বর্বরের অজাচার-ভীতি
প্রথম অধ্যায়
ক্রমোন্নতির পথে যে সমস্ত ধাপ আদিম অধিবাসীরা অতিক্রম করেছে সি সবের মাধ্যমেই আমরা তাদের জানতে পারি। যেমন জড় পদার্থের মধ্যে যাবতীয় স্মারকচিহ্ন, তাদের ব্যবহৃত নানা প্রকারের সরঞ্জাম, তাদের শিল্প ও তাদের ধর্ম, এবং যে দৃষ্টিতে তারা জীবনকে দেখেছে—তা-ও। এ-সবের কতকগুলি আমরা প্রত্যক্ষভাবে জেনেছি, আবার কতকগুলি জানতে পেরেছি নানা পুরনো কাহিনী, পৌরাণিক গল্প বা রূপকথার মাধমে এবং তাদের চিন্তাধারার অবিষ্টাংশ যা আজও আমাদের আচার ব্যবহার ও সামাজিক প্রথা মধ্যে বেঁচে রয়েছে, তা থাকে। এ ছাড়া একদিক থেকে তারা আজও আমাদের সমসাময়িক। কেননা, পৃথিবীতে এখনও এমন মানুষ আছে যাদের সম্পর্ক আমাদের চেয়ে আদিযুগের মানুষের সঙ্গেই বেশি ঘনিষ্ঠ, এবং যাদেরকে আমরা প্রাথমিক মানবের সোজাসুজি অধস্তন পুরুষ ও প্রতিনিধি বলে চিনতে পারি এইভাবে আমরা তথাকথিত বর্বর ও আধা-বর্বর জাতিকে তফাত করতে পারি। তাদের মনোজগতের মধ্যে আমরা আমাদের মনোজগতের ক্রমোন্নতির পর্যায়গুলিকে সুরক্ষিত অবস্থায় দেখতে পাই।
এই ধারণা যদি নির্ভুল হয় তবে লোকশ্রুতি-বর্ণিত আদিম মানবের মানসিকতার সঙ্গে, মনঃসমীক্ষণের মাধ্যমে প্রাপ্ত বিকৃতমন বা নিউরটিক ব্যক্তির মানসিকতার তুলনা করলেও অসংখ্য মিল পাওয়া যাবে; এবং যেসব বিষয় অল্পবিস্তরভাবে আমাদের পরিচিত তাদের সম্বন্ধে নূতন আলোকপাত হবে।
অষ্ট্রেলিয়া নবীনতম মহাদেশ। বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ উভয় কারণেই আমি অস্ট্রেলিয়ার আদিম জাতিদের সঙ্গে নিউরটিক ব্যক্তিদের তুলনা করব। জাতিবিদ্যাবিশারদগণ এই মহাদেশের আদিম জাতিদের সর্বাপেক্ষা অনুন্নত ও অ-মানুষ বলে বর্ণনা করেছেন। এই দেশের সংরক্ষিত প্রাণিজগতের বৃত্তান্ত থেকে আমরা আজ পর্যন্ত যা জেনেছি তার চেয়ে পুরনো ইতিবৃত্ত আর কোথাও পাওয়া যায় না।
অস্ট্রেলিয়ার এই অধিবাসীদের এক অদ্ভুত জাত বলে গণ্য করা হয়। এদের সব চেয়ে নিকট অধিবাসী মেলানেশিয়া, পলিনেশিয়া ও মালয়বাসীদের সঙ্গে এদের আকৃতিগত বা ভাষাগত কোনো বিষয়েই মিল নেই। এরা বাড়িঘর, এমনকি স্থায়ী কুঁড়েঘরও তৈরী করতে পারে না। এরা চাষ-আবাদ করতে জানে না, কুকুর ছাড়া অন্য কোনো গৃহপালিত পশুও পোষে না; এমনকি এরা মৃৎশিল্পও জানে না। এরা নানাধরনের পশু শিকার করে এবং মাটি খুঁড়ে শিকড় তোলে। ওই সব পশুর মাংস ও গাছের মূল খেয়েই এরা জীবন ধারণ করে। রাজা বা সর্দারের প্রচলন এদের মধ্যে নেই। নিজেদের দলীয় সবকিছু বিষয়ই দলের বয়োজ্যেষ্ঠরাই একসঙ্গে বসে স্থির করে দেয়। উচ্চস্তরের কোনো কিছু পূজার দ্বারা এরা যে কোনো ধর্ম পালন করে সে সম্বন্ধেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এদের মধ্যে যারা গভীর অরণ্যে বাস করে জলের অভাবে তাদেরকে তীরভূমিবাসীদের চেয়ে অনেক বেশি দুঃখকষ্ট সহ্য করে থাকতে হয়।
এই সব হতভাগ্য উলঙ্গ নরখাদকরা যে তাদের যৌনজীবনে আমাদের মতো নীতিরক্ষা করে চলবে বা যৌন-আবেগ সম্বন্ধে খুব বেশি সংযম রক্ষ করবে, এমন আশা আমরা নিশ্চয় করি না। কিন্তু জানা গেছে যে তারা অজাচারীয় (incestuous) যৌনসম্বন্ধ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রাখে এবং এ-সম্বন্ধে খুব কঠিন নিয়ম পালন করা উচিত বলে মনে করে। সত্যি বলতে কি, এদের সমগ্র সামাজিক কাঠামোটাই গড়ে উঠেছে এই উদ্দেশ্যকে উপলক্ষ করে; কিংবাম এই উদ্দেশ্যকে সফল করে তোলার জন্য।
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের সমস্ত ধর্ম ও সমাজব্যবস্থা টোটেম ব্যবস্থার অনুশাসনেই চালিত হয়ে থাকে। এরা ছোট ছোট দল বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং প্রত্যেক দল নিজ নিজ টোটেম নামে পরিচিত। এখন দেখা যাক, টোটেম বলতে ঠিক কী বোঝায়। টোটেম কোনো প্রাণী হবে, এটাই হচ্ছে সাধারণ নিয়ম। টোটেম ভক্ষণীয় কিংবা খুব নিরীহ জীব থেকে শুরু করে ভয়ঙ্কর এবং ভীতিকারক প্রাণীও হতে পারে। ক্বচিৎ কোনো গাছ বা প্রাকৃতিক শক্তিও (বৃষ্টি, জল) টোটেম হয়। এই টোটেমের সঙ্গে গোষ্ঠীর একটা অদ্ভুত রকমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। টোটেমই গোষ্ঠীর আদি পুরুষ। সেই-ই দৈবশক্তি স্বরূপ ও গোষ্ঠীর রক্ষাকর্তা। পৃথিবীতে টোটেমই পাঠায় অবতার এবং অন্যান্য বিষয়ে ভয়ঙ্কর হলেও সে তার বংশধরদের চেনে এবং তাদের কোনো ক্ষতি করে না। তেমনি টোটেমের বংশধররাও পবিত্র দায়ে বদ্ধ থাকে; তারা তাদের টোটেমকে হত্যা বা ধ্বংস করবে না, তার মাংস খাবে না বা তাকে অন্য কোনো ভোগের বস্তু হিসাবে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবে। এরূপ নিষেধের কোনো ব্যতিক্রম হলে শাস্তির ব্যবস্থাও সঙ্গে সঙ্গে হয়ে থাকে। টোটেমের স্বভাব কেবল একটা জন্তু বা জীবের মধ্যে আবদ্ধ থাকে না, পরন্তু বংশের প্রত্যেক সভ্যের মধ্যেই এর বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকে। মাঝে মাঝে উৎসব হয়। নৃত্য এই উৎসবের একটা প্রধান অঙ্গ। টোটেমের সভ্যতা তাদের টোতেমের চাল-চলন এবং বৈশিষ্ট্যকে নকল করে এই নাচের মধ্যে রূপ দেয়।
টোটেম হচ্ছে বংশানুক্রমিক; হয় মায়ের বংশ থেকে, নয়তো বাপের বংশ থেকে পাওয়া। সম্ভবত মায়ের দিক থেকেই প্রথমে শুরু হয়ে থাকবে এবং পরে পিতৃবংশ তার স্থান দখল করে থাকবে। অস্ট্রেলিয়াবাসীদের সমস্ত সামাজিক রীতিনীতির ভিত্তি হচ্ছে তাদের টোটেমের প্রতি অনুরক্তি। এই অনুরক্তি একদিকে যেমন জাতি-সম্পর্কেরও বেশি, অন্যদিকে তেমনি রক্ত-সম্পর্কেরও বড়ো(১)।
টোটেম ছোট-বড় কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় আবদ্ধ থাকে না। এর বংশধরেরা পরস্পর আলাদা হয়ে এবং অন্যান্য টোটেমের লোকদের সঙ্গে মিলে মিশে বন্ধুভাবে বাস করতে পারে(২)।
টোটেম প্রথার যে-দিকটা মনঃসমীক্ষকদের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকর্ষণ করে সেই দিকটার বিষয়ে এখন সবশেষে আমরা আলোচনা করব। টোটেম প্রথার চলন যেখানেই আছে সেইসব জায়গায় প্রায় সর্বত্রই একটি নিয়ম প্রচলিত আছে—সেটা হচ্ছে, একই টোটেমের ব্যক্তিরা পরস্পর যৌন-সম্পর্কে আবদ্ধ হতে পারবে না; অর্থাৎ তাদের মধ্যে বিবাহ হতে পারবে না। এইখানেই বহির্বিবাহের (exogamy) সঙ্গে টোটেমের সম্বন্ধ।
দৃঢ়তার সঙ্গে পালিত এই নিয়মটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এতক্ষণ পর্যন্ত টোটেমের প্রকৃতি বা গুণাবলি সম্বন্ধে যা জানা গেল তার সঙ্গে এই কঠোর নিয়মের কোনো সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায় না। সেইজন্য বোঝা যায় না, এরূপ নিয়ম কেমন করে টোটেম ব্যবস্থার মধ্যে স্থান পেল। সেইজন্যই যখন দেখি কোনো অনুসন্ধানী ধরে নেন যে প্রথমে বহির্বিবাহের সঙ্গে—এর উৎপত্তি ও তাৎপর্য উভয়ের সংগে—টোটেমের কোনো সম্পর্কই ছিল না, পরে যখন বিবাহ সম্বন্ধে বিধি-নিষেধের প্রয়োজন হয়েছে, তখন এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে মাত্র—গভীরভাবেই মোটেই যুক্ত নয়—তখন আমাদের বিস্মিত হবার কিছু থাকে না। সে যাই হোক, টোটেম ব্যবস্থা ও বহির্বিবাহের সঙ্গে সম্পর্ক আছেই এবং সম্পর্ক বেশ দৃঢ়।
এই নিষেধের আসল অর্থ কী আরও একটু আলোচনা করে দেখার চেষ্টা করা যাক।
ক. এই নিষেধের অন্যথা করলে তার শাস্তির ব্যবস্থা গতানুগতিক নিয়মের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয় না, যেমন নাকি টোটেমের অন্যান্য নিষেধ (যথা, টোটেম-প্রাণী হত্যা না করা) সম্বন্ধে প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে সমস্ত গোষ্ঠী একসঙ্গে আর প্রতিশোধ গ্রহণে তৎপর হয়। এ যেন এমন একটা বিপদ যা সমস্ত গোষ্ঠীকে আচ্ছন্ন করতে পারে, যার দ্বারা সমগ্র গোষ্ঠীর অকল্যান হতে পারে; এতএব তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার সমস্ত দায়িত্ব সকলের। ফ্রেজার সাহেবের পুস্তকের(৩) কয়েকটা লাইন পড়লে বোঝা যায় যে, যাদের আমরা আমাদের মান অনুযায়ী দুর্নীতিপরায়ণ বলে থাকি সেই অসভ্য জাতিরাই এরূপ নিয়ম ভংগের জন্য কত কঠিন ব্যবস্থা অবলম্বন করে থাকে।
অস্ট্রেলিয়াতে নিষিদ্ধ গোষ্ঠীর কোনো লোকের সঙ্গে রতিক্রিয়ার জন্যে শাস্তি হচ্ছে প্রাণদণ্ড। স্ত্রীলোকটি স্থানীয় কোনো দলভুক্তই হোক বা যুদ্ধবিগ্রহকালে অন্য কোনো গোষ্ঠী থেকে অপহৃতই হোক, তাতে কিছুই আসে যায় না। যে অপরাধী পুরুষটি ঐ স্ত্রীলোকটিকে পত্নী হিসাবে ব্যবহার করবে তাকে তার জ্ঞাতিরা খুঁজে বার করবে এবং হত্যা করবে। স্ত্রীলোকটির পক্ষেও বিধান তাই। যদিও, সেসব ক্ষেত্রে অপরাধীরা পালিয়ে গিয়ে কিছুদিনের জন্য লুকিয়া থাকতে পারে সেই সব ক্ষেত্রে তাদের অপরাধ উপেক্ষা করা হয়ে থাকে। নিউ সাউথ ওয়েল্সের তা তা থি (Ta Ta Thi) জাতির মধ্যে যদি ক্বচিৎ এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে পুরুষটিকে হত্যা করা হয়, কিন্তু স্ত্রীলোকটিকে একেবারে মেরে ফেলা হয় না। তবে মৃতপ্রায় না হওয়া পর্যন্ত তাকে হয় প্রহার করা হয়, নয়তো বর্শাবিদ্ধ করা হয়; কখনো-বা উভয় প্রকার শাস্তিই দেওয়া হয়ে থাকে। কেন একেবারে মেরে ফেলা হয় না, তার যুক্তি স্বরূপ বলা হয় যে, হয়তোবা সে পুরুষটি কর্তৃক পীড়িত হয়ে কুপথে আসতে বাধ্য হয়েছে। এমনকি সাময়িক প্রেমের ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞার কড়াকড়ির শেষ নেই। এই বিধি-নিষেধের কোনো প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতিকে ‘অত্যন্ত ঘৃণার বিষয় বলে ধরা হয় এবং তার পরিণাম হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড’ (Howitt)।
খ. সাময়িক প্রেমের ক্ষেত্রে—যেখানে সন্তান জন্মের প্রশ্ন নেই—ঐ একই কড়া শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। অতএব এরূপ শাস্তির ব্যবস্থা যে শুধু ব্যবহারিক সুবিধার কথা ভেবে অবলম্বন করা হয়েছে, তা মনে হয় না।
গ. টোটেম পুরুষানুক্রমিক ব্যবস্থা। বিবাহের দ্বারা তার বদল হয় না। অতএব এই নিষেধের ফলাফল—যদি মাতৃ-বংশগতির (maternal heredity) কথাই ধরা যায়—সহজেই অনুমেয়। উদাহরণ স্বরূপ ধরা যেতে পারে—পুরুষটি এমন গোষ্ঠীভুক্ত, যার টোটেম হচ্ছে ক্যাঙারু, সে বিয়ে করল এমন স্ত্রীলোককে যার টোটেম হবে এমু। টোটেম নিয়ম অনুযায়ী, মা এবং বোন প্রত্যেকের সঙ্গে ছেলের অজাচার-সম্পর্ক; কেননা, তারা সকলেই এমু-টোটেমভুক্ত। অতএব, এ ক্ষেত্রে বিবাহ-সম্পর্ক স্থাপিত হতেই পারে না(৪)।
ঘ. কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, শুধু মা এবং বোন সম্পর্কে অজাচার সম্পর্ক দূর করা ছাড়াও টোটেমের সঙ্গে জটিত বহির্বিবাহ (exogamy) আরো কিছু কাজ করে থাকে। কোনো লোকের পক্ষে তার দলের যে-কোনো স্ত্রীলোকের সঙ্গে বিবাহ-সম্পর্ক স্থাপন অসম্ভব তো বটেই, এ ছাড়া এমন বহু স্ত্রীলোক আছে সঙ্গে কোনো রক্ত-সম্পর্ক নেই অথচ রক্ত-সম্পর্ক থাকলে যেরূপ ব্যবহার করা দরকার সেইরূপ ব্যবহার করতে হয়। আপাতদৃষ্টিতে এরূপ অসাধারণ কঠোর শাসনের, যার সঙ্গে সভ্যজাতির নিয়মের তুলনা হতে পারে না, কোনো উপযুক্ত মনোবিদ্যক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এর থেকে আমরা এই বুঝব যে, পূর্বপুরুষরা টোটেমের (ঐ প্রাণীর) কার্যাবলিতে খুব একটা গুরুত্ব আরোপ করতেন। একই টোটেম-সম্ভূত প্রত্যেক লোকই জ্ঞাতি, অর্থাৎ একই পরিবারভূক্ত। এবং এই পরিবারের সবচেয়ে দূর সম্পর্কের জ্ঞাতির সঙ্গেও যৌন-সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে এক বিরাট বাধা বর্তমান।
অতএব এই অসভ্যদের আচার-ব্যবহার থেকে প্রকাশ পাচ্ছে যে, তাদের অজাচার-ভীতি বা অজাচার সম্পর্কে স্পর্শকাতরতা অসাধারণ রকমের প্রকট। এর সঙ্গে আবার যুক্ত রয়েছে রক্ত-সম্পর্কের পরিবর্তে টোটেম-সম্পর্ক প্রচলনের এক অদ্ভুত প্রথা, যেটা আমাদের কাছে সম্পূর্ণ বোধগম্য নয়। কিন্তু এই বৈষম্য নিয়ে আমাদের বেশি বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। এবং টোটেম-নিষেধের অন্তর্ভূক্ত সত্যিকারের অজাচারকে একটা বিশেষ দৃষ্টান্ত হিসাবে আমাদের মনে করা উচিত।
পারিবারিক সম্পর্কের স্থলে টোটেম-সম্পর্ক যে কীভাবে স্থাপিত হল সে এক রহস্য। এর সমাধান সম্ভবত টোটেমের ব্যাখ্যার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। বিবাহ-বন্ধন, রক্ত-সম্পর্ক ও তারই অজাচার নিষেধের গণ্ডির বাইরে যেটুকু যৌন-স্বাধীনতা আছে তা এতই অনিশ্চত যে, এসম্বন্ধে নিষেধবিধির আরও কারণ থাকতে পারে, সে কথা আমরা অস্বীকার করতে পারি না, এতএব নারীর উপর পুরুষের দাম্পত্যাধিকার ক্ষুণ্ণ হয় এমন যেসব সামাজিক নিয়ম ও প্রমোদানুষ্ঠানাদি অস্ট্রেলিয়ার প্রথায় স্বীকৃত সেগুলিকে বিশেষভাবে লক্ষ করা নিশ্চয়ই অবান্তর হবে না।
অস্ট্রেলিয়ার এই সব জাতি ও আরও অন্যান্য টোটেম-জাতির ভাষার ব্যবহারের মধ্যে যেসব প্রথার সন্ধান পাওয়া যায় তাদের এমন এক বৈশিষ্ট্য আছে, যার কথা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝানোর জন্য যে সমস্ত সম্বোধনবাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়, সেগুলি দুজন ব্যক্তির মধ্যে আসল সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে ঠিক করা হয় না। পরন্তু, এই সম্বোধনবাচক শব্দগুলি কোনো ব্যক্তির সঙ্গে তার জ্ঞাতি বা দলের সঙ্গে সম্পর্কিত। এল. এচ. মর্গান সাহেবের মতো এগুলি ‘শ্রেণীবিভাগ’ (classifying) তন্ত্রের অন্তর্ভূক্ত। তার অর্থ, কোনো লোক যেশুধু তার পিতাকেই পিতা বলে তা নয়, যে-কোনো লোক তার মাতাকে বিবাহ করতে পারত এবং তার জন্মদাতা হতে পারব, তাকেই পিতা বলে থাকে। যেমন শুধু গর্ভধারিণী মাকেই মা বলে না, পরন্তু জাতির আইন-কানুন অমান্য না করে যার পক্ষে তার মা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তাকেই মা বলে থাকে। ভাই এবং বোন শুধু যে নিজের জন্মদাতার সন্তানদেরই বলে থাকে তা নয়; যে সমস্ত ব্যক্তি পিতৃদলের অন্তর্ভূক্ত তাদের ছেলেমেয়েদেরও ভাই বা বোন বলে অভিহিত করে থাকে। এরূপ উদাহরণ আরও অনেক দেওয়া যায়। অতএব, দুজন অস্ট্রেলিয়াবাসী যে জ্ঞাতি নামে পরস্পরকে সম্বোধন, তার, আমাদের ভাষার নিয়মানুযায়ী যে অর্থ, তাদের ক্ষেত্রেও যে সেইরূপ রক্ত-সম্পর্ক সূচিত করবেই এমন কোনো কথা নেই। তাদের সম্পর্ক যত না দৈহিত তার চেয়ে বেশি সামাজিক। এই শ্রণীবিভাগতন্ত্রের হদিস খুব সম্ভবত আমাদের শিশু-নিকেতনগুলির মধ্যে পাওয়া যাবে। এই অবস্থায় শিশু প্রত্যেক পুরুষকে ‘কাকা’, ‘মেসো’ (uncle) ইত্যাদি, এবং প্রত্যেক স্ত্রীলোককে ‘মাসিমা’, ‘পিসিমা’ (aunt) ইত্যাদি বলে সম্বোধন করে। কিংবা, আমরা যখন বলি ‘Brothers in Apollo’ বা ‘Sisters in Christ’ তখন একটা আরোপের ভাব নিয়ে ঐ অর্থই প্রকাশ পায়।
এই ভাষাগত রীতি, যা খুব অদ্ভুত মনে হচ্ছে, তার ব্যাখায় খুব সহজ হয়ে যাবে, যদি আমরা রেভারেণ্ড এল. ফিনস উল্লিখিত সংঘ-বিবাহ (Group marriage) প্রথার কথা স্মরণ করি। এই নিয়মকে উপরোক্ত বিবাহ-প্রথারই শেষ পর্যায় ও শেষ চিহ্ন হিসাবে ধরা যেতে পারে। সংঘ-বিবাহ প্রথার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, একদল লোক একদল স্ত্রীলোকের উপর বৈবাহিক অধিকার ভোগ করে। এই সংঘবিবাহ-প্রসূত সন্তান-সন্ততির, যদিও তারা বিভিন্ন মাতার সন্তান, তবুও পরস্পরকে ভাই-বোন সম্বোধন করার অধিকারী হয়। এবং এরা দলের প্রত্যেক পুরুষকেই বাবা বলে সম্বোধন করে থাকে।
অনেকেই এই উপসংহারে আপত্তি করেছেন। উদাহরন স্বরূপ বি. ওয়েস্টারমার্কের “মানব বিবাহের ইতিহাস (History of Human Marriage)” পুস্তকের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু যাঁদের মত সর্বাপেক্ষা প্রামাণিক বলে ধরা হয়, তাঁদের অভিমত হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের জ্ঞাতিনামের সূত্রাপাত সংঘবিবাহ প্রথ থেকেই। স্পেনসার (Spencer) এবং গিলেন(৫) (Gillen)-এর মতে উরেবুন্না (Urabunna) ও ডিয়েরি (Dieri)-র অধিবাসীদের মধ্যে যে এখনো সংঘবিবাহ প্রচলিত রয়েছে তা প্রমাণ করা যায়। অতএব প্রমাণ হয় যে, ব্যক্তিগত বিবাহ প্রচলিত হবার আগে সংঘবিবাহ প্রচলিত ছিল, এবং এখনও ভাষা ও সামাজিক প্রথার মধ্যে এর নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়।
যদি ব্যক্তিগত বিবাহ সরিয়ে দেওয়া যায় তাহলে আমরা এই সব আদি জাতিদের মধ্যে অজাচার বর্জনের বিষয় লক্ষ করেছি তার আপাতবৃদ্ধির কারণ বুঝতে পারল। বংশের বাইরে বিবাহের বাধ্যবাধকতা ও একই গোষ্ঠীভুক্ত ব্যক্তির মধ্যে যৌনসম্পর্ক নিষিদ্ধতা দলীয় অজাচার নিবারণের প্রকৃষ্ট উপায় বলে মনে হবে এবং এই টোটেমীয় বহির্বিবাহ পরে নিশ্চিত নিয়ম হয়ে গিয়েছে ও সেই সংগে বাঁচিয়ে রেখেছে তার নিশ্চিত উদ্দেশ্যকে।
অস্ট্রেলিয়ার বর্বরদের বিবাহের কঠিন অনুশাসনের কারণ এখন আমরা বুঝেছি বলেই বিশ্বাস। কিন্তু আসল অবস্থাটা প্রকাশ পেলে আরও আশ্চর্য রকমের গোলমেলে বলে মনে হবে। কারণ অস্ট্রেলিয়াতে খুব কম জাতি আছে যারা টোটেম-নিষেধ ছাড়া আর কোনো নিষেধ মানে। এরা প্রায় সকলেই এমনভাবে সংগঠিত যে এদের দুটো ভাবে বিভক্ত করা চলে। এই ভাগকে বিবাহ-শ্রণী বা ফ্রাট্রিজ (phratries) বলা হয়। দুই ভাগের প্রত্যেক বিবাহদলই বংশের বাইরে বিবাহ করে এবং টোটেমদলকে দলভুক্ত করে। সাধারণত প্রত্যেক বিবাহদল দুইটি উপদল বা sub-phraties-এ বিভক্ত হয়। সুতরাং সমস্ত জাতিটি চারটি উপদলে ভাগ হয়ে পড়ে। এইভাবে উপদলগুলি টোটেমদল ও বিবাহদল বা phratries-এর মধ্যে পড়ে যায়।
অস্ট্রেলিয়ার আদি জাতিদের দল সংগঠনের ব্যাপারটা বেশ জটিল, তাই একটা বিশেষ ছক এখানে দেওয়া হল—
বিবাহদল (Phratries)
ক (উপদল (Sub phratries)
গ
ত (টোটেম)
থ (টোটেম)
দ (টোটেম)
ঘ
প (টোটেম)
ফ (টোটেম)
ব (টোটেম)
খ (উপদল (Sub phratries)
ঙ
১ (টোটেম)
২ (টোটেম)
৩ (টোটেম)
চ
৪ (টোটেম)
৫ (টোটেম)
৬ (টোটেম)
বারোটি টোটেমদলকে চারটি উপদল এবং দুটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। সব ভাগগুলি বহির্বিবাহশ্রয়ী(৬)। ‘গ’-উপদলটি ‘ঙ’-উপদলের সঙ্গে এবং ‘ঘ’-উপদলটি ‘চ’-উপদলের সঙ্গে বিবাহাশ্রয়ী হতে পারে। এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা খুবই স্পষ্ট। বিবাহ ব্যাপার পছন্দ-অপছন্দের উপর এবং যৌন-স্বাধীনতার উপর আরো একদফা অনুশাসন চাপিয়ে দেওয়া হয়। যদি মাত্র বারোটি টোটেমদল থাকত এবং যদি ধরে নেওয়া যে প্রত্যেক দল একই সংখ্যক ব্যক্তি বর্তমান তাহলে কোনো দলের প্রত্যেক পুরুষের পক্ষে ১১/১২ জন স্ত্রীলোককে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু দুটো প্রধান দল থাকার জন্য এই সম্ভবনা কমে গিয়ে ৬/২ বা ১/২ হয়ে যাচ্ছে। ‘ত’ টোটেমের কোনো পুরুষ কেবল মাত্র ‘১’ থেকে ‘৬’ টোটেমের নারীকে বিয়ে করতে পারে। উপদলগুলি থাকার জন্যে এই সম্ভাবনা ৩/১২ বা ১/৪-এ নেমে যায়। ‘ত’ টোটেমের কোনো পুরুষ বিবাহের জন্য কেবলমাত্র ৪ থেকে ৬ টোটেমদলের নারীদের মধ্যে তার পছন্দকে আবদ্ধ রাখতে বাধ্য।
বিবাহ ব্যবস্থার জন্য কোনো কোনো জাতির মধ্যে আটটি পর্যন্ত শ্রেণীবিভাগ দেখতে পাওয়া যায়। এই শ্রেণীর মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কের ব্যাখ্যা মোটেই পরিস্ফুট নয়। কেবলমাত্র দেখা যায় যে, এই ব্যবস্থা টোটেমীয় বহির্বিবাহের মতোই এক উদ্দেশ্য সাধনে সচেষ্ট; এমনকি তার চেয়েও বেশি তৎপর বলা যেতে পারে। টোটেমীয় বহির্বিবাহ-ব্যবস্থাকে একটি পবিত্র আইনের তুল্য মনে হয়—যদিও কেউ জানে না কবে এই ব্যবস্থা, বিশেষ প্রথায় এসে পৌঁছেছে।
কিন্তু বিবাহ-শ্রেণীর গোলমেলে অনুশাসনগুলি তাদের উপশ্রেণীর শর্তাবলী সমেত মনে হয় যেন কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আইন হয়ে দাঁড়িয়েছে। টোটেমের দৃঢ়তা কমে যাওয়ার জন্য মনে হয় তারা আবার নূতন করে অজাচার-নিষেধের কাজ গ্রহণ করেছে। এবং আমরা এও জানি যে, টোটেম যখন জাতির অসমাপ্ত সামাজিক কর্তব্য ও নৈতিক অনুশাসনের মূল ভিত্তি, তখন বিবাহ-নির্বাচন ব্যাপারটা একবার নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেলে শ্রেণীবিভাগের গুরুত্ব সাধারণত আর থাকে না। কেননা বিবাহ ব্যাপারটাকে নিয়ন্ত্রিত করাই এই শ্রেণীবিভাগে ছিল প্রধান উদ্দেশ্য।
বিবাহ ব্যবস্থার শ্রেণীবিভাগের আরও উন্নত পর্যায়ে দেখা যায় যে, সেখানে যেন স্বাভাবিক এবং দলীয় অজাচার-নিষেধের গণ্ডির বাইরে যাওয়ার ঝোঁক রয়েছে। এবং ক্যাথলিক ধর্মে যেমন ভাই-বোনের বিবাহের নিষিদ্ধতার সীমা জ্ঞাতি ভাই-বোনের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হয়েছে এবং তাদের জন্য আধ্যাত্মিক জাতি-সম্পর্কের স্তর আবিষ্কৃত হয়েছে, তেমনি এই ব্যবস্থাতেও আরো দূর সম্পর্কের জ্ঞাতিদের মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ করার চেষ্টা আছে(৭)।
বিবাহ-শ্রেণীর উদ্ভব ও বৈশিষ্ট্য এবং তার সঙ্গে টোটেম প্রথার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বিষয়টি খুবই জটিল মনে হবে এবং শেষ পর্যন্ত কোনো মীমাংসা হবে না। সুতরাং সে আলোচনার মধ্যে দিয়ে কোনো লাভ নেই। অস্ট্রেলিয়াবাসীরা ও আদি জাতিরা অজাচার নিবারণে যে কী পরিমাণ কৃতযত্ন হয়েছে কেবল সেইটুকু দেখালেই আমাদের আলোচনার পক্ষে যথষ্ট হবে।(৮) এই অসভ্য জাতিরা যে অজাচার বিষয়ে আমাদের চেয়েও অধিকরত সুবেদী, সে-কথা বেশ জোর দিয়েই বলা চলে। তাদের লোভপরবশতা আমাদের চেয়ে বেশি, এবং সেইজন্যই তাদের পক্ষে অজাচার শাসনের ব্যবস্থা ব্যাপকতর হওয়া প্রয়োজন।
যে সমস্ত বিধিব্যবস্থার কথা পূর্ব উল্লেখ করা হয়েছে কেবল সেইগুলির উপর নির্ভর করেই এদের অজাচার ভীতি ক্ষান্ত হয় না। মনে হয় উল্লিখিত ব্যবস্থাগুলি কেবল দলগত অজাচারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমরা যাদের নিকট-আত্মীয় বলি, তাদের সঙ্গে ব্যক্তির ব্যবহারের নীতি নির্ধারণ করে এমন কতকগুলি প্রথা বা বিধিনিষেধো এর সঙ্গে উল্লেখযোগ্য। এই প্রথাগুলির উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট এবং এগুলি ধর্মীয় নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয়। নিকট-আত্মীয় বা আত্মীয়ার নৈকট্য পরিহার করাই এই সব বিধিনিষেধের উদ্দেশ্য। এই বিধি-নিষেধগুলি অস্ট্রেলিয়ার টোটেম জাতির বাইরে বহু দূর দেশেও সুপরিচিত। অবশ্য বলে রাখা দরকার যে, এবিষয়ে যে প্রভূত উপাদান সংগ্রহ করা হয়েছে তার কিয়ংদশ মাত্র এক্ষেত্রে পরিবেশন করা যাবে।
মেলানেশিয়ার ছেলেদের পক্ষে মা ও বোনের সান্নিধ্য সময় ও ক্ষেত্রবিশেষে নিষিদ্ধ। যেমন, নিউ হেব্রাইডস-এর লেপারস্ দ্বীপে ছেলে একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর মা’র বাড়ি ছেড়ে সরাইখানাতে (clubohouse) চলে যায়। সেইখানেই সে নিয়মিত আহারাদি করে ও নিদ্রা যায়। এর পরেও সে বাড়ীতে আসতে পারে এবং খেতে চাইতে পারে, তবে তার বোন যদি বাড়ীতে থাকে তাহলে না-খেয়েই তাকে ফিরে যেতে হবে। আর বোন যদি বাড়ির ধারে পাশে না থাকে তাহলে সে দোরগড়ায় বসে খেতে পারে। যদি ভাইবোনে হঠাৎ কোথাও দেখা হয়ে যায় তাহলে বোন দৌড়ে পালাবে, কিংবা ঘুরে দাঁড়াবেন ও নিজেকে লুকিয়া ফেলবে। যদি ভাই বোনের পদচিহ্ন কোথাও চিনতে পারে তাহলে সে-চিহ্ন সে অনুসরণ করবে না। বোনের বেলায়ও ঐ একই নিয়ম। ভাই কখনো বোনের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করবে না; এমন কি চলতি কথার মধ্যে নামের আংশিক শব্দও যাতে উচ্চারণ না-করে ফেলে সে-বিষয়ে অবহিত থাকবে! এই ‘এড়িয়ে চলা’ শুরু হয় বালকের বয়ঃসন্ধি উৎসব হওয়ার পর থেকে এবং এই নিয়ম সারা জীবন কঠোরভাবে পালিত হয়ে থাকে। মা ও ছেলের মধ্যে ব্যবধান বয়ঃবৃদ্ধির অনুপাতে বাড়তে থাকে, এবং এ বিষয়ে মা’র দায়িত্বই বেশি। মা যদি ছেলের জন্য কোনো খাবার জিনিষ নিয়ে আসে তাহলে সে-খাবার সরাসরি ছেলেকে নিজে পরিবেশন না-করে পাত্রটি ছেলের সামনে মাটিতে নামিয়ে দেয়। মা-ছেলের ঘরোয়া সম্পর্কে সম্বোধন না-করে মা ছেলের প্রতি ভদ্রতা-সূচক সম্বোধন ব্যবহার করে। নিউ ক্যালিডোনিয়াতেও এই ধরনের ব্যবস্থা প্রচলিত দেখা যায়। এখান যদি ভাইবোনে কোথাও দেখা হয়, বোন দৌড়ে বনের মধ্যে পালিয়ে যায়, আর ভাই বোনের দিকে ঘাড়টি না-বেকিয়া সোজা এগিয়ে বলে চলে যায়(৯)।
নিউ ব্রিটেনের গেজেলি উপদ্বীপে বোনেরা বিয়ের শুরু থেকে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বন্ধ করে দেয়। এমনকি তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করে না। তবে ভাইকে উদ্দেশ করতে হলে নানাভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করে(১০)।
নিউ নেকলেনবার্গে কোনো কোনো জ্ঞাতি ভাইবোনেরা এইরূপ নিষেধাবলির শাসনে এসে পড়ে। ভাইবোনের পক্ষেও অবশ্য ঐ নিষেধ প্রযোজ্য। তারা পরস্পরের কাছে এগিয়ে হাত মেলাতে পারে না। একে অন্যকে উপহার দিতে পারে না। তবে কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে পরস্পর কথা বলতে পারে। বোনের সঙ্গে অজাচার সম্পর্কের শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড(১১)।
এই নিয়মাবলি ফিজি দ্বীপে বিশেষভাবে কঠোর। সেখানে রক্ত-সম্পর্কের ক্ষেত্র পেরিয়ে শ্রেণীভুক্ত বোনদের ক্ষেত্রেও ঐ নিয়ম চলে থাকে।
আবার এই অসভ্য অধিবাসীদের মধ্যে পবিত্র রতি উৎসবের (orgy) সময় যখন নিষিদ্ধ-সম্পর্কের মধ্যেই আসঙ্গলিপ্সা দেখা যায় তখন সেটা আমাদের কাছে খুবই অস্বাভাবিক মনে হয়; কিন্তু এই দুই পরস্পর-বিরোধী ঘটনার সাহায্যে নিষেধাজ্ঞাগুলির তাৎপর্যই স্পষ্ট হবে(১২)। সুমাত্রা দ্বীপের বাত্তাস জাতির মধ্যে দেখা যায় সকল প্রকার নিকট-সম্পর্কীয়দের মধ্যেই সান্নিধ্য পরিহার করা বিধি। যেমন কোনো বাত্তাবাসীর পক্ষে বোনকে নিয়ে সান্ধ্য-ভোজে যাওয়াটা অত্যন্ত আপত্তিজনক। অন্য লোক উপস্থিত থাকলেও ভাই-বোনের একত্র উপস্থিতিতে ভাই অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করবে। আত্মীয়দের একজন বাড়িতে প্রবেশ করলে অন্যজন বাড়ি থেকে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করবে। বাপের পক্ষে মেয়ের সঙ্গে একা এক গৃহে থাকা এবং মায়ের পক্ষে ছেলের সঙ্গে অনুরূপ অবস্থান অসম্ভব। যে ওলন্দাজ ধর্মযাজক এই সব প্রথা লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি বলেছেন যে, দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই সব প্রথা খুব দৃঢ়মূল। একজন পুরুষ ও একজন নারী একসঙ্গে একাকী থাকলে তারা যে ঘনিষ্টতম দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করবে, এ বিষয়ে এই সকল জাতির মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। অজাচারের পরিণাম যে অশুভ ও সর্বপ্রকাদের সামাজিক পীড়ন এ কথা তারা জানে; সুতরাং এই সব নিষেধাবলির সাহায্যে সর্বপ্রকার প্রলোভন দমন করার ব্যবস্থা করে তারা ভালোই করে বলতে হবে(১৩)।
আফ্রিকা মহাদেশের ভেলাগোয়া উপসাগর অঞ্চলে বারোঙ্গোদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করা হয় শ্যালকজায়া সম্বন্ধে। শ্যালকজায়া যে-কোনো ব্যক্তির পক্ষে মারাত্মক; তাই, যদি কোনো ব্যক্তির সঙ্গে তার শ্যালকজায়ার দেখা হয়ে যায় তা হলে অতি সাবধানতার সংগে তাকে এড়িয়ে চলে। উক্ত ব্যক্তি শ্যালকজায়ার সঙ্গে একই পাত্র থেকে খাবার খেতে সাহস করে না, শ্যালকজায়ার কুটিরে পদার্পন করার সাধ্য তার নেই এবং নিতান্ত ভয়কম্পিত, ভীরু কণ্ঠে সে তার আত্মীয়াকে সম্বোধন করে(১৪)।
ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকার আকাম্বা বা ওয়াকাম্বাদের মধ্যে প্রচলিত একটি বিশেষ বিধি হামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে শুরু করে বিয়ে না-হওয়া পর্যন্ত মেয়ে খুব সাবধানে বাবাকে এড়িয়ে চলে। কোনো পুরুষের সঙ্গে বাগ্দত্তা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মেয়ে যদি পথে তার পিতাকে দেখতে পায় তাহলে নিজেকে লুকিয়ে ফেলবে এবং কখনও পিতার খুব কাছাকাছি বসবার চেষ্টা করবে না। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বাবার সঙ্গে সামাজিক ব্যবহারে আর কোনো বাধা থাকে না(১৫)!
কোনো পুরুষের সঙ্গে তার শাশুড়ীর সামাজিক মেশামেশা বিষয়ে যেসব বিধিনিষেধ আছে সেগুলি সভ্যজাতির কাছে বোধহয় সবচেয়ে বেশি চিত্তাকর্ষক মনে হবে। এরূপ ব্যবস্থা অতীব কঠোর এবং অনেক জায়গায় প্রচলিত দেখা যায়। অস্ট্রেলিয়াতে এ ব্যবস্থা খুবই চলিত। মেলানেশিয়া, পলিনেশিয়া ও আফ্রিকার নিগ্রো জাতিদের মধ্যে, এবং যেখানে টোটেম প্রথা ও দল-সম্পর্ক ব্যবস্থা পৌঁছেছে, এমনকি কিছু কচিহু তার বাইরেও এরূপ বিধি চালু দেখা যায়। এই সমস্ত জাতিদের মধ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুরূপ বিধিনিষেধ পুত্রবধু এবং শ্বশুরের মধ্যে নির্দোষ সামাজিক ব্যবহারের বিরুদ্ধেও দেখা যায়। কিন্তু এগুলি তত গুরুত্বপূর্ণও নয়, স্থায়ীও নয়। কয়েকটি ক্ষেত্রে শ্বশুর ও শাশুড়ী উভয়কেই এড়িয়ে চলার নিয়ম আছে। আমরা বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর সম্প্রসারণের চেয়ে শাশুড়ীকে এড়িয়ে চলার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য কী, সেই বিষয়ে বেশি কৌতূহলী। অতএব এখানেও আমি কয়েকটি মাত্র উদাহরণের মধ্যে আমার বক্তব্য আবদ্ধ রাখব।
ব্যাঙ্কস্ দ্বীপে এই সব বিধি নিষেধ খুবই কঠোর ও পীড়াদায়কভাবেই ত্রুটিশূন্য। এখানে জামাতা ও শাশুড়ী উভয়েই পরস্পরকে এড়িয়ে চলে। যদি তাদের পরস্পরের সংগে পথে দেখা হয়ে যায় তা হলে শাশুড়ী জামাইয়ের দিকে পিছন ফিরে সরে দাঁড়ায়। জামাইও এরূপ না-করা পর্যন্ত বা চলে না-যাওয়া পর্যন্ত শাশুড়ী ঐভাবে দাঁড়িয়ে থাকে।
ভ্যানা লাভাতে (Port Patterson) সমুদ্রতীরে চলার সময় যতক্ষণ না শাশুড়ীরে পদচিহ্ন ঢেউ এসে মুছে দিয়ে যায় ততক্ষণ জামাই শাশুড়ীর অনুগমন করবে না। তবে তারা, দূর থেকে কথাবার্তা বলতে পারে। একে যে অন্যের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করবে না, সে-কথা বলাই বাহুল্য(১৬)।
সোলেমন দ্বীপে বিয়ের সময় থেকেই জামাই শাশুড়ীর সঙ্গে সাক্ষাৎ বা বাক্যালাপ করবে না। যদি শাশুড়ীকে পথে দেখতে পায় তাহলে সে যেন তাকে চেনে না। এমন ভাব দেখাবে এবং নিজেকে লুকিয়ে ফেলার জন্য সাধ্যমত দৌড় দেবে(১৭)।
জুলু কাফিরদের মধ্যে প্রচলিত প্রথা আছে যে শাশুড়ীর উপস্থিতিতে জামাই লজ্জিত হবে এবং তার সান্নিধ্য এড়িয়ে চলার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। যে কুঁড়েঘরে শাশুড়ী আছে সেই ঘরে জামাই ঢুকবে না। যদি তাদের পরস্পরের সঙ্গে দেখা হয় তা হলে শাশুড়ী পাশে সরে যায়, সম্ভবত ঝোপের মধ্যে লুকোবার জন্য; এবং জামাই তার ঢালটি সামনে ধরে নিজের মুখটি আড়াল করে। যদি এড়িয়ে চলার উপায় না-থাকে, তা হলে স্ত্রীলোকটি নিয়ম রক্ষার খাতিরে একগোছা ঘাস মাথার চারধারে বেঁধে নেয়। তাদের মধ্যে যদি কোনো কথাবার্তা হয় তবে সেটা কোনো তৃতীয় ব্যক্তির মারফত, নতুবা কোনো প্রতিবন্ধক, যেমন গরু-বাছুর আটকানোর বেড়া ইত্যাদি মাঝখানে রেখে দূরে দাঁড়িয়ে পরস্পরের উদ্দেশে চিৎকার করে। একে অপরের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারে না(১৮)।
নীল নদের উৎস অঞ্চলে নিগ্রো জাতির এক শাখা বোসোগাদের বাস। এখানে কোনো লোকের শাশুড়ী যদি অন্য ঘরে থাকে এবং তাকে দেখা না-যায় তাহলে লোকটি (জামাই) তার সঙ্গে কথা বলতে পারে। এই জাতি অজাচারিতাকে এত ঘৃণার চোখে যে, এমনকি গৃহপালিত পশুদের মধ্যেও এরূপ ঘটলে বিনা শাস্তিতে ছেড়ে দেয় না(১৯)।
এরূপ নিষেধাবলির অর্থ ও উদ্দেশ্য যে নিকট-আত্মীয়দের মধ্যে অজাচারিতার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচের ব্যবস্থা, এই ব্যাখ্যা সকলেই দিয়েছেন। কিন্তু শাশুড়ীর সঙ্গে জামাতার ব্যবহার বিষয়ে নিষেধাবলির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ভিন্ন। কেন যে এই সব জাতিরা একজন পুরুষের পক্ষে মায়ের বয়সী শাশুড়ী সম্বন্ধে এত বেশি রিরংসার ভয় পোষণ করে তা আমাদের পক্ষে বোঝা শক্ত(২০)।
একই আপত্তি ওঠে ফিশ্ন সাহেবের মতের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন যে, কোনো কোনো দল-বিবাহ পদ্ধতির মধ্যে কিছু কিছু ফাঁক দেখা যায়। যেমন, কোনোপুরুষের সঙ্গে তার শাশুড়ীর বিবাহের সম্ভাবনা একেবারে অচিন্ত্যনীয় নয়; তাই বাস্তবক্ষেত্রে এইরূপ সম্ভাবনা বিদূরিত করার জন্য বিশেষ নিষেধ-বিধির দরকার হয়েছে।
জামাতার প্রতি শাশুড়ির ব্যবহারের যে-বর্ণনা ইতিপূর্বে দেওয়া হয়েছে, স্যার জে. লাবক তাঁর ‘সভ্যতার উদ্ভব’ (The Origin of Civilization) গ্রন্থে তার উৎস খুঁজে পেয়েছেন প্রাচীনকালের ‘হরন-বিবাহ’ রীতির মধ্যে। তাঁর কথায়, ‘যতদিন পর্যন্ত প্রকৃতই মেয়েদের হরণ করে বিয়ে করা হত, ততদিন (হরণকারীর প্রতি) মেয়েদের বাপ-মায়ের ক্রোধও সম্ভবত বেশ প্রবল ছিল। পরে যখন এই ধরনের বিবাহ আর ঘটত না, আনুষ্ঠানিকভাবে তার কতকগুলি প্রতীকমাত্র পড়ে রইল, তখন বাপ-মায়ের ক্রোধও প্রতীকস্বরূপ হয়ে তাঁদের ব্যবহারের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পেতে লাগল। ক্রমে ক্রমে এই ক্রোধের উৎপত্তি কোথায় সেটা ভুলে গেলেও জামাতাকে পরিহার করার প্রথাটা চালু রইল।’ এই বিচার-সাপেক্ষে ব্যাখায় যে পূর্ববর্ণিত আচার-ব্যবহারের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলি বুঝতে কত অল্পই সাহায্য করে, ক্রলি সাহেব কিন্তু তা অনায়াসেই দেখিয়েছেন।
ঈ. বি. টেইলর মনে করেন, জামাইয়ের প্রতি শাশুড়ীর যে ব্যবহার, সেটা শাশুড়ীর সংসার থেকে জামাইকে একরকম ‘ছেঁটে ফেলা’ ছাড়া আর কিছুই নয়। জামাই একজন অপরিচিত ব্যক্তির শামিল। এবং যতদিন না মেয়ে-জামাইয়ের প্রথম সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হয় ততদিন জামাইয়ের প্রতি এই মনোভাবই বর্তমান থাকে। শেষের এই শর্ত পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও (অর্থাৎ সন্তান হওয়ার পরও) যেখানে নিষেধবিধির কোনো পরিবর্তন হয় না সেই সব উদাহরণ ছেড়ে দিলেও, এই ব্যাখ্যা সম্বন্ধে আপত্তি থেকে যায়। এই ব্যাখ্যা জামাতা ও শাশুড়ীর মধ্যে পারস্পরিক ব্যবহারগত যে-প্রথার উল্লেখ করা হয়েছে তা বুঝতে সাহায্য করে না : বরং এতে যৌন প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তা ছাড়া নিকট আত্মীয়কে পরিহার করার রীতির ভিতর দিয়ে যে একটা পবিত্র ঘৃণার ভাব প্রকাশ পায়, এই ব্যাখ্যার সে ব্যাপারটিকে মোটেই গণ্য করা হয়নি(২১)।
একজন জুলু স্ত্রীলোককে তাদের এই নিষেধবিধির কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে খুব সলজ্জ ও বিব্রত ভাবে বলে, ‘যে স্তন একদিন তার স্ত্রীকে পুষ্টিদান করেছে সেটা তার (জামাতার) দৃষ্টিগোচর হোক এটা ঠিক নয়(২২)।
সভ্য জাতিদের মধ্যেও জামাতা-শাশুড়ীর সম্পর্ক যে, পরিবার ব্যবস্থার মধ্যে কঠিন সমস্যাগুলির অন্যতম, এ কথা সর্বজনবিদিত। ইওরোপ ও আমেরিকার শ্বেতজাতি সমাজে পরিবারবিধির চলন আর নেই। তবুও উক্ত প্রথাটি টিকে থাকলে হয়তো বহুলাংশে পারিবারিক বিবাদ ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি হত না; এবং তার ফলে ব্যক্তিগতভাবে প্রথাটির পুনঃপ্রবর্তন করতে হত না। দুই নিকট-সম্পর্কের ব্যক্তির মধ্যে ঘনিষ্টতা নিষিদ্ধ করে বর্বর জাতিরা যে বিধির প্রবর্তন করেছে তার মধ্যে বহু ইওরোপবাসী প্রাজ্ঞ মনেরই পরিচয় পাবেন। শাশুড়ী ও জামাতার সম্পর্কের মধ্যে যে এমন কিছু আছে, যা দুইটি ব্যক্তির মধ্যে বিরোধ ও সংঘাতকে তীব্রতর করে তোলে এবং ফলে উভয়ের পক্ষে একত্রে বাস করা অসম্ভব হয়ে ওঠে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। সভ্য জাতিদের মধ্যে যে ধরনের রসালাপ শোনা যায় তার মধ্যে শাশুড়ী-সংক্রান্ত রসিকতার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ লক্ষ করার মতো। এতদৃষ্টে আমার মনে হয় যে, শ্বশ্রু-জামাতা সম্পর্কে যে প্রক্ষোভটি কাজ করে তার প্রকৃতি নির্ধারণ করে কতকগুলি পরস্পরবিরোধী উপাদান। অর্থাৎ আমার মতে, শ্বশ্রু-জামাতা সম্পর্কে উভয়বলতা (ambibvalence) বিদ্যমান; ভালোবাসা ও বৈরিতা এই দুই পরস্পরবিরোধী অনুভূতি সেখানে কাজ করে।
এই অনুভূতিগুলির কিয়দংশ খুব প্রকট। শাশুড়ী তার মেয়ের উপর নিজের অধিকার ত্যাগ করতে চায় না। যে অপরিচিত ব্যক্তির হাতে তার মেয়েকে সম্পর্পণ করা হয়েছে তাকে সে সন্দেহের চোখে দেখে; স্বগৃহে তার যে কর্তৃত্ব ছিল সেটি সে বজায় রাখতে চায়। অপরপক্ষে জামাইও চায় না কোন বাইরের লোকের প্রভূত্ব স্বীকার করতে। বিবাহের পূর্বে যারা তার স্ত্রীর প্রীতিভাজন ছিল, তাদের প্রতি সে বজায় রাখতে চায়। অপরপক্ষে জামাইও চায় না কোনো বাইরের লোকের প্রভূত্ব স্বীকার করতে। বিবাহের পূর্বে যারা তার স্ত্রীর প্রীতিভাজন ছিল, তাদের প্রতি সে ঈর্ষাপরায়ণ। পরিশেষে—এই ব্যাপারটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়—সে কল্পনায় তার স্ত্রীর মোহিনীশক্তিকে স্বভাবতই অতিরঞ্জিত করে এবং তার সেই কল্পনায় ব্যাঘাত ঘটলে সে বিরক্ত হয়। সাধারণত তার মধুর কল্পনার প্রতি এই আঘাত বিষয়েই সাদৃশ্য থাকে; কিন্তু শাশুড়ী বিগতযৌবনা, তার তো নেই সেই দেহ-লাবণ্য, সেই মানসিক স্বতঃবৃত্তি, যার দরুন তার স্ত্রী তার কাছে মহামূল্য সম্পদ বলে মনে হয়। বিগত-যৌবনশ্রী শাশুড়ীর মধ্যে তার রূপলাবণ্যময়ী স্ত্রীর পরিণতি লক্ষ করে সে পীড়িত বোধ করে।
মনঃসমীক্ষণী অনুসন্ধানের ফলে ব্যক্তি-মনের গভীরে নিহিত মানস-অনুভূতিগুলি সম্বন্ধে আমরা যা জানতে পেরেছি তাতে উল্লিখিত প্রেষণাগুলির সঙ্গে আরও কতকগুলি যুক্ত করা যেতে পারে। মেয়েদের কামজ-মানস (psycho-sexual) চাহিদাগুলি বিবাহ-বন্ধন ও পরিবারজীবনের মধ্যেই তৃপ্ত হবার কথা; কিন্তু দাম্পত্য জীবনের অকাল পরিণতি ঘটলে এবং স্ত্রীর প্রক্ষোভজীবন বৈচিত্র্যহীন হয়ে উঠলে অসন্তোষ আসতে পারে। এরূপ বিপদের সম্ভাবনা সব সময়েই আছে। যিনি সন্তানের জননী, বার্ধক্যের সীমায় এসে তিনি এই বিপদ এড়িয়ে যান পুত্র-কন্যার জীবনের মধ্যে দিয়ে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করে, তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে, তাদের প্রক্ষোভজ অভিজ্ঞতাগুলিকে আপন করে নিয়ে। বাপ-মায়েরা নাকি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এসে তাদের সমবয়সী হয়ে যান। বস্তুত সন্তান থাকার দরুন বাপ-মায়ের মানসিক যে সকল সুবিধা ঘটে, এটি তাদের অন্যতম। নিঃসন্তান হবার দুর্ভাগ্য এই যে বিবাহিত জীবনের অসন্তোষ ও ক্লান্তিকে সহনীয় করে তোলার প্রকৃষ্টতম কোনো উপায় থাকে না। অনায়াসেই মেয়ের সঙ্গে মায়ের এতখানি প্রক্ষোভজ একাত্ম ঘটা সম্ভব যে তিনি মেয়ের প্রেমাস্পদের সঙ্গেই প্রেমে পড়ে যেতে পারেন। এবং তাঁর ঐ প্রক্ষোভজ প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড মানসিক প্রতিরোধের দরুন চরম ক্ষেত্রে তাঁর কঠিন উদ্বায়ু রোগ হতে পারে। শাশুড়ীর মনের এই ধরনের মোহপ্রবণতা অনেক ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়, এবং হয় এই মোহটি স্বয়ং, নয় তো এর প্রতিরোধ কারী প্রতিপ্রবণতা, শাশুড়ীর মনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রক্ষোভশক্তিসমূহের সঙ্গে যুক্ত হয়। প্রায়শ তাঁর মনের প্রেম প্রক্ষোভোর অন্তর্গত এই কঠোর ও ধর্ষকামী উপাদানটিই তাঁর নিষিদ্ধ অনুরাগকে বিরুদ্ধ করতে গিয়ে জামাতার বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়।
শাশুড়ীর সঙ্গে জামাইয়ের যে-সম্পর্ক সেটাও জটিল হয়ে ওঠে শাশুড়ীর প্রতি জামাইয়ের অনুরূপ অনুভূতির দরুন, যদিও এই অনুভূতিগুলির উৎস অন্যত্র। কোনোও ব্যক্তির পক্ষে তার প্রেমপাত্র নির্বাচনের ব্যাপারে তার মা এবং সম্ভবত তার বোনের প্রতিরূপ প্রভাবিত করে। এই দুজনই তার শৈশবের প্রেমাস্পদ, কিন্তু অজাচারঘটিত বাধা থাকার দরুন এই দুজনের প্রতি তার স্বাভাবিক আকর্ষণ,পথভ্রংশ হয়, ব্যক্তি তাদের প্রতিরূপ খুঁজে পায় অপরিচিত পাত্রের মধ্যে। তখন সে তার শাশুড়ীকেই তার নিজের মা এবং তার বোনের মা’র আসনে দেখতে পায়। অতঃপর তার মন পাত্র নির্বাচনের আদি অবস্থায় ফিরে যেতে চায়, কিন্তু প্রবণতার বিরুদ্ধে তার মনের সমস্ত শক্তি কাজ করে। অজাচার-ভীতির দরুন সে প্রেমপাত্র নির্বাচনের আদিপর্বটা স্মরণে আনতে চায় না। শাশুড়ীকে সে যথাযথ দেখতে পায়, এবং শাশুড়ীকে যেহেতু সে জীবনভর মায়ের মতো দেখেনি, তার নির্জ্ঞান মনে তাঁর ছবি মায়ের মতো অবিকল থাকে না। ফলে শাশুড়ীকে প্রেমাস্পদেয় আসন থেকে বাতিল করা সহজতর হয়। এর সঙ্গে যখন জামাইয়ের মধ্যে উত্যক্ততা ও বৈরিতার অনুভূতি লক্ষ করা যায় তখন সন্দেহ হয় যে তার মনে শাশুড়ীর প্রতি অজাচার-প্রবণতা বর্তমান। শাশুড়ীর মেয়ের (স্ত্রী) প্রতি আকর্ষণ জন্মাবার আগেই যে, পুরুষ শাশুড়ীর প্রেমে পড়ে থাকে এমন দৃষ্টান্ত তো বিরল নয়।
অজাচারীয় ব্যাপারই যে বর্বর সমাজে জামাতা ও শাশুড়ীকে পরস্পরের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে প্রেষিত করে, এই অঙ্গীকারে (assumption) কোনো আপত্তি দেখি না। যে পরিহার-প্রথা এই আদিম জাতিরা নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলে, তার যতরকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে সেগুলির মধ্যে যে মতটি সর্বপ্রথম ফিশ্ন সাহেব প্রকাশ করেন সেটিকেই আমরা সর্বাপেক্ষা সমীচীন বলে মনে করি। তাঁর মতে এই পরিহারবিধি সম্ভাব্য অজাচার নিবারণের উপায় মাত্র। যারা পরস্পর রক্তের সম্পর্কে বা বৈবাহিক সম্পর্কে আত্মীয়, তাদের মধ্যে যাবতীয় পরিহার রীতির ব্যাখ্যাতেই এই মত খাটে। কেবল একটি মাত্র পার্থক্য দেখা যায়। যেমন, প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে সরাসরি অজাচারের সম্ভাবনা থাকায় অজাচার নিবারণের উদ্দেশ্য সংজ্ঞান মনে থাকা সম্ভব। এবং অপরক্ষেত্রে, অর্থাৎ যেখানে শাশুড়ী-সম্পর্ক বিজড়িত, সেখানে অজাচারপ্রবণতা নির্জ্ঞান মনে নিহিত অন্তর্বর্তী যোগসূত্রঘটিত মনঃসৃষ্টি (phantasy) মাত্র।
মনঃসমীক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলে লোকমনোবিদ্যার (Folk-Psychology) ক্ষেত্রে যে এক নতুন আলোকসম্পাত হয়, এই আলোচনায় সে-কথা বলার সুযোগ আমাদের হয়নি। কারণ বর্বরের অজাচার-ভীতি বহুকাল ধরে এই রকমই চলে আসছে। এবং নূতন ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই! অজাচার ভীতিকে ঠিক মতো বুঝতে হলে আমরা অতিরিক্ত যেটুকু বলতে পারি তা এই যে, এটি এক সূক্ষ্ম অপোগণ্ডীয় (infantile) প্রলক্ষণ (trait) এবং উদ্বায়ু রোগীর মানসজীবনের সঙ্গে এর আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। মনঃসমীক্ষণের সাহায্যে আমরা শিখেছি যে শিশুর প্রথম ভালোবাসার পাত্র নির্বাচন হচ্ছে অজাচারীয়। মা বা বোন জাতীয় নিষিদ্ধ পাত্রে তার ভালোবাসা ধাবিত হয়। আমরা আরও শিখেছি যে কি কি উপায়ে পরিণত ব্যক্তি অজাচারীয় আকর্ষণ থেকে নিজেকে মুক্ত করে। উদ্বায়ু রোগীর মধ্যে অবশ্য আমরা পুরোপুরি এক ধরনের মানসিক অপোগণ্ডতা দেখতে পাই। দেখা যায়, হয় সে শিশুসুলভ মানস-কামিতা (psycho-sexuality) থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি, নয়তো সে ঐ অবস্থায় ফিরে গেছে [মনের বর্ধন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে (inhibited development) কিংবা প্রত্যাবৃত্তি (regression) ঘটেছে]। সে-কারণে অজাচারীয় কামজ সংবন্ধন (fixation) তার নির্জ্ঞান মনে তদবধি কিংবা নূতন করে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ। আমরা এতদূর পর্যন্ত জোর করে বলতে পারি যে, মাতাপিতার প্রতি সন্তানের অজাচার-বাসনাতাড়িত যে সম্পর্ক, সেটাই উদ্বায়ুর প্রধান গূঢ়ৈষা (complex) উদ্বায়ু-প্রসঙ্গে অজাচারিতার যে-তাৎপর্য পাওয়া গেছে তা স্বাভাবিক (noromal) বয়ঃপ্রাপ্ত লোকের পক্ষে সাধারণত অবিশ্বাস্য। অটো র্যাঙ্ক (Otto Rank) যেসব গবেষণা করেছেন সেগুলিও সাধারণত বাতিল করা হয়ে থাকে। অজাচার বিষয়টি কত বিভিন্ন ও বিকৃত্রূপে কাব্যের প্রধান উপজীব্য হয়ে আছে, অটো র্যাঙ্ক-এর গবেষণাগুলি তা আরও বিশদভাবে দেখিয়েছে। এর থেকে আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হই যে, মনঃসমীক্ষণলব্ধ অজাচার বিষয়ক এই জ্ঞান অস্বীকার করার কারণ প্রথম জীবনে অজাচার ইচ্ছাগুলির—সেগুলি পরে অবদমিত হয়—প্রতি মানুষের গভীর বিতৃষ্ণা। মানুষের যে অজাচার-ইচ্ছাগুলি নির্জ্ঞান মনে চলে যেতে বাধ্য, সেগুলি যে বর্বরেরা আজও খুব সাংঘাতিক বলে মনে করে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করে এটা দেখানো আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।