রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট

রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট

রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট
মূল রচনা: উইলিয়াম শেকসপিয়র
ভাষান্তর: অজয় দাশগুপ্ত ও অরবিন্দ চক্রবর্তী

ইতালি দেশের এক সুন্দর শহর ভেরোনা—প্রাচীনত্ব আর ঐতিহ্যপূর্ণ। রাজা ছাড়াও এদেশে রয়েছে আরও দুটি অভিজাত পরিবার, ধন-সম্পত্তি আর ক্ষমতার দিক দিয়ে রাজার চেয়ে তারা কোনও অংশে কম নয়। এ দুটি বংশের একটি ক্যাপুলেট, অন্যটি মন্টেগু।

বংশ দুটি ধনী ও অভিজাত হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে চিরকালীন শত্রুতা। এ শত্রুতা যে কবে শুরু হয়েছিল তা সবার অজানা। উভয়ের সম্পর্কটা ঠিক সাপে-নেউলের মতো। উভয় পরিবারের শত্রুতার প্রভাব তাদের চাকর-বাকরদের মধ্যেও পড়েছে। রাস্তা-ঘাটে যখনই যেখানে দেখা হয়, কোনও না কোনও অজুহাতে একে অপরের সাথে ঝগড়া বাধায়, মারামারি করে—যার পরিসমাপ্তি হয় রক্তপাতে।

একদিন সাতসকালে ক্যাপুলেট পরিবারের দুই চাকর স্যামসন আর গ্রেগরি এসে হাজির হল শহরের এক জনবহুল ব্যস্ত এলাকায়—তাদের উদ্দেশ্যে মন্টেগু পরিবারের চাকরদের সাথে ঝগড়া বাধানো।

বিরক্তি মেশান স্বরে গ্রেগরিকে বলল স্যামসন, ‘আমি তোকে পরিষ্কার বলে দিচ্ছি গ্রেগরি, এভাবে প্রতিদিন কয়লার বোঝা বইতে পারব না আমি।’

‘ঠিকই বলেছি,’ বলল গ্রেগরি, ‘ও কাজ করলে আমরা সবাই আমাদের কয়লাখনির কুলি-কামিন বলবে।’

গলাটা সামান্য চড়িয়ে বলল স্যামসন, ‘দেখ গ্রেগরি! তুই কিন্তু ভুলে যাস না আমি বেজায় রাগী। রাগ হলেই আমি তলোয়ার বের করি।’

‘যা! যা! তোর আবার রাগ আছে নাকি’—স্যামসনকে ইচ্ছে করে তাতিয়ে বলল গ্রেগরি।

‘দ্যাখ গ্রেগরি! ভালো হচ্ছে না কিন্তু’—খেঁকিয়ে বলল স্যামসন। ‘জানিস! মন্টেগুদের বাড়ির একটা কুকুর আজ আমার মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে।’

জবাবে কী যেন বলতে চাচ্ছিল গ্রেগরি, এমন সময় তার চোখে পড়ল মন্টেগু বাড়ির দুজন বয়স্ক চাকর, আব্রাহাম আর বালথাজার তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।

‘ওরে স্যামসন! মন্টেগু বাড়ির ধেড়ে চাকর দুটি যে এদিকেই আসছে। নে! এবার তো তলোয়ার বের কর’—বলল গ্রেগরি।

একটি ভেবে নিয়ে স্যামসন বলল, ‘নারে! আগে ওদেরই শুরু করতে দে। তাহলে আইন আমাদের পক্ষে থাকবে।’

‘বেশ তাই হলে’—বলল গ্রেগরি। ‘চল, আমরা ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। যেতে যেতে আমি কিন্তু বারবার ভ্রু কুঁচকিয়া এক চোখ বুজে ওদের ভ্যাভাব।’

‘উঁহু, ওতে কোনও কাজ হবে না,’ বলল স্যামসন। ‘বরঞ্চ ওদের দিকে আমি বুড়ো আঙুল নাচাব। দেখবি, ঠিক কাজ হবে তাতে।’

তাদের উদ্দেশ্য করে বুড়ো আঙুল নাচানো দেখে মন্টেগুদের একজন বয়স্ক চাকর আব্রাহাম এগিয়ে এসে বলল, ‘ওহে ছোকরা! তুমি আমাদের বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছ?’

‘বেশ করেছি, দেখাবই তো’, গলা চড়িয়ে বলল স্যামসন। ঠিক তখনই তাকে পেছন থেকে চিমটি কাটল গ্রেগরি। চিমটি খেয়েই সুর পালটে বলল স্যামসন, ‘না, ঠিক তোমাদের নয়, আমি এমনই বুড়ো আঙুল নাচাচ্ছি।’

গ্রেগরি জানতে চাইল, তোমরা কি আমাদের সাথে ঝগড়া বাধাতে চাও?’

‘ঝগড়া। তোমাদের সাথে?’ অবাক হয়ে বলল আব্রাহাম, ‘বলা নেই, কওয়া নেই, অহেতুক ঝগড়া করতে কেন যাব?’

একগুঁয়ের মতো বলল স্যামসন, ‘ধরো, ভুলবশতই তোমরা ঝগড়া করতে চাইছ আমাদের সাথে। তাহলে কিন্তু ছেড়ে দেব না তোমাদের। আমরাও জানি কীভাবে বিবাদ বাধাতে হয়।’

পরিহাসের সুরে বলল আব্রাহাম, ‘আমার মতো বলছে কেন, আমার চেয়ে বেশি জান না বোধ হয়?’

কানে কানে স্যামসনকে বলল গ্রেগরি, ‘অকে বলে দে তোমার চেয়ে ভালো জানি।’

‘ঠিক বলেছিস’ বলেই নির্বোধের মতো আঙুল নাচাতে নাচাতে বলল স্যামসন, ‘তোমার চেয়ে ভালো জানি কী করে ঝগড়া বাধাতে হয়।’

এতক্ষণে রেগে গিয়ে বলল আব্রাহাম, ‘ওহে মিথ্যেবাদী ছোকরা! আমার সাথে ঝগড়া করার মুরোদ নেই তোমার।’

কথা শুনে ফুঁসে উঠে বলল স্যামসন, ‘দাঁড়াও, আমাকে মিথ্যেবাদী বলার মজা দেখাচ্ছি তোমায়’, বলেই খাপ থেকে তলোয়ার বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ল আব্রাহামের উপর। আত্মরক্ষার জন্য আব্রাহামও বাধ্য হল তলোয়া বের করতে। ওদিকে স্যামসনের দেখাদেখি গ্রেগরিও তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল বালথাজারের উপর।

ওদের এভাবে লড়াই করতে দেখে ছুটে এলেন সেনর বেলভোলিও। নিজের তলোয়ার বের করে ওদের থামাতে থামাতে বললেন, ‘ওরে গাধার দল! কী করছিস তা জানিস তোরা। ফেলে দে তলোয়ার। থামা তোদের লড়াই।’

ঠিক সেসময় ক্যাপুলেট গিন্নির ভাইপো টিবল্ট এসে হাজির সেখানে। বেনভোলিওকে দেখে সে বলল, কী হে বেনভোলিও। এসব ছোটোলোক চাকর-বাকরদের ব্যাপারে তুমি আবার নাক গলিয়েছ কেন? লড়ার ইচ্ছে হলে আমার সাথে লড়। বের কর তোমার তলোয়ার। চিরদিনের মতো তোমার সাধ মিটিয়ে দেব।’ বলেই তলোয়ার হাতে টিবল্ট ছুটে এল বেনভোলিওর দিকে।

বেনভোলিও জবাব দিলেন, ‘তুমি ভুল করছ টিবল্ট। আমি ওদের মিটমাটের চেষ্টা করছি।’

