শুরুতে জায়গাটা ছিল একেবারে অন্যরকম, ঊষর, বৈরী এক প্রান্তর। কোন ভাবেই এখনকার অবস্থার সাথে মেলানো যাবে না। তিন বছরে বদলে গেছে সবকিছু-মরগান পিসের আলীশান শরীরের পাশে চার কামরার ছোট র্যাঞ্চ হাউস, লাগোয়া বার্ন, করাল; অন্যপাশে বেড়ায় ঘেরা ওঅটর ট্রাফ। সামনে ঢালু জমি কয়েক মাইল দূরে বাফেলো টাউনের ট্রেইলে গিয়ে যেখানে মিশেছে তার পুরোটাই সবুজ ঘাসে পরিপূর্ণ। স্যামুয়েল ব্রুকসের পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। এখন আর বোকা বলে ওকে অবজ্ঞা করতে পারবে না কেউ, বরং বিস্মিত হবে। মরুভূমির মত ঘাসহীন এ জায়গায় বসতি গড়ায় শুরুতে সবাই একচোট হেসেছে ওর বোকামিতে। এখন সময় হয়েছে ঈর্ষা করার-আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ তৃণভূমি হয়ে উঠবে এ তল্লাটে গরু চরানোর জন্যে আদর্শ জায়গা। তবে জায়গাটা ছোট, সব মিলিয়ে এর পরিধি হবে বড়জোর ত্রিশ মাইল। স্যামুয়েল ব্রুকসের তাতে আক্ষেপ নেই, সে অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়।
সার্কেল-এফ বাথানের ট্রেইলটা ক্রীক ছাড়িয়ে মূল ট্রেইল থেকে সরে উত্তরপুবে চলে গেছে। মরগান পিক্সের শুরু এখান থেকেই, এরপর ধনুকের ছিলার মত ক্রমশ উত্তরে বেঁকে গেছে। বাঁকের কেন্দ্রে ব্রুকসের র্যাঞ্চ হাউস। এতদূর থেকে ওটাকে দেখাচ্ছে ছোট্ট একটা লগ কেবিনের মত। সন্তুষ্টচিত্তে পুরো লেআউটের ওপর চোখ বুলাল ও, তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে স্পর দাবাল। এগোল সার্কেল-এফের ট্রেইল ধরে। তিন মাইল পরে ওদের সীমানার শুরু।
সার্কেল-এফ ওকে কি ধরনের অভ্যর্থনা জানায় এটা একটা চিন্তার বিষয়। কারণ বাফেলো টাউন আর আশপাশের এলাকায় স্যামুয়েল ব্রুকসের পরিচিতি কম কথার মানুষ ও ঘরকুনো হিসেবে। কারও সাথে মেশার আগ্রহ ওর মধ্যে কেউ দেখেনি কখনও। সাপ্লাই নিতে মাসে একবার বাফেলোতে আসে, কাজ শেষে ফিরেও যায়। কারও সাথে খোশ-গল্প দূরে থাক, এক পেগ হুইস্কিও গেলে না। জেনারেল স্টোরের মালিক উইলিয়াম লকহার্ট এ জন্যে ওকে কঞ্জুস হিসেবে আখ্যা দিতেও ছাড়েনি যদিও সেসব আমল দেয় না ব্রুকস। হুইস্কি একে তো সয় না তারওপর কষ্টার্জিত টাকা এভাবে খরচ করার ইচ্ছে ওর নেই। প্রতিটি পেনির পেছনে ঘাম ঝরাতে হয়েছে ওকে, মাঝে মাঝে জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয়েছে। আশার কথা সার্কেল-এফের লোকেরা আন্তরিক ও মিশুক, ওর ঠিক উল্টো স্বভাবের। বেসিনের যে কেউ ফ্ল্যাগানদের সম্পর্কে এ কথাটাই আগে বলবে।
সার্কেল-এফের বিশাল র্যাঞ্চ হাউসের সামনে এসে গতি কমাল ব্রুকস। দূর থেকে চোখ বুলাল বারান্দা আর সামনের ফ্লাওয়ার বেডের ওপর। দারুণ র্যাঞ্চ হাউস, জেমস ফ্ল্যাগানের রুচি আছে, স্যাডল ছাড়ার সময় ভাবল ও। সময় নিয়ে গায়ের ধুলো ঝাড়ল, আসলে কারও বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় আছে। সময়টা অবশ্য ওর বিরুদ্ধে, রাউন্ড-আপের ব্যস্ততায় পুরুষদের থাকার সম্ভাবনা কম। হ্যাট খুলে অবিন্যস্ত চুলে আঙুল চালাল, তারপর হিচিং রেইলের সাথে বাঁধল ঘোড়ার লাগাম।
হাউডি!
ধীরে পাশ ফিরল ব্রুকস। করালের দরজায় দাঁড়ানো মেয়েটিকে দেখে নড করল। ফ্ল্যাগান-কন্যা লরিয়া, কমনীয় মুখটা আগেও দুএকবার দেখেছে। তবে দূর থেকেই, পরিচয় হয়নি কখনও। আমি স্যামুয়েল ব্রুকস, ম্যাম, তোমাদের প্রতিবেশী, নিজের পরিচয় দিল ও। জেমস ফ্ল্যাগানের কাছে এসেছি।
বাবা তো রাউন্ড-আপে। দক্ষিণে মেকিট ক্রসিঙের কাছে পাবে ওকে।
কত দূর যেতে হবে?
উঁ…তুমি কি একটু অপেক্ষা করবে? বাবা হয়তো এসে পড়বে, বলেছিল এখানে এসে লাঞ্চ করবে। কাছে চলে এল মেয়েটি, চোখে একরাশ কৌতূহল। খুঁটিয়ে দেখছে ওঁকে। আমি লরিয়া ফ্ল্যাগান। সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিল।
দস্তানা খুলে হাত মেলাল ব্রুকস।
বাবার অফিসে গিয়ে বসতে পারো তুমি, কোণের একটা কামরা দেখিয়ে বলল লরিয়া।
কামরাটায় ঢুকল ব্রুকস। বড় একটা টেবিল, কয়েকখানা চেয়ার আর ডেস্ক-এই হচ্ছে আসবাবপত্র। উল্টোদিকে ভেতরের দিকে যাওয়ার দরজা। একটা চেয়ার টেনে বসল ও।
ঠিক দুই মিনিট পর এল মেয়েটি। হাতে ট্রে, তাতে কফির পেয়ালা আর থালায় দুই রকমের বিস্কুট। মি. ব্রুকস, মা তোমাকে এখানে লাঞ্চ করে যেতে অনুরোধ করেছে, ট্রে নামিয়ে রাখার সময় বলল লরিয়া। কেউ তোমার অপেক্ষায় থাকবে না তো?
উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না ও, কফির পেয়ালা তুলে চুমুক দিল। নিজের ওপর মেয়েটির কৌতূহলী দৃষ্টি অনুভব করছে।
বাফেলো টাউন ছাড়া এই প্রথম অন্য কোথাও এলে তুমি।
দরকার পড়েনি। স্মিত হেসে কৈফিয়ত দিল ও।
প্রতিবেশীর বাড়ি গিয়ে এক কাপ কফি খাওয়া বা সৌজন্যমূলক আলাপ করা, তোমার ধারণায় এটা প্রয়োজনের মধ্যে পড়ে না? তুমি তা করোনি, বোধহয় চাও-ও না কেউ তোমার বাথানে যাক।
সৌজন্য দেখাতে কেউ আমার বাথানে যায়নি, আমিও তা করতে গিয়ে অযথা কারও সময় নষ্ট করিনি।
বোঝা যাচ্ছে ভুল শুনিনি, হাসল মেয়েটি। সত্যি তুমি রহস্যময় লোক এবং বোধহয় একাই থাকতে চাও। কিন্তু শেষপর্যন্ত কি তা পারবে? র্যাঙ্কিং করতে হলে প্রতিবেশী বাথানগুলোর সাথে ভাল সম্পর্ক থাকতে হয়। ঝামেলার কথা নাই-বা বললাম, রাউন্ড-আপ বা ড্রাইভের কথাই ধরো-এসময় অন্যদের সাহায্য তোমার লাগবেই।
হাসল ব্রুকস, মেয়েটি ওকে বাজিয়ে দেখতে চাইছে। কথাগুলো বলছে সমালোচনার সুরে কিন্তু তাতে কৌতুকের মেশালও আছে। এতদিন তো দরকার হয়নি, তাই আমিও কারও কাছে যাইনি। এখন থেকে শুরু করলাম…
সৌভাগ্য আমাদের সবাইকে বলতে পারব স্যামুয়েল ব্রুকস নামের ঘরকুনো লোকটা সাহায্যের প্রত্যাশায় সার্কেল-এফে প্রথম এসেছে, উজ্জ্বল দেখাচ্ছে মেয়েটির সবুজ চোখ, গলায় হালকা সুর। দারুণ একটা খবর!
নির্লিপ্ত থাকল ব্রুকস, লরিয়ার আয়ত চোখে উপহাস খোজার প্রয়াস পেল, কিন্তু সেখানে কেবলই কৌতুক। অনুমতি নিয়ে সিগারেট ধরাল, ধীরে ধোয়া ছাড়ল যাতে সবুজনয়নার দিকে না যায়। মেয়েটির স্বতঃস্ফুর্ত ভঙ্গি ওকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। এমনভাবে আলাপ করছে যেন ওরা মোটেও সদ্য পরিচিত নয়। কারণটা-মেয়েটির চেনা পরিবেশ ও আন্তরিকতা। জেমস ফ্ল্যাগান, এসে ওকে উদ্ধার করুক, মনে মনে এটাই চাইছে।
একটা প্রশ্ন করব?
চোখ তুলে তাকাল ও।
তোমরা এ জিনিসটা খাও কেন?
একজন নিঃসঙ্গ মানুষের প্রিয় সঙ্গী এটাই, খানিক ভেবে হালকা সুরে বলল ব্রুকস। তবে অল্প সময়ের জন্যে।
অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল মেয়েটি, তারপর ফিক করে হেসে ফেলল। যুক্তি বটে! আরও কিছু বলতে চেয়েছিল, কিন্তু বাইরে খুরের শব্দ হতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। বাবা, দেখো কে এসেছে। একটু পর লরিয়ার অতি উৎসাহী গলা শোনা গেল।
ব্রুকস বুঝে উঠতে পারে না সবাই ওর সম্পর্কে এত কৌতূহলী কেন। সে একজন নির্বিরোধী মানুষ, কারও সাতে-পাঁচে নেই, একা থাকতে পছন্দ করে। এতে সবারই খুশি থাকার কথা, অথচ বাফেললা টাউনের আশপাশের লোকজন ওর সম্পর্কে জানতে চায়, বিশেষ করে যে-জীবন ও পেছনে ফেলে এসেছে তা সম্পর্কে।
পারকারদের কেউ নয়, ভরাট একটা গলা শোনা গেল। ওরা আমার এখানে আসবে না। খানিক থেমে উৎফুল্ল স্বরে বলল: বুঝেছি! ওই লোকটা, তাই না?
বুঝলে কি করে? হতাশা লরিয়ার কণ্ঠে।
কালো রোয়ানটা দেখে। ওই তেজি ঘোড়াটাকে বোধকরি বেসিনের সবাই চেনে। … তুমি কি দয়া করে আমার সোরেলটাকে করালে রেখে আসবে, ম্যাম? হেঁয়ালিভরা কণ্ঠ জেমস ফ্ল্যাগানের। আমি ওর সাথে কথা বলি। আশা করছি ওকে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়নি।
ততক্ষণে পোর্চে বেরিয়ে এসেছে ব্রুকস।
মানুষটা ছোট-খাট, পঞ্চাশের মত হবে বয়স। বেল্টের ওপর মাঝারি সাইজের একটা উঁড়ি। চলার মধ্যে দৃঢ় একটা ভাব আছে, বোঝা যায় আত্মবিশ্বাসী লোক। ধূসর চোখজোড়ায় একইসাথে কৌতূহল আর বন্ধুসুলভ চাহনি। সেকেন্ড কয়েকের জন্যে মিলিত হলো দুজোড়া চোখ, পরস্পরকে বুঝে নিল ওরা। এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল সার্কেল-এফ মালিক। সবল হাতটা ধরে ছেড়ে দিল ব্রুকস, ফ্ল্যাগানের পিছু নিয়ে এগোল। অফিস রূমে এসে, বসা পর্যন্ত আর কোন কথা হলো না। নিজের চেয়ারে বসে ড্রয়ার খুলে চুরুট বের করল ফ্ল্যাগান, অফার করল ওকে। তুমি-নিশ্চই কোন কাজে এসেছ?
আমার কয়েকটা বাছুর দরকার। লকহার্টের কাছে শুনলাম বেচবে তুমি।
লরিয়া ঢুকতে ওর দিকে তাকাল ফ্ল্যাগান। খাবার রেডি করবি, লরা? খুব খিদে পেয়েছে। আর ব্রুকস আমাদের সাথে খাবে। মেয়ে চলে যেতে অতিথির পানে ফিরল। কয়টা?
তিনশো।
কবে নেবে?
সম্ভব হলে আজই।
উঁহু, আজ নয়। কুলাতে পারব না। দুদিন পর ঠিক এসময়ে এসো। দক্ষিণে মাইল খানেক দূরে আমরা ক্যাম্প করেছি।
পকেট থেকে টাকা বের করে এগিয়ে দিল ব্রুকস। পনেরোশা, বান্ডিল করা বিশ ডলারের নোট। টাকা গুনে ড্রয়ারে ভরে রাখল ফ্ল্যাগান, তারপর সাদা কাগজে রসিদ লিখে দিল। এক কাজ করতে পারো-…এক ফাঁকে তোমার ব্র্যান্ডিং রডটা দিয়ে যেয়ো। মার্কা বসিয়ে গরুগুলো পৌঁছে দেবে আমার ছেলেরা। ওদের ভাল করে কফি খাইয়ে দিলেই চলবে।
কৃতজ্ঞতা অনুভব করছে ব্রুকস, ওর পরিশ্রম কমিয়ে দিয়েছে ফ্লাগান। এতগুলো গরু বাথান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া ওর একার পক্ষে সম্ভব হত না, তোক ভাড়া করতে হত। ব্র্যান্ডিংয়ের কাজটাও কি কম ঝামেলার?
ভেতর থেকে ডাক পড়তে খাবার ঘরে চলে এল ওরা। বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে বসল ব্রুকস। মাঝবয়সী সুশ্রী এক মহিলার সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিল ফ্ল্যাগান। উঠে দাঁড়িয়ে মিসেস ফ্লাগানকে বাউ করল ও। ক্ষীণ হেসে ওর থালায় খাবার তুলে দিল মহিলা। নীরবে খাওয়া শুরু করল ব্রুকস, এরকম আন্তরিক পরিবেশে অনভ্যস্ত বলে মৃদু অস্বস্তি অনুভব করছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, প্রথম পরিচয়ে এমন আন্তরিক আতিথেয়তা ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি। অথচ ও নিজে ঠিক উল্টো স্বভাবের।
আর কদিন লাগবে, বাবা?
তিনদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
এরপর ড্রাইভে যাবে?
যেতে তো হবেই। বেশি গরু রেখে লাভ কি! তাছাড়া ওগুলো বেচলে টাকাও আসবে।
কোন কথা ছাড়া খাওয়া শেষ করল ব্রুকস। চমৎকার রান্না, ওর মনে পড়ল এত ভাল রান্না শেষ কবে খেয়েছে। মিসেস ফ্ল্যাগানকে ধন্যবাদ জানিয়ে অফিস রূমে চলে এল। সাথে সার্কেল-এফ মালিক।
একটু পর বিদায় নিয়ে ফিরতি পথ ধরল ও।
লোকটা কেমন যেন, পোর্চে বাপের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে লরিয়া। ঠিকমত ধন্যবাদও দেয়নি। যেভাবে দিল তাতে মনে হলো ইচ্ছের বিরুদ্ধে দিচ্ছে।
এখানকার বেশিরভাগ লোকই এরকম, সাফাই গাইল বাথান মালিক। মুখে সৌজন্য প্রকাশ করার চেয়ে বিনিময়ে প্রতিদান দেয়াই ওদের পছন্দ।
কি যেন একটা আছে ওর মধ্যে…ঠিক খাপ খায় না। যতটা সহজ মনে হয়, ও হয়তো তা নয়। সাথে পিস্তল নেই, অথচ থাকলেই যেন মানাত ওকে।
এখন নেই কিন্তু হলফ করে বলতে পারি বহুবার পিস্তল ব্যবহার করেছে ও। ওর বুড়ো আঙুলে হ্যামার টানার দাগ দেখেছিস? আমার ধারণা নিজেকে লুকিয়ে রাখতে এখানে এসেছে ও। এ জন্যেই পিস্তল ছেড়ে সাধারণ মানুষের মত চলাফেরা করার চেষ্টা করছে।
তুমি ওকে গরু দিচ্ছ?
পরিশ্রমী লোক। বিশ্বাসই হতে চায় না মরুভূমির মত ওই জায়গাটায় ঘাস ফলিয়েছে, তা-ও আবার একা। প্রতিবেশী হিসেবে ওকে আমাদের সাহায্য করা উচিত। তাছাড়া ড্রাইভে গরুর সংখ্যা কমাতে পারলে সময় আর পরিশ্রম দুটোই বাঁচবে। দিগন্তে স্যামুয়েল ব্রুকসের অবয়ব প্রায় মিলিয়ে গেছে, সেদিকেই তাকিয়ে আছে ফ্ল্যাগান।
কিছু একটা ভাবছ তুমি, বাবা?
চলাফেরায় বোঝা যায় ব্রুকস সাধারণ লোক নয়। পশ্চিম এমন এক জায়গা যেখানে কেউ ইচ্ছে করলে সহজেই নিজেকে আড়াল করতে পারে, বিশেষ করে আউট-লরা।
ওকে সেরকম ভাবছ নাকি?
এটা তো ঠিক, এখানে সবচেয়ে রহস্যময় লোক ও-ই, হেসে ফেলল ফ্ল্যাগান, গলায় দ্বিধার সুর। কেউই ওর সম্পর্কে বেশি কিছু জানে না। হয়তো ও সত্যি নিরীহ, শুধু শুধুই আমরা সমালোচনা করছি। ঘুরে অফিসের দিকে এগোল সার্কেল-এফ মালিক, পেছনে আসছে লরিয়া। আমার ধারণা খুব শিগগিরই ঝামেলায় পড়বে ব্রুকস। পারকাররা ওর জমির ওপর থাবা বসালে মোটেই অবাক হব না।
তোমার ধারণা ভুলও হতে পারে, তর্ক করল লরিয়া। তিন বছর ধরে এখানে থাকছে সে, কই পারকাররা তো ওর পিছু লাগেনি?
হেসে সিগার ধরাল বাগান মালিক, আয়েশ করে বসেছে নিজের চেয়ারে। এতদিন অপেক্ষা করেছে। কেন জানিস? সবকিছু যাতে ওদের জন্যে তৈরি হয়ে যায়। পাহাড়ে নালা কেটে জমিতে পানি বইয়ে দিয়েছে ব্রুকস, মরা ক্রীকটাতে গ্রীষ্মের সময়ও পানি থাকছে, জমিতে ঘাস ফলেছে। পারকাররা এসব কষ্ট করতে যাবে কেন? তা করার ইচ্ছে থাকলে তো অনেক আগেই ওই জমিটার জন্যে ক্লেইম করতে পারত, এতদিন তো খালি পড়ে ছিল আর ব্রুকস এসেছে এই সেদিন।
তুমি অযথাই ওদের দোষ দিচ্ছ, বাবা!
বেসিনে চল্লিশ বছর ধরে আমি আছি, কম তো দেখিনি, জুলিয়াস পারকারের বাপকে দেখেছি, ওকেও দেখছি এখন। কয়েক হাজার একর সীমানা বার-পির, কিন্তু এর খুব কম জায়গাই নিজেদের হাতে গড়া, বেশিরভাগ অন্যান্য আউটফিটকে উচ্ছেদ করে জবরদখল করা। নিজের বিশাল সীমানার সাথে আরও ত্রিশ মাইল জায়গা বাড়াতে পারলে খুশিই হবে পারকার। মরগান পিকসের ঝর্না আর ওঅটর হোলগুলোর দখলও সে পেয়ে যাবে-পানির সমস্যা থাকবে না, শীত মরসুমের জন্যে পাবে একটা বাড়তি জায়গা। জুলিয়াস পারকার এ সুযোগ ছাড়বে না, কোন একটা উসিলায় ওর ওপর ঠিক চড়াও হবে, দেখিস। বাজি ধরবি?
মেয়ের মধ্যে তর্ক করার বা চ্যালেঞ্জের কোন অভিব্যক্তি দেখতে পেল না ফ্ল্যাগান। বরং চিন্তিত মনে হলো ওকে। এটা অন্যায়, মাথা নাড়ল লরিয়া, জোর করে এভাবে…।
সবাই জানে সেটা, মেয়েকে বাধা দিল সার্কেল-এফ মালিক। কিন্তু কার-ই বা কি করার আছে! মার্শাল জ্যাক হবস হয়তো কিছু করতে পারত, কিন্তু এসব ব্যাপারের চেয়ে হুইস্কির বোতলের দিকে ওর মনোযোগ বেশি।
ব্রুকস নিশ্চয়ই রুখে দাঁড়াবে।
কি করবে তা সে-ই জানে। সময়ই বলে দেবে। তবে আমার ধারণা, পারকাররা সহজে ছাড় পাবে না। সমস্যা কেবল এক জায়গায়—স্যামুয়েল ব্রুকস একা। ত্রিশ মাইল জমি আর ওদের মাঝখানে কেবল একটা লোক, ওকে সরিয়ে দিতে পারলেই তো জমিটা বার-পির হয়ে যাবে।
স্যামুয়েল ব্রুকস সবে নাস্তা শেষ করেছে। একা থাকার দিন সম্ভবত ফুরিয়ে এসেছে, কফির মগে চুমুক দেয়ার সময় ভাবল ও-রান্না করার জন্যে একজন লোক দরকার এবং কমপক্ষে দুজন কাউহ্যান্ড। এ কয়দিনে তিনশো গরু সামলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে। গরু সামলে এসে রান্না করা ভারী কষ্টের কাজ, এক মগ কফি তৈরি করতেও অনীহা জাগে। আলসেমি, না বুড়িয়ে যাচ্ছে? উহু, তা হবে কেন, সবে উনত্রিশে পড়ল কেবল। জীবন গড়ে নেয়ার আদর্শ সময় তো এটাই।, ফ্ল্যাগান সত্যিকার ভদ্রলোক, আন্তরিক এবং সৎ, কৃতজ্ঞচিত্তে ভাবছে ব্রুকস। ইচ্ছে করলে ওকে গড়পড়তা কিছু গরু দিয়ে দিতে পারত। সে-সুযোগ নেয়নি সার্কেল-এফ মালিক।
মিনিট দশ পর সবকিছু গুছিয়ে স্যাড়লে চাপল ও, বাফেললা টাউনের উদ্দেশে ঘোড়া ছোটাল। নিজের জমি ছাড়িয়ে মূল ট্রেইলে এসে গতি বাড়াল। কাজ শেষ করে দ্রুত ফিরতে চায়।
মাইল তিন পর, ট্রেইলটা বাক নিয়ে দক্ষিণে চলে গেছে। হাতের বামে পারকারদের বার-পি। তৃণভূমির যতটুকু চোখে পড়ছে দিগন্তের শেষ সীমানা পর্যন্ত অবারিত সবুজ ঘাস, অগুনতি তাগড়া গরু চরে বেড়াচ্ছে। নিঃসন্দেহে বারপি এ তল্লাটের সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ বাথান।
বাঁকের মুখে সাইক্যামোর ঝোপের সারি, পাশে বিশাল জোড়া কটনউড। গাছ দুটোর ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ-এ পর্যন্ত অন্তত সাতজন গরুচোরকে ঝোলানো হয়েছে ওগুলোয়। রাসলারদের ব্যাপারে পারকাররা খুব নির্দয়, দেরি না করে ধরামাত্র কাজ সেরে ফেলে।
হঠাৎ চোখে পড়ল দৃশ্যটা-সাইক্যামোর ঝোপের কাছে ব্যস্ত এক জোড়া নারী-পুরুষ। ওদের পেরিয়ে যাওয়ার সময় মৃদু গোঙানির শব্দ পেল ব্রুকস। ভাল করে তাকাতে দেখতে পেল মেয়েটাকে-লরিয়া ফ্ল্যাগান। জোর করে ওকে চুমো খাওয়ার চেষ্টা করছে লোকটা, তৃতীয় আরেকজনের উপস্থিতি খেয়াল করেনি বা ভ্রুক্ষেপ করছে না।
দ্রুত স্যাডল ছাড়ল স্যামুয়েল ব্রুকস, প্রায় নিঃশব্দে পৌঁছে গেল। লরিয়াকে ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে লোকটা। দুহাত দূরে এসে তার কাঁধে হাত রাখল ও। মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে ঘুরল সে, চোখে রাগ আর বেপরোয়া চাহনি। অবাক হলো ব্রুকস-উনিশ কি বিশ হবে ছেলেটির বয়স।
কোন নরক থেকে উঠে এসেছ, আঁ? তড়পে উঠল তরুণ। এত সাহস যে আমার কাঁধে হাত রাখো! ঝট করে কোমরে হাত বাড়াল।
তৈরি ছিল ব্রুকস, জানত এরকম কিছু হতে পারে। দুপা এগিয়ে ব্যানডানা ধরে টান দিতে ওর দিকে প্রায় উড়ে এল তরুণ। আচমকা আক্রমণে থমকে গেছে। হোলস্টার থেকে বের করে ফেলেছিল পিস্তল, টানের চোটে সেটা ছুটে গেল মুঠি থৈকে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে, একটা চড় এসে পড়ল গালে।
তোমার দেখছি কিছুই শেখা হয়নি, মাটিতে পড়ে যাওয়া পিস্তল বুট দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার সময় বলল ব্রুকস, গলায় মৃদু ভৎসনা। পরেরবার কোন মেয়েকে চুমো খাওয়ার আগে অনুমতি নিয়ো, কেমন?
ও তোমার মেয়েমানুষ নাকি, মিস্টার? অবজ্ঞা ফুটে উঠল ছেলেটার চোখে। থুথু ছিটাতে তা ব্রুকসের মুখে এসে পড়ল।
সেকেন্ড কয়েকের জন্যে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাল ব্রুকস। তরুণের গাল টকটকে লাল হওয়ার পর চড় থামাল। তারপর পেছনে ঠেলে দিতে কটনউডের সাথে বেমক্কা ধাক্কা খেয়ে ককিয়ে উঠল ছেলেটা, হুড়মুড় করে মাটিতে পড়ে গেল। এগিয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল ব্রুকস, কুঁকে ব্যানডানা খুলে নিয়ে মুখ মুছল, তারপর ওটা ছুঁড়ে দিল তরুণের দিকে। একটা কথা না বলে পারছি না। এখন থেকে ড্র করার আগে দেখে নিয়ে অন্যজনের কাছে পিস্তল আছে কি-না। তবে এ-ও ঠিক আমি নিরস্ত্র বলেই এখনও বেঁচে আছ।
ঘুরে লরিয়ার দিকে ফিরল ব্রুকস, দুঃখ প্রকাশ করল। খেয়াল করল মেয়েটার ফর্সা গালে চড়ের দাগ লাল হয়ে আছে। কিছুটা আড়ষ্ট আর বিমূঢ় দেখাচ্ছে। পাশেই সার্কেল-এফের ছাপ মারা একটা বাদামি অ্যাপলুসা দাড়িয়ে ছিল। ওটার লাগাম ধরে কাছে নিয়ে এল ও, ফ্ল্যাগান-কন্যাকে স্যাডলে চড়তে সাহায্য করল। কেঁপে উঠল মেয়েটার শরীর, ভয় পেয়েছিল, তারই প্রতিক্রিয়া।
উফ, খোদা! তুমি না এলে কি যে হত… দ্রুত বলল লরিয়া, শেষ করল না।
কিছুই ঘটত না, ভাবল ব্রুকস, দুএকটা চুমো খাওয়ার চেয়ে বেশি কিছু করার সাহস বোধহয় তরুণের ছিল না। নিজের রোয়ানে চেপে লরিয়ার দিকে ফিরল ও। কোথায় যাচ্ছিলে?
শহরে।
বাফেলোতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে এখনও?
মাথা ঝাঁকাল লরিয়া। কাজ আছে।
এগোল ওরা। একবার পেছন ফিরে তরুণকে দেখল ব্রুকস, সামলে নিয়ে স্যাডলে চেপে বসেছে।
ভবিষ্যণ্টা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, একটু পর ছোটার মধ্যে বলল লরিয়া, ঝামেলায় পড়বে তুমি। ও এত সহজে মার ভুলে যাওয়ার লোক নয়।
ব্রুকস কিছু বলল না, মুখ দেখে মনে হচ্ছে না এ-নিয়ে বিশেষ চিন্তা আছে ওর।
তুমি কি ওকে চেনো না? এমন ভাব করছ যেন আমি বাড়িয়ে বলছি! লরিয়ার কণ্ঠে অসন্তোষ।
ও বাড পারকার, এই তো?
তোমার কাছে পারকার নামটার কোন গুরুত্ব নেই?
তা নয়। ও একটা ভুল করতে যাচ্ছিল, শাস্তিও পেয়েছে। পশ্চিমে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা ঘৃণ্য কাজ। একটু আগে তুমিই বলেছ, মারের ব্যাপারটা সহজে ভুলবে না বাড পারকার। আমিও মনে করি আজকের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে পারে ও।
ও তা করবে না। পুরো ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নিচ্ছ তুমি।
তুমি কি ভয় পাচ্ছ, ম্যাম?
সেটাই তো স্বাভাবিক। পারকারদের বিরুদ্ধে যাওয়ার স্পর্ধা বেসিনে কেউ দেখায় না।
হয়তো। কিন্তু কোন কিছুই একতরফা ভাবে বেশিদিন চলে না।
চুপ করে থাকল লরিয়া, বুঝতে পারছে পারকারদের আলাদাভাবে গুরুত্ব দেয়ার পক্ষপাতী নয় এ লোক। দুঃসাহস হয়ে গেল না? বাড পারকার যদি এর শোধ নিতে চায় তো নির্ঘাত ওর কপালে খারাবি আছে।
শহরে পৌঁছানো পর্যন্ত কেউই আর কোন কথা বলল না।
বাফেলো টাউন ছোট্ট অগোছাল শহর। কয়েকটা জেনারেল স্টোর, সেলুন, কামারশালা, ব্যাংক, নাপিতের দোকান, আস্তাবল, পশ্চিমের আর সব শহরে যা থাকে। মাঝামাঝি জায়গায় ল-অফিস। চল্লিশোর্ধ্ব জ্যাক হবস আর ডেপুটি টিম ম্যাসন হচ্ছে বাফেলোর আইনের লোক। এ শহরের পত্তন জুলিয়াস পারকারের বাবা ফ্রেডারিক পরকারের হাতে, সে-ই প্রথম আসে এখানে। শহরটা তেমন বেড়ে ওঠেনি যতটা বার-পির বেলায় ঘটেছে। পারকারদের রোষে পড়েছে, আবার বেসিনেও টিকে আছে, এমন কিছু এখানে ঘটেনি। হয় দেশছাড়া হয়েছে নয়তো পারকারদের হাতে মারা পড়েছে। হাতে-গোনা দুএকজন ছাড়া কেউই জুলিয়াস পারকারের দিকে চোখ তুলে কথা বলার সাহস দেখায় না। এককথায় পারকাররাই বেসিনের হর্তা-কর্তা-বিধাতা।
উইলিয়াম লকহার্টের স্টোরের সামনে ঘোড়া থামাল ওরা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সঙ্গিনীর দিকে তাকাল ব্রুকস। হাসল মেয়েটি, ধকলটা কাটিয়ে উঠেছে। মিসেস লকহার্টের কাছে যাব। তুমি কি অপেক্ষা করবে?
নড করল ব্রুকস। স্যাডল ছাড়ার সময় খেয়াল করল বিস্ময়ের সাথে ওদের দেখছে স্টোর মালিক, পাশে এসে দাড়িয়েছে ওর বউ। কি যেন বলল মহিলা, সায় জানিয়ে মাথা ঝাঁকাল লকহার্ট।
হিচিং রেইলের সাথে ঘোড়াগুলোর লাগাম বাধল ব্রুকস, তারপর গায়ের ধুলো ঝেড়ে স্টোরে ঢুকে পড়ল। ওকে অভ্যর্থনা জানাল লকহার্ট, যেমনটা সব খরিদ্দারকে জানায়। মাথা ঝুঁকিয়ে মহিলাকে সম্মান দেখাল, প্রত্যুত্তরে হেসে লরিয়াকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল বুড়ি।
নিজের চাহিদার ফর্দ স্টোর মালিককে ধরিয়ে দিয়ে একটা টুলে বসল ব্রুকস। তোমার তো একটা সেলুন আছে?
তাক থেকে কফির জার নামাচ্ছিল সে, ফিরে তাকাল।
দুজন পাঞ্চার আর একজন কূক দরকার আমার। কেউ আগ্রহী হলে পাঠিয়ে দিয়ো।
মাথা ঝাঁকাল সে।
সিগারেট ধরিয়ে আনমনে ফুঁকে চলল ব্রুকস। দৃষ্টি রাস্তার ওপর, পথচলা লোজন দেখছে।
একটু পর ভেতর থেকে বেরিয়ে এল লরিয়া। সামনে এসে দাঁড়াল। আমার সাথে একটু আসবে, মি. ব্রুকস?
স্টোর থেকে বেরিয়ে ফুটপাথ ধরে এগোল ওরা। বেশ খানিকটা আসার পর ছুটন্ত ঘোড়ার শব্দে ঘুরে তাকাল ব্রুকস, দ্বিতীয়বারের মত দেখতে পেল তরুণকে। পেরিয়ে যাওয়ার সময় বিষদৃষ্টিতে তাকাল একবার, ক্ষত-বিক্ষত রাস্তায় একরাশ ধুলো উড়িয়ে পারকারদের সেলুন প্যালেস-এর সামনে থামল। স্যাডল ছেড়ে লাফিয়ে সিঁড়ি টপকে পোর্চে উঠে গেল, ঘোড়াটাকে রেইলে বাঁধার সময় পায়নি। ব্যাটউইং দরজা সপাটে ঠেলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
ক্রস টের পেল ওর কনুই চেপে ধরেছে লরিয়া। তোমার এক্ষুণি সরে পড়া উচিত, মি. ব্রুকস! আতঙ্ক মেয়েটার কণ্ঠে। বাড নিশ্চয় একগাদা লোক নিয়ে তাড়া করবে তোমাকে। সেলুনটাতে বার-পির লোকজন সবসময়ই থাকে।
আমরা কোথায় যাচ্ছিলাম?
আমি ভেবেছিলাম তোমার সাথে কফি খাব।
সত্যি কফি খেতে চেয়েছ? হেসে জানতে চাইল ব্রুকস।
লরিয়া বিস্মিত। আমি মিথ্যে বলি না!
কিছু মনে কোরো না, ম্যাম। কোন ভদ্রমহিলা, তা-ও তোমার মত সুন্দরী, আমার সাথে কফি খেতে চাইল এই প্রথম, ফের হাসল ও, চোখে কৌতুক। সেসৌভাগ্য আমি হারাতে চাই না।
অস্বস্তিবোধ করছে লরিয়া, ভয় হচ্ছে ওর। তোমার কাছে অস্ত্র নেই, অথচ সুযোগ পেলেই গুলি করবে ওরা। বাড তো একবার চেষ্টা করেছিল, আবার করতে দোষ কোথায়?
মিছে ভয় পাচ্ছ, ওরা তা করবে না…এই মেয়ে, আমার সাথে কফি খাওয়ার ইচ্ছে আর নেই তোমার, তাই না?
ন-না।
তাহলে চলল।
এবার উল্টোদিকে এগোল লরিয়া। ব্রুকস বুঝতে পারল হালকা কথাবার্তায়ও মেয়েটির আশঙ্কা দূর করতে পারেনি ও। ওকে যদ্দূর সম্ভব পারকারদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছে লরিয়া, এ জন্যেই উল্টোদিকে এগোচ্ছে।
বেশ খানিকটা এসে হাতের ডানে প্রথম রেস্তোরাঁ পেয়ে ঢুকে পড়ল ওরা। ছোট, গোছানো। প্রায় ফাকাই। মাঝবয়সী এক মহিলা উষ্ণ সম্বর্ধনা জানাল ওদের। লরিয়াকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল মহিলা, মৃদু স্বরে অনুযোগ করল: তুমি তো আমার এখানে আসোই না! ব্রুকসের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজ থেকে পরিচয় দিল। মিসেস রিচার্ডস।
একটা টেবিলে বসল ওরা। ব্রুকস বসেছে দেয়ালের দিকে পিঠ দিয়ে যাতে দরজা আর রাস্তার ওপর অনায়াসে চোখ রাখতে পারে। লরিয়ার আশঙ্কা হেসে উড়িয়ে দিলেও জানে তা একেবারে অমূলকও নয়। জুলিয়াস পারকারের তিন ছেলের মধ্যে বাডই সবচেয়ে উদ্ধত ও বদমেজাজী। আজকের ঘটনা কিছুতেই ভুলবে না সে। একটু আগে তরুণের মধ্যে যে অস্থিরতা দেখেছে তাতে ধরে নেয়া যায় খুব শিগগিরই আবার ওদের দেখা হয়ে যাবে।
মিসেস রিচার্ডস কফি আর কেক দিয়ে গেছে। তটস্থ হয়ে আছে লরিয়া, আনমনে সোনালি চুলের কয়েক গাছি নাড়াচাড়া করছে। অন্যহাতে কফির মগ, কিন্তু চুমুক দিচ্ছে না।
মিস্ ফ্ল্যাগান?
তাকাল লরিয়া।
কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
ক্ষীণ হেসে চুমুক দিল মেয়েটি আমার খুব ভয় লাগছে।
ব্রুকসের চোখে জিজ্ঞাসা।
পারকারদের খুব ভাল করে চিনি. আমি। তোমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না ওরা। বাড হচ্ছে ওদের ফোরম্যান জেফরি করবেটের শিষ্য, বাডের ঝামেলাগুলো সে-ই সামলায়। লোকটা বন্দুকবাজ, মারামারিতে আরও ভয়ঙ্কর। একবার ডাবলএসের দুজন পাঞ্চারকে এমন পিটিয়েছিল যে হপ্তাখানেক বিছানা থেকে উঠতেই পারেনি ওরা।…আমি তোমাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম। আমার জন্যেই…
হাত তুলে ওকে থামাল ব্রুকস। অযথা ভয় পাচ্ছ, ম্যাম। ওরকম কিছু হবে না, অন্তত এখুনি নয়।
চুপ করে থাকল লরিয়া, বোঝা যাচ্ছে নিশ্চিত হতে পারছে না।
উঠবে, এসময় দলটাকে দেখতে পেল ব্রুকস। বাড পারকারের সাথে আরও দুজন যোগ দিয়েছে। রেস্তোরাঁর কয়েক গজের মধ্যে চলে এসেছে ওরা, কাচের দেয়াল ভেদ করে তরুণের দৃঢ় জেদি মুখ দেখা যাচ্ছে। দ্রুত এগোচ্ছে, জানে কোথায় আসতে হবে।
একটু অপেক্ষা করো, ম্যাম। উঠে দাঁড়াল ব্রুকস।
ঝট করে পেছনে ফিরল লরিয়া, আতঙ্ক ফুটে উঠল চোখে। মি. ব্রুকস…
দ্রুত এগোল ও, বেরিয়ে পোর্চে এসে দাঁড়াল। তিনজনের দলটা ঠিক পাঁচ হাত দূরে। বাড পারকারের মুখে উপচে পড়া রাগ, মুখিয়ে আছে শোধ তোলার জন্যে। অন্য দুজনকে সাধারণ পাঞ্চার মনে হলো ব্রুকসের, সম্ভবত করবেট এদের মধ্যে নেই।
বাড, এই লোকটাই?
মাথা ঝাঁকাল তরুণ, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চাহনিতে ঘৃণা।
এসো পারকারদের গায়ে হাত তোলার সাহস ওর জনমের মত মিটিয়ে দেই! উস্কে দিতে চাইল অপর সঙ্গী। উৎসাহটা তারই বেশি।
বার-পি তাহলে এভাবেই খেলতে অভ্যস্ত, একজনের খেলা কয়েকজনে মিলে শেষ করে? আর এই নিয়ে তোমাদের এত অহঙ্কার? তাচ্ছিল্যভরে বলল ব্রুকস। তোমাদের যখন এতই শখ! আমারও আপত্তি নেই। এসো, দেরি কিসের? কফিটা ঠাণ্ডা হচ্ছে, আরেক কাপ নেয়ার ইচ্ছে আমার নেই।
প্রতিপক্ষের আত্মবিশ্বাস চিড় ধরাল ওদের মনোবলে, তবে তা ক্ষণিকের জন্যে। তীব্র গাল বকলবাড পারকার, তারপর তিনজনে মিলে ঝাপিয়ে পড়ল।
ভেতর থেকে তা দেখে দম বন্ধ হয়ে এল লরিয়ার। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, কিন্তু মুখ ফুটে কোন শব্দ বেরোল না। পরের দশ মিনিট সদ্য পরিচিত লোকটিকে ভিন্ন রূপে দেখতে পেল-ভয়ঙ্কর, হিংস্র এবং নির্দয়। প্রচণ্ড মার খেয়ে ধূলিশয্যা নিল ওরা, চোটটা বেশি গেল বাডের ওপর দিয়ে। বেছে, দেখে-শুনে মারল ব্রুকস যাতে প্রতিটি আঘাত মোক্ষম জায়গায় লাগে। শেষে, যেন কিছুই হয়নি এমনি নির্বিকার মুখে রেস্তোরাঁর ভেতরে ঢুকল। বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে এসে বসল ছেড়ে যাওয়া আসনে।
লরিয়ার মোর তখনও কাটেনি।
আরেক কাপ নেবে, ম্যাম? মৃদু স্বরে জানতে চাইল ব্রুকস, আগের মতই শান্ত দেখাচ্ছে।
মাথা ঝাঁকাল লরিয়া, অবাক হয়ে সঙ্গীকে দেখছে। পারকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে তুমি, একটু পর বলল ও। এখন আর পিছিয়ে আসার উপায়। থাকল না। মনে পড়ল কয়েকদিন আগে এমন আশঙ্কাই করেছিল ওর বাবা, এখন ঠিক তাই ঘটেছে। বার-পির সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে স্যামুয়েল ব্রুকস।
অথচ নিরুদ্বিগ্ন, নির্বিকার দেখাচ্ছে তাকে।
কি হয়েছিল, লরা? কফি পরিবেশন করার সময় জানতে চাইল মিসেস রিচার্ডস।
বয়ান করল লরিয়া।
সাবধানে থেকো, ব্রুকসের উদ্দেশে বলল মহিলা। আমার মনে হয় এখন থেকে সাথে একটা অস্ত্র রাখাই উচিত হবে তোমার। পেছনেও একটা চোখ রেখো। সুযোগ পেলে পিঠে গুলি করার মত লোকও ওদের আউটফিটে দুএকজন আছে।
মৃদু হাসল ব্রুকস, ধন্যবাদ দিয়ে বিল মেটাল।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে লকহার্টের স্টোরে এল ওরা। তাজা খবরটা তখন সারা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্রুকস খেয়াল করল করুণাভরে ওকে দেখছে কেউ কেউ। এ-নিয়ে ভাবার ইচ্ছে বা ফুরসৎ হলো না ওর, বরং লোকগুলোর প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে যাচ্ছে-মেরুদণ্ডহীন, পারকারদের ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। স্বয়ং লকহার্ট পর্যন্ত মুখে তালা মেরে রেখেছে। পাওনা বুঝে নিয়ে রসিদ দিল সে, একটা কথাও বলল না।
চিন্তিত দেখাচ্ছে লরিয়া ফ্ল্যাগানকে, প্যালেস-এর দিকে দৃষ্টি চলে যাচ্ছে বারবার। একটু আগে কয়েকজন এসে বিধ্বস্ত দেহ তিনটে সরিয়ে নিয়ে গেছে সেখানেই। লরিয়ার ভয় হচ্ছে এখুনি হয়তো একটা দল ছুটে এসে ঘিরে ফেলবে ওদের, সবাই মিলে এরপর ব্রুকসকে পেটাবে নয়তো কোন ঝামেলায় না গিয়ে কপাল বরাবর একটা বুলেট পাঠিয়ে দেবে। ওদের পক্ষে সবই সম্ভব। নির একটা লোককে খুন করা সহজ যদি আইনের পরোয়া না করা যায়। এ তল্লাটে পারকাররা যা বলে সেটাই আইন, অন্তত যা বলে তা ঘটে যায়।
শহর ছাড়িয়ে ট্রেইলে এসে ভয় কাটল লরিয়ার। সঙ্গীর দিকে তাকাল, ভাবলেশহীন দৃঢ় একটা মুখ, দিগন্তে ট্রেইলের ওপর দৃষ্টি স্থির। খানিক আগে যে ভয়ঙ্কর মানুষটাকে দেখেছে তার ছিটেফোঁটাও নেই এখন। শান্ত কিন্তু সতর্ক।
মি. ব্রুকস?
ফিরে তাকাল সে। এটা তোমার আসল নাম নয়, তাই না?
খুটিয়ে লরিয়াকে দেখছে ব্রুকস, অবাক হয়েছে।
সঙ্গীর বিস্ময়ে পুলকিত লরিয়া, উপভোগ করছে। তিনজন লোক যা পারেনি ওর একটা কথাই তাকে বিমূঢ় করে দিয়েছে। বাবার ধারণা তুমি একজন টাফ লোক এবং এর আগে হামেশাই পিস্তল ব্যবহার করেছ। আজ বোধহয় তার কিছু প্রমাণও মিলেছে। আর, আমার ধারণা বসতি করতে এখানে এসেছ তুমি, তাই না? লরিয়া খেয়াল করল গম্ভীর দেখাচ্ছে ব্রুকসকে, সতর্ক দৃষ্টি ফুটে উঠেছে চোখে।
কোন মেয়ে এত অল্প বয়সে সবকিছু এভাবে তলিয়ে দেখতে পারে, আমার জানা ছিল না, মৃদু স্বরে মন্তব্য করল ব্রুকস, এড়িয়ে গেল আসল প্রসঙ্গ। তুমি আমাকে অবাক করেছ, মিস্ ফ্যাগান।
কয়টা মেয়েকে জানো তুমি? যদ্দূর বুঝতে পারছি মেয়েদের ব্যাপারে তুমি আনাড়ি।
ব্রুকস নীরব।
আমি যা বললাম তা কি সত্যি?
হতে পারে।
তুমি স্বীকার করছ না, আবার অস্বীকারও করছ না!
মৃদু হাসল ব্রুকস, জবাব দিল না।
লরিয়ার কৌতূহল হচ্ছে, কিন্তু চাপাচাপি করার ইচ্ছেও নেই। পশ্চিম এমন একটা জায়গা যেখানে কেউ চায় না অন্যরা তার ব্যাপারে কৌতূহল দেখাক। স্যামুয়েল ব্রুকস তারচেয়ে এক কাঠি বাড়া, তিনটে বছর লোকজনকে এড়িয়ে চলেছে সে। তবে এটা ঠিক সত্যের অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছে ও, ব্রুকসের চমকে ওঠা অভিব্যক্তি তার প্রমাণ। তাছাড়া সে অস্বীকারও করেনি।
আমাদের বাথানে যাচ্ছ তো?
না। সীমানা পর্যন্ত তোমাকে এগিয়ে দেব।
কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ পরেও পাওয়া যাবে, ভাবল লরিয়া। তাই তর্ক করল না। এ লোকটিকে অনেকটাই বুঝতে পেরেছে, এর সাথে তর্ক করে লাভ নেই। একরোখা লোকদের সাথে তর্ক চলে না।
স্যামুয়েল ব্রুকস নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানাল তিনদিন পর মেক্সিক্যান এক বুড়ো, এমিলিও কন্টেজ ওর কূকের চাকুরিতে যোগ দেয়ায়। প্রথম দর্শনেই লোকটাকে ভাল লাগল, তারপর দুই বেলা খাবার পেটে পড়তে পুরো পছন্দ হয়ে গেল তাকে। আরও কয়েকটা কারণও অবশ্য আছে-বুড়োর কৌতূহল কম এবং হাতের কাজ শেষ করে সুযোগ পেলেই অন্য কাজেও ওকে সাহায্য করে।
এ কয়দিনে গত তিন বছরের নিঃসঙ্গতার ভয়ঙ্কর নতুন করে টের পেয়েছে ব্রুকস। পাশাপাশি থাকছে দুজন, কথা না বললেও লোকটার উপস্থিতি ওকে আনন্দ দিয়েছে। সারাদিনে খুব একটা বাক্যব্যয় না করলেও রাতে শোয়ার পর মুখে কথার খৈ ফুটতে শুরু করে মেক্সিক্যানের। রাত জেগে নিজের জীবনের অসংখ্য গল্প শোনায়। ব্রুকস মনোযোগ দিয়ে শোনে, এমিলিওর গল্প বলার ভঙ্গিটা অসাধারণ বলে কখনও একঘেয়ে লাগে না। তাছাড়া দুর্গম অঞ্চলে বুনো মোষ শিকার, ঘোড়া ধরা, প্রসপেক্টিং, টুম্বস্টোনের বিখ্যাত ফিউডের গল্প…এগুলো কার ভাল লাগবে?
পঞ্চম দিন সকালে নাস্তা সেরে কফি পান করার সময় একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল এমিলিও। ব্রুকস দুপুরে ফিরবে না বলে খাবার দিয়েছে। কি করবে আজ?
জানতে চাইল সে, সিগারেট রোল করছে।
একটা নালা কাটব, এক স্প্রিঙের কাছে জায়গাটা শুকিয়ে গেছে। মরগান পিকসের ঝর্না থেকে পানি বইয়ে দিতে হবে।
ঝামেলার কাজ। আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।
একাই পারব। তুমি বরং সময় পেলে গরুগুলোকে একটু দেখে রেখো।
শ্রাগ করল এমিলিও, এটো থালাবাসন নিয়ে বেসিনের কাছে চলে গেল।
কেবিন থেকে বেরিয়ে আসতে ওদের দেখতে পেল ব্রুকস। চারজন। মাইল খানেক দূরে আছে এখনও, দ্রুত এগিয়ে আসছে। রোয়ানের পিঠে স্যাডল চাপানোর ফাঁকে চোখ রাখল দলটার ওপর। ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে কাঠামোগুলো। নিজের নিরস্ত্র অবস্থার কথা ভাবল একবার, হয়তো ওরা গোলাগুলির মধ্যে যাবে না। মুখোমুখি লড়াইয়ে নিরস্ত্র কাউকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা সহজ কাজ নয়। কেবল জাত খুনী হলেই তা সম্ভব।
কাগজ ও তামাক বের করে সিগারেট রোল করল ও। এমিলিওকে ডাকল। ছোটখাট একটা ঝামেলা হতে পারে, বুড়োকে দরজায় দেখে বলল, তুমি আবার এতে নাক গলিয়ো না। হতে পারে কেবল কথা বলতেই এসেছে ওরা।
ঘোড়সওয়ারদের দিকে চকিত দৃষ্টি হানল মেক্সিক্যান, ছোট্ট করে মাথা নেড়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল ব্রুকস। দৃষ্টিসীমায় চলে এসেছে ওরা। ডান থেকে দ্বিতীয় লোকটা বিশালদেহী, সবচেয়ে বড় ঘোড়ায় চড়েছে, বিশালবপুর তুলনায় ওটাকে তবু ছোটই লাগছে। পাশেরজনকে কোনমতেই সুঠামদেহী বলা যাবে না। অন্যজন গড়পড়তা, পশ্চিমের সাধারণ বা খেটে খাওয়া মানুষ যেমন হতে পারে। এবং সবার আগে, একটা গেল্ডিঙে চড়ে আসছে বাড পারকার, মুখের আদল তাকে চিনিয়ে দিচ্ছে।
ওদের আচরণে কোন তাড়া নেই, ধীরে এগোচ্ছে এখন। কেবল বাড পারকার আগের মতই অস্থির, দৃষ্টিতে বিষাক্ত ঘৃণা আর প্রতিহিংসা। বিশালদেহী লোকটা জেফরি করবেট, ধারণা করল ব্রুকস। সামনে এসে দাঁড়াল বার-পি ফোরম্যান, কৌতুক ও অবজ্ঞাভরা দৃষ্টিতে তাকাল। কিন্তু ওকে খুঁটিয়ে দেখার পর, চাহনিতে প্রচ্ছন্ন সতর্কতা ফুটে উঠল। কিছু একটা তাকে সাবধান করেছে বোধহয়।
কষে সিগারেটে টান দিল ব্রুকস, নিস্পৃহ দেখাচ্ছে ওকে। ইচ্ছে করলে ভেতরে এসে বসতে পারো তোমরা। এমিলিও, কফির পানি চড়িয়ে দাও। উদ্দেশ্য যাই হোক, ওরা আমার এখানে আসা প্রথম অতিথি।
শুয়োরের বাচ্চা! ঝামটে উঠল বাড পারকার। কুত্তাটা আমাদের কফি সাধছে, করবেট, সাহস দেখো! ইচ্ছে করছে ওর কপালে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেই!
চুপ করো, বাড! জেফরি করবেটের চাপা ধমকে নিরস্ত হলো তরুণ।
দেয়ালে হেলান দিয়ে শরীরের ভর এক পায়ে চাপাল স্যামুয়েল ব্রুকস, সিগারেটের শেষাংশ ফেলে বুটের তলায় পিষল। বোঝা গেল, কফি খাওয়ার ইচ্ছে তোমাদের নেই। করবেট, তোমার বসুকে বোলো ছেলেটাকে সামলে রাখতে। নয়তো বেশিদিন বাঁচবে না ও।
কি যেন বলতে চেয়েছিল বাড, ফোরম্যান মুখ খোেলায় থেমে গেল। একটা কথাও নয়, বাড। অনেক গোলমাল করেছ, যথেষ্ট হয়েছে। এবার আমাকে সামলাতে দাও। ব্রুকসের দিকে ফিরল সে, পকেট থেকে সিগার বের করে ধরাল। তুমি দেখছি নিরস্ত্র। হালকা সুরে বলল করবেট।
হয়তো সেজন্যেই এখনও তড়পাচ্ছে তোমার বসের ছেলেটা।
অধৈর্য ভঙ্গিতে স্যাডলে নড়েচড়ে বসল বাড।
স্যামুয়েল ব্রুকস, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল করবেটের দৃষ্টি। তোমাকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দেয়া হয়েছে। এরমধ্যেই বেসিন ছেড়ে চলে যাবে। জুলিয়াস পারকারের আদেশ এটা। চব্বিশ ঘণ্টা পর তোমাকে এখানে দেখা গেলে মুখে কিছু বলার চেয়ে বুলেট পাঠাতে পছন্দ করবে বার-পির লোকজন।
কথাগুলো যাকে উদ্দেশ্য করে বলা, হাসল সে। তোমাদের ছকেই তাহলে খেলতে হবে?
সেটা তোমার ইচ্ছে। তবে ভাল হবে যদি চলে যাও।
ব্রুকসের হাসি অম্লান। তোমাদের বস্ একটা ধাড়ি শকুন। নিজের ছেলেকে সামলে রাখার মুরোদ নেই, অথচ বিনা দোষে আমাকে উচ্ছেদ করতে চাইছে। তাকে গিয়ে বোললা আমি থাকছি।
নীরবে চেয়ে থাকল র্যামরড, তরুণ উসখুস করছে।
ভুল করলে, বন্ধু, জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল! পরে আর শোধরানোর সুযোগ পাবে না।
চারজন এলে কেন তোমরা? পরকারের গোয়ালে বুকের পাটাঅলা এমন কেউ নেই নাকি যে একাই চরমপত্রটা দিয়ে যেতে পারত? শ্লেষের সাথে বলল ব্রুকস, চাপা হাসি ওর মুখে।
রাগে জ্বলে উঠল করবেটের চোখজোড়া।
ওকে পিষে ফেলো, জেফ! উস্কে দিতে চাইল এক পাঞ্চার। বড় বড় কথা বলার মজা টের পাইয়ে দাও।
চোপরাও, টার্নার! কি করতে হবে তা আমি বুঝব।
বার-পি সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা পেয়ে গেলাম, জেফরি, মৃদু স্বরে বলল ব্রুকস যেন খোশ-গল্প করছে। তোমার ওপর দেখছি আস্থা নেই ওদের। ভয় পেয়েছ?
চমকে উঠল ফোরম্যান। এটা লড়ার সময় নয়, সামলে নিয়ে বলল সে, সঙ্গীদের বিস্মিত মুখগুলো দেখল একবার।
কিন্তু কথা তো এরকম ছিল না! টার্নার নামের পাঞ্চারকে অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে। আমরা দেখতে এসেছি…।
চুপ করবে না দুটো থাবড়া মারতে হবে? ধমকে উঠল করবেট।
মিইয়ে গেল লোকটা, কিন্তু দৃষ্টিতে চাপা অসন্তোষ লেগে থাকল।
বাড পারকারের ঘোড়াটা হঠাৎ করে আগে বাড়ল, অন্যদের ছাড়িয়ে এগিয়ে এসেছে তরুণ। বিদ্যুৎ গতিতে কোমরে চলে গেছে ওর হাত, খোলা খাপ থেকে হেঁচড়ে মুক্ত হলো পিস্তল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলি করল। কিন্তু তাড়াহুড়োয় লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো সেটা, ব্রুকসের হ্যাট উড়িয়ে নিয়ে গেল। ফের গুলি করার চেষ্টা করল বাড, এবার সময় নিয়ে নিশানা করে।
কেবিনের ভেতরে বোমা ফাটল যেন। একটা শার্পসের কান ফাটানো গর্জনে থমকে গেল সবাই। বাডকে দেখে মনে হলো অদৃশ্য কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেয়েছে, স্যাডলে হেলে পড়ল। ওর পাঠানো গুলি ব্রুকসের মাথার ওপর দরজার পাল্লা ফুটো করেছে।
নড়বে না কেউ! শার্পস কক করার ভারী আওয়াজ চাপা পড়ে গেল। এমিলিওর চড়া কণ্ঠে। পিস্তলে হাত দিলেই মরবে। কাপুরুষের দল, আরেকটু হলে নিরস্ত্র একটা লোককে খুন করে ফেলেছিলে!”কফি খাওয়ার খায়েশ ওদের নেই, এবার নিশ্চয়ই বুঝেছ, সাম?
ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে গেছে সব কজন। স্বয়ং র্যামরডকেও বোকা বোকা দেখাচ্ছে। ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি এরকম কিছু হতে পারে। অবিশ্বাস নিয়ে দেখছে স্যাডলে হেলে পড়া বাড পারকারের শরীর। বুকের বাঁ দিকে বিশাল একটা গর্ত। রক্ত গড়িয়ে ঘোড়াটার গা বেয়ে নামতে শুরু করেছে। বাডের চোখ খোলা, পিস্তলটা এখনও ধরে রেখেছে মুঠিতে।
সবার আগে জেফরি করবেটই সামলে নিল। স্থির দৃশটিতে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল, চাহনিতে অপরিসীম ঘৃণা উপচে পড়ছে। ধীরে ফিরল ব্রুকসের দিকে। ওই লোকটাকে এখুনি ঘোড়া ছোটাতে বলল, ব্রুকস, কোথাও যেন না থামে। জুলিয়াস পারকারের কজে ছিড়ে নিয়েছে ও। দেখামাত্র ওকে খুন করবে মি. পারকার।
একটু ভুল হলো বোধহয়, তুমি বা অন্য কেউ বরং তার হয়ে কাজটা করবে। তোমাদের মত ডালকুত্তাদের এ জন্যেই বেতন দেয় পারকার। নিজে ওসব করতে গিয়ে প্রাণ খোয়ানোর ঝুঁকি নেবে নাকি?
মরার খায়েশ হলো নাকি, করবেট? ফোরম্যান নড়ে উঠতে চেঁচাল এমিলিও। পিস্তলটা বের করো তাহলে! দেখেও যদি না শেখো তো কে শেখাবে তোমাদের?
রাগে লাল হয়ে গেল করবেটের বিশাল রোদপোড়া মুখ। অ্যামিগো, জুলিয়াস পারকারের কাছে তোমাকে খুন করার অনুমতি চাইব আমি। সেটা পেলে কাজ সারার আগে পানিও ছোঁব না!
বাছা, আমার বয়স তোমার বাপের সমান, মেক্সের চাপা হাসি শোনা গেল। এই জীবনে তোমার মত ধাড়ি ষাড় অনেক দেখেছি। ওসব ফালতু আলাপ বাদ দাও, আর আমার মেজাজ খারাপ হওয়ার আগেই লাশটা নিয়ে কেটে পড়ো। তোমাদের হোঁৎকা মুখগুলো একেবারেই সহ্য হচ্ছে না আমার!
স্পার দাবাল জেফরি করবেট, বাডের পাশে এসে দাঁড়াল। স্যাডলে উপুড় করে শোয়াল তরুণের লাশ, ঘোড়ার লাগাম হাতে তুলে নিল এরপর। এ দানটাও তোমরা জিতলে। পরেরবার কিন্তু আর এরকম হবে না। তোমাদের শান্তিতে থাকতে দেব তেমন মানুষ আমি নই। পারকারদের লেজে পা দেয়ার মজা হাড়ে হাড়ে টের পাবে। বিশ্বাস করো, একটা শব্দও বাড়িয়ে বলছি না! ঘুরে এগোল সে, পাশাপাশি এগোচ্ছে লাশবাহী ঘোড়াটা।
ভুল বলেছ, বাছা। পারকারদের লেজে পা দেইনি আমি, বরং ওদের একটা লেজ কেটে দিয়েছি। বলে ফোরম্যানের ঘোড়ার ঠিক পায়ের কাছে গুলি চালাল এমিলিও।
চমকে লাফিয়ে উঠল অবলা প্রাণীটা, পিঠ থেকে সওয়ারীকে ফেলে দেয়ার উপক্রম করেছে। আতঙ্কে উধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল এরপর। ওটাকে বাগে আনতে বেশ কসরৎ করতে হলো করবেটকে, ততক্ষণে সঙ্গীদের ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে। পেছন ফিরে অনুসরণরত পাঞ্চারদের দেখল, তারপর ধীরে এগোল যাতে অন্যরা ওকে সহজে ধরে ফেলতে পারে।
সহাস্যে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল এমিলিও। হাতের শ্বাপস রাইফেলের গায়ে আদুরে চাপড় মারল। কেমন দেখালাম, বাছা?
ভুল করেছ।
অকৃতজ্ঞ। ঘনঘন মাথা নাড়ল মেক্সিক্যান, ব্রুকসের মন্তব্য মেনে নিতে পারছে না যেন। তোমার প্রাণ বাঁচালাম, অথচ বলছ ছোকরাকে মেরে আমি ভুল করেছি! আরে, তোমাকে ফুটো করার জন্যে গুলি করেছিল ও, তোমার সাধের হ্যাট ফুটো করার জন্যে নয়।
তো?
তোমার সৌভাগ্য যে প্রথমবার মিস করেছিল। আর দ্বিতীয়বার ওর আগেই আমি গুলি করতে পেরেছি।
একেবারে প্রাণে না মারলেও বোধহয় চলত।
এ কথা তুমিও জানেনা যে এসব হিংস্র কয়োেটদের বাড়তে দেয়া ঠিক না। প্রথম সুযোগেই বাড পারকারের মত কাপুরুষদের খুন করা উচিত। আজ ও একজন নিরস্ত্র লোককে খুন করতে যাচ্ছিল, বেঁচে থাকলে কাল পেছন থেকে কাউকে গুলি করত।
তা জানে ব্রুকস, কিন্তু স্বীকার করল না।
কেবল চব্বিশ ঘণ্টার নোটিশ দেয়ার জন্যে চারজনের আসা? ভদ্রলোকের মত আচরণ হয়ে যাচ্ছে না? যে কারণেই এসে থাকুক, ভাবছে ও, সলতেটাকে আরও উস্কে দিয়েছে এমিলিও। ক্ষমা নামের জিনিসটার সাথে পরিচয় নেই জুলিয়াস পারকারের। ছেলেকে হারিয়ে উন্মাদ হয়ে যাবে বুড়ো, বেসিন থেকে ওদের উৎখাত করার চেয়ে দুটো কবর খুঁড়তে পছন্দ করবে। আইনের ধার দিয়েও যাবে না, সবকিছুর শেষ দেখবে সে, যা করার করবে নিজ হাতে।
ফুটো হওয়া হ্যাট তুলে মাথায় চাপাল ব্রুকস। আনমনা হয়ে গেল। আর সব সাধারণ মানুষের মত বাকি জীবনটা ঝামেলা ছাড়া কাটিয়ে দিতে এখানে পাড়ি জমিয়েছিল ও, কিন্তু সে-সুযোগ এখন আর থাকল না। বাড পারকারের লাম্পট্য দিয়ে যে অশান্তির শুরু, মরে গিয়ে তা স্থায়ী করে গেছে উদ্ধত, অহঙ্কারী ছেলেটা।
বার-পি র্যাঞ্চ হাউস।
বিশাল অফিস রূমে মিলিত হয়েছে সবাই। পঁচিশজন পাঞ্চার, ফোরম্যান জেফরি করবেট, জুলিয়াস পারকার আর তার দুই ছেলে নিকোলাস ও অ্যালান। বাপের পাশে দুটো চেয়ারে বসেছে ওরা। বাথান মালিকের সামনের টেবিল আর নিজেদের মধ্যে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে বেঞ্চে বসে আছে জনা বারো কাউহ্যান্ড, অন্যরা পেছনে দাঁড়িয়ে। বেঞ্চের পাশে হাতলহীন একটা চেয়ারে বসেছে জেফরি করবেট।
জুলিয়াস পারকারের বয়স সবে ষাট পেরিয়েছে। এখনও সুঠামদেহী সে, দীর্ঘ পেশীবহুল শরীরে উদ্যমের কমতি নেই। পাঞ্চারদের মতই সকাল-সন্ধ্যা টানা পরিশ্রম করতে পারে। একাধারে সে যেমন বুদ্ধিমান, কুশলী, তেমনি অহঙ্কারীও। অন্যান্য বাথান মালিকের চেয়ে একটু আলাদা-সাধারণ পাঞ্চারদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলে।
এ মুহূর্তে তাকে মোটেও শোকাতুর মনে হচ্ছে না। চারদিন আগে করবেট যখন বাডের লাশ নিয়ে বাথানে পৌঁছেছিল, একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি বুড়ো। নিজের কামরা ছেড়ে এরপর মাত্র একবারই বেরিয়েছে, বাডের ফিউনেরালের সময়। ছেলের মৃত্যু তাকে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছে। তিন ছেলের মধ্যে বাডের প্রতি আলাদা টান, ছিল বার-পি মালিকের। ছেলেটাকে জন্ম দেয়ার সময় মারা যায় মিসেস পারকার। বাড মানুষ হয়েছে বাপের কাছে। বলা বাহুল্য বাপের লাই পেয়েই তার বখে যাওয়া। বাপ ছাড়া আর কাউকে যদি পাত্তা দিত তো সে হচেছ ফোরম্যান জেফরি করবেট। কৈশোর পেরোনোর আগে থেকেই করবেটের পেছনে ছায়ার মত লেগে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে যায় সে।
শান্ত কিন্তু দৃঢ় স্বরে নীরবতা ভাঙল বার-পি মালিক। বাড়কে অকালে হারিয়েছি আমি। ওই লোকগুলোকে হটানো ছাড়া অন্য কিছু আমার মাথায় নেই। কাজটা সহজ হবে না, কারণ ওরা কঠিন লোক। হয়তো শেষপর্যন্ত এটা দুটো আউটফিটের লড়াই হয়ে দাঁড়াবে। যারা অস্ত্র চালাতে জানো এবং বাডের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাও, তাদেরকে ছাড়া অন্যদের প্রয়োজন নেই আমার। কেউ যদি থাকতে না চায়, সে চলে যেতে পারে। এখুনি পাওনা বুঝিয়ে দেব আমি। ড্রয়ার খুলে নোটের বান্ডিল বের করল পারকার, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল পাঞ্চারদের দিকে।
বুড়ো এক কাউহ্যান্ড উঠে দাঁড়াল। মি. পারকার, আমার বয়স হয়েছে। তাছাড়া অস্ত্রও চালাতে পারি না তেমন। আমি চলে যেতে চাই।
লেজার, ফোরম্যানের উদ্দেশে হাঁক ছাড়ল বাথান মালিক।
কামরার একপাশে ডেস্কের ওপর কাগজপত্র রাখা। পুরু একটা খাতা সেখান থেকে তুলে নিল করবেট। পাতা উল্টিয়ে রাখল বসের সামনে। পাঞ্চারের পাওনা মিটিয়ে দিতে বেরিয়ে গেল সে।
আর কেউ?
শেষপর্যন্ত থাকল কেবল আটজন। শেষ লোকটা বিদায় নিতে হাত তুলল ফোরম্যান।
তুমিও চলে যেতে চাও নাকি? উপহাস জুলিয়াস পারকারের কণ্ঠে।
ক্ষণিকের জন্যে বিচলিত দেখাল র্যামরডকে। ওদের বিদায় না করলে কি চলত না, বস? সামলে নিয়ে বলল সে। নতুন লোক আসা পর্যন্ত সবকিছু সামলাতে ঝামেলা হবে।
এটা ওদের লড়াই নয়। কাউকে বাধ্য করতে পারি না আমি।
নীরবতা নেমে এল। একে একে সবার ওপর নজর বুলাল পারকার, শেষে স্থির হলো করবেটের ওপর। তোমার কি বলার আছে, জেফ? ঠিক যা যা ঘটেছে তা-ই শুনতে চাই।
মরগান আর টার্নারসহ চারজন গিয়েছিলাম আমরা। কথা ছিল ওকে আচ্ছামত ধোলাই দিয়ে কেটে পড়তে বলব। কিন্তু. থেমে ঢোক গিলল সে।
আমিই পিছিয়ে গেলাম।
তুমি!? মাত্র একটা শব্দে বিস্ময় প্রকাশ করল পারকার। অন্যদের চোখ ছানাবড়া, কথাটা হজম করতে সময় লাগছে। হাতাহাতিতে অজেয় জেফরি করবেট লড়ার আগেই পিছিয়ে গেছে এটা ওদের কাছে কোনক্রমেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
হ্যাঁ, আমি। কেন জানতে পারি? বুড়োর কণ্ঠে শ্লেষ।
আমি ওকে চিনতে পেরেছি। সাধারণ কেউ নয় ব্রুকস। মিসৌরীর একটা সেলুনে একবার লড়তে দেখেছিলাম ওকে। আমার চেয়েও দশাসই এক লোক টিকতেই পারেনি। লোকজন বলছিল ওর নাম বব ম্যালোন, আমার সন্দেহ ভুয়া নামে পরিচয় দিয়েছিল ও।…তবু সেদিন আমি লড়তে পারতাম, কিন্তু তাতে…
তারপর?
প্রথম থেকেই মুখিয়ে ছিল বাড। খেপে গিয়ে পিস্তল বের করল ও। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল ব্রুকস, নিরস্ত্র। তাড়াহুড়োয় মিস করল বাড। দ্বিতীয়বার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তার আগেই কেবিনের ভেতর থেকে ওকে গুলি করে মেক্সিক্যান লোকটা। আমরা জানতাম না ভেতরে সশস্ত্র কেউ আছে।
তিনজন দাঁড়িয়ে থেকে মজা দেখলে?
আমাদের কিছুই করার ছিল না, বস্। মেক্সিক্যানটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম, ওদিকে নিজেরা দাঁড়িয়ে আছি ভোলা জায়গায়। বাডের মৃত্যুর ধাক্কা সামলাতে আমাদের সময় লেগেছে। কিছু করতে গেলে কচুকাটা হয়ে যেতাম।
অকম্মার ধাড়ি, কাপুরুষের দল! অধৈর্য দেখাল বুড়োকে, রাগে লাল হয়ে গেছে ফর্সা মুখ, চোখে অগ্নিদৃষ্টি। উল্টোদিকের লোকগুলো ভয়ে সিটিয়ে গেল, বিশেষ করে মরগান, টার্নার আর ফোরম্যান।
অনেকক্ষণ পর শান্ত হলো বার-পি মালিক। লোকটা কে যাকে এত ভয় পেলে?
সঠিক বলতে পারব না, বস, কিছুটা দ্বিধান্বিত দেখাল ফোরম্যানকে। মিসৌরীর লড়াই শেষে এক বুড়ো হলফ করে বলছিল ওর নাম হারডিন, বব ম্যালোন নয়।
ওয়েসলি হারডিন? ধীরে প্রশ্নটা করল পারকার, ভুরু কুঁচকে উঠেছে।
নড করল করবেট।
ফিসফিস করছে পাঞ্চাররা। ওদিকে চিন্তিত দেখাচ্ছে জুলিয়াস পারকারকে।
বাবা, আমি বলি কি, নিচু কণ্ঠে আলোচনায় যোগ দিল নিকোলাস। লোকটাকে বোধহয় না ঘটানোই ভাল হবে। বাড সেধে ঝামেলা বাধিয়েছে ওর সাথে। লরিয়াকে উত্ত্যক্ত করার কি দরকার ছিল? ওটা দিয়েই তো শুরু। আর শেষ করেছে আগে পিস্তল বের করে।
পারকার এমনভাবে ছেলের দিকে তাকাল যেন সে নর্দমার একটা কীট বিশেষ। সিটিয়ে গেল নিকোলাস, ঢোক গিলল অজান্তেই।
তুমি বাডকে পছন্দ করতে না বলে এ কথা বলছ,মৃদু স্বরে অভিযোগ করল বুড়ো। এবং লরিয়া ফ্ল্যাগানকে তুমিও চাও, তাই না?
স্বীকার করছি। কিন্তু আমি একাই নই, বেসিনের বেশিরভাগ লোক ওর উদ্ধত আচরণ পছন্দ করত না।
শাট আপ, নিক! মরা ভাই সম্পর্কে এ কথা বলতে তোমার এতটুকু বাধল না?
চুপ করে থাকল নিকোলাস, মাথা নিচু করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে।
বাবা, প্রসঙ্গটা বোধহয় আমাদের বাদ দেয়াই উচিত, মৃদু কেশে বলল অ্যালোন। বাড কেমন ছিল, ওকে কেউ পছন্দ করত বা না করত তাতে কিছু যাবে-আসবে না এখন। আমাদের বরং চিন্তা করা উচিত কি করে লোকগুলোকে শিক্ষা দেয়া যায়। যে দুঃসাহস ওরা দেখিয়েছে তার বিনিময়ে চড়া মাসুল দিতে বাধ্য করতে হবে ওদের। বেসিনে বার-পির প্রভাব এখন হুমকির মুখে। ছোট্ট একটা আউটফিট যদি বার-পিকে আঘাত করতে পারে তাহলে অন্যদেরও সাহস বেড়ে যাবে। যেভাবে হোক প্রথম সুযোগেই ওদের শায়েস্তা করতে হবে।
তোমরা কি ভাবছ?
আইনের সাহায্য নেয়া যেতে পারে, বাতলে দিল নিকোলাস, মার্শাল যদি ওদের নামে হুলিয়া…।
ধোপে টিকবে না, বাধা দিল পারকার… ব্রুকসের বাথানে ঘুরে এসেছে হবস। বাডের লাশ আর পিস্তলও পরীক্ষা করেছে। সবাই জানে নিরস্ত্র থাকে ব্রুকস, ওকে ফাঁসানোর চেষ্টা করলে উল্টো বাডের ঘাড়েই দোষ পড়বে। মেক্সিক্যান লোকটাকে অভিযুক্ত করেও সুবিধে করা যাবে না, কারণ বাড দুটো গুলি করেছিল যার একটা লেগেছে দরজার পাল্লায়। জুরীদের জেরার মুখে টার্নার বা মরগান একটা মিনিটও টিকবে না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ওরা বার-পির লোক এবং ঘটনাস্থল হচ্ছে ব্রুকসের বাথান যেখানে ওরা চারজন আগ বাড়িয়ে গেছে।
ওসব আইনের ঝামেলায় আমি নেই। জ্যাক হবস কিছু করতে পারবে না, শহরের বাইরে, ওর ক্ষমতা খুব সীমিত। যা করার আমরাই করব। দৃঢ় স্বরে নিজের সিদ্ধান্ত জানাল পারকার।
কিন্তু ওদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে বললে এখানকার কজন রাজি হবে তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মনে করিয়ে দিল নিকোলাস।
সামনাসামনি হওয়ার দরকার কি? বিরক্তি জুলিয়াস পারকারের গলায়। দূর থেকে একটা বুলেট পাঠিয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়! একটা মানুষকে মারতে কটা বুলেট লাগে? দল বেঁধে হামলা করা যেতে পারে, কজনকে আর সামলাবে! মওকা মত পেলে কাজ হাসিল করতে কোন অসুবিধে হবে না।
চুপ করে আছে সবাই। ওরা জানে ব্যাপারটা মোটেও এত সহজ নয়। এখানে বসে হাতি-ঘোড়া মারা মুহুর্তের ব্যাপার মাত্র, কিন্তু বাস্তবে দল বেঁধে হলেও একজন ফাস্টগানের মুখোমুখি হতে সেরকম বুকের পাটা লাগে। কয়েকজন মিলে চেপে ধরলেও ওরকম একটা লোক মরার আগে দুএকজনকে সাথে নিয়েই মরবে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে সে যদি সত্যি হারডিন হয়ে থাকে সাধারণ পাঞ্চারদের কয়েকজনের দলও ওকে ঠেকাতে পারবে না। বহুবার একাধিক লোকের বিরুদ্ধে শো-ডাউন হয়েছে এ গানম্যানের।
বন্দুকবাজ ভাড়া করতে পারি আমরা, প্রস্তাব দিল অ্যালান। টাকা দিলে আমাদের হয়ে নির্দ্বিধায় কাজটা করে দেবে ওরা। হারডিনের সমকক্ষ অনেকেই আছে।
তোমরা বসে থেকে আঙুল চুষবে?
আমরাও ওকে মওকামত পাওয়ার চেষ্টা করব। তবে দলের মধ্যে কয়েকজন টাফ লোক থাকলে সবার মনোবল বেড়ে যাবে। তোমার পাঞ্চাররা এমনিতে ওদের সামনে দাড়ানোর সাহস করবে না, বাবা, এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। অন্তত এখন, ব্রুকসের পরিচয় জানার পর। সাফল্যের সম্ভাবনা না থাকলে কেউ লড়াই করে না, জেফরি নিজে তা প্রমাণ করেছে।
অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল ফোরম্যান।
মুখ দেখে মনে হচ্ছে অ্যালানের প্রস্তাব মনে ধরেছে বুড়োর। সবচেয়ে ভাল সমাধান এটাই, ভাবছে পারকার, কিছু টাকা হয়তো বেরিয়ে যাবে কিন্তু সেটা বাডের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়ার চেয়ে বড় কিছু নয়। তাছাড়া উপরি হিসেবে স্যামুয়েল ব্রুকসের জমিটা তো আছেই। প্রয়োজনে উকিলকে দিয়ে ভুয়া কাগজ তৈরি করে নিলেই হবে।
জেফ? ফোরম্যানের উদ্দেশে হাঁক ছাড়ল পারকার।
করবেটের পিঠ সোজা হলো।
টাকসনের উদ্দেশে এক্ষুণি রওনা দেবে তুমি। অ্যাবিলিন বা সনোরায়ও যেতে পারো। টাফ কিছু লোক চাই আমার। এমন লোক যারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে আমার নির্দেশ। টাকার জন্যে চিন্তা কোরো না, ওরা যা চাইবে আবার তাতেও রাজি হয়ে যেয়ো না। ওখানে গিয়ে তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। দরকার হলে কয়েকটা দিন থাকবে, বুঝে-শুনে লোক নেবে। ভাল হয় যদি সবখানে খবর ছড়িয়ে দিতে পারো যে সত্যিকার কঠিন কিছু লোক আমার দরকার এবং এ জন্যে উপযুক্ত পারিশ্রমিকও দেয়া হবে। একবার প্রচার করে দিতে পারলে চারপাশ থেকে ছুটে আসতে শুরু করবে ওরা। ওদের মধ্যে থেকে বাছাই করে লোক নেব। এই সুযোগে, ঝামেলাটা শেষ হলে অন্যদেরও একটু শিক্ষা দেয়া যাবে। কয়েকজনকে খোঁচা দিয়ে মনে করিয়ে দেয়া দরকার পারকাররাই বেসিনে শাসন করবে, তারা যা বলবে তা-ই ঘটবে এখানে।
গ্যারেটরা দুভাই হারডিনের ওপর খুব খেপা। অনেকদিন ধরে খুঁজছে ওকে। হারডিনকে খুন করতে এক পায়ে খাড়া হয়ে আছে, কেবল খবর পেলেই হলো, টাকার কথা চিন্তাও করবে না।
কেন?
শুনেছি ওদের ছোট ভাইকে খুন করেছে হারডিন। ফ্রিসকোর একটা সেলুনে সংবাদ পাঠালে যেখানেই থাকুক খবর পেয়ে চলে আসবে ওরা।
ওদের দুজন ছাড়াও অন্তত আরও একডজন লোক চাই আমি।
বাবা, শেষে ঝামেলায় পড়বে না তো? নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করল নিকোলাস। কাউন্টি শেরিফ বা ইউ এস মার্শালের কানে গেলে…
তুমি আজীবন কাপুরুষই রয়ে গেলে, নিক! কিছু করার আগেই খারাপ দিকটা তোমার মাথায় আসে। চাপা স্বরে খেদ প্রকাশ করল পারকার। খেই ধরার সময় নরম হয়ে এল তার কণ্ঠ। ওদের করার আছেটা কি, সান? এটা একটা রেঞ্জ ওঅর, দুটো আউটফিট লড়বে। দেখে যাওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারবে না। বড়জোর কোন সমঝোতার জন্যে আমাকে অনুরোধ করতে পারে, তা-ও যদি খবরটা কানে যাওয়ার পর এতদূর আসতে পারে এবং ততদিন পর্যন্ত যদি স্যামুয়েল ব্রুকস টিকে থাকতে পারে। জ্যাক হবসের কথাই ধরো, শহরের বাইরে ফুটো পয়সার দাম নেই ওর। বাথানগুলোর ব্যাপারে যাতে নাক গলাতে না পারে প্রথম থেকেই ওভাবে নিয়ম করা হয়েছে।
তাছাড়া অভিযোগ করবে কে? প্রথম সুযোগেই ওদের কচুকাটা করে ফেলব আমরা। মোটে তো দুজন! টানা অনেকক্ষণ কথা বলায় হাঁপিয়ে উঠেছে জুলিয়াস পারকার, কিন্তু উৎফুল্ল দেখাচ্ছে তাকে। হাসল বাগান মালিক, ছেলে মারা যাওয়ার পর এই প্রথম। কিন্তু সেটা চোখ স্পর্শ করল না। চোখে কেবলই প্রতিহিংসার আগুন।
এমিলিও স্বীকার করুক বা না করুক স্যামুয়েল ব্রুকস জানে বাড পারকারকে খুন করা তার উচিত হয়নি। এ উপত্যকায় আসার পর থেকে গত তিন বছরে পারকারদের সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছে ও, কয়েকটা ঘটনাও দেখেছে। কাউকে ছাড় দেয়নি ওরা। জুলিয়াস পারকার বেসিনের সবচেয়ে ক্ষমতাবান লোক, শুরু থেকে সে যা চেয়েছে তা-ই হয়ে এসেছে এখানে। প্রতিবেশীদের সাথে তার সুসম্পর্ক নেই, সবাই তাকে সমঝে চলার কারণে কারও সাথে তার বাধে না। তবে একবার বেধে গেলে আর শান্তিতে থাকারও জো থাকে না। পথের কাঁটা দূর করতে কোনবারই বেশি সময় নেয়নি বুড়ো। ব্রুকস অন্তর থেকে অনুভব করছে। এখানে শান্তিতে থাকার দিন ওর ফুরিয়ে এসেছে।
স্যামুয়েল ব্রুকসের ফেলে আসা জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে ছন্নছাড়ার মত। ভাল করে বুঝতে শেখার আগেই পথে নেমেছিল, অসংখ্য তিক্ত অভিজ্ঞতায় চিনেছে বৈরী পশ্চিমকে। প্রতিটি মুহূর্ত ওকে সতর্ক থাকতে হয়েছে, প্রয়োজনে অন্যের প্রাণ কেড়ে নিতে হয়েছে। সবই নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্যে। দিনের পর দিন এ কষ্টকর জীবন-যাপনে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ও। বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটানোর উদ্দেশে এখানে আসা। তিনটে বছর নির্বাটে কাটালেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ঝামেলা ওর পিছু ছাড়েনি।
চুপ করে আছে বার-পি, একটা আঙুলও নাড়ছে না। একেবারে বেমানান। ছেলে খুন হওয়ার পরও বসে থাকার লোক নয় জুলিয়াস পারকার। ক্ষুদ্র কারণেও তার হাতে অন্যের রক্ত লেগেছে। আট দিন আগে মারা গেছে বাড, অথচ ভাল মানুষের মত হাত গুটিয়ে বসে আছে বুড়ো। কারণটা বুঝতে পারছে না ব্রুকস, একেকটা দিন গড়ানোর সাথে সাথে তাই ওর অস্বস্তি বাড়ছেই কেবল।
কেবিন থেকে বেরিয়ে উপত্যকায় চলে এল ও। পশ্চিমাকাশের দিকে গড়াতে শুরু করেছে সূর্য, দুপুরের তপ্ত রোদ এখন আর নেই। বিস্তীর্ণ প্রেইরিতে চলতে থাকা গরুগুলোর ছায়া ধীরে ধীরে লম্বা হচ্ছে। কয়েক ঘণ্টা পর সন্ধ্যা নামবে, সময়ের খানিক আগেই উপত্যকায় আঁধার নামে, এর কারণ মরগান পিসের পাহাড়শ্রেণী অস্তমান সূর্যকে আড়াল করে ফেলে।
গরুগুলোর কাছে একটা গেল্ডিঙে দেখা গেল এমিলিওকে। নিশ্চিন্তে কাজ করছে লোকটা, এতটুকু উদ্বেগ নেই। বার-পি যে কোন সময়ে হামলা করতে পারে, কিন্তু তা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়। কেবল প্রিয় শার্পসটা হাতের কাছে রাখছে সর্বক্ষণ। ব্রুকসের আশঙ্কা তৃণভূমিতে বা কেবিনে ওকে একা পেয়ে কজা করে ফেলতে পারে বার-পির ক্রুরা। বয়সের তুলনায় যথেষ্ট ক্ষিপ্র সে, কিন্তু মুখোমুখি লড়াইয়ে কয়েকজনের বিরুদ্ধে লড়ার সামর্থ্য এখন আর নেই।
ওর নিজের ক্ষেত্রেও এরকম হবে, ভাবছে ব্রুকস। বয়স বাড়ার সাথে শরীর বেঈমানি শুরু করে, তরুণ বা যুবক বয়সের ক্ষিপ্রতা তখন আর থাকে না, সহজ কাজুটাও কঠিন হয়ে যায়। এ আশঙ্কাই ওকে ক্লান্ত করে তুলেছিল, নিঝঞাট একটা বসতি গড়তে উৎসাহিত করেছিল। অন্য দশজনের মত স্বাভাবিক মৃত্যু কামনা করে ও, কারও পিস্তলের গুলিতে মরতে চায় না। যাদের লাশ পেছনে ফেলে এসেছে তাদের ছেলে বা ঘনিষ্ঠ কারও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে ওর নেই।
পুব দিগন্তে এক ঘোড়সওয়ারকে দেখে ওর চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটল। ফ্ল্যাগানদের কেউ? মেক্সিক্যানের দিকে তাকাল একবার। নিঃসঙ্গ ঘোড়সওয়ারকে সে-ও খেয়াল করেছে। একটু পর, কাঠামোটা পরিষ্কার হতে অবাক হলো ব্রুকস। লরিয়া ফ্ল্যাগান। কাছে আসতে হ্যাট খুলে নড় করল।
কেমন আছ, মি. ব্রুকস? সহাস্যে জানতে চাইল লরিয়া, উজ্জ্বল দেখাচ্ছে মুখ।
একা বেরিয়েছ তুমি?
হুঁ।
ঠিক করোনি। এখানে এসেছ তোমার বাবা জানে?
না।
সে হয়তো চিন্তা করবে। ব্রুকস খেয়াল করল আড়ষ্ট দেখাচ্ছে মেয়েটিকে, এখানে এসে এতগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হবে ভাবতে পারেনি বোধহয়।
তুমি কেন ভাবছ বাবা চিন্তা করবে? আমি তো বাথান থেকে বেশি দূরে আসিনি! বাফেলো এরচেয়ে বেশি দূরে, সেখানেও একা গিয়েছি।
সেদিনের ঘটনাটা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?
ওহ, ওটা তো একটা দুর্ঘটনা! তাছাড়া বাড় পারকার…
এদেশে অসংখ্য বাড পারকার আছে, ম্যাম, লরিয়াকে থামিয়ে দিল ব্রুকস, কিছুটা রূঢ় শোনাল ওর কণ্ঠ। আমাকে কদিন ধরে চেনো? বুঝবে কি করে আমিও আরেকটা বাড পারকার নই?
আমি এখানে এসেছি তা পছন্দ হয়নি তোমার, সেটাই বলছ না কেন? থমথমে দেখাচ্ছে লরিয়ার মুখ।
হ্যাঁ, পছন্দ হয়নি।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল লরিয়া, অপমানটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে ওর। খুব বড় ভুল করে ফেলেছে?
অ্যাপলুসার পাশে এসে দাঁড়াল ব্রুকস, লরিয়াকে নামতে সাহায্য করতে হাত বাড়াল। মন বিদ্রোহ করতে চাইল ওর, ইচ্ছে হলো ফিরে যাবে। কিন্তু অজান্তে নেমে এল স্যাডল ছেড়ে। অনুভব করল কঠিন এ লোকটি সম্পর্কে কৌতূহল ওর জেদের চেয়ে অনেক বেশি।
ধন্যবাদ, ম্যাম, আন্তরিক কণ্ঠে বলল ব্রুকস, ম্লান হাসি দেখা গেল মুখে। লরিয়ার সবুজ চোখে চোখ রাখল। ভুল করে এসেছ তুমি, তবু…আমার এখানে প্রথম অতিথি হিসেবে তোমার মত মহিলা…ধন্য হলো আমার বাথান!
লরিয়ার মন ভাল হয়ে গেল, খানিক আগের তিক্ততা মনে থাকল না। ব্রুকসকে অনুসরণ করে কেবিনে ঢুকল। সব মিলিয়ে চারটে কামরা। একপাশে খাবার ঘরে গোলাকার টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার। কোণে চুলো আর জিনিসপত্র রাখার জন্যে কয়েকটা তাক। ব্রুকস চেয়ার টেনে ধরতে তাতে বসল ও। অচেনা একটা বাথান, কেবল দুজন পুরুষ-ব্রুকসের মতে এটা বিপজ্জনক জায়গা, এবং এই মুহূর্তে কেবল ওরা দুজনেই রয়েছে এখানে। কিন্তু মোটেই ভয় লাগছে না লরিয়ার, বরং লোকটি পরোক্ষভাবে এ প্রসঙ্গ তোলায় মৃদু অস্বস্তি হচ্ছে। কোন পুরুষ কি এত সহজে নিজেদের দুর্বল দিকটা এভাবে প্রকাশ করবে?
চুলোর কাছে গিয়ে কেতলিতে পানি চড়াল ব্রুকস, টিন থেকে বিস্কুট তুলে থালায় পরিবেশন করল। আগ্রহভরে দেখছে লরিয়া। মেয়েলি কাজ, ভাবছে ও, কিন্তু লোকটা তা করছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
খুব সহজে কাউকে বিশ্বাস করা ঠিক নয়, কফি নিয়ে এসে উল্টোদিকের চেয়ারে বসল ব্রুকস। আমার ধারণা বাড়কেও বিশ্বাস করতে তুমি। একবারও ভাবোনি এরকম কিছু হতে পারে সেদিন। ও কিছু একটা বলে তোমাকে স্যাডল ছাড়িয়েছে, তাই না?
নড করল লরিয়া, বিস্কুট চিবুচ্ছে।
ঠেকে শেখার আগেই সাবধান হওয়া ভাল।
তোমার কাছ থেকে তেমন কিছু আশা করছি না আমি, কারণ তুমি ওর মত নও।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ব্রুকস। মেয়েটি বোকা কি-না বুঝতে পারছে না। হয়তো সবার সাথে এরকম অন্তরঙ্গভাবে মেশে, তবু এভাবে সহজ হওয়া বিপজ্জনক। তর্ক করল না ও, ত্যাগ করে কফিতে চুমুক দিল।
তোমরা দুজনে মিলে সবকিছু সামলাচ্ছ?
মাথা ঝাঁকাল ও।
পারকারদের কেউ আর আসেনি?
না। আমি চাই না এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করুক ওরা। ছেলেটা নিজের ভুলে মরেছে। পারকারের উচিত তা মেনে নেয়া এবং সেটাই বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে। যদিও আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে পারকার তা মেনে নেবে কি-না। ব্রুকস খেয়াল করল লরিয়া বারবার ওর হাতের আঙুলগুলো দেখছে, বিশেষ করে বুড়ো আঙুল। প্রশ্নটা এল একটু পর।
পিস্তল ছাড়লে কেন?
প্রাণ কেড়ে নেয়া ছাড়া আর কি পারে ওগুলো? উঁহু, আরেকটা ব্যাপার…মানুষকে খুনীও বানায়।
নিজেকে তুমি খুনী মনে করো? লরিয়া বিস্মিত।
একসময় তা না ভাবলেও এখন কিন্তু তাই মনে হয় আমার, ক্ষীণ হেসে হাতের দিকে তাকাল ব্রুকস। অনেকগুলো মানুষ আমার হাতে মারা পড়েছে এটা ভাবলে নিজেকে খুনী ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না, যদিও সেগুলো আইনসিদ্ধ ছিল। যে লোকটা মারা গেল, তার পরিজনদের কথা চিন্তা করো, ম্যাম, ওরা কিন্তু একটা ডুয়েলকে খুন হিসেবেই দেখবে। একজন মহিলা যখন তার স্বামীকে হারায় তখন স্বামীর মৃত্যুই তার কাছে আসল, কিভাবে মারা গেল তা কোন ব্যাপারই নয়। জুলিয়াস পারকারের কথাই ধরো, নিরস্ত্র একজন লোককে খুন করতে গিয়ে মারা পড়েছে তার ছেলে, এরচেয়ে বড় ফেয়ার ফাইট হবে কখনও? কিন্তু পারকার মোটেও তা ভাববে না, পুত্রশোক ওর মধ্যে কেবল প্রতিহিংসার আগুন জ্বালাবে।
আপনমনে শ্রাগ করল লরিয়া। কি জানি, ঠিক বুঝতে পারছি না। তোমার কথাগুলো বইয়ের মত শোনাচে-কঠিন, অস্পষ্ট…তবে এটুকু বুঝেছি যে শোক যার, জ্বালাও তার। এবং নেহায়েত রক্ষা করাও বোধহয় বিপজ্জনক, তাই না? মৃত লোকের আত্মীয় বা বন্ধুরা এসে পরে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
মাথা ঝাঁকাল ব্রুকস।
আমার কৌতূহল হচ্ছে, পারকাররা যদি আবার আসে কি করবে তুমি, অস্ত্র ছাড়া ওদের ঠেকাবে কিভাবে?
কফি নেবে? হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল ব্রুকস। লরিয়া সায় দিতে চুলোর কাছে গিয়ে মগদুটো পূর্ণ করল।
তোমার সম্পর্কে অন্যরা কি ভাবে, জানো? অহঙ্কারী, অভদ্রলোক। কেউ কেউ বলে বেড়ায় পেছনে অন্ধকার একটা অতীত ফেলে এসেছ, আর এখানে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাও। আসলে ওরা তোমার সাফল্যকে ঈর্ষা করে, এমন একটা কাজ তুমি করেছ যা কেউ কল্পনাই করতে পারেনি।
কৌতুক বোধ করছে ব্রুকস যদিও কারও মতে ওর কিছু আসে-যায় না। জানালা গলে তাকাল প্রেইরির দিকে। সবুজ ঘাসগুলো ইতোমধ্যে বড়সড় হয়ে উঠেছে। তিনশো গরু চরার জন্যে যথেষ্ট জায়গা। স্টকটা এখুনি বাড়ানোর ইচ্ছে নেই ওর, ভাল করে ঘাস গজিয়ে উঠুক। বছর শেষে তাহলে আরও কয়েকশো গরু চরতে পারবে।
এমিলিওকে কেবিনের দিকে আসতে দেখল ও।
লরিয়া ফ্ল্যাগানের হুট করে এখানে আসার কারণ আঁচ করার চেষ্টা করল। মেয়েটা প্রথম থেকে ভেবে এসেছে ওর কারণেই পারকারদের সাথে ঝামেলায় জড়িয়েছে ব্রুকস। বার-পি হয়তো আরেকবার হামলা করেছে-এই উদ্বেগ কাটাতে এখানে আসা। এ ভাবনাই ওকে অচেনা একটা বাথানে আসতে প্ররোচিত করেছে। ফ্লাগানরা আন্তরিক, এ মেয়ে তারচেয়েও বেশি। খুব সহজে কথা বলছে অথচ ওদের পরিচয় হয়েছে মাত্র দুই সপ্তাহ হলো। বোকা নয় মেয়েটি, তাহলে ব্রুকসের অতীত নিয়ে সন্দেহ করত না। কিন্তু অন্যকে সহজে বিশ্বাস করার প্রবণতা আছে ওর মধ্যে। ঠিক এ জন্যেই বাড পারকার এতটা সাহসী হতে পেরেছে। এ সরলতাই হয়তো ওর নিরাপত্তার যোগসূত্র, পাশাপাশি ভয়েরও কারণ।
মেক্সিক্যানকে দরজায় দেখা গেল। অতিথিকে বাউ করল সে, সহাস্যে এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিল। লরিয়ার হাত টেনে নিয়ে উল্টোপিঠে চুমো খেল। কফির মগ হাতে ওদের সাথে যোগ দিল এরপর। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বুড়োকে পছন্দ করে ফেলল লরিয়া। ওদিকে এমিলিওর মুখ থামছেই না।
লরিয়ার মনে পড়ল অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। ক্ষমা চেয়ে উঠে দাঁড়াল, বিদায় নিল বুড়োর কাছ থেকে। বাইরে এসে দেখল নিজের রোয়ানে স্যাডল চাপিয়ে অপেক্ষা করছে স্যামুয়েল ব্রুকস, পাশে ওর প্রিয় অ্যাপলুসা। লোকটা ওকে এগিয়ে দেবে বুঝতে পেরে কৃতজ্ঞবোধ করল। ওকে স্যাডলে চাপতে সাহায্য করল সে, নিজে রোয়ানে চাপল এরপর।
পিঠে শেষ বিকেলের আলো নিয়ে সার্কেল-এফের দিকে এগোল ওরা।
মি. ব্রুকস?
পাশ ফিরে তাকাল সে।
তোমরা কি অনেকদিনের বন্ধু?
না। কয়েকদিন হলো কেবল।
অথচ আমি তাই ভেবেছিলাম…তোমাদের সম্পর্কটা আমার কাছে সেরকমই মনে হয়েছে। মাত্র কয়েকদিনে এত কাছাকাছি আসা কি সম্ভব? এখানে আসার পাঁচদিনের মাথায় তোমার পক্ষে অস্ত্র ধরেছে ও, একজন মেক্সিক্যান বুড়ো, ইয়াঙ্কি হলেও না হয় কথা ছিল।
মূল ব্যাপারটা অন্য জায়গায়-পরস্পরকে পছন্দ করা।
মাত্র কয়েকদিনে তোমরা বন্ধু হয়ে গেলে? নিজের জীবন বাজি রেখে তোমাকে বাঁচিয়েছে ও।
সেজন্যে প্রথম দেখা বা একটা ছোট্ট ঘটনাই যথেষ্ট, ম্যাম। আমি জানি ওকে তোমারও পছন্দ হয়েছে, কিন্তু কতক্ষণ লাগল? কাউকে মনে জায়গা দেয়ার ব্যাপারটা তো এরকমই।
মেয়েদের ক্ষেত্রেও? লরিয়ার মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল প্রশ্নটা।
কি যেন বলতে চেয়েও থেমে গেল ব্রুকস। হয়তো, ম্যাম, একটু পর নিচু কণ্ঠে বলল কিন্তু সেখানে অনিশ্চয়তার সুর নেই। কারও কারও জন্যে একটা মুহূর্তই যথেষ্ট।
কৌতূহল হচ্ছে লরিয়ার, কিন্তু চেপে রাখল সেটা।
সার্কেল-এফে ওরা যখন পৌঁছাল, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দেরি করতে চাইছিল না ব্রুকস, কিন্তু মিসেস ফ্ল্যাগানের কাছে ওর কোন আপত্তিই ধোপে টিকল না। সাপার খেয়ে তবে ছাড়া পেল।
ফেরার সময় পোর্চে বেরিয়ে এল লরিয়া। সার্কেল-এফের নিজস্ব হসল্যার করাল থেকে রোয়ানটাকে বের করে এনেছে। ব্রুকসের হাতে লাগাম তুলে দিয়ে সরে পড়ল নোকটা।
স্যাডলে চাপার সময় ওর হাত চেপে ধরল লরিয়া, আবছা আলোয় মেয়েটির চোখে কেবল উদ্বেগই দেখা গেল। সাবধানে থেকো, মি. ব্রুকস! পারকাররা খুব ভয়ঙ্কর মানুষ। সুযোগ পেলে
এ দেশটাতে কে ভয়ঙ্কর নয়, ম্যাম, অন্তত যারা টিকে আছে? হেসে মেয়েটিকে অভয় দেয়ার চেষ্টা করল ব্রুকস। এমিলিওর কথাই ধরো, মেক্সিক্যান এ বুড়ো যে কতটা ভয়ঙ্কর ওরা নিশ্চই তা টের পেয়েছে, তাই না?
নিজের ব্যাপারে তুমি সবসময়ই এড়িয়ে যাচ্ছে! চাপা স্বরে অভিযোগ করল লরিয়া। বিকেলে জানতে চেয়েছিলাম পারকাররা এলে কি করবে তুমি। আমি চাই…যদি ওদের এড়াতে না পারো…।
আমি এখানে শান্তিতে থাকতে এসেছি, ম্যাম, দৃঢ় স্বরে বলল ব্রুকস, থামিয়ে দিল ওকে। কারও অধিকার নেই আমার এ শান্তিপূর্ণ জীবন ওলট-পালট করে দেয়ার। আগের জীবনে আমি ফিরে যেতে চাই না। ওরা যদি তা করতে আমাকে বাধ্য করে, তো ভুল করবে।
অমঙ্গল আর বিপদের আশঙ্কায় চোখের পাতা কেঁপে উঠল লরিয়ার, শিহরিত হলো শরীর। অন্ধকারে তার কোনটাই দেখতে পেল না ব্রুকস, লরিয়ার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে স্পার দাবাল। প্রেইরির দিকে ছুটল ঘোড়াটা।
ট্রেইলে এসে দ্রুত ঘোড়া ছোটাল ব্রুকস। অনেক সময় নষ্ট করেছে বলে নিজের ওপর বিরক্ত।
কেবিনটা দৃষ্টিসীমায় আসতে খুঁটিয়ে দেখল ও। খাবার ঘরে বাতি জ্বলছে, ম্লান আলো এসে পড়েছে পোর্চ আর সামনের খোলা জায়গায়। স্যাডল ছেড়ে ঘোড়াকে নিয়ে করালে ঢুকল, এমিলিওর গেল্ডিঙের অনুপস্থিতি সতর্কঘণ্টী বাজাল ওর মাথায়। রোয়ানের ঘাড়ে মৃদু চাপড় মেরে বেরিয়ে এল। দ্রুত ঢুকে পড়ল কেবিনে, সব কটা কামরায় খুঁজে দেখল-নেই।
চুলোতে স্টু চাপিয়েছিল বুড়ো, শুকিয়ে গেছে। আরেকটু দেরি হলে বোধহয় প্যানটাতে আগুন ধরে যেত। চুলোর আগুন নিভিয়ে দিয়ে খুঁটিয়ে দেখল পুরো কেবিন আর করাল। একটা জিনিসও ছোঁয়নি কেউ। শুধু এমিলিও আর ওর গেন্ডিংটা লাপাত্তা হয়ে গেছে।
সহসা ক্লান্তি অনুভব করল ব্রুকস, একটা চেয়ারে বসে পড়ল। মনেপ্রাণে চাইছে আশঙ্কাটা মিথ্যে প্রমাণিত হোক। শনিবার আজ, এমিলিও হয়তো বাফেলোয় গেছে কিংবা কাছে-পিঠে আছে। কিন্তু স্টু-র প্যানটা ওকে মোটেও স্বস্তি দিচ্ছে না। চুলোয় রান্না চড়িয়ে কোথাও যাওয়ার লোক নয় এমিলিও। শার্পসটা টেবিলে পড়ে আছে। ওরা ঘরে ঢোকার আগ পর্যন্ত কিছুই টের পায়নি মেক্সিক্যান, নয়তো ব্যাপারটা এত সহজে ঘটত না। বন্ধুর পরিণতি আন্দাজ করতে পারছে ব্রুকস-নিজহাতে ওকে খুন করবে জুলিয়াস পারকার, নয়তো জেফরি করবেট। তবে শেষেরটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
কষে নিজেকে গাল দিল ও। মেয়েটিকে এগিয়ে দিতে যাওয়া ঠিক হয়নি, অন্তত সার্কেল-এফ পর্যন্ত। শুধু তাই নয় ওখানে ঘণ্টাখানেক কাটিয়েও এসেছে। এত বড় ভুল ও করল কি করে? তিনটে বছরের অসতর্ক জীবন ওর সব বিচারবুদ্ধি ভোঁতা করে দিয়েছে? পোর্চে বেরিয়ে এসে অন্ধকার প্রেইরির দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে তাকাল। শত মাথা কুটলেও ভুলটা এখন আর শোধরানো যাবে না। লরিয়াকে পৌঁছে না দেয়াও ভুল হত, নিজেকে বোঝাল ও, বিপদ হতে পারত মেয়েটার। ব্রুকসের দুর্ভাগ্য বার-পির লোকজন মোক্ষম সময়ে এসেছিল, ওর অনুপস্থিতিতে তাদের কাজ সহজ হয়ে গেছে।
নিজেকে সুস্থির করার চেষ্টা করল ও-করালে গিয়ে ঘোড়াকে দানাপানি দিল, তারপর সময় নিয়ে দলাই-মলাই করল। কাজের ব্যস্ততায় অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা দূর করতে চাইছে। বার-পিতে যেতে পারে, এখনও হয়তো খুব একটা দেরিও হয়ে যায়নি। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হবে না, ওরা ধরে নেবে সেখানে যেতে পারে ব্রুকস তাই জমকালো অভ্যর্থনার আয়োজন করে রাখবে ঠিকই। সেধে বাঘের খাঁচায় ঢোকার কোন মানে হয় না, এমিলিওকে যদি বাঁচিয়ে রাখে তো পরেও সুযোগ পাওয়া যাবে।
নিজের ওপর বিরক্তি অনুভব করছে ও। ভেবে পাচ্ছে না এমন ছেলেমানুষী ওকে পেয়ে বসল কি করে। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছে আজ, এমন ভুল যা কোনভাবেই শোধরানোর নয়। অথচ সর্বক্ষণ আশঙ্কা করেছে, জানত বার-পি হামলা করবে।
খাবার ঘরে এসে স্টোভে পানি চড়াল। কফির মগ হাতে টেবিলে এসে বসল। রোয়ানটাকে কেবিনের সামনে ছেড়ে দিয়ে এসেছে, অনাহত কেউ এলে ওকে সতর্ক করে দেবে। বহুবার এ কাজ করেছে ঘোড়াটা।
শোবার ঘরে এল ও। পাশের খালি বিছানাটা ওকে এমিলিওর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। আরও দুটো কামরা আছে, কিন্তু কোনটাই ব্যবহার করতে রাজি হয়নি বুড়ো। পাশের বাঙ্কটাই ছিল তার পছন্দ। রাতভর গল্প করেছে দুজনে, মাঝে মাঝে বই পড়ে শোনাত এমিলিও। মেক্সিক্যান হিসেবে লোকটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের। স্বগোত্রের লোকজনকে ছেড়ে এসেছে যুবক বয়সে, এরপর বিভিন্ন বাথান আর ক্যাম্পে কাটিয়ে দিয়েছে জীবনটা।
মাত্র কয়েকদিনের সম্পর্ক। বয়সের ব্যবধান বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি ওদের মাঝে। পরস্পরকে বুঝতে পারত ওরা। ব্রুকস বিশ্বাস করে মেক্সিক্যান এ বুড়ো ছিল ওর আত্মার আত্মীয়। ওর জীবনে কেবল এই একটি লোক মনেপ্রাণে ওর ভাল চেয়েছে। অবচেতন মন তাই মেক্সের মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নিতে চাইছে না। হয়তো সকালেই ফিরে আসবে ও, স্যাডল ছেড়ে হাঁক দেবে: আমার স্টু কোথায়, স্যাম, একাই সাবাড় করে ফেলেছ নাকি? তুমি তো আচ্ছা মানুষ!
ঘুম নেমে এল ব্রুকসের চোখে। সারা রাত কাটল আধো ঘুম আধো জাগরণে। যখনই জেগেছে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করেছে কোন শব্দ পায় কি-না।
ভোরে সূর্য ওঠার আগে বিছানা ছাড়ল। চুলোয় আগুন জ্বেলে বেকন আর ডিম ভেজে নাস্তা সারল, এরপর কড়া এক মগ কফি। ঘোড়াকে দানাপানি দিয়ে করাল থেকে বেরিয়ে আসতে ক্ষীণ আলোয় পঞ্চাশ গজ দূরে দেখতে পেল এমিলিওর গেন্ডিংটাকে। স্যাডলের ওপর উপুড় হয়ে আছে একটা দেহ। শিস বাজাতে কাছে চলে এল ঘোড়াটা।
এমিলিওর দেহ স্পর্শ করল ও। ঠাণ্ডা, শক্ত হয়ে এসেছে। সম্ভবত এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার পরপরই খুন করা হয়েছে। হাতের আঙুলগুলো থেতলানো, বাহু থেকে কজি পর্যন্ত সিগারেটের আগুনে পোড়া অসংখ্য দাগ, কয়েক জায়গায় ফোস্কা পড়েছে। গালে, গলায় দেয়া ছুরির পোচগুলোতে রক্ত জমাট বেঁধে সরু রেখার সৃষ্টি করেছে। শেষ কাজটুকু সারা হয়েছে কপালে গুলি করে, বিশাল গর্তের চারপাশে গানপাউডারের পোড়া দাগ। উল্টোদিকে, মাথার পেছনে তুলনায় বড় আরেকটা গর্ত, বুলেটটা বেরিয়ে গেছে এ-পথে। শুকনো রক্ত আর মগজে মাখামাখি।
এমিলিওর দেহ স্যাডল থেকে নামিয়ে বাকে শুইয়ে দিল ও। তারপর স্যাডল ছাড়িয়ে সময় নিয়ে ঘোড়াটার যত্ন নিল। সূর্য যখন পুব আকাশে উঁকি দিতে শুরু করেছে, এসময়ে শাবল আর গাইতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সজি বাগানের পাশে মাটিচাপা দিল মেক্সিক্যানকে। কবরের পাশে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল ও, একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। শুধু মনে মনে বন্ধুর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করল।
মরগান পিক্সের ঝর্না থেকে গোসল সেরে এসে নিজের কামরায় এল। এতটুকু উদ্বেগ, ক্লান্তি বা অস্থিরতা-কোনটাই নেই এখন। সম্পূর্ণ শান্ত, নির্বিকার দেখাচ্ছে ওকে। বাঙ্কের নিচ থেকে ট্রাঙ্ক বের করে খুলল, কাগজে মোড়া প্যাকেট বের করে সেটা নিয়ে খাবার টেবিলে এসে বসল। ট্রাউজারের পকেট থেকে এবার বের করল এক টুকরো কাগজ, এমিলিওর পকেট হাতড়ে পেয়েছিল। ওটার ভাঁজ খুলে মেলে ধরতে ঝকঝকে কয়েকটা লাইন স্পষ্ট হলো:
ভাগ্য দেখছি এবারও তোমার পক্ষে, স্যামুয়েল ব্রুকস। সময়মত ঠিকই অনুপস্থিত ছিলে। বলেছিলাম মেক্সিকান কুত্তাটাকে খুন না করে পানিও ছোঁব না। আগামীকাল সকালে বাফেলোতে হুইস্কি দিয়ে উদযাপন করব উপলক্ষটা।
নিচে কিছু লেখা নেই-কারও নাম বা স্বাক্ষর। কিন্তু এটা করবেটের, লেখা, জানে ব্রুকস। নিশ্চলক চেয়ে থাকল কাগজের দিকে, বুঝতে পারছে এটা একটা ফাঁদ। ওকে প্ররোচিত করে বাফেলোতে নিয়ে যেতে চায় বার-পি ফোরম্যান। তারপর সুযোগ বুঝে নিকেশ করবে নাকি হাতাহাতি লড়বে? একটু যেন বেশিই আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে তাকে অথচ কয়েকদিন আগে ওদের প্রথম দেখার সময় করবেট মোটেও তা ছিল না। কারণটা কি, আলাদা কোন আয়োজন?
সিগারেট ধরাল ও। চুলোয় ছুঁড়ে মারল কাগজটা। সামনে রাখা প্যাকেটের দিকে দৃষ্টি পড়তে শরীর-মন শান্ত হয়ে এল-একেবারে নিরুদ্বিগ্ন, দ্বিধাহীন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। কি করতে হবে তা-ও পরিষ্কার জানে। কাগজের মোড়ক সরিয়ে বহুল ব্যবহৃত জোড়া পিস্তল, হোলস্টার আর রাইফেল বের করল। অজান্তেই বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ক্ষীণ হাসল ও।
শান্তির চেষ্টা ওর এখানেই শেষ।
পুরানো একটা ব্যানডানা দিয়ে অস্ত্রগুলো মুছল। ঠাণ্ডা বুলেটের স্পর্শ ওকে মনে করিয়ে দিল ফেলে আসা অস্থির দিনগুলো। নাহ্, বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। এ জায়গাটাকে নিজের মত করে দেখেছে এমিলিও ওর জীবনের সেরা কিছু মুহূর্ত উপহার দিয়ে গেছে লোকটা। তার আত্মাকে শান্তি দিতে চেষ্টা করবে ও। কজন লোক আছে জুলিয়াস পারকারের—দশ, পনেরো? পরোয়া করে না ব্রুকস।
সিলিন্ডারে তাজা বুলেট ঢুকিয়ে সবকিছু পরখ করে দেখল। নিচু করে উরুতে বাঁধল হোলস্টারজোড়া। কামরার এককোণে গিয়ে দাঁড়াল। টান টান হয়ে গেছে শরীর। বিদ্যুৎগতিতে হাতে উঠে এল জোড়া পিস্তল, উল্টোদিকের দেয়ালে গাঁথা পেরেকে নিশানা করল। অস্ত্রগুলো ফেরত পাঠিয়ে কয়েকবার অনুশীলন করল। সন্তুষ্ট।
এবার রাইফেল পরখ করার পালা। টেবিলের ওপর থেকে ওটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে এল। বিশ মিনিট পর সন্তুষ্ট হয়ে উপত্যকা থেকে ফিরে এল ও। করালে ঢুকতে আনন্দ প্রকাশ করল রোয়ানটা, ছোটার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে। অন্যদিন ভোরে বেরিয়ে পড়ে, আজ তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। সব অর্থেই তাই, ভাবল ব্রুকস, আজকের দিনটা সম্পূর্ণ অন্যরকম।
একটু পর বাফেলার উদ্দেশে যাত্রা করল ও। রোয়ানটা জোর গতিতে ছুটতে চাইছে, লাগাম টেনে গতি কমাল। তাড়া নেই ওর। ছোটাছুটি করে ঘোড়াকে অযথা ক্লান্ত করার মানে হয় না।
বাফেলো টাউন যেন ঝিমিয়ে আছে। চওড়া রাস্তার দুপাশে বাড়িগুলোর ওপর নজর বুলাল ও। সকালের সূর্যের তেরছা আলোয় বাড়িগুলোর দীর্ঘ ছায়া রাস্তায় এসে পড়েছে, খুরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত রাস্তাকে তাতে আরও রুগ্ন, ধূলিধূসর মনে হচ্ছে। গির্জার ঘণ্টাধ্বনি মনে করিয়ে দিল দিনটা আজ রোববার। দুজন মহিলাকে গির্জার দিকে এগোতে দেখে থেমে, টুপি খুলে নড় করল ব্রুক।
উইলিয়াম লকহার্টের স্টোরের সামনে এসে স্যাডল ছাড়ল। হিচিং রেইলে লাগাম বেঁধে ঢুকে পড়ল ভেতরে। খদ্দের নেই। মিসেস লকহার্টকে কোথাও দেখা গেল না। বিস্মিত দৃষ্টিতে ওকে দেখছে স্টোর মালিক, সচরাচর যে সম্ভাষণ জানায় তা-ও জানাতে ভুলে গেছে। চোরা চোখে দেখছে ওর উরুতে বাঁধা জোড়া পিস্তল আর স্যাডল বুটে রাখা রাইফেল।
বিল, হেনরীটার জন্যে দুশো রাউন্ড বুলেট চাই আমার। আর কোল্টগুলোর জন্যে দুই বাক্স।
স্টোর মালিকের চোখ কপালে ওঠার বাকি। তোমার নিজের জন্যে! যুদ্ধ করবে নাকি?
বেচবে কি-না তাই বললা! বিরক্তি প্রকাশ করল ব্রুকস।
অবশ্যই! দ্রুত মাথা ঝাঁকাল লকহার্ট, ছুটে চলে গেল পেছনের কামরায়। তিনটে কাঠের বাক্স নিয়ে ফিরে এল। এত বুলেট দিয়ে করবে কিন্তু এখানে তো কোন… ব্রুকস চোখ তুলে তাকাতে থেমে গেল সে। সহসা টের পেল এতদিন ধরে যে স্যামুয়েল ব্রুকসকে চিনত সামনে দাড়ানো লোকটার সাথে তার বিরাট ফারাক। এ লোকটি বেপরোয়া। চোখের হিমশীতল দৃষ্টি বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। একে না ঘটানোই ভাল।
গুলির বাক্স খুলে এক মুঠি বুলেট তুলে নিল ব্রুকস, পকেটে ঢোকাল। তারপর বাক্সগুলো তুলে নিয়ে স্যাডল ব্যাগে ঢোকাল। বেরিয়ে ঘোড়ার কাছে গেল, স্যাডলের ওপর আড়াআড়িভাবে ফেলে ফিতা দিয়ে বাঁধল ব্যাগটা। চুম্বকের মত ওর ওপর সেটে আছে স্টোর মালিকের দৃষ্টি। ব্রুকস ঘুরতে চোখ ফিরিয়ে নিল লকহার্ট, হিসাবের খাতায় চোখ ডুবাল।
ফিরে এসে দাম মেটাল ও।
পারকার তোমার পিছু লেগেছে নাকি?
বেরিয়ে যাচ্ছিল ব্রুকস, থেমে ফিরে তাকাল। এমিলিওকে খুন করেছে ওরা।
শোনো, স্যাম, ঘণ্টাখানেক আগে শহরে এসেছে জেফরি করবেট। সাথে দুজন রাইডার। ওদের দেখে আমার মোটেও ভাল লাগেনি। দুজনেই বন্দুকবাজ। একজনের নাম শুনলাম ম্যাট লোগান। তোমার এখুনি সরে পড়া উচিত।
কোথায় আছে ওরা?
থমকে গেল লকহার্ট। স্যামুয়েল ব্রুকসের চোখে যা দেখতে পাচ্ছে তা বহু লোকের চোখে দেখেছে—খুনের নেশা। সেলুনে…ডাস্টি ফগের প্যালেস-এ আছে ওরা।
ধন্যবাদ, বিল।
বার-পির আরও লোক থাকতে পারে। জানোই তো সেলুনন্টাতে পারকারের শেয়ার আছে, আর ওর লোকেরা ওই সেলুন ছাড়া অন্য কোথাও বসে না। ওখানে যাওয়ার কথা ভাবছ নাকি?
উত্তর দিল না ব্রুকস, দৃঢ় পায়ে হেঁটে চলেছে ফুটপাথ ধরে।
যুবকের পিঠের ওপর আটকে রইল লকহার্টের দৃষ্টি। পরিবর্তনটা চোখে লাগছে খুব, হাঁটার ভঙ্গি পর্যন্ত বদলে গেছে। আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছে, নিজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে যেন নিশ্চিত, অটল! লোকটা বোকা নয়, তাহলে এতগুলো লোকের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে কেন? লকহার্ট নিশ্চিত যত আত্মবিশ্বাসই থাকুক পাত্তাই পাবে না যুবক। স্যামুয়েল ব্রুকসের এ সাহস ধুলোয় মিশিয়ে দিতে জেফরি করবেট একাই যথেষ্ট।
সেলুনে ঢুকে দরজার একপাশে সরে দাঁড়াল স্যামুয়েল ব্রুকস। বাইরের উজ্জ্বল সকালের তুলনায় ভেতরের আলোকে অন্ধকারই বলা চলে। চোখ সয়ে আসার আগে সিগারেট আর সস্তা হুইস্কির কড়া গন্ধ লাগল নাকে। দম ছেড়ে ধীরে শ্বাস নিল, ইতোমধ্যে দেখে নিয়েছে ভেতরটা। একপাশে, উঁচু বারের ওপাশে ডাস্টি ফগের বিশাল চর্বিবহুল শরীর, বার মোছায় ব্যস্ত হাতদুটো থেমে গেছে। ছড়ানোছিটানো টেবিলগুলোর বেশিরভাগই খালি। এককোণে একটা টেবিল দখল করেছে ওরা। ম্যাট লোগানকে একনজরেই চিনতে পারল ব্রুকস, মুখের লম্বা দাগটা তার পরিচয় দিচ্ছে। দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বসা বিশালদেহী লোকটা জেফরি করবেট। তৃতীয় লোকটিকে চিনতে পারল না। আরেক কোণে ভিন্ন একটা টেবিলে দুজন পাঞ্চার বসেছে, ডাবল-এসের শটি হারপার আর টমাস ক্যারি। ওদের দিকে নজর দেয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল ব্রুকস, নিতান্তই নিরীহ লোক।
ডাস্টি, যতক্ষণ আমি এখানে আছি তোমার হাত দুটো সামলে রেখো, বারকিপারের হাত বারের ওপর থেকে সরে যেতে উদ্যত হতে গর্জে উঠল ব্রুকস। ভাল হয় যদি ওগুলো ওভাবেই থাকে। চালাকির চেষ্টা কোরো না, পস্তাবে। ওর চোখ তিনজনের ওপর, উল্টোদিকের দেয়ালে লাগানো আয়নায় ডাস্টির সন্ত্রস্ত মুখটা দেখল একবার।
মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল বার-পি ফোরম্যান, চোখে খানিকটা বিস্ময়। বিমূঢ় ভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই টেবিলের কাছে চলে এল ব্রুকস। ম্যাট লোগানের ওপর স্থির হলো ওর দৃষ্টি। বাড়ি ছেড়ে অনেক দূর চলে এসেছ, লোগান। টাকার খুব টানাটানি যাচ্ছে।
নির্বিকার মুখে ওকে দেখছে বন্দুকবাজ। অন্য লোকটা গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে যাচ্ছিল, হাতে এখনও বোতল ধরা। শূন্য আরেকটা বোতল রয়েছে টেবিলে। বোঝা যাচ্ছে ভালই উদ্যাপন করছিল ওরা।
খেতে পারো, উদার কষ্ঠে ঘোষণা দিল ব্রুকস। কিন্তু ভুলেও টেবিল থেকে হাত সরিয়ে না কেউ। করবেটকে দেখল, বোকা বোকা দেখাচ্ছে। ওকে এভাবে আশা করেনি বোধহয়। পাশে এসে দাড়িয়ে টেবিল থেকে শূন্য বোতলটা তুলে নিল। হঠাৎ আয়নায় ডাস্টি ফগের নড়াচড়া ধরা পড়ল চোখে, বারের নিচে নেমে যাচ্ছে ওর ডানহাত। মরার খায়েশ হলো নাকি তোমার, ডাস্টি? হেসে ধমকে উঠল ব্রুকস, ধরা পড়ে গাওয়ায় তোকটার থমকে যাওয়া উপভোগ করছে। বের করো শটগানটা, কিংখা তোমার বাচ্চাগুলোর কথা ভাবো একবার। ওরা এতিম হয়ে গেলে কোন গবে? আরে এপাশে এসে দাঁড়াও, খালি হাতে এবং কাধের ওপর হাত তুলে রাখবে…মাথা খাটাও, ভাবাতে থাকে তুমি থাকলে বাচ্চাগুলো আর তোমার বউয়ের কি উপায় হবে।
সিদ্ধান্ত নিচ্ছে দেরি করল না ডাস্টি ফগ।
এমিলিওকে খুন করেছে কে, কবেই, তুমি?
বার-পি ফোরম্যান চুপ করে থাকল, ঘামতে শুরু করেছে
ওর গ্লাসটা ভরে দাও, লাগানের সঙ্গীর উদ্দেশে বলল ব্রুকস। ঝটপট খেয়ে নাও, জেফরি। আমার সাথে কথা বলতে বোধহয় তোমার সাহসে কুলাচ্ছে না। দুই ঢোক খেলে সাহস বাড়বে।
ঠায় বসে থাকল করবেট, হুইস্কি গেলার আগ্রহ দেখা গেল না তার মধ্যে।
এমিলিওর হাতের কাজটা বোধহয় তোমার, তাই না? বলে বোতলটা নামিয়ে আনল ব্রুকস, টেবিলের কিনারায় লেগে ভেঙে গেল। বোতলের মুখের অংশটা ওর হাতে ধরা। ফোরম্যানের মেলে দেয়া হাতের পাঞ্জার ওপর এবার আচমকা ওটা নামিয়ে আনল। তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল করবেটের কণ্ঠ চিরে, দশাসই দেহ কেঁপে উঠল। হাত সরিয়ো না, জেফরি, তাহলে কিন্তু মনে করব ড্র করতে যাচ্ছ তুমি। ওর শীতল নির্দেশ কাঁপিয়ে দিল লোকটাকে। এমিলিও ছিল, দুর্বল একজন বুড়োমানুষ। ওকে বাধা দেয়ার সুযোগও বোধহয় দাওনি তুমি। ওকে যখন মারছিলে একটা পিস্তল নিশ্চয় ধরা ছিল ওর বুকের দিকে?
এবারও কোন উত্তর দিল না করবেট, যন্ত্রণায় কাতর। বোতলটা পুনরায় চালাল ব্রুকস, আগের চেয়ে জোরে। দ্বিতীয়বারের মত আর্তনাদ করে উঠল র্যামরড। আড়চোখে অন্যদের দেখল ব্রুকস-ললাগান পাথর হয়ে আছে আর ওর সঙ্গী ছটফট করছে। ওদিকে করবেটের সারা শরীর কাঁপছে, কপালে ঘাম। বোকার মত চেয়ে আছে হাতের দিকে। উপচে পড়া রক্তে টেবিল সয়লাব।
তোমার কাছে বাড পারকারের জীবনের এতই দাম, এমিলিওর কোন মূল্য নেই? মরার আগে একটা সুযোগও পেল না হতভাগ্য লোকটা। অথচ কোন অন্যায় করেনি ও, তা তোমার চেয়ে ভাল আর কে জানবে! ফের হাত চালাল ও, ঝড়ের গতিতে নেমে এল বোতলটা। ব্যথায় নীল হয়ে গেছে করবেটের মুখ, কপাল থেকে ঘাম ঝরছে টপটপ করে।
ভাঙা বোতল ছেড়ে অন্যটা তুলে নিল ব্রুকস, ছিপি খুলে ফোরম্যানের রক্তাক্ত হাতের ওপর হুইস্কি ঢালতে শুরু করল। ঘায়ের ওপর লবণের ছিটা পড়েছে যেন, তীব্র জ্বলুনি শুরু হতে দুহাত, শরীর শক্ত হয়ে গেল করবেটের, দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা আর জ্বলুনি সহ্য করার চেষ্টা করছে।
পেছনে সরে এসে বারের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল ও। কাগজ-তামাক বের করে সিগারেট রোল করতে শুরু করল। জেফরি করবেট, আমি এখানে এসেছিলাম শান্তিতে থাকতে। ভেবেছি আর কখনও অস্ত্র ধরব না, কিন্তু তোমরা আমাকে বাধ্য করেছ। পারকারদের শেষ লোকটা বেঁচে থাকা পর্যন্ত থামব না আমি, তার আগেই যদি আমাকে থামাতে না পারো।
একটা সুযোগ দিচ্ছি তোমাদের, লোগান। নিজের ঘরে ফিরে যাও। রোজগারের হাজারটা ফিকির তোমার জানা আছে, এখানকার আশা বাদ দিয়ে তারই একটা চেষ্টা কোরো। সাথে তোমার বন্ধুকেও নিয়ে যাও। দয়া করে ভুলেও এখানে থাকার চিন্তা মাথায় এনো না। পরেরবার আমি হয়তো এমনিতে ছেড়ে দেব না।
তুমি একা, বন্ধু, ম্যাট লোগানের মুখে হাসি দেখা গেল। সে ভাল করে জানে যতক্ষণ পর্যন্ত নিজে পিস্তলে হাত না দিচ্ছে স্যামুয়েল ব্রুকসের তরফ থেকে বিপদের আশঙ্কা নেই। সবসময় এরকম অপ্রস্তুত অবস্থায় পাবে না আমাদের। বরং কয়েকজনে মিলে ঠিকই কোণঠাসা করে ফেলব তোমাকে।
ঠিক এটাই ভাবছিলাম, হেসে উঠল ব্রুকস। জানতাম আমার কথা তোমাদের ভাল লাগবে না। দল বেঁধে কাউকে শিকার করা সত্যি সহজ ব্যাপার সে যত টাফ লোকই হোক, তাই না? আরও সহজ যদি পেছন থেকে গুলি করা যায়। চেষ্টা করে দেখবে নাকি? যদ্দূর জানি এতে তোমাদের আপত্তি নেই।
হিংস্র চাহনি বন্দুকবাজের চোখে, পরে সেটা ঘূণায় রূপ নিল। তুমি টিকতে পারবে না, বন্ধু, সামলে নিয়ে বলল সে, তারচেয়ে এখান থেকে বেরিয়েই স্যাডলে চেপে ছুটতে থাকো, একবারও পেছনে তাকিয়ো না। টেক্সাস বা মেক্সিকোর দিকে গেলে বেঁচে যাবে। সেখানে একবার পৌঁছাতে পারলে নিরাপদ।
আমি থাকছি, লোগান। ব্যাজঅলা কেউ আমার পেছনে ছুটছে না যে টেক্সাস বা মেক্সিকো পাড়ি দিতে হবে।
শ্রাগ করল লোগান, উঠে দাঁড়াল। ভাবখানা যেন বেরিয়ে যাবে। পেছনে ঠেলে দিল চেয়ার, আড়চোখে দেখল সঙ্গীকে। তারপর দৃষ্টি রাখল ব্রুকসের হাতে ধরা সিগারেটের ওপর, ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটে লাগিয়ে টানতে শুরু করেছে ঠিক এসময়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর হাতে। অন্য লোকটাও কোমরে হাত বাড়িয়েছে।
ম্যাট লোগানের চোখে উল্লাস, কিন্তু সেটার স্থায়িত্ব হলো সেকেন্ডেরও কম সময়। হতবাক হয়ে দেখল ভোজবাজির মত ব্রুকসের হাতে উঠে এসেছে জোড়া পিস্তল। আগুন ঝরল। লোগানের মনে হলো দুটো গজাল ঢুকে পড়েছে বুকে। চেয়ারের ওপর ছিটকে পড়ল প্রথমে, তারপর চেয়ারসমেত হুড়মুড় করে পেছনে ঢলে পড়ল তার শরীর।
অন্য লোকটা সবে পিস্তল বের করেছে, ওর কপালে টিপ পরিয়ে দিল ব্রুকস। বুক ফুটো করল, পরের গুলিতে। ধীরে হাঁটু ভেঙে পড়ল লোগানের সঙ্গী, পড়ার সময় থুতনির ধাক্কায় ভারসাম্য হারাল টেবিলটা, শেষে কাত হয়ে পড়ল তারই ওপর।
নিথর দেহগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ব্রুকস। আরও দুটো লাশ, এ নিয়ে চার হলো। সংখ্যাটা কেবল বাড়তে থাকবে যদ্দিন না ও নিজে মারা যায় কিংবা পারকারদের খায়েশ মেটে।
অবিশ্বাসের সাথে লাশগুলো দেখছে জেফরি করবেট, ব্যথা ভুলে তাকিয়ে আছে। পিস্তল রিলোড় করে হোলস্টারে ফেরত পাঠাল ব্রুকস, ফোরম্যানের সামনে এসে দাঁড়াতে কাপতে লাগল বিশাল কাঠামো। ভয়ে সিটিয়ে গেছে, চোখে নগ্ন আতঙ্ক। বিশ্বাস করো, আ…আমি খুন করিনি এমিলিওকে! মিনতি ফুটে উঠল করবেটের কণ্ঠে। ওই লোগানই ওকে খুন করেছে। আমি শুধু একটু পিটিয়েছি।
ঠোঁট থেকে সিগারেট সরিয়ে ছাই ঝাড়ল ব্রুকস, ফের টান দিল। ম্যাট লোগান তো কিছু বলতে পারবে না। আমিই বলছি; জেফরি, তুমি একটা মিথুক! সিগারেট ফেলে বুটের তলায় পিষল ও করবেটের পেছনে এসে হোলস্টার থেকে তুলে নিল তার পিস্তল। সিলিন্ডার খালি করে বাঁট নামিয়ে আনল করবেটের চাদিতে। আলগোছে ঢলে পড়ল বিশাল দেহটা। পিস্তল পাশে ছুঁড়ে ফেলে বারটেন্ডারের দিকে ফিরল ও। আগের মতই দাঁড়িয়ে আছে ডাস্টি, চোখে ভয়। ভ্রুকুটি করতে আতঙ্ক ফুটে উঠল চোখে, পিছিয়ে গেল দুপা। বারের সাথে ঠেকে গেছে পিঠ।
সেলুন থেকে বেরিয়ে ফুটপাথ ধরে দক্ষিণে এগোল ব্রুকস। উল্টোদিকের দোকানের পোর্চে ভিড় করেছে কয়েকজন। তাদের ওপর একবার দৃষ্টি বুলাল ও, মুঠোভরা বুলেটগুলো ছুঁড়ে ফেলল রাস্তায়।
স্টোরের পোর্চে দাঁড়িয়ে ছিল উইলিয়াম লকহার্ট। সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিতে দেখছে ব্রুকসকে। গুলির শব্দ শুনেছে সে, তারপর ওকে বহাল তবিয়তে বেরোতে দেখে আঁচ করতে পারছে অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা। ম্যাট লোগান অ্যারিজোনার সেরা গানশ্লিংগার, তারওপর অন্য লোকটা আর জেফরি করবেট তো ছিলই…অন্তত তিনজনকে সামলাতে হয়েছে, ভাবছে স্টোর মালিক, কিভাবে সম্ভব হলো?
রোয়ানের কাছে এসে লকহার্টকে এক ঝলক দেখল ব্রুকস, স্যাডলে চড়ে বসল। আমার একজন উকিলের দরকার। পারকারের চামচা নয় এমন কেউ আছে?
