বসকোম ভ্যালির রহস্য

বসকোম ভ্যালির রহস্য

শার্লক হোমসের টেলিগ্রামটাই এল সকাল বেলা— আমি তখন স্ত্রীকে নিয়ে প্রাতরাশ খেতে বসেছি। ‘দিন দুয়েকের জন্য বসকোম ভ্যালি যাবে? এইমাত্র টেলিগ্রাম পেলাম। তলব পড়েছে। প্যাডিংটন থেকে সওয়া এগারোটায় গাড়ি আছে।’ স্ত্রী-র উৎসাহে যাওয়াই মনস্থ করলাম। আফগানিস্তানে সামরিক জীবনে একটা জিনিস খুব ভালো রপ্ত করেছি। ঝট করে জিনিসপত্র গুছিয়ে রওনা হতে পারি। তাই যথাসময়ে স্টেশনে পৌছে দেখলাম প্ল্যাটফর্মে পদচারণা করছে শার্লক হোমস। আঁটসাঁট ধূসর পোশাকে দীর্ঘ কৃশ শরীরটা আরও তালঢ্যাঙা দেখাচ্ছে। উঠে বসলাম ট্রেনে। কামরায় আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। তন্ময় হয়ে একগাদা কাগজ পড়ে চলল হোমস, মাঝে মাঝে কী সব টুকে নিতে লাগল।

তারপর দলা পাকিয়ে কাগজের তাড়া বাঙ্কের ওপর ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘কেসটা সম্পর্কে কিছু শুনেছ?
‘কোনো কাগজই পড়িনি ক-দিন।’
‘মনে হয় খুব সহজ, সেইজন্যেই খুব জটিল। ‘ধাধায় ফেললে দেখছি।’
‘কিন্তু কথাটা খাঁটি। যে-কেস চোখে পড়ার মতো, জানবে জলের মতো সোজা। কিন্তু যা সাদাসিদে— গোলমাল তাতেই বেশি। এ-কেসে অভিযোগ আনা হয়েছে যিনি মারা গেছেন, তার ছেলের বিরুদ্ধে।’
‘খুনের মামলা?’
‘সেইরকমই মনে করা হয়েছে। কিন্তু তলিয়ে না-দেখা পর্যন্ত আমি সে-রকম কিছু মনে করার পাত্র নই। কেসটা শোনো।

‘বসকোম ভ্যালির সবচেয়ে বড়ো জায়গিরদার হলেন জন টার্নার। অস্ট্রেলিয়া থেকে অনেক টাকা রোজগার করে এনে জমিজমা কিনে চাষবাস করছেন। একটা গোলবাড়ি ভাড়া দিয়েছেন চার্লস ম্যাকার্থি নামে এক ভদ্রলোককে— ইনিও অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেছেন। সেখানে আগে আলাপ ছিল— এখানেও তাই প্রতিবেশী হয়ে রয়ে গেলেন। টার্নারের টাকাপয়সা বেশি থাকলেও তা মেলামেশার অন্তরায় হল না। দুজনেরই বউ গত হয়েছেন। টার্নারের এক মেয়ে, ম্যাকার্থির এক ছেলে — দুজনেরই বয়স আঠারো। প্রতিবেশীদের সঙ্গে কেউই খুব একটা মিশতেন না। টার্নারের বাড়িতে চাকরবাকর ছ-জন। ম্যাকার্থির দুজন। ‘গত সোমবার তেসরা জুন ম্যাকার্থি বিকেল তিনটে নাগাদ বসকোম হ্রদে যান— চাকরকে বলে যান কার সঙ্গে নাকি দেখা করার কথা আছে। আর ফেরেননি।

‘গোলাবাড়ি থেকে হ্রদ সিকি মাইল দূরে। দুজন দেখেছে ম্যাকার্থিকে যেতে। একজন বুড়ি— নাম জানা নেই। আর একজন বাগানের মালি। ম্যাকার্থির বেশ কিছু পেছনে তার ছেলে জেমসকেও যেতে দেখেছে সে— হাতে বন্দুক ছিল। বাপকে যেন চোখে চোখে রেখে হাঁটছিল ছেলে। ‘মালির মেয়েও দেখেছে বাপবেটাকে হ্রদের ধারে। বনের মধ্যে ফুল তুলছিল মেয়েটা। সেখান থেকেই দেখতে পায় কথা কাটাকাটি হচ্ছে বাপবেটায়— ছেলে এমনভাবে একবার হাত তুলল যেন এই বুঝি মেরে বসবে বাপকে। ভয়ের চোটে মেয়েটা দৌড়ে এসে মাকে সবে ঘটনা বলতে শুরু করেছে, এমন সময়ে ছুটতে ছুটতে জেমস এসে বললে— বাবাকে এইমাত্র মরে পড়ে থাকতে দেখে এসেছে বনের ধারে। জেমসের তখন বিহুল অবস্থা, মাথায় টুপি নেই, বগলে বন্দুক নেই, হাতে আর আস্তিনে কাচা রক্ত লেগে আছে। জেমসের সঙ্গে গিয়ে দেখা গেল, সত্যিই ম্যাকার্থির মৃতদেহ পড়ে রয়েছে হ্রদের ধারে– খুব ভারী কিন্তু ভোঁতা ধরনের কোন অন্ত্র দিয়ে বেশ কয়েকবার ঘা মেরে খুলি ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিক যেন ছেলের বন্দুকের কুঁদের মার। বন্দুকটাও পাওয়া গেল একটু তফাতে ঘাসের ওপর। ছেলেকে গ্রেপ্তার করে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ সব শুনে আমি বললাম, এ অবস্থায় জেমসকেই দোষী বলতে হয়।’

