ফিনিক্স অ্যাশ

ফিনিক্স অ্যাশ

অ্যারিনা নড়েচড়ে উঠতেই মাথার উপরের শেকল পাথরে বাড়ি খেয়ে ঝনঝন করে উঠলো। ব্যাথায় গোঙ্গানি বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। আর্তনাদটা ওর কারাকক্ষের বাইরে প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেলো। ভাগ্য ভালো যে আর্তনাদটা অন্য কোনো দেবতার না। যদিও দেবতাদেরকে ধরে ধরে অত্যাচার করার ব্যাপারে করিন নিজেকে একেবারে বিশেষজ্ঞ বানিয়ে ফেলেছে। প্রথম দিকে আর্তনাদেরআওয়াজ ওর সহ্য হতো না, বুকে কাপুনি সৃষ্টি করতো। তখন শুধু মনে হতো এরচে মরে যাওয়া ভালো। কিন্তু এখন এই যন্ত্রনাকাতর শব্দগুলোই ওকে এক অদ্ভুত প্রশান্তি দেয়। ও যে এখনো বেচে আছে তার একমাত্র প্রমাণ হলো এগুলো।নিদারুণ বন্দিদশায় এগুলোই এখন ওর সঙ্গী।

অন্ধকার কারাকক্ষটায় কেমন ঠাণ্ডা একটা হাওয়া বয়ে গেলো যেন। অ্যারিনা স্যাতসেতে পাথুরে মেঝে থেকে নিজেকে টেনে তুলে উঠে বসলো। মাথা আর গাল থেকে ধুলো আর টুকরো পাথর গড়িয়ে পড়লো গায়ে। হাত দিয়ে সেগুলো ঝেড়ে ফেলার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করলো। ডান হাতের ব্যাথাটা এখন আর নেই। ওর বাম হাতটানকল- ধাতুর তৈরি। কিন্তু এখন ও ওর রক্তমাংসের হাত আর নকল হাত কোনোটার মধ্যেই আর তফাত করতে পারে না। শারীরিক কোনো অনুভূতিই আর ডান হাত বেয়ে এখন মস্তিষ্কে পৌছায় না। তবে শিকলে টান পড়লে ঠিকই আবার ব্যাথার চোটে চোখে অন্ধকার দ্যাখে।

কারাকক্ষের পাথুরে দেয়াল জুড়ে নরম মস-এর আবরণ। এরপরেও ঘষা খেয়ে খেয়ে অ্যারিনার গায়ের চামড়া জায়গায় জায়গায় উঠে গেছে। মাথাটাও সারাক্ষণ ব্যাথা করে। মাথার আঙ্গুরলতার মুকুট শুকিয়ে ধূসর হয়ে গেছে। চুলও ধুলো বালিতে জট পাকিয়ে একসারা। ও ছিলো ফসলের দেবী। যে কোনো মৃত গাছ বা প্রাণীকেই জ্যান্ত করতে পারতো। কিন্তু বাম হাতের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এখন আর ওর পক্ষে আঙ্গুরলতাটাকে আবার জ্যান্ত করে তোলা সম্ভব না। আস্তে আস্তে ওর পুরো শরীরটাই নষ্ট হয়ে যাবে। অ্যারিনা বহু চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোনোভাবেই আর ওর ক্ষমতা ফিরে আসেনি। কাটা হাতটার সাথে সাথে ওর ক্ষমতাও ওকে চিরদিনের মত ছেড়ে গেছে। করিন ওকে বাচিয়ে রেখেছে ঠিক, কিন্তু বেচে থাকার বাইরে ও আর কিছুই পারে না।

ছোট্ট কারাকক্ষটাতে এভাবেই একঘেয়ে ভাবে কেটে যায় সময়। অ্যারিনা বুকের কাছে হাটু টেনে বসলো। এটুকেই গোড়ালি ব্যথা করে উঠলো। লোহার বেড়িতে চামড়া কেটে মাংস বেরিয়ে গেছে। ওগুলো চোখে দেখতে না পেলেও, ক্রমাগত জ্বলুনির দরুন অ্যারিনা আন্দাজ করতে পারে ক্ষতগুলো দেখতে কেমন হতে পারে। প্রতিটা নড়াচড়ায় মরচে পড়া শেকলগুলো এক অদ্ভুত বিদ্রূপাত্মক সুরে ঝমঝমিয়ে ওঠে। মাথার উপরের দেয়ালে গাথা বিশাল বিশাল কয়েকটা হুক থেকে ওগুলো ঝোলানো। অ্যারিনা কয়েকবার চেষ্টা করেছে বেয়ে ওঠার, কিন্তু নকল হাতটার কারণে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি।

কারাকক্ষটায় হঠাৎ হালকা একটা বাতাস বয়ে গেলো। বাতাসের দেবী যেন ফিসফিসিয়ে একটা বার্তা দিয়ে গেলো- প্রতিরোধের বার্তা, আশা আর শক্তির বার্তা।
করিন ওদেরকে আটকে রাখলেও আশা শেষ হয়ে যায়নি, কারণ এখনো বাতাস বইছে। তার মানে বায়ুদেবী এখনো মুক্ত।

বাইরের শব্দটা থেমে গেলো। করিনের ক্ষমতালিপ্সায় হয়তো ঝরে পড়লো আরেকটা প্রাণ। অ্যারিনা ভেবে পায় না সব দেবতামরে সাফ হয়ে আর কতদিন লাগতে পারে। হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা ক্যাচক্যাচ শব্দে বোঝা গেলো কারাগারের দরজা খোলা হচ্ছে। আশেপাশের নিস্তব্ধতায় কারারক্ষীর হালকা পদশব্দও গমগম করে কানে বাজতে লাগলো।

এক, দুই, তিন… অ্যারিনা পদধ্বনি গুনতে লাগলো। কারারক্ষীটা কতদূর গেলো বের করতে পারলে বোঝা যাবে এবার কার পালা।
এগারো, বারো, তেরো… কাজটা অ্যারিনার খুবই অপছেন্দের। কিন্তু তক্তা পেটানোর মত শব্দটা ওর মাথা থেকে কিছুতেই যেতে চায় না।
উনিশ, বিশ… পদধ্বনি থেমে গেলো। বিশটা পদক্ষেপ, তার মানে সেলাসিয়ার সেলের কাছে যায়নি, তার আগেই থেমে গেছে। শেষবার যখন অ্যারিনা সমুদ্রদেবী সেলাসিয়াকে দেখেছিলো, তখন সেলাসিয়া দুমড়ে মুচড়ে মেঝের উপর পড়ে ছিলো। দেখে মনে হচ্ছিলো যেন সমুদ্রঝড়ের পর সাগরের ফেনা জমে আছে পাথুরে মেঝেতে। ওর ডান পা-টা ঠিক অ্যারিনার বাম হাতের মত লাগছিলো- ঠাণ্ডা, ধাতব আর প্রাণহীন। এবারের মত সেলেসিয়া বেচে গেলো ভেবে কিছুটা স্বস্তি পেলোঅ্যারিনা। তবে ওর বদলে অন্য কোনোদেবতা ঠিকই করিনের রোষানলে পড়তে যাচ্ছে।
অ্যারিনা ওর নকল ধাতব হাতটা মুঠো করতেই ওটার নাট-বল্টুগুলো শব্দ করে উঠলো। তারপরে সাবধানে যেন মেঝে বা দেয়ালে হাতের ছোঁয়া না লাগে সেভাবে একপাশে সরে গেলো।

আবার শোনা গেলো পদধ্বনি। তবে এবার দূরে সরে যাচ্ছে। কারো কাতরানি শোনা না গেলেও অ্যারিনা জানে কারারক্ষী একা ফিরে যায়নি। সম্ভবত ইয়ুনকে নিয়ে গেছে। কেমন একটা কষ্ট যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে চেপে ধরলো, ওর শেকলগুলোর চাইতেও বেশি জোর সে কষ্টের। বৃষ্টি দেবতা কি পারবে করিনের রোষের সামনে টিকতে? ওরা কেউ কি আদৌ পারবে?
আবারো বায়ুদেবীর ফিসফিসানি শোনা গেলো,‘আশা ছেড়ো না।’
‘আমরা সবাই এতোটা নির্বোধ কিভাবে হলাম? কিভাবে সবাই ধরা পড়লাম?’ অন্যান্য দেবতাদের মনেও প্রশ্নটা ছড়িয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে অ্যারিনা ওর ভালো হাতটা মেঝের স্যাতস্যেতে পাথরে চেপে ধরলো। প্রশ্নটা ওর মাথায় কেবলি ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ তেরো সপ্তাহ হলো ও এখানে বন্দী, একাকী, সঙ্গী শুধুমাত্র মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া শত শত কণ্ঠস্বর।

কেউ বলছে, ‘কেনো আপনি আমাদের উপর অসন্তুষ্ট হে দেবী। ফসলের মাঠ খালি, বন জঙ্গল সব বিরান হয়ে যাচ্ছে, আমাদের বাচ্চাকাচ্চারা সব না খেয়ে আছে। আমাদের কি অপরাধ হে দেবী? দয়া করুন! ক্ষমা করুন আমাদের!’
প্রতিদিন এরকম একই প্রার্থনা ওর কানে বেজেই চলেছে। কিন্তু ও কিছুই করতে পারছে না। দিনে দিনে তাই হতাশার পাহাড়ই জমেছে শুধু। ওর হাত ছাড়া, ঐ হাতের ক্ষমতা ছাড়া ও নিতান্তই অসহায় একজন, কিছুই ও করতে পারবে না। বন্দী জীবনের কষ্ট কিংবা আশেপাশের যন্ত্রনা, আর্তনাদ ও সইতে পারবে, কিন্তু ওর ফসলের মাঠ, বন-জঙ্গল সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে আর ও কিছু করে পারছে না, এই নপুংশক বোধ- কোনো কিছু জন্মদানে অক্ষমতার যে জ্বালা তা ওর সহ্য ক্ষমতার বাইরে।
ধৈর্য্য- বাতাসে যেনো ভেসে এলো শব্দটা।
‘ধৈর্য্য’- অ্যারিনা নিজেও একবার বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো। যতক্ষণ বায়ুদেবী লিয়ানার কণ্ঠ বাতাসে শোনা যাবে ততোক্ষণ আশা আছে।
কিছুক্ষণ পরেই প্রচণ্ড অবসাদ ভর করলো অ্যারিনার উপর। পাথুরে মেঝেতে কাত হয়ে কাঁদতে লাগলো ও।
মাথার ভিতর বেজেই চলেছে, ‘দয়া করুন দেবী, আমাদের রক্ষা করুন!’

২।
কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলো অ্যারিনা তা বলতে পারে না। কারারক্ষীর প্রচণ্ড ঝাকুনিতে ও জেগে উঠেছে। রক্ষীর হাতে ওর শেকলের শেষ প্রান্ত। রক্ষীর কপালের ঠিক মাঝখানে গোল একটা চোখ, আরেকটা চোয়ালের হাড্ডির নীচে প্রায় ঢাকা পড়েছে। তোবড়ানো নাকটা দেখে মনে হচ্ছে মাত্রই ওটাকে কেউ মুগুরপেটা করেছে, মুখের কাটা এত বড় যে চেহারা পুরো দুই ভাগ হয়ে গেছে। কেমন একটা ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে ওর শেকলটা ধরে টান দিলো।
অ্যারিনা হাচড়ে পাচড়ে উঠে দাঁড়ালো। কারাকক্ষের স্যাতস্যেতে গন্ধের সাথে দৈত্যটার নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ মিলে ওর নাকে ঢুকতেই পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। বৃষ্টির পরের বনের তাজা ঘ্রাণ বা পাহাড়ের খাদে জন্মানো বুনোফুলের সুবাস পাওয়ার জন্যে ওর মনটা আকুলি বিকুলি করে উঠলো ওর। এমনকি পথের ধারের ছত্রাক পড়া পচা কাঠের গন্ধ পেলেও এখন বর্তে যেতো। কিন্তু সে সুযোগ আর ও পাবে কিনা কে জানে।

কোনো কথা না বলে রক্ষীটা ওকে টেনে নিয়ে চললো। লোহার কড়ার ঘষায় গোড়ালিতে মনে হলো আগুন ধরে গেছে। দৈত্যটার ডান পা বেঢপভাবে বাকানো। ফলে ওটার কুৎসিত অবয়ব আরো বেশি কদাকার লাগছে। কিছুদূর পরপরই রক্ষীটা অ্যারিনার শেকল ধরে হ্যাচকা টান দিচ্ছে। প্রতিবারই হোচট খেতে খেতে সামলেছে অ্যারিনা। ওর মাথার আঙ্গুরলতার মুকুট ঝুলতে ঝুলতে ওর পিঠের কাছে এসে আটকে গেলো। ওটার মর্মর ধ্বনিতে আবারো অ্যারিনার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

‘কেনো তুমি করিনের পক্ষে কাজ করছ?’ অ্যারিনা জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলো না। ‘ওর নিজের ভাইদেরকে মারতে হাত কাপছে না। আর তোমাকে ছেড়ে দেবে মনে করো? কাজ ফুরালে তোমার পরিণতিও বেশি ভালো হবে না।’
রক্ষী কিছু না বলে ঘুরে অ্যারিনার দিকে ঝুকে এলো। ওটার বিশাল মাথাটা অ্যারিনার মাথা থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে এখন। দৈত্যটা মুখ খুললো, কালো মাড়ি আর হলদেটে কয়েকটা দাঁত ছাড়া মুখের ভিতর আর কিছুই নেই, জিহ্বাও না। ফলে একটা কাতর গোঙ্গানি ছাড়া আর কোনো শব্দইবেরুলো না মুখ দিয়ে। সাথে সাথেই ওটা ঘুরে আবার সামনে চলা শুরু করলো।
অ্যারিনা যতটা পারছে আস্তে এগুনোর চেস্টা করছে। গতবার যখন করিনের সাথে ওর দেখা হয়েছিলো, তখন করিন ওর বাম হাত কনুই থেকে কেটে রেখে দিয়েছিলো। সে কথা মনে হতেই অ্যারিনা ওর ধাতব হাতটা মুঠো করে ফেললো। হাত থেকে ঝরে পড়লো কিছু মসের অংশবিশেষ। অ্যারিনা ওর ক্ষমতা ফেরত না পেলে আর কখনই পৃথিবীতে মস জন্মাবে না। অগ্নি দেবতা করিনের সাথে তাই আর কখনো দেখা না হলেই বরং ও খুশি হয়।

ওর মাথার মধ্যে নানান প্রশ্ন আর মানুষের প্রার্থনা জট পাকিয়ে যাচ্ছে। অ্যারিনা সেসব ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো। ওকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে।
রুক্ষ পাথুরে মেঝেতে লেগে অ্যারিনার পায়ের তলা কেটে গেলো। ওর কক্ষটার মতোই চারপাশ কেমন নীরস আর নিরানন্দ। নিভু নিভু মশালগুলো জায়গাটাকে আরো বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন করে করে তুলেছে। পাথর কেটে বানানো বিশাল বিশাল দেয়ালের মাঝের সরু পথটা ধরে ওরা এগুচ্ছে। চিপা জায়গায় দৈত্যটাকে তাই প্রায়ই থেমে থেমে মোচড়া মুচড়ি করে তারপর এগুতে হচ্ছে। দেয়াল থেকে ভেসে আসছে ভ্যাপসা তাপ। মাটির ঠিক কত নীচে ওরা আছে তা অ্যারিনা আন্দাজ করার চেষ্টা করলো। ভূ-অভ্যন্তরের গলিত লাভা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল ইমারা। করিন কি ওকেও বন্দী করেছে? অ্যারিনা এখনো বন্দীশালায় অগ্নিদেবীকে দ্যাখেনি। কে জানে, হয়তো সব অগ্নি দেবতা আর উপদেবতাইএকজোট হয়ে করিনের পক্ষে কাজ করছে।
ফসলের দেবতা রেস্তানের সেলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অ্যারিনা দেখলো সে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। হাত মাথার উপরে শেকল দিয়ে বাধা। নিজের অর্ধাঙ্গকে দেখে অ্যারিনার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। সুর্যের মত উজ্জ্বল মুখটার মলিনতা দেখে অ্যারিনা কেমন ভয় পেয়ে গেলো। রেস্তানের পাথর নির্মিত কাধ কেমন ঝুলে পড়েছে। ওক পাতার দাড়ি এলোমেলো, নিস্তেজ হয়ে বুকের উপর ছড়িয়ে আছে। ডান পায়ের জায়গায় একটা মরচে পড়া ধাতব দণ্ড। দেখে অ্যারিনার বুকটা ফেটে যেতে লাগলো। ওর মত রেস্তানও সব প্রার্থনা শুনতে পায়, রেস্তানেরও ঠিক অ্যারিনার মতোই অসহায় বোধ হয়।

‘এসবের শেষ পরিনতি কি?’ অ্যারিনা ওর সমস্ত শক্তি এক করে প্রশ্নটা রেস্তানের মাথার মধ্যে অনুরনিত কয়ার চেষ্টা করলো।
একেবারে শেষ মুহুর্তে রেস্তান মাথা তুলে তাকালো, একেবারে অ্যারিনার চোখের দিকে। ‘আমাদের বিজয় হবেই। চক্র পুরণ হবেই। মহাপ্রভুর উপর বিশ্বাস রাখো।’ রেস্তানের গমগমে কণ্ঠস্বর অ্যারিনার মাথায় প্রতিধ্বনি তুললো। মুক্ত অবস্থায় রেস্তানের গলার স্বর শুনলে মনে হতো যেন পাহাড় ধ্বসে পাথর গড়িয়ে পড়ছে। এখন মনে হলো ঘোড়ার ঘুরের আঘাতে ছিটকে পড়া নুড়ি পাথরের আওয়াজের মত। বেখেয়ালে অ্যারিনার বা হাত দেয়ালের একটা বের হওয়া অংশে বাড়ি খেলো। ব্যাথায় চোখে সর্ষে ফুল দেখলো ও। আরো সতর্ক থাকতে হবে। মনে মনে ভাবলো অ্যারিনা।

পরের কক্ষটাও অন্ধকার। এডোরার স্বর্ণালী চুল এখন আর সুর্যের মত চারপাশ আলোকিত করতে পারে না। ওর অবস্থা নিশ্চয়ই খুব খারাপ।
অ্যারিনা ইয়ুনের কক্ষটাতে উকি দিলো। যা ভেবেছিলো তাই- খালি।
সেলাসিয়ার সেলের কাছে আসতেই অ্যারিনার পায়ে কাপুনি শুরু হয়ে গেলো। সেলের ভিতরে তাকাতে সাহস হলো না। আড়চোখে দেখলো পানির দেবী দেয়ালের সাথে বাধা অবস্থায় অস্থিরভাবে নাড়াচাড়া করছে আর ওর দোমড়ানো ধাতব পাটা মেঝেতে ঘষা খেয়ে শব্দ করছে। ওর স্বচ্ছ নীল চোখ ভরা এখন কালো পানির অতল অন্ধকার, মাথার চুল অশান্ত সমুদ্রের মতোই অবিন্যস্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে। অ্যারিনাকে এখতে পেয়ে সেলাসিয়া আরো অস্থির হয়ে গেলো।

‘মহাপ্রভুআমাদের ভুলেই গেছেন’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেচিয়ে উঠলো সেলাসিয়া। বিচিত্র সব সামুদ্রিক আগাছা ওর গা বেয়ে ঝুলছে। মাথা নাড়তেই চুলে বাধা অসঙ্খ্য শামুক আর ঝিনুকের খোলস বাড়ি খেয়ে রিনঝিন করে উঠলো। ‘কেউ আর আমাদের বাচাতে পারবে না। মহাপ্রভুআমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছে।’
‘এখনো অনেক দেবতাই বেচে আছে। ধৈর্য্য ধরো।’ অ্যারিনা চেষ্টা করলো সেলাসিয়ার মনে মনে কথাগুলো বলতে, কিন্তু পারলো না।

‘মহাপ্রভুআমাদের উপর নারাজ হয়েছেন। তাই আমাদেরকে রেখে চলে গেছেন।’ অন্ধকারে সমুদ্র দেবীর খনখনে গলার হাসি শোনা গেলো। ধাতব পা-টা মেঝেতে আছড়ে আরো ভয়ানক শব্দ করা শুরু করলো সেলাসিয়া।
রক্ষী নিরাসক্ত ভঙ্গিতে অ্যারিনাকে টেনে নিয়ে গেলো। একটু পর একটা মোটা লোহার দরজা পেরিয়ে এলো ওরা। তার পরেই দেখা গেলো পাথর কেটে বানানো একটা পেচানো সিড়িপথ। অ্যারিনা ওর ধাতব হাতটা বাচিয়ে সাবধানে উঠতে লাগলো। করিন ওর কাছে আর কি চায়? অ্যারিনার কেমন দুর্বল লাগছে এখন। সেলাসিয়ার কথাগুলো কানে বাজছে শুধু।

‘আত্মার রক্ষাকারীর ইচ্ছায় তোমার জন্ম হে ফসলের দেবী। যাও, পৃথিবীর যা কিছু সবুজ আর বর্ধনশীল সেসবের যত্ন নাও। তোমাকে মৃতকে জীবিত করার শক্তি দেয়া হয়েছে। সাবধানে আর বুদ্ধি খাটিয়ে সেই ক্ষমতা ব্যবহার কোরো। একদিন সবাইকে মহাপ্রভুকাছে ফিরে আসতে হবে। সময় হলে সব জিনিসই তার পরিণতি ভোগ করবে।’ স্রষ্টার কথাগুলো আবার অ্যারিনার মনে পড়লো। হয়তো সেলাসিয়ার কথাই ঠিক। মহাপ্রভুওদের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন।

দৈত্যটা অ্যারিনাকে টানতে টানতে একটা বিশাল ঘরে নিয়ে এলো। এ ঘরের দেয়াল আর মেঝে দুটোই মসৃণ। চারপাশে মোমবাতি আর চেরাগের ছড়াছড়ি। সেগুলো থেকে বেরুনো একটা ঝাঝালো গন্ধে ঘরটা ভরপুর। ঘাড়ে একটা আচমকা ধাক্কা দিয়ে রক্ষী ওকে মেঝেতে ফেলে দিলো। সাথে ওর শেকলের প্রান্তটাও। তারপর ঘোঁতঘোঁত করতে করতে বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরই ওটার ভারী পদক্ষেপ মিলিয়ে গেলো।

অ্যারিনার পা শেকলে জড়াজড়ি হয়ে জট পাকিয়ে গেছে। পড়ার সময় পতন ঠেকাতে গিয়ে হাত আর হাটুতে চোট লেগেছে। মসৃণ মেঝেটাতে ধাতব হাতটার ঘষড়ানোর আওয়াজে ওর মেরুদণ্ড বেয়ে একটা ঠাণ্ডা শিরশিরানি নেমে গেলো। সাথেও ব্যাথাও।
‘অহঙ্কার নাকি পতনের মূল!’ করিনের আত্মতৃপ্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। কিন্তু অগ্নিদেবকে আশে পাশে কোথাও দেখা গেলো না।

অ্যারিনা উঠে দাড়িয়ে জবাব দিলো, ‘এ যে দেখছি ভূতের মুখে রাম নাম!’
‘ভালোইতো তেজ দেখি তোমার, ফসলে দেবী।’ ব্যঙ্গ করে বললো করিন। অ্যারিনার বাম কাধের উপর থেকে স্বরটা ভেসে এলো।

কাপুরুষটা চাইলে ওর মুখ দেখাবে কিন্তু অ্যারিনা নিজে থেকে ওর দিকে তাকাবে না বলে ঠিক করলো। তাই সেদিকে না তাকিয়েই অ্যারিনা বললো, ‘কি চাও তুমি করিন? আমার হাত তো কেটে নিয়েছোই। আমার আর দেওয়ার মতো কিছু নেই।’
‘তোমার কাছ থেকে এমন কর্কশ ব্যবহার পেয়ে আমি সত্যিই খুব অবাক হলাম ফসলের রাণী। আমিতো জানতাম অভাবী বা আর্তের ইচ্ছা পূরণে তুমি সর্বদাই সাড়া দাও।’ তারপর একটা ছোট বাচ্চা মেয়ের কণ্ঠ নকল করে করিন বললো, ‘দয়া করুন দেবী, সাহায্য করুন।’

অ্যারিনা জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেলো।
করিন তা দেখে হিসহিসিয়ে উঠলো, ‘তোমার পতন কেউ ঠেকাতে পারবে না।’
হঠাৎ করিনের সামনের চেরাগের আলো নিভে গেলো আর তা থেকে গলগল করে কালো ধোয়া বেরিয়ে একটা মানুষের অবয়ব নিলো।
লিয়ানার ফিসফিসানি অ্যারিনাকে সাহস জোগালো, ‘প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে হবে। মহাপ্রভুআমাদের সাথেই আছেন।’ কিন্তু তারপরেও করিনের দেহ পূর্ণ আকৃতি পেতেই ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।

করিন দেখতে বেশ সুদর্শন ছিলো। কিন্তু এখন ওকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো পাগলা পুতুল নির্মাতার হাতে সেলাই হওয়া একটা পুতুল। বিভিন্ন পুতুল থেকে হাত পা খুলে খুলে যেন ওকে বানানো হয়েছে। ওর বাম হাতের জায়গায় অ্যারিনার বাম হাত লাগানো। হাতের মাঝ বরাবর একটা দগদগে ক্ষত। একটা চিকন সবুজ সাপ কনুই থেকে পেচিয়ে হাত বেয়ে আঙ্গুল পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। নিজের হাতের শূন্যতা অনুভব করে অ্যারিনার ধাতব হাতটা আবারো মুঠো হয়ে গেলো। নিজের হাতে সাপটার সজীব স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করলো খুব। করিনের পা দুটো কারারক্ষীর পা দুটোর মতোই এলোমেলো। একটা গাছের গুড়ির মত মোটা আর আঙ্গুরলতা দিয়ে ঘেরা। অন্যটা সরু আর মেয়েলি। সেটার চকচকে চামড়া থেকে সমুদ্র তারা ঝুলছে। এডোরার সোনালি কেশদাম ওর কাধ বেয়ে নেমে গেছে। আর ইয়ুনের ডান হাত এক ফালি কাপড় দিয়ে ওর বুকের সাথে বাধা। ওটায় বরফের কুচি লেগে আছে- আলো পড়ে ঝিলিক দিচ্ছে। করিনের ডান চোখ বিকারগ্রস্তের মত জ্বলজ্বল করছে আর বাম চোখ পুড়ে নিঃশেষ হওয়া কয়লার মতোই কালো।

জীবনে প্রথমবারের মত অ্যারিনা সত্যিকার ভয়ের স্বাদ অনুভব করলো। কোন ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে কেউ বেপরয়াভাবে সাহায্য প্রার্থনা করে সে কথাও ও বুঝতে পারলো। ‘নিজের এ কি অবস্থা করেছ করিন?’
করিন একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলো, তবে সেটা হাসির চেয়ে ভেংচি বলেই মনে হলো বেশি। মৃত চোখ বাদে মুখের বাকিটা সম্ভবত করিনের নিজের-ই। তবে অ্যারিনা নিশ্চিত হতে পারলো না। ‘আমি নিজেকে পুনঃনির্মাণ করেছি বলতে পারো। আমার আগে কেউ যা করার সাহস করেনি। শীঘ্রই সব দেবতার শক্তি একসাথে একজনের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। যেরকমটা হওয়া উচিৎ ছিলো শুরু থেকেই।’
অ্যারিনা ওর হাটুতে আর জোর পেলো না। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। সেলাসিয়ার কথাই ঠিক। মহাপ্রভুওদের উপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন।

করিনও হাঁটু গেড়ে ওর পাশে বসলো। তারপর অ্যারিনার কাটা হাত দিয়েই অ্যারিনার গাল স্পর্শ করে বললো, ‘তুমিতো জানোই যে আমি একজন যুক্তিবাদী লোক। আমাকে সাহায্য করো, তাহলে তোমাকে আর এতো কষ্ট করতে হবে না। মুক্ত থাকবে তুমি, নরম বিছানা, চাকর-বাকর সব পাবে।’

নিজের হাতের স্পর্শে অ্যারিনার নিজের মধ্যে সেই আগের সঞ্জীবনী শক্তি অনুভব করলো। উষ্ণ আঙ্গুলগুলোর ছোয়ায় ওর মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো যেন। করিন থামলো না। হাতটা এবার উঠে গেলো মাথায়, তারপর ধীরে ধীরে চুল বেয়ে নামতে লাগলো নীচে। হাতের ছোয়ায় মৃত আঙ্গুরলতায় প্রাণ ফিরলো আবার। বেগুনি রঙের ফুল ফুটিয়ে আবার অ্যারিনার মুকুট হয়ে মাথায় সেটে থাকলো। করিন অ্যারিনার কাধ স্পর্শ করতেই সেখানে জমা মৃত মসগুলো আবার জ্যান্ত হয়ে উঠলো।
‘কি চাও তুমি আমার কাছে?’ অ্যারিনার কণ্ঠে আগে দৃঢ়তা আর নেই। হায় মহাপ্রভুকেনো আমাদের ছেড়ে গেলেন! মনে মনে ভাবলো ও।
‘স্তাবান কোথায় লুকিয়ে আছে আমাকে সেটা বলে দাও।’
অ্যারিনা আবারো করিনের এলোমেলো শরীরটা যাচাই করলো। না সেখানে আকাশ দেবতা স্তাবান বা অগ্নিদেবী ইমারার কোনো খণ্ডাংশ নেই।
‘আশা ছেড়ো না’, বাতাস দেবীর কণ্ঠ আবারো বাজলো কানে। এখনো হয়তো সুযোগ আছে।

‘বলো ও কোথায়।’ করিন আবার বললো। তবে এবার ওর মুখটা আর নরম নেই, কেমন কঠোর দেখাচ্ছে। করিন আস্তে ইয়ুনের হাত থেকে কাপড়ের ফালিটা খুলে ফেললো, তারপর বৃষ্টি দেবতার হাত দিয়ে অ্যারিনার গাল স্পর্শ করলো। ঠাণ্ডা হাতটা মনে হলো ওর চামড়া ঝলসে দিচ্ছে।
‘আমি জানি না।’ কোনোমতে বললো অ্যারিনা।
‘কিভাবে বুঝবো যে তুমি মিথ্যে বলছ না?’
অ্যারিনা ওর হাত আরো জোরে মুঠি করলো, মুখে কিছু বললো না। মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিলো, ‘মহাপ্রভুএর উপর ভরসা রাখো।’
‘চন্দ্র দেবতা কোথায় লুকিয়ে আছে বলো আমাকে।’

‘আমি জানিনা। ইমারা কোথায় আছে সেটাও আমি জানিনা। খামাখা সে প্রশ্নটা আমাকে না করলেও চলবে।’ আগের চেয়ে জোর দিয়ে বললো অ্যারিনা।
করিন মুখ টিপে হাসলো। তারপর ওর মৃত চোখটা টিপ দিয়ে বললো, ‘আমি জানি কোথায় ওই ডাইনী লুকিয়ে আছে। ও সব জায়গায় আছে, আবার কোথাও নেই। মহাপ্রভুএর কাছেই ফিরে গেছে আবার। বেচারির সময় ফুরিয়ে এসেছিলো। তবে মরার আগে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়ে গেছে।’ উত্তেজনায় মনে হলো করিনের লাল হয়ে যাওয়া চোখটা যেন ঠিকরে বের হয়ে যাবে।

অ্যারিনার বুকটা আবারো হতাশায় ভরে গেলো। আবারো উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না।
‘এমনকি তোমার জাদুর স্পর্শেও কোনো দেবতাকে মৃত থেকে জীবিত করা সম্ভব না। যাই হোক, কেউ না কেউ তো মুখ খুলবেই। তোমাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি তোমাদের মধ্যেই কেউ আমাকে আকাশ দেবতার খোজ ঠিকই দেবে। স্বয়ং মহাপ্রভুও আমাকে আটকাতে পারবে না।’

তবে করিনের কণ্ঠের কঠোরতা ওর চোখের অস্থিরতাকে চাপা দিতে পারলো না।অ্যারিনা কোনো জবাব দিলো না। দীর্ঘ কয়েক সেকেন্ড নীরবেই কেটে গেলো। করিনের নিস্পলক অগ্নি দৃষ্টি অ্যারিনার আর সহ্য হচ্ছে না।
শেষমেষ করিন-ই মুখ খুললো, ‘তবে তাই হোক!’ ও আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই ওর সমুদ্রদেবীর পা-টা নীচের দিকে বেকে গেলো। বিদ্যুতের গতিতে করিন উল্টো দিকে ঝাপিয়ে নিজেকে সামলালো, তারপর ধোয়া হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গেলো। ঘরের সবগুলো বাতির শিখা কেপে উঠলো। ‘রাইসান, ওকে আটকাও।’ যেনো আশেপাশের সব জায়গা থেকে ভেসে এলো করিনের স্বর।
সাথে সাথে দড়াম করে ঘরের দরজা খুলে গেলো আর দৈত্যটা আশ্চর্য দ্রুততায় অ্যারিনার দিকে এগিয়ে এলো। অ্যারিনা ওর এগিয়ে আসার পদশব্দও শুনতে পায়নি। একটা শব্দ না করে রাইসান অ্যারিনার শেকল তুলে নিয়ে এক ঝটকায় ওকে নিজের কাধে তুলে নিলো।

আরিনাও বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলো না। কর্কশ স্বরে করিন তখনও বলেই চলেছে, ‘ওকে আটকাও রাইসান, ওকে আটকাও।’ বন্দীশালার পুরু লোহার দরজাটা পা হওয়ার আগ পর্যন্ত তা থামলো না। সেলাসিয়ার সেলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অ্যারিনা দেখলো, সমুদ্রদেবীর ধাতব পা-টা নিজে গলায় পেচানো। শ্বাসরোধ হওয়ার কারণে সেলাসিয়ার নীল শরীরটা বেগুনি হয়ে গেছে।
রাইসান অ্যারিনাকে ওর সেলে ফেলে শেকলটা মাথার উপর জায়গা মত লাগিয়ে ধুপধাপ করে চলে গেলো।

