রাত বেশি নয়। নিউ ইয়র্ক শহরের এঁদো গলির ভিতর তিনতলা এক সস্তার বাসা বাড়ি। তার এক খুপরি ঘরের জানলার পাশে বসে ব্লেক আকাশ পাতাল ভাবছিল। টেবিলে এক তাড়া কাগজ। বেচারা দিন কয়েক পর আজ লিখতে বসেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বিশেষ এগোতে পারেনি। পারার কথাও নয়। সময়টা একেবারেই ভাল যাচ্ছে না।এভাবে আর কতদিন চলবে‚ থম হয়ে তাই ভাবছিল ও। বলা যায়‚ সন্ধে রাত। অথচ খিদেটা ইতিমধ্যেই বেশ জানান দিতে শুরু করেছে। অথচ পকেটে বেজায় টান। অনেক আসা করে একটু নিজের মতো থাকবে ভেবেই ঘরটা ভাড়া নিয়েছিল। কিন্তু কুলোতে পারেনি। দু’জন রুমমেট নিতে হয়েছে। একজন এক ফরাসী ছোকরা। অল্প বয়স। অন্যজন মাঝবয়সি দশাসই চেহারার এক ডেন‚ অর্থাৎ ড্যানিস। অগত্যা ঘরটা আর এখন নিজের মতো নেই। দুটো মাত্র তক্তপোষ। পালা করে একজনকে মেঝেতে শুতে হয়। অথচ আর্থিক ব্যাপারে খুব যে সুরাহা হয়েছে‚ এমন নয়।রোজগার ওদেরও তেমন ভাল নয়। তাই বেশিরভাগ রাতেই খাবার বলতে সামান্য ওট আর আলু সেদ্ধ। সঙ্গে কোনও দিন বড় জোর একটা ডিম।
আজ রাতে অবশ্য সামান্য ব্যতিক্রম হবার আশা আছে। ডাক পেয়ে দুই রুমমেট এক রেস্টুরেন্টের কাজে গেছে।কথা দিয়েছে‚ ফেরার সময় ভালমন্দ কিছু নিয়ে আসবে। কাজ থেকে ফেরার পথে তাই আর কিছু খায়নি। আসলে পকেটের যা অবস্থা‚ বাড়তি খরচ একেবারেই চলে না। বলা যায়‚ ব্লেক আজ সন্ধের পর সেই আনন্দেই কাগজ কলম নিয়ে বসেছিল।
এক সান্ধ্য দৈনিকে সামান্য মাইনের রিপোর্টার। দিনভর পুলিশ কোর্টে ধর্না দেওয়াই কাজ। সেই কারণে বিকেলে কোর্ট বন্ধ হতেই ছুটি মেলে। ওই সময় ঘরে ফিরে ব্লেক কোনও দিন কাগজ–কলম নিয়ে গল্প বা ফিচার লিখতে বসে পড়ে। যদিও সে সব কদাচিৎ ছাপা হয়। সম্পাদকের কথায়‚ এসব ম্যাদামারা গল্প কেউ নাকি পড়তেই চায় না।পাঠকের পছন্দ রহস্য নয়তো হাড় কাঁপানো রোমাঞ্চ কাহিনী। দিন কয়েক আগে এক সম্পাদক কিছু পরামর্শও দিয়েছেন। রিপোর্টার হিসেবে কাজ যখন পুলিশ কোর্টে‚ তেমন গল্প ওর পক্ষে নাকি চেষ্টা করলেই লেখা সম্ভব। ভাল দক্ষিণাও মিলবে। ঘরে ফিরে আজ লিখতে বসার পিছনে সেটাও আর এক কারণ।
কলমটা ফের হাতে নিয়ে ব্লেক পর্দা-হীন জানলা দিয়ে তাকাল। বাইরে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আধভাঙা কাচের ফাঁক দিয়ে কারও রান্নাঘর থেকে চমৎকার স্টেকের গন্ধ নাকে এসে লাগল। খিদেটাও যেন আরও চাগাড় দিয়ে উঠল। দুই রুমমেটের ফিরতে এখনো দেরি আছে। আজ আবার ওর মেঝেয় শোবার পালা। সেজন্য পাতলা এক তোষক রয়েছে। মোটই জুতের নয়। ব্লেকের মনে হল‚ এই ফাঁকে তক্তপোষে একটু গড়িয়ে নেওয়া যায়। সারাদিন এজলাস থেকে এজলাসে ঢুঁ মারতে মেহনতও কম হয়নি। ক্লান্ত শরীর। তবু টেবিল ছেড়ে উঠতে গিয়েও সামলে নিল।সম্পাদকের ফরমায়েশের কথা ভেবে লেখাতেই ফের মন বসাবার চেষ্টা করল।
দিন কয়েক আগে কোর্টের এজলাসে এক শুনানি চলছিল। তার বিস্তারিত রিপোর্ট ব্লেক তার কাগজের অফিসে জমাও দিয়েছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বাতিল করে দিয়েছেন। ছাপা হয়নি। সেই কেসটা একটু অন্যভাবে লেখার ইচ্ছে নিয়েই ব্লেকের আজ লিখতে বসা। কিন্তু কিছুতেই মনোমতো হচ্ছে না। কয়েক দফায় দু–চার লাইন করে লিখেও কেটে দিতে হয়েছে।
গালে হাত দিয়ে গভীরভাবে ভাবছিল ও। হঠাৎ দরজায় নক করল কেউ। পরপর কয়েকবার। রুমমেটদের কেউ নয়। ওরা এভাবে নক করে না। তা ছাড়া তাদের ফেরার সময়ও হয়নি। কে হতে পারে‚ ব্লেক ভেবে উঠতে পারল না।উপর তলায় এক বয়স্ক ভদ্রলোক থাকেন। মাঝে মধ্যেই আড্ডা দিতে আসেন। অথচ বাজে কথায় সময় নষ্ট একেবারেই পছন্দ নয় ওর। তবু ভদ্রলোক স্বজাতি ইংরেজ বলেই কখনো সহ্য করতে হয়।
‘আসুন।’ মুখে বললেও কিছু বিরক্তই হল ব্লেক।
মুহূর্তে দরজা ঠেলে যিনি ভিতরে ঢুকলেন‚ তাঁকে দেখে ভুরু কুঁচকে উঠল ওর। না‚ উপরতলার ভদ্রলোক নয়।অপরিচিত একজন। ব্লেক তাঁকে আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। আগন্তুক ইতিমধ্যে ঘরে ঢুকে সামান্য পাশ ফিরে দাঁড়িয়েছেন। তাই ব্লেক তাঁর মুখের একটা দিকই দেখতে পাচ্ছিল। বছর চল্লিশের মতো বয়স। গায়ে কলার তোলা ওভারকোট। মাথার ফেল্ট–হ্যাট কপালের উপর নামিয়ে দেওয়া। তাতে বৃষ্টির ফোঁটা চকচক করছে। হাতে কালো রংয়ের একটা ব্যাগ।
কর্মক্ষেত্রের কারণে ব্লেককে মানুষের সঙ্গে মিশতেই হয়। সামান্য পর্যবেক্ষণ করে মানুষটিকে ভদ্র দস্তুর বলেই মনে হল। সম্ভবত কোনও সংস্থার পদস্থ কর্মচারী। ব্লেক প্রশ্ন করার আগেই তিনি মার্জিত গলায় বললেন‚ ‘স্যার‚ আমি কি মি. ব্লেকের সঙ্গে কথা বলছি?’
‘হ্যাঁ‚ আমিই।’ ব্লেক উত্তর দিল।
‘মি. আর্থার ব্লেক?’
‘হ্যাঁ।’
‘মি. আর্থার হারবার্ট ব্লেক?’ সামান্য নীরবতার পর ভদ্রলোক ফের প্রশ্ন করলেন।
‘হ্যাঁ‚ ওটাই আমার পুরো নাম।’ ভদ্রলোক দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন। ব্লেক এবার তাঁকে বসতে ইঙ্গিত করল।
ঘরে একটিই সোফা। ধন্যবাদ জানিয়ে ভদ্রলোক অদ্ভুত কায়দায় পাশের দিকে পা ফেলে তার একপ্রান্তে গিয়ে সামান্য মাথা নামিয়ে বসলেন। টুপিটা পায়ের কাছে মেঝেতে নামিয়ে রাখলেও ব্যাগটি হাতেই ধরে রইলেন। তারপর একইভাবে মাথা না তুলে নরম গলায় বললেন‚ ‘আমি‚ আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির কাছ থেকে আসছি।’
সামান্য পাশ ফিরে বসায় ব্লেক এবারেও তাঁর মুখের একটি দিকই দেখতে পাচ্ছিল। সেই মুখে যথেষ্টই আন্তরিকতার ছোঁওয়া। সামান্য নড়ে বসল ও। কিন্তু অনেক ভেবেও এই নিউ ইয়র্ক শহরে তার তেমন কোন শুভাকাঙ্ক্ষী আছে বলে মনে করতে পারল না। ভেবেছিল ভদ্রলোক ফের হয়তো মুখ খুলবেন। কিন্তু তেমন কোনও লক্ষণ নেই দেখে বলল‚‘শুভাকাঙ্ক্ষী!’
‘ঠিক তাই।’ আগের মতোই মাথা নিচু করে ভদ্রলোক বললেন‚ ‘হ্যাঁ‚ আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী।’
‘কে তিনি? কী নাম?’ প্রায় রুদ্ধশ্বাসে ব্লেকের প্রশ্ন।
‘মাফ করবেন স্যার।’ সামান্য মাথা নাড়লেন উনি। কণ্ঠস্বর আর আগের মতো নরম নয়। যথেষ্টই দৃঢ়। ‘তাঁর নাম বলা যাবে না।’
‘সে কী? কেন?’ ব্লেকের কণ্ঠে সামান্য উত্তেজনার ছাপ। সেটাই স্বাভাবিক। ভাগ্যান্বেষণে ইংল্যান্ড ছেড়ে এসেছে বছর কয়েক। কিন্তু এখনো সেই তিমিরে। অপরিচিত মানুষটিকে হঠাৎ কে পাঠিয়েছেন‚ জানতে চাওয়াই স্বাভাবিক।
‘মালিকের বারণ আছে স্যার।’ ফের দৃঢ় কণ্ঠে ভদ্রলোক বললেন‚ ‘আমি সামান্য কর্মচারী। নিরুপায়। তাই সময় নষ্ট না করে কাজের কথাটা সেরে ফেলতে চাই। আপনার জন্য কিছু সাহায্য পাঠিয়েছেন তিনি। সেটা নিয়ে একটা রসিদ করে দিলেই আমি চলে যাব। এটুকুই বলা আছে আমাকে।’
ব্লেক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকাল। ভদ্রলোক একইভাবে চোখ নামিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে মানুষটির উদ্দেশ্য বোঝা মুশকিল। তবে রসিদ চাওয়ার কথায় অনুমান করল‚ সাহায্যটা সম্ভবত আর্থিক। টাকা–পয়সায়। কিন্তু তিনি কে হতে পারেন‚ অনেক ভেবেও মনে করতে পারল না। কাছের খাতিরে অনেকের সঙ্গেই পরিচয় আছে। বর্তমানে ওর দুরবস্থার কথাও অনেকে জানেন। তবে কী তাঁদের কেউ? ব্লেকের মনে হল‚ সম্ভাবনাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঢোঁক গিলে বলল‚ ‘তা কী সাহায্য করতে চান তিনি?’
প্রত্যুত্তরে কথা না বলে ভদ্রলোক হাতের ব্যাগ খুলে ভিতর থেকে ব্রাউন পেপারে মোড়া একটা প্যাকেট বের করলেন। সুতো দিয়ে সেটা শক্ত করে বাঁধা। সামান্য চেষ্টায় বাঁধন খুলতেই নোটের গোটা কয়েক বাণ্ডিল বের হয়ে পড়ল। সব ১০০ ডলারের নোট। হঠাৎ সামনে অতগুলো টাকা দেখে ব্লেকের গলা তখন প্রায় শুকিয়ে আসার জোগাড়।
‘দশ হাজার ডলার আছে এখানে।’ শান্ত গলায় বললেও পরেই কেমন বিষণ্ণ শোনাল তাঁর কণ্ঠস্বর‚ ‘হ্যাঁ স্যার‚ এগুলি এখন আপনার।’
‘দশ হাজার ডলার!’ প্রায় রুদ্ধ কণ্ঠে ব্লেক বলল‚ ‘সব আমার! আ–আপনার ভুল হয়নি তো?’
আসলে ব্লেকের তখন যা আর্থিক অবস্থা‚ এমন অযাচিত ভাবে এত টাকা হাতে আসতে পারে‚ কখনো ভাবতেই পারেনি। মনে হচ্ছিল‚ সব হয়তো স্বপ্ন! নয়তো ভুল হয়েছে কোথাও। লোকটি এখুনি হয়তো টাকাগুলো ফের ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়িয়ে জানাবে‚ ঠিকানা ভুল হয়েছে তার। আর্থার হারবার্ট ব্লেক অন্য ঠিকানার কোনও ব্যক্তি। সে নয়।ভাবতে গিয়ে ব্লেকের চোখে হঠাৎ শঙ্কার ছায়া নেমে এল। অকারণে নয়। মাস গেলে জাঁদরেল বাড়িওয়ালীর তাগাদা।একের পর এক পাওনাদার। এঁদো গলির এই ঘিঞ্জি ঘরে বাস। এসব কারই বা ভাল লাগে?
ইতিমধ্যে ভদ্রলোক নোটের বান্ডিলগুলো মেলাতে শুরু করেছেন। প্রতি বান্ডিলে একশো ডলারের দশটি করে নোট।দশটি বান্ডিলে মোট দশ হাজার ডলার। সব ঝকঝকে নতুন। সম্ভবত আজই ব্যাঙ্ক থেকে তোলা।
ব্লেক রুদ্ধশ্বাসে সেদিকে তাকিয়ে থাকলেও মাথাটা একেবারে গুলিয়ে যায়নি। নিয়মিত পুলিশ কোর্টে হাজিরা দেবার কারণে জানে‚ নিউ ইয়র্কের মতো শহরে প্রতারকের অভাব নেই। নানা কায়দায় লোক ঠকানোই শুধু নয়‚ব্লাকমেলিংয়ের ঘটনাও ভুরি ভুরি। আগন্তুক মানুষটির চেহারা বা ব্যবহার মার্জিত হলেও এযাবৎ একবারও মুখ তোলেনি। কিছুটা অস্বাভাবিক তো অবশ্যই। ব্লেক সতর্ক দৃষ্টিতে ফের লোকটির দিকে তাকাল।
ইতিমধ্যে ভদ্রলোক ডলারের বান্ডিলগুলো ব্লেকের সামনে রেখেছেন। অল্প পরে বললেন‚ ‘স্যার‚ এবার ডলারগুলো রিসিভ করে একটা রসিদ দিলেই আমি চলে যেতে পারি।’
লোকটির কথায় ব্লেকের মনে হল‚ বোধ হয় তাড়া রয়েছে তার। ও সাবধানে বলল‚ ‘কিন্তু এভাবে এত টাকা নেওয়া যায় কী? যিনি দিতে চাইছেন‚ তাঁর নাম জানা নেই। এমন কী কেন তিনি দিতে চাইছেন‚ সেটাও বলছেন না।’
‘দিতে চাইছেন কারণ‚ টাকাটা আপনার দরকার।’ ব্লেক থামতেই অন্য পক্ষের উত্তর। ‘আর এজন্য কোনও শর্তও উনি রাখেননি। রসিদটা দরকার‚ যাতে উনি বুঝতে পারেন‚ টাকাটা যথাস্থানে পৌঁছেছে। আর এটা যে ধার বা ওই ধরণের কিছু নয়‚ রসিদে স্বচ্ছন্দেই লিখতে পারেন সেটা।’
ভদ্রলোকের কথায় এবার কিছুটা যেন স্বস্তি পেল ব্লেক। প্রস্তাবের সারবত্তা আছে। এছাড়া টাকাটা নিয়ে রসিদ যদি কোনও সাক্ষী রেখে দেওয়া যায়‚ আরও নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। ভবিষ্যতে ব্লাকমেলের পথ বন্ধ করার রক্ষাকবচ। তা ছাড়া টাকাটা অন্ধকার পথেও রোজগার হতে পারে। হয়তো সম্প্রতি ঝামেলায় পড়ে গিয়ে এভাবে বেআইনি কিছু টাকা সরিয়ে রাখছেন। সেক্ষেত্রেও পরে সমস্যা হবার সম্ভাবনা। একজন সাক্ষী রাখতে পারলে অনেকটাই চিন্তামুক্ত হওয়া যায়।
ব্লেক নড়ে উঠে বলল‚ ‘ঠিক আছে‚ রসিদ দেওয়া যাবে। কিন্তু আমার মনে হয়‚ সেটা আইনানুগ হওয়া দরকার।
‘আইনানুগ! মানে?’ অন্যপক্ষের ভুরু কুঁচকে উঠল।
‘আইনানুগ মানে‚ রসিদে একজন সাক্ষী রাখতে চাই। উপস্থিত থেকে তিনিও সই করবেন।’
‘ওহহো‚ তাই বলুন!’ মুহূর্তে অন্যপক্ষের উত্তর। ‘হ্যাঁ‚ সে তো রাখতেই পারেন। রসিদে তারিখ‚ বাড়ির ঠিকানা‚এগুলোও বোধ হয় দরকার।’
অযথা আর চিন্তা করার মানে হয় না। এবার দরকার একজন উপযুক্ত সাক্ষী। ভাবতে গিয়ে উপর তলার মি.বার্কলের কথাই আগে মনে পড়ল ওর। বৃদ্ধ ভদ্রলোক জার্মান। ব্যবসায়ী মানুষ ছিলেন। এখন অবসর নিয়ে একাই থাকেন। বাড়িওয়ালী অবশ্য বৃদ্ধের উপর একেবারেই সদয় নন। অমন কৃপণ বুড়ো তিনি নাকি আগে দেখেননি। প্রতি মাসে ভাড়া দিতে বার কয়েক ঘোরাবেনই। অথচ প্রচুর টাকা। বাড়িওয়ালীর কথায়‚ বুড়ো নাকি দিনরাত ঘরে বসে সেই টাকা পাহারা দেন। ব্লেকের মনে হল‚ সাক্ষী হবার জন্য এই মানুষটিই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। ব্যবসায়ী মানুষ।রসিদ তৈরির ব্যাপার উপযুক্ত পরামর্শও দিতে পারবেন।
সময় নষ্ট না করে ব্লেক ভদ্রলোককে সামান্য অপেক্ষা করতে বলে উঠে দাঁড়াল। মতলব করাই ছিল। সেইমতো সোফার পাশ দিয়ে দরজার দিকে যাবার সময় চট করে পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। সেই থেকে আগন্তুক পাশ ফিরে থাকায় মুখের একটা দিকই শুধু দেখতে পেয়েছে। এই প্রথম অন্য দিকে নজর পড়ল। প্রায় চমকে উঠল ও। কী সর্বনাশ! লোকটার অন্য গালে টানা রক্তের দাগ। কানের নীচে থেকে গলা পর্যন্ত টাটকা ক্ষতচিহ্ন।
আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও ব্লেক কোনও ক্রমে সামলে নিল। সন্দেহ নেই‚ লোকটি সামান্য আগে খুন–জখমের মতো সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটিয়ে এসেছে। চেঁচামেচি করলে বিপদ বাড়বে আরও। ব্লেক টের পেল‚ তার পা কাঁপতে শুরু করেছে। তবু যথাসম্ভব স্বাভাবিক ভাবেই ঘর থেকে বের হয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। ভাগ্যিস লোকটা টের পায়নি। মুখ নামিয়ে আগের মতোই মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু তলিয়ে ভাবতে গিয়ে হঠাৎ ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল ওর। দরজার উলটো দিকের দেয়ালে বড় একটা আয়না ঝোলানো। লোকটি অন্য চোখে যদি সেদিকে তাকায়‚সহজেই ওকে লক্ষ করতে পারে। ধূর্ত লোকটা হয়তো করেছেও তাই। ও টের পায়নি।
জীবনে এত ভয় ব্লেক পায়নি কখনও। অর্থপ্রাপ্তি‚ রসিদ‚ সাক্ষী‚ মুহূর্তে সব উবে গেল মাথা থেকে। বুঝতে পারল‚প্রাণ বাঁচাতে হলে পালানো ছাড়া অন্য উপায় নেই। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে উপর তলায় মি. বার্কলের ঘরের দরজায় পৌঁছে নক করল ও। বৃদ্ধ দরজা খুললেই ঢুকে পড়বে ভিতরে।অভিজ্ঞ মানুষ। এই অবস্থায় কিছু পরামর্শও দিতে পারবেন উনি। কিন্তু বার কয়েক দরজায় নক করেও ভিতর থেকে কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
আরও বার কয়েক চেষ্টার পর ব্লেকের মনে হল‚ বৃদ্ধ হয়তো বাইরে বেরিয়েছেন। নয়তো আজ কিছু তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়েছেন। হাতে সময় কম। বিপজ্জনক লোকটা যে কোনও সময় উপরে উঠে আসতে পারে। সাত–পাঁচ ভেবে ব্লেক দরজার হাতল ঘোরাল। চাবি দেওয়া নেই। ক্যাঁচ করে খুলে যেতেই দ্রুত ভিতরে ঢুকে পড়ল।
ঘরে আলো নেভানো। অন্ধকারে ব্লেকের মনে হল‚ বৃদ্ধ হয়তো ঘরে নেই। বাইরে বেরিয়েছেন। কিন্তু দরজার চিলতে ফাঁক দিয়ে বাইরে প্যাসেজের সামান্য আলোয় ভাল করে নজর করতে ব্লেক বুঝতে পারল‚ বৃদ্ধ ঘরেই আছেন।বিছানায় শুয়ে ঘুমচ্ছেন।
দরজাটা আরও একটু ফাঁক করে দিয়ে ব্লেক বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার দিয়ে ঘরের ভিতর এখন অনেকটাই আলো। সেই আলোয় বিছানায় শুয়ে থাকা বৃদ্ধকে কেমন অস্বাভাবিক মনে হল ওর। গায়ে স্লিপিং গাউন নয়‚শার্ট–প্যান্ট। পায়ে জুতো। দেহের অনেকটা বিছানার বাইরে ঝুলছে। মানুষটিকে ওইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে কেমন যেন খটকা লাগল। বার কয়েক ডাকল। কোনও সাড়া নেই। বিছানার পাশে টেবিল ল্যাম্পটা ওই সময় নজরে পড়ল ওর। চট করে আলোটা জ্বেলে দিল। তারপরে বিছানার দিকে তাকাতেই মাথার প্রতিটি চুল নিমেষে খাড়া হয়ে উঠল।কী সর্বনাশ! বৃদ্ধর নিথর দেহ পড়ে আছে বিছানায়। প্রাণ নেই। ধারাল অস্ত্রের আঘাতে গলা প্রায় বিচ্ছিন্ন। চারপাশে থিকথিক করছে রক্ত। এখনো সেভাবে জমাট বাঁধেনি। এছাড়া তছনছ হয়ে রয়েছে ঘরের জিনিসপত্র। মেঝেয় ছড়িয়ে অনেকগুলো একশো ডলারের নোট।
ওই দৃশ্য দেখে কয়েক মুহূর্ত ব্লেক প্রায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চলার ক্ষমতাও তখন যেন লোপ পেয়েছে। তারপর সংবিৎ ফিরে আসতেই ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে পড়ল। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে নিজের ঘরের দিকে। ততক্ষণে কর্তব্য ঠিক করে ফেলেছে। যে কোনও ভাবেই হোক আগন্তুক লোকটার পালাবার পথ বন্ধ করতে হবে। তারপর লোকজন আর পুলিশ ডেকে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা।
ঘরের সামনে পৌঁছে ব্লেক দেখল‚ ইতিমধ্যে দরজা ভেজিয়ে দেওয়া হয়েছে। উৎকণ্ঠায় দুটো হাঁটু ফের কাঁপতে শুরু করেছে। টাল সামলাতে তাড়াতাড়ি দরজার হাতলটা আঁকড়ে ধরল ও। হাতটা সামান্য পিছলে গেলেও সাবধানে হাতল ঘুরিয়ে দরজা সামান্য ফাঁক করল। ঘর ফাঁকা। সরে পড়েছে লোকটা। মেঝেতে ছড়িয়ে ডলারের বান্ডিলগুলো। এছাড়া সোফার যে জায়গায় লোকটা বসেছিল‚ তার পাশে দুটো রক্তমাখা গ্লাভস আর মাংস কাটার বড় একটা চপার।
ঘরে ঢুকে কয়েক মিনিট প্রায় হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইল ব্লেক। কী করবে‚ কিছুই তার মাথায় ঢুকছিল না তখন।এভাবে এমন বিপদেও কেউ পড়ে! ভাবতে গিয়ে অজান্তেই কপালে হাত দিয়েছিল। আঙুলগুলো কেমন চটচট করে উঠল। একটু আগে দরজার হাতল ধরতে গিয়েও এমন হয়েছিল। সামান্য পিছলে গিয়েছিল হাতটা। চমকে উঠে ও হাতের দিকে তাকাল। সারা হাত রক্তে মাখা!
সন্দেহ নেই‚ অল্প আগে মৃত বার্কলের বিছানায় হাত দিয়েছিল। তখনই ব্যাপারটা ঘটেছে। হায় ভগবান! কোনও দিক দিয়েই যে রেহাই নেই আর! নিহত বৃদ্ধ বার্কলের রক্ত ওর হাতে। দরজার হাতলে। সব দিক দিয়েই ফেঁসে গেছে। আতঙ্কে ব্লেকের তখন দিশেহারা অবস্থা। কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সামান্য চিন্তা করার শক্তিও মাথায় আর অবশিষ্ট নেই। ওই সময় বাইরে গলির ভিতর একাধিক ভারি বুটের শব্দ। জোরাল কর্কশ শব্দে সদর দরজার বেলটা বেজে উঠল এরপর। তারপর সিঁড়ি ভেঙে বুটের আওয়াজ ওর ঘরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
নিশ্চয় পুলিশ! ব্লেক বুঝতে পারল‚ পরিত্রাণের কোনও পথই সামনে আর খোলা নেই। হাতে নিহত বার্কলের রক্ত।রক্ত দরজার হাতলে। ঘরে ছড়ানো নোটের বান্ডিল। অজস্র প্রমাণ। ওর একটি কথাও কেউ বিশ্বাস করবে না। বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সশব্দে ঘরের দরজা হাট করে খুলে গেল।
‘ওই‚ ওই সেই খুনে লোকটা!’ বিস্ফারিত চোখে ব্লেক দেখল‚ খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে যে চিৎকার করছে‚ সে আর কেউ নয়‚ অল্প আগে ব্যাগ হাতে সেই শয়তানটা লোকটা। বার্কলের হত্যাকারী। সঙ্গে দু’জন উর্দিধারী পুলিশ।
‘মিথ্যে কথা।’ আতঙ্কে ব্লেকের শরীর তখন হিম। সামান্য শক্তিও অবশিষ্ট নেই। তবু যথাসাধ্য চিৎকার করে উঠল।কিন্তু গলা দিয়ে কোনও শব্দ বের হল না। বরং দুটো ভারি হাত তার কাঁধের উপর চেপে বসল। ব্লেক দেখল‚ দু’জন পুলিশ হাতকড়া নিয়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে ওর দিকে। আর সেই মুহূর্তেই কানের কাছে পরিচিত কণ্ঠস্বর‚ ‘ওঠো‚ উঠে পড়ো বাপু। ঘুমিয়ে পড়েছ দেখছি!’
চমকে উঠে ব্লেক ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। চোখ মেলে দেখল রুমমেট বিশাল চেহারার ডেন তার দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে। পাশে ডিনার প্যাকেট হাতে অন্যজন। ও উঠে বসতেই সে বলল‚ ‘ব্লেক‚ রাতের ডিনার আনা হয়েছে। জম্পেশ ডিনার। এবার খেয়ে নিতে পারো।’
মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে ব্লেক তাড়াতাড়ি চোখ কচলে নিল। টেবিলের উপর খোলা কলম। কাগজের গোটা কয়েক পাতা লেখায় ভরতি হয়ে রয়েছে। মনে পড়ল‚ দারুণ গল্পের প্লটটা মাথায় আসতেই দ্রুত লিখতে শুরু করেছিল।তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছে হুঁশ নেই। তবে লাভই হয়েছে তাতে। গল্পের বাকিটা আজ রাতেই শেষ করে ফেলতে পারবে। আপাতত অবশ্য ডিনার প্যাকেটের ব্যবস্থাই বেশি জরুরী।