ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিডা

ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিডা

ট্রয় শহরের রাজপ্রাসাদের বাইরে পথের ধারে দাঁড়িয়ে রাজপুত্র ট্রয়লােস কথা বলছেন ক্রেসিডার কাকা প্যান্ডারাসের সাথে। ক্রেসিডার বাবা কালচাসট্রিয়ের পুরোহিত। তিনি এখন গ্রিকদের পক্ষে। তারই মেয়ে সুন্দরী ক্রেসিডার প্রেমে হাবুডুবু রাজপুত্র ট্রয়লাস।

এখন খুবই দুঃসময় চলছে ট্রয়ের। এখনকার রাজা প্রায়ামের পাঁচটি ছেলে, তাদের নাম হেক্টর, ট্রয়লাস, প্যারিস ডিফোবাস আর হেলেনাস। এছাড়াও রাজার এক অবৈধ পুত্রসস্তান আছে — নাম মারগারেলন। সে প্রায় ছবছর আগের কথা। রাজার সেজ ছেলে প্যারিস সে সময় প্রেমে পড়েছিলেন গ্রিক সেনাপতি আগামেমননের ভাই মিনিলাসের সুন্দরী স্ত্রী হেলেনের সাথে। স্বামীর কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে এনে সোজা তাকে রাজপ্রাসাদে এনে তুলেছিলেন প্যারিস। সেই থেকেই হেলেন রয়েছে প্যারিসের সাথে। এর পরপরই গ্রিসের রাজারা সবাই একজোট হয়ে ট্রয় আক্রমণ করেছেন। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হেলেনাকে উদ্ধার করে তাকে গ্রিসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। জলে, স্থলে চারদিক দিয়ে তারা বারবার আঘাত হানছে ট্রয়ের উপর।

বীর যোদ্ধা হিসেবে রাজপুত্র ট্রয়লাসের যথেষ্ট খ্যাতি সত্ত্বেও যতই দিন যাচ্ছে শত্রুসৈন্যের মোকাবিলা করার উৎসাহ কেন জানি তিনি হারিয়ে ফেলছেন। ট্রয়লাসের মনোভাব অনুমান করে

চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্রয়লাস বললেন, না, মন থেকে যেন সাড়া পাচ্ছি না।

বল কী! তোমার মতো বীরের মুখে তো এ কথা মানায় না, বললেন প্যান্ডারাস।

ট্রয়লাস বললেন, যুদ্ধ করা তারই পক্ষে সম্ভব হৃদয়-মন যার আয়ত্তে থাকে। আজ আর আমার মন নিজের আয়ত্তে নেই। যতক্ষণ রাজসভায় থাকি, সুন্দরী ক্রেসিডা আমার সারা মন জুড়ে থাকে। তখন আর নিজের মনের উপর অধিকার থাকে না।

প্যান্ডারাস বললেন, ক্রেসিডার কাকা হিসেবেই আমি বলছি, সে যতই সুন্দরী হোক না কেন, হেলেনের সাথে তার কোনও তুলনা হয় না। আমি ভেবে পাচ্ছি না কেন যে ক্রেসিডা তার বাবার সাথে গ্রিক শিবিরে যায়নি। তার উচিত ছিল সেখানে যাওয়া। ভবিষ্যতে তার সাথে দেখা হলে আমি তাকে সে কথা বলব। এই বলে অন্যদিকে চলে গেলেন প্যান্ডারাস। আর ক্রেসিডার কথা ভাবতে ভাবতে ট্রয়লাসও হাঁটা দিলেন রাজপ্রাসাদ অভিমুখে।

প্রাসাদের লাগোয়া পথ ধরে হেঁটে চলেছে ক্রেসিডা। এমন সময় ভৃত্য আলেকজান্দার এসে তাকে বলল, আজ সকালে সূর্য ওঠার আগেই যুবরাজ হেক্টর রওনা দিয়েছেন যুদ্ধ করতে।

অবাক হয়ে ক্রেসিড বললেন, সত্যি?

