এক…
ভীষণ ঠাণ্ডা। কালো আকাশ। শিগগিরই শুরু হবে প্রচণ্ড বরফপাত।
গায়ে কালো ওভারকোট। গলায় পেঁচানো মাফলার। মুখের ওপর সেটা তুলে দিল লোকটা। টেনে চোখের ওপর নামিয়ে আনল হ্যাট। কালভার স্ট্রিটের ৭৪ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে বেল পুশ টিপে দিতেই বাড়ির ভিতর তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠল বেল।
মিসেস কেসির দু’হাতই ব্যস্ত। তিক্তকণ্ঠে বলল, “দুত্তোর, ওই বেলটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। এক মুহূর্ত শান্তিতে থাকার জো নেই!”
আপনমনেই বিড়বিড় করতে করতে বেযমেন্টের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো মিসেস কেসি। দরজা খুলে দিল।
কালচে আকাশের পটভূমিতে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। ফিসফিস করে উঠল, “মিসেস লিয়ন!”
“দোতলা,” বলল মিসেস কেসি। “সোজা দোতলায় উঠে যান। আপনি যে আসবেন উনি জানেন?”
ধীরে ধীরে এদিক ওদিক মাথা নাড়ল লোকটা। “না।”
“ও। ঠিক আছে, উঠে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিন।”
মলিন কার্পেট বিছানো সিঁড়ি বেয়ে লোকটাকে উঠে যেতে দেখল মিসেস কেসি। আপনমনেই বিড়বিড় করে বলল, “অদ্ভুত!” শিউরে উঠল একবার। ঠাণ্ডায়ই বোধহয়। “লোকটা এমন ফিসফিস করল কেন? ঠাণ্ডা… ওই হতচ্ছাড়া ঠাণ্ডা, আর কিছু না… তবু…”
সিঁড়ির বাঁক ঘুরল লোকটা। শিস দিয়ে উঠল মৃদু স্বরে। ‘থ্রি ব্লাইন্ড মাইস’ গানের সুর।
কয়েক পা পিছিয়ে রাস্তায় নেমে এলো মলি ডেভিস। গেটের পাশের নতুন রঙ করা সাইনবোর্ডটার দিকে তাকাল। লেখা হয়েছে :
মংকসওয়েল ম্যানর
গেস্ট হাউস
ঠিকই হয়েছে, আপনমনেই মাথা ঝাঁকাল মলি। লোকে দেখে কিছু সন্দেহ করতে পারবে না। মলিরা যে পেশাদার হোটেল ব্যবসায়ী নয়, বোর্ডটা দেখে বুঝতে পারবে না। কাঠের খুঁটির ওপর বসানো বোর্ডটা সামান্য ঝুঁকে আছে টিলার খাড়াইয়ের দিকে। ম্যানরের দু’পাশের আগাছা পরিষ্কার করা হয়নি ভালোমতো। এছাড়া আর কোনো খুঁত নেই। চমৎকার কাজ করেছে গিলেস, বুদ্ধিমান লোক। আরও অনেক কাজই চমৎকারভাবে করতে পারে সে। বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে মলি, যদিও স্বামীকে এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। স্বামীর ব্যাপারে আজ যা ভাবে, দু’দিন পরেই সেটা পাল্টে নিতে হয়। আবার ভাবতে হয় নতুন করে। চাপা স্বভাবের
লোক বলা যাবে না গিলেস ডেভিসকে, কিন্তু নিজের ব্যাপারে প্রায় কিছুই বলতে চায় না সে, এমনকি মলির কাছেও না। তবে কাজের লোক, অনেকদিন নেভিতে চাকরি করে এলে যা হয়।
তবে এইবার বোঝা যাবে কতখানি বুদ্ধিমান আর কাজের লোক তার স্বামী, ভাবল মলি। গেস্ট হাউস চালানোর কোনো অভিজ্ঞতাই নেই দু’জনের কারও, এই ব্যবসায়ে একেবারে আনকোরা নতুন। তবু কপাল ঠুকে নেমে পড়েছে ওরা। কিছু না কিছু টাকা তো আসবেই, সেই সঙ্গে বাসস্থানের সমস্যাও মিটে গেল।
প্রস্তাবটা অবশ্য মলির। ক’দিন আগে মারা গেছেন আন্ট কেথেরিন। তাঁর মৃত্যুর দিন-কয়েক পরেই উকিলের নোটিশ পেয়েছে মলি। মংকসওয়েল ম্যানরটা মলিকে দান করে গেছেন আন্টি। সাধারণত যা হয়, চিঠি পেয়েই ঠিক করে ফেলল তরুণ স্বামী-স্ত্রী, বিক্রি করে দেবে বাড়িটা। গিলেস জানতে চেয়েছিল, “বাড়িটা দেখতে কেমন?” মলি জবাব দিয়েছিল, “বিরাট, প্রাসাদ বললেও চলে, তবে অনেক পুরানো। ভিক্টোরিয়ান ফার্নিচারে ঠাসা। আমার কেমন দমবন্ধ হয়ে আসে। সুন্দর একটা বাগান আছে, তবে আগাছায় ভরে গেছে এখন। যুদ্ধের পর থেকে আর পরিষ্কার করা হয়নি তো। লোকের অভাব।”
সিদ্ধান্ত নিয়েই দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে স্বামী-স্ত্রী। বাড়িটা বেচেই দেবে। বেছে বেছে দরকারি কিছু হয়া ফার্নিচার রেখে দেবে শুধু। বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে শহরে ছোট একটা ফ্ল্যাট কিনবে। তেমন পাওয়া গেলে ছোটখাটো একটা কটেজও কিনে ফেলতে পারে।
কিন্তু দুটো অসুবিধে দেখা দিল। তেমন ছোটখাটো ফ্ল্যাট বা কটেজ পাওয়া গেল না। ফার্নিচারও আনা যাবে না ম্যানর
থেকে। হালকা কিছুই নেই, সবই ঢাউস সাইজের। ফ্ল্যাট বা ছোট কটেজে জায়গাই হবে না ওসব ফার্নিচার।
“ঠিক আছে,” মলি বলেছে, “সব ফার্নিচারই বেচে দেব।”
দালাল ভরসা দিয়েছে সব জিনিসই বিক্রি করে দেয়া যাবে।
কে কিনবে, জানতে চেয়েছে মলি।
“কেনার লোকের অভাব আছে নাকি,” দালাল বলেছে। “হোটেল ব্যবসায়ীরাও কিনতে পারে। সুন্দর একটা গেস্ট হাউস বানিয়ে নেবে। অনেক পুরানো আমলের বাড়ি হলেও নতুন করে মেরামতের পর এখন খুব ভালো লাগে।”
দালালের বক্তব্য থেকেই বুদ্ধিটা মাথায় এসেছে মলির।
“গিলেস,” বলেছে ও, “বাড়িটাকে আমরাও তো গেস্ট হাউস বানাতে পারি?”
প্রথমে তেমন গুরুত্ব না দিলেও মলির চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত দিতে বাধ্য হয়েছে। স্বামীকে বুঝিয়েছে ও, “বেশি লোক দরকার নেই আমাদের— আর শুরুতে তো নয়ই— কারণ হোটেল ব্যবসার কিছুই বুঝি না আমরা। প্রতিটি বেডরুমের সঙ্গে অ্যাটাচড বাথ আছে, ঠাণ্ডা গরম দু’রকম পানিরই ব্যবস্থা আছে। সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম আছে, গ্যাস কুকার আছে। হাঁস-মুরগি পালতে পারব আমরা— ডিম আর মাংসের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বাড়ির সামনে-পিছনে অনেক জায়গা, তরিতরকারির চাষ করতে পারব। আর কী চাই?”
“কিন্তু কাজ তো অনেক। কে করবে? চাকর-বাকর পাওয়া আজকাল যা কঠিন।”
“আমরাই করব। পরের কাজ না করে নিজেদের কাজই করলাম। আর এমন বেশি কী কাজ? পার্মানেন্ট চাকর লাগবে না। তেমন দরকার পড়লে একজন বুয়া রেখে নেব। আপাতত জনা পাঁচেক গেস্টকে জায়গা দিতে পারব আমরা। হপ্তায় সাত গিনি করে…” মাসে কত আসবে মনে মনে হিসেব করতে লেগে গেছে মলি।
“ভেবে দেখো,” সবশেষে বলেছে মলি, “ওটা আমাদের নিজের বাড়ি। জিনিসপত্র সব নিজেদের। এছাড়া আর কোনো জায়গাও নেই আমাদের— কোথাও বাড়িও করতে পারব না, একেবারেই তো বাস্তুহারা।”
আর আপত্তি করেনি গিলেস। ঠিকই বলেছে মলি। ভালো কোনো চাকরি পায়নি দু’জনের কেউই। ছুটকো-ছাটকা কাজ করে রুটি কাপড় জোগাড় করতেই সময় বেরিয়ে গেছে। বিয়ের পর একসঙ্গে থাকার সুযোগ পায়নি কখনও। কোথাও থিতু হয়ে বসার ইচ্ছেটা ইদানীং বেশ অনুভব করছিল ওরা।
ঠিক হয়েছে, পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হবে ব্যবসাটা। ভালো করতে পারলে টিকে যাবে, নইলে অন্য কথা ভাববে। স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে ওরা, টাইমসেও দিয়েছে। চিঠি লিখে লোকে খবরাখবর নিতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই।
আজ প্রথম অতিথি আসার কথা। গাড়ি নিয়ে সকালেই বেরিয়ে গেছে গিলেস। আর্মির বাতিল কিছু তারের জালের নিলাম হবে, বিজ্ঞাপন দিয়েছে কাগজে। ওগুলো কেনা যায় কিনা দেখতে চায় সে। বেশি দূরে না, গাঁয়েরই শেষ প্রান্তে। মলি হেঁটেই গিয়েছিল গায়ের বাজারে, টুকিটাকি কিছু জিনিস কেনা বাকি রয়ে গিয়েছিল, নিয়ে এসেছে।
কিন্তু গোলমাল পাকাচ্ছে আবহাওয়া। গত দু’দিন ধরেই ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে, ঝিরঝিরে তুষারও ঝরতে শুরু করেছে এখন। ঘন কোঁকড়ানো চুলের ওপর পালকের মতো হালকা তুষার জমছে, জমছে ওয়াটারপ্রুফ কোটের কাঁধে। দ্রুত গিয়ে গাড়ি-বারান্দায় উঠল মলি। খানিক পর পরই রেডিওতে বিষণ্ণকণ্ঠে ঘোষিত হচ্ছে আবহাওয়ার পূর্বাভাস। প্রচণ্ড তুষারপাতের সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছে।
চিন্তিত হয়ে পড়ল মলি। পাইপের ভিতরে না আবার পানি জমে বরফ হয়ে যায়। শুরুতেই সব কিছু গোলমাল হয়ে যেতে থাকলে সর্বনাশ। ঘড়ি দেখল মলি। চায়ের সময় পেরিয়ে গেছে। এখনও ফিরছে না কেন গিলেস? গাঁয়ের বাজারে মলিকে খুঁজছে না তো, সঙ্গে করে নিয়ে আসবে বলে?
খালি বাড়ি। এখনও ফিরছে না গিলেস। রান্নাঘরে এসে টিনগুলো সরিয়ে রাখল মলি। টিনের খাবার খাওয়া ওদের কাছে বিলাসিতা। কিন্তু অতিথিরা আসবে। তাছাড়া আবহাওয়ার যা অবস্থা, খাবার জমিয়ে রাখা ভালো। কতদিন ধরে আটকে থাকতে হবে, কে জানে। টিনগুলো রেখে ওপরতলায় উঠে এলো সে। শেষবারের মতো আরেকবার তদারক করল সাজানো বেডরুমগুলো। দক্ষিণের ঘরটা মিসেস বয়েলের জন্য। আসবাবপত্র সব সেগুন কাঠের। মেজর মেটকাফের জন্য রেখেছে নীল রঙ করা ঘরটা। এ ঘরের আসবাবপত্র ওক কাঠের। পুবের ঘরটা পেয়ে নিশ্চয় মিস্টার রেনও খুব খুশি হবেন। জানালার কাছে দাঁড়ালে বাইরের অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাবেন। প্রতিটি ঘরই চমৎকার। মনে মনে আন্ট কেথেরিনকে আরেকবার ধন্যবাদ জানাল মলি। প্রচুর মখমলের
স্টক রেখে গেছেন। একটা বিছানার মখমলের চাদরে হাত বোলাল মলি। তারপর আবার নিচে নেমে এলো।
হঠাৎই বড় বেশি শান্ত আর খালি মনে হচ্ছে বাড়িটা। এমনিতেই নিঃসঙ্গ এই বাড়ি, গাঁয়ের লোকালয় থেকে দুই মাইল দূরে। এই আবহাওয়ায় দুই মাইল সোজা কথা নয়। আগেও অনেকবার একা থেকেছে বাড়িটাতে মলি, কিন্তু আজকের মতো নির্জন, খালি মনে হয়নি কখনও।
জানালার শার্শিতে আঘাত করছে তুষারমেশানো বাতাস, অদ্ভুত ফিসফিসে একটা আওয়াজ উঠেছে। কেমন যেন শিরশির করে ওঠে গা। যদি ফিরে না আসতে পারে গিলেস? এমনভাবে পথে বরফ জমে গেল যে গাড়ি চালানো গেল না, তখন? আগামী ক’দিন এ বাড়িতে একা থাকার কথা ভাবতেও অস্বস্তি বোধ করছে মলি।
পুরো রান্নাঘরে একবার চোখ বোলাল সে। বড়সড় ঘর। বিরাট কিচেন টেবিল, অনেক খাবার রাখা যাবে।
খিদে পেয়েছে। এক টুকরো কেক তুলে নিল মলি। কামড় বসাল। চিবুতে চিবুতে কাপে দুধ ছাড়া চা ঢেলে নিল। ভাবছে। সুযোগ-সুবিধে হলে রান্নায় সাহায্য করার জন্য দু’জন লোক রাখবে সে। একজন একটু বয়স্ক, পাকা বাবুর্চি। আরেকজন কম বয়েস, প্রচুর খাটতে পারে এমন। দু’জনেই কাজ করতে করতে সমীহের চোখে তাকাবে তার দিকে, মনিবানী মলি ডেভিসের দিকে। কল্পনার জাল বুনতে লাগল মলি। সব কিছুই কেমন যেন অবাস্তব মনে হচ্ছে এখন।
জানালার কাচের শার্শিত ছায়া পড়ল। অদ্ভুত একটা ছায়া। দরজা খুলে গেল। কিম্ভূত একটা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।
ওয়াটারপ্রুফ ওভারকোট, হ্যাট, গ্লাভস— সব কিছুতে বরফ। গ্লাভস পরা হাত দিয়ে বরফ ঝারল লোকটা।
হঠাৎই যেন বাস্তবে ফিরে এলো মলি। “গিলেস!” চেঁচিয়ে উঠল সে। এগিয়ে গেল। “তুমি এসেছ!”
“হ্যাঁ, ডার্লিং। কী আবহাওয়া! এক্কেবারে জমে গেছি।”
মেঝেতে লাথি মেরে জুতো থেকে বরফ খসাল গিলেস। দ্রুত হাতে ওভারকোট খুলে স্বভাবমাফিক চেয়ারে ছুঁড়ে ফেলতে গেল।
শূন্যেই কোটটা ধরে ফেলল মলি। একটা হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখল। পকেট থেকে বের করে আনল একটা মাফলার, খবরের কাগজ, এক বান্ডিল সুতো, দোমড়ানো কয়েকটা চিঠিপত্র— সকালে লেখা হয়েছিল। আবার রান্নাঘরে ঢুকল মলি, জিনিসগুলো রাখল টেবিলে। তারপর কেটলি চাপাল চুলায়।
“জালগুলো এনেছ?” জানতে চাইল মলি।
“না, পছন্দ হলো না। আমাদের কোনো কাজে আসবে না। আরেক জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। দেখেছিও। ওগুলোও পছন্দ হয়নি। এদিককার খবর কী? কেউ আসেনি?”
“মিসেস বয়েল আগামীকাল আসছে।”
“মেজর মেটকাফ আর মিস্টার রেন? তাদের তো আজই আসার কথা।”
“চিঠি পাঠিয়েছে মেজর। আগামীকালের আগে আসতে পারছে না।”
“তার মানে শুধু মিস্টার রেনের জন্যেই রাঁধতে হচ্ছে আজ রাতে। আচ্ছা, লোকটা কেমন হবে বলে মনে হয় তোমার? আমার মনে হয় ভালো লোকই হবে। হয়তো রিটায়ার্ড সিভিল সার্জেন্ট।”
“নাম শুনে আমার মনে হচ্ছে আর্টিস্ট।”
“তাহলেই সেরেছে,” গিলেস বলল। “এক হপ্তার ভাড়া অগ্রিম চাইতে হবে।”
“আরে না না, ও কাজও কোরো না। মালপত্র তো আনবেই। দরকার হলে ওগুলো আটকাতে পারব।”
“মালপত্র? খবরের কাগজে মুড়ে ইঁটও তো নিয়ে আসতে পারে। দুত্তোর ছাই, কত রকম সন্দেহ যে হচ্ছে। আসলে, অভিজ্ঞতা নেই তো, কী করতে হবে কিচ্ছু জানি না। আমরা যে ব্যবসায় নতুন, এটা ওদেরকে বুঝতে দেয়া চলবে না।”
“কিন্তু মিসেস বয়েল জেনে যাবেনই,” মলি বলল, “উনি ওই রকমই।”
“কী করে জানলে? এখনও তো দেখোইনি।”
ঘুরল মলি। টেবিলে একটা খবরের কাপড় বিছাল। খানিকটা পনির নিয়ে কাজে লেগে গেল।
“কী বানাচ্ছ?” জানতে চাইল গিলেস।
“ভাজব। রুটি, সিদ্ধ আলু আর এই পনির মিশিয়ে ভাজব। চমৎকার লাগে খেতে, ওয়েলশ রেয়ারবিট।”
“ভালো রাঁধুনি। খেয়ে খুশিই হবে অতিথিরা।”
“ভালো আর কই? চর্চা করারই সুযোগ পাইনি। আর সব যা-ই হোক, নাস্তা নিয়েই মুসিবতে পড়ব।”
“কেন?”
“একসঙ্গে সব করতে হবে। ডিম ভাজো, বেকন বানাও, দুধ গরম করো, কফি বানাও, টোস্ট করো। একসঙ্গে এত কাজ পারি না আমি। হয় দুধ পুড়বে, নয়তো টোস্ট পুড়বে, কিংবা বেকনে পোড়া দাগ লাগবে, অথবা ডিম বেশি শক্ত হয়ে যাবে। সব ঠিকমতো সামাল দেয়া, উঁহুঁ, আমাকে দিয়ে হবে বলে মনে হয় না।”
“কাল সকালে দরজার আড়ালে লুকিয়ে থাকব আমি,” হাসছে গিলেস, “দেখি, সামাল দিতে পারো কিনা।”
“আমার কষ্ট, আর হাসি আসছে তোমার, না!” মুখ ঝামটা দিল মলি। ওই যে, পানি ফুটেছে। লাইব্রেরিতে নিয়ে যাব? রেডিও শুনতে শুনতে খাওয়া যাবে। খবরের সময় হয়েছে।”
“মনে হচ্ছে রান্নাঘরেই বেশির ভাগ সময় কাটাতে হবে আমাদের। এখানেও রেডিও বসাতে হবে, কি বলো?”
“হ্যাঁ। আর এই ঘরটাও চমৎকার। আমার খুব পছন্দ। সারা বাড়িতে এটাই সবচেয়ে ভালো ঘর, আমার তাই ধারণা। ড্রেসারটা খুবই ভালো, প্লেটগুলোও সুন্দর। এমন একটা রান্নাঘরে সারাদিন রাঁধতেও আপত্তি নেই আমার।”
“চুলাটাও বিরাট।”
“হ্যাঁ। আস্ত গরুর রান সিদ্ধ করে ফেলা যাবে। আর কী বড় বড় পিতলের গামলা। জামের জ্যাম বানাত আন্টি। পাউন্ড পাউন্ড চিনি খরচ করত। আসলে, ওই ভিক্টোরিয়ান যুগটাই ছিল আরামের। এখনকার মতো এত টানাটানি ছিল না লোকের। বিরাট বাড়ি, বিরাট সব ঘর আর ফার্নিচার। দেরাজগুলো কী সুন্দর করে বানানো। টানলেই পাল্লা খুলে যায়, কী নিঃশব্দে মসৃণভাবে খুলে আসে ড্রয়ারগুলো। কোথাও একটা বাধে না। আর শহরে কী সব ঘরে থাকতাম! কী সব ফার্নিচার। ড্রয়ার খুলতে চায় না, আলমারির পাল্লা ফাঁক হয়ে থাকে। খুবই সস্তা, বাজে জিনিস।”
“ঠিকই বলেছ। তবে ব্যবসাটা ভালোমতো চালাতে না পারলে আবার ওসবের মধ্যেই ফিরে যেতে হবে।”
“চলো, যাই, খবর শুনি।”
প্রথমেই আবহাওয়ার খবর শোনাল সংবাদ-পাঠক। বার বার সতর্ক করে দিল জনসাধারণকে। তারপর পড়ল অন্যান্য খবর। ফরেন অ্যাফেয়ার্সে অচলাবস্থা, পার্লিয়ামেন্টে তুমুল হই-চই, ইত্যাদি। সবশেষে জানাল একটা খুনের খবর— প্যাডিংটনের কালভার স্ট্রিটের এক বাড়িতে হয়েছে খুনটা।
“দূর!” গজগজ করতে লাগল মলি— নতুন কোনো খবরই নেই। সেই পুরানো সব কেচ্ছা। আর আবহাওয়ারও যে কী কাণ্ড! খারাপ হওয়ার আর সময় পেল না। এই শীতে ব্যবসা শুরু করাই উচিত হয়নি আমাদের। বসন্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও পারতাম।” তারপর হঠাৎই স্বর পাল্টে বলল, “আচ্ছা, যে মহিলা খুন হলো, সে দেখতে কেমন?”
“মিসেস লিয়ন?”
“হ্যাঁ, ওরকমই কী একটা নাম বলল যেন। কে খুন করল গো ওকে? কেন করল?”
“আমি কী জানি। হয়তো ঘরের ভিতর গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছিল।”
“খবরে তো বলল পুলিশ একটা বিশেষ লোককে খুঁজছে, ওর সঙ্গে কথা বলার জন্যে। ও-ই কি খুনী?”
“হতে পারে। পুলিশ সব সময়ই একটু ঘুরিয়ে কথা বলে।”
হঠাৎ কলিংবেলের তীক্ষ্ণ শব্দে চমকে উঠল দু’জনেই।
“সামনের দরজায়,” লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল গিলেস। মলির দিকে তাকিয়ে হাসল। “খুনীটাই এসেছে হয়তো।”
“ওসব গল্প-নাটকে ঘটে। জলদি যাও। নিশ্চয় মিস্টার রেন। দেখি, কার কথা ঠিক। তোমার না, আমার।”
তুষার মেশানো ঝোড়ো বাতাসের ঝাপটায় যেন ঝড়ের মতোই ঘরে এসে ঢুকল মিস্টার রেন। খোলা দরজা দিয়ে মুহূর্তের জন্য বাইরের সাদা-কালো পৃথিবীটা চোখে পড়ল মলির, আর তারই পটভূমিকায় কালো একটা মূর্তি।
লাইব্রেরির দরজায় দাঁড়িয়ে আগন্তুককে তীক্ষ্ণ চোখে দেখল মলি। কালো ওভারকোট, ধূসর হ্যাট, গলায় জড়ানো মাফলার।
এক ঝটকায় সদর দরজা বন্ধ করে দিল গিলেস।
দ্রুত হাতে গলায় পেঁচানো মাফলার খুলে নিল রেন। উবু হয়ে নামিয়ে রাখল অন্য হাতের সুটকেস। হ্যাট খুলে নিল। সবগুলো কাজ খুব সামান্য সময়ের বিরতিতে করে ফেলল সে। সেইসঙ্গে কথাও চালিয়ে গেল। কর্কশ কণ্ঠ, উঁচুস্বরে কথা বলে। ভালো কথা বললেও মনে হয় যেন ঝগড়া করছে। হলরুমের আলো পড়েছে মুখে। বয়েসে তরুণ। রোদেপোড়া চুল। নিষ্প্রভ অশান্ত চোখ।
“ভয়ঙ্কর… ভয়ঙ্কর আবহাওয়া,” বলে যাচ্ছে রেন, “ইংলিশ শীতের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা… ডিকেনসের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে… ক্রুজ আর টিনি টিমও এমন আবহাওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। সহ্য করাটাই মুশকিল। আপনাদের কি মনে হয়? সেই ওয়ালস থেকেই সাংঘাতিক খারাপ রাস্তা পেরিয়ে এসেছি। আপনিই তো মিসেস ডেভিস? বাহ্, বেশ সুন্দরী তো!” হাত বাড়িয়ে মলির একটা হাত চেপে ধরল রেন। কঠিন থাবা। “ঠিক এই চেহারা কল্পনা করিনি আপনার। আমি ধরে নিয়েছিলাম কোনো আর্মি জেনারেলের বিধবা স্ত্রী হবেন-টবেন। গম্ভীর, অতিরিক্ত মেমসাহেবী চালবোল, অনেক দিন স্বামীর সঙ্গে বেনারসে কাটিয়ে এসেছেন, পুরোদস্তুর ভিক্টোরিয়ান মহিলা। ভালো, খুব ভালো, আপনাকে দেখে খুশি হলাম। তা, ফুল-টুল আছে তো এ বাড়িতে? ভালো জাতের পাখি পোষেন, এই যেমন বার্ড অভ প্যারাডাইজ? অবশ্য, ওসব না থাকলেও চলবে। জায়গাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এলাকাটা দেখলেই মধ্যযুগের কথা মনে পড়ে যায়, সেই পুরানো দুনিয়া। ম্যানর হাউস, না? খুব ভালো। বেনারসের পিতল, সেগুন, ওক কাঠের তৈরি সাইনবোর্ড আছে নিশ্চয়? ফলন্ত গাছের ছবি খোদাই করা আছে না পালঙ্কে?”
“আছে,” হাতটা ছাড়িয়ে নিল মলি। রেনের কথার তোড়ে জবান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এতক্ষণ। “সেগুন আর ওক কাঠের ফার্নিচারও আছে।”
“তাই? দেখতে পারি? এখন?”
