ভূত রহস্য

ভূত রহস্য

প্রায় দেড় দশক আগের কথা। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ করে আমি আর বন্ধু রুবেল গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। প্রত্যন্ত গ্রামটির নাম চরখিরাটি, যেখানে আজ অব্দি বিদ্যুৎ যায়নি। এমন এলাকার আকাশে-বাতাসে নানা অতিপ্রাকৃত কিচ্ছাকাহিনী সব সময়ই ভেসে বেড়ায়। সন্ধ্যা নামলে খুব কম মানুষ ঘরের বাইরে বেরোয়। রাত একটু গড়ালে সামান্য কিছু ঘরে হাই স্কুলের ছেলেমেয়েদের পড়ার জন্য জ্বালানো কুপিবাতির টিমটিমে আলো ছাড়া গোটা গ্রামে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কৃষিপ্রধান অঞ্চলটার ক্ষেতেখাটা মানুষগুলো খুব তাড়াতাড়ি বিছানায় যায়। চরখিরাটি থেকে উপজেলা সদরের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। উপজেলা সদরে তখন একটাই সিনেমা হল। রুবেলের পাল্লায় পড়ে লেট নাইট শো দেখে বাড়ি ফিরছি। টেম্পোতে করে গ্রামের কাছে মেইন রাস্তায় নেমে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার হাঁটাপথ। কোনো আলো নেই। তার ওপর নামল ঝমঝম বৃষ্টি। অনেক দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল না, তাই ভাবিনি এমন বিপত্তিও হতে পারে। ঘন বজ্রপাতের সঙ্গে সেই রকম ঝড়ো হাওয়া, ভয়ই পাচ্ছিলাম মাথায় আবার বাজ না পড়ে। আমার আবার ভয়ডর একেবারেই নেই, তবে রুবেলের সাহস একটু কম। চুপচুপে হয়ে ভিজেই দুজনে হনহন করে এগোতে থাকলাম। আমার কাছে একটা তিন ব্যাটারির টর্চ ছিল, রাতে ফিরতে হবে ভেবে সঙ্গে নিয়েছিলাম। পথে একটা গোরস্তান পড়ে, যেখান দিয়ে সাধারণত রাতে কোনো মানুষ যেতে চায় না। সেটার কাছে আসতেই শুনলাম রুবেল বিড়বিড় করে সুরা-কালাম পড়ছে। এই জায়গাটা ঘিরে অনেক গল্প শুনেছি। ওখানে নাকি রাতে বিড়ালের দল রাস্তা দখল করে রাখে, বটগাছের গোড়ার নিচে ছোট বাচ্চাদের কান্নার শব্দ পাওয়া যায়, বাজার থেকে মাছ কিনে ওখান দিয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখে মাছ অর্ধেকটা খাওয়া, ঘোড়া দাঁড়িয়ে থাকে, জঙ্গলের ভেতর থেকে ভৌতিক আওয়াজ আসে কিংবা কোনো কারণ ছাড়া বাঁশবাগান রাস্তায় নুয়ে পড়ে। বিশেষত সন্তানসম্ভবা এক নারীকে কবর দেওয়ার পর থেকে প্রায়ই নাকি এখানে সাদা শাড়ি পরা এক নারীর আবছা অবয়ব দেখা যায়। অনেকেই নাকি দেখেছে। আমাদের দুজনেরই সেটি মনে পড়ল। আমি ভূতে বিশ্বাস না করলেও কেন যেন মনে হলো, একটা শীতল অনুভূতি শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষ ভূতে বিশ্বাস না করলেও ভয় কিন্তু ঠিকই পায়। তবে ভয় জেঁকে বসার আগেই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। কবরখানার যতই কাছে যাচ্ছি রুবেলের গলায় সুরা-কালামের আওয়াজ ততই বাড়ছে। গোরস্তানটা পেরোলেই আমাদের বাড়ির রাস্তা। কিন্তু কবরের কাছে আসতেই যা ঘটল, তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। বৃষ্টি ততক্ষণে ধরে এসেছে। কবরের কাছে আসতেই হঠাৎ ঠসঠস টাইপের বেশ জোরালো একটা আওয়াজ শুনলাম। খুব আজব টাইপের, একেবারেই নতুন মনে হলো। শব্দটা চলতেই থাকল। আল্লাগো বলে রুবেল ততক্ষণে চম্পট দিয়েছে। খেয়াল করলাম, ভয়ে ঘাড়ের রোমগুলো খাড়া হয় গেছে। শব্দটা আসছে একটা ভাঙা কবরের ভেতর থেকে। কী মনে করে টর্চের আলো ফেললাম কবরের ওপর। যা দেখলাম, তাতে মূর্ছা যাচ্ছিলাম আরেকটু হলেই। কবরের ভেতর মাটি সরে একটা পলিথিন বেরিয়ে এসেছে। সম্ভবত পানির প্রবেশ ঠেকাতে দেওয়া হয়েছিল। সেই পলিথিনটা কবরের ভেতর থেকে কেউ টোকা দিচ্ছে আর তাতেই ওই শব্দ! পলিথিনটা রীতিমতো উঁচুনিচু হচ্ছে, যেন কেউ ওপরমুখে ঠেলছে! আমার গলা শুকিয়ে কাঠ, পা দুটি চঞ্চল হয়ে উঠছে! দৌড় দিতে চাচ্ছি; কিন্তু পা সরাতে পারছি না। মনে হলো, আজই আমার শেষ। ভয়ে ভয়ে কবরখানার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ দেখি, পলিথিনটার নিচ থেকে একটা লম্বাটে আকারের কিছু বেরিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ বন্ধ! আমি ওটার দিকে টর্চ তাক করলাম। তখনই হাসতে হাসতে আমার পেটে খিল ধরার জোগাড় হলো। একটা বিশাল ধেড়ে ইঁদুর পলিথনের নিচে আটকা পড়েছিল। ততক্ষণে রুবেল আশপাশের পাড়ার লোকজনসমেত হাজির। লাঠি, বল্লম, হারিকেন, টর্চসহ ডজনখানেক লোক চলে এসেছে আমাকে কবরখানার প্রেতাত্মার হাত থেকে বঁাঁচাতে, যার নেতৃত্বে আছেন গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেব স্বয়ং। আমি ঘটনা ব্যাখ্যা করলাম। সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, আমি রহস্যটা ধরতে না পারলে, সকালের মধ্যেই একটা নতুন কিচ্ছা ডালপালা মেলত। আগামীকাল থেকে ওই পথ দিয়ে সন্ধ্যার পর আর কাউকেই চলতে দেখা যেত না বহুকাল পর্যন্ত। গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে এমন ধরনের যেসব ঘটনার কথা শোনা যায়, তার পেছনের অন্ধকারটুকু আজ পরিষ্কার হলো। আসলে প্রতিটি ঘটনাই খুব স্বাভাবিকভাবে ঘটে; কিন্তু সেটির প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন না করেই মানুষ ঘটনাস্থল থেকে কেটে পড়ে আর পরে তার একটা আধা-কাল্পনিক বিবরণ দেয়। লোকের মুখে মুখে সেটিতে আরো রং চড়ে! তারপর একেকটা কাহিনী হয়ে ওঠে সে তল্লাটের কিংবদন্তি ভৌতিক গল্প।

গল্পের বিষয়:
রহস্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত