রাতের অন্ধকার এবং প্রচন্ড বৃষ্টিপাতের সময় কদাচিৎ সমুদ্র দেখা যায় । চালকদের মদ্যপ অবস্থায় থাকার জন্য গাড়ি অনিয়ন্ত্রিতভাবে রাস্তার এদিক-ওদিক চলে । হরহামেশা দূর্ঘটনা ঘটে এবং পুলিশ সবসময় দেরি করে আসে । ঘটনাস্থলের চারপাশে ভীড় করে থাকা উৎসুক জনতাকে পুলিশ সেই একই কথা জিজ্ঞেস করে: ‘চালক কী মদ্যপ ছিল ?’ ঘটনাস্থলে আসতে পুলিশের চেয়েও অ্যাম্বুলেন্সের বেশি দেরি হয় । একসময় জনতা নিজেদের গন্তব্যের দিকে পা বাড়ায় । কখনো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার মাঝে কোন এক কৌতূহলী লোককে পুলিশ লাথি এবং কিল-ঘুষি দিয়ে আহত করে কিংবা জীপের পেছনে তুলে নিয়ে যায় । কিন্তু উৎকোচ দিলে পুলিশ তাকে রাস্তার মাঝখানে ফেলে রেখে চলে যায় ।
সমুদ্রের প্রচন্ড গর্জন শোনা যায়, তবে বজ্রপাতের শব্দ তার চেয়েও বিকট । উপরন্তু পানশালা এবং হোটেলের পাশে থেমে থাকা গাড়ির ছাদের উপর বৃষ্টির আওয়াজ আরেকটু বাড়তি শব্দ সৃষ্টি করে ।
‘ওকলাহামা’ নৈশক্লাব থেকে সঙ্গীতের মূর্চ্ছণা ভেসে আসে । নৈশক্লাবের কাছাকাছি রয়েছে পানশালা । সেখানে দলে দলে লোকজন অনবরত আসে এবং যায় । প্রতি রাতে পানশালা থেকে লোকজন হৈচৈ করে বেরিয়ে আসে এবং মাঝেমধ্যে অন্যদলের সঙ্গে মারামারিতে লিপ্ত হয় । কখনো তারা ঘুষাঘুষি করে, আবার কখনো ধারালো ছুরি দিয়ে রক্তপাত ঘটায় । মারামারির শিকার হয়ে কদাচিৎ মহিলার রক্তাক্ত শরীর রাস্তার পাশে পড়ে থাকে । তখন জনতার মধ্যে যাদের সঙ্গে মারামারির কোন সংপৃক্ততা নেই, তারা সেই আহত মহিলার চতুর্দিকে ভীড় জমায় । যখন পুলিশ আসে, তখন অনেকেই চলে যায় । যারা সেখানে থাকে, পুলিশকে তারা ঘটনার কোন প্রামানিক তথ্য দিতে পারে না । তারপর পুলিশের চিরায়ত মন্তব্য, ‘এই হলো বারবনিতার ভাগ্য । রাস্তার পাশে ওদের তেমনই রক্তপাত হয়, যেমন করে ওরা টাকার জন্য পুরুষদের রক্তপাত ঘটায় ।’
এখন গাঢ় অন্ধকারে উত্তাল সমুদ্র উন্মত্ততায় মেতেছে এবং বৃষ্টিপতনের ধারা অনেকটা থিতিয়ে এসেছে ।‘ওকলাহামা’র সরু দরজা পেরিয়ে সুয়াদ তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসে । পিছনে দরজার পাল্লা বন্ধ হওয়ার প্রচন্ড শব্দ শোনা যায় । সুয়াদ কোটের বেল্ট শক্ত করে বাঁধে এবং মাটির বিশাল ফুলদানি ঘেরা ছোট্ট গোলাকার প্লাজার দিকে কিছুটা পথ এগিয়ে যায় । তারপর সাঈদ পানশালা থেকে বেরিয়ে এসে ধোপধুরস্ত পোশাকের দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলে । দারোয়ান তাকে ভালো করে চেনে ।
‘আজ আপনি মাতাল । গাড়ি চালিয়ে যেতে পারবেন ?’ দারোয়ান জিজ্ঞেস করে ।
‘আমি তেমন বেশি পরিমানে মদ্য পান করিনি । বাইরে যে বারবণিতা দাঁড়িয়ে আছে, সেই মহিলা পুরো বোতল হাপিশ করে দিয়েছে । অবশ্যই মহিলা বিল পরিশোধ করবে ।’
‘আপনি কী আজ রাতেও তা-ই করতে চান ? ন্যায়সম্মত কাজ করুন, সাঈদ ।’
‘আমি সারারাত তা-ই করবো । আমি রাজা শাহরিয়ার ।’
বলেই সে হাসতে থাকে এবং একটা দশ দিরহামের নোট নিমরাজি দারোয়ানের হাতে গুঁজে দেয় ।
‘আমরা বন্ধু । অযথা কেন টাকা নষ্ট করছেন ?’ দারোয়ান বললো ।
সুয়াদের দিকে তাকিয়ে সাঈদ অধৈর্য্যের ভাব প্রকাশ করে । ছোট্ট গোলাকার প্লাজার কাছে দাঁড়ানো সুয়াদকে ক্লান্ত দেখায় । সাঈদ হাত বাড়িয়ে সুয়াদের কাঁধের চারপাশে জড়িয়ে ধরে এবং তার দিকে টেনে নেয় ।
‘গাড়ি অই দিকে আছে ।’
‘হুম !’
