দ্য টু জেন্টেলমেন অব ভেরোনা

দ্য টু জেন্টেলমেন অব ভেরোনা

ভেরোনা ছিল ইতালির এক প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর। দুই যুবক, প্রোটিয়াস আর ভ্যালেন্টাইন এই শহরেরই অধিবাসী। ছোটোবেলা থেকেই এই ভদ্র, শিক্ষিত, সম্পন্ন পরিবারের ছেলে দুটি একই সাথে লেখাপড়া শিখে বড়ো হয়েছে। স্বভাবতই তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে অন্তরঙ্গ এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

প্রোটিয়াস প্রেমে পড়েছে এক সুন্দরী যুবতির—নাম জুলিয়া, তারা একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসে। এদিকে প্রোটিয়াসের বন্ধু ভ্যালেন্টাইনের ধ্যান-ধারণা অন্যরকম। প্রেম, ভালোবাসা ও হৃদয়াবেগ সম্পর্কেতার মতামত আলাদা। সব সময় প্রোটিয়াসের মুখে জুলিয়ার প্রেমানিবেদনের কথা শুনে এক এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। এ নিয়ে মাঝে মাঝে প্রোটিয়াসকে ঠাট্টা-তামাশা করতেও ছাড়ে না সে।

ভ্যালেন্টাইন একদিন প্রোটিয়াসকে জানাল যে সে মিলানে যাচ্ছে। তাই বেশ কিছুদিন তাদের দু-জনের মধ্যে আর দেখা-শোনা হবে না। কথাটা শুনেই বেশ মুষড়ে পড়ে প্রোটিয়াস, বন্ধুকে অনুরোধ করে যেন সে তাকেও সাথে নিয়ে যায়।

বন্ধুর অনুরোধের উত্তরে ভ্যালেন্টাইন জানোল, সেটা কী করে সম্ভব। তুমি কি ভেবে দেখেছি আমার সাথে গেলে তোমার প্রেমিকার অবস্থা কী হবে? তোমার অদর্শনে বেচারি জুলিয়া তো দমবন্ধ হয়ে ছটফট করে মারা যাবে।

ভ্যালেন্টাইনের কথার জবাবে বলার মতো কিছু না পেয়ে চুপ করে রইল প্রোটিয়াস।

এবার প্রোটিয়াসকে খোঁচা দিয়ে বলল ভ্যালেন্টাইন, অল্প বয়সে যখন প্রেমে পড়েইছ, তখন বিয়ে করে ঘর-সংসার কর! তারপর সুন্দরী বউ আর একগাদা ছেলেপেলে নিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলি কাটিয়ে দাও একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন ভাবে। তোমার মতো তরুণ প্রেমে হাবুডুবু না খেলে আমি নিশ্চয়ই নিয়ে যেতম তোমাকে। তবে এখন বলতে পারব না যে জুলিয়াকে ছেড়ে আমার সাথে মিলানে চল। আর তোমার পক্ষে সম্ভবও নয় তা। কাজেই আমাকে একাই যেতে হবে। তুমি একজন প্রেমিক। দিনরাত চুটিয়ে প্রেম চালিয়ে যাও জুলিয়ার সাথে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি ক্ৰমাগত তোমার প্রেমের শ্ৰীবৃদ্ধি হোক।

তবে তাই হোক, বলল প্রোটিয়াস, তুমি তাহলে একাই যাও। মিলানে থাকাকালীন যদি কোনও দুর্লভ জিনিস তোমার চোখে পড়ে, তাহলে মনে করো আমার কথা। আর কোনও দুঃসময় ও সংকট পড়লে চেষ্টা করো আমায় খবর দেবার। কথা দিচ্ছি, দুঃসময়ে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তোমায় সাহায্য করার।

নিশ্চয়ই প্রোটিয়াস, আমিও কথা দিচ্ছি। তেমন অবস্থায় পড়লে চেষ্টা করব তোমায় খবর দেবার, বলল ভ্যালেন্টাইন। যথারীতি প্রিয় বন্ধুকে আলিঙ্গন করে সে রওনা দিল মিলানের পথে।

দুই

ভ্যালেন্টাইন মিলানে রওনা দেবার কিছুক্ষণ বাদেই ছুটতে ছুটতে সেখানে এসে হাজির তার খাস চাকর স্পিডি। সে ভালোবাসত লুসেট্টা নামে একটি যুবতিকে, যে আবার ছিল প্রোটিয়াসের প্রেমিকা জুলিয়ার বাড়ির পরিচারিকা। শুধুমাত্র সেজন্যই স্পিডকে ভালোবাসত প্রোটিয়াস, কারণ তার হাত দিয়েই জুলিয়াকে প্রেমপত্র পাঠােত সে। সে প্রেমপত্র স্পিড় পাচার করে দিত। তার প্রেমিকা লুসেট্টার কাছে। আর লুসেট্টা যথারীতি তা পৌঁছে দিত তার মনিবানী জুলিয়ার হাতে। এভাবে দূতাগিরির মজুরি হিসেবে স্পিড প্রায়ই প্রোটিয়াসের পকেট খসিয়ে মোটা টাকা আদায় করে নিত।

কী ব্যাপার! তুই এত হস্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছিস কেন? স্পিডকে জিজ্ঞেস করল প্রোটিয়াস।

এসেছি আমার মানিবের খোজে, বলল স্পিড, তার সাথে আপনার কি দেখা হয়েছে?

দেখা হয়েছিল বটে, তবে তা অনেকক্ষণ আগে, বলল প্রোটিয়াস, তখন তোর মনিব জাহাজ ঘাটার দিকে এগুলো। এতক্ষণ হয়তো তার জাহাজ ছেড়েও দিয়েছে বলেই আড়াচোখে স্পিডের দিকে তাকিয়ে বলল, এই! জুলিয়ার হাতে আমার চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছিস তো?

আজ্ঞে, দিয়েছি, মুখটিপে হেসে স্পিড বলল, তিনি একটা চিঠি দিয়েছেন। আপনাকে দেবার জন্য। তবে কিছু মনে করবেন না কত্তা, আপনার প্রেমিকাটি বেজায় কিপটে, মোটেও জল গলে না। ওর হাত দিয়ে। এই চিঠিটা আপনাকে দেবার জন্য কোনও বিকশিশ উনি দিলেন না। আমাকে।

শোন! বকশিশ না দিলেও মন খারাপ করিস না, বলল প্ৰেটিয়াস। এবার দেখি জুলিয়ার চিঠিটা। চিঠিখানা স্পিড বের করতেই তা ছোঁ। মেরে কেড়ে নিল প্রোটিয়াস। তারপর পকেট থেকে এক পাউন্ডের মুদ্রা বের করে স্পিডের হাতে দিল সে। পকেটে সেটি গুজে নিয়ে প্রোটিয়াসকে বলল, দরাজ হাতে এরূপ বকশিশ দেন বলেই তো মুখ বুজে আপনার কাজ করে দিই। আপনার প্রেমিক যেমন ভুলেও এক আধলা উপূড় করেন না, তেমনি আমার মনে হয় দুহাত উজাড় করে বিয়ের পর তিনি আপনাকে পয়সা-কড়ি দেবেন না।

চুপ হতচ্ছাড়া। স্পিডকে ধমকাল প্রোটিয়াস। তারপর নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, দেখছি। এবার থেকে জুলিয়ার হাতে চিঠি পৌঁছে দেবার দায়িত্ব অন্য কাউকে দিতে হবে।

তিন

বকশিশ হিসেবে এক পাউন্ড প্রোটিয়াসের কাছ থেকে আদায় করে এবং সেই সাথে তার ধমক খেয়ে পালাল স্পিড। বাড়ি ফেরার পূর্বে মাঝরাস্তায় সে দাঁড়িয়ে পড়ল জুলিয়ার বাড়ির সামনে। লুসেট্টাকে ডেকে কিছুক্ষণ তার সাথে হাসি-ঠাট্টা করে জুলিয়াকে লেখা প্রোটিয়াসের চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বিদায় নিল। কিছুক্ষণ বাদে বাড়ির সামনের বাগানে পায়চারি করতে এল জুলিয়া। সে সময় লুসেট্টাও সুযোগ বুঝে! হাজির সেখানে। মনিবানীর সাথে যেতে যেতে সে নানা প্রকার রসালো বুলি আওড়াতে লাগলে যুবতি মেয়েদের প্রেমে পড়ার স্বপক্ষে।

যেতে যেতে ঘাড় না ফিরিয়েই বলল জুলিয়া, কী ব্যাপার বল তো লুসেট্টা! হঠাৎ আজ প্রেমে পড়ার জন্য আমায় জ্ঞান দিচ্ছিস কেন? আমার তো মনে হচ্ছে পুরুষের জন্য তুই ওকালতি করছিস।

কী যে বল দিদিমণি, বলেই মূহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নেয় লুসেট্টা, মুখ টিপে হোসে বলে, আমায় তুমি ভুল বুঝে না দিদিমণি। প্রেম সব সময় পবিত্র এবং স্বৰ্গীয়; আমার আসল বক্তব্য এই যে প্রেমে পড়ার পূর্বে ভালো করে সবকিছু ভেবে দেখা প্রয়োজন।

সায় দিয়ে জুলিয়া বলল, তা ঠিকই বলেছিস; কত পুরুষই তো আমার প্ৰেম-ভালোবাসা পেতে উদগ্রীব। তাই বলে যাকে তাকে তো আমি তা বিলিয়ে দিতে পারি না।

তা তো ঠিকই দিদিমণি, লুসেট্টা সায় দেয়।

এই এগলামুর লোকটার কথাই ধর না কেন, বলল জুলিয়া, ওর সম্পর্কে তোর ধারণা কী আর লোকটাই বা কেমন?

এগলামুর লোকটা দেখতে সুন্দর আর যোদ্ধা হিসেবে বেশ সুনামও রয়েছে, লুসেট্টা বলল, তবুও আমার অভিমত ঘর-সংসার করার জন্য এ লোককে বিয়ে করা ঠিক নয়।

অরি মার্কোশিয়? পুনরায় জানতে চাইল জুলিয়া, আমার মুখের একটু হাসির জন্য তিনি তো পাগল। তাছাড়া ওর প্রচুর টাকা-কড়িও রয়েছে। সেসব খবর রাখিস তুই?

টাকার কুমির হলেও লোকটা যেন কেমন, বলল লুসেট্টা, ওর হাব-ভাব, কথা-বার্তা, চলাফেরা, সবই যেন কৃত্রিম মনে হয়। নিজস্ব বলতে যেন ওর কিছু নেই। ছোটো মুখে কথাটা হয়তো বড়োই শোনাবে দিদিমণি, তবুও যখন তুললে তখন বলেই ফেলি, আমার মতে মানুষের মতো মানুষ একজনই রয়েছেন, তিনি হলেন প্রোটিয়াস।

তুই আর কাউকে পেলি না! এত লোকের মধ্যে শেষে কিনা প্রোটিয়াস? – লুসেট্টার মুখে ও নামটা শুনে অবাক হবার ভান করে বলল জুলিয়া, আমার তো ভুলেও ওর কথা মনে হয় না। তাছাড়া ওর মধ্যে এমন কী দেখেছিস যার জন্য তুই ওর হয়ে ওকালতি করছিস?

এজন্যই বলছি দিদিমণি যে তার সমস্ত মনপ্রাণ তিনি আপনাকেই সঁপে দিয়েছেন–একমাত্র আপনিই রয়েছেন তার মনের মণিকোঠায়, সেখানে আর কারও স্থান নেই, বলল লুসেট্টা।

জুলিয়া বলল, প্রোটিয়াস তো খুবই কম কথার লোক আর যিনি কম কথা বলেন তার প্রেমও তো ক্ষণস্থায়ী হবে।

তুমি ভুল করছ দিদিমণি, জুলিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল লুসেট্টা, যিনি কম কথা বলেন তীর হৃদয় প্রেমে ভরপুর। এরপ মানুষকে পাওয়া তো খুবই ভাগ্যের কথা। বলেই জামার ভেতর থেকে মুখবন্ধ খামটা বের করে জুলিয়ার হাতে দিয়ে বলল লুসেট্টা, মন দিয়ে ভেতরের লেখাটা পড়ুন তাহলে বুঝতে পারবেন আমার কথাটা কতদূর সত্যি।

খামের উপর চোখ বুলিয়ে জুলিয়া বলল, এ তো দেখছি চিঠি, খামের উপর আমার নাম লেখা। লুসেট্টা! এ চিঠি কে দিয়েছে?

চেগা-শোনা:; কিছুক্ষণ আগে সেই এ চিঠিটা দিয়েছে আমায়। মনে হচ্ছে আপনাকে দেবার জন্য চিঠিটা প্রোটিয়াসই দিয়েছেন স্পিডকে।

জুলিয়ার স্বভাবটাই আসলে অদ্ভুত। বহু আগেই প্রোটিয়াসের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু সে তা গোপন রাখতে চায় সবার কাছ থেকে। এর কারণ ভয় বা চাপ নয়। পরিচিতদের কাছে সে দেখাতে চায় প্রোটিয়াসের সম্পর্কে তার কোনও আগ্রহ নেই। সে জন্য লুসেট্টার হাত থেকে প্রোটিয়াসের লেখা চিঠিখান কেড়ে নিয়েই তাকে ধমকে উঠল জুলিয়া, প্রোটিয়াসের লেখা চিঠিটা কেন এনেছিস তুই! যা, এই মুহুর্তে এটা নিয়ে আমার সামনে থেকে দূর হয়ে যা। বলেই মুখবন্ধ খামটি ফিরিয়ে দিল তাকে। খামোটা নিয়ে লুসেট্টা ঘরের বাইরে বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ বাদেই জুলিয়ার ইচ্ছে হল প্রোটিয়াস তাকে কী লিখেছে তা জানতে। সাথে সাথেই সে চেঁচিয়ে ডাকল লুসেট্টাকে।

জুলিয়ার স্বভাব-চরিত্র ভালোভাবেই জানত লুসেট্টা। ঠিক এই ডাকেরই অপেক্ষায় ছিল সে। সাথে সাথেই সে পড়িমড়ি করে হাজির হল। যেন কিছুই হয়নি এরূপ ভাবে বলল জুলিয়া, দেখে আয়তো ঘড়িতে কটা বাজে আর জেনে আয় ডিনারের সময় হয়েছে কিনা।

দিদিমণি! ডিনারের সময় হয়ে গেছে, বলেই প্রোটিয়াসের চিঠিটা আবার বের করে জুলিয়ার হাতে দিয়ে লুসেট্টা বলল, আসলে এটার জন্যই তুমি আমায় ডেকেছি। নাও, এবার ভালো করে পড়ে ফেল।

জুলিয়া ভীষণ রেগে গেল লুসেট্টার কথা শুনে। কোনও চিন্তা-ভাবনা না করেই সে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে প্রোটিয়াসের চিঠিটা ফেলে দিল মেঝের উপর। মনে মনে লুসেট্টা খুব ব্যথা পেল জুলিয়ার কাণ্ড দেখে। চিঠির টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিতে যখন সে উবু হয়ে মেঝেতে বসতে যাবে, ঠিক তখনই চেঁচিয়ে উঠল জুলিয়া, খবরদার বলছি, ভালো চাস তো ওগুলো মোটেও ছবি না। চলে যা এখান থেকে। এখন আমার কোনও দরকার নেই তোকে।

ঘর থেকে লুসেট্টা চলে যাবার পর মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা চিঠির টুকরোগুলির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জুলিয়া। কেন যে সে এমন হঠকারিতা করল তা ভেবে নিজেরই ওপর ক্ষুব্ধ হল সে। মাথা গরম করে এভাবে চিঠিটা ছিড়ে ফেলার জন্য সে আক্ষেপ করতে লাগল।

অনেকক্ষণ হল ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে লুসেট্টী। ধারে কাছে কেউ নেই দেখে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসলজুলিয়া। চিঠিতে প্রোটিয়াস তাকে কী লিখেছিল তা জানার জন্য সে চিঠির টুকরোগুলিকে কুড়িয়ে নিয়ে পরপর সাজিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগল। হঠাৎ জুলিয়ার নজরে পড়ল একটুকরো কাগজে লেখা রয়েছে প্রেমের তিরবিদ্ধ প্রোটিয়াস। অন্যান্য কতকগুলি ছেড়া টুকরো লেখা রয়েছে মিষ্টি মিষ্টি অনেক প্রেমের বাণী। না জানি গোটা চিঠিটাতে আরও কত মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের কথা লেখা ছিল। অযথা মাথা গরম করে চিঠিটা ছিড়ে ফেলার দরুন সেসব কিছুই সে পড়তে পেল না। নিজের আচরণে খুবই অনুতপ্ত হল জুলিয়া। সে ঠিক করল নিজের কাছে রেখে দেবে চিঠির সেই ছেড়াটুকরোগুলিকে। নিয়ম করে দু-বেলা চুমু খাবে সেগুলির গায়। আমার অন্যায়ের প্ৰায়শ্চিত্ত কি তাতেও হবে না? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে জুলিয়া।

প্রোটিয়াসের বাবা অ্যান্টোনিও ধমকে উঠলেন তার বাড়ির পরিচারককে–অ্যাই ব্যাটা প্যানথিনো! তখন থেকে তোকে ডাকতে ডাকতে আমার গলা শুকিয়ে গেছে। এতক্ষণ কোথায় ছিলি?

প্যানথিনো জবাব দিল, আর্জের মঠে, আপনার ভাইয়ের কাছে।

দাবড়ে উঠলেন অ্যান্টোনিও, কেন রে হতচ্ছাড়া? এতক্ষণ কোন ঠাকুরের সেবা করছিলি মঠে বসে? নাকি আমার ভাই আটকে রেখেছিল তোকে?

না হুজুর, জবাব দেয় প্যনিথিনো, আসলে হয়েছে কি উনি তার ভাইপো অর্থাৎ আপনার ছেলের কথা খুবই চিন্তা করেন কি না, তাই সে নিয়েই কথা বলছিলেন আমার সাথে।

ভাই কী কথা বলছিল আমার ছেলের ব্যাপারে, জানতে চাইলেন অ্যান্টোনিও।

উনি বলছিলেন যে যৌবনে পা দেবার সাথে সাথে সাধারণ লোকেরা তাদের ছেলেদের বাড়ির বাইরে ছেড়ে দেয় মানুষ হবার জন্য, বলতে থাকে প্যানথিনো, সেই ছেলেদের মধ্যে কেউ যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা নিতে, কেউ যায় জাহাজে চেপে নতুন দ্বীপ আবিষ্কার করতে, আর কেউবা সেনাদলে নাম লিখিয়ে যুদ্ধে যায় সৌভাগ্যের সন্ধানে। আপনার ভাই বলছিলেন যে প্রোটিয়াসেরও সেরাপ করা উচিত ছিল। উনি আরও বলছিলেন যে প্রোটিয়াস এখন যৌবনে পা দিয়েছে। এবার যদি সে দেশ-বিদেশে না যেতে পারে, তাহলে সে পৃথিবীর কিছুই দেখতে পাবে না। পৃথিবীতে নানা ধরনের মানুষ রয়েছে। তাদের স্বভাব কেমন, সেও তার জানা হবে না। উনি আপনাকে জানাতে বলেছেন যেন প্রোটিয়াসকে আর আপনি বাড়ির মধ্যে আটকে না রাখেন।

এ সব কথা যদি আমার ভাই বলে থাকে, তাহলে সে খাটি কথাই বলেছে, সায় দিয়ে বললেন অ্যান্টোনিও, পরিশ্রম করলেই অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায় বলে আমার বিশ্বাস। তা প্যানটিনো, আমার ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তুই যখন ভাইয়ের সাথে এত আলোচনা করিস, এত ভাবিস তার জন্য, তাহলে তুই বল কোথায় পাঠানো যায় তাকে?

এ নিয়ে আর এত ভাবন কী, বলল প্যানথিনো, আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন যে উন্নতিলাভের আশায় প্রোটিয়াসের বন্ধু ভ্যালেন্টাইন মিলানের রাজসভায় গেছে।

হাঁ, আমি তা শুনেছি, বললেন অ্যান্টোনিও।

কত্তা! আমার মতে প্রোটিয়াসকে সেখানে পাঠিয়ে দিলেই ভালো হয়, বলল অ্যান্টোনিও, দেশ-বিদেশের প্রচুর লোক রোজ আসে সম্রাটের রাজসভায়। অনেক কিছু সে জানতে-শিখতে পারবে। যদি সে তাদের সাথে মেলামেশা করে। তারপর বারোমাস রাজসভায় লেগেই আছে তির ছােড়া, বন্দুকবাজি, তলোয়ার লড়াই প্রভৃতি অস্ত্র প্রতিযোগিতা। সে সব প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে প্রোটিয়াস যদি তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে, তাহলে সম্রাটের নজরে পড়ার সম্ভাবনা আছে।

ঠিকই বলেছ। তুমি প্যানথিনো, সায় দিয়ে বললেন অ্যান্টোনিও, আমিও চেষ্টা করছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রোটিয়াসকে মিলানের সম্রাটের রাজসভায় পাঠাবার।

আমি বলছি কি কত্তা, খামোখা দেরি না করে কালই রওনা করে দিন ছোটো কত্তা প্রোটিয়াসকো, বলল প্যানথিনো।

কিন্তু কাল কেন? জানতে চাইলেন অ্যান্টোনিও।

ডন অ্যালফানসোকে নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে কত্তা? বলল পানিথিনো, আগামীকাল কয়েকজন ভদ্রলোকের সাথে উনি চাকরির খোজে রওনা দিচ্ছেন মিলানে সম্রাটের দরবারে। আমি বলছি কি প্রোটিয়াসকেও আপনি কাল তাদের সাথে জাহাজে তুলে দিন।

সে তো খুবই ভালো কথা, বললেন অ্যান্টোনিও, আগামী কালই ডন অ্যালফানসো ও তার সাখীদের সাথে প্রোটিয়াসও রওনা দেবে মিলানের পথে। তাহলে আর দেরি নয়। প্যানথিখনো; ওর জামা-কাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্রগুলি তুই এবেলাই গুছিয়ে বাক্সে ভরে ফ্যাল!

প্রোটিয়াস কিন্তু তখনও জানে না যে বাড়ির পুরোনো চাকরের পরামর্শ মতো তার বাবা একরকম নির্বাসন দণ্ডের মতো তাকে মিলানে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন। কিছুক্ষণ আগে জুলিয়ার প্রেমপত্র পেয়ে সে খুশিতে ডানা মেলে উড়ছে কল্পনার আকাশে। বারবার ঘরিয়ে ফিরিয়ে চিঠিখানা দেখছে সে। শুরু থেকে চিঠিটা পড়ছিল প্রোটিয়াস। মাঝে মাঝে ন্যাকের কাছে নিয়ে শুকছিল তার গন্ধ; ঠিক সে সময় তাকে খজতে সেখানে এলেন তার বাবা অ্যান্টোনিও!

মন দিয়ে ছেলেকে চিঠি পড়তে দেখে অ্যান্টোনিও জিজ্ঞেস করলেন, ওটা করে চিঠি? কে লিখেছে?

কিছু না ভেবেই বলে বসিল প্রোটিয়াস, মিলান থেকে আমার এক বন্ধু ভ্যালেন্টাইন লিখেছে চিঠিটা। চিঠিটা নিয়ে এসেছে তারই এক বন্ধু।

চিঠিটা দাও তো, বলেই হাত বাড়ালেন অ্যান্টোনিও, পড়ে দেখি মিলানের কী খবর লিখেছে তোমার বন্ধু।

এই রে সেরেছে। নিজের মনে বিড়বিড় করে বলে উঠল প্রোটিয়াস, জুলিয়ার প্রেমপত্রটা এবার ওর হাতে তুলে দিতে হবে। উনি এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন চিঠিটা পড়তে না পারলে ওর ঘুম হবে না। আজ রাতে। এখন কী করব! সাথে সাথে নিজেকে সামলে নেয় প্রোটিয়াস। জামার হাতায় চিঠিটাকে গুজে রেখে সে বলল, কি করবে তুমি আমার বন্ধুর চিঠি পড়ে? মিলানের এমন কোনও খবর এতে নেই। যা তুমি ভাবছি। ও কেমন সুখে আছে মিলানের সম্রাটের দরবারে, দরবারে সব কাজে ওর ডাক পড়ে যখন-তখন—এই কথাই লেখা আছে চিঠিতে। সেই সাথে আমারও সেখানে যেতে লিখেছে।

সে কথা লিখেছে বুঝি? বললেন অ্যান্টোনিও, তোমার বন্ধু ভ্যালেন্টাইকে তো বেশ ভালো ছেলে বলেই মনে হচ্ছে।

নিজের মনে হাসতে হাসতে প্রোটিয়াস বলল, হাঁ, ও লিখেছে যে আমিও তার মতো সৌভাগ্যবান হতে পারি, যদি আমি মিলানে সম্রাটের দরবারে যাই।

অ্যান্টোনিও বললেন, তোমার বন্ধু যে একজন গুণী লোক তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তুমি শুনে খুশি হবে যে তোমার বন্ধুর মত-ই আমার মত। জীবনের অনেকগুলো দিনই তুমি নিষ্কর্ম হয়ে কাটালে। এবার গা ঝাড়া দিয়ে ওঠা। আমার ইচ্ছে ভ্যালেন্টাইনের মতো তুমিও কিছুদিন মিলানে সম্রাটের দরবারে থােক। টাকা-পয়সার জন্য ভেব না। যতদিন পর্যন্ত তোমার পাকাপাকি ব্যবস্থা না হয়, আমি তোমার থাকা-খাওয়ার খরচের টাকা পাঠিয়ে দেব। তোমায় আগামীকালই রওনা হতে হবে মিলানের উদ্দেশে। হাতে মোটেও সময় নেই। তাই আর দেরি না করে চটপট তৈরি হয়ে নাও।

বাবার কথা শুনে মুখ শুকিয়ে গেল প্রোটিয়াসের। কোনোমতে সে বলল, আগামী কালই আমায় যেতে হবে? কিন্তু কী করে তা সম্ভব? তৈরি হতেও তো কমপক্ষে দুটো দিন সময়ের দরকার।

প্রোটিয়াসকে বাধা দিয়ে বললেন অ্যান্টোনিও, শুধু দুটো কেন, তৈরি হবার জন্য একদিনেরও প্রয়োজন নেই তোমার। আগে তুমি রওনা দেও, তারপর প্রয়োজনীয় সবকিছু পাঠিয়ে দেব তোমায়, এখানে একটি দিনও আর থাকার প্রয়োজন নেই; ওরে প্যানথিনো, ছোটো কত্তার জিনিসপত্র তুই সব গুছিয়ে দে, বলতে বলতে চারককে সাথে নিয়ে অ্যান্টোনিও বেরিয়ে এলেন ছেলের ঘর থেকে।

আক্ষেপ করতে করতে নিজ মনে বলতে লাগিল প্রোটিয়াস, হায় রে! এবার আমার কী হবে? আগুন থেকে বাঁচতে বাপ দিলাম। সাগরে; কিন্তু কপাল মন্দ। শেষে ডুবে মরতে হল। সেই সাগরে। বাবা রেগে যাবেন জুলিয়ার চিঠি দেখলে। তাই চেষ্টা করলাম সেটাকে বন্ধুর চিঠি বলে চালাতে। কিন্তু উলটো ফল হল তাতে। জোর করে বাবা আমায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন সেই বন্ধুর কাছে। ফলস্বরূপ আমায় দূরে চলে যেতে হচ্ছে জুলিয়ার কাছ থেকে। আচমকাই আমার প্রেম ঢাকা পড়ে গেল মেঘের ছায়ায়।

প্রোটিয়াস জানত যে বাবার সিদ্ধান্তের নড়াচড় হবে না। তাই জুলিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিতে সে দেখা করল তার সাথে। তারা উভয়ে হাতে হাত রেখে প্ৰতিজ্ঞা করল, যতদিন পর্যন্ত তারা বেঁচে থাকবে, উভয়ে উভয়কে ভালোবাসবে, একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে। এরপর আংটি বদল হল দুজনের। বিচ্ছেদের মুহূর্তে তারা শপথ নিল যে হাতের আংটি কখনও খুলবে না।

চার

বন্ধুর সম্পর্কে যা খুশি মুখে এল বলে কোনও মতে সেদিনের মতো পরিস্থিতি সামলে দিল প্রোটিয়াস, বাস্তবে কিন্তু সত্যি হয়ে দাঁড়াল তারা সে কথাটাই। দিন যাবার সাথে সাথে মিলানের ডিউকের সুনজরে পড়তে লাগল। তার বন্ধু ভ্যালেন্টাইন। এর পাশাপাশি এমন একটা ব্যাপার ঘটল যা ভাবাই যায় না। — প্রেমে পড়ল ভ্যালেন্টাইন। তার প্রেমিকা যে সে কেউ নয়, খোদ ডিউকের সুন্দরী মেয়ে সিলভিয়া, যে ভ্যালেন্টাইন ভেরোনা থাকাকালীন প্রেম থেকে সর্বদা দূরে থাকত, সেই কিনা মিলানে এসে প্রেমে পড়ে গেল ডিউকের মেয়েকে দেখে। এদিকে সিলভিয়ারও ভালো লেগে গেল স্বাস্থ্যবান সুন্দর তরুণ ভ্যালেন্টাইনকে দেখে। বলাই বাহুল্য, সুন্দরী সিলভিয়ার ডাকে সেদিন সাড়া দিয়েছিল ভ্যালেন্টাইন। এরপর থেকে সবার নজর এড়িয়ে প্রেম করতে লাগল দুজনে। সবসময় নজর রাখতে লাগল সিলভিয়া যাতে ডিউক এ ব্যাপারে কিছু টের না পান। এর একটাই কারণ — ডিউক খুবই ভালোবাসতেন ভ্যালেন্টাইনকে আর প্রায় প্রতিদিনই তাকে প্রাসাদে নিয়ে এসে তার সাথে ডিনার খেতেন। কিন্তু একমাত্র মেয়ে সিলভিয়ার বিয়ে তিনি আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন তার এক তরুণ সভাসদ ঘুরিওর সাথে। ডিউকের সভাসদ হলেও এই থুরিও ছিল মাথামোটা লোক, খুব কমই ছিল তার বুদ্ধিাশুদ্ধি। এ কারণে বাপের পছন্দসই ভাবী পত্রিকে মোটেই পছন্দ করত না সিলভিয়া। থুরিওর সাথে দেখা হলেই সে তার প্রতি অবজ্ঞার ভােব প্রকাশ করত নানা ভাবে।

এরই মধ্যে একদিন প্রোটিয়াস এসে হাজির মিলানে। তার সাথে ডিউকের পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে প্রোটিয়াসের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে এমন সব প্রশস্তি গাইলেন ভ্যালেন্টাইন যা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন ডিউক। তিনি তাকে আমন্ত্রণ করলেন সভায় যাবার জন্য। এরপর ডিউক একদিন ভ্যালেন্টাইন এবং প্রোটিয়াস—উভয়কেই তার প্রাসাদে ডিনারের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।

একদিন বন্ধুর সাথে ডিউকের প্রাসাদে এল প্রোটিয়াস। ডিউকের মেয়ে সিলভিয়ার সাথে সেখানে তার পরিচয় করিয়ে দিলে ভ্যালেন্টাইন। এরই মাঝে একসময় প্রোটিয়াসকে একপাশে সরিয়ে এনে জানতে চাইল তার প্রেমিকা জুলিয়া কেমন আছে। সেই সাথে অকুণ্ঠে স্বীকারও করল। ভ্যালেন্টাইন এযাবত সে যা এড়িয়ে গেছে, সেই প্রেমই তাকে গ্ৰাস করেছে মিলানে আসার পর। সে উপলব্ধি করতে পেরেছে প্রেমের শক্তি কত ব্যাপক। ভ্যালেন্টাইন যে সিলভিয়ার প্রেমে পড়েছে তা মুখ ফুটে স্বীকার না করলেও প্রোমের প্রতি তার এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেখে তা বুঝতে অসুবিধা হল না প্রোটিয়াসের। কিন্তু সিলভিয়ার সাথে পরিচয় হবার পর সম্পূৰ্ণ পালটে গেছে তার মন। মন থেকে জুলিয়াকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় সিলভিয়াকে পেতে উদগ্রাব প্রোটিয়াস। আর প্রোটিয়াস ও এ ব্যাপারে সচেতন যে এ নিয়ে তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হবে বন্ধু ভ্যালেন্টাইনের সাথে।

কথায় কথায় পরদিন সিলভিয়ার সাথে তার প্রেমের কথা প্রোটিয়াসকে খুলে বলল ভ্যালেন্টাইন। সে এও বলল যে ডিউক তার মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন স্যার থুরিও নামে এক সভাসদের সাথে, কিন্তু সিলভিয়ার মোটেই পছন্দ নয় স্যার থুরিওকে।

কিন্তু সিলভিয়া স্যার থুরিওকে পছন্দ না করলেও তাতে কি তোমার কোনও সুবিধা হবে? জানতে চাইল প্রোটিয়াস, ডিউক তো তার মত বদলে তোমার সাথে মেয়ের বিয়ে দেবেন না!

আমি জানি তিনি তা দেবেন না, একটুও দমে না গিয়ে বলল ভ্যালেন্টাইন, বিয়ের ব্যাপারে আমি আর সিলভিয়া, উভয়েই স্থির করে ফেলেছি আমাদের মন।। আজ রাতেই আমরা এখান থেকে পালিয়ে গিয়ে অন্যত্র বিয়ে করব। বলেই ভ্যালেন্টাইন একটা দড়ির সিঁড়ি বের করে দেখাল প্রোটিয়াসকে।

কোন কাজে লাগবে এটা? জানতে চাইল প্রোটিয়াস।

এর জবাবে বলল ভ্যালেন্টাইন, আজি সন্ধের পর ডিউকের প্রাসাদের কোনও এক জানালায় এটা বেঁধে দেব। এ ব্যাপারে সিলভিয়াকে আগেই বলে দেব যাতে সে জানালাকে চিনে রাখে। তারপর রাত বাড়ার সাথে সাথে সবার নজর এড়িয়ে সিলভিয়া এই প্ৰাসাদ থেকে নেমে আসবে। বাইরে তৈরি থাকবে ঘোড়া। সিলভিয়া নেমে এলেই আমরা পালিয়ে যাব ঘোড়ায় চড়ে।

নিজের মনে প্রোটিয়াস বলল, বা! সব কিছুই দেখছি আমার স্বার্থসিদ্ধির পথে এগুচ্ছে। সে স্থির করল সিলভিয়াকে নিয়ে ভ্যালেন্টাইন মিলান ছেড়ে পালিয়ে যাবার পূর্বেই সে ডিউককে তাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেবে। সব শুনে ডিউক হয়তো ভ্যালেন্টাইনকে কঠিন সাজা, এমনকি মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারেন। ভ্যালেন্টাইনের অবর্তমানে সিলভিয়ার সাথে প্রেমের আর কোনও বাধা থাকবে না। তবে একটা বাধা তখনও থাকবে – তা হল স্যার থুরিও। কিন্তু তিনি তো একটা গবেট, মোটা বুদ্ধির লোক। তাছাড়া সিলভিয়াও তাকে দুচোখে দেখতে পারেনা। তাই স্যার থুরিওকে সরিয়ে দিতে তার বেশি সময় লাগবে না। আর দেরি না করে পথের কীটা ভ্যালেন্টাইনকে সরিয়ে দিতে সে দেখা করল ডিউকের সাথে।

পাঁচ

মুখ তুলে তাকিয়ে ডিউক বললেন, আসুন প্রোটিয়াস, এখানে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?

না মহামান্য ডিউক, বলল প্রোটিয়াস, এই অসময়ে আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি একটা বিশেষ কারণে।

নিঃসংকোচে আপনি আপনার প্রয়োজনের কথা বলতে পারেন, বললেন ডিউক।

আমতা আমতা করে প্রোটিয়াস বলল, আজ্ঞে ভ্যালেন্টাইন আমার বাল্যবন্ধু। কিন্তু যে পরিকল্পনা সে করেছে তা আপনার পরিবারের ক্ষতি করতে পারে।

ব্যস্ত হয়ে ডিউক বললেন, তই নাকি? তাহলে খুলেই বলুন ভ্যালেন্টাইনের পরিকল্পনার কথাটা?

ভ্যালেন্টাইনের মুখেই আমি শুনেছি সে আপনার মেয়ে সিলভিয়াকে নিয়ে আজ রাতে পালিয়ে যাবার মতলব এটেছে, বলল প্রোটিয়াস, সন্ধ্যার পর চারিদিক যখন গাঢ় আঁধারে ঢেকে যাবে, ঠিক তখনই রাজপ্রাসাদের একটা জানালা থেকে দড়ির সিঁড়ি ঝুলিয়ে দেবে ভ্যালেন্টাইন। লেডি সিলভিয়া সেই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আসবেন। তারপর এখান থেকে তিনি পালিয়ে যাবেন। ভ্যালেন্টাইনের সাথে। আর ওই দড়ির সিঁড়িটাকে তার আলখাল্লার ভেতরে লুকিয়ে রাখবে। ভ্যালেন্টাইন। আমি সত্যি কথা বলছি কিনা তা ওটা পেলেই আপনি বুঝতে পারবেন।

প্রোটিয়াসের মুখে সবকিছু শুনে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন ডিউক তারপর কিছুক্ষণ বাদে বললেন, সময় মতো কথাটা আমায় জানিয়ে আপনি আমার কী উপকারই যে করলেন তা বলে বোঝাতে পারব না। আপনি বলুন, এর প্রতিদানে আপনি কী পুরস্কার চান? হে মহামান্য ডিউক, বলল প্রোটিয়াস, পুরস্কারের আশায় আমি আপনার কাছে আসিনি। আপনাকে যা বলেছি তা কর্তব্যের খাতিরে বাধ্য হয়েই বলতে হয়েছে। তবে আপনি যখন পুরস্কারের কথা বলছেন, তখন আপনার কাছে চাইবার একটিমাত্র জিনিসই আছে আমার।

ডিউক জানতে চাইলেন, সেটা কি?

হে মহামান্য ডিউক, বলল প্রোটিয়াস, যত অপরাধই সে করে থাকুক ভ্যালেন্টাইন আমার ছেলেবেলার বন্ধু। আপনার কাছে আমার বিশেষ অনুরোধ, এ সব কথা যে আমি বলেছি তা যেন সে জানতে না পারে।

ডিউক বললেন, বেশ, আমি কথা দিচ্ছি ভ্যালেন্টাইনের পরিকল্পনার কথা আমি যে তোমার মুখ থেকে শুনেছি সেটা তার অজানা থেকে যাবে।

আপনি না বললেও আমিই যে এসব কথা বলেছি তা সে ঠিক জানতে পারবে, বলল প্রোটিয়াস, কারণ একমাত্র তিনজন অর্থাৎ ভ্যালেন্টাইন, আমি আর সিলভিয়াই জানি এ পরিকল্পনার কথা। ডিউক তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, মিছিমিছিই। আপনি ভয় পাচ্ছেন প্রোটিয়াস। একবার হাতের মুঠোর মধ্যে ভ্যালেন্টাইনকে পেলে আমি তাকে বাধ্য করাব অপরাধ স্বীকার করতে। তাই সে আপনাকে কোনও মতেই সন্দেহ করতে পারবে না।

বিনীতভাবে প্রোটিয়াস বলল, এবার তাহলে আমি আসি?

আসুন আপনি বলে মুখ টিপে হাসলেন ডিউক, ভ্যালেন্টাইন আসবে সন্ধের পর। তার পূর্বেই তাকে হাতের মুঠোয় পাবার ব্যবস্থা আমায় করে রাখতে হবে। আর এও জেনে রাখুন প্রোটিয়াস, স্যার থুরিওর সাথে বিয়ে না হলে আমি সিলভিয়াকে আটকে রাখব দুর্গের ভেতর

ছয়

প্রোটিয়াস বিদায় নেবার পর ডিউক আর ইচ্ছে করেই অন্য কোথাও গেলেন না। হাতে নাতে ভ্যালেনটাইনকে ধরার জন্য এমন এক জায়গায় বসে রইলেন যেখান থেকে প্রাসাদের সামনের রাস্তাটুকু স্পষ্ট দেখা যায়। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে এল। গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারদিক। এভাবে কিছুক্ষণ সময় কাটাবার পর ডিউক দেখতে পেলেন খুব জোরে পা চালিয়ে প্রাসাদের ফটকের দিকে এগিয়ে আসছে ভ্যালেন্টাইন। তার পা ফেলার মধ্যে যে একটা চাপা অস্থিরতা রয়েছে সেটাও ডিউকের নজর এড়াল না। কাছাকাছি আসতেই তিনি লক্ষ করলেন যে ভ্যালেন্টাইনের পরনের ঢোলা আলখাল্লার একটা দিক কেমন যেন উচু হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা যেন ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। যে দড়ির কথা প্রোটিয়াস বলেছিল, ডিউক আঁচ করলেন সেটাই ওখানে গুজে রেখেছে ভ্যালেন্টাইন।

আরে, ভ্যালেন্টাইন মনে হচ্ছে, জোর গলায় ডাকলেন ডিউক, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে একগাদা জরুরি কাজ যেন এখনই সেরে ফেলতে হবে। আপনি একবার। এদিকে আসন, জরুরি কথা আছে।

ডিউকের গলার আওয়াজ শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল ভালেন্টাইন। পায়ে পায়ে ডিউকের কাছে এসে বলল, আপনি সঠিক অনুমান করেছেন মহামান্য ডিউক। সত্যিই আমার একটা জরুরি কাজ রয়েছে। সেটা সেরেই আমি এখুনি আসছি।

জরুরি কাজ! সেটা কী জানতে পারি? বললেন ডিউক।

আমতা আমতা করে ভ্যালেন্টাইন বলল, আজ্ঞে বন্ধুদের জন্য কয়েকটি চিঠি লিখেছি। প্রাসাদের বাইরে আমার একজন চেনা লোক অপেক্ষা করছে সেগুলি নেবার জন্য।

ও সব পরে হবে, ভ্যালেন্টাইনের দিকে চেয়ে বললেন ডিউক, এমন দিয়ে আমার কথাটা শুনুন। আমি খুবই সমস্যার মধ্যে আছি একটা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে। আমি জানি যে আপনি খুবই বুদ্ধিমান। তাই এ ব্যাপারে সবকিছু আপনাকে খোলাখুলি বলছি। এ বিশ্বাস আমার আছে যে বুদ্ধি বাতলিয়ে আপনি আমায় সাহায্য করতে পারবেন।

ডিউকের কথায় গলে গিয়ে ভ্যালেস্টাইন বলল, আপনি বলুন, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব আপনাকে সাহায্য করার।

ডিউক বললেন, আপনি হয়তো শুনেছেন স্যার থুরিওর সাথে আমার মেয়ে সিলভিয়ার বিয়ের কথা আমি বহুদিন আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, সিলভিয়া কেমন যেন অবাধ্য হয়ে পড়ছে। আমার মনোনীত পাত্র তার মোটেই পছন্দ নয়। তাই আমি স্থির করেছি বুড়ে বয়সে আবার বিয়ে করব। সিলভিয়া যদি তার পছন্দমতো কাউকে বিয়ে করে, তাহলে সে বিয়েতে আমি কোনও যৌতুক দেব না। আর আমার মৃত্যুর পর আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির কানা-কড়িও সিলভিয়া পাবে না।

ভ্যালেন্টাইন ক্ৰমেই অধৈর্য হয়ে উঠছে ডিউকের কথা শুনতে শুনতে। মনে মনে ভাবছে সে, এই বুড়োটা আর কতক্ষণ তাকে এভাবে আটকে রাখবে। কিন্তু মনের ভাব বাইরে প্রকাশ করা চলে না। তাই সে ঘুরিয়ে বলল, মহামান্য ডিউক, আপনার সব কথাই তো শুনলাম। এবার বলুন কীভাবে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি।

মন দিয়ে আগে আমার সব কথা শুনুন ভ্যালেন্টাইন-~~~ তাকে বিশ্বাস করে যেন গোপনীয় কথা বলছেন এভাবে চারদিকে দেখে গলা নামিয়ে বললেন ডিউক, একটি যুবতি মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। মেয়েটি দেখতে সুন্দর, তার স্বভাবও খুব নম্র এবং শান্ত। আমি চাই যে মেয়েটি আমায় প্রেম নিবেদন করুক, অথচ গোল বেধেছে। সেখানেই। আপনারা সবাই এ যুগের তরুণতরুণী। প্রেম নিবেদনের পুরোনো রীতি এখন বাতিল। কী ভাবে তাকে প্রেম নিবেদন করা যায় তা আমি আপনার কাছ থেকে শিখতে চাই। এখন আপনি বলুন। এ ব্যাপারে কী ভাবে আমায় সাহায্য করতে পাবেন।

ভ্যালেন্টাইন বললেন, এ কালের যুবকেরা মাঝে মাঝে তাদের প্রেমিকদের সাথে দেখা করে, নানারূপ শৌখিন জিনিস উপহার দেয়। তাদের। প্ৰেমপত্র লিখে গোপনে তা পাঠিয়ে দেয়। কারও হাত দিয়ে। নামি রেস্তোরায় নিয়ে গিয়ে ভালো ভালো খাবার খাওয়ায়। তারা এ ভাবেই জয় করে প্রেমিকদের মন।

যে মেয়েটিকে আমি পছন্দ কয়েছি বললেন ডিউক, একটি শৌখিন উপহারও আমি তাকে পাঠিয়েছিলাম। সেটা সে গ্রহণ করেনি, ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। মেয়েটির উপর তার বাবা-মার কড়া নজর। তা এড়িয়ে দিনের বেলা কেউ তার কাছে যেতে পারে না, আর মেয়েটিও পারে না বাড়ি থেকে বের হতে। এখন বলুন, কীভাবে তার সাথে দেখা হবে?

ভ্যালেন্টাইন বলল, দিনের বেলা দেখা না হলে রাতে তার সাথে দেখা করবেন।

আপনি বলছেন রাতের বেলা তার সাথে দেখা করতে, ভুরু কুঁচকে বললেন ডিউক, কিন্তু রাতের বেলা তো তার বাড়ির দরজা বন্ধ থাকে। তাহলে কীভাবে তার দেখা পাব?

দরজা যদি বন্ধই থাকে, তাহলে কি আর বাড়ির ভেতর ঢোকা যায় না? পরিণতির কথা না ভেবেই মুখ ফসকে বলে ওঠে ভ্যালেন্টাইন।

কিন্তু কীভাবে ঢোকা যাবে? জানতে চাইলেন ডিউক।

কেন! দড়ির তৈরি সিঁড়ি বেয়ে, জবাব দিল ভ্যালেন্টাইন, আপনি চাইলে ওরূপ একটা সিঁড়ি আমিই এনে দেব আপনাকে। আমার মতো। আপনিও একটা আলখাল্লা পরবেন। সিঁড়িটা ভাঁজ করে আলখাল্লার ভেতর গুজে নেবেন। তাহলেই আর কেউ টের পাবে না বাইরে থেকে। তারপর আপনি সহজেই আটকে দেবেন। সেই সিঁড়িটা প্রাসাদের কোনও খোলা জানালায়। আর ওই সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে ঢুকে যাবেন বাড়ির ভেতরে। তবে তার আগে আপনাকে জানতে হবে পছন্দের মেয়েটি কোন ঘরে থাকে। আমার মনে হয় বাড়ির কাজের লোকদের দরাজ হাতে বিকশিশ দিলেই আগেভাগে তারা আপনাকে সেটা জানিয়ে দেবে।

ভ্যালেন্টাইনের কথা শেষ না হতেই বলে উঠলেন ডিউক, সাবাস, বেশ ভালো বুদ্ধি দিয়েছেন তো! দয়া করে এবার আর একটু উপকার করুন। আজ রাতের জন্য আপনারা ঢোলা আলখাল্লাটা ধার দিন আমায়।

ভ্যালেন্টাইন তখনও আঁচ করতে পারেনি। ডিউকের আসল মতলবটা। তাই সেইতস্তত করতে লাগল আলখাল্লাটা গা থেকে খুলে দিতে। কিন্তু ডিউকের আর তাঁর সইছে না। একরকম জোর করেই তিনি আলখাল্লাটা খুলে নিলেন তার গা থেকে। সেটা কেড়ে নিয়ে ভেতরে হাত ঢুকোতেই হাতে এল দড়ির সিড়ি আর ভঁাজ করা একটা কাগজ। ওগুলো বের করে ভ্যালেন্টাইনের সামনেই খুলে ফেললেন তিনি। দেখা গেল জিনিস দুটির মধ্যে একটি ভাজ করা দড়ির সিঁড়ি, অপরটি তার মেয়ে সিলভিয়াকে লেখা একটি চিঠি। সে চিঠির নীচে সই রয়েছে ভ্যালেন্টাইনের। চিঠিটা খুঁটিয়ে পড়লেন ডিউক। দেখলেন তাতে লেখা রয়েছে কীভাবে ভ্যালেন্টাইন সিলভিয়াকে নিয়ে মিলান থেকে পালিয়ে যাবে তার বিস্তারিত পরিকল্পনা।

চিঠিখানা পড়ে বেজায় রেগে গেলেন ডিউক। গালাগালি দিতে লাগলেন ভ্যালেন্টাইনকে, নচ্ছার! বেইমান! আমার কাছ থেকে এত উপকার এবং অনুগ্রহ পাবার পর শেষে কিনা এই প্রতিদান? এই মুহুর্তে আমি বিতাড়িত করছি আপনাকে আর সেই সাথে নির্বাসন দণ্ডও দিলাম। ভালো করে মন দিয়ে শুনুন ভ্যালেন্টাইন, এই মুহূর্তে মিলান ছেড়ে যেখানে খুশি আপনি চলে যাবেন। কাল সকলে এই শহরে আপনাকে দেখা গেলে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হবেন আপনি।

ডিউকের দেওয়া নির্বাসন দণ্ড মাথায় নিয়ে ভ্যালেন্টাইন বাধ্য হলেন সে-রাতে মিলান ছেড়ে চলে যেতে। যাবার পূর্বে সিলভিয়ার সাথে দেখা করার সুযোগটুকুও পেলেন না তিনি।

সাত

ওদিকে প্রোটিয়াসের প্রেমিকা জুলিয়া মনখারাপ করে বসে আছে ভেরোনায়। মনখারাপ হবারই কথা, কারণ বহুদিন ধরে তার কোন ও যোগাযোগ নেই প্রোটিয়াসের সাথে। প্রোটিয়াস কথা দিয়েছিল যে মিলানে গিয়ে নিয়মিত চিঠি-পত্র দেবে তাকে। অথচ আজ পর্যন্ত সে একটিও চিঠি লেখেনি। এ সব দুঃখের কথা পরিচারিকা লুসেট্টার কাছে বলে মনকে হালকা করছে জুলিয়া। লুসেট্টার বহু সাস্তুনা সত্ত্বেও মনের ক্ষোভ বেড়ে গেল জুলিয়ার। সে বলল লুসেট্টাকে, যতই তুই আমায় বােঝাবার চেষ্টা করিস না কেন, আমি কিন্তু ভুলছি না ত্রে ও সব ছেদাে কথায়। আমি তোকে বলে রাখছি, এত দূরে বসে তার পথ চেয়ে দিন গোনা আর আমার পোষাবে না। যেভাবেই হোক, এবার আমায় প্রোটিয়াসের কাছে মিলানে যেতে হবে। এটাই আমার শেষ কথা। যদি পরিস তো মাথা খাটিয়ে বের করা কীভাবে সেখানে যাওয়া যায়।

আমি বেশ বুঝতে পারছি তোমার মানসিক অবস্থা, কিন্তু ভেবেছ কি, সেখানে কী করে যাবে? বলল লুসেট্টা।

জুলিয়া বলল, ভেবে দেখলাম মেয়েমানুষ নয়, পুরুষের বেশে গেলে কারও কুনজর আমার উপর পড়বে না। এমনভাবে তুই আমায় সাজিয়ে দেয়াতে সবাই ভাবে আমি কোনও ধনী লোকের বাড়ির চাকর, খুঁজতে বেরিয়েছি নিজের মনিবকে।

কিন্তু ছেলে সাজতে হলে তো মাথার সব চুল আগে কেটে ফেলতে হবে, বলল লুসেট্টা। না, আমি চুল কাটব না, বলল জুলিয়া, এমনভাবে তুই আমার লম্বা চুলগুলি বেঁধে দিবি যাতে সবাই মনে ভাবে পুরুষ হয়েও আমি মেয়েদের মতো চুল রেখেছি।

লুসেট্টা বলল, বেশ, তাই দেব। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তোমার মনস্কামনা পূৰ্ণ হোক।

তাহলে আর দেরি না করে সাজিয়ে দে আমায়, বলল জুলিয়া, যাবার পূর্বে আমি আমার জিনিসপত্র, বিষয়-সম্পত্তি সবকিছু দেখাশোনার সব কিছু দায়িত্ব দিলাম তোকে। এখানকার খবরাখবর জানিয়ে মাঝে মাঝে তুই আমায় চিঠি দিস।

মিলান শহরের সীমান্তের কাছেই ম্যান্টুয়া। কোথায় যাবে ভেবে না পেয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ম্যান্টুয়ায় ঢুকে পড়ে নির্বাসিত ভ্যালেন্টাইন। ঢোকার সাথে সাথেই তাকে ঘিরে ধরে একদল ডাকত। তারা বলল, যদি প্ৰাণে বাঁচতে চাস, তাহলে সাথে যে টাকাকড়ি আছে তা ভালোয় ভালোয় দিয়ে দে।

অসহায়ভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল ভ্যালেন্টাইন, আমার নির্বাসন দণ্ড দিয়েছিলেন মিলানের ডিউক। কোনও টাকা-কড়ি নেই আমার কাছে।

ডাকাতদের একজন জানতে চাইল, তুমি কি ভেবেছ কোথায় যাবে?

ভাবছি ভেরোনায় যাব, উত্তর দিল ভ্যালেন্টাইন।

আর একজন ডাকাত জানতে চাইল, মিলানে তুমি কতদিন ছিলে?

মনে মনে হিসাব করে ভ্যালেন্টাইন বলল, তা কমদিন নয়, পুরো যোলো মাস। হয়তো আরও কিছুদিন থাকতাম, যদি কপাল খারাপ না হত।

প্রথম ডাকাত জানতে চাইল, তুমি কী এমন করেছিলে যার জন্য ডিউক তোমায় নির্বাসনে পাঠাল?

আমি একজনকে খুন করেছিলাম, ইচ্ছে করেই মিথ্যে কথাটা বলল ভ্যালেন্টাইন, মারপিট করতে করতে এমন বেধড়ক মারা তাকে দিয়েছি যে সে মরেই গেল। নির্বাসনের জন্য আমার কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু মৃত লোকটার মুখ যখন আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তখনই যেন মুষড়ে পড়ে আমার মনটা। বারবার মনে হয় কাজটা ঠিক হয়নি। আমি মহাপাপ করেছি। ওকে খুন করে!

যা ঘটে গেছে তার জন্য মিছামিছিমিন খারাপ কোরো না, বলল ডাকাতদের একজন, যদিও আমরা ডাকাত কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের অনেকেই ভদ্রঘরের ছেলে। আমিও ভেরোনা থেকে নির্বাসিত হয়েছি। ভদ্রঘরের এক যুবতির টাকা-পয়সা চুরির দায়ে।

আর এক ডাকাত বলল, আর আমিও ম্যান্টুয়া থেকে নির্বাসিত হয়েছি মানুষ খুনের দায়ে।

তুমিও যখন অপরাধ করে মিলান থেকে নির্বাসিত হয়েছ, তখন আর তোমাকে আমাদের একজন বলে ভাবতে বাধা নেই, বলল প্রথম ডাকাত, তুমি দেখতে ভালো, চমৎকার স্বাস্ত। আর কথাবার্তাও বেশ ভালো। কোনও সন্দেহ নেই যে তুমি বেশ বুদ্ধিমান আর ঠান্ডা মাথার লোক, তুমি আজ থেকে আমাদের সাথে থাকবে। তুমিই হবে আমাদের দলের সর্দার। তুমি যা বলবে আমরা তাই মেনে নেব। আমার এ প্রস্তাবে রাজি হলে ভালো, নইলে এক্ষুনি মেরে ফেলব তোমায়।

তোমার প্রস্তাবে আমি রাজি আছি তবে একটা শর্ত আছে আমার, বলল ভ্যালেন্টাইন, যদি তোমরা কথা দাও যে আমার শর্ত মেনে চলবে, তাহলে আমার আপত্তি নেই তোমাদের সর্দার হতো।।

ডাকাতরা জানতে চাইল, কী শর্ত?

সরল অসহায় গরিব লোক আর মেয়েদের উপর কোনও অত্যাচার করা চলবে না। টাকাকড়ি কেড়ে নেবার জন্য তাদের উপর কোনও অত্যাচার করতে পারবে না। এই আমার শর্ত বলল ভ্যালেন্টাইন।

ডাকাতরা সমবেতভাবে জোর গলায় বলে উঠল, আমরা কথা দিচ্ছি। তোমার শর্ত মেনে নেব।

তাহলে আমার আর আপত্তি নেই তোমাদের সর্দার হতে, বলে ওঠে। ভ্যালেন্টাইন।

আট

যে কারণে ভ্যালেন্টাইনকে নির্বাসন দণ্ড দিয়েছেন। ডিউক, তাতে প্রোটিয়াসের চেয়েও বেশি। খুশি হয়েছেন স্যার থুরিও, কারণ তার সাথে মেয়ে সিলভিয়ার বিয়ে ঠিক করেছেন। ডিউক। যেহেতু পথের কীটা দূর হয়েছে তাই ডিউকও খুব খুশি। আসলে কিন্তু ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে অন্যরকম। মিলান থেকে ভ্যালেন্টাইন নির্বাসিত হবার পর থেকেই সিলভিয়ার বিষনজরে পড়েছেন স্যার থুরিও। তাকে দেখতে পেলেই রেগে আগুন হয়ে উঠছে সিলভিয়া। এরই মাঝে কয়েকবার মেরে দীত ভেঙে দেব বলে স্যার থুরিওর দিকে তেড়ে গিয়েছিল সিলভিয়া। তবে সময়মতো ডিউক এসে পড়ায় সে যাত্রা বেঁচে যান তিনি। সিলভিয়া ধরেই নিয়েছে স্যার থুরিওর চক্রান্তেই নির্বাসনে যেতে হয়েছে ভ্যালেন্টাইনকে। তাই স্যার থুরিও যখন তখন ডিউকের কানের কাছে প্যান প্যান করে বলছেন যে ভ্যালেন্টাইনের নির্বাসনে কোনও লাভই হয়নি তার। আগের মতোই তার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে সিলভিয়া।

শুনে মুখ টিপে হেসে বললেন ডিউক, অত হতাশ হলে কী চলবে স্যার থুরিও! প্রেমিকের স্মৃতি অনেকটা বরফের পুতুলের মতো। আঁচ পেলেই গলে যায়। ধৈর্য ধরে একদিন চেষ্টা কর সিলভিয়ার মন জয় করার। তা হলেই দেখবে ভ্যালেন্টাইনের স্মৃতিটা উবে গেছে তার মন থেকে। ডিউক তার কথা শেষ করতেই সেখানে এসে হাজির প্রোটিয়াস। তাকে দেখে বললেন ডিউক, প্রোটিয়াস, এ তো বেশ মুশকিলের ব্যাপার হল। সিলভিয়া কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। ভ্যালেন্টাইনের নির্বাসনের ব্যাপারটা। মুখ কালো করে একা একা বসে দিনরাত শুধু চোখের জল ফেলে – স্যার থুরিওকে দেখতে পেলেই তেড়ে মারতে আসে, যা তা গালিগালাজ করে। কে জানে এভাবে চললে শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? বুঝলে প্রোটিয়াস, আমার একমাত্র ইচ্ছে যে তোমার বন্ধু ওই নচ্ছার, পাঁজি ভ্যালেন্টাইনকে ভুলে গিয়ে সিলভিয়া তার মনপ্রাণ সঁপে দিক স্যার থুরিওকে।

সব শুনে প্রোটিয়াস বলল, এ আর এমন কি কঠিন কাজ মহামান্য ডিউক? সুযোগ পেলেই সিলভিয়ার কনের কাছে বলতে হবে – ভ্যালেন্টাইন একটা ঠগ, জোচোর, মিথ্যেবাদী, কাপুরুষ। কানের কাছে সৰ্ব্বদা এমন শুনতে শুনতে ভ্যালেন্টাইন সম্পর্কে সত্যি সত্যিই সিলভিয়ার মনে গড়ে উঠবে সেরূপ একটি ধারণা।

প্রোটিয়াসের কথা শুনে বললেন ডিউক, তোমার সাথে আমি একমত। এ ব্যাপারে। কিন্তু যে ভ্যালেন্টাইনকে সিলভিয়া সত্যিই ভালোবাসে, তাকে গালিগালাজ দেওয়ার ব্যাপারটা কে সামলাবে? তুমি নিজে কি রাজি আছ একাজ করতে?

নির্বাসিত হলেও একসময় ভ্যালেন্টাইন ছিল আমার প্রিয় বন্ধু, বলল প্রোটিয়াস, আর যাই হোক, বিবেকহীন না হলে তার সম্পর্কে এরূপ গালিগালাজ করা কারও পক্ষে সম্ভবপর নয়। সেই সাথে আপনি আদেশ দিলে আমার পক্ষে তা অমান্য করা অনুচিত। আর আপনি এও মনে রাখবেন মনে থেকে ভ্যালেন্টাইনের স্মৃতি মুছে গেলেও সিলভিয়া যে সত্যিই স্যার থুরিওকে ভালোবাসবেন, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

এবার আগ বাড়িয়ে বললেন অতি উৎসাহী স্যার থুরিও, সেক্ষেত্রে আমি আপনাকে একটা বাস্তব ব্যবস্থা দেখাতে পারি। একই সাথে যদি আপনি ভ্যালেন্টাইনের নিন্দা আর আমার প্রশংসা করেন, যদি আপনি সুখ্যাতি করে বলেন যে আমার মতো প্রেমিক মিলানের ভেতরে-বাইরে কোথাও পাওয়া যাবে না, তাহলে কাজ হবার সম্ভাবনা আছে।

তোমার উপর আমার ভরসা আছে প্রোটিয়াস, বললেন ডিউক, ভ্যালেন্টাইন বলেছিল যে তোমার প্রেমিকা আছে- সে ক্ষেত্রে তুমি নিশ্চিন্তে কথা বলতে পার আমার মেয়ের সাথে। স্যার থুরিওকে গালিগালাজ না করে মানসিক দিক দিয়ে সিলভিয়া যাতে তাকে বিয়ে করতে তৈরি হয়। সে কথা বোঝাতে পার তাকে। আর তুমি এটা করতে পারলে স্যার থুরিও সহজেই সিলভিয়াকে আকৃষ্ট করতে পারবেন তার নিজের দিকে।

প্রোটিয়াস ডিউকে বললেন, আমি কথা দিচ্ছি, সাধ্যমতো চেষ্টা করব। স্থির করেছি আজ। রাতে একদল গাইয়ে -বাজিয়ে নিয়ে আপনার প্রাসাদে যাব। আপনার মেয়ে সিলভিয়া যে ঘরে থাকে, তার জানালার ঠিক নীচে বাগানে দাঁড়িয়ে তারা নাচ-গান করবে। আর ওই ফাকে আমি জোর গলায় প্রশংসা করে যাব স্যার থুরিওর। তবে আমি একলা হলে কিন্তু হবে না, স্যার থুরিওকে থাকতে হবে আমার সাথে। এই ওষুধে কাজ হয় কিনা তা দেখা যাক।

এদিকে সত্যি সত্যিই পুরুষের ছদ্মবেশে মিলানে এসে গেছে জুলিয়া, আশ্রয় নিয়েছে এক ভদ্রগোছের সরাইয়ে। সরাইয়ের খাতায় সে নিজের নাম লিখেছে সেবাস্টিয়ান। জুলিয়াকে দেখে আর তার কথা-বার্তা শুনে সরাইয়ের মালিক তাকে ভদ্র, সম্রাস্ত পরিবারের সন্তান ৰূলেই ধরে নিয়েছে। সরাইয়ের মালিক ভালো লোক। তার নতুন খদের সেবাস্টিয়ান মনমরা হয়ে দিনরাত ঘরে বসে আছে দেখে সে ধরে নিল হয়তো কোনও কারণে মনে আঘাত পেয়েছে। সিলভিয়ার মন ভালো করার জন্য ডিউকের প্রাসাদে প্রোটিয়াস যে নাচ-গানের আয়োজন করেছে, তার খবর জানতে পেরেছে সরাইয়ের মালিকও। সেদিন সকালে সেবাস্টিয়ান রূপী জুলিয়াকে সে বলল, আজি সন্ধেয় আমি আপনাকে নিয়ে যাব ডিউকের প্রাসাদে। ডিউকের মেয়ের মন ভালো করার জন্য সেখানে গান-বাজনার আয়োজন করেছেন তার প্রেমিক প্রোটিয়াস। সেখানে প্রেমিকার জানালার নিচে দাঁড়িয়ে গান গাইবেন প্রোটিয়াস। আপনি খুব আনন্দ পাবেন সেখানে গেলে।

প্রোটিয়াস! তার প্ৰেমিক! সে কিনা আসবে ডিউকের মেয়েকে গান শোনাতে? তাহলে সেই হয়েছে প্রোটিয়াসের নতুন প্রেমিক? আসলে হঠাৎ করে পুরুষের ছদ্মবেশে এতদূর আসাটা ঠিক হয়েছে কিনা, সেটাই ভাবচ্ছিল জুলিয়াকে। কিন্তু সরাই মালিকের মুখে ডিউকের মেয়ের প্রেমিকের নাম প্রোটিয়াস শুনেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল জুলিয়া। সে ঠিক করল সন্ধের পর নিজে ডিউকের বাগানে গিয়ে দেখবে প্রোটিয়াস তার নতুন প্রেমিকাকে কী গান শোনায়, কী ব্যবহার করে তার সাথে — এসব কিছুই নিজের চোখে দেখবে সে।

নয়

এক অল্পবয়সি ছোকরার ছদ্মবেশে সাহসে ভর করে জুলিয়া এসে হাজির ডিউকের প্রাসাদে। কৌশালে ডিউকের মেয়ে সিলভিয়ার সাথে দেখা করে তার সাথে ভাব জমাল। সে বলল তার নাম সেবাস্টিয়ান। গ্রাম থেকে সুদূর মিলানে সে এসেছে কাজের খোজে। সে কথায় কথায় সিলভিয়াকে জানাল যে প্রোটিয়াসের অপেক্ষায় রয়েছে তার প্রেমিকা জুলিয়া। একেই সিলভিয়া জেনেছিল যে ভ্যালেন্টাইনের নির্বাসনের মূলে রয়েছে প্রোটিয়াস, এবার তার প্রেমিকার কথা শুনে সে বেজায় রেগে গেল প্রোটিয়াসের উপর। কিছুক্ষণ বাদে ডিউকের প্রাসাদে এল প্রোটিয়াস। সিলভিয়ার ঘরের খোলা জানোলা দেখে তার মনে পড়ে গেল বন্ধু ভ্যালেন্টাইনের কথা।

নিজের মনেই বলল প্রোটিয়াস, আমি আমার পুরোনো বন্ধু ভ্যালেন্টাইনের সাথে বেইমানি করেছি। সিলভিয়াকে পাবার আশায়। ডিউক তাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন শুধু আমারই জন্য। এবার আমি চেষ্টা করছি সিলভিয়ার কাছ থেকে থোরিওকে সরিয়ে দেবার। আমি যখন সিলভিয়ার ংসা করি, তখন তা অসহ্য লাগে থুরিওর। তাই সে আমায় গালি দেয় খুচরো প্রেমের কারবারি বলে। সে এও বলে আমি নাকি জুলিয়ার প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। কিন্তু থুরিও এখনও আমায় চিনতে পারেনি। এত সব কাণ্ড ঘটে যাবার পরও সিলভিয়াকে পাবার লক্ষ্য থেকে সরে আসতে আমি রাজি নই। আমার জেদের সাথে তুলনা চলে শুধু স্প্যানিয়েল কুকুরের। এবার দেখা যাক ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়?

সন্ধে হবার কিছুক্ষণ বাদে থুরিও এসে হাজির সেখানে। প্রোটিয়াসকে দেখে সে অবাক হয়ে বলল, আরো স্যার প্রোটিয়াস, আপনি তো দেখছি আগে-ভাগেই হাজির?

কেন, আগে আসতে আমার কি কোনও নিষেধ আছে স্যার থুরিও? বলল প্রোটিয়াস, ভালোবাসা জিনিসটা কি আপনার একচেটিয়া না তাতে অন্য কারও অধিকার আছে?

হেসে স্যার থুরিও বললেন, ভালোবাসা? আপনি কাকে ভালোবাসেন বলছেন, সিলভিয়াকে?

অবশ্যই আমি তাকে ভালোবাসি, উত্তর দিলে প্রোটিয়াস।

বড়োই সুসংবাদ দিলেন মশাই, বললেন থুরিও, এবার তাহলে শুরু করা যাক গান-বাজনা। আশা করি তাতে আপনার আপত্তি নেই।

স্যার থুরিওর কথা শেষ হবার সাথে সাথেই সিলভিয়ার জানালার নিচে উপস্থিত শিল্পীরা হইচই করে বাজনা বাজিয়ে নাচতে-গাইতে শুরু করে দিল। তাদের সাথে প্রোটিয়াস নিজেও গাইতে লাগল।

খোলা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সিলভিয়া বলল, কে চোঁচাচ্ছে?

এবার নতজানু হয়ে সিলভিয়াকে অভিবাদন জানিয়ে বলল প্রোটিয়াস, হে আমার প্রিয়া! শুভ সন্ধ্যা।

গলাটা যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে, বলল সিলভিয়া, কথাটা কে বলল?

এভাবে শুধু একজনই তো তার হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করতে পারে বলল প্রোটিয়াস, শীঘ্রই তাকে চিনতে পারবে তার কথা শুনে।

ওহো স্যার প্রোটিয়াস, আপনি! ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল সিলভিয়া, তাই বলুন।

হ্যাঁ, আমিই সে প্রোটিয়াস, তোমার ভৃত্য এবং একনিষ্ঠ সেবক।

সে তো বুঝতে পারছি। অধৈর্যের সুর সিলভিয়ার গলায়, পুরোনো বন্ধুকে নির্বাসনে পাঠিয়েও আপনার সাধ মেটেনি? আর কী চান আপনি?

হে আমার প্ৰেয়সী সিলভিয়া! গদগদ স্বরে বলে ওঠে প্রোটিয়াস, আমি কী চাই তাও তোমায় বলে দিতে হবে? হৃদয়ের ভাষা শুনেও তুমি কি বুঝতে পারছি না আমি কী চাই?

থামুন মিথ্যেবাদী, বেইমান, ঠগ কোথাকার, গলা চড়িয়ে প্রোটিয়াসকে ধমকে দিল সিলভিয়া, নিজের প্রেমিককে ভুলে গিয়ে আমার জন্য গান গাইতে আপনার লজ্জা করছে না? যান, বাড়ি গিয়ে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ুন। শুয়ে শুয়ে প্রেমিকার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ুন। ভবিষ্যতে আর কখনও আমায় পাবার জন্য এরূপ তোষামোদ করবেন না। আর তা করলেও আপনার কোনও লাভ হবে না।

প্ৰেয়সী, তুমি ঠিকই বলেছ, গালাগালি খেয়ে একটুও দমে না গিয়ে বলল প্রোটিয়াস, আমি সত্যিই ভালোবাসতোম একটি মেয়েকে। কিন্তু অল্প কিছুদিন হল সে মারা গেছে।

মিথ্যেবাদী! বলেই জানালার আড়ালে দাঁড়ানো পুরুষবেশী জুলিয়া সামলে নিলে নিজেকে। হায়! সবার সামনে এই মূহূর্তে যদি আমার আসল পরিচয়টা প্রকাশ করতে পারতাম! বলেই সে আক্ষেপ করে নিজের মনে। গলা নামিয়ে সে সিলভিয়াকে লক্ষ্য করে বলল, লেডি সিলভিয়া! উনি মিথ্যে কথা বলছেন। সার প্রোটিয়াসের প্রেমিকা আজও জীবিত।

চেঁচিয়ে বলে উঠল সিলভিয়া, স্যার প্রোটিয়াস, আপনি মিথ্যে কথা বলছেন। আপনার প্রেমিকা যে আজও জীবিত তা আমার অজানা নেই। আর সেই ভ্যালেন্টাইনের বাগদত্ত আমি, তাকে দেশ ছাড়া হতে হয়েছে আপনারই জন্য। ভ্যালেন্টাইনকে আমি কথা দিয়েছিলাম যে বিয়ে করব। সেই ভ্যালেন্টাইন। কিন্তু আজও জীবিত; তাই এ অবস্থায় যে প্ৰেম আপনি আমায় নিবেদন করছেন তা শুধু অন্যায় নয়, অবৈধও বটে।

ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল সিলভিয়া, বাঃ সার প্রোটিয়াস, প্রথমে আপনার বন্ধু তারপর প্রেমিক, কত সহজেই না। আপনি দুজনকে মৃত বলে চালিয়ে দিলেন; এরপর হয়তো আপনি বলবেন সিলভিয়াও মারা গেছে। আর এও জেনে রাখুন। স্যার প্রোটিয়াস, সত্যিই যদি ভ্যালেন্টাইন মারা গিয়ে থাকে, তাহলে তার প্রতি আমার প্রেম, ভালোবাসা- সবই আমি তার কবরে সমাধিস্থ করব?

তেমন পরিস্থিতি হলে তোমার সে প্ৰেম আমি ভ্যালেন্টাইনের কবর খুলে বের করে আন ব, বলল প্রোটিয়াস।

স্যার প্রোটিয়াস, আমার প্রেম খুবই পবিত্র, বলল সিলভিয়া, ভুলেও আপনি তা তুলে আনার চেষ্টা করবেন না। এই তো খানিক আগে বললেন যে আপনার প্রেমিক মারা গেছে। তাহলে কবর খুঁড়েই না হয় আপনার পুরোনো প্রেমটা বের করে আনবেন।

আক্ষেপ করে বলল প্রোটিয়াস, হায় প্ৰেয়সী! তুমি কি কখনও সদয় হবে না। আমার প্রতি? তাহলে তোমার একটা ছবিই দাও আমাকে। না হয় তোমার পরিবর্তে সেই ছবিকেই আমি ভালোবাসব।

জানালার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা জুলিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রোটিয়াসের কথা শুনে।

সিলভিয়া সত্যি সত্যিই ভারি মুশকিলে পড়েছে। একদিকে সে জানতে পেরেছে মিলান থেকে নির্বাসিত হয়ে তার প্রেমিক দিন কাটাচ্ছে ম্যান্টুয়ার জঙ্গলে, ভেতরে ভেতরে সে অস্থির হয়ে উঠেছে তার কাছে যাবার জন্য। অন্য দিকে স্যার থুরিওর সাথে বিয়ে দেবার জন্য তার বাবা যে ভাবে উঠে পড়ে লেগেছেন, তার জন্যও এক দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে সে। সে স্থির করল। এ দুঃসহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে একদিন সবার অজান্তে বাড়ি থেকে পালিয়ে সে চলে যাবে ম্যান্টুয়ার জঙ্গলে ভ্যালেন্টাইনের কাছে। কিন্তু ম্যান্টুয়া বহুদূরের পথ। তার মতো একজন যুবতির পক্ষে এতদূর পথ পাড়ি দেওয়ার ঝুকি প্রচুর। তাই সে গোপনে বাবার এক বৃদ্ধ কর্মচারী এগলামুরকে অনুরোধ করল যেন সে তাকে সেখানে পৌঁছে দেয়। সিলভিয়াকে খুবই স্নেহ করতেন এগলামুর। তাই তিনি এড়িয়ে যেতে পারলেন না সিলভিয়ার অনুরোধ। সন্ধের অন্ধকার গাঢ় হবার পর সিলভিয়া এগালামুরকে বললেন প্রাসাদ থেকে কিছুটা দূরে সাধু প্যাট্রিকের মঠে থাকতে — কিছুক্ষণ বাদে তিনি সেখানে এসে তার সাথে মিলিত হবেন। তারপর দুজনে বেরিয়ে পড়বেন। ম্যান্টুয়ার পথে।

দশ

পরদিন সকালে সত্যিই প্রোটিয়াস এসে হাজির ডিউকের প্রাসাদে, উদ্দেশ্য সিলভিয়ার ছবি নেওয়া। প্রাসাদে ঢোকার মুখে তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন অল্পবয়সি একটি ছেলেকে দেখে। ছেলেটির সুন্দর মুখ আর সরল চাওনি দেখে ছেলেটির প্রতি মায়া হল প্রোটিয়াসের। নাম জিজ্ঞেস করায় ছেলেটি বলল তার নাম সেবাস্টিয়ান। গ্রাম থেকে কাজের খোজে। সে এসেছে মিলানে। অল্প কদিন হল প্রোটিয়াসের কাজের লোকটা পালিয়ে গেছে। তাই সে ওকে বহাল করল সেই পদে। সুস্তির নিশ্বাস ফেলল। জুলিয়া, কারণ প্রোটিয়াস তাকে চিনতে পারেনি। ছেলেটি কাজের কিনা তা পরীক্ষা করতে তার আঙুল থেকে একটি আংটি খুলে ছেলেটিকে দিয়ে বলল প্রোটিয়াস, এবার মন দিয়ে শোনা। এই যে আংটিটা দেখছ এটা আমার প্রাক্তন প্রেমিক দিয়েছিল আমায়। এটা নিয়ে চলে যাও ডিউকের মেয়ে লেডি সিলভিয়ার কাছে। তাকে বলবে স্যার প্রোটিয়াস এটা দিয়েছেন। তাকে। আংটিটিা দেবার পর তার একটা ছবি চেয়ে নিয়ে আসবে।

জুলিয়ার জানা ছিল না যে কোনও পুরুষ তার প্রেমিকার সাথে এরূপ বেইমানি করতে পারে। প্রোটিয়াসের দেওয়া আংটিটা হাতে নিয়ে জুলিয়া মনে মনে বলল, আমার দেওয়া আংটিটা আমারই হাতে দিয়ে পাঠাচ্ছে আর একটি মেয়ের মন জয় করতে। কিছু না বলে সে আংটিটা নিয়ে এসে সিলভিয়াকে দিয়ে বলল, এই আংটিটিা আমার মনিব স্যার প্রোটিয়াসকে দিয়েছিল তার প্রাক্তন প্রেমিকা। এটা তিনি আপনার জন্য পাঠিয়েছেন। আপনার একটা ছবি চেয়েছেন তিনি।

প্রাক্তন প্রেমিকার আংটি? হেসে বলল সিলভিয়া, স্যার প্রোটিয়াসের কি লজ্জা-সরাম বলে কিছু নেই যে তার প্রেমিকার আংটি পাঠিয়েছেন আমার মন জয় করতে? ছিঃ! ছি:! স্যার প্রোটিয়াস। এবার মুখ তুলে বলল সিলভিয়া, এ আংটি আমি নিতে পারব না। এটা নিলে অসম্মান করা হবে স্যার প্রোটিয়াসের প্রেমিকাকে।

সেবাস্টিয়ানরূপী জুলিয়া বলল, আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি স্যার প্রোটিয়াসের প্রেমিকা জুলিয়ার হয়ে। কারণ একটি মেয়েই শুধু পারে অন্য মেয়ের সম্মান রক্ষা করতে।

সিলভিয়া জানতে চাইল, তুমি কি চেনো জুলিয়াকে?

নিশ্চয়ই চিনি, বলল জুলিয়া, যেমন সুন্দর তাকে দেখতে, তেমনি মধুর তার স্বভাব। সত্যিই এটা আশ্চর্যের বিষয়। এক সময় স্যার প্রোটিয়াস সত্যি সত্যিই ভালোবাসতেন জুলিয়াকে, গর্ববোধ করতেন তার জন্য। কিন্তু কে জানত জুলিয়ার ভাগ্য এত খারাপ হবে? এটুকু বলেই সে সিলভিয়ার কাছ থেকে চলে এল। এবার সে নিশ্চিত যে সিলভিয়া মোটেও ভালোবাসে না প্রোটিয়াসকে।

সে দিন রাতে প্ৰসাদ থেকে পালিয়ে সাধু প্যাট্রিকের মঠে হাজির হল সিলভিয়া। আগে থেকেই এগলামোর সেখানে অপেক্ষা করছিলেন তার জন্য। এবার সিলভিয়ার ইচ্ছানুযায়ী তিনি তার সাথে রওনা হলেন ম্যান্টুয়ার পথে। এদিকে সিলভিয়া যে এগালামুয়ের সাথে ম্যান্টুয়ায় রওনা হয়েছে সে খবর যথাসময়ে সাধু প্যাট্রিকের মুখ থেকে জানতে পারলেন ডিউক। রেগে মেগে তিনি প্রোটিয়াস আর স্যার থুরিওকে সাথে নিয়ে মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে চললেন ম্যান্টুয়ায়।

ওদিকে অন্ধকার ম্যান্টুয়ার জঙ্গলের কাছে পৌছানো মাত্ৰই সিলভিয়া আর এগালামুর- কে ঘিরে ধরল। ডাকাতেরা। এগলামুর ছুটে পালাতে দুজন ডাকাত পেছু নিল তার। আর বাকি সবাই সিলভিয়াকে সাথে নিয়ে রওনা দিল সর্দার ভ্যালেন্টাইনের গুহার দিকে। কিন্তু তারা সেখানে পৌঁছাবার আগেই প্রোটিয়াস এসে হাজির। সিলভিয়াকে সেই রক্ষা করল। ডাকাতদের হাত থেকে। সিলভিয়া প্রোটিয়াসকে ধন্যবাদ জানাতেই সে ধরে নিল এবার সে সত্যিই সক্ষম হয়েছে তার মন জয় করতে। সাথে সাথেই সে গদগদ হয়ে বনের মাঝেই প্ৰেম জানাতে লাগল সিলভিয়াকে। সে বলল, আমি ভাষায় ব্যক্ত করতে পারবন না সিলভিয়া যে মন থেকে আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি। এবার তুমি রাজি হলেই আমাদের বিয়ে হতে পারে।

সেবাস্টিয়ানের ছদ্মবেশে তার নতুন সহচর জুলিয়া এসে দাঁড়িয়েছে প্রোটিয়াসের পাশে; সে বেজায় ঘাবড়ে গেল প্রোটিয়াসের ধরন-ধারণ দেখে। যদি সিলভিয়া বিয়ে করতে রাজি হয়। প্রোটিয়াসকে, তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে তার। এ সময় গুহার ভেতর থেকে বের হয়ে এল ডাকাতদের সর্দার ভ্যালেন্টাইন। কিছুক্ষণ আগেই সে খবর পেয়েছে যে ডাকাতরা একটি মেয়েকে ধরেছে। খবরটা পেতেই সেই মেয়েটিকে ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা করতে গুহার বাইরে এসেছে ভালেন্টাইন। এতদিন বাদে ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে পেয়ে জেগে উঠল প্রোটিয়াসের বিবেক। অনুতাপের সাথে ভ্যালেন্টাইনের দুহাত জড়িয়ে ধরে সে বলল, হে বন্ধ ভাল্লেন্টাইন, বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও তোমার সাথে যে বেইমানি করেছি তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী, আমায় ক্ষমা কর তুমি।

মনের দিক দিয়ে প্রোটিয়াসের চেয়েও অনেক উদার ভ্যালেন্টাইন। প্রোটিয়াসের কথা শুনে সে ক্ষমা করে দিল তার সব অপরাধ। সেই সাথে এও বলল, আমি ক্ষমা করলামু তোমায়। সেই সাথে প্রেমিক হিসেবে সিলভিয়ার উপর থেকে আমার এতদিনের দাবিও তুলে নিলাম। এবার সিলভিয়াকে বিয়ে করতে তোমার আর কোনও বাধা নেই।

সেবাস্টিয়ানবেশী জুলিয়া কিন্তু বেশ ঘাবড়ে গেল ভ্যালেন্টাইনের কথা শুনে। তার ভয় হল, হয়তো সিলভিয়া এবার সত্যিই বিয়ে করতে চাইবে প্রোটিয়াসকে, আর সেরূপ কিছু ঘটে গেলে ইহজীবনে তার সাথে প্রোটিয়াসের মিলন হবে না। এ সব ভাবতে ভাবতে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। কিছুক্ষণ বাদেই জ্ঞান ফিরে এল। তার। ঠিক তখনই প্রোটিয়াসের চোখে পড়ল সেবাস্টিয়ানের হাতের আঙুলে জুলিয়ার দেওয়া আংটিটা। অবাক হয়ে বলল প্রোটিয়াস, আরে সেবাস্টিয়ান! এ আংটিটা কোথায় পেলে তুমি? এটা তো জুলিয়ার?

আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। এটা জুলিয়ারই আংটিং, বলে উঠল সেবাস্টিয়ানরূপী জুলিয়া, ংটিটা জুলিয়া নিজেই এখানে নিয়ে এসেছে।

প্রোটিয়াস অবাক হয়ে গেল তার কথা শুনে। এবার সে একদৃষ্টি কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সেবাস্টিয়ানের মুখের দিকে। খুঁটিয়ে দেখার পর সে বুঝতে পারল তার প্রেমিকা জুলিয়াই তার সহচর সেবাস্টিয়ানরূপে এতদিন পর্যন্ত তার সাথে পাশে পাশে ঘুরে বেড়িয়েছে। প্রোটিয়াসের বুঝতে বাকি রইল না যে তার প্রতি প্রেমের প্রবল আকর্ষণেই জুলিয়া ছুটে এসেছে সুদূর ভেরোনা থেকে মিলানে। সব বুঝতে পেরে সে ফিরে পেল জুলিয়ার প্রতি তার হারানো প্রেম। সাথে সাথেই সে বলল ভ্যালেন্টাইনকে, সে তুমি যাই বল, লেডি সিলভিয়া কিন্তু তোমারই! আমার আর কোনও দাবি নেই তার উপর। আমি ফিরে পেয়েছি জুলিয়াকে। আমি সুখী হব বাকি জীবনটা তার সাথে কাটাতে পারলে। জুলিয়া আর সিলভিয়া, দুজনেই অনেক কষ্ট সয়েছে আমাদের জন্য। প্রোটিয়াসের কথা শেষ হতেই সেখানে হাজির মিলানের ডিউক আর তার সাথে স্যার থুরিও।

এগার

আমার বাগদত্তা সিলভিয়া, তারই সাথে ঠিক হয়েছে আমার বিয়ে, বলতে বলতে স্যার থুরিও এগিয়ে এলেন সিলভিয়ার দিকে।

রাগে চেঁচিয়ে উঠে বলল ভ্যালেন্টাইন, খবরদার থুরিও! এটা ম্যান্টুয়া, মিলান নয়, সে কথা মনে রেখ! আগেই বলে রাখছি তুমি কিন্তু বাঁচবে না। যদি বল সিলভিয়া তোমার বাগদত্তা। আমার ইশারামাত্র তোমার গর্দান নিয়ে নেবে। আমার অনুচরেরা। কেউ তোমায় বাঁচাতে পারবে না। ওদের হাত থেকে। আমার প্রণয়িনী সিলভিয়া, সে আমারই বাগদত্তা, তোমার কেউ নয়। যদি কোনও ভাবে তার আমর্যাদা কর, তার ফল কিন্তু ভালো হবে না। সে কথা মনে রেখ।

স্যার থুরিও একদম চুপসে গেলেন ভ্যালেন্টাইনের ধমক খেয়ে। ইতিমধ্যে ভ্যালেন্টাইনের অনুগত ডাকাতরা চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে তাকে! এক পলক তাদের দিকে তাকিয়ে পা পা করে পিছিয়ে এসে স্যার থুরিও দাঁড়ালেন ডিউকের পাশে।

আমার কোনও প্রয়োজন নেই। সিলভিয়ার মতো মেয়েকে, বললেন স্যার থুরিও, যে মেয়ের আমার প্রতি ছিটেফোটা টান নেই, খামোখা আমি কেন তার জন্য লড়তে যাব? বোকারাই শুধু বুক ফুলিয়ে এরূপ লড়াই করতে এগিয়ে যায়।

এবার তুমি থাম অপদাৰ্থ কাপুরুষ কোথাকার! থুরিওকে ধমকে দিয়ে বললেন ডিউক, আমি কখনই তোমার মতো অপােত্রর সাথে বিয়ে দেব না। আমার মেয়ের। তারপর ভ্যালেন্টাইনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি জানি যে তুমি আইনভঙ্গকারী এক ডাকাত দলের অধিপতি, তবুও স্যার থুরিওকে তুমি যা বললে তা শোভা পায় শুধু প্ৰকৃত বীরের মুখে। আমি স্থির করেছি যে তুমিই সিলভিয়ার উপযুক্ত পাত্র। তাই তার সাথে বিয়ে দেব তোমার। এবার বলো, তুমি কি চাও?

আপনার কাছে আমার একটিই প্রার্থনা, ইশারায় সামনে দাঁড়ানো অনুচরদের দেখিয়ে বলল ভ্যালেন্টাইন, খুনে-ডাকাত হলেও এরা সবাই সম্রাস্ত বংশের। আপনার আদেশে আমার মতো ওরাও মিলান থেকে নির্বাসিত হয়েছিল। আমি এতদিন ওদের সাথে এই জঙ্গলে কাটিয়েছি। রোজ ওঠা-বসা করেছি। ওদের সাথে। তখনই লক্ষ করেছি মিলান আর ম্যান্টুয়ার লোকেরা যাদের ভয়ে কঁপে, ম্যান্টুয়ার গভীর জঙ্গলের সেই ডাকাতদের মধ্যে সভ্য মানুষের অনেক খাঁটি গুণ এখনও বজায় আছে। আমার অনুরোধ, আপনি ক্ষমা করুন ওদের, সুযোগ দিন ওদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার। আমার বিশ্বাস, তাহলে আপনি ওদের অনেককেই দায়িত্বপূর্ণ কাজে লাগাতে পারবেন। সে কাজ সফল করে তারাও বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে সবার মাঝে। তাতে আপনার সুনাম বেড়ে যাবে –সেই সাথে মঙ্গল হবে মিলানেরও। আপনার কাছে। এ ছাড়া আমার আর কিছুচাইবার নেই। তাছাড়া ভেবে দেখুন। আপনার আদেশ শিরোধার্য করে তারা তো এতদিন ধরে নিজ পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেই এসেছে।

ভ্যালেন্টাইনের কথা শুনে হাসিমুখে তাকে বললেন ডিউক, বেশ, তোমার প্রার্থনা আমি পূরণ করব। আমি এদের মাফ করে দিলাম। কথা দিচ্ছি, নূতন করে যাতে ওরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সে ব্যবস্থা আমি করব। এবার বাকি রইল একটি কাজ তা হল প্রোটিয়াসের বিচার–আমার মেয়েকে পেতে গিয়ে এতদিন পর্যন্ত যে অন্যায়। সে তোমার উপর করেছে, আজ সর্বসমুখে নিজমুখে তা স্বীকার করতে হবে তাকে। আর সেটাই হবে তার উপযুক্ত শাস্তি।

বিবেকের দংশন আর লজ্জায় এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার উপায় নেই প্রোটিয়াসের, তবু ডিউকের আদেশে ভ্যালেন্টাইনের প্রতি যত অন্যায় সে করেছে, সবার সামনে সে স্বীকার করল সে সব। আর ওদিকে ডিউকের মার্জনা আর প্রিয়জনদের কাছে যাবার সুযোগ পেয়ে সিলভিয়া ও ভ্যালেন্টাইনকে মাথার উপর তুলে ধরে নাচতে শুরু করেছে ডাকাতের দল।

এরপর সিলভিয়া-ভ্যালেন্টাইন এবং জুলিয়া-প্রোটিয়াস—এই দু-জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকাকে সাথে নিয়ে মিলানে ফিরে এলেন ডিউক, ধুম-ধামের সাথে বিয়ে দিলেন তাদের।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত