সমুদ্রের বুকে কোনও এক দ্বীপে বাস করতেন দুটি মানুষ – প্রসপেরো নামে এক বৃদ্ধ আর মিরান্দা নামে তাঁর পরমাসুন্দরী যুবতী কন্যা। মিরান্দা খুব অল্প বয়সে এই দ্বীপে এসেছিল। তাই বাবার মুখ ছাড়া আর কোনো মানুষের মুখ তার মনে পড়ত না।
তাঁরা বাস করতেন একটা পাথুরে গুহায়। এই গুহায় বেশ কয়েকটি খুপরি ছিল। তার মধ্যে একটি ছিল প্রসপেরোর পড়ার ঘর। এই ঘরেই তিনি রাখতেন তাঁর বইপত্তর। সে যুগে শিক্ষিত লোকমাত্রই জাদুবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হতেন। প্রসপেরোও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাই তাঁর সংগ্রহের অধিকাংশ বইই ছিল জাদুবিদ্যা-সংক্রান্ত। জাদু জানতেন বলে তাঁর সুবিধাও হয়েছিল কত। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় এই যে দ্বীপটিতে এসে তাঁকে বাসা বাঁধতে হয়েছিল, এই দ্বীপটি আগে ছিল সাইকোরাক্স নামে এক ডাইনির দখলে। সে সময়ে কিছু ভাল অশরীরীর দল তার অন্যায় আদেশগুলি পালন করতে না চাইলে ডাইনি তাদের গাছের কোটরে বন্দী করে রাখে। সাইকোরাক্স মারা যাওয়ার কিছুকাল পরে এই দ্বীপে এসে হাজির হন প্রসপেরো। তিনি নিজের জাদুবলে সেই সব অশরীরীদের মুক্তি দেন। কৃতজ্ঞতার বশে ওই অশরীরীর দলও তাঁর বশংবদে পরিণত হয়। এদের সর্দারের নাম ছিল এরিয়েল।
প্রাণোচ্ছ্বল ছোট্ট প্রেত এরিয়েল। তার স্বভাব-চরিত্র মন্দ ছিল না। কিন্তু ক্যালিবান নামে কুৎসিত দৈত্যটাকে জ্বালাতন করতে বড়ো ভালবাসত সে। ক্যালিবান ছিল তার পুরনো দুশমন সাইকোরাক্সের ছেলে। দেখতে শুনতে মানুষের থেকে বনমানুষের সঙ্গেই তার সাদৃশ্য ছিল বেশি। এই হতভাগ্য প্রাণীটাকে জঙ্গলে কুড়িয়ে পান প্রসপেরো। অবশ্য তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন নি তিনি। বরং গুহায় নিয়ে এসে যত্ন করেন, কথা বলতে শেখান। কিন্তু মায়ের বদস্বভাব সে পেয়েছিল রক্তের সূত্রে। তাই কোনও ভাল কাজ তাকে শেখানো গেল না। অগত্যা তাকে রাখা হল ক্রীতদাসের মতো করে। কাঠ কুড়ানো আর সব কায়িক শ্রমের কাজগুলি তাকে দিয়ে করানো হতে লাগল। আর তাকে সব কাজ ঠিক ঠাক করিয়ে নেওয়ার দায়িত্বে প্রসপেরো নিয়োগ করলেন এরিয়েলকে।
প্রসপেরো ছাড়া এরিয়েলকে দেখতে পেত না কেউই। এরিয়েলের সে ছিল মহাসুযোগ। কাজে ফাঁকি দিলেই চুপি চুপি এসে ক্যালিবানকে চিমটি কেটে যেত সে। কখনও পাঁকে ঠেলে ফেলে দিত; কখনও বনমানুষের মতো মুখখানি করে ভেংচি কাটত; আবার কখনও কাঁটাচুয়ো হয়ে পড়ে থাকত ক্যালিবানের যাতায়াতের পথে। খালি পায়ে কাঁটা বিঁধে যাওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত ক্যালিবান। প্রসপেরোর আজ্ঞা পালনে কোনও রকম গাফিলতি দেখলেই এই রকম নানা উপায়ে ক্যালিবানকে হয়রান করে ছাড়ত এরিয়েল।
এই সব বাধ্য অশরীরীরা তাঁর আজ্ঞাবহ ছিল বলে বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্রের তরঙ্গ ছিল প্রসপেরোর নিয়ন্ত্রণে। একদিন তাঁর আদেশে এরা সমুদ্রের বুকে তুলল এক ভয়ানক ঝড়। সেই ঝড়ে বিক্ষুব্ধ সমুদ্র তরঙ্গের সঙ্গে প্রতি মুহুর্তে যুঝতে লাগল একটি মনোরম ও অতিকায় জাহাজ। রাক্ষুসে ঢেউগুলি যেন জাহাজটিকে গিলে খাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে উঠল। প্রসপেরো তাঁর মেয়েকে দেখালেন সেই দৃশ্য। বললেন, ওই জাহাজের মানুষেরাও তাঁদেরই মতো জ্যান্ত মানুষ। মিরান্দা বললে, “দোহাই তোমার বাবা, যদি নিজের জাদুবলে এই ঝড় তুলে থাকো, তবে এখনই একে সংবরণ করে নাও। দ্যাখো! জাহাজখানা যে ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে বসেছে। আহা বেচারারা! আমার ক্ষমতা থাকলে সমুদ্রটাকেই রসাতলে পাঠাতুম। এমন সুন্দর জাহাজখানা আর এতগুলি মূল্যবান প্রাণ নষ্ট হতে দিতুম না কিছুতেই।”
প্রসপেরো বললেন, “উতলা হোস্ না, মা। আমার আদেশ আছে। ওদের কিচ্ছুটি হবে না। জাহাজের কারো গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগবে না। আর এই যা করছি, এ জানবি তোরই জন্য। তুই তো জানিস না যে তুই কে – কোথা থেকেই বা এসেছিস। আমি তোর বাপ; এই পোড়া গুহায় থাকি – এটুকু ছাড়া আমার সম্পর্কেই বা কতটুকু জানিস তুই? আচ্ছা, আগেকার দিনের কথা তোর কি কিছু মনে পড়ে, মা। বোধহয় পড়ে না, তাই না? কেমন করেই বা পড়বে? তুই যে তখনও তিন বছরেরও হোসনি।”
মিরান্দা বললে, “নিশ্চয়ই মনে পড়ে, বাবা।”
প্রসপেরো জিজ্ঞাসা করেন, “কেমন করে? আর কেউ কি কোনও দিন তোকে কিছু বলেছে? বল মা, আমায়, কি মনে পড়ে তোর!”
