শিশুটির হৃদস্পন্দন থেমে গেছে।
শিশুটির কিশোরি মা নুরুন্নাহার তাকে কোলে করে মুর্তির মত বসে আছে। একটু আগেও শিশুটি কাঁদছিল, তীব্র শ্বাস কষ্টে হাত পা ছুড়ছিল। জ্বরে শিশুটির গা পুড়ে যাচ্ছিল। এখন তার কান্না থেমে গেছে। ছোট্ট উত্তপ্ত শরীরটা খুব দ্রুত উষ্ণতা হারাচ্ছে। নুরুন্নাহার শিশুটিকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছিল। যেন যমদূত কিছুতেই তার বাবুকে ছিনিয়ে নিতে না পারে। সে এখনো মৃত শিশুটিকে কোল ছাড়া করছে না। কেউ শিশুটির কাছাকাছি আসলেই চিলের মত চিৎকার করে উঠছে।
শিশুটির বাবা আবুল করিম অশ্রু সজল চোখে নুরুন্নাহারকে প্রবোধ দিতে চাইল, “প্লিজ একটু শান্ত হও। এখন তো সবি শেষ। যা হয়ার তা হয়ে গেছে। আমাদের যা গেছে তা আর ফিরে আসবে না।”
নুরুন্নাহার দুই চোখে প্রবল অবিশ্বাস নিয়ে স্বামির দিকে তাকাল। ওর কিশোরি চোখে আগুনের আচ পেয়ে আবুল করিম আর কথা বলল না। বউয়ের কাছ থেকে সরে গিয়ে মা’কে বলল, “আচ্ছা আরও থাকুক কিছুক্ষণ। মায়ের মন তো।”
বাবুর জ্বর সেই সন্ধ্যা থেকে। সাথে প্রবল শ্বাস কষ্ট। আবুল করিমকে বারবার বলার পরেও সে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি। বলেছে, “বাচ্চা মানুষের এমন একটু জ্বরজারি হয়। চিন্তার কিছু নেই । এমনি সেরে যাবে। আজকের রাতটা যাক। আগামীকাল অবস্থার উন্নতি না হলে তখন দেখা যাবে।” বাবু অবশ্য আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেনি। রাত একটা বত্রিশের দিকে বাবুর প্রচন্ড হেঁচকি দিয়ে কাপুনি শুরু হয়। তার দুই মিনিট পরেই বাবু নিঃশব্দ হয়ে যায়। এখন ঘড়ির কাটা প্রায় তিনটা ছুই ছুই। এই গভীর রাতেও ঘর ভর্তি অনেক মানুষ। পাশের বাসার ভাবি এসেছে। আবুলের এক চাচা কাছেই থাকেন। খবর পেয়ে তিনিও ছুটে এসেছেন। বারবার বলছেন, তাকে কেউ কেন আগে খবরটা দিল না। আগে জানলে তিনি নিজেই নাতিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতেন। অবশ্য এখন আসলে কারোরই কিছু করার নেই। যশোরের এই অঞ্চলে এতো গভীর রাতে কোনো ডাক্তার পাওয়া অসম্ভব।
সমস্যা হয়েছে বাচ্চার মা’কে নিয়ে। সে কেমন পাগলের মত হয়ে গেছে। বাচ্চাটাকে কারো হাতে দিচ্ছে না, কোন কথাও বলছে না। অবশ্য পাগলের মত হয়া স্বাভাবিক। মেয়েটার বয়স মাত্র উনিশ। এরই মধ্যে দু’বার মা হয়েছে। প্রথম বাচ্চাটা পেটে থাকতেই নষ্ট হয়ে যায়। তার দুই বছর পর বাবু’র জন্ম। দেখতে যেন চাঁদের মত। আর এক হপ্তা গেলেই বাবুর বয়স এক বছর পুর্ন হত।
নুরুন্নাহারের হঠাত মনে হল তার বাচ্চাটা হঠাত একটু নড়ে উঠল। কি ব্যপার! ওর কি সত্যি সত্যি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে!! না, না, ওই তো। ওই তো বাবুর আঙুলগুলো নড়ছে। নুরুন্নাহারের দম বন্ধ হয়ে এল। সেকি চোখে ভুল দেখছে। নাকি… নাকি সত্যি সত্যি তার বাবু বেঁচে আছে? একটু পর বাবু চোখ মেলে তাকাল। মায়ের দিকে ছোট্ট হাত বাড়িয়ে দিল। নুররুন্নাহার চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে চাইছে। কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন কথা আসছে না। ওর দুই চোখ পানিতে ভরে উঠছে।
বাবু বেঁচে আছে।
বাবু বেঁচে আছে।
তার বাবু মরেনি। বাবু বেঁচে আছে।
নুরুন্নাহার শক্ত করে বাবুকে বুকের সাথে চেপে ধরল। বাবুও দুই হাতে মায়ের গলা জরিয়ে ধরল। তারপর হা করে কামড় বসাল মায়ের গলায়। নরম ত্বকে বাবুর ছোট্ট ছোট্ট দাঁতগুলো কেটে বসে গেল।
একটু পর আবুল করিম ঘরে প্রবেশ করে তার জীবনের সবচে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি দেখল। নুরুন্নাহার তার সন্তানকে বুকে চেপে বসে আছে। তার চোখে আশ্রু কিন্তু মুখ ভর্তি হাসি। সে কান্নামিশ্রিত গলায় বলল, “বাবু বেঁচে আছে।” বাবু তখন তার মায়ের গলা কামড়ে অনেকখানি মাংস তুলে এনেছে। টকটকে লাল রক্তে নুরুন্নাহারের বুক ভেসে যাচ্ছে। সে অবশ্য কোন ব্যথা বা যন্ত্রণা অনুভব করছে না। বাবু বেঁচে আছে এটা ছাড়া আর কিছু তার মাথায় কাজ করছে না। ওর বুক জুড়ে কেবল একটা উষ্ণ অনুভূতি।
***
সকাল দশটা বাজে।
শাহেদ বিছানায় বসে আড়মোড়া ভাঙল। পাশে নিশিতা নেই। বাথরুম থেকে পানি গড়ানোর আওয়াজ আসছে। নিশিতা নিশ্চয়ই শাওয়ারে। শাহেদ মুচকি হাসল। গত রাতের স্মৃতি টুকরো টুকরো মনে পড়ছে। বিছানায় নিশিতা যেন পাগল হয়ে গিয়েছিল। আঁচরে কামড়ে কিছু রাখেনি। ওহ, হোয়াট আ নাইট!
বড় করে হাই তুলে বিছানা ছাড়ল শাহেদ। বাথরুমের দরোজা খোলা। দরোজার ফাঁক দিয়ে একটু একটু পানি গড়িয়ে পড়ছে মেঝেতে। কি ব্যপার? নিশিতা তো কখনো এভাবে দরোজা খোলা রেখে গোসল করে না। শাহেদ দরোজায় টোকা দিতে গিয়েও থেমে গেল। দুষ্ট বুদ্ধি উঁকি দিচ্ছে ওর মাথায়। দরোজা ফাঁক করে ভেতরে উঁকি দিল ও। নিশিতা শাওয়ার ছেরে বাথটাবে দাঁড়িয়ে আছে। পিঠ দরোজার দিকে ফেরানো। ওর দিঘল কালো মেঘের মত চুল ভিজে লেপ্টে আছে মসৃন পিঠের সাথে। নগ্ন কাঁধ বেয়ে নেমে আসছে জল ধারা। শাহেদ পা টিপে টিপে প্রবেশ করল বাথরুমে। নিশিতাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে চমকে দেবে। সেইসাথে আরও একশটা দুষ্ট বুদ্ধি খেলে যাচ্ছে শাহেদের মাথায়।
নিশিতার কাঁধ স্পর্শ করে একটু চমকে গেল শাহেদ। বরফের মত ঠান্ডা। কতক্ষণ ধরে শাওয়ারে ভিজছে নিশিতা? শাহেদের স্পর্শে নিশিতা চমকালো না। আলতো ভাবে শাহদের হাতটা স্পর্শ করল। যেন এই মুহুর্তে ওকেই এখানে আশা করছিল। শাহেদ ঝুঁকে নিশিতার কাঁধে চুমো খেল। কানে ফিসফিস করে বলল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।” নিশিতা উত্তর দিল না। শাহদের গালে গাল ঠেকাল। ইস নিশিতার গালটা এত ঠান্ডা কেন!!
নিশিতা শাহেদের হাতে অদ্ভুত ভাবে ঠোঁট বুলাচ্ছে। শাহেদের ভালো লাগছে না। ওর হাতের কব্জিতে নিশিতার আঙুলগুলো যেন ক্রমেই চেপে বসছে। একবার হাতের ত্বক ছুঁয়ে গেল নিশিতার দাঁত। শাহেদ হাত টেনে নেবার চেষ্টা করল। নিশিতা এবার আরো শক্ত করে চেপে ধরল।
“নিশি… কি করছ?…”
নিশিতা সরাসরি তাকালো শাহেদের দিকে। ওর চোখের দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে গেল শাহেদ। কেমন প্রাণহীন পাথরের মত চোখ। শাহেদ জোর করে হাত ছুটিয়ে নিল। নিশিতা ঘুরে দাঁড়িয়ে শাহেদের মুখোমুখি হল। ওর ঠোঁট সরে গিয়ে ধারালো দাঁতের সারি বের হয়ে এসেছে। মুখ দিয়ে কেমন একটা জান্তব ঘড়ঘড় আওয়াজ করছে।
শাহেদ তাড়াহুড়ো করে বাথটাব থেকে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেল মেঝেতে। টাইলসের মেঝেতে মাথা ঠুকে গেল। শাহেদের দৃষ্টি কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথার পেছন দিকে কেটে গিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। নিশিতাও বাঠটাব থেকে নামে পড়ল। পায়ে পায়ে এগিয়ে এল শাহেদের দিকে। ভেজা মেঝেতে পা ঘসে পিছিয়ে গেল শাহেদ। সেই সাথে অনুনয়ের কন্ঠে বলল, “নিশি… এমন করছ কেন?… কি হয়েছে তোমার??…” উত্তরে আরো একবার জান্তব ঘড়ঘড় আওয়াজ ভেসে এল নিশিতার মুখ থেকে।
বাথরুমের দরোজা ঠেলে বেডরুমে চলে এল শাহেদ। ওর পিছু নিয়ে ধির পায়ে এগিয়ে আসছে নিশিতা। নিশিতার মাথাটা অদ্ভুত ভাবে বেঁকে আছে শরীরের একপাশে। প্রতিবার পা ফেলার সাথে সাথে ভয়ঙ্কর ভাবে ঝাকি খাচ্ছে। যেন যে কোন মুহুর্তে ধঢ় থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে। নিশিতার মুখ খোলা। জিভ বেড়িয়ে আছে। সেই জিভের রঙ কুচকুচে কালো। শাহেদ ভয় পেয়ে ডেসিং টেবিল থেকে সিরামিকের ফুলদানিটা হাতে তুলে নিল। ওটা শক্ত করে ধরে বলল, “নিশি।। প্লিজ থামো… আর কাছে এস না।” শাহেদের হুমকিতে উল্টো ফল হল। একটা চাপা হুঙ্কার ছেরে নিশিতা বুলেটের মত ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল শাহেদের উপর। হঠাত ধাক্কা সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেল শাহেদ। ওর বুকের উপর চরে বসল নিশিতা। দুই হাতে চেপে ধরেছে শাহেদের গলা। আর মাথা নামিয়ে কামড় বসাতে চাইছে ওর ঘাড়ে। শাহেদ দুই হাতে ঠেলেও নড়াতে পারছে না ওকে। শাহেদের গলা থেকে আর ইঞ্চি খানেক দূরে রয়েছে নিশিতার হিংস্র চোয়াল। হাত থেকে পড়ে দূরে সরে গেছে ফুলদানিটা। শাহেদ এক হাত বাড়িয়ে পাগলের মত একটা অস্ত্র খুঁজছে। আরেক হাতে ঠেকিয়ে রেখেছে নিশিতার মুখ। ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ দুটো জলে ভরে উঠছে। নিশিতার খোলা মুখ থেকে আঠালো লালা ঝরছে শাহেদের মুখে। ওর বুক জালা করছে। আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না নিশিতাকে।
শেষ একটা গর্জন করে নিশিতা কামড় বসাল শাহেদের গলায়। আর ঠিক সেই মুহুর্তে নিশিতার মাথায় আঘাত করল শাহেদ। ওর হাতে ধরা ছিল ফুলদানির একটা ভাঙা টুকরো। তেকোনা ধারালো টুকরোটা ঘ্যচ করে ঢুকে গেল নিশিতার মাথায়। শাহেদের বুকের উপরই পড়ে গেল নিশিতার নিথর দেহ। শাহেদের মনে হল ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।
এরপর কি থেকে কি হল শাহেদ পরিষ্কার বলতে পারবে না। কতক্ষণ সে মেঝেতে শুয়ে ছিল কে জানে।
ওর যখন আবার বোধ ফিরল তখন সে আবিষ্কার করল ঘরের দরোজা ভেঙে একদল কালো পোশাকের সশস্ত্র র্যাব সদস্য বেডরুমে প্রবেশ করেছে। কারা ওদের খবর দিয়েছে কে জানে। দেখতে দেখতে সাংবাদিক আর উৎসুক মানুষের ভির জমে গেল বাসার সামনে।
এরপরের সব ঘটনা ঘটে গেল একের পর এক বিদ্যুৎ চমকের মতো। অকল্পনীয় দ্রুততার সাথে পুলিশ ও র্যাব মিলে নিশিতার লাশ সরিয়ে ফেলে ক্রাইম সিন ক্লিন করে ফেলল। নিশিতার সেলফোন, ল্যপটপ, ডায়রি ইত্যাদি এভিদেন্স হিসেবে বায়জেয়াপ্ত করা হল। কোন ফটোগ্রাফারই নিশিতা বা শাহদের ছবি তোলার সুযোগ পেল না। শাহেদকে আসামি করে রমনা থানায় খুনের মামলা করা হল। আহত শাহেদকে হাসপাতালে না নিয়ে চরম নিরাপত্তার মাঝে থানায় স্থানন্তর হল। পরদিন কোর্টে শাহেদের পক্ষ থেকে ওর উকিল বন্ধু আরিফ জামিনের সব রকম চেষ্টা করল। তাতে কোন লাভ হল না। জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হল। কোর্ট তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করল। রিমান্ডে শাহেদকে ইলেকট্রিক শক দেয়া হল। তবে মজার ব্যপার হচ্ছে পুলিশ ওর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করতে চাইছে না। তারা শেষ একমাসে নিশিতার সাথে ওর কি কি কথা হয়েছে সেগুলো বারবার জানতে চাইছে। শাহেদ প্রতিবার তাদের একই কথা বলছে। কিন্তু পুলিশের মন ভরছে না। তারা ভাবছে শাহেদ কিছু কথা গোপন করে যাচ্ছে। তিন দিনের রিমান্ড শেষে শাহেদকে কারাগারে ফেরত পাঠানো হল না। তার সাথে কাউকে দেখাও করতে দেয়া হল না। এমনকি তার উকিল কেও না। আরো পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে কোর্টে আবেদন করা হল। তবে এবার আরিফের চেষ্টায় কাজ হল। রিমান্ডের আবেদন নাকচ করে শাহেদকে কড়া শর্তে জামিন দেয়া হল। জামিনের পর পরই আরিফ ওকে ধরে সোজা নিয়ে গেল হাসপাতালে। শাহেদের শরীরের যা অবস্থা তাতে আর এক দিন জেলে থাকলেই ও মারা পড়ত।
শাহেদের সুস্থ হতে এক হপ্তার মত সময় নিল। এই সময় আরিফের মুখ থেকে ও অদ্ভুত কিছু খবর পেল। নিশিতা পেশায় ছিল সাংবাদিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিজমে অনার্স করে নিউ এইজ পত্রিকায় জয়েন করেছে এক বছর হল। ওর মৃত্যুতে সাংবাদিক মহলে ঝড় উঠবে এটাই স্বাভাবিক। অথচ এটা নিয়ে নাকি কারো মাঝে তেমন কোনো ভাবান্তর নেই। এমনকি ওর নিজের পত্রিকা নিউ এইজ ও বিষয়টা নিয়ে কিছু দিন লেখালিখি করে তারপর ঝিম মেরে গেছে। নিশিতার পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বলা হয়েছে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মৃত্যু। রিপোর্টের অনেক অংশই অস্পষ্ট। মৃত্যুর আগে নিশিতা যে হিংস্র আচরন করছিল তার কারন সম্পর্কে কিছু উল্লেখ নেই। আসামি পক্ষের উকিল হয়েও আরিফ বায়জেয়াপ্ত করা নিশিতার ল্যপটপ বা সেলফোন দেখার সুযোগ পায়নি। নিশিতার বাবা মা লন্ডনে থাকে। তাদের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। তারা মেয়ের মৃত্যুর খবর জানেন কিনা সেটাও পরিষ্কার না। দেশে ওর তেমন কোন আত্মিয় নেই। নিশিতার লাশ এখন আছে সিএমএইচ হাসপাতালের মর্গে। ডেডবডি কাউকে দেখতে দেয়া হচ্ছে না। কবে ডেডবডি হস্তান্তর করা হবে সেটাও কেউ বলছে না।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার দিন শাহেদের কাঁধ ছুঁয়ে আরিফ বলল, “সাবধান থাকিস। কত বড় বিপদে যে জড়িয়েছিস আমি নিজেই ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছি না। গত কাল আমার ফোনে আননোউন নম্বর থেকে ফোন করে হুমকি দিয়েছে। মনে রাখিস এখন আমরা কেউই নিরাপদ নই।”
বাড়ি ফেরার পথে শাহেদ টের পেল পেছনে ফেউ লেগেছে। নিল একটা মাইক্রোবাস ওকে বাসা পর্যন্ত ফলো করল। ওরা কি সারা দিনরাত নজর বসানোর ব্যবস্থা করেছে নাকি!!
