আহা! এ খেলায় যে কী মজা! কী যে আনন্দ। এমন উত্তেজনা আর মজা তারা বহুদিন পায়নি। বাগানে চিৎকার-চেঁচামেচি করে খেলা করছে শিশুরা। ছুটছে, দৌড়াচ্ছে, হাসছে, গাছে চড়ছে কেউ কেউ। ওদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে রকেট, রাস্তায় ফিসফিস আওয়াজে চলেছে বিটল কার। কিন্তু কোনো শব্দ শিশুদের খেলার আনন্দে ব্যাঘাত ঘটাতে পারছে না।
ছুটতে ছুটতে বাড়িতে ঢুকল মিংক। ধুলো-কাদায় মাখামাখি গা। ঘর্মাক্ত শরীর। সাত বছরের তুলনায় ওকে একটু বড়ই দেখায়। মিসেস মরিস দেখলেন ড্রয়ার টান মেরে খুলে প্যান আর কিছু যন্ত্রপাতি বড় একটি বস্তায় ঢোকাচ্ছে তার মেয়ে।
‘হেভেনস্, মিংক, করছ কী তোমরা?’
‘দারুণ একটা খেলা খেলছি!’ হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল মিংক, গোলাপি মুখ।
‘আরে একটু দম নাও না।’
‘সময় নেই, মা।’ হাঁপাচ্ছে মেয়ে। ‘আমি এ জিনিসগুলো নিই?’
‘দেখ আবার দাগটাগ ফেলে দিয়ো না যেন।’
‘থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ!’ চেঁচাল মিংক। বুম! পরক্ষণে উধাও মিংক। একটা রকেটের মতোই।
দ্রুত ধাবমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লেন মিসেস মরিস। ‘খেলার নাম কী?’
‘আক্রমণ!’ চেঁচিয়ে জবাব দিল মিংক। তার পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
রাস্তা বোঝাই ছেলেমেয়েরা সবাই ছুরি-কাঁচি, লোহার শলাকা, পুরনো স্টোভ পাইপ এবং ক্যান পাইপ নিয়ে এসেছে।
মজার ব্যাপার এ রকম খেলা শুধু একেবারে পিচ্চিগুলো খেলছে। যাদের বয়স দশ বা তার বেশি তারা নাকমুখ কুঁচকে ক্ষুদেগুলোর কাছ থেকে দূরে রয়েছে, খেলছে লুকোচুরি।
বাবা-মারা এলেন এবং ক্রোমিয়ামে তৈরি বিটল কারে চলেও গেলেন। রিপেয়ারম্যানরা এসে বাড়ির ভ্যাকুম এলিভেটর, ঝিরঝির ছবি আসা টিভি সেট, নেস্ট ফুড ডেলিভারি টিউব ইত্যাদি মেরামত করে দিয়ে গেল। বয়সীরা বাচ্চাদের লম্ফঝম্ফ প্রশ্রয় এবং ঈর্ষার চোখে দেখল।
খেলায় নেতৃত্ব দিচ্ছিল মিংক। একে একে এটা সেটা নিয়ে আসতে বলছিল। বারো বছরের জোসেফ কনরস ওদের দেখে ছুটে এলো।
‘ভাগো,’ তার মুখের ওপর সোজা বলে দিল মিংক।
‘আমি খেলব,’ বলল জোসেফ।
‘তোমাকে নেয়া যাবে না,’ স্রেফ জানিয়ে দিল মিংক।
‘কেন?’
‘কারণ তুমি আমাদের খেলা দেখে ঠাট্টা-তামাশা করবে।’
‘বিশ্বাস কর, করব না।’
‘না, আমরা জানি তুমি করবে। চলে যাও নইলে মার খাবে।’
বারো বছর বয়সী আরেকটি ছেলে ওদের পাশ কাটাল মোটর স্কেটে চড়ে। ‘হেই জো! চলে এসো! ন্যাংটাপুটুদের খেলতে দাও।’
জোসেফ তবু যেতে চাইছে না। আবার চেষ্টা করল সে।
‘আমি তোমাদের সঙ্গে খেলব।’
‘তুমি আমাদের চেয়ে বয়সে বড়,’ দৃঢ় গলায় বলল মিংক।
‘খুব বেশি বড় নই।’
‘তুমি হাসাহাসি করে আমাদের আক্রমণ খেলাটাকে নষ্ট করবে।’
মোটর স্কেটার ছেলেটা মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ করল।
‘তোমাকে আসতে বললাম না জো! পিচ্চিদের সঙ্গে আবার খেলা কীসের? ওগুলো তো পাগল!’
জোসেফ ধীর পায়ে চলে এলো ওখান থেকে। তবে বারবারই পেছন ফিরে দেখল প্রত্যাশা নিয়ে। কিন্তু ওকে ডাকল না কেউ।
আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মিংক। জোগাড় করা যন্ত্রপাতি দিয়ে একটা অ্যাপারেটাস বানাল। আরেকটা বাচ্চা মেয়েকে সে কাগজ-কলম দিয়েছিল কিছু নোট নিতে। সে হিজিবিজি কিসব লিখল। উষ্ণ সূর্যের আলোয় তাদের কণ্ঠ ওঠা-নামা করছে।
ওদের ঘিরে থাকা শহর গুঞ্জরিত। রাস্তার পাশে সবুজ, শান্তিময় বৃক্ষের সারি। এ রকম হাজর হাজার শহরে রয়েছে শিশু, যুবা, বৃদ্ধ, রাস্তাঘাট, ব্যবসায়ীরা তাদের অফিসে কাজে ব্যস্ত কিংবা দেখছে টিভি। নীল আকাশে সূচের মতো উড়ে বেড়াচ্ছে রকেট। ব্রহ্মা-জুড়ে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি, এ শান্তি কোনোদিন ভঙ্গ হবে না। কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে পৃথিবীতে মানুষ এখন একটাই মাত্র জাতি। মানুষ এখন মানুষকে বিশ্বাস করে।
সর্বত্র একটা অপূর্ব ভারসাম্য বিরাজমান। মানুষের মাঝে নেই কোনো ভেদাভেদ, বিশ্বাসঘাতকতা, কেউ কাউকে ছোট করে দেখে না; পৃথিবী এখন একটি একক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর অর্ধেক অংশ সূর্যের আলোয় আলোকিত, উষ্ণ বাতাসে সিক্ত বৃক্ষরাজি।
মিংকের মা ওপর তলার জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকালেন। ওরা ভালো ভালো খাবার খাচ্ছে, নিরুপদ্রবে ঘুমাচ্ছে, সোমবার ওরা স্কুলে যাবে। ওরা যেন সুস্থ-সবল থাকে। কান পাতলেন তিনি।
গোলাপ ঝাড়টার ধারে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন হাত নেড়ে নেড়ে খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলছে মিংক। যদিও ওখানে অন্য কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বাচ্চাগুলো ভারি অদ্ভুত। আর ওই ছোট্ট মেয়েটা কী যেন নাম ওর? অ্যানা? অ্যানা একটি প্যাডে কী যেন লিখছে। প্রথমে মিংক গোলাপ ঝাড়কে একটি প্রশ্ন করল তারপর জবাব দিল অ্যানার দিকে ফিরে।
‘ত্রিভুজ’ বলল মিংক।
‘কি,’ শব্দটা বুঝতে পারেনি অ্যানা, ‘ভুজ?’
‘কিছু না,’ বলল মিংক।
‘ভয়ে হ্রস্বিÑ’ ধীরে বানান করল মিংক, তারপর ঝামটে উঠল, ‘ওহ্, নিজেই বানান করে নাও না।’ আরেকটা শব্দ বলল সে।’ ‘রশ্মি।’
‘আমি এখনও ত্রি,’ বলল অ্যানা, ‘ভুজ লিখতে পারিনি।’
‘জলদি, জলদি!’ চেঁচাল মিংক।
মিংকের মা দোতলার জানালা দিয়ে মুখ বার করে অ্যানাকে বলে দিলেন বানানটা।
‘ওহ্, ধন্যবাদ, মিসেস মরিস,’ বলল অ্যানা।
‘ঠিক আছে,’ হাসতে হাসতে জানালা থেকে সরে এলেন মিংকের মা। ইলেকট্রো ডাস্টার ম্যাগনেট দিয়ে ঘর ঝাট দিতে লাগলেন। নিচ থেকে ভেসে এল মিংকের উচ্চকিত গলার আওয়াজ। সে একেকটা জিনিসের নাম লিখতে বলছে অ্যানাকে।
দুপুরে লাঞ্চের সময় বাড়ি ফিরল মিংক। এক চুমুকে দুধের গ্লাস শেষ করে পা বাড়াল দরজায়। তার মা টেবিল চাপড়ালেন।
‘টেবিলে এসে বসো,’ হুকুম দিলেন তিনি। ‘আমি গরম স্যুপ নিয়ে আসছি।’ তিনি কিচেন বাটলারের গায়ের একটি লাল বোতাম টিপলেন। দশ সেকেন্ড পরে রাবার রিসিভারে দুম করে কিছু একটা পড়ল। মিসেস মরিস খুললেন ওটা, একজোড়া অ্যালুমিনিয়াম হোল্ডার দিয়ে একটি ক্যান নিলেন, চাকু দিয়ে খুলে বাটিতে ঢাললেন গরম স্যুপ।
শুয়ে সময়টা অস্থিরভাবে নড়াচাড়া করল মিংক। ‘জলদি, মা! এটা জীবন-মরণ সমস্যা। আ’
‘তোমার বয়সে আমিও একইরকম ছিলাম। সব সময় জীবন-মরণ সমস্যা আমারও থাকত।’
মিংক গবগব করে স্যুপ গিলছে।
‘আস্তে খাও,’ বললেন মা।
‘পারব না,’ বলল মিংক। ‘ড্রিল আমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
‘কে ড্রিল? অদ্ভুত নাম তো!’ বললেন মা।
‘তুমি ওকে চিনবে না,’ বলল মিংক।
‘মহল্লায় নতুন এসেছে?’ জিজ্ঞেস করলেন মা।
‘নতুনই বটে,’ জবাব দিল মিংক। দ্বিতীয় বাটি স্যুপ টেনে নিল।
‘কোনজন ড্রিল?’ জানতে চাইলেন মা।
‘ও থাকে আশপাশেই,’ প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইছে মিংক। ‘ওকে দেখলে তোমরা হাসি-তামাশা করবে। সবাই তো আমাদের নিয়ে তা-ই করে। যত্তসব।’
‘ড্রিল ছেলেটা কি খুব লাজুক?’
‘হ্যাঁ। না। একদিক থেকে লাজুকই বলা যায়। এই যে, দেরি হয়ে গেল অনেক। মা, আক্রমণ করতে হলে এক্ষুণি ছুটতে হবে আমাকে।’
‘কে কাকে আক্রমণ করছে?’
‘মঙ্গলবাসীরা পৃথিবী আক্রমণ করছে। না, ঠিক মঙ্গলবাসী নয়। ওরা আমিও ঠিক জানি না। ওরা ওপর থেকে এসেছে।’ হাতের চামচটা শূন্যে ইঙ্গিত করল মিংক।
‘এবং ভেতর থেকে,’ বললেন মা, স্পর্শ করল মিংকের তপ্ত কপাল। আপত্তির সুরে বলল মিংক, ‘তুমি হাসছ! তুমি ড্রিলসহ সবার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে।‘
‘আমি হাসছি না,’ বললেন তিনি। ‘ড্রিল কি মঙ্গলবাসী?’
‘না। সে মনে হয় বৃহস্পতি, শনি অথবা শুক্রগ্রহ থেকে এসেছে। তবে খুব কষ্ট গেছে বেচারার।’
‘সে বুঝতে পারছি,’ মিসেস মরিস হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢাকলেন। ‘ওরা পৃথিবীতে হামলা করার রাস্তা খুঁজে পায়নি।’
‘আমরা দুর্ভেদ্য,’ গম্ভীর হওয়ার ভান করলেন মিসেস মরিস।
‘এ শব্দটাই ড্রিলও বলেছিল। দুর হ্যাঁ, তোমার শব্দটাই বলেছিল ও।’
‘বাহ, ড্রিলের মাথায় তো অনেক বুদ্ধি। এ রকম একটি কঠিন শব্দ উচ্চারণ করতে পারে।’
‘ওরা হামলার কোনো রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিল না, মা। ড্রিল বলেছে ও বলল ভালোভাবে লড়াই করতে হলে নাকি মানুষকে অবাক করে দেয়ার জন্য নতুন পথ খুঁজে বের করতে হয়। তাহলেই তুমি জিতবে। আর বলেছে তোমার শত্রুর কাছ থেকেও তোমাকে সাহায্য নিতে হবে।’
‘দেশদ্রোহী বাহিনী,’ বললেন মা। ‘যারা গোপনে শত্রুদের সাহায্য করে।’
‘হ্যাঁ। ড্রিলও তা-ই বলল। পৃথিবীকে অবাক করে দিতে বা সাহায্য পাওয়ার জন্য তারা নাকি কোনো উপায়ই খুঁজে পাচ্ছিল না।’
‘সেই স্বাভাবিক। কারণ আমরা যথেষ্ট শক্তিশালী,’ টেবিল পরিষ্কার করতে করতে হেসে উঠলেন মা। মিংক পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে টেবিলের দিকে।
‘তারপর একদিন,’ নাটুকে গলায় ফিসফিস করল মিংক, ‘ওদের মাথায় এলো শিশুদের কথা।’
‘আচ্ছা!’ মুখে হাসিটি ধরে রেখেছেন মিসেস মরিস।
‘তারা ভাবছিল বড়দের কথা যারা কখনও গোলাপ ঝাড় কিংবা বাগানের লনের দিকে তাকায় না!’
‘শুধু শামুক আর ছত্রাকের প্রয়োজন হলে ওসব জায়গায় যায়।’
‘তারপর ধরো ডিম ডিমের কথা।’
‘ডিম ডিম?’
‘ডাইমেন-শানস’।
‘ডায়মেনশন?’
‘চারটে! ওরা ভাবল নয় বছরের নিচের কল্পনাপ্রবণ বাচ্চাদের কথা। ড্রিলের কথা শুনতে বেশ মজাই লাগে।’
মিংকের বকবকানিতে ক্লান্তবোধ করছিলেন মিসেস মরিস। ‘বুঝতে পারছি ব্যাপারটা খুব মজার। তোমার ড্রিল বোধহয় তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। দিন শেষ হয়ে আসছে। সাপার বাথের আগেই যদি তোমার আক্রমণ আক্রমণ খেলাটি সাঙ্গ করতে চাও তাহলে এখুনি কেটে পড়।’
‘আমাকে বাথ নিতে হবে?’ অসন্তোষ প্রকাশ করল মিংক।
‘অবশ্যই! বাচ্চারা কেন যে পানি পছন্দ করে না?’
‘ড্রিল বলেছে আমার আর বাথ নেয়ার দরকার হবে না।’
‘তাই নাকি? বলেছে নাকি সে এ কথা?’
‘সব বাচ্চাকেই বলেছে। আর গোসল-টোসল করতে হবে না। আমরা ১০টা পর্যন্ত জেগে থাকতে পারব এবং শনিবারে একটার বদলে দুটি টেলিভিজর শো দেখতে পারব।’
‘দাঁড়াও, মি. ড্রিলের মা’র কাছে আমি ফোন করছি এবং’
দরজার কাছে গেল মিংক। ‘পিট ব্রিটস আর ডেল জেরিক খুব যন্ত্রণা করছে। ওরা বড় হচ্ছে। ওরা আমাদের নিয়ে বিদ্রƒপ করে। ওরা বাবা-মায়েদের চেয়েও খারাপ। তারা ড্রিলের অস্তিত্বেই বিশ্বাস করে না। ওরা খুব পাজি। বড় হচ্ছে তো তাই পাজি হয়ে যাচ্ছে। ওদের আমি ভীষণ ঘেন্না করি। ওদের আমরা সবার আগে হত্যা করব।’
‘তোমার বাবা আর আমাকে সবার শেষে?’
‘ড্রিল বলেছে তোমরা বড়রা খুব বিপজ্জনক। কেন জান? কারণ তোমরা বিশ্বাসই কর না যে মঙ্গলবাসীরা আছে। তারা আমাদের এ পৃথিবী চালানোর ভার দেবে। না, শুধু আমরাই নই, পাশের মহল্লার শিশুরাও সমান সুযোগ পাবে। তবে আমি বোধহয় সবার রানী হব।’ দরজা খুলল মিংক।
‘মা?’
‘বল?’
‘লড-জিক কী জিনিস?’
‘লজিক? কেন সোনা, লজিক হলো কোন জিনিসটা সত্যি আর কোন জিনিসটা মিথ্যা তা জানা।’
‘ও এটার কথাও বলেছে,’ বলল মিংক। ‘আর ইম-প্রে-শ-না-বল?’ শব্দটি উচ্চারণ করতে ওর এক মিনিট সময় লাগল।
‘মানে হলো ‘মা মেঝের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন। এর মানে হলোÑ কচিকাঁচা, সোনা।’
‘লাঞ্চের জন্য ধন্যবাদ!’ লাফ মেরে দরজার বাইরে গেল মিংক, পরমুহূর্তে মু-ু বাড়িয়ে বলল, ‘মা, তুমি যাতে বেশি ব্যথা না পাও তা আমি দেখব।’
‘আচ্ছা, ধন্যবাদ,’ বললেন মা।
দড়াম করে বন্ধ হলো দরজা।
চারটার দিকে বেজে উঠল অডিও-ভিজর। ট্যাব খুললেন মিসেস মরিস। ‘হ্যালো, হেলেন!’ অভ্যর্থনার সুরে বললেন তিনি।
‘হ্যালো মেরি। নিউইয়র্কের খবর কী?’
‘ভালো। আর স্ক্রানটনের কী অবস্থা? তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে।’
‘তোমাকেও। বাচ্চাগুলোর ঝক্কি সামলানো। বোঝোই তো।’
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মিসেস মরিস। ‘আমার মিংটাকে নিয়েও একই ঝামেলা। মহা-আক্রমণ।’
হেসে উঠলেন হেলেন। ‘তোমাদের বাচ্চারাও ওই খেলাটা খেলছে?’
‘ঈশ্বর। হ্যাঁ। কাল হয়তো খেলবে জ্যামিতিক জ্যাক এবং মোটরাইজড হপসকচ।’
‘আমার ছেলে টম এখন সারাক্ষণ ড্রিল নামে একজনের নাম জপ করছে।’
‘হয়তো ওটা ওদের নতুন পাসওয়ার্ড। আমার মিংকও তাকে খুব পছন্দ করে।’
‘জানতাম না নিউইয়র্ক পর্যন্ত এ জিনিস পৌঁছে গেছে। লোকের মুখেমুখেই হয়তো। আমি বোস্টনে জোসেফিনের সঙ্গে কথা বলেছি। ও বলল ওখানেও নাকি বাচ্চারা এ নতুন খেলা নিয়ে মত্ত। সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে উন্মাদনা।’
এ সময় মিংক ঢুকল রান্নাঘরে পানি খেতে। ওর দিকে ঘুরলেন মিসেস মরিস। ‘তোমার খেলা শেষ হবে কখন?’
‘প্রায় শেষের দিকে,’ বলল মিংক।
‘তোমার হাতে ওটা কী?’ জিজ্ঞেস করলেন মিসেস মরিস।
‘ইয়ো-ইয়ো।’ জবাব দিল মিংক। ‘দ্যাখো।’
সে রশি বাঁধা ইয়ো-ইয়োটা ওপরে ছুড়ল ওটা রশির শেষ মাথায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই অদৃশ্য হয়ে গেল।
‘দেখলে?’ বলল মিংক। সে আঙুলে ড্রিবলিং করছে, ইয়ো-ইয়োটা আবার হাজির হয়ে গেল রশি বাঁধা অবস্থায়।
‘আবার করো তো দেখি,’ বললেন মা।
‘পারব না। পাঁচটার সময় জিরো আওয়ার। বাই,’ বলে ইয়ো-ইয়ো নিয়ে লাফাতে লাফাতে চলে গেল মিংক।
অডিওÑ ভিজরে দৃশ্যটা দেখে হাসলেন হেলেন। ‘টিমও আজ সকালে ও রকম একটা ইয়ো-ইয়ো নিয়ে হাজির। আমি খেলাটা দেখতে চাইলাম। ও দেখাল না। নিজে চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না।’
‘পারনি কারণ তুমি ইমপ্রেশনাবল নও।’
‘কী?’
‘এমনি ঠাট্টা করলাম। আচ্ছা, ফোন করেছ কেন বলো?
‘তোমার ওই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট কেকের রেসিপিটা জানতে?’
ঘণ্টা আর প্রহরগুলো কেটে যাচ্ছে। শান্ত নীলাকাশের কোলে নেমে যাচ্ছে সূর্য। সবুজ বাগানে বাড়ছে ছায়ার দৈর্ঘ। হিহিহোহো হাসি আর উত্তেজনায় নেই কোনো বিরতি। ছোট একটি মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। সদর দরজায় উদয় হলেন মিসেস মরিস।
‘মিংক, ওটা পেগি অ্যান কাঁদছে না?’
উঠোনে, গোলাপ ঝাড়ের ধারে উবু হয়ে ছিল মিংক। বলল, ‘হ্যাঁ। ও একটা ভীতুর ডিম। ওকে আমরা আর খেলায় নেব না। আমাদের সঙ্গে খেলা করার বয়স ও পার হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই যেন বড় হয়ে গেছে।’
‘এ জন্যই ও কাঁদছিল? যত্তসব। সত্যি কথা বলো মেয়ে নইলে খেলতে দেব না।’
আতঙ্ক আর বিরক্তি নিয়ে পাঁই করে ঘুরল মিংক। ‘আমি এখন খেলা ছেড়ে আসতে পারব না। প্রায় সময় হয়ে গেছে। আমি আর দুষ্টামি করব না। আমি দুঃখিত।’
‘তুমি কি পেগি অ্যানকে মেরেছ?’
‘না, বিশ্বাস করো। ওকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো। ও খামোকা ভয় পেয়েছে।’
মিংকের চারপাশে বাচ্চারা একটা বৃত্ত এঁকে দিয়েছে। ওখানে সে চামচ, চৌকোনা হাতুড়ি আর পাইপ নিয়ে কী সব করছিল। ‘ওখানে আর ওখানে,’ বিড়বিড় করল মিংক।
‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইলেন মিসেস মরিস।
‘ড্রিল আটকে গেছে। অর্ধেক রাস্তায় আছে। ওকে যদি আমরা ঠিকঠাক নিয়ে আসতে পারি, তাহলে বাকিরা ওর পেছন পেছন চলে আসতে পারবে।’
‘আমি কোনো সাহায্য করতে পারি?’
‘না, মা। ধন্যবাদ। আমিই সব ব্যবস্থা করতে পারব।’
‘ঠিক আছে। আমি কিন্তু তোমাকে আধঘণ্টার মধ্যে গোসল করার জন্য ডাকব। তোমার ওপর সারাক্ষণ লক্ষ্য রাখতে রাখতে আমি ক্লান্ত।’
তিনি ভেতরে গিয়ে বৈদ্যুতিক রিলাক্সিং চেয়ারে বসলেন, আধখালি গ্লাস থেকে বিয়ার পান করলেন। চেয়ার তার পৃষ্ঠদেশ ম্যাসেজ করে দিতে লাগল। কাচ্চাবাচ্চার দল। শিশুদের মন বোঝা দায়। এরা কখনও তোমাকে ভালোবাসবে, পরক্ষণেই হয়তো ঘৃণা করবে। এই শিশুরা, যাদের বকাঝকা করে বাবা-মায়েরা, ধরে চাবকায়, হুকুম দেয়, তারা কি কোনোদিন তাদের বাবা-মাকে ক্ষমা করতে পারবে?
সময় চলে যেতে লাগল। অদ্ভুত, প্রতীক্ষিত নীরবতা নেমে এলো রাস্তায়, ক্রমে গাঢ় হতে লাগল।
বেলা পাঁচটা। মিষ্টি সুরে ঘরের কোথাও একটি ঘড়ি ঘোষণা করল। ‘পাঁচটা পাঁচটা পাঁচটা।’ তারপর চুপ মেরে গেল।
জিরো আওয়ার।
মৃদু হাসলেন মিসেস মরিস। জিরো আওয়ার। একটি বিটলকার গুঞ্জন তুলে ঢুকল ড্রাইভওয়েতে। মি. মরিস। হাসলেন মিসেস মরিস। মি. মরিস বিটল থেকে নামলেন। বন্ধ করলেন দরজা। মিংকের দিকে তাকিয়ে হ্যালো বললেন। মিংক তার দিকে ফিরেও তাকাল না। মি. মরিস হেসে উঠলেন। একটু দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের দেখলেন। তারপর পা বাড়ালেন সিঁড়িতে।
‘হ্যালো, ডার্লিং।’
‘হ্যালো, হেনরী।’
মিসেস মরিস চেয়ারের সামনে ঝুঁকে এলেন। কান পাতলেন। বাচ্চাদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। নীরব সবাই। বড্ড নীরব।
মি. মরিস তার পাইপ শেষ করলেন। একটা গুঞ্জনের শব্দ শুনলেন তিনি।
‘কীসের শব্দ?’ জিজ্ঞেস করলেন।
‘জানি না,’ জবাব দিলেন মিসেস মরিস। হঠাৎ ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বিস্ফারিত চক্ষু। কী যেন বলতে গিয়েও থেমে পড়লেন। হাস্যকর। তার স্নায়ুগুলো কেমন লাফাচ্ছে। ‘উঠোনের বাচ্চাগুলোর কাছে বিপজ্জনক কিছু নেই, তাই না?’
‘পাইপ আর হাতুড়ি ছাড়া কিছু নেই। কেন?’
‘কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি?’
‘আরে না,’ বললেন হেনরী। ‘দেখছি আমি।’
মিসেস মরিস হেঁটে কিচেনে গেলেন। গুঞ্জনধ্বনিটা চলছেই ‘তুমি ওদের গিয়ে বল খেলা বাদ দিতে। পাঁচটা বেজে গেছে। ওদের বল’ তার চোখ প্রথমে বিস্ফারিত তারপর সরু হয়ে এলো। ‘বল ওদের আক্রমণ আক্রমণ খেলা কালকেও খেলা যাবে।’ তিনি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হাসলেন।
গুঞ্জনধ্বনি ক্রমে জোরালো হয়ে উঠছে।
‘ওরা করছে কী? দেখি তো গিয়ে।
এমন সময় প্রচ- একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ হলো। বাড়িটি কেঁপে উঠল সে শব্দে। অন্য আরেক রাস্তা থেকেও আরেকটা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল।
চিৎকার দিলেন মিসেস মরিস। ‘এদিক দিয়ে এসো!’ তিনি কেঁদে উঠলেন। কেন কাঁদছেন নিজেও জানেন না। হয়তো চোখের কোণ দিয়ে কিছু একটা দেখেছেন; নতুন কোনো গন্ধ নাকে এসেছে তার কিংবা শুনেছেন অপরিচিত কোনো শব্দ। হেনরীকে বুঝিয়ে বলার সময় এখন নেই। সে যদি তাকে পাগল ভাবে ভাবুক। হ্যাঁ, পাগল! চিৎকার দিতে দিতে তিনি দোতলার সিঁড়িতে ছুটলেন। মি. মরিস ছুটলেন স্ত্রীর পিছুপিছু ঘটনা কী জানতে। ‘চিলেকোঠা!’ চেঁচালেন মিসেস মরিস। ‘ওখানেই ওটা আছে!’
বাইরে আবার বিস্ফোরণের আওয়াজ হলো। বাচ্চারা খুশিতে চিল্লাচিল্লি করতে লাগল যেন আতশবাজির খেলা শুরু হয়েছে।
‘ওটা চিলেকোঠায় নেই!’ চেঁচালেন হেনরী। ‘ওটা বাইরে আছে।’
‘না, না!’ শ্বাস টানতে টানতে, হাঁপাতে হাঁপাতে মিসেস মরিস চিলেকোঠার দরজা হাতড়ালেন। ‘আমি তোমাকে দেখাব। জলদি! আমি তোমাকে দেখাব!’
ওরা টলতে টলতে ঢুকলেন চিলেকোঠায়। মিসেস মরিস দড়াম করে লাগিয়ে দিলেন দরজা। তালা মারলেন। চাবিটি দূরে ছুড়ে মারলেন।
তিনি এখন উন্মাদের মতো বিড়বিড় করে কীসব বলছেন। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে শব্দগুলো। গোটা বিকেল ধরে গোপনে সন্দেহ আর ভয় অবচেতন মনে একটু একটু করে দানা বাঁধছিল, মদের মতো গাঁজলা তুলছিল। ছোট ছোট কিছু ঘটনা যুক্তির সাহায্য দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি আবার বাতিলও করে দিচ্ছিলেন বিশ্বাস করতে না পেরে। এখন ওটা তার ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে এবং তাকে টুকরো টুকরে করে ফেলেছে।
‘এখানে, ওখানে,’ দরজায় হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন তিনি।
‘আমরা আজ রাত পর্যন্ত এখানে নিরাপদ। হয়তো আমরা পালিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ পাব।’
হেনরী বললেন, ‘তুমি কি পাগল হলে? চাবিটা কেন ছুড়ে ফেললে?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি পাগল হয়ে গেছি। চাবি ছুড়ে ফেলেছি বেশ করেছি। তুমি আমার সঙ্গেই থাক।’
‘আমি এখান থেকে বেরোতে পারলে তো বেরোব!’
‘চুপ। আস্তে বলো। ওরা শুনতে পাবে। ওহ গড, ওরা আমাদের হয়তো এক্ষুণি পেয়ে যাবে
নিচতলা থেকে ভেসে এলো মিংকের কণ্ঠ। সেই গুঞ্জন ধ্বনিটা আরও বেড়েছে। ওখানে অডিও টেলিভিশন বাজছে। হেলেন কি ফোন করল? ভাবলেন মিসেস মরিস। আমি যা ভাবছি সে কথা বলার জন্যই কি ও ফোন করেছে।
বাড়িতে পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। ভারি পদক্ষেপ।
‘আমার বাড়িতে কে ঢুকল?’ ক্রুদ্ধ গলায় বললেন হেনরী। ‘কার এত সাহস বিনা অনুমতিতে আমার বাড়িতে ঢোকে?’
ভারি পায়ের শব্দ। কুড়ি, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ। পঞ্চাশ জন লোক ঢুকেছে বাড়িটিতে। গুঞ্জন ধ্বনি। শিশুদের খিলখিল হাসি।
‘এই পথে!’ নিচ থেকে ভেসে এল মিংকের গলা।
‘নিচতলায় কে?’ হুংকার ছাড়লেন হেনরী। ‘কে নিচতলায়?’
‘চুপ। ওহ না-আ-আ-আ-আ-আ!’ স্বামীকে জড়িয়ে ধরে দুর্বল গলায় বললেন স্ত্রী। ‘প্লিজ, চুপ করো। আওয়াজ না পেলে ওরা হয়তো চলে যাবে।’
‘মা?’ হাঁক ছাড়ল মিংক। ‘বাবা?’ একটুক্ষণ বিরতি। ‘কোথায় তোমরা?’
ভারি পদক্ষেপ, ভারি, ভারি খুবই ভারি পদক্ষেপ। উঠে আসছে ওপরতলায়। মিংক ওদের নিয়ে আসছে।
‘মা?’ দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠ। ‘বাবা?’ অপেক্ষা করছে জবাবের কিন্তু শুধুই নীরবতা।
চিলেকোঠায় ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছেন মি. এবং মিসেস মরিস। ইলেকট্রিক গুঞ্জন ধ্বনি, অদ্ভুত গন্ধ অচেনা সব শব্দের মাজেজা অবশেষে উপলব্ধি করতে পেরেছেন মি. মরিসও। তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন, অন্ধকার নৈঃশব্দের মাঝে দাঁড়িয়ে কাঁপছেন। পাশে তার স্ত্রী।
‘মা! বাবা!’
পায়ের আওয়াজ। ছোট্ট একটি গুঞ্জন ধ্বনি। চিলেকোঠার দরজার তালাটি গলে গেল। খুলে গেল দরজা। ভেতরে উঁকি দিল মিংক, তার পেছনে অনেক লম্বা লম্বা নীল ছায়া।
ধ‘ধরেছি!’ বলল মিংক।