প্রশ্নটার তাৎপর্য দুরকম আছে। অন্যটার কথাই আলোচনা করা যাক। প্রায়ই টশপ-গার্ল কথাটি কানে আসে। প্রকৃতপক্ষে শপ-গার্ল বলে কারো অস্তিত্বই নেই। বহু মেয়ে আছে যারা দোকানের কাজে লিপ্ত। এর মাধ্যমেই তারা পেটের ভাত জোগাড় করে। তা-ই যদি হয় তবে তাদের জীবিকাই কেন তাদের পরিচয় হবে? আমাদের উচিত উপযুক্ত বিচার করা। ফিফথ এভিনিউর মেয়েদের তো আমরা বিবাহিতা মহিলা বলে আখ্যা দেই না। এ স্বীকার করতেই হবে যে, শপ-গার্ল বলে আমরা তাদের সুবিচার করি না।
ন্যানসি আর লু যথার্থই অভিন্ন হৃদয়া বান্ধবী। বাড়িতে প্রয়োজনীয় খাবারের অভাব থাকায় তাদের কাজের ধান্ধায় শহরে পাড়ি জমাতে হয়েছিল। লুতখন বিশ বছরের যুবতী আর ন্যানসির চলেছে উনিশ। উভয়েই অজ পাড়াগায়ের মেয়ে, সুদৰ্শন। নাট্যশালার খাতায় নাম লেখানোর ইচ্ছা! আন্দেী কারো ছিল না। বরাতগুণে সস্তা ও মার্জিত রুচির একটা বোর্ডিংয়ে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই জুটে গেল। উভয়ের চাকরিও জুটে গেল। বেতন পেত মাস গেলে। তাদের বন্ধুত্বও অটুট রয়ে গেল।
মাস ছয়েক পরের কথা-লু একটা লণ্ড্রীতে জাম-কাপড় ইন্ত্রি করার কাজ করে। তার গায়ে আলখাল্লা গোছের ঢিলেঢালা একটা লাল জামা, মাথায় বে-মানান, প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বড়সড় আর চার ইঞ্চি লম্বা পালকের একটা টুপি আর সাদা পশমের তৈরী পাঁচশ ডলার দামের একটা স্কার্ফ ও মাফলার। চোখের মণি দুটো হাল্কানীল আর দুগালে লালচে আভা। খুশী যেন তার সর্বাঙ্গে টলমল করছে, উপচে পড়ছে।
আর ন্যানসি? পাঠক-বন্ধু, ন্যানসিকে তো আপনি শপ-গার্ল আখ্যাই দেবেন। কারণ, আপনি তো এতেই অভ্যস্ত। পৃথিবীতে ধরণ ধারণের কোন সুস্পষ্টব্যাখ্যা নেই। কিন্তু সবযুগে ও সবকালেই নিত্য নতুন ধরন-ধারণের তল্লাশ করে থাকে। ধরন ধারণের একটা নমুনা তুলে ধরছি।–সামনের দিকটা চুড়োর মত তুলে দিয়ে চুলের গোছাটাকে পিছনের দিকে কষে বেঁধে দেওয়া। সম্ভা দামের তৈরী হলেও স্বল্কার্টটা বাহারী বটে। বসন্তের দমকা বাতাসের হাত থেকে অব্যাহতি পাবার জন্য পোশাকে পশমের সুরক্ষার কিছুমাত্রও ব্যবস্থা নেই। তার মুখমণ্ডলেশপ-গার্লের ছাপই যেন সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। আর তার চোখের তারায় বঞ্চিত নারীদের বিরুদ্ধে ঘূণিত নীরব বিদ্রোহ স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। আর তাতে অচিরেই ভ্ৰাতৃশোধ নেবার বাসনার ছাপও স্পষ্ট। সে সরবে। হেসে ওঠার সময়ও সে ছাপটুকু মিলিয়ে যায় না। ঠিক এরকমই চাহনি লক্ষিত হয়রাশিয়ার চাষাভুষোদের চোখের তারায়। আর গেব্রিয়েল যেদিন আমাদের সংহার করতে আসবে সেদিন যারাটিকে থাকবে সেদিন তাদের চোখে মুখেও একই দৃষ্টি নজরে পড়বে। সে দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করে পুরুষদের লজ্জিত হওয়া উচিত। কিন্তু তার বদলে তারা মস্করায় লিপ্ত হয় সুতোয় বাঁধা ফুলের তোড়া তাদের লক্ষ্য করে ছুড়ে মারে, লাভ করে আত্মপ্রসাদ।
টুপিটা মাথা থেকে নামিয়ে বিদায় নেবার মুহুর্তে লুঠোটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে উঠবে।-তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। আর ন্যানসি? সে-ও মিষ্টি হাসির প্রলেপে তার রসিকতার ভাবটাকে আড়াল করে দেবে।
তারা উভয়েই ড্যাম-এর প্রতীক্ষায় মোড়ে দাঁড়িয়ে। সে ছিল লুর বাধা ক্রেতা। বিশ্বাসীও? না, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। যাকে বলে, যখন যেমন হাতের মুঠোয় আসে।
লু ন্যানসি-র দিকে ঘাড় ঘোরাল। ছোট্ট করে বলল-ন্যানসি, তোমার গীত লাগছে না? আচ্ছা, তুমি কেমন ধারার মেয়ে বল তো! হণ্ডায় মাত্র আট ডলার পেয়ে পুরনোসে দোকানটাতে চাকরি করছি। গত হাপ্তায় আমি কত কামিয়েছি, জানা? সাড়ে আঠারো ডলার। তবে দোকানে ফিতে বেচার মত ইস্ত্রি করার কাজটা সোজা নয়। হ্যাঁ, এ কাজে পয়সা আছে, স্বীকার করতেই হবে। আমরা যে কজন ইন্ত্রির কাজে লেগে রয়েছি। কারো রোজগারই দশ ডলারের কম নয়। আর কাজটাকে সম্মানের দিক থেকে কমতি বলেও আমি অন্ততঃ জ্ঞান করি না।
–হোক গে! ন্যানসি বলল–তুমি যা-ই পাও, হাপ্তায় আটটা ডলার আর শোবার। হলঘরই যথেষ্ট। মোদা কথা, সজন এবং সুপরিবেশেই থাকতে আমি বেশী পছন্দ করি। আর এরকমই আমাব পছন্দ মাফিক সুযোগ আমি পেয়েছি। মাত্র দিন কয়েক আগেই তো আমাদের দস্তানা বিভাগের এক যুবতী পিটুসবার্গের এক ইস্পাতের কারিগর, বা ওরকমই একটা লোককে বিয়ে করল। দেখবি, একদিন আমিও একজনকে গোথে ফেলব। সঙ্গতি সম্পন্ন কাউকে পেলেই লটিকে যাব। বিভাগীয় কাজে লেগে থাকা এক মেয়ের বরাতে এর বেশী আর কি জুটবে, বল তো?
–ডান-এর সঙ্গে ওখানেই তো আমার প্রথম দেখা ও আলাপ পরিচয় হয়।-গর্বের সঙ্গে লু বলল। জামার কলার ইন্ত্রি করাতে রবিবার সে এসেছিল। আমি তখন ইন্ত্রি করে চলেছি। সেদিন এলা ম্যাগিনিস অসুস্থ ছিল। তার জায়গাতে-প্রথম বোর্ডে আমি ইন্ত্রিকরছিলাম। আমাদের সবারই ইচ্ছা প্রথম বোর্ডে কাজ করি। উচ্ছসিত আবেগের সঙ্গে লু এবার বলল-সে বলেছে, আমার হাত দুটোর ওপরই নাকি প্রথম প্রথম তার নজর যায়, বেলনের মত গোলগাল হাত দুটো কী সুন্দর! আমার জামার হাত দুটো গোটানো ছিল। আসলে তাদের হাবভাব দেখলেই চেনা যায়। স্যুটকেসে জামা কাপড় নিয়ে এসে দুম করে ধাক্কা দিয়ে আচমকা দরজা খুলে ফেলে।
ন্যানসি বলল—লু, তোমার পছন্দ খুবই খারাপ। এরকম একটা কোমরবন্ধ কি করে পর ভেবে পাইনে!
চোখের তারায় ক্ষোভের ছাপ ফুটিয়ে তুলে লু। তার কথার উত্তর দিতে গিয়ে বলল— এ কোমরবন্ধটার কথা বলছ? ষোল ডলার দিয়ে কিনেছি। আসলে কম সে কম পাঁচশ ডলার তো দাম হবেই। এখানে এক মহিলা ইন্ত্রি করাতে দিয়ে গিয়ে আর নেয় নি। মালিক শেষ পর্যন্ত বিক্রি করে দিলেন। দেখতে পাচ্ছ, পুরো কোমরবন্ধটাই হাতে নক্সা করা। তোমার বিশ্রি কোমরবন্ধটার কথা ভাব তো একবারটি।
ভ্যান এলস্টাইন ফিশার-এর কোমরবন্ধটা দেখে আমি নিজে হাতে এটা তৈরী করে নিয়েছি। মেয়েদের বক্তব্য, এটা তৈরী করতে গুদাম থেকে বারশ ডলারের বিল পাঠানো হয়। আর মাত্র দেড় ডলার খরচ করে আমি নিজে হাতে আমারটা তৈরী করে নিয়েছি। ফুট দশেক দূর থেকে দেখলে চিনতে পারবে না। কোনটা তার আর কোনটা আমার।
কণ্ঠস্বরে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে লু এবার বলল-ভাল কথা, পেটে কিল মেরে তুমি যদি বড়লোকি চাল দেখাতে চাও তবে আমার আর আপত্তির কি থাকতে পারে। আমার কথা যদি জানতে চাও তবে বলব, দিনভর কঠোর পরিশ্রম করে যা রোজগার করব তা দিয়ে নক্সা করা ঝলমলে পোশাকই ব্যবহার করব।
তাদের কথোপকথনের মাঝখানে ডান এসে হাজির হল। গভীর স্বভাবের যুবক। গলায় সাদামাঠা ধরনের একটা নেক-টাই। ইলেকট্রিক মিস্ট্রির কাজ করে। হাপ্তায় ত্রিশ ডলার রোজগার করে। লু-র দিকে রোমিও-র মত বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকাল। সে ভাবল, লু-র কোমরবন্ধটা যেন একটা মাকড়সার জাল, যাতে জড়িয়ে পড়তে যেকোন পতঙ্গ উদ্রান্তের মত ছুটে আসবে।
লু আবেগ মধুর কণ্ঠে বলল—বন্ধু মিঃ ওয়েন্স, মিস ডানফোর্থ-এর সঙ্গে করমর্দন কর।
করমর্দনের জন্য হাতটা এগিয়ে দিয়ে ডান ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল-মিস ডানফোর্থ লুপ্রিায়ই আপনার কথা বলে। আজ পরিচয় হওয়ায় খুবই আনন্দ পেলাম।
ন্যানসি তার সঙ্গে করমর্দন সারতে গিয়ে তার আঙুলের সঙ্গে নিজের আঙুলগুলি ছুঁইয়ে বলল—ধন্যবাদ! লু-এর মুখে আপনার কথাও বহুবার শুনেছি।
সশব্দে হেসে লু বলল—ন্যানসি, একটা কথা, মিসেস ভ্যান এলস্টাইন ফিশার-এর সঙ্গেও তুমি এভাবেই করমর্দন কর কি?
ন্যানসি গভীর স্বরে তার কথার উত্তর দিল-আমি যদি করিই তুমিও অনায়াসেই এমনটা করতে পার।
না, অবশ্যই না। এ হাত দিয়ে আমার পক্ষে তা করা সম্ভবই না। এমন ভঙ্গীতে করমর্দন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এমন বড়লোকিপনায় করমর্দন সারতে হলে আঙুলে হীরের আংটি থাকা দরকার। আগে সেরকম কটা আংটি জোগাড় করি, তারপর না হয় চেষ্টা করব।
কায়দাটা আগে রপ্ত করে নাও, তবেই আংটি জোটানোর ব্যাপারটা সহজ হয়ে উঠবে।
মুখের মুচকি হাসিটুকু অব্যাহত রেখেই ডান বলল, আমি মনে করি, আপনাদের উভযাকে টিফানির দোকানে নিয়ে গিয়ে তর্কাতর্কির ব্যাপারটার নিম্পত্তি করার ক্ষমতা আমার নেই। তার চেয়ে বরং একটা রঙ্গ-নাটিকা দেখে আসা যেতে পাবে। আমি টিকিট সংগ্রহ করে এনেছি। আসল হারের আংটি পরে করমর্দন সারা যখন সম্ভবই নয়। তখন রঙ্গমঞ্চের হীরের আংটি দেখে এলে হয় না।
লু তার হাতের মুঠোর ভদ্রলোকটির গায়ে প্রায় গা লাগিয়ে চকচকে পোশাকে সজ্জিতা হয়ে বনময়ুরীর মত ছােট ছোট পা ফেলে হাঁটছে সাদামাটা পোশাক পাবে ন্যানসি পিছন পিছন হোটে নাট্যশালার দিকে এগিয়ে চলেছে।
বৃহদায়তন বিভাগীয় বিপনিকে কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দিতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তবে ন্যানসির কর্মস্থলটা তার চোখে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই তুলনীয়। সেখানকার দ্রব্যসামগ্ৰী রুচি শিল্পতা ও সংস্কৃতির পরিচয়ই বহন করে। বিলাসের পরিবেশে কেউ বাস করলে তাকে তো বিলাসী না হয়ে উপায় নেই। খরচাপাতির টাকা তুমি বা অন্য কেউ যে-ই দিক না কেন।
সে যেসব ক্রেতার কাছে দ্রব্যসামগ্ৰী বিক্রি করে তাদের বেশীর ভাগই মহিলা। তাদের পোশাক আশাক, ভাবভঙ্গী আর সামাজিক মর্যাদা সবই মানদণ্ড হিসেবে গণ্য হয়। ন্যানসি যা কিছু শিখেছে সবই তাদের দেখে। মোদা কথা, প্রত্যেকের কাছ থেকে হাঁসের মত জলটুকু ফেলে রেখে দুধ টুকু, মানে ভাল শিক্ষাটা বেছে নিয়েছে। যার মধ্যে যেটুকু ভাল দেখেছে, সেটুকুই সে নিয়েছে। যার হাঁটা চলা, বন্ধুকে আপ্যায়ণ কবাবি ভঙ্গীটুকু পর্যন্ত। সামাজিক সদাচার আর সুরুচির পরিমণ্ডলে বাস করায় গভীরতর একটা পরিণতিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াও তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে। সুঅভ্যাসকে সুনীতির চেয়েও শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করা হয়। আর সৎ আচরণকে হয়ত বা সুনীতির চেয়েও শ্ৰেষ্ঠত্বের আসন দেওয়া হয়। বাবা-মার কাছ থেকে যে সুশিক্ষা তুমি লাভ করেছ তা হয়ত তোমার নতুন ইংল্যান্ডের বিবেককে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে না। কিন্তু সোজা পিঠওয়ালা একটা চেয়ারে বসে যদি তুমি ত্ৰিশির কাঁচ আর তীর্থযাত্ৰা কথাটা চল্লিশবার মনে মনে বলতে পার তবে অতি বড় শয়তানও তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পথ পাবে না। ঠিক তেমনি ন্যানসিও যখন ভ্যান এলস্টাইন ফিশার-এর স্বর ও ভঙ্গী অনুকরণ করে কথা বলে তখন তার অস্থির চিত্তের ভেতর দিয়ে শিষ্টতার দায়বদ্ধতার শিহরণ জেগে ওঠে।
সে বিভাগীয় বিপনি থেকে শিক্ষালাভের আর একটি উৎস ছিল। যেখানেই দেখা যাবে তিনচারটে শপ-গার্ল একত্রিত হয়ে অর্থহীন আলোচনার সঙ্গে তাদের হাতের ব্রেসলেটের রিনিঝিমি আওয়াজ মিশিয়ে দিচ্ছে তখন যেন ভেবে বসবেন না যে এথেশ, কোন কায়দায় চুল বেঁধে তার সমালোচনা করতেই তারা সেখানে জড়ো হয়েছে। এসব আলোচনা থেকেই ন্যানসি আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করে নিয়েছিল। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে আত্মরক্ষায় সাফল্য লাভ করার অর্থই হচ্ছে জয়ী হওয়া। ন্যানসি-র ক্ষেত্রে একথা পুরোপুরি প্রযোজ্য।
বিভাগীয় বিপনির পাঠ্যসূচী বহুমুখী। কোন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ত বা মেয়েদের জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছবার এতখানি উপযুক্ত করে তুলতে সক্ষম হয় না। কি সে লক্ষ্য? লক্ষ্যটি হচ্ছে, বিয়ের লটারিতে পুরস্কারটা হস্তগত করা। বিপনিতে তার কাজের জায়গাটা গানের ঘরের লাগোয়া হওয়ায় সে অনায়াসেই শ্রেষ্ঠ সুরকারদের গান শুনে শুনে সেগুলো আয়ত্ত করে নিল।
ন্যানসির এ উচ্চাকাঙ্খার ব্যাপারটা বিপনির অন্য কর্মী-মেয়েরা ধরে ফেলে। এবার থেকে বরমাল্য পরাবার মত কোন যুবককে তার কাউন্টারের দিকে এগোতে দেখলেই তারা অনুচ্চকণ্ঠে বলত—ন্যানসি, তোমার বাঞ্ছিত টাকার কুমীর আসছে, দেখ।
পুরুষদের একটা স্বভাব, সঙ্গী মেয়েরা যখন কেনাকাটায় মেতে যায়। তখন তারা রুমালের কাউন্টারের সামনে বারবার চক্কর মারে আর ক্যাস্ত্রিকের চৌকোণা চুকরো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়ায় মেতে ওঠে।
ন্যানসির মেকী বড়লোকী ভাবসাব আর তার সত্যিকারের রূপের জৌলুসের আকর্ষণ আছে যার ফলে তার সামনে দিয়ে বহু যুবকই ঘুরঘুর করে। তাদের মধ্যে কেউ টাকার কুমীর হওয়া তো অসম্ভব নয়। আর অবশিষ্ট্ররা ধনীদের অনুকরণকারী ভদ্রবেশীবাদরের মতই। ন্যানসি উভয় দলের মধ্যে পার্থক্যটুকু বোঝার ক্ষমতা রপ্ত করে ফেলেছে।
রুমালের কাউন্টারের একদম শেষে একটা জানালা রয়েছে। সেটা দিয়ে ন্যানসি দেখতে পায় বিপনির ক্রেতাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য সারিবদ্ধভাবে গাড়ি দাঁড়িয়ে। সেগুলো দেখে সে বুঝতে শিখল গাড়িগুলোর আকৃতি যেমন স্বতন্ত্র, ঠিক তেমনই গাড়ির মালিকগুলো স্বতন্ত্রতা বজায় রাখছে, ছোট-বড় যাকে বলে।
একদিন এক সুদেহী ভদ্রলোক চার-চার ডজন রুমাল কিনে ফেলল। আর কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েই হাসিমাখা মুখে কথা বলে ন্যানসির সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলল। সে কাউন্টার ছাড়তেই একটা মেয়ে গভীর স্বরে বলে উঠল—ন্যানস। এটা কেমন হল, লোকটাকে আমলাই দিলে না। তুমি? দেখে তো মনে হল লোকটা রীতিমত একজন ধনকুবের।
তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে ন্যানসি জবাব দিল—। কার কথা বলছ? ওই যে—ওই লোকটা? তাকে তোয়াক্কা করার কোন মানেই হয় না। আমি নিজের চোখে দেখেছি, নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছে। একটা বারো অশ্বশক্তি সম্পন্ন যন্ত্র আর এক আইরিশ বদমাইস। লক্ষ্য করেছিলে কি, তাও আবার কিনেছে কতগুলো রেশমী রুমাল, গায়ে চাপিয়েছে। নকল কাপড়ের পোশাক পরিচ্ছদ। খাঁটি ভদ্র ও মালদার না হলে আমার মন গলে না, বুঝলে?
বিপনিতে দুটো রুচিশীলা মহিলা কর্মচাকরি করে। তাদের কয়েকটি পয়সাওয়ালা বন্ধু আছে। তারা মাঝে মধ্যে তাদের সঙ্গেই নৈশভোজ সারিতে যায়। একদিন তারা ন্যানসিকেও সঙ্গে করে নিয়ে গেল। নববর্ষের সন্ধ্যার জন্য সেখানকার টেবিলগুলো এক বছর আগেই সংরক্ষিত হয়ে যায়। দুজন ভদ্রলোক বন্ধুসঙ্গে রয়েছে। একজনের মাথা জুড়ে টাকা। চুলের চিহ্নমাত্র নেই। আমরা চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারি, যারা অগাধ সুখ-বিলাসের মধ্যে দিন কাটায় তাদের মাথার চুল উঠে যায়। আর দ্বিতীয়জন এক যুবক। ধনী আর সৌখিন রুচিসম্পন্ন। দুটো ব্যাপারে এটা ধরা যায়। সে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলল, সবগুলি মদের বোতলই ছিপি আঁটা। সেই সঙ্গে তার সার্টের কাফ লিংক দুটো হীরের। যুবকটা ন্যানসির প্রতি অদম্য আকর্ষণ বোধ করল। তার প্রকৃতি আর রুচিবোধ শপ-গার্লদের দিকে তাকে যেতে উৎসাহিত করল।
পরদিনই সে বিভাগীয় বিপনিতে হাজির হল। সরাসরি চলে গেল ন্যানসির কাউন্টারে। আইরিস রুমাল বাছতে বাছতে তাকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব করে বসল।
ন্যানসি আগন্তুক যুবকের প্রস্তাবে সম্মতি দিল না। ফুট দশেক দূরে দাঁড়িয়ে ঝলমলে পোশাকে সজ্জিতা একটা মেয়ে আড়চোখে তাকিয়ে আর উৎকৰ্ণ হয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করল।
যুবক ক্রেতাটা বিদায় নেবার পর সে গল্প ছেড়ে গালমন্দ করে ন্যানসিকে একেবারে নাজেহাল করতে লাগল।
ধুৎ! তুমি কেমন বোকা হাঁদা মেয়ে হে! ওই যুবকটা রীতিমত এক ধনকুবের। বুড়ো ভ্যান স্কিটলস-এর আপনি ভাগ্নে, জান? কথাবার্তাও তো সেভাবেই বলল। তোমার মাথাটাথা বিগড়ে গেছে নাকি ন্যানস? ভেবে পাচ্ছিনে, তুমি এটা করলে কি করে। ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে তুলে ন্যানসি বলল—তই নাকি? তার কথায় রাজি হইনি বলে? লোকটা যে ধনকুবের নয় এটা কিন্তু তোমার বোঝা দরকার ছিল। বছরে বিশ হাজার ডলার। পারিবারিক ভাতা সে পায়। ব্যস, কেবলমাত্র সেটাই তার খরচ করার অধিকার আছে। সেদিন নৈশভোজ সারিতে সারিতে এই লোকটার কথা সে বলছিল।
পোশাক আশাকে কেতাদুরন্ত মেয়েটা আর কয়েক পা এগিয়ে এসে ভ্রা কুঁচকে ন্যানসির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তাকাল। কৰ্কশ স্বরে ন্যানসিকে লক্ষ্য করে কথাটা ষ্টুড়ে দিল—তুমি কেমনটা চাও, জানতে পারি কি? এটাই কি তোমাৱ পক্ষে যথেষ্ট কলে মনে কর না? সলমোন হওয়ার সাধ হয়েছে নাকি তোমার? তুমি কি গ্লাডস্টেন ডোরি, স্পেনের অধিপতি। রকফেলার বা তাদেরই সমগোত্রীয় কারো গলায় বরমাল্য পরাবার বাসনা করেছ?
ন্যানসি ভেতরে ভেতরে ফুসতে থাকলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল-ব্যাপারটা পুরোপুরি বিত্তসম্পদকে কেন্দ্র করে নয়, সে রাত্রে নৈশভোজী সারিতে সারাতে তার বন্ধু তার মিথ্যে ভাষণ ধরে ফেলেছিল। এক মেয়েকে কথা দিয়েও তাকে নাকি দেখাতে নিয়ে যায় নি। আসলে মিথ্যাবাদীকে আমি বরদাস্ত করতে পারি না। মোদা কথা, লোকটা আমার অপছন্দ। সত্যিকারের একজন মানুষকেই আমি অন্তর থেকে চাইছি, যাকে বলে সত্যিকারের একজন কর্মী-পুরুষ, বুঝলে এবার?
চোখে-মুখে বিতৃষ্ণার ছাপ ফুটিয়ে তুলে কর্কশ স্বরে মেয়েটা বলে উঠল—তোমার উপযুক্ত স্থান একমাত্র হাসপাতালের ওয়ার্ড, বুঝলে? কথাটা বলেই সে পিছিয়ে নিজের জায়গায় চলে গেল।
ন্যানসি হগুপ্তায় আট ডলার রোজগার করে, এরকম উচ্চাশা নিয়ে দিন কাটাতে লাগল। শুকনো রুটিতে পেট ভরে দিনের পর দিন কোমরবন্ধটাকে আঁটতে আঁটতে অজ্ঞাত পুরুষকে শিকার করার প্রত্যাশায় দিন কাটাতে লাগল। তার চোখে-মুখে ভেসে উঠতে লাগল। অদৃষ্টের চক্করে পড়া পুরুষশিকারীদের হর্ষ-বিষাদ ক্লিষ্ট হাসির ছাপ। তার বিপনিটি অরণ্যের সামিলাই বটে। বহুবারই লম্বা শিং ও বড় মাপের শিকার জ্ঞান করে বারবার বন্দুক উচিয়ে ধরেও প্রতিবারই মনমরা হয়ে বন্দুকের নলটাকে নামিয়ে নিয়েছে। আবার নতুন শিকারের খোজে ওৎ পেতে অপেক্ষা করতে লাগল।
তার বান্ধবী লু? সে ইতিমধ্যেই বরাত ফিরিয়ে নিয়েছে। প্রতি হস্তায় পাওয়া সাড়ে আঠার ডলার থেকে ঘরভাড়া ও আহারাদি বাবদ ব্যয় করে ছাডলার। আর বাকি অর্থ পোশাক-পরিচ্ছদ বাবদ ব্যয় হয়ে যায়। ন্যানসির তুলনায় রুচি ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করার চিন্তায় নিজেকে লিপ্ত রাখার অবকাশ তার খুবই কম। সারাদিন গরম ইন্ত্রি হাতে নিয়ে তাকে কেবল কাজ আর কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে হয়। ইন্ত্রি গরম থাকলে তো আর থামার কথা ভাবাই যায় না। আর আসন্ন সন্ধ্যার আকাঙ্খিত আনন্দ অনুষ্ঠানের ভাবনা মাঝে মধ্যে মাথায় এসে ভর করে। রঙ-বেরঙের আর দামী পোশাক-আশাক তাকে ইন্ত্রি করতে হয়। সে জন্যই হয়ত ইন্ত্রি নামক যন্ত্রটার মাধ্যমে তার ভেতরে পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি আকর্ষণ উত্তরোত্তর বেড়েই চলে।
দিনের শেষে হাতের কাজ ফুরিয়ে গেলে ডান তার জন্য বাইরে অধীর প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে-মধ্যে কৌতুহল-মিশ্রিত চাহনি মেলে লু-র পোশাকের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারণ, পোশাকের চেয়ে লোক দেখানোর প্রয়াসই তার মধ্যে বেশী থাকে। ডান কিন্তু এতে খুশী নয়। পথচারীরা তার পোশাক আশাকের দিকে কৌতুহলী নজরে তাকিয়ে থাকলেও মোটেই আমল দেয় না।
তবে এ-ও সত্য নয় যে, লুতার বান্ধবীকে তেমন ভালবাসে না। ব্যাপারটা ধরতে গেলে রুটিনে দাঁড়িয়ে গিয়েছে, লু আর ডান যখন, যেখানে বেড়াতে যাবে ন্যানসি তাদের সঙ্গে যাবেই। এ উপরি ব্যয়ের বোঝা ডান নিদ্বিধায়, হাসিমুখেই বহন করে। বরং বলা যেতে পারে, ভ্রমণে বেরোলে লু রং জোগায়, ন্যানসি জোগায় সুর, আর ব্যয়ের বোঝা বয় ডান। রেডিমেড পোশাকে সজ্জিত হয়ে সহযাত্রী বন্ধটি পরমানন্দে তাদের সঙ্গদান করে। তাদের মেলামেশায় তিলমাত্র ব্যাঘাতও ঘটায় না। এমন সব ভাল মানুষ আছে যার উপস্থিতিতে সবাই নিজেদের ভুলে থাকে—সে এমনই একজন। আর সে অনুপস্থিত থাকলে তার কথা বডড বেশী করে স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এরকম হাল্কা আনন্দ-অনুষ্ঠানে ন্যানসি-র মত উন্নত ও মার্জিত রুচিসম্পন্না মেয়ের কাছে কিছুটা বিতৃষ্ণা তো মনে জাগেই। তবে সে-ও উদ্ভিন্ন যৌবনা। মানুষকে ভোজনরসিক করে তোলাই তো যৌবনের ধর্ম। সেক্ষেত্রে রুটির ব্যাপারটা প্রাধান্য পায় না।
একদিন লুতার বান্ধবী ন্যানসি-কে বলল-একটা কথা। ডান-এর ইচ্ছে, আমি এখনই তাকে বিয়ে করি। আমি বিয়েটিয়ের হাঙ্গামায় যাব কেন,বল তো? আমি সত্যিকারের স্বাধীন। এখন আমি আমার টাকাকড়ি যেভাবে খুশি খরচ করতে পারি। কিন্তু বিয়ের পর? তখন তো সে আমাকে চাকরি করতেই দেবে না। মুহুর্তকাল নীরবে ভেবে আকাের মুখ খুলল—ভাল কথা, ন্যানস। তুমি আদ্যিকালের বিপনিটাতে কোন পড়ে রয়েছ? মনের মত খাবার বা ভাল পোশাক পরিচ্ছদ কিছুই জোগাড় করতে পার না। তুমি রাজি থাকলে আমাদের লণ্ড্রীতে তোমার একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আরও কিছু বেশি পেনি রোজগার করতে পারলে তোমার এমন হিসেব করে খরচ করার দরকার পড়বে না।
মুচকি হেসে ন্যানসি বলল—আমি হিসেব করে খরচ করি এমনটা তো আমার মনে হয় না। লু। একটা কথা শুনে রাখ, আমি বরং একবেলা খাব, আধ-পেটা খেয়ে দিন কটাব তবু যেখানে আছি সেখানেই থাকতে আগ্রহী। তবে সুযোগের প্রতীক্ষায় আমি আছি, চিরদিন সেখানে পড়ে থাকিব না, শুনে রাখি। আমি সেখানে নিত্য নতুন শিক্ষা লাভ করছি। ধনকুবের নিয়েই আমার কাজ হলেও তাদের আমি মোটেই বরদাস্ত করতে পারিনে।
লু, চোখে-মুখে বিদ্রুপাত্মক হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল—একটা কথা ন্যানস, তোমার ধনকুবেরটাকে কি কাজ করতে পেরেছ?
না। আজ অবধি কাউকে নির্বাচন করতে পারিনি। জোর তল্লাশি ঢালিয়ে যাচ্ছি।
সে কী হে! এখনও তল্লাশি চালিয়ে যােচ্ছ? ব্যাপার কি, কাউকেই কি পাত্তা, মানে কাছে ঘোষতে দিচ্ছ না? তার মালকড়ি না হয় কিছু কমই থাকল, ক্ষতি কি? ধুৎ! তুমি রসিকতা করছ, টাকার কুমীরগুলো আমাদের কথা নিয়ে মাথা ঘামায় না।
যদি মাথা ঘামাত তবে আখেরে তাদেরই লাভ হত। স্বাভাবিক কণ্ঠেই ন্যানসি জবাবটা ছুড়ে দিল। মানে কিভাবে টাকা জমানো যায় এটা আমরা কেউ না কেউ তাদের শিখিয়ে দিতে পারতাম। খিল খিলিয়ে হেসে লু বলল—শোন, কেউ যদি আমার মুঠোর মধ্যে আসতে চায় আমি কিন্তু তাকে ঠিক বাগিয়ে নেব। আসলে তাদের চরিত্র সম্বন্ধে তোমার কোন ধারণা নেই বলেই তুমি এমন কথা এত সহজেই বলতে পারছি। সাধারণ মানুষ আর ধনীদের মধ্যে ফারাকটা বুঝতে হলে তাদের আরও কাছে গিয়ে দেখতে হবে। তুমি কি বুঝছি না, কোটটার চেয়ে ওই লাল সিক্ষের লাইনিংটা একটু বেশীই গাঢ়, কি, বুঝতে পারছ?
কই, আমার চোখে তো তেমন কিছু লাগছে না। আসলে রোদ-বৃষ্টিতে তোমার জামার রঙটা জ্বলে যাওয়ায় তার পাশে সেটাকে বেশী লাল দেখাচ্ছে।
ভাবে গদগদ স্বরে ন্যানসি এবার বলল—মিসেস ড্যান এলস্টাইন ফিশার-এর জ্যাকেটটার মতই কিন্তু এ জ্যাকেটটার কাট ছাট বলতে পার, হুবহু একই কায়দায় তৈরী। তিনি যে জ্যাকেটটা সেদিন গায়ে দিয়ে এসেছিলেন সেটার কথা বলছি, বুঝেছি তো? এটার জন্য আমাকে খরচ করতে হয়েছে ৩.৯৮ ডলার। আমার মনে হয় প্রায় ১০০ ডলার বেশী দিয়ে তাকে জ্যাকেটটা কিনতে হয়েছে।
লু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল—হতে পারে, স্বীকার করছি। আমার বিশ্বাস, এ পোশাক পরে তোমার পক্ষে কোন ধনকুবেরকে ছিপে গাঁথতে পারবে না। শোন, তোমার আগেই যদি আমি কোন ধনকুবেরকে কাজায় নিয়ে আসতে পারি। তবে অবাক হবার কিছুই থাকবে না। মুহুর্তের জন্য ন্যানসির মুখের দিকে তাকিয়ে লু এবার বলল-কি, মিথ্যে বলেছি?
ন্যানসি এ কথার কি জবাব দেবে ভেবে না পেয়ে নীরব চাহনি মেলে তার মুখেরদিকে তাকিয়ে রইল।
একজন কৃতী দার্শনিক ছাড়া দুবন্ধুর মতাদর্শের যথাযথ মূল্য নিদ্ধারণ করা সম্ভব নয়।
লণ্ড্রীর ভাপসাগরমে ইস্ত্রী নিয়ে মেতে থেকে লু ভালভাবেই দিন গুজরান করে যেতে লাগল। যা বেতন পায় তাতে খাওয়াদাওয়া ও পোশাক-পরিচ্ছদের জন্য খরচ-খরচা করে সুখেই আছে। কিন্তু মাঝে মধ্যে ডান-এর পরিচ্ছন্ন ও রুচিহীন পোশাক-আশাক দেখে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। ডান যে তার পরিবর্তনহীন, একান্ত অনুরাগী আর প্রতিদিনের সঙ্গী।
আর ন্যানসির ব্যাপার স্যাপারই আলাদা। হাজার হাজার ছাড়া সে ভাবতেই পারে না। পরনে সিস্কের পোশাক, গায়ে জড়োয়ার গহনাপত্ৰ, পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান গন্ধদ্রব্যাদি, নাচ-গানবাজনা প্রভৃতি তো নারীর জন্যই তৈরী হয়েছে। আর এসব তো জীবনেরই অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই এসব তার নাগালের মধ্যেই থািক চাই। ইসাউ-র মত তার পক্ষে তো নিজের সঙ্গে বেইমানী করা সম্ভব নয়। এগুলোর ওপর তার জন্মগত অধিকার, তবে তার আর খুবই সামান্য।
হ্যাঁ, ন্যানসি তো এরকম পরিবেশেই মানুষ হয়েছে। সম্ভা দামের খাবার খেয়ে আর অল্পদামের পোশাক পরেই সে তুষ্ট। এ বয়সেই সে মেয়েদের চরিত্র সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছে। এবার মন দিয়ে পুরুষ নামক জাতের বিচার করতে, তাদের অভ্যাস আর যোগ্যতা যাচাইয়ে আত্মনিয়োগ করেছে। আজ না হোক কাল তার বাঞ্ছিত শিকারটাকে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসবেই। কিন্তু সে নিজেকে প্ৰবোধ দিয়েছে, সে শিকারটা তার কাছে শ্রেষ্ঠতম হবে। ছোট কিছু নিয়ে সস্তুষ্ট হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
এভাবেই সে তার সেঁজুতিকে সেই কবে থেকে জ্বালিয়ে রেখেছে, যাতে স্বামীরত্নটি আসার সময় হলে তাকে বরণ করে নেওয়া সম্ভব হয়।
ন্যানসি আর একটা শিক্ষা লাভ করেছে, এমনও হতে পারে নিজের অজান্তেই সেটা লাভ করেছে। তার আদর্শের মূল্যমান ক্ৰমে পাল্টাতে আরম্ভ করেছে। ডলারের কথাটা ক্ৰমে তার মন থেকে মুছে যাচ্ছে, আর কােটা অক্ষর যেমন সম্মান, সত্য আর দয়া শব্দ কটা ক্ৰমে মনের কোণে জেগে উঠতে শুরু করেছে। উদাহরণস্বরূপ এমন একজনের কথা উল্লেখ করছি সে এক গভীর বনে হরিণ শিকার করতে অভ্যস্ত। শেওলা আর আগাছায় ছাওয়া ছোট্ট একটা উপত্যকা সে দেখতে পেল, সেখানে ছোট একটা বেগবতী নদী কুলকুলারবে তাকে বিশ্রাম আর আরামের আহ্বান জানায়। এরকম পরিস্থিতিতে তার বর্শাটা ভোঁতা হতে বাধ্য।
এক সন্ধ্যায় ন্যানসি বিপনি থেকে বেরিয়ে সিক্সথ এভিনিউ দিয়ে লণ্ড্রীটার দিকে হেঁটে চলল। লু আর ডান-এর সঙ্গে একটা গীতিনাট্য দেখতে যাওয়ার কথা।
ন্যানসি লস্ট্রীর কাছে যেতেই ডান বিষগ্নমুখে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।
ন্যানসিকে দেখেই ডান ক্ষীণকণ্ঠে উচ্চারণ করল—আমি জানতে এসেছিলাম, লু এখানে কিছু বলে গেছে কিনা।
লু? লু-র কথা বলছেন? সে এখানে নেই?
হ্যাঁ, লু-র কথাই বলছি। আমি ভেবেছিলাম, আপনি সব জানেন। গত সোমবার থেকে এখানে তো আসেইনি, বাড়িতেও ছিল না।
তার মানে?
তার যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে সে এ জায়গা ছেড়ে চলে গেছে। লণ্ড্রীর এক মেয়েকে নাকি সে বলে গেছে, হয়ত চলে যাবে। ন্যানসি সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল—কেউ তাকে কোথাও দেখতে পায়নি?
রীতিমত গভীর ও কর্কশ স্বরে ডান এবার বলল—লণ্ড্রীর কর্মচারীদের মুখে শুনলাম, গতকাল তারা তাকে একটা মোটরে করে যেতে দেখেছে। আমার মনে হয় যেসব ধনকুবেরদের নিয়ে তুমি আর লু দীর্ঘদিন ধরে ভাবনা চিন্তা করতে তাদেরই কারো সঙ্গে সে চম্পট দিয়েছে।
ন্যানসি জীবনে আজই প্রথম ভয়ে কুঁকড়ে গেল। কঁপা কঁপা হাতটাকে সে ডান-এর জামার হাতার ওপর রাখল। তারপর বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলল—ডান, আমাকে একথা বলার অধিকার আপনার নেই। আর জেনে রাখবেন, এ সবের সঙ্গে আমি জড়িতও নই, বুঝলেন?
ডান আমতা আমতা করে বলল—আমি সে রকম কিছু ভেবে কথাটা বলি নি, বিশ্বাস করুন। মুহুর্তকাল নীরবে ভেবে নিয়ে আগের মতই নরম স্বরে এবার বলল–আজ রাত্রের শো-র টিকিট পকেটে আছে। আপনি যদি ইচ্ছে–
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ন্যানসি তার কথায় আন্তরিকতার ছোঁয়া পেয়ে বলে উঠল–ডান, আমি তোমার সঙ্গে যেতে রাজী আছি।
এ ঘটনার তিন মাস পরে এক সন্ধ্যায় লু-র সঙ্গে ন্যানসি-র আবার মুখোমুখি দেখা হল।
বিপনির মেয়েটা একটা পার্কের গা দিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে পথ পাড়ি দেওয়ার সময় শুনতে পেল কে যেন তার নাম ধরে ডাকাড্রাকি করছে। সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখের পলকে লু দৌড়ে এসে তাকে জাপ্টে ধরল। উভয়ের জিভের ডগায় হাজার কৰ্কশ প্রশ্ন এসে ভিড় করল। কিন্তু কেউ-ই কাউকে আক্রমণ করতে পারলানা।ঠিক তখনই ন্যানসির নজরে পড়ল, লু-র বরাত খুলেছে। সে গায়ে চাপিয়েছে বহুমূল্য লোমশ কোট, আর মণি-মুক্তোর অলঙ্কার ঝলমল করছে। এলাহি ব্যাপার।
ন্যানসি মুখ খোলার আগেইলুগলা ছেড়ে বলে উঠল—বোকা মেয়ে কোথাকার! তুমি আজও সে দোকানেই কাজ করছ। তোমার গায়ে তো আগের মতই সস্তাদামের ও নোংরা পোশাক দেখতে পাচ্ছি। ভাল কথা, তোমার সে বড় শিকার ধরার কাজটা কত দূর এগিয়েছে? এখনও কাজ হাসিল করতে পারনি, তাই না?
লু এবার অনুসন্ধিৎসুদৃষ্টিতে ন্যানসি-র দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। তার সর্বাঙ্গ দিয়ে অত্যুজ্বল একটা দু্যতি যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। চোখের মণি দুটো মুক্তোর চেয়েও বেশী ঝকমক করছে। আর গাল দুটো গোলাপের আভার চেয়েও লাল হয়ে উঠেছে।
তোমার অনুমান অভ্রান্ত। এখনও সেই বিপনিতেই কাজ করছি। তবে আগামী হগুপ্তাতেই কাজটায় ইস্তফা দিয়ে দেব। আমার বাঞ্ছিত শিকারটাকে আমি হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিয়েছি। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম শিকার। লু তুমি এখন আর কিছু মনে করবে না তো। আমি ডানকে বিয়ে করতে চলেছি। ডান এখন আমার-একান্তভাবেই আমার। লু, ঠিক কাজ করেছি। তো?
কম বয়সী একটা নতুন পুলিশ পার্কের বঁােক ঘুরে এগিয়েই দেখতে পেল, বহুমূল্য লোমশ কোট পরা এবং আঙুলে হীরের আংটি পরে এক মহিলা পার্কের লোহার রেলিঙের ওপর ঝুঁকে ডুকরে কেঁদে চলেছে। আর সাধারণ পোশাক পরা রোগাটে খেটে-খাওয়া চেহারার একটা মেয়ে তাকে নানাভাবে প্ৰবোধ দিচ্ছে। পুলিশটা নতুন চাকরি পেয়েছে। তাই হয়ত ব্যাপারটাকে আমলনা দিয়ে, না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কারণ তার তো আর অজানা নয়, এসব ব্যাপার স্যাপারে তার মত শক্তিধরের কিছুই করার নেই। তবে হ্যাঁ, সে হাতের লাঠিটাকে মাটিতে এমনভাবে ঠুকতে ঠুকতে এগিয়ে যেতে লাগল যে, তা থেকে স্পষ্ট শব্দটা হয়ত আকাশের দূরতম নক্ষত্রটা পর্যন্ত চলে গেল। মহিলাটা অনবরত কেঁপেই চলেছে।