কথা যেমন দ্রুত বলে, কাজও তেমনি দ্রুতই করে রেন। ডাইনিং রুমের দরজার হাতল পরীক্ষা করে দেখল, সুইচ টিপে দেখল বাতি ঠিকমতো জ্বলে কিনা। ওর সঙ্গে রয়েছে মলি ও গিলেস। রেনের কাজকর্ম গিলেসের বিশেষ পছন্দ হচ্ছে বলে মনে হলো না।
“কোথায়? সেগুন কাঠের বড় ডাইনিং টেবিল কোথায়? ছোট টেবিলগুলো আলাদা আলাদা করে পেতেছেন কেন?”
“আমরা ভেবেছিলাম, গেস্টরা এভাবেই পছন্দ করবে,” মলি বলল।
“তা ঠিকই বলেছেন, তবে তেমন লোকও হওয়া চাই। এই যেমন, বিরাট এক পরিবার। শান্তশিষ্ট, সুন্দর দাড়িঅলা বাপ, ফ্যাকাসে চেহারার হাড্ডিসার মা, গণ্ডা তিনেক ছেলেমেয়ে, হোঁৎকা এক গভার্নেস, এবং ‘পুয়ার হ্যারিয়েট’ নামের কেউ একজন। ওই পুয়ার নামের পুয়ার লোকটা হবে সে পরিবারের প্রধান হেলপার। খুব বিশ্বাসী, মানে মাথামোটা গাধা আরকি। ওই যে, ফায়ারপ্লেসটার দিকে দেখুন। বিচ্ছিরিভাবে লাফাচ্ছে আগুনের শিখা। নিশ্চয় ওখানে পিঠ দিয়ে বসত মাথামোটা হারিয়েট, পিঠ পোড়াত।”
“আপনার সুটকেস নিয়ে যাচ্ছি আমি,” বলে উঠল গিলেস। “দোতলায়। পুবের ঘর।”
হাঁটতে শুরু করল গিলেস। পিছন পিছন হলে এসে ঢুকল রেন ও মলি।
“আমার ঘরে পালঙ্ক আছে তো?” গিলেসকে জিজ্ঞেস করল রেন। “মশারি টাঙানোর স্ট্যান্ড আছে? বিছানার চাদরে ফুল ছাপা আছে?”
“কিচ্ছু নেই,” রেনের দিকে তাকাল না গিলেস। গট গট করে গিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
“আপনার স্বামী আমাকে পছন্দ করতে পারছে না,” মলিকে বলল রেন। “কী কাজ করত আগে? নেভিতে ছিল কখনও?”
“ছিল।”
“এজন্যেই। আর্মি কিংবা এয়ারফোর্সের চেয়ে নেভির লোকের ধৈর্য অনেক কম। ক’দিন হলো বিয়ে হয়েছে আপনাদের? বনিবনা হচ্ছে?”
“আসুন, আপনার ঘর দেখে যান।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওটাই আগে দেখা দরকার। কিন্তু ঘরের মানুষগুলো সম্পর্কেও জানা দরকার ভালোমতো। হাজার হোক একসঙ্গে বাস করতে হবে।”
“আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি, কিছু মনে করেন না,” মলি বলল, আপনি কি সত্যিই মিস্টার রেন?”
থমকে দাঁড়াল লোকটা। চুলে আঙুল ঢুকিয়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে দেখাল, আসলই, নকল অর্থাৎ পরচুলা পরেনি। ছদ্মবেশ
নেই। বলল, “আপনার কি মনে হয়? হ্যাঁ, আমিই আদি এবং অকৃত্রিম ক্রিস্টোফার রেন। হাসবেন না। আমার বাবা-মা খুব রোমান্টিক ছিল, আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখত। ওদের আশা ছিল, আমি বড় হয় আর্কিটেক্ট হব। তাই শব্দটার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে আমার নাম রেখেছিল ক্রিস্টোফার। হা হা হা।”
“আপনি কি সত্যি আর্কিটেক্ট?”
“হ্যাঁ,” উফুল্লকণ্ঠে জবাব দিল রেন, “তা বলতে পারেন। তবে এখনও পুরোপুরি হইনি, অর্ধেক। তাই নামটাও অর্ধেক করে নিয়েছি। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলি, ক্রিস রেন।”
সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে আবার গিলেস। সেদিকে একবার তাকিয়ে মলি বলল, “চলুন, মিস্টার রেন, আপনার ঘর দেখিয়ে দিই।”
কয়েক মিনিট পর ফিরে এলো মলি। গিলেস জানতে চাইল, “ফার্নিচার পছন্দ হয়েছে ব্যাটার?”
“মশারির স্ট্যান্ড মশারির স্ট্যান্ড করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল আমার। অন্য ঘর দিতে বাধ্য হয়েছি।”
“হুঁহ্!” বিড়বিড় করে কী বলল গিলেস। শেষ শব্দ দুটো শুধু বুঝল মলি, “…খাবে হারামজাদা!”
“দেখো,” কিছুটা ঝাঁঝাল কণ্ঠে মলি বলল, “ওরা আমাদের আত্মীয় নয়, মুফতে বেড়াতে আসেনি, টাকা দিয়ে থাকবে। এটা আমাদের ব্যবসা, কথাটা মনে রেখো। ক্রিস্টোফার রেনকে তুমি পছন্দ করো আর না-ই করো…”
“করি না,” বাধা দিয়ে বলল গিলেস।
“এবং তাতে কিছু যায় আসে না যদি ঠিকঠাকমতো হপ্তায় সাত গিনি করে দিয়ে দেয়।”
“হ্যাঁ, যদি দেয়।”
“দেবে বলেছে। চিঠিতেই জানিয়েছে।”
“ওর সুটকেস কোথায়?”
“নিজের ঘরে নিয়ে গেছে।”
“এটা আমাদের কাছে রাখতে পারলে ভালো হতো। অবশ্য হতো কিনা কে জানে। ভিতরে মূল্যবান কিছু আছে বলে তো মনে হলো না। শোলার মতো হালকা।”
“চুপ! আসছে!” স্বামীকে সতর্ক করল মলি।
রেনকে লাইব্রেরিতে নিয়ে গেল সে। সুন্দর করে সাজানো ঘরটার ফায়ারপ্লেসের ধারে একটা বড় চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলল। জানাল আধঘণ্টার মধ্যেই ডিনার রেডি হয়ে যাবে।
আর কোনো গেস্ট এসেছে কিনা জানতে চাইল রেন। মাথা নাড়ল মলি। রান্নাঘরে ওকে সাহায্য করার প্রস্তাব দিল রেন। বলল, “ডিমের অমলেট খুব ভালো বানাতে পারি আমি।”
অতিথি মনক্ষুণ্ণ হতে পারে ভেবে মানা করতে পারল না মলি।
রাতের খাবার খাওয়ার পর মলিকে রান্নাঘরে বাসন-পেয়ালা ধোয়ায় সাহায্য করল রেন।
বিছানায় শুয়েও অস্বস্তি গেল না মলির। গেস্ট হাউসের অতিথির এতটা ঘরোয়া ব্যবহার বেমানান। তাছাড়া ব্যাপারটা মোটেও সুনজরে দেখেনি গিলেস। আগামী দিন অন্য গেস্টরা এসে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, আশা করে, ঘুমিয়ে পড়ল মলি।
####
দুই…
সকাল হলো। আকাশ অন্ধকার। তুষার পড়ছে। আকাশের মতোই মুখ গোমড়া হয়ে যাচ্ছে গিলেসের। চুপসে গেল মলি। আর কাউকে দোষ দিতে না পেরে সবকিছুর জন্য দায়ী করল এই খারাপ আবহাওয়াকে।
ভাড়াটে ট্যাক্সিতে করে এলো মিসেস বয়েল। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে রাস্তার হালহকিকত জানল গিলেস। ড্রাইভার জানাল, খুবই করুণ অবস্থা।
“রাতের আগেই শৈত্যপ্রবাহ শুরু হবে,” ভবিষ্যদ্বাণী করল ড্রাইভার।
বিষণ্ণ ভাবটা আরও বাড়িয়ে তুললেন যেন মিসেস বয়েল। বিশালদেহী, কুৎসিত চেহারা। গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয় যেন কাঁসার ঘণ্টায় বাড়ি পড়ছে। আশপাশের সবাই যেন তাঁর গোলাম, এমনি ভাবভঙ্গি। ঝগড়ার জন্য মুখিয়ে আছেন যেন সারাক্ষণ। যুদ্ধের সময় যুদ্ধশিবিরে কাজ করেছিলেন, হয়তো সেজন্যই মেজাজ কাঠখোট্টা হয়ে গেছে।
“বুঝতেই পারিনি নতুন ব্যবসা শুরু করেছে, তাহলে আসতামই না,” প্রথমেই শুরু করলেন মিসেস বয়েল। “ভেবেছিলাম, প্রতিষ্ঠিত কোনও গেস্ট হাউস। সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কোথায়!”
“পছন্দ না হলে কেউ থাকতে বলছে না আপনাকে, মিসেস বয়েল,” ফস করে বলে বসল গিলেস।
“না, বলেনি। এবং আমার থাকার ইচ্ছেও তেমন নেই।”
“তাহলে ট্যাক্সির জন্যে ফোন করুন। রাস্তা এখনও বরফে পুরোপুরি ঢেকে যায়নি। খুঁজে দেখুন, অন্য কোনো ভালো জায়গা পেয়ে যেতেও পারেন।” সেই সঙ্গে যোগ করল গিলেস, “অনেক আগ্রহী কাস্টোমার আছে আমাদের। চাপাচাপি করছে, কিন্তু ঘর দিতে পারছি না। আপনি বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের একজনকে খুশি করতে পারব। এবং বেশি ভাড়ায়।”
কড়া চোখে তাকিয়ে আছেন মিসেস বয়েল। গিলেসের কথা শেষ হলে বললেন, “পয়সা খরচ করে এসেছি এত সহজে যাবার জন্যে নয়। অন্তত জায়গাটা কতখানি খারাপ দেখার আগে
তো নয়ই। মিসেস ডেভিস, বড়সড় একটা বাথটাওয়েল দিতে হবে আমাকে। নাক মোছার রুমাল দিলে চলবে না, ওতে গা মোছা হবে না আমার।”
হাতির শরীর কি আর রুমাল দিয়ে মোছা যায়— বলতে ইচ্ছে করল গিলেসের— চেপে গেল। গটমট করে হেঁটে যাচ্ছেন মিসেস বয়েল। সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল সে। মিসেস বয়েলের পিছন থেকে অনুসরণ করছে মলির সঙ্গে।
“দারুণ, ডার্লিং,” ফিসফিস করে বলল মলি, “খুব এক হাত নিয়েছ বেটিকে!”
“যেমন কুকুর তেমন মুগুর,” গিলেস বলল।
“ভাবছি, ক্রিস্টোফার রেনের সঙ্গে বনবে কিনা এর।”
“বনবে না,” গিলেস বলল।
ঠিকই। সেই বিকেলেই মলির কাছে রেনের কথা বললেন মিসেস বয়েল, “বিচ্ছিরি স্বভাবের লোক।” বলার ভঙ্গিতেই বোঝা গেল রেনকে অপছন্দ করেছেন।
বেকারির লোক এলো রুটি নিয়ে। পোশাক দেখে মনে হলো মেরু অভিযানে বেরিয়েছে। দু’দিন পর পর এসে রুটি দিয়ে যায় সে। জানাল, পরের বার ঠিক সময়ে আর আসতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। পথঘাটের অবস্থা শোচনীয়। ক্রমেই খারাপ হচ্ছে আরও।
“অচল হয়ে যাবে সব,” রুটিওয়ালা বলল। “খাবার জমিয়ে রেখেছেন তো বেশি করে?”
“হ্যাঁ,” মলি জানাল। “টিনের খাবারও আছে। তবে, আরও কিছু ময়দা দিয়ে যেতে পারেন।”
আইরিশ কায়দায় বানানো সোডা ব্রেডের কথা মনে পড়ল তার। বেকারির রুটি যদি ফুরিয়ে যায়ই তাহলে ওই ব্রেড বানিয়ে নিতে পারবে।
খবরের কাগজও এনেছে লোকটা। নিয়ে টেবিলে বিছাল মলি। ফরেন অ্যাফেয়ার্স পাত্তা পায়নি এই সংখ্যায়। প্রথম পৃষ্ঠায় শুধু আবহাওয়া আর মিসেস লিয়নের খবর।
মহিলার ভালো ছবি পাওয়া যায়নি। আর যেটা পাওয়া গেছে, রিপ্রোডাকশন খুব খারাপ এসেছে। আবছা ছবি।
“নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়েছে মহিলাকে, কি বলেন?” পিছন থেকে বলে উঠল ক্রিস্টোফার রেন। “আর হবে না তো কী? যে পচা গলিতে থাকত। যেমন জায়গা তেমনি ওই মহিলা। আপনার কী মনে হয়, কোনো রকম ইতিহাস আছে এই খুনের পিছনে?”
“আছে তো বটেই,” জবাবটা দিলেন মিসেস বয়েল, গোমড়ামুখে। “কোনো সময় কোনো পাপ করেছিল হয়তো, তার সাজা পেয়েছে।”
“হুঁ!” ভুরু কুঁচকে মিসেস বয়েলের দিকে তাকাল রেন। “আপনি বলতে চাইছেন এর পিছনে সেক্স-টেক্স জড়িত?”
“ওরকম কিছুই আমি বলতে চাইছি না।”
“তাহলে?” বিড়বিড় করে আপনমনে রেন বলল, “শ্বাসরুদ্ধ করে মারা হয়েছে ওকে। ভাবছি,” নিজের লম্বা দুই হাতের দিকে তাকাল সে, “গলা টিপে মানুষ মারতে কেমন লাগে!”
“খুব মজা!” মিসেস বয়েল বললেন।
তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াল রেন। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল, “শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরতে আপনার কেমন লাগবে, মিসেস বয়েল?”
ঝাঁঝাল কণ্ঠে মিসেস বয়েল বললেন, “খুন করে আপনি খুব মজা পাবেন ভাবছেন?”
তাড়াতাড়ি দু’জনের মাঝে এসে দাঁড়াল মলি। “একটা লোককে খুঁজছে পুলিশ, কথা বলতে চায় ওই খুনের ব্যাপারে। লোকটার পরনে ছিল কালো ওভারকোট, ধূসর হ্যামবুর্গ হ্যাট, গলায় উলের মাফলার। উচ্চতা মাঝারি।”
“তার মানে,” রেন বলল, “লোকটা সহজেই জনতার ভিড়ে মিশে যেতে পারবে। চোখে পড়ার মতো কিছুই ছিল না ওর মধ্যে।”
“না, চোখে পড়ার মতো কিছুই ছিল না।”
####
তিন…
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। নিজের অফিস ঘরে বসে আছেন ইন্সপেক্টর পারমিন্টার। তাঁর সামনে বসে আছে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ক্যানি।
“লোক দু’জনকে দেখতে চাই আমি,” বললেন ইন্সপেক্টর।
“ঠিক আছে।”
“কেমন লোক?”
“বেশভূষায় মনে হলো শ্রমিক। চলন-বলনে ধীর। তবে আস্থা রাখা যায় মনে হলো।”
“বেশ। ডাকো।”
দু’জন লোক এসে ঢুকল ঘরে। একটু বিহ্বল ভাব, নতুন জায়গায় এসেছে বলেই বোধহয়, বিশেষ করে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের এক বিশিষ্ট পুলিশ অফিসারের ঘরে। সাধ্যমতো ভালো কাপড়-চোপড় পরে এসেছে।
তীক্ষ্ণ চোখে দু’জনকেই একবার দেখে নিলেন ইন্সপেক্টর। বুঝে নেয়ার চেষ্টা করলেন কেমন লোক ওরা। অচেনা লোককেও সহজে আপন করে নিতে পারেন তিনি।
“লিয়নের খুনের ব্যাপারে কিছু খবর দিতে পারবেন আপনারা, ভাবছেন তো?” পারমিন্টার বললেন। “এসে ভালোই করেছেন। বসুন। সিগারেট?”
দু’জনেই তাঁর প্যাকেট থেকে সিগারেট নিল। আগুন ধরাল। ইন্সপেক্টর বললেন, “সাংঘাতিক খারাপ আবহাওয়া।”
“ঠিকই বলেছেন, স্যার,” বলল একজন শ্রমিক।
“হ্যাঁ, এবার শুরু করা যাক। বলুন, কী বলতে এসেছেন।”
পরস্পরের দিকে তাকাল একবার দুই আগন্তুক। বিহ্বল ভাবটা পুরোপুরি কাটেনি এখনও। কী বলে শুরু করবে, ভাবছে।
“তুমিই বলো, জো,” দু’জনের মধ্যে গায়েগতরে বড় লোকটা সঙ্গীকে বলল।
জো বলল, “কোনখান থেকে শুরু করি? হ্যাঁ, ম্যাচ ছিল না আমাদের কাছে।”
“কোন জায়গায় ছিলেন তখন?” প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর।
“জার্মান স্ট্রিট। ওখানেই কাজ করি আমরা, রাস্তার ধারে গ্যাস স্টেশনে।”
মাথা ঝাঁকিয়ে বলে যেতে ইশারা করলেন ইন্সপেক্টর। প্রশ্ন করে জেনে নিলেন, জার্মান স্ট্রিটের কোন স্টেশনটায় কাজ করে ওরা। কোন সময়কার কথা বলতে এসেছে তা-ও জানলেন। জানলেন, মিসেস লিয়ন যেখানে খুন হয়েছে সেই কালভার স্ট্রিট থেকে বেশি দূরে নয় জার্মান স্ট্রিট।
“হ্যাঁ, তারপর? ম্যাচ ছিল না…” কথার খেই ধরিয়ে দিলেন ইন্সপেক্টর।
“বাক্স ছিল, কাঠি ফুরিয়ে গিয়েছিল,” বলল জো। “বিলের লাইটারও কাজ করছিল না, মানে, জ্বলছিল না। এই সময় লোকটাকে দেখলাম। গিয়ে বললাম : ম্যাচ আছে আপনার কাছে? লোকটাকে দেখে তখন কিছুই মনে হয়নি, আর দশজন সাধারণ পথচারীর মতোই হেঁটে যাচ্ছিল।”
আবার মাথা ঝাঁকালেন পারমিন্টার।
“ম্যাচ বের করে দিল লোকটা। কোনো কথা বলল না। বিল বলল : ‘ভীষণ ঠাণ্ডা পড়েছে।’ অদ্ভুত গলায় ফিসফিস করে বলল শুধু লোকটা : ‘হ্যাঁ, ঠাণ্ডাই!’ ভাবলাম, লোকটার ঠাণ্ডা লেগেছে, সেজন্যেই এমন ফিসফিস করছে। সারা শরীর কাপড়ে মোড়া। ধন্যবাদ জানিয়ে ম্যাচটা ফিরিয়ে দিলাম ওকে। নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল সে। রাস্তায় পড়ে থাকা ছোট নোটবুকটা চোখে পড়ল তখন। লোকটার ভেবে তুলে নিলাম। অনেকটাই এগিয়ে গেছে সে। ডাক দিয়ে বললাম, ‘এই যে মিস্টার, শুনছেন? আপনার নোটবুক ফেলে গেছেন।’ কিন্তু লোকটা শুনল বলে মনে হলো। প্রায় ছুটে চলেছে। বাঁকের কাছে চলে গেছে। দেখতে দেখতে মোড় নিয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেল। ঠিক বলেছি না, বিল?”
“ঠিক,” সায় দিল বিল। “হাঁটা নয়, আসলে দৌড়াচ্ছিল লোকটা।”
“পিছনে যেতে পারতাম, কিন্তু লাভ হতো না। আমরা গিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতেই হ্যারো রোডে ঢুকে যাবে, আন্দাজ করলাম। আর তাছাড়া তেমন কোনো মূল্যবান জিনিস নয়— মানিব্যাগ বা ওরকম কিছু— সাধারণ একটা নোটবুক। তাই গুরুত্ব দিইনি। চোখের ওপর নামানো হ্যাট, গ্রেটকোটের সব ক’টা বোতাম লাগানো— সিনেমার গুণ্ডা-বদমাশরা যা করে থাকে। বিলকে তখনই বলেছি আমার সন্দেহের কথা, না বিল?”
“হ্যাঁ,” মাথা ঝাঁকাল বিল।
“তবে প্রথমে দেখে লোকটাকে তত খারাপ মনে হয়নি। ভেবেছি, হয়তো শরীর খারাপ, ঠাণ্ডায় বাইরে থাকতে চাইছে না। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।”
“আমিও তাই ভেবেছি,” বিল বলল।
“বিলকে বললাম, নোটবুকটা খুলে পড়া দরকার। হয়তো লোকটার ঠিকানা লেখা আছে। সুযোগ করে এক সময় ওটা পৌঁছে দেব তার কাছে। দুটো ঠিকানা লেখা আছে বইটাতে। একটা, চুয়াত্তর নম্বর কালভার স্ট্রিট। আরেকটা, একটা ম্যানর হাউস। ভিক্টোরিয়ান যুগের ওই গান্ধা বাড়িগুলোর কোনোটা হবে আরকি।”
“মুখ খারাপ কোরো না,” বিল বলল।
“আমাদের ওখান থেকে কালভার স্ট্রিট কাছেই। বিলের সঙ্গে আলোচনা করলাম, ছুটির পরেই বইটা ওখানে পৌঁছে দিতে পারব আমরা। হঠাৎ পৃষ্ঠার একপাশে ওপর দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠল বিল : ‘কী লেখা?’ আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে পড়ল : ‘থ্রি ব্লাইন্ড মাইস— মাস্ট বি অফ হিস কার।’ ঠিক এই সময় শোনা গেল চিৎকার। দুটো গলির পরের গলি থেকে। এক মহিলা ‘খুন! খুন!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল।”
গল্প ক্লাইম্যাক্সে তুলে নিয়ে এসেছে। একটু জিরেন দেয়া দরকার মনে করল যেন জো। থামল।
“দু’জনে স্টেশন ছেড়ে একসঙ্গে যেতে পারি না,” আবার শুরু করল জো। “বিলকে বললাম, তুমি গিয়ে দেখে এসো। গেল
ও। ফিরে এসে জানাল : বহু লোকের ভিড়। পুলিশ এসেছে। এক মহিলা খুন হয়েছে। গলা কেটে নাকি গলা টিপে খুন করা হয়েছে বলতে পারল না বিল। বাড়িওলি নাকি প্রথম লাশ দেখে চেঁচিয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম, কোন গলিতে? বিল বলল, কালভার স্ট্রিটে। কত নম্বর জানতে চাইলাম। বলল, দেখতে পারেনি।”
কেশে উঠল বিল। পায়ে পা ঘষল। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “ভিড়ের জন্যে দেখতে পারিনি। তবে পরে আবার আমরা গিয়েছিলাম। হ্যাঁ, বাড়িটার নম্বর চুয়াত্তর। ব্যাপারটা নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা করেছি আমরা দু’জনে। শেষে পুলিশের ঘোষণা শুনলাম : একটা বিশেষ লোকের সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমরা বুঝলাম, ওই লোকটার সঙ্গেই কথা বলতে চায় পুলিশ। ওর ব্যাপারে কিছু জানালে পুলিশের সুবিধে হবে ভেবেই এখানে এসেছি। খামোকা সময় নষ্ট করলাম না তো আপনাদের?”
“না, ভালোই করেছেন এসে। ঠিক কাজই করেছেন,” পারমিন্টার বললেন। “নোটবুকটা সঙ্গে এনেছেন? ও, এনেছেন। থ্যাংক ইউ। এখন বলুন তো…”
একের পর এক প্রশ্ন করে গেলেন ইন্সপেক্টর। পুরো ঘটনাটা শুনলেন আবার জো ও বিলের মুখ থেকে। ঘটনার স্থান, সময়, তারিখ মিলে গেল ঠিক ঠিক। শুধু নোটবুকটা ফেলে গেল যে লোকটা তার চেহারার পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া গেল না। আতঙ্কিত বাড়িওলির কাছ থেকে যে বর্ণনা পাওয়া গেছে, একই রকম বর্ণনা দিল জো আর বিল। চোখের ওপর টেনে নামানো ছিল হ্যাট, কোটের সবক’টা বোতাম আটকানো, গলায় জড়ানো
মাফলারের একটা অংশ মুখের ওপর টেনে দিয়েছিল। হাতে ছিল দস্তানা। কথা বলেছে ফিসফিস করে।
কথা শেষ করে বিদায় নিয়ে চলে গেল দুই শ্রমিক। নোটবুকে মন দিলেন ইন্সপেক্টর। ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায় কিনা দেখার জন্য বিশেষ দপ্তরে পাঠাতে হবে বইটা। কিন্তু তার আগে লেখাগুলোর মর্মোদ্ধার করা দরকার। ঠিকানা দুটো বার-কয়েক পড়লেন ইন্সপেক্টর। ঠিকানার ওপরে পৃষ্ঠার একপাশে ছোট ছোট করে লেখা রয়েছে কয়েকটা শব্দ।
দুই শ্রমিককে এগিয়ে দিতে গিয়েছিল সার্জেন্ট ক্যানি, ফিরে এসে ঘরে ঢুকল।
মুখ তুলে তাকালেন পারমিন্টার। “এখানে এসো। এটা দেখো।”
ইন্সপেক্টরের পিছনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে লেখাটা পড়তে পড়তে মৃদৃ শিস দিয়ে উঠল সার্জেন্ট। “থ্রি ব্লাইন্ড মাইস…”
“হ্যাঁ,” ড্রয়ার খুলে নোটবুকের অর্ধেকটা ছেঁড়া পাতা বের করলেন পারমিন্টার। নোটবুকের পাশে রাখলেন। এটা পাওয়া গেছে মৃত মহিলার বুকে। কাপড়ের সঙ্গে পিন দিয়ে আটকানো ছিল। “এটা দেখো এবার।”
কাগজটায় লেখা : একটা শেষ হলো। এর নিচে কাঁচা হাতে আঁকা হয়েছে তিনটে ইঁদুর ছানা। ছবির নিচে গানের প্রথম চরণের স্বরলিপি লেখা।
থ্রি ব্লাইন্ড মাইস, সী হাউ দে রান… স্বরলিপি দেখে দেখে মৃদু শিস দিয়েই চলেছে সার্জেন্ট।
“বুঝতে পেরেছ কিছু? আসলে স্বরলিপিটাকেই স্বাক্ষর হিসেবে ব্যবহার করেছে খুনী।”
“পাগলামি, না স্যার?”
“কী জানি!” অনিশ্চিত শোনাল পারমিন্টারের গলা। “লাশের পরিচয় জানা গেছে?”
“হ্যাঁ, স্যার,” ফিঙ্গারপ্রিন্ট রিপোর্ট বের করে দিল সার্জেন্ট। “লোকে জানত ওর নাম মিস লিয়ন, আসলে ও গ্রেগ। মাস দুই আগে হলোওয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে।”
চিন্তিত দেখাল পারমিন্টারকে। রিপোর্টে জানানো হয়েছে : কালভার স্ট্রিটের ৭৪ নম্বর বাড়িতে থাকত। ওখানকার মানুষকে তার নাম জানিয়েছে, মরিন লিয়ন। মাঝে মধ্যে মদ খেত মহিলা, দুয়েকবার রাতে পুরুষ মানুষও সঙ্গে এনেছে। ভয় পাওয়ার কোনও লক্ষণ কখনও দেখা যায়নি ওর মাঝে। তার মানে কোনোরকম বিপদের আশঙ্কা করেনি। ওই অদ্ভুত লোকটা বেল বাজিয়েছে, বাড়িওলি দরজা খুলে দিলে মিসেস লিয়ন কোথায় থাকে জিজ্ঞেস করেছে, তারপর দোতলায় উঠে গেছে। লোকটার চেহারার বর্ণনা দিতে পারেনি বাড়িওলি। শুধু জানাতে পেরেছে : মাঝারি উচ্চতার লোক, গলার স্বর ফিসফিসে— হয়তো সাংঘাতিক ঠাণ্ডা লেগেছিল বলেই ওরকম হয়েছিল। লোকটার সঙ্গে কথা বলে আবার বেযমেন্টে ফিরে গেছে বাড়িওলি, নিজের কাজে। এরপর সন্দেহজনক আর কোনো শব্দ শোনেনি। লোকটার বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ শোনেনি। মিনিট দশেক পর চা নিয়ে ওপরে গিয়ে দেখে মরে পড়ে আছে মিসেস লিয়ন।
“হঠাৎ মাথা গরম করে একে খুন করা হয়নি, সার্জেন্ট,” পারমিন্টার বললেন। “প্ল্যান করে এসেছিল খুনী। আমি ভাবছি, মংকসওয়েল ম্যানর নামে ক’টা বাড়ি আছে ইংল্যান্ডে?”
“খুনীর তো দরকার একটা।”
“ভাগ্যের ওপর অতিমাত্রায় বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নেই। ভালোমতো খোঁজখবর করে দেখার সময়ও নেই আমাদের হাতে।”
সার্জেন্টের চোখ নোটবুকের পাতায় নিবদ্ধ। বিড়বিড় করে পড়ল : ৭৪ নম্বর কালভার স্ট্রিট, মংকসওয়েল ম্যানর। বলল, “তাহলে আপনি ভাবছেন…”
বাধা দিয়ে ইন্সপেক্টর বললেন, “কেন, তুমি ভাবছ না?”
“হতে পারে। মংকসওয়েল ম্যানর… মংকসওয়েল… কোথাও নামটা দেখেছি আমি, শিওর।”
“কোথায়?”
“ওটাই মনে করার চেষ্টা করছি… খবরের কাগজ… টাইমস… হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে… এক মিনিট, স্যার, আমি আসছি,” প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল সার্জেন্ট।
একটু পরেই ফিরে এলো আবার। হাতে একটা খবরের কাগজ। ইন্সপেক্টরের টেবিলে বিছিয়ে দিয়ে, একটা জায়গায় আঙুল রেখে বলল, “এই যে দেখুন।”
ইন্সপেক্টর বিড়বিড় করে পড়লেন : মংকসওয়েল ম্যানর, হারপ্লেডেন, বার্কস।
থাবা দিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিলেন ইন্সপেক্টর। দ্রুত হাতে ডায়াল করে বললেন, “বার্কশায়ার কাউন্টি পুলিশকে দাও, জলদি!”
###
চার…
মেজর মেটকাফও এসে পৌঁছল। পুরো হলো অতিথির সংখ্যা। এইবার পুরোদমে চালিয়ে যেতে হবে গেস্ট হাউস, ভাবল মলি।
লোকটা মিসেস বয়েলের মতো ঝগড়াটেও নয়, ক্রিস্টোফার রেনের মতো অস্থির স্বভাবেরও নয়। বেঁটেখাটো, মাঝবয়েসি, চেহারায় মিলিটারি ছাপ, চাকরির বেশির ভাগই নাকি ভারতে কাটিয়েছে। নিজের ঘর আর ফার্নিচার দেখে সন্তুষ্ট হলো সে। সঙ্গে মালপত্র বলতে শুয়োরের চামড়ায় তৈরি দুটো ভারি সুটকেস। দেখে আশঙ্কা দূর হলো গিলেসের। এই লোক পয়সা না দিলেও সুটকেস আটাকালে ভাড়া আদায় হয়ে যাবে, ভাবল
সে। মিসেস বয়েলের সঙ্গেও মোটামুটি মানিয়ে নিল মেজর। আলাপ-পরিচয় করে নিল। পুনার ইয়র্কশায়ারে নাকি মিসেস বয়েলের খালাত ভাইয়ের বন্ধু আছে, এবং সেই বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় আছে মেজরের… ইত্যাদি ইত্যাদি।
অতিথিদের সঙ্গে বসে একটানা গল্প করার সময়-সুযোগ পেল না গিলেস দম্পতি। রান্নাঘরেই ব্যস্ত থাকতে হলো ওদের। ডিনার সার্ভ করল, খাওয়া শেষ করল, বাসন-পেয়ালা ধুল। তাদের কফির খুব প্রশংসা করল মেজর।
রাত হলো। এতক্ষণে বিছানায় পিঠ লাগানোর সময় পেল গিলেস দম্পতি। ক্লান্ত, কিন্তু খুশি। প্রথম দিনের কাজকর্মগুলো ঠিকঠাকমতোই সারতে পেরেছে।
রাত দুটোয় হঠাৎ কলিং বেলের তীক্ষ্ণ আর্তনাদে ঘুম ভেঙে গেল দু’জনেরই।
“দুত্তোর!” বিরক্তি ঝরল গিলেসের কণ্ঠে। “এত রাতে…”
“জলদি করো!” তাড়া দিল মলি। গিয়ে দেখো!”
তীব্র চোখে একবার স্ত্রীর দিকে তাকাল গিলেস। কম্বল সরাল। ড্রেসিং গাউনটা গায়ে জড়াল ভালোমতো। ঘর থেকে বেরিয়ে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে।
দরজার ছিটকানি খোলার শব্দ শুনল মলি। লাগানো হলো আবার। হলঘরে কথার শব্দ। আর কৌতূহল সামলাতে পারল না সে। বিছানা থেকে নামল। সিঁড়ির মাথায় এসে দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিল। হলরুমে এক ভদ্রলোককে তুষার মাখা ওভারকোট
খুলতে সাহায্য করছে গিলেস। এখান থেকেও ওদের কথা শুনতে পেল মলি।
“বার্র্র্!” বিদেশি ভাষায় বিরক্তি প্রকাশ করলেন ভদ্রলোক। ইংরেজিতে বললেন, “ঠাণ্ডায় একেবারে অবশ হয়ে গেছে আঙুল! সাড়া নেই। পা দুটোও…” মেঝেতে লাথি মারার শব্দ হলো।
“এদিকে আসুন,” লাইব্রেরির দরজা খুলে দিয়ে গিলেস বলল। “এখানে গরম আছে। একটু বসুন। আপনাকে একটা ঘর রেডি করে দিচ্ছি।”
“কপাল ভালোই তাহলে আমার,” মোলায়েম স্বরে বললেন আগন্তুক। “ঘর আছে।”
রেলিঙের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল মলি। দেখা যাচ্ছে ভদ্রলোককে। বয়স্ক লোক। কালো দাড়ি। মেফিসটোফেলিন (Mephistophelean) ভুরু। চাঁদির চুল ধূসর হয়ে এসেছে। কিন্তু বয়েসের তুলনায় বেশ চটপটে, স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে হাঁটে।
ভদ্রলোক লাইব্রেরিতে ঢুকতেই বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিল গিলেস। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো দ্রুত।
মলি জিজ্ঞেস করল, “ভদ্রলোক কে?”
হেসে জবাব দিল গিলেস, “গেস্ট হাউসের আরেক গেস্ট। তুষারে ঢেকে গেছে পথ। পিছলে উল্টে গেছে তাঁর গাড়ি। কোনোমতে বেরিয়ে এসেছেন গাড়ি থেকে। সাংঘাতিক এই তুষারপাতের মধ্যে হেঁটে এলেন কীভাবে এখান পর্যন্ত, সেটাই ভাবছি!”
“ভালোমতো জিজ্ঞেস করেছ তো সব কিছু?”
“প্রয়োজন মনে করিনি। এত দুর্যোগে চুরি করতে আসেননি এটা ঠিক।”
“ভদ্রলোক বিদেশি না?”
“হ্যাঁ। নাম পারাভিসিনি। ওয়ালেটে নাম লেখা আছে, আমাকে দেখিয়েছেন। ওয়ালেটটা টাকায় ভর্তি। ইচ্ছে করেই দেখালেন কিনা কে জানে। বলে এলাম ঘর রেড়ি করে দিচ্ছি। কোন ঘরটা দেয়া যায়, বলো তো?”
“সবুজ রঙ করা ঘরটা। রেডিই আছে। বিছানাটা শুধু করে দিলেই হলো।”
“আমার পাজামাও ধার দিতে হবে ওঁকে। সব জিনিসপত্র নাকি গাড়ির ভিতর রয়ে গেছে। জানালা দিয়ে বেরিয়েছেন।”
ঘরে এসে চাদর, বালিশের কভার আর তোয়ালে বের করল মলি।
দু’জনে মিলে তাড়াতাড়ি সবুজ ঘরের বিছানা ঠিক করল। গিলেস বলল, “তুষারপাত বাড়ছে। মনে হয় আটকেই গেলাম, মলি। যোগাযোগ অচল হয়ে গেল। ভাবতে ভালোই লাগছে, এক ধরনের উত্তেজনা আছে, তাই না?”
“কী জানি!” মলির কণ্ঠস্বর অনিশ্চিত। “শেষমেশ খাবারের অভাবে সোডা ব্রেডই বানাতে হবে হয়তো আমাদের।”
“বানাতে হলে বানাবে। পাকা রাঁধুনি তুমি, ভয় কী?”
স্বামীর প্রশংসায় খুশি হলো মলি। “কিন্তু ওই রুটি তো কখনও বানাইনি আমি। যদি না পারি?”
“হুঁ, ভাবনার কথা। বেকারির লোক আসতে পারবে না যে শিখে নেবে। কসাই আসবে না, পোস্টম্যান না। খবরের কাগজ পাবে না। টেলিফোন লাইনও নষ্ট হয়ে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে।”
“শুধু রেডিওই ভরসা। বাইরের খবর কিছুটা হলেও জানতে পারব।”
“ভাগ্যিস জেনারেটর রাখার কথা ভেবেছিলাম। বিদ্যুৎ চলে গেলেও চালিয়ে নিতে পারব।”
“সেন্ট্রাল হিটিং এক মুহূর্তের জন্যে বন্ধ রাখা যাবে না। জমে মারা যাব।”
“কিন্তু কয়লাওয়ালাও তো আসবে না। স্টক কম। ফুরিয়ে গেলে জেনারেটর বন্ধ। তখন? নাহ্, সামনে সময় খুবই খারাপ, বোঝা যাচ্ছে।”
“ভয় লাগছে আমার, ডার্লিং।” চাদরে একটা শেষ চাপড় দিয়ে মলি বলল, “বিছানা করা হয়ে গেছে। ডেকে নিয়ে এসো ওঁকে। আমি শুতে গেলাম।”
সকালেই বোঝা গেল গিলেসের অনুমানই ঠিক, সামনে সময় খুবই খারাপ। ইতিমধ্যেই পাঁচ ফুট বরফ জমেছে। দরজা-জানালা খোলাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরে তুষার ঝরছে অনবরত। নিঃশব্দ সাদা প্রকৃতির দিকে তাকালে বুক কেঁপে ওঠে আতঙ্কে।
####
পাঁচ…
নাস্তার টেবিলে বসে আছেন মিসেস বয়েল। ডাইনিংরুমে আর কেউ নেই। খেয়ে উঠে গেছেন মেজর। তার এঁটোও পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। রেনের খাবার দেয়া আছে টেবিলে, সে এখনও আসেইনি। দেরিতে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস বোধহয়। আর মিসেস বয়েলের জন্য সকাল ন’টাই নাস্তার উপযুক্ত সময়।
ওমলেট খাওয়া হয়ে গেছে মিসেস বয়েলের। শক্তিশালী সাদা দাঁতের কামড় বসালেন মুচমুচে টোস্টে। মেজাজ খারাপ। সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। মংকসওয়েল ম্যানরের পরিবেশ তাঁর মনের মতো হয়নি। ভেবেছিলেন, স্মার্ট কথাবার্তা বলে আর যুদ্ধে
কাজ করার রেকর্ড নিয়ে একদল ছেলেছোকরা আর বাচ্চা মেয়ের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারবেন। সমাজের উঁচু মহলে তাঁর যোগাযোগের বহর দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু নিরাশ হতে হয়েছে তাঁকে।
যুদ্ধ তাঁর সর্বনাশই করে দিয়েছে বলতে গেলে। কিন্তু আগে কি জানতেন সে-কথা? যুদ্ধশিবিরে কাজ করার সময় কী কর্তৃত্বই না করতেন। অধীনস্ত মেয়েরা সারাক্ষণ তাঁর ভয়ে তটস্থ থাকত। কী দাপটটাই না ছিল তাঁর! তারপর? যুদ্ধ শেষ হলো। কাজ গেল। ক্ষমতাও গেল। বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে বাড়িটা। মেরামত করতে হবে, নতুন করে সাজাতে হবে। তার জন্য সময় দরকার, টাকা দরকার। সময় আছে, কিন্তু টাকা নেই। এক ভাইয়ের মেয়ে ভরসা দিয়েছে, টাকা দেবে। কিন্তু একটু সময় লাগবে। এই সময়টা কোথায় থাকবেন তিনি? ঠিক করেছিলেন, অল্প ভাড়ায় কোনো গেস্ট হাউস কিংবা বোর্ডিং হাউসে থাকবেন। কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে মংকসওয়েল ম্যানরটাকে পছন্দ হওয়ায় এখানে এসেছেন।
চোখে অবজ্ঞা নিয়ে ঘরটায় আরেকবার চোখ বোলালেন তিনি। “ঠকিয়েছে!” বিড়বিড় করলেন আপনমনে। “খুব ঠকানো ঠকিয়েছে। ঘুণাক্ষরেও যদি একবার বুঝতাম, নতুন কারবার শুরু করেছে এরা!”
খালি প্লেটটা ঠেলে সরালেন তিনি। কফির কাপ তুলে নিলেন। চুমুক দিয়ে ক্ষোভ কিছুটা কমল। আর যাই হোক, খাবারগুলো খুব ভালো দিয়েছে। ভালো রাঁধে মলি নামের মেয়েটা। মারমালেড ভালো। কফি ভালো। বিছানাও খারাপ না। চাদরে এমব্রয়ডারি করা ফুল। নরম বালিশ। মিসেস বয়েলের
আরাম-আয়েশ খুব পছন্দ। খুঁত ধরাটাও যেন একটা বিলাসিতা, আর এই কাজটা পারেনও খুব ভালো।
রাজকীয় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। বেরোতে যাবার মুখে মুখোমুখি হয়ে গেল ‘বিচ্ছিরি লোকটার’ সঙ্গে। লাল চুল। উলের একটা চেক টাই গলায়, কী বিচ্ছিরি রঙ। ক্যাটক্যাটে সবুজ।
“মানেই হয় না,” বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন বললেন মিসেস বয়েল, “কোনো মানে হয় না।”
চোখের কোণ দিয়ে তাঁর দিকে তাকাল যুবক। ব্যাপারটা আরও পছন্দ হলো না মিসেস বয়েলের।
“মানসিক রোগী,” আবার বিড়বিড় করলেন তিনি। “মানসিক রোগী না হয়েই যায় না!”
যুবকের হাসি হাসি ‘গুড মর্নিং’-এর জবাবে মাথাটা সামান্য একটু নোয়ালেন মিসেস বয়েল। তারপর মিলিটারি কায়দায় গটমট করে মার্চ করে এসে ঢুকলেন মস্ত ড্রইংরুমে। চেয়ারগুলো খুব আরামদায়ক, বিশেষ করে গোলাপি গদিওয়ালা বড় চেয়ারটা। এটা এখন থেকে তাঁর দখলেই থাকবে, বুঝিয়ে দেয়ার তাগিদ অনুভব করলেন তিনি। উলের বান্ডিল আর কাঁটা রেখে দখল করলেন। হেঁটে গিয়ে রেডিয়েটরে হাত রাখলেন। যা ভেবেছিলেন। ঠাণ্ডাই বলা চলে। উজ্জ্বল হলো মুখ। একটা কিছু নিয়ে ধমকানোর সুযোগ পাওয়া গেল।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। আবহাওয়া খুবই খারাপ। জায়গাটাও পছন্দ নয় তাঁর। যা-ই হোক, বেশিদিন থাকবেন না
এখানে, এটাই সান্ত্বনা। অবশ্য যদি বর্তমানে যে সব বোর্ডার আছে, তারা চলে গিয়ে নতুন পছন্দসই বোর্ডার আসে, তাহলে থাকার কথা ভেবে দেখবেন।
চালের ওপর থেকে ঝরে পড়ল একগাদা তুষার। নিচের বরফে বাড়ি খেয়ে আলতো ছড়াৎ শব্দ তুলে ছিটকে পড়ল চারদিকে।
চমকে উঠলেন মিসেস ৰয়েল। চেঁচিয়ে বললেন, “না না, আমি থাকবই না…”
পিছনে কারও হাসির শব্দে থেমে গেলেন তিনি। ঝট করে ফিরে তাকালেন। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে রেন। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবভঙ্গি মোটেও সুবিধের নয়, অন্তত মিসেস বয়েলের কাছে সেরকমই মনে হলো।
“আমারও তাই মনে হয়,” রহস্যময়কণ্ঠে রেন বলল, “খুব বেশিদিন আর থাকছেন না আপনি।”
####
ছয়…
পিছনের দরজার সামনে থেকে বেলচা দিয়ে বরফ সরাতে গিলেসকে সাহায্য করছেন মেজর। কর্মঠ লোক মেটকাফ, রীতিমতো কৃতজ্ঞ বোধ করল গিলেস।
“ভালো ব্যায়াম,” মেজর বললেন। “রোজ নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিত। শরীর ভালো থাকে।”
সেরেছে! ভাবল গিলেস। ব্যায়াম করার জন্য রোজ ভোরে উঠবেন মেজর। নাস্তা দিতে হবে তাঁকে। আর সেজন্য গিলেসকেও সকালে উঠতে হবে।
গিলেসের মনের কথা পড়ে ফেললেন যেন মেজর। বললেন, “খুব ভোরে আমাকে নাস্তা বানিয়ে দিয়েছে আপনার মিসেস। ওর কাজে খুব খুশি হয়েছি। আর হ্যাঁ, রোজ একটা করে নতুন পেড়ে রাখা মুরগির ডিম দিতে বলবেন, খুব পছন্দ করি আমি।”
ব্যবসার খাতিরে সাতটার আগেই উঠতে হয়েছে গিলেসকে। সিদ্ধ ডিম আর চা দিয়ে নাস্তা সেরে এসে বসার ঘরে বসেছিল মলির সঙ্গে। অতিথিদের নাস্তার সমস্ত ব্যবস্থা করে এসেছে। গিলেস ভাবছে, সে যদি এই গেস্ট হাউসের মালিক না হয়ে গেস্ট হতো, তাহলে কী করত? প্রথম কথা, এত সকালে বিছানা ছেড়ে উঠত না কোনোমতেই।
মেজর উঠে নাস্তা সারলেন। তারপর টহলো দিয়ে ফিরতে লাগলেন সারা বাড়িতে। কিছু একটা করার জন্য উসখুস করতে লাগলেন। গিলেস বেলচা নিয়ে বরফ পরিষ্কার করতে বেরোতেই
প্রায় লাফিয়ে উঠলেন মেজর। তিনিও একটা বেলচা তুলে নিয়ে ওকে সাহায্য করতে এলেন।
প্রচুর বরফ জমেছে। কতক্ষণ সরাবেন তিনি? চোরা চোখে একবার মেজরের দিকে তাকাল গিলেস। আর দশজন সাধারণ মানুষের তালিকায় ফেলা যাবে না তাঁকে। পোড়খাওয়া, মধ্যবয়সী মানুষটার চোখ দুটো সদাসতর্ক। কোনো কিছুই ওই চোখ এড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। এই লোক মংকসওয়েল ম্যানরে কেন ভেবে অবাক লাগল গিলেসের। গেস্ট হিসেবে কোনোমতেই মেনে নিতে পারছে না তাঁকে। কে জানে, হয়তো বেকার। টাকাপয়সা তেমন নেই। হয়তো যাবারও আর কোনো জায়গা খুঁজে পাননি।
####
সাত…
অনেক দেরি করে নামলেন পারাভিসিনি। এক টুকরো টোস্ট খেয়েই কফির কাপ টেনে নিলেন। পুরোদস্তুর ইয়োরোপীয় ব্রেকফাস্ট।
মলি মাস্তা নিয়ে ঢুকতেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। বাউ করেছিলেন অতি নাটকীয় ভঙ্গিতে। প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলেছেন, “বাহ্, বেশ সুন্দরী তো! নিশ্চয় আমাদের হোস্টেস। কী, ঠিক বলিনি?”
পারাভিসিনির খাওয়া শেষ করে কাপ-প্লেটগুলো নিয়ে এলো মলি। রান্নাঘরের সিংকে ডুবিয়ে ধুতে ধুতে আপনমনেই বিড়বিড় করল, “মহা মুসিবত! একেকজন একেক সময় উঠছে। বেশ গোলমেলেই মনে হচ্ছে ব্যবসাটা।”
কাপ-প্লেট তাকে সাজিয়ে বলে মলি। তাড়াতাড়ি উঠে এলো ওপরতলায়। বিছানাগুলো গোছাতে হবে। এখন আর গিলেসের কাছ থেকে সাহায্য পাবার আশা নেই। বরফ সরিয়ে বয়লার হাউস আর মুরগির খোঁয়াড়ে যাবার ব্যবস্থা করতেই অনেক সময় লেগে যাবে।
দ্রুত হাতে বিছানা গোছাতে লাগল মলি। মেজাজ খারাপই হয়ে যাচ্ছে। টান দিয়ে দিয়ে তুলে নিতে লাগল একেকটা বিছানার চাদর। নতুন চাদর বিছাল। তারপর ময়লা চাদরগুলো তুলে নিয়ে এসে বাথরুমে ঢুকল।
চাদর ধুতে ব্যস্ত সে, এই সময় বাজল ফোন।
কাজে বাধা পড়ায় গালিটা আপনাআপনি বেরিয়ে গেল ওর মুখ থেকে। আবার সামান্য স্বস্তিও বোধ করল। ওকে খানিক বিশ্রামের সময় করে দিয়েছে ওই টেলিফোন। প্রায় দৌড়ে নেমে এলো সে।
লাইব্রেরিতে ঢুকে রীতিমতো হাঁপাচ্ছে মলি। ছোঁ মেরে তুলে নিল রিসিভার।
“বলুন?”
কথায় আঞ্চলিক টান ও আন্তরিকতাভরা এক কণ্ঠ জিজ্ঞেস করল, “এটা কি মংকসওয়েল ম্যানর?”
“হ্যাঁ, মংকসওয়েল ম্যানর গেস্ট হাউস।”
“কমান্ডার ডেভিসের সঙ্গে কথা বলতে পারি, প্লিজ?”
“দুঃখিত। ফোনের কাছে আসার অবস্থায় নেই ও,” মলি বলল। “আমি মিসেস ডেভিস। আপনি কে?”
“সুপারিন্টেনডেন্ট হগবেন, বার্কশায়ার পুলিশ।”
হঠাৎ দম আটকে গেল যেন মলির। “ও… হ্যাঁ… তা-তাই নাকি?”
“মিসেস ডেভিস, একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। টেলিফোনে বেশি কিছু বলা যাবে না। ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ট্রটারকে পাঠিয়েছি আপনাদের ওখানে।”
“আসেনি এখনও।”
“যেকোনো মুহূর্তে পৌঁছে যেতে পারে।”
“বরফে আটকা পড়েছি আমরা। পথ বন্ধ।”
“ট্রটার পৌঁছবেই আপনাদের ওখানে,” বরফের কথা শুনে সামান্যতম বদলাল না অন্যপাশের কণ্ঠটা। “দয়া করে আপনার স্বামীকে বলবেন ট্রটারের প্রতিটি কথা যেন মনোযোগ দিয়ে শোনেন, মেনে চলেন।”
“কিন্তু সুপারিন্টেনডেন্ট হগবেন, কী এমন…”
খুট করে শব্দ হলো ওপাশে। লাইন কেটে গেছে। যতটা বলার বলেছেন সুপারিন্টেনডেন্ট। বার দুই ক্রেডল চেপে খটাখট খটাখট করল মলি, কোনো ফল হলো না। আস্তে করে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল সে। এই সময় খুলে গেল দরজা।
ফিরে তাকাল মলি। “ওহ্, গিলেস! ডার্লিং!”
গিলেসের চুলে তুষারকণা। হাতেমুখে কয়লার কালি। পরিশ্রমে লাল হয়ে গেছে মুখ। “কী হয়েছে, মলি? ঝুড়ি ভরে কয়লা এনে রেখেছি। মুরগির খোঁয়াড়টা পরিষ্কার করেই বয়লারের দিকে নজর দেব… কী হয়েছে, মলি? খুব ভয় পেয়েছ মনে হচ্ছে?”
“গিলেস, পুলিশ!”
“পুলিশ!” ভুরু কোঁচকাল গিলেস।
“একজন ইন্সপেক্টর… না না, সার্জেন্ট পাঠাচ্ছে এখানে।”
“কেন?”
“আমি জানি না। আয়ারল্যান্ড থেকে চোরাই পথে আনানো দু’পাউন্ড মাখনের কথাটা জেনে যায়নি তো?”
“কী জানি! রেডিওর লাইসেন্স তো করিয়েছিলাম, নাকি?”
“হ্যাঁ, ডেস্কেই আছে। গিলেস, মিসেস বিডলক আমার পুরানো টুইডের কোটটার বিনিময়ে পাঁচটা কুপন দিয়েছে। কাজটা ঠিক করেছি তো? বেঠিকও তো মনে হচ্ছে না। পাঁচটা কুপন, বিনিময়ে একটা টুইডের কোট। নাহ্, ঠিকই আছে। গিলেস, কী এমন করেছি আমরা যার জন্যে পুলিশ আসছে?”
“সেদিন একটা গাড়ির সঙ্গে গুঁতো লাগিয়েছিলাম। কিন্ত আমার দোষ ছিল না, ওই গাড়িটার ড্রাইভারের দোষ।”
“নিশ্চয় কিছু একটা করেছি আমরা!” কেঁদেই ফেলবে যেন মলি।
“আসলে সবাই কিছু না কিছু অপরাধ আমরা করেই চলেছি,” গম্ভীর গলায় বলল গিলেস। “সে-কারণে পুলিশের নাম শুনলেই আমরা ঘাবড়ে যাই, অস্বস্তি বোধ করি। আমার মনে হয়, আমাদের এই গেস্ট হাউস নিয়েই কিছু একটা ঘটেছে। গেস্ট হাউস চালাতে গেলে পুলিশের পারমিশন বা এ ধরনের কিছু হয়তো লাগে-টাগে।”
“মদ রাখার জন্যে হতেও পারে। কিন্তু আমরা তো কোনো গেস্টকে এখনও খেতেই দিইনি। তাছাড়া আমাদের ব্যবসা আমরা চালাব, তাতে পুলিশের কী? বেআইনি কিছু না করলেই তো হলো।”
“হয়তো কিছু করছি না। কিন্তু ওই যে বললাম, পারমিশন। আজকাল তো সবকিছুতেই অতি কড়াকড়ি।”
“ও ডিয়ার,” প্রায় ফুঁপিয়ে উঠল মলি। “এই ব্যবসায় নামাই উচিত হয়নি আমাদের। শুরুতেই বরফে আটকা পড়লাম। কোনো অসুবিধেয় পড়লেই এখন এখানে এসে ওঠার চেষ্টা করবে লোকে। আমাদের জমানো খাবার খেয়ে শেষ করবে। দুর্গত হিসেবে আসবে, কিছু বলতেও পারব না…”
“হয়েছে, হয়েছে। অত ভাবনার কিছু নেই,” সান্ত্বনা দিল গিলেস। “শুরুতে খারাপ যাচ্ছে, কিন্তু কাটিয়ে উঠতে পারব আমরা শীঘ্রি।”
মলির দু’কাধে হাত রাখল গিলেস। নিজের অজান্তেই ঝুঁকে চুমু খেল স্ত্রীর মাথায়। বদলে গেল কণ্ঠস্বর, “মলি, তবে অন্য
একটা বিষয়ে ভাবতে হবে আমাদের। নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। নইলে এই আবহাওয়ায় একজন পুলিশ সার্জেন্টকে পাঠানো হতো না।” আঙুল তুলে জানালার বাইরে তুষারপাতের দিকে নির্দেশ করল ও। “নিশ্চয় সাংঘাতিক কিছু…”
হঠাৎ খুলে গেল দরজা। ঘরে ঢুকলেন মিসেস বয়েল। বললেন, “এই যে, আপনারা এখানে। মিস্টার ডেভিস, রুমের সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেম যে ঠাণ্ডা বরফ হয়ে আছে, খবরটা জানা আছে আপনার?”
“দুঃখিত, মিসেস বয়েল। আমাদের কয়লা ফুরিয়ে এসেছে…”
বাধা দিয়ে কর্কশ গলায় মিসেস বয়েল বললেন, “সেটা তো আমার জেনে কোনো লাভ নেই। হপ্তায় সাত গিনি ভাড়া দিতে হবে আমাকে— সাত গিনি। কাজেই জমে মরতে চাইব না আমি কিছুতেই।”
লাল হয়ে উঠল গিলেসের মুখ। চাপা গলায় বলল, “ঠিক আছে, যাচ্ছি আমি। গরমের ব্যবস্থা করছি।” বেরিয়ে গেল সে।
মলির দিকে ফিরলেন মিসেস বয়েল। “মিসেস ডেভিস, অদ্ভুত এক যুবককে জায়গা দিয়েছেন এখানে। আজব। যেমন টাই, তেমনি ব্যবহার। চুল আঁচড়ানোরও দরকার মনে করে না।”
“উনি একজন ব্রিলিয়ান্ট আর্কিটেক্ট,” মলি বলল।
“কী বললেন?”
“ক্রিস্টোফার রেন একজন আর্কিটেক্ট…”
আবারও বাধা দিলেন মিসেস বয়েল, “স্যার ক্রিস্টোফার রেনের কথা আমি শুনিনি ভেবেছেন? সেইন্ট পল বিল্ডিঙের নির্মাতা স্যার রেনের কথা কে না শুনেছে।”
“আমি সেই বিখ্যাত রেনের কথা বলছি না। আমাদের এই যুবক অতিথির নামও ক্রিস্টোফার রেন। তিনিও একজন আর্কিটেক্ট। ব্রিলিয়ান্ট। আমার তো ধারণা, ভবিষ্যতে স্যার রেনের মতো এই রেনের নামও ছড়িয়ে পড়বে।”
“খুব বলেছেন যা হোক!” তিক্তস্বরে বললেন মিসেস বয়েল। “ও যে সত্যিই আর্কিটেক্ট, বুঝলেন কী করে? খোঁজ-খবর কিছু নিয়েছেন? কতখানি জানেন ওর ব্যাপারে?”
“আপনার ব্যাপারে যতখানি জানি। আপনিও যেমন হপ্তায় সাত গিনি দেবেন, তিনিও দেবেন, এটুকু জেনেই আমি খুশি। এর বেশি জানার দরকার নেই আমার।” মিসেস বয়েলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “গেস্ট গেস্টই। কাকে পছন্দ করলাম, কাকে করলাম না, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলে ব্যবসাই করা হবে না।”
রাগে লাল হয়ে গেল মিসেস বয়েলের চেহারা। “আপনি অনভিজ্ঞ, বয়েস কম। অভিজ্ঞ কারও উপদেশ আপনার মেনে চলা উচিত… ওই আজব বিদেশিটার কথাই ধরুন না। কখন এসেছে সে?”
“রাতে।”
“বলুন রাতদুপুরে। অদ্ভুত না? ওটা কি কোনো ভদ্রলোকের আসার সময় হলো?”
“আবহাওয়া খারাপ। তাছাড়া দুর্ঘটনা ঘটলে আসতে তো হবেই।”
“আপনি যাই বলুন, ওই পারাভি না কারাভি লোকটাকে আমার মোটেই…”
“…পছন্দ হয় না। লোকটা শয়তানের চ্যালা, তাই না, বুড়িমা?”
এমনভাবে চমকে গেলেন মিসেস বয়েল যেন খোদ শয়তান কথা বলেছে। নিঃশব্দে কখন ঘরে ঢুকেছেন পারাভিসিনি, দু’জনের কেউই টের পায়নি।
“আপনি আমাকে চমকে দিয়েছেন,” গোঁ-গোঁ করে বললেন মিসেস বয়েল। “জানান দিয়ে আসেননি।”
“পা টিপে টিপে আসতেই পছন্দ করি আমি,” পারাভিসিনি বললেন। লোকের অলক্ষ্যেই আমি যাই-আসি। খুব আনন্দ পাই তাতে। কখনও কখনও গোপন কথা শুনে ফেলি। ওতেও আনন্দ পাই।” মোলায়েম গলায় যোগ করলেন, “এবং শুনে ফেলা কথা কখনও ভুলে যাই না।”
অস্বস্তি বোধ করছেন মিসেস বয়েল। “তাই? ও, আমাকে যেতে হচ্ছে… উলকাঁটা ফেলে এসেছি, সিটিংরুমে।”
তাড়াহুড়া করে চলে গেলেন তিনি।
পারাভিসিনির দিকে তাকিয়ে আছে মলি। অবাক দৃষ্টি।
অদ্ভুত ভঙ্গিতে লাফিয়ে এগিয়ে এলেন পারাভিসিনি। মলি বাধা দেয়ার আগেই ওর একটা হাত তুলে নিলেন নিজের হাতে।
হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেলেন। “আমার সুন্দরী হোস্টেসকে অপ্রতিভ দেখাচ্ছে। কী ব্যাপার, ডিয়ার লেডি?”
এক পা পিছিয়ে এলো মলি। পারাভিসিনিকে পছন্দ করবে কিনা বুঝতে পারছে না। লোকটাকে অতিরিক্ত কামুক মনে হচ্ছে। গ্রীক পুরানের লম্পট বনদেবতা স্যাটারের মতো লাগছে, হাসিটাও ওই রকম।
“সব কিছুই কেমন গোলমেলে মনে হচ্ছে আজ সকালে,” কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল মলি। “এর মূলে নিশ্চয় ওই তুষারপাত।”
“হ্যাঁ,” ফিরে জানালার বাইরে তাকালেন পারাভিসিনি। “এরকম প্রবল তুষারপাত সব কিছুকেই গোলমেলে করে ফেলে। তাই না? নাকি সহজ করে তোলে?”
“কী বলছেন বুঝতে পারছি না।”
“না, কিছু না,” কী যেন ভাবছেন পারাভিসিনি। “অনেক কিছুই বুঝতে পারবেন না আপনি। অনেক কিছুই জানেন না। এই যেমন, কীভাবে গেস্ট হাউস চালাতে হয়, জানা নেই আপনার।”
থুঁতনি উঁচু করল মলি। “জানা নেই, তবে জেনে নিতে দেরি হবে না।”
“ভালো। তা এই আত্মবিশ্বাসের কারণ?”
“কারণ, আমি ভালো রাঁধতে পারি…”
“সত্যিই আপনি ভালো রাঁধেন, কোনো সন্দেহ নেই।”
চুপ করে রইল মলি।
পারাভিসিনি বললেন, “আপনাকে সাবধান না করে পারছি না, মিসেস ডেভিস, আরেকটু সাবধান হবেন। আপনারা— মানে আপনি এবং আপনার স্বামী মানুষকে বড় বেশি বিশ্বাস করেন। গেস্টদের ব্যাপারে কতটা জানেন আপনারা?”
“জানার দরকার আছে কি?” অস্বস্তি বোধ করছে মলি। “আমার ধারণা ওরা… ওরা শুধু থাকতে আসে এখানে…”
“জায়গা দেয়ার আগে প্রতিটি গেস্ট সম্পর্কে ভালোমতো খোঁজ-খবর নেবেন।” মলির কাঁধে আলতো চাপড় দিলেন পারাভিসিনি। “এই যে আমার কথাই ধরুন। রাতদুপুরে এসে উদয় হলাম। বললাম, আমার গাড়ি খাদে উল্টে পড়েছে। সত্যিই অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে কিনা, আমি কে, কেন এসেছি, কিছুই না জেনে আমাকে জায়গা দিয়ে দিলেন। অন্য গেস্টদের ব্যাপারেও একই কথা খাটে, কোনো খোঁজখবর নেননি আপনারা।”
“মিসেস বয়েলের…” বলতে গিয়ে থেমে গেল মলি। হাতে উলকাঁটা নিয়ে ঘরে ঢুকেছেন তিনি।
“ড্রইংরুমে ভীষণ ঠাণ্ডা,” মিসেস বয়েল বললেন। মার্চ করে গিয়ে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসলেন। “আমি এখানেই বসব।”
এগিয়ে গেলেন পারাভিসিনি। “আগুনটা উসকে দেব?”
ভদ্রলোকের লাফিয়ে হাঁটার অদ্ভুত ভঙ্গি আগের রাতেই লক্ষ্য করেছে মলি। তার সন্দেহ হলো, নিজেকে গোপন রাখতে বোধহয় পছন্দ করেন পারাভিসিনি। নাকি নিজের চেহারাটাই গোপন রাখতে চান তিনি? কিংবা হয়তো বয়েস গোপন রাখতে
চায় লোকটা, এবং ব্যর্থ হয়। আসলের চেয়ে বেশিই মনে হয় তাঁর বয়েস। নিজের বয়েস লুকাতে তরুণদের মতো হাঁটার চেষ্টা করে এবং তাতেও ব্যর্থ হয়। হাস্যকর হয়ে ওঠে লোকের চোখে।
মেজর মেটকাফ ঢুকতে ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলো মলি।
“মিসেস ডেভিস, আমার মনে হয়,” নিচুস্বরে মেজর বললেন, “নিচের ক্লোকরুমের পাইপের ভিতরের পানি জমে গেছে ঠাণ্ডায়।”
“সর্বনাশ!” ককিয়ে উঠল মলি। “খারাপ খবর আর কত শুনব! প্রথমে পুলিশ, তারপরে পাইপ…”
আগুন খোঁচানোর চোখা সিকটা পারাভিসিনির হাত থেকে খসে পড়ে গেল। ঠন ঠন শব্দে বোনা বন্ধ করে ফেলেছেন মিসেস বয়েল। স্থির হয়ে গেছেন মেজর মেটকাফ। চোখে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টি। দু’জন পুরুষের এই হঠাৎ পরিবর্তনে অবাক হলো মলি। বিশেষ করে মেজরের পরিবর্তনে। মোলায়েম ভাবটা চলে গেছে চেহারা থেকে। কঠিন হয়ে উঠেছে।
চাপা ভারি গলায় মেজর বললেন, “পুলিশ!”
ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে মেজরের মগজে, মলি বুঝতে পারছে। কেন? ভয়, সতর্কতা, নাকি উত্তেজনা? এই লোকটা— মনে মনে নিজেকে সাবধান করল মলি— বিপজ্জনক হতে পারে।
আবার কথা বললেন মেজর। এবার কণ্ঠে কৌতূহল, “পুলিশের ব্যাপারে কী যেন বলছিলেন?”
“একটু আগে ফোন করেছিল পুলিশ স্টেশন থেকে,” মলি বলল। “এখানে একজন সার্জেন্টকে পাঠানো হচ্ছে।” জানালার বাইরে তাকাল সে। “কিন্তু আসতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।” একটু যেন আশার ছোঁয়া তার গলায়।
“পুলিশ পাঠাচ্ছে কেন?” এক পা এগোলেন মেজর।
মলি জবাব দেবার আগেই দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকল গিলেস। “কয়লা আর কয়লা নেই, পাথর হয়ে গেছে!” সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে ভুরু কোঁচকাল। “কী হয়েছে?”
মেজর জানালেন, “শুনলাম, পুলিশ আসছে?”
“আসবে না,” গিলেস বলল, “মানে, আসতে পারবে না। রাস্তা যা খারাপ হয়ে আছে! পাঁচ ফুট উঁচু হয়ে বরফ জমেছে। এর মধ্যে গাড়ি চালানো অসম্ভব।”
ঠিক ওই মুহূর্তে জানালার শার্শিতে তিনবার টোকার শব্দ হলো।
চমকে উঠল ঘরের প্রতিটি লোক। দু’একটা মুহূর্ত কেউ অনুমান করতে পারল না শব্দটা কোনদিক থেকে এসেছে। তারপর হঠাৎ জানালার দিকে আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠল মলি। ফ্রেঞ্চ উইন্ডো ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা।
ছুটে গেল গিলেস। হ্যাঁচকা টানে ছিটকানি নামিয়ে জানালা খুলে দিল।
“থ্যাংক ইউ, স্যার,” খুশি খুশি কণ্ঠে বলল সুদর্শন চেহারার বলিষ্ঠ লোকটা। জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, “আমি সার্জেন্ট ট্রটার।”
মিসেস বয়েল তাকিয়ে আছেন আগন্তুকের দিকে। তার চোখের দৃষ্টিই বুঝিয়ে দিচ্ছে, লোকটাকে পছন্দ করতে পারছেন না। “আপনি সার্জেন্ট? এত কম বয়েসে তো কেউ সার্জেন্ট হয় না।”
মিসেস বয়েলের দিকে তাকাল যুবক। চোখে বিরক্তির ছাপ। “তাতে আপনার কোনো অসুবিধে আছে, ম্যাডাম? আপনার অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, আমার যা বয়েস তারচেয়ে অনেকটাই কম দেখায়।”
ঘরের সবক’টা লোকের ওপর ঘুরে এলো সার্জেন্টের চোখ। গিলেসের ওপর স্থির হলো। “আপনি নিশ্চয় মিটার ডেভিস?” নিজের কাঁধে রাখা স্কি জোড়া দেখিয়ে বলল, “এগুলো কোথায় রাখব?”
“আসুন, আমার সঙ্গে।”
গিলেসের পিছু পিছু বেরিয়ে গেল সার্জেন্ট। হলরুমের দরজা বন্ধ করা হলো। তিক্ততা ঝরল মিসেস বয়েলের কণ্ঠে, “এজন্যেই কি এত কষ্টের পয়সা ঢালছি আমরা পুলিশ বাহিনীর পিছনে? শীতকালে স্কি নিয়ে খেলে বেড়ানোর জন্যে?”
মলির কাছাকাছি সরে এলেন পারাভিসিনি। চাপা হিসহিসে কণ্ঠে বললেন, “মিসেস ডেভিস, পুলিশকে খবর দিয়েছেন কেন?”
অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকাল মলি। একটু আগের পারাভিসিনির সঙ্গে যেন এর কোনো মিলই নেই। অস্বস্তি বোধ করছে। কেমন অসহায় কণ্ঠে বলল, “আমি খবর দিইনি, সত্যি বলছি।”
এই সময় আবার খুলে গেল দরজা, ঝটকা দিয়ে। ঘরে ঢুকল উত্তেজিত রেন। তীক্ষ্ণ কর্কশকণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল, “কে এই লোক? কোত্থেকে এসেছে?”
বোমা ফাটানোর সুযোগ পেলেন মিসেস বয়েল, বললেন, “পুলিশ, পুলিশের লোক! স্কি করে চলে এসেছে!”
কাজ ফেলে স্কি করে বেড়াচ্ছে ওই পুলিশ সার্জেন্ট, সরকারি পয়সার অপচয় করছে, এই কথাটা ঘরের ‘নিচু স্তরের’ লোকগুলোতে যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করলেন মিসেস বয়েল।
মেজর কী যেন ভাবছেন। হঠাৎ মলির দিকে ফিরে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “মিসেস ডেভিস, টেলিফোনটা ব্যবহার করতে পারি?”
“নিশ্চয়। যান।”
টেলিফোনের কাছে গেলেন মেজর।
তীক্ষ্ণকণ্ঠে আবার চেঁচিয়ে উঠল রেন, “লোকটা অতিরিক্ত সুদর্শন, তাই না? সব সময়ই দেখেছি, পুলিশ বাহিনীর লোকেরা খুব সুন্দর হয়।”
“হ্যাল্লো, হ্যাল্লো…” চেঁচিয়ে বলে জোরে জোরে ক্রেডল চাপতে লাগলেন মেজর। মলির দিকে ফিরে বললেন, “মিসেস ডেভিস, টেলিফোন খারাপ হয়ে গেছে। একেবারে ডেড।”
“একটু আগেও তো ভালো ছিল। আমি…”
রেনের অট্টহাসিতে বাধা পড়ল মলির কথায়। হা হা করে হাসছে। পাগল হয়ে গেছে যেন। হাসির ফাঁকে ফাঁকে বলল, “কী মজা! সভ্য জগৎ থেকে আলাদা হয়ে গেছি আমরা। একেবারে বিচ্ছিন্ন। আহ্, কী আনন্দ!”
“এতে এত আনন্দের কী দেখলেন?” কঠোরকণ্ঠে বললেন মেজর।
“হ্যাঁ, খুশি হওয়ার কিছু নেই,” যোগ করলেন মিসেস বয়েল।
হেসেই চলেছে রেন। “আমার কাছে কিন্তু খুব মজা লাগছে।” হঠাৎ হাসি থামিয়ে দিল সে। ঠোঁটে আঙুল রাখল। “শ্শ্শ্! ব্যাটা আসছে!”
গিলেসের সঙ্গে এসে ঢুকল আবার সার্জেন্ট ট্রটার। স্কি রেখে এসেছে। ওভারকোটও খুলে রেখে এসেছে। গায়ে আর তুষার নেই এখন। হাতে বড়সড় একটা নোটবুক আর একটা পেন্সিল। তাড়া নেই তার। সবাইকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতে প্রস্তুত।
“মলি,” গিলেস বলল, “সার্জেন্ট ট্রটার আমাদের দু’জনের সঙ্গে আগে কথা বলতে চান।”
গিলেস ও সার্জেন্টের পিছু পিছু বেরিয়ে এলো মলি।
“চলো, স্টাডিতে গিয়ে কথা বলি,” গিলেস বলল মলিকে।
হলের পিছন দিকের ছোট ঘরটায় ঢুকল তিনজনে। ট্রটার আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দিল।
“আমরা কী করেছি, সার্জেন্ট?” মলি জিজ্ঞেস করল।
“কী করেছেন?” মলির দিকে তাকাল সার্জেন্ট। হাসি ছড়িয়ে পড়ল সারা মুখে। “না, যা ভাবছেন তা নয়, ম্যাডাম। সুপারিন্টেনডেন্ট নিশ্চয় ভুল বুঝিয়েছেন আপনাদের। তার হয়ে মাফ চাইছি। আসলে, মিসেস ডেভিস, ব্যাপারটা অন্যরকম। বরং বলা ভালো, পুলিশ প্রোটেকশন দরকার আপনাদের।”
কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে ট্রটারের দিকে তাকিয়ে রইল মলি ও গিলেস।
“মিসেস লিয়ন,” সার্জেন্ট বলল, “বুঝলেন? মিসেস লিয়নের খুনের সঙ্গে ব্যাপারটার সম্পর্ক আছে। দু’দিন আগে লন্ডনে খুন হয়েছে যে মহিলা, নিশ্চয় খবরটা শুনেছেন।”
“হ্যাঁ, রেডিওতে,” মলি বলল।
“প্রথমেই জানতে চাই, মিসেস লিয়নের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় ছিল কিনা।”
“খুন হবার আগে কোনোদিন নামই শুনিনি,” বিড়বিড় করল মলি।
“আমারও তাই ধারণা। একটা কথা নিশ্চয় জানেন না, মহিলার আসল নাম মিসেস লিয়ন নয়। তাছাড়া পুলিশ রেকর্ডও ছিল তার। ফাইলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট আছে। কাজেই ওকে সনাক্ত করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি আমাদের। ওর আসল নাম গ্রেগ, মেরিন গ্রেগ— পদবীটা অবশ্যই স্বামীর। তার নাম ছিল জন গ্রেগ, আগেই মারা গেছে। মজার ব্যাপারটা কী জানেন, এখান থেকে কিছুদূরে একটা ফার্ম— লংরিজ ফার্মের চাষী ছিল লোকটা। লংরিজ ফার্ম কেসের কথা শুনে থাকবেন হয়তো।”
ঘরে পিনপতন নীরবতা। ছাত থেকে তুষারের স্তূপ ঝরে পড়ার মৃদু শব্দ ভেসে আসছে মাঝেমধ্যে। এমনিতেই বিষণ্ণ পরিবেশ, আরও বিষণ্ণ আর ভূতুড়ে করে তুলছে।
ট্রটার বলল, “১৯৪০ সালের কথা। তিনটে অসহায় এতিম বাস্তুহারা ছেলেমেয়েকে পুনর্বাসনের জন্যে নিয়ে এলো একদল স্বেচ্ছাসেবী স্কাউট। তুলে দিল লংরিজ ফার্মের গ্রেগ পরিবারের হাতে। দিন কয়েক পরেই মারা গেল একটা বাচ্চা। দোষ পুরোপুরি গ্রেগ পরিবারের। বাচ্চা তিনটের মোটেই যত্ন নেয়নি ওরা, ঠিকমতো খেতে দেয়নি। যে বাচ্চাটা মারা গেছে সে অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চিকিৎসা করায়নি, পুরোপুরি অবহেলা করেছে। ওদের বিরুদ্ধে কেস করে দিল স্কাউটরা। জেলে যেতে হলো মিস্টার ও মিসেস গ্রেগকে। জেল থেকে পালাল একদিন জন গ্রেগ। একটা গাড়ি চুরি করল। পিছু ধাওয়া করল পুলিশ। পালিয়ে বাঁচতে পারল না গ্রেগ, পুলিশের হাতেও পড়ল না, গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল। জেলে বসে স্বামীর মৃত্যু সংবাদ শুনল মিসেস গ্রেগ। জেল খেটে বেরিয়েছিল মাত্র দুই মাস আগে।”
“এবং দুই দিন আগে খুন হলো।” ট্রটারের দিকে তাকাল গিলেস। “খুনটা কে করেছে?”
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ট্রটার জিজ্ঞেস করল, “লংরিজ ফার্মের কেসের কথা শুনেছেন না আপনি?”
মাথা নাড়ল গিলেস। “না। ১৯৪০ সালে আমি জাহাজে ছিলাম। ভূমধ্যসাগরে। মিডশিপম্যানের চাকরিতে।”
“আমি শুনেছি,” মলি বলল। “কিন্তু এর সঙ্গে তো আমাদের কোনো হাত নেই। আমাদের কাছে এসেছেন কেন? আমরা কী করেছি?”
আপনারা কিছু করেননি, কিন্তু ভয়ানক বিপদে আছেন আপনারা, মিসেস ডেভিস।”
“বিপদ!” চেঁচাতে গিয়েও সময়মতো কণ্ঠস্বর নামিয়ে নিল গিলেস।
“রাস্তায় একটা নোটবুক পাওয়া গেছে। মিসেস লিয়ন যে বাড়িতে খুন হয়েছে, তার কাছাকাছি। এই একটা ঠিকানা লেখা আছে, আর একটা বাড়ির নাম। ঠিকানাটা ৭৪ নম্বর কালভার স্ট্রিট।”
“ওবাড়িতেই খুন হয়েছে মহিলা?” মলি জানতে চাইল।
“হ্যাঁ। এখন বাড়িটার নাম শুনুন : মংকসওয়েল ম্যানর।”
“কী বললেন?” আঁতকে উঠল মলি।
“হ্যাঁ। সেজন্যেই ইন্সপেক্টর হগবেন জানার প্ৰয়োজন মনে করছেন, আপনারা দু’জন, আপনাদের মংকসওয়েল ম্যানর এবং লংরিজ ফার্মের মধ্যে কোনো ব্যাপারে কোনো যোগাযোগ আছে কিনা।”
“নেই,” জবাব দিল গিলেস। “আমার মনে হয় নোটবুকে এ বাড়ির নাম থাকাটা নিছকই একটা কাকতালীয় ব্যাপার।”
শান্তকণ্ঠে ট্রটার বলল, “ইন্সপেক্টর হগবেনের ধারণা কিন্তু অন্যরকম। পারলে তিনি নিজেই আসতেন। আবহাওয়া খারাপ, গাড়ি চলবে না। তাই আমাকে পাঠিয়েছেন, কারণ আমি স্কিইঙে এক্সপার্ট। এ বাড়ির প্রতিটি লোক সম্পর্কে খুঁটিয়ে জানার নির্দেশ রয়েছে আমার ওপর। জেনে নিয়ে ফোনে রিপোর্ট করতে হবে ইন্সপেক্টরের কাছে। আর বাড়ির লোকের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দায়িত্বও আমার ওপর।”
“নিরাপত্তা!” তীক্ষ্ণ হলো গিলসের কণ্ঠ। “আসলে কী বলতে চাইছেন আপনি বলুন তো? এখানেও খুনখারাপির সম্ভাবনা আছে নাকি?”
