কয়েকটি অণুগল্প

কয়েকটি অণুগল্প

১😈

মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীর উচ্চ পদস্থ কর্মচারী প্রতুলের সেদিন বেশ দেরী হয়ে গেল রাতে বাড়ি ফিরতে। একে শুক্রবার, সামনের দুদিন উইকএন্ড, তার ওপর আবার পরের সপ্তাহে সোমবার লাল দাগের ক্যালেন্ডার ছুটি ।তাই পুরো টিমের সাথে কাজটা শেষ করতে করতেই এই এতো রাত।

নিজের গাড়ি, নিজেই ড্রাইভ করে ফিরছে, তাই বাড়ি ফেরাটা নিয়ে চিন্তা ছিলো না সেরকম। কিন্তু হঠাৎ মাঝরাস্তায় গাড়িটা কাঁপতে কাঁপতে ইঞ্জিন বন্ধ। অসময়ে অকারণে গাড়ির এই ছ্যাবলামো মোটেই ভালো লাগলো না প্রতুলের, দিনের শেষে ক্লান্তি তাকে আরো ঝিমিয়ে দিচ্ছিলো যেন প্রতি মুহূর্তে। মাঝরাস্তায় বন্ধ গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই অসম্ভব ঠান্ডা অনুভব করে প্রতুল। বছরের এই সময়ে শহরের আবহাওয়ার এই পরিবর্তন প্রতুলকে অবাক করে। বাড়িতে ফোন করে জানাবার জন্য মোবাইল বের করে দেখে টাওয়ার নেই, টেম্পারেচারের সংখ্যার আগে একটা মাইনাস চিহ্ন দেখা যাচ্ছে… মাইনাস ৩ ডিগ্রি!!!!

স্ট্রীট লাইট গুলো পরপর ধুপ ধুপ করে নিভে গেলো একসাথে, পুরো রাস্তাটা মুহুর্তে অচেনা হয়ে গেল প্রতুলের কাছে। এতো প্রতিদিনের যাতায়াতের পথটা নয়!!!! কাঁপতে কাঁপতে গাড়ির ভেতরে বসলো প্রতুল, ঠান্ডায় চামড়ায় অস্বাভাবিক টান ধরছে। হাতের তালু ঘসে গরম করার বৃথা চেষ্টা চালাতে লাগলো প্রতুল। গাড়িটাকে অনেকবার স্টার্ট দিতে চেষ্টা করলো ঠান্ডায় কেঁপে ওঠা শরীর নিয়ে, কিন্তু ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই হয় না। জানলার কাচে হালকা সাদা আস্তরণ পড়তে থাকে ধীরে, ঝাপসা হয়ে আসে গাড়ির বাইরের পুরোটা…..

অন্যদিকে একজন প্রতুলের টাটকা ‘ভুডু পুতুলটা’ ফ্রিজারে রেখে তাপমাত্রা আরেক দাগ কমিয়ে দিলো……

২😈

কাগজ গুলোয় কালো প্যাস্টেল রঙটা নিয়ে তখনও ঘসঘস করে এলোমেলো ভাবে ঘসে যাচ্ছিল বছর পাঁচেকের নিম্মি। এখনও কথা বলতে পারেনা নিম্মি, আই কনট্যাক্ট ভীষণ পুওর, পড়াশোনা তো দূর অস্ত, একটুও মনোযোগ করতে পারেনা কিছুতেই। ডাক্তার সাসপেক্ট করছে অটিজম্।

আজকে চেম্বারে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না নিয়েই ওকে নিয়ে চলে আসায় ডাক্তার বাসু একটু ক্ষুব্ধ হন ওর মা বাবার উপর। সব পেশেন্ট চলে যাবার পর নাম ডাকা হয় নিম্মির। এই সারাটা সময় রিশেপসন থেকে কালার পেন্সিল আর অনেকগুলো সাদা কাগজ দেওয়া হয়েছিলো ওকে, ব্যস্ত রাখতে।

সামান্য অ আ শেখা বা না শেখা শিশু নিম্মি একটার পর একটা পাতা ওল্টাচ্ছে আর হিজিবিজি করে কালো রঙে ভরিয়ে দিচ্ছে পাতার পর পাতা। শান্ত স্বরে ডাক্তার নিম্মির সাথে হালকা কথাবার্তা শুরু করলেন। জবাব যদিও তিনি আশা করছিলেন না। হঠাৎ নিম্মি থেমে গেল, যখন ডাক্তার বাসু প্রশ্ন করলেন, ‘কেন কালো রঙ করছো তুমি সবকিছু , নিম্মি তুমি কিছু বলবে?’

পাতা উল্টে সাদা কাগজ বের করে গোটা গোটা ক্যাপিটাল অক্ষরে ইংরেজি ভাষায় লিখে চললো নিম্মি, ‘আই ক্যান সি দ্য ব্ল্যাক শ্যাডো বিহাইন্ড ইউ… ইট ইস ভেরী আগলি… আই অ্যাম ট্রাইং টু ড্র ইটস্ ফেস’।

৩😈

এসব কথা সবাইকে বলা যায় না সেটা ভালো করেই জানে শ্রীময়ী, তবে কিনা তার একার এরকম মনে হয় নাকি অন্যদেরও….

যেমন কোনো কোনো দিন ঠিক খাবার টেবিলে বসে প্লেটে খাবার নেবার পরই মনে পড়ে, কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখা একটা বাসের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ওর বয়সী মেয়েটা কেমন থ্যাত্থার করে বমি করছিলো। আবার রাতে বাথরুমে গেলে ‘কনজিউরিং ২ এর ভালাক’ কে মনে পড়বেই পড়বে। একা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ‘ব্লাডি মেরি ব্লাডি মেরি বলে ডাকতে ইচ্ছে করবেই, এবং ১২ বার ডাকার পরই মনে হবে নিশ্চিত ১৩ বারের মাথায় আয়নায় সেই বিভৎস মুখ ফুটে উঠবে।

কতোবার লিফটে করে ওঠা নামার সময় সেই সিনেমায় দেখা ট্রিপল সিক্স টিপেছে তার ইয়ত্তা নেই কিন্তু প্রতিবারই সেই ছ তলায় লিফট থেমেছে। মানে ভয় পাওয়াটা শ্রীময়ীর কাছে বেশ নেশার মতো, তবু প্রচন্ড ভয় পায় শ্রীময়ী। ভয় ভীষণ টানে তাকে, কাছে টানে।

এই মুহূর্তে শ্রীময়ীর বড় ঘুম পাচ্ছে, ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে নরম বালিশটায় মাথা রেখে পাশ ফিরলো। পাশে নতুন ভাড়া আসা ফ্যামিলির ওরই বয়সী মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটার মুখের একদম ওপরে নিজের মুখটা এনেও সরে গেলো শ্রীময়ী। সবে এসেছে এই ফ্যামিলিটা। আর কদিন নাহয় যাক। বড় বদনাম এই ফ্ল্যাটের। ‘ভুতুড়ে ফ্ল্যাট’।

৪😈

একটা কান্নার দলা গলার ঠিক নীচটায় পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে সোহমের। শ্বেতা ওকে ভুলে গেলো। ওদের প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে… সব ভুলে গেলো শ্বেতা। সোহম প্রাক্তন হয়ে গেছে শ্বেতার জীবনে এটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনা সোহম।

ছয় মাস সংসার করেছিলো দুজনে, সেই ১৮০ দিন শ্বেতার মনে নেই আর!!!!!

ঘুমন্ত অভিনবর হাতটা ছুঁয়ে আরেকটু তার কাছে ঘেঁষে শুলো শ্বেতা, অভিনব একটু নড়লো বোধহয়। গত পাঁচ বছরে শ্বেতা প্রত্যেকটা রাতে বুঝতে পারে সোহমের উপস্থিতি, ওর শরীরের গন্ধ। কিন্তু শরীরটা কোথায়!! সেটা তো ড্রাইভার সিটে দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল। সোহমের শরীরটাকে শেষ করার প্ল্যানটা ভালোই করেছিলো অভিনব শুধু শরীরের গন্ধটা শেষ করতে পারেনি।

৫😈

মোটামুটি রাত ৮ টা নাগাদ চেম্বার বন্ধ করেন জ্যোতিষ সম্রাট শঙ্করাচার্য। নিজের বাড়িতেই চেম্বার। মঙ্গল শনিবার যদিও বেশি ভীড় থাকে বলে একটু দেরী হয়। ঐ দিন গুলোয় তাবিজ কবজ বশীকরণ ব্যাপারগুলো সামলান তিনি। আজ চেম্বার বন্ধ করার পরেই বাড়িতে তার নিজের ভাগ্নে আসে, এই বছর ২৫ এর ছেলে, ভালো ছেলে, মামা মামা করে। এতো রাতে আসার কারণ জানা গেলো, ব্যাটা সেই কোষ্ঠী দুটো সঙ্গে নিয়ে এসেছে। তারই বানানো, ভাগ্নে আর তার প্রেমিকার। তার দিদিই বানিয়ে নিয়ে গেছিলো, আসলে দিদির মেয়েটাকে বিশেষ পছন্দ ছিলো না, তালবাহানা খুঁজছিলো বিয়ে পর্যন্ত যেন না এগোয় আর সেই জন্যই বেশ ভুলভাল তথ্য দিয়ে কোষ্ঠী বানিয়েছিলেন শঙ্করাচার্য। সেই কোষ্ঠী অনুযায়ী এই বিয়ের ফল ভীষণ ভয়ানক ইত্যাদি ইত্যাদি।

বুঝলেন তিনি, ভাগ্নে ঐ ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছে।

তিনি কিছু বলার আগেই ভাগ্নে গড়গড় করে বলে গেলো যে বিয়ে হবেনা শুনে তার প্রেমিকা আত্মহত্যা করেছে, আর সেই খবর শোনার পর নিজের হাতের শিরা কেটেছে ভাগ্নে। আর এখন তাঁর কাছে এসেছে একটাই কথা বলতে – ‘মৃত্যুর স্থান কাল সময় দিয়ে আবার কোষ্ঠী বানিয়ে দিন মামা’। শঙ্করাচার্য দেখলেন টেবিলের ওপর রাখা চ্যানেল ফাইলের ভিতরের কোষ্ঠীটার ভেতর থেকে একটা ফর্সা সাদাটে রক্তশূন্য হাত বেরিয়ে আসছে আর তার পুরো শরীরটাকে টেনে বের করার মরিয়া চেষ্টা করছে ভাগ্নে, যার দুটো হাত রক্তাক্ত..

…………………………………  (সমাপ্ত)  …………………………………..

গল্পের বিষয়:
অনুবাদ
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত