এক ওয়েস্টার্ন কাহিনী- ওল্ড ইয়েলার

এক ওয়েস্টার্ন কাহিনী- ওল্ড ইয়েলার

এ গল্প এক কিশোরের গল্প, কৈশোর সবে ছাড়তে উদ্যত হয়েছে যাকে। সেই বুনো পশ্চিমে খুনে ইনডিয়ানদের যখন-তখন হামলা তখনও বন্ধ হয়নি, টেকসাসে বসতি স্থাপন সবে শুরু হয়েছে, সেটলারদের টাকার অভাব, দল বেঁধে গরু নিয়ে দুর্গম পথ পেরিয়ে বিক্রি করতে যাওয়ার জন্যে পাড়ি দিতে হচ্ছে শত শত মাইল পথ, রোগ-বালাই মহামারী আকারে দেখা দেয়, বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে বুনো জানোয়ারের দল; সেই সময় সল্ট লিকের মত এক বুনো অঞ্চলে টিকে থাকার সংগ্রামে নামল এই দুঃসাহসী কিশোর, একা, অস্ত্র বলতে শুধু একটা আদিম বন্দুক। কেবল বাড়িঘর আর খেতখামারই নয়, মা আর ছোট্ট ভাইটিকে সামলানোর দায়িত্বও তার ওপর। পাশে এসে দাঁড়াল ওল্ড ইয়েলার…
———

০১.
আমরা ওকে ডাকতাম ওল্ড ইয়েলার বলে। এর দুটো কারণ। এক, ওর খাটো খাটো লোমগুলোর কালচে হলুদ রঙ। ইয়েলো অর্থাৎ হলুদ রঙকে বিকৃত করে বলতাম ইয়েলার। দুই, গলা ছেড়ে যখন চিৎকার করত সে, ঘেউ ঘেউয়ের বদলে তার গলা দিয়ে বেরোত এক ধরনের ইয়েল অর্থাৎ তীক্ষ্ণ আর্তনাদ।

মনে হয় এই তো কালকের কথা, আমাদের বার্ডসং ক্রীকের কাঠের বাড়িটাতে ঘুরে বেড়াত সে। ঘরে-বাইরে সবখানে ছিল তার অবাধ বিচরণ।

সে-বছর আব্বা সল্ট লিকের আরও কয়েকজন সেটুলারের সঙ্গে একটা পুল হার্ড গঠন করে গরুর পাল নিয়ে চলে গিয়েছিল কানসাসের অ্যাবিলনে নতুন গজিয়ে ওঠা একটা গরুর বাজারে। নগদ টাকার জন্যে। সিভিল ওঅরের পরের ওই সময়টায় টেকসাসের মানুষের টাকার বড় টানাটানি ছিল।

আমরা একটা সুন্দর জায়গায় বাড়ি করেছি তখন। প্রচুর ঘাস ছিল আমাদের এলাকায়। বন ছিল, পানি ছিল। প্রচুর শিকার মিলত, মাংসের অভাব হত না। মাটিও খুব উর্বর, শস্য ফলত চমৎকার। ইনডিয়ানদের ভয়ও ছিল না। তাদের জন্যে নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছিল। টেকসাসে দুর্গ তৈরি করল আমেরিকান সৈন্যরা। ইনডিয়ানদেরকে সরে যেতে বাধ্য করল।

আব্বা বলত, সবই আছে আমাদের, নেই কেবল নগদ টাকা। অ্যাবিলেনে গেলে সেটাও জোগাড় করে ফেলতে পারব।

টাকার কথা শুনতে খুবই ভাল লাগে, কিন্তু তবু কিছু কিছু লোক দ্বিধা করতে লাগল। টেকসাসের পাহাড়ী এলাকায় যেখানে বাস করতাম আমরা তার থেকে ছশো মাইলেরও বেশি উত্তরে অ্যাবিলেন। গরু বিক্রি করার জন্যে যেতে-আসতে কয়েক মাস লেগে যাবে। এই সময়টা সল্ট লিকের বুনো ওই সীমান্ত এলাকায় একা একা থাকতে হবে তাদের বউ-বাচ্চাদের।

কিন্তু টাকার সমস্যা বড় সমস্যা। সেটা পেতে চাইলে ঝুঁকি কিছুটা নিতেই হবে। অনেক আলাপ আলোচনা করে, অনেক ভেবেচিন্তে শেষে ঠিক করল পুরুষেরা, যাওয়াই উচিত। যাওয়ার জন্যে তৈরি হতে লাগল তারা। বাড়িতে যারা থাকবে তাদেরকে শিখিয়ে দিতে লাগল, চুক্তি ভেঙে হঠাৎ যদি হামলা করে বসে ইনডিয়ানরা, ফসলের খেত নষ্ট করে কুন, বন থেকে বেরিয়ে পোষা শুয়োর মারে ভালুক, তাহলে কি করতে হবে। তারপর যার যা গরু আছে জড় করে, ওগুলোর পেছনে যার যার ব্র্যাণ্ডের ছাপ মেরে, একদিন দল বেঁধে রওনা হয়ে গেল কানসাসের পথে দীর্ঘ যাত্রায়।

আব্বা যেদিন চলে গেল সেই দিনটার কথা খুব মনে আছে আমার। মনে আছে, ঘোড়ায় জিন পরিয়ে কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। খাপে পোরা বন্দুক, জিনের পেছনে বাঁধা গোটানো বিছানা। মনে আছে, কী লম্বা, সুঠাম দেহী, সুদর্শন একজন পুরুষ। মাথায় হাই-ক্রাউন হ্যাট, নাকের নিচে লম্বা গোঁফের কোণ গরুর শিঙের মত বাঁকা হয়ে ডগা দুটো গিয়ে নেমেছে ঠোটের কোণে। মনে আছে, আব্বা চলে যাচ্ছে বলে কিভাবে কান্না ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিল আম্মা। পাঁচ বছরের ছোট্ট আরলিস গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল। আব্বা চলে যাচ্ছে বলে নয়, আব্বার সঙ্গে চলে যাওয়ার জন্যে।

আমার কাঁদার উপায় ছিল না। চোদ্দ বছর বয়েস হয়েছে, বড় হয়ে গেছি, এই সময় আমার কান্না শোভা পায় না। দাঁড়িয়ে থেকেছি চুপচাপ। একটুও বুঝতে দিইনি যে আমারও কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

আম্মাকে আদর করল আব্বা, আরলিসকে চুমু খেলো, তারপর গিয়ে চাপল ঘোড়ায়। তার দিকে তাকালাম আমি। ইশারায় আমাকে কাছে ডাকল। সঙ্গে যেতে বলল। তার ঘোড়ার সঙ্গে সঙ্গে এগোলাম আমি। রাস্তা চলে গেছে ঝর্নার ওপারের বিশাল ওক গাছটার দিকে।

বাড়ির কাছ থেকে সরে এসে কাত হয়ে আমার কাঁধে হাত রাখল আব্বা। এখানে তার কথা শুনতে পাবেনা আম্মা কিংবা আরলিস।

শোন, ট্রাভিস, তুই এখন বড় হয়েছিস। আমার অবর্তমানে এ বাড়ির কর্তা। কাজেই সে ভাবেই চলতে হবে তোকে। মা আর আরলিসের দেখাশোনা করবি। ঘরের প্রয়োজনীয় কাজকর্ম করবি। মা বললে তারপর করব, এই মনোভাব নিয়ে কক্ষনো থাকবি না। যেটা করতে হবে করে ফেলবি। পারবি?

পারব, জবাব দিলাম।

গরুর দুধ দোয়াতে হবে তোকে, কাঠ কাটতে হবে, শুয়োরগুলোকে দেখেশুনে রাখতে হবে, মাংসের দরকার পড়লে শিকার করে আনতে হবে। তবে সবচেয়ে জরুরী ফসলের খেতের যত্ন নেয়া। ঠিকমত করতে না পারলেই গেল, গাছের গোড়া কেটে দেবে ইঁদুরে, কুনে গমের শিষ খেয়ে শেষ করবে। শীতে কপালে আর রুটি জুটবে না।

জানি।

গুড বয়। ভাবিসনে, বছর শেষ হতে হতেই চলে আসব আমি।

দাঁড়িয়ে রইলাম। আর কিছু বলার নেই। ঘোড়ায় করে চলে যাচ্ছে আব্বা।

হঠাৎ কথাটা মনে পড়ল। ডাকতে ডাকতে তার পেছনে দৌড় দিলাম।

থামল আব্বা, কি বলবি?

ঘোড়া।

কোন ঘোড়া? যেন আমার মুখে ওই শব্দটা তার কাছে নতুন।

দেখো, আব্বা, কিছুটা অভিমানের সুরেই বললাম, আমি কি বলছি ভাল করেই জানো তুমি, একটা ঘোড়ার জন্যে কী করি। বহুবার বলেছি তোমাকে।

হাসছে আব্বা। না জানার ভান করার কারণটা বুঝে ফেললাম। আমাকে রাগাচ্ছিল আব্বা। লজ্জা পেলাম। ভীষণ বোকা মনে হলো নিজেকে।

ঘোড়ার চেয়ে তো কুকুর বেশি পছন্দ করিস।

করতাম, তবে এখন ঘোড়াই বেশি পছন্দ।

এখন তোর একটা কুকুর খুব প্রয়োজন।

জানি। তবু ঘোড়াই লাগবে আমার।

বেশ, বড় হ, বড়দের মত আচরণ কর, কাজ দেখা, তখন বুঝব অত কষ্টের গরু বেচা পয়সা দিয়ে তোকে একটা ঘোড়া কিনে দেয়া যায় কিনা। এই কথাই রইল তাহলে।

হাত বাড়িয়ে দিল আব্বা। ধরে সেটা ঝাঁকিয়ে দিলাম। ওই প্রথম বড়দের সঙ্গে তাদের মত করে হাত মেলালাম। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। মনে হলো, অনেক বড় হয়েছি, নিজেকে পুরুষ মনে হতে লাগল। আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। যে কাজের দায়িত্ব আব্বা আমার ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেল, ঠিকই সামলে নিতে পারব সেটা।

মাথা সোজা করে আঁকাবাঁকা পথ ধরে হেঁটে চললাম বাড়ির দিকে। আব্বা ঠিকই বলেছে। এই ক্ষণে আমার একটা কুকুরই দরকার সব চেয়ে বেশি। অন্য সব সেটলারদেরই কুকুর আছে। বড় বড় ভয়ঙ্কর সব খেকি কুকুর, বুনো শুয়োর ধরতে, গরু খেদিয়ে আনতে, আর ফসলের খেত থেকে কুন তাড়াতে খুব কাজে লাগে ওগুলো। যখন তখন এসে পশুর খোয়াড়ে হামলা চালিয়ে বসে পাজি নেকড়ে, ভালুক, চিতাবাঘ। সাদা মানুষের বাড়িতে খাবার লুট করতে আসে ইনডিয়ানরা। এই সব উপদ্রব পুরোপুরি ঠেনোর সাধ্য কুকুরের নেই, কিন্তু পাহারা তো দিতে পারে, সাবধান করে দিতে পারে মানুষকে। একটা ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই; যে এলাকায় বাস করছি আমরা, সেখানে একটা ভাল কুকুর থাকা খুবই প্রয়োজন। অনেক সময় দুতিনজন মানুষ মিলে যা করতে পারে না একটা মাত্র কুকুর তা করে ফেলে। কুকুরের ব্যাপারে কারও চেয়ে কম জানি না আমি, কারণ গত গ্রীষ্মেও ভাল একটা কুকুর ছিল আমার।

ওটার নাম ছিল বেল। বয়েস প্রায় আমারই সমান। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছি ও আমাদের বাড়িতে আছে। ছোটবেলায় অনেক বার র্যাটল স্নেক আর বুনো শুয়োরের হাত থেকে বাঁচিয়েছে আমাকে। আমি বড় হওয়ার পর আমার সঙ্গে শিকারে বেরিয়েছে। একবার বার্ডসং ক্রীকে পানিতে ডুবে মরে যাচ্ছিলাম আমি, টেনে তুলে বাঁচিয়েছে আমাকে। আরেকবার সতর্ক করে দিয়েছে কোমাঞ্চি ইনডিয়ানদের ব্যাপারে। কয়েকজন ইনডিয়ান সেবার আমাদের খচ্চর জাম্পারকে মেরে খেয়ে ফেলতে এসেছিল।

তারপর একটা ছোট্ট বোকামির জন্যে মরতে হলো কেলকে।

ঘটনাটা খুলেই বলি। বাড়ির পেছনে একটুকরো প্রেইরিতে শুকনো ঘাস কাটছিলাম আমি আর আব্বা। ফণার পেছনে হীরে আঁকা বিরাট এক সাপ হঠাৎ ফোস করে উঠে ছোবল মারতে গেল আব্বাকে, দায়ের এক কোপে ওটার মাথা আলাদা করে দিল আব্বা। ধড়টা মোচড় খেতে লাগল, আর ওটার তিন-চার হাত দূরে কুৎসিত মুণ্ডটা মাটিতে পড়ে বার বার হাঁ করতে লাগল, যেন এই অবস্থায়ও কাউকে কামড়ানো হচ্ছে।

বেলের মত বুদ্ধিমান একটা কুকুর যে বোকামিটা করে বসবে কল্পনাও করতে পারিনি আমরা। মাথাটাকে গুঁকতে গেল। পরক্ষণেই গলা ফাটিয়ে দিল বিকট চিৎকার। জোরে জোরে মাথা ঝাড়া দিতে লাগল। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। তার নাক কামড়ে ধরে ঝুলছে কাটা মুণ্ডটা, বিষাদাঁত ঢুকে গেছে নাকের নরম মাংসে। মিনিটখানেক কসরত করার পর ওটাকে নাক থেকে ফেলতে পারল বটে, কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে তখন।

সেই রাতে মারা গেল বেল। পুরো একটা হপ্তা কেঁদেছি আমি ওর জন্যে। আমাকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করেছে আব্বা, তখুনি আরেকটা কুকুরও এনে দিতে চেয়েছে, কিন্তু আমি নিইনি। আরেকটা কুকুর পাব ঠিক, কিন্তু বেলকে তো আর পাব না। অন্য কুকুর এসে ওর জায়গা দখল করবে এটা ভাবতেও রাগ হচ্ছিল।

কুকুরের ব্যাপারে এখনও মনের অবস্থা একই আছে আমার। অন্য কোন কুকুর আর সহ্য করতে পারব না। সে জন্যে একটা ঘোড়াই চাই।

যে পথ দিয়ে হাঁটছি সেটা দিয়ে বার্ডসং ক্রীকে যাওয়া যায়। খাঁড়িটার পাড়ে বেশ কিছু বীমারটল ঝোপ হয়ে আছে। সাদা ফুল ফুটেছে, চমৎকার সুগন্ধ। একটা ঝোপের মাথায় বসে গান গাইছে একটা মকিংবার্ড। মনে করিয়ে দিল, বার্ডসং ক্রীক নামটা কি করে হয়েছে। আব্বার সঙ্গে যেদিন এসে এই এলাকায় উঠেছিল আম্মা, সেদিনই নামটা দিয়েছিল, আমি তখন হইনি, আম্মার মুখে গল্প শুনেছি। বাড়ি করার মালপত্র ছিল একটা গরুর গাড়িতে, বলদগুলোকে চালাচ্ছিল আম্মা, আব্বা তাড়িয়ে নিয়ে আসছিল গরুর পাল আর ঘোড়াগুলোকে। সল্ট ব্রাঞ্চের ওদিকটায় অন্যান্য সেটলারদের কাছাকাছিই বাড়ি করার ইচ্ছে ছিল তাদের। রাত কাটানোর জন্যে তাঁবু ফেলল ঝর্নাটার ধারে। সেদিন ফুলে ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল মার্টল ঝোপ, আর প্রতিটি ঝোপেই বসেছিল একটা করে মকিংবার্ড, গলা ছেড়ে গান গাইছিল। গান গাওয়ার নেশায় পেয়ে গিয়েছিল যেন পাখিগুলোকে। এত সুন্দর জায়গা, এত সুন্দর গন্ধ, এত সুন্দর গান মুগ্ধ করে দিয়েছিল আম্মাকে, জায়গাটা ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেনি আর।

আব্বাকে বলল, এখানেই ঘর করব আমরা।

আব্বা আপত্তি করেনি। দুজনে মিলে একটা ঘর তুলল। ইনডিয়ানদের সঙ্গে রীতিমত লড়াই করে জায়গাটা দখলে রাখল। এক টুকরো জমি পরিষ্কার করে নিয়ে গম চাষ করল। আমাকে, আরলিসকে, আর আমাদের একটা বোনকে জন্ম দিল। জ্বরে মারা গেছে আমাদের সেই বোনটা।

এক সময় আব্বার আর আম্মার ছিল বাড়িটা, এটা এখন আমারও বাড়ি। আব্বা নেই, কাজেই এটাকে দেখে রাখা আমার দায়িত্ব।

আমাদের ঝর্নাটার কাছে চলে এলাম। পাথরের ফাটল থেকে ফিনকি দিয়ে বেরোচ্ছে টলটলে পরিষ্কার ঠাণ্ডা পানি। জমা হচ্ছে গিয়ে একটা বিরাট গামলার মত জায়গায়। তাতে নেমেছে আরলিস। কান পর্যন্ত ডুবিয়ে রেখেছে পানিতে। খাওয়ার পানি নষ্ট করছে।

ডাকলাম, আরলিস, উঠে এসো!

আমাকে জিভ দেখাল আরলিস।

দেখো, ডাল ভেঙে আনছি কিন্তু! ধমক দিলাম।

জবাবে আরেকবার জিভ দেখাল। রাগানোর জন্যে পানি ছিটাতে লাগল আমার দিকে।

ছুরি বের করে একটা মেসকিটের ডাল কাটলাম। ছেঁটে ফেললাম পাতাগুলো, কাঁটা চাঁছলাম। ওটা হাতে নিয়ে এগোলাম তার দিকে।

আরলিস বুঝল মিথ্যে হুমকি দিচ্ছি না আমি। লাফাতে লাফাতে উঠে এল পানি থেকে, গায়ের পানি দিয়ে ভেজাল খুলে রেখে যাওয়া জামা-কাপড়। ন্যাংটো হয়েই গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড় দিল বাড়ির দিকে। ওর চিৎকারে মনে হলো কোমাঞ্চিরা আক্রমণ করেছে বুঝি, জবাই করতে শোয়ানো হয়েছে।

ঘর থেকে ছুটে বেরোল আম্মা। আরলিসকে দেখল। আমাকে দেখল তার পেছনে। আমার এক হাতে মেসকিটের ডাল, আরেক হাতে ভেজা জামা-কাপড়।

রেগে গেল আম্মা, ট্রাভিস, এটা কি হচ্ছে? ও না তোর ছোট ভাই!

জবাব দিলাম, এখনও কিছু হয়নি। তবে খাওয়ার পানি আবার নষ্ট করতে নামলে পিটিয়ে ওর ছাল তুলব আমি।

ওই গর্তে নেমে পানি নষ্ট করলে আব্বা ঠিক একথা বলেই শাসায় আরলিসকে। আমার মনে হলো, আব্বার জায়গা দখল করতে হলে তার মত করেই কথা বলতে হবে।

পুরো একটা মিনিট আমার দিকে তাকিয়ে রইল আম্মা। বোধহয় বোঝার চেষ্টা করল, ওভাবে কথা বলার উপযুক্ত আমি সত্যিই হয়েছি কিনা। বেশি পাকামো করি আমি, আম্মার মুখে একথাটা প্রায়ই শুনতে হয় আমাকে। আজও সেকথা বলবে কিনা ভাবছে বোধহয়। কিন্তু বলল না। ঠোঁটে হাসি ফুটল। চেপে ধরল আরলিসের কান।

আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠে কান ছাড়ানোর জন্যে লাফালাফি করতে লাগল আরলিস। ভেজা কাপড়গুলো নিয়ে এগিয়ে গেলাম। কান ছেড়ে তাকে কাপড় পরিয়ে দিতে দিতে আম্মা শাসাল, দেখ, বিচ্ছু, যদি পিটুনি খেতে না চাস, বড় ভাইয়ের কথা মেনে চলবি। চুপ করে বসে থাকার জন্যে ডগ রান-এ পাঠিয়ে দিল তাকে।

ডগ রান হলো আমাদের কেবিনের দুটো ঘরের মাঝের চালা দেয়া এক টুকরো জায়গা, যার কোন বেড়া নেই। ভীষণ গরমের দিনে ওখানে বসে তরমুজ খাওয়াটা খুব মজার। সে সময় রাতে ওখানে ঘুমাতেও আরাম। অনেক সময় শিকার করে আনা মাংস আমরা ওখানে ঝুলিয়ে রাখি।

ডগ রানে বসে বসে কিছুক্ষণ ফোঁপাল আরলিস। আমি গিয়ে ঝর্না থেকে বালতি দিয়ে পানি তুলে আনলাম। গরুর চামড়া দিয়ে বালতিটা বানিয়েছে আব্বা। পানি এনে ঢাললাম কেবিনের পাশের অ্যাশ হপারে। কাঠের ছাইয়ের ভেতর দিয়ে চুইয়ে ওই পানি গিয়ে জমা হয় নিচে রাখা পাত্রে, একে বলে লাই ওয়াটার। আম্মা ওই পানিতে শুয়োরের চর্বি মিশিয়ে লোহার পাত্রে ফুটিয়ে সেদ্ধ করে সাবান তৈরি করে।

পানি তোলা শেষ করে রান্নার জন্যে লাকড়ি কাটতে গেলাম। ডগ রানে আর বসে থাকতে পারল না আরলিস। আমার পিছে পিছে এল। আমি লাকড়ি ফাড়তে গেলেই সব সময় যেখানে দাঁড়ায়, আজও ঠিক সেই জায়গাটাতেই দাঁড়াল সে। ইচ্ছে করেই দাঁড়াল, যাতে কুড়ালের কোপে কাঠের চিলতে ছিটকে গিয়ে তার চোখে লাগে আর সে চেঁচাতে পারে, আমার দোষ দিয়ে আম্মার বকা শোনাতে পারে আমাকে। আজ তাকে সে সুযোগ দিলাম না, কড়া গলায় ধমক দিয়ে বললাম, এখানে কি? যাও, ঘরে যাও!

অন্য দিন বললে যেত না, কিন্তু আজ টু শব্দ না করে চলে গেল। এমনকি এবার আর জিভও দেখাল না আমাকে। এক জায়গায় ঠায় বসে থাকল।

ডিনার তৈরি করে আমাদের খেতে ডাকল আম্মা।

গমের খেতে চাষ দেয়া বাকি। খাওয়ার পর আমাকে সে কথা আজ আর মনে করিয়ে দিতে হলো না আম্মাকে। টেবিল থেকে উঠেই লাঙলের সঙ্গে জাম্পারকে জুতে নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম। তাড়াহুড়া করে বেরোলাম, তখনই শুরু করতে পারলে সূর্য ডুবতে ডুবতে শেষ করে ফেলতে পারব। আগের দিন যেখানটায় চাষ দেয়া শেষ করে রেখেছে আব্বা, তারপর থেকে দিতে শুরু করলাম।

জাম্পারের চামড়া মেটে রঙের। ঘাড়ের কেশরের ভেতর থেকে কালো সরু একটা ডোরা বেরিয়ে শিরদাঁড়া ধেয়ে চলে গেছে লেজের কাছে। আব্বা ওটার নাম রেখেছে জাম্পার। কারণও আছে। এমন কোন বেড়া ওই এলাকায় আজতক বানাতে পারেনি কেউ যেটা লাফিয়ে ডিঙোতে পারে না খচ্চরটা। হাসতে হাসতে আব্বা বলে, চাঁদের অপর পিঠ দেখারও যদি ইচ্ছে হয়, লাফ দিয়ে ঠিক ওখানে চলে যেতে পারবে সে।

খচ্চর হিসেবে জাম্পার যে খুব ভাল তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমনিতে খুব শান্ত, পিঠে চড়লে রাগে না, কাঁচা মাংসের বোঝা বয়ে আনলে রক্তের গন্ধে ঘাবড়ায় না, লাঙল জুতে দিয়ে যতই টানানো হোক ঠিক টেনে যাবে। তবে সেটা আব্বার বেলায়। আমি নিয়ে গেলেই গোলমাল বাঁধায়। হয়তো ভাবে পিচ্চি ছেলেকে অতটা পাত্তা না দিলেও চলবে। যখনই তার মনে হবে অনেক কাজ হয়েছে, আর দরকার নেই, সঙ্গে সঙ্গে কাজ থামিয়ে দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে যাবে। হয়তো খেতের মাঝখানে আছি, কাজ অনেক বাকি, কিন্তু তার মনে হলো ডিনারের সময় হয়ে গেছে। ব্যস, আর কোন কথা নেই, জমি চষা বাদ দিয়ে সোজা মুখ ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেবে। লাঙলের টানে টানে গমের চারা উপড়ে চলে গেলেও খেয়াল করবে না। লাগাম ধরে থাম, থাম বলে যতই চেঁচাই, কানে তুলবে না।

সেদিন বিকেলেও জাম্পার আমার সঙ্গে এই বেয়াদবিটা করতে চাইল। তবে তৈরি হয়েই এসেছি আমি। আব্বা নেই, জাম্পারকে বুঝিয়ে দিতে হবে আমিই এখন তার বস্। সিডার গাছের একটা ডাল গুঁজে রাখলাম লাঙলের হাতলের ফাঁকে।

তিন-চারটে টান দিলেই চাষ দেয়া শেষ হয়ে যাবে, এই সময় শয়তানীটা করল জাম্পার। জোরে একবার ভ্যাঁ করে উঠে লেজ নাড়তে নাড়তে রওনা হয়ে গেল। যেন লাট সাহেব, দুনিয়ায় আর কারও তোয়াক্কা করার দরকার নেই। ঘুরে গেলে রাস্তা বাড়বে সে জন্যে খেতের কোণাকুণি হাঁটা দিল। গমের চারা উপড়ালে তার কি?

আজ তাকে ডাকলাম না, থাম থাম বলে চেঁচালাম না, সিডারের ডালটা একটানে বের করে নিয়েই ধা করে মেরে দিলাম। চোয়ালের একপাশে লাগল বাড়িটা। এত জোরে মেরেছি, আরেকটু হলেই পড়ে যেত।

অবাক হয়ে গেল খচ্চরটা। দৌড় দিতে গিয়েও দিল না। গোঙাল একবার। ওখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল আমাকে। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না আমি বড় হয়ে গেছি, আমার পক্ষে অত জোরে বাড়ি মারা সম্ভব।

আবার লাঠি তুলে শাসালাম, জাম্পার, জলদি গিয়ে কাজ শেষ কর, নইলে একটা বাড়িও মাটিতে পড়বে না! যা-আ!

আমার প্রতিটি কথা যেন বুঝতে পারল জাম্পার। কাজে ফিরে গেল। বাকি জমিটা চাষ দিয়ে শেষ করলাম, একটি বারের জন্যে আর বেয়াড়াপনা করল না। আব্বা চাষ দিতে গেলে যে আচরণ করে আমার সঙ্গেও তখন তা-ই করল। একটা তফাৎ কেবল, যতক্ষণ তার পাশে পাশে হাঁটলাম, ঘাড় কাত করে একচোখ দিয়ে সতর্ক দৃষ্টি মেলে রাখল আমার দিকে।

কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরলাম। দুধ দোয়ানো সেরে ফেলেছে আম্মা। রাতের খাবার রেডি করে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে আরলিসকে নিয়ে; আব্বা দেরি করে কাজ থেকে ফিরলে আমরা যেমন অপেক্ষা করতাম, তেমনি ভাবে।

সে রাতে আরলিসকে নিয়ে বিছানায় শুতে গেলাম আমি। কয়েকটা গরুর চামড়া সেলাই করে জোড়া দিয়ে কাঠের ফ্রেমে আটকে তার ওপর খড়ের জাজিম পাতা, এই আমাদের বিছানা। কাঁচা মেঝে থেকে দুই ফুট ওপরে। শুয়ে শুয়ে ভাবছি। বার্ডসং ক্রীকের ওপাশের বনে পেঁচা ডেকে উঠছে মাঝে মাঝে। সারা দিন যা কাজ করেছি তার একটা খতিয়ান তৈরি করলাম মনে মনে।

শুরুটা ভালই মনে হলো। আরলিস আর জাম্পারকে বুঝিয়ে দিয়েছি আর আমার সঙ্গে বেয়াদবি করা চলবে না। আম্মাও আমার জন্যে খাবার তৈরি করে নিয়ে বসে থেকেছে, তার মানে বসে থাকার উপযুক্ত মনে করেছে আমাকে।

আত্মবিশ্বাস বাড়ল। মনে হলো, আব্বা না থাকলেও ঠিক তার মত করেই সংসারটাকে চালিয়ে নিতে পারব আমি।

পরদিন সকালে এসে হাজির হলো বিশাল হলদে কুকুরটা।

আলো ফুটেছে তখন। ডগ রানে গিয়ে খানিকটা মাংস কেটে এনে দিতে বলল আম্মা।

দরজা খুলে দেখি মাংসটা নেই। ভালুক-ঘাসে তৈরি দড়ি দিয়ে বেঁধে কাঠের খুঁটিতে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। এখন শুধু দড়িটা ঝুলছে, মাথাটা ছেড়া।

নিচে তাকালাম। এক কোণে একটা পিপা, তাতে কর্নমিল রাখি আমরা। কুণ্ডলী পাকিয়ে ওখানে ঘুমাচ্ছিল কুকুরটা, শব্দ শুনে উঠে দাঁড়াল। বিশাল আকৃতি। খাটো খাটো কান। তারও আবার একটা কাটা। অন্য কোন কুকুরের সঙ্গে লড়াই বাধিয়েছিল বোধহয়, কামড়ে কেটে ফেলেছে। লেজের গোড়াটা একটুখানি আছে শুধু। রোগ, হাড় জিরজিরে কুৎসিত শরীর। পেটটা ফুলে কুমড়া হয়ে আছে।

পেট ওরকম ফুললো কি করে বুঝতে অসুবিধে হলো না। যেখানে শুয়েছিল তার পাশে বড় একটা হাড় পড়ে আছে। একচিমটি মাংস নেই, চেঁচেপুঁছে খেয়েছে।

গত শীতে শুয়োর কেটেছিলাম আমরা। তারই শেষ টুকরোটা বাকি ছিল। এখন সেটাও গেল, রাগ লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি খেপে গেলাম কুকুরটার আচরণে। অপরাধ যে করেছে সেজন্যে সামান্যতম অনুশোচনা নেই, লজ্জা নেই। ধীরে-সুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে, আড়মোড়া ভেঙে, হাই তুলে, একটুখানি-লেজের গোড়া নেড়ে ঘেউ ঘেউ করে এমন ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে এল যেন আমি তার কতদিনের বন্ধু।

হারামজাদা, চোর কোথাকার! গাল দিয়ে উঠে কষে এক লাথি মারলাম।

ঝট করে নিচু হয়ে গেল সে। অল্পের জন্যে ফসকে গেল লাথিটা। কিন্তু দেখলে কেউ বলবে না ফসকেছে। ধপ করে মাটিতে পড়ে, চার পা শূন্যে তুলে বিকট চিৎকার করে উঠল। যেন লাঠি দিয়ে পিটিয়ে ওর হাড়গুলো একটা একটা করে ভাঙা হচ্ছে।

দৌড়ে এল আম্মা। দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে, ট্র্যাভিস?

দেখো না, কোত্থেকে এই চোরের বাচ্চাটা এসে সমস্ত গোস্ত খেয়ে ফেলেছে!

আরেকটা লাথি তুললাম। মারার আগেই চোখের পলকে লাফিয়ে উঠে সরে গেল, আবার মাটিতে পড়ে চেঁচাতে লাগল আরও জোরে।

এইবার বেরিয়ে এল আরলিস। উদোম গা, একটা সুতোও নেই, গরমকালে এরকম করেই ঘুমায় সে। হই হই করে উঠল, কুত্তা! কুত্তা! আমার হাতের নিচ দিয়ে ছুটে গিয়ে বসে পড়ল কুকুরটার পাশে। হাত বুলিয়ে শান্ত করল ওটাকে। তারপর ফিরে তাকাল আমার দিকে, দুচোখে আগুন।

আমার কুত্তাকে মারছ কেন!…তোমাকে আমি তোমাকে আমি… রাগে কথা হারিয়ে ফেলল সে। পিটিয়ে কাপড় পরিষ্কার করার লাঠিটা বেড়ার গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা আছে। ওটা তুলে নিয়ে বাড়ি মারতে এল আমাকে।

আরলিসকে ওভাবে রুখে উঠতে দেখে তো আমি অবাক। হাঁ করে তাকিয়ে আছি। বাড়িটা যখন মারল তখনও কিছু করলাম না। তবে আরেকবার বাড়ি তুলতেই লাফিয়ে সরে গেলাম। লাঠিটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিল আম্মা।

ও তখন বেসামাল। আম্মাকেই কিল মারার জন্যে হাত তুলল। শেষে কি মনে করে নামিয়ে নিল। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল কুকুরটার গলা। আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, ও আমার কুত্তা! খবরদার! ওর গায়ে হাত তুলতে এলে কাউকে ছাড়ব না আমি!

সাহস পেয়ে উঠে দাঁড়াল কুকুরটা। লেজের গোড়া নেড়ে লাল টকটকে জিভ বের করে আরলিসের গালের পানি চেটে দিতে লাগল।

হাসতে হাসতে আম্মা বলল, ট্রাভিস, মনে হচ্ছে আরেকটা কুকুর পেয়ে গেলাম আমরা।

কি বলছ তুমি? ওরকম বিচ্ছিরি একটা কুত্তা রাখব? এক নম্বরের চোর। রাতে এসে চুরি করে সব গোস্ত খেয়ে ফেলেছে।

রাখতে পারলে তো রাখবই। তবে ওর মালিক নিতে এলে আর কিছু করার নেই। সেটলারদেরই কারও হবে।

এখানকার কারও না। সল্ট লিকের সব কুত্তা আমি চিনি।

তাহলে আর কি। আরলিসের পছন্দ হয়েছে, রেখে দিক। বুদ্ধি আছে বুঝতে পারছি। এত উঁচুতে রাখা মাংস পেড়ে খেয়েছে। পিপাটার ওপর উঠে টেনে নামিয়েছে।

এগিয়ে গেলাম। পিপার ঢাকনার দিকে তাকিয়েই বুঝে গেলাম আম্মার কথা ঠিক। ধুলোর হালকা আস্তরণের ওপর কুকুরের পায়ের ছাপ।

হ্যাঁ, চোরগুলো চালাকই হয়, নইলে চুরি করবে কি করে? এই কুত্তা রাখা যাবেনা।

ট্রাভিস, এবার কিন্তু অন্যায় হচ্ছে। তুই তো জন্মেই কুকুর পেয়েছিলি। আরলিস কি পেয়েছে? তুই থাকবি হাজারটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ওর সঙ্গে কে খেলবে? অতটুকুন একটা ছেলে একা কি থাকতে পারে, বল? একটা কিছু তো দরকার?