‘সেভাবে দেখতে গেলে হয়তো অবিচারই করা হবে। জেমস দোষী হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। শুধু পরিস্থিতি দেখলে হবে না, অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। টার্নারের মেয়ে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লেসট্রেডকে দিয়ে তদন্ত করাচ্ছে। তারই নিবন্ধে আমার এখন ছুটতে হচ্ছে ঘণ্টায় পঞ্চাশ মাইল বেগে।’ “কিন্তু হালে পানি পেলে হয়— শেষ পর্যন্ত তোমাকে সুনাম খোয়াতে হবে মনে হচ্ছে। কেস তো জলের মতো পরিষ্কার।’ হাসল হোমস। বলল, ‘পরিষ্কার ব্যাপারেই অনেক কিছু চোখের বাইরে থেকে যায়। লেসট্রেড যা দেখেনি, আমার চোখে তা পড়তে পারে। যেমন ধর না কেন তোমার শোবার ঘরের জানলাটা যে ডান দিকে, এ জিনিস হয়তো লেসট্রেডের চোখ এড়িয়ে যাবে— কিন্তু আমার চোখ এড়ায়নি।’ সত্যিই অবাক হলাম, কিন্তু তুমি জানলে কী করে? ‘তোমার নাড়িনক্ষত্র জানি যে আমি। মিলিটারিতে থাকার ফলে পরিষ্কার থাকা তোমার অভ্যেস দাঁড়িয়ে গেছে। রোজ দাঁড়ি কামাও। এইসব মাসে রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে কামাও। কিন্তু দেখছি তোমার দাড়ি তেমন কামানো হয়নি। তার মানে কি এই নয় যে, যে-জানলায় দাঁড়াও সেখানে রোদ থাকে না সকালে? খুঁটিয়ে দেখলে এমনি অনেক কিছু আবিষ্কার করা যায়, এই কেসেও সে-সুযোগ আছে বলে আমার বিশ্বাস। ‘কীরকম?” ‘ছেলেটাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে গোলাবাড়ি ফিরে আসার পর— অকুস্থলে নয়। তখন সে বলেছিল, সে নাকি জানত তাকে গ্রেপ্তার হতে হবে।’

‘তার মানেই খুনের অপরাধ স্বীকার করে নেওয়া হল। কিন্তু তারপরেই বলেছে খুন সে করেনি।’ “কিন্তু তাতে সন্দেহ যায় না— বরং বাড়ে।’

‘মোটেই না— সন্দেহ একেবারে চলে যায়। গ্রেপ্তারের সময়ে মেজাজ দেখালেই বরং সন্দেহ হত— পাগলকে পাগল বললেই রেগে যায়। কিন্তু বাপের সঙ্গে কথা কাটাকাটির পরেই বাপ খুন হয়েছে— সুতরাং যে কেউ বলবে খুনি সে-ই— এই সোজা কথাটা সোজা ভাবে যে বলতে পারে, বুঝতে হবে তার মনে পাপ নেই।’ “কিন্তু ফাঁসি কি আটকানো যায়? এর চেয়ে কম সন্দেহের জোরে অনেকে ফাঁসিকাঠে উঠেছে। ‘অন্যায় সন্দেহেও অনেকে ফাঁসিতে ঝুলেছে।’ ‘ছেলেটি কী বলে?”

‘এই কাগজটা পড়লেই বুঝবে, বলে কাগজের তাড়ার একটা জায়গা আমাকে দেখিয়ে দিল হোমস। জেমস ম্যাকার্থি গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিবৃতি দিয়েছিল। এটা সেই জবানবন্দি। সে বলেছে : তিন দিন পরে বাড়ি ফিরে দেখলাম বাবা বাড়ি নেই। একটু পরে গাড়ির আওয়াজ শুনে দেখলাম, বাবা ফিরেছে। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমেই হনহন করে ফের বেরিয়ে গেল। কোন দিকে গেল বুঝতে পারলাম না। বন্দুক নিয়ে আমি বেরোলাম হ্রদের পাড়ে গিয়ে খরগোশ শিকার করব বলে। রাস্তায় মালির সঙ্গে দেখা হল। আমি বাবার পেছনে পেছনে চলেছিলাম, সে বলেছে। কথাটা ঠিক নয়। আমি জানতামই না বাবা আমার সামনে আছে। হ্রদের কাছাকাছি গিয়ে একটা ‘কু’ ডাক শুনলাম। এভাবে বাবা আমাকে ডাকে— আমিও বাবাকে ডাকি। তাই হনহন করে এগিয়ে গিয়ে দেখি লেকের ধারে বাবা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে অবাক হল, রেগে গেল, মারতে এল। বাবার মেজাজ খুব উগ্র। আমি তাই কথা না-বাড়িয়ে চলে এলাম। কিন্তু কিছুদূর আসতে-না- আসতেই বিকট চিৎকার শুনলাম পেছনে। দৌড়ে গিয়ে দেখলাম সাংঘাতিক জখম হয়েছে বাবা— মাথা ছাতু হয়ে গেছে বললেই চলে! বন্দুকটা ছুড়ে ফেলে দিলাম, বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম, প্রায় সঙ্গেসঙ্গে মারা গেল বাবা। কাছেই বাড়িটা মি. টার্নারের— মিনিট কয়েক বসে থাকার পর গেলাম সেখানে। সব বললাম। বাবার শত্রু নেই, এটুকু আমি জানি। বন্ধুও তেমন নেই। করোনার” তখন জিজ্ঞেস করে, প্রাণটা বেরিয়ে যাওয়ার আগে বাবা কিছু বলেছিলেন? ইদুর সম্বন্ধে কী যেন বলছিল। ‘মানে কি বুঝলে?’