শাহেদ প্রথমেই চেষ্টা করল নিউ এইজ পত্রিকার এডিটর বা সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে দেখা করতে। ও জানতে চায় নিশিতা সাম্প্রতিক কি বিষয়ে ইনভেস্টিগেট করছিল। কাজের ব্যপারে নিশিতার সাথে ওর তেমন একটা কথা হত না। তবে ওকে মৃত্যুর আগের এক সপ্তাহ একটা কিছু নিয়ে বেশ এক্সাইটেড মনে হচ্ছিল। কিন্তু সাংবাদিকরা কেউই শাহেদকে সময় দিলেন না। নিশিতার নাম শোনা মাত্র সবাই কেমন যেন মিইয়ে যান। ব্যপারটা নিয়ে সবার ভেতর চাপা একটা ভিতি কাজ করছে বুঝা যায়। সবাই যেন নিশিতাকে দ্রুত ভুলে গিয়ে হাফ ছাড়তে চায়। নিশিতার বাবা মা’র ও পাত্তা নেই। শাহেদের সাথে তাদের আগে কখনো কথা হয়নি। নিশিতার সাথে তার বাবা মা’র সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না। নিশিতা তাদের সাথে ঝগড়া করেই দেশে চলে আসে। ঢাকায় নিশিতার এক ফুপুর বাসা শাহেদ চেনে। সেই ফুপুর বাসায় গিয়ে দেখা গেল বাড়িতে কেউ নেই, সদর দরোজায় তালা ঝুলছে। এরপর শাহেদ যে ডাক্তার নিশিতার পোস্ট মর্টেম করেছে তার খোঁজ করল। জানা গেল ডক্টর দেশের বাইরে আছেন। তার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা গেল না। তবে পোস্টমর্টেম নিয়ে খোঁজ খবর করতে গিয়ে শাহেদ একটা নতুন তথ্য জানতে পারল। আরিফ বোধ হয় ইচ্ছে করেই এই তথ্যটা গোপন করে গেছে। নিশিতা দুই মাসের প্রেগন্যেন্ট ছিল।
এত কিছুর পরেও শাহেদ দমে গেল না। সে বুঝতে পারছে তার গতি বিধির উপর সারাক্ষন নজর রাখা হচ্ছে। ওর সেলফোনে আড়িপাতা হচ্ছে। এমনকি ও যাদের যাদের সাথে কথা বলে তাদের উপরেও নজর রাখা হচ্ছে। শাহেদ তাই এবার ভিন্ন পথে চেষ্টা চালাল। সে বুয়েটের সিএসসি’র টপ স্টুডেন্ট। নেটয়ার্কিং এর উপর ওর নিজের দুইটা পেপার আছে। টরেন্টো ইউনিভার্সিটিতে ওর স্কলারশিপ প্রায় নিশ্চিত। শাহেদ আগে কখনো হ্যকিং করেনি। কিন্তু হ্যকিং কিভাবে করতে হয় সেটা ওর চেয়ে ভালো বাংলাদেশে খুব কম মানুষই জানে। শাহেদ তার ল্যপটপে বসে দুই ঘন্টার মাথায় পুলিশের বায়জেয়াপ্ত করা নিশিতার সেলফোন হ্যাক করে ফেলল। মিনিট খেনেকের মধ্যেই নিশিতার পুরো কল লিস্ট, কন্টাকক্টস, ম্যেসেজ, রেকর্ডিংস, ডেইলি টাস্ক লিস্ট সব চলে এল শাহেদের কাছে।
চায়ের দোকানে বসে কালো চশমা পড়া লোকটা নজর রাখছে শাহেদের ফ্ল্যটের দিকে। আজ সারা দিন শাহেদ ঘর থেকে বের হয়নি। সকালে একবার বারন্দায় এসেছিল। তারপর আর পাত্তা নেই। অবশ্য জানালায় আলো জ্বলছে। ভেতরে মানুষের চলাচলের শব্দ হচ্ছে। বঝা যায় শাহেদ বাসায়ই আছে। তারপরেও কালো চশমা ব্যপারটা কনফার্ম করতে চাইল। গলির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা নিল মাইক্রোবাস থেকে কনফার্ম করা হল শাহেদ বাসায় আছে। একটু আগেই সে বন্ধু আরিফের সাথে ফনে কথা বলেছে। সে নাকি আজ সারা দিন ঘর থেকে বের হবে না। বিকেলের দিকে আবার শাহেদকে দুই সেকেন্ডের জন্যে বারান্দায় দেখা গেল। কালো চশমার খটকা কাটল না। লোকটা করছেটা কি? শাহেদ বেশ সাস্থ সচেতন মানুষ। সকাল বিকাল দুই বেলা নিয়ম করে দৌড়াতে বের হয়। আজ সেটাও বন্ধ। নিশ্চয়ই কোন ঝামেলা আছে।
অবশেষে আর অপেক্ষা করতে না পেরে সে সিড়ি বেয়ে শাহেদের ফ্ল্যটে উঠে এল। দু’বার কলিং বেল বাজাতে ওপাশ থেকে সাড়া এল, “কে??”
“শাহেদ সাহেব। দরোজা খুলুন। আমি ডিবি অফিস থেকে এসেছি।”
“খুলছি, দাড়ান”
তারপর এক মিনিট কেটে গেল কোন সাড়াশব্দ নেই। অধৈর্য হয়ে কালো চশমা আবার বেল বাজালো। এবার সুইচ চেপে ধরেই থাকল। অবশেষে খুট করে দরোজা খুলে গেল। কালো চশমার মুখ কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেল।
“আপনি…??”
আরিফ হাসি মুখে উত্তর দিল, “শাহেদ বাসায় নেই। কোথায় গেছে জানি না। ও যে কয়দিন না থাকে আমাকে ওর ফ্ল্যাটে এসে থাকতে বলেছে।”
কালো চশমা পাগলের মত সেলফোনে কারো সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে লাগল। শাহেদ ততক্ষনে বাসে যশোরের উদ্দ্যেশে অর্ধেক পথ পেড়িয়ে গেছে।
(চোখের সামনে জলজ্যান্ত নিশিতা পরিনত হল হিংস্র জম্বিতে। নিশিতাকে খুনের দায়ে ফেসে গেল তার প্রেমিক শাহেদ। পুলিশের নজর এড়িয়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে সে। যেভাবেই হোক, দলে দলে জীবন্ত মানুষের ক্ষুধার্ত দানবে পরিনত হবার রহস্য ভেদ করতেই হবে তাকে)
শাহেদ যখন শিলাহাটি বাস স্টেশনে নামল তখন রাত হয়ে গেছে। পথে ফেরিতে দেরি হয়ে গেছে। নয়ত দিনের আলো থাকতে থাকতেই পৌছানো যেত। এখানে সে কার বাসায় উঠবে কিচ্ছু ঠিক করে আসেনি। তার প্রথম লক্ষ নিয়ামুল করিম নামে একজন ডাক্তারকে খুঁজে বের করা। তারপর কোথায় রাত কাটানো যায় ভেবে দেখা যাবে। মৃত্যুর আগে নিশিতা যেই কেস ইনভেস্টিগেট করছিল তার সাথে নিয়ামুল করিম ডাক্তারের সম্পর্ক আছে। নিয়ামুলের সাথে নিশিতার বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। ওর মৃত্যুর আর ঠিক একদিন পরেই নিয়ামুল করিমের সাথে নিশিতার দেখা করার কথা। নিয়ামুল করিম শিলাহাটির একমাত্র সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার। একজন মফস্বলের ডাক্তারের সাথে নিশির কি এমন জরুরি কাজ থাকতে পারে?
শিলাহাটি সরকারি হাসপাতালের মুল কেচি গেইট তালাবদ্ধ। ইমার্জেন্সিতে খোঁজ করতে গেলে মোটা মত এক মহিলা রুক্ষ স্বরে জানিয়ে দিল, “এখন কোন রুগী দেখা হবে না। এত রাতে কোত্থেকে আসছেন? যান, যান।” শাহেদ যখন বলল সে ডাক্তার নিয়ামুল করিমের সাথে দেখা করতে এসেছে, শুনেই মহিলা চোখ বড় বড় করে তাকাল। বলল, “নিয়ামুল করিম নামে এখানে কোন ডাক্তার নেই।” শাহেদ রেগে গিয়ে বলল, “কি বলছেন এসব? নিয়ামুল করিম এখানেই কাজ করেন আমি ভালোভাবে খোঁজ নিয়েই এসেছি। আপনি একটু চেক করে দেখুন।” মোটা মহিলা ততোধিক রুক্ষ কন্ঠে বলল, “আমি কিছু জানি না। আপনি অন্য কারো সাথে কথা বলেন।” অন্য আর কার সাথে কথা বলতে হবে জিজ্ঞেস করলে মহিলা পরিষ্কার কোন জবাব দিল না। হতাশ হয়ে রিসেপশন ডেস্ক থেকে সরে আসার সময় শাহেদ চোখের কোন দিয়ে লক্ষ করল সেই মুটি টেলিফোনে যেন কার সাথে হড়বড় করে কথা বলছে। শাহেদ হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ইট বেছানো পথে উঠতেই দেখতে পেল দূরে অন্ধকারে বড় দুটো হেডলাইট ক্রমেই এগিয়ে আসছে। পুলিশের গাড়ি!! শাহেদ পথ থেকে চট করে নেমে পড়ল পাশের বাঁশ ঝারে। বড় একটা জিপ গাড়ি এসে থামল হাসপাতালের গেটে। কিন্তু জিপ থেকে যারা নামল তারা কেউ পুলিশ নয়। তাদের শরীরে আর্মির ইউনিফর্ম!!!
শাহেদ অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সরে এল। একটু পরে সামনে একটা লোকালয় পড়ল। ছড়ানো ছিটানো বেশ কিছু টিনের ঘর। কিছু পাকা দালানও রয়েছে। গ্রাম দেশে রাত আটটা মানেই অনেক রাত। কিন্তু তাই বলে এত জলদি সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে বিশ্বাস করা যায় না। অথচ কোন বাড়িতেই আলো জ্বলছে না। কারো কোন সাড়াশব্দ নেই। এমনকি একটা কুকুর বা ঝিঝি পোকাও ডাকছে না। চারিদিক কেমন থমথমে। শাহেদের পিঠ সিরসির করে উঠল। গ্রামের মানুষ জন সব কোথায়?
“কে যায়?”… জড়ানো কন্ঠটা শুনে চমকে আরেকটু হলে পরেই যাচ্ছিল শাহেদ। ফিরে তাকিয়ে দেখল তাল গাছের নিচে গায়ে চাদর জড়িয়ে বসে আছে একটা মানুষ। অন্ধকারে চেহারা বুঝা যাচ্ছে না। শুধু তার মুখে জ্বলন্ত সিগারেটের আগুনটা দেখা যাচ্ছে। শাহেদের মনে প্রথম যে চিন্তাটা এল সেটা হচ্ছে,… তাল গাছের নিচে… ভুত না’তো!! পর মুহুর্তেই নিজেই হেসে ফেলল। সে সিএসি’র ছাত্র। অথচ এখন ভুতের ভয় পাচ্ছে। আসলে পরিবেশটাই এমন থমথমে যে…।
লোকটার কাছে গিয়ে শাহেদ বুঝল মানুষটা গাঁজা টানছে। বুয়েটের হলে থেকে এই গন্ধের সাথে তার ভালোই পরিচয় হয়েছে। সে নিজেও টেনে দেখেছে দু’একবার। মানুষটি ঢুলুঢুলু চোখ তুলে বলল, “আপনি কে? এই এলাকায় আগে দেখছি বলে তো মনে হয় না।” শাহেদ নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, “আমি ঢাকা থেকে এসেছি ডাক্তার নেয়ামুল করিমের কাছে। তাকে চেনেন? সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার।”
“করিম ডাক্তাররে বেবাক্তেই চেনে।” নেশাতুর মানুষটি জবাব দেয়।
“বাহ, তাই নাকি! তাকে কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন?” শাহেদ উৎসুক হয়ে বলে।
“তারে তো পাইবেন না। তারে পুলিশ থানায় নিয়া গেসে।”
“থানায় নিয়ে গেছে? কেন?”
“হে অষুধ দিয়া বাচ্চা মারে। কচি বাচ্চা’র কলিজা কচকচাইয়া খায়।”
“কি বলছেন এসব…??” শাহেদ আঁতকে ওঠে। নেশাসক্ত মানুষটি বলে, “আমার কথা বিশ্বাস করলেন না? আমার বাচ্চারেও খাইসে ওই করিম ডাক্তার। কি সুন্দর ছিল আমার বাচ্চাটা।। এক্কেবারে চান্দের মতন…”
“আপনার নাম কি?”
“জি… আবুল করিম…”
“আচ্ছা… এখানে সবকিছু এত নিরব কেন? মানুষ জন কই??”
“সুর্য ডুবলে মানুষ আর ঘর ছাইড়া বের হয় না। ঘরে কুলুপ লাগাইয়া বইসা থাকে।”
“কেন?”
“ভয় পায়”
“কিসের ভয়??”
“মড়া মানুষের ভয়।” বলেই আবুল করিম খুন খুন করে হেসে উঠে। হাসতে হাসতেই তার ব্যপক কাশি পায়। মানুষটা মাটিতে বাঁকা হয়ে পরে কাশতে থাকে। এই সময় তীব্র একটা টর্চের আলো এসে পরে শাহেদের মুখে। শাহেদ কপালের উপর হাত তুলে টর্চের মালিককে দেখার চেষ্টা করে। একজন লম্বা চওড়া বলিষ্ঠ মানুষ টর্চ হাতে হেঁটে আসছে। তার পড়নে পুলিশের ইউনিফর্ম। শাহেদ ঘুরে দৌড় দেবে কিনা বুঝতে পারে না। ও সিদ্ধান্ত নেবার আগেই পুলিশটি তার কাছে পৌছে যায়।
“আপনি কে? এত রাতে এখানে ঘুরাফেরা করছেন কেন?”
“জি আমি… আমি শাহেদ। ঢাকা থেকে এসেছি।” ও ভয়ে ভয়ে উত্তর দেয়। পুলিশটি সাথে সাথে ওর হাত চেপে ধরে বলে, “ওহহ।। আপনিই… চলুন আমার সাথে থানায় চলুন…” শাহেদকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাতে হ্যন্ডকাফ পড়িয়ে দেয়া হয়। তারপর তাকে থানার দিকে হাটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। হাঁটতে হাঁটতে শাহেদ আবার চেষ্টা করে,
“আমাকে কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে সেটা তো অত্যন্ত বলুন।” পুলিশটি জবাব দেয়, “আপনি ফেরারি আসামি। সাংবাদিক নিশিতা হত্যার মামলায় ঢাকার পুলিশ আপনাকে খুঁজছে। আজ রাতেই থানার সবাইকে এলার্ট করে দেয়া হয়েছে আপনাকে এই অঞ্চলে দেখা মাত্র যেন গ্রেফতার করা হয়।” শাহেদ বলে, “দেখুন আপনি ভুল করছেন। আমি বুয়েটের ছাত্র। আমাকে দেখে কি আপনার খুনি বলে মনে হয়?”
পুলিশটি হেসে ফেলে বলে, “আপনার কি মনে হয় আমরা চেহারা দেখে কে খুনি কে নিরাপরাধ যাচাই করি? আমার উপর যেই নির্দেশ আছে আমি সেটা পালন করছি। আপনি খুনি না ভালো মানুষ সেটা থানায় গেলেই বুঝা যাবে।”
শাহেদ বুঝল এই গোয়ার পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যাবেই। সে মরিয়া হয়ে পুলিশটাকে ধাক্কা দিয়ে পথের পাশে লাফিয়ে পরে। তারপর অন্ধের মত ঝোপঝাঁর মারিয়ে দৌড় লাগায়। পুলিশটি চমকে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে শাহেদের পিছু নেয়। অন্ধকারে একহাত দুরেও দৃষ্টি চলে না। তার ওপর হাত দু’টো পিঠের পেছনে হ্যন্ডকাফ দিয়ে বাঁধা। এভাবে দৌড়ানো বেশ কঠিন। পথের বুনো ঝোপঝাড় যত্রতত্র হাত পায়ের ছাল চামড়া ছিলে নিচ্ছে নির্মম ভাবে। তবুও শাহেদ ছোটার গতি কমালো না। পেছনে টর্চের আলোটার সাথে ক্রমেই দূরত্ব বাড়ছে। হঠাত শক্ত কিছুতে পা বেঁধে গেল শাহেদের। ঢাল বেয়ে আলুর বস্তার মত গড়িয়ে পড়ল শাহেদের শরীরটা। তারপর ঝপাস করে পড়ল একটা নোংরা ডোবার মধ্যে। সাথে সাথে টুপ করে ডুবে গেল শাহেদ। হাত হ্যন্ডকাফে বাঁধা। আর হাত মুক্ত থাকলেই কি, শাহেদ সাঁতার জানে না। ভয়ে ওর মাথা কাজ করছে না। মুখ খুলে চিৎকার করতে যেতেই ডোবার দুর্গন্ধময় পানি ঢুকে গেল। ফুসফুসে কেউ যেন আগুন জালিয়ে দিয়েছে। মৃত্যুর আর তেমন দেরি নেই।
শক্তিশালী দুটো হাত এসে শাহেদের কাঁধ খামচে ধরল। তারপর হ্যচকা টানে ওকে তুলে আনলো পানির উপরে। দুর্বিনিত কাশির সাথে সাথে বমি করে ফেলল শাহেদ। পুলিশটি বলল, “আবার যদি এমন পাগলামি করেন তবে পিটিয়ে বেহুশ করে তারপর থানায় নিয়ে যাব।”
শাহেদ একটু সুস্থির হয়ে বলল, “আপনার নামটা জানতে পারি?”
“আমার নাম…? আমার নাম আলমগির হুসেন।”
“আলমগির সাহেব… আমার প্রান বাঁচানোর জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।”
“আমি আমার ডিউটি করছি মাত্র। এখন উঠেন।”
“নিজে যখন আমার প্রান বাচালেন তখন নিজ হাতেই আমাকে আবার হত্যা করবেন না প্লিজ। থানায় নিয়ে গেলে ওরা আমাকে নিশ্চিত মেরে ফেলবে।”
“কে মেরে ফেলবে?”
“আমি জানি না। আমি খুনি নই। আপনি প্লিজ আমার সব কথা শুনুন।” শাহেদকে অবাক করে দিয়ে আলমগির বলল, “আচ্ছা বলুন দেখি আপনি কি বলতে চান।”
শাহেদ বলতে শুরু করে…“আমি নিশিতাকে খুন করিনি। নিশিতা আমার… নিশিতা আমার…স্ত্রি।… ”
শাহেদ সব কিছু সংক্ষেপে খুলে বলে। নিশিতার অদ্ভুত আচরণ আর শাহেদকে আক্রমন করার কথা শুনতে শুনতে আলমগিরের চেহারা অন্যরকম হয়ে যায়। সে বিড়বিড় করে বলে
“ঠিক বাচ্চাগুলার মত।” শাহেদ কথা থামিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি বললেন?”
“না কিছু না। বিষয় হচ্ছে নিয়ামুল ডাক্তার এখন আছে থানায়। আর আপনি চাইলেও তার সাথে দেখা করতে পারবেন না।”
“তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কেন?”
“বলা হয়েছে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় এলাকার কিছু বাচ্চা মারা গেছে। কিন্তু কোথাও বড় কোন ঘাপলা আছে। আমরা আগে থেকেই আন্দাজ করছিলাম। যশোর ক্যন্টন্মেন্ট থেকে আর্মি এসে থানায় ক্যম্প বসিয়েছে। আমাদের সাধারণ পুলিশদের ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ডাক্তারের সাথে কেউকে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না। আর্মি সারাক্ষন থানা আর হাসপাতালে কড়া নজর রাখছে। আর্মি ডাকার কারন হিসেবে বলা হয়েছে সাম্প্রতিক হরতালের সময় নাশকতার বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য। কিন্তু এখানে হরতালে এমন কোন গন্ডগোল হয়নি যে আর্মি নামাতে হবে। আমাদের সবাইকে বলা হয়েছে বাইরের কারো সাথে বিশেষ করে কোন নিউজ মিডিয়ার সাথে যেন কোন কথা না বলি। সেই সাথে এলাকায় অচেন কাউকে দেখলেই সঙে সঙে থানায় রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে।”
“আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন?” শাহেদ জিজ্ঞেস করে।
“না।। আপনি পুরোপুরি সত্য বলেননি। নিশিতা আপনার স্ত্রি নয়। এটা আপনার মুখ দেখেই বুঝা যায়। তবে বাকি কথাগুলোও পুরোপুরি অবিশ্বাস করতে পারছি না।”
“আপনি যেভাবে হয় নিয়ামুল সাহেবের সাথে একবার কথা বলার ব্যবস্থা করে দিন। তারপর আর আপনার কোন সন্দেহ থাকবে না।”
“কিভাবে সম্ভব? নিয়ামুলের সাথে আমাদের কথা বলা নিষেধ। তাকে বিশেষ সেলে রাখা হয়েছে। সেটার দরোজায় চব্বিশ ঘন্টা একজন আর্মি পাহারায় থাকে।”
“এখানে বিশাল বড় একটা ষড়যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে। সরকারের উঁচু পর্যায়ের লোকজন, আর্মি, সবাই এর সাথে জড়িত। নিশিতা এই ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করতে গিয়েই মারা গেছে। আমরা যদি কিছু না করি তাহলে সামনে আরো কত লোক মারা যাবে কে জানে।”
আলমগির বড় করে নিঃশ্বাস নিল। খুব বড় একটা ষড়যন্ত্র যে চলছে সেই আচ সে আগেও পেয়েছে। তার সন্দেহ সত্যি হলে শুধু নিশিতা না এরই মধ্যে আরো অনেকগুলো প্রান এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গেছে। কিন্তু সে কি করতে পারে? সে মফস্বলের একজন সামান্য পুলিশ অফিসার। তার ক্ষমতা কতটুকু? তাকে তো সব সময় উপর মহলের কথায় চলতে হয়। সে কি করে এই প্রচন্ড শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? আলমগিরের মনে পড়ল বছর দুই আগের কথা যখন স্থানিয় এমপির ছোট ছেলে আর তার বন্ধুরা এক রাতে স্কুলঘরে দুই বোনকে রেপ করে মার্ডার করে ফেলেছিল। বোনদের একজনের বয়স ছিল বারো, অন্যটার চৌদ্দ বছর। এমপির নির্দেশে আলমগির নিজ হাতে সেই মার্ডারের সকল এভিডেন্স নষ্ট করে ফেলেছিল। এই ঘটনায় মেয়ে দুটির মা পাগল হয়ে যায়। আলমগির কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি। আজও কি আবার সেরকম কিছু ঘটতে যাচ্ছে?
আলমগির উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আসুন আমার সাথে।” শাহেদ জিজ্ঞেস করল “কোথায়?”
“থানায়। ডাক্তারকে উদ্ধার করতে যেতে হবে।”
*
আলমগিরের পরবর্তি কর্মকান্ডে শাহেদ শুধু বিস্মিত নয় রীতিমত শিহরিত হল। থানায় রাত নয়টার পর ইলেক্ট্রিসিটি থাকে না। তখন একটা ডিজেল জেনারেটর দিয়ে আলো জ্বালাবার ব্যবস্থা করা হয়। থানার বাইরে একটা টিনের ছাউনিতে জেনারেটরটি আছে। আলমগির সবার চোখ এড়িয়ে গিয়ে জেনারেটরের ক্যপ খুলে পকেটে করে নিয়ে আসল। মিনিট দুই পরেই বিকট ধ্রুম শব্দ করে জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেল। ছাউনি ঘর ভরে গেল কালো ধুয়ায়। থানার বাতি নিভে গেছে। শক্তিশালি ফ্ল্যাশ লাইট হাতে ছুটে এল আর্মির দুই জওয়ান। থানার সামনে রাখা জিপ দু’টোর হেডলাইট জালিয়ে বাড়তি আলোর ব্যবশ্তা করা হল। কিন্তু তাতে থানার ভতরের দিকের ঘরগুলোতে অন্ধকার কাটল না। আলমগিরের এরপরের কাজ আরো ভয়াবহ। থানার পাশেই দুইটা বড় খেজুর গাছ। আলমগির কোত্থেকে যেন এক গ্যলন পেট্রল জোগার করেছিল। তার পুরোটা ছিতিয়ে দিয়েছে গাছের গায়ে। জেনারেটর থেমে যেতেই আলমগির ত্রিশ সেকেন্ড অপেক্ষা করল। তারপর আগুন জালিয়ে দিল গাছের গায়ে। সাই সাই করে ছড়িয়ে পড়ল লাল সবুজ আগুনের শিখা। রাতের আকাশে সে এক ভয়াবহ চিত্র। ডালপালা মেলে ক্রুদ্ধ গর্জনে দাউ দাউ করে জ্বলছে দুইটা তাল গাছ। থানার বাকি আর্মি হইহই করে ছুটে এল আগুন নেভাতে। এই সুযোগে আলমগির দালানের পেছনের দিকের একটা জানালা গলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। নেয়ামুল করিমকে আটকে রাখা হয়েছে পাশের ঘরটিতেই।
দরোজার সামনে একজন কর্পোরাল ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। শালা এত্ত হাঙ্গামার পরেও পোস্ট থেকে নরেনি। আলমগিরকে দেখেই রাইফেল তুলে হুঙ্কার দিল, “ওখানে কে?”
“আমি আলমগির, থানার এসআই”
“ওহ।। আপনি। এই সময় এখানে কি?” আর্মিটি বন্দুক না নামিয়েই জিজ্ঞেস করে।
“মেজর সাহেদ বলেছেন বন্দিকে বের করে পাশের ঘরে নিয়ে যেতে। থানায় আগুন লেগেছে। আগুন এই ঘর পর্যন্ত চলে আসতে পারে।”
“কই আমার কাছে তো এমন কোন অর্ডার আসেনি। আর বন্দিকে সরাতে হলে তোমাকে পাঠাবে কেন? বাকিরা কই?”
“সবাই আগুন নেভাতে ব্যস্ত। বড় দুইটা কড়ই গাছে আগুন লেগে গেছে। সাংঘাতিক অবস্থা।”
“দাড়াও চেক করে দেখি।” কর্পোরাল মোবাইলে কাউকে ফোন করছে। আলমগির আর রিস্ক নিল না। কর্পোরালের রাইফেলের নল একটু সরে গেছে ওর দিক থেকে। এই সুযোগে সে কর্পোরালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ধস্তাধস্তিটা বেশিক্ষন স্থায়ি হল না। পাশের ঘর থেকে শাহেদ দৌড়ে এসে রাইফেলটা তুলে নিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিল কর্পোরালের মাথায়। ব্যস ব্যটা ঠান্ডা হয়ে গেল।
“মেরে ফেললাম নাকি!!!” শাহেদ রাইফেলের নল দিয়ে গুতো দিল কর্পোরালের পেটে।
“নাহ।। এত অল্পে মরবে না। আপনাকে না বাহিরে অপেক্ষা করতে বললাম?” আলমগির মাথা ডলতে ডলতে উঠে বসল। শাহেদ জবাব না দিয়ে দাঁত বের করে হাসল। কর্পোরালের কোমড়ের বেল্টে চাবির গোছা পাওয়া গেল। ঘরের ভেতরে ডাক্তার নিয়ামুল উদ্ভ্রান্তের মত তাকিয়ে আছেন। কি থেকে কি হচ্ছে তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। ওরা দুইজন ক্ররপোরালের অচেতন দেহ টেনে এনে ঘরের ভেতর ফেলল। আলমগির বলল, “কথা পরে। এখন যত দ্রুত সম্ভব থানা থেকে দূরে সরে যেতে হবে। রাইফেলটা সাথে রাখুন। পরে কাজে লাগতে পারে।” দুই মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার নিয়ামুলকে নিয়ে ওরা থানার বাইরে বের হয়ে এল।
*
ডাক্তার নিয়ামুল ওদের যে গল্প শুনাল তার জন্যে দুইজনের কেউই প্রস্তুত ছিল না। সারকারের পক্ষ থেকে চিকেন পক্সের একটা ভ্যক্সিন ফ্রিতে বিতরন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভ্যক্সিনটি সম্প্রতি অ্যামেরিকায় আবিষ্কৃত হয়েছে। গত মার্চের দুই তারিখ ভ্যক্সিনের প্রথম চালান হাসপাতালে এসে পৌছায়। শিলাহাটি ও আশেপাশের গ্রামের শূন্য থেকে ষোল বছরের প্রায় একশটি শিশু কিশোরকে ভ্যক্সিন দেয়া হয়। এর সার্বিক তত্তাবধানে ছিলেন ডক্টর নিয়ামুল। কত বড় সর্বনাশ যে হতে চলেছে তা তিনি তখন টের পাননি।
ভ্যক্সিনাইজেশনের ছত্রিশ ঘন্টার মধ্যে শিশুগুলো অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করে। প্রথমে জ্বর ও বমি। তারপর খিঁচুনি উঠে মৃত্যু। কারো কারো ক্ষেত্রে রক্ত বমি। যার বয়েস যত কম মৃত্যু তার উপর ভ্যক্সিন তত দ্রুত কাজ করে। বিপদ বুঝে সরকার তড়িঘড়ি করে আর্মি পাঠিয়ে ভ্যক্সিনাইজড সকল শিশুকে বাসা থেকে তুলে আনে। তাদের জন্যে শিলাহাটি হাসপাতালে একটা বিশেষ ইউনিট খোলা হয়। সেখানে সারাক্ষন আর্মির সশস্ত্র পাহারা থাকে। তাদের সাথে কেউ দেখা করতে পারে না। এমন কি তাদের বাবা মা’ও না। কি করা হচ্ছে ওই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কে জানে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
“মানে?” শাহেদ জিজ্ঞেস করে।
“ওরা মরে গিয়ে বেশিক্ষন কিছুক্ষণ পর আবার জেগে উঠে।” বলে ডাক্তার শুকনো হাসি হাসল।
“কি বলছেন আপনি??”
“আমার কথা বিশ্বাস হয়ার কথা না। নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। ওরা মরে গিয়ে একটু পর আবার জীবিত হয়ে উঠে। কিন্তু পুরোপুরি জীবিত বলা যায় না। পার্শিয়াল ব্রেইন এক্টিভিটি। আর ওদের মধ্যে মনুষ্যত্ব বলে আর কিছু থাকে না। ওরা কেমন ভয়ঙ্কর জানোয়ারের মত হয়ে যায়। আশেপাশে যাকে পায় তাকেই কামড়ে ধরে। ওরা যেন সবাই হাজার বছরের জমিয়ে রাখা ক্ষুধা পেটে নিয়ে জেগে উঠেছে।”
আর্মি যখন বাচ্চাগুলোকে বাসা থেকে তুলে আনতে শুরু করে তখন নিয়ামুল প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি চেষ্টা করেন বাইরের মিডিয়ার কাছে সব কিছু ফাঁস করে দিতে। প্রথমে কেউই তার কথায় কান দেয়নি। অবশেষে নিশিতা নিয়ামুলের কথা বিশ্বাস করে। নিশিতা খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে এই ভ্যক্সিন ম্যনুফ্যকচার করেছে আম্ব্রেলা করপোরেশন নামের একটা ফার্মাসিউটিক্যলস কোম্পানি। ভ্যক্সিনটা কমার্শিয়ালি ডিস্ট্রিবিউট করার আগে এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অনুন্নোত দেশে ফ্রি টেস্টিং এর জন্যে পাঠানো হয়েছে। ভ্যক্সিনটি আগে ল্যবে কন্ট্রোল্ড এনভায়রনমেন্টে টেস্ট করা হলেও ওয়াইড রেঞ্জ টেস্ট এই প্রথম। এই দেশের করাপ্ট গভর্ন্মেন্ট কোন রকম পরিক্ষা ছাড়াই সরাসরি সেটা পাঠিয়ে দিয়েছে ফিল্ডে ব্যবহারের জন্য।
“এখন আমরা কি করব?” শাহেদ অনিশ্চিত ভাবে জিজ্ঞেস করে।
“এই ঘটনা বাহিরের দুনিয়ার কাছে ফাঁস করতে হবে।” আলমগির জবাব দেয়।
“কিন্তু মানুষ আমাদের কথা বিশ্বাস করবে কেন?”
“বিশ্বাস করানোর মত যুক্তি প্রমান যোগাড় করতে হবে।” বলে আলমগির নিয়ামুলের দিকে তাকায়।
নিয়ামুল জানায় ইমুনাইজেশন প্রোগ্রাম সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র আছে হাসপাতালে। সেই সাথে ভ্যক্সিনের বেশ কিছু স্যম্পলও আছে ওখানে। এর একটি স্যম্পল যদি কোনভাবে বাইরে বের করে আনা যায় তাহলেই হবে। এর চেয়ে বড় প্রমান আর হয় না। কিন্তু ডাক্তারের পালানোর খবর নিশচই ইতিমধ্যে সবাই পেয়ে গেছে। হাসপাতালের আশেপাশে এখন আর্মির উপস্থিতি দ্বিগুন হয়ে যাবার কথা।
হাসপাতালের পেছন দিকে কিছুটা খালি জায়গা টিনের বেড়া দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। ওখানে কি হয় জানতে চাইলে ডক্টর উত্তর দিতে পারল না। তার সময়ে এই টিনের বেড়া ছিল না। শাহেদ চুপিচুপি বেড়ার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল। বেড়ার ওপাশে মাটি খুড়ে বিশাল গর্ত খোড়া হয়েছে। গর্তের পারে আর্মির ইউনিফর্ম পড়া দুইজনকে দেখা গেল। ভারি একটা কিছু ধরাধরি করে ওরা গর্তে নামাচ্ছে। কি নামাচ্ছে বুঝা গেল না। একটু পর তাদের একজনকে দেখা গেল টিনের গ্যলনে করে কিছু একটা গর্তের ভেতর ছিটিয়ে দিতে। একটু পর বুঝা গেল ওটা পেট্রল। একটা আর্মি দেয়াশলাই জ্বেলে গর্তের ভেতর ছুরে দিতেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল। এভাবে গোপনে কি পোড়াচ্ছে ওরা?
আর্মি দুইজন সরে যেতেই আলমগির সন্তপর্নে টিনের দরোজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। সাথে সাথে একটা বোটকা গন্ধ ধাক্কা দিল নাকে। গর্তের ভেতরে তখনো ধোঁয়া উড়ছে। কিন্তু ধোঁয়ার ফাঁক গলে দেখা যাচ্ছে ওগুলো কি? মানুষের হাত পা? আলমগিরের মনে হল সে দুঃস্বপ্ন দেখছে। গর্তের ভেতর উপচে পড়ছে মানুষের পোড়া হাত পা মাথার খুলি। সবগুলোই আকারে ছোট ছোট… দেখে বুঝা যায় এদের কারো বয়েসই দশ-বারো বছরের বেশি নয়।
ডাক্তার মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “এখন বুঝতে পারছি ওরা স্পেশাল ইউনিটের বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কি করে। ওদেরকে জাস্ট একটা ঘরের মধ্যে আটকে রাখে, আর কিছু না। ঘরের মধ্যে আটকে রেখে অপেক্ষা করে কখন মরবে। মরে গেলে লাশগুলো গর্তে ফেলে পুড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যস,কোন এভিডেন্স রাখছে না।”
শাহেদ বসে পরে হরহর করে বমি করে ফেলল। আলমগির দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ডাক্তার আপনি তো জানেন ভ্যক্সিনের স্যম্পল কোথায় আছে।” “হ্যাঁ, তিনতলার একটা ঘরে।” নিয়ামুল জবাব দেয়।
“আপনি শাহেদকে নিয়ে যান। ভ্যক্সিন আর অন্যান্য ডকুমেন্টস যা পান সাথে নিয়ে পুকুর পারে আমার জন্যে অপেক্ষা করবেন। আর বিপদ বুঝলে রাতের বাসে সোজা ঢাকা চলে যাবেন।” “আপনি কি করবেন?” শাহেদ জিজ্ঞেস করে।
“আমি বাকি বাচ্চাগুলোকে উদ্ধার করব। ওদেরকে এভাবে ঘরের ভেতর আটকে রেখে মেরে ফেলা হবে, মড়া পর লাশ পুড়িয়ে ফেলা হবে, এটা হতে দেয়া যায় না। মৃত্যুর সময় ওদের আপনজনদের কাছে থাকার কথা, ওদের বাবা মা’র জানার অধিকার আছে তাদের সন্তানের কি হয়েছে।”
শাহেদ আস্তে মাথা ঝাঁকায়।
*
মেজর সাদিক আর লেফটেন্যন্ট বশির কথা বলতে বলতে হাসপাতেলের করিডোর ধরে এগুচ্ছেন।
“উপর থেকে নির্দেশ এসেছে। আজ রাতের মধ্যেই সবগুলো ইনফেক্টেড স্পেসিমেন এলিমিনেট করতে হবে।”
“কি বলেন? ওদের অনেকে এখনো বেঁচে আছে। মড়া লাশ পুড়িয়ে ফেলা এক কথা আর জ্যন্ত শিশু…”
“কিছু করার নেই। ডাক্তারের পালিয়ে যাবার নিউজ উপর মহল পর্যন্ত চলে গেছে। ওরা আর রিস্ক নিতে চাইছে না। সবগুলো স্পেসিমেন নষ্ট করে আজকের মধ্যেই প্রজেক্ট ক্লোজ করতে হবে।”
“কিন্তু এইটা তো স্রেফ মার্ডার।”
“দেখ, প্ল্যন মত কাজ না করলে যে পঞ্চাশ লাখ পকেটে ভরেছ সেটা আর খরচ করার সুযোগ পাবে না। আমরা যা ক্রেছি তা বাহিরে প্রকাশ পেলে সবার কপালে ফাঁসির দড়ি ছাড়া আর কিছু জুটবে না।”
হ্যন্ডস আপ… হাতের অস্ত্র ফেলে দিন। অন্ধকার থেকে পিস্তল বাগিয়ে বের হয়ে আসে আলমগির।
মেজর মোটেও চমকে না উঠে শান্ত গলায় বলে “তোমাকে চেনাচেনা লাগছে। তুমি আলমগির রাইট? থানার সাব ইনস্পেক্টর?”
“শাট আপ। কোন কথা নয়। বাচ্চাগুলোকে কোথায় আটকে রেখেছ?”
“উত্তেজিত হয়ার কিছু নেই আলমগির। তুমি বাচ্চাগুলোকে দেখতে চাও তো। চলো আমাদের সাথে। বাই দ্যা ওয়ে, আজ কি তুমিই থানায় আগুন লাগিয়েছিলে? নাইস জব মাই বয়। ডান লাইক আ প্রফেশনাল”
ওরা আলমগিরকে পথ দেখিয়ে বড় একটা হল রুমে নিয়ে যায়। রুমের ভেতর প্রায় একশটা সারি বাঁধা হস্পিটাল বেড। প্রতিটি বেডে নানা বয়েসের শিশু কিশোর শুয়ে আছে। তাদের কেউ যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। কেউ নিস্তেজ পরে আছে।
“
দেখ আলমগির। চোখ খুলে দেখ। ওদেরকে বাঁচানোর আর কোন উপায় নেই। কিন্তু ওদের সাধারণ মানুষের মধ্যে ছেরে দেওয়া মানে এখন আরো কিছু নির্দোষ মানুষের প্রান বিপন্ন করা। এরা সবাই ভয়ঙ্কর অসুস্থ।”
কাশতে কাশতে একটা শিশু জেগে উঠে। একটা মেয়ে, আট দশ বছর বয়েস। আলমগির ছুটে যায় মেয়েটির কাছে। মেয়েটির গলা দিয়ে কালচে রক্ত উঠে আসছে। আলমগির কি করবে বুঝতে পারে না। দু’হাতে মেয়েটিকে বুকে চেপে ধরে থাকে। কাশতে কাশতেই এক সময় মেয়েটি নিস্তেজ হয়ে যায়। কালচে রক্তে আলমগিরের বুক ভেসে গেছে।
“ইফ ইউ ওয়ান্ট টু বি উইথ দেম টিল এন্ড, সো বি ইট।” মেজর আর লেফটেন্যন্ট চট করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ঘড়ঘড় শব্দে বুঝা যায় ওপাশ থেকে দরোজার তালা আটকে দেয়া হচ্ছে। ঘর ভর্তি প্রায় পঞ্চাশটি ভয়ঙ্কর শিশুর সাথে আলমগির একা। এই সময় ওর নাকে ধোঁয়ার গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়। ওরা ঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে!! দেখতে দেখতে কালচে ধোঁয়ায় হল ঘরের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে যায়। দরোজার ফাঁক দিয়ে আগুনের লেলিহান শিখা উঁকি দিচ্ছে। দেখতে দেখতে আগুন প্রবেশ করে ঘরের ভেতর। একে একে জানালার পর্দা, বিছানার বেড শিট থেকে শুরু করে আগুন ছড়িয়ে পরে চার পাশে।
ঘরের ভেতর অক্সিজেন কমে আসছে। আলমগিরের চোখ জ্বলছে। সে মেয়েটির নিস্তেজ দেহ বুকে চেপে সরে যায় ঘরের এক কোনায়। আলমগিরকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন। ওকে ঘিরে থাকা আগুনের বৃত্তটা ছট হয়ে আসছে দ্রুত। এই সময় আলমগিরের বুকের কাছে কিছু একটা নড়ে উঠে। মেয়েটা চোখ খুলে তাকিয়েছে। তার চোখের রঙ রক্ত বর্ন। চাপা হুঙ্কার ছেরে মেয়েটি যেন ছোবল মারে আলগিরের গলায়। যেকোন মুল্যে যেন এর গলায় দাঁত বসাতে হবে। ছিড়ে আনতে হবে কণ্ঠনালি। হিংস্র জন্তুর মত মেয়েটি হাত পা ছুঁড়ছে। সামলাতে না পেরে মেঝেতে পরে গেল আলমগির। ছোট্ট একটা মেয়ের শরীরে এত্ত শক্তি!!
মেয়েটা পাগলের মত খামচি মারছে আলমগিরের মুখে। আলমগির দুই পায়ে লাথি মেরে মেয়েটাকে দূরে সরিয়ে দিল। মেয়েটি থামে গেল না। দ্বিগুন জিঘ্নগসা নিয়ে ছুটে এল আলমগিরের দিকে। আলমগির কোমরের পিস্তল বের করল। কিন্তু এইটুকু একটা বাচ্চাকে সে কিভাবে গুলি করবে? মেয়েটা ছুটে আসছে খুনে শ্বাপদের মত। ওর মুখ থেকে লা লা ঝরছে। করাতের মত দাতগুল ঝলসে উঠছে আগুনের আলোয়। আলমগির শক্ত করে চোখ বুজল, তারপর ট্রিগার টেনে দিল। বদ্ধ ঘরে গুলির আওয়াজ বোমা ফাটার মত কানে ঠেকল।
এত কাছের টার্গেট মিস হবার কথা নয়। বাচ্চাটার খুলি উড়ে গেছে। ঘরের অন্যপাশ থেকে গোঙ্গানির আওয়াজ ভেসে এল। জেগে উঠছে অন্য বাচ্চাগুলোও। কয়েকটা বেডে এরই মধ্যে আগুন লেগে গেছে। বাচ্চাগুলো গোঙাতে গোঙাতে এগিয়ে আসছে। তাদের সবার চোখে রক্তের লোভ। আলমগির পিস্তল তুলে পাগলের মত ফায়ার করল। বুলেটের আঘাতে উড়ে যাচ্ছে বাচ্চা গুলোর খুলি। ছিটকে পড়ছে ওরা মেঝেতে। কিন্তু বাকিদের মাঝে ভাবান্তর নেই। তাদের যেন একটাই চিন্তা। ঘরের কোনে ওই মানুষটার শরীরে কামড় বসাতে হবে। ছিঁড়ে আনতে হবে তাজা মাংস।
খালি চেম্বারে হ্যমারের আঘাতের ক্লিক শব্দ হয়। গুলি শেষ। এবার!! বাচ্চাগুলো একেবারে কাছে চলে এসেছে। দুটো বাচ্চার গায়ে এরই মধ্যে আগুন লেগে গেছে। আগুনে ঝলসে যাচ্ছে তাদের হাত পা। মুখের চামড়া পুড়ে গিয়ে খসে পড়ছে। সেদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। কি এক অমোঘ টানে বাচ্চাগুলো হেলতে দুলতে এগিয়ে আসছে আলমগিরের দিকে। আলমগির পিস্তল ফেলে দিয়ে সবচেয়ে কাছের বাচ্চাটার মুখে ঘুষি মারে। হাড় ভাঙ্গার বিশ্রি শব্দ হয়। আরেকটা বাচ্চা ওর পা জাপ্টে ধরে। বারো তেরো বছরের একটা কিশোর হাতে একটা ভারি লোহার রড নিয়ে আগিয়ে আসে। আঘাতটা আসতে দেখেও আলমগির সময় মত মাথা সরিয়ে নিতে পারে না। ধপাস করে মেঝেতে পরে যায় সে। সাথে সাথে চার পাঁচটা বাচ্চা ক্ষুধার্ত হায়নার মত চেপে বসে ওর শরীরের উপর। আলমগিরের আর একটা আঙুল নাড়াবার ও শক্তি নেই। এই তাহলে মৃত্যু!!
প্রচন্ড শব্দে হল রুমের দরোজা খুলে যায়। তারপরই অটোম্যাটিক রাইফেলের কানফাটানো ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শোনা যায়। শিশুগুলোর শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে ছিটকে পরে এদিক সেদিক। এক মুহুর্ত পরেই ধোঁয়া আর আগুনের দেয়াল ভেদ করে একটি কাঠামো উদয় হয়। আলমগিরকে হ্যচকা টানে কাঁধে তুলে শাহেদ বের হয়ে আসে হল রুম থেকে। বাহিরে ডক্টর নেয়ামুল অপেক্ষা করছিল। শাহেদ বের হতেই তিন জন ছুটতে থাকে মুল ফটকের দিকে। এর মধ্যে আলমগির একবার পেছনে ফিরে দেখতে পায় জ্বলন্ত ঘরটা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসছে কিছু শিশু!!
*
দিনের বেলা। মতিঝিল বাস স্ট্যন্ড।
রাগের চোটে হাতের খবরের কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিল শাহেদ। বেশির ভাগ দৈনিকেই গত কাল রাতের ঘটনাটা আসেনি। এই একটা পত্রিকায় খবরটি ছাপা হয়েছে এইভাবে। শিলাহাটি সদর হাসপাতালে গতকাল গভীর রাতে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা হামলা করে আগুন জালিয়ে দিয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন রুগিসহ হাসপাতালের কর্মিরাও আহত হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হয়া যায়নি। এই হামলার পেছনে বিরোধীদলের হাত আছে কিনা তা কর্তৃপক্ষ খতিয়ে দেখছে। কি নিখুঁত কভার আপ!!
আলমগির জিজ্ঞেস করে, “এবার কি করবেন?”
“এখন সব কিছু সবাইকে জানাবার সময় হয়েছে। আমি দেশের সবগুলো বড় বড় নিউজ মিডিয়ার সাথে কথা বলব। ওরা সাহস না পেলে ইন্টারন্যশনাল মিডিয়ার কাছে যাব।ভ্যক্সিনের এই স্যম্পলটা দুনিয়ার সব বড় বড় ল্যবরেটরিতে টেস্ট করতে পাঠাব। এই জঘন্য ষড়যন্ত্রের পেছনে যারা আছে তাদের প্রত্যেককে আমি খুঁজে বের করব।” শাহেদের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে।
“হুম, ভ্যক্সিনের স্যম্পল্টা কোথায়?”
“ওটা তো ডাক্তার সাহেবের কাছে ছিল”
“ডাক্তার যে কখন নাস্তা কিনতে গেল এখনো তো এল না। এত দেরি হচ্ছে কেন বলুন তো?”
এই সময় শাহেদের সেলফোনটা গুঞ্জন করে উঠে। একটা নতুন ম্যসেজ। ডাক্তার নেয়ামুল করিম পাঠিয়েছেন।
“স্যম্পলটা নিয়ে গেলাম। আমাকে মাফ করবেন। এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। আমার পরিবার ওদের হাতে জিম্মি। স্যম্পল্টা ফিরিয়ে না দিলে ওরা সবাইকে মেরে ফেলবে। প্লিজ, আমাকে খুজার চেষ্টা করবেন না। বিদায়। ঈশ্বর আপনাদের সহায় হোন।”