ইয়োশিকা নামের উনিশ বছর বয়সী একটি মেয়ে জাপানের বেশ নামকরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার পর ইয়োশিকার মনে হল, তার ইংরেজি অনেক দুর্বল। ইংরেজিতে তার আরও অনেক উন্নতির প্রয়োজন, যা জাপানে বসে করা সম্ভব নয়। তাই সে আমেরিকার একটা ইউনিভার্সিটিতে ক্রেডিট ট্র্যান্সফারের মাধ্যমে আমেরিকায় চলে এল।
সে যে বিষয়ে পড়াশুনা করছিল, সেটায় অনেক রিপোর্ট জমা দিতে হয় এবং সেসব অবশ্যই ইংরেজিতে লিখতে হয়। ইয়োশিকা সারাদিন ক্লাস করার পর রাত জেগে রিপোর্ট লিখত। আর সেই রিপোর্টগুলোর ভুল খুঁজতে খুঁজতে প্রায় ভোর হয়ে যেত। ইয়োশিকা তার ঘুমানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পেত না। ইয়োশিকার কোন ল্যাপটপ ছিল না। এটা তার জন্য ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা।
কিছুদিনের মধ্যেই ইয়োশিকা ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার ল্যাবের সন্ধান পেয়ে গেল। সেখানে প্রায় পঞ্চাশটির মত কম্পিউটার রয়েছে। ল্যাবটা দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা সকল ছাত্র ছাত্রীর জন্য উন্মুক্ত থাকে। তবে সমস্যা হল, সারাদিন ক্লাসের পর সন্ধ্যায় ইয়োশিকা যখন ল্যাবে কম্পিউটার ব্যবহার করতে যায়, তখন ল্যাবে অনেক ভিড় থাকে। সবাই নেট ব্রাউজিং করতে আসে। কম্পিউটার ফ্রি পাবার জন্য রীতিমত লাইনে দাঁড়াতে হয়। ইয়োশিকা তাই একটু রাতের দিকে যেত, যখন ল্যাবে তেমন কেউ থাকত না।
এক রাতে ইয়োশিকা কম্পিউটারে রিপোর্ট টাইপ করতে করতে খেয়াল করল, রাত একটা বেজে গেছে। সে কম্পিউটার বন্ধ করে উঠবে মনস্থির করতে গিয়ে দেখে কিবোর্ডের টেবিলটাতে ধারালো কিছু দিয়ে ঘষে ঘষে কী যেন লেখা রয়েছে। ইয়োশিকা কিবোর্ডটা সরিয়ে ভালভাবে লেখাটা খেয়াল করে দেখে একটা ওয়েবসাইটের ইউআরএল (ঠিকানা)।
ইয়োশিকা কৌতূহলবশত ওয়েব ব্রাউজারে ইউআরএল-টা লিখে এন্টার চাপল। ধীরে ধীরে ওয়েবসাইটটা ওপেন হল। ইয়োশিকা
দেখল ওয়েবসাইটটার হোম পেইজে একজন নগ্ন লোকের ছবি। মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার সারা শরীর এবং আশেপাশের সব জায়গা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ছবিটার নিচে ক্যাপশনে লেখাঃ
“গর্দভ লোক। বয়স আনুমানিক ত্রিশ। আমার হাতে মৃত।”
ছবিটা এতটাই জীবন্ত ছিল যে, দেখার পর ইয়োশিকার পাকস্থলী মোচড় দিয়ে বমি চলে এল। ইয়োশিকা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি কম্পিউটারটা বন্ধ করে তার হোস্টেলের কামরায় ফিরে এল। বিছানায় শুয়ে সে নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিল যে, ইন্টারনেটে মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য অনেকেই এ ধরণের কাজ করে থাকে। ছবিটি মোটেও সত্যি নয়। পুরো ব্যাপারটা হয়ত কারও ফাজলামি ছাড়া আর কিছুই না। তারপরও ইয়োশিকা সারারাত তার দুই চোখের পাতা এক করতে পারল না।
পরদিন সকালে ইয়োশিকা নাস্তা করে তার প্রথম ক্লাসটায় যাবার আগে কম্পিউটার ল্যাবে এসে ঢুকল। সে আসলে নিজেকে দেখাতে চাইছিল যে, গতকাল রাতে সে যা দেখেছে তার সবই ছিল ভুল।
ইয়োশিকা একটা ফাঁকা কম্পিউটারে বসে ওয়েবসাইটটার ইউআরএল লিখে এন্টার চাপল। গত রাতের ছবিটা আজ আর নেই। এখন নতুন আরেকটি ছবি দেখা যাচ্ছে। সোনালী চুলের একটি মেয়ে ব্যস্ত সড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ছবিটা অনেকদূর থেকে তোলা। ছবির নিচে ক্যাপশনে লেখাঃ
“বোকা মেয়ে। বয়স আনুমানিক ছাব্বিশ। আমার আজকের শিকার।”
ভয়ে ইয়োশিকার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। সে কোনমতে ওয়েব ব্রাউজার ক্লোজ করে দিয়ে নিজের ক্লাসের দিকে ছুটল। সারাদিন একটা ক্লাসেও ইয়োশিকা ঠিকমত মনোযোগ দিতে পারল না। সন্ধ্যার পর আবারও সে কম্পিউটার ল্যাবে এল। ভয়ে ভয়ে একটা কম্পিউটারে বসে ওয়েবসাইটের ইউআরএল টাইপ করে এন্টার চাপল।
ওহ! চোখের সামনে সে এটা কী দেখছে? তার নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে না। সকালবেলাতেই যে মেয়েটার উচ্ছল প্রাণবন্ত ছবি সে দেখে গেল, এখন সেই মেয়েটাই রক্তে মাখামাখি অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। ঠিক আগের সেই লোকটার মত। আবারও আজ ক্যাপশনে লেখা,
“বোকা মেয়ে। বয়স আনুমানিক ছাব্বিশ। আমার হাতে মৃত।”
ছবিটা দেখে আজ ভয় পেলেও ইয়োশিকা অনেক কষ্টে নিজের মাথা ঠান্ডা রাখল। সে পুলিশের কাছে ফোন করল। পুলিশকে তার দুর্বল ইংরেজি দিয়ে ব্যাপারটা বোঝাতে তার অনেক বেগ পেতে হল। শেষমেশ পুলিশ তার নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার আর ওয়েবসাইটটার ইউআরএল লিখে নিল। তবে ইয়োশিকার সন্দেহ হচ্ছিল, তারা আদৌ ইয়োশিকার কথা ঠিকমত বুঝতে পেরেছে কিনা!
পরদিন সকালে ইয়োশিকা যথারীতি ল্যাবে এসে ওয়েবসাইটটাতে ঢুকল। আজ আবারও নতুন একটি ছবি। আজকের ছবিটিও একটা মেয়ের। ছবিটা পেছন দিক থেকে তোলা হয়েছে। মেয়েটির চুল ছোট করে কাটা। ঠিক ইয়োশিকার চুলের মত। মেয়েটির পরনে ইয়োশিকার গতকালের পোশাক। আজ ছবির নিচে ক্যাপশনের জায়গায় ইয়োশিকার নাম, ঠিকানা আর মোবাইল নাম্বার দেয়া আছে।
ইয়োশিকা উদভ্রান্তের মত দৌড়ে হোস্টেলে নিজের রুমে ফিরে এল। তারপর নিজের টুকিটাকি যা কিছু আছে সব প্যাক করে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা করল। এয়ারপোর্টে এসে জাপানে যাবার একটি টিকেট কনফার্ম করল। তার ফ্লাইট রাতে। ইয়োশিকা পুরোটা সময় এয়ারপোর্টে বসে কাটিয়ে দিল যতক্ষণ না তার ফ্লাইটে ওঠার ঘোষণা দেওয়া হল। ইয়োশিকা ধীর পায়ে তার জাপানগামী ফ্লাইটে ওঠার জন্য এগিয়ে যেতে গেল।
পরিশিষ্টঃ জাপানগামী সেই ফ্লাইটটাতে বাথরুমের দরজা অনেকক্ষণ ধরে বন্ধ থাকায় এক ভদ্রলোক ফ্লাইট এটেন্ডেন্টের সাহায্য নিয়ে চাবি দিয়ে বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে ইয়োশিকার রক্তমাখা মৃতদেহ খুঁজে পান।
(সমাপ্ত)