চুপ হয়ে গেলাম। এখন আর কিছু বলে লাভ নেই। কোন ব্যাপারে আম্মা একবার মনস্থির করে ফেললে সহজে আর তার মত বদলানো যায় না। কিন্তু ওরকম একটা চোরকে রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। আপাতত কিছু না বলাই ভাল। সুযোগ আসবেই। তখন ওটাকে তাড়াব।

রান্না করতে চলে গেল আম্মা। ফায়ারপ্লেসের ওপর একটা হাঁড়ি ঝুলিয়ে কর্নমিলের জাউ রাঁধল। তাতে মধু ঢালল। গেল বসন্তে আমি আর আব্বা বনের ভেতরের একটা গাছ থেকে মৌমাছির চাক কেটে মধু বের করেছিলাম। তারই খানিকটা রয়ে গেছে এখনও। মিষ্টি জাউয়ে মাখন মিশিয়ে আমাদের খেতে দিল।

চমৎকার স্বাদ, কোন সন্দেহ নেই। তবু এই মুহূর্তে এই মিষ্টি খাবার ভাল লাগল না। মাংস দরকার। ভাজা মাংস। কিন্তু পাব কোথায়? সব খেয়ে ফেলেছে পাজি কুকুরটা। আবার রাগ হতে লাগল ওটার ওপর। ইচ্ছে হলো এক বাড়িতে মাথা ফাটিয়ে দিই।

আমার মনের ভাব বুঝতে পারল আম্মা। খাওয়া শেষ হওয়ার আগে কিছু বলল না। কয়েকবার কোমল দৃষ্টিতে তাকাল কেবল। তারপর নরম গলায় বলল, ট্রাভিস, এক কাজ কর, গরু দোয়ানো শেষ করে বন্দুক নিয়ে বনে চলে যা। হরিণ মেরে নিয়ে আয়। মাংস হয়ে যাবে।

শিকার করতে আমার খুব ভাল লাগে। নরম হয়ে এলাম অনেকটা। কুত্তাটার ভাবনা আপাতত দূর করে দিলাম মন থেকে।

উঠে গিয়ে গরু দোয়ালাম। বালতিতে করে এনে দিলাম আম্মাকে। দুধের ব্যাপারে আমার দায়িত্ব শেষ, যা করার এখন আম্মাই করবে। রাইফেলটা বের করে নিয়ে চলে এলাম জাম্পারের কাছে। একটা দড়ির এক মাথা ওর গলায় বেঁধে বাকিটুকু দিয়ে ফাঁস বানিয়ে নাকে এঁটে দিলাম, দড়ির অন্য মাথাটা ব্যবহার করব লাগামের মত। আরেকটা দড়ি পেঁচিয়ে রাখলাম ওর পিঠে। হরিণ পাওয়া গেলে বেঁধে আনার জন্যে।

জাম্পারের পিঠে জিন পরানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না। লাফিয়ে উঠে বসলাম। এগোলাম বার্ডসং ক্রীকের ধার দিয়ে। শুয়োরের পিঠের মত দেখতে একটা শৈলশিরা ধরে এগোতে এগোতে ভাবলাম, ইস্, একটা ঘোড়া থাকত যদি আমার! বুড়ো খচ্চরের পিঠে চড়ার চেয়ে ঘোড়ায় চড়া অনেক আরামের।

চওড়া একটা ঢালের কাছে চলে এলাম। ঘাসবনের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জন্মে আছে ওকগাছ। ঘাস এখানে এত উঁচু, জাম্পারের পেট ছুঁয়ে যায়। সল্ট লিকের সিকি মাইল দূরে এসে থামলাম। খচ্চরটাকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে পায়ে হেঁটে এগোলাম।

ওকে সঙ্গে নিলে ঝামেলা করবে, তাই নিলাম না। সারাক্ষণ লেজ নেড়ে মাছি তাড়াবে, অকারণেই পা ঠুকবে মাটিতে, তাতে ঘাবড়ে গিয়ে সরে যেতে পারে হরিণ। বন্দুকের গুলির শব্দকে সাংঘাতিক ভয় পায় সে। শুনলেই ভড়কে গিয়ে দড়ি ছিড়ে পালাতে চাইবে। গলায় ফাঁসি লেগে দম আটকে মরারও পরোয়া করবে না। কিংবা ধপ করে মাটিতে পড়ে গিয়ে এমন ভঙ্গি শুরু করবেযেন গুলিটা তার গায়েই লেগেছে।

সুন্দর একটা সকাল, শিকারের জন্যে উপযুক্ত। উজ্জ্বল রোদে ঝলমল করছে লম্বা সবুজ ঘাস, বনের পাতা। হাওয়া খুব কম। পাতা নড়ে না। দেখে বোঝার উপায় নেই কোন দিক থেকে বইছে। একটা আঙুল চুষে ভিজিয়ে ওপর দিকে তুলে ধরলাম। যেদিক থেকে হাওয়া বইছে আঙুলের সেদিকটায় ঠাণ্ডা লাগবে। বোঝা গেল আমার দিক থেকে সল্ট লিকের দিকে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। আমার গায়ের গন্ধ পেয়ে যাবে হরিণ। আর এগোবেই না।

লিকটাকে এক পাশে রেখে হাঁটতে শুরু করলাম। দূর দিয়ে ঘুরে চলে এলাম এমন এক জায়গায় যেখানে লিকের দিক থেকে আমার দিকে বইছে বাতাস। হরিণ আর আমার গন্ধ পাবে না। অনেক বেশি ঝুপড়ি একটা ওকের ডাল থেকে ঝুলে রয়েছে বুনো আঙুরের ঝাড়। গাছের গায়ে পিঠ দিয়ে তার ভেতরে লুকিয়ে বসলাম। রাইফেলটা রাখলাম দু-হাঁটুর ওপর। স্থির হয়ে রইলাম গাছটার মতই।

ওভাবে বসতে আব্বাই আমাকে শিখিয়েছে। সেই ছোটবেলা থেকেই প্র্যাকটিস করতে করতে ওস্তাদ হয়ে গেছি এ ব্যাপারে। আব্বা বলে, তোর আকৃতিটা হরিণের চোখে পড়বে না, পড়বে নড়াচড়া। যদি গন্ধ না পায়, নড়াচড়া না দেখে, তোর দিকে তাকিয়ে থেকেও বুঝতে পারবে না তুই ওখানে আছিস।

সুতরাং ওভাবেই বসে রইলাম। চোখ ঘুরছে লিকের চারপাশের খোলা জায়গায়।

পাথরের ছড়াছড়ি ওখানে, ওগুলোর মাঝে মাঝে কালো দাগ। দাগগুলোতে রয়েছে লবণ। আব্বার কাছে শুনেছি, কোটি কোটি বছর আগে ওই লবণ পাথরে মিশেছে। এত আগের কথা কি করে জানল সে, সেটা আমার ধারণার বাইরে, তবে লবণ যে আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। শুয়োর, হরিণ এবং বুনো ও পোষ সমস্ত জানোয়ার আসে ওখানে লবণ চাটতে। সল্ট লিক নামটাও সেজন্যেই হয়েছে।

এই লবণ মানুষেও খেতে পারে। তবে নেহায়েত ঠেকায় না পড়লে কেউ খায় না। আমার জন্মের আগে আব্বা-আম্মাও নাকি একবার ঠেকায় পড়েছিল। লবণ ফুরিয়ে গিয়েছিল। আম্মা তো ভেবে অস্থির। লবণ ছাড়া কিছু খাওয়া যায় না। আব্বা শেষে ওই পাথর বাড়ি নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে ভেঙে পানিতে গরম করে লবণ বের করেছিল। সেই লবণ গোলা পানি দিয়ে মাংস নোনা করেছিল, ময়দায় মেখে রুটি তৈরি করেছিল।

বুনো জানোয়ারেরা লবণ চাটতে আসে সাধারণত সকালের শুরুতে আর শেষ বিকেলে, তখনই হরিণ শিকারের উপযুক্ত সময়। ভালুক, চিতাবাঘ আর বনবিড়ালের মত মাংসখেকো শিকারী প্রাণীরাও জানে এটা, তাই এই সময় ওরাও আসে শিকার ধরতে। হরিণ মারতে এসে এখানে দুবার দুটো বনবিড়াল মেরেছি আমি, আরেকবার মেরেছি একটা নেকড়ে। আব্বা, মেরেছে একটা চিতাবাঘ। একটা খচ্চরের বাচ্চাকে মেরে ফেলেছিল ওটা।

ভালুক আর চিতাবাঘ শিকারের ইচ্ছে আছে আমার। সুযোগ পেলে আজকেও ছাড়ব না। কিন্তু এল একদল হ্যাভেলিনা শুয়োর। ওগুলোকে গুলি করার বিপদ আমার ভাল করেই জানা। কোনটাকে জখম করলেই হয়, দল বেঁধে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে শিকারীর ওপর, জ্যান্ত ছিড়ে খেয়ে ফেলবে। ছোট জানোয়ার ওরা, দাঁতও পোষা শুয়োরের চেয়ে খুব একটা বড় নয়, কিন্তু রাগ খুব বেশি। একবার কাউকে তাড়া করলে তাকে শেষ না করে আর স্বস্তি নেই।

একবার হ্যাভেলিনা শুয়োরের পালে গুলি চালিয়েছিল জেড সিম্পসনের ছেলে রোজাল। তেড়ে এল শুয়োরের দল। আর কোন উপায় না দেখে একটা মেসকিট গাছে উঠে পড়ল সে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে আটকে রাখল শুয়োরেরা। যে গাছটায় উঠেছিল সে সেটা ছোট গাছ। দুটো শুয়োর সারাক্ষণ লাফিয়ে লাফিয়ে ধরার চেষ্টা করল তাকে, বাকিগুলো দাঁত দিয়ে কামড়ে গাছটাকে কেটে মাটিতে ফেলার চেষ্টা করল। পারেনি অবশ্য। সেই থেকে হ্যাভেলিনাকে গুলি করা তো দূরের কথা, দেখলেই পাঁচশো হাত দূর দিয়ে সরে যায় রোজাল।

শুয়োরগুলো চলে গেল। কয়েকটা ববহোয়াইট কোয়েল এসে নামল, পাথরগুলোর আশেপাশে ঠুকরে ঠুকরে পোকা খেতে লাগল। তারপর এল তিনটে গরু, সঙ্গে একটা বাছুর, আর একটা ষাঁড়। এসেই পাথর চাটতে আরম্ভ করল। কিছুক্ষণ ওগুলোকে দেখে চোখ তুললাম ওপর দিকে। আমি যে গাছে ঠেস দিয়ে বসেছি সেটার ডালেই খেলা জুড়েছে দুটো কাঠবেড়ালি।

দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি করছে ওরা, কিচির মিচির করছে। রোদ লেগে লেগে ঝিক করে উঠছে ওগুলোর রোমশ ফোলানো লেজ। একটা কাঠবেড়ালি লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল দূরের ডালে, ওখানে বসে ফিরে তাকিয়ে কিচকিচ করতে লাগল। যেন চ্যালেঞ্জ করছে তার সঙ্গীকে, দাও তো দেখি আমার মত লাফ! লাফ দিল তার সঙ্গী। ঠিকই পার হয়ে গেল। আবার লাফ দিল প্রথমটা। এবার আরও দূরের একটা ডালে। ফিরে বসে তাকাল সঙ্গীর দিকে, অর্থাৎ এবার দেখি কেমন পারো? ঠিকই পার হলো দ্বিতীয়টা। এরকম করতে করতে অনেক দূরের একটা ডালে যেতে গিয়ে থাবা ফসকাল প্রথমটার, পাতা খামচে ধরে আটকে থাকার চেষ্টা করল, পারল না, পড়ে গেল মাটিতে। তাই দেখে দ্বিতীয়টার কি উল্লাস। নাচতে শুরু করল। সেই সঙ্গে কিরকির কিরকির করে এক ধরনের বিচিত্র শব্দ। অট্টহাসি হেসে বলতে চাইছে, খুব তো বাহাদুরি করেছিলে, এখন!

আমিও হেসে উঠলাম। এবং ভুলটা করলাম।

কি করে আমার অলক্ষ্যে এত কাছে চলে এসেছে হরিণটা বলতে পারব না। যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়েছে। আমার গাছটার দিকেই তাকিয়ে আছে। ফোঁস ফোঁস করছে, বাতাস শুঁকছে, একটা পা ঠুকছে মাটিতে।

এখনও আমার গন্ধ পায়নি। সম্ভবত দেখেওনি। নড়লাম না। জোরেই হেসে ফেলেছিলাম, কানে গেছে হরিণটার, সন্দেহ করে বসেছে।

রাইফেল কাঁধে তুলতে ভরসা পেলাম না। নড়াচড়াটা ঠিক চোখে পড়ে যাবে তার, ছুটে পালাবে। আব্বা থাকলে অবশ্য অন্য কথা ছিল, তার নিশানা খুব ভাল, ছুটন্ত হরিণকেও ফেলে দিতে পারে, আমার অতটা আত্মবিশ্বাস নেই। তার চেয়ে চুপ করেই থাকি, দেখা যাক কি হয়। এক সময় না এক সময় চোখ ফেরাবেই সে, সেই সুযোগে তুলে নেব।

বসে আছি তো আছিই, চোখ আর ফেরায় না হরিণটা। একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে। শেষে আস্তে আস্তে এগোতে শুরু করল আমার দিকে।

কি করব বুঝতে পারছি না। অস্বস্তি লাগছে। দূর থেকে আমাকে চিনতে না পারলেও কাছে এসে ঠিকই চিনে ফেলবে। চোখের পলকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটতে শুরু করবে তখন, এত দ্রুত, গুলি করার সুযোগই হয়তো দেবে না।

উত্তেজনায় বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটছে আমার। টানটান হয়ে গেছে সমস্ত পেশী। আর দেরি করা যায় না। এমনিতেও যাবে ওটা, ওমনিতেও, চুপ করে বসে থাকার চেয়ে বরং একটা সুযোগ নিয়েই দেখা যাক। একটানে রাইফেল তুলে নিলাম কাঁধে।

যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই করল হরিণটা, ঘুরেই দৌড়। নলের মাছির সামনে বাদামী একটা ঝিলিক দেখলাম শুধু। সই করার আর সময় পেলাম না। টিপে দিলাম ট্রিগার।

কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেল আমার সামনেটা। তার ভেতর দিয়ে কিছুই চোখে পড়ল না। তাড়াতাড়ি রাইফেলে আরেকটা গুলি ভরেই লাফিয়ে উঠে দৌড় দিলাম ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে। অন্য পাশে বেরিয়ে যা দেখলাম তাতে দমে গেল মনটা।

ঝোপঝাড় ভেঙে লেজ তুলে ছুটে পালাচ্ছে ভীত গরুগুলো। ঘোৎ-ঘোৎ করছে। যেন ভূতে তাড়া করেছে ওগুলোকে। ওগুলোর পাশেই ছুটছে আমার হরিণটা। পিঠ বাঁকা। ছোট সাদা লেজটা লেপটে আছে গায়ের সঙ্গে।

বুঝতে পারলাম, গুলি লেগেছে, তবে মারাত্মক কিনা বোঝা গেল না।

ভাল লাগল না এটা। মাংসের জন্যে শিকার করতে খারাপ লাগে না আমার। আব্বা বলে, খাওয়ার জন্যে একজন আরেকজনকে মারতেই পারে, সেটা আলাদা কথা, কিন্তু জখম করে ছেড়ে দেয়াটা বড় খারাপ। বিশেষ করে হরিণের মত সুন্দর একটা প্রাণীকে। এভাবে জখম হয়ে পালিয়ে যাবে ওটা, তারপর অসহ্য যন্ত্রণা পেয়ে ধুকে ধুকে মরবে, ভাবতেই খারাপ লাগল।

আবার রাইফেল তুললাম। কিন্তু গরুগুলোর জন্যে গুলি করতে পারলাম না। মিস হয়ে হরিণের গায়ে না লেগে শেষে গরুর গায়েই লেগে যেতে পারে।

হঠাৎ অদ্ভুত এক কাণ্ড করল হরিণটা। সোজা ছুটে গেল একটা গাছের দিকে। যেন কানা হয়ে গেছে। গাছের গায়ে বাড়ি লাগল মাথা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। ডুবে গেল ঘাসের মধ্যে। অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে শুধু চোখে পড়ল তার সাদা পেটটা।

অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু উঠল না ওটা। কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে দিলাম দৌড়। চিবুক সমান উঁচু ঘাসের মধ্যে দিয়ে ছোটাও কঠিন। গতি বাড়ানো যায় না।

অবশেষে পৌঁছলাম এসে জায়গাটায়। দম ফুরিয়ে গেছে। জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে দেখলাম, মরে পড়ে আছে হরিণটা। গুলিটা লেগেছে পেটের একপাশে, হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি।

কি যেন একটা ঘটে গেল নিজের ভেতর। এক লাফে যেন অনেক বড় হয়ে গেলাম। অনেক ক্ষমতাবান আর শক্তিশালী মনে হতে লাগল নিজেকে। তারমানে নিশানা আমার ভালই, গুলি করতে জানি। অহেতুক একটা জানোয়ারের কষ্টের কারণ হইনি। পরিবারের জন্যে মাংস জোগাড় করতে এসেছি, ছুটন্ত হরিণকে গুলি করে ফেলে দিয়েছি, ঠিক আব্বা যা করে। আর কি চাই?

ফিরে চললাম বাড়িতে। পেট চিরে নাড়িভূঁড়িগুলো খুলে ফেলে দিয়ে হরিণটাকে বেঁধে নিয়েছি আমার পেছনে, জাম্পারের পিঠে। গর্বে ফুলে আধহাত উঁচু হয়ে গেছে বুক। শিকারির গর্ব। বার বার একটা কথাই মনে হচ্ছে, আমি সফল, পরিবারের জন্যে খাবার নিয়ে যেতে পারছি। একটা মাত্র গুলিতে অত কঠিন নিশানাকে ফেলে দিতে পেরে নিজেকে অনেক বড় শিকারি মনে হচ্ছে। অনেক বড় হয়ে গেছি যেন। কুকুরটার ব্যাপারে আরলিসকে এখন সিদ্ধান্ত দিতে পারি। তবে রাখতে না দেয়ার কথাটা আর ভাবলাম না। রাখতে চাইছে, রাখুকগে। ছোটদের এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে বড়দের মাথা না ঘামানোই ভাল। কুকুরটা যে চোর, সেটা ভেবেও আর বিরক্ত হলাম না। আরলিসকে খুশি করার জন্যেই ওটাকেও খাওয়াব, কারণ, মাংস জোগাড় করাটা এখন আমার জন্যে কোন ব্যাপার না।

ভাবতে ভাবতে চলেছি। যতই ভাবছি, ততই উদার হয়ে যাচ্ছে মন। বার্ডসং ক্রীক পেরিয়ে গাছপালার নিচ দিয়ে এগোলাম ঘরের দিকে।

হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেল আমার সমস্ত উদারতা। ডোবার মধ্যে আবার দেখলাম আরলিসকে। সে একা নয়, এবার তার সঙ্গে নেমেছে বিশাল কুকুরটাও। চোর, নোংরা, কুৎসিত জানোয়ারটাকে খাওয়ার পানি নষ্ট করতে দেখে আগুন ধরে গেল মাথার মধ্যে।

আরলিস! চিৎকার করে উঠলাম। জলদি পানি থেকে তোল কুত্তাটাকে!

আমাকে আসতে দেখেনি ওরা। চিৎকার শুনে ভীষণ চমকে গেল দুজনেই। লাফাতে লাফাতে পানি থেকে কুকুরটা উঠল একদিক দিয়ে, আরলিস আরেক দিক দিয়ে। গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে আরলিস। আর সেটা দেখেই এমন খাউ-খাউ জুড়ে দিল কুকুরটা, যেন আমি একটা প্যানথার, খেয়ে ফেলতে এসেছি ওদেরকে।

লাফ দিয়ে নামলাম খচ্চরের পিঠ থেকে। চিৎকার করতে করতে কুকুরটা এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে, ভাবসাব ভাল না, কামড়েও দিতে পারে। তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে কয়েকটা পাথর তুলে নিলাম।

আরেকটু এগিয়ে এল ওটা। বড় একটা পাথর ছুঁড়লাম ওটাকে সই করে। থ্যাপ করে গিয়ে লাগল দুচোখের মাঝখানে। বিকট এক চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল ওটা। কাঁপতে লাগল থরথর করে। বার দুই কুঁই কুঁই করে এক গড়ান দিয়ে সোজা হয়ে আবার উঠে দাঁড়াল। বিন্দুমাত্র সময় না দিয়ে আরেকটা পাথর ছুঁড়লাম। লাগল পাজরে। যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেল। কেঁউউ কেঁউউ করতে করতে লেজের গোড়াটা দাবিয়ে ছুটে পালাল বাড়ির দিকে।

আমিই পাথর ছোঁড়ায় একমাত্র ওস্তাদ নই। আরলিসের বয়েস কম, মাত্র পাঁচ, কিন্তু তাতে কি? ট্রেনিং দিয়ে দিয়ে এই বয়েসেই ওকেও আমারই মত ওস্তাদ করে তুলেছি। ওই মুহূর্তে আফসোস হতে লাগল, কেন শেখালাম! আরেকটু হলেই আমার বা কানটা ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছিল ওর একটা পাথর। কুকুরটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, পাথরটা কানে লেগে বেরিয়ে যেতেই চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরলাম। ঝট করে মাথা নামিয়ে ফেললাম, নইলে দ্বিতীয় ঢিলটা লাগত আমার বাঁ চোখে।

ধমক দিয়ে বললাম, আরলিস, ভাল চাস তো ওসব বন্ধ কর!

কানেই তুলল না সে। ভয়ে আর রাগে অন্ধ হয়ে গেছে। আরেকটা বিশাল পাথর তুলে নিল। ছুঁড়ে মারার শক্তি থাকলে ওটা দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিত আমার।

চোদ্দ বছর বয়েসে নয় বছরের ছোট ভাইয়ের সঙ্গে পাথর ছোড়াছুঁড়ির যুদ্ধ শোভা পাবে না তোমার। অন্যায়টা তার হয়ে থাকলেও নয়। কিছুতেই বলে বোঝাতে পারবে না একথা বড়দের। তারা তোমাকেই ধিক্কার দেবে, ছি-ছি করবে। বলবে, অত বড় হয়ে ওই অবোধ দুধের শিশুর সঙ্গে লাগতে তোমার লজ্জা করল না? বোঝানো যাবে না, অবোধটি মোটেও অবোধ নয়, আস্ত বিচ্ছু।

সুতরাং এ ক্ষেত্রে যে কাজটা করণীয়, তা-ই করলাম। ইয়েলারটার মতই দৌড় দিলাম বাড়ির দিকে। ওটা কেঁউ কেউ করতে করতে গেছে, আমি ডাকতে ডাকতে গেলাম আম্মাকে।

তেড়ে এল আরলিস। উলঙ্গ শরীর, হাতে পাথর। ওটা দিয়ে আমার মাথা ফাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছেটা ত্যাগ করতে পারছে না কিছুতেই। লক্ষ্য ভেদ করার জন্যে মরিয়া হয়ে আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে।

দৌড়ে অবশ্যই আমার সঙ্গে পারার কথা নয় তার, পারল না। অনেক পেছনে ফেলে দিলাম তাকে। ইতিমধ্যে বেরিয়ে এল আম্মা। স্কার্টের ঝুল উড়িয়ে দৌড়ে এল আমাদের দিকে। এই, কি হয়েছে রে! কি হয়েছে!

চেঁচিয়ে বললাম, আরলিসকে ধরো! বলেই আম্মার পাশ দিয়ে একদৌড়ে বেরিয়ে গেলাম।

ধরে ফেলল আম্মা। কিন্তু আরলিস তখন যেন পাগল হয়ে গেছে। হাত ছাড়ানোর জন্যে টানাটানি করতে লাগল। মনে হচ্ছে আম্মাকেই মেরে বসবে।

যা ঘটবে আশা করেছিলাম, ঠিক তা-ই ঘটল। খাওয়ার পানিতে কুত্তা নিয়ে নামার অপরাধে আরলিসকে ভালমত ধোলাই দিল আম্মা। তারপর আমাকে বকতে লাগল ওর সঙ্গে অত মুরুব্বিয়ানা ফলাতে যাওয়ায়। আর যে কুকুরটা, যার শয়তানীর জন্যে এত কিছু ঘটে গেল, সেটাকে কিছুই বলা হলো না, দিব্যি রেহাই পেয়ে গেল।

বার বার মনে হতে লাগল, আমার প্রতি মোটেও সুবিচার করা হয়নি। এই যদি হয় অবস্থা, পরিবারের দায়িত্ব নেব কিভাবে? আমার কথাই যদি না শোনে, কি ভাবছি না বোঝে, ওদেরকে চালাব কি করে?

ফিরে গিয়ে জাম্পারকে টেনে নিয়ে এলাম উঠানে। বাড়ির পাশের ওক গাছটায় হরিণটাকে ঝুলিয়ে চামড়া ছিলতে শুরু করলাম। কত আশা করে এসেছিলাম, হরিণটাকে মারার জন্যে অনেক বাহবা পাব, আমার অনেক প্রশংসা করবে আম্মা। অথচ কি হয়ে গেল? আমাকে পাত্তাই দিল না। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে লাগতে যাওয়ার জন্যে বকাঝকা করল, যদিও পুরো দোষটাই তার। আমাকে আরলিসের চেয়ে একটুও আলাদা করে ভাবছে না, বড় মনে করছে না।

চামড়া ছিলে মাংস কাটতে শুরু করলাম। কেবলই ভাবছি একটু আগের ঘটনাটার কথা। যতই ভাবলাম, ততই রাগ বাড়তে লাগল কুকুরটার ওপর।

ডগ রানে ঝুলিয়ে দিলাম বড় বড় কাটা টুকরোগুলো। এখান থেকেই শুয়োরের মাংস চুরি করে খেয়েছিল শয়তান কুত্তাটা। ইচ্ছে করেই ঝোলালাম ওখানে। দুটো কারণে। জায়গাটা খুব ঠাণ্ডা, মাংস ভাল থাকে। আরেকটা কারণ, দেখতে চাই আবারও চুরি করে কিনা সে। তাহলে ওটাকে তাড়ানোর একটা ভাল ছুতো পেয়ে যাব। এইবার চুরি করলে আর রাখবে না ওকে আম্মা, আরলিস যতই কান্নাকাটি করুক।

কিন্তু আমার ফাঁদে পা দিল না ওল্ড ইয়েলার। আমার ছুঁড়ে দেয়া হাড় চুষতে লাগল বসে বসে। ফিরেও তাকাল না ডগ রানের দিকে। ওখানে যে রসাল মাংস ঝোলানো আছে, তার গন্ধই যেন পায়নি।

দুদিন পর আরও খেপে গেলাম ওল্ড ইয়েলারের ওপর। কারণটা খুলেই বলি।

দুটো লংহর্ন ষাঁড় এসে আমাদের উঠানে ঝগড়া বাঁধাল। রুটি, হরিণের মাংস ভাজা, আর ঝর্নার ভাটি থেকে তুলে আনা শালুক দিয়ে ডিনার খাচ্ছিলাম। দক্ষিণের উঁচু শৈলশিরা থেকে নেমে এল একটা ষাঁড়। ক্যাটক্ল আর ওকের জঙ্গলের ভেতরে ওটার ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শুনতে পেলাম। রেগেছে কোন কারণে।

কিছুক্ষণ পর গলা চড়িয়ে এমন চিৎকার শুরু করে দিল যেন শিঙ্গা ফুঁকছে-পাহাড়ের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে গেল চারপাশে কয়েক মাইল।

ব্যাটার মাথা গরম হয়েছে, আম্মা আর আরলিসকে বললাম। বলছে, আমার চেয়ে কে বড়, গায়ে জোর বেশি, আয় দেখি, হয়ে যাক এক হাত-সামনে পড়লে বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়ব।

কিন্তু বাপের নামের পরোয়া করল না একটা বোকা ষাঁড়। সল্ট লিকের কাছে কোথাও থেকে বলল, কোথাকার কোন হাঁদারাম রে! এত বড় বড় কথা! তোকে তো আমি এক ফুয়ে উড়িয়ে দিতে পারি! আমি হলাম গে এ অঞ্চলের রাজা! আমার সঙ্গে মাতব্বরী করতে এসেছিস তুই কে রে!

বসে বসে শুনতে লাগলাম ওগুলোর হাঁক-ডাক। ঝোপের ভেতর দিয়ে একটা আরেকটার কাছাকাছি চলেছে। রেগে আগুন হচ্ছে ক্রমেই।

ষাঁড়, ভালুক, বুনো শুয়োর এসব বুনো জানোয়ারের লড়াই দেখতে আমার ভাল লাগে। এক লাফে উঠে ছুটে গেলাম দরজার কাছে। কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম। ঠিক করে ফেলেছি, লড়াই যদি বাঁধে, দেখতে যাবই আজ। প্রচুর আগাছা হয়েছে খেতে, নিড়ানি দেয়া দরকার, সেই কাজ বাদ দিয়ে হলেও লড়াই দেখব।

ঝর্নার শখানেক গজ ওপরে একটা উঁচু জায়গায় আমাদের ঘরটা। অনেক দিন আগেই আশেপাশের সমস্ত গাছপালা, বন-জঙ্গল কেটে সাফ করে দিয়েছে আব্বা। ঘরের কাছাকাছি দুটো ওক রেখে দিয়েছে শুধু, ছায়া পাওয়ার জন্যে। বাড়ির পাশে জঙ্গল হয়ে থাকলে এমনিতেই ভাল লাগে না। তবে কেটে ফেলার আরও একটা কারণ আছে। কোমাঞ্চি কিংবা অ্যাপাচি ইনডিয়ানরা আমাদের মাথা কাটতে আসতে চাইলে যাতে দূর থেকেই তাদের দেখতে পারে, গুলি চালিয়ে খতম করে দিতে পারে, সেই জন্যে। দরজা থেকেই নিচের অনেকখানি চোখে পড়ে। খোলা জায়গায় বেরোতে দেখলাম প্রথম ষাঁড়টাকে। অনেক দিন আগে ওখানে একটা কোমাঞ্চিকে গুলি করে ঘোড়ার পিঠ থেকে ফেলে দিয়েছিল আব্বা।

সরষে রঙের চামড়া ষাঁড়টার। চোয়াল আর পেটের নিচে কালো ফুটকি। বিশাল দুটো শিঙের একটার মাথা ওপর দিকে তোলা, খোঁচা মারার মস্ত সুবিধে, মারাত্মক অস্ত্র। আরেকটা নিচের দিকে ঝুলে আছে অদ্ভুত ভঙ্গিতে, যেন মোমের তৈরি, গরমে নরম হয়ে ঝুলে গেছে। এরকম শিংওয়ালা বঁড়কে মেকসিকানরা বলে চোঙ্গো, অর্থাৎ ঝোলা শিং।

দুলকি চালে হেঁটে এসে খোলা জায়গাটায় ঢুকল সে। মাথাটা নিচু করে একবার ঝাড়া দিল। তারপর শুরু করল একনাগাড়ে ঘোঁৎ-ঘোৎ। শিং ঝাড়ছে আর সামনের খুর দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। সেগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছে ঘাড়ের ওপর দিয়ে, ধুলোর ঝড় তুলছে।

অন্য ষাঁড়টাকে দেখতে পাচ্ছি না, তবে ডাক শুনে বুঝতে পারছি কাছাকাছিই আছে, এগিয়ে আসছে দ্রুত।

চেঁচিয়ে ডাকলাম আম্মা আর আরলিসকে। জানালাম, ভাল জায়গায় এসেছে। দেখতে পারব।

আমাদের কেবিনের চারপাশে কাঠের বেড়া। দৌড়ে গিয়ে উঠে বসলাম তার ওপরে, যাতে আরও ভাল করে দেখতে পাই। আম্মা আর আরলিসও এসে আমার পাশে উঠে বসল।

খোলা জায়গাটার আরেক পাশ দিয়ে ঢুকল দ্বিতীয় ষাঁড়টা। সেই লাল গরুটা, হরিণ মারতে গিয়ে সল্ট লিকের কাছে যেটাকে দেখেছিলাম। চোঙ্গোর মত পা অত লম্বা নয়, এত উঁচু আর বড়ও নয়, তবে শরীরটা বেশ গাট্টাগোট্টা, ভারি, গায়ে জোরও আছে বোঝা যায়। খাটো খাটো শিং, তবে দুটোই ওপর দিকে তোলা, দুদিক থেকেই খোঁচা মারতে পারবে।

লালুও চোঙ্গোর মত শিঙ্গা বাজাতে বাজাতে ঢুকল। থমকে দাঁড়িয়ে দেখল একবার প্রতিপক্ষকে। তারপর শিং ঝেড়ে, খুর দিয়ে খুঁচিয়ে মাটি তুলে, পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল, লড়াই করতে তারও এক বিন্দু আপত্তি নেই।

ঠিক এই সময় কেবিনের পেছন থেকে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে বেরোল ওল্ড ইয়েলার। ঘাড়ের রোম দাঁড়িয়ে গেছে। ষাঁড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিৎকার। ছুটে গেল বেড়ার নিচ দিয়ে। গরুর অত বাহাদুরি পছন্দ হয়নি তার। চিৎকার করে যেন বলতে লাগল, হারামজাদা, বেল্লিক কোথাকার, মরার আর জায়গা পাওনি! যা এখান থেকে, অন্য কোথাও গিয়ে মরগে যা!

ধমক দিয়ে বললাম, সর্ হারামজাদা কুত্তা! তোকে কে মাতব্বরি করতে বলেছে!

লাফালাফি বন্ধ হলো তার, কিন্তু চুপ করল না। চেঁচিয়েই চলল।

ভীষণ রাগ লাগল। লাফ দিয়ে নামলাম মাটিতে। একটা পাথর তুলে নিলাম। আমার ঢিল কি জিনিস জানা আছে তার। মারতে আর হলো না, আমি হাত তুলতেই কেঁউ কেঁউ করে ছুটে পালাল। গিয়ে লুকাল কেবিনের পেছনে।

গেল রেগে আরলিস। আমাকে গালাগাল শুরু করল। তাতেও আমার কিছু হচ্ছে না দেখে বেড়া থেকে নামার চেষ্টা করল। ঢিল মারবে।

নামতে দিল না আম্মা। বোঝানোর চেষ্টা করল, অমন করছিস কেন? মেরেছে নাকি? শুধু ভয় দেখাল। গরুগুলোকে তাড়ালে লড়াই দেখবি কি?

কিন্তু কে শোনে কার কথা। সে আমাকে না মেরে ছাড়বে না। শেষে ধমক দিয়ে তাকে থামাল আম্মা।

আবার উঠে বসলাম বেড়ায়। বাজি ধরাধরি শুরু হয়ে গেল আমার আর আম্মার মধ্যে। বললাম, আমি চোঙ্গো। ওর গায়ে জোর বেশি।

আম্মা বলল, আমি লালু। শিং দেখেছিস? ফেড়ে ফেলবে চোঙ্গোকে। হম্বিতম্বি আর বাহাদুরি চলল কিছুক্ষণ ষাঁড়দুটোর। হুমকি দিয়ে বলল যেন একটা, মাপ চা। ছেড়ে দেব।

অন্যটা বলল, তুই চা না। নাকে খত দে।

এঁএঁহ, নাকে খত! পারলে তুই দে না। তা-ও তো পারবি না। শিং একখান আছে। ঝুলে। খত দিতে হলেও তো ওটা খুলে রেখে আসতে হবে।

এই শিঙের ক্ষমতা জানিস?

জানব না কেন? কচু করবি তুই, চোঙ্গোর বাচ্চা চোঙ্গো।

কি, এতবড় কথা! আর সহ্য করল না চোঙ্গো। হঠাৎ মাটি খোঁড়া থামিয়ে লেজ উঁচু করে ফেলল।

অ্যাই, শুরু হলো! চেঁচিয়ে উঠলাম।

বিকট হাঁক ছেড়ে খুরের ঘায়ে মাটি কাঁপিয়ে তেড়ে গেল চোঙ্গো। লালুও সমান তেজে ছুটে এল মাথা নিচু করে শিং বাগিয়ে, লেজটা আকাশের দিকে তুলে।

দারুণ উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলাম আমিও।

দড়াম করে বাড়ি লাগল মাথায় মাথায়। শিঙের ঠোকাঠুকি। কেঁপে উঠলাম, যেন আমার গায়েই লাগল। বন্ধ করে ফেললাম চোখ। মনে হলো, দুটোরই মাথা শেষ, ফেটে চৌচির। কিন্তু কতটা শক্ত খুলি, তখনও বুঝিনি। পড়ে গেল লালু। চোঙ্গো জিতছে ভেবে হই হই করে উঠলাম।

বেশিক্ষণ আমাকে খুশি থাকতে দিল না লালু। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। খুরের ঘায়ে ধুলোর ঝড় তুলে ছুটে গিয়ে ঘ্যাঁচাং করে শিং ঢুকিয়ে দিল চোঙ্গোর কাঁধে। ঠেসে ধরে রাখল।

আটকা পড়ল চোঙ্গো। ঘুরতেও পারছে না, খুলতেও পারছে না শিংটা। কোনমতে খাড়া রয়েছে। বেকায়দা অবস্থায়।

ঠেলতে আরম্ভ করল লালু।

কাঁধে গেঁথে আছে শিং। বাধা দিতে পারছে না চোঙ্গো। ঠেলার চোটে সরছে। চলে আসছে আমাদের বেড়ার কাছে।

আঁতকে উঠল আম্মা। সব্বোনাশ! বলে এক লাফে বেড়ার ওপর থেকে নেমে পড়ল। টান দিয়ে নামাল আরলিসকে।

কিন্তু আমি এতটাই উত্তেজিত, তখনও টের পেলাম না বিপদটা। দেখতে দেখতে বেড়ার কাছে চলে এল ষাঁড়দুটো। এক ধাক্কায় বেড়ার কাঠ, খুঁটি ভেঙে ফেলল, যেন ওগুলো শোলার তৈরি। পড়ে গেলাম মাটিতে, জানোয়ার দুটোর পায়ের কাছে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আতঙ্কে কাঁপছে বুক। দাঁড়িয়েও সারলাম না, আবার ধাক্কা। মুখ খুঁজে পড়ে গেলাম মাটিতে। ধরে নিলাম, আমি শেষ। কানের কাছে ষাঁড়ের গোঁ গো, ফোসফোসানি। রক্তের উষ্ণ, আঠাল গন্ধ নাকে লাগছে। আমার চারপাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো খুর, একটা খোঁচাই আমার পাজরা গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। চোখের সামনে ধুলোর মেঘ। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

আম্মার হাত এসে পড়ল আমার হাতে, চেপে ধরল, টেনে সরিয়ে নিতে লাগল। আতঙ্কিত গলায় চিৎকার করছে, ওঠ, ট্রাভিস, পালা!