‘ভুল বকছিল। ‘বাবার সঙ্গে ঝগড়াটা হল কী নিয়ে ? ‘বলব না।’ ‘বলতেই হবে। ‘তার সঙ্গে এ ব্যাপারের কোনো সম্পর্ক নেই।’ ‘সেটা কোর্ট বুঝবে। জবাব না-দিলে তোমার ক্ষতি হবে।’ ‘হোক।’ ‘কু ডাক দিয়ে বাবা তোমাকে ডাকত, তুমিও বাবাকে ডাকতে? ‘হ্যাঁ!” কিন্তু বাবা তো জানতেন না তুমি বাড়ি ফিরেছ? ডাকলেন কেন? ঘাবড়ে গেল জেমস। বললে, “বলতে পারব না।’ বিকট চিৎকার শুনে ফিরে এসে সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলে?’

‘সে- রকম কিছু দেখিনি। ‘তাহলে কী দেখেছিলে ?’
‘আমি তখন পাগলের মতো বাবার দিকে দৌড়োচ্ছি — কোনোদিকে খেয়াল নেই। সেই সময়ে মনে হল যেন বা-দিকে ধূসর রঙের কী-একটা পড়ে আছে– অনেকটা আলখাল্লার মতো। বাবার পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জিনিসটা আর দেখিনি।’
‘মি. টার্নারের বাড়ি যাওয়ার আগেই দেখলে জিনিসটা নেই।’
‘হ্যাঁ।’
‘ঠিক কী বলে মনে হয় জিনিসটা ?” ‘কাপড়ের মতো কিছু।”
‘ডেডবডি থেকে কত তফাতে? ‘প্রায় বারো গজ তফাতে।’
‘বন সেখানে কদ্দুর? ‘ওইরকমই।”
‘তাহলে বলতে চাও তুমি থাকতে থাকতেই জিনিসটা উধাও হয়ে গেল? ‘আমি কিন্তু সেদিকে পেছন করে বসে ছিলাম।” জেরা এইখানেই শেষ । পড়া শেষ করে বললাম, ‘করোনার ঠিক ঠিক পয়েন্টেই চেপে ধরেছে। এক, বাবা তাকে দেখেনি, অথচ ডাকল কেন? দুই, ঝগড়ার বৃত্তান্ত চেপে যাওয়া। তিন, মরবার সময়ে ইদুর সম্বন্ধে কথা বলেছিলেন ম্যাকার্থি — মানেটা ছেলে বোঝেনি।’ হোমস হাসিমুখে বললে, ‘যে- অসংগতিগুলো দেখে তুমি আর করোনার খড়গহস্ত হয়েছ ছেলেটির ওপর— সেগুলোই কি ওর সত্যি কথা বলার প্রমাণ? পুরো ব্যাপারটা বানিয়ে বলার মতো কল্পনাশক্তিই যদি ওর থাকত, তাহলে ওই তিনটে অসংগতি চাপাচুপি দিয়ে চমৎকার তিনটে গল্প শুনিয়ে দিতে পারত। মিথ্যে যে বলে, সে কি গল্পের মধ্যে সন্দেহের বীজ রেখে উদ্ভট অসংগতি শোনাতে চায় ? না হে, ছেলেটা সত্যিই বলেছে। এখন আর এ নিয়ে কোনো কথা নয়। এই বইটা পড়তে বসলাম, বিশ মিনিটে সুইনডনে পৌছে লাঞ্চ খাব।” রস শহরে যথাসময়ে পৌঁছোলাম। বেজির মতো ক্ষিপ্র, ইনস্পেকটর লেসট্রেড দাঁড়িয়েছিল প্ল্যাটফর্মে। চোখে সেয়ানা চাহনি ! আগে নিয়ে গেল সরাইখানায়। ঘর ঠিক করাই ছিল। চা খেতে খেতে বললে, “এখুনি গাড়ি আসছে। সোজা অকুস্থলে চলুন। ‘আজ রাতে গাড়ির দরকার হবে বলে মনে হয় না।’ ‘তাই বলুন। কাগজ পড়েই তাহলে সমাধানে পৌছে গেছেন? খুবই সোজা কেস। কিন্তু মেয়েটা নাছোড়বান্দা। আপনার সঙ্গে কথা না-বলা পর্যন্ত রেহাই দিচ্ছে না।— এই যে এসে গেছে।’ একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল সরাইখানায়। হুড়মুড় করে ঢুকল একজন পরমাসুন্দরী তরুণী। উদবেগ উৎকণ্ঠায় সামলাতে পারছে না নিজেকে। মি. শার্লক হোমস?’ পর্যায়ক্রমে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে হোমসকে ঠিক চিনে নিল মেয়েটা, ‘খুব আনন্দ হচ্ছে আপনাকে দেখে। জেমস নির্দোষ। এইটুকু বয়স থেকে ওকে চিনি। মাছি পর্যন্ত যে মারতে পারে না, সে করবে খুন? মি. হোমস, শুধু এই বিশ্বাস নিয়েই আপনি তদত্ত শুরু করুন।’