আলেকজান্দার বলল, আজ্ঞে হ্যা! শুনেছি আজ হেক্টরের মা হেলেনাকে সাথে নিয়ে দুর্গে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখবেন। আজ তুমুল লড়াই হবে গ্রিক বীর অ্যাজাকসের সাথে হেক্টরের। তবে হেক্টর এক লড়াই করবেন না। তার পরের ভাই ট্রয়লাসও থাকবেন তার পাশে। সবাই জানে হেক্টরের চেয়ে যুদ্ধবিদায় কম পারদশী নন ট্রয়লাস।

আমার তো মনে হয় ট্রয়লাস তেমন বীর যোদ্ধা নন, বললেন হেলেন, আমি কিছুতেই রাজি নাইট্রয়লাসকে হেক্টরের চেয়ে বড়ো যোদ্ধা বলে মেনে নিতে।

আপনি মানুন বা না মানুন, এরাই জানে ট্রয়লাসের সমকক্ষ যোদ্ধা ট্রয়ে দ্বিতীয় নেই, বলল আলেকজান্দার, এমনকি যে হেলেনকে রাজপুত্র প্যারিস হরণ করে এনেছেন, সেও বলে হেক্টরের চেয়ে ট্রয়লাস বড়ো যোদ্ধা। আমার তো মনে হয় হেক্টরের চেয়ে ট্রয়লাসকে বেশি পছন্দ করে হেলেন।

অবাক হবার ভান করে ক্রেসিডা বললেন, এমন কথা কেন বলছ তুমি?

গলা নামিয়ে আলেকজান্দার বলল, কারণ কদিন আমি দেখেছি হেলেনকে গোপনে ট্রয়লাসের সাথে দেখা করতে। হেলেন যে ট্রয়লাসকে প্যারিসের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন তার আরও প্রমাণ আমার কাছে আছে।

কিছুক্ষণ বাদে ফিরে আসতে লাগলেন ট্রয়ের বীর যোদ্ধারা। প্যান্ডারাসও ছিলেন তাদের মাকে। ক্রেসিডাকে দেখতে পেয়ে তিনি তার কাছে এসে দাঁড়ালেন। একে একে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ট্রয়ের বীর যোদ্ধাদের। তাদের মধ্যে ছিলেন ট্রয়ালাস। ইচ্ছে করেই ক্রেসিডার সামনে ট্রয়লাসের বীরত্বের প্রশংসা করতে লাগলেন প্যান্ডারাস। এমন সময় ট্রয়লাসের তৃত্যু এসে তাকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, আমার প্রভু আপনাকে ডেকেছেন। ক্রেসিডাকে প্রাসাদে যাবার কথা বলে সেই ভূত্যের সাথে চলে গেলেন প্যান্ডারাস।

পরপর দু-বছর চলে গেল। তবুট্রয় নগরী ধ্বংস করতে পারলেন না গ্রিকরা। এই না পারার কারণ নিয়ে শিবিরে আলোচনায় বসেছেন গ্রিক সেনাপতিরা। এমন সময় ট্রয়ের সেনাপতি ইনিস এসে হাজির হলেন সেই শিবিরে গ্রিক সেনাপতি আগামেমননকে অভিবাদন জানিয়ে তিনি বললেন,

এত বেশ ভালো কথা, বললেন আগামেমনন, আমাদের শ্রেষ্ঠ বীর অ্যাকিলিস পাশের তাঁবুতে রয়েছেন। চলুন, আমি আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। শিবির থেকে আগামেমননের সাথে ইনিস চলে যাবার পর ইউলিসিস বললেন, অ্যাকিলিস যদি হেক্টরের সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে জেতে, তাহলে সে উদ্ধত এবং অহংকারী হয়ে উঠবে। আবার তিনি হেরে গেলে ভেঙে যাবে গ্রিক বাহিনীর মনোেবল। তার চেয়ে হাতের কাছে অ্যাজাক্স রয়েছে, ওকেই পাঠিয়ে দেওয়া যাক হেক্টরের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে। অ্যাজাক্স জিতলে আমরা তার নামে জয়ধ্বনি দেব। আর পরাজিত হলে বলব ওর চেয়েও বড়ো বীর আছেন গ্রিক বাহিনীতে।

ওই একই সময় ট্রয়ের রাজপ্রাসাদে বসে যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে ছেলেদের সাথে আলোচনারত রাজা প্রায়াম। কথায় কথায় তিনি বললেন, আমি নিশ্চিত পুনরায় হেলেনকে ছেড়ে দেবার প্রস্তাব আসবে গ্রিক শিবির থেকে। ওকে ছেড়ে দিলেই গ্রিকরা যুদ্ধ থামিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরে যাবে তাদের দেশে। রাজা হেক্টরের কাচজে জানতে চাইলেন, হেলেনকে ছেড়ে দিতে তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?

না পিতা, কোনও আপত্তি নেই, বললেন হেক্টর, যার জন্য হাজার হাজার ট্রয়বাসীর প্রাণ গেছে, আজ তার কোনও দাম মেই আমার কাছে। আমি চাই যত শীঘ্র সম্ভব হেলেনকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক গ্রিকদের হাতে।

তুমি ভুলে যাচ্ছ হেক্টর, আমাদের বংশের এক বয়স্ক মহিলাকে গ্রিকরা তাদের দেশে আটলো, রেখেছে, সম্পর্কে যিনি আমার পিসি হন, বললেন রাজা। প্রতিবাদের সুরে ট্রয়লাস বললেন, গ্রিকদের সেই কাজের প্রতিশোধ নিতে প্যারিস যখন গ্রিস থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এল হেলেনকে, তখন সবাই তাকে বাহবা দিয়েছিল। আজাকি তাহলে ধরে নেব হেলেনকে আটকে রাখার যোগ্যতা আমাদের নেই?

রাজা প্রায়ামের মুখের দিকে তাকিয়ে রাজপুত্র প্যারিস বললেন, সেদিন কিন্তু সবাই আমার কাজকে সমর্থন করেছিলেন। আমি তো নিজের ভোগ-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য হেলেনকে নিয়ে আসিনি, তাকে আমাদের দেশে রেখে দেওয়াটা ট্রয় জাতির পক্ষে এক গৌরবের বিষয়। দুনিয়ার সবচেয়ে রূপসি নারী হেলেনকে ট্রয় রেখে দেবার জন্য আমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাব।

ট্রয়লাস বললেন, হেলেনের সাথে জড়িয়ে আছে ট্রয়ের মান, মর্যাদা, খ্যাতি। পৃথিবীর সব সম্পদের বিনিময়েও আমরা হেলেনকে গ্রিকদের হাতে প্ৰত্যুপণ করতে রাজি নই।

এক সন্ধ্যায় প্যান্ডারাস তার বাগানবাড়িতে নিয়ে এলেন ট্রয়লাসকে, উদ্দেশ্য ভাইঝি ক্রেসিডার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেওয়া। বাগানবাড়ির এক উইলো গাছের নিচে ক্রেসিডাকে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে টেনে নিয়ে এলেন ট্রয়লাস। পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে গাঢ় চুম্বন রেখা একে দিলেন ক্রেসিডার নরম গালে, কপালে। খাওয়া-দাওয়ার পর প্যান্ডারাস তাদের শোবার আয়োজন করলেন এক সুসজ্জিত ঘরের নরম বিছানায়।

এদিকে গ্রিক বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েছেন ট্রয়ের বীর যোদ্ধা অ্যান্টিনার। তার মুক্তির বিনিময়ে ট্রয়ের পুরোহিত ক্যালচাস প্রস্তাব দিলেন তার মেয়ে ক্রেসিডাকে যেন তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তার এ প্রস্তাব মেনে নিলেন গ্রিক সেনাপতি আগামেমনন। অথচ ট্রয়লাস ও ক্রেসিডা এ ব্যাপারে বিন্দু-বিসর্গও জানতে পারলেন না।

জ্যোৎস্নালোকে উদ্ভাসিত ক্রেসিডার মুখের দিকে তাকিয়ে ট্রয়লাস বললেন, তোমার প্রতি চিরবিশ্বস্ত থেকে প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হব আমি। প্রেমের বিশ্বস্ততার নামই হবে ট্রয়লাস।

এদিকে হেক্টরের ডাকে সাড়া দিয়ে তার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নেমেছেন গ্রিক বীর অ্যাজাক্স। অ্যাজাক্স তার নিকট আত্মীয় জেনে কিছুক্ষণ বাদেই লড়াই থামিয়ে দিলেন হেক্টর।

অন্যদিকে ক্রেসিডাকে গ্রিক শিবিরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রয়ের সেনাপতি ইনিস প্যান্ডারাসের বাগানবাড়িতে এলেন গ্রিক বীর ডায়োমিডিসকে সাথে নিয়ে। কাকার মুখে সব কথা শুনে ক্রেসিডা কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিল ট্রয়লাসের কাছ থেকে। ক্রেসিডাকে হাতে পেয়ে ট্রয়ের বন্দি বীর সেনানায়ক অ্যান্টিনারকে মুক্তি দিল গ্রিক বাহিনী।

পরদিন শেষ বেলায় নিরস্ত হেক্টরকে হত্যা করলেন গ্রিক বীর অ্যাকিলিস। সেনাদের মনোেবল বাড়াতে পরম শত্রু হেক্টরের রক্তাক্ত মৃতদেহ রথের সাথে বেঁধে নিয়ে গোটা যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোরালেন অ্যাকিলিস।

সেদিন রাতে ক্রেসিডার সাথে গোপনে দেখা করতে এলেন ট্রয়লাস। আড়াল থেকে ডায়োমিডিসের সাথে ক্রেসিডার প্রেমালাপ শুনে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল তার মাথায়। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, পরদিন যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা করবেন ডায়োমিডিসকে।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত