মানুষ মাত্রই রহস্যময়। সে নিজেকে সবসময় রহস্যময় রাখতেই পছন্দ করে। কিন্তু সব মানুষ যে রহস্যময়তা পছন্দ করে তা কিন্তু নয়। মানুষ রহস্যময় সে না হয় মানা গেল, কিন্তু একটা গোটা গ্রামই যদি রহস্যময় হয়ে পড়ে, তাহলে তাকে আপনি কি বলবেন? মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এমনও হয় নাকি আবার? হ্যাঁ, হয়। আমাদের চারপাশেই ছড়িয়ে রয়েছে এমন কিছু রহস্যময়তা।
আজ আপনাদের এমনই এক রহস্যময় গ্রামের গল্প বলবো, যে গ্রামটিতে অদ্ভুত এক রহস্যময়তা বিরাজ করে। গ্রামের মানুষদের মধ্যে রয়েছে আত্মহত্যা করার চরম প্রবণতা। প্রতিদিন অন্তত একটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে সেই গ্রামটিতে। কেন এই ধরনের ঘটনা ঘটে? মানুষ তো তখনই আত্মহত্যা করতে উদ্যত হয়, যখন সে দেখে তার চারপাশে কোন আশার আলো নেই, সবদিকে শুধু নৈরাশ্যময়তা। যখন আশার কোনো আলো তার হৃদয়ে অনুভূত হয় না। যখন তার অস্তিত্ব ও সত্তার কোন মূল্যবোধ অবশিষ্ট রয়েছে বলে অনুভূত হয় না। তাই না? কিন্তু তাই বলে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষকে আত্মহত্যাপ্রবণকারী হতে হবে! প্রতিবছরই বিপুল সংখ্যক লোক আত্মহত্যায় নিজেকে বিলিয়ে দেবে শুধুমাত্র আশাহীন জীবনের জন্য, তা কি মেনে নেয়া যায়? নাকি কোন অশুভ শক্তি এর জন্য দায়ী? আসুন তা হলে, নেমে পড়ি তার অনুসন্ধান করি।
আপনি কি কখনো ‘বড়ি’ গ্রামের নাম শুনেছেন? কেমন অদ্ভুত শোনায় না গ্রামের নামটি? ‘বড়ি’ গ্রামটি ভারতের মধ্যপ্রদেশের খারগোন জেলার ঝিরানিয়া তেহসিলে অবস্থিত। বড়ি বর্ধিষ্ঞ এক গ্রাম। গ্রামটি ঝিরানিয়া উপজেলা সদর দফতর থেকে ৭ কিলোমিটার এবং খারগোন জেলা সদর দফতরের ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গ্রামের মোট ভৌগলিক এলাকা ৫৭৩.৫ হেক্টর। ২০০৯ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, গ্রামটিতে ৫২২টি পরিবার বাস করতো, আর তখন জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৬৪৪জন। বর্তমানে গ্রামটিতে ৩২০টি পরিবারের বাস এবং মোট লোকসংখ্যার পরিমান কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫০০। ভারতের বেশ কয়েকটি পিছিয়ে পড়া গ্রামের মধ্যে এটিও একটি।
আত্মহত্যাকারী গ্রাম হিসেবে এই গ্রামের একটা বদনাম আছে। গত বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায়, ১১০ দিনে প্রায় ১২০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে এই গ্রামে। সাম্প্রতিক অতীতে এত বড় আত্মহত্যার ঘটনা খুব একটা শোনা যায়নি। কিন্তু গ্রামবাসীদের এক প্রবল ধারণা হচ্ছে কোন দুষ্ট আত্মাই এর জন্য দায়ী। সেই দুষ্ট আত্মাই নাকি একের পর এক গ্রামবাসীকে আত্মহত্যার জন্য প্ররোচিত করছে বলে অনেক গ্রামবাসীদেরই বিশ্বাস। তাদের মতে, অপদেবতা ভর করেছে এই গ্রামের মানুষের উপর। ২০১৬ সালের প্রথম তিন মাসে ৮০টিরর মতো আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বড়ি গ্রামে, এমনি এক তথ্য দিয়েছেন খারগোন এলাকার এসপি আমিত সিং। তিনি জানান, গ্রামবাসীরা এই আত্মহত্যার জন্য কোনও শয়তান বা অপদেবতাকেই দায়ী করছেন।
গ্রামের পঞ্চায়তের প্রধান সাংবাদিকদের জানান, গ্রামের ৩২০ পরিবারের মধ্যে প্রায় প্রত্যেক পরিবারের অন্তত একজন আত্মহত্যার শিকার। শুধু কি তাই! এই পঞ্চায়েত বর্তমান প্রধানের বড় ভাই, যিনি ছিলেন পূর্বের পঞ্চায়েত প্রধান এবং তার মা ও আত্মহত্যা করেছেন কিছুদিন আগেই। ফলে একরকম দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়েই দিন কাটাচ্ছে ‘বড়ি’ গ্রামের অধিবাসীরা।
এ ধরনের আত্মহত্যা বিষয়ে ‘টাইম অব ইন্ডিয়া’কে মনোবিদ ডা. শ্রীকান্ত রেড্ডি এক সাক্ষাৎকারে জানান, একটা গ্রামে এরকম প্রতিনিয়ত আত্মহত্যার প্রধান কারণ হতে পারে, গ্রামবাসীদের মধ্যে বিষণ্নতা, আবার সিজোফ্রেনিয়া রোগের ফলেও তা ঘটতে পারে। বিষন্নতার কারণ হিসেবে তিনি মারাত্মক পরিমাণে কীটনাশক দেওয়া ছাড়াও কৃষকদের মধ্যকার আর্থিক দৈন্যতার কথাও তুলে আনেন। দেখা যায় চাষাবাদের জন্য বা মেয়ের বিয়ের জন্য লোন করেছেন, কিন্তু সময়মতো সে অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় তাদের মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজে করে এবং পরবর্তীতে যা বিষন্নতায় রূপ নেয়।
তিনি আরও বলেন, আর্থিক কারণ ছাড়াও আরো নানা কারণে এ ধরনের বিষন্নতা হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি চীনের কথা উল্লেখ করেন। একসময় চীনের একটি গ্রামেও এধরণের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। পরে বিভিন্ন গবেষণার মধ্য দিয়ে জানা যায়, একটি বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে যেটি বিষন্নতার কারণ। অথচ মানুষ বুঝতে না পেরে এটিকে অপদেবতা বলে দায়ী করছেন। যদিও তিনি স্বীকার করেন, বড়ি গ্রামের আত্মহত্যার বিষয়ে এখনো কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমান পাওয়া যায়নি।
গত দুই দশক ধরে প্রায় ৩৫০টিরও বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল এই গ্রামটিতে। কিন্তু হঠাৎই এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং শুধুমাত্র ২০১৫-তেই এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮১ জনে।
গ্রামটি বেশ পশ্চাৎপদ। শিক্ষার হার বেশ কম, গ্রামের লোকেরা এখনো নানা কুসংস্কারে জর্জরিত। গ্রামের মানুষেরা হাসপাতালের পরিবর্তে হাতুড়ি ডাক্তারের কাছে যেতে পছন্দ করেন। গ্রামের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জিতেন্দ্র কুশওয়াহা বলেন যে, গ্রামবাসীদের কেউ আহত হলে কোন অসুখে পড়লেও তারা হাসপাতালের পরিবর্তে হাতুড়ি ডাক্তারের কাছে যায়। যারা আত্মহত্যা করেছেন তাদের অনেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। সামাজিক কলঙ্কের আশঙ্কায় তাদেরকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি।
সম্প্রতি এইধরণের আত্মহত্যার কারণ খতিয়ে দেখতে রাজ্যের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের মতামত, গ্রামবাসীদের কাউন্সেলিং করা প্রয়োজন। পরিবারের মহিলারা এ ধরণের বিষন্নতা থেকে তাদের পরিবারের সদস্যদের রক্ষার জন্য কাউন্সিরিংয়ের বিষয়ে আগ্রহী হয়েছেন। ইতিমধ্যেই এই গ্রামে মদের বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে গ্রামটি আত্মহত্যা মুক্ত হবে বলে সকলের বিশ্বাস।
গল্পের বিষয়:
রহস্য