কোনমতে উঠেই দিলাম দৌড়। আমার হাত ছাড়ল না আম্মা। ডাইভ দিয়ে গিয়ে পড়লাম কেবিনের ভেতর। আম্মা ঢুকে দরজাটা কেবল লাগাল, ভ্রাম করে তার ওপর এনে চোঙ্গোকে ফেলল লালু।

থরথর করে কেঁপে উঠল ঘর। বেড়ার গায়ে লেপে দেয়া কাদার আস্তর বড় বড় টুকরোতে ঝরে পড়ল। ভয় পেলাম, দরজা ভেঙেই না ঢুকে পড়ে! পড়ত, পারল না বিশাল বপুর জন্যে। দরজার ফাঁকের তুলনায় ওগুলোর শরীর অনেক বড়।

নিজেকে ছাড়িয়ে নিল চোঙ্গো। পাল্টা আঘাত হানার জন্যে ঘুরল। দুটোই এখন মুক্ত। দাপাদাপি বাড়ল। আবার মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি। শিঙে শিঙে ঘষাঘষি। বারবার এসে পড়ছে বেড়ার গায়ে। কেঁপে উঠছে ঘর।

আম্মার দিকে তাকালাম। চাদরের মত সাদা হয়ে গেছে মুখ। ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে আরলিস। একেবারে চুপ। চিৎকার করতেও ভয় পাচ্ছে। এসব দেখে হঠাৎ ভয় চলে গেল আমার। মাথা চাড়া দিয়ে উঠল রাগ। খেপে গেলাম, দাড়া ষাঁড়ের বাচ্চা ষাঁড়, আজ তোদেরই একদিন কি আমারই একদিন!

বেড়ায় গাঁথা কাঠের গোঁজ। তাতে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝোলানো যোলো ফুট লম্বা একটা চাবুক। কাঁচা চামড়া পাকিয়ে তৈরি। খুলে নেয়ার জন্যে হাত বাড়ালাম।

কঁকিয়ে উঠল আম্মা, না না, এখন বাইরে বেরোসনে!

বললাম, ঘরটা তো ভাঙবে!

কিন্তু বেরোলেই ভর্তা করবে তোকে!

আবার বেড়ায় এসে আছড়ে পড়ল গরুদুটো। গোঁ-গো, ঘোৎ-ঘোৎ, বঁ-বঁ, ফেঁস-ফাঁস, যত রকম শব্দ করতে পারে ষাঁড়েরা, সব করছে। শিঙের গুঁতো, খুরের লাথি পড়ছে বেড়ায়।

দরজার দিকে এগোলাম। দেয়াল ভাঙতে দেয়া যাবে না কিছুতেই। কোনভাবে ঘরে ঢুকে পড়লে যে শুধু ঘরটাই যাবে তা নয়, আমরাও শেষ হব।

ছুটে এসে আমার হাত চেপে ধরল আম্মা, কুত্তাটাকে দিয়ে তাড়া! পায়ে কামড়ে দিলেই ভাগবে!

বাহ্, এই তো সুযোগ! এতক্ষণ ভাবিনি কেন? তাড়াতে পারলে তো একটা কাজের কাজই করল, না পারলে লাথি মেরে তাড়াব। আম্মাকে যুক্তি দেখাব, অপদার্থ একটা কুত্তাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর কোন মানে হয় না।

দরজা দিয়ে সাবধানে মাথা বের করলাম। ঘরের কাছ থেকে আবার সরে গেছে গরুদুটো। উঠানের পুরো বেড়াটাকেই ধসিয়ে দেয়ার মতলব যেন।

ঘর থেকে বেরিয়ে মাথা নিচু করে ছুটলাম। একদৌড়ে ডগ রানের একপাশ দিয়ে ঢুকে ছুটে বেরোলাম আরেক পাশ দিয়ে। চেঁচাতে লাগলাম, ইয়েলার! ইয়েলার! বলে। গরুগুলোকে তাড়াতে বললাম।

ঘরের পেছনে রয়েছে সে। আমার চিৎকারও শুনল। কিন্তু গরুর কাছে গেল না। চাবুক হাতে দেখে ভাবল তার ছাল ছাড়াতেই বেরিয়েছি। খাটো লেজটাকে দুপায়ের ফাঁকে গোটানোর চেষ্টা করতে করতে বনের দিকে ছুট। কেউ কেউউ করে টেনে টেনে চিৎকার, যেন বলছে, ওরে বাবারে, মেরে ফেলল রে, মেরে ফেলল!

সেটা করতে পারলেই খুশি হতাম। কিন্তু ভীতুর ডিম একটা কুত্তাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তখন নেই। গরুগুলোর ব্যবস্থা করা দরকার। জায়গাটা ধ্বংস করে ফেলছে। অনেক কষ্ট অনেক পরিশ্রম করে এই বাড়ি-ঘর তৈরি করেছে আব্বা, আমার ওপর দেখাশোনার ভার। দুটো খেপা ষাঁড় স্রেফ গোয়ার্তুমি করে সব নষ্ট করে ফেলবে এটা হতে দিতে পারি না।

এগিয়ে গিয়ে পেটাতে শুরু করলাম। চাবুক আমার হাতে খেলে ভাল। এত জোরে চালাতে পারি, বাতাসেই ফটাস করে পিস্তলের গুলি ফোটার শব্দ তোলে। বাড়ি মেরে কড়ে আঙুলের মত মোটা মেসকিটের ডাল অনায়াসে কেটে ফেলতে পারি।

কিন্তু উন্মত্ত জানোয়ার দুটোর মারামারি থামাতে পারলাম না। শিঙের গুঁতোয় এমনিতেই শরীরে অনেক জখম। সে সবের তুলনায় আমার চাবুকের বাড়ি কিছুই না ওগুলোর জন্যে, ফুঁ। কিন্তু থামলাম না। পিটিয়েই চললাম। চিৎকার তো করছিই।

পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। পরোয়াই করল না দৈত্যদুটো। আমাদের বাড়িটাকে ধসানোর পণ করেছে যেন। মাটিতে না মিশিয়ে থামবে না। নাহ্, বন্দুকই আনতে হবে দেখছি।

ঘরের একধারে রাখা দুই চাকার একটা মেকসিকান ঠেলাগাড়ি-খড় আর কাঠ বোঝাই করে আনতে কাজে লাগে। ওপাশ থেকে জায়গাটা ঢাল হয়ে নেমে গেছে খাড়ির দিকে।

লালুকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গিয়ে গাড়িটার গায়ে ঠেসে ধরল চোঙ্গো। খাড়া শিংটা রয়েছে লালুর পেটের নিচে। আচমকা এক ঝাকি…কাত হয়ে গেল লালু…তারপরেই চিত, গাড়ির ওপর পড়েছে, চার পা আকাশের দিকে।

চমকে গেলাম। শেষ পর্যন্ত আমাদের গাড়িটা বুঝি গেল! কিন্তু এতটা শক্ত, ভাবিনি। ধাক্কা খেয়ে চাকাগুলো পিছলে গেল, চলতে শুরু করল গাড়ি। লালুকে নিয়ে তীব্র গতিতে নেমে যেতে লাগল পাহাড় বেয়ে।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল চোঙ্গো। হলোটা কি, যেন বুঝতে পারছে না। কি এমন করল যে পা তুলে দিয়ে উড়ে পালাচ্ছে লালু! মার খেয়ে এমন করে পালাতে দেখেনি আর কোন গরুকে। মানুষ হলে বলা যেত হাঁ করে তাকিয়ে আছে, কিন্তু যেহেতু সে গরু, সেটা আর বলা যাচ্ছে না। লেজ ওপরে তোলা, সামনে বাড়ানো গলা, তাকিয়ে রয়েছে লালুর দিকে। যেন একটা ভাঁড়। খানিক আগের লড়াকু-দৈত্যটার ভঙ্গি দেখে এখন হাসি পেল আমার।

পাথরে ঠোকর খেতে খেতে নেমে গেল গাড়িটা। ঝর্নার কিনারে গিয়ে বড় একটা পাথরে আটকে গেল চাকা। প্রচণ্ড ঝাকি, নিচু হয়ে গেল সামনের দিকটা। প্রায় উড়ে গিয়ে পানিতে পড়ল লালু। ছিটকে উঠল পানি।

তাড়াতাড়ি দাঁড়াতে গিয়ে পা পিছলাল, আবার আছাড় খেয়ে পড়ল পানিতে। আবার দাঁড়াল। ঝাপুত-ঝুপুত করে উঠে এল পানি থেকে। গাড়ির ঝাঁকুনি, পানিতে চুবানি লড়াইয়ের ইচ্ছে দূর করে দিয়েছে তার। লেজ তুলে দৌড়। গা থেকে পানি ঝরে পড়ছে শুকনো বালিতে। ফিরেও তাকাল না আর। সোজা বনে গিয়ে ঢুকল।

লালুকে পানি থেকে উঠতে দেখেই ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে তেড়ে গেল আবার চোঙ্গো। কাত হয়ে থাকা গাড়িটার কাছে পৌঁছে যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়াল। একটা চাকা ঘুরছে তখনও। এই জিনিস আর দেখেনি সে। তাকিয়ে রইল। বোঝার চেষ্টা করছে জিনিসটা কি? নাক বাড়িয়ে শুঁকল। বুঝতে পারল না। সাহস করে গলা আরেকটু লম্বা করে জিভ বের করল। শুঁকে যখন পারল না, যা থাকে কপালে, চেটেই বুঝবে।

চাকার চারপাশে লোহার পাত লাগানো। চলার সময় পাথরে ঘষা খেয়ে এমনিতেই খসখসে হয়ে আছে ওটা, তার ওপর লেগেছে পাথরের কুঁচি আর মাটি। ঘষা লেগে জিভ গেল ছড়ে।

বাআআআ করে বিকট চিৎকার, ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে এল চোঙ্গো। ঘুরতে গিয়ে পা পিছলাল। হড়কে নেমে গেল কিছু দূর। আরেকটু হলে সে-ও পানিতে পড়ত। হাঁচড়ে-পাচড়ে উঠে এসে লালুর মতই লেজ তুলে দিল দৌড়, তবে উল্টো দিকে। বা-বা করে চেঁচাচ্ছে। যেন বলছে, বাবাগো, গেছিগো, আমি আর নেই, আমার জিভ শেষ!

লম্বা হয়ে ঝুলছে জিভটা। বীরত্ব আর বাহাদুরি খতম। পালাতে পারলে বাঁচে এখন।

হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার জোগাড় আমার। দুর্দান্ত একটা লড়াই উপহার দিয়েছে। তবে ক্ষতিও করেছে অনেক। উঠানের বেড়াটা শেষ।

আরলিসটাকে নিয়ে আর পারা যায় না! যেমন দুষ্টু তেমন বেয়াড়া। ঘর থেকে বেরোতে শেখার পর থেকেই একটা আজব অভ্যাস হয়েছে। যে প্রাণী দেখবে সেটারই পিছে লাগবে, ধরতে পারলে রেখে দেবে।

প্রতি রাতেই শুতে যাওয়ার আগে আটকায় তাকে আম্মা। সারা দিনের সমস্ত শিকার বের করে দিয়ে পকেট খালি করতে বলে। অদ্ভুত সব জিনিস পাওয়া যায় তার কাছে। ফড়িঙ, পোকা, প্রজাপতি, গিরগিটি সব তালগোল পাকিয়ে থাকে পকেটে। কোনটা মরা, কোনটা জ্যান্ত। কেঁচো, শুয়াপোকা, এসবকে পর্যন্ত ভয় পায় না সে। একদিন একটা শিংওলা ব্যাঙ ধরে নিয়ে এসেছিল। পকেট থেকে বের করতেই এমন ফুলতে শুরু করল ওটা, ফুলতে ফুলতে একেবারে গোল বল হয়ে গেল। রাগের চোটে রক্ত বেরিয়ে গেল চোখ দিয়ে। বাসা থেকে পড়ে যাওয়া পাখির ছানা, ঝর্নার পানিতে ভেসে বেড়ানো সবুজ ব্যাঙ, এমন কি সারা গায়ে হলুদ আঙটি আঁকা চোঁড়া সাপও ধরে নিয়ে আসে। একদিন তো পকেট ওল্টাতেই বেরিয়ে পড়ল একটা কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকা মারাত্মক কপারহেড সাপের বাচ্চা। দেখে তো প্রায় চোখ উল্টে দিয়েছিল আম্মা। সাপটা যে আরলিসকে কামড়ায়নি কেন সেটাই এক রহস্য। কিন্তু এর পর আর সাপের ব্যাপারে তাকে লাই দিল না আম্মা। এমন পিটান পিটাল, সাপ ধরার নাম ভুলিয়ে ছাড়ল।

পিটুনি খেয়ে সাপ ধরা বন্ধ করল বটে আরলিস, তবে জ্যান্ত সাপ। এরপর থেকে ধরার আগে ঢিল ছুঁড়ে মেরে নেয়, তারপর তুলে পকেটে ভরে। রাতে পকেট থেকে বের করার সময় একটু পচা গন্ধ বেরোয় এই যা, এছাড়া আর কোন অসুবিধে হয় না। এবং আরলিসের ধারণা, তার খাতিরে এটুকু অন্তত আম্মার মেনে নেয়া উচিত।

ইয়েলারটা আসার পর তার এই ধরাধরি আরও বেড়ে গেল। আরও বড় বড় জিনিস ধরতে শুরু করল কুকুরটার সাহায্যে। খরগোশ, পাখি, পোশামের বাচ্চা এসব। এই পোশমগুলো একটা মজার কাণ্ড করে। ধরা পড়লেই রোম ফুলিয়ে গোল হয়ে গিয়ে মরার ভান করে থাকে, একনাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা একটুও না নড়ে একভাবে পড়ে থাকতে পারে, যতক্ষণ না নিশ্চিত হয় আরলিস ওকে কিছু করবে না।

রার কাজগুলো অবশ্য ইয়েলারই করে। তাড়া করে গিয়ে ধরে এনে তুলে দেয় আরলিসের হাতে। বাড়ি ফিরে সে কথাটা বেমালুম চেপে গিয়ে দিব্যি একটা রোমাঞ্চকর গল্প বানিয়ে বলে দেয় আম্মাকে আরলিস, বলে নিজে ধরেছে ওগুলো।

একদিন বার্ডসং ক্রীকে একটা নীল ক্যাটফিশ ধরতে দেখলাম ওদেরকে। কি করে যেন অল্প পানিতে চলে এসেছে মাছটা। পানি এতই অল্প, ওটার পিঠের কাটাও ডোবে না। আমি যখন দেখলাম, একই সময়ে আরলিস আর ইয়েলারও দেখে ফেলল ওটাকে। দৌড় দিল। শরীর মুচড়ে মুচড়ে বেশি পানির দিকে যেতে শুরু করল মাছটা, কিন্তু তার আগেই পৌঁছে গেল ইয়েলার। বিশাল হাঁ করে মাছটাকে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে তুলে আনল ডাঙায়, ঘাসের ওপর ছেড়ে দিল। এমনই কায়দা করে ধরেছে একটা দাঁতও বসেনি। ঘাসের মধ্যে লাফাতে লাগল ওটা। দৌড়ে গিয়ে ধরল আরলিস। ভঙ্গিটা দেখার মত। যেন কি সাংঘাতিক কষ্ট করে পানি থেকে ধরে তুলে এনেছে। কিন্তু ধরার পর পরই কাঁটা ফুটিয়ে দিল ক্যাটফিশ, চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল সে, কিন্তু হাত থেকে মাছ ছাড়ল না।

চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়ির দিকে দৌড় দিল আরলিস। আম্মার সামনে নিয়ে গিয়ে মাটিতে ফেলে দিল মাছটা। হাতে রক্ত। যেখানে কাটা ফুটিয়েছে তার চারপাশটা গোল হয়ে ফুলে উঠেছে। মেসকিটের কাটাও অত বিষাক্ত নয়, অত যন্ত্রণা দেয় না ক্যাটফিসের কাঁটা যতটা দেয়।

তাড়াতাড়ি প্রিকলি-পারের মূল ছেঁচে জখমের ওপর লাগিয়ে বেঁধে দিল আম্মা। বিষ টেনে নেবে এই ওষুধ। ব্যথার কথা ভুলে যেতে দেরি হলো না আরলিসের।

সে রাতে খাওয়ার সময় পাতে দেয়া হলো ভাজা ক্যাটফিশ। গল্প ফেঁদে বসল আরলিস। ডুব দিয়ে চলে গিয়েছিল নাকি গভীর পানিতে। সেখানে পাথরের নিচে দেখে একটা গর্ত। তাতে ঢুকে পড়ল। টেনে বের করল মাছটাকে। তারপর ওটাকে ধরে রেখেই সাঁতরে এসে উঠল তীরে। গর্তে ঢুকে আরেকটু হলেই কি করে ডুবে মারা যাচ্ছিল, সেটার গা-শিউরানো বর্ণনা দিল অনেক ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে।

আরলিসের গপ মারা সহ্য হলো না আমার। সেটা আম্মাকে বলতে যেতেই আমাকে থামিয়ে দিল আম্মা। বলল, বলুক না। বলতে ভাল লাগছে ওর বলুক, কারও তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না।

প্রতিবাদ না করে পারলাম না, দেখো আম্মা, এভাবে লাই দিয়ো না। তুমি আর ওই ইয়েলারটা মিলে টেক্সাসের সব চেয়ে বড় মিখ্যাক বানিয়ে ছাড়বে আরলিসকে।

হেসে ফেলল আম্মা। আরলিস ওখান থেকে উঠে গেলে বলল, ওসব বানানো গল্প শুনতে তার ভালই লাগে। মুচকি হেসে যোগ করল, ছোটবেলায় এসব ব্যাপারে কেউই কম যায় না। আরলিসের চেয়ে অনেক বেশি গপ মেরেছে তার বড়রা, সেগুলো যদি হজম করতে পেরে থাকে, তারটাই বা পারবে না কেন?

খোঁচাটা যে কাকে মারল, বড়রা বলতে কাকে বোঝাল, বুঝতে অসুবিধে হলো না আমার। চুপ হয়ে গেলাম। আরলিস যদি টেক্সাসের বড় মিথ্যেবাদী হয়ই, তাতে আমার কি? হোক।

সাপ-ব্যাঙ ধরতে ধরতে এমন অবস্থায় চলে গেল আরলিস, এমন দুঃসাহসী হয়ে উঠল, শেষে ভালুককে হাতে পেয়েও ছাড়ল না। মারাই গিয়েছিল সেদিন আরেকটু হলে, অল্পের জন্যে বেঁচেছে।

ঘটনাটা যেদিন ঘটল, সেদিন ক্রীকের নিচে একটা জায়গায় বেড়া মেরামত করার জন্যে কাঠ কাটছিলাম আমি। গাছ কেটে বেড়া তৈরি খুব মেহনতের কাজ। ডিনারের পর পরই সেখানে চলে গেছি। কাজ করতে করতে ভারি হয়ে এল হাত। কুড়ালটা মনে হচ্ছে দশ মন ভারি। দরদর করে ঘামছি। পিঠ ব্যথা করছে। নিঃশ্বাস ভারি। কোপ বসানোর জন্যে আর কুড়াল তুলতেই ইচ্ছে করছে না।

সূর্য ডুবতে ঘণ্টাখানেক বাকি আছে তখনও। বসে পড়লাম। অবশ হয়ে এসেছে হাত। আব্বা হলে এত তাড়াতাড়ি কাহিল হত না। সূর্য ডোবার পরেও আরও এক ঘণ্টা অনায়াসে কাজ করতে পারত। আব্বা যে কি করে পারে! কিন্তু আমার পক্ষে মনে হচ্ছে অসম্ভব। কয়েক মিনিট জিরিয়ে নিয়ে কুড়ালটা কাঁধে ফেলে বাড়ি রওনা হলাম।

আম্মা যদি জিজ্ঞেস করে এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম কেন, কি জবাব দেব ভাবতে ভাবতে চলেছি, এই সময় শোনা গেল আরলিসের চিৎকার।

আরলিসের কাজই হলো কারণে-অকারণে চেঁচানো। যখন আনন্দে থাকে তখনও চেঁচায়, যখন কষ্ট পায় কিংবা খেপে যায় তখনও চোয়, অন্য সময় কোন কারণ ছাড়াই চেঁচায় শুধু চেঁচিয়ে মজা পাওয়ার জন্যে। তাতে অবাক হই না। কিন্তু এখনকার চিৎকারটা অন্য রকম। শুনেই ধড়াস করে উঠল বুক। বুঝে গেলাম ভীষণ বিপদে পড়েছে সে।

দিলাম দৌড়। মুহূর্ত আগেও এত ক্লান্ত লাগছিল, মনে হচ্ছিল, হেঁটে ঘরেই ফিরতে পারব না। পা আর চলছিল না। এখন আমার দৌড় দেখলে সেটা কেউ বিশ্বাস করবে না।

আবার চেঁচিয়ে উঠল আরলিস। আরও জোরে, আরও তীক্ষ্ণ স্বরে। সেই সঙ্গে শোনা গেল চাপা গোঙানি আর ফোঁপানি মেশানো কান্নার মত আরেকটা শব্দ। আরলিসের নয়, তবে শব্দটা চেনা চেনা। আগেও কোথাও শুনেছি, ঠিক মনে করতে পারলাম না ওই মুহূর্তে।

শোনা গেল খকখক কাশি মেশানো ভয়াবহ গর্জন। খেপা ভালুকের তেড়ে আসার শব্দ চিনতে ভুল হলো না। আরও একবার শুনেছি এই গর্জন, সেই যখন শুয়োর মারতে দেখে একটা ভালুককে গুলি করে জখম করেছিল আম্মা। যন্ত্রণায়, রাগে এমন করেই গর্জে উঠেছিল ওটা। শুয়োর ছেড়ে আমার দিকে ছুটে আসছিল। ইয়া বড় এক ছুরি হাতে সামনে গিয়ে দাঁড়াছিল আব্বা। ছুরি দিয়ে খুঁচিয়েই মেরে ফেলেছিল ভালুকটাকে।

ধড়াস ধড়াস করছে আমার বুক। মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডটাই বুঝি ছিড়ে যাবে। প্রাণপণে ছুটছি। আরও জোরে ছোটানোর চেষ্টা করলাম পা-দুটোকে। কতটা বিপদে পড়েছে আরলিস, জানি না। ভালুকটা যদি সত্যি সত্যি খেপা হয়ে থাকে, তবেই হয়েছে।

গাছপালার ফাঁক দিয়ে তেরছা হয়ে পড়ছে পড়ন্ত রোদ। বনের ভেতরে আলো-আঁধারির খেলা। রোদের বর্শাগুলো এসে চোখে লাগছে, অন্ধ করে দিতে চাইছে, সামনেটা দেখতে পাচ্ছি না ভালমত। খোলা জায়গায় বেরিয়েই ঘুরলাম। ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ড বেয়ে।

আবার সেই পানির গর্তটায় গিয়ে নেমেছে আরলিস। পানিতে প্রায় শুয়ে আছে, দেহের অর্ধেকটা পানিতে, অর্ধেকটা শুকনোয়। ছোট কুনের সমান একটা কালো ভালুকের বাচ্চার পেছনের পা চেপে ধরে আছে। বাচ্চাটা রয়েছে ডাঙায়। ছাড়া পাওয়ার জন্যে টানাটানি করছে। তিন পা দিয়ে আঁচড় কাটছে পাথরে, থাবা মারছে, নখ বসিয়ে দিয়ে উঠে যেতে চাইছে। সেই সঙ্গে চলছে ফোঁপানি আর গোঙানি। চেপে ধরে রেখেছে আরলিস। আতঙ্কে চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে। এতটাই ভয় পেয়েছে, পা ছেড়ে দেয়ার কথাও ভুলে গেছে। বাচ্চাটার এত কাছে গেল কি করে? ধরল কি করে?

ইচ্ছে করলেই ঘুরে হাতে কামড়ে দিতে পারে বাচ্চাটা। সেটা কেন করছে না তা-ও বুঝলাম না। হয়তো আরলিসের মতই ভয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেছে ওটারও, চিন্তা করার শক্তি নেইI

বাচ্চাটাকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমার, ভাবনা হলো তার মাকে নিয়ে। বাচ্চার চিৎকার শুনে ওটাকে বাঁচাতে ছুটে এসেছে ঝোপঝাড় ভেঙে। বার্ডসং ক্রীকের অন্য পাশে দেখতে পেলাম তাকে। ভীষণ রাগে গর্জন করছে। নামতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। বাচ্চা বাঁচাতে আরলিসকে খুন করতেও দ্বিধা করবে না।

আমার কাছ থেকে অনেকটাই দূরে। সময় মত পৌঁছতে পারব না ওখানে।

আরলিসের চিৎকার শুনে আম্মাও ছুটে এসেছে। ঝর্নার দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার করে বলছে বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু ছাড়ছে না আরলিস। পা চেপে ধরে রেখে সমানে চেঁচিয়ে চলেছে।

ক্রীকের পানিতে নেমে পড়েছে মা ভালুক। অল্প পানি ওখানটায়। লাফাতে লাফাতে পানি ভেঙে ছুটছে। পানি ছিটকে উঠছে, রোদ চমকাচ্ছে তাতে। রাগে রোম দাঁড়িয়ে গেছে ভালুকটার। বিকট হাঁয়ের ভেতরে দেখা যাচ্ছে হলদেটে ভয়ানক দাঁত। গিরিখাতের সবখানে ছড়িয়ে যাচ্ছে তার গর্জনের শব্দ। যত জোরেই ছুটুক না কেন আম্মা, যত জোরেই ছুটি না কেন আমি, ভালুকটার আগে কিছুতেই পৌঁছতে পারব না আরলিসের কাছে।

তাই বলে বসে রইলাম না। মরিয়া হয়ে ছুটছি। আরলিসের কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝে দিশেহারা হয়ে গেলাম। ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা দেখতে চাই না। চোখ বুজে ফেলতে চাইলাম, বন্ধ হলো না পাতা। চিৎকার করতে চাইলাম, স্বর বেরোল না।

ভালুকটা আরলিসের অনেক কাছে চলে গেছে। আর কোন আশাই নেই। এই সময় ঝোপের ভেতর থেকে ছুটে বেরোল সে। তীব্র গতিতে একটা হলুদ ঝিলিকের মত ছুটে গেল ভালুকটার দিকে।

বিশাল সেই ইয়েলার কুকুরটা। পাগল হয়ে গেছে যেন, ঘেউ ঘেউ করে কান ঝালাপালা করছে। কুকুর হিসেবে যত বড়ই হোক, আকারে ভালুকের তিন ভাগের এক ভাগও নয় সে, তবু দুর্দান্ত সাহস। একপাশ থেকে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠিকই কাত করে ফেলে দিল জানোয়ারটাকে। জাপটে ধরল একে অন্যকে। ভীষণ গর্জন করতে করতে গড়িয়ে নেমে যেতে শুরু করল ঢাল বেয়ে।

ওদুটোর পাশ দিয়ে ছুটে পার হওয়ার সময় দেখলাম, মানুষের মত দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠেছে ভালুকটা। ধারাল বাঁকা নখ দিয়ে থাবা মেরে গলা কামড়ে ঝুলে থাকা কুকুরটাকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। কি ঘটল, দেখার জন্যে দাঁড়ালাম না। একছুটে গিয়ে টান দিয়ে ভালুকের বাচ্চার পা থেকে আরলিসের আঙুলগুলো ছুটিয়ে দিলাম। হাতের কব্জি ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তুলে আনলাম পানি থেকে। গমের বস্তার মত প্রায় ছুঁড়ে ফেললাম আম্মার দিকে। চেঁচিয়ে বললাম, আম্মা, পালাও! নিয়ে যাও ওকে! বলেই চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরলাম ভালুকটার দিকে। কুড়ালটা তুলে নিলাম কোপ মারার ভঙ্গিতে। প্রথম চোটেই বসিয়ে দেব মাথায়।

তবে মারার সুযোগ হলো না আমার। প্রয়োজনই পড়ল না। ভালুকটাকে আমার কাছেই ঘেঁষতে দিল না ওল্ড ইয়েলার। ওটার সঙ্গে পারবে না সে, ভাল করেই জানে। তবু পিছিয়ে আসছে না।

দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে শাই শাই থাবা চালাচ্ছে ভালুকটা। যতবারই নাগালে পাচ্ছে, থাপ্পড় মেরে ফেলে দিচ্ছে কুকুরটাকে। ভাবছি, এই শেষ, আর উঠতে পারবে না ইয়েলার, কিন্তু ঠিকই উঠে দাঁড়াচ্ছে সে। মার খেয়ে বিকট চিৎকার করছে, চেঁচিয়ে গিরিখাত মাথায় করছে, পড়েও যাচ্ছে বার বার, কিন্তু হার স্বীকার করছে না। গড়ান দিয়েই উঠে দাঁড়াচ্ছে আবার।

কুড়াল তুলে দাঁড়িয়ে আছি। কতক্ষণ কাটল বলতে পারব না, হঠাৎ ঘরের দিক থেকে শোনা গেল আম্মার চিৎকার, ট্র্যাভিস, পালিয়ে আয়! ওখানে থাকিসনে, জলদি পালিয়ে আয়!

চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম যেন। মনে হচ্ছিল, ভালুকটার সঙ্গে লড়াই করা ছাড়া গত্যন্তর নেই আমার, পালানোর কথা মাথায়ই ঢোকেনি এতক্ষণ, এইবার ঢুকল। ঢুকতে আতঙ্ক এসে চেপে ধরল। একটা মুহূর্ত দেরি করলাম না। ঘুরেই দিলাম দৌড়।

কিন্তু এবারেও দৌড়ের পাল্লায় হেরে গেলাম ইয়েলারটার সঙ্গে। যেই দেখল আমরা সব নিরাপদ জায়গায় সরে গেছি, সে-ও আর দেরি করল না। পালিয়ে এল।

ঘরের কাছে এসে দেখলাম, আমার আগেই এসে বসে আছে সে। আম্মা বলল, পিছে পিছে কিছুদূর তেড়ে এসেছিল ভালুকটা। কুকুরটাকে ধরতে পারবে না বুঝে ফিরে গেছে।

মারাত্মক বিপদ থেকে বেঁচে এসেছে ইয়েলার। কিন্তু ভয়ের কোন লক্ষণই নেই ওর মধ্যে। একেবারে স্বাভাবিক। চেঁচানো থেমেছে আরলিসের। থরথর করে কাঁপছে এখনও। আঁকড়ে ধরে রেখেছে আম্মাকে। ঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে পড়েছে আম্মা। আরলিসকে জড়িয়ে ধরে নীরবে কাঁদছে। তার এই কান্না যেন আর জীবনে থামবে না। আমারও চোখে পানি এসে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে ঠেকালাম।

খুব খুশি ইয়েলার। ঘরে ঢুকে লাফালাফি জুড়ে দিল। তখন চেঁচিয়ে গিরিখাত মাথায় করেছিল, এখন করল ঘর। কানে তালা লাগিয়ে দেয়ার জোগাড় করল। যাকেই সামনে পেল তারই মুখ চেটে দিল।

ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ওরকম লড়াই সে হরহামেশাই করে। এসব কিছুই না তার জন্যে। তুড়ি মেরে চিত করে দিতে পারে যে কোনও ভালুককে।

আরলিসকে যে আমি এতটা ভালবাসি, ভালুকটার সঙ্গে লড়াইয়ের আগে বুঝতে পারিনি। আব্বা আর আম্মা যতটা বাসে তার চেয়ে কম বাসি না। মনে হতে লাগল, কিছু কিছু ব্যাপারে তাদের চেয়ে বরং বেশিই বাসি। সুতরাং সে যাকে পছন্দ করে সেই কুকুরটাকে আমি শেষ পর্যন্ত যে পছন্দ না করে পারব না এ তো স্বাভাবিক।

যতই মাংস চুরি করুক, আমাকে তার দিকে আড়চোখে তাকাতে দেখে মাটিতে শুয়ে পড়ে আতঙ্কে চেঁচাক, ষাড়ের লড়াইয়ের সময় আমাকে সাহায্য না করে দৌড়ে পালাক, এই ঘটনার পর ওল্ড ইয়েলারের ওপর আর রাগ ধরে রাখা গেল না। আমি যা করতে পারিনি তাই করে বসেছে ওল্ড ইয়েলার। আরলিসের জীবন বাঁচিয়েছে সে।

ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম আমি। চাপড়ে দিলাম। লেজ নেড়ে বুঝিয়ে দিল কতটা সুখি সে। ওর সঙ্গে কি দুর্ব্যবহারটা না করেছি এ-কদিন ভেবে লজ্জা লাগল। ওর যত্ন শুরু করলাম। পায়ের তলা খুঁজে দেখতে পেলাম দুই নখের মাঝে একটা মেসকিটের কাঁটা গেঁথে আছে। টেনে বের করলাম সেটা। কানের ভেতরে পেলাম তিনটে জোঁক, চামড়া কামড়ে ধরে আছে। রক্ত খেয়ে ফুলে উঠেছে। জ্বলন্ত কয়লার ছ্যাকা দিয়ে খসালাম ওগুলোকে। সাবান দিয়ে ভাল করে ডলে ডলে গোসল করালাম। উকুন দূর করার জন্যে লবণ মাখানো শুয়োরের চর্বি ডলে দিলাম। সারা গায়ে।

সেদিন রাতে অন্ধকারে আমাদের বিছানায় উঠে এল ইয়েলার। আমার আর আরলিসের মাঝে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। একসঙ্গে ঘুমালাম আমরা। কথাটা আম্মার কাছে চেপে গেলাম বেমালুম।

পরদিন ওকে আর আরলিসকে নিয়ে কাঠবেরালি শিকারে বেরোলাম। এই প্রথম আমার সঙ্গে শিকারে নিয়ে গেলাম আরলিসকে। চুপ থাকতে পারে না সে। বাড়িতে যে হারে চেঁচামেচি করে, শিকারে গিয়ে ওরকম করলে ত্রিসীমানায় থাকবে না কোন শিকার।

তাকে সাবধান করে দিলাম, শিকারে বেরোলে চুপচাপ থাকতে হয়। চুপ করেই আমাদের সঙ্গে চলল সে, অন্তত যতক্ষণ কোন কিছু নজরে না পড়ল। কিন্তু যেই একটা রঙিন প্রজাপতিকে উড়তে দেখল, প্রতিজ্ঞা ভুলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে তাড়া করল ওটাকে। ধরতে পারল না। চেঁচিয়ে আমাকে ডাকতে লাগল, গিয়ে তাকে সাহায্য করার জন্যে। কেন গেলাম না সে জন্যে রেগে গিয়ে আরও জোরে চেঁচাতে লাগল। তারপর থেকে আর চুপ থাকল না সে। কোন না কোন কারণে চেঁচিয়েই চলল। এক জায়গায় একটা চ্যাপ্টা পাথর দেখে দাঁড়িয়ে গেল। কৌতূহলী হয়ে উল্টে ফেলল পাথরটা। ওটার নিচে আশ্রয় নিয়েছিল পিঁপড়ে, শতপদী, ঝিঁঝি পোকা আর মারাত্মক বিষাক্ত কাঁকড়া বিছে। আচমকা আলো পড়ায় হুড়াহুড়ি করে ছুটে পালাতে শুরু করল ওগুলো। তাই দেখে আরলিসের সে কি চিৎকার। আমাকেও ডাকতে লাগল গিয়ে দেখার জন্যে।

আরেকবার গিয়ে উঠল একটা কাঁটাঝোপের ডালে। আর নামতে পারে না। ব্যস, শুরু হলো চিৎকার। শেষে বাধ্য হয়ে আমাকে গিয়ে নামাতে হলো। হাঁটার সময়ও স্বস্তি নেই। পাথরের ওপর পড়ে গিয়ে কনুইয়ে ব্যথা পেল। কয়েক মিনিট চুপচাপ থাকার পর আচমকা তারস্বরে এমন চিৎকার করে উঠল যেন মেরে ফেলা হচ্ছে তাকে। কি ব্যাপার? কনুই উল্টে দেখাল। যেখানে ব্যথা পেয়েছিল সেখান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে।

হতাশ হয়ে গেছি আমি। বুঝতে পারছি, কোন শিকারই আর আমাদের ধারেকাছে নেই। সব পালিয়েছে তল্লাট ছেড়ে, কেবল কাঠবেরালিরা বাদে। ওগুলোও উঠে গেছে গাছের মগডালে, লুকিয়ে থাকার জন্যে। তবে লুকানোর আগেই একটাকে দেখে ফেললাম। যে হট্টগোলে শিকার সব পালিয়েছে সেই হট্টগোলকেই কাজে লাগালাম এখন, কাঠবেরালিটাকে বোকা বানানোর জন্যে।

আরলিসকে পাঠালাম গাছের গোড়ায়। ঘুরে ঘুরে চিৎকার করবে আর লাঠি দিয়ে বাড়ি মারতে থাকবে ঘাস আর ঝোপঝাড়ে। আমি একটু দূরে চুপ করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করব।

দারুণ এক মজার কাজ পেয়ে গেল আরলিস। কাঠবেরালিটার চোখ তার ওপর। ঘুরতে শুরু করল ওটা। যাতে চোখে চোখে রাখতে পারে আরলিসকে। আমার কথা ভুলেই গেল। এটাই চেয়েছিলাম আমি। আমার দিকে ঘুরে আসতেই এক গুলিতে ফেলে দিলাম।

আমরা কি চাই বুঝে গেল ওল্ড ইয়েলার। আরলিসের চিৎকারে মাটি থেকে লাফিয়ে গাছে গিয়ে ওঠে কাঠবেরালি। কড়া নজর রাখে ইয়েলার। আমরা না দেখলেও সে ঠিকই দেখে ফেলে। ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে যায়। আরলিসকে তখন পাঠাই কাঠবেরালিটার নজর তার দিকে ধরে রাখার জন্যে। ঘুরতে ঘুরতে ওটা যেই আমার দিকে আসে, গুলি করে ফেলে দেইI

গোটা পাঁচেক কাঠবেরালি শিকার করতে খুব বেশিক্ষণ লাগল না আমাদের। রাতে ভেজে খাওয়ার জন্যে যথেষ্ট। আর দরকার নেই।

দিন সাতেক পর। একটা বুনো গবলার ধরতে সাহায্য করল আমাকে ইয়েলার। ও না থাকলে খুঁজেই পেতাম না পাখিটাকে। খেতে ঢুকেছিলাম মটরশুটি তোলার জন্যে। সঙ্গে বন্দুক ছিল। পাথর এনে খেতের চারপাশে বেড়া দিয়েছে আব্বা। বেড়ার কাছে পৌঁছেই দেখি গবলারটাকে। গাছ থেকে মটর ঠুকরে খাচ্ছে। মাঝে মাঝে গাছের গোড়ায় নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে পোকা বের করার জন্যে।

আরি, আম্মা বলল, গাছগুলোর সর্বনাশ করবে তো!

চুপ করে থাকো, আম্মাকে কথা বলতে নিষেধ করে বন্দুক কাঁধে তুলে নিলাম। নলটা রাখলাম সামনের পাথরে। নিশানা যাতে স্থির থাকে।

বেশি দূরে না পাখিটা। সহজ নিশানা। ফেলে দিতে পারব। পাখদুটো যেখানে পিঠের সঙ্গে জোড়া লেগেছে ঠিক সেখানে লক্ষ্য স্থির করলাম। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ট্রিগার টিপতে যাব, এই সময় ছুটতে ছুটতে এল আরলিস। আস্তে তো কথা বলতে পারে না, চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কাকে গুলি করছ, ট্রাভিস, আঁ! কি দেখেছ?

একই সঙ্গে চমকে দিল আমাকে আর গবলারটাকে। চাপ লেগে গেছে ট্রিগারে। পড়ে যেতে দেখলাম পাখিটাকে। কিন্তু পরমুহূর্তেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। একটা ডানা ভেঙে ঝুলছে শরীরের পাশে। সেটাকে টানতে টানতে দৌড় দিল শস্য খেতের ভেতর দিয়ে।

প্রচণ্ড রাগ লাগল আরলিসের ওপর। ধরে গলাটা মুচড়ে দিতে পারলে ওই মুহূর্তে খুশি হতাম। চেঁচিয়ে বললাম, আরলিস, মুখটা বন্ধ রাখতে পারিস না একটু! দিলি তো তাড়িয়ে! গেল, আর পাওয়া যাবে না!

আমার এই রাগের কারণ বুঝতে পারল না আরলিস। ওখানেই ধপ করে বসে কান্না জুড়ে দিল। মাটি ভেজাতে লাগল চোখের পানিতে। কিছু পড়ল খালি পায়ে। পুরু হয়ে লেগে থাকা বালিতে কালো কালো ফুটকি সৃষ্টি করল। ওর চোখের পানি দেখে অবাকই লাগে আমার। অকারণে, এত সহজে, এত তাড়াতাড়ি, এত বেশি পানি বেরোতে দেখিনি আর কারও।

আম্মা বলল, ট্র্যাভিস, গবলারটা পালায়নি। আছে এখনও। ওই যে দেখ।

তাকিয়ে দেখি মটর খেতের একধারে পাথরের বেড়ার কাছে লাফালাফি করছে ওল্ড ইয়েলার। কয়েকটা লাফ দিয়ে ছুটে এল গবলারটা যেখানে গুলি খেয়েছে সেখানে। জায়গাটাকে ঘিরে চক্কর দিল, গন্ধ শুকল, লেজের-গোড়া নাড়ল, তারপর ছুটল আবার। গবলারটা যেদিক দিয়ে গিয়ে গম খেতে ঢুকেছে ঘেউ ঘেউ করতে করতে গিয়ে সে-ও ঢুকে পড়ল সেদিক দিয়ে।

মিনিট দুয়েক পর খেতের ওপাশের জঙ্গলে শোনা গেল তার ডাক। ছুটে গেলাম। কাঠবেলিকে গাছে তুলে যে ভাবে চিৎকার করেছিল, সেরকম করছে। নিশ্চয় দেখতে পেয়েছে গবলারটাকে।

আমরাও দেখলাম। একটা ওকগাছে উঠে গেছে। চুপ করে এমন ভঙ্গিতে বসে আছে ডালে, ভাবখানা যেন তোমরা এদিকে তাকিয়ো না, লাভ হবে না-আমি নেই এখানে।

বন মোরগের রোস্ট, গমের আটার রুটি, শালুক সেদ্ধ দিয়ে সে রাতে খাওয়াটা আমাদের দারুণ জমল। ওল্ড ইয়েলার কিন্তু তেমন খেল না। বার বার খাওয়াতে চেষ্টা করলাম আমরা। হাজার হোক, গবলার শিকারে তার অবদানই বেশি। সৌজন্য বলেও তো একটা কথা আছে। ভাল মাংস তুলে নিয়ে দিলাম ওকে। কিন্তু দু-একবার চেটে দেখল কেবল, খেল না। অথচ এত স্বাদের খাবার গপ গপ করে গেলার কথা। মনে পড়ল, গত কদিন ধরেই ও কিছু খায় না বাড়িতে। তাজ্জব ব্যাপার! সুস্থ আছে কি করে? একেবারেই তো স্বাভাবিক চেহারা! চকচকে রোম! যেন দিনে তিনবার করে পেট ভরে খায়! ভূতুড়ে কাণ্ড নাকি!

সন্দিহান হয়ে উঠল আম্মা। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, মুরগীর খোয়াড় থেকেও তো কিছু চুরি করে না! ডিম চুরি করে না, বাচ্চাগুলো সব ঠিকঠাক আছে। আজকেও দেখেছি।

ব্যাপারটা নিয়ে লম্বা আলোচনা করলাম আমরা। কি খেয়ে বাঁচে ওল্ড ইয়েলার ভেবে ভেবে মাথা গরম করলাম। কিন্তু অবাক হওয়াই সার। কিছুই বুঝতে পারলাম না। রহস্যটা মাথায় নিয়েই ঘুমাতে চললাম। খচখচ করতে থাকল মনের মধ্যে।

রহস্য ভেদ হলো বাড সারসি যেদিন আমাদের বাড়িতে এল, আমরা কেমন আছি দেখার জন্যে, সেই দিন।

সারসির মুখটা লাল। পেট মোটা। বসতির এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে। বসে বসে ঘ্যানর ঘ্যানর করতে থাকে-দিনকাল বড় খারাপ চলছে হে, খেয়ে পরে আর বেঁচে থাকা যাবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। তামাক খায় আর সর্বত্র থুতু ছিটায়। আশায় আশায় থাকে কেউ তাকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানাবে।

আমি তার খুব একটা উপকারে আসতে পারিনি কখনও। আব্বা-আম্মাও তাকে পছন্দ করে না। আম্মা বলে, লোকটা একটা অকর্মার ধাড়ি। সে জন্যেই গরু বেচতে কেউ তাকে সঙ্গে নেয়নি। তাকে নিলে নাকি গরু নিয়ে কানসাসে পৌঁছতে পৌঁছতেই সবাই বুড়ো হয়ে যাবে। কাজেই রয়ে গেছে বাড সারসি। এখন সল্ট লিক আর অ্যাবিলেনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানোই তার কাজ।

সাদা চুলওয়ালা তার একটা নাতনী আছে, মেয়েটাকে আমার পছন্দ। বাবা-মা নেই, নানার কাছেই থাকে। এগারো বছর বয়েস। আর সব মেয়ের চেয়ে আলাদা। ছেলেদের কাছে কাছে ঘুরঘুর করে, ওরা কি করে না করে দেখে। কোন ছেলে কতটা ভাল গাছে চড়তে পারে, কে কত জোরে পাথর ছুঁড়ে কতটা বেশি দূরে নিতে পারে, কে ভাল সাঁতার কাটতে পারে, বন্দুকে কার নিশানা কত ভাল, এই সবে তার আকর্ষণ। অহেতুক জটিলতা পাকায় না, মাতব্বরী করার চেষ্টা করে না, মেয়েগুলো সাধারণত যা করে থাকে। ওর সব কিছুই আমার পছন্দ, কেবল চোখ বাদে। বড় বড় বাদামী চোখ দুটো সত্যিই সুন্দর। কিন্তু যখন কারও দিকে তাকায় মনে হয় দৃষ্টিটা ছুরির ফলার মত চিরে ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে, কি আছে ওখানে সব দেখে আসে। অস্বস্তি বোধ করতে থাকি আমি। তাই পারতপক্ষে তার চোখের দিকে তাকাই না।

ওর নাম লিজবেথ। নানার সঙ্গে সেদিন আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলো। রোগা একটা ঘোড়ায় চেপে এল ওরা। হাড় জিরজিরে জানোয়ারটাকে দেখে মনে হয় না কয়েক মাস পেটে দানাপানি কিছু পড়েছে। নানার পেছনে তার কোমরের বেল্ট চেপে ধরে বসেছে মেয়েটা। সাদা কোঁকড়া চুল ঝলমল করছে রোদে। পিছে পিছে এল একটা নীলচে রঙের মাদী কুকুর। অনেকেরই ধারণা, ওটা আমার বেলের বাচ্চা।

ওদের সাড়া পেয়েই দৌড়ে গিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার জুড়ে দিল ওল্ড ইয়েলার। কণ্ঠ শুনে মনে হলো না আগন্তুকদের তার অপছন্দ। তবু চেঁচাচ্ছে। কি জানি, হয়তো আমাদের খুশি করার জন্যেই। থামতে বললাম। একবার বলাতেই চুপ। তারমানে মেহমানদের তার পছন্দ হয়েছে। নাহলে আমার এক কথায় চুপ করার পাত্র সে নয়।

দরজায় বেরিয়ে এল আম্মা। লিজবেথ আর সারসিকে ঘোড়া থেকে নেমে ঘরে ঢোকার আমন্ত্রণ জানাল। ওদের সঙ্গে আসা কুকুরটার সঙ্গে গিয়ে খাতির করতে শুরু করল ইয়েলার। কেন অপছন্দ করেনি সারসিদেরকে বুঝতে আর বাকি রইল না আমার।

ঘোড়ার পিঠ থেকে পিছলে মাটিতে নামল লিজবেথ। বড় বড় চোখ মেলে তাকাল আমার দিকে। তার নানাও নামল। আম্মার দিকে তাকিয়ে সারসি বলল, ঘরে ঢুকতে পারবে না এই গরমের মধ্যে, তার চেয়ে ডগ রানে বসাটাই বরং ভাল। আরাম হবে। সুতরাং আম্মা আমাকে গরুর চামড়ায় তৈরি চারটে চেয়ার বের করে আনতে বলল। আমি যেটাতে বসতে সব চেয়ে পছন্দ করি সেই চেয়ারটাই বেছে নিল সারসি। তামাক বের করে একবারে অনেকখানি মুখে পুরল। উঁচু হয়ে ফুলে গেল এক পাশের গালের চামড়া। চিবাতে না চিবাতেই রস বেরোতে লাগল, ছিটানো শুরু হয়ে গেল তার। যেখানে ইচ্ছে ফেলছে। হাঁটতে গেলে যে কারও পায়ে লাগতে পারে। তোয়াক্কাই করছে না।

প্রথমে আম্মাকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের কেমন চলছে। আম্মা বলল, ভালই। ইনিয়ে বিনিয়ে তখন বলতে থাকল সারসি, এই এলাকার সমস্ত পরিবারের খোঁজখবর নিতে, ভালমন্দ দেখতেই তাকে রেখে গেছে বাড়ির কর্তারা। মস্ত দায়িত্ব। কাজের চাপে তার প্রায় মরার অবস্থা, তবু ভাল লাগছে বলে একাজ করে যাচ্ছে। আম্মাকে বলল, সামান্যতম অসুবিধে হলেও যেন সঙ্গে সঙ্গে তাকে খবর দেয়া হয়। আম্মা বলল, দেবে।

ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল সারসি। নানা রকম খোঁজখবর দিতে লাগল। বেশির ভাগই খারাপ খবর। বসতির কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে সব তার মুখস্থ। এ বছর নাকি সাংঘাতিক খরা পড়বে। ফসল সব শুকিয়ে যাবে। ঠিকমত ঘরে তোলা আর হবে না। বসন্তের আগেই খাবার শেষ হয়ে যাবে গৃহস্থের। বলল, গরুগুলো সব শুকিয়ে যাবে, বাগানে সব্জি যাবে মরে।

জেড সিম্পসনের ছেলে রোজাল নাকি একটা বনমোরগ শিকার করতে বসেছিল। হঠাৎ একটা শেয়াল তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে তখন বন্দুকের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে মারতে হয়েছে শেয়ালটাকে। সারসির ধারণা, নিশ্চয় জলাতঙ্ক রোগ হয়েছিল ওটার। নইলে এভাবে শিকারীকে শেয়ালে আক্রমণ করতে শোনা যায় না সচরাচর।

এই পর্যায়ে তার এক চাচার কথা মনে পড়ে গেল। পূর্ব টেকসাসের পাইন বনে নাকি পাগলা কুকুরের কামড় খেয়েছিল তার চাচা। সারসি তখন ছোট। কুকুরটা কামড়াতেই বুঝতে পারল চাচা, তার আর রেহাই নেই, মরতেই হবে। তখন একটা শেকল নিয়ে এক মাথা আটকাল গাছের সঙ্গে, আরেক মাথা নিজের পায়ে, যাতে কোনমতেই ছুটতে না পারে। ওখানেই থাকল। রোগটা দেখা দিল, পাগল হয়ে গেল সে। মুখ দিয়ে ফেনা বেরোতে লাগল। নিজের স্ত্রীকেও চিনতে না পেরে কামড়ানোর জন্যে তেড়ে গেল। তাড়া করল ছেলেমেয়েদের। কিন্তু শেকল আটকানো থাকায় ছুটতে পারল না, কামড়াতেও পারল না। এভাবেই মারা গেল সে। ওই গাছের নিচেই তাকে কবর দেয়া হলো।

তারপর একটা কালো চিতাবাঘের গল্প বলল সে। জো অ্যানসনের একটা ঘোড়ার বাচ্চা মেরে ফেলেছিল ওটা। তার ছেলেরা তখন কুত্তা লেলিয়ে দিল বাঘের পেছনে। একটা গুহায় কিয়ে কোণঠাসা করল বাঘটাকে। কুত্তাগুলো ঢুকল না ভেতরে। বুদ্ধি আছে ওগুলোর। জানে, গুহার ভেতরে বাঘের পেছনে ঢোকা সাংঘাতিক বিপজ্জনক, ধারাল নখের থাবায় মারাত্মক জখম হয়ে মরতে হবে। জো-র ছেলে জেফ খুব সাহসী। ঢুকে পড়ল গুহায়। বাঘটা তাকে কিছু করার আগেই ওটাকে মেরে ফেলল।

বকর বকর করেই চলল সারসি। ডিনারের আগে আর থামল না। খাওয়ার সময় কথা বলল।। শেষ লোকমাটা গিলেই আবার চালু করে দিল মুখ।

কি এক আজব জীব নাকি উদয় হয়েছে সল্ট লিকে। লোকের ঘরে ঢুকে খাবার চুরি করে। কয়োট নয়, পোসাম নয়, স্কাংক কিংবা কুনও নয়। কেউ জানে না কি জীব। স্মোকহাউস থেকে মাংস চুরি যাচ্ছে, মুরগীর ঘর থেকে ডিম। রুটি বানিয়েও শান্তি নেই মেয়েদের। ঠাণ্ডা হওয়ার জন্যে রেখে হয়তো একটু সরেছে, ফিরে এসে দেখে নেই। সব হাওয়া। গরু কেটে মাংস বানাচ্ছিল আইক ফুলার। উঠে পানি খেতে গিয়েছিল। কয়েক মিনিট পর ফিরে এসে দেখে তিন-চার পাউণ্ড মাংস গায়েব। কিসে যে নিল কিছু আন্দাজই করতে পারল না। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে।

শঙ্কিত হয়ে উঠছে সল্ট লিকের মানুষ। কিসে চুরি করছে সেটা জানা থাকলেও একটা স্বস্তি ছিল, জানোয়ারটার পেছনে লেগে ওটাকে খতম করার চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু আন্দাজই করতে পারছে না কেউ কিছু।

শুনতে শুনতে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। মিনিটখানেক পর সেটা আরও বাড়ল, যখন লিজবেথ তার সঙ্গে ঝর্নায় যেতে ইশারা করল।

পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম আমরা। পিছে পিছে আসছে ওল্ড ইয়েলার আর নীলচে কুকুরটা। বাড়ি থেকে দূরে এসে থামল লিজবেথ। মুখ তুলে বলল, ওর কাজ।

মানে? কি বলতে চাও?

তোমার কুকুরটা। আমি দেখেছি।

কি দেখেছ?

গরুর মাংস চুরি করতে। আমাদের মুরগীর খোয়াড় থেকে ডিম চুরি করতেও দেখেছি।

ওর চোখের দিকে তাকালাম। সে-ও তাকিয়ে রইল। একটুও সরাল না। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না আমি, সরিয়ে নিলাম।

কিন্তু আমি কাউকে বলব না, লিজবেথ বলল।

বিশ্বাস করলাম না তার কথা।

বললাম, না বলে কি আর পারবে?

বলব না, মাথা নেড়ে বলল সে।

কুকুরটা যে তোমার এটা না জানলেও বলতাম না।

কেন?

কারণ মিস প্রিসির বাচ্চা দরকার।

মিস প্রিসি?

আমার কুকুরটার নাম। ওটার বাচ্চা লাগবে। ওর বাচ্চার বাপ হতে যাচ্ছে ওল্ড ইয়েলার। কাজেই কিছুতেই চাইব না আমি, ওকে গুলি করে মেরে ফেলা হোক।

আবার তাকালাম ওর দিকে আবার সরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম। ওকে ধন্যবাদ জানাতে চাইলাম, কিন্তু ভাষাই খুঁজে পেলাম না। পকেট হাতড়ে বের করে আনলাম একটা তীরের ফলা। ইনডিয়ানদের তীর। কুড়িয়ে পেয়েছি বনের ভেতর। দিয়ে দিলাম ওকে।

হাতে নিয়ে জিনিসটা দেখতে লাগল সে। চোখ চকচক করছে। তারপর ঢুকিয়ে রাখল তার পোশাকের একটা লম্বা পকেটে।

কক্ষণো, কোন দিন আমি একথা কাউকে বলব না। ঘুরে বাড়ির দিকে দৌড় দিল লিজবেথ। ছুটতে ছুটতে চলে গেল।

ঝর্নার কিনারে গিয়ে বসে গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলাম। এখন মনে হতে লাগল, যতই বেশি কথা বলুক, যতই তামাকের রস ছিটাক না কেন, বাড সারসিকে আমি পুরোপুরি অপছন্দ করি না। কিন্তু ওল্ড ইয়েলারের ব্যাপারে অস্বস্তিটা গেল না মন থেকে। লিজবেথ যখন দেখেছে, আগে হোক পরে হোক আরও কারও নজরে পড়ে যেতে পারে। সেই লোক নিশ্চয় চুপ থাকবে না। গুলি করে মারা হবে ইয়েলারকে। চুরি করলে নিজের বাড়ির কুত্তাকেই দেখতে পারে না কেউ, অন্যের বাড়িরটাকে কে পারবে। ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই, আমি শিওর।

পেট ভরে সাপার খেয়ে, আরও কিছুক্ষণ বকবক করে অবশেষে উঠল সারসি। ঘোড়ায় চেপে রওনা হলো নানা-নাতনী।

মুরগীর খোয়াড় থেকে গিয়ে তিনটে ডিম বের করে আনলাম। ওল্ড ইয়েলারকে বাড়ির কাছ থেকে দূরে ডেকে নিয়ে এসে তার নাকের নিচে ভেঙে দিলাম সেগুলো। খেতে উৎসাহিত করতে লাগলাম। কিন্তু সে খেল না। এমন ভঙ্গি করতে লাগল, যেন ডিম কোন খাবারই নয়। ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল। মুখ চেটে দিল আমার।

খেপে গেলাম। চিৎকার শুরু করলাম, চোরের বাচ্চা চোর! পিটিয়ে হাড্ডিগুড্ডি-সব গুঁড়ো করে দেব!

বললাম বটে, কিন্তু আসলে আমি তা করব না। লাঠি তুললেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার শুরু করবে ইয়েলার, মাটিতে অহেতুক গড়াগড়ি খেতে শুরু করবে। তেড়ে আসবে আরলিস। লড়াই বেধে যাবে আমার সঙ্গে।

কুকুরটার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ধরা যখন পড়বে, তখব বুঝবে মজা। বন্দুকের গুলি কখনও খাওনি তো!

ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভাবলাম। কোন উপায় বের করতে না পেরে আম্মাকে বলার জন্যে রওনা হলাম।

আমিও আন্দাজ করেছি, আম্মা বলল। আমরা নাহয় সহ্য করলাম, কিন্তু লোকে কেন করবে? রেগে আগুন হয়ে যাবে ওরা।

দেখলেই গুলি করে মেরে ফেলবে।

বেঁধে রাখা দরকার।

সেই চেষ্টাই করলাম। শেকল কিংবা লোহার তার দরকার। নইলে কামড়ে কেটে ফেলবে। কিন্তু ওরকম জিনিস নেই আমাদের। প্রথমে দড়ি দিয়ে বাঁধলাম। তারপর মোটা চামড়া দিয়ে। কোনটাতেই কাজ হলো না। সন্ধ্যায় বেড়ার সঙ্গে বেঁধে রেখে ঘরে ঢুকেও সারি না আমরা, দুই মিনিটেই কামড়ে কেটে মুক্ত হয়ে চুরি করতে বেরিয়ে যায়। এক অদ্ভুত স্বভাবের কুকুর।

খড় পাকিয়ে দড়ি বানিয়ে দেখা যাক, পরামর্শ দিল আম্মা।

এটাতে বোধহয় কাজ হত, কিন্তু আরলিসের জন্যে পরখ করেই দেখা হলো না। যেই আমরা দরজা বন্ধ করলাম, কাটতে না পেরে চেঁচাতে শুরু করল ইয়েলার। বেরোনোর জন্যে খেপে উঠল আরলিস। ওকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলাম আমি আর আম্মা। কিন্তু কানেই তুলল না সে।

অনেক চেষ্টা করেও ওকে শান্ত করতে না পেরে হাল ছেড়ে দিয়ে আম্মা আমাকে বলল, আর আটকানো গেল না। মরবেই এবার কুকুরটা!

আমি বললাম, না। আরেকটা উপায় আছে। বাইরে যখন পারলাম না, ঘরেই আটকে রাখতে পারি ওকে। আমার আর আরলিসের সঙ্গে থাকবে। তাহলেই আর বেরোতে পারবে না।

তাহলে তো তোদের বিছানায় গিয়ে উঠবে। উকুন ছড়াবে। চুলকানি হবে।

বিছানায় উঠতে দেব না। মাটিতে গরুর চামড়া বিছিয়ে বিছানা পেতে দেব। তাহলেই আর উঠবে না।

ঘরে আটকে রইল বটে ইয়েলার, কিন্তু মাটিতে ঘুমাতে চাইল না। রাতে ঠিকই উঠে চলে এল বিছানায়। জোর করে নামিয়ে দিলে চেঁচানো শুরু করে। কি আর করব? থাকতে দিলাম। কয়েক দিনের মধ্যেই বাঁ হাতে দাদ দেখা দিল আমার। ওষুধ জানা আছে। তারপিন তেল ডলে দিতে সেরে গেল। ইতিমধ্যে ঘরে খাওয়ানো অভ্যেস করিয়ে ফেলেছি ইয়েলারকে। চুরি বন্ধ হয়ে গেল তার।

আমাদের খেতে ক্ষতিকর প্রাণীর উপদ্রব দেখা দিল। প্রায় সারা রাতই ওল্ড ইয়েলারকে নিয়ে খেত পাহারা দিতে হয়। বেশি যন্ত্রণা দেয় কুনেরা। রাতে আসে চোরের মত, যবের আধপাকা শীষগুলো কিছু খায়, কিছু নষ্ট করে। স্যাংকের লোভ তরমুজের ওপর। মাঝে মাঝে কয়োটও আসে তরমুজ খেতে। আর হরিণেরা যব, তরমুজ, মটরশুটি সবই খায়।

রাতে খেতের ধারে ঘুমাই। ঘরে থাকলে যে চামড়াটার ওপর শুতে চায় না ইয়েলার, সেটা বের করে নিয়ে গেছি, তাতে শুই। এখানে এটাতে শুতে আর তার কোন আপত্তি হয় না। তবে ঘুমের চেয়ে জেগে থাকা হয় বেশি। কান খাড়া করে রাখে ইয়েলার। আমি তাকিয়ে থাকি তারার দিকে। কান পেতে শুনি উষ্ণ রাতের বাতাসে দুলে ওঠা যবের শীষের শব্দ। মনে হয় আকাশে ঝুলে রয়েছে বড় বড় উজ্জ্বল তারাগুলো। ভাবি, আব্বাও কি আমারই মত শুয়ে শুয়ে এখন আকাশের তারা দেখছে?

আব্বাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করে তখন। নিঃসঙ্গ নই আমি, সঙ্গে ওল্ড ইয়েলার আছে, তবু বড় একা লাগে ওই সময়টায়। বুঝতে পারি, আব্বার জন্যেই এরকম লাগে। মনে হতে থাকে, কাজ নেই কানসাসে গিয়ে। তাড়াতাড়ি ফিরে আসুক আব্বা।

এ-ভাবনা থেকে সে-ভাবনা। ভাবি ভবিষ্যতের দিনগুলোর কথা। যখন আমি আব্বার মত বড় হব, নিজের ঘোড়ায় চড়ে নিজের গরুর পাল নিয়ে যাব কানসাসে। দেখব কত নতুন নতুন দেশ, উপত্যকা, পাহাড়-পর্বত, নদী, বন, ইনডিয়ানদের বাসস্থান। আকাশ পাতাল কত কি ভাবতে ভাবতে যখন ঘুম নেমে আসে চোখে, ভারি হয় পাতা, সেই সময় হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে ওল্ড ইয়েলার। আস্তে করে উঠে নিঃশব্দে এগোয় খেতের দিকে, চোর ধরার জন্যে। ঘুম দূর হয়ে যায় আমার। মিনিটখানেক পরেই কানে আসে ইয়েলারের বিকট হুঙ্কার। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিই খেতের দিকে। চেঁচিয়ে বলতে থাকি, ধর ব্যাটাকে, ধর, ইয়েলার! ছিড়ে ফেল!

কাজটা ইয়েলারও করতে চায়, কিন্তু মদ্দা কুনকে ছিড়ে ফেলা অত সহজ নয়। সাংঘাতিক যোদ্ধা। আকারে বেশি বড় নয়, কিন্তু যতই লড়াই চলতে থাকে, আমার মনে হয় ধীরে ধীরে যেন বড়ই হতে থাকে ওর শরীর। নিজের আয়তনের পাঁচগুণ বড় একটা জানোয়ারকেও কেয়ার করে না।

কুনের একটা বড় সুবিধে হলো তার চামড়া। এত মোটা, রোমশ, হড়হড়ে আর ঢলঢলে, কামড় বসানোই মুশকিল। কুকুরের দাঁতে শুধু চামড়াটাই আটকা পড়ে, মাংস লাগে না, পিছলে সরে যায়, ফলে ওই কামড়ে কোন ক্ষতি হয় না কুনের। ঝট ঝট করে ঘুরে যেতে থাকে কুকুরটার দিকে, একনাগাড়ে থাবা চালিয়ে নাকমুখ চিরে দিতে চায়। শুধু তাই নয়, কোন কোনটা এতই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, কুকুরকেই তাড়িয়ে ছাড়ে। বেশ কয়েকবার মদ্দা কুন আমাদের বেলকে তাড়া করে খেত থেকে বের করে দিয়েছিল। বাইরে আমাকে আর আব্বাকে দেখে আমাদেরও তাড়া করেছিল।

আমি খেতে ঢোকার আগেই কানে আসে লড়াইয়ের শব্দ। বেধে গেছে কুন আর ইয়েলারের মধ্যে। চলতেই থাকে। খেতের একটা অংশে যেন ঝড় বয়ে যায়। ওখানকার কোন গাছই আর আস্ত থাকে না। যখন শেষ হয় যুদ্ধ, কুন চলে যায় একদিকে, ইয়েলার আরেক দিকে। কেউ কাউকে আর ঘটাতে আগ্রহী নয়।

এত ঝগড়াঝাটির মধ্যে রাতে ঘুমাতে পারি না ঠিকই, তবে সময় কাটে বড় ভাল। কুনেরা রুখে দাঁড়ায়, মারামারি করে, আর স্কাংকেরা আক্রমণ ঠেকায় অন্যভাবে। বিটকেল দুর্গন্ধ ছড়িয়ে। স্কাংক মারা কিছুই না ইয়েলারের জন্যে। একদৌড়ে গিয়ে জানোয়ারটার মাথা কামড়ে ধরে জোরে দু-একটা ঝাকি, ব্যস, ঘাড় ভেঙে খতম। কিন্তু তার পরে যে ঘটনাটা ঘটে সেটার। অভিজ্ঞতা থাকলে কোন কুকুরই পারতপক্ষে ওই প্রাণীগুলোকে মারতে যেতে চায় না। বিশাল শিংওলা পেঁচার মত ভয়ঙ্কর শিকারী পাখিও স্কাংক মেরে গায়ে গন্ধ না লাগিয়ে ঝাড়া হাত-পা হয়ে ফিরতে পারে না। এমনই গন্ধের গন্ধ, একবার গায়ে লাগলে আর যেতে চায় না। ওগুলোকে মারতে অবশ্য পিছিয়ে আসে না আমাদের ইয়েলার, কিন্তু প্রতিবারেই খুন করার পর অসুস্থ হয়ে পড়ে সে। সইতে পারে না। শুরুতে ঘোৎ ঘোৎ করে, জোরে জোরে নাক টানে, কষ বেয়ে লালা গড়ায়, শেষে বমি। বালিতে, ঘাসের মধ্যে গড়াগড়ি খেতে থাকে সে, গা থেকে দুর্গন্ধ সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে। শেষে কিছুতেই কিছু করতে না পেরে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ে। অনেক কষ্ট করে আসে বেচারা। ওকে আর সরতে বলতে মন চায় না। বাধ্য হয়ে। আমিই উঠে যাই। দূরে গিয়ে শুই। একলা থাকতে ইচ্ছে করে না তার। কয়েক মিনিট পরেই উঠে চলে আসে আমার কাছে।

আব্বা বলে, সর্দি দূর করতে স্কাংকের গন্ধের জুড়ি নেই। কিন্তু এখন গরমকাল, আমার বা ইয়েলারের কারোরই ঠাণ্ডা লাগেনি, সর্দির নামগন্ধও নেই। দু-চার দিন ওরকম কষ্ট করার পর ইয়েলারও আর স্কাংক মারতে আগ্রহ দেখাল না, আমিও চাপাচাপি করলাম না। ভয় দেখিয়ে কেবল তাড়িয়ে দিয়ে আসতে পারলেই খুশি।

রাতের বেলা বুনো জানোয়ার তাড়াতে গিয়ে অনুভব করলাম, ওই মুহূর্তে একটা কুকুর আমাদের জন্যে কতটা জরুরী। ইয়েলার না থাকলে হাজার চেষ্টা করেও আমি কিছুই করতে পারতাম না। আমাকে পাত্তাই দিত না জানোয়ারের দল। ফল বাঁচাতে পারতাম না। আব্বা ঠিকই বলেছে, ঘোড়ার চেয়ে এখন একটা কুকুর বেশি দরকার আমার।

সেটা আরও ভাল করে বুঝলাম, আমাদের চিত্রা গাইটা প্রথম বাচ্চা দেয়ার পর। আমাদের প্রায় সব গরুই লঙহর্ন জাতের, দুধ তেমন একটা হয় না। বাছুরকে খাওয়ানোর পরেই শেষ। আমাদের জন্যে আর থাকে না। পাঁচ-ছয়টা গরু দোয়ালে কোনমতে টানাটানি করে দুধের চাহিদাটা মেটাতে পারি, তা-ও সব সময় নয়। সে জন্যে ভাল জাতের গরুর খোঁজে আছি আমরা।

কেবল একটা গরুই আছে আমাদের, যেটা দুধ মোটামুটি দেয়, তার নাম রোজ। কিন্তু এতই বুড়ো হয়ে গেছে বেশি দিন আর পারবে না। ওর মেয়ে বাচ্চাগুলোর ওপর আশা করেছিল আম্মা, বড় হয়ে রোজের মতই দুধ দেবে। কিন্তু প্রথম যে -তিনটে বড় হলো, তার কোনটাই আম্মার আশা পূরণ করতে পারল না। তখন যে গরুটার ওপর কারোরই কোন নজর ছিল না, সেই হাড় বের হওয়া, কুৎসিত চিত্রা গাইটাই একটা খেল দেখিয়ে দিল। বাচ্চা হলো ওটার। দুধে টইটম্বুর হয়ে গেল ওলান।

ছোট বেলা থেকেই চিত্রা বদমেজাজী। গায়ে হাত ছোঁয়ালেই রুখে দাঁড়াত। বড় হয়ে মেজাজ তো কমেইনি, বেড়েছে। তাকে শান্ত করার সব রকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে আম্মা।

একদিন বিকেলে দেখি আমাদের অন্য গরুগুলোর সঙ্গে নেই চিত্রা। পরদিন সকালেও তাকে দেখা গেল না। আম্মা শুনে বলল, বাচ্চা হওয়ার সময় হয়েছে তো। নিশ্চয় কোথাও হয়ে গেছে, আসতে পারছে না।

সুতরাং তার পরদিন সকালে উঠে খুঁজতে বেরোলাম। চলে গেলাম পাহাড়ের দিকে। অনেক খোজাখুঁজির পর ছোট একটা ঝর্নার ধারের ঝোপের পাশে পাওয়া গেল তাকে। ঠিকই অনুমান করেছে আম্মা। চমৎকার একটা বাচ্চা হয়েছে তার। বাছুরটার দিকে এগোলাম। শিং বাগিয়ে ঘোৎ-ঘোৎ করতে করতে আমাকে তাড়া করল চিত্রা। গরুটার স্বভাব আমার জানা আছে। না গুতিয়ে ছাড়বে না। ঝেড়ে দৌড় দিলাম। উঁচু একটা পাথরের ওপর চড়ে তারপর শান্তি। আমাকে ওখানে তুলে দিয়ে বার কয়েক ধমক দিয়ে শাসিয়ে ফিরে গেল সে।

আবার বাছুরটার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। তবে আর খালি হাতে নয়, কয়েকটা পাথর কুড়িয়ে নিলাম। বাছুর সহ ঝোপের ভেতর গিয়ে লুকিয়েছে চিত্রা। চিৎকার করে, পাথর ছুঁড়ে ঘুড়ে ভয় দেখিয়ে দুটোকে বের করার চেষ্টা চালালাম। বেরোল ঠিকই চিত্রা, তবে ভয় পেয়ে নয়, মেজাজ খারাপ করে। সোজা তেড়ে এল আমার দিকে। আবার দিলাম দৌড়। একছুটে এসে উঠলাম সেই পাথরটার ওপর।

আরও একবার বাছুরের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম। ওল্ড ইয়েলারকে নিয়ে আসার জন্যে বাড়ি ফিরে চললাম। গরু সামলানোর ব্যাপারে কোন অভিজ্ঞতা আছে কিনা ওর জানি না। তবু ওকে দিয়েই একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই।

কুকুরটাকে পাশে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম সেই ঝোপের কাছে। চেঁচাতে লাগলাম। সেই সঙ্গে পাথর ছুঁড়ে মারাও চলল। প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে তেড়েমেড়ে ঝোপ থেকে বেরোল চিত্রা। চেঁচিয়ে বললাম, ইয়েলার, থামাতো ওকে, দেখি কেমন বাপের ব্যাটা!

বাপের ব্যাটাই বটে ইয়েলার। জীবনে ওরকম কৌশলে কখনও বদমেজাজী গরু সামলাতে দেখিনি। অবাক হয়ে গেলাম ওর কাণ্ড দেখে। এমন ট্রেনিং কোথায় পেল সে!

চিত্রা তেড়ে আসতেই দৌড় দিয়েছি। একটা শেকড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। ভীষণ ভয়ে কলজে কেঁপে গেল। গরুটার শিঙের গুঁতো থেকে আর বুঝি রক্ষা নেই। কোনমতে উঠে দাড়িয়ে আবার ছুটতে গেলাম। পেছন ফিরে তাকালাম না। গরুটা কতটা কাছে এসেছে দেখার জন্যে সময় নষ্ট করতে চাই না। কিন্তু খুরের শব্দ কানে এল না। বাআআ করে আর্তনাদ করে উঠল চিত্রা, যন্ত্রণায়। ঝোপঝাড় ভেঙে মাটিতে আছড়ে পড়ল তার ভারি শরীর।

আরও খানিকদূর এগিয়ে তারপর ফিরলাম। দেখি মাটি থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে চিত্রা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে ইয়েলার। কি করে মাটিতে পড়ল গরুটা দেখতে পাইনি। কুকুরটার দিকে তাকিয়ে রাগে চিৎকার করে উঠল চিত্রা, মাটিতে পা ঠুকল, তারপর শিং বাগিয়ে তো মারতে গেল ওকে। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল ইয়েলার। যেন আমারই মত ভয় পেয়েছে। কিন্তু আমার মত পাথরে উঠে নাগালের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করল না। একটা ঝোপ ঘুরে চিত্রার পেছনে চলে গেল। নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াল গরুটার নাকের কাছে। একটিবারও দ্বিধা না করে নাক কামড়ে ধরল।

কি করে ঘটনাটা ঘটাল ইয়েলার, ঠাহর করতে পারলাম না। পরে আরও অনেকবার তাকে ওরকম করতে দেখেছি। কিন্তু কোন বারেই ভাল করে বুঝতে পারিনি কেন অমনটা ঘটছে। গরুর নাক কামড়ে ধরে নিজের শরীরটা বাকা করে একটা মোচড় দেয় সে। এক মোচড়ই যথেষ্ট। পরক্ষণেই দেখা যায় গরুর শরীরটাও পাক খেয়ে চিৎ হয়ে যাচ্ছে। খুর ওপরে তুলে দিয়ে একেবারে চিৎপাত। চিত্রার বেলায়ও এই ব্যাপারই ঘটল। ধড়াস করে মাটিতে আছড়ে পড়ল সে। এত জোরে পড়ল, ভয়ই পেয়ে গেলাম। ভুড়ি না ফেঁসে যায়!

চিত্রাও ভয় পেয়েছে। দ্বিতীয়বার উঠে দাঁড়ানোর পর দেখলাম লড়াইয়ের ইচ্ছে একেবারে তিরোহিত হয়েছে তার। আর ঘাটাতে এল না আমাদের। খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে চলল ঝোপের দিকে, তার বাচ্চার কাছে।

পিছু নিলাম আমি আর ইয়েলার। মা আর বাচ্চাকে খেদিয়ে নিয়ে চললাম পাহাড়ের দিকে, যেখানে আমাদের অন্য গরুগুলো চরছে। আর বেয়াদবি করল না চিত্রা। আমাদের কিছু না করলেও দুই দুইবার পালানোর চেষ্টা অবশ্য করল, কিন্তু ছুটে গেল ইয়েলার। তাকে সামনে দেখলেই তাড়াহুড়া করে আবার পথে চলে আসে সে।

চিত্রাকে খোয়াড়ে আনার পরেও ইয়েলারকে প্রয়োজন হলো আমাদের। দুধে ফেটে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে ওলান, বাছুরে খেয়েও অনেক বেঁচে যাবে। দুধ দোয়ানোর জন্যে বালতি আনতে গেল আম্মা। এনে দিল আমার হাতে। কিন্তু কাছে যাওয়ার সাহস হলো না। ওলানে হাত দিলেই যদি লাথি মারে!

ঠিকই আন্দাজ করেছি। ওলানের দিকে হাত বাড়াতেই লাথি মারল চিত্রা। আমার মাথায় লাগানোরই ইচ্ছে ছিল, কিন্তু তৈরি ছিলাম বলে পারল না। আবার হাত বাড়ালাম। আরেক বার লাথি মেরে ব্যর্থ হয়ে আর সেই চেষ্টা করল না সে। তাড়া করল আমাকে। আমিও তৈরি। দিলাম দৌড়। বেড়া ডিঙিয়ে এলাম চোখের পলকে।

নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে আম্মা বলল, এত সহজে পারবি বলে আশাও করিনি। আর কোন উপায় নেই। পেছনের পা খুঁটির সঙ্গে বেঁধেই নিতে হবে।

কিন্তু বাঁধাটা দুধ দোয়ানোর চেয়ে আরও কঠিন। যা পাজির পাজি চিত্রা, শুধু পা বাঁধলেই চলবে না, শিঙের তো থেকে বাঁচতে চাইলে ওর মাথাও বাঁধতে হবে। রোজ দুবার করে এই কাজটা নিয়মিত করে যাওয়া একটা অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হলো আমার। বাধ্য হয়ে শেষে খোঁয়াড়ের বাইরে দাঁড়ানো ইয়েলারের দিকে তাকালাম সাহায্যের জন্যে।

ইয়েলার, হাত নেড়ে ডাকলাম, এদিকে আয় তো। বেড়ার নিচের ফাঁক গলে ভেতরে ঢুকল সে। লাফাতে লাফাতে ছুটে এল।

আম্মা বলল, ওকে দিয়ে কি হবে? কুকুর দেখলে আরও খেপে যাবে চিত্রা। নতুন বাচ্চা হলে সব গরুই খেপে, আর ও তো সব সময় খেপেই থাকে।

হাসলাম। তা খেপে। তবে ইয়েলারকে কিছু করবে বলে মনে হয় না।

আমার কথাই ঠিক হলো। ইয়েলারকে দেখেই শিঙ নাড়া বন্ধ করে দিল চিত্রা। চোখ বড় বড় করে তাকাল তার দিকে।

ইয়েলার, তুই এখানে দাঁড়া। কিছু করে কিনা দেখবি।

আমি কি করতে চাই ঠিক বুঝে ফেলল ইয়েলার। এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল চিত্রার একেবারে মুখের কাছে। দরকার হলেই যেন চট করে নাক কামড়ে ধরতে পারে। কাটা লেজের গোঁড়াটা নাড়তে লাগল ধীরে ধীরে। যেন বোঝাতে চাইল, সাবধান গরু! কিছু করলেই বুঝবে ঠেলা!

কিন্তু চিৎ হয়ে আছড়ে পড়ার কোন আগ্রহই দেখা গেল না চিত্রার মধ্যে। চুপ করে দাড়িয়ে রইল। ওর গায়ে এক ধরনের কাঁপুনি হচ্ছে, টের পেলাম আমি। আবার বালতি নিয়ে গিয়ে বসলাম। লাথি মারার জন্যে আর পা তুলল না। কেবল ওলানে প্রথমবার যখন হাত ছোঁয়ালাম, সামান্য কুঁচকে ফেলল ওটা। এরপর আর কিছু না।

অবাক হয়ে গেল আম্মা। আশ্চর্য তো!…যাক, ঝামেলা মিটল। দোয়াতে আর অসুবিধে হবে না।

তিন দিনের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে গেল চিত্রা। কোন ঝামেলা ছাড়াই ওকে ডেকে নিয়ে যেতে পারলাম খোয়াড়ে, দুধ দোয়ানোর জায়গায়। ওখানে দাঁড়িয়ে সর্বক্ষণ ইয়েলারের দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। সাত দিনের মধ্যেই সামনে ফেলে রাখা খাবারেও মুখ লাগাল। তুলে নিয়ে চিবাতে লাগল একটু একটু করে। ওলানে হাত দিলে কিছু বলে না আর।

শেষে আর ইয়েলারকেও সামনে দাঁড় করিয়ে রাখার দরকার পড়ল না। একেবারে শান্ত গরুতে পরিণত হলো সে।

পুরো কৃতিত্বটাই ইয়েলারের। এরপর ওরকম একটা কুকুরকে আমাদের কাছ থেকে যদি কেউ নিয়ে যেতে আসে, কেমন লাগে!

তার নাম বার্ন স্যাণ্ডারসন। বয়েসে তরুণ। চমৎকার একটা ঘোড়ায় চেপে এল আমাদের বাড়িতে। ভদ্র, নরম ব্যবহার। আম্মাকে দেখেই হ্যাট খুলে সম্মান জানাল। ঘোড়া থেকে নামল আমাদের ঘরের সামনে। জানাল, সল্ট লিকে নতুন এসেছে। গরু নিয়ে এসেছে স্যান অ্যানটোনিও থেকে। ডেভিলস রিভারে আছে এখন ওগুলো, চরছে। সহকারী হিসেবে কাউকে নেয়ার সামর্থ্য নেই, তাই সাহায্য করার জন্যে দুটো কুকুর নিয়েছিল সঙ্গে। কিছু দিন হলো, দুটোর মধ্যে সব চেয়ে ভাল কুকুরটা হারিয়ে গেছে। সেটাকে খুঁজতে এসেছিল সল্ট লিকে। আমাদের এখানে যে একটা অচেনা কুকুর এসেছে বাড সারসি তাকে বলে দিয়েছে একথা।

বড় কুকুর? শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল আম্মা, কিন্তু তাতে মেশানো উদ্বেগ আমার কানকে ফাঁকি দিতে পারল না। হলদে রঙের?

হ্যাঁ, ম্যাম। হাসল লোকটা, এত্ত বড় চোর আপনি আর কোথাও পাবেন না। ওর জ্বালায় ডিম রাখতে পারবেন না, মাংস রাখতে পারবেন না, সব চুরি করে খেয়ে ফেলবে। তবে গরু সামলানোর জন্যে এত ভাল কুকুর আমি আর দেখিনি।

আমার দিকে ফিরল আম্মা, ট্র্যাভিস, ইয়েলারকে ডাকো।

পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি, ভাবনাও যেন স্থবির হয়ে গেছে।

কি হলো? তাগাদা দিল আম্মা। দেখোগে, ক্রীকের ওদিকে বোধহয় আরলিসের সঙ্গে খেলছে…

আম্মা! ইয়েলারকে ছাড়া আমরা…

ট্রাভিস!

শপাং করে উঠল যেন আম্মার তীক্ষ্ণ কণ্ঠ। ক্রীকে রওনা হলাম। বাড সারসির ওপর রাগে গা জ্বালা করতে লাগল। কথাটা না বললে কি হত না!

ক্রীকের কাছে গিয়ে আরলিসকে বললাম আম্মা ডাকছে।

আমার কণ্ঠস্বরেই বোধহয় খারাপ কিছু আঁচ করে ফেলল সে। মুখ ভেংচাল না, জিভ দেখাল না, চুপচাপ উঠে এল পানি থেকে। আমার পিছে পিছে বাড়ি রওনা হলো। মহা লজ্জায় ফেলে দিল আম্মা আর লোকটাকে। কারণ তার গায়ে একটা সুতোও নেই। যে ভাবে পানিতে নেমেছিল সে ভাবেই চলে এসেছে। কাপড়গুলো সব হাতে।

ওল্ড ইয়েলারকে আমরা কতটা চাই, বোধহয় সেটা আঁচ করে ফেলেছে বার্ন, কিংবা আমি চলে গেলে আম্মা তাকে কিছু বলেছে। তাই কুকুরটার কথা কিছু বলতে অস্বস্তি বোধ করছে। আম্মাকে বলল, মিসেস কোটেস, বুঝতে পারছি এখানে আপনাদের খুব অসুবিধে। কিন্তু আমারও ওকে খুব দরকার। ঠিক আছে, কুকুরটাকে ছাড়াই আপাতত চালিয়ে নেব আমি। আপনার স্বামী ফিরে না আসা পর্যন্ত থাক আপনাদের কাছে।

মাথা নেড়ে আম্মা বলল, না না, লাগবে না। আপনার দরকার না থাকলে এক কথা ছিল। নিয়ে যান। ছেলেদের আমি বুঝিয়ে বলব।

ইয়েলারের গলায় দড়ি বেঁধে দড়ির আরেক মাথা হাতে নিয়ে ঘোড়ায় চাপল বার্ন। কি ঘটছে এতক্ষণে বুঝতে পারল আরলিস। চোখ উল্টে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হলো তার। চিৎকার করে কেঁদে উঠে গালাগাল শুরু করল। ছুটে গিয়ে কয়েকটা পাথর তুলে নিয়ে ছুঁড়তে শুরু করল বার্নকে সই করে। একটা লাগল লোকটার ঘোড়ার পেটে। আরলিসের ছোঁড়া পাথরের জোর জানা আছে আমার। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল ঘোড়াটা। মাথা ঝাঁকাতে লাগল। এটা মহা উত্তেজনার ব্যাপার ইয়েলারের জন্যে। পরম আনন্দে ঘেউ ঘেউ করে দড়ি বাঁধা অবস্থায়ই ঘোড়াটার পেছনে লাগল সে।

পাথর ছুঁড়তে নিষেধ করতে করতে আরলিসের দিকে দৌড় দিল আম্মা। চিৎকার, চেঁচামেচি শোরগোল পড়ে গেল বাড়িতে।

ভীত ঘোড়াটাকে শান্ত করে ইয়েলারকে ধমক দিল বার্ন। চুপ না করলে পিটিয়ে মাথা ভাঙার হুমকি দিল। তারপর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে ফিরে আসতে শুরু করল আমাদের দিকে। মুখে বিমল হাসি।

আরলিসের এক হাত আমি ধরে রেখেছি, আরেক হাত আম্মা, সেটা দেখে হাসি আরও বাড়ল বার্নের। ছাড়া পাওয়ার জন্যে লাফালাফি করছে আরলিস। হাত ছাড়াতে পারলেই আবার পাথর ছুঁড়বে। পারছে না বলে একেক লাফে শূন্যে উঠে পড়ছে, চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে।

ছেড়ে দাও ওকে, আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল বার্ন। পাথর আর মারবে না।

ঘোড়া থেকে নামল সে। আরলিসের কাছে এসে তাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে লাগল। বলল, ওই বুড়ো চোরটাকে তুমি সত্যিই ভালবাস, না?

আরলিসের চোখে চোখে তাকিয়ে আছে সে। আরলিসও একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। জবাব দিল না।

কি হলো? ভালবাস?

মাথা ঝাঁকাল আরলিস। চোখ ফেরাল আরেক দিকে।

বেশ, একটা চুক্তি হোক। তোমার আর আমার। কুকুরটা তোমাকে দিয়ে দেব, তবে আমাকেও তোমার কিছু দিতে হবে।

আরলিস পুরোপুরি শান্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল বার্ন। তারপর বলল, থাকি গরুর সঙ্গে। রান্না করার কেউ নেই। নিজেকেই বেঁধে খেতে হয়। খিদেয় পেট জ্বলতে জ্বলতে যখন আর থাকতে পারি না, তখন গিয়ে কিছু সেদ্ধ করে গিলে নিই। সুতরাং বুঝতেই পারছ সত্যিকার ভাল রান্না খাওয়ার আমার কতটা লোভ। মাকে গিয়ে রাজি করাও, আমাকে রান্না করে খাওয়াক। লেজ কাটা, কান কাটা একটা চোরের জন্যে আর কাঁদতে হবে না তোমাকে।

আর দাঁড়াতে পারলাম না। ছুটে সরে গেলাম সেখান থেকে। নইলে আমি যে কেঁদে ফেলেছি, ঠিক ধরা পড়ে যেতাম বার্ন স্যাণ্ডারসের কাছে।

আম্মার হাতে অনেক রান্না খেয়েছি, কিন্তু সেদিনকার রান্নার তুলনা হয় না। মাংসের রোস্ট, ক্যাটফিশ ভাজা, কাঠবেরালির স্যুপ, ব্ল্যাকআইড পা, কর্নব্রেড, ফ্লাওয়ার গ্রেভি, হগ-পাম জেলি, মাখন, বুনো মধু আর দুধ। কত খাব। কোনটা ফেলে কোনটা খাব। গলা পর্যন্ত গিললাম। তবু মনে হলো না বার্ন স্যাণ্ডারসনের ধারেকাছে যেতে পেরেছি। হালকা-পাতলা মানুষ সে, আব্বার মত বিশালদেহী নয়, তবু যে অত খাবার কোথায় জায়গা করল সে-ই জানে। কাঠবেরালির স্যুপ শেষ চামচটুকুও গিলে নিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে চেয়ারে হেলান দিল। আমার মনে হতে লাগল আগামী দশ দিন আর ওর কিছু খাওয়া লাগবে না।

খাওয়ার পর আম্মার রান্নার অনেক প্রশংসা করল সে। ধন্যবাদ দিল। আরও কিছুক্ষণ কথা বলল। ভুট্টার শুকনো ডাটা দিয়ে আরলিসকে খেলনা ঘোড়া বানিয়ে দিল। তারপর আম্মাকে আরেকবার ধন্যবাদ দিয়ে যাওয়ার জন্যে তৈরি হলো। আমাকে বলল তাকে ঝর্নাটা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে। মনে পড়ে গেল আমার আব্বা যাওয়ার দিন এভাবেই ডেকে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। তার মানে বার্ন স্যাণ্ডারসনেরও কিছু বলার ইচ্ছে। শুধু আমাকে।

ঝর্নার কাছে এসে ঘোড়ার মুখের লাগাম খুলে নিয়ে ওটাকে পানি খাওয়াতে নিয়ে গেল সে। তারপর ফিরল আমার দিকে।

শোনো, একটা কথা। ভয় পাবেন, সেজন্যে তোমার আম্মাকে বলিনি। জলাতঙ্ক দেখা দিয়েছে। মহামারী হয়ে যেতে পারে। সাবধান থেকো।

হিম হয়ে আসতে লাগল আমার হাত-পা। জলাতঙ্ক কি জিনিস দেখিনি আমি কখনও। কিন্তু বাড সারসির মুখে শোনা তার চাচার কথা ভুলিনি। অন্যকে আক্রমণ করার ভয়ে নিজেই নিজেকে শেকল দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল। তাতেই বুঝে গেছি কি ভয়াবহ অসুখ। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম বার্নের দিকে।

সে বলল, দুটো নেকড়ে, একটা শেয়াল আর একটা স্কাংককে গুলি করে মেরেছি আমি। জলাতঙ্ক হয়েছিল ওগুলোর। সল্ট লিকে এক মহিলা বাড়ির সবগুলো বেড়ালকে মেরে ফেলেছেন। অসুখে ধরেছিল কিনা বুঝতে পারেননি, তবু কোন ঝুঁকি নিতে চাননি।

কিন্তু আমি কি করে বুঝব কোনটাকে মারব, আর কোনটাকে মারব না?

শুরুতে বোঝা কঠিন। অসুখ বেড়ে গেলে মুখ দিয়ে ফেনা ঝরবে, হাঁটার সময় টলে পড়ে যেতে চাইবে। তখন বোঝা যায়। তবে তার আগেই শেষ করে দেয়া উচিত। যদি দেখো, বাড়ির বেড়ালটা তোমাকে দেখে অকারণেই রেগে উঠে কামড়াতে আসছে, দেবে গুলি করে। কুকুরের বেলায়ও একই কথা। শেয়াল, বনবেড়াল, নেকড়ে, স্কাংক, সব একই আচরণ করবে। মোট কথা, এখন থেকে কোন জানোয়ারকে অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখলেই গুলি করবে। যদি কামড়ে কিংবা আঁচড়ে দেয়, আর রেহাই নেই, বাঁচবে না।

বুকের মধ্যে কাঁপুনি শুরু হলো আমার। গলা শুকিয়ে কাঠ। মাটির দিকে তাকিয়ে আছি। আনমনে লাথি মেরে সরিয়ে দিলাম একটা পাথর।

ভয় পেয়েছ? তোমার বাবা তোমার ওপর বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে গেছে একথা জেনেই বললাম। যা-ই ঘটুক, আমার ধারণা তুমি সামলাতে পারবে। খুব সাবধান থাকবে। কড়া নজর রাখবে। কিছুতেই যাতে পরিবারের কাউকে জলাতঙ্কে না ধরতে পারে। আমার বিশ্বাস তুমি পারবে ঠেকাতে পারবে না?

ঢোক গিলে কোনমতে বললাম, পারব।

টানটান ভাবটা চলে গেল তার চেহারা থেকে। ঝুঁকে আমার কাঁধে হাত রাখল, যাওয়ার দিন আব্বা যে ভাবে রেখেছিল।

গুড। একজন পুরুষের ওভাবেই কথা বলা উচিত।

জোরে একবার আমার কাঁধে চাপ দিল বার্ন। ঘোড়ায় চেপে রওনা হয়ে গেল। হারিয়ে গেল গাছপালার আড়ালে। জলাতঙ্ক এতটাই ভয় পাইয়ে দিয়েছে আমাকে, ওল্ড ইয়েলারের জন্যে তাকে ধন্যবাদ দেয়ার কথাটাও মনে পড়ল না।

কিশোর বয়েসী ছেলেরা, যৌবন যাদেরকে হাতছানি দিচ্ছে, বুনো জানোয়ারের সঙ্গে তাদের অনেক মিল। কোন কারণে আজ যদি কাবু হয়ে যায়, কালই দেখা যাবে সব ভুলে গেছে।

আমার ক্ষেত্রে অন্তত সে রকমই হয়েছে। বার্ন স্যাণ্ডারসনের কাছে জলাতঙ্কের কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। ভাল করে ঘুমাতে পারলাম না সে রাতে। মনের পর্দায় কেবলই ঘুরে ফিরে আসতে থাকল পাগলা কুকুর আর পাগলা নেকড়ের ছবি। মুখ দিয়ে ফেনা ঝরছে, টলমল পায়ে হাঁটতে গিয়ে বার বার পড়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে জীবন্ত যা কিছু দেখছে তাকেই কামড়াতে আসছে। মনে হলো, আম্মা আর আরলিসকেও কামড়ে দিয়েছে। পাগল হয়ে যাচ্ছে দুজনে। বিছানায় শুয়ে শিউরে শিউরে উঠলাম। প্রচুর দুঃস্বপ্নও দেখলাম সে রাতে।

কিন্তু পরদিন সকালেই সব ভুলে গেলাম। ইয়েলারকে নিয়ে বেরোলাম সে বছর শুয়োরের যে সব বাচ্চা হয়েছে ওগুলোকে ধরে চিহ্ন দিয়ে রাখার জন্যে।

বনেবাদাড়েই তখন ঘুরে বেড়ায় আমাদের শুয়োরগুলো। কারণ ওসব জানোয়ার রাখার মত কোন খোঁয়াড় নেই আমাদের। খাবারও দিতে হয় না। বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে নিজেরাই নিজেদের খাবার জোগাড় করে নেয়। কেবল প্রচণ্ড শীতে যখন খাবার দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে, তখন কাছাকাছি এলে কয়েক মুঠো শস্য ওগুলোর সামনে ধরে দিই, ব্যস।

বাইরে থাকে ওরা, বাইরে খায়, বাইরেই ঘুমায়। গরমকালে থাকে পানির ডোবাগুলোর কাছাকাছি। কখনও পানির ধারের নরম কাদামাটিতে, কখনও পানিতে। শীতকালে আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেলে, প্রচণ্ড তুষারপাত কখন শুরু হবে আগে থেকেই টের পেয়ে যায় ওরা। দল বেঁধে গিয়ে টন টন ডালপাতা আর শুকনো ঘাস জোগাড় করে এনে জড় করে ঘন ঝোপের ভেতরে কিংবা কোন গুহায়। সে সব বিছিয়ে ভারি বিছানা পাতে। তারপর তাতে নাকমুখ গুঁজে পড়ে থাকে যতদিন না তুষারপাত বন্ধ হয়।

পাহাড়ের সমস্ত ঢাল, উপত্যকা, গিরিখাত হলো ওদের চারণভূমি। বুনো ফলমূলের অভাব নেই ওসব অঞ্চলে, ফলে ওদের খাবারেরও ঘাটতি হয় না। সাধারণত নিরামিষভোজী হলেও মাংস ভোজনেও অরুচি দেখা যায় না ওদের। সদ্যজাত গরুর বাছুরকে ধরে নিয়ে যায় তার মায়ের সামনে থেকেই, যদি মা দুর্বল হয়, শিং দুলিয়ে ভয় দেখিয়ে ঠেকাতে না পারে। লম্বা ঘাসের মধ্যে বাচ্চা লুকিয়ে রেখে হরিণ যদি অন্য কোথাও যায় পানি কিংবা খাবার খেতে, আর সেটা শুয়োরের দলের চোখে পড়ে যায়, তাহলে বাচ্চাটার রেহাই নেই। একদিন আমি আর আব্বা একটা ধাড়ি শুয়োরকে ডোবায় নেমে মাছ ধরে খেতেও দেখেছি।

তবে বুড়ো শুয়োরগুলোই মাংসখেকো হয়ে ওঠে, বিশেষ করে তীব্র শীত কিংবা অন্য কোন প্রাকৃতিক কারণে যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় তখন। আব্বা বলে, বনের ভেতর মরে পড়ে থাকা গরু কিংবা হরিণের মড়া খেয়েই মাংস খাওয়ার হাতেখড়ি হয় ওগুলোর। সব সময় তো আর মড়া পাওয়া যায় না। তখন জ্যান্ত প্রাণীর দিকে নজর দেয়। ছোটবেলায় একবার নাকি আব্বাকেই আক্রমণ করে বসেছিল শুয়োরেরা। সময় মত তার আব্বা অর্থাৎ আমার দাদা দেখে না ফেললে সেদিনই শেষ হয়ে যেত আব্বা।

এরকম ছেড়ে রাখা শুয়োরকে তাই ঠিক পোষা বলা যায় না। আর এগুলোর ব্যাপারে একটা ভীতি আছে আমার। কাজেই সে বছর যখন শুয়োরকে চিহ্ন দেয়ার জন্যে বেরোতে চাইলাম আমি, বাধা দিল আম্মা। জানে, কাজটা করতেই হবে, নইলে অনেক শুয়োর হাতছাড়া হয়ে যাবে আমাদের, মাংসের সমস্যায় পড়তে হবে, তবু আমাকে যেতে দিতে চাইল না। শুয়োর সবারই প্রয়োজন। যে যত বেশি ধরে চিহ্ন দিয়ে রাখতে পারবে সে ততটার মালিক।

বললাম, খামাকা ভয় পাচ্ছ। আমি তো আর একা যাচ্ছি না। ইয়েলার আছে। শুয়োর সামলাতে ওর জুড়ি নেই, বার্ন স্যাণ্ডারসন কি বলে গেল শুনলে না।

তাতে কি? একটা কুকুর তো আর একপাল শুয়োরকে ঠেকাতে পারবে না। সামান্য একটু ভুল হলেও আর বাঁচবি না। কেটে ফালা ফালা করে ফেলবে।

আম্মা ঠিকই বলেছে। এই কাজের অভিজ্ঞতা আমার আছে। আব্বার সঙ্গে গিয়ে শুয়োর ধরে চিহ্ন দিয়েছি। শুয়োরকে না ঘটালে সে-ও কিছু করে না। বড় জোর ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে দুচারবার হুমকি-ধামকি দেয়, কখনও বা তা-ও করে না, সরে যায় সামনে থেকে। কিন্তু কিছু করলে, রাগিয়ে দিলে কিংবা ভয় দেখালে, ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তখন সে টেক্সাসের সবচেয়ে মারাত্মক জানোয়ার। পাল থেকে একটা বাচ্চাকে ধরে আনলেই হলো। বাচ্চাটা চেঁচাবে। দলের সমস্ত শুয়োর দাঁত ঘষতে ঘষতে তেড়ে আসবে। দাঁত তো নয় যেন ক্ষুরের ফলা। পালাতে না পারলে শেষ। দুনিয়ার কোন শক্তিই আর বাঁচাতে পারবে না।

বাধ্য হয়েই এরকম হতে হয়েছে ওদের। নইলে নেকড়ে, চিতাবাঘ, ভালুক আর বনবেড়ালে ভরা বিপজ্জনক বনের মধ্যে টিকে থাকতে পারত না।

শুয়োর ধরে চিহ্ন দিতে আমার খুব ভাল লাগে। এর মধ্যে এক ধরনের রোমাঞ্চ, এক ধরনের মজা আছে। আব্বার সঙ্গে এতদিন করেছি এই কাজ, অতটা ভয় ছিল না। মনে হত, যা-ই ঘটুক আব্বাই বাঁচাবে। কিন্তু এখন যেতে হবে একা। সঙ্গে অবশ্য থাকছে। তার ওপর কতটা ভরসা করতে পারব জানি না।

আম্মার বাধা মানলাম না। তাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ইয়েলারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম দলটার দেখা পেয়ে গেলাম বার্ডসং ক্ৰীকের একটা ঝর্নার কাছে। প্রায় শুকনো একটা খাড়িতে। মাদী-মদ্দা আর বাচ্চা নিয়ে মোট একুশটা। তার মধ্যে দুটো বিশাল দাঁতাল শুয়োর।

পানি খেতে আর কাদাপানিতে গড়াগড়ি করতে এসেছে ওগুলো।

আমাদের চোখ পড়ল ওগুলোর ওপর, ওরাও আমাদের গন্ধ পেয়ে গেল। নাক উঁচু করে বাতাসে গন্ধ শুকতে শুকতে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে শুয়োরের ভাষায় যেন জিজ্ঞেস করল ধাড়িগুলো, কি চাই? আমাদের জবাবের অপেক্ষা করল না। পানি থেকে উঠে ঢাল বেয়ে ছুটল ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে।

চেঁচিয়ে উঠলাম, ইয়েলার, ধর ব্যাটাদের, ধর!

না বললেও চলত। বলার আগেই ছুট লাগিয়েছে সে। একটা অল্প বয়েসী শুয়োরের পেছনের পা কামড়ে ধরল গিয়ে। বাকিগুলো জানতেই পারল না কিছু।

তীক্ষ্ণ চিৎকার করল শুয়োরটা। চোখের পলকে ঘুরে দাঁড়াল বয়স্ক শুয়োরগুলো। তেড়ে এল ইয়েলারকে। ঘাড়ের রোম দাঁড়িয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত ঘষার শব্দ হচ্ছে। কামড় ছাড়ল না ইয়েলার। আমার মনে হলো, বাঁচতে পারবেনা ও, ঠিক ধরে ফেলবে ওকে। শেষ মুহূর্তে কামড় ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াল ইয়েলার। দৌড় দিল আমার দিকে। পিছু ছাড়ল না শুয়োরের পাল। আসতেই থাকল। দূরত্ব একবার বাড়ে, একবার কমে।

শেষ পর্যন্ত যখন বুঝল ধরতে পারবে না, থেমে গেল শুয়োরগুলো। গায়ে গা ঠেকিয়ে শক্ত একটা চক্র তৈরি করল। মুখ রয়েছে চক্রের বাইরের দিকে। ভেতরের খালি জায়গায় রয়েছে বাচ্চাগুলো। চিতাবাঘ কিংবা ভালুকে আক্রমণ করলে এভাবেই ব্যুহ তৈরি করে ঠেকায় শুয়োরেরা। কিছুতেই ভেতরে ঢুকে বাচ্চা ধরে নিয়ে যেতে দেয় না।

কিন্তু অামরা, অর্থাৎ আমি আর ইয়েলার ভালুক বা চিতাবাঘ নই। ওই সব জানোয়ারের চেয়ে মাথায় অনেক বেশি বুদ্ধি আমাদের। চক্র ভেদ করার চেষ্টা করতে গিয়ে ওগুলোর দাঁতের শিকার হলাম না। করার দরকারও নেই। আমি ওগুলোকে নিয়ে যেতে চাই সুবিধেজনক কোন জায়গায়। সেটা ইয়েলারও জানে।

আবার ফিরে গেল সে। একেবারে ওগুলোর মুখোমুখি। তবে অবশ্যই দাঁতের নাগালের বাইরে রইল। সেখানে দাঁড়িয়ে গলা ফাটিয়ে ঘেউ ঘেউ করে ওগুলোকে রাগাতে লাগল। মাঝে মাঝে সামনে লাফিয়ে গেল আক্রমণের ভঙ্গিতে। ব্যুহ ভেঙে তেড়ে এল দু-একটা ধাড়ি। কিন্তু সরে গেল ইয়েলার। তাকে ছুঁতেও পারল না ওরা। ধরতে না পেরে ফিরে যেতেই আবার এগোল সে। শেষে বিরক্ত হয়ে আবার তাকে দল বেঁধে তাড়া করল বয়স্কগুলো। ছুটল ইয়েলার। নিজের মাত্র কয়েক ইঞ্চি পেছনে রাখল ওগুলোকে।

পেছন দিক ও দুপাশ থেকে তার কাছাকাছি হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে শুয়োরের দল। দাঁত লাগিয়ে চিরে দিতে চাইছে কুকুরটার পেটের নরম চামড়া। কোনমতে একবার লাগাতে পারলেই হয়। নাড়িভুড়ি বের করে দেবে। তখন তাকে শেষ করাটা কিছুই না ওদের জন্যে।

সাংঘাতিক বিপজ্জনক খেলায় মেতেছে ইয়েলার। মারাত্মক ঝুঁকি নিচ্ছে। কিন্তু ভাব দেখে মনে হচ্ছে না ভয় পাচ্ছে সে। বরং যেন মজাই পাচ্ছে। পাহাড় থেকে নামিয়ে আনছে শুয়োরগুলোকে। এমন কোথাও, যেখানে ওগুলোকে ধরতে সুবিধে হয় আমার।

নিয়ে আয় ইয়েলার, নিয়ে আয়! চেঁচিয়ে বলে আমিও ছুটতে শুরু করলাম বড় একটা ওক গাছের দিকে। এক চিলতে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা গাছটা বেছে নিয়েছি, কারণ অনেক বড় একটা ডাল এক দিকে বেরিয়ে রয়েছে ওটাতে। মাটি থেকে বেশি উঁচুতে নয়, আবার এতটা নিচেও নয় যে শুয়োরে নাগাল পাবে।

তাড়াতাড়ি গাছে উঠে কোমরে পেঁচিয়ে রাখা দড়ি খুলে নিলাম। একটা মাথা ডালের সঙ্গে বেঁধে আরেক মাথায় ফাঁস তৈরি করলাম। তারপর ইয়েলারকে ডেকে বললাম শুয়োরগুলোকে এদিকে নিয়ে আসার জন্যে।

যা বললাম ঠিক তাই করল সে। শুয়োরগুলোকে টেনে নিয়ে এল গাছের কাছে। আমার উদ্দেশ্য বুঝে গেছে। খুব ভাল ট্রেনিং রয়েছে তার, আরেকবার প্রমাণ করল। একটা বাচ্চা চলে এল ঠিক আমার ডালটার নিচে। গলায় ফাঁস পরিয়ে টেনে তুলাম ওটাকে। দু-হাটু দিয়ে চেপে ধরে ছুরি বের করে প্রথমে ডান কানের ওপর থেকে তিন কোণা করে খানিকটা কেটে নিলাম। তারপর বা কানের নিচের দিক থেকে কাটলাম খানিকটা। এই ডিজাইনটা আমাদের চিহ্ন। একেকজনের একেক ধরনের চিহ্ন থাকে। আমাদেরটা তিন কোণা। ডান কানে থাকবে ওপর দিকে, বা কানে নিচের দিকে। সব সেটলারদের মধ্যেই একটা অলিখিত চুক্তি আছে। কড়াকড়ি ভাবে সেটা মেনে চলে সবাই। একজনের চিহ্ন দিয়ে রাখা শুয়োর আরেকজন মারবে না।

কান কাটলে যতটা রক্ত বেরোয় ততটা ব্যথা পায় না শুয়োর। তত চিৎকারও করে না। কিন্তু এই শুয়োরটা এমন জোরে চেঁচিয়ে উঠল যেন তাকে জবাই করে ফেলা হচ্ছে। ওকে দোষ দিই না। আমাকে চেপে ধরে আমার কান কেউ কাটলে এর চেয়ে জোরে চেঁচাতাম কোন সন্দেহ নেই। জীবন্ত প্রাণীদেহে এই কাটাকাটির ব্যাপারটা আমার ভাল লাগে না। কিন্তু আর কোন উপায়ও নেই।

শুয়োরটার চিৎকার আর রক্তের গন্ধে পাগল হয়ে গেল যেন নিচের শুয়োরগুলো। ভীষণ রাগে ঘোৎ ঘোঁৎ করে দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে গাছের গোঁড়া ঘিরে ঘুরতে লাগল। আমাকে ধরার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ওগুলোর কণ্ঠস্বর আর কুতকুতে চোখের দৃষ্টিতে ঝরছে তীব্র ঘৃণা। রক্ত হিম করে দিতে যথেষ্ট। ভাগ্যিস শুয়োরেরা গাছে উঠতে পারে না। কোন ভাবে এখন আমি গাছ থেকে পড়ে গেলে কি ঘটবে ভেবে শিউরে উঠলাম। তবে সে জন্যে লজ্জা পেলাম না। আব্বা বলে, ভয় হলো মানুষের স্বাভাবিক অনুভূতি। বড়রাও ভয় পায়। কাজেই ভয় পেলেই যে নিজেকে ছোট ভাবতে হবে তার কোন কারণ নেই। তবে ইচ্ছে করলে ভয়কে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। সে জন্যে প্রচুর প্র্যাকটিস দরকার।

কাজেই ভয়টা দূরেই সরিয়ে রাখলাম। তাছাড়া এই মুহূর্তে ভয় পাওয়ারও কিছু নেই। আমি রয়েছি গাছের মোটা ডালে। এখানে উঠতে পারবে না শুয়োরের পাল। ডাল ভেঙে পড়ারও কারণ নেই। আক্রান্ত হওয়ার চিন্তাটা দূরে সরিয়ে কাজে মন দিলাম। প্রথমটাকে নিচে ফেলে দিয়ে আরেকটাকে টেনে তুললাম।

ইতিমধ্যে বুঝে ফেলেছে ইয়েলার ঠিক কোন শুয়োরগুলোকে চিহ্ন দিতে চাই আমি। ওগুলোকেই টেনে টেনে আনতে লাগল ডালের নিচে। আমিও একটার পর একটা ধরে তুলে কান কেটে চললাম।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে গেল। কান কাটা মাদী আর বাচ্চাগুলোকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে মদ্দা আর বয়স্কগুলো। অনেক পরিশ্রম করেছে ইয়েলার। মূল কাজটা সে-ই করেছে। তাকে বললাম খানিক দূরে গিয়ে বসে জিরিয়ে নিতে।

শুয়োরগুলো কখন যাবে তার কোন ঠিক নেই। এখন ওগুলোর যাওয়ার অপেক্ষায় চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই আমাদের।

যখন দেখল কুত্তাটা দূরে গিয়ে বসে আছে, বিরক্ত করছে না, আমিও চুপচাপ, আস্তে আস্তে ঘৃণা আর সন্দেহ দূর হয়ে যেতে লাগল ওগুলোর চোখ থেকে। আরও ঘন্টাখানেক গাছের নিচে ঘোরাফেরা করল, তারপর রওনা হয়ে গেল ঝোপের দিকে।

আরও কিছুক্ষণ বসে রইলাম। তারপর যখন বুঝলাম, সত্যিই চলে গেছে, তখন নামলাম গাছ থেকে।

বিশাল বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় শুয়োরের পাল। যতই চিহ্ন দিয়ে রাখো না কেন, কখন কোথায় ওগুলোকে খুঁজে পাওয়া যাবে বলা মুশকিল। তবে দল বেঁধে থাকে বলে বের করা হরিণের চেয়ে সহজ। কাজকে কঠিন ভেবে বসে থাকলে সেটা আর করা হবে না। তাই কষ্ট করেই খুঁজে বের করতে লাগলাম। চিহ্ন দিয়ে কাটা কানের টুকরোগুলো রেখে দিই। সেগুলো বাড়িতে এনে কাঠিতে গেঁথে রোদে শুকিয়ে রাখি গুণে দেখার সুবিধের জন্যে। ছেচল্লিশটা শুয়োরকে চিহ্ন দেয়ার পর আর কোন দল খুঁজে পেলাম না। আম্মা বলল, এ-বছর এই কয়টাই বেড়েছে। শুয়োর খোঁজা বাদ দিয়ে তখন আবার শস্য খেতের দিকে নজর দিলাম। কিন্তু একদিন বার্ড সারসি এসে জানাল, আমাদের একটা দলকে নাকি দেখে এসেছে ব্যাট কেভের ওদিকে।

জায়গাটা আমাদের বসতি থেকে অনেক দূরে। সল্ট ব্রাঞ্চের ওই ধারে কখনও যাইনি আমি। তবে জায়গাটার নাম শুনেছি আব্বার কাছে। সুতরাং পরদিন সকালে উঠেই ইয়েলারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। খেতে কাজ করার চেয়ে শুয়োর খেদানো অনেক মজার। ভাগ্য ভাল হলে দলটাকে তো পাবই, হয়তো বাদুড়ের দলকেও গুহা থেকে বেরোতে দেখতে পারব। সন্ধ্যায় লক্ষ লক্ষ বাদড় গুহা থেকে বেরোয়, সেটা নাকি এক দেখার মত জিনিস।

সল্ট ব্রাঞ্চের এই ধারে গিয়েছি আমি। উঁচু একটা পাহাড় আছে। এক দিকের ঢাল ওপর থেকে খাড়া করে কাটা, দেয়ালের মত, ওটা বেয়ে ওঠার উপায় নেই। হাজার হাজার বাবুই পাখির বাসা আছে ওখানে। জায়গাটা আমার ভারি পছন্দ।

আরও একটা জায়গা আমার পছন্দ ওখানে। একটা গিরিখাত। অনেকটা ঘোড়ার খুরের আকৃতি। টলটলে পানির একটা পুকুর আছে। স্বচ্ছ সেই পানির দিকে ঝুঁকে ঢালের গায়ে দাড়িয়ে আছে অনেক বড় বড় গাছ। সেই সব গাছে শত শত বকের বাসা। কোনটা নীল, কোনটা সাদা। তবে গায়ের রঙ যা-ই হোক, দুই জাতেরই পাখার ডগা কালো। গাছের ডালগুলো পানির ওপরে অনেকখানি বেরিয়ে এসেছে। সেগুলোর নিচে এসে চুপচাপ পড়ে থাকে গজখানেক লম্বা ক্যাটফিশ। পাখির বাচ্চার লোভে। বাসা থেকে প্রায়ই পানিতে পড়ে যায় বকের বাচ্চা। পড়লে আর রেহাই নেই। টুক করে ধরে গিলে ফেলে রাক্ষুসে মাছ।

চলতে চলতে মনে হতে লাগল আমার, ব্যাট কেভ ওরকমই কোন চমৎকার জায়গা হবে। একটা ডোবার কাছে এসে শুয়োরের গন্ধ নাকে লাগল ইয়েলারের। শুঁকে শুঁকে চলে এল কাটাআপেলের ঝোপে। টকটকে লাল রসালো ফলগুলো দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু খাওয়া আর যায় না। সারা গায়ে চুলের মত কাটা। তবু কয়েকবার চেষ্টা করে দেখেছি, খেতে খুব স্বাদ বলে। বালিতে ঘষে ঘষে কাটা ফেলে দিয়ে তারপর কামড় দিয়েছি। কিন্তু তারপরেও কি করে যেন কাটা থেকে গিয়েছিল, জিভে গেঁথে যন্ত্রণা দিয়েছে। কি করে যে এগুলো গপগপ করে গেলে শুয়োরেরা সে এক বিস্ময় আমার কাছে। আরও কিছু প্রাণীর পছন্দ ওই ফল। রঙ লাল হয়ে এলেই আসতে আরম্ভ করে বন মোরগ, এক জাতের বিশাল ইদুর আর বড় বড় কানওয়ালা লেজে আংটি আঁকা বনবেড়াল। মজা করে খায়।

সহজেই শুয়োরগুলোকে খুঁজে বের করে ফেলল ইয়েলার। ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে বসেছিল। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে ঘোঁৎ ঘোঁৎ শুরু করল। বেরিয়ে এল কয়েকটা ধাড়ি শুয়োর। ঠিকই বলেছে সারসি। ওগুলোর কানে আমাদের চিহ্ন দেখতে পেলাম। চেঁচামেচি করে পুরো দলটাকে বের করে আনল ইয়েলার। আপেলের রসে লাল হয়ে আছে ওগুলোর লম্বা লম্বা নাক। অনেকগুলো বাচ্চা হয়েছে। চিহ্ন দিতে হবে। জুতসই একটা গাছ খুঁজতে শুরু করলাম।

তেমন গাছ কাছাকাছি নেই। রয়েছে সিকি মাইল দূরে। অতদূরে শুয়োরগুলোকে টেনে নিয়ে যাওয়া কঠিন। হয়তো নেয়াই যাবে না। তাই অন্য জায়গা দেখতে লাগলাম। গাছ আর আপেল ঝোপের মাঝামাঝি একটা টিবি চোখে পড়ল। একটা ধার একেবারে সমান, দেয়ালের মত। বৃষ্টির পানি বয়ে যেতে যেতে এই অবস্থা হয়েছে। খুশি হয়ে উঠলাম। এই তো পাওয়া গেছে জায়গা। ঘুরে যদি অন্য পাশ দিয়ে গিয়ে উঠি শুয়োরেরা দেখতে পাবে না আমাকে। ইয়েলার ওগুলোকে টেনে আনবে দেয়ালের মত দিকটায়। নিচে খাদ হয়ে আছে। এদিক দিয়ে আমার কাছে কিছুতেই উঠতে পারবে না ধাড়ি শুয়োরগুলো। ধরতে পারবেনা।

শুয়োরগুলোকে ব্যস্ত রাখার ভার ইয়েলারের ওপর ছেড়ে দিয়ে আমি গিয়ে উঠলাম সেই ঢিবিটায়। কোমর থেকে দড়ি খুলে ফঁাস তৈরি করে নিচে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

শুয়োরগুলোকে সেখানে নিয়ে এল ইয়েলার। আমার অনেক নিচে রয়েছে ওগুলো। এত ওপর থেকে ফাঁস ছুঁড়ে ঠিকমত লাগাতে পারব কিনা বুঝতে পারছি না। শুয়ে পড়লাম উপুড় হয়ে। মনে হচ্ছে এবারে পারব।

সত্যি পারলাম। তুলে নিলাম একটা ছানাকে। বড়ই তঁাদড়। শরীর মুচড়ে পিছলে যেতে চাইল। চিৎকার করছে গলা ফাটিয়ে। ওর চিৎকারে কান দিলাম না। কান কাটতে শুরু করলাম। তারপর দুহাতে ধরে যতটা সম্ভব ঝুঁকে ছেড়ে দিলাম নিচে। নরম বালিতে পড়ল। কোন ক্ষতি হলো না ওটার, ব্যথা পেল না। বুড়ো শুয়োরগুলো ঘিরে এল ওটাকে। রক্তাক্ত কান শুঁকেই খেপে গিয়ে চেঁচাতে শুরু করল। কি করে ঘটল ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। আমাকেও দেখতে পায়নি।

শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। নাগালের মধ্যে আরেকটা এলেই ধরব। খাদের দেয়াল ঘেঁষে একটা গর্ত, অনেকটা গুহার মত। তার মধ্যে ঢুকে গেছে মাদী আর বাচ্চা শুয়োরগুলো। আমি দেখতে পাচ্ছি না।

অবশেষে বেরোল আরেকটা বড় বাচ্চা। ভাল করে দেখার জন্যে হাতে ভর দিয়ে কয়েক ইঞ্চি আগে বাড়লাম। আরও একটু ঝুঁকলাম। হ্যাঁ, এবার দেখতে পাচ্ছি। ফাঁসও পরাতে পারব।

দড়ি নামিয়ে দিলাম। ধরেও ফেললাম শুয়োরটাকে। টেনে তুলতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। চাপ আর আমার ভার সইতে না পেরে ভেঙে গেল বালির ঢিবির কিনার। টন টন বালি ধসে পড়ল খেপা শুয়োরগুলোর ওপর। আমিও পড়লাম সেই সঙ্গে। হুমড়ি খেয়ে মাথা নিচু করে পড়লাম সেই খুনী জানোয়ারগুলোর একেবারে মাঝখানে।

শুয়োরগুলোকে ঢেকে দিয়েছে বালি। কিন্তু আলগা বালিতে কোন ক্ষতি হলো না ওগুলোর। বালির ভেতর থেকে লাফিয়ে বেরোল বিরাট একটা মন্দা। যেন মাটি খুঁড়ে উদয় হলো। ঝাড়া দিয়ে দিয়ে বালি ফেলতে লাগল শরীর থেকে। পড়ার সময় চিৎকার করেছি কিনা মনে নেই। এখন টের পেলাম ভীষণ আতঙ্কে সাংঘাতিক লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা। মনে হচ্ছে বেরিয়ে আসবে বুকের খাঁচা থেকে। প্রাণ বাঁচানোর প্রচণ্ড তাগিদে মরিয়া হয়ে লাফ দিয়ে উঠে দৌড় দিতে গেলাম। কিন্তু দেরি করে ফেলেছি। খ্যাচ করে এসে আমার পায়ে লাগল শুয়োরটার ধারাল দাঁত। ক্ষুর দিয়ে কোপ মারল যেন পায়ের গোছার নরম মাংসে।

তীব্র একটা যন্ত্রণা। চিৎকার করে উঠলাম। বুঝতে পারছি, আর রক্ষা নেই। রেহাই দেবে আমাকে খেপা শুয়োরগুলো।

বাঁচাল ওল্ড ইয়েলার। যেমন করে আরলিসকে বাঁচিয়েছিল ভালুকটার কবল থেকে। প্রচণ্ড রাগে ছুটতে ছুটতে এল সে। ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার আর শুয়োরগুলোর মাঝখানে। দাঁত খিচিয়ে হুমকি দিল দু-একবার। তারপর এগোল কামড়ে দিতে। কিন্তু তার আগেই তার চামড়া চিরে দিল শুয়োরের ধারাল দাঁত। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল সে। আমার শাস্তিগুলো নিজের গায়ে তুলে নিয়েছে স্বেচ্ছায়। আমাকে পালিয়ে বাঁচার ক্ষীণ একটা সুযোগ করে দিয়েছে।

সুযোগটা নিলাম। লাফিয়ে উঠে মরিয়া হয়ে দৌড় দিলাম শুকনো নালার বুক ধরে। কিছুদূর এগিয়ে ডানের খাড়া পাড় বেয়ে অনেক কষ্টে ওপরে উঠে ঢুকে পড়লাম কাঁটাঝোপের মধ্যে। সাধারণ সময় যেখানে ঢোকার আগে হাজার বার চিন্তা করতাম, তার মধ্যে দিয়েই ছুটলাম। কয়েক গজ যেতে না যেতে একটা শেকড়ে পা বেঁধে উড়ে গিয়ে পড়লাম মাটিতে।

ঠিক মাটিতে পড়েছি বললে ভুল হবে। পড়েছি আসলে অর্ধেক মাটিতে আর অর্ধেক কাটাঝোপের ডালপাতার ওপর। উঠে বসতে গিয়েও বিপদ। পুট পুট করে চামড়া ছিদ্র করে অনেকগুলো কাটা ঢুকে গেল শরীরের এখানে ওখানে, বিশেষ করে নিতম্বে।

তবুও উঠে বসেছি। হাঁপাচ্ছি। কানের কাছে যেন অনবরত হাতুড়ির বাড়ি মারছে রক্তস্রোত। তবে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেছে আবার।

ব্যথার ভয় না করে ডাল ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে খুলে ফেললাম নিতম্বে বেঁধা কাটাগুলো। শুয়োরের দাঁতে কতটা কেটেছে দেখার জন্যে প্যান্ট গুটিয়ে ওপরে তুললাম। চমকে গেলাম এত রক্ত দেখে। আতঙ্ক এসে গ্রাস করল আরেকবার। কাটা জায়গা দিয়ে দরদর করে রক্ত বেরিয়ে গিয়ে ঢুকে যাচ্ছে জুতোর মধ্যে।

হাঁ করে তাকিয়ে আছি। শিউরে উঠল শরীর। জোর করে মন শক্ত করলাম। হাত দিয়ে মুছে ফেললাম রক্ত। ভাল কাটাই কেটেছে। যেমন লম্বা তেমন গভীর। হাড় দেখা যায়। এখনও তেমন যন্ত্রণা নেই। তবে ব্যথাটা আসবে, আমি জানি। আরও পরে যখন রক্তপাত বন্ধ হয়ে যাবে, ফুলে উঠবে জখম, তখন। তার আগেই কাটাটা বেঁধে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় বাড়ি চলে যাওয়া দরকার। পায়ের পেশী আড়ষ্ট হয়ে গেলে আর পারব না।

ছুরি দিয়ে শার্ট কেটে কাপড়ের লম্বা একটা চিলতে বের করলাম। সেটা দিয়ে শক্ত করে বাঁধলাম ক্ষতস্থান। উঠে পা লম্বা করে দিয়ে দেখলাম বাঁধনের জন্যে হাঁটতে অসুবিধে হয় কিনা। হয়, তবে হাঁটতে পারছি।

রওনা হলাম। কিন্তু বাড়ির দিকে নয়। কাঁটাঝোপের ভেতর দিয়ে এগোলাম উল্টো দিকে।

কেন যে ওদিকে যাচ্ছি নিজেও ঠিক জানি না। ওল্ড ইয়েলার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। হয়তো এতক্ষণে মরে গেছে, তবে সেটা দেখে নিশ্চিত না হয়ে আমি বাড়ি ফিরছি না। তাতে যদি দেরি হয়, পায়ের পেশী শক্ত হয়ে যায়, যাক। না দেখে আমি যাব না। এই কথাগুলো ভাবাই আমার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু আমি ভাবলাম না। কেবল সোজা এগিয়ে চললাম সেদিকে যে দিকটাতে ওর থাকার কথা।

শুকনো নালার বুকে ও পড়ে আছে। যেখান থেকে মোড় নিয়ে ঢাল বেয়ে উঠে আমি কাঁটাঝোপে ঢুকেছি। আমাকে অনুসরণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু জখমটা বড় বেশি। সে জন্যেই আর কুলিয়ে উঠতে পারেনি। বড় একটা চ্যাপ্টা পাথরের তলায় ঢুকে আত্মরক্ষা করেছে। ওপর থেকে কোন কারণে গড়িয়ে পড়েছিল পাথরটা। নিচের দিকে মাটিতে একটা ফোকর। ভেতরে অতি খুদে একটা গুহা। ওটা পেয়ে গেছে বলেই এখনও বেঁচে আছে।

চলে গেছে শুয়োরগুলো। মাটিতে, পাথরের চারপাশে ওগুলোর খুরের দাগ। ইয়েলারকে ধরার অনেক চেষ্টা করেছে, বোঝা যায়। পারেনি। আমি ওকে দেখতে পেতাম না। পাথরটাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম। আমি যাওয়ার সময় সে গুঙিয়ে উঠেছিল বলেই জানলাম ওই পাথরের তলায় রয়েছে।

উবু হয়ে বসলাম পাথরটার পাশে। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে টেনে বের করলাম ওকে। গুঙিয়ে উঠল সে ব্যথায়, মৃদু কোঁ কোঁ করল। কিন্তু বাধা দিল না। নেতিয়ে পড়ল মাটিতে। রক্তে মাখামাখি। লেজের গোড়াটা নাড়তে গিয়েই কেঁপে উঠল শরীর, এতটা দুর্বল হয়েছে। তার পরেও আমার কাটা জায়গাটা চেটে দেয়ার চেষ্টা করল।

গলার কাছে একটা দলা আটকে গেল যেন আমার। চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে এল। আমার জখম হয়েছে একটা, আর ওর অন্তত এক ডজন। তারপরেও আমাকেই সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে আমার জখম চেটে দিতে চাইছে। ওর পেটের কাটাটা তো মারাত্মক। চেরা জায়গা দিয়ে নাড়িভুড়ি সব ঠেলে বেরিয়ে আসার হুমকি দিচ্ছে। কিছু কিছু বেরিয়ে পড়েছে।

তাকানো যায় না সেদিকে। উঠে দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করল। এই দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারছি না।

কিন্তু পালালাম না। চোখ বন্ধ করে ইয়েলারের মাথায় একটা হাত রেখে বুলিয়ে দিতে লাগলাম। তার আঠা আঠা রক্ত লাগছে আমার হাতে। অনুভূতিটা ভাল নয় মোটেও। তবু হাত তুলে আনলাম না। জানি, আমার হাত বোলানোতে তার জখমের কোন উপকার হবে না। কিন্তু ওভাবে তাকে একলা মরার জন্যে ফেলে রেখে উঠে চলেও যেতে পারলাম না।

এই সময় মনে হলো এখনও মরেনি ও। হয়তো মরতে হবে না। চেষ্টা করলে বাঁচানো যেতেও পারে। জলদি জলদি বাড়ি গিয়ে আমাকে ডেকে আনতে পারলে ওর চিকিৎসা করা যাবে। আম্মা ডাক্তার নয়, তবে জখমের চিকিৎসা মোটামুটি জানে।

শার্টের হাতা দিয়ে চোখের পানি মুছে মনকে শক্ত করলাম। আমি এখানে বসে বসে কাঁদলে ইয়েলারের কোন উপকার হবে না। শার্টটা খুলে নিয়ে কেটে লম্বা লম্বা ফালি করলাম। বড় একটা টুকরো দিয়ে যত্ন করে মুছলাম ওর পেটের জখমে লেগে থাকা বালি। সাবধানে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলাম বেরিয়ে যাওয়া নাড়ি। চেরা জায়গাটার দুটো ধার টেনে কাছাকাছি এনে কাপড়ের ফালি দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধলাম।

সহ্য বটে ইয়েলারের। নিশ্চয় প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু টু শব্দ করল না। রোদ লাগছে। গরম থেকে বাঁচাতে তাকে আবার ঠেলে ঢুকিয়ে দিলাম পাথরের নিচে। এইবার গোঙাল সে। ব্যথায় নয়। বুঝে ফেলেছে, ওকে ফেলে যাব আমি। হামাগুড়ি দিয়ে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল।

বেরোতে দেয়া চলবে না। গর্তের মধ্যেই নিরাপদ। ভারি কিছু দিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিতে হবে। বড় একটা পাথর হলেও চলে। তবে পেয়ে গেলাম তার চেয়ে ভাল জিনিস।

শুকনো নালার পাড়ে মরে পড়ে আছে একটা উপড়ে যাওয়া মেসকিট গাছ। গোড়াটা বেশ মোটা আর ভারি। পায়ে চোট না থাকলে বয়ে আনতে খুব একটা অসুবিধে হত না আমার। কিন্তু এই অবস্থায় টানাহেঁচড়া করে আনতে গিয়ে ঘামতে লাগলাম। আবার ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল পায়ের কাটা থেকে। থামলাম না। গাছটা নিয়ে এলাম গর্তের কাছে।

ইয়েলারকে গর্তে ঢুকিয়ে দিয়ে গাছটা ঠেলে দিলাম মুখের কাছে। প্রায় ভরে গেল মুখটা। সামান্য যে ছিদ্রটা আছে এখন তা দিয়ে শরীর মুচড়ে মুচড়ে একটা কুকুর হয়তো বেরোতে পারে, তবে সুস্থ কুকুর হলে। ইয়েলারের সেই সাধ্য হবে বলে মনে হয় না।

গর্ত থেকে বেরোনোর চেষ্টা আর করল না সে। আমার দিকে এমন করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, গলার কাছের দলাটা আবার উঠে এল আমার। আমার দয়া ভিক্ষা করছে, যা কখনও করে না সে।

হাতটা ঢুকিয়ে দিলাম ভেতরে। মাথায় হাত দিয়ে বললাম, ইয়েলার, ভাবিসনে। আমি আম্মাকে আনতে যাচ্ছি। তুই থাক। যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব।

আর দেরি করলাম না। খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্রায় দৌড়ে চললাম বাড়ির দিকে। পেছনে হউউ হউউ করে টেনে টেনে চিৎকার করতে লাগল ইয়েলার। কাঁদছে সে। বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল আমার। তাকে এভাবে কাঁদতে শুনিনি আর কখনও।

মনে হতে লাগল, কোন দিনই আর ওল্ড ইয়েলারের কাছে ফিরে যেতে পারব না। বাড়ি যাওয়ার জন্যে এত তাড়াহুড়ো করছি, হাঁপিয়ে গেলাম অল্পক্ষণেই। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। পায়ের কাটাটা যন্ত্রণা দিচ্ছে খুব। এখনও শক্ত হয়নি। হয়ে যেত। অতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে পেশীগুলো, সে জন্যেই পারছে না। তবে ইতিমধ্যেই তার খেসারত দিতে আরম্ভ করেছে পা। তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা মোচড় দিয়ে দিয়ে উঠতে লাগল যেন জায়গাটায়। আমি বাড়ি পৌঁছানোর পরও বন্ধ হলো না।

প্রথমে দেখে ভয়ে তো আঁতকে উঠল আম্মা। নানা ভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ইয়েলারের অবস্থা খুব খারাপ। তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার। কানই দিল না আম্মা।

বলল, আগে তোর পায়ের চিকিৎসা দরকার। ধুয়ে ব্যাণ্ডেজ বাঁধতে হবে। শুয়োরের দাঁতের বিষ তো জানিস না কি জিনিস। অবহেলা করলে সাপের বিষকেও হার মানাবে। দেখি, চুপ করে বসতো। নড়াচড়া একদম করবি না।

আম্মার সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। যেটা ভাল বুঝবে সেটাই করবে। চুপ করেই বসলাম। তবে যখন জখমে তারপিন লাগানো শুরু করল, চুপ করে থাকা আর সম্ভব হলো না। গলা ছেড়ে চিৎকার করতে লাগলাম। মনে হচ্ছে লোহা লাল করে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে জায়গাটায়। শুয়োরটা যখন কামড়ে দিয়েছিল তখন এর হাজার ভাগের এক ভাগ ব্যথাও করেনি। এমন চিৎকার জুড়ে দিলাম, শেষে আরলিসও আর স্থির থাকতে না পেরে কাঁদতে শুরু করল। তবে তারপিনের জ্বালাটা যখন কমে এল, তখন টের পেলাম মোচড় দিয়ে দিয়ে ওঠা ব্যথাটা চলে গেছে।

একটা পরিষ্কার সাদা কম্বল ছিড়ে কাটা জায়গায় চেপে বসিয়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিল আম্মা। বলল, এবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়। বিশ্রাম নে। সাত দিন আর নামবি না। হাঁটাহাঁটি একদম বন্ধ।

উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, আম্মা, আমি ইয়েলারের কাছে যাচ্ছি। ওকে কথা দিয়ে এসেছি যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে যাব। তুমি এসো।

আম্মা কি বলে শোনার জন্যে দাঁড়ালাম না। বাইরে বেরিয়ে খোঁয়াড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।

আমি জাম্পারকে বের করে আনতে আনতে তৈরি হয়ে গেল আম্মা। মাথায় টুপি পরে ফেলেছে। দ্বিধা যাচ্ছে না এখনও। তবে আমাকে যে আর ঠেকাতে পারবে না বুঝে গেছে। জিজ্ঞেস করল, আনব কি করে ওকে?

জাম্পারের পিঠে করে। আমি ওকে দুহাতে ধরে কোলে নিয়ে বসে থাকব।

পারবি না। ও অনেক ভারি। তোর নিজেরই বসার শক্তি নেই এখন।

পারব। কাহিল হয়ে গেলে নামিয়ে দিয়ে জিরিয়ে নেব। তারপর আবার কোলে নেব।

পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আনমনে পুরো এক মিনিট পা ঠুকল আম্মা। বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন বোঝাতে লাগল, ঠেলাটা ব্যবহার করতে পারব না। রাস্তা নেই। আর যা মাটির মাটি, এত উঁচুনিচু, ঠেলেও আনা যাবে না।

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, এক কাজ কর, বেড়া থেকে গরুর চামড়াটা খুলে নিয়ে আয়। আমি বালিশ নিয়ে আসি।

গরুর চামড়া?

জাম্পারের পিঠে বেঁধে নে। কি করব পরে দেখিস।

আম্মা কি বুদ্ধি বের করেছে কিছু বুঝলাম না। তবে আর জিজ্ঞেসও করলাম না। সঙ্গে তো যাচ্ছেই। কি করে দেখতেই পাব।

গরুর চামড়াটা খুলে এনে জাম্পারের পিঠে ছড়িয়ে দিলাম। শুকনো চামড়ার ঘষা আর খচমচ শব্দ কোনটাই ভাল লাগল না তার। ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিল।

জাম্পার! ধমক দিয়ে বললাম, চুপ থাক বলছি! মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেব!

আর জ্বালাতন করল না সে। বালিশ আর দড়ি নিয়ে এসেছে আম্মা। গরুর চামড়া আর বালিশগুলো জাম্পারের পিঠে বেঁধে নিতে বলল। আরলিসকে তুলে বসিয়ে দিল বালিশের ওপর।

আমাকে বলল, তুই ওর পেছনে ওঠ। আমি হেঁটে আসব।

কাছাকাছি পৌঁছতেই শকুন উড়তে দেখলাম। নীল আকাশে কালো ফুটকির মত দেখা যায় প্রথমে, ঘুরতে ঘুরতে নেমে আসে নিচে। যখন শুধুই ঘোরে তখন বুঝতে হয় খাবারের সন্ধান করছে। কিন্তু আমরা দেখলাম দ্রুত নেমে আসতে। তারমানে খাবার দেখেছে। শাঁ করে প্রায় আমাদের মাথা ছুঁয়ে উড়ে গেল একটা। কুৎসিত মাথাটা সামনে বাড়ানো। একধরনের শীতল শিহরণ খেলে গেল আমার মেরুদণ্ডে। তাহলে শেষ হয়ে গেছে ওল্ড ইয়েলার!

জাম্পারের আগে আগে হাঁটছে আম্মা। ফিরে তাকাল আমার দিকে। আমার মত একই কথা ভাবছে। এতটাই অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম, মনে হলো সহ্য করতে পারব না।

কাঁটা ঝোপগুলোর কাছাকাছি এসে কিছুটা হালকা হলো মন। আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। হঠাৎ করে ডানা ঝাপটে ওপরে উঠে গেল একটা শকুন। আরেকটা। তারপর আরও একটা। নিশ্চয় কেউ চমকে দিয়েছে ওটাকে। কে দিয়েছে তা-ও আন্দাজ করতে পারছি।

পর মুহূর্তেই নিশ্চিত হয়ে গেলাম, আমার ধারণাই ঠিক। ইয়েলারের দুর্বল কণ্ঠ শোনা গেল। ইচ্ছে করল আনন্দে চিৎকার করতে করতে ছুটে যাই। হো হো করে হাসতে ইচ্ছে। করল। এখনও বেঁচে আছে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে তৈরি!

আমরা পৌঁছে দেখলাম নালার পাড়ে আবার নেমে এসেছে শকুনগুলো। সারি দিয়ে অপেক্ষা করছে। আমাদের দেখে উড়ে যেতে শুরু করল একের পর এক। ভারি ওই পাখিগুলো দেখতে যেমন কুৎসিত, ওগুলোর ওড়ার ভঙ্গিটাও বিশ্রী। অন্য পাখির মত বসা থেকে উড়তে পারে না। খানিক দূর দৌড়ে গিয়ে গতি সঞ্চার করে নিতে হয়। তারপর ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে লাফ দিয়ে ওঠে শূন্যে। দেখে মনে হয় আবার পড়ে যাবে মাটিতে। তবে পড়ে না। ওগুলোকে দেখে এমন রাগ হলো আমার, বন্দুকটা সঙ্গে থাকলে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে দিতাম।

ওল্ড ইয়েলারের চোখে একধরনের বন্য দৃষ্টি। হাত বাড়িয়ে ওকে বের করে আনতে গেলাম। ঘেওও করে উঠে কামড়ে দিতে এল হাতে।

এক ঝটকায় হাত সরিয়ে আনলাম। চিৎকার করে বললাম, আমি, ইয়েলার, আমি!

এইবার চিনতে পারল সে। ভাল করে তাকায়ইনি এতক্ষণ। ভেবেছিল শকুন। দৃষ্টি আবার স্বাভাবিক হয়ে এল তার। এমন করে গুঙিয়ে উঠে নেতিয়ে পড়ল, যেন বিরাট ভার নেমে গেল বুকের ওপর থেকে।

গাছটা সরাতে আমাকে সাহায্য করুল আম্মা। তারপর দুজনে ধরে আস্তে করে ওকে বের করে আনলাম গর্ত থেকে। রোদে শুইয়ে দিলাম।

জখমগুলোতে রক্ত শুকিয়ে আছে। সেদিকে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করল না আম্মা। পেটের ব্যাণ্ডেজটা খুলতে শুরু করল।

আমার পাশে এসে দাঁড়াল আরলিস। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ইয়েলারের কি হয়েছে।

আম্মার হাত থেমে গেল। বলল, আরলিস, নালায় অনেক সবুজ গিরগিটি আছে। একটা ধরে আনতে পারবে? আসার সময় ওই যে ওখানটাতেই দেখলাম একটাকে।

খুবই অবাক হলাম। আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আরলিসের মুখ। এতদিন গিরগিটি ধরার জন্যে শুধুই বকা খেতে হয়েছে তাকে, আজকে আম্মাই ধরে এনে দিতে বলছে। একটা মুহূর্ত দেরি না করে ঘুরে দৌড় দিল গিরগিটি ধরার জন্যে।

আমার দিকে তাকিয়ে হাসল আম্মা। এতক্ষণে বুঝলাম। আরলিসকে সরিয়ে দিল যাতে ভয়াবহ জখমটা দেখতে না হয়। ইয়েলারের চেরা পেট দেখলে সহ্য করতে পারবে না সে।

আমাকে বলল, জাস্পারের লেজ থেকে একটা চুল ছিড়ে নিয়ে আয়। দেখিস, সরে থাকিস। লাথি খাসনে আবার।

পায়ের কাছ থেকে সরে থেকে হ্যাঁচকা টানে ছিড়ে নিলাম একটা চুল। নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করল জাম্পার, লাথিও মারল, তবে লাগাতে পারল না। চুলটা এনে দিলাম আম্মাকে। কি করবে বুঝতে পারছি না। তবে যখন গায়ের গাউনে গেঁথে রাখা একটা লম্বা সুচ টেনে বের করল, বুঝে ফেললাম।

কাঁটাচেরা সেলাইয়ের জন্যে এই চুলের তুলনা হয় না, আম্মা বলল। কেন হয় না, সে কথা বলল না। আমিও জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম।

আম্মা জানতে চাইল ইয়েলারের নাড়ি কোথাও কেটেছে কিনা। মাথা নাড়লাম। কাটাটাটা দেখিনি আমি।

তাহলে আর ওটা নিয়ে সময় নষ্ট করে লাভ নেই, আম্মা বলল। কাটা হলেও অবশ্য কিছু করতে পারব না। ওসব মেরামত করা আমার সাধ্যে কুলাবে না।

ধীর গতিতে চলল কাজ। কাঁচা চামড়া সেলাই করাটাও একটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সুঁচ ঢোকালে যে ভাবে কেঁপে কেঁপে ওঠে ইয়েলার, তাতেই বুঝতে পারছি কি ব্যথাটাই না পাচ্ছে সে। কিন্তু মুখ বুজে রইল। আমি ওকে ধরে রেখেছি। মাঝে মাঝে হাত চেটে দিচ্ছে আমার।

সেলাই শেষ করে পরিষ্কার এক টুকরো কম্বল তার শরীরে পেঁচিয়ে বাঁধল আম্মা। এই সময় চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এল আরলিস। মুখে বিজয়ীর হাসি। হাতে ঝুলছে একটা সবুজ গিরগিটি।

সাংঘাতিক দ্রুতগতি এই প্রাণীগুলোকে কি করে অবলীলায় ধরে ফেলে সে সেটা আমার কাছে এক মহাবিস্ময়। যেন যুদ্ধ জিতে দেশ বিজয় করে এসেছে এমন গর্বিত ভঙ্গিতে আম্মার দিকে গিরগিটিটা বাড়িয়ে দিল।

পুরোপুরি অসহায় হয়ে গেল আম্মা। আরলিস পারবে না ভেবেই সবুজ গিরগিটি ধরতে বলেছিল। গিরিগিটি, সাপ, শুয়াপোকা দেখলেই যে শিউরে ওঠে, লাফ দিয়ে সরে যায়, তার হাতে যদি সেই জিনিস তুলে দেয়ার চেষ্টা করা হয় অবস্থাটা কি হবে! কিন্তু আরলিসকে নিরাশ করতে পারল না আম্মা। অনেক কষ্টে একবার ছুঁয়ে দেখল কোনমতে। আরলিস কিছু সন্দেহ করতে না পারে এমন করে বলল, এটা তোমার হাতেই থাক। পরে নেব। এতে আরও খুশি হলো। আরলিস।

এবার একটা খেলা খেলব আমরা, তাকে বোঝাল আম্মা। এমন ভান করব, যেন ওল্ড ইয়েলার অসুস্থ। তার যত্ন করছি। তুমি আর সে বসবে গরুর চামড়াটার ওপর। ইনডিয়ানরা যে ভাবে রোগীকে টেনে নিয়ে যায় তোমাদেরকেও সে ভাবে নেয়া হবে।

খেলাটেলার ব্যাপারগুলো এমনিতেই আরলিসের খুব পছন্দ। নতুন খেলার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়ল সে। তক্ষুণি শুরু করে দিতে চাইল।

জাম্পারের পিঠ থেকে চামড়াটা খুলে নিয়ে মাটিতে বিছাল আম্মা। তার ওপর রাখল বালিশগুলো। কি করতে চায় এতক্ষণে বুঝতে পারলাম আমি। দুজনে ধরাধরি করে ইয়েলারকে এনে রাখলাম বালিশের ওপর। নরম বালিশে থাকায় ব্যথা কম পাবে সে।

আম্মা বলল, আরলিস, বালিশের ওপর বসে ইয়েলারকে ধরে রাখো, যেন পড়ে না যায়। খবরদার, ভুলেও ওর ওপর উঠে বসবে না। রোগী রোগী খেলা খেলব আমরা। ইয়েলার রোগী। কোনভাবেই তাকে ব্যথা দেয়া চলবে না।

এমন চমৎকার খেলা আর খেলেনি আরলিস। কোনভাবেই পণ্ড করবে না, কথা দিল আম্মাকে। আম্মা যেখানে বসতে বলল লক্ষ্মী ছেলের মত সেখানেই বসল। কোলে তুলে নিল ইয়েলারের মাথা।

ইতিমধ্যে জাম্পারের গলায় দড়ি বেঁধে ফেলেছি। গলায় একটা বড় ফাঁস পরিয়েছি এমনভাবে যাতে তার দম আটকে না যায়। ফাঁসের দুদিক থেকে দুটো দড়ি বের করে কাঁধের ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে এলাম। ছুরি দিয়ে চামড়ার দুই মাথায় দুটো ছিদ্র করে তার ভেতরে দড়ির মাথা ঢুকিয়ে বাধলাম। অনেকখানি ফাঁক রেখেছি দুটো দড়ির মাঝে, যাতে জাম্পারের পায়ে না লাগে। পায়ে দড়ি লাগলে ভড়কে যায় সে। উল্টোপাল্টা আচরণ করে বসে।

হয়েছে, এবার তুই ওঠ, আমাকে বলল আম্মা।

আমিই বরং হাঁটি। পেছনে চামড়ার খরখর শুনলে কি করে বসে ঠিক নেই। লাঠি না দেখলে ঠাণ্ডা হবে না।

তোকে যা বলছি কর। ওই পা নিয়ে হাঁটলে মরবি। লাঠি আমিও নিতে পারব।

রওনা হলাম। অনর্গল বকবক করছে আরলিস। আনন্দে, উত্তেজনায়। জাম্পারকে নিয়ে যা সন্দেহ করেছিলাম ঠিক তাই করল। চামড়াটা হিচড়ানোর শব্দ হতেই ভড়কে গেল সে। ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। গলার দড়ি খুলে ফেলতে চাইল। জিন ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ধমক লাগাল আম্মা, এই জাম্পার, চুপ থাক, শয়তান কোথাকার!

একটা লিকলিকে ডাল হাতেই আছে আমার। শপাং করে বাড়ি মারলাম তার কানের ওপর। দুজনের শাসন অতিরিক্ত হয়ে গেল খচ্চরটার জন্যে। শান্ত হয়ে চলাটাই ভাল মনে করল সে। আর গোলমাল করল না। চলতে চলতে মাঝে মাঝে কেবল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল কি জিনিস টেনে নিয়ে চলেছে। যা দেখছে মোটেও পছন্দ হচ্ছে না তার। তবে প্রতিবাদ করে আর পিটুনি খেতে চাইল না।

এত ভাল সময় খুব কমই কেটেছে আরলিসের। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছে সে। আমাদের জন্যে দীর্ঘ একেকটি ঘন্টা, তার জন্যে যেন একটা মুহূর্ত, ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে যাচ্ছে। ওল্ড ইয়েলারও ততটা কষ্ট পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। নালার বালির ওপর দিয়ে যতক্ষণ হিচড়ে গেল চামড়াটা ততক্ষণ কোন ঝাঁকুনিই লাগল না। নালা ছেড়ে যখন ওপরে উঠলাম, সমতল জমির ওপর দিয়ে চলার কারণে তখনও তেমন অসবিধে হলো না। জাম্পারকে ঘুরপথে নিয়ে চলল আম্মা। বনের মধ্যে না ঢুকে যতটা সম্ভব সমভূমিতেই থাকার চেষ্টা করল। লম্বা ঘাসের ওপর দিয়ে যেন পিছলে পিছলে যাচ্ছে চামড়াটা। এই ঘাস নরম গদির কাজ করছে অনেকটা। পিছলেও যাচ্ছে চমৎকার। কিন্তু যত চেষ্টাই করুক, সব সময় ঘাসের ওপর দিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পাথর এড়ানো যাচ্ছে না। নিচে পাথর পড়লেই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগছে আরোহীদের গায়ে।

কখনও ঝাকুনি, কখনও দাঁতে দাঁতে বাড়ি লেগে যাচ্ছে। দমছে তো না-ই, বরং মজা পেয়ে জোরে জোরে হেসে উঠছে আরলিস। কিন্তু ইয়েলার সহ্য করতে পারছে না। তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গুঙিয়ে উঠছে।

বেশি যখন গোঙাচ্ছে, বুঝতে পারছি তার যন্ত্রণা খুব বেশি হচ্ছে। জিরানোর জন্যে তখন থামছি আমরা। তারপর আবার চলা। অন্য কারণেও থামতে হচ্ছে। পানি প্রয়োজন হচ্ছে। পানি খাওয়ানোর জন্যে একবার থামলাম পাথুরে অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময়। ওখানে ছোট একটা ঝর্না আছে। দ্বিতীয়বার থামলাম বার্ডসং ক্রীকের ধারে।

আমার হ্যাটে করে পানি এনে তাকে খেতে দিল আম্মা। মাথাও তুলতে পারে না, এতটাই দুর্বল। তার নাকের নিচে হ্যাটটা ধরে রাখে আম্মা, আমি মাথাটা উঁচু করে ধরি যাতে সে পানি খেতে পারে।

বাড়ি থেকে অনেক দূরের পথ, ধীরগতি, তার ওপর জায়গায় জায়গায় থামা। মনে হতে লাগল, কোন দিনই বাড়ি ফিরতে পারব না। কিন্তু পারলাম শেষ পর্যন্ত। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে তখন। তারা উঠেছে রাতের আকাশে।

পুরোপুরি শক্ত হয়ে গেছে আমার পা। কোন অনুভূতি নেই। ফুলে উঠেছে। ভারি লাগছে। মনে হচ্ছে একটা মরা গাছের কাণ্ড বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। জাম্পারের পিঠ থেকে নামলাম। শরীরের ভার রাখতে পারল না পা-টা। মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম মাটিতে। ভীষণ দুর্বল। জখমের প্রচণ্ড যন্ত্রণা। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছি না।

এই শরীর নিয়ে ইয়েলারকে আনতে যাওয়ার জন্যে আমাকে অনেক বকাবকি করল আম্মা। চুপ করে রইলাম। ইয়েলারকে যে বাড়ি আনতে পেরেছি এতেই আমি খুশি। ও এখনও বেঁচে আছে। তারার আলোয় দেখছি আরলিসের গাল চাটছে ও।

ঘুমিয়ে পড়েছে আরলিস।

পরের দুটো হপ্তা আমার আর ইয়েলারের জন্যে বড়ই দুঃসময়। আমি শুয়ে থাকলাম ঘরের মধ্যে বিছানায়। ইয়েলার রইল ডগ রানে, গরুর চামড়ায়। দুজনেই ভুগতে লাগলাম। জখমের যন্ত্রণায় গোঙানো ছাড়া আর কিছুই করার সাধ্য নেই। মাঝে মাঝে এতটাই ব্যথা বাড়ে, কি ঘটছে খেয়াল রাখতে পারি না। চিৎকার আর গোঙানি কানে আসে। সেগুলো শুধুই আমার, না ইয়েলারেরও, বুঝতে পারি না। এমন ফোলা ফুলেছে পা-টা মনে হচ্ছে ফেটে যাবে। জ্বরে গা পুড়ে যেতে চায়। উত্তাপ কমানোর জন্যে ঝর্না থেকে গিয়ে ঠাণ্ডা পানি এনে আমার গায়ে ঢালতে হয় আম্মাকে।

পানি ঢালা ছাড়াও আরও অনেক কিছু করতে হয় তাকে। প্রিকলি-পারের মূল তুলে এনে ছেঁচে ভর্তা করে মলম বানিয়ে আমার জখমে লাগায়।

বাড়ির কাছেই অনেক প্রিকলি-পার জন্মে আছে। কিন্তু অনেক বড় আর শক্ত হয়ে গেছে ওগুলো। মূলের গুণও নষ্ট হয়ে গেছে অনেকখানি। ছোট গাছ দরকার। ওপরের অংশটা তত বড় হবে না, কিন্তু মূল হবে অনেক বড় আর মোটা, অনেকটা মিষ্টি আলুর মত। সেগুলো বাড়ির কাছে নেই। আনার জন্যে অনেক দূরে যেতে হয় আমাকে, একেবারে সল্ট লিকের কাছে।

আমাকে দেখলেই হয় না, ইয়েলারের চিকিৎসাও তাকেই করতে হয়। আমাকে যতখানি যত্ন আর দরদ নিয়ে সেবা করে, তাকেও ততটাই করে। রাতে অনেকবার করে উঠতে হয় আমাদের জখমে মলম লাগানো, পানি ঢেলে জ্বর কমানো আর খিদে পেলে খাওয়ানোর জন্যে। শুধু আমাদের সেবা করলেই তো চলে না, বাড়িতে আরও হাজারটা কাজ আছে। দুধ দোয়ানো, আরলিসের দেখাশোনা, কাপড় ধোয়া, কাঠ কাটা সব একহাতে করতে হয়।

তার ওপর বাড়তি ঝামেলা হয়েছে জাম্পার।

আবহাওয়ার ব্যাপারে যে ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিল বাড সারসি সেই খারাপ সময়ও এসে হাজির হলো। সবুজ ঘাস শুকিয়ে গেল। ওগুলো আর খেতে ভাল লাগে না খচ্চরটার। শস্য খেতের বেড়া ডিঙিয়ে ঢুকে পড়ে ভেতরে।

এটা চলতে দেয়া যায় না। ওই শস্য খেয়ে শেষ করে ফেললে শীতকালে রুটির জন্যে, ময়দাই পাব না আমরা। কিছুতেই তাকে ঠেকাতে না পেরে ভয়ই পেয়ে গেল আম্মা। জাম্পারকে খেত থেকে বের করে ঘুরেও সারে না, আবার গিয়ে ঢোকে শয়তানটা।

অনেক ভেবে শেষে এক বুদ্ধি বের করল আম্মা। দড়ি দিয়ে সামনের ডান পায়ে ভারি একটা কাঠ বেঁধে দিল। বেশ খানিকটা লম্বা রাখল দড়িটা। যাতে করে খেতে অসুবিধে না হয় খচ্চরটার, কিন্তু পা তুলে লাফ দিয়ে বেড়া ডিঙিয়ে খেতে ঢুকতে না পারে।

তাতে আরেক ঝামেলা দেখা দিল। শস্য বাঁচল বটে, তবে কাজ আরও বেড়ে গেল আমার। যেখানে সেখানে দড়ি পেঁচিয়ে আটকে বসে থাকে জাম্পার। পাথরে, শেকড়ে, গাছের গোড়ায় আটকে যায়। গেলেই ভয়ে চেঁচানো শুরু করে। আম্মা গিয়ে যে তাকে ছুটাবে সেই সময়টাও দিতে চায় না। ক্রমেই বেড়ে যায় তার গলার জোর। মনে হয় পিটিয়ে তাকে মেরে ফেলা হচ্ছে। চেঁচাননা সইতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে তাকে ছাড়ায় আম্মা, তবেই রক্ষা।

আসল কাজেরই অভাব নেই, এগুলো তো বাড়তি ঝামেলা। আরলিস অনেক ছোট, কোন সাহায্যই করতে পারে না। খেলার সঙ্গী না পেয়ে একলা হয়ে গেছে সে। ফলে আম্মা যেখানে যায়, সে-ও পিছে পিছে যায়। ছায়ার মত লেগে থাকে। জ্বালাতন করে। আম্মা তাকে সময় দিতে পারে না। বিরক্ত হয়ে চুপ করতে বললে আমাকে এসে জ্বালাতন শুরু করে। মিনিটও যায় না, এসে আমার হাত ধরে টানতে টানতে বলে, এত শুয়ে থাকিস কেন, ভাইয়া? ওঠ না, ওঠ। একলা একলা আমার যে একটুও ভাল্লাগে না। আমার সাথে খেলবি একটু, ওঠ।

আমাকে পাগলই করে দিত সে। বাঁচাল বাড সারসির নাতনি লিজবেথ। সঙ্গে করে নিয়ে এল একটা কুকুরছানা।

বাচ্চাটা যে আনা হয়েছে বুঝতেই পারিনি প্রথমে। লিজ এসেছে তা-ও টের পাইনি। বাড সারসির গলা শুনতে পেলাম। আম্মার সঙ্গে কথা বলছে। বিছানায় গড়িয়ে গিয়ে যে দরজা দিয়ে উঁকি দেব সেই অবস্থাও নেই আমার। বুড়োটা আসাতে বিরক্তিতে ছেয়ে গেল মন। অকাজের ধাড়ি! কাজ নেই কিছু নেই, এসেছে জ্বালাতে! বড় বড় কথা বলে পিত্তি জ্বালাবে। বলবে সল্ট লিকের মহিলা আর বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্যে রয়ে গেছে সে। অথচ একটা কুটো রানোর জন্যেও আঙুল নাড়বে না। ভদ্রতার খাতিরেও বলবে না, ঠিক আছে, কাঠগুলো আমিই কেটে দিই। কিংবা খড়গুলো জড় করে আঁটি বাধি। ডগ রানে বসে বসে বকবক করবে, তামাক চিবাবে আর থুথু ছিটিয়ে নষ্ট করবে সমস্ত জায়গা। আশা করে বসে থাকবে অনেক সুখাদ্য রান্না করে খাওয়াবে তাকে আম্মা। দুপুরে তো খাবেই, রাতেও খাওয়ার জন্যে বসে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই, এতটাই নির্লজ্জ। আর আম্মার তো লজ্জা-শরম একটু বেশিই। কিছুতেই না বলতে পারবে না।

খানিক পর হালকা পায়ের শব্দ হলো। মুখ ঘুরিয়ে তাকালাম। দরজায় দাড়িয়ে আছে লিজ। দুই হাত পেছনে। বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

জিজ্ঞেস করল, খুব কষ্ট হচ্ছে?

হচ্ছে যে সে কথাটা স্বীকার করতে বাঁধল। হাজার হোক, পুরুষ মানুষ ভাবতে শুরু করেছি নিজেকে। বললাম, না।

খবরটা আগে পেলে আরও আগেই দেখতে আসতাম। একথার কি জবাব দেব ভেবে পেলাম না। চুপ করে রইলাম। তোমার জন্যে একটা জিনিস এনেছি। দেখলে চমকে যাবে।

রোগে কাহিল। এখন আমার চমকাতে ভাল লাগবে না। কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে সত্যি কথাটা বলে তাকে আহত করতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কি?

মিস প্রিসির একটা বাচ্চা।

পেছন থেকে সামনে হাত নিয়ে এল লিজ। ডান হাতে ঝুলছে একটা কুকুরছানা, এক বছর বয়েসী অপোসামের সমান হয়ে গেছে। ময়লা সাদা রঙ। তার ওপর নীল ছোট ছোট দাগ। যেন গরুর পোকায় ছেয়ে আছে সারা গা। সুন্দর বলা যাবে না কোনমতেই। ঘাড়ের টিলা চামড়া ধরে ঝুলিয়ে রেখেছে তাকে লিজ। কিন্তু কোন অভিযোগ নেই বাচ্চাটার। চোখ বোজা। মনে হয় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে।

একটা ব্যাজারের গর্তে জন্ম হয়েছে ওর, লিজ বলল। সাতটা বাচ্চার মধ্যে সব চেয়ে ভালটা নিয়ে এসেছি তোমার জন্যে।

ওই বাচ্চা যদি সব চেয়ে ভালটা হয় তাহলে মা হিসেবে মিস প্রিসিকে বাহবা দেয়ার কিছুই নেই। তবে সেকথা না বলে বললাম, ভালই।

সত্যিই ভাল। দেখেছ কেমন করে ধরে রেখেছি, অথচ ইকটুও কাঁদে না। এত ভাল বাচ্চা আর দেখেছ?

ভাল কুকুর কি ভাবে বুঝতে হয় সেটার ব্যাপারে একেকজন একেক কথা বলে। কারও মতে ঘাড়ের চামড়া ধরে ঝুলিয়ে রাখলে যেটা চুপ করে থাকে সেটা ভাল। আব্বার মতে, দেখতে হবে মুখের ভেতরটা। মাড়ি কালো হলে সেটা ভাল হবেই। পোষার জন্যে সেটাকেই নেয়া উচিত। যেহেতু আব্বা বলে, আমারও সে রকমই বিশ্বাস।

কিন্তু মাড়ি কালো না লাল দেখার আগ্রহ আমার হলো না। সবুজ হলেও কিছু এসে যায় না। আমার এখন একমাত্র চিন্তা, কি করলে পায়ের যন্ত্রণা একটু কমবে। বললাম, নিয়ে যাও। আরলিস খুশি হবে।

বলেই বুঝলাম, ভুল কথা বলে ফেলেছি। লিজের চোখই বলে দিল সে আহত হয়েছে। অন্য কথা আশা করেছিল সে।

চুপচাপ তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে যেন। তার সেই দৃষ্টি সইতে পারলাম না। চোখ সরিয়ে নিলাম। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে আর একটাও কথা না বলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বাচ্চাটা দিয়ে দিল আরলিসকে।

ওর এই আচরণে রাগ হলো আমার। পচা একটা বাচ্চা নিয়ে এসে আর কি আশা করেছিল? কাহিল হয়ে বিছানায় পড়ে যন্ত্রণায় ককাচ্ছি আমি। দম নিতে গেলেও কষ্ট হয়। এই সময় কুকুরছানা দিয়ে কি করব?

তাছাড়া বড় একটা কুকুর আছে আমার। ওল্ড ইয়েলারের মত কুকুর। হোক না আহত, সেরে তো উঠছে। আম্মা বলেছে আমাকে। ভাল হলে ওকে নিয়ে আবার বনে যেতে পারব। শিকার করতে পারব। ওকেই আমার বেশি দরকার। ছানা দিয়ে আমি কি করব? ওটাকে আরলিসেরই বরং বেশি দরকার। খেলতে পারবে। আমাকে আর বিরক্ত করবে না। তাহলে ভূলটা বললাম কি? কেন এত রাগ?

শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, লিজবেথ কতটা বোকা। আবার তার আসার অপেক্ষায় রইলাম। এলে বুঝিয়ে বলব, আসলে কেন বাচ্চাটা আমার দরকার নেই। কিন্তু সেই সুযোগ আমাকে দিল না ও। বাইরে রইল। আরলিসের সঙ্গে খেলল। অবশেষে থুথু করে আরেকবার থুথু ছিটিয়ে যাওয়ার জন্যে উঠে পড়ল তার দাদা, শুনতে পেলাম। দরজার সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখলাম তাকে আর আরলিসকে। যাওয়ার সময় আমার দিকে একবার তাকিয়েই ঝট করে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল লিজ।

হঠাৎ করেই রাগটা চলে গেল আমার। বরং দুঃখ হতে লাগল লিজের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছি বলে। মনেপ্রাণে চাইছি, আরেকবার আসুক আমার কাছে। তাকে বুঝিয়ে বলব।

কিন্তু এল না।

শেষে ডেকেই আনব ঠিক করলাম। কিন্তু আমি মুখ খোলার আগেই তার নানা বলল, মিসেস কোটেল, বুঝতে পারছি সময় খুব খারাপ যাচ্ছে আপনার। তবে ভাববেন না। সবার দেখাশোনার ভার যখন আমার ওপর, ব্যবস্থা তো একটা করতেই হয়। লিজকে রেখে যাচ্ছি। কাজেকর্মে আপনাকে সাহায্য করবে।

অবাক কণ্ঠে আম্মা বলল, বলেন কি! না না, দরকার নেই! আমি একাই সামলাতে পারব। সাহায্য যে করতে চেয়েছেন এতেই খুশি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

কি যে বলেন আর না বলেন। এত ঝামেলা একা একজন মেয়েমানুষ করতে পারে? ও খুশি হয়েই আপনার কাজ করবে।

কিন্তু ও এখনও অনেক ছোট। একরাতও নিশ্চয় বাড়ি ছেড়ে থাকেনি।

থাকেনি বলে যে কখনোই থাকবে না তা তো নয়। থাকতে হবে। এখন থেকেই শুরু করুক। আরও একটা গুণ আছে তার। আমার স্বভাব পেয়েছে। অন্যের বিপদে হাত গুটিয়ে থাকতে পারে না। থাকুক ও। দেখবেন, কতটা ঝামেলা কমে গেছে আপনার।

নানা ভাবে মানা করল আম্মা, কিন্তু কানেই তুলল না বাড সারসি। তার এক কথা, লিজবেথ খুব কাজের মেয়ে, লক্ষ্মী মেয়ে, বাড়িঘরের কাজ জানে, অনেক সাহায্য করতে পারবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

লিজকে রেখে ঘোড়ায় চেপে চলে গেল বাড।

আমিও আম্মার সঙ্গে একমত। এখানকার কাজ করতে পারবে না লিজবেথ। গায়ে কিছু নেই ওর। বরং আম্মার জন্যে বাড়তি আরেকটা ঝামেলা হবে।

কিন্তু আমরা দুজনেই ভুল করেছি। ঠিকই বলে গেছে বাড সারসি। সত্যিই কাজের মেয়ে লিজ। ঝর্না থেকে পানি আনা, মুরগীকে খাবার খাওয়ানো, কাঠ জড় করা, রুটি তৈরি, বাসন মাজা, আরলিসকে গোসল করানো, সব পারে। মাঝে মাঝে এসে আমার পায়ে নতুন করে ব্যাণ্ডেজও বেঁধে দিয়ে যায়।

কোন কাজের জন্যেই তাকে বলতে হয় না। কোনটা কখন করতে হবে জানে। ঘরের কাজে আম্মার জন্যে আমিও এতটা সহায়ক নই। আর আমাদের কাজ, অর্থাৎ পুরুষের কাজেও সে পিছিয়ে যায় না। জাস্পার আর ঠেলাগাড়িটা নিয়ে শস্য তুলে আনতে যায় আম্মা। লিজও যায়। এসব কাজেও কোন খেদ নেই তার, নিজের ইচ্ছেতেই সব করে। অথচ এই কাজটা আমারও ভাল লাগে না। ভীষণ পরিশ্রমের, বিরক্তিকরও বটে। যবের ডাটা গায়ে লাগলে খুব চুলকায়। রাতেও চুলকাতে চুলকাতে ঘুম ভেঙে গেছে একেক দিন। মনে হয়েছে বিছুটি ডলে দেয়া হয়েছে।

কিন্তু লিজের যেন কিছুই হয় না। বরং দেখেশুনে আমার মনে হতে লাগল শস্য তুলতে গিয়ে চমৎকার সময় কাটছে আম্মা, লিজ আর আরলিসের। আমার দরজার সামনে দিয়েই যায় গাড়িটা। শস্যের আঁটির ওপর বসে থাকতে দেখি তিনজনকে। হাসাহাসি করে, কথা বলে। ওদের আনন্দ দেখে হিংসে হয় আমার। রাগ হয় পা-টার ওপর। উঠতে দিচ্ছে না বলে।

আত্মসম্মানেও লাগল। লিজবেথের মত একটা ছোট মেয়ে এসে এমন সব কাজ করে দিচ্ছে যেগুলো সামলানোর দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিল আব্বা। খারাপ লাগল আরও একটা ব্যাপারে। আমি মনে করেছিলাম, আব্বার পরে একমাত্র আমি ছাড়া এসব কাজ আর কেউ করতে পারবে না। অথচ দিব্যি করে ফেলছে আম্মা আর লিজ। ভাবাই যায় না। যাই হোক, বনে গিয়ে শুয়োরকে চিহ্ন দেয়া, শিকার করা, কাঠ কাটা, এসব পারবে না; এগুলো শুধুই আমার কাজ, ভেবে মনে মনে খানিকটা সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করলাম…

শস্য তোলা শেষ হওয়ার আগেই মারাত্মক বিপদ এসে হাজির। আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম না এ বিপদ থেকে কি করে রক্ষা পাব।

শুরুটা হলো এভাবে। দুধ দোয়ানোর সময় পার হয়ে গেল, কিন্তু বাড়ি এল না আমাদের চিত্রা গাইটা। খেত থেকে আসতে আসতে আমাদেরও দেরি হয়ে গেল। খুঁজতে যে যাবে তারও আর সময় নেই। রাত হয়ে যাচ্ছে। পরদিন ছাড়া আর হবে না।

তবে পরদিন সকালে আর যেতে হলো না তাকে। গরুটাই এসে হাজির। আমিই ডাক শুনতে পেলাম প্রথমে। আমার পায়ের ফোলা প্রায় চলে গেছে। ব্যথাও নেই। তবে শরীর এত দুর্বল, উঠতে গেলেই বৃষ্টিতে ভেজা মুরগীর ছানার মত কাঁপতে থাকি।

ডাকতে ডাকতে এল চিত্রা। বাছুর হারিয়ে গেলে কিংবা দুধের ভারে ওলান টনটন করলে যেমন করে ডাকে, অনেকটা তেমনি।

ডাকটা আমি যেমন চিনতে পারলাম, তার বাছুরটাও পারল। গোয়াল ঘরে সারা রাত না খেয়ে থেকেছে। দুধের জন্যে পাগল হয়ে আছে। মায়ের সাড়া পেয়েই যেন উন্মাদ হয়ে গেল। বেরোনোর জন্যে গোয়ালের মধ্যে ছুটাছুটি করছে শুনতে পেলাম।

আম্মাকে ডেকে বললাম, আম্মা, চিত্রা অমন করে ডাকছে কেন দেখো তো?

আর কি জন্যে ডাকবে? বিরক্ত কণ্ঠে জবাব দিল আম্মা, রাতে আসেনি। বাছুর ফেলে গেছে। ওলানে দুধ। ভেবেছিলাম স্বভাব ভাল হয়ে গেছে। কিন্তু একবার খারাপ হলে কি আর ঠিক হয়।

চিত্রাকে ডাকতে ডাকতে গোয়ালের দিকে চলে গেল আম্মা। একটু পরেই খেপা ষাঁড়ের মত বাআআ বাআআ করে উঠল গাইটা, সেই সঙ্গে শোনা গেল আম্মার তীক্ষ্ণ চিৎকার। আরলিসকে নিয়ে লিজকে তাড়াতাড়ি চলে আসার জন্যে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে এল কেবিনের দিকে। ভয় পেয়েছে। বিছানায় উঠে বসলাম। আরলিসের হাত ধরে দৌড়ে এল লিজ।

ঘরে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিল আম্মা। আমার দিকে ঘুরে বলল, আমাকে গুঁতোতে এল। আশ্চর্য! চিনলই না যেন আমাকে!

আস্তে করে দরজাটা একটুখানি ফাঁক করল। বাইরে একবার উঁকি দিয়েই একটানে পুরো পাল্লাটা খুলে ফেলে গোয়ালের দিকে তাকাল।

আরি, কাণ্ড দেখো! বাছুরটার দিকেও খেয়াল নেই। চলে যাচ্ছে। বিষটিষ খেয়ে এল নাকি?

পাহাড়ে এক ধরনের লতা জন্মায় শীতকালে। বসন্তে ফুল ফোটে। মৃদু মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়ায়। ঘাসের সঙ্গে এই লতাও খেয়ে ফেলে গরু-ঘোড়ারা। খুব ভাল প্রোটিন পায় এ থেকে। চর্বি লাগে গায়ে, মোটা হয়। মাঝে মাঝে ঘাস বাদ দিয়েই ওই লতা বেশি খেয়ে ফেলে। শুরু হয় বিষক্রিয়া। মাতলামি আরম্ভ করে। টলে টলে পড়ে, ঠিকমত দাঁড়িয়েও থাকতে পারে না। অনেক বেশি খেলে মারাও যায়।

বসে বসে চিত্রার ডাক শুনতে থাকলাম। আবার ডাকছে। প্রথমবার যেমন ডেকেছে তেমন করেই। বাচ্চাকে দুধ না খাইয়েই আবার চলে যাচ্ছে বনের দিকে। অবাক লাগল আমার। এই সময় এমন মাতাল করে দেয়ার মত লতা কোথায় পেল সে?

আম্মা, লতা খায়নি। সব এখন মরে গেছে। খাওয়ার উপযুক্ত নেই।

আমার দিকে একবার তাকিয়েই আরেক দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল আম্মা। জানি। সে জন্যেই তো চিন্তা হচ্ছে।

বার্ন স্যান্ডারসনের হুঁশিয়ারি মনে পড়ে গেল আমার। কোন জানোয়ার অস্বাভাবিক আচরণ করলেই বুঝতে হবে…

আম্মা, গরুর নিশ্চয় জলাতঙ্ক হয় না?

চমকে গেল লিজ। বড় বড় চোখজোড়া ঘুরে গেল আমার দিকে।

আম্মা বলল, জানি না। কুকুরের হতে দেখেছি। গরুর হয় বলে শুনিনি কখনও।

পরের কয়েকটা দিন খুব উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটল। কড়া নজর রেখেছি জলাতঙ্কের দিকে। দ্রুত সেরে উঠছি এখন আমি আর ইয়েলার।

চিত্রার আচরণে কোন পরিবর্তন নেই। আসে যায়, আসে যায়, ডেকে ডেকে সারা হয়। অনেকখানি জায়গা নিয়ে চক্কর দিয়ে বেড়ায়। দিনে অন্তত দুবার চলে আসে বাড়ির কাছাকাছি। থামে না। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় আবার পাহাড়ের দিকে। মাথা তোলার শক্তি নেই। ঝুলিয়ে রেখে টলে টলে হাঁটে। খুবই দুর্বল ভঙ্গি। কিন্তু হাঁটাও থামায় না, ডাকও বন্ধ করে না।

তারপর এল একটা ষাঁড়। চিত্রার মতই আচরণ করতে লাগল। তবে ষাঁড় তো, অনেক বেশি বিপজ্জনক। ডগ রানে চেয়ারে বসে আছি আমি। পায়ের কাছে শোয়া ইয়েলার। ওর কাটা কানের গোড়াটা আস্তে আস্তে চুলকে দিচ্ছি। এটা তার খুব পছন্দ। আম্মা রয়েছে রান্নাঘরে। রান্নায় ব্যস্ত। আরলিস আর লিজ গেছে ক্ৰীকের নিচের ঝর্নায়। ক্যাটফিশ ধরতে। কুকুরের বাচ্চাটা নিয়ে গেছে সঙ্গে করে। ওদেরকে দেখা যাচ্ছে। হাসাহাসি করছে। মাছের টোপের জন্যে ঘাসফড়িং খুঁজছে।

হঠাৎ গোঙানি কানে এল। তাকিয়ে দেখি ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসছে ষাঁড়টা। সেই লালুটা, লড়াইয়ের সময় যাকে ঠেলাগাড়িতে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল ঝোলা শিংওয়ালা চোঙ্গো। কিন্তু ও যেভাবে হেঁটে এল এভাবে আর হাঁটতে দেখিনি কোন ষাঁড়কে। মাথা নিচু। টলছে। এলোমেলো পা ফেলছে। কোথায় যাবে তা-ও যেন জানে না। একটা মেসকিট গাছের দিকে সোজা এগোল। যেন চোখেই পড়েনি ওটাকে। গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল। কোনমতে উঠে দাঁড়াল আবার। আবার এগোল। ঘোৎ-ঘোৎ করছে, গোঙাচ্ছে। টলতে টলতে রওনা হলো ঝর্নার দিকে।

বন থেকে তুলে আনার পর এই প্রথম গরুর চামড়াটা থেকে নামল ইয়েলার। ষাঁড়টার ঘ্যানঘ্যানানিতে কান দেয়নি। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই সতর্ক হয়ে গেছে। নিশ্চয় ষাঁড়ের গায়ের গন্ধ এসে লেগেছে তার নাকে। রোগের গন্ধ।

উঠে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ শুরু করল। টলোমলো পায়ে এগোল ষাঁড়টার দিকে। দুর্বল ভঙ্গি। সোজা হয়ে ঠিকমত দাঁড়াতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। ঠোঁট তুলে ফেলেছে ভেঙচি কাটার ভঙ্গিতে। দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। ঘাড়ের রোম দাঁড়িয়ে গেছে।

তার এই চেহারা দেখে আমারও ঘাড়ের কাছটায় শিরশির করে উঠল। সাংঘাতিক বিপদ না দেখলে এরকম আচরণ করে না সে।

বুঝলাম, আমি আর আম্মা ব্যাপারটাকে জোর করে এড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছি। বুঝেও বুঝতে চাইছি না। ভান করছি শুধু শুধু। মিথ্যে আশায় থেকে ভাবছি, চিত্রার রোগ সেরে যাবে। কদিন ধরে ওটার বাছুরটাকে অন্য গরুর দুধ খাওয়ানো হচ্ছে। খেতে দিতে কি আর চায়। লাথি মেরে সরিয়ে দেয়। শেষে গরুটার পেছনের পা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে আম্মা আর লিজ। আম্মা আশা করছে, এই অবস্থা বেশি দিন থাকবে না। শীঘ্রিই ভাল হয়ে যাবে চিত্রা। ফিরে আসবে। দুধের সমস্যা আর থাকবে না তার বাছুরের।

কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত, চিত্রা আর কোন দিনই ভাল হবে না। ভাল হবে না এই ষাঁড়টাও। মারাত্মক জলাতঙ্কে ধরেছে ওদেরকে। ওই ভয়াবহ রোগের গন্ধ পেয়েই এমন আতঙ্কিত চিৎকার শুরু করেছে ইয়েলার।

ভয় পেয়ে গেলাম আরলিস আর লিজের জন্যে। ঝর্নায় রয়েছে ওরা। ষাঁড়টাও গেছে সেদিকেই। চেয়ার থেকে উঠে চিৎকার করে আম্মাকে ডাকলাম, আম্মা, জলদি আমার বন্দুকটা এনে দাও।

দৌড়ে এল আম্মা। কি হয়েছে?

জলাতঙ্ক! ওই দেখো, ষাঁড়টা কি করছে। আরলিসরা ওখানে…

একবার তাকিয়েই আঁতকে গেল আম্মা, সর্বনাশ! সোজা দৌড় দিল ক্ৰীকের দিকে। চিৎকার করে আরলিস আর লিজকে বলছে গাছে উঠে পড়ার জন্যে। ষাঁড়টার কাছ থেকে সরে যেতে বলছে।

আম্মার চিৎকার কানে গেল ষাঁড়টার। থমকে দাঁড়াল। গুতো মারার জন্যে ঘুরতে গেল। তাড়াহুড়ায় গেল হাঁটু ভেঙে পড়ে। আবার উঠে দাঁড়াল। টলতে টলতে এগোল। গরুটা অসুস্থ না হলে কোন সুযোগই পেত না আম্মা। কিন্তু এখন তাকে ধরতে পারল না চোঙ্গো। কয়েক কদম এগিয়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। গোঙাতে লাগল। কয়েক মুহূর্ত একভাবে পড়ে থেকে আবার উঠল।

ততক্ষণে তার কাছে পৌঁছে গেছে ইয়েলার। ঘেউ ঘেউ করছে। বেশি শয়তানি করলে জ্যান্ত খেয়ে ফেলার হুমকি দিচ্ছে।

আর দাঁড়ালাম না। ঘরে গিয়ে বন্দুকটা বের করে নিয়ে চলে এলাম ষাঁড়টার কাছে। ঠিকমত হাঁটতে পারি না আমিও। মুখোমুখি দাঁড়ালাম ওটার। অহেতুক ঝুঁকি নেয়ার কোন মানে হয় না। ঠিক মগজে একটা গুলি ঢুকিয়ে দিতে চাই।

বোকামি করে ফেললাম। ষাঁড়টাকে বাড়ির এত কাছে না মারলেও চলত। মাংস পচা গন্ধ ছড়াবে। বিষাক্ত করে তুলবে পরিবেশ। ঝর্নাটাও কাছেই। ওটার পানিতেও বিষ ছড়াতে পারে। খাওয়ার পানিই পাব না তাহলে।

সরিয়ে ফেলা দরকার, আম্মা বলল। তারপর পোড়াতে হবে।

পোড়াবে? অবাক হয়ে বললাম, দরকার কি? ফেলে রাখলেই হবে। একদিনেই শেষ করে দেবে শকুন আর শেয়ালের দল।

তাতে রোগ ছড়াবে।

আম্মা গিয়ে জাম্পারকে লাগাম পরাতে শুরু করল। আমাকে দড়ি এনে দিল লিজ। মোটা করে ষাঁড়টার দুই শিঙে দড়ি বাঁধলাম। জাম্পারকে টানতে টানতে নিয়ে এল আম্মা। মরা গরু আর রক্ত দেখে অস্থির হয়ে ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাস ছাড়তে শুরু করল ওটা। লাফিয়ে সরে যেতে চাইল। রোগের গন্ধ মনে হয় সে-ও পেয়েছে। ওকে চুপ থাকার জন্যে গালাগাল করলাম।

তাতেও যখন হলো না, ডাল ভেঙে নিলাম পেটানোর জন্যে। মারের ভয়ে বাধ্য হয়ে শান্ত হলো সে। ওর গলায় বাধা দড়ির সঙ্গে ষাঁড়ের শিঙের দড়ি বাঁধল আম্মা।

এতবড় একটা ষাঁড়, অনেক ভারি। টেনে সরানো জাস্পরের সাধ্যের বাইরে। টানতে টানতে বাঁকা হয়ে গেল। ফুলে উঠল ঘাড়ের পেশী। প্রাণপণ চেষ্টায় বড় জোর হাতখানেক সরাতে পারল মরা গরুটাকে, তারপরই হাল ছেড়ে দিল।

জাম্পারটা ভীষণ পাজি, কিছুতেই কাজ করতে চায় না, খালি ফাঁকি দেয়ার তালে থাকে, কাজে গোলমাল করে দেয়, সবই ঠিক। কিন্তু একটা কাজে সে সত্যিই ওস্তাদ। সেটা হলো বোঝা টানা। কিন্তু তার মত ভারবাহীও সরাতে পারল না ষাঁড়টাকে। আসলেই এটা তার ক্ষমতার বাইরে।

অন্য কৌশলে টানানোর চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। একটা দড়ি ছিড়ে বেরিয়ে গেল আমার কানের পাশ দিয়ে। চাবুকের মত শপাং করে উঠল। আরেকটু হলেই লাগত আমার কানে। কানটা খোয়াতে হত তাহলে।

নাহ্, সরানো যাবে না এভাবে। আম্মার দিকে তাকালাম।

মাথা নেড়ে আম্মা বলল, আর কিছু করার নেই। এখানেই পোড়াতে হবে। মুশকিল হবে এখন কাঠ আনা নিয়ে।

এত বড় একটা ষাঁড় পোড়ানো সহজ কথা নয়। অনেক কাঠ দরকার। শুকনো কাঠ পাওয়া যায় কাছাকাছি এমন কোন ব্যবস্থা নেই। মরা বা শুকনো গাছটাছ যা ছিল অনেক আগেই সেগুলো শেষ করে ফেলেছি আমরা। আমি সুস্থ থাকলে অতটা অসুবিধে হত না। গিয়ে কেটে নিয়ে আসতে পারতাম। উপায় না দেখে শেষে আম্মা আর লিজই বনে গেল জাম্পারকে নিয়ে। শুকনো ডালপালা জোগাড় করে আনল। সেগুলো মরা গরুটার ওপর সাজিয়ে দিয়ে আগুন ধরাতে ওদেরকে সাহায্য করলাম আমি।

দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। অনেক উঁচুতে উঠে গেল আগুনের শিখা। প্রচণ্ড তাপ, পোড়া চামড়া আর মাংসের অসহ্য তীব্র গন্ধ যেন ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিতে চাইল আমাদের।

ভাবলাম, আগুন যা হয়েছে তাতে চোঙ্গোর মত তিনটে ষাঁড়কে পুড়িয়ে ফেলা সম্ভব। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক যেতেই ভুল ভাঙল আমার। নিভে এল আগুন। অবাক হয়ে দেখি অর্ধেকটাও পুড়ে শেষ হয়নি। আবার কাঠ আনতে বনে যেতে হলো আম্মা আর লিজকে।

দুই দিন দুই রাত লাগল বঁড়টাকে পুড়িয়ে ছাই করতে। সারা দিন ধরে এই কাজই করলাম আমরা। আম্মা আর লিজ গিয়ে কাঠ আনে, আমি সেগুলো আগুনে ফেলি। চর্বিপোড়া গন্ধে টেকা দায়। রাতে হয় আরেক যন্ত্রণা। পোড়া মাংসের গন্ধে এসে হাজির হয় নেকড়ের দল। নিজেরা নিজেরা ঝগড়া করে, মারামারি করে, চিৎকারে কান ঝালাপালা করে। আগুনের ভয়ে কাছে আসতে পারে না। তবে মাংসের লোভও ছাড়তে পারে না। বসেই থাকে। আর চেঁচামেচি করে জ্বালিয়ে মারে আমাদের। ওগুলোর অত্যাচারে ঘুমাতে পারি না আমরা।

রাতভর জেগে পাহারা দেয় ওল্ড ইয়েলার। খোঁড়াতে খোঁড়াতে একবার যায় আগুনের কাছে, আবার ফিরে আসে ঘরের কাছে। চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে। দূরে সরে থাকার হুমকি দেয় নেকড়েগুলোকে।

দুই রাতই জেগে রইলাম আমি। দেখলাম নেকড়ের চোখ, অন্ধকারে জ্বলে জ্বলন্ত কয়লার মত। মাঝে মাঝে কানে আসে বেচারি চিত্রার যন্ত্রণা কাতর ডাক। এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। বাড সারসির চাচার কথা মনে করে গায়ে কাঁটা দেয় আমার। শিউরে শিউরে উঠি।

কেবলই আব্বার কথা মনে হয়। আর পারি না। তাকে এখন ভীষণ প্রয়োজন আমাদের।

ষাঁড়টাকে পোড়ানো শেষ হলে আম্মা বলল, এবার চিত্রাটারও একই গতি করা দরকার। বলল বটে, কিন্তু তার মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম একথা বলতে কতটা কষ্ট হচ্ছে তার। এত ভাল একটা দুধেল গাই খোয়ানোর কথা, সত্যিই, ভাবা যায় না।

আমার মতই আম্মাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এতটা উদ্বিগ্ন হতে আর কখনও দেখিনি তাকে। কোন সন্দেহ নেই, আমারই মত ঘাবড়ে গেছে। দুটো গরুকে যখন জলাতঙ্কে ধরেছে। বাকিগুলোকেও ধরতে পারে।

বললাম, বাঁচবে তো না এমনিতেও, শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছে। তবে বাড়ির কাছে আর না। বনে নিয়ে যাব। কাঠ আছে এমন জায়গায়।

তোর পায়ের অবস্থা কেমন?

ভাল। হাঁটাহাঁটি শুরু করা উচিত। নইলে খিচ ধরাটা ছাড়বে না।

খোলা জায়গায় ফেলবি, সাবধান করে দিল আম্মা। শুকিয়ে খড়খড়ে হয়ে আছে ঘাস। আগুনের ছোঁয়া পেলেই দপ করে জ্বলে উঠবে। দাবানল লেগে যাবে।

গরুটার আসার অপেক্ষায় রইলাম। এল ওটা। বাড়ির পাশ দিয়ে ঘুরে গিয়ে বনের দিকে এগোতেই বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে বন্দুক হাতে তার পিছু নিলাম।

তাকানো যায় না বেচারির দিকে। রোগে একেবারে শেষ করে দিয়েছে। হাড় কখানা শুধু আছে, তার ওপর চামড়াটা জড়ানো। জীবন্ত একটা কঙ্কালই বলা চলে। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে রয়েছে। দুনিয়ার কোন দিকেই খেয়াল নেই। আপনাআপনি পা পড়ছে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে। কিছুদূর গিয়ে গিয়েই মাটিতে পড়ে যায়। মনে করি, এই বুঝি তার শেষ পড়া, আর উঠতে পারবে না। কিন্তু ঠিকই পারে। গোঙানিও চলতে থাকে আবার।

সুবিধে মত একটা জায়গার ওপর দিয়ে এগোলেই গুলি করব। কিন্তু গেল না। তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ারও সাহস হলো না। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে। এখন আর ওকে দিয়ে কিছুই করানো যাবে না। করাতে গেলে উল্টোপাল্টা কিছু করে বসতে পারে। বিপদে ফেলে দিতে পারে ষড়টার মতো।

মাইলখানেক আসার পর একটা শুকনো নালার দিকে এগোল সে। গুলি করার জন্যে উপযুক্ত জায়গা। বাড়ি থেকে অবশ্য বেশ কিছুটা দূরে, পোড়াতে আসতে অসুবিধে হবে, কিন্তু আশেপাশে শুকনো ডালপালা পাওয়া যাবে প্রচুর। শুকনো ঘাসে আগুন ধরে গিয়ে দাবানল ছড়ানোরও ভয় নেই।

তাড়াহুড়ো করে ওর সামনে চলে এলাম। লুকিয়ে পড়লাম একটা ঝোপে। না লুকালেও বোধহয় চলত। কোন দিকেই খেয়াল নেই। একেবারে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেও হয়তো দেখতে পেত না।

এক গুলিতেই ফেলে দিলাম।

এইটুকু পথ হেঁটেই হাত-পা কাঁপতে শুরু করল আমার। দরদর করে ঘাম বেরোচ্ছে। বড় বেশি কাহিল হয়ে পড়েছি। কবে যে আবার ঠিকমত চলার শক্তি পাব কে জানে!

আমার দিকে এক নজর তাকিয়েই সোজা বিছানায় চলে যাওয়ার হুকুম দিল আম্মা। তুই শুয়ে থাক। পোড়ানোর কাজটা আমরাই সারতে পারব। পায়ে এখন বেশি চাপ দেয়া ঠিক না। আবার ফুলবে।

তর্ক করলাম না। করার অবস্থাও নেই। কোথায় চিত্রাকে ফেলে এসেছি আম্মাকে কললাম।

দলবল নিয়ে রওনা হয়ে গেল আম্মা। জাম্পারের পিঠে চেপে গেল লিজ। আম্মা গেল হেঁটে। আগুন জ্বালানোর জন্যে এক কড়াই জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে গেছে। আরলিসকে রেখে গেছে বাড়িতে।

একেবারে শেষ মুহূর্তে উঠে দাঁড়াল ইয়েলার। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। যাবে কি যাবে না এই নিয়ে দ্বিধা। তবে থাকতে পারল না। পা সুড়সুড় করছে যাওয়ার জন্যে। মিনিটখানেক পর খোঁড়াতে খোঁড়াতে রওনা হয়ে গেল ওদের পেছনে। খুব রোগা হয়ে গেছে। হাঁটার সময় একটা পা উঁচু করে রাখে, প্রায় ফেলতেই পারে না মাটিতে। তবে তিন পায়ে ভর করেও যেতে পারবে। আমার মত এত সহজে কাহিল হবে বলেও মনে হলো না। তাই ফিরে আসতে ডাকলাম না। যাক।

ওকে যেতে দিয়ে এক হিসেবে ভালই করেছি। নইলে সারা জীবন পস্তাতে হত। ওই মুহূর্তে বুঝতে পারিনি সেটা। মানুষ যদি তার ভবিষ্যটা জানতে পারত, তাহলে অনেক মারাত্মক অঘটন থেকে বেঁচে যেত। কি ঘটবে তখন জানলে কি আর কাউকে বেরোতে দিই। কিছুতেই দিতাম না।

শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বলতে পারব না। একটানা ঘুমালাম সূর্য ডোবা পর্যন্ত। হঠাৎ চমকে জেগে উঠলাম। মনে পড়ল আরলিসের কথা। সর্বনাশ! একা একা কি করছে ও খোদাই জানে! গাল দিলাম নিজেকে। এভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীনের মত ঘুমিয়ে পড়া উচিত হয়নি।

তবে ভালই আছে আরলিস। কুকুরের বাচ্চাটার সঙ্গে খেলছে। দারুণ একটা সঙ্গী জটে গেছে তার। একটুকরো দড়ি হাতে নিয়ে ওটাকে দেখিয়ে দৌড়াচ্ছে। দড়ির একটা প্রান্ত গড়াচ্ছে মাটিতে। সেটাকে লক্ষ্য করে ছুটছে বাচ্চাটা। কাছাকাছি হলেই ধরার জন্যে লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ছে। কখনও ধরতে পারছে, কখনও পারছে না। যখন পারছে তখনও রাখতে পারছে না। হ্যাচকা টান মারছে আরলিস। ডিগবাজি খেয়ে পড়ছে ওটা। দড়িটা ছুটে যাচ্ছে দাঁত থেকে। আমার তো ভয়ই হলো, দাঁত না খসে আসে। এলেও অবশ্য কোন ক্ষতি নেই। ওগুলো দুধের দাঁত। এমনিতেও পড়ে গিয়ে নতুন দাঁত গজাবে। মুহূর্তের জন্যেও দমছে না বাচ্চাটা। নতুন উদ্যমে আবার উঠে তাড়া করছে দড়ির মাথাকে।

আম্মা আর লিজ এখনও ফেরেনি। দেরি অবশ্য হওয়ারই কথা। কাঠকুটো জোগাড় করে সেগুলো দিয়ে গরুটাকে ঢেকে আগুন ধরানোটা সহজ কাজ নয়। তাছাড়া ওরা মেয়েমানুষ। এসব কাজ পুরুষের জন্যে যতটা সহজ, ওদের জন্যে নয়। বাড়ি থেকেও বেশ অনেকটা দূরে। আসতে সময় লাগে। আশা করলাম কাজ শেষ করে অন্ধকারের আগেই ফিরে আসতে পারবে।

একটা বালতি নিয়ে ঝর্নায় চললাম পানি আনতে। আব্বার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছি। দুই দিন আগে আম্মা বলেছে তার আসার সময় হয়ে গেছে। যে কোন দিন চলে আসতে পারে। কিন্তু আমার আর তর সইছে না। ঘোড়ার জন্যে নয়, ভয় পাচ্ছি জলাতঙ্ককে। আব্বা থাকলে অনেকটা ভরসা পেতাম। রোগটা এখনও মহামারী আকারে শুরু হয়নি। গোয়ালের বাকি গরুগুলোকেও যদি ধরে, দিশেহারা হয়ে যাব। কি করব তখন জানি না।

অন্ধকার হয়ে গেল। ফিরল না আম্মারা। অস্বস্তি বাড়তে লাগল আমার। যদিও চিন্তার কিছু নেই। একটা গরু পোড়াতে কতটা সময় লাগে তা তো দেখেছি। তেমন কোন বিপদেরও আশঙ্কা দেখছি না। বাড়ি থেকে বেশি দূরে যায়নি যে হারিয়ে যাবে। হারালেও সমস্যা নেই। জাম্পার রাস্তা চেনে। ইয়েলার তো রয়েছেই।

তবু অস্বস্তি গেল না আমার। খারাপ কিছু ঘটার বোধটা কিছুতেই সরতে চাইল না মন থেকে। আরলিস বাড়ি না থাকলে কি হয়েছে দেখার জন্যে বেরিয়ে পড়তাম। ওর খাবার সময় হয়েছে। খিদে পেলেই চেঁচানো শুরু করবে। তারপরেই ঘুম।

ওকে আর বাচ্চাটাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেলাম। মোম জ্বেলে দিয়ে মাটিতেই বসালাম দুজনকে। একটা বাটিতে দুধ ঢেলে তার মধ্যে রুটি ভিজিয়ে দিলাম। একটু একটু করে এক বাটি থেকেই খেতে লাগল ওরা। এভাবে মানুষ আর কুকুরে এক পাত্র থেকে খাওয়া উচিত হচ্ছে না। সেটা জানে আরলিস। আমি তো জানিই। কিন্তু বারণ করলাম না। এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না।

আরলিস আর বাচ্চাটাকে শুইয়ে দিয়েই বেরিয়ে পড়ব ভাবছি। ওদের খাওয়া প্রায় হয়ে গেছে এই সময় একটা শব্দ কানে এল। কুকুরের ঝগড়ার মত। দরজায় এসে দাঁড়ালাম। অন্ধকার বনের ওদিক থেকে আসছে শব্দটা। বেরিয়ে এলাম উঠানে। ওল্ড ইয়েলারের গলা চিনতে ভুল হলো না আমার।

মরণপণ লড়াইয়ের সময় ও এরকম চিৎকার করে। সেদিন আমাকে খেপা শুয়োরগুলোর কবল থেকে বাঁচানোর সময়ও এমন করেই চেঁচিয়েছিল।

ভয়ে কলজে কেঁপে গেল আমার। পায়ে যেন শেকড় গজিয়ে গেছে। নড়তে পারছি না। কি হয়েছে? কি এমন হতে পারে? আমার কি করা উচিত?

হঠাৎ শুনতে পেলাম জাম্পারের ডাক। পরক্ষণেই চিৎকার করে আম্মা বলল, ট্র্যাভিস, আলো জ্বাল! বন্দুক নিয়ে আয়! জলদি কর!

ঝাকি খেয়ে যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। সাড়া দিয়ে জানালাম তার ডাক শুনতে পেয়েছি। দৌড় দিলাম বন্দুক আনার জন্যে। কি ধরনের আলো দরকার বুঝতে পারলাম না প্রথমে। তারপর মনে এল ভালুক-ঘাসের কথা। এগুলোর জোগান রাখি আমরা। প্রয়োজন হয়। একধরনের তৈলাক্ত রস থাকে এই ঘাসে, অনেকক্ষণ ধরে জ্বলে, উজ্জ্বল আলো দেয়।

দৌড়ে গিয়ে চার গোছা ঘাস টেনে বের করলাম। অল্প দিন আগে তোলা। ভাল করে শুকায়নি। শক্ত ঘাসের চোখা মাথা বিধল আমার হাতে, বুকে। কেয়ার করলাম না। সময় নেই। নিয়ে এসে ফেললাম উঠানের বেড়ার ধারে। তারপর ছুটলাম চুলা থেকে জ্বলন্ত কয়লা আনতে।

লোহার হাতা দিয়ে কয়লা এনে ঘাসের ওপর ঢেলে দিয়ে হ্যাট খুলে বাতাস করতে লাগলাম তাড়াতাড়ি ধরানোর জন্যে। পুড়লে বাজে গন্ধ বেরোয় এই ঘাস থেকে। যা খুশি বেরোক। এখন আমার আলো দরকার। প্রথমে মৃদু আগুন দেখা দিল, কাঁপল দু-একটা ধোয়াটে শিখা, হঠাৎ যেন বিস্ফোরিত হয়ে আগুনের ফুল ফুটল।

লাফ দিয়ে সরে এলাম। বন্দুক তুলে নিলাম হাতে। তাকানোর সুযোগ পেলাম এতক্ষণে। আলোর সীমানায় ঢুকে পড়েছে লড়াকু জানোয়ার দুটো। একটা আমাদের ওল্ড ইয়েলার, আরেকটা একটা বুনো জানোয়ার।

আলোর বাইরে থেকে চিৎকার করে আম্মা বলল, সাবধান, ট্রাভিস! দেখে গুলি করবি! ওটা নেকড়ে, পাগল হয়ে গেছে!

ধড়াস করে এক লাফ মারল আমার হৃৎপিণ্ড। এতবড় নেকড়ে আমাদের এই এলাকায় সচরাচর দেখা যায় না। নিশ্চয় ধূসর নেকড়ে। ওগুলোর কথা অনেক শুনেছি। ভয়াবহ জানোয়ার। শোনা যায় গরু-ঘোড়াকেও মেরে ফেলতে পারে। আর ওরকম একটা জানোয়ারের সঙ্গে লড়াই করছে অসুস্থ ইয়েলার! এতক্ষণ টিকছে কি করে সে!

বন্দুক কাঁধে ঠেকিয়ে আম্মাকে বললাম, ঘরে ঢোকো। গুলি করতে পারছি না। কার গায়ে লেগে যাবে ঠিক নেই।

মহা গণ্ডগোল শুরু করে দিয়েছে জাম্পার। খালি এদিক ওদিক সরে যেতে চায়। বাড়ি মারল আম্মা। গুঙিয়ে উঠল ওটা। তবে এগোতে আর অরাজি হলো না। অনেকটা ঘুরে দৌড়ে এসে দাঁড়াল ঘরের সামনে। আমার পেছনে দরজায় আম্মার সাড়া পাওয়ার পরেও গুলি করতে পারলাম না। ইয়েলারের গায়ে লেগে যাওয়ার ভয়ে।

প্রচণ্ড লড়াই করছে ইয়েলার আর নেকড়েটা। ঘুরছে, লাফাচ্ছে, জড়াজড়ি, কামড়াকামড়ি করছে। আগুনের আলোয় ঝিক করে উঠছে ওদের চোখ। সবুজ দেখাচ্ছে।

গড়াগড়ি শুরু করল দুটোতে। ইয়েলারের ওপর উঠে গেল নেকড়েটা। বুক দিয়ে চেপে ধরে কামড়ে ধরল গলা। এই আমার সুযোগ। এক গুলিতেই সাবাড় করতে হবে। বেশি সময় পাবে না ইয়েলার। এমনিতেই দুর্বল। দ্রুত আমি কিছু করতে না পারলে বিশাল নেকড়ের ভয়ঙ্কর কামড় থেকে নিস্তার নেই তার।

কাঁপা কাঁপা ওই আলোয় বন্দুকের মাছি আর নেকড়ের মাথা কোটাই ভাল দেখতে পাচ্ছি। লক্ষ্য স্থির করতে পারছি না। অনেকটা আন্দাজের ওপরই গুলি চালাতে হবে।

তা-ই করলাম। টিপে দিলাম ট্রিগার। আলগা করেই ধরেছিলাম বোধহয়, আমার কাঁধে প্রচণ্ড আঘাত করল বন্দুকের বাট। নলের মাথা দিয়ে বেরোনো আগুনের ঝলকে অন্ধ হয়ে গেলাম যেন ক্ষণিকের জন্যে। ওপাশের কিছুই দেখতে পেলাম না।

তবে টের পেলাম গর্জন আর গরগর থেমে গেছে। দৌড় দিলাম। পাশাপাশি পড়ে আছে দুটো ধূসর শরীর।

ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো ইয়েলারকেও মেরে ফেলেছি। কিন্তু না, আমি ওর কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে নড়ে উঠল সে। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে বসল। ভীষণ কাঁপছে। ওই অবস্থায়ই হাত চেটে দিল আমার।

এতটাই স্বস্তি বোধ করলাম, মনে হলো হঠাৎ করেই সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে আমার। ধপ করে বসে পড়লাম। আমিও কাঁপছি ইয়েলারের মত।

দৌড়ে এল আম্মা। একটা হাত রাখল আমার কাঁধে। কি হয়েছিল বলল।

যা অনুমান করেছিলাম তা-ই। কাঠ জোগাড় করে গরুটাকে ভাল করে ঢেকে দিয়ে আগুন লাগাতে অনেক সময় লেগেছে। অন্ধকার হয়ে গেছে তখন। লিজকে নিয়ে জাম্পারের পিঠে চেপে বাড়ি রওনা হলো। বাড়ি থেকে যাওয়ার পর আর পানি খায়নি। খুব পিপাসা পেয়েছে। বার্ডসং ক্ৰীকের কাছে এসে পানি খাওয়ার জন্যে খচ্চরের পিঠ থেকে নামল দুজনে। উবু হয়ে বসে পানি খাচ্ছে, এই সময় নেকড়েটা এসে হাজির।

কি মনে হতেই ঝট করে চোখ তুলে তাকাল আম্মা। দেখে, একটা বিশাল কালো ছায়া ছুটে আসছে তাদের দিকে। গর্জন করে উঠল ছায়াটা। হাতের কাছেই একটা ডাল পড়ে ছিল। এক থাবায় ওটা তুলে নিয়েই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল আম্মা। ঘুরিয়েই গায়ের জোরে নেকড়ের মাথায় মারল বাড়ি।

পড়ে গেল নেকড়েটা। ওটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ইয়েলার।

পড়িমরি করে দৌড়ে গিয়ে জাম্পারের পিঠে চেপে লিজকে নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটল আম্মা। ওদের পিছু নিল নেকড়েটা। না ধরে ছাড়বে না। ধরে ফেলতও। পারল না ইয়েলারের জন্যে। বাধা হয়ে দাঁড়াল সে। গায়ের জোর অনেক কম তার, আকারেও ছোট। নেকড়েটার সঙ্গে পারার প্রশ্নই ওঠে না। তবু মরিয়া হয়ে লড়তে লাগল সে। বাধা দিয়ে চলল। জাম্পারের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখল নেকড়েটাকে।

পাগল হয়ে গিয়েছিল ওটা, আম্মা বলল। না হলে ওরকম আচরণ করে না নেকড়েরা। সে যে কোন নেকড়েই হোক।

কথাটা আমিও জানি। বললাম, ইয়েলার যে ওকে কি করে ঠেকাল খোদাই জানে! ওর জন্যেই বাঁচলে আজ।

একটা মুহূর্ত চুপ করে থাকল আম্মা। তারপর বলল, আমরা বাঁচলাম। কিন্তু ওর মস্ত ক্ষতি হয়ে গেল, ট্রাভিস।

মোচড় দিয়ে উঠল পেটের ভেতর। ঝট করে সোজা হলাম। কি বলো! ইয়েলার ঠিকই আছে। কয়েকটা জখম-টখম হয়েছে এই যা। ও সেরে যাবে। দেখলে না, হেঁটে চলে গেল ঘরের দিকে। জখমগুলো মারাত্মক না…

আচমকা একটা ধাক্কা খেয়ে যেন থেমে গেলাম। দেরিতে হলেও আম্মা কি বোঝাতে চেয়েছে বুঝে ফেলেছি। জমে যাচ্ছে যেন হাত-পা। দম নিতে পারছি না।

লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ভীষণ ভয় পেয়েছি। সাংঘাতিক! কিন্তু আম্মা! চিৎকার করে উঠলাম, এই মাত্র তোমাদের জীবন বাঁচাল সে! আমাকে বাঁচিয়েছে সেদিন! আরলিসকে বাঁচিয়েছিল! ওকে আমরা…

উঠে এসে আমার কাঁধে হাত রাখল আম্মা। জানি, বাবা। কিন্তু কিছু করার নেই আমাদের। পাগলা নেকড়েতে কামড়েছে ওকে।

আগুন নিভে আসছে। অন্ধকারে পাক খেয়ে খেয়ে ছুটে বেড়াতে লাগলাম এদিক ওদিক।

যেন আমি একটা ইঁদুর। খাঁচায় আটকে দেয়া হয়েছে আমাকে। মুক্তি পাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছি।

আম্মা, নিজেকেই বুঝ দেয়ার চেষ্টা করছি, আমরা এখনও শিওর না। অপেক্ষা করে তো দেখতে পারি। বেঁধে রাখতে পারি, কোথাও ওকে ভরে আটকে রাখতে পারি। শিওর না হওয়া পর্যন্ত।

আর সইতে পারল না আম্মা। কেঁদে ফেলল। আমার কাঁধে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল গলা। চাপ লাগছে। প্রায় শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে আমার।

এই ঝুঁকি নিতে পারি না আমরা, বাবা, ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল আম্মা। এর পরের শিকার তুইও হতে পারিস। কিংবা আরলিস, কিংবা আমি, কিংবা লিজ। তোর যদি কষ্ট হয়, আমিই গুলি করব ওকে। যে-ই করুক, কাজটা কাউকে না কাউকে করতেই হবে। একটুও আর দেরি করা উচিত না। ওর ছোঁয়াও এখন ভয়ঙ্কর। তোকে যে চাটল, তাতেও ভয় পাচ্ছি আমি।

মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল আমার। বুঝতে পারলাম, আম্মা ঠিকই বলছে। ঝুঁকি নেয়া একদম ঠিক হবে না। নেকড়েটার যে জলাতঙ্কই হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভাবতেও ভেতরটা চুরচুর হয়ে যাচ্ছে আমার। কিন্তু তবু আমি জানি, গুলিটা আমাকেই করতে হবে। জিইয়ে রেখে অহেতুক ইয়েলারকে কষ্ট দেয়ারও কোন মানে হয় না।

সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতেই আর কোন দ্বিধা রইল না আমার। কোন অনুভূতিও যেন নেই। একেবারে ভোতা হয়ে গেছে মনটা। পাথর।

দ্রুত পায়ে এসে দাঁড়ালাম আগুনের কাছে। আবার গুলি ভরলাম বন্দুকে। ঘর থেকে ডেকে বের করে আনলাম ইয়েলারকে। ও কিছু বোঝার আগেই নলটা মাথায় ঠেকিয়ে টিপে দিলাম ট্রিগার।

দিন যায়। কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না ব্যাপারটা। খেতে পারি না। ঘুমাতে পারি না। কাঁদতে পারি না। ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগে। যন্ত্রণা হয়। সারা জীবনে যত যন্ত্রণা পেয়েছি সেগুলো এর তুলনায় কিছুই নয়। রোগ হলে কিংবা আহত হলে যন্ত্রণা হয়, তার চিকিৎসাও থাকে, কিন্তু এর কোন চিকিৎসা নেই। কেবলই মনে পড়ে কুকুরটার কথা। কি করে সে এল আমাদের বাড়িতে, কি করে তার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো শুরু করলাম, কি করে আরলিসকে ভালুকটার কবল থেকে বাঁচিয়েছিল সে, কি করে খেপা শুয়োরের কবল থেকে আমাকে রক্ষা করেছিল, কি করে পাগল নেকড়ের সঙ্গে লড়াই করে আম্মা আর লিজকে বাঁচিয়েছিল। ভাবি আর ভাবি। লালু আর চিত্রাকে মারার সময় কল্পনাই করতে পারিনি ইয়েলারকেও গুলি করতে হবে আমাকে।

এ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় আম্মা। তাকে বলতে দিই। আম্মা আমাকে বোঝায়। আমিও সে সব বুঝি। কিন্তু মন থেকে শূন্য অনুভূতিটা দূর করতে পারি না কিছুতেই।

লিজও আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। কথা কম বলে সে, বেশি লাজুক। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা কথাই বলে, আর একটা কুকুর তো হয়েই গেছে তোমার। ইয়েলারের বাচ্চা। সবচেয়ে ভালটাই দিয়েছি।

কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয় না। ইয়েলারের বাচ্চা হতে পারে, কিন্তু ইয়েলার তো নয়। আমাদের সকলের জীবন বাঁচিয়েছে সে, অথচ তাকে এমন ভাবে গুলি করে মারা হলো যেন কোন দামই নেই তার।

তারপর একরাতে মেঘ করল খুব। সারা রাত বৃষ্টি হলো। সকালে থামল। আমার মনে। হতে লাগল, এ বৃষ্টি ঈশ্বরের আশীর্বাদ। ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে এবার জলাতঙ্কের জীবাণু।

পরদিন সকালে বষ্টি থামতেই দেখলাম আব্বাকে। কাদা মাড়িয়ে আসছে ঘোডায় চড়ে।

বহু পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে। কানসাসে একবার যাওয়া, একবার আসা, সহজ কথা নয়। বেতের মত হয়ে গেছে শরীর। দড়ির মত ফুলে উঠেছে রগ। তবে পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে এসেছে। সবার জন্যে এনেছে আনন্দ, আর আমার জন্যে একটা চমৎকার ঘোড়া। নীলচে গায়ের রঙ। কালো কেশর, কালো লেজ। প্রথমেই ধরে আমাকে ওটার পিঠে চড়িয়ে দিল আব্বা। এক চক্কর দৌড়ে আসতে বলল।

দৌড় করাতে গিয়ে বুঝলাম ঘোড়াটা সত্যিই ভাল। একেবারে আগুন। অথচ মেজাজ ঠাণ্ডা। শান্ত। যে কোন পুরুষের গর্ব।

কেমন বুঝলি? জিজ্ঞেস করল আব্বা।

ভাল।

আব্বা ভেবেছিল আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করব আমি। অনেক খুশি হব, তাকে ধন্যবাদ দেব। কিন্তু কিছুই করলাম না। ঘোড়াটা আমাকে পুলকিত করতে পারল না।

একটা কিছু হয়েছে, বুঝে গেল আব্বা। চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল আম্মার দিকে। নীরবে শুধু মাথা নাড়ল আম্মা।

সন্ধ্যার একটু আগে আমাকে ঝর্নার ধারে ডেকে নিয়ে গেল আব্বা। পাশে নিয়ে বসল কথা কলার জন্যে। বলল, তোর আম্মা আমাকে সব বলেছে।

হুঁ, এর বেশি কিছু আর বলতে ইচ্ছে হলো না।

ব্যাপারটা সত্যিই দুঃখজনক। তবে তোর জন্যে আমার খুব গর্ব হচ্ছে ট্রাভিস। যে ভাবে সামাল দিয়েছিস তুই, একজন পুরুষ মানুষই কেবল পারে এরকম। তুই বড় হয়ে গেছিস।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল আব্বা। কয়েকটা নুড়ি তুলে নিয়ে এক এক করে ছুঁড়তে লাগল পানিতে। লম্বা পা-ওয়ালা এক ধরনের পোকা ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায় পানির ওপর। ওগুলোর মাঝে ঢিল পড়লেই অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে ছুটে সরে যায় এদিক ওদিক।

পানির দিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলল, এখন পুরুষের মতই আচরণ করতে হবে তোকে। ভুলে যেতে হবে সব।

কি করে? এরকম একটা ঘটনা মানুষ ভোলে কি করে?

মুখ ফেরাল আব্বা। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। মাথা নাড়ল, ঠিক এটা বোঝাতে চাইনি আমি। এমন কথা ভোলে না মানুষ, ভোলা যায় না। ভুললে তো অমানুষ হয়ে গেল। আমি বলতে চাইছি, ভুলে থাকতে হবে। জীবনে এমন ঘটনা তো ঘটবেই, আরও ঘটবে। খুব নিষ্ঠুর মনে হবে সেগুলোকে। কিন্তু নিষ্ঠুরতা জীবনেরই অঙ্গ।

কিন্তু তাই বলে এটাই জীবনের সব নয়। খারাপ যেমন আছে, অনেক ভালও আছে। খারাপগুলোর জন্যে দুঃখ করে করে ভালগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখা মুর্খতা। অন্তত বুদ্ধিমান পুরুষ মানুষের সেটা করা উচিত নয়। তাতে ভালগুলোও খারাপ হয়ে যায়।

হুঁ, আবার একই ভঙ্গিতে বললাম। বুঝলাম সবই, কিন্তু তাতে মনের কোন পরিবর্তন হলো না আমার। সেই আগের মতই ভোতা আর শূন্য হয়ে রইল মনটা।

আরও একটা হপ্তা পেরোল। তারপর এমন একটা ঘটনা ঘটল, যাতে হঠাৎ করেই চাঙা হয়ে উঠলাম আবার।

জাম্পার আর ঘোড়াগুলোকে খাবার দিচ্ছি আমি। এই সময় বাড়ির ভেতর থেকে আমার চিৎকার শোনা গেল, অ্যাই অই চোর! দে, দে বলছি! পরক্ষণেই কেউ কে র উঠল কুকুরের বাচ্চাটা।

রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বন্দুকের গুলির মত ছিটকে বেরোতে দেখলাম বাচ্চাটাকে। আস্ত একটা রুটি ঝুলছে মুখে। লেজটা দু-পায়ের ফাঁকে গুটানো। এমন চিৎকার করছে যেন পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে তাকে। কিন্তু রুটি ছাড়ছে না দাঁত থেকে।

বাড়ির ভেতর মহা হই-চই। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে আরলিস। আম্মাকে গালাগাল করছে। কুকুরের বাচ্চাটাকে মারার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে সে-ও নিশ্চয় আম্মার ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে। আম্মাও চিৎকার করছে। আব্বা হাসছে হো হো করে।

বাচ্চাটাকে ওভাবে বেরোতে দেখে মনের কোথায় যেন একটা গিট খুলে গেল আমার। কেটে গেল শূন্যতা। একটা বোঝা নেমে গেল মন থেকে।

সেদিন সারাটা দিনই ভাল কাটল আমার। ঘোড়াটাকে বের করে তাতে চেপে রওনা হলাম বনের দিকে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ালাম বনের মধ্যে, শুকনো খাড়িতে, পাহাড়ের ঢালে।।

ঘুরে ঘুরে সূর্য ডোবার আগে এসে পৌঁছলাম বার্ডসং ক্রীকের ধারে। কানে এল আরলিসের চেঁচামেচি। দেখি, একেবারে ন্যাংটো হয়ে ডোবার পানিতে দাপাচ্ছে সে। তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে রুটি-চোর বাচ্চাটা। খাওয়ার পানি নষ্ট করছে।

ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। হেসে উঠলাম শব্দ করে। ঘোড়া থেকে নেমে ডোবার উঁচু পাড়ে বসে হাসতেই থাকলাম। হাসিটা এক সময় কান্নায় রূপ নিল।

কান্নাও থেমে গেল এক সময়। একেবারেই হালকা হয়ে গেছে মন। আবার গিয়ে ঘোড়ায় চাপলাম। রওনা হলাম বাড়ির দিকে। ভাবছি, কালই কাঠবেড়ালি শিকারে বেরোব আরলিস আর কুকুরের বাচ্চাটাকে নিয়ে। এখনও ওটা অনেক ছোট। কিন্তু তাতে কি? যে এই বয়েসেই বাপের মত পাকা চোর হতে পারে, সে বাপের মত পাকা শিকারী হতে পারবে না কেন?

আর কোন দুঃখ রইল না। আমার ওল্ড ইয়েলারকে ফিরে পেয়েছি।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত