো, একটা ছোট বেসমেন্ট ফ্লোর-পাথরের, ফায়ার লাইটের কমলা রঙের আলোতে জায়গাটা আলোকিত হয়ে আছে।

 

দম নিয়ে, সোফি ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। কী হচ্ছে, সেটা দেখতে কয়েক সেকেন্ড লাগলো তার। ঘরটা একটা গুহা—পাহাড়ের গ্রানাইটে তৈরি গহ্বরটা। দেয়ালের একটা মশালই ঘরটার একমাত্র বাতি। বাতির আলোতে, ত্রিশ জন বা সেই সংখ্যক লোক ঘরটাতে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

 

আমি স্বপ্ন দেখছি, সোফি নিজেকে বলেছিলো। একটা স্বপ্ন ছাড়া আর কী?

 

ঘরের সবাই মুখোশ পরে আছে। মহিলারা পরেছে সাদা গাউন আর সোনালি জুতা। তাদের মুখোশগুলো সাদা, হাতে সোনালি রঙের গোলক ধরা। পুরুষেরা কালো আলখেল্লা পরা, তাদের মুখোশও কালো। তাদেরকে দেখে বিশাল দাবার কোর্ট বলে মনে হচ্ছে। বৃত্তের সবাই সামনে এবং পেছনে দুলছে আর সুর করে গাইছে। তাদের সামনে কোন কিছু রাখা আছে, সেটাকে তারা এভাবে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে…কিছু একটা যা সোফি দেখতে পাচ্ছিলো না।

 

সুরধ্বনিটা আরো স্পষ্ট শোনা যেতে লাগলো। সেটা ক্রমশ বেড়ে বজ্রপাতের মতো প্রবল হলো এবার। অংশগ্রহণকারীরা এক কদম এগিয়ে গিয়ে হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো। ঠিক সেই মুহূর্তেই, সোফি মাঝখানে কী হচ্ছে সেটা দেখতে পেলো। দৃশ্যটা দেখে ভয়ে পিছু হটে গেলেও, এই দৃশ্যটাই তার মনে চিরকালের জন্য গেঁথে গিয়েছিলো। তার বমি বমি ভাব হলে সে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে লাগলো। পাথরের দেয়ালটা কোনভাবে হাতরাতে হাতরাতে সে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে চেষ্টা করলো। দরজাটা টেনে বন্ধ করে ঐ বাড়িটা ছেড়ে চলে গেলো সে। কাঁদতে কাঁদতে গাড়ি চালিয়ে সেই রাতে প্যারিসে ফিরে এসেছিলো সোফি।

 

ঐ রাতে সোফি ভগ্নহৃদয় নিয়ে সবকিছু গোছগাছ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। ডাইনিং রুমের টেবিলের ওপর একটা চিরকুট রেখে গিয়েছিলো সে।

 

আমি সব দেখে ফেলেছি। আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবে না।

 

চিরকুটটার পাশেই শ্যাতুর বাড়িটার পুরনো একটা চাবি রেখে দিয়েছিলো।

 

সোফি! ল্যাংডন তাড়া দিয়ে বললো, থামাও! থামাও।

 

স্মৃতি থেকে ফিরে এসে সোফি জোরে ব্রেক কষলো। কি? কি হয়েছে?

 

ল্যাংডন সামনের রাস্তার দিকে ইঙ্গিত করলো।

 

দৃশ্যটা দেখে সোফির রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। একশো গজ সামনে, রাস্তার মোড়টায় ডিসিপিজের কয়েকটা গাড়ি পথ আঁটকে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কার। তারা গ্যারিয়েল এভিটা সিল করে দিয়েছে!

 

ল্যাংডন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এ্যামবাসিতে যাওয়াটা আজ রাতে কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

 

রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ডিসিপিজের দুজন অফিসার তাদের দিকে তাকালো।

 

ঠিক আছে, সোফি, খুব ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে ফেলে।

 

সোফি স্মার্ট গাড়িটা একটু পেছনে নিয়ে বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে ফেললো। গাড়িটা ছুটতেই সে শুনতে পেলো কতগুলো চাকার খ্যা খ্যাচ্‌ শব্দ আর সাইরেনের আওয়াজ। সোফি সঙ্গে সঙ্গে এক্সেলেটরে চাপ দিলো

 

 

 

৩৩.

 

সোফির স্মার্ট গাড়িটা কূটনৈতিক এলাকা ছেড়ে এগিয়ে গেলো। অ্যামবাসি আর কনসুলেটগুলো অতিক্রম করে অবশেষে একটা রাস্তায় এসে পড়লো তারা, সেখান থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে আবার শাম্প-এলিসির বিশাল চত্বরটাতে ফিরে গলো।

 

ল্যাংডন সিটে বসে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখলো কোন পুলিশের গাড়ি দেখা যায় কি না। হঠাৎ করে তার মনে হলো সে আর পালাবে না। তুমি এরকম কোরো না, নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলো। বাথরুমের জানালা দিয়ে জিপিএস ডটটা যখন সোফি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো তখন তার হয়ে সোফিই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলো। এখন অ্যামবাসি থেকে চলে যাবার সময়, শাম্প-এলিসির পথ দিয়ে ছুটতে ছুটতে ল্যাংডনের মনে হলো তার সুযোগগুলো কমতে শুরু করেছে। যদিও মনে হচ্ছে সোফি পুলিশকে ক্ষণিকের জন্য ফাঁকি দিতে পেরেছে কিন্তু ল্যাংডনের সন্দেহ খুব বেশিক্ষণ তারা এভাবে নিজেদের সৌভাগ্য ধরে রাখতে পারবে না।

 

এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে থাকা অবস্থায় অন্য হাত দিয়ে সোফি তার সোয়েটারের পকেট থেকে ধাতব একটা বস্তু বের করে আনলো। জিনিসটা ল্যাংডনের দিকে এগিয়ে ধরলো সে। রবার্ট, জিনিসটা একটু দেখো। এটাই আমার দাদু ম্যাডোনা অব দি রকস্-এর পেছনে রেখে গিয়েছেন।

 

ভেতরে ভেতরে প্রবল উত্তেজনা বোধ করে ল্যাংডন জিনিসটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো। খুব ভারি আর ক্রুশ আকৃতির একটা জিনিস। তার প্রথমে মনে হলো, সে ধরে রেখেছে একটা শেষকৃত্যের পাইকবরের পাশে, মাটিতে পোতা ফলকের ছোটখাটো একটা সংস্করণ। কিন্তু ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলো জিনিসটা আসলে এক ধরনের উন্নত মানের সূক্ষ্ম-যন্ত্রবিশেষ।

 

এটা একটা লেজার-কাট চাবি, সোফি তাকে বললো। শুধুমাত্র ইলেক্ট্রক-আই দিয়েই এটা রিড করা যায়।

 

একটা চাবি? ল্যাংডন কখনও এরকম কিছু দেখেনি।

 

অন্য দিকটা দেখো, সোফি বললো। রাস্তা বদলে একটা মোড়ের কাছে এসে পড়লো তারা।

 

ল্যাংডন যখন চাবিটা ঘুরিয়ে দেখলো তার মুখ হা হয়ে গেলো। কুশটার মাঝখানে খোঁদাই করা ফ্লার-দ্য-লিস এবং পিএস অক্ষর দুটো রয়েছে! সোফি, সে বললো, এই সিলটার কথাই তোমাকে আমি বলেছিলাম। প্রায়োরি অব সাইনর অফিশিয়াল প্রতীক।

 

সে মাথা নেড়ে সায় দিলো। তোমাকে যেমনটা বলেছিলাম, আমি চাবিটা অনেক আগে একবার দেখেছিলাম। তিনি আমাকে এ ব্যাপারে কখনও কোন কিছু বলতে বারণ করে দিয়েছিলেন।

 

ল্যাংডনের চোখ তখনও চাবিটার দিকেই নিবদ্ধ। এর অতি উন্নত প্রাযুক্তিক কৌশল আর বহু প্রাচীন প্রতীকের সহাবস্থান আধুনিকতা আর প্রাচীনের সংমিশ্রন বলে মনে হলো তার কাছে।

 

তিনি আমাকে বলেছিলেন চাবিটা দিয়ে একটা বাক্স খোলা যায়, যেখানে তিনি অনেক গোপনীয় কিছু রাখেন।

 

ল্যাংডন এটা ভেবে খুব শীতল অনুভব করলো যে, জ্যাক সনিয়ের মতো একজন মানুষ কী ধরনের সিক্রেট রাখতে পারেন। একজন প্রাচীন ভ্রাতৃসংঘের মানুষ এরকম একটা চাবি দিয়ে কী করতেন। ল্যাংডনের সে সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। প্রায়োরিরা একটা সিক্রেটকেই রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সংগঠনটির পত্তন করেছিলেন। অবিশ্বাস্য ক্ষমতার একটা সিক্রেট। এই চাবিটা কি সে সবের সাথে সংশ্লিষ্ট? ভাবনাটা তাকে রোমাঞ্চিত করলো।

 

তুমি কি জাননা এটা দিয়ে কী খোলা যায়?

 

সোফিকে দেখে খুব হতাশ মনে হলো। আমি আশা করেছিলাম তুমিই সেটা জানো।

 

ল্যাংডন নিরবে চাবিটার ক্রশ পরীক্ষা করতে লাগলো। এটা দেখতে খৃস্টিয় বলে মনে হচ্ছে, সোফি জানালো।

 

ল্যাংডন অবশ্য এ ব্যাপারে অতোটা নিশ্চিত ছিলো না। চাবির মাথায় যে কুশটা আঁকা আছে সেটা প্রচলিত খৃস্টিয় ক্রশের মতো একটা বাহু লম্বা নয়, বরং এটার চারটা বাহুই সমান-চারটা বাহু দৈর্যে একেবারে একই রকম-যা খৃস্টাব্দের পনেরোশ বছর আগেকার সময়কেই নির্দেশ করছে। এই ধরনের ক্রশ কোন খৃস্টিয় ধর্ম সম্পর্কিত নয়, যা ক্রুশবিদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট। রোমানরা যেটা শাস্তি দেয়ার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতো। ল্যাংডন সব সময়ই অবাক হয়ে ভেবেছে, কতজন খৃস্টান এটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, তাদের প্রতীকের রক্তাক্ত ইতিহাসটা এর নামকে সঠিকভাবেই প্রতিধ্বনিত করছে : ক্রশ এবং ক্রুশিফিক্স বা ক্রুশবিদ্ধ শব্দটা এসেছে লাতিন ক্রিয়াপদ Cruiare থেকে-মানে, নির্যাতন করা।

 

সোফি, সে বললো, আমি যেটা তোমাকে বলতে পারি সেটা হলো, এরকম সমান বাহুর ক্রশকে শান্তিপূর্ণ ক্রশ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তাদের চারকোনা আকৃতিটা ক্রুশবিদ্ধ করার জন্য অনুপোযোগী হয়ে যায়, তাদের উলম্ব আর আনুভূমিক ভারসাম্য নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সম্মিলনকে ইঙ্গিত করে। এটা প্রায়োরিদের দর্শনের একটি প্রতীকি উপস্থাপন।

 

সোফি একটা হতাশাপূর্ণ ভঙ্গী করলো। তোমার কোন ধারণা নেই, তাই না?

 

ল্যাংডন ভুরু তুলে বললো, একটা ক্লুও পাচ্ছি না।

 

ঠিক আছে, আমাদেরকে রাস্তাটা ছাড়তে হবে। সোফি তার বিয়ার-ভিউটা দেখে নিলো। আমাদেরকে নিরাপদ একটা জায়গায় গিয়ে খুঁজে বের করতে হবে চাবিটা দিয়ে কী খোলা যায়।

 

ল্যাংডন তার হোটেল রিজ-এর আরামদায়ক ঘরটির কথাই প্রথমে ভাবলো। নিশ্চিতভাবেই এটা কোন জায়গা হতে পারে না। প্যারিসে আমার আমেরিকান ইউনিভার্সিটির নিমন্ত্রণকতার জায়গাটা কেমন হয়?

 

এটা একদম নিশ্চিত, ফশে তাদের ওখানে সবার আগে খোঁজ নেবে।

 

তুমি এখানে থাকো, অনেককেই নিশ্চয় চেননা।

 

ফশে আমার ফোন, ই-মেইল রেকর্ড ঘেঁটে দেখবে, আমার সহকর্মীদের সাথে কথা বলবে। আমার পরিচিতজনদের কোন জায়গা নিরাপদ হবে না, আর কোন হোটেলে যাওয়াটাও ঠিক হবে না, সব জায়গায়ই আইডি কার্ড চাইবে।

 

ল্যাংডন আবার ভাবতে লাগলো, যদি সে লুভরেই ফশের হাতে গ্রেফতার হোতো তবেই বেশি ভালো হতো। আসো, অ্যামবাসিতে ফোন করি। আমি তাদের সমস্ত পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে পারবো আর অ্যামবাসির কাউকে আমাদের সাথে অন্য কোথাও দেখা করার জন্য লোক পাঠাতে বলবো।

 

আমাদের সাথে দেখা করা? সোফি তার দিকে ঘুরে এমনভাবে তাকালো যেনো ল্যাংডন একজন পাগল। রবার্ট, তুমি স্বপ্ন দেখছো। তোমার অ্যামবাসি নিজের কম্পাউন্ডের বাইরে এরকম কোন আইনগত ক্ষমতা রাখে না। আমাদেরকে নেয়ার জন্য লোক পাঠানোর অর্থ হলো ফরাসি সরকারের একজন ফেরারী আসামীকে সাহায্য করা। এটা হবে না। তুমি যদি তোমার অ্যামবাসিতে গিয়ে সাময়িক আশ্রয় চাওয়ার অনুরোধ করো সেটা একটা কথা, কিন্তু তাদের কাছে ফরাসি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিরুদ্ধে যায় এমন কিছু চাওয়াটা? সোফি মাথা ঝাঁকালো। তোমার অ্যামবাসিকে এক্ষুণি ফোন করে, তারা তোমাকে বলবে আর বেশি ক্ষতি না করে ফশের কাছে ধরা দিতে। তারপর তারা প্রতীজ্ঞা করবে কূটনৈতিকভাবে ব্যাপারটা মীমাংসা করার, যাতে তুমি ন্যায় বিচার পাও। সোফি শাম্প-এলিসির অভিজাত এলাকার দিকে তাকালো। তোমার কাছে কি পরিমাণ টাকা আছে?

 

ল্যাংডন মানি ব্যাগটা দেখে নিলো। একশো ডলার, আর কিছু ইউরো। কেন?

 

ক্রেডিট কার্ড?

 

অবশ্যই।

 

সোফি গাড়িটার গতি বাড়াতেই ল্যাংডন অনুমান করতে পারলো সে একটা পরিকল্পনা আঁটছে। একেবারে সামনে শাম্প-এলিসির শেষ মাথায় আর্ক দ্য ট্রায়াঙ্গ অবস্থিত-নেপোলিয়নের ১৬৪ ফুট উচ্চতার স্মৃতিস্তম্ভ যা তার সেনাবাহিনীর শক্তিকে প্রকাশ করছে-সেটার চারপাশ ঘিরে রয়েছে ফ্রান্সের সবচাইতে বড় একটা চত্বর।

 

সেখানে পৌঁছাতেই সোফি আবারো বিয়ার-ভিউ আয়না দিয়ে তাকালো। কিছুক্ষণের জন্য হলেও তাদেরকে আমরা ফাঁকি দিতে পেরেছি, সোফি বললো, কিন্তু এই গাড়িতে যদি আমরা থাকি তবে পাঁচ মিনিটও আর টিকতে পারবো না।

 

তো, অন্য আরেকটা গাড়ি চুরি করতে হবে, ল্যাংডন মনে মনে বললো, আমরা এখন সত্যিকারের অপরাধী। তুমি কি করতে চাও?

 

সোফি গাড়িটা দ্রুত গতিতে চত্বরটার সামনে নিয়ে গেলো। আমার উপর আস্থা রাখো।

 

ল্যাংডন কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আজ রাতে আস্থা তাকে খুব বেশি দূর অবধি নিয়ে যেতে পারেনি। শার্টের হাতা গুটিয়ে হাত ঘড়িটা দেখলো-একটা পুরনো, সংগ্রহশালার সংস্করণের মিকি মাউস হাত-ঘড়ি, যা তার বাবা-মা তার দশম জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলো। যদিও এটা দেখতে অল্পবয়সীদের মতো লাগে তবুও ল্যাংডন কখনও এটা বাদে অন্য কোন ঘড়ি পরেনি; আকার এবং রঙের জাদুর সাথে তার প্রথম পরিচয় ডিজনির কার্টুনের মধ্য দিয়ে। আর মিকি, ল্যাংডনকে প্রতিদিনের সময়ের কথা স্মরণ করার মধ্যে দিয়ে তাকে মনের দিক থেকে তরুণ করে রেখেছে। এখন মিকির হাত দুটো অত ভীতে আছে, ইঙ্গিত করছে সেরকমই অত সময়টাকে।

 

২টা ৫১ মিনিট।

 

মজার ঘড়িতো, গাড়িটা একটানে ঘোরাতে ঘোরাতে তার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সোফি বললো।

 

এটার লম্বা একটা গল্প আছে, হাতটা নামিয়ে সে বললো।

 

আমারও সে রকমই ধারণা। তার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা হাসি দিলো সে। গাড়িটা ঘুরিয়ে উত্তর দিকে গেলো। রাস্তাটা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে চলে গেছে। মোড়টা ছাড়িয়ে যেতেই তারা গাড়ির গতি বাড়িয়ে বুলেভার্ড মলেশাব-এর দিকে ছুটলো। সারি সারি গাছপালা সমৃদ্ধ কূটনৈতিক এলাকা ছেড়ে ঘন আঁধারে ঢাকা শিল্পাঞ্চলের ভেতরে ঢুকে পড়লো তারা। সোফি বাম দিকে মোড় নিতেই ল্যাংডন বুঝতে পারলো তারা এখন কোথায় আছে।

 

গার সেন্ট-লাজারে।

 

তাদের সামনে কাঁচের ছাদের ট্রেন টার্মিনালটা দেখতে অনেকটা এয়ারপ্লেন হ্যাঙ্গার অথবা গৃন-হাউজের মতোই লাগছে। ইউরোপের ট্রেন স্টেশনগুলো কখনও ঘুমায় না। এমন কি এই সময়ে প্রবেশ দ্বারের সামনে আধ ডজন ট্যাক্সি অলসভাবে দাড়িয়ে আছে। গাড়িতে করে স্যান্ডউইচ আর মিনারেল ওয়াটার বিক্রি করছে ফেরীওয়ালারা, মুটে-মজুররা মাল-পত্র ওঠানো নামানোর জন্য অপেক্ষা করছে। রাস্তার ওপরে দাঁড়ানো কয়েকজন পুলিশ পর্যটকদেরকে রাস্তা-ঘাট চেনার কাজে সহায়তা দিচ্ছে।

 

যদিও পার্কিং এলাকাতে পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে তারপরও সোফি তার গাড়িটা ট্যাক্সি পার্ক করা জায়গার ঠিক পেছনে রেঙ-জোন এলাকায় থামালো। ল্যাংডন তাকে কী হচ্ছে বা কী করবে জিজ্ঞেস করার আগেই সোফি গাড়ি থেকে নেমে সামনের ট্যাক্সিটার জানালা দিয়ে ড্রাইভারের সাথে কথা বলতে শুরু করে দিলো।

 

ল্যাংডন গাড়ি থেকে নামতেই দেখতে পেলো সোফি ড্রাইভারকে এক বান্ডিল টাকা দিচ্ছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার মাথা নেড়ে ল্যাংডনকে বিস্মিত করে তাদের ছেড়ে চলে গেলো।

 

কি হয়েছে? ট্যাক্সিটা চলে যেতে দেখে ল্যাংডন জানতে চাইলো।

 

সোফি ইতিমধ্যেই ট্রেন স্টেশনের প্রবেশদ্বারের দিকে এগিয়ে গেছে। আসো। আমরা পরের ট্রেনেই প্যারিস ছেড়ে যাবার জন্য দুটো টিকেট কিনবো।

 

ল্যাংডন তার পিছু পিছু দ্রুত ছুটতে লাগলো। ইউএস অ্যামবাসি থেকে এক মাইল দূরে এসে এখন যা শুরু হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে একেবারে প্যারিসই ছাড়তে হবে। ল্যাংডন এই আইডিয়াটাকে একদমই পছন্দ করতে পারছিলো না।

 

 

 

৩৪.

 

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিমান বন্দর থেকে যে ড্রাইভার বিশপ আরিঙ্গারোসাকে তুলে নিলো সে একটা ছোট্ট সাদা-মাটা কালো ফিয়াট সিডান গাড়ি নিয়ে এসেছে। আরিজারোসার মনে পড়ে গেলো সেইসব দিনগুলোর কথা যখন ভ্যাটিকানের পরিবহন শাখায় ছিলো ব্যয়বহুল আর অভিজাত সব গাড়ি, যাতে মেডেল আর হলি সির সিলযুক্ত পতাকা উড়তো। সেইসব দিন আর নেই। ভ্যাটিকানের গাড়িগুলো জৌলুস হারিয়েছে, এখন আর সেগুলোর সবগুলোতে কোন কিছু দিয়ে চিহ্নিত করা থাকে না। ভ্যাটিকানের দাবি, এতে করে খরচ কমিয়ে বিশপদের এলাকায় আরো বেশি সেবামূলক কাজ করা যাবে। তবে আরিঙ্গারোসার সন্দেহ এটা আসলে নিরাপত্তার জন্যই করা হয়েছে। পৃথিবীটা উন্মাদ হয়ে গেছে, আর ইউরোপের অনেক অংশেই তোমার যিশুর জন্য ভালবাসার বিজ্ঞাপনটা করা হয়ে থাকে অনেকটা তোমার গাড়ির ছাদে ষাড়ের চোখ আঁকার মতো করে।

 

কালো আলখেল্লাটা বেঁধে নিয়ে আরিজারোসা গাড়ির পেছনের সিটে গিয়ে বসলেন কাস্তেল গাডোলফোর উদ্দেশ্যে লম্বা একটা ভ্রমণের জন্য। এটা হবে ঠিক পাঁচ মাস আগের ভ্রমণের মতোই।

 

গত বছরের রোমের ভ্রমণ, তিনি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। আমার জীবনের দীর্ঘতম একটি রাত।

 

পাঁচ মাস আগে ভ্যাটিকান তাকে ফোন করে বলেছিলো সঙ্গে সঙ্গে যেনো রোমে উপস্থিত হয়। তারা কোন ব্যাখ্যা দেয়নি। আপনার টিকিট এয়ারপোর্টেই আছে। হলি সি একটা ঢেকে থাকা রহস্য পুণরুদ্ধারের জন্য প্রবলভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন, এমনকি এর উচ্চতম যাজকও। এই রহস্যময় ডেকে আনাটা, আরিঙ্গাবোসা ভেবেছিলেন, সম্ভবত ওপাস দাইর সাম্প্রতিক সফলতার জন্য পোপ এবং ভ্যাটিকানের অন্যান্য কর্মকর্তাদের সাথে ছবি তোলার একটা সুযোগ-নিউইয়র্কে তাদের বিশ্ব-সদর দফতরের কাজ সমাপ্ত হয়েছিলো। আর্কিটেকচারাল ডাইজেস্ট ওপাস দাইর ভবনটাকে আধুনিক স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে ক্যাথলিকদের জৌলুসের উজ্জ্বল আলো, হিসেবে বর্ণনা করেছিলো। শেষ পর্যন্ত মনে হলো ভ্যাটিকান আধুনিক শব্দটার সাথে কোন না কোনভাবে জড়িয়ে গেছে।

 

দাওয়াতটা কবুল করা ছাড়া আরিজারোসার কোন উপায় ছিলো না। তারপরও তিনি অনিশ্চয়তা নিয়েই সেটা মেনে নিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ের পাপাল প্রশাসনের কোন ভক্ত হিসেবে নয়, আরিজারোসা অন্যসব রক্ষণশীল যাজকদের মতোই, নতুন পোপের প্রথম বছরটা প্রচণ্ড উদ্বিগ্নতার সাথে লক্ষ্য করে যাচ্ছিলেন, কীভাবে তিনি তার অফিস চালান সেটা দেখতে। একটা নজিরবিহীন উদারতায় হিজ হলিনেস ভ্যাটিকানের ইতিহাসের সবচাইতে বির্তকিত কনক্লেইভ-এর মধ্য দিয়ে পাপাসিটাকে সুরক্ষিত করেছিলেন। পোপ এখন ঘোষণা দিয়েছেন, তার পাপাল মিশনটা হবে ভ্যাটিকানের মতবাদকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করা এবং ক্যাথলিকবাদকে তৃতীয় সহস্রাব্দের উপযোগী করে গড়ে তোলা। এই কাজটাকে অন্যেরা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে বলে আরিজারোসার আশংকা হয়েছিল। যারা মনে করে আধুনিককালে ক্যাথলিকবাদ অকেজো, তাদের মন জয় করার জন্য লোকটা কি ঈশ্বরের আইনকে নতুন করে লেখার মতো দুঃসাহস দেখাবে?

 

আরিঙ্গাবোসা ওপাস দাই আর তাদের ব্যাংকের মাধ্যমে সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে পোপ এবং তার উপদেষ্টাদেরকে চাপ দিলেন। বোঝালেন, চার্চের নিয়ম কানুন শিথিল করার মাধ্যমে শুধুমাত্র বিশ্বাসহীনতাই তৈরি হবে না বরং রাজনৈতিকভাবেও আত্মহত্যা করা হবে।

 

তিনি অতীতে চার্চের নিয়ম-কানুন পরিবর্তন করার ভ্যাটিকানের দ্বিতীয় ফিয়াকোটার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, যে ঘটনাটি মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়েছিলো : চার্চের বর্তমান সময়ে উপস্থিতির হার যে কোন সময়ের তুলনায় কম, আর্থিক সাহায্যও কমে আসছে, এমনকি ক্যাথলিক চার্চে সভাপতিত্ব করার মতো পর্যাপ্ত সংখ্যক পাদ্রীরও সংকট চলছে এখন।

 

চার্চ থেকে লোকজন গঠনমূলক এবং কিছু দিকনির্দেশনাও প্রত্যাশা করে, আরিঙ্গাবোসা চাপাচাপি করেছিলেন, আসকারা দেয়া কিংবা প্রশ্রয় দেয়াটা তারা আশা করে না।

 

কয়েক মাস আগের সেই রাতে, ফিয়াটটা এয়ারপোর্ট থেকে ভ্যাটিকানের দিকে না গিয়ে পূর্বদিকের একটা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে চলে গিয়েছিলো। আরিঙ্গাবোসা খুবই অবাক হয়েছিলেন। আমরা কোথায় যাচ্ছি? ড্রাইভারের কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন।

 

আলবান হিল-এ, লোকটা জবাব দিয়েছিলো। আপনার সাক্ষাক্টা হবে কাস্তেল গাভোলফোতে।

 

পোপের গ্রীষ্মকালীন আবাস? আরিঙ্গাবোসা কখনও সেখানে যায়নি, যাওয়ার ইচ্ছেও হয়নি কখনও। পোপের এই বাড়তি আবাসটা, ষষ্ঠ শতাব্দীর স্পেকুলা ভ্যাটিকানা, সিটাডেল হাউজ ছিলো-ভ্যাটিকানের অবজারভেটরি-ইউরোপের সবচাইতে অগ্রসর অবজারভেটরির মধ্যে এটা অন্যতম। আরিঙ্গাবোসা ভ্যাটিকানের বিজ্ঞান নিয়ে ছেলেমানুষী করার ইতিহাসটায় খুবই ব্ৰিত বোধ করেন। বিজ্ঞান এবং বিশ্বাসের সংমিশ্রনের যৌক্তিকতা কি? যে ব্যক্তি ঈশ্বরে বিশ্বাস ধারণ করে তার দ্বারা নিরপেক্ষ বিজ্ঞান ভাবনা সম্ভব নয়। যেমনটা সম্ভব নয় বিশ্বাসী কারোর পক্ষে তার বিশ্বাসের স্বপক্ষে বস্তুগত কোন প্রমাণের।

 

যাহোক, এইতো এটা, কাস্তেল গান্ডোলফোটা দৃষ্টিগোচর হলে তিনি মনে মনে বলেছিলেন। নভেম্বরের তারা ভরা আকাশে বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা। দূর থেকে প্রাসাদটাকে দেখা যায় ইতালিয় সভ্যতার পাদপীঠে-যে উপত্যকায় কুরিয়াজি এবং ওরাজি ক্লান লড়াই করেছিলো রোম পত্তন হবার অনেক আগে।

 

প্রাসাদটার ছায়া দেখেও মনে হবে একটা আত্মরক্ষামূলক স্থাপত্যের চমৎকার অবয়ব। দুঃখজনক হলো, আরিঙ্গাবোসা দেখতে পান ভ্যাটিকান প্রাসাদটাকে এর ছাদের উপর বিশাল বড় দুটো অ্যালুমুনিয়ামের টেলিস্কোপ বসানোর মধ্য দিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। যেনো এককালের গর্বিত কোন যোদ্ধার মাথায় পার্টি টুপি পরিয়ে দেয়া হয়েছে।

 

আরিঙ্গাবোসা গাড়ি থেকে নামতেই একজন তরুণ যাজক খুব দ্রুত ছুটে এসে তাঁকে অভিবাদন জানিয়েছিলো। বিশপ, আপনাকে স্বাগতম। আমি ফাদার মাঙ্গাননা। এখানকার একজন জ্যোর্তিবিদ।

 

আপনার জন্য উপযুক্ত জায়গা। আরিঙ্গাবোসা শুভেচ্ছা বিনিময় করে ফাদারের পিছু পিছু প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করেন। অভ্যর্থনা কক্ষটি বেশ খোলামেলা জায়গা, সেখানকার সাজসজ্জা বেঁনেসা চিত্রকলা এবং জ্যোর্তিবিদ্যার চিত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে। এতে করে জৌলুসহীন হয়ে পড়েছে ভেতরের পরিবেশ। বিশাল এবং প্রশস্ত মার্বেলের সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার সময় আরিঙ্গাবোসা লক্ষ্য করেন কনফারেন্স রুম, সায়েন্স লেকচার হল আর পর্যটন তথ্য সার্ভিস ইত্যাদি সাইনগুলো। এটা তাকে বিস্মিত করলো। তিনি ভাবেন, ভ্যাটিকান প্রতিটি ক্ষেত্রেই আধ্যাত্মিকতার সমৃদ্ধি না ঘটিয়ে বরং পর্যটকদের কাছে ভৌত জ্যোর্তিবিদ্যার বক্তৃতা দিয়ে থাকে।

 

আমাকে বলুন, আরিজারো তরুণ যাজককে বলেন, কখন থেকে লেজে কুকুর নাড়াতে শুরু করেছে?

 

তরুণ যাজক তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। স্যার?

 

আরিঙ্গাবোসা ইশারা করে ব্যাপারটা ক্ষান্ত দেন। তিনি ঠিক করেন আজকের সন্ধ্যায় আর এইসব ব্যাপার নিয়ে আক্রমণাত্মক কোন কিছু বলবেন না। ভ্যাটিকান উন্মাদ হয়ে গেছে।

 

ওপরের তলার করিডোরটা খুবই প্রশস্ত, একদিকেই চলে গেছে সেটা-একটা বিশাল ও কাঠের দরজার দিকে, যেটাতে পিতলের একটা সাইন লাগানো :

 

BIBLIOTECA ASTRONOMICA

 

আরিঙ্গাবোসা এই জায়গাটা সম্পর্কে শুনেছিলেন-ভ্যাটিকানের জ্যোর্তিবিদ্যার লাইব্রেরি-গুজব আছে, এখানে পঁচিশ হাজার ভলিউম সংরক্ষণ করা আছে, যার মধ্যে কোপার্নিকাসের বিরল কাজগুলোও রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটন আর সেচ্চির। আরো অভিযোগ আছে, এখানেই পোপের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা গোপন মিটিং করে থাকে…এসব মিটিং তারা ভ্যাটিকানের চার দেয়ালের মধ্যে করাটা পছন্দ করেন না।

 

দরজার দিকে এগোতে থাকা বিশপ আরিঙ্গাবোসা কখনও কল্পনাও করতে পারেননি ভেতরে ঢুকে তিনি কী রকম দুঃখজনক একটি সংবাদ শুনবেন। এই ঘটনাই তাকে একটা মিশনে নামতে প্রবৃত্ত করেছিলো। এখন থেকে ছয় মাস পরে। মনে মনে ভাবলেন তিনি। ঈশ্বর আমাদের সাহায্য করুন।

 

 

 

এখন ফিয়াটে বসে বিশপ আরিঙ্গাবোসা বুঝতে পারলেন, প্রথম মিটিংটার কথা ভেবে তার হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি তার মুঠোটা খুলে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিয়ে তার পেশীগুলো নিস্তেজ করলেন।

 

সবকিছু ঠিকঠাক মতো হবে, ফিয়াটটা পাহাড়ী পথে উঠতেই তিনি নিজেকে বললেন। তিনি এখনও আশা করছেন তাঁর সেলফোনটা বাজুক। টিচার কেন ফোন করছে না আমাকে? সাইলাস হয়তো এরইমধ্যে কি-স্টোনটা পেয়ে থাকবে।

 

নিজের নাভটা স্থিত করার জন্য বিশপ তার হাতের আঙটির বর্ণালি এমেথিস্টটার দিকে তাকিয়ে ধ্যান করার চেষ্টা করলেন। তার এও মনে হলো, হাতের পাথরটার যে ক্ষমতা আছে তার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতা তিনি খুব শীঘ্রই অর্জন করতে যাচ্ছেন।

 

 

 

৩৫.

 

গার সেন্ট লাজারের ভেতরটা দেখতে ইউরোপের অন্যান্য ট্রেন স্টেশনের মতোই, ছোট-ঘোট গমন-নির্গমনের দরজা, অনেকটা গুহার মতো-গৃহহীন লোকেরা হাতে সাইনবোর্ড ধরে আছে, কতোগুলো স্কুল কলেজের ছাত্র পিঠে ঝোলা নিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমাচ্ছে, কেউবা এমপি খৃ কানে লাগিয়ে গান শুনছে, নীল রঙের ব্যাগেজ নিয়ে সিগারেট ফুকছে একদল মুটে।

 

সোফি উপরে ঝোলানো বিশাল ডিপার্চার বোর্ডটার দিকে তাকালো। কালো আর সাদা ট্যাবগুলো বদলে যাচ্ছে, ভেসে উঠছে নতুন তথ্য। আপডেটগুলো শেষ হলে ল্যাংডন সেটা দেখলো। তালিকার সবার উপরের লেখাটা পড়লো সে :

 

লিলে-রেপাইড-৩:০৬

 

মনে হচ্ছে এটা খুব শীঘ্রই ছাড়বে, সোফি বললো।

 

শীঘই। ল্যাংডন তার ঘড়ির দিকে তাকালো : ২:৫৯। ট্রেনটা সাত মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে যাবে আর এখন পর্যন্ত তারা টিকেট হাতে পায়নি।

 

সোফি ল্যাংডনকে কাউন্টারের দিকে নিয়ে গিয়ে বললো, তোমার ক্রেডিট কার্ডটা দিয়ে দুটো টিকেট কেনো।

 

আমার মনে হয় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলে ওরা ট্রে করে ফেলবে–

 

একেবারেই ঠিক।

 

ল্যাংডন এগিয়ে গিয়ে ভিসাকার্ডটা দিয়ে লিলের দুটো টিকেট কিনে সোফির হাতে তুলে দিলো।

 

তাকে নিয়ে অন্য জায়গায় চলে গেলো সোফি। একটা পরিচিত কণ্ঠ মাথার উপর বেজে চলছে। পিএ ঘোষক লিলের বোর্ডিংয়ের জন্য চুড়ান্ত আহ্বান জানাচ্ছে। তাদের সামনে যোলোটা রেললাইন চলে গেছে। দূরের ডান দিকে, তিন নম্বর লাইনটাতে লিলের ট্রেনটা ছাড়ার জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু সোফি ল্যাংডনের কোমর এক হাতে জড়িয়ে ধরে তাকে ঠিক বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। তারা লবিটা এবং সারারাত খোলা থাকে এমন একটা কফিশপ পেরিয়ে অবশেষে স্টেশনের পশ্চিম দিকের দরজা দিয়ে বের হয়ে বাইরে ফাঁকা রাস্তায় এসে পড়লো।

 

দরজাটার সামনেই খালি একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। সোফিকে দেখেই হেডলাইট জ্বালালো ড্রাইভার।

 

সোফি গাড়িটার পেছনের সিটে গিয়ে বসে পড়লে ল্যাংডনও তাকে অনুসরণ করে পেছনে গিয়ে বসলো।

 

ট্যাক্সিটা স্টেশন থেকে ছেড়ে যেতেই সোফি এইমাত্র কেনা টিকেট দুটো বের করে ছিঁড়ে ফেললো।

 

ল্যাংডন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সতেরো ডলার কতো ভালোভাবেই না খরচ করা হলো।

 

তাদের ট্যাক্সিটা উত্তর দিকের রুই দ্য ক্লিচিতে না আসা পর্যন্ত ল্যাংডনের মনে হলো না তারা পালাতে পেরেছে। ডান দিকের জানালা দিয়ে সে দেখতে পেলো চমৎকার সুন্দর মস্তমাত্রে আর মনোরম স্যাকর-কোয়ে। বিপরীত দিক থেকে পুলিশের গাড়ির হেডলাইটের আলোতে দৃশ্যগুলো দেখতে বাঁধা পেলো।

 

সাইরেনের আওয়াজটা পেতেই ল্যাংডন আর সোফি নিচু হয়ে শুয়ে পড়লো।

 

সোফি ড্রাইভারকে আগেই বলে দিয়েছিলো সোজা শহরের বাইরে বেড়িয়ে যেতে, আর ল্যাংডন সোফির শক্ত চোয়ালটা দেখে অনুমান করতে পারলো পরবর্তী পরিকল্পনাটাও মনে মনে এঁটে নিচ্ছে মেয়েটা।

 

ল্যাংডন ক্রুশাকৃতির চাবিটা আবার পরীক্ষা করতে লাগলো। জানালার সামনে তুলে ধরলো সেটা, খুব কাছে নিয়ে দেখতে চেষ্টা করলো ওটাতে কোন মার্ক দেয়া আছে কি না, যাতে বোঝা যায় চাবিটা কোথায় বানানো হয়েছে। কিন্তু এই স্বল্প আলোতে সে কেবল প্রায়োরি সিলটা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না।

 

কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, বললো সে।

 

কোনটা?

 

তোমার দাদু এতো কষ্ট করে তোমার কাছে এমন একটা চাবি দিয়ে গেলেন যা দিয়ে কী করতে হবে সেটা তুমি জানো না।

 

ঠিক বলেছো।

 

তুমি কি নিশ্চিত তিনি ছবিটার পেছনে অন্য কিছু লেখেননি?

 

আমি পুরো জায়গাটা খুঁজেছি। এটাই শুধু ছিলো। এই চাবিটা ছবিটার পেছনে ছিলো। আমি প্রায়োরি সিলটা দেখেই চাবিটা পকেটে ভরে চলে এসেছি।

 

ল্যাংডন কপাল কুচকে চাবির ত্রিভূজাকৃতির দণ্ডটার দিকে তাকালো। কিছুই নেই। এবার চাবিটার মাথা ভালো করে দেখলো। সেখানেও কিছু নেই। আমার মনে হচ্ছে চাবিটা সম্প্রতি পরিষ্কার করা হয়েছে।

 

কেন?

 

এটা থেকে এলকোহলের গন্ধ পাচ্ছি।

 

সোফি ঘুরে তাকালো। বুঝলাম না?

 

এটা থেকে গন্ধ পাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে কেউ এটা ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করেছে। ল্যাংডন চাবিটা নাকের কাছে ধরে গন্ধ শুকলো। এদিকটাতে আরো বেশি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে জিনিসটা উল্টে দেখলো। হ্যাঁ, এলকোহলই। মনে হচ্ছে। ক্লিনার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অথবা– ল্যাংডন থামলো।

 

কি?

 

সে চাবিটা আলোর কাছে কোনাকুনি করে ধরে এটার মসৃন পৃষ্ঠটার দিকে তাকালো। ভেজা-ভেজা মনে হচ্ছে, তাই চকচক করছে। চাবিটা পকেটে ঢোকানোর আগে তুমি এটার পেছনে কি ভালো করে দেখেছো?

 

কি? না, ভালো করে দেখিনি। আমার খুব তাড়া ছিলো।

 

ল্যাংডন সোফির দিকে ঘুরলো। তোমার কাছে কি ব্ল্যাক লাইটটা আছে?

 

সোফি তার পকেট থেকে ইউভি পেনটা বের করে দিলে ল্যাংডন সেটা হাতে নিয়ে জ্বালিয়ে চাবিটার পেছন দিকে আলোর লম্মি ফেললো।

 

পেছনটা সাথে সাথে জ্বলজ্বল করে উঠলো। কিছু একটা লেখা আছে।

 

তো, ল্যাংডন হেসে বললো। আমার মনে হয় এলকোহলের গন্ধের কারণ কি সেটা আমি জানি।

 

সোফি বিস্ময়ে চাবিটার পেছনে বর্ণালি লেখাটার দিকে তাকিয়ে আছে।

 

২৪ রুই হ্যাক্সে

 

একটা ঠিকানা। আমার দাদু একটা ঠিকানা লিখে গেছেন।

 

সেটা কোথায়? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

 

এ ব্যাপারে সোফির কোন ধারণাই ছিলো না। সামনের দিকে ঝুঁকে গাড়ির ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো সে, কনোসেজ-তু লা রুই হস্লো?

 

ড্রাইভার একটু ভেবে মাথা নেড়ে সায় দিলো। সে জানালো জায়গাটা প্যারিসের বাইরে, পশ্চিম দিকে অবস্থিত টেনিসকোটের কাছেই। সোফি তাকে তক্ষুণিই সেই জায়গায় যেতে বললো।

 

দ্রুত যাওয়ার রাস্তাটা হলো বোয়ে দ্য বুলোয়াঁ দিয়ে, ড্রাইভার ফরাসিতে সোফিকে জানালো। ওদিক দিয়ে যাবো?

 

সোফি একটু চিন্তা করলো। সে চাইছে যতো কম সমস্যা হয় তেমন একটা পথ ধরে যেতে কিন্তু আজ রাতে হয়তো সেটা সম্ভব হচ্ছে না। উই। আমরা এই বেড়াতে আসা আমেরিকানটাকে একটু ঘাবড়ে দিতে পারবো।

 

সে চাবিটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, এটা দিয়ে ২৪ রুই দ্য হ্যাক্সোতে গিয়ে কী খুঁজে পাবে। একটা চার্চ? প্রায়োরিদের হেড কোয়ার্টার জাতীয় কিছু?

 

তার আবারো মনে পড়ে গেলো, দশ বছর আগে বেসমেন্টে দেখা সেই গোপন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানটার কথা, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। রবার্ট, তোমাকে আমার অনেক কথা বলার আছে। সোফি একটু থেমে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। ট্যাক্সিটা পশ্চিম দিকে ছুটছে এখন। কিন্তু প্রথমে আমি চাই তুমি আমাকে প্রায়োরি অব সাইওন সম্পর্কে সব কিছু খুলে বলো।

 

 

 

৩৬.

 

সল দে এতাত-এর বাইরে, বেজু ফশে লুভরের ওয়ার্ডেনের কাছে সোফি আর ল্যাংডন কিভাবে তাকে নিরস্ত্র করে পালিয়ে গেছে সেটা শুনে ফুসতে লাগলো। আপনি কেন ছবিটাতে গুলি করলেন না।

 

ক্যাপ্টেন? লেফটেনান্ট কোলেত কমান্ড-পোস্ট থেকে এসে বললো। ক্যাপ্টেন, এইমাত্র আমি শুনলাম, তারা এজেন্ট সোফির গাড়িটার অবস্থান জানতে পেরেছে।

 

সে কি অ্যামবাসির দিকে যাচ্ছে?

 

না। ট্রেন স্টেশনে। দুটো টিকেট কিনেছে। ট্রেনটা এইমাত্র ছেড়েছে।

 

ফশে ওয়ার্ডেন গ্রুয়ার্দকে হাত নেড়ে চলে যেতে বলেই কোলেতকে নিয়ে একটু আড়ালে গেলো। নিচু স্বরে বললো, গন্তব্যটা কোথায়?

 

লিলে।

 

সম্ভবত একটা ফাদ। ফশে খুব আগ্রহ নিয়ে একটা পরিকল্পনা আঁটলো। ঠিক আছে, পরের স্টেশনকে সতর্ক করে দাও। দরকার হলে ট্রেনটা থামিয়ে তল্লাশী করতে বলো। সোফির গাড়িটা বাদ দিয়ে, ওখানে সাদা পোশাকের কিছু লোককে নজরদারিতে রাখো, যদি তারা ফিরে আসে সেক্ষেত্রে তাদেরকে পাকড়াও করা যাবে। স্টেশন এলাকার আশেপাশে কিছু লোক পাঠিয়ে দিও, তারা যদি পায়ে হেঁটে পালাতে চায় তো ধরা যাবে। স্টেশন থেকে কি বাস ছাড়ে?

 

এই সময়টাতে, স্যার। শুধু ট্যাক্সি ছাড়ে। ভালো।

 

ড্রাইভারদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ কোরো। দেখো, তারা তাদের দেখেছে কী। তারপর ট্যাক্সি কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করবে। আমি ইন্টারপোলে ফোন করছি।

 

কোলেতকে খুব অবাক হতে দেখা গেলো। আপনি এই ব্যাপারটা ওখানে জানাবেন?

 

ফশে সম্ভাব্য ব্ৰিত হওয়ায় অনুশোচিত হলো কিন্তু এছাড়া তার কিছু করারও নেই।

 

জালটা খুব দ্রুত গুটিয়ে ফেলল, খুব শক্ত করে করো।

 

প্রথম ঘন্টাটি হলো খুব জটিল। পালানোর পর ফেরারীরা প্রথম ঘণ্টায় খুব বেশি অনুমেয় থাকে। তাদের সবসময়ই দরকার হয় একই জিনিস। ভ্রমণ। আশ্রয়। টাকা। পবিত্র-জয়ী। ইন্টারপোল এই তিনটি উধাও হওয়া জিনিস চোখের পলকে খুঁজে বের করতে পারে। ল্যাংডন আর সোফির ছবি প্যারিসের ট্রালে অধিকর্তা, হোটেল আর ব্যাংকে প্রচার করার মধ্য দিয়ে ইন্টারপোল কোন অপশনই বাদ রাখবে না-শহর ছেড়ে যাবার কোন পথই আর থাকবে না। কোথাও পালানো যাবে না, আর কোথাও থেকে নিজের পরিচয় লুকিয়ে টাকাও তোলা যাবে না। সাধারণত ফেরারীরা রাস্তাঘাটে ভয়ে থাকে, বোকার মতো কাজ করে বসে। হয়তো একটা গাড়ি চুরি করে। কোন দোকানে ডাকাতি করে। মরিয়া হয়ে ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করে। যে ভুলই তারা করুক না কেন, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের অবস্থান খুব দ্রুতই জানাজানি হয়ে যায়।

 

শুধু ল্যাংডন, ঠিক আছে? কোলেত জানতে চাইলো। আপনি সোফি নেভুকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। সে তো আমাদেরই এজেন্ট।

 

অবশ্যই। আমি তাকে নিয়ে ব্যস্ত হবো ফশে জোর দিয়ে বললো। সে যদি ল্যাংডনের সব নোংরা কাজগুলো করে ফেলে তো ল্যাংডনকে নিয়ে টানাটানি করাতে আর লাভ কী? আমি নেভু ফাইলটা দেখার কথা ভাবছিবন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, ব্যক্তিগত যোগাযোগ-এমন কেউ, যার কাছে সোফি সাহায্যের জন্য যেতে পারে। আমি জানি না সে কী করছে কিন্তু এটা শুধু তার চাকরিই খাবে না তারচেয়েও বেশি কিছু হবে!

 

আপনি কি আমাকে ফোনে রাখতে চান, না ফিল্ডে?

 

ফিল্ডে। ট্রেন স্টেশনে গিয়ে পুরো দলটার সমন্বয় করো। তুমিই সবকিছু করবে, তবে আমার সাথে কথা না বলে কোন পদক্ষেপ নেবে না।

 

জি, স্যার। কোলেত দ্রুত চলে গেলো।

 

ফশের মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। বাইরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে সে কাঁচের পিরামিডটা দেখতে পেলো। জ্বলজ্বল করছে সেটা। জানালায়ও সেই আলোর ছটা এসে পড়েছে। তারা আমার হাত ফসকে বেড়িয়ে গেছে, মনে মনে বললো সে।

 

এমনকি একজন প্রশিক্ষিত এজেন্টও ইন্টারপোলের চাপ সহ্য করতে পারবে না, সেটা পারলে সেই এজেন্টটার জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপারই হবে।

 

একজন মহিলা ক্রিপ্টোলজিস্ট আর একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

 

ভোর পর্যন্তও তারা টিকতে পারবে না।

 

 

 

৩৭.

 

গভীর বনে আচ্ছাদিত উদ্যান যা বোয়ে দ্য বুলোয়াঁ হিসেবে পরিচিত। একে অনেক নামে ডাকা হলেও প্যারিসবাসি এটাকে জানে জাগতিক আনন্দের উদ্যান হিসেবেই। প্রশংসাসূচক কথাটা খুব বেশি বাড়াবাড়ি মনে হলেও সেটা একেবারেই স্ববিরোধী। একই নামে লুরিড ব-এর চিত্রকর্মটা কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে। ছবিটা বনের মতোই খুব কালো আর দোমড়ানো-মোচরানো, বিপথগামী আর জড়বস্তুর পূজা করে যারা তাদের জন্য প্রায়শ্চিত্তমূলক। রাতের বেলায় বনের মধ্যে রাস্তাগুলোতে শতশত চক্চকে শরীর দাঁড়িয়ে থাকে ভাড়া খাটার জন্য, জাগতিক ফুর্তিকে সন্তুষ্ট করার জন্য, কারোর গহীনের অকথিত কামনা নিবৃত্তির জন্য-নারী, পুরুষ, আর এদের মাঝামাঝি যারা আছে, সবাই।

 

ল্যাংডন সোফিকে প্রায়োরি অব সাইওন সম্পর্কে বলার জন্য মনস্থির করতেই পার্কের কাঠের তৈরি প্রবেশদ্বারটা পেরিয়ে পশ্চিম দিকের নুড়ি পাথরের ক্রশফেয়ারের দিকে এগিয়ে গেলো তাদের গাড়িটা। পার্কের নিশাচর অধিবাসীরা গাড়ির হেডলাইটের আলোতে আরো বেশি করে ল্যাংডনের চোখের সামনে উদ্ভাসিত হতে লাগলো, এতে তার মনোেযোগর বিঘ্ন ঘটলো। সামনে দুজন নগ্নবক্ষের অল্পবয়স্কা মেয়ে ট্যাক্সিটার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের পাশেই এক কৃষ্ণাঙ্গ শরীরে তেল মেখে নিজের পশ্চাদদেশ প্রদর্শন করছে। তার সাথে এক অসাধারণ সোনালি চুলের মেয়ে নিজের মিনিস্কাটটা তুলে ধরে বোঝাতে চাইছে, আসলে সে মেয়ে নয়।

 

ঈশ্বর আমাকে সাহায্য করো! ল্যাংডন তার চোখটা সরিয়ে নিয়ে গাড়ির ভেতরে তাকিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিলো।

 

আমাকে প্রায়োরি অব সাইওন সম্পর্কে বলো, সোফি বললো।

 

ল্যাংডন মাথা নাড়লো, কোথেকে শুরু করবে ভেবে পেলো না। ভ্রাতৃসংঘের ইতিহাসটা হাজার বছরের…একটা বিস্ময়কর সিক্রেট, ব্ল্যাকমেইল, বিশ্বাসঘাতকতা, এমনকি একজন রাগী পোপের হাতে বর্বর নির্যাতনের ইতিহাস এটি।

 

প্রায়োরি অব সাইওন? সে বলতে শুরু করলো, ফরাসি সম্রাট গড়ফই দ্য বুইলো ১০৯৯ সালে জেরুজালেম দখল করে নেবার পর পরই জেরুজালেমে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

 

সোফি মাথা নাড়লো, তার চোখ ল্যাংডনের দিকে স্থির হয়ে আছে।

 

সম্রাট গড়ফই একটা শক্তিশালী সিক্রেটের অধিকারী ছিলেন বলে গুজব ছিলো খৃস্টের সময় থেকেই সিক্রেটটা তার পরিবারের কাছে ছিলো। তিনি মারা গেলে সিক্রেটটা চিরতরে হারিয়ে যাবে বলে তার আশংকা ছিলো, তাই তিনি একটা ভ্রাতৃসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন-প্রায়োরি অব সাইন-তিনি তাদেরকে সিক্রেটটা রক্ষা করার জন্যে বংশ পরম্পরায় এটা ধারণ করতে প্ররোচিত করেছিলেন। জেরুজালেমে সেই সময়ে প্রায়োরি অব সাইন জানতে পারলো, একগাদা দলিল-দস্তাবেজ ভগ্ন প্রায় হেরোডর মন্দিরের নিচে লুকিয়ে রাখা আছে। এই মন্দিরটা সলোমনের মন্দিরের ভগ্নাবশেষের ওপরেই নির্মাণ করা হয়েছিলো। তারা বিশ্বাস করতো এইসব দলিল গড়ইর শক্তিশালী সিক্রেটটার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং সেগুলো এতোটাই উত্তেজনা সৃষ্টিকারী যে, চার্চ যেভাবেই হোক তাদেরকে নিবৃত্ত করে ওগুলো আয়ত্তে নিতে চাইবে।

 

সোফিকে দেখে মনে হলো সে বুঝতে পারছে না।

 

প্রায়োরিরা প্রতীজ্ঞা করলো, যতো সময়ই লাগুক না কেন এইসব দলিল মন্দিরের নিচ থেকে উদ্ধার করে চিরতরের জন্য সংরক্ষণ করা হবে, যাতে সত্যটা কখনই হারিয়ে না যায়। দলিলগুলো ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করার জন্যে প্রায়োরিরা একটি সামরিক বাহিনী সৃষ্টি করলো-নয়জন নাইটের একটি দল, যাদেরকে ডাকা হতো অর্ডার অব দি পুওর নাইটস্ অব ক্রাইস্ট অ্যান্ড দ্য টেম্পল অব সলোমন নামে। ল্যাংডন একটু থামলো। সাধারণভাবে যারা পরিচিত ছিলো নাইট টেম্পলার হিসেবেই।

 

সোফি বিস্ময়ে তার দিকে তাকালো, তার চাহনিতে আছে স্বীকৃতি।

 

ল্যাংডন নাইট টেম্পলারদের সম্পর্কে প্রায়ই বক্তৃতা দিয়ে থাকে। সে এও জানে, পৃথিবীর প্রায় সবাই এদের সম্পর্কে জানে। নিদেনপক্ষে, অর্থহীনভাবে হলেও। একাডেমিকদের জন্য টেম্পলারের ইতিহাস একটা আজব জগৎ, যেখানে সত্য-মিথ্যা, নানান মতবাদ, ভুল তথ্য, এমনভাবে একটার সাথে আরেকটা মিলে আছে যে, তা থেকে খাটি সত্যটা বের করে আনা প্রায় অসম্ভব। আজকাল ল্যাংডন নাইট টেম্পলারদের ব্যাপারে বক্তৃতা দিতেও বেশ দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, কারণ সেটা নিশ্চিতভাবেই কতিপয় ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্বের বাধার সম্মুখীন হয়।

 

সোফিকে খুব হতভম্ব দেখালো। তুমি বলছো নাইট টেম্পলাররা প্রায়োরি অব সাইন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো একটা গোপন দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে? আমি জানি টেম্পলারদের জন্ম হয়েছিলো পবিত্রভূমি সুরক্ষার জন্য।

 

একটা সার্বজনীন ভুল ধারণা। তীর্থযাত্রী দলের সুরক্ষার ধারণাটি আসলে একটা ভান, যার আড়ালে টেম্পলাররা তাদের মিশন পরিচালনা করতো। পবিত্র ভূমির জন্য তাদের সত্যিকারের লক্ষ্যটা হলো, ভগ্নপ্রায় মন্দিরের নিচ থেকে দলিল-দস্তাবেজগুলো দখলে নেওয়া।

 

তাঁরা কি সেটা খুঁজে পেয়েছিলো?

 

ল্যাংডন ভুরু তুললো। কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না কিন্তু একটা ব্যাপারে সব একাডেমিকরাই একমত, তা হলো : নাইটরা ভগ্নস্তুপের নিচ থেকে কিছু একটা খুঁজে পেয়েছিলো…যাতে তারা ধারণাতীতভাবেই সম্পদশালী এবং ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে।

 

ল্যাংডন খুব দ্রুত সোফিকে নাইট টেম্পলারদের সম্পর্কে স্ট্যান্ডার্ড একাডেমিক রূপরেখাটি ব্যাখ্যা করলো। পবিত্র ভূমির নাইটরা দ্বিতীয় ক্রুসেডের সময় কীভাবে ছিলো। তারা সম্রাট দ্বিতীয় বন্ডউইনকে বলেছিলো, খৃস্টান তীর্থযাত্রী দলগুলোকে যাত্রা পথে রক্ষা করবে তারা। যদিও বেতনহীন আর আর্থিকভাবে দরিদ্র ছিলো তারপরও নাইটরা ম্রাটকে বলেছিলো, তাদের একটা আশ্রয়ের দরকার, অনুরোধ করেছিলো ভগ্নপ্রায় মন্দিরের মধ্যেই যেনো তাদের আবাসন দেয়া হয়। স্রাট বন্ডউইন তাদের অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন, আর তখনই নাইটরা সেই জরাজীর্ণ মন্দিরে নিজেদের আস্তানা গেঁড়ে বসেছিলো।

 

আস্তানা গাঁড়ার এমন পছন্দের ব্যাপারটা ল্যাংডন ব্যাখ্যা করলো, আর যাই হোক কাকতালীয় ব্যাপার ছিলো না। নাইটরা বিশ্বাস করতে প্রায়োরিরা যেসব দলিল খুঁজছে সেগুলো ধ্বংসাবশেষের নিচে রয়েছে-হলি অব হলিস্-এর নিচে একটা পবিত্র কক্ষ, যেখানে স্বয়ং ঈশ্বর থাকেন বলে তারা বিশ্বাস করতো। আক্ষরিক অর্থে ইহুদীদের বিশ্বাসের মূলের মতোই। প্রায় একদশক ধরে নয়জন নাইট সেই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বাস করেছিলো আর শক্ত পাথর খুঁড়ে বের করে এনেছিলো সিক্রেটটা।

 

সোফি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। তুমি বলছে তারা কিছু একটা উদঘাটন করেছিলো?

 

অবশ্যই তারা পেয়েছিলো, ল্যাংডন বললো, ব্যাখ্যা করলো কীভাবে এই কাজটা করতে নয় বছর লেগেছিলো। অবশেষে নাইটরা যা খুঁজছিলো সেটা পেয়ে যায়। মন্দির থেকে সম্পদটা নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বের হয়েছিলো তাঁরা। সেখানে তাঁদের প্রভাব রাতারাতি সুদৃঢ় হয়েছিলো।

 

নিশ্চিত করে কেউ জানে না, নাইটরা কি ভ্যাটিকানকে রাকমেইল করেছিলো নাকি চার্চ তাঁদের নিরবতা কিনে নিয়েছিলো। কিন্তু পোপ দ্বিতীয় ইনোসেন্ট খুব দ্রুতই একটা নজিরবিহীন পাপাল বুল ইসু জারি করেছিলেন, যাতে নাইট টেম্পলারদেকে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়ে তাদেরকে তারা নিজেরাই স্বয়ং আইন-একটা স্বায়ত্তশাসিত সেনাবাহিনীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। তারা সম্রাট এবং রাজ্যের কোনো কর্তৃপক্ষেরই অধীনে নয়, সবকিছু থেকেই তারা স্বাধীন, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় দুই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও।

 

ভ্যাটিকানের কাছ থেকে নতুন এই ক্ষমতার স্বীকৃতি পাবার পর নাইট টেম্পলাররা দ্রুত রাজনৈতিক শক্তি এবং সংখ্যায় বাড়তে লাগলো। এক ডজনেরও বেশি দেশে বিশাল রাজ্য জমিয়ে ফেললো তারা। দেউলিয়া লোকদেরকে ঋণ দিয়ে বিনিময়ে সুদ চালু করলো। এভাবেই আধুনিক ব্যাংকের পত্তন করে এবং নিজেদের সম্পদ ক্রমাগতভাবে বাড়াতে থাকে তাঁরা।

 

১৩০০ সালের মধ্যে, ভ্যাটিকানের প্রদত্ত ক্ষমতার বলে, নাইটদের ক্ষমতা এতো বেড়ে গেলো যে, পোপ পঞ্চম ক্লেমেন্ত ঠিক করলেন, কিছু একটা করতেই হবে। ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ ফিলিপের সাথে যৌথভাবে মিলে পোপ একটা সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা আঁটলেন। টেম্পলারদের সম্পদটা জব্দ করে ভ্যাটিকান যাতে সিক্রেটটার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। একটা সামরিক কৌশলের মাধ্যমে, অনেকটা সিআইএর সঙ্গেই সেটা তুলনীয়, পোপ ক্লেমেন্ত একটা সিলংকিত গোপন নির্দেশ পাঠালেন, যা সমগ্র ইউরোপের সৈনিকরা একই সাথে খুলেছিলো, শুক্রবার, অক্টোবর ১৩, ১৩০৭ সালে।

 

তেরো তারিখের ভোর বেলায়, সিলংকিত নির্দেশটা ভোলা হলে বিষয় বস্তুগুলো প্রকাশিত হলো। ক্লেমেন্তের চিঠিতে দাবি করা হলো যে, ঈশ্বর তাঁকে দেখা দিয়ে বলেছেন, নাইট টেম্পলাররা জঘন্য রকমের শয়তানের পূজা অর্চনা করছে, সমকামীতা আর কুশকে অপব্যাখ্যা সহ অন্যান্য ঈশ্বর নিন্দার কাজ করছে। পোপ ক্লেমেন্তকে ঈশ্বর নির্দেশ দিয়েছেন, সব নাইটদের ধরে এনে নির্যাতন করে তাদেরকে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অপরাধের স্বীকারোক্তি আদায় করে সব কিছু শুদ্ধ করতে হবে। ক্লেমেন্তের ম্যাকিয়াভেলীয় অপারেশনটা ঠিক ঘড়ির কাটা ধরে করা হয়েছিলো। সেদিনটাতে, অগুণতি নাইটকে ধরা হয়েছিলো। প্রচণ্ড নির্যাতনের পর ধর্মবিরোধীতা করার দণ্ডে দণ্ডিত করে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো। ট্র্যাজেডিটার প্রতিধ্বনি এখনও আধুনিক সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হয়ে আসছে; আজকের দিনের তেরো তারিখের শুক্রবারকে দূর্গ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

 

সোফিকে খুব হতবিহবল দেখালো। নাইট টেম্পলারদেরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে? আমি ভাবতাম টেম্পলারদের ভ্রাতৃসংঘের অস্তিত্ব আজও টিকে আছে।

 

তা আছে, বিভিন্ন নামে। ক্লেমেন্তের মিথ্যা অভিযোগ এবং তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার সর্বাত্মক চেষ্টার পরও, নাইটদের ছিলো শক্তিশালী মিত্র। তাদের অনেকেই ভ্যাটিকানের রোষাণল থেকে পালিয়ে যেতে পেরেছিলো। টেম্পলারদের মূল্যবান সম্পদটা, যা তাদের ক্ষমতার উৎসও বটে, সেটাই ছিলো ক্লেমেন্তের আসল লক্ষ্য, কিন্তু সেটা তার হাত ফসূকে বের হয়ে গিয়েছিলো। দলিল-দস্তাবেজগুলো দীর্ঘদিন ধরে টেম্পলারদের কাছে নিরাপদে ছিলো, পরে তাদেরই ছায়া দল, প্রায়োরি অব সাইন, সিক্রেটটা ভ্যাটিকানের রুদ্ররোষ থেকে বাঁচিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। প্রায়োরিরা তাদের দলিলটা প্যারিস থেকে রাতের অন্ধকারে লা রশেলের টেম্পলারদের জাহাজে করে পাচার করেছিলো।

 

দলিল-দস্তাবেজগুলো গেলো কোথায়?

 

ল্যাংডন কাঁধ ঝাঁকালো। এই রহস্যময় উত্তরটা কেবলমাত্র জানে প্রায়োরি অব সাইওন। কারণ দলিলগুলো এখনও, এমনকি আজকের দিনেও, বিরামহীন তদন্ত আর তল্লাশীর শিকার।

 

বার কয়েকই এগুলো ধরা পড়ে যাচ্ছিলো প্রায়। সাম্প্রতিককালে, অনুমান করা হয়, দলিলগুলো যুক্তরাজ্যের কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

 

সোফি একটু অস্বস্তি বোধ করলো।

 

হাজার বছর ধরে, ল্যাংডন বলে চললো, সিক্রেটটার কিংবদন্তী হস্তান্তর হয়ে আসছে। পুরো দলিলটা, এটার ক্ষমতা এবং সিক্রেটটা একটি নামেই পরিচিত স্যাংগৃল। এর ওপরে শত শত বই লেখা হয়েছে। স্যাংগৃলের মতো আর কোন রহস্যই ইতিহাসবিদদের এতো বেশি কৌতূহলী করেনি।

 

স্যাংগৃল? শব্দটা কি ফরাসি শব্দ স্যাং অথবা স্পেনিশ স্যাংগার-এর সাথে সম্পর্কিত–যার অর্থ রক্ত?

 

ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো। রক্ত হলো স্যাংগুলের মেরুদণ্ড, তারপরও সেটা সোফি যেমনটি কল্পনা করছে সেরকম কিছু নয়। কিংবদন্তীটা খুব জটিল, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটা স্মরণে রাখা দরকার, তা হলো, সত্যটা প্রকাশ করার জন্য প্রায়োরিরা ইতিহাসের সঠিক সময়টার জন্য অপেক্ষা করছে।

 

সত্যটা কি? কী এমন সিক্রেট, যা খুবই শক্তিশালী হতে পারে?

 

ল্যাংডন খুব বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। সোফি, sangreal একটা প্রাচীন শব্দ। এটা সময়ে আরেকটা শব্দে রূপান্তরিত হয়ে গেছে… একটা আধুনিক নামে। সে একটু থামলো। যখন আমি তোমাকে এর আধুনিক নামটা বলবো, তখন তুমি বুঝতে পারবে, এ সম্পর্কে তুমি অনেক কিছুই জানো। সত্যি বলতে কী, পৃথিবীর প্রায় সবাই sangreal এর গল্পটা শুনেছে।

 

সোফি সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। আমি এ সম্পর্কে কখনও কিছু শুনিনি।

 

অবশ্যই শুনেছো। ল্যাংডন হাসলো। তুমি এটা হলি গ্রেইল নামে চেনো।

 

 

 

৩৮.

 

সোফি গভীর সতর্কতার সাথে ট্যাক্সির পেছনে বসা ল্যাংডনের দিকে তাকালো। সে ঠাট্টা করছে। হলি গ্রেইল?

 

ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো, তার ভাবভঙ্গী খুবই গুরুগম্ভীর। স্যাংগৃলের আক্ষরিক অর্থ হলো হলি গ্রেইল। শব্দটা এসেছে ফরাসি Sangraal থেকে, যা Sangreal-এ রূপান্তরিত হয়েছে, আর সেটাই প্রকারন্তরে দুটি শব্দ San Greal-এ বিভক্ত হয়ে গেছে।

 

হলি গ্রেইল। সোফি ভাষাগত সংযোগটা তৎক্ষণাৎ ধরতে না পারাতে অবাক হলো। তারপরও, ল্যাংডনের দাবি টা তার কাছে বোধগম্য বলে মনে হচ্ছে না। আমি জানতাম হলি গ্রেইল হলো একটা পেয়ালা।…আর তুমি বলছো স্যাংগৃল হলো কতোগুলো দলিল-দস্তাবেজ, যা খুব গভীর কোন সিক্রেটকে উন্মাচিত করে।

 

হ্যাঁ, স্যাংগৃল দলিল-দস্তাবেজগুলো হলি গ্রেইলের অর্ধেক গুপ্তধন। সেগুলো গ্রেইলের সাথেই সমাধিস্থ হয়ে আছে…আর এর সত্যিকারের অর্থটা প্রকাশ করে। দলিল-দস্তাবেজগুলো নাইট টেম্পলারদেরকে খুবই শক্তিশালী করে তুলেছিলো, কারণ এসব পৃষ্ঠায় গ্রেইলের সত্যিকারের ধারণাটা উন্মোচিত হয়েছে।

 

গ্রেইলের সত্যিকারের ধারণা? সোফির এখন নিজেকে আরো বেশি হতবিহ্বল মনে হলো। সোফি জানতো হলি গ্রেইল হলো একটা পেয়ালা, যা যি লাস্ট সাপারে পান করেছিলেন। যাতে পরবর্তীতে, আরিমাথিয়ার জোসেফ ক্রুশবিদ্ধের রক্ত পেয়েছিলেন। হলি গ্রেইল হলো যিশুর পেয়ালা, সে বললো, এর চেয়ে সহজ আর কী হতে পারে?

 

সোফি, ল্যাংডন নিচুস্বরে বললো, এখন তার দিকে ঝুঁকে আছে সে। প্রায়োরি অব সাইন-এর মতে, হলি গ্রেইল মোটেও কোন পেয়ালা নয়। তারা দাবি করে গ্রেইলের পেয়ালার কিংবদন্তীট আসলে একটা রূপক ধারণ করে আছে। খুব দক্ষতার সাথেই সেটা করা হয়েছে। তার মানে, গ্রেইলের কাহিনীটাতে পেয়ালার ব্যবহারটা একটা রূপক, যার অর্থ এমন, যা খুবই শক্তিশালী কিছুর চেয়েও বেশি। সে একটু থামলো। এমন কিছু, যার সাথে তোমার দাদু আজ যা বলতে চেষ্টা করেছেন, তার সবকিছুর সাথেই একেবারেই খাপ খেয়ে যায়। তাঁর সব প্রতীকধর্মী উল্লেখই পবিত্র নারীকে নির্দেশ করে।

 

তবুও অনিশ্চিত, সোফি আঁচ করতে পারলো, ল্যাংডনের ধৈর্যের হাসিটাতে তার দ্বিধাটা ধরা পড়েছে। তারপরও তার চোখে আন্তরিকতা। কিন্তু, হলি গ্রেইল যদি একটা পেয়ালা না হয়ে থাকে, সোফি জিজ্ঞেস করলো, তাহলে সেটা কি?

 

ল্যাংডন জানতো এই প্রশ্নটা করা হবে, তারপরও কীভাবে তাকে কথাটা বলবে বুঝতে পারছিলো না। সে যদি উত্তরটা এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সহকারে না উপস্থাপন করে, তবে সোফির আবারো বিস্ময় হওয়া ছাড়া আর কিছুই হবে না ঠিক এরকম অবাক হবার ভঙ্গী ল্যাংডন কয়েক মাস আগে তার লেখা নতুন পাণ্ডুলিপিটা হস্ত ত্তির করার সময় তার সম্পাদকের চেহারায় দেখতে পেয়েছিলো।

 

এই লেখাটায় কি দাবি করা হয়েছে? তার সম্পাদক মদের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বিস্ময়ে বলেছিলেন। তাঁর সামনে পড়ে ছিলো আধা খাওয়া লাঞ্চ। তুমি সত্যি বলছো নাকি।

 

একদম সত্যি, একবছর ধরে গবেষণা করার মতোই সিরিয়াস।

 

নিউইয়র্কের বিখ্যাত সম্পাদক জোনাস ফকম্যান তার থুতনীর দাঁড়িটা চুলকাতে চুলকাতে বলেছিলেন। ফম্যানের কোন সন্দেহই ছিলো না যে, তার বর্নাঢ্য পেশাগত জীবনে এমন অদ্ভুত বইয়ের কথা কখনই শশানেনি। কিন্তু, এই বইটার কথা শুনে লোকটা হতভম্ব হয়ে গেলো।

 

রবার্ট, ফকম্যান অবশেষে বলেছিলেন, আমাকে উল্টাপাল্টা কিছু বোলো না। আমি তোমার কাজ পছন্দ করি, আর আমরা দুজন একসঙ্গে খুব অসাধারণ কাজ করেছি। কিন্তু আমি যদি এই ধরনের বই প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিই, তবে লোকজন আমাকে আমার অফিসের সামনেই একমাস ধরে পেটাতে থাকবে। তাছাড়া, এতে তোমার সুনামকেও একেবারে শেষ করে দেবে। তুমি হারভার্ডের একজন ইতিহাসবিদ। ঈশ্বরের দোহাই, তুমি কোন পপকমিস্টার নও যে, দ্রুত টাকা কামানোর ধান্দা করছে। এই রকম একটা তত্ত্বকে প্রমাণ করার জন্য তুমি পর্যাপ্ত এবং বিশ্বাসযোগ্য আলামত কোথেকে পাবে?

 

নিরব হাসি দিয়ে ল্যাংডন তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ফকম্যানকে দিয়েছিলো। কাগজটাতে পঞ্চাশেরও বেশি শিরোনামের তালিকা ছিলো খুবই সুপরিচিত ইতিহাসবিদদের বইয়ের তালিকা। কিছু সাম্প্রতিক কালের, কিছু শত বছরেরও পুরনো অনেকগুলোই একাডেমিক বেস্টসেলার। সবগুলো বইয়েরই শিরোনাম, ল্যাংডন এইমাত্র যা বলেছে, সেই বিষয়টারই ইঙ্গিত করছে। ফকম্যান তালিকাটা পড়ার পর তাকে দেখে মনে হলো, এইমাত্র তিনি আবিষ্কার করেছেন যে, পৃথিবীটা আসলে সমতল। আমি এখানে কিছু কিছু লেখকদের চিনি। তারা… সত্যিকারের ইতিহাসবিদ!

 

ল্যাংডন হাসলো। আপনি দেখতেই পাচ্ছেন, জোনাস, এটা শুধু আমার নিজের মতবাদ নয়। অনেকদিন আগে থেকেই এটা হয়ে আসছে। আমি কেবলমাত্র এটার ওপর কিছু একটা নির্মাণ করতে চাচ্ছি। এখন পর্যন্ত কোন বই-ই হলি গ্রেইলের ঐতিহাসিক কিংবদন্তীটাকে সিমোলজিমের দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেনি। তত্ত্বটার পক্ষে, প্রমাণের জন্য আমি যেসব আইকনোগ্রাফিক প্রমাণ-পত্র খুঁজে বের করেছি, সেগুলো খুবই গ্রহণযোগ্য।

 

ফকম্যান তালিকাটার দিকেই তাকিয়ে রইলো। হায় ঈশ্বর, এইসব বইয়ের একটা লেখক তো দেখি স্যার লেই টিবিং—একজন বৃটিশ রয়্যাল ইতিহাসবিদ।

 

টিবিং তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময়ই ব্যয় করেছেন হলি গ্রেইল নিয়ে পড়াশোনা করে। তিনি আসলে, আমার অনুপ্রেরণার একটা বিশাল অংশ। তালিকার অন্য সবার মতোই, তিনি একজন বিশ্বাসী, জোনাস।

 

তুমি আমাকে বলছো, এইসব ইতিহাসবিদরা আসলে বিশ্বাস করেন… ফকম্যান একটা ঢোক গিললেন, প্রকারন্তরে তিনি শব্দটা বলতেই পারলেন না।

 

ল্যাংডন আবারো দাঁত বের করে হাসলো। হলি গ্রেইলটা তর্কাতীতভাবেই মানবেতিহাসের সবচাইতে বেশি গুপ্তধন সন্ধানের প্রচেষ্টা। গ্রেইলটা কিংবদন্তী ছড়িয়েছে, যুদ্ধ বাঁধিয়েছে, আর আজীবন এটা অন্বেষণ করা হয়েছে। এতে করে কী মনে হয়, এটা একটা নিছকই পেয়ালা? যদি তাই হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই অন্য পুরানিদর্শনগুলো একই রকম কিংবা আরো বেশি কৌতূহলের জন্ম দিতে রাজ মুকুট, সত্যিকারের ক্রুশবিদ্ধের কুশটা, টিটালাসটা—তারপরও সেগুলো নয়। ইতিহাস জুড়েই হলি গ্রেইল বিশেষ কিছু একটা হিসেবে ছিলো। ল্যাংডন হাসলো। এখন আপনি বুঝতে পারছেন কেন।

 

ফকম্যান বার বার মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন। কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে এইসব বই লেখা হলেও, কেন এই মতবাদটা এতো বেশি সুপরিচিত নয়?

 

এইসব বই শত শত বছরের প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের সাথে টক্কর দিতে পারেনি। বিশেষ করে এমন ইতিহাসের সাথে, যা সর্বকালের সেরা বিক্রি হওয়া বইতে রয়েছে।

 

ফকম্যানের চোখ দুটো বড় হয়ে গেলো। আমাকে বোলো না যে, হ্যারি পটার আসলে হলি গ্রেইল সম্পর্কিত।

 

আমি বাইবেলের কথা বলছিলাম।

 

ফকম্যান জিভ কাঁটলো। আমি জানতাম সেটা।

 

 

 

লেইসেজ-লো! সোফির চিৎকারটা ট্যাক্সির ভেতরের বাতাস কাঁপিয়ে দিলো। নামিয়ে রাখো!।

 

সোফি ঝুঁকে ড্রাইভারের আসনের দিকে এসে চিৎকার দিতেই ল্যাংডন চম্‌কে গেলো। সে দেখতে পারছিলো ড্রাইভার হাতে রেডিও মাউথপিসটা ধরে কথা বলছে।

 

সোফি এবার ঘুরে ল্যাংডনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলো। কি হচ্ছে সেটা বোঝার আগেই সে পিস্তলটা বের করে আনলো। সেটা পেছন থেকে ড্রাইভারের মাথা বরাবর তা করলো। সাথে সাথেই ড্রাইভার হাত থেকে রেডিওটা ফেলে দিয়ে অন্য হাতটা মাথার ওপর তুলে ধরলো।

 

সোফি! ল্যাংডন আর্তস্বরে বললো। কি হচ্ছে এসব–

 

আরেতেজ! সোফি ড্রাইভারকে আদেশ করলো। কাঁপতে কাঁপতে ড্রাইভার তার কথা মেনে গাড়িটা একটা জায়গায় নিয়ে থামালো।

 

তখনই ল্যাংডন রেডিও থেকে একটা কণ্ঠ শুনতে পেলো। ট্যাক্সি কোম্পানি থেকে ঘোষণা দিচ্ছে, …কুইসাপেলে এজেন্ট সোফি নেভু… রেডিওটা খট খট করে উঠলো। এত্ উঁ আমেরিকেই, রবার্ট ল্যাংডন…

 

ল্যাংডনের পেশীগুলো শক্ত হয়ে গেলো। তারা এরই মধ্যে আমাদেরকে খুঁজে বের করে ফেলেছে?

 

দিসেনদেজ, সোফি আদেশ করলো।

 

কাঁপতে থাকা ড্রাইভার দুহাত মাথার ওপর তুলে গাড়ি থেকে বের হয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।

 

সোফি জানালার কাঁচটা নামিয়ে অস্ত্রধরা হাতটা বের করে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ড্রাইভারের দিকে তাক করলো। রবার্ট, সে খুব শান্তভাবে বললো, স্টিয়ারিংয়ে গিয়ে বসো। তুমি গাড়ি চালাবে।

 

অস্ত্রহাতে ধরা কোন মেয়ের সাথে ল্যাংডন তর্ক করার সাহস করলো না। সে গাড়ি থেকে নেমে সামনে গিয়ে বসলো। ড্রাইভার লোকটা আকুতি মিনতি করতে লাগলো, তার হাত দুটো মাথার ওপরেই তোলা।

 

রবার্ট, পেছনের সিট থেকে সোফি বললো, আমার বিশ্বাস তুমি আমাদের জাদুর বনটা যথেষ্ট দেখেছো?

 

সে মাথা নেড়ে সায় দিলো। যথেষ্টই।

 

ভালো। এখান থেকে বের হও আগে।

 

ল্যাংডন গাড়িটার সামনের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করলো। ধ্যাৎ। সে স্টিয়ারিংটা ধরলো। সোফি? যদি তুমি–

 

চালাও! সোফি চিৎকার করে বললো।

 

বাইরে, কিছু সংখ্যক পতিতা কী হচ্ছে সেটা দেখার জন্য উঁকি মারলো। একটা মেয়ে তার সেলফোনে ফোন করতে লাগলো। ল্যাংডন গিয়ারের স্টিকটা ধরেই প্রথমে তার যা মনে হলো, সেটা হলো ফার্স্ট গিয়ার।

 

ল্যাংডন ক্লাচটা চেপে ধরলো। ট্যাক্সিটা সামনে এগোতেই চাকার খ্যাচ্‌ খ্যাচ্‌ শব্দ শোনা গেলো। সামনে জড়ো হওয়া মানুষজন আত্মরক্ষার্থে এদিক-ওদিক ছুটতে লাগলে ফোন হাতে ধরা মেয়েটা লাফিয়ে বনের ভেতরে চলে গেলো, অল্পের জন্য সে গাড়ি চাপার হাত থেকে বেঁচে গেছে।

 

দুসমেঁ! গাড়িটা রাস্তায় আসতেই সোফি বললো, তুমি করছোটা কি?

 

আমি তোমাকে সতর্ক করার চেষ্টা করছি, গিয়ারের শব্দকে ছাপিয়ে সে চিৎকার করে বললো। আমি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালাচ্ছি।

 

 

 

৩৯.

 

যদিও রুই লা ব্রুয়েরের, ধূসর পাথরের অনাড়ম্বরপূর্ণ ঘরটা অনেক যন্ত্রণার সাক্ষী, কিন্তু সাইলাসের সন্দেহ, এখন তার শরীরে যে শারীরিক যন্ত্রণাটা আঁকড়ে ধরেছে সেটার সাথে আর কোন কিছুরই তুলনা হয় না। আমি প্রতারিত হয়েছি। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।

 

সাইলাসের সাথে চালাকি করা হয়েছে। ভায়েরা তাকে মিথ্যে বলেছে। তাঁরা সত্যিকারের সিক্রেটটা প্রকাশ করার বদলে মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছে। টিচারকে ফোন করার মতো শক্তি সাইলাসের ছিলো না। সে শুধুমাত্র চারজন লোককেই খুন করেনি, যারা জানতো কি-স্টোনটা কোথায় লুকিয়ে রাখা আছে, উপরন্তু, সেন্ট-সালপিচের অভ্যন্তরে একজন নানাকেও খুন করেছে। নানটা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কাজ করতো! সে ওপাস দাইর কাজ-কর্মগুলোও নিন্দা করতে!

 

হঠাৎ করেই একটা অপরাধবোধ, মহিলার মৃত্যু ব্যাপারটাকে খুব বেশি জটিল করে ফেলেছে। বিশপ আরিঙ্গারোসার ফোন কলটার জন্যই সাইলাস সেন্ট-সালপিচের ভেতরে ঢুকতে পেরেছিলো; তিনি যখন আবিস্কার করবেন, নান মারা গেছে, তখন কি ভাববেন? যদিও সাইলাস মৃতদেহটা তার বিছানায় রেখে এসেছে, কিন্তু নানের আঘাতটা সহজেই চোখে পড়ে যাবে। সাইলাস জমিনের ভাঙা টাইল্সগুলো ঠিক করে রেখে দেবার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু ওগুলো এতো বেশি ভেঙে গিয়েছে যে, সবাই জেনে যাবে, এখানে কেউ এসেছিলো।

 

সাইলাস পরিকল্পনা করেছিলো এখানকার কাজটা শেষ করে ওপাস দাইর ভেতরে লুকিয়ে পড়বে। বিশপ আরিঙ্গাবোসা আমাকে রক্ষা করবেন। সাইলাস কল্পনা করলো, ওপাস দাইর হেড কোয়াটারের অভ্যন্তরে প্রার্থনা করা আর ধ্যান করার চেয়ে বড় কোন আশীবাদের অস্তিত্ব এ জীবনে নেই। সে আর কখনই বাইরে পা রাখবে না। তার সব প্রয়োজনই ঐ উপাসনালয়ের ভেতরেই মেটাবে। কেউ আমার অভাবও অনুভব করবে না। দূভার্গ্যজনকভাবে, সাইলাস জানতো, বিশপ আরিঙ্গারোসার মতো খ্যাতিমান ব্যক্তি খুব সহজে উধাও হতে পারবে না।

 

আমি বিশপকে বিপদে ফেলে দিয়েছি। সাইলাস জমিনের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের কথা ভাবলো। হাজারহোক, আরিঙ্গারোসাই তাকে নতুন জীবন দান করেছিলেন…স্পেনের সেই ছোট্ট মঠে, তাকে শিক্ষাদীক্ষা দিয়েছেন, তার জীবনের উদ্দেশ্য ঠিক করে দিয়েছেন।

 

আমার বন্ধু, আরিঙ্গাবোসা তাকে বলেছিলেন, তুমি ধবল হয়ে জন্মেছে। এজন্যে অন্যের কাছে তুমি লজ্জিত হয়ো না। তুমি কি বুঝতে পারছে না, এজন্যে তুমি কতোটা আলাদা হয়ে উঠেছো? তুমি কি জানো না, নুহ নিজেও একজন ধ্বল ছিলেন?

 

নৌকার নূহ? সাইলাস একথাটা কখনও শোনেনি।

 

আরিঙ্গারোসা হেসেছিলেন। অবশ্যই, নৌকার নৃহ। তিনি একজন ধবল ছিলেন। তোমারই মতো। তার ছিলো ফেরেস্তাদের মতো সাদা চামড়া। এটা মনে রেখো। নূহু এই পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকূলকে রক্ষা করেছিলেন। তোমারও জন্ম হয়েছে মহৎ কিছু করার জন্য, সাইলাস। ঈশ্বর তোমাকে একটা কারণেই মুক্ত করেছেন। তোমার ডাক তুমি পেয়েছে। ঈশ্বর তোমার সাহায্য চাইছে তার কাজের জন্য।

 

সময়ে, সাইলাস নিজেকে নতুন আলোয় চিনতে শিখলো। আমি বিশুদ্ধ। সাদা। সুন্দর। ফেরেস্তাদের মতোন।

 

ঠিক এই সময়েই, যদিও সে তার নিজের ঘরে, তার বাবার হতাশ কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেলো। অতীত থেকে তার কাছে ফিসফিস করে বলছে।

 

তু ইস্ উঁ দেসাস্ত্রে। উঁ স্পেকত্রে।

 

কাঠের ফ্লোরে হাটু গেঁড়ে বসে সাইলাস ক্ষমা প্রার্থনা করলো। তারপর, দড়িটা খুলে ফেলে আবার তার প্রায়শ্চিত্তে ফিরে গেলো।

 

 

 

৪০.

 

গিয়ারের শিফটটা নিয়ে বেসামাল ল্যাংডন খুব কষ্টে হাইজ্যাক করা গাড়িটা কোনমতে বোয়ে দ্য বুলোঁয়া থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারলো। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, এই ঘটনার কৌতুককর দিকটা, রেডিওতে ট্যাক্সি কোম্পানির বার বার ঘোষণার মধ্যে হারিয়ে গেলো।

 

ভয়তুর সিঙ্গ-সিক্স-ত্রয়। ওউ ইতে-ভু? রিপোনদেজ!

 

ল্যাংডন যখন পার্ক থেকে বের হবার পথটার কাছে এসে পৌঁছালো, তখন সে সজোড়ে ব্রেক কষলো। তুমিই চালাও।

 

সোফি স্টিয়ারিংয়ে গিয়ে বসতেই ল্যাংডন হাপ ছেড়ে বাঁচলো বলে মনে হলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই, সোফি গাড়িটাকে খুব সুন্দর করে চালিয়ে নিয়ে জাগতিক আনন্দের উদ্যানটা পেছনে ফেলে, পশ্চিম দিকের আলি দ্য লং শাম্প-এর দিকে নিয়ে গেলো।

 

রুই হাক্সোটা কোন্ দিকে? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো। স্পিড মিটারের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো ঘন্টায় একশো কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়িটা চলছে।

 

সোফির চোখ রাস্তার দিকেই নিবিষ্ট। ড্রাইভার বলেছিলো জায়গাটা রোল্যা গারো টেনিস স্টেডিয়ামের কাছেই। আমি সেই জায়গাটা চিনি।

 

ল্যাংডন আবারো তার পকেট থেকে ভারি চাবিটা বের করে হাতের তালুতে রেখে সেটার ওজন অনুভব করলো। তার মনে হলো, এটা একটা বিশাল পরিণতির জিনিস। তার নিজের স্বাধীনতার চাবির মতোই অনেকটা।

 

একটু আগে, যখন সোফিকে নাইট টেম্পলারদের ব্যাপারে বলছিলো, তখন ল্যাংডন বুঝতে পারছিলো যে, এই চাবিটা, প্রায়োরিদের সিলংকিত। প্রায়োরি অব সাইওনের সাথে খুব সূক্ষ্ম একটা সংযোগ ধারণ করে আছে। সমবাহুর ক্রুশ ভারসাম্য আর সম্প্রীতির প্রতীক, কিন্তু সেটা নাইট টেম্পলারদেকেও বোঝায়। সবাই নাইট টেম্পলারদের চিত্রকর্মগুলো দেখেছে, সাদা পোশাক পরা আর তার মাঝে লাল রঙের সমবাহুর ক্রুশ আঁকা। তবে এটা ঠিক, টেম্পলারদের ক্রশের বাহুর শেষ মাথাগুলো কিছুটা চওড়া, কিন্তু সেগুলোও সমান দৈর্ঘের।

 

একটা সুষম বাহুর ক্রশ। ঠিক এই চাবিটাতে যেমন আছে।

 

এটা দিয়ে তারা কী খুঁজে পাবে ভাবতেই, ল্যাংডনের কল্পনা পাগলাঘোড়ার মতো ছুটতে লাগলো। হলি গ্রেইল। কথাটার অর্থহীনতা ভেবে সে প্রায় জোরে হেসে উঠতে যাচ্ছিলো। বিশ্বাস করা হয়, গ্রেইলটা ইংল্যান্ডের কোথাও আছে, কোন এক টেম্পলার চার্চের ভূগর্ভস্থ গোপন কক্ষে সেটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে, কমপক্ষে ১৫০০ সাল থেকে।

 

গ্র্যান্ডমাস্টার দা ভিঞ্চির সময়কাল থেকে।

 

প্রায়োরিরা, তাদের শক্তিশালী দলিল-দস্তাবেজগুলো নিরাপদে রাখার জন্যে শত শত বছর ধরে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরাতে বাধ্য হয়েছিলো। ঐতিহাসিকরা এখন আশংকা করছে, গ্রেইলটা জেরুজালেম থেকে ইউরোপে নিয়ে আসার পর থেকে কম করে হলেও, ছয় জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে। গ্রেইলটা শেষবার দেখা গিয়েছিলো ১৪৪৭ সালে, যখন অসংখ্য চাক্ষুষ স্বাক্ষীদাতা বর্ণনা করেছে, দলিল দস্তাবেজগুলো আগুনে প্রায় পুড়ে যাবার আগেই, সেগুলো নিরাপদে চারটা সিন্দুকে করে সরিয়ে নেবার জন্য ছয় জন লোক লেগেছিলো। এরপর থেকে, কেউই আর গ্রেইলটা কখনও দেখেনি। যা কিছু শোনা গেছে, তাহলো, মাঝে মাধ্যে একটা ফিস্ ফাস্। গ্রেইলটা নাকি লুকিয়ে রাখা আছে গ্রেট বৃটেনে, নাইট আর্থার আর রাউন্ড টেবিলের নাইটদের দেশে।

 

যেখানেই থাকুক না, দুটো গুরুত্বপূর্ণ সত্য রয়ে গেছে :

 

লিওনার্দো তাঁর জীবনকালে জানতেন গ্রেইলটা কোথায় রাখা আছে।

 

লুকিয়ে রাখার জায়গাটা বোধহয় আজকের দিন পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়নি।

 

এই কারণেই, গ্রেইল নিয়ে উৎসাহটা এখনও দা ভিঞ্চির ছবিতে আর ডায়রিতে গ্রেইলের বর্তমান অবস্থানটার সম্পর্কে কোন কু লুকিয়ে আছে বলে আশা করা হয়। কেউ কেউ দাবি করে থাকে, ম্যাড়োনা অব দি রকস-এর পেছনের পর্বতের দৃশ্যটা স্কটল্যান্ডের সারি সারি গুহা-পর্বতের সাথে একেবারে মিলে যায়। অন্যেরা দাবি করে, দ্য লাস্ট সাপার-এর শিষ্যদের সন্দেহজনক অবস্থানটা আসলে এক ধরনের কোড। এখনও অনেকে দাবি করে যে, মোনালিসার এক্সরেতে এটা উন্মোচিত হয়েছে যে, তাকে আসলে আইসিস এর ল্যাপিস লাজুইলি পরা অবস্থায় আঁকা হয়েছিলোদা ভিঞ্চি পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এটার ওপরে আরো নিখুঁতভাবে কিছু আঁকার। ল্যাংডন কখনও এমন কোন প্রমাণ দেখেনি, বা কল্পনা করতে পারেনি, হলি গ্রেইলকে উন্মোচিত করে। তারপরও গ্রেইল সম্পর্কিত খবরাখবর ইন্টারনেটের বুলেটিন আর চ্যাট রুমে আলোচিত হয়। সবাই চক্রান্ত–ষড়যন্ত্র পছন্দ করে।

 

আর চক্রান্তগুলো এখনও হচ্ছে। খুবই সাম্প্রতিককালে, পৃথিবী কাঁপানো একটা আবিস্কার হয়েছে যে, দা ভিঞ্চির বিখ্যাত এডোরেশন অব দি মাজাইর পরতে পরতে একটা সিক্রেট লুকিয়ে রাখা আছে। ইতালিয় চিত্রকলা ডায়াগনোস্টিশিয়ান মরিজিও সেরাসিনি সত্যটা উন্মোচন করেছেন, যা নিউইয়র্ক টাইম ম্যাগাজিন খুবই গুরুত্বের সাথে লিওনার্দোর ছদ্মবেশ শিরোনামে ছেপেছে।

 

সেরাসিনি কোন সন্দেহের উদ্রেক না করেই উদঘাটন করেছেন যে, এডোরেশন এর ধূসর সবুজ স্কেচটার নিচের ড্রইংটা নিশ্চিতভাবেই দা ভিঞ্চির কাজ, কিন্তু উপরের মূল ছবিটা নয়। সত্য হলো, কোন অজানা শিল্পী দা ভিঞ্চির মৃত্যুর অনেক বছর পর, কয়েকবারই এর ওপর পেইন্ট করেছে। আরো বেশি ভয়ংকর ব্যাপার হলো, উপরে আঁকা ছবিটার নিচে যা আছে, সেটা ইনফারেন্স রিফ্লেক্টোগ্রাফি ছবি আর এক্স-রে বলছে, দৃবৃত্ত শিল্পী দা ভিঞ্চির স্কেচটার বিকৃত সাধন করেছে…যাতে দা ভিঞ্চির আসল উদ্দেশ্যটা উল্টিয়ে দেয়া হয়েছে। নিচের ড্রইংটার সত্যিকারের স্বরূপটা এখন পর্যন্ত জনসাধারনের কাছে প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি ফ্লোরেন্সের উফিজি গ্যালারির বিব্রত কর্মকর্তারা সঙ্গে সঙ্গে ছবিটা রাস্তার অপরপাশে একটা ওয়্যারহাউসে স্থানান্তর করে ফেলে। গ্যালারির যে জায়গাটাতে এক সময় এডোরেশন-টা ঝোলানো ছিলো, সেখানে দর্শনার্থীরা গিয়ে একটা বিভ্রান্তিকর এবং ক্ষমাপ্রার্থনাসূচক কার্ড দেখতে পাবে এখন।

 

এই শিল্পকর্মটি মেরামতের জন্য

ডায়াগনোস্টিক টেস্ট-এর কাজ চলছে।

 

আধুনিক গ্রেইল অম্বেষণকারীদের উদ্ভট আন্ডারওয়ার্ল্ডে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিশাল একটি উন্মাদনা হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছেন। তাঁর শিল্পকর্ম একটা সিক্রেট-এর কথা বলছে যেনো, তার পরও, সেটা একেবারে লুকায়িত আছে। সম্ভবত ছবিটার নিচের পরতে, হয়তোবা সাদামাটা দর্শনের মধ্যে কোন গুপ্তলিখনের ভেতরে, অথবা একেবারেই কোথাও না। হতে পারে দা ভিঞ্চির হতবুদ্ধিকর কু-গুলো কিছুই না, কেবলই অসাড় প্রতীজ্ঞা, যার পেছনে রয়েছে অতি আগ্রহীদেরকে বিভ্রান্ত করা, তাঁর মোনালিসার বোকার মতো ভান করা হাসির মতোই।

 

এটা কি সম্ভব, পেছনে বসে থাকা ল্যাংডনের দিকে ফিরে সোফি জিজ্ঞেস করলো, তুমি যে চাবিটা ধরে রেখেছে, সেটা দিয়ে হলি গ্রেইলের লুকিয়ে রাখা জায়গাটা খোলা যাবে?

 

ল্যাংডনের হাসি পেলো। আমি আসলেই ভাবতে পারছি না। তাছাড়া, গ্রেইলটা যুক্তরাজ্যের কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়, ফ্রান্সে নয়। সে তাকে ইতিহাসটা দ্রুত বলে দিলো।

 

কিন্তু, গ্রেইলটা-ই মনে হচ্ছে, একমাত্র যৌক্তিক উপসংহার, সে জোর দিয়ে বললো। আমাদের কাছে একটা অসম্ভব নিরাপদ চাবি আছে, প্রায়োরি অব সাইন এর সিলংকিত, আর সেটা দিয়েছেন প্রায়োরিদেরই একজন সদস্য—একটা ভ্রাতৃসংঘ, যা একটু আগে তুমি আমাকে বলেছো, হলি গ্রেইলের অভিভাবক।

 

ল্যাংডন জানতো, সোফির কথায় যুক্তি আছে, তারপরও সেটাকে মনে প্রাণে সে মেনে নিতে পারছে না। গুজব আছে যে, প্রায়োরিরা প্রতীজ্ঞা করেছিলো, একদিন গ্রেইলটাকে ফ্রান্সে ফিরিয়ে আনবে এবং অন্তিম শয়নে রাখবে, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই কোন ঐতিহাসিক প্রমাণাদি নেই, যাতে মনে হতে পারে এটা বাস্তবিকই ঘটেছে। তারপরও, যদি প্রায়োরিরা গ্রেইলটা ফ্রান্সে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়ে থাকে, ২৪, রুই হাক্সো, টেনিস স্টেডিয়ামের নিকটের জায়গাটা কোনমতেই চুড়ান্ত অন্তিম শয়ানের স্থান বলে মনে হয় না। সোফি, আমি এই চাবিটার সাথে গ্রেইলের কোন সম্পর্কই দেখতে পাচ্ছি না।

 

কারণ গ্রেইলটা ইংল্যান্ডে থাকার কথা?

 

শুধু তাই নয়। হলি গ্রেইলের অবস্থানটা ইতিহাসের সব চাইতে সিক্রেট একটি ব্যাপার। প্রায়োরির সদস্যরা কয়েক দশক অপেক্ষা করে নিজেদেরকে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে প্রতিপন্ন করে থাকে। তারপর, তারা জানতে পারে গ্রেইলটা কোথায় আছে। সিক্রেটটা খুবই জটিল একটি জ্ঞান। আর যদিও প্রায়োরিদের ভাইয়েরা সংখ্যায় অনেক বেশি, তারপরও, একই সময়ে, কেবলমাত্র চার জন সদস্য জানে গ্রেইলটা কোথায় লুকিয়ে রাখা আছে—এ্যান্ড মাস্টার আর তাঁর তিন জন সেনেক্য। তোমার দাদুর বেলায় এরকম চারজনের একজন হওয়াটা, সম্ভবত খুবই ক্ষীণ।

 

আমার দাদু তাদেরই একজন, সোফি ভাবলো। এক্সলেটরটা চাপ দিলো। তার স্মৃতিতে একটা ছবি আছে যা খুব নিশ্চিত করেই বলে দেয়, তার দাদুর অবস্থান ছিলো নিঃসন্দেহে ভ্রাতৃসংঘের ভেতরেই।

 

আর তোমার দাদু যদি সে রকম কিছু হয়েও থাকেন, তবে কখনও ভ্রাতৃসংঘের বাইরের কারো কাছে সেটা প্রকাশ করার কথা নয়। তিনি তোমাকে তাদের একেবারে ভেতরের সার্কেলে নিয়ে আসবেন, সেটা বিশ্বাসযোগ্যও নয়।

 

আমি ইতিমধ্যেই সেখানে ঢুকে গিয়েছিলাম, সোফি ভাবলো। বেসমেন্টের আচার অনুষ্ঠানটার ছবি ভেসে উঠলো তার মনের পর্দায়। সে ভাবলো, এই মুহূর্তে ল্যাংডনের কাছে নরম্যান্ডির শ্যাতুতে দেখা সেই রাতের ঘটনাটার কথা বলবে কি না। এখন থেকে দশ বছর আগে, কাউকে কথাটা বলতে তার ভীষণ লজ্জা করতো। কথাটা মনে করলেই সে দারুণভাবে লজ্জিত আর ব্রিত হতো। দূরে কোথাও সাইরেন বাজছে, তার মনে হলো, তার ভেতরে হালকা একটা অবসাদ এসে ভর করেছে।

 

এইতো! ল্যাংডন বললো, সামনের বিশাল বোলা গারো টেনিস স্টেডিয়ামটা দেখে সে দারুণ উত্তেজনা অনুভব করলো।

 

সোফি স্টেডিয়ামটার দিকে এগোলো। একটু যেতেই তারা রুই হাক্সোর মোড়টা খুঁজে পেলো। জায়গাটা খুব বেশি শিল্পাঞ্চলের মতো মনে হলো। সারি সারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

 

আমাদের দরকার চব্বিশ নাম্বার, ল্যাংডন আপন মনে বললো, বুঝতে পারলো, সে গোপন একটা চার্চের চূড়া দেখার আশা করছে। হাস্যকর হয়ো না। এই রকম জায়গায় একটা বিস্মৃত টেম্পলার চার্চ?

 

এইতো সেটা, সোফি বিস্ময়ে চিক্কার করে উঠলো। আঙুল দিয়ে দেখালো জায়গাটা।

 

ল্যাংডনের চোখ সামনের স্থাপত্যটার দিকে গেলো। এটা আবার কি?

 

ভবনটা খুব আধুনিক। চারকোনা একটা ভবন, তাতে একটা বিশাল সমানবাহুর ক্রশ উপরের দিকে অংকিত। ক্ৰশটার নিচে লেখা :

 

জুরিখের ডিপোজিটরি ব্যাংক

 

ল্যাংডন ভাবলো তার টেম্পলার চার্চের প্রত্যাশার কথাটা সোফিকে বলবে না। ল্যাংডন প্রায় ভুলেই গেলো যে, এই শান্তিপূর্ণ, সমবাহুর ক্রশটা নিরপেক্ষ দেশ সুইজারল্যান্ড তাদের ফ্ল্যাগে স্থান করে নিয়েছে। নিদেনপক্ষে, রহস্যটার একটা সমাধান তো হলো।

 

সোফি আর ল্যাংডন সুইস ব্যাংকের একটা ডিপপাজিট বক্সের চাবি হাতে ধরে রেখেছে।

 

 

 

 

 

 

০৫. কাস্তেল গাভোলফোর

৪১.

 

কাস্তেল গাভোলফোর বাইরে, বিশপ আরিঙ্গাবোসা তাঁর ফিয়াট গাড়িটা থেকে নামতেই, একটা পাহাড়ি বাতাসের ঝাঁপটা চুড়া থেকে নেমে এসে তাঁর শরীরে শীতল পরশ বুলিয়ে দিলো। এই আলখেল্লাটার চেয়েও বেশি কিছু আমার পরে আসা উচিত ছিলো, তিনি ভাবলেন। ঠাণ্ডা বাতাসটার সাথে লড়াই করতে হলো তাকে। আজ রাতে তার যা দরকার সেটা হলো, হয় তাকে দুর্বল, নয়তো ভীতিকর হিসেবে আবির্ভূত হতে হবে।

 

প্রাসাদটা অন্ধকারে ডুবে আছে, ওপরের তলার একটা জানালা দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে সেটা। লাইব্রেরি, আরিঙ্গারোসা মনে মনে বললেন। তারা জেগে জেগে অপেক্ষা করছে। মাথাটা উঁচু করে আশেপাশে খুব ভালো মতো না তাকিয়ে তিন সোজা এগিয়ে গেলেন।

 

তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা যাজককে দেখে তাঁর ঘুমঘুম মনে হলো। পাঁচ মাস আগেও এই একই যাজক তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলো। অবশ্য আজকে তাকে দেখে একটু কম অতিথিপরায়ন বলেই মনে হচ্ছে। আমরা আপনার জন্য খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম, বিশপ, নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে যাজক বললো, তার চেহারায় উদ্বিগ্নতার চেয়েও বেশি বিরক্তি মনে হলো।

 

ক্ষমা করবেন আমাকে। আজকাল বিমানগুলো খুবই অবিশ্বস্ত হয়ে গেছে।

 

যাজক লোকটা বিড়বিড় করে কী যেনো বললো, বোঝা গেলো না, তারপর বললো, তারা উপরের তলায় আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আপনাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি।

 

লাইব্রেরিটা বিশাল একটা চৌকোনা ঘর। ছাদ থেকে জমিন পর্যন্ত কালো কাঠে তৈরি। চারদিকে লম্বা লম্বা বুক-সেলফে মোটা-মোটা বইয়ে পূর্ণ। জমিনটা এম্বার মার্বেলের, খুব সহজেই মনে করিয়ে দেয়, ভবনটা এক সময় প্রাসাদ ছিলো।

 

স্বাগতম, বিশপ, ঘরের একপাশ থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ বললো।

 

আরিঙ্গাবোসা দেখার চেষ্টা করলেন কে কথাটা বলছে। কিন্তু ঘরের ভেতরের আলোটা হাস্যকর রকমেরই স্বল্পতার প্রথম আগমনের সময় থেকেও বেশি স্বল্প। তখন সবকিছুই জ্বলজ্বল করছিলো। রাতটা পুরোদস্তর জেগে উঠেছে। আজ রাতে, সেই সব লোকগুলো অন্ধকারে বসে আছে, যেনো তারা কী করতে যাচ্ছে তার জন্যে খুব লজ্জিত।

 

আরিঙ্গাবোসা খুব ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন। তিনি কেবল ঘরের ভেতরে, একটু দূরে, টেবিলে বসে থাকা মানুষগুলোর ছায়া দেখতে পেলেন। মাঝখানে বসে থাকা অবয়বটা দেখে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি চিনতে পারলেন অবিস্ সেক্রেটারিয়েট ভ্যাটিকানা, ভ্যাটিকান সিটির অভ্যন্তরে সমস্ত আইনী ব্যাপারগুলো দেখেন তিনি। উচ্চ পদস্থ একজন ইতালিয় কার্ডিনাল।

 

আরিগারোসা তাদের সামনে এগিয়ে গিয়ে বললেন, এই দেরির জন্য আন্তরিক ক্ষমা নেবেন। আমরা ভিন্ন টাইম-জোনে ছিলাম। আপনি খুব ক্লান্ত হয়ে থাকবেন।

 

মোটেই না, সেক্রেটারি বললেন, তার হাত দুটো বিশাল বপুর ওপরে ভাঁজ করে রাখা। আপনি এতোদূর আসাতে, আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা কি আপনাকে এক কাপ কফি দিতে বলবো, ক্লান্তি দূর করার জন্য?

 

আমার মনে হয়, আমাদের ভনিতা করা ঠিক হবে না যে, এটা একটা সোশ্যাল ভিজিট। আমাকে আরেকটা প্লেন ধরতে হবে। আমরা কি কাজের কথা শুরু করতে পারি?

 

অবশ্যই, সেক্রেটারি বললেন। আমাদের ধারণার চেয়েও দ্রুত আপনি সাড়া দিয়েছেন।

 

তাই?

 

আপনার হাতে এক মাস সময় ছিলো।

 

আপনারা আপনাদের ব্যাপারটা আমাকে পাঁচমাস আগে জানিয়েছিলেন, আরিগারোসা বললেন। আমি অপেক্ষা করবো কেন?

 

তাতো ঠিকই। আমরা আপনার আনুগত্যে খুব খুশি।

 

আরিঙ্গারোসার চোখ লম্বা টেবিলটার উপরে রাখা কালো বৃফকেসটার দিকে গেলো। এটার জন্যেই কি আমাকে অনুরোধ করা হয়েছে?

 

এটার জন্যেই। সেক্রেটারির কণ্ঠে অস্বস্তিকর একটা ভাব দেখা গেলো। অবশ্য, আমি স্বীকার করছি, অনুরোধটা নিয়েই আমাদের চিন্তা হচ্ছিলো। এটা মনে হয়েছিলো …

 

বিপজ্জনক, অন্য একজন কার্ডিনাল কথাটা শেষ করলেন।

 

আপনি কি নিশ্চিত, আমরা এটা আপনার কাছে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে অন্য কোথাও পাঠাতে পারবো না? অংকটা কিন্তু অনেক বড়।

 

মুক্তি অনেক ব্যয়বহুল। আমি আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত নই। ঈশ্বর আমার সঙ্গে আছেন।

 

মানুষগুলোকে একটু সন্দেহগ্রস্ত দেখালো।

 

তহবিলটা কি আমার অনুরোধের মতোই ঠিক আছে!

 

সেক্রেটারি সায় দিলেন। বিশাল অংকের বন্ড, ভ্যাটিকান ব্যাংক থেকে তোলা। পৃথিবীর যেকোন জায়গাই এটা টাকার মতোই ব্যবহার করা যাবে।

 

আরিঙ্গারোসা টেবিলটার শেষ মাথায় হেটে গিয়ে বৃফকেসটা খুললেন। ভেতরে দুটো বান্ডিলের বন্ড, প্রতিটাতে ভ্যাটিকানের সিলাঙ্কিত আর লেখা আছে PORTATORE

 

সেক্রেটারিকে খুব উদ্বিগ্ন দেখালো। আমাকে বলতেই হচ্ছে বিশপ, আমাদের সবাই খুব কম আশংকা করতাম, যদি এই তহবিলটা নগদে হোততা।

 

সেই পরিমাণ টাকা আমি বহন করতে পারতাম না, আরিঙ্গারোসা ভাবলেন, বৃফকেসটা বন্ধ করে রাখলেন। বন্ডগুলো নগদ টাকার মতোই ব্যবহার করা যায়। আপনি নিজেই বলেছেন সেই কথা।

 

কার্ডিনালরা একটা অস্বস্তির দৃষ্টি বিনিময় করলেন, শেষে একজন বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু এই বন্ডগুলো ভ্যাটিকান ব্যাংক খুব সহজেই ট্রে করতে পারবে।

 

আরিজারোসা মনে মনে হাসলেন। ঠিক এই কারণেই টিচার আরিঙ্গারোসাকে টাকাগুলো ভ্যাটিকান ব্যাংকের বন্ডের মাধ্যমে নিতে বলেছিলেন। এটা একটা ইনসুরেন্সের মতো কাজ করবে। আমরা সবাই এই ব্যাপারে এক সঙ্গে আছি। এটাতো খুবই বৈধ একটি হস্তান্তর, আরিঙ্গাবোসা আত্মপক্ষ সমর্থন করলেন। ওপাস দাই হলো ভ্যাটিকান সিটিরই নিজস্ব অঙ্গসংগঠন, আর পোপের কাছে এটা ঠিকই মনে হবে, টাকাটা যেভাবেই থাকুক না কেন। এখানে তো কোন আইন ভঙ্গ করা হচ্ছে না।

 

সত্য, তারপরেও… সেক্রেটারি একটু সামনের দিকে ঝুঁকলেন, তাতে চেয়ারটা থেকে মটমট করে একটা আওয়াজ হলো। আপনি এই তহবিলটা দিয়ে কী করবেন সে সম্পর্কে আমাদের কিছুই জানা নেই। আর যদি এটা কোনভাবে অবৈধ কিছু …

 

আপনারা আমাকে কী জিজ্ঞেস করছেন সেটা বিবেচনা করুন, আরিঙ্গাবোসা পাল্টা জবাব দিলেন, এই টাকা দিয়ে আমি কি করবো, সেটা আপনাদের ব্যাপার নয়।

 

লম্বা একটা নিরবতা নেমে এলো।

 

তাঁরা জানে আমি সঠিক, আরিঙ্গাবোসা ভাবলেন। এখন আমি মনে করতে পারি, আপনারা সই করে দেবেন?

 

তারা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে কাগজটা তার দিকে ঠেলে দিলো যেনো তারা চাইছে আরিজারোসা এখান থেকে দ্রুত চলে যাক।

 

আরিঙ্গারোসা তাঁর সামনে রাখা কাগজটার দিকে তাকালো। এটাতে পাপাল-এর সিল মারা আছে। আপনারা আমার কাছে যে কপিটা পাঠিয়েছেন, এটার সাথে তার মিল আছে?

 

পুরোপুরি।

 

দলিলটা সই করার সময় সে কতো কম আবেগতাড়িত হলো সেটা ভেবে আরিঙ্গাবোসা খুবই অবাক হলেন। উপস্থিত তিন জন, মনে হলো একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

 

ধন্যবাদ, বিশপ, আপনাকে, সেক্রেটারি বললেন। চার্চের জন্য আপনার কাজের কথাটা কখনই বিস্মৃত হবে না।

 

আরিজারোসা বৃফকেসটা তুলে নিতেই এর ওজনের মধ্যে কর্তৃত্ব আর প্রতীজ্ঞা অনুভব করলেন। চার জন লোক একে অন্যের দিকে এমনভাবে তাকালেন যেনো আরো কিছু বলার আছে তাদের, কিন্তু দৃশ্যত তারা কিছুই বললেন না। আরিঙ্গাবোসা ঘুরে দরজার দিকে চললেন।

 

বিশপ? আরিঙ্গারোসা দরজার কাছে যেতেই কার্ডিনালদের একজন ডাক দিলেন।

 

আরিঙ্গাব্রোসা থেমে, ঘুরে দাঁড়ালেন। হ্যাঁ?

 

এখান থেকে আপনি কোথায় যাবেন?

 

আরিঙ্গাবোসা আঁচ করতে পারলেন, প্রশ্নটা যতটা না ভৌগলিক তারচেয়েও বেশি আধ্যাত্মিক। তারপরও, এই সময়ে তাঁর নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা করার কোন ইচ্ছে হলো না। প্যারিস, কথাটা বলেই দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন তিনি।

 

 

 

৪২.

 

ডিপোজিটরি ব্যাংক অব জুরিখ চব্বিশ ঘন্টার সার্ভিস দিয়ে থাকে। এই গেন্ডশ্রাংক ব্যাংক সুইসব্যাংকের ঐতিহ্য অনুসারে পুরোপুরি আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর। জুরিখ, কুয়ালালামপুর, নিউইয়ক এবং প্যারিসে তাদের অফিস রয়েছে। সাম্প্রতিককালে তারা তাদের সার্ভিসকে শতভাগ কম্পিউটারাইজ করেছে। বর্তমানে সবধরণের কাজই কোড দিয়ে করা হয় আর একাউন্ট নাম্বারগুলোর অদৃশ্য ডিজিটাইজ ব্যাক-আপ থাকে।

 

এই ব্যাংকের প্রধান কাজটা করা হয়ে থাকে বহু পুরনো আর সরল একটা পদ্ধতিতে বড়সড় একটা লেজার—তাতে তথ্য গোপন রাখা হয়, আর সেটা নিরাপদ ডিপোজিট বক্স সার্ভিস হিসেবে পরিচিত। গ্রাহক নিজেদের স্টক সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে চিত্রকর্ম পর্যন্ত ডিপোজিট রাখতে পারে এখানে। অতি উচ্চ-প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছে এই ব্যাংকে। গ্রাহক যখন খুশি, ইচ্ছে করলেই সঙ্গোপনে এবং পূর্ণ নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ডিপোজিটে রাখা জিনিসটা নিজেদের হেফাজতে নিয়ে নিতে পারে।

 

ব্যাংকের কাছাকাছি একটা জায়গায় সোফি গাড়িটা থামালো। ল্যাংডন ভবনটার পুরোদস্তুর স্থাপত্যশৈলীর দিকে তাকিয়ে আর্চ করলো ডিপোজিটরি ব্যাংক অব জুরিখের হাস্যরসের ব্যাপারে সম্যক ধারণাই আছে। ভবনটা জানালাবিহীন চৌকোনা, পুরোপুরি স্টিল দিয়ে তৈরি করা। এর গাথুনীটা বড়-বড় লোহার ইটে তৈরি। মাটি থেকে ভবনটার ভিত পনেরো ফুট উঁচুতে। নিয়ন আলো আর সম-বাহুর ঐশ ভবনটার বাইরের দিকে জ্বল জ্বল করছে।

 

ব্যাংকিং খাতে সুইজারল্যান্ডের গোপনীয়তার সুনামটিই হলো সেই দেশের সবচাইতে লাভজনক রপ্তানি পণ্য। শিল্প সমাজের কাছ থেকে এই ধরনের সুবিধার ব্যাপারে বিরোধীতার সম্মুখীন হয়ে আসছে ভারা কারণ, তারা শিল্পকর্মের চোরদের চুরি করা জিনিস লুকিয়ে রাখার জন্য একেবারে নিরাপদ জায়গা দিয়ে থাকে। চোরেরা কয়েক বছর পরে, যখন চুরির ঘটনাটা বিস্মৃত হয়ে আসে, তখন সেগুলো তুলে নিয়ে থাকে, কারণ আইনগতভাবেই ডিপোজিটগুলো যে কোন ধরনের পুলিশী তল্লাশী থেকে মুক্ত, আর একাউন্টগুলো নামের উপরে না হয়ে সংখ্যার মাধ্যমে হয়ে থাকে। চোরেরা এটা জেনে স্বস্তিতে থাকে যে, তাদের চুরি করা মালামালগুলো নিরাপদে আছে এবং সেগুলো কোনভাবেই খোঁজ করা যাবে না।

 

সোফি ব্যাংকের দরজার সামনেই গাড়িটা থামালো। ল্যাংডনের মনে হলো তাদের উপরে একটা ভিত্তিও ক্যামেরা নজরদারি করছে, এই ক্যামেরাটা লুভরের মতো নয়, একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য।

 

সোফি গাড়ির কাঁচটা নামিয়ে ঠিক পাশেই রাখা ইলেকট্রনিক মঞ্চে রাখা এলসিডি মনিটরের দিকে তাকালো। সেখানে সাতটা ভাষায় দিকনির্দেশনা দেয়া আছে। সবার উপরে ইংরেজি।

 

INSERT KEY

 

সোফি পকেট থেকে গোল্ড লেজার চাবিটা বের করে মঞ্চটার ঠিক নিচের ত্রিভূজাকৃতির একটা ছিদ্রটাতে ঢুকালো।

 

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এটা কাজ করবে, ল্যাংডন বললো।

 

চাবিটা পুরোপুরি ঢোকাবার পরই সোফির মনে হলো, এটা ঘোরাবার দরকার নেই। সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে গেলো। সোফি গাড়িটা চালিয়ে সামনের দ্বিতীয় দরজাটার দিকে এগোলো, তার পেছনের দরজাটা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গিয়ে তাদেরকে ভেড়া-বন্দী করে ফেললো।

 

ল্যাংডন এই বন্দী অবস্থাটা অপছন্দ করলো না। আশা করা যাক, দ্বিতীয় দরজাটাও খুলবে।

 

দ্বিতীয় দরজাটাও আগের মতো করেই খুলতে হলো।

 

INSERT KEY

 

চাবিটা ঢোকানো মাত্রই দরজাটা খুলে গেলো। কিছুক্ষণ পরেই তারা ভকটার পেটের ভেতরে ঢুকে পড়লো। গাড়ি রাখার জায়গাটা ছোট আর সংকীর্ণ। এক ডজন গাড়ি রাখার মতো আয়তন জায়াগাটার। অন্যপ্রান্তে, ল্যাংডন ভবনটার মূল প্রবেশ দ্বারের দিকে তাকালো। সিমেন্টের ফ্লোরটাতে একটা লম্বা লাল গালিচা বিছানো। দর্শনার্থীদেরকে স্বাগতম জাগানোর জন্য সেখানে রয়েছে একটা বিশাল দরজা, তার কাছে মনে হলো পুরোপুরি লোহার তৈরি বলে।

 

স্বাগতম এবং দূরে থাকুন, ল্যাংডন ভাবলো।

 

প্রবেশদ্বারের সামনে একটা পার্কিং লটের কাছে সোফি গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে গিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলো। তুমি অস্ত্রটা গাড়িতেই রেখে দাও।

 

আনন্দের সাথেই, ল্যাংডন মনে মনে বলে পিস্তলটা সিটের নিচে রেখে দিলো।

 

সোফি আর ল্যাংডন গাড়ি থেকে নেমে লাল গালিচাটা ধরে এগোলো। দরজাটার কোন হাত নেই। কিন্তু ঠিক তার পাশেই, দেয়ালে আরেকটা ত্রিভূজাকৃতির ছিদ্র দেখা গেলো। এখানে অবশ্য কোন নির্দেশনা নেই।

 

ধীরে শেখে যারা তাদের কাছ থেকে দূরে থাকো, ল্যাংডন বললো।

 

সোফি হাসলো, তাকে নার্ভাস দেখাচ্ছে। এইতো। সে ছিদ্রটার ভেতরে চাবি ঢুকালে সাথে সাথে দরজাটা খুলে গেলো। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে সোফি আর ল্যাংডন ভেতরে প্রবেশ করতেই দরজাটা ভোতা একটা শব্দে বন্ধ হয়ে গেলো।

 

ডিপোজিটরি ব্যাংকের ফয়ারটা যে রকমভাবে সাজানো হয়েছে, সে রকমটি ল্যাংডন কখনও দেখেনি। যেখানে বেশিরভাগ ব্যাংক পালিশ করা মার্বেল বা গ্রানাইট দিয়ে সাজায়, সেখানে এই জায়গাটার সারা দেয়াল জুড়ে লোহা আর নাট-বল্ট দিয়ে সাজানো।

 

তাদের ডেকোরেটর কে? ল্যাংডন অবাক হয়ে ভাবলো। স্টিলের গলি?

 

সোফিও একইরকম ভয়ে লবিটার দিকে তাকালো। চারদিকেই ধূসর লোহা জমিন, দেয়াল, কাউন্টার, দরজা, এমনকি লবির চেয়ারগুলোও লোহার তৈরি। তাসত্ত্বেও, ব্যাপারটা দেখতে খুবই আকর্ষণীয় আর চমক্কার। মেসেজটা খুব পরিষ্কার : তুমি একটা ভন্টের ভেতরে হাটছে।

 

তারা ঢুকতেই কাউন্টারে বসা এক বিশাল দেহের লোক তাদের দিকে তাকালো। সে ছোট্ট একটা টেলিভিশন বন্ধ করে তাদের দিকে প্রশান্তির একটা হাসি দিলো। বিশাল মাংসপেশী এবং শক্ত বাহু থাকা সত্ত্বেও, তার কণ্ঠে এবং আচারে মার্জিত সুইস বেলহপ-এর পরিচয় পাওয়া গেলো।

 

বঁজুখ, সে বললো, আপনাদেরকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

 

দুভাষায় অভিন্দন জানানোটা এই ইউরোপিয়ান অভ্যর্থনাকারীর নতুন একটা চাল।

 

সোফি জবাবে কিছুই বললো না। সোজা সোনার চাবিটা লোকটার সামনের কাউন্টারের উপর রেখে দিলো।

 

লোকটা সেটার দিকে তাকিয়েই সোজা উঠে দাঁড়ালো। অবশ্যই। আপনার লিফটটা ঘরের শেষ মাথায়। আমি জানিয়ে দিচ্ছি, আপনারা আসছেন।

 

সোফি মাথা নেড়ে চাবিটা তুলে নিলো।কোন্ তলায়?

 

লোকটা তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকালো। আপনার চাবিটা-ই তো নির্দেশ করছে কোন তলা।

 

সোফি হেসে বললো, আহ্, তাইতো।

 

 

 

গার্ড দুই আগন্তুককে লিফটের কাছে যেতে দেখলো। তারা চাবি ঢুকিয়ে লিফটের ভেতরে চলে গেলো। দরজাটা বন্ধ হতেই ফোনটা তুলে নিলো লোকটা। কাউকে তাদের আসার কথা জানানোর জন্য বললো না; এর কোন দরকারও নেই। বাইরের প্রবেশদ্বারে কোন গ্রাহক চাবি ঢোকানোর সাথে সাথেই পুরো ভল্টটাই সতর্ক হয়ে যায়।

 

গার্ড আসলে ব্যাংকের রাত্রিকালীন ম্যানেজারকে ডাকতে ফোন করছে।

 

ফোনের রিং হতেই গার্ড টেলিভিশনটা ছেড়ে দিয়ে সেটা দেখতে লাগলো। যে খবরটা সে দেখছিলো সেটা এইমাত্র শেষ হলো। এতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। সে ইতিমধ্যেই এই দুজনের ছবি টেলিভিশনে দেখে ফেলেছে।

 

ম্যানেজার জবাব দিলো, উই?

 

এখানে একটা ঘটনা ঘটেছে।

 

কি হয়েছে? ম্যানেজার জানতে চাইলো।

 

ফরাসি পুলিশ দুজন ফেরারিকে খুঁজছে। আজ রাতে।

 

তো?

 

তাদের দুজন এখন আমাদের ব্যাংকের ভেতরে ঢুকেছে।

 

ম্যানেজার শান্ত কণ্ঠেই বললো, ঠিক আছে। আমি মঁসিয়ে ভার্নেটের সাথে যোগাযোগ করছি।

 

গার্ড ফোনটা নামিয়ে রেখে আরেকটা ফোন করলো। এটা করা হলো ইন্টারপোলে।

 

 

 

ল্যাংডন খুব অবাক হলো, কারণ তার মনে হলো, লিফটটা উপরের দিকে না উঠে বরং নিচের দিকে নামছে। লিফটের দরজাটা খোলর আগে সে বুঝতেই পারলো না ডিপোজিটরি ব্যাংক অব জুরিখের নিচের কত তলায় গেলো। সে অবশ্য পরোয়া করলো না। লিফট থেকে বের হতে পেরেই সে দারুণ খুশি। ইতিমধ্যেই একজন অভ্যর্থনাকারী মিষ্টি হেসে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা বয়সে প্রবীন আর বেশ হাসিখুশি। সে পরে আছে পরিষ্কার ফ্লানেল সুট, যা এই জায়গার সাথে একদম বেমানান–আধুনিক উচ্চপ্রযুক্তির জগতে একজন পুরনো দিনের ব্যাংকার।

 

বঁজুখ, লোকটা বললো। গুড ইভিনিং। আপনারা কি দয়া করে আমাকে অনুসরণ করবেন, সিল ভু প্লেই? কোন জবাবের অপেক্ষা না করেই, সে ঘুরে একটা সংকীর্ণ করিডোর দিয়ে যেতে লাগলো।

 

ল্যাংডন সোফির পেছন পেছন কয়েকটা করিডোর পার হলো। তারা কয়েকটা মেইন ফ্রেম কম্পিউটার ভর্তি ঘরও পার হলো। ওগুলোর বাতি জ্বলছিলো, নিভছিলো।

 

ভয়সি, লোকটা বললো, একটা লোহার দরজার সামনে এসে সেটা খুলে দিলো তাদের জন্য। এইতো এখানে।

 

ল্যাংডন আর সোফি আরেকটা জগতে প্রবেশ করলো। তাদের সামনে ছোট্ট ঘরটা দেখতে চমৎকার কোন হোটেলের বিলাসবহুল বসার ঘরের মতো। সেখানে লোহা আর নাট-বল্ট তিরোহিত হয়েছে। সেই জায়গাটা দখল করেছে প্রাচ্যদেশীয় কার্পেট, ওক কাঠের ফার্নিচার, আর কুশন সংবলিত চেয়ার। ঘরের মাঝখানে রাখা চওড়া ডেস্কটার উপরে, দুটো ক্রিস্টালের গ্লাস, তার পাশে খোলা পেরিয়ারের বোতল, সেটার বুদবুদ এখনও উঠছে। তার পাশেই রয়েছে একটা কফি পট।

 

লোকটা একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিলো। আমার মনে হচ্ছে, আপনারা আমাদের এখানে এই প্রথম এসেছেন?

 

সোফি একটু ইতস্তত করে মাথা নেড়ে সায় দিলো।

 

বুঝেছি। প্রায়শই, চাবিগুলো উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়ে থাকে। আর আমাদের এখানে প্রথম যারা আসে, তারা সাধারণত এখানকার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকে না। সে টেবিলে রাখা পানীয়ের দিকে ইশারা করলো। এই ঘরটা আপনাদের, যতোক্ষণ ইচ্ছে আপনারা এটা ব্যবহার করবেন।

 

আপনি বলছেন, চাবিগুলো প্রায়শই উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়ে থাকে? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

একদম ঠিক। আপনার চাবিটা অনেকটা সুইস ব্যাংক একাউন্টের মতোই, যা প্রায়শই, পরবর্তী বংশধরদের কাছে উইল করে দেয়া হয়। আমাদের গোল্ড একাউন্টের সর্বনিম্ন লিজ নেয়ার সময়কাল হলো পঞ্চাশ বছর। অগ্রিম পরিশোধ করা হয়। তো, সে জন্যেই, আমরা অনেক পরিবারের বদল হতে দেখি।

 

ল্যাংডন তার দিকে তাকালো। আপনি বলছেন পঞ্চাশ বছর?

 

সর্বনিম্ন, লোকটা জবাব দিলো। অবশ্য, আপনি এর চেয়ে বেশি সময়ের জন্যও লিজ নিতে পারেন। আর যদি সময় না বাড়িয়ে পঞ্চাশ বছর অতিক্রম হবার পরও একাউন্টটা সচল না করা হয়, তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই, সেফ ডিপোজিট বাক্সটা ধ্বংস করে ফেলা হয়। আমি কি আপনাদের বাক্সটা খোলার কাজ শুরু করবো?

 

সোফি মাথা নেড়ে সায় দিলো। প্লিজ।

 

লোকটা একটা বিলাসবহুল কামড়ার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে দেখালো। এটা আপনাদের ব্যক্তিগত ভিউয়িংরুম। আমি এই ঘর থেকে চলে যাবার পর, আপনারা যতোক্ষণ দরকার ততোক্ষণ থেকে, নিজেদের সেফ-ডিপোজিট বাক্সের জিনিসগুলো দেখতে পারেন, নিতে পারেন। সে হেটে ঘরটার একদিকের দেয়ালের কাছে গিয়ে বললো, আপনার চাবিটা এখানে ঢুকাবেন… লোকটা একটা ইলেক্ট্রনিক পোডিয়ামের দিকে ইঙ্গিত করলো। পোডিয়ামটার অতিপরিচিত ত্রিভূজকৃতির একটা ছিদ্র ছিলো। কম্পিউটার আপনার চাবিটা নিশ্চিত করলে, আপনি আপনার একাউন্ট নাম্বারটা ইনসার্ট করবেন, তারপরেই আপনার সেফ-ডিপোজিটরি বাক্সটা ভল্টের নিচে আপনা আপনিই এসে যাবে। বাক্সটার কাজ শেষ করার পর, একই প্রক্রিয়ায় আপনি সেটা আবার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখতে পারবেন। চাবিটা আবার ঢোকাতে হবে কিন্তু। সব কিছুই স্বরংক্রিয় ব্যবস্থায় হবে, তাই প্রাইভেসির গ্যারান্টি রয়েছে। এমন কি ব্যাংকের কর্মচারীদের কাছেও কিছুই জানা সম্ভব নয়। আপনাদের যদি কিছুর দরকার হয়, তাহলে শুধু টেবিলের মাঝখানের বোতামটা টিপলেই হবে।

 

সোফি কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাবে, তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। লোকটা খুব বিব্রত আর হতভম্ব হলো। ক্ষমা করবেন, আমাকে, প্লিজ। সে ফোনটার কাছে গেলো, সেটা টেবিলে রাখা কফি পটটার পাশেই ছিলো।

 

উই? সে জবাব দিলো। ফোনের অপর পাশ থেকে কথা শুনে তার ভুরু কপালে উঠলো। উই…উই…দার্কোদ। সে ফোনটা রেখে দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তির একটা হাসি দিলো। আমি দুঃখিত, আমাকে একটু যেতে হবে। আপনারা নিজের ঘর মনে করবেন। সে খুব দ্রুত দরজার দিকে চলে গেলো।

 

একটু শুনুন, সোফি লোকটাকে ডাকলো। যাবার আগে কি একটা বিষয় পরিষ্কার করে যাবেন? আপনি বলেছেন, আমাদেরকে একটা একাউন্ট নাম্বার ঢোকাতে হবে?

 

লোকটা দরজার সামনে গিয়ে থামলো। তার মুখটা ফ্যাঁকাশে দেখালো। তাতো অবশ্যই। সুইস ব্যাংকের একাউন্টের মতো, আমাদের সেফ ডিপোজিটরি বক্সের একাউন্টেরও একটা নাম্বার থাকে, কোন নাম নয়। আপনার কাছে একটা চাবি এবং পারসোনাল নাম্বার আছে, যা শুধু আপনিই জানেন। চাবিটা হলো আইডিন্টিফিকেশনের কেবলমাত্র অর্ধেকটা। আপনার একাউন্ট নাম্বারটা হলো বাকি অর্ধেক। তা-না হলে আপনি আপনার চাবিটা হারিয়ে ফেললে, যে কেউ সেটা ব্যবহার করতে পারবে।

 

সোফি ইতস্তত করে বললো, কিন্তু, আমার উইলদাতা যদি আমাকে কোন একাউন্ট নাম্বার না দিয়ে থাকেন তো?

 

লোকটার হৃদস্পন্দন লাফাতে লাগলো। তাহলে নিশ্চিতভাবেই এখানে এসে আপনার কোন কাজ হবে না! সে তাদের দিকে তাকিয়ে একটা শান্ত হাসি দিলো। আমি কাউকে ডেকে দিচ্ছি, আপনাদেরকে সাহায্য করার জন্য। সে খুব দ্রুতই এসে যাবে।

 

চলে গিয়ে ব্যাংকার লোকটা দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বাইরে থেকে চাবি মেরে দিলো। তাদেরকে ভেতরে আঁটকে ফেলা হলো।

 

 

 

শহরের উপকণ্ঠে, কোলেত গার দু নর্দ ট্রেন টামিনালে দাঁড়িয়ে আছে। তার ফোনটা বেজে উঠলো।

 

ফশের ফোন। ইন্টারপোল একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছে। ল্যাংডন আর সোফি এইমাত্র প্যারিসের ডিপোজিটরি ব্যাংক অব জুরিখের একটা শাখায় গেছে। আমি চাই, তুমি তোমার লোকজন নিয়ে সেখানে এক্ষুণি চলে যাও।

 

এজেন্ট নেভু আর রবার্ট ল্যাংডনের কাছে সনিয়ে কী বলতে চেষ্টা করেছেন, সে ব্যাপারে কি কিছু জিজ্ঞেস করবো?

 

ফশের কণ্ঠটা শীতল হয়ে গেলো। তুমি যদি তাদেরকে গ্রেফতার করতে পারো লেফটেনান্ট কোলেত, তখন আমি নিজেই সেটা তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে পারবো।

 

কোলেত ইঙ্গিতটা ধরতে পারলো। চব্বিশ রুই হাক্সো। এক্ষুণি যাচ্ছি ক্যাপ্টেন। সে ফোনটা কেটে দিয়ে তার লোকদের কাছে ওয়্যারলেস করলো।

 

 

 

৪৩.

 

আদ্রেঁ ভার্নেট–জুরিখের ডিপোজিটরি ব্যাংকের প্যারিস শাখার প্রেসিডেন্ট ব্যাংকের ওপরেই বিরাট একটা ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। তাঁর এই চমক্কার থাকার জায়গা সত্ত্বেও তিনি স্বপ্ন দেখেন লিলের সেন্ট লুইর নদীর তীরের একটা এপার্টমেন্টের মালিক হতে, যেখানে তিনি তার কাঁধ সোজা করে সত্যিকারের মর্যাদা নিয়ে থাকবেন, এখানকার মতো নোংরা ধনীদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার মতো কিছু থাকবে না সেখানে।

 

আমি যখন অবসরে যাবো, ভার্নেট নিজেকে বললেন, আমার ঘরটা বোর্দ মদ দিয়ে ভরে রাখবো, আর সারা দিন কাটাবো পুরনো ফার্নিচার এবং লাতিন কোয়ার্টার থেকে সংগ্রহ করা বই।

 

আজ রাতে, ভার্নেট, এইতো, মাত্র সাড়ে ছয় মিনিট আগে জেগেছেন। তারপরও, যখন ব্যাংকের আন্ডারগ্রাউন্ড করিডোর দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন তখন তাকে দেখলে মনে হবে তাঁর ব্যক্তিগত দর্জি এবং হেয়ার ড্রেসার তাকে ঘষা-মাজা করে চকে করে তুলেছে। নিখুঁতভাবেই সিল্কের সুট পরেছেন ভার্নেট, মুখে মাউথন্দ্রে করেছেন। হাটতে হাটতে টাইটা বেঁধে নিলেন ঠিক মতো। আন্তর্জাতিক কোন গ্রাহক, ভিন্ন কোন টাইম জোন থেকে ব্যাংকে এসে পৌঁছালে তাঁকে এভাবে উঠতেই হয়, এটা কোন অদ্ভুত ব্যাপার নয় তার কাছে। ভার্নেট মাসাই যোদ্ধাদের আদলে ঘুম দিয়ে থাকেন—এই আফ্রিকান উপজাতি, গভীর ঘুম থেকে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জেগে ওঠে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে পারার ক্ষমতা রাখে।

 

যুদ্ধ প্রস্তুত, ভার্নেট ভাবলেন। আশংকা করলেন আজ রাতের ঘটনাটা খুব অভাবনীয় কিছু হবে। গোল্ড কি গ্রাহকের আগমন সবসময়ই বাড়তি মনোযোগ দাবি করে। কিন্তু একজন গোল্ড কির গ্রাহক যে কি-না জুডিশিয়াল পুলিশ কর্তৃক ফেরারি, সেটা নিঃসন্দেহে নাজুক একটা ব্যাপার। গ্রাহকদের গোপনীয়তার ব্যাপারটা নিয়ে ব্যাংকের সাথে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকদের যথেষ্ট লড়াই হয়েছে। তারা কোন প্রমাণ ছাড়াই কিছু গ্রাহককে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো।

 

পাঁচ মিনিট, ভার্নেট নিজেকে বললেন। পুলিশ আসার আগেই এই লোকগুলো ব্যাংক থেকে বের হয়ে যাওয়া দরকার।

 

যদি খুব দ্রুত পৌঁছানো যায়, এই অনাহুত বিপদটা পাশ কাটানো যেতে পারে। ভার্নেট পুলিশকে বলতে পারবে, ফেরারিরা তাঁর ব্যাংকে এসেছিলো ঠিকই, কিন্তু তারা যেহেতু গ্রাহক নয়, আর তাদের কোন একাউন্টও নেই তাই তারা চলে গেছে। তিনি মনে মনে চাইছিলেন বোকা দারোয়ানটা যেনো ইন্টারপোলে ফোন না করে বসে। ১৫ ইউরো প্রতি ঘণ্টার দারোয়ানের কাছ থেকে বিচক্ষণতার প্রত্যাশা করা ঠিক নয়।

 

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, তিনি একটা লম্বা দম নিয়ে নিজের মাংসপেশীগুলোকে শিথিল করে নিলেন। তারপর, একটা কপট হাসি জোর করে মুখে এঁটে দিলেন। দরজাটা লাগিয়ে ঘরের ভেতরে গরম বাতাসের মতো ঢুকে পড়লেন।

 

গুড ইভিনিং, তিনি বললেন, তার চোখ ক্লায়েন্টদের খুঁজলো। আমি আজেঁ ভার্নেট। আমি কীভাবে আপনাদের সা শব্দটার বাকি অংশ তঁার এডামস এ্যাপেলের কোথাও আঁটকে গেলো। তাঁর সামনের মেয়েটা এতোটাই অপ্রত্যাশিত যে, ভার্নেট সেটা কল্পনাই করতে পারছিলেন না।

 

 

 

আমি দুঃখিত, আমরা কি একে অন্যেকে চিনি? সোফি জিজ্ঞেস করলো। সে ব্যাংকারকে চিনতে না পারলেও, কয়েক মুহুর্তের জন্য তার মুখটা দেখে মনে হলো, তিনি যেনো ভূত দেখছেন।

 

না… ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তোতলাতে শুরু করলেন। আমার…বিশ্বাস। আমাদের সার্ভিসটা বেনামে হয়। তিনি দম নিয়ে একটা হাসি দেবার চেষ্টা করলেন। আমার সহকারী আমাকে বলেছে, আপনাদের কাছে একটা গোল্ড কি আছে, কিন্তু কোন একাউন্ট নাম্বার নেই? আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি, চাবিটা কোথেকে পেয়েছেন?

 

আমার দাদু আমাকে এটা দিয়েছেন, লোকটাকে একটু ভালো করে দেখে সোফি জবাব দিলো। তার অস্বস্তিটা এখন আরো বেশি ইঙ্গিতবহ মনে হচ্ছে।

 

সত্যি? আপনার দাদ আপনাকে চাবিটা দিলেও একাউন্ট নাম্বার দিতে পারেন নি?

 

আমার মনে হয়, তিনি সময় পাননি, সোফি বললো। তিনি আজ রাতে খুন হয়েছেন।

 

তার কথায় লোকটা একটু পিছিয়ে গেলো। জ্যাক সনিয়ে মারা গেছেন? তিনি জানতে চাইলেন, তার চোখ জুড়ে আতংক। কিন্তু … কিভাবে?

 

এবার সোফি দারুণ অবাক হলো, ঘটনার আকস্মিকতায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। আপনি আমার দাদুকে চিনতেন?

 

ব্যাংকার আদ্রেঁ ভার্নের্টকেও একইরকম বাকরুদ্ধ হতে দেখা গেলো, টেবিলের কোনা ধরে একটু হেলে পড়লেন তিনি। জ্যাক এবং আমি খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। কখন ঘটনাটা ঘটলো?

 

আজ রাতের শুরুতে। লুভরের ভেতরেই।

 

ভার্নেট একটা চামড়ার চেয়ারে বসে পড়লেন। আপনাদের দুজনকে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আছে। তিনি ল্যাংডন আর সোফির দিকে তাকালেন। আপনাদের কেউ কি তার মৃত্যুর সাথে কোনভাবে জড়িত?

 

না! সোফি জোড় দিয়ে বললো। একেবারেই নয়। ভার্নেটের চেহারাটায় একটা তিক্তভাব দেখা গেলো, তিনি একটু থেমে ভাবতে লাগলেন। ইন্টারপোল আপনাদের ছবি সম্প্রচার করছে। এজন্যেই আমি আপনাদেরকে চিনতে পেরেছিলাম, আপনারা হত্যার খুনের আসামী।

 

সোফি আৎকে উঠলো। ফশে ইতিমধ্যে ইন্টারপোলে সম্প্রচার করে ফেলেছে? এতে মনে হলো, সোফির ধারণার চেয়েও ক্যাপ্টেন অনেক বেশি করিকর্মা। সে খুব দ্রুত ল্যাংডনের পরিচয়টা দিয়ে দিলো আর লুভরের ভেতরে কী ঘটেছে সেটাও জানালো।

 

ভার্নেট খুব বিস্মিত হলো। আপনার দাদু মারা যাবার সময় আপনার জন্য একটা মেসেজ লিখে বলে গেছেন যে, মি. ল্যাংডনকে খোঁজ করুন?

 

হ্যাঁ। আর এই চাবিটা। সোফি সোনার চাবিটা প্রায়োরির সিলটার দিক মুখ করে ভার্নেটের সামনে কফি টেবিলের ওপরে রাখলো।

 

ভার্নেট চাবিটার দিকে তাকালেন, কিন্তু সেটা ধরলেন না। শুধু চাবিটাই আপনাকে দিয়েছে? আর কিছু না? কোন কাগজের টুকরো?

 

সোফি জানতো, সে লুভরে খুব তাড়াহুড়ো করেছিলো। কিন্তু সে একেবারে নিশ্চিত, মাড়োনা অব দি রকসর পেছনে অন্য কিছু ছিলো না। না, শুধু চাবিটা।

 

ভার্নেট একটা হতাশাজনক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, প্রতিটা চাবির সাথেই দশ সংখ্যার একটা একাউন্ট নাম্বারও থাকে। সেই নাম্বারটাই হলো। পাসওয়ার্ড। নাম্বারটা ছাড়া চাবিটা একেবারেই মূল্যহীন।

 

দশ সংখ্যার নাম্বার। সোফি মনে মনে ক্রিপ্টোগ্রাফিক কোডটার হিসাব-নিকাশ করতে শুরু করলো। দশ বিলিয়ন সম্ভাব্য সংখ্যা হবে। সে যদি ডিসিপিজের সবচাইতে শক্তিশালী প্যারালাল কম্পিউটার ব্যবহার করে তবে কোডটা ভাঙতে তার কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে। অবশ্যই মঁসিয়ে, সব কিছু বিবেচনা করে আপনি আমাদেরকে সাহায্য করতে পারেন।

 

আমি দুঃখিত। সত্যি বলতে কী, আমি কোন সাহায্যই করতে পারবো না। গ্রাহকরা তাদের একাউন্ট নাম্বারগুলো একটা নিরাপদ টার্মিনালের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। তার মানে, একাউন্ট নাম্বারটা কেবল গ্রাহক এবং কম্পিউটারই জানতে পারে। এইভাবে আমরা আমাদের সুরক্ষা দিয়ে থাকি। আর এটা আমাদের কর্মচারীদেরকেও নিরাপত্তা দিয়ে থাকে।

 

সোফি বুঝতে পারলো। কনভিনিয়েন্স স্টেটনারও একই জিনিস করে থাকে। কর্মচারীদের কাছে চাবি থাকে না। এই ব্যাংক নিশ্চিতভাবেই চায় না এমন ঝুঁকি নিতে, যাতে করে কেউ একটা চাবি চুরি করে ব্যাংকের কোন কর্মচারীকে জিম্মি করে একাউন্ট নাম্বারটা নিয়ে নিতে পারে।

 

সোফি ল্যাংডনের পাশে বসে পড়লো। চাবির দিকে তাকিয়ে তারপর ভানেক্টের দিকে তাকালো। আমার দাদু ব্যাংকে কী রেখেছেন, সে সম্পর্কে কি আপনার কোন ধারণা আছে?

 

একেবারেই না। এটাই গেন্ডশ্রাংক ব্যাংকের সংজ্ঞা।

 

মঁসিয়ে ভার্নেট, সে আরেকটু চাপাচাপি করলো। আজ রাতে আমাদের হাতে খুব অল্পই সময় আছে। আমি সরাসরিই বলছি। সে সোনার চাবিটা হাতে নিয়ে প্রায়োরি সিলটা তাঁকে দেখালো। এই চাবির প্রতীকটা কি আপনার কাছে কোন অর্থ বহন করে?

 

ভার্নেট ফ্লার-দ্য-লিস সিলটার দিকে তাকিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। না, কিন্তু আমাদের অনেক গ্রাহকই নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লোগো কিংবা আদ্যক্ষর অংকিত করে থাকে।

 

সোফি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো, তখনও তাঁকে সতর্কভাবে দেখে যাচ্ছিলো। এই সিলটা একটা গুপ্তসংগঠন, প্রায়োরি অব সাইন-এর প্রতীক।

 

ভার্নেট আবারো কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। আমি এসবের কিছুই জানি না। আপনার দাদু আমার একজন বন্ধু ছিলেন। কিন্তু আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজের কথা বলতাম। লোকটা তার টাই ঠিক করে নিলেন, এখন খুব নার্ভাস দেখাচ্ছে তাঁকে।

 

সিয়ে ভার্নেট, সোফি জোর দিয়ে বললো, তার কণ্ঠ খুবই দৃঢ়। আমার দাদু আজ রাতে আমাকে ফোন করে বলেছিলেন যে, তিনি এবং আমি মারাত্মক বিপদে আছি। তিনি বলেছেন, তার নাকি আমাকে কিছু একটা দেয়ার আছে। তিনি আমাকে আপনার ব্যাংকের এই চাবিটা দিয়েছেন। এখন তিনি মারা গেছেন। আপনি আমাদেরকে কিছু বললে, সেটা আমাদের খুব সাহায্যে আসবে।

 

ভার্নেট ঘামে ভিজে গেলেন। আমাদেরকে এই ভবন থেকে বের হয়ে যেতে হবে। আমার ভয় হচ্ছে পুলিশ খুব শীঘ্রই এখানে এসে পৌঁছাবে। আমার দারোয়ান ইন্টারপোলকে ফোন করে দিয়েছে।

 

সোফি একটু ভয় পেয়ে গেলো। সে শেষবারের মতো একটা চেষ্টা করে দেখলো। আমার দাদু বলেছিলেন যে, তিনি আমার পরিবার সম্পর্কে একটা সত্য কথা বলতে চান। এটা কি আপনার কাছে কোন অর্থ বহন করে?

 

মাদামোয়াজেল, আপনার পরিবার একটা গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলো, তখন আপনি খুবই ছোট ছিলেন। আমি দুঃখিত। আমি জানি আপনার দাদু আপনাকে খুব ভালোবাসতেন। সে আমাকে অনেকবারই বলেছে, আপনার সাথে তার সম্পর্কচ্ছেদের জন্য কী কষ্টটাই না সে পেয়েছে।

 

সোফি কী বলবে ভেবে পেলো না।

 

ল্যাংডনই জিজ্ঞেস করলো, এই একাউন্টে যা রাখা হয়েছে, তার সাথে কি স্যাংগৃলের কোন সম্পর্ক রয়েছে?

 

ভার্নেট আজব ভঙ্গীতে তার দিকে তাকালো। এটা আবার কি, এ সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই নেই। ঠিক এই সময়েই ভার্নেটের সেল ফোনটা বেজে উঠলে বেল্ট থেকে ওটা খুলে নিলেন। উই? তিনি কয়েক মুহূর্ত শুনলেন। তাঁর চেহারায় বিস্ময় আর দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা গেলো। লা পুলিশ? সি র‍্যাপিদেমো? তিনি দ্রুত ফরাসিতে কিছু নির্দেশ দিয়ে দিলেন, আর বললেন কয়েক মিনিটের মধ্যে সে নিজেই। লবিতে আসছে।

 

ফোনটা রেখেই তিনি সোফির দিকে ঘুরলেন। পুলিশ খুব দ্রুতই ছুটে এসেছে দেখছি। আমরা কথা বলতে বলতেই তারা এসে পড়বে। শুনুন, ভার্নেট বললেন, জ্যাক আমার বন্ধু ছিলেন, আর আমার ব্যাংক চায় না এটা জানা-জানি হোক। তাই দুটো কারণে, আমি আমার এখানে কোন ধরণের গ্রেফতার হওয়াটা চাইছি না। আমাকে একটু সময় দিন, দেখি আপনাদেরকে এখান থেকে সবার অলক্ষ্যে বের করে দিতে পারি কিনা। এটা ছাড়া আমি আর কোনভাবে জড়িত হতে চাই না। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে চলে গেলেন। এখানেই থাকুন। আমি ব্যবস্থা করে ফিরে আসছি।

 

কিন্তু সেফ-ডিপোজিট বাক্সটা, সোফি জানালো। আমরা তো শুধু শুধু চলে যেতে পারি না।

 

এ ব্যাপারে আমি কিছু করতে পারবো না। ভার্নেট বললেন, দ্রুত দরজার দিকে এগোলেন। আমি দুঃখিত।

 

সোফি তার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো, ভাবলো, হয়তো একাউন্ট নাম্বারটা বছরে পর বছর ধরে তার দাদুর পাঠানো অসংখ্য চিঠির ভীড়ে চাপা পড়ে আছে, যা সে কখনই খুলে দেখেনি।

 

ল্যাংডন আচম্‌কা উঠে দাঁড়ালো। সোফি আঁচ করতে পারলো অপ্রত্যাশিত কিছু একটা তার চোখে, আশাব্যঞ্জক কিছু।

 

রবার্ট তুমি হাসছো।

 

তোমার দাদু একজন জিনিয়াস।

 

কি বললে?

 

দশ সংখ্যা?

 

সোফি কিছুই বুঝতে পারলো না। সে কি বলছে।

 

একাউন্ট নাম্বারটা, সে বললো, তার চেহারার একটা বুদ্ধিদীপ্তি ঝলক দেখা যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত, তিনি ওটা আমাদের কাছেই রেখে গেছেন।

 

কোথায়?

 

ল্যাংডন তার পকেট থেকে কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটটা বের করে কফি টেবিলের ওপর রাখলো। সোফি প্রথম লাইনটা পড়েই বুঝতে পারলো ল্যাংডন ঠিকই বলছে।

 

13-3-2-21-1-1-8-5

 

O, Draconian devil!

Oh, I ame saint!

P.S.Find Robert Langdon

 

 

 

৪৪.

 

দশটি সংখ্যা, সোফি বললো, প্রিন্ট-আউটটা দেখে তার ক্রিপ্টোলজিক জ্ঞানে টনক নড়লো।

 

১৩-৩-২-২১-১-১-৮-৫

 

দাদু তাঁর একাউন্ট নাম্বারটা লুভরের ফ্লোরে লিখে গেছেন!

 

সোফি যখন প্রথম এলোমেলো ফিবোনাচ্চি সংখ্যামটা কাঠের ফ্লোরে দেখেছিলো, তার নিশ্চিত ধারণা ছিলো, এটার মূল উদ্দেশ্য, ডিসিপিজের একজন ক্রিপ্টোগ্রাফার জড়িত করানো, যাতে সোফি এই ঘটনায় জড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে, সে বুঝেছিলো, সংখ্যাগুলোর বাকি লাইনগুলোর মর্মোদ্ধার করার একটা কু-ও বটে—এলোমেলো একটা সংখ্যাক্রম…একটা সংখ্যার এনাগ্রাম। এখন, পুরোপুরি বিস্মিত হয়ে, সে দেখছে, সংখ্যাগুলোর গুরুত্ব আসলে অনেক বেশি। সেগুলো তার দাদুর রহস্যময় সেফ ডিপোজিট বক্স খোলার চাবিকাঠি। তিনি ছিলেন একজন দ্ব্যর্থবোধক বিষয়ের ওস্তাদ, ল্যাংডনের দিকে ফিরে সোফি বললো। একাধিক অর্থ আছে এমন কোনকিছুকে তিনি খুবই পছন্দ করতেন। কোডের ভেতরে কোড।

 

ল্যাংডন ইতিমধ্যে ইলেক্ট্রনিক পোডিয়ামের দিকে এগিয়ে গেলে সোফি কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটটা হাতে নিয়ে তাকে অনুসরণ করলো।

 

এটিএম ব্যাংকের মতোই পোডিয়ামটার একটা কি-প্যাড রয়েছে। পর্দায় ব্যাংকের অফিশিয়াল লোগে আর একটা ক্রুশ ভেসে এলো। কি-প্যাডটার পাশেই একটা ত্রিভূজাকৃতির ছিদ্র আছে। সোফি আর দেরি না করে সেই ছিদ্রের ভেতরে তার চাবিটা ঢুকিয়ে দিলে সঙ্গে সঙ্গে পর্দাটা বদলে গেলো।

 

একাউন্ট নাম্বার :

 

কারসরটা চম্‌কাতে লাগলো। অপেক্ষা করছে।

 

দশ সংখ্যা। সোফি কাগজটা থেকে সংখ্যাগুলো পড়লো আর ল্যাংডন সেগুলো টাইপ করে নিলো।

 

একাউন্ট নাম্বার :

১৩-৩-২-২-১-১-৮-৫

 

শেষ সংখ্যাটা লেখা হওয়ার সাথে সাথে পর্দাটা আবার বদলে গেলো। কয়েকটা ভাষায় একটা বার্তা ভেসে এলো, সবার ওপরে ইংরেজি।

 

সাবধান :

Enter বাটনে চাপ দেবার আগে দয়া করে

আপনি আপনার একাউন্ট নাম্বারটা ঠিক আছে কিনা

সেটা চেক করে দেখুন।

আপনার নিরাপত্তার জন্যই, যদি কম্পিউটার

আপনার একাউন্ট নাম্বার চিনতে না পারে,

তবে এই সিস্টেমটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে।

 

ফঙ্কশন তারমিনার, চিন্তিত হয়ে সোফি বললো। মনে হচ্ছে একবারই চেষ্টা করা যাবে। স্টান্ডার্ড এটিএম মেশিন ব্যবহারকারীদেরকে তিন বার পিন নাম্বার টাইপ করার সুযোগ দিয়ে থাকে। এটা অবশ্য সেরকম সাধারণ কোন ক্যাশ মেশিন নয়।

 

সংখ্যাগুলো মনে হচ্ছে ঠিকই আছে, ল্যাংডন নিশ্চিত করে বললো। কাগজের লেখার সাথে টাইপ করা লেখাটা মিলিয়ে দেখলো। Enter বোতামটার দিকে এগোলো। দিলাম চেপে।

 

সোফি তার তর্জনীটা কি প্যাডের কাছাকাছি এনেও দ্বিধান্বিত হলো। তার মনে অদ্ভুত এক ভাবনা খেলে গেলো।

 

দাও, ল্যাংডন বললো। ভার্নেট খুব জলদিই ফিরে আসবে।

 

না। সে তার হাতটা সরিয়ে নিলো। এটা সঠিক একাউন্ট নাম্বার না।

 

অবশ্যই এটা! দশ সংখ্যার। তাহলে অন্য কোনটা?

 

এটা খুব বেশি এলোমেলো।

 

খুব বেশি এলোমেলো? ল্যাংডন খুব বেশি দ্বিমত পোষণ করতে পারলো না।

 

প্রতিটি ব্যাংকই তার কাস্টমারদেরকে পিন নাম্বার হিসেবে এলোমেলো সংখ্যা বেছে নেবার জন্য উপদেশ দিয়ে থাকে, যাতে অন্য কেউ সেটা অনুমান করতে না পারে। নিশ্চিতভাবেই, এখানেও গ্রাহকদেরকে এলোমেলো সংখ্যাই বেছে নিতে বলা হয়।

 

সোফি যা টাইপ করেছিলো, তার সবটাই মুছে ফেললো। সে ল্যাংডনের দিকে তাকালো। তার তাকানোর মধ্যে আত্মবিশ্বাসী একটা ভাব ছিলো। এই সংখ্যাগুলো ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রম অনুযায়ী সাজানো হলেই মনে হয় নাম্বারটা সঠিক হবে।

 

ল্যাংডন বুঝতে পারলো, তার কথায় যুক্তি আছে। প্রথম দিকে সোফি এই একাউন্ট নাম্বারটা চিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রম অনুযায়ীই সাজিয়েছিলো। এটা করা এমন কি আর অদ্ভুত ব্যাপার?

 

সোফি আবারো কি-প্যাডে হাত রাখলো। এবার ভিন্ন একটা নাম্বার টাইপ করলো, স্মৃতি থেকেই। আরেকটা কথা, আমার দাদুর প্রতীক এবং কোডের প্রতি দুর্বলতার জন্য মনে হয়, তিনি এমন সংখ্যাক্রমই বেছে নেবেন, যা খুব সহজেই মনে রাখতে পারেন। সে টাইপ করে এন্টার কি-তে চাপ দিয়ে একটা নরম হাসি দিলো। এমন কিছু, যা দেখতে এলোমেলো মনে হলেও, আসলে তা নয়।

 

ল্যাংডন পর্দার দিকে তাকালো।

 

একাউন্ট নাম্বার :

১১২৫৮১৩২১

 

কয়েক মুহূর্ত ভেবে ল্যাংডন বুঝতে পারলো সোফি ঠিকই করছে।

 

ফিবোনাচ্চি সংখ্যাক্রম।

 

১-১-২-৩-৫-৮-১৩-২১

 

যখন ফিবোনাচ্চি সংখ্যাগুলো দশটি সংখ্যায় আলাদা আলাদা করে মিলিয়ে ফেলা হয়, তখন সেটা দৃশ্যত চেনাই যায় না। সহজেই স্মরণ করা যায়, তারপরও মনে হয়, এলোমেলো। দশসংখ্যার একটা অসাধারণ কোড, যা কখনও সনিয়ে ভুলতেন না।

 

সোফি এন্টার কি-তে চাপ দিয়ে দিলো।

 

কিছুই হলো না।

 

এমন কিছু হলো না, যাতে তারা কিছু বুঝতে পারে।

 

 

 

ঠিক সেই সময়েই, তাদের নিচে, ব্যাংকের ভূ-গর্ভস্থ ভল্টে, একটা রোবটিক হাত জীবন্ত হয়ে উঠলো। হাতটা নির্দিষ্ট জিনিস খুঁজছে। সিমেন্টের ফ্লোরের নিচে, শত শত পরিচিতিমূলক প্লাস্টিকের বাক্স সারি করে সাজানো আছে…অনেকটা ছোট ছোট কফিন যেনো মাটির নিচে থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

 

রোবোটিক হাতটা সঠিক বাক্সটা খুঁজে পেয়ে, বাক্সের গায়ে লেখা কোডটা সেই হাতের সাথে লাগোয়া একটা ইলেক্টক চোখ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো, নাম্বারটা ঠিক আছে কি না। তারপর কম্পিউটারের নির্দেশে হাতটা একটা বাক্সকে ধরে উপরের দিকে সোজা তুলতে শুরু করলো।

 

ধীরে ধীরে মাটি থেকে বাক্সটা উপরে উঠে আসতে লাগলো…

 

উপরের তলায় সোফি আর ল্যাংডন কনভেয়ার বেল্টটা নড়তে দেখে হাপ ছেড়ে বাঁচলো। বেল্টটার পাশে দাঁড়িয়ে তাদের মনে হলো, অনেক পথ ভ্রমণ করে অবশেষে যে লাগেজের জন্য তারা অপেক্ষা করছে, সেই রহস্যময় লাগেজটাতে কী আছে, সেটা তারা জানে না। কনভেয়ার বেল্টটার স্লাইডিং ডোরটা খুলে যেতেই, একটা প্লাস্টিকের বাক্স আর্বিভূত হলো। সেটা বেল্টের নিচ থেকে উঠে এসেছে। বাক্সটা কালো। খুব ভারি প্লাস্টিকে মোড়ানো, আর সেটা সোফি যে রকম বাক্সের কথা ভেবেছিলো, সেই রকমই। তাতে কোন ছিদ্র নেই।

 

বক্সটা সরাসরি তাদের সামনে এসে থামলো।

 

ল্যাংডন আর সোফি রহস্যময় কন্টেইনারের দিকে তাকিয়ে, সেখানেই নিরবে দাঁড়িয়ে রইলো।

 

এই ব্যাংকের সবকিছুর মতোই বাক্সটাও লোহার কয়ড়া বিশিষ্ট। এর উপরে একটা বারকোড-এর স্টিকার লাগানো আছে। সেটার একটা হাতলও রয়েছে। সোফি ভাবলো, এটা দেখতে অনেকটা বিশাল যন্ত্রপাতি রাখার বাক্সের মতো।

 

কোন সময় নষ্ট না করেই সোফি কয়ড়াটা খুলে ফেললো। তারপর, ল্যাংডনের দিকে তাকালো সে। দুজন এক সাথে ভারি ঢাকনাটা খুলে ফেললো।

 

বাক্সটার ভেতরে তাকালো তারা।

 

প্রথমে সোফি ভেবেছিলো, বাক্সটা খালি। তারপরই সে কিছু একটা দেখতে পেলো। বাক্সটার ঠিক মাঝখানে, একটা জিনিস রাখা আছে।

 

পালিশ করা একটা কাঠের বাক্স, জুতার বাক্সের আকারের। তাতে নক্সা করা রয়েছে। কাঠটা খুবই সুন্দর গভীর বেগুনী রঙের, দানাদার যুক্ত। রোজউড। সোফি বুঝতে পারলো। তার দাদুর প্রিয় জিনিস। ঢাকনাটাতে খুবই সুন্দর করে একটা গোলাপ আঁকা। তারা একে অন্যের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকালো। সোফি ঝুঁকে বাক্সটা তুলে নিলো।

 

হায় ঈশ্বর, অনেক ভারি!

 

সে ওটা তুলে পাশের টেবিলটার উপর রাখলো। ল্যাংডন তার পাশে এসে দাঁড়ালো, তাদের দুজনেই সোফির দাদার সেই সেই ছোট্ট জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রইলো। এটা ওদের দখলে নেবার জন্যই দাদু তাকে মেসেজ দিয়েছিলেন।

 

ল্যাংডন ঢাকনাটার দিকে বিস্ময়ে চেয়ে রইলো। বিশেষ করে নক্সাটার দিকে পঁচটা পাপড়ির গোলাপ। সে এ ধরনের গোলাপ অনেকবার দেখেছে। পাঁচ পাপড়ির গোলাপ হলো, সে ফিসফিস করে সোফিকে বললো, প্রায়োরিদের হলি গ্রেইলের প্রতীক।

 

সোফি তার দিকে ঘুরে তাকালো। ল্যাংডন বুঝতে পারলো সে কী ভাবছে। সেও একই রকম কথা ভাবছিলো। এই বাক্সটার ডাইমেনশন, এটার ওজন, এবং প্রায়োরিদের হলি গ্রেইল-এর প্রতীক, সবটাই একটি জিনিসকেই বোধগম্য করে তুলে। এই কাঠের বাক্সটার ভেতরে যিশুখৃস্টের পেয়ালা আছে। ল্যাংডন আবারো নিজেকে সুধালো, এটা অসম্ভব।

 

আকারটা যথার্থই, সোফি ফিস্ ফিস্ করে বললো, একটা পেয়ালাকে…ধারণ করার জন্য।

 

এটা পেয়ালা হতেই পারে না।

 

সোফি বাক্সটা খুলে ফেললো। ওটা খুলতেই অপ্রত্যাশিতভাবে, অদ্ভুত গরুগরু শব্দ বের হতে লাগলো। ল্যাংডন সঙ্গে সঙ্গে ভাবলো, এর ভেতরে তরল পদার্থ আছে?

 

সোফিকেও খুব বিভ্রান্ত দেখালো। তুমি কি শুনতে পেয়েছো…?

 

ল্যাংডন মাথা নাড়লো। তরল।

 

একটু সামনে এগিয়ে, সোফি ঢাকনাটা পুরোপুরি খুলে ফেললো। ভেতরের জিনিসটা এমন কিছু, যা ল্যাংডন চিন্তাও করতে পারেনি। একটা জিনিস তারা দুজনে খুব দ্রুতই বুঝতে পারলো যে, নিশ্চিতভাবেই এটা যিশু খৃস্টের পেয়ালা নয়।

 

 

 

৪৫.

 

পুলিশ রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছে, ওয়েন্টিং রুমের দিকে যেতে যেতে আদ্রেঁ ভার্নেট বললেন। আপনাদেরকে বের করে দেয়াটা খুব কঠিন কাজ হবে। দরজাটা বন্ধ করতেই ভার্নেট দেখতে পেলেন বিশাল পাস্টিকের বাক্সটা কনভেয়ার বেল্টের উপরে রাখা। হায় ঈশ্বর! তারা সনিয়ের একাউন্টটা খুলে ফেলেছে?

 

সোফি আর ল্যাংডন টেবিলের কাছেই ছিলো, তাদের হাতে ধরা ছিলো একটা কাঠের বাক্স, দেখতে অনেকটা গহনার বাক্সের মতোই। সোফি সাথে সাথেই ঢাকনাটা বন্ধ করে দিয়ে তার দিকে তাকালো। শেষ পর্যন্ত আমরা একাউন্ট নাম্বারটা পেয়েছি, সে বললো।

 

ভার্নেট বাকরুদ্ধ। এখন তো সবকিছুই বদলে গেলো। তিনি সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে বাক্সটার দিকে তাকালেন, চেষ্টা করলেন পরবর্তী পদক্ষেপ কী নেবেন সেটা বের করতে। তাদেরকে আমার ব্যাংক থেকে বের করতেই হবে! কিন্তু পুলিশ রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়াতে এখন একটি মাত্র পথই খোলা আছে। মাদামোয়াজেল নে আমি যদি আপনাদেরকে ব্যাংক থেকে নিরাপদে বের করে দিতে পারি, তাহলে আপনারা কি এই জিনিসটা নিজেদের সাথেই নেবেন নাকি ব্যাংকের ভল্টে রেখে যাবেন?

 

সোফি ল্যাংডনের দিকে চেয়ে তারপর ভার্নেটের দিকে তাকালো। আমাদের এটা সঙ্গে নিতে হবে।

 

ভার্নেট মাথা নেড়ে সায় দিলেন। খুব ভালো। তাহলে, জিনিসটা যাইহোক, আমি আপনাদেরকে বলবো, এটা আপনার জ্যাকেটে মুড়িয়ে নিন, হলওয়ে দিয়ে যাবার সময় আমি চাইবো কেউ যাতে এটা দেখে না।

 

ল্যাংডন সেটা জ্যাকেটের তলায় নিতেই ভার্নেট তড়িঘড়ি করে কনভেয়ার বেল্টের দিকে গেলো। খালি বাক্সটা বন্ধ করে কি-প্যাডে কী যেনো টাইপ করলো। কনভেয়ার বেল্টটা আবার নড়তে শুরু করলো, নিজের জায়গায় চলে গেলো পাস্টিকের বাক্সটা। পোডিয়াম থেকে সোনার চাবিটা খুলে সোফির হাতে দিয়ে দিলেন তিনি।

 

এই দিকে প্লিজ। তাড়াতাড়ি।

 

তারা এগোতেই টের পেলো নিচে পুলিশ এসে জড়ো হয়েছে। পুলিশের গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা যাচ্ছে। ভার্নেট চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সম্ভবত, তারা পুরো ভবনটা ঘিরে ফেলেছে। আমি কি সত্যি এটা খুলে ফেলবো? ভার্নেট এখন ঘামছেন।

 

ভার্নেট ব্যাংকের ছোট্ট একটা পরিবহন ট্রাকের দিকে এগোলেন। ট্রান্সপোর্ট সুর হলো জুরিখের ডিপোজিটরি ব্যাংকের আরো একটি সার্ভিস। কার্গোটাতে উঠে পড়ন, পেছনের বিশাল স্টিলের দরজাটা খুলে দিয়ে বললেন, আমি আসছি।

 

সোফি আর ল্যাংডন কার্গোর ভেতরে উঠতেই, ভার্নেট ড্রাইভারের অফিসের দিকে চলে গেলেন। ভেতরে ঢুকেই তিনি চাবিটা নিয়ে ড্রাইভারের একটা পোশাক আর টুপি নিয়ে নিলেন। ড্রাইভারের পোশাকটা পরার পর তার কোট, টাই সব ঢাকা পড়ে গেলো। তিনি একটা শোল্ডার হোলস্টারও পরে নিলেন, জামাটার ভেতরে। বের হবার সময় ড্রাইভারের একটা পিস্তল সাথে করে নিয়ে নিলেন। সেটা হোলস্টারের ভরে পোশাকটার বোম লাগিয়ে নিলেন। গাড়িটার কাছে ফিরে এসেই ভার্নেট টুপিটা আরো নামিয়ে দিলেন। সোফি আর ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তারা কার্গোর ভেতরে রাখা স্টিলের বাক্সের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।

 

আপনারা কি এটা চান, ডানেট বলেই ভেতরে ঢুকে একটা সুইচ টিপলেন, আর সাথে সাথে ভেতরে একটা বা জ্বলে গেলো। আপনারা বসে পড়ন। গেট দিয়ে বের হবার সময় কোন শব্দ করবেন না।

 

সোফি আর ল্যাংডন লোহার ফ্লোরে বসে পড়লো। ল্যাংডন তার জ্যাকেটের ভেতর থেকে বাক্সটা বের করে কোলের ওপর রাখলো। বিশাল দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। ভার্নেট তাদেরকে ভেতরে তালা মেরে দিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে গাড়ির ইঞ্জিনটা চালু করে দিলেন।

 

ট্রাকটা পার্কিং লাইন থেকে বের হয়ে বাইরের দিকে এগোতেই ভার্নেট ঘেমে উঠলেন। তার এইমাত্র পরা টুপিটার নিচেও ঘাম জমে গেছে। তিনি দেখতে পেলেন বাইরে তাঁর ধারণার চেয়েও বেশি পুলিশের গাড়ি পার্কিং লট থেকে বের হতেই দরজাটা আপনা আপনিই খুলে গেলো। ভার্নেট গেট থেকে বের হয়ে একটু থামলেন, পেছনের দরজাটা বন্ধ হবার জন্য অপেক্ষা করলেন। তারপর, তার সামনের গেটটাও খুলে গেলে গাড়িটা নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলেন।

 

ভার্নেট গাড়িটা নিয়ে সামনের দিকে এগোলেন।

 

রাস্তার ব্যারিকেডের সামনে থাকা একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে তার গাড়িটা হাত দিয়ে থামাতে নির্দেশ দিলো। সামনে চারটা প্যাট্রল গাড়ি ব্লক করে দাঁড়িয়ে আছে।

 

ভার্নেট গাড়িটা থামালেন। ড্রাইভারের টুপিটা টেনে আরেকটু নিচে নামিয়ে নিলেন। দরজাটা খুলে পুলিশের দিকে তাকালেন। লোকটার চেহারা অনমনীয় আর পাণ্ডুর।

 

কুয়েস্ত সি কুই সে পাস? ভার্নেট জিজ্ঞেস করলেন, তাঁর কণ্ঠ খুব রুক্ষ্ম।

 

জো সুই জোরো কোলেত, লোকটা বললো। লেফতেনান্ত পুলিশ জুডিশিয়ার। সে কার্গোর দরজার দিকে এগোলো, কুয়েস্ত-সি কুইল আ লো দেদান?

 

আমি কী করে জানবো, ভার্নেট কর্কশ ফরাসিতে জবাব দিলেন। আমি কেবলমাত্র একজন ড্রাইভার।

 

কোলেতকে দেখে মনে হলো জবাবটা শুনে সে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। আমরা দুজন অপরাধীকে খুঁজছি।

 

ভার্নেট হাসলেন। তাহলেতো আপনি সঠিক জায়গায়ই এসেছেন। আমি যেসব লোকের টাকা বহন করি, সেই সব বানচোতদের অনেকেই অপরাধী।

 

লোকটা রবার্ট ল্যাংডনের একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি বের করে দেখালো। আজ রাতে এই লোকটা কি আপনাদের ব্যাংকে এসেছিলো?

 

ভার্নেট কাঁধ ঝাঁকালো। আমি হলাম আদার ব্যাপারি, জাহাজের খবর রাখি না। তারা আমাকে গ্রাহকদের কাছে ঘেষতে দেয় না। আপনি ভেতরে যান, ফ্রন্ট ডেস্কে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন।

 

আপনার ব্যাংক ভেতরে ঢোকার আগে আমাদের কাছে সার্চ-ওয়ারেন্ট দাবি করছে।

 

ভার্নেট মুখে একটা তিক্তভাব আনলেন। প্রশাসকরা। আমাকে বলে লাভ নেই।

 

আপনার ট্রাকের দরজাটা খুলুন, প্লিজ। কোলেত কার্গোর দরজার দিকে ইঙ্গিত করলো।

 

ভার্নেট কোলেতের দিকে তাকিয়ে জোর করে একটা বিশ্রী হাসি হাসলেন। দরজা খুলবো? আপনার ধারণা, আমার কাছে চাবি আছে? আপনার কি মনে হয়, তারা আমাদেরকে বিশ্বাস করে? আপনি আমার বেতনের খাতাটা দেখতে পারেন।

 

কোলেতের মাথাটা একদিকে হেলে গেলো, সন্দেহের চিহ্ন এটা। আপনি বলছেন আপনার নিজের ট্রাকের চাবি আপনার কাছে নেই?

 

ভার্নেট মাথা ঝাঁকালেন। এইসব গাড়ির দরজা লোডিং-ডকের ড্রাইভার কর্তৃক সিল মারা হয়। তারপর, অন্য কেউ চাবিটা নিয়ে যায় গন্তব্যে। গ্রাহকের কাছে চাবিটা পৌঁছানোর পর, তারা আমাদেরকে ফোন করে জানালে, আমরা গাড়িটা চালিয়ে ওখানে নিয়ে যাই। তার এক সেকেন্ড আগেও না। আমি কী বহন করছি সে সম্পর্কে কখনই কিছু জানতে পারি না।

 

এই ট্রাকটা কথন বন্ধ করা হয়েছে?

 

এক ঘণ্টা আগেতো হবেই। আমি যাচ্ছি সেন্ট থুরিয়ালে। চাবিটা ইতিমধ্যেই ওখানে পৌঁছে গেছে।

 

এজেন্ট লোকটা কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না, তার চোখ ভার্নেকে খুঁতিয়ে খুঁতিয়ে দেখছে, তাঁর ভাবনা-চিন্তা ধরার চেষ্টা করছে।

 

কপাল বেয়ে ঘামের ফোটা ভার্নেটের নাক দিয়ে পড়তে যাচ্ছিলো। যদি কিছু মনে না করেন? হাতে কাপড় দিয়ে নাকের ঘাম মুছে তিনি বললেন, পুলিশের ব্যারিকেডের দিকে ইঙ্গিত করলেন। আমি খুবই টাইট শিডিউলে আছি।

 

আপনাদের সব ড্রাইভারই কি রোলেক্স ঘড়ি ব্যবহার করে থাকে? এজেন্ট জিজ্ঞেস করলো, ভার্নেটের হাতের দিকে ইঙ্গিত করলো সে।

 

ভার্নেট তার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন তাঁর অত্যন্ত মূল্যবান ঘড়িটা, জ্যাকেটের হাতা থেকে বের হয়ে গেছে। মার্দে। এই শালার জিনিসটা? সেন্ট জার্মেইন দে প্রেস-এর এক তাইওয়ানি ভ্রাম্যমান বিক্রেতাদের কাছ থেকে বিশ ইউরো দিয়ে কিনেছিলাম। আমি এটা আপনার কাছে চল্লিশ ইউরোতে বেঁচতে পারি।

 

এজেন্ট একটু থেমে, শেষে সরে দাঁড়ালো। ধন্যবাদ, লাগবে না। আপনার ভ্রমণ নিরাপদ হোক।

 

ট্রাকটা রাস্তায় নেমে পঞ্চাশ মিটার পর্যন্ত যাওয়ার আগে ভার্নেট নিঃশ্বাস নিতে পারছিলেন না। এখন তার আরেকটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাঁর কার্গো। কোথায় আমি তাদেরকে নিয়ে যাবো?

 

 

 

৪৬.

 

সাইলাস তার ঘরে ক্যানভাস ম্যাটের ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে পিঠের ক্ষতটা বাতাসে শুকাতে দিলো। আজ রাতের দ্বিতীয় দফা আচারের ফলে তার শরীর আড়ষ্ট আর দুর্বল হয়ে গেছে। তারপরেও সে সিলিস বেল্টটা খোলেনি। টের পেলো, তার ঊরু চুইয়ে রক্ত ঝড়ছে। তারপরেও সেটা বলে ফেলার কোন কারণ দেখতে পেলো না।

 

আমি চার্চকে ব্যর্থ করে দিয়েছি। তার চেয়েও বেশি খারাপ ব্যাপার হলো, আমি বিশপকে ব্যর্থ করে দিয়েছি।

 

আজ রাতটা হতে পারতো বিশপ আরিঙ্গারোসার মোক্ষ লাভের রাত। পাঁচ মাস আগে, বিশপ আরিঙ্গাবোসা ভ্যাটিকানের অবজারভেটরি থেকে ফিরে এসেছিলেন, সেখানে তিনি এমন কিছু জেনে এসেছিলেন, যা তাঁকে গভীরভাবে বদলে দিয়েছিলো। কয়েক সপ্তাহ ধরে বিষণ্ণ থেকে আরিঙ্গাবোসা খবরটা সাইলাসকে বলেছিলেন।

 

কিন্তু এটা অসম্ভব। সাইলাস চিৎকার করে বলেছিলো। আমি এটা মেনে নিতে পারছি না!

 

এটা সত্যি, আরিঙ্গাবোসা বলেছিলেন। অচিন্তনীয়, কিন্তু সত্য। মাত্র ছয় মাসে।

 

বিশপের কথাটা সাইলাসকে আতংকিত করে ফেলেছিলো। তিনি পরিত্রাণের জন্য প্রার্থনা করলেন, এমনকি সেইসব ঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনেও ঈশ্বর এবং দ্য ওয়ের প্রতি তাঁর আস্থা একটুও টলতে পারেনি। মাত্র একমাস পরেই, অলৌকিকভাবেই, মেঘগুলো কাটতে শুরু করে আলোর সম্ভাবনা উঁকি মারলো।

 

স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ, আরিজারোসা এটাকে এ নামেই ডাকলেন।

 

মনে হলো এই প্রথম, বিশপ খুব আশাবাদী হলেন। সাইলাস, তিনি নিচু স্বরে বললেন, ঈশ্বর দ্য ওয়েকে রক্ষা করার জন্য আমাদের উপর একটা সুযোগ বর্ষণ করেছে। অন্যান্য যুদ্ধের মতোই, আমাদের যুদ্ধেও আত্মত্যাগের দরকার রয়েছে। তুমি কি ঈশ্বরের সৈনিক হবে?

 

সাইলাস, যে লোকটা তাকে নতুন জীবন দিয়েছে, সেই বিশপের সামনে হাটু গেঁড়ে বসে পড়েছিলো। সে বলেছিলো, আমি ঈশ্বরের একটি মেষ শাবক। আপনার হৃদয় যা বলে, তা দিয়ে আমাকে চড়িয়ে বেড়ান।

 

যখন আরিঙ্গারোসা তাঁর সামনে যে সুযোগটা উপস্থিত হয়েছে, সেটা খুলে বললেন, সাইলাসের স্থির বিশ্বাস জন্মালো, এটা ঈশ্বরের নিজ হাতেরই কাজ। অলৌকিক ভাগ্য! আরিঙ্গাবোসা সাইলাসকে সেই লোকের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন, যে এই পরিকল্পনাটার প্রস্তাব করেছে লোকটা নিজেকে একজন টিচার হিসেবে পরিচয় দিলো। যদিও টিচার আর সাইলাস কখনও মুখখামুখি হয়নি। সব সময়ই তারা ফোনে কথা বলতো। সাইলাস টিচারের প্রগাঢ় ধর্ম বিশ্বাস এবং ক্ষমতার উপর আস্থাশীল হলো। মনে হলো, টিচার এমন একজন ব্যক্তি যিনি, সব জানেন, সবখানেই তার চোখ আর কান পাতা আছে। কীভাবে টিচার তথ্য যোগাড় করেন, সে সম্পর্কে সাইলাস কিছুই জানতো না। আরিঙ্গারোসা টিচারের উপর প্রচণ্ড আস্থাশীল ছিলেন এবং সাইলাসকে বলেছিলেন, তাঁর মতোই আস্থাশীল হতে। টিচার তোমাকে যা আদেশ করেন তা-ই কোরো। বিশপ সাইলাসকে বলেছিলেন, এতে করেই আমরা জয়ী হবো।

 

বিজয়ী! সাইলাস এখন খালি ফ্লোরটার দিকে চেয়ে আতংকিত হলো যে, জয় বোধহব সূদুরপরাহত। টিচারের সাথে চালাকি করা হয়েছে। কি-স্টোন একটা কানা গলি। আর ছল-চাতুরীর ফলে তাদের সব আশা উবে গেছে।

 

সাইলাস বিশপকে ফোন করতে চাইছিলো তাকে সর্তক করার জন্য, কিন্তু টিচার আজ রাতে সব রকম যোগাযোগের লাইনই গুটিয়ে ফেলেছেন। আমাদের নিরাপত্তার জন্যই।

 

শেষে সাইলাস হামাগুড়ি দিয়ে দড়িটা খুঁজে পেলো। সেটা মাটিতেই পড়েছিলো। সে তার পকেট থেকে সেল ফোনটা বের করে আনলো। লজ্জায় মাথা নত করে সে ডায়াল করলো।

 

টিচার, সে ফিস ফিস করে বললো, সব শেষ হয়ে গেছে। সাইলাস তাঁকে সত্য-সত্যই বললো, কীভাবে সে প্রতারণার শিকার হয়েছে।

 

তুমি তোমার বিশ্বাস খুব দ্রুতই হারাচ্ছো, টিচার জবাব দিলেন। আমি এইমাত্র সংবাদটা পেয়েছি। খুবই অপ্রত্যাশিত এবং ভালো। সিক্রেটটা এখনও বেঁচে আছে। জ্যাক সনিয়ে মারা যাবার আগে সেটা হস্তান্তর করে গেছেন। আমি তোমাকে শীঘ্রই ফোন করবো। আজ রাতে, আমাদের কাজটা এখনও সমাপ্ত হয়নি।

 

 

 

৪৭.

 

মৃদু আলোর বদ্ধ কার্গোর ভেতরটা যেনো অনেকটা ভ্রাম্যমান জেলখানা। ল্যাংডনের অতি পরিচিত আবদ্ধ জায়গার অস্বস্তিটা ভর করলো এখানে। ভার্নেট বলেছিলেন, তিনি আমাদেরকে শহরের বাইরে নিরাপদ কোথাও নিয়ে যাবেন। কোথায়? কতো দূরে?

 

হাটু মুড়ে লোহার ফ্লোরে বসে থাকার দরুণ, ল্যাংডনের পা দুটো আড়ষ্ট হয়ে গেলো। সে একটু নড়ে চড়ে বসলো, টের পেলো তার শীরের নিমাংশ থেকে রক্ত ঝড়ছে। দুহাতে, এখনও সে ব্যাংক থেকে তুলে নেয়া অদ্ভুত গুপ্তধনটা ধরে রেখেছে।

 

আমার মনে হচ্ছে, আমরা এখন হাইওয়েতে আছি, সোফি নিচু স্বরে বললো।

 

ল্যাংডনেরও তা-ই মনে হচ্ছিলো। ট্রাকটা যখন ব্যাংকের সামনে একটু থেমেছিলো, সেই মুহূর্তটা ছিলো স্নায়ু বিধ্বংসী। তারপর থেকে সেটা ছুটছে তো ছুটছেই। মিনিট দুয়েক পরপর, হয় ডানে কিংবা বায়ে মোড় নিচ্ছে। আর এখন মনে হচ্ছে, সবোর্ড গতিতে আছে। তাদের নিচে বুলেটপ্রুফ টায়ারটা শশা শো করছে। তার হাতে ধরা রোজউড বক্সটার দিকে সব মনোযোগ তাদের। ল্যাংডন জিনিসটা ফ্লোরে নামিয়ে রাখতেই সোফি তার পাশে এসে বসলো। ল্যাংডনের হঠাৎ করেই মনে হলো, তারা দুজন বাচ্চা ছেলে-মেয়ে, ক্রিসমাসের উপহার ভোলার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছে।

 

রোজউড বাক্সটার গায়ের রঙের সাথে বৈচিত্র রেখে খোঁদাই করা গোলাপটা ছাই রঙের, যা মৃদু আলোতেও দেখা যাচ্ছে। গোলাপ। সমগ্র সেনাবাহিনী আর ধর্মমতগুলো এই প্রতীকটার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যেমনটি হয়েছে গুপ্ত সোসাইটির ক্ষেত্রে। দ্য রোসিশিয়ান্স। দ্য নাইটস্ অব দি রোজি ক্রুশ।

 

থামলে কেন, সোফি বললো। খোলো।

 

ল্যাংডন গভীর একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিলো। ঢাকনাটার ওপর হাত রেখে আরেকবার চোরা চোখে সে কাঠের নক্সা করা কাজটার দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর সেটা খুলে ফেলে ভেতরের জিনিসটা উন্মোচিত করলো।

 

এটার ভেতরে কী আছে, এই নিয়ে ল্যাংডন একাধিক ফ্যান্টাসিতে আক্রান্ত হয়েছিলো। কিন্তু পরিষ্কারভাবেই তার সবগুলো ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। ভেতরে সিল্ক কাপড়ে পেঁচানো একটা কিছু আছে, যা সে কল্পনাও করেনি।

 

সাদা পালিশ করা মার্বেলের কারুকাজ খচিত। পাথরের চোঙা জাতীয় একটা জিনিস। এর ব্যস হবে, আনুমানিক একটা টেনিস বলের সমান। একাধিক অংশ জোড়া লাগানো একটা চোঙা, অভিন্ন পাথরে তৈরি নয় সেটা। চোঙাটা অনেকগুলো অংশ জোড়া লাগিয়ে বানানো হয়েছে। পাঁচটা পুরু মার্বেলের চাকতি, একটার সাথে আরেকটা লাগিয়ে নেয়া হয়েছে। অনেকটা একাধিক চাকা বিশিষ্ট একটা কেলিডোস্কোপের মতো। চোঙাটার দুমাথাই ক্যাপ দিয়ে আঁটকানো, সেগুলোও মার্বেলের, তাই ভেতরটা দেখা একেবারেই অসম্ভব। ভেতরে তরল জাতীয় কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে। তাই ল্যাংডন বুঝতে পারলো, ভেতরটা ফাঁপা।

 

এই রহস্যময় আকৃতির চোঙাটার গায়ে খোঁদাই করা একটা নক্সার দিকে ল্যাংডনের মনোেযোগ আকর্ষিত হলো। পাঁচটা চাকতির প্রতিটাই খুব যত্ম করে বিভিন্ন অক্ষরের সারি খোঁদাই করা আছে ইংরেজির পুরো বর্ণমালা। চোঙার অক্ষরগুলো ল্যাংডনের ছেলেবেলার একটা খেলনার কথা মনে করিয়ে দিলো।

 

অদ্ভুত, তাই না? সোফি নিচু স্বরে বললো।

 

ল্যাংডন তার দিকে তাকালো। আমি জানি না, এটা কি জিনিস?

 

সোফির চোখে একটা দ্যুতি দেখা গেলো। আমার দাদু এ ধরনের কারুকাজ করতেন, এটা তার শখ ছিলো। এগুলো লিওনার্দো দা ভিঞ্চির উদ্ভাবন।

 

এই স্বল্প আলোতেও সোফি ল্যাংডনের অবাক হওয়াটা দেখতে পেলো।

 

দা ভিঞ্চি? সে বিড়বিড় করে বললো। জিনিসটার দিকে আবারো তাকালো।

 

হ্যাঁ। এটাকে ক্রিপটেক্স বলে। আমার দাদুর মতে, এটার নক্সাটা দা ভিঞ্চির গোপন ডায়রি থেকে নেয়া হয়েছে।

 

এটা কিসের জন্য?

 

আজকের রাতের ঘটনাগুলো বিবেচনা করলে, সোফি জানতো, উত্তরটা খুবই মজার হবে। এটা একটা ভল্ট, সে বললো। গোপন তথ্য রাখার।

 

ল্যাংডনের চোখ দুটো বড় হয়ে গেলো।

 

সোফি ব্যাখ্যা করে বোঝালো যে, দা ভিঞ্চির মডেলগুলো তৈরি করাটা তার দাদুর প্রিয় একটা শখ ছিলো। তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান কর্মকার, যিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঠ আর লোহা-লক্কর নিয়ে সময় কাটাতেন। জ্যাক সনিয়ে দক্ষ কর্মকারদেরকে অনুকরণ করতেনফাবার্জ, এসোর্টেড ক্লোইজোন আর্টিজানদের। কিন্তু খুব বেশি অনুকরণ করতেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে। এমন কি দা ভিঞ্চির জার্নালাগুলোতে এক ঝলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেও, এটা প্রতীয়মান হবে যে, কেন একজন জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে তিনি বিখ্যাত ছিলেন, যেমনটা তিনি ছিলেন তাঁর অসাধারণত্বের জন্যও। দা ভিঞ্চি শত শত নক্সা এঁকে ছিলেন এমনসব জিনিসের, যা তিনি কখনওই নির্মাণ করেননি। জ্যাক সনিয়ের সময় কাটানোর মধ্যে অন্যতম ছিলো দা ভিঞ্চির কুয়াশাচ্ছন্ন মস্তিকের স্রোতধারাকে জীবন দেয়া সময় খণ্ডিত করা, পানির পাম্প, ক্রিপটেক্স, এমনকি মধ্য যুগের ফরাসি নাইটদের নিখুঁত মডেল, যা এখন তার অফিসের ডেস্কে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। এটা দা ভিঞ্চি ১৪৯৫ সালে নক্সা করেছিলেন, যে সময়টাতে তিনি এনাটমির উপরে কাজগুলো করছিলেন। রোবোট নাইটের ভেতরকার কলকজাগুলো ছিলো নিখুঁত জয়েন্ট। সেটা বসতে আর হাত-পা নাড়তে পারে, সেই সাথে নড়নচড়ন সক্ষম কাধের সাহায্যে মাথাও ঘোরাতে পারে। চোয়ালও ভোলা যায় একদম নিখুঁতভাবে। সোফি সবসময় বিশ্বাস করতো, এই বর্ম-পরিহিত নাইটটা তার দাদুর তৈরি সবচাইতে সুন্দর জিনিস…সেটা অবশ্য রোজউড বাক্সের ক্রিপ্টেক্সটা দেখার আগে।

 

তিনি আমাকে এরকম একটা জিনিস তৈরি করে দিয়েছিলেন, যখন আমি ছোট ছিলাম,  সোফি বললো। তবে এরকম নক্সওয়ালা আর বড় কখনও দেখিনি।

ল্যাংডনের চোখটা বক্সটা থেকে একটুও সরছে না। আমি ক্রিপ্টেক্স সম্পর্কে কখনও কিছু শুনিনি।

 

সোফি অবাক হলো না। লিওনার্দোর বেশিরভাগ অ-নির্মীয়মান উদ্ভাবনগুলো কখনই স্টাডি করা হয়নি, অথবা ওগুলোর নামও দেয়া হয়নি। ক্রিপেক্স শব্দটা খুব সম্ভবত, তার দাদুরই দেয়া। তথ্য সুরক্ষার জন্য ক্রিপ্টোলজি আর কোডেক্স শব্দ দুটোর সম্মিলন বলা যায়।

 

দা ভিঞ্চি ক্রিপ্টোলজির একজন অগ্রদূত ছিলেন, সোফি সেটা জানতো, যদিও এ ব্যাপারে তাকে খুব কমই কৃতিত্ব দেয়া হয়। সোফির বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্ট্রাক্টর যখন তথ্য নিরাপত্তার জন্য কম্পিউটার এনক্রিপশন পদ্ধতি উপস্থাপন করেছিলেন, তখন আধুনিক ক্রিপ্টোলজিস্ট, যেমন জিমার ম্যান এবং স্নেইয়ারদেরকে প্রশংসা করেছিলেন কিন্তু এটা উল্লেখ করেননি যে, লিওনার্দোই শত শত বছর আগে, সংকেতিক বার্তার মর্মোদ্ধারের প্রথম পাবলিক কির নিয়ম উদ্ভাবন করেছিলেন। সোফির দাদুই সেই লোক যে তাকে এসব বলেছিলেন।

 

তাদের ট্রাকটি হাইওয়ে দিয়ে ছুটে যেতেই সোফি ল্যাংডনকে ব্যাখ্যা করলো, দা ভিঞ্চির ক্রিপ্টেক্স-ই বহুদূরে বার্তা পাঠানোর নিরাপত্তা বিষয়ক জটিলতার সমাধান দিয়েছিলো। টেলিফোন অথবা ই-মেইলবিহীন যুগে, কেউ যদি নিজের বার্তাটি সম্পূর্ণ গোপনে এবং নিরাপদে পাঠাতে চাইতো, তখন সেটা কোন কিছুর উপর লেখা ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। তারপর, একজন বিশ্বস্ত বার্তাবাহকের উপরই তাকে নির্ভর করতে হতো। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, যদি বার্তাবাহক আঁচ করতে পারতো যে, বার্তার মধ্যে কোন মূল্যবান তথ্য আছে, তখন সে উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে সেটা চড়া মূল্যে বিক্রি করে লাভবান হতে পারতো।

 

ইতিহাসের অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি তথ্য-সুরক্ষার নিমিত্তে ক্রিপ্টোলজিক উদ্ভাবন করেছিলেন : জুলিয়াস সিজার এক ধরনের কোড-লেখনীর প্রচলন করেছিলেন, যা সিজার বক্স নামে ডাকা হোততা; স্কটল্যান্ডের রাণী ম্যারি এক ধরনের বিকল্প সংকেত তৈরি করে কারাগার থেকে গুপ্তসংগঠনে সেটা প্রেরণ করেছিলেন; আর প্রতিভাবান আরবীয় বিজ্ঞানী আবু ইউসুফ ইসমাইল আল কিন্দি তার গোপনীয়তা রক্ষা করেছিলেন এক ধরনের ভিন্নধর্মী বর্ণের সাহায্যে সংকেত তৈরির মাধ্যমে।

 

দা ভিঞ্চি, প্রকারন্তরে, যান্ত্রিক উপায়ে বার্তার সুরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেটা হলো ক্রিপ্টেক্স। একটা বহনযোগ্য আধার, যা অক্ষর, মানচিত্র, ডায়াগ্রাম, এবং যা কিছুই হোক না, সেগুলোর সুরক্ষা করে। একবার ক্রিপ্টেক্স-এর ভেতরে কোন তথ্য ঢুকিয়ে সিল করে দিলে, শুধুমাত্র যথার্থ পাসওয়ার্ড জানা লোকের পক্ষেই তা বের করে আনা সম্ভব ছিলো।

 

আমাদের একটা পাসওয়াডের দরকার, অক্ষর সংবলিত ডায়ালের দিকে ইঙ্গিত করে সোফি বললো। একটা ক্রিপ্টেক্স কাজ করে অনেকটা বাইসাইকেল কম্বিনেশন লকের মতো। তুমি যদি ডায়ালগুলো ঠিক মতো অবস্থানে আনতে পারো, তবে তালাটা খুলে যাবে। ক্রিপ্টেক্সটার পাঁচটা ডায়াল আছে। ঠিক মতো মেলাতে পারলেই পুরো চোঙাটা খুলে যাবে।

 

আর ভেতরে?

 

চোঙাটা খুলে গেলে, তুমি একটা ফাঁপা কম্পার্টমেন্ট পাবে, যাতে একটা কাগজ মোড়ানো থাকবে, সেটাতেই তথ্যগুলো লেখা থাকে।

 

ল্যাংডনকে দেখে মনে হলো সন্দেহগ্রস্ত। তুমি বলছিলে তোমার দাদু এসব বানিয়েছেন, যখন তুমি ছোট ছিলে?।

 

হ্যাঁ, ছোট আকাড়ের একটা। আমার জন্ম দিনে তিনি আমাকে একটা ত্রিপ্টেক্স আর একটা ধাঁধা দিতেন। ধাঁধার উত্তরটাই ছিলো ক্রিপ্টেক্সের পাসওয়ার্ড। আর সেটা করতে পারলে আমি ক্রিপ্টেক্সটা খুলে এর ভেতরে একটা কার্ড পেতাম।

 

একটা কার্ডের জন্য খুব বেশি খাটুনি হয়ে গেলো না।

 

না, কার্ডে আরো একটা ধাঁধা অথবা কু থাকতো। আমার দাদু সারা বাড়িতে গুপ্তধন রেখে দিতেন। ধাঁধা আর কুর মধ্য দিয়ে আমি আমার সত্যিকারের উপহারটা খুঁজে পেতাম। বলা চলে, পরীক্ষা আর প্রতিযোগীতার ভেতর দিয়ে আমি উপহারগুলো পেতাম। আর পরীক্ষাগুলো মোটেও সহজ ছিলো না।

 

ল্যাংডন বস্তুটার দিকে আবারো তাকালো। তাকে এখনও সন্দেহগ্রস্তই মনে হলো। কিন্তু এটা ভেঙে ফেলে কি সম্ভব নয়? অথবা গুড়িয়ে দিয়ে? ধাতুটা মনে হচ্ছে নাজুক, আর মার্বেল হলো নরম পাথর।

 

সোফি হাসলো। যেহেতু, দা ভিঞ্চি ছিলেন খুবই স্মার্ট, তাই তিনি এটা এমনভাবে তৈরি করেছেন, যাতে ভেঙে ফেললে ভেতরের তথ্যটা ধ্বংস হয়ে যায়। দ্যাখ্যো। সোফি বাক্সটা থেকে চোঙাটা বের করে আনলো। এটার ভেতরে কিছু লিখে ভরতে হলে, প্রথমে সেটা প্যাপিরাসেই লিখতে হবে।

 

ভেড়ার চামড়ায় নয়?

 

সোফি মাথা ঝাঁকালো। প্যাপিরাস। আমি জানি ভেড়ার চামড়া বেশি দিন টেকে আর সে সময়ে ওগুলো খুব সহজলভ্যও ছিলো, কিন্তু এটা প্যাপিরাসেই হতে হবে। পাতলা হলেই ভালো।

 

ঠিক আছে।

 

ক্রিপ্টেক্সের ভেতরে প্যাপিরাসটা ঢোকাবার আগে সেটা রোল করে একটা কাঁচের টিউবের ভেতরে ঢোকানো হয়। সে ক্রিপ্টেক্সটা ঝাকিয়ে এর ভেতরের তরল পদার্থটির শব্দ শোনালো। এর ভেতরে তরল পদার্থ আছে।

 

জিনিসটা কি?

 

সোফি হাসলো। ভিনেগার।

 

ল্যাংডন কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করার পর মাথা নেড়ে সায় দিলো। অসাধারণ।

 

ভিনেগার আর প্যাপিরাস, সোফি ভাবলো। কেউ যদি জোর করে ক্রিপ্টেক্সটা খুলতে যায়, কাঁচের টিউবটা তবে ভেঙে যাবে, আর ভিনেগার সঙ্গে সঙ্গেই প্যাপিরাসকে ভিজিয়ে দেবে। সুতরাং গোপন বার্তাটা কেউ পড়তে চাইলে, সেটা একটা অর্থহীন মণ্ড ছাড়া আর কিছুই পাবে না।

 

দেখতেই পাচ্ছো, সোফি তাকে বললো, এটার মুখটা ঠিকভাবে খুলতে চাইলে পাঁচ অক্ষরবিশিষ্ট একটা পাসওয়ার্ডের দরকার। আর পাঁচটা ডায়ালের প্রতিটাতে রয়েছে ছাব্বিশটি অক্ষর। সে খুব দ্রুত হিসাব করে নিলো। আনুমানিক বারো মিলিয়ন সম্ভাবনা।

 

যদি তাই হয়, ল্যাংডন বললো, দেখে মনে হলো তার মাথার ভেতরে বারো মিলিয়ন প্রশ্ন খেলে যাচ্ছে। তবে তোমার কি মনে হয়, এটার ভেতরে কি তথ্য থাকতে পারে?

 

সে যা-ই হোক, আমার দাদু নিশ্চিতভাবেই চাইছিলেন সেটা গোপন রাখতে। সে একটু থামলো। ঢাকনাটা বন্ধ করে সেটার উপরে পাঁচ পাপড়ি বিশিষ্ট গোলাপটার দিকে তাকালো। কিছু একটা তাকে খুঁচিয়ে যাচ্ছিলো। তুমি কি বলেছিলে যে, গোলাপ হলো গ্রেইলের প্রতীক?

 

একদম ঠিক। প্রায়োরিদের কাছে গোলাপ আর গ্রেইল একই জিনিস।

 

সোফি তার ভুরু কপালে তুললো। এটা খুব অদ্ভুত, কারণ আমার দাদু সবসময় আমাকে বলতেন যে, গোলাপ মানে গোপনীয়তা। তিনি বাড়িতে থাকার সময় যখন ভেতরে কারো সাথে খুব গোপনীয় কোন ফোন করতেন, এবং চাইতেন না আমি তাকে বিরক্ত করি, তখন তার অফিস ঘরের দরজায় একটা গোলাপের প্রতীক ঝুলিয়ে রাখতেন। তিনি আমাকেও এরকমটি করতে উৎসাহ দিতেন। সুইটি, তার দাদু তাকে বলতেন, আমরা একে অন্যের দরজায় তালা না মেরে বরং গোলাপ প্রতীকটা ঝুলিয়ে রাখতে পারিলা ফ্লার দে সিক্রেট যখন আমাদের গোপনীয়তার দরকার হবে। এভাবে আমরা একে অন্যেকে সম্মান এবং বিশ্বাস করতে শিখতে পারবো। গোলাপ ঝুলানোটা প্রাচীন রোমের একটা রীতি।

 

সাব রোসা, ল্যাংডন বললো। রোমানরা কোন সভায় গোলাপ ঝুলিয়ে রাখলে সবাই বুঝতে সভাটা খুব গোপনীয়। উপস্থিত সবাই বুঝতো যে, গোলাপের অধীনে যা বলা হবে সাব রোসার নিচে তা গোপন রাখতে হবে।

 

ল্যাংডন খুব দ্রুত ব্যাখ্যা করে বললো, প্রায়োরিরা গ্রেইলের প্রতীক হিসেবে গোলাপকে কেবল গোপনীয়তার জন্যই বেছে নেয়নি। রোসা রুগোসা হলো গোলাপের সবচাইতে প্রাচীন একটা প্রজাতি, যার পাঁচটি পাপড়ি পঞ্চভূজের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ঠিক গাইডিং-স্টার ভেনাসের মতো। এজন্যেই, গোলাপ নারীত্বের প্রতিমূর্তি হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। তাছাড়াও, সত্যিকারের দিক নির্দেশনার ধারণার সাথেও গোলাপের সংযোগ রয়েছে। কম্পাস-রোজ ভ্রমণকারীদের পথ দেখানোর কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ঠিক যেমনটি মানচিত্রে দ্রাঘিমাংশের কাজ রোজ লাইন করে থাকে। এই কারণেই, গোলাপকে গ্রেইলের প্রতীক হিসেবে বিভিন্ন দিক থেকেই বিবেচনা করা হয়—গোপনীয়তা, নারীত্ব, আর দিক-নির্দেশনা নারী পেয়ালা এবং গাইডিং-স্টার যা গোপন-সত্যের দিকে নিয়ে যায়।

 

ল্যাংডন তার ব্যাখ্যা শেষ করতেই, আচমকা তার অভিব্যক্তিটা শক্ত হয়ে গেলো।

 

রবার্ট? তুমি কি ঠিক আছে?

 

তার চোখ রোজউড বক্সের উপর স্থির। সাব…রোসা, সে বিড়বিড় করে বললো, একটা ভীতিকর অভিব্যক্তি তার চেহারায় ছড়িয়ে পড়লো। এটা হতে পারে না।

 

কি?

 

ল্যাংডন ধীরে ধীরে তার চোখ তুলে তাকালো। গোলাপের প্রতীকটার নিচে, সে বিড়বিড় করে বললো। এই ক্রিপ্টেক্সটা…আমার মনে হয়, এটা কি, তা আমি জানি।

 

 

 

৪৮.

 

ল্যাংডন সবেমাত্র নিজের ধারণাটায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, তার পরও, বিবেচনা করছে কে তাদেরকে এই চোঙাটা দিয়েছে, কীভাবে সেটা তাদেরকে দিয়েছে। এখন বাক্সটার ওপরে আঁকা গোলাপটা দেখে ল্যাংডন একটা উপসংহারেই পৌঁছাতে পারলো।

 

আমি প্রায়োরি কি-স্টোন ধরে রেখেছি।

 

কিংবদন্তীটা খুবই যথার্থ।

 

কি-স্টোন হলো এক ধরনের কোডবদ্ধ পাথর যা গোলাপ প্রতীকের নিচে রাখা আছে!

 

রবার্ট? সোফি তাকে দেখছিলো। কি হচ্ছে বলোতো?

 

ল্যাংডন তার ভাবনাগুলো সমন্বিত করার জন্য কিছু সময় নিলো। তোমার দাদু কি কখনও তোমাকে লা ক্লেফ দ্য ভূত সম্পর্কে কিছু বলেছিলো?

 

সিন্দুক, মানে ভল্টের চাবি? সোফি অনুবাদ করে নিলো।

 

না, এটাতো হলো আক্ষরিক অনুবাদ। ক্লেফ দ্য ভুত হলো একটা সাধারণ স্থাপত্য বিষয়ক পদবাচ্য। ভুত মানে ব্যাংকের ভল্ট নয়। এটার অর্থ হলো খিলানযুক্ত পথের ভেতরে একটা ভল্ট, যেমন গম্বুজওয়ালা ছাদ।

 

কিন্তু গম্বুজওয়ালা ছাদের তো চাবি থাকে না।

 

সত্যি বলতে কী, থাকে। প্রতিটি পাথরে তৈরি গম্বুজওয়ালা ছাদেরই একটা কেন্দ্র থাকে, যাকে বলে কীলকাকর পাথর, একেবারে উপরে থাকে সেটা, বাকি টুকরোগুলোকে এক সঙ্গে সংযুক্ত করে সমস্ত ভরটা বহন করে থাকে। এই পাথরটাকেই স্থাপত্যকলায় বলা হয় খিলানের চাবি বা ভল্ট-কি। ইংরেজিতে এই জিনিসটাকেই আমরা কি-স্টোন বলি। ল্যাংডন সোফির চোখের দিকে তাকালো কথাটার কোন স্বীকৃতি তাতে ঝলক দিচ্ছে কিনা সেটা দেখার জন্য।

 

সোফি কাঁধ ঝাঁকিয়ে ক্রিপ্টেক্সের দিকে তাকালো। কিন্তু এটা মোটেও কোন কি স্টোন নয়।

 

ল্যাংডন জানে না কোথেকে শুরু করবে। ভবন নির্মাণের ব্যাপারে কি-স্টোন হলো একটি ম্যাসনারি কৌশল, আর এটা ম্যাসোনিক ভ্রাতৃসংঘের প্রথমদিকে সবচাইতে গুপ্তবিদ্যা হিসেবে বজায় ছিলো। রয়্যাল আর্চ ডিগ্রি। স্থাপত্য। কি-স্টোন। সবগুলোই একটার সাথে আরেকটা সংযুক্ত। কি-স্টোন দিয়ে গম্বুজ বানানোর গুপ্তবিদ্যাটা ম্যাসন ভায়েদেরকে যথেষ্ট পরিমাণে সম্পদশালী কারিগর বানিয়েছিলো, আর তারাও এটাকে গোপন রেখেছিলো দীর্ঘদিন। তারপরও, রোজউড বক্সের কি-স্টোনটা আসলে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি জিনিস। প্রায়োরি কি-স্টোনটা—তারা এখন যেটা ধরে রেখেছে সেরকম যদি কিছু থেকে থাকে ল্যাংডন যেমনটা কল্পনা করেছিলো, মোটেও সে রকম কিছু নয়।

 

প্রায়োরি কি-স্টোনটা আমার জানা কি-স্টোনের মতো কিছু নয়, ল্যাংডন স্বীকার করলো। হলি গ্রেইল সম্পর্কিত আমার আগ্রহ, সাধারণত প্রতীকি, তো সেটা আসলে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যায় সেটা আমার কাছে একেবারেই গুরুত্বহীন একটি বিষয়।

 

সোফির ভুরু দুটো কপালে উঠলো। হলি গ্রেইল-এর খোঁজ?

 

ল্যাংডন একটা অস্বস্তি নিয়ে মাথা ঝাঁকালো। পরের কথাগুলো সাবধানে বললো। সোফি, প্রায়োরিদের মতে, কি-স্টোন হলো একটা কোডবদ্ধ মানচিত্র…হলি গ্রেইল এর লুকিয়ে রাখা জায়গাটার মানচিত্র।

 

সোফির মুখ ফ্যাঁকাশে হয়ে গেলো। আর তুমি মনে করছে, এটা সেই জিনিস?

 

ল্যাংডন বুঝতে পারলো না কী বলবে। তার কাছেও কথাটা অবিশ্বাস্য শোনালো। তারপরও, সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, কি-স্টোনই হলো একমাত্র যৌক্তিক সমাপ্তি। একটা খোঁদাই করা শিলালিপি, গোলাপ প্রতীকের নিচে লুকিয়ে রাখা আছে।

 

ক্রিপ্টেক্সটার নক্সা করেছেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চিপ্রায়োরি অব সাইন-এর সাবেক গ্র্যান্ড মাস্টার—এই জিনিসটা দেখে মনে হচ্ছে, এটা অবশ্যই প্রায়োরিদের একটা কি-স্টোন। একজন সাবেক এ্যান্ড মাস্টারের নীল-নক্সা…আরেকজন গ্র্যান্ড মাস্টার কর্তৃক বাস্তবায়িত করা হয়েছে শত বছর বাদে, এটা এতোটাই নিশ্চিত যে, বাতিল করা যায় না।

 

বিগত দশক ধরে ঐতিহাসিকগণ ফ্রান্সের চার্চগুলোতে কি-স্টোনটা খুঁজে চলছেন। গ্রেইল অম্বেষণকারীরা, প্রায়োরিদের দ্ব্যর্থবোধক সাংকেতিক বার্তার সাথে পরিচিত ছিলো, তারা লা ক্লেফ দ্য ভূতকে আক্ষরিক অর্থেই কি-স্টোন হিসেবে চিহ্নিত করেছে—একটা স্থাপত্য—খোঁদাই করা একটা পাথর, খিলানযুক্ত কোন চার্চের গোপন কক্ষের ভেতরে রাখা আছে। গোলাপ প্রতীকের নিচে। স্থাপত্য জগতে গোলাপের কোন কমতি নেই। গোলাপ জানালা বা রোজ উইন্ডোজ। রোসেট রিলিফ। এবং অবশ্যই, সিনকোয়ে ফয়েল দিয়ে পূর্ণ-পাঁচ পাপড়ির মনোরম গোলাপ প্রায়শই চার্চের ছাদে পাওয়া যায়, ঠিক কি-স্টেনের উপরে। লুকানো জায়গাটা নারকীয়ভাবে খুবই সহজ সরল। হলি গ্রেইলের মানচিত্রটা কোন বিস্মৃত চার্চের সাথে সম্পর্কিত, চার্চের যাতায়াতকারীরা না বুঝেই হেটে চলে সেটার উপর দিয়ে।

 

এই ক্রিপ্টেক্সটা কি-স্টোন হতে পারে না, সোফি দ্বিমত পোষণ করলো। এটা খুব বেশি পুরনো নয়। আমি নিশ্চিত, এটা আমার দাদু তৈরি করেছেন। এটা কোন প্রাচীন গ্রেইল কিংবদন্তীর অংশ হতে পারে না।

 

আসলে, ল্যাংডন জবাব দিলো, সে অনুভব করলো তার ভেতরে একটা উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, বিশ্বাস করা হয়, কি-স্টোনটা কয়েক দশক আগে প্রায়োরিরা তৈরি করেছে।

 

সোফির চোখে অবিশ্বাসের ছটা। কিন্তু এই ক্রিপ্টেক্সটা যদি হলি গ্রেইলের লুকানো জায়গাটার খোঁজ দিয়ে থাকে, তবে, সেটা আমার দাদু আমাকে কেন দেবেন? এটা কীভাবে খুলতে হবে, সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই নেই, কিংবা, এটা দিয়ে আমি করবোটা কী। এমনকি আমি জানিও না, হলি গ্রেইল আসলে কী?

 

ল্যাংডন বুঝতে পারলো, সোফি ঠিকই বলছে, যদিও সে এখনও তার কাছে হলি গ্রেইলের সত্যিকারের বৈশিষ্টটা কী সেটা ব্যাখ্যা করেনি। সেই গল্পটা আপাতত তোলা থাক। এই মুহূর্তে তারা কি-স্টোনটা নিয়েই ব্যস্ত।

 

যদি এটা সেই জিনিসই হয়ে থাকে…

 

তাদের নিচে বুলেট প্রুফ চাকাটার গর্জনকে ছাপিয়ে, ল্যাংডন খুব দ্রুত সোফিকে তার জানামতে কি-স্টোনটা কী, সেটা ব্যাখ্যা করতে শুরু করলো। শত শত বছর ধরে, প্রায়োরিদের সবচাইতে বড় সিক্রেটটা হলো—-হলি গ্রেইলের অবস্থান সেটা কখনও লেখা হয়নি। নিরাপত্তার খাতিরেই, সেটা মৌখিকভাবে প্রত্যেক সেন্যের কাছে একটা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে হস্তান্তরিত হয়ে আসছে। তবে যেভাবেই হোক, বিগত শতাব্দীর কোন এক সময়, একটা গুঞ্জন শোনা গিয়েছিলো যে, প্রায়োরিরা তাদের নীতি বদলিয়েছে। সম্ভবত, সেটা এ জন্যে যে, নতুন ইলেক্ট্রনিক সক্ষমতার যুগ সমাগত হয়েছে। কিন্তু প্রায়োরিরা গ্রুতে প্রতীজ্ঞা করেছিলো তারা কখনও গোপন পবিত্র স্থানটি সম্পর্কে মুখ খুলবে না।

 

তাহলে, সিক্রেটটা তারা কীভাবে হস্তান্তর করতো? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

এখানেই কি-স্টোনের কথাটা এসে যায়, ল্যাংডন ব্যাখ্যা করলো। যখন শীর্ষ চার জন ব্যক্তির একজন মৃত্যু বরণ করে থাকেন, তখন নিচের সারি থেকে একজনকে সেনেক্য হিসেবে অধিষ্ঠিত করার জন্য বেছে নেয়া হয়। নতুন সেনেককে হলি গ্রেইলের গোপন স্থানটি না জানিয়ে, বরং তাকে একটা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করার সুযোগ দেয়া হয়।

 

এ কথা শুনে সোফি একটু দ্বিধাগ্রস্ত হলো। হঠাৎ করেই ল্যাংডনের মনে পড়ে গেলো, সোফির দাদু কীভাবে তার সাথে গুপ্তধন-খোজা খেলাটা খেলতেন প্রিউভু দ্য মেরিট মানে মেধা যাচাই। মানতেই হয়, কি-স্টোনটাও সেইরকমই একটি ধারণা। তারপরও, এরকম পরীক্ষা গোপন সংগঠনের মধ্যে খুবই সাধারণ একটি ঘটনা। ম্যাসনরা এক্ষেত্রে বেশ সুপরিচিত ছিলো, যেখানে, সদস্যরা উচ্চপদ অর্জন করে থাকতেন বিভিন্নরকম আনুষ্ঠানিকতা আর মেধার পরীক্ষা দেবার মধ্য দিয়ে, যাতে করে তারা গোপন রাখার সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। বহুবছর ধরে সেটা করা হয়ে থাকতো। কাজটা ক্রমাগতভাবেই কঠিন হতে থাকতো।

 

তো, কি-স্টোনটা হলো প্রিভিউ দ্য মেরিট, সোফি বললো। যদি একজন উদীয়মান প্রায়োরি সেনেক্য এটা খুলতে পারেন, তবে তিনি এর তথ্যটার মালিক বনে যান।

 

ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো। আমি ভুলে গিয়েছিলাম, তুমি এ ধরনের জিনিসের সাথে পরিচিত।

 

শুধুমাত্র আমার দাদুর সাথেই নয়। ক্রিপ্টোলজিতে এটাকে বলা হয় আত্মস্বীকৃত ভাষা। এর মানে, তুমি যদি এটা পড়তে পারো, তবে তুমি জানতে পারবে ওতে কী বলা হয়েছে।

 

ল্যাংডন একটু ইতস্তত করলে। সোফি, তুমি বুঝতে পারছো, যদি এটা সত্যিই একটা কি-স্টোন হয়ে থাকে, তবে ধরে নিতে হবে, তোমার দাদু প্রায়োরিদের ভেতরে খুবই শক্তিশালী অবস্থানে ছিলেন। তাঁকে হতে হবে শীর্ষ চার জন সদস্যের একজন।

 

সোফি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তিনি সিক্রেট সোসাইটিতে খুবই শক্তিশালী অবস্থানে ছিলেন। এ ব্যাপারে আমি একদম নিশ্চিত। আমি অনুমাণ করতে পারি, সেটা প্রায়োরিই ছিলো।

 

ল্যাংডন অবাক হয়ে বললো, তুমি জানতে, তিনি সিক্রেট সোসাইটিতে ছিলেন?

 

দশ বছর আগে আমি এমন কিছু দেখেছিলাম, যা আমার দেখার কথা ছিলো না। তখন থেকে আমরা আর কথা-বার্তা বলিনি। সে একটু থামলো। আমার দাদু দলটির শীর্ষ পর্যায়েরই শুধু ছিলেন না…আমার বিশ্বাস, তিনি ছিলেন একেবারে উচ্চপদের একজন সদস্য।

 

এইমাত্র সে যা বললো, ল্যাংডন তা বিশ্বাস করতে পারলো না। গ্র্যান্ড মাস্টার? কিন্তু…এটা তোমার জানা কথা নয়!

 

আমি এ ব্যাপারে কিছু বলবো না। সোফি অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো, তার অভিব্যক্তি যতোটা দৃঢ়, ততোটাই যন্ত্রণাকাতর।

 

ল্যাংডন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বসে রইলো। জ্যাক সনিয়ে গ্র্যান্ড মাস্টার? যদিও শুনতে খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে, তার পরও, এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, ল্যাংডনের মনে হলো, তাহলে ব্যাপারটা খুব ভালোই হয়। একেবারে বাপে-ধাপে মিলে যায়। হাজার হোক, আগের গ্র্যান্ডমাস্টাররাও ছিলেন বিখ্যাত সব ব্যক্তি আর শৈল্পিক-সত্ত্বার অধিকারী। এর সত্যতা কয়েক বছর আগে, প্যারিসের বিবলিওথেক ন্যাশনাল তাদের লো ভোসিয়ার সিক্রেট নামে পরিচিত কাগজে খবরটা ফাস করেছিলো।

 

প্রায়োরি ঐতিহাসিক এবং গ্রেইল অন্বেষণকারীদের সবাই ডোসিয়ারটা পড়েছে। নাম্বার 4,lm249 এর ক্যাটালগটা, ডোসিয়ার সিক্রেট নামে পরিচিত, অনেক বিশেষজ্ঞ কর্তৃকই সেটা বিশ্বাসযোগ্য বলে স্বীকৃত হয়েছে। ঐতিহাসিকরা এটা দীর্ঘ দিন ধরেই খুঁজছিলেন।

 

প্রায়োরি গ্র্যান্ড মাস্টারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, বত্তিচেল্লি, স্যার আইজ্যাক নিউটন, ভিক্টর হুগো এবং সাম্প্রতিক কালে, জ্য কতো, প্যারিসের বিখ্যাত শিল্পী ও কবি।

 

তবে জ্যাক সনিয়ে নয় কেন?

 

ল্যাংডন বুঝতে পারলো, আজ রাতে সনিয়ের সাথে তার সাক্ষাৎক্টা না হওয়াতে কী অপরিমেয় ক্ষতিই না হয়ে গেছে। প্রায়োরিদের গ্র্যান্ড মাস্টার আমার সাথে দেখা করার জন্য একটা বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলেন? শিল্পসংক্রান্ত নিছক গল্পগুজব করার জন্য? আচমকাই তার মনে হচ্ছে, তা নয়। হাজার হোক, যদি ল্যাংডনের মন যা বলছে, তা সত্য হয়ে থাকে, তবে প্রায়োরি অব সাইওনের গ্র্যান্ড মাস্টার ভ্রাতৃসংঘের ধারাবাহিকতায় কি-স্টোনটা তার নাতনীর কাছে হস্তান্তর করে গেছেন এবং বার বার। তাকে রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করার জন্য তাগাদা দিয়েছেন।

 

অসম্ভব!

 

তারপরও ল্যাংডনের কাছে ব্যাপারটা খাপ খাচ্ছে না। সনিয়ে কেন এমন আচরণ করলেন। তিনি যদি মারা যাওয়ার আশংকাই করে থাকেন, তবে তো আরো তিন জন সেনেক্য ছিলেন, যারা প্রায়োরিদের সিক্রেটটা রক্ষা করতে পারেন। তবে কেন সনিয়ে তার নাতনীর কাছে কি-স্টোনটা দেবার জন্য এতো ঝুঁকি নিতে গেলেন, যখন দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা মোটেও ভালো ছিলো না? আর কেনইবা, ল্যাংডনকে জড়ানো হলো… একেবারেই অপরিচিত একজন?

 

এই পাজলের একটা অংশ এখনও পাওয়া যাচ্ছে না, ল্যাংডন ভাবলো। উত্তরটার জন্য অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে। গাড়ির ইনজিনের ধীর গতির শব্দ তাদের দুজনকে তাকাতে বাধ্য করলো। টায়ারে খ্যাচ খ্যাচ করে একটা শব্দ হলো। সে কেন গাড়ি থামালো? ল্যাংডন অবাক হয়ে ভাবলো, ভার্নেট তাদেরকে বলেছিলেন তাদেরকে শহরের বেশ বাইরে, নিরাপদে নিয়ে যাবেন। সোফি ল্যাংডনের দিকে অস্বস্তিতে তাকালো। দ্রুত ক্রিপ্টেক্সটার বাক্স বন্ধ করে ল্যাংডন সেটা তার জ্যাকেটের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললো।

 

দরজাটা খুলে গেলে ল্যাংডন অবাক হয়ে দেখলো, গাড়িটা রাস্তা থেকে অনেক দূরে, একটা বনের মধ্যে থেমেছে। ভার্নেটের চোখে অদ্ভুত চাহনি। তার হাতে একটা পিস্তল।

 

এজন্যে আমি দুঃখিত, তিনি বললেন। এছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিলো না।

 

 

 

৪৯.

 

আদ্রেঁ ভার্নেটকে পিস্তল হাতে খুবই অদ্ভুত দেখাচ্ছে। কিন্তু তাঁর চোখের দৃঢ়তা দেখে ল্যাংডন আঁচ করতে পারলো, তার সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করাটা হবে বোকামী।

 

আমি বলতে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাকে জোর করতেই হবে, অস্ত্রটা তাদের দুজনের দিকে তাক করে নিয়ে ভার্নেট বললেন, বাক্সটা নিচে নামিয়ে রাখুন।

 

সোফি বাক্সটা তার বুকে চেপে ধরলো। আপনি বলেছিলেন, আপনি এবং আমার দাদু বন্ধু ছিলেন।

 

আপনার দাদুর সম্পদ রক্ষা করা আমার কর্তব্য, ভার্নেট জবাব দিলেন। আর আমি ঠিক, সেই কাজটাই করছি। এখন বাক্সটা নিচে নামিয়ে রাখুন।

 

আমার দাদু এটা আমাকে দিতে চেয়েছেন! সোফি জানালো।

 

নামিয়ে রাখুন বলছি, ভার্নেট তার অস্ত্রটা উঁচিয়ে ধরে বললেন।

 

সোফি বাক্সটা তার পায়ের কাছে নামিয়ে রাখলো।

 

মি. ল্যাংডন, ভার্নেট বললেন, আপনি বাক্সটা আমার কাছে নিয়ে আসুন। আর সর্তক থাকবেন, আমি আপনাকে বলছি এজন্যে যে, আপনাকে গুলি করতে আমি একটুও দ্বিধা করবো না।

 

ল্যাংডন ব্যাংকারের দিকে অবিশ্বাস ভরে তাকালো। আপনি কেন এসব করছেন?

 

আপনি কি ভাবছেন? ভার্নেট চট করে জবাব দিলেন, তাঁর ইংরেজি উচ্চারণটা এখন একটু বদলে গেলো। আমার গ্রাহকের সম্পত্তি রক্ষা করতে।

 

আমরাই এখন আপনার গ্রাহক, সোফি বললো।

 

অদ্ভুত একটা ভাবনায় ভার্নেটের মুখটা বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। মাদামোয়াজেল নেভু, আমি জানি না, আপনি কীভাবে এই চাবিটা আর একাউন্ট নাম্বারটা আজ রাতে পেয়েছেন। তবে নিশ্চিতভাবেই মনে হচ্ছে, উল্টা-পাল্টা কিছু হয়েছে। আমি যদি জানতাম, আপনাদের অপরাধটা কী, তবে আমি কখনও আপনাদেরকে ব্যাংক থেকে বের করতে সাহায্য করতাম না।

 

আমি আপনাকে বলেছি, সোফি বললো, আমার দাদুর মৃত্যুর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।

 

ভার্নেট ল্যাংডনের দিকে তাকালেন, তারপরও রেডিওতে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে যে, আপনি কেবল জ্যাক সনিয়েকেই খুন করেননি, বরং বাকি তিন জনকেও হত্যা করেছেন?

 

কী! ল্যাংডন বজ্রাহত হলো। আরো তিনটা খুন হয়েছে? সে নিজে যে প্রধান সন্দেহভাঁজন তার থেকেও এইমাত্র বলা সংখ্যাটা তাকে বেশি ভাবিত করলো। মনে হচ্ছে এটা কাকতালীয় নয়। তিন জন সেনেক্য? ল্যাংডনের চোখ নিচে রাখা রোজউড বক্সের দিকে চলে গেলো। সেনেক্যরা যদি মারা গিয়ে থাকেন, তো, সনিয়ের কাছে অন্যকোন পথ খোলা ছিলো না। তাকে কি-স্টোনটা অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করতেই হোতো।

 

আমি আপনাকে পুলিশের হাতে তুলে দেবার পরই তারা এটা খুঁজে দেখতে পারবে, ভার্নেট বললেন। আমি আমার ব্যাংককে ইতিমধ্যেই খুব বেশি জড়িয়ে ফেলেছি।

 

সোফি ভার্নেটের দিকে তাকালো, আপনার নিশ্চয় আমাদেরকে তুলে দেবার কোন অভিপ্রায় নেই। তাহলে তো আপনি আমাদেরকে ব্যাংকেই নিয়ে যেতেন। অথচ তার বদলে আপনি আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করেছেন?

 

আপনার দাদু আমাকে ভাড়া করেছিলেন একটা কারণেই, তঁার জিনিসটা নিরাপদে আর গোপনে রাখার জন্যে। এই বাক্সের ভেতরে যা-ই থাকুক না কেন, আমি চাই না তা পুলিশের জব্দ তালিকায় ঠাই পাক। মি. ল্যাংডন, বাক্সটা আমার কাছে নিয়ে আসুন।

 

সফি মাথা ঝাঁকালো। না, তুমি তা করবে না।

 

একটা গুলির আওয়াজ শোনা গেলো, বুলেটটা তাদের পাশেই ভ্যানটার গায়ে গিয়ে বিধলে গুলির আঘাতে গাড়িটা একটু কেঁপে উঠলো।

 

উফ! ল্যাংডন বরফের মতো জমে গেলো।

 

ভার্নেট এখন আরো বেশি আত্মবিশ্বাসের সাথে কথা বললেন। মি. ল্যাংডন, বক্সটা তুলে নিন।

 

ল্যাংডন বক্সটা তুলে নিলো।

 

এখন, এটা আমার কাছে নিয়ে আসুন। ভার্নেট এবার অস্ত্রটা সোজা তার দিকেই তাক্‌ করলো। রিয়ার বাম্পারের পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর অস্ত্রটা এখন

 

কার্গোর দরজার হাতলটার কাছাকাছি।

 

বাক্স হাতে ল্যাংডন খোলা দরজাটার হাতলের দিকে এগিয়ে এলো।

 

আমাকে কিছু একটা করতেই হবে! ল্যাংডন ভাবলো। আমি প্রায়োরিদের কি স্টোনটা তুলে দিচ্ছি! ভার্নেটের অস্ত্রটা তুলে ধরা থাকলেও, সেটা ল্যাংডনের হাটু বরাবর হবে। সজোড়ে জায়গা মতো একটা লাথি, সম্ভবত? দুঃখের বিষয় হলো, ল্যাংডন কাছে পৌঁছতেই, ভার্নেটও যেনো বিপদটা আঁচ করতে পারলেন। তিনি কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে ছয় ফুট দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

 

ভার্নেট আদেশ করলেন, দরজার পাশেই বাক্সটা রাখুন।

 

আর কোন উপায় না দেখে, ল্যাংডন হাটু গেঁড়ে বসে পড়ে বাক্সটা কার্গোর হোন্ডের নিচে নামিয়ে রাখলো, ঠিক খোলা দরজাটার সামনে।

 

এখন দাঁড়িয়ে পড়ুন।

 

ল্যাংডন উঠতে শুরু করে থেমে গেলো, ট্রাকের দরজার নিচের দিকে যে ছিটকিরিটা আছে সেটা সবার অগোচরে নামিয়ে দিলো।

 

উঠে দাঁড়ান, বাক্সটা থেকে সরে যান এবার।

 

ল্যাংডন একটু থামলো, তারপর উঠে দাঁড়ালো।

 

পেছন দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে থাকুন।

 

ল্যাংডন তা-ই করলো।

 

 

 

নিজের হৃদস্পন্দনটা টের পেলেন ভার্নেট। ডান হাতে পিস্তলটা ধরে, বাম হাত দিয়ে বাক্সটা তুলে নিলেন। বুঝতে পারলেন, বাক্সটা খুবই ভারি। দুহাতে ধরতে হবে। তার জিম্মিদের দিকে ফিরে দেখে ঝুঁকিটা হিসাব করলেন। তারা দুজনেই পনেরো ফুট দূরে, কার্গোর হোন্ডের কাছে, তার দিকে মুখ ফেরানো। ভার্নেট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। খুব দ্রুতই, তিনি অস্ত্রটা বাম্পারের ওপর রেখে, দুহাতে বাক্সটা তুলে নিয়ে এসে কাগোর কাছে মাটিতে রেখে দিলেন। তারপর, সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রটা হাতে তুলে নিলেন আবার। তার বন্দীরা একটুও নড়লো না।

 

একদম ঠিক আছে। এবার দরজাটা লাগাতে হবে। বাক্সটা মাটিতে রেখেই তিনি লোহার দরজাটা বন্ধ করতে লাগলেন। কিন্তু দরজাটা ঠিক মতো লাগলো না। হলোটা কী? ভার্নেট আবারো দরজাটা টান দিলেন। কিন্তু বোল্টগুলো লাগলো না। দরজাটা পুরোপুরি লাগছে না। একটু ভয় পেয়ে গেলেন। আবারো, সজোড়ে লাগানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু হলো না। কিছু একটায় আঁটকে গেছে! ভার্নেট দরজাটা ফাঁক করে ভেতরে উঁকি মেরে দেখলেন। কিন্তু এবার, দরজাটা বাইরের দিক থেকে খুলে, ভার্নেটের মুখ সজোড়ে আঘাত হানলে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। তাঁর নাকটা ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হতে লাগলো। অস্ত্রটা তার কাছ থেকে ছিটকে পড়ে গেছে। ভার্নেটের নাক দিয়ে গরম রক্ত ঝড়তে লাগলো।

 

রবার্ট ল্যাংডন সজোড়ে ঘুষি চালিয়েছে। ভার্নেট চেষ্টা করেও উঠতে পারলেন না, কারণ চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। তাঁর দৃষ্টি ফাঁকা হয়ে গেছে, তাই আবারো মাটিতে পড়ে গেলেন। সোফি নেভু চিৎকার করতে লাগলো। কিছুক্ষণ বাদে, ভার্নেট শুনতে পেলেন, ট্রাকের চাকার খ্যা খ্যাচ্‌ শব্দ। গাড়িটা ঘুরতে গিয়ে সামনের একটা গাছের সাথে ধাক্কা খেলো। গাড়িটার সামনের বাম্পার খুলে একটু ঝুলে গেলেও সেটা চলতে শুরু করলো। গাড়িটা রাস্তায় পৌঁছতেই, দূর থেকে সেটার বাতি দেখা গেলো।

 

ভার্নেট মাটির দিকে তাকালেন, যেখানে গাড়িটা থামানো ছিলো। অল্প-স্বল্প চাঁদের আলোতেও তিনি দেখতে পেলেন, সেখানে কিছুই নেই, কাঠের বাক্সটাও।

 

 

 

৫০.

 

ফিয়া সিডান গাড়িটা কাস্তেল গান্ডোলফো ছেড়ে এলবান পাহাড়ের সাপের মতো এঁকে-বেঁকে যাওয়া পথ দিয়ে নিচের উপত্যকায় নেমে গেলো। পেছনের সিটে বসে বিশপ আরিজারোসা হাসছিলেন। তাঁর কোলের ওপর রাখা বৃফকেসটার ভেতরে বন্ডগুলোর ওজন অনুভব করছিলেন। অবাক হয়ে ভাবছিলেন টিচারের কাছে এটা হস্তান্তর করার জন্য কতো সময় লাগতে পারে।

 

বিশ মিলিয়ন ইউরো।

 

এই অংকের বিনিময়ে আরিঙ্গাবোসা যে ক্ষমতা অর্জন করবেন, সেটা এর চেয়েও বেশি মূল্যবান। আরিঙ্গাবোসা আবারো অবাক হয়ে ভাবলেন, টিচার কেন এখনও তার সাথে যোগাযোগ করছেন না। নিজের আলখেল্লাটার পকেট থেকে সেল ফোনটা বের করে দেখলেন নেটওয়ার্ক খুবই দুর্বল।

 

সেল সার্ভিস এই উঁচু জায়গায় বাঁধা পায়, রিয়ার আয়না দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে ড্রাইভার বললো। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমরা পাহাড় থেকে নেমে যাবো, তখন নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে।

 

ধন্যবাদ, তোমাকে। আরিঙ্গারোসা হঠাৎ করে একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। পাহাড়ের উপরে কোন নেটওয়ার্ক নেই? হয়তো টিচার তার সাথে এতোক্ষণ ধরে যোগাযোগ করার জন্য চেষ্টা করে গেছেন। হয়তো মারাত্মক কিছু একটা ঘটে গেছে।

 

সঙ্গে সঙ্গে, আরিঙ্গারোসা ফোনের ভয়েস মেইলটা চেক করে দেখলেন। কিছুই নেই। তারপর আবারো, তিনি বুঝতে পারলেন, টিচার কখনওই কোন রেকর্ড করা মেসেজ রেখে যাবেন না, তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক সর্তকতা অবলম্বন করে থাকেন।

 

এই আধুনিক যুগে প্রকাশ্য কথাবার্তার ঝুঁকি সম্পর্কে তার চেয়ে বেশি কেউ জানে। ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন তার বিস্ময়কর, রহস্যময় জ্ঞান অর্জনের জন্য সাহায্য করেছে।

 

এই জন্যেই, তিনি আগাম সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন।

 

দুঃখজনক হলো, টিচার তাঁর সতর্কতার অংশ হিসেবে আরিঙ্গারোসাকে কোন ফোন নাম্বার দেননি। আমি একাই যোগাযোগ রাখবো, টিচার তাঁকে জানিয়েছিলেন। সুতরাং আপনার ফোন বন্ধই রাখুন। এখন আরিঙ্গারোসা বুঝতে পারলেন, তাঁর ফোনটা হয়তো ঠিকমতো কাজ নাও করে থাকবে। তিনি আশংকা করলেন, যদি টিচার তাঁকে বারবার ফোন করার পরও না পেয়ে থাকেন, তবে কী ভাববেন।

 

তিনি ভাববেন, কিছু একটা হয়েছে। অথবা, আমি বন্ডগুলো নিতে পারিনি।

 

বিশপ একটু ঘেমে উঠলেন।

 

অথবা, তার চেয়েও খারাপ কিছু…টাকাগুলো নিয়ে সটকে পড়েছি।

 

 

 

০৬. ঘণ্টায় ষাট কিলোমিটারের মধ্যম গতি

৫১.

 

এমনকি ঘণ্টায় ষাট কিলোমিটারের মধ্যম গতিতে ছুটলেও গাড়ির সামনে ঝুলে থাকা বাম্পারটা রাস্তার সাথে ঘষা লেগে শব্দ করার সাথে সাথে স্ফুলিঙ্গ হতে লাগলো। আমাদেরকে রাস্তা থেকে নেমে যেতে হবে, ল্যাংডন ভাবলো।

 

সে কোথায় যাচ্ছে বুঝতে পারছিলো না আর সামনের রাস্তাটাও দেখতে পাচ্ছিলো। ট্রাকের একমাত্র সচল হেডলাইটটা বাম্পারের আঘাতে বেঁকে যাওয়াতে সেটার আলো রাস্তায় না পড়ে পাশের ঝোপ-ঝাড়ে পড়ছে।

 

সোফি বসেছিলো প্যাসেঞ্জার সিটে। কোলের উপর রাখা রোজউড বাক্সের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।

 

তুমি কি ঠিক আছো? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

 

সোফি একটু চমকালো। তুমি কি তাঁর কথা বিশ্বাস করো?

 

বাকি তিন জনের খুন হওয়ার কথাটা? অবশ্যই। এটা অনেকগুলো প্রশ্নেরই উত্তর দিয়ে দিচ্ছে তোমার দাদুর কি-স্টেনেটা হস্তান্তর করার জন্য মরিয়া হওয়াটা এবং ফশে আমাকে ধরার জন্য কেন এতো বেশি উদগ্রীব, সব কিছুরই উত্তর মিলে যাচ্ছে।

 

না, আমি বলতে চাচ্ছি, ভার্নেট তার ব্যাংককে রক্ষা করার ব্যাপারটি।

 

ল্যাংডন তার দিকে তাকালো। এটার বিরুদ্ধে আপত্তি?

 

কি-স্টোনটা নিজের কাছে নিতে চাওয়াটা।

 

ল্যাংডন কথাটা বিবেচনাও করলো না। সে কীভাবে জানবে, বাক্সটার ভেতরে কি রাখা আছে?

 

তার ব্যাংক ওটা রেখেছিলো। তিনি আমার দাদুকেও চিনতেন। হয়তো তিনি কিছু জানেন। তিনি হয়তো ঠিক করেছিলেন যে, তিনি নিজেই গ্রেইলটা চান।

 

ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো। ভার্নেটকে সে রকম মোটেই মনে হয়নি। আমার অভিজ্ঞতা বলে, দুধরনের লোক আছে, যারা গ্রেইলটার খোঁজ করে। হয় তারা ধরে নিয়েছে কিংবা বিশ্বাস করে যে, তারা খৃস্টের হারানো পেয়ালাটা খুঁজছে…

 

অথবা?

 

অথবা, তারা সত্যটা জানে, আর এটা তাদেরকে আতংকিত করে থাকে। ইতিহাস জুড়ে অনেক দলই গ্রেইলটা ধ্বংস করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছে।

 

তাদের দুজনের মধ্যেকার নিরবতাটা বাম্পারের ঘর্ষণজনিত শব্দের জন্য ঢাকা পড়ে গেলো। তারা এখন কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত চলে এসেছে। গাড়ির সামনের চাকার দিক থেকে স্কুলিঙ্গটা দেখে ল্যাংডনের মনে হলো, সেটা আবার বিপজ্জনক কিছু নাতো। যদি তারা রাস্তার দুপাশ থেকে কোন গাড়িকে অতিক্রম করে, তবে নিশ্চিতভাবেই মনোযোগের কারণ হবে সেটা। ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।

 

আমি দেখছি, যদি বাম্পারটা আগের জায়গায় লাগাতে পারি।

 

সে গাড়িটাকে থামালো।

 

অবশেষে নিরবতা নেমে এলো।

 

ল্যাংডন ট্রাকের সামনে যেতেই, হঠাৎ করেই একটু সতর্কতা অনুভব করলো। এই মুহূর্তে আর গ্রেফতার হওয়ার ঝুঁকি নেয়া যাবে না। তার কাঁধে এখন মস্তবড় দায়িত্ব। সোফির হাতে যে জিনিসটা আছে, সেটা ইতিহাসের সবচাইতে বড় রহস্যের জট খুলতে। সাহায্য করবে।

 

যদি দায়িত্বটা অতো গুরুতর না হোততা, তবে ল্যাংডন প্রায়োরিদের খুঁজে বের করে কি-স্টোনটা তাদের কাছেই ফিরিয়ে দিতো। বাকি তিন জনের মৃত্যুর খবরটা মারাত্মকভাবেই সবকিছু বদলে দিয়েছে। প্রায়োরিদের ভেতরে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তারা আপোষ করে ফেলেছে। ভ্রাতৃসংঘকে অবশ্যই কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছিলো। অথবা কোন স্তরে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে কিংবা, তাদের মধ্যে গুপ্তচর রয়েছে। সনিয়ে কেন কি-স্টোনটা সোফি আর ল্যাংডনের কাছে হস্তান্তর করতে চেয়েছেন, সেটা এখন বোঝা যাচ্ছে-ভ্রাতৃসংঘের বাইরের লোকজন, যে লোককে, তিনি মনে করেছেন আপোষ করবে না। আমরা কি-স্টোনটা আর ভ্রাতৃসংঘের কাছে ফেরত দিতে পারবো না। এমন কি, ল্যাংডন যদি প্রায়োরি সদস্যদের কাউকে খুঁজে বেরও করে, তবে যে-ই কি-স্টোনটা নেবার জন্যে এগিয়ে আসবে সে-ই শক্র বনে যাবে। এই মুহূর্তে, অন্তত, এটা মনে হচ্ছে, কি-স্টোনটা সোফি আর ল্যাংডনের হাতেই থাকবে, সেটা তারা চাক বা না চাক।

 

ট্রাকের সামনের অংশটা ল্যাংডনের ধারণার চেয়েও বেশি খারাপ হয়ে গেছে। বাম দিকের হেড লাইটটা নেই, ডান দিকেরটা দেখে মনে হচ্ছে, চোখের মনি বের হওয়া একটা নষ্ট চোখ। ল্যাংডন সেটা ঠিক করার জন্য সোজা করলো, কিন্তু আবারো ওটা ঝুলে পড়লো। ভাঙাচোড়া বাম্পারটার যে মাথা আঁটকে কোনরকম ঝুলে আছে, সেখানে ল্যাংডন সজোড়ে একটা লাথি মেরে সেটা পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে চাইলো।

 

দোমড়ানো মোচড়ানো বাম্পারটাতে লাথি মারতে মারতে ল্যাংডন কিছুক্ষণ আগে বলা সোফির কথাটা স্মরণ করলো। আমার দাদু আমার জন্যে একটা ফোন মেসেজ রেখে গেছেন, সোফি তাকে বলেছিলো। তিনি বলেছিলেন, আমার পরিবার সম্পর্কে একটা সত্য কথা বলার দরকার। সেই সময়ে কথাটার কোন অর্থ বহন করেনি, কিন্তু এখন, প্রায়োরি অব সাইন-এর জড়িত থাকার কথাটা জেনে, ল্যাংডনের মনে নতুন একটা সম্ভাবনা উঁকি মারতে শুরু করলো।

 

বাম্পারটা আচকা ভেঙে পড়লো। নিদেনপক্ষে ট্রাকটা দেখে এখন আর মনে হচ্ছে না, সেটা একটা ফোর্থ অব জুলাইর স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টিকারী কিছু। বাম্পারটা পাশের ঝোপের আড়ালে ফেলে দিলো সে। এবার ভাবতে লাগলো, এরপর তারা কোথায় যাবে। ক্রিপ্টেক্সটা কীভাবে খুলবে, সে সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই নেই। অথবা এই জিনিসটা সনিয়ে তাদেরকে কেন দিলো, তাও জানে না। দুঃখজনক হলেও সত্য,

 

আজকের রাতে তাদের টিকে থাকতে হলে, এই প্রশ্নের উত্তর পেতেই হবে।

 

আমাদের সাহায্যের দরকার, ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিলো। পেশাদারী সাহায্য।

 

হলি গ্রেইল এবং প্রায়োরি অব সাইওনের জগতে একজন ব্যক্তিই আছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা হলো, কীভাবে এই আইডিয়াটা সোফির কাছে তুলে ধরবে।

 

 

 

গাড়ির ভেতরে, সোফি তার কোলে রোজউড বাক্সটা নিয়ে ল্যাংডনের জন্য অপেক্ষা করছে। আমার দাদু কেন এটা আমাকে দিলেন? এই জিনিসটা দিয়ে সে কী করবে, তার বিন্দুবিসর্গও সে জানে না।

 

ভাবো, সোফি! তোমার মাথাটা খাটাও। দাদু তোমাকে কিছু বলতে চেষ্টা করছেন!

 

বাক্সটা খুলে সে ক্রিপ্টেক্সের ডায়ালের দিকে তাকালো, মেধার উৎকর্ষতার চিহ্ন। সে তার দাদুর হাতের তৈরি কাজটা অনুভব করলো। কি-স্টোন হলো একটা মানচিত্র যা শুধুমাত্র সুযোগ্য লোকই অনুসরণ করতে পারে।

 

বাক্সটা থেকে ক্রিপ্টেক্সটা বের করে, সোফি এর ডায়ালের উপর আঙ্গুল বোলালো। পাঁচ অক্ষরের। সে ডায়ালটা একের পর এক ঘোরাতে লাগলো। যন্ত্রটা খুব সুন্দর করে ঘুরলো। সে একটা শব্দ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মেলালো। এবার পাঁচ অক্ষরে যে শব্দটা হলো, সোফি জানতো, সেটা একেবারে অর্থহীন কিছু।

 

G-R-A-I-L.

 

আস্তে করে সিল্ডিরের দুপাশ ধরে টান দিলো সে। ক্রিপ্টেক্সটা খুললো না। ভেতরের ভিনেগারের ঘরঘর শব্দ শুনতে পেলো। তারপর, আবারো চেষ্টা করলো।

 

V-I-N-C-I

 

আবারো, কোন সাড়া শব্দ নেই।

 

V-0-U-T-E

 

ক্রিপ্টেক্সটার কিছুই হেরফের হলো না।

 

চিন্তিত হয়ে, সে রোজউড বাক্সটার ঢাকনাটা বন্ধ করে দিলো। বাইরে, ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে সে কৃতজ্ঞ বোধ করলো যে, আজ রাতে সে তার সাথে আছে। পি এস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো। তাকে জড়িত করার দাদুর অভিপ্রায়টা এখন খুবই যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। সোফি তার দাদুর অভিপ্রায় সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারছে না। আর রবার্ট ল্যাংডন এক্ষেত্রে তাকে দিক নির্দেশনা দিতে পারে। একজন টিউটর, যে কিনা তার ছাত্রের লেখা-পড়ার তদারকি করছে। ল্যাংডনের জন্য দুঃখজনক যে, সে আজ রাতে টিউটরের চেয়েও বেশি কিছু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সে বেজু ফশের শিকারে পরিণত হয়েছে…আর কিছু অদৃশ্য শক্তি হলি গ্রেইলটা দখলে নেবার পায়তারা করছে।

 

গ্রেইলটা যা-ই হোক না কেন।

 

সোফি অবাক হয়ে ভাবলো, তার জীবনে কোন সত্য জানা যাবে কিনা।

 

ট্রাকটা চলতে শুরু করলে ল্যাংডন খুশি হলো যে, সেটা খুব ভালো মতোই চলছে। ভার্সেইতে কীভাবে যাওয়া যাবে, তুমি কি জানো?

 

সোফি তার দিকে তাকালো। বেড়াতে যাবে?

 

না, আমার একটা পরিকল্পনা আছে। ওখানে একজন ধর্মীয় ইতিহাসবেত্তা রয়েছেন, আমার চেনা, তিনি ভার্সেইর কাছেই বাস করেন। আমি ঠিক বলতে পারছি

 

না, কোথায়, কিন্তু আমরা পেঁজ করে দেখতে পারি। আমি তাঁর এস্টেটে বার কয়েক গিয়েছি। তার নাম লেই টিবিং। তিনি একজন সাবেক বৃটিশ রয়্যাল হিস্টোরিয়ান।

 

তিনি প্যারিসে থাকেন?

 

টিবিংয়ের আজীবনের আকাঙ্খ হলো, হলি গ্রেইল। যখ, পনেরো বছর আগে প্রায়োরিদের কি-স্টোনটার ব্যাপারে কথাবার্তা শোনা গিয়েছিলো, তখন তিনি ফ্রান্সে চলে আসেন, বিভিন্ন চার্চে সেটা খোঁজার আশায়। তিনি কি-স্টোন এবং হলি গ্রেইল এর ওপর অনেক বই লিখেছেন। তিনি হয়তো আমাদেরকে সেটা কীভাবে খুলতে হবে সে ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবেন।

 

সোফির চোখে উদ্বিগ্নতা। তুমি তাকে বিশ্বাস করো?

 

কিসে বিশ্বাস করি? তথ্যটা চুরি করবে না?

 

এবং আমাদেরকে বিপদে ফেলবে না।

 

আমার কোন ইচ্ছে নেই, তাকে বলি যে, আমরা পুলিশের ফেরারি।

 

রবার্ট, তোমার কি মনে হচ্ছে না, আমাদের দুজনের ছবি ইতিমধ্যে ফ্রান্সের সমস্ত টেলিভিশনে প্রচারিত হয়ে গেছে? বেজু ফশে সবসময়ই তার সুবিধার জন্য মিডিয়াকে ব্যবহার করে থাকে। আমরা যাতে পরিচয় লুকাতে না পারি, সে ব্যাপারে সে সবকিছুই করবে।

 

খুব ভালো কথা, ল্যাংডন ভাবলো। ফরাসি টিভিতে আমার ডেবু হবে প্যারিসের মোস্ট ওয়ান্টেড হিসেবে। নিদেন পক্ষে, জোনাস ফকম্যান তাতে খুশিই হবে; যতোবারই ল্যাংডন খবরের শিরোনাম হয়েছে, তার বইয়ের কাটতি বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে।

 

এই লোকটা কি তোমার ভালো বন্ধু? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

প্রশ্নটা বিবেচনার দাবি রাখে। ল্যাংডনের মন বলছে, টিবিং পুরোপুরি বিশ্বস্তই হবে। একটা উপযুক্ত নিরাপদ আশ্রয়। টিবিং শুধু ল্যাংডনকে সাহায্যই করবে না, সে নিজেও একজন গ্রেইল অম্বেষণকারী এবং গবেষক, আর সোফি দাবি করছে, তার দাদু প্রায়োরি অব সাইওনের একজন গ্র্যান্ড মাস্টার। টিবিং যদি এ কথা শোনে, তবে নির্ঘাত সাহায্যকরার জন্য উঠে পড়ে লেগে যাবে।

 

টিবিং হতে পারে খুব শক্তিশালী একজন মিত্র, ল্যাংডন বললো। তবে সেটা নির্ভর করছে, তুমি তার কাছে কতটুকু বলবে।

 

ফশে সম্ভবত বিরাট অংকের পুরস্কারের ঘোষণা দেবে।

 

ল্যাংডন হেসে উঠলো। বিশ্বাস করো, এই লোকটার কাছে টাকা পয়সা হলো শেষ জিনিস, লেই টিবিং খুবই ধনী ব্যক্তি। বৃটেনের ল্যাংকাস্টারের প্রথম ডিউকের একজন বংশধর। টিবিং তার টাকা পয়সা সেই পুরনো রীতি অনুযায়ীই পেয়েছে–উত্তরাধীকারী সূত্রে। প্যারিসের বাইরে তাঁর এস্টেটটা সপ্তদশ শতাব্দীর একটা প্রাসাদ, সেটাতে দুটো হৃদও রয়েছে।

 

ল্যাংডন টিবিংয়ের সাথে প্রথম পরিচিত হয়েছিলো কয়েক বছর আগে, বৃটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের মাধ্যমে। টিবিং বিবিসিকে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল সহকারে হলি গ্রেইলের তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টিকারী একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা মূলধারার টেভিভিশনের দর্শকদের জন্য সম্প্রচার করা হবে। বিবিসি টিবিংয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা, পাণ্ডিত্য আর গবেষণার উপর আস্থা রাখলেও, এরকম একটি বির্তকিত বিষয় নিয়ে প্রামান্যচিত্র নির্মাণের ঝুঁকি নিতে চায়নি, কারণ এতে করে তাদের মানসম্মত সাংবাদিকতার দীর্ঘ দিনের ঐতিহ্যটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। টিবিংয়ের সাজেশনেই, বিবিসি বিশ্বের তিন জন সম্মানিত ইতিহাসবিদ, যারা হলি গ্রেইল সম্পর্কে নিজেদের মতবাদের জন্য বিখ্যাত, তাদেরকে জড়ো করে সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিলো।

 

ল্যাংডন ছিলো তাদেরই একজন। বিবিসি সাক্ষাঙ্কারটি ধারণ করার জন্য ল্যাংডনকে টিবিংয়ের প্যারিসের এস্টেটে নিয়ে গিয়েছিলো। টিবিংয়ের চমৎকার ড্রইংরুমে ক্যামেরার সামনে বসেছিলো টিবিংয়ের গল্পটা শোনার জন্য। প্রথমদিকে, হলি গ্রেইলের বিকল্প উপাখ্যানটাতে তার সন্দেহ ছিলো এই কথাটা ল্যাংডন স্বীকার করে নিয়ে বলেছিলো যে, কয়েক বছর গবেষণা করার পর অবশেষে সে বুঝতে পেরেছে কাহিনীটা সত্য।

 

শেষে, ল্যাংডন তার নিজের কিছু গবেষণার কথা বর্ণনা করেছিলো সিম্বোলজিক সংযোগের একটা সিরিজ, যা খুব ভালো করেই বির্তকের দাবি রাখে।

 

যখন অনুষ্ঠানটি বৃটেনে সম্প্রচার করা হলো, তখন এটার সুনির্মাণ আর যথাযথ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, খৃস্টান সমাজের বিরাট একটা অংশ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলো, তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিলো। এটা আর যুক্তরাষ্ট্রে কখনও প্রচারিত হয়নি। কিন্তু বিক্ষোভটা ঠিকই আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছিলো। এর কিছুদিন বাদেই, ল্যাংডন এক পুরনো বন্ধুর কাছ থেকে একটা পোস্টকার্ড পেয়েছিলো ফিলাডেলফিয়ার একজন ক্যাথলিক বিশপ। কার্ডটাতে শুধু লেখা ছিলো : এত, তু রবার্ট?

 

রবার্ট, সোফি জিজ্ঞেস করলো, তুমি নিশ্চিত, এই লোকটাকে বিশ্বাস করা যায়?

 

অবশ্যই। আমরা সহকর্মী। তার টাকার দরকার নেই। আর আমি এও জানি, ফরাসি কর্তৃপক্ষের ওপর সে দারুণ ক্ষেপে আছে। ফরাসি সরকার ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শনটা কেনার জন্য তাঁর কাছ থেকে অসম্ভব রকমের কর আদায় করেছে। সে বেজু। ফশেকে সহযোগীতা করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে না।

 

সোফি অন্ধকার পথের দিকে তাকালো। আমরা যদি তার কাছে যাই, তুমি তাকে কতটুকু বলতে চাও?

 

ল্যাংডনকে এটা নিয়ে চিন্তিত মনে হলো না। আমাকে বিশ্বাস করো, লেই টিবিং, প্রায়োরি অব সাইওন আর হলি গ্রেইল সম্পর্কে এই পৃথিবীতে সবচাইতে বেশি জানে।

 

সোফি তার দিকে তাকালো। আমার দাদুর চেয়েও বেশি?

 

আমি বলতে চাচ্ছি, ভ্রাতৃসংঘের বাইরে।

 

তুমি কী করে জানলে টিবিং ভ্রাতৃসংঘের সদস্য নয়?

 

টিবিং সারাজীবন ব্যয় করেছেন হলি গ্রেইল সম্পর্কে সত্য কথা প্রচার করার জন্য। প্রায়োরিদের শপথ হলো হলি গ্রেইলটা গোপন রাখা।

 

কথাটা শুনে আমার কাছে মনে হচ্ছে, স্বার্থের দ্বন্দ্ব।

 

ল্যাংডন তার আশংকাটা বুঝতে পারলো। সনিয়ে ক্রিপ্টেক্সটা সরাসরি সোফিকে দিয়েছেন, যদিও সে জানে না ওতে কী আছে, কিংবা এটা দিয়ে সে কী করবে। তাই সে এ ব্যাপারে একজন অপরিচিত লোককে জড়িত করতে দ্বিধান্বিত। টিবিংকে শুরুতেই কি-স্টোন সম্পর্কে কিছু বলার দরকার নেই। অথবা, একেবারেই বলার দরকার নেই। তার বাড়িটা আমাদেরকে লুকিয়ে থেকে সুস্থিরভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দেবে। আমরা তার সাথে গ্রেইল নিয়ে আলাপের সময় তুমি ঠিক সময় মতো

 

জানাবে, কেন তোমার দাদু তোমাকে এটা দিয়েছেন।

 

আমাদেরকে, সোফি স্মরণ করিয়ে দিলো।

 

ল্যাংডন খুব গর্বিত বোধ করলো। আরেকবার, অবাক হয়ে ভাবলো, কেন সনিয়ে তাকে এ ঘটনায় যুক্ত করেছেন।

 

তুমি কি অল্প-বিস্তর জানো, টিবিং কোথায় থাকেন? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

ভার এস্টেটটা শ্যাতু ভিলে নামে পরিচিত।

 

সোফি অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে তাকালো। শ্যাতু ভিলে?

 

সেটাই।

 

চমৎকার বন্ধুই বটে।

 

তুমি এস্টেটটা চেনো?

 

আমরা সেটা অতিক্রম করে ফেলেছি। এটা কাস্তেল জেলায়। এখান থেকে বিশ মিনিটের পথ।

 

ল্যাংডন চিন্তিত হলো। এতো দূর?

 

হ্যাঁ, এই সময়ের মধ্যে তুমি আমাকে বলল, আসলে হলি গ্রেইলটা কি?

 

ল্যাংডন একটু থামলো। আমি টিবিংয়ের ওখানেই সেটা বলবো। সে আর আমি এ ব্যাপারটার বিভিন্ন দিকের ওপর বিশেষজ্ঞ। তাঁর আর আমার কথাবার্তায় তুমি পূর্ণাঙ্গ চিত্রটা পাবে। ল্যাংডন হাসলো। তাছাড়া, গ্রেইল হলো টিবিংয়ের জীবন, টিবিংয়ের কাছ থেকে হলি গ্রেইলের গল্প শোনা আর আইনস্টানের কাছ থেকে আপেক্ষিকতাবাদের ব্যাখ্যা শোনা একই কথা।

 

আশা করি, মাঝরাতে আগমনের জন্য টিবিং কিছু মনে করবেন না।

 

মনে রেখো, উনি স্যার লেই। ল্যাংডন একবারই এই ভুলটি করেছিলো। টিবিং একজন মজার মানুষ। কয়েক বছর আগে, হাউজ অব ইয়র্ক-এর ওপরে জ্ঞানগর্ভ একটা লেখার পরপরই সে নাইট উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।

 

সোফি মাথা ঝাঁকালো। তুমি ঠাট্টা করছে, তাই না? আমরা একজন নাইটের কাছে যাচ্ছি।

 

ল্যাংডন একটা অদ্ভুত হাসি দিলো। আমরা এখন গ্রেইলের খোঁজে আছি, সোফি। আর, একজন নাইটের চেয়ে এ ব্যাপারে কে বেশি সাহায্য করতে পারে?

 

 

 

৫২.

 

১৮৫ একরের বিশাল শ্যাতু ভিলে প্যারিসের ভার্সেই নগরীর উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। প্যারিস থেকে মাত্র পঁচিশ মিনিটের পথ। কাউন্ট অব অউফলর জন্য ১৬৬৮ সালে ফ্রাসোয়া মাসাত এটির নক্সা করেছিলেন। এটা প্যারিসের অন্যতম ঐতিহাসিক একটি শ্যাতু। দুটো বড় আয়তক্ষেত্রাকারের হৃদ আর একটা বিশাল বাগান আছে। এখানে। লো নটর বাগানটার নক্সা করেছিলেন। শ্যাতু ভিলেকে একটা ম্যানসনের চেয়ে বরং প্রাসাদ বলেই বেশি মনে হয়। এস্টেটটাকে লা পেতিত ভার্সাই বলেই ডাকা হয়।

 

ল্যাংডন ট্রাকটা শ্যাতুর প্রবেশ পথের গেটে কাছে থামালো, এখান থেকে শ্যাতুটা আরো এক মাইল দূরে। সিকিউরিটি গেট দিয়ে দূরের প্রান্তরের মাঝখানে টিবিংয়ের প্রাসাদটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকাটা দেখা যায়। গেটের ফলকটা ইংরেজিতে লেখা। ব্যক্তিগত সম্পত্তি। প্রবেশ নিষেধ। যেনো ঘোষণা দিচ্ছে, এটা বৃটেনের কোন অঞ্চল। টিবিং কেবল গেটের ফলকটিই ইংরেজিতে লেখেন নাই, বরং গেটের পাশে ইন্টারকমটাও ডান দিকে রেখেছেন ইউরোপে কেবল ইংল্যাচেই প্যাসেঞ্জাররা বাম দিকে বসে।

 

সোফি ইন্টারকমের অদ্ভুত অবস্থান দেখে অবাক হলো। কেউ যদি প্যাসেঞ্জার ছাড়া এখানে এসে পৌঁছায়, তাহলে কি হবে?

 

আমাকে জিজ্ঞেস করো না। ল্যাংডন এ ব্যাপারটা নিয়ে টিবিংয়ের সাথে একবার কথা বলেছিলো। সে যেখানে থাকে, সেই জায়গাটাকে নিজের দেশের মতো করে ভাবতেই বেশি পছন্দ করে।

 

সোফি পাশের কাঁচটা নামিয়ে দিলো। রবার্ট, তুমিই কথা বলো।

 

ল্যাংডন সোফির দিকে হেলে তার কোলের উপর দিয়ে, হাত বাড়িয়ে ইন্টারকমের বোতাম টিপলো। এ সময়ে মনোরম একটা সুগন্ধী তার নাকে এসে লাগলো, বুঝতে পারলো, সোফির খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। ঐরকম অদ্ভুত ভঙ্গীতেই অপেক্ষা। করলো। কিছুক্ষণ বাদে, ফোনটা বাজতে লাগলো।

 

শেষে, ইন্টারকম থেকে একটা খসখসে কণ্ঠ ফরাসিতে বললো। শ্যাতু ভিলে। কে বলছেন?

 

রবার্ট ল্যাংডন বলছি, সোফির কোল ঘেষে ফোনটার আরো কাছে এগিয়ে গেলো সে। আমি স্যার লেই টিবিংয়ের একজন বন্ধু। আমার তাঁর সাহায্যের দরকার।

 

আমার মনিব ঘুমাচ্ছেন। আমিও তার সাথে আপনার কি দরকার?

 

একটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাঁর অন্যতম সেরা আগ্রহের বিষয় সেটা।

 

তাহলে, আমি নিশ্চিত, তিনি আপনাদেরকে সকালেই আমন্ত্রণ জানাতে পারলে খুশি হবেন।

 

ল্যাংডন একটু নড়ে চড়ে বসলো, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 

স্যার লেই ঘুমাচ্ছেন, আর আপনি যদি তার বন্ধুই হোন, তো আপনার ভালো করেই জানা আছে, তার স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো নেই।

 

স্যার লেই টিবিং শৈশব থেকেই পোলিওতে ভুগছেন। এখন তিনি লেগব্রেস ব্যবহার করেন, সাথে ক্রাচও। কিন্তু তাঁর সাথে শেষ দেখার সময়, ল্যাংডন তার মধ্যে যথেষ্ট প্রাণ প্রাচুর্য দেখেছিলো। যদি পারেন, দয়া করে তাঁকে জানান, আমি গ্রেইল সম্পর্কে নতুন কিছু খুঁজে পেয়েছি। আমাদের পক্ষে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব। নয়।

 

একটা লম্বা বিরতি।

 

ল্যাংডন আর সোফি অপেক্ষা করতে লাগলো।

 

পুরো এক মিনিট পার হয়ে গেলো।

 

অবশেষে, একজন কথা বললো। আমার ভালো মানুষ, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনি এখনও হারভার্ডের স্টান্ডার্ড সময়েই আছেন। কণ্ঠটা খস্ খসে এবং মৃদু।

 

ল্যাংডন হাসলো। চিনতে পারলো বৃটিশ বাচন-ভঙ্গীর কণ্ঠটা। লেই, এরকম অসময়ে আপনাকে ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

 

আমার কাজের লোক বললো, আপনি কেবল প্যারিসেই আছেন তা নয়, বরং গ্রেইল সম্পর্কেও কিছু বলতে চান।

 

আমি ভেবেছিলাম একথা শুনে আপনি বিছানা ছেড়ে উঠবেন।

 

তাই হয়েছে।

 

এই পুরনো বন্ধুর জন্যে দরজা খোলার কোন সম্ভাবনা আছে কি?

 

যারা সত্যের অন্বেষণ করে, তারা বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু। তারা আমার ভাই।

 

ল্যাংডন সোফির দিকে চোখ গোল করে তাকালো।

 

অবশ্যই, আমি গেটটা খুলে দিচ্ছি। টিবিং বললেন, কিন্তু, প্রথমে আমাকে নিশ্চিত হতে হবে, আপনার স্মরণ শক্তি ঠিক আছে কিনা। একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। আপনি তিনটা প্রশ্নের উত্তর দেবেন।

 

ল্যাংডন ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সোফিকে ফিস্ ফিস্ করে বললো, তোমাকে আগেই বলেছি, সে খুবই মজার একজন মানুষ।

 

আপনার প্রথম প্রশ্ন, টিবিং বললেন, তাঁর কণ্ঠে গাম্ভীর্য। আপনাকে আমি চা, না কফি খাওয়াবো?

 

ল্যাংডন জানতো, আমেরিকানদের কফি প্রীতি সম্পর্কে তাঁর মনোভাবটা কী রকম। চা, সে জবাব দিলো। হালকা বাদামী।

 

চমৎকার। আপনার দ্বিতীয় প্রশ্ন। দুধ, না চিনি?

 

ল্যাংডন একটু ইতস্তত করলো।

 

দুধ, সোফি তার কানে ফিসফিস্ করে বললো, আমার মনে হয় বৃটিশরা দুধই দেয়।

 

দুধ, ল্যাংডন বললো।

 

নিরবতা।

 

চিনি?

 

টিবিং কোন জবাবই দিলেন না।

 

দাঁড়ান! ল্যাংডনের মনে পড়ে গেলো, শেষবার যখন দেখা হয়েছিলো, তখন তেতো একটা পানীয় পান করেছিলো। সে বুঝতে পারলো, প্রশ্নটাতে চালাকি আছে। লেবু! সে জানালো।

 

হালকা বাদামী, সঙ্গে লেবু।

 

অবশ্যই। টিবিংয়ের কণ্ঠটা এখন খুব আমুদে শোনালো। শেষ প্রশ্ন, কোন্ বছর হারভার্ডের একজন নৌকাবাইচওয়ালা হেনলিতে অক্সফোর্ডের একজন লোককে পেছনে ফেলে গিয়েছিলো?

 

ল্যাংডন এ সম্পর্কে কিছুই জানে না, তবে সে এটা বুঝতে পারলো, উত্তর একটাই হবে, এ জন্যেই এটা জিজ্ঞেস করা হয়েছে। নিশ্চিত করেই বলা যায়, এরকম কোন হাস্যকর ঘটনা কখনও ঘটেইনি।

 

গেটটা খট করে খুলে গেলো। আপনার স্মরণ শক্তি ঠিকই আছে, বন্ধু। আপনি পাশ করেছেন।

 

 

 

৫৩.

 

মঁসিয়ে ভার্নেট। জুরিখের ডিপোজিট ব্যাংকের রাত্রিকালীন ম্যানেজার টেলিফোনে ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের কণ্ঠটা শুনতে পেরে স্বস্তি অনুভব করলো। আপনি কোথায় গিয়েছিলেন, স্যার? এখানে পুলিশ এসেছে, সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে!

 

আমার একটু অসুবিধা হয়েছে, ব্যাংক প্রেসিডেন্ট বললেন, তাকে খুব তিক্ত মনে হচ্ছে। আমার এখন তোমার সাহায্য দরকার।

 

আপনার একটু না, বেশিই সমস্যা হয়েছে, ম্যানেজার ভাবলো। পুলিশ ব্যাংকটা চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে, তারা হুমকি-ধামকি দিচ্ছে, ডিসিপিজের ক্যাপ্টেন নিজে এসেছেন। ব্যাংকের দাবি অনুযায়ী ওয়ারেন্টও নিয়ে আসা হয়েছে। আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি, স্যার?

 

ট্রাক নাম্বার তিন, সেটা একটু খোঁজো।

 

হতভম্ব হয়ে ম্যানেজার তার ডেলিভারির শিডিউলটা দেখলো। এটাতো এখানেই আছে। নিচের লজিং ডকে।

 

আসলে, সত্যি বলতে কী, সেটা নেই। পুলিশ যে দুজনকে খুঁজছে, তারাই ট্রাকটা চুরি করে নিয়ে গেছে।

 

কী? তারা কিভাবে ওটা নিয়ে বাইরে গেলো?

 

আমি ফোনে সেটা ব্যাখ্যা করতে পারবো না, কিন্তু আমাদের এখানে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে যা দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের ব্যাংকের জন্য বিপর্যয়কর।

 

আপনি আমার কাছ থেকে কি সাহায্য চান, স্যার?

 

আমি চাই, তুমি এক্ষুণি ট্রাকের ইর্মাজেন্সি ট্রান্সপোন্ডারটা চালু করো।

 

ম্যানেজারের চোখটা ঘরের অন্যপাশে রাখা লোজ্যাক কন্ট্রোল বক্সের দিকে গেলো। সব আরমোর ট্রাকের মতোই, ব্যাংকের প্রতিটা ট্রাকেই রেডিও-কন্ট্রোড যন্ত্র বসানো আছে, যা ব্যাংক থেকেই রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে চালু করা যায়। ম্যানেজার তার জীবনে সেটা মাত্র একবারই চালু করেছিলেন, একটা হাইজ্যাক হবার পর, আর সেটা দারুণভাবেই কাজ করেছিলোস্ট্রাকটার অবস্থান চিহ্নিত করে, স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কর্তৃপক্ষকে সেটা জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো। আজ রাতে, ম্যানেজারের মনে হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট তার কাছ থেকে আরো বেশি কিছু আশা করছেন। স্যার, আপনি ভালো করেই জানেন, আমি যদি সেটা চালু করি, সেটা একইসাথে কর্তৃপক্ষকেও জানিয়ে দেবে, তাতে আমাদের সমস্যা হবে।

 

ভার্নেট কয়েক সেকেন্ড নিরব রইলেন। হ্যাঁ, আমি জানি, যাইহোক, ওটা করো। ট্রাক নাম্বার তিন। আমি ফোন ধরে রাখছি। ট্রাকটার একেবারে নিখুঁত অবস্থান জানার সঙ্গে সঙ্গেই, আমি চাই তুমি সেটা আমাকে জানিয়ে দেবে।

 

ঠি আছে স্যার।

 

 

 

ত্রিশ সেকেন্ড পর, চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, ট্রাকের ভেতর লুকিয়ে রাখা ছোট্ট ট্রান্সপোন্ডারটার চালু হয়ে গেলো।

 

 

 

৫৪.

 

ল্যাংডন আর সোফি ট্রাকটা নিয়ে ভেতরের পথ দিয়ে যেতেই, সোফি অনুভব করলো তার মাংসপেশীগুলো শিথিল হচ্ছে। রাস্তা থেকে ভেতরে আসতে পারাটা স্বস্তি দায়ক, আর সোফি এই রকম একজন বিদেশী দ্রলোকের ব্যক্তিগত মালিকানার এস্টেটের চেয়ে বেশি নিরাপদ জায়গার কথা ভাবতেও পারেনি।

 

তারা একটা বৃত্তাকারের পথ দিয়ে যেতেই শ্যাতু তিলেটা দৃষ্টি সীমার ভেতরে চলে এলো। তিন-তলা উঁচু এবং কমপক্ষে ষাট মিটার দীর্ঘ, সামনের অংশটা ধূসর পাথরের তৈরি, আর সেটা বাইরের স্পটলাইটের কারণে জ্বলজ্বল করছে।

 

ভেতরের বাতিগুলো সবে জ্বালানো হয়েছে। ল্যাংডন সোজা ট্রাকটা চালিয়ে সদর দরজার সামনে না গিয়ে, পাশের সবুজ-বীথির কাছে গিয়ে গাড়িটা থামালো, যাতে রাস্তা থেকে সেটা না দেখা যায়। রাস্তা থেকে দেখে ফেলার ঝুঁকি নেবার কোন কারণই নেই। সে বললো। অথবা, এরকম একটা ট্রাক নিয়ে কেন এসেছি, সেটা লেই টিবিংয়ের কাছে প্রশ্ন হয়েও দেখা দিতে পারে।

 

সোফিও তার সাথে সায় দিলো। ক্রিপ্টেক্সটা নিয়ে আমরা কি করবো? এটা এখানে রাখাটা ঠিক হবে না। কিন্তু লেই যদি এটা দেখে ফেলেন, তবে নিশ্চিতভাবেই জানতে চাইবেন জিনিসটা কি।

 

উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই, ল্যাংডন বললো। জ্যাকেটটা খুলে বাক্সটা মুড়িয়ে নিয়ে সেটা কোলে নিয়ে নিলো, যেনো কোনো বাচ্চা কোলে নিয়েছে।

 

সোফি সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। চতুর।

 

টিবিং কখনও নিজের ঘরের দরজা খোলে না; সে ভেতরেই দেখা করতে বেশি পছন্দ করে। ভেতরে ঢুকেই, আমি তার আসার আগে এটা কোথাও লুকিয়ে রাখবো। ল্যাংডন একটু থামলো। আসলে, তুমি তার সাথে দেখা করার আগে আমার উচিত তোমাকে একটু সতর্ক করে দেয়া। স্যার লেইর হাস্য-রসাত্মক ব্যাপারগুলো লোকজনের কাছে প্রায়শই একটু …অদ্ভুত বলে মনে হয়।

 

সোফি সন্দেহ করলো, এ পর্যন্ত যা ঘটেছে তাতে মনে হয় না, তার চেয়েও বেশি অদ্ভুত কিছু আজ রাতে ঘটবে।

 

প্রধান ফটকের দিকে চলে যাওয়া পথটা কেবল পাথরে তৈরি। সোফি দরজাটাতে ন করার আগেই সেটা ভেতর থেকে খুলে গেলো।

 

একজন অভিজাত বাটলার তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। নিজের টাইটা ঠিক করে নিলো সে। আসলে, সবেমাত্র সে পোশাকটা পরেছে। দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স পঞ্চাশ। তার ভাবসাব দেখে মনে হলো, তাদের এই সময়ে উপস্থিতিত হওয়াতে সে মোটেও অবাক হয়নি।

 

স্যার লেই নিচে নেমে আসছেন, সে জানালো, তার বাচনভঙ্গী পুরোপুরি, ফরাসি। পোশাক পরছেন। তিনি নাইট ড্রেস পরে মেহমানদের অভ্যর্থনা জানাতে পছন্দ করেন না। আমি কি আপনার কোটটা নিতে পারি? সে ল্যাংডনের হাতে ধরা পেচানো টুইড জ্যাকেটটার দিকে ইঙ্গিত করলো।

 

ধন্যবাদ, ঠিক আছে।

 

অবশ্যই। এদিকে আসুন, প্লিজ।

 

বাটলার তাদেরকে বিশাল একটা ড্রইং রুমে নিয়ে এলো, সেখানে ভিক্টোরিয়ান ল্যাম্পের নরম আলো জুলছিলো। ঘরের ভেতরে পাইপের তামাকের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ঘরের এক কোনায় ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বলছে। সেটা এতো বড় যে, এর ভেতরে আস্ত একটা বাড়কে রোস্ট করা যাবে। বাটলার সেই ফায়ার প্লেস আর মোমবাতিগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দিলে ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠলো।

 

লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের জ্যাকেটটা ঠিকঠাক করলো। আমার মনিব অনুরোধ করেছেন, এখানে আপনারা নিজের বাড়ি মনে করে থাকবেন। এই বলে সে ল্যাংডন আর সোফিকে একা রেখে চলে গেলো।

 

সোফি ভাবলো, সে কোন পাশটাতে বসবে—একপাশে আছে রেনো যুগের ভেলভেট ডিভান, একটা পুরনো দিনের রকিং চেয়ার, একজোড়া পাথরের আসন, দেখে মনে হচ্ছে, ওগুলো বাইজানটাইন মন্দির থেকে তুলে আনা হয়েছে।

 

ল্যাংডন মোড়ানো কোটটা খুলে ক্রিপ্টেক্সটা বের করে ডিভানের নিচে ঠেলে দিলে জিনিসটা দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেলো। তারপর, জ্যাকেটটা অবার পরে নিলো। সোফির দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বসে পড়লো সে।

 

সোফিও তার পাশে বসলো। ফায়ার প্লেসের আগুনের উত্তাপটা উপভোগ করে সোফির মনে হলো, এরকম একটা ঘর, তার দাদু অবশ্যই পছন্দ করতেন। গাঢ় কাঠের দেয়াল জুড়ে রয়েছে মহান শিল্পীদের সব ছবি, তাদের একটাকে সোফি চিনতে পারলো, সেটা পুশিনের, তার দাদুর দ্বিতীয় সেরা পছন্দের শিল্পী। ফায়ার প্লেসের ঠিক উপরে আইসিস দেবীর একটা আবক্ষ মূতি, তাদের দিকে চেয়ে আছে সেটা।

 

মিশরীয় দেবীর নিচে, ফায়ার প্রেসের ভেতরে, দুটো গারগোয়েল, তাদের হা করা মুখটা দিয়ে জিভ বের হয়ে আছে। শৈশবে গারগোয়েল দেখে সোফি সবসময়ই ভয় পেতো; তবে একবার, তার দাদু তাকে নটরডেম ক্যাথেড্রালের গারগোয়েলগুলো দেখিয়ে বলেছিলেন, প্রিন্সেস, এইসব নিরীহ জিনিসগুলোকে দ্যাখো, তুমি কি এদের মুখ থেকে মজার শব্দ শুনতে পাচ্ছো?

 

সোফি মাথা নেড়ে শব্দটা শুনে একটু হেসেছিলো। তারা গার্গল করছে। তার দাদ তাকে বলেছিলেন। গারগারিসার! সেজন্যেই তাদেরকে গারগোয়েল-এর মতো অদ্ভুত নামে ডাকা হয়।

 

সোফি এরপর থেকে আর সেগুলোকে ভয় পায়নি কখনও।

 

এই প্রিয় স্মৃতিটার কথা মনে করে সোফির ভেতরে প্রচণ্ড যন্ত্রণার সৃষ্টি হলো। দাদু চলে গেছে। সে ভাবলো ক্রিপ্টেক্সটা কীভাবে খোলা যায়, সেটা যদি লেই টিবিং জানতো। সোফির দাদুর অন্তিম মুহূর্তের কথায় ল্যাংডনের কাছে যাবার নির্দেশ ছিলো। তিনি অন্য কাউকে জড়িত করার কথা বলেননি। আমাদের লুকানোর জন্য একটা জায়গার দরকার। সোফি বললো, ঠিক করলো রবার্টের বিচার বুদ্ধির ওপরে আস্থা রাখবে।

 

স্যার রবার্ট! তাদের পেছনে থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। আপনি দেখি একজন কুমারীর সঙ্গে ভ্রমণ করছেন।

 

ল্যাংডন উঠে দাঁড়ালে সোফিও উঠে দাঁড়ালো। ঘরের এক কোনায় পেঁচানো একটা সিঁড়ি দিয়ে টিবিং নেমে এলেন।

 

গুড ইভিনিং, ল্যাংডন বললো। স্যার লেই, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, সোফি নেভু।

 

কী সৌভাগ্য আমার। টিবিং আলোর দিকে চলে এলেন।

 

আপনাকে ধন্যবাদ, সোফি বললো, দেখতে পেলো পায়ে লোহার লেগব্রেস পরেছেন তিনি আর হাতে ক্রাচ। আমি বুঝতে পারছি একটু দেরি হয়ে গেছে।

 

দেরি নয়, মাইডিয়ার, একটু জলদিই এসে গেছেন। তিনি হাসলেন। ভু নেত পাস আমিরিকেই?

 

সোফি মাথা ঝাঁকালো। প্যারিসেঁ।

 

আপনার ইংরেজি চমৎকার।

 

ধন্যবাদ। আমি রয়্যাল হলোওয়েতে পড়েছি।

 

তাইতো বলি। টিবিং একটু কাছে এগিয়ে এলেন। হয়তো রবার্ট আপনাকে বলেছে, আমি অক্সফোর্ডের কাছাকাছিই একটা স্কুলে পড়েছি। টিবিং ল্যাংডনের দিকে তাকালেন। অবশ্যই, আমি হারভার্ডেও পড়েছি, একটা নিরাপদ শিক্ষায়তন হিসেবে।

 

সোফির কাছে তাদের নিমন্ত্রণকর্তাকে দেখতে ঠিক স্যার এলটন জনের মতো মনে হলো না। টিবিংয়ের চুল লাল আর কথা বলার সময় তার দুটো চোখ পিটপিট করে।

 

টিবিং ল্যাংডনের কাছে এসে হাত মেলালেন। রবার্ট আপনি ওজন হারিয়েছেন। ল্যাংডন হাসলো। আর আপনি সেগুলোর কিছু পেয়ে গেছেন।

 

টিবিং প্রাণখুলে হাসলেন। নিজের পেটে চাপড় মারলেন। এবার সোফির দিকে ঘুরে আলতো করে তার হাত দুটো ধরে সরাসরি তার দিকে তাকালেন, মালেডি।

 

সোফি ল্যাংডনের দিকে তাকালো। সে একটু পিছিয়ে গিয়ে হাটু গেঁড়ে সম্মান জানাবে, নাকি হাতটা চুমু খাওয়ার জন্য এগিয়ে দেবে, বুঝতে পারছিলো না।

 

চায়ের কেটলি নিয়ে বাটলার ঘরে ঢুকে ফায়ারপ্লেসের সামনে রাখা টেবিলে সেটা রেখে দিলো।

 

এই হলো রেমি লেগালুদে, টিবিং বললেন। আমার গৃহভৃত্য।

 

বাটলার একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো।

 

রেমি লিওঁর অধিবাসী, টিবিং নিচু স্বরে বললেন, যেনো কথাটা খুব আপত্তিকর। কিন্তু সে খুব ভালো সসেজ বানাতে পারে।

 

ল্যাংডন অবাক হলো। আমি ভেবেছিলাম, আপনি হয়তো একজন ইংরেজকে এনেছেন।

 

হায় ঈশ্বর, তা হবে কেন! আমি এটা আশা করতে পারি না, একজন বৃটিশ শেফকে ফ্রেঞ্চ ট্যাক্স কালেক্টররা মেনে নেবে। তিনি সোফির দিকে তাকালেন। পারাদোনেজ-মোয়ে? মাদামোয়াজেল নে। দয়া করে নিশ্চিত হবেন, আমার ফরাসি বিদ্বেষ কেবলমাত্র রাজনীতিবিদ আর ফুটবলমাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আপনার সরকার আমার টাকা চুরি করে। আর আপনাদের ফুটবল টিম, সাম্প্রতিককালে আমাদেরকে অপমানিত করেছে।

 

সোফি একটা স্বস্তির হাসি দিলো।

 

টিবিং তার দিকে চেয়ে ল্যাংডনের দিকে ফিরলো। কিছু একটা হয়েছে। আপনাদের দুজনকেই একটু অন্যরকম লাগছে।

 

ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো। আমাদের একটা অদ্ভুত রাত কেটেছে, লেই।

 

তাতে সন্দেহ নেই। আপনারা মাঝরাতে আমার এখানে এসে গ্রেইল সম্পর্কে বলছেন। বলুন আমাকে, এটা কি আসলেই গ্রেইল নিয়ে, নাকি আপনারা এটা বলছেন এজন্যে যে, এই একটি মাত্র ব্যাপারই আছে যা আমাকে মাঝরাতেও জাগাতে পারে?

 

বলা চলে দুটোই। সোফি ভাবলো, সোফার নিচে ক্রিপ্টেক্সটার কথা মনে করলো সে।

 

লেই, ল্যাংডন বললো, আমরা আসলে প্রায়োরি অব সাইওন সম্পর্কে আলোচনা করতে চাচ্ছি।

 

টিবিংয়ের ভুরু দুটো কৌতূহলে কুচকে গেলো। রক্ষক। তো, এটা আসলে গ্রেইল সম্পর্কিতই বটে। আপনারা বলেছিলেন, আপনাদের কাছে একটা খবর আছে? নতুন কিছু, রবার্ট?

 

সম্ভবত। তবে আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত নই। আমাদের মনে হচ্ছে, আপনার কাছ থেকে এ সম্পর্কে আগে শুনতে পারলেই আমাদের জন্য ভালো হয়।

 

টিবিং তার আঙ্গুলগুলো নাচাতে লাগলেন। চতুর আমেরিকান। আগে শুনতে চান। খুব ভালো। আমি আপনাদের সেবায় নিয়োজিত। বলুন, আমাকে কী বলতে হবে?

 

ল্যাংডন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আমি আশা করছি, আপনি আগে মিস্ নেভূকে হলি গ্রেইলের সত্যিকারের চরিত্রটি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করবেন।

 

টিবিং দারুণ অবাক হলেন। উনি জানেন না? ল্যাং

 

ডন মাথা ঝাঁকালো।

 

টিবিংয়ের মুখে যে হাসিটা দেখা গেলো, সেটা প্রায় অশ্লীল। রবার্ট, আপনি আমার কাছে একজন কুমারী নিয়ে এসেছেন?

 

ল্যাংডন কাচুমাচু হয়ে সোফির দিকে তাকালো। কুমারি বা ভার্জিন এমন একটা শব্দ, যা এমন একজনের বেলায় প্রয়োগ করা হয়, যে গ্রেইলের সত্যিকারের গল্পটা শোনেনি, এই প্রথম তাকে সেটা বলা হবে।

 

টিবিং আগ্রহভরে সোফির দিকে তাকালেন। আপনি কতোটুকু চান, মাই ডিয়ার?

 

সোফি সংক্ষেপে জানালো, ল্যাংডনের কাছ থেকে অল্প-বিস্তর যা শুনেছিলো, তার বর্ণনা দিলো।

 

এই? টিবিং ল্যাংডনের দিকে কটমট করে তাকালেন। রবার্ট, আমি ভেবেছিলাম আপনি একজন দ্রলোক। ইতিমধ্যেই আপনি তার উত্তেজনা হরণ করেছেন?

 

আমি ভেবেছিলাম, হয়তো আপনি আর আমি দুজনে মিলে… ল্যাংডন বুঝতে পারলো কথাবার্তাগুলো একটু বেশিই দ্ব্যর্থবোধক হয়ে যাচ্ছে, বাড়াবাড়িও হয়ে গেছে।

 

টিবিং ইতিমধ্যেই সোফিকে নিজের দৃষ্টিতে আঁটকে রেখেছেন। আপনি একজন গ্রেইল ভার্জিন, মাই ডিয়ার। বিশ্বাস করুন, আপনি আপনার প্রথম অভিজ্ঞতার কথাটি কখনও ভুলবেন না।

 

 

 

৫৫.

 

ল্যাংডনের পাশে সোফায় বসে সোফি চায়ে চুমুক দিয়ে একটা কেক তুলে নিলো। ক্যাফেইন আর কেকটার স্বাগতম জানানোর আবেশটা অনুভব করলো সে। স্যার লেই টিবিং চোখ কুচকে অদ্ভুতভঙ্গীতে ফায়ার প্লেসের সামনে হাটতে লাগলেন। তার পায়ের লেগব্রেসটা খটখট করে শব্দ করলো।

 

হলি গ্রেইল, টিবিং বললেন, তার কণ্ঠে ধর্মীয় উপদেশের ভাবগাম্ভীর্যের ছোঁয়া। বেশিরভাগ লোক আমাকে জিজ্ঞেস করে থাকে, সেটা কোথায়। আমার মনে হয়, এটা এমন একটা প্রশ্ন, যার উত্তর আমি কখনই দেবো না। তিনি ঘুরে সোজা সোফির দিকে তাকালেন। যাহোক…তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো : গ্রেইলটা আসলে কি?

 

সোফি আঁচ করতে পারলো, তার দুজন পুরুষ সঙ্গীর মধ্যে এক ধরনের একাডেমিক আবহের উদ্ভব ঘটেছে।

 

গ্রেইলটাকে পুরোপুরি বুঝতে হলে, টিবিং বলতে শুরু করলেন, আমাদেরকে সবার আগে বাইবেল বুঝতে হবে। আপনি নিউ টেস্টামেন্ট সম্পর্কে কতোটুকু জানেন?

 

সোফি কাঁধ ঝাঁকালো। একদমই না, আসলে, আমি এমন একজন লোকের কাছে বড় হয়েছি, যিনি লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে পূজা করতেন।

 

টিবিংকে একই সাথে হতচকিত আর আনন্দিত মনে হলো। একটি আলোকিত আত্মা। চমৎকার! তাহলে আপনি জানেন যে, লিওনার্দো ছিলেন হলি গ্রেইলের সিক্রেট রক্ষাকারীদেরই একজন। আর তিনি তার শিল্পে সেটার কু লুকিয়ে রেখেছেন।

 

রবার্ট আমাকে এ সম্পর্ক বলেছে।

 

আর নিউটেস্টামেন্ট সম্পর্কে দা ভিঞ্চির দৃষ্টিভঙ্গী?

 

কোন ধারণা নেই।

 

টিবিং তাঁর ঘরের এককোণে রাখা বুক-সেলুফের দিকে তাকালেন। রবার্ট, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, ঐ দিকের শেলফে রাখা লা স্টোরিয়া দি লিওনার্দো বইটা দেবেন কি?

 

ল্যাংডন বিশাল আর্টের বইটা নিয়ে এসে তাদের সামনের টেবিলটার ওপর রাখলো। টিবিং বইটার মলাট খুলে প্রথম দিকের একটা পৃষ্ঠায় কতোগুলো উক্তির দিকে নির্দেশ করলেন। এগুলো দা ভিঞ্চির নোটবুক থেকে সংগৃহীত। টিবিং বললেন। আমার মনে হয়, এতে আপনি আমাদের আলোচনার সাথে সম্পর্কিত কিছু পাবেন।

 

সোফি লেখাটা পড়লো।

 

অনেকেই ইন্দ্রজালের ব্যবসা আর বানোয়াট অলৌকিকত্ব দেখিয়ে

বোকা জনগণকে ধোকা দিয়েছে।

—লিওনার্দো দা ভিঞ্চি

 

এখানে আরেকটা আছে, টিবিং আরেকটা উক্তির দিকে নির্দেশ করে বললেন।

 

অন্ধ অজ্ঞতা আমাদেরকে ভুল পথে চালিত করে।

ও! জীবিত মানুষ, তোমার চোখ খোলো!

–লিওনার্দো দা ভিঞ্চি

 

সোফি খুবই উত্তেজনা অনুভব করলো। দা ভিঞ্চি বাইবেল সম্পর্কে বলেছেন?

 

টিবিং সায় দিলেন। বাইবেল সম্পর্কে লিওনার্দোর অনুভূতি সরাসরি হলি গ্রেইলের সাথে সংশ্লিষ্ট। সত্যি বলতে কী, দা ভিঞ্চি হলি গ্রেইলের আসল ছবিটা একেঁছিলেন। একটু পরে আপনাকে আমি সেটা দেখাবো। তবে, প্রথমে আমরা বাইবেল নিয়েই কথা বলবো। টিবিং হাসলেন। আর বাইবেল সম্পর্কে আপনার যা জানার দরকার, তা কামান বিশেষজ্ঞ মার্টিন পারসি কর্তৃক হিসাব করা। টিবিং তাঁর গলাটা পরিষ্কার করে জানালেন, বাইবেল ফ্যাক্স হয়ে কিংবা স্বর্গ থেকে আসেনি।

 

কী বললেন?

 

বাইবেল মানুষেরই তৈরি, মাইডিয়ার। ঈশ্বরের নয়। বাইবেল জাদুর মতো আকাশ থেকে পড়েনি। মানুষই এটা তৈরি করেছে, ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে। আর এটা অসংখ্যবার অনুবাদিত হয়েছে, সংযোজিত হয়েছে, সংস্কার করা হয়েছে। বইটির সুনিশ্চিত নির্মযোগ্য কোন সংস্করণ ইতিহাসে পাওয়া যায়নি।

 

ঠিক আছে।

 

যিশু খৃস্ট ইতিহাসের একটি প্রভাবশালী চরিত্র। সম্ভবত সবচাইতে ক্ষ্যাপাটে অনুপ্রেরণাদায়ক বিশ্ব নেতাও বটে। পৃথিবীতে এর আগে তার মতো কেউ আসেনি। এাণকর্তা হিসেবে বিবেচিত হলেও, তিনি রাজা বনে গিয়েছিলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন আর নতুন দর্শনের প্রবক্তা হয়েছিলেন। রাজা সোলেমান আর রাজা ডেভিডের বংশধর হিসেবে যিশু খৃস্টের ইহুদিদের বৈধ রাজা হবার অধিকার ছিলো। বোধগম্য কারণেই, পৃথিবীব্যাপী তাঁর জীবন সংরক্ষিত হয়েছিলো লক্ষ-লক্ষ অনুসারীদের দ্বারা।

 

টিবিং চা খাওয়ার জন্য একটু থামলেন। নিউ টেস্টামেন্টের জন্য আশিটি গসপেল নির্বাচিত করা হয়েছিলো, কিন্তু খুব অল্পসংখ্যকই অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছিলো ম্যাথিও, মার্ক, লিউক, এবং জনই সেইসব অর্ন্তভূক্ত করেছিলেন।

 

কোন্ গসপেলটা অন্তর্ভূক্ত হবে, সেটা কে বেছে নিয়েছিলো? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

আহা! টিবিং আতিশয্যে বললেন। খৃস্টবাদের মৌলিক দূর্ভাগ্য! বাইবেল, আজকে যেমনটি আমরা দেখি, প্যাগান রোমান সম্রাট কনস্টানটিন দ্য গ্রেট কর্তৃক বিন্যস্ত হয়েছিলো।

 

আমি জানতাম কনস্টানটিন একজন খৃস্টান ছিলেন, সোফি বললো।

 

খুব একটা নয়, টিবিং বললেন। তিনি ছিলেন আজীবন একজন প্যাগান, যাকে মৃত্যু শয্যায় ব্যাপটাইজ করা হয়েছিলো। আর তিনি এতোটাই দুর্বল ছিলেন যে, প্রতিবাদ করতে পারেননি। কনস্টানটিনের সময়ে, রোমের রাজকীয় ধর্ম ছিলো সূর্য পূজাসল ইনভিকটাস-এর ধর্ম, অথবা, অদৃশ্য সূর্যের ধর্ম আর কনস্টানটিন ছিলেন সেটার প্রধান পুরোহিত। তার জন্যে খুব দুর্ভাগ্য ছিলো যে, একটা ক্রমবর্ধমান ধর্ম রোমকে কুক্ষিগত করতে যাচ্ছিলো। যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার তিন শত বছর পর, তার অনুসারীরা বহুগুণে বাড়তে শুরু করেছিলো। খৃস্টান আর প্যাগানরা যুদ্ধ করতে শুরু করলো। আর দ্বন্দ্বটা এতোটাই প্রকট হয়ে উঠেছিলো যে, সেটা রোমকে দুভাগে বিভক্ত করার একটা হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিলো। কনস্টানটিন সিদ্ধান্ত নিলেন, রোমকে একক একটি ধর্মে ঐক্যবদ্ধ করবেন। খৃস্টান ধর্মে।

 

সোফি খুব অবাক হলো। একজন প্যাগান সম্রাট কেন খৃস্টান ধর্মকে রষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে বেছে নিলেন?

 

টিবিং মিটিমিটি হাসলেন। কনস্টানটিন একজন ভালো ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন খৃস্টান ধর্ম ক্রমশ বাড়ছে, তাই তিনি বিজয়ী ঘোড়ার ওপরই বাজি ধরেছিলেন বলা চলে। ঐতিহাসিকরা এখনও যারপরনাই বিস্মিত হোন, কীভাবে, কনস্টাটিন সূর্য-পূজারী প্যাগানদেরকে খৃস্ট ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। প্যাগান প্রতীক, সন-তারিখ, এবং আচারগুলোকে তিনি খৃস্টীয় ঐতিহ্যের সাথে মিশিয়ে দিয়ে নতুন এবং শংকর একটি ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন, যা দুপক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়েছিলো।

 

প্যাগান ধৰ্ম রূপান্তরিত হয়ে খৃস্টান ধর্মের প্রতীকে ঠাই করে নেয়ার সত্যটা অনস্বীকার্য। ল্যাংডন বললো। মিশরীয় সূর্য চাকতি হয়ে গেলো ক্যাথলিক সেন্টদের হালোস। আইসিস দেবীর অলৌকিকভাবে পাওয়া সন্তানের সেবা করার ছবিটা খুব দারুণভাবেই, আধুনিককালে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠা কুমারী ম্যারি শিশু যিশুকে সেবা করার দৃশ্যের সাথে মিলে যায়। আর ক্যাথলিকদের আচারগুলোর প্রায় সবটাই মিতার, বেদী, ডক্সোলজি, আর কমিউনিয়ন-এর গড ইটিং-সরাসরি প্যাগানদের কাছ থেকে নেয়া।

 

টিবিং আর্তনাদ করে উঠলেন। খৃস্টান ধর্মের কোনকিছুই আসল নয়। প্রাক খৃস্টীয় ঈশ্বর মিথারস যাকে ডাকা হোতো ঈশ্বরের পুত্র এবং জগতের আলো বলে তিনি জন্মেছিলেন ২৫ শে ডিসেম্বর, মারা গিয়েছিলেন একটা পাথরের ফলকের ওপর। তারপর, তিন দিন পরে তাঁর পুণরুত্থান হয়েছিলো। ভালো কথা, ২৫ শে ডিসেম্বর অসিরিস, এডোনিস আর ডায়োনিসাস-এরও জন্মদিন। খৃস্টানদের সাপ্তাহিক ছুটিটাও প্যাগানদের কাছ থেকে চুরি করা।

 

আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?

 

প্রথমে, ল্যাংডন বললো, খৃস্টান ধর্ম ইহুদিদের শনিবারের সাবাঘকে সম্মান জানিয়ে ছিলো, কিন্তু কনস্টানটিন সেটা বদলে, প্যাগানদের শ্রদ্ধেয় রবিবার, অর্থাৎ সান ডে-কে ছুটি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে একটু থেমে দাঁত বের করে হাসলো।

 

আজকের দিনে, বেশিরভাগ চার্চ গমনকারীই জানে না, তারা আসলে প্যাগানদের সূর্য দেবতাকেই প্রকারন্তরে সম্মান করতে যাচ্ছে রবিবার।

 

সোফির মাথা ঘুরতে লাগলো। আর এসব কিছুই গ্রেইলের সাথে সংশ্লিষ্ট?

 

অবশ্যই টিবিং বললেন। আমার সাথেই থাকুন। এই দুটো ধর্মের সংমিশ্রণের সময়ে, কনস্টানটিনের নতুন খৃস্টীয় ঐতিহ্যকে দৃঢ় করার প্রয়োজন হয়ে পড়লো, সেজন্যে, তিনি একটা বিখ্যাত ধর্মসভার ডাক দিলেন, যা নিয়ে নামে পরিচিত।

 

সোফি কথাটা একবার শুনেছিলো, তবে সেটা নিসেন ক্রিডের জন্মস্থান হিসেবে।

 

এই সম্মেলনেই, টিবিং বললেন, খৃস্টান ধর্মের অনেক কিছুই আলোচনা করে ভোট দিয়ে সব ঠিক করা হয়েছিলো ইস্টারের দিন, বিশপের ভূমিকা, পুরোহিতদের ক্ষমতা এবং অবশ্যই যিশুর দেবত্ব।

 

আমি বুঝতে পারছি না। দেবত্ব?

 

মাইডিয়ার, টিবিং ঘোষণা দিলেন, এই দিনের আগপর্যন্ত, যিশুকে তার অনুসারীরা একজন মরণশীল পয়গম্বর হিসেবেই দেখতো…একজন মহান এবং শক্তিশালী মানুষ হিসেবে। আর অবশ্যই, একজন মরণশীল মানুষ হিসেবে।

 

ঈশ্বরের পুত্র নয়?

 

ঠিক, টিবিং বললেন। যিশুকে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রস্তাব করা হয়েছিলো সেই কাউন্সিলে, আর সেটা ভোটের মাধ্যমে অনুমোদিতও হয়েছিলো, নিসায়েতে।

 

দাঁড়ান। আপনি বলছেন যিশু দেবত্ব ভোটের ফল?

 

অনেকটা সে রকমই, টিবিং যোগ করলেন।

 

খৃস্টের দেবত্ব প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের ঐক্য এবং নতুন শক্তি কেন্দ্র ভ্যাটিকানকে আরো বেশি দৃঢ়তা দিয়েছিলো। আনুষ্ঠানিকভাবে যিশুকে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে প্রমাণ করার মধ্য দিয়ে কনস্টানটিন যিশুকে দেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মনুষ্য সমাজের বাইরের একজন, যার শক্তি সমস্ত সন্দেহের উর্ধ্বে। এর মধ্য দিয়ে কেবল প্যাগানদের উথানই ঠেকানো হয়নি, বরং তার অনুসারীরা একটি সংগঠনও তৈরি করে ফেললো-রোমান ক্যাথলিক চার্চ।

 

সোফি ল্যাংডনের দিকে তাকালে সে সোফিকে কথাটার সত্যতা সম্পকে আশ্বস্ত করলো।

 

সবটাই ছিলো ক্ষমতা সংক্রান্ত ব্যাপার, টিবিং আবারো বলতে শুরু করলেন। ত্রাণকর্তার ব্যাপারটা খৃস্টীয় চার্চ এবং রাষ্ট্রের কাছে খুবই স্পর্শকাতর ছিলো। অনেক পণ্ডিতের দাবি, শুরুর দিকে চার্চ যিশুকে তাঁর সত্যিকারের অনুসারীদের কাছ থেকে চুরি করেছিলো। তার মানবিক বার্তাগুলো হাইজ্যাক করা হয়েছিলো, তাঁকে অপ্রবেশ্য এক স্বর্গীয় মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিলো, আর এসব কিছুই করা হয়েছিলো নিজেদের শক্তি বাড়াতে। এই বিষয়ে আমি কতগুলো বইও লিখেছি।

 

আমি অনুমান করতে পারি, একনিষ্ঠ খৃস্টানরা আপনার কাছে প্রতিদিন ঘৃণার চিঠি পাঠিয়েছে?

 

কেন তারা সেটা করবে? টিবিং পাল্টা প্রশ্ন করলো। শিক্ষিত খৃস্টানদের মধ্যে বিশাল সংখ্যকই তাদের বিশ্বাসের ইতিহাসটা জানে। যিশু অবশ্যই একজন মহান আর ক্ষমতাবান লোক ছিলেন। কনস্টানটিনের নিজস্ব স্বার্থে তাকে ব্যবহার করার জন্য তো আর যির মহিমান্বিত জীবনটা হেয় হয়ে যায় না। কেউ তো আর বলছে না, খৃস্ট একজন ভণ্ড ছিলেন। অথবা অস্বীকার করতে পারে না যে, তিনি এই পৃথিবীর লক্ষ-লক্ষ মানুষকে উন্নততর জীবনের জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। আমরা যা বলছি সেটা হলো, কনস্টানটিন যিশুর প্রভাব এবং গুরুত্বকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। আর এটা করার মধ্য দিয়ে তিনি খৃস্টান ধর্মকে একটি আকার দিয়েছেন, যা আজ আপনারা দেখছেন।

 

সোফি তার সামনে রাখা আট-বুকটার দিকে তাকালো। এটা ভেতরে দা ভিঞ্চির আঁকা হলি গ্রেইলটা দেখার জন্য উদগ্রীব সে।

 

কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো, টিবিং বললেন, এবার তিনি খুব দ্রুত বলে যেতে লাগলেন। যেহেতু যিশুর মৃত্যুর চার শত বছর পর কনস্টানটিন তাকে মহিমান্বিত করেছিলেন, তাই তার জীবন যে মরণশীল একজন মানুষের জীবন, সে সম্পর্কে হাজার হাজার দলিল-দস্তাবেজের অস্তিত্ব রয়ে গিয়েছিলো। ইতিহাসের বই নতুন করে লেখার জন্য কনস্টানটিনের দরকার ছিলো রক্তাক্ত একটি অধ্যায়ের। এখানেই শুরু হয়েছিলো। বৃস্টিয় ইতিহাসের সবচাইতে বড় অধ্যায়ের। সোফির দিকে তাকিয়ে টিবিং বিরতি দিলেন। কনস্টানটিন একটা নতুন বাইবেলের জন্য অর্থ প্রদান করে একটি কমিটি গঠন করলেন। এতে করে বাইবেল থেকে ঐসব গসপেল বাদ দিয়ে দেয়া হলো যাতে যিশুকে মানুষ হিসেবে বিবৃত করা হয়েছিলো। তার বদলে এমন সব গসপেল অর্ন্তভূক্ত করা হলো, যাতে যিশুকে ঈশ্বরতুল্য বলে মনে হয়। অনেক আদি গসপেল সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিলো।

 

আরেকটা কথা, ল্যাংডন যোগ করলো। কেউ যদি কনস্টানটিনের সংস্করণটা বাদ দিয়ে আসল গসপেলটা বেছে নিতো, তবে তাকে হেরোটিক বা ধর্মবিরোধী আখ্যা দেয়া হোতো। Heretic শব্দটা তখন থেকেই পৃথিবীতে প্রচলিত হয়ে গেলো। লাতিন শব্দ Haereticus মানে পছন্দ। যারা খৃস্টের আসল ইতিহাসটা পছন্দ করতো, তারাই ছিলো পৃথিবীর প্রথম ধর্মবিরোধী বা heretic।

 

ইতিহাসবেত্তাদের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার হলো, টিবিং বললেন, কনস্টানটিন যেসব গসপেল নিশ্চিহ্ন করেছিলেন, সেগুলোর কিছু কিছু টিকে গিয়েছিলো। ডেড সি ফুল বা পুঁথি, ১৯৫০ এর দশকে আবিষ্কৃত হয়েছিলো যা জুদিয়ান মরুভূমির কাছে কামরানের একটি গুহায় লুকিয়ে রাখা ছিলো। আর অবশ্যই, ১৯৪৫ এ নাগ হাম্মাদিতে প্রাপ্ত কপটিক্ স্কুলটা তো আছেই। এইসব দলিলে খৃস্টকে একজন মানুষ হিসেবেই বিবৃত করা হয়েছে। অবশ্য, ভ্যাটিকান তাদের ঐতিহ্য অনুসারে চেষ্টা করেছে এই ফুলগুলো যাতে প্রকাশিত না হয়। আর কেনই বা তারা সেটা করবে না। দলিলগুলোতে যে তথ্য আছে, তাতে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, বাইবেল সম্পাদিত এবং সংস্করণকৃত করা হয়েছিলো মানুষ কর্তক, যার ছিলো একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা-মানুষ যিশুকে দেবত্ব আরোপ করে, তার প্রভাবকে ব্যবহার করার মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করা।

 

তারপরও, ল্যাংডন পাল্টা বলতে লাগলো, এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, আধুনিক চার্চ এইসব দলিলগুলোকে বিশ্বাস না করে নিজেদের বিশ্বাসেই অটল রয়েছে। ভ্যাটিকান মনে করে, এসব দলিল বানোয়াট এবং মিথ্যা।

 

টিবিং সোফির বিপরীতে একটা চেয়ারে বসেছিলেন, তিনি চুক চুক করে একটা শব্দ করলেন। আপনি দেখতেই পারছেন, আমাদের অধ্যাপক সাহেব রোমের ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশিই নরম। তারপরও, তিনি ঠিক বলেছেন। আধুনিক চার্চ এসবকে বানোয়াট বলেই বিশ্বাস করে একটা বোধগম্য কারণেই। কনস্টানটিনের বাইবেলটা দীর্ঘদিন ধরে তাদের কাছে সত্য বলে পরিগণিত হয়ে আসছে। কেউই প্রবর্তকারীর চেয়ে কেউ বেশি প্রবর্তন করতে পারে না।

 

এর মানে হলো, ল্যাংডন বললো, আমরা আমাদের বাবাদের ঈশ্বরের আরধনা করি।

 

আমি যা বলতে চাই, টিবিং সাথে সাথে বললেন। আমাদের বাবারা আমাদেরকে খৃস্ট সম্পর্কে যা বলে গেছেন তার প্রায় সবটাই মিথ্যা। হলি গ্রেইলের গল্পটাও সেরকমই।

 

সোফি দা ভিঞ্চির বইয়ের সেই উক্তিটার দিকে তাকালো।

 

টিবিং বইটা খুলে ভেতরের পাতায় গেলেন। আর শেষে, আপনাকে দা ভিঞ্চির আঁকা হলি গ্রেইলের ছবিটা দেখাবার আগে, আমি চাই আপনি এটা একটু দেখুন। তিনি বইয়ের একটা রঙ্গীন ছবির দিকে নির্দেশ করলেন, যা সমস্ত পাতা জুড়ে রয়েছে। আমার ধারণা আপনি এই ফ্রেসকোটা চিনতে পেরেছেন?

 

উনি ঠাট্টা করছেন, তাই না? সোফি সর্বকালের সবচাইতে বিখ্যাত ফ্রেসকোটার দিকে চেয়ে আছে–দ্য লাস্ট সাপার–মিলানের সান্তা মারিয়া দেল গ্রাজির দেয়ালে আঁকা দা ভিঞ্চির কিংবদন্তী চিত্রকর্মটা। ক্ষয়িষ্ণু ফ্রেসকোটাতে যিশু এবং তাঁর শিষ্যদের ছবি আছে, যখন যিশু ঘোষণা দিলেন যে, তাদের মধ্যেই একজন তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।

 

আমি এই ফ্রেসকোটা চিনি।

 

তাহলে, আপনি হয়তো আমাকে এই ছোট্ট খেলাটা খেলতে দেবেন? চোখ বন্ধ করুন।

 

একটু ইতস্তত করে সোফি তার চোখ বন্ধ করলো।

 

যিশু কোথায় বসে আছেন? টিবিং জিজ্ঞেস করলেন।

 

মাঝখানে।

 

ভালো। তিনি এবং তাঁর শিষ্যরা কি খাবার খাচ্ছেন?

 

রুটি। অবশ্যই।

 

চমৎকার। পানীয়?

 

মদ। তারা মদ পান করেছিলো।

 

খুব ভালো। শেষ প্রশ্ন। টেবিলে কয়টা মদের গ্লাস আছে?

 

সোফি একটু থামলো, বুঝতে পারলো প্রশ্নটাতে চালাকি আছে। আর প্রাতরাশ সেরে যিশু তার মদে পেয়ালাটা তুলে নিয়ে শিষ্যদের সাথে ভাগাভাগি করলেন। একটা কাপ, সে বললো। চ্যালিস মানে পেয়ালা। খৃস্টের পেয়ালা। হলি গ্রেইল। যিশু একটা পেয়ালা দিয়েই মদ পরিবেশন করেছিলেন, একজন একজন করে, যেমনটি আধুনিক খৃস্টানরা কমিউনের সময় করে থাকে।

 

টিবিং দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখ খুলুন।

 

সোফি চোখ খুললো। টিবিং দাঁত বের করে ইঙ্গিতপূর্ণ একটা হাসি হাসছেন। সোফি চোখ খুলেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখলো টেবিলে সবার জন্য একটা করে কাপ আছে, খৃস্টের জন্যও। তেরোটি কাপ। তারচেয়েও বড় কথা, কাপগুলো খুব ছোট। কাঁচের তৈরি। ছবিটাতে কোন পেয়ালা বা চ্যালিস নেই। কোন হলি গ্রেইল নেই।

 

টিবিংয়ের চোখ পিট পিট করছে। একটু অদ্ভুত লাগছে, তাই না, বাইবেল এবং হলি গ্রেইলের কিংবদন্তীতে নিশ্চিতভাবেই হলি গ্রেইলের কথা বলা আছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, দা ভিঞ্চি দৃশ্যত যিশুর কাপটা আঁকতে ভুলে গিয়েছিলেন।

 

নিশ্চিতভাবেই, চিত্রকলার পণ্ডিতেরা এটা নোট করে নিতে পারেন।

 

আপনি এটা জেনে আরো বেশি ঘাবড়ে যাবেন, যা বেশির ভাগ পণ্ডিতই, হয় ব্যাপারটা খেয়াল করেননি, অথবা এড়িয়ে গেছেন। এই ফ্রেসকোটা আসলে হলি গ্রেইলের রহস্যের মূলচাবিকাঠি। দা ভিঞ্চি সেটা দ্য লাস্ট সাপার-এ খোলাখুলিভাবেই দেখিয়েছেন।

 

সোফি ছবিটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো। এই ফ্রেসকোটাতে কি বলা আছে, হলি গ্রেইল আসলে কি?

 

কি না বলে বলুন, কে। হলি গ্রেইল কোন বস্তু নয়। এটা আসলে…একজন ব্যক্তি।

 

 

 

৫৬.

 

সোফি টিবিংয়ের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে ল্যাংডনের দিকে তাকালো। হলি গ্রেইল একজন ব্যক্তি?

 

ল্যাংডন সায় দিলো। আসলে, একজন নারী।

 

সোফির ফ্যাঁকাশে চেহারাটা দেখে ল্যাংডন তার অবস্থাটা বুঝতে পারলো। সে যখন প্রথম এই তথ্যটা জানতে পেরেছিলো, তখন তারও এমন অবস্থা হয়েছিলো। সেই কথাটা তার মনে পড়ে গেলো।

 

টিবিং এবার ল্যাংডনকে বললো, রবার্ট, হয়তো একজন সিম্বোলজিস্ট হিসেবে ব্যাপারটা আরো খোলাসা করে বলার সময় হয়েছে? তিনি টেবিলের কাছে গিয়ে একটা কাগজ তুলে নিয়ে সেটা ল্যাংডনের সামনের মেলে ধরলেন।

 

ল্যাংডন তার পকেট থেকে একটা কলম বের করলো। সোফি, তুমি কি নারী পুরুষের আধুনিক আইকনের সাথে পরিচিত? সে অতিপরিচিত পুরুষ প্রতীকটা ♂ এবং নারী প্রতীকটা ♀ আঁকলো।

 

অবশ্যই, সে বললো।

 

এগুলো, সে খুব শান্ত কণ্ঠে বললো, নারী-পুরুষের আসল প্রতীক নয়। অনেকেই ভুল করে ধারণা করে যে, পুরুষ প্রতীকটা এসেছে বর্ম এবং বর্শা থেকে, যেখানে নারী প্রতীক প্রতিনিধিত্ব করে আয়নার প্রতিফলিত সৌন্দর্যকে। আসলে, প্রতীকগুলোর উৎস হলো প্রাচীন জ্যোর্তিবিদ্যার মঙ্গল গ্রহ আর ভেনাসের প্রতীকগুলো। আসল প্রতীকগুলো অনেক বেশি সরল ছিলো। ল্যাংডন কাগজের উপর আরেকটা আইকন আঁকলো।

 

^

 

এই প্রতীকটা ছিলো পুরুষের, সোফিকে বললো। একটা আদিম পুরুষ লিঙ্গ।

 

একদম যথার্থই বলা যায়, সোফি বললো।

 

আসলটার মতোই, টিবিং বললেন।

 

ল্যাংডন আবারো বলতে লাগলো। এই আইকনটা সাধারণভাবে রেড বা তলোয়ার নামে পরিচিত। আর এটা প্রতিনিধিত্ব করে আগ্রাসন এবং পুরুষত্ব। সত্যি বলতে কী, ঠিক এই পুরুষলিঙ্গের প্রতীকটা, আজকের দিনেও আধুনিক সেনাবাহিনীতে উচ্চতর র‍্যাংক নির্দেশ করতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

 

একদম ঠিক। টিবিং দাঁত বের করে হাসলেন। তোমার যতো বেশি লিঙ্গ থাকবে, ততো বেশি উচ্চ র‍্যাংক হবে।

 

ল্যাংডন একটু বিব্রত হলো। নারী প্রতীকটার দিকে যাই, এটা একেবারে পুরুষেরটার বিপরীত। সে আরেকটা প্রতীক আঁকলো। এটাকে বলা হয় চ্যালিস বা পেয়ালা।

 

V

 

সোফি চোখ তুলে তাকালো, তাকে দেখে মনে হলো অবাক হয়েছে।

 

ল্যাংডন বুঝতে পারলো, সোফি ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে। চ্যালিস, সে বললো, একটা পেয়ালা বা আঁধারের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। তারচেয়েও বড় কথা, এটার আকৃতি নারীর যোনীর মতো। এই প্রতীকটা নারীত্বের, মাতৃত্বের, আর উর্বরতার। ল্যাংডন এবার তার দিকে সরাসরি তাকালো। সোফি, কিংবদন্তী বলছে, হলি গ্রেইল হলো একটা চ্যালিস মানে, একটা পেয়ালা। পেয়ালা হিসেবে গ্রেইলের বর্ণনাটা আসলে হলি গ্রেইলের সত্যিকারের চরিত্রকে রক্ষা করার জন্যই। এজন্যেই বলা হয়, কিংবদন্তীতে চ্যালিসকে একটা রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

 

একজন নারী, সোফি বললো।

 

একদম ঠিক। ল্যাংডন হাসলো। বাস্তবিক, গ্রেইল হলো নারীত্বের প্রাচীন একটা প্রতীক। হলি গ্রেইল দিয়ে আসলে পবিত্ৰ-নারী এবং দেবীদের বোঝানো হয়েছে, যা বর্তমানে হারিয়ে গেছে। সত্যি বলতে কী, চার্চ সেটাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। নারীর শক্তি এবং নতুন জীবন উৎপাদন করার ক্ষমতাকে এক সময় খুব পবিত্র জ্ঞান করা হতো। কিন্তু, এটা পুরুষশাসিত চার্চ ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিলো, আর সেজন্যেই পবিত্র নারীকে ডাইনী আখ্যা দিয়ে ভ্রষ্ট করা হয়েছিলো। ঈশ্বর নয়, বরং মানুষই, আদি পাপের স্রষ্টা, যেখানে বলা হয়েছে, হাওয়া আদমকে গন্ধম খাইয়ে স্বর্গচ্যুত করেছিলেন। নারী, এক সময়ের পবিত্র জন্মদাত্রী, শত্রু হয়ে গেলো।

 

আমার আরো বলা দরকার, টিবিং দাবি করলো, নারীরা জীবন আনে এই ধারণাটি আসলে প্রাচীন ধর্মের ভিত্তি ছিলো। সন্তান জন্ম দেয়াটা রহস্যময় আর শক্তিশালী একটি ব্যাপার। দুঃখজনক যে, খৃস্টিয় দর্শন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো যে, নারীর সৃজন ক্ষমতাকে অবজ্ঞা করে, জীববিদ্যার সত্যকে অস্বীকার করে, পুরুষকে স্রষ্টা হিসেবে তুলে ধরা হবে। জেনিসিস বা সৃষ্টিতত্ত্ব আমাদেরকে বলছে, আদমের পাঁজর থেকে হাওয়া সৃষ্টি হয়েছে। নারী হয়ে গেলো পুরুষ থেকে উদ্ভূত একটি পাপী জীব। জেনিসিসের শুরুটা হলো দেবীদের সমাপ্তি।

 

গ্রেইল হলো, ল্যাংডন বললো, বিস্মৃত দেবীর একটি প্রতীক। খৃস্টান ধর্মের আগমনে, প্রাচীন প্যাগান ধৰ্ম খুব সহজেই মৃত্যুবরণ করেনি! নাইটরা, যারা চ্যালিস অন্বেষণকারী হিসেবে বিবেচিত, তাঁরা চার্চের হাত থেকে নারীদেরকে বাঁচাতে অবতীর্ন হয়েছিলেন। চার্চ দেবীদের নিশ্চিহ্ন করা শুরু করেছিলো, অবিশ্বাসীদেরকে পুড়িয়ে মেরে, প্যাগানদের পবিত্র নারীকে নিষিদ্ধ করেছিলো তারা।

 

সোফি মাথা ঝাঁকালো। আমি দুঃখিত, যখন তুমি বলছিলে, হলি গ্রেইল হলো একজন ব্যক্তি, আমি ভেবেছিলাম তুমি সত্যিকারের ব্যক্তিকেই বুঝিয়েছে।

 

সত্যিকারেরই তো। ল্যাংডন বললো।

 

যে কোন ব্যক্তি নয়, টিবিং উৎফুল্ল হয়ে বললেন, উত্তেজনায় দাঁড়িয়েই গেলেন। এমন একজন নারী, যিনি এমন শক্তিশালী একটা সিক্রেট ধারণ করছেন, যা প্রকাশ পেলে খৃস্টধর্মের মূল ভিত্তিটাই ধ্বংস হবার হুমকি রয়েছে!

 

সোফিও দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠলো। এই নারী কি ইতিহাসে খুবই সুপরিচিত?

 

অনেকটাই। টিবিং ক্রাচটা ধরে হলের দিকে এগোলেন। আমরা যদি পড়ার ঘরে যাই, তবে আমি আপনাকে দা ভিঞ্চির আঁকা তাঁর ছবিটা দেখাতে পারবো।

 

 

 

দুই ঘর পরে, রান্না ঘরে, গৃহপরিচারক রেমি লেগালুদেচ টেলিভিশনের সামনে নিশ্চুপ দাড়িয়ে ছিলো। খবরে একজন নারী আর পুরুষের ছবি প্রচার করা হচ্ছিলো…ঠিক সেই দুজনের, একটু আগে রেমি যাদেরকে চা পরিবেশন করে এসেছে।

 

 

 

৫৭.

 

জুরিখের ডিপোজিটরি ব্যাংকের বাইরে রোড-ব্লকের সামনে দাঁড়িয়ে, লেফটেনান্ট কোলেত ভাবতেই পারছে না তল্লাশীর ওয়ারেন্টটা নিয়ে আসতে ফশের এতো দেরি হচ্ছে কেন। ব্যাংকাররা নিশ্চিত কিছু একটা লুকাচ্ছে। তারা দাবি করছে, ল্যাংডন আর নেভু একটু আগে ব্যাংকে ঠিকই এসেছিলো, কিন্তু তাদের কাছে কোন একাউন্ট নাম্বার না থাকার দরুন তারা এখান থেকে ফিরে গেছে।

 

তাহলে তাদেরকে ভেতরে একটু তল্লাশী করতে দিচ্ছে না কেন?

 

অবশেষে, কোলেতের সেলুলার ফোনটা বেজে উঠলো। কলটা লুভরের কমান্ড পোস্ট থেকে এসেছে। সার্চওয়ারেন্ট কি পাওয়া গেছে? কোলেত জানতে চাইলো।

 

ব্যাংকের কথা ভুলে যাও, লেফটেনান্ট, এজেন্ট তাকে বললো। আমরা একটা খোঁজ পেয়েছি। ল্যাংডন আর নেভু কোথায় লুকিয়ে আছে, ঠিক সেই অবস্থানটা খুঁজে পেয়েছি।

 

কোলেত তার গাড়ির হুডের ওপর বসে পড়লো। তুমি ঠাট্টা করছো।

 

মফশলের দিকে আমার কাছে একটা ঠিকানা আছে। ভার্সেইর কাছাকাছি সেটা।

 

ক্যাপ্টেন ফশে কি সেটা জানে?

 

এখন পর্যন্ত না। তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ কলে ব্যস্ত আছেন।

 

আমি যাচ্ছি। তিনি ফু হতেই তাকে ফোন কোরো। কোলেত ঠিকানাটা দেখে লাফিয়ে উঠলো। ব্যাংক থেকে বের হতেই তার মনে হলো, কে ল্যাংডনদের অবস্থান খোঁজ করতে ডিসিপিজেকে বলেছিলো। এতে অবশ্য কিছু যায় আসে না।

 

সে তার জীবনের সবচাইতে বড় এবং হাই প্রােফাইল গ্রেফতারটি করতে যাচ্ছে। কোলেত ওয়্যারলেসে পাঁচটা গাড়িকে তার সাথে আসতে বললো। কোন সাইরেন না, বুঝেছো। ল্যাংডন যেনো না জানে, আমরা আসছি।

 

 

 

চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, একটা কালো অদি গাড়ি, গ্রামীন পথ দিয়ে এসে একটা মাঠের ছায়ায় থামলো। সাইলাস গাড়ি থেকে বের হয়ে রট আয়রনের ফাঁক দিয়ে ভেতরের দিকে তাকালো। তার সামনে বিশাল একটা প্রাঙ্গণ। নিচের ঘরের বাতিগুলো সব জ্বলছে। এই সময়ে বাতি জ্বলা অদ্ভুতই বটে, সাইলাস ভাবলো, মুচকি হাসলো। টিচার তাকে যে তথ্য দিয়েছেন, সেটা একেবারে নিখুঁত। কি-স্টোনটা ছাড়া আমি এই বাড়ি থেকে সরছি না, সে প্রতীজ্ঞা করলো। আমি বিশপ এবং টিচারকে ব্যর্থ হতে দিতে পারি না।

 

লোহা কাটার যন্ত্রটা পরীক্ষা করে দেখলো সে। বারগুলো কেটে, দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। তার ঊরুতে বাঁধা সিলিস বেল্টের যন্ত্রণা উপেক্ষা করেই কাজে নেমে গেলো। অস্ত্রটা হাতে নিয়ে সাইলাস সুবিশাল সবুজ চত্বরে পা ফেললো।

 

 

 

৫৮.

 

টিবিংয়ের স্টাডিরুমের মতো কোন স্টাডিরুম সোফি, জীবনেও দেখেনি। একটা বিলাসবহুল অফিস কক্ষের চেয়েও সেটা ছয় কী সাতগুণ বড়। সায়েন্স ল্যাবরেটরি, আর্কাইভ-লাইব্রেরি এমনকি ইনডোর ফ্রি মার্কেটও এতো বড় নয়। তিনটা ঝাড় বাতি ঝোলানো আছে। ফ্লোরের টাইলস ঢাকা পড়ে গেছে ওয়ার্ক টেবিল, আর্ট-ওয়ার্ক, হস্ত শিল্প, আর অবিশ্বাস্যরকমের ব্যাপার হলো, বিপুল সংখ্যক ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি–কম্পিউটার, প্রজেক্টোর, মাইক্রোস্কোপ, কপি-মেশিন এবং বিশাল একটা স্ক্যানার।

 

আমি বল রুমটাকে বদলে নিয়েছি, টিবিং বললেন, তাঁকে দেখে মনে হলো মজা করছে। নাচার জন্য আমার হাতে খুব কম সময়ই থাকে।

 

সোফির মনে হলো, রাতটা যেনো এক ধরনের গোধূলির মতো, যেখানে তার প্রত্যাশার কিছুই ঘটছে না। এ সবই আপনার কাজের জন্য?

 

সত্য জানাটা আমার জীবনের প্রেম হয়ে গেছে, টিবিং বললেন। আর স্যাংগৃল হলো আমার প্রিয় রক্ষিতা।

 

হলি গ্রেইল হলো একজন নারী, সোফি ভাবলো, তার মাথায় এসব কিছুই ঢুকছিলো না। আপনি বলছেন, আপনার কাছে এই নারীর ছবিটা আছে যাকে আপনি দাবি করছেন হলি গ্রেইল হিসেবে।

 

হ্যাঁ, কিন্তু তিনি যে হলি গ্রেইল, সেটা আমার দাবি নয়। খৃস্ট নিজে সেটা দাবি করেছেন।

 

কোন ছবিটা? সোফি জিজ্ঞেস করলো, দেয়ালগুলো ভালো করে দেখে নিলো।

 

উম-ম-ম… টিবিংকে দেখে মনে হলো, তিনি সেটা ভুলে গিয়েছিলেন। হলি গ্রেইল। স্যাংগৃল। চ্যালিস। তিনি আচমকা ঘুরে দূরের একটা দেয়ালের দিকে ইঙ্গিত করলেন। সেখানে আট ফুট দীর্ঘ দ্য লাস্ট সাপার-এর একটা প্রিন্ট টাঙানো রয়েছে। ঠিক এই ছবিটাই, একটু আগে সোফি দেখেছে। এইতো সে!

 

সোফি নিশ্চিত, সে কিছু একটা ধরতে পারছে না। এই ছবিটাই তো আপনি আমাকে একটু আগে দেখিয়েছেন।

 

তিনি মুচকি হাসলেন। আমি জানি, কিন্তু বড়টা আরো বেশি মজার এবং কৌতূহলোদ্দীপক। আপনার কি মনে হয় না?

 

সোফি সাহায্যের জন্য ল্যাংডনের দিকে ঘুরলো। আমি ধরতে পারছি না।

 

ল্যাংডন হাসলো। হলি গ্রেইলটা দ্য লাস্ট সাপার-এর মধ্যেই আবির্ভূত হয়েছে। লিওনার্দো তাকে খুব ভালোভাবেই অন্তর্ভূক্ত করেছেন।

 

দাঁড়াও, সোফি বললো। তুমি বলছো হলি গ্রেইল হলো একজন নারী। দ্য লাস্ট সাপার হলো তেরো জন পুরুষের একটা ছবি।

 

তাই কি? টিবিং তার ভূরু কপালে তুললেন। একটু ভালো করে দেখুন তো।

 

একটু ইতস্তত করে সোফি ছবিটার কাছে গেলো, তেরোটি অবয়ব ভালো করে দেখে নিলো যিশু খৃস্ট মাঝখানে, ছয় জন শিষ্য তাঁর বাম দিকে, আর বাকি ছয় জন ডান দিকে। তারা সবাই পুরুষ, সে নিশ্চিত হয়ে বললো।

 

ওহ্? টিবিং বললেন। প্রভুর ডান দিকের সম্মানের জাগাটাতে, যিনি বসে আছেন, তার ব্যাপারে?

 

সোফি যিশুর ডান দিকে বসা চরিত্রটা ভালে করে পরীক্ষা করে দেখলো। খুতিয়ে খুতিয়ে দেখতে লাগলো সে। চরিত্রটার মুখ আর শরীর ভালো করে দেখতেই বিস্ময় জেগে উঠলো তার মধ্যে। চরিত্রটার চুল লাল, খুবই সরু ভাঁজ করা দুটো হাত। আর বুকের কাছে স্তনের আভা। এটা, নিঃসন্দেহে…একজন নারী।

 

এটাতো একজন নারী! সোফি বিস্ময়ে বলে উঠলো।

 

টিবিং হাসতে লাগলেন, খুব অবাক হয়েছেন, তাই না। বিশ্বাস করুন, এটা ভুল করে হয়নি। লিওনার্দো নারী-পুরুষ আঁকার বেলায় খুবই দক্ষ ছিলেন, গুলিয়ে ফেলার প্রশ্নই আসে না।–

 

সোফি যির পাশে বসা রমণীর দিক থেকে চোখ ফেরাতেই পারছিলো না। দ্য লাস্ট সাপার তো তেরো জন পুরুষের ছবি হবার কথা। এই মেয়েটা তবে কে? যদিও সোফি এই ক্লাসিক ছবিটা বহুবার দেখেছে, কিন্তু এই জিনিসটা একদমই খেয়াল করেনি।

 

সবাই মিস্ করে, টিবিং বললেন। আমাদের পূর্বচিন্তা এই ছবিটার বেলায় এতো শক্তিশালী যে, ছবিটা দেখার সময় আমাদের চোখের উপর সেটা সেঁটে থাকে।

 

এটা Scotona হিসেবে পরিচিত, ল্যাংডন পাশ থেকে বললো। খুব শক্তিশালী প্রতীকের বেলায় মস্তিষ্ক এরকমটি করে থাকে।

 

এই মেয়েটাকে ধরতে না পারার আরেকটা কারণ আছে, টিবিং বললেন, সেটা হলো, মূল ছবিটা থেকে বেশির ভাগ ফটোগ্রাফই ১৯৫৪ সালের আগে তোলা। তখন পর্যন্ত ছবিটা অষ্টাদশ শতকের এক শিল্পীর তুলির আঁচরে, কতগুলো পরতে ঢাকা ছিলো। এখন, এই ফ্রেসকোটা পরিষ্কার করে দা ভিঞ্চির সত্যিকারের ছবিটা তুলে আনা হয়েছে। ছবিটার দিকে ঘুরলেন তিনি। এত ভইলা?

 

সোফি ছবিটার আরো কাছে গেলো। যিশুর ডান দিকে বসা নারীটা অল্প-বয়স্কা এবং দেখতে ধার্মিক। নম্র মুখ আর সুন্দর লাল চুল, হাতগুলো সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা এটাই কি সেই নারী, যে একাই চার্চকে নাড়িয়ে দিতে পারে?

 

কে সে? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

এটা হলো, মাইডিয়ার, টিবিং জবাব দিলেন, ম্যারি মাগদালিন।

 

সোফি চমকে উঠলো। বারবণিতা?

 

টিবিং ছোট্ট করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন, যেনো কথাটাতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আহত বোধ করলেন। মাগদালিন সেরকম কিছু ছিলেন না। এই দুঃখজনক ভুল ধারণাটি শুরুর দিকে চার্চই ছড়িয়েছে। চার্চের দরকার ছিলো ম্যারি মাগদালিনকে ভ্রষ্টা হিসেবে হেয়প্রতিপন্ন করার, যাতে ঢাকা পড়ে যায় তার বিপজ্জনক সিক্রেটটা হলি গ্রেইল হিসেবে তার ভূমিকা।

 

তাঁর ভূমিকা?

 

যেমনটি আমি বলেছি, টিবিং পরিষ্কার করে বললেন, শুরুর দিকে চার্চের দরকার ছিলো বিশ্ববাসীকে এটা জানানো যে, পয়গম্বর যিশু আসলে স্বর্গীয় স্বত্তা। তাই, যেসব গসপেলে যিশুকে মর্ত্যের মানুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিলো, সেগুলো বাইবেল থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু প্রথম দিককার পরিমার্জনাকারীদের জন্য যেটা দুর্ভাগ্য, তাহলো, একটা পার্থিব বিষয়ের গসপেল বাইবেলে রয়ে গিয়েছিলো। ম্যারি মাগদালিন। বিরতি দিলেন তিনি। আরো ভালো করে বলতে গেলে বলতে হয়, যিশুর সাথে তার বিয়ে।

 

ক্ষমা করবেন, কী বললেন? সোফি ল্যাংডনের দিকে চেয়ে আবার টিবিংয়ের দিকে ফিরলো।

 

এটা ঐতিহাসিক রের্কডের ব্যাপার, টিবিং বললেন, আর দা ভিঞ্চি এ ব্যাপারে পুরোপুরি জ্ঞাত ছিলেন। দ্য লাস্ট সাপার-এ, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, চিৎকার করে জানান দিচ্ছে যে, যিশু আর মাগদালিন ছিলেন স্বামী-স্ত্রী।

 

সোফি আবারো ফ্রেসকোটার দিকে তাকালো।

 

খেয়াল করে দেখুন, যিশু যে পোশাকটা পড়েছেন, তার মিরর ইমেজের পোশাক পড়েছেন মাগদালিন। টিবিং ছবিটার মাঝখানে বসা দুজনের দিকে ইঙ্গিত করলেন।

 

সোফি হতবিহ্বল হয়ে গেলো। এটা নিশ্চিত যে, তাদের দুজনের পোশাকের রঙই উল্টো করে সাজানো আছে। যিশু পড়ে আছেন লাল রঙের রোব এবং নীল রঙের ক্লোক, ম্যারি পড়েছেন নীল রঙের রোব, এবং লাল ক্লোক। ইন এবং ইয়াং।

 

আরো অদ্ভুত কিছুতে প্রবেশ করা যাক, টিবিং বললেন, খেয়াল করুন, যিশু এবং তাঁর বধুকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো ঊরুর দিক থেকে ঘেষে আছেন তাঁরা, আর একে অন্যের দিকে এমনভাবে হেলে আছেন, যেনো তাদের মধ্যেকার নেগেটিভ স্পেসটা একটা নক্সা তৈরী করে ফেলেছে।

 

টিবিং সোফিকে সেটা দেখাবার আগেই, সোফি নিজেই ওটা দেখতে পেলো— তর্কাতীতভাবেই, ছবিটার মাঝখানে এই V আকৃতিটা আছে। ল্যাংডন একটু আগেই বলেছিলো, এটা হলো, নারীর যোনীর প্রতীক।

 

অবশেষে  টিবিং বললেন, আপনি যদি যিশু আর মাগদালিনকে মানুষ হিসেবে দেখে, কম্পােজিশনাল এলিমেন্ট হিসেবে দেখেন, তাহলে দেখতে পাবেন আরেকটা আকৃতি। একটু থামলেন তিনি। ইংরেজি বর্ণমালার একটা অক্ষর।

 

সোফি সঙ্গে সঙ্গেই সেটা দেখতে পেলো। অক্ষরটার পুরোটা হঠাৎ করেই সে দেখতে পেলো। ছবিটার মাঝখানে, প্রশ্নাতীতভাবেই একটা বড়সড় M অক্ষর দেখা যাচ্ছে।

 

কাকতালীয় বললে খুব বেশিই বলা হবে, অক্ষরটা খুবই নিখুঁত, আপনি কি বলেন? টিবিং বললেন।

 

সোফি খুবই রোমাঞ্চিত হলো। এটা এখানে কেন?

 

টিবিং কাঁধ ঝাঁকালেন। ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকের দল বলবে, এটা দিয়ে বোঝানো হয়েছে Matrimonio বা বিবাহ, অথবা ম্যারি মাগদালিন। সত্যি বলতে কী, কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না। নিশ্চিত করে যা বলা যায়, তাহলো, লুকানো M-টা ভুল করে দেয়া হয়নি। গ্রেইল সম্পর্কিত অসংখ্য কাজে লুক্কায়িত M রয়েছে হয় জলছাপে, ছবির নিচে, কিংবা কম্পােজিশনাল প্রহেলিকার মাধ্যমে। সবচাইতে আলোচিত M টা লন্ডনের Our Lady of Paris-এর বেদীতে চিত্রিত করা আছে, যা প্রায়োরিদের এক সাবেক গ্র্যান্ড মাস্টার জ কতো ডিজাইন করেছিলেন।

 

সোফি তথ্যটা জানতো। আমি মানছি, লুক্কায়িত M হলো কৌতূহলদীপক, তারপরও বলা যায়, কেউ এমন দাবি করছে না যে, সেটা যিশু এবং মাগদালিনের বিয়ের প্রমাণ।

 

না, না, টিবিং বললেন, পাশের একটা টেবিলে রাখা বইয়ের দিকে গেলেন। আমি আগেই বলেছি, যিশু এবং মাগদালিনের বিয়ের ব্যাপারটা ঐতিহাসিক রেকর্ডের অংশ। তিনি বইটা ওল্টাতে লাগলেন। তারচেয়েও বড় কথা, বাইবেলের বর্ণিত অবিবাহিত যিশুর চেয়ে, বিবাহিত যিশুই আমাদের কাছে বেশি মানানসই বলে মনে হয়।

 

কারণ, যিশু একজন ইহুদি ছিলেন, টিবিং যখন বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন সেই ফাঁকে কথাটা ল্যাংডন বললো। সেই সময়কার সামাজিক প্রেক্ষাপটে, একজন ইহুদি পুরুষের পক্ষে অবিবাহিত থাকাটা প্রায় অসম্ভব ছিলো। ইহুদি রীতি মতে, কুমার থাকাটা নিন্দনীয়। একজন ইহুদি বাবার জন্য নিজের ছেলের উপযুক্ত একজন স্ত্রী খুঁজে দেয়াটা বাধ্যতামূলক ছিলো। যদি যিশু অবিবাহিত থাকতেন, তবে কমপক্ষে একটি গসপেলেও সেটার উল্লেখ থাকতো।

 

টিবিং বড়সড় একটা বই খুঁজে পেয়ে সেটা তুলে আনলেন তাদের সামনের টেবিলে। চামড়ায় বাঁধানো বইটার মলাটে লেখা আছে : The Gnostic Gospels. টিবিং সেটা খুললেন। ল্যাংডন আর সোফি তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালো। সোফি দেখে বুঝতে পারলো, পৃষ্ঠাগুলো কোন প্রাচীন পুঁখির বড় করে তোলা ছবিতে পূর্ণ লেখাগুলো হাতের লেখা। প্রাচীন ভাষাটা সে চিনতে পারলো না, কিন্তু পরের পৃষ্ঠায় সেগুলোর টাইপ করা অংশ ছাপা আছে। সেগুলো অনুবাদ করা।

 

এগুলো নাগ হাম্মাদি এবং ডেড সি স্কুলের ফটোকপি, যা আমি আগেই উল্লেখ করেছিলাম। টিবিং বললেন। খৃস্টধর্মের প্রাথমিক সময়ের রেকর্ড। সমস্যার কথা হলো, এগুলো বাইবেলের গসপেলের সাথে মেলে না।

 

টিবিং একটা প্যারার দিকে ইঙ্গিত করলেন। ফিলিপ-এর গসপেলটাই শুরুর জন্য সবসময় ভালো।

 

সোফি সেটা পড়লো :

 

আর ত্রাণকর্তার সঙ্গীনী হলেন ম্যারি মাগদালিন। খৃস্ট তাঁকে বাকি সব শিষ্যদের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন এবং প্রায়ই তার ঠোঁটে চুমু খান। বাকি শিষ্যরা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেদের আপত্তির কথা জানালো। তারা তাকে বললো, আপনি কেন তাকে আমাদের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন?

 

কথাগুলো সোফিকে দারুণ অবাক করলো। তারপরও, সেগুলো থেকে কোন উপসংহার টানা যায় না। এখানে বিয়ের কোন কথা বলা হয়নি।

 

অউ কনত্রেয়ার। টিবিং হাসলেন। প্রথম লাইনটার দিকে ইঙ্গিত করলেন। যেকোন আরামাই পণ্ডিতই আপনাকে বলে দেবে যে, সেসব দিনে সঙ্গীনী শব্দটি আক্ষরিক অর্থে স্ত্রী হিসেবেই ব্যবহৃত হোত।

 

সোফি আবারো প্রথম লাইনটা পড়লো। আর ত্রানকর্তার সঙ্গীনী হলো ম্যারি মাগদালিন।

 

টিবিং আরো অনেক প্যারা সোফিকে দেখালেন, যাতে এই কথাটার সত্যতা পাওয়া যায়। এসব প্যারাগুলো পড়তে পড়তে সোফির মনে পড়ে গেলো সেই ক্ষেপে যাওয়া যাজকের ঘটনাটির কথা, যে তার দাদুর দরজায় জোরে জোরে আঘাত করেছিলো, সোফি তখন স্কুলে যায়।

 

এটা কি জ্যাক সনিয়ের বাড়ি? ছোট্ট সোফি যখন দরজাটা খুলেছিলো, যাজক লোকটা তখন নিচু হয়ে তার দিকে তাকিয়ে জানতে চেয়েছিলো। আমি তার সাথে এই সম্পাদকীয়টা নিয়ে কথা বলতে চাই, এটা উনি লিখেছেন। যাজক লোকটার হাতে একটা সংবাদ পত্র ছিলো।

 

সোফি তার দাদুকে ডেকে দিলে, দুজনে স্টাডিরুমে দরজা বন্ধ করে আলাপে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। আমার দাদ পত্রিকায় কিছু লিখেছে? সোফি সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরে দৌড়ে গিয়ে, সকালের পত্রিকাটা হাতে তুলে নিয়ে দেখেছিলো। দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় সে তার দাদুর নাম লেখা একটা প্রবন্ধ দেখতে পেলো। সে ওটা পড়লো। কিছুই বুঝতে পারলো না, কী লেখা আছে। কিন্তু এটুকু বুঝলো যে, ফরাসি সরকারকে পাদ্রীরা চাপ দিচ্ছে একটা আমেরিকান ছবি দ্য লাস্ট টেম্পটেশন অব ক্রাইস্ট-কে নিষিদ্ধ করার জন্য। যাতে দেখানো হয়েছে, যিশু ম্যারি মাগদালিন নামের এক রমনীর সাথে সঙ্গম করছেন। তার দাদুর প্রবন্ধে বলা আছে যে, চার্চ খুব বেশি উগ্র আচরণ করছে আর তারা নিষিদ্ধ করার ব্যাপারেও ভুল করছে।

 

এতে কোন ভুল নেই যে, যাজক লোকটি ছিলো পাগল। সোফি ভেবেছিলো।

 

এটা পর্নোগ্রাফি! জঘন্য! যাজক লোকটি চিৎকার করে বলেছিলো। স্টাডি রুম থেকে হনহন করে বের হয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলেছিলো, আপনি এটা কীভাবে বললেন! এই মার্টিন স্করসিজ আমেরিকানটা একজন ব্লাসফেমার। চার্চ তাকে কখনও ফ্রান্সে ঢুকতে দেবে না। যাজক ধপাস করে দরজা খুলে বের হয়ে গিয়েছিলো।

 

তার দাদু বাইরে এসে দেখে সোফির হাতে পত্রিকাটা ধরা। খুব জলদি করে ফেলেছে।

 

সোফি জিজ্ঞেস করেছিলো, তুমি কি মনে করো, যিশুর বান্ধবী ছিলো?

 

না, ডিয়ার, আমি বলেছি, আমরা কোন্ বিনোদনটা গ্রহণ করবো, আর কোটা করবো না, সেটা চার্চের ঠিক করে দেয়াটা উচিত হবে না।

 

যিশুর কি বান্ধবী ছিলো?

 

তার দাদু কয়েক মুহূর্ত নিরব ছিলেন। থাকলে কি তিনি খারাপ হয়ে যাবেন?

 

সোফি একটু ভেবে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিলো, আমি অবশ্য এতে কিছু মনে করবো না।

 

 

 

স্যার লেই তখনও কথা বলে যাচ্ছিলেন। যিশু আর মাগদালিনের বিয়ে সংক্রান্ত অসংখ্য রেফারেন্স দেখিয়ে আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না। এগুলো আধুনিক ইতিহাসের অংশ। আমি বরং আরেকটা প্যারা আপনাকে দেখাতে পারি। অন্য আরেকটা প্যারার দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। এটা ম্যারি মাগদালিনের গসপেল থেকে নেয়া।

 

সোফি জানতো না, মাগদালিনের নামেও একটা গসপেল রয়েছে। সে গসপেলটা পড়লো :

 

আর পিটার বললো, ত্রাণকর্তা কি আমাদের অগোচরে কোন রমনীর সাথে কথা বলেছেন? আমরা কি তার দিকে ঘুরবো, তার সব কথা শুনবো? তিনি কি সেটা পছন্দ করবেন?

আর লেভি জবাব দিলো, পিটার, তুমি সব সময়ই রগচটা। এখন আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি একজন নারীর বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমেছে। যদি ত্রাণকর্তা তাকে গ্রাহ্য করে, তবে তুমি কে, তাকে প্রত্যাখান করছো? নিশ্চিতভাবেই ত্রাণকর্তা তাকে ভালো করেই চেনেন। এজন্যেই, তিনি তাকে আমাদের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন।

 

যে নারী সম্পর্কে তারা কথা বলছে, টিবিং বুঝিয়ে বললেন, তিনি হলেন ম্যারি মাগদালিন। পিটার তাকে ঈর্ষা করতো।

 

কারণ, যিশু ম্যারিকে পছন্দ করতেন?

 

শুধু তাই না। তারচেয়েও বেশি কিছু। গসপেলের এই জায়গাটাতে, যিশু আশংকা করেছিলেন, খুব শীঘ্রই তাকে ধরে ক্রুশবিদ্ধ করা হবে। তাই যিশু মাগদালিনকে তাঁর চলে যাবার পর, তাঁর চার্চ কীভাবে চলবে, সে ব্যাপারে কিছু নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। এর ফলে, পিটার নিজেকে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে অবমূল্যায়িত হয়েছেন বলে মনে করেছিলেন, তাও আবার একজন নারীর কাছে। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, পিটার কিছুটা নারীবিদ্বেষী ছিলেন।

 

সোফি বললো, এটা হলো সেন্ট পিটার। যিশুর চাচ নির্মাণ করেছিলেন যিনি।

 

সবই ঠিক আছে, কেবল একটা বাদে। এইসব দলিল মতে, যিশু পিটারকে নয় বরং ম্যারি মাগদালিনকেই প্রথম বৃস্টিয় চার্চ নির্মানের জন্য দিক নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন।

 

সোফি তার দিকে তাকালো। তুমি বলছো, খৃস্টিয় চার্চ একজন নারী কর্তৃক নির্মিত হয়েছে?

 

এটাই ছিলো পরিকল্পনা। যিশু ছিলেন প্রথম নারীবাদী। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর চার্চের ভবিষ্যৎ ম্যারি মাগদালিনের হাতে ন্যস্ত হোক।

 

আর এতে পিটার অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, ল্যাংডন বললো, দ্য লাস্ট সাপারের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। এইতো পিটার, এখানে। তুমি দেখতেই পাচ্ছো, দা ভিঞ্চি এ ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন যে, পিটার মাগদালিনের ব্যাপারে কী মনোভাব পোষণ করতেন।

 

আবারো সোফি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। ছবিতে, পিটার ম্যারি মাগদালিনের দিকে ঝুঁকে আছে, আর তাঁর ছুরির মতো ধারালো আঙ্গুল ম্যারির ঘাড়ের দিকে তেড়ে আছে। একই ভঙ্গী ছিলো ম্যাডোনা অব দি রসে-ও!

 

আর এখানেও আছে, ল্যাংডন বললো, পিটারের কাছে, শিষ্যদের ভীড়ের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। এই হাতটা কি একটা চাকু ধরে আছে না?

 

হ্যাঁ। অচেনা কেউ, তুমি যদি হাতগুলো গুণে দেখো, তবে দেখতে পাবে সেটা …কারোরই না। এটা অদৃশ্য কারোর। ছদ্মবেশী একজনের।

 

সোফিকে দেখে মনে হলো বেশ উত্তেজিত। আমি দুঃখিত, আমি এখনও বুঝতে পারছি না, এসব দিয়ে কীভাবে বোঝা যায় যে, মারি মাগদালিন হলেন হলি গ্রেইল।

 

আহা! টিবিং আবারো আতিশয্যে বললেন। এখানেই তো মজাটা লুকিয়ে আছে! আরেকটা বিশাল তালিকা বের করলেন তিনি। সেটা টেবিলের উপর ছড়িয়ে দিলেন। একটা বিশাল বংশ তালিকা। খুব কম লোকই বুঝতে পারে যে, ম্যারি মাগদালিন সেই সময়ে খুবই শক্তিশালী ছিলেন।

 

সোফি এখন পরিবারের তালিকাটা দেখতে পেলো।

 

বেনজামিনের গোত্র

 

ম্যারি মাগদালিন হলেন এখানে, টিবিং বললেন। বংশ তালিকার উপরের দিকে নির্দেশ করলেন তিনি।

 

সোফি খুব বিস্মিত হলো। তিনি বেনজামিনের বংশের ছিলেন?

 

অবশ্যই, টিবিং বললেন। ম্যারি মাগদালিন ছিলেন রাজ বংশোদ্ভুত।

 

কিন্তু, আমি জানতাম, মাগদালিন ছিলেন খুবই গরীব।

 

টিবিং মাথা ঝাঁকালেন। মাগদালিনকে বেশ্যা হিসেবে প্রচার করা হয়েছিলো, যাতে তার শক্তিশালী পরিবারের ব্যাপারটা মুছে ফেলা যায়।

 

ল্যাংডনও কথাটার সাথে সায় দিলো।

 

সে টিবিংয়ের দিকে ফিরে বললো, কিন্তু মাগদালিন যদি রাজ বংশেরই হয়ে থাকে, তবে চার্চ কেন তাকে এতো পরোয়া করলো?

 

ব্রাইটনটা হাসলেন। মাইডিয়ার, চার্চ ম্যারি মাগদালিনের রাজকীয় বংশ নিয়ে মাথা ঘামায়নি, তারা মাথা ঘামিয়েছিলো যিশুর সাথে তার সম্পর্কটা নিয়ে, যিশুও রাজ বংশের ছিলেন। আপনি হয়তো জানেন, বুক অব ম্যাথিউ বলছে, যিশু ছিলেন ডেভিডের বংশধর। মানে ইহুদিদে রাজা সোলেমানের বংশোদ্ভুত। বেনজামিনের বংশের কাউকে বিয়ে করার মধ্য দিয়ে যিশু দুটো রাজ বংশের রক্তের অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন। এতে করে সম্ভাব্য রাজনৈতিক ঐক্য সাধিত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয় আর সোলেমানের সময়ের মতো, আবারো একই বংশের লোক হিসেবে সিংহাসনের বৈধ দাবি দার হয়ে ওঠেন তিনি।

 

সোফি বুঝতে পারলো, অবশেষে তিনি আসল জায়গায় এসেছেন।

 

টিবিংকে আরো বেশি উত্তেজিত দেখাচ্ছে। হলি গ্রেইলের কিংবদন্তীটা আসলে রাজ বংশের রক্তধারার কিংবদন্তী। যখন গ্রেইল কিংবদন্তী বলে যিশুর রক্তের পেয়ালা বা চ্যালিস…তার মানে, সেটা ম্যারি মাগদালিন—যে নারীর যোনী যিশুর বংশকে ধারণ করেছে।

 

কথাটা সোফির কাছে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো। মারি মাগদালিন যিশুর বংশধারাকে বহন করেছেন? কিন্তু যিশু কীভাবে বংশধর রেখে যাবেন, যদি না…? সে একটু থেমে ল্যাংডনের দিকে তাকালো।

 

ল্যাংডন আততা করে হাসলো। যদি না তাদের কোন বাচ্চা-কাচ্চা না থাকে।

 

সোফি উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলো।

 

টিবিং যেনো ঘোষণা দিলেন, মানবেতিহাসের সবচাইতে বড় সিক্রেট। যিশু কেবল বিয়ে থা-ই করেননি, বরং তিনি একজন বাবাও ছিলেন। মাইডিয়ার, ম্যারি মাগদালিন ছিলেন একজন পবিত্র আধার!

 

সোফির মনে হলো, তার হাতের পশমগুলো খাড়া হয়ে গেছে। কিন্তু, এরকম একটা সিক্রেট কি করে এতোদিন পর্যন্ত চেপে থাকলো?

 

হায় ঈশ্বর! টিবিং বললেন। এটা মোটেও চেপে রাখা ছিলো না! যিশুর বংশ তালিকাই হলো সর্বকালের সেরা কিংবদন্তীর উৎস হলি গ্রেইল। মাগদালিনের গল্পটা শত শত বছর ধরে উচ্চারিত হয়েছে, বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন কৌশলে। আপনি চোখ খুললেই দেখতে পাবেন, তাঁর গল্পটা চারিদিকেই আছে।

 

আর স্যাংগৃল দলিল-দস্তাবেজগুলো? সোফি বললো। তারাও কি এই প্রমাণ দিচ্ছে যে, যিশুর বংশধর আছে?

 

তারাও বলছে।

 

তো, হলি গ্রেইলের পুরো কিংবদন্তীটা আসলে রাজবংশ সংক্রান্ত?

 

আক্ষরিক অর্থে তাই। টিবিং বললেন। Sangreal শব্দটা এসেছে San Greal থেকে অথবা হলি গ্রেইল থেকে, কিন্তু সুপ্রাচীনকালে Sangreal শব্দটা দুটো ভাগে বিভক্ত ছিলো। টিবিং একটা কাগজে লিখে সেটা সোফির কাছে দিলেন।

 

সোফি লেখাটা পড়লো।

 

Sang Real

 

সঙ্গে সঙ্গে, সোফি এটার অর্থটা ধরতে পারলো। Sang Real-এর আক্ষরিক অর্থ হলো Royal Blood, মানে, রাজকীয় রক্ত।

 

 

 

৫৯.

 

নিউইয়র্কের লেক্সিংটনে অবস্থিত ওপাস দাইর সদর দফতরের লবিতে বসে থাকা পুরুষ রিসেপশনিস্ট, ফোনে বিশপ অরিঙ্গারোসার কণ্ঠটা শুনে অবাকই হলো। শুভ সন্ধ্যা, স্যার।

 

আমার জন্য কোন ম্যাসেজ আছে? বিশপ জানতে চাইলেন, তার কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা, যা সচরাচর দেখা যায় না।

 

হ্যাঁ, স্যার। আপনি ফোন করাতে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি আপনার এপার্টমেন্টে যেতে পারিনি। আধ-ঘণ্টা আগে আপনার জন্যে একটা জরুরি ফোন ম্যাসেজ এসেছে।

 

হ্যাঁ? কথাটা শুনে খুব স্বস্তি পেলেন বলে মনে হলো। কলার কি তার নাম বলেছে?

 

না, স্যার, শুধু একটা নাম্বার দিয়েছে। অপারেটর নাম্বারটা বলে দিলো।

 

প্রিফিক্স তেত্রিশ? এটাতো ফ্রান্সের, ঠিক বলছি না?

 

হ্যাঁ, স্যার। প্যারিসের। কলার বলেছে, আপনাকে খুব দ্রুত যোগাযোগ করতে।

 

ধন্যবাদ। আমি এই কলটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আরিঙ্গাবোসা চট করে ফোনটা রেখে দিলেন।

 

রিসেপশনিস্ট ফোনটা নামিয়ে রাখতেই ভাবলো, আরিঙ্গারোসার ফোন থেকে ঘর ঘর শব্দ আসছিলো কেন। বিশপের ডেইলি শিডিউল বলছে, তিনি এই সপ্তাহান্তে নিউ ইয়র্কেই আছেন, তারপরও শব্দ শুনে মনে হচ্ছিলো, বহু দূরে কোথাও আছেন। গত কয়েক মাস ধরে বিশপ আরিজারোসা খুবই অদ্ভুত আচরণ করছেন।

 

 

 

আমার সেলুলার ফোনটা হয়তো কোন কল রিসিভ করছিলো না, রোমের সিয়ামপিনো চার্টার বিমানবন্দর থেকে ফিয়াটটা নিয়ে বের হতেই তিনি ভাবলেন। টিচার হয়তো আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন। প্রত্যাশিত ফোন কলটা মিস্ করা সত্ত্বেও, আরিঙ্গারোসা খুবই উষ্ণু বোধ করলেন এই ভেবে যে, টিচার ওপাস দাইর সদর দফতরে সরাসরি ফোন করার মতো আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।

 

প্যারিসে হয়তো আজ রাতের সবকিছু খুব ভালো মতোই এগোচ্ছে। আরিঙ্গারোসা ফোন নাম্বারটা ডায়াল করতে করতে খুবই উত্তেজিত বোধ করলেন, হয়তো তিনি খুব শীঘ্রই প্যারিসে যাবেন। ভোর হবার আগেই সেখানে পৌঁছে যাবো। আরিজারোসার জন্য একটা চার্টার প্লেন অপেক্ষা করছে, ফ্রান্সে যাবার জন্য।

 

ফোনটার রিং হতে লাগলো।

 

একটা নারী কণ্ঠ জবাব দিলো, ডিরেকশন সেন্ট্রাল পুলিশ জুডিশিয়ার।

 

আরিঙ্গাবোসা ইতস্তত করলেন। এটা খুবই অপ্রত্যাশিত। আহ্, হ্যাঁ,..আমাকে এই নাম্বারে ফোন করতে বলা হয়েছে?

 

কুই এতৃ-ভু? মেয়েটা বললো। আপনার নাম?

 

আরিঙ্গারো নাম বলতে ইতস্তত করলেন। ফরাসি জুডিশিয়ার পুলিশ।

 

আপনার নাম, সিয়ে? মেয়েটা আবারো বললো।

 

বিশপ ম্যানুয়েল আরিঙ্গাবোসা।

 

উঁ মোমেস্ত। লাইনে একটা ক্লিক করে আওয়াজ হলো। দীর্ঘবিরতির পরে, আরেকজন লোকের গলা শোনা গেলো। তার কণ্ঠে বিচলিতভাব। বিশপ, শেষ পর্যন্ত আপনাকে পেয়ে আমি খুব খুশি। আপনার সাথে আমার অনেক কথা বলার আছে।

 

 

 

৬০.

 

স্যাংগৃল…স্যাংগ রিয়েল…স্যান গৃল…রাজ বংশের রক্ত…হলি গ্রেইল।

 

সবগুলোই, একটার সাথে আরেকটা সম্পর্কিত।

 

হলি গ্রেইল হলো ম্যারি মাগদালিন … যিশুখৃস্টের সন্তানের মা। ল্যাংডন আর টিবিং যতোই টুকরো টুকরো প্রমাণগুলো জোড়া লাগাচ্ছে, ততোই এই পাজলটা বড় বেশি অননুমেয় হয়ে উঠছে।

 

দেখতেই পাচ্ছেন, মাই ডিয়ার, টিবিং বললেন। একটা বইয়ের শেলফের দিকে ছুটে গেলেন তিনি। হলি গ্রেইল সম্পর্কে সত্যি কথাটা কেবল লিওনার্দো একাই বলার চেষ্টা করেননি। ঐতিহাসিকদের অনেকেই যিশুর বংশধরদের কথা উল্লেখ করে গেছেন। তিনি কয়েক ডজন বইয়ের ওপর আঙ্গুল বুলালেন।

 

সোফি তার মাথাটা একটু উঁচু করে নামগুলো দেখলো :

 

দ্য টেম্পলার রিভিলেশন :

খৃস্টের সত্যিকারের পরিচয়ের শুপ্ত অভিভাবকগণ

 

দ্য উইমেন উইথ দ্য এলাবাস্টার জার :

ম্যারি মাগদালিন এবং হলি গ্রেইল

 

গসপেলের দেবীরা :

পবিত্র নারীর পুণঃদাবি

 

সম্ভবত এটা সবচাইতে বেশি পরিচিত বই, টিবিং বললেন। শেফ থেকে একটা মোটা বই বের করে সোফির হাতে দিলেন।

 

মলাটে লেখা আছে :

 

হলি রাড, হলি গ্রেইল :

আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার হিসেবে স্বীকৃত

 

সোফি খুব অবাক হলো, একটা আন্তর্জাতিক বেস্টসেলার? আমি এটার সম্পর্কে কখনও কিছু শুনিনি তো।

 

আপনি তখন খুব ছোট ছিলেন। এটা উনিশশ আশির দিকে। আমার মতে, লেখকদের কিছু সন্দেহজনক বিশ্লেষণ থাকা সত্ত্বেও, অবশেষে তারা যিশুর বংশধরদের ব্যাপারটাকে মূলধারায় নিয়ে আসতে পেরেছে, এটাই তাদের কৃতিত্ব।

 

এই বইটা সম্পর্কে চার্চের প্রতিক্রিয়া কি ছিলো?

 

বলাই বাহুল্য, প্রচণ্ড ক্ষোভের। সেটা অবশ্য, প্রত্যাশিতই ছিলো। হাজার হোক, এটা এমন একটা সিক্রেট যা চতুর্থ শতকেই ভ্যাটিকান মাটি চাপা দিয়েছিলো। সেটা ক্রুসেডেরও একটা কারণ ছিলো। জড়ো করে তথ্য প্রমাণ ধ্বংস করা। প্রথম দিককার চার্চের পুরুষদের জন্য ম্যারি মাগদালিন ছিলেন বিশাল একটা হুমকি। তিনি যে কেবল যিশু কর্তৃক চার্চ প্রতিষ্ঠা করার আদেশই পেয়েছিলেন তাই নয়,বরং যিশু খৃস্টকে চার্চ যে অপার্থিব বলে দাবি করেছিলো সেটার বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন মূর্তিমান এক প্রমাণ। চার্চ নিজেকে রক্ষার জন্য রটিয়ে দেয় যে, মাগদালিন ছিলেন একজন বেশ্যা, আর এতে করে যিশুর সাথে তার বিয়ের ব্যাপারটা চার্চ ধামাচাপা দিতে পেরেছিলো। এজন্যেই যিশুর বংশধর থাকার সত্যটাকে চার্চ বিরোধীতা করে আসছে।

 

সোফি ল্যাংডনের দিকে তাকালে সেও কথাটার সাথে সায় দিলো। সোফি, ঐতিহাসিক প্রমাণাদি এটার সত্যতা সম্পর্কেই সাক্ষ্য দেয়।

 

আমি মানছি, টিবিং বললেন, ব্যাপারটা খুবই কঠিন, কিন্তু আপনি বুঝতেই পারছেন, সত্যটা ধামাচাপা দেবার ব্যাপারে চার্চের প্রচারণা কতোটা শক্তিশালী ছিলো। জনগণ যদি বংশধরদের ব্যাপারটা জানে, তবে তারা কখনই টিকে থাকতে পারবে না। যিশুর একজন সন্তান, চার্চের যিশু সম্পর্কিত অপার্থিব মানব বা স্বর্গীয়-সত্ত্বার দাবিটাকে বাতিল করে দেবে।

 

পাঁচ পাপড়ির গোলাপ, সোফি বললো। আচমকাই টিবিংয়ের একটা বইয়ের দিকে ইঙ্গিত করলো সে। ঠিক এই নক্সাটাই রোজউড বাক্সে আছে।

 

টিবিং ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলেন। তার চোখ খুব ভালো। সোফির দিকে ফিরলেন এবার, এটা প্রায়োরিদের হলি গ্রেইলের প্রতীক। ম্যারি মাগদালিন। যেহেতু, তার নামটা চার্চ কর্তৃক নিষিদ্ধ ছিলো, তাই ম্যারিকে গোপনে অনেক ছদ্ম নামে ডাকা হোতো চ্যালিস, হলি গ্রেইল, এবং রোজ বা গোলাপ। একটু থামলেন। গোলাপের সাথে ভেনাসের পাঁচ-ভূজের পেনটাকলের মিল রয়েছে। তাছাড়া রোজ শব্দটা ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি এবং আরো অনেক ভাষাতেই সুপরিচিত।

 

রোজ বা গোলাপ, ল্যাংডন বললো। এটা গৃকের যৌন দেবতা Eros-এর একটা এনাগ্রামও বটে।

 

টিবিংয়ের কথাটা শুনে সোফি ল্যাংডনের দিকে অবাক হয়ে তাকালো।

 

গোলাপ সবসময়ই নারী যৌনতার প্রধান প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রাচীন দেবী পূজায়, পাঁচ পাপড়ির গোলাপ নারী-জীবনের পাঁচটি অধ্যায়কে প্রকাশ করতো–জন্ম, মৃত্যু, ঋতুস্রাব, মাতৃত্ব এবং মেনোপোজ। আর আধুনিক যুগে ফুটন্ত গোলাপ নারীত্বের অনেক বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য ব্যাপারটার সাথে সংশ্লিষ্ট। কথাটা বলেই রবার্টের দিকে তাকালেন। সম্ভবত, সিম্বোলজিস্ট সাহেব সেটা ব্যাখ্যা করতে পারবেন?

 

রবার্ট ইতস্তত করলো। নিশ্ৰুপ রইলো।

 

ওহ্, ঈশ্বর! টিবিং কপট নিরাশা প্রকাশ করলেন। আপনারা, আমেরিকানরা খুব বেশি ভদ্র। সোফির দিকে ফিরলেন আবার। রবার্ট যে ব্যাপারটা নিয়ে ইতস্তত করছে, সেটা হলো, ফুটন্ত গোলাপ নারীর যোনর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সেটার মধ্য দিয়েই এই পৃথিবীতে সব মানুষের আবির্ভাব ঘটে। আর আপনি যদি জর্জিয়া ওকিফির কোন চিত্রকর্ম দেখে থাকেন, তবে বুঝতে পারবেন, আমি কী বলতে চাচ্ছি।

 

ব্যাপারটা হলো, ল্যাংডন বইয়ের শেফের দিকে তাকিয়ে বললো, এই সব বই-পুস্তক একটা ঐতিহাসিক দাবি কেই তুলে ধরে।

 

যিশু একজন বাবাও ছিলেন।

 

সোফি এখনও দ্বিধাগ্রস্ত।

 

হ্যাঁ, টিবিং বললেন। আর মাগদালিনই হলেন তার বংশধরদের ধারক। প্রায়োরি অব সাইন, আজকের দিনে, এখনও, ম্যারি মাগদালিনকেই দেবী হিসেবে পূজা করে থাকে।

 

সোফির আবারো বেসমেন্টে দেখা সেই ঘটনাটার কথা মনে পড়ে গেলো।

 

প্রায়োরিদের মতে, টিবিং বলে চললেন। যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার সময় ম্যারি মাগদালিন অন্তঃস্বত্তা ছিলেন। যিশুর অনাগত সন্তানের নিরাপত্তার খাতিরে, পবিত্র ভূমি ছেড়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোন উপায় ছিলো না। যিশুর বিশ্বস্ত চাচা, জোসেফ আরিমাথিয়ার সাহায্যে ম্যারি ফ্রান্সে পালিয়ে আসেন। তখন এ দেশটির নাম ছিলো গল। এখানে এসে তিনি ইহুদি সমাজে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছিলেন। ফ্রান্সেই তিনি এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। তার নাম ছিলো সারাহ্।

 

সোফি বিস্ময়ে চেয়ে রইলো। তারা বাচ্চাটার নামও জানতো?

 

তার চেয়েও বেশি। মাগদালিন এবং সারাহ ইহুদিদের কাছে সুরক্ষিত ছিলো। মনে রাখবেন, মাগদালিনের সন্তান ইহুদিদের রাজা ডেভিড আর সোলেমানেরই বংশধর। সারার অসংখ্য বংশধরের নামের তালিকাও রয়েছে।

 

সোফি আবারো বিস্মিত হলো। যিশুর পরিবারের বংশতালিকার অস্তিত্বও রয়েছে?

 

অবশ্যই, স্যাংগৃল দলিল-দস্তাবেজের একটাতে খৃস্টের বংশধরদের প্রথম দিককার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকার কথা রয়েছে।

 

খৃস্টের বংশধরদের তালিকায় কীই-বা এসে যায়? সোফি জিজ্ঞেস করলো। এটাতো কোন প্রমাণ হতে পারে না। ঐতিহাসিকরা এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারবেন না।

 

টিবিং মুচকি হাসলেন। তাহলে, বাইবেলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও নিশ্চিত হওয়া যায় না।

 

মানে?

 

মানে হলো, ইতিহাস সবসময়ই বিজয়ী কর্তৃক লিখিত হয়ে থাকে। যেমনটি নেপোলিওন বলেছিলেন, ইতিহাস বিজয় গাথা ছাড়া আর কিছুই না। তিনি হাসলেন। ইতিহাসের চরিত্রই এমন যে, সেটা এক পক্ষকেই হিসাবের মধ্যে রাখে।

 

সোফি কখনও এভাবে ভেবে দেখেনি।

 

স্যাংগৃল দলিল-দস্তাবেজগুলো খৃস্টের অন্যদিকের গল্পটাই বলে। আপনি কোন্ দিকটার গল্প বিশ্বাস কবেন, সেটা আপনার বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত অভিরুচির ব্যাপার। স্যাংগৃল দলিলগুলো দশ-হাজার পৃষ্ঠার তথ্য সংবলিত। চাক্ষুষ করেছে যারা, তারা বলেছে, চারটা বড় ট্রাংকে করে সেগুলো বহন করা হয়েছিলো। এইসব ট্রাংককে পিউরিষ্ট ডকুমেন্ট নামে ডাকা হয়। হাজার হাজার পৃষ্ঠার প্রাক কনস্টানটিন যুগের দলিল। যিশুর প্রথম দিককার অনুসারীদের লেখায়, তাকে একজন পরিপূর্ণ মানুষের শিক্ষক এবং পয়গম্বর হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে। আরো গুজব রয়েছে, দলিলগুলোর কিছু অংশ হলো Q দলিল–ভ্যাটিকানও এটার অস্তিত মেনে নিয়েছে। দাবি করা হয়, এটা যিশুর রচিত বই। সম্ভবত, তার নিজের হাতের লেখা।

 

যির নিজের হাতের লেখা?

 

অবশ্যই, টিবিং বললেন। কেন, যিশু তাঁর নিজের সময়ের কথা লিখবেন না? সেই সময়কার দিনে বেশিরভাগ লোকই তা করতো। আরেকটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী দলিল হলো, মাগদালিন ডায়রিজমরি মাগদালিনের ব্যক্তিগত বিষয়, যিশুর সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা, যি ক্রুশবিদ্ধ হওয়া, আর ফ্রান্সে তাঁর সময়ের কথা বিবৃত হয়েছে।

 

সোফি কিছুক্ষণ নিরব রইলো। এই চার সিন্ধুক দলিল নাইট টেম্পলাররা সোলমানের মন্দিরের নিচ থেকে পেয়েছিলো?

 

একদম ঠিক। এই দলিলগুলোই তাদেরকে অসম্ভব শক্তিশালী আর ক্ষমতাবান করেছিলো।

 

কিন্তু আপনি বলেছেন যে, হলি গ্রেইল হলো ম্যারি মাগদালিন। যদি সবাই দলিলগুলো খোঁজ করে থাকে, তবে আপনি কেন সেটাকে হলি গ্রেইলের অন্বেষণ বলেছেন?

 

টিবিং তার চোখের দিকে তাকালেন, তার অভিব্যক্তি একটু নরম বলে মনে হলো। কারণ, হলি গেইলের লুকানো জায়গায় একটা সমাধি-ফলকও রয়েছে।

 

বাইরে প্রচণ্ড বাতাসের শব্দ শোনা গেলো।

 

টিবিংকে এখন আরো বেশি শান্ত মনে হচ্ছে। হলি গ্রেইলের অনুসন্ধান মানে, আক্ষরিক অর্থে, ম্যারি মাগদালিনের হাড়-গোড়ের সামনে হাটু গেঁড়ে বসে প্রার্থনা করার অনুসন্ধান। সমাজচ্যুত একজনের পদতলে বসে প্রার্থনার পরিভ্রমণ করা। হারানো, বিস্মৃত পবিত্র এক নারী।

 

সোফির মধ্যে অপ্রত্যাশিত একটা বিস্ময়ের উদয় হলো। হলি গ্রেইলের লুকিয়ে রাখা জায়গাটা আসলে…একটা সমাধি?

 

টিবিংয়ের চোখ দুটো ঘোলাটে দেখালো। তাই। ম্যারি মাগদালিন এবং দলিলগুলোর একটা কবর।

 

প্রায়োরির সদস্যরা, অবশেষে সোফি বললো। এতোগুলো বছর ধরে স্যাংগৃল দলিল আর মাগদালিনের সমাধিটা রক্ষা করে যাচ্ছে?

 

হ্যাঁ, কিন্তু ভ্রাতৃসংঘের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও রয়েছে-বংশটাকে রক্ষা করা। খৃস্টের বংশধরেরা ক্রমাগত বিপদের মধ্যেই আছে। প্রথম দিকে, চার্চ আশংকা করতো, যদি যিশুর বংশধরদের খবরটা জানাজানি হয়ে যায়, তবে ক্যাথলিক মতবাদের মূল ভিত্তিটাই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে যাবে—সর্গীয় ত্রাণকর্তা ঈসা মসীহ নারী সংস্পর্শে এসেছিলেন, বা যৌনকর্ম করেছিলেন। তিনি একটু থামলেন। তাসত্ত্বেও, পঞ্চম শতাব্দীতে ফরাসি রাজবংশের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হবার আগ পর্যন্ত খৃস্টের বংশ, ফ্রান্সে সঙ্গোপনেই বেড়ে উঠছিলো। যারা পরিচিত ছিলো মেরোভিনজিয়ান বংশ হিসেবে।

 

এই কথাটা সোফিকে খুবই অবাক করলো। মেরোভিনজিয়ান এমন একটা শব্দ, যা প্রতিটি ফরাসি ছাত্রছাত্রীই জানে। মেরোভিনজিয়ানরাই প্যারিসের গোড়াপত্তন করেছিলো।

 

হ্যাঁ, এজন্যেই, গ্রেইল কিংবদন্তী ফ্রান্সে এতো সমৃদ্ধ। ভ্যাটিকানের অনেক গ্রেইল অনুসন্ধানকারীই ফ্রান্সে এসে রাজবংশকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছিলো। আপনি রাজা ডাগোবার্টের নাম শুনেছেন?

 

সোফির মনে পড়ে গেলো সেই একঘেয়েমী ইতিহাসের ক্লাসের কথা। ডাগোবার্ট একজন মেরোভিনজিয়ান রাজা ছিলেন। তাই না? ঘুমন্ত অবস্থায়, চোখে ছুরির আঘাতের জন্য মারা গিয়েছিলেন?

 

একদম ঠিক। সপ্তম শতাব্দীর শেষ দিকে পেপিন দি হেরিসটাইলের সহযোগীতায় ভ্যাটিকান এই গুপ্তহত্যা করেছিলো। ডাগোবার্টের হত্যার মধ্য দিয়ে মেরোজিনজিয়ান বংশ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলো। সৌভাগ্যবশত, ডাগোবার্টের ছেলে, সিগিসবার্ট, গোপনে পালিয়ে গিয়ে বংশধারাকে অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। পরবর্তীতে সেই বংশেই জন্মেছিলেন গদফ্রোই দ্য বুইলো—প্রায়োরি অব সাইন-এর প্রতিষ্ঠাতা।

 

এই লোকই, ল্যাংডন বললো। নাইট টেম্পলারদেকে সোলেমানের মন্দিরের নিচ থেকে স্যাংগৃল দলিলগুলো উদ্ধারের আদেশ দিয়েছিলেন, যাতে এটা প্রমাণ করা যায় যে, মেরোনিজিয়ানরা যিশুরই বংশধর।

 

টিবিং সায় দিলেন। আধুনিক প্রায়োরিরা স্যাংগৃল দলিলগুলোকে রক্ষা করে থাকে। তাদেরকে ম্যারি মাগদালিনের কবরটাও রক্ষা করতে হয়। আর অবশ্যই, তাদেরকে যিশুর বংশধরদেরকেও রক্ষা করতে হয়—মেরোভিনজিয়ান বংশের যে কয়জন এখনও বেঁচে আছে, তাদেরকে।

 

যিশুর বংশধরেরা, এই আধুনিক কালেও বেঁচে আছে? তার দাদুর কণ্ঠটা আবারো তার কানে ফিস ফিস করে বলে উঠলো। প্রিন্সেস, তোমার পরিবার সম্পর্কে সত্য কথাটা আমাকে বলতেই হবে।

 

তার গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেলো।

 

রাজ বংশ।

 

সে ভাবতেই পারছে না।

 

প্রিন্সেস সোফি।

 

স্যার সেই? গৃহপরিচারকের কণ্ঠটা দেয়ালের ইন্টারকম থেকে শোনা গেলো। সোফি একটু চমকে গেলো।

 

আমাকে একটু রান্নাঘর থেকে আসতে হবে। টিবিং ইন্টারকমের কাছে গিয়ে বোতাম টিপলেন। রেমি, তুমিতো জানোই, আমি আমার অতিথিদের সঙ্গে ব্যস্ত আছি। আমাদের যদি রান্নাঘরে কিছু প্রয়োজন পড়ে, আমরা নিজেরাই সেটা নিয়ে নিতে পারবো। ধন্যবাদ তোমাকে, গুডনাইট।

 

আমি চলে যাবার আগে, আপনার সাথে একটা কথা বলে যেতে চাই, স্যার।

 

টিবিং তার কথা মেনে নিয়ে বোতাম টিপলেন। জলদি করো, রেমি।

 

এটা গৃস্থালির ব্যাপার, স্যার, অতিথিদের সামনে বলাটা ঠিক হবে না।

 

টিবিং একটু রু কুচকালেন। সকালের জন্য কি একটু অপেক্ষা করা যায় না?

 

না, স্যার। আমার কথাটা বলতে মিনিট খানেক সময়ও লাগবে না।

 

টিবিং চোখ দুটো গোল গোল করে ল্যাংডন আর সোফির দিকে তাকালেন। কখনও কখনও, আমার মনে হয়, কে কার চাকর? তিনি আবারো বোতাম টিপলেন। আমি আসছি, রেমি। তোমার জন্য কি কিছু নিয়ে আসবো?

 

শুধু নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি, স্যার।

 

রেমি, তুমি বুঝতে পারছো, তোমার স্টিক অউ পোইভর-ই হলো একমাত্র কারণ, যার জন্যে তুমি এখনও আমার জন্যে কাজ করতে পারছে।

 

যেমনটি আপনি বলছেন, স্যার, যেমনটি আপনি বলছেন।

 

 

 

০৭. প্রিন্সেস সোফি

৬১.

 

প্রিন্সেস সোফি।

 

টিবিংয়ের ক্রাচের খ্যাখ্যা শব্দটা হলওয়ের দিকে অপসৃয়মান হতেই সোফির খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগলো। অচেতনভাবেই সে ফাঁকা বলরুমে ল্যাংডনের দিকে তাকালো। সে তার দিকে চেয়ে মাথাটা নাড়লো, যেনো সোফির মনের কথাটা বুঝতে পেরেছে।

 

না, সোফি, সে ফিস্ ফিস্ করে বললো। তার চোখে আশ্বস্ত করার ভাব। আমি যখন প্রথম শুনেছিলাম তোমার দাদু প্রায়োরিতে ছিলেন, তখন, আমারও একই ভাবনা হয়েছিলো। তুমি বলছে, তিনি তোমাকে তোমার পরিবার সম্পর্কে একটা সত্য কথা বলতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু এটা অসম্ভব। ল্যাংডন একটু থামলো। সনিয়ে নামটা কোন মেরোভিনজিয়ান নাম নয়।

 

সোফি বুঝতে পারলো না, সে হতাশ হবে, নাকি স্বস্তিবোধ করবে। একটু আগে, ল্যাংডন সোফিকে একটা আজব প্রশ্ন করেছে, তার মায়ের কুমারি নামের ব্যাপারে, শোভেল। প্রশ্নটার মানে এখন পরিষ্কার।শভেল? সোফি উদ্বিগ্ন হয়ে বললো।

 

আবারো ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো। আমি দুঃখিত, বর্তমানে মেরোভিনজিয়ানদের কেবলমাত্র দুটো সরাসরি বংশধারা টিকে আছে। তাদের পারিবারিক নাম হলো প্লান্টার্ড এবং সেনক্লেয়ার। দুটো পরিবারই গোপনে বসবাস করে, সম্ভবত প্রায়োরিদের তত্ত্বাবধানে।

 

সোফি নামগুলো মনে মনে উচ্চারিত করে মাথা ঝাঁকালো। তাদের পরিবারের কারোর নামই প্লান্টার্ড অথবা সেনক্লেয়ার ছিলো না। সোফির মনে পড়ে গেলো তার পরিবারের কথা, বেদনায় আক্রান্ত হলো মুহূর্তেই। তারা এখন মৃত, সোফি। তারা আর ফিরে আসবে না। তার মনে পড়ে গেলো, তার মা রাতে তাকে গান গেয়ে ঘুম পারাতেন। বাবা কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সবকিছুই চুরি হয়ে গেছে। তার কেবল দাদুই ছিলো। আর এখন, সেও চলে গেছে। আমি এখন একা।

 

সোফি সঙ্গে সঙ্গে দ্য লাস্টসাপার-এর দিকে তাকালো, ভালো করে ম্যারি মাগদালিনকে দেখলো। দীর্ঘ লাল চুল আর শান্ত চোখ দুটো। এই নারীর অভিব্যক্তিতে এমন কিছু আছে, যা, হারানো ভালোবাসার একজনকে খুঁজছে যেনো। সোফি সেটা অনুভব করতে পারলো।

 

রবার্ট? সে খুব কোমল কণ্ঠে বললো।

 

সে তার খুব কাছে চলে এসেছে।

 

আমি জানি, লেই বলেছেন, গ্রেইলের গল্পটা আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে আছে, কিন্তু, আজকের রাতেই আমি এটা প্রথম শুনলাম।

 

ল্যাংডন তার হাতটা সোফির কাঁধে রাখতে গিয়েও রাখলো না। তুমি তার গল্পটা আগেও শুনেছে, সোফি। সবাই শুনেছে। কিন্তু আমরা সেটা যখন শুনি, তখন বুঝতে পারি না।

 

আমি বুঝতে পারলাম না।

 

গ্রেইলের কাহিনীটা সবজায়গাতেই আছে। কিন্তু সেটা লুকানো অবস্থায়। চার্চ যখন ম্যারি মাগদালিনের ব্যাপারে কথা বলার উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো, তখন তার গল্পটা আরো বেশি বুদ্ধিদীপ্ত আকারে প্রচলন করা হলো। প্রতীক আর রূপকের আকারে।

 

অবশ্যই। চিত্রকলাতেও।

 

ল্যাংডন দ্য লাস্ট সাপার-এর দিকে ফিরলো। এটা একটা ভালো উদাহরণ। আজকের দিনেও, কিছু চিত্রকলায়, সাহিত্য এবং সঙ্গীতে গোপনে ম্যারি মাগদালিন এবং যিশুর ইতিহাস বলা হয়।

 

ল্যাংডন খুব দ্রুত তাকে দা ভিঞ্চি, বত্তিচেল্লি, পুশিন, বার্নিনি, এবং ভিক্টর হুগোর কাজগুলোর কথা বলে গেলো। তারা সবাই বিস্মৃত পবিত্র নারীর পুণঃঅধিষ্ঠিত করার খোঁজে ছিলেন। স্যার গোয়াইন এবং গৃন নাইট, কিং আর্থার আর স্লিপিং বিউটির কিংবদন্তীগুলো গ্রেইলেরই রূপক বর্ণনা। ভিক্টর হুগোর হাঞ্চব্যাক অব নটরডেম এবং মোজার্টের ম্যাজিক ফুট ম্যাসোনিক প্রতীক আর গ্রেইল সিক্রেট-এ পরিপূর্ণ।

 

একবার হলি গ্রেইলের দিকে তুমি চোখ খুলে তাকালে, ল্যাংডন বললো, তাকে সবজায়গায়ই দেখতে পাবে। চিত্রকর্মে। সঙ্গীতে। সাহিত্যে। এমনকি কাটুন, থিম পার্ক আর জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে।

 

ল্যাংডন তার মিকি মাউস হাত ঘড়িটা দেখিয়ে বললো, ওয়াল্ট ডিজনি এটাকে এমনভাবে তৈরি করেছেন, যাতে গ্রেইল কাহিনীটাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা যায়। ডিজনিকে একজন আধুনিককালের লিওনার্দো দা ভিঞ্চি হিসেবে অভিহিত করা হতো। এদুজনই নিজেদের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। অনন্যভাবেই সৃষ্টি প্রদত্ত প্রতিভাবান শিল্পী আর গুপ্ত সংগঠনের সদস্য। লিওনার্দোর মতোই, ডিজনিও চিত্রকর্মের মধ্যে লুকায়িত বার্তা আর প্রতীক রাখতে পছন্দ করতেন।

 

ডিজনির বেশিরভাগ লুক্কায়িত বার্তাই ধর্ম সংক্রান্ত, প্যাগান মিথ, এবং বিস্মৃত প্রায় দেবীদের গল্পকাহিনী নিয়ে। ডিজনি যে পুণরায় সিনডেরেলা, স্লিপিং বিউটি, এবং স্নো হোয়াইট-এর গল্পগুলো বলেছেন, তা ভুল করে নয়-এগুলো সবটাই পবিত্র নারী সংক্রান্ত। স্নো হোয়াইটের প্রেক্ষাপটে যে একটা প্রতীকি ব্যাপার আছে, সেটা কারোর না বোঝার কথা নয়—এক রাজকুমারী বিষাক্ত আপেল খেয়ে অধঃপতিত হয় তার সঙ্গে স্বর্গের উদ্যান থেকে হাওয়ার আপেল খাওয়ার জন্য বিতারিত হওয়ার অসাধারণ কাহিনীটার মিল রয়েছে। অথবা স্লিপিং বিউটির রাজকুমারী অরোরা ছদ্মনাম যার রোজ, গভীর বনে লুকিয়ে থাকে, ডাইনীর রুদ্ররোষ থেকে বাঁচার জন্যে—তা আসলে শিশুতোষ গ্রেইল কাহিনী।

 

কর্পোরেট ভাবমূর্তি থাকা সত্ত্বেও, ডিজনির রয়েছে সেই পুরনো ঐতিহ্য। আর তাদের শিল্পীরা, এখনও ডিজনির সামগ্রীতে লুক্কায়িত প্রতীক ঢুকিয়ে থাকে। ল্যাংডন একটা ঘটনা কখনও ভুলবে না, যখন তার এক ছাত্র লায়ন কিং-এর একটা ডিভিডি এনে একটা দৃশ্যে থামিয়ে দেখিয়েছিলো, সেখানে SEX শব্দটা পরিষ্কারভাবেই দৃষ্টিগোচর হয়েছে। অক্ষরগুলো সিম্বার মাথার উপর উড়তে থাকা ধূলোর আকৃতি ধারণ করে। যদিও ল্যাংডনের সন্দেহ হয়েছিলো, এটা এক ধরনের কাটুনর্জাতীয় হাস্যরস, কোন উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রহেলিকা নয়, যা প্যাগান যৌনতাকে ইঙ্গিত করে, তারপরও সে বুঝেছিলো, প্রতীকের ব্যাপারে ডিজনির অনুরাগ নিছক কোন কিছু নয়। দ্য লিটল মারমেইড ও এক ধরনের প্রতীকি রূপকথা, যাতে দেবী সংক্রান্ত ব্যাপারটাই তুলে ধরা হয়েছে। এটা কাকতালীয় হতে পারে না।

 

ল্যাংডন যখন প্রথম দ্য লিটল মারমেইড দেখেছিলো, সে বুঝতে পেরেছিলো এরিয়েলের পানির নিচের বাড়িটা আসলে সপ্তদশ শতকের শিল্পী জর্জেস দালা তুরর দ্য পেনিটেন্ট মাগদালিন চিত্র কর্মটিই-ম্যারি মাগদালিনের প্রতি বিখ্যাত একটা শ্রদ্ধাঞ্জলী সাজসজ্জাগুলো ছবিতে আসলে নব্বই মিনিটের আইসিস দেবী, হাওয়া পিসেস দ্য ফিশ গডেস বা মৎস কুমারী এবং ম্যারি মাগদালিনের রেফারেন্স হিসেবেই আর্বিভূত হয়েছে। লিটল মারমেইডের নামটা, আরিয়েল, পবিত্র নারী এবং বুক অব ইসায়ির সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত, দ্য হলি সিটি বিসিজ-এর একটা সমার্থক শব্দ। আর নিশ্চিতভাবেই লিটল মারমেইডের লাল চুলটা মোটেও কোন কাকতালীয় ব্যাপার। নয়।

 

টিবিংয়ের ক্রাচের আওয়াজটা শোনা গেলে তার পদক্ষেপ খুবই দ্রুত আর চেহারায় বিস্ময়।

 

রবার্ট, শান্ত কণ্ঠে বললেন তিনি। আপনি আমার সাথে সততা দেখাননি।

 

 

 

৬২.

 

আমি ফাঁদে পড়ে গেছি, লেই,,ল্যাংডন বললো। শান্ত থাকার চেষ্টা করলো। আপনি আমাকে চেনেন। আমি কাউকে খুন করত পারি না।

 

টিবিংয়ের কণ্ঠটা নরম হলো না। রবার্ট, আপনার ছবি টেলিভিশনে দেখাচ্ছে। আপনি কি জানতেন, কর্তৃপক্ষ আপনাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে?

 

হ্যাঁ।

 

তবে তো, আপনি আমার বিশ্বাসের অপব্যবহার করেছেন। আমি অবাক হয়েছি, আপনি আমার এখানে এসে আমাকে বিপদের মধ্যে ফেলেছেন আর গ্রেইলের কাহিনী ফেঁদে আমার বাড়িতে লুকানোর ফন্দি করেছেন।

 

আমি কাউকে খুন করিনি।

 

জ্যাক সনিয়ে মারা গেছেন, পুলিশ বলছে আপনিই সেটা করেছেন। টিবিংকে খুব বিষণ্ণ দেখালো। শিল্পের জন্য একজন নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি ছিলেন তিনি…

 

স্যার? গৃহপরিচারক এসে বললো। তার হাত দুটো ভাঁজ করা। তাদেরকে কি আমি বাইরে চলে যেতে বলবো?

 

সেটা আমাকেই করতে দাও। টিবিং হেঁটে গিয়ে লবির কাঁচের দরজাটা খুলে দিলেন। দয়া করে নিজেদের গাড়িটা নিয়ে চলে যান।

 

সোফি নড়লো না। আমাদের কাছে ক্লেফ দ্য ভুত-এর খবর রয়েছে। প্রায়োরি কি-স্টোনটা?

 

টিবিং কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে একটু রেগে গেলেন। ভালো ছলনা। রবার্ট জানে, এটা আমি কীভাবে খুঁজছি।

 

সে সত্য কথাই বলছে, ল্যাংডন বললো। এজন্যেই আমরা আজ রাতে আপনার এখানে এসেছি, কি-স্টোনটার ব্যাপারে কথা বলতে।

 

গৃহপরিচারক এবার নাক গলালো। চলে যান, তা-না হলে আমি কর্তৃপক্ষকে ডাকবো।

 

লেই, ল্যাংডন নিচুস্বরে বললো। আমরা জানি, সেটা কোথায়।

 

টিবিংয়ের ভারসাম্য মনে হলো একটু টলে গেলো।

 

রেমি এগিয়ে এলো। এক্ষুনি চলে যান। তা না হলে জোড় করতে–

 

রেমি! রাগে কটমট করে টিবিং তার দিকে তাকালেন। আমাদেরকে একটু একা থাকতে দাও।

 

চাকরটার মুখ হা হয়ে গেলো। স্যার? আমি মেনে নিতে পারছি না। এসব লোক–

 

সেটা আমি দেখছি। টিবিং তাকে চলে যেতে ইশারা করলেন। গভীর নিরবতার পর, রেমি নেড়ি কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে চলে গেলো।

 

টিবিং এবার ল্যাংডন আর সোফির দিকে ঘুরলেন। ভালো। কি-স্টোন সম্পর্কে আপনারা কি জানেন?

 

 

 

টিবিংয়ের স্টাডিরুমের বাইরে, সাইলাস পিস্তল হাতে জানালা দিয়ে উঁকি মারলো। একটু আগে সে বাড়িটা ঘুরে অবশেষে দেখতে পেয়েছে ল্যাংডন আর সোফি স্টাডি রুমে আছে। সে কিছু করার আগেই দেখতে পেলো, ক্রাচে ভর দিয়ে একটা লোক ঘরে ঢুকছে। চিৎকার করে, দরজা খুলে তাদেরকে বের হতে বলছিলো। তারপরই, মেয়েটা কি-স্টোনের কথা বলার পর, সবকিছু বদলে গেলো। চিৎকার পরিণত হলো ফিসফিসানিতে। আর কাঁচের দরজাটও বন্ধ হয়ে গেলো।

 

এখন, সাইলাস অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কাঁচের ভেতর দিয়ে তাদেরকে দেখতে লাগলো। কি-স্টোনটা এই বাড়ির কোথাও আছে। সাইলাস যেনো সেটা অনুভব করতে পারলো।

 

সে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো। তাদেরকে সে পাঁচ মিনিট সময় দিলো। তারা যদি কি-স্টোনটা কোথায় আছে সেটা না বলে, তবে সাইলাস ভেতরে ঢুকে বলপূর্বক তাদেরকে বাধ্য করবে।

 

 

 

স্টাডিরুমের ভেতরে, ল্যাংডন টিবিংয়ের আমুদে ভাবটা আঁচ করতে পারলো।

 

গ্র্যান্ড মাস্টার? টিবিং সোফির চোখের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বললেন। জ্যাক সনিয়ে?

 

সোফি সায় দিলো, সেও তাঁর চোখে বিস্ময়টা দেখতে পেলো।

 

কিন্তু, আপনার তো সেটা জানার কথা নয়!

 

জ্যাক সনিয়ে আমার দাদু।

 

টিবিং একটু পিছিয়ে গেলেন। এক ঝলক ল্যাংডনের দিকে তাকালেন, সে তাকে আশ্বস্ত করলো। টিবিং এবার সোফির দিকে ঘুরলেন। মিস্ নেভু, আমি বাকরুদ্ধ। এটা যদি সত্য হয়, তাহলে আমি আপনার দাদুর মৃত্যুর জন্য খুবই দুঃখিত। আমাকে মানতেই হবে, আমার গবেষণার জন্য আমি প্যারিসের কয়েকজন ব্যক্তিকে তালিকায় রেখেছিলাম, যারা প্রায়োরিদের সাথে জড়িত থাকতে পারে। জ্যাক সনিয়ে সেই তালিকায় ছিলেন। কিন্তু গ্র্যান্ড মাস্টার, আপনি বলছেন? এটা বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। টিবিং একটু থামলেন। নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন। এখনও আমার মাথায় ঢুকছে না। যদি আপনার দাদু গ্র্যান্ড মাস্টার হয়েও থাকেন, এবং কি-স্টোনটা তৈরি করে থাকেন, তারপরও, তিনি কখনই আপনাকে সেটা খোজার কথা বলবেন না। কি স্টোনটা ভ্রাতৃসংঘের অনিবার্য সম্পদের খোঁজ দিয়ে থাকে। নাতনী হলেও আপনি এ ধরনের তথ্য জানার জন্যে উপযুক্ত নন।

 

মি. সনিয়ে মারা যাবার সময় তথ্যটা পাচার করে গেছেন। ল্যাংডন বললো। তার কাছে খুব কম সুযোগই ছিলো।

 

তাঁর সুযোগ থাকার কোন দরকারই নেই, টিবিং আপত্তি করলেন। আরো তিন জন সেনেক্য আছেন, যারা তথ্যটা জানে। এটাই তাদের সিস্টেমের সৌন্দর্য। একজন গ্র্যান্ড মাস্টার হিসেবে আবির্ভূত হবেন এবং নতুন একজন সেনেক হিসেবে নির্বাচিত হবেন।

 

আমার মনে হয়, আপনি পুরো খবরটা দেখেননি। সোফি বললো। আমার দাদু ছাড়াও প্যারিসের আরো তিনজন বিখ্যাত লোক খুন হয়েছেন আজ রাতে, একইভাবে। মনে হচ্ছে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিলো।

 

টিবিংয়ের মুখটা হা হয়ে গেলো। আর আপনি ভাবছেন তারা…

 

সবাই সেনেক্য ছিলো। ল্যাংডন বললো।

 

কিন্তু কিভাবে? একটা খুনের মাধ্যমে প্রায়োরিদের শীর্ষ চার জনের পরিচয় জানা সম্ভব কীভাবে! আমাকে দেখুন, আমি তাদেরকে নিয়ে যুগযুগ ধরে গবেষণা করছি, তার পরও, আমি একজন প্রায়োরির নামও বলতে পারবো না। মনে হচ্ছে, তিন জন সেনেক্য এবং গ্র্যান্ড মাস্টারকে চিনতে পারা এবং একই দিনে সবাইকে খুন করাটা অসম্ভব একটি ব্যাপার।

 

আমার আশংকা তথ্যগুলো একদিনে সংগ্রহ করা হয়নি। সোফি বললো, মনে হচ্ছে, খুব ভালো একটা ডিক্যাপিটার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। এটা এমন একটা টেকনিক, যা সংগঠিত অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যবহার করা হয়। ডিসিপিজে তাদের টার্গেট গ্রুপের সদস্যদেরকে দীর্ঘদিন ধরে অনুসরণ করে, তাদের কথাবার্তা আঁড়িপেতে শশানে। তারপর, নেতাটাকে পাকড়াও করে এবং একই দিনে বাকিদেরকে। নেতৃত্বহীন হয়ে দলটি বিক্ষিপ্ত আর দুর্বল হয়ে পড়ে। এটা খুব সম্ভব যে, প্রায়োরিদেরকে কেউ দীর্ঘ দিন চোখে চোখে রেখেছে, তারপর আক্রমণ করেছে। এই আশায় যে, শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হয়তো কি-স্টোনের অবস্থানটার কথা জানিয়ে দেবে।

 

টিবিংকে দেখে মনে হলো কথাটাতে আশ্বস্ত হতে পারছে না। কিন্তু, ভাতসংঘের ভায়েরা একে অন্যের সাথে কখনও কথা বলে না। তারা তো তথ্যটা গোপন রাখার জন্য ওয়াদাবদ্ধ, এমনকি মৃত্যুর মুখেও।

 

একদম ঠিক। ল্যাংডন বললো, তার মানে, সিক্রেটটা যদি কখনও হস্তান্তর না করে তাঁরা মৃত্যু বরণ করেন…

 

টিবিং আতিশয্যে বললেন, তাহলে কি-স্টোনের অবস্থানটার কথা চিরতরের জন্য হারিয়ে যাবে।

 

আর, সেইসাথে, ল্যাংডন বললো, হলি গ্রেইলের অবস্থানটাও।

 

টিবিং ধপাস করে চেয়ারে বসে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

 

সোফির কণ্ঠটা নরম শোনালো। আমার দাদুর পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা বিবেচনা করলে এটা মনে হওয়া সম্ভব যে, ভ্রাতৃসংঘের বাইরের কারো কাছে সিক্রেটটা হস্তান্তর করার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। এমন কারোর কাছে, যাকে তিনি বিশ্বস্ত মনে করেছেন। তাঁর নিজের পরিবারেরই কেউ।

 

টিবিংয়ের চেহারাটা ফ্যাঁকাশে হয়ে গেলো। কিন্তু এরকম আক্রমণ চালাতে সক্ষম কেউ…ভ্রাতৃসংঘকে উদঘাটনে সক্ষম কেউ… তিনি থামলেন। নতুন এক ভীতিতে আক্রান্ত হলেন। এটা কেবল একটি শক্তিই করতে পারে। এই ধরনের অনুপ্রবেশ কেবলমাত্র প্রায়োরিদের পুরনো শত্রুদের তরফ থেকেই হতে পারে।

 

ল্যাংডন তার দিকে তাকালো। চার্চ।

 

আর কে? শত শত বছর ধরে রোম হলি গ্রেইল খুঁজে বেড়াচ্ছে।

 

সোফিকে দেখে মনে হলো, এ ব্যাপারটাতে সে সংশয় প্রকাশ করছে। আপনি মনে করছেন, চার্চ আমার দাদুকে হত্যা করেছে?

 

টিবিং জবাব দিলেন, ইতিহাসে এবারই প্রথম নয় যে, চার্চ নিজেকে বাঁচাতে হত্যা করেছে। হলি গ্রেইলের দলিল-দস্তাবেজগুলোতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী তথ্য আছে। আর চার্চ সেগুলোকে ধ্বংস করতে চায়।

 

ল্যাংডন টিবিংয়ের এই মতটা মেনে নিলো না। সে নতুন পোপ আর কয়েকজন কার্ডিনালের সাথে সাক্ষাত করেছে। ল্যাংডন জানে, তারা সবাই খুবই ধার্মিক আর আধ্যাত্মিক মানুষ। তারা কখনই গুপ্তহত্যাকে অনুমোদন দেবে না। যতো প্রয়োজনই পড়ুক।

 

সোফিকে দেখেও মনে হচ্ছিলো, সে একইরকম ভাবছে। এটা কি সম্ভব নয় যে, প্রায়োরি সদস্যরা চার্চের বাইরের কারো দ্বারা খুন হয়েছেন? এমন কেউ যে, জানে না গ্রেইল জিনিসটা আসলে কি? খৃস্টের কাপ, হাজার হলেও খুবই দামি একটা এ্যান্টিক। নিশ্চিতভাবেই, গুপ্তধন অম্বেষণকারীরা এজন্যে খুন করতেও পিছপা হবে না।

 

লেই, ল্যাংডন বললো। তকটা স্ববিরোধী। কেন ক্যাথলিক যাজকদের সদস্যরা প্রায়োরি সদস্যদের হত্যা করতে যাবে এমন একটা দলিল ধ্বংস করার জন্য, যেসব দলিলকে তারা নিজেরাই মিথ্যা আর ভূয়া বলে বিবৃতি দিয়েছে?

 

টিবিং শ্লেষ ভরে বললেন, হারভার্ডের আইভরি টাওয়ার আপনাকে খুব বেশি নরম করে ফেলেছে, রবার্ট। রোমের যাজকেরা নিজেদের বিশ্বাসের ব্যাপারে খুব দৃঢ়। কিন্তু তাদের বিশ্বাসের সাথে মিল খায় না, এমন দলিল প্রকাশিত হলে কী হবে, ডিয়ার। বাকিদের বেলায় কি হবে? যারা অতো গভীরভাবে বিশ্বাসী নয়? তাদের বেলায় কি হবে যারা এ পৃথিবীর হিংসা-বিদ্বেষ দেখে প্রশ্ন করে, ঈশ্বর কোথায়, আজ? যারা চার্চের কেলেংকারী দেখে জিজ্ঞেস করে, এইসব লোক কারা, যারা পাদ্রী কর্তৃক শিশু যৌন নিপীড়নের কথা লুকাতে চায় আর দাবি করে যিশু সম্পর্কে তারাই সত্য কথা বলছে? টিবিং থামলেন। এইসব লোকের বেলায় কি হবে, রবার্ট, যদি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা যায় যে, চার্চের বলা যিশুর গল্পটা মিথ্যা।

 

ল্যাংডন কিছু বললো না।

 

এইসব দলিল প্রকাশিত হলে কি হবে, আমি বলছি। টিবিং বললেন। ভ্যাটিকান তার দুহাজার বছরের ইতিহাসে সবচাইতে বড় সংকটে পড়বে।

 

দীর্ঘ নিরবতার পরে, সোফি বললো, যদি এই আক্রমণটা চার্চই করে থাকে, তবে তারা, এখন করলো কেন? এতো বছর পরে? প্রায়োরিরা স্যাংগুল দলিলগুলো লুকিয়ে রেখেছে। তারা তো চার্চের জন্য হুমকি ছিলো না?

 

টিবিং একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাংডনের দিকে তাকালেন। রবার্ট, আমার ধারণা, আপনি প্রায়োরিদের চূড়ান্ত পদক্ষেপটা সম্পর্কে জ্ঞাত আছেন?

 

ল্যাংডন কথাটা বুঝতে পারলো। হ্যাঁ আছি।

 

মিস নেভু, টিবিং বললেন, চার্চ আর প্রায়োরিদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটা অলিখিত চুক্তি বিরাজ করছিলো। তাহলো, চার্চ প্রায়োরিদেরকে আক্রমণ করবে না। আর প্রায়োরিরাও তাদের স্যাংগৃল দলিলগুলো লুকিয়ে রাখবে। তিনি থামলেন। তা সত্ত্বেও, প্রায়োরিদের একটা অংশের পরিকল্পনা ছিলো সিক্রেটটা উনাোচিত করার। একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগমনে, প্রায়োরিরা তাদের সিক্রেটটা ফাস করবে। আর যিশু খৃস্টের সত্যিকারের কাহিনীটা পাহাড়ের শীর্ষ থেকে চিৎকার করে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে। দেয়া হবে।

 

সোফি টিবিংয়ের দিকে নিরবে চেয়ে রইলো। অবশেষে, সেও বসে পড়লো। আপনি মনে করছেন, সেই দিনটা সমাগত? আর চার্চও সেটা জানে?

 

এটা একটা অনুমান, টিবিং বললেন।

 

এবার ল্যাংডন বললো, আপনি কি মনে করেন, প্রায়োরিদের দিনটার কথা উদঘাটন করার মতো সক্ষমতা চার্চের রয়েছে?

 

কেন নয়–আমরা যদি মনে করতে পারি, চার্চ প্রায়োরিদের পরিচয় উদঘাটন করতে পেরেছে, তবে নিশ্চিতভাবেই তারা তাদের পরিকল্পনার কথাটাও জেনে গেছে। আর তারা যদি তাদের দিনটার কথা একদম ঠিক করে নাও জানে, তবে তাদের কুসংস্কার সেটা জানাতে সাহায্য করবে।

 

কুসংস্কার? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

ভবিষ্যত্বাণী হিসেবে, টিবিং বললেন। বর্তমানে, আমরা একটা পরিবর্তনের মধ্যে আছি। এইতো, কদিন আগে মিলেনিয়াম অতিক্রম করলো। এর সাথে পিসিজের দুহাজার বছরের জ্যোতিষ-কালও সমাপ্ত হয়েছে পিসিজ মানে মাছটা, যিশুরই প্রতীক। যে কোন জ্যোতিষ আপনাকে বলে দেবে যে, এই সময়টা উত্তপ্ত ধর্মের সময়কাল। এখন আমরা প্রবেশ করেছি এ্যাকোয়ারিয়ামের সময়ে পানির অধিকর্তা—যার দর্শন দাবি করে, মানুষ সত্য জানবে এবং নিজে নিজেই চিন্তা করতে সক্ষম হবে। আদর্শগত পরিবর্তনটা বেশ বড়, আর এটা বর্তমানেই সংঘটিত হচ্ছে।

 

ল্যাংডন একটা কাঁপুনি অনুভব করলো। জ্যোতিষীদের ভবিষ্যত্বাণীতে তার কখনই কোন আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু, সে জানতো, চার্চে এমন অনেকেই আছেন, যারা এসব মেনে চলেন। চার্চ এই সন্ধিক্ষণকে শেষ দিন হিসেবে অভিহিত করে।

 

সোফিকে সন্দিগ্ধ মনে হলো। পৃথিবীর শেষ হিসেবে? এ্যাপোক্যালিপসো?

 

না, ল্যাংডন জবাব দিলো। এটা একটা সাধারণ ভুল ধারণা। অনেক ধর্মই শেষ দিনের কথা বলেছে। এতে পৃথিবীর শেষ দিন বোঝায় না, বরং আমাদের সাম্প্রতিক সময়কে বোঝায় পিসিজ, যা যিশুর জন্মের সময় থেকে শুরু হয়ে দুহাজার বছর ধরে চলেছে। আর সেটা শেষ হয়ে যাবার পর, এখন আমরা এ্যাকোয়ারিয়ামের সময়ে প্রবেশ করেছি। শেষ দিন সমাগত হয়েছে।

 

গ্রেইল ঐতিহাসিকদের অনেকেই, টিবিং যোগ করলেন, বিশ্বাস করেন যে, প্রায়োরিরা হয়তো এরকম একটি সময়কেই বেছে নেবে সত্যটা প্রকাশ করার জন্য। বেশির ভাগ প্রায়োরি একাডেমিক, আমি সহ, অনুমাণ করি, ভ্রাতৃসংঘের সত্য প্রকাশটা মিলেনিয়ামের সাথে কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে। আসলে তা নয়। আমি জানি না কোন্ চার্চ প্রায়োরিদেরকে আক্রমণ করার জন্য এসময়টা বেছে নিলো। টিবিংকে একটু চিন্তিত দেখালো। আর বিশ্বাস করুন, চার্চ যদি হলি গ্রেইল খুঁজে পায়, তারা সেটা ধ্বংস করে ফেলবে, দলিলটা আর মাগদালিনের দেহাবশেষ সহ। তাঁর চোখ দুটো খুব ভারী মনে হলো। তাহলে, মাইডিয়ার, স্যাংগৃল দলিলগুলো শেষ হয়ে গেলে সবরকম প্রমাণই হারিয়ে যাবে। চার্চ তাহলে তাদের সহস্র বছরের যুদ্ধে জিতে যাবে। আর একটা অতীত, চিরতরের জন্য হারিয়ে যাবে।

 

ধীরে ধীরে সোফি তার কুশাকৃতির চাবিটা পকেট থেকে বের করে. টিবিংয়ের সামনে তুলে ধরলো।

 

টিবিং চাবিটা দেখে নিলেন। হায়, হায়। এটাতো প্রায়োরির সিল। আপনি এটা কোথেকে পেলেন?

 

আজ রাতে, আমার দাদু মারা যাবার আগে এটা আমাকে দিয়ে গেছেন।

 

টিবিং চাবিটা হাতে তুলে নিলেন চার্চে ঢোকার একটা চাবি?

 

সোফি একটা গভীর নিঃশ্বাস নিলো। এই চাবিটা দিয়ে কি-স্টোনে ঢোকা যায়।

 

টিবিংয়ের মাথাটা নড়ে উঠলো, তার মুখে অবিশ্বাসের চিহ্ন। অসম্ভব! আমি কোন চার্চটা বাদ দিয়েছি? ফ্রান্সের প্রতিটা চার্চই আমি খুঁজে দেখেছি!

 

এটা কোন্ চার্চে নেই, সোফি বললো। এটা সুইস ডিপোজিটরি ব্যাংকে আছে।

 

টিবিংকে আরো বেশি বিস্মিত মনে হলো। কি-স্টোনটা একটা ব্যাংকে আছে?

 

একটা ভল্টে, ল্যাংডন জানালো।

 

ব্যাংকের ভল্টে? টিবিং পাগলের মতো মাথা ঝাঁকালেন। অসম্ভব, কি-স্টোনটা গোলাপ চিহ্নের নিচে লুকিয়ে রাখার কথা।

 

তা-ই আছে, ল্যাংডন বললো। এটা একটা রোজউড বাক্সের ভেতরে পাঁচ পাঁপড়ির গোলাপ অংকিত বাক্সের ভেতরে আছে।

 

টিবিংকে দেখে মনে হলো বজ্রাহত। আপনারা কি-স্টোনটা দেখেছেন?

 

সোফি মাথা নেড়ে সায় দিলো। আমরা ব্যাংকে গিয়েছিলাম।

 

টিবিং তাদের কাছাকাছি আসলেন, তাঁর চোখে বন্য ভয়। আমার বন্ধুরা, আমাদেরকে কিছু একটা করতেই হবে। কি-স্টোনটা বিপদে আছে! এটা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। যদি আরো কোন চাবি থেকে থাকে? সম্ভবত খুন হওয়া সেনেক্য দের কাছে? আপনাদের মতো যদি চার্চও ব্যাংকে প্রবেশ করতে পারে

 

তাহলে তারা খুব দেরি করে ফেলবে, সোফি বললো। আমরা কি-স্টোনটা সরিয়ে ফেলেছি।

 

কী।আপনারা কি-স্টোনটা সরিয়ে ফেলেছেন?

 

ঘাবড়াবেন না, ল্যাংডন বললো। কি-স্টোনটা ভালো জায়গাতেই লুকিয়ে রাখা আছে।

 

খুবই ভালো মতো লুকানো আছে, আশা করি।

 

আসলে, ল্যাংডন তার হাসিটা লুকাতে পারলো না। এটা নির্ভর করে, আপনি আপনার সোফাটা কতদিন পরপর ঝাড়ু দিয়ে থাকেন তার ওপরে।

 

* * *

 

জানালার ওপাশে, বাতাসের ঝাঁপটায় সাইলাসের আলখেল্লাটা উড়ছিলো। যদিও সে বেশিরভাগ কথাবার্তাই শুনতে পায়নি, তারপরও কি-স্টোন শব্দটা বার কয়েক জানালা ছাপিয়ে তার কানে এসেছে।

 

এটা ভেতরেই আছে।

 

টিচারের কথাগুলো তার পরিষ্কার মনে আছে। শ্যাতু ভিলেতে প্রবেশ করো। কি স্টোনটা ওখানে আছে। কাউকে আঘাত কোরো না।

 

এখন, ল্যাংডন আর বাকিরা অন্য একটা ঘরে চলে গেলো।

 

প্যান্থারের নিরবে শিকার ধরার মতো, সাইলাসও কাঁচের দরজাটা দিয়ে নিরবে ঢুকে পড়ে ভেতর থেকে দরজাটা আস্তে করে বন্ধ করে দিলো। পাশের ঘর থেকে গুঞ্জনের শব্দ তার কানে এলো। সাইলাস পকেট থেকে পিস্তলটা বের করলো। সেফটি লটা বন্ধ করে হলওয়ের দিকে এগিয়ে গেলো সে।

 

 

 

৬৩.

 

লেফটেনান্ট কোলেত লেই টিবিংয়ের বিশালাকৃতির বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে। নিরিবিলি আর অন্ধকার। লুকানোর জন্য ভালো জায়গা। কোলেত তার আধ-ডজন এজেন্টের দিকে তাকালো, যারা বাড়িটার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে, নিরবে। এক মিনিটের মধ্যেই তারা বেড়া টপকিয়ে বাড়িটা ঘেরাও করতে পারবে।

 

কোলেত ফশেকে ফোন করতে যেতেই, ফোনটা বেজে উঠলো।

 

ফশের কথা শুনে মনে হলো না এই ব্যাপারটার অগ্রগতি সম্পর্কে সে খুব একটা খুশি হয়েছে। ল্যাংডনের ব্যাপারের যে খোঁজ পাওয়া গেছে, সেটা আমাকে কেউ ফোনে জানায়নি কেন?

 

আমরা ফোনে ব্যস্তছিলাম, আর—

 

তোমরা ঠিক কোথায়, লেফটেনান্ট কোলেত?

 

কোলেত তাকে ঠিকানাটা দিলো। এস্টেটটা একজন বৃটিশ নাগরিকের, নাম টিবিং, ল্যাংডনের গাড়িটা সিকিউরিটি গেটের ভেতরেই আছে। দেখে মনে হচ্ছে না, জোর করে ঢুকেছে, তাই মনে হচ্ছে ল্যাংডন মালিককে চেনে।

 

আমি আসছি, ফশে বললো। তোমরা কোনো কিছু কোরো না। আমি নিজে সেটা দেখবো।

 

কোলেতের মুখটা হা হয়ে গেলো। কিন্তু ক্যাপ্টেন, আপনি তো বিশ মিনিটের দূরত্বে আছেন। আমাদেরকে এখনই কিছু একটা করতে হবে। আমার সাথে আট জন লোক আছে। চার জনের সঙ্গে আছে ফিল্ড-রাইফেল, আর বাকিদের সঙ্গে রয়েছে সাইড আর্মস।

 

আমার জন্যে অপেক্ষা করো।

 

ল্যাংডন যদি ভেতরে কাউকে জিম্মি করে, তবে কি হবে? সে যদি আমাদের দেখে পালাতে চায়, তাহলেই বা কী হবে? আমার লোকজন ভেতরে যাবার জন্য অবস্থান নিয়ে আছে।

 

লেফটেনান্ট কোলেত, তুমি আমার আসার জন্য অপেক্ষা করো। কোনো এ্যাকশন নেবে না। এটা আমার আদেশ। ফশে ফোনটা রেখে দিলো।

 

হতবাক কোলেত ফোনটার সুইচটা বন্ধ করে দিলো। ফশে কেন আমাকে অপেক্ষা করতে বলছে? কোলেত উত্তরটা জানতো। ফশে, যদিও তার আচরণের জন্য বিখ্যাত, তার পরও অহংকারের জন্য তার দুর্নামও রয়েছে। ফশে গ্রেফতারের কৃতিত্বটা নিতে চায়। আমেরিকানটার চেহারা টিভি পর্দায় দেখাবার পর, ফশে নিজের চেহারাটাও সমান সংখ্যক সময় পর্দায় দেখাতে চাচ্ছে। অপেক্ষা ছাড়া কোলেতের কিছু করার নেই, তার বসের নির্দেশ।

 

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোলেত এই দেরি করানোর ব্যাপারে দ্বিতীয় আরেকটা কারণের কথাও ভাবলো। ড্যামেজ কন্ট্রোল। আইন-প্রয়োগকারী সংস্থায় তখনই একজন ফেরারীকে গ্রেফতারের ব্যাপারে ইতস্তত করা হয়, যখন তার অপরাধের ব্যাপারে একটু সন্দেহ থাকে। ল্যাংডনই সেই ব্যক্তি, এই ব্যাপারে ফশের কি দ্বিতীয় কোন চিন্তা আছে? চিন্তাটা খুব ভীতিকর। ল্যাংডনকে গ্রেফতারের ব্যাপারে ফশের অবস্থা শাখের করাতের মতো। বেজু ফশের মতো বড় মাপের কেউও টিকে যেতে পারবে না, যদি ভুলক্রমে বিখ্যাত আমেরিকানটাকে এই মামলায় ফাঁসানো হয়। ফশে যদি এখন বুঝতে পারে, সে ভুল করেছে, তাহলে এই দেরির কারণটা বোধগম্য।

 

তারচেয়েও বড় কথা, কোলেত বুঝতে পেরেছে, যদি ল্যাংডন নির্দোষ হয়ে থাকে, তবে মামলাটার মধ্যে একটা হেঁয়ালী তৈরি হবে কেন নিহতের নাতনী সোফি নেভু, অভিযুক্ত খুনিকে পালাতে সাহায্য করবে। যদি না সোফি জানে যে, ল্যাংডনকে ভুয়া অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ফলে এই ঘটনায় সোফির অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যাটা মনে মনে ঠিক করে রেখেছে নিশ্চিত। ব্যাখ্যাটা এইরকম, সোফি হলো সনিয়ের একমাত্র উত্তরাধিকারী, সে তার প্রেমিক রবার্ট ল্যাংডনকে প্ররোচিত করে সনিয়েকে খুন করিয়েছে, যাতে উত্তরাধীকারসূত্রে বিশাল অংকের টাকা পাওয়া যায়। সনিয়ে সেটা একটু আগে-ভাগে বুঝতে পেরেই একটা মেসেজ লিখে গেছেন, পি, এস, রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো। কোলেতের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিলো, এখানে কিছু একটা ঘটছে। সোফি নেভুকে দেখে মনে হয় না, সে এরকম কোন ঘটনায় জড়াবে।

 

লেফটেনান্ট? ফিল্ড এজেন্টদের একজন তার কাছে দৌড়ে এসে বললো। আমরা একটা গাড়ি খুঁজে পেয়েছি।

 

কোলেত প্রবেশ পথ থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে গিয়ে দেখলো, একটা কালো অদি, রাস্তার ওপর পাশে, অন্ধকারে পার্ক করা রয়েছে। এটার গায়ে ভাড়া করা প্লেট লাগানো। কোলেত হুডটা ধরে দেখলো, এখনও গরম আছে।

 

এটা দিয়েই হয়তো ল্যাংডন এখানে এসেছে, কোলেত বললো। রেন্টাল কম্পানিকে ফোন করো। খোঁজ করে দ্যাখো, এটা চুরি করা হয়েছে কিনা।

 

আরেকজন এজেন্ট বেড়ার দিক থেকে আসলো। লেফটেনান্ট, এটা একটু দেখুন। সে কোলেতের হাতে একটা নাইট-ভিশন দূরবীন দিলো। গাছের নিচ থেকে পেয়েছি।

 

 

 

কোলেত দূরবীনটা তুলে নিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকালো। সেটা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। ধীরে ধীরে, সবুজ রঙের দৃশ্যটা ফোকাস হলো। সে এবার প্রবেশ পথের দিকে তাকালো, গাছগুলোর দিকে দেখার চেষ্টা করলো। সেখানে, সবুজ গাছের ছায়ায় একটা ট্রাক দেখা যাচ্ছে। কোলেত ডিপোজিটরি ব্যাংক অব জুরিখ থেকে যে ট্রাকটাকে চলে যাবার অনুমতি দিয়েছিলো। তার মনে হলো, এটা এক ধরনের কিম্ভুতকিমাকার কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু সে জানতো, এটা হতেই পারে না।

 

মনে হচ্ছে, এজেন্ট বললো, এই ট্রাকটাতে করেই ল্যাংডন আর নেভু ব্যাংক থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলো।

 

কোলেত একদম নির্বাক। সে ট্রাকটার ড্রাইভারের ব্যাপারে একটু ভেবেছিলো, রোলেক্স ঘড়িটা দেখে। চলে যাবার জন্য তার অধৈর্য ছিলো। আমি গাড়ির কার্গোটা চেক করে দেখিনি।

 

সঙ্গে সঙ্গেই কোলেত বুঝতে পারলো, ব্যাংকের কেউ, ডিসিপিজের সাথে মিথ্যে কথা বলে ল্যাংডন আর সোফিকে পালাতে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেটা কে? আর কেনইবা এটা করতে যাবে? কোলেত ভাবলো, হয়তো এজন্যেই, ফশে তাকে এই মুহূর্তে কিছু করতে না করেছে। হয়তো, ফশে বুঝতে পেরেছে, এই ঘটনায় ল্যাংডন আর সোফি ছাড়াও আরো কেউ জড়িত। যদি ল্যাংডন আর সোফি এই ট্রাকটাতে করে এসে থাকে, তবে অদি গাড়িটা চালিয়েছে কে?

 

 

 

শত শত মাইল দূরে, দক্ষিণ দিকে, একটা চার্টাড বিমান তিরেনিয়ান সাগর পেরিয়ে উত্তর দিকে ছুটে চলছে। শান্ত আকাশ থাকা সত্ত্বেও, বিশপ আরিঙ্গারাসা হাতে একটা এয়ার-সিকনেস ব্যাগ রেখেছেন। তিনি নিশ্চিত, যেকোন মুহূর্তেই অসুস্থ হয়ে পড়বেন। প্যারিসের সাথে তার কথাবার্তাটা মোটেই সুখকর কিছু ছিলো না। এটা তার কাছে অকল্পনীয় বলে মনে হয়েছে।

 

একটা ছোট্ট কেবিনে, আরিজারোসা তার আঙুলের সোনার আংটিটা মোচরাতে লাগলেন, নিজের দুশ্চিন্তা আর উত্তেজনা কাটানোর জন্য। প্যারিসের সবকিছুই উল্টা পাল্টা হয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে আরিঙ্গাবোসা প্রার্থনা করলেন, যেনো বেজু ফশে সবকিছু ঠিক করে ফেলে।

 

 

 

৬৪.

 

টিবিং সসাফায় বসে উডবাক্সটা কোলের ওপর রেখে ঢাকনার ওপরে আঁচিত গোলাপের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আজ রাতটা আমার জীবনের সবচাইতে অদ্ভুত আর যাদুময় এক রাত।

 

ঢাকনাটা খুলুন, সোফি নিচু স্বরে বললো তাকে। তার পেছনেই ল্যাংডনের সাথে দাঁড়িয়ে আছে সে।

 

টিবিং হাসলেন। আমাকে তাড়া দিবেন না। এই কি-স্টোনটা যুগ যুগ ধরে খুঁজে যাচ্ছেন, তাই প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতে চান। কাঠের ঢাকনাটার উপর আঙুল বুলিয়ে অঙ্কিত ফুলটা অনুভব করলেন।

 

রোজ, নিচু স্বরে বললেন তিনি। রোজ বা গোলাপ হলো মাগদালিন, আর মাগদালিন হলেন হলি গ্রেইল। রোজ হলো কম্পাস, যা পথ দেখায়। নিজেকে বোকা বোকা লাগলো বলে টিবিং ভাবলেন। বছরের পর বছর ধরে তিনি ফ্রান্সের ক্যাথেড্রাল থেকে চার্চে চার্চে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ভেতরে ঢোকার জন্য অনুনয়-বিনয় করেছেন, শত শত খিলান খুঁজে দেখেছেন তার নিচে খোঁদাই করা কি-স্টোন আছে কিনা। লা ক্লেফ দ্য ভূত-গোলাপ বা রোজের চিহের নিচে একটা কি-স্টোন।

 

টিবিং আস্তে আস্তে ঢাকনাটা খুললেন।

 

ভেতরের জিনিসটার দিকে তাকিয়ে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলেন এটাই সেই কি-স্টোন। পাথরের চোঙাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন টিবিং খোঁদাই করা অক্ষরের ডায়ালটা দেখলেন। জিনিসটা তার কাছে খুবই পরিচিত বলে মনে হলো।

 

দা ভিঞ্চির ডায়রি থেকে নক্সা করা হয়েছে, সোফি বললো। আমার দাদু শখের বশে এটা বানিয়েছিলেন।

 

অবশ্যই। টিবিং বুঝতে পারলেন। তিনি স্কেচ আর নক্সাটা দেখেছেন। এই পাথরের ভেতরেই হলি গ্রেইল খুঁজে পাবার মূল চাবিকাঠিটা রয়েছে। টিবিং ভারি ক্রিপ্টেক্সটা বাক্স থেকে তুলে নিয়ে আলতো করে সেটা ধরলেন। যদিও তিনি জানেন

 

চোঙাটা কীভাবে খোলা যায়, তারপরও তার মনে হলো তাঁর নিয়তি এটার ভেতরেই শায়িত রয়েছে। ব্যর্থ মুহূর্তগুলোতে টিবিং নিজেকে প্রশ্ন করতেন, এই জীবনে তিনি ওটার খোঁজ পাবেন কিনা। এখন এসব সন্দেহ চিরতরের জন্য চলে গেছে। তিনি সেই প্রাচীন কথাটা শুনতে পেলেন…গ্রেইল কিংবদন্তীর মূল ভিত্তি সেটা :

 

ভূ নো ক্রভেজ পাস লো সেনগ্রাল, সেস্ত লো সেনগ্রল কুয়ে ক্ৰভ।

 

তোমাকে গ্রেইল খুঁজতে হবে না, গ্রেইলই তোমাকে খুঁজে নেবে।

 

আজ রাতে বিস্ময়করভাবেই হলি গ্রেইলের খোঁজ করার চাবিটা তাঁর দরজায় হেটে এসেছে।

 

যখন সোফি আর টিবিং বসে বসে ক্রিপ্টেক্সটার পাসওয়ার্ড কি হতে পারে সে নিয়ে কথা বলে যাচ্ছিলো, ল্যাংডন তখন রোজউড বাক্সটা ঘরের অন্য পাশে আলোর কাছাকাছি একটা টেবিলে নিয়ে গেলো সেটা ভালো করে দেখার জন্য। এইমাত্র টিবিং যা বলেছেন সেটা তার মাথায় ঘুর ঘুর করছে।

 

হলি গেইলের চাবিকাঠিটা, গোলাপের চিত্রে নিচে লুকায়িত আছে।

 

ল্যাংডন বাক্সটা আলোর সামনে তুলে ধরে গোলাপ চিহ্নটা পরীক্ষা করে দেখলো। চিত্রকলার সাথে তার পরিচয় থাকলেও সেটা কাঠের কাজ কিংবা খোঁদাই করা কোন কিছুর সাথে নয়।

 

ল্যাংডন গোলাপটার দিকে আবার তাকালো।

 

গোলাপের নিচে।

 

সাব রোসা।

 

সিক্রেট।

 

তার পেছনে একটা কিছু টের পেয়ে সে ঘুরে তাকালো। অন্ধকার, ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলো না। টিবিংয়ের গৃহপরিচারক খুব সম্ভবত এদিক দিয়ে চলে গেছে। ল্যাংডন আবারো বাক্সটার দিকে তাকালো। সে অঙ্কিত গোলাপটা আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে দেখলো।

 

বাক্সটা খুলে ঢাকনাটার ভেতরে ভালো করে দেখলো সে। খুব মসৃন সেই জায়গাটা। বাক্সটা উল্টে দেখতে পেলো ভেতরের দিকে ছোট্ট একটা ছিদ্র রয়েছে। ঠিক মাঝখানে। ল্যাংডন ঢাকনাটা বন্ধ করে উপরের দিক থেকে দেখলো। কোন ছিদ্র নেই।

 

এটা এপাশ ওপাশ দিয়ে ছিদ্র করা নয়।

 

টেবিলের ওপর বাক্সটা রেখে ঘরটার চারপাশ দেখে নিয়ে একটা কাগজের বান্ডিল আর পেপার ক্লিপ নিয়ে আসলো সে। বাক্সটা খুলে ছিদ্রটা আবারো ভালো করে দেখলো। সাবধানে ক্লিপটার বাঁকানো আকৃতি সোজা করে ছিদ্রটার ভেতরে ঢুকিয়ে আলতো করে একটা ধাক্কা দিলো। টেবিলে খট করে কিছু একটার আওয়াজ শুনতে পেলো সে। ল্যাংডন ঢাকনাটা বন্ধ করে দেখলে কী হচ্ছে। কাঠের গোলাপটা ঢাকনা থেকে খুলে টেবিলে পড়ে আছে।

 

নির্বাক ল্যাংডন গোলাপটা যেখানে ছিলো সেই খালি জায়গাটার দিকে তাকিয়ে রইলো। সেখানে খোঁদাই করা কাঠে নিখুঁত হাতে লেখা একটা টেক্সট। এমন একটা ভাষায় সেটা লেখা যা এর আগে সে কখনও দেখেনি। অক্ষরগুলো দেখে মনে হচ্ছে সেমিটিক, ল্যাংডন মনে মনে বললো। তারপরও সেটা আমি চিনতে পারছি না!

 

তার পেছনে হঠাৎ করে একটা কিছুর আবির্ভাবে সে সজাগ হয়ে উঠলো। আচম্‌কা প্রচণ্ড জোড়ে ঘুষি তার মাথায় আঘাত করলে ল্যাংডন হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো। পড়ে যেতেই সে একটা ফ্যাঁকাশে ভূতকে তার উপর উড়তে দেখলো। ভূতটার হাতে অস্ত্র। তারপর সব অন্ধকার হয়ে গেলো।

 

 

 

৬৫.

 

সোফি নেভু আইন-প্রয়োগকারী সংস্থায় কাজ করলেও আজকের আগে বন্দুকের নলের সামনে পড়েনি। অস্ত্রটা এক অতিকায় শেতি লোকের সাদা ফ্যাঁকাশে হাতে ধরা। লোকটা লম্বা আর সাদা চুলের। সে সোফির দিকে লাল চোখে তাকালো যাতে ভীতিকর কিছু আছে। যেনো অশরীরী এক আত্মা। একটা উলের আলখেল্লা পরা, দেখে মনে হচ্ছে মধ্যযুগের একজন পাদ্রী। লোকটা কে সে সম্পর্কে সোফির কোন ধারণা নেই, তবে হঠাৎ করেই তার মনে টিবিং সম্পর্কে একটা শ্রদ্ধাভাব জাগ্রত হলো, কেনো টিবিং সন্দেহ করেছিলেন এসবের পেছনে চার্চ জড়িত রয়েছে।

 

তোমরা জানো আমি কেন এসেছি, পাদ্রী বললো, তার কণ্ঠস্বর ফ্যাসফ্যাসে।

 

সোফি আর টিবিং সোফায় বসে ছিলো, তারা দুহাত উপরে তুলে ধরলো আক্রমণকারীর নির্দেশে। ল্যাংডন মাটিতে পড়ে গোঙাচ্ছে। পাদ্রীর চোখ সঙ্গে সঙ্গে টিবিংয়ের কোলে রাখা কি-স্টোনটার দিকে গেলো।

 

টিবিংয়ের কণ্ঠস্বর তখনও দৃঢ়। তুমি এটা খুলতে পারবে না।

 

আমার টিচার খুবই জ্ঞানী ব্যক্তি, পাত্রী জবাব দিলো। আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে অস্ত্রটা সোফি আর টিবিংয়ের মাঝখানে ধরলো।

 

সোফি ভাবতে লাগলো টিবিংয়ের গৃহপরিচারক কোথায়। সে কি রবার্টের পড়ে যাওয়াটা শুনতে পায়নি।

 

তোমার টিচার কে? টিবিং জিজ্ঞেস করলেন। হয়তো আমরা টাকা-পয়সার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে পারি।

 

গ্রেইল অমূল্য। সে আরেকটু কাছে এগিয়ে আসলো।

 

তোমার রক্ত ঝড়ছে, টিবিং খুব শান্তভাবে পাত্রীর ডান দিকের গোড়ালী বেয়ে রক্ত পড়ার দিকে ইঙ্গিত করলো। তুমি তো খোঁড়াচ্ছো।

 

ঠিক তোমার মতো, পাদ্রী জবাব দিলো। টিবিংয়ের ক্রাচের দিকে ইঙ্গিত করলো সে।এবার কি-স্টোনটা আমাকে দিয়ে দাও।

 

কি-স্টোন সম্পর্কে তুমিও জানো? টিবিং বললেন। কথা শুনে মনে হলো, খুব অবাক হয়েছেন।

 

আমি কি জানি সেটা বাদ দাও। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াও, তারপর এটা আমাকে দিয়ে দাও।

 

আমার জন্য দাঁড়ানো খুব কষ্টকর।

 

একেবারে ঠিক। কেউ নড়বে না, সেটাই আমি চাই।

 

টিবিং তার ডান দিকের ক্রাচটা ধরে বাম হাতে কি-স্টোনটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়ালেও একটু কাঁপছেন তিনি।

 

পাদ্রী কয়েক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। অস্ত্রটা এবার ঠিক টিবিংয়ের মাথার দিকে তা করলো সে। সোফি চেয়ে চেয়ে দেখছে, পাদ্রী কি-স্টোনটা নেবার সময় নিজেকে তার খুব অসহায় বলে মনে হলো।

 

তুমি সফল হবে না, টিবিং বললেন। কেবল যোগ্য লোকই এটা খুলতে পারবে।

 

ঈশ্বরই বিচার করে, কে যোগ্য, সাইলাস ভাবলো। খুব ভারি কিন্তু, হাতটা বাড়াতে বাড়াতে টিবিং বললেন। তুমি যদি এটা নিতে দেরি করে তবে আমি কিন্তু এটা ফেলে দেবো।

 

সাইলাস কি-স্টোনটা নেবার জন্য এগিয়ে আসলো। এগিয়ে আসতেই ক্রাচে ভর দেয়া লোকটা ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। ক্রাচটা ফসকে গিয়ে ডান দিকে পড়ে যেতে লাগলেন টিবিং। না! সাইলাস কি-স্টোনটা বাঁচাতে এক হাত বাড়িয়ে দিলো, এতে করে অটা নিচের দিকে কাত হয়ে যাওয়ায় কি-স্টোনটা তার কাছ থেকে সরে গেলো। লোকটা ডানদিকে পড়তেই কি-স্টোনটা সোফায় ফেলে দিলেন। ঠিক একই সময়ে মেটাল কাঁচটার নিচ থেকে একটা মুখ খুলে গেলো, টিবিংই সেটা করেছেন, সেটার ভেতর থেকে ধারালো কিছু একটা বের হয়েছে, আর সেটা সাইলাসের পায়ে বিধে দেয়া হলো।

 

প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সাইলাসের শরীরটা বেঁকে গেলো, কারণ ক্ৰাচটা তার সিলিস-এ আঘাত করেছে। সাইলাস হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো। একটা গর্জন দিয়ে পিস্তলটা হাত থেকে ফেলে দিলো সে। বুলেটটা ঘরের মেঝের এক কোনে গিয়ে বিঁধলো। পিস্তলটা আবার তুলে গুলি করার আগেই পা দিয়ে সজোড়ে তার চোয়ালে আঘাত হানলে সোফি।

 

 

 

বাড়ির বাইরে প্রবেশ পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোলেত গুলির শব্দটা শুনতে পেলো। ফশে ইতিমধ্যেই রওনা দিয়ে দেয়াতে ল্যাংডনকে ধরতে পারার ব্যক্তিগত কৃতিত্বের দাবিটা হাতছাড়া হয়েই গেছে। কোলেত ফশের ইগোকে আর পরোয়া করবে না বলে স্থির করলো।

 

একটা আবাসিক বাড়ির ভেতরে অস্ত্র থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে, আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রবেশ পথে অপেক্ষা করছিলে?

 

কোলেত জানতো সুযোগটা এসে গেছে। সে আরো জানতো, যদি আর এক মুহূর্তও দেরি করে তবে তার ক্যারিয়ারটাই সকালের মধ্যে ইতিহাস হয়ে যাবে। প্রবেশ পথের লোহার গেটের দিকে তাকিয়ে সে তার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললো।

 

আসো, গেটটা খুলে ফেলল।

 

 

 

একটা ঘোরের মধ্যেই গুলির আওয়াজটা শুনতে পেলো ল্যাংডন, যন্ত্রণার সুতীব্র চিৎকারটাও শুনলো। তার নিজের? তার মাথার পেছনে একটা বিশাল হাতুড়ির আঘাত

 

লেগেছে যেনো। কাছেই কোথাও লোকজনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।

 

তুমি কোথায়, কোন নরকে আছছ? টিবিংয়ের কণ্ঠটা শোনা গেলো।

 

দ্রুত এসে হাজির হয়েছে গৃহপরিচারক। কি হয়েছে? হায় ঈশ্বর! এই লোকটা কে? আমি পুলিশকে ফোন করছি।

 

আরে রাখো! পুলিশকে ফোন কোরো না। কাজে লেগে যাও, কিছু একটা নিয়ে আসো যাতে এই দৈত্যটাকে বেঁধে রাখা যায়।

 

আর কিছু বরফ! সোফি তাকে বললো।

 

ল্যাংডনের কানে আরো কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। লোকজনের চলাচল। এখন সে সোফাতে। সোফি তার মাথায় একটা বরফের পঠি ধরে রেখেছে। তার মাথা প্রচণ্ড ব্যথা করছে। ল্যাংডনের দৃষ্টি পরিষ্কার হতেই সে দেখতে পেলো মেঝেতে একটা দেহ পড়ে রয়েছে। আমার কি হেলুসিনেশন হচ্ছে। বিশাল আকৃতির শ্বেতকায় এক পাদ্রীকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে, তার মুখ টেপ দিয়ে আঁটকানো, আর লোকটার ডান ঊরু থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে।

 

ল্যাংডন সোফির দিকে তাকালো। এই লোকটা কে? হয়েছেটা কি?

 

টিবিং তার সামনে এসে বললেন, আপনি একজন নাইটের ছুরির কল্যাণে এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন, জিনিসটা একমে অর্থোপোডিক কর্তৃক নির্মিত।

 

হাহ ল্যাংডন উঠে বসার চেষ্টা করলো।

 

সোফি আততা করে হাত দিয়ে চাপ দিলো। এক মিনিট আরাম করো, রবার্ট।

 

আমার মনে হচ্ছে, টিবিং বললেন, আমি আপনার মেয়েবন্ধুকে এইমাত্র দূর্ভাগ্যজনকভাবে পাওয়া আমার সুবিধার প্রদর্শন করতে পেরেছি। মনে হচ্ছে সবাই আপনাকে খুব হাল্কা করে দেখে।

 

নিজের আসন থেকেই ল্যাংডন পাদ্রীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলো কী ঘটেছে।

 

সে একটা সিলিস পরে আছে, টিবিং বোঝাতে লাগলেন।

 

কি?

 

টিবিং ঊরুতে আঁটকানো লোহার তৈরি কাটাতারের বেল্টটার দিকে ইঙ্গিত করলেন। একটা ডিসিপ্লিন বেস্ট সে তার ঊরুতে পরেছে। আমি খুব সর্তকভাবে লক্ষ্য করে মেরেছিলাম।

 

ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো। সে ডিসিপ্লিন বেল্টটার সম্পর্কে জানে। কিন্তু কিভাবে…আপনি জানলেন?

 

টিবিং দাঁত বের করে হাসলেন। খৃস্ট ধর্ম হলো আমার গবেষণার বিষয়, রবার্ট। কয়েকটা ধর্মীয় গোষ্ঠীই এরকম জিনিস ব্যবহার করে থাকে।

 

ওপাস দাই, ল্যাংডন ফিসফিস্ করে বললো। তার মনে পড়ে গেলো সাম্প্রতিক সময়ে বোস্টনের কয়েকজন বিখ্যাত ব্যবসায়ীর ওপাস দাইর সদস্য পদ নেবার সংবাদটার কথা। এরকম একজন সদস্যই এখন ল্যাংডনের সামনে পড়ে আছে।

 

টিবিং রক্তাক্ত বেল্টটার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলেন। কিন্তু ওপাস দাই কেন হলি গ্রেইল খোঁজার চেষ্টা করবে?

 

রবার্ট, উডেন বক্সটার কাছে গিয়ে সোফি বললো। এটা কি? ঢাকনা থেকে খোলা ছোট গোলাপটা হাতে নিয়ে সোফি বললো।

 

এটা বক্সটার মধ্যে একটা লেখাকে ঢেকে রেখেছিলো। আমার মনে হয় লেখাগুলো হয়তো কি-স্টোনটা খুলতে সাহায্য করবে।

 

সোফি আর টিবিং কিছু বলার আগেই আধমাইল দূর থেকে পুলিশের সার্চলাইটের নীল আলোর বন্যা এসে পড়লো তাদের ঘরের মধ্যে, সেই সাথে সাইরেনের শব্দ। টিবিং চিন্তিত হয়ে পড়লেন। আমার বন্ধুরা, মনে হচ্ছে আমাদেরকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আর সেটা নিতে হবে খুব দ্রুত।

 

 

 

৬৬.

 

কোলেত এবং তার এজেন্টরা স্যার লেই টিবিংয়ের এস্টেটের ভেতরে সশস্ত্র অবস্থায় হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো। ঘরের মধ্যে ঢুকেই বাড়ির প্রথম তলার সবগুলো ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজলে তারা! ড্রইংরুমের মেঝেতে বুলেটের একটা গর্ত খুঁজে পেলো। ধস্তাধস্তির চিহ্নও দেখা গেলো সেখানে। কয়েক ফোঁটা রক্ত, অদ্ভুত একটা কাঁটা তারের বেষ্ট আর ব্যবহৃত টেপের কিছু অংশ। পুরো তলাটা মনে হলো একেবারে ফাঁকা।

 

কোলেত তার লোকজনদেরকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে বেসমেন্টে তল্লাশী করার জন্য পাঠাবার ঠিক আগেই উপর থেকে কিছু কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো।

 

তারা উপরের তলায় আছে!

 

চওড়া সিঁড়িটা দিয়ে উঠে কোলেত আর তার লোকজন বিশাল বাড়ির প্রতিটি ঘরই এক এক করে খুঁজে দেখলো। তারা যতোই এগোতে লাগলো কণ্ঠটা ততোই বেশি শোনা যেতে লাগলো। দীর্ঘ হলওয়ের শেষ মাথা থেকে সম্ভবত শব্দটা আসছে। এজেন্টরা করিডোর আর প্রতিটি বিকল্প পথ সিল করে দিলো।

 

শেষ বেডরুমটার কাছে পৌঁছাতেই কোলেত দেখতে পেলো ঘরটার দরজা খোলা। কণ্ঠটা আচমকা থেমে গেলো, এবার একটা ঘঘ শব্দ শোনা যেতে লাগলো, যেনো কোনো হনের শব্দ।

 

হাত দিয়ে ইশারা করে কোলেত সিগনাল দিলো। নিঃশব্দে দরজার খুব কাছে এসে পড়লো সে। ভেতরে ঢুকেই বাতির সুইচটা খুঁজে পেলো। সুইচটা চেপে বাতি জ্বালালো কোলেত। ভেতরে ঢুকেই অন্ত্রটা তা করলো…কিন্তু কিছুই নেই।

 

একটা ফাঁকা গেস্টরুম।

 

গাড়ির ইঞ্জিনের ঘবৃষ শব্দটা বিছানার পাশে রাখা কালো ইলেকট্রনিক প্যানেল থেকে আসছে। কোলেত এসব জিনিস বাড়ির অন্য ঘরেও দেখেছে। এক ধরনের ইন্টারকম সিস্টেম। সে ওটার দিকে ছুটে গেলো। প্যানেলটার প্রায় এক ডজন বাটন আছে :

 

স্টাডি…কিচেন,..লড়ি…সেলার

 

তো আমি কোথেকে গাড়ির শব্দটা শুনতে পেলাম?

 

মাস্টার বেডরুম…সানরুম…বার্ন…লাইব্রেরি…

 

বার্ন, মানে গোলাঘর কোলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিচে নেমে পেছনের দরজার দিকে ছুটে গেলো একজন এজেন্টকে সঙ্গে নিয়ে। তারা একটা গোলাঘরের কাছে এসে দাঁড়ালো। ভেতরে প্রবেশ করার আগেই অপসৃয়মান গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেলো সে। অস্ত্রটা তুলে ভেতরে ঢুকেই আলো জ্বালিয়ে দিলো এবার।

 

গোলা ঘরের ডানদিকে একটা ওয়ার্কশপ-ঘাস কাটার যন্ত্র, অটোমোটিভ টুলস, বাগানের যন্ত্রপাতি। কাছের দেয়ালেই সেই একই রকমের ইন্টারকম প্যানেল। এর একটা বাটন নিচে নামানো। চালু আছে যন্ত্রটা।

 

গেস্টবেডরুম-২

 

কোলেত ঘুরে দাঁড়ালো, রেগেমেগে আগুন সে। তারা ইন্টারকমের মাধ্যমে আমাদেরকে উপর তলায় টোপ দিয়ে নিয়ে গেছে! গোলাঘরের অন্য পাশটায় গিয়ে দেখা গেলো একটা ঘোড়া রাখার স্টলের সারি, কিন্তু কোন ঘোড়া নেই। মালিক ভিন্ন ধরনের অশ্বশক্তিই বেশি পছন্দ করে বলে মনে হচ্ছে স্টলগুলো গাড়ি রাখার পার্কিং এলাকা হিসেবে বদলে নেয়া হয়েছে। সংগ্রহটা খুবই চমকপ্রদ-একটা কালো ফেরারি, প্রিস্টিন রোস রয়েস, পুরনো অ্যাস্টন মার্টিন স্পোটর্স কু, একটা ভিনটেজ পোরশে ৩৫৬।

 

শেষ স্টলটা খালি।

 

কোলেত দৌড়ে গিয়ে দেখলো স্টলের মাটিতে তেল পড়ার দাগ রয়েছে। তারা কম্পাউন্ড থেকে চলে যেতে পারবে না। বের হবার গেটটা দুটো প্যাট্রল গাড়ি দিয়ে ব্যারিকেড করা আছে।

 

স্যার? এক এজেন্ট স্টলের কাছে ইঙ্গিত করলো।

 

গোলাঘরের দরজাটা খোলা, সেখান থেকে অন্ধকারের দিকে একটা পথ চলে গেছে, কাছেই একটা ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে দেখলো কোন হেডলাইট দেখা যাচ্ছে না। এমন বন-জঙ্গল আর ঝোপ-ঝাড় দিয়ে কেউ যেতে পারবে বলে কোলেতের মনে হলো না। কিছু লোককে ওখানে পাঠিয়ে দাও। তারা হয়তো খুব বেশিদূর যেতে পারেনি, কাছেই কোথাও আঁটকে গেছে। এইসব ফ্যান্সি স্পোর্টসকার ঝোপ-ঝাড় দিয়ে যেতে পারে না।

 

উম, স্যার? এজেন্ট কাছেই একটা বোর্ডের দিকে ইঙ্গিত করলো, যেখানে অনেকগুলো চাবি ঝোলানো রয়েছে।

 

ডেইমলার…রোলস রয়েস.. অ্যাস্টন মার্টিন…

পোর্‌শে…

 

শেষ ঘরটা খালি।

 

কোলেত যখন ঘরটার নিচের লেখাটা পড়লো, বুঝতে পারলো সমস্যায় পড়ে গেছে সে।

 

 

 

৬৭.

 

রেঞ্জ রোভার গাড়িটা জাভা ব্ল্যাক পার্ল মডেলের, ফোর হুইল ড্রাইভ, মানসম্মত ট্রান্সমিশন, উচ্চ-শক্তির পলি প্রপিলিন ল্যাম্প আর রিয়ার লাইট ক্লাস্টার ফিটিংস রয়েছে এতে। স্টিয়ারিংটা ডান দিকে।

 

গাড়িটা চালাতে হচ্ছে না বলে ল্যাংডন খুব খুশি। টিবিংয়ের গৃহপরিচারক রেমি তার মনিবের নির্দেশে শ্যাতু ভিলের পেছন দিককার বিশাল ঝোপ-ঝাড় আর মাঠ দিয়ে পূর্ণিমার আলোতে অসম্ভব দক্ষতায় গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির কোন হেড লাইট জ্বালানো নেই, তারপরেও অন্ধকারে সে গাড়িটা দ্রুতবেগে চালিয়ে এস্টেটের বাইরে নিয়ে যেতে লাগলো। তার সামনে ঘন বনের অন্ধকার অবয়বটা দেখা যাচ্ছে।

 

ল্যাংডন কি-স্টোনটা কোলে নিয়ে সামনের সিটে বসে আছে, সোফি আর টিবিং পেছনের সিটে।

 

তোমার মাথার কি অবস্থা, রবার্ট? সোফি জিজ্ঞেস করলো, তার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

 

ল্যাংডন জোর করে একটা কাষ্ঠহাসি হাসলো। ভালো, ধন্যবাদ তোমাকে। যন্ত্রণাটা বেশ তীব্র ছিলো। আঘাতটার কারণে সে মারা যেতে বসেছিলো।

 

সোফির পাশে টিবিং ঘাড় বেঁকিয়ে পেছনের লাগেজ রাখার জায়গায় হাত-পা-মুখ বাধা পাদ্রীটার দিকে তাকালেন। পাদ্রীর অস্ত্রটা টিবিংয়ের কোলের উপর রাখা। দৃশ্যটা দেখে মনে হচ্ছে যেনো বৃটিশ সাফারি দলের একজন তার শিকারের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে।

 

আপনাকে আজ রাতে পেয়ে আমি খুব খুশি, রবার্ট, টিবিং বললেন। দাঁত বের করে হাসলেন, যেনো বহু বছর পর তিনি এমন মজা পেয়েছেন।

 

আপনাকে এসবে জড়িয়ে ফেলার জন্য দুঃখিত, লেই।

 

ওহ্, না, না। আমি সারা জীবন ধরে এরকম জড়িয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। টিবিং এবার চালকের আসনে বসা রেমির দিকে তাকালেন, পেছন থেকে তাকে টেপ দিয়ে তার কাঁধটা আটকে রেখেছেন টিবিং। মনে রেখো, কোন ব্রেক লাইট জ্বালানো যাবে না। দরকার হলে এমার্জেন্সি ব্রেকটা ব্যবহার করবে। আমি একটু জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতে চাই। বাড়ি থেকে তারা আমাদের দেখে ফেলুক সেটা আমি চাই না।

 

গাড়িটা গভীর জঙ্গলে আস্তে আস্তে ঢুকে গেলো। আকাশের জ্যোৎস্না গাছপালার ডালের কারণে ঢেকে আছে।

 

আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, ল্যাংডন ভাবলো। সামনে কী আছে তা আন্দাজ করেও উঠতে পারলো না সে। একেবারে নিকষ কালো অন্ধকার। গাড়ির বাম দিকে গাছপালার ডাল লাগলে রেমি ডান দিকে সরে যাচ্ছে। সে গাড়িটা যতোদূর সম্ভব সোজা চালাতে লাগলো।

 

তুমি খুব সুন্দর চালাচ্ছো, রেমি, টিবিং বললেন। যথেষ্টই ভালো। রবার্ট, যদি পারেন নিচের দিকে নীল রঙের বাটনটা চাপ দিন। দেখেছেন সেটা?

 

ল্যাংডন বাটনটা খুঁজে পেয়ে চাপ দিলো।

 

একটা হাল্কা হলুদ আলো তাদের গাড়ির সামনের পথে ছড়িয়ে পড়লো, ফগ লাইট, ল্যাংডন বুঝতে পারলো। তারা এতো ঘন জঙ্গলের ভেতরে এসে গেছে যে, একটু আধটু আলো বাইরে থেকে দেখা যাবে না।

 

ভালো, রেমি, টিবিং খুশির চোটে বললেন। বাতি জ্বলে গেছে। আমাদের জীবন তোমার হাতে এখন।

 

আমরা কোথায় যাচ্ছি? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

এভাবে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তিন কিলোমিটার যেতে হবে, টিবিং বললেন। তারপর উত্তর দিকে মোড় নেবো। কোন জলাশয় অথবা পড়ে থাকা গাছের সাথে ধাক্কা না খেলে আমরা হাইওয়ে ফাইভের দিকে চলে যাবো খুব সহজেই।

 

ল্যাংডন তার কোলে রাখা কি-স্টোনটার দিকে তাকালো। ঢাকনায় খচিত গোলাপটা আবার ঢাকনার উপরে লাগানো হয়েছে। যদিও তার মাথাটা ভনভন করছে তারপরও ইচ্ছে হলো গোলাপটা সরিয়ে সেই জায়গার লেখাটা পড়ে দেখতে। সে ঢাকনাটা আস্তে করে খুলতে যেতেই পেছন থেকে টিবিং তার কাঁধের উপরে হাত রাখলেন।

 

ধৈর্য ধরুন, রবার্ট। টিবিং বললেন। জায়গাটা উঁচু-নিচু আর ঘন অন্ধকার। কোন কিছু ভেঙে গেলে ঈশ্বর জানে কী হবে। আলোতেই যদি আপনি ভাষাটা চিনতে না পারেন তো অন্ধকারে সেটা কীভাবে চিনবেন? এটা দেখার জন্য সময় পাবেন খুব জলদিই।

 

ল্যাংডন জানে টিবিং ঠিকই বলেছেন। মাথা নেড়ে সে ঢাকনাটা বন্ধ করে দিলো।

 

পেছনে পড়ে থাকা পাদ্রীটা গোঙাচ্ছে এখন। বন্ধন মুক্ত হবার চেষ্টা করছে সে। আচমকা পাগলের মতো লাথি মারতে শুরু করলো এবার।

 

টিবিং পেছনের সিটের দিকে ঘুরে পিস্তলটা তার দিকে তাক করলেন। আমি তোমার অভিযোগের কোন কারণ দেখছি না, স্যার। তুমি আমার বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করে আমার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধুর মাথায় বেদম আঘাত করেছে, এই মুহূর্তে তোমাকে গুলি করে জঙ্গলে ফেলে দেয়ার অধিকার আমার আছে। সেখানে পচে মরবে তুমি।

 

পাদ্রী নিচুপ হয়ে গেলো।

 

আপনি কি নিশ্চিত, তাকে আমাদের সাথে নেয়াটা ঠিক হচ্ছে? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

 

একদমই নিশ্চিত! টিবিং আতিশয্যে বললেন। আপনি খুনের মামলার ফেরারী, রবার্ট। এই বদমাশটা আপনার মুক্ত হবার টিকেট। পুলিশ আপনাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে আমার বাড়ি পর্যন্ত এসে পড়েছে।

 

এটা আমারই দোষ, সোফি বললো। ব্যাংকের ট্রাকটাতে সম্ভবত ট্রান্সমিটার লাগানো ছিলো।

 

সেটা নয়, টিবিং বললেন। পুলিশ আপনাকে খুঁজে পেয়েছে এতে আমি অবাক হইনি। আমি অবাক হয়েছি এই ওপাস দাইর লোকটা আপনাকে খুঁজে পাওয়াতে। আপনি আমাকে যা বলেছেন তাতে মনে হচ্ছে এই লোকটার সাথে জুডিশিয়াল পুলিশ অথবা জুরিখ ডিপোজিটরি ব্যাংকের যোগাযোগ না থেকে পারে না।

 

ল্যাংডন কথাটা বিবেচনা করলো। বেজু ফশে নিশ্চিত করেই ল্যাংডনকে বলির পাঠা বানানোর পায়তারা করছে। আর ব্যাংকার ভার্নেটের আচরণও তার কাছে বোধগম্য বলে মনে হচ্ছে এখন।

 

এই পাদ্রী একা একা কাজ করছে না, রবার্ট, টিবিং বললেন, আর আপনারা যততক্ষণ না জানতে পারছেন এর পেছনে কে আছে ততোক্ষণ দুজনেই নিরাপদ নন। ভালো খবর এই যে, এখন আপনারা বেশ ভালো অবস্থায় আছেন, বন্ধু। আমার পেছনে ফেলে রাখা এই দৈত্য সেই তথ্যটা জানে, আর যে লোক এই সূতা নাড়াচ্ছে সে এখন ভীষণ ঘাবড়ে আছে।

 

রেমি গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো। এবার গাড়িটা বেশ আরামেই চালাতে পারছে সে। গাড়ির চাকায় অল্প-বিস্তর পানির ছিটা লাগছে।

 

রবার্ট, আপনি কি ঐ ফোনটা আমার হাতে একটু দেবেন? টিবিং গাড়ির ড্যাশে রাখা ফোনটার দিকে ইঙ্গিত করলেন।

 

ল্যাংডন সেটা তাঁকে দিলে টিবিং একটা নাম্বার ডায়াল করতে লাগলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ফোনটাতে টিবিং কণ্ঠ শুনতে পেলেন। রিচার্ড? আমি কি তোমার ঘুম ভাঙালাম? অবশ্যই, ঘুম ভাঙিয়েছি। হাস্যকর প্রশ্ন। আমি দুঃখিত। একটা ছোট্ট সমস্যায় পড়ে গেছি। আমার শরীর একটু খারাপ লাগছে। চিকিৎসার জন্যে রেমি আর আমার একটু আইল্যান্ডে যাবার দরকার, আর সেটা এক্ষুণি। আগে না জানানোর জন্য দুঃখিত। তুমি কি বিশ মিনিটের মধ্যে এলিজাবেথকে প্রস্তুত করতে পারবে? আমি জানি, একটু আপ্রাণ চেষ্টা করো। একটু বাদেই দেখা হচ্ছে। ফোনটা তিনি রেখে দিলেন।

 

এলিজাবেথ? ল্যাংডন বললো।

 

আমার প্লেন। তার দাম আমার কাছে রাণীর হীরার মতোই।

 

ল্যাংডন তার দিকে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকালো।

 

কি? টিবিং জানতে চাইলেন। জুডিশিয়ার পুলিশের পুরো দলটা আপনাদের পেছনে লেগে যাবার পরে আপনারা ফ্রান্সে থাকার প্রত্যাশা করতে পারেন না। লন্ডনই হবে আপনাদের জন্য বেশি নিরাপদ।

 

সোফিও টিবিংয়ের দিকে ঘুরে তাকালো। আপনি মনে করেন আমাদের দেশ ত্যাগ করা উচিত?

 

বন্ধুরা আমার, আমি এই ফ্রান্সের চেয়ে অন্যত্র সভ্য কোন দেশে অনেক বেশি ক্ষমতাবান। তাছাড়া গ্রেইলের কথঅ যদি বলেন, ধারণা করা হয় ওটা গ্রেট বৃটেনেই আছে। আমরা যদি কি-স্টোনটা খুলতে পারি তবে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, আমরা একটা মানচিত্র পাবো, যাতে বৃটেনের কথাই থাকবে।

 

আপনি খুব বেশি ঝুঁকি নিচ্ছেন, সোফি বললো, আমাদেরকে সাহায্য করে। ফরাসি পুলিশে আপনি কোন বন্ধু পাবেন না।

 

টিবিং একটা বেপরোয়া অভিব্যক্তি দিলেন। ফ্রান্সের সাথে আমার সব চুকেবুকে গেছে। আমি এখানে এসেছিলাম কি-স্টোনটার খোঁজে। সেই কাজ হয়ে গেছে। শ্যাতু ভিলেটা আর না দেখতে পারলে আমার কিছুই এসে যাবে না।

 

সোফিকে একটু ইতস্তত মনে হলো। আমরা এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি কিভাবে পার হবো?

 

টিবিং মুচকি হাসলেন। আমি লো বোর্গো থেকে ফ্লাই করি। ওটা একটা এক্সিকিউটিভ এয়ারফিল্ড, এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। ফরাসি ডাক্তাররা আমাকে নার্ভাস করে ফেলে তাই দুসপ্তাহে একবার আমি ইংল্যান্ডে প্লেনে করে চলে যাই। দুই দেশেই আমি একটা বিশেষ ধরনের সুবিধা পাওয়ার জন্য টাকা দিয়ে থাকি। একবার প্লেনে ওঠার পর আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন ইউএস অ্যামবাসির কারো সাথে দেখা করবেন কি না।

 

ল্যাংডন এ মুহূর্তে ইউএস অ্যামবাসির সাথে কিছু করতে চাইছে না। সে শুধু কি স্টোনটার কথাই ভাবছে। মনে মনে ভাবলো, টিবিং বৃটেন সম্পর্কে যা বলছে তা যদি সত্য হতো। এটা ঠিক, আধুনিক গ্রেইল কিংবদন্তীর মতে গ্রেইলটা যুক্তরাজ্যেই আছে। এমনকি নাইট আর্থারের মিথ, যা আইল অব আভালন-এর কথা বলেছে, এখন বিশ্বাস করা হয় সেই জায়গাটা আসলে ইংল্যান্ডের গ্লাসটনবেরি। গ্রেইলটা যেখানে থাকুক, ল্যাংডন কখনও ভাবেনি সে সত্যি ওটা খোঁজ করবে। স্যাংগৃল দলিল দস্তাবেজগুলো। যিশুখৃস্টের সত্যিকারের কাহিনীটা। ম্যারি মাগদালিনের সমাধি।

 

স্যার? রেমি বললো। আপনি কি সত্যি ভাবছেন চিরতরের জন্য ইংল্যান্ডে চলে যাবেন?

 

রেমি, এই নিয়ে তোমার উদ্বিগ্ন হবার দরকার নেই, টিবিং তাকে আশ্বস্ত করলেন। আমি আশা করছি তুমিও আমার সাথে ওখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাবে। আমি ডেভনশায়ারে একটা চমৎকার ভিলা কেনার কথা ভাবছি। আর আমরা তোমার সবকিছু ওখান থেকে দ্রুত এখানে নিয়ে আসবো। একটা রোমাঞ্চকর অভিযান, রেমি। একটা অভিযান!

 

ল্যাংডনকে হাসতেই হলো। উদাসভাবে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে জঙ্গলটা অতিক্রম করতে দেখলো। আজ রাতের সংকট সত্ত্বেও ল্যাংডন তার চমৎকার সঙ্গীর জন্য ধন্যবাদ দিলো নিজেকে।

 

কয়েক মিনিট এভাবে চলার পর ল্যাংডন আচমকা অনুভব করলো সোফি তার দিকে ঝুঁকে কাঁধে হাত রেখেছে। তুমি ঠিক আছো?

 

ল্যাংডন দেখতে পেলো তার ঠোঁটে একটা মুচকি হাসি, বুঝতে পারলো সে নিজেও এখন হাসছে।

 

 

 

রেঞ্জরোভারের পেছনে শুয়ে থেকে সাইলাস নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। তার হাত-পা শক্ত করে বাঁধা। গাড়ির প্রতিটি ঝাঁকুনিতেই তার দোমড়ানো-মোচড়ানো কাঁধটাতে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। যাইহোক, তার পাকড়াওকারীরা অন্ততপক্ষে সিলিসটা খুলে ফেলেছে। মুখ বাঁধা থাকার জন্য তাকে নাক দিয়েই নিঃশ্বাস নিতে হচ্ছে এখন। সেটাও ধুলো ময়লার জন্য বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছে। সে এবার কাশতে শুরু করলো।

 

আমার মনে হয় তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, রেমি বললো, তার কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা।

 

টিবিং কাঁধ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকালেন। তোমার ভাগ্য ভালো, তুমি একজন বৃটিশের পাল্লায় পড়েছে, টিবিং মুখের টেপটা খুলে দিলেন।

 

সাইলাসের মনে হলো তার মুখ দিয়ে যে বাতাসটা বুক ভরে নিলো সেটা ঈশ্বর তার জন্যে পাঠিয়েছে।

 

তুমি কার হয়ে কাজ করছো? বৃটিশ ভদ্রলোক জানতে চাইলেন।

 

আমি ঈশ্বরের জন্য কাজ করি।

 

তুমি ওপাস দাইর লোক, টিবিং বললেন। অবশ্য এটা কোন প্রশ্ন ছিলো না।

 

আপনি কিছুই জানেন না, আমি কে।

 

ওপাস দাই কি-স্টোনটা চাচ্ছে কেন?

 

সাইলাসের উত্তর দেবার কোন অভিপ্রায়ই নেই। কি-স্টোনটা হলি গ্রেইল খুঁজে পাওয়ার একমাত্র সংযোগ, আর হলি গ্রেইল হলো বিশ্বাস রক্ষার চাবিকাঠি।

 

আমি ঈশ্বরের কাজ করি। দ্য ওয়ে প্রায় সমাগত।

 

এখন রেঞ্জরোভারের ভেতরে এভাবে বন্দী হয়ে যাওয়াতে সাইলাসের মনে হলো, সে তার টিচার আর বিশপকে চিরতরের জন্য ব্যর্থ করে দিয়েছে। সে তাদেরকে ফোন করে এই অবস্থাটার কথাও জানাতে পারছে না। আমাকে যারা ধরেছে তাদের কাছে কি-স্টোনটা আছে। তারা আমাদের আগেই গ্রেইলটা পেয়ে যাবে! অন্ধকারেই সাইলাস প্রার্থনা করতে শুরু করলো।

 

একটা অলৌকিক, প্রভু। আমার দরকার একটা অলৌকিক।

 

সাইলাসের পক্ষে এটা কোনভাবেই জানা সম্ভব ছিলো না যে, এখন থেকে ঘণ্টাখানেক পরেই সে এটা পেয়ে যাবে।

 

রবার্ট? সোফি এখনও তার দিকে তাকিয়ে আছে। তোমার মুখে একটা কৌতুকের আভা দেখা গেলো এইমাত্র।

 

তোমার সেলফোনটা আমার একটু দরকার, সোফি।

 

এখন?

 

আমার মনে হয় আমি কিছু একটা বের করতে পেরেছি।

 

কি?

 

কিছুক্ষণ পরই বলছি। তোমার ফোনটা আগে দাও।

 

সোফিকে খুব চিন্তিত দেখালো। আমার আশংকা ফশে ট্রে করছে, সোফি তাকে ফোনটা দিয়ে বললো।

 

আমি যুক্তরাষ্ট্রে কিভাবে ডায়াল করবো?

 

তোমাকে রিভার্স চার্জ করতে হবে কারণ আমার ফোনের আটলান্টিকের ওপারের সার্ভিস নেই।

 

ল্যাংডন শূন্য ডায়াল করলো। সে জানতো পরবর্তী ষাট সেকেন্ডে একটা উত্তর পাওয়া যাবে, যা তাকে সারা রাত ধরে হতবিহ্বল করে রেখেছে।

 

 

 

৬৮.

 

নিউইয়র্ক এডিটর জোনাস ফকম্যান রাতে বিছানায় ঘুমোতে যেতেই ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন করার জন্য একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে, গজ গজ করতে করতে রিসিভারটা তুলে নিলেন।

 

অপারেটরের কণ্ঠ তাকে জিজ্ঞেস করলো : আপনি কি রবার্ট ল্যাংডনের ফোন কলের জন্য বিল দিতে প্রস্তুত আছেন?

 

হতভম্ব হয়ে জোনাস বাতি জ্বালালো। উহ্…অবশ্যই, রাজি আছি।

 

লাইনে একটা ক্লিক করে শব্দ হলো। জোনাস?

 

রবার্ট তুমি আমাকে ঘুম থেকে তুলে ফোনের বিল আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছো?

 

জোনাস, ক্ষমা করো আমায়, ল্যাংডন বললো। আমি খুব অল্প সময়ই নেবো। আমার সত্যি জানতে হবে, যে পাণ্ডুলিপিটা আমি তোমাকে দিয়েছি সেটা কি তুমি–

 

রবার্ট, আমি দুঃখিত, আমি জানি আমি বলেছিলাম সম্পাদিত কপিটা এই সপ্তাহে পাঠাবো। কিন্তু আমি কাজে আঁটকে গেছি। কথা দিচ্ছি পরের সোমবারে পেয়ে যাবে।

 

আমি সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন নই। আমার জানা দরকার তুমি কি তার কোন কপি আমাকে না জানিয়ে অন্য কাউকে দিয়েছো?

 

ফকম্যান ইতস্তত করলেন। ল্যাংডনের নতুন পাণ্ডুলিপিটা দেবী পূজার ইতিহাসের একটি উন্মোচন-তাতে ম্যারি মাগদালিনের কয়েকটা অধ্যায় আছে, যা নির্ঘাত বির্তকের ঝড় তুলবে। যদিও বিষয়বস্তুটা খুব ভালোভাবেই প্রমাণসহ উপস্থাপন করা হয়েছে, তারপরও কয়েকজন ইতিহাসবিদ এবং শিল্পবোদ্ধাকে খসড়াটা না দেখিয়ে সেটার ছাপার কোন অভিপ্রায় তার নেই। জোনাস শিল্পজগতের দশজন বিখ্যাত ব্যক্তিকে বেছে নিয়ে তাদের কাছে পাণ্ডুলিপিটার একটা করে কপি পাঠিয়েছেন, সেই সাথে একটা চিঠি লিখে বিনীতভাবে তাদেরকে একটা শর্টনোট লিখে দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন যেগুলো বইয়ের মলাটে যাবে। ফম্যানের অভিজ্ঞতা বলে, বেশিরভাগ লোকই নিজেদের নাম ছাপা অক্ষরে দেখার সুযোগ পেলে লাফিয়ে ওঠে।

 

জোনাস? ল্যাংডন চাপ দিলো। তুমি আমার পাণ্ডুলিপিটা পাঠিয়েছে, তাই না?

 

ফকম্যান চিন্তিত হলেন, আঁচ করতে পারলেন ল্যাংডন এই ব্যাপারটাতে খুশি হতে পারেনি। রবার্ট, আমি তোমাকে কিছু মন্তব্য দিয়ে চমকে দিতে চেয়েছিলাম।

 

একটা বিরতি। তুমি কি লুভরের কিউরেটরের কাছেও এক কপি পাঠিয়েছো?

 

তোমার কি মনে হয়? তোমার পাণ্ডুলিপিতে তার লুভর সংগ্রহের কথা কয়েকবারই উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর বইগুলো তোমার বিবলিওগ্রাফিতেও আছে। আর দেশের বাইরে বিক্রির জন্য লোকটার নাম থাকা খুবই দরকার।

 

অন্যপ্রান্তের নিরবতাটা দীর্ঘক্ষণ ধরে রইলো। তুমি কবে সেটা পাঠিয়েছো?

 

একমাস আগে। আমি এও উল্লেখ করেছিলাম, তুমি খুব শীঘ্রই প্যারিসে যাচ্ছে, আর তোমাকে বলে দিয়েছি তার সাথে যেনো আজ্ঞা দাও। সে কি তোমাকে ফোন করেছে দেখা করার জন্য? ফকম্যান একটু থামলেন। দাঁড়াও দাঁড়াও, এই সপ্তাহে তোমার কি প্যারিসে থাকার কথা না?

 

আমি এখন প্যারিসেই আছি। ফকম্যান উঠে দাঁড়ালেন। তুমি প্যারিস থেকে আমাকে ফোন করে সেই বিলটা আমার ওপর চাপাচেছা?

 

সেটা আমার বইয়েল রয়্যালটি থেকে কেটে নিও, জোনাস। তুমি কি সনিয়ের ফিরতি ফোনটা পেয়েছিলে। তিনি কি পাণ্ডুলিপিটা পছন্দ করেছিলেন?

 

আমি জানি না। এখনও তার সাথে কথা বলা হয়নি।

 

তো, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমি একটু দৌড়ের ওপরে আছি। এটুকু ব্যাখ্যাই আমার জন্য যথেষ্ট। ধন্যবাদ।

 

রবার্ট—

 

কিন্তু ল্যাংডন ফোনটা রেখে দিয়েছে।

 

ফকম্যান ফোনটা রেখে অবিশ্বাসে মাথা নাড়তে লাগলেন, লেখকেরা, তিনি ভাবলেন। এমনকি সবচাইতে সুস্থজনও পাগল হয়ে থাকে।

 

 

 

রেঞ্জরোভারের ভেতরে লেই টিবিং একটা বিস্মিত হবার অভিব্যক্তি করলেন। রবার্ট, আপনি বলছিলেন আপনি একটা পাণ্ডুলিপি লিখছেন যা সিক্রেট সোসাইটি নিয়ে, আর আপনার এডিটর সেটা সিক্রেট সোসাইটির এক সদস্যের কাছেই পাঠিয়ে দিয়েছে?

 

ল্যাংডন হতাশ হলো। তাই তো মনে হচ্ছে।

 

একটা নিমর্ম কাকতালীয় ব্যাপার, বন্ধু।

 

এটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয়, ল্যাংডন জানে। জ্যাক সনিয়েকে দেবী পূজা সংক্রান্ত কোন পাণ্ডুলিপির ব্যাপারে মন্তব্য করতে বলার মানে হলো, টাইগার উডসকে গলফ খেলার উপরে মন্তব্য করতে বলা। তারচেয়েও বড় কথা, দেবী পূজার উপরে কোন বইতে প্রায়োরি অব সাইনের উল্লেখ করাটা রীতিমতো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

এবার মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন, টিবিং বললেন। আপনি কি প্রায়োরিদের পক্ষে লিখেছিলেন, না বিপক্ষে?

 

ল্যাংডন টিবিংয়ের কথাটার মর্ম বুঝতে পারলো। অনেক ইতিহাসবিদই প্রশ্ন করেছেন, প্রায়োরিরা কেন এখন পর্যন্ত স্যাংগৃল দলিলগুলো লুকিয়ে রেখেছে। অনেকেই মনে করেন, তথ্যটা পৃথিবীবাসীকে অনেক আগেই জানানো উচিত ছিলো।

 

আমি প্রায়োরিদের অবস্থানের ব্যাপারে কোন মতামত দেইনি।

 

তার মানে?

 

ল্যাংডন বুঝতে পারলো টিবিং দলিলগুলো প্রকাশের পক্ষেই।

 

আমি কেবল ভ্রাতৃসংঘের ইতিহাসটা জানিয়েছি আর তাদেরকে আধুনিককালের দেবী পূজারী সোসাইটি হিসেবে বর্ণনা করেছি। গ্রেইলের রক্ষাকর্তা এবং ধারক, আর প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজের অভিভাবক হিসেবে।

 

সোফি তার দিকে তাকালো। তুমি কি কি-স্টোনটার কথা উল্লেখ করেছো?

 

ল্যাংডন কাচুমাচু খেলো। সে তা-ই করেছে। অসংখ্যবার। আমি বলেছি, কি স্টোনটা হতে পারে স্যাংগৃল দলিলগুলো খুঁজে পাবার দিক নির্দেশনা।

 

সোফিকে খুব অবাক মনে হলো। আমার মনে হয় এজন্যেই পি.এস রবার্ট ল্যাংডনকে খুঁজে বের করো কথাটা লেখা হয়ছিলো। এখন সেটা বোঝা যাচ্ছে।

 

ল্যাংডন আঁচ করলো, আসলে এটা অন্য কিছু, যা তার পাণ্ডুলিপিটাতে আছে, আর সেটাই সনিয়ের কৌতূহলের বিষয়। কিন্তু এই বিষয়টা এমন কিছু যা ল্যাংডন সোফিকে একান্তে বলতে চায়।

 

তো, সোফি বললো, তুমি ক্যাপ্টেন ফশের কাছে মিথ্যে বলেছিলে?

 

কোনটা? ল্যাংডন জানতে চাইলো।

 

তুমি তাকে বলেছিলে, আমার দাদুর সাথে তোমার কখনও যোগাযোগ হয়নি।

 

হ্যাঁ, যোগাযোগ হয়নি। আমার এডিটর উনার কাছে পাণ্ডুলিপিটা পাঠিয়েছে।

 

এটা ভেবে দ্যাখো, রবার্ট। ক্যাপ্টেন ফশে যদি পাণ্ডুলিপির এনভেলপটা খুঁজে না পায় সে এই সিদ্ধান্তে আসবে যে, এটা তুমিই পাঠিয়েছে। সে একটু থামলো। অথবা, তারচেয়েও খারাপ কিছু, তুমিই সেটা হাতে হাতে তার কাছে দিয়েছে, আর সে ব্যাপারটা অস্বীকার করে মিথ্যা বলছে।

 

***

 

রেঞ্জরোভারটা লো বোর্গরেত এয়ারফিল্ডে এসে পৌঁছালে রেমি গাড়িটা হ্যাংগারের দিকে চালিয়ে নিয়ে গেলো। তারা এগোতেই খাকি প্যান্ট শার্ট পরা এক শক্ত-সামর্থ লোক হাত নেড়ে তাদেরকে বিশাল লোহার দরজার দিকে ইশারা করলো। ওটার ভেতরে একটা সাদা জেট প্লেন দেখা যাচ্ছে।

 

ল্যাংডন চঞ্চ করা প্লেনটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

 

এটাই এলিজাবেথ?

 

টিবিং দাঁত বের করে হাসলেন।

 

লোকটা তাদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। একেবারে রেডি, স্যার, সে বৃটিশ উচ্চারণে বললো। দেরির জন্য ক্ষমা চাইছি, কিন্তু আপনি আমাকে হুট করেই খবর দিয়েছেন- গাড়ি থেকে তাদেরকে বের হতে দেখে সে একটু থামলো। সোফি আর ল্যাংডনের দিকে তাকালো, তারপর টিবিংয়ের দিকে।

 

টিবিং বললেন, আমার সহযোগী আর আমাকে লন্ডনে জরুরি একটা ব্যাপারে যেতে হবে। নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। রওনা হবার জন্য সব প্রস্তুত করো, প্লিজ। কথা বলার সময় পিস্তলটা ল্যাংডনের হাতে তুলে দিলো টিবিং।

 

অস্ত্রটার দিকে পাইলটের চোখ গেলো। টিবিংয়ের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো সে, স্যার, ক্ষমা করবেন। আমার ডিপ্লোমেটিক ফ্লাইটের অনুমতি কেবল আপনি আর আপনার চাকরের জন্য। আমি আপনার অতিথিদেরকে নিতে পারবো না।

 

রিচার্ড, উষ্ণ একটা হাসি দিয়ে টিবিং বললেন। দুহাজার পাউন্ড আর গুলি রা পিস্তলটা বলছে, তুমি আমার অতিথিদেরকে নিতে পারবে। তিনি রেরোভারটার দিকে ইঙ্গিত করলেন। আর সেই সাথে অভাগা একজন, যে গাড়ির পেছনে পড়ে রয়েছে, তাকেও।

 

 

 

৬৯.

 

হকার ৭৩১ টুইন গ্যারেট টিএফই-৭৩১-এর ইঞ্জিনটা সশব্দে চালু হলো। আকাশের দিকে মুখ করে রওনা হলো সেটা। জানালার বাইরে লো বোর্গরেত এয়ারফিটা ফেলে দ্রুত বেগে ছুটে চললো।

 

আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি, সোফি ভাবলো, তার শরীরটা সিটের পেছনে সেঁটে আছে। এই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত সে বিশ্বাস করতো, ফশের সাথে তার ইদুর-বেড়ালের খেলাটাকে ডিফেন্স-মিনিস্ট্রির কাছে যেভাবেই হোক গ্রহণযোগ্য করা যাবে। আমি একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিমাত্র। আমি আমার দাদুর মৃত্যুকালীন শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে চেষ্টা করেছি। সোফি জানে এই সুযোগটার দ্বার এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সে দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। কোন কাগজ-পত্র ছাড়া, একজন ফেরীকে সঙ্গে নিয়ে এবং হাত-পা বাঁধা একজন জিম্মিকে অপহরণ করেছে তারা। তোন সীমা যদি থেকে থাকে তবে সে সেটা অতিক্রম করে ফেলেছে। প্রায় শব্দের গতির মতো দ্রুততায়।

 

সোফি সামনের কেবিনে টিবিং আর ল্যাংডনের পাশে বসেছে। তাদের সামনে ছোট্ট একটা টেবিল। পাশে ছোট্ট একটা বোর্ডরুম। টিবিংয়ের গৃহপরিচারক পিস্তল হাতে বসে আছে, তার পায়ের কাছে হাত-পা বাধা পাত্রী যেনো কোনো লাগেজের মতো পড়ে আছে সেখানে।

 

কি-স্টোনের দিকে মনোযোগ দেবার আগে, টিবিং বললেন, আমি ভাবছি, আমাকে যদি আপনারা কিছু বলার অনুমতি দেন। তার কথাবার্তা শুনে খুব গুরুগম্ভীর মনে হচ্ছে। যেনো এক বাবা তাঁর সন্তানদের কাছে কোন বিষয়ে লেকচার দিচ্ছেন। বন্ধুরা আমার, আমি জানি আমি এই ভ্রমণের একজন অতিথি ছাড়া আর কিছুই না। আর এতেই আমি সম্মানিত বোধ করছি। তারপরও, একজন আজীবন গ্রেইল অশেষণকারী হিসেবে বলছি, আপনাদেরকে সর্তক করে দেয়াটা আমার দায়িত্ব, আপনারা এমন একটা পথে নামছেন যেখান থেকে ফিরে আসার কোন পথ নেই, বলাই বাহুল্য, এতে অনেক বিপদও রয়েছে। সোফির দিকে তাকালেন তিনি। মিস নে, আপনার দাদু আপনাকে ক্রিপ্টেটা দিয়ে গেছেন এই আশায় যাতে হলি গ্রেইলের সিক্রেটটা বেঁচে থাকে।

 

হ্যাঁ।

 

সঙ্গত কারণেই এ ঘটনার ফলাফল যাই হোক, আপনি সেটা মেনে নেবেন।

 

সোফি মাথা নেড়ে সায় দিলো। যদিও তার ভেতরে দ্বিতীয় আরেকটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আমার পরিবার সম্পর্কে সত্য কাহিনীটা! কি-স্টোনের সাথে সোফির অতীতের কোন সম্পর্ক নেই, এই আশ্বাসটা ল্যাংডন দিলেও সোফি আঁচ করলো এই ত্রিপ্টেক্স আর যাবতীয় রহস্যময় ঘটনাগুলোর সাথে তার নিজের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে খুব গভীরভাবেই।

 

আপনার দাদু এবং বাকি তিনজন আজ রাতে মারা গেছেন। টিবিং আবারো বলতে শুরু করলেন, আর তারা চেয়েছিলেন কি-স্টোনটা চার্চের হাত থেকে দূরে রাখতে। ওপাস দাই এটা দখলে নিতে একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছিলো। আশা করি আপনি বুঝেছেন, এতে করে আপনার অবস্থান এখন খুবই দায়িত্বপূর্ণ জায়গায়। আপনার কাছে একটা মশাল হস্তান্তর করা হয়েছে। দুহাজার বছরের প্রজ্জ্বলিত শিখাটাকে নিভিয়ে দেয়া যায় না। এই মশালটা ভুল কোন হাতেও দেয়া যায় না। তিনি থামলেন। রোজউড বক্সটার দিকে তাকালেন। আমি বুঝতে পেরেছি, এ ব্যাপারে আপনার কোন পছন্দ-অপছন্দ নেই, মিস নেভু, এখানকার বিপদটার কথাও ভাবুন, হয় আপনি এই দায়িত্বটা নিজেই বহন করবেন…নয়তো আপনাকে দায়িত্বটা অন্য কারোর কাছে দিয়ে দিতে হবে।

 

আমার দাদু ক্রিপ্টেক্সটা আমাকেই দিয়েছেন। আমি নিশ্চিত তিনি ভেবেছেন এই দায়িত্বটা আমি পালন করতে পারবো।

 

টিবিংকে উৎসাহ দেখালেও খুশি হয়েছেন বলে মনে হলো না। ভালো। এরকম দৃঢ়তার দরকার রয়েছে। তারপরও, আপনি নিশ্চয় জানেন কি-স্টোন সফলভাবে খুলতে পারাটা আরো বড় কিছুর সম্মুখীন করবে আপনাকে।

 

কিভাবে?

 

মাই ডিয়ার, ভাবুন, আচমকা আপনি এমন একটি মানচিত্র হাতে পেলেন যা হলি গ্রেইলের অবস্থানটা উন্মোচিত করছে। সেক্ষেত্রে আপনি এমন একটি সত্যের মালিক বনে যাবেন যা ইতিহাসকে চিরতরে বদলে দেবে। আপনি এমন একটি সত্যের ধারক হবেন লোকে যেটা শত শত বছর ধরে খুঁজে চলছে। আপনি তখন সত্যটা পৃথিবীকে জানানোর দায়িত্বের মুখোমুখি হবেন। এই কাজটা যে করবে তাকে অনেকেই শ্রদ্ধা করবে, আবার অনেকেই করবে ঘৃণা। প্রশ্ন হলো, এই কাজটা করার মতো প্রয়োজনীয় শক্তি আপনার আছে কি না।

 

সোফি চুপ রইলো। এটা আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।

 

টিবিংয়ের ভূরু কপালে উঠলো। না? কি-স্টোনের মালিক সেটা যদি না করে তবে করবেটা কে?

 

দীর্ঘদিন ধরে সিক্রেটটা যে ভ্রাতৃসংঘ রক্ষা করে গেছে তারা।

 

প্রায়োরিরা? টিবিংকে দেখে সন্দেহগ্রস্ত বলে মনে হলো, কিন্তু কিভাবে? তারা তো আজ রাতে শেষ হয়ে গেছে। তাদের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ ঘটেছে, হয় বাইরের কোন চর কিংবা নিজেদেরই ছদ্মবেশি কোন সদস্য। এই মুহূর্তে ভ্রাতৃসংঘের কেউ এ ব্যাপারে এগিয়ে আসলে আমি তাকে বিশ্বাস করতে পারবো না।

 

তাহলে আপনার উপদেশটা কি ওনি? ল্যাংডন বললো।

 

রবার্ট, আমার মতো আপনি জানেন, প্রায়োরিরা এই সিক্রেটটা এতোদিন ধরে রক্ষা করেছে কেবলমাত্র লুকানোর জন্যই না। তারা সঠিক একটি সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছে, যখন সিক্রেটটা পৃথিবীবাসীকে জানানো হবে। এমন একটা সময়ে যখন পৃথিবী এই সত্যটা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হবে।

 

আপনার বিশ্বাস সেই সময়টা এসে গেছে? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

 

অবশ্যই, এরচেয়ে নিশ্চিত হতেই পারে না। যদি তা না-ই হবে তবে চার্চ কেন এই মুহুর্তে আক্রমণ করলো?

 

সোফি তর্ক করে বললো, পাদ্রী কিন্তু এখনও তার উদ্দেশ্যের কথা আমাদের কাছে বলেনি।

 

পাদ্রীর উদ্দেশ্য চার্চেরই উদ্দেশ্য, টিবিং জবাব দিলেন। দলিলগুলো ধ্বংস করে ফেলা, যাতে বিশাল একটা ছলনার উন্মোচন না হয়। আগের যেকোন সময়ের তুলনায় চার্চ এই কাজটা করতে সবচাইতে বেশি কাছাকাছি এসে গিয়েছিলো। প্রায়োরিরা এটা আপনার ওপর অর্পন করেছে, মিস্ নেভু। হলি গ্রেইল রক্ষা করার কাজটার মধ্যে প্রায়োরিদের অন্তিম ইচ্ছাটাও অন্তর্ভুক্ত, আর সেটা হলো সত্যটা বিশ্ববাসীকে জানানো।

 

ল্যাংডন মাঝখানে বললো। লেই, সোফিকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বলাটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে না, সে তো সবেমাত্র জানলো স্যাংগৃল দলিলগুলোর কথা।

 

টিবিং দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি যদি বেশি চাপাচাপি করে থাকি তবে সেজন্যে ক্ষমা চাচ্ছি, মিস্ নেভু। স্পষ্টতই আমি সব সময়ই বিশ্বাস করে এসেছি দলিলগুলো সর্বসাধারণকে জানানো হোক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তটা আপনিই নেবেন। আমি কেবল বোঝাতে চেয়েছি, কি-স্টোনটা সফলভাবে খোলর পর কি করা উচিত।

 

মহোদয়গণ, সোফি বললো, তার কণ্ঠে দৃঢ়তা। আপনাদের কথাটাই বলছি, তুমি গ্রেইলকে খুঁজবে না, গ্রেইলই তোমাকে খুঁজে নেবে। আমি বিশ্বাস করি, গ্রেইলটা আমাকে দেবার কারণ আছে, আর সময় আসলে আমি জানবো আমাকে কী করতে হবে।

 

তাদের দুজনকেই হতভম্ব দেখালো।

 

তাহলে, সোফি রোজউড বাক্সটার দিকে তাকিয়ে বললো। এটা খোলা হোক।

 

 

 

৭০.

 

শ্যাতু ভিলের ড্রইং রুমে দাঁড়িয়ে লেফটেনান্ট কোলে নিভে যাওয়া আগুনের দিকে হতাশ আর ক্ষুব্ধ হয়ে চেয়ে আছে। ক্যাপ্টেন ফশে একটু আগে এসেছে, পাশের ঘরে ফোনে কথা বলছে, রেঞ্জরোভারটা ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে।

 

এ সময়ের মধ্যে গাড়িটা যেকোন জায়গাতেই যেতে পারে, কোলেত ভাবলো।

 

ফশের সরাসরি আদেশ অমান্য করা আর ল্যাংডনকে দ্বিতীয়বারের মতো ধরতে না পারার ব্যর্থতা তারই। কোলেত পিটিএস-এর কাছে কৃতজ্ঞ যে, তারা ফ্লোরে একটা বুলেটের ফুটো খুঁজে বের করেছে। এতে করে কোলেতের পক্ষে একটা যুক্তি দেয়া যাবে। এখনও ফশের মেজাজ তেঁতে আছে। কোলেত আঁচ করতে পারলো, সকাল হতেই কঠিন বকুনি জুটবে কপালে।

 

দূর্ভাগ্য, এখানে কী ঘটেছে কিংবা কারা ঘটিয়েছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কিছুও বোঝা যাচ্ছে না। বাইরের কালো রঙের অদিটা ভূয়া নামে ভাড়া করা হয়েছে ভূয়া ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে।

 

আর গাড়ির ভেতরে পাওয়া আঙুলের ছাপটা ইন্টারপোলের ডাটাবেজে ম্যাচ করেনি। আরেকজন এজেন্ট লিভিংরুমে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। তার চোখে তাড়া। ক্যাপ্টেন ফলে কোথায়?

 

কোলেত তার তাড়াহুড়োকে পাত্তাই দিলো না, চোখ তুলে তাকালো না তার দিকে। তিনি ফোনে কথা বলছেন।

 

আমার ফোন করা শেষ, ঘরের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে ফশে বললো। তোমার কাছে কি খবর আছে?

 

এজেন্ট লোকটা বললো, স্যার, সেন্ট্রাল অফিস আদ্রেঁ ভার্নেটের একটা ফোন পেয়েছে। সে আপনার সাথে একান্তে কথা বলতে চায়। সে তার গল্পটা বদলে ফেলেছে।

 

ওহ্, ফশে বললো।

 

এবার কোলেত মুখ তুলে তাকালো।

 

ভার্নেট স্বীকার করেছে ল্যাংডন আর সোফি আজ রাতে ব্যাংকে কিছুক্ষণ ছিলো।

 

সেটা আমরা আগেই বুঝতে পেরেছি। ফশে বললো, ভার্নেট কেন এ ব্যাপারে মিথ্যা বলেছিলো?

 

সে বলছে সে কেবল আপনার সাথেই কথা বলতে চায় কিন্তু সে পূর্ণ সহযোগীতা দেবার জন্য রাজি আছে।

 

কিসের বিনিময়ে?

 

তার ব্যাংকের নামটা যেনো সংবাদে না ওঠে আর তার কিছু চুরি হওয়া জিনিস উদ্ধার করে দিতে সাহায্য করতে হবে। মনে হচ্ছে ল্যাংডন আর সোফি নিহত সনিয়ের একাউন্ট থেকে কিছু চুরি করেছে।

 

কি? কোলেত চম্‌কে বললো। কিভাবে?

 

ফশে এজন্টের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

 

তারা কি চুরি করেছে।

 

ভার্নেট আর বেশি কিছু বলেনি কিন্তু তার কথা শুনে মনে হচ্ছে সেটা ফিরে পাবার জন্য যেকোন কিছু করতেই সে রাজি আছে।

 

ব্যাপারটা কীভাবে ঘটেছে সেটা কোলেত কল্পনা করতে চেষ্টা করলো। হয়তো ল্যাংডন আর সোফি কোন ব্যাংক কর্মচারীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করেছিলো? হয়তো বা তারা ভার্নেটকে বাধ্য করেছিলো, সনিয়ের একাউন্টটা খুলে দিতে, তারপর জিনিসটা নিয়ে ট্রাকে করে পালিয়েছে। কোলেতের ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো, এরকম একটি কাজে সোফি নেভু জড়িয়ে পড়েছে।

 

রান্নাঘর থেকে আরেকজন এজেন্ট চিৎকার করে ফশেকে ডাকলো। ক্যাপ্টেন? আমি টিবিংয়ের স্পিড ডায়াল নাম্বারে ঢুকে লো বোর্গরেত এয়ারফিন্ডে ফোন করেছি। আমার কাছে কিছু খারাপ সংবাদ আছে।

 

 

 

ত্রিশ সেকেন্ড বাদে, ফলে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে শ্যাতু ভিলে ছেড়ে যাবার প্রস্তুতি নিলো। সে এইমাত্র জানতে পেরেছে টিবিং লো বোর্গরেত এয়ারফিন্ডে একটা নিজস্ব প্লেনে করে আধঘণ্টা আগে উড়াল দিয়েছে।

 

বোর্গরেত এয়ারফিন্ডের প্রতিনিধি ফোনে জানিয়েছে, কারা প্লেনে উঠেছে এবং কোথায় গেছে সেটা জানা যায়নি। টেক-অফটা শিডিউল বর্হিভূত ছিলো। মারাত্মক বে আইনী কাজ। ফশে নিশ্চিত, খুব বেশি চাপ দিলে সে যা জানতে চায় সেটার উত্তর পেয়ে যাবে।

 

লেফটেনান্ট কোলেত, ফশে দরজার দিকে এগোতে এগোতে গর্জন করে বললো, তোমাকে এখানকার পিটিএস তদন্তের দায়িত্ব দেয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। এবার কিছু একটা করার চেষ্টা করো।

 

 

০৮. হকারটার নাক ইংল্যান্ডের অভিমুখে

৭১.

 

হকারটার নাক ইংল্যান্ডের অভিমুখে যেতেই ল্যাংডন সযত্নে রোজউড বক্সটা কোল থেকে হাতে নিলো। বিমান ছাড়ার সময় সেটার সুরক্ষার জন্য ল্যাংডন দুহাতে ধরে কোলের উপর রেখে দিয়েছিলো। এখন বক্সটা টেবিলের উপর রাখতেই আঁচ করতে পারলো সোফি আর টিবিং সামনের দিকে ঝুঁকে এসেছে। বক্সটার ঢাকনা খুলে ল্যাংডন ক্রিপ্টেক্সের দিকে নজর দিলো। ক্রিপ্টেক্সের ডায়ালের অক্ষরগুলোর দিকে নয় বরং ঢাকনাটার ভেতরে ছোট্ট ছিদ্রটার দিকে। একটা কলম দিয়ে ছিদ্রটার ভেতরে খোচা মেরে ঢাকনার উপরে লাগানো ছোই গোলাপটা খুলে ফেলে এর নিচের লেখাগুলো উন্মোচিত করলো। সাব রোসা, সে ভাবলো, আশা করলো ভালো করে লেখাগুলোর দিকে তাকালে পরিষ্কার বুঝতে পারবে। সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে ল্যাংডন অদ্ভুত লেখাটা নিরীক্ষণ করলো।

 

da-vinci-code-1

 

কয়েক সেকেন্ড তাকানোর পরও সে কিছুই ধরতে পারলো না। লেই, আমি ধরতে পারছি না।

 

***

 

সোফি টেবিলের যেখানটায় বসে ছিলো সেখান থেকে লেখাগুলো দেখা যাচ্ছিলো না। কিন্তু ল্যাংডন সেগুলো ধরতে পারছে না দেখ সে খুব অবাক হলো। আমার দাদু এমন একটা ভাষায় কথা বলছেন যা একজন সিম্বোলজিস্টও ধরতে পারছে না। তার আচমকাই মনে হলো, তার কাছে এটা বোধগম্য হবে। এটা তো আর প্রথম সিক্রেট নয়, যা জ্যাক সনিয়ে তার নাতনীর কাছে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

 

সোফির বিপরীতে বসা লেই টিবিং উদগ্রীব হয়ে আছেন। লেখাগুলো দেখার জন্য ছটফট করে উত্তেজনায় এপাশ ওপাশ করছেন তিনি। চেষ্টা করছেন ল্যাংডনের কাছ থেকে লেখাটা নিয়ে দেখতে। ল্যাংডন এখনও সেটা পড়ার চেষ্টা করছে।

 

আমি জানি না, ল্যাংডন আপন মনে বলে উঠলো। আমার প্রথমে মনে হয়েছিলো, এটা সেমেটিক কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত নই। প্রাচীন সেমেটিক ভাষার বেশিরভাগই নেডট-এর অন্তর্গত। এটা সে রকম নয়।

 

হয়তো বেশি প্রাচীন, টিবিং জানালেন।

 

নেক্কুডট? সোফি জানতে চাইলো।

 

টিবিং বাক্সটা থেকে চোখ সরাচ্ছেন না একদম। বেশিরভাগ আধুনিক সেমেটিক ভাষার অক্ষরে স্বরবর্ণ নেই, তার বদলে ব্যবহার করা হয় নেকুডট-ঘোট ঘোট বিন্দু এবং ড্যাশ, হয় ব্যঞ্জনের নিচে না হয় উপরে ব্যবহার করা হয়-স্বরবর্ণের ধ্বনিটা কিভাবে উচ্চারিত হবে সেটা এগুলো নির্দেশ করে। ইতিহাস বলে, নেডট হলো ভাষার আধুনিক সংযোগ।

 

ল্যাংডন এখনও লেখাটার ওপরেই চোখ রেখে আছে। একটা সেফারডিক ট্রান্সলিটারেশন, সম্ভবত…?

 

টিবিংয়ের আর তর সইছিলো না। আমি যদি দেখি, হয়তো… সামনে এগিয়ে ল্যাংডনের কাছ থেকে বাক্সটা নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। সন্দেহ নেই, ল্যাংডন প্যাক লাতিন আর রোমান ভাষায় খুবই দক্ষ কিন্তু টিবিংয়ের কাছে মনে হলো এই ভাষাটা সে রকম কিছু না, সম্ভবত একটা রাশি স্ক্রিপ্ট, অথবা ক্রাউনসহ STA’M।

 

একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে টিবিং আবারো খোঁদাই করা লেখাটার দিকে চোখ রাখলেন। অনেকক্ষণ ধরে কিছুই বললেন না। সময় পার হচ্ছে আর টিবিংয়ের মনে হচ্ছে তার আত্মবিশ্বাসে চির ধরছে। আমি খুবই অবাক হচ্ছি, তিনি বললেন। এই ধরনের ভাষা আমি জীবনেও দেখিনি!

 

ল্যাংডনও একমত হলো। মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

 

আমি কি এটা দেখতে পারি? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

টিবিং এমন ভাব করলেন যেনো কথাটা শুনতেই পাননি। রবার্ট, একটু আগে আপনি বলছিলেন, এরকম কিছু একটা আপনি আগে দেখেছিলেন?

 

ল্যাংডনকে দেখে হতভম্ব বলে মনে হলো। আমিও তাই ভেবেছিলাম। আমি নিশ্চিত নই। যাই হোক, লেখাগুলো আমার কাছে খুবই পরিচিত বলে মনে হচ্ছে।

 

লেই? সোফি আবারো বললো, এই আলোচনায় তাকে পাশ কাটানোটাকে সে ভালোভাবে নেয়নি। আমার দাদুর তৈরি বাক্সটা আমি কি একটু দেখতে পারি?

 

অবশ্যই, ডিয়ার, টিবিং বললেন জিনিসটা তার দিকে ঠেলে দিয়ে। তাঁর মনে হলো, যেখানে একজন বৃটিশ রয়্যাল হিস্টোরিয়ান আর হারভার্ডের সিম্বোলজিস্ট পর্যন্ত ভাষাটা চিনতে পারছেন না, সেখানে

 

আহ্, বাক্সটা দেখার পরমুহূর্তেই সোফি বললো। আমার আগেই অনুমান করা উচিত ছিলো।

 

ল্যাংডন আর টিবিং একসাথে তার দিকে তাকালো।

 

কি অনুমান? টিবিং জানতে চাইলেন।

 

সোফি কাঁধ ঝাঁকালো। এই ভাষাটা আমার দাদু ব্যবহার করতেন।

 

আপনি বলছেন, এই লেখাগুলো আপনি পড়তে পাচ্ছেন? টিবিং অবাক হলেন।

 

খুব সহজেই, সোফি উৎফুল্ল হয়ে বললো। এখন খুব উপভোগ করছে ব্যাপারটা। আমার বয়স যখন ছয় তখন আমার দাদু এই ভাষাটা আমাকে শিখিয়েছিলেন। আমি এটা অনর্গল বলতে পারি। সে টেবিলের অপর প্রান্তে বসে থাকা টিবিংয়ের দিকে মুচকি হেসে তাকালো। আর সত্যি বলতে কী স্যার, আপনি এটা চিনতে পারেননি বলে আমি খুব অবাক হয়েছি।

 

মুহূর্তেই ল্যাংডন বুঝতে পারলো।

 

লেখাটা যে খুবই পরিচিত সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কয়েক বছর আগে, ল্যাংডন ফগ মিউজিয়ামের একটা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলো। হারভার্ড ড্রপআউট বিল গেটস তাঁর আলমা-আতাতে ফিরে এসেছিলেন, তার কাছে রক্ষিত আরমান্ড হ্যামার এস্টেট থেকে নিলামে কেনা আঠারো পৃষ্ঠার অমূল্য দলিল জাদুঘরে দেবার জন্য।

 

তার উইনিং বিড ছিলো-৩০.৮ মিলিয়ন ডলার।

 

লেখাগুলোর লেখক-লিওনার্দো দা ভিঞ্চি।

 

আঠারোটা ফলিও-এখন সেগুলো লিওনার্দোর কোডেক্স লিসেস্টার হিসেবে পরিচিত, বিখ্যাত আর্ল অব লিসেস্টারের মালিকের নামানুসারে রাখা হয়েছিলো এর নাম-সেখানেই লিওনার্দোর মহামূল্যবান আর কৌতূহলোদ্দীপক নোটবুকগুলো ছিলো : ড্রইং, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল, আর্কিওলজি এবং পানি বিজ্ঞানের উপর দা ভিঞ্চির অগ্রসরমান চিন্তাভাবনার লেখা।

 

ল্যাংডন দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর পরে সেগুলো দেখতে পারার যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো সেটা কোনদিনও ভুলতে পারবে না। পুরোপুরি হতাশ। পাতাগুলো একেবারেই বুদ্ধিবৃত্তিকহীন ছিলো। যদিও হাতের লেখা আর ড্রইংগুলো ছিলো চমৎকার–কোডেক্সগুলো ছিলো খুবই দূবোধ। প্রথমে ল্যাংডন ভেবেছিলো লেখাগুলো দা ভিঞ্চি আরসেইক ইতালিতে লিখেছেন বলে সে পড়তে পারছে না। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে ওগুলো খুব ভালো করে দেখার পর সে বুঝতে পারলো, একটা ইতালিয় শব্দও সে চিনতে পারছে না। এমনকি একটা অক্ষর পর্যন্ত।

 

এটা চেষ্টা করে দেখুন, স্যার, সোফি একটা মেকআপ বক্সের আয়নার দিকে ইঙ্গিত করলো। সেটা হাতে নিয়ে আয়নাতে অক্ষরগুলো দেখলো ল্যাংডন।

 

মুহূর্তেই সব পরিষ্কার হয়ে গেলো।

 

ইতিহাসবিদরা এই লেখাটা নিয়ে এখনও বির্তক করেন। তারা মনে করেন, ভিঞ্চি এটা করেছেন লোকজনের কাছে থেকে লেখাগুলো আড়াল করার জন্য যাতে কেউ তার আইডিয়াটা চুরি করতে না পারে, অথবা নিজেকে আনন্দ দেবার জন্যে। কিন্তু সেটা এখন অবান্তর। আসলে দা ভিঞ্চি এটা করেছেন যেমনটি তিনি চেয়েছিলেন।

 

রবার্ট অর্থটা বুঝতে পেরেছে দেখে সোফি একটু হাসলো। আমি প্রথম কয়েকটা শব্দ পড়তে পারি, সোফি বললো। এটা ইংরেজিতে লেখা।

 

টিবিং তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কী হচ্ছে?

 

উল্টা করে লেখা, ল্যাংডন বললো। আমাদের একটা আয়নার দরকার।

 

না, তার দরকার নেই, সোফি বললো। এই কাঠটা খুবই পাতলা বলে মনে হচ্ছে। সে রোজউড বাক্সটা একটু ওপরে তুলে ধরলো দেয়ালের কাছে একটা ক্যানিস্টার লাইটের দিকে। তারপর ঢাকনাটা খুলে ফেললো। তার দাদু আসলে এটা উল্টো করে লেখেননি। তিনি সবসময়ই সোজা করে লিখে কাগজটা উল্টো করে ছাপ নিতেন।

 

সোফি ঢাকনাটা আলোর দিকে নিতেই সে দেখতে পেলো তার ধারণাই ঠিক। তীব্র আলো পাতলা কাঠের স্তর ভেদ করেছে, আর তাতে লেখাগুলো উল্টো করে পড়া যাচ্ছে। উল্টো লেখা উল্টো করলে সোজা হয়ে যায়। তাই হলো।

 

মুহূর্তেই বোধগম্য হলো সব।

 

ইংরেজিতে, টিবিং আফসোস করে বললেন, লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখলেন। আমার মাতৃভাষায়।

 

প্লেনের রিয়ারে বসে রেমি লেগালুদেচ ইঞ্জিনের আওয়াজ ভেদ করে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করলো। কিন্তু কথাবার্তাগুলো একদমই বোঝা যাচ্ছে না। রাতটা যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে রেমির ভালো লাগছে না। একদমই না। সে তার পায়ের নিচে হাত পা বাঁধা পাদ্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলো। লোকটা একেবারে নিথর হয়ে পড়ে আছে। যেনো পরিস্থিতিটা মেনেই নিয়েছে সে, অথবা নিরবে প্রার্থনা করছে মুক্তি পাবার জন্য।

 

 

 

৭২.

 

আকাশের পনেরো হাজার ফুট উঁচুতে রবার্ট ল্যাংডনের মনে হলো সনিয়ের মিরর ইমেজের কবিতাটার কথা ভাবতে ভাবতে তার জাগতিক দুনিয়াটা ফিকে হয়ে যাচ্ছে। লেখাগুলো বাক্সটার ঢাকনার উপরে জ্বল জ্বল করছে।

 

সোফি একটা কাগজ নিয়ে খুব দ্রুত সেটা কপি করে ফেললো। তার লেখা শেষ হলে তাদের তিনজনই পড়ার জন্য লেখাটার দিকে তাকালো। মনে হলো এটা একধরনের আর্কিওলজিক্যাল ক্রশ-ওয়ার্ড…একটা ধাঁধা, যা বুঝতে পারলে ক্রিপ্টেক্সটা কীভাবে খোলা যায় তা জানা যাবে। ল্যাংডন পংক্তিটা আস্তে আস্তে পড়তে লাগলো।

 

এই স্ক্রলটা মুক্ত করবে জ্ঞানের প্রাচীন একটি শব্দ…আর আমাদেরকে তাঁর বিচ্ছিন্ন হওয়া পরিবারকে এক করতে সাহায্য করবে…টেম্পলার কর্তৃক প্রশংসিত একটা সমাধি ফলকই হলো মূল চাবিকাঠি…আর atbash তোদের কাছে সত্যটা উন্মোচিত করবে।

 

da-vinci-code-2

 

ল্যাংডন প্রাচীনতম শব্দের পাসওয়ার্ডটা কি সেটা ভাবার আগেই তার নিজের ভেতরে একটা জিনিস খেলে গেলো-কবিতাটার মিটার। আইয়াম্বিক পেন্টামিটার। ইউরোপের সিক্রেট সোসাইটিগুলো নিয়ে গবেষণা করার সময় ল্যাংডন এই মিটারের সাথে প্রায়ই পরিচিত হতো। গত বছরের ভ্যাটিকানের সিক্রেট আর্কাইভের সময়ও সেটা হয়েছিলো। শত শত বছর ধরে আইয়াম্বিক পেন্টামিটার সারা বিশ্বব্যাপী, প্রাচীন গৃকের আর্কিলোকাস থেকে শেক্সপিয়ার, মিল্টন, চসার এবং ভলতেয়ার তাদের সাহিত্য কর্মে ব্যবহার করেছেন-এইসব সাহসী মানুষেরা এই মিটারটা নিজেদের ভাষ্যগুলো লেখার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। অনেক দিন ধরেই বিশ্বাস করা হতো এতে আধ্যাত্মিক কিছু আছে। ইয়াম্বিক পেন্টামিটারের শেকড়টা প্যাগানদের মধ্যে গভীরভাবে প্রােথিত।

 

ইয়াম্ব। দুটো সিলেবেল, বিপরীত শুরুত্বের। ইন এবং ইয়াং। একটি ভারসাম্যপূর্ণ জোড়। পাঁচ তারের সমম্বয়ে। পেন্টামিটার। পাঁচ দিয়ে ভেনাসের পেনটাকল এবং পবিত্র-নারী বুঝায়।

 

এটা তো পেন্টামিটার! টিবিং আতিশয্যে বলে ল্যাংডনের দিকে তাকালেন। পংক্তিটা ইংরেজিতে! লা লিঙ্গুয়া পিউরা!

 

ল্যাংডন সায় দিলো। অন্য অনেক ইউরোপীয় সিক্রেট সোসাইটির মতো প্রায়োরিরাও ইংরেজিকে দীর্ঘদিন যাবত ইউরোপের একমাত্র বিশুদ্ধ ভাষা হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। ভ্যাটিকানের ভাষা ফরাসি, স্প্যানিশ এবং ইতালিয় ভাষা নয়, যা লাতিনের থেকে উদ্ভুত। ইংরেজিকে রোমের প্রপাগান্ডা যন্ত্র তিরোহিত করেছিলো আর এজন্যেই সেটা পবিত্র আর গুপ্ত ভাষা হয়ে ওঠে। ভ্রাতৃসংঘ তাদের সদস্যদেরকে শিক্ষা দেয়ার কাজে এটা ব্যবহার করতো।

 

এই কবিতাটা, টিবিং বিস্ময়ে বললেন, শুধুমাত্র গ্রেইলকেই উল্লেখ করছে না, বরং নাইট টেম্পলার আর ম্যারি মাগদালিনের বিচ্ছিন্ন হওয়া পরিবারের কথাও বলছে। এর চেয়ে বেশি আমাদের আর কী জানার আছে?

 

পাসওয়ার্ডটা, কবিতাটার দিকে আবারো তাকিয়ে সোফি বললো। মনে হচ্ছে আমাদের এখন জ্ঞানের প্রাচীন একটি শব্দ জানার দরকার?

 

অ্যাবাকা ড্যাবরা? টিবিং ঠাট্টাচ্ছলে বললেন, তার চোখ দুটো পিট পিট করছে।

 

পাঁচটি অক্ষরের একটি শব্দ, ল্যাংডন ভাবলো। জ্ঞানের প্রাচীন শব্দগুলো কী হতে পারে চিন্তা করতে লাগলো সে। তালিকাটা অন্তহীন বলেই মনে হচ্ছে।

 

পাসওয়ার্ডটা, সোফি বললো, মনে হচ্ছে, টেম্পলারদের সংশ্লিষ্ট কিছু হবে। সে জোরে জোরে লেখাটা পড়তে লাগলো। টেম্পলারদের কর্তৃক প্রশংসিত একটি সমাধি ফলক হলো মূল চাবিকাঠি।

 

লেই, ল্যাংডন বললো, আপনি হলেন টেম্পলার বিশেষজ্ঞ। কোন ধারণা আছে?

 

টিবিং কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ততা, সমাধি ফলকটি অবশ্যই একটা কবরের হবে। এটা সম্ভব যে, কবিতাটি এমন একটি সমাধি ফলকের কথা বলছে যাতে মনে হচ্ছে টেম্পলাররা ম্যারি মাগদালিনের সমাধি ফলকের প্রশংসা করছে। কিন্তু এটা আমাদের কোন সাহায্যে আসবে না কারণ তার কবরটা কোথায় সেটা আমরা জানি না।

 

শেষ লাইনটা বলছে, সোফি বললো, এটবাশ সত্যটা জানাবে। আমি এই এটবাশ শব্দটা শুনেছি।

 

আমি মোটেই অবাক হচ্ছি না, ল্যাংডন জবাব দিলো। তুমি এটা সম্ভবত ক্রিপ্টোলজি ১০১-এ শুনেছো। এটবাশ সিফার বা সংকেত হচ্ছে মানুষের জানা সবচাইতে পুরনো একটি কোড।

 

অবশ্যই। সোফি ভাবলো। বিখ্যাত হিব্রু সাংকেতিক এনকোডিং সিস্টেম।

 

এটবাশ সিফার সোফির ক্রিপ্টোলজি শিক্ষার প্রথম দিকের অংশ ছিলো। সিফারটা ৫০০ খৃস্ট পূর্বাব্দের। একটি সাধারণ ইহুদী ক্রিপ্টোগ্রাম। এটবাশ সিফার হলো বাইশটি হিব্রু অক্ষরের বিকল্প কোড। এটবাশে প্রথম অক্ষরটাকে ধরা হয় শেষ অক্ষর হিসেবে দ্বিতীয় অক্ষরটা শেষের দিক থেকে দ্বিতীয়, এভাবেই হিসাব করা হয়।

 

টিবিং বললেন, এটবাশ সংকেতে লেখা পাওয়া যায় কাব্বালা, ডেড সি লে, এমনকি ওন্ড টেস্টামেন্টেও। ইহুদী পণ্ডিত আর আধ্যাত্মিক নেতারা এখনও এটবাশে ব্যবহৃত লুক্কায়িত অর্থ খুঁজে যাচ্ছে। প্রায়োরিরা তাদের শিক্ষায় নিশ্চিতভাবেই এটবাশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

 

একমাত্র সমস্যা হলো, ল্যাংডন বললো, আমাদের কাছে এমন কিছু নেই যা এই সিফারে প্রয়োগ করা যায়।

 

টিবিং দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সমাধি ফলকে অবশ্যই একটা কোড আছে। আমাদেরকে টেম্পলার কর্তৃক প্রশংসিত সমাধি ফলকটা খুঁজে বের করতে হবে।

 

সোফি ল্যাংডনের ফ্যাঁকাশে চেহারাটা দেখে আঁচ করতে পারলো, টেম্পলার সমাধি ফলক খুঁজে পাওয়াটা খুব সহজ ব্যাপার হবে না।

 

এটবাশ হলো চাবি, সোফি ভাবলো। কিন্তু আমাদের কাছে তো কোন দরজা নেই।

 

তিন মিনিট পরে, টিবিং একটা হতাশাপূর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকালেন। আমার বন্ধুরা, আমি নাচার। রেমি আর আমাদের অতিথিকে একটু চেক করে দেখে আসার পর ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখবো। এই বলে টিবিং প্লেনের পেছনে চলে গেলেন।

 

তাঁকে চলে যেতে দেখে সোফির খুব ক্লান্ত বোধ হলো।

 

জানালার বাইরে, ভোরের আগমুহূর্তের অন্ধকারটা দেখা যাচ্ছে। সোফির মনে হলো, সে শূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে কিন্তু কোথায় নামবে সেটা জানে না।

 

এখানে আরো কিছু আছে, নিজেকে বললো সে। লুকিয়ে আছে…দেখা যাচ্ছে না।

 

সে আরো ভাবলো, ক্রিপ্টেক্সের ভেতরে তারা যে জিনিসটা পাবে সেটা কোন হলি গ্রেইলের মানচিত্র জাতীয় কিছু হবে না। যদিও টিবিং আর ল্যাংডনের দৃঢ় বিশ্বাস, মার্বেলের সিলিন্ডারটার ভেতরেই রয়েছে সেই সত্য, কিন্তু সোফি জানে তার দাদু জ্যাক সনিয়ে নিজের সিক্রেটটা এতো সহজে ছেড়ে দেবেন না। এটা সে ছোটবেলা থেকে দাদুর দেয়া অনেক ধাঁধার জট খুলতে শিখেছে।

 

 

 

৭৩.

 

বোর্গরেত এয়ারফিল্ডের রাতের শিফটের এয়ারট্রাফিক কন্ট্রোলার একটা রাডার পর্দার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকাতেই জুডিশিয়াল পুলিশের ক্যাপ্টেন তার দরজা ধপাস করে খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো।

 

টিবিংয়ের প্লেনটা, বেজু ফশে ছোট টাওয়ারটার ভেতরে এগোতে এগোতে চিৎকার করে বললো, কোথায় গেছে।

 

কন্ট্রোলার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তোতলাতে তোতলাতে তাদের বৃটিশ ক্লায়েন্টের প্রাইভেসি রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। এই ক্লায়েন্ট হলেন তাদের সবচাইতে শ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তি। তার সমস্ত অজুহাত দুঃখজনকভাবেই ব্যর্থ হলো।

 

ঠিক আছে, ফলে বললো, তবে, আমি আপনাকে কোন ধরনের ফ্লাইট-প্ল্যান রেজিস্ট্রি ছাড়া প্লেন উড্ডয়নের জন্য গ্রেফতার করতে পারি। ফলে অন্য এক অফিসারের দিকে ঘুরতেই সে একটা হাতকড়া নিয়ে এগিয়ে আসতে উদ্যত হলো। এটা দেখে কন্ট্রোলার ভয়ে আৎকে উঠলো। তার মনে পড়ে গেলো সংবাদপত্রের সেই আর্টিকেলটার কথা, যেখানে বির্তক করা হয়েছিলো, দেশের পুলিশ ক্যাপ্টেন কি একজন হিরো, নাকি খলনায়ক। সেই প্রশ্নের উত্তরটা সে এইমাত্র পেয়ে গেছে। দাঁড়ান! কন্ট্রোলার হাতকড়াটার দিকে তাকিয়ে আচমকাই বলে উঠলো। আমি বলছি। স্যার সেই টিবিং অনুরোধ করেছিলেন চিকিৎসার জন্য তাকে জরুরি ভিত্তিতে লন্ডনে যেতে হবে। লন্ডনের বাইরে কেন্টের বিগিন-হিল এয়াপোর্টে তার নিজের একটা হ্যাংগার রয়েছে।

 

হাতকড়া হাতে দাঁড়ানো লোকটাকে ফশে হাত নেড়ে ইশারা করলো। আজ রাতে কি তার গন্তব্যস্থল বিগিন-হিলে?

 

আমি জানি না, কন্ট্রোলার সত্য-সত্যই বললো। রাডারে শেষ পর্যন্ত দেখেছি প্লেনটা যুক্তরাজ্যের দিকেই যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বিগিন-হিলেই যাবে।

 

তাঁর সাথে কি অন্য কেউ ছিলো?

 

আমি কসম খেয়ে বলছি, সেটা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আমাদের ক্লায়েন্ট সরাসরি গাড়ি চালিয়ে হ্যাংগারে যেতে পারেন। চাইলে ইচ্ছে মতো মালামালও নিতে পারেন। প্লেনে কারা আছে সেটা অবতরণস্থলের কাস্টসের দেখার দায়িত্ব।

 

ফশে তার হাত ঘড়িটা দেখে টাওয়ারের বাইরে পার্ক করা জেটপ্লেনগুলোর দিকে তাকালো। যদি তারা বিগিন-হিলেই গিয়ে থাকে তাহলে কতক্ষণে ওখানে ল্যান্ড করতে পারবে?

 

কন্ট্রোলার তার সামনে থাকা রেকর্ডগুলো একটু হাতুরে দেখলো। এটা খুবই ছোট্ট একটা ফ্লাইট। তাঁর প্লেনটা…সাড়ে ছয়টার মধ্যেই ল্যান্ড করতে পারবে। এখন থেকে আরো পনেরো মিনিট পরে।

 

ফশে চিন্তিত হয়ে তার একজন লোকের দিকে ঘুরলো। একটা ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করো। আমি লন্ডনে যাচ্ছি আর কেন্টের স্থানীয় পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে আমাকে ফোন দাও। বৃটিশ এমআই ফাইভকে নয়। আমি চাই একটু গোপনীয়তা। কেন্টের স্থানীয় পুলিশ, তাদেরকে বলো আমি চাই, টিবিংয়ের প্লেনটাকে ল্যান্ড করার অনুমতি দেয়া হোক, তারপর, টার্মাকেই সেটাকে ঘেরাও করে রাখুক তারা। আমি আসার আগ পর্যন্ত কেউ যেনো প্লেনের ভেতরে না ঢোকে।

 

 

 

৭৪.

 

হকারের ভেতরে কেবিনে বসে ল্যাংডন সোফির দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি চুপ করে আছে।

 

ক্লান্ত লাগছে, সে জবাব দিলো। আর কবিতাটা, আমি জানি না।

 

ল্যাংডনও একই রকম ভাবছিলো। ইজিনের শব্দ আর প্লেনটার মৃদু-মন্দ আঁকি সম্মােহনের মতো লাগছে তার কাছে। তার মাথার যে জায়গাটাতে পাদ্রী আঘাত করেছিলো, সেখানে এখন ব্যথা করছে। টিবিং প্লেনের পেছনের দিকে গেছে। ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিলো এই একাকী মুহূর্তের সুযোগে, তার মনে যে কথাটা খেলে যাচ্ছে, সেটা সোফিকে বলবে। আমার মনে হয়, তোমার দাদু কেন, আমাকে আর তোমাকে একসাথে জুড়ে দিয়েছেন, সেটা অংশত আমি জানি। মনে হয়, কিছু একটা আছে, যা তিনি চেয়েছেন আমি তোমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেই।

 

হলি গ্রেইলের ইতিহাস আর ম্যারি মাগদালিনই কি যথেষ্ট নয়?

 

ল্যাংডন কী বলবে, ভেবে পেলো না। তোমার সাথে তার সমস্যাটা, যে কারণে তুমি দশ বছর ধরে তার সাথে কথা বলেনি। আমার মনে হয়, তিনি হয়তো আশা করেছিলেন, আমি সেই ব্যাপারটা তোমার কাছে ব্যাখ্যা করতে পারবো।

 

সোফি তার সিটে নড়ে-চড়ে বসলো। আমি তোমাকে বলিনি, কেন আমাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা ভেঙে গিয়েছিলো।

 

ল্যাংডন খুব সাবধানে তার চোখের দিকে তাকালো। তুমি একটা যৌনাচারের দৃশ্য দেখেছিলে। তাই না?

 

সোফি খুবই অবাক হলো। তুমি সেটা কীভাবে জানলে?

 

সোফি, তুমি আমাকে বলেছিলে, তুমি এমন কিছু দেখেছিলে, যাতে তোমার স্থির বিশ্বাস হয়েছিলো, তোমার দাদু সিক্রেট সোসাইটির একজন সদস্য। আর তুমি যা-ই দেখে থাকো, সেটা তোমাকে এতোটাই ব্যথিত করেছিলো যে, তার সাথে তুমি এরপর থেকে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলে। আমি সিক্রেট সোসাইটি সম্পর্কে বেশ ভালোই জানি। তুমি কি দেখেছো, সেটা অনুমান করার জন্য দা ভিঞ্চির মস্তিকের দরকার হয় না।

 

সোফি চেয়ে রইলো।

 

সেটা কি বসন্ত কালে ছিলো? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো। দিন-রাত যখন সমান থাকে, সে সময়টার কাছাকাছি? মার্চের মাঝামাঝি?

 

সোফি জানালার বাইরে চেয়ে রইলো। আমি বসন্তের ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরছিলাম। একটু আগেভাগেই বাড়িতে এসেছিলাম।

 

তুমি এ ব্যাপারে আমাকে বলতে চাও?

 

আমি বলবো না। সে আচমকা ল্যাংডনের দিকে ঘুরে তাকালো, তার চোখে আবেগের বহিপ্রকাশ। আমি কী দেখেছি, আমি জানি না।

 

নারী-পুরুষ উভয়েই ছিলো সেখানে?

 

একটু সময় নিয়ে, সে মাথা নেড়ে সায় দিলো।

 

সাদা আর কালো পোশাক পরা ছিলো?

 

সে চোখ মুছে মাথা নাড়লো। মনে হলো, এবার হয়তো খুলে বলবে। মেয়েরা সাদা গাউন…আর সোনালী জুতা পরা ছিলো। তাদের হাতে ছিলো সোনালী রঙের গোলক। পুরুষেরা কালো পোশাক আর কালো জুতা পরা ছিলো।

 

ল্যাংডন তার আবেগটা প্রশমিত করলো, তারপরেও সে বিশ্বাস করতে পারলো না, এসব সে কী শুনছে। সোফি নেভু ঘটনাচক্রে দুহাজার বছরের পুরনো একটি পবিত্র আচার-অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছে।

 

মুখোশ ছিলো? সে জিজ্ঞেস করলো, নিজের কণ্ঠটা শীতল রাখার চেষ্টা করলো।

 

হ্যাঁ। সবারই মুখোশ ছিলো। সাদাগুলো মেয়েরা, কালোগুলো পুরুষের।

 

ল্যাংডন এই অনুষ্ঠানটির সম্পর্কে বই-পত্রে পড়েছে, এর আধ্যাত্মিক শেকড়টাও সে বোঝে। এটাকে বলে হায়ারোস গামোস, সে আস্তে করে বললো। প্রায় দুহাজার বছরের পুরনো। মিশরীয় যাজক আর যাজিকারা এটা নিয়মিতভাবেই পালন করতো নারীর পুণরুৎপাদন ক্ষমতাকে উদযাপন করার জন্য। সে একটু থেমে তার দিকে ঝুঁকলো। আর, তুমি যদি কোন ধরনের প্রস্তুতি ছাড়া, এটার আসল অর্থ না বুঝে, হায়ারোস মোস প্রত্যক্ষ করে থাকো, তবে আমি অনুমাণ করতে পারি, সেটা খুব যন্ত্রণাদায়কই ছিলো।

 

সোফি কিছুই বললো না।

 

হায়ারোস গামোস হলো একটি গৃক শব্দ, সে আবারো বলতে লাগলো। এর অর্থ পবিত্র বিয়ে।

 

যে জিনিস আমি দেখিছি, সেটা কোন বিয়ে ছিলো না।

 

মিলন অর্থে বিয়ে, সোফি।

 

তুমি বলতে চাচ্ছো, যৌনমিলন অর্থে।

 

না।

 

না? সোফি বললো, তার অলিভ রঙের চোখ ল্যাংডনকে বাজিয়ে দেখছে।

 

ল্যাংডনও পাল্টা জবাব দিলো। তো…হ্যাঁ, বললে, সে রকমই মনে হয়, কিন্তু আজকে আমরা যেভাবে ব্যাপারটা বুঝি, সে রকমভাবে নয়। সে ব্যাখ্যা করলো, যদিও সোফি দৃশ্যত একটা যৌনাচারের অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছে, কিন্তু হায়ারোস গামোসের সাথে যৌনাকাঙ্খার কোন ব্যাপার-স্যাপার নেই। এটা আধ্যাত্মিক কাজ। ঐতিহাসিকভাবে, যৌনমিলনকে দেখা হোতো নারী-পুরুষের ঈশ্বর অভিজ্ঞতা হিসেবে। প্রাচীন কালে বিশ্বাস করা হতো, পুরুষ আত্মিক দিক থেকে অসম্পূর্ণ, যতোক্ষণ না তার নারী অভিজ্ঞতা না হয়। নারী আর পুরুষের দৈহিক মিলনের মাধ্যমে পুরুষ সম্পূর্ণতা অর্জন করে অবশেষে, অর্জন করে gnosis—স্বর্গীয় জ্ঞান। আইসিসের সময় থেকে, যৌনাচার অনুষ্ঠানগুলোকে মানুষের মত থেকে স্বর্গের একমাত্র সেতু হিসেবে বিবেচনা করা হোতো। নারী সংসর্গে, ল্যাংডন বললো, মানুষ এক ধরনের অতি উত্তেজনাকর মুহূর্ত অর্জন করে, যখন তার মন সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে পড়ে আর সে দেখতে পায় ঈশ্বরকে।

 

সোফিকে খুবই সন্দেহগ্রস্ত বলে মনে হলো। প্রার্থনা হিসেবে সঙ্গম?

 

ল্যাংডন কিছুই বললো না, যদিও সোফির কথাটা একদম ঠিক। দৈহিকভাবে বীর্য ঋলনের মুহূর্তে পুরুষের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা কয়েক মুহূর্তের জন্য শূন্য হয়ে যায়। একটি সাময়িক, সংক্ষিপ্ত সময়ের মানসিক শূন্যতা। একটা স্বচ্ছ মুহূর্ত, যখন ঈশ্বর তার কাছে আবির্ভূত হতে পারে। ধ্যান-সাধক গুরুরা এই অবস্থা অর্জন করে কোন রকম যৌন সঙ্গম ছাড়া আর নির্বানকে প্রায়শই অন্তহীন পুলক হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

 

সোফি, ধীর কণ্ঠে ল্যাংডন বললো, এটা মনে রাখা খুবই জরুরি যে, প্রাচীন কালের লোকেরা যৌনতা সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করতো, তা আমাদের আজকের দিনের ঠিক বিপরীত। যৌনতা নতুন জীবন আনে চুড়ান্ত অলৌকিক আর অলৌকিক কেবলমাত্র ঈশ্বরই করতে পারেন। নারীর এই নতুন জীবন উৎপাদন করার ক্ষমতার জন্যই তাকে পবিত্র জ্ঞান করা হয়, একজন ঈশ্বর হিসেবে। যৌন মিলন হলো মানবিক আত্মার দুই অধের্কের সশ্রদ্ধ মিলন নারী এবং পুরুষ—যার ভেতর দিয়ে পুরুষ তার আধ্যাত্মিকতার পূর্ণতা পায় এবং ঈশ্বরের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। তুমি যা দেখেছে সেটা যৌনতা সম্পর্কিত নয়, আধ্যাত্মিকতা সর্ম্পকিত। হায়ারো গামোস আচার-অনুষ্ঠানটা কোন বিকৃত যৌনাচার নয়। এটা খুবই পবিত্র একটি অনুষ্ঠান।

 

তার কথাগুলো সোফির স্নায়ুতে গিয়ে আঘাত করলো বলে মনে হলো। তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়তে লাগলো আবার। জামার আস্তিন দিয়ে সেগুলো মুছে ফেললো সে। ল্যাংডন সোফিকে কিছুটা সময় দিলো। স্বীকার করবেই হবে, ঈশ্বরের পথ হিসেবে সঙ্গমের ধারণাটি প্রথম শুনলে, ভীমড়ি খাবার যোগাড় হয়। ল্যাংডনের ইহুদি ছাত্রেরা সব সময়ই হতবুদ্ধিকর হয়ে পড়তো, যখন ল্যাংডন তাদেরকে প্রথমে বলতো যে, প্রথম দিকে ইহুদি ঐতিহ্যে যৌনাচার ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিলো। মন্দিরের অভ্যন্তরেই, অন্য কোথাও নয়। তখনকার সময়ে, ইহুদিরা বিশ্বাস করতো, পবিত্রতম সোলেমনের মন্দিরটা শুধুমাত্র ঈশ্বরের ঘরই নয়, বরং সেটা তার শক্তিশালী সমকক্ষ নারী, শেকিনারও ঘর। পুরুষেরা আধ্যাত্মিকতা সম্পূর্ণ করতে মন্দিরের যাজিকাদের কাছে আসতো অথবা হায়ারোস ভূলেদের কাছে তাদের সাথে তারা সঙ্গম করে স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা লাভ করতো শারিরীক মিলনের মধ্য দিয়ে। ইহুদি টেটরাগ্রামাটন YHWH–ঈশ্বরের পবিত্র নাম আসলে এসেছে জিহোভা থেকে। এটি হলো, পুরুষ জাহ্ এবং ইভ্‌ বা হাওয়ার এক হিব্রু নাম হাভাহ্ র সম্মিলিত রূপ।

 

প্রথম দিকে, ল্যাংডন কোমল কণ্ঠে ব্যাখ্যা করলো, যৌনতাকে ঈশ্বরের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে মানুষের ব্যবহার করাটাকে ক্যাথলিক চার্চ তাদের শক্তি কেন্দ্রের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করেছিলো। ঈশ্বরের সাথে সংযোগের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে স্বঘোষিত চার্চের জন্য এটা অস্বস্তিকরই ছিলো। তাই, সংগত কারণেই, তারা যৌনতাকে শয়তানী কাজ বলে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছে। এর ফলে, তারা এই কাজটাকে মহাপাপ বলে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলো। অন্যান্য প্রধান প্রধান সব ধর্মও একই কাজ করেছে।

 

সোফি চুপ করে রইলো, কিন্তু ল্যাংডন আঁচ করতে পারলো, সে তার দাদুকে ভালোভাবে বুঝতে শুরু করেছে। পরিহাসের বিষয় হলো, ল্যাংডন ঠিক এই লেকচারটাই এই সেমিস্টারে শ্রেণী কক্ষে দিয়েছিলো। যৌনতার ব্যাপারে আমরা দ্বন্দ্বে ভূগি, সেটা কি অবাক করা ব্যাপার না? সে তার ছাত্রদের জিজ্ঞেস করেছিলো। আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য আর শরীরবৃত্তীয় বিজ্ঞান বলে যে, যৌনতা স্বাভাবিক একটি ব্যাপার আধ্যাত্মিক পূর্ণতার এক চমকপ্রদ পথ-তারপরও, আধুনিক ধর্মগুলো এটাকে একটা লজ্জাজনক কাজ বলে ঘোষণা দিয়েছে। আমাদেরকে শিক্ষা দেখা হয়, যৌন আকাঙ্খকে ভয় করতে, সেটা নাকি শয়তানের কাজ।

 

ল্যাংডন ঠিক করলো, সে আর তার ছাত্রদেরকে এই কথাটা বলে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়াবে না যে, পৃথিবীব্যাপী এক ডজনের বেশি সিক্রেট সোসাইটি—যাদের অনেকেই খুবই প্রভাবশালী—এখনও যৌনাচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে প্রাচীন ঐতিহ্যটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। Eeys wide shut ছবিতে অভিনেতা টম ক্রুজের চরিত্রটি অতি অভিজাত ম্যানহাটনবাসীদের একটি গোপন সম্মেলনে ঢুকে পড়ে হায়ারোস গামোস প্রত্যক্ষ করে ফেলে। দুঃখজনক যে, বেশিরভাগ চলচ্চিত্রকারই ব্যাপারটাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে থাকে।

 

প্রফেসর ল্যাংডন? একজন ছাত্র পেছনের বেঞ্চ থেকে হাত তুলে বললো। তার। কণ্ঠ শুনে মনে হলো, সে খুব আশাবাদী। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে, চার্চে না গিয়ে আমাদের বেশি বেশি সঙ্গম করা উচিত?

 

ল্যাংডন মুখ টিপে হাসলো। হারভার্ডের পার্টি থেকে সে জানতে পেরেছে, এইসব ছেলে পেলেরা যথেষ্ট পরিমাণেই সঙ্গম করে থাকে। মহোদয়গণ, সে বলেছিলো, জানতো, সে খুব নাজুক অবস্থায় আছে। আমি কি আপনাদেরকে একটা উপদেশ দিতে পারি। প্রাক-বিবাহ সঙ্গমকে উৎসাহিত না করে এবং আপনারা সবাই এক

 

একজন কুমার বা ফেরেস্তা, এটা না মনে করেই, আমি আপনাদেরকে, আপনাদের যৌন জীবন নিয়ে একটা উপদেশ দেবো।

 

সব ছাত্র সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লো, শোনার জন্য উদগ্রীব তারা।

 

এরপর, আপনারা মেয়েদের সাথে সময় কাটানোর মুহূর্তে, নিজেদের মনকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, যদি আপনারা যৌনতাকে আধ্যাত্মিক বা মরমী হিসেবে না খুঁজে পান, তবে নিজেদেরকে চ্যালেঞ্জ করে খুঁজে পাবেন সেই স্বর্গীয় স্ফুলিঙ্গটি, যা মানুষ কেবলমাত্র পবিত্র নারীদের সাথে মিলিত হবার মধ্য দিয়েই অর্জন করে থাকে।

 

মেয়েরা মুচকি হেসে মাথা নাড়লো আর ছেলেরা একে অন্যের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে তাকালো।

 

ল্যাংডন দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলো। কলেজের ছেলেগুলো এখনও বাচ্চা-ছেলেই রয়ে গেছে।

 

 

 

প্লেনের জানালায় মাথাটা ঠেকাতেই সোফির কপালে ঠাণ্ডা অনুভূত হলো। সে শূন্যে চেয়ে রইলো। এইমাত্র ল্যাংডন তাকে যা বলেছে, সেটা বোঝার চেষ্টা করছে। সে এক ধরনের অনুশোচনায় আক্রান্ত হলো। দশটি বছর। সে এক গাদা চিঠির কথা ভাবলো, যেগুলো সে কোনদিন খুলে পড়েনি। চিঠিগুলো তার দাদু পাঠিয়েছিলো। আমি রবার্টকে সবই বলবো। জানালা থেকে মাথাটা না সরিয়েই সে কথা বলা শুরু করলো, ধীরে ধীরে আর ভয়ার্ত কণ্ঠে।

 

সেই রাতে কী ঘটেছিলো, সেই কথাটা বলা শুরু করতেই তার মনে হলো, সে অতীতে ফিরে গেছে…তার দাদুর নরম্যান্ডির শ্যাতুতে…ফাঁকা বাড়িটাতে খুঁজতে খুঁজতে …নিচ থেকে কিছু কণ্ঠ শুনতে পেয়েছিলো…তারপর, লুকানো দরজাটা খুঁজে পেলো সে। পাথরের সিঁড়িটা দিয়ে নিচে নেমে গেলো। মাটির নিচে গুহার মতো সেই জায়গাটা। সেটা ছিলো মার্চ মাস। সিঁড়ির নিচে, অন্ধকার জায়গাটা থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সে দেখতে পেয়েছিলো কমলা রঙের মোমবাতির আলোতে কতগুলো আগন্তুক গুণগুণ করে গান গাইছে।

 

আমি স্বপ্ন দেখছি, সোফি নিজেকে বলেছিলো, এটা স্বপ্ন। তাছাড়া আর কী?

 

নারী আর পুরুষেরা সামনে পেছনে দুলছে, কালো, সাদা, কালো, সাদা। নারীদের হাতে সোনালী গোলক ধরা আর তারা গুণগুণ করে গাইছে এক সাথে, শুরুতে আমি তোমার সাথেই ছিলাম, সব পবিত্র ভোরেই, আমি তোমাকে জঠরে ধারণ করেছি দিন শুরুর আগেই।

 

মেয়েরা তাদের গোলকগুলো নিচে নামালেই পুরুষেরা সবাই পিছু হটে যাচ্ছে আর ওপরে ওঠাতেই আবার সামনে এসে পড়ছে। তারা চারিদিকে গোল হয়ে আছে, আর সামনের দিকে কিছু একটার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে।

 

তারা কিসের দিকে তাকিয়ে আছে?

 

কণ্ঠগুলো আরো জোরে জোরে শোনা গেলো এবার। উচ্চ কণ্ঠ। আর দ্রুত।

 

নারীকে যে ধারণ করে আছে, সে হলো প্রেম! মেয়েরা বললো, হাতে ধরা গোলকগুলো আবারো তুলে ধরলো। পুরুষেরা জবাব দিলো, তার স্থায়ী নিবাস হলো অমরত্বে

 

গুঞ্জনটা আবারো বাড়লো। এবার বজ্রপাতের মতো শোনালো। দ্রুত। অংশগ্রহণকারীরা সামনে এগিয়ে হাটু গেঁড়ে বসে পড়লো।

 

ঠিক সেই মুহূর্তেই, সোফি দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছিলো।

 

মাঝখানে একটা নিচু বেদীতে একজন লোক শুয়ে আছে। সে সম্পূর্ণ নগ্ন, কালো একটা মুখোশ পরে উপুড় হয়ে আছে। সোফি সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারলো কাঁধের জন্ম দাগটা দেখে। সে প্রায় চিৎকার করে উঠলো। গ্র্যঁ পেয়া! এই দৃশ্যটা ছিলো সোফির চিন্তার বাইরে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি কিছু তার জন্যে অপেক্ষা করছিলো।

 

তার দাদুর দুই পায়ের ফাঁকে সাদা মুখখাশ পরা একজন নগ্ন নারী। তার শরীরটা ছিলো বেশ নাদুস-নুদুস। গুঞ্জনের সাথে, ছন্দের তালে তালে শরীর দোলাচ্ছিলো— সোফির দাদুর সাথে সঙ্গম করছিলো সে।

 

সোফি ঘুরে দৌড়ে চলে যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু সে পারেনি। বৃত্তাকারে অংশগ্রহণকারীরা, মনে হলো, এবার গান গাইতে শুরু করেছে। গুঞ্জনটা বাড়তে বাড়তে আচম্‌কা একটা গর্জন হলো। পুরো ঘরটা যেনো উত্তেজনার শীর্ষ সুখে ফেঁটে পড়লো। সোফি দম নিতে পারছিলো না। সে নিরবে ওখান থেকে বের হয়ে, গাড়ি চালিয়ে প্যারিসে ফিরে এসেছিলো।

 

 

 

৭৫.

 

চার্টার করা বিমানটা যখন সবেমাত্র মোনাকো অতিক্রম করলো, তখন আরিঙ্গাবোসা দ্বিতীয়বারের মতো ফশের সাথে ফোনে কথা বলছিলেন। তিনি এয়ার-সিকনেস ব্যাগটা হাতে তুলে নিলেন, কিন্তু তার মনে হলো বমি করলে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। কোন রকমে বিমানটা থামুক!

 

ফশের নতুন সংবাদটা মনে হচ্ছে দূর্বোধ্য। অবশ্য, আজ রাতের সবকিছুই তো দুবোর্ধ হয়ে উঠছে। এসব হচ্ছে কি? সবকিছুই যেনো হাত ফসকে বের হয় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে। সাইলাসকে জড়িত করে পেলাম কি? আমিই বা জড়িত হয়ে পেলাম কি।

 

টালমাটাল পায়ে আরিজারোসা কপিটের দিকে হেটে গেলেন। আমার গন্ত ব্যস্থল বদলানোর প্রয়োজন।

 

পাইলট পেছনে ফিরে তাকিয়ে হাসলো। আপনি ঠাট্টা করছেন, তাই না?

 

না। আমাকে এক্ষুণিই লন্ডনে যেতে হবে।

 

ফাদার, এটা চার্টার বিমান, কোন ট্যাক্সি-ক্যাব না।

 

আমি আপনাকে এজন্যে বাড়তি টাকা দেবো। কত চান? লন্ডন এখান থেকে মাত্র এক ঘণ্টার পথ, তো

 

ফাদার এটা টাকার প্রশ্ন নয়, অন্য কারণও রয়েছে।

 

দশ হাজার ইউরো। এক্ষুণি দেবো।

 

পাইলট বিস্ময়ে তার দিকে চেয়ে রইলো। কত? কোন্ ধরনের পাদ্রী এই পরিমাণ টাকা বহন করে?

 

আরিঙ্গাবোসা তাঁর কালো বৃফকেসটার কাছে ফিরে গিয়ে সেটা খুলে একটা বন্ড বের করে পাইলটের হাতে বন্ডটা তুলে দিলেন।

 

এটা কি? পাইলট জানতে চাইলো।

 

দশ হাজার ইউরোর বন্ড, ভ্যাটিকান ব্যাংক থেকে ভোলা।

 

পাইলট সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো।

 

এটা নগদ টাকার সমপরিমাণ।

 

না, নগদই চাই, বন্ডটা ফিরিয়ে দিয়ে পাইলট বললো।

 

আরিঙ্গাবোসা নিজেকে খুব দুর্বল বলে মনে হলো। এটা জীবন-মরণ সমস্যা। আপনি অবশ্যই আমাকে সাহায্য করবেন। আমার লন্ডনে যেতেই হবে।

 

পাইলট বিশপের হাতের আঙ্গুলে সোনার আঙটিটার দিকে তাকালো। আসল হীরার?

 

আরিঙ্গাবোসা আঙটিটার দিকে তাকালেন। এটা আমি হাতছাড়া করতে পারবো না।

 

পাইলট কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজের কাজে ফিরে গেলো। আরিঙ্গাবোসা গভীর দুঃখবোধে আক্রান্ত হলেন। তিনি আঙটিটার দিকে আবারো তাকালেন। অনেকক্ষণ পর, আঙ্গুল থেকে আঙটিটা খুলে পাইলটের সামনে প্যানেলের ওপর সেটা রাখলেন।

 

আরিঙ্গাবোসা ককপিট থেকে দ্রুত বের হয়ে এসে নিজের সিটে গিয়ে বসলেন। পনেরো সেকেন্ড পরে, পাইলট যে গতিপথ বদলাচ্ছে, সেটা তিনি টের পেলেন। তারপরেও, আরিজারোসা খুব লজ্জিত বোধ করলেন। একটা অসাধারণ পরিকল্পনা। এখন, অনেকটা তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়ছে…এর শেষটা, দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

 

 

 

৭৬.

 

ল্যাংডন দেখতে পেলো হায়ারোস গামোস-এর কথাটা শুনে সোফি এখনও থিতু হতে পারেনি। আর তার নিজের বেলায়, ল্যাংডনও কথাটা জানতে পেরে রোমাঞ্চ অনুভব করছে। এজন্যে নয় যে, সোফি ঐ আচার-অনুষ্ঠানটা প্রত্যক্ষ করেছে, বরং রোমাঞ্চকর ব্যাপার হলো, তার নিজের দাদুই ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অংশগ্রহণকারী… প্রায়োরি অব সাইওনের গ্র্যান্ড মাস্টার। খুবই বিখ্যাত লোকেদের সংগঠন। দা ভিঞ্চি, বত্তিচেলি, আইজ্যাক নিউটন, ভিক্টর হুগো, জঁ কতো…জ্যাক সনিয়ে।

 

আমি জানি না, তোমাকে আর কী বলতে পারি, ল্যাংডন বললো আস্তে করে।

 

সোফির চোখ দুটো এখন গভীর সবুজ দেখাচ্ছে, অশ্রুসিক্ত। তিনি আমাকে নিজের মেয়ের মতো লালন-পালন করেছেন।

 

ল্যাংডন তার আবেগটা বুঝতে পারলো। খুবই করুণ। গভীর আর সুদূরের। সোফি নেভু এখন তার দাদুকে সম্পূর্ণ নতুন আলোয় দেখতে পাচ্ছে।

 

বাইরে ভোর হচ্ছে খুব দ্রুত। নিচের পৃথিবী এখনও অন্ধকারে ডুবে আছে।

 

কিছু খাবেন, মাই ডিয়ার। টিবিং উৎফুল্ল হয়ে তাদের সাথে যোগ দিলেন, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন কোক আর ওল্ড ক্র্যাকার্স। খাবারগুলো খুব বেশি পরিমাণে নেই বলে তিনি ক্ষমা চাইলেন। আমাদের পাদ্রী বন্ধু এখনও কথা বলছে না, তিনি খুশিতে বললেন, তাকে সময় দিন। একটা ক্র্যাকারে কামড় দিতে দিতে তিনি কবিতাটার দিকে তাকালেন। তো, কোন কিছু পেলেন? সোফির দিকে তাকিয়ে বললেন। আপনার দাদু আমাদেরকে কি বলতে চাচ্ছেন? এই সমাধি ফলকটা আবার কোথায়? যা টেম্পলার কর্তৃক প্রশংসিত।

 

সোফি মাথা ঝাঁকালো, নিরব রইলো।

 

টিবিং যখন কবিতার মধ্যে ডুব মারলেন, ল্যাংডন তখন একটা কোকের ক্যান খুলে চুমুক দিতে দিতে জানালার দিকে তাকালো। তার চিন্তা-ভাবনাগুলো গুপ্ত আচার অনুষ্ঠান আর কোডের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। টেম্পলারদের কর্তৃক প্রশংসিত একটা সমাধি ফলকই হলো চাবি। সে বড় একটা চুমুক দিলো কোকের ক্যানে। টেম্পলারদের কর্তৃক প্রশংসিত একটা সমাধি ফলক। কোকটা খুব গরম।

 

ল্যাংডন নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলো ইংলিশ চ্যানেলটা। আর বেশি দেরি নেই এখন।

 

টেম্পলারদের কর্তৃক প্রশংসিত একটা সমাধি ফলক।

 

প্লেনটা যখন আবার মাটির ওপরে উড়তে লাগলো, তখন তার মনে হুট করেই একটা আলোর ছটা খেলে গেলো। আপনারা এটা বিশ্বাস করতে পারবেন না, সে অন্যদের দিকে ঘুরে কথাটা বললো। টেম্পলারদের সমাধি ফলকটা আমি বের করে ফেলেছি।

 

টিবিংয়ের চোখ দুটো গোল হয়ে গেলো। আপনি জানেন, সমাধি ফলকটা কোথায়?

 

ল্যাংডন হাসলো। কোথায় না, বলুন কি।

 

সোফি শোনার জন্য সামনের দিকে ঝুকলো।

 

আমার মনে হয়, সমাধি ফলকটা আসলে আক্ষরিক অর্থে একটা স্টোন-হেডকেই নির্দেশ করেছে, নিজের উত্তেজনাকে প্রশমিত করে ল্যাংডন ব্যাখ্যা করলো। এটা

 

কোন সমাধি ফলক নয়।

 

একটা পাথরের মাথা? টিবিং জানতে চাইলো।

 

সোফিকেও খুব দ্বিধাগ্রস্ত বলে মনে হলো।

 

লেই, ল্যাংডন বললো, ইনকুইজিশনের সময় চার্চ নাইট টেম্পলারদেরকে সব ধরনের ধর্মবিরুদ্ধ কাজের জন্য অভিযুক্ত করেছিলো, ঠিক?

 

ঠিক। সবগুলো বানোয়াট অভিযোগ এনেছিলো। সমকামীতা, ক্রুশের উপর প্রস্রাব করা, শয়তান পূজা, আরো অনেক কিছু।

 

আর সেই তালিকায় ভূয়া মূর্তি পূজাও ছিলো, ঠিক? নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, চার্চ টেম্পলারদেরকে গোপনে ধোদাই করা পাথরের উপাসনা করার জন্য অভিযুক্ত করেছিলো …যা ছিলো পাগনদের ঈশ্বর–

 

বাফোমেট! টিবিং উচ্চস্বরে বললেন।

 

হায় আমার ঈশ্বর, রবার্ট, আপনি ঠিকই বলেছেন। একটা পাথরের মাথা, টেম্পলারদের কর্তৃক প্রশংসিত!

 

ল্যাংডন খুব দ্রুত সোফিকে ব্যাখ্যা করে বোঝালো, বাফোমেট হলো প্যাগানদের উর্বরতার দেবতা, পুনঃউৎপাদনের শক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট। ভেড়া অথবা ছাগলের মাথা হলো বাফোমেটের প্রতীক। টেম্পলাররা বাফোমেটকে সম্মান দেখানোর জন্য পাথরের একটা রেপ্লিকাকে বৃত্তাবদ্ধ হয়ে প্রার্থনা করতো।

 

বাফোমেট অনুষ্ঠানটা, টিবিং রহস্য করে বললেন। যৌনমিলনের সৃষ্টিশীল জাদুকে সম্মান জানানোর জন্য করা হোততা। কিন্তু পোপ ক্লেমেন্ত সবাইকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, বাফোমেটের মাথাটা আসলে শয়তানের মাথা। পোপ বাফোমেটের মাথাটাকে টেম্পলারদের বিরুদ্ধে একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।

 

ল্যাংডন একমত পোষণ করলো। চার্চ বাফোমেটকে শয়তান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলো। যদিও সেটা সম্পূর্ণ নয়। ঐতিহ্যবাহী আমেরিকান থ্যাংকস গিভিং টেবিলে এখনও প্যাগান শিং ওয়ালা উর্বরতার প্রতীকটি থাকে। কর্নকোপিয়া হলো বাফোমেটেরই একটি প্রতিরূপ। বাফোমেটের শিংটা ভি-চিহ্ন হিসেবেও বদলে গেছে। যা বিজয়সূচক চিহ্ন হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত।

 

হ্যাঁ, হ্যাঁ, টিবিং উত্তেজনায় বললেন, কবিতাটায় যা বলা হয়েছে, সেটা বাফোমেটকেই নির্দেশ করে। টেম্পলারদের কর্তৃক প্রশংসিত একটি পাথরের মাথা।

 

ঠিক আছে, সোফি বললো, কিন্তু বাফোমেট যদি টেম্পলার কর্তৃক প্রশংসিত পাথরের মাথা হয়ে থাকে, তবে আমাদের নতুন একটা সমস্য দেখা দেবে। সে ক্রিপ্টেক্সের ডায়ালের দিকে ইঙ্গিত করলো। বাফোমেটের আটটি অক্ষর। আমাদের চাই মাত্র পাঁচটি।

 

টিবিং দাঁত বের করে হাসলেন। মাইডিয়ার, এখানেই দরকার হয়ে পড়ে এটবাশ সিফার-এর ভূমিকা।

 

 

 

৭৭.

 

ল্যাংডন খুবই অভিভূত হলো। টিবিং হিব্রু ভাষার বাইশটি অক্ষরের সবগুলোই লিখে ফেললেন—আলেফ-বেই—একবারে স্মৃতি থেকে। তিনি হিব্রু অক্ষরের বদলে সেগুলোর সমকক্ষ রোমান অক্ষরগুলো ব্যবহার করলেন। অক্ষরগুলো তিনি জোরে জোরে উচ্চারণ করে পড়ে শোনালেন।

 

A B G D H V Z C h T Y K L M N S O P Tz Q R Sh Th

 

আলেফ, বেই, গিমেল, ডালেত, হেই, ভাভ্‌, জাইন, শেত, তেত, য়ুদ, কাফ, লাম্‌দ, মিম্‌, নুন, সামেখ, আইন, পাই, জাদিক, কফ, রিশ, শিন এবং তাভ। টিবিং নাটকীয়ভাবেই ভুরু দুটো নাচালেন। প্রচলিত হিব্রু ভাষায় স্বরবর্ণের উচ্চারণ থাকলে ও তা লেখা হয় না। এজন্যেই, আমরা যখন হিব্রু অক্ষর দিয়ে বাফোমেট শব্দটি লিখবো, তখন, সেটা তার তিনটি স্বরবর্ণ বাদ দিয়ে লিখতে হবে–

 

পাঁচটি অক্ষর, সোফি উত্তেজিত হয়ে বললো। টিবিং সায় দিয়ে আবার লিখতে শুরু করলেন। ঠিক আছে, এখানে হিব্রু অক্ষরে যথাযথভাবে বাফোমেট লেখা হয়েছে। আমি বাদ দেয়া স্বরবর্ণগুলোও লিখছি, বোঝার সুবিধার্থে।

 

B a P O Me Th

 

মনে রাখবেন, টিবিং বললেন, হিব্রু সাধারণত বিপরীত দিক থেকে লেখা হয়। কিন্তু, আমরা এটবাশটা এইভাবেই ব্যবহার করবো। এরপর, আমাদেরকে বিকল্প স্কিম লিখতে হবে, সবগুলো বর্ণমালাকে পুণরায় বিপরীত দিক থেকে।

 

আরেকটা সহজ রাস্তা আছে, টিবিংয়ের কাছ থেকে কলমটা নিয়ে সোফি বললো। একটা ছোট্ট কৌশল, যা আমি শিখেছি রয়্যাল হলোওয়েতে। সোফি বর্ণমালার প্রথম অর্ধেকটা লিখলো বাম থেকে ডান দিকে, তারপর, সেগুলোর নিচে বাকি অর্ধেক বর্ণমালা লিখলো ডান থেকে বাম দিকে। ক্রিপ্টো বিশেজ্ঞরা এটাকে বলে ফোন্ড-ওভার। অর্ধেকটা জটিল, পুরোটা পরিষ্কার।

 

A             B             G             D             H             V             Z              Ch           T              Y              K

Th           Sh           R             Q             Rz           P             O             S              N             M            L

 

 

টিবিং সোফির হাতের লেখাটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। একদম ঠিক লিখেছেন। হলোওয়ের ছেলে-পুলেরা কাজকর্ম করতে পারছে দেখে খুব ভালো লাগছে।

 

সোফির বিকল্প মেট্রিক্সটার দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন ভেতরে ভেতরে খুব রোমাঞ্চ অনুভব করলো। এটবাশ সিফারটা যখন প্রথম দিকে পণ্ডিতরা ব্যবহার করেছিলো, তখন তারাও একই রকম রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলো। এখন সেই সিফারটাকে শেশাখ-এর রহস্য বলে ডাকা হয়। বছরের পর বছর ধরে ধর্মীয় পণ্ডিতরা শেশাখ নামের শহরটার উল্লেখ দেখে খেই হারিয়ে ফেলতেন। এই নামের কোন শহর, কোন মানচিত্র বা দলিল-দস্তাবেজের উল্লেখ নেই, তার পরেও এই নামটা জেরেমিয়ার পুস্তকে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে—শেশাখের রাজা, শেখ নগরী, শেশাখের জনগণ। শেষে, একজন পণ্ডিত এটবাশ সিফার প্রয়োগ করে শব্দটার আসল রূপ বের করেছিলেন। ফলাফলটা ছিলো হতবুদ্ধিকর। সিফারের মাধ্যমে দেখা গেলো যে, শেশা আসলে অন্য আরেকটা বিখ্যাত শহরের সাংকেতিক নাম। সংকেত উদ্ধারটা ছিলো খুবই সহজ।

 

Sheshach হিব্রুতে বানান করে লেখা হয় : Sh-Sh-Sh-K।

 

এটাকে যখন বিকল্প মেট্রিক্সে ফেলা হলো, তখন সেটা হয়ে গেলো B-B-L B-B-L হিব্রুতে উচ্চারণ করা হয় Babel।

 

শেশাখের রহস্যটা উন্মোচিত হলো বাবেল শহর হিসেবে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আরো কতগুলো এটবাশ কোডের শব্দ ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে উদ্ধার করা হলো, উন্মোচিত করা হলো লুক্কায়িত অর্থগুলো, যা পণ্ডিতরা জানতো না কোথায় ছিলো সেগুলো।

 

আমরা খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছি, ল্যাংডন ফিফিস্ করে বললো, নিজের উত্তেজনা দমন করতে পারছে না সে।

 

আর কয়েক ইঞ্চি, রবার্ট, টিবিং বললো। সোফির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। আপনি প্রস্তুত?

 

সোফি সায় দিলো।

 

ঠিক আছে, হিব্রুতে বাফোমেটকে স্বরবর্ণ ছাড়া পড়া হয় : B-P-V-M-Th। এখন আমরা আপনার এটবাশ বিকল্প মেট্রিক্সটা প্রয়োগ করে আমাদের পাসওয়ার্ডের পাঁচটি অক্ষরে অনুবাদ করবো।

 

ল্যাংডনের হৃদকম্পন শুরু হয়ে গেলো। B-P-V-M-Th। সূর্যটার আলো এখন জানালা দিয়ে ঢুকে পড়েছে। সে সোফির বিকল্প মেট্রিক্সটার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করলো। B হলো Sh… P হলো V…

 

টিবিং ক্রিসমাসের সময় স্কুলের বাচ্চাদের মতো দাঁত বের করে হাসতে লাগলেন। এটবাশ সিফারটাতে হয়ে যায় … তিনি একটু থামলেন। বেশ, বেশ! তার মুখটা ফ্যাঁকাশে হয়ে গেলো।

 

ল্যাংডন মাথা নাড়লো।

 

হয়েছে কি? সোফি জানতে চাইলো।

 

আপনারা বিশ্বাস করবেন না। টিবিং সোফির দিকে তাকালেন। বিশেষ করে আপনি।

 

কি বলতে চাচ্ছেন? সে বললো।

 

চমৎকার… নিচু স্বরে বললেন। একেবারেই অভূতপূর্ব! টিবিং আবারো কাগজের ওপর লিখলেন। এই তো, আপনার পাসওয়ার্ড। কাগজের লেখাটা তাদেরকে দেখালেন।

 

Sh-V-P-Y-A

 

সোফি ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। এটা কি?

 

ল্যাংডনও সেটা চিনতে পারলো না।

 

টিবিংয়ের কণ্ঠটা মনে হলো বিস্ময়ে কাঁপছে। এটা হলো, বন্ধুরা আমার, আসলে জ্ঞানের প্রাচীন একটি শব্দ!

 

ল্যাংডন অক্ষরগুলো আবারো পড়লো। এই ফুলটা যুক্ত করবে ওদানের প্রাচীন এক শব্দ। মুহূর্তেই সে ধরতে পারলো! সে একটুও ভাবেনি এটা। জ্ঞানের প্রাচীন একটা শব্দ!

 

টিবিং হাসতে লাগলেন। আক্ষরিক অর্থেই!

 

সোফি শব্দটা দেখে ডায়ালের দিকে তাকালো। সাথে সাথেই, বুঝতে পারলো ল্যাংডন আর টিবিং একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। দাঁড়ান! এটা পাসওয়ার্ড হতে পারে না, সে বললো। ক্রিপ্টেক্সের ডায়ালে Sh অক্ষরটা নেই। এটাতে তো ঐতিহ্যবাহী রোমান বর্ণমালা ব্যবহার করা হয়েছে।

 

শব্দটা পড়ো, ল্যাংডন তাগাদা দিলো। দুটো জিনিস মনে রেখো। হিব্রুতে Sh-কে S-এর মতোও উচ্চারণ করা যায়, নির্ভর করে বাচনভঙ্গীর ওপরে। যেমন P অক্ষরটা F-এর মতো উচ্চারিত করা যায়।

 

SVFYA? সে ভাবলো, বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।

 

জিনিয়াস! টিবিং যোগ করলেন। VAV অক্ষরটা প্রায়শই 0 স্বরবর্ণের মতো উচ্চারিত হয়।

 

সোফি আবারো অক্ষরগুলোর দিকে তাকালো, সেগুলোর উচ্চারণ কী রকম হয় সেটা চেষ্টা করে দেখলো।

 

S… 0… f… y… a।

 

ল্যাংডন সোৎসাহে মাথা নাড়লো। হ্যা! গৃক ভাষায় সোফিয়ার আক্ষরিক অর্থ হলো জ্ঞান। তোমার নামের উৎসটা হলো আক্ষরিক অর্থেই জ্ঞান।

 

সোফি হঠাৎ করেই তার দাদুর অভাব অনুভব করলো, প্রচণ্ডভাবে। তিনি আমার নামে প্রায়োরিদের কি-স্টোনটা এনক্রিপ্ট করেছেন। তার গলাটাতে কিছু একটা আঁটকে গেলো যেননা। সব কিছুই মনে হচ্ছে নিখুঁত। কিন্তু পাঁচ অক্ষরের ডায়ালটার দিকে তাকাতেই, সে বুঝতে পারলো আরো একটা সমস্যা রয়ে গেছে। কিন্তু দাঁড়ান… Sophia শব্দের তো অক্ষর ছয়টা।

 

টিবিংয়ের হাসিটা মিইয়ে গেলো না। আপনার দাদুর লেখা কবিতাটার দিকে তাকান, জ্ঞানের প্রাচীন একটি শব্দ।

 

হ্যাঁ।

 

টিবিং ভুরু তুললেন। প্রাচীন গৃকে জ্ঞান শব্দটা S-O-F-I-A বানানে লেখা

 

 

 

৭৮.

 

সোফি ক্রিপ্টেক্সটার ডায়াল ঘোরাতে ঘোরাতে নিজের মধ্যে একটা বন্য উত্তেজনা অনুভব করলো। স্কুলটা মুক্ত করবে জ্ঞানের প্রাচীন একটা শব্দ। ল্যাংডন আর টিবিং সেটার দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হলো তাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে।

 

S…0…F…

 

সাবধানে, টিবিং বললেন। খুব সাবধানে।

 

…I…A।

 

সোফি ডায়ালটা পুরোপুরি মেলালো। ঠিক আছে, নিচু স্বরে সে বলে তাদের দিকে তাকালো। আমি এটা টানছি।

 

ভিনেগারের কথাটা মনে রেখো, ল্যাংডন ভীত কণ্ঠে বললো। সাবধানে।

 

সোফি জানতো, এই ক্রিপ্টেটা যদি তার ছোট বেলার ক্রিপ্টেক্সগুলোর মতো হয়ে থাকে, তবে সে সিলিন্ডারের দুদিক হাত দিয়ে ধরে আস্তে করে বিপরীত দিক থেকে চাপ দিলেই হবে। পাসওয়ার্ডটা যদি সঠিক হয়ে থাকে, তবে এক দিকের মাথাটা খুলে যাবে, তখন সেটার ভেতর থেকে রোল করা প্যাপিরাসটা বের করে নিতে পারবে। কাগজটা ভিনেগারের ভায়ালকে পেঁচিয়ে রোল করা থাকবে। আর যদি পাস ওয়ার্ডটা ভুল হয়ে থাকে, তবে বাইরে থেকে চাপ দেয়ার ফলে ভেতরের লিভারটা কাঁচের ভায়ালটাকে ভেঙে ফেলবে।

 

খুব আস্তে করে টানো, নিজেকে বললো সোফি।

 

সিলিন্ডার অর্থাৎ চোঙাটার দু মাথা হাত দিয়ে ধরতেই ল্যাংডন আর টিবিং সোফির দিকে ঝুঁকে পড়লো। কোডটার মর্মোদ্ধার করার প্রবল উত্তেজনায় সোফি প্রায় ভুলতেই বসেছিলো ভেতরে তারা কী খুঁজে পাবার প্রত্যাশ করছে। এটা হলো প্রায়োরি কি স্টোন। টিবিংয়ের মতে, এটার মধ্যে হলি গ্রেইলের মানচিত্রটা রয়েছে। যাতে ম্যারি মাগদালিন এবং স্যাংগৃল দলিলগুলোর খোঁজ পাওয়া যাবে…অতি গোপন সত্যটার অনিবার্য এক গুপ্তধন।

 

পাথরের টিউবটা ধরে, সোফি পুণরায় দেখে নিলো, ডায়াল করা অক্ষরগুলো ঠিক মতো সারিবদ্ধ করা আছে কিনা। তারপর, আস্তে করে সে টান দিলো। কিছুই হলো না। আরেকটু জোড়ে টান দিলে হঠাৎ করে পাথরের মুখটা খুলে গেলো। মুখটার আঁটকানো অংশটা তার হাতে খুলে এলো। ল্যাংডন, আর টিবিং রীতিমতো লাফিয়ে উঠলো। সিলিন্ডারের ভেতরে তাকাতেই সোফির হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগলো।

 

একটা স্ক্রল!

 

রোল করা কাগজটার দিকে তাকিয়ে সোফি দেখতে পেলো, সেটা চোঙার মতো কিছু একটা পেঁচিয়ে আছে ভিনেগারের ভায়ালটা, সে বুঝতে পারলো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ভিনেগারের ভায়ালটা পেঁচিয়ে থাকা কাগজটা নরম পাতলা প্যাপিরাস নয়, বরং সেটা ভেড়ার চামড়ার। এটা খুবই অদ্ভুত, সে ভাবলো, ভিনেগারতো ভেড়ার চামড়াকে নষ্ট করতে পারে না।

 

সে আবারো জিনিসটার দিকে তাকালো, এবার সে দেখতে পেলো মাঝখানের জিনিসটা আসলে ভিনেগারের ভায়াল নয়। জিনিসটা একেবারেই অন্যকিছু।

 

কি হয়েছে? টিবিং জিজ্ঞেস করলেন। স্ক্রলটা টেনে বের করুন।

 

সোফি রোল করা চামড়াটা টেনে বের করলো।

 

এটাতো প্যাপিরাস নয়, টিবিং বললেন। খুব ভারি এটা।

 

আমি জানি। এটা একটা প্যাড।

 

কিসের জন্য? ভিনেগারের ভায়ালের জন্য?

 

না। সোফি স্কুলটা খুলে পেঁচানো চামড়ার ভেতর থেকে জিনিসটা বের করলো। এটার জন্য।

 

ল্যাংডন যখন ভেলামের ভেতর থেকে বের করা জিনিসটা দেখতে পেলো, সে খুব আশাহত হলো।

 

ঈশ্বর আমাদেরকে সাহায্য করো, ভগ্ন হৃদয়ে টিবিং বললেন। আপনার দাদু একজন নির্মম স্থপতি।

 

ল্যাংডন বিস্ময়ে চেয়ে রইলো। সব দেখে মনে হচ্ছে, এটা সহজ করে তোলার কোন অভিপ্রায় সনিয়ের ছিলো না।

 

টেবিলের ওপরে দ্বিতীয় আরেকটা ক্রিপ্টেক্স রাখা। ছোট্ট। কালো অনিক্স দিয়ে তৈরি সেটা। প্রথমটার ভেতরেই এটা ছিলো। দ্বৈতবাদের প্রতি সনিয়ের মোহ। দুটো ক্রিপ্টের। প্যারিসের সবখানেই এমনটি দেখা যায়। নারী আর পুরুষ। সাদার ভেতরে কালো। ল্যাংডন অনুভব করলো সিম্বোলজিমের জাল ছড়িয়ে আছে তার সামনে। সাদা জন্ম দিচ্ছে কালো।

 

প্রতিটি মানুষই নারীদের থেকে এসেছে।

 

সাদা–নারী।

 

কালো—পুরুষ।

 

ল্যাংডন ছোট ক্রিপ্টেক্সটা তুলে নিলো। এটা দেখতে অনেকটা প্রথমটার মতোই। শুধুমাত্র আকারে অর্ধেক আর কালো রঙের। সে অতিপরিচিত গরুগরু শব্দটা শুনতে পেলো। অবধারিতভাবেই, তারা যে ভিনেগারটার কথা ভেবেছিলো, সেটা এই ঘোট ক্রিপ্টেক্সটার ভেতরেই রয়েছে।

 

তো রবার্ট, তাঁর সামনে ভেড়ার চামড়াটা মেলে ধরে টিবিং বললেন। আপনি এটা শুনে খুশি হবেন যে, আমরা অন্ততপক্ষে ঠিক জায়গাতেই যাচ্ছি।

 

ল্যাংডন পাতলা চামড়াটার দিকে তাকালো। সুন্দর হাতের লেখায় আরো চারটা পংক্তি আছে সেটাতে। এটাও ইয়াম্বিক পেনটামিটারে লেখা। পংক্তিটা সাংকেতিক, ল্যাংডন সেটা পড়ে দেখলো।

 

পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট, লন্ডনে আছেন শায়িত।

 

কবিতাটার বাকি লাইনগুলো স্পষ্টতই, এমন একটা পাসওয়ার্ড হবে, যা দ্বিতীয় ক্রিপ্টেটা খুলতে সাহায্য করবে, আর সেই ক্রিপ্টেক্সে থাকবে একজন নাইটের সমাধি ফলকের কথা, লন্ডন শহরেরই কোথাও হবে সেটা।

 

ল্যাংডন উত্তেজনায় টিবিংয়ের দিকে তাকালো। আপনার কি কোন ধারণা আছে, এই কবিতায় কোন্ নাইটের কথা বলা হয়েছে?

 

টিবিং হাসলেন। এটা খুব কষ্টকর কিছু নয়। আমি জানি কোন্ সমাধিটা আমাদের খুজঁতে হবে, এ ব্যাপারে আমি একেবারেই নিশ্চিত।

 

 

 

ঠিক সেই মুহূর্তে, তাদের থেকে পনেরো মাইল দূরে, কেন্ট পুলিশের ছয়টি গাড়ি বৃষ্টি ভেজা পথ ধরে বিগিন-হিল এক্সিকিউটিভ এয়াপোর্টের দিকে ছুটে যাচ্ছে।

 

 

 

৭৯.

 

লেফটেনান্ট কোলেত টিবিংয়ের ফুজ থেকে একটা পেরিয়ার মদ নিয়ে ড্রইংরুমে ফিরে এলো। ফশের সাথে লন্ডনে না থেকে, যেখানে ঘটনাটা সংঘটিত হয়েছে সেই শ্যাতু ভিলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পিটিএস দলটির বেবি সিটিংয়ের দায়িত্ব পালন করছে এখন।

 

এ পর্যন্ত তারা যেসব প্রমাণ-পত্র খুঁজে পেয়েছে সেগুলো কোন সাহায্যেই আসবে। : ফ্লোরে একটা বুলেট বিদ্ধ হয়ে আছে; একটা কাগজে অসংখ্য প্রতীক ভরা আর তাতে লেখা আছে তলোয়ার এবং পেয়ালা; আর একটা রক্তাক্ত কাঁটাযুক্ত বেল্ট। পিটিএস দলটি তাকে বলেছে, এটা রক্ষণশীল ক্যাথলিক গ্রুপ ওপাস দাইর সাথে সংশ্নিষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ে, তাদের উগ্র আর আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলো দলটি।

 

কোলেত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বড়সড় হলওয়েটার দিকে চলে গেলো সে। একটা বিশাল স্টাডি রুমে প্রবেশ করলো। এখানে প্রধান পিটিএস পরীক্ষক আঙুলের ছাপের জন্য ব্যস্ত রয়েছে।

 

কিছু পেলেন? ঢুকতে ঢুকতে কোলেত বললো।

 

পরীক্ষক মাথা ঝাঁকালেন। নতুন কিছু না। বাকি ঘরে যাদের ছাপ পাওয়া গেছে এখানেও সেই একই জিনিস।

 

সিলিস বেল্টটার আঙুলের ছাপ?

 

ইন্টারপোল এটা নিয়ে কাজ করছে। এখানে যা-ই পাওয়া যাচ্ছে, আমি সেগুলো আপলোডেড করে ফেলছি।

 

কোলেত ডেস্কের ওপরে রাখা দুটো এভিডেন্স-ব্যাগের দিকে ঘুরলো। আর . এটা?

 

লোকটা কাঁধ ঝাঁকালো। অভ্যাসবশত কাজ। যা কিছুই অদ্ভুত পাচ্ছি, সবই ব্যাগে রাখছি।

 

কোলেত সেটার কাছে গেলো। অদ্ভুত?

 

এই বৃটিশটা খুবই আজব মানুষ, পরীক্ষক বললো। এটা একটু দেখুন। সে ব্যাগ থেকে একটা জিনিস বের করে কোলেতকে দিলো।

 

ছবিটাতে দেখা যাচ্ছে গোথিক ক্যাথেড্রালের প্রবেশ পথটা ঐতিহ্যবাহী খিলানযুক্ত পথ, সেটা গিয়ে থেমেছে ছছাট একটা দরজার দিকে।

 

কোলেত ছবিটা দেখে ঘুরলো। এটা অদ্ভুত?

 

ওটা উল্টিয়ে দেখুন।

 

ছবিটার পেছনে, ইংরেজিতে কিছু লেখা। ক্যাথেড্রালের সুদীর্ঘ অভ্যন্তরীন পথটাকে বর্ণনা করা হয়েছে নারীদের যোনী হিসেবে, যা প্যাগানদের গোপন শ্রদ্ধা। এটা খুবই অদ্ভুত। একটা ক্যাথেড্রালের প্রবেশ পথকে বর্ণনা করা হয়েছে। দাঁড়ান! সে মনে করে একটা ক্যাথেড্রালের প্রবেশ পথ নারীর যোনীকে প্রতিনিধিত্ব করে…

 

পরীক্ষক সায় দিলো। কোলেত দ্বিতীয় ব্যাগটা খুলে দেখলো। একটা বড় ছবি রয়েছে সেখানে, মনে হচ্ছে, কোন পুরনো দলিলের ছবি সেটা। উপরে লেখা আছে :

 

লো ডোসিয়ার সিক্রেট নাম্বার 40 I mI 249

 

এটা কি? কোলেত জিজ্ঞেস করলো।

 

জানি না। সারা বাড়িটাতে এটার কপি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তাই এর কপি আমি ব্যাগে ভরে রেখেছি।

 

কোলেত দলিলটা ভালো করে দেখলো।

 

প্রায়োরি দ্য সাইওন—এ্যান্ড মাস্টারস

 

জ্য দ্য গিলোর্‌স ১১৮৮-১২২০

 

ম্যারি দ্য সেন ক্লেয়ার ১২২০-১২৬৬

 

গুইলামে দ্য গিসোরস ১২৬৬-১৩০৭

 

এদুয়াদ দ্য বার ১৩০৭-১৩৩৬

 

জ্যঁ নে দ্য বার ১৩৩৬-১৩৫১

 

জ্যঁ দ্য সেন ক্লেয়ার ১৩৫১-১৩৬৬

 

ব্লাঁশে দাভরু ১৩৬৬-১৩৯৮

 

নিকোলাস ফ্লামেল ১৩৯৮-১৪১৮

 

রেনে দাঁজু ১৪১৮-১৪৮০

 

আয়োলন্দে দ্য বার ১৪৮০-১৪৮৩

 

সান্দরো বত্তিচেল্লি ১৪৮৩-১৫১০

 

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ১৫১০-১৫১৯

 

কন্নেতাব্‌লে দ্য বুরবোয়াঁ ১৫১৯-১৫২৭

 

ফার্দিনান্দ দ্য গনজাক ১৫২৭–১৫৭৫

 

লুইস দ্য নেভারস ১৫৭৫-১৫৯৫

 

রবার্ট ক্লাড ১৫৯৫-১৬৩৭

 

জে, ভ্যালেন্টিন আঁদ্রেয়া ১৬৩৭-১৬৫৪

 

রবার্ট বয়েল ১৬৫৪-১৬৯১

 

আইজ্যাক নিউটন ১৬৯১-১৭২৭

 

চালর্স র‍্যাডক্লিফ ১৭২৭-১৭৪৬

 

শার্ল দ্য লোরেইন ১৭৪৬-১৭৮০

 

ম্যাক্সিমিলান দ্য লোরেইন ১৭৮০-১৮০১

 

চার্লস নডিয়ার ১৮০১–১৮৪৪

 

ভিক্টর হুগো ১৮৪৪-১৮৮৫

 

ক্লদ দেবাশি ১৮৮৫-১৯১৮

 

জ্যঁ কতো ১৯১৮-১৯৬৩

 

প্রায়োরি দ্য সাইওন? কোলেত বিস্মিত হলো।

 

লেফটেনান্ট? আরেকজন এজেন্ট এসে বললো। ক্যাপ্টেন ফশেকে একজন খুব জরুরি প্রয়োজনে খুঁজছে, তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনি কি ফোনটা ধরবেন?

 

কোলেত রান্নাঘরে গিয়ে ফোনটা ধরলো। আঁদ্রে ভার্নেট করেছে।

 

ব্যাংকারের পরিষ্কার মার্জিত কণ্ঠটা তার দুশ্চিন্তাকে খুব কমই ঢাকতে পেরেছে। আমি ভেবেছিলাম ক্যাপ্টেন ফশে আমাকে ফোন করবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি করেননি।

 

ক্যাপ্টেন খুবই ব্যস্ত আছেন, কোলেত জবাব দিলো। আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?

 

আমাকে আশ্বস্ত করা হয়েছিলো, আজকের ঘটনার অগ্রগতি সম্পর্কে আমাকে জানানো হবে।

 

কয়েক মুহূর্তের জন্য, কোলেতের মনে হলো, সে লোকটার কণ্ঠটা চিনতে পেরেছে, কিন্তু কার কণ্ঠ, নিশ্চিত হতে পারলো না। মঁসিয়ে ভার্নেট, বর্তমানে আমিই প্যারিসের তদন্ত কাজের দায়িত্বে আছি। আমার নাম লেফটেনান্ট কোলেত।

 

ফোনে একটা দীর্ঘ বিরতি নেমে এলো। লেফটেনান্ট, আমার আরেকটা ফোন এসেছে। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনাকে পরে ফোন করছি। সে ফোনটা রেখে দিলো।

 

কোলেত ফোনটা কিছুক্ষণ ধরে রাখলো। তারপরেই তার মনে পড়লো। আমি জানতাম, কণ্ঠটা চিনতে পেরেছি। প্রবল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো তার মধ্যে।

 

ব্যাংকের সেই ট্রাক ড্রাইভার।

 

নকল রোলেক্স ঘড়ি পরা।

 

কোলেত এবার বুঝতে পারলো ব্যাংকার কেন তড়িঘড়ি করে ফোনটা রেখে দিয়েছে। ভার্নেটও জড়িত। সে মনে করেছিলো, সে ফশেকে ফোন করছে। আবেগতাড়িত হয়ে কোলেত বুঝতে পারলো, এটাই তার জীবনের সবচাইতে সাফল্য মণ্ডিত হবার সুযোগ এনে দিয়েছে।

 

সে তখনই ইন্টারপোলকে ফোন করে অনুরোধ করলো, জুরিখের ডিপোজিটরি ব্যাংক এবং এর প্রেসিডেন্ট আঁদ্রে ভার্নেট সম্পর্কিত সব তথ্য যেনো খুঁজে দেখা হয়।

 

 

 

৮০.

 

সিটবেল্ট, প্লিজ, হকারটা বৃষ্টিস্নাত সকালে নিচে নেমে আসতেই টিবিংয়ের পাইলট ঘোষণা দিলো। আমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ল্যান্ড করবো।

 

টিবিং নিজের দেশে ফিরে আসতে পেরে উৎফুল্ল হলেন। বিমান থেকে নিচে তাকিয়ে দেখলেন কুয়াশাচ্ছন্ন কেন্টের পর্বতমালা ছড়িয়ে আছে। প্যারিস থেকে ইংল্যান্ড এক ঘন্টারও কম সময়ের দূরত্বে। তারপরেও, মনে হয় বহু দূরের। এই আদ্র সকালটা, সবুজ বসন্তের সময়ে, মনে হচ্ছে, তাকে তার দেশ স্বাগতম জানাচ্ছে। ফ্রান্সে আমার সময় শেষ হয়ে গেছে। আমি ইংল্যান্ডে বিজয়ীর বেশে ফিরছি। কি-স্টোনটা পাওয়া গেছে। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, কি-স্টোনটা শেষপর্যন্ত তাদেরকে কোথায় নিয়ে যাবে। যুক্তরাজ্যের কোথাও আছে সেটা। ঠিক কোথায়, টিবিংয়ের কোন ধারণাই নেই, তবুও বিজয়ের স্বাদ অনুভব করছেন তিনি।

 

ল্যাংডন আর সোফি তাঁর দিকে তাকালে টিবিং উঠে গিয়ে ক্যাবিনের অপর পাশে চলে গেলেন। তারপর, দরজার একটা প্যানেল এক পাশ থেকে টানতেই সেটা সরে গিয়ে ছোট্ট, চমৎকার একটা ওয়াল-সেফ বেড়িয়ে আসলো। সেখান থেকে দুটো পাসপোর্ট বের করলেন টিবিং। রেমি আর আমার জন্য কাগজ-পত্র। এরপর পঞ্চাশ পাউন্ডের একটা বান্ডিল তুলে নিলেন। আর এটা হলো, আপনাদের কাগজ-পত্র।

 

সোফি কটাক্ষ করে বললো, ঘুষ?।

 

সৃজনশীল কূটনীতি। একজন বৃটিশ কাস্টমস অফিসার আমাদেরকে হ্যাঙ্গারে অভ্যর্থনা জানাতে আসবে। তাকে আসতে না বলে বরং বলবো, আমি একজন ফরাসি সেলিবৃটিকে নিয়ে এসেছি, যে চায় না, কেউ জানুক মে ইংল্যান্ডে এসেছে বিশেষ করে সাংবাদিকরা আর আমি সেই অফিসারকে তার বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নেবার জন্য ছোট্ট একটা পারিতোষিক দেবো।

 

ল্যাংডনকে দেখে মনে হলো সে খুব মজা পেয়েছে। তারা এটা গ্রহণ করবে?

 

যে কোন ব্যক্তির কাছ থেকে নয়, কিন্তু এরা আমাকে খুব ভালো করেই চেনে, আমি তো কোন অস্ত্র বিক্রেতা নই। আমি নাইট উপাধি পাওয়া। টিবিং হাসলেন। একটু বাড়তি সুবিধাতো এতে আছেই।

 

রেমি এসে উপস্থিত হলো, তার হাতে হেলার এ্যান্ড কোচ পিস্তলটা ধরা। স্যার, আমার কাজ কি?

 

টিবিং তাঁর গৃহপরিচারকের দিকে তাকালেন। আমি চাই তুমি প্লেনেই থাকো আমাদের অতিথির সাথে, যতোক্ষণ না আমি ফিরে আসি। আমরা তো আর তাকে নিয়ে সারা লন্ডন শহরটা ঘুরতে পারি না।

 

সোফিকে দেখে মনে হলো, সে খুব উদ্বিগ্ন। লেই, আমি নিশ্চিত, আমরা ফিরে যাবার আগেই ফরাসি পুলিশ আপনার প্লেনটা খুঁজে পাবে।

 

টিবিং হাসলেন। হ্যাঁ, তারা যদি প্লেনে উঠে রেমিকে পায়, তবে তো।

 

সোফি তার এই দুঃসাহস দেখে অবাক হলো। লেই, আপনার প্লেনে হাত-পা বাঁধা একজন জিম্মি আছে, যাকে আপনি আন্তর্জাতিক সীমানা পার করেছেন। এটা খুবই মারাত্মক একটি ব্যাপার।

 

সেটা আমার উকিলরা দেখবে। পাদ্রীর কাছে গেলেন তিনি। এই জানোয়ারটা আমার বাড়িতে ঢুকে আমাকে প্রায় খুনই করে ফেলেছিলো। এটাতো সত্যি। রেমি সাক্ষ্য দেবে।

 

কিন্তু, আপনি তাকে হাত-পা বেঁধে লন্ডনে উড়িয়ে নিয়ে এসেছেন? ল্যাংডন বললো।

 

টিবিং তার ডান হাতটা তুলে ধরে আদালতে শপথ নেবার ভঙ্গী করলেন। ইয়োর অনার, একজন বৃদ্ধ নাইটের বৃটিশ আদালতের প্রতি বোকার মতো বেশি পক্ষপাতকে ক্ষমা করবেন। আমি বুঝতে পারছি, আমার উচিত ছিলো ফরাসি কর্তৃপক্ষকে বলা, কিন্তু আমি ঐসব ফরাসি লেইসে ফেয়ারদেরকে পুরোপুরি বিশ্বাস করি না। এই লোকটা আমাকে মেরেই ফেলেছিলো। হ্যাঁ, আমি তাড়াহুড়ো করে আমার গৃহপরিচারককে বাধ্য। করেছি তাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে আসতে। কিন্তু আমি খুবই মানসিক চাপের মধ্যে ছিলাম। মিয়া কুলপা। মিয়া কুলপা।

 

স্যার? পাইলট আবারো বললো। টাওয়ার থেকে জানাচ্ছে, আমাদের হ্যাঙ্গারের সামনে প্লেনটা নিয়ে যাবার ব্যাপারে তাদের কিছু সমস্যা রয়েছে, তারা আমাদেরকে সরাসরি টার্মিনালের দিকে ল্যান্ড করতে বলছে।

 

টিবিং বিগিন-হিলে প্রায় এক দশকে ধরে প্লেন ব্যবহার করছে, আর এবারই প্রথম এরকম হলো। তারা কি বলেছে সমস্যাটা কী?

 

কন্ট্রোলার স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। পাম্পিং স্টেশনে গ্যাস লিক জাতীয় কিছু? তারা আমাকে টার্মিনালের সামনে ল্যান্ড করতে বলেছে আর তারা না বলার আগ পর্যন্ত সবাইকে প্লেনেই থাকতে বলেছে। নিরাপত্তার জন্যই।

 

টিবিং সন্দেহগ্রস্ত হলেন। গ্যাস লিক, না অন্য কিছু। হ্যাঙ্গার থেকে পাম্পিং স্টেশনটা আধ মাইল দূরে অবস্থিত।

 

রেমিকেও চিন্তিত মনে হলো। স্যার, অন্য কিছু মনে হচ্ছে।

 

টিবিং ল্যাংডন আর সোফির দিকে তাকালেন। বন্ধুরা, আমার একটা খারাপ সন্দেহ হচ্ছে যে, আমরা হয়তো কোন অভ্যর্থনা কমিটির মুখখামুখি হতে যাচ্ছি।

 

ল্যাংডন একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললো মনে হয়, ফশে এখনও ভাবছে, আমিই তার শিকার।

 

টিবিং এসব নিয়ে ভাবছিলেন না। ফশের ব্যাপারটা বাদ দিয়ে খুব দ্রুত তাদেরকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনিবার্য লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। গ্রেইলটা। আমরা খুব কাছাকাছি এসে পড়েছি।

 

লেই, ল্যাংডন বললো, তার কণ্ঠে গভীর উদ্বেগ, আমার উচিত আত্মসমর্পণ করে এই ব্যাপারটা বৈধভাবে সমাধান করা। আপনাদের সবাইকে এতে করে রেহাই দেয়া যাবে।

 

ওহ্, রবার্ট! টিবিং হাত নেড়ে অসম্মতি জানালেন। আপনি কি সত্যি মনে করেন, তারা আমাদেরকে রেহাই দেবে? আমি আপনাকে অবৈধভাবে পরিবহণ করেছি। মিস্ নেভু লুভর থেকে আপনাকে পালাতে সাহায্য করেছেন, আর হাত-পা বাঁধা একজন লোক আছে আমাদের সঙ্গে। এখন আমরা সবাই এ ব্যাপারে এক সাথেই আছি।

 

হয়তো অন্য কোন বিমান বন্দরে? সোফি বললো।

 

টিবিং মাথা ঝাঁকালেন। এখান থেকে আমরা যদি উড়াল দেই, তবে অন্য কোথাও নামার আগেই আমাদের অভ্যর্থনাকারী দল আর্মি ট্যাংক নিয়ে সেখানে হাজির হবে।

 

সোফি হতাশ হয়ে ধপ্ করে বসে পড়লো।

 

টিবিং আঁচ করলেন, তারা যদি কোনভাবে বৃটিশ কর্তৃপক্ষের সাথে মুখোমুখি হওয়াটা এড়াতে পারে, তবে গ্রেইল খোজাটার জন্য সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। আমাকে এক মিনিট সময় দিন, তিনি বললেন, ককপিটের দিকে হুড়মুড় করে যেতে উদ্যত হলেন।

 

কি করছেন? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

 

বেচা-বিক্রির আলোচনা, টিবিং বললেন, ভাবতে লাগলেন, তাঁর পাইলটকে খুব বড় ধরনের একটা অনিয়ম করতে রাজি করার জন্য কত খরচ হতে পারে।

 

 

 

০৯. হকারটা ল্যান্ড করার চুড়ান্ত মুহূর্তে

৮১.

 

হকারটা ল্যান্ড করার চুড়ান্ত মুহূর্তে উপনীত হলো।

 

সাইমন এডওয়ার্ড–বিগিন-হিল এয়ারপোর্টের এক্সিকিউটিভ সার্ভিস অফিসার–বৃষ্টি ভেজা রান-ওয়ের দিকে নার্ভাসভাবে তাকিয়ে কন্ট্রোল টাওয়ারে পায়চারী করছে। শনিবারের সকালে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে জেগে ওঠানোটা তার মনপুত হচ্ছে না। কিন্তু, এটা খুবই জঘন্য ব্যাপার যে, তাকে বিদেশ থেকে ফোন করে তার সবচাইতে সেরা ক্লায়েন্টকে গ্রেফতার করতে বলা হয়েছে। স্যার লেই টিবিং শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত হ্যাঙ্গারের জন্যই ভাড়া দিয়ে থাকেন না, বরং প্রতিটি ল্যাডিংয়ের জন্যও তিনি ফি দিয়ে থাকেন। সাধারণত, তাঁর আগমনের কথাটা আগেভাগেই এয়ারফিল্ডে জানানো হয়ে থাকে। টিবিং এমনটিই পছন্দ করে থাকেন। তার চমৎকার জাগুয়ারটা তাঁর হ্যাঙ্গারেই সবসময় তেল ভরে মওজুদ থাকে। পালিশ করে সেটা ফিটফাট করে রাখা হয়, আর যেদিন তিনি আসবেন, সেদিনের লন্ডন টাইমস্-এর এক কপি পেছনের সিটে রাখা থাকে। একজন কাস্টমস অফিসার প্লেনের কাছে চলে যায় প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র আর লাগেজ চেক করার জন্য। মাঝে মাঝেই টিবিং কাস্টসের লোকদেরকে কিছু নির্দোষ জিনিসের ব্যাপারে অন্ধ থাকার জন্য মোটা অংকের বখশিস দিয়ে থাকেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকে ফরাসি দামি দামি খাবার আর ফলমূল। প্লেনটা আসতে দেখে এডওয়ার্ডের নার্ভটা আরো বেশি টান টান হয়ে গেলো। যদিও এডওয়ার্ডকে এখনও জানানো হয়নি, টিবিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগটা কী। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, সেগুলো খুবই গুরুতর কিছু হবে।

 

বৃটিশ পুলিশ যদিও সাধারণত অস্ত্র বহন করে না, কিন্তু ঘটনার গুরুত্ব বুঝে তারা একটা সশস্ত্র দলকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। এখন, আট জন পুলিশ অস্ত্র হাতে টার্মিনালের ভেতরে অপেক্ষা করছে প্লেনটা নামার জন্য। প্লেনটা নামলে, সেটা বৃটিশ পুলিশ ঘিরে থাকবে, যতক্ষণ না ফরাসি কর্তৃপক্ষ এসে হাজির হয়।

 

সাইমন এডওয়ার্ড নিচে নেমে এলো টারমার্ক থেকে প্লেনটার অবতরণ দেখবে বলে। প্লেনটার চাকা রানওয়ে স্পর্শ করলে ধীরে ধীরে সেটা থামতে শুরু করলো, কিন্তু কথা মতো টার্মিনালের দিকে না এসে, সেটা টিবিংয়ের হ্যাঙ্গারের দিকেই এগোতে লাগলো।

 

পলিশের সবাই অবাক হয়ে এডওয়ার্ডের দিকে তাকালো। আমার মনে হয়, আপনি পাইলটকে বলেছিলেন, টার্মিনালের দিকে ল্যান্ড করতে, আর সেও রাজি হয়েছিলো!

 

এডওয়ার্ড অবাক হয়ে বললো, রাজিই তো হয়েছিলো! কয়েক সেকেন্ড বাদে এডওয়ার্ড পুলিশ সমেত একটা পুলিশের গাড়িতে করে হ্যাঙ্গারের দিকে ছুটে গেলো। পুলিশের গাড়ি থেকে হ্যাঙ্গারটা এখনও পাঁচশ গজ দূরে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে, টিবিংয়ের প্লেনটা হ্যাঙ্গারের ভেতরে ঢুকে দৃষ্টি সীমার আড়ালে চলে গেছে। হ্যাঙ্গারের বিশাল দরজাটার সামনে পুলিশের গাড়িটা আসতেই একদল সশস্ত্র পুলিশ দ্রুত নেমে পড়তেই এডওয়ার্ডও গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।

 

হৈ হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো।

 

হ্যাঙ্গারের ভেতরের প্লেনটার ইজিনের শব্দ এখনও শোনা যাচ্ছে। প্লেনটা ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে, হ্যাঙ্গারের সামনের দিকে মুখ করলে এডওয়ার্ড পাইলটকে দেখতে পেলো। বোধগম্য কারণেই, সামনে পুলিশের ব্যারিকেড দেখে তার মুখটা বিস্ময়ে হতবাক।

 

পাইলট অবশেষে ইজিনটা বন্ধ করলো। পুলিশের দলটা প্লেনটা ঘিরে ধরলো। এডওয়ার্ড কেন্ট-এর চিফ ইন্সপেক্টরের কাছে গেলো। লোকটা প্লেনের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড পর প্লেনের দরজাটা খুললো।

 

প্লেনের ইলেক্ট্রনিক সিঁড়িটা ধীরে ধীরে দরজার নিচে নামতেই দরজার কাছে লেই টিবিং আর্ভিভূত হলেন। নিচে পুলিশের অস্ত্র তাক করা দৃশ্যটা দেখে টিবিং ক্রাচে ভর দিয়ে মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, সাইমন, আমি কি বিদেশে থাকার সময় পুলিশের লটারি জিতেছি? তার কণ্ঠটাতে দুশ্চিন্তার চেয়েও বেশি ছিলো রসিকতা। সাইমন এডওয়ার্ড সামনে এগিয়ে একটা ঢোক গিলে বললো, গুড মর্নিং স্যার। এজন্যে ক্ষমা চাইছি। আমাদের এখানে একটা গ্যাস লিক হয়েছে, আর আপনার পাইলট বলেছিলো, সে টার্মিনালের দিকে আসছে।

 

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তো আমিই তাকে ওখানে না গিয়ে এখানে আসতে বলেছি। আমি একটা এপয়েন্টমেন্টের জন্য খুব বেশি দেরি করে ফেলেছি। আমি এই হ্যাঙ্গারের জন্য পয়সা দেই, আর গ্যাস লিক এড়ানোর কথাটা আমার কাছে খুব বাড়াবাড়ি ধরনের সর্তকতা বলে মনে হয়েছে।

 

আপনার এভাবে আগেভাগে না জানিয়ে আসাতে আমাদের একটু বেগ পেতে। হয়েছে, স্যার।

 

আমি জানি। আমি শিডিউলের বাইরে এসেছি। চিকিৎসার প্রয়োজনে।

 

পুলিশের লোকগুলো একে অন্যের দিকে তাকালো। এডওয়ার্ড হাসলো। খুব ভালো করেছেন, স্যার।

 

স্যার, কেন্টের চিফ ইন্সপেক্টর বললো, সামনের দিকে এগিয়ে আসলো সে। আপনাকে আমার বলার দরকার যে, আপনি আরো আধঘণ্টা আপনার প্লেনের ভেতরেই থাকবেন।

 

টিবিং সিঁড়ি দিয়ে নামতে যেতেই কথাটা শুনে ভুরু কুচকালো। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এটা অসম্ভব। আমার ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট আছে। টারমার্কে নেমে গেলেন তিনি। ওটা মিস্ করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

 

চিফ ইন্সপেক্টর টিবিংয়ের গতি পথ আগলে ধরলো। আমি ফরাসি জুডিশিয়ার পুলিশের নির্দেশ পালন করছি। তারা দাবি করছে, আপনি আপনার প্লেনে করে একজন আসামীকে নিয়ে এসেছেন।

 

টিবিং ইন্সপেক্টরের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। এটা কি কোন লুকানো ক্যামেরার টিভি অনুষ্ঠান? দারুণ তো!

 

ইন্সপেক্টর ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এটা খুবই সিরিয়াস ব্যাপার, স্যার। ফরাসি পুলিশ আরো দাবি করছে, আপনি নাকি একজন জিম্মিও সাথে করে নিয়ে এসেছেন।

 

টিবিংয়ের গৃহপরিচারক রেমি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। স্যার লেইর হয়ে কাজ করাটা আমার কাছে নিজেকে একজন জিম্মিই মনে হয়। কিন্তু, তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন, আমি এখন মুক্ত, যেখানে খুশি চলে যেতে পারি। রেমি তার ঘড়িটা দেখলো। মাস্টার, আমাদের সত্যি অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে হ্যাঙ্গারের ভেতরে রাখা জাগুয়ারটার দিকে ইশারা করলো। আমি গাড়িটা নিয়ে আসছি। রেমি এগোতে লাগলো।

 

আমরা আপনাদেরকে যেতে দিতে পারছি না, চিফ ইন্সপেক্টর বললো। দয়া করে নিজেদের প্লেনে ফিরে যান। দুজনেই। ফরাসি পুলিশের প্রতিনিধি দলটি খুব জলদিই এসে পৌঁছাবে।

 

টিবিং সাইমনের দিকে তাকালেন। সাইমন, ঈশ্বরের দোহাই, খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে! আমাদের সাথে অন্য কেউ নেই। রেমি, আমাদের পাইলট আর আমি। যাও, ভেতরে গিয়ে দ্যাখো, প্লেনটা খালি কি না।

 

এডওয়ার্ড জানতো, সে ফাঁদে পড়ে গেছে। জ্বি স্যার। আমি দেখছি।

 

খবরদার! কেন্টের ইন্সপেক্টর হাক দিলো। সে আগেই সন্দেহ করেছিলো, টিবিংয়ের ব্যাপারে সাইমন তাদের কাছে মিথ্যে বলে থাকতে পারে। আমি নিজেই দেখছি।

 

টিবিং মাথা ঝাঁকালেন। না, আপনি যাবেন না, ইন্সপেক্টর। এটা ব্যক্তিগত সম্পত্তি, আর যতোক্ষ না, আপনার কাছে তল্লাশীর ওয়ারেন্ট থাকছে, ততোক্ষণ আপনি আমার প্লেন থেকে দূরে থাকুন। আমি আপনাকে যৌক্তিক প্রস্তাবই দিচ্ছি। মি. এডওয়াড এই তল্লাশীটা চালাতে পারেন।

 

না, সেটা হবে না।

 

টিবিং চোয়াল শক্ত করে বললেন, ইন্সপেক্টর, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনার এই ছেলে-খেলায় আমার কোন আগ্রহ নেই। আমার দেরি হয়ে গেছে, আমি চলে যাচ্ছি। যদি আমাকে থামানোটা আপনাদের জন্য এতো বেশিই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে। তবে আমাকে গুলি করুন। এই কথা বলে টিবিং আর রেমি ইন্সপেক্টরকে পাশ কাটিয়ে পার্ককরা গাড়িটার দিকে চলে গেলো।

 

 

 

কেন্টের পুলিশ ইন্সপেক্টর লেই টিবিংয়ের এভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়াতে যারপরনাই বিরক্ত হলো। একটু বেশি অগ্রাধিকার পাওয়া লোকেরা সব সময়ই নিজেদেরকে আইনের উর্বে মনে করেন।

 

কিন্তু তারা তা নন। চিফ ইন্সপেক্টর ঘুরে টিবিংয়ের পেছন দিক থেকে পিস্তল তাক্‌ করে বললেন। থামুন! না হলে আমি গুলি করবো।

 

তাই করুন, পেছনে না তাকিয়ে এবং বিন্দুমাত্র না থেমেই টিৰিং বললেন। আমার উকিলরা আপনার বিচি সিদ্ধ করে নাস্তা খাবে। আর ভুলেও ওয়ারেন্ট ছাড়া আমার প্লেনে উঠবেন না, বলে দিচ্ছি।

 

ইন্সপেক্টর,ভাবলো, টেকনিক্যালি টিবিংই ঠিক। প্লেনে উঠতে হলে তাদের দরকার একটা সার্চ ওয়ারেন্টের। কিন্তু, প্লেনটা ফ্রান্স থেকে এসেছে, আর মহা ক্ষমতাধর বেজু ফশের নির্দেশ আছে সেটা থামাতে। তাই, টিবিংয়ের প্লেনে কি আছে, সেট দেখারও দরকার রয়েছে। তার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি কিছু লুকাচ্ছেন।

 

তাদেরকে থামাও, ইন্সপেক্টর আদেশ করলো। আমি প্লেনটা সার্চ করবো।

 

তার লোকজন অস্ত্র উঁচিয়ে টিবিং আর তার গৃহপরিচারকের পথ আঁটকে দিলো যাতে তারা গাড়িতে উঠতে না পারে।

 

এবার টিবিং ঘুরে দাঁড়ালেন। ইন্সপেক্টর, আমি শেষবারের মতো সর্তক করে দিচ্ছি। এই প্লেনে ওঠার চিন্তাও করবেন না। আপনি পস্তাবেন।

 

হুমকিটা অগ্রাহ্য করে চিফ ইন্সপেক্টর প্লেনে উঠতে উদ্যত হলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ক্যাবিনের ভেতরে ঢুকে পড়লো। এটা আবার কি?

 

ভীতসন্ত্রস্ত পাইলট ছাড়া পুরো বিমানটাই ফাঁকা। দ্রুত বাথরুম, লাগেজ-রুম চেক করে দেখলো সে। একজন মানুষের চিহ্নও পেলো না ইন্সপেক্টর … অনেক জন তো দূরের কথা।

 

বেজু ফশে ভাবছেটা কি? মনে হচ্ছে লেই টিবিং সত্যি কথাই বলেছেন।

 

চরম বিরক্ত হয়ে ইন্সপেক্টর ফাঁকা ক্যাবিনটাতে দাঁড়িয়ে রইলো। ধ্যাত্। তার মুখ লাল হয়ে গেছে। প্লেন থেকে নিচে নেমে এসে টিবিংয়ের দিকে তাকালো। তাদেরকে যেতে দাও, আদেশ করলো সে। আমাদের খবরটা ঠিক ছিলো না, মনে হচ্ছে।

 

টিবিংয়ের চোখে দুষ্টুমি দেখা গেলো। আপনি আমার উকিলের ফোন প্রত্যাশা করতে পারেন। আর ভবিষ্যতের জন্য বলে রাখছি, ফরাসি পুলিশকে বিশ্বাস করবেন না।

 

টিবিংয়ের গৃহপরিচারক গাড়িটার দরজা খুলে তার খোঁড়া মনিবকে পেছনের সিটে বসতে সাহায্য করলো। তারপর, রেমি নিজের আসনে ফিরে গিয়ে গাড়িটা চালু করে চলে গেলে পুলিশের লোকেরা অপসৃয়মান গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

 

 

 

ভালো অভিনয় করেছে, হে, টিবিং সামনে বসা গাড়ি চালক রেমিকে উত্যু হয়ে বললেন। এবার তিনি তাঁর সামনের খাজের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।

 

সবাই ঠিক আছেন তো?

 

ল্যাংডন দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে সায় দিলো। সে আর সোফি শ্বেতকায় লোকটার সাথে সিটের সামনে পাদানীতে শুইয়ে আছে।

 

প্লেনটা যখন হ্যাঙ্গারে প্রবেশ করেছিলো, তখন পুলিশ আসার আগেই রেমি দরজাটা খুলে দিলে ল্যাংডন আর সোফি মিলে পাদ্রীটাকে পাজাকোলা করে নিচে নামিয়ে এনেছিলো। পুলিশের দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবা জন্যে তারা টিবিংয়ের গাড়ির পেছনে লুকিয়ে পড়েছিলো। তারপর প্লেনটার ইজিন আবারো চালু করা হলো, যাতে পুলিশ মনে করে প্লেনটা সবেমাত্র থেমেছে।

 

এবার লিমুজিনটা কেন্টের দিকে ছুটে চললো। সোফি আর ল্যাংডন উঠে বসলো, কেবলমাত্র হাত-পা বাঁধা পাদ্রীকে পায়ের নিচে ফেলে রাখা হলো। টিবিং তাদের দিকে তাকিয়ে চওড়া একটা হাসি দিলেন। লিমুজিনের ভেতরে রাখা ছোট্ট বারটা খুলে ফেললেন তিনি। আমি কি আপনাদেরকে ড্রিংসের প্রস্তাব দিতে পারি? নিলিস? ক্রিসৃপ? বাদাম? সেলঞ্জার?

 

সোফি আর ল্যাংডন দুজনেই মাথা ঝাঁকালো।

 

টিবিং দাঁত বের করে হেসে বারটা বন্ধ করে দিলেন। তো এবার, নাইটদের সমাধিটা…

 

 

 

৮২.

 

ফ্লিট স্টৃট? ল্যাংডন লিমোর পেছনে বসা টিবিংয়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো। ফ্লিট স্টটে একটা ভূ-গর্ভস্থ কক্ষ আছে? এ পর্যন্ত নাইট সমাধিটা কোথায় থাকতে পারে বলে মনে করেন তা নিয়ে খুবই সুচতুরভাবে খেলেছেন টিবিং। ছোট ক্রিপ্টেক্সটাকে যে পাসওয়ার্ড দিয়ে খোলা যাবে, সেটা কবিতাটাতেই রয়েছে।

 

টিবিং দাঁত বের করে হেসে সোফির দিকে তাকালেন। মিস্ নেভু, হারভার্ডের ছোক্রাটাকে আরেকবার সেই কবিতাটা পড়ে শোনাবেন কি?

 

সোফি তার পকেট থেকে কালো রঙের ক্রিপ্টেক্সটা বের করলো, সেটা ভেড়ার চামড়ায় মোড়ানো ছিলো। সবাই মিলে তারা ঠিক করেছিলো, রোজউড বক্স আর বড় ক্রিপ্টেক্সটা প্লেনের স্ট্রং বক্সেই রেখে আসবে। তাদের সঙ্গে কেবল সেটাই রাখবে, যার দরকার রয়েছে। আর এক্ষেত্রে, কালো ক্রিপ্টেক্সটা যেমন দরকারি, তেমনি বহন করাও সহজ। সোফি চামড়াটা খুলে ল্যাংডনকে সেটা দিয়ে দিলো।

 

যদিও ল্যাংডন প্লেনে থাকার সময় কয়েকবার কবিতাটা পড়েছে, তারপরও, সে অবস্থানটা চিহ্নিত করতে পারেনি। এবার যখন ওটা আবার পড়ছে, তখন ধীরে ধীরে চেষ্টা করছে জিনিসটা বোধগম্য করতে। আশা করছে, পেনটা মেট্রিক ছন্দের কবিতাটির অর্থ বোধহয় এবার সে ধরতে পারবে।

 

পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট লন্ডনে আছেন শায়িত। যার শ্রমের ফল হয়ে ছিলো ধর্মাবতারের ক্রোধের কারণ। যে গোলক তুমি খোঁজো সেটা সমাধি ফলকেই থাকার কথা। এটা বিবৃত করে গোলাপী শরীর আর বীজপ্রসূ গর্ভের আখ্যান।

 

ভাষাটা খুবই সহজ মনে হচ্ছে। লন্ডনে একজন নাইটের কবর আছে। এমন একজন নাইট, যার কার্যকলাপ চার্চকে ক্রুদ্ধ করেছিলো। একজন নাইট যার সমাধি ফলকের গোলক হারিয়ে গিয়েছে। কবিতাটার শেষ লাইন-গোলাপের শরীর আর বীজপ্রসূ গর্ভের আখ্যান—এটাতে ম্যারি মাগদালিনকেই নির্দেশ করছে পরিষ্কারভাবে, যে গোলাপ, যিশুখৃস্টের বীজকে বহন করেছে।

 

কবিতাটাতে সরাসরি ইঙ্গিত করা সত্ত্বেও, ল্যাংডনের কোন ধারণাই নেই, কে সেই নাইট, আর কোথায় তাকে সমাহিত করা হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা, একবার তারা সমাধিটা খুঁজে পেলেও, মনে হচ্ছে যেনো তারা এমন কিছু খুঁজবে যা ওখানে নেই। গোলকটা সমাধি ফলকের ওপরেই থাকার কথা?

 

কিছু পেলেন না? টিবিং হতাশ হয়ে বললেন। যদিও ল্যাংডন আঁচ করতে পারছে, রয়্যাল হিস্টোরিয়ান কিছু একটা উপভোগ করছেন। মিস নেভু?

 

সোফি মাথা ঝাঁকালো।

 

আমি না থাকলে, আপনারা দুজন কী করতেন? টিবিং বললেন। খুব ভালো, আমি আপনাদেরকে সেখানে নিয়ে যাবো। এটা আসলে খুবই সহজ। প্রথম লাইনটাই হলো মূল চাবিকাঠি। আপনি কি সেটা একটু পড়বেন?

 

ল্যাংডন জোরে জোরে পড়লো, পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট লন্ডনে আছেন শায়িত।

 

একদম ঠিক। এমন একজন নাইট, যাকে পোপ সমাহিত করেছিলেন। ল্যাংডনের দিকে তাকালেন তিনি। এটা আপনার কাছে কী অর্থ বহন করে?

 

ল্যাংডন কাঁধ ঝাঁকালো। পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট? এমন একজন নাইট, যার শেষ কৃত্যানুষ্ঠানটিতে স্বয়ং পোপ উপস্থিত ছিলেন?

 

টিবিং জোরে জোরে হেসে উঠলেন। ওহ্, খুব ভালো বলেছেন। সব সময়ই আপনি খুব আশাবাদী, রবার্ট। দ্বিতীয় লাইনটা দেখুন। এই নাইট এমন কিছু করেছিলেন, যাতে ধর্মাবতার, মানে চার্চ ক্রুব্ধ হয়েছিলো। আরেকবার ভাবুন। চার্চ এবং নাইট টেম্পলারদের সম্পর্কের কথাটা বিবেচনা করুন। পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট?

 

পোপ কর্তৃক খুন হওয়া একজন নাইট? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

টিবিং হেসে সোফির হাটুতে চাপড় মারলেন। ভালোই বলেছেন, মাই ডিয়ার। পোপ কর্তৃক সমাহিত অথবা খুন হওয়া একজন নাইট।

 

ল্যাংডন ১৩০৭ সালের নটরিয়াস নাইট টেম্পলারের কথাটা স্মরণ করলোঅপয়া ১৩ তারিখ, শুক্রবার যখন পোপ ক্লেমেন্ট শত শত নাইট টেম্পলারদেরকে হত্যা করে সমাহিত করেছিলেন।

 

কিন্তু পোপ কর্তৃক খুন হওয়া নাইটদের কবরের সংখ্যাতত অসংখ্য।

 

আহা, অতোটা নয়! টিবিং বললেন। বেশির ভাগকেই আগুনে পুড়িয়ে টাইবার নদীতে কোন শেষকৃত্য ছাড়াই ফেলে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু এই কবিতাটিতে একটা সমাধির কথা বলা হয়েছে। লন্ডনের একটা সমাধি। আর লন্ডনে হাতে গোনা কয়েকজন নাইটকেই সমাহিত করা হয়েছে। তিনি থামলেন, ল্যাংডনের দিকে তাকালেন, যেনো ভোরের আলোর জন্য অপেক্ষা করছেন। অবশেষে, তিনি আবারো বলতে শুরু করলেন, রবার্ট, ঈশ্বরের দোহাই! লন্ডনে নির্মিত চার্চটি প্রায়োরিদের সশস্ত্র-যোদ্ধা দল তৈরি করেছিলোনাইট টেম্পলাররা নিজেরাই ছিলেন?

 

টেম্পলার চার্চ? ল্যাংডন গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বললো। ওখানে কি কোন ক্রিপ্ট বা ভূ-গর্ভস্থ কক্ষ আছে?

 

দশটি ভীতিকর সমাধি ফলক আছে, যা আপনি কখনও দেখেননি।

 

ল্যাংডন আসলে কখনই টেম্পলার চার্চে যায়নি, যদিও সে প্রয়োরিদের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে অসংখ্যবার এটার উল্লেখ করেছে। এক সময়ে সব ধরণের প্রায়োরি কাজকর্মের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো যুক্তরাজ্যের টেম্পলার চার্চ। টেম্পলার চার্চের নাম ছিলো সলোমনের মন্দির, পরে টেম্পলারদের নামানুসারে এটার নাম রাখা হয়। সেখানেই তাঁরা স্যাংগৃল দলিলগুলো রেখেছিলেন, যা রোমে তাঁদের ক্ষমতার উৎস ছিলো। গল্প প্রচলিত আছে যে, নাইটরা সেখানে অদ্ভুত আর গোপন কিছু অনুষ্ঠান করতেন। টেম্পলার চার্চটা ফ্লিট স্টটে?

 

আসলে, সেটা ফ্লিট স্টুট থেকে একটু দূরে, ইনার টেম্পল লেইনে অবস্থিত। টিবিংকে দেখে মনে হলো একটু মজা করছেন। আমি দেখতে চাই, আমি সেই কথাটা বলার আগে আপনি একটু ঘামুন।

 

ধন্যবাদ।

 

আপনাদের কেউই সেখানে কখনও যাননি?

 

সোফি আর ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো।

 

আমি অবাক হইনি, টিবিং বললেন। চাৰ্চটা এখন বড় একটা বিল্ডিংয়ের আড়ালে চলে গেছে। খুব কম লোকেই জানে সেটা ওখানে আছে। খুবই পুরনো একটা জায়গা। মূলগত দিক থেকে স্থাপত্যটি প্যাগান।

 

সোফিকে দেখে মনে হলো খুবই অবাক হয়েছে। প্যাগান?

 

সমাধিস্থলের দিক থেকে প্যাগান। টিবিং বিস্ময়ে বললেন। চার্টটা বৃত্তাকার। টেম্পলাররা খৃস্টীয় ঐতিহ্য অনুসারে ক্রুশাকৃতিটা এড়িয়ে, বৃত্তাকারে তৈরি করেছেন, সূর্যের সম্মানে। তার ভুরু দুটো নেচে উঠলো।

 

সোফি টিবিংয়ের দিকে তাকালো। কবিতার বাকি অংশগুলোর ব্যাপারটা কি?

 

ইতিহাসবিদের আমুদে মেজাজটা এবার উবে গেলো। আমি ঠিক নিশ্চিত নই। এটা খুবই হতবুদ্ধিকর। আমাদের দরকার সমাধির সবগুলোই খুব সতর্কভাবে পরীক্ষা করে দেখার। ভাগ্য ভালো থাকলে, এমন একটাকে পেয়ে যাবো, যার গোলকটি নেই।

 

ল্যাংডন বুঝতে পারলো, তারা কত কাছাকাছি এসে পড়েছে। যদি হারানো গোলকটা পাওয়া যায়, তবে সেটা থেকে পাসওয়ার্ডটা পাওয়া যাবে, যা দিয়ে দ্বিতীয় ক্রিপ্টেক্সটা খোলা যাবে। তারা কী খুঁজে পাবে, সে ব্যাপারে সে কিছুই ভাবতে পারছিলো না।

 

ল্যাংডন কবিতাটার দিকে আবারো তাকালো। মনে হচ্ছে, এটা একটা প্রাইমোরডায়াল ক্রশ-ওয়ার্ড পাজল। পাঁচ অক্ষরের একটা শব্দ যা গ্রেইলের কথা বলবে? প্লেনে বসে তারা সম্ভাব্য পাসওয়ার্ডটা কী হতে পারে, সেটা ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলো–GRAIL, GRAAL, VENUS, MARIA, JESUS, SARAH–কিন্তু সিলিন্ডারটা খোলেনি।

 

স্যার লেই? রেমি পেছন ফিরে বললো। সে রিয়ার-ভিউ মিরর দিয়ে তাদের দিকে চেয়েছিলো। আপনি বলছেন ফ্লিট টটা ব্ল্যাকফ্রাইয়ারূসের বৃজের কাছাকাছি?

 

হ্যাঁ, ভিক্টোরিয়া নদীর তীর ঘেষে যাও।

 

আমি দুঃখিত। আমি নিশ্চিত নই, জায়গাটা কোথায়। আমরা তো সবসময় সাধারণত হাসপাতালেই যাই।

 

টিবিং চোখ গোল গোল করে ল্যাংডন আর সোফির দিকে তাকালেন, কসম খেয়ে বলছি, কখনও কখনও মনে হয়, একটা শিশুকে বেবিসিটিং করছি। এক মিনিট, প্লিজ। নিজেরাই ড্রিংকস আর স্ন্যাক্স নিয়ে নিন। তিনি সামনের দিকে চলে গেলেন রেমির কাছে, কথা বলার জন্য।

 

সোফি এবার ল্যাংডনের দিকে তাকালো, তার কণ্ঠ খুব শান্ত। রঝর্ট, কেউ জানে, তুমি আর আমি এখন ইংল্যান্ডে আছি।

 

ল্যাংডন বুঝতে পারলো, সে ঠিকই বলছে। কেন্ট পুলিশ ফশেকে জানাবে যে, প্লেনটা খালি ছিলো। ফশে ভাববে, তারা এখন ফ্রান্সেই আছে। আমরা অদৃশ্য হয়ে গেছি। লেইর ছোট্ট চালাকিতে তাদেরকে অনেক সময় দিয়ে দিয়েছে।

 

ফশে খুব সহজে হাল ছাড়বে না, সোফি বললো। সে এই গ্রেফতারের জন্য আরো বেশি উঠে পড়ে লাগবে।

 

ল্যাংডন ফশের কথা না ভাবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। সোফি তাকে কথা দিয়েছে, এই ব্যাপারটা মিটে যাবার পর, হত্যা মামলা থেকে রেহাই দিতে তাকে সমস্ত শক্তি দিয়ে সাহায্য করবে। কিন্তু ল্যাংডনের ভয়, এতে কিছুই যায় আসে না। ফশে খুব সহজেই এই ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারে। ল্যাংডন অবশ্য ভাবতে পারছে না যে, জুডিশিয়ার পুলিশ হলি গ্রেইল নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু আঁচ করতে পারছে, অন্য কিছু। ফশে একজন ধার্মিক ব্যক্তি, আর এই হত্যাকাণ্ডটি তার ওপরে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করছে সে। অবশ্য সোফির মতে, ফশে এই গ্রেফতারটি নিজে করে কৃতিত্ব নিতে চাইছে। আর ল্যাংডনের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যেসব প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেগুলো ফশের কাছে কেন, সবার কাছেই খুবই জোড়ালো বলে মনে হবে। সনিয়ে তার নাম লুভরের ফ্লোরে লিখে গেছেন। তাঁর ডেট বুকেও ল্যাংডনের নাম রয়েছে।

 

রবার্ট, আমি খুব দুঃখিত, তুমি গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে, হাতটা ল্যাংডনের হাটুর উপর রেখে সোফি বললো। কিন্তু আমি খুব খুশি যে, তুমি এখানে আছে।

 

কথাটা রোমান্টিকের চাইতেও বেশি বাস্তবিক বলে মনে হচ্ছে। তারপরেও তাদের দুজনের মধ্যে এক ধরণের আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। সে সোফির দিকে চেয়ে ক্লান্ত হাসি দিলো। যখন ঘুমিয়ে ছিলাম, তখন খুব আনন্দে ছিলাম।

 

সোফি কয়েক সেকেন্ড চুপ রইলো। আমার দাদু আমাকে বলেছেন, তোমাকে বিশ্বাস করতে। আমি খুব খুশি যে, আমি একবারের জন্যে হলেও তার কথা শুনেছি।

 

তোমার দাদু কিন্তু আমাকে চিনতেনও না।

 

তারপরও বলবো, উনি যা চেয়েছেন, তুমি তার সবটাই করেছে। কি-স্টোনটা খুঁজে বের করতে সাহায্য করেছে আমাকে। স্যাংগৃল কী, সেটা ব্যাখ্যা করেছে, আমার দেখা সেই অদ্ভুত দৃশ্যটার কথাও বলেছো। সে একটু থামলো। অনেক বছর পর, আমি আজকে আমার দাদুকে খুব কাছাকাছি অনুভব করতে পারছি। আমি জানি, তিনি এতে খুব খুশি হতেন।

 

ল্যাংডন উদাসভাবে বাইরে তাকিয়ে রইলো, হঠাৎ করেই তার মনে হলো, তার হাটুতে যেনো কিছু একটা। সম্বিত ফিরে পেতেই দেখলো সোফির হাতটা তার হাটুর ওপর। সোফি তার সাথে কথা বলছিলো। আমরা যদি স্যাংগৃল দলিলগুলো খুঁজে পাই, তবে তোমার মতে সেগুলো নিয়ে আমাদের কি করা উচিত? সে নিচু স্বরে বললো।

 

আমি অশরীরি কিছু ভাবছি, ল্যাংডন বললো। তোমার দাদু ক্রিপ্টেক্সটা তোমাকে দিয়েছেন, তাই তোমার যা মনে হয়, তুমি তা-ই করবে। এটা তোমারই এখতিয়ার।

 

আমি তোমার মতামতটা জানতে চাচ্ছি। তুমি নিশ্চিতভাবেই তোমার পাণ্ডুলিপিটাতে এমন কিছু লিখেছে, যাতে আমার দাদু তোমাকে বিশ্বাস করেছেন। তোমার বিচার ক্ষমতার ওপর আস্থা রেখেছেন। তিনি তোমার সাথে একটা ব্যক্তিগত সাক্ষাতেও ব্যবস্থা করেছিলেন। এটা খুবই বিরল একটি ব্যাপার।

 

হয়তো, তিনি বলতে চেয়েছিলেন, আমি যা লিখেছি তার সবই ভুল।

 

তিনি যদি তোমার আইডিয়াটা পছন্দই না করে থাকেন, তবে কেন আমাকে বলবেন, তোমাকে খুঁজে নিতে। তোমার পাণ্ডুলিপিতে কি তুমি স্যাংগৃল দলিলগুলো প্রকাশ কারর পক্ষে বলেছে, নাকি ওগুলো গোপনেই থাকুক সেটা বলেছো?

 

কোনটাই না। আমি কোন মতামত দেইনি। পাণ্ডুলিপিটা পবিত্র নারীর প্রতীক নিয়ে ইতিহাসে তাদের আইকনোগ্রাফি অনুসন্ধান বিষয়ক। হলি গ্রেইলটা কোথায় আছে, কিবা সেটা প্রকাশ করা উচিত কিনা, সে ব্যাপারে আমি কোন মতামত দেইনি।

 

তারপরেও, তুমি এ ব্যাপারে একটা বই লিখছে, অবশ্যই তুমি মনে করো, তথ্যটা প্রকাশ করা হোক।

 

খৃস্টের বিকল্প ইতিহাস এবং অনুমান নি ইতিহাসের মধ্যে অনেক অনেক মতপার্থক্য রয়েছে, এবং… সে থেমে গেলো।

 

এবং কি?

 

এবং হাজার হাজার প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজ হাজির করে ওল্ড টেস্টামেন্টটা যে ভুয়া সেটা প্রমাণ করা নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে।

 

কিন্তু, তুমি আমাকে বলেছিলে, নিউ টেস্টামেন্টটার কোন ভিত্তিই নেই।

 

ল্যাংডন হাসলো। সোফি, এই বিশ্বের সবগুলো ধর্মমতই ভিত্তিহীন। এটাই ধর্মবিশ্বাসের সংজ্ঞা—এটা মেনে নেয়া যে, আমরা যা ভাবছি, সেটা সত্যি, কিন্তু আমরা সেটা প্রমাণ করতে পারি না।

 

তাহলে তুমি স্যাংগৃল দলিলগুলো চিরতরের জন্য লুকানোই থাক, সেটার পক্ষে?

 

আমি একজন ইতিহাসবিদ। দলিল-দস্তাবেজ ধ্বংসের বিপক্ষে আমি। আর আমি দেখতে চাই ধর্মীয় পণ্ডিতেরা যিশু খৃস্টের জীবনের সত্যিকারের কাহিনীটা মেনে নিক।

 

তুমি আমার প্রশ্নের দুটো দিক নিয়ে তর্ক করছে।

 

তাই? বাইবেল এই পৃথিবীর লক্ষ-কোটি মানুষের মৌলিক দিক-নির্দেশনার উৎস, একই কথা কোরান, তোরাহ এবং বৌদ্ধ ত্রিপিটকের কথাও প্রযোজ্য। তুমি আর আমি যদি এমন দলিল-দস্তাবেজ খুঁজে পাই, যা ইসলামী, ইহুদি, বৌদ্ধ, প্যাগান ধর্ম বিশ্বোসের পবিত্র কাহিনীগুলোকে বাতিল করে দেয়, তবে কি সেটা আমাদের প্রকাশ করা উচিত হবে? আমাদের কি উচিত হবে, একটা পতাকা নেড়ে এটা জানানো যে, বুদ্ধ আসলে পদ্মফুল থেকে জন্ম নেননি, এ ব্যাপারে আমাদের কাছে প্রমাণ আছে? অথবা, যিশু আক্ষরিক অর্থে কোন কুমারীর গর্ভে জন্মাননি? যারা সত্যিকারভাবে তাদের ধর্মে বিশ্বাসী তারা এটা বোঝে যে, কাহিনীগুলো রূপকার্থে বলা হয়েছে।

 

সোফিকে দেখে মনে হলো সন্দিগ্ধ। আমার ধার্মিক খৃস্টান বন্ধুরা বিশ্বাস করে, যিশু সত্যি পানির ওপর দিয়ে হাটতেন, পানিকে মদ বানাতে পারতেন, আর তিনি একজন কুমারী মায়ের গর্ভে জন্মেছেন।

 

আমার কথাটা হলো, ল্যাংডন বললো। ধর্মীয় কাহিনীর ভিত্তি মিথ্যা হলেও সেটা এখন বাস্তব, আর এই বাস্তবতা লক্ষ-কোটি মানুষকে ভালোভাবে জীবন যাপন করতে সাহায্য করছে।

 

কিন্তু, তাদের বাস্তবতাটা তো মিথ্যে।

 

ল্যাংডন বললো, ঠিক সেই রকম মিথ্যে, যেরকমটি গাণিতিক ক্রিপ্টোগ্রাফাররা বিশ্বাস করে i নামের কাল্পনিক একটা সংখ্যায়, যেটা তাদের কোডের মর্মোদ্ধারে সাহায্য করে।

 

সোফি ভুরু কুকালো। এটা ঠিক হচ্ছে না।

 

এরপর কিছু মুহূর্ত পার হলো।

 

তোমার প্রশ্নটা কি? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

 

আমি মনে করতে পারিছ না।

 

সে হাসলো। এরকমটি সবসময়ই হয়।

 

 

 

৮৩.

 

ল্যাংডন যখন সোফি আর টিবিংয়ের সাথে ইনার টেম্পল লেন-এ এসে গাড়ি থেকে নামলো তখন তার মিকি মাউস হাত ঘড়িটাতে সাড়ে সাতটা বাজে। টেম্পল চার্চের সামনের একটা ভবনের প্রাঙ্গণের দিকে তারা তাকালো। খরুখরে হিউন পাথরের দালানটা বৃষ্টিতে ভিজে জ্বলজ্বল করছে।

 

লন্ডনের প্রাচীন চার্টটা সম্পূর্ণভাবে সায়েন পাথরে নির্মিত। একটা চমকপ্রদ বৃত্তাকারের অট্টালিকা, যার সামনে রয়েছে একটি সুবিশাল প্রাঙ্গন। ভবনটার মাঝখানে একটা চূড়া আর একপাশে বিশাল বারান্দা। চার্টটাকে প্রার্থনার জায়গার চেয়েও একটা সামরিক দূর্গ হিসেবেই বেশি মনে হয়। হেরাকুইস কর্তৃক ১১৮৫ সালের দশই ফেব্রুয়ারিতে এটা উৎসর্গ করা হয়। হেরাকুইস ছিলেন জেরুজালেমের অধিপতি। টেম্পল চার্চটা বিগত আট শতাব্দীর রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যেও টিকে আছে। লন্ডনের গ্রেট ফায়ার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৪০ সালের লুফটওয়াফ-এর বোমা হামলায়ই কেবল এটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। যুদ্ধের পরই, এটাকে আসল অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়, একেবারে অবিকল আগের অবস্থায়।

 

প্রথমবারের মতো ভবনটা দেখেই ল্যাংডন সমীহ করলো। স্থাপত্য শৈলীটা খুবই সহজ সরল। এটা একটা নিখুঁত মন্দিরের চেয়েও রোমের কাস্তেল সেন্ট এ্যাংলোর সাথেই বেশি মিলে যায়। অবশ্য এটার প্যাগান স্থাপত্য শৈলীর বৈশিষ্টটাকে পরবর্তীকালের কিছু সংস্কারের মাধ্যমে কিছুটা হলেও ঢেকে দেয়া গেছে।

 

আজ শনিবারের সকাল, টিবিং বললেন, প্রবশদ্বারের দিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যেতে যেতে তাই, আমার ধারণা, এখানে খুব একটা লোকজন থাকবে না। কর্মচারীর সংখ্যাও কমই হবে।

 

চার্চের সদর দরজাটা বিশাল, কাঠের তৈরি। দরজার বাম পাশে, একটা বুলেটিন বোর্ড ঝোলানো আছে। তাতে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময়সূচী দেয়া।

 

বোর্ডের লেখাটা পড়ে টিবিং ভুরু কুচকালেন। তারা দশর্নাথীদের জন্য আর কয়েক ঘণ্টা পরেই চার্চটা খুলে দেবে। দরজার দিকে চলে গিয়ে টিবিং সেটা খেলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু দরজাটা খুললো না। দরজায় কান লাগিয়ে কিছু শোনার চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণ বাদে, কানটা সরিয়ে নিয়ে তিনি বুলেটিন বোর্ডের দিকে চিন্তিত মুখে তাকালেন। রবার্ট, সার্ভিস শিডিউলটা চেক করে দেখবেন কি? এই সপ্তাহে কে সভাপতিত্ব করবেন?

 

 

 

চার্চের ভেতরে, একটা কাজের ছেলে বেদীমূলটা পরিষ্কার করছিলো, হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলো সে। ব্যাপারটা আমলেই নিলো না। ফাদার হাতে নোলসের কাছে নিজস্ব একটা চাবি রয়েছে, আর তিনি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফিরবেন না। কড়াটা সম্ভবত কোন কৌতূহলী পর্যটক, কিংবা কোন অভাবী লোক নাড়ছে। কাজের ছেলেটা নিজের কাজই করে যেতে লাগলো। কিন্তু বার বার কড়া নাড়ার শব্দ হতে লাগলো। দরজার লেখাটা কি পড়তে জানে না? দরজার পাশে পরিষ্কারভাবেই লেখা আছে, শনিবারে চার্চ সাড়ে নটায় খোলা হয়। কাজের ছেলেটা নিজের কাজই করে যেতে লাগলো।

 

আচম্‌কা, দরজার টোকাটা প্রচণ্ড আঘাতে রূপান্তরিত হলো। যেনো কেউ লোহার রড দিয়ে দরজাটাতে আঘাত করছে। ছেলেটা তার ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের সুইচটা বন্ধ করে রেগেমেগে দরজার দিকে ছুটলো। ভেতর থেকে ওটা ঝট করে খুলে ফেললো সে। সামনে তিন জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। পর্যটক, সে ধরে নিলো। আমরা সাড়ে নটায় খুলি।

 

ভারিক্কি ধরনের লোকটা, নিঃসন্দেহে দলনেতা, ধাতব কাঁচটায় ভর দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন। আমি স্যার লেই টিবিং, তার কণ্ঠটা বেশ গুরুগম্ভীর, স্যাক্সোনে বৃটিশদের মতো। যেহেতু তুমি চিনতে পারছে না, তাই পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, মি. এবং মিসেস ক্রিস্টোফার রেন চতুর্থ। তিনি একটু পাশ ফিরে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আকর্ষনীয় এক দম্পত্তির দিকে তাকালেন। তিনি তাদের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। মেয়েটা হালকা পাতলা গড়নের, আর লাল চুলের। পুরুষটা লম্বা, কালো চুলের, দেখে মনে হয়, খুব পরিচিত কেউ।

 

কাজের ছেলেটা বুঝতে পারলো না, সে কী করবে। স্যার ক্রিস্টোফার রেন হলেন টেম্পল চার্চের সবচাইতে খ্যাতিমান দাতা। গ্রেট ফায়ারের পর চার্চের ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানটার পুণনির্মাণ করতে তিনি সম্ভব সব ধরনের সহযোগিতাই করেছিলেন। তিনি তো অষ্টাদশ শতকের শুরুতেই মারা গিয়েছেন। উম্…আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে আমি সম্মানিত বোধ করছি?

 

ক্রাচে ভর দেয়া লোকটা অবাক হলেন। ভাগ্য ভালো, তুমি সেলসে কাজ করছে না ছোকরা, তোমার আচার-ব্যবহার খুব সুবিধার নয়। ফাদার নোল্‌স কোথায়?

 

আজ শনিবার। তিনি একটু পরে আসবেন।

 

খোঁড়া লোকটা গভীর নিঃশ্বাস নিলেন। এই হলো কৃতজ্ঞতা। তিনি বলেছিলেন আজ এখানে থাকবেন, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে, তাঁকে ছাড়াই আমাদেরকে এটা করতে হবে। খুব বেশি সময় লাগবে না।

 

কাজের ছেলেটা তাদের পথ আগলেই দাঁড়িয়ে রইলো। আমি দুঃখিত, কিসের কথা বলছেন?

 

দশর্নাথী খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তিনি একটু সামনের দিকে ঝুঁকে চাপা স্বরে বললেন, যেনো সবাইকে একটা বিব্রতকর অবস্থা থেকে রক্ষা করছেন। ছোক্রা, মনে হচ্ছে, তুমি এখানে খুব নতুন। প্রতি বছর স্যার ক্রিস্টোফারের বংশধররা তাঁর দেহভস্ম নিয়ে এসে এখানে ছিটিয়ে থাকেন। এটা উনার শেষ ইচ্ছা ছিলো। এই ভ্রমণটাতে কেউই খুশি না, কিন্তু কি আর করা?

 

কাজের ছেলেটা এখানে কয়েক বছর ধরেই আছে, কিন্তু এরকম কিছুর কথা সে কখনও শোনেনি। আপনারা সাড়ে নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই ভালো হয়। চার্টটা তো এখনও খুলেনি, আর আমার পরিষ্কার করা কাজটাও শেষ হয়নি।

 

ক্রাচে ভর দেয়া লোকটা ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন। ওহে ছো, এইখানে তোমার পরিষ্কার করার মতো একটা জিনিসই বাকি আছে, আর সেটা এই ভদ্রমহিলার পকেটে রয়েছে।

 

কী বললেন?

 

মিসেস রেন, লোকটা বললেন, আপনি কি দয়া করে ছাইগুলো এই ছোক্রাটাকে একটু দেখাবেন?

 

মেয়েটা কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করলো, তারপর সোয়েটারের পকেট থেকে একটা কাপড়ে মোড়ানো ছোট সিলিন্ডার বের করে আনলো।

 

এইতো, দেখেছো? ক্রাচে ভর দেয়া লোকটা খিট খিটে গলায় বললো। এবার, তুমি ছাইগুলো ছিটিয়ে দিতে দাও, এতে করে মৃত ব্যক্তির শেষ ইচ্ছাটা অন্তত পূরণ হোক, তা না হলে, আমি ফাদার নোর্সকে বলবো, আমাদের সাথে কী রকম আচরণ করা হয়েছে।

 

কাজের ছেলেটা ইতস্তত করলো, ফাদার নোর্সর চার্চের ঐতিহ্যের ব্যাপারে দারুণ শ্রদ্ধা রয়েছে…তার চেয়েও বড় কথা, তাঁর মেজাজ খুব চড়া থাকে যখন এখানে কেউ অসময়ে এসে পড়ে। হয়তো ফাদার নোম এই পরিবারের সদস্যদের এখানে আসার কথাটা বেমালুম ভুলে গেছেন। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে তাঁদেরকে ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে ফিরিয়ে দিলে ঝুঁকিটা খুব বেশি হয়ে যাবে। হাজার হোক, তারা বলেছেন, কাজটা সারতে মিনিট খানেক সময় লাগবে। এতে কী আর এমন ক্ষতি হবে?

 

কাজের ছেলেটা সরে গিয়ে মি. এবং মিসেস রেনকে ভেতরে যেতে দিয়ে সে তার নিজের কাজে ফিরে গেলো। এক কোণে বসে কাজ করতে করতে সে আগত দর্শনার্থীদেরকে চোরা চোখে দেখতে লাগলো।

 

 

 

চার্চের ভেতরে ঢুকেই ল্যাংডন মুখ টিপে হাসলো। লেই, সে নিচু স্বরে বললো, আপনি খুব চমৎকার মিথ্যে বলেন তো।

 

টিবিংয়ের চোখ দুটো পিট পিট করলেন। অক্সফোর্ড থিয়েটার ক্লাব। তারা। এখনও আমার জুলিয়াস সিজারের অভিনয়ের কথা বলাবলি করে। আমি নিশ্চিত, কেউই তৃতীয় অংকের প্রথম দৃশ্যটা এতো নিবেদিতভাবে অভিনয় করতে পারেনি।

 

ল্যাংডন তাঁর দিকে তাকালো। আমি তো জানি, সেই দৃশ্যে সিজার মারা যান।

 

টিবিং কৃত্রিম একটা হাসি দিলেন। হ্যাঁ, কিন্তু, যখন আমি পড়ে গিয়েছিলাম আমার আলখেল্লাটা ছিঁড়ে খুলে গিয়েছিলো, আর সেজন্যে আমাকে মঞ্চে আরো এক ঘন্টা বানিয়ে বানিয়ে সংলাপ দিতে হয়েছিলো। তবুও, আমি একটুও নড়িনি। আমি খুব দারুণ করেছিলাম, বলা যায়।

 

ল্যাংডন কৌতুক বোধ করলো। দুঃখিত, আমি সেটা দেখিনি। তারা আয়তক্ষেত্রের এনেক্সের কাছে এগোতেই, ল্যাংডন খুব অবাক হলো, ফাঁকা আর অনাড়ম্বর সাজসজ্জা দেখে। যদিও বেদীর আকারটা লম্বা বৃস্টিয় চ্যাপেলের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, তারপরেও আসবাবগুলো সাদামাটা আর শীতল, তাতে ঐতিহ্যবাহী কোন অলংকরণও নেই। নিরস, সে নিচু স্বরে বললো।

 

টিবিং চাপা হাসি হাসলেন। ইংল্যান্ডের চার্চ। এ্যাংলিকানরা তাদের ধর্মকে একেবারে সোজা সুজি পান করে। তাদের দুঃখ-দুর্দশা এটাকে টলাতে পারে না।

 

সেফি বিশাল খোলা জায়গাটার দিকে তাকালো, যা চার্চের বৃত্তাকার জায়গাটার দিকে চলে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে, এখানে দূর্গ ছিলো, সে চাপা কণ্ঠে বললো।

 

ল্যাংডনও তার সাথে একমত পোষণ করলো। দেয়ালগুলো তার কাছে অন্য রকম বলে মনে হলো।

 

নাইট টেম্পলাররা যোদ্ধা ছিলেন, টিৰিং মনে করিয়ে দিলেন, তাঁর এলুমুনিয়ামের ক্রাচের শব্দ চার্চের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হলো। একটি ধর্মীয়-সামরিক গোষ্ঠী। তাদের চার্চগুলো ছিলো তাদের ঘাটি এবং ব্যাংক।

 

ব্যাংক? লেইর দিকে তাকিয়ে সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

হ্যাঁ। আধুনিক ব্যাংকের গোড়াপত্তন টেম্পলাররাই করেছিলেন। ইউরোপীয়ান ব্যবসীয়ীরা ভ্রমণের সময় স্বর্ণ বহন করতেন, তাই টেম্পাররা অভিজাত ব্যবসায়ীদেরকে তাদের স্বর্ণ নিকট টেম্পলার চার্চে জমা রাখতে দিতেন আর সেটা ইউরোপের যে কোন দেশের টেম্পলার চার্চ থেকে তুলে নিতে পারতো ব্যবসায়ীরা। শুধুমাত্র দরকার ছিলো প্রয়োজনীয় দলিলের। তিনি চোখ দুটো পিট পিট করলেন। এবং ছোট্ট একটা কমিশন। তারাই ছিলেন অরিজিনাল ATM। টিবিং একটা স্টেইড গ্লাসের জানালার দিকে ইঙ্গিত করলেন, যেখান দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকে কাঁচে আঁকা সাদা রঙের নাইটের লাল রঙের ঘোড়ায় চড়া ছবিটা ফুটে ওঠে। এলানাস মার্সেল, টিবিং বললেন, দ্বাদশ শতকের প্রথম দিকে টেম্পল-এর মাস্টার ছিলেন। তিনি এবং তাঁর উত্তরসূরীরা আসলে প্রিমাস বারো এনজিয়ের পার্লামেন্টের চেয়ারটা অধিকারে রেখেছিলেন।

 

ল্যাংডন খুব অবাক হলো। রিমের প্রথম ব্যারোন?

 

টিবিং মাথা নেড়ে সায় দিলেন। টেম্পলের মাস্টার, কারো কারো মতে, রাজার চেয়েও বেশি ক্ষমতা রাখতেন তিনি। বৃত্তাকারের কক্ষটার দিকে আসতেই, টিবিং কাজের ছেলেটার দিকে এক ঝলক তাকালেন, সে দূরের বেদীর কাছে ময়লা পরিষ্কার করছে। আপনি জানেন, টিবিং সোফিকে নিচু স্বরে বললেন, হলি গ্রেইলটা এই চার্চে এক রাতের জন্য নিয়ে আসা হয়েছিলো বলে কথিত আছে, পরে সেটা রাতের আঁধারেই টেম্পলাররা অন্য কোথাও লুকিয়ে ফেলেছিলেন। আপনি কি ভাবতে পারেন। চারটা সিন্দুকের স্যাংগৃল দলিলগুলো ঠিক এখানে ম্যারি মাগদালিনের দেহাবশেষের পাশে রাখা হয়েছিলো? এটা ভাবতেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

 

বৃত্তাকার কক্ষটাতে প্রবেশ করতেই ল্যাংডনেরও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। চারদিকে গারগোয়েল, পিশাচ, দৈত্য, দানব, আর যন্ত্রণাকাতর মানুষের মুখ, সব পাথরে তৈরি। সবগুলো যেনো তাদের দিকে চেয়ে আছে।

 

গোল নাট্যমঞ্চ, ল্যাংডন ফিসফিস করে বললো।

 

টিবিং ক্রাচটা তুলে ঘরটার বাম দিকের কোনায় নির্দেশ করলেন, তারপর ডান দিকে। ল্যাংডন ইতিমধ্যেই সেগুলো দেখেছে।

 

দশটা পাথরের নাইট।

 

বাম দিকে পাঁচটা। ডান দিকে পাঁচটা।

 

চিরনিদ্রায় শায়িত হবার ভঙ্গীতে জমিনে খোঁদাই করা একেকটা প্রমাণ সাইজের মূর্তি। নাইটগুলো সব বর্ম পরে আছে, ঢাল আর তলোয়ার হাতে। সবগুলো মূর্তিই শাত-শাতে, কিন্তু পরিষ্কারভাবেই প্রতিটি মূর্তিই বৈশিষ্ট মণ্ডিত–ভিন্ন ভিন্ন বর্ম, হাত এবং পায়ের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান, মুখের আকৃতি, আর তাদের ঢালের চিহ্নগুলোও আলাদা রকমের।

 

পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট, লন্ডনে আছেন শায়িত।

 

বৃত্তাকার কক্ষটার ভেতরে প্রবেশ করতেই ল্যাংডন একটু আড়ষ্ট অনুভব করলো।

 

এটাই সেই জায়গা।

 

 

 

৮৪.

 

টেম্পল চার্চের খুব কাছেই একটা নোংরা-পূতিগন্ধময় গলিতে রেমি লেগালুদে জাগুয়ার লিমোজিন গাড়িটা একটা ডাস্টবিনের সামনে এনে থামালো। ইজিনটা বন্ধ করে সে জায়গাটা ভালো মতো দেখে নিলো। ফাঁকা, জন-মানব শূন্য। গাড়িটা থেকে নেমে, রিয়ারের দিকে গেলো সে। লিমোজিনের পেছনের দিকে, মূল কেবিনে ঢুকলো, যেখানে পাদ্রীটা পড়ে রয়েছে। রেমির উপস্থিতি টের পেয়ে পাদ্রীটা যেনো একটা নিরব প্রার্থনা থেকে জেগে উঠলো। তার লাল চোখ দুটোতে ভয়ের থেকে বেশি ছিলো কৌতূহল। সারাটা রাত রেমি এই লোকটার ধীর-স্থির থাকার ক্ষমতাটা দেখে দারুণ অবাক হয়েছে। রেঞ্জরোভার গাড়িটার ভেতরে, শুরুতে একটু ধস্তাধস্তি করলেও, একটু পরেই পাদ্রীটা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলো, পরিস্থিতিটা মেনে নেয়াই ভালো। তাই, সে তার ভাগ্যকে, উচ্চ ক্ষমতাবানদের হাতেই সপে দিলো।

 

রেমি তার বো-টাইটা আলগা করে নিয়ে হাই কলারটা খুলে ফেলে এমনভাবে দম নিলো, যেনো কত বছরের মধে এই প্রথম ভালোভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারলো। লিমোজিনের বার থেকে একটা স্মিরনফ ভদকা নিয়ে এক ঢোক পান করলো, তারপর আরো এক ঢোক।

 

বারের ভেতর থেকে একটা বোতলের ছিপি খোলার ছুরি বের করলো। রেমি ছুরিটা হাতে নিয়ে সাইলাসের দিকে তাকালো।

 

এবার লাল চোখ দুটোতে ভীতির আভা দেখা গেলো।

 

রেমি মুচকি হেসে লিমোজিনের পেছনে গেলে পাদ্রীটা তার বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে শুরু করলো।

 

যেমন ছিলে তেমনি থাকো, রেমি হাতের ছুরিটা তুলে ধরে চাপা স্বরে বললো।

 

সাইলাস বিশ্বাস করতে পারিছলো না, ঈশ্বর তাকে এভাবে পরিত্যাগ করেছে। শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করেও সাইলাস আধ্যাত্মিক চর্চা করেছে।আমি সারাটা রাত প্রার্থনা করেছি মুক্তির জন্য। এখন ছুরিটা তার দিকে এগোতেই সাইলাস চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো।

 

তার কাঁধে একটা যন্ত্রণার অনুভূতি হলো। সে চিৎকার করলো, এই লিমোজিনের পেছনে সে মারা যাচ্ছে, এটা বিশ্বাস করতেই পারছিলো না। আত্মরক্ষা করতেও অক্ষম সে। আমি ঈশ্বরের কাজ করছি। টিচার বলেছেন, তিনি আমাকে রক্ষা করবেন।

 

সাইলাস তার পিঠে আর কাঁধে প্রচণ্ড যন্ত্রণাটা টের পেলো। যেননা, তার মাংস পেশী কেঁটে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। এবার মনে হলো, ঊরুতেও যন্ত্রণা হচ্ছে।

 

তার সমস্ত শরীরে যন্ত্রণাটা ছড়িয়ে পড়লে সাইলাস আরো তীব্রভাবে চোখ দুটো বন্ধ করে রাখলো, যাতে তার শেষ সময়টাতে নিজের খুনির ছবিটা দেখতে না হয়। তার বদলে সে তরুণ বিশপ আরিজারোসার ছবিটা কল্পনা করলো, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন স্পেনের একটা চার্চের সামনে, যে চাৰ্চটা তিনি এবং সাইলাস, দুজনে মিলে নিজ হাতে নির্মাণ করেছিলেন। আমার নতুন জীবনের শুরু ছিলো সেটা।

 

সাইলাসের মনে হলো, তার শরীরটা আগুনে পুড়ে যাচ্ছে।

 

একটু মদ খাও, ছুরি হাতে ধরা লোকটা নিচু স্বরে বললো। তার কথার টানটা ফরাসি। এতে তোমার রক্ত সঞ্চালনে সাহায্য হবে।

 

সাইলাস বিস্ময়ে চোখ খুললো। লোকটা তাকে মদ সঁধছে। দোমড়ানো মোচরানো ডাক্ট-টেপ তার পাশেই পড়ে আছে, সেটার পাশে পড়ে রয়েছে রক্তহীন ছুরিটাও।

 

এটা পান করো, সে আবারো বললো। তোমার মাংসপেশীতে রক্ত জমে যাবার জন্যই ব্যথা পাচ্ছো।

 

সাইলাস ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। যাহোক, ভদকাটা খুবই বিস্বাদ লাগছে। তারপরও, সে ওটা পান করে কৃতজ্ঞ বোধ করলো। আজ রাতে তার ভাগ্য খুব একটা ভালো না হলেও, ঈশ্বর একটা অলৌকিকতার মধ্য দিয়েই সেটা সমাধান করে দিয়েছেন।

 

ঈশ্বর আমাকে পরিত্যাগ করেনি।

 

সাইলাস জানতো, বিশপ আরিঙ্গাবোসা এটাকে কী নামে ডাকতেন।

 

স্বর্গীয় হস্তক্ষেপ।

 

আমি তোমাকে আরো আগেই মুক্ত করতে চেয়েছিলাম, গৃহপরিচারক ক্ষমা চাইলেন, শ্যাতু ভিলেতে পুলিশ এসে পড়াতে আর তারও পরে, বিগিন-হিল এয়ারপোর্টে সেটা সম্ভব ছিলো না। এখনই কেবল সম্ভব হলো, মুক্ত করতে। তুমি বুঝতে পারছো, সাইলাস?

 

সাইলাস তার দিকে চেয়ে রইলো। আপনি আমার নাম জানেন?

 

গৃহপরিচারক মুচকি হাসলো।

 

সাইলাস এবার উঠে বসলো, আবেগ, দ্বিধাদ্বন্দ আর অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। আপনি কি…টিচার?

 

রেমি মাথা ঝাঁকালো, কথাটা শুনে হেসে ফেললো। হায়, আমার যদি সেই ক্ষমতা থাকতো। না, আমি টিচার নই। তোমার মতোই, আমিও টিচারের সেবা করি। টিচার তোমার ব্যাপারে খুবই উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। আমার নাম রেমি।

 

সাইলাস দারুণ অবাক হলো। আমি বুঝতে পারছি না। আপনি যদি টিচারের হয়ে কাজ করে থাকেন, তবে ল্যাংডন কেন কি-স্টোনটা আপনাদের বাড়িতে নিয়ে এলো?

 

আমার বাড়িতে নয়, পৃথিবীখ্যাত গ্রেইল ইতিহাসবিদ স্যার লেই টিবিংয়ের বাড়িতে।

 

আপনিতো সেই বাড়িতেই থাকেন। অদ্ভুত…

 

রেমি মুচকি হাসলে, এটা ছিলো পুরোপুরিই অনুমেয় একটি ব্যাপার। রবার্ট ল্যাংডনের কাছে কি-স্টোনটা হস্তগত হওয়াতে তার সাহায্যের দরকার হয়ে পড়ে। লেই টিবিংয়ের বাড়ি ছাড়া আর কোন্ জায়গা ছিলো, তাদের আশ্রয়ের জন্য? আমি সেখানে থাকি বলেই টিচার আমাকে এই ঘটনায় জড়িয়েছেন। সে একটু থামলো। আপনি কীভাবে জানলেন, টিচার গ্রেইলের ব্যাপারে খুব ভালো জ্ঞান রাখেন?

 

এবার সব কিছু পরিষ্কার হলে সাইলাস বিস্ময়ে হতবাক হলো। টিচার একজন। গৃহপরিচারক নিযুক্ত করলেন, যে লেই টিবিংয়ের সবধরনের গবেষণার বিষয়ে প্রবেশ করতে পারে। সেটা ছিলো খুবই অসাধারণ একটি পরিকল্পনা।

 

তোমাকে আমার অনেক কিছুই বলার আছে, রেমি বললো, সাইলাসের হাতে লোডেড হেল্লার এ্যান্ড কোচ পিস্তলটা দিয়ে দিলো সে। তারপর, গ্লোভ-বক্স থেকে ছোট্ট একটা পিস্তল বের করে নিলো। কিন্তু প্রথমে, তোমাকে আর আমাকে একটা কাজ করতে হবে।

 

 

 

ক্যাপ্টেন ফশে তার বিমান থেকে বিগিন-হিল এয়ারপোর্টে নেমেই কেন্টের পুলিশ চিফের কাছ থেকে টিবিংয়ের হ্যাঙ্গারে কী ঘটেছে সেটা শুনে বিশ্বাস করতে পারছিলো না।

 

আমি নিজে প্লেনটা তল্লাশী করেছি, ইন্সপেক্টর জোর দিয়ে বললো, ভেতরে কেউ ছিলো না। তার কণ্ঠে রাগের বহিপ্রকাশ দেখা গেলো। আর আমি এটাও বলতে চাই যে, যদি স্যার লেই টিবিং আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, তবে আমি

 

আপনি কি পাইলটকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন?

 

অবশ্যই না। সে তো ফরাসি, আর আমাদের আইনে আছে—

 

আমাকে প্লেনে নিয়ে যান।

 

হ্যাঙ্গারে কাছে পৌঁছাতেই লিমোজিনটা রাখার জায়গায় কয়েক ফোঁটা রক্তের আলামত খুঁজে বের করতে ফশের মাত্র ষাট সেকেন্ড সময় লাগলো। সে প্লেনটার কাছে গিয়ে খুব জোরে জোরে ঘোষণা দিলো।

 

আমি ফরাসি জুডিশিয়ার পুলিশের ক্যাপ্টেন ফশে বলছি। দরজাটা খুলুন!

 

ভীত পাইলট দরজা খুলে সিঁড়িটা ঝুলিয়ে দিলো। ফশে সেই সিঁড়িটা দিয়ে উঠে গেলো। তিন মিনিট বাদে, তার পিস্তলটার সাহায্যে, সে পুরো স্বীকারোক্তি আদায় করে ফেললো। ধবল পাদ্রীর বর্ণনাও ছিলো তাতে। সে আরো জানালো, ল্যাংডন আর সোফি এক ধরনের কাঠের বাক্স জাতীয় কিছু প্লেনের সিন্দুকে রেখে গেছে। যদিও পাইলট অস্বীকার করলো, বাক্সটাতে কী আছে সেটা সে জানে না, তারপরও সে খেয়াল করেছে প্লেনে থাকার সময় ল্যাংডন সেই জিনিসটার দিকেই সমস্ত মনোযোগ রেখেছিলো।

 

সিন্দুকটা খুলুন,ফশে বললো।

 

পাইলটকে খুবই ভীত মনে হলো। আমি তো ল নাম্বারগুলো জানি না!

 

খুব খারাপ। আমি আপনার পাইলটের লাইসেন্সটা দেখতে চাইবো।

 

পাইলট সজোড়ে মাথা দোলালো। এখানকার কিছু রক্ষণাবেক্ষণকারীকে আমি চিনি। হয়তো তারা ভূল করে খুলতে পারবে?

 

আপনাকে আধঘণ্টা সময় দিচ্ছি।

 

পাইলট তার রেডিওটা তুলে নিলো।

 

ফশে প্লেনের পেছনে এসে একটু কড়া মদ খেয়ে নিলো। সে মোটেও ঘুমায়নি। একটা সিটে বসে চোখ দুটো বন্ধ করলো। কী হচ্ছে, তা বোঝার চেষ্টা করলো। কেন্ট পুলিশের বোকামির জন্য আমাকে মাশুল দিতে হবে, খুব চড়া দামে। এবার সবাই একটা কালো জাগুয়ার লিমোজিন গাড়িকে খুঁজতে শুরু করবে।

 

ফশের ফোনটা বেজে উঠলো, সে একটু শান্তিতে থাকতে চেয়েছিলো। আলো?

 

আমি লন্ডনের পথে আছি। বিশপ আরিঙ্গাবোসা বললেন। আমি একঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবো।

 

ফশে বসে পড়লো। আমি তো জানতাম আপনি প্যারিসে যাচ্ছেন।

 

আমি খুব চিন্তিত আছি। আমি আমার পরিকল্পনাটা বদলে ফেলেছি।

 

আপনার এটা করা উচিত হয়নি।

 

আপনি কি সাইলাসকে পেয়েছেন?

 

না। তাকে যারা বন্দী করেছে, আমি আসার আগেই তারা পুলিশকে বোকা বানিয়ে সটকে পড়েছে।

 

আরিঙ্গারোসার রাগটা চড়ে গেলো। আপনি আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন, প্লেনটাকে থামাবেন!

 

ফশে তার কণ্ঠটা নিচু করলো। বিশপ, আপনার অবস্থাটা একটু বিবেচনা করুন। আমি আপনাকে বলবো, আজকে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, সাইলাস এবং বাকিদেরকে খুঁজে বের করবো। আপনি কোথায় নামছেন?

 

একটু দাঁড়ান। আরিঙ্গারোসা ফোনটা সরিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ পরই ফিরে আসলেন। পাইলট হিথরোতে ক্লিয়ারেন্স নেবার চেষ্টা করছে। আমিই তার একমাত্র যাত্রী, কিন্তু আমাদের আসাটা শিডিউল বহির্ভূত।

 

তাকে কেন্টের বিগিন-হিলে আসতে বলুন। আমি তার ক্লিয়ারেন্স পাইয়ে দিচ্ছি। আপনি আসার সময় যদি আমি এখানে নাও থাকি, তবে আপনার জন্যে একটা গাড়ি ভাড়া করে রাখা থাকবে।

 

ধন্যবাদ, আপনাকে।

 

বিশপ, যখন আমরা প্রথম কথা বলেছিলাম, আপনার খুব ভালো করেই স্মরণে আছে যে, আপনিই একমাত্র ব্যক্তি নন, যে সব কিছু হারাবার দাঁড়প্রান্তে রয়েছেন।

 

 

 

৮৫.

 

যে গোলক তুমি খোঁজো, সেটা সমাধিতেই থাকার কথা।

 

টেম্পল চার্চের খোঁদাই করা প্রতিটি নাইটের মাথার পেছনে একটা করে পাথরের আয়তক্ষেত্রাকারের বালিশ রয়েছে। সোফির হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। কবিতাটিতে একটা গোলকের কথা বলা হয়েছে, যা তার দাদুর বেসমেন্টের নিচে ঐ দৃশ্যটার সাথে মিলে যায়। ওখানেও তাদের কাছে গোলক জাতীয় কিছু ছিলো।

 

হায়ারোস গামোস। গোলক।

 

সোফি অবাক হয়ে ভাবলো, সেই অনুষ্ঠানটি এই ধর্মশালায় অনুষ্ঠিত হয়েছিলো কিনা। বৃত্তাকার কক্ষটা দেখে মনে হচ্ছে প্যাগান আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। গোলাকার আকৃতির একটা নাট্যমঞ্চ, রবার্ট যেমন এটাকে বলেছিলো। সে কল্পনা করলো, রাতের বেলায় এই কক্ষটা মুখোশধারী লোকজনে পূর্ণ, সমস্বরে কী যেনো বলছে মশাল জ্বালিয়ে। সবাই প্রত্যক্ষ করছে ঘরের মাঝখানে পবিত্র মিলন।

 

মাথা থেকে এই ভাবনাটা জোর করে দূর করে সোফি চলে গেলো ল্যাংডন আর টিবিংয়ের দিকে, তারা নাইটের খোঁদাই করা মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। টিবিংয়ের মতে, তাদের তদন্তটি খুব নিখুঁতভাবে হওয়া দরকার বললেও, সোফির মনে হলো, তাদেরকে ঠেলে ঠুলে বাম দিকের পাঁচটি নাইটের দিকে নিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখবে।

 

এইসব সমাধি ফলক ভালো মতো লক্ষ্য করে সোফি তাদের মধ্যে মিল আর অমিলগুলো দেখতে পেলো। সবগুলো নাইটই পেছনে দিকে মুখ করে আছে, কিন্তু তিন জন নাইটের পা সামনের দিকে এগোনো আর দুজন নাইটের দুটো পা আড়াআড়ি করে রাখা। এই বৈশাদৃশ্যটার সাথে মনে হচ্ছে, হারানো গোলকের কোন সম্পর্ক নেই। তাদের কাপড়-চোপরগুলো পরীক্ষা করে সোফি দেখতে পেলো, দুজন নাইট বর্মের ওপর একটা নিমা বা অন্তর্বাস পরে রয়েছে, আর বাকি তিন জনের গোড়ালি পর্যন্ত আলখেল্লা পরা। আবারো, কিছুই পাওয়া গেলো না। সোফি তার সব মনোযোগ বাকি পার্থক্যগুলোর দিকে নিবিষ্ট করলো তাদের হাতের অবস্থান। দুজন নাইট তলোয়ার ধরে আছে, দুজন প্রার্থনায়রত। আর একজনের হাত নিজের পাশে রাখা। হাতের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর, সোফি কাঁধ ঝাঁকালো, একটা গোলকের অনুপস্থিতির কোন চিহ্নই সে দেখতে পেলো না।

 

সে ল্যাংডন আর টিবিংয়ের দিকে তাকালো। তারা আস্তে আস্তে হেটে নাইটগুলো দেখছে, এখন পর্যন্ত মাত্র তৃতীয় নাইটের সামনে তারা। দেখে মনে হচ্ছে, তারাও কোন কিছু পাচ্ছে না।

 

অপেক্ষা না করেই সোফি তাদেরকে পাশ কাটিয়ে দ্বিতীয় নাইটের দলটাকে দেখতে শুরু করলো। এবার সে স্মৃতি থেকে কবিতাটা আবৃত্তি করতে চেষ্টা করলো। বার কয়েক দেখে দেখে কবিতাটা মুখস্থ হয়ে গেছে তার।

 

পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট লন্ডনে আছেন শায়িত।

তার পরিশ্রমের ফল হয়েছিলো ধর্মাবতার রাগের কারণ।

যে গোলক তুমি খোঁজো, সেটা সমাধিতেই থাকার কথা।

এটা বিবৃত করে গোলাপী শরীর আর বীজপ্রসূ গর্ভের আখ্যান।

 

সোফি নাইটদের দ্বিতীয় দলটার দিকে যেতেই দেখতে পেলো, প্রথম দলটির মতোই এই দলটির অবস্থা। সাদৃশ্যপূর্ণ। সবগুলোই বিভিন্ন ভঙ্গীতে, বর্ম পরিহিত আর তলোয়ার হাতে।

 

শুধুমাত্র দশ নাম্বার সমাধি ফলকটাই ব্যতিক্রম। দ্রুত সেটার দিকে গিয়ে সোফি তাকিয়ে রইলো।

 

কোন বালিশ নেই। কোন বর্মও নেই। অন্তর্বাস নেই। তলোয়ারও নেই।

 

রবার্ট? লেই? সে ডাক দিলো, তার কণ্ঠটা কক্ষের ভেতরে প্রতিধ্বনিত হলো। এখানে কিছু একটা নেই।

 

তারা দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এলো।

 

একটা গোলক? ক্রাচে ভর দিয়ে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে টিবিং উত্তেজিত হয়ে বললেন। গোলকটা কি নেই?।

 

না, ঠিক তা নয়, দশম সমাধিটার দিকে চিন্তিত হয়ে তাকিয়ে সোফি বললো। মনে হচ্ছে পুরো একটি নাইটই নেই এখানে।

 

তারা দুজনেই তার সামনে এসে দশম সমাধি ফলকটার দিকে তাকালো। একটা নাইটের জায়গায় সেখানে একটা পাথরের কাসকেট বসানো আছে। কাসকেটটা অসম বাহু বিশিষ্ট, পায়ের দিকে সংকুচিত, উপরের দিকে প্রসারিত।

 

এখানের নাইটটা দেখা যাচ্ছে না কেন? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

 

অপূর্ব, টিবিং বললেন, গাল চুলকাতে চুলকাতে। এই বিসদৃশ্যটার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কয়েক বছর আগে আমি এখানে শেষবার এসেছিলাম।

 

এই কফিনটা, সোফি বললো, দেখে মনে হচ্ছে, বাকি নয়টা সমাধি ফলক খোঁদাই করার সময়ই খোঁদাই করা হয়েছিলো। তো, এই নাইটটা কাসকেটের ভেতরে কেন, উন্মুক্ত নয় কেন?

 

টিবিং মাথা ঝাঁকালেন। এটাই এই চার্চের একটা রহস্য। আমি যতোদূর জানি, কেউ কখনও এটার ব্যাখ্যা খুঁজে পায়নি।

 

শুনুন? কাজের ছেলেটা বললো, চোখে মুখে তার বিস্ময়যুক্ত সন্দেহ। কথাটা রূঢ় শশানালেও আমায় ক্ষমা করবেন, আপনি বলেছিলেন, আপনারা ছাই ছিটাতে এসেছেন, আর এখন পর্যন্ত আপনারা কেবল দর্শন করেই যাচ্ছেন।

 

টিবিং ছেলেটার দিকে একটু তাকিয়ে ল্যাংডনের দিকে ফিরলেন। মি. রেন, মনে হচ্ছে আপনার পরিবারের দান-দক্ষিণার প্রতিদানে এখানে বেশি সময় পাওয়া যাবে না, তো, ছাই ছিটাতে শুরু করুন। টিবিং সোফির দিকে ঘুরলো। মিসেস রেন?

 

সোফিও নাটক করে চললো, চামড়ায় পেচানো ক্রিপ্টেক্সটা পকেট থেকে বের করে আনলো।

 

এবার, ছেলেটাকে টিবিং বললেন, তুমি কি আমাদেরকে একটু একা থাকতে দেবে?

 

কাজের ছেলেটা একটুও নড়লো না। সে খুব ভালো করে ল্যাংডনের তাকিয়ে আছে। আপনাকে দেখে খুবই চেনা চেনা লাগছে।

 

টিবিং কথাটা কেড়ে নিলেন। হয়তো এজন্যে যে, মি. রেন এখানে প্রতিবছরই এসে থাকেন!

 

অথবা, সোফি একটু ভড়কে গেলো, কারণ, সে ল্যাংডনকে গতবছর টেলিভিশনে ভ্যাটিকানে দেখেছে।

 

আমি মি. রেনকে কখনও দেখিনি, কাজের ছেলেটা জানালো।

 

তুমি ভুল করছে, ল্যাংডন খুব ভদ্রভাবে বললো। আমার বিশ্বাস, তোমার সাথে আমার গত বছরেই দেখা হয়েছিলো। ফাদার নোর্স অবশ্য তোমার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু, এখানে আজ এসেই আমি ভোমার চেহারা দেখে চিনতে পেরেছি। তো, তুমি কি আমাদেরকে আরো কয়েকটা মিনিট সময় দেবে। আমি খুব দূর থেকে এসেছি, একটু ক্লান্ত বোধ করছি। এইসব সমাধি ফলকে ছাই ছিটাতে হবে। ল্যাংডন টিবিংয়ের মতো করে বললো যেনো কথাটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।

 

কাজের ছেলেটার চেহারায় আরো বেশি সন্দেহের প্রকাশ দেখা গেলো। এগুলো তো সমাধি ফলক নয়।

 

আমি দুঃখিত, কী বললে? ল্যাংডন বললো।

 

অবশ্যই এগুলো সমাধি ফলক, টিবিং বললেন। তুমি কি বলছো?

 

কাজের ছেলেটা মাথা ঝাঁকালো। সমাধিতে মৃত দেহ থাকে, এই সব জিনিসের নিচে কোন শব নেই।

 

এটা একটা ক্রিপ্ট! টিবিং বললেন।

 

শুধুমাত্র অপ্রচলিত ইতিহাসের বইতে এগুলোকে ক্রিপ্ট হিসেবে বিশ্বাস করা হোততা, কিন্তু ১৯৬০ সালের পুনঃনির্মাণের সময় তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি।

 

টিবিং ল্যাংডনের দিকে তাকালেন। মি. রেনের সেটা জানতে পারার কথা। তার পরিবারই সত্যটা উদঘাটন করেছিলো।

 

একটা অস্বস্তিকর নিরবতা নেমে এলো।

 

সেই নিরবতাটা ভাঙলো দরজায় প্রচণ্ড আঘাতের শব্দে।

 

ফাদার নোস বোধ হয় এলেন? টিবিং বললেন। সম্ভবত তোমার গিয়ে দেখা উচিত?

 

কাজের ছেলেটা সন্দেহগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকালেও ঘুরে চলে গেলো দরজার কাছে। যাবার সময় টিবিং, ল্যাংডন আর সোফির দিকে ভুরু কুচকে তাকালো।

 

লেই, ল্যাংডন নিচু স্বরে বললো। কোন শব নেই? সে বলছেটা কি?

 

টিবিংকে দেখে হতভম্ব মনে হলো। আমি জানি না। আমি সব সময়ই ভেবেছি…নিশ্চিতভাবেই, এটাই সেই জায়গা। আমি কল্পনাও করতে পারছি না, ও কী বলে গেলো। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না?

 

কবিতাটি কি আমি দেখতে পারি? ল্যাংডন বললো।

 

সোফি পকেট থেকে সেটা বের করে দিলো।

 

ল্যাংডন কবিতাটার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলো। হ্যাঁ, কবিতাটায় নিশ্চিত করেই একটা সমাধির কথা বলা আছে। কোন ভণিতা করে নয়।

 

কবিতাটা কি ভুল হতে পারে? টিবিং জিজ্ঞেস করলেন। জ্যাক সনিয়ে কি আমার মতোই ভুল করেছেন কি না?

 

ল্যাংডন কথাটা বিবেচনা করে মাথা ঝাঁকালো। লেই, আপনি এটা নিজেই বলেছিলেন। এই চার্টটা প্রায়োরিদের সামরিক শাখা নাইট টেম্পলাররা তৈরি করেছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, প্রায়োরিদের গ্র্যান্ড মাস্টারের খুব ভালো করেই ধারণা রয়েছে, এখানে কোন নাইটকে কবর দেয়া হয়েছে কিনা।

 

টিবিং হতবুদ্ধিকরভাবে বললেন, কিন্তু এই জায়গাটা খুব নিখুঁত আর যথার্থ। নাইটগুলোর দিকে তিনি আবারো ঘুরে দাঁড়ালেন। আমরা এখানে কিছু একটা ধরতে পারছি না!

 

 

 

এনেক্স ভবনের দিকে পৌঁছে কাজের ছেলেটা কাউকে দেখতে না পেয়ে খুবই অবাক হলো। ফাদার নোস? আমি তো দরজায় শব্দ শুনেছিলাম। সে ভাবলো। সামনের দিকে এগিয়ে গেলো।

 

হালকা পাতলা গড়নের জ্যাকেট পরিহিত এক লোক দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে, মাথা চুলকাচ্ছে, যেনো কোন কিছু হারিয়ে ফেলেছে। কাজের ছেলেটা তখনই মনে পড়ে গেলো, ভেতরে যারা আছে তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেয়ার সময় দরজাটার তালা লাগাতে সে ভুলে গিয়েছিলো। আমি দুঃখিত, সামনের একটা বড় পিলারের দিকে এগোতে এগোতে সে বললো, চাৰ্চটা এখন বন্ধ আছে।

 

পেছন থেকে আচমকা একটা কাপড় তার নাকমুখ চেপে ধরলে তার মাথাটা পেছনের দিকে হেলে গেলো। পেছন থেকেই প্রচণ্ড শক্ত একটা হাত তার মুখটা জোরে চেপে ধরলো। যে হাত দুটো তার মুখ ধরেছে, সেটা ধবধবে সাদা। তার নাকে এলকোহলের গন্ধ এসে লাগলো।

 

সামনে দাঁড়ানো জ্যাকেট পরা লোকটা কাজের ছেলেটার মাথা বরাবর পিস্তল তা করে ধরলো।

 

মনোযোগ দিয়ে শোেননা, হালকা পাতলা গড়নের লোকটা ফিস্ ফিস্ করে বললো। তুমি নিরবে, দৌড়ে, এই চার্চ থেকে বের হয়ে যাবে। একদম থামবে না। কথাটা বুঝেছো? মুখচাপা অবস্থায়ই ছেলেটা যতোদূর সম্ভব মাথা নেড়ে সায় দিলো।

 

তুমি যদি পুলিশকে ফোন করো… জ্যাকেট পরা লোকটা পিস্তলটা তার শরীরে ঠেকিয়ে ধরলো। আমি তোমাকে ঠিকই খুঁজে নেবো।

 

ছেলেটা এরপর প্রাণপণে দৌড়ে চার্চ থেকে বেড়িয়ে গেলো। পেছনে না তাকিয়ে দুপায়ে সমস্ত শক্তি নিয়ে সে দৌড়ে চলে গেলো।

 

 

 

৮৬.

 

ভূতের মতো নিঃশব্দে সাইলাস পিছু নিলো তার শিকারের। সোফি নেভু ব্যাপারটা টের পেতে একটু দেরিই করে ফেললো। ঘুরে দেখার আগেই সাইলাস তার কোমরে পিস্তলটা ঠেকিয়ে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরলো তকে। ভয়ে সে চিৎকার দিলে টিবিং আর ল্যাংডন দুজনেই ঘুরে তাকালো। প্রচণ্ড অবাক হলো তারা, সেই সাথে ভয়ে আতকে উঠলো।

 

কি…? টিবিংয়ের মুখ ফসকে কথাটা বের হয়ে গেলো। তুমি রেমিকে কী করেছো?

 

আপনার একমাত্র বিবেচনার বিষয় হলো, সাইলাস শীতল কণ্ঠে বললো, আমি এখান থেকে কি-স্টোনটা নিয়ে চলে যাবে, বুঝলেন। এই পুণরুদ্ধারের মিশনটা, রেমি যেভাবে তাকে বলেছে, হতে হবে খুব সহজ আর ঝামেলা মুক্ত : চার্চে ঢুকে, কি স্টোনটা নিয়ে চলে আসা; কোন খুন খারাবি নয়, ধস্তাধস্তি নয়।

 

সোফিকে শক্ত করে ধরে সাইলাস তার বুকের কাছ থেকে হাতটা সরিয়ে নিলো, হাতটা সোফির সোয়েটারের পকেটে ঢুকিয়ে দিলো সে। সোফির চুলের সুবাস নাকে টের পেলো। সেটা কোথায়? ফিসফিস করে বললো। কি-স্টোনটা একটু আগেও তার পকেটে ছিলো। সেটা এখন কোথায়?

 

সাইলাস দেখতে পেলো ল্যাংডন তার সামনে কালো রঙের ক্রিপ্টেক্সটা ধরে রেখেছে। সেটা এমনভাবে দোলাতে লাগলো, যেনো কোন নিরীহ প্রাণীকে প্রলুব্ধ করার জন্য একজন ম্যাটাডোর কিছু নাড়াচ্ছে।

 

নিচে নামিয়ে রাখুন, সাইলাস ধমক দিয়ে বললো।

 

সোফি আর লেইকে চার্চ ছেড়ে যেতে দাও, ল্যাংডন জবাব দিলো। তুমি আর আমি এটা নিয়ে কথা বলবো।

 

সাইলাস সোফিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে অস্ত্রটা ল্যাংডনের দিকে তাক করে তার সামনে এগিয়ে আসলো।

 

আর এক পা-ও এগোবে না, ল্যাংডন বললো, তারা এই ভবন থেকে চলে না যাবার আগ পর্যন্ত।

 

আপনি কোন কিছু দাবি করার মতো অবস্থায় নেই।

 

আমি একমত হতে পারছি না। ল্যাংডন ক্রিপ্টেক্সটা তার মাথার ওপরে তুলে ধরলো। আমি এটা ভেঙে ফেলতে কোন কার্পণ্য করবো না।

 

যদিও সাইলাস হুমকিটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিলো না, তারপরও, তার মনে একটা ভয় জাগলো। এটা অপ্রত্যাশিত। সে তার অস্ত্রটা ল্যাংডনের মাথায় তা করলো আর কণ্ঠটাও রাখলো তার হাতের মতোই দৃঢ়। আপনি কখনই ক্রিপ্টেক্সটা ভাঙতে পারবেন না। আপনিও আমার মতো গ্রেইলটা খুঁজে ফিরছেন।

 

তুমি ভুল করছে। গ্রেইলটা তুমি আমার চেয়েও বেশি চাও। তুমি প্রমাণ করেছো, এটার জন্য খুনও করতে পারো।

 

 

 

চল্লিশ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে এনেক্সের একটা থামের পেছন থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে রেমি লেগালুদেচ সবকিছু দেখে একটা তাড়না অনুভব করলো। সব কিছু ঠিক পরিকল্পনা মতো এগোচ্ছে না। এখান থেকেই সে দেখতে পাচ্ছে, সাইলাস পরিস্থিতিটা সামলাতে পারছে না। টিচারের আদেশ অনুযায়ী, রেমি সাইলাসকে গুলি করতে বারণ করে দিয়েছে।

 

তাদের যেতে দাও, ল্যাংডন আবারো বললো, মাথার ওপরে ক্রিপ্টেটা তুলে ধরে সাইলাসের অস্ত্রের দিকে তাকিয়ে রইলো।

 

পাদ্রীটার লাল চোখে হতাশা আর ক্রোধ দেখা গেলো। রেমির এই আশংকা হতে লাগলো যে, ক্রিপ্টেক্সটা হস্তগত করার পর, সাইলাস আসলে ল্যাংডনকে গুলি করবে। ক্রিপ্টেটা পড়বে না!

 

ক্রিপ্টেক্সটা রেমির মুক্তি আর সম্পদশালী হবার একটা টিকেট। এক বছরেরও বেশি আগে, সে ছিলো পঞ্চান্ন বছরের সামান্য একজন গৃহপরিচারক, শ্যাতু ভিলের চার দেয়ালে থাকতো আর খোঁড়া স্যার লেই টিবিংয়ের সেবা করতো। তারপরই, তাকে একটা অসাধারণ প্রস্তাব দেয়া হলো। স্যার লেই টিবিংয়ের সাথে রেমিকে সহযোগিতা করতে হবে, একটা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। এই ঘটনা তার জীবনে এমন একটা কিছু নিয়ে আসলো, যেটার স্বপ্ন সে জীবনেও দেখতো না। তারপর থেকে, শ্যাতু ভিলেতে তার বসবাস করার সময়টা হয়ে গেলো স্বপ্ন পূরণের একটি ধাপ।

 

আমি খুব কাছাকাছি এসে গেছি, রবার্ট ল্যাংডনের হাতে ধরা কি-স্টোনটার দিকে তাকিয়ে রেমি নিজেকে বললো। ল্যাংডন যদি সেটা ফেলে দেয়, তবে সব কিছুই ভেস্তে যাবে।

 

আমি কি দেখা দেবো? এটা করতে টিচার কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছেন। রেমি হলো একমাত্র ব্যক্তি, যে টিচারের পরিচয়টা জানে।

 

আপনি কি নিশ্চিত, সাইলাসকে দিয়ে এই কাজটা করাতে চাচ্ছেন? কি-স্টোনটা চুরি করার ব্যাপারে রেমি আধ ঘণ্টা আগে টিচারকে জিজ্ঞেস করেছিলো। আমি নিজেই সেটা করতে পারবো।

 

টিচার অনড় ছিলেন। সাইলাস চার জন প্রায়োরি সদস্যদের ব্যাপারে খুব ভালো কাজ করেছে। সে কি-স্টোনটা পুণরুদ্ধার করবে আর তুমি আড়ালেই থাকবে। যদি অন্যেরা তোমায় দেখে ফেলে, তবে তাদেরকে শেষ করে দিতে হবে, আর ইতিমধ্যেই অনেক বেশি খুন খারাবি হয়ে গেছে। তুমি তোমার চেহারাটা দেখিও না।

 

আমার চেহারাটা বদলে যাবে, রেমি ভাবলো। আপিনি আমাকে যা দেবেন তা দিয়ে আমি হয়ে যাবো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ। অস্ত্রোপচার করে তার আঙুলের ছাপও বদলানো যাবে, টিচার তাকে বলেছিলেন। খুব জলদিই সে মুক্ত হবে—আরেকটা অচেনা সুন্দর চেহারা নিয়ে সাগর তীরে সূর্যের আলো পোহাবে। বুঝতে পেরেছি, রেমি বলেছিলো। আমি আড়ালে থেকেই সাইলাসকে সাহায্য করবো।

 

তোমার নিজের জেনে রাখা দরকার, রেমি, টিচার তাকে বলেছিলেন, টেম্পল চার্চের ভেতরে যে সমাধিটার কথা বলা হচ্ছে, সেটা আসলে ওখানে নেই। তো, ভয়ের কিছু নেই। তারা ভুল জায়গায় খোঁজ করছে।

 

রেমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো। আপনি জানেন, সমাধিটা কোথায়?

 

অবশ্যই। তোমাকে পরে বলবো। এই মুহূর্তে তুমি খুব দ্রুত কাজ করবে। অন্যেরা যদি সত্যিকারের অবস্থানটা জেনে যায় আর তোমার যাওয়ার আগে চার্টটা ছেড়ে চলে যায়, তবে আমরা গ্রেইলটা চিরতরের জন্য হারাববা।

 

রেমির কাছে অবশ্য গ্রেইলটার কোন মূল্য নেই, কেবল সেটা উদ্ধার করার পর তাকে যে টাকা দেয়া হবে, সেটাই তার চিন্তা। রেমি যখনই টাকাটার কথা ভাবে, সে লোভী হয়ে ওঠে, বিশ মিলিয়ন ইউরোর এক তৃতীয়াংশ। চিরতরে উধাও হবার জন্য খুব বেশিই।

 

এখন, এই টেম্পল চার্চে, ল্যাংডন কি-স্টোনটা ভেঙে ফেলার হুমকি দেবার সঙ্গে সঙ্গে, রেমির ভবিষ্যষ্টাও ঝুঁকির মুখে পড়ে গেলো। এতো কাছে এসে সব ভেস্তে যাবে, রেমি সেটা ভাবতেও পারলো না। সে একটা সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো। তার হাতে অস্ত্রটা লুকিয়ে রাখা যায়, ছছাই, জে-ফ্রেম মেডুসা, কিন্তু খুব কাছ থেকে গুলি করলে মারাত্মক হয়ে ওঠে জিনিসটা।

 

ছায়া থেকে বেড়িয়ে রেমি বৃত্তাকার কক্ষের দিকে গিয়ে টিবিংয়ের মাথায় অস্ত্রটা তা করলো। বুড়া, আমি অনেক দিন ধরে এই কাজটা করার জন্য অপেক্ষা করেছি।

 

 

 

রেমিকে তার দিকে পিস্তল তাক করতে দেখে স্যার লেই টিবিং-এর হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো। সে করছেটা কি? টিবিং ছোট্ট মেডুসা রিভলবারটা চিনতে পারলো। এটা তার লিমোজিনে রাখা ছিলো।

 

রেমি? টিবিং প্রচণ্ড মর্মাহত হলেন। এসব হচ্ছেটা কি?

 

ল্যাংডন আর সোফিও হতভম্ব হয়ে গেলো।

 

রেমি পেছন থেকে ঘুরে এসে টিবিংয়ের বুকে অস্ত্রটা ধরলো।

 

টিবিং বুঝতে পারলেন, আতংকে তার পেশীগুলো অসাড় হয়ে গেছে। রেমি, আমি–

 

আমি খুব সোজা করে দিচ্ছি, রেমি ল্যাংডনের দিকে তাকালো। কি-স্টোনটা নামিয়ে রাখুন, তা না হলে, আমি টৃগার টিপে দেবো।

 

কিছুক্ষণের জন্য ল্যাংডনের মনে হলো, সে প্যারালাইজ হয়ে গেছে। কি-স্টোনটা তোমার কাছে মূল্যহীন, সে বললো। তুমি এটা খুলতে পারবে না।

 

উন্নাসিক বোকা, রেমি নাক সিটকিয়ে বললো। আপনারা কি খেয়াল করেননি, আমি সারারাত ধরে এইসব কবিতা শুনেছি। আমি সবকিছুই শুনেছি। আর সেগুলো অন্যেকে বলে দিয়েছি, যে আপনাদের চেয়েও অনেক বেশি জানে। আপনারা এমনকি সঠিক জায়গায়ও আসেননি। যে সমাধিটা খুঁজছেন, সেটা একেবারেই অন্য জায়গায় রয়েছে।

 

টিবিং ভয় পেয়ে গেলেন। সে বলছে কী!

 

তুমি কেন গ্রেইলটা চাচ্ছো? ল্যাংডন জানতে চাইলো। এটা ধ্বংস করতে? শেষ সময়ের আগে?

 

রেমি পাদ্রীটাকে ডাক দিলো, মি. ল্যাংডনের কাছ থেকে কি-স্টোনটা নিয়ে নাও।

 

পাদ্রীটা এগোতেই ল্যাংডন পিছু হটে গেলো। কি-স্টোনটা ওপরে তুলে ধরলো, দেখে মনে হলো মাটিতে আছাড় মারবে।

 

এই জিনিসটা ভুল মানুষের হাতে যাওয়ার আগে, ল্যাংডন বললো, আমি বরং এটা ভেঙেই ফেলবো।

 

টিবিংয়ের মনে প্রচণ্ড একটা ভীতির উদ্রেক হলো। তিনি দেখতে পেলেন তাঁর আজীবনের লালায়িত স্বপ্ন, এতো পরিশ্রম চোখের সামনেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।

 

রবার্ট, না! টিবিং চিৎকার করে বললেন। ফেলবেন না! আপনি যেটা ধরে আছেন, সেটাই গ্রেইল! রেমি আমাকে কখনও গুলি করতে পারবে না। আমরা একে অন্যেকে দশ বছর ধরে–

 

রেমি ছাদের দিকে তাক্ করে একটা গুলি ছুড়লো। ছোট অস্ত্র হিসেবে আওয়াজটা খুব বেশিই হলো। পাথরের কক্ষটার ভেতরে গুলির শব্দটা বজ্রপাতের মতো প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।

 

সবাই পাথরের মতো জমে গেলো।

 

আমি কোন ছেলে-খেলা খেলছি না, রেমি বললো। পরেরটা হবে তার পিঠে। সাইলাসের কাছে দিয়ে দিন।

 

ল্যাংডন এবার ক্রিপ্টেক্সটা দিয়ে দিলো। সাইলাস সামনে এগিয়ে এসে সেটা নিয়ে নিলো। কি-স্টোনটা তার পকেটে ভরে ফেলে সাইলাস পিছু হটে গেলো, অস্ত্রটা

 

এখনও ল্যাংডন আর সোফির দিকে তাক করা আছে।

 

টিবিংয়ের কাঁধে খুব জোরে চাপ লাগলো যখন রেমি তাঁর গলাটা পেঁচিয়ে ধরে পিছু হটতে শুরু করলো ওখান থেকে বের হবার জন্য।

 

তাঁকে ছেড়ে দাও, ল্যাংডন বললো।

 

আমরা মি. টিবিংকে একটু গাড়িতে করে ঘুরিয়ে নিতে যাচ্ছি, পিছু হটতে হটতে রেমি বললো। আপনি যদি পুলিশে খবর দেন, তবে উনি মারা যাবেন। আপনারা কোন কিছু করলেই উনি মারা যাবেন। বুঝতে পেরেছেন!

 

আমাকে নিয়ে যাও,ল্যাংডন বললো, তার কণ্ঠে আবেগ উথলে উঠলো। লেইকে ছেড়ে দাও।

 

রেমি হাসলো তা হচ্ছে না। উনার সাথে আমার খুবই চমৎকার ইতিহাস রয়েছে। তাছাড়া, তাকে আমাদের এখনও প্রয়োজন রয়েছে।

 

সোফি আর ল্যাংডনের দিকে পিস্তলটা তা করে সাইলাসও পিছু হটতে লাগলো।

 

সোফির কণ্ঠটা একটুও কাঁপলো না। তুমি কার হয়ে কাজ করছো?

 

পিছু হটতে থাকা রেমির কাছে প্রশ্নটা হাসির উদ্রেক করলো। আপনি খুবই অবাক হবেন, মাদামোয়াজেল, নেভূ।

 

 

 

৮৭.

 

শ্যাতু ভিলের ফায়ার-প্লেসটা নেভানো থাকলেও কোলেত ইন্টারপোল থেকে, ফ্যাক্সটা পেয়ে সেটার সামনে পায়চারী করতে লাগলো।

 

একেবারেই অপ্রত্যাশিত কিছু।

 

অফিশিয়াল রেকর্ড মতে, আদ্রেঁ ভার্নেট খুবই অনুকরণীয় একজন নাগরিক। পুলিশের খাতায় তাঁর কোন নাম নেই—এমনকি একটা পার্কিং টিকেটও না। সরবোর্ন এবং প্রেপ স্কুলে পড়ালেখা করে আন্তজার্তিক ফাইন্যান্স-এ একটা কামলদ ডিগ্রি নিয়েছেন। ইন্টারপোল বলছে, ভার্নেটের নাম সংবাদপত্রে বারবার এসেছে, কিন্তু সবসময়ই ইতিবাচক কাজ-কর্মের জন্য। প্রকারন্তরে, লোকটা জুরিখের ডিপোজিটরি ব্যাংকের নিরাপত্তা বেষ্টনীর নক্সাকার। ইলেকট্রনিক সিকিউরিটির অত্যাধুনিক দুনিয়ায় তিনি একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি। ভার্নেটের ক্রেডিট কার্ড রেকর্ড ঘেটে দেখা গেছে, আর্টের বই-পুস্তক, দামি মদ আর ক্লাসিক গানের সিডির প্রতি তাঁর আসক্তি রয়েছে কয়েক বছর আগে, একটা ব্যয়বহুল স্টেরিও সিস্টেম কিনেছিলেন।

 

শূন্য, কোলেত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

 

ইন্টারপোল থেকে আজ রাতে একমাত্র যে লাল পতাকা পাওয়া গেছে, সেটা হলো টিবিংয়ের চাকর রেমির আঙুলের ছাপ। পিটিএস চিফ-এক্সামিনার ঘরের এক কোনে আরামদায়ক একটা চেয়ারে বসে রিপোর্টটা পড়ছিলো।

 

কোলেত সেদিকে তাকালো। কিছু পেলেন?

 

এক্সামিনার কাঁধ ঝাঁকালো। আঙুলের ছাপটা রেমি লেগালুদেচের। ছিচকে অপরাধী, তেমন কিছু না। দেখে মনে হচ্ছে, বিনা পয়সায় ফোন করার জন্য চোরাই পথে টেলিফোনের তার টানার অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতারিত হয়েছিলো… পরে, আরো কিছু ছিচকে চুরি করেছিলো। একবার শ্বাসনালীতে অস্ত্রোপচারের পর হাসপাতাল থেকে বিল না দিয়ে পালিয়েছিলো। সে চোখ তুলে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলো। চিনাবাদাম এলার্জি।

 

কোলে মাথা নেড়ে সায় দিলো। একটা পুলিশী তদন্তের কথা স্মরণ করলো, যাতে একটা রেস্টুরেন্ট তাদের মেনুতে চিলি রেসিপিতে চিনাবাদাম তেলের কথাটা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছিলো। ঐ খাবার খেয়ে একজন মারা গিয়েছিলো।

 

লেগালুদেচ সম্ভবত গ্রেফতার এড়াতে এখানে এসে বসবাস করছে। এক্সামিনার আমুদে ভঙ্গীতে বললো। তার সৌভাগ্যের রাত।

 

কোলেত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ঠিক আছে, আপনি বরং এই তথ্যটা ক্যাপ্টেন ফশেকে দিয়ে দিন।

 

এক্সামিনার চলে যেতেই পিটিএসর আরেকজন এজেন্ট ঘরের ভেতর হুড়মুর করে প্রবেশ করলো। লেফটেনান্ট! আমরা গোলা-ঘরের মধ্যে একটা কিছু পেয়েছি।

 

এজেন্টের উদ্বিগ্ন হওয়া মুখটা দেখে কোলেত একটাই অনুমান করলো। মৃতদেহ।

 

না, স্যার। খুবই অপ্রত্যাশিত কিছু।

 

কোলেত তার এজেন্টের পিছু পিছু গোলা-ঘরের দিকে গেলো। এজেন্ট ঘরের মাঝখানে একটা মইয়ের দিকে ইঙ্গিত করলো। সেটা মাচাঙে ওঠার জন্য লাগানো হয়েছে।

 

প্রথম যখন এসেছিলাম তখন এই মইটাতো এখানে ছিলো না। কোলেত বললো।

 

না, স্যার। আমি এটা লাগিয়েছি। এখানে রোলস রয়েস গাড়িটাতে আঙুলের ছাপ নেবার সময় আমি মইটা পড়ে থাকতে দেখে উপরে লাগিয়ে মাচাঙটাতে কি আছে দেখি।

 

কোলেত মইটার ধাপগুলোতে দাগ দেখে বুঝতে পারলো, এটা দিয়ে কেউ নিয়মিতই মাচাঙে যেতো?

 

একজন সিনিয়র পিটিএস এজেন্ট মইটার ওপরে আর্বিভূত হয়ে নিচের দিকে তাকালো। আপনি এটা একটু দেখেন, লেফটেনান্ট? সে বললো।

 

ক্লান্ত ভঙ্গীতে কোলে মাথা নেড়ে মইটা বেয়ে ওপরে উঠে গেলো।

 

ওখানে দেখুন, পিটিএস এজেন্ট বললো, অসম্ভব পরিষ্কার জায়গাটার দিকে ইঙ্গিত করলো সে। এখানে কেবলমাত্র এক জনের আঙ্গুলের ছাপই পাওয়া গেছে। তার পরিচয়টা আমরা একটু বাদেই পেয়ে যাবো।

 

কোলেত ডিম-লাইটের আলোতে ভালো করে দেখার জন্য চোখ দুটো সংকুচিত করলো। এটা কি? ওপাশের দেয়ালে বিশাল একটা কম্পিউটার ওয়ার্ক-স্টেশন বসানো রয়েছে–দুই টাওয়ারের সিপিইউ, একটা ফ্ল্যাট স্ক্রিন মনিটর, স্পিকার, কতগুলো যন্ত্রপাতি এবং মালটি চ্যানেল অডিও কনসোল। মনে হচ্ছে, বৈদ্যুতিক সাপ্লইটা স্বয়ংম্পূর্ণ।

 

এসব যন্ত্রপাতি দিয়ে এখানে কি কাজ করা হতো?

 

কোলেত যন্ত্রপাতিগুলোর কাছে গেলো। আপনারা কি এটা পরীক্ষা করে দেখেছেন?

 

এটা আঁড়ি পাতার ঘাঁটি।

 

কোলেত অবাক হলো। নজরদারি করা হতো?

 

এজেন্ট মাথা নেড়ে সায় দিলো। খুবই আধুনিক নজরদারি সিস্টেম। কেউ একজন খুব ভালো করেই জানতে এখানে সে কি করতো। এইসব যন্ত্রপাতি আমাদের যন্ত্রপাতিগুলোর মতোই উন্নতমানের। অতি ক্ষুদ্র মাইক্রোফোন, ফটো ইলেক্ট্রিক রিচার্জিং সেল, হাই ক্যাপাসিটি RAM চিপস। এমনকি এখানে নতুন ন্যানো ড্রাইভও আছে।

 

কোলেত খুব অবাক হলো।

 

এখানে পুরো সিস্টেমটাই রয়েছে, এজেন্ট বললো, কোলেতের হাতে একটা পকেট ক্যালকুলেটর আকারের এসেম্বলি দিলো। এটা একটা হাই ক্যাপাসিটি হার্ড ডিস্ক অডিও রেকর্ডিং সিস্টেম। রিচার্জেবল ব্যাটারি আছে।

 

কোলেত এসব খুব ভালো করেই চিনতো। এগুলো হলো ফটো-সেল মাইক্রোফোন, কয়েক বছর আগে, এটা ছিলো খুবই চমকপ্রদ একটা আবিষ্কার।

 

অতিক্ষুদ্র এই আঁড়ি পাতার যন্ত্র দিয়ে সব কিছু পরিষ্কার শোনা যায়।

 

সিগনালটা কি? কোলেত জিজ্ঞেস করলো। রেডিও ওয়েভ। ছাদের ওপর ছছাট্ট একটা এন্টেনা আছে। এজেন্ট বললো।

 

কোলেত এইসব রেকর্ডিং সিস্টেম ভালো করেই চিনতো। সাধারণত অফিসে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ভয়েস এক্টিভিটেড সিস্টেম, কথা বলা হলেই কেবল রেকর্ডিং হয়, না হলে রেকর্ডিং বন্ধ থাকে। এতে হার্ড ডিস্কের জায়গা বেঁচে যায়। ইচ্ছে মতো হার্ড ডিস্কটা আবার মুছে ফেলাও যায়। রেকর্ড করা কথপোকথনগুলো সম্প্রচার করার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হার্ড ডিস্ক সেগুলো মুছে ফেলে। আবার রেকর্ডিং-এর জন্য তৈরি হয়ে যায়।

 

কোলেত এবার সেলফে রাখা কতগুলো অডিও ক্যাসেটের দিকে তাকালো। কয়েক শত হবে। সবগুলোতেই তারিখ আর সংখ্যার লেবেল লাগানো। কেউ একজন এগুলো নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলো। সে এজেন্টের দিকে ঘুরে বললো, আপনার কি কোন ধারণা আছে?

 

লেফটেনান্ট, এজেন্ট বললো, কম্পিউটারের কাছে গিয়ে একটা সফটওয়্যার লাঞ্চিং করলো সে। এটা খুবই অদ্ভুত একটা জিনিস…

 

 

 

৮৮.

 

ল্যাংডনের নিজেকে খুব নিঃস্ব মনে হলো। সোফিকে নিয়ে টেম্পল টিউব স্টেশনের টানেল আর প্লটফর্ম দিয়ে দৌড়াতে লাগলো সে। নিজেকে তার খুব অপরাধী বলেও মনে হলো।

 

আমি লেইকে জড়িয়েছি, আর এখন সে মহাবিপদে পড়ে গেছে।

 

রেমির জড়িয়ে পড়াটা খুব অপ্রত্যাশিত আর দুঃখজনক। তারপরও, ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে, যে-ই গ্রেইলটা হাতাতে চাচ্ছে, সে একজনকে নিযুক্ত করেছিলো। আমি যে কারণে টিবিংয়ের কাছে গিয়েছিলাম, ঠিক একই কারণে, তারাও তার কাছে গিয়েছিলো। ইতিহাসে দেখা যায়, যার কাছেই গ্রেইলের খবর ছিলো, চোর-বাটপার আর পণ্ডিতেরা চুম্বকের মতো আকর্ষণে তার কাছেই ছুটে গেছে। যে কারণে, টিবিং এসবের টার্গেট হয়েছে, সেই কারণটার কথা ভেবে ল্যাংডনের অপরাধ বোধটার তীব্রতা কম হবার কথা, কিন্তু সেটা হলো না। লেইকে আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে, তাকে সাহায্য করতে হবে। এক্ষুণি।

 

ল্যাংডন সোফিকে অনুসরণ করলো, সে ওয়েস্ট-বাউন্ড ডিস্ট্রক্টের প্লাটফর্মটার সামনে একটা পে-ফোনের কাছে গেলো, পুলিশকে ফোন করতে। যদিও রোমি এব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলো। ল্যাংডন পাশের একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লো বিষণ্ণ মনে।

 

লেইকে সাহায্য করার সবচাইতে ভালো উপায় হলো, সোফি ডায়াল করতে করতে বললো, এক্ষুণি লন্ডনের পুলিশকে খবরটা জানিয়ে দেয়া, আমাকে বিশ্বাস করো।

 

শুরুতে ল্যাংডন এই আইডিয়াটার সাথে একমত হতে পারেনি। কিন্তু যতোই তারা পরিকল্পনাটা নিয়ে এগিয়েছে, সোফির যুক্তিগুলো মনে হচ্ছে ঠিকই। এই মুহূর্তে টিবিং নিরাপদেই আছেন। যদি রেমি এবং অন্যেরা সমাধিটা কোথায় আছে সেটা জানেও, তবুও তাদেরকে টিবিংয়ের দরকার রয়েছে গোলকের খবরটা বের করার জন্য। কিন্তু ল্যাংডনের যে বিষয়ে চিন্তা হচ্ছে, সেটা হলো, গ্রেইল মানচিত্রটা খুঁজে পাবার পর লেইর কী হবে। লেই তখন বিশাল একটা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

 

ল্যাংডন যদি টিবিংকে সাহায্য করতে চায়, অথবা গ্রেইলটা দেখতে চায়, তবে সবার আগে সমাধিটা খুঁজে বের করাই হলো সবচাইতে জরুরি। দূর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, শুরু করার জন্য রেমির কাছে রয়েছে মস্তবড় একটা মস্তিষ্ক।

 

রেমি আর সাইলাসকে লন্ডনের পুলিশের কাছে সোফি ফেরারি হিসেবে তুলে ধরতে পারবে, তাদেরকে লুকিয়ে পড়তে বাধ্য করতে পারবে, অথবা, ওদেরকে গ্রেফতার করাতেও পারবে। সেই তুলনায়, ল্যাংডনের পরিকল্পনাটা আরো বেশি অনিশ্চিত এটিউব স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে কাছের কিংস কলেজে যাওয়া, যা ধর্মবিদ্যা সংক্রান্ত ডাটাবেজের জন্য সুবিখ্যাত। অনিবার্য গবেষণার হাতিয়ার, ল্যাংডন এই কথাটা শুনেছিলো। ধর্ম সংক্রান্ত কোন ইতিহাসের প্রশ্নের তাৎক্ষনিক উত্তর পাওয়া যায়। সে ভাবতে লাগলো ডাটাবেজ-এ পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট-এর ব্যাপারে কি বলা থাকবে।

 

সে উঠে দাড়িয়ে পায়চারী করতে লাগলো, কামনা করলো, ট্রেনটা যেনো খুব জলদি এসে পড়ে।

 

 

 

পে-ফোনে সোফির লাইনটা অবশেষে লন্ডন পুলিশের সংযোগ পেলো।

 

স্নো হিল ডিভিশন, ডেসপ্যাচার বললো। আপনার কলটাকে আমি কোথায় দেবো?

 

আমি একটি অপহরণ মামলা রিপোর্ট করবো। সোফি বললো।

 

নামটা, প্লিজ?

 

সোফি একটু থামলো। এজেন্ট সোফি নেভু, ফরাসি জুডিশিয়ার পুলিশ।

 

আকাঙ্খ অনুযায়ীই টাইটেলটার ফল পাওয়া গেলো। এক্ষুণি দিচ্ছি, ম্যাম্। আমি একজন গোয়েন্দাকে লাইনে দিয়ে দিচ্ছি।

 

কলটার সংযোগ পেতেই সোফি ভাবতে শুরু করলো, পুলিশ তার দেয়া টিবিং আর তাঁর অপহরণকারীদের বর্ণনাটা বিশ্বাস করবে কিনা। টুক্সেডো জ্যাকেট পরা একজন লোক। এর চেয়ে আর কত সহজে একজন সন্দেহভাঁজনের পরিচয় দেয়া যায়? রেমি যদি তার পোশাকটা পাল্টিয়েও ফেলে, তাতেও অসুবিধা নেই, তার সঙ্গে ধবল পাদ্রীটা রয়েছে। এটা মিস্ করা অসম্ভব। তারচেয়েও বড় কথা, তাদের কাছে একজন জিম্মি রয়েছে, তাই তারা পাবলিক যানবাহন ব্যবহার করতে পারবে না। সোফি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো, লন্ডনে কতগুলো জাগুয়ার লিমোজিন চলাচল করে।

 

ফোনে গোয়েন্দার লাইন পেতে সোফির মনে হলো সারাজীবন লেগে যাবে। জলদি! সে ক্লিক করে একটা শব্দ শুনতে পেলো। পনেরো সেকেন্ড পার হয়ে গেছে।

 

অবশেষে লাইনে একটা লোকের কণ্ঠ শোনা গেলো। এজেন্ট নেভু?

 

বিস্মিত হয়ে সোফি কণ্ঠটা তক্ষুণি চিনতে পারলো।

 

এজেন্ট নেভু, বেজু ফশে আবারো তাড়া দিলো। আপনি আছেন কোথায়?

 

সোফি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। ফশে লন্ডন পুলিশকে সোফির ব্যাপারে আগেই বলে রেখেছিলো, তাদেরকে অনুরোধ করেছিলো, সোফির ফোন এলে যেননা তার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। শুনুন, ফশে ফরাসিতে বললো। আজ রাতে আমি বিশাল একটা ভুল করে ফেলেছি। রবার্ট ল্যাংডন নির্দোষ। তার বিরুদ্ধে সব ধরনের অভিযোগ বাদ দেয়া হয়েছে। তারপরও, আপনারা দুজন খুব বিপদে রয়েছেন। আপনাদের আমার কাছে আসার দরকার।

 

সোফির মুখটা হা হয়ে গেলো। কী বলবে ভেবে পেলো না। কোন কিছুর জন্য ক্ষমা চাওয়া মতো লোক বেজু ফশে নয়।

 

আপনি আমাকে বলেননি, ফশে বলতে লাগলো, জ্যাক সনিয়ে আপনার দাদু হন। যাহোক, এই মুহূর্তে, আপনি আর ল্যাংডনের দরকার নিকটস্থ লন্ডন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আশ্রয় নেয়া।

 

আমি লন্ডনে আছি, সে এটা জানে? ফশে আর কি জানে? সোফি শুনতে পেলো ফশের ফোনে ড্রিলিং অথবা মেশিন চলার শব্দ। সে ফোনের লাইনে অদ্ভুত একটা ক্লিক ক্লিক শব্দও শুনতে পেলো। আপনি কি এই কলটা ট্রে করছেন, ক্যাপ্টেন?

 

ফশের কণ্ঠটা এবার খুব দৃঢ় হলো। আপনাকে আমার সাথে সহযোগীতা করার দরকার, এজেন্ট নেভু। আমারা দুজনেই অনেক কিছু হারিয়েছি। এটা হলো ড্যামেজ কন্ট্রোল। আমি কাল রাতে কিছু ভুল করে ফেলেছি। আর এই ভুলের জন্য যদি একজন আমেরিকান অধ্যাপক আর ডিসিপিজের একজন ক্রিপ্টোলজিস্ট মারা যায়, তবে আমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। আমি আপনাকে নিরাপদে নেবার জন্য কয়েক ঘন্টা ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

 

সোফিও নিরাপদ আশ্রয় চায়। প্রকারন্তরে ল্যাংডনেরও সেরকমই ইচ্ছে।

 

আপনি যে লোকটাকে চাচ্ছেন, সে হলো রেমি লেগালুদেচ, সোফি বললো। সে টিবিংয়ের গৃহপরিচারক। একটু আগে টেম্পল চার্চের ভেতর থেকে সে টিবিংকে অপহরণ করে–

 

এজেন্ট নেভু! স্টেশনে ট্রেনটা ঢুকতেই ফশের গলাটা প্রচণ্ড কোলাহলের শব্দে চাপা পড়ে গেলো। এটা নিয়ে এভাবে ফোনে কথা বলা ঠিক নয়। আপনি আর ল্যাংডন এক্ষুণি আসুন। আপনাদের ভালোর জন্যই! এটা আমার সরাসরি আদেশ!

 

সোফি ফোনটা রেখে ল্যাংডনকে নিয়ে ট্রেনের কাছে চলে গেলো।

 

 

 

৮৯.

 

টিবিংয়ের প্লেনের ক্যাবিনে বেজু ফশে সম্পূর্ন একা। সে সবাইকে বের করে দিয়ে মদ আর সামনে উডেন বাক্সটা নিয়ে চুপচাপ বসে আছে।

 

ঢাকনার ওপরে গোলাপটাতে আঙুল বুলিয়ে, সে ঢাকনাটা খুললো। ভেতরে একটা পাথরের চোঙা পেলো, তাতে অক্ষর বিশিষ্ট ডায়াল আছে। পাঁচটি ডায়াল SOFIA বানানটাতে মিলিয়ে রাখা আছে। ফশে শব্দটার দিকে তাকিয়ে চোঙাটার মুখ খুলে ফেললো। ভেতরের প্রতিটা ইঞ্চি সে ভালো করে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। চোঙাটার ভেতরে কিছু নেই, একেবারে ফাঁকা।

 

ফশে সেটা রেখে প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে উদাসভাবে তাকালো। সোফির সাথে তার সংক্ষিপ্ত ফোনালাপের কথাটা আর শ্যাতু ভিলে থেকে যে তথ্যটা পেয়েছে সেটা ভাবতে লাগলো। ফোনের রিংয়ের শব্দে দিবা-স্বপ্ন থেকে ফিরে এলো সে।

 

ডিসিপিজে থেকে এসেছে। ডেসপ্যাচার ক্ষমা প্রার্থী হলো। জুরিখের ডিপোজিটরি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বার বার ফোন করে যাচ্ছে। যদিও তাকে কয়েকবারই বলা হয়েছে, ক্যাপ্টেন লন্ডনে একটা কাজে খুব ব্যস্ত আছে। তারপরও লোকটা ফোন করেই যাচ্ছে। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ফশে অপারেটরকে ফোনটা দিতে বললো।

 

মঁসিয়ে ভার্নেট, লোকটা কোন কিছু বলার আগেই ফশে বললো, আমি দুঃখিত, আমি আপনাকে ফোন করতে পারিনি বলে। খুব ব্যস্ত ছিলাম। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আপনার ব্যাংকের নাম মিডিয়াতে আসবে না। তো, আপনার এখন চিন্তার কারণটা কি?

 

ভার্নেটের কণ্ঠটাতে উদ্বেগ দেখা দিলো যখন সে বর্ণনা করলো, কীভাবে সোফি আর ল্যাংডন তার ব্যাংক থেকে উডবাক্সটা নিয়েছে এবং তাকে পটিয়ে-পাটিয়ে তাদেরকে ব্যাংক থেকে পালানোর জন্য তার সাহায্য আদায় করে নিয়েছে। তারপর, আমি যখন রেডিওতে শুনলাম তারা অপরাধী, ভার্নেট বললেন, আমি তাদের কাছে বক্সটা ফেরত চাইলাম, কিন্তু তারা আমাকে আক্রমণ করে ট্রাকটা নিয়ে পালিয়ে যায়।

 

আপনি একটা কাঠের বাক্স নিয়ে চিন্তিত আছেন, ফশে বললো, বাক্সটার দিকে তাকিয়ে সেটার ঢাকনাটা খুলে পাথরের চোঙাটা হাতে তুলে নিলো। আপনি কি আমাকে বলতে পারবেন, বাক্সটার ভেতরে কি আছে?

 

ভেতরের জিনিসটা কোন ব্যাপার নয়, ভার্নেট পাল্টা বললো। আমি আমার ব্যাংকের সুনাম নিয়ে চিন্তিত। আমাদের কখনও কোন কিছু ডাকাতি হয়নি। কখনই না। আমি যদি আমার ক্লায়েন্টের জন্য এটা পুণরুদ্ধার করতে না পারি, তবে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।

 

আপনি বলছেন, এজেন্ট নেভু আর রবার্ট ল্যাংডনের কাছে একটা পাসওয়ার্ড আর চাবি ছিলো। তাহলে আপনি কীভাবে বলছেন বাক্সটা চুরি হয়েছে?

 

তারা মানুষ খুন করেছে। সোফি নেভুর দাদাকেও। পাসওয়ার্ড আর চাবিটা অবশ্যই খারাপ পথে নেয়া হয়েছে।

 

মি. ভার্নেট, আমার লোকজন আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড আর আগ্রহের বিষয়ে কিছু খোঁজ খবর নিয়েছে। আপনি একজন রুচিবান, সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি। আমি অনুমান করতে পারি, আপনি একজন সম্মানিত লোকও, আমার মতোই। আমি বলছি, কথা দিচ্ছি আপনাকে, পুলিশ জুডিশিয়ারের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে, আপনার বাক্সটা এবং ব্যাংকের সুনাম বর্তমানে খুবই নিরাপদ একটা হাতে রয়েছে।

 

 

 

৯০.

 

শ্যাতু ভিলের মাচাঙের ওপরে দাঁড়িয়ে কম্পিউটার মনিটরের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে রইলো কোলেত। এই সিস্টেমটা এতোগুলো জায়গাকে নজরদারি করে?

 

হ্যাঁ, এজেন্ট বললো। দেখে মনে হচ্ছে, ডাটাগুলো এক বছর আগে সংগ্রহ করা হয়েছিলো।

 

বাকরুদ্ধ হয়ে কোলেত তালিকাটি আবারো পড়লো।

 

কোলবার্ট সসটাক-চেয়ারম্যান, সাংবিধানিক কাউন্সিল

জ্যঁ শ্যাফি–কিউরেটর, জো দ্য পমে মিউজিয়াম

এদোয়ার্দো দেরোশার–সিনিয়র আর্কাইভিস্ট, মিতের লাইব্রেরি

জ্যাক সনিয়ে—কিউরেটর, লুভর মিউজিয়াম

মাইকেল ব্রেটন–DAS-এর প্রধান (ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থা)

 

এজেন্ট স্ক্রিনের দিকে ইঙ্গিত করলো। চার নাম্বারের ব্যক্তিটিই আমাদের তদন্তের বিষয়।

 

কোলেত উদাস হয়ে মাথা নাড়লো। সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে। জ্যাক সনিয়েকে আঁড়িপাতা হয়েছিলো। তালিকার বাকি নামগুলোর দিকে আবারো তাকালো সে। কীভাবে একজন এতো বিখ্যাত লোকদেরকে আড়িপাতার মতো কাজটি করতে পারলো? আপনি কি কোন অডিও ফাইল শুনেছেন?

 

অল্প কয়েকটা। এখানে অতি সাম্প্রতিক সময়ের একটা আছে। এজেন্ট লোকটা কম্পিউটারের কি বোর্ডে বোতাম চাপলো। এবার স্পিকারে কিছু শোনা গেলো। ক্যাপিতেই, উ এজেন্ত দু দিপাৰ্তমেন্তে দা ক্রিপ্টোগ্রাফি এস এরাইভ। কোলে নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এ তো আমার কণ্ঠ! তার মনে পড়ে গেলো, সে সনিয়ের ডেস্কে বসে গ্র্যান্ড গ্যালারিতে ফশেকে সোফি নেভুর আগমন সম্পর্কে সতর্ক করেছিলো ফোনে।

 

এজেন্ট লোকটা মাথা দোলালো। লুভরে আমাদের তদন্তের অনেক কিছুই রেকর্ড করা হয়ে গেছে।

 

আপনি কি কাউকে আড়িপাতার জায়গাটা খুঁজে বের করার জন্য পাঠিয়েছেন?

 

তার আর দরকার নেই। আমি জানি, সেটা ঠিক কোথায় আছে। এজেন্ট লোকটা একগাদা কাগজ থেকে একটা পৃষ্ঠা নিয়ে কোলেতের হাতে তুলে দিলো। চিনতে পেরেছেন?

 

কোলেত দারুণ অবাক হলো। তার হাতে প্রাচীন স্কেমিটিক ডায়াগ্রামের একটা ফটোকপি, যাতে একটা যন্ত্রের ড্রইং আঁকা আছে। ইতালিয় ভাষায় বলে সে হাতের লেখাটা পড়তে পারলো না। তারপরও, সে জানতো সে কী দেখছে। একটা মধ্যযুগীয় ফরাসি নাইটের একটি পূর্ণাঙ্গ নক্সা। এই নাইটটা তো সনিয়ের ডেস্কের ওপর রাখা!

 

কোলেতের চোখ মার্জিনের দিকে গেলো, যেখানে কেউ লাল কালিতে হিজিবিজি করে কিছু লিখে রেখেছে। লেখাগুলো ফরাসিতে। এতে বর্ণনা করা হয়েছে, কীভাবে নাইটটার ভেতরে শব্দ শোনার যন্ত্র ঢুকানো যায়।

 

 

১০. সাইলাস টেম্পল চার্চের কাছে

৯১.

 

সাইলাস টেম্পল চার্চের কাছেই পার্ক করা জাগুয়ার লিমোজিনটার পেছনের সিটে বসে আছে। টিবিংকে এখানে নিয়ে এসে পেছনের ট্রাংক থেকে পাওয়া দড়িগুলো দিয়ে রেমি তাকে বেঁধে ফেলে রেখেছে। কি-স্টোনটার ওপর হাত বুলাতে বুলাতে সাইলাস রেমির জন্য অপেক্ষা করছে।

 

অবশেষে, রেমি এসে সামনের ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো, সাইলাসের পাশে।

 

সব ঠিক আছে? সাইলাস জিজ্ঞেস করলো।

 

রেমি মিটিমিটি হেসে বৃষ্টির পানি ঝাড়ার জন্যে মাথা ঝাঁকালো। ঘাড় বেকিয়ে হাত-পা-মুখ বাঁধা রিয়ারের নিচে পড়ে থাকা টিবিংয়ের দিকে তাকালো সে। তিনি কোথাও যাচ্ছেন না।

 

সাইলাস টিবিংয়ের গোঙানী শুনতে পেলো, বুঝতে পারলো, পুরনো ডাক্ টেপগুলো দিয়ে ওঁর মুখ আঁটকে দেয়া হয়েছে।

 

ফামে তা গুয়েলে! রেমি টিবিংকে চিৎকার করে বললো। কন্ট্রোল প্যানেলের একটা বোতাম টিপলো সে। পেছনের সিট থেকে সামনের সিটের মধ্যে একটা দেয়াল উঠে গেলো। টিবিং দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে তার কণ্ঠটাও নিরব হয়ে গেলো।

 

সাইলাসের দিকে তাকালো রেমি। আমি তাঁর তর্জন-গর্জন অনেকদিন ধরেই সহ্য করে এসেছি, আর নয়।

 

 

 

মিনিটখানেক পর, জাগুয়ারটা চলতে শুরু করতেই সাইলাসের ফোনটা বেজে উঠলো। টিচার। সে উত্তেজিত হয়ে জবাব দিলো। হ্যালো?

 

সাইলাস, টিচারের অতি পরিচিত ফরাসি উচ্চারণ। তোমার কণ্ঠটা শুনতে পেরে খুব স্বস্তিবোধ করছি। তার মানে, তুমি এখন নিরাপদে আছে।

 

সাইলাসও টিচারের কণ্ঠটা শুনে আরাম বোধ করলো। কয়েক ঘণ্টা ধরে অপারেশনটা বেশ এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত, মনে হচ্ছে, সবকিছু আবার পরিকল্পনা মতোই এগুচ্ছে। কি-স্টোনটা এখন আমার কাছে।

 

এটাতো অসাধারণ একটা সংবাদ, টিচার তাকে বললেন। রেমি কি তোমার সাথে আছে?

 

সাইলাস খুব অবাক হলো টিচারের মুখে রেমির নামটা শুনতে পেয়ে। হ্যাঁ, রেমিই আমাকে মুক্ত করেছে।

 

যেমনটি আমি তাকে আদেশ করেছিলাম। আমি খুব দুঃখিত, তোমাকে দীর্ঘ সময় ধরে বন্দী থাকতে হয়েছে।

 

শারীরিক কষ্ট কোন ব্যাপারই না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কি-স্টোনটা এখন আমাদের হাতে।

 

হ্যাঁ। আমি চাই, সেটা এক্ষুণি আমার কাছে দিয়ে দাও। সময়টা খুবই মূল্যবান।

 

সাইলাস শেষ পর্যন্ত টিচারের সাথে মুখোমুখি দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলো। হ্যাঁ, স্যার, আমি খুবই সম্মানিত বোধ করবো।

 

সাইলাস, আমি চাইছি রেমি সেটা আমার কাছে নিয়ে আসুক।

 

রেমি? সাইলাস আকাশ থেকে পড়লো। টিচারের জন্য এতো কিছু করার পর, তার বিশ্বাস হয়েছিলো, সে-ই এই মূল্যবান সম্পদটা হস্তান্তর করবে। টিচার দেখি রেমিকেই বেছে নিচ্ছেন?

 

আমি তোমার হতাশাটা বুঝতে পারছি, টিচার বললেন। তার মানে, তুমি আমার কথার অর্থটা বুঝতে পারছে না।

 

তিনি কণ্ঠটা নিচে নামিয়ে ফিসফিস্ করে বললেন। তোমাকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে, আমি তোমার হাত থেকেই কি-স্টোনটা নিতে বেশি পছন্দ করতাম একজন অপরাধীর চেয়ে বরং ঈশ্বরের একজন বান্দাকেই বেশি পছন্দ করা ভালো কিন্তু, রেমিকেই কাজটা করতে হবে। সে আমার আদেশ অমান্য করে আমাদের পুরো মিশনটাকে মহা বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

 

সাইলাস একটা বিপদ আঁচ করতে পেরে রেমির দিকে তাকালো। টিবিংকে অপহরণ করাটা পরিকল্পনার কোন অংশ ছিলো না। আর তাকে নিয়ে কী করা হবে, সেটা নতুন একটা সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

 

তুমি আর আমি হলাম ঈশ্বরের বান্দা, টিচার ফিসৃফিস্ করে বললেন। আমরা আমাদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হতে পারি না। দীর্ঘ বিরতি নেমে এলো। শুধুমাত্র, এই কারণেই, আমি রেমিকে বলেছি কি-স্টোনটা নিয়ে আসতে। তুমি কি বুঝতে পেরেছো?

 

সাইলাস টিচারের কণ্ঠে রাগের বর্হিপ্রকাশটা টের পেয়ে অবাকই হলো। তার চেহারাটা দেখতে পাওয়াটা আর এড়ানো যাবে না। সাইলাস ভাবলো। রেমি যা করার তা করেছে। কি-স্টোনটা রক্ষা করেছে সে। বুঝতে পেরেছি, সাইলাস বললো।

 

ভালো। তোমার নিজের নিরাপত্তার জন্যেই, এক্ষুণি তুমি রাস্তায় নেমে পড়ো। পুলিশ খুব জলদিই লিমোজিনটা খুঁজতে শুরু করবে। আর আমি চাই না, তুমি ধরা পড়ো। লন্ডনে ওপাস দাইর একটা আবাস আছে না?

 

অবশ্যই আছে।

 

তোমাকে সেখানে স্বাগতম।

 

একজন ভাই হিসেবে।

 

তাহলে, সবার নজর এড়িয়ে ওখানে চলে যাও। কি-স্টোনটা হাতে পাবার পর তোমাকে আমি ফোন করবো।

 

আপনি কি লন্ডনেই আছেন?

 

আমি যা বলছি, তা-ই করো, সবকিছু ঠিক মতোই হবে।

 

জ্বি, স্যার।

 

টিচার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, যেনো এখন তাকে যে কাজটা করতে হবে, সেটা খুবই অপছন্দের একটি কাজ।

 

রেমিকে দাও, তার সাথে কথা বলবো।

 

সাইলাস ফোনটা রেমিকে দিলো। আঁচ করতে পারলো, এই ফোনটাই হয়তো রেমি লেগালুদেকের জীবনের শেষ ফোন।

 

***

 

রেমি ফোনটা হাতে নিতেই বুঝতে পারলো, বেচারা, এই ক্ষতবিক্ষত পাত্রীর কোন ধারণাই নেই তার ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে।

 

টিচার তোমাকে ব্যবহার করেছে, সাইলাস। আর তোমার বিশপ হলেন দাবার একটি খুঁটি।

 

রেমি টিচারের ছেলে-ভোলানো ক্ষমতায় খুবই অবাক হলো, বিশপ আরিজারোসা সব কিছুই বিশ্বাস করেছেন। তিনি তার নিজের মরিয়া আচরণের জন্যে অন্ধ হয়ে গেছেন। আরিজারোসা এতোটাই উদগ্রীব যে, বিশ্বাস না করে পারেননি। যদিও রেমি টিচারকে পছন্দ করে না, তারপরেও, লোকটার আস্থাভাঁজন হয়ে, তার জন্যে কাজ করতে পেরে সে গর্বিত। আমি আমার পারিশ্রমিক পেতে যাচ্ছি।

 

খুব মনোযোগ দিয়ে শোনো, টিচার বললেন। সাইলাসকে ওপাস দাইর আবাসিক ভবনে নিয়ে যাও, কয়েক রাস্তা আগেই তাকে নামিয়ে দিও। তারপর, সেন্ট জেম্স পার্কে চলে আসো। জায়গাটা পার্লামেন্ট ভবন আর বিগ বেনের কাছেই। তুমি হর্স গার্ড প্যারাডে গাড়িটা পার্ক করতে পারবে। আমরা সেখানেই কথা বলবো।

 

এই কথা বলেই তিনি লাইনটা কেটে দিলেন।

 

 

 

৯২.

 

কিংস কলেজ, ১৮২৯ সালে রাজা জর্জ চতুর্থ কর্তৃক নির্মিত হয়েছিলো। এতে ডিপার্টমেন্ট অব থিওলজি আর রিলিজিয়াস স্টাডি বিভাগ রয়েছে। পার্লামেন্ট-এর পাশে আবস্থিত এই জায়গাটা রাজ পরিবারের অনুদান। কিংস কলেজের রিলিজিয়ন ডিপার্টমেন্টটা কেবল ১৫০ বছরের শিক্ষকতা আর গবেষণার অভিজ্ঞতায়ই ঋদ্ধ নয়, বরং ১৯৮২ সালে তারা একটা সিস্টেমেটিক থিওলজি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে, যাতে রয়েছে এই পৃথিবীর অন্যতম উন্নতমানের ইলেক্ট্রনিক রিসার্চ লাইব্রেরি।

 

বৃষ্টির মধ্যে সোফিকে নিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকে ল্যাংডনের খুব আড়ষ্ট লাগছে। প্রাইমারি রিসার্চ রুমটা, টিবিং যেমন বর্ণনা করেছিলেন—একটা বড় আট কোনার ঘর। মাঝখানে বিশাল গোল একটা টেবিল। যাতে রয়েছে বারোটি ফ্ল্যাট স্ক্রিন কম্পিউটার মনিটর। ঘরের অন্য মাথায়, একজন লাইব্রেরিয়ান এইমাত্র এক কাপ চা নিয়ে এসে বসেছে।

 

চমৎকার সকাল, মেয়েটা উষ্ণু বৃটিশ বাচনভঙ্গীতে বললো। চা-টা রেখে তাদের কাছে এগিয়ে এলো। আমি কি আপনাদের সাহায্য করতে পারি?

 

ধন্যবাদ আপনাকে, ল্যাংডন জবাব দিলো। আমার নাম—

 

রবার্ট ল্যাংডন। মেয়েটা সুন্দর করে হেসে বললো। আমি জানি, আপনি কে।

 

কয়েক মুহূর্ত সে ভাবলো, ফশে হয়তো ইংলিশ টেলিভিশনেও তার ছবিটা সম্প্রচার করেছে, কিন্তু লাইব্রেরিয়ানের হাসিটা অন্য কথা বলছে। ল্যাংডন এখনও একজন সেলিবৃটির মতো এরকম পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। তারপরও বলা যায়, যদি এই পৃথিবীর কেউ তার চেহারাটা চিনতে পারে, সেটা রিলিজিয়াস লাইব্রেরিয়ানই হবে।

 

পামেলা গেটাম, হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে লাইব্রেরিয়ান বললো। আকর্ষণীয় চেহারা আর চমৎকার কণ্ঠ তার। হর্ন–

 

রিড চশমাটা তার গলায় ঝুলছে, সেটা খুবই পাতলা। আপনার সাথে পরিচিত হতে পেরে আমি আনন্দিত, ল্যাংডন বললো। এ হলো আমার বন্ধু, সোফি নেভু।

 

তারা দুজন হাত মেলালো। গেটাম ল্যাংডনের দিকে ঘুরে বললো, আমি জানতাম না আপনি আসছেন।

 

আরে, আমরাও কি জানতাম। যদি খুব বেশি অসুবিধা না হয়ে থাকে, আমাদেরকে আপনার একটা তথ্য খুঁজে দিতে সাহায্য করতে হবে।

 

গেটাম একটু ইতস্তত করলো। সাধারণত, আমাদের সেবা নিতে হলে আগে যোগাযোগ করে কিংবা দরখাস্ত করতে হয়। অবশ্য, আপনি নিশ্চয় কোন কলেজের অতিথি হয়ে এসেছেন?

 

ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো। আমি আসলে কাউকে না জানিয়ে এসেছি। আমার এক বন্ধু আপনার খুব সুনাম করেছেন। স্যার লেই টিবিং? নামটা বলতেই ল্যাংডনের ভেতরে একটা বিষণ্ণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। বৃটিশ রয়্যাল হিস্টোরিয়ান।

 

গেটামের চেহারাটা উজ্জ্বল হয়ে গেলো এবার, হেসে উঠলো সে। হায় ঈশ্বর, হ্যাঁ। আজব মানুষ। উন্মাদ! যখনই তিনি আসেন, সেই একই বিষয়। গ্রেইল। গ্রেইল। গ্রেইল। এই অম্বেষণটা ছাড়ার আগেই লোকটা মরবে, কসম খেয়ে বলছি। সে একটু ভুরু কুকালো। এসব কাজে সময় আর প্রচুর টাকা লাগে, আপনি কি বলেন? লোকটা একজন ডন কুইজোট।

 

আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারবেন কি? কোন সুযোগ আছে? সোফি জিজ্ঞেস করলো। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এটা।

 

গেটাম ফাঁকা লাইব্রেরিটার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে তাদের দুজনকে চোখ টিপে ইশারা করলো। তো, আমি যে খুব ব্যস্ত আছি, সেটা তো আর বলতে পারছি না।

 

পারি কি? বলুন কী খুঁজতে চান?

 

আমরা লন্ডনে একটা সমাধি খুঁজছি।

 

গেটামকে দেখে সন্দেহগ্রস্ত মনে হলো। আমাদের কাছে এরকম প্রায় বিশ হাজার রয়েছে। আপনি কি আরেকটু নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন?

 

এটা একটা নাইটের সমাধি। আমরা তার নাম জানি না।

 

এজন নাইটের। এটাতে দেখি কাজ হয় কিনা।

 

যে নাইটকে আমরা খুঁজছি, তাঁর সম্পর্কে আমাদের কাছে তেমন কোন তথ্য নেই। সোফি বললো। শুধু এটুকুই আমরা জানি। সে একটা কাগজ বের করলো যাতে সনিয়ের কবিতাটার প্রথম দুটো লাইন টুকে রাখা আছে।

 

একজন বহিরাগতের কাছে পুরো কবিতাটা না দেখানোর সিদ্ধান্তই তারা নিয়েছিলো। কিন্তু মনে হচ্ছে, এক্ষেত্রে তারা একটু বেশি সর্তকতাই নিয়ে ফেলেছে। এর খুব একটা দরকারও নেই।

 

 

 

গেটাম বিখ্যাত আমেরিকান পণ্ডিতের চোখে তাড়াহুড়োটা টের পেলো। যেনো এই সমাধিটা খুঁজে পাওয়াটা খুবই জরুরি একটা কাজ। তার সঙ্গী, সবুজ চোখের মেয়েটাও মনে হচ্ছে খুব উদ্বিগ্ন।

 

হতভম্ব হয়ে গেটাম এইমাত্র তাকে দেয়া কাগজটাতে ভালো করে চোখ বুলালো।

 

পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট লন্ডনে আছেন শায়িত।

তাঁর কার্যকলাপ হয়েছিলো ধর্মাবতার ক্রোধের কারণ।

 

মেয়েটা তার সামনের অতিথিদের দিকে তাকালো। এটা কি? হারভার্ডের কোন গোলক বাধা?

 

ল্যাংডন জোর করে হাসলো। হ্যাঁ, সেরকমই কিছু।

 

গেটাম থামলো, বুঝলো, তাকে পুরো গল্পটা বলা হচ্ছে না। যাইহোক, সে কবিতাটার দিকে মনোযোগ দিলো, কৌতূহলবশত। এই কবিতাটার মতে, একজন নাইট এমন কিছু করেছিলেন যাতে ঈশ্বর নাখোশ হয়েছিলেন। তারপরও, পোপ তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাকে সমাহিত করেছিলেন, লন্ডনে।

 

ল্যাংডন সায় দিলো। এতে কি কিছু বোঝা যাচ্ছে?

 

গেটাম একটা কম্পিউটারের দিকে গেলো। খালি হাতে তো কিছু বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু দেখা যাক, ডাটাবেজ থেকে কিছু বের করে আনা যায় কিনা।

 

বিগত দুশতকের বেশি সময় ধরে কিংস কলেজের রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর সিস্টেমেটিক থিওলজি বিভাগটি অপটিক্যাল ক্যারাক্টার রিকগনিশন সফটওয়্যার ব্যবহার করে আসছে, সেই সাথে অনুবাদ করা, ক্যাটালগ তৈরি করা আর ডিজিটাইজ করার জন্য রয়েছে কিছু যন্ত্রপাতি। এ দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল এক তথ্য ভাণ্ডার এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিওন, রিলিজিয়াস বায়োগ্রাফি, ইতিহাস, ভ্যাটিকানের চিঠিপত্র, যাজকদের ডায়রি, ইত্যাদি সমস্ত ধর্ম বিষয়ক তথ্যদি সেখানে পাওয়া যায়। বর্তমানে এই বিশাল তথ্য ভাণ্ডারটি বিট আর বাইটে রূপান্তর করার ফলে তথ্যগুলোতে প্রবেশ করা, খুঁজে বের করা, সীমাহীনভাবেই সহজসাধ্য হয়ে গেছে।

 

কাগজটা দেখে দেখে গেটাম কিছু টাইপ করলো। শুরুতে আমরা কিছু কি-ওয়ার্ড দিয়ে খুঁজে দেখি কী হয়।

 

ধন্যবাদ, আপনাকে।

 

গেটাম কিছু শব্দ টাইপ করলো :

 

লন্ডন, নাইট, পোপ

 

সার্চ বোতামে চাপ দিতেই বিশাল যন্ত্রটার চালু হওয়ার শব্দ শোনা গেলো। সুবিশাল হার্ডডিস্ক ড্রাইভ কাজ করতে শুরু করছে। ডাটা স্ক্যান করার হার প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ মেগাবাইট। কিছুক্ষণ পর পর্দায় একটা লেখা ভেসে এলো।

 

পোপের পেইন্টিং। স্যার জশুয়া রেনল্ডসর পোট্রেট সংগ্রহ।

লন্ডন ইউনিভার্সিটি প্রেস।

 

গেটাম মাথা ঝাঁকালো। অবশ্যই, আপনারা যা খুঁজছেন তা নয়।

 

সে পরের হিটটায় গেলো।

 

আলেকজান্ডার পোপ-এর লন্ডনের রচনাবলী

-– জি. উইলসন নাইট

 

আবারো সে মাথা ঝাঁকালো।

 

স্ক্রিনে যেসব রেফারেন্স ভেসে এলো সেগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই ছিলো অষ্টাদশ শতকে বৃটিশ লেখক আলেকজান্ডার পোপ সংক্রান্ত। যার অসংখ্য ধর্মীয় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ কবিতায় নাইট আর লন্ডনের উল্লেখ রয়েছে।

 

গেটাম স্ক্রিনের লেখার নিচে গাণিতিক সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালো। কতগুলো রেফারেন্স আছে সেটার হিসাব দেয়া আছে এখানে।

 

আনুমানিক হিট-এর মোট সংখ্যা : ২,৬৯২

 

আমাদেরকে আরো নির্দিষ্ট করে কিছু কু দিতে হবে, গেটাম বললো। সে সার্চ করা থামিয়ে দিলো। সমাধি সম্পর্কে এটাই কি আপনাদের কাছে একমাত্র তথ্য? আর কিছু নেই এই ব্যাপারে?

 

ল্যাংডন সোফির দিকে অনিশ্চয়তায় তাকালো।

 

এটা কোন সামান্য খোজাখুজির ব্যাপার নয়, গেটাম আঁচ করতে পারলো। সে গত বছর রোমে ল্যাংডনকে নিয়ে কানাঘুষাগুলো শুনেছিলো। এই আমেরিকানটাকে পৃথিবীর সবচাইতে সুরক্ষিত আর গোপন লাইব্রেরিতে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছিলো–ভ্যাটিকান সিক্রেট আর্কাইভ। আর সে এও জানে, ল্যাংডন কেন সেখানে গিয়েছিলো। আজকের, এই খোজাখুজির উদ্দেশ্যও গেটামের কাছে পরিষ্কার বলে মনে হচ্ছে। গেইল।

 

গেটাম মুচকি হেসে চশমাটা ঠিক করে নিলো। আপনারা লেই টিবিংয়ের বন্ধু, ইংল্যান্ডে এসেছেন, আর একজন নাইটকে খুঁজছেন। সে তার হাত দুটো ভাঁজ করে বুকের কাছে রাখলো। আমি অনুমান করতে পারি, আপনারা গ্রেইল-এর খোঁজে আছেন।

 

ল্যাংডন আর সোফি একে অন্যের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। গেটাম হেসে ফেললো। বন্ধুরা, এই লাইব্রেরিটা হলো গ্রেইল অন্বেষণকারীদের একটা ঘাটি। লেই টিবিং তাদের মধ্যেই একজন। আমি যদি প্রতিটি সার্চের জন্য এক শিলিং করে নিতাম তবে, রোজ রোজ ম্যারি মাগদালিন, স্যাংগৃল, মেরোভিনজিয়ান, প্রায়োরি অব সাইন ইত্যাদি সব খুঁজে খুঁজে অনেক পয়সা রোজগার করতে পারতাম। চশমাটা খুলে তাদের দিকে তাকালো সে। আমার দরকার আরো কিছু তথ্য।

 

এই যে, সোফি নেভু বললো। আমরা যা জানি, এটাই হলো সেই জিনিস। ল্যাংডনের কাছ থেকে একটা কলম নিয়ে সে কাগজটাতে আরো দুটো লাইন লিখে গেটামকে সেটা দিয়ে দিলো।

 

যে গোলক তুমি খোঁজো সেটা সমাধিতেই থাকার কথা।

এটা বিবৃত করে গোলাপী শরীর আর বীজপ্রসূ গর্ভের আখ্যান।

 

গেটাম একটা অদ্ভুত হাসি দিলো। গ্রেইলই বটে, সে ভাবলো, গোলাপ আর তার বীজ বপন করার গর্ভের রেফারেন্সের কথাটা নোট করলো সে। আমি আপনাদেরকে সাহায্য করতে পারবো। কাগজটার দিকে তাকিয়ে সে বললো। আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি, পংক্তিগুলো কোথেকে পেয়েছেন? আর কেনই বা একটা গোলক খুঁজছেন?

 

আপনি জিজ্ঞেস করতেই পারেন, একটা বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি দিয়ে ল্যাংডন বললো। কিন্তু সেটা খুবই লম্বা একটা গল্প, আর আমাদের হাতে সময়ও বেশি নেই।

 

কথাটা শুনে মনে হচ্ছে, ভদ্রভাষায় নিজের চরকায় তেল দিন কথাটার মতো।

 

আমরা আপনার কাছে চির ঋণী থাকবো, পামেলা, ল্যাংডন বললো, যদি আপনি খুঁজে বের করতে পারেন, কে সেই নাইট আর কোথায় তাকে কবর দেয়া হয়েছে।

 

খুব ভালো, গেটাম বললো, আবারো টাইপ করলো। যদি এটা গ্রেইল সংক্রান্ত ইসু হয়ে থাকে, আমাদেরকে তবে গেইল-এর কি-ওয়ার্ডগুলো দিয়ে রেফারেন্স দিতে হবে। আমি সার্চটার সুবিধার্থে সম্ভাব্য গ্রেইল সম্পর্কীয় কিছু শব্দ যোগ করে দিচ্ছি।

 

নাইট, লন্ডন, পোপ, সমাধি

এবং

গ্রেইল, রোজ, স্যাংগৃল, চ্যালিস

 

এতে কতোক্ষণ সময় লাগবে? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

পনেরো মিনিটের মতো। গেটাম হিসাব করে বললো।

 

ল্যাংডন আর সোফি কিছুই বললো না, কিন্তু গেটাম আঁচ করতে পারলো, কথাটা শুনে তাদের কাছে মনে হচ্ছে অনন্তকাল।

 

চা চলবে? টি-পটটার কাছে গিয়ে গেটাম জিজ্ঞেস করলো। লেই সবসময়ই আমার চা খুবই পছন্দ করেন।

 

 

 

৯৩.

 

লন্ডনের ওপাস দাইর সেন্টারটা খুবই আধুনিক একটি ভবন, ৫ ওম কোর্ট এলাকায় অবস্থিত সেটা। জায়গাটা কিংসটন গার্ডেনের উত্তর দিকে। সাইলাস এখানে কখনও আসেনি, কিন্তু ভবনটাতে ঢোকার সময় তার মনে হলো, সে একজন উদ্বাস্তু, আশ্রয়প্রার্থী। বৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও, রেমি তাকে একটু দূরে নামিয়ে দিয়েছে। হাটতে সাইলাসের কোন সমস্যা হয় না। বৃষ্টিটা ধুয়ে মুছে সাফ করার মতো মনে হচ্ছে।

 

রেমির অনুরোধে সাইলাস তার অস্ত্রটা একটা সুয়ারেজ ড্রেনে ফেলে দিয়েছে। এটা থেকে মুক্ত হতে পেরে তার ভালোই লাগছে। দীর্ঘক্ষণ হাত-পা বাঁধা থাকার জন্য তার পা-টা এখনও ব্যথা করছে। কিন্তু এর চেয়েও অনেক বেশি ব্যথা সাইলাস সহ্য করেছে। সে টিবিংয়ের কথা ভাবলো, তাকে রেমি হাত-পা বেঁধে লিমোজিনের পেছনের সিটে ফেলে রেখেছে। এখন হয়তো বৃটিশটা যন্ত্রণা অনুভব করতে শুরু করেছে। মনে হয়, ইতিমধ্যেই শেষ করে ফেলা হয়েছে।

 

।তুমি তাকে নিয়ে কি করবে? এখানে আসার সময় সাইলাস গাড়িতে রেমিকে জিজ্ঞেস করেছিলো।

 

রেমি কাঁধ ঝাকিয়েছিলো। এটা টিচারের সিদ্ধান্ত। তার কণ্ঠে খুবই অদ্ভুত একটা টান ছিলো।

 

সাইলাস ওপাস দাইর ভবনে ঢুকতেই বৃষ্টিটা আরো জোরে পড়তে শুরু করলে তার ভারি আলখেল্লাটা ভিজে গেলো। আগের দিনের ক্ষতে পানি লাগলো। বিগত চব্বিশ ঘণ্টার পাপ থেকে নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত সে। তার কাজ শেষ হয়ে গেছে।

 

সামনের দরজার দিকে এগোতেই সাইলাস দেখলো দরজাটায় কোন তালা মারা নেই, সে একটুও অবাক হলো না। ভেতরে ঢুকে ফয়ারে এসে হাজির হলো। একটা ইলেক্ট্রনিক চাইমের মৃদু শব্দ ওপর তলা থেকে শুনতে পেলো। এই বেলের আওয়াজটা একেবারেই পরিচিত। এখানকার বেশির ভাগ সদস্যই দিনের বেশিরভাগ সময় প্রার্থনায় ব্যস্ত থাকে। আর সেই সময়টাতেই এই বেলটা বেজে থাকে। কাঠের ফ্লোরে মানুষের হাটা চলার শব্দ শুনতে পেলো সাইলাস।

 

আলখেল্লা পরা এক লোক নিচে নেমে এলো। আমি আপনার জন্য কি করতে পারি? তার দয়ালু চোখ সাইলাসের অদ্ভুত অবয়বটা দেখেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

 

আপনাকে ধন্যবাদ। আমার নাম সাইলাস। আমি ওপাস দাইর একজন সদস্য।

 

আমেরিকান?

 

সাইলাস মাথা নাড়লো, আমি মাত্র একদিনের জন্য এ শহরে থাকবো। আমি এখানে বিশ্রাম নিতে পারি?

 

আপনার জিজ্ঞেস করারও দরকার নেই। চার তলায় দুটো খালি ঘর আছে। আমি কি আপনার জন্য কিছু চা-নাস্তার ব্যবস্থা করবো?

 

ধন্যবাদ আপনাকে। সাইলাস বললো।

 

সাইলাস ওপর তলার একটা ঘরে গিয়ে তার আলখেল্লাটা খুলে ফেললো। হাটু গেঁড়ে, অন্তর্বাস পরিহিত অবস্থায়ই সে প্রার্থনা করতে শুরু করলো। শুনতে পেলো তার নিমন্ত্রণকর্তা দরজার বাইরে একটা ট্রে রেখে গেলো। প্রার্থনা শেষ করে সাইলাস খাওয়া দাওয়া করে তারপর ঘুম দিলো।

 

 

 

তিন তলার নিচে একটা ফোন বাজলে, যে লোকটা সাইলাসকে স্বাগতম জানিয়েছিলো

 

সে-ই ফোনটা ধরলো।

 

লন্ডন পুলিশ বলছি, ফোনের ওপর পাশ থেকে বলা হলো। আমরা একজন ধবল পাদ্রীকে খুঁজছি। আমাদের কাছে খবর আছে, সে এখানেই এসেছে। আপনি কি তাকে দেখেছেন?

 

লোকটা অবাক হলো। হ্যাঁ, সে এখানেই আছে। কি হয়েছে?

 

সে এখন আপনার ওখানে?

 

হ্যাঁ, উপর তলায়, প্রার্থনা করছে। কি হয়েছে?

 

সে যেখানে আছে সেখানেই থাকুক, অফিসার বললো, কাউকে কিছু বলবেন। আমি এক্ষুণি কিছু অফিসার পাঠাচ্ছি।

 

 

 

৯৪.

 

সেন্ট জেম্স পার্ক হলো লন্ডনের মাঝখানে একটা সবুজের সমুদ্র। এটা এমন একটা পাবলিক পার্ক, যার চারদিকে রয়েছে ওয়েস্ট মিনিস্টার, বাকিংহাম আর সেন্ট জেম্স প্রাসাদ। এক সময় এটা অষ্টম হেনরির হরিণ শিকারের উদ্যান ছিলো। এখন এটা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে, লন্ডনবাসিরা এখানে এসে পিকনিক করে আর পুকুরের পেলিকানদেরকে খাবার খাওয়ায়। এইসব পেলিকানদের পূর্ব-পুরুষ, রাশিয়ান এ্যাম্বাসেডর চার্লস দ্বিতীয়ের দেয়া উপহার ছিলো।

 

আজ টিচার কোন পেলিকানই দেখতে পেলেন না। ঝড়বৃষ্টির এই আবহাওয়ায় তার বদলে বরং সাগর থেকে আসা গাংচিল দেখা যাচ্ছে। সবুজ চত্বরটা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তারা শত শত সাদা শরীর একই দিকে মুখ করে আছে। সকালের কুয়াশা থাকা সত্ত্বেও, পার্ক থেকে পার্লামেন্ট হাউজ আর বিগবেন ঘড়িটার চমৎকার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ভবনটার মিনার স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে টিচার, ওখানেই নাইটের সমাধিটা আছে—এখানে রেমিকে আসতে বলার পেছনে আসল কারণ এটাই।

 

পার্কে পার্ক করা লিমোজিনটার সামনের দরজায় টিচার পৌঁছাতেই রেমি দরজাটা খুলে বের হয়ে এলো। টিচার একটু দাঁড়ালেন। তাঁর সাথে বহন করা একটা ফ্লাস্ক থেকে একটু কগনাক মদ পান করলেন।

 

রেমি কি-স্টোনটা এমনভাবে তুলে ধরলো, যেনো সেটা একটা ট্রফি। এটা প্রায় হারাতে বসেছিলাম।

 

তুমি খুব চমৎকার কাজ করেছে, টিচার বললেন।

 

আমরা খুব চমৎকার কাজ করেছি, টিচারের হাতে কি-স্টোনটা তুলে দিয়ে রেমি জবাব দিলো।

 

দীর্ঘ সময় ধরে টিচার সেটার দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। একটু হাসলেন। আর অস্ত্রটা? তুমি ওটা ফেলে দিয়েছো?

 

যেখান থেকে পেয়েছিলাম, সেই গ্লোভ বক্সেই রেখে এসেছি।

 

চমৎকার। টিচার আরেকটু মদ পান করে ফ্লাস্কটা রেমির কাছে দিয়ে দিলো। আমাদের বিজয়কে উদযাপন করো। খুব সামনেই রয়েছে সমাপ্তি।

 

রেমি বোতলটা কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ করলো। কগনাকটার স্বাদ তার কাছে লবনাক্ত লাগলো, কিন্তু রেমি সেটা গ্রাহ্য করলো না। সে আর টিচার এখন সত্যিকারের অংশীদার। সে অনুভব করতে পারলো, এখন জীবনের অনেক উঁচুতে উঠে যাচ্ছে সে। আমি আর কখনই চাকর হবে না। রেমি পুকুরের তীরের দিকে তাকাতেই তার মনে হলো, শ্যাতু ভিলেটা যেনো হাজার মাইল দূরে।

 

আরেকটু কনাক পান করতেই রেমি টের পেলো তার রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই রেমির একটু অস্বস্তিভাব শুরু হলো। বো-টাইটা আলগা করে ফ্লাস্কটা টিচারের কাছে ফিরিয়ে দিলো। হয়তো, আমি খুব বেশিই খেয়ে ফেলেছি, তার একটু দুর্বল দুর্বল লাগলো।

 

ফ্লাস্কটা নিয়ে টিচার বললেন, রেমি, তুমি হয়তো জানো, তুমিই হলে একমাত্র ব্যক্তি, যে আমার চেহারাটা চেনে। আমি তোমার উপর অনেক আস্থা রেখেছি।

 

হ্যাঁ, টাইটা আরেকটু আলগা করতে করতে সে বললো, তার খুব বেশি অস্বস্তি হতে লাগলো। আর আপনার পরিচয় আমার মৃত্যুর পর কবর পর্যন্ত যাবে।

 

টিচার অনেকক্ষণ নিরব রইলো। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, কি-স্টোন আর ফ্লাস্কটা পকেটে ভরে টিচার গ্লোভ বক্সটার কাছে গিয়ে ছোট্ট মেডুসা পিস্তলটা বের করে নিলেন। মুহূর্তেই, রেমির মনে একটা ভীতির উদ্রেক হলো। কিন্তু টিচার সেটা সোজা তার পকেটে ভরে ফেললেন।

 

সে করছেটা কি? রেমি মনে মনে ভাবলো, আচমকা সে ঘেমে উঠলো।

 

আমি জানি, আমি তোমার কাছে প্রতীজ্ঞা করেছিলাম, তোমাকে মুক্তি দেবো, টিচার বললেন। তার কণ্ঠটা এখন অনুশোচনার মতো শোনালো। কিন্তু, তোমার সব কিছু বিবেচনা করে, আমি এটাই করতে পারি।

 

রেমির গলাটা এমনভাবে কাঁপতে লাগলো যেনো ভূমিকম্প হচ্ছে। সে টালমাটাল হয়ে পড়ে যেতে লাগলো। গলাটা দুহাতে চেপে ধরলো সে। তার বমি বমি লাগছে। একটা চিৎকার দিলো, কিন্তু সেটা খুব চাপা গলায়, তাই আওয়াজটা গাড়ি থেকে একটু দূরেও শোনা গেলো না।

 

আমি খুন হচ্ছি।

 

অবিশ্বাসে রেমি টিচারের দিকে তাকিয়ে দেখে তিনি খুব ধীর-স্থিরভাবে বসে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। রেমির চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো, শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো। আমি তার জন্যে সম্ভব সব কিছুই করার চেষ্টা করেছি। এটা সে কীভাবে করতে পারলো! হয় টিচার রেমিকে হত্যা করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কোন সাক্ষী না রাখার জন্য, না হয়, রেমি টেম্পল চার্চের ভেতর যা করেছে, তাতে সে টিচারের আস্থা হারিয়েছে, কারণ যাই হোক, রেমি সেটা আর কখনও জানতে পারবে না। ভীতি আর রাগ তার ভেতরে ঝড় তুললো। রেমি টিচারকে ধরার চেষ্টা করলো, কিন্তু তার অসাড় শরীর খুব একটা নড়লো না। আমি আপনাকে সবকিছু দিয়েই বিশ্বাস করেছিলাম।

 

রেমি তার হাতটা তুললো হর্ন বাজাবার জন্য, কিন্তু পারলো না, বরং দুহাতে গলাটা চেপে ধরে এক পাশে কাত হয়ে পড়ে গেলো। বৃষ্টিটা এখন খুব জোরে নামতে শুরু করেছে। রেমির দৃষ্টি অন্ধকার হয়ে গেলো। টের পেলো, পুরোপুরি চেতনা লোপ পেতে শুরু করেছে তার।

 

 

 

টিচার লিমোজিন থেকে বের হয়ে চারপাশটা চেয়ে দেখে খুব খুশি হলেন, কেউ তাঁর দিকে তাকিয়ে নেই। এছাড়া আমার কিছু করার ছিলো না, তিনি মনে মনে বললেন। অবাক হলেন, এইমাত্র যে কাজটি তিনি করলেন, সেটার ব্যাপারে তাঁর মধ্যে কোন দুঃখবোধ হচ্ছে না। রেমি তার নিজের ভাগ্য নিজেই ঠিক করে দিয়েছে। টিচার মোটামুটি ধরেই নিয়েছিলেন যে, রেমিকে শেষ করে দেয়া হবে, কিন্তু টেম্পলার চার্চে নিজেকে প্রকাশ করাতে ব্যাপারটা আরো দ্রুত সামনে এগিয়ে এসেছিলো। রবার্ট ল্যাংডনের আচমকা শ্যাতু ভিলে চলে আসাটা টিচারের জন্য একই সাথে সুবিধা এবং অসুবিধা দুটোই বয়ে এনেছিলো। ল্যাংডন কি-স্টোনটা সরাসরি অপারেশনের মূল প্রাণ টিবিংয়ের হাতে তুলে দেয়াটা ছিলো অবাক করা একটি ব্যাপার। তবে তার পেছনে পুলিশ চলে আসাতে এই অবাক আনন্দের ব্যাপারটা আর আনন্দঘন রইলো না। শ্যাতু ভিলের সব জায়গায় রেমির আঙুলের ছাপ রয়েছে। গোলা-ঘরের শোনার ঘাটিটাতেও। সেখানে রেমি নজরদারি করতো। তবে টিচার রেমির সাথে খুব দূরত্ব বজায় রাখাতে, সবার কাছে তিনি আড়ালেই থেকে গেছেন। শুধুমাত্র রেমিই বলতে পারতো তার ভূমিকার ব্যাপারটা। আর এখন, তাকে নিয়েও চিন্তার কিছু নেই।

 

আরেকটা ভুল শোধরানো গেলো, টিচার ভাবতে ভাবতে ড্রাইভিং সিটের কাছে চলে এলেন। পুলিশ বুঝতেই পারবে না কী ঘটেছে…আর তাদেরকে বলার জন্য কোন সাক্ষীও নেই। চারপাশটা তাকিয়ে দেখলেন কেউ দেখছে কিনা, তারপর ড্রাইভিং সিটে বসে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।

 

 

 

মিনিটখানেক বাদে, টিচার সেন্ট জেম্স পার্কটা অতিক্রম করলেন। এখন শুধু দুজন লোক বাকি আছে, ল্যাংডন আর সোফি।

 

তারা আরো বেশি জটিল। কিন্তু ম্যানেজ করা যাবে। এই মুহূর্তে, ক্রিপ্টেক্সটা টিচারের কাছে আছে।

 

বাইরে বিজয়ীর মতো তাকিয়ে, তিনি দেখতে পেলেন তার গন্তব্যস্থলটি। পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট লন্ডনে আছেন শায়িত। টিচার কবিতাটা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গিয়েছিলেন উত্তরটা কি হতে পারে। তারপরও, অন্যেরা যে এটা বের করতে পারেনি, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। আমারতো একটা বাড়তি, অনৈতিক সুবিধা রয়েছে। মাসের পর মাস ধরে সনিয়ের কথপোকথন শোনার সময় একবার নিয়ে এই নাইটের কথাটা উল্লেখ করেছিলেন। কবিতাটার উল্লেখিত নাইটটা কেউ একবার দেখতে পেলেই চিনতে পারবে—তার পরও, এই সমাধিটা কীভাবে চূড়ান্ত পাস ওয়ার্ডটা উন্মোচিত করবে, সেটা এখনও একটা রহস্যই রয়ে গেছে।

 

যে গোলক তুমি খোঁজো সেটা সমাধিতেই থাকার কথা।

 

টিচার খুব সহজেই বিখ্যাত সমাধির ফটোটার কথা মনে করতে পারলো, বিশেষ করে ওটার সবচাইতে আকর্ষণীয় অংশটা, একটা চমক্কার গোলক। পাহাড়ের চূড়ার উপরে, বিশাল একটা সমাধি।

 

গোলকটার উপস্থিতি টিচারের কাছে আগ্রহী আর হতাশ দুটোই করেছিলো। একদিকে, এটা দেখে মনে হয়, একটা সাইন পোস্ট, তারপরও, কবিতাটার মতে, পাজলের হারানো অংশ হলো একটা গোলক, যা তাঁর সমাধিতে থাকার কথা ছিলো… কেবল তাই না, সেটা ইতিমধ্যেই ওখানে রয়েছে। তিনি ভালো করে সমাধিটা লক্ষ্য করে দেখলেন, উত্তরটা পাওয়া যায় কিনা।

 

বৃষ্টিটা এখন খুব জোরে পড়তে লাগলো। তিনি ক্রিপ্টেক্সটা এই সাত-সঁতে আবহাওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে ডান দিকের পকেটে রেখে দিলেন। ছোট্ট মেডুসাটা রাখলেন বাম দিকে, যাতে সেটা কেউ না দেখে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই, তিনি লন্ডনের সবচাইতে পুরননা, নয় শত বছরের প্রাচীন ধর্মশালাতে নিরবে প্রবেশ করলেন।

 

 

 

টিচার বৃষ্টি থেকে ভেতরে ঢুকতেই, বিগিন-হিল এক্সিকিউটিভ এয়ারপোর্টের বৃষ্টি ভেজা রানওয়েতে আরিজারোসা তার প্লেন থেকে বাইরের বৃষ্টির মধ্যেই বের হলেন।

 

তিনি আশা করেছিলেন, ক্যাপ্টেন বেজু ফশে তাকে অভ্যর্থনা জানাবে। তার বদলে এক তরুণ বৃটিশ পুলিশ ছাতা হাতে এগিয়ে আসলো।

 

বিশপ আরিঙ্গাবোসা? ক্যাপ্টেন ফশেকে চলে যেতে হয়েছে। তিনি আমাকে বলে গেছেন আপনার দেখাশোনা করতে। তিনি বলেছেন, আমি যেনো আপনাকে স্কটল্যান্ড-ইয়ার্ডে নিয়ে যাই। তিনি মনে করেন, এটাই হবে সবচাইতে নিরাপদ জায়গা।

 

নিরাপদ? আরিঙ্গাবোসা তার হাতে ধরা ভারি বৃফকেসটার দিকে তাকালেন, যার ভেতরে রয়েছে ভ্যাটিকান বন্ডগুলো। তিনি এটার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। য়া, ধন্যবাদ আপনাকে।

 

আরিঙ্গাবোসা পুলিশের গাড়িতে উঠে বসলেন। ভাবলেন, সাইলাস কোথায় আছে। মিনিটখানেক বাদে, পুলিশের স্ক্যানারটা খটখট করে শব্দ করলো।

 

৫ ওর্‌ম কোর্ট।

 

আরিঙ্গাবোসা ঠিকানাটা চিনতে পারলেন মুহূর্তেই। ওপাস দাইর লন্ডনের কেন্দ্র।

 

তিনি ড্রাইভারকে বললেন, এক্ষুণি আমাকে এখানে নিয়ে যান!

 

 

 

৯৫.

 

সাচটা শুরু হবার পর থেকেই ল্যাংডনের চোখ কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে সরেনি।

 

পাঁচ মিনিটে। মাত্র দুটো হিট। দুটোই অপ্রাসঙ্গিক।

 

সে উদ্বিগ্ন হতে শুরু করলো।

 

পামেলা গেটাম পাশের ঘরেই আছে। গরম পানীয় তৈরি করছে সে। ল্যাংডন আর সোফি উঁকি মেরে দেখলো চায়ের সাথে কফি পাওয়া যায় কিনা, কিন্তু মাইক্রোওয়েভের শব্দ শুনে মনে হচ্ছে, তাদের অনুরোধে হয়তো, বড়জোর ইন্সট্যান্ট নেস ক্যাফে দেয়া হবে।

 

অবশেষে কম্পিউটারটা ঠিক জায়গায় আঘাত করতে পারলো।

 

মনে হচ্ছে, আরেকটা পেলেন, পাশের ঘর থেকে গেটাম বললো, শিরোনামটা কি?

 

ল্যাংডন স্ক্রিনে ভালো করে তাকালো।

 

মধ্যযুগের সাহিত্যে গ্রেইলের রূপক বর্ণনা :

স্যার গোয়াইন এবং সবুজ নাইটদের একটি দলিল।

 

সবুজ নাইটদের রূপক বর্ণনা, সে জবাব দিলো।

 

খবর ভালো না, গেটাম বললো। মিথলজির সবুজ দৈত্যদের খুব বেশি সংখ্যকের কবর লন্ডনে নেই।

 

ল্যাংডন আর সোফি ধৈর্য ধরে ক্রিনের দিকে চেয়ে রইলো। অপেক্ষা করলো আরো দুটো সন্দেহজনক ফলাফলের জন্য। কম্পিউটারটা আবারো একটা তথ্য হাজির করলো, যদিও সেটা ছিলো অগ্রহণযোগ্য।

 

ফন রিচার্ড ওয়াগনার-এর মৃত্যু

 

ওয়াগনারের অপেরা? সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

গেটাম দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো, তার হাতে কয়েক প্যাকেট ইন্সট্যান্ট কফি, এটাতো মনে হচ্ছে, আজব ম্যাচিং। ওয়াগনার কি নাইট ছিলেন?

 

না, ল্যাংডন বললো, হঠাৎ করেই একটু কৌতূহলী হয়ে উঠলো। কিন্তু তিনি ছিলেন ভ্রাতৃসংঘের খুবই বিখ্যাত একজন সদস্য। মোজার্ট, বেথোফেন, শেক্সপিয়ার, গরশ্যিন হুন্দি আর ডিজনির মতোই।

 

ভলিউমটাতে উল্লেখ করা আছে, ভ্রাতসংঘের সাথে নাইট টেম্পলার, প্রয়োরি অব সাইওন আর হলি গ্রেইলের সম্পর্কের কথা। আমি এটা একটু দেখতে চাই। পুরো লেখাটা আমি কিভাবে দেখতে পারবো?

 

আপনি পুরো লেখাটা চাইবেন না, গেটাম বললো। হাইপার টেক্সট-এ ক্লিক করুন। কম্পিউটার আপনার কি-ওয়ার্ডটা দেখাবে।

 

মেয়েটা কী বললো ল্যাংডন তার কিছুই বুঝতে পারলো না। আরেকটা নতুন উইন্ডো আবির্ভূত হলো।

 

… মিথলজিক্যাল নাইট, নাম পারসিফল যে…

… রূপক শোভিত গ্রেইল অন্বেষণ যা তর্কসাপেক্ষ…

… লন্ডন ফিলারমনিক…১৮৫৬ সালে…

রেবেকা পোপের অপেরা এথলজি

দেবীর…

…ওয়াগনারের সমাধি জার্মানির বায়রুথে…

 

ভুল পোপ, হতাশ হয়ে ল্যাংডন বললো। তার পরেও সে সিস্টেমটার সহজ সাধ্য ব্যবহার দেখে বিস্মিত হলো। লেখার বিষয় বস্তুর কি-ওয়ার্ডটা দেখেই ল্যাংডনের মনে পড়ে গেলো ওয়াগনারের পার্সিফল অপেরার কথা, যা ম্যারি মাগদালিন আর যিশু খৃস্টের বংশধরদের উৎসর্গ করে রচিত হয়েছিলো। এতে একজন নাইটের কাহিনী বিবৃত হয়েছে যে, সত্যান্বেষণে বেড়িয়েছে।

 

।একটু ধৈর্য ধরুন, গেটাম তাদেরকে প্রশমিত করলো। এটা হলো সংখ্যার খেলা। যন্ত্রটাকে চলতে দিন।

 

পরের পাঁচ মিনিট ধরে কম্পিউটার অনেকগুলো গ্রেইল রেফারেন্স হাজির করলো। তার মধ্যে একটা টেক্সট ছিলো বাদর সম্পর্কিত ফ্রান্সের বিখ্যাত ভবঘুরে রাষ্ট্রদূত বা মন্ত্রী। বাদুর ছিলেন ম্যারি মাগদালিন চার্চের ভ্রাম্যমান সেবক অথবা মন্ত্রী। সঙ্গীতের মাধ্যমে জন সাধারণের কাছে পবিত্র নারীর গল্পটা প্রচার করতো সে। তারা একটা গান গাইত আওয়ার লেডি নামেপোপ কর্তৃক সমাহিত একজন মাইট, লন্ডনে আছেন শায়িত।

 

তাতে একজন রহস্যময়ী সুন্দরী নারীর কাছে তারা সারাজীবনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবার কথা বলতো।

 

উদগ্রীব হয়ে সে হাইপার টেক্সট-এ চেক করে দেখেলো, কিন্তু কিছুই পেলো না। কম্পিউটারটা আবারো কিছু বিষয়-বস্তু হাজির করলো।

 

নাইট, তাসের গোলাম, পোপ, এবং পেনটাকল :

টারোট-এর মধ্য দিয়ে হলি গ্রেইলের ইতিহাস

 

অবাক করার মতো কিছু না, সোফিকে ল্যাংডন বললো। আমাদের কিছু কি ওয়ার্ড এর সাথে কিছু কার্ডের নামের মিল রয়েছে। সে মাউসটা নিয়ে হাইপার লিংকে ক্লিক্ করলো।

 

আমি নিশ্চিত নই, আপনার দাদু আপনার সাথে টারোট খেলার সময় এটা উল্লেখ করেছিলেন কি না। এই খেলাটা হলো ফ্লাশ কার্ড ক্যাটাসিজম, চার্চের শয়তানীর জন্য বিচ্ছেদ হওয়া হারানো কনে আর তার বরের কাহিনীর।

 

সোফি তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকালো। আমার কোন ধারণাই ছিলো না।

 

এটাই হলো কথা। রূপকধর্মী খেলার মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে গ্রেইলের অনুসারীরা কড়া নজরদারী থাকা সত্ত্বেও চার্চকে ধোঁকা দিতেন। ল্যাংডন প্রায়ই অবাক হয়ে ভাবে, আজকের আধুনিক যুগে কতজন কার্ড খেলোয়াড় জানে, তাদের চারটা কার্ড স্পেড, হার্ট, ক্লাব, ডায়মন্ড-আসলে গ্রেইল সংশ্লিষ্ট প্রতীক থেকে আসা টারোট-এর চারটা কার্ড সোর্ড, কাপ, সেন্টার এবং পেনটাকল থেকে সরাসরি নেয়া।

 

স্পেড হলো সোড় তলোয়ার। পুরুষ।

হার্ট হলো কাপ-পেয়ালা। নারী।

ক্লাব হলো সেপ্টার রাজবংশ। ফুলজাতীয় কিছু।

ডায়মন্ড হলো পেনটাকল—দেবী। পবিত্র নারী।

 

***

 

চার মিনিট পরে, ল্যাংডন যখন আশংকা করতে শুরু করেছে, তারা যা খুঁজতে চাইছে, সেটা হয়তো পাবে না, ঠিক সেই সময়েই কম্পিউটার আরেকটা নতুন তথ্য উপস্থাপন করলো।

 

একজন জিনিয়াসের গুরুত্ব :

একজন আধুনিক নাইটের জীবনী

 

জিনিয়াসের গুরুত্ব? ল্যাংডন গেটামকে বললেন। একজন আধুনিক নাইটের জীবনী?

 

গেটাম একটা কর্ণার থেকে উঁকি দিলো। কত আধুনিক? দয়া করে বলবেন না যে, এটা আপনাদের স্যার রুডি জুলিয়ানি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এটা দেয়া ঠিক হয়নি।

 

ল্যাংডনের নিজেরও আরেক জন নতুন নাইট উপাধি পাওয়া স্যার মিক জ্যাগারের ব্যাপারে আপত্তি রয়েছে, কিন্তু এখন, বৃটিশ নাইটহুডের রাজনীতি নিয়ে তর্কবিতর্ক করার সময় নয়। একটু দেখুন তো। ল্যাংডন হাইপার টেক্সট-এর কি-ওয়ার্ডগুলো পর্দায় হাজির করলো।

 

…অনারেবল নাইট, স্যার আইজ্যাক নিউটন…

…লন্ডন শহরে, ১৭২৭ সালে এবং…

…তার সমাধি ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবিতে…

…আলেকজান্ডার পোপ, বন্ধু এবং সহকর্মী…

 

মনে হচ্ছে আধুনিক শব্দটা আপেক্ষিক, গেটামকে বললো সোফি। এটা একটা পুরনো বই। স্যার আইজ্যাক নিউটনের ওপরে।

 

গেটাম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকালো। ভালো না। নিউটন ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবেতে সমাহিত আছেন, সেটা ইংলিশ প্রটেস্টান্টদের জন্য। সেখানে একজন ক্যাথলিক পোপের উপস্থিত থাকাটা একেবারে অসম্ভব। মাখন আর চিনি?

 

সোফি মাথা নাড়লো।

 

গেটাম অপেক্ষা করলো। রবার্ট?

 

ল্যাংডনের হৃদপিণ্ডটাতে হাতুরি পেটা শুরু হয়ে গেলো। সে পর্দা থেকে চোখটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। স্যার আইজ্যাক নিউটন হলেন আমাদের নাইট।

 

সোফি বসেই রইলো। আপনি বলছেন কি?

 

নিউটনকে লন্ডনে সমাহিত করা হয়েছিলো, ল্যাংডন বললো। তার আবিষ্কার আর নতুন বিজ্ঞান চার্চের রাগের কারণ হয়েছিলো। তিনি প্রায়োরিদের গ্র্যান্ড মাস্টারও ছিলেন। আমরা এর চেয়ে বেশি আর কী চাইতে পারি?

 

আর কি, মানে? সোফি কবিতাটার দিকে ইঙ্গিত করলো।

 

একজন পোপ কর্তৃক সমাহিত নাইট, সেটার কি হবে? আপনি মিসেস গেটামের কাছ থেকে তো শুনেছেনই, নিউটন কোন ক্যাথলিক পোপ কর্তৃক সমাহিত হননি।

 

ল্যাংডন মাউসটা হাতে নিলো। ক্যাথলিক পোপের কথা কে বলছে? সে পোপ হাইপার লিংকে ক্লিক করলে কম্পিউটারের পর্দায় কিছু লেখা ভেসে এলো।

 

স্যার আইজ্যাক নিউটনের শেষকৃত্যে রাজা এবং অভিজাতরা উপস্থিত ছিলেন, সভাপতিত্ব করেন আলেকজান্ডার পোপ, বন্ধু এবং সহকর্মী, যিনি সমাধি দেবার পর পর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে একটি প্রশংসাসূচক বিবৃতি পড়ে শুনিয়ে ছিলেন।

 

ল্যাংডন সোফির দিকে তাকালো। আমাদের দ্বিতীয় হিটেই সঠিক পোপকে পেয়ে গেছি। আলেকজান্ডার। সে একটু থামলো। একজন পোপ।

 

পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট, লন্ডনে আছেন শায়িত।

 

সোফি উঠে দাঁড়ালো। তার অবস্থা হতবুদ্ধিকর।

 

জ্যাক সনিয়ে, দ্ব্যর্থবোধকতার একজন মাস্টার, আবারো প্রমাণ করলেন, তিনি ভংয়কর রকমেরই একজন চতুর ব্যক্তি।

 

 

 

৯৬.

 

সাইলাস চম্‌কে ঘুম থেকে উঠে গেলো।

 

তার কোন ধারণাই নেই কতক্ষণ ধরে ঘুমিয়ে আছে অথবা কিসের জন্য তার ঘুম ভাঙলো। আমি কি স্বপ্ন দেখছিলাম? খড়ের তৈরি ম্যাটের ওপরে উঠে বসলো। শুনতে পেলো ওপাস দাইর আবাসিক এলাকার শান্ত-নিথর শব্দ। নিচের তলায় কারোর নিচু স্বরে প্রার্থনা করার বিড়বিড় একটা শব্দ। এই সব শব্দ তার কাছে অতি পরিচিত, আর এতে সে খুব স্বস্তি বোধ করে থাকে।

 

তারপরও, আচমকাই, অপ্রত্যাশিতভাবে একটু বিচলিত বোধ করলো সে।

 

শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরেই সে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গেলো। আমাকে কি অনুসরণ করা হচ্ছে? নিচের প্রাঙ্গণটা একেবারেই ফাঁকা, ঢোকার সময় সে যেমনটি দেখেছিলো। কান পেতে শুনলো। সুনশান। তবে আমার এরকম অস্বস্তি লাগছে কেন? অনেক আগেই, সাইলাস বুঝতে শিখেছিলো, নিজের ইনটুইশন, মানে সজ্ঞার ওপর আস্থা রাখা যায়। অনেক অনেক আগে, এই ইনটুইশনই তাকে ছোটবেলায়, মার্সেইর রাস্তায় বাঁচিয়ে রেখেছিলো। জানালা দিয়ে এবার নিচে তাকিয়ে দেখলো নিচের প্রাঙ্গণের এক কোণে একটা গাড়ির ছায়া দেখা যাচ্ছে। গাড়িটার ছাদে পুলিশের সাইরেন লাগানো। সিঁড়িতে কারো ওঠার শব্দ পাওয়া গেলো। একটা দরজায় তালা খোলার শব্দ হলো।

 

তক্ষুণি সাইলাস দৌড়ে গিয়ে ঘরের দরজার পেছনে লুকিয়ে পড়তেই সেটা ধপাস করে খুলে গেলো। প্রথম পুলিশ অফিসারটি ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকে পড়লো। প্রথমে বাম দিকে তারপর ডান দিকে পিস্তলটা তা করলো সে। ঘরটা খালি দেখতে পেলো। সাইলাস কোথায় আছে সেটা প্রথম অফিসার বোঝার আগেই দ্বিতীয় অফিসার ঘরে ঢুকে পড়লো। দরজার পেছন থেকে সাইলাস আচম্‌কা দ্বিতীয় জনের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো। প্রথম অফিসারটি ঘুরে গুলি করতে উদ্যত হতেই সাইলাস সজোড়ে তাকে লাথি মারলো। অস্ত্রটা ছিটকে পড়ে যাওয়ার আগে একটা বুলেট সাইলাসের কানের পাশ দিয়ে চলে গেলো। সজোরে সেই অফিসারের দুপায়ের মাঝখানে লাথি মারার সাথে সাথে লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তার মাথাটা প্রচণ্ড জোড়ে মাটিতে আছাড় খেলো। দ্বিতীয় অফিসারের হাটুতে লাথি মেরে তাকেও মাটিতে ফেলে দিলো সাইলাস, সঙ্গে সঙ্গে তার ওপরে ঝাপিয়ে পড়লো সে।

 

প্রায় নগ্ন হয়েই সাইলাস সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। সে জানতো, তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে, কিন্তু সেটা কে করেছে? সে যখন ফয়ারে আসলো, সামনের দরজা দিয়ে বেশ কয়েকজন অফিসার হুড়মুর করে ঢুকে পড়লো। সাইলাস সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে, ভবনটার আরো ভেতরে ঢুকে পড়লো। নারীদের প্রবেশ পথ। প্রতিটা ওপাস দাই বিল্ডিংয়েই এটা আছে। খুবই সরু একটা পথ দিয়ে ছুটে সাইলাস রান্নাঘরে চলে গেলো। কর্মরত নারী শ্রমিকরা নগ্ন সাইলাসকে দেখে ভয় পেয়ে সরে গেলো। সাইলাস তাদের পেরিয়ে বয়লার রুমে ঢুকে পড়লো। যে দরজাটা সে খুঁজছিলো, এবার সেটা পেয়ে গেলো।

 

প্রচণ্ড গতিতে দৌড়ে বাইরের বৃষ্টিতে এসে পড়লো সে। সামনের দিকে দেখতে পেলো একজন অফিসার তার দিকে তেড়ে আসছে। দুজন লোকের মধ্যে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা লাগলো। সাইলাস প্রশস্ত কাঁধ আর নগ্নদেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে লোকটার বুকে আঘাত করলো। লোকটা মাটিতে আছড়ে পড়লো। সে শুনতে পেলো, পেছনে থাকা অফিসারদের চিৎকার চেঁচামেচি। যে অফিসারটা পড়ে আছে, তার হাত থেকে ছিটকে পড়া পিস্তলটা তুলে নিলো সাইলাস। সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালালো পেছনে থাকা তিন জন অফিসারের দিকে। তাদের রক্ত ছিটকে পড়লো।

 

পেছন থেকে একটা কালো ছায়া যেনো হুট করে উদয় হলো। লোকটার একটা হাত সাইলাসের কাঁধ শক্ত করে ধরলো। যেনো হাত দুটো শয়তানের শক্তি রাখে। লোকটা তার কানে চিৎকার করে বললো। সাইলাস, না!

 

সাইলাস ঘুরেই সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালালো। দুজনের চোখাচুখি হলো। বিশপ আরিঙ্গাবোসা মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই সাইলাস তীব্র আতংকে চিৎকার দিলো।

 

 

 

৯৭.

 

তিন হাজারেরও বেশি লোকের সমাধি রয়েছে ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবিতে। সমাধিগুলোতে সম্রাট, রাষ্ট্রনায়ক, বিজ্ঞানী, কবি আর সঙ্গীতজ্ঞদের দেহাবশেষ রয়েছে। সুন্দর করে সাজানো পাথরের সমাধিগুলোর মধ্যে সবচাইতে অভিজাত আর চিত্তাকর্ষক হলো রাণী এলিজাবেথেরটা। এটার ভেতরে একটা চ্যাপেলও রয়েছে। রাণীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি হয়েছিলো সেটা।

 

এটার নক্সা করা হয়েছিলো আমিয়েন, শারলে, এবং ক্যান্টারবেরির মহান ক্যাথেড্রালের স্টাইল অনুসারে। ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবিকে না ক্যাথেড্রাল না প্যারিশ চার্চ, কোনটাই বিবেচনা করা হয় না। উইলিয়াম দ্য কনকরার-এর অভিষেক অনুষ্ঠানটা ১০৬৬ সালে ক্রিসমাসের সময় এখানেই অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। তারপর থেকে এই জায়গাটা বিরামহীন রাজকীয় আর রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের সাক্ষী হয়ে আছে—এডওয়ার্ড দ্য কনফেসর-এর অভিষেক থেকে প্রিন্স এডুজ আর সারাহ ফারগুসনের বিয়ে, পঞ্চম হেনরি, রাণী প্রথম এলিজাবেথ এবং লেডি ডায়নার শেষকৃত্য পর্যন্ত।

 

তারপরও, রবার্ট ল্যাংডন এখন এ্যাবির অন্য কোন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আগ্রহ দেখালো না, শুধুমাত্র একটা বাদে বৃটিশ নাইট, বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান।

 

পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট, লন্ডনে আছেন শায়িত।

 

ল্যাংডন আর সোফি দ্রুতই সেই জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। তারা এ্যাবির নতুন স্থাপনাটির সামনে এসে থামলো—একটা বিশাল মেটাল ডিকটেটর গেট বর্তমানে লন্ডনের বেশিরভাগ ঐতিহাসিক ভবনেই এটা দেখা যায়। একজন রক্ষী তাদেরকে সেখানে অভ্যর্থনা জানালো। তারা নির্বিঘ্নেই গেটটা পার হলো, কোন এলার্ম বাজলো না।

 

ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবির মূল জায়গাটাতে ঢুকেই ল্যাংডনের মনে হলো বাইরের পৃথিবীটা হুট করেই যেনো বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে। কোন ভীড়-বাট্টা নেই এখানে। বৃষ্টি বাদলাও নেই। শুধুমাত্র নিথর এক নিরবতা। যাতে মনে হচ্ছে, ভবনটা নিজেই যেনো ফিস্ ফিস্ করছে। .

 

ল্যাংডন আর সোফির চোখ প্রায় সব আগত দর্শনার্থীর মতোই, সঙ্গে সঙ্গেই আকাশের দিকে গেলো। যেখানে এ্যাবির বিশাল অতল গহ্বরটা মাথার ওপরে জুড়ে আছে। ধূসর পাথরের কলামগুলো যেনো ছায়ার মধ্যে গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে, একটা প্রশস্ত পথ উত্তর দিকে চলে গেছে। যেনো অনেকটা গভীর গিরিখাদের মতো। দুপাশটা স্টেইড গ্লাস দিয়ে সাজানো। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে, এ্যাবির জমিনটা প্রিজমের মতো আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়। আজকে, এই বৃষ্টির দিনে, স্বল্প আলোতে সেটা হচ্ছে না।

 

এটাতো প্রায় ফাঁকাই আছে, সোফি নিচু স্বরে বললো।

 

ব্যাপারটা ল্যাংডনের কাছে হতাশাজনক বলে মনে হলো। সে আশা করেছিলো অনেক অনেক লোক থাকবে। এটাতো খুবই সুপরিচিত পাবলিক প্লেস। এর আগে ফাঁকা টেম্পল চার্চের ভেতরকার ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি চাচ্ছিলো না সে। জন-সমাগম আছে এমন জনপ্রিয় জায়গায় ল্যাংডন নিরাপত্তা বোধ করে। আজ এপ্রিলের বৃষ্টির এক সকাল। তাই পর্যটকদের মওসুম হওয়া সত্ত্বেও জায়গাটা ফাঁকা।

 

আমরা মেটাল ডিটেটর দিয়ে ঢুকতে পেরেছি, সোফি মনে করিয়ে দিলো, ল্যাংডন কথাটা বুঝতে পারলো বলে মনে হলো। যদি এখানে কেউ ঢোকে, তো অস্ত্র নিয়ে ঢুকতে পারবে না।

 

ল্যাংডন মাথা নেড়ে সায় দিলো, তারপরও, সে একটু অস্বস্তি বোধ করছে। সে চেয়েছিলো সঙ্গে করে লন্ডন পুলিশকে নিয়ে আসতে। কিন্তু সোফি তাতে রাজি হয়নি। আমাদেরকে ক্রিপ্টেটা উদ্ধার করতে হবে, সোফি চাপাচাপি করেছিলো। এটাই হলো সব কিছুর মূল চাবিকাঠি।

 

অবশ্য, সে ঠিকই বলেছে।

 

লেইকে জীবিত ফিরে পাওয়ার চাবিকাঠি। হলি গ্রেইকে খুঁজে পাবার চাবিকাঠি। এর পেছনে কে আছে, সেটা খুঁজে পাবারও চাবিকাঠি।

 

দূভাগ্যজনকভাবে, তাদের জন্য কি-স্টোনটা পুনরুদ্ধার করার একমাত্র সুযোগটা মনে হচ্ছে এখানেই আছে…আইজ্যাক নিউটনের সমাধিতে। যার কাছেই ক্রিপ্টেক্সটা থাকুক না কেন, এই সমাধিতে এসে সংকেতটা উদ্ধার করতেই হবে। আর, তারা যদি এসে চলে গিয়ে না থাকে, তবে ল্যাংডন আর সোফি তাদেরকে মাঝ পথেই আঁটকে ফেলতে পারবে।

 

কবিতাটা দেখার জন্য তারা বাম দিকের দেয়ালের দিকে চলে গেলো। একটা আড়াল করা জায়গায় গিয়ে থামলো। ল্যাংডন কোনভাবেই তার মাথা থেকে জিম্মি হওয়া টিবিংয়ের ছবিটা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলো না। সম্ভবত তাঁকে এখন তার নিজের লিমোজিনেই হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। প্রায়োরিদের শীর্ষ ব্যক্তিদেরকে হত্যা করার আদেশটি যে-ই দিয়ে থাকুক না কেন, সে যে তার পথের মাঝে এসে পড়া কাউকে হত্যা করতে পিছপা হবে না, সেটা একদম নিশ্চিত। মনে হচ্ছে, এটা ভাগ্যের একটি নিমর্ম পরিহাস যে, টিবিং—একজন আধুনিক বৃটিশ নাইট জিম্মি হয়েছেন, তাঁর নিজের দেশেরই লোক স্যার আইজ্যাক নিউটনের সমাধিটা খুঁজে পাওয়ার জন্য।

 

সেটা কোন দিকে? চারদিকে তাকিয়ে সোফি জিজ্ঞেস করলো।

 

সমাধিটা। ল্যাংডনের কোন ধারণাই নেই। আমাদেরকে একজন ডোসেন্ট খুঁজে বের করে জিজ্ঞেস করতে হবে।

 

এখানে লক্ষ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করার চেয়ে কি করতে হবে সেটা ল্যাংডন ভালো করেই জানতো। লুভরের গ্র্যান্ড গ্যালারির মতোই, ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবির একটাই প্রবেশ পথ রয়েছে যে দরজাটা দিয়ে তারা ঢুকেছিলো—ভেতরে ঢোকার পথ খুঁজে বের করা খুব সহজ, কিন্তু বের হওয়ার পথ খুঁজে বের করা কঠিন। আক্ষরিক অর্থেই একটা পর্যটকদের জন্য একটা ফাঁদ, ল্যাংডনের এক সহকর্মী কথাটা বলেছিলো। স্থাপত্য ঐতিহ্য অনুসারে, এ্যাবিটাতে একটা বিশাল আকৃতির কুশিফিক্স মাটিতে শায়িত রাখা হয়েছে। বেশির ভাগ চার্চের মতো, এটার প্রবেশ পথ মাঝখান দিয়ে না হয়ে, বরং পাশ দিয়ে রাখা হয়েছে। তারচেয়েও বড় কথা, এ্যাবিটার রয়েছে অনেকগুলো উদ্যান আচ্ছাদিত পথ, একেবারে এ্যাবির সংলগ্ন আর সেগুলো চার দিকে ছড়িয়ে গেছে। একবার ভুল জায়গায় ঢুকে পড়লে, দর্শনার্থী গোলক ধাঁধায় পড়ে যাবে, আর নিজেকে প্রাচীর বেষ্টিত অবস্থায় দেখতে পাবে।

 

ডোসেন্টরা গাঢ় লাল রঙের পোশাক পরা থাকে, চার্চের কেন্দ্রস্থলের দিকে এগোতে এগোতে ল্যাংডন বললো। দক্ষিণ দিকের উঁচু বেদীটার দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন দেখতে পেলো, কয়েকজন লোক কবরে ঘষামাজা করছে। এই তীর্থ যাত্রীদের দৃশ্যটা পোয়েট কর্নারের একটি সাধারণ দৃশ্য, যদিও ব্যাপারটা দেখে খুব একটা পবিত্র কিছু বলে মনে হয় না। পর্যটকরা কবর ঘষামাজা করছে।

 

আমি তো কোন ডোসেন্ট দেখতে পাচ্ছি না, সোফি বললো। হয়তো আমরা নিজেরাই সমাধিটা খুঁজে বের করতে পারবো।

 

কোন কথা না বলে ল্যাংডন তাকে নিয়ে এ্যাবির কেন্দ্রস্থলের দিকে এগোলো। সে ডান দিকটায় ইঙ্গিত করলো।

 

এ্যাবির মূল অংশটার বিশালত্বের দিকে তাকিয়ে সোফি একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললো, জায়গাটার পুরো আকৃতি এবার দৃশ্যমান হলো। আহ্, সে বললো, চলো একজন ডোসেন্ট খুঁজি।

 

 

 

ঠিক সেই সময়ে চার্চটা থেকে একশ গজ দূরে, কয়্যার স্ক্রিনের পেছনে, দৃষ্টির আড়ালে, স্যার আইজ্যাক নিউটনের সমাধির সামনে একজন দর্শনার্থী দাঁড়িয়ে আছেন। টিচার সমাধিটা দশ মিনিট ধরে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন।

 

নিউটনের সমাধিটাতে বিশাল আকৃতির একটা কালো মার্বেল পাথরের সমাধি ফলক আছে, যাতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের ভাস্কর্য রয়েছে। একটা ক্লাসিক্যাল পোশাক পরে আছেন তিনি। এক থাক বই পুস্তকের ওপর ভর দিয়ে একপাশে গর্বিতভাবে হেলে রয়েছেন

 

ডিভাইনিটি, ক্রনোলজি, অপটিক্স, আর ফিলোসফিয়ে ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা। নিউটনের পায়ের কাছে ডানাযুক্ত দুটো বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের হাতে একটা স্কুল ধরা। নিউটনের শরীরের পেছনে একটা সাধারণ পিরামিড জেগে আছে। যদিও পিরামিডটা খুবই অদ্ভুত, দেখে মনে হচ্ছে এটা অর্ধেক অংশ জেগে থাকা একটা পাহাড়ের মতো, এটাই টিচারকে বেশি কৌতূহলী করলো।

 

একটা গোলক।

 

টিচার সনিয়ের ছলা-কলার ধাঁধাটি নিয়ে একটু ভাবলেন। যে গোলক তুমি খোঁজো, সেটা তার সমাধিতে থাকার কথা। পিরামিডের অবয়বটা থেকে বিশাল একটা গোলক বেড়িয়ে আসছে। জিনিসটা বাসো-রিলিভো পদ্ধতিতে খোঁদাই করা, আর সেটা সব ধরনের নক্ষত্র-মণ্ডলীকেই তুলে ধরছেনক্ষত্রপুঞ্জ, রাশিচক্রের প্রতীক, ধূমকেতু, তারা, আর গ্রহসমূহ। এটার ওপরে, তারা ভরা আকাশের নিচে জ্যোর্তিবিজ্ঞানের দেবীর ছবি।

 

অসংখ্য গোলক।

 

টিচার মনে করেছিলেন, একবার তিনি সমাধিটা খুঁজে পাবার পর, হারানো গোলকটা খুঁজে পাওয়া সহজই হবে। এখন, তিনি খুব একটা নিশ্চিত হতে পারছেন না। জটিল মহাকাশটার দিকে ভালো করে তাকালেন। এখানে কি কোন গ্রহের অনুপস্থিতি আছে? নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে কি কোন জ্যোর্তিবিদ্যার গোলক বাদ দেয়া হয়েছে? তার কোন ধারণাই নেই। তারপরও, টিচার এটা না ভেবে পারলেন না যে, সমাধানটা আসলে পরিষ্কার আর সরলই হবে—পোপ কর্তৃক সমাহিত একজন নাইট। কোন গোলকটা আমি খুঁজছি? নিশ্চিতভাবেই,এস্ট্রোফিজিক্স-এর উন্নত-জ্ঞান হলি গ্রেইল খোঁজার জন্য আবশ্যিক কোন শর্ত নয়, তাই না?

 

এটা বিবৃত করে গোলাপের শরীর আর বীজপ্রসূ গর্ভের আখ্যান।

 

টিচারের মনোযোগ কয়েকজন পর্যটকের আগমনে ভেঙে গেলো। তিনি ক্রিপ্টেক্সটা দ্রুত পকেটে ভরে ফেলে দর্শনার্থীদের চলে যাওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করলেন। তারা একটা পাত্রের মধ্যে কিছু দানের টাকা রেখে গেলো। তাদের হাতে চারকোল পেন্সিল আর কাগজ। এ্যাবির সদর দরজার দিকে সবাই চলে গেলো, সম্ভবত, জনপ্রিয় পোয়েট কর্নারের দিকে, চসার, টেনিসন, আর ডিকেন্স-এর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

 

আবারো একা, টিচার সমাধিটার আরেকটু কাছে এগিয়ে গেলেন। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ভালো করে নিরীক্ষণ করলেন। সমাধি ফলকটার নিচে, উপরে, নিউটনকে পাশ কাটিয়ে, তার বই-পুস্তকগুলো এড়িয়ে, ছেলে দুটোকেও অতিক্রম করে পিরামিডটার দিকে তাকালেন। সেখান থেকে বিশাল গোলক আর তার ভেতরকার নক্ষত্রপুঞ্জ এবং অবশেষে উপরের তারা ভরা শামিয়ানার দিকে।

 

কোন গোলকটা এখানে থাকার কথা…যা নেই?

 

তিনি তাঁর পকেটে রাখা ক্রিপ্টেক্সটা স্পর্শ করলেন, যেনো সনিয়ের সুনিপূণ কারু কার্যের মার্বেলটা থেকে স্বর্গীয় উত্তর পেয়ে যাবেন। কেবল পাঁচটি অক্ষর গ্রেইল থেকে আমাকে দূরে রেখেছে।

 

কয়্যার স্ক্রিনের দিকে হেটে গিয়ে তিনি গভীর একটা নিঃশ্বাস নিলেন। দূরের প্রধান বেদীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সেখানে গাঢ় লাল রঙের পোশাক পরা একজন ডোসেন্ট দুজন আতিপরিচিত লোককে হাত নেড়ে এই জায়গার দিকে নির্দেশ করছে।

 

ল্যাংডন আর নেভু।

 

আস্তে করে টিচার দুহাত পিছিয়ে গিয়ে, কয়্যার স্ক্রিনের পেছনে চলে গেলেন। খুব জলদিই তারা এসে পড়লো। তিনি আগেই অনুমান করেছিলেন, ল্যাংডন আর সোফি কবিতাটার মর্মোদ্ধার করার পর নিউটনের সমাধিতে আসবে। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটে গেলো তার কল্পনার চেয়েও বেশি তাড়াতাড়ি। একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে টিচার তাঁর উপায়গুলো নিয়ে ভাবলেন। তিনি বিস্ময় আর অবাক করা ঘটনার সাথে অভ্যস্ত হয়েই বেড়ে উঠেছেন।

 

ক্রিপ্টেটা আমার কাছেই আছে।

 

পকেটে হাত ঢুকিয়ে তিনি দ্বিতীয় বস্তুটা স্পর্শ করলেন, যা তাঁকে আত্মবিশ্বাসী করে; মেডুসা রিভারটা। যেমনটি আশা করা হয়েছিলো, তাঁর লুকানো পিস্তলটার জন্য এ্যাবির মেটাল ডিটেক্টরটা, টিচার প্রবেশ করতেই বাতি জ্বলে ওঠে শব্দ করেছিলো। রক্ষীরা সঙ্গে সঙ্গেই তার দিকে তাকালে, তিনি পরিচয়-পত্রটা বের করে দেখালেন। তারা আর কিছু বলেনি।

 

যদিও টিচার প্রথমে ভেবেছিলেন, ক্রিপ্টেক্সটা একা একাই সমাধান করবেন, কিন্তু এখন তিনি আঁচ করতে পারলেন, ল্যাংডন আর নেভুর আগমন আসলে আর্শীবাদ হয়েই দেখা দিয়েছে। গোলকটা খুঁজে পাবার ব্যাপারে তাঁর ব্যর্থতার জন্য, এখন তিনি হয়তো তাদের অভিজ্ঞতা আর দক্ষতাকে ব্যবহার করতে পারবেন। হাজার হোক, ল্যাংডন যদি কবিতাটার মমোৰ্দ্ধার করেই থাকে, সমাধিটা খুঁজে পেয়ে থাকে, তাহলে, সে যে গোলকটা সম্পর্কেও কিছু জানে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আর ল্যাংডন যদি পাসওয়ার্ডটা জানতে পারে, তবে সেটা চাপ দিয়ে তার কাছ থেকে আদায় করাটা কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার মাত্র।

 

এখানে নয়, অবশ্যই। অন্য কোথাও, নিরিবিলিতে। টিচার এ্যাবিতে ঢোকার সময় ছোট্ট একটা ঘোষণা সংবলিত সাইনবোর্ড দেখতে পেয়েছিলেন, সেটার কথা ভাবলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বুঝে গেলেন, কোথায় তাদেরকে ফাঁদে ফেলা যাবে।

 

এখন একমাত্র যে প্রশ্নটি…তা হলো, টোপ হিসেবে তিনি কী ব্যবহার করবেন।

 

 

 

৯৮.

 

ল্যাংডন আর সোফি চার্চের উত্তর দিকের স্তম্ভগুলোর কাছে চলে গেলো। অর্ধেক পথ পাড়ি দেবার পরও তারা নিউটনের সমাধিটার কোন চিহ্নও দেখতে পেলো না। সমাধি ফলকটা অন্যান্য সমাধির ফলকের জন্য দূর থেকে দেখা যাচ্ছে না।

 

নিদেনপক্ষে বলা যায়, এখানে কেউ নেই, সোফি ফিসফিস্ করে বললো।

 

ল্যাংডনও তার সাথে একমত হয়ে স্বস্তিবোধ করলো। নিউটনের সমাধির চার পাশটা একেবারেই ফাঁকা। ওখানে আমি যাচ্ছি, সে নিচু স্বরে বললো। তুমি এখানেই থাকো, ঘটনাক্রমে যদি কেউ–

 

সোফি তার সাথে ইতিমধ্যেই রওনা দিয়ে দিয়েছিলো।–আমাদের নজরদারী করতে থাকে, ল্যাংডন দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

 

বিশাল গোল চত্বরটার অতিক্রম করে ল্যাংডন আর সোফি মনোরম সমাধিটার সামনে এসে পড়লো। এটা দেখতে অদ্ভুত রকম সুন্দর…কালো মার্বেলের একটা সমাধি ফলক…হেলে থাকা নিউটনের একটা মূর্তি…ডানাযুক্ত দুটো বাচ্চা ছেলে…একটা বিশাল পিরামিড…আর…একটা বড়সড় গোলক।

 

তুমি কি এটা সম্পর্কে জানতে? সোফি বললো, তার কণ্ঠে বিস্ময়।

 

ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো, সেও অবাক হয়েছে।

 

দেখে মনে হচ্ছে, এসব নক্ষত্রপুঞ্জগুলো এটার ওপরে খোঁদাই করা হয়েছে, সোফি বললো।

 

জায়গাটার দিকে এগোতেই, ল্যাংডনের মনে হলো, একটা উত্তেজনায় সে ডুবে যাচ্ছে। নিউটনের সমাধিটা গোলক দিয়ে পরিপূর্ণ-তারা, ধূমকেতু, গ্রহ-নক্ষত্র। যে গোলক তুমি খোঁজো, সেটা তাঁর সমাধিতেই থাকার কথা? এখন এটা দেখে মনে হচ্ছে, একটা বিশাল গলফ মাঠের ঘাসের মধ্যে হারানো একটা ব্রেড খোজার মতো একটি ব্যাপার।

 

গ্রহাণুপুঞ্জ, সোফি বললো, তাকে দেখে চিন্তিত মনে হলো। অনেকগুলোই আছে।

 

ল্যাংডন চিন্তিত হয়ে পড়লো। গ্রহ-নক্ষত্র আর গ্রেইলের সাথে একমাত্র সংযোগটা হলো, ভেনাসের পেনটাকল। আর ইতিমধ্যেই, Venus পাসওয়ার্ডটা টেম্পল চার্চে যাবার সময় সে ব্যবহার করে ফেলেছে।

 

সোফি সরাসরি সমাধির দিকে চলে গেলো, কিন্তু ল্যাংডন কয়েক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে থেকে চারপাশটায় চোখ রাখলো।

 

ডিভাইনিটি, সোফি বললো, মাথাটা ঝুঁকে, নিউটন যেসব বইয়ের ওপর ভর দিয়ে হেলান দিয়ে রয়েছেন সেগুলোর শিরোনামগুলো পড়লো। ক্রনোলজি। অপটিক্স ফিলোসফেই ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা? সে ল্যাংডনের দিকে ঘুরলো। কিছু ধরতে পারলে?

 

ল্যাংডন কয়েক পা এগিয়ে এসে সেগুলো দেখলো। প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমাটিকা, যতোদূর আমার মনে আছে, মধ্যাকর্ষণ শক্তি নিয়ে, যা আমাদের গ্রহসমূহকে টেনে রেখেছে…মানে গোলক সংক্রান্ত, মানতেই হবে, এটা কোন কাজে আসবে বলে মনে হচ্ছে না।

 

রাশিচক্রের চিহ্নটার ব্যাপারে কি বলা যায়? গোলকের ভেতরের নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে ইঙ্গিত করে সোফি জিজ্ঞেস করলো। তুমি এর আগে পিসেজ আর অ্যাকোয়ারিস-এর ব্যাপারে বলেছিলে, তাই না?

 

শেষ দিন, ল্যাংডন ভাবলো। পিসেজের শেষ, আর অ্যাকোয়ারিসের সূচনাকে বলা হয় প্রায়োরিদের স্যাংগৃল দলিল-দস্তাবেজগুলো প্রকাশ করার পরিকল্পনার ঐতিহাসিক দিনক্ষণ। কিন্তু মিলেনিয়ামটা এসে চলে গেলো, কোন ঘটনা না ঘটেই, কখন সত্যটা জানা যাবে এই অনিশ্চয়তায় ইতিহাসবেত্তাদেরকে ফেলে দিয়ে।

 

মনে হচ্ছে এটা সম্ভব, সোফি বললো, প্রায়োরিদের সত্য প্রকাশের পরিকল্পনাটার সাথে কবিতাটার শেষ লাইনের একটা সম্পর্ক আছে।

 

এটা বিবৃত করে গোলাপের শরীর আর বীজপ্রসূ গর্ভের আখ্যান। ল্যাংডন একটা সম্ভাবনার কথা ভেবে কেঁপে উঠলো। সে এই লাইনটার কথা এর আগে এভাবে ভাবেনি।

 

তুমি আমাকে আগে বলেছিলে, সোফি বললো, যে, প্রায়েরিদের সত্য প্রকাশের পরিকল্পনাটা, গোলাপ আর তাঁর গর্ভ, সরাসরি গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের সাথে সংযুক্ততার মানে, গোলক।

 

ল্যাংডন তার কথাটার সাথে সায় দিলো। তার মনে হলো, একটা সম্ভাবনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। তারপরও, তার ইনটুইশন বলছে, জ্যোর্তিবিদ্যা এটার মূল চাবিকাঠি নয়। গ্র্যান্ড মাস্টারের আগের সবগুলো সমাধানই শব্দ-বাক্যের চাতুর্য আর প্রতীকধর্মী ছিলো—মোনালিসা, ম্যাডোনা অব দি, রস, সোফিয়া। তাই এখন রাশিচক্র আর গ্রহ সংক্রান্ত গোলককে ঠিক আস্থায় নেয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া, জ্যাক সনিয়ে নিজেকে একজন নিখুঁত কোড লেখক হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তাই, ল্যাংডন বিশ্বাস করে, তাঁর শেষ পাসওয়ার্ডটা হবে শুধুমাত্র প্রতীকধর্মীই নয়, বরং স্ফটিকের মতোই স্বচ্ছ।

 

দ্যাখো! সোফি আতকে উঠে ল্যাংডনের হাতটা খামছে ধরলে তার চিন্তা-ভাবনা একটা ঝাকুনি খেয়ে গেলো। সোফির ভয়ার্ত অবস্থা দেখে ল্যাংডনের মনে হলো, কেউ হয়তো তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু, সে যখন তার দিকে ঘুরলো, দেখলো সোফি কালো মার্বেলের সমাধি ফলকটার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। এখানে কেউ ছিলো, সমাধি ফলকের কাছে ইঙ্গিত করে সোফি চাপা কণ্ঠে বললো। নিউটনের ডান দিকের পায়ের কাছে।

 

ল্যাংডন তার ইঙ্গিতটা ধরতে পারলো না। একজন ভুলো মনা পর্যটক সমাধি ফলকের কাছে কবরের গাঁয়ে আঁকা-আঁকি করার জন্য ব্যবহৃত চারকোল পেন্সিল। নিউটনের পায়ের কাছে ফেলে গেছে। এটা তেমন কিছু না। ল্যাংডন সেটা তুলতে যেতেই দেখতে পেলো পালিশ করা কালো মার্বেলটাতে কিছু একটা লেখা রয়েছে, সে একেবারে জমে গেলো। সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলো, সোফি কেন ভয় পেয়েছে।

 

সমাধি ফলকে নিউটনের মূর্তিটার পায়ের নিচে, চারকোল পেন্সিলে লেখা একটা মেসেজ রয়েছে :

 

টিবিং এখন আমার কাছে।

চাপ্টার হাউজে যান,

দক্ষিণ দিকে বের হবার দরজার বাইরে,

পাবলিক গার্ডেনে।

 

ল্যাংডন কথাগুলো দুবার পড়লো, তার হৃদস্পন্দন পাগলা ঘোড়ার মতো লাফাচ্ছে এখন।

 

সোফি ঘুরে চারপাশটা ভালো করে দেখে নিলো।

 

একটা ভয়ের চাদর তাদেরকে ঢেকে দিলেও, এই লেখাগুলো দেখে ল্যাংডন মনে মনে বললো, এটা একটা ভালো খবরই। লেই তাহলে বেঁচে আছে। এখানে আরেকটা ব্যাপারও স্পষ্ট। তারা পাসওয়ার্ডটা জানে না, সে চাপা কণ্ঠে বললো।

 

সোফি সায় দিলো। তা না হলে তো, তারা তাদের উপস্থিতিটা জানাতো না?

 

তারা হয়তো লেইয়ের বিনিময়ে পাসওয়ার্ডটা চায়।

 

অথবা এটা একটা ফাঁদ।

 

ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো। আমি তা মনে করি না। গার্ডেনটা এ্যাবির দেয়ালের ঠিক ওপাশেই। একটা পরিচিত পাবলিক প্লেস। ল্যাংডন একবার এ্যাবির বিখ্যাত। কলেজ গার্ডেনটাতে গিয়েছিলো একটা ছোট ফল আর ঔষধি গাছের বাগান—এক সময় পাদ্রীরা সেখানে প্রাকৃতিক ঔষধ ফলাতো। ফলের বাগানের পরিচয় ছাড়াও কলেজ গার্ডেনটা পর্যটকদের জন্য খুবই জনপ্রিয় একটি স্পট। এ্যাবিতে না ঢুকেই সেখানে যাওয়া যায়। আমার মনে হচ্ছে, আমাদেরকে বাইরে দেখা করতে বলাটার কারণ, যাতে আমরা আস্থা রাখি, বিশ্বাস করি। নিরাপদ মনে করি।

 

সোফিকে সন্দেহগ্রস্ত দেখালো। তুমি বলতে চাচ্ছো বাইরে, তার মানে কোন মেটাল ডিকটেটর নেই?

 

ল্যাংডন ঢোক গিললো সোফির কথায় যুক্তি আছে। গোলক-পূর্ণ সমাধি ফলকের দিকে তাকিয়ে, ল্যাংডন ভাবলো, ক্রিপ্টেক্সর পাসওয়ার্ডটা সম্পর্কে যদি তার কোন ধারণা থাকতো…যা দিয়ে সে দরকষাকষি করতে পারবে। আমি লেইকে এ ব্যাপারে জড়িয়েছি, আর তাঁকে উদ্ধার করার জন্য আমাকে যা দরকার তাই করতে হবে।

 

লেখাটাতে চাপ্টার হাউজের বের হবার দক্ষিণ দিকের জায়গাটাতে যেতে বলা হয়েছে, সোফি বললো, হয়তো বাইরে থেকে আমরা গার্ডেনটা দেখতে পাবো? এভাবে আমরা ওখানে গিয়ে কোন বিপদে পড়ার আগেই, অবস্থাটা বুঝতে পারবো?

 

আইডিয়াটা ভালোই। ল্যাংডন খুব সহজেই চাপ্টার হাউজের কথাটা স্মরণ করতে পারলো, যেখানে একটা বিশাল আট কোনার ভবন রয়েছে, আধুনিক পার্লামেন্ট ভবনের আগে, সেটাই ছিলো বৃটিশ পার্লামেন্ট। অনেক বছর আগে, সে ওখানে গিয়েছিলো, তারপরও, তার মনে পড়লো, সেখানে কোথাও প্রাচীরবেষ্টিত একটি মঠ রয়েছে। সমাধিটা থেকে কয়েক হাত পিছিয়ে গিয়ে, ল্যাংডন ডান দিকের কয়্যার স্ক্রিনের দিকে তাকালো।

 

সেখানে সরু গিরিখাদের মতো একটা পথ রয়েছে, যার ওপরেই আছে একটা সাইনবোর্ড।

 

এই দিকে:

ক্লয়েস্টার

যাজকের কার্যালয়

কলেজ হল

জাদুঘর

পিক্স চেম্বার

সেন্ট ফেইথ চ্যাপেল

চাপ্টার হাউজ

 

ল্যাংডন আর সোফি তাড়াহুড়া করে, দৌড়াতে দৌড়াতে সাইনবোর্ডেটার নিচ দিয়ে সেই পথটাতে ঢুকে পড়লো। ঢোকার সময় তারা লক্ষ্যই করতে পারলো না, ছোষ্ট্র একটা ঘোষণা সংবলিত নোটিশ টাঙানো আছে, তাতে বলা আছে, কিছু এলাকা সংস্কার কাজে জন্য বন্ধ রয়েছে।

 

তারা সঙ্গে সঙ্গেই একটা উঁচু প্রাচীর ঘেরা ছাদ-খোলা প্রাঙ্গণে এসে পড়লো, সকালের বৃষ্টির মধ্যেই। তাদের মাথার ওপর প্রচণ্ড বাতাস বইছে। নিচু হয়ে আসা সংকীর্ণ গলিটাতে ঢুকতেই, যা প্রাঙ্গনের চারপাশটাকে বেষ্টন করে রেখেছে, ল্যাংডনের সেই চিরচেনা অস্বস্তিটা শুরু হলো—কোন আবদ্ধ জায়গায় তার এরকমটি হয়ে থাকে। এইসব গলিগুলোকেই কুয়েস্টার বলে। এজন্যেই আবদ্ধ জায়গার ব্যাপারে ভীতিকে বলে ক্লাস্ট্রোফোবিক।

 

টানেলটার ঠিক শেষ মাথার দিকে তারা এগিয়ে গেলো। ল্যাংডন চাপ্টার হাউজের সাইনটা অনুসরণ করলো। বৃষ্টিটা এখন প্রচণ্ড বেগে পড়ছে। বিপরীত দিক থেকে আরেক জোড়া নারী-পুরুষ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে তাড়াহুড়া করে তাদেরকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। কুয়েস্টারটা এখন একেবারে ফাঁকা।

 

পূর্বদিকে, ক্লায়েস্টার থেকে চল্লিশ গজ দূরে, একটা খিলানযুক্ত পথ বাম দিকে চলে গেছে অন্য আরেকটা হলওয়ের অভিমুখে। যদিও এটাই সেই প্রবেশ-পথ যা তারা খুঁজছে, কিন্তু সেটার খোলা জায়গাটা পরিত্যক্ত মাল-সামাল দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সেখানে একটা অফিশিয়াল সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে।

 

সংস্কার কাজের জন্য বন্ধ আছে

পিক্স চেম্বার

সেন্ট ফেইথ চ্যাপেল

চাপ্টার হাউজ

 

সঙ্গে সঙ্গে ল্যাংডন মাল সামালগুলোর ভেতর দিয়ে দেখতে পেলো পিক্স চেম্বার আর সেন্ট ফেইথ চ্যাপেলের প্রবেশপথটা ডান আর বাম দিকে। চাপ্টার হাউজের প্রবেশ পথটা, আরো বেশি দূরে, দীর্ঘ হলওয়ের শেষ মাথায়। এমন কি এখান থেকেও, ল্যাংডন সেটার ভারি কাঠের দরজাটা খোলা দেখতে পেলো। চাপ্টার হাউজে যান, দক্ষিণ দিকে বের হবার জায়গাটার সামনে, পাবলিক গার্ডেনে।

 

আমরা পূর্বদিকের কুয়েস্টারটা ফেলে এসেছি, ল্যাংডন বললো, সুতরাং বাগান থেকে দক্ষিণ দিকে বের হবার জায়গাটা ওখানেই হবে, ডান দিকে।

 

সোফি মাল-সামালগুলো ইতিমধ্যেই পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলো।

 

অন্ধকারচ্ছন্ন করিডোরটা দিয়ে তাড়াহুড়া করে ছুটতেই তাদের পেছনে বাতাস আর বৃষ্টির শব্দটা মিইয়ে গেলো। চাপ্টার হাউজ ভবনটা তাদের সামনে আবির্ভূত হলো।

 

এটা দেখতে অনেক বড়, সামনের দিকে এগোতেই সোফি বললো।

 

ল্যাংডন ভুলেই গিয়েছিলো এই ভবনটা কত বড়। এখান থেকেই তারা গার্ডেনটার দৃশ্য দেখতে পারবে।

 

প্রবেশস্থলটা পার হতেই, ল্যাংডন আর সোফি তীর্যক চোখে একে অন্যেকে দেখে নিলো। গুমোট ক্লয়েস্টারের পর চাপ্টার হাউজটা মনে হলো একটা কাঁচের ঘরের মতো। ঘরটার ভেতরে দশ ফুট যেতেই দক্ষিণ দিকের দেয়ালটা বুজলো, বুঝতে পারলো, যে দরজাটার কথা তাদেরকে বলা হয়েছিল, সেটা ওখানে নেই।

 

একটা বিশাল কানা গলিতে তারা দাঁড়িয়ে আছে।

 

তাদের পেছনের ভারি দরজাটার খটখট শব্দে তারা ঘুরে তাকালো। দরজাটা একটা ভোতা শব্দে বন্ধ হয়ে গেলো। দরজার পেছনে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে খুব ধীর-স্থির দেখাচ্ছে। লোকটা তাদের দিকে পিস্তলটা তাক করে ধরে রেখেছে। লোকটা একদিকে কাত হয়ে দুটো এলুমিনিয়ামের ক্রাচের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

 

কয়েক মুহূর্তের জন্য ল্যাংডনের মনে হলো, সে স্বপ্ন দেখছে। লোকটা হলো লেই টিবিং।

 

 

 

৯৯.

 

সার লেই টিবিং সোফি আর ল্যাংডনের দিকে তাঁর মেডুসা রিভলবারটা তা করে ধরে রাখাতে একটু দুঃখিত হলো। আমার বন্ধুরা, তিনি বললেন, গত রাতে আপনারা আমার বাড়িতে আসার পর থেকেই আমি আপনাদেরকে সবধরনের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু, আপনাদের নাছোর বান্দার মতো লেগে থাকাটা আমাকে একটা কঠিন অবস্থার মধ্যে এনে দাঁড় করিয়েছে।

 

তিনি সোফি আর ল্যাংডনের চোখে-মুখে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়ার অভিব্যক্তিটা দেখতে পেলেন। তারপরও, তার দৃঢ় আত্মবিশ্বাস, খুব শীঘ্রই তারা দুজনেই এই ঘটনা পরম্পরার ব্যাপারটা বুঝতে পারবে, যা তাদের তিন জনকে এরকম একটি অদ্ভুত পরিস্থিতিতে এনে ফেলেছে।

 

আপনাদের দুজনের কাছেই আমার অনেক কিছু বলার আছে … অনেক কিছু, যা এখনও আপনারা বুঝতে পারছেন না।

 

দয়া করে বিশ্বাস করুন, টিবিং বললেন, আপনাদেরকে জড়ানোর কোন ইচ্ছেই আমার ছিলো না। আপনারা আমার বাড়িতে আমার খোঁজেই এসেছিলেন।

 

লেই? ল্যাংডন অবশেষে মুখ খুললো। আপনি এসব কি করছেন? আমরা ভেবেছিলাম আপনি খুব বিপদে রয়েছেন। আমরা আপনাকে সাহায্য করতেই এখানে এসেছি।

 

আমারও বিশ্বাস ছিলো, আপনি সেটা করবেন, তিনি বললেন। আমাদের অনেক কিছুই আলোচনা করার আছে।

 

ল্যাংডন আর সোফি তাদের দিকে তাক করে রাখা রিভলবারটা থেকে বিস্মিত চোখটা কোনভাবেই সরাতে পারছিলো না।

 

এটা আপনাদেরকে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত করতে চাই যে, টিবিং বললেন, আমি যদি আপনাদের কোন ক্ষতি করতে চাইতাম, তো ইতিমধ্যেই আপনারা মারা যেতেন। আপনারা গত রাতে আমার বাড়িতে আসার পর থেকে, আপনাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সব কিছুই করেছি। আমি একজন সম্মানিত ব্যক্তি। আর আমি প্রতীজ্ঞা করেছিলাম, কেবল তাদেরকেই বলি দেবো, যারা স্যাংগৃলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

 

বলছেন কি এসব? ল্যাংডন বললো। স্যাংগৃলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।

 

আমি একটা ভয়ংকর সত্য জানতে পেরেছি, টিবিং দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। আমি জেনে গেছি, কেন স্যাংগৃল দলিল-দস্তাবেজগুলো পৃথিবীর কাছে উন্মোচিত করা হয়নি। আমি জেনে গেছি, প্রায়োরিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দলিলগুলো আর প্রকাশ করা হবে না। এজন্যেই, মিলেনিয়ামটা কোন ধরনের উন্মোচন ছাড়াই পার হয়ে গেলো। আর শেষ দিন সমাগত হবার পরও কিছুই ঘটেনি।

 

ল্যাংডন প্রতিবাদ করার জন্যে একটা দম নিয়ে নিলো।

 

প্রায়োরিদেরকে, টিবিং বলা অব্যাহত রাখলেন, সত্যটা প্রকাশ করার জন্য একটা পবিত্র দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো, স্যাংগৃল দলিলগুলো শেষ দিন সমাগত হলে প্রকাশ করতে হবে। শত শত বছর ধরে দা ভিঞ্চি, বত্তিচেলি আর নিউটনের মতো ব্যক্তিরা দলিলগুলো রক্ষা করার জন্য সবকিছুই করেছেন, আর তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটা পালন করেছেন। আর এখন, প্রকাশ হবার অনিবার্য সময়টাতে, জ্যাক সনিয়ে তার সিদ্ধান্ত বদলে ফেললেন। তিনি নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে, খৃস্টিয় ইতিহাসে খৃস্টবাদকে সবচাইতে বেশি সম্মান দিয়েছেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সময়টা প্রকাশ করার জন্য সঠিক নয়। টিবিং সোফির দিকে ফিরলেন। তিনি গ্রেইলকে ব্যর্থ করেছেন। প্রায়োরিদের ব্যর্থ করেছেন। আর তিনি, যে প্ৰজন্মটি এই মুহূর্তটাকে সম্ভব করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন, তাদের স্মৃতিকে ব্যর্থ করেছেন।

 

আপনি? চোখ তুলে তাকিয়ে সোফি জোরে বললো। তার সবুজ চোখে প্রচণ্ড ক্রোধ আর ঘৃণা ছড়াচ্ছে। আপনিই তাহলে আমার দাদুর হত্যার জন্য দায়ি?

 

টিবিং রেগে গেলেন। আপনার দাদু আর তাঁর সেনেক্যরা গ্রেইলের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছেন।

 

সোফির ভেতরে একটা ক্রোধের ঝড় বয়ে গেলো। মিথ্যে বলছে লোকটা!

 

টিবিংয়ের কণ্ঠটা দৃঢ়। আপনার দাদু চার্চের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছিলেন। এটা নিশ্চিত যে, তারা তার ওপর সত্যটা চেপে যাবার জন্যে প্রচণ্ড চাপ দিয়েছিলেন।

 

সোফি মাথা ঝাঁকালো। আমার দাদুর ওপর চার্চের কোন প্রভাব ছিলো না!

 

টিবিং শীতল একটা হাসি দিলেন। মাই ডিয়ার, যারা চার্চের মিথ্যাকে প্রকাশ করার হুমকি দেয়, তাদেরকে নিবৃত্ত করার দুহাজার বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে চার্চের। কনস্টানটিনের সময় থেকেই, চার্চ খুব সফলভাবেই, ম্যারি মাগদালিন আর যিশু সম্পৰ্কীয় সত্যটা লুকিয়ে রাখতে পেরেছে। আমাদেরকে এখন, অবাক হলে চলবে না যে, তারা আবারো পৃথিবীকে অন্ধকারে রাখার পথটা খুঁজে পেয়েছে। চার্চ তো আর ক্রুসেডার নিয়োগ করে অবিশ্বাসীদেরকে নির্মূল করতে পারবে না, কিন্তু তাদের প্রভাব একটুও কমেনি। কমেনি তাদের ছলনা আর প্রতারণা। তিনি থামলেন, যেনো সেটা তার কথাটা বলার জন্য। মিস নেভু, কয়েকদিন ধরে আপনার দাদু আপনার পরিবার সম্পর্কে সত্য কথাটা বলতে চাচ্ছিলেন।

 

সোফি দারুণ বিস্মিত হলো। আপনি সেটা কীভাবে জানলেন?

 

আমার পদ্ধতিগুলো সম্পকে জানাটা এখানে অবান্তর। আপনার জন্য এখন যেটা জরুরি, সেটা হলো, এই কথাটা জানা, একটা নিঃশ্বাস নিলেন তিনি, যে, আপনার বাবা-মা আর ভাইয়ের মৃত্যুটা কোন দূর্ঘটনা ছিলো না।

 

কথাটা সোফির আবেগকে আবার জাগিয়ে তুললো, সে কথা বলার জন্য মুখ খুলতে গেলো, কিন্তু পারলো না।

 

ল্যাংডন মাথা ঝাঁকালো। আপনি বলছেন কি?

 

রবার্ট, এটা সব কিছুকেই ব্যাখ্যা করে, সবগুলো অংশই ঠিক ঠিক মিলে যায়। স্যাংগুলের ব্যাপারে চুপ করার জন্য খুন করার নজির অতীতেও চার্চের রয়েছে। শেষ দিন সমাগত হবার সাথে সাথেই গ্র্যান্ড মাস্টারের প্রিয় মানুষদেরকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে একটা পরিষ্কার বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছিলো। চুপ থাকো, নয়তো এরপরে তুমি আর সোফি।

 

ওটা একটা গাড়ি দূর্ঘটনা ছিলো, সোফি জোর দিয়ে বললো। একটা দূর্ঘটনাই!

 

আপনার নিষ্কলুষতাকে রক্ষা করার জন্য একটা ছেলে ভোলানো গল্প, টিবিং বললেন। বিবেচনা করুন, শুধুমাত্র দুজন সদস্যকে অক্ষত রাখা হয়েছে-প্রায়োরির গ্র্যান্ড মাস্টার আর তার একমাত্র নাতনী চার্চ কর্তৃক ভ্রাতৃসংঘকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটা যথার্থ অবস্থা। আমি কেবল অনুমান করতে পারি, বিগত বছরগুলোতে চার্চ আপনার দাদুকে হুমকি দিয়ে আসছিলো, তিনি যদি স্যাংগৃল দলিলগুলো প্রকাশ করেন, তবে আপনাকে হত্যা করা হবে। তারা আরো হুমকি দিয়েছিলো, আপনার দাদু যেনো প্রায়োরিদের পুরনো প্রতীজ্ঞাটা পুণর্বিবেচনা করার জন্য উদ্যোগ নেন, তা না হলে, তারা তাদের কাজটা সমাধা করবে।

 

লেই, ল্যাংডন তর্ক করে বললো। নিশ্চিতভাবেই, আপনার কাছে কোন প্রমাণ নেই যে, এসব হত্যাকাণ্ড চার্চই করেছে। অথবা প্রায়োরিদের সিদ্ধান্ত বদলাতে প্রভাব বিস্তার করেছে তারা।

 

প্রমাণ? টিবিং পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। আপনি প্রমাণ চাচ্ছেন, প্রায়োরিদের প্রভাবিত করা হয়েছিলো কি না? নতুন মিলেনিয়াম এসে গেছে, তারপরও দুনিয়ার সবাই অন্ধকারেই আছে। এটাই কি যথেষ্ট প্রমাণ নয়?

 

টিবিংয়ের কথার প্রতিধ্বনির মধ্যে সোফি আরেকটা কণ্ঠ শুনতে পেলো। সোফি, তোমার পরিবার সম্পর্কে আমাকে সত্যটা বলতেই হবে। বুঝতে পারলো, সে কাঁপছে। এটাই সেই সত্য, যা তার দাদু তাকে বলতে চেয়েছিলেন? তার পরিবারকে খুন করা হয়েছে? যে দুর্ঘটনা তার পরিবারকে কেড়ে নিয়েছিলো, সে সম্পর্কে সে আসলে সত্যিকারভাবে কতটুকু জানে? শুধু ভাসা ভাসা কিছু বিবরণ। এমন কি সংবাদপত্রেও খবরটা তেমনভাবে আসেনি। একটা দূঘর্টনা? ছেলে ভুলানো গল্প? সোফির আচমকাই তার দাদর অতি নিরাপত্তামূলক আচরণের কথাটা মনে পড়ে গেলো। তিনি কখনও সোফিকে তার ছেলেবেলায় একা ছাড়তে চাইতেন না। এমন কি বড় হবার পর। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও সে টের পেতো, তার দাদু তাকে কড়া নজরে রাখছেন। সে ভাবলো, তবে কি তাকে প্রায়োরি সদস্যরা আড়াল থেকে চোখে চোখে রাখতো। দেখাশোনা করতো।

 

আপনি সন্দেহ করছেন, তাঁকে কুক্ষিগত করা হয়েছিলো, ল্যাংডন বললো, অবিশ্বাসে সে টিবিংয়ের দিকে তাকালো। আর তাই আপনি তাকে খুন করলেন?

 

আমি টৃগারটা টানিনি, টিবিং বললেন। সনিয়ে অনেক বছর আগেই মারা গিয়েছিলেন, যখন চার্চ তাঁর পরিবারকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলো। তিনি আপোস করে ফেলেছিলেন। এবার তিনি সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁর ওপর অর্পিত পবিত্র দায়িত্বটা পালন না করার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। বিকল্পটি বিবেচনা করুন। কিছু একটা করতেই হোতো, পৃথিবী কি চিরদিনের জন্য অজ্ঞই থাকবে? চার্চ কি সারাজীবনের জন্য তাদের মিথ্যাটাকেই ইতিহাসের বইয়ে প্রতিষ্ঠিত করে রাখবে? চার্চকে কি হত্যা আর শঠতা করার অনুমতি দেয়া অব্যাহত রাখা হবে? না, কিছু একটা করার দরকার ছিলো। এখন আমরা, সনিয়ের ধারাক্রমটা বজায় রাখতে পারি। তিনি থামলেন। আমরা তিন জন। একসাথে।

 

সোফি কেবল ঘৃণাই অনুভব করতে পারলো। আপনি কিভাবে বিশ্বাস করলেন, আমরা আপনাকে সাহায্য করবো?

 

কারণ, মাইডিয়ার, প্রায়োরিরা যে দলিলগুলো প্রকাশে ব্যর্থ হয়েছে, তার কারণ আপনিই। আপনার দাদু, আপনার প্রতি তাঁর যে ভালবাসা ছিলো, সেটাই তাঁকে চার্চের সাথে দ্বন্দ্বে যেতে দেয়নি। তাঁর একমাত্র ভয় ছিলো, বেঁচে থাকা একমাত্র সদস্যকে হারানোর। তিনি কখনও সত্য কথাটা আপনাকে বলে যেতে পারেননি, কারণ আপনি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তাঁকে হাত-পা বেঁধে অপেক্ষায় রাখতে বাধ্য করেছিলেন। এখন, আপনি পৃথিবীর কাছে সত্যটা প্রকাশ করার জন্য ঋণী হয়ে গেছেন। আপনি এটা করবেন, আপনার দাদুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই।

 

 

 

রবার্ট ল্যাংডন টিবিংকে বোঝানোর চেষ্টা বাদ দিলো। যদিও তার মনে একগাদা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তারপরও সে জানতো, এখন একটা জিনিসই করার আছে—এখান থেকে সোফিকে জীবিত অবস্থায় বের করে নিয়ে আসা। ল্যাংডন এর আগে টিবিংকে এই ঘটনায় জড়িত করার জন্য অপরাধ বোধে ভুগছিলো, আর এখন সেটা বদলে গিয়ে সোফিকে জড়ানোর জন্য নিজেকে দায়ি করলো। আমি সোফিকে শ্যাতু ভিলেতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমিই দায়ি।

 

ল্যাংডনের মনে হলো না, লেই টিবিং তাদেরকে এই চাপ্টার হাউজে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারবে। তারপরও, এটাতো ঠিক, ভুল পথে গ্রেইল অন্বেষণ করতে যেয়ে টিবিং বাকিদেরকে হত্যা করিয়েছে। ল্যাংডনের মনে হলো, এই জায়গাটাতে গুলির শব্দ হলে, সেটা বাইরে মোটেও শোনা যাবে না, মোটা দেয়াল আর প্রচণ্ড বৃষ্টির জন্যই। লেই তো এইমাত্র আমাদের কাছে নিজের অন্যায়ের কথাটা স্বীকার করেছেন।

 

ল্যাংডন সোফির দিকে তাকালো, সে কাঁপছে। প্রায়োরিদের নিপ করার জন্য চার্চ সোফির পরিবারকে খুন করেছে?

 

ল্যাংডনের হঠাৎ করেই মনে হলো, আধুনিক চার্চ মানুষ হত্যা করে না। অন্য কোন ঘটনা আছে এতে।

 

সোফিকে যেতে দিন, ল্যাংডন লেইর দিকে তাকিয়ে বললো। আপনি আর আমি এটা নিয়ে কথা বলি।

 

টিবিং একটা অতিপ্রাকৃত হাসি দিলেন। আমি দুঃখিত, এই কাজটা করতে পারছি। আমি বরং আপনাকেই যেতে দিতে পারি। ক্রাচের ওপর পুরোপুরি ভর দিয়ে নির্দয়ভাবে টিবিং সোফির দিকে অস্ত্রটা ধরলো, আরেক হাতে, পকেট থেকে কি স্টোনটা বের করে আনলেন। সেটা এমনভাবে হাতে তুলে নিলেন, যেনো ল্যাংডনকে ওটা দেবেন। বিশ্বাসের একটা টোকেন, রবার্ট।

 

রবার্ট খুব ঘাবড়ে গেলো, একটুও নড়লো না। লেই কি-স্টোনটা আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছেন।

 

নিন, টিবিং ল্যাংডনের দিকে সেটা এগিয়ে দিয়ে বললেন।

 

টিবিং এটা কেন ফিরিয়ে দিচ্ছে, সে সম্পর্কে ল্যাংডন কেবল একটা কথাই ভাবতে পারলো। আপনি ওটা ইতিমধ্যেই খুলেছেন। মানচিত্রটা সরিয়ে ফেলেছেন।

 

টিবিং মাথা ঝাঁকালেন। রবার্ট, আমি যদি কি-স্টোনটা সমাধান করতেই পারতাম, তবে গ্রেইলটা খুঁজে পাওয়ার জন্য উধাও হয়ে যেতাম, আর আপনাকেও এ ঘটনায় জড়াতাম না। না, আমি উত্তরটা জানি না। আর সেই কথাটা আমি খোলাখুলিই স্বীকার করতে পারি। একজন সত্যিকারের নাইট গ্রেইলে মুখোমুখি বিব্রতকর হয়। আমি যখন আপনাকে এ্যাবিতে ঢুকতে দেখলাম, বুঝেছিলাম, আপনারা একটা কারণেই এখানে এসেছেন। সাহায্য করতে। গ্রেইল আমাদের সবাইকে খুঁজে নিয়েছে। আর এখন, সে প্রকাশ হবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছে। আমাদেরকে অবশ্যই এক সাথে কাজ করতে হবে।

 

যদিও টিবিং সহযোগীতার কথা বলছেন, তাঁর অস্ত্রটা কিন্তু সোফির দিকেই তাক্‌ করা। ল্যাংডন সামনের দিকে এগিয়ে টিবিংয়ের কাছ থেকে মার্বেলের সিলিন্ডারটি নিয়ে নিলো। ডায়ালগুলো এখনও এলোমেলো হয়ে আছে, ক্রিপ্টেটা বন্ধই রয়েছে।

 

ল্যাংডন টিবিংয়ের দিকে তাকালো। আপনি কিভাবে বুঝলেন, আমি এটা ভেঙে ফেলবো না?

 

টিবিংয়ের হাসিটা ছিলো ভুতুরে ধরনের। আমার বোঝা উচিত ছিলো, টেম্পল চার্চের ভেতরে আপনার ভেঙে ফেলার হুমকিটা মিথ্যে ছিলো। রবার্ট ল্যাংডন কখনও কি-স্টোনটা ভাঙবে না। আপনি একজন ইতিহাসবিদ, রবার্ট। আপনি হাতে ধরে রেখেছেন দুহাজার বছরের ইতিহাস স্যাংগৃলের হারানো চাবি। এই সিক্রেটটা রক্ষা করতে গিয়ে যেসব নাইট আগুনে পুড়ে মরেছে, তাদের আত্মাটা আপনি অনুভব করতে পারেন। আপনি কি তাদের মৃত্যুগুলোকে ব্যর্থ করে দেবেন? না, আপনি সেটা করবেন না। আপনি যেসব লোককে শ্রদ্ধা করেন, তাদের সারিতে যোগ দেবেন—দা ভিঞ্চি, বত্তিচেল্লি, নিউটন তাদের সম্মানিত হবার সুযোগটা এখন আপনার পায়ের নিচে এসে পড়েছে। কি-স্টোনটার বিষয়-বস্তু আমাদের কাছে চিৎকার করে আবেদন করছে। মুক্ত হবার জন্য উদগ্রীব। সময় এসে গেছে। নিয়তি আমাদেরকে এই মুহূর্তটাতে এনে দাঁড় করিয়েছে।

 

আমি আপনাকে সাহায্য সাহায্য করতে পারবো না, লেই। এটা কীভাবে খোলা যায়, সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই নেই। আমি নিউটনের সমাধিটা কেবলমাত্র অল্প সময়ের জন্য দেখেছি। আর আমি যদি পাসওয়ার্ডটা জানিও… ল্যাংডন থামলো, বুঝতে পারলো, সে খুব বেশি বলে ফেলছে।

 

আপনি আমায় বলবেন না? টিবিং দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমি হতাশ এবং বিস্মিত হয়েছি রবার্ট, আপনি আমার ঋণের ব্যাপারটা খেয়াল করছেন না। আমার কাজটা খুব বেশি সহজ হতো, যদি রেমি আর আমি আপনাদের দুজনকে শ্যা ভিলেতেই শেষ করে দিতে পারতাম। তার বদলে, আমি আপনাদের সাথে বদান্যতা দেখিয়েছি, সমস্ত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও।

 

এটা বদান্যতা? অস্ত্রের দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন জানতে চাইলো।

 

দোষটা সনিয়ের, টিবিং বললেন। তিনি আর তার সেনেকরা সাইলাসের কাছে মিথ্যে বলেছেন। তা না হলে, আমি কোন ধরনের জটিলতা ছাড়াই কি-স্টোনটা হস্তগত করতে পারতাম। আমি কীভাবে জানবো যে, গ্র্যান্ড মাস্টার এরকম চালাকি করবেন, আমাদেরকে ধোঁকা দেবেন আর কি-স্টোনটা তার অজ্ঞাত নাতনীকে দিয়ে দেবেন? টিবিং সোফির দিকে ঘৃণাভরে তাকলেন। যে কিনা, এই জ্ঞানটা ধারণ করবার জন্য এতোটাই অযোগ্য যে, তার একজন সিম্বোলজিস্ট বেবি-সিটারের দরকার। টিবিং আবার ল্যাংডনের দিকে তাকালেন। সৌভাগ্যক্রমে, রবার্ট, আপনার জড়িয়ে পড়াটা আমার জন্যে সাপে বর হয়ে গিয়েছিলো। কি-স্টোনটা আজীবন। ডিপোজিটরি ব্যাংকের লকারে বন্দী হয়ে থাকার চেয়ে, আপনি বরং সেটা ওখান থেকে নিয়ে এসে আমার বাড়িতে হাজির হলেন।

 

এছাড়া আমি আর কোথায়ই বা যেতাম? ল্যাংডন ভাবলো। গ্রেইল ইতিহাসবিদদের সম্প্রদায়টা তো খুবই ছোট, আর টিবিং এবং আমার, এক সাথে কাজ করার একটা ইতিহাসও রয়েছে।

 

টিবিংকে দেখে খুব আত্মতৃপ্ত মনে হলো এখন। যখন আমি জানতে পারলাম, সনিয়ে আপনার কাছে একটা অন্তিম-বার্তা রেখে গেছেন, তখন আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলাম যে, আপনার কাছে প্রায়োরিদের সম্পর্কে খুবই দামি তথ্য রয়েছে। হয়, সেটা কি-স্টোন সম্পর্কে, নয়তো, সেটা কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে, সে সম্পর্কে, আমি অবশ্য নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু আপনার পেছনে পুলিশ লেগে যাওয়াতে, আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আপনি আমার কাছে আসতে পারেন।

 

ল্যাংডন ঠোঁট বেকিয়ে বললো। আর যদি না আসতাম?

 

তবে আমি একটা পরিকল্পনা করতাম, যাতে আপনি আমার একজন সাহায্যকরী হয়ে ওঠেন। যেভাবেই হোক, কি-স্টোনটা শ্যাতু ভিলেতেই আসতো।

 

কী! ল্যাংডন কষ্টে পেয়ে বললো।

 

সাইলাস শ্যাতু ভিলেতের বাড়িতে ঢুকে আপনাদের কাছ থেকে কি-স্টোনটা চুরি করার কথা ছিলো—এভাবে প্রেক্ষাপট থেকে আপনাদেরকে সরিয়ে দেয়া যেতো। তাতে আমাকে কোন সন্দেহ করা হতো না। কিন্তু, আমি যখন সনিয়ের কোডের ঘোর-প্যাচটা দেখতে পেলাম, সিদ্ধান্ত নিলাম, আপনাদের দুজনকে অতিথি হিসেবে আরো কিছুক্ষণ আঁটকে রাখি। আমি সাইলাসকে কি-স্টোনটা পরে চুরি করতে বলতাম, ভাবলাম, কাজটা আমার পক্ষেও করা সম্ভব।

 

টেম্পল চার্চে, সোফি বললল, তার কণ্ঠে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হবার ছাপ দেখা গেলো।

 

 

 

সব কিছুই এখন পরিষ্কার হতে শুরু করছে, টিবিং ভাবলেন। টেম্পল চার্চই হলো সোফি আর ল্যাংডনের কাছ থেকে কি-স্টোনটা চুরি করার সঠিক জায়গা ছিলো। রেমিকে যে আদেশ করা হয়েছিলো, সেটা ছিলো খুবই পরিষ্কার-সাইলাস যখন কি-স্টোনটা পুণরুদ্ধার করবে, তখন সবার অলক্ষ্যে থাকবে, তোমাকে যেনো কেউ দেখে না ফেলে। কিন্তু, ভাগ্য খারাপ, ল্যাংড়ন কি-স্টোনটা ভেঙে ফেলার হুমকি দেয়াতে রেমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। যদি, শুধুমাত্র রেমি নিজেকে ওভাবে প্রকাশ করে না ফেলতো, টিবিং বিষণ্ণ হয়ে ভাবলেন। তার মনে পড়ে গেলো, নিজের ভূয়া অপহরণটার কথা। রেমিই ছিলো আমার পরিচয়টা জানার ব্যাপারে একমাত্র সংযোগ, আর সেও কিনা নিজেকে দেখিয়ে ফেললো।

 

ভাগ্য ভালো, টিবিংয়ের সত্যিকারের পরিচয়টা সাইলাস জানতো না। তাই তাকে খুব সহজেই বোকা বানানো গেছে। লিমোজিনের ভেতরে সাউন্ডপ্রুফ দেয়ালটা তুলে দেয়াতে, সাইলাস আর রেমির মাঝখানে টিবিংয়ের অবস্থানটা আরো বেশি নিরাপদ হয়ে গিয়েছিলো। টিবিং সামনের সিটে বসে সাইলাসকে ফোন করে, টিচারের ফরাসি উচ্চারণে কথা বলে, সাইলাসকে সরাসরি ওপাস দাইর ভবনে চলে যেতে বলেন। পুলিশকে একটা ছোট্ট খবর দিলেই, তারা সাইলাসকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে ফেলতে পারবে।

 

একটাকে সরিয়ে ফেলা গেলো।

 

আরেকটা খুবই শক্ত। রেমি

 

টিবিং এই সিদ্ধান্তটা নিতে খুব দোটানায় ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রেমি নিজেকে একটা বোঝা হিসেবেই প্রমাণ করলো। প্রতিটি গ্রেইল অন্বেষণেই একটা বলির দরকার হয়। লিমোজিনের ওয়েট-বারটা টিবিংকে পরিষ্কার একটা সমাধান দিয়েছিলো ফ্লাস্কে অল্প পরিমাণ কগনাক আর এক ক্যান বাদাম। ক্যানের নিচে থাকা পাউডারটা রেমির এলার্জিটা উস্কে দেবার জন্য যথেষ্ট। রেমি যখন লিমোজিনটা হস গার্ড প্যারাডে পার্ক করলো, টিবিং পেছন থেকে নেমে পড়েছিলেন। তারপর সামনের ড্রাইভার সিটে রেমির পাশে গিয়ে বসলেন। মিনিট খানেক বাদে, টিবিং গাড়ি থেকে নেমে এলেন। রিয়ারটাতে আবার ঢুকে সমস্ত প্রমাণ-পত্র পরিষ্কার করে ফেললেন। এরপরই, নিজের মিশনের শেষ অংশটা সমাধান করতে নেমে পড়লেন।

 

ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবির রাস্তাটা হাটার জন্য খুবই ছোট্ট একটা পথ। টিবিংয়ের লেগব্রেস্ কাঁচ, আর অস্ত্রটা থাকা সত্ত্বেও, মেটাল দরজার সামনে পুলিশের লোকগুলো জানতো না, তারা কী করবে। আমরা কি তাঁকে তাঁর পায়ের ব্রেসটা খুলে হামাগুড়ি দিতে বলবো? টিবিং রক্ষীদেরকে সহজ একটা সমাধান দিয়েছিলেন সাইট খেতাব পাওয়ার একটা পরিচয়-পত্ৰ। ওটা দেখার সাথে সাথেই বেচারারা তাঁকে সসম্মানে স্যালুট দিয়ে ঢুকতে দিলো।

 

এখন, বিস্মিত ল্যাংডন আর সোফির দিকে চোখ রেখে টিবিং একটা তাড়না অনুভব করলো, সে কীভাবে, কত অসাধারণভাবে ওপাস দাইকে এই ষড়যন্ত্রে জড়িছে। সেই কথাটা। কিন্তু সেটা পরে বলা যাবে। এই মুহূর্তে, অন্য কাজ আছে।

 

মে এমি, টিবিং ফরাসিতে বললেন, ভু নো ক্রভেজ পাসলো সেনগ্রাল, সেস্ত লো সেন-গ্রাল কুই ভু ভে। তিনি হাসলেন। আমাদের এক সঙ্গে চলার পথটা এর চেয়ে বেশি স্পষ্ট হতে পারে না। গ্রেইল আমাদেরকে খুঁজে নিয়েছে।

 

নিরবতা।

 

তিনি এবার তাদেরকে চাপা কণ্ঠে বললেন। শুনুন। আপনারা কি এটা শুনতে পাচ্ছেন? গ্রেইলটা শত শত বছর ধরে আমাদেরকে বলে যাচ্ছে। সে প্রায়োরিদের শঠতার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে আবেদন করছে। আমি আপনাদের দুজনকেই অনুরোধ করবো, এই সুযোগটা গ্রহণ করুন। এই মুহূর্তে, আমাদের তিন জনের চেয়ে বেশি যোগ্য লোক পাওয়া যাবে না, যারা কোডটার মর্মোদ্ধার করে ক্রিপ্টোক্সটা খুলতে পারবে। টিবিং একটু থামলেন। তাঁর চোখ জ্বলজ্বল করছে। আমাদের দরকার, এক সঙ্গে একটা শপথ নেয়ার। সত্যটা উদ্ধার করে সেটা জানিয়ে দেয়া।

 

সোফি টিবিংয়ের চোখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো, আমি আমার দাদুর হত্যাকারীর সঙ্গে কোন শপথ নেবো না। আমি কেবল শপথ নিতে পারি, আপনাকে জেলে পাঠাবার।

 

টিবিং একটু মর্মাহত হলেন, তারপর সেটা কাটিয়ে উঠলেন। আমি দুঃখিত, আপনি এভাবে ভাবছেন, মাদামোয়াজেল। অস্ত্রটা ঘুরিয়ে তিনি ল্যাংডনের দিকে তাক করলেন। আর আপনি, রবার্ট? আপনি কি আমার সাথে আছেন, নাকি আমার বিরুদ্ধে?

 

 

 

১০০.

 

বিশপ ম্যানুয়েল আরিজারোসার শরীরটা অনেক ধরনের যন্ত্রণাই সহ্য করেছে, তারপরও বুকে বুলেট বিদ্ধ হবার তীব্র উত্তাপটা তাঁর কাছে একেবারেই অচেনা বলে মনে হলো। খুব গভীর আর যন্ত্রণার। শরীরের ক্ষত নয়…সেটা যেনো হৃদয়ের খুব কাছেই।

 

তিনি চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করলেন, কিন্তু মুখের ওপর বৃষ্টি পড়ছে বলে দৃষ্টিটা ঝাঁপসা হয়ে গেছে। আমি কোথায়? টের পেলেন একটা শক্ত হাত তাকে ধরে রেখেছে। তাঁর শরীরটাকে এমনভাবে তুলে ধরেছে যেনো একটা পুতুলকে কোলে করে রেখেছে। তার কালো আলখেল্লাটা এলোমেলো হয়ে গেছে।

 

একটা দুর্বল হাত দিয়ে চোখটা মুছে চেয়ে দেখলেন সাইলাস তাঁকে ধরে রেখেছে। বিশাল আকৃতির শ্বেতি লোকটা ধোয়াটে ফুটপাত দিয়ে টলতে টতে হাটছে আর চিৎকার করে হাসপাতালের জন্য ডাক দিচ্ছে। তার কণ্ঠে হৃদয় বিদীর্ণ করা আর্তনাদ। চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ছে। মুখে রক্তের দাগ।

 

আমার বাছা, আরিঙ্গাবোসা ফিসফিসিয়ে বললেন। তুমি আহত হয়েছে।

 

সাইলাস তাকালো, তার মুখে তীব্র যন্ত্রণা। আমি খুবই দুঃখিত, ফাদার। তাকে দেখে মনে হলো, সে এতো কষ্টে আছে যে, কথা বলতে পারছে না।

 

না, সাইলাস, আরিঙ্গাবোসা জবাব দিলেন। আমিই দুঃখিত, এটা আমারই দোষ। টিচার আমাকে কথা দিয়েছিলেন কোন ধরনের খুন-খারাবি হবে না, আমিও তোমাকে সেটা মেনে চলতে বলেছিলাম। আমি খুব বেশি উদগ্রীব ছিলাম। খুব বেশিই আশংকা করেছিলাম। তুমি আর আমি প্রতারিত হয়েছি। টিচার কখনও হলি গ্রেইলটা আমাদের কাছে দেবেন না।

 

আরিঙ্গাবোসা পুরনো দিনের কথা ভাবতে শুরু করলেন। স্পেনে। তার শুরুর সময়কার ঘটনা। সাইলাসকে সঙ্গে নিয়ে ওভিদোতে ছোট্ট একটা চার্চ বানানো। তার। পর, নিউইয়র্কে, লেক্সিংটন এভিনুতে, ওপাস দাইর সেন্টার।

 

পাঁচ মাস আগে, আরিঙ্গাবোসা একটি ভয়াবহ সংবাদ পেয়েছিলেন। তার সারা জীবনের কর্মটা ধ্বংসের মুখোমুখি। কাস্তেল গানডোলফোতে তার সাক্ষাৎটি তাঁর নিজের জীবনটাকেই বদলে দিলো…এই খবরটাই, বলা চলে, পুরো বিপর্যয়টাকে নির্ধারণ করে দিয়েছে।

 

আরিগারোসা গানডোলফোর জ্যোর্তিবিদ্যার লাইব্রেরিতে প্রবেশ করেছিলেন মাথা উঁচু করে। আশা করছিলেন, দারুণ একটা অভ্যর্থনা পেতে যাচ্ছেন, আমেরিকাতে ক্যাথলিক মতবাদ সম্প্রসারণ করার জন্য।

 

কিন্তু সেখানে মাত্র তিন জন উপস্থিত ছিলো।

 

ভ্যাটিকানের সেক্রেটারিয়াস। ওবিস্। দাউর।

 

দুজন উচ্চপদস্থ ইতালিয় কার্ডিনাল। পবিত্রতার ভান করে থাকা। আত্মতৃপ্ত ভঙ্গী।

 

সেক্রেটারিয়াস? হতভম্ব হয়ে আরিঙ্গাবোসা বলেছিলেন।

 

লিগ্যাল এফেয়ার্সের দায়িত্বরত কার্ডিনাল আরিজারোসার সাথে হাত মেলালেন, তারপর ঘুরে তাকালেন বিপরীত দিকে বসা কার্ডিনালের দিকে, দয়া করে, আরাম করে বসুন।

 

আরিঙ্গাবোসা বসলেন, টের পেলেন কিছু একটা হয়েছে।

 

আমি অবান্তর কথাবার্তায় খুব একটা দক্ষ নই, বিশপ, সেক্রেটারিয়াস বললেন, সুতরাং, আপনার এখানে আসার কারণটা আমাকে সরাসরিই বলতে হচ্ছে।

 

প্লিজ। খোলাখুলি বলুন। আরিঙ্গাবোসা কার্ডিনাল দুজনের দিকে তাকালেন।

 

আপনি এব্যাপারে সচেতন আছেন যে, সেক্রেটারিয়াস বললেন। হিজ হলিনেস্ এবং রোমের অন্য সবাই, একটু দেরিতে হলেও ওপাস দাইর বির্তকিত অনুশীলনের রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ব্যাপারে দারুণ চিন্তিত।

 

আচকা, আরিঙ্গারোসার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।

 

আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে চাই, সঙ্গে সঙ্গে সেক্রেটারিয়াস আবার বললেন, আপনারা আপনাদের ওপাস দাই কীভাবে চালাবেন, সেটা বদলানোর কোন ইচ্ছে হিজ হলিনেস-এর নেই।

 

আমিও সেরকমটি আশা করি না। তাহলে, আমি এখানে কেন?

 

বিশাল আকারের লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিশপ, আমি ঠিক কীভাবে এই কথাটা বলবো, বুঝতে পারছি না, তাই সরাসরিই বলি। দুদিন আগে, সেক্রেটারিয়েট কাউন্সিল, প্রায় নিরঙ্কুশভাবেই, ওপাস দাইর ব্যাপারে ভ্যাটিকানের যে অনুমোদনটা ছিলো, সেটা বাতিলের পক্ষে ভোট দিয়েছে।

 

আরিঙ্গারোসা নিশ্চিত ছিলেন তিনি ভুল শুনছেন। আমি বুঝতে পারলাম না, আবার বলবেন কি?

 

সোজা বলতে গেলে, আজ থেকে ছয়মাস পরে, ওপাস দাইকে আর ভ্যাটিকানের অঙ্গসংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হবে না। আপনারা নিজেরাই নিজেদের চার্চ হিসেবে থাকবেন। পোপ আপনাদের কাছ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। হিজ হলিনেস এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন, আর আমরা এ সংক্রান্ত আইনী কাগজপত্র তৈরি করছি।

 

কিন্তু…এটাতো অসম্ভব!

 

বরং বলা যায়, এটা একেবারেই সম্ভব আর খুব জরুরি। হিজ হলিনেস * আপনাদের আগ্রাসী নীতিমালা প্রণয়ন এবং কোরপোরাল মর্টিফিকেশন অনুশীলন করার জন্য খুবই অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেছেন। তিনি থামলেন। নারীদের প্রতি আপনাদের মনোভাবটাও ভ্যাটিকান ভালো চোখে দেখছে না। ভোলাখুলিভাবে বললে বলতে হয়, ওপাস দাই একটা দায় আর বিব্রতকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

বিশপ আরিঙ্গাবোসা ক্ষেপে গেলেন। বিব্রতকর?

 

এতে তো আপনার অবাক হবার কথা নয়।

 

ওপাস দাই হলো একমাত্র ক্যাথলিক সংগঠন, যা ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। আমাদের এখন এগারোশ যাজক রয়েছে!

 

সত্য। আমাদের সবার জন্যেই সেটা একটা সমস্যা।

 

আরিজারোসা বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়ালেন। হিজ হলিনেসকে জিজ্ঞাসা করুন, ১৯৮২ সালে, ওপাস দাই যখন ভ্যাটিকানকে সাহায্য করেছিলো, সেটা কি বিব্রতকর ছিলো!

 

সেজন্যে ভ্যাটিকান চিরদিন কতৃজ্ঞ থাকবে, সেক্রেটারিয়াস বললেন, তাঁর কণ্ঠটা শান্ত, আর অনেকেই, এটাও বিশ্বাস করে যে, ১৯৮২ সালের অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্যই আপনাদেরকে ভ্যাটিকানের অঙ্গসংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার একমাত্র কারণ।

 

এটা সত্য নয়। কথাটার খোচা আরিঙ্গারোসাকে দারুণভাবে ক্ষিপ্ত করে তুললো।

 

যা-ই হোক, আমরা ঠিক করেছি সৎবিশ্বাসে কাজ করবো। আমরা কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়ার খসড়াও করেছি। যার মধ্যে সেই টাকাটা ফেরত দেবার পরিকল্পনাও রয়েছে। সেটা পাঁচটি কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে।

 

আপনারা আমাকে কিনতে চাচ্ছেন? আরিঙ্গারাসা খুব জোরে বললেন। নিরবে চলে যাবার জন্য টাকা দিচ্ছেন? যখন ওপাস দাই-ই হলো একমাত্র যৌক্তিক কণ্ঠ।

 

একজন কার্ডিনাল চোখ তুলে তাকালেন। আমি দুঃখিত, আপনি কি বলছেন যৌক্তিক?

 

আরিঙ্গাররাসা টেবিলের সামনে ঝুঁকে কণ্ঠটা আরো তীক্ষ্ম করলেন। ক্যাথলিকরা কেন চার্চ ছাড়ছে, সেটা নিয়ে কি আপনারা সত্যি ভাবেন? আপনার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, কার্ডিনাল। লোকজন শ্রদ্ধাবোধ হারাচ্ছে। বিশ্বাসের দৃঢ়তা উধাও হয়ে গেছে। আমাদের মতবাদটা আজ যুদ্ধের মুখোমুখি। মিতাচার, স্বীকারেক্তি, কমিউনিয়ন, ব্যাপটিজম, মাস্-বেছে নেন—যেটা আপনাকে আনন্দিত করবে, সেটা বেছে নেন আর বাকিগুলোর কথা ভুলে যান। কোন ধরনের আধ্যাত্মিক দিক নির্দেশন চার্চ প্রস্তাবনা করছে?

 

তৃতীয় শতকের আইন-কানুন, দ্বিতীয় কার্ডিনাল বললেন। আধুনিক খৃস্ট অনুসারীরা অনুসরণ করতে পারে না। আজকের সমাজে সেইসব নিয়ম আর কাজ করছে না।

 

তো, সেগুলো তবে ওপাস দাইর জন্যই কার্যকর এখনও!

 

বিশপ আরিঙ্গারোসা, সেক্রেটারিয়াস বললেন, তাঁর কণ্ঠে সমাপ্তির আভাস, আগের পোপের সাথে আপনার ওপাস দাইর সম্পর্কটাকে শ্রদ্ধা করেই, হিজ হলিনেস ওপাস দাইকে ভ্যাটিকান থেকে পরিত্যাগ করার জন্য ছয় মাসের সময় দিয়েছেন। আমি বলবো, আপনি আপনার ভিন্নমত নিয়ে নিজস্ব পথে এগোন, আর নিজেদের খৃস্টিয় সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলুন।

 

আমি মানছি না! আরিজারোসা জানালেন।

 

আমি তার সাথেই এটা নিয়ে একান্তে কথা বলবো!

 

আমার মনে হয়, হিজ হলিনেস আর আপনার সাথে দেখা করতে চাইবেন না।

 

আরিঙ্গারোসা উঠে দাঁড়ালেন। তিনি আগের পোপের ব্যক্তিগতভাবে স্বীকৃতি দেয়া অঙ্গ সংগঠনকে ধ্বংস করার দুঃসাহস দেখাবেন না!

 

আমি দুঃখিত। সেক্রেটারিয়াসের চোখটাতে একটুও পলক পড়লো না। ঈশ্বরই দেন, তিনিই তুলে নেন।

 

আরিঙ্গারাসা বিস্মিত হয়ে সেই মিটিং থেকে বেড়িয়ে এসেছিলেন তীব্র আতংকে। নিউইয়র্কে ফিরে, বিষণ্ণ চোখে তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে খৃস্টান ধর্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন।

 

তার কয়েক সপ্তাহ পরেই, সেই ফোনটা এসেছিলো, যা সব কিছুই বদলে দিয়ে ছিলো। ফোনের লোকটা নিজেকে টিচার হিসেবে পরিচয় দিলেন, তার কথা শুনে ফরাসি বলে মনে হলো টিচার শব্দটা তাঁদের অনুশাসনে বহুল ব্যবহৃত। তিনি বলেছিলেন, তিনি জানেন, ভ্যাটিকান ওপাস দাইয়ের প্রতি সমর্থনটা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।

 

এটা তিনি কীভাবে জানতে পেলেন? আরিঙ্গরোসা অবাক হয়ে ভাবলেন। তাঁর ধারণা ছিলো, খবরটা ভ্যাটিকানের গুটিকয় লোকই জানে। কিন্তু খবরটা চাউর হয়ে গিয়েছিলো।

 

সব জায়গায়ই আমার কান রয়েছে, বিশপ, টিচার নিচু স্বরে বলেছিলেন। আমার সেইসব কান দিয়ে আমি নির্ভূল তথ্য পেয়ে থাকি। আপনার সাহায্যে, আমি সেই পবিত্র সিক্রেটটার অবস্থান উন্মোচিত করতে পারবো, যা আপনাকে অসামান্য ক্ষমতাবান করে তুলবে…এতোটা ক্ষমতাবান, যে, ভ্যাটিকান আপনাকে নত মস্তকে সম্ভাষণ জানাবে। ধর্ম বিশ্বাসটা বাঁচানোর জন্য পর্যাপ্ত শক্তি দেবে। তিনি থামলেন। শুধুমাত্র ওপাস দাইর জন্যই নয়, বরং আমাদের সবার জন্যে।

 

ঈশ্বর কেড়ে নেন…এবং ঈশ্বরই দিয়ে দেন।

 

আরিজারোসা একটা বিজয়ের আলো দেখতে পেলেন। আপনার পরিকল্পনাটার কথা বলুন।

 

 

 

সেন্ট ম্যারি হাসপাতালের দরজাটা যখন ভোলা হলো তখনও বিশপ আরিজারোসা অচেতন ছিলেন। সাইলাস হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লো। মাটিতে হাটু গেঁড়ে বসে সে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে শুরু করলো। রিসেপশনের সবাই অর্ধনগ্ন শ্বেতি লোকটা আর তার কোলে রক্তাক্ত যাজককে দেখে দারুণ অবাক হলো।

 

ডাক্তার এসেই আরিজারোসার নাড়ি-স্পন্দনটা পরীক্ষা করে দেখলো। উনার অনেক রক্তক্ষরণ হয়ে গেছে। আমি খুব একটা আশাবাদী নই।

 

আরিঙ্গাবোসা একটু একটু করে চোখ খুলে সাইলাসকে দেখলেন। আমার বাছা…

 

সাইলাসের হৃদয়টা তীব্র যন্ত্রণা আর ক্ষোভে ফেটে পড়লো। ফাদার, যদি আমার সারাজীবনও লেগে যায়, তারপরও আমাদেরকে যে প্রতারিত করেছে তাকে আমি খুঁজে বের করবো। আমি তাকে খুন করবো।

 

আরিঙ্গারো মাথা ঝাঁকালেন, তাঁকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাচ্ছে দেখে ব্যথিত হলেন। সাইলাস … তুমি যদি আমার কাছ থেকে কিছু শিখে না থাকো, দয়া করে… এটা শেখো। তিনি সাইলাসের একটা হাত সজোড়ে চেপে ধরলেন। ক্ষমা হলো ঈশ্বরের মহত্তম উপহার।

 

কিন্তু ফাদার…

 

আরিঙ্গারোসা চোখ বন্ধ করলেন। সাইলাস, প্রার্থনা করো।

 

 

 

১১. রবার্ট ল্যাংডন

১০১.

 

রবার্ট ল্যাংডন চাপ্টার হাউজের গম্বুজের নিচে টিবিংয়ের অস্ত্রের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

 

রবার্ট আপনি কি আমার সাথে আছেন, নাকি আমার বিরুদ্ধে? রয়্যাল হিস্টোরিয়ানের কথাটা ল্যাংডনের মনে নিরব প্রতিধ্বনি হতে লাগলো।

 

ল্যাংডন জানতো, এ কথার কোন জবাব নেই। হ্যাঁ বলা মানে, সোফিকে বিকিয়ে দেয়া। আর না-র অর্থ, তাদের দুজনকেই হত্যা করা ছাড়া টিবিংয়ের আর কোন পথ নেই।

 

ল্যাংডন তার জীবনে কখনও অস্ত্রের সাথে লড়াই করা শেখেনি। কিভাবে এরকম পরিস্থিতিতে আচরণ করবে, তাও জানে না। কিন্তু, শ্রেণী কক্ষে সে শিখেছিলো, কীভাবে হেয়ালী করে উত্তর দিতে হয়। যখন কোন প্রশ্নের সত্যিকারের উত্তর থাকে না, তখন একটা সৎ প্রতিক্রিয়াই দেখানোর থাকে।

 

হ্যাঁ এবং না-র মাঝখানের ধূসর এলাকাটি।

 

নিরবতা।

 

তার হাতে ধরা ক্রিপ্টেক্সটার দিকে তাকিয়ে, ল্যাংডন ঠিক করলো, সোজা ওখান থেকে চলে যাবে।

 

সে তার চোখ না সরিয়েই, পিছু হটতে লাগলো। সেখান থেকে বেড়িয়ে, একটা বিশাল ভোলা জায়গায় এসে পড়লো। নিরপেক্ষ-জায়গা। সে আশা করলো, ক্রিপ্টেক্সটা নিয়ে এভাবে আসাতে টিবিংকে একটা সংকেত দেয়া গেছে, সহযোগীতা করার একটা শর্ত আছে। তার নিরব সংকেতটা বলে দিচ্ছে, সে সোফিকে পরিত্যাগ করবে না।

 

এই ফাঁকে চিন্তা করার সময় পাওয়া যাবে।

 

কিন্তু ল্যাংডন আশংকা করলো, চিন্তা করার কাজটা আসলে টিবিংয়েরই প্রত্যাশা। এজন্যেই সে ক্রিপ্টেক্সটা আমাকে দিয়ে দিয়েছে। যাতে আমি সিদ্ধান্তটার ভার অনুভব করতে পারি। বৃটিশ রয়্যাল হিস্টোরিয়ান জানেন, ল্যাংডন তার একাডেমিক কৌতূহলে ক্রিপ্টেক্সটা খুলতে চাইবে। আর সে এও জানে, ক্রিপ্টেক্সটা না খোলার অর্থ হলো, ইতিহাসটা হারিয়ে যাওয়া।

 

ঘরের ভেতরে অস্ত্রের মুখে থাকা সোফিকে মুক্ত করার একটাই পথ, ক্রিপ্টেক্সটার পাসওয়ার্ড বের করা, যাতে সেটা দিয়ে টিবিংয়ের সাথে দর কষাকষি করা যায়। আমি যদি মানচিত্রটা মুক্ত করতে পারি, টিবিং তাহলে দরকষাকষি করবে। এই কঠিন কাজটা করার জন্যই ল্যাংডন দূরের জানালার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। নিউটনের সমাধির অসংখ্য জ্যোর্তিবিদ্যা সংক্রান্ত ছবিগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করলো সে।

 

যে গোলক তুমি খোঁজো, সেটা তাঁর সমাধিতেই থাকার কথা।

এটা বিবৃত করে গোলাপী শরীর আর বীজপ্রসূ গর্ভের আখ্যান।

 

ল্যাংডন টাওয়ারিং জানালার কাছে গেলো, সেখানকার স্টেইড গ্লাসের মোজাইকে অনুপ্রেরণামূলক কোন কিছু আছে কিনা দেখতে। সেখানে কিছুই নেই।

 

নিজেকে সনিয়ের চিন্তা-ভাবনায় স্থাপন করো, সে নিজেকে বললো। এবার কলেজ গার্ডেনের দিকে তাকালো। নিউটনের সমাধিতে গোলকটার ব্যাপারে তিনি কি ভাবতেন, যেটা সেখানে থাকার কথা ছিলো? তারা, ধূমকেতু, আর গ্রহ-নক্ষত্রের চিত্রসমূহ বৃষ্টি পড়ার মতো টাপুর-টুপুর করছে। কিন্তু ল্যাংডন সেগুলো এড়িয়ে গেলো। সনিয়ে তো আর বিজ্ঞানের লোক ছিলেন না। তিনি ছিলেন মানবিকতা, শিল্পকলা আর ইতিহাসের একজন মানুষ। পবিত্র নারী…চ্যালিস…গোলাপ…নিষিদ্ধ মারি মাগদালিন… দেবীদের বিলুপ্তি…হলি গ্রেইল।

 

কিংবদন্তী সবসময়ই গ্রেইলকে ছলনাময়ী রক্ষিতা হিসেবে চিত্রিত করেছে, অন্ধকারে নাচছে, দৃষ্টির আড়ালে, তোমার কানে কানে কথা বলছে, তোমার দিকে এক পা এগিয়েই উধাও হয়ে যাচ্ছে। কুয়াশায়।

 

কলেজ গার্ডেনের বন্য গাছ পালাগুলোর দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন টের পেলো হাস্যকর উপস্থিতিটা। চিহ্নগুলো সবখানেই আছে। কুয়াশার ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসা দৃশ্যের মতো, বৃটেনের সবচাইতে পুরনো আপেল গাছের ডালপালাগুলো পাঁচ পাপড়ির পাতায় ফুটছে। সবগুলোই ভেনাসের মতো জ্বলজ্বল করছে। দেবীটা এখন বাগানে। সে বৃষ্টিতে নাচছে, কালের সঙ্গীত গাইছে।

 

 

 

ঘর থেকে, স্যার লেই টিবিং খুব আত্মবিশ্বাস নিয়েই দেখতে লাগলেন, ল্যাংডন জানালার দিকে তাকাচ্ছে, মন্ত্রমুগ্ধের মতো। ঠিক যেমনটি আমি আশা করেছিলাম, টিবিং ভাবলেন। সে আসবেই।

 

কিছুক্ষণ আগেও টিবিং আশংকা করেছিলেন, ল্যাংডনের কাছে হয়তো গ্রেইল-এর চাবিটা রয়েছে। ল্যাংডন যে রাতে সনিয়ের সাথে সাক্ষাৎ করবে, সেরাতেই টিবিং পরিকল্পনা করেছিলেন, সেটা কোন কাকতালীয় ঘটনা ছিলো না। কিউরেটরের কথা আড়ি পেতে শুনে, টিবিং নিশ্চিত ছিলেন যে, ল্যাংডনের সাথে দেখা করবার জন্য সনিয়ের ব্যগ্রতার একটা অর্থই রয়েছে।

 

ল্যাংডনের রহস্যময় পাণ্ডুলিপিটাতে প্রায়োরিদের নাড়ির খবর স্পর্শ করা হয়েছে। ল্যাংডন সত্যটা ধরতে পেরেছে। আর সনিয়ে সেটা প্রকাশ হবার জন্যে ভীত ছিলেন। টিবিং একদম নিশ্চিত ছিলেন, গ্র্যান্ড মাস্টার ল্যাংডনকে চুপ করার জন্য ডেকে আনতে চেয়েছিলেন।

 

সত্যটা অনেক দিন ধরেই বোবা হয়ে আছে, আর নয়!

 

টিবিং জানতেন, তাঁকে খুব দ্রুতই কাজ করতে হবে। সাইলাসের আক্রমণে দুটো লক্ষ্য পূরণ হলো। এতে করে সনিয়ে ল্যাংডনকে নিরব থাকতে বলার অনুরোধটা আটকানো গেলো এবং আরো নিশ্চয়তা পাওয়া গেলো যে, এক সময় কি-স্টোনটা টিবিংয়ের হাতেই আসবে, সেই সাথে ল্যাংডনকেও কোডটা উদ্ধারের কাজে লাগানো যাবে।

 

সনিয়ে আর সাইলাসের দূর্ভাগ্যজনক সাক্ষাতের ব্যবস্থা করাটা খুব সহজ কাজ ছিলো। আমার কাছে সনিয়ের গভীর ভীতিটার খবর ছিলো। গতকাল দুপুরে, সাইলাস কিউরেটরকে ফোন করে নিজেকে একজন ক্ষ্যাপা পাদ্রী হিসেবে তুলে ধরে। মঁসিয়ে সনিয়ে, আমাকে ক্ষমা করবেন আমাকে এক্ষুণি আপনার সাথে কথা বলতে হবে। আমি কখনও কনফেশনের কথা চাউর করিনি। কিন্তু এবার, আমাকে বোধহয় সেটা করতেই হবে। আমি এক লোকের কনফেশন নিয়েছি, যে, দাবি করেছে, সে আপনার পরিবারকে খুন করেছে।

 

সনিয়ের প্রতিক্রিয়াটা ছিলো

 

খুবই ঘাবড়ে যাওয়ার মতো। আমার পরিবার সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। পুলিশের চূড়ান্ত রিপোর্টেও তা বলা হয়েছে।

 

হ্যাঁ, একটা গাড়ি দুর্ঘটনা, সাইলাস বলেছিলো। যে লোকটার সাথে আমি কথা বলেছি, সে বলেছে, সে তাদের গাড়িটাকে জোর করে রাস্তা থেকে ছিটকে ফেলে দিয়েছিলো, একটা নদীতে।

 

সনিয়ে চুপ হয়ে গিয়েছিলেন।

 

মঁসিয়ে সনিয়ে, লোকটা যদি আমার কাছে এমন কিছু না বলতে যাতে আপনার জীবনটাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়, তবে হয়তো আমি আপনার কাছে সরাসরি ফোনই করতাম না। সে একটু থেমেছিলো, সেই লোকটা আপনার নাতনী সোফির কথাও বলেছে।

 

সোফির নামটা উল্লেখ করাটা ছিলো চাতুর্যপূর্ণ। কিউরেটর এবার নড়েচড়ে বসলেন। তিনি সাইলাসকে অতিদ্রুত তাঁর সাথে দেখা করতে বললেন, তার সবচাইতে নিরাপদ জায়গায় লুভর অফিসে। তারপর তিনি সোফিকে বিপদটার কথা জানিয়ে ফোন করেন। রর্বাট ল্যাংডনের সাথে সাক্ষাৎকারটি সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল হয়ে যায়।

 

এখন, ল্যাংডনের কাছ থেকে সোফিকে আলাদা করতে পেরে টিবিং আঁচ করলেন, তিনি দুজনকে বেশ সফলতার সঙ্গেই বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছেন। ল্যাংডন পাস ওয়ার্ডটা খুঁজে বের করছে। সে বুঝতে পেরেছে, গ্রেইলটা খুঁজে পাওয়া আর সোফিকে বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করার গুরুত্বটা।

 

সে ওটা আপনার জন্য খুলবে না, সোফি শীতল কণ্ঠে বললো। যদি সে পাস ওয়ার্ডটা খুঁজে পায়, তবুও না।

 

কিন্তু ল্যাংডন ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো, টিবিং গ্রেইলের জন্য সবকিছুই করতে পারে। যে কারোর চেয়ে গ্রেইলটাই তার কাছে অনেক বড়।

 

ঠিক এই সময়েই, ল্যাংডন জানালার কাছে চলে এলো। সমাধিটা… হঠাৎ করেই সে বললো। তার চোখে একটা আশার আলো যেনো জ্বল জ্বল করছে। আমি জানি নিউটনের সমাধির কোথায় সেটা খুঁজতে হবে। হ্যাঁ, আমার মনে হয়, আমি পাস ওয়ার্ডটা খুঁজে পেয়েছি!

 

টিবিংয়ের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলো। কোথায়, রবার্ট? আমাকে বলুন!

 

সোফি ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে বললো, রবার্ট, না! তুমি তাঁকে সাহায্য করবে, ঠিক আছে?

 

ল্যাংডন দৃঢ় পদক্ষেপে ক্রিপ্টেক্সটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসলো।না, সে বললো, টিবিংয়ের দিকে তাকাতেই তার চোখ দুটো শক্ত হয়ে গেলো। তোমাকে চলে যেতে দেবার আগে তো নয়ই।

 

টিবিংয়ের আশাটা কালো মেঘে ঢেকে গেলো। আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ, রবার্ট। আমার সাথে খেলা খেলবেন না!

 

কোনো খেলা নয়, ল্যাংডন বললো। তাকে যেতে দিন। তারপরে, আমি আপনাকে নিউটনের সমাধিতে নিয়ে যাবো। আমরা ক্রিপ্টেক্সটা এক সঙ্গেই খুলবো।

 

আমি কোথাও যাচ্ছি না। সোফি জোর দিয়ে বললো। তার চোখ রাগে কুচকে আছে। ক্রিপ্টেক্সটা আমার দাদু আমাকে দিয়েছেন, আপনাদেরকে নয়।

 

ল্যাংডন ঘুরে দাঁড়ালো, ভীত সন্ত্রস্ত দেখালো তাকে। সোফি, প্লিজ! তুমি বিপদে আছে। আমি তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করছি!

 

কিভাবে? যে সিক্রেটটা রক্ষা করার জন্য আমার দাদু খুন হয়েছেন, সেটা বিকিয়ে দেবার মাধ্যমে? তিনি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলেন, রবার্ট। আমিও তোমাকে বিশ্বাস করেছি!

 

ল্যাংডনের নীল চোখে আতংক দেখা গেলো। টিবিং মিটি মিটি হাসছেন, তাদের দুজনের এই অবস্থা দেখে।

 

সোফি, ল্যাংডন আবেদন জানালো। প্লিজ…তুমি চলে যাও।

 

সে মাথা ঝাঁকালো। যতক্ষণ না, তুমি আমাকে ক্রিপ্টেক্সটা না দাও, অথবা মাটিতে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলছে।

 

কি? ল্যাংডন আতকে উঠলো।

 

রবার্ট, আমার দাদু সিক্রেটটা তাঁর নিজের খুনির হাতে দেখার চেয়ে বরং চিরতরের জন্য সেটা হারিয়ে যেতেই বেশি পছন্দ করতেন।

 

খুব ভালো। টিবিং অস্ত্রটা তা করলো।

 

না! ল্যাংডন চিৎকার করে বললো, ক্রিপ্টেক্সটা উপরে তুলে ধরে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিতে উদ্যত হলো। লেই, আপনি যদি এরকম কিছু ভেবেও থাকেন, আমি এটা ফেলে দেবো।

 

টিবিং হাসলেন। এই ধোকাটা রেমির বেলায় কাজ করেছিলো। আমার বেলায় সেটা হবে না। আমি আপনাকে ভালো করেই চিনি, রবার্ট।

 

তাই নাকি, লেই?

 

হ্যাঁ, তা-ই। আপনার চেহারাটাতে আরেকটু অভিব্যক্তির দরকার রয়েছে। এটা ভাবতে আমার কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছে, এখন আমি বুঝতে পারছি, আপনি মিথ্যা বলছেন। আপনার কোন ধারণাই নেই, নিউটনের সমাধির কোথায় উত্তরটা লুকিয়ে রয়েছে।

 

সত্যি, রবার্ট? আপনি জানেন, সমাধির কোথায় সেটা?

 

জানি।

 

ল্যাংডনের চোখ দেখে লেই ধরে ফেললেন যে, তাতে মিথ্যের আভাস দেখা যাচ্ছে। সোফিকে বাঁচাবার জন্য একটা মরিয়া প্রচেষ্টা। টিবিং খুবই গভীর একটা হতাশা অনুভব করলেন।

 

আমি নিঃসঙ্গ একজন নাইট, আমার চারপাশে যতোসব ফালতু লোক। আমাকে একাই, নিজে নিজে কি-স্টোনটা খুলতে হবে।

 

ল্যাংডন আর নেভু এখন টিবিং আর সেই সাথে গ্রেইলের কাছেও কাছে একটা হুমকি ছাড়া আর কিছুই না। সমাধানটা যতো পীড়াদায়কই হোক না কেন, টিবিং জানেন, সেটা তিনি করতে পারবেন। একমাত্র সমস্যা হলো, ল্যাংডনকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কি-স্টোনটা মাটিতে নামিয়ে রাখা, যাতে টিবিং খুব নিরাপদেই এই গোলক ধাঁধাটা শেষ করতে পারে।

 

বিশ্বাসের নমুনা হিসেবে, অস্ত্রটা সোফির দিকে তাক করে টিবিং বললেন। কি-স্টোনটা নামিয়ে রাখুন, তারপরে আমরা কথা বলি।

 

ল্যাংডনও জানতো, তার মিথ্যাটা ব্যর্থ হয়েছে।

 

 

 

সে টিবিংয়ের মুখে অন্ধকার সমাধাটা দেখতে পেলো, সে জানতো, সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। আমি এটা নামিয়ে রাখলেই সে আমাদের দুজনকে হত্যা করবে। সোফির দিকে না তাকিয়েই, সে তার হৃদস্পন্দনটা শুনতে পেলো। সোফি নিরবে যেনো বলছে, আকুতি জানাচ্ছে। রবার্ট, এই লোকটা গ্রেইলের উপযুক্ত নয়। দয়া করে এটা ওর হাতে তুলে দিও না। যেকোন মূল্যেই হোক।

 

জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কলেজ গার্ডেনের দিকে তাকিয়েই ল্যাংডন সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিলো।

 

সোফিকে রক্ষা করো।

 

গ্রেইলকে রক্ষা করো।

 

ল্যাংডন মরিয়া হয়ে প্রায় চিৎকার করেই বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, কীভাবে!

 

এই বিভ্রান্তিকর মুহূর্তটি এমন একটি ভাবনা সামনে নিয়ে আসলো যা তারা কখনও ভাবেনি। সত্যটা তোমার চোখের সামনে, রবার্ট। সে জানতো না, কোথা থেকে বাতাটা আসছে। গ্রেইল তোমার সাথে ঠাট্টা করছে না, সে আর্তনাদ করে ডাকছে কোন সুযোগ্য আত্মাকে।

 

লেই টিবিংয়ের কাছ থেকে কয়েক গজ দূরে, হাটু গেঁড়ে বসে, ক্রিপ্টেক্সটা মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে ধরে রাখলো ল্যাংডন।

 

হ্যাঁ, রবার্ট, টিবিং ফিসূফিস্ করে বললেন, অস্ত্রটা তার দিকে তাক করে ধরলেন। এটা নিচে নামিয়ে রাখুন।

 

ল্যাংডনের চোখ উপরের দিকে গেলো, চাপ্টার হাউজের গম্বুজের নিচে। নিচু হয়ে ল্যাংডন টিবিংয়ের অক্সটার দিকে একবার তাকালো।

 

আমি দুঃখিত, লেই।

 

মুহূর্তের মধ্যেই ল্যাংডন লাফিয়ে উঠে হাত দুটো আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলো। ক্রিপ্টেটা ছিটকে শূন্যে লাফিয়ে উঠলো।

 

 

 

লেই টিবিং টৃগারটা চাপ দিতে চাননি, তবুও তার মেডুসা থেকে একটা গুলি বের হয়ে ল্যাংডনের পাশ দিয়ে চলে গেলো। ল্যাংডন শূন্যে লাফ দিয়ে সরে গেলে গুলিটা ল্যাংডনের পায়ের কাছে মাটিতে কোথাও গিয়ে বিধলো। টিবিংয়ের অর্ধেক মস্তিষ্ক অটার নিশানা ঠিক করে রেগেমেগে তাকে আবার গুলি করতে উদ্যত হলো, আর বাকি অর্ধেক মস্তিষ্ক, তার চেয়েও বেশি চাইলো, গম্বুজের নিচে, চাটার হাউজের ছাদের দিকে তাকাতে বাধ্য করলো তাকে।

 

কি-স্টোনটা!

 

সময়টা মনে হলো বরফের মতো জমে গেলো, অনেকটা ধীর গতিতে, স্বপ্নের দৃশ্যের মতো, টিবিংয়ের পুরো জগৎটা শূন্যে ভাসা কি-স্টোন হয়ে গেলো। কয়েক মুহূর্ত সেটার দিকে তাকিয়ে চোখটা মাটির দিকে নেমে এলো।

 

টিবিংয়ের সমস্ত স্বপ্ন আর আশা মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ছে। এটা মাটিতে আছড়ে পড়তে পারে না!

 

টিবিং মুহুর্তেই অস্ত্রটা ফেলে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন, ক্রাচ দুটো ফেলে, দুটো হাত শূন্যে বাড়িয়ে দিলেন। এগিয়ে দেয়া হাতের মধ্যে পড়ন্ত কি-স্টোনটা আঁটকে গেলো।

 

কি-স্টোনটা ধরার বিজয়ী মুহূর্তটাতেও টিবিং জানতেন, সামনের দিকে খুব দ্রুতই পড়ে যাবেন তিনি। পড়ে গেলে তার হাত দুটো প্রথমে মাটিতে আছাড় খাবে, তাতে করে ক্রিপ্টেক্সটা মাটিতে সজোড়ে আঘাত পাবে।

 

এটার ভেতরে খুবই দুর্বল কাঁচ রয়েছে। প্রায় কয়েক মুহূর্ত টিবিং শ্বাস নিতে পারলেন না। মাটিতে আছাড় খেলে ক্রিপ্টেক্সটার ভেতরের কাঁচের ভায়ালটা ভেঙে গিয়ে ভিনেগার তরলটি প্যাপিরাসকে মণ্ড বানিয়ে ফেলবে।

 

একটা বন্য আতংক পেয়ে বসলো তাকে। না! ছবিটার কথা ভেবেই টিবিং আতংকিত হয়ে উঠলেন। রবার্ট, আপনি বোকা! সিক্রেটটা হারিয়ে গেলো।

 

টিবিং বিভ্রান্তের মতো ভাবতে লাগলেন। গ্রেইলটা হারিয়ে গেলো। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। ল্যাংডনের এরকম আচরনে অবাক হয়ে টিবিং সিলিন্ডারটি আলাদা করার চেষ্টা করলেন। ইতিহাসটা চিরতরে হারিয়ে যাবার আগে, সেটা এক ঝলক দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। কিন্তু অবাক হলেন, কি-স্টোনটার এক মাখা খুলতে গিয়ে দেখলেন সিলিন্ডারটা আলাদা হয়ে গেছে।

 

হাঁপাতে হাঁপাতে সিলিন্ডারের ভেতরে তাকিয়ে দেখলেন, ভেতরটা একেবারেই ফাঁকা, শুধুমাত্র ভেঁজা কাঁচটা ছাড়া। কোন লণ্ডভণ্ড হওয়া প্যাপিরাস নেই। টিবিং ল্যাংডনের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালেন। সোফির পাশেই সে দাড়িয়ে আছে। অস্ত্রটা তাঁর দিকে তাক করে রেখেছে।

 

অবাক হয়ে কি-স্টোনটার দিকে তাকিয়ে টিবিং বুঝতে পারলেন। ডায়ালগুলো আর এলোমেলো নেই। সেগুলো পাঁচটা অক্ষরের একটা শব্দ হয়ে আছে : APPLE

 

 

 

যে গোলকটা হাওয়া তুলে নিয়েছিলো। ল্যাংডন শীতল কণ্ঠে বললো, ঈশ্বরের বিরাগ ভাঁজন হয়েছিলো সে। আদি পাপ। পবিত্র নারীর পতনের একটা প্রতীক।

 

টিবিং অনুভব করলেন, সত্যটা তার ওপর আচমকাই,অদ্ভুতভাবে পতিত হয়েছে। যে গোলকটা নিউটনের সমাধিতে থাকার কথা, সেটা আর কিছু নয়, স্বর্গ থেকে পতিত হওয়া লাল টক টকে একটা আপেল, যা নিউটনের মাথায় পড়েছিলো, তাঁকে তাঁর মহৎ কর্ম সম্পাদন করতে প্রেরণা দিয়েছিলো। তাঁর শ্রমের ফল। গোলাপী দেহ, বীজপ্রসূ গর্ভ।

 

রবার্ট, টিবিং বিস্ময় আর আতিশয্যে বললেন। আপনি এটা খুলেছেন। কোথায় …মানচিত্রটা?

 

চোখের পলক না ফেলেই, ল্যাংডন তার টুইড জ্যাকেটের বুক পকেট থেকে খুবই পাতলা, ভাঁজ করা প্যাপিরাস বের করে আনলো। টিবিং যেখানে মাটিতে বসে আছেন, সেখান থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরেই, ল্যাংডন প্যাপিরাসটার ভাঁজ খুলে সেটার দিকে ইঙ্গিত করলো। বেশ কিছুক্ষণ পর, একটা পরিচিত হাসি ল্যাংডনের মুখে ছড়িয়ে পড়লো।

 

সে জানে! টিবিংয়ের মন-প্রাণ সেই জ্ঞানটার জন্য আকুল মিনতি জানাচ্ছিলো। আমাকে বলুন! টিবিং বললেন। প্লিজ! ওহ ঈশ্বর, প্লিজ! খুব বেশি দেরি হয়নি!

 

খুব ভারি পায়ের শব্দ শোনা যেতেই ল্যাংডন প্যাপিরাসটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিলো।

 

না! টিবিং চিৎকার করে বললেন, বৃথাই দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন।

 

দরজাটা ধুম করে খুলতেই বেজু ফশে একটা ষাড়ের মতো ঢুকে পড়লো। তার ক্ষিপ্ত চোখ দুটো চারপাশটা খুঁজছে, শিকারকে খুঁজছেলেই টিবিং মাটিতে পড়ে আছেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তার অস্ত্রটা হোলস্টারে ভরে রাখলো ফশে। সে সোফির দিকে তাকালো। এজেন্ট নেভু, আপনি আর মি. ল্যাংডন নিরাপদে আছেন দেখে আমি স্বস্তি অনুভব করছি।

 

ফশের পেছনে পেছনে বৃটিশ পুলিশ প্রবেশ করলো। তারা অপরাধীকে ধরে হাতকড়া পড়িয়ে দিলো।

 

সোফি ফশেকে দেখে খুবই বিস্মিত হলো। আমাদেরকে আপনি কিভাবে খুঁজে পেলেন?

 

ফশে টিবিংয়ের দিকে ইঙ্গিত করলো। সে তার আইডি কার্ডটা এ্যাবিতে ঢোকার সময় দেখিয়ে ভুল করেছিলো। গার্ডরা পুলিশের কাছ থেকে আগেই তাকে খোজার খবরটা জানতে পেরেছিলো।

 

ওটা ল্যাংডনের পকেটে আছে! টিবিং উন্মাদের মতো চিষ্কার করে বলতে লাগলেন। হলি গ্রেইলের মানচিত্রটা।

 

পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাবার সময়ও পেছনে তাকিয়ে টিবিং গর্জন করতে লাগলেন। রবার্ট! আমাকে বলুন, সেটা কোথায় লুকিয়ে রাখা আছে।

 

টিবিংয়ের দিকে চোখ রেখে ল্যাংডন বললো, শুধুমাত্র যোগ্য লোকেরাই গ্রেইলটা খুঁজে পায়, লেই। কথাটা আপনিই আমাকে বলেছিলেন।

 

 

 

১০২.

 

সবার অলক্ষ্যে সাইলাস নিরবে প্রবেশ করতেই কেনসিংটন গার্ডেনে যেনো কুয়াশা থিতু হয়ে গেলো। ভেঁজা ঘাসের ওপরে হাটু গেঁড়ে বসে পড়ে সাইলাস টের পেলো পাঁজরে বিদ্ধ হওয়া বুলেটটার ক্ষত থেকে রক্ত ঝড়ে পড়ছে। তারপরও, সে সোজা সামনের দিকে চেয়ে আছে।

 

কুয়াশার কারণে জায়গাটা স্বর্গের মতো লাগছে।

 

রক্তাক্ত হাত দুটো তুলে প্রার্থনা করতে শুরু করতেই দেখতে পেলো বৃষ্টির পানি তার আঙুলগুলোকে পরশ বুলিয়ে সেগুলোকে আবার সাদা করে ফেলেছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো জোরে জোরে পড়তে শুরু করলে তার মনে হলো, তার দেহটা একটু একটু করে কুয়াশায় মিশে যাচ্ছে।

 

আমি ভূত।

 

একটা দকা বাতাস তাকে অতিক্রম করে গেলো, তাতে পৃথিবীর নতুন জীবনের সুবাস ছিলো। তার শরীরের প্রতিটি সজীব কোষের সাহায্যে সাইলাস প্রার্থনা করলো। ক্ষমার জন্যে প্রার্থনা। দয়া ভিক্ষার জন্যে প্রার্থনা। আর সবচাইতে বেশি চাইলো, তার রক্ষাকর্তা…বিশপ আরিজারোসার জন্য…যেনো ঈশ্বর তাঁকে তাঁর সময়ের আগে তুলে

 

নেন। তাঁর অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে।

 

কুয়াশাটা এখন তাকে যেনো পেঁচিয়ে ধরলো, সাইলাসের নিজেকে এতোটাই হাল্কা বলে মনে হলো যে, বাতাসের একটা ঝাঁপটা বুঝি তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। চোখ বন্ধ করে সে তার চুড়ান্ত প্রার্থনাটা সেরে নিলো।

 

কুয়াশার কোথাও থেকে আরিজারোসার কণ্ঠটা তাকে ফিসফিস করে বললেন।

 

আমাদের ঈশ্বর খুবই ভালো এবং ক্ষমাশীল।

 

অবশেষে, সাইলাসের যন্ত্রণাটা কমতে শুরু করলো, আর সে জানতো বিশপ ঠিকই বলেছেন।

 

 

 

১০৩.

 

শেষ বিকেলে লন্ডনে সূর্যের মুখ দেখা গেলে শহরটা শুকাতে শুরু করলো। জিজ্ঞাসাবাদ করার ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে বেজু ফশের খুব ক্লান্ত লাগছে। হাত নেড়ে একটা ট্যাক্সি থামালো। স্যার লেই টিবিং খুবই বাক চাতুর্যের সাথে নিজেকে নির্দোষ হিসেবে দাবি করছেন।

 

অবশ্যই। ফলে ভাবলো। উন্মাদ। টিবিং নিখুঁতভাবেই নিজেকে প্রদর্শন করেছেন একটা পরিকল্পনা আঁটতে, যাতে মনে হয়, তিনি নির্দোষ। ভ্যাটিকান আর ওপাস দাই, দুটোকেই ব্যবহার করেছেন তিনি। এই দুটো দলই আসলে নির্দোষ বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তাঁর নোংরা কাজগুলো না জেনেই, ধর্মোন্মাদ এক সন্ন্যাসী আর একজন বেপরোয়া বিশপ জড়িয়ে পড়েছিলো। তার চেয়েও বেশি চালাকি করে টিবিং তার ইলেকট্রনিক আঁড়িপাতার যন্ত্রগুলো এমন এক জায়গায় স্থাপন করেছিলেন, যেখানে পোলিওতে পঙ্গু হওয়া ব্যক্তির পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব নয়। আসলে তার হয়ে তাঁর কাজের লোক রেমিই নজরদারী করতে একমাত্র ব্যক্তি, যে টিবিংয়ের পরিচয়টা জানতো—এখন সেও এলার্জিক প্রতিক্রিয়ায় মারা গেছে।

 

শ্যাতু ভিলে থেকে কোলেতের পাঠানো খবরগুলো শুনে মনে হচ্ছিলো টিবিংয়ের ধূর্ততা এতোটাই চমৎকারভাবে চলেছে যে, ফশের নিজেরও এটা থেকে শেখার অনেক কিছুই আছে। খুব সফলভাবেই, প্যারিসের সবচাইতে শক্তিশালী অফিসে আঁড়িপাতার যন্ত্র বসানোর মধ্য দিয়ে বৃটিশ রয়্যাল হিস্টোরিয়ান গৃক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ট্রোজান ঘোড়া। তার কয়েকজন শিকারকে খুব চমৎকার শিল্পকর্ম উপহার দিয়েছিলেন তিনি। বাকিদেরকে, নিলামে কিছু জিনিস পাইয়ে দিয়ে, তাতে নির্দিষ্ট কোন জায়গায় যন্ত্রগুলো বসিয়ে দিয়েছেন। সনিয়ের বেলায়, তাঁকে শ্যাতু ভিলে একটা ডিনার-পর্টির দাওয়াত দিয়ে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, লুভরে দা ভিঞ্চির একটা উইং নির্মানের সম্ভাব্য তহবিলের ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে। সনিয়েকে সঙ্গে করে একটা রোবোটিক নাইট মূর্তি নিয়ে গিয়েছিলেন। কেনো, গুজব ছিলো, জিনিসটা তিনিই তৈরি করেছেন। সেটা ডিনারের সময় নিয়ে আসুন? টিবিং অনুরোধ করে বলেছিলেন। সনিয়ে তাই ওটা সঙ্গে করেই নিয়ে গিয়েছিলেন আর নাইট মূর্তিটা দীর্ঘ সময়ের জন্য রেমির কাছে ছিলো। সেই সময়েই, সনিয়ের অগোচরে মূর্তিটার ভেতরে আড়িপাতার যন্ত্রটা বসিয়ে দেয়া হয়েছিলো, রেমিই করেছিলো কাজটা।

ক্যাবের পেছনের সিটে বসে ফশে চোখ দুটো বন্ধ করলো। প্যারিসে ফিরে যাবার আগে, আরেকটা জায়গায় আমাকে যেতে হবে। সেন্ট মারি হাসপাতালের রিকভারি রুমটা খুবই রৌদ্রোজ্জ্বল।

আপনি আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন, নার্স বললো, তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। অলৌকিকের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

বিশপ আরিজারোসা একটা দুর্বল হাসি দিলেন। আমি সব সময়ই আশীর্বাদ পেয়েছি।

 

নার্স তার কাজ শেষ করে বিশপকে একা রেখে চলে গেলো। সূর্যের আলোটা তার চেহারায় উষ্ণতা এবং অভ্যর্থনার অনুভূতি সৃষ্টি করলো। গতরাতটি ছিলো তার জীবনের সবচাইতে অন্ধকারময় রাত।

 

উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি সাইলাসের কথা ভাবলেন, যার দেহটা পার্কে খুঁজে পাওয়া গেছে।

 

দয়া করে বাছা আমার, ক্ষমা করে দিও।

 

আরিঙ্গারোসা তার গৌরবোজ্জ্বল পরিকল্পনার চুড়ান্ত মুহূর্তটিতে সাইলাসের সাথে মিলিত হবার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। গতরাতে, আরিঙ্গারোসা বেজু ফশের কাছ থেকে একটা ফোন পেলেন, সে বিশপকে তার পরিচিত একজন নান, সেন্টসালপিচে খুন হবার ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো। আরিঙ্গাবোসা বুঝতে পেরেছিলেন, সবকিছু মারাত্মক রকমেই গড়বর হয়ে গেছে। আরো চারজনের হত্যার খবরটা তাঁর ভীতিকে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় পরিণত করে তুললো। সাইলাস! তুমি করেছে কি!

 

টিচারের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে বিশপ বুঝে গিয়েছিলেন তাঁকে ঝেড়ে ফেলা হয়েছে। ব্যবহার করে ফেলে দেয়া হয়েছে। এইসব বীভৎস ঘটনার ধারাবাহিকতা বন্ধ করা জন্য তিনি ফশের কাছে সব খুলে বলেছিলেন। আর তখন থেকেই, আরিঙ্গাবোসা আর ফশে সাইলাসকে দিয়ে টিচার আর কোন খুনখারাবি করার আগেই তাকে ধরার জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়।

 

খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে, আরিঙ্গাররাসা চোখ বন্ধ করে টেলিভিশন সংবাদে প্রখ্যাত বৃটিশ নাইট, স্যার লেই টিবিংয়ের পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার খবরটা শুনতে লাগলেন। টিচার সবার কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেছেন। টিচার আগে ভাগেই জানতে পেরেছিলেন যে, ভ্যাটিকান ওপাস দাইকে পরিত্যাগ করছে। তিনি আরিজারোসাকে তার পরিকল্পনার একটি ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। হাজার হোক, আমার মতো সবকিছু উজাড় করে আর কে গ্রেইলের জন্য ঝুঁকি নেবে? যে গ্রেইলটা অধিকার করবে সে-ই অপরিমেয় ক্ষমতার অধিকারী হবে।

 

লেই টিবিং নিজের পরিচয়টা খুবই চাতুর্যের সাথে রক্ষা করেছেন ফরাসি বাচনভঙ্গীতে কথা বলে, দাবি করেছিলেন মূল্য পরিশোধের জন্য এমন কিছুর, যার দরকার তার ছিলো না টাকা। আরিঙ্গাবোসা এতোটাই উদগ্রীব ছিলেন যে, সন্দেহই করেননি। বিশ মিলিয়ন ইউরো ডলারের মূল্যটা গ্রেইল অর্জনের সাথে তুলনা করলে তেমন বিশাল কিছু না। আর ভ্যাটিকান থেকে ওপাস দাইর আলাদা হবার জন্য ফেরত দেয়া বিশাল অংকের টাকা, ব্যাপারটাকে একেবারেই সহজসাধ্য করে ফেললো। অন্ধ তাই দেখে, যা সে দেখতে চায়। টিবিংয়ের অনিবার্য অসম্মানটা ছিলো, অবশ্যই, পেমেন্টটা ভ্যাটিকানের বন্ডের মাধ্যমে দাবি করাটা, যাতে কোন কিছু গড়বর হলে, তদন্ত কাজটি রোম পর্যন্ত চলে যায়।

 

আমি খুবই খুশি যে, আপনি ভালো আছেন, মাই লর্ড।

 

আরিঙ্গারোসা দরজার সামনে থেকে বলা গুরু-গম্ভীর কণ্ঠস্বরটা চিনতে পারলেন, কিন্তু মুখটা ছিলো অপ্রত্যাশিত ঝজু, শক্তিশালী গঠনের, চকে উল্টো করে আঁচড়ানো চুল আর চওড়া কাঁধ, যা তার কালো স্যুটটার সাথে আঁটোসাঁটো হয়ে আছে। ক্যাপ্টেন ফশে? আরিজারোসা জিজ্ঞেস করলেন।

 

ক্যাপ্টেন বিছানার কাছে এসে একটা অতিপরিচিত কালো রঙের বৃফকেস চেয়ারের ওপরে রাখলো। আমার বিশ্বাস এটা আপনার।

 

আরিঙ্গারোসা বৃফকেসটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেটা বন্ডেপূর্ণ, তারপর সঙ্গে সঙ্গেই মুখটা সরিয়ে নিলেন। খুব লজ্জা লাগলো তার। হ্যা…আপনাকে ধন্যবাদ। একটু থেমে আবার বললেন, ক্যাপ্টেন, আমি খুব গভীরভাবে ভেবে দেখেছি, আর আপনার কাছে আমি একটু সাহায্যও কামনা করি।

 

অবশ্যই।

 

প্যারিসের সেইসব পরিবারে, সাইলাস যাদেরকে… তিনি আবারো একটু থামলেন। নিজের আবেগটা নিয়ন্ত্রনে নিলেন। আমি জানি, তাদের ক্ষতি পুষিয়ে দেবার জন্য কোন বড় অংকের টাকাই যথেষ্ট নয়, তারপরও, যদি পারেন তো, এই বৃফকেসের টাকাগুলো তাদের মধ্যে বন্টন করে দেবেন…সেই সব শোকসন্তপ্ত পরিবারের মধ্যে।

 

ফশের কালো চোখ দুটো তাকে অনেকক্ষণ ধরেই নিরীক্ষণ করছিলো। একটা সদগুণসম্পন্ন ইচ্ছা, মাইলর্ড। আমি আপনার ইচ্ছাটার বাস্তবায়ন দেখতে পাচ্ছি।

 

গভীর একটা নিরবতা নেমে এলো।

 

টেলিভিশনে, একটা বিশাল বাড়ির সামনে বসে একজন ফরাসি পুলিশ অফিসারের প্রেস কনফারেন্স করার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। ফশে লোকটা কে সেটা দেখার জন্য পর্দার দিকে মনোযোগ দিলো।

 

লেফটেনান্ট কোলেত, বিবিসির একজন সংবাদদাতা বললো, মেয়েটার কণ্ঠ অভিযোগকারীর মতো। গত রাতে, আপনার ক্যাপ্টেন দুজন নিরপরাধ লোককে জন সম্মুখে হত্যার জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন। রবার্ট ল্যাংডন আর সোফি নেভু কি আপনার ডিপার্টমেন্টের কাছে এজন্যে দোষী ব্যক্তির বিচার চেয়েছেন? এতে করে কি ক্যাপ্টেন ফশে তার চাকরিটা হারাবেন?

 

লেফেটেনান্ট কোলেতের হাসিটা ক্লান্ত কিন্তু শীতল। আমার অভিজ্ঞতা বলে যে, ক্যাপ্টেন বেজু ফশে খুব একটা ভুল করেন না। এ ব্যাপারে আমি তার সাথে এখনও কোন কথা বলিনি। কিন্তু, তিনি কীভাবে কাজ করেন, সেটা জানি বলেই বলছি, আমার মনে হচ্ছে, জনসম্মুখে তিনি সোফি নেভু আর মি. ল্যাংডনকে অভিযুক্ত করে আসলে সত্যিকারের খুনিকে ধরার জন্য প্রলুব্ধ করেছেন।

 

সংবাদদাতারা একে অন্যের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। কোলেত বলতে লাগলো। মি. ল্যাংডন আর মিস্ নেভু, এই নাটকে ইচ্ছাকৃতভাবে জড়িয়েছেন কিনা, সেটা অবশ্য আমি জানি না। ক্যাপ্টেন ফশে তার পদ্ধতিগুলো কাউকে বলেন না। আমি যা বলতে পারি, তা হলো, ক্যাপ্টেন খুব সফলভাবেই আসল খুনিকে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। আর কি! ল্যাংডন আর মিস নেভু নিরাপদে আছেন।

 

ফশের ঠোঁটে পাতলা একটা হাসি। সে আরিঙ্গারোসার দিকে ঘুরলো। একজন ভালো মানুষ, এই কোলেটা।

 

কয়েক মুহূর্ত পার হয়ে গেলো। অবশেষে, ফলে তার মাথায় আঙুল চালিয়ে চুলগুলো পেছন দিকে টেনে নিয়ে আরিঙ্গারোসর দিকে তাকালো। মাই লর্ড, প্যারিসে ফিরে যাবার আগে, আমি একটা বিষয়ে আপনার সাথে একটু আলোচনা করতে চাই। আপনার লন্ডনের অনির্ধারিত ফ্লাইটটা। আপনি পাইলটকে গন্তব্য বদলানোর জন্য ঘুষ দিয়েছিলেন। এটা করে আপনি একটি আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছেন।

 

আরিজারেসা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমি খুবই মরিয়া ছিলাম।

 

হ্যাঁ। ঠিক যেমনটি পাইলট ছিলো; আমার লোকজন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

 

ফশে তার পকেট থেকে একটা সুন্দর পাথরের আঙটি বের করলো।

 

আরিঙ্গাবোসা আঙটিটা ফিরে পেয়ে, নিজের আঙুলে ওটা পরার সময় কেঁদে ফেললেন। আপনি খুবই দয়ালু। তিনি ফশের হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলেন। ধন্যবাদ আপনাকে।

 

ফশে উঠে জানালার কাছে গেলো, বাইরে শহরের দিকে তাকালো। ঘুরে জিজ্ঞাসা করলো, মাইলর্ড, আপনি এখান থেকে কোথায় যাবেন?

 

আমার আশংকা, আমার পথটা আপনার পথের মতোই অনিশ্চিত।

 

হ্যাঁ। ফশে থামলো। আমার মনে হচ্ছে, আমাকে একটু আগেভাগেই অবসরে যেতে হবে।

 

আরিঙ্গারোসা হাসলেন। ছোট্ট একটা বিশ্বাস বিস্ময়কর কিছু করতে পারে, ক্যাপ্টেন। অল্প একটু বিশ্বাস।

 

 

 

১০৪.

 

রোজলিন চ্যাপেল—প্রায়শই যাকে বলা হয় কোডের ক্যাথেড্রাল-স্কটল্যান্ডের এডিনবরাহর সাত মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। একটা প্রাচীন মিথারেই মন্দিরের পাশে ১৪৪৬ সালে নাইট টেম্পলাররা এটা নির্মাণ করে। চ্যাপেলটাতে খোঁদাই করা আছে ইহুদি, খৃস্টান, মিশরীর, ম্যাসোনিক আর প্যাগান প্রতীক। সেগুলো চিন্তার খোরাক যোগায়।

 

চ্যাপেলটার ভৌগলিক অবস্থান, নিখুঁতভাবেই উত্তর-দক্ষিণ মধ্যরেখা বরাবর যা গ্লাস্টনবারি দিয়ে চলে গেছে। এই দ্রাঘিমাংশ রোজলাইন হলো কিং আর্থারের আইল অব আভালনের একটি ঐতিহবাহী চিহ্ন, আর এটাকে বৃটেনের পবিত্র ভূমিরূপের কেন্দ্রীয় স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রোজ লাইন সত্যিকারের বানানটা ছিলো রোজলিন—সেখান থেকেই এসেছে।

 

রোজলিনের অমসৃন চূড়াটা ছায়ায় ঢেকে যেতেই ল্যাংডন আর সোফি একটা ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে চ্যাপেলটার সামনে এসে পড়লো। লন্ডন থেকে এডিনবরাহর ছোট্ট ফ্লাইটটা বিশ্রামের হলেও এখানে কী ঘটাবে বা কী দেখতে পাবে, এই ভেবে ভেবে না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে চ্যাপেলটার দিকে তাকিয়ে ল্যাংডনের মনে হলো, যেনো এলিস খোরগোশের গর্তে পড়ে গেছে। এটা স্বপ্নই হবে। তারপরও, সনিয়ের চূড়ান্ত মেসেজটা যে এর চেয়ে বেশি নির্দিষ্ট হতে পারতো না, সেটা সে জানতো।

 

হলি গ্রেইল প্রাচীন রোজলিনের নিচে অপেক্ষা করে।

 

ল্যাংডন ভেবেছিলো সনিয়ের গ্রেইল মানচিত্রটা কোন ডায়াগ্রামই হবে—একটা ড্রইংয়ে X মার্ক দিয়ে একটা জায়গা চিহ্নিত করা–আবারো প্রায়োরিদের চূড়ান্ত সিক্রেটটা উন্মোচিত হলো, সেই শুরু থেকে যেমনটি হয়ে এসেছে, তেমন করেই। সহজ সরল পংক্তির মধ্য দিয়ে। চারটা লাইনে, কোন সন্দেহ ছাড়াই, এই জায়গাটাকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। সরাসরি রোজলিন নামটা উল্লেখ করলেও পংক্তিটাতে চ্যাপেলটার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যশৈলীর উল্লেখ রয়েছে।

 

যদিও সনিয়ের চূড়ান্ত প্রকাশটা খুবই স্পষ্ট, তারপরও ল্যাংডনের মনে হলো, একটু ভারসাম্যহীন, আলোকিত নয়। তার কাছে, জায়গা হিসেবে এটা একেবারেই নিশ্চিত ছিলো। শত শত বছর ধরে, এই পাথরের চ্যাপেলটি হলি গ্রেইলের উপস্থিতির কথা প্রতিধ্বনি করে আসছে। এই ফিসফাটা ইদানীংকালে চিৎকারে পরিণত হয়েছে, যখন ভূমি ভেদকারী রাডার দিয়ে দেখা গেলো যে, এর নিচে আরেকটা বিস্ময়কর স্থাপত্যের অস্তিত্ব রয়েছে—একটা বিশাল ভূ-গর্ভস্থ কক্ষ। এটা যে কেবল চ্যাপেলের নিচেই আছে তা নয়, বরং এর ভেতরে ঢোকা বা বের হবার কোন পথও নেই। আর্কিওলজিস্টরা পাথর ভেদ করে রহস্যময় কক্ষের ভেতরে অনুসন্ধানের জন্য আবেদন জানিয়েছিলো, কিন্তু রোজলিন ট্রাস্ট পবিত্র স্থানটিতে এরকম কোন কিছু করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। আর এজন্যেই, অনুমান আর সন্দেহের আগুনে ব্যাপারটা আরো বেশি ঘি ঢেলে দিয়েছে। রোজালিন ট্রাস্ট কি লুকাতে চেষ্টা করছে?

 

রহস্য অনুসন্ধানকারীদের জন্য রোজালিন এখন তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ দাবি করে, এ জায়গার একটা চৌম্বক ক্ষেত্র তাদেরকে এখানে টেনে এনেছে, আর কেউ দাবি করে, তারা পাহাড়ি এলাকায় একটা প্রবেশ পথ খুঁজতে এসেছে, যেখান দিয়ে সেই লুকানো কক্ষটাতে ঢোকা যাবে। কিন্তু বেশিরভাগই স্বীকার করে তারা শুধু এটা দেখতে আসে। হলি গ্রেইলের আকর্ষণে।

 

যদিও এর আগে ল্যাংডন রোজলিনে আসেনি, তারপরও, সে যখনই শুনেছে, চ্যাপেলটাকে হলি গ্রেইলের বর্তমান আবাস হিসেবে বিচেনা করা হয়, মিটি মিটি হেসেছে সে। স্বীকার করতেই হবে, রোজলিনে এক সময় গ্রেইলটা ছিলো, সেটা অনেক আগের কথা…কিন্তু নিশ্চিতভাবেই, এখন না। আজ হোক, কাল হোক, কেউ না কেউ, গোপন কক্ষটাতে ঢোকার পথ বের করবেই।

 

সত্যিকারের গ্রেইল একাডেমিকরা একমত পোষণ করেন যে, রোজলিন একটা ফাঁদ—এমন একটি কানা গলি, যা প্রায়োরিরা খুব নিখুঁতভাবেই প্রয়োগ করেছে। আজ, প্রায়োরিদের কি-স্টোনটা একটা পংক্তির মধ্যে দিয়ে সরাসরি এই জায়গাটাকেই নির্দেশ করেছে। তাই ল্যাংডন আর এ নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করতে পারছে না। এটাকে ল্যাংডন। এক কথায় উড়িয়ে দিতেও পারছে না। সারাটা দিন তার মনে হতবুদ্ধিকর একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো :

 

সনিয়ে কেন এই জায়গাটাতে আমাদের নিয়ে যেতে চাইছেন?

 

একটাই যৌক্তিক কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে।

 

রোজলিন সম্পর্কে এমন কিছু একটা আছে, যা আমরা এখনও বুঝতে পারিনি।

 

রবার্ট? সোফি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ছিলো, তার দিকে ফিরে বললো। তুমি কি আসছো না? তার হাতে রোজউড বাক্সটা, ক্যাপ্টেন ফশে তাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে সেটা। ভেতরে দুটো ক্রিপ্টেক্সকেই আবার আগের অবস্থায় রাখা হয়েছে।

 

প্যাপিরাসটা ভাঁজ করে রাখা হয়েছে ভেতরে-কেবল ভেঙে যাওয়া ভিনেগারের ভায়ালটা ছাড়া।

 

দীর্ঘ পাথরের পথটা দিয়ে চ্যাপেলের দিকে যাওয়ার সময়, ল্যাংডন আর সোফি চ্যাপেলের বিখ্যাত পশ্চিম দেয়ালটা অতিক্রম করে গেলো। অনিয়মিত দর্শনার্থীরা এই দেয়ালটাকে দেখে মনে করবে, এটা চ্যাপেলেরই অংশ যেটার কাজ পুরোপুরি শেষ করা হয়নি। সত্যটা হলো, ল্যাংডন মনে করতে পারলো, আরো বেশি কৌতূহলোদ্দীপক।

 

সলোমন মন্দিরের পশ্চিম দেয়াল।

 

নাইট টেম্পলাররা রোজলিন চ্যাপেলকে ঠিক জেরুজালেমের সলোমন মন্দিরের স্থাপত্য-নক্সার আদলে নির্মাণ করেছিলেন পশ্চিম দেয়ালটাসহ একটা সংকীর্ণ আয়তক্ষেত্রাকৃতির উপাসনার স্থান, আর ভূগর্ভস্থ কক্ষ, যেখানে সত্যিকারের নয় জন নাইট সর্ব প্রথম তাঁদের সম্পদগুলো খুড়ে বের করেছিলো।

 

রোজলিন চ্যাপেলের প্রবেশদ্বারটি ল্যাংডনের ধারণার চেয়েও বেশি সাদামাটা। ছোট্ট কাঠের দরজাটার রয়েছে দুটো কড়া আর একটা ও চিহ্ন।

 

রোজলিন

 

রোজলিন শব্দটার বানান এসেছে রোজ লাইন শব্দ থেকে, ল্যাংডন সেটা সোফিকে বুঝিয়ে বললো। আর রোজ লাইন এসেছে চ্যাপেলের ভেতরকার মধ্য রেখাটার জন্যে। আবার গ্রেইল একাডেমিকগণ এটা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে যে, লাইন অব রোজ থেকেই সেটা এসেছে–ম্যারি মাগদালিনের বংশধারা।

 

রোজেজ। দেবীর গর্ভ।

 

চ্যাপেলটা খুব শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ল্যাংডন দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। যদিও সে রোজলিনের ভেতরকার পাথরের কাজগুলো সম্পর্কে পড়েছে, কিন্তু নিজের চোখে সেটা দেখা দারুণ উত্তেজনার একটি ব্যাপার।

 

প্রতীক বিদ্যার স্বর্গ, ল্যাংডনের এক সহকর্মী এটাকে এ নামেই ডাকে।

 

চ্যাপেলের প্রতিটি পৃষ্ঠই কোন না কোন প্রতীকে খোঁদাই করা-খৃস্টিয় ক্রুশাকৃতি, ইহুদি তারা, ম্যাসোনিক সিল, টেম্পলার ক্রশ, করনুকোপিয়াস, পিরামিড, জ্যোর্তিবিদ্যার চিহ্ন, গাছপালা, শাক-সবজি, পেনটাকল আর গোলাপ। নাইট টেম্পলাররা ছিলেন পাথরের কাজে ওস্তাদ। সারা ইউরোপেই তারা চার্চ ছড়িয়ে দিয়েছিলো, কিন্তু রোজলিনই তাদের সবচাইতে সেরা কাজ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। পাথুরে কাজের ওস্তাদেরা কোন পাথরই খোঁদাই না করে রাখেনি। রোজলিন চ্যাপেল হলো সব বিশ্বাসের মন্দির …সব সংস্কৃতির…আর সবার ওপরে, সব প্রকৃতি এবং দেবীর।

 

মন্দিরটা কতিপয় দর্শনার্থী ছাড়া প্রায় ফাঁকাই বলা চলে। সেইসব দর্শনার্থী একজন তরুণের বলা কিছু কথা শুনছে। সে তাদেরকে একটা সারি করে একটা দেয়ালের দিকে নিয়ে যাচ্ছে—একটা অদৃশ্য পথ মন্দিরের ভেতরের ছয়টি প্রধান স্থাপত্যিক অবস্থানের সাথে সংশ্লিষ্ট। দিনের পর দিন, দর্শনার্থীরা এইসব সোজা রেখাগুলো অতিক্রম করে যায়, আর তাদের পায়ের ছাপ জমিনের ওপরে অসংখ্য প্রতীকের ছাপ ফেলে দেয়।

 

✡︎

 

ডেভিডের তারা, ল্যাংডন ভাবলো। কোন কাকতালীয় ব্যাপার নেই এখানে। সলেমনের সিল হিসেবেও এটা পরিচিত, এই ছয়মাথা বিশিষ্ট তারাটি এক সময় ছিলো স্টার গেজিং যাজকদের গোপন প্রতীক, পরে, সেটা ইসরাইলী রাজা গ্রহণ করে নেয়—ডেভিড আর সলোমন।

 

বন্ধ হবার সময় হয়ে গেলেও ডোসেন্ট ল্যাংডন আর সোফিকে আসতে দেখে একটা সুন্দর হাসি দিলো। তাদেরকে ঘুরে ঘুরে দেখার জন্য একটা ইঙ্গিত করলো।

 

ল্যাংডন মাথা নেড়ে ধন্যবাদ জানালে তাকে, তারপর মন্দিরের ভেতরে ঢুকে পড়লো। সোফি, কি কারণে জানি, দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলো, তার চোখে মুখে হতবুদ্ধিকর একটা ভাব। কী হয়েছে? ল্যাংডন জিজ্ঞেস করলো।

 

সোফি চ্যাপেলটার চারপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। আমার মনে হয় …আমি এখানে এসেছিলাম।

 

ল্যাংডন খুব অবাক হলো। কিন্তু তুমি বলেছিলে, তুমি এমন কি রোজলিনের নামটিও শোনননি।

 

তা শুনিনি… সে চারপাশটা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো। তাকে দেখে অনিশ্চিত মনে হলো। আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন আমার দাদু আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। আমি ঠিক জানি না। আমার খুব চেনা-চেনা লাগছে। ভেতরটার চারপাশ ভালো করে দেখার পর সে আরো বেশি নিশ্চিত হয়ে মাথা দোলাতে লাগলো।

 

হ্যাঁ সে মন্দিরের সামনের দিকটাতে ইঙ্গিত করলো। ঐ দুটি স্তম্ভ…আমি দেখেছি।

 

ল্যাংডন মন্দিরের অন্য পাশে খুব সূক্ষ্মভাবে কারুকার্য খচিত, ভাস্কর্য সম্বলিত স্তম্ভ দুটোর দিকে তাকালো। স্তম্ভ দুটোর অবস্থান যেখানে সাধারণত বেদী থাকে সেই জায়গায়। ব্যাপারটা অদ্ভুত। বাম দিকের স্তম্ভটা অপেক্ষাকৃত কম কারুকাজ করা। সেই তুলনায় ডান দিকেরটা বেশি নক্সা করা, ফুলের কাজ আছে।

 

সোফি ইতিমধ্যেই সেগুলোর দিকে চলে গেছে। ল্যাংডনও দ্রুত তার পিছু পিছু চললো। স্তম্ভগুলোর কাছে পৌঁছাতেই সোফি আরো বেশি নিশ্চিত হয়ে মাথা নাড়তে লাগলো।

 

হ্যাঁ, আমি একদম নিশ্চিত, আমি এগুলো আগে দেখেছি!

 

তুমি যে এগুলো আগে দেখেছে সে ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই, ল্যাংডন বললো, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এখানেই দেখেছো।

 

সে ঘুরে দাঁড়ালো। কি বলতে চাচ্ছে?

 

এই দুটো স্তম্ভ ইতিহাসের সবচাইতে বেশি নকল স্থাপত্যিক অবকাঠামো। রেপ্লিকা বা প্রতিরূপ সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে রয়েছে।

 

রোজলিনের রেপ্লিকা? তাকে সন্দেহগ্রস্ত বলে মনে হলো।

 

না। স্তম্ভগুলো। তোমার কি মনে আছে, একটু আগে আমি তোমাকে বলেছিলাম যে, রোজলিন সলোমনের মন্দিরের অনুকরণ? এই দুটো স্তম্ভ, সলোমনের মন্দিরের দুটো স্তম্ভের একেবারে অনুকরণে নির্মিত হয়েছিলো। ল্যাংডন বাম দিকের পিলারটা দেখিয়ে বললো, এটাকে বলে বোয়াজ-অথবা ম্যাসনের স্তম্ভ। অন্যটাকে বলে জখিন অথবা শিক্ষানবীস স্তম্ভ। সে একটু থামলো। আসলে, পৃথিবীর সব ম্যাসোনিক মন্দিরেরই এ রকম দুটো স্তম্ভ রয়েছে।

 

ল্যাংডন তাকে এরই মধ্যে টেম্পলারদের সাথে আধুনিক ম্যাসোনিক গুপ্ত সংঘের যে নিবিড় সম্পর্ক ছিলো, সেই কথাটা বলেছিলো। যাদের প্রাইমারি ডিগ্রিগুলো হলো শিক্ষানবীস ফ ম্যাসন, ফেলোক্রাফট ফু ম্যাসন এবং মাস্টার ম্যাসন। সোফির দাদু তাঁর কবিতার শেষ পংক্তিতে, সরাসরিই মাস্টার ম্যাসনদের উল্লেখ করেছেন, যারা রোজলিনের কারুকার্য করেছিলো। এটাতে রোজালিনের মাঝখানের ছাদের কথাও বলা আছে, যাতে গ্রহ-নক্ষত্র আর তারার ছবি খোঁদাই করা।

 

আমি কখনও ম্যাসোনিক মন্দিরে আসিনি, সোফি বললো, এখনও স্তম্ভগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একেবারে নিশ্চিত, এগুলো আমি এখানেই দেখেছি। সে ঘুরে চ্যাপেলের ভেতরে চলে গেলো, যেনো কিছু একটা খুঁজতে, যাতে তার স্মৃতিটা মিলে যায়।

 

বাকি দর্শনার্থীরা চলে গেলে তরুণ ডোসেন্ট তাদের দিকে হাসি মুখে এগিয়ে এলো। ছেলেটা দেখতে খুব সুন্দর, বিশের মতো বয়স হবে। সোনালী চুলের। আমি আজকের দিনের মতো চ্যাপেলটা বন্ধ করে দিচ্ছি। আমি কি আপনাদেরকে কিছু খুঁজে বের করে দিতে সাহায্য করতে পারি?

 

হলি গ্রেইলের ব্যাপারটা কি? ল্যাংডন বলতে চাইলো।

 

কোডটা, হুট করে সোফির মুখ দিয়ে কথাটা বের হয়ে গেলো। এখানে একটা কোড আছে!

 

ডোসেন্ট সোফির উচ্ছ্বাস দেখে খুশি হলো। হ্যাঁ, এখানে আছে, ম্যাম।

 

এটা সিলিংয়ে, সে বললো, ডান দিকে দেয়ালটার দিকে ঘুরে ওখানেরই কোথাও …

 

ছেলেটা হাসলো। মনে হচ্ছে, রোজলিনে এটা আপনার প্রথম আসা নয়।

 

কোডটা, ল্যাংডন ভাবলো। সে এটার কথা বলতে ভুলেই গিয়েছিলো। রোজলিনের অসংখ্য রহস্যের মধ্যে খিলানযুক্ত পথটাও আছে। শত শত পাথরের ব্লক দিয়ে সেটা তৈরি করা হয়েছে। প্রতিটি ব্লকই প্রতীকে খোঁদাই করা। এলোমেলো মনে হয় সেগুলো। তাতে একটা দূর্বোধ্য সংকেত তৈরি হয়েছে। কিছু কিছু লোকের বিশ্বাস এই কোডটা চ্যাপেলের নিচের কক্ষটার ভেতরে প্রবেশ করার দিক নির্দেশনা। অন্যেরা বিশ্বাস করে, সত্যিকারের গ্রেইল কিংবদন্তীটা এতে বিবৃত হয়েছে। এগুলোকে আমলে না নিয়ে ক্রিপ্টোগ্রাফাররা শত শত বছর ধরে এটার মর্মোদ্ধার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আজকের দিনে, রোজলিন ট্রাস্ট, এইসব কোডের অর্থ কেউ বের করতে পারলে তাকে পুরস্কার দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু কোডটা রহস্যই রয়ে গেছে।

 

আমি আপনাদের দেখাতে পারলে খুব খুশি হতাম…

 

 

 

ডোসেন্টের কণ্ঠটা আচকা থেমে গেলো।

 

আমার প্রথম কোড, সোফি ভাবলো, একা একা কোডে পূর্ণ খিলানযুক্ত পথ দিয়ে এগোতে লাগলো সে। রোজউড বাক্সটা ল্যাংডনের হাতে দিয়ে, সে ক্ষণিকের জন্য হলি গ্রেইল, প্রায়োরি অব সাইওন এবং বিগত দিনের সব রহস্যের কথা ভুলে গেলো। সে যখন কোড যুক্ত ছাদের নিচে এসে পৌঁছালো এবং মাথার ওপরের প্রতীকগুলোর দিকে চেয়ে দেখলো, তার অতীত স্মৃতিগুলো প্লাবনের মতো ফিরে আসলো। তার মনে পড়ে গেলো এখানে প্রথম আসার স্মৃতিটার কথা, অদ্ভুতভাবেই সেই স্মৃতিটা অপ্রত্যাশিত এক দুঃখবোধের জন্ম দিলো।

 

সে ছিলো খুব ছোট্ট একটি মেয়ে…তার পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর এক বা দুবছর পরের ঘটনা। স্কুলের ছুটিতে তার দাদু তাকে স্কটল্যান্ডে নিয়ে এসেছিলো। প্যারিসে ফিরে যাবার আগে তারা রোজলিন চ্যাপেলে বেড়াতে এসেছিলো। সময়টা ছিলো সন্ধ্যার পরে, চ্যাপেলটা তখন বন্ধ ছিলো। তার পরেও, তারা ভেতরে ঢুকতে পেরেছিলো।

 

আমরা কি বাড়ি যেতে পারি গ্র্যঁ পেয়া? সোফি মিনতি জানিয়েছিলো। তার খুব ক্লান্ত লাগছিলো।

 

খুব জলদিই, ডিয়ার, খুব জলদি। তাঁর কণ্ঠটা ছিলো বিষাদগ্রস্ত। এখানে আমাকে একটা কাজ করতে হবে, খুবই জরুরি। তুমি গাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করলে কেমন হয়?

 

তুমি আরেকটা বড় মানুষদের কাজ করবে?

 

তিনি মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিলেন। খুব দ্রুত করবো। কথা দিচ্ছি।

 

আমি কি খিলানযুক্ত কোডগুলো আবারো বের করতে পারি? খুব মজার ছিলো সেটা।

 

আমি জানি না। আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে। তুমি এখানে একা একা ভয় পাবে না?

 

অবশ্যই না! সে খুব জোর দিয়ে বলেছিলো। এখনও তো খুব বেশি সন্ধ্যা হয়নি!

 

তিনি হেসেছিলেন। তাহলে তো খুব ভালো। তিনি তাকে খিলানযুক্ত পথে নিয়ে গেলেন, একটু আগেই যা দেখিয়েছিলেন।

 

সোফি সোফি সঙ্গে সঙ্গে তার মাথার ওপরের কোডগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতে শুরু করেছিলো। তুমি ফিরে আসার আগেই আমি এই কোডগুলোর মর্মোদ্ধার করে ফেলবো!

 

তাহলে তো এটা একটা খেলা হয়ে গেলো। তিনি হাটু গেঁড়ে বসে তার কপালে চুমু খেয়ে কাছের একটা দরজা দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমি বাইরেই আছি। দরজাটা খোলা থাকলো। আমাকে যদি তোমার দরকার হয়, শুধু ডাক দিও। তিনি এই বলে বের হয়ে গিয়েছিলেন।

 

সোফি ফ্লোরে শুয়ে কোডের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটোতে ঘুমঘুম ভাব চলে এলো। কয়েক মিনিট পর, প্রতীকগুলো ধোঁয়াটে হয়ে গেলো। তারপর, সেগুলো উধাও হয়ে গেলো।

 

সোফি যখন ঘুম থেকে উঠলো তখন ফ্লোরটা খুব ঠাণ্ডা লাগছিলো তার।

 

গ্র্যঁ পেয়া?

 

কোন উত্তর এলো না। সে উঠে দাঁড়িয়ে, শরীরটা ঝাড়া দিলো। দরজাটা তখনও খোলা ছিলো। সন্ধ্যাটা ঘন অন্ধকার হয়ে গেছে। সে বাইরে এসে দেখতে পেলো, তার দাদু চার্চের ঠিক পেছনে, পাথরের একটি বাড়ির বারান্দা ঘরে দাঁড়িয়ে আছেন। একজনের সাথে কথা বলছিলেন তিনি, কিন্তু ভারি পর্দার দরজার ভেতর দিয়ে খুব ভালো মতো দেখা যাচ্ছিলো না দৃশ্যটা।

 

গ্র্যঁ পেয়া? সে ডাক দিলো।

 

তার দাদু তার দিকে ঘুরে হাত নেড়ে তাকে একটু অপেক্ষা করতে বললো, তারপর, তিনি খুব ধীরে, শেষ কিছু কথা বলে বের হয়ে বাতাসে একটা চুমু ভাসিয়ে দিলেন। সোফির কাছে আসলেন অশ্রু ভেঁজা চোখে।

 

দাদু, তুমি কাঁদছো কেন?

 

তাকে কোলে তুলে নিলেন। ওহ, সোফি, তোমাকে আর আমাকে এই বছর অনেক লোকজনকেই বিদায় বলতে হয়েছে। এটা খুবই কষ্টের।

 

সোফি তার পরিবারের দূর্ঘটনাটার কথা ভাবলো। তার মা-বাবা, দাদি আর ছোট ভাইকে গুডবাই জানাতে হয়েছিলো। তুমি কি আরেকজন লোককে গুডবাই জানালে?

 

একজন প্রিয় বন্ধুকে, যাকে আমি খুব ভালোবাসি, তিনি প্রচণ্ড আবেগী কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন। আর আমার মনে হচ্ছে, দীর্ঘদিন তাকে আর দেখতে পাবো না।

 

 

 

ডোসেন্টের সাথে দাঁড়িয়ে, ল্যাংডন চ্যাপেলের দেয়ালগুলো ভালো করে দেখতে লাগলো, ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবলো, একটা কানা গলিতে বোধ হয় তারা এসে পড়েছে। সোফি তার কাছে রোজউড বাক্সটা দিয়ে ভেতরে চলে গেছে চ্যাপেলটা ঘুরে ঘুরে দেখতে। এই বাক্সটাতেই গ্রেইল মানচিত্রটা রয়েছে। কিন্তু সেটা আর এখন কোন কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছে না। যদিও সনিয়ের কবিতায় সরাসরি স্পষ্ট করেই রোজলিনের কথা বলা আছে, তারপরও, ল্যাংডন জানে না, এখানে পৌঁছাবার পর আর কী-ই বা করার আছে। কবিতাটাতে তলোয়ার আর পেয়ালার উল্লেখ রয়েছে। যা এখানে কোথাও ল্যাংডন দেখতে পাচ্ছে না।

 

হলি গ্রেইল প্রাচীন রোজলিনের নিচে অপেক্ষা করে।

তলোয়ার আর পেয়ালা তার দরজায় পাহায় দেয়।

 

আবারো ল্যাংডনের মনে হলো, এই রহস্যের অন্য কিছু দিক এখনও উন্মোচিত হয়নি।

 

আমি অনাহুতভাবে উঁকিঝুঁকি মারাটা ঘৃণা করি, ডোসেন্ট বললো, ল্যাংডনের হাতে ধরে রাখা রোজউড বাক্সটার দিকে তাকিয়ে।

 

কিন্তু, এই বাক্সটা…আমি কি জিজ্ঞেস করতে পারি, আপনি কোথেকে পেয়েছেন?

 

ল্যাংডন একটা ক্লান্ত হাসি দিলো।এটা একটা লম্বা-ইতিহাস। ছেলেটা দ্বিধাগ্রস্ত হলো, আবারো বাক্সটার দিকে চোখ গেলো তার। এটা খুবই অদ্ভুত একটা জিনিস আমার দাদির কাছেও ঠিক এরকম একটি বাক্স রয়েছে অলঙ্কারের বাক্স। ঠিক ঢাকনার মধ্যে যে রকম গোলাপটি লাগানো আছে, সেরকমই। এমনকি কড়াটা পর্যন্ত না।

 

ল্যাংডন জানে, ছেলেটা অবশ্যই ভুল করছে। এরকম কোন বাক্স যদি থেকেই থাকে, তবে সেটা এই বাক্সটাই বাক্সটা প্রায়োরিদের কি-স্টোন রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছে। দুটো বাক্সের হয়তো অনেক মিল রয়েছে, কিন্তু পাশের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেলে তারা দুজনেই সেদিকে তাকালো। সোফি উত্তেজিত হয়ে, কোন কথা না বলেই এখন পাশের পাথরের বাড়িটার দিকে যেতে লাগলো। ল্যাংডন তার দিকে চেয়ে রইলো। সে যাচ্ছে কোথায়? সে খুব অদ্ভুত আচরণ করছে, এখানে আসার পর থেকেই, বিশেষ করে এটার ভেতরে ঢোকার পর থেকে। সে ডোসেন্টের দিকে তাকালো। আপনি কি জানেন, বাড়িটা কিসের?

 

সে মাথা নাড়লো, সোফিকে ওখানে যেতে দেখে তাকে খুব হতভম্বও দেখালো। ওটা চ্যাপেলের যাজকের বাসভজ্বন। চ্যাপেলের কিউরেটরও ওখানে থাকেন। তিনি রোজলিন ট্রাস্টের প্রধান। সে একটু থামলো। তিনি আমার দাদি হোন।

 

আপনার দাদি রোজলিন ট্রাস্টের প্রধান?

 

ছেলেটা মাথা নেড়ে সায় দিলো। আমি তার সাথেই ওখানে থাকি এবং চার্চের দেখাশোনা করি, পর্যটকদের গাইডের কাজও করি পাশাপাশি। সে কাঁধ ঝাঁকালো। আমি এখানে জন্ম থেকেই আছি। আমার দাদি আমাকে এই বাড়িতেই লালন পালন। করেছেন।

 

সোফির জন্য চিন্তি হয়ে ল্যাংডন চ্যাপেলের দরজার কাছে গেলো তাকে ডাকতে। সে একটু এগোতেই থেমে গেলো। ছেলেটার একটা কথা তার মনে পড়লো।

 

আমার দাদি আমাকে লালন-পালন করেছেন।

 

ল্যাংডন পেছন থেকে সোফির দিকে একবার তাকিয়ে, তার হাতে ধরা রোজউড বাক্সটার দিকে তাকালো। অসম্ভব। আস্তে করে ল্যাংডন ছেলেটার দিকে ঘুরলো। আপনি বলছিলেন আপনার দাদির কাছেও এরকম একটি বাক্স আছে?

 

প্রায় এরকম।

 

তিনি এটা কোত্থেকে পেয়েছেন?

 

আমার দাদু তার জন্যে ওটা বানিয়েছিলেন। আমি যখন বাচ্চা অবস্থায় তখন তিনি মারা যান। কিন্তু আমার দাদি এখনও তার কথা বলেন। তিনি বলেন, দাদু নাকি হাতের কাজে একজন জিনিয়াস ছিলেন। তিনি সব ধরনের জিনিসই বানাতে পারতেন।

 

ল্যাংডনের মনে একটা অসম্ভব কল্পনা খেলে গেলো। একটা যোগসূত্র উদয় হলো তার মনে। আপনি বলছেন আপনার দাদি আপনাকে লালন পালন করেছেন। আপনি কিছু মনে করবেন না, আপনার বাবা-মার কি হয়েছিলো?

 

ছেলেটা খুবই অবাক হলো। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তারা মারা গিয়েছে। সে একটু থামলো। ঠিক একই দিনে আমার দাদুও।

 

ল্যাংডনের হৃদপিণ্ডটা লাফাতে লাগলো। একটা গাড়ি দুর্ঘটনায়?

 

ডোসেন্টের সবুজ চোখে বিস্ময়। হা। একটা গাড়ি দূঘর্টনায়। সেদিন আমার পুরো পরিবারই মারা যায়। আমার দাদা, বাবা-মা এবং… সে একটু ইতস্তত করে মাটির দিকে চেয়ে রইলো।

 

আর আপনার বোন, ল্যাংডন বললো।

 

***

 

পাথরের বাড়িটা সোফির যেমনটি মনে ছিলো ঠিক তেমনি। রাত নেমে এসেছে এখন, বাড়িটা থেকে উষ্ণ আর আমন্ত্রণমূলক মরীচিকা ঝড়ছে যেনো। রুটি তৈরির গন্ধ ভারি পর্দার খোলা দরজাটা দিয়ে বাইরে ভেসে আসছে। জানালা দিয়ে সোনালী একটা আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। সোফি এগোতেই ভেতর থেকে একটা শান্ত ফেঁপানো কান্না ভেসে এলো।

 

দরজার ভারি পর্দার ভেতর দিয়ে সোফি একজন বয়স্ক মহিলাকে দেখতে পেলো। তিনি দরজার দিক থেকে পেছন ফিরে আছেন। কিন্তু সোফি ঠিকই দেখতে পেলো তিনি কাঁদছেন। মহিলার দীর্ঘ-অভিজাত সাদা চুল, যা অপ্রত্যাশিত একটা স্মৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট। সোফি দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। মহিলা একটা ছবির ফ্রেম ধরে রেখেছেন, ছবিটা একজন লোকের। তিনি তার হাতের আঙুল পরম মমতায় ভালবাসায় ছবির লোকটার মুখে হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন।

 

ছবিটা এমন একজনের যাঁকে সে খুব ভালো করেই চেনে।

 

গ্র্যঁ পেয়া।

 

মহিলা নিশ্চিত গতকালকে তার মৃত্যুর খবরটা শুনেছেন।

 

সোফির পায়ের নিচের কাঠের পাটাতনটা খ্যাচ্‌ করে উঠলে মহিলা আস্তে করে ঘুরে তাকালেন।

 

তার বিষণ্ণ চোখ দুটো সোফিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। সোফি দৌড়াতে চাইলো কিন্তু স্থির হয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে রইলো সে। দুজন নারী একে অন্যেকে এমন ভাবে দেখতে লাগলো যেনো অনন্তকাল অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। তারপর সমুদ্রের ঢেউরের মতো মহিলার মুখে অনিশ্চয়তা থেকে…অবিশ্বাস থেকে…আশাতে…এবং অবশেষে চরম আনন্দ আছড়ে পড়লো।

 

খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে এসে মহিলা তার নরম হাত দুটো দিয়ে সোফির মুখটা ধরলেন, সোফির বজ্রাহত মুখটাতে আদরের পরশ বুলিয়ে দিলেন তিনি। ওহ্, আমার আদরের বাহা…তুমি এসে গেছে!

 

যদিও সোফি তাকে চিনতে পারেনি তারপরও সে জানে কে এই মহিলা। সে কথা বলতে চাইলেও নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।

 

সোফি, মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তার কপালে চুমু খেলেন।

 

সোফির কথাটা ফিসফিসানিতে পরিণত হলো। কিন্তু… পেয়া বলেছিলেন তুমি…।

 

আমি জানি, মহিলা তার মমতাময়ী হাতটা সোফির কাঁধে রেখে খুবই অতিপরিচিত একটা চাহুনি দিলেন। তোমার দাদু আর আমি অনেক কথাই বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমরা যা ভেবেছি ঠিক তা-ই করেছি। আমি দুঃখিত। সেটা ছিলো তোমার নিজের নিরাপত্তার জন্যই, প্রিন্সেস।

 

সোফি তার শেষ কথাটা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই দাদুর কথা মনে পড়ে গেলো। যিনি সোফিকে প্রিন্সেস বলেই ডাকতেন।

 

মহিলা দুহাতে সোফিকে জড়িয়ে ধরলেন। অশ্রু ঝড়ে পড়তে লাগলো তাঁর। তোমার দাদু তোমাকে সবকিছু বলার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তোমাদের দুজনের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিলো না। তিনি অনেক চেষ্টাই করেছিলেন। অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করার ছিলো, তিনি আবারো সোফির কপালে চুমু খেলেন। তারপর কানে কানে বললেন, আর কোন গোপনীয়তা নয়, প্রিন্সেস। এখন সময় এসেছে তোমার পরিবার সম্পর্কে সত্যি কথাটা জানার।

 

 

 

সোফি আর তার দাদি দরজার কাছে সিঁড়িতে বসে জড়িয়ে ধরে যখন কাঁদছিলো তখন ডোসেন্ট ছেলেটা এসে পড়লো সেখানে। তার চোখে আশা আর অবিশ্বাস জ্বলজ্বল করছে।

 

সোফি?

 

কান্না ভেজা চোখেই সোফি মাথা নেড়ে সায় দিলো, ছেলেটাকে সে চিনতে পারলো। কিন্তু একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরতেই সে তার রক্তের টান অনুভব করলো…

 

 

 

ল্যাংডন যখন সোফিদের কাছে এসে পৌঁছালো তখন সোফি বিশ্বাসই করতে পারছিলো না, কেবল গতকালই তার মনে হয়েছিলো সে এই পৃথিবীতে একা হয়ে গেছে। আর এখন যেভাবেই হোক, এই বিদেশ বিভূঁইয়ে তিন তিনজন লোকের সঙ্গ পেয়ে তার অবশেষে মনে হলো, নিজের বাড়িতেই আছে সে।

 

 

 

১০৫.

 

রোজলিনর ওপর রাত নেমে এসেছে।

 

রবার্ট ল্যাংডন ফিল্ডস্টোন হাউজের সামনে দাঁড়িয়ে তার পেছনে থাকা স্বচ্ছ দরজার ভেতর থেকে পূণর্মিলনী আর হৈ হুল্লোরের শব্দ শুনতে পেলো। তার হাতে ব্রাজিলিয়ান কফির একটা মগ থাকাতে প্রচণ্ড অবসাদটা দূর হতে লাগলো, তারপরও তার মনে হলো ক্লান্তিটা বুঝি সহজে কাটবার নয়। শরীরের এই ধকলটা একেবারে গভীরে গিয়ে আঘাত হেনেছে।

 

আপনি কিছু না বলে চলে এসেছেন, পেছন থেকে একটা কণ্ঠ তাকে বললো।

 

সে ঘুরে দেখলো সোফির দাদি এসেছে, তাঁর রূপালি চুল রাতের আঁধারে জ্বল জ্বল করছে। তাঁর নাম বিশেষ করে বিগত আঠাশ বছর ধরে ছিলো ম্যারি শভেল।

 

ল্যাংডন একটা ক্লান্ত হাসি দিলো। আমি ভেবেছিলাম আপনাদের পরিবারকে এক সঙ্গে হবার জন্যে কিছুটা সময় দেই। জনালা দিয়ে সে দেখতে পেলো সোফি তার ভাইয়ের সাথে কথা বলছে।

 

ম্যারি তার পেছনে এসে দাঁড়ালেন। মি. ল্যাংডন, আমি যখন প্রথম জ্যাক সনিয়ের মৃত্যুর খবরটা পাই তখন সোফির নিরাপত্তা নিয়ে যারপরনাই উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম। তাকে আজ রাতে আমার দরজায় সামনে দেখতে পেয়ে জীবনের সবচাইতে বড় স্বস্তিটা পেয়েছি। তার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ দিলে যথেষ্ট হবে না।

 

ল্যাংডন কী বলবে ভেবে পেলো না। যদিও সে সোফি এবং তার দাদিকে একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলো, তারপরও ম্যারি তাকে তাদের সাথে থেকে কথা শুনে যেতে বলেছিলেন। আমার স্বামী অবশ্যই আপনাকে বিশ্বাস করতেন, মি. ল্যাংডন, আমিও সেরকমই বিশ্বাস করি।

 

আর তাই ল্যাংডন থেকে গিয়েছিলো, যখন সোফির দাদি সোফিকে তার মৃত বাবা-মার গল্পটা শুনাচ্ছিলো তখন সোফির পাশে দাড়িয়ে নিরব বিস্ময় দেখেছিলো সে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, তারা দুজনেই মেরোভিনজিয়ান পরিবারের-ম্যারি মাগদালিন আর যিশুখৃষ্টের প্রত্যক্ষ বংশধর। সোফির বাবা-মা এবং তাদের পূর্ব পুরুষরা নিজেদের সুরক্ষার জন্য পদবী পরিবর্তন করে পান্টার্ড এবং সেন-ক্লেয়ার রেখেছিলেন। তাদের ছেলে-মেয়েরা সরাসরি রাজকীয় রক্তের ধারাক্রম বহন করে চলছে বলে প্রায়োরিরা তাদেরকে খুব সযত্নে রক্ষা করে গেছে। যখন সোফির বাবা-মা গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা গেলেন, যার কারণ সত্যিকারভাবে জানা যায়নি, প্রায়োরিরা তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিলো, রাজ বংশের পরিচয়টা বোধহয় ফাঁস হয়ে গেছে।

 

তোমার দাদু এবং আমি, ম্যারি দুঃখভরা কণ্ঠে ব্যাখ্যা করলেন, টেলিফোনে খবরটা শোনা মাত্রই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম। তোমার বাবা-মার গাড়িটা তখন মাত্র নদীতে খুঁজে পাওয়া গেছে। তিনি নিজের চোখের পানি মুছলেন। আমাদের ছয়জনের সবাই-তোমাদের দুজনসহ-সেই রাতে গাড়িতে করে ভ্রমণ করার কথা ছিলো। সৌভাগ্যবশত, শেষ মুহুর্তে আমরা পরিকল্পনাটা একটু বদলে ফেলেছিলাম, তাই তোমার বাবা-মা একাই গাড়িতে করে গিয়েছিলেন। দূর্ঘটনার কথা শুনে জ্যাক এবং আমার পক্ষে কোনভাবেই জানা সম্ভব ছিলো না আসলে কী ঘটেছিলো …অথবা, আদৌ এটা কোন দূর্ঘটনা কিনা। ম্যারি সোফির দিকে তাকালেন। আমরা জানতাম, আমাদের নাতি-নাতনীদেরকে রক্ষা করতে হবে আর আমরা সেটাই করেছি। যেটা ভালো মনে হয়েছে আমাদের কাছে। জ্যাক পুলিশের কাছে রিপেটি করেছিলো, তোমার ভাই এবং আমি গাড়িতে ছিলাম…আমাদের মৃতদেহ দুটো নদীর স্রোতে ভেসে গিয়েছে। তারপরই, তোমার ভাই আর আমি প্রায়োরিদের সাথে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেলাম। জ্যাক একজন বিখ্যাত লোক হিসেবে অদৃশ্য হবার বিলাসিতা দেখাতে পারেনি। এজন্যেই মনে করা হয়েছিলো, বড় হিসেবে সোফি প্যারিসেই জ্যাকের কাছে থেকে শিক্ষাদীক্ষা নেবে আর প্রায়োরিদের কাছাকাছি থাকবে নিরাপত্তার জন্যে। তাঁর কণ্ঠটা ফিসফিসানিতে পরিণত হলো। পরিবারকে আলাদা করার কাজটা ছিলো আমাদের জন্যে সবচাইতে কঠিন কাজ। জ্যাক আর আমি একে অন্যের সাথে দেখা করতাম খুবই অনিয়মিত আর গোপনীয়ভাবে…প্রায়োরিদের অধীনে, তাদের সুরক্ষায়। কিছু অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ভ্রাতৃসংঘের ভায়েরা সবসময়ই বিশ্বস্ত থেকেছেন।

 

ল্যাংডন ধারণা করলো, গল্পটা আরো গভীরে যাবে আর সেটা তার শোনা ঠিক হবে না তাই সে বেড়িয়ে এসেছিলো। এখন রোজলিনের দিকে তাকিয়ে ল্যাংডন ভাবলো, এটার অমীমাংসিত রহস্যটা ভেদ না করে কোনভাবেই পালাতে পারবে না। গ্রেইলটা কি সত্যি রোজলিনের এখানেই আছে? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সনিয়ে কবিতায় যে তলোয়ার আর পেয়ালার কথা উল্লেখ করেছেন সেটা কোথায়?

 

এটা আমাকে দিন, ল্যাংডনের হাতের দিকে ইঙ্গিত করে ম্যারি বললেন।

 

ওহ, ধন্যবাদ আপনাকে। ল্যাংডন তার খালি কফির কাপটা তাঁর হাতে তুলে দিতে উদ্যত হলো।

 

ম্যারি তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি আপনার অন্য হাতটার কথা বলছিলাম, মি. ল্যাংডন।

 

ল্যাংডন তার হাতের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলে সে সনিয়ের প্যাপিরাসটা ধরে রেখেছে। সে এটা ক্রিপটেক্স থেকে আবার বের করে নিয়েছিলো এই আশায় যে, প্রথম দেখায় যা ধরতে পারেনি সেটা এবার হয়তো ধরতে পারবে। অবশ্যই আমি দুঃখিত।

 

কাগজটা হাতে নিয়ে ম্যারি খুবই খুশি হলেন। আমি জানি, প্যারিসের এক ব্যাংকের লোক সম্ভবত এই রোজ বাক্সটা ফিরে পেতে উদগ্রীব হয়ে আছেন। আদ্রেঁ ভার্নেট হলেন জ্যাকের খুবই প্রিয় একজন বন্ধু আর জ্যাক তাঁকে প্রচণ্ড বিশ্বাস করতেন। এই বাক্সটা যত্ন নেবার সনিয়ের অনুরোধটা রক্ষার জন্যে আদ্রেঁ নিজেকে সম্মানিত মনে করেন।

এমনকি এজন্যে আমাকে গুলিও করতে কসুর করেনি, ল্যাংডনের মনে পড়ে গেলো, সিদ্ধান্ত নিলো সে যে বেচারির নাকটা ভেঙে ফেলেছিলো সে কথা উল্লেখ করবে না। প্যারিসের কথা ভাবতেই ল্যাংডনের মনের পর্দায় ভেসে উঠলো তিন জন সেনেক, যাঁদের সবাই আগের দিন রাতে মারা গেছেন। আর প্রায়োরির? এখন তবে কি হবে?

চাকাটা ইতিমধ্যেই ঘুরতে শুরু করেছে, মি. ল্যাংডন। ভ্রাতৃসংঘ শতাব্দী পর শতাব্দী ধরে এটা টিকিয়ে রেখেছে আর এই জিনিসটাই এটাকে টিকিয়ে রাখবে। সব সময়ই এরা অপেক্ষা করছে এটা সরাতে এবং নতুন করে নির্মাণ করার জন্যে।

সারা রাত ধরে ল্যাংডন সন্দেহ করেছে যে, সোফির দাদি প্রায়োরিদের কর্মকাণ্ডের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। হাজারহোক, প্রায়োরিদের সবসময়ই নারী সদস্য থাকে। চার জন গ্র্যান্ড মাস্টার ছিলেন নারী। সেন্যেরা প্রথাগতভাবেই ছিলেন পুরুষ-অভিভাবক-তার পরও, নারীরা প্রায়োরিতে অনেক বেশি সম্মানিত অবস্থান পেয়ে থাকে এবং বলতে গেলে যেকোন উচ্চপদে আসীন হতে পারে তারা।

ল্যাংডন লেই টিবিং আর ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবির কথা ভাবলো। মনে হচ্ছে এটা কতো জনম আগের কথা। চার্চ কি আপনার স্বামীকে স্যাংগৃল-এর কথা শেষ দিনের আগে প্রকাশ না করার জন্যে চাপ দিচ্ছিলো?

না। শেষ দিন-এর কিংবদন্তীটা বিকৃত মস্তিষ্কপ্রসূত। প্রায়োরি মতবাদের কোথাও এমন কোন দিনের কথা বলা নেই যেদিন গ্রেইলটা প্রকাশ করা হবে। সত্যি বলতে কী, প্রায়োরিরা সব সময়ই চেয়েছে গ্রেইলটা যাতে কোনদিনই প্রকাশ না হয়।

কখনই না? ল্যাংডন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।

এটা হলো রহস্যময়তা আর বিস্ময় যা আমাদের আত্মাকে পরিচালিত করে, গ্রেইলটা নয়। গ্রেইলের সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে তার অশরীরি স্বভাবে।ম্যারি শভেল এখন রোজলিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কারো কারো কাছে গ্রেইল হলো পেয়ালা যা তাদেরকে অমরত্ব দেবে। অন্যদের কাছে এটা হলো হারানো দলিল-দস্তাবেজ এবং গোপন ইতিহাসের অন্বেষণ। আর বেশির ভাগের কাছে, আমার সন্দেহ, হলি গ্রেইল হলো একটা দারুণ আইডিয়া…একটা গৌরবোজ্জ্বল বিষয়, অর্জন করা যায় না এমন কোন সম্পদ, যা আজকের এই হট্টগোলপূর্ণ পৃথিবীতেও আমাদেরকে অনুপ্রেরণা দেয়।

কিন্তু স্যাংগৃল দলিলগুলো যদি লুকানোই থাকে তবে তো ম্যারি মাগদালিনের গল্পটা চিরতরের জন্য হারিয়ে যাবে, ল্যাংডন বললো।

তাই? দেখুন। তাঁর গল্প চিত্রকলায়, সঙ্গীতে আর বই-পুস্তকে বলা হচ্ছে। তার চেয়েও বেশি বলা হচ্ছে প্রতিদিন। পেন্ডুলামটা দুলছে। আমরা আমাদের ইতিহাসের বিপদটা আঁচ করতে শুরু করছি…এবং আমাদের ধ্বংসাত্মক পথটাও। আমরা পবিত্র নারীকে পূণরায় অধিষ্ঠিত করার কথা ভাবতে শুরু করছি। তিনি থামলেন। আপনি বলেছিলেন, পবিত্র নারী সম্পকিত একটা লেখা লিখছেন, তাই না?

হ্যাঁ।

তিনি হাসলেন। ওটা শেষ করুন, মি. ল্যাংডন। পবিত্র নারীর গান গেয়ে উঠুন। পৃথিবীর দরকার আধুনিক গীতিকবির।

ল্যাংডন নিরব রইলো, তার ওপর তাঁর কথার ওজনটা বুঝতে পারলো। খোলামেলা জায়গাটা দিয়ে দূরের গাছের সারিগুলোর ফাঁক গলে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। রোজলিনের দিকে চোখ ফিরিয়ে ল্যাংডন এর সিক্রেটটা জানতে পেরে ছেলেমানুষির মতো উৎফুল্ল বোধ করলো। জিজ্ঞেস কোরো না, নিজেকে বললো সে। এটা জিজ্ঞেস করার সময় নয়। সে ম্যারির হাতের প্যাপিরাসের দিকে তাকালো তারপর আবার রোজলিনের দিকে।

প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করুন মি. ল্যাংডন, ম্যারি বললেন, তাঁকে খুব খোশ মেজাজে দেখাচ্ছে। আপনি সেই অধিকার অর্জন করেছেন।

ল্যাংডন দারুণ চাঞ্চল্য অনুভব করলো।

আপনি জানতে চান গ্রেইলটা রোজলিনের এখানে আছে কিনা।

আপনি কি আমাকে বলতে পারবেন?

তিনি একটা ঠাট্টার মতো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কেন লোকজন গ্রেইলটাকে শান্তিতে থাকতে দিতে চায় না? হেসে উঠলেন, অবশ্যই তিনি উপভোগ করছেন ব্যাপারটা। কেন আপনি ভাবছেন এটা এখানে আছে?

ল্যাংডন তাঁর হাতের প্যাপিরাসের দিকে তাকালো। আপনার স্বামীর কবিতায় নির্দিষ্ট করে রোজলিনের কথা বলা আছে, অবশ্য তাতে তলোয়ার আর পেয়ালা গ্রেইলটা পাহারা দিচ্ছে বলেও বলা আছে। আমি কোন তলোয়ার আর পেয়ালার প্রতীক এখানে দেখতে পাচ্ছি না।

তলোয়ার আর পেয়ালা? ম্যারি জিজ্ঞেস করলেন। সেগুলো দেখতে ঠিক কি রকম?

ল্যাংডন আঁচ করতে পারলো তার সাথে ছেলেখেলা করা হচ্ছে কিন্তু সেও খেলতে শুরু করে দ্রুত প্রতীকগুলোর বর্ণনা দিয়ে দিলো।

তাঁর চোখে মুখে কৌতূহল দেখা গেলো। আহ, হ্যাঁ, অবশ্যই। তলোয়ার পুরুষকে প্রতিনিধিত্ব করে। আমার বিশ্বাস সেটা দেখতে এরকম, না? তর্জনীটা দিয়ে তিনি অন্য হাতের তালুতে একটা আকৃতি আঁকলেন।

 

হ্যাঁ, ল্যাংডন বললো। ম্যারি তলোয়ারের সবচাইতে অপ্রচলিত সরল আকৃতিটা আঁকলেন, যদিও ল্যাংডন এই প্রতীকটার ছবি দেখেছে।

আর উল্টোটা, তিনি বললেন, আবার নিজের তালুতে আঁকলেন, হলো পেয়ালা, যা নারীকে বোঝায়।

 

একদম ঠিক, ল্যাংডন বললো।

আর আপনি বলছেন, এই এখানে রোজলিন চ্যাপেলে শত শত প্রতীকের মধ্যে এই দুটোকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না?

আমি তাদেরকে কোথাও দেখিনি।

আর আমি যদি আপনাকে সেগুলো দেখিয়ে দেই তবে কি আপনি একটু ঘুমাবেন?

ল্যাংডন কোন জবাব দেবার আগেই ম্যারি শভেল চ্যাপেলের দিকে হাটতে শুরু করলেন। ল্যাংডনও তাঁকে দ্রুত অনুসরণ করলো। প্রাচীন দালানটার ভেতরে ঢুকে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে পবিত্র স্থানটার মাঝখানের দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। এই তো, মি. ল্যাংডন। তলোয়ার এবং পেয়ালা।

ল্যাংডন পাথরের জমিনটার দিকে তাকালো। সেটা একেবারে ফাঁকা। এখানে ততা কিছুই নেই….

ম্যারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চ্যাপেলের ফ্লোরের বিখ্যাত পথটা ধরে হাটতে লাগলেন। এই পথটাই ল্যাংডন আজকের রাতের প্রথম দিকে দর্শকদেরকে হাটতে দেখেছে। সে একটা বিশাল প্রতীকের দিকে তাকিয়েও কিছুই খুঁজে পেলো না। কিন্তু

এটাতো ডেভিডের তারা—

 

তলোয়ার এবং পেয়ালা।

একটাতে মিলেছে।

ডেভিডের তারা…নারী এবং পুরুষের যর্থাথ সম্মিলন…সলোমনের সিল…হলি অব হলির চিহ্ন দেয়া, যেখানে নারী এবং পুরুষের দেবত্ব-ইয়োহে এবং শেকিনাহ-মনে করা হয় একসাথে বসবাস করে।

কী বলবে তার জন্যে ল্যাংডনের কয়েক মিনিটের দরকার হলো। পংক্তিটা রোজলিনের দিকেই ইঙ্গিত করে। একেবারে যথার্থভাবেই।

ম্যারি হাসলেন। দৃশ্যতই।

নিহিতার্থটা তাকে কাঁপিয়ে দিলো। তো হলি গ্রেইলটা তবে কি আমাদের নিচে ভূ-গর্ভস্থ কক্ষে আছে?

তিনি হাসলেন। একমাত্র চেতনার মধ্যে। প্রায়োরিদের একটা প্রাচীন প্রতীজ্ঞা ছিলো। একদিন হলি গ্রেইলকে তার নিজের দেশ ফ্রান্সে ফিরিয়ে আনা হবে যেখানে সে চিরদ্রিায় শায়িত যাবে। শত শত বছর ধরে তাকে বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় টানাহেচরা করা হয়েছে নিরাপত্তার জন্য। খুবই অপমানজনক। জ্যাক যখন গ্র্যান্ড মাস্টার হিসেবে অধিষ্ঠিত হলো তখন তাঁর প্রতীজ্ঞা ছিলো তাঁকে ফ্রান্সে ফিরিয়ে এনে রাণীর মর্যাদায় একটা সমাধি নির্মাণ করে তাঁর সম্মানকে পূণরুদ্ধার করা হবে।

তিনি কি সফল হয়েছিলেন?

তাঁর চেহারাটা খুবই সিরিয়াস হয়ে উঠলো। মি. ল্যাংডন, আজ রাতে আপনি আমার জন্যে যা করেছেন সেটা বিবেচনা করে রোজলিন ট্রাস্টের একজন কিউরেটর হিসেবে আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি, গ্রেইলটা আর এখানে নেই।

ল্যাংডন সিদ্ধান্ত নিলো চাপাচাপি করবে। কি-স্টোনটা সেই জায়গাটাই নির্দেশ করে যেখানে হলি গ্রেইলটা লুকানো আছে এখন। কেন সেটা রোজলিনের দিকে ইঙ্গিত করে?

হয়তো আপনি এর অর্থটা ধরতে পারেননি। মনে রাখবেন, গ্রেইলটা ধোঁকাও হতে পারে। আমার স্বৰ্গত স্বামীর মতো প্রহেলিকাময়।

কিন্তু তিনি এর চেয়ে বেশি আর কতো স্পষ্ট হতে পারতেন? সে জিজ্ঞেস করলো। আমরা তলোয়ার এবং পেয়ালা চিহ্নিত একটা ভূ-গর্ভস্থ কক্ষের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি, চারিদিকে ঘিরে আছে মাস্টার শিল্পীদের ছবি। সবকিছুই রোজলিনের কথা বলছে।

খুব ভালো, আমাকে এই রহস্যময় পংক্তিটা একটু দেখতে দিন। তিনি প্যাপিরাসটার ভাঁজ খুলে জোরে জোরে কবিতাটা পড়লেন :

হলি গ্রেইল প্রাচীন রোজলিনের নিচে অপেক্ষা করছে।

তলোয়ার আর পেয়ালা তাঁর দরজা পাহারা দেয়।

মাস্টার শিল্পীদের ছবিতে প্রশংসিত হয়ে শায়িত আছে সে।

তারা ভরা আকাশের নিচে অবশেষে চিরদ্রিায়।

যখন তিনি শেষ করলেন কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত একটা রেশ থেকে গেলো, যতোক্ষণ না একটা পরিচিত হাসি তাঁর ঠোঁটে দেখা গেলো। আহ, জ্যাক।

ল্যাংডন প্রতীক্ষায় তাঁর দিকে চেয়ে রইলো। আপনি এটা বুঝতে পেরেছেন?

চ্যাপেলের ফ্লোরে আপনি যেমনটি দেখেছেন, মি. ল্যাংডন, সহজ-সরল জিনিসগুলোকে অনেকভাবেই দেখা যায়।

ল্যাংডনের বুঝতে খুব কষ্ট হলো। জ্যাক সনিয়ের সম্পর্কিত সব কিছুই মনে হচ্ছে দ্ব্যর্থবোথক, আর ল্যাংডন সেটা এখানে দেখতে পাচ্ছে না।

ম্যারি একটা ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মি. ল্যাংডন, আমি আপনার কাছে একটা স্বীকারোক্তি করছি। আমি গ্রেইলের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোনদিনই জানতে পারিনি। কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, আমি এমন একজন লোককে বিয়ে করেছিলাম যে ছিলো অসামান্য প্রভাবশালী একজন…আর আমার মেয়েলী স্বজ্ঞা ছিলো খুবই প্রখর।

ল্যাংডন কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু ম্যারি আবারো বলতে শুরু করলেন।

আমি দুঃখিত, আপনার সমস্ত পরিশ্রমের পরও রোজলিন থেকে আপনি কোন সত্য উত্তর পাবেন না। তার পরও আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি এমন কিছু পাবেন যা আপনি খুঁজে ফিরছেন। একদিন এটা আপনার কাছে উদ্ভাসিত হবে। তিনি হাসলেন। আর যখন এটা ঘটবে, আমি বিশ্বাস করি, আপনি এবং বাকি সব লোক এটা গোপন রাখবেন।

দরজার দিক থেকে কারোর আসার শব্দ শোনা গেলো। তোমরা দুজনেই হাওয়া হয়ে গেলে দেখছি, সোফি আসতে আসতে বললো।

আমি চলে যাচ্ছিলাম, তার দাদি জবাব দিলেন দরজার দিকে এগোতে এগোতে। গুডনাইট, প্রিন্সেস। তিনি সোফির কপালে চুমু খেলেন। মিঃ ল্যাংডনকে বাইরে বেশিক্ষণ রেখো না।

ল্যাংডন আর সোফি দেখলো দাদি ঘরের ভেতরে চলে যাচ্ছে। সোফি তার দিকে ঘুরলো, তার দুচোখে গভীর আবেগ। ঠিক আমার প্রত্যাশা অনুযায়ী সমাপ্তিটা ঘটেনি।

আমাদের দুজনের বেলায়, সে ভাবলো। ল্যাংডন দেখতে পেলো সে খুব আবেগতাড়িত হয়ে আছে। আজ রাতে সে যে খবরটা পেয়েছে সেটা তার জীবনের সবকিছু বদলে দিয়েছে। তুমি কি ঠিক আছো? অনেক ধকল গেছে।

সে নিরবে হাসলো। আমার একটা পরিবার আছে। সেখান থেকেই আমি শুরু করতে চাই। আমরা কারা এবং কোথা থেকে এসেছি সেটা বুঝতে আরো কিছু সময় লাগবে।

ল্যাংডন নিরব রইলো।

আজ রাতের পরে তুমি কি আমাদের সাথে থাকবে? সোফি জিজ্ঞেস করলো। নিদেনপক্ষে কয়েকটা দিন?

ল্যাংডন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এর বেশি কিছু চাচ্ছিলো না। সোফি, তোমার পরিবারের সাথে তোমার কিছু সময় একান্তে থাকার দরকার। সকালেই আমি প্যারিসে ফিরে যাচ্ছি।

তাকে দেখে হতাশ মনে হলেও সেই সাথে এও মনে হচ্ছে, সে জানে এটাই ঠিক কাজ। তাদের কেউই অনেকক্ষণ কথা বললো না। শেষে সোফি একটু সামনে এগিয়ে এসে তার হাতটা ধরে চ্যাপেলের বাইরে নিয়ে আসলো। তারা একটু হাটলো। এই জায়গা থেকে স্কটিশ গ্রামাঞ্চলটা ছড়িয়ে গেছে। নিরবে দাড়িয়ে রইলো দুজনে হাত ধরে, নিজেদের সাথে লড়াই করে যাচ্ছিলো তারা।

আকাশে তারাগুলো সবে দেখা যেতে শুরু করেছে কিন্তু পশ্চিম দিকে একটা বিন্দু অন্য সবকিছু থেকে বেশি জ্বল জ্বল করছিলো। সেটা দেখে ল্যাংডন হাসলো। এটা হলো ভেনাস। প্রাচীন দেবী তার স্থির এবং প্রশান্ত আলোয় জ্বল জ্বল করছে।

রাতটা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হতে শুরু করলো, একটা শীতল বাতাস নিমভূমি থেকে ধেয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরে ল্যাংডন সোফির দিকে তাকালো। তার চোখ বন্ধ আর ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। ল্যাংডনের মনে হলো, তার নিজের চোখের পাতাও ভারি হয়ে আসছে। সে তার হাতটা চেপে ধরলো। সোফি?।

ধীরে ধীরে সে তার চোখ খুলে তার দিকে তাকালো। পুর্ণিমার আলোতে তার মুখটা অপূর্ব লাগছে। একটা ঘুম ঘুম হাসি হাসলো। হাই।

ল্যাংডন অপ্রত্যাশিতভাবে একটা দুঃখবোধে আক্রান্ত হলো এটা ভেবে যে, সে সোফিকে রেখে প্যারিসে ফিরে যাচ্ছে। হয়তো আমি চলে যাবো তুমি জেগে ওঠার আগেই। সে একটু থামলো, তার গলাটা ধরে আসছে। আমি দুঃখিত, আমি এসবে খুব একটা ভালো—

সোফি তার নরম হাতটা ল্যাংডনের মুখের উপর রাখলো। তারপর সামনের দিকে হেলে, তার চিবুকে একটা প্রগাঢ় চুমু খেলো। আবার কবে তোমাকে দেখতে পাবো?

ল্যাংডন কয়েক মুহূর্ত ঘোরের মধ্যে ডুবে গেলো, তার চোখের মধ্যে হারিয়ে গেছে সে।

কখন?

সে একটু থামলো, কৌতূহলী হলো, সোফির কি কোন ধারণা আছে সে নিজেও এই একই বিষয় নিয়ে ভাবছে। আসলে পরের মাসে আমার ফ্লোরেন্সে একটা কনফারেন্সে বক্তৃতা দেবার কথা আছে। সেখানে আমার এক সপ্তাহের মতো সময় হাতে থাকবে আর হাতে তেমন কাজও থাকবে না।

এটা কি কোন আমন্ত্রণ?

আমরা খুব বিলাসবহুল জায়গায় থাকবে। তারা আমাকে ব্রুনেপ্লেসিতে একটা ঘর দেবে।

সোফি ঠাটাচ্ছলে হাসলো। মি. ল্যাংডন, তুমি খুব বেশি ভেবে ফেলেছে।

সে একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলো। আমি আসলে যা বলতে চেয়েছিলা–*

ফ্লোরেন্সে তোমার সাথে দেখা করতে আমার ভালোই লাগবে, রবার্ট। কিন্তু একটা শর্তে। তার কণ্ঠ সিরিয়াস। কোন জাদুঘর নয়, চার্চ নয়, শিল্পকলা নয়, শিলালিপি নয়।

ফ্লোরেন্সে? এক সপ্তাহের জন্যে? এসব কিছুই হবে না।

সোফি তার দিকে ঝুঁকে আবারও একটা চুমু খেলো, এবারে ঠোঁটে। তাদের শরীর ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো, প্রথমে খুব আলতো করে পরে একেবারেই জড়িয়ে। যখন সে ছাড়িয়ে নিলো তার চোখ জুড়ে ছিলো প্রতীজ্ঞা।

ঠিক আছে, ল্যাংডন বললো। সেই কথাই রইলো তবে।

 

উপসংহার

রবার্ট ল্যাংডন হুট করে ঘুম থেকে জেগে উঠলো। সে স্বপ্ন দেখছিলো। তার বিছানার পাশে রাখা বার্থরোবের একটা মনোগ্রামে হোটেল রিজ প্যারিস লেখাটি লাগানো আছে। অন্ধকার ঘরটাতে একটা ডিম লাইট জ্বলছে। এখন সন্ধ্যা না ভোর? অবাক হয়ে ভাবলো সে।

ল্যাংডনের শরীরটা খুব গরম আর অসাড় মনে হলো। গত দুদিন ধরে দিনের বেশির ভাগ সময়ই ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। বিছানায় ধীরে ধীরে উঠে বসে বুঝতে পারলো কিসের জন্য তার ঘুম ভেঙ্গেছে…অত একটি ভাবনা। কয়েকদিন ধরে কতোগুলো তথ্য নিয়ে সে খতিয়ে দেখেছে কিন্তু ল্যাংডন এখন নিজেকে এমন একটি অবস্থায় খুঁজে পেলো যা এর আগে ভেবে দেখেনি।

এটা কি হতে পারে?

কয়েক মুহূর্ত সে স্থির হয়ে রইলো।

বিছানা থেকে নেমে মার্বেল শাওয়ারের দিকে গেলো। ভেতরে ঢুকেই ছেড়ে দিলো শক্তিশালী জেট মেসেজটি। তখনও সেই ভাবনাটিই তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

অসম্ভব।

বিশ মিনিট পরে, ল্যাংডন হোটেল রিজ থেকে বের হয়ে প্লেস ভেঁদোমে এলো। রাত নেমে এসেছে। কয়েক দিনের ঘুমের জন্য তার ঘোর ঘোর ভাবটা এখনও কাটেনি …এখনও তার মনে হচ্ছে অদ্ভুত প্রহেলিকাময়। সে ভেবেছিলো হোটেল থেকে বের হবার আগে লবি সংলগ্ন ক্যাফে অ্যা লেইতে ঢুকে মাথাটা একটু পরিষ্কার করে নেবে। কিন্তু তার দুপা তাকে সোজা হোটেলের বাইরে প্যারিসের এই নির্জন রাতে নিয়ে এলো।

রুই দে পেতিত শাম্প-এর পূর্ব দিক দিয়ে হাটতে হাটতে ল্যাংডনের মনে হলো, তার উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। দক্ষিণ দিকে ঘুরে রুই রিশেলু ধরে এগোতে লাগলো। সে, জেসমিন ফুলের মিষ্টি বাতাস প্যালেস রয়্যালের রাষ্ট্রীয় বাগান থেকে ভেসে আসছে।

দক্ষিণ দিক দিয়েই হেটে যেতে লাগলো সে, যতোক্ষণ না যা খুঁজছিলো তা পেয়ে গেলো-বিখ্যাত রয়্যাল আর্কেড-পালিশ করা চকে মার্বেল পাথরের সুবিশাল চত্বর। সেখানে গিয়ে ল্যাংডন ভালো করে তার পায়ের নিচের জমিনটা দেখে নিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার পরিচিত জিনিসটা পেয়ে গেলো-অনেকগুলো ব্রোঞ্জের মেডেল মাটিতে খোঁদাই করা, নিখুঁতভাবে সোজা লাইনে সাজানো। প্রতিটি চাকতির ব্যস হবে পাঁচ মিটারের মতো এবং তার ওপর খোঁদাই করা ইংরেজি N এবং S অক্ষর।

 

নর্দ। সুদ।

সে দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে মেডেলের সোজা লাইনটার দিকে চেয়ে দেখলো। আবার লাইনটা অনুসরণ করে চলতে শুরু করলো সে। পেভমেন্টের দিকে লক্ষ্য রেখে হাটতে লাগলো ল্যাংডন। কমেদি ফ্রাসোয়ের কোণায় এসে দেখতে পেলো আরেকটি ব্রোঞ্জ মেডেল তার পায়ের নিচ দিয়ে অতিক্রম করছে। হ্যাঁ!

ল্যাংডন এটা জেনেছিলো, প্যারিসের রাস্তাগুলো কয়েক বছর আগেই এ রকম ১৩৫টি ব্রোঞ্জ মেডেল দিয়ে চিহ্নিত করা আছে, ফুটপাত, চত্বর এবং রাস্তাঘাটে শহর জুড়ে উত্তর-দক্ষিণ অক্ষে খোঁদাই করা আছে। সে এবার সিন নদীর উত্তর দিকের স্যাকরেকোয়ের একটি লাইন ধরে অনুসরণ করে শেষ পর্যন্ত প্রাচীন প্যারিসের অবজারভেটরিতে পৌঁছে গেলো। সেখানে পবিত্র পথের বিশেষত্ব আবিষ্কার করলো সে।

পৃথিবীর আদি মধ্য রেখা।

পৃথিবীর প্রথম শূন্য দ্রাঘিমাংশ।

প্যারিসের প্রাচীন রোজ লাইন।

এখন রুই দ্য রিভোলির দিকে দ্রুত ছুটতে গিয়ে ল্যাংডনের মনে হলো সে তার গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে। আর একটা ব্লকেরও কম দূরে সেটা।

হলি গ্রেইল প্রাচীন রোজলিন-এর নিচে অপেক্ষা করছে।

সবকিছু এখন খুব দ্রুতই উন্মোচিত হচ্ছে। সনিয়ের রোজলিনের প্রাচীন বানান …তলোয়ার এবং পেয়ালা…সমাধি ফলকটি অসাধরণ চিত্রে সজ্জিত।

এর জন্যেই কি সনিয়ে আমার সাথে কথা বলার দরকার মনে করেছিলেন? আমি কি আমার অজান্তেই সত্যটা জানতাম?

সম্বিত ফিরে পেতেই বুঝতে পারলো তার পায়ের নিচেই রোজলিনটা। তাকে পথ দেখাচ্ছে, গন্তব্যের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্যাসেজ রিসেলুর লম্বা টানেলের ভেতরে ঢুকতেই তার ঘাড়ের চুলগুলো এক অজানা আশংকায় খাড়া হয়ে গেলো। সে জানতো টানেলের শেষ প্রান্তে প্যারিসের সবচাইতে রহস্যময় মনুমেন্টটি অবস্থিত-১৯৮০তে স্ফিংসর নিজের ধারণায়, মানে ফ্রাসোয়া মিরোর অনুমোদনে তৈরি হয়েছিলো, যার সম্পর্কে গুজব ছিলো যে, তিনি গুপ্ত সংঘে যোগ দিয়েছিলেন।

আরেকটি জীবনকাল।

সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে ল্যাংডন সেই পথ থেকে বেড়িয়ে অতি পরিচিত প্রাঙ্গণে এসে থামলো। নিঃশ্বাসহীন, অবিশ্বাসে নিজের সামনে থাকা চকে স্থাপত্যের দিকে ভূরু তুলে তাকালো।

লুভর পিরামিড।

অন্ধকারে জ্বল জ্বল করছে।

সে কয়েকমুহূর্ত সপ্রশংস দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তার ডান দিকে যে জিনিসটা রয়েছে সেটার দিকেই বেশি আগ্রহী হলো। ঘুরে দাঁড়িয়েই তার মনে হলো তার পা দুটো আবার প্রাচীন রোজলিন লাইনের অদৃশ্য পথের খোঁজে চলতে শুরু করেছে। তাকে প্রাঙ্গণ পেরিয়ে কারুজেল দু লুভরর দিকে নিয়ে যাচ্ছে-ঘাসের তৈরি বড় একটা বৃত্ত, সেটার চারদিক ঘিরে রেখেছে আরেকটা বেড়া-এক সময়কার প্যারিসের প্রকৃতি পূজা উৎসবের জায়গা…আনন্দ উজ্জ্বল আচার অনুষ্ঠান করা হতো উর্বরতা আর দেবীদের নিবেদন করে।

ঘাসের এলাকাটায় প্রবেশ করতেই ল্যাংডনের মনে হলো সে অন্য একটা পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে। এই বিশাল চত্বরটা বর্তমানে শহরের সবচাইতে ন্নি ধরণের মনুমেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এখানের কেন্দ্রের মধ্যে, কাঁচের তীরের মতো বিধে আছে বিশাল আকৃতির একটা কাঁচের তৈরি উল্টো পিরামিড, যেটা সে কয়েকদিন আগে রাতের বেলায় লুভরের ভূ-গর্ভস্থ টানেলে প্রবেশ করার সময় দেখেছিলো।

লা পিরামিড ইনভার্সি।

অনেকটা টলতে টলতে ল্যাংডন লুভরের ভূ-গর্ভস্থ কপ্লেক্সে প্রবেশ করলো। অ্যাম্বার লাইটের আলোয় জায়গাটা ঘোলাটে লাগছে। তার চোখে শুধু উল্টো পিরামিডটাই ধরা পড়লো না বরং সেটার একেবারে নিচে যা ছিলো সেটাও। এখানে ফ্লোরের নিচে যে কক্ষটা আছে সেখানে একটা ক্ষুদ্র স্থাপত্য রয়েছে…যে স্থাপত্যের কথা ল্যাংডন তার লেখায় উল্লেখ করেছে।

অচিন্ত্যনীয় সম্ভাবনার রোমাঞ্চে ল্যাংডনের মনে হলো সে পুরোপুরি জেগে উঠেছে। লুতরের দিকে আবার চোখ তুলে তাকালো, তার মনে হলো জাদুঘরের বিশাল উইংগুলো তাকে জাপটে ধরছে…ওখানকার হলওয়েতে পৃথিবীর সবচাইতে সেরা শিল্পকর্মগুলো রাখা আছে।

দা ভিঞ্চি…বত্তিচেলি…

প্রসংশিত মাস্টারদের প্রিয় ছবিতে সে শায়িত আছে।

বিস্ময়ে সজীব হয়ে ওঠে সে আরেকবার কাঁচের ভেতর দিয়ে নিচে রাখা ক্ষুদ্র স্থাপত্যটার দিকে তাকালো।

আমাকে অবশ্যই নিচে যেতে হবে!

ওখান থেকে বের হয়ে সে প্রাঙ্গণটা পেরিয়ে লুভরের পিরামিডের প্রবেশপথের দিকে গেলো। সেই দিনের শেষ দর্শকটি বের হয়ে এলো জাদুঘর থেকে।

রিভলভিং দরজাটা ঠেলে ল্যাংডন পিরামিডের ভেতরের বাঁকা সিঁড়িটা দিকে অগ্রসর হলো। ঠাণ্ডা বাতাসটা টের পেলো সে। সিঁড়ির একেবারে নিচে এসে লুভরের প্রাঙ্গণের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া দীর্ঘ টানেলের ভেতরে প্রবেশ করলো এবার। লা পিরামিড ইনভার্সি র দিকে প্রত্যাবর্তন।

টানেলের শেষ মাথায় একটা বিশাল কক্ষের সামনে এসে পড়লো। সরাসরি তার সামনে, উপর থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে উল্টো পিরামিডটাকে-একটা শ্বাসরুদ্ধকর V আকৃতির কাঁচ।

পেয়ালা।

ল্যাংডন এটার সরু মাথাটা পর্যবেক্ষণ করে দেখলো, মাটি থেকে সেটা মাত্র ছফুট উঁচুতে আছে। এখানে, ঠিক তার নিচেই সেই ক্ষুদ্র স্থাপত্যটি রয়েছে।

পিমিডের একটা ছোট্ট সংস্করণ। মাত্র তিন ফুট লম্বা। এই কমপ্লেক্সের একমাত্র স্থাপত্য যা এতো ছোট আকারে তৈরি করা হয়েছে।

ল্যাংডনের লেখায়, যেখানে সে সুরের বিশাল দেবী চিত্রকর্মের সংগ্রহশালা সম্পকে আলোকপাত করেছে সেখানে এই সুন্দর পিমিড সম্পকে একটা নোট আছে। ছোট এই কাঠামোটি মাটিতে এমনভাবে উঠে এসেছে যেনো সেটা কোন হিমখণ্ডের ভেসে থাকা অংশ-বিশাল একটা পিরামিডিয় ভল্ট, লুক্কায়িত কক্ষের মতো ডুবে আছে যেনো।

ভেতরের নরম আলো জ্বলছে, দুটো পিরামিড একে অন্যের দিকে তাক করা, একই রেখায় অবস্থিত তারা, তদের মাথা প্রায় স্পর্শ করছে।

উপরে পেয়ালা। নিচে তলোয়ার।

তলোয়ার আর পেয়ালা তাঁর দরজা পাহারা দেয়।

ল্যাংডন ম্যারি শভেলর কথাটা শুনতে পেলো। একদিন এটা আপনার কাছে উদ্ভাসিত হবে।

সে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন রোজ লাইন রেখার নিচে, তার চারপাশ জুড়ে আছে মাস্টার শিল্পীদের চিত্রকর্ম। তদারকি করার জন্যে এর চেয়ে ভালো জায়গা সনিয়ের জন্য আর কি হতে পারতো? এখন শেষ পর্যন্ত তার মনে হচ্ছে, সে গ্র্যান্ড মাস্টারের পংক্তিটা বুঝতে পারছে। চোখ তুলে উপরের কাঁচের ভেতর দিয়ে দীপ্তিময় তারা ভরা রাতের দিকে তাকালো সে।

অবশেষে তারা ভরা আকাশের নিচে শায়িত আছে সে।

আঁধারের গুঞ্জনের মতো বিস্মৃত শব্দাবলী প্রতিধ্বণিত হলো। হলি গ্রেইলর সন্ধান

মানে ম্যারি মাগদালিন-এর দেহাবশেষের সামনে হাটু গেঁড়ে বসা। সমাজচ্যুত একজনের পায়ের সামনে বসে প্রার্থনা করার একটি সফর।

আচমকা এক শ্রদ্ধাভাবের উদয়ের ফলে রবটি ল্যাংডনের মনে হলো সে হাটু গেঁড়ে বসে পড়েছে।

অল্পক্ষণের জন্য সে একটা নারী কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেলো…প্রজ্ঞার যুগ…পৃথিবীর গহ্বর থেকে উঠে আসলে একটা চাপা কণ্ঠ।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত