ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টে জানালার পাশে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম আমি আর জর্জ। জর্জ আনমনে বাইরে তাকিয়ে আছে। ‘অনেকটা তোমার মতোই এক লোককে চিনতাম আমি।’ নীরবতা ভেঙে বলে উঠল ও।
‘বল কী! আমি তো আরও এতোদিন ধরে ভেবে এসেছি আমি ওয়ান পিস ছেলে। আমার মতো আর কেউই নেই।’ আমি জবাব দিলাম।
‘তোমার সাথে ওর কিছুটা মিল আছে, এই যা। তবে কোন কিছু চিন্তা না করেই তাড়াহুড়ো করে সবসময় শুধু কাগজে হিজবিজ করে আজেবাজে সব লেখার ক্ষেত্রে তুমি ওয়ান পিসই বটে।’ জর্জ বলল।
‘আমি তাড়াহুড়ো করে কিছু লিখি না।’ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলাম। ‘ওয়ার্ড প্রসেসর ব্যাবহার করে সময় নিয়েই লিখি।’
‘আমি কিন্তু বলেছি ‘তাড়াহুড়ো করে।’’ জর্জ আমার প্রতিবাদকে কোন পাত্তাই দিল না। ‘একজন সত্যিকারের লেখকের কথাটা ধরতে পারা উচিত ছিল।’ নাটকীয় ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে চকলেট জুসে মুখ ডুবাল ও।
জর্জকে আমি একদম হাড়ে হাড়ে চিনি। কাজেই ওর ভেতর ঠিক কী চলছে বুঝে নিতে কোন সমস্যাই হলো না আমার। ‘তুমি আবার তোমার ওই অ্যাজাজেলকে নিয়ে কোন গপ্পো ফাঁদছো, তাই না?’
আমার উপর কড়া একটা নজর বোলাল ও। ‘ছাইপাশ লিখবার জন্য কল্পনা করতে করতে বাস্তবজ্ঞান তোমার এখন আর একদমই নেই। তবে তোমাকে সত্যি সত্যিই একটা গল্প শোনান দরকার।’ আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জর্জ।
বাইরে ওই বাস স্টপটার দিকে তাকালেই আমার শুধু মোরডেসাইয়ের কথা মনে পড়ে। ছাঁইপাশ লিখে যা কামাতো তাতে বেশ ভালোভাবেই চলত ওর। সেজন্যেই বলেছি তোমার সাথে ওর বেশ মিল আছে। তবে তোমার মতো এতো বেশী ছাঁইপাশ লিখত না। মাঝে মাঝে ওর দু’একটি লেখা আমার নজরে এসেছে, মোটামুটি মানের বলা যায়। নো ওফেন্স, তুমি এখনও ওর মানের লেখকও হতে পারনি। মানে, খবরের কাগজে তো সেরকমই বলে তোমার লেখা সম্পর্কে। অবশ্য আমি তোমার লেখা পড়ি না, পাঠক হিসেবে এতোটা নিচু শ্রেণীর না আমি।
মোরডেসাই’য়ের সাথে তোমার একটা অমিলও রয়েছে। ও খুব অধৈর্য স্বভাবের মানুষ। সেদিক থেকে তুমি কিছুই না। আয়নায় একবার নিজের চেহারটা দেখে আসো, তোমার কোন ভাবান্তরই হবে না। ক্যাবলার মতো চেয়ারে বসে হাত ঝুলিয়ে দিয়েছো। কেউ কস্মিনকালেও চিন্তা করতে পারবে না যে তোমার উপর লেখালেখির এতো চাপ।
কিন্তু এদিক থেকে মোরসেডাই মোটেই তোমার মতো নয়। সবসময় পিছিয়ে যাবার ভয় করত ও, তাই নিজের ডেডলাইনের আগেই সব লেখা শেষ করে রাখতো।
সেই দিনগুলো এখন আর নেই। প্রতি মঙ্গলবারে একসাথে দুপুরে খেতে যেতাম আমরা। তোমার মতো ও মোটেও চুপচাপ নয়। সারাক্ষণ বকবক করেই যেতো।
‘কাল সকালেই মেইলে একটা লেখা পাঠাতে হবে।’ ‘আরেকটা লেখা রিভিশন দিতে হবে কিন্তু কোন সময়ই পাচ্ছি না।’ ‘প্রকাশক ব্যাটা এখনো চেক পাঠাচ্ছে না।’ ‘ওয়েটার কই গেলো!’ এইসব ছিলো ওর কথার ধরণ।
টাকার ব্যাপারে সবসময় অস্থিরতায় ভুগতো ও। সময়মতো যদি প্রকাশক চেক না পাঠাতো তো একদম পাগল হয়ে যেত। এতো অধৈর্য যে বলার বাইরে। ধর, তুমি কোন বাসস্টপে গেলে, বাস আসতে দেরী করলে এই ঠান্ডার মধ্যে কী করবে? কলারটা উপর দিকে টেনে দিয়ে, হাত পকেটে ঢুকিয়ে উষ্ণতার জন্য হাত-পা ঘষাঘষি করবে। আর ও কী করত জানো? রাস্তার মধ্যে দৌঁড়ে গিয়ে দেখত বাসের চিহ্ন দেখা যায় কি না। দেখা গেলে ভালো, না গেলে গালিগালাজ করে অস্থির করে ফেলতো। বাসস্টপের অন্য যাত্রীদের সিটি হলে গিয়ে যেন নালিশ করে সেজন্য প্ররোচণা চালাবে।
আমার কাছে প্রায় সবসময়ই কোন না কোন নালিশ নিয়ে আসতো ও।
কাছে এসে দ্রুত বলত, ‘আমি খুব ব্যস্ত মানুষ জর্জ।’ ও সবসময়ই দ্রুত কথা বলে। ‘লজ্জার ব্যাপার হলো পুরো পৃথিবীটাই আমার পেছনে লেগে আছে। এক হাসপাতালে গিয়েছিলাম, রুটিন টেস্ট করব বলে। ওরা সময় দিয়েছিল ৯:৪০ এ। আমি একদম কাঁটায় কাঁটায় হাজির হলাম। গিয়ে দেখি ডেস্কে লেখা ৯:৩০ থেকে টেস্ট শুরু করা হয়। অথচ ডেস্কের পেছনে কেউই নেই। তার উপর আবার ডেস্কের লেখায় বানান ভুল।’
এক বাঁদরে খুঁজে বের করে জিজ্ঞেস করলাম আমার টেস্ট কখন করবে, গাধাটায় উত্তর দিল, ‘কেউ আসেননি এখনো।’
‘কিন্তু সাইনবোর্ডে তো লেখা সাড়ে ন’টা থেকে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু।’
‘কিছুক্ষণের মধ্যেই কেউ না কেউ চলে আসবে।’
বুঝো তাহলে অবস্থাটা। আমি অসুস্থ হয়ে যে কোন সময় মরে যেতে পারি অথচ সেদিকে কারও কোন কেয়ারই নেই! দশটা চার মিনিটে এক হারামজাদা এলো। আমি দৌঁড়ে গেলাম টেস্ট করাবার জন্য। হারামজাদাটা বলে কী না, ‘আপনার সিরিয়াল না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।’
মোরসেডাই আমাকে যে কতবার ওর জীবনের এমন গল্প শুনিয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। মানুষ সময়ের দাম দিতে চায় না দেখে ওর মতো বিরক্ত আর কাউকে আমি পাইনি। ওর মতে মানুষ যদি ঠিকঠাকভাবে সময়ের দাম দিতো তো ওর লেখার পরিমাণ আরও বিশ গুণ বেড়ে যেত। আর সময়মতো চেক দেয় না বলে তো নিজের প্রকাশকদের উপরও ও ভয়ানক রেগে থাকত।
ওকে সাহায্য করার জন্য নিজেই নিজেকে তাগিদ দেয়া শুরু করেছিলাম। তবে তখন ভুলেও অ্যাজাজেলের কথা ভাবতাম না আমি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কোন উপায় না পেয়ে অ্যাজাজেলের কাছেই যেতে হলো।
প্রাচীণ কয়েকটা মণ্ত্র পড়ে অ্যাজাজেলকে ডাকলাম আমি। ও তখন ঘুমাচ্ছিল। ছোট্ট চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আছে। বিশ্রী শব্দ করে নাক ডাকছে। ওর ঘুম ভাঙাবার জন্য ফন্দি খুঁজছিলাম। তখনই মাথায় বুদ্ধিটা এলো। ওর পেটের ওপর এক ফোঁটা পানি ফেললাম। সাথে সাথে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুম থেকে উঠল ও। অবশ্য ওকে পটিয়ে শান্ত করতে বেশীক্ষণ সময় লাগল না আমার। তারপর মোরসেডাইয়ের ঘটনা খুলে বললাম ওকে।
সব শুনে অ্যাজাজেলের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। ‘তুমি আমাকে ‘প্রবাবিলিটি ল’র মধ্যে নাক গলাতে বলছো?’
ও অল্পতেই পরিস্থিতি বুঝে ফেলেছে বলে আমি খুশি হয়ে উঠলাম, ‘ঠিক তাই।’
‘কাজটা মোটেও সহজ নয়,’ ও বলল।
‘সহজ তো নয়ই,’ আমি জবাব দিলাম। ‘সহজ হলে কি আর তোমার কাছে আসি? সহজ কাজ হলে তো আমি নিজেই করতাম। কিন্তু এমন কঠিন কাজ তুমি ছাড়া কে করে দেবে, বল?’
অ্যাজাজেলকে তেল মারলে ও খুব খুশি হয়। আমার কথায় মুচকি হেসে জবাব দিল, ‘আমি কিন্তু বলিনি কাজটা অসম্ভব।’
‘তোমার জন্য তো কিছুই অসম্ভব নয়।’
‘আমাকে শুধু তোমাদের পৃথিবীর জিনহুইপার কন্টিয়াম অ্যাডজাস্ট করে দিতে হবে।’
‘ঠিক। আমিও সেটাই বলতে চাইছিলাম।’
‘ফন্টিয়ামের ইন্টারকানেকশনে তোমার বন্ধুর সাথে কিছু নোডসের সহযোগ ঘটিয়ে দিতে হবে। তাহলে ও আর
ডেডলাইন নিয়ে কোন সমস্যায় ভুগবে না। তবে একবার নোডসের সাথে সংযোগ ঘটালে সেটা কিন্তু আর কেটে দেয়া সম্ভব হবে না।’
‘কেন?’
‘থিওরিটিক্যালি সেটা অসম্ভব।,’ উদাস সুরে জবাব দিল ও।
যদিও ওর কথা আমার বিশ্বাস হলো না তারপরও মুখে বললাম, ‘তোমার তো আর ওটা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দরকার নেই। মোরডেসাই লেখালেখি করার জন্য একটু অতিরিক্ত সময় পেলই হলো। সারাজীবনের জন্য খুশি হয়ে যাবে ও।’
‘ঠিক আছে। কাজটা তাহলে করে দেব।’
অনেক্ষণ সময় লাগল কাজটা শেষ হতে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার যাদুকরদের মতো অ্যাজাজেলের হাত হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে আবার উদয় হতে দেখলাম। অবশ্য এমনিতেও ওর হাত যেরকম ছোট তাতে ওদের অস্তিত্ব আছে কি না বোঝা দায়।
‘কী করছো তুমি?’ শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসলাম।
জবাবে অ্যাজাজেল মাথা নাড়ল। কিছু গোণার ভঙ্গিতে ঠোঁট নড়ছে। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে টেবিলের উপর শুয়ে পড়ল।
‘কাজ শেষ?’
মাথা দোলাল অ্যাজাজেল। ‘আই থিংক, তুমি বুঝতে পেরেছো আমাকে ওর এনট্রপি কোটিয়েন্ট স্থায়ী করে দিতে হয়েছে।’
‘মানে? বুঝলাম না আমি।’
‘এর মানে হলো, তোমার বন্ধুর আশেপাশে এখন থেক যা-ই ঘটুক সেগুলো হবে সুনিয়ন্ত্রিত।’
‘তাহলে তো এর মধ্যে চিন্তার কিছু নেই।’
‘তো তো অবশ্যই। তবে তুমি থারমোডিনামিক্সের দ্বিতীয় সূত্রটার সাথে পুরো বিষয়টা আর মেলাতে পারবে না। মানে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য কোথাও খানিকটা অনিয়ন্ত্রিত ঘটনাও ঘটবে।’
‘কী রকম?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘হয়তো কারও চোখেই পড়বে না ঘটনাগুলো। পুরো এফেক্টটা আমি সোলার সিস্টেমের মাধ্যেমে সরিয়ে দিয়েছি। ফলে দু’একটা গ্রহাণুর সংঘর্ষ হতে পারে, আইয়োতে বিস্ফোরণ হবে। মোট কথা সূর্য প্রভাবিত হবে।’
‘কীভাবে?’
‘পৃথিবী আড়াই মিলিয়ন বছরের মধ্য এমন উত্তপ্ত হবে যে মানুষ বাসের অযোগ্য হয়ে যাবে।’
‘আড়াই মিলিয়ন বছর আসতে বহু দেরী। এখন ওসব নিয়ে না ভাবলেও চলবে।’
সপ্তাহখানেক পর আবার মোরডেসাইয়ের সাথে ডিনার করলাম। ও বেশ উত্তেজিত হয়ে ছিল। আমি টেবিলে ড্রিঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম, ও হাসি মুখে এসে উপস্থিত হলো।
জর্জ,’ ও বলল। ‘দারুণ একটা সপ্তাহ কাটল। সবকিছু একদম ঘড়ির কাঁটার নিয়ম মেনে চলেছে।’
আমি হাসলাম, ‘তাই?’
‘ব্যাঙ্কে গেলাম, দেখি ক্যাশিয়ার হাসিমুখে জানালার পাশে বসে আছে। ডাকঘরে গেলাম, চিন্তাও করতে পারবে না, সেখানেও এক কর্মকর্তাকে পেয়ে গেলাম। হাসি মুখে আমার চিঠি রেজিস্টার করে দিল। বাস স্টপেজে যাওয়ামাত্র বাস এসে হাজির। হাত তুলার সাথে সাথেই কোথা থেকে টেক্সি এসে হাজির। ড্রাইভারকে বলতেই ফিফথ এন্ড ফোর্টিনাইন অ্যাভিনিউয়ে নিয়ে গেল। আর কী চাই, জর্জ?’
এরই মধ্য ওয়েটার এসে মেন্যু দিয়ে গেছে। মোরডেসাই সেখানে একবার নজর বুলিয়ে আমাদের জন্য খাবারের অর্ডার দিয়ে দিল। লক্ষ করলাম পাশে ওয়েটার আছে কী নেই সেদিকে ওর কোন ভ্রূঁক্ষেপ নেই। অন্য সময় হলে ওয়েটার না থাকার জন্য রাগারাগি শুরু করে দিত।
এবারে ওয়েটার ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
অর্ডার দেয়ার একটু পরেই ওয়েটার দু’হাত কচলাতে কচলাতে কুর্নিশ করে খাবার পরিবেশন করল।
আমি বললাম, ‘তোমার ভাগ্য তো বেশ ভালো হয়ে গেছে মাই ফ্রেন্ড।’
‘এটা মোটেও ভাগ্য নয়,’ শার্টের কলারে ন্যাপকিন গুঁজে হাতে ছুরি আর কাঁটা চামচ নিয়ে খাবার খাওয়া শুরু করে দিল মোরডেসাই। ‘এ হল কাজের দৈব ঘটনার অনিবার্য ফলাফল।’
‘দৈব ঘটনা?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘অবশ্যই,’ ও জবাব দিল। ‘আমি আমার সারটা জীবন ব্যায় করেছি অন্যদের সময় নষ্ট করে ফাঁদে পড়ে। দৈব ঘটনার মাধ্যমে সেই ক্ষতি পূরণ হওয়ার কথা ছিল। সেটাই এখন ঘটছে। আশা করি, সারা জীবনই এমন ঘটবে এখন। সবকিছুর মধ্য দারুণ একটা ছন্দ এসে গেছে।’ আমার দিকে ঝুঁকে হালকা একটা ধাক্কা দিল ও বেরসিকের মতো। ‘আমার উপর ভরসা রাখ। আমি জানি তুমি সম্ভাবনার সূত্র বোঝ না।’
খাওয়ার পুরোটা সময় এই সম্ভাবনার সূত্র নিয়ে লেকচার দিল ও। আমি নিশ্চিত তোমার মতো সে-ও এই বিষয়ে একটু কমই জানে। অবশেষে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘লেখালেখির জন্য এখন নিশ্চয়ই বেশী সময় পাচ্ছ?’
‘অবশ্যই,’ সাথে সাথে জবাব দিল ও। ‘আমার ধারণা ঠিক হলে এখন আগের চেয়ে বিশ ভাগ বেশী লিখতে পারছি।’
‘তাহলে তোমার লেখালেখির সংখ্যাও বাড়ার কথা।’
‘ইয়ে,’ একটু ইতস্তত করল ও। ‘এখনো তেমন কিছু ঘটেনি। তবে আস্তে আস্তেই সবকিছু অ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে। হুট করে এমন হলো তো তাই এখনো সবকিছুতে অভ্যস্ত হতে পারিনি।’
মোরসেডাই হাত তুলে না তাকিয়েই ওয়েটারের হাত থেকে বিলের কাগজটা নিল। বিলে একবার চোখ বুলিয়ে ক্রেডিট কার্ডটা ওয়েটারের হাতে দিয়ে দিল। ওয়েটার ক্রেডিট কার্ড নিয়ে চলে গেল।
ডিনার খেতে আমাদের সব মিলিয়ে ত্রিশ মিনিট লেগেছে। সত্যি বলতে আমি ভেবেছিলাম শ্যাম্পেন, ব্র্যান্ডি আর গল্প-গুজব সব মিলিয়ে কমপক্ষে আড়াই ঘন্টা লাগবে। তবে দু’ঘন্টা সময় বেঁচে যাওয়ায় ভালোই হয়েছে। মোরসেডাই লেখলেখির জন্য সময় পাবে এখন।
ওই ডিনারের পরের তিন সপ্তাহ আর ওর সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না। সম্ভবত ও শহরের বাইরে গিয়েছিল। যাই হোক, একদিন সকালে এক কফিশপ থেকে নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছি, দেখি খানিকটা দূরেই মোরসেডাই দাঁড়িয়ে আছে।
সেদিন খুব তুষার পড়ছিলো। এমন দিনে ট্যাক্সির কথা চিন্তা করা নেহাত দিবাস্বপ্ন। কিন্তু মোরসেডাই হাত তুলতেই দেখি কোথা থেকে এক ট্যাক্সি এসে হাজির হলো। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মোরসেডাই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ট্যাক্সিওয়ালা কয়েকমিনিট অপেক্ষা করে হতাশ হয়ে অন্যদিকে চলে গেল। উইন্ডশিল্ড দিয়ে ট্যাক্সিওয়ালার মুখটা আমি পরিস্কার দেখতে পারছিলাম।
মোরসেডাই আমার দিকে পেছন ফেরা তাই আমাকে লক্ষ্য করেনি। আবার হাত তুলল ও। সাথে সাথেই আরেকটা ট্যাক্সি এসে হাজির হলো। ট্যাক্সিতে উঠে এমন জোরে সিটে বসল যে চল্লিশ গজ দূর থেকেও আমি শব্দ শুনতে পেলাম।
খানিক বাদে ফোন করে পরিচিত একটা বারে আসার জন্য বললাম ওকে।
সেদিনই বারে এলো ও। তবে দেখে মনে হলো ভালো নেই ও। একদম বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।
আমাকে বলল, ‘ওয়েট্রেসকে ডাকবে, জর্জ?’
আমি এই বারের ওয়েট্রেসদের বেশ পছন্দ করি। তাই দেরি না করে হাত তুলে একজনকে ডাক দিলাম। কিন্তু আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। বরং নগ্ন পিঠটা আমার দিকে পেছন ফিরিয়ে রাখল।
‘তুমিই বরং ডাক দাও, মোরসেডাই,’ আমি বললাম। ‘তোমার সম্ভাবনা আইন আমার ক্ষেত্রে কাজ করে না।’
‘রাখো তোমার ডাকাডাকি,’ খ্যাঁকিয়ে উঠল ও। ‘আমি ডাকতে পারব না।’
ওয়েট্রেসদের নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যাথা নেই। বরং মোরসেডাইকে নিয়ে কৌতুহল হলো।
‘মোরসেডাই,’ আমি বললাম। ‘তোমাকে বেশ বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। আজ সকালে দেখলাম খালি ট্যাক্সি পেয়েও উঠলে না। আরেকটা ট্যাক্সি ডেকে নিলে। ঘটনা কী?’
‘ঘটনা আবার কী?’ মোরসেডাই পাল্টা প্রশ্ন করল। ‘আমি ওই হারামজাদাগুলোকে নিয়ে দিন দিন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সবসময়ই আমার পিছু নেয়। যেখানেই যাই সেখানেই এসে হাজির। বারে ঢুকলে ওয়েটারের দল ঘিরে থাকে, বন্ধ দোকানের সামনে গেলে দোকানদার পর্যন্ত সাথে সাথে দোকান খুলে দেয়। কোন বিল্ডিংয়ে গেলে আমার জন্য এলিভেটর খালি হয়ে যায়। কোন অফিসের রিসিপশনে গেলেই রিসিপশনিস্টগুলো হেসে স্বাগত জানায়। সব জায়গাতেই…’
আই বাঁধা দিয়ে বললাম, ‘এ তো বেশ ভালো, মোরসেডাই। তোমার লেখালেখির জন্য তাহলে আরও বেশী সময় পাচ্ছো।’
‘পাচ্ছি না,’ করুণ গলায় বলল ও। ‘আমি আসলে কোন লেখালেখিই করতে পারছি না।’
‘সে কী! কেন?’
‘কারণ আমি কল্পনাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি।’
‘কী হারিয়ে ফেলেছো বললে?’
‘আমি এখন কোন কিছুই কল্পনা করতে পারি না। আমার কল্পনা আমার ইন্টেলেকচুয়াল মোটিভেশনের জোগান দেয়, আমার ক্রোধ জাগায় আমার ইমোশনাল মোটিভেশন। যখন সবকিছু অনিয়ম করতো আমার ভীষণ রাগ হতো। সেই রাগগুলো মেটাতাম টাইপরাইটারের উপর। কিন্তু এখন সব নিয়ম মেনে চলেছে। কিছু ভাবতেও পারি না তাই, পারি না কিছু লিখতেও। একটা জিনিস দেখবে?’
মোরসেডাই বৃদ্ধাঙ্গুলি আর মধ্যমা এক করে তুড়ি বাজাতেই এক সুন্দরী ওয়েট্রেস এসে হাজির হলো। বলল, ‘আপনার জন্য কী করতে পারি, স্যার?’
অনেক কিছুই সে করতে পারত তবে মোরসেডাই ওকে শুধু দু’টো ড্রিঙ্ক আনতে বলল।
‘আগেই জানতাম,’ বলল ও। ‘নতুন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি সেটা অসম্ভব।’
‘যে সুযোগগুলো পাচ্ছ সেগুলো ফিরিয়ে দিলেই পারো।’
‘তাই? আজ সকালেই না দেখলে একটা ট্যাক্সি ছেড়ে দিতে না দিতেই আরেকটা এসে হাজির। এভাবে যদি পঞ্চাশটা ট্যাক্সি রিফিউজ করি তারপরও একান্ন নাম্বার ট্যাক্সিটা আসবেই।’
‘অফিসে বসে চিন্তা করার জন্য দু’এক ঘন্টা সময় রাখছো না কেন?’
‘অফিস! অফিস দিয়ে কী হবে? আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই উত্তেজিত হওয়ার জন্য। রাগ করার জন্য। রাগ না থাকলে আমরা মাথা থেকে লেখা বের হয় না।’
‘এখন আর রাগ করার সুযোগ পাচ্ছো না?’
‘অন্যায়-অবিচার দেখলে মানুষ রাগ করে। কিন্তু বিনয়-ভদ্রতা দেখালে তার উপর রাগ করি কী করে বলো তো? আমার এখন আর কোন রাগ হয় না। বুক ভরা শুধু দুঃখ আর দুঃখ। লিখতে না পারার দুঃখ।’
অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকলাম আমরা। তারপর মোরসেডাই-ই নীরবতা ভেঙে বলল, ‘জর্জ, আমার মনে হয় কেউ আমাকে অভিশাপ দিয়েছে। সম্ভবত আমার গডমাদার। ওকে আমার ক্রাইস্টেনিংয়ের সময় দাওয়াত করিনি বলে খুব রেগে গিয়েছিল। সে-ই হয়তো অভিশাপ দিয়েছে।’
ওর করুণ চেহারা দেখে আমার খারাপই লাগল। তবে মেজাজ খারাপ করে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটল তার একটু পরেই। বিলের কাগজটা আমার দিকে ঠেলে দিল ও।
‘বিলটা তুমি দিও। আমি বাড়ি গেলাম।’
অগত্যা বিল দিতে হলো। এছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল?
এরপরে আর কখনো মোরসেডাইয়ের সাথে আমার দেখা হয়নি। শুনছে ও দেশান্তরী হয়েছে। দক্ষিণ সাগরের ওদিকে কোথায় নাকি উষ্ণবৃত্তি করে বেরায়। জিনিসটা ঠিক কী তা আমি জানি না। তবে আমি শিওর ও যদি চায় তো সাগরের ঢেউও ওর কাছে চলে আসবে।
আমাদের খাবারের বিল চলে এলো। জর্জ যথারীতি ওটার দিকে ফিরেও তাকাল না।
আমি বললাম, ‘অ্যাজাজেলকে নিশ্চয়ই আমার জন্য কিছু করতে বলোনি?’
‘তুমি এমন কোন লোক নও যে তোমার জন্য আমি অ্যাজাজেলের কাছে প্রার্থনা করতে যাব,’ জর্জ জবাব দিল।
‘তাহলে তুমি আমার জন্য কিছু করছো না?’
‘কিচ্ছু না।’
‘বেশ,’ আমি বললাম। ‘তাহলে আমিই বিলটা দিয়ে দিচ্ছি।’
‘দিলে তো ভালোই হয়।’
…………………………………………………….(সমাপ্ত)………………………………………………