পুরো এলাকা জুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আমরা রাস্তায় কেউ কারো দিকে না তাকিয়ে সোঁজা হাটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ এভাবে হাটার পর আবির আমাকে জিজ্ঞেস করলো- কিরে আর কতদূর? ‘আরো দশ মিনিট হাটা লাগবে, বলেই আমি আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশটা কেমন যেন গুমট ধরে আছে। সেই সকাল থেকে মেঘলাচ্ছন্ন। সকাল প্রায় সাড়ে আটটায় বের হয়েছিলাম।
কনকনে শীতের মাঝে ঢাকা শহরে খুব তেমন একটা শীত পড়ছে না। তারপরও আজ বের হওয়ার সময় গায়ে ব্লেজার পরেই বের হলাম। কারন মফস্বলে নাকি শীত মোটামুটি আছে। রাতে যখন ফেসবুকে একটু ঢু মেরে আসি তখনই ব্যাপারটা আমার চোখে পড়লো। তাই ঠান্ডাকে মানাতে ব্লেজার নিলাম সাথে। আবিরও নিয়েছে ব্লেজার। ঢাকা শহরে অভিজাত একটা শপিংমল থেকেই এটা কিনেছিলাম। আমরা দুজনেই একই রকম চয়েজের মানুষ। তাই যাই নিবো তা দুজন একসাথেই নিই।
প্রতিদিনের মতো রাতে ফেসবুক ব্যবহার শেষে ঘুমোতে যাই রাত ১ টার দিকে। আমার আবার ফেসবুকে সময় দিতে খুব ভালো লাগে। বলতে গেলে এক ধরনের নেশার মতো। একবার ঢুকলে তিন-চার ঘন্টার বাইরে বের হই না। তাই যথারীতি আজও সব কমপ্লিট করে ঘুমোতে গেলাম। শরীর মোটামুটি টায়ার্ড থাকার কারনে সাথে সাথেই ঘুম চলে আসে।
সকাল ৮ টা বাজে ঘড়িতে। ফোন আওয়াজ করার সাথে সাথে ভাইব্রেট করে ওঠলো। আড়মোড় ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে ফোনটা হাতে নিলাম। ডিসপ্লেতে শফিক স্যারের নাম ভেঁসে উঠল। সাথে সাথেই ফোনটা রিসিব করলাম,
-হ্যালো স্যার, স্লামালাইকুম।
-অলাইকুম স্লাম। অর্ক সাহেব ঘুমোচ্ছেন নাকি?
-জ্বি, স্যার। আপনার ফোন পেয়েই মাত্র ঘুমটা ভাঙ্গলো।
-আচ্ছা, শুনুন। জরুরি একটা কারনে আপনাকে ফোনটা দিয়েছি। অফিস টাইমতো নয়টায়। কিন্তু আজ আপনাকে একটু তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। কাল অফিসের একটা প্রজেক্টের জন্য নতুন একজন ক্লাইন্টের কাছে আরাফাত সাহেবকে মুরাদপুর পাঠিয়েছিলাম। রাতেই তার কাজ শেষ করে ফিরে আসার কথা। কিন্তু, তিনি আসলেনতো না বরং একটা ফোনও দিলেন না। ব্যাপারটা কি বলুন তো? আপনি কি একটু সেখানে গিয়ে দেখবেন?
-জ্বি, আচ্ছা। স্যার আপনি আমাকে এড্রেসটা একটু টেক্সট করে দিন। আমি ফ্রেস হয়ে এক্ষুনি বের হচ্ছি।
-অকা, পারলে সাথে কাউকে নিয়ে যাবেন।
-জ্বি আচ্ছা। ওপাশ থেকে ফোন রেখে দেয়ার শব্দ হলো। কি ব্যাপার আরাফাত সাহেবতো এমনটা কখনও করেন না।
তিনি তার সকল কাজ যথারীতি শেষ করেন। এমনকি অফিসের সবাই তাকে অনেক ভালো বলেও জানে। কারন, তিনি জবের প্রতি খুব সিন্সিয়ার। নাহ্ কোনো সমস্যা হলো নাতো? ভাবতে ভাবতে আমি আবিরকে একটা ফোন দিলাম।
-হ্যালো আবির।
-হুম, অর্ক বল।
-পাঁচ মিনিটের মধ্যে তুই আমার বাসায় এসে হাজির হ। একটা জায়গায় যেতে হবে।
-ওকে, আসছি।
আবারও ফোনটা কেটে দিলাম। মাত্র দু মিনিটের দূরত্ব আমার বাসা থেকে আবিরের বাসা। আবির পাশের ফ্ল্যাটে থাকে তার পরিবারের সাথে। খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড আমার। যেকোনো বিপদ আপদে তাকে কাছে পাই। আমাকে তাড়াতাড়ি রেডি হতে হবে। ফোনটা রেখেই ফ্রেশ হতে চলে গেলাম ওয়াশরুমে।
কয়েক মিনিটের মাথায় আবির চলে আসলো আর আমিও রেডি। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম টেক্সটও ততক্ষনে চলে এসেছে।
আবির বললো, -কিরে, কই যাবি?
-আগে বের হ তারপর সব বলছি।
বলেই আমি ফোনটা প্যান্টের পকেটে রেখে দরজাটা বের হয়ে বন্ধ করে দিলাম। আসতে আসতে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললাম তাড়াতাড়ি আমাদের এই ঠিকানায় পৌঁছাতে হবে- আবিরকে টেক্সট মেসেজটা দেখালাম।
বললাম, -কিরে, ছিনোস?
আবির বললো, – হুঁ।
তাহলে চল তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে পৌছাতে হবে। রাস্তায় নেমে একটা রিক্সা নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেলাম। বেশি দূরে গাড়িতে করে যাওয়ার দূরুত্ব না হওয়ায় আমরা লোকাল বাসে উঠলাম। দুটো সিটও খালি পেয়ে গেলাম। বসতে বসতে আবিরকে বললাম শোন তাহলে, আমি আবিরকে পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম।
যতটুকু দরকার ততটুকু গাড়িতে করে এসে তারপর হাটার রাস্তা ধরলাম। ঠিকানা অনুযায়ী যেখানে যাওয়ার কথা সেই মুরাদপুরের একটা এলাকাতে ঢুকলাম। চারিদিকে কেমন যেন থমথমে একটা অবস্থা বিরাজ করছে। আমরা কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছি না। আকাশে তাকিয়ে দেখছি মেঘাচ্ছন্ন ভাবটাও কাটতে চাইছে না। এমন কেন হচ্ছে। আসলে কি কিছু ঘটেছে? আন্দাজ করে কিছুই বলতে পারছি না। রাস্তা ধরে আমরা আস্তে আস্তে আমাদের গন্থব্যে পৌঁছচ্ছি। একটু সামনে তাকালাম আমি দেখলাম দূর থেকে দলে দলে মানুষ এগিয়ে আসছে।
১১:৩১ টা। ঘড়িতে তাকিয়ে এই সময়টাই দেখলাম। দূরের মানুষগুলো আস্তে আস্তে আমাদের সামনে কাছাকাছি চলে আসলো। তাড়া ফিসফিস করে কিসের যেন কথা বলছে। অপরিচিত এলাকা বলে আমরা তেমন কারো সাথে কথা বলতে চাইলাম না। তারপরও লোকগুলো ফিসফিস কথার আওয়াজে একটা খবর শুনতে পেলাম। গ্রামে নাকি একটা অজ্ঞাত লাশ পাওয়া গেছে। হঠাৎ আমার এবং আবিরের বুকটা ছেৎ করে উঠল। মনে মনে দোয়া পড়তে লাগলাম আর খোদার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম পরিচিত কারো লাশ যাতে না হয়।
হাটছি। পকেটে হাত দিয়ে ফোনটা আবার বের করলাম। কন্ট্যাক্ট লিস্টে একটু ঢুকলাম। চ্যাক করে দেখিতো আরাফাত সাহেবের নাম্বারটার আছে কিনা। থাকারতো কথা। সেদিন অফিসের একটা পার্টিতে তার সাথে অনেক ক্লোজ হয়ে গিয়েছিলাম। যদিও বা এর আগে তার সাথে তেমন একটা কথা বলা হয়নি। তখন এক সাথে হালকা সফ্ট ড্রিংকসও নিলাম আমরা। তখনই আমরা একে অপরের নাম্বার আদান প্রদান করি। একটু স্ক্রল করলাম কন্ট্যাক্ট লিস্টটাকে। এইতো, আরাফাত সাহেব নামে ইংরেজিতে নাম্বার সেইভ আছে। সাথে সাথে ফোন দিলাম। একি! ওপাশ থেকে এসব বলছে কেন? ‘আপনার ডায়েলকৃত নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না’- বারবার এটাই বলছে। নিজেকে সান্তনা দিলাম, হতে পারে টায়ার্ড হয়ে ফোন সুইচ অফ করে ঘুমোচ্ছেন বাসায় আরাফাত সাহেব।
আবির তখন আমাকে বললো, -কিরে, কি চিন্তা করছিস?
-কিছু না, আরাফাত সাহেব ফোন সুইচ অফ পাচ্ছি। কিছুই বুঝতেছিনা।
গন্থব্যের কাছাকছি এসে গেলাম। যাওয়ার আগেই সামনে একটা ব্রীজ পড়লো আমাদের। ব্রীজের অপর প্রান্তে দেখছি অনেকগুলো মানুষের ভিড়। কিছু একটা ঘিরে তারা সবাই দাড়িয়ে আছে। দূর থেকে তাকিয়ে দেখলাম সবার চোখে মুখে দুচিন্তা আর আঁতঙ্কের ছাপ। আমরা দুজনেই সামনে এগুনো বন্ধ করে দিলাম।
ফোনটা হাতে নিলাম আবার। শফিক সাহেবের দেয়া ঠিকানার শেষে একটা নাম্বারও দিয়েছেন সেখানে একটা সংযোগ লাগালাম। রিং বাজতেই কলটা রিসিব হয়ে গেলো, -হ্যালো, অর্ক সাহেব বলুন।
-জ্বি, আমি অর্ক বল….. সরি! আপনি আমাকে চিনেন কি করে?
-প্রায় অনেক্ষন আগে আপনাদের বস আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। এবং আপনার নাম্বার সহ আপনি যে আসবেন তার সব ডিটেল্স দিয়েছিলেন। -তা ঠিক, কিন্তু কালতো আমাদের অন্য একজন এসেছিলো তার খবর কি? সে আসেনি আপনার কাছে?
-না, আপনারটার মতো তারও ফোন নাম্বার এবং আসার খবর শফিক সাহেব আমাকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত আসলেন না। একটা সময় আমি তাকে ফোন দেই কোথায় তা জানার জন্য।
প্রথম কিছুক্ষন ফোন রিং হলেও পরের কল থেকে আমি তার ফোন সুইচ অফ পাই। তারপর আপনাদের বসকে জানাই। -আচ্ছা, আমি আসছি বলেই ফোনটা রেখে দিলাম।
কেমন যেন খটকা লাগছে আমার কাছে। ভেবেছিলাম সে ঘুম দিচ্ছে কাজ শেষ করে। কিন্তু সে নাকি এখানে আসেই নি। তারপর গন্থব্যে যাওয়ার জন্য পা বাড়াই। একটু ভেবে আবার মনোস্থির করলাম সামনে কি হলো সেটা একটু দেখেই যাই বরং। সামনে গিয়ে ভিড় ঠেলে ভিড়ের ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেখলাম একটা লাশ পরে আছে। ‘ও মাই গড’ কথাটা বলেই আমি শকড হয়ে গেলাম। এ দেখি আরাফাত সাহেব। পাথর হয়ে অনেক্ষন তাকিয়ে থাকলাম লাশটার দিকে। নিথর হয়ে পড়ে আছে একটা লাশ। লাশটা দেখে মনে হচ্ছে শেষ রাতের দিকেই এর উপর অত্যাচার শুরু হয়েছে। এখনও তরতাজা মনে হচ্ছে। পাশের একটা লোক আমাকে বলতে থাকলো কিভাবে কি হলো,
লোকটি বললো, – সকাল বেলা মাটি কাটিতে কামে যাচ্ছিলাম, পথিমধ্যে দেহি এই একটা লাশ পড়ি রয়েছে। চিৎকার দিয়ে আমি মানুষেরে জড়ো করিলাম। কোইত্থেকে আইলো কেউ বলতি পারতিছি নে। এনারে চিনেন?
আমি মাথা ইষৎ নেড়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিলাম। মাথাটা আমার ভার ভার লাগছে খুব। চোখ দিয়েও কেমন যেন পানি পড়ছে। আরাফাত সাহেবের একটু কাছে গিয়ে দেখলাম ছুড়ি দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়েছে। প্রায় কয়েক জায়গায় ছুড়ির আঘাত দেখলাম।
নিজেকে অনেক শক্ত করে। আরাফাত সাহেবের মৃত দেহটাকে এম্বুলেন্সে করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলাম। হাসপাতালে আনলাম। ডাক্তারও তাকে মৃত ঘোষনা দিলো। এদিকে পুলিশি রিপোর্টও করা শেষ। সব তথ্য জানার জন্য পোস্ট মর্টেমের ব্যবস্থা করা হলো। লাশকাটা ঘরের দিকে আরাফাত সাহেবের দেহটাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দৃশ্যটা দেখেই আমার বুকটা কিঞ্চিৎ ব্যথা দিয়ে উঠল। আস্তে আস্তে আরাফাত সাহেবকে রুমের ভেতরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শেষ বারের মতো আরাফাত সাহেবের হাতটাকে ধরে দেখতে ইচ্ছে করলো।
আমি, দাঁড়ান বলে একটা শব্দ দিলাম। ডাক্তার সহ তার সাথের লোকগুলো বলে উঠলো, – কি ব্যাপার?
আমি বলে উঠলাম, – আরাফাত সাহেব মরতে পারে না।
তার মতো একজন ভালো মানুষের আরো কিছুদিন দুনিয়াতে থাকা দরকার। আল্লাহর কাছে কথাটা বলে প্রার্থনা করতে লাগলাম।
আমি তারপর আরাফাত সাহেবের হাতটা শেষ বারের মতো ধরে দেখতে হাতটা তার হাতের উপর রাখলাম। একি! আরাফাত সাহেবের হাতের পাল্সগুলো নড়ছে।
চিৎকার দিয়ে বলে উঠলাম, – বেঁচে আছে!
ডাক্তার তড়িঘড়ি করে সব চেক করে দেখলেন আর বললেন- ‘মিরাক্কেল এতো বেঁচে আছে। তাড়াতাড়ি আইসিইউ তে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।’ আর আমি উপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠলাম, – ‘আল্লাহ মহান।’