রাতের এই সব জনহীন রাস্তা আর আধো-অন্ধকার বাড়ির রহস্যময় জানলার দিকে তাকালে আমার মনে হয়, আজ তোমার সঙ্গে দেখা হবে। এই সব বাড়ির নির্জন কোনও কোণ কিংবা রাস্তার ধারেকাছের কোনও ঝোপ— কোথাও নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছ তুমি। আছ কি?
নাকি তুমি আমাদের রক্তমাংসের দুনিয়া ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে স্বপ্নেই ফিরে গেছ? যে স্বপ্নের ভিতরে তোমার জন্ম। মনে আছে, কেমন তীব্র শীত পড়েছিল সেবার? সময়টা ‘সামার’ হলেও হাড় কাঁপানো শীতে সেবার জবুথবু ইউরোপ। সেবারের গ্রীষ্ম বিখ্যাত হয়ে আছে ‘দ্য ইয়ার উইদাউট আ সামার’ নামে।
সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরের এক প্রকাণ্ড বাগানবাড়িতে চারজনের জমায়েত। উইলিয়াম গডউইন ও মেরি উলস্টানক্রফটের কন্যা ষোড়শী মেরিকে নিয়ে পালিয়েছেন পার্সি শেলি। পকেটের অবস্থা শোচনীয়! এদিকে ব্যভিচারের ফলে সিফিলিসের মতো জঘন্য অসুখ বাসা বেঁধেছে শরীরে। বারেবারে গর্ভপাতে কাহিল মেরিও। ঘুরতে ঘুরতে দু’জনে হাজির বায়রনের ভাড়া বাড়িতে। বায়রন সেখানে রয়েছেন এক তুতো বোনের সঙ্গে। কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যে ভূতের গল্প লেখার চ্যালেঞ্জ। আর তার পরই স্বপ্নের মধ্যে ভেসে উঠলে তুমি…
তোমাকে কি কখনও ভালবেসেছিলেন তোমার স্রষ্টা? না হলে কেন তোমায় রেখে দেবেন নামহীন! এই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসে ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ নামটাই লোকের কাছে তোমার নাম। অথচ সে তো সেই বিজ্ঞানীর! তুমি কে? কেবলই নামহীন এক দানব? অন্ধকার থেকে অন্ধকার… তার পর আরও ঘন অন্ধকারের ভিতরে হারিয়ে যাওয়াই যার নিয়তি! মেরিই তো লিখে গিয়েছেন, অন্ধকারে লাফিয়ে পড়লে তুমি, নিজেকে ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। কিন্তু সত্যিই কি আত্মহত্যা করেছিলে তুমি?
উঁহু। আমি জানি তুমি আসলে পালিয়ে বেড়াচ্ছ। তুমি আছ, আজও। না হলে আমি কেন খুঁজব তোমায়, বলো?
|| ২ ||
মাঝে মাঝে এমন সংলাপ মাথার মধ্যে চলকে ওঠে। আর বাড়ি ফিরে লাভক্র্যাফট খুলে বসি। এইচ পি লাভক্র্যাফট। কেননা মেরি শেলির ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’-এর কথা মনে হলে আমার ‘আউটসাইডার’ নামের সেই অসামান্য কাহিনির কথাও মনে পড়ে। লাভক্র্যাফটের গল্পের সেই উত্তমপুরুষ চরিত্রও তো চূড়ান্ত একলা একজন মানুষ। মানুষ! লিখতে গিয়ে থমকাতেই হয়। কে বলল মানুষ! মানুষ হলে তাকে দেখে ভয়ে কেন পালাবে সবাই! তা ছাড়া সে তো নিজেই বলেছে, ‘‘আমি সব সময়েই জানতাম আমি একজন বহিরাগত। যারা এখনও মানুষ, তাদের মধ্যে আমি একজন আগন্তুক।’’
একটা হাসিখুশি পার্টির মধ্যে সেই আগন্তুক এসে দাঁড়াতেই সমস্ত আলোময় আনন্দের মধ্যে কে যেন কালির স্রোত ঢেলে দিয়েছিল। আতঙ্কে হলদে হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে সবাই পড়িমরি করে পালিয়েছিল। আর অত বড় হলঘরে এক্কেবারে একলা হয়ে বিস্মিত সেই আগন্তুক হতভম্বের মতো দাঁড়িয়েছিল। সামান্য এগোতেই সে এসে দাঁড়িয়েছিল আর এক ভয়ঙ্করের সামনে! কে সে! বিস্ময়ে তার দিকে আঙুল সামান্য বাড়াতেই সে স্পর্শ করেছিল… না, কোনও শরীর নয়। আয়নার হিমশীতল কাচ! বুঝতে পেরেছিল এই তার নিয়তি। নিজের প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কেউ নেই তার সঙ্গে। আর সেই প্রতিবিম্বও এমনই ভয়ঙ্কর, যার সঙ্গে থাকতে গেলে গা শিউরে ওঠে।
সেই আগন্তুকের সঙ্গে আমি ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’-এর দানবের কোনও তফাত দেখি না। দু’জনেই তারা ভয়ঙ্কর। দু’জনেই অসম্ভব একা।
বারবার ‘ভয়ঙ্কর’ কথাটা লিখতে লিখতে থমকাতে হল। কেন ভয়ঙ্কর? কীসের ভয়ঙ্কর? আসলে বলা উচিত ‘ভয়ঙ্কর দর্শন’। লাভক্র্যাফটের গল্পের এই চরিত্র হোক বা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানব’— এদের সবচেয়ে বড় শত্রু এদের মুখ। দেখলেই মনে হয়, সেই মুখে লেগে রয়েছে বীভৎসতা ও নিষ্ঠুরতার নারকীয় আঁতাতের চিহ্ন। আর এখানেই উঠে আসে প্রশ্ন। ‘কুরূপ’ বলেই ভয় পেতে হবে? বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে মানুষের সমাজ থেকে! বহিরাবয়বে ভয় জাগাচ্ছে মানে সে ভিতরেও অতটাই বিপজ্জনক? কি এক সরল সমীকরণে দু’টো একাকার হয়ে যায়।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানব’ জানত সে কুৎসিত। এমনকি, তার স্রষ্টা পাগল বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনও তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। সকলের থেকে একলা হয়ে যাওয়া সেই দানব চেয়েছিল নিজের মতো করে বাঁচতে। নিজের মতোই এক কুরূপাকে সঙ্গিনী হিসেবে চেয়েছিল সে। প্রথমে রাজি হয়েও পরে পিছিয়ে আসেন ভিক্টর। যদি দুই কুরূপ আর কুরূপার মিলনে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় আরেক ভয়ঙ্কর, এই আশঙ্কায়। এরপর ক্রুদ্ধ সেই দানব যখন ভিক্টরের সদ্য পরিণীতা নববধূর শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়, তখন তার সেই হত্যা-লীলা ‘জাস্টিফায়েড’ হয় না ঠিকই, কিন্তু ইতিহাসের বিচারে তা মানুষের প্রকৃতিকেই তুলে ধরে। দানব বলে, ‘‘ইফ আই ক্যান নট ইন্সপায়ার লাভ, আই উইল কজফিয়ার!’’
‘অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবিতে’ দানব হয়ে ওঠে হিংস্র। তার এই হিংসা কি অভূতপূর্ব? মহাকাব্য থেকে পুরাণ কিংবা ইতিহাস— এমনটাই তো দেখে এসেছি আমরা। আমি না পেলে আমি কাউকেই পেতে দেব না, এ তো কেবল ওই দানবের ইচ্ছে নয়। তাহলে তাকে আলাদা করে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার অর্থ কী?
‘সাটান হ্যাজ হিজ কম্প্যানিয়নস, ফেলো ডেভিলস… বাট আই অ্যাম সলিটারি অ্যান্ড ডিটেস্টেড।’
শয়তান তার সঙ্গী-সাথী নিয়ে আছে, কিন্তু আমি একলা। মেরি শেলির উপন্যাসের এই অমোঘ সংলাপেই ধরা রয়েছে সবটা।
|| ৩ ||
এ লেখা লিখতে লিখতে কবেকার একটা স্বপ্নের কথা মনে পড়ল। একজন সামান্য কলমচির স্বপ্নে কারও আগ্রহ থাকার কথা নয়, জানি। তবু বলতে চাই, কেননা আমার ধারণা এই স্বপ্ন আসলে আমি একা দেখিনি। আরও অনেকে দেখেছে। হয়তো দৃশ্যগুলো এক নয়। তবু…
একটা অন্ধকার রাস্তায় একটা ভয়ঙ্কর দর্শন লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে যাকে ছুঁয়ে দেবে, সে-ই তার মতো হয়ে যাবে। তাই সে কারও কাছে ঘেঁষতে এলেই সে পড়িমরি করে পালিয়ে যাচ্ছে। তার শরীরটা ঠিক কেমন ছিল তা ঘুম ভাঙার পরে আর মনে নেই। কিন্তু তার চোখ-নাক-মুখ যে কুষ্ঠ রোগীর মতো বিকৃত ছিল সেটা স্পষ্ট মনে আছে। সে কেমন যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অন্য লোকেদের কাছে যাচ্ছে। আর বাকিরা চোর-পুলিশ খেলার মেজাজে পালিয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ লোকটা আমার একেবারে কাছে চলে এলো। আর আমি সরে যাওয়ার আগেই আমায় আঁচড়ে দিল!
স্বপ্নের মধ্যে আঁচড়ে দেওয়ার মুহূর্তটা আমার কাছে দারুণ জ্যান্ত বলে মনে হয়েছিল। আরও কিছু ছিল সেই স্বপ্নে, সেটা স্পষ্ট মনে নেই। কেবল, আঁচড়ের পর মুহূর্তে লোকটার অশ্লীল হাসিটা মনে রয়ে গিয়েছে।
ওই লোকটা, চেহারা-চরিত্রে যাকে একজন দানবের মতোই মনে হয়, সে-ও চাইছিল একজন সঙ্গী। যে ঠিক তারই মতো হবে। অবিকল ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’-এর দানবের আকুতি। আর সেটা ভাবতে গেলেই মনে হয়, মেরি শেলি না দেখলে ওই স্বপ্ন অন্য কেউ দেখত। দেখতে হতোই। কেননা, ওই দানব আমাদের স্বপ্নে স্বপ্নে ঘুরে বেড়িয়েছে। আমার উত্তরপুরুষেরাও কখনও না কখনও স্বপ্নে ওই দানবকে দেখবেই। সভ্যতার অমোঘ নিয়তির মতো নানা রূপে, নানা চরিত্রে ওই দানবকে ফিরে ফিরে আসতেই হবে।
একটা স্বপ্ন থেকে আর একটা স্বপ্নে যাই। রবার্ট লুই স্টিভেনসন নামের এক ব্যক্তি একদিন একটা স্বপ্ন দেখলেন। স্ত্রী ফ্যানি স্টিভেনসন আবিষ্কার করলেন তাঁর স্বামী ঘুমের মধ্যে ভয়ের স্বপ্ন দেখে মুখ দিয়ে কেমন শব্দ করছেন। তড়িঘড়ি স্বামীর ঘুম ভাঙান ফ্যানি। ঘুম ভেঙে স্ত্রীর ওপর প্রচণ্ড রেগে যান রবার্ট। বলেন, ‘ডাকলে কেন? একটা অদ্ভুত ভয়ের স্বপ্ন দেখছিলাম!’
এরপরই লেখা হয় ‘স্ট্রেঞ্জ কেস অফ ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’। ডক্টর হেনরি জেকিলের অল্টার ইগো এডওয়ার্ড হাইড। জেকিল হাসিখুশি। অথচ সে-ই যখন মিস্টার হাইড, তখন সে ভয়ঙ্কর।
এই উপন্যাসের কথা ভাবতে গেলে ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’-এর ছায়া টের পাওয়া যায়। আর ততই বোঝা যায়, নিজেদের ভিতরে যাকে ধারণ করে রাখছি আমরা, তার হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলবে না। বারে বারে সে স্বপ্নের শরীরে থেকে বেরিয়ে এসে বইয়ের পাতা, স্টেজ বা সিনেমা হলের অন্ধকার পর্দায় এসে দাঁড়াবে।
১৮২৩ সালে ‘প্রিজাম্পশন, অর দ্য ফেট অফ ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ নাটক দেখে লন্ডনে হলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন একাধিক মহিলা দর্শক! গা ছমছমে আলো-আঁধারিতে ঢাকা তৎকালীন লন্ডন শহরের বাসিন্দাদের মনের মধ্যে জাঁকিয়ে বসেছিল এক ভয়ঙ্কর দানবের মুখচ্ছবি। ভাবতে বসলে মনে হয়, এই ভয় আসলে কাকে? কাকে?
|| ৪ ||
আর ভাবতে ভাবতেই বুঝতে পারি, তোমায় খুঁজে পাওয়ার একমাত্র উপায় হল আয়না। অন্ধকার ঘরে রাতের নিস্তব্ধতা চুইয়ে চুইয়ে নামতে থাকা আয়নার ঠাণ্ডা কাচ স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে। করি না। কেবল তাকিয়ে দেখি আয়নার ওপারের পৃথিবীকে। লুইস ক্যারলের অ্যালিস আয়নার দেশে গিয়েছিল। বয়স বাড়লে সেই পৃথিবীটা আর তেমন কোনও অজানা মজার দেশ থাকে না। একাকার হয়ে যায়।
আয়নার ভিতর থেকে তুমি বেরিয়ে এসে ক্রমশ ঢুকে পড়ছ আমার ভিতরে। নাকি আমিই আয়নার ভিতরে দাঁড়ানো তোমার অন্ধকারাচ্ছন্ন অবয়বের ভিতরে ঢুকে পড়তে থাকি? আমি যেমন তোমাকে খুঁজছি, তুমিও তো খুঁজছ আমায়! শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে যেতে থাকে। আমার, আমাদের এই অন্বেষণ ফুরবার নয়।
কবেকার এক অষ্টাদশীর স্বপ্নের ঘোর আজও সভ্যতাকে মগ্ন করে রাখে রাতের পর রাত।