দশ বছরেরও বেশি সময়ের আগের ঘটনা।
চীনা নববর্ষের আগের দিন সন্ধ্যেবেলা আমি চংকিং এলাকার এক পাড়ায় আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার বান্ধবী একটা অফিস বিল্ডিংয়ের সবচেয়ে ওপর তলায় থাকতো। উপরে ওঠার সিঁড়িগুলো ছিল খুবই সরু এবং ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢাকা। সেই অন্ধকারের ভেতর সরু সিঁড়ি বেয়ে বান্ধবীর ঘরে যেতে হতো। সেখানে যাওয়ার আগে সামনে একটা ছোট ঘর ছিল এবং সেই ঘরের ভেতর ছিল একটা টেবিল, বসার জন্য কয়েকটা বাঁশের টুল এবং দেয়ালে ঝোলানো টেলিফোন। সেই ঘরের পাশেই ছিল আরেকটা ঘর এবং সেখানে আমার বান্ধবী থাকতো। আমি যখন গিয়েছিলাম, তখন বান্ধবী ঘরে ছিল না। কিন্তু আমার জন্য জানালার পাশে টেবিলের ওপর একটা চিরকুট রেখে গিয়েছিল। তাতে সে লিখেছে, অপ্রত্যাশিত এক জরুরি কাজে বাইরে যেতে হয়েছে এবং আমি যেন তার ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করি।
বান্ধবীর কথামতো আমি তার ঘরে প্রবেশ করি এবং ডেস্কের সামনে একটা টুলের ওপর বসি। চারপাশে ইতিউতি তাকিয়ে একসময় হাত বাড়িয়ে খবরের কাগজ নিয়ে পড়া শুরু করি। অকস্মাৎ বাইরের কাঠের দরজা খোলার চিঁ-চিঁ আওয়াজ পেলাম। একটু পরেই শুনতে পেলাম কেউ যেন বাঁশের টুল সরাচ্ছে। জানালার পর্দা সরিয়ে আমি আট-নয় বছরের একটা মেয়েকে দেখতে পেলাম। মেয়েটির হালকা গড়নের মুখটা মলিন এবং প্রচ- ঠা-ায় তার ঠোঁট জমে নীল হয়ে গেছে। তার মাথার চুলগুলো বেশ খাটো করে কাটা এবং পরনে ছেঁড়া জামা। তার পায়ে কোন মোজা নেই এবং সে একজোড়া ঘরে পরার স্যান্ডেল পরেছে। দেয়ালে ঝোলানো টেলিফোন ধরার জন্য সে বাঁশের টুলের ওপর ওঠার চেষ্টা করছিল। যেইমাত্র আমার সঙ্গে ওর চোখাচোখি হয়, সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি ভয়ে চমকে ওঠে এবং দ্রুত হাত গুটিয়ে নেয়।
কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি কি কাউকে টেলিফোন করতে চাও ?’
‘হ্যাঁ,’ অস্ফুট গলায় বলেই মেয়েটি টুল থেকে নেমে আসে। কথার রেশ টেনে সে আরো বললো, ‘আমি হাসপাতালে ডা. হুকে ফোন করতে চাচ্ছিলাম। একটু আগে মায়ের গলা দিয়ে প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ হয়েছে।’
‘তুমি কি ডাক্তারের ফোন নম্বর জানো?’ হালকা গলায় আমি জিজ্ঞেস করলাম।
মেয়েটি পুনরায় হ্যাঁ-সূচক ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বললো, ‘আমি টেলিফোন অপারেটরকে তাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম।’
চটজলদি টেলিফোনের বই টেনে নিয়ে নম্বর খুঁজে বের করার সময় আমি পুনরায় মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘যদি ডাক্তারকে পাই, তাহলে তাকে কোথায় যেতে বলবো?’
‘তাকে শুধু বলুন যে ওয়াং চুনলিনের স্ত্রী খুবই অসুস্থ এবং তিনি যেন তৎক্ষণাৎ চলে আসেন,’ জবাবে মেয়েটি বললো।
চটজলদি আমি ডাক্তারকে ফোন করি এবং তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলি। মেয়েটি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আমাকে ধন্যবাদ জানায়।
একসময় মেয়েটি যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে আমি তাকে থামিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করি, ‘এখান থেকে তোমাদের বাড়ি কি অনেক দূরে?’
‘উপত্যকার পাদদেশে। অই যে যেখানে একটা বিশাল ফলের গাছ আছে,’ জানালার বাইরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে মেয়েটি বললো। ‘ওখানে যেতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় লাগে,’ বলেই সে চঞ্চল পায়ের শব্দ তুলে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে যায়।
বান্ধবীর ঘরে ফিরে এসে আমি পুনরায় খবরের কাগজে মনোনিবেশ করি এবং শুরু থেকে শেষ অবধি পড়তে থাকি। পড়া শেষ করে তিন শত তাং কবিতা বই তুলে নিই এবং প্রায় অর্ধেকটা পড়া শেষ করি। বাইরের বিশাল খোলা আকাশে ক্রমশ মেঘ জমে অন্ধকার হয়ে আসছিল। কিন্তু বান্ধবীর ফিরে আসার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না। অপেক্ষা করতে করতে আমি রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠি এবং আনমনে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েকবার আড়মোড়া ভাঙি। তারপর জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ঘন কুশাশায় ঢাকা ধূসর পাহাড়ের নান্দনিক দৃশ্য দেখতে থাকি। একসময় আমি বড় ফল গাছের নিচে একটা কুঁড়েঘর দেখতে পাই। হঠাৎ কেন জানি আমার মনে হলো, বান্ধবী ফিরে আসার আগে আমি অনায়াসে মেয়েটি এবং তার অসুস্থ মাকে দেখে আসতে পারি। কালবিলম্ব না করে আমি তৎক্ষণাৎ সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসি এবং পাশের দোকান থেকে কয়েকটা কমলা কিনি। তারপর কমলাগুলো হাতের ব্যাগে ঢুকিয়ে উঁচু-নিচু সরু পথ ধরে কুঁড়েঘরের দিকে হাঁটতে থাকি।
আলতো করে আমি কাঠের দরজায় শব্দ করি। কিছুক্ষণ আগে যে মেয়েটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল, ভেতর থেকে ওরই কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। দরজা খুলে অপ্রত্যাশিত আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সে ভয়ে সামান্য পেছনে সরে যায়। তারপর চোখেমুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে আমাকে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেয়। ঘরের উল্টো দিকের দেওয়ালের সঙ্গে কাঠের বিছানার ওপর চোখ বন্ধ করে মেয়েটির মা শুয়ে আছে। নিশ্চয়ই সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার গলার আশপাশে বিছানার চাদরের ওপর রক্তের দাগ লেগে আছে। দেওয়ালের দিকে তার মুখ। আমি শুধু তার গলার কাছে এবং মাথার পেছনের দিকে জট পাকানো চুল দেখতে পেয়েছি। দরজার পাশে কয়লার চুলার ওপর একটা পাত্রের মধ্যে অল্প তাপে রান্না হচ্ছে। মেয়েটি সেই জ্বলন্ত চুলার কাছে আমাকে একটা পাদানীতে বসতে বলে নিজেও আমার পাশে বসলো। একসময় কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘ডাক্তার কি এসেছিলেন?’
‘হ্যাঁ এসেছিলেন এবং মাকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়েছেন। মা এখন একটু ভালো,’ বলেই মেয়েটি কয়েক সেকেন্ডের জন্য থামলো। তারপর আমাকে সান্ত¡না দেয়ার ভঙ্গিতে বললো, ‘কিছু ভাববেন না। আগামীকাল ভোরে ডাক্তার আবার আসবেন।’
‘তোমার মা কি কিছু খেয়েছে? এখানে কি রান্না হচ্ছে?’ আমি জ্বলন্ত উনুনের ওপর পাত্রের দিকে আঙুল উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করি।
মেয়েটি একঝলক হাসলো এবং হাসি মুখেই বললো, ‘মিষ্টি আলু সেদ্ধ হচ্ছে। এটাই আমাদের নববর্ষের আগের রাতের বিশেষ খাবার।’
অকস্মাৎ আমার মনে পড়লো আমি তো ওদের জন্য কমলা এনেছি। সঙ্গে সঙ্গে আমি ব্যাগ থেকে বের করে কমলাগুলো বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলের ওপর রাখি। মেয়েটি কোনো কথা বললো না। একসময় নিঃশব্দে সে সবচেয়ে বড় কমলাটা তুলে নেয়। তারপর একটা ছুরি দিয়ে খোসা খানিকটা কেটে বাকিটুকু আঙুল দিয়ে ছাড়াতে থাকে।
‘তোমাদের সঙ্গে আর কে থাকে?’ মৃদু গলায় আমি জিজ্ঞেস করি।
‘এই মুহূর্তে কেউ না। বাবা অন্যত্র গেছেনৃ,’ মেয়েটি কথা সম্পূর্ণ না করেই থেমে যায়। আলতো হাতে কয়েকটা কমলার কোষ তুলে সে তার মায়ের বালিশের পাশে রাখে।
ইতোমধ্যে কয়লার চুলার আগুন নিভে গেছে এবং বাইরে রীতিমতো অন্ধকার নেমে এসেছে। যাওয়ার জন্য আমি উঠে দাঁড়াই। মেয়েটি আমার হাত ধরে বসায়। তারপর সে খুব দ্রুত সুতো ভর্তি একটা বড় সুঁই নিয়ে এসে কমলার খোসা সেলাই করতে থাকে। উল্টোদিকের দুই মাথা সে এমনভাবে সেলাই করে, যা দেখতে অনেকটা ছোট্ট ঝুড়ির মতো। ওটা সে একটা বাঁশের সরু কঞ্চির সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। তারপর জানালার কাছ থেকে একটা মোমবাতি এনে কমলার খোসা দিয়ে তৈরি ঝুড়ির ভেতর রাখে এবং তাতে অগ্নিসংযোগ করে। তারপর সে আমার হাতে বাতি দিয়ে বললো, ‘বাইরে ভীষণ অন্ধকার এবং রাস্তা খুবই পিচ্ছিল। অন্ধকারে পাহাড়ের ওপরে যেতে এই কমলার খোসা দিয়ে তৈরি বাতিটা আপনাকে সাহায্য করবে।’
সানন্দে আমি মেয়েটির হাত থেকে বাতিটা গ্রহণ করি এবং তাকে ধন্যবাদ জানাই। মেয়েটি বাইরে এসে আমাকে বিদায় জানায়। সেই মুহূর্তে আমি আবেগে ভাষা হারিয়ে ফেলি। জানি না, আমার আর কি বলা উচিত ছিল।
যাহোক, উল্টো সান্ত¡না দেয়ার ভঙ্গিতে মেয়েটি বললো, ‘শিগগিরই বাবা ফিরে আসবেন। তারপর মা সুস্থ হয়ে উঠবেন।’
বলেই সে তার ছোট হাত দিয়ে বাতাসের মধ্যে একটা অদৃশ্য বৃত্ত তৈরি করে এবং আমার হাতের ওপর হাত চেপে ধরে পুনরায় বললো, ‘আমরা সবাই ভালো হয়ে যাবো।’
মেয়েটির মুখে আশার কথা শুনে আমি রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে যাই। তবে আমি জানি, এই ‘আমরা’র মধ্যে আমিও একজন।
বাতিটার গায়ে মেয়েটির হাতের আন্তরিকতার মোলায়েম স্পর্শ লেগে আছে। আমি বাতিটা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে অন্ধকারের ভেতর কুয়াশা ভেজা পাহাড়ি সরু পথে হাঁটতে থাকি। সত্যি বলতে কি, কমলা রঙের বাতিটার টিমটিমে আলো বেশি দূর পৌঁছায়নি। যাহোক, মেয়েটির আন্তরিকতা এবং তার আশাবাদের জন্য আমার কাছে মনে হয়েছে ফেরার সময় ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর সবটুকু পথই উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত ছিল।
একসময় আমার বান্ধবী ফিরে আসে। আমার হাতে কমলা রঙের বাতি দেখে বান্ধবী জিজ্ঞেস করে আমি কোথায় গিয়েছিলাম। তাকে বললাম, ‘আমি ৃ আমি ওয়াং চুনলিনের বাড়ি গিয়েছিলাম।’
আমার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ের একটুরো ধূসর মেঘ এসে বান্ধবীর চোখেমুখ ঢেকে দেয়।
‘ওয়াং চুনলিন, যে লোকটি আসবাবপত্র তৈরি করে? তুমি কেমন করে তাকে চেনো?’ আতঙ্কিত গলায় বান্ধবী জিজ্ঞেস করে। তারপর কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে সে কণ্ঠস্বর খানিকটা স্বাভাবিক করে বললো, ‘গত বছর পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্র গণসাম্যবাদী কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য ধরা পড়েছিল। এ ঘটনার পরে ওয়াং চুনলিন গুম হয়ে যায়। লোকজনের মুখে শুনেছি, সে নাকি অই সব ছেলেদের কাছে গোপন খবর সরবরাহ করতো।’
সেই রাতেই আমি পাহাড়ি গ্রাম ছেড়ে চলে আসি। তারপর থেকে আজো সেই মেয়েটি এবং ওর অসুস্থ মায়ের কোনো খবর জানি না।
কিন্তু প্রতি বছর চীনা নববর্ষের আগের দিন আমি সেই কমলা রঙের বাতির কথা স্মরণ করি। এরই মাঝে বারো বছর কেটে গেছে। নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে মেয়েটির বাবা ফিরে এসেছে এবং ওর মায়ের অসুখ সেরে গেছে।
এখন আমরা ‘সবাই’ ‘ভালো’ আছি।