‘কী বললে, খোলা তলোয়ার হাতে শান্তিরক্ষা?’ হেসে উঠে বললেন টিবল্ট, ‘শুনে রাখ, মন্টেগু পরিবারের সবাইকে আমি চরম ঘৃণা করি। তোমরা শেয়াল-কুকুরের চেয়েও হীন। নাও, এবার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও’—বলেই খোলা তলোয়ার হাতে বেনভোলিওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল টিবল্ট। এবার শুরু হয়ে গেল লড়াই। খোলা রাস্তার উপর ক্যাপুলেট আর মন্টেগু পরিবারের দুই সদস্য ও দু-জোড়া চাকর নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে মেতে উঠল। নিমেষের মধ্যে রটে গেল ক্যাপুলেট আর মন্টেগুরা ফের শুরু করেছে নিজেদের মধ্যে লড়াই। খবর পেয়ে শান্তিরক্ষক তার কয়েকজন কর্মচারীকে সাথে নিয়ে সেখানে এলেন। দাঙ্গাবাজদের নিরস্ত করতে কয়েকজন স্থানীয় নাগরিকও সেখানে গেলে অস্ত্র হাতে।

নাগরিকদের উদ্দেশ্য করে শান্তিরক্ষক বললেন, ‘ধর ব্যাটাদের। মেরে শেষ করে দে সব কটাকে। এমন শিক্ষা দিবি যাতে চিরকালের জন্য ওদের মারামারির শখ মিটে যায়।’

‘মন্টেগু আর ক্যাপুলেট, দুপক্ষই নিপাত যাক’—বলে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল নাগরিকরা। দাঙ্গাবাজ দু-পক্ষকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে জমে উঠল লোকের ভিড়, হই-হট্টগোল আর চিৎকার-চেঁচামেচি। মারামারির খবর পেয়ে ক্যাপুলেটদের বুড়ো কর্তা স্ত্রীকে নিয়ে হাজির হলেন সেখানে। গোলমাল দেখে স্ত্রীকে বললেন, ‘শয়তানগুলো বুঝি আবার মারামারি শুরু করেছে?’ যাও তো, কাউকে বাড়ি পাঠিয়ে আমার তলোয়ারগুলি নিয়ে আসতে বল। তারপর দেখাচ্ছি ওদের মজা।

বুড়োকর্তার স্ত্রী বললেন, ‘তুমি বুড়ো মানুষ। তলোয়ার দিয়ে কী করবে? তার চেয়ে বরং সেই ঠেঙ্গোটা পাঠিয়ে দেই যাতে ভরে দিয়ে তুমি চলা-ফেরা কর।’

‘নাঃ নাঃ ঠেঙ্গোতে হবে না, তলোয়ারই চাই আমার। দেখছ না, বুড়ো মন্টেগু তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে ওরও হাতে রয়েছে তলোয়ার।’

ক্যাপুলেটদের বুড়ো কর্তাকে দেখামাত্রই হেঁকে উঠলেন মন্টেগুদের বুড়ো কর্তা, ‘অ্যাই বদমাস ক্যাপুলেট! যদি বাঁচতে চাস তো ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক। মোটেই বাধা দিবি না আমার কাজে।’

স্বামীর সাথে তাল মিলিয়ে মন্টেগু গিন্নিও বলে উঠলেন, ‘সাবধান করে দিচ্ছি তোদের। আর একপাও এগুবি না।’

এবার ঝগড়া শুরু হয়ে গেল দু’পক্ষের বুড়ো-বুড়িদের মাঝে।

সে সময় ভেরোনার রাজা এসকেলাস তার সভাসদদের নিয়ে সে পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। গণ্ডোগোল আর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ঘোড়া থামিয়ে তিনি সেখানে দাঁড়ালেন। তারপর দাঙ্গাবাজদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আবার তোমরা রাস্তায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধিয়েছ? ভালো চাও তো সবার হাত থেকে তলোয়ার ফেলে দাও।’ রাজার আদেশে সবাই তলোয়ার ফেলে দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

এরপর মন্টেগু আর ক্যাপুলেট—দুই বুড়োর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রাজা বললেন, ‘আপনারা দুজনেই বয়স্ক লোক, কোথায় আপনারা থামাবেন, তা নয়, তলোয়ার হাতে দুজনেই ছুটে এসেছেন। এই নিয়ে পরপর তিনবার এরূপ কাণ্ড ঘটল শহরে। আমি আপনাদের সাবধান করে দিচ্ছি ভবিষ্যতে এরূপ কাণ্ড ঘটলে আমি বাধ্য হব আপনাদের সবার প্রাণদণ্ড দিতে। যান! হাতের তলোয়ার ফেলে নিজ নিজে কাজে চলে যান।’ এরপর ক্যাপুলেটদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি চলুন আমার সাথে। আর হ্যাঁ মন্টেগু, আপনি আজ দুপুরের বিচারসভায় যাবেন। আমার যা বলার সেখানেই বলব’—বলেই সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলেন রাজা।

সবাই চলে যাবার পর মন্টেগু পরিবারের বুড়ো কর্তা জিজ্ঞেস করলেন তার ভাইপোকে, ‘আচ্ছা, বলতো কী হয়েছিল? কে আবার নতুন করে ঝগড়াটা বাধাল?’

কাকার প্রশ্নের জবাবে সেনর বেনভোলিও বললেন, ‘সে সময় আমি এপথ দিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি দু বাড়ির কয়েকজন চাকর তলোয়ার নিয়ে লড়াই করছে। আমি ওদের ছাড়াতে গেছি এমন সময় কোথা থেকে খবর পেয়ে টিবল্ট এসে হাজির সেখানে। টিবল্টের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাধ্য হয়ে আমাকেও তলোয়ার বের করতে হয়। এরপরই শুরু হল বেজায় লড়াই। ভাগ্যিস সে সময় এপথ দিয়ে আসছিলেন রাজামশাই। তিনি সাবধান করে দিলেন সবাইকে। নইলে দেখতে পেতেন দু-চারটে লাশ রাস্তায় গড়াগড়ি দিচ্ছে।’

‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, রোমিও ছিল না সেখানে—’ বললেন মন্টেগু গিন্নি, ‘তুমি জান এখন সে কোথায়?’

বেনভোলিও বললেন, ‘আমার মনটা ভারাক্রান্ত ছিল। খুব সকালে সূর্য ওঠার আগেই আমি বেরিয়েছিলাম পথে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছিলাম শহরের পশ্চিম অঞ্চলে। তখন দেখলাম একটা গাছের নিচে পায়চারি করছে রোমিও। আমাকে দেখেই পা চালিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল সে। সেসময় নিজের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বিব্রত ছিলাম আমি। আতি ওকে আর ডাকিনি। শুনতে পেলাম রোমিওকে নাকি প্রায়ই এই বনে ঘোরা-ফেরা করতে দেখা যাচ্ছে।’

বৃদ্ধ মন্টেগুর একমাত্র ছেলে রোমিও। সে একজন সুন্দর-সুপুরুষ-স্বাস্থ্যবান যুবক। সে শুধু সুন্দরই নয়, আচার-আচরণেও খুব ভদ্র। তার মতো সাহসী, বীর সে অঞ্চলে খুব কমই আছে। এক কথায় সে একজন আদর্শ তরুণ।