‘কাছেই ।’
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি ?’
‘তোমার মন যেদিকে যেতে চায় । এখনো অন্য অনেক দোকান খোলা আছে । আজ রাত আমাদের ।’
গাড়িতে উঠেই সুয়াদ হাতব্যাগের ভেতর থেকে সিদ্ধি ভর্তি সিগারেট বের করে এবং আঙুলের ফাঁকে চেপে ধরে ।
‘সাঈদ, সামনে কোথাও গাড়ি থামাও । আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করবো । বেচারী ! আমি নিশ্চিত যে, আজ রাতে নেশা করার মতো তার কাছে কিছু নেই ।’
‘তার কাছে নেই কেন ? করনিচ প্রমিনাডে অনেকই সিদ্ধি বিক্রি করে ।’
‘দুঃখজনক যে, সে যদি সিদ্ধি না পায়, তাহলে মারা যাবে নতুবা আত্মঘাতী হবে । সে আমার কাছের বন্ধু । সৎ পিতা এবং ছেলেবন্ধুকে নিয়ে তার অনেক সমস্যা আছে । তার একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে । কিন্তু সেই ছেলেবন্ধু মেয়েটিকে স্বীকার করে নিতে চায় না । তুমি জানো, সে অনেক ধনী এবং ক্ষমতাশালী পরিবার থেকে এসেছে ?’
‘আমি এসব পরিবারকে চিনি । তোমার মতো নারীরাই তাদের পছন্দ করে ।’
‘আমি ওদের পছন্দ করি না । কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে চাই ।’ সুয়াদ কন্ঠস্বরে খানিকটা অলসতার মাখন লাগিয়ে বললো । সেই সময় সাঈদ মনোরম এবং নান্দনিক ভিলার মাঝ দিয়ে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছিল । বিভিন্ন রঙের বাতি দিয়ে ভিলাগুলোর বাগান সজ্জিত করা হয়েছে । সুয়াদ সিদ্ধি ভরা সিগারেট প্রায় নিমীলিত চোখের কাছে আনে এবং সাঈদকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কী ধূমপান করো ?’
সুয়াদের হাত থেকে সাইদ সিগারেট নিয়ে একটা সুখটান দিয়ে পুনরায় ফিরিয়ে দেয় ।
‘এবং এখন তাহলে তুমি কী বলবে ? আমার বান্ধবী কোথায় ?’ টিপ্পনি কেটে সুয়াদ বললো ।
‘আমি জানি না । হয়তো সে এই দুনিয়ার কোথাও আছে ।’
‘এবং আমরা ? আমরা কোথায় আছি ?’
‘তাদের মাঝে ।’
‘কাদের মাঝে ?’
‘যাদের তুমি ভালোবাসো ।’
‘আমি কাউকেই ভালোবাসি না । আমি আলমূতীকে ভালোবাসতাম । কিন্তু তাকে ছেড়ে এসেছি । কেননা তার কোন টাকা-পয়সা ছিল না । সে আমার টাকা চুরি করে মাদক কিনতো । যদি সে টাকা না পেত, তাহলে উন্মাদ হয়ে যেত এবং আমাকে খুন করার হুমকি-ধামকি দিত । হাই স্কুলে আমরা এক সঙ্গে গিয়েছি, কিন্তু স্কুল থেকে আমাদের বহিস্কার করা হয়েছে । তার বাবা অনেকবার তার মাকে খুন করার চেষ্টা করেছে । তুমি তা জানো । আমি তার বাবাকে চিনি না । কিন্তু আমাকে সে তার বাবার সম্পর্কে বলেছে । কোন সন্দেহ নেই যে, বাবার মতোই ছেলে । আমি যদি তাকে বিয়ে করতাম, তাহলে সে-ও আমাকে খুন করার চেষ্টা করতো । কিন্তু আমি মরতে চাই না । আমি জীবনকে ভালোবাসি ।’
গাড়ির ভেতর জোরে গান বাজছিল এবং গাড়ি বেশ ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল । জানালা বন্ধ । বাইরে বৃষ্টি এবং ঠান্ডা হাওয়া । মনে হচ্ছিল গাড়িটা যেন একটা বন্ধ বাক্স । গাড়ির ভেতর দম আটকে যাওয়ার মতো সিদ্ধির ধোঁয়া এবং পোড়া গন্ধ । কিন্তু সাঈদ জানালা খুলতে নারাজ । এই ফাঁকে একটা বিশাল মোটরসাইকেল তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায় । সাঈদ খানিকটা নড়েচড়ে বসে এবং হাত দিয়ে গাড়ির ভেতরের কাঁচ পরিস্কার করে ।
‘আমার যদি এমন বড় একটা মোটরসাইকেল থাকতো,’ সুয়াদ বললো ।
‘সুতরাং তুমি যখন পাথরের আঘাত পেয়ে আহত হবে, তখন তোমার সামনে রাস্তার উপর সবগুলো গাছ কেটে ফেলবে ।’
‘হা ! হা ! বাড়িয়ে বলো না । যারা অই ধরনের মোটরসাইকেলের মালিক, তারা সবাই সিদ্ধি সেবন করে ।’
তারা আলিশান বাড়ির চোহদ্দি অতিক্রম করে । বৃষ্টির পরে সারা শহর নিস্তব্ধতায় ডুবে গেছে । রাতের বেলা রাস্তার পাশের বাতির আলোয় বৃষ্টির তোড়ে তৈরি কিছু গর্ত আলোকোজ্জ্বল দেখায় । মাঝেমাঝে গাড়ির বাতি নিভিয়ে টহল পুলিশ ধীর গতিতে তাদের অতিক্রম করে যায় এবং রাস্তার পাশে থেমে ভবঘুরে লোকজন খোঁজে । সুয়াদের পড়নে কোট এবং সে উষ্ণতা অনুভব করে । একসময় সে পেছনের দিকে মাথা এলিয়ে দিয়ে শিথিল হয়ে বসে । তার চোখের পাতা বন্ধ । তবে অনেক চেষ্টা করে সে খুলতে পারে । সুয়াদ বিড়বিড় করে এবং সাঈদ বুঝতে পারে যে, আসলে সে কিছু খেতে চায় । সে-ও ক্ষুধা অনুভব করে । সাধারণত: এধরনের রাতে সে কিছু খায় না এবং অনেক সময় পড়নের কাপড়-চোপড় না পাল্টিয়ে এবং জুতা না খুলেই গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় ।
‘তোমার কী ক্ষুধা পেয়েছে ?’ সাঈদ জিজ্ঞেস করে ।
‘হ্যাঁ ।’
‘তাহলে চলো, হারিরা স্যুপ খেতে যাই ।’
‘হারিরা স্যুপ টক এবং আঁশ ভরা । ডালের স্বাদ যেন পাথরের মতো ।’
‘সিদ্ধি তোমার ক্ষুধা বাড়িয়ে দিয়েছে, তাই না ?’
‘হ্যাঁ, একবার তুমি বিশাল পাত্র ভর্তি খুসখুস খেয়েছিলে, যা আমার পক্ষে খাওয়া অসম্ভব ছিল ।’ সুয়াদ হাত দিয়ে পরিমান বোঝায় ।
‘বাড়িয়ে বলো না ।’
‘আমার সম্মানের দিব্যি করে বলছি ।’
‘তোমার কী কোন সম্মান আছে ? তুমি …’ হঠাৎ সাঈদ থেমে যায় ।
‘বলো, থামলে কেন ? কথাটা তোমার মুখ থেকে বের হয়ে আসতে দাও । তোমার অবগতির জন্য বলছি, অইসব আলিশান বাড়ির মেয়েদের তুলনায় আমার সম্মান অনেক বেশি । আমি তাদের চিনি । বহুবার আমরা একসঙ্গে সিদ্ধি সেবন করেছি ।’
‘ঠিক আছে । এ-টা কোন ব্যাপার নয় । সুতরাং তুমি হারিরা খেতে চাও না ?’
‘না, আমি বরং ডিম এবং সস দিয়ে কুফতার বার্গার খাবো । দামে কম এবং সিনসিনাটি বেভারেজের কাছেই টানওয়াজি রেঁস্তোরায় পাওয়া যায় ।’
‘কিন্তু সেখানে ভিড় বেশি । অনেক সময় শেষ রাতের দিকে মাতাল লোকজন নারী ঘটিত মারামারিতে লিপ্ত হয় । তখন সেখানে টহল পুলিশ যায় এবং আইডি দেখে । তোমার সঙ্গে কী আইডি আছে, সুইটহার্ট ।’
‘তুমি কী ভেবেছ আমি অন্য গ্রহ অথবা এধরনের কোন জায়গা থেকে এসেছি ? আমিও মরক্কান এবং অন্যান্যদের মতো আমারও বাবা এবং মা আছেন । সহজে পেয়েছ বলে তুমি কী আমাকে নগণ্য ভাবছো ? আমি যদি তোমাকে অপছন্দ করতাম, তাহলে তোমার সঙ্গে বের হতাম না । তুমি জানো, আমি পুরুষদের ধরন বুঝতে পারি । তুমি কী ভেবেছ, আমি তোমার স্যুট এবং টাই পছন্দ করি ? না, তোমার ভেতরে অন্য কিছু আছে । হয়তো তোমার মধ্যে এমন কিছু আছে, যা তুমি নিজেও জানো না । তুমি জানো, খুব কম মানুষ আছে যারা নিজেদের সম্পর্কে জানে ।’