বিল কারভারের কাছে যেতে পারো। সৎ লোক। ও-মাথায় রাস্তার পশ্চিমে দোতলায় ওর অফিস। পেছনের বাড়িটায় থাকে সে। অফিসে না পেলে বাড়িটাতে খোজ কোরো।
লাগাম ঢিলে করতে ধীরে এগোেল রোয়ানটা। পেরিয়ে যাওয়ার সময় ব্রুকস খেয়াল করল প্যালেস-এর সামনের ভিড় বেড়েছে। নিশ্চল দাড়িয়ে থেকে ওকে দেখছে লোকগুলো।
অসম একটা লড়াই শুরু হলো, ভাবছে ও। ম্যাট ললাগান ঠিকই বলেছে, শেষপর্যন্ত টিকে থাকার সম্ভাবনা ওর একেবারে নেই। ঠিক এ জন্যেই ব্রুকস চায়
মরগান পিকসের ওই জায়গা পারকার বা ওরকম কারও হাতে পড়ক। অনেক ঘাম ঝরিয়ে জমিটাকে আজকের অবস্থায় নিয়ে আসতে হয়েছে। অনাহূত কেউ এর ফল ভোগ করলে ওর সব পরিশ্রম বৃথা যাবে। নিজের কোন নিকটজন নেই, থাকলেও চেনে না। এমিলিওর ব্যাপারটাও সেরকম। সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রথম যে নামটা মাথায় এল তাতে চমকে উঠল ব্রুকস, কিন্তু একটু পরে সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলল।
ঘণ্টাখানেক পর বিল কারভারের অফিস থেকে বেরিয়ে স্যাডলে চাপল ও। কাজটা কি ভাল হলো? ভাবছে, এমিলিও বেঁচে থাকলে চিন্তা করতে হত না। এখন ওর সবকিছুর উত্তরাধিকারী ওই একজনই। এটা একটা চমক হবে। ক্ষমা প্রার্থনা করে একটা চিঠি লিখেছে, ওর মৃত্যুর পরই কেবল সেটা ভোলা হবে।
বাথানে ফিরে ঘোড়ার পরিচর্যা শেষে রান্না করল। খাওয়া সেরে অনুশীলন করল কিছুক্ষণ। সজি বাগানের কাছে চলে এল এরপর। তৃণভূমিতে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে গরুগুলো, সার্কেল-এফের কয়েকটা গরুও আছে সাথে। ফ্রি রেঞ্জ বলে এটা হবেই।
ব্রুকসের মনে হচ্ছে আগের জীবনে ফিরে গেছে, কেবল বিরামহীন চলাটা ছাড়া। সেই উদ্বেগ, সারাক্ষণ সতর্কতা আর বিপদের আশঙ্কা। মোটেও আফসোস নেই ওর। বরং এটাই ওকে শান্ত, সুস্থির রেখেছে। বাফেলো টাউনে যা ঘটল তা শুরুমাত্র, এরচেয়েও কঠিন পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। জুলিয়াস পারকারকে একটা নাড়া দেয়া গেছে, এবার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে বুড়ো। জেফরি করবেট আজ ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু লোকটার ধাত ভাল করে জানে ব্রুকস। সুযোগ পেলে পেছন থেকে গুলি করতেও দ্বিধা করবে না বার-পি ফোরম্যান।
শুধু লোক ভাড়া করেনি, টাফ লোকই জোগাড় করেছে বার-পি। নগণ্য এক স্যামুয়েল ব্রুকসকে শায়েস্তা করতে ম্যাট লোগানের মত বন্দুকবাজের প্রয়োজন হয় না। করবেট ওকে দেখে এত ভয় পেল কেন? এর ব্যাখ্যা একটাই-ওরা জানে কার সাথে লড়তে হবে। কি করে জানল? যেভাবে হোক, ভাবল ব্রুকস, টের পেয়েছে, এটাই হচ্ছে মূল ব্যাপার। ম্যাট লোগানের ব্যর্থতা সতর্ক করে দেবে ওদের। আরও টাফ লোক আনার চেষ্টা করবে এবার। নাকি ইতোমধ্যে এসে গেছে? সবাই লোগানের মত নয়, একই ভুলও বারবার করবে না। ওর কপালে সত্যি খারাবি আছে।
বিকেলে তৃণভূমিতে দুজন ঘোড়সওয়ারকে দেখতে পেল ব্রুকস, শহরের দিক থেকে আসছে। ওদের পরিচয় আন্দাজ করতে পারছে। কেবিনে গিয়ে চুলোতে পানি চড়িয়ে পোর্চে এসে অপেক্ষায় থাকল। কাছে আসার পর চিনতে পারল আগন্তুকদের, মার্শাল আর তার ডেপুটি।
দশ হাত দূরে এসে থামল ওরা। স্যাডল ছেড়ে হিচিং রেইলে ঘোড়ার লাগাম বাঁধল জ্যাক হবস।
ভেতরে এসো, জ্যাক, কফি আছে। আমন্ত্রণ জানাল ব্রুকস।
গাঁট হয়ে স্যাডলে বসে আছে টিম ম্যাসন, রোষ মাখানো দৃষ্টিতে দেখছে ওকে।
কি হলো তোমার, নামছ না কেন? ভেতরে ঢুকতে উদ্যত হয়েছিল মার্শাল, ফিরে খেঁকিয়ে উঠল ডেপুটির উদ্দেশে। নাকি ধরেই নিয়েছ ফ্ল্যাগানদের মত উপাদেয় হবে না ওর কফি?
দেখার মত প্রতিক্রিয়া হলো ম্যাসনের। রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখ স্বাভাবিক হতে সময় লাগল। ধীরে স্যাডল ছাড়ল সে, বিড়বিড় করে বলল কি যেন। ঘোড়ার রাশ বেঁধে কেবিনে ঢুকল। খাবার ঘরে একটা চেয়ারে জাকিয়ে বসেছে মার্শাল, আর চুলোর কাছে কফির আয়োজনে ব্যস্ত ব্রুকস।
তোমার সাথে কথা বলতে এলাম, হালকা সুরে বলল হবস। কিছু ব্যাপার খোলসা হওয়া দরকার।
কফির মগ হাতে ওদের সাথে যোগ দিল ব্রুকস। সিগারেট অফার করল।
তোমার কাজ-কারবার ধাধার মত লাগছে, স্যাম, গরম কফিতে চুমুক দিয়ে বলল মার্শাল। দুদিন আগেও যে লোক নিরস্ত্র থাকত, হঠাৎ করে কোমরে পিস্তল ঝুলিয়েছে সে। অনায়াসে ধরাশায়ী করে ফেলল ম্যাট লোগানের মত দুজন টাফ লোককে। তারও আগে থেকে, এখানকার লোকেরা সবচেয়ে কম জানে তোমার সম্পর্কেআমিও। নিজের সম্পর্কে কিছু বললানি তুমি। কোথেকে এসেছ এটাও পরিষ্কার জানে না কেউ।
নীরবে মার্শালকে দেখল ব্রুকস, ধীরে ধোয়া ছাড়ল। দেখো, জ্যাক, আমি কথা কম বলি সেটা তো কোন সমস্যা নয়। কারও সাতে-পাঁচে নেই এবং তোমার পোস্টারগুলোয় আমার ছবি পাবে না, এটাই হচ্ছে বড় কথা।
সেটাই তো চিন্তার বিষয়! পিস্তলগুলো দেখে মনে হচ্ছে ভাল চালাতে জানো, না খুব ভাল…নইলে ম্যাট লোগান মারা পড়ত না। এত ভাল একজন বন্দুকবাজকে চিনি না এটাই আমার মাথা-ব্যথার কারণ।
চুপ করে থাকল ও।
ম্যাট লোগানকে খুন করলে কেন?
আত্মরক্ষা করা কি খুন?
ওদের কেউ একটা গুলিও ছুঁড়তে পারেনি।
উল্টোটা হলে কি তুমি খুশি হতে, জ্যাক? ওরাই আমার আগে পিস্তল বের। করেছিল।
ডাস্টি কিন্তু এ কথা বলেনি। ও বলেছে হঠাৎ অস্ত্র বের করে গুলি শুরু করেছ তুমি.। একটা যুক্তিও দেখিয়েছে ও, আগে পিস্তলে হাত না দিলে লোগানের মত লোক তোমার হাতে খুন হবে না।
ডাস্টি ফগ একটা মিথুক! সেলুনে ডাবল-এসের দুজন পাঞ্চার ছিল, শর্টি আর টম। ওদের সাথে কথা বললে ভিন্ন কিছু শুনতে পাবে।
আমাদের ঠেকা পড়েছে? ফোড়ন কাটল ম্যাসন।
শীতল দৃষ্টিতে ডেপুটিকে দেখল ব্রুকস, যুবকের উদ্ধত আচরণ পছন্দ করতে পারছে না।
এখানে টিকতে পারবে না তুমি, স্যাম, খেই ধরল মার্শাল। সম্ভাবনা একেবারেই কম। পারকারদের সাথে সমানে-সমান লড়ার শক্তি তোমার নেই। তারচেয়ে, জমিটা বেচে দিয়ে কেটে পড়ো। তুমি থাকলেই ঝামেলা বাড়বে, আমাদের সমস্যা হবে।
ঝামেলা সামাল দেয়াই তোমাদের কাজ, জ্যাক।…সবকিছুর শুরু পারকাররাই করেছে। মিস্ ফ্ল্যাগানকে উত্ত্যক্ত করছিল ছেলেটা, আমি তাতে বাধা দিয়েছি। তুমি হলেও তাই করতে। এরপর বাড নিজে আগ বাড়িয়ে এসেছে আমাকে শায়েস্তা করতে। পরেরবার জেফরি করবেটসহ চারজন এসেছিল। আমি নিরস্ত্র ছিলাম, তারপরও ড্র করেছিল বাড়। আমার সৌভাগ্য রাইফেল হাতে জানালায় বসে ছিল এমিলিও। পারকারদের পক্ষ থেকে এমন কাপুরুষােচিত আচরণ আশা করিনি আমি, অথচ তা ঠিকই টের পেয়েছে এমিলিও।
নিজের জীবনের বিনিময়ে আমাকে বাঁচানোর খেসারৎ দিয়েছে ও। গতকাল ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল করবেট, ওর শরীরে ইচ্ছেমত হাতের কারসাজি দেখিয়েছে। কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে এরপর নির্দয়ভাবে খুন করেছে। একটা সুযোগ কি ওর পাওয়া উচিত ছিল না?
আত্মরক্ষা করা কি দোষের, তোমার আইন কি বলে, জ্যাক? বারবার মার দেবে ওরা, আর চুপ করে থেকে দেখব কেবল? ম্যাট লোগানকে আমি চলে যেতে বলেছিলাম, সুযোগটা ও নেয়নি।
এরকম আর কোন ঘটনা বরদাস্ত করব না আমি, কঠিন শোনাল মার্শালের কণ্ঠ। পিস্তলবাজি করতে হলে শহরের বাইরে করবে।
আমি যা করেছি, সবই বাধ্য হয়ে। ওরা কিছু না করলে আমিও ভাল মানুষ।
আমার শহরে তুমিই শুরু করেছ। ওরা তোমার কাছে যায়নি, বরং তুমিই ওদের কাছে গিয়েছিলে।
করবেটকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম ও এমিলিওকে খুন করেছে কি-না। তবে তৈরি ছিলাম কেউ যাতে আগের মত নিশ্চিন্তে গুলি করতে না পারে। পার্থক্যটা এখানেই। ওরা ড্র করায় আমাকে পিস্তল ব্যবহার করতে হয়েছে।
কিন্তু পিস্তলের মুখে করবেটকে বোতল দিয়ে পিটিয়েছ তুমি, যোগ করল ম্যাসন। ডাস্টি কসম খেয়ে বলেছে।
বুঝতে পারছি না ডাষ্টি নাকি পারকারদের সাথে তোমার খাতির বেশি, কাটা কাটা স্বরে ডেপুটির উদ্দেশে বলল ব্রুকস। ডাস্টি এটা নিশ্চয়ই বলেনি যে আমি সেলুনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শটগান বের করতে চেয়েছিল ও? জ্যাক হবস, মার্শালের দিকে ফিরল ও। তোমার ডেপুটিকে একটা অপদার্থ মনে হচ্ছে। তদন্তের আগেই একজন বারকিপারের কথাকে যে ধ্রুবসত্য হিসেবে ধরে নেয়, তাকে এছাড়া অন্য কিছু ভাবা বোধহয় ঠিক হবে না।
বিতৃষ্ণার সাথে ডেপুটিকে দেখল হবস। দয়া করে চুপ করে থাকো, টিম।
ওরা তিনজন ছিল, ম্যাসন, ব্যাখ্যা দিল ব্রুকস। কারও দিকে পিস্তল ধরিনি আমি, আসলে ওখানে কোন শো-ডাউন হবে এটাই আশা করিনি। তিনজনের বিরুদ্ধে একা লড়তে যাব কোন্ দুঃখে? টেবিল থেকে হাত সরাতে নিষেধ করেছিলাম কেউ যাতে আমার অজান্তে পিস্তলে হাত দিতে না পারে। কিন্তু লোগান আমাকে বাধ্য করেছে। ওদের আগে গুলি করতে পেরেছি বলে বেঁচে আছি, নইলে আমার রক্তই ডাস্টিকে মেঝে থেকে পরিষ্কার করতে হত এবং ও তা করত আনন্দের সাথে।
ব্রুকস থেমে যেতে নীরবতা নেমে এল। জ্যাক হবস ভাবছে কি যেন, নিরাসক্ত দৃষ্টিতে জানালাপথে প্রেইরি দেখছে ডেপুটি। বোঝা যাচ্ছে ব্রুকসের ব্যাখ্যা তার মনে ধরেনি।
তুমি কে, ব্রুকস? মার্শালের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বিদ্ধ করল ওকে। সাধারণ কেউ ম্যাট লোগানের মত লোককে ধরাশায়ী করে ফেলবে এটা আমাকে বিশ্বাস করতে বোলো না। পিস্তলের ব্যবহার তুমি ওদের চেয়ে ঢের ভাল জানেনা।
সহাস্যে মার্শালের দিকে তাকিয়ে থাকল ও।
কপালটাই মন্দ আমার, হাল ছেড়ে দিয়ে বলল হবস। শেষ বয়সে এসে উটকো সব ঝামেলা সামাল দিতে হচ্ছে, যেগুলো সামাল দেয়া আমার ক্ষমতার বাইরে। তোমার বা লোগানদের মত লোককে সামাল দেবে আমার মত চুনোপুঁটি? তাহলে তো কথাই ছিল না! বার কয়েক মাথা নাড়ল মার্শাল, অস্থিরভাবে নাড়াচাড়া করছে হাতের আঙুলগুলো। কণ্ঠে হতাশা আর বিরক্তি ফুটে উঠল। পারকার একগাদা লোক ভাড়া করেছে। পুরানো একজন কাউহ্যান্ডও নেই ওর, সব কটা আজেবাজে লোক। ঘোড়া বা গরু সামলানোর চেয়ে পিস্তলবাজি ভাল জানে ওরা। এসব লোক আমাকে পাত্তাই দেবে না। পারকার তো আরও এককাঠি বাড়া, মুখের ওপর বলে দেবে পারলে কিছু করো গিয়ে।
দয়া করে শহরটা এড়িয়ে চলল, স্যাম, যদ্দূর সম্ভব, অনুরোধ ঝরে পড়ল মার্শালের কণ্ঠে। তোমার যা ইচ্ছে শহরের বাইরে কোরো, নাক গলাতে আসব না আমি। শহর কমিটির কেউ এ লড়াই পছন্দ করতে পারছে না। ওরা ভাবছে কেবল ব্যবসা নিয়ে। কদিন পর রেলরোড আসবে, তরতর করে উঠে যাবে বাফেলল টাউন। কেউ চায় না তোমাদের কারণে তার আগেই শহরটা ধ্বংস হয়ে যাক।
শহর কমিটির আশঙ্কা অমূলক নয়, বুঝতে পারছে ব্রুকস। পশ্চিমের অনেক উঠতি শহর এভাবেই ধ্বংস হয়ে গেছে। দুটো বাথানের লড়াইয়ে পরোক্ষভাবে আশপাশের বাথানগুলোরও ক্ষতি হয়। এসব লড়াইয়ে বেশিরভাগ লোক থাকে ভাড়াটে, বেপরোয়া। ওঁদের থামানো যায় না যতক্ষণ পর্যন্ত না ওরা নিজেরা থামে বা শেষ হয়ে যায়। শেষমেশ ওদের রোষ গিয়ে পড়ে শহর বা অন্য বাথানের ওপর। যদি চলেও যায়, যাওয়ার আগে লুঠপাট তোকরেই দুএকটা খুন করতেও কসুর করে না।
বার-পিতে যাব ভাবছি, উঠে দাঁড়াল জ্যাক হবস। নিজের দায়িত্ব আমাকে পালন তো করতেই হবে, যদিও ভাল করে জানি পারকারকে বোঝানো আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। এমন একরোখা লোক আর দেখিনি। এমিলিওর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করব ওকে, হলফ করে বলতে পারি অস্বীকার করবে সে। তাছাড়া তুমিও কোন অভিযোগ করোনি। বেরিয়ে এসে রেইল থেকে লাগাম খুলে স্যাড়লে চাপল মার্শাল, তারপর ফিরল পোর্চে দাঁড়ানো ব্রুকসের দিকে। সামনে কঠিন সময়। অসম একটা লড়াই, তবু তোমার সাফল্য কামনা করছি, বাছা। নড করে স্পার দাবাল হবস।
মাটিতে একদলা থুথু ফেলল টিম ম্যাসন, হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাল ব্রুকসের দিকে। তোমার পরিচয় ঠিকই বের করে ফেলব, ব্রুকস, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে না। পরেরবার যখন আসব তখন আমার হাতে একটা পোস্টার আর ওয়ারেন্ট থাকবে।
উদার ভঙ্গিতে হাসল ব্রুকস। পারকারের ডালকুত্তাদের সাথে এসো না আবার, তাহলে কিন্তু তোমার বুকের ওই তারাটা বুলেট ঠেকাতে পারবে না।
কদিন টিকবে! দ্বিগুণ তেজে উত্তর দিল ডেপুটি। সবাই মিলে ওরা তোমাকে কচুকাটা করে ফেলবে।
তুমি ওদের রাইফেলগুলো লোড করে দিয়ো।
অপমানে লাল হয়ে গেল ম্যাসনের ফর্সা মুখ। ব্রুকস যা বলেছে সেটা বাচ্চা বা মেয়েদের কাজ। খুব বেড়েছ দেখছি! চাপা গর্জনের মত শোনাল যুবকের কণ্ঠ, স্যাডলে চেপেছে। লোগানকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পেয়েছিলে বলে নিজেকে বড় বন্দুকবাজ ভাবতে পারছ। জেফরি করবেট ঠিকই এর শোধ নেবে। স্পার দাবাল সে, দ্রুত ছুটতে শুরু করল ঘোড়াটা।
ক্ষীণ হাসল স্যামুয়েল ব্রুকস, হাড়ে হাড়ে চিনে ফেলেছে ডেপুটিকে। এক রত্তি মুরোদ নেই, অথচ সারাক্ষণ নিজেকে জাহির করার প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। ঠিক বাড পারকারের মত, যেন জেফরি করবেটের আরেক শিষ্য। কিন্তু ওকে শত্রু ভাবার কারণটা অজানাই রয়ে গেল। পারকারদের সাথে হয়তো কোন সম্পর্ক আছে ডেপুটির হতে পারে সেজন্যেই ওর প্রতি এত বিদ্বেষ। শ্রাগ করে কেবিনে ঢুকল ব্রুকস। টিম ম্যাসনকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। দূর থেকে লাফ-ঝাপ দেয়াই সার, কাছে এসে কিছু করার মত বুকের পাটা তার নেই।
সন্ধ্যার খানিক আগে বার-পি বাথানে পৌঁছাল মার্শাল ও তার ডেপুটি। অফিসে এনে ওদের বসিয়েছে অ্যালান পারকার। দুদফা কফি পরিবেশন করা হয়েছে, কিন্তু বাথান মালিকের পাত্তা নেই। জ্যাক হবস তিতিবিরক্ত। বাঙ্ক হাউস থেকে ভেসে আসা হৈচৈ ওর ধৈর্যচ্যুতির খোরাক হয়েছে।
উঠে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঠিক এসময়ে দরজায় দেখা গেল জুলিয়াস পারকারকে। দৃঢ় পায়ে হেঁটে এসে নিজের আসনে বসে মার্শালের দিকে তাকাল। কোন সম্ভাষণ এমনকি দেরি করার জন্যে দুঃখও প্রকাশ করল না। কেন এসেছ? স্পষ্ট কর্তৃত্বের সুরে জানতে চাইল।
পকেট থেকে চুরুট বের করে ধরাল জ্যাক হবস, দেখল র্যাঞ্চারকে-পাথরের মত মুখ, দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ। আয়েশ করে ধোয়া ছাড়ল মার্শাল, মৃদু স্বরে জবাব দিল: বোঝা যাচ্ছে আমাদের আসা পছন্দ হয়নি তোমার। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি তুমিই আসতে বাধ্য করেছ।
চটে গেল বুড়ো, চোখ জ্বলছে। মুখ সামলে কথা বলো, জ্যাক! আমি তোমাকে কখন বাধ্য করলাম?
কিছু ঝামেলাবাজ লোক ভাড়া করেছ তুমি। বাফেলোতে গিয়ে যা ইচ্ছে করে বেড়াচ্ছে ওরা, পণ্যের বদলে একটা পয়সাও দিচ্ছে না। কেউ প্রতিবাদ করলে উল্টে মারধর করছে। এটা তোমাকে বন্ধ করতে হবে, নয়তো…
নয়তো কি?
শহর কমিটি বাধ্য হবে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে। ব্যবসায় ক্ষতি করতে ওরা আসেনি এখানে। গায়ের ঘাম ঝরিয়ে প্রতিটি পয়সা রোজগার করতে হয় ওদের। কতগুলো গুণ্ডার ইচ্ছেমাফিক চলতে পারে না শহরটা।
ওরা যদি পয়সা না দেয় তো সেটা আমার দোষ?
তুমি বলে দিলে ওরা তা শুনতে বাধ্য, যেহেতু লোকগুলো তোমার কাছে ওদের পিস্তল বিকিয়েছে।
আমি যদি তোমার দিকে পিস্তল তাক করতে বলি, ওরা তা শুনবে। কিন্তু নিজেদের রোজগারের টাকা কিভাবে খরচ করবে সেটা বললে মোটেও পছন্দ করবে না। তুমি করবে? বেতনের টাকায় দেদারছে মদ গিলছ, জ্যাক, আমি মানা করলে শুনবে?
খানিক অস্বস্তি অনুভব করল মার্শাল, শ্রাগ করল। বুঝতে পারল আসল কথার ধারে-কাছে দিয়েও যাবে না বাগান মালিক। এ জন্যে তুমিই দায়ী থাকবে, জুল। স্যামুয়েল ব্রুকসকে নিয়ে যা ইচ্ছে কোরো, আপত্তি নেই আমাদের। নিজের দোষে মারা গেছে তোমার ছেলে, বদলে এমিলিওকে খুন করেছে তোমার লোকেরা, খেলাটা তারপরও চালিয়ে যাচ্ছ। আমার কাছে ওয়ারেন্ট থাকলে আগে তোমাকেই গ্রেফতার করতাম। তোমার লোকেরা যদি এভাবে ঝামেলা করতে থাকে…
হবস! তুমি নিজের অফিসে নেই এটা বোধহয় ভুলে গেছ, জুলিয়াস পরকারের কঠিন কৃর্তত্বপূর্ণ স্বর থামিয়ে দিল মার্শালকে, র্যাঞ্চারের চোখে উপহাস। তোমার কাজ হচ্ছে শহরের শান্তি রক্ষা করা। আমার কোন ব্যাপারে তোমার ওই নোংরা নাক গলিয়ো না।
শুনে রাখো, পারকার, মোটেও দমল না হবস। তোমার কোন লোক যদি শহরে আরেকটা ঝামেলা করে, তাকে গ্রেফতার করব আমি।
তোমার ক্ষমতায় কুলাবে?
কাজটা কঠিন, কিন্তু পারব, হেসে বলল মার্শাল, আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। তোমার ভুলে যাওয়া উচিত নয় শহরের শুরুতে এমন ডজনখানেক লোককে মোকাবিলা করেছি। ভেবেছিলাম শেষ কটা দিন ঝামেলা ছাড়া কাটিয়ে দেব, তোমার কারণে তা যখন হচ্ছে না তখন উঠে পড়েই লাগব আমি।
তেমন একটা অতীত তুমি ফেলে এসেছ, পনেরো বছর আগে। কিন্তু সেটা অতীতই। কত হলো তোমার, হবস, সাতচল্লিশ? বেশ বুড়িয়ে গেছ। আগের ক্ষিপ্রতা নেই, শরীরও মুটিয়ে গেছে। তোমার তুলনায় ওরা অনেক তরুণ।
পুরানো সময়ে ফিরে যেতে হবে আমাকে।
সেটা কি এতই সহজ?
পরীক্ষা নিতে চাও, পারকার? শীতল কণ্ঠে বলল মাশাল। ভুলেও ও-কাজ কোরো না। নিজে মরার আগে যে কটাকে পারি সাথে নিয়ে যাব। শহরের লোকজন আমার পেছনে এসে দাঁড়াবে। প্রয়োজনে ওরা তোমাকেও ছাড়বে না।
সশব্দে হেসে উঠল জুলিয়াস পারকার। ভয়ে নড়েচড়ে বসল ডেপুটি টিম ম্যাসন, সারাক্ষণই অস্বস্তিবোধ করছে।
বাফেলো টাউনের শুরু পারকারদের হাত দিয়ে, এটা তোমরা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে? উল্লসিত দেখাল বুড়োকে, গলায় চাপা অহঙ্কার। দরকার হলে শহরটাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেব আমি!
তোমার এত রাগের কারণ তো বুঝতে পারছি না, কৌশল বদলাল মার্শাল, গলায় আপসের সুর। বুঝতে পেরেছে বাগান মালিককে খেপিয়ে লাভ হবে না। সবাই মিলে হামলে পড়েছ ব্রুকসের ওপর। অন্যায় করেছে তোমার ছেলে, অথচ তুমি আগুনটাকে আরও উস্কে দিতে চাই।
তুমি তো আর ছেলে হারাওনি, বুঝবে কি করে। শ্লেষের সাথে বলল পারকার। যত অন্যায়ই করুক, ও আমার ছেলে। ওর মৃত্যুর শোধ আমি নেই!
এমিলিওকে খুন করেও তোমার সাধ মেটেনি?
যার কারণে এত কিছু সে তো বহাল তবিয়তে আছে। আমি চাইলেও করবেট এখন আর থামবে না। ম্যাট লোগান আর ওই লোকটার বন্ধুরাও অসন্তুষ্ট হবে আমি যদি ওদের কেটে পড়তে বলি। বুঝতেই পারছু ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে গেছে ব্যাপারটা, আমার ইচ্ছের ওপর এখন আর নির্ভর করছে না। থেমে সিগার ধরাল বুড়ো, একসঙ্গে অনেক ধোয়া টানতে গিয়ে কেশে উঠল। দুঃখিত, জ্যাক, এর শেষ না দেখে ছাড়ছি না। নিজ হাতে ছেলেকে কবরে শুইয়েছি আমি। একজন বুড়ো বাপের কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ বোধহয় এটাই।
বোঝা গেল, তোমার কাছে অযথাই এসেছি।
করবেটকে দেখে যাও।
অভিযোগ করছ?
উঁহু, হিসেবটা নিজেই মিটিয়ে ফেলতে পছন্দ করবে ও, থেমে সিগারে টান দিল পারকার, ধোয়ায় ঢাকা পড়ে গেল মুখ। ও আবার সহজে কিছু ভোলে না। তোমার এত উতলা হওয়ার কিছু নেই। মাত্র তো কটা দিন, ব্রুকসও একা। জেফরির লোকজন প্রথম দফায় শেষ করে ফেলবে ওকে। ভাড়াটে লোকগুলোকে রাখার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে তখন। তোমারও আর মাথা ঘামাতে হবে না। হতচ্ছাড়া এ শহরের চেয়ে ওদের জন্যে ঢের মজার শহর পড়ে আছে।
উঠে মাথায় হ্যাট চাপাল জ্যাক হবস। বেরোতে গিয়েও দরজার কাছে ফিরে দাঁড়াল। তোমার ক্রুদের আবার অন্য বাথানগুলোর পেছনে লাগিয়ে দিয়ো না। তাহলে কিন্তু ভুল করবে। সবাই একাট্টা হলে তুমি টিকতে পারবে না, কারণ স্যামুয়েল ব্রুকসের গতি করার পর তোমার অবস্থা হবে অনেকটাই নড়বড়ে। ব্রুকস মামুলি কেউ নয়, মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে ও এবং মরার আগে তোমার ক্রুদের যে কটাকে পারে খসিয়ে দেবে।
তাতে আমার কিছু আসে-যায় না।
সেটা ঠিক, বেরিয়ে যাওয়ার সময় ভাল জ্যাক হবস, তোমার সাম্রাজ্য টিকে থাকলেই হলো। ব্রুকসের জন্যে করুণা অনুভব করল মার্শাল, শক্তপাল্লার এক শত্রু জুটিয়েছে ও। পারকার থামবে সবকিছু শেষ হওয়ার পর।
মার্শাল আর ডেপুটি বেরিয়ে যেতে আপনমনে হাসলা জুলিয়াস পারকার। বুড়ো বয়সে ভীমরতিতে পেয়েছে জ্যাক হবসকে, কারণটা কি? গত কয়েক বছরে এ লোকের আচরণ ছিল মেরুদণ্ডহীন একটা জীবের মত, সারাক্ষণ মদে চুর হয়ে থাকত। ডেপুটি টিম ম্যাসনই শহরে কর্তৃত্ব করে এসেছে এ কারণে যে নিজের অফিস ছেড়ে বেরোয় না হবস। হঠাৎ করে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে লোকটা। খারাপ লক্ষণ। জ্যাক হবসকে তার ভালই চেনা আছে। যুবক বয়সের ক্ষিপ্রতা নেই ঠিকই, কিন্তু আত্মবিশ্বাসেরও কমতি নেই। পারকার জানে মার্শাল ওকে অপছন্দ করে, সে-ও। ঝামেলাটা মিটে গেলে টাইট দিতে হবে হবসকে, সিদ্ধান্ত নিল বার-পি মালিক। করবেটকে লেলিয়ে দিলে ল্যাঠা চুকে যাবে। হতচ্ছাড়াকে একেবারে শেষ করে দিলেও অবশ্য মন্দ হয় না। কিন্তু তা করতে হলে অন্য কারও সাহায্য লাগবে, করবেট এ কাজের উপযুক্ত নয়। বাফেলো টাউনের শুরুতে বহু ফাস্টগানকে সামাল দিয়েছে হবস, তার কিছুটাও যদি অবশিষ্ট থাকে তো অনায়াসে ফোরম্যানকে মোকাবিলা করতে পারবে। কারণ পিস্ত লের চেয়ে মুঠি চালাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে জেফরি করবেট। ঝুঁকির মধ্যে না গিয়ে বরং অন্য কাউকে দিয়ে কাজটা করিয়ে নেয়াই সবদিক থেকে ভাল হবে, এমন কেউ যে আইনের লোককে খুন করতে পিছ-পা হবে না।
অ্যাল! মেঝো ছেলেকে ডাকল পারকার। জেফরিকে ডাকো।
ও তো অসুস্থ, বাবা।
পায়ে হেঁটে আসবে সে, হামাগুড়ি তো দিতে হবে না! বিরক্তি প্রকাশ করল বার-পি মালিক।
একটু পর কামরায় প্রবেশ করল করবেট। এমনিতে সে, বিশালদেহী, তারওপর ব্যান্ডেজ থাকায় হাতগুলোকে প্রকাণ্ড দেখাচ্ছে। সামনে এসে দাঁড়াল ও, অস্বস্তিভরে তাকাল মালিকের দিকে।
সাপারের পর তৈরি হতে বোললা ওদের, দৃঢ় কণ্ঠে আদেশ করল জুলিয়াস পারকার। ব্রুকসের বাথানে গিয়ে নজর রাখবে। মাঝরাতের দিকে কেবিনটা ঘেরাও করার পর কাজ শেষে পুড়িয়ে দেবে।
আমি তো রাইড করতে পারব না, বসু।
তোমাকে রাইড করতে বলল কে? বিরক্তিতে কুঁচকে উঠল বুড়োর কপাল। কি করতে হবে তা ভাল করে বুঝিয়ে দাও ওদের, কোথাও যেন ভুল না হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে শুনতে চাই, স্যামুয়েল ব্রুকস নামে বেসিনে কেউ নেই।
সিদ্ধান্তটা হঠাৎ করে নিয়েছে স্যামুয়েল ব্রুকস। আগাম বিপদ টের পাওয়ার সহজাত প্রবণতা আছে ওর মধ্যে। কারণ বিপদ ওর বহু পুরানো বন্ধু। পারকারের রাইডারেরা যে কোন সময়ে হামলা করতে পারে, কেবিনের চার দেয়ালের মধ্যে ওকে পেয়ে গেলে কাজটা সহজ হয়ে যাবে। সন্ধের পরপরই তাই সজি বাগানের পেছনে, উইলো ঝোপের পাশে আশ্রয় নিয়েছে। জায়গাটা এমন কেবিন ও তার আশপাশের সবকিছুই স্পষ্ট চোখে পড়বে, অথচ আগে থেকে জানা না থাকলে ওদিক থেকে ওর অবস্থান আঁচ করা কঠিন।
অন্যদিনের চেয়ে একটু আগে সাপার সেরেছে ও, তারপর হেনরীটা নিয়ে উইলো ঝোপের কাছে চলে এসেছে। ঘাসের ওপর বেডরোল বিছিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে, নির্জন প্রেইরিতে চোখ। চাঁদের ম্লান আলো নিকষ কালো আঁধার দূর করতে পারেনি। দশ হাত দূরে রোয়ানের অস্পষ্ট নড়াচড়া টের পাচ্ছে। এমিলিওর গেল্ডিংটাকে প্রেইরিতে ছেড়ে দেয়ার পর থেকে গরুগুলোর সাথেই থাকছে, খাওয়ার সময় হলে কেবিনের কাছে চলে আসে। ঘোড়াদুটোর ওপর আস্থা আছে ওর, বিশেষ করে দীর্ঘদিনের সঙ্গী রোয়ানের ওপর। অনাহুত কেউ আসামাত্র ওকে সতর্ক করার চেষ্টা করবে। তাছাড়া ও নিজে তো আছেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ঠিক ঠিক আগে থেকে টের পেয়ে যায় ও, বহুবার এমন হয়েছে। কেউ এলে একেবারে নিঃশব্দে আসা অসম্ভব, সুতরাং ও টের পাবেই। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল হঠাৎ করেই। মুখের ওপর থেকে হ্যাট সরিয়ে উঠে বসল ব্রুকস, কোলের ওপর তুলে নিল হেনরীটা। কেবিনের দিকে চলে গেছে দৃষ্টি, পোর্চে কয়েকটা ছায়া দেখে একটুও অবাক হলো না। ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একজন, সপাটে দরজা আটকে দিল। হারামজাদা ভেগেছে! চাপা স্বরে বলল সে, কেবিনে আগুন লাগিয়ে দাও।
নড়েচড়ে উঠল লোকগুলো। দূরে দাঁড়ানো ঘোড়ার স্যাডল থেকে বড়সড় একটা টিনের পাত্র নিয়ে এল একজন, মুখ খুলে ভেতরের তরল দেয়ালে ছিটাতে শুরু করল, শেষে ছাদে ছুঁড়ে মারল।
প্রমাদ গুনল ব্রুকস, নিজের অবস্থান ফাস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। নইলে কেবিনটাকে রক্ষা করা যাবে না, সাথে ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও সব যাবে। হেনরী কক্ করল ও, নির্জন রাতে শব্দটা তুলনামূলক জোরাল শোনাল। কাঠ হয়ে গেছে সবকটা ছায়া। ও কাজ কোরো না, তাহলে কিন্তু গুলি করব।
সাহস থাকে তো সামনে এসো! উস্কানি দিল একজন।
ডানদিকে চারহাত দূরের বোন্ডারের দিকে তাকাল ব্রুকস, অনায়াসে ঝাঁপ দিয়ে ওটার পেছনে আড়াল নেয়া যাবে। এদিকে ওর অবস্থান আঁচ করার চেষ্টা করছে লোকগুলো, সুযোগ পেলেই কোমরে হাত বাড়াবে। সময় যেন আটকে আছে। পায়ের ভর বদল করল একজন, হঠাৎ করে পাশে সরল সামনের লোকটা। তাতে আড়ালে পড়ে গেল পরের জন। ফশ করে দেয়াশলাইয়ের একটা কাঠি জ্বলে উঠল। ওরা এতটা সাহস দেখাবে ভাবতে পারেনি কন্স, তবে নির্দ্বিধায় গুলি করল। রাইফেলের ভারী গর্জনে কেঁপে উঠল প্রেইরির জমাট নিস্তব্ধতা। ঢলে পড়ল সামনের বার-পি, দেয়াশলাইয়ের কাঠিসহ হাতটা শরীরের নিচে চাপা পড়ে গেল।
ঝটিতি ঘুরেই আন্দাজের ওপর গুলি করল পেছনের লোকটা। ব্রুকসের দুহাত দূরে একটা বার্চের ওড়িতে গিয়ে বিধল। ফের গুলি করল ও, ফলাফল দেখার অপেক্ষায় না থেকে ঝাপ দিল। গড়ান দিয়ে চলে এল বোল্ডারের আড়ালে। জায়গাটায় যেন নরক ভেঙে পড়ল এরপর, সমানে গুলি করছে ওরা।
অপেক্ষা। প্রথম ঝাপটা কেটে যেতে থেমে গেল গুলির শব্দ। বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে আছে বাতাস। মাথা সরিয়ে তাকাল ব্রুকস, চারটে ছায়া, সবার ডান হাত লম্বা। একপাশে সরে গেল দুজন। বোন্ডারের আড়াল থেকে শরীর বের করল ও। নড়াচড়া টের পেয়ে গেল বার-পি জুরা, কিন্তু সুযোগ পেল না। ব্রুকসের গুলিতে থেমে গেল সামনের জন, ধীরে হাটু ভেঙে পড়ে গেল। অন্যরা ঝাপ দিয়েছে, মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলতে চাইছে শরীর।
সামলে নিয়ে আরেকপশলা গুলি চালাল ওরা, কিন্তু ততক্ষণে নিরাপদে সরে পড়েছে ব্রুকস।
মিনিট দশ ঠায় পড়ে থাকল ও। প্রতিপক্ষের সাড়া নেই। পিঠটান দিল নাকি? অন্তত দুজন মরেছে, তবু বলা যায় মোটেই আনাড়ি ছিল না লোকগুলো। ভড়কে দিয়ে ফায়দা লুটেছে ও। আরেকটা সুবিধা ছিল-বার-পি ক্ৰদেৱ মত ওকে খোলা জায়গায় থাকতে হয়নি। লড়াইয়ের সমীকরণ যখন অসমান তখন প্রতিপক্ষের দুর্বলতাই ওর পুঁজি। এটাও ঠিক একই ভুলও ওরা বারবার করবে না।
ধীরে নিঃশব্দে সরে এল ও। পেছনে ঘন উইলো ঝোপ, চাপ চাপ অন্ধকারের পটভূমিতে ওকে চোখে পড়ার কথা নয়। অনেকক্ষণ পর দুটো ছায়া চোখে পড়ল, পিছু হটছে। আপাতত বোধহয় ঝামেলা বিদায় হয়েছে। একটু পর দিগন্তের আবছা অবয়বে দেখা গেল ঘোড়সওয়ারদের, তিনজন। বার-পি বাথানের দিকে যাচ্ছে।
কেবিনের সামনে খোলা জায়গায় দৃষ্টি বুলাল ও, নিথর একটা দেহ পড়ে আছে পোর্চে। একটু দূরে করালের কাছে আরেকজন। তিন নম্বরকে পাওয়া গেল সজি বাগানের একেবারে কিনারায়। সম্ভবত মৃত। নিশ্চিত হতে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ও, তারপর বেরিয়ে এসে লাশগুলো পরীক্ষা করল।
কফির তেষ্টা পেয়েছে। কেবিনের ছাদ ও দেয়ালে তেল ঢেলেছে লোকগুলো, চুলো জ্বালানো বিপজ্জনক হতে পারে। পোর্চে উঠে এসে পা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিল লাশটা, তারপর ভেতরে ঢুকে পড়ল। তিন বছর ধরে থাকছে এখানে, অন্ধকারেও অনায়াসে তাই চলতে পারছে। রান্নাঘরে চলে এল ও, হাতড়ে ওঅশ বেসিনের পাশে পেল কেতলিটা। ওটায় পানি ঢেলে মগ, চিনি আর কফির গুঁড়ো নিয়ে বেরিয়ে এল। উইলো ঝোপের পেছনে খোলা জায়গা দেখে মাটিতে গর্ত করল, আগুন জ্বালিয়ে তিনটা পাথরখণ্ডের ওপর কেতলি চাপিয়ে দিল।
মগভর্তি গরম কফি নিয়ে আয়েশ করে বিছানায় বসল ও। ধীরে চুমুক দিচ্ছে। বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত না নিলে এতক্ষণে লাশ হয়ে পড়ে থাকতে হত, ভাবছে ও। চমৎকৃত হওয়ার কিছু নেই, জানত এরকম কিছু হতে পারে। ধরে নেয়া যায় বাকি রাতটুকু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে। বার-পি এত মরিয়া হয়ে যায়নি যে আজ রাতেই ফের হামলা চালাবে। মরার ভয় ওদেরও আছে, তাছাড়া লড়াই করতে যারা এসেছিল কেউই বোধহয় পরকারের নিজস্ব লোক নয়। ভাড়াটে লোকের আগ্রহ কখনোই আন্তরিক হয় না। ওরা লড়াই করবে তখুনি যখন সাফল্যের পাল্লা নিজেদের দিকে ভারী থাকবে।
ভোরে ঘুম ভাঙল ওর। চারপাশের ফিকে আলোয় নির্জন প্রেইরি ঝাপসাভাবে চোখে পড়ছে। পায়ে বুট গলিয়ে কফির পানি চড়াল, তারপর কেবিনে এসে ঢুকল। হাত-মুখ ধুয়ে শুকনো জার্কি আর বিস্কুট দিয়ে নাস্তা সেরে নিল। কফির মগ হাতে বিতৃষ্ণার সাথে দেখল লাশগুলো। বিন্দুমাত্র করুণা হচ্ছে না। অস্থির অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনটা পেছনে ফেলে এসেছিল ও, এরা ওকে বাধ্য করেছে সে-জীবনে ফিরে যেতে। মাসুল তো দিতেই হবে, হয় তাদেরকে নয়তো ওকেই।
কফি শেষ করে মাটি দিয়ে গর্তটা ভরাট করল, বেডরোল গোটাল এরপর। এমিলিওর গেন্ডিংটা কাছে চলে এসেছে। করালে গিয়ে দুটো ঘোড়ারই যত্ন নিল। শেষে গেল্ডিঙের পিঠে স্যাডল চাপাল, আপত্তি করল না ঘোড়াটা। দূর থেকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখছে রোয়ানটা, পছন্দ বা অপছন্দ কোনটাই করছে না। আপনমনে হাসল ব্রুকস, ঘোড়াটা ওর মতই-প্রয়োজন ছাড়া নিরুৎসাহী, ধীর-স্থির কিন্তু লক্ষ্যে অবিচল।
গেন্ডিঙে চড়ে তৃণভূমিতে এল ও। কয়েকটা গরু সীমানার কাছাকাছি চলে গেছে, বেশ কসরৎ করে ফিরিয়ে আনল ওগুলোকে। সজি বেড় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল এরপর। চারপাশে সজাগ দৃষ্টি রাখছে, জানে বার-পি আবারও চড়াও হতে পারে।
জুলিয়াস পারকারকে রীতিমত ঘৃণা করতে শুরু করেছে ব্রুকস। নিজের লড়াই অন্যকে দিয়ে করায় দুর্বল ও কাপুরুষেরা, পারকার, তেমনই একজন। কিন্তু এ তল্লাটে সবচেয়ে বেশি প্রতাপ তারই। হাস্যকর। নিজের তৈরি প্রতিরক্ষা ব্যুহের ভেতর লোকটা প্রচণ্ড শক্তিশালী ঠিকই, দেয়ালটা একবার ভেঙে গেলে ইদুরের মত ভয়ে সিঁটিয়ে যাবে।
পারকারের পরবর্তী চাল অনুমান করতে কষ্ট হয় না। টাকার পরোয়া না করে আরও লোক আনবে। ভয়ঙ্কর কিছু লোকের আনাগোনায় ভরে যাবে বেসিন। সত্যিকার কিছু টাফ লোকও আসবে যাদের গতরাতের মত সহজে ভড়কে দেয়া কিংবা কাবু করা যাবে না। তবে এসব নিয়ে খুব একটা ভাবছে না ব্রুকস। একসময় নিজের হাতে ভাগ্য গড়তে চেয়েছিল, কিন্তু নয়তি ওর পিছু ছাড়েনি, পুরানো জীবনে এনে দাঁড় করিয়েছে। তাই নিয়তির হাতে সঁপে দিয়েছে সবকিছু, ও কেবল টিকে থাকার চেষ্টা করবে। এতগুলো লোকের সাথে পেরে ওঠা অসম্ভব, জানে, কিন্তু পিছিয়ে যাওয়া ওর ধাতে নেই। পরিণতি নিয়েও ভাবছে না। ব্রুকস জানে, দেখেছেও বহুবার-একজন বন্দুকবাজের মৃত্যু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় বন্দুকের গুলিতে। তেমন করে মরতে হবে ওকে, হয়তো আজ বা কাল…কিংবা আরও পরে। নির্ভর করে কিভাবে টিকে থাকছে তার ওপর।
পুব দিগন্তে দুজন ঘোড়সওয়ারকে দেখে ভুরু কুঁচকে উঠল ওর। সীমের চারাগুলোর মাঝখান থেকে দ্রুত কয়েকটা আগাছা তুলে নিল। একবার নজর বুলাল রাইফেলের ওপর, নাগালের মধ্যেই আছে। লাশগুলোর কথা মনে পড়তে উঠে পড়ল। টেনে ঝোপের কাছে এনে রাখল ওগুলো। কাজটা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু আগন্তুকদের পরিচয় আন্দাজ করতে পারছে বলেই করল।
পোর্চে দাঁড়িয়ে বাপ-বেটির ওপর নজর বুলাল ব্রুকস, তৃণভূমি আর পর্বতমালা দেখছে ওরা। ঠোঁট নড়ছে, আলাপের বিষয়বস্তু ব্রুকসের কানে না এলেও আঁচ করতে পারছে। কাছে আসার পর জেমস ফ্ল্যাগানের কথায় ওর ধারণাই সত্যি হলো।
দারুণ এক বাথান! অকৃত্রিম প্রশংসা সার্কেল-এফ মালিকের কণ্ঠে। পাঞ্চাররা বলাবলি করত কিন্তু কখনোই আমল দেইনি আমি। স্যাম, মনে হচ্ছে কেবল তোমার পক্ষেই সম্ভব এটা, অন্য কেউ পারত না। নালা কেটে, ঝর্নার গতিপথ বদলে দিয়েছ। আর তাতে সবকিছু এভাবে বদলে যাবে কে ভেবেছিল! তোমার অনেক আগে এখানে এসেছি আমরা, কিন্তু এরকম ধারণা কারও মাথায়ই আসেনি।
ফ্ল্যাগান-কন্যার দিকে তাকাল ব্রুকস। নিতান্ত সাধারণ স্কার্ট-ব্লাউজে অপূর্ব লাগছে। মহিলাদের সাথে মেশার অভিজ্ঞতা ওর বলতে গেলে নেই, কিন্তু কোন্ মুখ কতটা সুন্দর তা ভাল করে জানে।
ওর আশঙ্কা লাশগুলো হয়তো মেয়েটার চোখে পড়ে যাবে, তাহলে অস্বস্তিতে ভুগবে লরিয়া।
স্যাডল ছেড়ে পোর্চে এসে দাঁড়াল জেমস ফ্ল্যাগান। তবে সবার আগে খুশি হয়েছি তোমাকে খাড়া থাকতে দেখে।
ব্রুকসের চোখে প্রশ্ন ফুটে উঠল।
রাতে গোলাগুলির শব্দ শুনলাম। নিশ্চয়ই হামলা করেছে বার-পি। কজন এসেছিল?
ছয়জন।
ফিরে গেল কজন?
অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে লরিয়া, ওদের এসব আলাপ ভাল লাগছে না। সজি বাগানের ওপর চোখ পড়তে আঁতকে উঠল, চোখে বিস্ময়। বাবা, দেখো…লোকগুলো, ওরা কি সত্যি…
লরা, ভেতরে গিয়ে কফি তৈরি করবি? দ্রুত বলে উঠল ফ্ল্যাগান, মেয়েকে সরিয়ে দিতে চাইছে। লরিয়া কেবিনের ভেতর ঢুকে পড়তে বাগানের দিকে এগোল। কাছে গিয়ে লাশগুলো উল্টে চেহারা দেখল। সবকটা বদমাশ! এর আগে একজনকেও দেখিনি, কিন্তু ওরা যে নির্দয় খুনী তা মরার পরও ওদের চেহারায় লেখা রয়েছে। ফেরার সময় সিগার ধরাল সার্কেল-এফ মালিক। এতদিনে শিক্ষা হবে বুড়ো ভামটার! আজীবন অন্যের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে এসেছে, এবার মজা বুঝবে। তুমি লোকটা আসলেই অসাধারণ! শুধু খাটতেই জানো না, বুকের পাটাও আছে। তোমার জায়গায় হলে আমি কখন সটকে পড়তাম!
ক্ষীণ হাসল ব্রুকস যদিও একমত হতে পারল না। ফ্ল্যাগানদের আত্মসম্মানবোধ খুব প্রখর, আইরিশদের মধ্যে বরাবর যা দেখা যায়। এ লোক মরবে কিন্তু পালাবার দলে নয়।
তোমাকে সাহায্য করতে পারলে খুশি হতাম, স্যাম। দুজন কাউহ্যান্ডকে ধার দিতে পারি, তবে এটা ঠিক, তোমার মত লড়তে পারবে না ওরা। অবশ্য বাথানের কাজে সাহায্য করতে পারবে।
সার্কেল-এফকে এর সাথে জড়াতে চাই না আমি।
লরিয়াকে নিয়েই তো ঝামেলার শুরু। তুমি অস্বীকার করলেও আমি মনে করি সার্কেল-এফ প্রথম থেকে এতে জড়িয়ে আছে।
তোমার লোকগুলো কেমন, ফ্ল্যাগান? তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়। দুএকজনের সাথে আমার কথাও হয়েছে। উঁহু, নিরীহ লোকগুলো পারকারদের তোপের মুখে পড়ক তা আমি যেমন চাই না তেমনি ওরাও চাইবে না।
এই, বাবা, ভেতর থেকে ডাকল লরিয়া। কফি হয়েছে, এসো তোমরা।
ফ্ল্যাগান এগোতে অনুসরণ করল ব্রুকস। টেবিলে অপেক্ষা করছিল লরিয়া, মগপূর্ণ ধূমায়িত কফি আর বিস্কুট পরিবেশন করেছে।
লরা, আমরা ওর বাড়িতে এলাম নাকি ও আমাদের বাড়িতে এল? সহাস্যে জানতে চাইল সার্কেল-এফ মালিক।
আভা ছড়াল মেয়েটার ফর্সা গালে। চুপ করবে? কড়া দৃষ্টিতে দেখছে বাপকে, ব্রুকসের অভিব্যক্তিহীন মুখের দিকে তাকাল একবার, তারপর বাপের পাশে বসে পড়ল। শোনো, বুড়ো, তোমার মুখটা থামাও নইলে লবণ মেশানো কফি জুটবে কপালে। ভুলে যেয়ো না কফি তৈরি করার অনুরোধ তুমিই করেছিলে।
টিম ম্যাসনের মত? সশব্দে হেসে উঠল সার্কেল-এফ মালিক। কিন্তু ছেলেটা তো মোটেও খারাপ নয়, অন্তত আমার দৃষ্টিতে। চাকুরিটাও ভাল। কেমন জবরদস্ত প্রভাব ওর সারা তল্লাটে! নিখাদ কৌতুক ফ্ল্যাগানের চোখে।
আমি ওকে পছন্দ করি না, ব্যস! অধৈর্য দেখাল মেয়েটাকে। ও আমাকে বিরক্ত করছিল, তাই কফির সাথে লবণ মিশিয়ে দিয়েছি। এতে অন্তত একটা লাভ হয়েছে, ও আর আমার ধারে-কাছে ঘেষছে না।
কৌতুক বোধ করল ব্রুকস। ডেপুটির সাথে তামাশা করার ভাল উপাদানই পেয়েছে মার্শাল জ্যাক হবস।
ওকেও লবণ মেশানো কফি দিলি নাকি?
বিমূঢ় দেখাল লরিয়াকে, খানিকটা ফ্যাকাসেও। না! নিচু স্বরে প্রতিবাদ করল।
ফ্ল্যাগানের হাসি থামছে না। তোকে ম্যাসনের মত বিরক্ত করলে?
ও আমাকে বিরক্ত করেনি, বরং আমরাই…
বুঝলে, স্যাম, উত্যু স্বরে মেয়েকে বাধা দিল ফ্ল্যাগান। আমার খুব ভাল লাগছে এ জন্যে যে শেষপর্যন্ত কোন পুরুষকে মনে ধরেছে ওর।
ব্রুকসের সাথে চোখাচোখি হলোলরিয়ার, সবুজ চোখে আহত দৃষ্টি। বাপের ওপর অভিমানহত মনে হচ্ছে ওকে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বাপের দিকে তাকাল মেয়েটা, দৃষ্টি বদলে গিয়ে প্রচ্ছন্ন রাগ ফুটে উঠেছে। আমাকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্যে এখানে এসেছ, বাবা? তুমি চুপ না করলে আমি চলে যাব।
দুহাত তুলে হার মানল সে। দুঃখিত, ম্যাম। আমি ভাবলাম… তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না!
মেয়ের অগ্নিমূর্তি দেখে বাধ্য শিশুর মত মাথা কাত করল বাথান মালিক। কিন্তু মুখে চাপা হাসি লেগে থাকল। লরিয়া মগগুলো নিয়ে বেসিনের দিকে চলে যেতে মুখ টিপে হাসল। তুমি কিছু মনে করছ না তো, স্যাম? ব্রুকসের দিকে সরে এসে নিচু কণ্ঠে বলল: আমাদের বাপ-বেটিতে খুনসুটি লেগেই থাকে। আমি খুব উপভোগ করি। ওকে কত সহজে রাগানো যায় তা আমার চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না।
কিছু না বলে সিগারেট ধরাল ব্রুকস।
তোমার সামনে কঠিন সময়, স্থা। পারকার খুব নাছোড়বান্দা লোক। তুমিও কম যাও না দেখছি, মাটি কামড়ে পড়ে আছ। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে, বয়। ক্ষমতায় কুলালে সাহায্য করতাম। কিন্তু আসলে তেমন কিছু করার নেইও। সবাই যখন কাল রাহুর দটনা গুনবে, অবাক হয়ে যাবে। এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে কি করে টিকে আছ এটা ওদের জন্যে গবেষণার ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
টিম ম্যাসনের মত ব্যাখ্যা দাঁড় করাবে, ভাবল ব্রুকস মার্শাল কেমন লোক?
জ্যাক হবস? খানিক ভোবে বলতে শুরু করল সার্কেল-এফ মালিক। একসময় ওকে দেখে অ্যাপের কথা মনে হত আমার-সাহসী, দুধর্ষ এবং বেপরোয়া। বাফেলো টাউনের শুরুতে খুনে-বদমাশে ভরে গিয়েছিল শহরটা, ফ্রেডারিক পারকার পরোক্ষভাবে মদদ দিত। যখন অতিষ্ঠ হতে বাকি, হঠাৎ হাজির হলো ও। বিশ্বাস করব কি, ওকে দেখে হাসি থামাতে কষ্ট হচ্ছিল আমাদের। মদে চুর হয়ে আছে, নোংরা কাপড় পরনে। ঘোড়া তো ছিলই না পিস্তল পর্যন্ত খুইয়েছে। এমন লোক যদি বলে দুই হাজার ডলার পেলে শহরটা সাফ করে দেবে তাহলে না হেসে উপায় আছে? পাত্তা দিলাম না আমরা। ও চলে গেল, লকহার্টের সেলুনে হুইস্কির বোতল নিয়ে বসল। রাতে ওর সাথে টক্কর বাধল টমাস হার্ডির। সে তখন শাসন করছিল শহরটা। দুজনে মিলে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে দিল সেলুনে। হার্ডিকে ধরে আচ্ছামত পেটাল ও, নিজেও অবশ্য কম খায়নি। পরদিন ওর কাছে গেলাম আমরা, দাবি বেড়ে গেল ওর। দুই হাজার ডলার, পিস্তল-রাইফেল আর একটা ঘোড়ায় রফা হলো। দশদিনের মধ্যে শহরটা খালি করে ফেলল হবস। এরপর থেকে বলতে গেলে বাফেলোতে বড় কোন ঝামেলা হয়নি, তা কেবল ওর কারণেই। যদিও মদ ওকে শেষ করে দিয়েছে। তবু, ভুলেও ওর সাথে লাগতে যেয়ো না। বয়স হলেও এখনও সমানে দুহাতে গুলি চালাতে পারে। মাতাল অবস্থায়ও ওর মাথাটা পরিষ্কার থাকে। ওকে সৎ হিসেবে জানি আমরা।
টিম ম্যাসন?
অপদার্থ একটা। শহরে রাজত্ব ওরই, দরকার না পড়লে হবস বেরোয় না কি-না।
দ্বিতীয় দফায় কফি পরিবেশন করল লরিয়া। এর আগে ছিলে কোথায়, স্যাম? কফিতে চুমুক দিয়ে হঠাৎ জানতে চাইল জেমস ফ্ল্যাগান।
আসলে নির্দিষ্ট কোথাও থাকিনি আমি। সারা বছর চলার মধ্যে কাটিয়ে দিতাম, ইচ্ছে হলে হয়তো থেমেছি কোথাও। হাঁপিয়ে উঠলে আবার পথচলা। ব্রুকস খেয়াল করল অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে সার্কেল-এফ মালিককে। ওর অতীত ঘটার ইচ্ছে তার পূরণ হয়নি।
এখানেও কি সেরকম থাকছ? লরিয়ার প্রশ্ন।
না। এখানে বসতি করতেই এসেছি। ছুটে ছুটে ক্লান্তি লাগছিল, বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটাতে চাই।
বলো কি! বয়েস কত হলো তোমার, স্যাম? সারা জীবনই তো সামনে পড়ে আছে!
সাত বছর বয়স থেকে আমি পথে পথে ঘুরছি, ফ্ল্যাগান। ঘুরতে খারাপ লাগে, কিন্তু অনেকেই পিস্তলের নলের আগায় পেতে চায় আমাকে। আর আমি তাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কাজ হয় না, তাতে। একজোড়া পিস্তল এড়িয়ে গেলে পড়তে হয় আরেক জোড়ার সামনে। এই টানাপোড়ন আর চাই না। ভেবেছি এখানে যদ্দিন থাকব ওসবে আর ফিরে যাব না। সবকিছু পেছনে ফেলে শান্তিতে থাকতে চাই, কাউকে যেমন ঝামেলায় ফেলার ইচ্ছে নেই তেমনি চাই না কেউ অযথাই আমাকে ঝামেলায় ফেলুক।
একজন নিঃসঙ্গ যুবকের চিন্তা! কৌতুকপূর্ণ স্বরে মন্তব্য করল ফ্ল্যাগান, হাসছে। এ তল্লাটের মেয়েদের জন্যে সুখবর!
জেমস ফ্ল্যাগানের চরিত্রের থই পাচ্ছে না ব্রুকস। খুব দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করছে, কখনও খুব গম্ভীর, সিরিয়াস আবার কখনও বেখেয়ালী মনে হচ্ছে। আগাগোড়া আমুদে লোক, নিজের মেয়েকে অস্বস্তিতে ফেলেও আনন্দ পাচ্ছে। একটা ব্যাপারে অবশ্য নিশ্চিত ও-ফ্ল্যাগানরা ভাল মানুষ এবং ওর শত্রু হতে যাচ্ছে না।
তোমার ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকছে না, নিচু স্বরে বলল সার্কেল-এফ মালিক, গম্ভীর দেখাচ্ছে। আসলে তুমি কে? উঁহু, ব্রুকস কিছু বলতে যেতে হাত তুলে বাধা দিল। বুঝতে পারছি নিজের পরিচয় জানাতে তোমার যথেষ্ট আপত্তি আছে। হয়তো দুদিনের মধ্যে তা জেনে ফেলবে জ্যাক হবস। আমার মাথা-ব্যথা কেবল এক জায়গায়-আইন তোমার পিছু নিচ্ছে না তো? কঠোর হয়ে এল তার কণ্ঠ। আমি চাই না কোন জোচ্চোর বা খুনে-বদমাশের সাথে আমার বন্ধুত্ব থাকুক। আর, তেমন কারও কাছে আমার মেয়ে আসুক তা-ও চাই না।
ক্ষীণ হাসল ব্রুকস। তুমি তো মানুষ চেনো, কি মনে হয় আমাকে?
টাফ একজন লোক। বাথান মালিক হিসেবে ঠিক মানায় না, একটু থামল ফ্লাগান, ভাবছে। না, ভুল বললাম। বাথানের কাজ যে কারও চেয়ে ভাল জানো, এটা তুমি প্রমাণ করেছ।…আসলে আমার মাথায় কেবল গতরাতের ঘটনাই ঘুরপাক খাচ্ছে। ছয়জনের বিরুদ্ধে একা। আবার বোলো না যে এটা হঠাৎ করে হয়ে গেছে। তো ব্যাপারটা কি দাড়াল? দুর্ধর্ষ একজন লোক লুকিয়ে আছে মরগান পিকসের উপত্যকায় যাকে খোচাতে এসে দিশেহারা হয়ে পড়েছে পারকাররা।…নাহ, আমি বিভ্রান্ত। তবে এটা ঠিক, তোমার সাথে আমার শুভাকাঙ্ক্ষা থাকবে এবং খুশি হব যদি শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারো। থেমে হাসল ফ্ল্যাগান, সিগার ধরাল।
তুমি খুব সিগার টানছ, বাবা! অভিযোগ করল লরিয়া।
চুপ করে থাক! মেয়েকে কপট হুমকি দিল ফ্ল্যাগান। বড়দের ব্যাপারে নাক গলাবি না। বেশি জ্বালালে এক থাবড়া মারব!
ছোঁ মেরে সিগার কেড়ে নিল লরিয়া, ওঅশ বেসিনে ছুঁড়ে ফেলল। বোকা বোকা দেখাচ্ছে সার্কেল-এফ মালিককে। তাকে মিষ্টি হাসি উপহার দিল মেয়েটা, অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে ভুরু নাচাল। ব্রুকসের দিকে ফিরল এবার। নিশ্চিন্তে রোল করা সিগারেট ফুকছে ও, খানিক আগে ফ্ল্যাগানের বলা কথাগুলো সম্পর্কে ভাবছে। লরিয়ার সাথে দৃষ্টি এক হতে ঠোঁট থেকে সিগারেট নামাল, তারপর ছাইদানিতে গুঁজে রাখল। একজন ভদ্রমহিলা যখন চাচ্ছে না কেউ তার সামনে ধূমপান করুক তখন তাকে সম্মান দেখানো ছাড়া উপায় থাকে না। হালকা সুরে বলল ও।
সব ব্যাটাই দেখছি টিম ম্যাসন! ব্রুকসের প্রবোধে কাজ হলো না, গোমড়া মুখে কপট বিরক্তি প্রকাশ করল বাগান মালিক। আমার বাচ্চাটাকে খুশি করার তালে আছে কেবল!
হেসে তামাশায় যোগ দিল ব্রুকস।
বাবা, ওঠো, অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাছাড়া ওর নিশ্চই কাজ আছে।
ইশশ, গল্পটা তো ভালই জমেছিল! উঠে দাঁড়াল ফ্ল্যাগান, মাথায় হ্যাট চাপিয়ে দরজার দিকে এগোল। ধন্যবাদ, স্যাম। সময়টা দারুণ কাটল।…প্রয়োজন হলে সোজা পুবদিকে ঘোড়া ছোটাবে, আমার র্যাঞ্চের আগে থেমো না।
মৃদু হেসে পোর্চে বেরিয়ে এল ব্রুকস। বাপ-মেয়ে স্যাডলে চেপেছে।
বিশ্বাস করো, বাছা, তোমাকে আমার হিংসে হচ্ছে। দারুণ একটা জায়গা তৈরি করে নিয়েছ। যদি কখনও সিদ্ধান্ত নাও বেচবে, সবার আগে আমাকে জানিয়ো।
তোমার এই ইচ্ছেটা পূরণ হবে না। বিক্রি করে চলে যাওয়ার জন্যে কষ্টটুকু করিনি। তবে আমি মারা গেলে, লরিয়ার দিকে তাকাল ব্রুকস, সবুজ চোখে কৌতূহল। মনে মনে আনন্দ পেল এই ভেবে যে ইচ্ছে করলে মেয়েটিকে দারুণ বিস্মিত করে দিতে পারে। বলছিলাম আমার মৃত্যুর পর হয়তো একটা সুযোগ আসবে তোমার। পারকাররা সে-সুযোগ করে দেয়ার জন্যে তো মুখিয়েই আছে।
ব্যাপারটাকে অন্যভাবে নিল জেমস ফ্ল্যাগান-মালিকহীন একটা বসতি হিসেবে। সন্দেহ নেই আসল ঘটনা তাকেও বিস্মিত করবে। পুলক অনুভব করছে ব্রুকস, ওর জন্যে এ ধরনের অনুভূতি এই প্রথম। নিজের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটি কাউকে বিলিয়ে দেয়ার মধ্যে অন্য এক ধরনের আনন্দ আছে।
শহরে যাচ্ছে এমন কাউকে ট্রেইলে পেলে বলে দেব, লাশগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল ফ্লাগান। এতক্ষণে খবর পেয়ে না থাকলে চলে আসবে মার্শাল।
ধন্যবাদ, ফ্লাগান।
সাবধানে থেকো, বাছা, স্পার দাবাল সার্কেল-এফ মালিক। তার কণ্ঠের আন্তরিকতা ছুঁয়ে গেল ব্রুকসকে, তাকিয়ে থাকল ছোটখাট মানুষটার দিকে। নিঃস্বার্থভাবে কখনও ওর ভাল চায়নি কেউ, কেবল এমিলিও ছাড়া।
মি. ব্রুকস? লরিয়ার ডাকে চৈতন্য ফিরল ওর।
কোন ভাবে কি পারকারদের এড়ানো যায় না?
হয়তো, যদি আমি পালিয়ে যাই।
মাথা নাড়ল লরিয়া। তুমিও ওদের মত লোক ভাড়া করতে পারো।
ধারণাটা মন্দ নয়। কিন্তু আমার অপছন্দ, তাছাড়া সে-সময়ও নেই।
খুব ভয়ঙ্কর লোক তুমি, তাই না? তিরস্কার মেয়েটির কণ্ঠে। এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে একা কদিন টিকবে? সাহস দেখানোর একটা সীমা আছে, প্রথমেই সেটা পেছনে ফেলে এসেছ তুমি। শুধু বুকভর্তি সাহস নিয়ে কেউ টিকতে পারে?
মাথা নাড়ল ব্রুকস। আরেকটা জিনিস আছে আমার। এখানে বসতি গড়ার স্বপ্ন।
ঠিক বুঝতে পারছি না তোমাকে, শ্রাগ করল লরিয়া। একবার তাকাল বাপের দিকে, ততক্ষণে বেশ দূরে চলে গেছে সে। তবে এটুকু বুঝতে পারছি পারকারদের মত তুমিও একরোখা আর অহঙ্কারী। এতকিছু ঘটতে দেখেও আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না যে সব ঘটছে সামান্য একটা কারণে, আর তিন বছর শান্তিতে কাটানো নিরীহ লোকটিই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। বাফেলোয় যাওয়ার পথে সেদিন বাড পারকারকে এড়িয়ে যেতে পারতে তুমি। তাহলে এত লোক মারা যেত না, এত রক্তও ঝরত না।
তাহলে লরিয়া ফ্ল্যাগানকে অপমানিত হতে হত।
ব্রুকসের চোখে দৃষ্টি রাখল লরিয়া। স্যামুয়েল ব্রুকস, তাতে তোমার কিছু আসত-যেত, এখন যে চড়া মাসুল দিতে হচ্ছে?
হয়তো, কিংবা না।…তোমার বাবা অপেক্ষা করছে, ম্যাম।
সার্কেল-এফের দরজা তোমার জন্যে খোলা থাকবে। তোমার সাহায্যে আসতে পারলে খুশি হব। আর…একদিন হয়তো আমার কোন প্রশ্নকেই এভাবে এড়িয়ে যাবে না তুমি। সখেদে বলল মেয়েটা, দৃষ্টিতে একরাশ অভিযোগ ছুঁড়ে দিয়ে লাগাম ঢিলে করতে এগোল ঘোড়াটা, কয়েক গজ এগিয়ে ছুটতে শুরু করল।
ঘোড়াটা দৃষ্টির আড়াল হওয়া পর্যন্ত লরিয়ার অভিমানমাখা মুখ আর দৃষ্টি ভেসে থাকল ব্রুকসের চোখে। চাপা জেদ প্রকাশ পাচ্ছিল মেয়েটির চাহনিতে। চেষ্টা করেও তা ভুলতে পারছে না ব্রুকস।
কেবিনে ফিরল ও, নিজের ওপর বিরক্ত। অযথা অনেক সময় নষ্ট হলো। অলস দৃষ্টিতে তাকাল কামরার চারদিকে, কেবিনটার মায়া ত্যাগ করতে হচ্ছে। বার-পি ক্রুরা একবার চেষ্টা করেছিল, আবারও করবে। সারাক্ষণ এখানে থাকা সম্ভব নয়, আবার থাকাও বিপজ্জনক হবে। জিনিসপত্র যে কটা সম্ভব সরিয়ে ফেলতে হবে। চুলোয় স্টু চাপিয়ে কাজে নেমে পড়ল ও। দুপুর পর্যন্ত টানা কাজ করল, উপত্যকার গোপন একটা জায়গায় সরিয়ে ফেলল কেবিনের বেশিরভাগ জিনিসপত্র।
লাঞ্চ সেরে কফির মগ হাতে নিয়ে বসেছে এসময়ে নিজের জমির সীমানায় দেখতে পেল দুজনকে। একজন ঘোড়ায় চেপেছে, অন্যজন একটা ওয়াগন চালিয়ে নিয়ে আসছে। সূর্যের আলো পড়তে ঘোড়সওয়ারের বুকে ঝিলিক দিয়ে উঠল কিছু একটা। ব্রুকস ধারণা করল লোকটা জ্যাক হবস, আর অন্যজন বোধহয় আন্ডারটেকার। ডেপুটি এত মোটাসোটা নয়।
চেয়ার ছেড়ে কেতলিতে পানি চড়াল ও। ঘড়ঘড় শব্দে ওয়াগনটা যখন বাইরে এসে পৌঁছাল, বেরিয়ে এল। সবে স্যাডল ছেড়ে গায়ের ধুলো ঝাড়ছে মার্শাল, বিরক্ত দেখাচ্ছে।
একটুও শান্তিতে থাকতে দেবে না দেখছি! চারপাশে চোখ বুলিয়ে ঝোপের পাশে স্থির হলো মার্শালের দৃষ্টি। স্থূলদেহ টেনে নিয়ে এগোল সেদিকে। তুমি লোকটা মোটেও সুবিধের নও, স্যাম। ঝামেলা ছাড়া চলতেই পারো না। পা দিয়ে ঠেলে লাশগুলো উল্টে দেখল। লেসলি উলফ আছে দেখছি, শয়তানটা মরে গিয়ে ভালই হয়েছে। অ্যারিলিনের চৌহদ্দিতে রাসলিংটা বন্ধ হকে এবার। অন্য দুটোই বা কম কিসের! রাস্টি স্টুয়ার্ট আর বিল লয়ারী। নাহ্, মানতেই হবে তোমার ভাগ্যটা সত্যি ভাল। তিনজনের রিওয়ার্ডের টাকা, সব মিলিয়ে সাতশো। টাকা আসতে সময় লাগবে এবং তদ্দিন পর্যন্ত যদি টিকে থাকতে পারো, নইলে তোমার উত্তরাধিকারীকে পৌঁছে দিতে হবে। তাকে খুঁজে বের করতে হবে এবং সেটাও ঝামেলার কাজ। দেখলে, স্যাম, ঝামেলার সাথে তোমার কেমন সখ্যতা?
বিল কারভারের কাছে চলে যেয়ো, ও জানে টাকাটা দিয়ে কি করতে হবে।
সব দেখছি আগে থেকে ভেবে রেখেছ!
বাজে লোক আমার সম্পত্তি ভোগ করবে কেন?
ঘুরে দাঁড়াল জ্যাক হবস, মোটাসোটা সঙ্গীর দিকে তাকাল। ও টোলবি, আন্ডারটেকার।
মাঝবয়সী লোকটির দিকে ফিরে নড় করল ব্রুকস, কফির আমন্ত্রণ জানাল। মাথা কঁকিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে, একাই লাশগুলো ওয়াগনে তুলতে লাগল। বয়স হলেও একটা লাশ বইবার মত শারীরিক সামর্থ্য তার যথেষ্টই আছে। কফির ব্যাপারে টোলবির চেয়ে মার্শালকেই বেশি উৎসাহী মনে হলো, ভেতরে এসে আয়েশ করে বসল।
পুরো ব্যাপারটা ঘোলাটে লাগছে, স্যাম, আলাপী সুরে শুরু করল জ্যাক হবস, কিন্তু গুরুত্বটা চাপা থাকল না। চারপাশে কিছু খোজ-খবর করতে গিয়ে ভয় ধরে গেছে আমার! অ্যারিজোনার তাবৎ বন্দুকবাজ এখন বাফেলো টাউনের পথে। তুমি বোধহয় এর কিছুটা ব্যাখ্যা দিতে পারবে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওকে দেখছে মার্শাল।
কফি পরিবেশন করে চেয়ার টেনে বসল ব্রুকস, ক্ষীণ হাসল। দুঃখিত, জ্যাক, সাহায্য করতে পারছি না। ওদের কাউকেই আমি ডেকে পাঠাইনি।
অনেকক্ষণ ধরে ওকে দেখল হবস, কি যেন বোঝার চেষ্টা করছে। তারপর শ্রাগ করে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল। আমি কিন্তু বলিনি যে তুমিই ভাড়া করেছ বা ডেকে পাঠিয়েছ ওদের। হতে পারে এরা কেউ তোমার বন্ধু, কেউ বা শত্রু। এসব লোক শেষপর্যন্ত জাঁকিয়ে বসবে এখানে। শহরটাকে নরক বানিয়ে ছাড়বে, আমার দুশ্চিন্তার কারণ এটাই। নিরীহ লোকজনও যে মরবে না তার নিশ্চয়তা কি? কফির মগ টেনে নিয়ে চুমুক দিল সে, খেই ধরল এরপর। তালিকাটা বেশ লম্বা। ইয়েলোস্টোনের খনিতে কাজ করছিল বিল লসন, পাঁচ দিন আগে রওনা দিয়েছে সে। সাথে ওর স্যাঙাৎ স্টিভ কোলম্যান। কার্লি ব্রসন যাত্রা করেছে। ফ্রগস রীভার সিটি থেকে। কয়েক মাস লাপাত্তা থাকার পর হঠাৎ করে টাকসনে দেখা গেছে টম স্টিরাপকে, সেখানে এক রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে বাফেলোর পথ ধরেছে ও। মন্টানা কিড, লিয়ন সিটির মার্শালকে খুন করার পর এদিকেই ঘোড়া ছুটিয়েছে। আরও কতজন যে হবে তা কে জানে! ভয়ঙ্কর ব্যাপার, গ্যারেটরা দুই ভাই নাকি কলোরাডে ক্যানিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। সারা বছর ওখানেই কাটায় ওরা। যখন বেরিয়ে আসে নির্ঘাত কারও কপালে খারাবি থাকে।
লোকগুলোকে ঠিকমত দেখোনি তুমি, মৃদু স্বরে অনুযোগ করল ব্রুকস।
এই জীবনে কম দেখিনি, প্রসঙ্গ বদলে যাওয়ায় বিরক্ত দেখাল মার্শালকে। ওরা এখানে মরতে এসেছে!
কেউ পেছন থেকে গুলি করেনি এবং দুএকটা গুলি করার সুযোগ ওদেরও হয়েছে, এটা যদি তোমার মুখ থেকে বেরোয় তো আমার আর ঝামেলা থাকে না। কেউ বলতে পারবে না আমি ওদের অ্যাম্বুশ করেছি।
কেন তোমার পক্ষে বলব? অধৈর্য দেখাচ্ছে হবসকে। আমি কারও পক্ষে নই। যা দেখেছি বুঝেছি, তা-ই আমার কাছে চূড়ান্ত। সিদ্ধান্তটা কারও বিরুদ্ধে গেলে আমার কিছু যায়-আসে না।
পারকার হয়তো বলবে ওদের অ্যাম্বুশ করা হয়েছে।
সেটা যে ধোপে টিকবে না এটুকু বোঝে ও, টেবিলে চাপড় মারল মার্শাল, পুরানো প্রসঙ্গে ফিরে গেল। দুজনের খবর পাইনি আমি। ইয়েট অ্যাৰ্প আর হারডিনের। অ্যাৰ্প অনেকদিন থেকে নিখোঁজ, আমার ধারণা অ্যাবিলিনে সত্যিই মারা গেছে ও। ওর গল্পগুলোর মত এটাও অবশ্য গুজব। আর হারডিন তো ছায়ার মত ঘুরে বেড়ায় সারা পশ্চিমে। কেউ ওকে চেনে না।…তোমার বয়স কত, স্যাম?
উনত্রিশ। হারডিনের সাথে ঠিক মেলে না। ওর সম্পর্কে যেসব গল্প চালু আছে তাতে ওকে আরও বয়স্ক মনে হয়। তাতে অবশ্য কিছুই প্রমাণিত হয় না। করবেটকে আগে থেকে চিনতে নাকি?
না।
ওর ওপর যেভাবে চোটপাট দেখালে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে আমার। বসে বসে মার খেল, টু শব্দ করেনি, অথচ তোমার চেয়ে দেড়গুণ চওড়া সে। আতঙ্কে সিটিয়ে ছিল, ভয় পেয়েছিল তোমাকে, কেন? মামুলি একজন স্যামুয়েল ব্রুকসকে এত ভয় পাওয়ার কি আছে?
মার্শালকে দেখছে ব্রুকস। ফ্লাগান ঠিকই বলেছে, লোকটার মাথা পরিষ্কার। আসল ঘটনা ঠিক আঁচ করে নিয়েছে। সেটা করবেট ভাল বলতে পারবে, প্রত্যুত্তরে বলল ও। আমি ওদের বলেছিলাম টেবিল থেকে হাত সরালেই মনে করব ড্র করতে যাচ্ছে। প্রথমে না হলেও শেষে সাহস দেখিয়েছে লোগান আর ওর বন্ধু।
এবং মরেছে, সিগার ধরিয়ে টান দিল হবস। ধোঁয়ার পেছন থেকে ভেসে এল পরের কথাগুলো। তিনজন লোক যাদের একজন ম্যাট লোগান, তুমি জানতে ড্র করবে ওরা। কিংবা কালকের কথাই ধরো, ছয়জনের বিরুদ্ধে লড়তে হবে জেনেও তোমার বুক এতটুকু কাপল না। স্যামুয়েল ব্রুকসের জন্যে ঘটনাগুলো একটু অস্বাভাবিক নয় কি?
ভয় পাইনি তা কি বলেছি? তাছাড়া পরিস্থিতি আমার অনুকূল ছিল।
আর হাসিয়ো না, স্যাম। দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি, ওরা কোন পাত্তাই পায়নি। এত সাহস বুকে নিয়ে চলে এরকম মানুষ এদেশে কমই আছে।
তুমি দেখছি আমাকে নায়ক বানিয়ে ছাড়বে, হালকা সুরে বলল ব্রুকস। শুনতে অবশ্য মন্দ লাগছে না। কিন্তু আসল ব্যাপার অন্যরকম, এটা হঠাৎ করে হয়ে গেছে এবং ভাগ্য ও পরিবেশের সহায়তা পেয়েছি আমি। কোণঠাসা হয়ে গেলে এমন হতেই পারে।
বিরক্ত মনে হলো মার্শালকে। কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, টোলবি প্রবেশ করায় নিরস্ত হলো। নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাকাল কফির দিকে, এক চুমুকে শেষ করে ফেলল। আরাম করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল, এরপর, দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে। বুঝলে বাছা, হারডিন ব্যাটাকে আমি ঠিক ধরে ফেলেছি। একমত না হয়ে তুমি আমার আনন্দটুকু মাটি করে দিচ্ছ।
টোলবিকে কফি পরিবেশন করতে মিনমিন করে ধন্যবাদ জানাল সে।
তোমার কাজ আরও বাড়বে, টোলবি। কাকে যে কখন বুটহিলে জায়গা নিতে হয় তার ঠিক নেই।
সায় জানানোর মত একটা ভঙ্গি করল আন্ডারটেকার, কথা বলার চেয়ে কফিতে আগ্রহ বেশি।
অনেকদিন থেকে শুনে আসছিলাম গ্যারেটরা খুঁজে বেড়াচ্ছে হারডিনকে, আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেল হবস। এখন দেখছি সেটাই ঠিক। পারকারদের টাকা বোধহয় বিফলে যাবে না এবার।
বাজে বকছ, জ্যাক। একজন মার্শাল ফ্যান্টাসি নিয়ে কাজ করে না।
নাম ভাড়িয়ে আশা করছ তোমাকে চিনতে পারবে না কেউ, এটাই তো সবচেয়ে বড় ফ্যান্টাসি! মৃদু হাসল জ্যাক হবস, পকেট থেকে ছোট্ট একটা হুইস্কির বোতল বের করে অফার করল ওকে, ব্রুকস প্রত্যাখ্যান করায় খুশি মনে গলায় ঢালল তরল পানীয়। শেষপর্যন্ত নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে না, স্যাম, ঠোঁট চাটল মার্শাল। পকেটে বোতল ঢোকানোর সময় খেয়াল করল বেরিয়ে যাচ্ছে টোলবি। সামনে কঠিন সময়, বাছা। ইচ্ছে থাকলেও তোমাকে সাহায্য করতে পারব না। মনে হচ্ছে ঝামেলা আমাকেও পোহাতে হবে, গ্যারেটরা শহরে এসে যদি বেতাল কিছু করে তবে কপালে খারাবি আছে আমার। ওদের দিকে পিস্তল তাক করতে আমার বুক কাঁপবে।
তোমার আশঙ্কা ঠিক না-ও হতে পারে।
আমি ভাল করেই জানি ওরা কেন, কোথায় আসছে। যেখানেই যায় হারডিনের খোজ করে গ্যারেটরা। ওদের দুর্ভাগ্য দেশটা অনেক বড় বলে এতদিন হদিস পায়নি। এবার নিশ্চিত হয়ে ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে এসেছে। আচ্ছা, ওদের ছোট ভাইটাকে খুন করলে কেন?
চুপ করে থাকল ব্রুকস।
দেখো বাছা, রাখ-ঢাক করে লাভ হবে না। পারকার ভাল করেই জানে তুমি কে, নয়তো এত নামী-দামী গানম্যানরা বাফেলো টাউনে আসত না। তোমার আচরণও বলে দেয় তুমি সাধারণ কেউ নও। পারকারের ক্রুরা ছাড়া আর কেবল আমিই জানি তোমার পরিচয়। জেমস ফ্ল্যাগান বোধহয় কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে, তবে ও ভাবছে তুমি হয়তো বড়সড় কোন বন্দুকবাজ। শেষপর্যন্ত সবাই জানবে। তো লুকিয়ে রেখে লাভ কি?
আমার পরিচয় নিয়ে এত মাথা-ব্যথা হওয়া উচিত নয় তোমার। বাফেলোতে আরও অনেক কিছু ঘটছে।
তুমি একজন ভয়ঙ্কর লোক। মার্শাল হিসেবে বিপজ্জনক লোকের ওপর আমাকে নজর রাখতে হয়, পরিচয় জানা থাকলে সেটা সহজ হয়ে যায়। আগ্রহভরে তাকিয়ে আছে মার্শাল, দুহাতে টেবিলে ভর দিয়ে ঝুঁকে এসেছে। তাছাড়া এবার পারকারকে চেপে ধরার চিন্তা করছে শহরের লোকজন। বাথান মালিকেরাও রাজি হবে। যার যার অবস্থান থেকে বার-পির বিরুদ্ধে একজোট হতে পারি আমরা। তুমি একা, সাহায্য ছাড়া বেশিদিন টিকতে পারবে না। আমরা তোমাকে সাহায্য করব যদি নিশ্চিত হতে পারি যে একজন সৎ লোককে সাহায্য করছি।
এমন কিছু আমি করিনি যাতে সন্দেহ করতে পারে কেউ, আমার বিরুদ্ধে কেউ কোন অভিযোগ করতে পারবে না।
সায় জানাল জ্যাক হবস। কিন্তু অবস্থাটা এমন, তোমাকে নিজেদের একজন বলে ভাবতে পারছে না এখানকার কেউ। এ জন্যে যে তুমি কারও সাথে মিশতে চাওনি। তোমার আর পারকারদের মধ্যে ওরা পার্থক্য দেখে কমই।
ফ্ল্যাগানদের সাথে আমার পরিচয় আছে।
সেটা মাত্র কিছুদিন হলো। আর ঠিক এ জন্যেই তোমার প্রতি কিছুটা সহানুভূতি আছে ওদের। বেসিনে ফ্ল্যাগানদের পরিচিতি সবচেয়ে ভালমানুষ হিসেবে। লরিয়াকে সাহায্য করে ওদের অনেকটা কাছে চলে এসেছ তুমি। এখন দরকার সবার আস্থা অর্জন করা। সবাই মিলে পারকারকে ঠেকাতে পারলে তোমাকে নিজেদের একজন বলে ভাববে ওরা।
দেখো, জ্যাক, সময় নিয়ে সিগারেট রোল করল ব্রুকস, ভাবছে অযথা কেন ওকে খোচাচ্ছে মার্শাল। তোমার খেলাটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। আমাকে হারডিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তোমার কি লাভ সেটাই মাথায় ঢুকছে না। শান্তি তে থাকতে এখানে এসেছি আমি, কেউ তাতে বাগড়া দিলে তাকে মাসুল দিতে হবে। আর…কারও সাহায্য আমার লাগবে না। নিজের ঝামেলা নিজেই মিটিয়ে নিতে পারব। কারও খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার ইচ্ছেও আমার নেই।
বিমূঢ় দেখাল মার্শালকে। দুহাতের আঙুলগুলো টেবিলে তাল ঠুকছিল, থেমে গেছে। চওড়া কাধ উচিয়ে অসহায় একটা ভঙ্গি করল। দারুণ একরোখা লোক তুমি, স্যাম। সবকিছু জেনেও কি করে অস্বীকার করছ মাথায় ঢুকছে না আমার।
তুমি যেমন অযথাই খোচাচ্ছ আমাকে। আচ্ছা, আমার চেহারার কোন পোস্টার খুঁজে পেলে নাকি?
ওই কাজটা করছে টিম ম্যাসন। ওর ধারণা তুমি লুকিয়ে থাকা দাগী কোন আসামী। দিনকে দিন ওর বিশ্বাস আরও দৃঢ় হচ্ছে এবং তা প্রমাণ করার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে। তবে ভুল পথে এগোচ্ছে ও। আমার স্থির বিশ্বাস তোমাকে অভিযুক্ত করা যায় এমন কিছু খুঁজে পাবে না।
আর তুমি?
সে-চেষ্টা আমি করছি না। কাঁচা কোন কাজ ওয়েসলি হারডিন করে না। ওর কাজে কোন খুঁত থাকে না। +
হারডিন সম্পর্কে বেশ অভিজ্ঞ মনে হচ্ছে তোমাকে?, বরং আগ্রহী বলতে পারো, ব্রুকসের মুখে আটকে থাকল মার্শালের দৃষ্টি। পরিচিত হয়ে অবশ্য মন্দ লাগেনি। তবে আফসোেস একটাই, নিজের চোখে একবার ড্র করতে দেখলাম না! উঠে দাঁড়ানোর সময় অর্থপূর্ণ চাহনি হানল হবস, অলস ভঙ্গিতে মাথায় হ্যাট চাপাল। কফির জন্যে ধন্যবাদ, বাছা।
একই জায়গায় বসে থাকল স্যামুয়েল ব্রুকস। খুরের শব্দ মিলিয়ে গেল একসময়। উঠে বেসিনের কাছে গিয়ে মগগুলো ধুয়ে নিল, মুছে তাকের ওপর রাখল। শুকনো জার্কি, সিদ্ধ সীম আর বেশ কিছু রুটি ভরল একটা প্যাকেটে। বেরিয়ে এসে দরজা আটকে দিল। আজকের পর আর কেবিনে থাকা সম্ভব কি-না জানে না কিন্তু যে কোন অবস্থার জন্যে তৈরি থাকতে চায় ব্রুকস। ওকে কোণঠাসা অবস্থায় পেয়ে যাক বার-পি ক্রুরা, সেরকম ইচ্ছে ওর মোটেও নেই।
পরের আক্রমণটা এল ভোরবেলা।
বরাবরের মত ভোরে ঘুম ভাঙল স্যামুয়েল ব্রুকসের। চোখ বুজে শুয়ে থেকে মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করল চারপাশের শব্দগুলো। ভুল হলো না, ঘাসের ওপর দিয়ে বুক টেনে চলার হালকা শব্দ দ্বিগুণ সতর্ক করে তুলল ওকে। গড়ান দিয়ে নেমে এল মেঝেয়, রাইফেল তুলে নিয়েছে হাতে। জানালা দিয়ে তাকাতে, ফিকে আলোয় পঞ্চাশ গজ দূরে চলন্ত কয়েকটা ছায়া দেখতে পেল-পাঁচজন। কেবিনের ডানদিকে দেখল আরও চারজনকে। বন্ধ দরজার দিকে তাকাল ব্রুকস, বাজি ধরে বলতে পারবে এদিকেও কয়েকজন আছে। নিশ্চিন্তে, এগিয়ে আসছে ওরা, সহজ শিকারের আশায় উন্মুখ।
ক্রল করে ভেতরের কামরায় চলে এল ও। ছোট্ট করিডর পেরিয়ে উঠে দাড়াল। এখন থেকে প্রতিটি মুহূর্ত দারুণ মূল্যবান। পেছনের দরজার খিড়কি খুলে প্রায় নিঃশব্দে বেরিয়ে এল। দুহাত দূরে মরগান পিক্সের নিরেট শরীর। কেবিনের দেয়াল ঘেঁষে এগোচ্ছে ও। পনেরো গজ দূরে করাল, পৌঁছাতে তিন সেকেন্ডের বেশি লাগল না। ঘোড়াদুটো সজাগ দাড়িয়ে। দেয়ালের আঙটায় ঝোলানো স্যাডল নামিয়ে রোয়ানের পিঠে চাপাল। পাশে ছোট একটা বোঁচকা, বিপদের আশঙ্কায় আগে থেকে ওতে খাবার ভরে রেখেছে। স্যাডল হর্নের সাথে ক্যান্টিন আর বোঁচকা ঝুলিয়ে, ঘোড়ার লাগাম হাতে সজি বেডের পাশ দিয়ে এগোল। দশ হাত দূরে ঘন অ্যাসপেনের পেছনে গোপন ট্রেইলের শুরু! রোয়ানটা দ্বিধা করছে, পাছায় চাপড় মেরে এগোতে বাধ্য করল ওটাকে। ঘোড়াটা অ্যাসপেনের আড়ালে চলে যেতে ফিরে এল করালের কাছে। ততক্ষণে টের পেয়ে গেছে প্রতিপক্ষ, সমানে রাইফেল খালি করছে। বাধ্য হয়ে বানের পাশে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকল ব্রুকস। ষাট গজ দূরে আছে ওরা। তৃণভূমি থেকে ঢাল জমি যেখানে পাহাড়শ্রেণীতে গিয়ে মিশেছে ব্রুকসের অবস্থান ঠিক সেখানে, কিছুটা উঁচুতে। মাথা তুললে দেখতে পাবে ওদের, এবং ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকলে গুলি লাগার সম্ভাবনা একেবারে নেই।
রাইফেল পাশে রেখে কোস্টগুলো হাতে নিল ও, ওলি থামার অপেক্ষায় থাকল। বেশ কিছুক্ষণ পরে থামল ওদের গুলিবর্ষণ। সুনসান নীরবতা নেমে এল। ঝটিতি উঠে দাঁড়াল ও, পোর্চের কাছে পড়ে থাকতে দেখল চারটে দেহ। মাথা উঁচিয়ে দেখতে চাইছিল একজন, বুলেটটা কপালে বিধতে ঢলে পড়ল নোকটা। পাশেরজন, দশাসই শরীরে নড়তে দেরি করায় সেটাই তার কাল হলো-পেটে আর ঘাড়ে দুটো গুলি ঢুকল পরপর। নিথর হয়ে গেল দেহটা।
একপাশে রাইফেলের নিশানায় ওকে পেয়ে গেছে তিনজন, চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল ব্রুকস। দ্রুত সেদিকে ঘুরেই গুলি শুরু করল, পিস্তল দুটো খালি হওয়া পর্যন্ত থামল না। অন্তত দুজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে মাটির সাথে শরীর মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে লোকগুলো।
পিস্তলের খালি চেম্বারে হ্যামারের বাড়ি পড়তে ঝাঁপ দিল ও, একটু দেরি করলে অন্তত তিনটে বুলেট বিদ্ধ করত ওকে। হাত বাড়িয়ে টেনে নিল রাইফেল, সামনে আনতে দেরি কেবল। একটা লোক উঠে দাঁড়িয়েছে, হয়তো ভেবেছে পিস্তল ছাড়া কিছু নেই ওর কাছে, ওকে রিলোড করার সময় দিতে নারাজ। লোকটার বোকামির জন্যে করুণা অনুভব করল। শেষ মুহূর্তে ভুল বুঝতে পারল সে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। শেষ চেষ্টা করল সে, হাতের রাইফেল থেকে আগুন ঝরল, সেইসাথে বুকে হাতুড়ি পেটাল ব্রুকসের পাঠানো গুলি। টলে উঠল দেহটা, পড়ন্ত দেহে আরেকটা বুলেট পাঠাল ব্রুকস।
নীরবতা নেমে এল। পুব আকাশে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। গান পাউডারের তাজা গন্ধে ভারী হয়ে গেছে বাতাস। ঠায় পড়ে আছে প্রতিপক্ষ, আগের তুলনায় সতর্ক। দুর্বল অবস্থানের অসুবিধে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। অবশ্য বেশিক্ষণের জন্যে নয়, জানে ব্রুকস। বার-পি ক্রুরা সংখ্যায় বেশি, অধৈর্য হয়ে একসময় ওকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করবে।
সময় যেন আটকে আছে, ফুরোতেই চাইছে না। ব্রুকসের চঞ্চল দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রেইরি, সজি বাগান আর কেবিনের আশপাশে। সূর্য ওঠার পরও অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেল! মৃদু কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, কিছু একটা নিয়ে পরামর্শ করছে লোকগুলো। কেবিনের ওপাশে চলাফেরা করছে কেউ। জানালার গরাদ ভেঙে গেল একটু পর। এপাশে দরজা ও জানালার ওপর নজর বুলাল ও, কেবিনের ভেতর একটা ছায়া দ্রুত ডানদিকে সরে গেল। ওদিকে সজি বাগানের কাছে অবস্থান নেয়া লোকগুলো ক্রমশ এগিয়ে আসছে।
কেবিনের দরজার ওপর চোখ রেখে ধীরে পিছু হটতে শুরু করল ব্রুকস। এখানে থেকে সুবিধে করতে পারবে না আর। যে কোন মুহূর্তে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে বার-পির ক্রুরা, তেমন হলে লোকগুলোকে সামলানো যাবে না।
অ্যাসপেন ঝোপের কাছে চলে এসেছে ও। মাথা উঁচিয়ে পেছনে তাকাল, দৃষ্টিসীমায় নেই কেউ। ঘুরে ছুটতে শুরু করল, সরু একটা পথ ধরে পৌঁছে গেল উপত্যকায়। অপেক্ষা করে অধৈর্য হয়ে পড়েছিল রোয়ানটা, ব্রুকস স্যাডলে চাপতে ছুটতে শুরু করল। রাশ টেনে গতি কমাল ও। পথটা বিপজ্জনক, এভাবে ছুটতে থাকলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
উত্তেজিত গলার শব্দে বোঝা গেল টের পেয়ে গেছে ওরা। ট্রেইল খুঁজে বের করতে হবে, তার আগে পেছনে রেখে আসা ঘোড়াগুলোকে আনতে হবে-অনেক সময়, এ ফুরসতে অনেকটা এগিয়ে যেতে পারবে ও তাজা ট্র্যাক ফেলে যাচ্ছে, তা ধরে সহজে এগোতে পারবে বার-পির ক্রুরা। ব্রুকসও তাই চাইছে। এমন জায়গায় ওদের নিয়ে যেতে চায় যেখানে বাড়তি কিছু সুবিধে পাবে ও, লড়াইটা তাহলে আর একতরফা হবে না। এ পাহাড়শ্রেণীতে তেমন জায়গার অভাব নেই।
ট্রেইলের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখছে ও। বুনো জানোয়ারের চলা পথ, অ্যাসপেন আর মেকিটের ছড়াছড়ি। কয়েকটা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ঝর্নার কাছে এসে পৌঁছাল। ওপাশে কয়েক মাথা উঁচু ঘন সিডারের সারি। বামে উঁচু উপত্যকা থেকে ঢলে পড়ছে শুভ্র জলরাশি, সরু নালার আকারে এটা পরে ওর জমিতে গিয়ে পড়েছে।
লাগাম ঢিলে করতে ঝর্নায় নেমে পড়ল ঘোড়াটা। স্বচ্ছ পানির নিচে শক্ত পাথুরে মাটি আর বিভিন্ন রঙের নুড়ি-পাথর। কয়েক হাত দূরে এক ঝাক ট্রাউট চোখে পড়ল। চলার মধ্যে মাথা নুইয়ে পানি পান করল রোয়ানটা। ওপাড়ে উঠে এসে সিডারের ঘন সারির মাঝখান দিয়ে চিরে চলে যাওয়া সরু পথ ধরে এগোল। কিছুক্ষণ ধরে পেছনে খুরের শব্দ পাচ্ছে। ইচ্ছে করলে এখানেই রুখে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু শত্রুপক্ষ সংখ্যায় বেশি। এখানে বড়জোর কয়েক মিনিট টিকতে পারবে ও।
সিডার উপত্যকার যেন শেষ নেই।
একসময় ঢালু জমির শুরু হলো, সিডারের সংখ্যা কমে এসেছে। আকাশছোয়া দুটো কটনউড রয়েছে পথের দুধারে। কয়েকশো ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এল ঘোড়াটা। জায়গাটা সমতল, ওপাশের ঢাল এত খাড়াভাবে নেমে গেছে যে কোন ঘোড়ার পক্ষে পিঠে সওয়ারী ছাড়াই নেমে যাওয়া কষ্টকর। ঢালের শেষে তিনশো ফুট নিচে গভীর খাদ।
স্যাডল ছেড়ে নেমে পড়ল ব্রুকস। খাবারের পোটলা খুলে বেকন আর আলুভাজা দিয়ে নাস্তা সেরে নিল। দুই ঢোক পানি খেয়ে ক্যান্টিন আর খাবারের প্যাকেট যথাস্থানে রেখে ওপাশে ঢালের কাছে নিয়ে এল রোয়ানটাকে। চাপড় মারল ওটার পাছায়, খানিক ইতস্তত করে পা বাড়াল ঘোড়াটা। পথটা ওদের কাছে নতুন নয়, আগেও কয়েকবার আসা-যাওয়া করেছে। মেসার এ প্রান্তে এসে শক্ত মাটির ওপর শুয়ে পড়ল ও, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে ইন্দ্রিয়গুলো। আসছে শিকারীরা। প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রুকস, কাউকে জখম করতে না পারলেও কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ভড়কে দিয়ে সময় আদায় করা যাবে।
তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল ও। পিঠে সূর্যের উত্তাপ অনুভব করছে। এরইমধ্যে ঘেমে গেছে, গায়ের সাথে শার্ট লেপ্টে থাকায় অস্বস্তি হচ্ছে। ধূমপানের ফাঁকে মনোযোগ দিয়ে খুরের শব্দ শুনল, হঠাৎ করে মিইয়ে এসেছে, তারমানে সিডারের বনে ঢুকে পড়েছে বার-পি কুরা। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, ধীরে সিগারেট শেষ করল ও। লোকগুলোর পৌঁছাতে সময় লাগবে, ওর মত নিশ্চিন্তে এগোনোর উপায় নেই তাদের, অ্যাম্বুশের আশঙ্কা ছাড়াও ট্র্যাক পরীক্ষা করতে হচ্ছে। সময় তো লাগবেই।
রাইফেলের মাজলে একটা সিডারের শাখায় নিশানা করল ব্রুকস। ট্রিগারে আঙুল চেপে বসেছে। খুরের শব্দ জোরেসোরে শোনা যাচ্ছে এখন। ট্রেইলের ওপর আঠার মত সেঁটে আছে ওর দৃষ্টি, যে কোন সময়ে ছুটন্ত ঘোড়া দেখতে পাবে। পায়ে খিল ধরায় নড়েচড়ে ছাড়াল সেটা।
হঠাৎ দেখা গেল প্রথম ঘোড়সওয়ারকে। লোকটা প্রকাণ্ড, কোন রকমে শরীর চাপিয়েছে একটা স্ট্যালিয়নের স্যাডলে। একে একে আরও চারজনকে দেখা গেল পেছনে। রাইফেলের নলে দ্বিতীয় লোকটাকে অনুসরণ করল ব্রুকস, ট্রিগার টেনে দিল। নির্জন উপত্যকায় প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগে পরের লোকটাও ধরাশায়ী হলো। সওয়ারীকে পেছনে ফেলে ছুটতে থাকল স্যাডলশূন্য ঘোড়াটা, ঢাল বেয়ে উঠে এল মেসার ওপর।
দুটো লাশ পড়ে আছে ভোলা জায়গায়। অন্যরা পিছু হটেছে।
রাইফেলের ব্রীচে নতুন একটা বুলেট পাঠাল ও, তারপর পিছু হটতে শুরু করল। এখানে থাকলে হয়তো আরও দুএকজনকে খসিয়ে ফেলতে পারবে, কিন্তু একসময় ঠিকই ওকে কোণঠাসা করে ফেলবে প্রতিপক্ষ। দল বেঁধে ছুটে এলে কিছু করার থাকবে না। উঠে দাঁড়াতে অনেকগুলো গুলি ছুটে গেল আশপাশ দিয়ে। মেসার কিনারে এসে থামল ক্ষণিকের জন্যে, ঢালু পথের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে ছুটে নামতে শুরু করল। খাড়া ঢাল ওর গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। চোখ সেঁটে আছে সামনের পথে, তাল রাখতে গিয়ে শরীর হেলে পড়েছে। মেলায় উঠে আসার পর, দলের প্রথম লোকটা হয়তো স্যাডলে চেপে ঢাল বেয়ে নামার চেষ্টা করবে, ভাবছে ব্রুকস, তেমন হলে ব্যাটার কপালে খারাবি আছে, দুর্ঘটনা এড়ানো কঠিন হয়ে যাবে। ক্ষীণ হাসল ও, একজন যদি এমনিতে কমে যায় মন্দ হয় না।
নিচে পাথুরে জমিতে নেমে এল ও। রোয়ানটা অপেক্ষা করছিল, দৌড়ের ওপর স্যাডলে চেপে বসল। নিজ থেকে ছুটতে শুরু করল ঘোড়াটা। সরু খাদটা বেশ খোলামেলা, দুশো গজের মত হবে, তারপর পাহাড়ের আড়াল পাওয়া যাবে। বার-পির ক্রুরা মেসায় উঠে আসার আগেই জায়গাটা পেরোতে হবে নইলে ইচ্ছেমত টার্গেট প্র্যাকটিস করার সুযোগ পেয়ে যাবে ওরা।
নির্বিঘ্নে জায়গাটা পেরিয়ে এসে বামে মোড় নিল ও। পাহাড়শ্রেণী ওদের কাছে অপরিচিত, অথচ ব্রুকসের কাছে তা হাতের তালুর মতই। উপযুক্ত পরিবেশের সুবিধা পেলে হয়তো খসিয়ে দিতে পারবে লোকগুলোকে। ওরা লড়তে জানে, বাফেলো টাউন বা অন্য কোথাও এদের দুতিনজনের সাথে দুই মিনিট টিকতে পারত না ব্রুকস। কিন্তু এখানকার কথা আলাদা, প্রতিপক্ষের সংখ্যা ইতোমধ্যে কমতে শুরু করেছে। পাহাড়ী গোলকধাঁধায় দুটিয়ে ওদের ক্লান্ত করে তুলতে চাইছে ও, সুযোগ পেলে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে ফায়দা লুটবে। ভাগ্যের সহায়তা পেলে হয়তো শেষপর্যন্ত এদের পেছনে ফেলে বেরিয়ে যেতে পারবে।
কিছুদূর এগিয়ে ডানে মোড় নিল। এ পথে পাহাড়শ্রেণীর ওপাশে বেরিয়ে যেতে পারে, মূল ট্রেইলে উঠে এসে ঘুরপথে এরপর কেবিনের কাছে যেতে পারে। কিন্তু তাতে লড়াইয়ের শেষ হবে না, লোকগুলো আগে-পরে ওকে কোণঠাসা করে ফেলবেই। এদের কাউকে জীবন্ত ফিরে যেতে দিতে নারাজ ও। হয় তাদেরকে নয়তো ওকেই মরতে হবে।
ডানে বাঁক নিয়েছে ট্রেইল। পথটা দুর্গম, খানা-খন্দ আর ক্যাকটি ঝোপে ভরা। বুনো জাতের কিছু ক্যাকটাসও আছে। পেরোতে সময় লাগবে। বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল ও। স্যাডল ছেড়ে মাথা থেকে হ্যাট সরাল। ঘামে জবজব করছে সারা শরীর, চুলগুলোও ভিজে গেছে। তপ্ত হলকা ছড়াচ্ছে মধ্যাহ্নের সূর্য। ব্যানডানার গিঁট সামান্য আলগা করে দিল। ক্যান্টিন থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গলায় ঢালল এরপর। হ্যাটের উল্টোপিঠে পানি ঢেলে, ঘোড়াটার দিকে এগিয়ে ধরল। সানন্দে তা নিঃশেষ করে ফেলল তৃষ্ণার্ত জানোয়ারটা। খানিকটা পানি ঢেলে ওটার মাথা ভিজিয়ে দিল। সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে ওটাকে, দুপা এগিয়ে ক্যাকটাসের পাশে বেড়ে ওঠা বুনো লতার দিকে মনোযোগ দিল।
বেকন আর শুকনো জার্কি দিয়ে খাওয়া সেরে নিল ব্রুকস। ধূমপানের ফাঁকে নজর বুলাল ফেলে আসা পথের ওপর। এ পর্যন্ত আসতে সময় লাগবে বার-পি রাইডারদের। মিনিট ত্রিশ বিশ্রাম নিয়ে ফের স্যাডলে চাপল। সরু উপত্যকা ধরে এগোচ্ছে। শক্ত পাথুরে জমিতে ঘোড়ার ছাপ কমই পড়ছে। একটু চেষ্টা করলে তা মুছে ফেলতে পারে, তাতে অযথাই কিছু সময় নষ্ট হবে। বার-পির লোকগুলো পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরুক, এটাই চায় ও।
সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়া পর্যন্ত টানা এগিয়ে চলল ব্রুকস। বন্ধুর পথে চলতে কষ্ট হচ্ছে ঘোঁড়াটার, তবু সন্ধ্যা নাগাদ আরও মাইলখানেক পাড়ি দিল। পাহাড়শ্রেণীর প্রায় ওপাশে এসে পড়েছে। প্রতিপক্ষ অন্তত দুই মাইল পেছনে। অন্ধকার নামলে আর এগোতে পারবে না লোকগুলো, ব্রুকসের ক্ষেত্রেও তাই। সুতরাং নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নেয়া যেতে পারে।
পাহাড়ের মধ্যে একটা ফাটল খুঁজে পেয়ে ক্যাম্প করল ও। পাশের উপত্যকায় বুনো লতা আর কিছু ঘাস রয়েছে, রোয়ানের জন্যে তা যথেষ্ট হবে। ক্যান্টিনের সবটুকু পানি ঘোড়াকে দিল, তারপর স্যাডল ছাড়িয়ে দলাই-মলাই করে দিল। আগামী কয়েকদিন ঘোড়াটা ওর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, পিস্তল বা রাইফেলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। ঘোড়া ছাড়া মরগান পিক্স পাড়ি দেয়া অকল্পনীয় ব্যাপার।
ফাটলের নিচে ঝর্নার ক্ষীণ একটা ধারা বয়ে চলেছে। ওখানে নেমে এল ব্রুকস। ক্যান্টিন ভরে কাপড় খুলে পানিতে নেমে পড়ল। ঠাণ্ডা পানির স্পর্শে শরীর জুড়িয়ে গেল, ক্লান্তি কেটে যাচ্ছে। মিনিট দশ পর উপত্যকায় উঠে এসে খাওয়া সেরে একটা জুনিপারের আড়ালে বেডরোল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। রোয়ানটা চরছে।
তারাজ্বলা আকাশের দিকে তাকাল ও, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বারবার পীড়া দিতে, চাইছে। উটকো এ ঝামেলা থেকে কবে যে মুক্তি পাবে তার ঠিক নেই। হয়তো চব্বিশ ঘণ্টাও টিকতে পারবে না। সবকিছু নির্ভর করছে ভাগ্য আর প্রতিপক্ষের ওপর। যে লোকগুলো পিছু নিয়েছে তাদের মধ্যে দুএকজন ছাড়া অন্যদের তেমন শক্ত লোক মনে হয়নি। তবে সবার কাছে অস্ত্র আছে, এটাই হচ্ছে বড় কথা। কাউকে ছোট করে দেখার উপায় নেই কারণ মৃত্যুর জন্যে একটা বুলেটই যথেষ্ট। এখানে ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড নিয়ে বসে নেই কেউ, তাই নিজের খোলা পিঠ ওদের দিকে দেয়ার ইচ্ছে ওর নেই।
জোর করে সব দুশ্চিন্তা তাড়িয়ে দিল ও। পরিপূর্ণ বিশ্রাম দরকার, আরও কদিন যে এমন হাড়ভাঙা খাটুনি যাবে বলা যাচ্ছে না।
পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে চলা শুরু করল ও। ধীরে এগোল সঙ্কীর্ণ ট্রেইল ধরে। পাহাড়শ্রেণীর ওপাশে এসে ঢাল বেয়ে নামতে যাবে, প্রেইরির ওপর চোখ পড়তে থেমে গেল। স্পষ্ট দেখতে পেল পাঁচজনের দলটাকে, উধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে। ব্রুকস জানত এখান থেকে বেরোনোর সবগুলো পথ আগলে রাখার চেষ্টা করবে প্রতিপক্ষ। ওর সৌভাগ্য লোকগুলো পৌঁছাতে খানিক দেরি করে ফেলেছে, নয়তো এখুনি হাতের মুঠোয় পেয়ে যেত ওকে। আগে আসার সুবিধেটুকু নিতে পারে ও, ভাল একটা আড়াল খুঁজে অপেক্ষা করলে বন্দুকের মুখে পাওয়া যাবে প্রেইরি ধরে আসা ক্রুদের। খোলা জায়গায় থাকবে বলে সুবিধা করতে পারবে না ওরা। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, পেছনে অন্তত একটা দল অনুসরণ করে আসছে। দুই দলের মাঝখানে পড়া ওর জন্যে মোটেও সুখের হবে না।
রোয়ানের মুখ ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরল ব্রুকস। ট্র্যাক ফেলে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই করার নেই। ওগুলো মুছতে গেলে ঘাড়ের ওপর এসে পড়বে পেছনের দলটা। দ্রুত এগোচ্ছে যদিও পুরোমাত্রায় সজাগ। একশো গজের মত এগিয়ে ডানের সরু ট্রেইলটা খুঁজে পেয়ে সেটা ধরে এগোল। খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করছে এবার। সহজে এ ট্রেইল খুঁজে পাবে না ওরা, পেলেও ওকে সাহায্য করার জন্যে সামনে দারুণ এক আয়োজনের সুযোগ পড়ে রয়েছে। মিনিট ত্রিশ এক নাগাড়ে চলে জায়গাটা পেল ও। উপত্যকা খোলামেলা হয়ে এসেছে এদিকে। পঞ্চাশ গজ দূরে ফাটলটা-পাঁচ হাত তফাতে পাহাড়ের খাড়া নিরেট দেহ, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী।
লাফ দিতে ইতস্তত করছে রোয়ানটা, কাছে গিয়ে থেমে গেল, প্রথমবার যেমন করেছিল। ঝুঁকে ওটার কেশরে হাত বুলাল ও, কিছুই না, বাছা, পিছিয়ে আসার সময় বিড়বিড় করে উৎসাহ জোগাল। আগেও এটা পার হয়েছি আমরা। কিছুক্ষণের জন্যে থেমে ধাতস্থ হওয়ার সুযোগ দিল ঘোড়াকে। বড় বড় শ্বাস টানছে ঘোড়াটা, নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। মৃদু স্পর দাবাতে ছুটল এবার, খাদের কিনারায় এসে লাফ দিল। শূন্যে ভেসে থাকল কিছু সময়, তারপর ওপাড়ের শক্ত মাটিতে নেমে এল চারটে খুর। ব্রুকসের মনে হলো হোঁচট খাবে ঘোড়াটা, যদিও এলোমেলো, কয়েক পদক্ষেপের পর স্বাভাবিক হয়ে এল ওটার চলা, থেমে গেল একটু পর।
লাফিয়ে স্যাডল ছাড়ল ও। আদর করে রোয়ানের নাকে হাত ঘষে দিল। শাবাশ ব্যাটা! আরেকবার প্রমাণ করলি তোর অসাধ্য কিছুই নেই। লাগাম ধরে ওটাকে হটিয়ে নিয়ে উপত্যকার ভেতরে চলে এল। দুটো সিডার আর কয়েকটা অ্যাসপেন আছে এদিকে, আড়াল হিসেবে মন্দ নয়। ঘোড়াকে নিরাপদ দূরত্বে ছেড়ে এসে পছন্দসই একটা জায়গা খুঁজল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে এল ফুট দশেক। বোল্ডারের কোণা বেরিয়ে আছে এক জায়গায়, পাশে খানিকটা জায়গা। একজন লোকের বসে থাকার জন্যে যথেষ্ট। আড়াল হিসেবে আদর্শ না হলেও কাজ চালিয়ে নেয়া যাবে। তাছাড়া প্রতিপক্ষ দারুণ ব্যস্ত থাকবে, লোকগুলোকে কোন সুযোগই দেবে না ব্রুকস।
দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল ও। হাঁটুর ওপর রাইফেল রেখে ধূমপানের আয়োজন করল। চোখ সামনের পাহাড়, উপত্যকা আর ট্রেইলে। আশা করছে অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবে বার-পি রাইডারেরা।
সাতজন, খাদের কিনারায় এসে দাঁড়াল একে একে। দশাসই এক লোক, পেছনে ছিল এতক্ষণ, সামনে এসে খাদটা দেখল। তারপর তাকাল এ-পাড়ের দিকে। পাহাড়ের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজছে লোকটার চোখ, শেষে ব্রুকসের পিঠের সাথে লেগে থাকা বোল্ডারের ওপর এসে থামল। ব্রুকস চিনল তাকে, বিল লসন। এখানেই আছে ও, চড়া গলায় ঘোষণা করল ইয়েলোস্টোনের রংবাজ। যেভাবেই হোক খাদ পেরিয়ে গেছে। ও যদি পেরে থাকে তো আমাদেরও না পারার কিছু নেই। স্যাডল, হর্ন থেকে রাইফেল তুলে নিল সে, নিশানা করছে। ঠোঁটে চেপে রাখা সিগার থেকে ধোঁয়া উঠছে।
খানিক পাশে সরে এসে গুলি করল ব্রুকস। বিল লসনের সিগার সে ধূলিশয্যা নেয়ার আগেই মাটিতে পড়ল। ফের গুলি করে ভূপতিত দেহটা বিদ্ধ করল। তারপর পাশের লোকটাকে। ততক্ষণে ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়েছে যেন, উল্টোদিকে ছুটতে শুরু করেছে বাকিরা। এ-পাড়ে আসার চেষ্টা করল একজন, যথেষ্ট গতি না থাকায় খাদ পেরোনোর সময় মাঝপথে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল ঘোড়াটা। ভয়ার্ত চিৎকারকে অনুসরণ করল পানিতে ভারী কিছু আছড়ে পড়ার শব্দ। কিন্তু সেদিকে মনোযোগ দেয়ার ফুরসৎ নেই কারও। রাইডারদের একজন স্যাডল ছেড়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছে, রাইফেল তুলে নিশানা করছে। লোকটার কপাল বরাবর দুটো গুলি পাঠিয়ে দিল ব্রুকস।
নিচে নামতে শুরু করতে কয়েক হাত দূরে আছড়ে পড়ল বেশ কটা গুলি। তারই একটা পাহাড়ের গায়ে পিছলে গিয়ে গোড়ালির কাছে ওর বুটে আঘাত করল। কিঞ্চিৎ ভারসাম্য হারাল ও, গড়িয়ে নেমে এল বাকি পথটুকু। নিচে নেমে উপত্যকার দিকে ছুটতে শুরু করল। পাশ দিয়ে গুলির তুবড়ি ছুটছে, সবচেয়ে কাছেরটা ওর শার্টের আস্তিনে একটা টানের কারণ হলো কেবল। নিরাপদে রোয়ানের কাছে, বিশালকায় সিডারের পেছনে এসে পৌঁছাল।
সুস্থির হয়ে জায়গাটা ভাল করে খুঁটিয়ে দেখল ও! দুটো লাশ আর একটা ঘোড়া পড়ে আছে। পেছনে ট্রেইলের আশপাশে আড়াল নিয়েছে লোকগুলো, তেমন জায়গা ওদিকে প্রচুর আছে, এদিকের মত ভোলামেলা নয়। খানিক অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রুকস। জানে এত সহজে হাল ছাড়বে না ওরা, খাদ পেরোনোর চেষ্টা আবারও করবে।
অপেক্ষার পালা। দুদফা গুলি করে ওর কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে সাহস বেড়ে গেল প্রতিপক্ষের। একটু পর তর্ক শোনা গেল, চড়া গলায় খাদ পেয়োনোর পরামর্শ দিচেছ একজন, আরেকজন সেটা সমর্থন করলেও অন্যরা নারাজ। কিছুক্ষণ বাদে সন্তর্পণে বেরিয়ে এল প্রথম লোকটা, পাঁচ মিনিটের মধ্যে অনুসরণ করল বাকিরা! স্বতঃস্ফূর্ত ওদের চলাফেরা, ধরেই নিয়েছে কেটে পড়েছে ব্রুকস। আড়াল থেকে ঘোড়াগুলোকে বের করে এনে স্যাডলে চাপল, খাদের কিনারায় এসে সার বেঁধে দাড়াল। তারপর পিছিয়ে যেতে শুরু করল। অবলা প্রাণীগুলো ঝিম মেরে আছে, সহজ হতে পারছে না। নির্দয় স্পর ওগুলোকে এগোতে বাধ্য করল, কিন্তু খাদের কিনারে এসে বেঁকে বসল দুটো। সামনের পা তুলে দিয়ে থামার চেষ্টা করল, পিঠ থেকে সওয়ারীদের ফেলে দিতে চাইছে। কিন্তু গ্যাট হয়ে বসে আছে মানুষগুলো, পড়ল তো না-ই উল্টো উপর্যুপরি স্পরের খোচা খেতে হলো। আতঙ্ক তাড়া করল ঘোড়াগুলোকে, নিজ থেকে ফিরতি পথ ধরল।
পেরোতে গিয়ে ঘোড়াসমেত খাদে খসে পড়ল একজন, আরেকজন উড়ন্ত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হলো। এ-পাড়ে এসে ঘোড়া সামলাতে ব্যস্ত একজনের দিকে ছোড়া ব্রুকসের গুলি ঘোড়াটার গায়ে বিধল। সওয়ারীকে নিচে ফেলে তার ওপর আছড়ে পড়ল ওটা। খাদ পেরিয়ে আসা শেষ লোকটাকে সামলে নেয়ার সময় দিল না ব্রুকস, গলা ফুটো করল তার। স্যাডলে উপুড় হয়ে থাকা লাশ নিয়ে ছুটতে থাকল ঘোড়াটা, রক্তের ধারা উপচে পড়ছে পেছনে।
এ অবসরে ঘোড়র তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে অন্য লোকটা, সমানে নিশানা ছাড়াই গুলি করছে। আতঙ্কে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। প্রমাদ গুনল ব্রুকস, লোকটাকে পকেটে হাত দিতে দেখে আপনমনে হাসল। বিপদ টের পেয়ে দ্রুত হাতে পিস্তলে টোটা ভরল লোকটা, তাড়াহুড়োয় ঠিকমত করতে পারল না। সিলিন্ডারে বুলেট ঢুকিয়ে হাত উঁচু করতে তার কপালে টিপ পরিয়ে দিল ব্রুকস। গুডবাই, টার্নার! বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল ও। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল মুব টার্নার, পিস্তল ধরা হাত শিথিলভাবে পড়ে থাকল দেহের পাশে। বাড় পারকার যেদিন মারা পড়েছিল সেদিন এই বার-পি পাঞ্চারও এসেছিল ওর বাথানে।
প্রথমে সাতজন ছিল ওরা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সংখ্যাটা আরও বেশি, পিছিয়ে আসার সময় ভাবছে ব্রুকস, তারমানে প্রেইরির ক্রুরা ছাড়াও আরও কিছু লোক যোগ দিয়েছে পেছনের দলটার সাথে। কত লোক ভাড়া করেছে পারকার? সারা অ্যারিজোনায় কাউকে ব্যক্তি রাখেনি বোধহয়। আজকের পর আর ভুল করবে না ভরা, করে ফেলার পর্ণ বন্ধ করে অপেক্ষা করবে এখানে আর আরেকটা দলকে পাঠাবে ঋ এদিবে।
রোয়ানটাকে খুশিমত এগোতে দিচ্ছে ও।
লুকোচুরি এ খেলাটাকে কখনোই সহজ ভাবেনি ব্রুকস, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে কাজটা আরও কঠিন। প্রতিপক্ষকে ফুটিয়ে হয়রান করতে গিয়ে ওর নিজের ক্লান্তি কম হচ্ছে না, কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই। বৈরী পরিবেশের সুযোগ নিয়ে ওদের সংখ্যা যত কমিয়ে অলা যাবে জয়ের পাল্লা কিছুটা হলেও ওর দিকে ঝুঁকবে। এখনও সবটাই পারকারের দিকে।
সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা এগোল। আরেকটু হলে মুখোমুখি হয়ে পড়েছিল একটা দলের, এই দলে আছে টম স্টিরাপ। কয়েক বছর আগে রেঙরকে অ্যাকশনে দেখেছিল তাকে। ফাস্ট গান হলেও সামনাসামনি লড়ার চেয়ে চোরাগোপ্তা হামলা পছন্দ করে। চল্লিশে পড়তে যাচ্ছে, কিন্তু বয়স হার মেনেছে ওর কাছে-পঁচিশ বছরের যুবকের মত সুঠাম পৈশীবহুল শরীর। নড়াচড়া ধীর-স্থির, দৃঢ় প্রত্যয় মেশানো। ওর পেশার লোক বেশিদিন বাঁচে না, অন্তত এরকম প্রতাপের সাথে-হয়তো এটাই ওর দৃঢ়তার কারণ।
রাত পেরিয়ে ভোর হলে আবারও চলা! ওই একই পরিবেশ, নির্দিষ্ট কয়েকটা ছবি ঘুরে-ফিরে আসছে। তুষারশুভ্র সুউচ্চ পর্বতসারি, সঙ্কীর্ণ শৈলশিরা আর দৈত্যাকার রীজ। কালের গ্রাসে অটল এ্যানিটের তামাটে শরীর, শ্যাওলা আর সূর্যের আঁচে ম্লান হয়ে যাওয়া ক্লিফের সারি। অবারিত সবুজ উপত্যকায় পাইন, স্পস আর বার্চের বনভূমি। এমনও জায়গা আছে যেখানে একটা গাছও নেই-পাথুরে জমিতে লাভার চাঙড়ের মত ধারাল, ট্র্যাকহীন পথ; মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দেয়ার মত, চলার সময় আশঙ্কা জাগে হয়তো কোন নিষিদ্ধ এলাকা, অবাঞ্ছিত প্রবেশের পর যেখান থেকে ফেরার আর উপায় থাকে না, ভুল পথের নির্দেশনায় কেবল সামনেই চলা যায়। মাঝে মাঝে পাজরের হাড়ের মত সাজানো একটার পর একটা মালভূমির মত বিস্তৃত প্রান্তর। তারপরই হয়তো সুউচ্চ শৃঙ্গ থেকে ছিটকে পড়া ঝর্নাধারা যেগুলো আরও এগিয়ে বেসিনের বুকে আছড়ে পড়েছে।
বিস্তৃত ঢাল বেয়ে কখনও নামল, আবার কখনও চড়াই বেয়ে উঠতে হলো-ফুটের পর ফুট, যেখানে ঘোলাটে মেঘেরা ক্লিফের গায়ে ঘুরে-ফিরে কেবলই চুমো খায়। স্বল্প দৃষ্টিসীমার মধ্যে মেঘের স্পর্শ শীতল অনুভূতি এনে দেয় শরীরে। জমে থাকা তুষারে ঢাকা একটা শৈলশ্রেণীতে উঠে এল ব্রুকস, সামনের বিস্তৃত প্রেইরির দিকে তাকাল। মাইলের পর মাইল, প্রায় পুরো বেসিনটাই চোখে পড়ছে। বার-পি, ডাবল-এস, সার্কেল-এফ, বক্স-বি, ওর রাউন্ড-এসবি…একইসাথে, পাশাপাশি একটা ছবির মত। সমভূমিতে চলমান গরুগুলোকে দেখাচ্ছে একেকটা বিন্দুর মত, আর ওগুলোর সারিবদ্ধ পালকে মনে হচ্ছে সচল একখণ্ড মেঘের ছায়া।
নির্দিষ্ট কোন ছক অনুসরণ করছে না ব্রুকস, ব্যাপারটা তাহলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। আগে থেকে ওর গন্তব্য আঁচ করতে পারলে শুধু সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করলে ওকে পেয়ে যাবে বিপক্ষ এবং কপাল বরাবর একটা বুলেট পাঠিয়ে দিলে চুকে যাবে সব। পরদিন শত্রুর সংখ্যা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেল ও। ত্রিশজনের কম হবে না, ছয়টা দলে ভাগ হয়ে তাড়া করছে ওকে। এদের মধ্যে অন্তত দশজন সত্যিকার কঠিন ও ভয়ঙ্কর লোক। অন্য সময় হলে এদের ধারেকাছেও ঘেঁষত না ব্রুকস, কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই এখন। হন্যে হয়ে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে লোকগুলো, ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে। খেলাটা ওদের ভাল লাগছে না আর, বিশেষত এ জন্যে যে পাহাড়শ্রেণী থেকে বেরোনোর সবকটা পথ বন্ধ করা ছাড়া কাজের কাজ কিছু করতে পারেনি এখন পর্যন্ত।
না চাইলেও দুশ্চিন্তা ভর করতে চাইছে। নিজেকে ফাদে পড়া ইদুরের মত মনে হচ্ছে ওর। বেরোনোর সবকটা পথ বন্ধ, পেছনে পাঁচ-ছয়জনের একটা দল সর্বক্ষণই লেগে আছে। পালা করে ধাওয়া করছে ওরা, নিজেদের লোক ছড়িয়েছিটিয়ে থাকায় অসুবিধে হচ্ছে না। বরং চারদিক থেকে ক্রমশ জালটাকে গুটিয়ে আনছে।
চতুর্থ দিন সকালে ব্রুকস টের পেল একটা সরু উপত্যকায় আটকা পড়েছে ও। ট্রেইলের দুদিকে অবস্থান নিয়েছে রাইডারেরা। একপাশে মরগান পিকসের চূড়া থেকে খসে পড়া ঝর্না, যেটা পরে ব্রুকসের জমিতে নদী হয়ে উপচে পড়েছে। অন্যপাশে আকাশছোঁয়া পর্বতশৃঙ্গ, তবে একেবারে দুর্গম নয়। আতঙ্কের সাথে লক্ষ্য করল সেখানেও আছে একটা দল, রাইফেলের নলে সূর্যের আলোর প্রতিফলনে অবস্থানটা ফাঁস করে ফেলেছে, নইলে না জেনে হয়তো ওদিকেই ঘোড়া ছোটাত ব্রুকস এবং ওদের তোপের মুখে গিয়ে পড়ত।
নিজের অবস্থান খতিয়ে বিচার করল ও। মন্দের ভাল বলা যেতে পারে। ট্রেইল থেকে একপাশে একটা উপত্যকায় আশ্রয় নিয়েছে, দুদিকের ঘন অ্যাসপেনের ঝোপ সামনের ট্রেইল আর পাশের উচু মালভূমির মত জায়গা থেকে আড়াল করেছে ওকে। পেছনে ক্লিফের খাড়া ঢাল নেমে গেছে ঝর্নার একেবারে তলা পর্যন্ত যেখানে শুভ জলরাশি তুমুল বেগে আছড়ে পড়ে প্রপাতের সৃষ্টি করেছে। আড়াল হিসেবে চমৎকার হত যদি প্রতিপক্ষ ওর অবস্থান না জানত। হয়তো জানে না ঠিক কোথায় আছে ও, তবে আঁচ করে নিতে পারবে। কয়েক ঘণ্টা ধৈর্য ধরে চোখ রাখলে বের করা কঠিন কিছু নয়।
শুকনো জার্কি চিবানোর ফাঁকে ট্রেইলের ওপর চোখ বুলাল ব্রুকস। উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে শরীর, নিশ্চিত জানে, অতি উৎসাহী হয়ে আক্রমণ করতে যাচ্ছে বিপক্ষ। চারদিনের অমানুষিক পরিশ্রমে ক্লান্ত ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছে ওদের বেশিরভাগ লোক। তাছাড়া এ কদিনে আগ বাড়িয়ে হামলা করতে পারেনি একবারও, কেবল ঠেকাতেই হয়েছে। শিকার এখন কোণঠাসা, কাজটা দ্রুত শেষ করতে পারলে ঝামেলা চুকে যায়। ব্রুকস জানে, এভাবে চিন্তা করবে না কয়েকজন-মন্টানা কিড, টম, স্টিরাপ, গ্যারেটরা…ওদের ধৈর্য শকুনের মত, পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে না আসা পর্যন্ত বেরিয়ে আসবে না। বরং হুজুগে কয়েকজনকে উস্কে দিয়ে ওকে অধৈর্য করে তুলবে যাতে শেষ কাজটুকু নিজেরা অনায়াসে সারতে পারে।
যতক্ষণ সম্ভব লড়ে যাবে, সিদ্ধান্ত নিল ও, প্রয়োজনে আগ বাড়িয়ে হামলা করবে। অনন্তকাল এখানে আটকে থাকার ইচ্ছে নেই, খাবার আর পানিও ফুরিয়ে এসেছে। নড়েচড়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসল ও, সিগারেট ধরাল। ধীরে সময় বয়ে চলেছে।
বামদিকে ফেলে আসা ট্রেইলের কাছে মৃদু কথাবার্তার শব্দ শোনা গেল, জেফরি করবেটের গলা। রাখ-ঢাকের কোন চেষ্টা নেই, তর্ক করছে কারও সাথে। হঠাৎ অন্যদিকে ক্ষীণ নড়াচড়া ধরা পড়ল ওর চোখে। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ইন্দ্রিয়গুলো, পরিকল্পনাটা আঁচ করতে পারছে। ওপাশের লোকগুলো অতি উৎসাহী হয়ে পড়েছে, ভাবছে বার-পি ফোরম্যান ওর মনোযোগ ধরে রাখতে পারবে আর এই সুযোগে হামলা করবে নিজেরা। মৃদু হাসল ব্রুকস, আসুক ব্যাটারা। যে কজনকে পারে সাথে নিয়ে যাবে। কোণঠাসা অবস্থায় আজই নতুন নয়। একটা সুবিধে আছে ওর—খোলা জায়গা পেরিয়ে আসতে হবে রাইডারদের এবং জানে
ঠিক কোথায় ওর অবস্থান। এত অধৈর্য না হলেও চলে, কয়েকটা দিন অবরোধ করে রাখলে বাধ্য হয়ে ওকে বেরিয়ে যেতে হবেই। কিন্তু এত ধৈর্য ওদের নেই, একে তো দলে ভারী তার ওপর এই প্রথম বাগে পেয়েছে ওকে। যে-জন্যে হন্যে হয়ে ঘোরা তা সামনে পেলে নিজেকে সামলে রাখতে পারে কজন?
ঠিক ইন্ডিয়ানদের মত বেরিয়ে এল ওরা দল বেঁধে, দ্রুত, নিঃশব্দে। কিন্তু ব্রুকসের সহজাত প্রবৃত্তি ওকে সতর্ক করে দিয়েছে। তিনজন বেরিয়ে আসতে সমানে গুলি চালাতে শুরু করল। সংক্ষিপ্ত লড়াইটা স্থায়ী হলো মাত্র কয়েক সেকেন্ড। দুটো লাশ আর একটা ঘোড়া পড়ে রইল জায়গাটায়। পরেরবার আরও সাবধানে আসবে; পিস্তল রিলোড করার সময় ভাবল ব্রুকস, এবং দুদিক থেকে একসঙ্গে হামলা করার চেষ্টা করবে।
অসম লড়াইটাতে ও এখনও টিকে আছে কেন? এর কারণ পরিবেশ সবসময়ই ওর অনুকূলে ছিল এবং তারচেয়েও বড় কারণ-ব্রুকস লড়েছে নিজের প্রাণ বাঁচাতে, যখুনি সুযোগ পেয়েছে নিষ্ঠুরের মত চড়াও হয়েছে প্রতিপক্ষের ওপর, বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি বা দয়া দেখায়নি। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে। এ নিয়ে কোন অপরাধবোধ নেই ওর কারণ কিছু খুনীকে মেরেছে ও সুযোগ পেলে যারা অবলীলায় ওকেই খুন করত। একই মনোভাব দেখাতে দোষ কোথায়? দল বেঁধে এতগুলো লোক হামলা করতে পারলে ও কেন ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারবে না? সবচেয়ে বড় ব্যাপার এখানে ওর পথ কেবল দুটি—হয় মারো নয়তো নিজে মরো, মাঝামাঝি কিছু নেই।
অন্যদিকে বার-পি ক্রুরা লড়ছে টাকার বিনিময়ে, পৈত্রিক প্রাণ বিসর্জন দেয়ার ইচ্ছে তাদের নেই। বরং অবস্থা বেগতিক দেখলে পিছুটান দিতেও দ্বিধা করবে না। নাগালের মধ্যে ওকে পেলে উল্লসিত হবে, এখন সে-সুযোগ এসেছে। নগদ টাকার পাশাপাশি জেদের পর্যায়ে চলে গেছে ব্যাপারটা, একটু আগে মরিয়া হয়ে আক্রমণ চালানোর কারণ এটাই। তার মাসুলও দিয়েছে। যারা মারা গেল জুলিয়াস পারকারের টাকা তাদের কোন কাজে আসবে না, করুণাভরে ভাবল ও। অদ্ভুত যোগাযোগ! ঠিক মত এদের বেশিরভাগ লোকই ওকে চেনে না, অথচ ধাওয়া করছে মানুষগুলো, আর ব্রুকসও অবলীলায় তাদের প্রাণ সংহার করছে। পারকারের প্রতিহিংসা আর জেদ এর জন্যে দায়ী। কেবল এতগুলো লোককেই নয়, এদের প্রত্যেকের পরিবারকেও পিস্তলের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে দাম্ভিক বুড়োটি, নিজেকেও। তবে একটি সান্ত্বনা আছে ওর, তিক্ত মনে ভাবল ব্রুকস, ও মারা গেলে আফসোস করবে না কেউ। পারকার তাতে ছেলেকে ফিরে পাবে না কিন্তু শোধ নিয়েছে এ চিন্তা করার সুযোগ পাবে। শুধু এ প্রবোধটুকু পেতে এত আয়োজন, এত রক্তক্ষয়-প্রাণহানি! জুলিয়াস পারকারের প্রতি ঘৃণা অনুভব করছে ও, কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল-বেঁচে থাকলে ছাড়বে না বুড়োকে। মাসুল তাকে দিতেই হবে। এতগুলো মানুষ দিয়েছে, আশপাশে যারা আছে তাদের অনেকেই দেবে, ব্রুকস নিজেও। যদি বেঁচে থাকেও, ওর শান্তিপূর্ণ জীবন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সঙ্কল্প…সব বিলীন হয়ে গেছে। এটা কি কম মূল্যের মাসুল? ওয়েসলি হারডিন হিসেবে এখানে থাকতে চায়নি ও, গত তিনটে বছরে হারডিন নামের লোকটা পশ্চিম থেকে প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। ওরা আবার তাকে জন্ম দিয়েছে, এখানে মরগান পিসের এই উপত্যকায়। ব্রুকস যেমন নিজের শান্তিপ্রিয় পরিচয় হারিয়েছে, তেমনি চড়া মূল্যের কিছু একটা মাসুল দিতে হবে পারকারকে। ছাড়া সে পাবে না। জন ওয়েসলি হারডিন কেমন মানুষ জানবে সে, এ কদিনে তার কুরা যেমন জেনেছে।
অখণ্ড নীরবতায় সময় বয়ে চলেছে। মানসিক চাপ বাড়ছে। ব্রুকস জানে এভাবে বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না। একসময় ওকে বেরিয়ে যেতেই হবে। প্রতিপক্ষকে টপকে যেতে হবে নয়তো অন্য কোন পথে সটকে পড়তে হবে। রাতটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময়। অন্ধকারে কাছে চলে আসতে পারবে লোকগুলো, রাত জেগে পাহারা দেয়া সম্ভব নয় ওর পক্ষে। কয়েকদিনের লাগাতার ছোটাছুটিতে এমনিতেই ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে ও।
সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছুই ঘটল না। বার-পি রাইডাররা বোধহয় রাতের অপেক্ষায় আছে। এদিকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ব্রুকস। স্যাডল হর্নে যে ল্যাসো ছিল লম্বায় ওটা পঞ্চাশ ফুটের মত। অ্যাসপেন ঝোপের ঠিক পেছনেই মজবুত দুটো সিডার, তারই একটার গুঁড়িতে ল্যাপোর একপ্রান্ত বেঁধে ক্লিফের কিনারা ধরে ঝুলিয়ে দিয়েছে। বেশ কবার ভেবে দেখেছে, ঝুঁকিটা নেয়া ছাড়া উপায় নেই। ওদের হাতে পড়ে অসহায়ভাবে মরার চেয়ে এ-ই ভাল।
অন্ধকার পুরো গাঢ় হতে ক্রল করে লাশগুলোর দিকে এগোল ব্রুকস, সময় নিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে। মৃত ঘোড়াটার কাছে পৌঁছাতে যেন একযুগ লেগে গেল। ল্যাসো নিয়ে নিরাপদে ফিরে এল। আগেরটার সাথে জোড়া লাগাল। সব মিলিয়ে একশো ফুটের মত হবে, মন্দ নয়। রোয়ানের কাছে গেল এবার, গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে কথা বলল। খরখরে জিভ দিয়ে ওর গাল, হাত চেটে দিল ঘোড়াটা। গলায় ক্যান্টিন ঝুলিয়ে পিছিয়ে এল ও, ল্যাসো ধরে নামতে শুরু করল।
শক্ত পাথুরে দেয়ালে পা ঠেকিয়ে নেমে যাচ্ছে, তাড়াহুড়ো করছে না। বাহু, কাঁধ আর হাতের ওপর চাপ পড়ছে। দস্তানার আবরণ শক্ত ল্যাসোর অত্যাচার থেকে বাচাতে পারছে না ওর হাতের মুঠিকে। ছেচড়ে নেমে যেতে পারে, কিন্তু তাতে পরিশ্রম কম হলেও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। নিস্তব্ধ রাতে অনেকদূর থেকে শোনা যাবে শব্দটা।
ল্যাসো শেষ হওয়ার আগেই ক্লিফের গা থেকে বের হওয়া একটা চাতালে এসে নামল ও। বসে বিশ্রাম নিল কিছুক্ষণ, স্বাভাবিক হয়ে এল শ্বাস-প্রশ্বাস। উঁকি দিয়ে নিচে ক্লিফের খাড়া শরীর দেখল। নেমে যাওয়া সম্ভব, সেজন্যে অসীম ধৈর্য আর মনোবল দরকার হবে। মনে মনে একটা জিনিসই প্রার্থনা করছে, লোকগুলো যেন এখনই ওকে দেখতে না পায়। আরেকটা ভয় আছে, নামার পথে ক্লিফের গায়ে জন্ম নেওয়া বেশ কিছু গুল্ম জাতীয় গাছের সাহায্য নিতে হবে, ওগুলোর কোন একটা ওর ওজন সইতে না পারলে চুকে যাবে সব।
বড় করে শ্বাস টেনে বুক ভরে নিল ব্রুকস, ফের নামতে শুরু করল। প্রচুর সময় লাগছে। অন্ধকার ওকে আড়াল করেছে ঠিকই, আবার বেরসিকের মত ক্লিফের নিরেট শরীর ঠিকমত ঠাওর করতেও দিচ্ছে না। ক্রমাগত ঝুলে থাকায় টান টান হয়ে আছে হাত-পা, বিশ্রাম চাইছে শরীর। ভয় হচ্ছে হাত ছুটে গিয়ে নিচে আছড়ে পড়বে। বাধ্য হয়ে একপাশে সরে গুহার মত ছোট্ট একটা জায়গায় এসে থামল। চিত হয়ে শুয়ে পড়ল প্রথমে, একটু সুস্থির হতে পানি খেল।
ক্যান্টিনে বাকি যেটুকু পানি ছিল তা নাকে-মুখে, ঘাড়ে ছিটিয়ে দিল। আর চল্লিশ কি পঞ্চাশ ফুট, তারপরই নদীতে নেমে পড়বে—পানি পাওয়া যাবে, সেই সাথে এবারকার মত বোধহয় ফাঁকি দিতে পারবে লোকগুলোকে।
দুর্ঘটনাটা ঘটল হঠাৎ করে। একটা জুনিপারের শুকনো কাণ্ডে শরীরের ভার চাপিয়ে দিতে গোড়াসুদ্ধ হাতে উপড়ে এল সেটা, আর হেঁচড়ে নেমে যেতে শুরু করল ওর দেহ। দুহাত ছড়িয়ে দিল ও, প্রাণপণ চেষ্টা করছে কিছু একটা ধরতে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে শরীরের কয়েক জায়গায়, ক্লিফের দেয়ালে ঘর্ষণের ফল। কিন্তু সেটা মোটেই ভাবাচ্ছে না ওকে। শেষ মুহূর্তে এসে বৃথা গেল এত পরিশ্রম, তিক্ত মনে ভাবল ও। আতঙ্কিত ব্রুকস ডানহাতে কিছু একটা লাগতে চেপে ধরেও আশান্বিত হতে পারল না। টান টান হয়ে গেল অ্যাসপেনের কচি ডগা, কিন্তু ধরে রাখল ওকে। ওর আতঙ্ক এবার বাস্তবে রূপ নিল, নিঃশব্দ রাত্রিতে বার-পি ক্রুদের উচ্চকিত গলা শোনা গেল এবং বলা বাহুল্য সেটা ওর কানে অনেক জোরাল মনে হলো।
ত্রিশ ফুট নিচে খরস্রোতা নদীর বুকে ডুবন্ত পাথর দেখা যাচ্ছে। একবার ভাবল হাত ছেড়ে দেবে, যা হয় হোক। শেষে তাড়িয়ে দিল সে-চিন্তা। আবছা অন্ধকারে হয়তো ওর সঠিক অবস্থান আঁচ করতে পারবে না প্রতিপক্ষ।
উরুতে প্রচণ্ড ধাক্কা অনুভব করতে ভুলটা ভাঙল, মনে হলো মাংস ভেদ করে আমূল ঢুকে গেছে তীক্ষ্ণধার একটা ছুরি। দারুণ ওদের হাত, অন্ধকারেও ওর অবস্থান ঠিক আঁচ করে নিয়েছে এবং সমানে গুলি করছে। ডান কাঁধে বিধল পরের গুলি। কেউ যেন অ্যাসপেনের ডাল থেকে প্রবল টানে ছুটিয়ে দিয়েছে ওর হাত, নামতে শুরু করল ভারী শরীর। আশপাশে বুলেট-বৃষ্টি হচ্ছে, কাছ দিয়ে যাচ্ছে সবকটা।
সশব্দে পানিতে আছড়ে পড়ল ওর দেহ। স্রোত টেনে নিয়ে চলল ওকে। এড়াবার কোন সুযোগই পেল না ব্রুকস, সোজা গিয়ে আছড়ে পড়ল পাথরটার ওপর। প্রচণ্ড ধাক্কায় টলে উঠল ওর পৃথিবী, অন্ধকার নেমে এল অনুভূতিতে।
উল্লাসে ফেটে পড়ল উপত্যকার লোকগুলো।
জেমস ফ্ল্যাগান দুটো স্ট্যালিয়ন জুড়ল ওয়াগনে। খানিক আগে বাফেলো টাউনের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে শেষ দুই পাঞ্চার। বেসিনের অবস্থা বিশেষ সুবিধের না হলেও পে-ডের ফুর্তি থেকে বঞ্চিত হতে নারাজ ওরা। গতকাল সন্ধ্যায় পাঞ্চারদের উদ্দেশে বলা কথাগুলো শহরে পৌঁছে, হুইস্কি গেলার পর কতটুকু ওদের মাথায় থাকে সেটাই দেখার বিষয়। সার্কেল-এফ মালিকের আশঙ্কা কাটছে না। বার-পি রাইডারে গিজগিজ করছে সারা শহর, সামান্য কারণেও গোলাগুলি হয়ে যেতে পারে। বার-পির সাথে অযথা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছে তার নেই, তেমন কিছু হলে সামাল দেয়ার ক্ষমতাও নেই।
ওয়াগনের আসনে চেপে বসতে ফ্ল্যাগান খেয়াল করল লরিয়া ওর অ্যাপলুসার লাগাম হাতে করাল থেকে বেরিয়ে আসছে। পরনে রাইডিং পোশাক। কোথাও যাবি?
শহরে।
সেটা কি ঠিক হবে? এমনিতেই প্রচুর ঝামেলা হচ্ছে, তারওপর আজ শনিবার…
আমি যাব, বাবা! দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ দেখাল লরিয়াকে, স্যাডলে চেপে বসেছে।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল ফ্ল্যাগান। ওকে নিরুৎসাহিত করা দরকার, কিন্তু ভেবে পাচ্ছে না কি বলবে। গত কয়েকদিন ধরে খুব গম্ভীর হয়ে আছে লরিয়া, সারাক্ষণই চিন্তিত। রাত জাগছে। স্যামুয়েল ব্রুকসের চিন্তা ওকে ভালভাবে পেয়ে বসেছে, ভাবল সার্কেল-এফ মালিক। মেয়েটা ভুল করতে যাচ্ছে, এর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। ব্রুকস আর দশজন যুবকের চেয়ে ভিন্ন ধাতে গড়া। লরিয়া ওকে আকর্ষণ করতে পারবে না, পারলেও নোকটার অস্থির অনিশ্চিত জীবন বাধা হয়ে দাঁড়াবে দুজনের মধ্যে। সবচেয়ে বড় কথা, পারকারদের সাথে লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত টিকতেই পারবে না ব্রুকস।
ঠিক আছে, মৃদু স্বরে সম্মতি জানাল ফ্ল্যাগান। কিন্তু আমার সাথে থাকবি সবসময়।
বাপ-মেয়ে এগোল ট্রেইল ধরে, লরিয়ার অ্যাপলুসা ওয়াগনের পাশাপাশি থাকছে।
দূর থেকে ব্রুকসের জায়গাটার ওপর চোখ পড়ল। কেবিন, বার্ন, করাল কিছুই নেই। তিন দিন আগে পুড়িয়ে দিয়েছে বার-পির ক্রুরা।
একটা জিনিস খেয়াল করেছ, বারা, গতকাল থেকে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না?
হতে পারে ওকে খুঁজে পেয়েছে, লোকগুলো নয়তো… শেষ করল না ফ্ল্যাগান।
কোন আশা নেই?
লোকগুলো ভয়ঙ্কর, মা। তাছাড়া ওরা সংখ্যায় অনেক আর ব্রুকস তো একা।
কিন্তু তুমি বলেছিলে পারকারের ক্রুদের চেয়ে অনেক শক্ত লোক ও, আর মরগান পিক্সে চলে যাওয়ায় ওর একটা সুযোগ আছে। জায়গাটা অন্যদের চেয়ে ভাল চেনে ও।
সেটা কেবল সম্ভাবনাই। কজনের সাথে পারা যায়? পাঁচ, ছয়…বড়জোর দশজন। অথচ গণ্ডায় গণ্ডায় লোক ভাড়া করেছে পারকার।
প্রথম দুদিনেই তো ওদের আটজন মারা পড়েছে।
সংখ্যাটা কমেছে কেবল।
নীরব হয়ে গেল লরিয়া, মুখ থমথমে।
বাফেলোর রাস্তায় বেশ লোকজন দেখা যাচ্ছে, অন্য যে কোন দিনের চেয়ে বেশি। বার-পি রাইডারদের চারজনের একটা দল ওদের পরপরই ধুলো উড়িয়ে শহরে ঢুকল। পেরিয়ে যাওয়ার সময় বাপ-মেয়েকে নড় করল ওরা।
আগে ব্যাংকে যাব। তুই যাবি?
মাথা নাড়ল লরিয়া। জ্যাকের অফিসে থাকব আমি। কাজ শেষে ওখানে এসো।
ব্যাংকের কাছে এসে আলাদা হয়ে গেল দুজন। ধীরে এগোল লরিয়া। দুটো বাড়ি পর মার্শালের অফিস কাম সেল। পাশে কোর্ট হাউস, তারপর ল-ইয়ার বিল কারভারের অফিস। স্যাডল ছেড়ে হিচিং রেইলে অ্যাপলুসার লাগাম বাঁধল ও। রাস্তার ওপাশের সেলুনের সামনে বসে ছিল চারজন, চেহারাই বলে দেয় বার-পির ভাড়া করা লোক। লোভী দৃষ্টিতে দেখছে ওকে। শিস বাজাল একজন, কি একটা মন্তব্য করতে হেসে উঠল সবাই। গা জ্বলে উঠল লরিয়ার, দ্রুত পায়ে পোর্চে উঠে এল। শহরে আসা বোধহয় ভুল হয়েছে, তিক্ত মনে ভাবল ও।
একটা শটগান পরিষ্কার করছিল মার্শাল জ্যাক হবস। দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকাল, হাসি ফুটল মুখে। টুপির কিনারা ধরে নড করল। কেমন আছ, লরা?
প্রত্যুত্তরে মাথা ঝাকিয়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ল লরিয়া। কিছুটা সুস্থির লাগছে, ওর ভয় হচ্ছিল লোকগুলো হয়তো পিছু নেবে। স্বস্তিকর আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে টিম ম্যাসনের অনুপস্থিতি। ব্রুকসের কোন খবর জানো তুমি, জ্যাক?
হাসি মুছে গেল হবসের মুখ থেকে। শটগান রেখে ডেস্কের কাছে গিয়ে স্টোভে কেতলি চাপাল। জানালা দিয়ে দেখো, ওপাশের সেলুনের রেইলে বাঁধা কালো ঘোড়াটা চিনতে পারছ?
ঝটিতি ঘুরে তাকাল লরিয়া। ব্রুকসের রোয়ানটা!
গতকাল ওটায় চেপে শহরে এসেছে কার্লি ব্রনসন। না, চুরি করেনি। ওরা বলছে মারা গেছে ব্রুকস।
সময় নিয়ে কফি তৈরি করল মার্শাল। লরিয়া নীরব, ঠায় বসে আছে, বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করেনি। কফির পেয়ালা এগিয়ে দেয়ার পরও আগ্রহী মনে হলো
না ওকে।
একা এসেছ?
না, বাবার সঙ্গে। ব্যাংকে গেছে।
কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, লরা।
পেয়ালা তুলে চুমুক দিল লরিয়া, বিস্বাদ লাগছে যদিও কফিটা মোটেও খারাপ হয়নি। তুমি এরচেয়ে বেশি কিছু জানো?
দুদিন আগে একটা উপত্যকায় ওকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল রাইডাররা। আগ বাড়িয়ে হামলা করতে গিয়ে দুজনকে হারিয়েছে। সারাদিন ওভাবে কাটার পর, সন্ধেয় কয়েকশো ফুট খাড়া ক্লিফ বেয়ে নেমে যাচ্ছিল ব্রুকস, শেষ মুহূর্তে ওকে দেখে ফেলে ক্রুরা সমানে গুলি করেছে। পরদিন দুপুর পর্যন্ত নদীর খাড়িতে আটকে ছিল ওর লাশ, পরে স্রোতে ভেসে গেছে।
ঘোড়াটা?
ওটাকে উপত্যকায় রেখে সরে পড়তে চেয়েছিল ব্রুকস।
জ্যাক, তুমি ঠিক জানো? মানে…ওকে পাওয়া গেছে?
ক্ষীণ হাসল মার্শাল, বুঝতে পারছে আশা ছাড়তে চাইছে না মেয়েটা। লাশটা পাওয়া যায়নি।
মাথা নিচু করে নখ খুঁটছে লরিয়া, হতাশা কাটাতে পারছে না। তোমরা এতগুলো মানুষ, বিশেষ করে তুমি, জ্যাক, কেউ একটু সাহায্য করলে না ওকে! প্রতিবাদও করোনি! অথচ জুলিয়াস পারকার অন্যায়ভাবে খুনের দল লেলিয়ে দিয়েছে ওর পেছনে।
দুঃখিত, লরা। আমার ক্ষমতা কেবল শহরেই। তাছাড়া এটা একটা রেঞ্জ ওঅর। দুটো আউটফিটের মধ্যে…
মাত্র একজন লোককে তুমি আউটফিট বলছ! খেপে গেল লরিয়া, অসন্তুষ্ট দেখাচ্ছে। আর এটা কি করে রেঞ্জ ওঅর হলো? প্রথম থেকেই ওর পিছনে লেগে ছিল পারকাররা, ব্রুকস কেবল আত্মরক্ষা করেছে। বিশ-পঁচিশজন লোক মিলে একটা মানুষকে তাড়া করেছে আর তুমি সেটাকে আইনের খোলস পরিয়ে বসে আছ!
এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল ওর, আমি ওকে বেসিন ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলাম।
জুলিয়াস পারকার নিশ্চয়ই তোমাকে কিনে নেয়নি? অসহিষ্ণু দেখাচ্ছে লরিয়াকে। খুনে-বদমাশগুলোকে ভাল করেই চেনেনা। এদেরকে বেসিনে আনার জন্যেই তো পারকারের সাজা হওয়া উচিত। এমিলিও খুন হওয়ার পরও কাউকে গ্রেফতার করোনি তুমি!
মাথা ঠাণ্ডা রাখো, লরা। আপসের সুরে বলল জ্যাক হবস। আমার কিছু করার নেই, এটা তুমিও বুঝবে। যতক্ষণ না ওরা শহরে কিছু করছে আমাকে হাত গুটিয়েই বসে থাকতে হবে। তবু কাউন্টি শেরিফকে তার করেছি, সে এলে বোধহয় কিছু একটা করতে পারবে। দায়িত্বটা তারই, আমার নয়। বিস্মিত হয়ে মেয়েটাকে লক্ষ্য করল মার্শাল, খটকা লাগছে-লরিয়া ফ্ল্যাগানকে স্যামুয়েল ব্রুকসের ব্যাপারে শুধু উদ্বিগ্নই নয় বরং খুব স্পর্শকাতর মনে হচ্ছে। এর মানে কি? ওর মনে পড়ল না মেয়েটা এর আগে কারও সাথে এরকম উদ্ধত, অসহিষ্ণু আচরণ করেছে কি-না। অদ্ভুত ব্যাপার, বেসিনের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে নীরস স্যামুয়েল ব্রুকসের ব্যাপারে আগ্রহী মনে হচ্ছে না?
সে হয়তো আসবে সবকিছু শেষ হওয়ার পর। পারকারকে অভিনন্দন জানানো ছাড়া আর কি-ইবা করতে পারবে! স্বগতোক্তির মত বলল লরিয়া, কিছুটা সুস্থির দেখাচ্ছে এখন, সামলে নিয়েছে।
নীরবতা নেমে এল।
তোমার খোঁজ করেছিল কারভার। ওর সাথে দেখা করবে?
চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল লরিয়া।
আমাকে বলেনি।
ফের নীরবতা। নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল মার্শাল, ড্রয়ার থেকে হুইস্কির বোতল বের করে গলায় ঢালল।
দুঃখিত, জ্যাক, ওভাবে বলা উচিত হয়নি, উঠে দাঁড়ানোর সময় বলল মেয়েটা, স্বাভাবিক দেখাচ্ছে ওকেম গলায় আন্তরিকতার ছোঁয়া। বাবা এলে বোলো কারভারের অফিসে থাকব আমি।
হেসে ওকে আশ্বস্ত করল মার্শাল।
ল-অফিস থেকে বেরিয়ে ফুটপাথ ধরে এগোল লরিয়া ফ্লাগান। টেরই পেল উল্টোদিক থেকে এগিয়ে আসছে লোকটা। বিল কারভারের অফিসের সামনে পৌঁছার আগেই সামনে এসে দাঁড়াল, টুপির কিনারা উঁচিয়ে নড় করল। থেমে তাকে দেখল লরিয়া। মুখে কাটাকুটির দাগ, কালো চোখে অস্থির চাহনি, ভয় ধরিয়ে দেয়ার মত লোক।
আমার নাম কার্লি ব্রনসন, ম্যাম, হাসল সে, কিন্তু লরিয়ার গা গুলিয়ে উঠল, চকিতে তাকাল রোয়ানটার দিকে। ব্রুকসের ঘোড়া, ঠিকই ধরেছ, বলে চলল লোকটা। ঘোড়া মরা মানুষের কোন কাজে আসে কি?
চুপ করে থাকল লরিয়া।
কোথায় যাচ্ছ, ম্যাম? বাজে লোকে গিজগিজ করছে শহরটা। এভাবে বেরোনো ঠিক হয়নি তোমার। চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
তোমার মত লোক, মি. ব্রনসন?
হতে পারে, নির্লজ্জের মত হাসল ব্রনসন। কিন্তু ওরা কখনও তোমাকে উইশ করবে না, কিংবা একসাথে কফি খাওয়ার প্রস্তাব দেবে না।
হয়তো ওরা তোমার চেয়ে আরেকটু জ্ঞ, কাটা কাটা স্বরে বলল লরিয়া, কেন জানি লোকটাকে এখন আর মোটেও ভয় পাচ্ছে না। একজন ভদ্রমহিলার পথ আটকে কফি খাওয়ার প্রস্তাব দেয়ার চেয়ে নিজের চরকায় তেল দয়াটাই ভাল মনে করে।
এবারও হাসল ব্ৰসন। ব্রুকসের সাথে তোমার পরিচয় ছিল, তাই না? মিলটা ভেবে দেখেছ? ওর ঘোড়া আমার হয়ে গেল, আর ওর মেয়েমানুষ… বিদ্যগতিতে আসা প্রচণ্ড চড়টা থামিয়ে দিল তাকে। ব্রনসনও তার প্রতিক্রিয়া দেখাল দ্রুত, দুএকটা চড় যেন তার কাছে কিছুই নয় বরং উদ্দেশ্যসিদ্ধির উসিলা মাত্র। ঝটিতি লরিয়ার হাত চেপে ধরল, আরেক হাতে কাধ চেপে ধরে মুখ কাছে নিয়ে এল। এবার হানি, কি করবে? একটু পর তোমার সব আঁঝ জুড়িয়ে দেব আমি! চাপা স্বরে বলল সে, মুখটা লরিয়ার মুখ থেকে মাত্র ইঞ্চিখানেক দূরে। মদ আর তামাকের তীব্র গন্ধে কুঁচকে উঠল ওর মুখ।
মেয়েটাকে ছেড়ে দাও, ব্ৰনসন! গম্ভীর, শীতল একটা কণ্ঠ শোনা গেল।
কোন শুয়োরের বাচ্চার এত সাহস? দ্রুত পেছনে ঘুরল কার্লি ব্রনসন, রাগে ধকধক করছে চোখজোড়া। লরিয়ার হাত ধরে রেখেছে এখনও। গ্যারেট! অস্কুট স্বরে বিস্ময় আর বিরক্তি প্রকাশ করল সে।
লোকটাকে দেখল লরিয়া। ছোটখাট, বেঁটেই বলা চলে। শক্ত গড়ন। জেরী টেম্পলারের মুদি দোকানের সামনে পোর্চের খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগার। নির্লিপ্ত মুখ। একটু আগে কি যেন বললে, কার্লি? আমি হয়তো ভুল শুনেছি। সিগার থেকে ছাই ঝাড়ল সে, লরিয়ার সাথে চোখাচোখি হতে নড় করল।
আড়চোখে রাস্তার ওপাশে সঙ্গীদের দিকে তাকাল ব্রনসন। ওর তিন স্যাঙাৎ উঠে দাঁড়িয়েছে।
ভদ্রমহিলাকে ছেড়ে দাও, কার্লি, ব্ৰনসনের তিন সঙ্গীর ওপর একবার দৃষ্টি বুলাল গ্যারেট। গলার স্বর শান্ত। তাহলে একটু আগে যা বললে, ভুলে যাব আমি।
আমার ব্যাপারে নাক গলাচ্ছ কেন?
ওর সাথে যেতে চাও, ম্যাম? লরিয়ার দিকে ফিরে জানতে চাইল সে।
না। জানাল ও।
এই তো চুকে গেল ব্যাপারটা, হেসে বলল টেক্সান। বোঝা যাচ্ছে ভদ্রমহিলাদের সাথে কি রকম আচরণ করতে হয় শেখা হয়নি তোমার। শোনো, কার্লি, দুটো জিনিসের সাথে কখনও জোর করতে নেই—মহিলা আর ঘোড়া। তুমি তার দুটোই করেছ।
তুমি ওর কে?
কেউ না। যেমনটা তুমি।
আমি তোমাকে কেয়ার করি না, গ্যারেট! চেঁচিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে বলল কার্লি ব্রনসন, লরিয়ার হাত ছেড়ে দিয়েছে। কলোরাডো বা টেনেসীতে তোমার জোর আছে, স্বীকার করছি, কিন্তু এখানে নয়। তাছাড়া তোমার কাছ থেকে টাকাও নিচ্ছি
যে তোমার কথা শুনতে হবে।
এই মেয়েটার পেছনে লাগার জন্যে পারকার তোমাকে টাকা দিচ্ছে?
তা দেয়নি, কিন্তু তাতে কি-ইবা আসে-যায়! কোন্ মেয়েকে আমি চুমো খাব সেটা তার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে নাকি? শোনো, গ্যারেট, অযথাই বাগড়া দিলে। ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ হয়নি আমার। একসঙ্গে কাজ করতে এসে…
তো? তাকে থামিয়ে দিল টেক্সান।
আমি চাই না নিজেদের মধ্যে কোন ঝামেলা হোক। তাছাড়া পারকারও সেটা পছন্দ করবে না। তুমি যদি মাপ চাও তো ব্যাপারটা ভুলে যেতে পারি।
হেসে বুটের তলায় সিগারের শেষাংশ পিষে ফেলল গ্যারেট। লরিয়ার দিকে তাকাল। সরে এসো, ম্যাম। যেখানে যাচ্ছিলে, যাও। কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর, ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে ব্রনসন তো নয়ই এমনকি ওর সঙ্গীদের ব্যাপারেও তার মাথা-ব্যথা নেই।
বাড়াবাড়ি করছ, প্যাট! শীতল শোনাল ব্রনসনের কণ্ঠ। ফের দেখল স্যাঙাৎদের, তৈরি আছে ওরা। সে নিজেও। সবচেয়ে বড় কথা, মানিকজোড়ের আরেকটা নেই। গ্যারেটকে সহজেই কুপোকাত করা যাবে। সারা পশ্চিমের লোকজন গল্প করবে কার্লি ব্রনসনের হাতে মারা গেছে প্যাট গ্যারেট, সন্তুষ্টচিত্তে ভাবল সে।
প্যাট, তোমার এ ব্যাপারটা আমার একেবারেই অপছন্দ, সবসময় একাই পুরোটা মেরে দিতে চাও! রাস্তার ওপাশে শোনা গেল আরেকটা কণ্ঠস্বর। নাপিতের দোকান থেকে এইমাত্র বেরিয়ে এসেছে, প্যাট গ্যারেটের সংস্করণ বলা যায়।
লরিয়া আন্দাজ করল যমজদের আরেকজন সে-ব্র্যাড গ্যারেট।
ওহে, কার্লি, তোমাকে একটা ভাল পরামর্শ দিচ্ছি, ব্র্যাডের গলায় কৌতুক এবং প্রচ্ছন্ন তাচ্ছিল্য। কোমর থেকে হাত সরিয়ে নাও। কেউ আগেভাগে পিস্তলের দিকে হাত বাড়ালে প্যাট আবার অস্বস্তিবোধ করে। ওর টিপ কিন্তু মিস্ হয় না, সবার আগে তুমিই পটল তুলবে। তোমরা, তিন স্যাঙাতের দিকে ফিরল না সে, যার যার চেয়ারে বসে পড়ো, একটু আগে যেমন ছিলে।
ততক্ষণে সামলে নিয়েছে ব্রনসন। ভেবো না আজকের ঘটনা ভুলে যাব। ভাল মানুষ সাজছ! হাড়ে হাড়ে চিনি তোমাদের, আউট-ল ছাড়া কি তোমরা?
সেটা ঠিক, হাতের চেটো দিয়ে গালে লেগে থাকা সাবান মুছল ব্র্যাড। কিন্তু কোন মহিলাকে আমরা অপমান করি না কিংবা কাউকে কোণঠাসা করে লড়াই করি না। আমরা সামনাসামনি লড়তে শিখেছি এবং পছন্দও করি।
মরগান পিক্সে না গিয়ে সেজন্যেই শহরে বসে মদ গিলছ? তোমাদের ক্ষমতা…
তুমি কি ওখানে ফিরে যাবে? শীতল কণ্ঠে বাধা দিল প্যাট গ্যারেট, আঙুল তুলে ওপাশের সেলুনটা দেখাল। নাকি পৌঁছে দিতে হবে?
স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল ব্রনসন। খানিক বাদে কাঁধ উঁচাল।
ঠিক আছে, ব্যাপারটা আপাতত এখানেই শেষ হচ্ছে। বাফেলো টাউন এখুনি ছাড়ছি না, আশা করি তোমরাও থাকছু।
আমরা অপেক্ষা করব, কালি।
দৃঢ় পায়ে রাস্তা পেরোল সে। ওপাশে সেলুনের সামনে পৌঁছে একদলা থুথু ফেলল মাটিতে। চোখ তুলে দেখল ব্র্যাডকে, বিড়বিড় করে কি যেন বলল। তারপর ব্যাটউইং দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল ভেতরে। অন্যরা অনুসরণ করল ওকে।
তোমাদের দুজনকেই ধন্যবাদ, আন্তরিক কণ্ঠে বলল লরিয়া। তোমরা না থাকলে…
ওর সাহস খুব কম, নিজেই তো দেখলে, ম্যাম। এরচেয়ে বেশি সাহস তুমিই দেখিয়েছ…আমরা না থাকলেও আর কয়েকজন ছিল, দেখো, শটগান হাতে ল-অফিসের সামনে দাঁড়ানো মার্শালকে দেখাল প্যাট গ্যারেট। লরিয়া দেখল কারভারও তার, দোতলার জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে, হাতে রাইফেল। এটাই, স্বাভাবিক, বলে চলেছে টেক্সান। কার্লির মত দুএকজন ছাড়া সব লোকই মেয়েদের সম্মান করে এবং কোথাও এর অন্যথা হলে রুখে দাঁড়ায়। মার্শালের ব্যাপারটা ভাবো একবার, গত কয়েক বছরে একবারের জন্যেও এটা ঘটেনি, অথচ শটগান হাতে চারজনের বিরুদ্ধে লড়তে বেরিয়েছে সে আজ।
সবার ওপর কৃতজ্ঞ দৃষ্টি বুলাল লরিয়া। সার্কেল-এফে তোমাদের সবার নিমন্ত্রণ রইল। তোমরা এলে খুব খুশি হব।
শুনেছ, প্যাট, মেয়েটা কি বলছে? হেসে উঠে সহোদরের উদ্দেশে ভ্রুকুটি করল ব্র্যাড। এক টেবিলে বসে মার্শাল আর ল-ইয়ারের সাথে খানা খেতে কেমন লাগবে তোমার? শুনতে কিন্তু মন্দ লাগছে, না, মার্শাল আমাদের গ্রেফতার না করলেই হলো।
ক্ষীণ হেসে অফিসে ঢুকে পড়ল জ্যাক হবস।
মিস্ ফ্ল্যাগান, একটু আসবে? শুধাল বিল কারভার। তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
টেক্সানদের কাছ থেকে বিদায় নিল লরিয়া, এগোল আইনজ্ঞের অফিসের দিকে। দালানের শুরুতে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। দোতলায় উঠে বারান্দা থেকে ফিরে তাকাল রাস্তার দিকে, কোথাও দেখতে পেল না গ্যারেটদের। তামাশা দেখা লোকজন চলতে শুরু করেছে যার যার কাজে।
বিল কারভারের অফিসটা ছোট তবে গোছানো। বেশিরভাগ জায়গা দখল করেছে তিনটি বইয়ের আলমারি আর একটা ডেস্ক। মাঝখানে টেবিলের দুদিকে চারখানা চেয়ার। একটায় বসে পড়ল লরিয়া, বড় বাঁচা বেঁচেছে আজ, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
ডেস্ক থেকে একটা ফাইল তুলে নিয়ে নিজের চেয়ারে বসল কারভার। ওটা খুলে দৃষ্টি বুলাল, তারপর মুখ তুলে তাকাল। মিস্ ফ্লাগান, আমরা স্যামুয়েল ব্রুকসের ব্যাপারে আলাপ করব।
ঠায় বসে থাকল লরিয়া, বুঝতে পারছে না।
পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে মারা গেছে ও। আমাকে কিছু দায়িত্ব দিয়ে গেছে সে। কদিন আগে একটা উইল করেছিল। সে-অনুযায়ী এখন তুমি-ই ওর সব সম্পত্তির মালিক।
লরিয়া হতভম্ব। ওর জীবনের সবচেয়ে বড় বিস্ময় বোধহয় এটাই। কয়েক মিনিট কথা জোগাল না মুখে। একসময় সামলে নিয়ে দ্বিধান্বিত কণ্ঠে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করল। কোথাও একটা ভুল হয়েছে নিশ্চয়ই। এটা হতেই পারে না! এক মাসও হয়নি আমাদের পরিচয় হয়েছে।
হতে পারে। কিন্তু ভেবে-চিন্তে কাজটা করেছে সে! ওকে আমার পাগলাটে মনে হয়নি, বরং বলা যায় দূরদৃষ্টি ছিল ওর। বোধহয় চায়নি অবাঞ্ছিত কেউ জমিটার দখল নিক।
কিভাবে তা সম্ভব?
তোমাকে একটা চিঠি লিখেছে ও, একটা চিরকুট এগিয়ে দিল আইনজ্ঞ। লরিয়া সেটা নিল, কিন্তু পড়ার আগ্রহ পাচ্ছে না। পড়ো, ম্যাম, অনুরোধ করল কারভার।
ছোট্ট চিঠি, অল্প কয়েকটা কথা কেবল। পড়ল লরিয়া:
দুঃখিত, মিস্ ফ্লাগান। তোমাকে ব্ৰিত করার জন্যে ক্ষমা চাইছি। তেমন কেউ আমার নেই যাকে এসব দিয়ে যেতে পারি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার আমি চাই বাথানটা পারকারদের হাতে পড়ক। তোমার সৌভাগ্য কামনা করছি।
সৌভাগ্য সে-ই বয়ে এনেছে, নিজের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসল অন্যকে দান করে, ভাবল লরিয়া।
বাথান আর নগদ চোদ্দ হাজার পাঁচশো। এছাড়া কিছু রিওয়ার্ড মানি। সব মিলিয়ে সতেরো হাজার হবে। ফিরিস্তি দিল কারভার।
সে কি করে ভাবল আমি এসব নেব? রেগে গেছে লরিয়া।
দুঃখিত, ম্যাম, বলতে পারছি না।
আমি যদি না নিই?
তাহলে…বাথানটা সরকারী সম্পত্তি হয়ে যাবে, ইচ্ছে করলে যে কেউ তখন ওটার দখল নিতে পারবে। কিন্তু টাকাটা আমাকে ঝামেলায় ফেলবে… দরজা খোলার শব্দে থেমে গেল আইনজ্ঞ।
বাপকে দেখে চেয়ার ছাড়ল লরিয়া, ছুটে গিয়ে আছড়ে পড়ল ফ্ল্যাগানের বুকে। কাঁদতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণ পর সুস্থির হতে পাশাপাশি বসল বাপমেয়ে। দেখো, বাবা, অদ্ভুত কি যেন বলছে তোমাদের ল-ইয়ার। অনুযোগ করল লরিয়া।
ব্যাখ্যা করল কারভার।
ফ্ল্যাগানের প্রতিক্রিয়া হলো তার মেয়ের মতই। একটা কথা, বিল, ও এসব করল কখন?
ডাস্টির সেলুনে ম্যাট লোগানের সাথে শো-ডাউন শেষে এখানে এসেছিল ও। আগে থেকে সবকিছু ভেবে রেখেছে। কি কি করতে হবে আমাকে কেবল তা-ই বলে গেছে, কোন ব্যাখ্যা দেয়নি।
কয়েকদিন আগের ঘটনাটা মনে পড়ল ফ্লাগানের। বাথান বিক্রির কথা বলেছিল ব্রুকসকে, হেঁয়ালিভরা উত্তরটার মানে এখন বুঝতে পারছে। ধন্যবাদ, বিল, উঠে দাঁড়াল সার্কেল-এফ মালিক, চিন্তিত। আমার মেয়েটার মাথা প্রায় খারাপ করে দিয়েছ। একদিনে এতগুলো চমকের ধকল সইতে পারছে না বেচারি।
মৃদু হাসল আইনজ্ঞ। ব্রুকসের মৃত্যুটা নিশ্চিত নয়, তবু সুবিধে হবে ভেবে আগেই জানালাম। জানা থাকায় পারকার কিছু করার আগেই তৈরি হয়ে নিতে পারবে। সে অবশ্য সুবিধা করতে পারবে না, জমিটার দখল নিলেই বরং আইনের ঝামেলায় পড়বে। আরও দুদিন অপেক্ষা করব, তারপর ভূমি বণ্টন অফিসে গিয়ে মিস্ ফ্ল্যাগানের নামে ক্লেইম করব আমি।
খুশি হব যদি শুনি ও বেঁচে আছে! নিচু স্বরে স্বগতোক্তি করল লরিয়া।
বিল কারভারের অফিস থেকে বেরিয়ে দক্ষিণে এগোল ওরা। ফ্ল্যাগান খেয়াল করল স্নান দেখাচ্ছে লরিয়াকে, গম্ভীর, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। স্যামুয়েল ব্রুকসের উইল ভারী বোঝার মত চেপে বসেছে মেয়েটার কাধে। ব্রুকসের মৃত্যু ওকে দগ্ধ করছে। বাথান আর টাকাগুলো তা ভুলতে দেবে না, তাড়া করে বেড়াবে কেবল।
গ্যারেটদের ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না আমার, মেয়ের মনোযোগ আকর্ষণ করতে বলল সার্কেল-এফ মালিক। পশ্চিমে ওদের আউট-ল হিসেবে চেনে সবাই। এখানে এসেছে পরকারের ভাড়াটে লোক হিসেবে অথচ অন্যদের মত ব্রুকসকে তাড়া করেনি, বু ঈগলেই ওদের সময় কাটছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, তোকে আজ সাহায্য করল এবং আরেকটু হলে নিজেদের লোকের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরত।
কার্লি ব্রনসনের সাথে খুব একটা মিল নেই ওদের। স্বার্থের কারণে একত্রে আছে, হয়তো দেখা যাবে পরস্পরকে ঘৃণা করে ওরা এবং সুযোগ পেলে একে অন্যকে খুনও করবে। লোকগুলো বেপরোয়া, কেউ কাউকে পরোয়া করে না, একদলে থাকার পরও এটাই হচ্ছে ওদের সংঘাতের কারণ।
অত কিছু বুঝি না। গ্যারেটরা আমাকে সাহায্য করেছে, ওদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এটাই হচ্ছে সাফ কথা।
তা মানছি। তবু তোর সাবধানে থাকা উচিত। আর…এরপর থেকে শহরে আসার দরকার নেই।
খুশি হয়ে মেনে নিল লরিয়া। যা অভিজ্ঞতা হয়েছে আজ! ব্যাংকের কাজ সেরেছ?
সায় জানাল ফ্ল্যাগান। পাঞ্চারদের পাওনা মেটানোর সময় আরেকবার সতর্ক করে দিয়েছে। ওরা তা মনে রাখলেই হয়, ভাবল সার্কেল-এফ মালিক। রাস্তার ওপাশে সেলুনের পোর্চে চোখ বুলাল, বেয়াড়া কেউ বসে বা দাড়িয়ে নেই।
লকহার্টের স্টোরে পৌঁছে ভেতরে ঢুকল ফ্ল্যাগান, স্টোর মালিককে ফর্দ গছিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল।
কফি না হলে চলছে না আমার, ক্লিষ্ট হাসি দেখা গেল লরিয়ার মুখে। বাবা, তুমিও এসো। মিসেস রিচার্ডসের রেস্তোরাঁয় এসে বসল ওরা। কুশল বিনিময় হলো মহিলার সাথে। টেবিলে বসার পর গ্যারেটদের ঢুকতে দেখে উজ্জ্বল হয়ে উঠল লরিয়ার মুখ। মি. গ্যারেট, এদিকে এসো, আমাদের সাথে বোসো। মিসেস রিচার্ডস, চার কাপ কফি, প্লীজ।
বাপের সাথে যমজদের পরিচয় করিয়ে দিল লরিয়া।
কিঞ্চিৎ অস্বস্তি বোধ করলেও তা চেপে রাখল ফ্ল্যাগান, সহাস্যে সম্ভাষণ জানাল। ধন্যবাদ। তোমরা সাহস করে এগিয়ে না গেলে বিপদ হতে পারত লরিয়ার। কফি শেষ করে দুজনকে সিগার অফার করল ও। আজকের দিনটা মোটেই ভাল কাটছে না আমার বাছাটার।
যা শুনেছি তাতে মনে হচ্ছে একমাত্র তোমাদের সাথেই ব্রুকসের পরিচয় আছে, হালকা সুরে বলল প্যাট গ্যারেট, আয়েশ করে সিগার টেনে চলেছে। আমরা ওর সম্পর্কে আগ্রহী।
আবার! বাপের দিকে তাকাল লরিয়া, নিজেকে ভাবিক রাখতে কষ্ট হচ্ছে ওর। দিনটা আজ সত্যি খারাপ যাচ্ছে, ভাবছে ও, ঘুরে-ফিরে বারবার এ লোকটির প্রসঙ্গ চলে আসছে। মরে গিয়ে সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে সে!
সায় দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল ফ্ল্যাগান।
অনেকদিন ধরে ওকে খুজছি আমরা।
কেন?
বব, আমাদের ছোট ভাই, মারা পড়েছিল ওর হাতে। শুনেছি ডুয়েলটা ফেয়ার ছিল না। দূর থেকে ঘটনাটা আর ওর চেহারার বর্ণনা পেয়েছি কেবল, সন্দেহ আছে ও সত্যি খুনটা করেছে কি-না। বাতাসে তো কত কথাই ভেসে বেড়ায়! আমাদের নিশ্চিত হতে হবে।
ও তো মারা গেছে।
হাসল প্যাট গ্যারেট, চোখ দেখে বোঝা যায় বিশ্বাস করেনি। একগাদা লোককে বারবার হটিয়ে দিয়েছে ও, একা। আর শেষে কি-না নদীতে নেমে যাওয়ার সময় অসহায়ভাবে মারা যাবে? উহু, বিশ্বাস করি না। আমরা যাকে খুজছি তার প্রাণ বড় শক্ত, মি. ফ্ল্যাগান। ওর মত লোক এত সহজে মরবে না। আচ্ছা বলো তো, কেমন লোক ছিল ও?
কেমন আবার, জেমস ফ্লাগান বিভ্রান্ত। সাহসী, পরিশ্রমী…কয়েকদিন আগেও, পিস্তল তুলে নেয়ার আগে ও ছিল বেসিনের সবচেয়ে নিরীহ লোক। সশস্ত্র অবস্থায় এত ভয়ঙ্কর লোকের কথা আমি কখনও শুনিনি।
বুঝলে, মি. ফ্ল্যাগান, এবার মুখ খুলল অন্যজন। চারটে বছর যেখানেই গেছি খুঁজে বেড়িয়েছি ওকে। ওর আসল পরিচয় কোথাও পাইনি। বিভিন্ন জায়গায় ওর ব্যবহার করা অন্তত দশটা নাম বলতে পারব। একটা চেহারার বর্ণনা আর অনেকগুলো নাম যার কোনটাই আসল নয়, এই নিয়ে খোজ করছি আমরা। তবে, একবার মুখোমুখি হলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
তোমরা পরকারের লোক অথচ মরগান পিসে যাওনি, অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল লরিয়া। ওখানে গেলে হয়তো নিশ্চিত হতে পারতে।
ভুল করছ, ম্যাম, আমরা পারকারের হয়ে লড়ছি না। আসলে এ লড়াইয়ে আমাদের কোন ভূমিকাই নেই। ববের হত্যাকারী এখানে আছে-জানিয়েছিল পারকার। বাফেলোতে এসে বুড়োর সাথে দেখা করলাম, আর এতে সবাই মনে করেছে ওর দলে যোগ দিয়েছি। ওর পক্ষে লড়াই করলেও মরগান পিকসে যেতাম না, ওরকম লড়াই আমরা করি না। টেনেসীর নাম শুনেছ, ম্যাম? ওখানকার মেয়েরা পর্যন্ত বেটাছেলেদের মত সামনাসামনি লড়ে। আমরা ওখানকার মানুষ। শহরে বসে ব্রুকসের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম…ও এলে নিশ্চিত হওয়া যেত।
এবং ডুয়েল শেষে মারা পড়ত সে।
বোঝা যাচ্ছে ওর সম্পর্কে আসল খবর জানো না, ছাইদানিতে সিগারের শেষাংশ গুজে রাখল ব্র্যাড গ্যারেট। ও এমন এক লোক যার সামনে পিস্তল হাতে দাড়াতে আমারও বুক কাপবে। আমরা মনেপ্রাণে চাইছি ব্রুকস যেন সে-লোক না হয়, যদিও এখানে এসে ওর সম্পর্কে যা শুনেছি এবং পরকারের লোকদের বিরুদ্ধে ও যেভাবে লড়ছে তাতে মনে হচ্ছে আমরা ঠিক জায়গায় এসেছি।
এসব আলোচনা ভাল লাগছে না লরিয়ার। ক্ষতটা তাতে কেবল বড়ই হবে। স্যামুয়েল ব্রুকস ওর জন্যে এখন সবচেয়ে স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ। যেখানেই যাচ্ছে মৃত এ লোকটি সম্পর্কে আলাপ করতে হচ্ছে। কি ভেবেছে সে? প্রায় অচেনা একটা মেয়েকে নিজের সব সম্পত্তি দান করার সাহস করল কি করে? ওর আত্মসম্মানবোধের কথাও কি তার মাথায় আসেনি?
তোমাদের জন্যে কিছু বাকি রইল না, বলল জেমস ফ্ল্যাগান। ব্রুকস নেই, থাকলেও নিশ্চিত হওয়ার উপায় ছিল না। খুন করে কেউ স্বীকার করে না।
ও করত, সে-সাহস ওর আছে।
তোমরা কি চলে যাবে? প্রসঙ্গ বদলাল লরিয়া।
না, ঘোষণা করল ব্র্যাড গ্যারেট। ওর জন্যে অপেক্ষা করব।
ফ্ল্যাগান বিস্ময় বোধ করছে, মুখে কথা সরল না।
তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো, মি. ফ্ল্যাগান, ও বেরিয়ে আসবেই। তাছাড়া পারকারের লোকেরা একটা ভুল করেছে, ব্রুকস যখন নদীর খাড়িতে আটকে ছিল, ঠিক কাজ হত নেমে গিয়ে ওকে খুন করা। ওরা তা করেনি। প্যাট গ্যারেটের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কথাগুলো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে সে, এবং বাস্তবে ঘটবেও তাই।
এত নিশ্চিত হচ্ছ কি করে?
কারণ লোকটার নাম ওয়েসলি হারডিন। বিস্ময়ের বদলে বিপর্যয় বোধ করল লরিয়া। অল্প সময়ের ব্যবধানে এতগুলো চমক আর ঘটনা ওর মন মেনে নিতে চাইছে না। জন ওয়েসলি হারডিন, পশ্চিমের সেরা বন্দুকবাজ? না, ওর কাছে মোটেও তা মনে হচ্ছে না, লরিয়ার কাছে সে স্যামুয়েল ব্রুকস নামের পরিশ্রমী একরোখা এক পোর্ক যে শান্তির জন্যে এখানে। বসতি গড়েছে। তিনটে বছর বেসিনের তাবৎ লোক যাকে জানত অহঙ্কারী এক বাথান মালিক হিসেবে যে কখনও পিস্তল ঝোলায় না। শান্ত, নির্বিরোধী। অন্যের ব্যাপারে সে নাক গলিয়েছে একবারই, বাড পারকার যখন, লরিয়াকে উত্যক্ত করছিল। সে এটা করেছে সহজাত প্রবৃত্তি বশে, একজন মহিলার অপমান সহ্য করা যায় না বলে। হয়তো অশিক্ষিত, ঠিক মিশুক নয়, তবে অবশ্যই নিপাট একজন ভদ্রলোক।
তোমরা ঠিক বলছ? চাপা স্বরে জানতে চাইল ফ্ল্যাগান। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
নড করল প্যাট, হাসল। বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো নাম ব্যবহার করেছে ও, কিন্তু চেহারা তো ওই একটাই। ওকে দেখতে পেলে পুরো নিশ্চিত হয়।
কফি নেবে আর? আহ্বান করল লরিয়া।
মিসেস রিচার্ডস কফি দিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আর কোন কথা হলো না। কি যেন ভাবছে জেমস ফ্ল্যাগান। কথাবার্তার ফাঁকে সুযোগ পেলেই চারপাশে নজর বুলাচ্ছে গ্যারেটরা, এমনকি কাচের দেয়াল ফুড়ে রাস্তা বা ওপাশের বাড়িগুলোর ওপরও চোখ রাখছে। সদা সতর্ক ভঙ্গি। সহসাই খুশি হয়ে উঠল লরিয়া, আশান্বিতশ্রুকসের একটা সুযোগ তাহলে সত্যি আছে! খোদা, ও যেন বেঁচে থাকে! অন্তস্তল থেকে প্রার্থনা করল ও। তারপরই রাজ্যের ভয় গ্রাস করল ওকে, বেঁচে থাকলেও টেক্সানদের মুখোমুখি হতে হবে ব্রুকসকে। পারকারের লোকগুলোর চেয়ে এরা ভিন্ন প্রকৃতির-ধীর-স্থির, নিজেদের সঙ্কল্পে অবিচল। ভয়ডর কি জিনিস এরা জানে না। লড়াইয়ের কিছু বোঝে না লরিয়া, কিন্তু উপলব্ধি করল পারকারের তাবৎ লোকদের চেয়ে এদের দুজনকে মোকাবিলা করা ব্রুকসের জন্যে অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। চারটে বছর একটা বিশ্বাসের ওপর সারা দেশ চষে বেড়িয়েছে এরা, উদ্দিষ্ট লোকটাকে হাতের মুঠোয় পেলে হয়ে উঠবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, নির্দয়। টেক্সানরা কতটা ভয়ঙ্কর মানুষ নিজ চোখে দেখেছে ও আজ, কার্লি ব্রনসনের মত লোক তিনজন সঙ্গী থাকার পরও ওদের সাথে লড়ার সাহস পায়নি।
কফির জন্যে ধন্যবাদ, ম্যাম, মাথায় হ্যাট চাপিয়ে উঠে দাঁড়াল ব্র্যাড গ্যারেট, হাত মেলাল ফ্ল্যাগানের সাথে। লরিয়াকে বাউ করে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল। অনুসরণ করল অন্যজন।
বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাপ-বেটি। সারা রাস্তায় খুঁজেও টেক্সানদের কোথাও দেখতে পেল না লরিয়া। স্বতঃস্ফুর্ত, নিঃশব্দ ওদের চলাফেরা। কি করে আউট-ল হলো ওরা? অনেকের চেয়ে ভদ্রোচিত ওদের আচরণ, অথচ সেটা মেকিও নয়। পশ্চিম বড় অদ্ভুত জায়গা-এখানে বাড পারকারের মত সুবেশী, কপট যেমন আছে, তেমনি আছে ব্রুকস বা গ্যারেটদের মত বুনো কিন্তু মনেপ্রাণে ভদ্রলোক। ওরা যা বিশ্বাস করে সেটা মুখের ওপর বলে দেয় এবং করেও দেখায়। গ্যারেটরা যদি ব্রুকসের বন্ধু হত, দারুণ হত তাহলে! পরকারের লোকগুলোকে হটিয়ে দিত তিনজনে মিলে। বোকার মত অলীক কল্পনা করছে বলে নিজেকে তিরস্কার করল লরিয়া। গ্যারেটরাও কি তাই ভাবছে না? ওরা মনে করে মরগান পিস থেকে ঠিকই বেরিয়ে আসবে ব্রুকস, এটাই কি সবচেয়ে বড় ফ্যান্টাসি নয়?
লকহার্ট সবকিছু তৈরি রেখেছে, রসদ তুলে দিয়েছে ওয়াগনে। চালকের আসনে বসে মেয়ের দিকে ফিরল ফ্ল্যাগান। তুই কি ঘোড়ায় চড়বি?
সায় জানাল লরিয়া।
শহর ছাড়িয়ে এসে হাঁফ ছাড়ল ও। যা একটা দিন গেল আজ! দারুণ সব অভিজ্ঞতা হয়েছে, কখনোই ভুলতে পারবে না এ দিনটা।
কিন্তু আরেকটা বিস্ময় অপেক্ষা করছিল ওর জন্যে।
স্যামুয়েল ব্রুকসের জমির ওপর দিয়ে যে ট্রেইল চলে গেছে সেটা ধরে এগোচ্ছে ওরা। ক্রীকের কাছে এসে পেছন ফিরে পোড়া কেবিন দেখল লরিয়া, তছনছ করে ফেলা হয়েছে সজি বেডগুলো। তিক্ত মনে জুলিয়াস পারকারকে অভিসম্পাত করল ও। ক্রীক পেরোনোর সময় উজান ধরে তাকাল, ঢালু পাড়ে বাদামী একটা কিছু নজর কাড়তে রাশ টানল। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে অজান্তেই এগোল সেদিকে।
লরা? পেছন থেকে ডাকল ফ্ল্যাগান।
ক্রীকের কিনারার পানি ভেঙে এগোচ্ছে লরিয়া। উইলো ঝোপের বাইরে একজোড়া বুট বেরিয়ে আছে। বাবা, ঝোপটার কাছে দেখো, কেউ একজন পড়ে আছে! উত্তেজিত শোনাল ওর কণ্ঠ, টের পেল দ্রুত হয়ে এসেছে শ্বাস-প্রশ্বাস, বুক ধড়ফড় করছে। গলা শুকিয়ে আসছে। হয়তো পারকারের কোন লোক, ভাবল লরিয়া, কিংবা ব্রুকসই, কিন্তু একটা লাশ ছাড়া কিছু নয়।
ফ্ল্যাগান একবার ভাবল মেয়েকে শাসন করবে, তারপর কি ভেবে ওয়াগনের আসন ছেড়ে নেমে এল। ক্ৰীকের পাড়ে উঠে এসে দ্রুত এগোল। তাকাল চারপাশে, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। পাহাড়শ্রেণীতে নেই কেউ, অবশ্য লুকিয়ে থাকলে বোঝার উপায় নেই।
পৌঁছে গেছে লরিয়া। ঘোড়াটা পুরো থামার আগেই ছুটতে শুরু করল। আরেকটু হলে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কোনরকমে সামলে নিল। জায়গাটায়, পৌঁছে দ্রুত হাতে উইলোর শাখাগুলো সরাল। বাবা, ও-ই! অস্ফুট স্বরে বলে উঠল ও, কুঁকে পড়ে আঁকড়ে ধরল ব্রুকসের শরীর। বেঁচে আছে, বাবা! একইসঙ্গে উল্লাস আর বেদনা প্রকাশ পেল কণ্ঠে।
মেয়ের পাশে এসে দাড়াল সার্কেল-এফ মালিক। অজ্ঞান স্যামুয়েল ব্রুকসের ওপর নজর বুলাল। বহুকষ্টে পানির কিনারা থেকে উঠে এসেছে সে। কাদায় শরীর হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ, আর কয়েক জায়গায় জমাট বঁধা রক্ত। দশফুট জায়গা পেরোতে তিনবার থেমেছে। সারাদেহ কাদা আর রক্তে মাখামাখি। কয়েকদিনের অনাহার আর রক্তক্ষরণ ওকে দুর্বল করে দিয়েছে, ভাবল ফ্ল্যাগান। তুই সরে যা, ওয়াগনের পাটাতনে জায়গা কর। আমি ওকে নিয়ে আসছি।
সরে গিয়ে অ্যাপলুসায় চড়ল লরিয়া, ফেলে আসা ওয়াগনের দিকে ছুটল।
ক্ষতগুলো পরীক্ষা করল জেমস ফ্ল্যাগান। কাঁধে ও উরুতে দুটো বুলেট ঢুকেছে, দগদগে ঘা-র মত দেখাচ্ছে ওগুলোর মুখ। মাথার চামড়া ছিলে চলে গেছে আরেকটা। কোনটাই মারাত্মক নয়। ব্রুকস নিজে দুই জায়গায় পট্টি বাঁধলেও নড়াচড়ার ফলে বারবার রক্তক্ষরণ হয়েছে। মাথার একপাশে ভোতা আঘাতের চিহ্ন, চামড়া ছড়ে গিয়ে ফুলে গেছে জায়গাটা। ফ্ল্যাগান ধারণা করল কোন কিছুর সাথে সংঘর্ষের ফল এটা। সার্কেল-এফ মালিক বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল তখনও একটা পিস্তল ধরা ছিল ব্রুকসের মুঠোয়, শেষ মুহূর্তেও হাল ছাড়েনি। সিলিন্ডার খুলে দেখল একটা গুলি খরচ করা হয়েছে, এরমানে-নদীর খাড়ি থেকে এখানে আসার পথে কেউ একজন ওর সামনে পড়ে প্রাণ দিয়েছে। খুঁজতে হলো না, অবশ্য সে-ইচ্ছেও ছিল না তার, ক্রীকের পাড় ধরে তাকাতে একটা উইলো ঝোপের কাছে পড়ে থাকতে দেখল একটা দেহ। ভাগ্যিস, লোকটার খোজে আসেনি কেউ! সেরকম হলে ব্রুকসকে আবিষ্কার করে ফেলত বার-পি কুরা। এ অবস্থায় কোন প্রতিরোধই করতে পারত না সে, অসহায়ভাবে মরতে হত।
পিস্তলটা কোমরে খুঁজে নিয়ে ব্রুকসকে তুলে নিল জেমস ফ্লাগান। ভারী দেহটা বইতে কষ্ট হচ্ছে তার, কিন্তু আনন্দের সাথে করছে সেটা।
শহরে নিয়ে যাবে? লরিয়ার কণ্ঠে উদ্বেগ, ব্রুকসকে ওয়াগনে শুইয়ে দেয়ার সময় বাপকে সাহায্য করল।
তাই করা উচিত এবং তাতে ভীমরুলের চাকে ঢিলও পড়বে। একটা দিন পেরোনোর আগেই শেষ হয়ে যাবে সব। নাহ, ওকে বাথানেই নিয়ে যাব।
কিন্ত ওর একজন ডাক্তারের দরকার, বাবা।
সেটা সম্ভব, একজন উপযুক্ত নার্সের আন্তরিক সেবাও সে পাবে, কৌতুকে নেচে উঠল ফ্ল্যাগানের চোখজোড়া। দ্রুত হাত চালাচ্ছে, পুরানো পট্টি খুলে ব্যানডানা দিয়ে ব্রুকসের ঊরুর ক্ষত পেঁচাল। তোর ওটা দে, ব্যানডানা চাইল সার্কেল-এফ মালিক। লরিয়া সেটা দিতে কাঁধের ক্ষতটা বাধল। ওকে নিয়ে যেতে পারবি না?
নড করল লরিয়া। শহরে যাচ্ছ?
ওয়াগন ছেড়ে নেমে পড়ল ফ্ল্যাগান, অ্যাপলুসার দিকে এগোল। ডক-কে মনে হয় ধরেই নিয়ে আসতে হবে। ও ব্যাটা তো সারাদিন পাগলা পানি খেয়ে চুর হয়ে থাকে।
ওয়াগনের আসলে বসে ঘোড়ার রাশ তুলে নিল লরিয়া, ফিরে তাকাল বাপের দিকে। তাড়াতাড়ি এসো, বাবা।
মাথা ঝাঁকাল সে, স্মিত হেসে অভয় দিল মেয়েকে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, আস্তে আস্তে যাবি, স্যাডলে চাপার সময় পরামর্শ দিল বাগান মালিক। ওয়াগনে যেন ঝকি না লাগে, পারবি না?
নড করে ওয়াগন ছেড়ে দিল মেয়েটা।
বাড়তি ঘোড়া সঙ্গে নিতে পারলে ভাল হত, ভাবছে ফ্ল্যাগান। সবচেয়ে তাড়ার সময়েই অযথা দেরি হয়। হয়তো দেখা যাবে ডক্ হেনরীর ঘোড়া খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বা সাজ পরাতে সময় লাগছে, কিংবা একটা ঘোড়াও ভাড়া করতে হতে পারে। ডাক্তারের হুশ ফেরাতে বেশি সময় না লাগলেই হলো। কোমরে গোজা পিস্তলে হাত বুলাল ও, দরকার হলে ব্যাটার কানের কাছে গুলি ফুটিয়ে দেবে, তারপরও যদি হুশ না ফেরে তো তুলে নিয়ে এসে তাকে আচ্ছামত গোসল করাবে এই ক্রীকে। নিজেকে শাসন করল ফ্ল্যাগান, অদ্ভুত জিনিস ভাবছে, হাস্যকর। কারণটা আর কিছু নয়-সারাদিনের, উহু, কয়েকদিনের উৎকণ্ঠা, অমঙ্গল আশঙ্কা আর অনেক তিক্ত অনুভবের পর উদ্বেগ থেকে মুক্তি। ব্যাপারটা উপভোগ করছে সে। লরিয়ার কথা ভাবল, ওর জন্যে এটা আরও তৃপ্তিকর।
পেছন ফিরে দেখল ওয়াগনটা চলতে শুরু করেছে। কারও সাথে দেখা হওয়ার আগেই যেন ওরা পৌঁছে যায়, প্রার্থনা করল জেমস ফ্ল্যাগান।
প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে কাটছে লরিয়া ফ্ল্যাগানের দিনগুলো। ব্রুকসের অক্লান্ত সেবা করছে। রাত-দিন সারাক্ষণই পাশে থাকছে, জোর করেও ওকে সরাতে পারেনি ফ্ল্যাগান। তৃতীয়দিন সকালে বিছানা ছাড়তে চাইল ব্রুকস, একরকম তেড়ে উঠল লরিয়া। আরও অন্তত দুদিন বিশ্রাম নেবে, দৃঢ় স্বরে ঘোষণা দিল। ডক্ হেনরীও তাই বলেছে।
আমাকে অলস বানিয়ে ছাড়বে তোমরা, মিস্ ফ্ল্যাগান! বিরক্ত মনে হলো ব্রুকসকে। ওদিকে অনেক কাজ পড়ে আছে।
পিস্তলবাজি? সেটা কদিন পরে হলেও চলবে। দারুণ একটা বাথান আর এতগুলো টাকা দিয়ে যাচ্ছ আমাকে, হয়তো শিগগির পটলও তুলবে। আমি কৃতার্থ হয়ে গেছি! তোমার যত্ন নিয়ে ঋণের বোঝা কিছুটা হালকা করতে দাও। লরিয়ার কণ্ঠে তীব্র শ্লেষ, দৃষ্টিতে উপহাস ঝরে পড়ছে।
চমকে উঠল ব্রুকস, লরিয়ার কটুক্তি গায়ে মাখল না। তুমি জানো?
আমাকে বলেছে কারভার। সবাই জানত মারা গেছ তুমি, পারকারের লোকেরা তাই বলছিল, বিশেষ করে কার্লি ব্রনসন। আহ্, আরেকটু হলে বেসিনের সবচেয়ে ধনী মহিলা হয়ে গিয়েছিলাম আমি!
ভুলটা কোথায় হয়েছে বুঝতে পারছে না ব্রুকস, বোকা বোকা দেখাচ্ছে ওকে।
স্যামুয়েল ব্রুকস, তুমি আমাকে অপমান করেছ!রাগ লরিয়ার চোখে-মুখে, অধৈর্য দেখাচ্ছে। আমি কি তোমার স্ত্রী না মেয়েমানুষ? বেসিনের সবলোক যখন জানবে কি ভাববে ওরা? তোমার খেয়ালের কাছে আমার আত্মসম্মানের কোন মূল্য নেই? যে কাজটা করেছ তা করার অধিকার কি তোমার আছে?
মেয়েটার আচরণের কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না ব্রুকস। অচেনা মনে হচ্ছে, হঠাৎ করে পাল্টে গেছে যেন। ক্ষমা চাইছি, ম্যাম, ভয়ে ভয়ে বলল ও। এখানে আমার পরিচিত কেবল তোমরাই, তাছাড়া আমি চাইনি বাথানটা অন্য কারও হাতে পড়ক। তোমার বাবা…
তাহলে আমার বাবাকে দিয়ে গেলে না কেন? স্যামুয়েল ব্রুকস, তুমি একটা মিথ্যুক! ম্যাট লোগান যেদিন তোমার হাতে মারা পড়ল সেদিন উইলটা করেছ তুমি। অথচ বাবা তোমাকে জমি কেনার কথা বলেছে আরও পরে। তুমি ঠিকই বুঝেছিলে বাবা এমনিই বলেছিল কথাটা। তোমার হেঁয়ালিভরা উত্তর আর চাহনি ভুলে যাইনি আমি।
ব্রুকস নীরব, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে।
তোমার সাথে আমার বোঝাপড়া এখনও শেষ হয়নি। তুমি ওয়েসলি হারডিন?
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছু করতে পারল না ব্রুকস। ওকে আজ সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে, ভাবল-অচেনা, উতলা ও আগ্রাসী।
বলছ না কেন?
হ্যাঁ। কিন্তু জানলে কিভাবে?
গ্যারেটরা বলছে ওদের ছোট ভাইকে খুন করেছ তুমি, সত্যি?
ওরাও এসেছে তাহলে!
হ্যাঁ। তোমার সৌভাগ্য ওরা মরগান পিসে যায়নি, বরং শহরে তোমার অপেক্ষায় আছে।
তোমার সাথে ওদের দেখা হয়েছে?
সেদিনের ঘটনাগুলো খুলে বলল লরিয়া। আমার উত্তর কিন্তু পাইনি।
বব গ্যারেট আমার হাতে মারা গেছে ফেয়ার ডুয়েলে, কিন্তু ওদের কাছে আমি ববের খুনীই। মনে আছে, তোমাকে একদিন বলেছিলাম, কিভাবে মারা গেল তারচেয়ে প্রিয়জন হারানোর ব্যাপারটাই একজন লোকের কাছে আসল? একটা ডুয়েলের আলাদা কোন অর্থ নেই তার কাছে। মিস্ ফ্ল্যাগান, তিক্ত শোনাচ্ছে ব্রুকসের কণ্ঠ, হতাশাভরা। এই জীবনে আমাকে বহুবার মৃত লোকের স্বজনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হয়েছে। এটা বড় কষ্টকর কাজ, তবু তা করা ছাড়া উপায় থাকে না, নইলে আমাকেই মরতে হবে। নিজের জীবনের ওপর ঘৃণা হচ্ছে আমার! সান্তনা একটাই—আমার মৃত্যুর পর প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে বেরিয়ে পড়বে না কেউ, না আমার পক্ষে না অন্য কারও পক্ষে। সব শোধ-বোধের পালা তখন শেষ হয়ে যাবে।
পিস্তল ছেড়ে তুমি সে-চেষ্টাই করেছ, তাই না? এখন বুঝতে পারছি কেন কারও সাথে মিশতে চাওনি তুমি। নতুন একটা নাম নিয়ে, নিরীহ একটা পরিচয় নিয়ে বেসিনে থাকতে চেয়েছ। ব্রুকসের হাত চেপে ধরল লরিয়া, কণ্ঠে সহানুভূতির ছোঁয়া। এবার ওর মধ্যে পরিচিত আদলটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু পারকাররা তোমাকে বাধ্য করেছে আবার অস্ত্র তুলে নিতে… দরজায় নক্ হওয়ার শব্দে থেমে গেল।
দুজন লোক তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে, ম্যাম, মেক্সিক্যান পরিচারিকা লুইসা জানাল। অফিসে অপেক্ষা করছে।
ব্রুকসের উদ্দেশে ক্ষীণ হাসল লরিয়া, বেরিয়ে গেল। অফিস কামরায় আসতে বিস্মিত হলো প্রথমে, তারপর ভয় পেল। . দাড়িয়ে ওকে বাউ করল দুই যমজ। আমরা ওর সাথে দেখা করতে এসেছি, ম্যাম, ঘোষণা দিল প্যাট গ্যারেট।
কিছু বলতে পারল না লরিয়া, ভয়ে-আশঙ্কায় দিশেহারা বোধ করছে। জানে কেন এসেছে ওরা। না, ও অসুস্থ…অসহায় একটা লোক তোমরা ওকে খুন করবে!
শুধু কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর, ম্যাম। আপাতত ওর কাছে আমাদের চাওয়া এরচেয়ে বেশি কিছু নয়।
ও এখানে আছে তোমরা জানলে কিভাবে?
এটা এমন কোন কঠিন কাজ হলো? ডাক্তার কয়েকবার এসেছে এখানে, ব্রুকসের জন্যে একসেট কাপড় কিনেছে ফ্ল্যাগান…সবচেয়ে বড় কথা বেসিনে কেবল তোমরাই ওর বন্ধু। সন্দেহ করার জন্যে এগুলোই কি যথেষ্ট নয়? জুলিয়াস পারকারও জেনে ফেলেছে। মাতাল ডাক্তারকে চেপে ধরেছিল জেফরি করবেট, দুটো চড়ের বদলে সব উগরে দিয়েছে সে। দুশ্চিন্তা করার মত ব্যাপার একটাই, আসার সময় করবেটকে দলবলসহ তৈরি হতে দেখলাম। নিশ্চিত ধরে নাও এখানেই আসছে ও।
কিন্তু আমার কাছ থেকে কোন সুবিধা পাবে না, দৃঢ় স্বরে ঘোষণা করল লরিয়া। আমি তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ, আগাম একটা খবরও দিয়েছ। তবু ওর কাছে নিয়ে যাচ্ছি না তোমাদের!
সেটা অন্যায় হবে, ম্যাম, সিগার ধরাল ব্র্যাডগ্যারেট। চার বছর ধরে ওকে খুঁজছি। ভাবো একবার-এখানে পড়ে আছে ও, আর ওদিকে সারা দেশ চষে বেড়িয়েছি আমরা। কেবল ওর মুখ থেকে একটা কথা শোনার জন্যে।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছি, ও বলেছে ওটা ফেয়ার ফাইট ছিল।
আমরা ওর মুখ থেকে শুনব।
কিন্তু তাতে কিছু আসবে-যাবে? বব গ্যারেট ওর হাতে মারা গেছে এটাই সবচেয়ে বড় কথা, আর তোমরা তাই শুনতে চাও।
একটু বসবে, ম্যাম? ব্যাপারটা তাহলে ব্যাখ্যা করি, বোঝা যাচ্ছে আমরা তোমাকে বোঝাতে পারিনি, অনুরোধ করল প্যার্ট গ্যারেট। থেমে অপেক্ষা করল, লরিয়া বসে পড়ার পর খেই ধরল। ঘটনাটা ঘটেছিল মন্টানার এক সেলুনে। পোকার, খেলছিল ওরা-ড্যান মরগান ওরফে হারডিন, বব আর ওখানকার স্থানীয় দুজন যার একজন হচ্ছে মন্টানা কিড। বিলি দ্য কিডের মত দেখতে বলে ওকে ওই নামে ডাকে সবাই। হারডিনই জিতছিল, সম্ভবত চুরি না করে, যদিও সেলুনের বারটেন্ডার বলেছে চুরি করছিল ও। ভাইটা আমাদের বরাবরই ছিল একটু বেয়াড়া স্বভাবের, তারওপর ওখানকার কেউ চিনতে পারেনি হারডিনকে, ববও চেনেনি। হেরে গিয়ে হারডিনকে চ্যালেঞ্জ করল ও। হারডিন হাসল কেবল, প্রমাণ করার অনুরোধ জানাল। কিছুই করতে পারল না বব। খেলায় ইস্তফা দিয়ে চলে যাচ্ছিল সে, দশ-পা এগিয়ে ঘুরেই গুলি করল। বব মারা গেল।
প্রশ্নটা এখানেই। বারকিপসহ আরও কয়েকজন বলছে বব পিস্তলে হাত দেয়নি। ওরা মিথ্যে বলবে কেন? ওখানকার শেরিফ বলছে ভিন্ন কথা, সে কিছু দেখেনি কিন্তু হারডিনের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। আরও জানিয়েছে কয়েকদিন ধরে সেলুনটাতে নিয়মিত আড্ডা দিচ্ছিল বব, কিডের সাথে পোকার খেলছিল। এবং একদিন আগে ওখানে এসে কিডকে পিটিয়েছিল হারডিন। কিডের সাথে আবার বারকিপারের খুব খাতির, হতে পারে লোকটাকে ম্যানেজ করে ওকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছে সে। আরেকটা ব্যাপার, হারডিন তো এমনিতে ফাস্ট… বব পিস্তল বের করার আগেই হয়তো গুলি খেয়েছে, কেউ কিছু বুঝতেই পারেনি। এমন ডুয়েলগুলো চোখের পলকে ঘটে যায়।
তোমরা বারকিপ বা মন্টানাকে চেপে ধরোনি কেন?
কিডকে আমরা পাইনি, তাছাড়া কোন্ উসিলায় ওকে চার্জ করব? বাফেলোতেও ওর দেখা পাইনি, মরগান পিকসে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে সে। আর বারকিপ লোকটা নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিল, কসম খেয়ে বলেছে। তাছাড়া…সরাসরি ওর কাছে জানতে চাওয়াই তো সবদিক থেকে ভাল, একমাত্র ও-ই নিশ্চিত বলতে পারবে ঠিক কি ঘটেছিল সেদিন, তাই না? শুনতে হয়তো বেখাপ্পা লাগবে, কিন্তু এটা ঠিক কিডের চেয়ে বরং ওর মুখের একটা কথার ওপর আমাদের আস্থা বেশি। কারণ নিজের নাম বা ওরকম ছোটখাট ব্যাপারে মিথ্যে বললেও সত্য স্বীকার করার সাহস ওর আছে। থেমে লরিয়ার দিকে তাকাল ব্র্যাড, ওর চোখে-মুখে দ্বিধা দেখে স্মিত হাসল। আমাদের খুনী মনে হয়, ম্যাম? ওকে খুন করার উদ্দেশে এসে থাকলে তোমার কাছে অনুমতি নিতাম না, জোর করে ঢুকে পড়তাম। হয়ঙ্গে আমরা শক্ত মানুষ, কিন্তু আইনের প্রতি শ্রদ্ধা মোলোআনা। ও যদি ববের সাথে চালাকি না করে থাকে তো আমাদেরও কোন অভিযোগ নেই। সত্যিটা জানার পরপরই চলে যাব। কিন্তু উল্টোটা যদি হয়, তো স্বয়ং শয়তানও আমাদের হাত থেকে ওকে বাঁচাতে পারবে না।
চুপ করে থাকল লরিয়া, সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে টেবিলে রাখল ব্র্যাড। আমরা নিরস্ত্র অবস্থায় ওর সাথে কথা বলব, ম্যাম।.ও যদি খুনী হয়ে থাকে, ওকে মোকাবিলা করব অন্য কোথাও যেখানে সমান সুযোগ পাবে সে এবং আগে আমি লড়ব, আমি
পারলে প্যাট চেষ্টা করবে। থেমে সহোদরের দিকে ফিরল, প্যাট ওর পিস্তল রাখল টেবিলে। চারটে বছর অনেক মানসিক যন্ত্রণা সইতে হয়েছে আমাদের। ওকে খুজে খুজে ক্লান্ত ও অধীর হয়ে পড়েছি। সবকিছুর শেষ ভালভাবে হোক এটা আমাদের চেয়ে বেশি আর কেউ চাইবে না। খুশি হব যদি জানতে পারি এতদিন কেবল একটা মিথ্যের পেছনে ছুটছিলাম।
অসহায় দৃষ্টিতে টেক্সানদের দেখুল লরিয়া, তারপর মাথা ঝাঁকাল। আমার বিশ্বাসটা ভেঙে দিয়ো না, প্লীজ! দুজনকে অনুসরণ করতে বলে এগোল। করিডর ধরে চলে এল উদ্দিষ্ট কামরার সামনে। ভেজানো দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল ও। মি. ব্রুকস…
গ্যারেটরা, তাই না? আগেই বলে উঠল ব্রুকস, দেয়ালে বালিশ ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে বসেছে। গম্ভীর কিন্তু নিরুদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। দুভাই কামরায় ঢুকতে নিষ্কম্প দৃষ্টিতে দেখল ওদের।
পেছনে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে পাশাপাশি দাঁড়াল ওরা। অবশেষে তোমার দেখা পেলাম! প্যাট গ্যারেটের কণ্ঠস্বর একটু বেশি দৃঢ় শোনাল। বহুদিন ধরে তোমাকে খুঁজছি আমরা, হারডিন।
আমি জানতাম না। তবে কিছু উড়ো কথা শুনেছি যে তোমরা হারডিনকে খুঁজছ।
প্রথমে আমরা ড্যান মরগানের পেছনে ছুটেছি, তাকে কি আর পাওয়া যায়? তা বুঝে আসল লোকটির পরিচয় বের করতে অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছিল। আর এদিকে এখানে বসে আছ তুমি। মৃদু স্বরে অভিযোগ করল প্যাট। হাজারটা পরিচয় ওর, চলাফেরা করে ছায়ার মত, ভাবছে টেক্সান। এ কারণেই এত যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। তিনটে বছর এখানে ঘুণাক্ষরেও ওকে সন্দেহ করেনি কেউ। শেষপর্যন্ত হারডিন লোকটা গায়েব হয়ে যেত যদি না বেসিনে এ ঝামেলা হত। জুলিয়াস পারকার ওকে স্বরূপে আবির্ভূত হতে বাধ্য করেছে।
লরিয়া ফ্লাগানের দিকে তাকাল প্যাট-ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে মেয়েটি, রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখ। আমরা জানতে চাই ববের সাথে তুমি কোন চালাকি করেছ কি-না। মৃদু কণ্ঠে মূল প্রসঙ্গ উপস্থাপন করল ও।
তোমরা অন্য কিছু শুনেছ নাকি?
হারডিন, আমরা তোমার কথাটাই শুনতে চাইছি! অধৈর্য দেখাল ব্র্যাডকে।
আমার কথা বিশ্বাস করবে?
আমরা জানি তুমি মিথ্যে বলবে না। বললেও তা ধরতে পারব।
হ্যাঁ, ও আমার গুলিতে মারা গেছে। দেয়ালের আয়নায় ওকে পিস্তল বের করতে দেখে ঘুরেই গুলি করেছিলাম।
গ্যারেটদের মুখগুলো যেন পাথরে খোদাই করা, স্থির দৃষ্টিতে দেখছে কসকে।
একসময় পায়ের ভর বদল করল প্যাট। এটাই স্বাভাবিক, আনমনে মাথা ঝাঁকাল। রব গ্যারেটকে মোকাবিলা করতে চালাকির দরকার হবে না হারডিনের। তবু সন্দেহটা ছিল এ জন্যে যে তুমি ওখানে নাম ভাড়িয়ে ছিলে এবং তোমার অ্যাকশন এত দ্রুত ছিল যে বব কিছু বুঝে ওঠার আগেই বোধহয় গুলি খেয়েছে।
ওর হাতে গুলি করতে পারতে! চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ল ব্র্যাড গ্যারেট। জানতে তোমার চেয়ে কখনোই ফাস্ট হবে না ও, আদপে তো তাই ঘটেছে। খুব বেশি হলে পিস্তলটা হয়তো হোলস্টার থেকে বের করতে পেরেছিল। হতাশায় স্নান দেখাচ্ছে ভয়ঙ্কর লোকটাকে, ভাইয়ের মৃত্যুর শোক যেন তাকে এইমাত্র স্পর্শ করেছে।
বাজে বকছ!…তোমাদের মধ্যে কে কোন জন? তুমি ব্র্যাড? টেক্সান মাথা ঝাঁকাতে খেই ধরল ব্রুকস। তোমার দিকে কেউ পিস্তল ধরলে তুমি কি তার হাতে গুলি করবে? বুকে বা মাথায় গুলি খেয়েও আমি অনেককে দেখেছি প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে, আর হাতের কথা কি বলব। একটা ডুয়েলে দুই প্রতিদ্বন্দীর সম্ভাবনা সব সময়ই সমান। কেউ যখন ডুয়েলের জন্যে রীচ করে তখন সাফল্যের আশা করে সে, সেজন্যে নিশ্চিত হয়েই গুলি ছোঁড়ে। সে এ-ও জানে এটাই তার জীবনের শেষ মুহূর্ত হতে পারে, একটা গুলিই সব চুকিয়ে দিতে পারে। ব্রনসনের সঙ্গীদের তোমরা কি ছোট করে দেখেছ, নাকি আগে লোকগুলোকে দুএকটা, গুলি ফোটাবার সুযোগ দিয়ে তারপর নিজেরা গুলি করতে? ব্রুকস খেয়াল করল পাশে এসে বসেছে লরিয়া, কোমল পেলব হাতের মুঠোয় তুলে নিয়েছে ওর একটা হাত। খানিক আগের উৎকণ্ঠার ছাপ এখনও মুখে রয়ে গেছে।
ব্র্যাড, ও ঠিকই বলেছে, সমর্থন করল প্যাট। কেবল বোকারাই নিশ্চিত না হয়ে গুলি ছোড়ে। ধন্যবাদ, হারডিন…না, ব্রুকস, যেমন আছ তেমনি থাকো তুমি। তোমাকেও ধন্যবাদ, ম্যাম। তোমাদের সাথে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল। তবে সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার বোধহয় এটাই যে এ লোকটির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে হলো না। এগিয়ে এল সে, বিছানার কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। একে একে হাত মেলাল দুভাই। তোমাকে দেখে আমার হিংসা হচ্ছে, ব্রুকস! দারুণ এক বাথান আর অমূল্য একটা রত্ন পেয়েছ। আমারও ইচ্ছে করছে চলার পথে সব ছেড়ে দিয়ে নাম ভাঙিয়ে কোথাও থেমে যাব কি-না।
রত্ন? ব্রুকসের জিজ্ঞাসা।
লরিয়া ফ্ল্যাগানের দিকে তাকাল প্যাট, হাসল। রত্নটা তোমাকে আগলে আছে, বুঝতে পারছ না?
ব্রুকসের হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াল লরিয়া, সাঁমলে নিয়েছে। তোমরা কিন্তু না খেয়ে যেতে পারবে না। অফিসে গিয়ে বোসো, কফি নিয়ে আসছি আমি। বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল মেয়েটা।
ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকল ব্রুকস।
বোঝা যাচ্ছে এ ব্যাপারে কিছুই জানো না তুমি, ব্রুকসকে সিগার অফার করল প্যাট। মেয়েটা তোমাকে পছন্দ করে।
সিগারে দ্রুত কয়েকবার টান দিল ব্রুকস, পুলক অনুভব করছে। লরিয়ার অস্বাভাবিক আচরণের অর্থ খুঁজে পাচ্ছে এখন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মেয়েটা জানতে চেয়েছিল ব্রুকস ওকে পছন্দ করে কি-না। শুধু কেউ নেই বলেই কি সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করা না অন্য কারণে, মেয়েটা নিশ্চিত হতে চেয়েছিল।
প্যাট, দেখো!
চমকে তাকাল প্যাট গ্যারেট, সহোদরের গলায় বিপদ সঙ্কেত ঠিকই টের পেয়েছে। ব্র্যাডের দৃষ্টি অনুসরণ করে জানালা পথে তাকাল। ব্রুকসও দেখতে পাচ্ছে। র্যাঞ্চ হাউসের দিকে আসছে রাইডারদের বড়সড় একটা দল। পারকারের ডালকুত্তা বাহিনী। হলফ করে বলতে পারি ওরা তোমার জন্যেই আসছে, ব্রুকস।
ঝামেলা, প্যাট! কৌতুকে নেচে উঠল ব্র্যাডের চোখ। লাঞ্চটা খাওয়া হলো দেখছি। ওরা বিপদে পড়তে যাচ্ছে। আমাদের সমাদর করবে কি, মনে হচ্ছে। সেটা করবেটকেই করতে হবে!
বিকারহীন দেখাল ব্রুকসকে। পিস্তলগুলো দেবে? চেয়ারের ব্যাক-রেস্টের সাথে হোলস্টারসহ ঝোলানো কোল্টগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে অনুরোধ করল।
পিস্তলগুলো এগিয়ে দিল প্যাট। না হে ওঠার দরকার নেই, মেয়েটা তাহলে খেপে যাবে। আমার মনে হয় ব্যাপারটা সামাল দিতে পারবে জেমস ফ্লাগান। আর যাই হোক পাইকারি হারে খুন করতে এখানে আসেনি ওরা। ব্রুকসের উদ্দেশে উইশ করল সে, ভাইয়ের দিকে ফিরল। চলো, ব্র্যাড, কফির স্বাদ নেয়া যাক। শেষে আবার ওটাই না হারিয়ে বসি!
যমজরা বেরোনোর আগেই ট্রে হাতে ঢুকল লরিয়া। চেয়ারের ওপর নামিয়ে রাখল সেটা, উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে ওকে। দয়া করে তোমরা নিজেরাই নিয়ে নাও। বাবাকে সাহায্য করতে হবে। ভাগ্যিস, এরকম কিছু হতে পারে ভেবে দুজন। কাউহ্যান্ডকে কাজে পাঠাইনি! ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হয়েও ব্রুকসের দিকে ফিরল, তুমি কিন্তু উঠবে না, খবরদার!
টেনেসীর মেয়েদের একটা সংস্করণ, তাই না ব্র্যাড? লরিয়া বেরিয়ে যেতে কফির মগ তুলে নিল প্যাট, ব্রুকসকে এগিয়ে দিল একটা। সেবায় অন্তপ্রাণ আবার প্রয়োজনে পাশে এসে সাহায্য করবে, যা করবে মন উজাড় করে দেবে। এমন মেয়েই আমার পছন্দ।
ভুলেও ওর দিকে মনোযাগ দিয়ো না, প্যাট! ব্রুকস তাহলে খুন করবে তোমাকে।
ও ব্যাটা একটা আস্ত গাধা! সোৎসাহে কৌতুকে যোগ দিল অপর যমজ, নিচু কণ্ঠে বললেও তা শুনে হেসে ফেলল ব্রুকস। আজকের আগে ও জানতই না মেয়েটা ওকে পছন্দ করে।
হতে পারে। কিন্তু রত্নটা হারানোর কোন ইচ্ছে ওর আছে বলে মনে হয় না।
লাঞ্চ খেয়ে যাবে, না কেটে পড়বে?
আমি থাকছি, প্যাট। মেয়েটা আরেকদিন নিমন্ত্রণ জানাবে এ আশা আমার নেই। তাছাড়া পকেট তো গড়ের মাঠ হতে বাকি। লাঞ্চের পয়সাও যদি বেঁচে যায় তো ক্ষতি কি?
সর্বাগ্রে জেফরি করবে, তার পেছনে সাতজন।
এদের একজনকেও চেনে না জেমস ফ্ল্যাগান। কিন্তু জানে সুযোগ পেলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে ছাড়বে না ওরা।
জেমস ফ্ল্যাগান আজীবনই ছিল নিরীহ, নির্বিরোধী একজন মানুষ। এ বেসিনে বড় হয়েছে সে, কেউ বলতে পারবে না কারও সাথে তার কখনও কোন গাৈলমাল বেধেছে, এমনকি দুরন্ত কৈশোরের সময়েও। কেউ তাকে ঘাঁটায়নি, সে-ও কারও জন্যে ঝামেলা বয়ে আনেনি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কঠিন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে এখন। তিক্ত মনে ফেলে আসা যৌবনের কথা ভাবল সার্কেলএফ মালিক। অবশ্য টগবগে তারুণ্যও এদেরকে রুখতে পারত না। এরা একেকজন ঠাণ্ডা মাথার খুনী। ওদের মুখোমুখি হতে যা লাগবে-সাহস, সেটা তার যথেষ্টই আছে। পিছিয়ে যাওয়ার উপায় বা ইচ্ছে কোনটাই নেই। স্যামুয়েল ব্রুকস তার কেউ নয়, তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তার নয়। কিন্তু এরচেয়েও বড় প্রশ্ন সেখানে আছে। লরিয়া ওকে পছন্দ করে, ব্রুকস-ও। লরিয়াকে সবকিছুর উত্তরাধিকার দেয়ার কারণ ঠিক সেটাই।
মেয়ের সুখের জন্যে সবকিছু করতে প্রস্তুত জেমস ফ্ল্যাগান।
ধীরে পোর্চের সামনে এসে থামল ঘোড়াগুলো, থামার পরও কয়েকটা অস্থিরভাবে পা ঠুকতে থাকল। খুরের আঘাতে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া ধুলো থিতিয়ে আসতে সময় লাগল, এই ফাঁকে যতটা সম্ভব লোকগুলোকে দেখে নিল ফ্ল্যাগান। বেশিরভাগই নিচু করে হ্যাট চাপিয়েছে, তার ওপর বাতাসে উড়ন্ত ধুলো অস্বচ্ছ আস্তর তৈরি করেছে ওদের চারপাশে। তবু যতটুকু দেখতে পেল, তাতেই বুকটা কেঁপে উঠল তার। এরা সবাই কঠিন মানুষ। এতগুলো বেপরোয়া লোকের সামনে দাঁড়াতে হলে বুকভর্তি সাহস লাগবে। সেটা কি তার আছে? নিজেই সন্দিহান হয়ে উঠল বাগান মালিক।
দশাসই শরীর নিয়ে হেঁচড়ে স্যাডল থেকে নামল জেফরি করবেট, পোর্চে উঠতে যাবে এসময় হাত তুলে ওকে থামাল সার্কেল-এফ মালিক। আজকের দিনটি ভিন্ন, জেফরি, শান্ত কিন্তু দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলল। একগাদা খুনে-বদমাশ সঙ্গে নিয়ে এসেছ। অতীতে যা কখনও হয়নি, একসাথে কফি খেতে আজ আমার ভাল লাগবে না।
থমকে গেল বার-পি ফোরম্যান। তোমার এরকম আচরণ পছন্দ করবে না মি, পারকার।
তাতে আমার কিছু আসে-যায় না। একসাথে অনেক সময় কাটিয়েছি বটে, কিন্তু তোমার বস কখনোই আমার বন্ধু ছিল না। সুতরাং বুঝতেই পারছ আজকের আচরণ তাকে নাখোশ করলেও কিছু করার নেই। বরং এই লোকগুলোকে পাঠিয়েছে বলে বিরক্ত হয়েছি আমি। যাকগে, তোমার উদ্দেশ্য সাফ সাফ জানিয়ে জলদি বিদায় হও।
স্যামুয়েল ব্রুকস আছে এখানে। মিথ্যে বলে লাভ হবে না, আমরা নিশ্চিত জানি।
তো, তাতে তোমার কি?
ওকে আমাদের হাতে তুলে দাও।
তুমি কি মার্শাল হবস, না ব্রুকস কোন আসামী?
আমাদের অন্তত একজন লোককে খুন করেছে ও।
দারুণ! একডজন ডালকুত্তাকে মেরে ভাল কাজ করেছে ও, এতে দোষের কিছু দেখছি না আমি। আগ বাড়িয়ে লাগতে গিয়ে নিজেদের নাক কেটেছ
তোমরা।
মি. পারকারকে খেপিয়ে ভোলা কি ঠিক হবে, ফ্ল্যাগান? ভুল করছ তুমি, এর মাসুল দেয়ার সামর্থ্য তোমার নেই।
ভয় দেখাচ্ছ, করবেট?
লোকটাকে আমাদের হাতে তুলে দাও। অবশ্য বের করে দিলেও চলে। ওকে থাকতে দেবে না, এটাই হচ্ছে সাফ কথা।
আমি কি তোমার চাকুরি করি, না তোমার বসের? নিজের বাথানে যা ইচ্ছে করব, তোমাদের কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব না।…আর কিছু বলবে?
রাগে লাল হয়ে গেছে করবেটের মুখ। ভেবে পাচ্ছে না এত সাহস কোথেকে পেল জেমস ফ্ল্যাগান। অথচ ও ভেবেছে কত সহজে সারা যাবে কাজটা, বিশাল দলটা দেখলে বাপ বাপ করে কূল পাবে না। অথচ ভয় তো পাচ্ছেই না উল্টো ওকে প্রায় শাসাচ্ছে সার্কেল-এফ মালিক।
এত প্যাচালের কি দরকার! পেছন থেকে বলল একজন, বিরক্ত। ভেতরে ঢুকে যাও, জেফরি। কুত্তাটাকে বের করে আনো!
লোকটার দিকে তাকাল জেমস ফ্ল্যাগান। জেফরি করবেটের চেয়ে শক্তপাল্লা। দয়া-মায়ার ছিটেফোঁটাও নেই চেহারায়, হাসতে হাসতে খুন করতে পারবে এ লোক। তুমিই এসো, আহ্বান করল বাথান মালিক। মনে হচ্ছে করবেটের সাহসের কমতি আছে। তুমি একবার চেষ্টা করে দেখবে নাকি? নিজেই জানে না ওর ভেতর এত সাহস এল কোত্থেকে। অন্য সময় হলে ভুলেও এসব লোকের ছায়া মাড়াত না।
দুপা আগে বাড়ল লোকটার সোরেল। কি করবে, বুড়ো? ইচ্ছে করলেই তোমাকে শুইয়ে দিতে পারি। হিংস্র কয়োটের মত হাসল সে, কণ্ঠে তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞাভরে দেখছে ফ্ল্যাগানকে।
গাধাটাকে কোথায় পেলে, জেফরি? বিন্দুমাত্র ঘিলু নেই ওর মাথায়। ওর ধারণা তোমাদের সাথে এমনিতেই খোশ-গল্প করছি আমি। তাই তো বলি এত লোকজন নিয়েও কেন ব্রুকসকে কোণঠাসা করতে পারোনি। তোমার দলের সবাই কি ওর মত?
বড়জোর দুজন লোক আছে তোমার। আর তুমি তো একটা সহজ টার্গেট, রাইফেল তোলার আগেই মারা পড়বে।
চেষ্টা করে দেখো, নিষ্কম্প গলায় চ্যালেঞ্জ করল বাথান মালিক। তবে মনে রেখো তোমার দিকেই ছোঁড়া হবে প্রথম গুলিটা।
ঘোড়া থেকে নামল সে, এগোতে শুরু করেছে। মাত্র তিনজন-বার্ন আর কোণের কামরায় একজন করে এবং তুমি। প্রথম দফায় শেষ হয়ে যাবে সবাই, কোন সুযোগই পাবে না। আটজনকে সামলানোর মুরোদ তোমাদের নেই, বুড়ো।
থামো, ব্রনসন! চাবুকের মত হিসহিস করে উঠল প্যাট গ্যারেটের কণ্ঠস্বর। আরেক পা এগোলে এখানে ঢোকার খায়েশ তোমার চিরদিনের জন্যে মিটে যাবে! ফ্ল্যাগানের পেছনে একটা কামরার সামনে এসে দাড়িয়েছে, পা জোড়া ফাঁক হয়ে আছে। দুই হাতের তালু আলতোভাবে লেপ্টে আছে হোলস্টারের গায়ে। সতর্ক এবং তৈরি।
থমকে দাঁড়িয়েছে কার্লি, অপ্রতিভ দেখাচ্ছে মুখ। নিশ্চয়ই ওই বজ্জাতটাও আছে?
হাউডি, কার্লি! অফিস রুমের দরজায় দেখা গেল ব্র্যাড গ্যারেটকে, ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগার। বারবার শুধু তোমার সাথেই দেখা হচ্ছে। কিন্তু তোমার ইঁদুরমুখো চেহারা মোটেই ভাল লাগছে না!
সলতেয় আগুন ধরল যেন, রাগে ফেটে পড়ল ব্রনসন। পা দিয়ে আঘাত করল মাটিতে। দেখে নেব তোমাদের, গ্যারেট! খোদার কসম, কাজটা শেষ করে নিই, তারপর…।
এখুনি নয় কেন, কার্লি? উস্কে দিতে চাইল ব্র্যাড। খেয়াল করেছে চাপা উত্তেজনা লোকগুলোর মধ্যে, রাইফেল বা পিস্তলের কাছে সবার হাত। যে কোন সময়ে নরক ভেঙে পড়বে, কেবল কেউ শুরু করলেই হলো। চোখ ফিরিয়ে এনে তাকাল ব্রনসনের দিকে। দ্বিধা দেখা যাচ্ছে লোকটার চোখে, সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। হোলস্টারের ওপর আলতোভাবে ছুঁয়ে আছে ওর হাত। সহসাই মুখের পেশীতে দৃঢ়তা দেখা গেল, টান টান হয়ে গেল শরীর। মরিয়া একটা ভাব ফুটে উঠেছে দৃষ্টিতে।
শাট আপ, কার্লি! পেছন থেকে শীতল একটা কণ্ঠ নিরস্ত করল তাকে। ওর সাথে পাত্তাই পাবে না। বোকার হদ্দ, পিছিয়ে এসো! তুমিও, করবেট, বোঝা গেছে তোমার দৌড়। পুরুষ মানুষের মত লড়ার মুরোদ তোমাদের কারও নেই।
হাউডি, স্টিরাপ! প্যাট গ্যারেটের উৎফুল্ল স্বর। তুমিও এসে জুটেছ দেখছি।
নির্বিকার দেখাল গানম্যানকে। শীতল সাবধানী দৃষ্টিতে মাপছে দুই ভাইকে।
প্যাট গ্যারেটের দিকে ফিরল বার-পি ফোরম্যান। মি. পারকারকে জানাব যে তোমাদের কারণেই আজ খালি হাতে ফিরতে হলো। অযথা বাগড়া দিলে, এর ফল মোটেও ভাল হবে না।
আমরা পারকারের চাকুরি করি না, করবেট, এক কথায় চুকিয়ে দিল ব্র্যাড।
ভেবো না এটাই শেষ, তড়পে উঠল কার্লি ব্রনসন। পরেরবার ঠিকই পেড়ে ফেলব!
ব্রুকসের দলে যোগ দিলে নাকি? জানতে চাইল স্টিরাপ। হিসাব কষছে সে, সাবধানী লোক, সাফল্য ও পরিণতির কথা আগে ভাবছে।
না হে, তবে যোগ দিলে মন্দ হত না। খেলাটা আমার ভালই লাগছে, বিশেষ করে কার্লির তড়পানি, হাসল সে, ফোরম্যানের দিকে তাকাল। শোনো, জেফরি, এরা আমাদের লাঞ্চের নিমন্ত্রণ করেছে। এতক্ষণে টেবিলে বসে যেতাম, তোমরা এসে দেরি করিয়ে দিয়েছ। ওদিকে পেটের ভেতর ছুঁচো নাচতে শুরু করেছে। তোমরা কেটে পড়লে এবার শান্তিতে খেতে পারি।
আমাদের চলে যেতে বলছ?
কি আর করবে! ফ্ল্যাগান তো অতিথি হিসেবে তোমাদের পছন্দ করতে পারছে না।
চলে এসো, জেফরি। ওদের পরেও পাওয়া যাবে। উল্টোদিকে ফিরল টম স্টিরাপ, দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল বার-পি ফোরম্যানের জন্যে, করবেট তাকে পেরিয়ে যেতে মুখ খুলল। এখন থেকে তোমার কথায় আর চলছি না। তুমি শুধু ঝামেলাই করতে জানো, কাজের বেলায় কেবল ফাঁকি। তোমার বুদ্ধিতে এখানে আসা মোটেও ঠিক হয়নি। স্যামুয়েল ব্রুকসকে ওর জমিতে বা বাফেলোতে পেয়ে যাব আমরা।
ধুলো উড়িয়ে ফিরে গেল বার-পি রাইডাররা।
মাঝখানের একটা কামরা থেকে রাইফেল হাতে বেরিয়ে এল ফ্ল্যাগান-কন্যা। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। মি. গ্যারেট, কি বলে যে তোমাদের…
হয়েছে, আর বলতে হবে না, হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিল ব্র্যাড। প্যাট আবার বেশি প্রশংসা সইতে পারে না। আমরা খাবার ঘরে গিয়ে বসি, ম্যাম? দারুণ খিদে পেয়েছে।
হেসে উঠল লরিয়া, মাথা ঝাঁকাল।
ভরপেট খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল প্যাট গ্যারেট। মন্টানা ওদের মধ্যে ছিল, খেয়াল করেছ?
কফির মগ টেনে নিয়ে চুমুক দিল ব্র্যাড। ও আমাদের সামনে আসবে না, এটাই স্বাভাবিক। বুঝে নিয়েছে ব্রুকসের সাথে আমাদের ফয়সালা শেষ, তারমানে ওর মিথ্যেও ধরা পড়ে গেছে। লসনের চেলা কোলম্যান, টম লোগান, রে ডবসন…ওরা কেউই ছিল না। হয়তো কোন সেলুনে বসে তাস পেটাচ্ছে।
ব্রুকসের কপালে সত্যি খারাবি আছে। বারবার মরগান পিকসে গা ঢাকা দিতে পারবে না। তাছাড়া এখন থেকে পারকারের লোকেরা আরও সতর্ক থাকবে। ওকে কোন সুযোগই দেবে না।
কোথায় যাবে ভেবেছ কিছু?
না…পকেটের অবস্থা তো খারাপ। শুধু শুধু এতদূর এলাম। একটা লাভ অবশ্য হয়েছে, এরকম ছোটাছুটি আর করতে হবে না। এক কাজ করা যাক, অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকাল প্যাট। এ উসিলায় ব্রুকসের কাছ থেকে কিছু খসানো যেতে পারে, সেইসাথে খেলাটায় যোগ দিতে পারব। মন্টানার পাওনাও শোধ দেয়া যাবে। ওর জন্যেই এত হয়রানি গেছে আমাদের।
তোমার এই ব্যাপারটা আমার দারুণ লাগে, প্যাট! মোক্ষম সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে পারো তুমি। চলো, ব্রুকসের কাছে যাই, দেখি ও কি বলে। মনে হচ্ছে রাজি হবে না।
স্যামুয়েল ব্রুকস সিগারেট ফুঁকছিল। বিছানার কাছে চেয়ারে বসে আছে লরিয়া।
বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, বলল প্যাট, যদিও দুঃখের ছিটেফোঁটাও নেই তার মুখে।
কিছু লাগবে? জানতে চাইল লরিয়া।
প্রয়োজনটা ওর কাছে, আঙুল তুলে ব্রুকসকে দেখাল ব্র্যাড। এই যে ব্রুকস, আরাম পেয়ে বিছানাটা দেখছি ছাড়ছই না। ওদিকে তোমার বাথানের অবস্থা তো যায় যায়! দুজন কাজের লোক হলে কেমন হয়? বান্দারা হাজির। আমাদের সান্তা ফে পর্যন্ত যাওয়ার খরচ দিলেই চলবে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল ব্রুকস, দেখল টেক্কানদের। তারপর মাথা নাড়ল। তোমরা অযথাই জড়াতে চাইছ। লড়াইটা আমার একার।
বলেছিলাম না, ও রাজি হবে না, মৃদু ভৎসনার সাথে ব্রুকসকে দেখল ব্র্যাড। এই ব্যাটা আসলেই অহঙ্কারী। দূর থেকে আজীবন যা শুনে এসেছি, তা-ই দেখলাম। রাজি করাতে হবে ওর রত্নটাকে।
তোমরা সত্যি থাকতে চাও? আনন্দিত দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে লড়তে হবে
ও একা যদি ভয় না পায় তো আমরা পাব কেন?
আরও কিছুক্ষণ তর্ক করল ওরা।
জীবনেও শুনিনি জোর করে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ নিয়েছে কেউ, শেষে হতাশ কণ্ঠে বিরক্তি প্রকাশ করল ব্রুকস। কেবল তোমাদের পক্ষেই সম্ভব।
আমরাও কখনও শুনিনি একজন লোক একা বিশ-পঁচিশজনের বিরুদ্ধে লড়তে চাইছে, তাও আবার বিছানায় শুয়ে, সকৌতুকে বলল ব্র্যাড। টেক্সাসে জন্মেছি বলে গর্ব করি আমরা, ম্যাম। টেক্সান হিসেবে আমাদের কেউই স্বীকার করবে না, যদি শোনে এরপরও বেয়াড়া লোকটাকে সাহায্য করিনি। কি বলল, প্যাট, ঠিক বলিনি?
সায় জানাল সে।
একশো ডলারের একটা নোট এগিয়ে দিল ব্রুকস। বোধহয় কিছুই বাকি রাখেনি ওরা, স্বগতোক্তির মত বলল, রসদ নিয়ে যেতে হবে। বাফেলোতে লকহার্টের স্টোরে চলে যাও, যা যা প্রয়োজন নিয়ে এসো। ওকে বোলো আমার নামে খাতায় লিখে রাখতে।
নড় করে বেরিয়ে গেল যমজরা।
অদ্ভুত মানুষ! ওদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকল ব্রুকস। ফুর্তিবাজ, বেপরোয়া-…ভেবে দেখো, মাত্র একটা কথা শোনার জন্যে ঘুরে বেড়িয়েছে এতদিন। সত্যটা গ্রহণ করেছে কত সহজে। ওরাই পশ্চিমের খাটি মানুষ। স্বজন হারানোর কষ্ট আছে বুকে, আবার আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বা প্রতিশোধ নেয়ার। দৃঢ়তাও আছে। ওদের মুখোমুখি দাঁড়াতে সত্যি ভয় পাব আমি, বিশ্বাস করো, এমন বেপরোয়া লোক আর দেখিনি। হিকক, বিলি দ্য কিড পর্যন্ত এই দুই ভাইকে সমঝে চলে।
আমি একটা ফ্যান্টাসি ভেবেছিলাম, সেটাই সত্যি হলো। সন্তুষ্টি লরিয়ার কণ্ঠে।
কি?
তোমাদের তিনজনকে একপক্ষে কল্পনা করেছিলাম, ব্যাখ্যা করল মেয়েটা। সেদিন সত্যি আমার মাথার ঠিক ছিল না।
ইচ্ছে করলে পারকারের টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যেতে পারত ওরা, সেটাই বরং সহজ ছিল। অথচ কঠিন কাজটা বেছে নিয়েছে এবং প্রায় জোর করে।
তুমিও কম অদ্ভুত নও, হালকা সুরে মন্তব্য করল লরিয়া। নিজেও কি জানো এরপর কি করবে? উফ, আরেকটু হলে আমার মাথা প্রায় খারাপ করে দিয়েছিলে! স্যামুয়েল ব্রুকস, আমি তোমাকে এখনও ক্ষমা করিনি।
আবার আর্জি জানাব?
না। প্রথমবার বাফেলোয় গিয়ে উইলটা বাতিল করবে, তাহলেই চলবে।
মৃদু হাসল ব্রুকস। কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু বাধা দিল লরিয়া।
আর একটা কথাও নয়। ঘুমোও এবার।
প্রশান্তিতে চোখ বুজল ব্রুকস। লরিয়ার ধারণা ভুল, না ভেবে কিছু করা ওর ধাতের বাইরে। মেয়েটা জানতে পারলে অবাক হবে যে ওর জন্যেই এখানে বসতি করতে চেয়েছে ব্রুকস। ওর মানসপটে ভেসে উঠল একটা ছবি…লরিয়া ফ্লাগানকে দেখার প্রথম মুহুর্তটি-তিন বছরেরও আগে বাফেলো টাউনের গির্জা থেকে বেরোতে দেখেছিল ওকে। ব্রুকস তখুনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এখানেই বসতি গড়বে, অনিন্দ্যসুন্দর এ মেয়েটিকে জয় করবে। ওই একটি মুহূর্তই ওর জীবনটাকে পাল্টে দিয়েছিল, ভবঘুরে জীবনকে বিদায় জানিয়ে দিয়েছিল সেদিন।
সময় লেগেছে, কিন্তু সফল হয়েছে সে।
তিনদিন পর বিছানা ছাড়ল ব্রুকস। লরিয়ার যুক্তি বা বাধা কোনটাকেই পাত্তা দিল না। শুয়ে শুয়ে বিরক্তি ধরে গেছে। হোলস্টারগুলো বাধার সময় লক্ষ্য করল রেগে গেছে মেয়েটা, মুখ থমথমে দেখাচ্ছে। নিঃশব্দে সরে গেল জানালার কাছে, দাঁড়াল। দৃষ্টি বাইরে। লোহার গ্রিল চেপে ধরা আঙুলগুলো ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।
এ পরিবারটার কাছে ওর অনেক ঋণ, ভাবছে ব্রুকস, বিশেষত এ মেয়েটির কাছে। এরা হাত বাড়িয়ে না দিলে অনেক আগেই বুটহিলে জায়গা নিতে হত। নিঃস্বার্থ এ পরোপকার বিপদ ডেকে এনেছে ওদের জন্যে। জুলিয়াস পারকার নিশ্চয়ই ভুলে যাবে না। সম্ভবত ব্রুকসের সাথে লেন-দেন চুকিয়ে তারপর এদের দিকে মনোযোগ দেবে দাম্ভিক বুড়ো। সেটা হতে দেয়া যাবে না, যে করেই হোক, সিদ্ধান্ত নিল ব্রুকস। প্রয়োজনে পাইকারি হারে খুন শুরু করবে, সমূলে বিনাশ করবে পারকারদের। জানে তারপরও ফ্ল্যাগানদের ঋণ শোধ হবে না।
শরীরে খিল ধরে গেছে, টের পেল ও, আড়ষ্ট দেহ নড়তেই চাইছে না। কিছুক্ষণ উঠ-বস করল, হাত-পা ঝাড়ল। তারপর ড্র করল কয়েকবার। শ্লথ মনে হচ্ছে। এটা অবশ্য কেটে যাবে, একটা দিনের ব্যাপার।
লরিয়া কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে অসহায় বোধ করল ও। মেয়েটার খুব বেশি আগলে রাখার প্রবণতা ওকে পীড়া দিচ্ছে। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল, প্রেইরির ওপর চোখ রাখল। জেমস ফ্লাগান বাথানটাকে ভালই সাজিয়েছে, বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে হাঁটু সমান সবুজ ঘাস, তাগড়া সব গরু চরে বেড়াচ্ছে। নিঃসন্দেহে সার্কেল-এফ বেসিনের সেরা বাথানগুলোর একটা।
দিগন্তে চলে গেল ওর দৃষ্টি, মরগান পিক্সের আবছা অবয়ব চোখে পড়ছে এখান থেকে। নিজের কেবিনের লে-আউট মনে পড়ল ওর, ক্লিষ্টভাবে হাসল, এখন তো কিছুই নেই। গ্যারেটরা হয়তো পাহাড়ে রাত কাটাচ্ছে।
রাইফেল হারিয়েছে, পিস্তলের জন্যে নেই বাড়তি বুলেট। বাফেলোতে যেতে হবে। কেবিন তৈরি করতে হবে, ভাবছে ব্রুকস, লকহার্টের কাছে প্রয়োজনীয় সবকিছু পাওয়া যাবে। গ্যারেটরা থাকায় ভালই হয়েছে, ওর একার পক্ষে যেটা এক সপ্তাহের কাজ, তা দুদিনে শেষ হয়ে যাবে। বার্ন, করাল, শীত মরসুমের জন্যে একটা অতিরিক্ত শেড এবং র্যাঞ্চ হাউস…প্রচুর খরচ হবে। আগে বিল কারভারের কাছে যেতে হবে। জমানো টাকার বড় একটা অংশ খরচ হয়ে যাবে, তাতে অবশ্য দুঃখ হচ্ছে না। এবার আর কাউকে পোড়াতে দেবে না।
লরিয়া ঢুকল, চাপা অসন্তোষ ওর চোখে-মুখে। তোমার ঘোড়া তৈরি।
আমার ঘোড়া? হা, অ্যাপলুসাটা। ওটা আবার আমার হলো কবে থেকে?
হলো। এখন থেকে।
কিন্তু ওটা তোমার প্রিয় ঘোড়া।
ক্ষীণ হাসল লরিয়া, আয়ত সবুজ চোখ তুলে রাখল ব্রুকসের চোখে। কাউকে কিছু দিতে হলে প্রিয় জিনিসটাই তো দিতে হয়, তাই না? তোমার কাছ থেকে শিখেছি।
শ্রাগ করে দরজার দিকে এগোল ব্রুকস।
আবার কবে আসবে?
থেমে দাঁড়াল ও, ঘুরল ধীরে ধীরে। জানি না…হয়তো কখনোই নয়।
বিবল দেখাল লরিয়াকে, উত্তরটা ওকে আহত করেছে।
নিজের কথা বলার এটাই উপযুক্ত সময়, তাছাড়া ওর রাগ ভাঙানো উচিত, সিদ্ধান্ত নিল ব্রুকস। কাছে গিয়ে মেয়েটার হাত তুলে নিল নিজের হাতে। লরিয়া?
মুখ তুলল ফ্লাগান-কন্যা, ওর চোখজোড়া কাঁপছে।
আমার ছোট্ট জায়গাটা তোমার পছন্দ হয়?
ঘন ঘন বার কয়েক মাথা দোলাল লরিয়া।
সবকিছু নতুন করে শুরু করতে হবে…শুরুতে কয়েকটা দিন হয়তো কষ্ট হবে তোমার।
আমি পারব?
তাহলে পরেরবার যখন আসব, কেবল তোমার জন্যেই…আমি তোমাকে নিতে আসব।
ওহ, কি নিষ্ঠুর তুমি, স্যাম! ব্রুকসের বুকে আছড়ে পড়ল লরিয়া। এটা শোনার জন্যে আমাকে এতদিন অপেক্ষা করতে হলো!
হেসে ওকে জড়িয়ে ধরল ব্রুকস। মাত্র তো কয়েকটা দিন অপেক্ষা করেছ তুমি, আর আমাকে ধৈর্য ধরতে হয়েছে তিনটে বছর। নিজেকে তৈরি করতে হয়েছে তোমার জন্যে।
সত্যি?
হ্যাঁ।
তিনটা বছর, অথচ কোনদিন আমার সামনে আসোনি তুমি। ঠিক বিশ্বাস হয় না। কয়েকদিন আগে পরিচয়…তারপর অনেক ঘটনা… কিভাবে যে ঘটে গেল! ঠিক স্বপ্নের মত…
এ ব্যাপারে বাড পারকারের কাছে কৃতজ্ঞ আমরা, হেসে হালকা সুরে বলল ব্রুকস। ও-ই আমাদের কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
লরিয়ার উষ্ণ আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হতে চাইলে ওকে আরও গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা। দুহাতে গলা ধরে ঝুলে থাকল। আরও একটা দিন থাকো, স্যাম। গ্যারেটরা তো আছেই, ওরাই সব সামাল দেবে। সবুজ চোখে বিপুল প্রত্যাশা ফুটে উঠল।
গ্যারেটরা আমার হয়ে খাটছে, অথচ আমি এখানে বসে আছি, কোন কাজে আসছি মা, এটা কি ভাল দেখায়? একটা দিনই বা দেরি করব কেন? ঝামেলাটা যত তাড়াতাড়ি শেষ হবে তত আগে আমার শান্তিপ্রিয় জীবনে ফিরে যেতে পারব। একদিন আগে তোমাকে নিতে আসতে পারব।
স্যামুয়েল ব্রুকস, তুমি খুব চালাক। তুমি সবসময়ই কিছু একটা বুঝ দিয়ে আমাকে নিরস্ত করে ফেলল। এমনকি মিথ্যে বলতেও তোমার বাধে না! লরিয়ার কণ্ঠে অসন্তোষ চাপা থাকল না।
এখানে আমি যা করেছি, বলেছি…সবই তোমাকে পাওয়ার জন্যে, লরিয়া!
একটু পর বেরিয়ে এল ওরা। বারান্দায় অপেক্ষা করছিল ফ্ল্যাগান দম্পতি। অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় হলো দুজনের মধ্যে।
মহিলাকে নড় করল ব্রুকস। ঘুরে আঙিনার দিকে তাকাল, স্যাডল চাপানো হয়েছে অ্যাপলুসায়। কাছে গিয়ে ওটার গলা, কাঁধ আর পাজরে হাত বুলাল। চুপ করে দাড়িয়ে থেকে আদর উপভোগ করল ঘোড়াটা। স্যাডলে চাপার পরও আপত্তি করল না।
কাছে এসে দাঁড়াল লরিয়া। সাবধানে থেকো, প্লীজ! নিচু কণ্ঠে অনুরোধ করল। ওর কণ্ঠের উদ্বেগ আর আন্তরিকতাটুকু ছুয়ে গেল ব্রুকসকে। মাথা ঝাকিয়ে, ফ্ল্যাগান-দম্পতির উদ্দেশে হাত নেড়ে স্পর দাবাল।
বাপের সামনে গিয়ে দাঁড়াল লরিয়া। বাবা, আমি কি ভুল করেছি?
মেয়েকে কাছে টানল ফ্ল্যাগান। না, লরা। একটু কঠিন মানুষ ও, কিন্তু নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায়। কখনও জোর করবি না, বিগড়ে যাবে তাহলে। এ জিনিসটা ওর ধাতে নেই, স্বাধীনচেতা লোক!
নিজের জমিতে ফিরে এসেছে স্যামুয়েল ব্রুকস।
কেবিনের জায়গায় শুকনো ছাই আর পুড়ে যাওয়া কাঠের কিছু অবশেষ আছে কেবল। বার্ন আর করালটাও বাদ যায়নি। দানবীয় আক্রোশে ইচ্ছেমত তছনছ করা হয়েছে সজি বাগানগুলো। বুকে অপরিসীম কষ্ট অনুভব করল ব্রুকস, এগুলোর পেছনে অনেক ঘাম ঝরাতে হয়েছে ওকে। এর শোধ ও নেবে, সময়ে সুদাসলে পাওনা বুঝে পাবে পারকাররা।
ইতোমধ্যে অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছে গ্যারেটরা। অস্থায়ী একটা শেড তৈরি করে তাতে রসদ রেখেছে। একপাশে রান্নার কাজ সারার জন্যে খানিকটা জায়গা। ভাঙা ওঅটর ট্রাফটাকে কিভাবে যেন জোড়াতালি দিয়ে দাড় করিয়ে ফেলেছে। সামনে শীত আসছে, এ কথা ভেবে বড়সড় ঘাস কেটে উপত্যকায় জমা করতে ভোলেনি। যদ্দূর সম্ভব সজি বাগানের যত্ন নিয়েছে। এছাড়া বাথানের স্বাভাবিক কাজগুলো তো আছেই। বোঝা যাচ্ছে ওরা কাজের লোক।
আমার জন্যে কিছু বাকি রাখোনি তোমরা। সন্তুষ্টি প্রকাশ করল ব্রুকস।
এ আর এমনকি! তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল প্যাট গ্যারেট। টেক্সাসে এরচেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করি আমরা।
শহরে কোন ঝামেলা হয়নি তো?
লকহার্টের স্টোর থেকে বেরিয়ে আসার সময় স্টিরাপের সাথে দেখা হয়েছিল, ও শহরে ঢুকছিল তখন। একা থাকায় বাতচিৎ করেনি, হিসেবী মানুষ তো। তবে শাসাতে ভুল করেনি, পারকার নাকি খেপে বোম হয়ে আছে।
বার-পি দের বেশিরভাগই প্যালেসে আস্তানা গেড়েছে, যোগ করল ব্র্যাড। ধুমসে মদ গিলছে। এখনও তেমন কিছু করেনি, কিন্তু করতে কতক্ষণ? শহরবাসীদের পাঁচ-ছয়জনের একটা দল জ্যাক হবসের অফিসে গিয়ে শহর পরিষ্কার করার দাবি জানিয়ে এসেছে। এতেই বোঝা যাচ্ছে পারকারের ক্রুরা শহরের লোকদের কি রকম তটস্থ রেখেছে।
তারমানে…হবস কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।
বুড়োর হাড় শক্ত। দুএকজন কঠিন লোক পেলে কাজটা সারতে পারবে ও। তবে এ ঠেলায় বোধহয় চাকুরিটা থাকছে না আর, পারকার পছন্দ করছে না, আবার ওকে বসে থাকতে দেখে লোকজনও খেপে যাচ্ছে।
বাফেলোতে যাচ্ছি আমি।
নিশ্চয়ই মার্শালকে সাহায্য করতে নয়?
রাইফেল আর পর্যাপ্ত গুলি দরকার। কেবিন, বার্ন, করাল…এসবের জন্যেও রসদ আনতে হবে। তোমাদের কিছু দরকার থাকলে বলতে পারো।
তুমি মানুষটা দেখছি সুবিধের নও, হাসল ব্র্যাড। বুঝতে পারছি মওকা পেয়ে আমাদের বেশ খাটিয়ে নেবে।
আমরাও যাব। প্যাটের প্রস্তাব।
উঁহু, তোমরা এখানেই থাকছ। আমি ওদের এড়িয়ে চলব, তবু সামনাসামনি পড়ে গেলে সামলাতে পারব বোধহয়। তাছাড়া মনে হয় না শহরে, সবার সামনে ওরা আমার ওপর হামলা করবে।
বুঝেছ, প্যাট, সবটা একাই মেরে দেয়ার তালে আছে ও। না বাপু, তোমার সাথে যাচ্ছি আমি। এ সুযোগে গলাও ভেজানো যাবে। তুমি থাকছু, প্যাট। রান্নার কাজটা সেরে রেখো। দ্রুত স্যাডলে চাপল ব্র্যাড, ভাইকে কোন সুযোগ না দিয়ে ঘোড়া ছোটাল।
টেক্সানকে অনুসরণ করল ব্রুকস।
দুপুরের আগে বাফেললা টাউনে পৌঁছে গেল ওরা। ব্র্যাড গ্যারেটের মধ্যে খামখেয়ালী ভাবটা উধাও হয়ে গেছে। তীক্ষ্ণ সতর্ক দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশে, বাড়ির ছাদগুলো পর্যন্ত বাদ দিচ্ছে না। মাঝরাস্তা ধরে ধীরে এগোল ওরা। পারকারের সেলুন প্যালেস-এর সামনে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। হিটিং রেইলে ছয়টা ঘোড়া বাঁধা, একটাতেও বার-পির মার্কা নেই। থাকবে এমন কোন কথাও নেই, ভাড়াটে লোকগুলোর বেশিরভাগই নিজেদের ঘোড়া ব্যবহার করছে।
ল-অফিস ছাড়িয়ে বিল, কারভারের অফিসের সামনে এসে থামল ওরা। স্যাডল ছেড়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে শুরু করে ব্রুকস খেয়াল করল অনুসরণ করছে না ব্র্যাড, সাইডওকে দাঁড়িয়ে আছে।
কারভারের সাথে কাজ তত তোমার, আমি গিয়ে কি করব? তারচেয়ে এখানেই থাকি। কেউ এলে আগে-ভাগে জানতে পারব। তাছাড়া, প্যালেসের ওপরও চোখ রাখা যাবে।
শ্রাগ করে এগোল ব্রুকস।
অফিসেই ছিল বিল কারভার। উঠে দাঁড়িয়ে হাত মেলাল আইনজ্ঞ। বড় শক্ত প্রাণ তোমার, স্যাম। আমরা তো ভেবেছি তুমি আসলেই শেষ। আমি একটা ভুল করেছি…মিস ফ্ল্যাগানকে জানিয়ে দিয়েছি সব।
ঠিকই করেছ, হেসে তাকে আশ্বস্ত করল ব্রুকস।
উইলটা বাতিল করতে এসেছ?
লরিয়ার জেদী মুখটা ভেসে উঠল ব্রুকসের মানসপটে। না, ওটা ওরকমই থাকবে। আমি বরং ওর ভাগ থেকে কিছু খসাতে এসেছি।
গতকাল তোমার রিওয়ার্ডের টাকা দিয়ে গেছে হবস। সতেরোশো।
তাহলে ওটাই দাও। এভাবে কামাই করা মন্দ নয় দেখছি।
ঝুঁকি আছে, ব্রুকসের কৌতুকে যোগ দিল কারভার। উঠে গিয়ে ডেঙ্ক থেকে একটা ফাইল নিয়ে এল। তোমার চেয়ে টাফ কারও সামনে পড়ে যেতে পারো। ভাগ্য তো সব দিন সমান যায় না। ড্রয়ার খুলে টাকা বের করে দিল। একটা রসিদ লিখে দাও, আর ফাইলে একটা স্বাক্ষর।
শেষমেশ তুমিই দেখছি আমার ব্যাংকার হয়ে গেলে।
মন্দ লাগছে না। তোমার মত আরও কয়েকজন হলে সবার টাকা দিয়ে একটা ব্যাংক চালু করব কি-না, পরে ভেবে দেখা যাবে। মার্টিন র্যাঙ্কিন অবশ্য খেপে যাবে, ছোট্ট একটা শহরে একজন প্রতিদ্বন্দী কে-ই বা চায়।
চলো, একসাথে পান করা যাক। উঠে দাঁড়াল ব্রুকস।
ধন্যবাদ, আজ নয়। আরেকদিন।
বেরিয়ে এসে গ্যারেটকে এক মহিলার সাথে আলাপ করতে দেখল ও। মহিলার কাছ থেকে বিদায় নিল টেক্সান। ফিরতি পথে এগোল ওরা। পারকারের সেলুনের পোর্চ তেমনি ফাঁকা, তবে রেইলে একটা ঘোড়া বেড়েছে, বার-পি ব্র্যান্ড দেয়া। করবেট এসেছে। আমাকে দেখে এমন ভেঙচি মেরেছে যে আরেকটু হলে অজ্ঞান হয়ে যেত ওই মহিলা। স্বভাবসুলভ হেঁয়ালিভরা কণ্ঠে জানাল ব্র্যাড।
কি বুঝছ?
নির্ঘাত ঘোট পাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে সহজে বেরোতে পারব না।
আগে কাজ সেরে নিই, তৃষিত দৃষ্টিতে ব্র্যাডকে সেলুনের দিকে তাকাতে দেখে বলল ব্রুকস। তোমার অবশ্য না গেলেও চলে কিন্তু আমাদের বোধহয় আলাদা হওয়া ঠিক হবে না।
মাথা ঝাঁকাল টেক্সান, পাশাপাশি এগোচ্ছে।
উইলিয়াম লকহার্টের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পাওয়া গেল। নিজের চাহিদার কথা তাকে জানাল ব্রুকস। বিল, তোমার সেরা রাইফেলটা চাই, শেষে যোগ করল। রিপিটার হলে চলবে না। এবং প্রচুর গুলি।
ভেতরে এসো, পছন্দ করে নাও। উঠে দাঁড়াল স্টোর মালিক।
তাকে অনুসরণ করে ভেতরের কামরায় গেল ব্রুকস। পাঁচ মিনিট বাদে চকচকে একটা হেনরী হাতে বেরিয়ে এল। পকেটে বেশ কিছু বুলেট। তোমার ওয়াগনটা ধার দিতে হবে, বিল। আর বাড়তি একজন লোক, রসদগুলো পৌঁছে দেবে। ওর পারিশ্রমিকসহ হিসেব কোরো।
আর কিছু জানতে চাইল মিসেস লকহার্ট।
হীরাসমেত সোনার একটা আঙটি চাই, ম্যাম, হেসে বলল ব্রুকস, দেখল বুড়ির চোখ কপালে উঠছে। তোমার কাছে না থাকলে টাকসন থেকে আনিয়ে নিয়োওটা কদিন পর হলেও চলবে, কিন্তু পনেরো দিনের বেশি দেরি কোরো না। আর, লরিয়া ফ্ল্যাগানকে সবচেয়ে সুন্দর আর দামী কাপড়ের একটা গাউন তৈরি করে দেবে।
তোমরা বিয়ে করছ? অভিনন্দন!
মৃদু হেসে বেরিয়ে গেল ব্রুকস।
এতদিন পর পুরুষমানুষ খুঁজে পেল মেয়েটা, মন্তব্য করল বুড়ি।
দুজনকে দারুণ মানাবে, সোৎসাহে বলল লকহার্ট। বেসিনের সেরা বিয়ে হবে সেটা।
বাইরে এসে স্যাডল বুটে হেনরীটা রাখল স্যামুয়েল ব্রুকস। অধৈর্য দেখাচ্ছে টেক্সানকে, গলায় হুইস্কি ঢালার জন্যে অধীর। দুটো বাড়ি পর লকহার্টের সিলভার রক সেলুন। ওদের ছোট ছেলে কেভিন চালায় ওটা। ভেতরে ঢুকল দুজন, স্বভাবতই আগে গ্যারেট। সোজা বারের দিকে চলে গেল সে। কেভিন লকহার্ট নিজেই আছে বারের দায়িত্বে। তাক থেকে বোতল নামিয়ে, গ্লাসে ঢেলে এগিয়ে দিল। এক ঢোকে সবটা পান করে ফেলল ব্র্যাড, বারের ওপর গ্লাস নামিয়ে রাখার ভঙ্গিতে প্রকাশ পেল আরও চাই ওর।
ধীরে চুমুক দিল ব্রুকস। সেলুনটা একরকম ফাকাই। মাত্র দুজন খদ্দের, কোণের একটা টেবিল দখল করেছে। কাচ গলে বাইরে তাকাল, পারকারের সেলুনটা এখান থেকে স্পষ্ট চোখে পড়ছে। পোর্চে বেরিয়ে এসেছে চারজন রাইডার, এদের একজন বার-পি ফোরম্যান।
একটা টুল টেনে বসল ব্র্যাড, দ্বিতীয় দফা পান করছে। করবেটের ওপর চোখ। হ্যাটের ব্রিম ঠেলে তুলে দিল, ব্রুকসের দিকে ফিরল, গলায় উত্তেজনার ছোয়া। দেখো, বাপু, তুমি আবার কেটে পড়ার ধান্ধা কোরো না। ওদের যখন এতই খায়েশ, আসুক। অনেকদিন পর রক্ত গরম করার সুযোগ পাচ্ছি।
ফোরম্যানের সাথে আরও দুজন যোগ দিয়েছে। একজনকেও চেনে না ব্রুকস। জীবনে প্রথম দেখছে অথচ এরাই ওর শক্র, তিক্তমনে ভাবল, একটু পর ভয়ঙ্কর আক্রোশে পরস্পরকে খুন করতে চাইবে। বড় অদ্ভুত যোগাযোগ!
দয়া করে বাইরে চলে যাও, মি. ব্রুকস। আমার এখানে… পুরোটা শেষ করতে পারল না কেভিন। লাফিয়ে উঠে ওর শার্টের কলার চেপে ধরেছে ব্র্যাড, বারের ওপর টেনে তুলে ফেলল শরীরের অর্ধেকটা। ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন কেভিনের চোখ, আতঙ্কে মুখ হা হয়ে গেছে।
এই কৃমির বাচ্চাটাকে নিয়ে কি করি, স্যাম? শেষ করে দেব নাকি? শীতল কণ্ঠে জানতে চাইল গ্যারেট, কণ্ঠে বিন্দুমাত্র তামাশার সুর নেই।
ছেড়ে দাও।
টেক্সান ছেড়ে দিতে হুড়মুড় করে বারের ওপাশে পড়ল কেভিন। খানিক বাদে কোনরকমে উঠে দাড়াল, ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। দুচোখে এখনও নগ্ন আতঙ্ক। গ্যারেট তাকাতে ঢোক গিলল, ব্রুকসের দিকে চকিত চাহনি! হানল সাহায্যের প্রত্যাশায়।
ঝামেলা শেষ করে নিই, তারপর টাইট দেব তোমাকে! শাসাল ব্র্যাড।
বারের ও-মাথায় চলে যাও, কেভ, নির্দেশ দিল ব্রুকস। ভুলেও অন্য কিছু করার কথা মাথায় এনো না।
দ্রুত বার কয়েক মাথা কঁকাল, সে, সরে গেল নির্দেশমত। দুঃখিত, মি. ব্রুকস…শেষপর্যন্ত এখানে ভাঙচুর করবে ওরা। তোমরা এখানে এসেছ এ দোষে চড়াও হবে আমার ওপর।
হেসে ফেলল ব্রুকস। বাপের চেয়ে এককাঠি বাড়া, টনটনে ব্যবসায়িক জ্ঞান। হিসেব করে রেখো, সব শোধ করে দেবে পারকার, কেভিনের চোখ দেখে বোঝা গেল মোটেও বিশ্বাস করেনি সে। দেবে, অবশ্যই দেবে, তাকে আশ্বস্ত করল ও। কয়েকটা দিন দেরি হবে, এই যা।
ঠিক আছে। আমি তাহলে এখানেই থাকছি।
জাহান্নামে যাও তুমি! গাল বকল গ্যারেট। বস্তাপচা শহরের নর্দমার কীট!
টেক্সানের হঠাৎ বিরক্তি ও আগ্রাসী মনোভাবের কারণ বুঝতে পারছে ব্রুকস, আসন্ন লড়াইয়ের উৎকণ্ঠা। একটু পর কে বেঁচে থাকবে বা মারা পড়বে সেটা আগে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। প্রতিপক্ষ সংখ্যায় বেশি, যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে। ডুয়েলের আগে ফাস্টেস্ট গানও উদ্বেগে ভোগে, এটাই স্বাভাবিক। কেউ সেটাকে দমিয়ে রাখতে পারে, কেউ পারে না।
জেফরি করবেটের বিশাল শরীরের ধাক্কায় খুলে গেল ব্যাটউইং দরজা। উড়ে এল যেন সে, চোখের পলকে চলে এল কয়েক গজ। সঙ্গীরা ঢোকা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। এবার বাগে পেয়েছি তোমাদের, বাছাধন, দেখি কি করে পালিয়ে যাও! চাপা স্বরে হুঙ্কার ছাড়ল, দুচোখে নগ্ন উল্লাস, খুনের নেশায় উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। ছোবল মারল করবেটের হাত, নিমেষে উঠে এল পিস্তল। বার-পি ফোরম্যান ভেবেছিল প্রতিপক্ষকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পেয়েছে, দুএকটা গরম কথাবার্তার আগে কি পিস্তল বের করে কেউ! বুকে গুলির প্রচণ্ড ধাক্কায় ভুল ভাঙল। বিশাল দেহ উড়ে গিয়ে পড়ল ব্যাটউইং দরজার ওপর। মাটিতে পড়ার আগেই মারা গেল করবেট, ব্র্যাড গ্যারেটের গুলি ওর ঘাড়ের শিরদাড়া ভেঙে দিয়েছে।
সেলুনে নরক ভেঙে পড়ল যেন। মুহুর্মুহু গুলির শব্দে মুখরিত, তাজা গান পাউডারের গন্ধ আর ধোঁয়ায় ভরে গেছে। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল ব্রুকস, এককোণে সরে এসেছে। ধীরে ধোয়া কাটল। তিনটা লাশ পড়ে আছে মেঝেতে, আরেকজন হাত চেপে ধরে ককাচ্ছে। ছুটন্ত পদশব্দে বোঝা গেল পালিয়েছে অন্যরা।
যাক, বেঁচে আছ তাহলে, ঘরের আরেক কোণ থেকে বলে উঠল ব্র্যাড গ্যারেট, গলায় কৌতুক ভাবটা ফিরে এসেছে। ভাবছিলাম তুমি মরে গেলে কার কাছ থেকে বেতন নেব। পিস্তলে টোটা ভরল সে, তারপর ফিরল সিঁটিয়ে থাকা কেভিনের দিকে। হুইস্কি লাগাও, কেভিন, তুমিও নাও।
মাথা নেড়ে নিষেধ করল ব্রুক। দুহাত দূরে পড়ে আছে ওর হ্যাট, ঝুঁকে তুলে নিল। ওপরের দিকে ছোট্ট একটা ফুটো। ভাগ্যিস! দুই ইঞ্চি নিচ দিয়ে বুলেট গেলে এটা আর পরতে হত না।
গ্যারেট হুইস্কি শেষ করার আগেই সেলুনে ঢুকল টিম ম্যাসন। গম্ভীর মুখে দেখল লাশগুলো, তারপর ব্রুকসের সামনে এসে দাড়াল। লোকগুলোকে খুন করেছ তোমরা।
তো কি হয়েছে? হেসে উঠল ব্র্যাড। ডুয়েলে প্রতিপক্ষকে মেরে ফেলা যাবে না এমন কথা কোথাও লেখা আছে?
কোন সুযোগ দাওনি ওদের। আগেভাগে পিস্তল বের করেছ।
তুমি কি পারকারের সেলুনে বসে তাই দেখলে? বিজপ করল ব্রুকস।
দুজনে মিলে এতগুলো লোক মেরেছ। আগে পিস্তলে হাত না দিলে তা পারতে না।
কজন ছিল ওরা, ম্যাসন?
করবেটসহ ছয়জন।
প্রচণ্ড জোরে ঘুসিটা হাঁকাল ব্রুকস, মোক্ষ জায়গায় লাগল। উড়ে গিয়ে একটা টেবিলের ওপর আছড়ে পড়ল ডেপুটি। ভারী, দেহের ভার সইতে না পেরে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল ওটা, ম্যাসন পড়ল তার ওপর। দুপা এগিয়ে বুকে ডেপুটির বুকের তারা টান মেরে খুলে ফেলল ও, তারপর ছুঁড়ে দিল কেভিন লকহার্টের দিকে। হবসকে ডেকে নিয়ে এসো, কেভ। ওকে বোলো তারাটা পরার কোন যোগ্যতা এই ছুঁচোটার নেই।…পরেরবার একটা ঘুসিতে ছাড়ব না, বুঝেছ, ম্যাসন?
কেবল অসহায় একটা ভঙ্গি করল ডেপুটি, কিছুই বলতে পারল না। থুথু ফেলতে রক্ত আর তিনটে দাঁত পড়ল মেঝেতে।
আমার টেবিলটা, মি. ব্রুকস…
তোমার বাপের কাছ থেকে ওটার দাম নিয়ো, আর ওকে বোলো এই কাঠগুলোই যেন আমার কাছে বিক্রি করে। বিরক্ত হয়ে বলল ব্রুকস।
বোকার মত চেয়ে থাকল কেভিন। ঠিক আছে, মি. পরকারের নামে লিখে রাখব, খানিক ভেবে খুশি হয়ে বলল সে।
তোমার পেছনে একটা লাথি হাঁকাবে পারকার! বিড়বিড় করে বলল টেক্সান, দরজার দিকে এগোতে বাধা পেল।
পেছনের দরজা দিয়ে লকহার্টের স্টোরে যাব আমরা, বিল মেটানোর ফাঁকে বলল ব্রুকস।
মাথা নাড়ল ব্র্যাড, পছন্দ করতে পারছে না।
উঁহু, বীরত্ব দেখানোর সুযোগ পরেও পাবে। যথেষ্ট হয়েছে, আর কোন ঝামেলা চাই না।
শ্রাগ করে কেভিনের দিকে ঘুরল টেক্সান। তোমার কোন আপত্তি আছে?
ন্-না, মোটেই না।
দ্রুত বেরিয়ে পড়ল ওরা। বাড়ি আর দোকানগুলোর পেছনের জায়গাটা পরিচ্ছন্নই, বোঝা যাচ্ছে নিয়মিত ব্যবহার করা হয়। দুটো বাড়ি পেরিয়ে এসে লকহার্টের স্টোরের দরজায় নক করল ব্রুকস। তিনবারের পর বিরক্তিতে গজগজ করতে করতে দরজা খুলল স্টোর মালিক। ওদের দেখে নিমেষে দাঁত কেলিয়ে হাসল। ঝামেলায় পড়েছ? দরজা বন্ধ করার সময় জানতে চাইল সে।
একটাও বাজে জিনিস দেবে না, বিল, কঠিন সুরে বলল ব্রুকস। তাহলে তোমার চাঁদি আস্ত রাখব না!
অবশ্যই। তুমি হলে আমার নিয়মিত খরিদ্দার। তোমার ছেলের মাথায় ধারণাটা ভাল করে ঢুকিয়ে দিয়ো। পরামর্শ দিল ব্র্যাড।
কি করেছে ও?
ব্রুকস বা গ্যারেট কেউই উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। বেরিয়ে যাচ্ছে ওরা। পোর্চে এসে রাস্তার দক্ষিণে তাকাতেই দেখতে পেল জুলিয়াস পারকারকে। সদলে শহরে প্রবেশ করছে বুড়ো, একটা বাগিতে চড়েছে। উদ্ধত অহঙ্কারী ভঙ্গিতে বসেছে। শরীর টান টান, দৃষ্টি মাটির সমান্তরাল, ভুলেও কারও দিকে তাকাচ্ছে না। পেছনে গ্রুলার স্যাডলে মেঝো ছেলে অ্যালান। সবশেষে স্টিরাপ, বিশালদেহী স্টিভ কোলম্যান। ছেলে কিছু একটা বলতে ওদের দিকে ফিরল বার-পি মালিক।
পেছন দরজা দিয়ে যাই! গ্যারেট যেন ভেঙচি কাটল, উপহাস ঝরে পড়ছে ওর কণ্ঠে। কপালে আছে ঝামেলা, তুমি কি করে এড়াবে, স্যামুয়েল ব্রুকস? ওটা করবেটের ফিউনেরালের শোভাযাত্রা নয়, বুঝতে পারছ?
হিচিং রেইল থেকে ঘোড়ার লাগাম ছাড়িয়ে নিল ব্রুকস, স্যাডলে চাপল। চোখ পরকারের দলের ওপর।
অপেক্ষা কিসের? চলো কেটে পড়ি!
দয়া করে মুখটা বন্ধ রাখো
শ্রাগ করে সিগার ধরাল গ্যারেট, স্যাডলে চেপে বসেছে। ব্রুকসের ঘোড়া ঠায় দাড়িয়ে, অপেক্ষা করছে।
দশ গজ দূরে এসে থামল বাগি। শীতল দৃষ্টিতে তাকাল পারকার। শেষপর্যন্ত তাহলে আমাদের দেখা হলো। ভালই করছ তুমি, ব্রুকস, আমার লোকগুলোকে বারবার ঘোল খাইয়ে ছাড়ছ, হাসল সে, আত্মবিশ্বাসের হাসি। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে, বাছা। অনেকদিন বসে থেকে গায়ে খিল ধরে গিয়েছিল, এবার খানিকটা গা-ঝাড়া দেয়া যাবে। ব্রুকসের ওপর থেকে সরে গিয়ে টেক্সানের ওপর স্থির হলো বুড়োর দৃষ্টি।
দুঃখিত, বুড়োখোকা, তোমার সাথে থাকা গেল না, পারকার কিছু বলার আগেই বলে উঠল ব্র্যাড়। কি করব, আমি কি আর জানি যে তোমার নোংরা টাকা গলা দিয়ে বেরিয়ে আসবে?
রাগ দেখা গেল বার-পি মালিকের চোখে। মরগান পিকসেই তোমাদের কবর দেব আমি!
ভাল কথা। আমি বলি কি, ম্লান হলো না টেক্সানের হাসি। স্টিরাপকে দিয়ে নিজের জন্যে একটা কবর খুঁড়ে রাখছ না কেন? শেষে তো সময় পাবে না। বাফেলোর মালিককে যদি বুটহিলে শুতে হয় এরচেয়ে বড় অপমান আর কি হতে পারে! তোমার খারাপ লাগবে না?
জুলিয়াস পারকার এমনভাবে তাকাল যেন পুড়ে যাবে ব্র্যাড, রাগের সাথে ঘৃণা দেখা যাচ্ছে চোখে। ওই কুত্তাটাকে ধরো… ওকে নিজহাতে চাবকাব আমি, তারপর কুকুরকে দিয়ে ওর মাংস খাওয়াব!
কয়েকটা ব্যাপার ঘটল একসঙ্গে—টম স্টিরাপের ঘোড়াটা আগে বাড়ল, রাইফেল তুলে নিতে স্যাডল হর্নে হাত বাড়াল অ্যালান পারকার; এবং পিস্তলে বুডোর বুক নিশানা করল ব্রুকস। মি. পারকার, স্টিরাপকে পিছিয়ে যেতে বলল, সতর্ক দৃষ্টি বুলাল সবার ওপর। আর তোমার ওই বোকা ছেলেটাকে বলল রাইফেল থেকে হাত সরিয়ে নিতে। ওরা, কিংবা তুমি আমার কথা না শুনলে, তোমার কপালে গুলি করব।
একপাশে সরে এসেছে স্টিরাপ, চোখজোড়া জ্বলছে। উরুতে পিস্তলের বাঁট ছুঁয়েছে ওর হাত। ওদিকে রাইফেল তুলে নিয়েছে অ্যালান। স্টিভ কোলম্যান সুযোগ খুঁজছে, না দেখলেও ব্রুকস বুঝতে পারছে মুহূর্তের ব্যবধানে ড্র করবে সে, কেবল অন্য কেউ শুরু করলেই হলো। জুলিয়াস পারকার ঘামতে শুরু করেছে।
সহসা ভয় পেল বার-পি মালিক। ও যা বলছে করো! কাঁপা স্বরে আদেশ করল। হারামজাদারা, তোদেরকে আমিই বেতন দেই!
হাত গুটিয়ে নিল ওরা।
পিস্তল নামিয়ে পমেলের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখল ব্রুকস, এমনভাবে যাতে সবাই দেখতে পায়। চারপাশে কৌতূহলী লোকের ভিড় জমে গেছে, নিরাপদ দূরত্বে থেকে মজা দেখছে। পারকারের সেলুন, ওপাশের বাড়ির ছাদের ওপর নজর বুলাল ও। অবাক হওয়ার কিছু নেই যদি দুএকজন অতি উৎসাহী রাইডার ওখানে ওঁৎ পেতে থাকে।
তোমার কারণে মারা গেছে আমার ছেলে, ব্রুকস। আর আজকের ব্যাপারটাও ভুলব না। আমার দিকে পিস্তল তাক করেছে এমন কেউ এখনও বেঁচে নেই, থাকবেও না। বিপদ কাটতে স্বরূপে ফিরেছে পারকার, প্যালেস-এর দিকে দৃষ্টিপাত করল একবার। হয়তো আশা করছে ওদিক থেকে কোন সাহায্য আসবে। কিন্তু তার জানা নেই খানিক আগে মারা গেছে র্যামরড।
সময় থাকতে সামলে নাও, মি. পারকার। নইলে তোমার অন্য ছেলেগুলোকেও হারাবে।
আমারই শহরে দাঁড়িয়ে আমাকে শাসাচ্ছ?
ভুল বলেছ। বাফেলো টাউন এখন আর তোমার একার শহর নয়। শুরুটা তোমরা করেছিলে তা ঠিক। অন্যদের ছাড় দেয়ার সময় হয়েছে এখন, এটা তোমাকে বুঝতে হবে। এখানকার লোকজনকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, তোমার সাথে একমত হবে না কেউ।
দরকার হলে অ্যাৰ্প, মাসট্যাঙ, শ্যানন…সবাইকে আনাব।
তার আগে দেখো তুমি নিজেই শেষ হয়ে যাও কি-না। ফোড়ন কাটল ব্র্যাড।
_ জুলিয়াস পারকারের চেহারা দেখে মনে হলো হাতের নাগালে পেলে টেক্সানকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে।
মি. পারকার, দল নিয়ে ফিরতি পথ ধরো। আমরা সরে যাওয়ার পর শহরে ঢুকবে তুমি।
আমাকে পিছিয়ে যেতে বলছ?
নইলে সামনে আসতে পারো। তোমার ভাড়াটে লোকগুলো এটাই চাইছে, এমনকি তোমার ছেলেও। ওরা বোধহয় চায় না তুমি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকো।
কি করবে যদি…?
সবার আগে তোমার কপাল ফুটো করব, এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি।
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হচ্ছে না, একগুয়ে স্বরে বলল পারকার, বলার ভঙ্গিতে জেদ প্রকাশ পাচ্ছে।
আমিও তাই চাই, হাসল ব্রুকস। প্রাণের ঝুঁকি না নিয়ে পিছিয়ে যাও। দশটা মিনিটের ব্যাপারই তো। একবার পিছিয়ে গেলে কিছু যাবে-আসবে কি? এই একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে তোমাকে অনুরোধ করছি।
পিস্তল হাতে কেউ অনুরোধ করে নাকি?
যা ইচ্ছে ভাবতে পারো। তবে এটা মনে রেখো এখানে কোন কিছু ঘটলে সবার আগে তুমিই ভুগবে। পারকাররা এ এলাকার অহঙ্কার, তাই না? মরে গেলে ওই জিনিসটার কোন দাম থাকে কি?
শেষপর্যন্ত প্রাণের মায়াই জয়ী হলো। জেদ চেপে রেখে বাগি ঘুরিয়ে নিল পারকার। তোমার জন্যে আফসোস হচ্ছে, ব্রুকস। চুটিয়ে উপভোগ করলে সময়টা। কিন্তু এ-সুখ বেশিদিন থাকবে না। তোমাকে শায়েস্তা করে এই শহরটা ধ্বংস করব। সবকটা হারামীর বাচ্চা দাঁত কেলিয়ে মজা লুটছে, হাড়ে হাড়ে টের পাবে এর ফল!
দলটা বেশ দূরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল ব্রুকস। আশপাশের লোকজনের ওপর চোখ বুলাল। এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি, এখন সমানে কথার খৈ ফুটছে মুখে। ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে স্পার দাবাল ও। ধুলো উড়িয়ে বেরিয়ে এল বাফেলো থেকে।
অ্যাপলুসাটা দারুণ ছুটতে পারে, নিজের জমিতে পেীছে ভাবল ব্রুকস।
প্যাট শুনলে আফসোস করবে, কেবিনের কাছে পৌঁছে বলল ব্র্যাড। দারুণ জমেছিল তোমাদের খোশ-গল্প।
এখন থেকে আরও সতর্ক থাকতে হবে, ভাবছে ও। জ্বলন্ত আগুন উস্কে দিয়ে এসেছে আজ। ওদের শেষ না করে শান্তি পাবে না জুলিয়াস পারকার।
একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ, এ পর্যন্ত একবারও তোমাকে আসল পরিচয়ে ডাকেনি ওদের কেউ? না পারকার, না ওর কোন ক্রু। অথচ ওরা ঠিকই জানে কার পেছনে লেগেছে। লাঞ্চের পর শেডের কাছে বসে কফির মগ তুলে নিয়ে বলল ব্র্যাড।
ক্রুদের সবাই কিন্তু জানে না, মুখ খুলল প্যাট। পারকার সবাইকে জানায়নি। তেমন হলে অনেকেই সটকে পড়ত, অন্তত এখন। বহু লোক হারিয়েছে পারকার, বাকিদের মধ্যে রণেভঙ্গ দেয়ার জন্যে হারডিন নামটার গুরুত্ব কম নয়। আবার এমনও হতে পারে রাইডারদের মনোবল চাঙা রাখতে চেপে গেছে সে, মামুলি একজন স্যামুয়েল ব্রুকসকে শায়েস্তা করতে খুব বেশি সাহসী লোকের দরকার হয় না।
বাফেলোর সাধারণ লোকেরা তোমার পরিচয় জানতে পারলে পরকারের সমস্যা আরও বাড়বে, যোগ করল ব্র্যাড। শহরটা এখন আর ওর হাতের মুঠোয় নেই। লোকজন বুঝে গেছে পারকারকেও আঘাত করা যায়। ওরা যদি হারডিনকে সাহায্য করতে আসে তো অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। লোকগুলো সাহস পাবে এবং ওদের স্বার্থোদ্ধারের সম্ভাবনা তাতে বাড়বে। শহরে তোমার নামটা একবার ছড়িয়ে দাও, দেখবে পারকারের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে গেছে লোকজন। ওরা ভেবে সাহস পাবে যে হারডিনের মত দুর্ধর্ষ একজন তোক পরোক্ষভাবে হলেও ওদের সাথে আছে।
শেষতক হয়তো তোমার ইচ্ছেই পূরণ হবে, হেসে বলল প্যাট। হারডিন নামটা বোধহয় অজানাই থেকে যাবে। অবশ্য স্যামুয়েল ব্রুকসের নাম তখন ছড়িয়ে পড়তে পারে।
স্যাডল ছাড়িয়ে ঘোড়াটাকে উপত্যকায় নিয়ে এল ব্রুকস, সময় নিয়ে যত্ন নিল। গ্যারেটদের কথাগুলো হালকা হলেও ভাবাচ্ছে ওকে। হারডিনের পুনর্জন্ম যেমন আশা করে না, তেমনি চায় না স্যামুয়েল ব্রুকসও আরেক হারডিন হয়ে উক। তেমন হলে আবারও প্রতিশোধপরায়ণ কিছু লোক হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করবে ওকে, এবং এবার একটা ঠিকানাসহ-সহজেই চলে আসবে যাফেলো টাউনে। এটা হতে দেয়া যাবে না। পুরানো অনিশ্চিত জীবনে ফিরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই ওর। ব্রুকস শান্তিপূর্ণ একটা জীবন চায় যেখানে খ্যাতির বিড়ম্বনা থাকবে না, পিস্তল হাতে কারও মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে না।
লকহার্টের কর্মচারী লেইভ জোন্স ওয়াগনে করে দুদফায় মালামাল পৌঁছে দিল সেদিন।
পরদিন থেকে কাজে নেমে পড়ল ওরা। বিকেলের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল র্যাঞ্চ হাউসের কাঠামোপরিশ্রান্ত দেহ ঘাসের ওপর বিছিয়ে কফির স্বাদ উপভোগ করছিল, এসময়ে উপস্থিত হলে জ্যাক হবস।
কাছে এসে স্যাডল ছাড়ল মার্শাল, কফির মগ এগিয়ে দিতে সাগ্রহে নিল। গম্ভীর, চিন্তিত দেখাচ্ছে। চঞ্চল দৃষ্টি বুলাল গ্যারেটদের ওপর, বিড়বিড় করে বলল কি যেন। ধীরে কফিতে চুমুক দিল।
অপেক্ষা করছে ব্রুকস, আঁচ করতে পেরেছে সমস্যায় আছে লোকটা। প্রথমেই চোখে পড়েছে বুকপকেটে তারাটা নেই।
শেষপর্যন্ত চাকুরিটা হারালাম, একসময় স্নান গলায় বলল হবস।
আমি ভাবছিলাম তারাটা হয়তো চুরি গেছে! সহাস্যে বলল ব্র্যাড।
আমার কাছ থেকে ওটা কেড়ে নিয়েছে পারকার।
আগ্রহী হয়ে উঠল গ্যারেটরা, অথচ একটু আগে পাত্তাই দিচ্ছিল না। ঘুরে বসল হবসের দিকে।
তোমরা চলে আসার পরেই ঝামেলার শুরু। ল-অফিসে এল জুলিয়াস পারকার, করবেটকে খুনের দায়ে তোমাদের নামে হুলিয়া বের করতে বলল। আহ, চেহারাখান যদি একবার দেখতে! ফোরম্যান তো নয় যেন মেয়ে-জামাইকে হারিয়েছে! বললাম সবার আগে তাহলে ওকেই গ্রেফতার করা উচিত। বেসিনে একগাদা খারাপ লোক ও-ই আনিয়েছে। শুনে ব্যাটা হেসে খুন, বলল ওর কথা না শুনলে মন্টানা কিডকে লেলিয়ে দেবে আমার পেছনে। শেরিফ বা মার্শালদের খুন করা তো শয়তানটার অভ্যাসে দাড়িয়ে গেছে।
ভয় পাওনি? মুখ টিপে হাসছে ব্র্যাড।
দেখো, বাছা, বেশি ফটফট কোরো না। হাড়ে হাড়ে চিনি তোমাদের, সব কটা আস্ত হারামী! বয়সটা দশ বছর কম হলে এই দুটোকেও জেলে ভরতাম।
আইনের পক্ষে অস্ত্র ধরতে বয়স লাগে না, মনের জোরই আসল। ওটাই নেই তোমার, জ্যাক হবস।
মাথা নাড়ল মার্শাল, ব্র্যাডের কটাক্ষ গায়ে মাখল না। কিড বা কোলম্যানের কথাই ধরো, মরে গেলেও পিস্তল হাতছাড়া করবে না ওরা। কিডকে নিরস্ত্র করতে গিয়ে মারা গেল লিয়ন সিটির মার্শাল, কোন সুযোগই পায়নি বেচারা।
ওকে গ্রেফতার করা তোমার দায়িত্ব, হবস।
হয়তো, কিন্তু কজনকে গ্রেফতার করব? গণ্ডা গুণ্ডা লোক, শয়তানের দোসর ওরা। এই যমজ দুটোই বা কম কিসে?
আমাদের ধরছ না কেন?
একটা পরিকল্পনা করেছি, এবার উজ্জ্বল দেখাল হবসের মুখ। কটাকে আর গরাদে ঢোকাতে পারতাম! তারচেয়ে…এখন কারও গায়ে আঁচড়টিও দেব না…।
দারুণ! ব্যঙ্গ করল ব্র্যাড, থামিয়ে দিয়েছে হবসকে। সাহস আছে তোমার, জ্যাক।
তোমার বয়স কত, বাছা? এবার খেপে গেল সে, চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। পঞ্চাশ পর্যন্ত বেঁচে থাকো, তারপর টের পাবে বয়স কি করে সামর্থ্য কেড়ে নেয়।
ওভাবে বেঁচে না থাকাই ভাল।
তোমরা থামবে? বাদ সাধল ব্রুকস। আসল কথাই এখনও জানা হয়নি। কি করে চাকুরি হারালে, জ্যাক?
সন্ধের সময় সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ল পারকারের ক্রুরা। যে যেভাবে পারল জোর দেখানো শুরু করল। বড় চোট গেল লকহার্টের ওপর দিয়ে, প্রয়োজনমত গোলা-বারুদ আর রসদ নিয়ে একটা পয়সাও দেয়নি। কেভিনকে ধরে আচ্ছামত ধোলাই দিয়েছে কোলম্যান। রাতটা ওখানেই কাটিয়েছে ওরা। দেদার মদ গিলেছে।
কেভিনের তালিকাটা একটা টেবিলের পর বেশ লম্বাই হবে দেখছি! সকৌতুকে বলল ব্র্যাড গ্যারেট।
কি বললে? বুঝতে না পেরে জানতে চাইল হবস।
তারপর? তাড়া দিল ব্রুকস।
রাতে আবার এসেছিল পারকার, একই অভিযোগ করল। পাত্তা দিলাম না, থেমে, উঠে গিয়ে মগ ভরে নিল হবস। চুমুক দিয়ে খেই ধরল। পিস্তলের মুখে আমার তারা কেড়ে নিল। আর বলল শহরটাকে ঝামেলামুক্ত না করে বাথানে ফিরে যাবে না। শহরের সাদা ওই বাড়িতে রাত কাটিয়েছে।
ওর পণ ভাঙাতে যাচ্ছি না আমরা।
হাসি পেল ব্রুকসের, ব্র্যাড গ্যারেট সত্যি মজার লোক। সুযোগ পেলেই রসাল মন্তব্য করছে। এতে আর কিছু না হোক, সময়টা আর ওদের সঙ্গ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। তো, বাফেলোতে এখন তাহলে পারকারই কর্তৃত্ব করছে, স্বগতোক্তির মত বলল ও। তারাটা নিশ্চয়ই দিয়েছে কাউকে।
ম্যাসন পেয়েছে ওটা। সাথে কোলম্যান, স্টিরাপ…ওরা ডেপুটি সেজেছে।
ওরা যদি মার্শাল হতে পারে তো আমরা সিনেটর। তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে উঠল ব্র্যাড।
সেই ব্যবস্থা করে এসেছি আমি।
ব্রুকস বা গ্যারেটরা কেউ কিছু বলছে না, বিস্মিত। ওদের দেখছে জ্যাক হবস, আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে তাকে। বলেছিলাম না, একটা পরিকল্পনা করেছি? ধীরে সিগার ধরাল তারা-হারানো মার্শাল। তোমরাই হবে আমার হাতিয়ার। পারকারকে শিক্ষা না দিয়ে ছাড়ছি না আমি! প্রতিজ্ঞায় জ্বলজ্বল করছে ওর চোখ, দৃঢ়বদ্ধ চোয়াল জানান দিচ্ছে আত্মবিশ্বাসের কমতি নেই।
বুঝলাম না, ধীরে ধীরে বলল প্যাট। তবে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছি।
রাতে লকহার্টের বাসায় মিলিত হয়েছিলাম আমরা, সব মিলিয়ে বারোজন। পারকারকে মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা। পরিকল্পনা মাফিক তোমাদের ডেপুটি করে নিচ্ছি আমরা।
আরিব্বাপস! শুনছ, প্যাট, বুড়ো হাবড়াটা কি বলছে? তারার শোকে মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওর! ওটা উদ্ধার করবে আমাদের রূপালি তারা পরিয়ে। ভাবো একবার, গ্যারেটরা কোন শহরে আইনের প্রতিনিধিত্ব করছে, আমাকে এটাও দেখতে হবে! লোকজন তো হেসেই খুন হয়ে যাবে। নিজেই হাসতে শুরু করল ব্র্যাড, হাসির দমকে তার ছোটখাট শরীর কাঁপছে।
ওদিকে বোকার মত ওর দিকে তাকিয়ে আছে জ্যাক হবস।
কোন সন্দেহ নেই গ্যারেটদের জন্যে ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর। পশ্চিমে ওদের পরিচয় লড়াকু লোক ও আউট-ল হিসেবে। সারা জীবন ছুটতে হয়েছে আইনের লোকের সামনে, উল্টোটা তাই ওদের কাছে হাস্যকর। ওরা নিজেরাও তা উপলব্ধি করে। কিন্তু পশ্চিমে এ ধরনের ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। এমন অনেক লোক আছে একটা শহরকে ঝামেলামুক্ত করা বা কোথাও আইনের কর্তৃত্ব করার পর দেখা গেছে সে আউট-ল ছাড়া আর কিছু নয়। বৈরী এ দেশটিতে পরিস্থিতিই সবকিছুর নিয়ামক। তাই বিলি দ্য কিড, ইয়েট অ্যাৰ্প বা বো মাস্ট্যাঙ এদের অনেককে দেখা গেছে আইনের কঠোর প্রতিনিধি হিসেবে। বলা বাহুল্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা, সফল হয়েছে। আবার উল্টোটাও ঘটেছে। আইনের মানুষ আউট-লয়ে পরিণত হয়েছে এমনও হাজারটা উদাহরণ দেয়া যাবে।
জুলিয়াস পারকারকে হটানোর উদ্দেশে বাফেলোর নিরীহ লোকজন এ সাহসী, সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভাবছে রুকস। গ্যারেটদের ওপর আস্থা রেখেছে ওরা, দেখেছে অসম সাহসিকতার সাথে টেক্কানরা কিভাবে কার্লি ব্রনসনের দলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল কিংবা সার্কেল-এফের ঘটনাও হয়তো শুনে থাকবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, বেসিনে এখন কেবল দুটো পক্ষ-জুলিয়াস পারকার আর তার মুখোমুখি অন্যরা। সবাই এক হলে দাম্ভিক বুড়োকে শায়েস্তা করা কঠিন হবে না।
মাত্র কয়েকদিনের ব্যাপার, কাজ শেষে গ্যারেটরা যা ছিল তাই থাকবে। বড়জোর এখানকার মানুষ ভিন্নরূপে জানবে ওদের, ওরা কতটা দৃঢ়তা দেখাতে পারে তা-ই মনে রাখবে।
রঙজ্বলা জিনসের পকেট হাতড়ে তিনটে তারা বের করে এগিয়ে দিল হবস। গ্যারেটরা নিশ্চপ, বিশেষ করে ব্র্যাড। এতক্ষণ হালকাভাবে নিচ্ছিল, সত্যটা এখন উপলব্ধি করতে পারছে। সাফ জানিয়ে দিচ্ছি, মুখর হলো সে। এর মধ্যে নেই আমি।
জীবনে তো অনেক কিছুই করলাম, চিন্তিত স্বরে বলছে প্যাট। কেবল এই একটা কাজ বাকি ছিল। দেখি না কেমন লাগে! মজা তো পাওয়া যাবে। কি বলো, স্যাম, তুমি তো অনেকবার তারা পরেছ?
দুভাইয়ের অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে ব্রুকস, ওদিকে হবস আশান্বিত।
ওগুলো ফেরত নিয়ে শেষে আমাদের শিকের ভেতর ঢোকাবে না তো?
পারকারকে যদি আমরা হটাতে পারি, আমার ধারণা বীরোচিত সম্বর্ধনা পাবে তোমরা। চাই কি চাকুরিটা স্থায়ীও হয়ে যেতে পারে। কারণ ঠিক করেছি আর ওসরে থাকব না আমি। বুড়ো হাড়ে এত ধকল সইছে না।
তোমরা আসলে আমাদের ব্যবহার করতে চাইছ। অভিযোগ করল প্যাট।
অস্বীকার করছি না। রাজি না হলেও পারো। দায়িত্বটা নিলে বাড়তি কিছু সুবিধা পাবে। পারকার আগে তোমাদেরই শায়েস্তা করতে চাইবে, আর তোমরা তা ঠেকাতে বসে আছ। ডেপুটি হলে কাজ কিন্তু একই। লাভের মধ্যে-আইনের পক্ষে থাকছ আর বেসিনের বেশিরভাগ লোককে পেছনে পাবে।
সব দেখছি আগে থেকে ভেবে রেখেছ, এবার হাসল ব্র্যাড। কিন্তু নগদ নারায়ণের ব্যাপারটা? উহু, কোন লাভ নেই, হবস কিছু বলতে চেষ্টা করতে হাত তুলে বাধা দিল। পারকারের বুলেটের সামনে দাড়াতে হবে আমাদেরই, বুঝতে পারছি দূরে দাঁড়িয়ে থেকে তোমরা কেবল তামাশাই দেখবে।
চুপ করে থাকল জ্যাক হবস, মুখ দেখে মনে হলো যেন টেক্সানের কথায় আহত হয়েছে।
ঝুঁকিটা আমরা নেব না তোমরা, জ্যাক? বলে চলেছে ব্র্যাড। আমাদের কোন দায় পড়েনি। নেহায়েত পকেট খালি বলে রাজি হচ্ছি, নইলে ওরকম দুএকটা বাফেলো টাউনের কি হলো বা না হলে তাতে আমাদের কিছু যায়-আসে না।একটু থেমে ভাইয়ের দিকে তাকাল। মাথাপিছু দুশো ডলার, একেবারে সস্তায়। আর হ্যাঁ, রিওয়ার্ডের সব টাকা।
তুমি জানো আমরা নিরুপায়।
কিভাবে এগোবে ভেবেছ কিছু? জানতে চাইল ব্রুকস।
ওরা তোমার ওপর ছেড়ে দিয়েছে, স্যাম। এ ব্যাপারে তোমার তো অনেক অভিজ্ঞতা। তাছাড়া…
শুধু টাকা আর টিনের তারা দিয়ে খালাস! বিরক্তি প্রকাশ করল ব্র্যাড।
ক্রুদের সবাই শহরে আছে? টেক্সানকে গুরুত্ব দিল না ব্রুকস।
সায় জানাল হবস। বেশিরভাগ।
সকালে লকহার্টের পেছনের কামরায় মিলিত হব আমরা। তারপর বেরোব ওদের খোজে। যে কটাকে পারি ধরে সেলে ঢোকাব। প্রথম দিনে যতটুকু সম্ভব দলটাকে ছোট করে দিতে হবে।
আমার কিন্তু লিয়ন সিটির মার্শালের কথা মনে পড়ছে, অন্যমনস্ক দেখাল প্যাটকে। কিডকে গ্রেফতার করতে গিয়ে মারা পড়েছে সে এবং বহাল তবিয়তে আছে কিড।
এটা লিয়ন সিটি নয় আর ওই মার্শালের মত ভুল করব না আমরা।
অসম্ভব একটা কাজ, স্যাম। কারণ ওরা কে কোথায় থাকবে আগে থেকে সঠিক জানার উপায় নেই। তাছাড়া সংখ্যাটাও ঠিক জানি না। কিন্তু তোমার পরিকল্পনাটা মন্দ নয়। কাজ হলে দলটা অর্ধেক কানা হয়ে যাবে। ওদের আত্মবিশ্বাসে নাড়া দিতে পারলে পরের কাজটুকু কঠিন হবে না, হুজুগে কিছু লোক এমনিতেই পালানো শুরু করবে।
দেখার মত ব্যাপার হবে, বিড়বিড় করে বলল ব্র্যাড গ্যারেট, সিগার টানছে। উজ্জ্বল দেখাচ্ছে চোখ-মুখ। সারা শহরে ঘুরে বেড়াবে টিনের তারাঅলারা, আবার একপক্ষ আরেক পক্ষকে হাজতেও ঢোকাবে। নাহ, আমার মনে হয় খেলাটা ভালই জমবে!
লকহার্টের স্টোরে নির্বিঘ্নে পৌঁছাল ওরা।
উইলিয়াম লকহার্টকে আজ অন্য রকম মনে হচ্ছে-চাপা উৎকণ্ঠা লোকটার চোখে-মুখে। অন্য কোন সময় হলে যা হত, বড় ধরনের কিছু ঘটলেও সেটা তাকে স্পর্শ করত না, আজ তা নেই। এই প্রথম স্বভাববিরুদ্ধ একটা কাজে হাত দিয়েছে স্টোর মালিক, বাফেলো টাউনের একজন সচেতন অধিবাসী হিসেবে আইনকে সক্রিয় সহযোগিতা করছে।
লকহার্ট হুইস্কির বোতল এগিয়ে দিতে নিষেধ করল ব্রুকস, কিন্তু গ্যারেটরা সোৎসাহে নিল। সিগারেট ধরিয়ে মার্শালের দিকে তাকাল ও। ওরা কোথায় আছে, জ্যাক?
হবসের মনোযোগ অন্যদিকে, লোলুপ দৃষ্টিতে দেখছিল প্যাটের হাতের বোতল। সংবিৎ ফিরতে ফিরে তাকাল। কার কথা বলছ?
মন্টানা, ম্যাসন, কোলম্যান…, মন্টানা আর কোলম্যানসহ চারজন আছে সিলভার রকে। টিম আছে লঅফিসে, আমার চেয়ারটা বোধহয় ওর ভাল লাগতে শুরু করেছে। স্টিরাপকে কোথাও দেখিনি। গতকাল বেশিরভাগ সময় প্যালেসে কাটিয়েছে ও, সাথে আরও তিনজন ছিল। একটাকেও চিনি না। গ্যারেট বোতল এগিয়ে দিতে লুফে নিল সে, আগ্রহের সাথে চুমুক দিল।
দায়িত্বটা বুঝতে পারছ, জ্যাক? তোমাকে সক্রিয় হতে হবে। এভাবে গিলতে থাকলে শেষে গুলিয়ে ফেলবে সব।
আমি অভ্যস্ত, স্যাম।
অফিসে বসে সময় কাটাতে তুমি আরও বেশি অভ্যস্ত! কঠিন সুরে বলল ব্রুকস, বিরক্তি চেপে রাখার কোন চেষ্টা করল ন!। টিম ম্যাসনের পায়ে ধরে দেখো, ও হয়তো চেয়ারটা তোমাকে দিয়ে দিতে পারে।
আহত দেখাল মাশালকে। ঠিক আছে, তুমি যখন পছন্দ করছ না… শেষ না করে হতাশ ভঙ্গিতে কাঁধ উঁচাল হবস, বোতলটা ধরিয়ে দিল স্টোর মালিকের হাতে, বিড়বিড় করে কি বলল বোঝা গেল না।
ভাল করে শুনে নাও, সিলভার রকে যাচ্ছি আমরা। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকবে ব্র্যাড। জ্যাক, তুমি সামনের দরজা দিয়ে। তোমার একটু পরে ঢুকব আমরা, ঠিক আছে?
সবাই একসঙ্গে ঢুকলে অসুবিধে কি?
আছে। সেটা করলে, আমাদের দেখেই গুলি করতে শুরু করবে ওরা। কাজটা তাতে কঠিন হয়ে যাবে।
ব্র্যাড বেরিয়ে যাওয়ার পর জ্যাক হবসকে অনুসরণ করল ব্রুকস আর প্যাট। রৌদ্রোজ্জ্বল একটা সকাল, ঠাণ্ডা বাতাস জানিয়ে দিচ্ছে শীতের আগাম সংবাদ। সিলভার রক সেলুনের সামনে এসে ঘুরে দাঁড়াল মার্শাল, দৃষ্টি বিনিময় হলো একটু পাশে দাড়িয়ে থাকা ব্রুকসের সাথে। মাথা ঝাকিয়ে দৃঢ় পায়ে এগোল হবস, পোর্চে উঠে গেল। একটু আগের চেয়ে ঢের আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে তাকে।
ব্যাটউইং দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল জ্যাক হবস। সবকটা চোখ ঘুরে গেল তার দিকে। বুকে লাগানো তারাটাই ওদের বেশি আকর্ষণ করছে, টের পেল মার্শাল।
বারের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল স্টিভ কোলম্যান, হাতে হুইস্কির গ্লাস। অবাক হয়ে দেখছে হবসকে। বারের ওপর গ্লাস নামিয়ে রেখে এগিয়ে এল। এটা আবার কোখেকে জোগাড় করলে, জ্যাক? আমুদে গলায় জানতে চাইল। তোমাকে না বলা হয়েছে এ জিনিসটা তোমার শার্টের সাথে ঠিক মানায় না? মায়ায় পড়ে গেছ?
আড়চোখে মন্টানা কিডের দিকে তাকাল মার্শাল। কোণের একটা টেবিলে আয়েশ করে বসেছে, মুখে জ্বলন্ত সিগার। সন্তুষ্টির সাথে লক্ষ্য করল ওদের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে না গানম্যান। ভাবলেশহীন মুখে হাতের তাস দেখল একবার, তারপর মুখ তুলে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাকাল প্রতিদ্বন্দীর দিকে। আরেক বন্দুকবাজ, এল পাসো থেকে এসেছে। লোকটার পরিচয় জানা নেই হবসের। ওদের কাছেই, দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট রোল করছিল চতুর্থ লোকটা, পাশে ব্রঙ গ্যারেটের উপস্থিতি টের পেয়ে থেমে গেছে হাতগুলো!
আরাটা তোমাকে একেবারেই মানাচ্ছে না, জ্যাক, বলে চলেছে কোলম্যান, পাঁচ হ্যত দূরে এসে দাড়িয়েছে। খুলে আমার দিকে ছুঁড়ে দাও তো! নাকি আগেরবারের মত কেড়ে নিতে হবে?
ওখানেই দাঁড়াও, কোলম্যান! নিজের উপস্থিতি জানান দিল ব্র্যাড়। আর এগিয়ো না?
চরকির মত আধ-পাক ঘুরল লোকটা, দুহাতে তুলে আনছে জোড়া পিস্তল। মাঝপথে ফুটো হলো র পেট, গুলির ধাক্কায় থেমে গেল ঘূর্ণন। পিস্তল তুলে নিশানা করার চেষ্টা করল কোলম্যান। ব্র্যাভ এবার ওর কপাল ফুটো করতে হুড়মুড় করে মেঝেয় ধসে পড়ল শরীর, কয়েকটা খিচুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেল।
দাড়িয়ে থাকা লোকটা শালি করতে যাচ্ছিল গ্যারেটকে। নির্দ্বিধায় তার বুকে দুটো বুলেট পাঠিয়ে দিল জ্যাক হবস। দেয়ালে আছড়ে পড়ল বিশাল দেহটা, হেঁচড়ে নেমে গেল। পা ছড়িয়ে বসে পড়ল এরপর, মাথা নোয়ানো। আগেই পিস্তল ছেড়ে দিয়েছে।
ব্রুকস আর প্যাট ইতোমধ্যে এসে পড়েছে।
টেবিল উল্টে ফেলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মন্টানা কিড, কোমরে চলে গেছে হাত। চারটা উদ্যত পিস্তল দেখতে পেয়ে আগুনে পানি পড়ল যেন, নিমেষে হাত সরিয়ে নিল। যথেষ্ট দূরত্বে এনে রাখল।
কাজ সেরে ফেলল, জ্যাক, তাগাদা দিল ব্রুকস। আমরা কাভার করছি।
দুই গানম্যানকে নিরস্ত্র করল মার্শাল।
আমার নামে কোন পোস্টার পাবে না, মনে করিয়ে দিল মন্টানা। এখানে এসেও এমন কিছু করিনি যাতে কোনভাবে আমাকে অভিযুক্ত করতে পারো তোমরা।
তাতে কিছু যায়-আসে না। আপাতত তোমাদের সেলে ভরছি। আমলনামা যদি সত্যি পরিষ্কার থাকে তো ঝামেলাটা শেষ হলে ছাড়া পাবে। নাও, এগোও এবার। কোন চালাকি করতে যেয়ো না।
বাইরে চোখ রাখছিল প্যাট গ্যারেট। ওরা টের পেয়ে গেছে, ঘোষণা করল সে।
একসাথে বেরোব আমরা। সামনে রাখো ওদের।
ব্যাপারটা পছন্দ করতে পারছে না মন্টানা কিড। আগাগোড়া একজন পেশাদার বন্দুকবাজ সে, বুঝতে পারছে পারকারের পরিকল্পনা মাফিক একতরফা ভাবে আর কিছু ঘটবে না এখন। স্যামুয়েল ব্রুকস যে শক্তপাল্লা সেটা খুব ভালভাবে প্রমাণ করেছে। একগাদা লোক লেলিয়ে দিয়েও কাজের কাজ হয়নি কিছু, বহাল তবিয়তে আছে সে। এখন আরও দুজন কঠিন লোক জুটিয়েছে সাথে এবং সম্ভবত বাফেলল টাউনের সাধারণ মানুষ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মার্শাল জ্যাক হবসকে পদচ্যুত না করার পরামর্শ দিয়েছিল সে, ওর কথা কানে তোলনি পারকার। ওর আশঙ্কাই ফলতে যাচ্ছে-পুনর্বহাল হয়েছে হবস, জুলিয়াস পারকারকে জড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করবে এবার। কাজটা কঠিন কিন্তু তিনজন সেরা নোক সাথে থাকায় অসম্ভব হবে না।
সুযোগ আসবেই। ওর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই। সুতরাং আটকে রাখতে পারবে না, খুব বেশি হলে দুটো দিন। টাকা নিয়ে কাজ করেনি, আজতক এমন অপবাদ ওকে দিতে পারেনি কেউ। এবারের কাজটাও সারবে, জুলিয়াস পারকার মরে গেলেও নড়চড় হবে না। আপাতত ধৈর্য ধরতে হবে, কারণ ওরাই আছে চালকের আসনে। যে কোন মুহূর্তে ছকটা পাল্টে যেতে পারে।
টম লোগানকে পাশে নিয়ে এগোচ্ছে কিড। লোকজন কৌতূহলী হয়ে দেখছে। প্যালেসের সামনে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, ভেতরে চার-পাঁচজনের থাকার কথা, ভাবল সে। ওরা বেরিয়ে এলেও কিছু করতে পারবে না বরং মন্টানা আর লোগানই এলোপাতাড়ি গুলির মুখে পড়বে।
ফুটপাথ ধরে এগোচ্ছে গ্যারেটরা, রাস্তার দুপাশে দুভাই। মাঝরাস্তায় দুই আসামীর পেছনে মার্শাল ও ব্রুকস। দুপাশের বাড়িগুলো থেকে কেবল ওদের চারজনকে দেখা যাবে। যে কেউ চাইলে ওদের গুলি করতে পারে, এবং দুপাশ থেকে গ্যারেটরা নিমেষে সক্রিয় হয়ে উঠলে তাকে অবাক হতে হবে। সিলভার রকের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ল-অফিসে যেতে পারত ওরা, তাতে কোন ঝুঁকিও ছিল না। স্যামুয়েল ব্রুকস তা করেনি। দারুণ পরিকল্পনা করেছে লোকটা, ভাবছে মন্টানা, বার-পি রাইডারদের প্রলুব্ধ করতে চাইছে সে এবং চায় বাফেলোর তাবৎ লোকজন যাতে দৃশ্যটা দেখে সাহস পায়। কি করে লড়তে হয় জানে লোকটা, প্রশংসার সাথে নিঃসঙ্কোচে ভাবল কিড, আর এ জন্যেই সারা পশ্চিমের ট্রেইলের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে ওর নাম। শিগগিরই তার সামনাসামনি দাঁড়াবে ও, পুরানো লেন-দেনটা চুকিয়ে ফেলতে হবে।
পারকারের সেলুনের সামনে চলে এসেছে দলটা। হঠাৎ করে ব্যাটউইং দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল দুজন। বোকা, ফাঁদে পড়ে কচুকাটা হয়ে যাবে, করুণার সাথে ভাবল মন্টানা কিড। একটু পর দেখল পোর্চের ওপর লুটিয়ে পড়ল ওরা, একটা গুলি করারও সুযোগ পায়নি।
ল-অফিসের দিকে এগোও, কিড়। তাড়া দিল মার্শাল।
মোড় নিয়ে সেদিকে এগোল দুই গানম্যান। লোগান উসখুস করছে, কিছু একটা করার জন্যে প্রাণ ফেটে যাচ্ছে ওর। চোখের সামনে দুটো লোককে মরতে দেখেও হুঁশ হয়নি। বোকার হদ্দ! বেঁচে থাকলে পরেও সুযোগ পাবে, নিচু স্বরে তাকে ধমকে উঠল মন্টানা। যা বলছে করো। দেখেছ তো পিস্তল হাতেও ওরা পাত্তা পায়নি, আর তুমি তো নিরস্ত্র।
তাই বলে সেলে ঢুকব? দ্বিগুণ তেজে চিৎকার করল সে। পেয়েছেটা কি! চারজনে মিলে সবাইকে হারাতে পারবে না নিশ্চয়ই?
লোগানের মেরুদণ্ড বরাবর পিস্তলের নল হাঁকাল ব্রুকস। তীব্র ব্যথায় ককিয়ে উঠল এল পাসোর বন্দুকবাজ, দাড়িয়ে পড়েছে। কাঁপছে সারা শরীর, মনে হলো হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাবে। শোনো, স্ট্রেঞ্জার, মন্টানা ঠিকই বলেছে। পরেও সুযোগ পাবে, লোগানকে বলল ও, হাসছে। আর যদি চাও তোমাকে একটা পিস্তল দিতে পারি। সাহস থাকে তো ত্রিশ হাত দূরে গিয়ে দাঁড়াও।
ঘৃণাভরে ওকে দেখল টম লোগান, থুথু ফেলল মাটিতে। অত তাড়া দেখছি না, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, কণ্ঠে অবজ্ঞা। আমার ভাইকে খুন করেছ তুমি, ব্রুকস। মনে রেখো তোমাকে খুন না করে শান্তি নেই আমার!
এগোও, নইলে আবার মারব।
চলে এসো, টম, ডাকল মন্টানা।
মাথা ঝাঁকাল সে, আরেকবার থুথু ফেলে এগোল। কিছুক্ষণের মধ্যে টিম ম্যাসনের দেখা পাবে, ভাবছে, ম্যাসন নিশ্চয়ই ল-অফিসে আছে। ওরা ঢুকলে নিজের কাজ দেখাবে।
ভেতরে ঢোকার পর আশাহত হলো টম লোগান।
সেলে ঢোকানো হলো দুই আসামীকে। পেছনের কামরায় চলে এল হবস, ম্যাসনের পাত্তা সেখানেও নেই। এতে অবশ্য ওদের কাজ সহজ হয়ে গেছে। সমানে চলছিল লোগানের মুখ, জ্যাক হবস যখন জানাল এরকম গালাগাল করলে দুপুরের খাবার পাবে না, চুপ মেরে গেল সে। একটা সিগারেট চাইল কেবল।
ফিরে এসে কফির পানি চড়াল মার্শাল। একটু আগে বেরিয়ে গেছে ডেপুটিরা। নিজের আসনে বসে প্রশান্তি অনুভব করল সে, দরজা খোলার শব্দে তাকাল। দুই যুবককে নিয়ে ঢুকেছে উইলিয়াম লকহার্ট। শহরের একমাত্র হোটেলের মালিক ফ্রেডারিক হারপারের ছেলে জোনাথন আর লেসলি হারপার। স্বেচ্ছাসেবক। অস্ত্রে পারদশী না হলেও কাজ চালিয়ে নিতে পারবে।
কটাকে ধরেছ, জ্যাক? চেয়ার টেনে বসল স্টোর মালিক। হারপাররা দুভাই জানালার কাছে সরে গিয়ে নজর রাখার দায়িত্বে থাকল।
মন্টানা আর লোগান।
কোন্ লোগান?
ম্যাট লোগানের ভাই। ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রতিশোধ নিতে এসেছে।
পোস্টার আছে?
না। তবে ওদের কাউকেই ধোয়া তুলসি পাতা মনে হচ্ছে না।
কি করবে? আটকে রাখা মানেই ঝামেলা, আবার ছেড়ে দিলেও বিপদ।
সবকিছু ভালয় ভালয় শেষ হোক। ভাবছি এরমধ্যে খোঁজ নেব। মন্টানার নামে কোন পোস্টার নেই ঠিকই, কিন্তু লিয়ন সিটিতে তার করলে ওর বিরুদ্ধে যথেষ্ট তথ্য পাওয়া যাবে মনে হয়।
তোমার ডেপুটিরা কোথায়?
তিনজনই কিছু না বলে বেরিয়ে গেছে। উঠে চুলোর কাছে গেল মার্শাল, সময় নিয়ে কফি তৈরি করল। পরিকল্পনাটা দারুণ কাজে দিচ্ছে। পারকারের নাগাল পেতে বেশি দেরি নেই আর। অর্ধেক লোক এখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ঘোড়া ছোটাবে।
এত সহজ ভেবো না, কফিতে চুমুক দিল স্টোর মালিক। পারকার হাল ছেড়ে দেয়ার লোক নয়। এ শহরের জন্ম থেকে ওদের ইচ্ছেমাফিক হয়ে এসেছে সব। আজও যেন তার ব্যতিক্রম না হয় সে-চেষ্টাই করবে। আমি ভয় পাচ্ছি অন্য কারণে—আমরা সফল বা ব্যর্থ যাই হই না কেন, ও এটা আজীবন মনে রাখবে এবং সুযোগ পাওয়ামাত্র শোধ তুলবে।
তোমাকে ঠিক মানাচ্ছে না, বিল, খানিকটা বিস্ময় আর পরিহাসের সুরে বলল মার্শাল। পাকা ব্যবসায়ী তুমি, লাভ ছাড়া একটা পা-ও ফেললা না এবং বরাবর ভবিষ্যৎটা আগে থেকে ভেবে নাও। এবার না ভেবেই চাল দিয়ে দিলে।
ভেবেছি, বন্ধু, অমায়িক হাসল লকহার্ট। আমাকে এত বোকা ভেবো না, বুড়ো বয়সে এসে মাথাও খারাপ হয়ে যায়নি। এ ঠেলায় জুলিয়াস পারকারকে পঙ্গু করে দেব আমরা, এরপর যাতে কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
কি করবে তুমি!?
আমি নিজে কিছুই করব না। ঘটনাগুলো দেখো, তাহলে বুঝতে পারবে। লোকটা নিজেই নিজেকে ধ্বংস করবে। ওর শত্রু হচ্ছে ওর অহঙ্কার আর জেদ। ব্রুকসের পেছনে লাগাটাই ওর কাল হয়েছে।
ল-অফিস থেকে বেরিয়ে এসে ফুটপাথে দাঁড়াল স্যামুয়েল ব্রুকস। ফাকা রাস্তার ওপর চোখ বুলাল, নেই কেউ। সিলভারের পোর্চে দেখা যাচ্ছে কয়েকজনকে, অলস সময় পার করছে। যে কোন সময়ে গোলাগুলি শুরু হতে পারে জানে ওরা, রাস্তায় বেরিয়ে তাই ঝুঁকি নেয়ার ইচ্ছে নেই কারও। উল্টোদিকে একটা ক্যাফের ভেতর জানালার কাছে বসে আছে ব্র্যাড গ্যারেট, হাতে সিগার আর সামনে টেবিলের ওপর কফির মগ। ওর সহোদর আছে বিল কারভারের অফিসের বারান্দায়। উত্তরে গির্জা ছাড়িয়ে চলে গেল ব্রুকসের দৃষ্টি, বিশাল সুদৃশ্য বাড়িটার ওপর আটকে রইল, জুলিয়াস পারকারের বাড়ি। বারান্দা বা ছাদে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ওখানেই আছে বাকি লোকগুলো, অন্তত বেশিরভাগ।
প্যালেস-এর ওপর স্থির হলো ওর দৃষ্টি। স্বল্প আলোয় আবছাভাবে চোখে পড়ছে ভেতরটা। কয়েকজন খদ্দের আছে, তাদের কেউ কেউ বার-পির ক্র-ও হতে পারে। সুযোগের অপেক্ষায় আছে হয়তো। কোন একটা ছুতোয় লোকগুলোকে বের করে আনতে হবে, নয়তো ওদেরই উদ্যোগী হয়ে পারকারের সেলুনে অথবা বাড়িতে হানা দিতে হবে। কাজটা সহজ হবে না। টিম ম্যাসনের অনুপস্থিতি ভাবাচ্ছে ওকে, তাকে সেলে পোরা দরকার। ফাঁকতালে কখন কি করে বসে ঠিক নেই।
সন্ধে পর্যন্ত যখন কিছুই ঘটল না পারকারের সেলুনে হানা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল ব্রুকস। রাস্তায় বেরিয়ে এল। আশপাশের বাড়ি আর দোকান থেকে লণ্ঠনের ম্লান আলো এসে পড়েছে পোর্চ ও ফুটপাথে। সেলুনের ভেতরটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, কিন্তু কাচের দেয়ালের এপাশ থেকে ভেতরের সবকিছু ভালভাবে বোঝার উপায় নেই। হিচিং রেইলে মাত্র চারটে ঘোড়া। খদ্দেররা বোধহয় আঁচ করতে পেরেছে ঝামেলা হতে পারে এখানে, তাই এড়িয়ে চলছে বাফেলোর সবচেয়ে জমজমাট সেলুনটি।
রাস্তা পেরোনোর সময় ঠাণ্ডা বাতাস লাগল গায়ে। এবার শীত বোধহয় আগে-ভাগে এসে পড়বে, ভাবল ব্রুকস। বাথানে অনেক কাজ পড়ে আছে, শীত জাঁকিয়ে বসার আগেই ওগুলো শেষ করতে হবে। বেগার খাটুনি যাবে কয়েকটা দিন। তবে সবার আগে এ ঝামেলাটা শেষ করতে হবে।
পোর্চে উঠে এল ও। সেলুনের ভেতরে কোন হৈ-হল্লা নেই। ব্যাটউইং দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। যে কয়েকজন খদ্দের ছিল, অলস আলাপ থামিয়ে দেখল ওকে। ন্যাকড়া দিয়ে একটা বোতল মুছছিল বারটেন্ডার ডাস্টি ফগ, থেমে গেল হাত। চোখে বিস্ময়।
লোকগুলোকে খুঁটিয়ে দেখল ব্রুকস-দুজন লেযি-এস, তিনজন বক্স-বির। নিরীহ পাঞ্চার। বারের পাশে দাঁড়ানো লোকটার ওপর থমকে গেল ওর দৃষ্টি। আয়েশ করে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে, তবে সতর্ক একটা ভাব আছে। রোদপোড়া কঠিন মুখ। সমর্থ, মজবুত শরীর। কাউকে খুঁজছ নাকি, ব্রুকস? শান্ত স্বরে জানতে চাইলেও শীতল ভাবটুকু গোপন থাকল না।
ব্রনসন, স্টিরাপ বা অন্য কেউ, যারা তোমার মতই পারকারের দলে নাম লিখিয়েছে। একটা ফাঁদ! স্পষ্ট অনুভব করছে ব্রুকস।
পুঁচকে ট্রাউটগুলোকে খুঁজছ দেখছি! হাসালে আমাকে, ব্রুকস, হাসির ছিটেফোঁটাও নেই তার মুখে। নাম কিনছ তাহলে? তবে স্বীকার করতেই হবে ওদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে পেরেছ। পারকারের কোলে গিয়ে ঠাই নিয়েছে সবাই। পুরুষ মানুষের মুরোদ কারও নেই। চাপা দম্ভ প্রকাশ পেল তার কণ্ঠে।
বোধহয় একটু বৈশি টেনে ফেলেছ?
দুই ঢোক গিলেছি কেবল। সেই দুপুর থেকে তোমার অপেক্ষায় আছি।
বেরিয়ে গিয়ে ডাকলেই পারতে।
চাইনি ভয় পেয়ে তুমি আবার পালিয়ে যাও।
বারের কাছে এসে দাঁড়াল ব্রুকস, সতর্ক দৃষ্টিতে মাপছে লোকটির প্রতিটি নড়াচড়া-আত্মবিশ্বাসের কমতি নেই, দেহের পাশে শিথিলভাবে পড়ে আছে হাতগুলো; লম্বা আঙুল উরুতে বাধা হোলস্টার থেকে পিস্তলজোড়া যে কোন মুহূর্তে তুলে নিতে পারে। নিঃসন্দেহে কঠিন লোক। স্মৃতি হাতড়েও চিনতে পারল না ও। অবশ্য সব ফাস্টগানকে চেনার আগ্রহ ওর কোন দিনই ছিল না। নিজেকে রক্ষা করার জন্যে পিস্তল ব্যবহার করে ও, নাম কেনার জন্যে নয়। বিশাল এ দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পিস্তলই আইন এবং নিরাপত্তার অবলম্বন। সুতরাং ওটার ব্যবহার যে যত ভাল জানবে সে তত বেশিদিন বাঁচবে। সেজন্যে সবার চেষ্টা থাকে পিস্তলে কি করে দ্রুত ও লক্ষ্যভেদী হওয়া যায়।
ব্রুকস নিশ্চিত এখানে একটা কিন্তু আছে। এত আত্মবিশ্বাসী হলে লোকটা নিজেই ওকে খুঁজে নিতে পারত। পেছনের দরজার ওপর নজর বুলাল, খানিক ফাঁক হয়ে আছে কবাটজোড়া, পেছনে অন্ধকার। হয়তো ওখানে পিস্তল হাতে তৈরি আছে কেউ। পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, ঝুঁকিটা নিতেই হবে। দারুণ পরিকল্পনা করেছে লোকটা। ভেতরে ভেতরে ঘেমে উঠেছে ও। পিস্তলের কালো একটা নল হয়তো ধরা আছে বুক বরাবর, ইচ্ছে করলে দরজার পেছনের লোকটা গুলিও করতে পারে। কিন্তু সেটা বোধহয় এখুনি করবে না, নিরপেক্ষ তোক উপস্থিত আছে এখানে। অস্বস্তিবোধ করলেও আচরণে তা প্রকাশ পেতে দিল না ব্রুকস। দুজনে মিলে সাজানো আয়োজনটাকে একটা ফেয়ার ডুয়েলের রূপ দিতে চাইছে, খ্যাতির স্বপ্নে বিভোর-জন ওয়েসলি হারডিনকে যে লোক ডুয়েলে হারাতে পারবে, এক সপ্তাহে সারা পশ্চিমে বিখ্যাত হয়ে যাবে সে।
তোমার এত নাম-ডাক শুনেছি, অবজ্ঞা লোকটার গলায়, সিগার ধরিয়েছে। কিন্তু এমন কাউকে আমি পাইনি যে সরাসরি ডুয়েল লড়তে দেখেছে তোমাকে, এমন একটা কবরও দেখিনি যার ফলকে হত্যাকারী হিসেবে তোমার নাম লেখা। হয়তো একেক শহরে একেক পরিচয় দাও। কিন্তু আমার ধারণা একটা ফালতু লোক তুমি, স্রেফ ভাগ্যগুণে নাম কিনেছ।
হতে পারে। তোমার মত আরেকজন হয়তো এরকমই বলবে আরেকটা শহরে, অন্য কোন দিন। পেছনের লোকটা কেবল ওকেই দেখতে পাচ্ছে, ভাবছে ব্রুকস, দুজনের ওপর একসঙ্গে চোখ রাখা সম্ভব নয়। সে-চেষ্টাও করবে না। কারণ ডুয়েলের সময় প্রতিটি মুহূর্তই গুরুত্বপূর্ণ, এক লহমায় সবকিছুর কিনারা হয়ে যেতে পারে। অচেনা এ বন্দুকবাজ একটা সঙ্কেত দেবে, খুব সম্ভব নিজে যখন পিস্তলের দিকে হাত বাড়াবে। এবং নিশ্চিতভাবে ওর আগেই ড্র করবে। সঙ্কেত শোনামাত্র গুলি করবে অন্যজন। সিগন্যালটা কি হবে? বোঝা যাচ্ছে না, তবে এটুকু পরিষ্কার, কিছু একটা বলবে সে।
তোমার জন্যে দুঃখ হচ্ছে, ব্রুকস, প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া সিগার মেঝেতে ফেলল সে, বুট দিয়ে মাড়ানোর সময় সিধে হলো। টানটান হয়ে গেছে শরীর, ক্ষিপ্র বেগে পিস্তলগুলো তুলে আনার জন্যে হোলস্টারের কাছে চলে গেছে হাত, এত কাছে যে প্রায় বাট ছুঁয়েছে। মুহূর্তটা উপস্থিত, যে কোন সময়ে ড্র করবে সে। যাকগে, মরার আগে আমার নামটা শুনে নাও, হাসল বন্দুকবাজ, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বেঁকে গেল ঠোঁটের কোণ। নইলে মরেও শান্তি পাবে না যে কার হাতে মারা পড়লে।
গলার স্বরে আকস্মিক পরিবর্তন আর প্রসঙ্গটা বাতলে দিল সবকিছু। নিজের নাম উচ্চারণ করার সাথে সাথে ড্র করবে আগন্তুক। চোখ তুলে তার শীতল চোখের দিকে তাকাল ব্রুকস, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে বন্দুকবাজকে। এবং উল্লসিত। বলে যাও, ধীরে ধীরে বলল ও। কবরের ফলকে নামটা তো লিখে রাখতে হবে, তাই না?
মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল লোকটা, বোধহয় খানিক অস্বস্তি হলো প্রতিপক্ষের দৃঢ়তা লক্ষ করে। লম্বা করে শ্বাস টানতে নাকের পাটা ফুলে উঠল। তুমি রব কোহেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছ, হারডিন! নিচু স্বরে কথাগুলো বলল সে, বিদ্যুৎ বেগে ছোবল মেরেছে হোলস্টারে। চোখের নিমেষে খাপমুক্ত হলো পিস্তলজোড়া, কোমরের কাছ থেকে গুলি করল।
একসাথে দুটো গুলি করেছে ব্রুকস, শব্দ শুনে মনে হলো একটাই। ইঞ্চিখানেক ফাঁক হয়ে ছিল দরজার কবাটদুটো, সেই ফাঁক দিয়ে পাঠাল প্রথম বুলেট। নরম কিছুতে গুলি বেঁধার ভোতা শব্দ হলো প্রথমে, তারপর ক্ষীণ কাতরধ্বনি, সবশেষে দরজার ওপর সশব্দে ভারী কিছু হুমড়ি খেয়ে পড়ার আওয়াজ। কবাটজোড়া লেগে গেল। ঠিক সময়ে গুলি করেছিল লোকটা, কিন্তু সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল ব্রুকস, ডুয়েলের সময় বরাবর যা করে, সেটাই ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। ওর হ্যাট তুলে নিয়ে চলে গেছে বুলেট। এর পরপরই ঝাপ দিয়েছে পাশে, মাঝপথে গুলি করল রব কোহেনকে, দুটো পিস্তল থেকে একসঙ্গে। বারের ওপর ছিটকে পড়ল সে, শেষ চেষ্টায় ট্রিগার টিপেছিল, ছাদ ফুটো করল কেবল।
শুয়ে থেকে শেষ বুলেটটা পাঠাল ব্রুকস, রব কোহেনের কপালে টিপ পরিয়ে দিল। ধীরে উঠে দাঁড়াল, দেখছে কোহেনকে। চরম বিস্ময় লেগে আছে বন্দুকবাজের চোখে। মেঝেতে পড়ার সময় ঘাড় থেকে শরীরের নিচের অংশ বিশ্রীভাবে বেঁকে গেছে। মৃত্যুটা এমনিতেই হত, শেষ গুলিটা অযথা খরচ হলো। বন্ধ দরজার দিকে তাকাল ও, যদিও ওদিক থেকে বিপদের আশঙ্কা নেই। জলদি দরজাটা খোললা, ডাস্টি! শীতল কণ্ঠে আদেশ করল বারকিপকে।
ছুটল ডাস্টি ফগ। দরজা ঠেলে দিতে গড়িয়ে পড়ল শরীরটা। আবছা আলোয় লোকটাকে দেখল ব্রুকস, অচেনা। রব কোহেনের কোন দোস্ত বা স্যাঙাৎ হবে বোধহয়।
পিস্তলে টোটা ভরার সময় বারকিপারের দিকে ফিরল ও। আর একটা মুহূর্তও নয়, ডাস্টি! এখুনি বাফেলল টাউন ছাড়ছ তুমি।
আমার দোষ কি, মি. ব্রুকস?
পিস্তলের নল চালাল ও। আর্তনাদ করে দুহাতে নাক চেপে ধরল ডাস্টি, রক্ত ঝরতে শুরু করেছে। জঘন্য একটা লোক তুমি! পরকারের কোন চামচা এ শহরে থাকতে পারবে না।
আমার পরিবার, ওরা… সন্ত্রস্ত গলায় বলার চেষ্টা করল বারকিপ, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল ব্রুকস।
দেরি করলে ওদের দেখা কোনদিনই পাবে না।
যাচ্ছি, মি. ব্রুকস, যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে বলল সে। নাক থেকে সরিয়ে চোখের সামনে তুলে দেখল রক্তাক্ত হাত। বারের ওপাশে গিয়ে গায়ের অ্যাপ্রন খুলে নাকমুখের রক্ত মুছল।
আমাকে একটা ড্রিঙ্ক দাও। হোলস্টারে পিস্তল ভরে একটা টুলে বসল ব্রুকস।
শিওর, মি. ব্রুকস, দ্রুত হাত চালাল ডাস্টি, গ্লাসে হুইস্কি ঢালার সময় বারের ওপর ছলকে পড়ল খানিকটা। কাঁপা হাতে বাড়িয়ে দিল গ্লাস।
সেলুনে ঢুকল ব্র্যাড গ্যারেট, হাতে ভোলা পিস্তল। ভেতরের পরিস্থিতির ওপর নজর বুলিয়ে হোলস্টারে অস্ত্র ফেরত পাঠাল। এগিয়ে এসে পাশে বসল টেক্সান। ওহে, ফগের বাচ্চা, আমাকেও এক গেলাস দাও। হবসের ছাইপাঁশ খেয়ে কি আর তেষ্টা মেটে? ব্রুকসের দিকে ফিরল এবার। সাজানো একটা নাটকের গন্ধ পাচ্ছি যেন? তুমি বাপু সবটা একাই মেরে দিলে!
একা থাকায়ই ভাল হয়েছে, হুইস্কিতে চুমুক দিল ব্রুকস, তোমরা সাথে থাকলে ঢোকার পরপরই গুলি করত ওরা। অনুভব করছে তরল আগুন ওর উত্তেজিত স্নায়ুগুলোকে বশে আনছে। ডাস্টি ফগের দিকে তাকাল, হতাশায় স্নান দেখাচ্ছে বারকিপকে। তার প্রতি আচরণটা রূঢ় হয়ে গেছে, ভাবল ও। এমন একটা মুহূর্ত এইমাত্র পেরিয়ে এসেছে যা ওকে আগ্রাসী হতে বাধ্য করেছিল। সাজানো নাটকের অসহায় শিকার ছিল ও, পিছিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না, বাধ্য হয়ে ওদের খেলায় যোগ দিতে হয়েছে। ব্যর্থতার আশঙ্কা ছিল এবং তা পেরিয়ে এসেও ওর উৎকণ্ঠা কাটেনি। হুট করে এখানে ঢোকার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে বিরক্তিবোধ করছিল। সব মিলিয়ে নিজের ওপর ওর নিয়ন্ত্রণ ছিল কমই। ডাস্টি ফগ হয়তো এ ষড়যন্ত্রের সহযোগী নয়, সেরকম হলে সত্যি বড় রকমের ভুল করে ফেলেছে।
বড্ড ঝুঁকি নিয়েছিলে। মৃদু স্বরে মন্তব্য করল ব্র্যাড।
উপায় নেই, ওরা দলে,ভারী, সংখ্যাটা কমাতে হলে কিছু ঝুঁকি তো নিতেই হবে। ভাবছি পারকার কবে টলি-তলোয়ারবিহীন হবে।
খুব শিগগির। ব্যাটার আবার ধৈর্য কম। এখনও আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আছে ওরা। হবসের মেহমানখানায় আরও কয়েকটাকে ঢোকাতে পারলে অবশ্য মন্দ হত না, কয়েকজন তো সটকে পড়তই।
আমি সেরকম ভাবছি না।
বুঝলে, স্যাম, তারাটা আমার কাছে ভালই লাগছে, বুকের ব্যাজের দিকে ইঙ্গিত করল ব্র্যাড। একেবারে মন্দ নয়। ভাবছি যদ্দিন পারি ডেপুটি থেকে যাব কি-না। তোমার বাথানে গাধার খাটুনির চেয়ে ডেপুটির কাজটা অনেক আরামের, তাই না?
তা ঠিক, তবে সমস্যাও আছে। প্রায়ই বেয়াড়া কিছু বুলেটকে সামাল দিতে হবে। তাছাড়া বাফেলোর লোকজন যখন জানবে তোমরা টেনেসীর দুই বিখ্যাত যমজ ভদ্রলোক, তখন খেপে গিয়ে তোমাদের টিকির সন্ধান করতে পারে।
তুমি দেখছি দারুণ অকৃতজ্ঞ! শূন্য গ্লাস বারের ওপর নামিয়ে রাখল গ্যারেট, কৃত্রিম সন্দেহের চোখে তাকাল ওর দিকে। তোমার উদ্দেশ্য ভাল মনে হচ্ছে না, স্যাম। বেতন না দেয়ার মতলব করছ না তো? শেষে হয়তো আমাদের ধরিয়ে দেবে, আর বেঁচে যাওয়া টাকায় বিয়ের জন্যে একটা দামী কোট বানাবে।
ভাল বুদ্ধি বাতলেছ, ধন্যবাদ! হেসে উঠল ব্রুকস, পকেট থেকে রূপোর ঈগল বের করে বারের ওপর রাখল, কিন্তু ডাস্টি তা না নিতে অবাক হলো। কি ব্যাপার, খাতির করছ যে?
মি. ব্রুকস, ওরা আমাকে বাধ্য করেছিল। আমি চাইনি এরকম সাজানো একটা ডুয়েল হোক। বিশ্বাস না হলে ওদের জিজ্ঞেস করে দেখো। বক্স-বি পাঞ্চারদের দেখাল সে, করুণ মুখে আবেদন ঝরে পড়ছে।
বারকিপকে দেখল ব্রুকস, ভয়ে কেঁচো হয়ে গেছে লোকটা। মিথ্যে বলছে না বোধহয়।
পরিবার নিয়ে বিপদে পড়ে যাব আমি। দয়া করে তোমার আদেশটা যদি তুলে নিতে…সেলুনটাতে আমার শেয়ার আছে, এখন চলে গেলে পারকার আমাকে একটা পয়সাও দেবে না। তাছাড়া আমার বউয়ের বাচ্চা হবে। এসময় যাত্রার ধকলটা…
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল ব্রুকস। ঠিক আছে, ডাস্টি। কিন্তু মনে রেখো এটাই তোমার শেষ সুযোগ। আর…আমারও ভুল হয়েছে, মাথার ঠিক ছিল না, দুঃখিত। এখন ডাক্তারের কাছে যাও। উক্ হেনরিকে বলল ওর বিল আমিই দেব।
খুশিতে উজ্জ্বল দেখাল লোকটার মুখ যদিও তা রক্তাক্ত। ইতোমধ্যে নীল হয়ে গেছে নাকের গোড়া। ধন্যবাদ, মি. ব্রুকস! অস্ফুট স্বরে বলল বারকিপার, দৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা।
তুমি তো দেখছি দারুণ লোক হে! সকৌতুকে মন্তব্য করল ব্র্যাড। বেয়াড়া লোকগুলোকে পিস্তল ছাড়াই কাৎ করে ফেলতে পারো। কসম, এরকম আর দেখিনি, শুনিওনি! মার খেয়েও কেউ ভুলে যায় তা এই প্রথম দেখলাম!
ল-অফিসে রাত কাটিয়েছে ওরা। আশঙ্কা করেছিল পারকারের লোকেরা হয়তো মন্টানা কিড আর টম লোগানকে বের করে নিয়ে যেতে চাইবে। তাই রাত জেগে পাহারা দিয়েছে। তেমন কিছু অবশ্য ঘটেনি।
শেষ পালা ছিল ব্রুকসের। কাজ না থাকলে যা হয়, নানান চিন্তায় সময়টা কাটিয়েছে ও। গত কয়েকদিনের ঘটনাগুলো ভেবেছে, ওর জন্যে মিশ্র অনুভূতির-টান টান উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা আর হাড়ভাঙা খাটুনির পর ফ্ল্যাগানদের বাথানে কেটেছে জীবনের সেরা কয়েকটা দিন।
আগাগোড়া একজন নিঃসঙ্গ মানুষ সে, ওর ফেলে আসা জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে ট্রেইলে। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে দিনের পর দিন কারও সাথে একটা কথা বলারও সুযোগ হত না। এখানে, মরগান পিক্সের কোলে যখন বসতি করেছে তখনও তাই ঘটেছে। হাঁপিয়ে উঠলে ইচ্ছে করত শহরে ছুটে যায়, কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসে কোন সেলুনে। পরে যখন সাপ্লাই আনতে যেত, লকহার্টের সাথে মামুলি কথা, যা-ও বা দুএকটা হত উপভোগ করত সেগুলো। এখানকার প্রতিটি মুহূর্ত ওকে মনে করিয়ে দিত একজন সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা-একজন মেয়েমানুষ, একটা সংসার।
লরিয়া ফ্ল্যাগান ওকে আগাগোড়া টেনে রেখেছিল। এ মেয়েটিকে না দেখলে এতকিছু ঘটত না। হঠাৎ করে এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিত না, কোন জমি না পেয়েও মরগান পিসের উষর ওই জায়গাটাকে তৃণভূমিতে পরিণত করার সাহস করত না। সবই ঘটছে এই মেয়েটির জন্যে। ভাবলে নিজেকে বোকা মনে হয়, ছেলেমানুষের মত হয়ে গিয়েছিল ওর আচরণগুলো-বৈরী এ জায়গাটাকে বাসযোগ্য করতে সারা জীবনের সঞ্চয় ব্যয় করেছে, অমানুষিক শ্রম দিয়েছে কেবল অনিশ্চিত বিশ্বাসের ওপর যে শেষ পর্যন্ত একে পছন্দ করবে লরিয়া ফ্লাগান। জন ওয়েসলি হারডিনের পরিচয় ওর কাম্য ছিল না, আবার স্যামুয়েল ব্রকস হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার উচ্চকাভক্ষাও ছিল। কাজটা শেষ করার তাড় ছিল, কিন্তু লরির সাথে যেচে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছে কখনও হয়নি দারুণ বোকামি, মেয়েটা যদি অন্য কাউকে পছন্দ করে ফেলত? ওর ইচ্ছে পূরণ হওয়ার কোন নিশ্চয়তাই ছিল না কাজটা পরোক্ষভাবে করে দিয়েছে পারকাররা। ওরাই ব্রুকস আর লরিয়াকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছে।
না, কোন ভুল করেনি সে, সন্তুষ্টচিত্তে উপসংহার টেনেছে ব্রুকস। এখানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হঠকারিতা, তাতে কোন সন্দেহ নেই, বছরকে বছর ধরে কোথাও থেকে নিজের বসতি গড়ার ইচ্ছেও ওর স্বভাববিরুদ্ধ ছিল ঠিকই, কিন্তু সবই স্থবির একটা ভবিষ্যতের জন্যে। লরিয়া এমন এক মেয়ে যার জন্যে সবকিছু করা যায়। তাই সব হঠকারি সিদ্ধান্ত, পরিশ্রম…সবই ওর জন্যে আত্মপ্রসাদের।
আকাশ পরিষ্কার হতে চেয়ার ছাড়ল ব্রুকস, জানালার কাছে এসে ফাঁকা রাস্তা আর বাড়িগুলোর ওপর নজর বুলাল। দরজা খুলে পার্কে বেরিয়ে এল। খুটিয়ে দেখল জুলিয়াস পারকারের বাড়িটা। নাহ, কোন সাড়া নেই। ফিরে এসে কেতলি চাপাল, গ্যারেটদের জাগাল এরপর। ফাকা দুটো সেলে রাত কাটিয়েছে ওরা।
হবসকে জাগাও, ব্র্যাড। দুবার ডেকেছি। মনে হচ্ছে জাগাতে হলে গুলি ফোটাতে হবে। মগে চিনি ঢালার সময় বলল ও। মার্শালের টেবিলে পড়ে ছিল ওয়ান্টেড পোস্টারগুলো, কফিতে চুমুক দেয়ার সময় তুলে নিয়ে দেখতে শুরু করল। ছবিতে টম স্টিরাপকে চেনা মুশকিল, বেশ কয়েক বছর আগের পোস্টার। কালি ব্রনসন, রব কোহেন আর ওর স্যাঙাতের নামেও হুলিয়া রয়েছে। টেক্সানরাও বাদ যায়নি।
আমাদের ধরিয়ে দেবে নাকি? সামনে বসে পোস্টারগুলো টেনে নিল ব্র্যাড।
মাত্র দুশো ডলার। পোষাবে না।
দুশো ডলার, ফুঃ! শুনতে আমার নিজেরই জঘন্য লাগছে। অথচ কোলম্যানের জন্যে চারশো।
ওর শিষ্য হলে ভাল করতে, কিংবা স্টিরাপের, হেসে মগে কফি ঢালল ব্রুকস। এতে একটা জিনিস পরিষ্কার, আউট-ল হিসেবে তোমরা যাচ্ছেতাই ধরনের। স্টিরাপ বা ব্রনসনের ধারে-কাছেও নয়।
খুব বিপদে না পড়লে তেমন কিছু করি না আমরা, কফির মগ নিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল প্যাট গ্যারেট। সনোরায় যা ঘটেছিল ওটা রঙ চড়ানো। শেরিফ ব্যাটা শুধু শুধুই ফাঁসিয়েছে আমাদের। না হয় ওর পকেট থেকে ত্রিশ ডলার নিয়েইছি, সেজন্যে হুলিয়া? একে তো পকেট খালি ছিল তারওপর মাতাল হওয়ায় সেলে ঢুকিয়ে খেতে দেয়নি। খিদে চাগিয়ে উঠলে কি মাথার ঠিক থাকে? ব্যস, বেরিয়ে এসে দুঘা লাগিয়ে ব্যাটার পকেট খালি করে কেটে পড়লাম।
পোস্টারে কিন্তু লেখা তাকে খুন করেছ তোমরা।
আমরা চলে আসার পরের দিন খুন হয় সে। ওর ডেপুটিই ফাঁসিয়েছে আমাদের।
ধরা না দিয়ে কিন্তু তা-ই প্রতিষ্ঠিত করে ফেলছ।
ওসবে পাত্তা দিলে চলে না, তাচ্ছিল্যের সাথে হাত নাড়ল ব্র্যাড। আমরা নিজেরাই পোস্টারটার কথা ভুলতে বসেছি, আর লোকজন তো দুএক বছর পর
এমনিতেই ভুলে যাবে। তাছাড়া ধরতে পারলে তো!
সব শেরিফ বা মার্শাল কিন্তু হবসের মত নয়।
তা হয়তো ঠিক। কিন্তু যে লোক আমাদের ধরতে আসবে, সে এটাও ভাববে তাকে দুজনের মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের ব্যাপারে রেঞ্জারদের আগ্রহ কম হওয়ার রহস্য বোধহয় এখানেই। তাছাড়া ঝুকির তুলনায় রিওয়ার্ডের টাকা খুব কম।
বোঝা যাচ্ছে যমজ রেঞ্জার ছাড়া তোমাদের সাথে সুবিধা করতে পারবে না কেউ।
বেড়ে বলেছ, স্যাম! টেবিল চাপড়ে বলল ব্র্যাড়। তোমার জানামতে এমন কেউ পয়দা হয়েছে নাকি?
কি সব ফালতু আলাপ করছ! বিরক্তি মাখানো কণ্ঠ মার্শালের, চোখে-মুখে ঘুমের রেশ লেগে আছে এখনও, ভেতরের কামরার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দেবে না? এত জলদি জেগে কি হবে?
ভাবছিলাম দল বেঁধে সিলভারে যাব, সহাস্যে বলল ব্র্যাড। তোমাকে না জানালে তো শেষে দুষবে।
নরকে যাও, ছোকরা! কয়েকবারের চেষ্টায় কোমরের বেল্ট আটকাল সে, এগিয়ে এসে কফির মগ তুলে নিল। নিজের চেয়ারে ছেড়ে দিল ভারী শরীর। হুইস্কি ছাড়া হতচ্ছাড়া এ শহরে আছে কি!
স্বেচ্ছাসেবক হারশারদের সকালে আসার কথা। লকহার্ট জানিয়েছে আরও দুজনকে পাঠাবে। সব মিলিয়ে আটজন…মন্দ নয়, ভাবছে ব্রুকস। বার-পি ক্রুদের হয়তো ঠেকিয়ে দেয়া যাবে। আজকের দিনটা সবার জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটা সকাল দেখার সৌভাগ্য থেকে কে বঞ্চিত হবে সেটা আগে থেকে কেউ বলতে পারবে না।
পেছনের দরজার খিড়কি খুলে রেখো, জ্যাক, রাইফেল হাতে উঠে দাঁড়াল ব্রুকস।
কোথায় যাচ্ছ?
লকহার্টের সাথে কিছু পরামর্শ করা দরকার। তাছাড়া, ভাবছি কয়েদীদের দেখে আসব। কেভিনের ওপর নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। টেক্সানদের দেখল ও, নিরুদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, অথচ জানে খুব শিগগির ভয়ঙ্কর কিছু লোকের মুখোমুখি হতে হবে।
বেরিয়ে এসে পোর্চে দাঁড়াল ও, খুঁটিয়ে দেখল ছোট্ট শহরটাকে। দক্ষিণে গির্জার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে এক ভবঘুরে। কামারের দোকান থেকে হাতুড়ির সাথে ধাতব কোন বস্তুর সংঘর্ষের শব্দ ভেসে আসছে। নাপিত সাইরাস ওর দোকানের ঝাপ তুলে ঝাড় দিচ্ছে। ধোয়া উঠছে মিসেস রিচার্ডসের রেস্তোরাঁর চিমনি দিয়ে। জুলিয়াস পারকারের বাড়িটা তেমনি আছে, কোন সাড়া নেই। বোঝার উপায় নেই ভেতরে কোন লোক আছে কি-না, কিন্তু ব্রুকস নিশ্চিত জানে অন্তত আধডজন লোক ওখানে রাত কাটিয়েছে।
টিম ম্যাসনের আচরণ অবাক করেছে ওকে। ডেপুটির সাধের অফিস বেহাত হয়ে যাওয়ার পর পুরো একটা দিন পেরিয়ে গেছে অথচ কোন পাত্তা নেই তার। ম্যাসন যেরকম অস্থিরমতির ওর জন্যে ব্যাপারটা একেবারে অস্বাভাবিক। খুব সম্ভব পারকারের সাথে বসে ঘোট পাকাচ্ছে।
উইলিয়াম লকহার্টের স্টোরের ওপর চোখ পড়তে ধারণাটা মাথায় এল। ষাট গজ দূরত্ব, একটা রাইফেলের জন্যে কোন ব্যাপারই নয়। প্যাট, একটু বাইরে আসবে? টেক্সানকে ডাকল, সে পোর্চে বেরিয়ে আসতে ব্যাখ্যা করল পরিকল্পনাটা।
মন্দ নয়, সিগারে টান মেরে মন্তব্য করল প্যাট। বাড়তি সুবিধে পাওয়া যাবে। হারপারদের নিয়ে তুমি বরং ওখানেই চলে যাও। আমরা এদিকটা সামলাতে পারব।
বেগতিক দেখলে প্রথম সুযোগে কেটে পড়ো।
মাথা ঝাঁকাল টেক্সান। পেটে ছুঁচো, নাচছে। মিসেস রিচার্ডসকে কি বলবে নাস্তাটা একটু তাড়াতাড়ি পাঠাতে?
পোর্চ থেকে নেমে সাইডওঅক ধরে এগোল ব্রুকস। রেস্তোরাঁয় ঢুকল প্রথমে, প্যাটের তাড়ার কথা মহিলাকে জানিয়ে বেরিয়ে এসে সিলভারে গেল। কেভিনকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না, ওর কর্মচারী বার পরিষ্কার করছে। পেছনে এসে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে এল। ডানে প্রথম কামরার সামনে একটা টুলে বসে দুলছে কেভিন লকহার্ট, কোলের ওপর একটা শটগান। কাছে যেতে চমকে চোখ মেলল সে ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল। কি-কিছু ঘটেছে, মি. ব্রুকস? এইমাত্র চোখ লেগে এসেছিল। দ্রুত আমতা আমতা করে কৈফিয়ত দিল।
দরজার পাল্লা দুটো টেনে ফাঁক গলে ভেতরে তাকাল ও, বাঙ্কের ওপর ঘুমাচ্ছে দুই আসামী। জুলিয়াস পারকার এদেরকে বের করে নিতে পারে ভেবে গতকাল সন্ধেয় সবার অগোচরে এখানে নিয়ে এসেছে। ফালতু কিছু ঝামেলা বেচেছে এতে। খুশি হয়ে দায়িত্ব নিয়েছিল কেভিন, হয়তো বিনে পয়সায় খাওয়া হুইস্কির পাওনা তুলে নেওয়ার খায়েশ হয়েছে ওর।
দরজাটা ভাল করে দেখল ব্রুকস। সরু কড়াতে লাগানো তালা সন্তুষ্ট করতে পারছে না ওকে। মরিয়া হয়ে ওঠা দুজন শক্তিশালী লোকের কাছে খোদ দরজাই কোন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কবাট টেনে দিয়ে ওপরের শিকল তুলে দিল ও, কেভিনের দিকে ফিরল। দায়িত্বটা তুমি স্বেচ্ছায় নিয়েছ, সবকিছু তোমাকেই সামলাতে হবে, কেভ। দরজাটা দেখে আমি মোটেও ভরসা পাচ্ছি না। উল্টোদিকে দূরে গিয়ে বসো, শটগান তাক করে রাখবে। বেচাল দেখলেই গুলি করবে। তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে আসবে না কেউ। ওরা খুব ভয়ঙ্কর লোক, দরকার মনে করলে কাউকে ডেকে নাও।
আমি পারব।
শ্রাগ করে ফিরতি পথ ধরল ও। মনের খুঁতখুঁতে ভাব যাচ্ছে না। জেনারেল স্টোরে চলে এল। ইতোমধ্যে সবকিছু গুছিয়ে প্রথম খদ্দেরের অপেক্ষায় আছে লকহার্ট টাকার বাক্সের পেছনে রাইফেলের নল উঁকি দিচ্ছে
ঠিক আছে সব? জানতে চাইল স্টোর মালিক।
পোর্চে কয়েকটা ময়দার বস্তা এনে ফেলল, নড় করে বলল ও। হারপাররা এলে এখানেই পজিশন নিতে বোলো।
পরকারের বাড়িটা ঘেরাও করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়, বাপ বাপ করে বেরিয়ে আসবে সবকটা।
যতটা সহজ ভাবছ তা কিন্তু নয়। সবাই সেখানে না-ও থাকতে পারে। মার্শালের পক্ষে হলেও আমরা তা করতে পারি না, বেআইনী হবে। তাছাড়া বাড়িটা এমন যে কয়েকদিন অবরোধ করে রাখলেও সুবিধা করতে পারব না। তারচেয়ে ওরাই বেরিয়ে আসুক। একটু ঝুঁকি আছে কিন্তু এটাই সহজ হবে।
শহরের আরও কয়েকজনের সাথে আলাপ হয়েছে আমার। পারকার যদি মন্টানা আর লোগানকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তো রুখে দাঁড়াবে ওরা। সব মিলিয়ে চার-পাঁচজন হবে, তবে নিরীহ লোক।
কয়েদীরা কোথায় আছে ভুলেও কাউকে জানিয়ো না।
মাথা ঝাঁকাল লকহার্ট।
দরজার কাছে এসে বসো। উত্তরে শহরে ঢোকার মুখে নজর রাখবে। বারপি রাইডাররা ওদিক থেকে এলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ওদের দেখতে পেলে তিনবার ফাঁকা গুলি কোরো।
স্টোর থেকে বেরিয়ে এসে মিসেস রিচার্ডসের রেস্তোরাঁয় কোণের একটা টেবিল দখল করল ব্রুকস। ল-অফিস আর পারকারের বাড়ির সম্মুখটা চোখে পড়ছে। সেদ্ধ মটরশুটি, ডিম আর স্টু দিয়ে নাস্তা সেরে নিল।
তুমি চলে যাওয়ার পরপরই নাস্তা পাঠিয়ে দিয়েছি, মি. ব্রুকস। কফি পরিবেশন করার সময় বলল মহিলা।
ধন্যবাদ, ম্যাম। হিসেব রেখো, শহর কমিটি তোমার পাওনা মিটিয়ে দেবে। আর আমাকে মিস্টার বলার দরকার নেই, বন্ধুদের জন্যে শুধু স্যাম নামটাই আমার পছন্দ।
নড করল মিসেস রিচার্ডস, স্মিত হাসল। লরিয়া তোমার খোঁজ করেছিল।
কখন? কফিতে চুমুক দিতে গিয়ে থমকে গেল ব্রুকস।
ফ্ল্যাগানসহ রাতে শহরে এসেছে। সাপার করার সময় তোমার কথা জানতে চেয়েছিল, বলেছিল ল-অফিসে গেলে পাওয়া যাবে তোমাকে। তুমি রাগ করতে পারো ভেবে দেখা করতে যায়নি।
কোথায় ও, তোমার এখানে উঠেছে?
মাথা ঝাঁকাল মহিলা। ফ্ল্যাগান অবশ্য হোটেলে উঠেছে।
ধন্যবাদ, ম্যাম। আমাকে জানিয়ে ভাল করেছ।
ওর সাথে দেখা করবে?
চুপ করে থাকল ও, সিগারেট ধরাল। খুচরো পয়সা বের করে বিল মেটাল। তারপর এগোল দরজার দিকে। ওকে বোলো আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত যেন এখানেই থাকে। রাস্তায় বের না হওয়াই বোধহয় ভাল হবে। ঝামেলা হতে পারে।
স্যাম?
দরজার কাছে পৌঁছে গেছে ও, ঘুরে তাকাল। খানিকটা বিরক্ত।
মেয়েটা উদ্বেগের মধ্যে আছে, তোমাকে নিয়ে চিন্তিত ও। দুবার ক্যাফেতে, এসেও দেখা না করে চলে গেলে ওর আত্মসম্মানে লাগবে। ভাববে তোমার কাছে ওর গুরুত্ব কম। শুরুতে এ ভুলটা ইচ্ছে করলেই এড়িয়ে যেতে পারো তুমি, ও-ও খুশি হবে।
লরিয়া নিজে এসব বলেছে?
না। এগুলো আমার নিজস্ব ভাবনা।
ধন্যবাদ, ম্যাম। আমি এভাবে ভেবে দেখিনি।
এঁটো থালাবাসন নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোল মিসেস রিচার্ডস। দোতলায়, বামে প্রথম কামরায় পাবে ওকে, সহাস্যে জানাল মহিলা। সিঁড়িতে তোমার জুতোর শব্দ শোনার জন্যে হয়তো এতক্ষণে অধীর হয়ে গেছে বেচারি।
দোতলায় এসে দরজায় নক করল ও।
সরে যাওয়া পাল্লার মাঝখানে এসে দাড়াল লরিয়া ফ্ল্যাগান। দ্রুত চোখ বুলাল ব্রুকসের সারা শরীরে, তারপর খুশিতে উজ্জ্বল হলো ওর সবুজ চোখজোড়া। ব্রুকস কাছে টেনে নিল ওকে, উপলব্ধি করল মিসেস রিচার্ডসের পরামর্শ না শুনলে সত্যি ভুল করত। খানিকটা নির্ভরতা একজোড়া নারী-পুরুষের পারস্পরিক বিশ্বাস অনেক দৃঢ় করতে পারে।
একদণ্ড শান্তিতে থাকতে পারছি না, অভিযোগ করল লরিয়া। ঝামেলা দেখছি তোমার পিছু ছাড়ছে না। ওই তারাটা বুকে লাগানোর কি দরকার ছিল?
মরগান পিকসের বসতিতে বাকি জীবনটা আমি শান্তিতে কাটাতে চাই, এই শহরে নিশ্চিন্তে আসবে-যাবে আমার বাচ্চারা, প্রয়োজন এটাই। জুলিয়াস পারকারকে হটাতে না পারলে বেসিনে কখনও শান্তি আসবে না। কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে। গ্যারেটদের দেখো, কি জন্যে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে লোকগুলো? এখানে থাকে না ওরা, থাকবেও না, আবার কখনও আসে কি-না তারও ঠিক নেই অথচ বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিনিময়ে কি পাবে ওরা? অন্য দশজনকে শান্তিতে রাখার জন্যে দুর্ধর্ষ লোকগুলোর চেষ্টা, আরেকটা কারণ-লড়াইটা ওরা উপভোগ করছে। সত্যিকার পুরুষ মানুষের মত যেমন মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে চায় তেমনি মরতেও চায় সাহস, প্রত্যয় আর সম্মানের সাথে। একজন জুলিয়াস পারকারকে ওরা ভয় পায় না, আমলও দেয় না।
দুঃখিত, স্যাম। দুশ্চিন্তা কাটছে না। ওদের জন্যে কেউ অপেক্ষা করছে কিজানি না, কিন্তু আমি তোমার জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করছি।
সবকিছু হয়তো আজকেই চুকে যাবে।
ব্রুকসের গলা ধরে থাকল লরিয়া, চোখ তুলে কঠিন মুখটা দেখল। সাবধানে থেকো, প্লীজ, স্যাম! ফেরার সময় আমাকে নিয়ে যাবে তুমি।
নাস্তা করেছ?
না।
চলো নিচে যাই।
না, তোমার দেরি হচ্ছে। বাবা এলে নাস্তা করব।
মাথা ঝাঁকাল ব্রুকস। ভুলেও বেরোবে না, আমি তাহলে নিশ্চিন্ত থাকতে পারব।
বাধ্য মেয়ের মত মাথা ঝাঁকাল লরিয়া, সরে গিয়ে মৃদু হাসল। তারপর ফের ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। আমার ভয় হচ্ছে, এত উদ্বেগ ভাল লাগছে না, স্যাম। আমি তোমাকে হারাতে চাই না, অনেক উৎকণ্ঠার পর পেয়েছি… শেষ করল না লরিয়া, থামিয়ে দিয়েছে ব্রুকস।
একদিন তোমাকে বলেছিলাম, সাহস ছাড়াও কিছু স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে মানুষ, মনে আছে? এত ধকল গেল, এত বিপদ পার হয়ে এতটুকু আসতে পেরেছি কেবল এই কারণেই। জুলিয়াস পারকারকে দেখো, জেদ আর প্রতিহিংসা আছে ওর, কোন স্বপ্ন নেই। ওর লোকদেরও নেই। কিন্তু আমার আছে। তাই যেভাবে হোক সবকিছু উতরে যাব আমরা।
এটা কোন যুক্তি হলো? হেসে ফেলল লরিয়া।
যুক্তি নয় ঠিকই, কিন্তু বিশ্বাস তো! যা নিয়ে অসাধ্য সাধন করার প্রেরণা পায় মানুষ।
অত কিছু বুঝি না। তুমি মরতে পারবে না, জন স্যামুয়েল ব্রুকস! এই হচ্ছে আমার সাফ কথা। মিসেস লকহার্টকে গাউন আর আঙটির ফরমাশ দিয়েছ, রোববারে ওগুলো পরতে চাই আমি। গাঢ় স্বরে বলল লরিয়া, সবুজ চোখে বিপুল প্রত্যাশা ফুটে উঠল।
মাথা ঝাঁকাল ব্রুকস, ধীরে ছেড়ে দিল লরিয়াকে।
রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে ফিরতি পথে ল-অফিসের দিকে এগোল। স্টোর পেরোনোর সময় দেখল পোর্চে একটা টুলের ওপর বসে আছে লকহার্ট, কোলে রাইফেল, দৃষ্টি উত্তরে শহরের প্রবেশপথে।
পারকারের বাড়ির ওপর চোখ পড়তে দেখল বেরিয়ে আসছে ক্রুরা। রাস্তার ওপর সার বেঁধে দাড়াল। সবশেষে সাদা একটা সোরেলে চেপে বেরোল জুলিয়াস পারকার নিজে। দলটার সামনে এসে চড়া গলায় কথা বলল কিছুক্ষণ, তারপর ল অফিসের দিকে এগোতে শুরু করল।
ফিরে এলে যে? পোর্চে উঠে আসতে জানতে চাইল প্যাট।
লকহার্ট ওদিকটা সামলাবে। মনে হলো যা কিছু সব এদিকেই ঘটবে। নিজেদের পজিশন একবার যাচাই করল ব্রুকস-ল-অফিসে ওরা চারজন, লকহার্টের স্টোরের পোর্চে সে নিজে আর হারপাররা দুভাই, নাপিতের দোকানের ছাদে অবস্থান নিয়েছে আরও তিনজন…মন্দ নয়। পারকার সহজে ছাড় পাবে না।
পিশাচটা দেখছি নিজেই নেতৃত্ব দিচ্ছে, জানালার পাশ থেকে সুকৌতুকে। বলল ব্র্যাড গ্যারেট। ভালই হয়েছে, এ ঠেলায় গোড়াসুদ্ধ উপড়ে ফেলা যাবে।
ভেতরে ঢুকতে মার্শালাকে দেখতে পেল ব্রুকস, এইমাত্র বোতল খালি করেছে। কঠিন কিছু বলতে চেয়েও নিজেকে নিবৃত্ত করে নিল ও। পারকার আসছে, জ্যাক। তৈরি হয়ে নাও। ও বোধহয় আগে তোমার সাথে কথা বলতে চাইরে।
পরোয়া করি না, জ্যাক হবসের কণ্ঠে উত্তেজনা আসুক ব্যাটা, বহুত জ্বালিয়েছে, আজ ওর নয়তো আমারই শেষ দিন! দাড়িয়ে গানবেল্ট, হোলস্টার ঠিক করে নিল সে, পিস্তল পরখ করল।
নীরবতা নেমে এল, ব্র্যাড গ্যারেট পর্যন্ত চুপ মেরে গেছে।
পারকারের দলটা পৌঁছে গেছে। ল-অফিসের সামনের রাস্তায় সার বেঁধে দাঁড়াল, সবার সামনে জুলিয়াস পারকার। তারপর অ্যালান, স্টিরাপ, ম্যাসন…যোলোজন। বুক টান টান করে স্যাডলে বসেছে বুড়ো, মাথা উঁচু। অস্থির দৃষ্টিতে দেখল ল-অফিসের কাঠামো। বেরিয়ে এসো, হবস! তোমার সাথে কথা আছে। চড়া গলায় ডাকল, আত্মবিশ্বাসী কর্তৃত্বপূর্ণ স্বর বেরিয়ে যাওয়ার সময় দরজাটা একটু বেশি জোরে ভিড়িয়ে দিল মার্শাল। দৃঢ় পায়ে পোর্চে গিয়ে দাঁড়াল। অনিশ্চয়তা বা পিছুটানের কোন নমুনা নেই ওর মধ্যে। হারানো আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছে। আমার সাথে কথা বলতে এত লোক লাগে নাকি, পারকার? স্থির নিষ্কম্প কণ্ঠে জানতে চাইল হবস, খানিকটা বিদ্রুপের সুরে। ভয় পাচ্ছ নাকি? সাহস থাকে তো ভেতরে এসে তোমার প্যাচাল পাড়তে পারো।
চোপরাও, হবস! খেপে গেল পারকার, রাগে জ্বলে উঠল চোখজোড়া। আমি তোমার চাকুরি করি না। বরং মাসশেষে তুমিই আমার কাছ থেকে বেতন মাও।
সেজন্যে তোমাকে কোলে বসিয়ে চুমো খেতে হবে?
বেড়ে বলেছ, জ্যাক! ভেতর থেকে উৎসাহ জোগাল ব্র্যাড গ্যারেট।
মরার আগে যত ইচ্ছে তড়পে নাও, হবস! চেঁচিয়ে বলল অ্যালান পারকার।
হাঁসের বাচ্চাটাকে চুপ করতে বলল, পারকার বড়দের মধ্যে ফোড়ন কাটার অভ্যাস দেখছি ওর যায়নি।
তোমাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, কিন্তু দুজন ডেপুটিকে খুন করে ল-অফিস দখল করেছ। একটা টিনের তারাও দেখছি জোগাড় করে ফেলেছ। জোর করে ক্ষমতা দখল আর দুই ডেপুটিকে খুনের দায়ে বিচার হবে তোমার।
আমাকে ধরতে আসছে কে, পারকার? আর কেনই বা! শহরের লোকেরা এখানকার কর্তা হিসেবে তোমাকে মানতে রাজি নয়, ওরা ঠিক করেছে তোমার বিষদাতকে আর ভয় করবে না। ব্যাজটা আমাকে ফেরত দিয়েছে, বাফেলোর শান্তি রক্ষার দায়িত্ব তাই এখনও আমারই, তোমার পোষা বাদর ডেপুটিদের নয়। আফসোেস না করে মেনে নাও। আমার ক্ষমতা কেবল শহরে সীমাবদ্ধ নয় এখন, বুঝতেই পারছ এ তল্লাটে যা ঘটবে তাতেই নাক গলাতে পারব। বাড়াবাড়ি করলে তোমাকেই গ্রেফতার করব। কেমন বুঝছ?।
বোঝার বাপারটা সবার আগে চুকিয়ে ফেলল অ্যালান পারকার। এক রাইডারের পেছনে ছিল সে, হাতে খোলা পিস্তল। কিন্তু কেউই সেটা দেখেনি। রাইডারের আড়াল থেকে সরে এসে নিমেষে পিস্তল তুলে গুলি করল। এমন কিছু হতে পারে আশা করেনি জ্যাক হবস, তবু ড্র করল। বুকে দুটো গুলি নিয়েও পাঁচটা গুলি করল সে। ততক্ষণে রক ভেঙে পড়েছে জায়গাটায়, সমানে গোলাগুলি হচ্ছে। শক্তি পাচ্ছে না মাশাল, মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পোর্টে। ডান হাতে সব শক্তি সঞ্চয় করল সে, তারপর সময় নিয়ে নিশানা করে গুলি করল। ছুটে আসছিল অ্যান্সাম পারকার, মাত্র দশ গজ দূর থেকে ভারী কালিবারের গুলি ওর মাথায় আঘাত করল। স্যাল থেকে ছিটকে পড়ল দেহটা।
সবকাকে শেষ করে ফেলো! রাগে চেঁচাল জুলিয়াস পারকার। লাফিয়ে স্যাডল ছেড়ে, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল স্যালানের দিকে। কাছে গিয়ে বসে পড়ল, কোলে তুলে নিল ছেলের মাখা! প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যেও তার অস্কুট আর্তনাদ স্পষ্ট শোনা গেল।
থেমে গেছে লড়াইটা। রাস্তার ওপাশে সরে গেছে বার-পির তুরা, অস্থির ঘোড়াগুলোকে সামলে নিচ্ছে। বুঝতে পারছে না কি করবে। ল-অফিসের পোর্কের কাছে ছেলের মাথা কোলে নিয়ে অনড় বসে আছে পারকার। হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে, মুখে শোক আর সর্বস্ব হারানোর বেদনা। মাঝরাস্তায় আরও পাঁচটা লাশ পড়ে আছে।
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে নীরবে পরিস্থিতি দেখছে ব্রুকস। অপেক্ষমাণ রাইডারদের ওপর নজর থাকলেও বারবার ওর মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে জুলিয়াস পারকার। এখন আর উদ্ধত ভাবটা নেই বুড়োর মধ্যে। নিদারুণ বাস্তবতা মেনে নিতে পারছে না লোকটা। শোকে বিহ্বল পিতা, এ-নিয়ে দুবার একই অভিজ্ঞতা হলো বার-পি মালিকের। মোটেও সুখকর নয়, করুণার সাথে ভাবল ও। কিন্তু এর পেছনে তার নিজেরও কিছুটা দায় আছে, উদ্ধত অহঙ্কারী ছেলেগুলোকে সামলে রাখার কোন চেষ্টা সে কখনও করেনি। কারণহীন আক্রোশের মাসুল তাকে দিতে হয়েছে চড়া দামে। এরপরও কি থামবে পারকার?
একই প্রশ্ন বোধহয় রাইডারদের মনেও ভিড় করেছে। উসখুস করছে লোকগুলো, চাইছে পারকার একটা নির্দেশ দিক। আকস্মিক থেমে যাওয়া লড়াইটা শুরু করতে পারে কেবল তার একটা নির্দেশ, কিংবা থামিয়েও দিতে পারে চিরদিনের জন্যে। নিজেদের মধ্যে কি যেন আলাপ করল স্টিরাপ আর ব্রনসন। পাশে দাঁড়িয়ে তা শুনছে ম্যাসন।
সঙের মত দাঁড়িয়ে আছ কেন? হঠাৎ করে শোনা গেল পারকারের পরিচিত জেদী কণ্ঠ। সব কজনকে চাই আমি, ওদের লাশ দেখতে না পেলে আমার শান্তি হবে না! মন্টানা আর লোগানকে বের করে আনো, তারপর পুড়িয়ে দেবে শহরটা, একটা বাড়িও যেন আস্ত না থাকে!
একসঙ্গে নড়ে উঠল সবাই, ছুটে আসছে। শুরুতে স্যাডলশূন্য হলো কয়েকটা ঘোড়া। মরা ঘোড়ার পেছনে অবস্থান নিল দুজন। পোর্চের কাছে এসে নিমেষে স্যাডল ত্যাগ করল কার্লি ব্রনসন, ছুটে এসে দরজার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ভেজানো পাল্লা সরে যেতে গড়িয়ে ভেতরে ঢুকল তার শরীর। চোখ তুলে দশ হাত দূরে দেখতে পেল ব্র্যাড গ্যারেটকে, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পিস্তল সোড় করছে। চার চোখ এক হতে স্থির দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল ওরা, মাত্র একটা সেকেন্ড, তারপর দুজনেই সক্রিয় হলো। ব্রনসনের উল্লাসধ্বনি চমকে দিল অন্যদের, গোলাগুলির আওয়াজ ছাপিয়ে উঠল সেটা। পিস্তল তুলে গুলি করল সে। ওদিকে অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছে টেক্সান, বিদ্যুৎ বেগে ঘাড়ের পেছনে চলে গেল ওর ডানহাত। তীক্ষ্ণ শব্দে বাতাস কাটল একটা ছুরি, ঠক করে বিঁধল ব্ৰনসনের গলায়। হাঁটু ভেঙে মেঝেতে পড়ল বিস্মিত ব্রনসন, গলগল করে বের হওয়া রক্ত অবিশ্বাসের সাথে দেখছে। এদিকে তীব্র ব্যথায় কুঁচকে উঠেছে ব্র্যাড গ্যারেটের মুখ, বুক চেপে ধরে কাত হয়ে পড়ে গেল সে।
মুহূর্তের জন্যে সহোদরের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়েছিল প্যাট, ঠিক এসময়ে ওর উরু ভেদ করল গুলিটা। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল সে, দরজার দিকে তাকাতে দেখতে পেল টম স্টিরাপকে। পিস্তল তুলছে আবার। টেক্সানের গুলি তার পেট ফুটো করল, পরেরটা বুকে বিঁধল। দরজার বাটের ওপর কাত হয়ে পড়ল তার বিশাল দেহ। শেষবারের মত চেষ্টা করল স্টিরাপ, কিন্তু ঝাপসা দৃষ্টি বিশ্বাসঘাতকতা করল ওর সাথে। শক্তিতে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ছেড়ে দিল পিস্তলটা, মরার আগে নিজের উদ্দেশে তীব্র গাল বকল।
ঘোড়ার পেছনে অবস্থান নেয়া লোকগুলো এলোপাতাড়ি গুলি করে যাচ্ছে। ছেলের পাশে পড়ে আছে জুলিয়াস পারকার, কখন কিভাবে গুলি লেগেছে কেউই বলতে পারবে না। চারজন লোক চম্পট দিয়েছে। ইচ্ছে করলে ওদের অন্তত দুজনকে ধরাশায়ী করতে পারত ব্রুকস, তা করেনি। পেছন থেকে কাউকে গুলি করা ওর ধাতে নেই।
লকহার্টের তোপের মুখে শেষতক অবশ্য রেহাই পেল না লোকগুলো।
হঠাৎ করে এভাবে লড়াই শুরু হবে পারকারের কল্পনাতেও বোধহয় তা ছিল না। বোকার মত সবকিছু ভজকট করে দিয়েছে অ্যালান, তারপর আর কারও পিছিয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। যে লড়াই অনেকক্ষণ ধরে চলার কথা তা মাত্র অল্প কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। জুলিয়াস পারকার লোক হিসেবে যাই হোক না কেন তার ছেলেগুলো অকম্মার চূড়ান্ত, ওরাই তাকে ডুবিয়েছে, এমনকি এই শেষ মুহূর্তেও।
তোমরা দুজন, ঘোড়ার পেছনে, চেঁচাল ব্রুকস। হাত তুলে উঠে দাঁড়াও। আমার হাতে একটা শটগান আছে। শুনেছ?
উত্তরে পাল্টা গুলি করল ওরা। শটগান কক করল ও। শব্দটা নিশ্চিতভাবেই ওদের কানে যাবে।
ধীরে উঠে দাঁড়াল ওরা, টিম ম্যাসন আর অচেনা এক লোক। ব্রুকস খেয়াল করল হাত তোলেনি ডেপুটি এবং পিস্তলটা এখনও ডান মুঠিতে ধরে রেখেছে। ক্ষীণ হাসল ও, নিজেকে খুব স্মার্ট ভেবেছে ম্যাসন। ওটা ধরে আছ কেন, ম্যাসন? হালকা সুরে জানতে চাইল ও।
এই তো ফেলে দিচ্ছি, বলে ঝুঁকল সে, এবং গুলি করল।
গোলাটা দুভাগ করে ফেলল ডেপুটিকে। বসে পড়েছে অন্য লোকটা, চোখে আতঙ্ক। গড়গড় করে বমি করতে শুরু করল।
দুটোকে ধরে এনেছি, স্যাম, লকহার্টের চড়া গলা শোনা গেল।
এটাকেও নিয়ে এসো, বিল। সেলে ঢোকাও। সাড়া দিল ও। আর জলদি কাউকে ডকের কাছে পাঠাও। আসতে না চাইলে যেন জোর করে নিয়ে আসে। গ্যারেটদের কাছে গেল ও। ভাইকে চেপে ধরে আছে প্যাট। ব্র্যাডের বুকের ক্ষত থেকে রক্ত গড়িয়ে মেঝেতে ছোটখাট একটা পুকুরের সৃষ্টি হয়েছে। অচেতন টেক্সানকে পরীক্ষা করল ও, ঠিকমত চিকিৎসা হলে হয়তো বেঁচে যাবে।
বিষণ্ণ, শূন্য দৃষ্টিতে ওকে দেখল প্যাট, চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। কঠিন লোকটাকে এ মুহূর্তে পশ্চিমের আর দশজনের মতই সাধারণ মনে হচ্ছে-কষ্ট, প্রিয়জন হারানোর বেদনা যাদের সহজেই স্পর্শ করে।
ডাক্তার আসার পর কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে বাঙ্কে ভোলা হলো ব্র্যাডকে। একপাশে সরিয়ে ফেলা হয়েছে লাশগুলো, বেঁচে যাওয়া বার-পি ক্রুদের সেলে ঢোকানো হলো।
বেরিয়ে এল ব্রুকস, লম্বা করে শ্বাস টানল। গান পাউডারের গন্ধে ভারী হয়ে আছে বাতাস, রাস্তার কয়েক জায়গায় জমাট বাধা রক্ত। শেষপর্যন্ত বোধহয় চুকল ঝামেলাটা, ভাবল ও, অনেক রক্তের বিনিময়ে পারকারদের জেদ থেমেছে।
মি. ব্রুকস?
সেলুনের পোর্চে দাঁড়িয়ে আছে ডাস্টি ফগ।
তোমার সাথে কথা বলতে চায় মি. পারকার।
ভূ-লুণ্ঠিত জুলিয়াস পারকারের লাশ ভেসে উঠল ওর মানসপটে।
জুলিয়াস পারকারের বড় ছেলে, নিকোলাস পারকার।
ওর কাছে তার কি প্রয়োজন? বাপের সাথে যোগ দেয়নি নিকোলাস, এটাও বিস্ময়ের ব্যাপার। কদিন আগে পারকারের সাথে মুখোমুখি পড়ে যাওয়ার সময়েও বুড়োর সাথে ছিল না নিকোলাস। সম্ভবত এড়িয়ে যাওয়ার স্বভাবটাই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে এখনও, আজকের লড়াইয়ে যোগ দিলে হয়তো বাপ-ভাইয়ের মত একই পরিণতি হত ওর।
রাস্তা পেরিয়ে ডাস্টির পিছু নিল ও।
সেলুনে ঢুকে দেখতে পেল তাকে। একটা টেবিলে বসে আছে, বিধ্বস্ত জড়সড় দেখাচ্ছে। সামনে হুইস্কির বোতল আর গ্লাস। ফোলা ফোলা চোখ তুলে একবার দেখল ওকে, তারপর মাথা নিচু করল। অপরাধবোধ আর স্বজন হারানোর ব্যথায় কাতর। সারাটা জীবন ভুগবে যুবক।
নিকোলাস পারকারের প্রতি করুণা অনুভব করল ব্রুকস। চেয়ার টেনে বসল ও, অপেক্ষায় থাকল।
অনেকক্ষণ পর মুখ তুলল নিকোলাস। বুঝলে, ব্রুকস, আমি একটা কাপুরুষ! চোখের সামনে ওদের মরতে দেখলাম অথচ কিছুই করতে পারলাম না। এমন নয় যে পিস্তল চালাতে জানি না, কিন্তু আমি জানতাম, শেষপর্যন্ত ওরা হেরে যাবে। অ্যালান দলে থাকলে তা ঘটবেই। প্রথম থেকেই ওদের সিদ্ধান্তগুলো আমি মেনে নিতে পারিনি।
বিরক্তিবোধ করছে ব্রুকস, কিন্তু নির্লিপ্ত থাকল।
এখান থেকে চলে যেতে চাই আমি। সব বেচে দেব। তুমি কি আমাকে এটুকু সাহায্য করবে?
আমি কি করতে পারি?
শহরের লোকজনকে বোঝাবে যে আমার পক্ষ থেকে আর কোন ঝামেলা হবে না। তোমার কথা ওরা ফেলবে না।
তোমার বাবা বোধকরি এটা কখনোই চায়নি। তার অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করার চেষ্টাই হয়তো তোমার করা উচিত।
একগাদা গানম্যান, আউট-ল ভাড়া করে, তারপর ওভাবে আত্মাহুতি দিয়ে?
তোমার বেলায় ওরকম না-ও ঘটতে পারে।
বেসিনে অশান্তির কারণ হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই, কখনও ছিল না।
তুমি যদি কেবল নিজেকে নিয়ে থাকো তো কেউ তোমাকে তাড়া করতে আসবে না। তবে দুএকজন যে তোমার সাথে তামাশা করবে না তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। এটা তোমার প্রাপ্য, বাপ-ভাইদের অপকর্মের ফল ভোগ করতেই হবে। উঠতে যাচ্ছিল ব্রুকস, মন্টানা কিড আর টম ললাগানকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর শরীর। দুকান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে ওদের হাসি, হাতে উদ্যত পিস্তল। দরজার সাথে শরীর ঠেস দিয়ে দাঁড়াল লোগান, মন্টানা এগিয়ে এল।
ঝাঁপটা নামিয়ে দাও, ডাস্টি, আমুদে কন্ঠে নির্দেশ দিল মন্টানা। দেনাপাওনা চুকাতে সময় লাগবে। লোকজন এসে অযথা বাগড়া দিলে আমার মোটেও ভাল লাগবে না।
ছুটল বারকিপ, বেরিয়ে গিয়ে ঝাপ নামাতে শুরু করল।
ধীরে বসে পড়ল ব্রুকস, নিকোলাসের দিকে তাকাল। তো নিকোলাস পারকার, বাপ-ভাইদের পথেই আছ তুমি। আরেকটু হলে তোমার গল্প বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। দারুণ অভিনয় করেছ কিন্তু।
শ্লেষের জবাবে বিদ্যুৎবেগে এল চড়টা, জ্বালা ধরে গেল ব্রুকসের গালে। অভিনয়? কোনটা অভিনয়? সম্পূর্ণ বদলে গেছে নিকোলাসের চাহনি, এখুনি যেন ঝাঁপিয়ে পড়বে ওর ওপর। তোমার কারণে মারা গেল আমার বাপ-ভাইয়েরা। ভেবেছ সহ্য করব? একটু আগে তুমিই বলেছ যে ওদের দেখানো পথেই যাওয়া উচিত। হঁ্যা, আমি বাধ্য হয়েছি। ওদের মত কখনও ভাবিনি, কিন্তু মরে গিয়ে আমাকে হিংস্র হতে বাধ্য করেছে ওরা। কি মনে করেছ, পারকাররা এতদিন ইচ্ছেমত বেসিন শাসন করেছে আর আজ আমি মাথা হেঁট করে বাফেলো থেকে বেরিয়ে যাব? সেটা কখনও হবে না। মাথা উচু করেই যাব আমি। তাবৎ লোকজন বিস্মিত হয়ে দেখবে জুলিয়াস পারকারের সবচেয়ে শান্ত ও বোকা ছেলেটা বাপের মতই হিংস্র হয়ে উঠেছে। এখন থেকে এ তল্লাটে শাসন করবে এই নিকোলাস পারকার।
রাজত্ব পাওয়ার আগেই স্বপ্ন?
মন্টানা কিড সক্রিয় হলো এবার। তার চালানো পিস্তলের নলের আঘাতে ব্রুকসের মনে হলো থুতনি ভেঙে গেছে। তীব্র ব্যথায় অবশ হয়ে গেল জায়গাটা। মনে মনে কেভিন লকহার্টের চোদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করল, তার ওপর নির্ভর করা মোটেও ঠিক হয়নি। এমন একটা ভুল ও করল কি করে? মন্টানা আর লোগান ছাড়া না পেলে পারকার এত হিংস্র হয়ে উঠতে পারত না।
আমাদের পুরানো ব্যাপারটা ভুলে গেছ নাকি, ব্রুকস? মন্টানায় একচোট নিয়েছিলে আমার ওপর, উঁহু, মোটেও ভুলিনি আমি। আজ পেয়েছি তোমাকে, সুদে-আসলে সব উসুল করে নেব!…ডাস্টি, আমাকে হুইস্কি দাও।
পাশ ফিরে বারকিপারের দিকে তাকাল ব্রুকস, চোখাচোখি হতে চোখ সরিয়ে নিল সে। ব্রুকস ধারণা করল; এ বিশ্বাসটা অন্তত নষ্ট হয়নি, ডাস্টি ফগের হাত নেই এসবে। যেভাবেই হোক তাকে ম্যানেজ করেছে পারকার, সম্ভবত ওর মতই ভাওতা দিয়ে। তবে উল্টোটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেলুনটা মূলত পারকারদের আর বার-পি রাইডাররা আগাগোড়া এখানেই সময় কাটাত। ডাস্টি ফগকে এখনও সবাই জানে পারকারদের দোসর হিসেবে।
তোমার তো অনেক দেনা, আলাপী সুরে বলছে মন্টানা। আমার, পারকারের, লোগানের, এমনকি ফগের কাছেও কিভাবে এত দেনা শোধ করবে? বারকিপারের হাত থেকে হুইস্কির গ্লাস নেয়ার সময় ডাস্টির ব্যান্ডেজ বাঁধা নাকের দিকে তাকাল। কি ফগ, ভুলে গেলে নাকি তোমার নাক ভেঙে দিয়েছিল এ ব্যাটা?
না।
পাওনা তুলে নেবে না?
আমার হয়ে তোমরাই না হয়… অন্যরা হেসে উঠতে থেমে গেল সে।
কখন ছাড়া পেল ওরা, পারকারের সাথে যোগাযোগ হলো কিভাবে? যেভাবেই হোক সুষ্ঠুভাবে ঘটেছে সবকিছু। বাপের সাথে যোগ না দিয়ে এভাবেই নিজের কাজ সারতে চেয়েছে নিকোলাস, হয়তো পুরো দলের ওপর আস্থা ছিল না ওর কিংবা লড়াই শেষ হওয়ার পর পরিকল্পনা করেছে। কৌশলটা কাজে দিয়েছে এটাই হচ্ছে বড় কথা। বাগে পেয়েছে ওকে। মন্টানা কিড, স্বভাব বা আচরণে না হলেও গায়ে-গতরে সে বিলি দ্য কিডের ছায়া। ওঁর হাতে মরা লোকের সংখ্যা কিংবদন্তীর ওই বন্দুকবাজের চেয়েও বেশি। শারীরিক মিলের কারণে কিড হিসেবে আখ্যা পেলেও ফেয়ার ডুয়েলে সে আসল কিডের ধারে-কাছেও হবে না। কিন্তু তাতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। ওকে কোন সুযোগই দেবে না মন্টানা, লোকটার ধাতে তা নেই। চোখের দিকে তাকিয়ে, কপালে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে বহু নিরস্ত্র লোককে খুন করেছে সে। টম লোগান আরও এক কাঠি বাড়া, পেছন থেকে খুন করা তার সবচেয়ে পছন্দ। ওর ভাই, ম্যাট লোগান খুন হয়েছে ব্রুকসের হাতে, লোগানের আক্রোশ তাই মন্টানার চেয়েও বেশি।
এত কি ভাবছ, ব্রুকস? লাভ হবে না, গ্যাড়াকলে পড়েছ এবার। মুখিয়ে উঠল মন্টানা, পিস্তল নাচাল ওর মুখের সামনে। সারা পশ্চিমে তোমার এত নামডাক, এতবড় একজন বন্দুকবাজকে নিরস্ত্র অবস্থায় মারতে চেয়েছিল লোগান, আমি বাদ সেধেছি। তোমার জোড়া পিস্তল তোমারই থাকবে, কিন্তু আমার হাতে থাকবে হ্যামারটানা পিস্তল, কেবল ট্রিগার টানলেই হলো। বোঝে ব্যাপারটা, পিস্তল থেকেও অসহায় তুমি! মজাটা তো এখানেই। আমি দেখতে চাই তুমি কত বড় বন্দুকবাজ, আমার ট্রিগার টানার আগেই পিস্তল বের করে গুলি করতে পারবে?
ঘামতে শুরু করেছে ব্রুকস। মাত্র একটা সুযোগ চাই ওর, তাহলেই লোকটার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস গুড়িয়ে দিতে পারবে। নিদেনপক্ষে তাকে নিয়ে মরবে। মাথাটা দ্রুত সচল হয়ে উঠল, ভাবছে একটার পর একটা সম্ভাবনা, বাতিলও করে দিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। উহু, অতিরিক্ত ঝুঁকি। অস্বীকার করার উপায় নেই, এরকম কঠিন অবস্থায় জীবনে পড়েনি আর। নিশ্চিত মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। কিন্তু এভাবে অসহায়ভাবে মরতে চায় না ও। হঠাৎ করে লরিয়া ফ্ল্যাগানের অনিন্দ্যসুন্দর মুখটা ভেসে উঠল ওর মানসপটে, মেয়েটাকে পাওয়া তার হলো না…স্বপ্নটা অপূর্ণই থেকে যাবে?
রাজত্বের কথা বলছিলে না, ব্রুকস? সিগার ধরিয়ে সজোরে ধোঁয়া ছাড়ল পারকার, ব্রুকসের চোখে-মুখে এসে পড়তে চোখ জ্বালা করে উঠল। ওটা তো আগে থেকেই আছে, আমি কেবল আরেকটু জাঁকিয়ে বসব। একটু টাইট দেব এখানকার কয়েকটা হারামজাদাকে, এমন শিক্ষা দেব যাতে জীবনে আর আমার বিরুদ্ধে লাগার সাহস না হয়। রাজকন্যার কথা শুনবে না? লরিয়া ফ্ল্যাগান। আমার ভাগ্যটা সত্যি দারুণ! বাড়ও ওকে পছন্দ করত, কিন্তু শেষপর্যন্ত ওকে আমিই পাব। জেমস ফ্ল্যাগানকে চেপে ধরলে বাপ-মেয়ে দুজনেই রাজি হয়ে যাবে।
না, এত সহজ হবে না, ভাবল ব্রুকস। ফ্লাগান জেদী মানুষ, প্রখর আত্মসম্মানবোধ আছে তার। লরিয়া ওর বাপের মতই, আপস করার মানসিকতা ওর মধ্যে নেই। তুমি ওদের চিনতে ভুল করেছ, পারকার। ফ্লাগান রুখে দাড়াবে।
বাইরে হৈ-হল্লা শোনা যাচ্ছে, ফুর্তি করছে লোকজন। তাঁদের জানার উপায় নেই পারকারের সেলুনের ভেতর কি ঘটছে। নামানো ঝাপের ওপর অনেকগুলো ঢিল এসে পড়ল, সাথে কয়েকটা মন্তব্য। ফগটা একটা দালাল! চলো সেলুনে আগুন লাগিয়ে দেই। একজন প্রস্তাব করতে অন্যরা হৈ-হৈ করে উৎসাহ জোগাল। কিন্তু সবাইকে নিরস্ত করল লকহার্টের চড়া গলা।
ব্রুকসের কপালে পিস্তলের নল চেপে ধরেছে মন্টানা, তাকিয়ে আছে চোখে। দৃষ্টিতে খুনের নেশা। ও টু-শব্দ করলে গুলি করার সুযোগ পাবে। ঠায় বসে আছে ব্রুকস, নীরবে দেখছে তিনজনকে। পারকার নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করেও উদ্বেগ চেপে রাখতে পারছে না, মৃদু অস্বস্তি তার চোখের তারায়। লোগানৈর পিস্তল দরজার দিকে তাক করা। বারের ওপাশে এককোণে দাঁড়িয়ে থেকে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে দরজা দেখছে ডাস্টি ফগ, তার আশঙ্কা উন্মত্ত লোকগুলো হয়তো দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়বে।
সময় যেন আটকে থাকল, অনেকক্ষণ। একসময় ধীরে দূরে সরে গেল লোকগুলো। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল ওদের। পিস্তল সরিয়ে নিল মন্টানা। আরও কিছুক্ষণ, আয়ু বাড়ল তোমার, সহাস্যে বলল সে, সরে গেল খানিকটা। ডাস্টিকে ইঙ্গিত করল হুইস্কি দিতে, ব্রুকসের ওপর থেকে চোখ না সরিয়েই। ওকে একটা ড্রিঙ্ক দাও, ডাস্টি। দেখছ না গলা শুকিয়ে গেছে? মরার আগে শেষবারের মত গলা ভিজিয়ে নিক।
আমাকে পিস্তলবাজ বলবে না, ব্রুকস? সন্তুষ্টি পারকারের গলায়, হাসছে। নিজে পিস্তল না চালিয়েও জন ওয়েসলি হারডিনকে কত সহজে বধ করতে যাচ্ছি। সেরা পিস্তলবাজ তো আমাকেই বলা উচিত।
হুইস্কি ভরা গ্লাস ওর সামনে নামিয়ে রাখল বারকিপ।
নাও, গলা ভেজালে কিছু মনে করব না। কিন্তু সাবধান, ভুলেও কিডকে সুযোগ দিয়ো না! ও এমনিতেই মুখিয়ে আছে। দুর্ভাগ্য ব্রুকস, তোমার শত্রুরা তোমার মতই জেদী এবং বেপরোয়া। ওদের দোষ দিতে পারো না তুমি, শোধবোধের সময় রাখ-ঢাক কেউই পছন্দ করে না। খেলাটা বুঝতে পারছ? তোমাকে পিস্তল বের করতে বলে গুলি করবে মন্টানা কিড। কেবল একটা চেষ্টা করার সুযোগ পাবে তুমি, ব্যর্থতার সম্ভাবনা যোলো-আনা। খেলাটার মজা আমাকেও স্পর্শ করেছে! উৎফুল্ল দেখাল নিকোলাসকে।
দুজনকে সামলাতে হবে, ভাবছে ধ্রুকস, সম্ভব কি অসম্ভব তা এখন আর ওর মাথায় নেই। একটা সুযোগের অপেক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। হাতু বাড়িয়ে তুলে নিল গ্লাসটা, ধীরে চুমুক দিল। বিস্বাদ লাগছে, এমন একটা মুহূর্তে কিছুই ভাল লাগার কথা নয়। ইতোমধ্যে সবার অগোচরে দুটো কাজ সেরে ফেলেছে-চেয়ারের পায়ার পেছনে চলে গেছে ওর ডান পা, আর সামনে খানিকটা মেলে দিয়েছে বাম পা-টা। শেষপর্যন্ত তুমি ব্যর্থ হবেই, নিকোলাস পারকার, গ্লাস নামিয়ে রাখার সময় ধীরে ধীরে বলল ও। সম্পূর্ণ শিথিল করে দিয়েছে শরীর, যাতে ওরা কিছু আন্দাজ করতে না পারে। যা হওয়ার হবে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, শেষ চেষ্টা করবে। ক্ষীণ একটা সম্ভাবনা আছে।
বারের ওপাশে নড়ে উঠল ডাস্টি ফগ। বোধহয় শটগান তুলে আনছিল, ধরা পড়ে গেল লোগানের চোখে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে গুলি করল লোগান। ব্রুকসের দিকে তাক করা ছিল ওর পিস্তল, সেটা ঘোরাতে যে সময় লাগল তাতে অনায়াসে বারের আড়ালে বসে পড়তে পারল ডাস্টি। তাকে রাখা বোতল ফুটো করল গুলিটা। তরল হুইস্কি ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এসে বার ভিজিয়ে দিল।
মন্টানার চোখ সরে গিয়েছিল সেদিকে, কিন্তু একচুলও নড়েনি পিস্তলের নল। ঘুণাক্ষরেও আশা করেনি বাগড়া দেবে বারকিপার! এ সুযোগটাই নিল ব্রুকস। ডান পা চেয়ারের পায়ার সাথে বাধিয়ে ধাক্কা দিল, একইসাথে বাম পায়ে মেঝেতে ভর দিয়ে পেছনে ঠেলে দিল চেয়ার আর নিজের শরীর। গুলি করল মন্টানা, কিন্তু ব্রুকস আগের অবস্থানে নেই আর। গুলিটা ওর কপালে গরম আঁচ লাগিয়ে চুলে সিঁথি কাটল। চেয়ারসমেত মেঝেয় পড়ার আগেই গুলি করল ব্রুকস, মন্টানা কিডের মুখ তুবড়ে দিল সেটা। মাত্র চার হাত দূর থেকে করা, নাক বরাবর বিশাল গর্তের সৃষ্টি হলো। বুলেটের ধাক্কায় ছিটকে পড়ল সে।
কেবল একটা গুলি করার সুযোগ পেল টম লোগান। ওটা ব্রুকসের বাম কাঁধে বিধতে কেঁপে উঠল ওর দেহ, নিশানা ছুটে গেল। তবু, লোগনের কান ফুটো করেছে গুলিটা। পরেরটা এত দ্রুত করল যে শব্দে মনে হলো একটাই গুলি করেছে। লোগানের গলা ফুটো হয়ে যেতে গলগল করে রক্ত বেরোতে শুরু করল। পিস্তল ছেড়ে দিয়ে দুহাতে গলা চেপে ধরল গানম্যান, বাতাসের জন্যে হাঁসফাস করছে। গলা থেকে ঘড়ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে। চোখে নগ্ন বিস্ময় আর সীমাহীন আতঙ্ক। গড়িয়ে পড়া রক্ত ভিজিয়ে দিল ওর হাত আর বাহুমূল, কাশি দিতে রক্ত উঠে এল মুখে। ফেনিল রক্তের ধারা বমির মত গলা দিয়ে উগরে দিতে শুরু করল এবার। দেয়াল বরাবর হেঁচড়ে নেমে গেল শরীর, কয়েকবার খিচুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেল।
নিকোলাস পারকারের দিকে নিশানা ধরে রেখেছে ব্রুকস, সারা শরীর কাঁপছে। এতক্ষণ চেপে রাখা অবর্ণনীয় মানসিক চাপ আর একই সাথে বিপদমুক্তির প্রশান্তি সারা দেহ জুড়ে। বিহ্বল হয়ে পড়েছে পারকার, বিশ্বাস করতে পারছে না ছক পাল্টে গেছে। ক্লান্তি অনুভব করল ব্রুকস, গুলির শব্দে কান ঝাঁঝাঁ করছে। মন্টানার সাথে ওর গুলি বিনিময় হয়েছে পয়েন্ট ব্লাঙ্ক রেঞ্জে। সারা ঘরে গান পাউডারের ধোয়া আর তীব্র গন্ধ।
ছুটে এসে ওকে ধরল ডাস্টি, একটা চেয়ারে বসাল। হুইস্কির গ্লাস এগিয়ে ধরতে তাতে চুমুক দিল ব্রুকস। কিছুটা সুস্থির বোধ করছে। ধন্যবাদ, ডাস্টি, তুমিই আমাকে বাঁচিয়েছ! আন্তরিক কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল ও।
আমি আবার কি করলাম!
তখন শটগান তুলে নিতে হাত বাড়ালে না?
আদপে ওখানে কিছু ছিল না, হাসছে ডাস্টি। ভাওতা দিয়েছি ওদের। আসলে তোমার ওপর চোখ রেখেছিলাম, দেখলাম তৈরি হয়ে গেছ। পা নাড়তে দেখে আন্দাজ করে নিয়েছি কি করতে চেয়েছ। আমি কেবল একটা ডাইভারশন সৃষ্টি করেছি। অন্য কেউ হলে এতেও শেষ রক্ষা করতে পারত না। তুমি হারডিন বলেই…
ভুলে যাও, ব্রুকস নামটাই আমার পছন্দ, বাধা দিল ও। নয়তো স্যাম ডাকতে পারো। তুমি যা-ই করে থাকো না কেন আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এখন দয়া করে দুটো কাজ করবে? আগে পারকারকে কষে বেঁধে কোথাও আটকে রাখা, তারপর দরজাটা খোলো।
আঁতকে উঠল ডাস্টি। আমার সেলুনের বারোটা বাজাবে ওরা!
তা করবে না। লোকজনকে বোঝনোর দায়িত্ব আমার।
মাথা ঝাঁকিয়ে কাজে নেমে পড়ল বারকিপ, যদিও পুরোপুরি সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে তাকে।
দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে গোড়ালি আর কাঁধে একরাশ ব্যথা অনুভব করল ব্রুকস। ক্ষত থেকে চুইয়ে রক্ত ঝরছে। আর কত ক্ষত তৈরি হবে ওর শরীরে, তিক্ত মনে ভাবল। হাত নাড়তে টের পেল ব্যথাটা আঙুল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। হাঁটতে গিয়ে মচকে যাওয়া গোড়ালিতে জোর পেল না, বসে পড়ল চেয়ারে। লাশগুলো এককোণে সরিয়ে ফেললা, ডাস্টি। দুঃখিত, সাহায্য করতে পারছি না।
লাগবে না, স্যাম। কাঁধে তো বইব না, টেনে সরিয়ে নেব কেবল। বহুত জ্বালিয়েছে ওরা। ওদের মরতে দেখে শান্তি লাগছে। বিশ্বাস করো, লাশগুলো টানতেও সুখ পাব।
একটু পর দরজা খুলল সে, উঠে দাঁড়াল ব্রুকস।
এত তাড়া কিসের? বলে উঠল বারকিপ। বসে পড়ো, ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছি। অবশ্য অনেক আগেই তা করা উচিত ছিল। আমি আসলেই একটা গাধা! ওদের সরিয়ে লাভটা কি, যা করলাম তা মরা মানুষগুলোর কোন কাজে আসবে না!
বাইরে ছুটন্ত শব্দ, অনেকের। সবার আগে পোর্চে উঠে এল লরিয়া ফ্ল্যাগান। ব্যাটউইং দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। ছুটে আসছে। বারের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল ব্রুকস। উড়ে এসে ওর বুকে আছড়ে পড়ল লরিয়া, দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে ফোপাতে শুরু করল। সারা শহরে খুঁজে মরছি, কোথাও পাচ্ছিলাম না তোমাকে। বোঝে আমার মনের অবস্থাটা! তারপর কেভিন বলল এদিকে গুলির শব্দ শোনা গেছে, ছুটে এলাম। ওহ, স্যাম, এত খুশি লাগছে!
গাধাটা তাহলে বেঁচে আছে। মন্টানা আর লোগানের তো ওকে ছেড়ে দেয়ার কথা নয়।
লরিয়া খেয়াল করল ব্রুকসকে কষ্ট দিচ্ছে। লজ্জায় আরক্ত হলো ওর গাল, মাথা নিচু করে ফেলল। ছুটে গিয়ে একটা চেয়ার এনে বসাল ব্রুকসকে। নিচু হয়ে গাউনের দুটো পরতা তুলে আরেক পরতা থেকে একখণ্ড কাপড় ছিড়ে ফেলল। তারপর ব্রুকসের কাঁধে বাধতে শুরু করল।
সজল সবুজ চোখজোড়ার দিকে তাকাল ব্রুকস। মেয়েটা ওর কাজে পুরোমাত্রায় মনোযোগী। লরিয়া?
চোখ তুলে তাকাল ফ্ল্যাগান-কন্যা।
আমার গানবেল্টগুলো খুলে নেবে? আর কখনও ওগুলো ছোঁব না আমি।
পরে হয়ত এগুলোর দরকার হবে, স্যাম।
হবে না। বেসিনের অশান্তি মিটে গেছে। আমার খোজেও আর আসবে না কেউ। কারণ ওয়েসলি হারডিন মরে গেছে আজ। বিকেলে বুটহিলে দুটো কবর খোড়া হবে, একটা মন্টানা কিডের আরেকটা হারডিনের। দারুণ একটা ডুয়েল শেষে দুজনেই মারা গেছে।
বিমূঢ় লরিয়া, গানবেল্ট খুলে নিয়েছে। অনেকেই তোমার আসল পরিচয় জানে।
কজন হবে? যারা জানত তাদের বেশিরভাগই এখন আর নেই। এখানকার দুএকজন হয়তো জানে, কিন্তু ওরা বোধহয় আমার জন্যে এটুকু করবে। মিথ্যে তো বলতে হবে না, স্রেফ হজম করে ফেলবে সত্যটা। তাছাড়া একটা কবর মানুষের বিশ্বাস অর্জনের জন্যে যথেষ্ট। কি বলল, ডাস্টি?
একমত আমি,সহাস্যে বলল সে। আমার মনে হয় সবার কাছ থেকে এটুকু পাওয়ার দাবি ও করতে পারে।
বেরিয়ে এল ওরা। ডাক্তার হেনরীর চেম্বার হয়ে মিসেস রিচার্ডসের রেস্তোরাঁয় বসল। উফুল্ল দেখাচ্ছে শহরের লোকজনকে। পারকার পরিবারের গ্রাস থেকে মুক্তি পাওয়াটা সবার কাছে উপভোগ্য মনে হচ্ছে।
ওয়েসলি হারডিন একজন ভয়ঙ্কর মানুষ, বেসিনের লোকজনের কাছে এখানকার অধিবাসী হিসেবে স্যামুয়েল ব্রুকসের মত নিরীহ লোকই পছন্দ, এটা কি তুমি ধরতে পেরেছ? সারা জীবনে আমি অনেক দেখেছি–পশ্চিমের লোকেরা বন্দুকবাজদের এড়িয়ে চলে, কখনোই সহজ হতে পারে না এবং ভয় করে। এক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে মহিলারাই বেশি এগিয়ে। লরিয়া, এ জন্যেই হারডিন হিসেবে তোমার সামনে আসতে চাইনি আমি। তাই পণ করেছিলাম কখনও পিস্তল ধরব না।
ভুল জানো তুমি। আমার কিন্তু মোটেও সেরকম মনে হচ্ছে না। তবে এটা ঠিক, স্যামুয়েল ব্রুকসকেই আমার কাছে সহজ মনে হয়। বুঝতে পারি তাকে। আচ্ছা, পিস্তল ধরতে তোমাকে বাধ্য করেছিল পারকাররা, পণ ভাঙায় তোমার দুঃথ হয়নি?
না, সহাস্যে, গাঢ় স্বরে বলল ব্রুকস। একটুও না। কারণ বিনিময়ে আকাক্ষিত রত্নটি পেয়েছি আমি।
হাসল লরিয়া, কপাল থেকে অবাধ্য একগোছা চুল সরিয়ে দিল। সে দিনটি আমার তাড়াতাড়িই এসেছে, তাই না? এখন থেকে আমার কোন প্রশ্নই তুমি এড়িয়ে যাবে না।
ঘটনাটা মনে পড়তে আপনমনে হাসল ব্রুকস। আমার ভয় ছিল তুমি হয়তো আমাকে পছন্দ করবে না। নিজের ইচ্ছের কথা তাই তোমাকে বুঝতে দিতে চাইনি।
ওহ, ওই উইলটার কথা না জানলে আমি ধরতেই পারতাম না! অথচ আমি তখন ভালবেসে ফেলেছি তোমাকে। তুমি ধরতে পারোনি। অভিযোগ লরিয়ার কণ্ঠে। অথচ বাবা ঠিক ঠিক বুঝে ফেলেছিল।
আমার ভয় হচ্ছিল হয়তো তোমার আগ্রহকে ভুল বুঝেছি।
এবার বলো, ওই প্রশ্নটার উত্তর আমার পাওনা।
শুনতেই হবে? তুমি নিজেও জানো ওটার উত্তর, অন্তত এখন।
তবু শুনতে চাই। শুনতে যে আমার ভাল লাগবে!
হ্যাঁ, লরিয়া ফ্ল্যাগান অপমানিত হলে অনেক কিছু আসত-যেত স্যামুয়েল ব্রুকুসের। এখানে ওর জীবন নতুন করে শুরু হয়েছিল তো ওই মেয়েটির জন্যেই।
পরের রোববারে গির্জায় বিয়ে হয়ে গেল ওদের। প্রিস্টের কাছে অস্ত্র জমা রেখে শপথ করল ব্রুকস যে আর কখনও ওগুলো তুলে নেবে না।
স্যামুয়েল ব্রুকস তার শপথ অটুট রাখতে পারেনি, পরে আবারও তুলে নিয়েছিল নিজের বহুল ব্যবহৃত অস্ত্র।
সেটা ভিন্ন গল্প।