বেশ ক’দিন ধরেই মন খারাপ রোমিওর। এর কারণ এক রূপসি যুবতি—নাম রোজালিন। রোমিও চায় তাকে বিয়ে করতে কিন্তু রোজালিন মোটেও খুশি নয় তার উপর। বেশ কিছুদিন ধরে রোজালিন না আসায় রোমিওর মন এতই খারাপ যে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে পর্যন্ত দেখা করছে না সে। পাগলের মতো শুধু বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার দুজন অন্তরঙ্গ বন্ধুর মধ্যে একজন মন্টেগু কর্তার ভাইপো সেনর বেনভোলিও, অপরজন রাজার আত্মীয় মার্কুলিসও। দাঙ্গা বন্ধ হবার পর রোমিওকে খুঁজতে খুঁজতে তারা এসে হাজির হল সেই গভীর জঙ্গলে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তারা দেখা পেল রোমিওর। যার জন্য রোমিওর এ অবস্থা, সেই রোজালিনকে নিয়েও হাসি-ঠাট্টা করল তারা। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে বন্ধুদের অনুনয় করে বলল রোমিও, ‘ভাই, যে ভাবেই হোক তোরা ব্যবস্থা করে দে যাতে অন্তত একবার তার দেখা পাই।’

অরণ্য থেকে বেরিয়ে এসে যখন তারা রাস্তায় কথাবার্তা বলছিল, সে সময় একজন লোক এসে একটা কাগজ মেলে ধরল তাদের সামনে। কাগজটা আর কিছু নয় একটা তালিকা। তারা পড়ে দেখলে ওতে রয়েছে ভেরোনার সব সম্ভ্রান্ত বংশের নারী-পুরুষদের নাম, বাদ গেছে শুধু মন্টেগু পরিবার। যে লোকটা কাগজ নিয়ে এসেছিল সে ক্যাপুলেটদের বাড়ির চাকর—সম্পূর্ণ নিরক্ষর। কাগজে কী লেখা তা সে জানেনা—ক্যাপুলেট বাড়ি কর্তা-গিন্নিরও জানা নেই সেটা। তারা ওর হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিয়েই বলেছেন—’এতে যাদের যাদের নাম লেখা আছে তাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে আসবি। তাদের বিনীতভাবে বলবি তারা যেন আজ রাতে আমাদের বাড়িতে নৈশভোজনের আসরে যোগ দেন। সেই সাথে নাচ-গানের ব্যবস্থার কথাটাও বলে আসবি।’

‘তাই হবে কর্তা’—বলে কাগজখানা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সে। সে যে সম্পূর্ণ নিরক্ষর একথাটা লজ্জায় জানাতে পারেনি মনিবকে। কাজেই রাস্তা-ঘাটে যাকে পাচ্ছে, তাকে দিয়েই কাগজটা পড়িয়ে নিচ্ছে। ক্যাপুলেটদের সাথে মন্টেগুদের চিরকালীন রেষারেষির ব্যাপারটা জানত চাকরটি। কিন্তু রোমিও ও তার দু-বন্ধুকে জানতে না সে। জানলে কখনই সে কাগজটি তাদের পড়তে দিত না।

তালিকায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে উঠল রোমিও, ‘আরে! এযে দেখছি চাঁদের হাট বসাবার ব্যবস্থা হয়েছে। শহরের সম্ভ্রান্ত বংশীয় স্ত্রী-পুরুষ কেউ বাদ নেই এতে।’ লোকটিকে কাগজটা ফিরিয়ে দিয়ে রোমিও বলল, তা ভাই এদের কোথায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা হয়েছে?’

লোকটি উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে হুজুর, উপরে।’

‘কী বললে, উপরে! তা সে জায়গাটা কোথায়?’ জানতে চাইল রোমিও।

‘আজ্ঞে, রাতের বেলা আমাদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার নিমন্ত্রণ করা হয়েছে এদের সবাইকে। কর্তা বলেছেন নাচ-গানের ব্যবস্থাও করা হয়েছে’—উত্তর দিল লোকটি।

‘তা তোমার মনিবটি কে বাপু?’ জানতে চাইল রোমিও।

‘ক্যাপুলেটদের বুড়ো কর্তাই আমার মনিব’—বলল লোকটি, তবে আপনি যদি মন্টেগুদের কেউ না হন, তাহলে অনায়াসে সেখানে যেতে পারেন বন্ধুদের নিয়ে। সেখানে গিয়ে রাতে খাওয়া-দাওয়া করবেন। আচ্ছা হুজুর! তাহলে আসি’—বলে চলে গেল লোকটি।

রোজালিন নামটাই বারবার ঘুরতে লাগল রোমিওর মাথায়। ঐ তালিকায় রোজালিনের নামও রয়েছে। সে স্থির করল যা হয় হোক, শুধু রোজালিনকে দেখতেই ক্যাপুলেটদের নৈশ ভোজের আসরে যাবে। রোমিওর ভাবনা আন্দাজ করে তাকে ঠাট্টা করে বলল বেনভোলিও, ‘আরে এরে ভাববার কী আছে। রোজালিনের জন্য মন যখন এতই খারাপ, তখন ঝুঁকি নিয়েই ক্যাপুলেটদের বাড়ি গিয়ে দেখে এস তাকে।’

বন্ধু যে ঠাট্টা করছে তা বুঝতে না পেরে রোমিও বলল, ‘যাবই তো, গিয়ে প্রাণ ভরে দেখে আসব তাকে।’

বেনভোলিও বলল, ‘বেশ তো, যাও। হয়তো আজই তোমার শেষ দিন। রোজালিনকে দেখার পর এককোপে তোমার গর্দান নামিয়ে দেবে ক্যাপুলেটরা।

কার্কুসিও বলল, ‘যত ঝুঁকি আর বিপদের ভয় থাকুক না কেন, তোমার কিন্তু সেখানে যাওয়া উচিত। ভেরোনার সুন্দরীরা সেজেগুজে জড় হবে সেখানে। তাদের মধ্যে কাউকে মনে ধরে গেলে রোজালিনকে ভুলে যাবে তুমি—কেটে যাবে তোমার মোহ।’

রোমিও স্থির করল মোহ কাটাতে নয়, প্রাণভরে রোজালিনকে দেখার জন্যই ঝুঁকি সত্ত্বেও ক্যাপুলেটদের বাড়ির নৈশভোজের আসরে যাবে সে। তবে সে একা যাবে না, সাথে থাকবে দু-বন্ধু মার্কুসিও আর বেনভোলিও। তিন বন্ধু স্থির করল শত্রুর চোখে-ধুলো দেবার জন্য তারা ছদ্মবেশ ধরে যাবে।

ফুল আর আলোর রোশনাইয়ে সেজে উঠেছে ক্যাপুলেটদের প্রাসাদসম বাড়িটা। ভেরোনার অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েরা নাচ-গানে মেতে উঠেছে ভিতরের বিশাল হলঘরে। তাদের দেখলে মনে হবে রূপ-যৌবন যেন উপচে পড়েছে তাদের দেহে—তারা যেন মর্তের মানুষ নয়, রূপকথার কাল্পনিক স্বর্গ থেকে যেন তারা নেমে এসেছে। দামি পোশাক পরিধান করে ক্যাপুলেটদের বুড়োকর্তা দাঁড়িয়ে রয়েছেন হলঘরের দরজায়। তার একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়ির একজন সুন্দরী পরিচারিকা—তার হাতের সাজিতে সাজানো রয়েছে একগুচ্ছ ফুটন্ত গোলাপ কুঁড়ি।

কিছুক্ষণ বাদে সেখানে এসে পৌঁছালেন কাউন্ট প্যারিস। তাকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্থ হয়ে পড়লেন বুড়োকর্তা। কাউন্ট শুধু দেখতে সুন্দর নন, প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক তিনি। তার সাধ হয়েছে বুড়োকর্তার একমাত্র মেয়ে জুলিয়েটকে বিয়ে করার।

বহুদিন হল মারা গেছে বুড়োকর্তার অন্যান্য ছেলেমেয়েরা। বেঁচে আছে শুধু চোদ্দ বছর বয়সি জুলিয়েট। কাউন্ট প্যারিসের সাথে জুলিয়েটের বিয়েতে আপত্তি নেই বুড়োকর্তার, কিন্তু তিনি চান না এখনই বিয়ে হয়ে যাক এই ছোট্ট মেয়েটার। তিনি কাউন্টকে বলেছেন মেয়েটার ষোলো বছর বয়েস হলে তিনি তার বিয়ে দেবেন। দু-বছর যথেষ্ট সময়। কাউন্ট ইচ্ছে করলে এ সময় জুলিয়েটের সাথে মেলামেশা করতে পারেন। বুড়োকর্তার তরফে এ নিয়ে কোনও আপত্তি নেই। আর এ মেলামেশার ফলে কাউন্টকে ভাবী স্বামী বলে মেনে নেবার জন্য মানসিক দিক দিয়ে তৈরি হতে পারবে। এ কথা অবশ্য ঠিক যে জুলিয়েটের মতো বয়েসে তার গিন্নি অনেকগুলি সন্তানের মা হয়েছিলেন।

গায়ক-বাদকদের ছদ্মবেশে অতিথিদের মধ্যে মিশে গিয়ে রোমিও ও তার দু-বন্ধু এক সময় ঢুকে পড়ল ক্যাপুলেটদের প্রাসাদের ভিতরে। এরা কেউ ক্যাপুলেট পরিবারের সদস্যদের ধারেকাছেও ভেড়েনি। বাড়ির মেয়েরা যেখানে সমবেত হয়েছে, তাদের তিনজোড়া চোখ সেখানেই খুঁজে বেড়াচ্ছে রোজালিনকে। কিন্তু রোজালিনকে খুঁজতে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটে যাবে তা কল্পনাও করতে পারেনি রোমিও আর তার দুই বন্ধু।

তার দু-বন্ধু বারবার তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, ‘ওভাবে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থক না, সামনে এগিয়ে চল।’ কিন্তু সেদিকে কোনও হুঁশ নেই রোমিওর। পলকহীন দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে সে চেয়ে আছে আর মাঝে মাঝে বন্ধুদের বলছে, ‘কে-রে ভাই ওই মেয়েটা? দোহাই তোদের, ওর নামটা একবার জেনে আয় না।’

কিন্তু মন্দ ভাগ্য রোমিওর। তাই মেয়েটির পরিচয় জানার আগেই ক্যাপুলেটরা জেনে গেল রোমিওর আসল পরিচয়। তার পরিচয়টা যে জানল সে হল ক্যাপুলেট পরিবারের সবচেয়ে শয়তান লোক টিবল্ট—মন্টেগুদের নাম শুনলে যে তেলে-বেগুলে জ্বলে ওঠে। সে একটা চাকরকে ডেকে বলল, ‘যা দৌড়ে গিয়ে, আমার তলোয়ারটা নিয়ে আয়।’

চাকরটা তলোয়ার আনতে যাবে এমন সময় সেখানে এসে পৌঁছলেন ক্যাপুলেট বাড়ির বুড়োকর্তা। টিবল্ট যে চাকরকে ডেকে তলোয়ার আনতে বলেছে সে কথাটা শুনেছেন তিনি আর তাতেই বুঝে গেছেন কোনও একটা গুরুতর ব্যাপার ঘটেছে।

বুড়ো কর্তা টিবল্টকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে রে তোর? অযথা কেন মাথা গরম করছিস আজকের দিনে?’

দূর থেকে রোমিওকে দেখিয়ে বলল টিবল্ট, ‘আমি অযথা মাথা গরম করছি না। ওই যে বাজনাদারের পোশাক পরা ছেলেটিকে দেখছ, ও হল মন্টেগু বাড়ির রোমিও। নিশ্চয়ই ওর কুমতলব আছে, নইলে ছদ্মবেশে আসবে কেন। আমি ওর কান দুটো কেটে নেব তলোয়ার দিয়ে।’

টিবল্টের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন বুড়োকর্তা, তারপর বললেন, ‘তোমার সাবধান করে দিচ্ছি আমি। রাজার ধমক খাবার পরও তোর শখ মেটেনি লড়াই করার? আমি তো নিজে দেখেছি রোমিওকে। কী সুন্দর ওকে দেখতে। তাছাড়া শত্রু হওয়া সত্ত্বেও সে নিজে যখন আমাদের বাড়িতে এসেছে তখন সে আমাদের অতিথি। তাকে সম্মান না হয় না জানালি, তাই বলে তার কান কেটে নিবি? এ কেমন কথা? ক্যাপুলেট বাড়ির ছেলের মুখে এ কথা সাজেনা। আমার সাবধানবাণী সত্ত্বেও যদি তুমি ওর গায়ে হাত তোল, তাহলে তার ফল তুমি একাই ভোগ করবে। বিচারের সময় আমি কিন্তু তোমাকে বাঁচাতে যাব না। সে কথা মনে রেখ।’ বুড়োকর্তার ধমকানিতে শেষমেষ ঠাণ্ডা হল টিবল্ট।

ক্যাপুলেটরা যে রোমিওকে চিনতে পেরেছে সে কথা কিন্তু তখনও পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি সে। তার মন পড়ে রয়েছে সেই অল্পবয়সি সুন্দরী মেয়েটির দিকে। সে জানে সুন্দরী মেয়েদের মন জয় করার উপায় হল সাহসে ভরে করে তাদের সাথে যেতে আলাপ করা। কিছুদূর গিয়ে বন্ধুদের চোখের আড়ালে পাঁচিল টপকে সে লাফিয়ে পড়ল ক্যাপুলেটদের বাগানে। এতসব হই-হট্টগোলের মাঝেও সে যেচে গিয়ে আলাপ করছে মেয়েটির সাথে। মেয়েটি বেশ ভালোভাবেই কথাবার্তা বলেছে তার সাথে। তাই দেখে রোমিও ধরে নিল মেয়েটিরও নিশ্চয় পছন্দ হয়েছে। কিন্তু অসুবিধা এই মেয়েটির নাম পর্যন্ত জানে না সে। সেটাই সবসময় খোঁচাতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদে মেয়েটির ধাই-মা এসে ‘জুলিয়েট’ বলে ডাকল তাকে। আর তখনই রোমিও জানতে পারল মেয়েটির নাম ‘জুলিয়েট’। ধাই-মাকে জিজ্ঞেস করে রোমিও জানতে পারল জুলিয়েট সবে তেরো ছেড়ে চোদ্দে পা দিয়েছে—আর ক্যাপুলেট কর্তার একমাত্র কন্যা সে।

মনে মনে আক্ষেপ করে রোমিও বলল, ‘হায় ভগবান। একি হল? এই পরমাসুন্দরী মেয়েটি কিনা আমাদের চিরশত্রু ক্যাপুলেট কর্তার একমাত্র মেয়ে?’ কিন্তু শত্রুর মেয়ে হলে কী হবে? প্রথম দেখা থেকেই রোমিও এত ভালোবেসে ফেলেছে জুলিয়েটকে, যে তার পক্ষে কোনও মতেই সম্ভব নয় জুলিয়েটকে ছেড়ে থাকা।

আবার একই সমস্যার মাঝে পড়েছে জুলিয়েট। রোমিওকে দেখে, তার কথাবার্তা শুনে খুবই ভালো লেগে গেছে জুলিয়েটের। এখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে কেন সে সময় ছেলেটির নাম জেনে নেয়নি। তবে সে লক্ষ করেছে ছেলেটি ধাইমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার সাথে কথা বলছিল। তাই সে ধাইমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা ছেলেটির নাম কী?’

কোন ছেলেটির কথা জুলিয়েট জানতে চাইছে সেটা বুঝতে প্রেও মুখে বলল ধাইমা, ‘কার কথা বলছ মেয়ে? অনেক ছেলেই তো এসেছিল। নেচে-গেয়ে, খেয়ে-দেয়ে তারা সবাই বিদায় নিল।’

আদুরে মেয়ের মতো ধাইমার গলা জড়িয়ে বলল জুলিয়েট, ‘ওই যে গো ধাইমা, রাজপুত্তুরের মতো দেখতে সেই সুন্দর ছেলেটা—যার পরনে ছিল বাজনাদারের পোশাক, আবার নাচিয়েদের মতো রংও মেখেছিল মুখে। আমি সেই ছেলেটার কথা বলছি যখন আমায় ডাকতে এসে তুমি তার সাথে কথা বলছিলে।’

ধাইমা বলল, ‘এত ছেলে এল গেল, সে সব বাদ দিয়ে ওকেই কিনা তোর পছন্দ হল’ বলেই নিজেকে সামলিয়ে নিলে সে। তারও একদিন রূপ-যৌব ছিল। সে জানে অপরিচিত ছেলের নাম জানার জন্য কমবয়সি মেয়েরা কত না আগ্রহী হয়। ধাইমার মনে হল আগে রোমিওর পরিচয় জানিয়ে দিলে তার উপর থেকে জুলিয়েটের আকর্ষণ আপনা থেকেই উবে যাবে।

জুলিয়েটের কানের কাছে মুখটা নিয়ে ধাইমা বলল, ‘তুমি ওই ছেলেটার নাম জানতে চাইছ? ও হল আমাদের চিরশত্রু মন্টেগুদের একমাত্র বংশধর—নাম রোমিও। তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি এ বাড়িতে ওর নাম উচ্চারণ করবে না তুমি। তাহলে কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। রোমিও এ বাড়িতে আসায় ওর কান কেটে নিতে চেয়েছিল টিবল্ট। অনেক বকাঝকা করে তাকে ঠাণ্ডা করেছেন বুড়োকর্তা।

ভেরোনার অল্পবয়সি ছেলেদের মাঝে রোমিওর মতো সুপুরুষ, স্বাস্থ্যবান, সুন্দর যুবক আর কেউ নেই সে কথা জানে জুলিয়েট। তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল যখন সে জানতে পারল রোমিও তাদের পরম শত্রু মন্টেগু বাড়ির ছেলে।

গভীর রাত। শত চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারছে না জুলিয়েট। বারবারই তার মনে পড়ছে রোমিওর কথা, সেই সাথে কেটে যাচ্ছে ঘুমের রেশ। বিছানায় কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে শেষে বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল সে। চেয়ে দেখল একপাশে কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে ধাইমা। সে যাতে টের না পায় এমনভাবে খাট থেকে নেমে এল জুলিয়েট। মোববাতির ক্ষীণ আলোতে মোটেও দেখা যাচ্ছে না খোলা জানালার নিচে বিশাল বাগান, গাছপালা, ফুল, আর লতাপাতা। এতক্ষণে রোমিও আর মন্টেগুদের কথা ভেবে মাথা গরম হয়ে উঠেছিল তার। বাগানের এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ার স্পর্শে জুড়িয়ে গেল তার মন।

কখন যে তার অজান্তে আক্ষেপের সুরে কথাগুলি বেরিয়ে এল জুলিয়েটের মুখ থেকে, ‘রোমিও! কেন তুমি জন্মেছিলে মন্টেগু বংশে? তুমি কি জান না সেতাই আমাদের মিলনের পথে প্রধান অন্তরায়? তুমি যদি নামটা পালটে নাও তাহলে এমন কী ক্ষতি হবে তোমার? তুমি কি জান না যে নামে কিছু আসে যায় না—গোলাপকে যে নামেই ডাক, তার সুগন্ধ নষ্ট হয় না?’

অনেক আগেই রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে ক্যাপুলেটদের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসেছে রোমিও ও তার দু-বন্ধু। কিছুদূর যাবার পর বন্ধুদের অজান্তে ক্যাপুলেটদের প্রাচীর টপকে বাগানের ভেতর লাফিয়ে পড়ল রোমিও। রোমিওকে না দেখে তার দু-বন্ধু বেনভোলিও আর মার্কুসিও বহুক্ষণ ডাকাডাকি করল তাকে। কিন্তু কোন সাড়া পেল না। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও রোমিও ফিরে না আসায় তারা যে যার বাড়িতে চলে গেল।

বাগানে নেমে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় সে এসে পৌঁছাল জুলিয়েটের ঘরের জানালার নিচে। এমন সময় উপর থেকে জুলিয়েটের আক্ষেপ তার কানে এল। সে মুখ তুলে উপর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিকই বলেছ। এখন থেকে রোমিও না বলে ‘প্রিয়তম’ বলে ডেক আমাকে।’

রোমিওর গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে জুলিয়েট বলল, ‘কে তুমি নিচে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে আমার কথা শুনছ?’

রোমিও বলল, ‘নিজের পরিচয়টা না হয় গোপনই থাক। কারণ নিজের নামটাকে ঘেন্না করি—ওটাই আমার পরম শত্রু।’

খুশিভরা গলায় বলল জুলিয়েট, ‘তুমি না বললেও আমি চিনতে পেরেছি তোমায়। তুমি নিশ্চয়ই রোমিও, তাই না?’

রোমিও উত্তর দিল, ‘যদি ও নামটা তোমার পছন্দ না হয়, তাহলে ধরে নাও ওটা আমার নাম নয়।’

জুলিয়েট জানতে চাইল, ‘আমাদের বাগানের এত উঁচু পাঁচিল টপকে কীভাবে ভেতরে এলে তুমি?’

রোমিও বলল, ‘কোনও বাধাই প্রেমিককে ঠেকাতে পারে না। সাহস থাকলে প্রেমিক যে কোনও কাজ করতে পারে।’

জুলিয়েট বলল, ‘তুমি তো জান আমার পরিবারের লোকদের, তোমায় পেলে তারা খুন করে ফেলবে।’

আবেগ মেশানো গলায় বলল, ‘সে ভয় নেই আমার। তোমাকে দেখার জন্য তলোয়ারের আঘাত সইতেও রাজি আমি।’

এমন সময় ঘুম ভেঙে গেল ধাইমার। জুলিয়েটকে বিছানায় দেখতে না পেয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল সে।

জুলিয়েটের নাম করে বেশ কয়েকবার ডাকল ধাইমা। সে আওয়াজ কানে যেতে রোমিওকে সাবধান করে দিয়ে দ্রুত এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল জুলিয়েট। কিন্তু শুয়েও ছটফট করতে লাগল সে। বারবার ছুটে এল জানালার সামনে। নিচে তখনও রোমিও দাঁড়িয়ে। সারারাত জেগে তার সাথে ভালোবাসার অনেক কথা বলল জুলিয়েট। ভোর হবার সাথে সাথে বাগান থেকে বেরিয়ে গেল রোমিও। যাবার আগে জুলিয়েটের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিল রোমিও যে সে তাকে ভালোবাসে, বিয়ে করতেও রাজি আছে তাকে। জুলিয়েট প্রতিশ্রুতি দিল বেলা হবার আগে সে ধাইমাকে পাঠিয়ে দেবে তার কাছে—রোমিও তার মারফত জানিয়ে দেবে কখন কোথায় তাদের বিয়ে হবে।

সময় পেলেই শহরের বাইরে বেরিয়ে আসে রোমিও—চলে যায় লরেন্স নামে সংসার ত্যাগী এক সন্ন্যাসীর কাছে—নানা বিষয়ে আলোচনা হয় তাদের মধ্যে। সন্ন্যাসীও খুব ভালোবাসেন রোমিওকে। সেদিন শেষরাতে ক্যাপুলেটদের বাগান থেকে বেরিয়ে বাড়িতে না ফিরে রোমিও গিয়েছিল সন্ন্যাসীর কাছে। জুলিয়েটকে সে ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে চায়—সে কথা সন্ন্যাসীকে বলেছিল রোমিও। আর এও বলেছিল এ ব্যাপারে তারা পরস্পরকে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা সারতে হবে গোপনে। জানাজানি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে—কারণ ক্যাপুলেট আর মন্টেগু, উভয় পরিবারের লোকেরাই চেষ্টা করবে সর্বশক্তি দিয়ে এ বিয়ে বন্ধ করার। হয়তো দু-চারটে লাশও পড়ে যেতে পারে।