‘নিশ্চয় করব, জেমস যে নির্দোষ তাও প্রমাণ করব।”
‘ওর জবানবন্দি পড়ে কি আপনার মনে হয়নি ও নির্দোষ?”
‘সেইরকমই মনে হয়েছে।’ ‘কী! বলেছিলাম না? লেসট্রেডের দিকে ফিরে তাচ্ছিল্যের সুরে বললে মেয়েটা। লেসট্রেড কাঁধ বাকিয়ে বললে, ‘মি. হোমস একটু তাড়াতাড়িই সিদ্ধান্তে পৌছে যাচ্ছেন।
‘কিন্তু হক কথা বলেছেন। জেমস নির্দোষ। বাবার সঙ্গে ঝগড়ার কারণটা কেন বলেনি জানেন? ওর মধ্যে আমিও আছি বলে।’ ‘কীরকম ? শুধোয় হোমস। ‘জেমসের বাবা চান আমার সঙ্গে জেমসের বিয়ে হোক। কিন্তু আমরা ছেলেবেলা থেকে ভাইবোনের মতো পরস্পরকে ভালোবেসে এসেছি। বাপবেটায় প্রায়ই ঝগড়া হত এই নিয়ে।’
‘তোমার বাবা কী বলত?’
‘তার মত নেই। জেমসের বাবা ছাড়া কারোরই মত নেই,’ বলতে বলতে সুন্দর মুখখানা লাল হয়ে গেল মিস টানারের। ‘কালকে তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাব ভাবছি।’ ‘ডাক্তার রাজি হবেন বলে মনে হয় না।’
‘কেন?’ ‘গত কয়েক বছর ধরেই শরীর খুব খারাপ। তারপর এই ধাক্কায় একেবারে বিছানা নিয়েছেন। হাল ছেড়ে দিয়েছেন ডাক্তার। ভিক্টোরিয়ায় থাকার সময় থেকেই তো বন্ধুত্ব মিস্টার ম্যাকার্থির সঙ্গে । ‘ভিক্টোরিয়ায় ? খবরটা কাজে লাগবে।’ ‘খনির কাজে ছিলেন।’ “সোনার খনি, তাই না? টাকা রোজগার করেছেন সেইখানেই ?
‘হ্যা।’ ‘ধন্যবাদ। এ- খবরটাও কাজে লাগবে।’ ‘জেমসের সঙ্গে নিশ্চয় দেখা করতে যাবেন জেলখানায়? ওকে বলবেন আমি জানি ও নির্দোষ।’
‘বলব, নিশ্চয় বলব!’ ‘আর বসব না, চলি। বাবার অবস্থা ভালো নয়।’ বলতে বলতে বেগে বেরিয়ে গেল মিস টার্নার। একটু পরেই শুনলাম চাকার আওয়াজ— মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে। গম্ভীর গলায় লেসট্রেড বললে, ‘কাজটা ভালো করলেন না মি. হোমস। মিথ্যে আশা দিলেন মেয়েটাকে!’
‘লেসট্রেড, জেমসকে খালাস করতে পারব এ- বিশ্বাস আমার আছে। জেলখানায় গিয়ে দেখা করার অনুমতি পাব কি আমি ?’ ‘শুধু আপনি আর আমি পাব।’
‘তাহলে চল বেরিয়ে পড়া যাক। ট্রেন পাওয়া যাবে?’ ‘পাবেন।’

‘ওয়াটসন, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ফিরছি আমি। এই দুটো ঘণ্টা যেন আর কাটতে চাইল না আমার। ওদেরকে ট্রেনে তুলে দিয়ে একটু এদিক-ওদিক ঘুরে সরাইখানায় ফিরলাম। চটকদার উপন্যাস পড়বার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মন চলে আসতে লাগল খুনের রহস্যে। বিরক্ত হয়ে বই ফেলে ভাবতে বসলাম। হোমসের খাতিরেই যদি ধরি ছেলেটা সত্যি বলছে, তাহলে সে বাবার কাছ থেকে চলে আসার সময় থেকে আরম্ভ করে বাবার চিৎকার শুনে ফিরে যাওয়া পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ভয়ানক কিছু একটা ঘটেছিল। আবার, বাবার কাছে পিছন ফিরে বসে থাকার সময়েও কেউ সেখানে এসে পেছন থেকে ধূসর জিনিসটা সরিয়ে নিয়ে গেছে। ভারি আশ্চর্য ব্যাপার তো! জিনিসটা কী? খুনির পোশাক? আমি নিজে ডাক্তার। কাজেই আঘাতের ধরনটা অনুধাবন করতে গিয়ে দেখলা, চোট লেগেছে খুলির পেছনকার বা-দিকের হাড়ে— গুড়িয়ে গেছে গুরুভার অস্ত্রের আঘাতে। অথচ ছেলেটিকে দেখা গেছে বাপের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঝগড়া করতে। অবশ্য এ-যুক্তির কোনো মানে নেই। বাপ পেছন ফিরতেই হয়তো হাতিয়ার চালিয়েছিল জেমস। কিন্তু মরবার ঠিক আগে ইঁদুর নিয়ে বিড়বিড় করতে গেলেন কেন মি. ম্যাকার্থি? এ সময়ে আচমকা আঘাতে কেউ তো আবোল-তাবোল বকে না? কী বলতে চেয়েছিলেন ভদ্রলোক ? হোমস এক ফিরল অনেক দেরিতে — লেসট্রেড শহরে থেকে গেছে। আসন গ্রহণ করে বললে, ‘অকুস্থলে পৌছোনোর আগে বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে গেলে মুশকিলে পড়ব।— জেমসের সঙ্গে দেখা হল জেলখানায়।’

‘কী মনে হল? অন্ধকারে আলো দেখাতে পারল জেমস ? ‘একেবারেই না। প্রথমে মনে হয়েছিল খুনিকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। পরে দেখলাম নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। খুব চৌকস নয় ছেলেটা, কিন্তু সুদর্শন। মনটা পরিষ্কার।’ ‘মিস টার্নারের মতো মেয়েকে বিয়ে করতে যে চায় না, তার পছন্দরও খুব একটা তারিফ করা যায় না ? ‘ওহে ওর মধ্যেও একটা হৃদয়বিদারক ঘটনা রয়েছে। ছোকরা বোর্ডিং স্কুলে থাকার সময়ে ব্রিস্টলের একটা হোটেলের মেয়ের পাল্লায় পড়ে। তাকে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে পর্যন্ত করে। বোকা আর বলে কাকে। কাউকে কথাটা বলাও যাচ্ছে না। এদিকে বদমেজাজি বাবার কাছে ধমক খেতে হচ্ছে মিস টার্নারকে বিয়ে করতে চাইছে না বলে। হাত-পা ছুড়ে লেকের পাড়ে প্রতিবাদ জানিয়েও লাভ হয়নি। সত্যি কথাটা বললেই তো বাড়ি থেকে বার করে দেবে বাবা— গুমরে গুমরে তাই মরছে। তিন দিন ব্রিস্টলে স্ত্রী- র সঙ্গে কাটিয়ে বাড়ি ফেরার পরেই খুন হয়ে গেল বাবা। কাগজে খবরটা পড়ল হোটেলের মেয়ে। জেমসের ফাঁসি হবেই বুঝতে পেরে নিজে থেকেই কেটে পড়ল। চিঠি লিখে জানিয়েছে, ওর আগের স্বামী বর্তমান— কাজেই জেমসের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।’

‘বেশ তো, জেমস যদি খুন না-করেই থাকে, তাহলে করলটা কে? ‘দুটো ব্যাপার নিয়ে তোমাকে ভাবতে বলব। এক নম্বর হল, জেমসের বাবা জানতেন না ছেলে বাড়ি ফিরেছে— তা সত্ত্বেও তিনি “কু” করে ডেকেছিলেন। দু- নম্বর হল, লেকের পাড়ে যার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন সে আর যেই হোক তার ছেলে নয়— কারণ উনি জানতেন ছেলে এ- তল্লাটেই নেই। আজ আর এ-নিয়ে কোনো কথা নয়।’ সকাল বেলা গাড়ি নিয়ে এল লেসট্রেড। আকাশ নির্মেঘ। রাতেও বৃষ্টি হয়নি। গোলাবাড়ি আর হ্রদের দিকে রওনা হলাম আমরা। যেতে যেতে লেসট্রেড বললে, ‘মি. টার্নার আর বাঁচেন কি না সন্দেহ।” ‘বয়স অনেক হয়েছে বুঝি?? হোমস বললে। ‘ষাট বছর তো বটেই। শরীরের ওপর অনেক অত্যাচার করেছেন বিদেশে থাকার সময়ে। এমনিতেই কাহিল ছিলেন, বন্ধু ম্যাকার্থির মৃত্যুতে একেবারে ভেঙে পড়েছেন। বন্ধুর জন্যে কম করেননি— গোলাবাড়ির ভাড়া পর্যন্ত নেন না।’ ‘বটে। খবরটা শুভ।’ ‘বিনা ভাড়ায় শুধু থাকতেই দেননি, আরও অনেক উপকার করেছেন ম্যাকার্থির— পাঁচজনে বলেছে।’ ‘তাই নাকি! একটা ব্যাপারে কি তোমার খটকা লাগেনি লেসট্রেড ?’

‘কী বলুন তো?’ ‘এত উপকার করা সত্ত্বেও মেয়ের সঙ্গে মি. ম্যাকার্থির ছেলের বিয়ে দিতে মি. টার্নার রাজি নন। অথচ মি. ম্যাকার্থি বিয়ের কথা সমানে বলে যাচ্ছেন— যেন খুবই স্বাভাবিক প্রস্তাব। মেয়েটি কিন্তু মি. টার্নারের সব সম্পত্তি পাবে। কী? আঁচ করতে পারলে ?’ ‘ঘটনার ঠেলায় অস্থির হয়ে পড়েছি, আঁচ করার হেপাজত আর পোয়াতে পারব না।’

‘তা ঠিক। ঘটনার ঠেলায় তুমি হিমশিম খাচ্ছ, গম্ভীর গলা হোমসের।’ চটে গেল লেসট্রেড। ‘আপনি কিন্তু এখনও মরীচিকা দেখছেন। যা ভাবছেন, তা নয়।’ কুয়াশার চাইতে তো ভালো! হেসে বললে হোমস। এই যে, এসে গেছে গোলাবাড়ি। বেশ বড়ো গোলাবাড়ি। দোতলা। সদ্য শোকের ছাপ সর্বত্র। দরজায় ধাক্কা দিতেই ঝিঁ বেরিয়ে এল। হোমস তার কাছে দু-জোড়া জুতো চাইল। মারা যাওয়ার সময়ে মি. ম্যাকার্থি যে বুট পরে ছিলেন, সেইটা। আর তার ছেলের একজোড়া বুট। জুতো এল। ফিতে বার করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সাত আট রকম মাপ নিল হোমস। তারপর রওনা হলাম লেকের দিকে। এবং পালটে গেল ওর চোখ- মুখের চেহারা। বরাবর দেখেছি এই ধরনের সন্ধানী অভিযানে নামলেই ও যেন শিকারি কুকুরের মতো আত্মনিমগ্ন আর হন্যে হয়ে উঠে। তখন কারো কথা কানে ঢোকে না— বেশি কথা বলতে গেলে খেকিয়ে ওঠে। ভুরু কুঁচকে ইস্পাত- কঠিন চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে, দু-কাঁধ বাঁকিয়ে, নাকের পাটা ফুলিয়ে হনহন করে হেঁটে যায় হেঁট মাথায়। এইভাবেই মাঠে নামল, গেল লেকের ধারের জঙ্গলে। জলা জায়গায় অসংখ্য পদচিহ্ন। হোমসের নজর সব দিকেই। কখনো জোরে যাচ্ছে, কখনো আস্তে। মাঠটাকেও চক্কর দিয়ে এল একবার। রকম-সকম দেখে অবজ্ঞার হাসি হাসছে লেসট্রেড। আমার কৌতুহল কিন্তু বেড়েই চলেছে। শার্লক হোমসকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। অকারণে সে কিছু করে না। বসকোম লেকটাকে একটা বড়োসড়ো দিঘি বললেই চলে। একদিকে জায়গিরদার মি. টার্নারের বাড়ি আর একদিকে মি. ম্যাকার্থির গোলাবাড়ি। লেক ঘিরে আগাছা, ঘাস, জঙ্গল আর জলাজমি। এইখানে একটা ঘাস জমির ওপর পাওয়া গেছে মৃতদেহ। বেশ ভিজে জায়গা। হোমস শিকারী কুকুরের মতো আবার দৌড়াদৌড়ি আরম্ভ করেছে। অনেক কিছুই দেখতে পাচ্ছে। ঘাসজমির উপর পায়ের দাগ বিস্তর। হঠাৎ ফিরল লেসট্রেডের দিকে, “এখানে কী করতে এসেছিলে ?’

‘দেখছিলাম হাতিয়ারটা যদি পাওয়া যায়।’ ‘খুব কাজ করেছ! পায়ের ছাপগুলোর বারোটা বাজিয়ে বসে আছ। নিজের পায়ের ছাপেই সব জায়গা ভরিয়ে তুলেছ! উফ! এর চাইতে একপাল মোষ এলেও বুঝি এ-রকম হত না! চিনতে পারছ এই জুতোর দাগটা? তোমার জুতো! আর এই যে বনরক্ষক মশায় দলবল নিয়ে কর্তব্য করে গেছেন— এখানে— ডেডবডির চারধারে ছয় থেকে আট ফুট পর্যন্ত জায়গায় যত পায়ের ছাপ ছিল, মাড়িয়ে দফারফা করে গেছেন। আ! এই যে একজোড়া পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। একদম আলাদা দাগ দেখছি, বলতে বলতে ভিজে মাটিতে বর্ষাতি বিছিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল হোমস। আতশকাচ বার করে মাটির ওপরকার বুট চিহ্ন দেখতে দেখতে যেন স্বগতোক্তি করে বলল, “এই হল গিয়ে ছেলেটার জুতোর দাগ। দু-বার যাতায়াত করেছে— তারপরে টেনে দৌড়েছে— দৌড়েছে বলেই গোড়ালির ছাপ প্রায় ওঠেনি— চেটোর ওপরেই ভর পড়েছে বেশি। তার মানে, ছোকরা খাঁটি কথাই বলেছে। বাপের চিৎকার শুনে দৌড়ে এসেছিল। আর এইখানে পায়চারি করছিলেন মি. ম্যাকার্থি। পাশেই বন্দুকের কুঁদের দাগ— বাপ বেটায় কথা হচ্ছিল এখানে। আরে! আরে! ওইটা আবার কী! বুটের মালিক একবার এল— আবার গেল— আবার এসেছে দেখছি… ও হ্যাঁ, আলখাল্লাটা কুড়িয়ে নিতে এসেছিল। কিন্তু এল কোথেকে? দেখা যাক।’ চেনা গন্ধ পেয়ে ব্লাড হাউন্ড যেভাবে নাক নামিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োয়, হোমসও এবার সেইভাবে মাটি দেখতে দেখতে দৌড়োতে লাগল। পেছনে ছুটলাম আমরা। এসে পৌঁছোলাম বনের ধারে। আরও কিছুদূর গেল হোমস। ফের সটান উপুড় হয়ে শুয়ে মাটি পরীক্ষা করল আতশকাচ দিয়ে। শুকনো পাতা-টাতা সরিয়ে ধুলোর মতো খানিকটা বস্তু নিয়ে খামের মধ্যে ভরল। খুশিতে চোখ-মুখ বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। আশপাশ আবার দেখল আতশকাচের মধ্যে দিয়ে। এবড়োখেবড়ো একটা পাথর নিয়েও তন্ময় হয়ে রইল অনেকক্ষণ। শ্যাওলার মধ্যে পড়ে ছিল পাথরটা। গেল বড়োরাস্তা পর্যন্ত । ফিরে এসে সহজ গলায় বললে, ইন্টারেস্টিং মামলা। ডান হাতি বাড়িটা নিশ্চয় মি টার্নারের। তোমরা এগোও— আমি আসছি মি. টার্নারের বাড়ির সরকারের সঙ্গে দেখা করে। একটা চিঠি লিখে আসতে হবে।’ মিনিট দশেক পরে হোমস এল। গাড়ি ছুটল শহরের দিকে। হোমসের হাতে শ্যাওলায়-পড়ে- থাকা সেই পাথরটা দেখলাম। লেসট্রেডের হাতে তুলে দিয়ে বললে, “এই নাও হত্যার হাতিয়ার।’

‘কী করে বুঝব যে এটা দিয়েই খুন করা হয়েছিল? গায়ে তো কোনো দাগ দেখছি না।’
‘না, দাগ নেই। কিন্তু এটা যেখানে পড়ে ছিল, তার তলায় ঘাস ছিল। কোথেকে তুলে এনে ফেলা হয়েছে, তাও দেখতে পাইনি। যে ধরনের চোট দেখা গেছে খুলিতে, এই পাথর দিয়েই তা সম্ভব।” ‘খুনটা করেছে কে?’

‘সে মাথায় বেশ ঢাঙা, ল্যাটা, ডান পা টেনে চলে, পুরু সোলের শিকারের বুট পরে, গায়ে ধূসর আলখাল্লা আছে, নলে ভারতীয় চুরুট লাগিয়ে খায়, পকেটে ভোঁতা পেনসিলকাটা ছুরি রাখে। এতেই হবে তোমার।’ হেসে ফেলল লেসট্রেড, “আদালতে গ্রাহ্য হবে না যা বললেন। কল্পনা দিয়ে কারবার করলে চলে না আমাদের।” আস্তে আস্তে হোমস বললে, তাহলে তুমি তোমার পদ্ধতিতে কাজ চালাও — আমি চালাই আমার পদ্ধতিতে। সন্ধের ট্রেনে লন্ডন ফিরব ভাবছি।’

‘সে কী! তদন্ত শেষ না-করেই যাবেন ? ‘আরে না, শেষ করেই যাব।’ ‘সমস্যার সমাধান?’ ‘সে তো হয়ে গেছে।’ ‘খুনি কে?’ ‘যার বর্ণনা দিলাম।” ‘তার নাম ?’ ‘খুঁজলেই পেয়ে যাবে— খুব একটা লোকজন এ-তল্লাটে নেই।’ ‘দুর মশায়! খোড়া ল্যাটার সন্ধানে টাে টাে করলে হেসে কুটিপাটি হবে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড!” হোমস শুধু বলল, ‘সূত্র দিয়ে দিলাম— আমার কর্তব্যও শেষ হল। এসে গেছে তোমার আস্তানা।’ নেমে গেল লেসট্রেড। আমরা ফিরলাম সরাইখানায়। খেতে বসে বিশেষ কথা বলল না হোমস। মুখ দেখে বুঝলাম, দোটানায় পড়েছে। খাওয়া শেষ হল। চুরুট ধরিয়ে হোমস বললে, ‘ওয়াটসন, এ মামলায় দুটো অত্যন্ত আশ্চর্য ব্যাপার শুনে নিশ্চয় তোমার খটকা লেগেছে। এক হল, “কু” ডাক। দুই, মরবার সময়ে “ইদুর” শব্দটা বলা। “কু” ডাকটা অস্ট্রেলিয়ায় চালু আছে। সেখানে একজন আর একজনকে এইভাবে ডাকে। মি. ম্যাকার্থি যাকে ডেকেছিল, সে-ও তাহলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকত। সেখানেই দুজনের পরিচয় । দেখাও করতে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে— ছেলেকে ডাকেননি।’ ইঁদুর-ইঁদুর করে মারা গেলেন কেন? পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে টেবিলে বিছিয়ে ধরল হোমস | বলল, “এই হল ভিক্টোরিয়া কলোনির ম্যাপ। ব্রিস্টলে কাল চিঠি লিখে আনিয়েছি। ম্যাপের এক জায়গা হাত চাপা দিয়ে— ‘কী আছে পড়ো তো ?’ “ARAT” হাত তুলে বলল, ‘এবার? “BALLARAT” ‘এই নামটাই মরবার আগে বলেছিলেন মি. ম্যাকার্থি– ছেলে শুধু শুনতে পায় শেষটুকু। নামটা নিশ্চয় খুনির।’ ‘অদ্ভুত ব্যাপার তো!’ ‘তিন নম্বর অদ্ভুত ব্যাপার হল সেই ধূসর জিনিসটা— যা একটা আলখাল্লা। তাহলে, ব্যালারাট নামে এক অস্ট্রেলিয়াবাসী গায়ে ধূসর আলখাল্লা চাপিয়ে ডাঙশ মারার মতো পাথর হাকিয়ে খুন করে গেছে মি. ম্যাকার্থিকে। পরিষ্কার? ‘নিশ্চয় |’ ‘এ-অঞ্চল তার নখদপর্ণেও বটে। কেননা লেকে পৌছোনোর দুটোই তো কেবল রাস্তা — একটা গোলাবাড়ি থেকে, আর একটা মি. টার্নারের বাড়ি থেকে। ‘ঠিক, ঠিক। ‘জমি পরীক্ষা করে খুনির দেহের যে-বর্ণনা মাথামোটা লেসট্রেডকে শোনালাম, তুমিও তা শুনেছ।’

‘শুনেছি ঠিকই, কিন্তু কীভাবে অত খবর জানলে বুঝিনি। কতখানি লম্বা, সেটা না হয় দুটাে পায়ের ছাপের মধ্যে ফাঁকটা দেখে আন্দাজ করলে। জুতোর চেহারাও ছাপ দেখে বলা যায়। কিন্তু এক পায়ে খোড়া জানলে কী করে ? ‘ডান পা সবসময়ে আলতোভাবে জমি ছুয়ে গেছে— চাপ পড়েনি। পা টেনে চলে বলেই এমন হয়েছে।’ ‘কী করে বললে সে ল্যাটা ?”

‘খুলির পেছনে হাড় কীভাবে গুড়িয়েছিল, তুমি জান। চোট লেগেছিল বা-দিক ঘেষে। অর্থাৎ বা-হাতে পাথর মেরেছে খুনি। বাপ-বেটায় ঝগড়ার সময়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে চুরুট খেয়েছে আর ছাই ঝেড়েছে। ১৪০ রকম তামাকের ছাই নিয়ে একটা প্রবন্ধ এককালে লিখেছিলাম। তাই ছাই দেখেই বুঝলাম, ইন্ডিয়ান সিগার। কিছুদূরে পেলাম চুরুটের গোড়া— ফেলে দেওয়া হয়েছে।’ ‘নলে লাগিয়ে খাওয়া হয়েছে বুঝলে কী করে? ‘গোড়াটায় দাঁতের কামড় নেই— নিশ্চয় নলে লাগানো হয়েছিল। যে- ছুরি দিয়ে কাটা হয়েছে, সেটা ভোঁতা— কেননা, কাটাটা অসমান।’

‘বুঝেছি তুমি কার কথা বলছ। খুনি হলেন—’ ঠিক এই সময়ে দরজা খুলে গেল। হোটেলের চাকর একজন আগন্তুককে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললে, ‘মি. জন টার্নার।’ ভদ্রলোকের চেহারাটা দেখবার মতো। বার্ধক্যের ভারে কাঁধ ঝুলে পড়েছে, পা টেনে টেনে হাঁটছেন, বলিরেখা আঁকা রুক্ষ মুখটি কিন্তু দুৰ্জয় মনোবলের প্রতিচ্ছবি। দাঁড়িতে জট, কার্নিশের মতো জটিল ভুরু— খানদানি, শক্তিমান চেহারা। কিন্তু মুখে যেন রক্ত নেই, ঠোঁট আর নাকের খাঁজ নীল হয়ে এসেছে। নিশ্চয় ছিনেজোঁক রোগের খপ্পরে পড়েছেন দীর্ঘদিন। প্রশান্ত কষ্ঠে হোমস বললে, ‘চিঠি পেয়েছেন তাহলে। বসুন।’ ‘আপনি লিখেছেন, কেলেঙ্কারি যদি না- চাই, তাহলে আপনার সঙ্গে যেন দেখা করি। ‘নিজে আপনার কাছে যায়নি ওই কারণেই।’ ‘বলুন কেন ডেকেছেন?’

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত