উজ্জ্বল চন্দ্রের অস্বচ্ছ আলোয় ফেনলকের ঘন অরন্যটা ভেসে যাচ্ছে। গাছপালার ফাকফোকরে উঁকি দেয়া চাঁদটাকে কেমন হিংস্র শ্বাপদের ভয়ংকর চোখ বলে ভ্রম হয়। এর সাথে যোগ হয়েছে তীব্র কুয়াশার বিস্তৃত চাদর, পুরো অরন্যটাকে সিক্ত করে রেখেছে। এখানে সেখানে ভেজা সবুজ শ্যাওলার ঝাড়। হঠাৎ ফিসফিসানি কিংবা অস্বস্তিকর শব্দ রাতের নিঃশব্দ নিরবতার গায়ে কাটা ফোটায় যেন। তবে এই অশুভ শব্দ শোনার মত কখনও কেউ থাকেনা আশেপাশে। এই ফেনলক অরন্যের গল্পগাথা আশেপাশের জনপদের অধিবাসী সকলেরই জানা। শুধু তাই নয় দুরবর্তী নগর রাজ্যেও এর কেচ্ছা-কাহিনী মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। ছায়াশ্বাপদ আর অজানা ভয়ের আশঙ্কায় সকলেই বরাবরই এড়িয়ে চলে এই জায়গাটা। আশেপাশে বাস করা শিশুদের ছোট থেকেই শেখানো হয় যেন এখানে প্রবেশ না করে। অন্ধকার নামার সাথে সাথে ভূতুরে রূপ ধারণ করে এ অরন্য। চারপাশ হয়ে ওঠে নিরব নিস্তব্ধ। কস্মিনকালেও এ সময়ে অরন্যে কেউ ঘোরাফেরা করেছে বলে শোনা যায় নি। তবে আজই ব্যতিক্রম ঘটল। মধ্যবয়সী এক মহিলা জঙ্গলের ঝোপালো পথটা ধরে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। একটু পর পরই চকিত চোখে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে আশপাশটা। চোখে তার আশঙ্কা। মৃদু জোছনায় তার নিঃশ্বাসে জমে ওঠা বাষ্প স্পষ্ট অবলোকন করা যায়। লম্বা আলখাল্লার নিচে মহিলার ঘন কালো চুল আবছাভাবে দোল খাচ্ছে। তার পুরুষ্ঠ লাল ঠোঁটদ্বয় গায়ের উজ্জ্বলতার সাথে চমৎকার মানিয়ে গিয়েছে। তার সবুজ সতেজ চোখগুলোতে স্পষ্ট ভয়। তার হাতে আগলে রাখা ছোটখাট পোটলাটার জন্য ভয়। মৃদু নাক ডাকার একটা শব্দ ভেসে আসছে সেখান থেকে। পোটলার ঝুলে থাকা কাপড়টা একটু সরিয়ে মহিলাটা তার মেয়ের ছোট গোলাপী মুখটার দিকে তাকাল। গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে শিশুটি, ছোট হাতের মুষ্টিগুলো সে চিবুকে গুজে রেখেছে। তার নিঃশ্বাসের সাথে ক্ষুদ্র এক প্রস্থ জলীয় বাষ্প বেরিয়ে আসে। ঠোঁটের নিচে গোল একটা বৃত্তের মত জন্মদাগ চোখে পড়ে। মহিলাটি ছোট মেয়েটির চিবুকে হাত রেখে একটু হাসার চেষ্টা করল। এরপর ভালভাবে পোটলাটা একটু রক্ষাকারী ভঙ্গিতে জড়িয়ে রাখল। বাচ্চাটি একটু অস্থিরভাবে নড়াচড়া করতেই মহিলাটি আরো ভালভাবে বাচ্চাটির মুখসহ সারা শরীর আবৃত করে ফেলল। এরপর আবার আশেপাশে চকিত দৃষ্টি মেলে দ্রুত পায়ে চলা শুরু করল। একটা পাথুরে পথে আসতেই তার পদক্ষেপ হয়ে উঠল আরও দ্রুততর। এই পথটাই খুঁজছিল সে। পাক খাওয়া রাস্তাটি অনেক মোড় ঘুরে একেবেকে এই প্রাচীন অরন্যের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে। অবশেষে মহিলাটি গোলাকার একটা প্রান্তে এসে থামল। আশেপাশে মরীচিকার মত বড় বড় গাছগুলো কৃষ্ণকালো রূপ পেয়েছে। পলাতক ব্যক্তির মত যেন অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়েছে সেগুলো। মহিলাটি বাচ্চাটির মা, যে অন্যদের মত তার শিশুটির প্রতি আশা হারিয়ে ফেলে নি। শিশুটির জন্ম হয়েছে দ্বিতীয় পূর্ণচন্দ্রের দিন।
কথিত আছে বছরের প্রত্যেক দ্বিতীয় চন্দ্রের সময়ে জন্ম নেয়া শিশুরা বিশেষ স্পিরিটদের আশীর্বাদপুষ্ট। এদের চারপাশে অদ্ভূত অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটে। জনপদের মানুষগুলো ভয় পায় এমন বাচ্চাদের। তারা যখন বাচ্চাটিকে নিয়ে নিতে চাইল মহিলাটি অবশ্যই তা হতে দেয়নি। সে তাদেরকে তার বাচ্চাকে নিয়ে যেতে দিতে পারেনা। নিতে দেয়ও নি। রাগান্বিত কোলাহল আর উপর্যুপরি ফেলা আলোর মধ্যেই সে রাতের আধারে পালিয়ে আসে বাচ্চাটিকে নিয়ে।
গোলাকার জায়গাটার মাঝামাঝি শক্ত পাথরটার দিকে এগিয়ে গেল সে। এরপর বাচ্চাটাকে পাথরের উপর সোজা করে রেখে হাঁটু গেড়ে বসল। তার গলায় বাধা ক্রস দুই হাতের মধ্যে চেপে ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনা শুরু করে দিল। প্রার্থনার মাঝেই সামনে পিছনে দুলতে দুলতে তার চোখ বেয়ে নেমে এল দুর্বোধ্য জলধারা। কোলাহলের শব্দটা কাছাকাছি শোনা যেতেই তার কান্নার দমকটা বেড়ে গেল। হাপাতে শুরু করল সে, কিন্তু প্রার্থনা থামল না। পাথরে রাখা পোটলাটার উপর তার হাতটা আলিঙ্গনবদ্ধ করে রাখল। ফিসফিস করে বলল, ‘আমি আমার মেয়েকে ওদের হাতে তুলে দিব না।’
মুহুর্তের মধ্যে ক্রোধান্বিত মানুষে আঙ্গিনাটা ভরে গেল। তাদের হাতে ভয়ালদর্শন হাতে তৈরি অস্ত্র, চিৎকার করছে সবাই। বাতাসের মৃদু শীস আর ভারী একটা শব্দ মহিলাটাকে নিশ্চুপ করে দিল। শেষবারের মত হালকা কাতরধ্বনি করে সে ঢলে পড়ল। কাতরতা মিশ্রিত দৃষ্টি নিয়ে শেষবারের মত তাকাল উপরের দিকে। আর তখনই অদ্ভূত কান্ডটা ঘটল। উজ্জ্বল জ্যোতিময় একটা আলোকধারা কোত্থেকে যেন উপস্থিত হয়ে আঙ্গিনাটা আলোকিত করে দিল। এই মোহময় দৃশ্য দেখে মহিলাটি মাটিতে মাথা ঠেকাল। এরপর ধীরে ধীরে তার চোখটা বন্ধ হয়ে গেল। চিরদিনের জন্য। মারা গেছে সে। রক্তের ক্ষীণ ধারা মুহুর্তেই ভাসিয়ে দিল তাকে, একটা তীর গেঁথে আছে তার পিছনে। লোকটা তার ধনুক ফেলে হাঁটুগেড়ে মহিলাটির সামনে বসে পড়ল।
লোকগুলো হতবাক হয়ে সামনের উজ্জ্বল আলোকরশ্মির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। মনে হল আলোকরশ্মিটা কিছুক্ষণের জন্য মহিলাটির পাশে বসল। এরপর যেন উঠে এগিয়ে গেল ধনুক ফেলে বসে পড়া মানুষটার দিকে। আলোকধারাটা লোকটার কাছাকাছি গিয়ে অজানা ভাষায় কি যেন বলল ফিসফিস করে। মানুষগুলো কিছুই বুঝতে পারল না। এরপর হঠাৎই আলোটা উজ্জ্বল হতে শুরু করল, এতটাই উজ্জ্বল যে আশপাশটা দিনের আলোর মত ফকফকা হয়ে গেল। এরপরই সব অন্ধকার। চলে গেছে আলোটা। ছোট শিশুটি আর তার মা, এদেরকেও আর দেখা গেল না। আর কখনও এদেরকে দেখাও যায় নি। দ্বিতীয় পূর্ণচন্দ্রে জন্ম নেয়া কোন শিশুর কথাও এরপর আর শোনা যায় নি।
পরবর্তীতে প্রাঙ্গনে থাকা লোকগুলো তীরন্দাজ লোকটাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আলোটা তার কানে কি বলে গেছে। সে কিছুটা গম্ভীর হয়ে সেই কথাগুলোর পুণরাবৃত্তি করেছে, ‘আমি কখনোই তোমাদেরকে আমার সন্তানকে নিতে দেব না। মনে রেখ সে চন্দ্রকন্যা, দ্য ডটার অভ মুন!’
……………………………………………………………….সমাপ্ত………………………………………………………………