রোমিও সন্ন্যাসীকে অনুরোধ করে বলল, ‘প্রভু! সব কথাই তো আপনাকে খুলে বললাম। এবার আপনি বিয়ে দেবার দায়িত্ব নিয়ে আমাদের বাঁচান। সন্ন্যাসী ভেবে দেখলেন ক্যাপুলেট আর মন্টেগু, দুই পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠলে হয়তো অবসান হবে তাদের চিরশত্রুতার। সে সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে তিনি রাজি হলেন রোমিওর অনুরোধে। সন্ন্যাসীর কথায় আশ্বস্ত হয়ে রোমিও ফিরে গেল বাড়িতে। সারারাত খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকার দরুন প্রচণ্ড ক্লান্ত তার শরীর, ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ, ব্যথায় ছিঁড়ে যেতে বসেছে তার শরীর। কিন্তু এত বাধা-বিপত্তির মাঝেও সন্ন্যাসীর কাছ থেকে তার ও জুলিয়েটের বিয়ের আশ্বাস পেয়ে সব কিছুকে তুচ্ছ করে এগিয়ে চলেছে রোমিও।

বেলার দিকে জুলিয়েট তাই ধাইকে পাঠিয়ে দিল রোমিওর কাছে। ধাই মারফত রোমিও জানাল জুলিয়েটের সাথে তার বিয়ের সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে আছে। বিকেলের দিকে যদি সন্ন্যাসী লরেন্সের ওখানে যায়, তাহলে সেদিনই তাদের বিয়ে হয়ে যাবে—সন্ন্যাসী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের বিয়ে দেবেন। ফিরে গিয়ে ধাই সবকথা জানান জুলিয়েটক। গির্জায় যাবে বলে মার অনুমতি নিয়ে সে দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল জুলিয়েট। সবার অলক্ষে গিয়ে হাজির হল সন্ন্যাসী লরেন্সের ডেরায়। বিয়ের জোগাড় যন্তরের সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করা হয়েছিল। এবার সন্ন্যাসী লরেন্স বিয়ে দিয়ে দিলেন রোমিও-জুলিয়েটের।

বিয়ের ক’দিন বাদেই দুর্ভাগতের ছায়া নেমে এল রোমিওর জীবনে। বেনভোলিও আর মার্কুসিওর সাথে হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে গেল টিবল্টের। সেদিন উৎসবের রাতে রোমিওকে হাতের কাছে পেয়েও শায়েস্তা করতে না পারায় মনে মনে খুব ক্ষোভ ছিল টিবল্টের। আজ রাস্তায় রোমিওর দু-বন্ধু বেনভোলিও আর মার্কুসিওকে দেখতে পেয়ে বেজায় গালাগালি দিতে লাগল টিবল্ট। সে যে সহজে তাদের নিষ্কৃতি দেবে না একথা বুঝতে পেয়ে তারা চেষ্টা করলেন টিবল্টকে নিরস্ত করতে, ঠিক সে সময় সেখানে এসে হাজির হল রোমিও। তাকে দেখতে পেয়ে খাপ থেকে তলোয়ার বের করল টিবল্ট।

সব সময় বিবাহিত রোমিওর চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে স্ত্রী জুলিয়েটের কচি লাবণ্যভরা মুখখানি। টিবল্ট আবার সম্পর্কে জুলিয়েটের ভাই। তাই তাকে তো আর চট করে আঘাত করা যায় না। টিবল্টের কথায় রেগে না গিয়ে সে চেষ্টা করল তাকে শান্ত করতে, কিন্তু উলটো ফল হল তাতে। টিবল্ট ধরে নিল রোমিও একজন কাপুরুষ। তাই সে ইচ্ছে করেই মন্টেগু বংশের সবার নামে গালাগালি দিতে লাগল।

টিবল্টকে শায়েস্তা করা মোটেই শক্ত কাজ নয় রোমিওর পক্ষে। কিন্তু টিবল্ট যে জুলিয়েটের ভাই, সে কথা মনে ভেবে চুপ করে রইল সে। কিন্তু মার্কুসিওর কাছে অসহ্য মনে হল টিবল্টের ব্যবহার। সে তলোয়ার হাতে তেড়ে গেল টিবল্টের দিকে।

এবার সমস্যায় পড়ে গেলেন রোমিও—একদিকে জুলিয়েটের ভাই টিবল্ট, অন্যদিকে তার প্রধান বন্ধু মার্কুসিও, এদের যে কেউ আহত বা মারা গেলে চরম ক্ষতি হবে তার। তাদের বাঁচাতে রোমিও ঝাঁপিয়ে পড়লেন উভয়ের উদ্যত তলোয়ারের মাঝে। সাথে সাথে তার তলোয়ার সরিয়ে নিল মার্কুসিও, কিন্তু টিবল্ট তা করল না। রোমিওকে ঢালের মত ব্যবহার করে সে সজোরে আঘাত হানল মার্কুসিওর বুকে। মার্কুসিও আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যাবার কিছুক্ষণ বাদেই মৃত্যু হল তার।

এভাবে মার্কুসিওকে মরতে দেখে খুন চেপে গেল রোমিওর মাথায়। তখন জুলিয়েটের কথা আর মনে রইল না রোমিওর। সে তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল টিবল্টের উপর। তার তলোয়ার সোজা গিয়ে বিঁধল টিবল্টের হৃৎপিণ্ডে। সে আঘাতে রাস্তায় পড়ে গিয়ে ছটফট করতে করতে মারা গেল রক্তাক্ত টিবল্ট।

টিবল্টের মৃত্যু দেখে হুঁশ ফিরে এল রোমিওর। সে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল উত্তেজনার বশে এরূপ কাজ করার জন্য। কিন্তু এবার কী হবে? কোন মুখে সে দাঁড়াবে জুলিয়েটের সামনে?

রাস্তার উপর পাশাপাশি পড়ে রয়েছে মার্কুসিও আর টিবল্টের মৃতদেহ দুটি। এদিকে কৌতূহলী জনতার ভিড়ও ক্রমশ বেড়ে উঠছে। অনেক দিনই ভেরোনার রাজা আদেশ দিয়েছিলেন রাজপথে যে দাঙ্গা বাধাবে তার প্রাণদণ্ড হবে। কার এত দুঃসাহস রাজাদেশ লঙ্খন করে ভর দুপুরে এমন কাণ্ড বাধাল! খবর পেয়ে রাজা নিজেই ছুটে এলেন ঘটনাস্থলে। রাজাকে সব কথা খুলে বললে বেনভোলিও। সে আরও জানান ক্যাপুলেট বাড়ির টিবল্টই প্রথম আক্রমণ শুরু করেছিল। মার্কুসিওর হত্যাকারী সে। আত্মরক্ষার খাতিরেই প্রতি-আক্রমণ করতে হয়েছিল রোমিওকে, তারই ফলে মারা যায় টিবল্ট। সে কথা শুনে প্রাণদণ্ডের পরিবর্তে রোমিওকে নির্বাসন দণ্ড দিলেন রাজা। রাজাদেশ তৎক্ষণাৎ ভেরোনা ছেড়ে মান্টুয়ায় আশ্রয় নিতে হল রোমিওকে। এমনকি জুলিয়েটের সাথে দেখার করার সময়টুকু পর্যন্ত তাকে দিলেন না রাজা।

এই তো সবে বিয়ে হয়েছে রোমিও-জুলিয়েটের। এরই মধ্যে রোমিওর হাতে টিবল্টের মৃত্যু ও তার পরিণতিতে রোমিওর নির্বাসন দণ্ডের খবর শুনে যার-পর-নাই ভেঙে পড়ল জুলিয়েট। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে সর্বদাই সে কাঁদতে লাগল। বাবা, মা, বাড়ির সবাই নানাভাবে বোঝালেন তাকে—তা সত্ত্বেও জুলিয়েটের চোখের জল বাঁধা মানল না।

একমাত্র মেয়ের এরূপ অবস্থা দেখে বুড়ো ক্যাপুলেট বড়োই উদ্বিঘ্ন হয়ে উঠলেন। তার মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেল, রাতের ঘুম যে কোথায় পালিয়ে গেল তা কে জানে। শেষ অনেক ভেবেচিন্তে স্ত্রীর সাথে আলোচনা করে একটা উপায় খুঁজে পেলেন তিনি। তিনি তো কাউন্ট প্যারিসকে আগেই কথা দিয়েছেন যে জুলিয়েটের বিয়ে দেবেন। তিনি স্থির করলেন অযথা কাল-বিলম্ব না করে কাউন্টের সাথে জুলিয়েটের বিয়েটা চুকিয়ে দেবেন। স্বামী-স্ত্রী ধরে নিলেন বিয়ের আনন্দে টিবল্টের কথা ভুলে যাবে জুলিয়েট।

এবার জুলিয়েটের বিয়ের জোরদার আয়োজন শুরু হল। পরিবারের সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘর-দোর সাজানো, রাতারাতি জুলিয়েটের জন্য গহনা গড়ানো, এ সবই হয়ে গেল। ব্যাপার-স্যাপার দেখে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল জুলিয়েট। এর তো সবে মাত্র বিয়ে হয়েছে তার, আর তাও কিনা চিরশত্রু মন্টেগু পরিবারের রোমিওর সাথে—মরে গেলেও এ খবর তিনি জানাতে পারবেন না কাউকে। সে মিনতি জানিয়ে বাবা-মাকে বলল তার মনটা বড়োই চঞ্চল হয়ে আছে। এসময় তার বিয়ে দিলে বিয়ের কোনও আনন্দই উপভোগ করতে পারবে না সে।

কিন্তু জুলিয়েটের কাতর মিনতি ও চোখের জল সত্ত্বেও তার বাবার মন গলল না। তার অনুরোধের কোনও মূল্য দিলেন না তার বাবা। তিনি জুলিয়েটকে ডেকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে কাউন্ট প্যারিসের সাথেই তার বিয়ে হবে। এতে জুলিয়েট রাজি না হলে একবস্ত্রে তাকে বের করে দেবেন বাড়ি থেকে। আর যতদিন বেঁচে থাকবেন তার মুখদর্শন করবেন না।

একগুঁয়ে বাপের সিদ্ধান্ত শুনে খুবই মুশকিলে পড়ে গেল জুলিয়েট। সে ভেবে পেল না কীভাবে এই বিপদ থেকে মুক্তি পাবে। শেষমেশ তার মনে পড়ল সন্ন্যাসী লরেন্সের কথা—যিনি তাদের বিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন সবার অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে চলে গেল সন্ন্যাসীর আস্তানায়। সন্ন্যাসীকে সব কথা বলে তার পরামর্শ চাউল সে।

সবকথা শোনার পর সন্ন্যাসী তাকে বললেন, ‘দেখ, বাবার অবাধ্য হয়ো না। কাউন্ট প্যারিসকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও তুমি। ও নিয়ে কান্না-কাটি করোনা। ফুলের তৈরি একটা ওষুধ আমি তোমায় দিচ্ছি। তুমি সেটা সাবধানে রেখে দিও। এটা যেন অন্য কারও হাতে না পড়ে। যে দিন তোমার বিয়ে হবে, তার আগের দিন রাতে এই ওষুধটা খেয়ে তুমি শুয়ো। এই ওষুধের প্রভাবে খুব শীঘ্র ঘুমিয়ে পড়বে তুমি—তখন মৃতের সমস্ত লক্ষণ দেখা দেবে তোমার দেহে। পরদিন সকালে তোমাকে দেখে সবাই ধরে নেবে তুমি মারা গেছ। তখন বাধ্য হয়ে তোমার বাবা বিয়ে বন্ধ করে তোমার মৃতদেহ গির্জায় পাঠিয়ে দেবেন কবর দেয়ার জন্য। গির্জার ভেতর ক্যাপুলেটদের একটা নিজস্ব ঘর আছে। পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ী তোমার মৃতদেহ কমপক্ষে একদিন রাখা হবে সেখানে। আমি যে ওষুধটা তোমায় দিচ্ছি তার মেয়াদ চব্বিশ ঘণ্টা। এর অর্থ রাত ফুরোবার আগেই ক্যাপুলেটদের সেই কক্ষে ঘুম ভেঙে যাবে তোমার। ঘুম ভেঙে গেলেই দেখবে তোমার কাশে বসে আছে রোমিও। তোমার জ্ঞান ফিরে এলেই রাতারাতি তোমায় মান্টুয়ায় নিয়ে যাবে রোমিও। নিশ্চিন্তে সেখানে ঘর বাঁধতে পারবে তোমরা। আমি এখনই একজন বিশ্বস্ত লোককে মন্টুয়ায় রোমিওর কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। রোমিওর যা যা করণীয় তাকে আগে থেকেই বলে আসবে সে। আশা করি এবার তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে।’

সন্ন্যাসীর কথায় আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এল জুলিয়েট। বাবাকে ডেকে সে বলল, ‘বাবা! কাউন্টকে বিয়ে করতে রাজি আমি। তুমি যেদিন বলবে সে দিনই বিয়ে হবে।’

বাবা ভাবলেন সম্ভবত বাড়ি ছাড়ার ভয়েই জুলিয়েট রাজি হয়েছে কাউন্ট প্যারিসকে বিয়ে করতে। যাই হোক, এবার তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে মেয়ের বিয়ের দিন-ক্ষণ স্থির করলেন।

সে দিন তার বিয়ে হবে তার আগের রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে তার ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল জুলিয়েট। রোমিওর সাথে প্রথম পরিচয়ের রাতে যে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে রোমিও সারারাত তার সাথে কথা বলেছিল, সে দিকে তাকিয়ে বহুক্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তারপর ধারেকাছে কাউকে দেখতে না পেয়ে সন্ন্যাসী প্রদত্ত ওষুধটা খেয়ে ফেলল সে। একটু বাদেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ বাদেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।

পরদিন সকালে জুলিয়েটকে ডাকতে এসে ধাই দেখতে পেল মড়ার মতো নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে পড়ে আছে জুলিয়েট। কাছে গিয়ে সে দেখল তা নিশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না, বুকের ধুকপুকুনি নেই, চোখের মণি ওপরে উঠে গেছে। ভয় পেয়ে তৎক্ষণাৎ খবর দিল জুলিয়েটের বাবা-মাকে। তারা এসে মেয়ের অবস্থা দেখে বেজায় ঘাবড়ে গেলেন। সাথে সাথেই জুলিয়েটের বাবা চাকরকে পাঠিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনলেন। জুলিয়েটকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন বহু আগেই মৃত্যু হয়েছে। ডাক্তারের কথা শুনে বাড়িময় কান্নার রোল উঠল। বাড়ির সবাই বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল। তারা স্বপ্নেও ভাবেনি এমন সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে।

মেয়ের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে তার মৃতদেহটিক ফুলে সাজিয়ে কবর দেবার জন্য গির্জায় পাঠিয়ে দিলেন জুলিয়েটের বাবা-মা। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী জুলিয়েটের মৃতদেহটি একদিন সমাধি ক্ষেত্রে রাখার ব্যবস্থা করা হল।

সন্ন্যাসী লরেন্সও চুপচাপ বসে ছিলেন না। একজন বিশ্বস্ত লোককে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে তাকে পাঠিয়েছিলেন মান্টুয়ায় রোমিওর কাছে। কথা ছিল সেই লোক রোমিওকে সব কিছু খুলে বলবে এবং জুলিয়েটের মৃতদেহ সমাধিকক্ষে রাখা হলে সে রোমিওকে সেখানে নিয়ে আসবে। সন্ন্যাসী লরেন্স জানতেন জুলিয়েট যে ওষুধ খেয়েছে তার মেয়াদ কখন শেষ হবে। তিনিও রাতের বেলা সেখানে চলে আসবে যাতে ঘুম ভেঙে জুলিয়েট দেখে তাকে আর রোমিওকে। এরপর জুলিয়েটকে ভেরোনার সীমান্ত পার করিয়ে মান্টুয়ায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব তারই।

অথচ রোমিওর দুর্ভাগ্য এমনই যে সন্নাসীর লোক পৌঁছাবার আগেই ভেরোনা ফেরত অন্য এক লোকের মুখে জানতে পারল জুলিয়েট মারা গেছে। জুলিয়েটের বাবা-মা তার বিয়ে ঠিক করেছিল কাউন্ট প্যারিসের সাথে। কিন্তু বিয়র নির্দিষ্ট দিনে ভোরের আলো দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি জুলিয়েটের। আগের রাতেই মারা গেছে সে। জুলিয়েটের মৃত্যুর কথা শুনে মন ভেঙে গেল তার। সে স্থির করল আত্মহত্যা করবে। এক ওঝার কাছ থেকে মারাত্মক বিষ সংগ্রহ করে ভেরোনায় এসে পৌঁছাল সে। অনেক খোঁজ করেও সন্ন্যাসী লরেন্সের লোক খোঁজ পেন না রোমিওর।

আবার রোমিওর মত ঠিক একই অবস্থা হয়েছে কাউন্ট প্যারিসের। জুলিয়েটের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল প্যারিস। এবার জুলিয়েটের মৃত্যু-সংবাদ শুনে সে যেন সত্যিই পাগল হয়ে গেল। পরদিন সকালেই জুলিয়েটকে সমাধি দেওয়া হবে শুনে তাকে এক ঝলক দেখার জন্য সে রাতেই কাউন্ট এসে হাজির সেই সমাধিক্ষেত্রে। কিন্তু নিয়তি কী নিষ্ঠুর! তিনি আসার কিছু আগেই রোমিও এসেছে সেখানে। সমাধিক্ষেত্রে ঢোকার আগে সে চারপাশে খুঁজে দেখছিল সেখানে কেউ পাহারা দিচ্ছে কিনা।

কাউন্ট প্যারিস সমাধিকক্ষে ঢোকার সময় রোমিওকে হঠাৎ সেখানে দেখে বেজায় চমকে উঠলেন। তিনি জানেন তোমিও ক্যাপুলেটদের চিরশত্রু। কিছুদিন আগে ক্যাপুলেট বংশের টিবল্টকে হত্যার দরুন ভেরোনার রাজার যে রোমিওকে মান্টুয়ায় নির্বাসনে পাঠিয়েছেন সে কথাও অজানা নেই তার। স্বভাবতই কাউন্টের মনে হল সীমান্ত পেরিয়ে এত রাতে এখানে কেন এসেছে রোমিও? নিশ্চয়ই তার কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আছে নইলে সে এখানে ঘোরাঘুরি করছে কেন। জুলিয়েটকে বিয়ে করতে না পারলেও কাউন্ট নিজেকে ক্যাপুলেটদের আত্মীয় বলেই মনে করেন। সে কথা মনে রেখে কাউন্ট তখনই তলোয়ার বের করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রোমিওর উপর। সাথে সাথে রোমিও পালটা আক্রমণ করল কাউন্টকে। এ ধরনের চোরা-গোপ্তা আক্রমণের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে এসেছিল রোমিও। কিন্তু তলোয়ারবাজিতে তার সাথে মোটেই পাল্লা দিতে পারলেন না কাউন্ট প্যারিস। কিছুক্ষণ বাদেই তিনি রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়লেন সমাধিকক্ষের দোরগোড়ায়। জুলিয়েটের নামটা কোনওমতে আউড়ে চিরকালের মতো নীরব হয়ে গেলেন তিনি।

শত্রু নিধনের পর রোমিও প্রবেশ করলেন জুলিয়েটের সমাধিকক্ষে। সেখানে ঢুকে মোমবাতির মৃদু আলোয় দেখতে পেলেন সামনেই একটা কফিনে শুয়ে আছে জুলিয়েট—প্রাণের স্পন্দন নেই শরীরে। সন্ন্যাসীর দেওয়া ওষুধের প্রভাব তখনও কাটেনি। জ্ঞান ফিরে আসতে দেরি আছে। কিন্তু রোমিও তো জানে না সন্ন্যাসীর দেওয়া ওষুধের কথা। তাই সে ধরে নিল জুলিয়েটের মৃত্যু হয়েছে। ওঝার দেওয়া বিষের শিশিটা বের করে শেষবারের মতো জুলিয়েটের ঠোঁটে চুমু খেল রোমিও। তারপর শিশির পুরো বিষটা ঢেলে দিল নিজের গলায়। বিষের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে কিছুক্ষণ বাদেই জুলিয়েটের কফিনের পাশে শেষ নিশ্বাস ফেলল রোমিও।

ওষুধের প্রভাব কেটে যাবার পরই চোখ মেলে তাকাল জুলিয়েট। কফিনের বাইরে বেরিয়ে সে দেখল বরফ-ঠাণ্ডা মেঝের উপর শুয়ে আছে রোমিও। বহুবার ডেকেও তার কোনও সারা পেলনা জুলিয়েট। সন্দেহ হতে রোমিওর নাকের সামনে হাত নিয়ে দেখলে নিশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না। ঠিক সে সময় তার নজরে এলো মেঝের উপরে পড়ে রয়েছে একটা শিশি। শিশিটা কুড়িয়ে নিয়ে শুঁকতেই তীব্র গন্ধে তার নাক জ্বলে যেতে লাগল। শিশিতে যে তীব্র বিষ ছিল এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হল জুলিয়েট। রোমিওর কোমরের খাপ থেকে ছোরাটা বের করে সজোরে নিজের বুকে বসিয়ে দিল জুলিয়েট। দু-একবার ছটফট করে চিরকালের মতো নিশ্চল হয়ে গেল তার দেহ।

সঠিক সময়ে সন্ন্যাসী লরেন্স এলেন সেখানে। রোমিও-জুলিয়েটের মৃতদেহ দেখে আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি।

খবর পেয়ে ক্যাপুলেট আর মন্টেগু—উভয় পরিবারের লোকেরা সেখানে ছুটে এল তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে। ভেরোনার রাজাও খবর পেয়ে ছুটে গেলেন সেখানে। সন্ন্যাসী লরেন্স সবাইকে বলতে লাগলেন কীভাবে রোমিও-জুলিয়েট ঘর বাঁধার পরিকল্পনা করেছিল আর নিষ্ঠুর নিয়তির প্রভাবে কীভাবে তা ধ্বংস হয়ে গেল। কীভাবে অতীতের সামান্য শত্রুতার জেরে তাদের উভয় পরিবারের জীবনে এমন সর্বনাশ নেমে এল সে কথা উপলব্দি করে সবার সামনে কেঁদে ফেললেন রোমিও ও জুলিয়েটের বাবা। হাতে হাত মিলিয়ে তারা ঘোষণা করলেন আজ থেকে সমস্ত বৈরিতার অবসান হল—সেই সাথে শপথ নিলেন ভেরোনা শহরের মাঝখানে তাঁরা রোমিও-জুলিয়েটের মর্মর মূর্তি স্থাপন করবেন।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত