জ্ঞাতিভাই স্লেন্ডার আর গ্রামের পাদরি স্যার হিউ ইভানসের কথা শোনার পর বিচারপতি ফ্যালো বললেন, খুবই অন্যায় করেছেন স্যার জন ফলস্টাফ। তবে বুদ্ধি দিয়ে এর মোকাবেলা করতে হবে, আইনের সাহায্যে নয়।
পাদরি জন ইভানস বললেন, হুজুর! আমার মাথায় একটা ভালো ফন্দি এসেছে। মাস্টার জর্জ পেজের মেয়ে অ্যানি বেসা আজকাল বেশ বড়োসড়ো হয়ে উঠেছে। ওর মতো সুন্দরী মেয়ে আর একটিও মিলবে না। আমাদের গ্রামে। মরার আগে ওর ঠাকুর্দা নাতনির জন্য নগদ সাতশো পাউন্ড টাকা আর একগাদা সোনা-রুপোর গয়না রেখে গেছেন। সে সব কিছুই অ্যানি তার বিয়েতে যৌতুক পাবে। এখন অ্যানিদের বাড়িতেই রয়েছেন স্যার জন ফলস্টাফ। আপনি সেখানে গেলেই তাকে পেয়ে যাবেন।
তই নাকি! তাহলে তো একবার যেতেই হয় সেখানে বলে জ্ঞাতিভাই স্লেন্ডার আর পাদরি স্যার ইভানসকে নিয়ে পেজের বাড়িতে এলেন বিচারপতি ফ্যালো। সে সময় ওখানেই ছিলেন স্যার ফলস্টাফ। বিচারপতি ফ্যালো তাকে বললেন, আপনি অন্যায়ভাবে আমার বাড়িতে ঢুকে আমার পালিত হরিণটাকে মেরে ফেলেছেন।
হ্যা, আমি আমার অপরাধ স্বীকার করছি, বললেন স্যার ফলস্টাফ, তবে আমি তো আর আপনার দারোয়ানের মেয়ের মুখে চুমো খেতে যাইনি?
দেখিছেন! আপনার অপদার্থ চাকারগুলো কী হাল করেছে আমার? কাদো কঁদো স্বরে বললেন স্লেন্ডার, ওরা আমায় শুড়িখানায় নিয়ে গিয়ে জোর করে মদ গিলিয়েছে। তারপর নেশা হলে আমার সব টাকা-কড়ি কেড়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে।
পাদরি স্যার ইভানস বললেন, এসব ঘটনা আমি আমার ডাইরিতে নোট করে রাখছি। পরে বিচার করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জর্জ পেজের যুবতি মেয়ে অ্যানি বেশ ডাগর-ডোগর দেখতে। সে ভালোবাসে ফেনটন নামে একটি ছেলেকে, আর ফেনটনও ভালোবাসে অ্যানিকে। বিয়ের স্বপ্নে বিভোর দু-জনে। কিন্তু অ্যানির বাবা মোটেও রাজি নন ফেনটনের সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিতে। তিনি চান বিচারপতি ফ্যালোর জ্ঞাতিভাই স্লেন্ডারের সাথে অ্যানির বিয়ে দিতে। পেজ ভালোই জানেন স্লেন্ডার অ্যানিকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু অ্যানি মোটেও পছন্দ করে না স্লেন্ডারকে। এদিকে অ্যানির মার পছন্দ আবার কেইয়াস নামে এর ফরাসি চিকিৎসককে–তারই সাথে তিনি মেয়ের বিয়ে দিতে চান। কেইয়াসও পছন্দ করে অ্যানিকে।
এদিকে অ্যানির মা মিসেস পেজ আর তার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশিনী মিসেস ফোর্ড–দুজনের সাথেই গোপন প্রেমের খেলা খেলছেন স্যার জন্য ফলস্টাফ। তার আসল উদ্দেশ্য উভয়ের সাথে প্রেমের অভিনয় করে মোটা টাকা হাতিয়ে নেওয়া। একদিন স্যার ফলস্টাফের কাজের লোক নাইস এবং পিস্তল মি. ফোর্ডের সাথে দেখা করে করে বলল যে তাদের মনিবা স্যার ফলস্টাফ গোপনে মিসেস ফোর্ডের সাথে মিলিত হবার ইচ্ছা জানিয়ে তাকে একটি চিঠি লিখেছেন। তারা চিঠিখানা দেখাল মি. ফোর্ডকে। ওদিকে স্যার ফলস্টাফও যে গোপনে মিসেস পেজের সাথে একই প্রেমের খেলা খেলছেন, সে কথা জানতে পেরে বেজায় রেগেন গেলে মিসেস ফোর্ড। তিনি স্থির করলেন উচিত শিক্ষা দিতে হবে স্যার ফলস্টাফকে। তিনি আগে থেকেই মিসেস পেজকে জানিয়ে দিলেন যে মি. ফলস্টাফ রাতে তাঁর বাড়িতে আসবেন।
এসব কিছুই জানা নেই। মি. ফলস্টাফের। রাতের বেলা তিনি সেজেগুজে এলেন মিসেস ফোর্ডের বাড়িতে। তার কিছুক্ষণ পরেই এলেন মিসেস পেজ। আড়াল থেকে তাকে দেখতে পেয়ে ভয়ে ভয়ে পাশের ঘরে লুকোলেন স্যার ফলস্টাফ। তাকে উদ্দেশ্য করে গলা চড়িয়ে মিসেস পেজ বলতে লাগলেন যে গ্রামের লোকেরা বেজায় চটে আছে। ফলস্টাফের উপর। তাকে উচিত শিক্ষা দিতে এদিকেই এগিয়ে আসছে তারা।
মিসেস পেজের কথাগুলি শুনতে পেয়ে স্যার ফলস্টাফ বেজায় ঘাবড়ে গেলেন। সুযোগ পেয়ে মিসেস ফোর্ড তাকে বসিয়ে দিলেন এক বড়ো ঝুড়িতে। এমন ভাবে ময়লা জামা-কাপড় বুড়ির উপর চাপিয়ে দিলেন যাতে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে না পারে। এরপর মিসেস ফোর্ডের নির্দেশে তার বাড়ির কাজের লোকেরা সেই ঝুড়ি বাইরে নিয়ে গিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল নদীর কর্দমাক্ত জলে। সেই নোংরা জলে মাখামাখি হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন স্যার ফলস্টাফ।
স্যার ফলস্টাফকে পুনরায় শিক্ষা দেবার জন্য এবার মিসেস ফোর্ড তার কাছে পাঠালেন ড. কেইয়াসের বাড়ির কাজের মেয়ে কুইকলিকে। মিসেস ফোর্ডের শেখানো অনুযায়ী কুইকলি স্যার ড.ফলস্টাফকে বলল সে দিন পাখি শিকারে যাবেন মি. ফোর্ড। কাজের লোক ছাড়া বাড়িতে আর কোনও পুরুষ মানুষ থাকবে না। মিসেস ফোর্ড তাকে অনুরোধ জানিয়েয়েছেন তিনি যেন রাত আটটা থেকে দশটার মধ্যে তার কাছে যান। কুইকলি ফিরে যাবার পর মি. ব্রুক নামে এক বিদেশির ছদ্মবেশে স্যার ফলস্টাফের কাছে এলেন মি. ফোর্ড! স্যার ফলস্টাফ তাকে বিশ্বাস করে নিজের গোপন প্রেমের সব কথা জানিয়ে দিলেন। এবার মজা দেখানোর পালা মি. ফোর্ডের।
রাতের বেলা আবার মিসেস ফোর্ডের কাছে এলেন মি. ফলস্টাফ। তাকে হাতে নাতে ধরার জন্য খানিক বাদে মি. ফোর্ডও এলেন নিজের বাড়িতে। ফলস্টাফের কাকুতি-মিনতিতে নরম হয়ে এবারও তাকে প্ৰাণে বঁচিয়ে দিলেন মিসেস ফোর্ড। মেয়েদের মতো ঢোলা গাউন আর টুপি পড়িয়ে বাড়িতে পরিচারিকার মাসি সাজিয়ে চলে যেতে বললেন তাকে। বাড়ির পরিচারিকার এই মাসির উপর আগে থেকেই রেগে ছিলেন মি. ফোর্ড। সিঁড়ি দিয়ে মাসি নেমে আসতেই খপ করে। তাকে ধরে ফেললেন মি. ফোর্ড। তারপর মনের সুখে কয়েকটা কিল বসিয়ে দিলেন তাঁর পিঠে। কিল খেয়ে বুড়ি পালিয়ে যাবার পর হাসতে হাসতে মিসেস ফোর্ড তার স্বামীকে বললেন, ওই বুড়ির ছদ্মবেশে ছিলেন স্বয়ং স্যার জন ফলস্টাফ।
এবার সবাই মতলব আঁটলেন আরও একবার স্যার জনকে ডেকে তাকে উচিত শিক্ষা দেবার। তাদের নির্দেশ অনুযায়ী কুইকলি গিয়ে স্যার ফলসফিকে বলল, তিনি যেন আর্ডেনের এক ওক গাছের কাছে যান। সে এও বলল যে তার প্রেমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার দুই প্রেমিকা মিসেস ফোর্ড আর মিসেস পেজ–উভয়েই আসবেন সেখানে। তবে যাবার সময় তিনি যেন তার মাথায় এক জোড়া শিং এটে বনদেবতা থানের সাজে। সেখানে যান। — এই বলে বিদায় নিল কুইকলি।
মাথায় একজোড়া শিং এটে রাতের বেলা জঙ্গলে এলেন স্যার জন্য ফলস্টাফ। তাকে দেখতে পেয়েই ওক গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন মিসেস ফোর্ড। সাথে সাথেই তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন। ফলস্টাফ। সেই সময় বেজে উঠল। শিঙ্গা। একদল ছোটো ছেলেমেয়ে এসে তাদের ঘিরে ধরল। তাদের সবাইর হাতে রয়েছে জুলন্ত মোমবাতি। তাদের মধ্যে কেউ সেজেছে সাদা পোশাকের পরি, কেউবা ভূত-প্রেতি আর রানি সেজেছে স্বয়ং অ্যানি পেজ। অ্যানির নির্দেশে সেই ছেলেমেয়েরা জুলন্ত মোমবাতির ছ্যাক দিতে লাগল স্যার ফলস্টাফের শরীরে। অনেকে আবার খিমচে তুলে নিল তার গায়ের মাংস।
অ্যানি বলে উঠল, মার বদমাইশকে! আরও বেশি করে মার। ঠিক সে সময় স্লেন্ডার এসে হাজির সেখানে। অ্যানি ভেবে তিনি সাদা পোশাক পরা একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ বাদে সেখানে এলেন ড. কেইয়াস। তিনিও অ্যানি মনে করে সবুজ পোশাক পরা একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে চলে গেলেন। এ সময় পালাতে যাচ্ছিলেন স্যার জন্য ফলস্টাফ। কিন্তু পরম তৎপরতার সাথে তাকে ধরে ফেলে মি. পেজ। বললেন, পরপর দু-বার আপনি পালিয়ে বেঁচেছেন। কিন্তু এবার আর রক্ষণ নেই। আপনার বাপের নাম ভুলিয়ে দিয়ে তবে ছাড়ব।
কোনওমতে ঢ়োক গিলে আমতা আমতা করে বললেন স্যার ফলস্টাফ, আপনারা কী করতে চান আমায় নিয়ে?
বিশেষ কিছু নয়, বললেন মি. পেজ, আজ রাতে আমাদের সাথে আপনাকে ডিনার খেতে হবে। আর সে সময় আমার স্ত্রীর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে তার মন রাখতে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হবে।
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম আমি একটা আস্ত নির্বোধ, বললেন স্যার জন ফলস্টাফ।
সাথে সাথে মিসেস পেজ আর মিসেস ফোর্ড, আপনি শুধু নির্বোধ নন, গোরু-ছাগলের চেয়েও নিকৃষ্ট জীব আপনি। মেয়েদের আপনি কী মনে করেন? জবাব দিতে না পেরে মুখ বুজে রইলেন স্যার জন্য ফলস্টাফ। এর মাঝে স্লেন্ডার এসে জানাল এ্যানি ভেবে সে যাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, গির্জায় পৌঁছে দেখে সে এখানকার পোস্ট মাস্টারের ছেলে। স্লেন্ডারের পেছু পেছু ড. কেইয়াসও হাজির হলেন সেখানে। তিনিও জানালেন সবুজ পোশাক পরা যে মেয়েটিকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন, গির্জায় গিয়ে দেখেন সেও একটি ছেলে, সদ্য গোফ গজিয়েছে তার।
এবার অ্যানি পেজ-দম্পতির সামনে এগিয়ে এলেন ফেনটনের হাত ধরে। বাবা-মার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসি। তোমরা আমাদের বিয়ের অনুমতি দাও।
তাদের উভয়কে বুকে জড়িয়ে ধরে পেজ দম্পতি বললেন, আমরা আশীর্বাদ করছি ঈশ্বর যেন তোমাদের সুখী রাখুন।