মিরান্দা বললে, “কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। আচ্ছা বাবা, সেই সময় কি চার-পাঁচজন স্ত্রীলোক আমার পরিচর্যা করতেন?”
প্রসপেরো বললেন, “করতেন বই-কি, আরও অনেকেই করতেন। কিন্তু সে সব কথা আজও কিভাবে মনে আছে তোর? আচ্ছা, এখানে আসার কথা কি কিছু মনে পড়ে?”
মিরান্দা বললে, “না বাবা, আর কিছুই মনে পড়ে না আমার।”
“বারো বছর আগের কথা,” প্রসপেরো বলতে থাকেন, “আমি তখন মিলানের ডিউক। আর তুই ছিলি রাজকন্যা – আমার একমাত্র উত্তরাধিকারিণী। অ্যান্টোনিও নামে এক ভাইও ছিল আমার। পৃথিবীতে সে-ই ছিল আমার সবচেয়ে আস্থাভাজন লোক। লেখাপড়ার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল চিরকালের। অবসরযাপনই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। সেই জন্য রাজসভার যাবতীয় দায়দায়িত্ব তারই হাতে তুলে দিয়ে আমি সারাক্ষণ ডুবে থাকতুম বইয়ের জগতে। জীবন উৎসর্গ করেছিলুম হৃদয়কে মহত্তর করে তোলার কাজে। উপেক্ষা করেছিলুম যাবতীয় কর্তব্যকর্ম। এদিকে আমার বকলমা পেয়ে আমার ভাই নিজেকেই ডিউক ভাবতে শুরু করল। প্রজাদের মধ্যে নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলার একটা সুযোগ আমি তাকে দিয়েছিলাম। আর সেটাকেই হাতিয়ার করে সে লিপ্ত হল আমাকেই রাজ্যচ্যূত করার ষড়যন্ত্রে। মিথ্যাই সে আমার ভাই। ষড়যন্ত্র সফল করল সে কিনা আমারই চিরশত্রু নেপলস-রাজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে!”
মিরান্দা জিজ্ঞাসা করলে, “কিন্তু বাবা, তাঁরা সেই মুহুর্তেই আমাদের ধ্বংস করলেন না কেন?”
প্রসপেরো উত্তর দিলেন, “আসলে মা, সে সাহস তাদের ছিল না। প্রজারা আমাকে মনেপ্রাণে ভালবাসত। অ্যান্টোনিও আমাকে জোর করে একটা জাহাজে তোলে। তারপরে কূল থেকে কয়েক যোজন দূরে মাঝসমুদ্রে একটা ছোটো ডিঙিতে আমাদের নামিয়ে দিয়ে জাহাজ নিয়ে চলে যায়। সেই ডিঙিতে না ছিল হাল, না ছিল কোনো পাল। ভেবেছিল, আমাদের ওভাবে ফেলে গেলেই বুঝি আমরা মারা পড়ব। কিন্তু গঞ্জালো নামে আমার এক অনুগত অমাত্য গোপনে সেই ডিঙিতে জল, খাবার, পোষাক আর আমার কিছু বই রেখে দিয়েছিল। এই বইগুলি আমার কাছে ছিল আমার রাজ্যের চেয়েও মূল্যবান।”
মিরান্দা বললে, “ওহ্ বাবা, তবে আমার জন্য তোমাকে কত না কষ্ট সইতে হয়েছিল।”
প্রসপেরো বললেন, “না সোনা, তুইই তো ছিলি আমার সেই ছোট্ট মানিক, যার মুখ চেয়ে বেঁচে থাকার একটা কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম আমি। তোর মুখের নিষ্পাপ হাসি আমাকে সব প্রতিকূলতা জয় করার সাহস জোগাত। দ্বীপে এসে নামার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রসদ ফুরালো। সেই থেকে আমার কাজ হল তোকে লেখাপড়া শেখানো। আর আমার শিক্ষকতায় আজ তুই রীতিমতো বিদূষী এক রাজকন্যা।”
মিরান্দা বললে, “ঈশ্বর তোমার ভাল করুন, বাবা। এখন বলো তো, এই ঝড় তুমি কেন তুললে?”
প্রসপেরো বললেন, “শোন্ তবে, আমি ঠিক করেছি, আমার দুই পুরনো শত্রু, নেপলসের রাজা আর আমার সেই নিষ্ঠুর ভাইকে এই ঝড় তুলে এই দ্বীপে এনে ফেলব।”
এই বলে মেয়েকে তাঁর জাদুছড়িটি দিয়ে আলতো করে স্পর্শ করতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। অশরীরী এরিয়েল হাজির হল প্রভুকে ঝড়ের বিবরণ দিতে। কেমন করে জাহাজের যাত্রীদের জাহাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে সে, তার ফিরিস্তি শোনাতে। মিরান্দা এইসব অশরীরীদের দেখতে পেত না। তাই প্রসপেরোও চাইতেন না, তাঁকে এদের সঙ্গে কথা বলতে দেখে তাঁর মেয়ে ভাবুক, বাবা নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন। সেই জন্য, এরিয়েল উপস্থিত হওয়া মাত্র, তিনি ঘুম পাড়িয়ে দিলেন মেয়েকে।
প্রসপেরো এরিয়েলকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি সংবাদ, আমার সাহসী বেতাল? তোমার কাজ শেষ করেছো?”
এরিয়েল তখন ঝড়ের এক চমৎকার বর্ণনা দিলে – কেমন করে জাহাজের নাবিকেরা ভয়ে কুঁকড়ে গেল; যুবরাজ ফার্দিনান্দ জলে পড়ে গেলেন; বাপের চোখের সামনে তাঁকে গ্রাস করে নিল সমুদ্রের বিশাল ঢেউ – সে সব কথা বেশ গুছিয়ে বললে সে।
তারপর এরিয়েল বললে, “সে অবশ্য এখন নিরাপদ। দ্বীপের এক কোণে দুই বাহুর উপর হাত রেখে বসে আছে। ভাবছে বাপটা বুঝি ডুবেই মোলো। তার নিজের কিন্তু একগাছি চুলেরও ক্ষতি হয়নি। এমনকি তার রাজপোষাকখানা জিভে জবজবে হয়ে গেলেও আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝলমল করছে এখন।”
প্রসপেরো বললেন, “শাবাস এরিয়েল। এখানে নিয়ে আয় তাকে। আমার মেয়ে যেন সেই তরুণ যুবরাজকে দেখতে পায়। আচ্ছা, ওই রাজা আর আমার ভাই – তারা সব কোথায়?”
এরিয়েল বললে, “তারা সব ফার্দিনান্দকে খুঁজছে। পাবার আশা অবশ্য খুব একটা করছে না। আসলে কিন্তু জাহাজের একজন যাত্রীও হারিয়ে যাননি। কিন্তু সকলেই ভাবছে, সে-ই বুঝি একা এ যাত্রায় বেঁচে গেল। আর জাহাজখানা আমি অদৃশ্য করে নিরাপদে জাহাজঘাটায় লুকিয়ে রেখেছি।”
প্রসপেরো বললেন, “খুব ভাল কাজ করেছিস তুই, এরিয়েল। কিন্তু এখনও যে অনেক কাজ বাকি।”
এরিয়েল বললে, “আরও কাজ বাকি? আপনি যে বলেছিলেন আমাকে চিরতরে মুক্তি দেবেন। প্রভু, আপনাকে সে কথা একবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। দোহাই আপনার, একবার ভেবে দেখুন, কত ভালভাবে সেবা করেছি আপনার, একটাও মিছে কথা কইনি, একটাও ভুল করিনি, কখনও কোনও কাজে না করিনি।”
প্রসপেরো বললেন, “কেন? ভুলে গেলি কোন যন্ত্রণা থেকে তোকে মুক্তি দিয়েছিলাম আমি? মনে পড়ে, সেই ভয়ঙ্করী ডাইনি সাইকোরাক্সের কথা? মনে আছে তোর, কোথায় তার জন্ম?”
এরিয়েল বলে, “আলজিয়ার্সে, প্রভু।”
প্রসপেরো বললেন, “ঠিক। আলজিয়ার্সে। মনে আছে, তোকে কোন অবস্থায় পেয়েছিলাম আমি। নাকি ভুলে গিয়েছিস! ওই অলক্ষুনে ডাইনিকে ওরা দেশ থেকে তাড়িয়ে দিলে। নাবিকেরা তাকে ফেলে গেল এই দ্বীপে। আর তুই, ভালমানুষ ভূত, তার আদেশ অমান্য করলি বলে সে তোকে গাছের কোটরে বন্দী করে রাখল। আমি যখন তোকে খুঁজে পাই, তখন আতঙ্কে চিৎকার করছিস তুই – মনে পড়ে তোর, মনে পড়ে সেই যন্ত্রণার কথা, যার থেকে তোকে মুক্তি দিয়েছিলাম সেদিন।”
নিজের অকৃতজ্ঞতায় লজ্জা পেয়ে এরিয়েল বললে, “মাপ করুন, প্রভু। আমি আপনার আজ্ঞাই পালন করব।”
প্রসপেরো বললেন, “তাই কর। মুক্তি আমি তোকে ঠিকই দেবো।” এই বলে পরের কাজগুলি এরিয়েলকে ভাল করে শিখিয়ে পড়িয়ে দিলেন তিনি। এরিয়েল প্রথমে গেল ফার্দিনান্দের কাছে। দেখল যুবরাজ সেই একই ভাবে বসে আছেন।
সে বলল, “কুমার বাহাদুর, এবার আপনাকে নিয়ে যাব মিরান্দা ঠাকরুণের কাছে। আপনার সুকুমার রূপ যাতে তাঁর চোখে পড়ে, করব সেই ব্যবস্থা। আসুন মহাশয়, আমাকে অনুসরণ করুন।” এই বলে সে একটি গান ধরল। গানটির মর্মার্থ: আপনার পিতা এখন অতল জলে নিমগ্ন, তাঁর অস্থিতে আজ প্রবালকীটের বাসা, চোখদুটি হয়ে গেছে মুক্তা। আর তাঁর কিছুই ক্ষয় হবার নেই। বরং সাগর এবার তাঁকে বদলে অদ্ভুতুড়ে কোনো পদার্থে পরিণত করবে। সাগরবালিকারা প্রহরশেষে ঘণ্টা বাজাবে। ওই শোনো, আমি শুনতে পাচ্ছি সে তান – ঢং ঢং ঢং।
হারিয়ে যাওয়া বাপের এই অদ্ভুত সংবাদে তাঁর অর্থহীন বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুসরণ করলেন এরিয়েলের কণ্ঠস্বর। সেই স্বর তাঁকে পৌঁছিয়ে দিল প্রসপেরো ও মিরান্দার কাছে। একটি বিরাট গাছের ছায়ায় বসেছিলেন তাঁরা। মিরান্দা জীবনে তার বাপ ছাড়া অন্য কোনো পুরুষকে দেখেনি।
প্রসপেরো তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “মিরান্দা, কী দেখছিস মা ওদিকে?”
বিস্মিত মিরান্দা বললে, “বাবা, ও নিশ্চয়ই কোনও অশরীরী, তাই নয়? দ্যাখো দ্যাখো, কী সুন্দর দেখতে ওকে। সত্যি করে বলো বাবা, ও কি কোনও অশরীরী, নাকি আমাদেরই মতো মানুষ।”
প্রসপেরো বললেন, “না মা, ও কোনও অশরীরী নয়। আমাদের মতো খিদে, তেষ্টা, ঘুম – সবই ওর আছে। ওর অনুভূতিগুলিও আমাদেরই মতো। কেবল বিষণ্ণ বলে তোর ওকে একটু অন্যরকম লাগছে। নইলে ওকে তুই বলতিস, সুপুরুষ ব্যক্তি। আসলে নিজের হারিয়ে যাওয়া সঙ্গীসাথীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে ও।”
মিরান্দা ভাবত সব পুরুষমানুষেরই বুঝি তার বাবার মতো গম্ভীর মুখ আর সাদা দাড়ি থাকে। তাই ওই রূপবান যুবকটিকে দেখে সে ভারি খুশি হল। ফার্দিনান্দও এই পরিত্যক্ত দ্বীপে এমন সুন্দরীর দেখা পেয়ে এবং আশ্চর্য সব শব্দ শুনে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ভাবলেন যে নির্ঘাৎ কোনো মায়াবী দ্বীপে এসে উপস্থিত হয়েছেন তিনি আর এ দ্বীপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন এই মিরান্দা। সেভাবেই তাকে সম্বোধন করলেন তিনি।
দুরু দুরু বুক নিয়ে মিরান্দা জানালে যে সে কোনও দেবী নয় – বরং সাধারণ এক মেয়ে। আপন পরিচয় সে যুবককে জানাতে যাচ্ছিল, কিন্তু এমন সময় প্রসপেরো এসে বাধা দিলেন তাঁদের কথাবার্তায়। তাঁরা একে অপরকে বেশ পছন্দ করছিলেন দেখে প্রসপেরোও খুশি হচ্ছিলেন। তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন যে, আমরা যাকে প্রথম দর্শনে প্রেম বলে থাকি, এ ক্ষেত্রে ঠিক তাই-ই ঘটেছে। তবু ফার্দিনান্দকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্য তাদের প্রেমের পথে কিছু বাধা সৃষ্টি করতে চাইলেন তিনি। যুবরাজকে সম্বোধন করে কড়া ভাষায় অভিযোগ করলেন যে সে এক গুপ্তচর। প্রসপেরোর দ্বীপ প্রসপেরোর অধিকার থেকে কেড়ে নিতেই তার এখানে আগমন। “আমাকে অনুসরণ করো,” বললেন প্রসপেরো, “তোমার পা আর গর্দান একত্রে শৃঙ্খলিত করব আমি। তুমি পান করবে সমুদ্রের জল; কাঁকড়া-শামুক, উপড়ানো শিকড় আর ওক বীজের ভূষি হবে তোমার খাদ্য।” “না,” ফার্দিনান্দ বললেন, “যতক্ষণ না আমার অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী কোনও শত্রুর হাতে পরাস্ত হই, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি বাধা দেবো।” এই বলে তিনি তাঁর তরবারি কোষবিমুক্ত করলেন। প্রসপেরো একবার মাত্র তাঁর জাদুছড়িটি চালনা করে মুহুর্তে ফার্দিনান্দকে একেবারে নিশ্চল করে দিলেন।
মিরান্দা তার বাবাকে ধরে পড়লে; বললে, “কেন নিষ্ঠুর হও, বাবা? দয়া করো! আমি ওর জামিন হতে প্রস্তুত। দ্যাখো, আমার দেখা দ্বিতীয় পুরুষ ইনি আর আমার বিশ্বাস ইনি সত্যিই একজন ভাল মানুষ।”
“চুপ্ কর!” গর্জে উঠলেন প্রসপেরো, “আর একটি শব্দ করলে আমার কাছে বকুনি খাবি তুই, মেয়ে! এত স্পর্ধা তোর! একজন প্রতারকের হয়ে ওকালতি করছিস্! শুধু আমাকে আর ক্যালিবানকে দেখেই তোর মনে হল পৃথিবীতে ভাল মানুষ আর একটাও মেলে না। জেনে রাখ, ওরে বোকা মেয়ে, এই লোকটা ক্যালিবানের চেয়ে কিছু ভাল হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীতে এর চেয়েও ঢের ভাল পুরুষ তুই খুঁজে পাবি।” কথাগুলি মেয়েকে তিনি বললেন তাকে বাজিয়ে দেখার জন্য। মেয়ে উত্তর দিলে, “আমার ভালবাসার কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, বাবা। আর নেই বলেই, এঁর চেয়েও ভাল কাউকে দেখার প্রবৃত্তিও আমার নেই।”
“সঙ্গে এসো, যুবক,” যুবরাজকে আদেশ করলেন প্রসপেরো, “আমাকে অমান্য করার শক্তি আর তোমার নেই।”
“তা নেই বটে,” আশ্চর্য হয়ে বললেন ফার্দিনান্দ। তিনি বুঝতে পারেননি যে প্রসপেরোর জাদুবলেই তিনি তাঁর বাধাদানের সব ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। অন্য কোনও উপায় না দেখে পিছু পিছু তিনি চললেন গুহার দিকে। কিন্তু চলতে চলতে পিছন ফিরে যতক্ষণ মিরান্দাকে দেখা যায়, ততক্ষণ বলে চললেন, “আমার সর্বশক্তি আবদ্ধ। আমি যেন স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে রয়েছি। কিন্তু এই ব্যক্তির ভীতিপ্রদর্শন বা আমার সব দুর্বলতা, যা আমি এখন অনুভব করছি, তা সবই লাঘব হয়ে যেতে পারে, যদি বন্দীদশায় প্রত্যহ একবার এই অপরূপার দর্শন পাই আমি।”
প্রসপেরো ফার্দিনান্দকে বেশিক্ষণ গুহায় আটকে রাখলেন না। বরং বাইরে এনে অত্যন্ত ভারী কিছু কাজের দায়িত্ব তাঁর উপর চাপিয়ে দিলেন। খেয়াল রাখলেন যেন তাঁর কন্যা জানতে পারে ঠিক কিরকম পরিশ্রমের কাজ তিনি ফার্দিনান্দকে দিয়ে করাচ্ছেন। তারপরে পড়ার ঘরে চলে যাওয়ার ভান করে গোপনে নজর রাখতে লাগলেন যুবরাজ ও মিরান্দার গতিবিধির উপর।
প্রসপেরো একগাদা ভারী গাছের গুঁড়ি স্তুপীকৃত করার হুকুম দিয়েছিলেন ফার্দিনান্দকে। রাজপুত্রেরা কায়িক শ্রমের কাজে খুব একটা অভ্যস্ত হতেন না। তাই অল্পক্ষণ বাদেই মিরান্দা দেখতে পেল, ভয়ানক পরিশ্রমে প্রাণ যায় যায় অবস্থা ফার্দিনান্দের। “এত পরিশ্রম করবেন না,” সে বললে, “বাবা এখন পাঠাগারে। অর্থাৎ, ঘণ্টা তিনেকের জন্য সেখান থেকে তাঁর বের হবার সম্ভাবনা নেই। দোহাই আপনার, এই সুযোগে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিন।”
“সাহস হয় না, সুচরিতে,” বললেন ফার্দিনান্দ, “বিশ্রাম নেওয়ার আগে আমার কাজ আমাকে শেষ করতেই হবে।”
“তবে আপনি একটু বসুন,” মিরান্দা বললে, “আমি কিছুক্ষণ না হয় আপনার হয়ে কাঠ বয়ে দিই।” কিন্তু ফার্দিনান্দ কিছুতেই সে প্রস্তাবে রাজি হলেন না। সাহায্যের বদলে মিরান্দা হয়ে দাঁড়াল তাঁর কাজের দীর্ঘসূত্রিতার কারণ। অনেকক্ষণ ধরে চলতে লাগল তাঁদের প্রেমালাপ। ফলে কাঠ-বহনের কাজটির গতি হল মন্দ।
মেয়ে ভেবেছিল বাবা পাঠাগারে। আসলে প্রসপেরো আদৌ সেখানে ছিলেন না। ফার্দিনান্দের ভালবাসার কিঞ্চিত পরীক্ষা নেওয়ার মানসেই তিনি তাঁকে এই পরিশ্রমে নিযুক্ত করেন। আর নিজে অদৃশ্য হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তাঁদের বাক্যালাপ শুনতে থাকেন।
ফার্দিনান্দ মিরান্দাকে তার নাম জিজ্ঞাসা করলে। প্রসপেরো মিরান্দাকে তার নাম আগন্তুককে জানাতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু বারণ ভুলেই ফার্দিনান্দকে নিজের নাম বলে ফেলল সে।
কন্যার এই প্রথম অবাধ্যতায় প্রসপেরো একটু হাসলেন মাত্র। তাঁর জাদুবলেই মিরান্দা এত শীঘ্র প্রেমে পড়েছে। তাই কন্যা যখন তাঁর আজ্ঞালঙ্ঘন করে প্রেমের সাক্ষর রেখে গেল তখন তিনি রাগ করলেন না। ফার্দিনান্দ একটি দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে বললেন যে তাঁর দেখা পৃথিবীর সকল নারীর উর্ধ্বে তিনি মিরান্দার প্রতি তাঁর প্রেমকে স্থান দিলেন। তা শুনে পরম সন্তোষ লাভ করলেন প্রসপেরোও।
তারপর ফার্দিনান্দ পৃথিবীর সকল নারীর সৌন্দর্যের উর্ধ্বে মিরান্দার সৌন্দর্যকে স্থাপনা করলে মিরান্দা প্রত্যুত্তরে জানালে, “হে প্রিয়, অপর কোনও স্ত্রীলোকের মুখ আমার মনেই পড়ে না। আমার পিতা ও আপনাকে ছাড়া আর কোনও পুরুষমানুষকেও কোনও দিন চাক্ষুস করিনি আমি। দূর পৃথিবীর কথাও আমার কিছুই জানা নেই। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনাকে ছাড়া আর কাউকে সঙ্গী নির্বাচন করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার মনে নেই। আপনার রূপধ্যান ভিন্ন অপর কোনও কল্পনা আর আমার প্রিয় হতে পারছে না। এই রে, আমি বোধহয় একটু বেশিই স্বাধীনতা নিয়ে ফেলেছি। আমার বাবার বারণ সব ভুলেই আপনার সঙ্গে আলাপ করে চলেছি।”
শুনে প্রসপেরো হেসে মাথা নাড়লেন। যেন বলতে চাইলেন, “ঠিক যেমনটি চেয়েছিলাম, তেমনটিই হচ্ছে। আমার মেয়ে নেপলস্-এর রাজমহিষী হতে চলেছে।”
তারপর ফার্দিনান্দ আরেকটি রাজসভাসুলভ অলংকারমণ্ডিত দীর্ঘভাষণের মাধ্যমে মিরান্দাকে জানালেন যে তিনি নেপলস্-রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী। তাঁকে বিবাহ করলে অপাপবিদ্ধা এই মিরান্দা হবেন তাঁর রাজমহিষী।
মিরান্দা বললে, “হা ভগবান, কী বোকাই না আমি! যে জন্য আমার আনন্দিত হওয়ার কথা, তারই জন্য কাঁদছি। বন্ধু, খুব সরলভাবে আপনার কথার উত্তর দিই, আপনি আমাকে বিবাহ করলে আমি আপনার স্ত্রীই হব।”
প্রত্যুত্তরে ফার্দিনান্দ তাকে ধন্যবাদ জানাতে যাবেন এমন সময় বাধা পড়ল – প্রসপেরো আবির্ভূত হলেন তাঁদের সম্মুখে।
তিনি বললেন, “ভয় নেই মা, আমি সবই শুনেছি। যা বললে তুমি, তাতে আমার আপত্তি নেই। ফার্দিনান্দ, তোমাকে যদি খুব বেশি কষ্ট দিয়ে থাকি, তবে ক্ষতিপূরণে অনেক অনেক বেশি দামি আমার এই কন্যাটিকে দান করলাম তোমায়। তোমাকে এতখানি পীড়া দেওয়ার কারণ আর কিছুই নয়, তোমার ভালবাসাকে একটু পরখ করে দেখা। এই পরীক্ষায় তুমি সসম্মানে উত্তীর্ণ। তাই তোমার সত্য প্রেম যাকে যথাযথভাবেই জয় করেছে, আমার সেই কন্যাকে তুমি উপহার নাও। আমি সদম্ভে বলতে পারি, আমার এই কন্যাটি সকল প্রশংসার উর্ধ্বে – এই কথাটি অবজ্ঞা কোরো না কখনও।” এরপর প্রসপেরো বললেন যে তাঁর এখন বিশেষ কিছু কাজ আছে। তাই যতক্ষণ না তিনি ফিরে আসেন ততক্ষণ ফার্দিনান্দ ও মিরান্দা বসে একটু গল্পগুজব করে। মিরান্দা অবশ্য এই আদেশের মধ্যে অমান্য করার মতো কিছু পেল না।
ফার্দিনান্দ ও মিরান্দাকে রেখে এসে প্রসপেরো ডাক দিলেন এরিয়েলকে। এরিয়েলও হাজির হল চকিতে। প্রসপেরোর ছোটো ভাই ও নেপলসস্-রাজের কী হাল সে করেছে, তা প্রভুকে জানাবার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল এরিয়েল। বললে, নানারকম আশ্চর্য দৃশ্য দেখিয়ে ও নানান অদ্ভুত শব্দ শুনিয়ে সে ভয়ে অচৈতন্য করে এসেছে তাঁদের। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে তাঁরা; তখন এরিয়েল তাদের সামনে মেলে ধরে এক এলাহি ভোজের আয়োজন। তারপর যেই না তাঁরা সেই সব ভোজনসামগ্রীর দিকে এগিয়েছেন অমনি অতিকায় ডানাবিশিষ্ট অতিভোজী দৈত্য হার্পির[১] ছদ্মবেশে তাঁদের সম্মুখে আবির্ভূত হয় এরিয়েল। আর সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে যায় সব ভোজ্যসামগ্রী। তারপর আশ্চর্য হয়ে তাঁরা শোনেন হার্পি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে প্রসপেরোকে রাজ্য থেকে বিতারণ, তাঁকে ও তাঁর শিশুকন্যাকে অকূল সমুদ্রে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার তাদের সেই নিষ্ঠুর প্রয়াসই তাঁদের আজকের এই ভয়াবহ দুরবস্থার কারণ।
নেপলস্-রাজ ও প্রসপেরোর দুষ্ট ভাই তখন প্রসপেরোর প্রতি কৃত তাঁদের অন্যায়ের জন্য অনুতাপ করতে লাগলেন। এরিয়েল তার প্রভুকে জানালে যে সে নিশ্চিত তাঁদের এই অনুতাপ আন্তরিক। এমনকি এও বললে যে একজন অশরীরী হয়েও সে তাঁদের প্রতি দয়ার্দ্রচিত্ত না হয়ে পারছে না।
প্রসপেরো বললেন, “তবে তাদের এখানে নিয়ে আয়, এরিয়েল, যদি তুই এক অশরীরী হয়ে তাদের কষ্টে বেদনা অনুভব করতে পারিস, তবে আমি তাদেরই মতো একজন হয়েও আমি কেন তা পারব না? এখনি এখানে নিয়ে আয় তাদের, যা।”
এরিয়েল তখনই ছুটল নেপলস্-রাজ, অ্যান্টোনিও ও বুড়ো গঞ্জালোর দলটিকে ধরে আনতে। এক আশ্চর্য সুর বাজিয়ে সে তাদের বাধ্য করল তাকে অনুসরণ করতে। এভাবে এরিয়েল তাঁদের নিজ প্রভুর সন্নিকটে হাজির করল। এই গঞ্জালোই সেই ব্যক্তি যিনি প্রসপেরো ডিঙিতে রসদসামগ্রী ও বই রেখে তাঁর প্রাণ রক্ষা করেছিলেন।
ভয়ে দুঃখে অভিভূত হয়ে তাঁরা প্রথমে প্রসপেরোকে চিনতেই পারলেন না। তখন প্রসপেরো দয়ালু বুড়ো গঞ্জালোকে তাঁর জীবনরক্ষক বলে উল্লেখ করে তাঁর কাছেই প্রথমে আত্মপ্রকাশ করলেন। আর তার পরেই প্রসপেরোর ভাই ও নেপলস্-রাজ চিনতে পারলেন যে ইনিই তাঁদের পূর্বকৃত অপরাধের শিকার নির্বাসিত ডিউক প্রসপেরো।
অন্তরের অনুশোচনায় আর্দ্রনয়ন অ্যান্টোনিও দাদার কাছে ক্ষমা চাইলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কৃত ষড়যন্ত্রে নেপলস্-রাজের হাত ছিল; তাই তিনিও ক্ষমা চাইলেন নির্বাসিত ডিউকের কাছে। উদারচিত্ত প্রসপেরো ক্ষমা করলেন উভয়কেই। তাঁরা প্রসপেরোর হৃতরাজ্য প্রসপেরোর হাতেই পুনরায় প্রত্যার্পণের প্রতিশ্রুতি দিলেন। তখন প্রসপেরো নেপলস্-রাজকে বললেন, “তোমার জন্যও একটি উপহার গচ্ছিত আছে আমার কাছে।” এই বলে তিনি একটি দরজা খুলে দিলেন। সবাই দেখল যুবরাজ ফার্দিনান্দ বসে দাবা খেলছেন মিরান্দার সঙ্গে।
নেপলস্-রাজ ও ফার্দিনান্দ উভয়েই মনে করেছিলেন অপর জনের সলিলসমাধি ঘটেছে। তাই পিতাপুত্রের এই অপ্রত্যাশিত পুনর্মিলনে তাঁদের আনন্দের সীমা রইল না।
মিরান্দা বললে, “কী আশ্চর্য! কোথাকার মহৎ সৃষ্টি এরা? তবে কী এমন কোনও এক সাহসী নতুন ভুবন আছে যেখানে এমন সব ব্যক্তিরা বাস করেন।”
তরুণী মিরান্দার রূপসৌন্দর্য দেখে ছেলের মতো বাবাও আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলেন। “কে এই নারী?” তিনি প্রশ্ন করলেন, “মনে হচ্ছে ইনি কোনও দেবী। মনে হচ্ছে যেন ইনিই আমাদের বিচ্ছিন্ন করে এমনভাবে পুনর্মিলিত করলেন।” মিরান্দাকে প্রথম দেখে সে যে ভুলটি করেছিল, তার বাবাকেও সেই একই ভুল করতে দেখে কৌতুক বোধ করল ফার্দিনান্দ। “না বাবা,” সে বললে, “ও এক মানবী। দৈবের ইচ্ছায় ও আমার। বাবা, আমি মনে করেছিলাম আপনার সলিলসমাধি ঘটেছে। তাই আপনার অনুমতির অপেক্ষা না রেখেই ওকে আমার জীবনসঙ্গিনী নির্বাচিত করে ফেলেছি আমি। মিলানের বিখ্যাত ডিউক এই প্রসপেরোর কন্যা ও। প্রসপেরোর খ্যাতির কথা আমি আগে শুনেছিলাম বটে, কিন্তু কখনও চাক্ষুস করিনি তাঁকে। আজ আমি ওঁর কাছ থেকে পেলাম এক নতুন জীবন। নিজ কন্যাকে আমার হস্তে অর্পণ করে আজ তিনি আমার দ্বিতীয় পিতা।”
তখন নেপলস-রাজ মিরান্দার উদ্দেশ্যে বললেন, “তবে তো আমিও ওর পিতা। কিন্তু মা, কথাটা আশ্চর্য শোনালেও, আমিও আজ সন্তানের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী।”
প্রসপেরো বললেন, “আর ও কথা নয়। সমাপন যখন মধুর হল, তখন ওসব পুরনো কথা না তোলাই ভাল।” একথা বলে প্রসপেরো তাঁর ভাইকে আলিঙ্গন করলেন। জানালেন, সর্বান্তকরণে তিনি মার্জনা করেছেন তাঁর ছোটো ভাইকে। সঙ্গে এও বললেন যে এক চতুর মহাশক্তিশালী দৈবই তাঁকে তাঁর হতভাগ্য রাজ্য মিলান থেকে নির্বাসিত করেছিল; আবার আজ সেই দৈবের বশেই তাঁর কন্যা হলেন নেপলস্-সিংহাসনের উত্তরাধিকারিনী। সেজন্যই এই জনবিরল দ্বীপে আবার মিলন হল তাঁদের। যুবরাজ ফার্দিনান্দ মিরান্দার প্রেমে পড়লেন।
ভাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই প্রসপেরো এই কথাগুলি বলা। কিন্তু এই দয়ার্দ্র বাক্যে অ্যান্টোনিও লজ্জা ও অনুতাপে দগ্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর চোখ দিয়ে বইল জলের ধারা। তিনি বাক্রহিত হলেন। দুই ভাইয়ের পুনর্মিলনে আনন্দাশ্রু বইল গঞ্জালোর চোখেও। প্রণয়ীযুগলের জন্য তিনি কামনা করলেন আশিষ।
প্রসপেরো জানালেন যে তাঁদের জাহাজ জাহাজঘাটে সুরক্ষিত আছে। নাবিকরাও সব জাহাজেই আছেন। পরদিন তাঁদের সঙ্গে নিয়ে সেই জাহাজেই তিনি সকন্যা রওয়ানা হবেন গৃহাভিমুখে। “ততক্ষণ,” বললেন প্রসপেরো, “আমার এই ক্ষুদ্র গুহায় আশ্রয় নিয়ে বিশ্রাম করো তোমরা। আজকের সান্ধ্য বিনোদন হিসেবে তোমাদের শোনাতে চাই এই পাণ্ডববর্জিত দ্বীপে আসার পর থেকে ঘটে যাওয়া আমার জীবনের সকল কাহিনি।” এরপর প্রসপেরো ক্যালিবানকে ভোজন প্রস্তুত করার আদেশ করলেন। বললেন, গুহাটি গুছিয়ে-গাছিয়ে রাখতে। সকলেই অবাক হলেন, যখন তাঁরা শুনলেন এই কিম্ভুত বুনো দৈত্যটা নির্বাসনকালে প্রসপেরোর একমাত্র আজ্ঞাবহ ছিল।
দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রসপেরো এরিয়েলকে অব্যাহতি দিয়ে গেলেন তার কাজ থেকে। এরিয়েল ছিল প্রভুর বিশ্বস্ত ভৃত্য। তবু নিজের মুক্তির জন্য সে ছিল উন্মুখ। বনের পাখি যেমন সবুজ গাছের তলায় সুস্বাদু ফল আর সুগন্ধী ফুলের মাঝে বাধাহীন হয়ে ঘুরে বেড়ায়, ঠিক তেমনই ঘুরে বেড়াতে চাইত সে। তাই মুক্তি পেয়ে সে ভারী খুশি হল। “আমার সুদক্ষ এরিয়েল,” ছোট্ট অশরীরীটিকে মুক্তি দেওয়ার সময় বললেন প্রসপেরো, “তোর অভাব প্রতি পদে অনুভব করব আমি; যা, তুই এখন থেকে মুক্ত।” “ধন্যবাদ, প্রভু আমার,” বললে এরিয়েল, “কিন্তু বিদায় জানাবার আগে আপনার এই বিশ্বস্ত এরিয়েলকে তার শেষ কাজটি করতে দিন – আপনার জাহাজ নির্বিঘ্নের দেশে পৌঁছিয়ে দিতে দিন। তারপর মুক্তি নিয়ে আনন্দে বিহার করব আমি।” এই বলে সে একটি গান গাইল, তার মর্মার্থ এইঃ অলি যেথায় মধুপান করে, সেখানে আমিও পান করি; আমি ঘাসফুলের গলায় দুলি; পেঁচাদের গান গাইবার কালে গুটিয়ে শুয়ে থাকি আমি; আর বাদুড়ের পিঠে চেপে উড়ে বেড়াই। চৈত্র শেষের সুখে আমি রই মহাসুখে; যে ফুলটি ফোটে বৃক্ষতলে, আমি রই তারই তলে॥
তারপর প্রসপেরো মাটির গভীরে পুঁতে তাঁর জাদুগ্রন্থাবলি ও জাদুছড়িখানি। তিনি মনস্থ করেছিলেন আর কোনও দিন জাদুবিদ্যার প্রয়োগ ঘটাবেন না। এভাবে শত্রুদের জয় করে; ভাই ও নেপলস-রাজের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়ে তাঁর আনন্দের সীমা রইল না। বাকি রইল শুধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে স্বহস্তে শাসনভার পুনর্বার তুলে নেওয়া। এবং তাঁর কন্যার সঙ্গে যুবরাজ ফার্দিনান্দের বিবাহ দেওয়া। রাজা বলেছিলেন, নেপলস-এ ফিরেই সেই উৎসব তাঁরা মহাসমারোহে পালন করতে চলেছেন। অশরীরী এরিয়েলের নিরাপদ তত্ত্বাবধানে এক মনোরম সমুদ্রযাত্রার পর খুব শীঘ্রই সেখানে উপস্থিত হতে চলেছেন তাঁরা।
————-
১. হার্পিঃ পৌরাণিক দানবী। এর দেহের অর্ধেক নারী, অর্ধেক পাখির মতো। অন্য অর্থে হার্পি বলতে অতিলোভী ব্যক্তিকে বোঝায়। [অনুবাদক]