“ইন্সপেক্টর হগবেনের তাই ধারণা।” ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে ট্রটার বলল, “আপনাদের ভয় পাইয়ে দেয়ার জন্যে দুঃখিত। কিন্তু না বললেও চলছিল না।”
“কিন্তু কেন? কী কারণে…”
বাধা দিয়ে ট্রটার বলল, “সেই কারণটা বের করতে এসেছি আমি।”
“পুরো ব্যাপারটাই পাগলামি মনে আমার কাছে,” গিলেস বলল।
“পাগলামি এবং সাংঘাতিক বিপজ্জনক।”
মলি বলল, “আরও কিছু জানেন আপনি, সার্জেন্ট, কিন্তু আমাদের বলছেন না।”
“ঠিক আছে, বলছি। নোটবুকে এক জায়গায় লেখা আছে ‘থ্রি ব্লাইন্ড মাইস’। মৃত মিসেস লিয়নের বুকে এক টুকরো কাগজ আটকানো ছিল। তাতে লেখা : একটা শেষ হলো। এর নিচে তিনটে ইঁদুর ছানার ছবি। ছবির নিচে ‘থ্রি ব্লাইন্ড মাইস’ গানের প্রথম চরণের স্বরলিপি লেখা।”
নিজের অজান্তেই মৃদুস্বরে গেয়ে উঠল মলি :
“থ্রি রাইন্ড মাইস,
সি হাউ দে রান!
দে অল র্যান আফটার দা ফারমারস ওয়াইফ।
শী…”
হঠাৎ থেমে গেল মলি। প্রায় ফিসফিস করে বলল, “কী ভীষণ! মা গো, কী সাংঘাতিক! সার্জেন্ট, তিনটে ছেলেমেয়ে ছিল বললেন না?”
“হ্যাঁ, মিসেস ডেভিস। পনেরো বছরের একটা ছেলে, বারো বছরের একটা ছেলে, আর চোদ্দ বছরের একটা মেয়ে।”
“মরল তো একটা, অন্য দুটোর কী হলো?”
“মেয়েটাকে, আমার ধারণা, কেউ জায়গা দিয়েছে। ওর কোনো খোঁজ পাইনি। বড় ছেলেটার বয়েস এখন তেইশ বছর হবে। শুনেছি, সব সময়ই ছেলেটার ভাব-নমুনা একটু অন্যরকম ছিল। আঠারো বছর বয়েসে আর্মিতে যোগ দিল। টিকতে পারল না। পালাল একদিন। তারপর থেকেই সে নিখোঁজ। আর্মি সাইক্রিয়াট্রিস্ট রায় দিয়েছে, ছেলেটার মাথায় গোলমাল আছে।”
“আপনার কি ধারণা ও-ই খুন করেছে মিসেস লিয়নকে?” গিলেসের প্রশ্ন। “একটা পাগল খুনী? এখানে এসে হাজির হবে?”
“আমাদের ধারণা, এখানকার কারও সঙ্গে লংরিজ ফার্মের ঘটনার কোনো সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটা কী— সেটা জানতে পারলেই কাজ অনেকখানি সহজ হয়ে যাবে। তাহলে আপনি বলছেন, ওই কেসের সঙ্গে—মিসেস লিয়নের খুনের সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই? মিসেস ডেভিস, আপনারও নিশ্চয় নেই?”
“অ্যাঁ… হ্যাঁ… না না!”
“এ-বাড়িতে আর কে কে আছে বলবেন?”
গিলেস বলল। ট্রটার নোটবুকে টুকে নিল। মিসেস বয়েল। মেজর মেটকাফ। মিস্টার ক্রিস্টোফার রেন। মিস্টার পারাভিসিনি।
“কাজের লোক?”
“নেই।” কাজের লোকের কথায় কাজের কথা মনে পড়ে গেল মলির। “আরে ভুলেই গেছি। আলু সিদ্ধ করতে হবে।” তাড়াহুড়া করে চলে গেল সে।
গিলেসের দিকে তাকাল ট্রটার। “যাদের নাম বললেন, তাদের সম্পর্কে কী কী জানেন?”
“আমি… মানে আমরা…”কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল, “আসলে, ওদের সম্পর্কে কিছুই জানি না আমরা। বুর্নমাউথের
একটা হোটেল থেকে চিঠি দিয়েছিলেন মিসেস বয়েল। লেমিংটন থেকে মেজর মেটকাফ। মিস্টার রেন লিখেছিল দক্ষিণ কেনসিংটনের একটা হোটেল থেকে। আর মিস্টার পারাভিসিনি এসে হাজির হলেন মাটি… না না, বরফ ফুঁড়েই বলা ভালো। বরফে পিছলে নাকি খাদে উল্টে পড়েছে তাঁর গাড়ি। তবে, আমার মনে হয় ওদের সবারই আইডেনটিটি কার্ড, রেশন বুক আছে।”
“সবই দেখব।”
“আবহাওয়া ভয়ানক খারাপ,” গিলেস বলল। “একদিক থেকে ভালোই হলো। এই সাংঘাতিক তুষারপাতের মধ্যে খুনীটা আসতে পারবে না, তাই না?”
“তুষারপাত ওকে ঠেকাতে পারবে বলে মনে হয় না।”
“মানে?”
এক মুহূর্ত দ্বিধা করে ট্রটার জবাব দিল, “একটা কথা ভাবছেন না কেন, সে হয়তো ইতিমধ্যেই এখানে এসে বসে আছে।”
স্থির দৃষ্টিতে ট্রটারের দিকে তাকিয়ে থেকে গিলেস বলল, “কী বলছেন!”
“মিসেস গ্রেগ দু’দিন আগে খুন হয়েছে। আপনার অতিথিরা সবাই তার পর এসেছে।”
“কিন্তু চিঠি আরও আগেই লিখেছে সবাই, শুধু পারাভিসিনি বাদে— উনি চিঠিই লেখেননি।”
জোরে নিঃশ্বাস ফেলল ট্রটার। “এবং আরও আগে করা হয়েছে একাধিক খুনের পরিকল্পনা,” তার কণ্ঠস্বরে সামান্য ক্লান্তির ছোঁয়া।
“একাধিক! কী করে জানলেন?”
“জানি। আর হবে জেনেই এসেছি। ঠেকাতে। চেষ্টা যে হবেই, তাতে আমি নিশ্চিত।”
“যদি তাই হয়,” উত্তেজিত হলো গিলেস, “তাহলে একটা লোককেই সন্দেহ হয় আমার, যার সঙ্গে খুনীর বয়েসের মিল আছে, আর সে হলো ক্রিস্টোফার রেন।”
উঠে পড়ল সার্জেন্ট। রান্নাঘরে মলির সঙ্গে দেখা করল। “মিসেস ডেভিস, আমার সঙ্গে একবার লাইব্রেরিতে আসতে পারবেন? গেস্টদের সবার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনার স্বামী তাদের ডাকতে গেছেন…”
“যাচ্ছি, একটু দাঁড়ান। আলুগুলো হয়ে যাক। একেক সময় বিরক্তি ধরে যায়, মনে হয় স্যার ওয়াল্টার রেলি এই হতচ্ছাড়া তরকারিটা আবিষ্কার না করলেই ভালো করতেন।”
মলির কথায় সমর্থন জানাল না ট্রটার। চুপ করে রইল।
“আচ্ছা,” মলি বলল, “আমি কিন্তু একেবারেই বিশ্বাস করতে পারছি না, কেমন আশ্চর্য…”
“অবিশ্বাসের কিছুই নেই এতে, মিসেস ডেভিস। নির্জলা সত্য নিয়ে কাজ করছি আমরা।”
“লোকটার চেহারার বর্ণনা দিতে পারবেন?” কৌতূহলী গলায় জানতে চাইল মলি।
“মাঝারি উচ্চতা— মোটাও না, শুকনোও না। গায়ে কালো ওভারকোট ছিল, মাথায় ধূসর হ্যাট, ফিসফিস করে কথা বলে, মাফলার দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছিল। আর দশজন সাধারণ লোকের মতোই স্বাভাবিক।” একটু থামল ট্রটার। যোগ করল, “তিনটে কালো ওভারকোট ও তিনটে ধূসর কোট এ বাড়ির হলে ঝুলতে দেখেছি আমি, মিসেস ডেভিস।”
“আমার মনে হয় না তাদের কেউই লন্ডন থেকে এসেছে।”
“তাই নাকি?” মলি কিছু বুঝে ওঠার আগেই এগিয়ে গেল ট্রটার। প্রায় ছোঁ মেরে ড্রেসারের ওপর থেকে একটা খবরের কাগজ তুলে নিল। “উনিশে ফেব্রুয়ারির কাগজ। দু’দিন আগের। ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড। কেউ এনে রেখেছে এখানে।”
“আশ্চর্য তো!” কাগজটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মলি। কী যেন মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। “কোত্থেকে এলো এটা?”
“শুধু চেহারা দেখেই কারও ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন না, মিসেস ডেভিস। এই বাড়িতে জায়গা দিয়েছেন বটে, কিন্তু অতিথিদের কারও সম্পর্কেই কিছু জানেন না।” যোগ করল ট্রটার, “ধরেই নিচ্ছি, গেস্ট হাউস ব্যবসায় আপনারা নতুন।”
“হ্যাঁ,” স্বীকার করল মলি। সবাই ধরে ফেলছে ব্যাপারটা। নিজেকে বড় বেশি আনাড়ি, অনভিজ্ঞ, ছেলেমানুষ মনে হলো।
“আপনাদের বিয়ে নিশ্চয় বেশিদিন হয়নি, কি বলেন?”
“মাত্র এক বছর,” সামান্য লাল হলো মলির গাল। “হঠাৎ করেই হয়ে গেল বিয়েটা।”
“প্রথম দর্শনেই প্রেম?” জানতে চাইল ট্রটার।
ব্যক্তিগত প্রশ্ন, কিন্তু এমন ভঙ্গিতে প্রশ্নটা করল সার্জেন্ট, জবাব না দিয়ে পারল না মলি। “হ্যাঁ। একে অন্যকে চিনতে মাত্র চোদ্দ দিন সময় পেয়েছিলাম আমরা।”
প্রেম-পরিচয়ের সেই সাংঘাতিক উত্তেজনাময় দিনগুলোতে ফিরে গেল মলির মন। দ্রুত পরস্পরকে চিনে নেবার চেষ্টা করেছিল ওরা। দু’জনের কারও মনেই কোনো সন্দেহ জাগেনি। অদ্ভুত এক আকর্ষণে দ্রুত কাছাকাছি হয়ে গিয়েছিল। আবিষ্কার করেছিল এক রোমাঞ্চকর পৃথিবী। নিজের অজান্তেই হাসি ফুটল মলির ঠোঁটে।
ট্রটারের চোখে চোখ পড়তেই কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এলো মলি। অবাক চোখে তাকে দেখছে সার্জেন্ট।
“আপনার স্বামীর বাড়ি নিশ্চয় এদিকে কোথাও নয়, না?” জানতে চাইল ট্রটার।
“ঠিকই ধরেছেন,” মলি বলল। “ওর বাড়ি লিংকনশায়ারে।”
গিলেসের ছোটবেলা সম্পর্কে খুব একটা জানে না মলি। কোথায় কীভাবে বড় হয়েছে, প্রায় কিছুই জানে না। এ সব প্রশ্ন তুললেই গিলেস এড়িয়ে যায়। মলি শুধু জানে, অল্প বয়েসেই
গিলেস বাবা-মাকে হারিয়েছে। ছেলেবেলায় খুব কষ্ট করতে হয়েছে।
“আপনাদের দু’জনেরই বয়েস খুব কম। বিশেষ করে এমন একটা ব্যবসা চালানোর জন্যে তো বটেই।”
“কম কিনা জানি না। আমার বাইশ বছর…”
দরজা খুলতে দেখে থেমে গেল মলি। ঘরে ঢুকছে গিলেস।
“সব ঠিক করে এলাম,” গিলেস বলল। “মোটামুটি একটা ধারণাও দিয়েছি সবাইকে। চলবে তো, সার্জেন্ট?”
“আমার সময় বাঁচিয়ে দিলেন,” ট্রটার বলল। “মিসেস ডেভিস, আপনার হলো?”
“হ্যাঁ,” আলুর পাত্রটা নামাল মলি।
####
আট…
সার্জেন্ট ট্রটার লাইব্রেরিতে ঢুকতে একসঙ্গে কথা বলে উঠল চারটে কণ্ঠ।
সবচেয়ে কর্কশ আর তীক্ষ্ণ কণ্ঠ ক্রিস্টোফার রেনের। জোর গলায় জানাল, খুব রোমাঞ্চ অনুভব করছে সে। বলল, রাতে ভালো ঘুম হবে, দয়া করে যদি সার্জেন্ট এখন সব কথা খুলে বলেন।
ভারি মোটা গলা মিসেস বয়েলের, “এসবের… এসবের কোনো মানে হয় না। লোকের বাড়িতে স্বচ্ছন্দে খুনী ঘুরে বেড়ায়, আর পুলিশ কিছুই করতে পারে না। এ রকম পুলিশ ফোর্স দিয়ে কী উপকার হবে দেশের?”
কথা বলার চেয়ে নিজের হাতের দিকেই যেন খেয়াল বেশি মিস্টার পারাভিসিনির। কিছু বলছেন, কিন্তু মিসেস বয়েলের জোরাল কণ্ঠের কারণে চাপা পড়ে গেল সেটা, কিছু শোনাও গেল না, বোঝাও গেল না।
বয়েলের কথা শেষ হতেই কাটা কাটা কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করলেন মেজর মেটকাফ। ঘটনাটা কী জানতে চাইছেন।
হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে ইশারা করল ট্রটার।
চুপ হয়ে গেল সবাই। ঘরে পিনপতন নীরবতা।
“থ্যাংক ইউ,” ট্রটার বলল। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত বিরতি দেয়ার পর নাটকীয়ভাবে শুরু করল, “এখানে আমার আসার কারণ মিস্টার ডেভিস জানিয়েছেন আপনাদের। একটা কথা, শুধু একটা কথাই জানতে চাই আমি, এবং খুব তাড়াতাড়ি। লংরিজ ফার্ম কেসের সঙ্গে আপনাদের কার কী সম্পর্ক আছে?”
অখণ্ড নীরবতা। চার জোড়া নিষ্পলক চোখ তাকিয়ে আছে ট্রটারের দিকে। ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা মোছার মতো নিমেষে মুছে ফেলা হয়েছে যেন কয়েক মুহূর্ত আগের উত্তেজনা, রাগ, চেঁচামেচি, হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি, জিজ্ঞাসা, সব।
আবার কথা বলল ট্রটার। জোর দিল প্রতিটি শব্দের ওপর। “আমাকে বোঝার চেষ্টা করুন, প্লিজ। বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, আপনাদের মধ্যে কোনও একজনের মাথায় বিপদের খাঁড়া ঝুলছে। কার মাথায়, সেটা জানতেই হবে আমাকে।”
এবারও কেউ কোনো কথা বলল না। নড়ল না।
“ঠিক আছে,” রাগ প্রকাশ পেল ট্রটারের গলায়। “এক এক করে জিজ্ঞেস করি। মিস্টার পারাভিসিনি?”
পাতলা হাসি দেখা গেল পারাভিসিনির ঠোঁটে। বিদেশি কায়দায় এক হাত তুলে প্রতিবাদের ভঙ্গি করলেন। “এ অঞ্চলে আমি নতুন, ইন্সপেক্টর। বহু বছর আগে এখানকার কোথায় কী একটা ঘটনা ঘটেছে, সেটা আমার জানার কথা নয়। আমি জানি না।”
“আমি ইন্সপেক্টর নই, সার্জেন্ট,” ট্রটার বলল। “মিসেস বয়েল?”
“আমি বুঝতেই পারছি না, এই ঘটনাটার সঙ্গে আমার কেন, কী সম্পর্ক থাকতে পারে!”
“মিস্টার রেন?”
তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে উঠল ক্রিস্টোফার, “ঘটনাটা যখন ঘটে, ওই সময় তো ধরতে গেলে শিশুই ছিলাম আমি। ঘটনাটার কথা কখনও শুনেছি কিনা, তা-ও মনে করতে পারছি না।”
“মেজর মেটকাফ?”
“খবরের কাগজে পড়েছি। সে-সময় এডিনবার্গে ছাউনি ফেলেছিলাম আমরা।”
“এছাড়া আর কারও কিছু বলার নেই?” ট্রটারের প্রশ্ন।
আবার নীরবতা।
হতাশকণ্ঠে সার্জেন্ট বলল, “কিছু তো বললেন না, অতএব কেউ যদি খুন হন এখানে, নিজেই দায়ী হবেন।”
ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ট্রটার। গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
“মাই ডিয়ারস,” ক্রিস্টোফার বলল, “কী একখান নাটক করে গেল! তবে যা-ই বলেন, লোকটা অতিরিক্ত সুদর্শন, তাই না? পুলিশ অফিসারদের আমি পছন্দ করি। ভীষণ স্মার্ট।” একটু থেমে বলল, “উত্তেজনা আমার ভালো লাগে।” থ্রি রাইন্ড মাইস গানের সুরে শিস দিয়ে উঠল সে।
“থামুন!” আর ধৈর্য রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল মলি।
পাঁই করে মলির দিকে ঘুরল ক্রিস্টোফার। হাসল। রসিকতা করল, “কিন্তু ম্যাডাম, এখন গান না গাইলে কি চলে? এটা আমার সিগনেচার টিউন। খুনখারাপি হয়ে যাবে… কী ভীষণ উত্তেজনা! যা ভালো লাগছে না!”
“যত্তোসব!” ভারি গলায় বললেন মিসেস বয়েল। “ট্রটারের একটা কথাও বিশ্বাস করি না আমি।”
শয়তানি হাসি নেচে উঠল ক্রিস্টোফারের চোখে। “তাই নাকি? বেশ, অপেক্ষা করতে থাকুন। হঠাৎ দেখবেন পা টিপে টিপে আপনার পিছনে হাজির হয়ে গেছি আমি। গলা টিপে ধরতে যাচ্ছি।”
নিজের অজান্তেই এক পা পিছিয়ে গেল মলি।
রেগে গেল গিলেস। “আমার স্ত্রীকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন, রেন। এসব বিশ্রী রসিকতা উচিত হচ্ছে না।”
“ভুল বললেন, মিস্টার ডেভিস,” ক্রিস্টোফার বলল। “রসিকতা তো আগেই শুরু হয়ে গেছে। শেষ না হলে কি ভালো লাগবে?”
চুপ করে রইল গিলেস।
ঘরের সবার ওপর নজর বোলাল ক্রিস্টোফার। হেসে উঠল। “আয়নায় নিজেদের চেহারা যদি এখন দেখতেন।”
হাসতে হাসতেই ঘুরে দাঁড়াল সে। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
সবার আগে সামলে নিলেন মিসেস বয়েল। “লোকটা পাগল! মানসিক রোগী! নাকি পাগলামির ভান করছে?”
“এয়ার রেইডের সময় নাকি বোমা পড়েছিল তার ট্রেঞ্চের কিনারে। ট্রেঞ্চের মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্যে জ্যান্ত কবর হয়ে গিয়েছিল। পরে খুঁড়ে বের করা হয়েছে ওকে। আমাকে বলেছে ও,” মেজর মেটকাফ বললেন। “এটা নিয়েও হেসেছে। ওই উত্তেজনা নাকি খুব ভালো লেগেছিল ওর, খুব নাকি মজা পেয়েছিল।”
“এ রকম অবস্থায় পাগলেই শুধু মজা পেতে পারে,” মিসেস বয়েল বললেন। “তবে যুদ্ধের সময় ব্যাপারটা আলাদা ছিল। এতই উত্তেজনা ছিল তখন, অনেক কিছুতেই ভয় পেত না লোকে। আমিও তো পেতাম না, বরং মজাই লাগত। কত ভয়ানক বিপদ গেছে মাথার ওপর দিয়ে, একটিবারের জন্যেও সাহস হারাইনি।”
“মিসেস বয়েল, আপনার ওপরই বোধহয় খুনীর নজর,” মেজর মেটকাফ বললেন।
থমকে গেলেন মিসেস বয়েল। “কী বলতে চান?”
শান্তকণ্ঠে মেজর বললেন, “উনিশশো চল্লিশ সালে এ জেলার বিলেটিং অফিসার ছিলেন আপনি।” মলির তাকালেন তিনি। আলতো মাথা ঝাঁকাল মলি। আবার মিসেস বয়েলের ফিরে বললেন, “তাই না?”
মিসেস বয়েলের মুখ লাল হয়ে গেল। রেগে উঠে বললেন, “তাতে কী?”
শীতল গলায় মেজর বলেন, “লংরিজ ফার্মে তিনটে ছেলেমেয়েকে পাঠানোর ভার ছিল আপনার ওপর। আপনিই ওদেরকে ওখানে পাঠিয়েছিলেন।”
“হ্যাঁ, পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে খারাপটা কোথায় করলাম? ফার্মের লোকগুলো খারাপ ছিল না, এতিম ছেলেমেয়েগুলোর ভার নিতে আগ্রহীই ছিল তখন। ওদের কাছে পাঠানোয় কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছি না আমি। আর এতে দায়িত্বটাই বা আমার ওপর আসছে…”
বাধা দিল গিলেস। “এসব কথা ট্রটারকে বলেননি কেন?”
“পুলিশের এত কথা জানার দরকার আছে মনে করি না,” কঠোর শোনাল মিসেস বয়েলের কণ্ঠ। “আর তাছাড়া নিজের দেখাশোনা করার ক্ষমতা আমার আছে।”
মেজর বললেন, “সাবধানে থাকবেন, মিসেস বয়েল।”
তিনিও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
“মলি, তুমি কিছু জাননা?” গিলেস জিজ্ঞেস করল।
প্রশ্নের জবাব দিল না মলি। মিসেস বয়েলকে জিজ্ঞেস করল, “মস্ত একটা বাড়িতে থাকতেন না আপনি?”
“থাকতাম,” মিসেস বয়েল বললেন। “পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে এখন বাড়িটা।” গলায় তিক্ত ক্ষোভ। “মিলিটারিকে উৎসর্গ করেছিলাম। ওরাই ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।”
হাসলেন পারাভিসিনি। প্রথমে মৃদু। বাড়তেই থাকল হাসিটা। বাড়তে বাড়তে শেষে অট্টহাসিতে রূপ নিল।
“আমাকে… আমাকে মাপ করবেন,” হাসতে হাসতে বললেন পারাভিসিনি, “কিন্তু শুনে আমার খুব মজা লাগছে। খুব মজা পাচ্ছি আমি। যাদের উৎসর্গ করলেন তারাই ধ্বংস করল… আর হ্যাঁ, ক্রিস্টোফার রেনের মতো এখানকার উত্তেজনা আমারও ভালো লাগছে। খুব উপভোগ করছি।”
এ সময় আবার এসে ঘরে ঢুকল ট্রটার। ভুরু কুঁচকে পারাভিসিনির দিকে তাকাল। টিটকারির ভঙ্গিতে বলল, “খুব ভালো, খুব ভালো। মজা পাচ্ছেন জেনে খুশি হলাম।”
“সরি, মাই ডিয়ার ইন্সপেক্টর, মাপ করবেন। আপনার গুরুগম্ভীর সাবধান বাণীতে কেউই ভীত নয় জেনে হতাশ হয়েছেন, না?”
“গুরুগম্ভীর বলছেন কেন? আসলে পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেছি মাত্র আমি। আরেকটা কথা, আমি ইন্সপেক্টর নই, সার্জেন্ট।” মলির দিকে ফিরল সে। “মিসেস ডেভিস, টেলিফোনটা ব্যবহার করব।”
হাসি থামাল না পারাভিসিনি। বিচিত্র ভঙ্গিতে লাফিয়ে হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
“লোকটা অদ্ভুত!” গিলেস বলল।
“ক্রিমিনাল!” কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ট্রটার। “বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই এসব লোককে!”
“হুঁ!” মলি বলল, “তাই ভাবছেন? কিন্তু বয়েস তো মিলছে না। অনেককে অবশ্য কম বয়েসেই বুড়ো মনে হয়। উল্টোটাও
ঘটে। নাকি ছদ্মবেশ নিল? হাঁটে কেমন করে দেখেছেন? হাঁটা দেখলে মনেই হয় না এত বয়েস। সার্জেন্ট ট্রটার, আপনি কী ভাবছেন…”
“ভাবলে অনেক কিছুই ভাবা যায়,” গোমড়ামুখে বলল ট্রটার। “কিন্তু তাতে আসল কাজ বিশেষ এগোবে বলে মনে হয় না। হ্যাঁ, টেলিফোন। সুপারিন্টেনডেন্ট হগবেনকে রিপোর্ট করতে হবে।”
টেলিফোনের দিকে এগোতে গেল ট্রটার।
“লাভ নেই,” মলি বলল। “ফোন ডেড।”
“ডেড মানে?” তীক্ষ্ণ হলো ট্রটারের কণ্ঠ। “কখন থেকে?”
“আপনি আসার একটু আগে থেকে। মেজর মেটকাফ ফোন করতে গিয়ে দেখেন ডেড।”
“তিনি ফোন করতে যাবার আগে নিশ্চয় ভালো ছিল। আপনি তো সুপারিন্টেনডেন্টের সঙ্গে কথা বলেছেন।”
“হ্যাঁ। আমার মনে হয় দশটা নাগাদ খারাপ হয়েছে। প্রচণ্ড তুষারপাতে হয়তো তার ছিঁড়ে গেছে।”
থমথমে দেখাচ্ছে ট্রটারের চেহারা। “আশ্চর্য! কেটে ফেলল না তো কেউ?”
চোখ তুলে তাকাল মলি। “কাটবে কেন?”
জবাব না দিয়ে ট্রটার বলল, “দেখি, শিওর হতে হচ্ছে,” বলে তাড়াহুড়া করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করে গিলেসও সার্জেন্টের পিছু পিছু বেরিয়ে গেল।
“সর্বনাশ! লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে!” মনে পড়তেই আঁতকে উঠল মলি। “সব পড়ে আছে ওদিকে। উপোস থাকতে হবে…” ছুটে বেরিয়ে গেল সে।
“এক্কেবারে আনাড়ি,” বিড়বিড় করলেন মিসেস বয়েল। “আর কী একখান জায়গা! এর জন্যে সাত গিনি… না, দেব না আমি!”
####
নয়…
ঝুঁকে টেলিফোনের তারটা দেখতে দেখতে এগোল ট্রটার। গিলেসকে জিজ্ঞেস করল, “এক্সটেনশন আছে?”
“আছে। দোতলায়। আমাদের বেডরুমে। দেখব গিয়ে?”
“প্লিজ, খুব ভালো হয় তাহলে।”
জানালার পাল্লা খুলে চৌকাঠের ওপর দিকে লেগে থাকা বরফ পরিষ্কার করল ট্রটার। মাথা বাড়িয়ে বাইরে উঁকি দিল।
সেদিকে একবার তাকিয়ে ঘুরে দাঁড়াল গিলেস। সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছল। উঠতে শুরু করল সিঁড়ি বেয়ে।
মস্ত ড্রইংরুমে ঢুকলেন মিস্টার পারাভিসিনি। গ্র্যান্ড পিয়ানোটার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ডালা তুললেন। পাশেই রাখা টুল টেনে নিয়ে বসে পড়লেন। এক আঙুলে চাপ দিতে লাগলেন চাবিতে। মোলায়েম বাজনা বেজে উঠল। সুরটা :
থ্রি ব্লাইন্ড মাইস
সি হাউ দে রান…
ক্রিস্টোফার রেন রয়েছে তার শোবার ঘরে। পায়চারি করছে। শিস দিচ্ছে আপনমনে। হঠাৎ শিস থামিয়ে বিছানার কিনারে বসে পড়ল। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল। বিড়বিড় করে বলল, “পারছি না। কিছুতেই এগোতে পারছি না।”
হঠাৎ বদলে গেল তার মেজাজ। ঝট করে মাথা তুলল। বদলে গেছে মুখের ভাব। চওড়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “পারতেই হবে, আমাকে পারতেই হবে।”
বেডরুমে টেলিফোনটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে গিলেস। মেঝেতে চোখ। একটা চেয়ারের নিচে পড়ে আছে মলির একটা দস্তানা।
উবু হয়ে দস্তানাটা তুলে নিল গিলেস। দস্তানার ভিতর থেকে পড়ল লাল রঙের এক টুকরো কাগজ। বাসের টিকেট। ওটা দেখে মুখের ভাব বদলে গেল তার।
ঘুরে দাঁড়াল গিলেস। ঘোরের মধ্যে যেন দরজার দিকে এগোচ্ছে। দরজা খুলল। দাঁড়িয়ে থেকে করিডর দেখল। সিঁড়ির মাথার দিকে তাকাল। খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে ওকে।
আলুর খোসা ছাড়ানো শেষ করেছে মলি। বড় কড়াইতে রেখে চুলোয় চাপাল। আগুনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, প্ল্যানমতোই এগোচ্ছে সমস্ত কাজ।
টেবিলে পড়ে আছে দুই দিনের পুরানো ‘ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড’-এর একটা কপি। ওটার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে গেল তার। কী যেন মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। যদি…
হঠাৎ নিজের অজান্তেই চোখের দিকে উঠে গেল তার হাত। বিড়বিড় করল, “না না!”
আস্তে করে চোখের ওপর থেকে হাত সরাল মলি। সারা রান্নাঘরে চোখ বোলাল। নতুন দেখছে যেন ঘরটাকে। গরম, আরামদায়ক, খোলামেলা রান্নাঘরে খাবারের সুগন্ধ।
“না না!” চাপা গলায় আবার বলল মলি।
ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগোল সে। ঘুমের ঘোরে হাঁটছে যেন। আস্তে করে দরজা খুলে হলে এসে ঢুকল। কেমন যেন
থমথমে হয়ে আছে পুরো বাড়িটা। নাকি তারই ওরকম মনে হচ্ছে? থেকে থেকে কানে আসছে হালকা শিসের শব্দ।
সেই সুর…
শিহরণ খেলে গেল যেন মলির শরীরে। নিজের অজান্তেই পিছিয়ে এলো দুই পা। মিনিটখানেক অপেক্ষা করে খোলা দরজা দিয়ে আবার ফিরে তাকাল রান্নাঘরের দিকে। ভিতরটা দেখল। না, সব ঠিকই আছে। ঠিকঠাকমতোই এগোচ্ছে সব। আবার রান্নাঘরের দরজার কাছে ফিরে এলো সে।
নিঃশব্দে সিঁড়ির পিছনে এসে দাঁড়ালেন মেজর মেটকাফ। দু’এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন। আস্তে করে খুললেন বিরাট আলমারির পাল্লা। বড় বেশি নীরব লাগছে বাড়িটা। কাউকে দেখা গেল না। সহজেই কাজ চালিয়ে যাওয়া যায়…
####
দশ…
অস্বস্তি বোধ করছেন মিসেস বয়েল। লাইব্রেরিতে বসে আছেন। হাত বাড়িয়ে রেডিওর নব ধরে ঘুরিয়ে দিলেন। স্পিকারে ভেসে এলো গমগমে কণ্ঠস্বর। বিষয়টা মোটেও পছন্দ হলো না তাঁর। আগে জানলে ‘অন’ই করতেন না।
বক্তা বলছে : “ভয়ের সংজ্ঞা দেয়া সহজ নয়। তবে বোঝানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। ধরা যাক, একটা নীরব ঘরে একা রয়েছেন আপনি। নিঃশব্দে খুলে গেল আপনার পিছনের দরজা…”
সত্যিই খুলে গেল পিছনের দরজা।
ভীষণ চমকে গিয়ে ঝট করে মাথা ঘোরালেন মিসেস বয়েল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ও, আপনি। রেডিও খুললেই খালি বকবকানি। শুনতে মোটেও ভালো লাগে না।”
“আমারও লাগে না, মিসেস বয়েল।”
নাক কুঁচকালেন মিসেস বয়েল। “আচ্ছা, এই খুনখারাপির ব্যাপারটা কী বলুন তো? আমার কিন্তু এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না…”
“হচ্ছে না?”
“মানে!… ও কী করছেন…”
মিসেস বয়েলের কথা শেষ হওয়ার আগেই রেনকোটের একটা বেল্ট দিয়ে ফাঁস পরিয়ে দেয়া হলো তাঁর গলায়। চেপে বসতে লাগল ফাঁসটা। নব ঘুরিয়ে আরও বাড়িয়ে দেয়া হলো রেডিওর শব্দ। ‘ভয়’ সম্পর্কে আলোচনা চলেছে গমগমে ভারি কণ্ঠে। মিসেস বয়েলের গলা থেকে সামান্য আওয়াজ যা বেরোল, তা-ও ঢেকে গেল রেডিওর শব্দে।
খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেল কাজ।
পাকা হাত খুনীর।
####
এগারো…
রান্নাঘরে জড় হয়েছে সবাই। চুলার ওপর বসানো কড়াইতে মৃদু শব্দ তুলে আলু ভাজা হচ্ছে। বাতাসে কাবাব আর কিডনিপাইয়ের সুগন্ধ।
স্তব্ধ হয়ে আছে চারজন পুরুষ। একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। ঘরের পঞ্চম মানুষটি মলি, মুখ ফ্যাকাসে। কাঁপছে সে। হাতে হুইস্কির গ্লাস। জোর করে তার হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিয়েছে ছয় নম্বর লোকটি, সে সার্জেন্ট ট্রটার।
কঠোর হয়ে উঠেছে তার মুখ। চোখে আগুন। একে একে চোখ বোলাল ঘরের প্রতিটি মানুষের মুখের ওপর। মাত্র পাঁচ মিনিট আগে চেঁচিয়ে উঠেছিল মলি। লাইব্রেরিতে ছুটে এসেছিল সবাই।
“মিসেস বয়েল খুন হবার পর পরই আপনি ওই ঘরে ঢুকেছেন, মিসেস ডেভিস,” ট্রটার বলল। “হলে কারও দেখা পেয়েছেন? কোনো ধরনের শব্দ শুনেছেন?”
“হালকা শিসের শব্দ শুনেছি,” প্রায় ফিসফিস করে বলল মলি। “তবে সেটা আগে। পরে… আমার মনে হয়… আমি শিওর না… মনে হলো কোথায় যেন দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুনলাম। খুব মৃদু শব্দ… তার পর পরই আমি লাইব্রেরিতে ঢুকেছি।”
“কোন দরজা?”
“বলতে পারব না।”
“ভাবুন, মিসেস ডেভিস। মনে করার চেষ্টা করুন। ওপরে… নিচে… ডানে… বাঁয়ে… কোথায়?”
“জানি না, বললামই তো!” প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মলি। “আওয়াজটা সত্যিই শুনেছি কিনা, তাতেও আমি শিওর নই।”
“ওকে বিরক্ত করছেন কেন?” রেগে গেল গিলেস। “দেখছেন না, কেমন ভেঙে পড়েছে?”
“আমি খুনের তদন্ত করছি, মিস্টার ডেভিস… সরি, কমান্ডার ডেভিস।”
“নামের আগে যুদ্ধের সময়কার পদবী আমি ব্যবহার করি না, সার্জেন্ট।”
“তা ঠিক,” বলে থামল ট্রটার। কী যেন ভেবে মনস্থির করে নিল। “ওই যে, যা বলছিলাম, একটা খুনের তদন্ত করছি আমি। খানিক আগেও ব্যাপারটাকে এখনকার মতো গুরুত্ব দেননি কেউ। মিসেস বয়েল তো নয়ই। তথ্য প্রকাশ করেননি আমার কাছে। আর তার ফলাফল তো দেখলেন। এখনও সবাই তথ্য গোপন করছেন আমার কাছে, কিছু কিছু কথা লুকিয়ে রেখেছেন, বলছেন না খোলাখুলি। মিসেস বয়েল তো গেছেন। আবার সাবধান করছি আপনাদের, এখনও যদি সব না বলেন, খুব শীঘ্রি আরও একজন খুন হবেন।”
“আরও একজন? কেন?” গিলেসের প্রশ্ন।
“কারণ,” গম্ভীর স্বরে ট্রটার বলল, “তিনটে ছোট অন্ধ ইঁদুরের কথা লেখা হয়েছে।”
“একেকটা ইঁদুর মানে একেকজন লোক?” অবিশ্বাস প্রকাশ পেল গিলেসের গলায়। “কিন্তু যোগাযোগটা কোথায়? অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, এই তিনজন আর খুনীর মাঝে যোগাযোগটা কোথায়?”
“কোনো একটা যোগাযোগ নিশ্চয় আছে।”
“কিন্তু তৃতীয় খুনটা এখানেই ঘটবে কেন?”
“কারণ মাত্র দুটো ঠিকানা লেখা আছে নোটবুকে। ৭৪ নম্বর কালভার স্ট্রিটে সম্ভবত একজনই ছিল। সে খুন হয়েছে। কিন্তু মংকসওয়েল ম্যানরে অনেকে আছে।”
“বাজে কথা, ট্রটার। নিতান্তই ঘটনাচক্রে দুটো লোক খুন হওয়ার জন্যে এখানে এসে হাজির হয়েছে, এটা অতিরিক্ত অতিকল্পনা হয়ে যাচ্ছে না?”
“বাস্তবে অনেক কিছুই ঘটে যা অনেক সময় কল্পনাকেও হার মানায়। ওসব কথা এখন থাক, মিস্টার ডেভিস,” অন্যদের দিকে ফিরল ট্রটার। “এখন কিছু কথা জানতে হবে আমাকে। মিসেস বয়েল খুন হবার সময় আপনারা কে কোথায় ছিলেন, জানতে হবে আগে। মিস্টার রেনকে দিয়েই শুরু করা যাক। মিসেস ডেভিস যখন চেঁচিয়ে উঠলেন, কোথায় ছিলেন আপনি?”
“আমার ঘরে।”
“মিস্টার ডেভিস, আপনি দোতলায় আপনাদের বেডরুমে টেলিফোন লাইন পরিষ্কার করছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“মিস্টার পারাভিসিনি?”
“ড্রইংরুমে ছিলাম। পিয়ানো বাজাচ্ছিলাম।”
“অথচ কারও কানে গেল না আপনার বাজনা?”
“খুব আস্তে এক আঙুলে কী চাপছিলাম।”
“কী সুর বাজাচ্ছিলেন?”
“থ্রি ব্লাইন্ড মাইস,” পারাভিসিনি হাসলেন। “ওপরতলায় যে সুরে মিস্টার রেন শিস দিচ্ছিলেন, ঠিক সেই সুর। আসলে, সবার মনেই খেলছিল তো সুরটা, বেরিয়ে আসছিল নিজেদের অজান্তেই।”
“ভয়ানক সুর,” বিড়বিড় করল মলি।
“টেলিফোন ডেড হলো কীভাবে?” মেজর মেটকাফ জানতে চাইলেন। “তার কেটে ফেলা হয়েছে?”
“হ্যাঁ, মেজর,” জবাব দিল ট্রটার। “কিছুটা জায়গার তার কেটে ফেলে দেয়া হয়েছে। ডাইনিং রুমের জানালার বাইরের দিকে যেখান দিয়ে তারটা গিয়েছে, সেখানে। ভালোমতো পরীক্ষার সুযোগ পাইনি। মিসেস ডেভিসের চিৎকারে দৌড়ে এলাম।”
“কিন্তু এ তো পাগলামি। এসব করে পার পেয়ে যাবে খুনীটা, ভাবল কী করে?” তীক্ষ্ণ শোনাল ক্রিস্টোফার রেনের গলা।
স্থির চোখে তাকে দেখল ট্রটার। “হয় নিজেই বোকামি করেছে, নয়তো আমাদেরকে বোকা ভেবেছে। খুনীরা এ ধরনের ভুল করে, আর করে বলেই ধরা পড়ে। ট্রেনিঙের সময় ছোটখাটো একটা সাইকোলজি কোর্স করতে হয় আমাদের। তাই জানি শিযোফ্রেনিকস মেন্টালিটির ব্যাপারটা ভারি ইন্টারেস্টিং।”
“এসব বড় বড় কঠিন শব্দের ব্যবহার এখন বাদ দিলে কেমন হয়?” গিলেস বলল।
“ঠিকই বলেছেন, মিস্টার ডেভিস, সরি। আসলে এ মুহূর্তে দুটো ছোট্ট শব্দ নিয়েই আলোচনা করা উচিত আমাদের— খুন এবং বিপদ। মেজর মেটকাফ, আপনার কথা কিছু বলুন এবার। সে-সময়টাতে কোথায় ছিলেন?”
“ভাঁড়ারে।”
“ওখানে কী করছিলেন?”
“ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম,” মেজর বললেন। “সিঁড়ির উল্টোদিকে আলমারির ভিতরটা দেখছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়ল পাশের একটা দরজার ওপর। খুললাম। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে। কৌতূহল ঠেকাতে পারলাম না। নেমে গেলাম নিচে।” গিলেসের দিকে ফিরলেন তিনি। “সত্যিই চমৎকার আপনাদের ভাঁড়ারটা। অনেক পুরানো।”
“প্রাচীন নিদর্শন নিয়ে আলোচনা করছি না আমরা, মেজর মেটকাফ,” ট্রটার বলল, “খুনের তদন্ত হচ্ছে।” মলির দিকে ফিরে বলল, “মিসেস ডেভিস, একটু কান পেতে শুনবেন?” বলে বেরিয়ে গেল সার্জেন্ট। একটা দরজা বন্ধ হবার মৃদু আওয়াজ শোনা গেল। আবার ফিরে এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ট্রটার জিজ্ঞেস করল, “এই শব্দই শুনেছিলেন না?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেকটা এ রকমই।”
“সিঁড়ির উল্টোদিকের আলমারি বন্ধ হবার শব্দ। হয়তো মিসেস বয়েলকে খুন করার পর হলরুম ধরে পালাচ্ছিল খুনী। আপনাকে আসতে শুনে তাড়াতাড়ি আলমারির ভিতর ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়।”
“তাহলে আলমারির দরজায় তার আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে,” চেঁচিয়ে উঠল ক্রিস্টোফার।
“খুঁজলে আমার আঙুলের ছাপও পাওয়া যাবে,” মেজর মেটকাফ বললেন।
“ঠিক,” ট্রটার বলল। “কিন্তু কেন পাওয়া যাবে, এ ব্যাপারে একটা সন্তোষজনক জবাব আমরা আশা করতে পারি, তাই না?”
“দেখুন, সার্জেন্ট,” গিলেস বলল, “আপনি পুলিশের লোক, খুনের তদন্ত করছেন, খুনীকে খুঁজে বের করার ভার আপনার ওপর। কিন্তু এটা আমার বাড়ি। এখানে যে অতিথিরা আছেন, তাদের ভালোমন্দ দেখাশোনার ভার রয়েছে আমার ওপর। আগে থেকেই সাবধান হওয়া উচিত নয় কি আমার? কোনো একটা পদক্ষেপ কী নিতে পারি না, অবশ্যই আপনার সাহায্যে?”
“যেমন?”
“যাকে আমাদের বেশি সন্দেহ, তাকে কোনো ঘরে বন্দি করে রাখতে পারি না?” ক্রিস্টোফার রেনের দিকে তাকাল গিলেস।
রেগে গেল রেন, চিৎকার করে বলল, “আমার পিছু লেগেছেন কেন? সবাই আমার পিছু লেগেছেন! সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করে সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপানোর ব্যবস্থা করেছেন…”
“শান্ত হোন,” মেজর বললেন। “কেউ আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেনি।”
“হ্যাঁ, ঠিক,” এগিয়ে গিয়ে রেনের বাহুতে হাত রাখল মলি। “কেউ আপনার বিরুদ্ধে নয়, কেউ পিছু লাগেনি।” ট্রটারের দিকে ফিরে বলল, “ওকে শান্ত হতে বলুন। বলুন, ওর কোনো ভয় নেই।”
“মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করি না আমরা, মিস্টার রেন,” ট্রটার বলল।
“বলুন, ওকে আপনি অ্যারেস্ট করছেন না,” মলি বলল।
“এখনও কাউকেই অ্যারেস্ট করছি না। করতে হলে প্রমাণ দরকার। সেটা এখনও পাইনি।”
গম্ভীর হয়ে গিলেস বলল, “মলি, মাথা খারাপ হলো নাকি তোমার?” ট্রটারের দিকে ফিরে বলল, “সার্জেন্ট, ওই একটা লোককেই সবদিক থেকে সন্দেহ করা যায়। সবকিছু খাপে খাপে মিলে যায় একমাত্র ওর সঙ্গেই…”
বাধা দিল মলি, “থামো তুমি, গিলেস। চুপ করো। সার্জেন্ট ট্রটার, আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে আমার। একলা।”
“কিন্তু আমি সঙ্গে থাকব,” গিলেস বলল।
“না, গিলেস, প্লিজ। আমি কথা বলতে চাই।”
গিলেসের মুখ কালো হয়ে গেল। “তোমার কী হলো, মলি, বুঝতে পারছি না।”
মলি ও ট্ৰটারকে রেখে একে একে বেরিয়ে গেল সবাই। সবার শেষে বেরোল গিলেস। পিছনে দড়াম করে লাগিয়ে দিয়ে গেল দরজাটা।
“কী বলবেন, বলুন, মিসেস ডেভিস?”
“সার্জেন্ট ট্রটার, আপনি বলেছেন তিন ভাইবোনের বড় ভাইটাই এসব খুনখারাপির জন্যে দায়ী। কিন্তু আপনি শিওর নন, কথাটা জেনেশুনে বলেননি, তাই না?”
“ঠিকই বলেছেন, মিসেস ডেভিস। তবে সেটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মানসিক অস্থিরতা, আর্মি থেকে পালানো, সাইক্রিয়াট্রিস্টের রিপোর্ট সেই দিকেই নির্দেশ করছে।”
“জানি কী বলতে চাইছেন। ক্রিস্টোফারের কথাই বলছেন আপনি। কিন্তু আরও তো সম্ভাবনা আছে। ধরুন, ওই তিনটে ছেলেমেয়ের বাবা কিংবা অন্য কোনও আত্মীয়? থাকতে তো পারে, তাই না?”
“হ্যাঁ। মা আগেই মরে গিয়েছিল। বাবা চাকরি করত তখন জাহাজে।”
“বেশ, তার কথাই ধরুন। কোথায় আছে এখন সে?”
“জানি না। গত বছর রেজিগনেশনের দরখাস্ত করেছে শুনেছি। এরপর আর কোনো খবর জানি না।”
“ছেলের মানসিক রোগ আছে, সেটা বাপের কাছ থেকেও পেতে পারে?”
“পারে।”
“খুনী তাহলে মাঝবয়েসী লোকও হতে পারে। পুলিশ আসার কথা শুনে মেজর মেটকাফকে চমকে উঠতে দেখেছি।”
শান্তকণ্ঠে ট্রটার বলল, “সেদিকটা যে ভাবিনি আমি, তা নয়। আসলে কোনোরকম সম্ভাবনাই বাদ দিচ্ছি না। বড় ছেলেটির নাম জিম, সে খুনী হতে পারে, তার বাপ হতে পারে, এমনকি তার বোনও হতে পারে। কোনো মেয়ে তরুণী আর সুন্দরী
হলেই কি সে খুনী হতে পারে না? কাউকেই সন্দেহ থেকে বাদ দেয়া যায় না। কারণ এখনও বুঝতে পারিনি খুনী কে। পুলিশে কাজ করি, এমন অনেক কিছুই দেখেছি, রীতিমতো তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। বিয়েঘটিত অনেক গোলমাল দেখেছি, বিশেষ করে যুদ্ধের সময়ের বিয়েগুলোতে। বর কনে কেউ কারও পরিচয় ভালোমতো জানেই না, কোনো আত্মীয়ের সাক্ষাৎ নেই, অথচ বিয়ে হয়ে গেছে। একে অন্যের কথাকেই যথেষ্ট ভেবেছে ওরা, কোনো কিছু খতিয়ে দেখার কথা ভাবেনি। বর হয়তো বলল সে ফাইটার প্লেনের পাইলট কিংবা আর্মির মেজর, মেয়েটাও সেটা বিশ্বাস করল। বহুদিন, হয়তো পুরো এক বছর কিংবা তারও বেশি সময় জানতেই পারল না লোকটা আসলে কোনো ব্যাংকের সাধারণ কর্মচারী। কিংবা হয়তো আগে বিয়ে করেছিল, সে বউ-ও আছে, তাকে তালাক দেয়া হয়নি। এমনকি হয়তো প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়েও আছে।”
থামল ট্রটার। মলির দিকে তাকাল। বলল, “আপনি কী ভাবছেন, বুঝতে পারছি, মিসেস ডেভিস। আরেকটা কথা, খুন করাটা— আমার মনে হয় খুন করাটা খুব উপভোগ করছে এই খুনী। হ্যাঁ, করছে, আমি শিওর।”
দরজার দিকে এগোল ট্রটার।
স্থির দাঁড়িয়ে আছে মলি। কান, গাল গরম হয়ে উঠেছে।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে চুলার দিকে এগোল সে। চুলার নিচের দরজাটা খুলতেই সুগন্ধ এসে ধাক্কা মারল নাকে। হঠাৎ হালকা হয়ে গেল মন। জোর ধাক্কা খেয়ে যেন বাস্তবে ফিরে এলো। স্বামীসেবা, ঘরকন্যা, রান্নার কাজগুলোই আবার প্রধান মনে হলো।
দরজা খুলে গেল। ফিরে তাকাল মলি। ক্রিস্টোফার রেন ঢুকছে। একটু অবাকই হলো মলি।
“মাই ডিয়ার ম্যাডাম,” রেন বলল, “একটা মজার খবর আছে। ট্রটারের স্কি চুরি করেছে কে জানি।”
“স্কি চুরি করবে কে? আর করবেই বা কেন?”
“বুঝতে পারছি না। এতে তো আটকা পড়বে ট্রটার। সে চলে গেলেই তো বরং খুনীর জন্যে ভালো। নাহ্, মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।”
“গিলেসই তো স্কিগুলো নিয়ে গিয়ে রেখেছিল, সিঁড়ির উল্টোদিকের আলমারিটাতে।”
“রেখেছিল, কিন্তু এখন নেই। তাজ্জব কাণ্ড, তাই না?” দাঁত বের করে হাসল রেন। “খেপে বোম হয়ে আছে ট্রটার। হাত-পা ছুঁড়ছে সমানে। বার বার মেজরকে জিজ্ঞেস করছে, ওগুলো কোথায়। তার ধারণা, মেজরই ওগুলো সরিয়েছেন। কিন্তু মেজর সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি কিছু জানেন না। আলমারি খুলে ওগুলো চোখে পড়েনি তাঁর। ট্রটার বলছে, মিসেস বয়েল খুন হবার আগে স্কি দুটো ওখানেই ছিল।” কণ্ঠস্বর খাদে নামাল রেন। “ট্রটারের মনোবল ভাঙতে আরম্ভ করেছে।”
“আমাদের সবারই ভাঙছে।”
“আমার ভাঙছে না। বরং ভালো লাগছে। অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটছে এবং সেটা বইপুস্তক কিংবা স্বপ্নে নয়, বাস্তবে, সত্যি সত্যি।”
কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ হলো মলির, “ভালো লাগত না, যদি মিসেস বয়েলের লাশটা আপনি প্রথম দেখতেন। পড়ে থাকার ভঙ্গি দেখতেন। কী সাংঘাতিক দৃশ্য! মুখ ফোলা, চোখ যেন ছিটকে বেরোবে, মুখের বাইরে বেরোনো আধ হাত জিভ… ওহ্, মাগো, কী ভয়ঙ্কর!” কেঁপে উঠে দু’হাতে মুখ ঢাকল সে।
কাছে এলো রেন। মলির কাঁধে হাত রাখল। “সরি, আপনাকে ভয় পাইয়ে দিলাম। মাপ চাইছি। মোটেই ভেবে বলিনি।”
ফুঁপিয়ে উঠল মলি। গলাটা শুকনো। “আর খারাপ লাগছে না… এই রান্নাঘর… খাবার…” কেমন অনিশ্চিত শোনাল তার কণ্ঠ। “রান্নাবান্নায় মন দিয়ে জোর করে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম দুঃস্বপ্নটা। কিন্তু আপনি ঢুকতেই…”
মাথা নিচু করে মলির দিকে তাকিয়ে আছে রেন। চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। “বুঝেছি। বুঝতে পেরেছি। আর আপনাকে বিরক্ত করব না। আমি যাই।”
আচমকা চেঁচিয়ে উঠল মলি, “না না, যাবেন না!”
দরজার হাতল ছুঁয়েছিল সবে রেনের আঙুল, সে-অবস্থায়ই থেমে গেল। ফিরে তাকাল সে। কুঁচকে গেছে ভুরু। চোখে জিজ্ঞাসা। ধীরে ধীরে ফিরে এলো আবার আগের জায়গায়।
“সত্যি বলছেন?”
“কী সত্যি?”
“আমার চলে যাওয়াটা সত্যি চাইছেন না?”
“না। একা থাকতে ভয় করছে আমার।”
টেবিলের পাশে বসল রেন।
চুলার ওপর ঝুঁকল মলি। পাইয়ের পাত্রটা ওপরের তাকে বসাল। চুলার দরজা বন্ধ করল। তারপর এসে দাঁড়াল রেনের কাছে।
“আশ্চর্য!” রেন বলল।
“কী আশ্চর্য?”
“আপনি আমাকে ভয় পাচ্ছেন না।”
মাথা নাড়ল মলি। “না, পাচ্ছি না।”
“কেন?”
“আমি জানি না। বলতে পারব না।”
“অথচ আমাকেই বেশি সন্দেহ করা হচ্ছে। খুনীর সঙ্গে আমার মিলই সবচেয়ে বেশি।”
“না। অন্য কারোও থাকতে পারে। ট্রটারের সঙ্গে সব আমি আলোচনা করেছি।”
“ও কি আপনার সঙ্গে একমত হয়েছে?”
“একমত না হলেও দ্বিমত করেনি,” মলি বলল।
বিশেষ কিছু কথা ঘুরপাক খাচ্ছে মলির মাথায়। ট্রটারের শেষ কথাটা আছে তার মাঝে : “আপনি কী ভাবছেন, বুঝতে
পারছি, মিসেস ডেভিস।” কিন্তু আসলেই কি বুঝতে পেরেছে? সত্যি কথাটা জানে? ট্রটারের ধারণা, খুন করে খুব মজা পাচ্ছে খুনী। আসলেই কি তাই?
রেনকে জিজ্ঞেস করল মলি, “ঘটনাটায় আপনি খুব মজা পাচ্ছেন, উপভোগ করছেন, তাই না? এই একটু আগেই তো বললেন।”
“না না, কী যে বলেন!” তাড়াতাড়ি বলে উঠল রেন। “ও তো একটা কথার কথা।”
“কথাটা আমার নয়, রেন, ট্রটারের। লোকটাকে ঘৃণা করি আমি। মানুষের মাথায় যা-তা সব দুশ্চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়।”
আবার দু’হাতে মুখ ঢাকল মলি।
আস্তে করে মলির হাতটা মুখের ওপর থেকে সরিয়ে দিল রেন। “মলি, তাকান তো এদিকে। আসলে কী হয়েছে আপনার, বলুন তো?”
জোর করে মলিকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল সে। খেপামি কিংবা ছেলেমানুষীর কোনো চিহ্নই নেই এখন তার চেহারায়। “কী হয়েছে, মলি, খুলে বলুন আমাকে।”
রেনের দিকে তাকাল মলি। “আপনার সঙ্গে কয় দিনের পরিচয় আমার, রেন? দু’দিন?”
“প্রায়। নিশ্চয় ভাবছেন এত অল্প সময়ে পরস্পরকে চিনে ফেলেছি আমরা, তাই না?”
“তাই। অবাক কাণ্ড না?”
“কী জানি। কোথায় যেন কী একটা মিল হয়ে গেছে আমাদের। হয়তো, হয়তো দু’জনেই আমরা ব্যাপারটার বিরুদ্ধে।”
“আপনার নাম আসলে ক্রিস্টোফার রেন নয়, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে কেন…”
“এই ছদ্মনাম নিলাম? একটা অদ্ভুত খেয়ালও হতে পারে। স্কুলে একটা বিশেষ কারণে সহপাঠীরা আমাকে ক্রিস্টোফার রবিন বলে ডাকত। রবিনকেই রেন করে ফেলেছি।”
“আপনার আসল নাম কী?”
“থাক না ওটা। শুনেও কোনো লাভ হবে না আপনার। তবে এটুকু জেনে রাখুন, আমি আর্কিটেক্ট নই। আর্মিতে চাকরি করতাম। পালিয়েছি।”
মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠল মলির চোখের তারা।
রেনের চোখ এড়াল না সেটা। বলল, “হ্যাঁ, আমাদের এই খুনীর মতোই পালিয়েছি। এবার নিশ্চয় আমার সম্পর্কে আর ভালো ধারণা থাকছে না?”
“বোকার মতো কথা বলবেন না। আপনি যে খুনী নন, আমি জানি। অন্তত, আপনাকে খুনী বলে মনে হয় না। বলুন, আপনার সম্পর্কে আরও বলুন। আর্মি থেকে পালালেন কেন?”
“ভয় পেয়েছি ভাবছেন? মোটেই না। কোনো ব্যাপারেই ভয় পাবার লোক নই আমি। যেকোনো পরিস্থিতিকে সহজভাবে নিতে পারি। পালানোর কারণ আমার মা।”
“মা?”
“হ্যাঁ। বিমান আক্রমণে মারা গেছে। ইঁট-কাঠের নিচে চাপা পড়েছে। খবরটা শুনে কী যেন ঘটে গেল আমার ভিতরে। জঞ্জালের ভিতর থেকে মাকে বের করে আনার প্রবল ইচ্ছেটা রোধ করতে পারলাম না। ছুটি চাইলাম, দিল না কর্তারা। আর কোনো উপায় না দেখে পালালাম।” মাথা নিচু করল রেন। দু’হাতের তালুর দিকে তাকাল। কণ্ঠস্বর খাদে নেমে এলো। “তারপর অনেক খুঁজেছি। ধসে পড়া কত বাড়ির ইঁট-কাঠ সরিয়েছি। কিন্তু আর খুঁজে পেলাম না মাকে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। আবার আর্মিতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু গিয়ে আবার কোন বিপদে পড়ি, এই ভয়ে যেতে পারলাম না। তারপর থেকেই বেকার, কোনো কাজ করি না।”
কোমল দৃষ্টিতে রেনের দিকে তাকিয়ে আছে মলি। “এতটা ভেঙে পড়ার কোনো কারণ দেখছি না। আর্মিতে যেতে পারেননি কেন বুঝলাম, কিন্তু অন্য কোনো কাজ তো করতে পারেন? পুরুষ মানুষের বেকার থাকাটা ভালো দেখায় না।”
“বলছেন?”
“নিশ্চয়। এখনও বয়েস অনেক কম আপনার। নতুন কিছু শুরু করার সময় শেষ হয়ে যায়নি।”
“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সব কিছুর শেষে চলে এসেছি আমি।”
“না,” মলি বলল, “মোটেও তা আসেননি। আপনার যেটা হয়েছে, সেটা মানসিক অসুখ। অনেকেই ভোগে। আবার সেরেও যায়। ইচ্ছে করলেই এই মনের রোগ তাড়াতে পারেন আপনি।”
“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনিও এই রোগের শিকার?”
“হ্যাঁ, হয়েছিলাম। কাটিয়ে ফেলেছি।”
“আপনার কী হয়েছিল?”
“অনেকের জীবনেই যা ঘটে। এক তরুণ পাইলটের সঙ্গে এনগেজমেন্ট হয়েছিল আমার। ফাইটার প্লেনের পাইলট। যুদ্ধে মারা গেছে।”
“সরি!”
“এরচেয়ে বড় শকও পেয়েছি আমি। ভয়াবহ নিষ্ঠুর সেই অভিজ্ঞতা। জীবন সম্পর্কে একটা আতঙ্ক বাসা বেঁধেছিল মনে। তারপর জ্যাক যখন মারা গেল, আকর্ষণ হারালাম জীবনের ওপর। বেঁচে থাকার আর কোনো অর্থ খুঁজে পেলাম না। কিন্তু তবু বেঁচে রইলাম।”
“নিশ্চয়, তখনই গিলেস এসেছিল আপনার জীবনে, আপনাকে উদ্ধার করেছিল?”
“হ্যাঁ।” এক চিলতে হাসি ফুটল মলির ঠোটে। “গিলেস এলো, ঠিকঠাক হয়ে গেল সবকিছু। নিরাপদ, সুখী মনে হলো আবার নিজেকে… গিলেস…”
কী যেন মনে হতেই হঠাৎ হাসি অদৃশ্য হয়ে গেল মলির মুখ থেকে। পাথর হয়ে গেল যেন। কেঁপে উঠল একবার, ঠাণ্ডায় বলে মনে হলো না রেনের।
“কী হলো, মলি? ভয় পেয়েছেন মনে হচ্ছে?”
মাথা ঝাঁকাল মলি।
“নিশ্চয় গিলেসের কোনও ব্যাপার? কিছু বলেছে সে? কিছু করেছে?”
“না, গিলেস নয়। ওই সাংঘাতিক লোকটা।”
“কোন লোকটা?” অবাক হলো রেন। “কার কথা বলছেন? পারাভিসিনি?”
“না, সার্জেন্ট ট্রটার।”
“ট্রটার?”
“হ্যাঁ। লোকের মনে খালি আজেবাজে সন্দেহ ঢোকায়। গিলেসকে নিয়েও ভাবতে আরম্ভ করেছি আমি। এমন সব ভাবনা, যা আগে কখনও মাথায়ই আসেনি আমার। ওই লোকটাকে ভীষণ ঘৃণা করি আমি।”
ধীরে ধীরে উঁচু হলো রেনের ভুরু। “গিলেস… গিলেস… হ্যাঁ, নিশ্চয়… বুঝেছি!” আপনমনে মাথা দোলাল সে। “গিলেস আর আমার কাছাকাছি বয়েস। যদিও দেখে আমার চেয়ে অনেক বেশি বয়স্ক মনে হয় ওকে। হ্যাঁ, আমার মতোই গিলেসও সন্দেহের তালিকায় পড়ে। কিন্তু মলি, আপনি অকারণে
ভাবছেন। লন্ডনে যেদিন মিসেস লিয়ন খুন হয়, সেদিন গিলেস ওখানে যায়ইনি। এখানে আপনার সঙ্গে ছিল।”
চুপ করে রইল মলি।
মলির দিকে তাকিয়ে ভুরু কোঁচকাল রেন। “কী হলো? ছিল না এখানে?”
“না, ছিল না…” ঘোরের মধ্যে যেন বলতে লাগল মলি, “সারাদিন বাইরে ছিল… গাড়ি নিয়ে গিয়েছিল… গাঁয়ের ওদিকে কোথায় নাকি নিলামে তারের জাল বিক্রি হয়েছে, সেগুলো কিনতে গিয়েছিল… ও এসে বলেছে, আমিও বিশ্বাস করেছি… কিন্তু…”
“কিন্তু কী?”
আস্তে করে হাত বাড়িয়ে টেবিলে পড়ে থাকা ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকাটা ছুঁলো মলি। তারিখটা দেখাল।
রেন বলল, “লন্ডন এডিশন। দু’দিন আগের।”
“এই কাগজটা সেদিন নিয়ে এসেছে গিলেস। ও… ও নিশ্চয় লন্ডনে গিয়েছিল।”
চিন্তিত ভঙ্গিতে কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইল রেন। নিজের অজান্তেই ঠোঁট গোল হয়ে গিয়ে শিস বেরিয়ে এলো। থেমে গেল পরক্ষণে। এই মুহূর্তে শিস দেয়াটা বেমানান, বিশেষ করে ওই থ্রি ব্লাইন্ড মাইস গানের সুর।
মুখ ফিরিয়ে মলির দিকে তাকাল সে। “গিলেসকে কতখানি চেনেন আপনি? কতদিনের পরিচয়?”
“চিনি না! একেবারেই চিনি না!” ককিয়ে উঠল মলি। “মাত্র দুই হপ্তা। একজন মানুষকে চেনার জন্যে ওই সময়টা কিছুই না। আর ঠিক এই ইঙ্গিতটাই দিয়েছে ওই জঘন্য লোকটা। যুদ্ধের সময় বিয়ে করে অনেকেই নাকি ঠকেছে— শুধু মুখের কথায় বিশ্বাস করে।”
“ভুল বলেনি।”
“আপনিও তাই বলছেন? না না, এ হতে পারে না। গিলেস ওরকম লোকই নয়। আসলে পরিবেশ-পরিস্থিতি মাথায় গোলমাল করে দিচ্ছে আমাদের। যা-তা ভাবছি। ট্রটারের কথা ঠিক না… ভুল, একেবারেই ভুল…”
রান্নাঘরের দরজা খুলতে দেখে হয়ে গেল মলি।
ঘরে ঢুকল গিলেস। চোখ-মুখ কঠিন। “কোনো অসুবিধে করলাম না তো?”
রেন বলল, “রান্না শিখছিলাম…”
“তাই? ন্যাকামি করার আর জায়গা পান না। খবরদার, আর রান্নাঘরের ধারেকাছে আসবেন না বলে দিলাম।”
“কিন্তু…”
“কি বললাম শুনেছেন? আমার স্ত্রীর কাছ থেকে দূরে থাকবেন। আমি কিছুতেই চাই না ও খুন হয়ে যাক।”
“আমিও চাই না,” রেন বলল। “ওর জন্যে আমারও ভাবনা হচ্ছে।”
রেনের ইঙ্গিতটা বুঝেই যেন মুখ কালো করে ফেলল গিলেস। চোখ জ্বলে উঠল। “ওকে নিয়ে ভাবনার দায়িত্বটা আমার ওপর ছেড়ে দিলেই ভালো করবেন। আমার স্ত্রীর দেখাশোনার ভার আমি খুব নিতে পারব। যান এখান থেকে।”
মলি বলল, “রেন, চলে যান, প্লিজ!”
ধীরপায়ে দরজার দিকে এগোল রেন। দরজা খোলার আগে মলির দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, “যাচ্ছি, তবে খুব বেশি দূরে যাব না আমি।”
“আপনি বেরোবেন?” চেঁচিয়ে উঠল গিলেস।
হাসল রেন। ব্যঙ্গের হাসি। “আই আই, কমান্ডার।”
রেন বেরিয়ে গেল। জোরে ধাক্কা খেয়ে বন্ধ হয়ে গেল দরজার পাল্লাটা।
মলির দিকে ফিরল গিলেস। “মলি, তোমার আক্কেল-বুদ্ধি কি সব খুইয়ে বসেছ? ভয়ানক এক উন্মাদ খুনীর সঙ্গে এক ঘরে দরজা দিয়ে বসেছিলে!”
“ও খুনী…” বলতে গিয়ে থেমে গেল মলি। কথা ঘোরাল, “ও ভয়ানক নয়। আর হলেও ক্ষতি হতো না। সতর্ক ছিলাম আমি। তাছাড়া নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা আমার আছে।”
শুকনো হাসি হাসল গিলেস। “মিসেস বয়েলও এই কথাই বলেছিল।”
“আহ্, গিলেস!”
“সরি! বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছি। ওই শয়তানটাই দায়ী। ওর ভিতরে তুমি কী দেখলে বুঝতে পারছি না।”
“ওর জন্যে কষ্ট হচ্ছে আমার।”
“একটা উন্মাদ খুনীর জন্যে! এত তাড়াতাড়ি এই ঘনিষ্ঠতা হলো কী করে?”
“অকারণে মন ছোট কোরো না, গিলেস। মানুষের সঙ্গে মানুষের ঘনিষ্ঠতা হতে দেরি হয় না। আর সব ঘনিষ্ঠতার অর্থই খারাপ নয়।”
“কিন্তু মাত্র দু’দিনে? নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে? আগে থেকেই চিনতে না তো? হয়তো তুমিই চিঠি লিখে ওকে এখানে আসতে বলেছ। দু’জনে পরামর্শ করেই…”
“কী যা-তা বলছ, গিলেস!”
“যা-তা বলছি না। ক্রিস্টোফার রেন তোমার পুরানো প্রেমিক। আমাকে বলোনি।”
“সত্যিই পাগল হয়ে গেছ তুমি!”
“পাগল যদি হয়েই থাকি, সেটার মূলে তুমি। হয়তো বলবে, এখানে আসার আগে চিনতেই না রেনকে, জীবনে কখনও দেখোইনি, এখানেই প্রথম পরিচয়। ওর মতো একজন আর্কিটেক্ট যে এ রকম একটা অজায়গায় এসে উঠেছে, এটাই তো আশ্চর্য!”
“মেজর মেটকাফ কিংবা মিসেস বয়েলের চেয়েও?”
“হ্যাঁ, আমার তো তাই মনে হয়। কোথায় যেন পড়েছি, ওসব বিড়বিড় করা উন্মাদগুলোর মেয়েমানুষের প্রতি বেজায়
লোভ থাকে। এখন তো দেখছি সত্যি তা-ই। ওর সঙ্গে পরিচয় হলো কী করে? কতদিন ধরে চলছে এসব?”
“বিশ্বাস করো, গিলেস, এখানে আসার আগে কখনও চোখেও দেখিনি ক্রিস্টোফার রেনকে।”
“ক’দিন আগে তুমি লন্ডনে যাওনি? ওখানেই দেখা করেছ ওর সঙ্গে। তখনই তুমি ওকে এখানে আসার কথা বলেছ।”
“তুমি ভালো করেই জানো গিলেস, গত কয়েক হপ্তা লন্ডনে যাইনি আমি।”
“তাই? তুমি যে এতটা মিথুক হতে পারো, কল্পনাও করিনি।” পকেট থেকে রোমশ একটা দস্তানা বের করল গিলেস। “এটা পরেই গিয়েছিলে সেদিন— যেদিন আমি তারের জাল কিনতে সেইলহ্যামে গিয়েছিলাম, তাই না?”
“সেইলহ্যামে যেদিন গিয়েছিলে তুমি, সেদিন আমি ওই গ্লাভস পরেছিলাম,” গিলেসের চোখে চোখ রেখে বলল মলি, “বাইরে বেরিয়েছিলাম।”
“জানি। গাঁয়ে যাবার কথা বলে বেরিয়েছিলে। তাহলে গ্লাভসের ভিতর এটা এলো কী করে?”
লাল রঙের এক টুকরো কাগজ দেখাল গিলেস, বাসের টিকেট।
চুপ করে রইল মলি।
এক মুহূর্ত নীরবতা।
“তার মানে তুমি লন্ডনে গিয়েছিলে,” আবার বলল গিলেস।
“বেশ,” ঝটকা দিয়ে চিবুক ওপরে তুলল মলি, “গিয়েছিলাম।”
“ওই হারামজাদা ক্রিস্টোফার রেনটার সঙ্গে দেখা করতে?”
“না।”
“তাহলে কেন গিয়েছিলে?”
“সেকথাটা আপাতত তোমাকে আমি বলব না।”
“সময় নিচ্ছ? চমৎকার একটা গল্প বানানোর জন্যে?”
“তোমাকে… তোমাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে!”
“আমারও করছে,” গিলেস বলল। “এই প্রথম মনে হচ্ছে, আমি তোমাকে চিনি না। তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না।”
“আমারও তাই মনে হচ্ছে। তুমি এখন আ কাছে একজন অচেনা অদ্ভুত মানুষ। এমন একজন মানুষ, যে আমাকে মিথ্যে কথা বলে…”
“আমি মিথ্যে বলেছি!”
“বলেছ। তোমার জাল কিনতে যাবার গল্পটা বানানো। সেদিন তুমি লন্ডনে গিয়েছিলে।”
“ও, তাহলে আমাকে দেখেছ তোমরা। আর সেজন্যেই আমাকে বিশ্বাস করো না…”
“জীবনে আর কাউকেই কখনও বিশ্বাস করব না।”
দু’জনের কেউই খেয়াল করল না ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে দরজার পাল্লা।
মৃদু কাশি দিয়ে জানান দিলেন পারাভিসিনি।
“অসময়ে ঢুকে পড়লাম, সরি,” বিড়বিড় করে বললেন। “যা বলছেন এগুলো কী আপনাদের মনের কথা, না ঝগড়ার সময় একে অন্যকে এক হাত নিচ্ছেন? প্রেমটা আরও গভীর করছেন?”
“প্রেম!” তীব্র ব্যঙ্গ গিলেসের কণ্ঠে। “প্রেম আবার কোথায় দেখলেন?”
“যা বলেছি ঠিকই বলেছি,” পারাভিসিনি বললেন। “আপনাদের মনের অবস্থা কেমন এখন জানি আমি। এই বয়েস আমারও ছিল, এসব আমিও করেছি। জানি, কেমন লাগে। হ্যাঁ, যে জন্যে এসেছি, বলি। ইন্সপেক্টর পাঠিয়েছে আমাকে। আমাদের সবাইকে ড্রইংরুমে জড়ো হতে বলেছে। মনে হচ্ছে কোনো আইডিয়া এসেছে তার মাথায়।” থেমে আপনমনে বিড়বিড় করলেন, “কোনো সূত্র খুঁজে পেলে অবাক হবার কিছু ছিল না। কিন্তু আইডিয়া! পুলিশ অফিসারের মাথায় আইডিয়া! লোকটাকে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো অতিরিক্ত চালাক, নয়তো একেবারেই বোকা। তবে ভেবে ভেবে মগজের কোষগুলোকে একটু বেশি কষ্ট দেয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।”
“গিলেস, তুমি যাও,” মলি বলল, “আমার রান্না এখনও বাকি। আমি না থাকলেও চলবে ট্রটারের।”
“রান্না? আজ কী রান্না হবে?” অদ্ভুত ভঙ্গিতে লাফিয়ে কাছে চলে এলেন পারাভিসিনি। “মুরগির কলজে বেঁধেছ কখনও, শুয়োরের মাংসের কুচি দিয়ে, প্রচুর সরষে মাখিয়ে?”
“ওসব আজকাল তো তেমন পাওয়াই যায় না,” গিলেস বলল। “রাঁধবে কীভাবে?”
“ওকে সাহায্য করতে থেকেই যাই আমি, কি বলেন?” গিলেসের দিকে তাকিয়ে বললেন পারাভিসিনি।
“না, দরকার নেই। চলুন, ড্রইংরুমে যাই।”
মৃদু হাসলেন পারাভিসিনি। “আপনার স্বামী ভয় পাচ্ছেন। আমাকে আপনার সঙ্গে রেখে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। একটু আগে না ঝগড়া করছিলেন?” হাসিটা চওড়া হলো তাঁর। “কিন্তু আমাকে এত ভয় কেন? দেখে কি পাগল কিংবা খুনী মনে হচ্ছে?”
অস্বস্তি বোধ করছে মলি। “মিস্টার পারাভিসিনি, কী যা-তা…”
“যা-তা নয়, মিসেস ডেভিস,” মাথা নাড়লেন পারাভিসিনি। “মিস্টার গিলেস, আপনার কাছে প্রমাণ করব, না ট্রটারের কাছে?”
“কী প্রমাণ করবেন?”
“আমি যে পাগল নই সেটা।”
“আপনার ইচ্ছে।”
“কাজটা করা যদিও খুব কঠিন,” বিড়বিড় করলেন পারাভিসিনি। “লোকে সহজে কোনো কথা বিশ্বাস করতে চায় না।” গুন গুন করে উঠলেন তিনি।
কুঁকড়ে গেল মলি। “না না, মিস্টার পারাভিসিনি, প্লিজ! ওই ভয়ানক সুর না!”
“কী করব, থ্রি ব্লাইন্ড মাইস-এর সুরটা মগজে ঢুকে গেছে আমার। কিছুতেই বেরোতে চায় না। সত্যিই ভয়ানক সুর, কথাগুলোও। চাষীর বউ বাঁকা একটা ছুরি দিয়ে যেভাবে ইঁদুর ছানাগুলোর লেজ কেটে দিল, বড় হয়ে ওরা তাকে কামড়ে প্রতিশোধ নিলে ওদের দোষ দেয়া যায় না… আর ছানাগুলো যদি মানুষের হয়, তাহলে তো কথাই নেই…”
“থামুন, প্লিজ! চুপ করুন!” বাধা দিল মলি। “এসব কথা বলতে একটুও খারাপ লাগছে না আপনার? হাসছেন আবার!”
“হয়েছে, মলি,” গিলেস বলল, “যথেষ্ট পাগলামি হয়েছে। এবার এসো, সবাই ড্রইংরুমে যাই। ট্রটার নিশ্চয় অধৈর্য হয়ে উঠেছে। রান্না পরে করলেও চলবে। খাওয়ার চেয়ে এখন খুনীকে ধরা অনেক বেশি জরুরি।”
“আপনার কথা মেনে নিতে পারলাম না, ইয়াং ম্যান,” পিছন থেকে লাফিয়ে হেঁটে দু’জনকে অনুসরণ করলেন পারাভিসিনি। “খাওয়ার জন্যেই বেঁচে আছি আমরা। খেতেই যদি না হতো, বাঁচার কী অর্থ থাকত বলতে পারেন?”
হলঘরে ওদের দেখা পেল ক্রিস্টোফার রেন। একবার তাকিয়েই গিলেসের কড়া চাহনি থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল। উদ্বিগ্ন চোখে দ্রুত একবার তাকাল মলির দিকে। কিন্তু মলি তার দিকে তাকাল না। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। এক সারিতে মিছিল করে এগিয়ে চলেছে ওরা। সারির পিছনে রয়েছেন পারাভিসিনি, সেই বিচিত্র ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছেন।
ড্রইংরুমে ওদের জন্য অপেক্ষা করছে ট্রটার আর মেজর মেটকাফ। মুখ গোমড়া করে রেখেছেন মেজর। ট্রটারের মুখ উজ্জ্বল, প্রাণশক্তিতে ভরপুর।
“সবাই এসেছেন,” ট্রটার বলল। “একটা বিশেষ পরীক্ষা করতে চাই আমি। আপনাদের সাহায্য দরকার।”
“বেশিক্ষণ লাগবে?” মলি জানতে চাইল। “রান্নাঘরে কাজ পড়ে আছে আমার। শেষ না করলে খাওয়া জুটবে না।”
“তাই তো,” ট্রটার বলল, “আমাদের খাওয়ানো আপনার দায়িত্ব। তবে কিছু কিছু সময় খাওয়ার চেয়েও জরুরি দায়িত্ব পড়ে যায়। এখন সমস্যা নেই আপনার। মিসেস বয়েলের মতো খাবার নিয়ে চেঁচামেচি করব না আমরা। দেরি হলে কিছু বলব না।”
“সত্যি, সার্জেন্ট,” মেজর বললেন, “কথাটা স্পষ্ট করে বলতে পেরেছেন, যদিও আরেকটু রেখে-ঢেকে বললে ভালো হতো।”
“সরি, মেজর, কিন্তু আমি চাই সবাই সহযোগিতা করুন আমাকে।”
“আপনার স্কি পেয়েছেন?” ট্রটারকে জিজ্ঞেস করল মলি।
কঠোর হলো ট্রটারের চোয়াল। “না, পাইনি। তবে কাজটা কে করেছে জানি। কেন চুরি করেছে, তা-ও জানি। তবে এ মুহূর্তে এসব নিয়ে আলোচনা করতে চাই না।”
“প্লিজ, এক্ষুণি কিছু বলবেন না,” পারাভিসিনি বললেন। “রহস্যের সমাধান একে একে হওয়াই উচিত, ক্লাইম্যাক্সে উঠতে উঠতে শেষ অধ্যায়টা শেষ করতে হবে। সব কথা একবারে বলে ফেললে উত্তেজনা থাকে না, মজা নষ্ট হয়।”
“এটা কোনো মজার খেলা নয়, স্যার,” গম্ভীর স্বরে বলল ট্রটার।
“তাই? ভুল বললেন। মজার খেলাই এটা, অন্তত একজনের কাছে তো বটেই।”
“খুনী খুব উপভোগ করছে,” বিড়বিড় করল মলি।
সবক’টা চোখ ঘুরে গেল তার দিকে। লাল হলো মলির গাল। “কথাটা আমার নয়, সার্জেন্ট ট্রটারের।”
ট্রটারকে খুশি মনে হলো না। “মিস্টার পারাভিসিনি শেষ অধ্যায়ের কথাটা খুব ভালো বলেছেন। রোমাঞ্চকর উপন্যাসের মতো। তবে এটা উপন্যাস নয়। কঠিন বাস্তব।”
“আমারও ভালোই লাগছে,” ঘাড় চুলকাচ্ছে ক্রিস্টোফার রেন। “অবশ্য আঘাত যতক্ষণ অন্যের ওপর দিয়ে যাবে, ততক্ষণই শুধু ভালো লাগবে…”
“হয়েছে,” বাধা দিলেন মেজর, “এখন একটু চুপ করুন সবাই। সার্জেন্ট ট্রটার কিছু বলতে চান। তিনি কী করতে চান, বলবেন।”
কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিল ট্রটার।
“একটু আগে আপনাদের সবার বক্তব্য জেনেছি,” ট্রটার বলল। “মিসেস বয়েল খুন হবার সময় কে কোথায় ছিলেন জানিয়েছেন। মিস্টার রেন আর মিস্টার ডেভিস ছিলেন তাঁদের যাঁর যাঁর বেডরুমে। মিসেস ডেভিস ছিলেন রান্নাঘরে। মেজর মেটকাফ ছিলেন সেলারে। আর মিস্টার পারাভিসিনি এখানে এ ঘরে ছিলেন।” একটু থেমে আবার বলল সে, “আপনারা বক্তব্য দিয়েছেন, কিন্তু ওগুলো খতিয়ে দেখার তেমন প্রয়োজন মনে করছি না। আপনাদের কথা সত্য হতে পারে, না-ও হতে পারে। তবে এটা পরিষ্কার, পাঁচজনের অন্তত একজন মিথ্যে কথা বলেছেন। কে?”
একে একে সবার মুখের ওপর নজর বোলাল সে। সবাই চুপ।
“চারজন সত্যি বলেছেন, একজন মিথ্যে বলেছেন, সেই মিথ্যুক লোকটা কে? কে মিথ্যে বলেছে ধরার জন্যে একটা প্ল্যান করেছি আমি। আর সেটা জানতে পারলেই খুনী কে জানতে পারব।”
“মিথ্যে বললেই যে সে খুনী হয়ে যাবে, সেটা মনে হয় না আমার,” গিলেস বলল। “অন্য কারণেও মিথ্যে বলতে পারে।”
“আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না, মিস্টার ডেভিস।”
“কিন্তু আপনার ইচ্ছেটা কী? এই তো বললেন বক্তব্যগুলো খতিয়ে দেখার কোনো দরকার মনে করছেন না।”
“না। তবে আমি চাই আবার একবার আগের অবস্থানে চলে যান সবাই, খুনের সময়টায় যে যেখানে ছিলেন।”
“বাহ্, চমৎকার!” মেজর বললেন। “রিকনস্ট্রাকশন অভ ক্রাইম। একেবারে বিদেশি আইডিয়া।”
“রিকনস্ট্রাকশন অভ ক্রাইম নয়, মেজর। কে কোথায় কোন অবস্থানে ছিলেন, জানতে চাইছি শুধু।”
“জেনে কী হবে?”
“মাফ করবেন। ঠিক এই মুহূর্তে সব জানাতে রাজি নই।”
“তার মানে,” মলি বলল, “একটু আগের নাটকটার পুনরাভিনয় করাতে চাইছেন?”
“অনেকটা তাই, মিসেস ডেভিস।”
আবার চুপ হয়ে গেল সবাই। অস্বস্তি বোধ করছে কেউ কেউ।
“ফাঁদ,” ভাবছে মলি, “নিশ্চয় এটা একটা ফাঁদ। কিন্তু বুঝতে পারছি না কীভাবে…”
হাসি হাসি মুখ ট্রটারের। নিশ্চিত একটা ভাব। চোরা চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে সবাই। বোঝার চেষ্টা করছে হয়তো কিছু।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল ক্রিস্টোফার, “কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, আসলে কী বের করার চেষ্টা করছেন আপনি? পুরো ব্যাপারটাই অহেতুক হয়রানি মনে হচ্ছে আমার কাছে।”
“তাই নাকি, মিস্টার রেন?”
“নিশ্চয়,” বলল বটে, কিন্তু ক্রিস্টোফারের গলায় আগের মতো জোর নেই। “ঠিক আছে, যা বলবেন করব। সহায়তা করব আমরা। যা করছিলাম, ঠিক তা-ই করব।”
“হ্যাঁ, ঠিক তা-ই করতে হবে,” কেমন অনিশ্চিত শোনাল মেজর মেটকাফের গলা।
মেজরের দিকে তাকাল ট্রটার। তারপর পারাভিসিনির দিকে। “পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন আপনি। ঠিক কীভাবে বসেছিলেন, কীভাবে কী সুর বাজাচ্ছিলেন দেখাবেন আমাদেরকে?”
“নিশ্চয়, মাই ডিয়ার সার্জেন্ট।”
লাফিয়ে হেঁটে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন পারাভিসিনি। বড় পিয়ানোটার সামনে রাখা টুলে গিয়ে বসলেন। “পিয়ানোর মাস্টার এখন খুনের সহায়তা করতে একটা সুর বাজাচ্ছে,” নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন তিনি। দর্শকদের দিকে চোখ ফিরিয়ে হাসলেন। তারপর তাকালেন কী-বোর্ডের দিকে। একটা কী-তে আঙুল রাখলেন। চাপ দিলেন। বেজে উঠল পিয়ানো।
একে একে কী টিপে চললেন পারাভিসিনি। থ্রি ব্লাইন্ড মাইস-এর সুর বাজতে থাকল। হালকা নরম সুর মস্ত ঘরটায় কেমন এক ধরনের অসহ্য পরিবেশ সৃষ্টি করে চলল।
“থ্যাংক ইউ, মিস্টার পারাভিসিনি,” ট্রটার বলল। “ধরে নিচ্ছি, আগেরবারও আপনি ঠিক এভাবেই বাজাচ্ছিলেন।”
“ধরে নেয়ার কিছু নেই, ইন্সপেক্টর, আগের বারেও ঠিক এমনিভাবেই বাজিয়েছি। তিনবার।”
মলির দিকে ফিরল ট্রটার। “মিসেস ডেভিস, আপনি পিয়ানো বাজাতে জানেন?”
“জানি।”
“মিস্টার পারাভিসিনির মতো সুরটা বাজাতে পারবেন? ঠিকই একই ভঙ্গিতে, একই পর্দায়?”
“পারব।”
“তাহলে পিয়ানোতে বসবেন, প্লিজ? আমি ইশারা করলেই বাজানো শুরু করবেন।”
ট্রটার আসলে কী চায় বুঝতে পারছে না মলি। অবাক লাগছে। কিন্তু কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে গেল পিয়ানোর দিকে।
টুলটা পিছনে ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন পারাভিসিনি। তীক্ষ্ণ গলায় প্রতিবাদ জানালেন, “কিন্তু সার্জেন্ট, ঠিক আগের বারের মতো তো ঘটছে না ব্যাপারটা। তখন এখানে আমি বসে বাজাচ্ছিলাম…”
বাধা দিল ট্রটার, “আগের ঘটনা নিয়ে নাটকটা অভিনীত হবে। কিন্তু চরিত্রগুলো যে সব এক থাকবে তা তো বলিনি। তাহলে মিসেস বয়েলকে পাবেন কোথায়?”
“ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছে না আমার কাছে,” গিলেস বলল।
“এতে না বোঝার কী আছে? আপনারা যে সব বক্তব্য দিয়েছেন, তার সত্যতা যাচাই করতে যাচ্ছি। বিশেষ করে একজনের বক্তব্য। এখন আপনাদেরকে যেখানে যেতে বলব, যাবেন দয়া করে। মিসেস ডেভিস, আপনি এখানেই থাকবেন, পিয়ানো বাজাবেন। মিস্টার রেন, আপনি যাবেন রান্নাঘরে। দেখুন, মিসেস ডেভিসের রান্নার কাজ কিছুটা এগিয়ে রাখতে পারেন কিনা। মিস্টার পারাভিসিনি, আপনি মিস্টার রেনের শোবার ঘরে যান। শিস দিয়ে আপনার সঙ্গীতের বিদ্যা জাহির করবেন। আগের বারের মতো একই পর্দায় থ্রি ব্লাইন্ড মাইস-এর সুরে শিস দেবেন। মেজর মেটকাফ, আপনি মিস্টার ডেভিসের বেডরুমে যান। টেলিফোন লাইন পরীক্ষা করুন। আর আপনি, মিস্টার ডেভিস, আলমারি পরীক্ষা করুনগে। ওখান থেকে সেলারে নামবেন, মেজর মেটকাফের মতো।”
এক মুহূর্ত চুপচাপ থাকার পর পায়ে পায়ে দরজার দিকে এগোল চারজন লোক। পিছন থেকে ওদেরকে অনুসরণ করল ট্রটার। বেরিয়ে যাবার আগে কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল। “এক থেকে পঞ্চাশ গুনুন, মিসেস ডেভিস। তারপর বাজানো শুরু করুন।”
বেরিয়ে গেল সে।
দরজা বন্ধ হওয়ার আগের মুহূর্তে পারাভিসিনির তীক্ষ্ণ গলা কানে এলো মলির, “বাচ্চাদের মতো লুকোচুরি খেলা যে পুলিশেরও এত পছন্দ, জানতাম না!”
####
বারো…
“…আটচল্লিশ, ঊনপঞ্চাশ, পঞ্চাশ!”
গোনা শেষ করল মলি। বাজানো শুরু করল। ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল হালকা মৃদু সুর। নিষ্ঠুরভাবে প্রতিহত হচ্ছে যেন ঘরের দেয়ালে দেয়ালে :
থ্রি ব্লাইন্ড মাইস
সি হাউ দে রান…
হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে, অনুভব করছে মলি। পারাভিসিনির কথাগুলো মনে পড়ছে : ধারাল ছুরি দিয়ে ইঁদুর ছানাগুলোর লেজ কেটে দিয়েছিল চাষীর বউ…
ওপর থেকে হালকা পর্দায় ভেসে আসছে একটা সুর, শিস দিচ্ছেন পারাভিসিনি। ক্রিস্টোফার রেনের চরিত্রে অভিনয় করছেন এখন তিনি।
কিন্তু কেন? কী দরকার ছিল এসবের? ফাঁদটা কোথায়? গণ্ডগোল একটা নিশ্চয় আছে, কিন্তু ঠিক কোনখানে বুঝতে পারছে না মলি।
ঘাড়ের ওপর এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ার পরশ লাগল। নিশ্চয় দরজা খুলে গেছে, ঘরে ঢুকেছে কেউ। ঝট করে ঘাড় ঘোরাল মলি। কই? কেউ তো নেই। অস্বস্তি বোধ করল সে। ভয় পেল। মনে হচ্ছে, ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে যেন কোনো অশরীরী। বাতাসে মিশে নিজেকে অদৃশ্য করে দিয়ে এগিয়ে আসছেন যেন মিস্টার পারাভিসিনি, লাফিয়ে লাফিয়ে, দু’হাত সামনে বাড়িয়ে, কুৎসিত ভঙ্গিতে বাঁকানো আঙুলগুলো, গলা টিপে ধরতে আসছেন…
কী থেকে আঙুলগুলো প্রায় উঠে চলে এসেছিল মলির, এই সময় কথাটা মনে পড়ল : মিস্টার পারাভিসিনির বাজনা কেউ তখন শুনতে পায়নি, এটাই কি ফাঁদ? কে জানে, হয়তো পিয়ানো বাজানইনি তিনি। হয়তো ড্রইংরুমে ছিলেন না, ছিলেন লাইব্রেরিতে। মিসেস বয়েলকে খুন করছিলেন।
মলিকে পিয়ানো বাজাতে বলায় স্পষ্ট বিরক্তি ফুটেছিল পারাভিসিনির মুখে। খুবই মৃদু পর্দায় বাজিয়ে শুনিয়েছিলেন তিনি। এতই মৃদু শব্দ, বাইরে থেকে শোনা যাওয়ার কথা নয়।
তিনিও চেয়েছিলেন যাতে বাইরে থেকে শোনা না যায়। নইলে ধরা পড়ে যাবেন। মলিও আস্তেই বাজাচ্ছে। বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে না নিশ্চয়। তাহলে ট্রটার কী করে জানবে পারাভিসিনি মিথ্যে বলেছে?
আস্তে করে খুলে গেল ড্রইংরুমের দরজা। প্রায় লাফিয়ে উঠল মলি, চিৎকার করতে মুখ খুলেই থেমে গেল। পারাভিসিনি নয়। সার্জেন্ট ট্রটার।
“থ্যাংক ইউ, মিসেস ডেভিস,” ট্রটার বলল। আত্মতৃপ্তি আর আত্মবিশ্বাসে ভরা ভঙ্গি।
কী থেকে আঙুল সরাল মলি। “যা চেয়েছেন, পেয়েছেন?”
“পেয়েছি,” খুশি খুশি গলা ট্রটারের। “যা চেয়েছি, পেয়েছি।”
“কে?”
“আপনি জানেন না, মিসেস ডেভিস? আসলে আপনি খুব বোকা। তৃতীয় শিকারটাকে পেতে সাহায্য করেছেন আপনি। ভীষণ বিপদে পড়বেন, বুঝতেও পারেননি।”
“কী বলছেন আপনি, সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না।”
“বলতে চাইছি, খুব সহজ করে দিয়েছেন আমার কাজ। যেমন করেছিল মিসেস বয়েল।”
“বুঝলাম না।”
“নিশ্চয় বুঝেছেন। লংরিজ ফার্ম কেসের কথা যখন প্রথম বলেছি, তখন থেকেই টানাপোড়েন চলেছে আপনার মনে। মিসেস বয়েল বিলেটিং অফিসার ছিল, আপনিই বলেছেন।
আপনাদের দু’জনের বাড়ি একই অঞ্চলে। কাজেই তৃতীয় শিকারটা কে বুঝতে অসুবিধে হয়নি আমার। বুঝতে পারব না, দেখে কি এতটা বোকা মনে হয় আমাকে?”
নিচু গলায় মলি বলল, “আপনি বুঝতে পারছেন না। আমি আসলে মনে করতে চাইনি।”
“খুব বুঝেছি,” আচমকা বদলে গেল ট্রটারের কণ্ঠস্বর, কঠিন হয়ে উঠল, “বিয়ের আগে আপনার পদবী ওয়েইটরাইট ছিল, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“দেখে যতটা মনে হয়, আপনার বয়েস তারচেয়ে বেশি। উনিশশো চল্লিশ সালে যখন ঘটনাটা ঘটে, আবিভেলে স্কুল টিচার ছিলেন আপনি।”
“না।”
“হ্যাঁ, ছিলেন, মিসেস ডেভিস।”
“আমি বলছি, ছিলাম না।”
“মৃত্যুর আগে বাচ্চাটা একটা চিঠি পাঠাতে পেরেছিল আপনার কাছে। সাহায্য চেয়েছিল। টিচারের করুণা ভিক্ষা করেছিল। টিচারেরও একটা দায়িত্ব ছিল। একটা ছেলে হঠাৎ কেন স্কুলে আসছে না খোঁজখবর নেয়া উচিত ছিল। আপনি
নেননি। ছোট্ট ছেলেটার সাহায্য চেয়ে পাঠানো চিঠিকে সরাসরি অবজ্ঞা করেছেন আপনি।”
“বুঝেছি,” গাল জ্বলছে মলির, “আপনি আসলে আমার বোনের কথা বলছেন। স্কুলমিস্ট্রেস ছিল। চিঠিটাকে অবজ্ঞা করেনি আমার বোন। কী করবে, তখন সে অসুস্থ। নিউমোনিয়ায় ভুগছে। বাচ্চাটা মারা যাবার চিঠিটা তার চোখে পড়ে। ঘটনাটা ভীষণ নাড়া দিয়েছিল তাকে। বাচ্চাটার মৃত্যুর ব্যাপারে কোনো হাত ছিল না তার। শুনে আমারও খুব খারাপ লেগেছিল। এতই খারাপ, দুনিয়ার মানুষের ওপরই বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল।”
চোখের ওপর উঠে গেল মলির হাত। চোখ ঢাকল। আবার সরিয়ে নিলে দেখল তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ট্রটার।
“ও, তাহলে আপনার বোন,” মৃদুস্বরে বলল সে। অদ্ভুত হাসি ফুটল মুখে। “তাতে কিছু এসে যায় না। যায় কি? আপনার বোন, আমার ভাই…” পকেট থেকে কী যেন বের করল সে। হাসিটা লেগেই রয়েছে মুখে।
ট্রটারের হাতের জিনিসটার দিকে তাকিয়ে আছে মলি। “আমি জানতাম পুলিশের কাছে রিভলভার থাকে না।”
“ঠিকই জানেন,” ট্রটার বলল। “কিন্তু মিসেস ডেভিস, আমি পুলিশ নই। জিম। জর্জের ভাই। গাঁয়ের ফোন বক্স থেকে আমিই সেদিন ফোন করে বলেছিলাম, আমি পুলিশ। মিথ্যে নাম বলেছিলাম, সার্জেন্ট ট্রটার। এখানে পৌঁছে আগে টেলিফোন লাইনটা কেটেছি। যাতে আপনারা পুলিশ স্টেশনে ফোন করে কোনোরকম খোঁজখবর নিতে না পারেন।”
মলি দেখল, তার বুক বরাবর তাকিয়ে আছে রিভলভারের নল।
“নড়বেন না, মিসেস ডেভিস,” চাপা ফিসফিসে কঠিন কণ্ঠে বলল ট্রটার নামধারী জিম, “চেঁচাবেন না। গুলি খাবেন তাহলে।”
হাসি মোছেনি মুখ থেকে। হাসিটা কেমন অস্বাভাবিক লাগছে মলির কাছে। গলার স্বরটাও স্বাভাবিক নয়।
“হ্যাঁ,” আবার বলল জিম, “আমি জর্জ… জর্জির ভাই। ও মারা গিয়েছিল লংরিজ ফার্মে। ওই হারামি মেয়েমানুষটা আমাদেরকে মরতে পাঠিয়েছিল ওখানে। চাষীর বউ আমাদের সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছে। আপনারাও আমাদের সাহায্য করেননি, বরং তিনটে অসহায় ইঁদুর ছানার লেজ কাটতে চাষীর বউকে সহযোগিতা করেছিলেন।” নাক কুঁচকাল জিম। “আর্মিতে ঢুকেছিলাম, ওখানেও ওরা যথেষ্ট বিরক্ত করেছে আমাকে। আমার পিছনে ডাক্তার লেলিয়ে দিয়েছে। পালাতে বাধ্য করেছে। ভয় পাচ্ছিলাম, আমাকে খুঁজে বের করে আবার নিয়ে গিয়ে আটকে ফেলবে ওরা, যা করতে চাই করতে দেবে না। কিন্তু এখন তো আর ছোট নই, বড় হয়েছি, তাই ধরতে পারেনি। বড়দের আমি দেখতে পারি না— ওরা যা ইচ্ছে তাই করে।”
তুমুল গতিতে ভাবনা চলেছে মলির মাথায়। কথা বলাতে হবে উন্মাদটাকে, আটকে রাখতে হবে, এমন কিছু করা চলবে না যাতে ও গুলি করে বসে।
“কিন্তু এসব করে লাভটা কী হচ্ছে?” মলি বলল, “বাঁচতে তো পারবেন না। এখান থেকে বেরোবেন কীভাবে?”
জিমের মুখ কালো হয়ে গেল। “কেউ আমার স্কি লুকিয়ে ফেলেছে। এখনও খুঁজে পাইনি। কিন্তু খুব অসুবিধে হবে না। এই রিভলভারটা আপনার স্বামীর। ওর ড্রয়ার থেকে চুরি করেছি। সবাই জানবে, আপনার স্বামী আপনাকে খুন করেছে। আর তারপরও যদি ধরা পড়ি, দুঃখ নেই। আমার কাজ আমি শেষ করেছি। কী মজাই না পেয়েছি! লন্ডনে সেই মেয়েমানুষটা— আমাকে দেখে যা চেহারা করেছিল— যদি দেখতেন! আর আজ সকালে করল আরেকজন, মিসেস বয়েল! হাহ্ হাহ্ হাহ্!”
আপনমনে হেসে চলল সে।
হঠাৎ শোনা গেল শিস। থ্রি ব্লাইন্ড মাইস-এর সুরে শিস দিচ্ছে কেউ।
চোখ ফেরাল জিম। মলির দিক থেকে সামান্য সরে গেল রিভলভারের মুখ।
চেঁচিয়ে উঠল একটা কণ্ঠ, “বসে পড়ুন, মিসেস ডেভিস, বসে পড়ুন!”
ধপ করে মেঝেতে পড়ল মলি।
দরজার দিকের একটা সোফার পিছন থেকে লাফ দিলেন মেজর মেটকাফ। লাফ দিয়ে প্রায় উড়ে এসে পড়লেন জিমের ওপর।
ট্রিগারে চাপ লেগে গুলি বেরিয়ে গেল। লাগল দেয়ালে ঝোলানো একটা অয়েল পেইন্টিঙে। ছিদ্র হয়ে গেল ছবিতে আঁকা মিসেস এমোরির বুক।
মুহূর্তে ছুটে এলো সবাই। গিলেস, রেন, পারাভিসিনি।
কঠিন হাতে জিমের কব্জি ধরে রেখেছেন মেজর মেটকাফ। রিভলভারটা কেড়ে নিয়েছেন আগেই। মলিকে বললেন, “আপনি যখন পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন, দরজা খুলে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকেছিলাম। লুকিয়ে পড়েছিলাম ওই সোফার আড়ালে। প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ হচ্ছিল ও পুলিশের লোক নয়। কারণ আমি পুলিশ, ইন্সপেক্টর ট্যানার। মেজর মেটকাফের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে মেটকাফ সেজে এসেছি। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড আশঙ্কা করেছিল, কিছু একটা ঘটবেই এই মংকসওয়েল ম্যানরে। তাই আমাকে পাঠানো হয়েছে।”
শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জিম। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে না। ইন্সপেক্টর বললেন, “তুমি এসো আমার সঙ্গে। কেউ কিছু করবে না।”
বাচ্চা ছেলের মতো আদুরে গলায় বলে উঠল জিম, “জর্জি রাগ করবে না তো?”
“না, রাগ করবে না।”
গিলেসের পাশ কাটানোর সময় ওর দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে ট্যানার বললেন, “বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছে! বেচারা!”
জিমকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর।
রেনের বাহুতে হাত রাখলেন পারাভিসিনি। “এসো, তুমি এসো আমার সঙ্গে।” গিলেস আর মলিকে দেখালেন, “এদের কথা বলতে দাও।”
বেরিয়ে গেল দু’জনে।
পরস্পরের দিকে তাকাল মলি ও গিলেস। তারপর ছুটে এলো। জড়িয়ে ধরল একে অন্যকে।
“ডার্লিং,” আবেগ জড়ানো গলায় গিলেস বলল, “তোমার কোথাও লাগেনি তো? ব্যথা দেয়নি তো জানোয়ারটা?”
“না না, আমি ভালোই আছি। কোথাও লাগেনি। গিলেস, খুব খারাপ ব্যবহার করেছি তোমার সঙ্গে। আমি ভেবেই বসেছিলাম, লন্ডনে গিয়ে খুন করে এসেছ তুমি।”
“আগামীকাল আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। তোমার জন্যে একটা উপহার আনতে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, শেষ মুহূর্তে তোমাকে দেখিয়ে চমকে দেব।”
“কী আশ্চর্য! আমিও একই কারণে লন্ডনে গিয়েছিলাম।”
“অথচ তোমার সঙ্গে কী ব্যবহারটাই না করলাম। তোমার চরিত্রের দোষ দিলাম। পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। মাপ করে দাও আমাকে, ডার্লিং।”
দরজা খুলে গেল। ঘরে ঢুকলেন পারাভিসিনি। গলা খাঁকারি দিলেন। হাসি একান-ওকান হয়ে গেছে।
“আবার বাগড়া দিলাম,” পারাভিসিনি বললেন, “তোমাদের মুহূর্তটাই মাটি করে দিলাম। কিন্তু না এসে উপায় ছিল না। বাইরে পুলিশের জীপ দাঁড়িয়ে আছে। বরফের মধ্যে কীভাবে এসে হাজির হয়েছে জানি না। মেজর মেটকাফের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন তাঁর বস। আমাকে একটা লিফট দিতে রাজি করিয়েছি ওদের।” মলির কাছে এসে দাঁড়ালেন তিনি। কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, “শীঘ্রি আবার তোমাদের জ্বালাতে আসব। এবার আর
খালি হাতে আসব না। টার্কি, হ্যাম, ফরাসি শরষে, সব নিয়ে আসব। তোমার জন্যে একজোড়া মোজা আনব। কিছু একটা উপহার তো দিতে হয়।” গিলেসের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মিস্টার ডেভিস, হলের টেবিলে বিলের চেক চাপা দিয়ে রেখে এসেছি।”
মলির একটা হাত তুলে নিয়ে উল্টো পিঠে চুমু খেলেন তিনি। হাতটা ছেড়ে দিয়ে আর কিছু না বলে ঘুরে দাঁড়ালেন। বিচিত্র ভঙ্গিতে লাফাতে লাফাতে এগোলেন দরজার দিকে।
“মোজা?” বিড়বিড় করল মলি। “টার্কি! হ্যাম! সরিষা! নিজেকে কী মনে করে পারাভিসিনি? সান্তা ক্লজ?”
“সান্তা ক্লজের একেবারে উল্টোটাও হতে পারে,” মন্তব্য করল গিলেস।
দরজায় উঁকি দিল ক্রিস্টোফার রেন। “মাই ডিয়ারস, নাক গলাচ্ছি। রান্নাঘর থেকে বিশ্রী পোড়া একটা গন্ধ আসছে। গিয়ে দেখব কিছু করতে পারি কিনা?”
“আমার পাই!” আঁতকে উঠল মলি। ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
*****************************************************************************************