কয়েক মুহূর্ত পরেই বন্দীশালার নীরবতা চিরে সেলাসিয়ার তীক্ষ্ণ কণ্ঠের আর্তনাদ শোনা গেলো। ‘মরবি তুই। এসবের পরিণতি তোর ভালো হবে না। যমে তোকে ছাড়বে না।’ তারপরই হঠাৎ যেমন শুরু হয়েছিলো তেমনি ওর কণ্ঠ থেমে গেলো। শেকলের ঝনঝনানি আর রাইসানের পদশব্দও একটু পর মিলিয়ে গেলো।
তারপর আবার নীরবতা নামলো চারপাশে। অ্যারিনার মাথার ভিতর প্রার্থনা বেজেই চলছে। কিন্তু সেসবের জবাব দেয়ার ক্ষমতা ওর আর নেই। ও মরে গেলে কে এদেরকে দেখবে? অ্যারিনা পাথুরে দেয়ালটা ধরে উঠে বসে প্রার্থনা করতে লাগলো। মহাপ্রভুনিশ্চয়ই ওদেরকে এভাবে করিনের হাতে মরার জন্যে ছেড়ে চলে যাবেন না।
‘রেস্তান?’ মৃদুস্বরে ডাকলো অ্যারিনা। মনে মনে কথা বলার মত শক্তি ওর আর অবশিষ্ট নেই।
‘বলো প্রিয়তমা।’
অ্যারিনার বলার অনেক কিছুই ছিলো, কিন্তু কি বলবে ভেবে পেলো না। শুধু বললো, ‘এখন কি হবে?’

বাইরে কোথাও স্তাবান লুকিয়ে আছে আর অপেক্ষাকৃত নিম্ন শ্রেণীর দেবতাদের সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওদের একমাত্র আশা এখন এটাই। স্তাবান যদি করিনের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারে।
কষ্ট করে শ্বাস নিতে নিতে রেস্তান বললো, ‘মহাপ্রভুএর উপর ভরসা রাখো, সোনা। চোখ কান খোলা রাখো। চক্র পূরণের সময় হয়ে এসেছে।’
অ্যারিনার কিছুই বলার নেই। যেটুকু শক্তি ছিলো সেটুকু দিয়ে ও সেলাসিয়ার মনে মনে কথা বলার চেষ্টা করলো, কিন্তু ওকে কোথাও খুজে পেলো না। সমুদ্রদেবী হয় ঘুমিয়েছে নাহয় অচেতন হয়ে পড়ে আছে।
‘চক্র পূরণের সময় হয়ে এসেছে’ রেস্তানের গমগমে কণ্ঠটা আবার শোনা গেলো। তারপরেই অ্যারিনা অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়লো।

৩।
অ্যারিনা! বায়ুদেবীর মোলায়েম কণ্ঠস্বর শুনে অ্যারিনা চোখ মেললো। ‘জীবনের জননী! ফসলের দেবী?’
অ্যারিনা বহু কষ্টে ভালো ডান হাতটা দিয়ে দেয়াল বেয়ে উঠে দাঁড়ালো। ‘বলো লিয়ানা, আমি শুনতে পাচ্ছি।’
‘দেবী, আমার মালিক স্তাবান মহাপ্রভুর কাছে ফিরে গেছেন।’
‘নাআআ…সে ছিলো আমাদের একমাত্র ভরসা।’ চিৎকার করে কেদে উঠলো অ্যারিনা। সামলাতে গিয়ে হিক্কা উঠতে লাগলো।
‘আশা হারাবেন না। মহাপ্রভুই আমাদের ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল। আগুনের সাথে লড়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। মহাপ্রভুর উপর আস্থা রাখুন’
কথাগুলো অ্যারিনার গাল ছুয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেলো।

‘রেস্তান? সেলাসিয়া?’ অন্ধকারে চিৎকার করে ডাকলো অ্যারিনা। কিন্তু কেউ জবাব দিলো না। এমনকি মাথার ভিতর আর কোনো প্রার্থনাও শোনা যাচ্ছে না। পৃথিবী কি তাহলে ধ্বংস হয়েই গেলো? দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ওর।
ফসলের দেবী এখনো বেচে তবে একেবারে একা। বন্দী অন্যান্য দেবতারা তাও এতোদিন ছিলো এখন স্মৃতি ছাড়া ওর সঙ্গী আর কেউ নেই। এডোরার উষ্ণ রোদের কথা মনে পড়লো অ্যারিনার, সমস্ত জ্যান্ত জিনিসের প্রাণসুধা ছিলো তা। ইয়ুনের কথা মনে পড়লো। বসন্তের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি কিংবা গ্রীষ্মের কালবৈশাখী দুটোই ধূসর জমিনে এনে দিতো সবুজের শ্যামলতা। দেবতাদের ছাড়া পৃথিবী টিকবে কিভাবে?
ওর সেদিনের কথা মনে পড়লো। সেই ভয়াবহ দিনটার কথা। ছোট্ট মেয়েটা আর মুমূর্ষু বৃদ্ধটার কথা মনে পড়লো। ‘দয়া করুন দেবী! পৃথিবীতে ইনি ছাড়া আর কেউ নেই। দয়া করে এনাকে বাচান।’ মেয়েটা কাদতে কাদতে বলেছিল কথাটা। অ্যারিনা সাহায্যের জন্যে বৃদ্ধের হাতটা ধরলো আর হাতের সাপটা বৃদ্ধটাকে পেচিয়ে ধরলো। কিন্তু বৃদ্ধের দেহে জাদু করার আগেই একটা আলোর ঝলক এসে ওকে অন্ধ করে দিলো আর বাচ্চা মেয়েটার ঠোটে দেখা গেলো একটা শয়তানি হাসি। যেনো অ্যারিনাকে ভেঙ্গাচ্ছে।

অ্যারিনার মাথার ভিতর বাচ্চা মেয়েটার প্রতিচ্ছবি মুছে গিয়ে সেটা করিনের বিকৃত দেহে রূপ নিলো। সমুদ্র দেবীর পা বেকে ও পড়ে যাচ্ছে আর চিৎকার করছে, ‘ওকে আটকাও রাইসান, ওকে আটকাও।’
মনের চোখে দেখতে পেলো সেলাসিয়ার ধাতব পা-টা ও গলায় চেপে বসছে আর সুন্দর মুখটা বেগুনি হয়ে যাচ্ছে। ‘যমে তোকে ছাড়বে না।’ সেলাসিয়ার চিৎকারটাও মনে পড়লো।

হঠাৎ ঝড়ের মতোই একটা চিন্তা ওর মাথায় ভর করলো। ‘আমাদেরকেইচক্র পূরণ করতে হবে।’ বিড়বিড় করে নিজেকে শোনালো ও। ‘একদিন সবাইকে মহাপ্রভুরকাছে ফিরে আসতে হবে। সময় হলে সব জিনিসই তার পরিণতি ভোগ করবে।’ তারপর মহাপ্রভুর কাছে শক্তির জন্যে প্রার্থনা শুরু করলো।
আরো একবার ও অন্য দেবতাদের সাথে মনে মনে কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু কারো সাড়া পাওয়া গেলো না। তারপর নকল হাতটার আঙ্গুলগুলো ধরে ভালো হাতটা দিয়ে সজোরে টানতে লাগলো। উদ্দেশ্য হাতটা খুলে ফেলবে কিন্তু পারলো না। উল্টো ব্যাথায় চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করলো।
চিৎকার করতে করতে অ্যারিনা সর্বশক্তিতে হাতটা দেয়ালের গায়ে আছড়াতে লাগলো। অন্যান্য কারাকক্ষের বন্দীরা নড়েচড়ে উঠলো। বাইরের প্রহরীদের পদশব্দও থেমে গেলো।

‘একদিন সবাইকে মহাপ্রভুকাছে ফিরে আসতে হবে। সময় হলে সব জিনিসই তার পরিণতি ভোগ করবে।’ অ্যারিনা হাত আছড়ানোর ফাকে ফাকে কথাটা চেচিয়ে বলতে লাগলো। যেন বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিবার হাতটা দেয়ালে বাড়ি দিতেই মনে হচ্ছিলো কেউ যেন ওর মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করছে। কিন্তু ও থামলো না। কিন্তু হাতের কোনো ক্ষতিই হলো না। তাই ওটা বাদ দিয়ে অ্যারিনা ওর শেকল ধরে দেয়াল বেয়ে ওঠা শুরু করলো।
‘যমে তোকে ছাড়বে না’ সেলাসিয়ার কণ্ঠও শোনা গেলো আবার। ওর কক্ষ থেকেও শেকলের ঝনঝনানি ভেসে আসছে।
করিনের ক্রুদ্ধ গর্জন বন্দীশালায় ভেসে এলো। মশালগুলো সব কেপে কেপে নিভে গেলো।

‘চক্রটা পুরন করো’ চেচামেচির মাঝেও এক মুহুর্তের জন্যে এডোরার নরম কণ্ঠটা শোনা গেলো। তারপরেই এডোরা আর সেলাসিয়ার জীবন প্রদীপ নিভে গেলো।
করিনের চিৎকারের মাত্রাও কমে গেলো আর রাইসান সজোরে বন্দীশালার দরজা টেনে খুললো। পাথুরে দেয়ালগুলো সব কেপে উঠলো।
‘মহাপ্রভুর কাছে আবার আমাদের দেখা হবে।’ রেস্তানের কণ্ঠ শুনতে পেলো অ্যারিনা। তারপরেই রেস্তান আর ইয়ুন মারা গেলো।

শেকল ধরে উঠতে উঠতে অ্যারিনার হাত কাপতে লাগলো। রাইসান কাছেই চলে এসেছে। অ্যারিনা বহু কষ্টে একটা শেকল নিজের গলায় পেচিয়ে নিলো। তারপর নিজেকে ছেড়ে দিলো। অবশ্য ওর দুর্বল শরীর আর ধরেও রাখতে পারতো না।

দেবতারা যেদিন পৃথিবীটা নতুন করে গঠন করলো সেদিন চারদিকে ছিলো আগুন আর পানির ছড়াছড়ি। পাহাড়গুলো যেনো সব জেগে উঠেছিলো। ওগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে ভিতরের তরল আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। সবুজ শ্যামল মাঠ প্রান্তর সেই আগুনে বিরান হয়ে গেলো। সাগর ফুসে উঠে সমগ্র মহাদেশগুলোকেই বিলীন করে দিলো। স্বর্গের পবিত্র আত্মারাও সেদিন কোনো সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। যে কজন এই প্রলয় থেকে বেচে গিয়েছিলো তাদের ভাষ্যমতে পৃথিবীতে সেদিন অগুনিত ভূমিকম্প হয়েছিলো। তাদের মুখ থেকেই আস্তে আস্তে লোকগাথা ছড়িয়ে পড়লো। তারা এই দিনটার নাম দিয়েছিলো ‘পৃথিবী উল্টানোর দিন’। কিন্তু মহাপ্রভু সর্বশক্তিমান। তিনিই দেবতাদের রোষানল থেকে পৃথিবীকে বাচিয়েছেন। মহাপ্রভুর উপর ভরসা রাখো আর চক্র পুরণের দিকে খেয়াল রাখো। তিনিই সবাইকে রক্ষা করবেন।

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত